অধ্যায় ৪৭ – অ্যাসিরীয়ার রেনেসাঁ
খ্রিস্টপূর্ব ৯৩৪ থেকে ৮৪১ সালের মাঝে অ্যাসিরীয়া একটি নতুন সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পশ্চিমা সেমাইটরা তাদের স্বাধীনতা হারাতে শুরু হরে।
আপনাদের হয়তো মনে আছে, যাযাবর আরামিয়ান গোত্রের সদস্যরা নিয়মিত মেসোপটেমিয়ায় হামলা চালাচ্ছিল। তাদের এই উদ্যোগে অ্যাসিরীয়া ও ব্যাবিলনীয়ার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হয়। তবে একপর্যায়ে তারা কিছু ছোট – ছোট স্বাধীন রাজ্যে থিতু হয়। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে সচেয়ে শক্তিশালী রাজ্যটি গড়ে ওঠে দামাসকাস শহরকে গিরে। ইউফ্রেতিস নদ থেকে অ্যাসিরীয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সমতলভূমিতে ছিল এই শহরের অবস্থান। ইসরায়েলের রাজা ডেভিড দামাসকাসের আরামিয়ানদের আংশিকভাবে হলেও তার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন। ডেভিডের কাহিনিকার গর্ব করে লেখেন, ‘তিনি ২২ হাজার আরামিয়ান হত্যা করেন, এবং এরপর থেকে তাদের কাছ থেকে নিয়মিত নজরানা পেতে থাকেন।
একই বছর অ্যাসিরীয়রা ইউফ্রেতিসের পশ্চিমের পুরো অঞ্চলকে ‘আরাম’ নাম দেয়, যেটি আরামিয়ান নেতাদের দখলে থাকা সকল শহরের একটি সমষ্টিগত নাম। অ্যাসিরীয়রা আরামিয়ানদের বিরুদ্ধে পুরোপুরি নিরুপায় ছিল। ডেভিডের নাতি রেহোবোয়ামের আমলে যেয়ে অবশেষে একজন অ্যাসিরীয় শাসক আরামিয়ানদের পিছু হটতে বাধ্য করেন। এই শাসকের নাম ছিল আশুর-দান দ্বিতীয়। তিনিই ছিলেন প্রথম মহান অ্যাসিরীয় রাজা, যিনি অ্যাসিরীয়াকে অন্ধকার যুগ থেকে বের করে নতুন, পুনর্জাগরণের ‘রেনেসাঁ যুগে নিয়ে আসেন।
আশুর-দানের শিলালিপি মতে, তিনি যাযাবরদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়, অ্যাসিরীয় ভূমির ওপর নির্মিত আরামিয়ান শহরগুলো পুড়িয়ে দিয়ে যেসব যাযাবর মানুষ ‘ধ্বংস ও হত্যা’ চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তিনি ব্যবস্থা নেন। তবে বাস্তবে তিনি পুরনো অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সীমানা পুনঃস্থাপন করার ধারে কাছেও যেতে পারেননি। তিনি অ্যাসিরীয়ার মূল ভূখণ্ডকে নিজের দখলে আনেন, এবং একে সুরক্ষিতও করেন। তিনি পর্বত থেকে সেসব অ্যাসিরীয় গ্রামবাসীদের ফিরিয়ে আনেন, যারা নিজ শহর থেকে ‘চাহিদা, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের’ কারণে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি তাদের পুনর্বাসন করেন। তবে প্রজ্ঞাবান এই শাসক উত্তর বা পূর্ব দিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করার কোনো প্রচেষ্টা হাতে নেননি, কারণ সেসব জায়গায় তখনও আরামিয়ানরা শক্তিশালী অবস্থানে ছিল।
দক্ষিণে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য তাদের স্বাধীনতা ধরে রাখতে পেরেছিল, যদিও তাদের আগের সেই রমরমা অবস্থা আর বজায় ছিল না। একের পর এক ব্যাবিলনীয় পরিবার দেশটির সিংহাসনের দখল নেয় এবং রাজধানী শহরও বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তর হতে থাকে। ইতোমধ্যে আরামিয়ানরা পুরনো ব্যাবিলনীয় অঞ্চলে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, ব্যাবিলনের বাসিন্দাদের প্রাচীন ভাষা, আক্কাদিয়ানকে প্রতিস্থাপন করে নতুন ভাষা হিসেবে পশ্চিমা সেমাইটদের ‘আরামাইক’ প্রচলিত হতে থাকে।
আরও তিন প্রজন্ম পর অ্যাসিরীয়ার এক মহান রাজা দেশের শাসনভার নেন। আশুর-দানের উত্তরসূরি (নাতির নাতি) আশুরনাসিরপাল দ্বিতীয় অবশেষে অ্যাসিরীয়াকে (আবারও) একটি সাম্রাজ্যে রূপান্তর করতে সক্ষম হন। তিনি নিনেভেহ শহরের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল পর্যন্ত যুদ্ধ করে এগিয়ে যান এবং এই শহরটিকে তার উত্তরাঞ্চলীয় ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি টাইগ্রিস নদীর পূর্ব-উপকূল পার হন এবং পুরনো গ্রাম কালেহ যেখানে ছিল, ঠিক সে জায়গায় তার নতুন রাজধানী শহর তৈরি করেন। তিনি ঘোষণা দেন, ‘অ্যাসিরীয়ার সাবেক রাজা ও আমার পূর্বসূরি শালমানেসার কালেহ শহরটি তৈরি করেছিলেন, যেটি ক্ষয় হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সে শহরকে আমি নতুন করে নির্মাণ করছি এবং তার চারপাশে ফলের বাগান তৈরি করছি। আমি আসসুরের প্রতি ফল ও মদ নিবেদন করছি। হে আমার প্রভু, আমি পানির উৎস হিসেবে কুয়া খনন করেছি এবং এর সুরক্ষায় প্রাচীর তুলেছি।’
সেসময় থেকে কালেহ তার সরকারের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হল। আসসুর পরিণত হল উৎসব উদযাপন কেন্দ্র। কালেহ শহরে তিনি প্রশাসনিক ভবনের পাশাপাশি একটি রাজপ্রাসাদও নির্মাণ করলেন। পুরো প্রাসাদজুড়ে বিভিন্ন যোদ্ধা ও রাজাদের ছবি আঁকা হল, যারা তার কাছে বশ্যতা শিকার করেছেন। যে হলঘরে বসে তিনি উপঢৌকন গ্রহণ করতেন, সেখানে কতগুলো রক্ষক মূর্তি বসানো হল। এগুলো ছিল সুবিশাল ডানাযুক্ত মহিষাকৃতির মূর্তি। মূর্তির মুখাবয়ব ছিল স্বয়ং আশুরনাসিরপালের মতো করে বানানো।
রাজপ্রাসাদের নির্মাণকাজ শেষ হলে আশুরনাসিরপাল এই আনন্দঘন মুহূর্তটিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য একটি বড় ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। এই অনুষ্ঠানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে একটি শিলালিপিতে। সেখানে বলা হয়েছে, অতিথিদের ১ হাজার করে মহিষ, গরু ও ভেড়া, ১৪ হাজার আমদানি করা ও মোটাতাজা করা বিদেশি ভেড়া, ১ হাজার বকরি, ৫০০ করে পাখি ও হরিণ, ১০ হাজার করে মাছ, ডিম, পাউরুটি, বিয়ার ও ১০ হাজার ড্রাম ভর্তি মদ ও আরও অনেক কিছু খাওয়ানো হয়েছিল।
আশুরনাসিরপালের হিসেব মতে, টেবিলে ৬৯ হাজার ৫৭৪ জন অতিথি ছিলেন। তারা সবাই এই মহান রাজার সাফল্যের উদযাপন করছিলেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি ‘মহান রাজা, বিশ্বের রাজা, সেই সাহসী বীর, যে আসসুরের (দেবতা) সহায়তা নিয়ে এগিয়ে যান, সে ব্যক্তি যার পৃথিবীর চারপ্রান্তে কোনো প্রতিপক্ষ নেই, মহিমান্বিত মেষপালক, সেই শক্তিশালী জলোচ্ছ্বাস যার বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে পারে না, যার হাত ধরে সব ভূখণ্ড ও পর্বতমালার দখল এসেছে’—এসব নাম ধারণ করেন।
তবে বড় বড় কথা বলার পাশাপাশি আশুরনাসিরপাল এমন একটি কাজ করতে পেরেছিলেন, যেটি তার পূর্বসূরিরা কেউ পারেননি—তিনি যুদ্ধ করতে করতে ইউফ্রেতিস পর্যন্ত পৌঁছাতে সমর্থ হন এবং এই নদী পার হয়ে যান স্বচ্ছন্দে। তিনি বলেন, ‘আমি চামড়ার তৈরি জাহাজে করে ইউফ্রেতিস পেরিয়ে যাই। আমি লেবানন পর্বতের পাশ দিয়ে পদযাত্রা করি এবং সেই বিশাল সাগরে আমার অস্ত্র ধুয়ে নিই।’ অসংখ্য, বছর আগে সারগন একই ধরনের দাবি জানিয়েছিলেন, পারস্য উপসাগর পার হওয়ার পর।
এই যাত্রার পর আশুরনাসিরপাল ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে পৌঁছে গেলেন। তখন এই অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন ওমরি নামের এক রাজা। বাইবেলে ওমরির বিষয়ে খুব বেশি কিছু বলা হয়নি। সেখানে বস্তুত ঈশ্বরের আইন ভঙ্গকারী হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বুক অব ওয়ান কিংস থেকে আমরা জানতে পারি যে ওমরি অপর এক দাবিদারের কাছ থেকে উত্তরের সিংহাসন জোর করে দখল করে নিয়েছিলেন এবং তার আগের যেকোনো রাজার চেয়ে তিনি বেশি খারাপ ছিলেন। তবে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে ওমরি একজন মহান যোদ্ধা ও নির্মাতা ছিলেন। তিনি উত্তরের নতুন রাজধানী হিসেবে সামারিয়ার গোড়াপত্তন করেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম ইসরায়েলি রাজা ছিলেন যার কথা অন্য একটি দেশের শিলালিপিতে সমীহের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। মোয়াবাইটস নামে পরিচিত গোত্রটি জর্ডান নদীর তীরে একটি শিলালিপি রেখে যায়। এর নাম ‘মেশা শিলালিপি’। এতে দুঃখের সঙ্গে বলা হয়েছে, ওমরি ‘মোয়াবকে দীর্ঘদিন ধরে দমিয়ে রেখেছেন।’
নিঃসন্দেহে তিনি শক্তিমান শাসক ছিলেন। আশেপাশের মোটামুটি সব ভূখণ্ড দখল করে নিলেও আশুরনাসিরপাল তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেননি।
ততদিনে আশুরনাসিরপালের অঞ্চল ইউফ্রেতিসের পুরো তীর জুড়ে বিস্তৃত হয়ে ভূমধ্যসাগরের উপকূল ঘেঁষে বন্দরনগরী আরভাদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। তবে তিনি কখনো টির বা সিডনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেননি। এ অঞ্চলের রাজাদের ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি এমনকি, ব্যাবিলনীয়ার বিরুদ্ধেও হামলা চালাননি। তবে তিনি দক্ষিণে ইউফ্রেতিসের তীর ধরে এগিয়ে যেয়ে অ্যাসিরীয়া ও ব্যাবিলনীয়ার সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছান। সেখানে তিনি ব্যাবিলনীয়দের ভয় দেখাতে সীমান্তবর্তী একটি শহরে লুটপাট চালান। তবে এতেই ক্ষান্ত দেন আশুরনাসিরপাল—আর আগাননি তিনি।
একজন নির্দয় রাজা হিসেবে আশুরনাসিরপালের খ্যাতি(!) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী প্রায় সব অ্যাসিরীয় রাজা তার এই ভাবমূর্তি অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। এক শহরের জনতা তাদের অ্যাসিরীয়া থেকে নিয়োজিত প্রশাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাকে হত্যা করেছিল। তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আশুরনাসিরপাল “নেতাদের গায়ের চামড়া তুলে নেন এবং একটি পিলারের গায়ে সে চামড়া জড়িয়ে দেন। তারপর তিনি সেই পিলারের মাঝে অন্য অপরাধীদের জ্যান্ত কবর দেন। কয়েকজনকে কাঁটা দিয়ে বিদ্ধ করে পিলারের চারপাশে ফেলে রাখা হয়। শহরের ভেতর আরও অনেকের কপালে একই পরিণতি ছিল।
আশুরনাসিরপালের নিজের বয়ানে, যেসব রাজকীয় কর্মকর্তা নগর প্রশাসককে সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল, আমি তাদের লিঙ্গ কেটে নিয়েছিলাম।” অন্যান্য সময়ে তিনি এই শাস্তির সঙ্গে নাক-কান কেটে নেওয়া, চোখ উপড়ে ফেলা ও বাগানের গাছগাছালির সঙ্গে মাথা বেঁধে রাখার মতো কাজও করেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, “জ্যান্তদের দিয়ে আমি একটি পিলার বানিয়েছিলাম।” এটি ছিল অ্যাসিরীয়দের ভয়াবহ এক আবিষ্কার। বন্দিদের একে অপরের উপর দাঁড় করিয়ে তাদের গায়ে প্লাস্টার মাখিয়ে এই কলাম তৈরি করা হত। “আমি তাদের কান ও আঙ্গুল কেটে নিতাম। অনেকেরই চোখ উপড়ে নেওয়া হত। তাদের তরুণ- তরুণীদের আগুনে পুড়িয়ে মারতাম আমি”, সদম্ভে জানান আশুরনাসিরপাল।
২৫ বছরের ত্রাসের রাজত্বের পর আশুরনাসিরপাল দ্বিতীয় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এবং তার ছেলে শালমানেসার তৃতীয়র হাতে ক্ষমতা দিয়ে যান। শালমানেসার পশ্চিমা সেমাইটদের ভূখণ্ড দখলে মনোযোগ দেন। তিনিও তার পিতার মতো ইউফ্রেতিস পার হয়ে সমুদ্রের কাছাকাছি যে-অংশে ‘সূর্য অস্ত যায়’, সেখানে যেয়ে পৌঁছান এবং যথারীতি ‘সমুদ্রে তার অস্ত্র ধুয়ে নেন’। খুব সম্ভবত, এটি খুবই গর্বের একটি কাজ ছিল। তবে তিনি তার বাবার মতো ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় রাজত্ব থেকে দূরে থাকেননি।
মজার ব্যাপার হল, সে আমলে ইসরায়েলের শক্তিমত্তা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। ওমরি’র ছেলে আহাব তার বাবার সিংহাসন দখল করেছিলেন। পূর্ব ও উত্তরে অ্যাসিরীয়দের আধিপত্য ছড়িয়ে পড়তে দেখে তিনি ফিনিশীয় রাজা সিডনের মেয়ের সঙ্গে একটি কৌশলগত বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। রাজকন্যা জেজেবেল ছিলেন তার প্রথম এবং প্রধান স্ত্রী, যার ফলে অ্যাসিরীয় সেনাদলের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি-ফিনিশীয় জোট বেশ শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
তবে এই কৌশল কাজে আসলেও আহাব বেশকিছু বড় ধরনের ভুল চাল চাললেন। তিনি ইসরায়েলের দেবতাকে অগ্রাহ্য করে, অন্যান্য দেবতাদের উপাসনা করার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন, যেমন ফিনিশীয় এবং বেশকিছু পশ্চিমা সেমাইট গোত্র ও শহরের বাসিন্দাদের মূল উপাস্য ‘বাআল’। এই উদ্যোগে তার টির, বিবলোস এবং অগ্রসরমান অ্যাসিরীয় বাহিনীর পথিমধ্যে থাকা বেশকিছু শহরের বন্ধুত্ব পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। তিনি ইসরায়েলের দেবতা ইয়েহভেহ’র উপাসনা চালু রাখেননি। ইতোমধ্যে তার ফিনিশীয় স্ত্রী আব্রাহামের সকল পূজারিকে গ্রেপ্তার করে জবাই করেন। তবে ১০০ জন ধর্মীয় নেতা পালিয়ে গিয়ে পূর্বের পার্বত্য এলাকায় আত্মগোপন করেন। এই আশ্রয়স্থল থেকে তারা ‘অশুভ রাজার’ বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইন্ধন জোগাতে থাকেন।
আহাবের প্রতিপক্ষদের মধ্যে ছিলেন ধর্মীয় নেতা এলিজাহ। এই ‘বন্য’ স্বভাবের মানুষটি পশুর চামড়া পরে জেজেবেলের চোখে ধুলা দিয়ে পালিয়েছিলেন। তিনি জেহু নামের একজন তরুণ ইসরায়েলি কর্মকর্তাকে পরবর্তী রাজা হিসেবে ‘ঈশ্বরের পছন্দের’ দাবিদার হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি একইসঙ্গে জেহুকে স্বর্গীয় অনুমতি এনে দেন, যাতে তিনি আহাব, জেজেবেল ও পুরো রাজপরিবারকে হত্যা করতে পারেন।
ইসরায়েলিদের নিজেদের মধ্যে এই কোন্দলের সুযোগ নেন আরামিয়ানদের ‘কিং অব দামাসকাস’। তিনি ৩২ জন আরামিয়ান সামন্তপ্রভুর সাহায্য নেন এবং তাদের সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালান। এক লেখকের ভাষ্য : “ইসরায়েলিদের বাহিনীর আকার ছিল ২টি ছোট ভেড়ার পালের মতো। আর অপরদিকে, আরামিয়ানরা পুরো পল্লি অঞ্চল জুড়ে অবস্থান নিয়েছিল।”
দুই পক্ষের মধ্যে এত ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও আহাবের নেতৃত্বে ইসরায়েলের সেনাদল বেশ ভালো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। আরামিয়ানরা যুদ্ধের ফল হিসেবে ‘ড্র’কে মেনে নিতে বাধ্য হয়। দামাসকাসের রাজা আহাবের সঙ্গে একটি সন্ধিচুক্তি করলেন। এই চুক্তির ফলে দুই দেশের মধ্যে তিন বছরের জন্য শান্তি নেমে এল।
তৃতীয় বছরে শালমানেসার ইসরায়েলের সীমান্তের দিকে সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হলেন।
তবে এবার প্রস্তুত ছিল ইসরায়েল। আহাব তার নিজস্ব ইসরায়েলি সেনার পাশাপাশি, উপকূলের ফিনিশীয় মিত্রের কাছ থেকে পাওয়া সেনা ও দামাসকাসের রাজার পাঠানো সেনা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। এই তিন দেশের সেনার সঙ্গে যোগ দিল মিশরের ২২তম রাজবংশের পঞ্চম ফারাও ওসরকন দ্বিতীয়র বাহিনী। ফারাও অ্যাসিরিয়ার ভয়ে কাঁপাকাঁপি করছিলেন। তার ধারণা ছিল, পশ্চিমা সেমাইটদের ভূখণ্ড দখলের পর হয়তো শালমানেসার ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে তার দোরগোড়ায় এসে হাজির হবেন।
খ্রিস্টপূর্ব ৮৫৩ সালে কারকার শহরে বিভিন্ন দেশের সৈন্যরা সংঘাতে লিপ্ত হল।
এরপর ঠিক কী হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা প্রায় অসম্ভব। শালমানেসার নিজেকে বিজয়ী দাবি করলেন। গর্ব সহকারে তিনি বললেন, “আমার শত্রুদের রক্তে উপত্যকা ভিজে উঠল এবং আমি পর্বতের চারপাশে তাদের লাশগুলো ফেলে রাখলাম।” মনোলিথ শিলালিপি নামের একটি লেখায় তিনি এসব দাবি করেন। অ্যাসিরীয়দের এঁকে রাখা ছবিতে দেখা যায়, মৃত অ্যাসিরীয় সেনাদের ওপর দিয়ে শত্রুসেনারা এগিয়ে আসছে। সাধারণত তাদের বর্ণনায় মৃত শত্রু ও জীবিত সেনা দেখা গেলেও, এসব ছবিতে ভিন্ন বাস্তবতা সম্পর্কে জানা যায়।
শালমানেসারের এরকম দাম্ভিক দাবি সত্ত্বেও তার শাসনামলের বাকি ৩০ বছরে তিনি আর আগাতে পারেননি। ফিনিশীয় নগর, ইসরায়েলি ভূখণ্ড ও দামাসকাস—সবাই অ্যাসিরীয়ার গ্রাস থেকে মুক্ত ছিল।
খুব সম্ভবত এই যুদ্ধেও কোনো ফল আসেনি। তবে অ্যাসিরীয়ার ক্ষয়ক্ষতি এতটাই ব্যাপক ছিল যে, বাধ্য হয়ে শালমানেসার সেনা প্রত্যাহার করে নেন। পশ্চিমা সেমাইট রাজারাও তাদের নিজ নিজ শহরে ফিরে যান। মিশরীয় বাহিনী নিজ দেশে ফিরে যেয়েই নতুন আরও একটি গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হয়। অন্তর্কলহ নিয়ে ব্যস্ত মিশর আবারও বেশ কয়েক বছরের জন্য আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায়।
তবে বসে ছিলেন না আহাব। সফলভাবে দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার পর তার মনোবল ও সাহস অনেক বেড়ে যায়। কারকারের যুদ্ধের পর আহাব বিশ্রাম নেন, তার মিত্র দামাসকাসের রাজার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করার এটাই উপযুক্ত সময়। তিনি দক্ষিণে জুদাহ’র রাজা জেহোশাফাটের কাছে বার্তা পাঠালেন। তিনি তাকে অনুরোধ জানালেন তার সঙ্গে উত্তরে যাত্রা করে যৌথভাবে ইসরায়েলি সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত আরামিয়ান শহর রামোথ-গিলিয়াদে আক্রমণ চালাতে। এই শহরটি মৈত্রীচুক্তির আওতায় সুরক্ষিত ছিল।
জেহোশাফাট ছিলেন সলোমনের নাতির নাতি। তিনি অন্যতম প্রধান গোত্র জুদাহ ও ছোট গোত্র বেঞ্জামিনের দখলে থাকা ভূখণ্ডের রক্ষাকর্তা ও শাসক ছিলেন। এই পুরো অঞ্চলটি সামগ্রিকভাবে ‘জুদাহ’ নামে পরিচিত ছিল। তার কোনো বড় আকারের সামরিক শক্তিমত্তা ছিল না। যেহেতু, রামোথ গিলিয়াদ জুদাহ’র উত্তর-দক্ষিণ সীমান্তে ছিল বিধায় জেহোশাফাটের জোট আহাবকে সেই শহরে হামলা চালাতে দেওয়ার প্রক্রিয়াগত কোনো বাধা ছিল না।
জেহোশাফাট আহাবের সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে রাজি হলেন। কিন্তু আহাবের রাজসভায় এসে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন জেহোশাফাট। জেজেবেলের আমদানি করা ধর্মনেতা এবং টীর থেকে আসা প্রতিনিধিদের দেখে তার কাছে মনে হল তিনি যেন কোনো ফিনিশীয় রাজসভায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি অস্বস্তিতে পড়তে লাগলেন। ফিনিশীয় উপদেষ্টারা একইসঙ্গে ভবিষ্যদ্বক্তার দায়িত্বও পালন করতেন। তারা আরামিয়ানদের বিরুদ্ধে সুনিশ্চিত জয়ের পূর্বাভাস দিতে লাগলেন। কিন্তু জেহোশাফাট আহাদকে একটি নির্দোষ প্রশ্ন করলেন : ‘আপনি কি কোনো হিব্রু ধর্মনেতাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, জেনে নিতে ইয়াহওয়েহ এই পরিকল্পনার বিষয়ে কী মনোভাব পোষণ করেন?’
‘হ্যাঁ। আমি একজন গুরুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে পারি। কিন্তু তাকে আমি পছন্দ করি না। সে কখনোই আমার ব্যাপারে ভালো কিছু বলে না’, উত্তর দিলেন আহাব।
জেহোশাফাটের পীড়াপীড়িতে ধর্মগুরু মিকাইআহকে ডেকে আনা হল। তিনিও সাদাসিধে উত্তর দিলেন, ‘আরামিয়ানদের আক্রমণ করেন। ঈশ্বর আপনাকে বিজয় এনে দেবে।’
এটি একটি বুদ্ধিদীপ্ত, কিন্তু মিথ্যে উত্তর ছিল। আহাব সেটা বুঝতে পেরে বললেন, ‘কতবার আপনাকে সত্য বলার জন্য নির্দেশ দিতে হবে?’ এরপর মিকাইআহ মন্তব্য করলেন, এই আক্রমণ তো ব্যর্থ হবেই, আহাব নিজেও মারা পড়বেন।
‘দেখলেন? আমি আপনাকে বলেছি, সে কখনো আমার ব্যাপারে ভালো কিছু বলে না।
এই ভবিষ্যৎবাণী সত্ত্বেও জেহোশাফাট আক্রমণে শামিল হতে রাজি হলেন। পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে যা বোঝা যায়, তা হল, তার নিজেরও সম্ভবত আরামিয়ান সরকারের সঙ্গে কোনো একধরনের বন্দোবস্ত ছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আরামিয়ান রথ-অধিনায়করা জেহোশাফাটের রাজকীয় পোশাক দেখে তার দিকে সরাসরি ধেয়ে গেলেন। কিন্তু তখন তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি জুদাহ’র রাজা, ইসরায়েলের নয়।’ তখন রথচালকরা তাদের গতিপথ বদলে অন্যদিকে চলে গেলেন।
আহাব ছদ্মবেশ নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন। তা সত্ত্বেও তার কপাল সুপ্রসন্ন ছিল না। হঠাৎ উড়ে আসা এক ঘাতক তির তার বর্মের মাঝে অনাবৃত অংশে আঘাত হানে এবং তিনি মারা যান।
১২ বছর পর তার ছেলে জোরাম আবারও রামোথ গিলিয়াদ দখল করার চেষ্টা চালান। আরামিয়ান বাহিনীর কাছে পরাস্ত হন তিনি। ব্যর্থ যুদ্ধের পর আহত অবস্থায় তিনি জর্ডান নদীর তীর ধরে ইসরায়েলি শহর জেজরিলে এসে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি তার ক্ষতগুলোর চিকিৎসা করান। তাৎক্ষণিকভাবে ইসরায়েলের এক ধর্মীয় নেতা জেহুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালান। এই তরুণ কর্মকর্তাকে ১৫ বছর আগে ইলাইজাহ আহাবের পরিবারকে হত্যা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
জেহু এতদিন আত্মগোপনে ছিলেন। মজার বিষয় হল, সেই নেতা জেহুকে খুঁজে পেলেন রামোথ-গিলিয়াদে। অর্থাৎ, তিনি ইসরায়েলের শত্রুদের মাঝেই লুকিয়ে ছিলেন। জোরাম আহত হয়েছেন, এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার রথ প্রস্তুত করলেন, কাঁধে এক বিশাল ধনুক ঝোলালেন এবং দাঁতে দাঁত চেপে জেজরিলের উদ্দেশে রওনা হলেন।
তবে আহাবের মতো লুকিয়ে না থেকে জোরাম তার নিজের পোশাক পরলেন, রথ প্রস্তুত করলেন এবং জেহুর মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে গেলেন। জেহু তাকে তিরের আঘাতে হত্যা করলেন এবং জেজরিলের দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন।
তিনি জেজরিলে পৌঁছানোর আগেই রানীমাতা জেজেবেল সেখানে পৌঁছে গেলেন। তিনি আহত সন্তানের সেবা-শুশ্রূষা করার আশায় সেখানে এসেছিলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে জোরামের মৃত্যু ও মৃত্যুদূত হিসেবে জেহুর আসন্ন আগমনের সংবাদ পেয়ে গেছেন তিনি। তিনিও তার রাজকীয় পোশাক গায়ে চড়িয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তার এ কাজের পেছনের কারণটি স্পষ্ট নয়। তিনি কি ভেবেছিলেন সমগ্র রাজসভা তার পেছনে এসে দাঁড়াবে, নাকি তিনি মৃত্যু নিশ্চিত জেনে এই কাজ করলেন, তা কেউ সঠিক করে বলতে পারেনি। কারণ যেটাই হোক, যখন জেহু এসে রাজকীয় বাসভবনের সামনে দাঁড়ালেন, তখন জানালা দিয়ে মাথা বের করে রানী চিৎকার করে বললেন, “তুমি কি শান্তির বার্তা নিয়ে এসেছ, হে প্রভু-হত্যাকারী?’
তবে জেহু জানতেন যে, জোরামের নিজ হাতে নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তাদের মনেও ততদিনে অসন্তোষ দানা বেধেছে। এই ভরসায় তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করে উঠলেন। রানীমাতার নিজ আবাস থেকে ৩ খোঁজা ভৃত্য বের হয়ে এসে রানীকে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন। রানী মাটিতে পড়ে গেলেন এবং জেহু তার দেহের ওপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে তাকে হত্যা করলেন। শহরের চারপাশে ঘুরতে থাকা ক্ষুধার্ত বন্য কুকুর এসে রানীকে খেয়ে ফেলল। এই আগ্রাসন থেকে শুধু তার দুই হাত, দুই পা আর খুলি বেঁচে যায়।
দ্য বুক অব ২ কিংস এর বর্ণনা মতে, জেহু আহাবের পরিবারের বাকি সব সদস্যকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং জেজেবেলের ফিনিশীয় ধর্মনেতাদেরও হত্যা করেন। এই দুই ঘটনা ছাড়া জেহুর রাজত্ব সম্পর্কে আর তেমন কিছুই জানা যায় না। তবে তার আমলে ‘ঈশ্বর ইসরায়েলের আকার কমিয়ে দেন’, বলে জানা যায়। তিনি পরবর্তীতে দামাসকাসের রাজার কাছে পরাজিত হন। জেহু ক্ষমতায় বসার পর দামাসকাসের আরামিয়ান রাজা ইসরায়েলের ওপর থেকে তার সমর্থন প্রত্যাহার করেন। একই সঙ্গে জর্ডান নদীর পূর্বের সব অঞ্চলও দখল করে নেন।
অবশ্য এই গুরুতর পরাজয়ের কথা বাইবেলে বলাই হয়নি।
তবে এই ঘটনা শালমানেসার তৃতীয়র বিজয় প্রকাশ-সূচক মিনার ‘ব্ল্যাক ওবেলিস্কে’ খোদাই করা আছে। এর ওপর ডজন-ডজন পরাজিত রাজা শালমানেসারের জন্য উপহার নিয়ে আসার উদাহরণ রয়েছে। একপাশের ২য় প্যানেলে ইসরায়েলের জেহুকে দেখা যায় অ্যাসিরীয় রাজার পায়ের কাছে মাথা নোয়াতে। শালমানেসার দাঁড়িয়ে থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে সূর্য থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একজন ভৃত্য মাথার উপর ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। শালমানেসার প্রথম অ্যাসিরীয় রাজা হিসেবে ইসরায়েলের ভূখণ্ড দখল করতে সমর্থ হন। তবে তিনিই শেষ রাজা নন, যিনি এই কীর্তি গড়তে পেরেছিলেন।
জেহু আহাবের সব পুরনো মিত্রকে হারিয়েছিলেন। আরামিয়ানরা তার বিরুদ্ধে চলে গেছিল। ফিনিশীয়রা তাদের রাজকন্যা জেজেবেল ও ধর্মনেতাদের নৃশংসভাবে হত্যা করার কারণে জেহুর ওপর চরম ক্ষিপ্ত হয়েছিল। জেহু ইসরায়েলের রাজপরিবারকে কলুষযুক্ত করার অভিযানে নেমে উল্টো তাদেরকে ‘মিত্রবিহীন’ জাতিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। অবশেষে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না।