২০.
খালিদকে নিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যখন হাজির হলো আসিফ আর তানিয়া, সেখানকার অবস্থা দেখে দমে গেল ওরা।
যেন ঢল নেমেছে আহত-রক্তাক্ত মানুষের। কেউ ছুরি খেয়েছে, ঘুসি মেরে ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে কারও নাকমুখ, কারও কারও শরীরে বুলেটের ক্ষত। কারণ দাঙ্গা শুরু হয়েছে। বেনগাজিতে। পানির অভাব প্রকট হচ্ছে দিন দিন, গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করছেন অনেকেই। পত্রিকায় এটাই এখন প্রধান ইস্যু।
ইমার্জেন্সি রুমের একটা কোনা খালি আছে দেখে সেখানে ঠাই নিল আসিফরা। খালিদের অবস্থা দেখে তাকে সোজা নিয়ে যাওয়া হলো ওটিতে। আগেই খবর দেয়া হয়েছিল, তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয়ে গেল লিবিয়ান সিকিউরিটি সার্ভিসের একজন সদস্য। আসিফ-তানিয়াকে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করল লোকটা। জেনে নিল খালিদের সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হয়েছে ওদের, কেন এসেছে ওরা লিবিয়াতে, আজ ঠিক কী ঘটেছে পাম্পিংস্টেশনে ইত্যাদি।
চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না আসিফ-তানিয়ার কথা বিশ্বাস করেছে সিকিউরিটির লোকটা। পাম্পিংস্টেশনের আরও দু চারজন কর্মী কর্তব্যের খাতিরে সঙ্গ দিচ্ছে আসিফ-তানিয়াকে, ওরাও বলল কীভাবে কী ঘটেছে, তারপরও নোট নিল লোকটা। বিদ্রোহীদের হামলা এবং আসিফদের পালানোর ব্যাপারে আরও কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল।
ওটির বাইরে নীরবতা। শেষপর্যন্ত কী হবে খালিদের তা নিয়ে আসিফ-তানিয়া চিন্তিত। পাম্পিংস্টেশনে যে-কর্মীরা আছে, তারা ভাবছে কখন যেতে পারবে হাসপাতাল থেকে।
বাইরে থেকে ধাক্কা মেরে খুলে ফেলা হলো করিডোরের দরজা, চাকাওয়ালা স্ট্রেচারে করে আরেক লোককে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওটির দিকে। রক্তাক্ত লোকটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিকিউরিটি এজেন্ট, চেহারায় দুশ্চিন্তা।
এসব ঘটতে শুরু করল কখন? জিজ্ঞেস করল তানিয়া। এভাবে চলতে থাকলে একটু পরে তিলধারণের জায়গা থাকবে না হাসপাতালে!
বেনগাজির কোনও কোনও এলাকায় পানির সরবরাহ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার, বলল সিকিউরিটি এজেন্ট। তারপরই শুরু হয়েছে দাঙ্গা। আজ বিকেলে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে সেটা। রেশনিং করে পানি দিতে চাইছে। সরকার, কিন্তু এসব বুঝবার মতো বুঝ কই আমজনতার? মরিয়া হয়ে উঠেছে ওরা। আমার মনে হয় উত্তেজিত করে তোলা হয়েছে ওদেরকে।
উত্তেজিত করা হয়েছে? বলল আসিফ। কে করেছে?
ইদানীং লিবিয়ার ওপর চোখ অনেকেরই। মিশরের গুপ্তচরেরা ঢুকে পড়েছে আমাদের বিভিন্ন শহরে। প্রশ্ন করতে পারেন, কেন? উত্তর: জানি না। শুধু জানি, বিদেশি এজেন্টরা এখন খোলাখুলি চলাফেরা করছে এদেশে।
সেজন্যই কি বিশ্বাস করতে পারছেন না আমাদেরকে? বলল তানিয়া। ভাবছেন আমরাই ক্ষতি করেছি মিস্টার খালিদের?
তাকে গতমাসেও খুন করার চেষ্টা হয়েছে, ঘুরিয়ে জবাব দিল এজেন্ট। যে বা যারা পানির জন্য উত্তেজিত করছে সাধারণ মানুষদের, তাদের শত্রু তিনি। কারণ একমাত্র তিনিই পারেন পানি কমে যাওয়ার কারণ বের করতে, সমস্যাটার সমাধান করতে। তাঁকে যদি সরিয়ে দেয়া যায়, বুঝতেই পারছেন কী হতে পারে।
ওটি থেকে বেরিয়ে এলেন একজন সার্জন, এদিকওদিক তাকিয়ে বুঝে নিলেন কারা আছে খালিদের সঙ্গে। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে এসে মাস্ক সরালেন। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে বেচারার, চেহারা বিধ্বস্ত। বোঝা গেল গত কয়েকদিন ধরে একটানা খেটে যাচ্ছেন রোগীদের পেছনে।
লোকটা বেঁচে আছে, সুখবর শোনালেন তিনি। এবং একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছে। একটা বুলেট লেগেছে ঊরুতে, হাড়ের কোনও ক্ষতি হয়নি। আর পেটে যা ঢুকেছিল তা আসলে বুলেট না, ছিটকে-আসা লোহার টুকরো। ভাইটাল কোনও অর্গানের ক্ষতি হয়নি।
কথা বলা যাবে মিস্টার খালিদের সঙ্গে? বলল তানিয়া।
এখনই না। অ্যানেসথেশিয়ার প্রভাব শেষ হতে সময় লাগবে। হাতঘড়ি দেখলেন সার্জন। আরও আধ ঘণ্টা পরে দেখা করতে পারবেন।
পকেট থেকে আইডি ব্যাজ বের করল এজেন্ট। আমাকে এই মুহূর্তে দেখা করতে হবে তাঁর সঙ্গে। ভিতরে নিয়ে চলুন আমাকে।
গাউন পরতে হবে আপনাকে। আর…বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবেন না।
এজেন্টকে ড্রেসিংএরিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন সার্জন, এমন সময় বেজে উঠল তানিয়ার স্যাটেলাইট ফোন। স্ক্রিনে নামটা দেখামাত্র একইসঙ্গে আশ্চর্য ও খুশি হলো সে। মাসুদ ভাই!
এদিকওদিক তাকিয়ে ব্যালকনির দিকে ইঙ্গিত করল আসিফ। চলো ওখানে যাই। তাজা বাতাস পাওয়া যাবে।
ব্যালকনিতে এসে ফোনের রিসিভ বাটন চাপল তানিয়া।
কী খবর? জানতে চাইল রানা।
সংক্ষেপে কিন্তু গুছিয়ে সব বলল তানিয়া।
শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল রানা। তারপর বলল, একটা কাজে ফ্রান্সে যেতে হবে তোমাদেরকে।
ফ্রান্স? কিন্তু আমাদেরকে যে লিবিয়ায় থাকতে হবে?
খরা আর মিস্টার খালিদের কারণে তো? কিন্তু ওসব আপাতত ছেড়ে দিতে হবে অন্য কারও দায়িত্বে। বেনগাজি থেকে ফ্রান্সের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে, এ-রকম একটা প্লেনে তোমাদের দুজনের ব্যবস্থা করিয়ে দিচ্ছি।
কী হয়েছে, মাসুদ ভাই?
প্লেনে উঠলেই জানতে পারবে।
যদি সেটাতে উঠতে দেয়া হয় আমাদেরকে, সিকিউরিটি এজেন্ট এবং লোকটার জিজ্ঞাসাবাদের কথা রানাকে জানাল তানিয়া।
যদি কোনও কারণে আটকা পড়ে যাও, জানিয়ে আমাকে।…রাখছি। লাইন কেটে দিল রানা।
ওটি থেকে বেরিয়ে এল সিকিউরিটি এজেন্ট, আসিফ তানিয়াকে খুঁজে নিয়ে হাজির হলো ব্যালকনিতে। আপনাদের ব্যাপারে আর কোনও সন্দেহ নেই আমার মনে। সব বলেছেন মিস্টার খালিদ।
তারমানে যেতে পারি আমরা? বলল তানিয়া।
মাথা ঝাঁকাল এজেন্ট।
মিস্টার খালিদকে বিদায় জানিয়ে সোজা চলে যাব। এয়ারপোর্টে, ওটির উদ্দেশে পা বাড়াল আসিফ।
.
বিসিআই হেডঅফিস, মতিঝিল, ঢাকা।
ফোনে অ্যাডমিরাল হ্যাঁমিল্টনের সঙ্গে কথা বলছেন মেজর জেনারেল (অবঃ) রাহাত খান।
গত বারো ঘন্টায় ব্যাপক রদবদল ঘটে গেছে উত্তর আফ্রিকার রাজনৈতিক মানচিত্রে, বললেন হ্যাঁমিল্টন। পতন ঘটেছে তিউনিসিয়া আর আলজেরিয়া সরকারের। মসনদে বসতে ইচ্ছুক নতুন নতুন জোট গড়ে উঠছে সেখানে। এসবের জন্য দায়ী উত্তরোত্তর বাড়তে-থাকা সন্ত্রাস আর খরা।
চুরুটের সুগন্ধী ধোঁয়ায় নিজের অফিস আচ্ছন্ন করে ফেলেছেন রাহাত খান। আমি অন্তত আশা করিনি এত জলদি পতন ঘটবে আলজেরিয়া সরকারের।
বিশ্বাসঘাতক অনেকেই আছে ওদের প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে। আছে গৃহযুদ্ধ উস্কে দেয়ার মতো অনেক লোক। …উত্তর আফ্রিকার উপর সিআইএ একটা অ্যাসেসমেন্ট পাঠিয়েছে হোয়াইট হাউসে, এক কপি এসেছে আমার হাতেও।
লিবিয়া সরকারের ভাগ্য ঝুলছে সুতোয়।
ওদেরকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে ইটালি।
হোয়াইট হাউস কী চায়?
ওরা চায়, লিবিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটুক। জনগণের সমর্থন নিয়ে নতুন কোনও দল আসুক।
তাতে কি পানিসমস্যার সমাধান হচ্ছে?
মনে হয় না।
আলজেরিয়া-তিউনিসিয়ার ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের বক্তব্য কী?
আসলে উত্তর আফ্রিকায় যেসব দেশেই গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়েছে বা দিতে যাচ্ছে, তাদের সরকারকে নতুন করে সাহায্য দিতে চাইছে না হোয়াইট হাউস। …রানা-সোহেলের কী খবর?
মিশরে গেছে।
.
কায়রোর যে-রাস্তা দিয়ে ভাড়া-করা গাড়ি চালাচ্ছে রানা, সেখানে গাড়িঘোড়ার চেয়ে মানুষ বেশি। কোন গাড়ি কোনদিক দিয়ে যাচ্ছে তা দেখারও প্রয়োজন বোধ করছে না লোকজন, অবলীলায় রাস্তা পার হচ্ছে। একটু পর পর ব্রেক চাপতে হচ্ছে রানাকে।
ওর পাশে বসে আছে সোহেল। পেছনের সিটে বসা লামিয়া স্যাটেলাইট থেকে ডেটা রিসিভ করছে নিজের আইপ্যাডে। কিছুতেই ওদের সঙ্গ ছাড়তে রাজি হয়নি মেয়েটা, আঠার মত সেঁটে গেছে রানা-সোহেলের সঙ্গে।
আগে বাড়ছে আখতার, বলল মেয়েটা।
অথবা ওর ফোন, মন্তব্য করল রানা। ব্রেক চাপতে বাধ্য হয়েছে আবারহুট করে গাড়ির সামনে চলে এসেছিল বেতাল এক পথচারী। রাস্তার এদিকটা খানাখন্দে ভরা।
সুচতুর অপরাধীও কোনও-না-কোনও ভুল করে, অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে এমন কোনও সূত্র ফেলে যায় যা পরে ধরিয়ে দেয় তাকে; তা-ই করেছে হুসাইন আখতার। মাল্টায় যে-স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করেছে, সেটাই ব্যবহার করছে মিশরে। স্যাটেলাইটের সঙ্গে কানেক্টেড হয়েছে লামিয়া, কোনদিকে যেতে হবে বলে দিচ্ছে রানাকে। তবে ফোনটা আখতারই ব্যবহার করছে কি না, না দেখা পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
রানার ধারণা, নিজেদের আস্তানায় যাচ্ছে আখতার।
বাঁদিকে মোড় নাও, রানাকে বলল লামিয়া। গতি কমাচ্ছে সে।
বাঁদিকের রাস্তায় যাওয়ামাত্র আখতারের গতি কমানোর কারণ বুঝতে পারল রানা। সারি সারি দোকান আর রেস্টুরেন্ট এখানে, দুধারের ফুটপাত বোঝাই হয়ে আছে মানুষ দিয়ে। গাড়িঘোড়া এগোচ্ছে কচ্ছপের গতিতে।
এদিকওদিক তাকাচ্ছে সোহেল। আরবি আর ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় কোনটা সোনার দোকান, কোনটা ইলেকট্রনিক্সের, আর কোনটা কার্পেটের। কোনও কোনও দোকানের বাইরে নিজেদের পসরা সাজিয়ে বসে গেছে ফলৈর ব্যাপারীরা।
কয়েক ব্লক এগোনোর পর রানাদের গাড়ি হাজির হলো নীল নদের পুব তীরে। এখন একটা পোতাশ্রয় ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে।
পোতাশ্রয়ের একজায়গায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে কয়েকটা ক্রেন। কতগুলো বার্জ থেকে শস্যদানার বিশাল বিশাল বস্তা নামানো হচ্ছে। জাহাজঘাটায় অপেক্ষায় আছে চার-পাঁচটা ফেরি, গাড়ি আর মানুষ সারি বেঁধে উঠছে সেগুলোতে। জাহাজঘাটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে অনেকগুলো ফিশিংবোট আর প্রমোদতরী।
এসবের উপর থেকে চোখ সরাল রানা। আমাদের টার্গেট কোথায়?
ক্ষুদ্রাকৃতির লাল একটা বৃত্ত জ্বলছে-নিভছে আইপ্যাডে, সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখছে লামিয়া। কিছুক্ষণ পর বলল, নীল নদের দিকে যাচ্ছে। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল দূরের একটা ভাঙাচোরা ফুটপাত।
ওই জায়গায় জমিন ঢালু হয়ে নেমে গেছে তীরের দিকে। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বানানো আছে ওখানে।
পোতাশ্রয়ের সঙ্গের একটা পার্কিংলটে গাড়ি থামাল রানা। নামল গাড়ি থেকে।
লামিয়া আর সোহেলও নামল। আইপ্যাড এখনও আছে। মেয়েটার কাছে।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল তিনজনে, একটু দাঁড়াল। সরু ডকইয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে রানা। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা চলমান মূর্তিকে।
আখতার, নিচু গলায় বলল রানা। কোনও সন্দেহ নেই।
যেন কিছুই দেখছে না, কোনওকিছুতেই যেন কোনও পরোয়া নেই, এমনভঙ্গিতে ধূসর একটা পাওয়ারবোটে গিয়ে উঠল আখতার। পেছনদিকে বসে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে চালু হলো ওটার ইঞ্জিন। পাওয়ারবোটটা সরে যাচ্ছে ডকইয়ার্ড থেকে।
আমাদেরও একটা বোট দরকার, বলল লামিয়া।
দ্রুত এগোল রানা, ডকইয়ার্ড ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে একসারিতে অনেকগুলো টুরিস্টবোট বাঁধা আছে। রঙচঙে একটা ওয়াটারট্যাক্সিতে উঠে পড়ল ও। ওর পেছন পেছন উঠল সোহেল আর লামিয়া।
ওদের তিনজনকে একদৃষ্টিতে দেখছে ট্যাক্সিচালক, সিগারেট ফুঁকছে। যাত্রী নেয়ার আগ্রহ নেই তার। হাতঘড়ি দেখে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, আজকের মতো কাজ শেষ আমার।
পকেট থেকে একগাদা নোট বের করে দেখাল রানা। ওভারটাইমের কথা ভুলে যাচ্ছ কেন?
চালু হয়ে গেল ওয়াটারট্যাক্সির ইঞ্জিন।
অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে বাঁকানো স্টিলের-শিকে ক্যানভাসের ছাউনি লাগানো আছে, তিনটা সিটে বসে পড়ল ওরা।
সোজা এগোতে থাকো, বলল রানা।
মাথা ঝাঁকিয়ে আগে বাড়ল ড্রাইভার।
গতি বাড়ছে ওয়াটারট্যাক্সির, নীল নদের স্রোতের বিরুদ্ধে যুঝতে যুঝতে এগিয়ে চলেছে। নিজেদেরকে ট্যুরিস্ট প্রমাণ করার জন্য সঙ্গে-আনা ক্যামেরা বের করেছে সোহেল, এটা সেটার ছবি তুলছে। নদের মুক্তবাতাস উপভোগ করছে লামিয়া, ফালতু প্রসঙ্গে বকবক করছে, মাঝেমধ্যে তাকাচ্ছে আইপ্যাডের দিকে।
একটা বিনকিউলার বের করল রানা। দূরে দেখা যাচ্ছে আখতারের পাওয়ারবোট।
কতদূর যাবেন আপনারা? জানতে চাইল ড্রাইভার।
আপাতত শুধু যেতে থাকো, বলল রানা। কখন আর কোথায় থামতে হবে, বলে দেব। বিনকিউলার তুলে আরেকবার তাকাল পাওয়ারবোটের দিকে।
এগিয়ে চলেছে আখতার।
কয়েকটা বার্জ পাশ কাটাল রানাদের ওয়াটারট্যাক্সি। রানা আর লামিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সোহেল। নদের অন্যতীরে, দূরদিগন্তে, চিত্রার্পিতের মতো দেখা যাচ্ছে গিজার পিরামিডগুলো। বিকেলের রোদ কমলা আভা মেখে দিয়েছে আকাশে; দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, অদ্ভুত সে-আলোয় আলোকিত হয়ে কমলা রঙ ধারণ করেছে পিরামিডগুলোও।
দক্ষিণদিকে মোড় নিয়েছে আখতার, বলল লামিয়া। নদের আরেকপাড়ের দিকে যাচ্ছে।
ড্রাইভারকে দিক বদল করতে বলল রানা।
কাছিয়ে আসছে নীল নদের পশ্চিমতীর। এলাকাটা অনুন্নত-পুব তীরে আছে সারি সারি অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল আর অফিস; পশ্চিম তীরে কেবল ধ্বংসপ্রাপ্ত অতি-পুরনো কিছু দালান। তবে যেন আশার-আলো হয়ে আছে নতুন একটা কন্ট্রাকশন প্রজেক্ট। কতগুলো ক্রেন, বুলডোজার আর সিমেন্ট-বোঝাই ট্রাক দেখা যাচ্ছে ওখানে।
বোঝা গেল, ব্যক্তিগত স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে পশ্চিমতীরের বড় একটা অংশে। কয়েকটা বিল্ডিং আর পার্কিং এরিয়ার কাজ শেষের পথে। কাঁটাতারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে পুরো জায়গা, যত্রতত্র ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে বড় বড়, ব্যানার, যেগুলোতে একইসঙ্গে আরবি ও ইংরেজিতে লেখা আছে: আমেনথেস কন্ট্রাকশন। নির্মাণশৈলীর বিচারে কোম্পানিটার কাজ নিঃসন্দেহে মনোমুগ্ধকর, কিন্তু রানার খটকা লাগল অন্য কারণে।
একটা কৃত্রিম খাল খনন করা হয়েছে প্রজেক্টের একপাশে, নদের তীর ঘেঁষে। ওটা কমপক্ষে এক শ ফুট চওড়া এবং আধ মাইল দীর্ঘ। লামিয়ার আইপ্যাডে স্যাটেলাইট থেকে যে সিগনাল আসছে, তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আমেনথেসের প্রায় পুরো প্রজেক্ট ঘিরে আছে ওই খাল। কংক্রিটের পুরু একটা পার্টিশন-দেয়াল নদ থেকে আলাদা করেছে ওটাকে। তীব্র স্রোতের ফেনিল পানি ছুটে চলেছে খালে, পরে জলপ্রপাতের মতো আছড়ে পড়ছে নদের বুকে।
কৃত্রিম জলপ্রপাত? বিস্মিত হয়েছে লামিয়া।
হাইড্রো-ইলেকট্রিক, বলল ড্রাইভার। আমেনথেস পাওয়ার অ্যাণ্ড লাইট।
ইন্টারনেটের সাহায্য নিল লামিয়া। নদের একজায়গায় পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে কৃত্রিম পদ্ধতিতে, বদলে দেয়া হচ্ছে পানির গতিপথ, বাধ্য করা হচ্ছে তীব্র গতিতে খাল বেয়ে ছুটে আসতে। ওখানে কতগুলো সাবমার্জড় টারবাইন আছে। ঘণ্টায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ওই পাওয়ার-প্লান্ট। আমেনথেস কন্ট্রাকশনের ওয়েবসাইট বলছে, নদের তীরে আরও উনিশটা প্লান্ট স্থাপন করেছে। ওরা-পুরো মিশরের বিদ্যুচ্চাহিদা পূরণ করতে চায়।
বিনকিউলার দিয়ে জলপ্রপাতটা কিছুক্ষণ দেখল রানা। তারপর ওটা নামিয়ে লামিয়াকে বলল, খাল থেকে বের হওয়া পানির লেভেলের সঙ্গে নদের পানির লেভেলের কয়েক ফুট পার্থক্য আছে। বিনকিউলার এগিয়ে দিল লামিয়ার দিকে।
ব্যাপারটা দেখল লামিয়া, তারপর সোহেলও।
বিনকিউলার রানার হাতে ফিরিয়ে দেয়ার সময় সোহেল বলল, আমার মনে হচ্ছে বাড়তি পানি বেরিয়ে যাওয়ার কোনও নির্গমনপথ বানানো হয়েছে।
কোথাও কোনও বাধ আছে মনে হয়, বলল লামিয়া।
মাথা নাড়ল রানা। নেই। ভালোমতো দেখেছি। খাল আর নদের পানির লেভেল সমান থাকার কথা। শুধু তা-ই না, খাল বেয়ে ছুটে-আসা পানির গতি নদের পানির গতির তুলনায় কম হবে, কারণ ওই পানি অনেকগুলো টার্বাইন ঘোরাচ্ছে।
খালের পানির গতি ত্বরান্বিত করার বিশেষ কোনও উপায় বের করেছে ওরা? সোহেলের কণ্ঠে যতটা না জিজ্ঞাসা, তারচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তা।
আবারও বিনকিউলার তুলল রানা, কন্ট্রাকশন সাইটের দিকে তাকাল। পাহারার কড়াকড়ি দেখা যাচ্ছে ওখানে। উর্দিপরা অনেক গার্ড আছে, তাদের কয়েকজনের হাতে শিকলবাঁধা অ্যালসেশিয়ান। খিলানের মতো করে বানানো মূল এন্ট্রেন্সের গেট বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকছে, যখন কোনও গাড়ি ঢুকছে তখন ভালোমতো পরীক্ষা করা হচ্ছে ওটাকে।
আমেনথেসের ওই প্লান্টকে একটা মিলিটারি ঘাঁটি বলে মনে হচ্ছে আমার, বলল রানা।
আখতার গিয়ে ঢুকেছে ওখানে, আইপ্যাডের উপর চোখ লামিয়ার।
আমেনথেসের ইতিবৃত্ত জানতে হবে আমাদেরকে, বলল রানা। আখতার যদি আর বের না হয়, ওই প্লান্টে ঢুকতে হবে।
জাদুঘরের গুদামে ঢোকার চেয়ে ওই প্লান্টে ঢোকা অনেক। কঠিন, বলল লামিয়া।
অফিশিয়াল কোনও বাহানার দরকার হবে আমাদের। সরকারি কিছু হলে সবচেয়ে ভালো হয়। তোমার বন্ধুরা কোনও সাহায্য করতে পারবে?
মনে হয় না। এদেশের প্রভাবশালী কোনও মহলের সঙ্গে খাতির নেই আমার বন্ধুদের।
সোহেলের দিকে তাকাল রানা, চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দুজনের।
লুঙ্কর হোসেইনির কাছে যাবে ওরা (নরকের কীট দ্রষ্টব্য)। প্রমোশন পেয়ে এখন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হয়েছে সে।
যেখান থেকে উঠেছিলাম, ওয়াটার ট্যাক্সির চালককে বলল রানা, সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে চলো আমাদেরকে।
.
২১.
কী করছ এখন? লুঙ্কর হোসেইনিকে জিজ্ঞেস করল সোহেল।
একটা অ্যাডভার্টাইযিং ফার্ম চালাচ্ছি। স্বাধীন পেশা। মনের মতো করে কাজ করার সুযোগ আছে। উদ্ভাবনীক্ষমতার পরিচয় দেয়া যায়।
সেনাসদরে গিয়েছিল ওরা। জানতে পারে, চাকরি ছেড়ে দিয়েছে হোসেইনি। অফিস খুলেছে কায়রোতেই। ঠিকানা অনুযায়ী জায়গামতো হাজির হয়েছে ওরা।
এত ভালো একটা চাকরি ছেড়ে দিলে কেন? আবার জানতে চাইল সোহেল। তোমাকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বানানো হয়েছিল।
চেয়ারে হেলান দিল হোসেইনি। ক্ষমতার পালাবদল। আরব বসন্তের সময় আমাদের দেশে কী হয়েছে, তা নতুন করে বলতে চাই না। আর্মির অনেকেই যে যার মতো আখের গুছিয়ে নিয়েছে তখন। বিবেকের বাধায় কাজটা করতে পারিনি আমি। পরে ভেবে দেখলাম, যারা স্বার্থসিদ্ধি করছে তাদেরকে সঙ্গ না দিলে ওরা পরে একজোট হয়ে আমারই ক্ষতি করবে।
কিন্তু তাই বলে অ্যাডভার্টাইযিং ফার্ম?
অসুবিধা কী? পেট চালানো দিয়ে কথা। এ-লাইনে অনেকেই উন্নতি করেছে এবং করছে। আমার অবস্থাও মন্দ না। মিশরে এখন সবাই কিছু-না-কিছু বেচতে চায়। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল হোসেইনি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, শুধু কুশল বিনিময়ের জন্য আসোনি তোমরা।
ঠিক, বলল সোহেল। তারপর বলল আসল ঘটনা।
শুনতে শুনতে ভ্রূ কুঁচকে গেল হোসেইনির। তোমাদের জায়গায় আমি থাকলে ঘাঁটাতাম না আমেনথেসকে।
ওরা কারা? জিজ্ঞেস করল রানা।
হোসনি মুবারাকের ওল্ড গার্ড রেজিমেন্ট। কয়েক বছর আগে আর্মির কিছুসংখ্যক অফিসারকে বিভিন্ন কারণে তাড়িয়ে দেয়া হয়। চাকরিচ্যুত সে-রকম কয়েকজন অফিসার গড়ে তোলে দলটা। ওদের দলনেতার নাম সারওয়ার বিন জামাল। সিক্রেট পুলিশের দুর্ধর্ষ এক কর্নেল ছিল সে। নাসের, সাদাত অথবা মুবারাকের মতো ওরও ইচ্ছা: একদিন মিশরের মালিক হবে।
কেউ কিছু বলল না।
আমেনথেস এখন মিশরের অন্যতম প্রভাবশালী সংগঠন। সবজায়গায় লোক আছে ওদের। যোগাযোগ আছে বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের হোমরাচোমরাদের সঙ্গে। মসনদ ধরে রাখতে অথবা নতুন করে মসনদে যেতে সারওয়ারকে রাজি খুশি রাখতে চায় অনেকেই। …লিবিয়া, তিউনিসিয়া আর আলজেরিয়ায় ইদানীং কী ঘটছে, জানো নিশ্চয়ই?
জানি,বলল সোহেল।
অনেকেই বলছে, যারা ওসব দেশের সরকার গঠন করেছে অথবা করতে যাচ্ছে, তারা সারওয়ারের মদদপুষ্ট। তাই বলছিলাম তোমাদের জায়গায় আমি থাকলে ঘাটাতাম না আমেনথেসকে।
মুচকি হাসল সোহেল। ছোট একটা মাছ ধরতে গিয়ে দেখি, ওটাকে তাড়া করছে বড় আরেকটা। বড় মাছটাকে ভয় দেখাতে যেই নেমেছি পানিতে, অমনি হাজির হলো এক হাঙর।
ওসিরিসের নিজস্ব আর্মি আছে। রেগুলার ফোর্স থেকে যাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যারা এককালে স্পেশাল ফোর্সের সদস্য ছিল এবং যারা সিক্রেট পুলিশে গুপ্তঘাতকের দায়িত্ব পালন করেছে, মূলত তাদেরকে নিয়েই দল গড়েছে সারওয়ার।
তারপরও ওসিরিসের ঘাঁটিতে ঢুকব আমরা, বলল রানা। আমাদের সাফল্যের উপর নির্ভর করছে অনেক মানুষের জীবন।
সারওয়ার যদি জানতে পারে আমি আছি তোমাদের সঙ্গে, ব্যবসা তো গোটাতে হবেই, আমার জান নিয়েও টানাটানি পড়ে যেতে পারে। তারপরও সাহায্য করব তোমাদেরকে। কারণ তোমাদের কাছে আমি ঋণী। তোমাদের কাছে মিশর ঋণী। …কীভাবে ঢুকতে চাও ওসিরিসের ঘাঁটিতে?
হোসেইনির দিকে আইপ্যাড ঠেলে দিল লামিয়া। আমার কলিগরা আমেনথেস প্রান্টের কিছু নকশা পাঠিয়েছে। রানা বলছিল ওর মাথায় একটা আইডিয়া আছে।
রানার দিকে তাকাল হোসেইনি।
সামনে ঝুঁকে আইপ্যাডের স্ক্রিনে ট্যাপ করল রানা। বড় হয়ে দেখা দিল একটা হাই-রেফেলুশন ফটো। আমেনথেস প্রান্ট আর আশপাশের এলাকা দেখা যাচ্ছে। মূল রাস্তা দিয়ে প্লান্টে ঢোকার মুখে সিকিউরিটি-ব্যবস্থা ভেদ করা অসম্ভব। তারমানে প্লান্টে ঢুকতে হলে নদীপথে হানা দিতে হবে আমাদেরকে। একটা বোট দরকার হবে আমাদের, সঙ্গে ডাইভিংগিয়ার আর মাঝারি ফ্রিকোয়েন্সির লেসার। সবুজ হলে ভালো, তবে টার্গেট করার জন্য আর্মিতে যে-ধরনের ব্যবহৃত হয় সে-রকম হলেও ক্ষতি নেই।
মাথা ঝাঁকাল হোসেইনি। জোগাড় করে দিতে পারব। আর?
প্লান্ট থেকে আধ মাইল দূরের একটা জায়গা দেখাল রানা আইপ্যাডের স্ক্রিনে। বোটে করে এখানে যাব আমরা প্রথমে। ঢুকে পড়ব হাইড্রো-ইলেকট্রিক চ্যানেলে, পাশ কাটাব টার্বাইনগুলোকে। যেহেতু রাতের বেলায় যাব, তখন সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে থাকবে প্লান্টে। টার্বাইনগুলো এড়িয়ে দেয়াল ঘেঁষে এগোনোর চেষ্টা করব। সেকেণ্ড স্টেজ ইম্পেলারের সঙ্গে আছে পিনবল মেশিনের মতো দেখতে ডিফ্লেক্টর গেটপিক আওয়ারে যত-বেশি-সম্ভব পানি পাঠায় টার্বাইনের ব্লেডে। গেটের সঙ্গে, একপাশে ঝালাই করে লাগানো আছে মেইনটেনেন্স ল্যাডার। ওটা বেয়ে উঠে পড়তে চাই।
কিন্তু গেট খোলা থাকলে কী করবেন?
হিসেব করে দেখেছি, ওই চ্যানেলে স্রোতের গতি ঘণ্টাপ্রতি দুই নট। গেট খোলা থাকলে হয়তো দ্বিগুণ হবে।
সামাল দেয়া মুশকিল।
ঝুঁকি নিতে হবে, উপায় নেই।
চ্যানেলের দিকে তাক করা আছে দুটো সিসি ক্যামেরা, বলল লামিয়া। আর সামনের দিকের টার্বাইনগুলো পার হওয়ার পর মাত্র একটা। ওগুলো এড়াতে হবে আমাদেরকে।
রানার দিকে তাকাল হোসেইনি। সেজন্যই কি লেসার নিতে চাইছেন?
মাথা ঝাঁকাল রানা। সিসি ক্যামেরায় লেসার ফেললে সিগনাল প্রসেস করতে পারে না সেন্সর, কালো একটা পর্দা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না মনিটরে।
কিন্তু যদি অ্যালার্ম আর ইন্টেরিয়র সিকিউরিটি ক্যামেরা থাকে? বলল হোসেইনি।
ভিতরে ঢুকতে পারলে ওগুলো অকেজো করে দিতে পারব আমি, নিশ্চয়তা দিল লামিয়া। আমেনথেস হাইড্রো-ইলেকট্রিক তাদের ওয়েবসাইটে হ্যাঁলিফ্যাক্স সফ্টওয়্যার ব্যবহার করার কথা বলেছে। তারমানে ওই সফটওয়্যার দিয়ে অ্যালার্ম আর সিকিউরিটি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করছে ওরা। ওদের সিস্টেম হ্যাঁক করার কায়দা আমাকে জানিয়েছে আমাদের টেকনিকাল সেকশন।
হুসাইন আখতারের স্যাটেলাইট ফোনের সিগনাল ফলো করছিলাম আমরা, বলল রানা। ওটা দুর্বল হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায়। আমার ধারণা, মাটির নিচে নেমেছে সে, সম্ভবত ওদের পাওয়ার জেনারেশন সেকশনে গেছে। যদি মাটির উপরেই থাকত তা হলে সিগনাল হারাতাম না।
প্লান্টের ভিতরে ঢুকলে বাইরে থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে তোমাদেরকে, বলল হোসেইনি সোহেলের দিকে চেয়ে।
জানি।
তোমরা যখন ভিতরে থাকবে তখন আমি কী করব?
নীল নদে অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য।
.
হোসেইনির এক বন্ধু একটা বোট ধার দিয়েছে ওকে, ওটাতে করে নীল নদের পশ্চিম তীরে হাজির হয়েছে ওরা চারজন।
অন্ধকারের কালো চাদর বিছিয়ে দিয়েছে রাত। চাঁদ ওঠেনি এখনও, তবে পুব তীরসংলগ্ন পানি আলোকিত হয়ে আছে উঁচু উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং আর হোটেলের আলোয় পশ্চিম তীরে কালিগোলা অন্ধকার, সেই সঙ্গে জমাটবাঁধা নীরবতা।
একটা নাইটভিশন বিনকিউলার দিয়ে চ্যানেলের দিকে তাকিয়ে আছে সোহেল। ডিফ্লেক্টর গেট বন্ধ।
কাজ সহজ হলো আমাদের, বলল রানা। ডাইভ দেয়ার প্রস্তুতি নে।
কাপড়ের নিচে কালো ওয়েটস্যুট পরে আছে রানা, সোহেল আর লামিয়া। কাপড় খুলে ফেলল তিনজনই। বোটের গতি কমিয়েছে হোসেইনি।
বয়ান্সি কম্পেন্সেটর ডিভাইস পরে নিল ওরা তিনজন। এয়ারট্যাঙ্ক আটকিয়ে নিয়ে রেগুলেটর চেক করল। ইচ্ছা করেই রঙচটা অক্সিজেন সিলিণ্ডার বাছাই করেছে রানা, ওগুলোতে আলো প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। প্লিট ফিনস, ওয়াটারপ্রুফ পাউচ আর লো ইনটেনসিটি ডাইভলাইট আছে তিনজনের সঙ্গেই। শুধু নেই কোনও আণ্ডারওয়াটার কমিউনিকেশন সিস্টেম। যদি দরকার হয়, হাতের সিগনালের সাহায্যে কাজটা চালাতে হবে ওদেরকে।
রেডি তোমরা? জানতে চাইল হোসেইনি।
মাথা ঝাঁকিয়ে বোটের কোনা দিয়ে উল্টে পানিতে পড়ে গেল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর সোহেল। আইপ্যাডটা শেষবারের মতো দেখে নিয়ে ওদের দুজনের সঙ্গে যোগ দিল লামিয়াও।
.
পানির নিচে এসে টের পাওয়া গেল, আসলে বিভিন্নমুখী স্রোত বইছে নদে; ওগুলোর পারস্পরিক সংঘর্ষে কোথাও কোথাও মৃদু জলঘূর্ণিও তৈরি হচ্ছে। পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে বালিকণা এবং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী আরও বিভিন্ন জিনিস। তীরের কাছাকাছি থাকার সিদ্ধান্ত নিল রানা। ডাইভলাইট জ্বালিয়ে একসঙ্গে থাকার ইশারা করল বাকিদেরকে।
ধীর কিন্তু মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে রানা। এগোনোর গতি কত হতে পারে, অনুমান করার চেষ্টা করল। খুব সম্ভব তিন নট। হাইড্রোচ্যানেলের প্রবেশমুখে হাজির হতে মিনিট দশেকের বেশি লাগার কথা না।
আশপাশের অন্ধকার আলকাতরার মতো কালো। মুখ তুলে উপরের দিকে তাকালে অস্পষ্ট একটা ঝিকিমিকি চোখে পড়ে। ক্ষয়টে চাঁদ বোধহয় দেখা দিয়েছে আকাশে।
গতিপথ বদলে সামান্য বাঁদিকে মোড় নিল রানা, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মৃদু আলো দিচ্ছে সোহেল আর লামিয়ার কব্জিতে বাঁধা ফ্ল্যাশলাইটের এলইডি। সামনে তাকাল রানা।
দূরে অস্পষ্ট আলো দেখা যাচ্ছে। ওটা কন্ট্রাকশন প্রজেক্টের ফ্লাডলাইট, আলোকিত করেছে নদের পানিকে। আরেকটু গভীরে নামল রানা।
হাইড্রোচ্যানেলকে নদ থেকে আলাদা করেছে কংক্রিটের ভিত্তি; ফ্লাডলাইটের আলো পানির যে-পর্যন্ত নামছে, তার নিচে থেকে ওই ভিত্তির কাছে হাজির হলো রানা। এই জায়গায় বেয়াড়া আলোড়ন জেগেছে পানিতে, রানা একটু অসতর্ক হলেই ব্যাকস্লো বা স্লিপস্ট্রিমের কারণে ছিটকে দূরে চলে যেতে পারে।
সময় নিচ্ছে ও, একটু একটু করে আগে বাড়ছে। বড় রকমের অসুবিধা ছাড়াই ঢুকে পড়তে পারল চ্যানেলে। স্রোত এখানে সহনীয় পর্যায়ে আছে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে পর্যাপ্ত আলো। নিজেকে তো বটেই, হাতের ডানদিকের কংক্রিটের দেয়াল আর চ্যানেলের তলার কংক্রিটের মেঝে পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রানা।
কিছুটা সামনে হীরক-আকারের বিরাট কিছু একটা দেখা যাচ্ছে চ্যানেলের তলদেশে। জলপ্রবাহকে উত্তাল করার কাজে ব্যবহৃত হয় ওটা সম্ভবত। সাবধানে সাঁতার কেটে ওই জিনিস পার হলো রানা। ধরা পড়ার আশঙ্কা করছে প্রতি মুহূর্তে-চ্যানেলের তীরে এসে কেউ যদি পানির দিকে তাকায় তা হলে নির্ঘাৎ দেখতে পাবে ওকে।
দেয়ালের কাছ ঘেঁষে এল ও। দম ছাড়ছে অনিয়মিত বিরতিতে–চায় না পানির উপর দেখা-দেয়া বুদ্বুদ চোখে পড়ক কারও। আলোকরাজ্যের বাইরে চলে এল একসময়, এখন যেখানে আছে সেখানে কিছুটা হলেও জমাট বেঁধেছে অন্ধকার।
অনতিদূরে ফার্স্ট-স্টেজ টার্বাইনগুলো। অন্ধকারের পট ভূমিতে ওগুলো দেখে মনে হচ্ছে, কুয়াশার চাদর খুঁড়ে বের হচ্ছে ছোট ছোট কিছু জাহাজ। প্রতিটা টার্বাইন পঞ্চাশ ফুট ব্যাসেরু, ভিতরে ঘন সন্নিবিষ্ট অবস্থায় লাগানো আছে কমপক্ষে বারোটা করে ব্লেড-বিশালাকৃতির এগস্ট ফ্যান হয়ে গেছে একেকটা। স্রোতের কারণে মাঝেমধ্যে ঘুরছে কোনও কোনও ব্লেড, টিক্ টিক্ আওয়াজ হচ্ছে তখন।
সবচেয়ে কাছের টার্বাইন আর দেয়ালের মাঝখানে বড়জোর দেড় ফুটের ব্যবধান, শরীরটা মুচড়ে ওই জায়গা পার হলো রানা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল, ওকে ঠিকমতোই ফলো করছে সোহেল আর লামিয়া।
চ্যানেলের মাঝামাঝি নাগাদ পৌঁছানোর পর দেখা পাওয়া গেল সেকেণ্ড-স্টেজ টার্বাইনগুলোর। এখানে গতি আরও কমাল রানা, গা বলতে গেলে মিশিয়ে ফেলেছে দেয়ালের সঙ্গে। মেইনটেনেন্স ল্যাডারটা এখন ওর জন্য বাতিঘর।
একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে, কেমন গভীর আর অলক্ষুণে একজাতের কম্পন টের পাওয়া যাচ্ছে। খেয়াল করলে মনে হয়, চালু হয়েছে কোনও জাহাজের প্রপেলার।
মেইন টার্বাইনটা বেশি দূরে না। এটার ব্যাস, প্রথম যে টার্বাইন দেখেছিল রানা সেটার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। চ্যানেলের প্রস্থ বরাবর অনেকখানি জায়গা দখল করে রেখেছে ওটা একাই ঘুরতে শুরু করেছে ওটার ব্লেডগুলো। আড়ালে দেখা যাচ্ছে ডিফ্লেক্টর গেটের একটা পাশ।
গেটের কাছে গিয়ে হাজির হলো রানা, দুহাতে ধরে ফেলল ল্যাডারের একটা ধাপ। স্টিলের কতগুলো রিইনফোর্সমেন্ট রড কায়দামতো বাঁকিয়ে ঝালাই করে দেয়া হয়েছে গেটের সঙ্গে, হয়ে গেছে মেইনটেনেন্স ল্যাডার।
ধাপটা ধরে রেখে কিছুক্ষণ দম নিল রানা, এদিকওদিক তাকিয়ে দেখছে অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ হাজির হয়েছে কি না কাছেপিঠে। সে-রকম কাউকে দেখতে পেল না। ফিন খুলে ছেড়ে দিল হাত থেকে। স্রোতের ধাক্কায় ভেসে দূরে চলে গেল ওগুলো, হারিয়ে গেল একসময়।
চ্যানেলে স্রোতের গতি নদের স্রোতের চেয়ে খুব বেশি না, তারপরও স্রোতের অবিরাম ঠেলার কারণে রানার মনে হচ্ছে, যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহের। সোহেল আর লামিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ফুসফুসে আরও কিছু বাতাস পাঠাল ও।
একসময় ওর কাছে পৌঁছে গেল দুজন, ওরই মতো আঁকড়ে ধরল দুটো আলাদা ধাপ। ফিন খুলে ফেলল ওরাও। এখন পর্যন্ত সব ঠিক আছে বোঝানোর জন্য ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখাল সোহেল।
হাতঘড়ি দেখল রানা। একটু এদিকওদিক হওয়া সময়ের কথা বাদ দিয়ে বললে আসলেই সব ঠিক আছে এখন পর্যন্ত। ওদেরকে এখন ঠিক তিন মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তারপর লেসার চালু করবে হোসেইনি।
মেইনটেনেন্স ল্যাডারের উপরে যে-ক্যাটওয়াক আছে, সেটার ক্যামেরাকে অন্ধ বানিয়ে দেবে সে।
.
২২.
নীল নদের পশ্চিম তীরে বোট ভিড়িয়েছে হোসেইনি। মোড়ক খুলে লেসার বের করল সে, রাখল ট্রাইপডের উপর। ওটার সিস্টেমটা সিভিলিয়ান, প্রধানত ব্যবহৃত হয় সার্ভে করার কাজে। তবে হোসেইনি আর্মিতে থাকার সময় যে-ধরনের জিনিস ব্যবহার করত, তার সঙ্গে খুব একটা তফাৎ নেই।
ডিভাইসটা সেট করে চোখে বিনকিউলার লাগাল হোসেইনি, যে-ক্যামেরা অকেজো করতে হবে সেটা ঠিক কোথায় আছে দেখে নিল। এবার চোখ রাখল লেসারের স্কোপে, ফোকাস সেট করল টার্গেট ক্যামেরার লেন্সে। তারপর পিছিয়ে এল কিছুটা।
হাতঘড়ি দেখল। দুই মিনিট বাকি আছে। লেসারের নির্দিষ্ট একটা বাটনে চাপ দেয়া ছাড়া এখন আর কিছু করার নেই।
কিছু না করে এক শ বিশটা সেকেণ্ড কাটিয়ে দেয়ার মতো মানুষ না সে, তাই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরাল। এগিয়ে-আসা একটা হেলিকপ্টারের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মুখ তুলে তাকাল হোসেইনি। কালচে আকাশের পটভূমিতে হেলিকপ্টারের কয়েকটা জ্বলন্ত আলো দেখা যাচ্ছে। আমেনথেস প্লান্টের মেইনবিল্ডিঙের দিকে যাচ্ছে ওটা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপ্টারের গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হলো হোসেইনি।
প্লান্টের ভিতরে হেলিপ্যাডে যখন নামছে ওটা, হোসেইনি ভাবল, এত রাতে কে কেন দেখা করতে এসেছে সারওয়ার বিন জামালের সঙ্গে?
.
মেইনটেনেন্স ল্যাডারের রড আঁকড়ে ধরে পানির ত্রিশ ফুট নিচে আছে রানা, সোহেল আর লামিয়া; ওদের কানে পৌঁছাল না হেলিকপ্টারের আওয়াজ। অন্য কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত আছে ওরা এখন। ভারী একটা যান্ত্রিক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে একটানা, সেই সঙ্গে বেশ আলোড়ন তৈরি হয়েছে ওদের আশপাশের পানিতে।
দেয়ালের গায়ে বিশেষভাবে একটা ফোকর বানিয়ে বিশেষ কায়দায় আড়াল করে রাখা হয়েছিল সেটা; এখন সরে যাচ্ছে ঢাকনা, উন্মুক্ত হচ্ছে ফোকর। প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে আকস্মিক বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্টর্ম-ড্রেইন নামে জলনির্গমনের বিশেষ ব্যবস্থা থাকে কোনও কোনও শহরে, বোঝা গেল ওই ফোকর আসলে সে-রকম বড় কোনও রানঅফ পাইপ। খুলে দেয়া হয়েছে সেটার মুখ, হাজার হাজার গ্যালন পানি হড়হড় করে বেরিয়ে এসে পড়ছে চ্যানেলে।
স্রোতের ধাক্কায় ছিটকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। ওদের তিনজনের; যার যার রিইনফোর্সমেন্ট রড সর্বশক্তিতে আঁকড়ে ধরে আছে ওরা। ইতোমধ্যেই টনটন করতে শুরু করেছে হাতের আঙুল, ব্যথা করছে কাঁধ। বুঝতে পারছে, যদি ওই পাইপের মুখ শীঘ্রি বন্ধ করা না হয়, চ্যানেলের তলদেশের সঙ্গে এই আজব অনুভূমিক অবস্থায় লটকে থাকতে পারবে না বেশিক্ষণভেসে যাবে।
যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকাল রানা। আর এক মিনিট।
পাইপ দিয়ে পানি পড়ছে তো পড়ছেই। স্রোতের গতি বেড়েছে মনে হয়। যান্ত্রিক আওয়াজটা আরও ভারী হয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অদ্ভুত কম্পনটাও। মনে হচ্ছে, কাঁপছে ল্যাডার, কাঁপছে ওদের শরীর। মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে রিফ্লেক্টর গেটটা খুলে যেতে শুরু করল এমন সময়। স্রোতের গতি আরও বাড়বে এখন।
দূরের টার্বাইনগুলো ঘুরতে শুরু করেছে। পানির নিচে থেকেও ছপছপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে ওরা তিনজন।
আর পারছে না লামিয়া, রড ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে এবার। রানার দিকে তাকাল সে, চোখে আকুতি। মাথা নাড়ল রানা, টিকে থাকার ইঙ্গিত করল। অবস্থান বদল করে লামিয়ার কাছে গেল, দুই পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল মেয়েটার কোমর। হাত থেকে রড ছুটে গেলেও ভেসে যেতে দেবে না। মেয়েটাকে।
ঘড়ঘড় একটা আওয়াজ শোনা গেল এমন সময়। মুখ তুলে তাকাল ওরা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রিফ্লেক্টর গেট। কিন্তু পাইপ দিয়ে পানি পড়া কমেনি।
লামিয়ার কোমর ছেড়ে দিল রানা, স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে দুই হাঁটু ভাঁজ করল পেটের কাছে। খাটো করে নিল নিজেকে যাতে পানির ধাক্কা কিছুটা হলেও কম লাগে শরীরে। ডান হাতে রড ধরে রেখে আলগা করল বাঁ হাত, একটুও দেরি না করে থাবা চালাল ফুট তিনেক উপরের আরেকটা রডে। ওটা কেবল আঁকড়ে ধরেছে, এমন সময় ওকে একদিকে কাত করে দিল স্রোত। শরীরের সব জোর খাটিয়ে নির্জের ভাজকরা শরীরটা ল্যাডারের কাছাকাছি নিয়ে গেল ও, দুই পা দিয়ে আঁকড়ে ধরল একটা রড।
একটুও বিরতি দিল না, একটা একটা করে রড বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। কী করতে হবে তা দেখিয়ে দিচ্ছে সোহেল আর লামিয়াকে, ওরাও একই কায়দায় নিজেদেরকে রক্ষা করল ভেসে গিয়ে টার্বাইনের ব্লেডে আছড়ে পড়া থেকে।
যখন পানির আর বেশি নিচে নেই, তখন ইশারায় লামিয়াকে কাছে ডাকল রানা, ওর অক্সিজেন ট্যাঙ্ক আর মাস্ক খুলে দিতে বলল। নিজেকে রানার গায়ের সঙ্গে সাঁটিয়ে দিয়ে একহাতে কাজটা করে দিল মেয়েটা। স্রোতের ধাক্কায় মুহূর্তের মধ্যে দশ-বারো হাত দূরে চলে গেল ওগুলো।
পানির উপরে শুধু নাক আর মুখ বের করল রানা, হা করে দম নিচ্ছে।
ফুসফুস দুটো বাতাসে ভর্তি করে কায়দামতো শরীর মোচড়াল ও, এখন হাঁটুর পেছনটা আটকে নিয়েছে রডে, মাথা আর দুই হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে পানির ভিতরে। খুলে দিল লামিয়ার ট্যাঙ্ক আর মাস্ক, উপরে উঠে আসতে সাহায্য করল মেয়েটাকে। তারপর একই কাজ করল সোহেলের বেলায়। সুবিধাজনক পজিশনে গিয়ে রানাকে উঠে আসতে সাহায্য করল সোহেল।
হাতঘড়ি দেখল রানা। আর তিন সেকেণ্ড। সময়ের হিসেবটা ইশারায় জানিয়ে দিল দুই সঙ্গীকে। আরও উপরে
ওঠার ইঙ্গিত করল।
ডিফ্লেক্টর গেটের উপরে চড়ে বসল ওরা তিনজন। নিচে সগর্জনে ধেয়ে চলেছে পানি, জলঘূর্ণি তৈরি হচ্ছে গেটের কাছে।
গেটের মাথার ক্যাটওয়াক ধরে হাঁটতে শুরু করল লামিয়া। ওর দিকে একটা মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল সোহেল, তারপর পিছু নিল। কিছুক্ষণ হাঁ করে দম নিল রানা, তারপর অনুসরণ করল আগের দুজনকে। মেইনটেনেন্স ডোরের দিকে এগোচ্ছে ওরা।
নীল নদের পশ্চিম তীরটা যেদিকে, ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল রানা। দেখা যায় কি যায় না এমন একটা সবুজাভ আলোর ফুটকি চোখে পড়ে। ক্যামেরালেন্সকে অন্ধ বানিয়ে রাখার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে হোসেইনির লেসার।
আরেকটু হলেই গেছিলাম, রানার কানের কাছে ফিসফিস করল সোহেল। এত রাতে গেট খুলতে গেল কেন শালারা?
গেটের কারণে না, বলল রানা, ওই রানঅফ পাইপের কারণে বারোটা বাজতে যাচ্ছিল আমাদের। ব্লুপ্রিন্টে ও-রকম কোনও পাইপের অস্তিত্ব ছিল না।
কিন্তু বাস্তবে ওটা আছে এবং সেখান দিয়ে হাজার হাজার গ্যালন পানি প্রবাহিত করে সারওয়ার অ্যাণ্ড আখতার। …কেন?
আরও একবার হাতঘড়ি দেখল রানা। এটা নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। আর এক মিনিটের মধ্যে লেসার বন্ধ করে দেবে হোসেইনি, আমাদের হাতে সময় কম। লামিয়ার দিকে তাকাল।
ইতোমধ্যে টুকটাক যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মেয়েটা। সঙ্গের ওয়াটারপ্রুফ পাউচ থেকে এক সেট লকপিক বের করেছে। কিছুক্ষণের চেষ্টায় খুলে ফেলল ক্যাটওয়াকের দরজার লক, পাল্লা ঠেলে ঢুকল ভিতরে।
দরজা থেকে ফুট দশেক দূরে অ্যালার্ম সিস্টেমের প্যানেল। ওটার কভার খুলে ফেলে ডেটাটে ছোট্ট একটা ডিভাইস সংযুক্ত করল লামিয়া ডেটাকেবলের মাধ্যমে। হাবিজাবি অনেক সংখ্যা আর অক্ষর দেখা যাচ্ছে ওই ডিভাইসের স্ক্রিনে। সম্ভাব্য দশ মিলিয়ন কোড থেকে সঠিক কোড বাছাই করে নিয়ে ওটা অকেজো করে দিল লামিয়ার ডিভাইস। সবুজ বাতি জ্বলে উঠল প্যানেলে।
কাজ হয়ে গেছে, চাপা গলায় বলল মেয়েটা। বন্ধ হয়ে গেছে সব অ্যালার্ম। কার্যকর থাকা অবস্থাতেই কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে ক্যামেরাগুলো। মনিটরে প্রি-রেকর্ডেড একটা দৃশ্য দেখাতে থাকবে ওগুলো আগামী পঁচিশ মিনিট। ডিভাইসটা পাউচে রেখে দিয়ে যিপার আটকাল।
এগোনোর ইঙ্গিত করল রানা।
একটা হল ধরে যাচ্ছে ওরা, কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা মিলল সিঁড়ির। কেবল তিন ধাপ নেমেছে, এমন সময় শোনা গেল ভারী যান্ত্রিক গুঞ্জন।
সোহেল আর লামিয়াকে অপেক্ষা করতে বলে এগিয়ে গেল রানা, সবচেয়ে কাছের দরজাটা খুলে ভিতরে দেখে ফিরে এল। জেনারেটর রুম। আমাদের কোনও কাজে লাগবে না। আখতার নেই ওখানে, থাকার কথাও না। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না আশপাশে কোথাও।
টুং করে একটা আওয়াজ হলো। খুলে যাচ্ছে হলের শেষমাথার এলিভেটরের দরজা। দুই লাফে জেনারেটর রুমের কাছে হাজির হলো রানা, দরজা খুলে ঢুকে গেল ভিতরে। খোলাই রাখল দরজাটা, মুহূর্তের মধ্যে ভিতরে ঢুকে পড়ল সোহেল আর লামিয়া। দরজাটা ভিড়িয়ে দিল রানা, কিন্তু লাগাল না।
হল ধরে হেঁটে আসছে একদল লোক। ওদের জুতোর শক্ত সোল খটাখট আওয়াজ তুলেছে মেঝেতে। পাল্লার ফোকরে চোখ রাখল রানা।
মোট সাতজন লোক। তিনজনের পরনে কালো ইউনিফর্ম। তিনজন পরেছে খাঁটি আরবি পোশাক। অন্য লোকটার গায়ে বিযনেস স্যুট আর সাদা শার্ট, টাই নেই।
জেনারেটর রুমের বাইরে, কিছুটা দূরে থামল খটাখট আওয়াজ। একইসঙ্গে অনেক কমে গেল জেনারেটরের গুঞ্জন। কেউ একজন রুমের বাইরে থেকে পাওয়ার বন্ধ করে দিয়েছে ওটার।
কীভাবে পাওয়ার জেনারেট করি আমরা, বদ্ধ হলে গমগম করে উঠল একজনের কণ্ঠ, দেখলেন আপনারা। এবার আপনাদেরকে দেখাব, কেন আমাদের দাবি পূরণ না করে উপায় নেই আপনাদের। ইংরেজি উচ্চারণ শুনলে মনে হয় লোকটা হয় ইটালিয়ান নয়তো স্প্যানিশ।
এসব কী পাগলামি শুরু করেছেন, বলুন তো? তিন আরবের একজনের কণ্ঠে উম্মা। সারওয়ারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি আমরা, আপনাদের কারিগরি দেখতে আসিনি।
কথা বলার ভঙ্গি এবং হাত নাচানোর ধরন বলে দেয়, বাকি দুই আরবের প্রতিনিধি সে।
সময় কি চলে যাচ্ছে? দেখা করতে এসেছেন, দেখা হবে। তবে তার আগে আপনাদের সঙ্গে দরদাম করতে চান তিনি।
দরদাম? কীসের? সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল আমাদেরকে। আলবার্তো, কী খেলা শুরু করলেন আপনি, বলুন তো?
রানা খেয়াল করল, নামটা শোনামাত্ৰ কুঁচকে গেল লামিয়ার চোখমুখ।
কোনও খেলা না, বলল আলবার্তো। কিন্তু অদলবদলের আগে নিজেদের অবস্থানটা বুঝে নেয়া উচিত আপনাদের। তা না হলে বোকার মতো ভুল করে ফেলতে পারেন।
উর্দিপরা এক লোক, কিবোর্ডের মতো দেখতে একটা কিছুর বাটনে চাপ দিল। ঘড়ঘড় শব্দে গ্যারেজের দরজার মতো একদিকে উঠে যাচ্ছে একদিকের ওয়ালপ্যানেল। পেছনে দেখা যাচ্ছে অন্ধকার একটা টানেল। পাল্লার ফোকর দিয়ে ধাতব রেললাইন, বড় ব্যাসের একটা পাইপ আর একটা ট্রামকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না রানা।
ও-রকম একটা বাইপাস টানেল বানানোর প্রয়োজন হলো কেন ওদের? জানতে চাইল লামিয়া।
জবাব দিল না রানা বা সোহেল, কারণ জবাবটা জানা নেই দুজনের কারও।
তিন আরবকে নিয়ে ট্রামকারে চড়েছে পিয়োলা আর ওর তিন দেহরক্ষী। চলতে শুরু করেছে ওটা।
ওয়ালপ্যানেলটা খোলা আছে।
ওয়াটারপ্রুফ পাউচ খুলে ভিতর থেকে একটা নাইন মিলিমিটার বেরেটা বের করল রানা। চলো।
.
২৩.
সিসি ক্যামেরার সিস্টেমে গড়বড় ধরা পড়েছে আমেনথেস হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্লান্টের সিকিউরিটি সেন্টারে।
ক্যামেরা সিস্টেম নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে একজন গার্ড। কন্ট্রাস্ট আর ব্রাইটনেস বার বার কমিয়ে-বাড়িয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে মনিটরের ছবি ঠিক করার। কিন্তু পারছে না। শেষপর্যন্ত খবর দিল সিকিউরিটি সুপারভাইযারকে।
সেন্সর জ্বলে গেছে সম্ভবত, ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে মত দিল সুপারভাইযার, তাকাল সঙ্গে-করে-আনা টেকনিশিয়ানের দিকে। রিপ্লেস করা যাবে?
নতুন সেন্সর পেলে আমার জন্যে ডালভাত, সাপ্লাই কেবিনেটের দিকে এগিয়ে গেল টেকনিশিয়ান। শেলফের কতগুলো বাক্স ঘাঁটাঘাঁটি করে, যা খুঁজছিল তা বের করে নিয়ে এল।
কত সময় লাগবে? জিজ্ঞেস করল সুপারভাইয়ার।
মিনিট বিশেক।
কাজ শুরু করে দাও তা হলে, এগিয়ে গিয়ে একটা মনিটরের সামনে বসে পড়ল সুপারভাইযার। শেষ হলে আমাকে বলবে, নিজে চেক করে দেখব।
টুলবক্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাবে টেকনিশিয়ান, এমন সময় লাইভ পিকচার ফিরে এল মনিটরে। তারমানে কাজ শুরু করেছে ক্যামেরা।
আজব তো! পিঠ খাড়া হয়ে গেছে সুপারভাইযারের, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে। সব তো দেখি ঠিকই আছে। কিন্তু কৃতক্ষণ ঠিক থাকবে, কে জানে! তারচেয়ে বরং সেন্সরটা বদলে ফেলা যাক। পুরনোটা যে-কোনও সময় বিগড়ে যেতে পারে আবার।
মাথা ঝাঁকিয়ে বাইরে চলে গেল টেকনিশিয়ান।
দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাল সুপারভাইযার। তৃতীয় শিষ্ট শুরু হতে আর এক ঘণ্টা বাকি আছে। তারপর আজকের মতো ওর ছুটি।
.
আমেনথেসের ঘাঁটি থেকে মাইলখানেক দূরে সব গোছগাছ। করতে শুরু করেছে হোসেইনি।
ট্রাইপডটা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে ফেলেছে প্যাকেটে, লেসার বন্ধ করে ক্যাপ পরিয়ে ফেলেছে লেন্সে। এখন বাক্সবন্দি করছে ওটাকে।
কাজ শেষে প্যাসেঞ্জার সিটের উপর রাখল বাক্সটা, যদি দরকার হয় তা হলে একধাক্কায় ফেলে দেবে পানিতে। বোট চালু করে ওটার নাক যতটা নিঃশব্দে সম্ভব ঘোরাল পুব তীরের দিকে। বন্ধুদের কাজে লাগতে পারে ভেবে বিশেষ কয়েকটা লাইট জ্বালিয়ে দিল বোটের।
শোল্ডার হোলস্টার থেকে একটা পিস্তল বের করল সে। স্লাইড টেনে একটা বুলেট পাঠিয়ে রাখল চেম্বারে। পিস্তলের কোনও দরকারই হবে না হয়তো শেষপর্যন্ত, তারপরও সতর্কতার মার নেই।
.
হল ধরে দ্রুত, নিঃশব্দে এবং একসারিতে এগোচ্ছে ওরা তিনজন।
হাঁ হয়ে-থাকা ওয়ালপ্যানেলটা বন্ধ হতে শুরু করেছে, এমন সময় মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকে পড়ল ওরা। টানেলের এককোনায় যখন ঘাপটি মেরে দাঁড়াল তখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে প্যানেলটা।
অন্ধকার। রেললাইন ধরে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। ট্রামকারটা। বাতি জ্বলছে কয়েকটা, আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। টানেলের দেয়াল আর ছাদে। কালো একটা কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে পাশেই, বোঝা যায় ওটা আরেকটা ট্রামকার। আপাতত খালি।
ওটার আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল রানা। এগোনোর গতি বাড়িয়েছে প্রথম ট্রামটা, থামার লক্ষণ নেই। ওটার মোটরের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে টানেলের দুপাশের দেয়ালে। অদ্ভুত গুমগুম শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারমানে রানা যত জোরে শুনতে পাচ্ছে আওয়াজটা, ট্রামকারের যাত্রীরা তারচেয়ে জোরে শুনছে।
কাজেই সোহেল আর লামিয়াকে নিয়ে যদি খালি ট্রামে উঠে পড়ে ও, যদি ফলো করতে শুরু করে, ওদের ট্রামের আওয়াজ শুনতে পাবে না আলবার্তো আর ওর সঙ্গের লোকগুলো।
উঠে পড়ো, বলল রানা। বেরেটার বাঁট দিয়ে বাড়ি মেরে মেরে ভেঙে ফেলল ট্রামকারের সবগুলো লাইট। তারপর নিজেও উঠল।
ইতোমধ্যে কন্ট্রোল খুঁজে নিয়েছে সোহেল, কব্জির এলইডি আলোতে বুঝে নিচ্ছে মেকানিযম। স্টার্ট বাটনে চাপ দিল, কিন্তু ট্রামকার এগোল না। আরও কয়েকটা বাটনে চাপ দিয়ে যখন দেখল কিছু হচ্ছে না, ঠেলা মারল গ্রুটলে। ঘড়ঘড় শব্দে ঘুরতে শুরু করল চাকা।
এগোচ্ছে ট্রামকার। গতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে সোহেল।
ওকে ওর মতো কাজ করতে দিয়ে কারের পেছনদিকে চলে এল রানা। এখানে এককোনায় দাঁড়িয়ে আছে লামিয়া।
রানঅফ পাইপটা কী কাজে ব্যবহার করছে এরা? রানাকে কাছে পাওয়ামাত্র জিজ্ঞেস করল লামিয়া।
ঠিক বুঝলাম না। ওটা স্টর্ম ড্রেইনপাইপ হতে পারে।
কিন্তু কায়রোর মতো একটা মরুশহরে পাইপটা বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? এখানে তো সে-রকম বৃষ্টি হয় না! তখন যে-ঢল নামল, কোত্থেকে এল অত পানি?
হতে পারে শহরের সব বর্জ্য পানি কোনও এক জায়গায় জড়ো করা হয়। পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় ওই পাইপ দিয়ে। তবে বৃষ্টির কথাটা যুক্তিসঙ্গত। গেল কয়েক সপ্তাহে ছিটেফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি কায়রোতে।
তা হলে অত পানি আসছে কোত্থেকে?
জানি না। হতে পারে আমেনথেসের আরও কোনও প্রজেক্ট আছে যেটার ব্যাপারে জানতে এখনও বাকি আছে আমাদের। …বাদ দাও। অন্য একটা কথা বলো। স্যুট পরা ওই লোকটা…আলবার্তো নাম…তখন মনে হলো ওকে চেনো তুমি। কে সে?
পুরো নাম আলবার্তো কামিন্স। ইটালির একজন সংসদসদস্য। আমেরিকা যে-ভূমিকা নিয়েছে লিবিয়ার ব্যাপারে, সেটার কট্টর সমালোচক সে। ওর মতো আমাদের আরও কয়েকজন সাংসদ আমেরিকার সমালোচকের ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে।
কেন?
লিবিয়া একসময় আমাদের কলোনি ছিল।
আমেনথেসের ঘাঁটিতে কী করছে লোকটা?
জানি না। তোমার মতো আমিও আশ্চর্য হয়েছি। কোনও-না-কোনও যোগসূত্র আছে কোথাও-না-কোথাও, ধরতে পারছি না।
একটা পাওয়ার ফোর্স হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আমেনথেস। রাজা বানানেওয়ালার ভূমিকা পালন করছে সারওয়ার বিন জামাল। চাকরিচ্যুত ওল্ড গার্ড রেজিমেন্টের সঙ্গে দহরম-মহরম আছে উত্তর আফ্রিকার কয়েকটা দেশের হোমরাচোমরাদের। ওই দেশগুলোয় দেখা দিয়েছে আকস্মিক পানিস্বল্পতা যার কোনও ব্যাখ্যা নেই।
আকস্মিক পানিস্বল্পতা? বুঝতে পারেনি লামিয়া।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে সোহেল, ওর দৃষ্টিতেও একই প্রশ্ন।
আসিফ আর তানিয়ার কাছ থেকে যা জানতে পেরেছে, বলল রানা। তারপর বলল, আমরা হাজির হয়েছি। আমেনথেসের তথাকথিত হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্লান্টে, যেখানে এত বড় একটা পাইপ আছে যার ভিতর দিয়ে চলাচল করতে পারবে ডেলিভারি ট্রাক, যা দিয়ে সেকেণ্ডে এক টন পানি প্রবাহিত হয়ে গিয়ে পড়ছে নীল নদে-যখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের অফপিক সময় তখন।
কী বলতে চাও? ওই: পানিস্বল্পতার জন্য আমেনথেসই দায়ী?
ওটার পেছনে যদি মানুষের হাত থেকে থাকে, আমি বলব সে-মানুষ সারওয়ার বিন জামাল ছাড়া আর কেউ না।
আর আলবার্তো?
ওর ভূমিকাটা বুঝতে পারছি না। তবে কোনও-না কোনও, ফায়দা লোটার মতলব যে আছে লোকটার, সন্দেহ নেই।
কিন্তু একটামাত্র পাইপ দিয়ে এত পানি… মাথা নাড়ল সোহেল, সম্ভব?
পাইপের সংখ্যা যদি উনিশ হয় তা হলে? ভুলে যাচ্ছিস কেন, নিজেদের ওয়েবসাইটে উনিশটা প্লান্টের কথা বলেছে আমেনথেস? যদি বলি, ওই পাইপগুলোই সাব-সাহারা অ্যাকুইফার থেকে সব পানি সরিয়ে এনে ফেলছে নীল নদে?
তারমানে আর পানিস্বল্পতা একইসূত্রে গাঁথা, বলল লামিয়া।
রানা বা সোহেল কিছু বলল না।
বেশ কিছুক্ষণ পর সোহেল আওয়াজ দিল, টানেলের শেষমাথায় চলে এসেছি মনে হয়। আলো দেখা যাচ্ছে। সামনের ট্রামকার গতি কমাচ্ছে।
তুইও কমা।
গতি কমাল সোহেল।
এখন কচ্ছপের মতো এগোচ্ছে ওদের ট্রাম। যে-জায়গা টানেলের প্রান্ত বলে মনে হচ্ছে, সেখান থেকে প্রায় এক শ গজ দূরে থামল সোহেল; নেমে পড়ল। নামল রানা আর লামিয়াও। পায়ে হেঁটে এগোচ্ছে ওরা তিনজন।
টানেলের প্রান্তের কাছে আগে পৌঁছাল সোহেল। দেয়ালের আড়ালে থেকে উঁকি দিয়ে তাকাল। অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল ওর মুখ দিয়ে, সরে এল দুই সঙ্গীর কাছে।
কী? জানতে চাইল রানা।
নিজে দ্যাখ।
সোহেলের কায়দায় উঁকি দিল রানাও।
হলরুমের মতো অথবা তারচেয়েও বড় একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। এদিকওদিক তাকানোয় বোঝা গেল, ওটা আসলে একটা গুহা, তবে মানুষের হাতের ছোঁয়া পেয়েছে। সর্পিলাকার কালো তারের সঙ্গে যুক্ত লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে বালিরঙা পাথুরে দেয়াল। একপাশের দেয়ালে দেখা যাচ্ছে মিশরীর চিত্রকলা আর হায়ারোগ্লিফিক্স। আরেকপাশের দেয়াল ছেনি-হাতুড়ি চালিয়ে ভাঙা হয়েছে-বানানো হয়েছে অন্য কোনও গুহায় ঢোকার পথ। ওটার প্রবেশমুখের কাছে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে শেয়ালমাথা দেবতা আনুবিসের বড় বড় দুটো মূর্তি।
কোথায় এসেছি আমরা? রানার কানে ফিসফিস করল লামিয়া।
ছিলাম আধুনিক এক হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রান্টে, ফিসফিস করল রানাও, চলে এসেছি প্রাচীন মিশরে।
খেয়াল করল, পাইপলাইন আর টানেল দুটোই বিস্তৃত হয়েছে আরও পশ্চিম দিকে। স্মৃতির পর্দায় দেখল প্লান্টের ব্লুপ্রিন্ট। প্লান্টের পশ্চিমদিকে জালের-মত-বিছিয়ে-থাকা সরু কিছু রাস্তা এবং কতগুলো গুদাম ও অফিস ছাড়া অন্য কিছু দেখেনি।
যে-গতিতে যতক্ষণ চলেছি আমরা ট্রামকারে, বলল ও, মনে হয় নদের পশ্চিম তীর থেকে পাঁচ কি ছমাইল দূরে চলে এসেছি। আমার ধারণা, গিজার পিরামিডগুলো এখন আমাদের মাথার উপর।
বলো কী! তাজ্জব হয়ে গেছে লামিয়া।
মাথা ঝাঁকাল রানা। যদি তা না-ও হয়, গিজার মালভূমির নিচে আছি আমরা এখন।
কত নিচে?
শ পাঁচেক ফুট হতে পারে।
একটা আশ্চর্য ব্যাপার খেয়াল করেছ? কোথাও কোনও গার্ড নেই।
কারণ ওরা ভাবতে পারেনি, আমরা যে-কৌশলে ঢুকেছি সেভাবে ঢুকে পড়বে কেউ ওদের আস্তানায়। ঘরটার দিকে আবার তাকাল রানা।
কম ওয়াটের যে-লাইটগুলো জ্বলছে সেগুলো ঘরের অন্ধকার দূর করার জন্য যথেষ্ট না। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে মমিকরা কুমির, বিড়াল, পাখি, ব্যাঙ। ব্যাঙের সংখ্যা শত শত।
ঘরের ভিতরে ঢুকল ওরা, আনুবিসের মূর্তি দুটোকে পাশ কাটিয়ে প্রবেশ করল গুহায়। সাবধানে এগিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ পর হাজির হলো উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত একটা ঘরে। ঘরের বেশিরভাগ জিনিসে প্রাচীনত্বের ছোঁয়া।
একদিকের দেয়ালে একজন ফারাওয়ের ছবি খোদাই করা। দেবতা আনুবিস পরিচর্যা করছেন তাঁর। আরেকদিকের দেয়ালে দেখা যাচ্ছে, সবুজ চামড়ার একজন মিশরীয় দেবতা বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন অন্য একজন মৃত ফারাওকে। তৃতীয় দেয়ালে দেখা যাচ্ছে নদীতে সাঁতার কাটছে কুমিরের মতো মাথাওয়ালা কয়েকজন লোক, খুঁজে বের করছে কচ্ছপ আর ব্যাঙ।
সবুজ চামড়ার ওই লোককেই দেখেছিলাম ওয়্যারহাউসের লিপিফলকে, রানার কানে বলল সোহেল। তিনিই ওসিরিস-জীবন, মৃত্যু, পরকাল ও পুনরুত্থানের দেবতা।
দেয়ালচিত্রগুলো আরেকবার দেখে মাথা ঝাঁকাল রানা।
ঘরের মাঝখানে কয়েক সারি পাথরের-শবাধার। আরেকদিকে ফিংসের একটা ছোট মূর্তি; নীলকান্তমণি আর সোনা দিয়ে বানানো পাতার-মুকুট শোভা পাচ্ছে ওটার মাথায়। রানার ঠিক মুখোমুখি একটা পানিভর্তি গর্তে খুঁড়ির মতো ভেসে আছে চারটে জ্যান্ত কুমির। গর্তটা থেকে উঠে আসার উপায় নেই ওগুলোর, কারণ ওটার পাড়গুলো একদম খাড়া।
ওদের তিনজনকে চমকে দিয়ে সরু একটা টানেল থেকে বেরিয়ে এল দুজন লোক, কুমিরের গর্ত পার হয়ে গিয়ে ঢুকল আরেকটা টানেলে।
রানার কাছে ঘেঁষে এসেছে লামিয়া। এত বড় বড় ঘর আর ওসব টানেল বানাল কারা? এবং মাটির নিচে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কাজটা করল কীভাবে?
উবু হয়ে মাটি থেকে একটা ঝামাপাথর তুলে নিল সোহেল। ওসব পাথরের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে গুহার প্রায় সব জায়গায়। সোডিয়াম কার্বোনেট, বলল ও। মিশরীয়রা বলে, ন্যাট্রন। মমি বানানোর কাজে ব্যবহৃত হতো এই জিনিস। কিন্তু এটা যদি বিশেষ একজাতের তেলের সঙ্গে মিশিয়ে জ্বালানো হয়, তা হলে ধোঁয়াবিহীন আগুন তৈরি হয়। আমার মনে হয় মাটির এত নিচে কবর আর খনিতে ওভাবেই কাজ করেছে ওরা।।
খনি? কবর আবার খনি হয় কী করে?
জানি না। তবে এটা জানি, মাটির নিচের যে-খনিতে পানি ঢুকে শুকিয়ে যায়, সেখানে ন্যাট্রন তৈরি হয়।
এই জায়গার সঙ্গে কালো কুয়াশার কোনও সম্পর্ক নেই তো?
থাকতে পারে, বলল রানা। ডিসুজা আর ওই অ্যাডমিরাল যা খুঁজছিলেন, তা হয়তো এখানেই ছিল। গোপন কথাটা জানতে পেরে নিজেদের আস্তানা থেকে এই জায়গা পর্যন্ত টানেল খুঁড়েছে সারওয়ারের লোকেরা, প্রবেশমুখগুলো সুরক্ষিত করেছে যাতে ওরা ছাড়া আর কেউ ঢুকতে না পারে।
চাকার ঘড়ঘড় আওয়াজ পাওয়া গেল। চট করে ছায়ায় সরে গেল রানা, ওর দেখাদেখি বাকি দুজনও। দুই সিটের একটা ফোর হুইলারে বসে আছে দুজন লোক, ওটা চালিয়ে নিয়ে ঢুকছে গুহায়। চ্যাপ্টা একটা শেলফু দেখা যাচ্ছে। কেইজের পেছনদিকে।
লোক দুটোর পরনে কালো উর্দি। হুইলারে দুজন যাত্রী আছে, পরনে ল্যাবকোট। ওরা ধরে রেখেছে একটা কেইজের রোলবার, একইসঙ্গে সামলাচ্ছে একটা ছোট কুলার। দেখে মনে হচ্ছে, ঝাঁকুনির কবল থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে কুলারটাকে। স্ফিংসের মূর্তি ছাড়িয়ে আরেকটা টানেলে ঢুকে গেল ফোর হুইলারটা।
ফার্মাসিউটিকাল সেটআপ, বলল সোহেল।
ফোর হুইলারটা যেদিকে গেছে সেদিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল রানা, কয়েকজন লোকের গমগমে কণ্ঠ শোনা গেল এমন সময়। স্ফিংসের সামনে হাজির হয়েছে লোকগুলো, পাথরের শবাধারগুলো ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কুমিরের গর্তের দিকে।
আখতার, ফিসফিস করে বলল সোহেল।
ওর পাশের লোকটা কে? জানতে চাইল লামিয়া।
খুব সম্ভব সারওয়ার বিন জামাল, বলল রানা।
.
২৪.
লিবিয়াকে নতুনভাবে গড়ে তোলার সুযোগ এসেছে। আপনাদের, অতিথিদের বলল সারওয়ার।
আপনার পুতুল-সরকার হিসেবে? জিজ্ঞেস করল ওর এক অতিথি।
জবাব না দিয়ে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকাল সারওয়ার।
তারপর কী হবে? আবার জিজ্ঞেস করল লোকটা। আপনি যা চাইবেন তা-ই দিতে হবে? ইংরেজরা যেভাবে মিশর শাসন করেছিল, আপনিও কি সে-রকম চান? আলবার্তো, আমাদের দেশে নতুন কোনও উপনিবেশ স্থাপনের চিন্তা করছেন নাকি?
কেউ-না-কেউ তো আপনাদের মাথার উপর ছড়ি ঘোরাবেই, না? বলল সারওয়ার। আমেরিকান বা ইয়োরোপিয়ানদের বদলে একজন আরব যদি করে কাজটা, আমার বিবেচনায় ভালো হয়।
নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্তটা আপনাকে জানাব আমরা।
এখানে আলোচনা করার কী আছে? আর কতবার বোঝাতে হবে? পানি ছাড়া মরবেন আপনারা সবাই। যদি দরকার হয়, একফোঁটা পানিও রাখব না আমি উত্তর আফ্রিকায়। যদি দরকার হয়, মিশরীয়দের দিয়ে ভরে ফেলব ওই অঞ্চলকে।
চুপ হয়ে গেছে সারওয়ারের তিন অতিথি।
একটু পর বাকবিতণ্ডা শুরু হলো ওদের মধ্যে।
একজন বলল, কী করছেন আপনি?
আরেকজন বলল, এভাবে লড়াই করে জিততে পারব না আমরা। আমরা যদি পরাজয় মেনে না নিই, অন্যরা নেবে। সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাশূন্য হওয়ার চেয়ে ক্ষমতা আংশিক হারানো ভালো।
না! গর্জে উঠল ওদের নেতা, একটু আগে সে-ই দরদাম করছিল সারওয়ারের সঙ্গে। কিছুতেই না! আমি কারও হাতের পুতুল হতে রাজি না! ঘুরে সারওয়ারের মুখোমুখি হলো, দুচোখে অগ্নিদৃষ্টি।
ক্রোধ বা ক্ষোভের কোনওটাই নেই সারওয়ারের ভাবভঙ্গিতে। ছোট একটা টিউব তুলল সে মুখোমুখি দাঁড়ানো লোকটার বুক নিশানা করে, একটা বাটনে চাপ দিল। ছোট একটা তীর ছুটে গেল লোকটার দিকে, ওর বুকে বিঁধল।
থমকে গেছে তীরখাওয়া লোকটা। কিন্তু মাত্র একটা মুহূর্ত, তারপরই কালো হতে শুরু করল ওর চেহারা। হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল ওর, মেঝেতে বসে পড়তে বাধ্য হলো সে।
ভীষণ ভড়কে গেছে ওর দুই সঙ্গী, আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত তুলে ফেলেছে মাথার ওপর। সারওয়ারের বিরুদ্ধে কোনওরকম লড়াইয়ে অংশ নিতে চায় না।
বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত, বলল সারওয়ার। আপনাদেরকে আপনাদের দেশে ফেরত পাঠাব আমি। সেখানে আমার পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করবেন। বর্তমান সরকারের পতন ঘটার পর দেশের লাগাম ধরার জন্য কোনও একজনের নাম প্রস্তাব করবেন মিস্টার আলবার্তো। ওই লোকের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক যত খারাপই হোক না কেন, ওকে সমর্থন দেবেন।
তারপর? জিজ্ঞেস করার দুঃসাহস দেখাল হাত উঁচিয়ে রাখা দুজনের একজন।
তারপর পুরস্কার দেয়া হবে আপনাদেরকে। আবার পানি পাবেন আপনারা। পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হবে।
মুখ চাওয়াচাওয়ি করল দুই অতিথি।
ইঙ্গিতে ওদের নেতাকে দেখাল একজন। সারওয়ারকে জিজ্ঞেস করল, ওর কী হয়েছে?
মরেনি, তবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। নতুন এক মারণাস্ত্র আবিষ্কার করেছি আমি। নাম কালো কুয়াশা। এটা কাউকে মারে না, শুধু কোমায় পাঠিয়ে দেয়। হাসল সারওয়ার। আপনাদের নেতা আর দশজনের মতো সব দেখবে, শুনবে, অনুভব করবে। কিন্তু সাড়া দিতে পারবে না, প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবে না, চেঁচাতে পারবে না। চুটকি বাজিয়ে ডাকল দুই গার্ডকে।
নেতার বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে ওকে তুলে নিল গার্ডরা, কুমিরের গর্তে ফেলে দিল। লোকটাকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে গিলতে শুরু করল ক্ষুধার্ত কুমিরগুলো।
বাকিদের সঙ্গে নিয়ে একটা টানেলে গিয়ে ঢুকল সারওয়ার।
.
ফোর হুইলারের পেছনে ল্যাবকোট-পরা যে-দুজন ছিল, সোহেল আর লামিয়ার উদ্দেশে বলল রানা, তারা হয় ডাক্তার নয়তো ফার্মাসিস্ট। তারমানে এখানে কোথাও একটা ল্যাব খুলেছে সারওয়ার। ওটা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।
.
কন্ট্রোল ডেস্কে বসে আছে আমেনথেস হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রাস্টের সিকিউরিটি সুপারভাইর, বার বার ঘড়ি দেখছে। ওর সামনের মনিটর আর কম্পিউটার স্ক্রিনে ক্যামেরার লাইভ ইমেজ কোথাও কাঁপছে, আবার কোথাও পরিবর্তিত হচ্ছে বার বার। ঝিমুচ্ছে লোকটা; চোখ বন্ধ করার ইচ্ছে হচ্ছে ওর, জোর খাটিয়ে বিরত রেখেছে নিজেকে কাজটা করা থেকে। মেইন লট, সেকেণ্ড লট, নর্থ এক্সটেরিয়র, সাউথ এক্সটেরিয়র, তারপর ইন্টার্নাল সবগুলো ক্যামেরার শট–সিকিউরিটি ক্যামেরার লাইভ দৃশ্য দেখার চেয়ে বিরক্তকর কাজ আর বোধহয় নেই পৃথিবীতে। সবসময় কেবল একই দৃশ্য।
হাই তুলতে যাচ্ছিল লোকটা, হঠাৎ কিছু একটা খেলে গেল ওর মাথায়, আপনাআপনি খাড়া হয়ে গেল পিঠ।
সবসময় কেবল একই দৃশ্য।
না, তা তো হওয়ার কথা না!
বাইরে যে টেকনিশিয়ান, পুড়ে যাওয়া সেন্সর রিপ্লেস করতে গেল, ক্যাটওয়াক ধরে হাইড্রোচ্যানেলের কাছে যাবে সে-ওকে কমপক্ষে তিনটা ক্যামেরায় দেখতে পাওয়ার কথা সুপারভাইবারের। কিন্তু…
রেডি তুলে নিয়ে টক সুইচে চাপ দিল সুপারভাইযার। কাযিম, বেইস থেকে বলছি। তুমি কোথায়?
জবাব দিতে একটু দেরি হলো কাযিমের। ক্যাটওয়াকে আছি। সেন্সর রিপ্লেস করছি।
কোনদিক দিয়ে গেছ সেখানে?
মানে?
আহ, জবাব দাও!
মেইন হল ধরে পুবদিকের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছি। …কেন, এখানে আসার অন্য কোনও পথ আছে নাকি?
কিন্তু লোকটাকে একবারের জন্যও দেখা যায়নি কোনও ক্যামেরায়।
সিঁড়ির কাছে ফিরে এসো তো, বলল সুপারভাইযার। জলদি!
কেন?
যা বলছি করো।
নিজের অজান্তেই চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। সুপারভাইযারের, টের পাচ্ছে হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে ওর।
সিঁড়িতে এসেছি, কিছুক্ষণ পর জানান দিল টেকনিশিয়ান। এবার বলো কী সমস্যা?
যে-ক্যামেরা এক্সকুসিভলি কভার করছে পুবদিকের সিঁড়িটা, কন্ট্রোল প্যানেলে ওটার কয়েকটা বাটন চাপাচাপি করল সুপারভাইযার। চারটা সমান ভাগে ভাগ হয়ে গেল ডিসপ্লে, মেঝের ছবি দেখা যাচ্ছে সবগুলোতে-কোথাও কোনও পরিবর্তন নেই।
কোথায় আছ তুমি? জিজ্ঞেস করল সুপারভাইযার। কেন, সিঁড়িতেই তো দাঁড়িয়ে আছি! দেখতে পাচ্ছ না আমাকে?
না, সুপারভাইযার দেখতে পাচ্ছে না টেকনিশিয়ানকে।
তারমানে, চোয়াল শক্ত করল সুপারভাইযার, বড় রকমের কোনও গড়বড় হয়েছে সিসি ক্যামেরা সিস্টেমে।
না, দেখতে পাচ্ছি না তোমাকে, বলল সে। পুবদিকের সিঁড়ি কভার করার জন্য যে-ক্যামেরা আছে, ওটার সেন্সরও কি পুড়েছে?
না…দেখে তো ঠিকই মনে হচ্ছে আমার!
একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে সুপারভাইযারের মাথায়। হাইড্রোচ্যানেলের ক্যামেরার সেন্সর গেছে। ইন্টার্নাল প্রায় সবগুলো ক্যামেরা একই ডিসপ্লে দেখিয়ে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। তারমানে,..
কেউ একজন অনুপ্রবেশ করেছে হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্লান্টে।
অ্যালার্ম বাটনে চাপ দিল সুপারভাইযার–সতর্ক হয়ে যাবে সব গার্ড। সব চ্যানেলে যাতে একসঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে সেজন্য চাপ দিল রেডিওর বিশেষ একটা বাটন। পুরো বিল্ডিং লক করে দাও। ভালোমতো সার্চ করো। একটা ইঞ্চিও যেন বাদ না যায়। এক বা একাধিক লোক ঢুকে পড়েছে প্রান্টে। ক্যামেরা অথবা অটোমেটেড সিস্টেমের উপর ভরসা করার উপায় নেই। সার্চ করে প্রতিটা সেকশন দেখতে হবে তোমাদেরকে। …এখুনি!
.
ছায়া থেকে বের হয়েছে কি হয়নি রানা, বিনা-নোটিশে একটা ফোর হুইলার বেরিয়ে এল একটা টানেল থেকে, ছুটে আসছে ওর দিকে-পিষে ফেলতে চায় ওকে।
ইচ্ছা করলে চালককে শুইয়ে দিতে পারে রানা একগুলিতে, কিন্তু তাতে সব ভণ্ডুল হবে। একটা মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকল ও, প্রতিপক্ষকে ভাবতে দিতে চায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়। রানার সঙ্গে ফোর হুইলারের সংঘর্ষের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেছে ওটার চালক, নিজের সম্ভাব্য সাফল্যের কথা ভেবে কয়েকটা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে ওর, ঠিক তখন ডাইভ দিল রানা। উড়ে গিয়ে পড়ল ফুটবলের সমান বড় একটা ঝামাপাথরের পাশে। ওকে মিস করেই মেজাজ বিগড়ে গেছে চালকের, গালির তুবড়ি ছুটেছে। মুখে, ব্যাকগিয়ার দিয়ে হ্যাণ্ডেল ঘোরাচ্ছে। আবার ছুটে আসার মতলব রানার দিকে।
উবু হয়ে মেঝে থেকে টেনিসবলের সমান বড় একটা ঝামাপাথর তুলে নিল লামিয়া, নিশানা করেই গায়ের জোরে ছুঁড়ে মারল ফোর হুইলারের চালকের দিকে। একই কাজ করল সোহেলও। তবে ও পাথর ছুঁড়েছে চালকের সঙ্গীর মাথা লক্ষ্য করে–হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করতে যাচ্ছিল লোকটা।
চালকের মাথা নিশানা করে পাথর ছুঁড়েছিল লামিয়া, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে ওর, মাথার বদলে লোকটার কাঁধে লেগেছে। পাথর। থমকে গেছে লোকটা, কারণ রানাকেই একমাত্র শত্রু ভেবেছিল। কে পাথর ছুঁড়েছে দেখার জন্য, স্বাভাবিকভাবেই, ঘাড় ঘুরাল রানার কথা ভুলে গেছে আপাতত।
সোহেলের নিশানা ব্যর্থ হয়নি, তা ছাড়া লামিয়ার চেয়ে অনেক জোরে পাথর ছুঁড়েছে ও। পিস্তল বের করে ফেলেছিল চালকের সঙ্গী, হাত থেকে ওটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো–কপাল আর ডান-চোখের-কোনার সংযোগস্থল চেপে ধরেছে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে।
উঠে দাঁড়িয়েই বিদ্যুৎগতিতে ছুট লাগাল রানা। ওর ছুটে আসার ব্যাপারে যতক্ষণে হুঁশ হলো ফোর হুইলারের চালকের, ততক্ষণে লামিয়ার ছোঁড়া আরেকটা পাথর গিয়ে লেগেছে লোকটার ডান কানে, ভোঁ-ভোঁ করছে কানটা।
বাঁ পায়ে ফোর হুইলারের বাম্পারে ভর দিয়েই লাফ মেরেছে রানা। শরীরটা একদিকে কাত করে ডান পা-টা মেলে দিয়েছে সামনের দিকে। কানের ভো ভো বন্ধ হলো চালকের, বেইযবল ব্যাটের বাড়ি খাওয়ার মতো একটা আঘাত টের পেয়েছে নাকেমুখে।
ফোর হুইলারের হ্যাণ্ডেলের উপর আছড়ে পড়ল রানা। ব্যথা পেল কিন্তু পাত্তা দিল না। আবার চালিয়েছে ডান পা–এবার সাইডকিক মেরেছে চালকের বাঁ কানের উপর। তারপর ঝট করে নেমে পড়ল চালক আর তার সঙ্গীর মাঝখানে, বাঁ পায়ে ঝেড়ে পর পর কয়েকটা লাথি মারল চালকের সঙ্গীর মাথায়। সিট থেকে খসে নিচে পড়ে গেল লোকটা।
ওই সিটে বসে পড়ল রানা, ঘুরল চালকের দিকে। বুকের কাছে ভাঁজ করল দুই পা, তারপর প্রচণ্ড লাথি মারল চালকের মাথায়। নিজের সিট থেকে ছিটকে নিচে পড়ল লোকটা।
তার সঙ্গী নড়ছিল অল্প অল্প, সাইডবাম্পার আঁকড়ে ধরে উঠে বসার চেষ্টা করছিল, এগিয়ে এসে ওর মাথায় পর পর কয়েকটা লাথি মেরে ওকে অজ্ঞান বানিয়ে দিল সোহেল।
লাফ দিয়ে চালকের পাশে ল্যাণ্ড করল রানা, লোকটাকে আরও পিটুনি দেয়ার দরকার আছে কি না দেখছে। না, নেই–নিস্তেজ হয়ে গেছে সে।
লামিয়ার দিকে তাকাল রানা। একটা গার্ড ছোটখাটো গড়নের ছিল, ওর ইউনিফর্ম বেশি ঢলঢলে হবে না তোমার গায়ে। কাপড় বদলে নাও,। অন্যজনের কাপড় পরবে সোহেল। আনুবিসের দুই মূর্তির আড়ালে বসিয়ে দেব দুই গার্ডকে।
তারপর ওদের অস্ত্রগুলো নিয়ে নেব আমরা, বেঁটে গার্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মিয়া।
.
২৫.
একটা কাঁচদরজার ওপাশে দেখা যাচ্ছে ল্যাবটা। দরজা জুড়ে রাবারের সিল, তবে ওটা লক করা না। সোহেল আর লামিয়াকে পেছনে নিয়ে পাল্লা ঠেলে ঢুকে পড়ল রানা।
ল্যাবকোট-পরা দুজন মানুষ কাজ করছিল ভিতরে, চমকে উঠল ওরা, কাজ থেমে গেছে আপনাআপনি।
নড়বে না, সাবধান করল রানা, বেরেটা নাচাল।
বলার দরকার ছিল না। ল্যাবের দুই কর্মীর একজন পুরুষ; রানার পিস্তলটা দেখেছে আগেই, বরফের মতো জমে গেছে।
কিন্তু চাঞ্চল্য দেখা গেল নারীকর্মীর মধ্যে। একলাফে এগিয়ে গেল সে সিকিউরিটি অ্যালার্মের দিকে। ওর চেয়েও বেশি দ্রুততা দেখা গেল লামিয়ার মুভমেন্টে, ঘাড়ে রদ্দা চালিয়ে অজ্ঞান করে দিল ওই মহিলাকে।
আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দুই হাত উপরে তুলে দিয়েছে অল্পবয়েসি এক লোক, লড়াইয়ের কোনও ইচ্ছা নেই।
তুমি বিজ্ঞানী? লোকটাকে জিজ্ঞেস করল রানা।
বায়োলজিস্ট, বলল লোকটা।
ইংরেজি শুনলে আমেরিকান মনে হয়।
মাথা ঝাঁকাল লোকটা।
কী নাম তোমার?
হেনরি ক্লার্ক।
আমেনথেসের ফার্মাসিউটিকাল ডিভিশনে কাজ করছ?
আবারও মাথা ঝাঁকাল হেনরি। কায়রোর একটা ল্যাবে কাজ করার জন্য ভাড়া করা হয়েছে আমাকে। আলেকন্দ্রিয়াতেও একটা ল্যাব আছে এদের। অজ্ঞান মহিলাটাকে দেখাল ইঙ্গিতে। আমার সঙ্গে কাজ করছে ও।
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ স্বাভাবিক কিছু ঘটছে না এখানে?
বুঝতে পারলেও কিছু করার নেই। ওদের কথা না শুনলে মরতে হবে।
আমরা কেন এসেছি, বুঝতে পেরেছ?
পেরেছি। চলো, দেখাচ্ছি।
রানাকে পথ দেখিয়ে ল্যাবের আরেকদিকে নিয়ে চলল হেনরি। প্রায় পুরো ল্যাবই উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত; সেন্ট্রিফিউ, ইনকিউবেটর, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপসহ আরও অনেক ইকুইপমেন্টে ঠাসা। মেঝে, দেয়াল আর ছাদ চকচকে অ্যান্টিসেপ্টিক প্ল্যাস্টিকে মোড়া।
হাঁটতে হাঁটতে রানাকে নিয়ে মেইন ল্যাব থেকে আলাদা একটা সেকশনে হাজির হলো হেনরি। এই জায়গা মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত কাঁচদেয়ালে ঘেরা, এয়ারলক করা।
কী-প্যাডের কাছে এগিয়ে গেল হেনরি, কোড চাপল। মৃদু হিসহিস শব্দে খুলে গেল এয়ারলক। ভিতরে পা রাখল সে। ওর সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে আছে রানা।
আশপাশে অনেকগুলো রেফ্রিজারেটেড শেলফ আছে। আলো জ্বলছে সবগুলোর ভিতরে। কোনওটাতে আছে কাঁচের ছোটবড় শিশি, কোনওটাতে দেখা যাচ্ছে টেস্টটিউবের সারি। কোনও কোনও শিশি বা টেস্টটিউবের গায়ে করোটি আর আড়াআড়ি দুই হাড়ের লেবেল সাঁটা।
কিছু সময়ের জন্য এই জায়গায় দাঁড়াল হেনরি, তারপর এগিয়ে গেল আরেকটা দরজার দিকে। ওটা খুলে ঢুকল বড় আরেকটা ঘরে। এটার মেঝে ধূলিধূসরিত। ভিতরে এত গরম যে, বেশিক্ষণ থাকলে গলদঘর্ম হতে হবে। পরিবেশটা ভীষণ শুষ্ক। চোখধাঁধানো উজ্জ্বল লালরঙা হিটল্যাম্প জ্বলছে।
আশপাশে তাকিয়ে রানার মনে হলো, মঙ্গল গ্রহের ভূপৃষ্ঠে হাজির হয়েছে যেন।
.
ল্যাব থেকে অনেক দূরে, মেইন কন্ট্রোলরুমে আখতার আর আলবার্তোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারওয়ার। ওদের মুখোমুখি দেয়ালের অনেকখানি জুড়ে কতগুলো কম্পিউটার স্ক্রিন। সাব সাহারা অ্যাকুইফার থেকে পানি তুলে তা নীল নদে ফেলার জন্য পাম্প, কুয়া আর পাইপলাইনের যে-ইন্টারকানেক্টেড নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আমেনথেস, সেটা দেখছে ওরা ওসব স্ক্রিনে।
মেইন কন্ট্রোলরুম কেন্দ্র করে গোলকধাঁধার মতো বিস্তৃত টানেলগুলোর বিভিন্ন চার্ট আর ডায়াগ্রাম আছে আরেকদিকের দেয়ালে-সারওয়ারের লোকেরাই বানিয়েছে ওসব, যদিও এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ টানেল অনাবিকৃত রয়ে গেছে।
স্ক্রিনের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চার্ট আর ডায়াগ্রামগুলোর দিকে তাকাল আলবার্তো। তোমাদের এই ঘাঁটি দেখে তাজ্জব হয়ে গেছি, বিশ্বাস করো। টানেলগুলো ঠিক কতদূর বিস্তৃত?
আমরা নিজেরাও জানি না, বলল সারওয়ার। যতগুলো টানেল আছে এখানে, আমার মনে হয় এখন পর্যন্ত তার অর্ধেকেও ঢোকা হয়নি আমাদের। ফারাওরা টানেলের পর টানেল বানিয়ে এই জায়গা থেকে প্রথমে সোনা-রূপা, তারপর লবণ আর ন্যাট্রন তুলেছে। পুরো গুহাব্যবস্থায় বড় ঘরের মতো দেখতে ভোলা জায়গা আর বিভিন্ন দেয়ালের যত্রতত্র ফাটল রয়ে গেছে এখনও।
তোমরা যখন এই জায়গা খুঁজে পাও তখন এর পুরোটাই পানিতে তলিয়ে ছিল? জিজ্ঞেস করল আলবার্তো।
পুরোটা না, বেশিরভাগ। বিশেষ করে নিচু জায়গাগুলো। পাম্প করে সব পানি সরিয়ে ফেলতে হয়েছে। অ্যাকুইফার থেকে পানি সরানোর ফন্দিটা তখনই আসে আমার মাথায়।
পুরো সাহারাকে কভার করছে ওই অ্যাকুইফার?
উল্টোটা। পুরো অ্যাকুইফারকে কভার করছে সাহারা। পশ্চিমদিকে এগিয়ে একেবারে মরক্কোর বর্ডারে চলে গেছে ওটা।
আচ্ছা, অন্য দেশগুলো যদি জেনে ফেলে ব্যাপারটা?
জানলেও কিছু করতে পারবে না। কারণ যতক্ষণে জানবে ততক্ষণে ওদের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থাকবে আমাদের হাতে। দেখে নিয়ো, মরক্কো-সরকারের পতন ঘটবে অচিরেই। পুরো উত্তর আফ্রিকাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে নেব আমি। তখন যদি ইচ্ছা করো, উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে কিছু সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারবে তুমি আর তোমার বন্ধুরা।
মাথা ঝাঁকাল আলবার্তো। মাটির নিচের এই কবরগুলো কি তোমরাই আগে খুঁজে পেয়েছ? আমি শুনেছি এগুলো খুঁজে বের করার জন্য নাকি অনেক চেষ্টা করেছিল আর্কিয়োলজিস্টরা।
করেছিল, কিন্তু পারেনি। আসলে এই জায়গার কোনও রেকর্ড ছিল না কোথাও। মিশরের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের এক আর্কিয়োলজিস্ট একবার কিছু প্যাপাইরাস নিয়ে যায়। আমাদের কাছে। ওগুলো পড়ে কৌতূহলী হয়ে উঠি আমি, নিজের লোকদের দিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করি।
কালো কুয়াশার সন্ধান পেলে কীভাবে?
এখানকার এক গুহা থেকে পাওয়া লিপিফলকের মাধ্যমে। ওগুলোতে লেখা ছিল কোথায় এবং কী অবস্থায় আছে কালো কুয়াশা। বলা ছিল, ওসিরিসের পুরোহিতরা কীভাবে তৈরি করত ওই সিরাম। গবেষণা করে ওটা আরও উন্নত করেছি আমরা। উন্নতি ঘটিয়েছি ওটার অ্যান্টিডোটেরও।
গোপন কথা জানতে পারার খুশিতে অদ্ভুত এক দ্যুতি দেখা দিয়েছে আলবার্তোর চোখেমুখে। সারওয়ার বলেনি, তারপরও আলবার্তো নিজেই নিজেকে সারওয়ারের বিশ্বাসভাজন ভাবতে শুরু করেছে। ওকে যদি এত বিশ্বাস না করত লোকটা, তা হলে ওসব গোপন কথা বলত?
দেশে ফিরে তুমি চেষ্টা করবে তোমাদের সংসদে ভোটাভুটির ব্যবস্থা করতে, করণীয় সম্পর্কে আলবার্তোকে বলছে সারওয়ার। আমি চাই লিবিয়া তোমাদের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হোক। যদি তা হয়, সেখানে মিশর আর ইটালির যৌথ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
ধূর্ত হাসি হাসল আলবার্তো। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। ভোটাভুটিতে জিততে হলে আমাকেও কিছু একটা অফার করতে হবে। কালো কুয়াশার আগের চালানটা তো নষ্ট হয়ে গেল লিনোসা উপকূলে, চেষ্টা করে দেখো নতুন কোনও চালান পাঠাতে পারো কি না। আমি যদি আমার দলে ইটালির আরও দশজন মন্ত্রীকে ভেড়াতে পারি, ভোটের ফল, আমার পক্ষে যাবে। এমনকী অনাস্থা প্রস্তাব এনে নতুন সরকারও গঠন করতে পারি আমরা, যেখানে আমি হব নতুন প্রধানমন্ত্রী।
নতুন একটা চালান তৈরি করার কাজ চলছে, মুখ খুলল আখতার। কিন্তু লিবিয়ানরা যদি আমাদের সাহায্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, কোনও কাজেই লাগবে না ওই চালান। পতন ঘটছে না ওদের সরকারের।
মাথা ঝাঁকাল সারওয়ার। সেক্ষেত্রে লিবিয়ার অবস্থা আরও খারাপ বানাতে হবে আমাদেরকে।
পারবে? আলবার্তোর কণ্ঠে সন্দেহ। দেশটার পানির প্রধান উৎস শেষ করে দিয়েছ তোমরা, কিন্তু ছোট ছোট বেশ কয়েকটা পাম্প কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এখনও। ত্রিপোলির কাছে অনেক বড় একটা ওয়াটার প্লান্ট আছে, ওটা এখনও পূর্ণশক্তিতে কাজ করে চলেছে।
ওই প্লান্টটা ধ্বংস করার জন্য পাঠাতে হবে কাউকে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল সারওয়ার। আর এখন থেকে রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করবে আমার অন্য পাম্পিংস্টেশনগুলো। এক গ্লাস পানিও পাবে না লিবিয়ানরা।
তখন লিবিয়ায় ঢোকাটা সহজ হবে আমাদের সৈন্যদের জন্য। বন্দুক উঁচিয়ে সেখানে যাওয়ার চেয়ে পিপাসার্ত মানুষদের জন্য পানি নিয়ে যাবে ওরা। কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।
মাথা ঝাঁকাল সারওয়ার। কল্পনার চোখে দেখছে, হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে লিবিয়ায়। সংখ্যাটা লক্ষ লক্ষও হতে পারে। দেশটা নিয়ন্ত্রণ করছে মিশর, অন্যকথায় সারওয়ার আর ওর অনুগতরা। তারপর আলজেরিয়া আর তিউনিসিয়ার দিকে হাত বাড়িয়েছে ওরা। ক্ষমতার লিঙ্গ পূরণ হয়েছে সারওয়ারের।
তা হলে যত জলদি সম্ভব ইটালিতে ফিরে যাই আমি, আলবার্তোর কথায় বাস্তবে ফিরল সারওয়ার।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু তারের সঙ্গে সংযুক্ত একটা ফোন বেজে উঠল এমন সময়। এগিয়ে গিয়ে কল রিসিভ করল আখতার, সংক্ষিপ্ত কথা সেরে ফিরে এল। কঠোর হয়ে গেছে ওর চেহারা।
হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্লান্ট থেকে ফোন এসেছিল, জানাল সে।
কে? ভ্রূ কুঁচকে গেছে সারওয়ারের।
সিকিউরিটি সুপারভাইর। কে বা কারা নাকি ঢুকে পড়েছে প্রান্টের ভিতরে। খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে ওরা, কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে ধরতে পারেনি। তবে…।
চোয়ালের হাড় দুটো ফুলে ফুলে উঠছে সারওয়ারের।
একটা ট্রামকার পাওয়া যাচ্ছিল না জায়গামতো; বলছে আখতার, আনুবিস পয়েন্টের থেকে এক শ ফুট দূরে দেখা গেছে ওটাকে কিছুক্ষণ আগে।
তারমানে অনুপ্রবেশকারীরা প্লান্ট ছেড়ে চলে এসেছে এখানে।
.
মঙ্গলগ্রহের উত্তাপ অসহ্য লাগছে রানার।
এটা আমাদের ইনকিউবেটর, বলল হেনরি।
খটখটে শুকনো মাটি ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না রানা, নির্দিষ্ট জ্যামিতিক রীতিতে বানানো ঢিবির মতো দেখতে শত শত মাটির-চাই আছে মেঝের জায়গায় জায়গায়। কী উৎপাদন করছ তোমরা এখানে?
উৎপাদন করছি না। হাইবারনেশন প্রসেস চলছে।
বুঝিয়ে বলো।
একটা ঢিবির পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, হেনরি। একটা খুরপি নিয়েছে হাতে, ওটা দিয়ে খুঁচিয়ে ঢিবি থেকে আলগা করল টেনিস বলের সমান একটা ঢেলা। খুরপি দিয়ে চেঁছে সব আলগা মাটি ফেলে দিল ঢেলার গা থেকে বেরিয়ে পড়ল বলটা। খুরপি দিয়ে কয়েকবার আলতো বাড়ি মেরে ভেঙে ফেলল বলের বাইরের আবরণ।
ফুলে ঢোল হওয়া, অর্ধেক মমিকরা একটা ব্যাঙ দেখা যাচ্ছে।
আফ্রিকান বুলফ্রগ, বলল হেনরি।
আনুবিসের মূর্তিওয়ালা একটা গুহায় এ-রকম ব্যাঙ কম করে হলেও এক শ’টা দেখেছি।
কিন্তু ওগুলোর সঙ্গে এটার পার্থক্য হচ্ছে, ওগুলো মরার পর মমি করা হয়েছে, আর এটা এখনও মরেনি। শুধু ঘুমিয়ে আছে। বায়োলজির ভাষায় হাইবারনেশনে আছে।
সাপ-ব্যাঙ জাতীয় প্রাণীরা হাইবারনেশনে যায় শীত কালে। এখন কেন? এটাকে মাটির ঢেলায় ঢুকিয়ে ইন কিউবেটরের উত্তাপ অনেক বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে?
হ্যাঁ। প্রচণ্ড তাপ আর বাতাসে আর্দ্রতার অভাবের কারণে সার্ভাইভাল মোডে চলে গেছে ব্যাঙটা। কাদার ভিতরে ঢুকে নিজেদের শরীরের বাইরে রেশমগুটির মতো একটা আস্তরণ তৈরি করেছে। এমন এক সুপ্তাবস্থায় চলে গেছে, যার ফলে হৃৎস্পন্দন কমে গেছে, কমে গেছে শ্বাসপ্রশ্বাসের হার।
সুপ্তাবস্থায় থাকা বুলফ্রগ থেকেই বানিয়েছ তোমরা?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
এ-রকম শুষ্ক ও তপ্ত পরিবেশে, হাইবারনেটিং বুলগের শরীরে একরকম গুচ্ছ-এনইম তৈরি হয়। ওই এনইমকে যদি কোনওভাবে অন্য প্রাণীকোষের সংস্পর্শে আনা যায়, হাইবারনেশনে বাধ্য হবে সে-কোষও। দেহ যেহেতু কোষ দিয়ে তৈরি, সেহেতু কোষের যা হবে, দেহেরও তা-ই হবে। তখন শুধু মস্তিষ্কের একটা অংশ কার্যকর থাকবে।
কোমা, মন্তব্য করল রানা।
অনেকটা।
তারমানে তুমি আর তোমার সহকারীরা বুলগের শরীর থেকে গুচ্ছ-এনইম আলাদা করে তা মানবদেহের উপর প্রয়োগ করার কৌশল বের করেছ?
মাথা ঝাঁকাল হেনরি। শুধু মানবদেহ না, আরও বড় প্রাণীদেহেও হাইবারনেশন এফেক্ট তৈরিতে সক্ষম কালো কুয়াশা। যদি সাবযিরো টেম্পারেচারে সংরক্ষণ করা হয় ওটা, কেয়ামতের আগে নষ্ট হবে না। কিন্তু স্বাভাবিক রুম টেম্পারেচারে আট ঘণ্টার বেশি টেকে না। আর বাতাসের সংস্পর্শে এলে দুই কি তিন ঘণ্টার বেশি কার্যক্ষম থাকে না, সিম্পল অর্গানিক কম্পাউণ্ডে বিশ্লিষ্ট হয়ে যায়।
এবার বুঝলাম কেন লিনোসার বাতাসে কালো কুয়াশার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। …খুব শক্তিশালী মারণাস্ত্র, কিন্তু খুব নাজুক।
মারণাস্ত্র হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য কিন্তু আবিস্কৃত হয়নি কালো কুয়াশা। ইতিহাস বলে জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে, অন্যকথায় চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হতো ওটা। ট্রমা রোগী, আগুনে পোড়া ব্যক্তি অথবা গুরুতরভাবে আহত রোগীদের ওই কায়দায় অজ্ঞান করতেন প্রাচীনকালের ডাক্তাররা। একটু থামল হেনরি।
কালো কুয়াশাকে মারণাস্ত্র বানালে কেন?
ওরা তা-ই করাতে চেয়েছিল আমাকে দিয়ে।
তোমার বিবেকে বাধল না?
আমার মতো আরও অনেক বায়োলজিস্ট কাজ করত এখানে। যাদের বিবেকে বেধেছিল, তারা সবাই কুমিরের পেটে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল হেনরি। খুব শীঘ্রিই পুরো প্রসেসটা অটোমেটেড বানিয়ে ফেলবে ওরা। তখন আর আমাকেও দরকার হবে না। বুলফ্রগটা ঢেলার ভিতরে ঢুকিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। এসো আমার সঙ্গে।
আরেকটা এয়ারলক দরজা পার হয়ে সাধারণ একটা রিসার্চ ল্যাবে ঢুকল ওরা। এটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, তবে ততটা আলোকিত না। রেফ্রিজারেটর আর ল্যাব টেবিলের সারি দেখা যাচ্ছে। কোনও কোনও টেবিলের উপর ধীরগতিতে ঘুরছে। ছোট ছোট কিছু সেন্ট্রিফিউগাল মেশিন।
কয়েকটা সেন্ট্রিফিউয পরীক্ষা করে দেখল হেনরি। নতুন চালানটা রেডি হয়নি এখনও।
কীসের নতুন চালান, তা জেনে নিল রানা। তারপর বলল, কালো কুয়াশাকে কি অ্যান্টিডোট হিসেবে ব্যবহার করা যায়?
মাথা নাড়ল হেনরি।
অ্যান্টিডোটটা লাগবে আমার। লিনোসায় কী ঘটেছে, সংক্ষেপে বলল রানা হেনরিকে। ওই দ্বীপের মানুষগুলোকে বাঁচাতে হবে।
কিন্তু এখানে তো ওই জিনিস বানানো হয় না। অনুমতি নেই।
কোথায় পাব?
জবাব দিতে যাচ্ছিল হেনরি, এয়ারলক দরজা খোলার আওয়াজ শুনে থমকে গেল।
চোখের কোনা দিয়ে রানা দেখল, মঙ্গলগ্রহ থেকে একঝলক লাল আলো এসে আলোকিত করে দিয়েছে ল্যাবের একটা কোনা। যারা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়, তাদের কেউই সোহেল বা লামিয়া না।
সূঙ্গে সঙ্গে ডাইভ দিল ও, একহাত বাড়িয়ে খামচে ধরেছে হেনরিকে।
হ্যাঁচকা টান লেগে টলে উঠল হেনরি, সে যখন হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছে তখন শোনা গেল গুলির আওয়াজ।
রানার একহাতে আঁচড় কেটে বেরিয়ে গেল একটা বুলেট। দুটো লেগেছে হেনরির বুকে।
একটা টেবিলের আড়ালে চলে এসেছে রানা, টানতে টানতে নিয়ে এসেছে হেনরিকেও। ফুসফুস ফুটো হয়ে গেছে ভাড়াটে বায়োলজিস্টের, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে সে। ওর মুখের কাছে কান নিয়ে গেল রানা।
…এয়ারটাইট কনটেইনার…তিন দিন পর পর… আরও কিছু বলল, কিন্তু শব্দ বের হলো না ওর মুখ দিয়ে। প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁচকে গেছে চেহারা। আস্তে আস্তে ঢিলে হয়ে এল শরীরটা, তারপর স্থির হয়ে গেল কিছুক্ষণ পর। কীসের কথা বলছিল বায়োলজিস্ট, বুঝে ফেলল রানা।
মাসুদ রানা! দরজার কাছ থেকে চিৎকার করে ডাকল কেউ।
টেবিলের আড়ালে যেভাবে ছিল সেভাবে পড়ে রইল রানা, জবাব দিল না। বুঝতে পারছে, শত্রুপক্ষ দেখতে পাচ্ছে না ওকে। এটাও বুঝতে পারছে, ওরা গুলি করতে শুরু করলে একটা বুলেটও ঠেকাতে পারবে, না সারি সারি টেবিলের পাতলা কাঠ।
বেরেটার দিকে তাকাল রানা। এই মুহূর্তে ওটা একটা খেলনা ছাড়া আর কিছুই না।
উপর্যুপরি গুলির আশঙ্কা করছে রানা, কিন্তু তা করছে না শত্রুপক্ষ। ল্যাবের ভিতরেও ঢুকছে না কেউ-হয়তো রানার সহজ টার্গেটে পরিণত হতে চায় না। কেন গুলি করছে না ওরা, তা একটু ভাবতেই বুঝতে পারল রানা। বিষবাষ্পে ভরা ল্যাবে গোলাগুলি করতে চায় না ওরা, হয়তো শিক্ষা নিয়েছে লিনোসার ঘটনাটা থেকে।
তারমানে আলোচনা চালিয়ে ওদেরকে কিছুক্ষণ ব্যস্ত রাখতে পারবে রানা।
বেকায়দায় ফেলে দিয়েছ, চেঁচাল ও। তোমাদের সঙ্গে মোলাকাত করতে পারছি না বলে দুঃখিত। কিছু মনে কোরো না।
বেকায়দাতেই থাকতে হবে তোমাকে, দরজার কাছ থেকে উচ্চকণ্ঠ শোনা গেল আবারও।
টেবিলের আড়াল থেকে মাথাটা একটুখানি বের করল রানা, তাকাল দরজার দিকে। তিনটা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। মাঝখানের লোকটা, রানার অনুমান, সারওয়ার বিন জামাল। ইনকিউবেশন রুমের উজ্জ্বল লাল আভায় শয়তানের মতো দেখাচ্ছে ওকে।
মনে হচ্ছে, পুরনো কোনও দেনা চুকাতে হাজির হয়ে গেছে শয়তানটা।
.
২৬.
লোকটাকে এখনও ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না রানা। শুধু বুঝতে পারছে, বেশ লম্বা সে। এবং ওর দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই চামচার কাছে রাইফেল আছে।
উঠে দাঁড়াতে পারো তুমি, বলল সারওয়ার।
তা পারি বটে। কিন্তু কাজটা করলে চিরতরে শুয়ে পড়তে হবে আবার তোমাদের সহজ টার্গেটে পরিণত হতে চাই না। শুধু যদি আমার চাঁদমুখ দেখার জন্য আসতে, সঙ্গে রাইফেলের বদলে ফুল আনতে।
কথা বলতে বলতে প্রতিপক্ষের অবস্থান ভালোমতো বুঝে নিচ্ছে রানা, যাচাই করেছে লড়াই শুরু হলে ওর জেতার সম্ভাবনা কতটুকু। দু-একবার গুলি করতে পারবে ও, কিন্তু এত কঠিন অ্যাঙ্গেল থেকে ঘায়েল করতে পারবে প্রতিপক্ষের বড়জোর একজনকে। ও ফায়ার করতে শুরু করলেই বিষবাষ্পের ভয় ভুলে যাবে বাকি দুজন, সমানে টানতে শুরু করবে রাইফেলের ট্রিগার। তা ছাড়া ওদের সঙ্গে আরও লোক থাকতে পারে।
হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল দরজার কাছ থেকে। তুমি কিন্তু তেমন একটা কঠিন টার্গেট নও আমাদের জন্য। এখন যেখানে আছ সেখানেই থাকো, গুলি চালাতে বলি আমার লোকদেরকে, মরার আগে জানতেও পারবে না ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলে। কাজেই হাতের পিস্তলটা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াও।
তুমিও কি খুব একটা কঠিন টার্গেট না আমার জন্য, বলল রানা। এখন যেখানে আছ সেখানেই থাকো। তোমাকে মারার জন্য ঝাঁঝরা করার দরকার নেই আমার।
উঠে দাঁড়াও, রানা, সারওয়ারের কণ্ঠে হুমকি। শেষবারের মতো বলছি।
যেন পিস্তল বের করছে এমনি ভঙ্গি করে বামহাত বাড়িয়ে গোটা কয়েক কাঁচের ঠাণ্ডা ভায়াল নিয়ে ভরল রানা ওর ওয়াটারপ্রু পাউচে, তারপর যিপ টেনে দিল।
বেরেটাধরা হাতটা টেবিলের উপর তুলল রানা, নিরীহ ভঙ্গিতে নাচাল পিস্তলটা। তারপর দরজার দিকে ছুঁড়ে দিল ওটা। ঠেলে-দেয়া বল যেভাবে রিসিভ করা হয় ফুটবল খেলায়, অনেকটা সেই কায়দায় বুট দিয়ে পিস্তলটা আটকাল সারওয়ার। এবার ওঠো।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল রানা। ও কে, কেন এসেছে এখানে, ঢুকল কীভাবে ইত্যাদি না-জানার আগে বোধহয় গুলি চালাবে না প্রতিপক্ষ।
তোমার বন্ধুরা কোথায়?
বন্ধু? আমার কোনও বন্ধু নেই। পৃথিবীতে আমি…
আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে এখানে ঢুকেছ তুমি। প্রথম থেকেই তোমার সঙ্গে কাজ করছে ওরা। কোথায় ওরা?
রানা আসলেই জানে না সোহেল আর লামিয়া কোথায়। এবং প্রশ্নটার জবাব সারওয়ারও জানে না দেখে ভালো লাগল ওর। বিপদ আসছে টের পেয়ে খুব সম্ভব লুকিয়ে পড়েছে ওরা কোথাও।
আমার সঙ্গে ওদের বিচ্ছেদ ঘটার আগপর্যন্ত, চটুল কথায় সারওয়ারকে ব্যস্ত রাখতে চায় রানা, বাথরুমের খোঁজ করছিল একজন। জোরে লেগে গিয়েছিল। বড়টা।
বায়ের লোকটার দিকে তাকাল সারওয়ার। আখতার, পাম্পগুলো চেক করো। স্যাবোটাজের মতলব থাকতে পারে এদের।
হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্লান্ট, চট করে বলল রানা, আসলে আরেক দেশ থেকে পানি চুরি করার আয়োজন। মাথায় বুদ্ধি আছে আর বেসিক ইঞ্জিনিয়ারিং জানে এ-রকম যে-কেউ বুঝে ফেলবে তোমার ধান্দাবাজি।
কীভাবে? কিছুটা হলেও আশ্চর্য হয়েছে সারওয়ার।
যত পানি ঢুকছে তোমার হাইড্রোচ্যানেলে, তারচেয়ে বেশি বেরিয়ে যাচ্ছে। ফারাকটা হলো কী করে?
ওই তফাৎ নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন করেনি। শুধু তুমিই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছ।
কাঁধ, ঝাঁকাল রানা। আমি আর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কী জানি? ওই বিষয়ে আমার চেয়ে ঢের পণ্ডিত আছে অনেক।
ওকে এগোনোর ইঙ্গিত করল সারওয়ার। তাতে কিছু যায়-আসে না। আর কিছুদিনের মধ্যেই সফল হবে আমার পরিকল্পনা। তখন পানি চুরি করা বাদ দিয়ে আসল কাজ শুরু করবে আমার হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্লান্ট। ততদিনে কবরের ভিতরে তোমার মাংস পচে কঙ্কাল বেরিয়ে আসবে।
হাঁটতে হাঁটতে সারওয়ারের সামনে এসে দাঁড়াল রানা। ওর দুই হাত যিপ-টাই দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল আখতার। তারপর ওকে ঠেলা মারল ইনকিউবেশন রুমের দিকে, কোন্দিকে যেতে হবে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
এসব কেন করছ? হাঁটতে হাঁটতে সারওয়ারকে জিজ্ঞেস করল রানা।
ক্ষমতার জন্য।
তোমার ক্ষমতার লিপ্সা নিমেষে জীবন্মত বানিয়ে দিয়েছে লিনোসার পাঁচ হাজার মানুষকে। ধুকে ধুকে মরেছে অথবা মরতে যাচ্ছে উত্তর আফ্রিকার হাজার হাজার মানুষ। গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ওই দেশগুলোয়।
লিনোসার ঘটনাটা আসলে একটা দুর্ঘটনা। আর গৃহযুদ্ধ যদি লাগে তা হলে তা চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে আমার জন্য, সব শেষ হবে তাড়াতাড়ি। রক্তপাত ছাড়া ক্ষমতার বড় রকমের পালাবদল হয়নি দুনিয়ার কোথাও।
ইনকিউবেশন রুমের এয়ারলক দরজা পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল ওরা। এখানে কালো উর্দিপরা আরও কয়েকজন গার্ড আছে।
আখতারের দিকে তাকাল সারওয়ার। রানাকে ঠিক কোথায় নিয়ে গিয়ে ইন্টারোগেশন শুরু করলে ভালো হয়?
ফ্যানাটিক আখতারের দাঁত দেখা গেল। দড়ি দিয়ে বেঁধে কুমিরের গর্তে একটুখানি নামিয়ে দিই। আমাদের প্রশ্নের জবাব না দিলে দড়ি নিচু হবে, তখন ওর পায়ে কামড় বসাবে কুমির। এভাবে ওকে একটু একটু করে…
কথা শেষ করতে পারল না সে।
ফোর হুইলারের গর্জন শোনা গেল। একটা টানেলের ভিতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল ওটা।
গার্ডদের কেউ সতর্ক হওয়ার আগেই ওদের উপর হুইলার চড়িয়ে দিল লামিয়া, ছিটকে একেকদিকে পড়ল একেকজন। শোল্ডার হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করতে যাচ্ছিল সারওয়ার, সোলার প্লেক্সাসে রানার প্রচণ্ড লাথি খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। ততক্ষণে আখতারের দুই নিতম্বের সংযোগস্থলে সেঁধিয়ে গেছে ফোর হুইলারের সম্মুখভাগ। পেছন থেকে ষাঁড়ের গুঁতো খেলে যেভাবে শূন্যে উঠে যায় কোনও লোক, তা-ই হলো আখতারের; বাতাসে একবার গোত্তা খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ল সে। ককিয়ে উঠল ব্যথায়।
এগিয়ে গিয়ে সারওয়ারের নাকেমুখে লাথি মারল রানা, থেঁতলে দিল ওর দুই ঠোঁট। উবু হয়ে লোকটার শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করে নিল একটা ম্যাগনাম।
ফোর হুইলারের গুতো খাওয়া থেকে বেঁচে গেছে দুজন। গার্ড, মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে তারা। কারণ তাদের দিকে একে ফোর্টি সেভেন উঁচিয়ে রেখেছে হুইলারের প্যাসেঞ্জার সিটে বসা সোহেল।
মিশরের সূর্যসন্তানেরা! তরল গলায় বলল ও, জননেন্দ্রিয় হারাতে না চাইলে হাতের রাইফেল ফেলো! দ্বিতীয়বার বলব না, মাথায় বা বুকে গুলি করব না, সোজা গুলি করব…
আর বলতে হলো না, যার যার রাইফেল ফেলে দিল দুই গার্ড।
এগিয়ে গিয়ে ও-দুটোও তুলে নিল রানা, তারপর ঝটপট উঠে পড়ল হুইলারে। আবারও গর্জন করে উঠল ওটার ইঞ্জিন, গাড়ি ঝটকা দিয়ে সামনে বাড়ল। আরেকটু হলে পড়েই গিয়েছিল রানা।
কোনদিকে যাচ্ছে লামিয়া জানে না নিজেই। ঢুকে পড়েছে একটা টানেলে, যত দ্রুত সম্ভব এবং যত বেশি সম্ভব দূরত্ব তৈরি করতে চাইছে প্রতিপক্ষের সঙ্গে।
গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল একটানা। তারমানে এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে আহত গার্ডরা, যে-টানেলে ঢুকেছে লামিয়া সেটা তাক করে একে ফোর্টি সেভেন খালি করছে। হ্যাঁলেটা বার বার এদিকওদিক ঘুরিয়ে হুইলারটাকে আঁকাবাঁকা পথে ছোটাচ্ছে লামিয়া, সহজ টার্গেটে পরিণত হতে দিতে চায় না নিজেদেরকে।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রানা। টানেলের প্রবেশমুখ আর ভিতরের দিকের দেয়ালে বিধছে একের পর এক বুলেট, খসে খসে পড়ছে মাটি, উড়ছে ধুলো।
একটা বাঁক ঘুরে টানেলের আরও গভীরে ঢুকে পড়ল লামিয়া।
রানার কাছ থেকে ম্যাগনাম আর রাইফেল দুটো আগেই নিয়ে নিয়েছে সোহেল, এবার পকেটনাইফ বের করে কেটে দিল যিপ-টাই। লামিয়ার দিকে তাকাল রানা। চুল খোঁপা করে ক্যাপের নিচে গুঁজে দিয়েছে মেয়েটা।
কী রে, শালা? একটু নির্ভার হয়েছে সোহেল, তাই পরিহাস ভর করেছে ওর কণ্ঠে। উদ্ধার অভিযান কেমন লাগল?
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা কঠিন, পিছন থেকে শোনা যাচ্ছে আরও ফোর হুইলারের গর্জন, সেদিকে ইঙ্গিত করল রানা।
ধেয়ে আসছে কমপক্ষে দুটো হুইলার, টানেলের দেয়ালে দেখা যাচেৎ আলোর নাচন।
সাবধান, খোকাবাবুরা! লামিয়ার চিৎকার শোনা গেল। ইটালির পাহাড়-পর্বতে কীভাবে হুইলার চালাই আমরা তা দেখিয়ে দিতে চাই ওদেরকে।
কথা শেষ করেই মোচড় দিল হ্যাঁণ্ডেলে। একদিকের দেয়ালে একটুখানি ঘষা খেল বাহনটা, সঙ্গে সঙ্গে আরেকদিকের দেয়ালের দিকে হ্যাণ্ডেল ঘোরাল মেয়েটা। আরেকটা বাঁক দেখা যাচ্ছে সামনে। গতি না কমিয়েই পেরিয়ে এল ওটা, একটু পর পর ডানে-বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে হ্যাণ্ডেল।
গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল পেছন থেকে।
ম্যাগনামের বুলেট খরচ না করার সিদ্ধান্ত নিল রানা। যেভাবে চালাচ্ছে লামিয়া, তাতে শরীর মোচড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ–পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ওই কাজই করল ও, দুপা দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে প্যাসেঞ্জার সিটের নিচের রড। সোহেলের কাছ থেকে একটা একে ফোর্টি সেভেন নিয়ে তুলল কাঁধে। খেয়াল করল ঠিক কীভাবে বার বার দিক বদল করছে লামিয়া।
পেছনের দেয়ালে আবার দেখা গেল আলোর নাচন, আবারও গুলি চালানো হলো একটা হুইলার থেকে। পর পর তিনবার জবাব দিল রানা। চুরমার হয়ে গেল পেছনের প্রথম হুইলারের হেডলাইট, গতি কমাতে বাধ্য হলো ওটার চালক। ওকে পাশ কাটিয়ে এগোনোটা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করল না দ্বিতীয় হুইলারের ড্রাইভার, তাই গতি কমাল সে-ও। লামিয়ার হুইলারের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ল ও-দুটোর।
বাঁক নিয়ে সরু একটা টানেলে ঢুকে পড়ল লামিয়া। এখানে মাটি একজায়গায় উঁচু হয়ে আছে স্পিডব্রেকারের মতো, জানা না থাকায় গতি কমাতে পারল না লামিয়া, জোরে ঝাঁকুনি খেয়ে শূন্যে উঠে গেল হুইলার।
প্যাসেঞ্জার সিট ছেড়ে শূন্যে উঠে গেছে রানা আর সোহেলও। রানার মনে হলো, ওর মাথাটা ঠুকে যাবে টানেলের ছাদের সঙ্গে। একে ফোর্টি সেভেনটা ছেড়ে দিয়েছে হাত থেকে। একহাতে চেপে ধরেছে হুইলারের একদিকের রড, আরেকহাতে খামচে ধরেছে সোহেলের শার্টের কলার না ধরলে পড়ে যেত সোহেল।
উদ্ধার অভিযান কেমন লাগল? জিজ্ঞেস করল রানা।
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে… কথা শেষ করতে পারল না সোহেল, আবারও প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়েছে ফোর হুইলার।
প্যাসেঞ্জার সিট ছেড়ে আবারও শূন্যে উঠে পড়েছে দুই বন্ধু।
হুইলারের গুঁতোয়, ল্যাণ্ড করার পর দাঁতে দাঁত চেপে বলল সোহেল, আমি শিয়োর আখতারের পাছাটা আরও এক ফুট চওড়া হয়ে গেছে। আর এ-ব্যাপারেও নিশ্চিত, এত ঝাঁকুনি খেলে আমাদের পাছা বলে কিছু থাকবে না–ভর্তা হয়ে যাবে।
হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল ড্রাইভিংসিট থেকে, সঙ্গে সঙ্গে আরও একবার ঝাঁকুনি খেল ফোর হুইলার। ল্যাণ্ড করামাত্র ব্রেক চাপল লামিয়া, ছিটকে গিয়ে ওর পেছনের রডে বাড়ি খেল রানা আর সোহেল। থেমে দাঁড়িয়েছে ফোর হুইলার।
কী সমস্যা? কাঁধের যেখানে বাড়ি খেয়েছে সেজায়গা ডলছে সোহেল।
ডেড এণ্ড, বলল লামিয়া।
একটা একে ফোর্টি সেভেন ছুঁড়ে দিল রানা সোহেলের দিকে, অন্যটা নিয়েছে নিজে। জলদি নাম, বলল ও, তুলে নিল ম্যাগনামটা, দিল লামিয়াকে।
লাফিয়ে প্যাসেঞ্জার সিট ছেড়ে নেমে পড়ল রানা ও সোহেল। ড্রাইভিংসিট ছাড়ল লামিয়া, ম্যাগনামটা নিয়ে পজিশন নিল হুইলারের আড়ালে।
ওর দুপাশে পজিশন নিল রানা আর সোহেল।
যথাসম্ভব চেষ্টা কোরো গুলি খরচ না করতে, লামিয়াকে বলল রানা। আমরা যদি খালি হয়ে যাই তখন… কথা শেষ করতে পারল না, শোনা গেল ধাওয়াকারী হুইলার দুটোর গর্জন।
লামিয়ার মতো ঝাঁকুনি খেল বাহন দুটো, উড়াল দিল শূন্যে। সামনের হুইলারটা যখন বাতাসে আছে তখন একে ফোর্টি সেভেনসহ উঁকি দিল রানা, নিশানা করে টান দিল ট্রিগারে। বাহনটা ল্যাণ্ড করার আগেই ঝাঁকুনি খেল ড্রাইভারের শরীর, বুকের একপাশ চেপে ধরে খসে পড়ল সে।
এলোপাতাড়ি ফায়ার করছে প্যাসেঞ্জার সিটের অন্য গার্ডরা। লামিয়ার হুইলারের বডিতে আর বিভিন্ন জায়গার স্টিলের রডে ফুলকি তুলছে বুলেটগুলো। চট করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল রানা, হুইলারের একদিকের চাকার আড়াল থেকে বের করে রেখেছে একে ফোর্টি সেভেনের নল।
আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে সোহেল, প্রতিপক্ষের সামনের হুইলারের গার্ডদের উদ্দেশে খালি করছে নিজের একে ফোর্টি সেভেন। চারজন গার্ড নেমে পড়েছিল পেছনের সিট ছেড়ে, তাদের দুজন লুটিয়ে পড়ল। বাকি দুজন বিনা কভারে দাঁড়িয়ে থাকাটা উচিত মনে করল না, ঘুরে ছুট লাগাল।
আবার আড়াল ছেড়েছে রানা, প্রতিপক্ষের দ্বিতীয় হুইলার টার্গেট করে গুলি করছে। মারা পড়ল ওটার ড্রাইভার আর তার পাশে-বসা গার্ড, লক্ষ্যভ্রষ্ট কয়েকটা বুলেট ছুটে এল ওদের সঙ্গীদের পক্ষ থেকে। রাইফেলের নল ঘোরাল সোহেল, দ্বিতীয় হুইলারের গার্ডদেরকে শিক্ষা দিতে চায়। ট্রিগারে টান দিচ্ছে।
সারওয়ারের গার্ডরা বুঝে গেছে, আসলে ফাঁদে পড়ে গেছে ওরা–রানা আর ওর দুই সঙ্গী আগে থেকেই পজিশন নিয়ে থাকায় সুবিধাজনক অবস্থায় আছে ওরা। তা ছাড়া ওরা গার্ড, সৈন্য না-ওদেরকে সারওয়ার এমন বিশেষ কিছু দেয় না যার কারণে জীবন উৎসর্গ করতে হবে নোকটার জন্য।
অস্ত্র ফেলে ছুট লাগাল ওরাও।
আড়াল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল লামিয়া, একলাফে চড়ে বসল ড্রাইভিংসিটে। দেরি না করে হুইলারে উঠল সোহেলও। রানা ছুটে গিয়ে নিয়ে এল মারা-পড়া গার্ডদের কয়েকটা রাইফেল। রিভার্স গিয়ারে দিয়ে বাহনটাকে পিছিয়ে নিল লামিয়া, তারপর অন্য দুটোকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এল টানেলের বাইরে। ঢুকে পড়ল নতুন একটা টানেলে, ছুটছে সগর্জনে।
.
বোটের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে লুত্যর হোসেইনি, হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্লান্টের দিকে তাকিয়ে আছে নাইট ভিশন গগসের মাধ্যমে। কয়েক ঘণ্টা হয়ে গেছে ওখানে গিয়ে ঢুকেছে রানা, সোহেল আর লামিয়া।
প্লান্ট ছেড়ে মিনিট চল্লিশেক আগে চলে গেছে হেলিকপ্টারটা। পানির স্রোত অনেক বেড়েছে হাইড্রোচ্যানেলে, ওটাকে স্রোতা নদী বলে মনে হচ্ছে এখন।
ওই তিনজনের কোনও পাত্তা নেই।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হোসেইনির দুশ্চিন্তা। এবং সেটা শুধু ওর বন্ধুদের জন্যই না। সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছে সে, জানে কোনও ব্যর্থ হামলার পরিণতি কী। সন্দেহ নেই, পাল্টা হামলার শিকার হয়েছে ওর বন্ধুরা।
ওদের কেউ যদি গ্রেপ্তার হয়ে থাকে, তা হলে ইতোমধ্যে নির্যাতন শুরু হয়ে গেছে; সে-বেচারা হাল ছেড়ে দেয়ার আগপর্যন্ত তা চলতেই থাকবে। অন্য কারা সাহায্য করেছে, জানতে চাইবেই সারওয়ার। তখন বেরিয়ে আসবে হোসেইনির নাম। তারমানে, নিকট ভবিষ্যতে কপালে খারাপি আছে সেইনির।
সারওয়ারের লোকেরা খুঁজে বের করবে হোসেইনিকে। তারপর ওকে খুব সম্ভব খুন করে ফেলবে। ধরেও নিয়ে যেতে পারে, কয়েদ করে রাখতে পারে গোপন কোনও জায়গায়।
তারমানে এখন কয়েক জায়গায় ফোন করার সময় হয়েছে। এই কলগুলো আগেই করা উচিত ছিল হোসেইনির, সোহেল যখন সাহায্যের জন্য গিয়েছিল ওর কাছে তখন।
প্রথম তিন-চারজন ওর কথা শুনেই লাইন কেটে দিল, বিদায় বলার প্রয়োজনটুকু বোধ করল না।
একটু বোঝার চেষ্টা করো, ইজিপ্ট অ্যান্টিটেরোরিস্ট ব্যুরোয় আছে হোসেইনির এক বন্ধু, ফোনে লোকটাকে বলল সে প্রাথমিক কথাবার্তার পর, এমন কয়েকজনকে চিনি আমি যারা কথা বলতে চায়, কিন্তু ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না
তোমারই মতো। ওরা আমাকে বলেছে, ইউরোপিয়ানদের উপর হামলা করতে যাচ্ছে সারওয়ার। লিনোসার ঘটনাই সেটা প্রমাণ করে। ওই লোক এবং ওর প্রতিষ্ঠান আমেনথেস, লিবিয়ায় যা ঘটছে তার পেছনে আছে। সময় থাকতেই ঠেকাতে হবে ওকে, নইলে একসময় মিশরকেও নিজের কজায় নিয়ে নেবে সে।
আমি কী করব?
ওই প্রান্টের ভিতরে ঢুকে পড়তে হবে আমাদেরকে। ভণ্ডুল করে দিতে হবে ওদের পরিকল্পনা।
ফোনের ও-প্রান্তে নীরবতা।
যা করার জলদি করতে হবে আমাদেরকে, তাড়া দিল হোসেইনি। সকাল হয়ে গেলে দেরি হয়ে যাবে অনেক।
প্রাক্তন কমাণ্ডো, আর্মিতে বর্তমানে কর্মরত অফিসার, সেনাবাহিনী ছেড়ে রাজনীতিবিদ বনে-যাওয়া একসময়ের বন্ধু-একের পর এক অনেকের সঙ্গে প্রায় একই কথা বলল হোসেইনি। এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হলো অনেককেই।
একটা স্পেশাল কমাণ্ডো গ্রুপের দায়িত্বে থাকা একজন কর্নেল রাজি হলো ওর দল নিয়ে আসতে। কয়েকজন রাজনীতিবিদ বলল, ওরা ওই কমাণ্ডো অভিযান সমর্থন করবে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন বন্ধু আশ্বাস দিয়ে বলল, কমান্ডোদের সাহায্য করার জন্য একদল এজেন্ট পাঠাবে।
সাহস পেল হোসেইনি। কর্নেলকে ফোন করল আবার। ভোমার লোকেরা পজিশন নিলে আমাকে জানিয়ো। ওদেরকে নেতৃত্ব দেব আমি। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হচ্ছে সারওয়ার বিন জামালের।
অধস্তনদের সামনে রানার মার খেয়ে যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। ওদের সবার চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে গেল ওই তিনজন, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না ওরা। পিছু ধাওয়া করতে গিয়েছিল কয়েকজন গার্ড, তাদের অর্ধেক মরেছে, বাকিরা জান নিয়ে পালিয়ে এসেছে কোনওরকমে।
আখতারের উপর সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে সারওয়ারের। নিজের হাতে গুলি করে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে কুত্তার বাচ্চাটাকে। এত অযোগ্য একটা লোকের উপর এতদিন চোখ-বন্ধ-করে বিশ্বাস করায় থুতু দিতে ইচ্ছা করছে নিজেরই গায়ে। যারা নির্বিষ তাদের বেলায় আখতার খুব যোগ্য। আর যারা মাসুদ রানার মতো বিষাক্ত, তাদের সামনে পাত্তাই পায় না সে আর ওর অনুচররা।
খুঁজে বের করু ওদেরকে, আখতারের সঙ্গে তুই তোকারি শুরু করল সারওয়ার। কোথায় কীভাবে খুঁজবি জানি না, ওই তিনজনকে চাই আমি। ওদেরকে না নিয়ে আমার সামনে আসবি না। যদি আসিস… বাকি কথা না বলে চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিল।
কোমরের মাঝখানটা একটু পর পর ডলছে আখতার, সারওয়ারের ভয়ে ওই জায়গায় কোনও ব্যথানাশক লাগানোরও সুযোগ পায়নি এখন পর্যন্ত। একটা কথা বলতাম…
শোল্ডার হোলস্টারে থাবা চালাল সারওয়ার, কিন্তু ম্যাগনামটা নেই সেখানে। মনে পড়ে গেল কীভাবে হারিয়েছে অস্ত্রটা, তাকাল আখতারের দিকে। দুই চোখ যেন জ্বলছে ভাটার মতো।
ওদেরকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, বলতে শুরু করল আখতার। আমার মতো তুমিও জানো এখানে শত শত টানেল আছে, আছে বড় বড় প্রাকৃতিক ফোকর আর কয়েক মাইল করে দীর্ঘ প্যাসেজওয়ে। ওগুলোর অর্ধেকেরও ম্যাপ বানাতে পারিনি আমরা এখন পর্যন্ত।
এখনও দুশ লোক আছে তোর হাতে! বুনো জন্তুর মতো গর্জন করল সারওয়ার।
প্রতিটা টানেলে যদি একজন করেও তোক পাঠাই, অর্ধেকের বেশি টানেল খালি পড়ে থাকবে। অস্ত্র ছাড়া যাবে না ওদের কেউ। একজনকে শেষ করতে অসুবিধা হবে না ওদের তিনজনের। এখানে রেডিও কাজ করে না। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের কোনও উপায় নেই আমাদের। আমরা বোকামি করলে ওদের অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছু হবে না।
মানে! ওদেরকে ছেড়ে দিতে চাস তুই?
হ্যাঁ, শান্ত গলায় বলল আখতার।
চুপ হয়ে গেল সারওয়ার, ওর রাগ প্রশমিত হচ্ছে আস্তে আস্তে। বুঝতে পারছে আসলেই কিছু বলার আছে। আখতারের।
এখান থেকে বের হওয়ার পথ আছে পাঁচটা, বলে চলল আখতার। পাম্পিংস্টেশনের নিচে আছে দুটো, ওখানে কড়া পাহারা আছে। বাকি তিনটা, ইচ্ছা করলেই, কড়া পাহারার আওতায় আনতে পারি আমরা। আমার কথা হলো, কষ্ট করে খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার দরকার কী? গুহাব্যবস্থা থেকে বের হতে না পারলে না-খেতে পেয়ে হয় আত্মসমর্পণ করবে ওরা, নইলে মরবে।
এখনও চুপ করে আছে সারওয়ার, ভাবছে।
সিংহের গুহায় ঢুকে পড়াটা হয়তো কঠিন কিছু না, বলছে আখতার, কিন্তু সিংহ নিজেই যদি বসে পড়ে গুহামুখের কাছে, যে ঢুকল সে কি আর কখনও বের হতে পারবে?
রাগ কমে গেছে সারওয়ারের। এখান থেকে বের হওয়ার আরও পথ যদি থাকে?
জোর দিয়ে বলব না আরও পথ নেই। তবে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। গত একটা বছর ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে মাত্র পাঁচটা বের করেছি আমরা, ওরা রাতারাতি বের করতে পারবে আরেকটা? আর করলেই বা কী? ওরা মরুভূমিতে হাজির হওয়ামাত্র ধরা পড়ে যাবে আমাদের চোখে।
ওদের লাশ নিজচোখে দেখতে চাই আমি।
তা হলে ও-রকম আদেশই দিচ্ছি আমার লোকদের।
মনে রেখো, এ-ই তোমার শেষ সুযোগ। যদি ব্যর্থ হও, স্রেফ খুন হয়ে যাবে আমার হাতে।
.
২৭.
কোন্ টানেল থেকে কোন্ টানেলে গিয়ে ঢুকছে, তারপর হাজির হচ্ছে কোন্ ফোকরে, বলতে পারবে না লামিয়া। শুধু ছুটছে ওর ফোর হুইলার-অবিরাম।
গত কয়েকটা টানেলে পথ আস্তে আস্তে উঠেছে উপরের দিকে। মনে হচ্ছে, ছাদ আর জমিনের মাঝখানের ফারাকটা কমছে দ্রুত। শেষে এমন একজায়গায় হাজির হলো ওরা, যেখান দিয়ে বের হওয়ার উপায় আছে বটে, কিন্তু হুইলার চালিয়ে তা করতে পারবে না লামিয়া। কারণ অনতিদূরে পথ রোধ করে দিয়েছে বড় একটা বোল্ডার।
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল মেয়েটা, রিভার্স গিয়ারে দিল হুইলারটা। গ্যাসপ্যাডেলের উপর চাপ বাড়াতে যাচ্ছে।
এত তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, বলল রানা। কেউ আমাদের পিছু ধাওয়া করছে না।
কথাটা ঠিক। পেছনে আলোর নাচন নেই কোনও, নেই ইঞ্জিনের গর্জন। পেছনে শুধুই অন্ধকার আর নীরবতা।
হতাশ হয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল মিয়া, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমরা মনে হয় হারিয়ে গেছি টানেলের গোলকধাঁধায়। কোত্থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম, কোথায় এসে হাজির হয়েছি, কিছুই বুঝতে পারছি না।
হারিয়ে গেছি ভাবাটা কাজের কথা না, হুইলার থেকে নামল রানা। বরং ভাবো, পথ খুঁজে নেয়ার নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে আমাদের সামনে।
ওর দিকে তাকিয়ে থাকল লামিয়া কয়েকটা মুহূর্তের জন্য। কী ভাবছে, সে-ই জানে।
চল গিয়ে দেখি ওই বোল্ডারের আড়ালে কী আছে, বলল সোহেল, হুইলার ছেড়ে নেমে পড়েছে।
যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে মুখ করে ঘুরিয়ে রাখল লামিয়া হুইলারটাকে। তারপর চলল রানা আর সোহেলের সঙ্গে।
এত ভালো হুইলার চালানো শিখলে কোথায়? সপ্রশংস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রানা।
বাবার কাছে। ইটালির পাহাড়ে-পর্বতে হুইলার চালানোর নেশা ছিল তাঁর। আমি এখনও সুযোগ পেলে হুইলার নিয়ে ছুটে বেড়াই ওসব জায়গায়।
বোল্ডারটা পার হলো সোহেল। সরু আর খাটো একটা ফোকর দেখা যাচ্ছে সামনে, ঢুকতে হলে মাথা নিচু করতে হবে। সঙ্গে করে আনা ফ্ল্যাশলাইট হালাল ও, আলো ফেলেছে ফোকরের ভিতরে। কিছুক্ষণ দেখে বলল, ইন্টারেস্টিং।
ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা আর লামিয়া। নিজের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাল মেয়েটাও।
যে-ফোকরের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে আছে ওরা সেটা অনেক বড়। ভিতরটা, দেখে মনে হচ্ছে, বাতিল গাড়ির কোনও গ্যারেজ। প্রতিটা গাড়িই অদ্ভুত। লম্বা আর নিচু হুড সবগুলোর, কোনওটারই ছাদ নেই। প্রায় হুডের সমান উঁচু বিশাল বিশাল চাকা দেখা যাচ্ছে সবগুলোতে। সামনের আর পেছনের সিটের সঙ্গে বিশেষ কায়দায় আটকানো আছে ভারী মেশিনগান।
এদিকওদিক আলো ফেলছে লামিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমলের কিছু?
পা বাড়াল রানা।
ভিতরে ঢুকে বোঝা গেল, ফোকরটা আকারে এয়ারক্র্যাফ্ট-হ্যাঙারের সমান। নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা অদ্ভুত গাড়ির মোট সংখ্যা সাত। পাহাড়ি দেয়ালের জায়গায় জায়গায় কংক্রিটের আস্তরণ। ছাদ যাতে ধসে না পড়ে সেজন্য জমিন থেকে-ছাদ-পর্যন্ত উঁচু ইস্পাতের থাম দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো। গাড়িগুলোর চাকা নিঃশব্দে বলে দিচ্ছে, সাধারণ জমিনের বদলে বালির উপর দিয়ে চলার জন্য বানানো হয়েছে ওগুলো।
একটা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল রানা। ওটার একপাশে ঝালাই করে আটকে দেয়া হয়েছে রূপা-দিয়ে-বানানো ঈগল পাখির প্রতীক। ধুলো পুরু হয়ে জমেছে প্রতীকটার গায়ে। আঙুল দিয়ে ধুলো মুছল রানা। ইটালির তিন রঙ, মানে সবুজ, সাদা আর লাল সমানভাবে দেখা যাচ্ছে ঈগলটার গায়ে।
ও-রকম আরও একটা প্রতীক দেখা যাচ্ছে গাড়ির বড়িতে, একটু দূরে। ধুলো সরানোর পর দেখা গেল কুঠার সংযুক্ত অবস্থায় কতগুলো লাকড়ি খোদাই করা আছে রূপার পাতটার গায়ে। লাকড়িগুলোর উপর দেখা যাচ্ছে একটা সিংহের মাথা।
সিম্বল অভ দ্য ফ্যাসিস্ট, বলল লামিয়া, রানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এসব গাড়ি মুসোলিনির।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে ইটালিয়ান মিলিটারির একটা ইউনিট এসেছিল, বলল রানা।
কিন্তু ইতিহাস বলছে, যুদ্ধের সময় ইটালি সেনাবাহিনী পৌঁছাতে পারেনি কায়রোতে, প্রতিবাদ করল লামিয়া।
এ-পর্যন্ত যে এসেছিল তা তো নিজচোখেই দেখছি, বলল রানা। আবার, এমনও হতে পারে, এই গাড়িগুলো ওদের কোনও অগ্রগামী দলের। এদিকওদিক তাকাচ্ছে, ফ্ল্যাশলাইট নিয়েছে লামিয়ার হাত থেকে।
স্পেয়ার পার্টস, খালি ক্যান, অস্ত্রপাতি আর অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস পড়ে আছে ছড়িয়েছিটিয়ে।
আর পড়ে আছে একটা লাশ–দুটো গাড়ির মাঝখানে।
পায়ে পায়ে লাশটার কাছে এগিয়ে গেল ওরা তিনজন।
কঙ্কালটার পরনে ইটালি সেনাবাহিনীর উর্দি; কালের ছোবলে ওটা বিবর্ণ আর মলিন হয়ে গেছে, ছিঁড়ে গেছে কোনও কোনও জায়গায়। কঙ্কালের একহাতে একটা পিস্তল। ওটা থেকে একটু দূরে, জমিনের উপর, কিছু ছাই–পোড়ানো হয়েছিল কতগুলো কাগজ।
উবু হয়ে বসে পড়ল রানা।
একটা নোটবুক দেখা যাচ্ছে কঙ্কালের আরেকপাশে। ওটা তুলে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল, খুলে পাতা উল্টাল। কে বা কারা যেন ছিঁড়ে নিয়ে গেছে বেশিরভাগ পাতা। চিঠির মতো কিছু একটা লেখা আছে এক পাতায়।
নোটবুকটা লামিয়ার হাতে তুলে দিল রানা।
…পানি প্রায় সরে গেছে, ইটালিয়ান ভাষায় লেখা চিঠিটা অনুবাদ করে পড়ে শোনাচ্ছে লামিয়া, তিন সপ্তাহ হতে চলল এখানে আছি আমরা। ডের্ট ফক্স নামে পরিচিত জার্মান ফিল্ড মার্শাল এরইন রোমেলের অধীনে ছিল আমাদের অনেক কোয়ালিশন সৈন্য, মিশর থেকে ইংরেজরা খেদিয়ে দিয়েছে মরুশেয়ালকে, মারা পড়েছে আমাদের বহু লোক। আমরা যারা লুকিয়ে আছি তাদের অনেকেই বলাবলি করছিল বাইরে গিয়ে লড়াই করার কথা। কিন্তু যে-যুদ্ধের পরিণতি পরাজয়, তাতে অংশ নিয়ে কী লাভ? গোপন একটা পথ ধরে ওদেরকে চলে যেতে বলেছি আমি। ওদের কেউ ধরা পড়লে গুপ্তচরের মতো গুলি করে মারা হবে তাকে… পড়া থামাল লামিয়া।
গোপন পথ, বলল সোহেল।
নোটবুকের পাতা উল্টাচ্ছে লামিয়া, একজায়গায় থামল। …এখনও আমাকে খুঁজে পায়নি শত্রুপক্ষ। কিন্তু ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানোরও কোনও উপায় নেই। টানেলটা উড়িয়ে দিয়েছি। ইংরেজরা ভিতরে ঢুকতে পারবে না, আমাদের গাড়িগুলোরও খোঁজ পাবে না। আমি গুরুতর আহত। নাকমুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। ইচ্ছা করলে পিস্তলের একগুলিতে আমার সব যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে পারি। কিন্তু করব না কাজটা। আত্মহত্যা করা মহাপাপ। পিপাসা লেগেছে খুব। মরণপিপাসা…
এই গাড়িগুলো এখানে আনতে টানেল বানিয়েছিল ওরা, বলল সোহেল। এবং সেটা কাছেপিঠেই কোথাও আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের এই ইটালিয়ান বন্ধু নিজেই বলছে, টানেলটা উড়িয়ে দিয়েছিল সে।
ওটা খুঁজে পেলে বাইরে বের হওয়ার কোনও-না-কোনও কায়দা করতে পারব, বলল লামিয়া।
কাজটা উচিত হবে না, বলল রানা।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রানার দিকে তাকাল লামিয়া।
আমাদেরকে ধাওয়া করা বাদ দিয়েছে সারওয়ারের লোকেরা, বলছে রানা। দুটো কারণে ধাওয়া বন্ধ করতে পারে ওরা। হয় জানে, এই গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়ার কোনও পথ নেই, নয়তো যতগুলো পথ আছে সবগুলোর বাইরে ইতোমধ্যে পাহারা বসিয়েছে সারওয়ার।
ইঙ্গিতে আশপাশ দেখাল সোহেল। এখন আর অস্ত্রপাতির অভাব নেই আমাদের। ওরা ধরে নেবে সামান্য কয়েকটা রাইফেল আর একটা ফোর হুইলার নিয়ে বের হব আমরা। কিন্তু আসলে বের হব ভারী অস্ত্রে সজ্জিত আর্মার্ড কার নিয়ে।
হোসেইনি বলেছে সারওয়ারের নিজস্ব আর্মি আছে, সোহেলের দিকে তাকিয়ে বলল লামিয়া। তারমানে ওর ট্যাঙ্ক বা হেলিকপ্টারও থাকতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমলের এই গাড়িগুলো নিয়ে টিকতে পারব কি না ওগুলোর বিরুদ্ধে, সন্দেহ আছে আমার।
দন্তবিকশিত হাসি দেখা গেল সোহেলের। রানা সঙ্গে থাকলে নরকে ছুঁ মেরে আসতেও আপত্তি নেই আমার।
হাসল লামিয়াও, উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকাল রানার দিকে। আমারও।
.
ফ্রান্সের দিনান শহরটা ছবির মতো।
ঠিকানা খুঁজে মাদাম কারলিতার বাড়িতে হাজির হলো আসিফ আর তানিয়া। বাড়িটা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন মাদাম কারলিতা। জীবনের শেষ দিনগুলো এখানে কাটিয়েছেন অ্যাডমিরাল, যার সঙ্গে চিঠি চালাচালি হয়েছিল মিস্টার ডিসুজার পূর্বপুরুষ এটিনের। ম্রাট নেপোলিয়নের সঙ্গে দেখা করে ফেরার পর এই বাড়িতেই অথবা দিনান শহরেরই কোথাও রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন দুর্ভাগা অ্যাডমিরাল।
শহরের মতো বাড়িটাও ছিমছাম আর সুন্দর। দোতলা থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে লতানো ফুলগাছ। উজ্জ্বল লাল আর নীল রঙের অনেকগুলো ফুল ফুটে আছে গাছগুলোতে।
আসিফ কলিংবেলে দুবার চাপ দেয়ার পর দরজা খুলে দিলেন এক বৃদ্ধা, বয়স নব্বইয়ের বেশি হবে।
ইংরেজি আর ফ্রেঞ্চ মিলিয়ে শুরু হলো ওদের কথোপকথন।
গুড ডে, বলল তানিয়া। আপনিই মাদাম কারলিতা?
হ্যাঁ। আপনারা?
নিজেদের পরিচয় দিল তানিয়া, কেন এসেছে জানাল।
ভিতরে আসুন, আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন মাদাম কারলিতা। এ
ওদের দুজনকে নিয়ে গিয়ে কিচেনটেবিলে বসালেন ভদ্রমহিলা। রাঁধছিলেন তিনি, রান্নাঘরের বাতাসে খাবারের সুবাস। পাউরুটি সেকা হয়েছে, এপ্রিকট আর ব্লুবেরি ফল মিলিয়ে বানানো হয়েছে একধরনের চাটনি।
আমার এখানে মেহমান আসে না তেমন একটা, বললেন মাদাম কারলিতা। আপনারা আসায় খুশি হয়েছি। হাতের কাজ সেরে খাবারের প্লেট আর ডিশগুলো নিয়ে বসে পড়লেন অতিথিদের সঙ্গে।
যার যার প্লেটে খাবার তুলে নিল ওরা।
আমার দাদার কাছে ছিল চিঠিগুলো, আসল প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন মাদার কারলিতা। তবে এই ব্যাপারে মুখ খোলেননি কখনওই। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে বাবা খুঁজে পান ওগুলো।
অ্যাডমিরালের কিছু জিনিস বেচার চেষ্টা করেছিলেন আপনি, বলল তানিয়া।
করেছিলাম, অনেক বছর আগে। টাকাপয়সার টানাটানি চলছিল তখন। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর বেশ অসুবিধায় পড়ে যাই। অ্যান্টিক ভ্যালু আছে এ-রকম যে কোনওকিছু বেচাকেনার হুজুগ চলছিল সে-সময় ফ্রান্সে। ভাবলাম, অ্যাডমিরালের কয়েকটা জিনিস নিলামে তুলে দেখি কী হয়।
চিঠিগুলো বেচতে পেরেছিলেন?
না। লোকে বাটপার মনে করল আমাকে। ভাবল, নেপোলিয়নের একজন অ্যাডমিরালের নামে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি অন্য কারও চিঠি।
তারপর?
হতাশ হয়ে ওগুলো দিয়ে দিলাম একটা লাইব্রেরিতে। নিজের কাছে রেখে কী করব? সঙ্গে দিয়েছি কয়েকটা পুরনো বই আর কিছু পেইন্টিংস।
তানিয়ার সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল আসিফ। কোন লাইব্রেরি?
আমাদের শহরেরই, আবার কোনটা?
ওটা কি আজ খোলা পাব?
হাসলেন মাদাম কারলিতা। বন্ধ থাকার কারণ দেখি না।
.
লাইব্রেরিটাকে ফ্রান্সের ইতিহাস আর দুপ্রাপ্য বইয়ের একটা সংগ্রহশালা বলা চলে। দিনানকে চিরে দিয়ে বয়ে চলা একটা নদীর একতীরে ওটার অবস্থান।
স্টাফরা গোমড়ামুখো, কিন্তু সাহায্য করছে। আসিফ আর তানিয়া কী দেখতে চায় জানার পর ওদেরকে বিল্ডিঙের পেছনদিকের একটা সেকশনে নিয়ে গেলেন প্রোক্টর। মাদাম কারলিতার দানকরা জিনিসগুলো এখানে আছে।
চিঠিগুলোকে তেমন মূল্য দেয়নি কেউ, বলছেন প্রোক্টর। পেইন্টিংসগুলোও, বোদ্ধাদের দৃষ্টিতে, অর্থহীন। স্মৃতি হাতড়ে কিছু যুদ্ধের দৃশ্য এঁকেছেন অ্যাডমিরাল-যদি আসলেই সেগুলো তাঁর আঁকা হয়ে থাকে। কথাটা বললাম, কারণ অনেকেই মানতে রাজি না, আঁকার হাত ছিল অ্যাডমিরালের। তা ছাড়া ছবিগুলোর নিচেরদিকে কারও কোনও স্বাক্ষর নেই।
তা হলে রাখলেন কেন ওগুলো? জিজ্ঞেস না করে পারল না তানিয়া।
নিজেদের সংগ্রহের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য। …চলুন, অ্যাডমিরালের তথাকথিত জিনিসগুলো দেখাই।
প্রথমেই পুরনো বইগুলোর উপর নজর দিল আসিফ তানিয়া। টলেমিক গ্রিকের উপর কিছু রেফারেন্স বই দেখা যাচ্ছে, মিশরে ব্যবহৃত অনেক ভাষার মধ্যে এটা একটা। ব্যাপারটা আশাব্যঞ্জক, কারণ লিপিফলক অনুবাদের কাজ করেছেন অ্যাডমিরাল আর এটিন দুজনই।
যুদ্ধের উপর গবেষণামূলক আলোচনা-গ্রন্থ পাওয়া গেল কয়েকটা। অখ্যাত এক ফরাসি লিখেছেন ওগুলো।
সবগুলো বইয়ের পাতা উল্টাল তানিয়া, কিন্তু কোনও বইয়ের কোনও পাতার মার্জিনেই কিছু লেখা নেই। ছিঁড়েও নেয়া হয়নি কোনও পাতা। এমনকী অন্য কোনও পাতা খুঁজেও রাখা হয়নি কোনও বইয়ের ভিতরে।
চিঠিগুলো দেখা যাবে? প্রোক্টরকে বলল আসিফ।
ফটো অ্যালবামের মতো দেখতে একটা বই হাতে নিলেন প্রোক্টর, বাড়িয়ে দিলেন আসিফের দিকে। ওটা খুলল সে। প্ল্যাস্টিকের আলাদা আলাদা শিটে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে দুশ বছরের পুরনো কয়েকটা চিঠি। ফাউন্টেন পেন অথবা পাখির পালক ব্যবহার করে লেখা হয়েছে ওগুলো।
চিঠির সংখ্যা মাত্র পাঁচ, বললেন পোক্টর। অ্যাডমিরাল বোধহয় লেখালেখি করতেন না তেমন একটা। সব মিলিয়ে মোট সতেরো পৃষ্ঠা।
অ্যালবামটা নিয়ে এককোনার একটা জানালার ধারে বসে পড়ল আসিফ আর তানিয়া। ওদের মাথার উপরের বাতিটা জ্বালিয়ে দিলেন প্রোক্টর। সঙ্গে করে আনা নোটবুক খুলল তানিয়া।
সবগুলো চিঠি লেখা হয়েছে ফরাসি ভাষায়, বলাবাহুল্য। ভাষাটা মোটামুটি জানে তানিয়া, পড়তে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না।
তুমি এক কাজ করো, ওকে বলল আসিফ। চিঠিগুলো পড়তে থাকো। সেই ফাঁকে পেইন্টিংসগুলো দেখে আসি আমি।
কিছু না বলে শুধু মাথা ঝাঁকাল তানিয়া।
কী করতে চায়, তা প্রোক্টরকে জানাল আসিফ।
ওকে নিয়ে চললেন তিনি। একটা করিডোর ধরে এগিয়ে গিয়ে হাজির হলেন ওটার শেষমাথায়। পকেট থেকে চাবি বের করে খুললেন বড় একটা কেবিনেটের দরজা।
ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের ফ্রেমেবাধা পেইন্টিংস আছে কেবিনেটটার ভিতরে। সমান্তরালভাবে বিন্যস্ত আলাদা আলাদা র্যাকে রাখা আছে ওগুলো।
এতগুলো ছবি এঁকেছেন অ্যাডমিরাল?
মাত্র তিনটা, বললেন প্রোক্টর। আর আবারও মনে করিয়ে দিই, ওগুলো যে তারই আঁকা, তার কিন্তু কোনও প্রমাণ নেই।
না থাকুক। আমি দেখব।
সাবধানে টান দিয়ে প্রথম পেইন্টিংটা বের করলেন প্রোক্টর। সাধারণ হার্ডউডে আঁকা ছবিটা রাখলেন একটা ইয়েলে, বাকি দুটো বের করার জন্য কেবিনেটের দিকে এগিয়ে গেলেন আবার। পুরনো হয়ে গেছে প্রতিটা ফ্রেমই, ক্ষয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়।
ফ্রেমগুলো কি আসল?
অবশ্যই। এবং সম্ভবত পেইন্টিং-এর চেয়ে বেশি দামি। বাকি পেইন্টিং দুটোও রাখলেন দুটো আলাদা ইয়েলে।
একটা লাইট জ্বালাল আসিফ, মনোযোগ দিল অ্যাডমিরালের চিত্রকর্মের উপর। এসব অত ভালো বোঝে না সে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তৈলচিত্র, কোনও কোনও জায়গায় প্রয়োজনের চেয়ে ঘন মনে হচ্ছে ব্রাশের ছোপ। কালার কম্বিনেশন যাচ্ছেতাই।
প্রথম পেইন্টিংটা, কাঠ দিয়ে বানানো একটা যুদ্ধজাহাজের তিন চতুর্থাংশের। এমনভাবে আঁকা হয়েছে যে, জাহাজটা দ্বিমাত্রিক মনে হচ্ছে। হতে পারে অ্যাডমিরাল অপটু হাতে এঁকেছেন বলে অমন হয়েছে। আবার হতে পারে, খুব তাড়াহুড়ো করেছেন তিনি ছবিটা আঁকার সময়।
দ্বিতীয় পেইন্টিং ধুলোধূসরিত একটা রাস্তার, সেখানে রাত ঘনিয়েছে। ঘন দিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে আছে রাস্তাটা; দুধারে বাড়িগুলোর দরজা ভিতর থেকে শক্ত করে আটকানো। কোথাও কোনও মানুষ দেখা যাচ্ছে না। ডানদিকে, এককোনায় ত্রিভুজাকৃতির কী যেন দেখা যাচ্ছে; আসিফের মনে হলো রাস্তা থেকে দূরের কোনও সমতলভূমি।
তৃতীয় পেইন্টিং-এ একটা লংবোটের দাঁড় প্রাণপণে বাইতে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন লোককে।
ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে আসিফ, কোনও যোগসূত্র আছে কি না ভাবছে, এমন সময় প্রোক্টরের নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকল ফ্রন্টডেস্কের মেয়েটা।
আসছি আমি, অন্যমনস্ক আসিফকে কথাটা বলে সরে গেলেন প্রোক্টর।
ইযেল তিনটার দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আসিফ, কিন্তু বিশেষ কিছু বুঝতে পারল না। গিয়ে হাজির হলো তানিয়ার কাছে। চিঠি পড়ে কিছু জানা গেল?
মাথা নাড়ল তানিয়া। আসলে এগুলোকে চিঠি বলা যায় কি না, তা নিয়েই সন্দেহ আছে আমার। তারিখ আছে, কিন্তু স্বাক্ষর নেই। বিশেষ কাউকে সম্বোধন করে লেখা হয়নি একটা চিঠিও। ফ্রেঞ্চ যতটুকু জানি, মনে হচ্ছে অসংলগ্ন কথা বলেছেন অ্যাডমিরাল। এবং একই কথা বার বার বলেছেন।
জার্নালের মতো?
কী জানি কীসের মতো! লোকে স্বগতোক্তি করে; মনে হচ্ছে হাতের কাছে কাগজ, কলম আর কালি পেয়ে এবং করার মতো কোনও কাজ না-থাকায় তা-ই করেছেন অ্যাডমিরাল। বিশেষ একটা চিঠি দেখাল তানিয়া। এটাতে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়েছে। মূল কথা: একটা সমৃদ্ধ রিপাবলিককে ব্যক্তিগত সাম্রাজ্যে পরিণত করে দেশটার বারোটা বাজাতে চলেছেন তিনি। আরেকটা চিঠি দেখাল। এটাতে নেপোলিয়নকে বলা হয়েছে বিরাট একটা ঘোড়ায় চড়ে-বসা পুঁচকে এক লোক।
খামোকা সাতবার ছুরি খাননি অ্যাডমিরাল, মন্তব্য করল আসিফ।
লিবিয়া থেকে প্লেনে করে ফ্রান্সে আসার সময় ল্যাপটপের সাহায্যে ইন্টারনেটে কানেক্টেড হয়েছিল আসিফ আর তানিয়া। ই-মেইল পাঠিয়ে রানা জানিয়ে দিয়েছিল, কোথায় যেতে হবে ওদেরকে, কার সঙ্গে দেখা করতে হবে। তারপর নুমার ওয়েবসাইটে লগইন করে ওরা, জানতে পারে আরও অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য। শেষে পুরো প্লেনযাত্রার সময়টাতে নেট ঘাটাঘাটি করে বিস্তারিত জেনে নেয় অ্যাডমিরালের ব্যাপারে।
দেশটাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন নেপোলিয়ন, তৃতীয় একটা চিঠি পড়ে আসিফকে শোনাচ্ছে তানিয়া। ও রকম মাথামোটা এক লোক দেশের জনগণের ওপর সওয়ার হলো কী করে, বুঝি না! সাহায্যের হাত বাড়াতে চাইলাম, কী চোটপাটটাই না করলেন তিনি আমার সঙ্গে। তিনি কি বুঝতে পারেননি কী দিতে চেয়েছি আমি তাঁকে? ঈশ্বরের রোষ আর পাওয়া হলো না তার।
ঈশ্বরের রোষ?
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল তানিয়া, কিছু বলল না।
এসো তো আমার সঙ্গে!
জরুরি কিছু একটা ছিল আসিফের কণ্ঠে, ওর দিকে মুখ তুলে তাকাতে বাধ্য হলো তানিয়া। ততক্ষণে ঘুরে পেইন্টিংগুলোর উদ্দেশে হাঁটা ধরেছে আসিফ।
ইযেলগুলোর সামনে গিয়ে থামল সে।
ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল তানিয়া। কিছুক্ষণ দেখার পর বলল, কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
ঈশ্বরের রোষ, বলল আসিফ।
কীসের নাম ওটা? যুদ্ধজাহাজের?
আঙুল তুলে রাস্তার ছবিটা দেখিয়ে দিল আসিফ। অনেক আগে এক যাজকের সঙ্গে খাতির ছিল আমার। ওল্ড টেস্টামেন্টের বেশকিছু কাহিনি শুনিয়েছে সে আমাকে। …দেখো, ওটাই ঈশ্বরের রোষ।
ছবিটা দেখল তানিয়া, কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না। অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকাল স্বামীর দিকে।
ওটা মিশরের কোনও একটা রাস্তার পেইন্টিং। দূরে তিনটে ত্রিভুজ দেখতে পাচ্ছ? প্রথমে ভেবেছিলাম ওগুলো সমতলভূমি। এখন বুঝতে পারছি, আসলে পিরামিড। সবগুলো বাড়ির দরজা দেখো লাল রঙের–আসলে ভেড়ার রক্ত লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এবার তাকাও কালো কুয়াশার ওই চাদরের দিকে। ওটাই ঈশ্বরের রোষ, ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী মিশরে নাজিল হওয়া শেষ মহামারী বা গজব। ইসরাইলিরা চাইছিল মিশর ছেড়ে চলে যেতে, অথচ ফারাও আটকে রেখেছিলেন ওদেরকে। ফলে, ওল্ড টেস্টামেন্ট বলছে, রুষ্ট হয়েছিলেন ঈশ্বর। যেসব মিশরীয় তাদের বাড়ির দরজায় ভেড়ার রক্ত লাগায়নি তারা আক্রান্ত হয়েছিল ওই মহামারীতে।
ছবিটার দিকে এখন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তানিয়া।
প্রথম দেখায় রাস্তাটা ধূলিধূসরিত মনে হয়েছিল আমার কিন্তু ওগুলো আসলে পঙ্গপাল-আরেক গজব। ভালোমতো তাকালে কিছু ব্যাঙও দেখতে পাবে…গজব নম্বর তিন।
ঈশ্বরের রোষ… বিড়বিড় করছে তানিয়া, …কালো কুয়াশা। ঝট করে তাকাল আসিফের দিকে। তারমানে একইসঙ্গে ছবি এঁকে আর চিঠি লিখে নিজের কথা বলে গেছেন অ্যাডমিরাল?
মাথা ঝাঁকাল আসিফ। হতে পারে।
একদৌড়ে চিঠির অ্যালবামটা নিয়ে এল তানিয়া। বিশেষ একটা চিঠি পড়তে লাগল, সব ক্ষমতা আছে ওই জাহাজে। মুক্তির চাবিকাঠি আছে ওটাতে। আঙুল তুলে দেখাল যুদ্ধজাহাজের পেইন্টিং।
কিছু বলল না আসিফ। কী যেন গড়বড় লাগছে ওর কাছে। কী সেটা? পেইন্টিংগুলো? নাকি চিঠি? বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে কোথায় যেন গেছেন প্রোক্টর, ফিরছেন না কেন তিনি?
আরেকটা চিঠি বের করল তানিয়া। এটা ছবির সঙ্গে সবচেয়ে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে আমার। তারিখ অনুযায়ী যদি বিবেচনা করি, এই চিঠি লেখা হয়েছে বাকিগুলোর পরে। আর বিষয়বস্তু অনুযায়ী, এটা লেখা হয়েছে এটিন ডিসুজাকে, যদিও সম্বোধন বা স্বাক্ষর কোনওটাই নেই। খুক করে গলা পরিষ্কার করে পড়তে শুরু করল, …আমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইছে না এজেন্ট লোকটা। যা বলছি তা প্রমাণ করে দেখাতে বলছে ওকে। আরও বলছে, আমি নাকি অপরাধী হয়ে আছি নেপোলিয়নের কাছে। যদি দায়মুক্তি চাই, যা প্রস্তাব করেছি তার জন্য কোনও বিনিময় আশা করা যাবে না। কী করি এখন? এদিকে নতুন এক শঙ্কা ভর করেছে আমার মনে। বিশেষ সেই অস্ত্র যদি তুলে দিই নেপোলিয়নের হাতে, কী করবেন তিনি সেটা দিয়ে? আমি জানি পুরো পৃথিবীটাও যথেষ্ট তাঁর জন্য। তা হলে কি সত্যি চাপা থাকাই ভালো? তা হলে কি ওই অস্ত্র নৌকায় করে কোথাও পাঠিয়ে দেয়াই উচিত?
পড়া শেষ তানিয়ার। লংবোটের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে এখন। ছবিটা দেখছে আসিফও।
কী ভাবছ? জিজ্ঞেস করল আসিফ।
এটিন ডিসুজা যা পাঠিয়েছিলেন অ্যাডমিরালের কাছে, তা লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। তবে আমার ধারণা, হাতের নাগালেই কোথাও রেখেছিলেন।
তাড়াহুড়ো করে আঁকা ছবি…অথচ ছবি-আঁকিয়ে হিসেবে কেউ কখনও উচ্চারণ করেনি অ্যাডমিরালের নাম। তিনি জানতে চেয়েছেন, সত্যি চাপা থাকাই কি ভালো? তারমানে এই ছবিগুলোতেই কি চাপা দিয়ে রেখেছেন তিনি সত্যটা?
জবাব না দিয়ে মহামারীর ছবিটার দিকে এগিয়ে গেল তানিয়া। ইযেল থেকে তুলল ওটাকে, উল্টাল। ফ্রেমের সঙ্গে মোটা আর বাজে একটা কাগজ সাঁটিয়ে দেয়া হয়েছে আঠা দিয়ে। ইযেলে উল্টো করে রাখল ছবিটা, পার্স থেকে বের করল একটা পকেট নাইফ। আসিফ, ছুরি দিয়ে মোটা কাগজটা কাটব আমি। ফ্রেমটা শক্ত করে ধরো।
প্রোক্টর যদি…।
যা তিনি জানেন না তা তাকে না জানালেই তো হলো, নাকি? তা ছাড়া তিনি নিজেই বলেছেন, এই পেইন্টিংগুলোর কোনও দাম নেই। …নাও, ধরো এখন।
আসিফ ফ্রেম ধরামাত্র কাগজে ছুরি চালাতে শুরু করল তানিয়া।
জলদি করো! তাড়া দিল আসিফ।
যথাসম্ভব জলদি করারই চেষ্টা করছে তানিয়া। খেয়াল রেখেছে যাতে বেশি ভিতরে ঢুকে না যায় ছুরির ফলা, তাতে ক্ষতি হতে পারে মূল পেইন্টিং-এর। ফ্রেমের গা থেকে মোটা কাগজটা অনেকখানি সরিয়ে নেয়ার পর তাকাল ভিতরে।
কিছু নেই।
কাগজটা কেটে ফ্রেম থেকে পুরো আলগা করে ফেলল তানিয়া।
না, আসলেই কিছু নেই ফ্রেম আর কাগজের মাঝখানের শূন্যস্থানে।
মুখ চাওয়াচাওয়ি করল আসিফ আর তানিয়া।
তা হলে কি সত্যি চাপা থাকাই ভালো? বলল আসিফ।
তা হলে কি ওই অস্ত্র নৌকায় করে কোথাও পাঠিয়ে দেয়াই উচিত? বলল তানিয়া।
আবারও মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ওরা, তারপর চটজলদি হাজির হলো লংবোটের ছবির কাছে। ইযেলের উপর উল্টো করল ওটাকে।
এবার আর ফ্রেম চেপে ধরার কথা বলতে হলো না আসিফকে।
জলদি করো! চাপা গলায় হুঁশিয়ার করল আসিফ। কেউ আসছে!
করিডোরে খটাখট আওয়াজ তুলেছে কারও শুর শক্ত সোল। নিয়মিত বিরতিতে হাঁটছে না সে, বরং মনে হচ্ছে ভারী কিছু বয়ে বা হেঁচড়ে আনছে যেন; কারণ খটাখট আওয়াজটা কখনও বেশি আবার কখনও কম হচ্ছে।
একটানে তানিয়ার হাত থেকে লংবোটের ছবিটা নিয়ে নিল আসিফ, কেবিনেটের ভিতরে একটা র্যাকে ঢুকিয়ে দিল ওটা।
দরজা দিয়ে ঢোকানো হলো প্রোক্টরকে।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি আসিফ আর তানিয়ার দিকে, চেহারা ভাবলেশহীন। ওভাবে তাকিয়ে থেকেই আস্তে আস্তে ঝুঁকতে শুরু করলেন সামনের দিকে, শেষে পুরো ঘর কাঁপিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন মেঝেতে।
তাঁর পিঠে আমূল ঢুকে আছে একটা ছুরি।
.
২৮.
অচেনা এক লোক দাঁড়িয়ে আছে করিডোরের দরজায়।
ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মতো বয়স তার। চেহারা আর গলার জায়গায় জায়গায় ফোস্কা, কোনও কোনওটা শুকাতে শুরু করেছে। উবু হয়ে প্রোক্টরের পিঠ থেকে টেনে ছুরিটা বের করল সে, ওটার ফলা থেকে রক্ত মুছল তাঁরই জামায়। যখন সিধে হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আরও দুই অচেনা গুণ্ডা ওর দুপাশে এসে দলে ভারী করেছে ওকে।
এবার কাজ শুরু করব আমরা, ফ্যাসফেঁসে গলায় আসিফ আর তানিয়ার উদ্দেশে বলল ফোস্কাওয়ালা।
কে তুমি? জানতে চাইল আসিফ।
কেউ কেউ আমাকে বিছা নামে ডাকে। স্করপিয়ন।
তোমার চেহারার ওই ফোস্কাগুলোর জন্য কি কোনও বিছা দায়ী?
ছুরি নাচিয়ে বুঝিয়ে দিল লোকটা ঠাট্টা-মস্করার ইচ্ছে বা সময় নেই তার। ডিসুজার ডায়েরিটা আমাদের কাছে আছে। অ্যাডমিরালের কথা অনেকবার বলেছে সে। মাদাম কারলিতাকে খুঁজে বের করতে তেমন অসুবিধা হয়নি আমাদের, শুধু একটু দেরি হয়ে গেছে।
বুঝলাম, বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে আসিফ। কিন্তু যা বুঝলাম না তা হলো, আমাদেরকে খুঁজে বের করতে গেলে কেন।
চিঠির অ্যালবামটা দাও, হাত বাড়াল বিছা।
ইশারায় তানিয়াকে জানিয়ে দিল আসিফ, গুণ্ডারা যা বলছে তা করাই ভালো। ওই অ্যালবামের আর দরকার নেই ওদের।
তানিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল আসিফ, আসলে আড়াল করল মেয়েটাকে, যাতে পকেটইফটা লুকাতে পারে। অবশ্য নয় ইঞ্চির ফলাওয়ালা যে-ছুরি দিয়ে প্রোক্টরকে খুন করেছে বিছা, সেটার মোকাবেলায় ওই পকেটনাইফ কিছু না।
অ্যালবামটা বন্ধ করে টেবিলের উপর দিয়ে বিছার দিকে ঠেলে দিল আসিফ।
হাত দিয়ে ওটার গতিরোধ করল বিছা, তুলে নিয়ে খুলে দেখল একনজর। তারপর বন্ধ করে বগলদাবা করল।
পুলিশ আসার আগে চলে যাওয়াই কি ভালো না? বিছাকে বলল আসিফ।
পুলিশ আসছে না।
জানলে কী করে? কেউ হয়তো দেখে ফেলেছে তোমাদেরকে।
তুমি কথা বেশি বলো। …পেইন্টিংগুলো দিয়ে কী করছিলে?
নিশ্চয়ই খাচ্ছিলাম না, চুলের তেল হিসেবে মাথাতেও দিচ্ছিলাম না।
কী করছিলে? চাপা ধমক দিল বিছা।
দেখছিলাম।
এবার আমাকে দেখাও, ছুরিটা দোলাল বিছা।
জো হুকুম, জাহাপনা, শরীর মুচড়ে উবু হয়ে একটা ফ্রেম তুলে নিল আসিফ, সিধে হলো ধীরেসুস্থে। শরীরের ভর রেখেছে বাঁ পায়ের উপর, ভান পা-টা একটু আগে বাড়াল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে কোমরের কাছ থেকে ফ্রেমটা ছুঁড়ে মারল বিছার দিকে–অনেকটা ফ্রিবির ভঙ্গিতে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিল শত্রুপক্ষের উদ্দেশে।
প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ পায়নি বিছা, ফ্রেমটা সজোরে আঘাত করেছে ওর নাকেমুখে। আকস্মিক প্রচণ্ড ব্যথায় হাত থেকে ছুরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সে, বগল থেকে পড়ে গেছে চিঠির অ্যালবামও। বসে পড়তে বাধ্য হয়েছে।
ছয় ফুট সাত ইঞ্চির শরীরটা নিয়ে শত্রুপক্ষের সামনে হাজির হতে দুই সেকেণ্ডও লাগল না আসিফের। প্রচণ্ড জোরে লাথি মারল বিছার একসঙ্গীর তলপেটে। ঘুসি পাকিয়ে এগিয়ে আসছিল আরেকজন, নাকেমুখে আসিফের দ্বিতীয় লাথিটা খেয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।
তানিয়া! গলা ফাটাল আসিফ। দৌড় দাও!
বলার দরকার ছিল না, আগেই ছুট লাগিয়েছে তানিয়া। বিছা আর ওর দুই সঙ্গীর কী হাল তা দেখার প্রয়োজন বোধ করল না আসিফ, স্ত্রীর পিছু নিল। একদৌড়ে দরজা পেরিয়ে করিডোরে হাজির হলো ওরা, লাইব্রেরির সদর-দরজার দিকে ছুটছে।
ধরো ওদেরকে! ক্রুদ্ধ চিৎকার শোনা গেল বিছার।
ততক্ষণে সদর-দরজা খুলে ফেলেছে, তানিয়া, বেরিয়ে যাচ্ছে। ওর ঠিক সঙ্গেই আছে আসিফ। একছুটে রাস্তায় বেরিয়ে এল ওরা, বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছে এখন। দৌড়াতে দৌড়াতে ফরাসি ভাষায় পুলিশ, পুলিশ, বলে চেঁচাচ্ছে। পথচারীরা অনেকেই থমকে দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের দুজনকে।
লাইব্রেরির সদর-দরজায় হাজির হয়েছে বিছা আর ওর দুই চামচা। ইতোমধ্যে বড় রাস্তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে আসিফ আর তানিয়া। সন্দেহ জেগেছে অনেক পথচারীর মনে, মোবাইলে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে কয়েকজনকে–পুলিশে খবর দিচ্ছে কি না কে জানে। পথচারীদের কেউ কেউ পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে লাইব্রেরির দিকে।
অবস্থা বেগতিক, বুঝে নিতে সময় লাগল না বিছার। আসিফদের পিছু ধাওয়া করা অথবা লাইব্রেরিতে অবস্থান করা কোনওটাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। দুই সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে লাইব্রেরি থেকে, আসিফরা যেদিকে গেছে তার উল্টোদিকে হাঁটছে।
অ্যাডমিরালের চিঠির অ্যালবামটা বিছার হাতে। তাঁর দুটো পেইন্টিং ভাগাভাগি করে বহন করছে বিছার দুই সঙ্গী।
পালাচ্ছে ওরাও।
.
কন্ট্রোলরুমে বসে আছে সারওয়ার বিন জামাল, অপেক্ষা করছে খবরের।
ইতোমধ্যে জেনেছে সে, জরুরি মিটিং শুরু হয়েছে লিবিয়ায়। ওখানকার বিরোধীদলের নেতা, যে কিনা আসলে সারওয়ারের লোক, সমর্থন পাচ্ছে অনেকের। আসলে টাকার বিনিময়ে কেনা হয়েছে ওই সমর্থন। তবে আমজনতার, মনে সরকারের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব তৈরি করা গেছে, এবং ওটার জন্য কোনও খরচ হয়নি। বেশিরভাগ শহরে দাঙ্গা লেগে গেছে। আরও বেশি পানির আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। মন্ত্রীরা, কিন্তু সারওয়ার জানে সে না চাইলে কোনোদিনও পূরণ হবে না ওই আশ্বাস। বর্তমান সরকার আর আটচল্লিশ ঘন্টাও টিকবে কি না, সন্দেহ আছে ওর।
আলবার্তো ইতোমধ্যে ফিরে গেছে ইটালিতে। জরুরি বৈঠকে বসেছে ইটালির বড় বড় নেতাদের নিয়ে। খবর পাঠিয়েছে, যদি নতুন সরকার গঠিত হয় লিবিয়ায়, পূর্ণ সমর্থন আদায় করে নিতে পারবে ওর সরকারের পক্ষ থেকে। যোগাযোগ করা হচ্ছে ফরাসি নেতাদের সঙ্গে, যাতে আলজেরিয়া আর লিবিয়ার গণঅভ্যুত্থান সমর্থন করেন তাঁরা।
অর্থাৎ সব চলছে পরিকল্পনামাফিক। সব আছে মুঠোর ভিতরে। শুধু নাগালের বাইরে রয়ে গেছে মাসুদ রানা। আর ওর দুই সঙ্গী।
কে এই মাসুদ রানা? আখতার জানিয়েছে, লোকটা নুমার এজেন্ট। চামড়ার রঙ বলে দেয়, লোকটা ভারতীয় উপমহাদেশের। মাসুদ রানা ঠিক কোন দেশের নাগরিক? কী তার আসল পরিচয়? নুমার একজন এজেন্ট এভাবে কাঁপিয়ে দিতে পারে না সারওয়ার বিন জামালকে, যেভাবে দিয়েছে মাসুদ রানা।
টেবিলের আড়াল থেকে যখন উঠে দাঁড়াল লোকটা, ওর চোখে একরত্তি মৃত্যুভয় দেখেনি সারওয়ার। অল্প কিছুটা সময় সে ছিল সারওয়ারের সঙ্গে, তাতেই ক্ষমতার বিচ্ছুরণ টের পাওয়া গেছে ওর। গায়ে কী শক্তি লোকটার! কমাণ্ডো ট্রেনিং আছে সারওয়ারের, তারপরও ওকে শুইয়ে দিয়েছে ব্যাটা একলাথিতে।
নিজের অজান্তে ঠোঁটের কাছে হাত তুলল সারওয়ার। রক্তপাত বন্ধ হয়েছে আগেই, কিন্তু এখনও টনটন করছে আহত জায়গাটা।
মাসুদ রানা বিশেষ কেউ না হয়ে পারে না। কারণ তা না হলে মাত্র দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়তে পারত না হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্লান্টে। সমস্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে হাজির হতে পারত না সমাধিপ্রকোষ্ঠে। অবলীলায় গায়েব হয়ে যেতে পারত না এতগুলো লোকের চোখের সামনে দিয়ে। আট-দশজন গার্ডকে শুইয়ে দিয়ে তাদের অস্ত্র নিয়ে গা ঢাকা দিতে পারত না।
প্রশ্ন হচ্ছে, ও-রকম বিশেষ কাউকে নুমার পরিচয়ে কে লাগিয়েছে সারওয়ারের পেছনে? সিআইএ? উঁই, সে-রকম কোনও আভাস পায়নি সারওয়ার। কেজিবি? প্রশ্নই আসে না। উত্তর আফ্রিকায় যদি আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় সারওয়ার, রাশানদের কিছু আসবে-যাবে না। তা হলে? রানা কি ইউরোপিয়ান কোনও দেশের সিক্রেট সার্ভিসের হয়ে কাজ করছে? কই, আলবার্তো তো কিছু বলল না?
কে যেন টোকা দিল দরজায়। চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল সারওয়ারের। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, এসো।
দরজা ঠেলে আখতারকে ঢুকতে দেখে আরও বাড়ল ওর বিরক্তি। খারাপ খবর থাকলে না-বলাই ভালো হবে তোমার জন্য, সতর্ক করল।
ফ্রান্স থেকে কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে বিছা। ওই দম্পতির সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে ওদের। কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু কাজ হয়েছে।
কী এনেছে বিছা?
জানাল আখতার।
হেলান দিল সারওয়ার, কিছুটা সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে ওকে।
তবে অ্যাডমিরালের চিঠিগুলো পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু না, বলছে আখতার। আর ওর পেইন্টিংগুলো জঘন্য। বিছা বলেছে, ছবিগুলোর পেছনে কিছু লুকানো আছে কি না খুঁজছিল জামাই-বউ। ফ্রেমের কভার ছিঁড়ে দেখেছে বিছার লোকেরা, কিন্তু লুকানো নোট বা মেসেজ পায়নি।
তারমানে…
মাথা ঝাঁকাল আখতার। রা তার অ্যান্টিডোটের ব্যাপারে যদি কিছু জেনে থাকে অ্যাডমিরাল বা এটিন ডিসুজা, অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে সে ইতিহাস।
সন্তুষ্ট হয়েছে সারওয়ার, কিন্তু পুরোপুরি না। জামাই বউয়ের কী হয়েছে?
ওদের ব্যাপারে আর কিছু জানায়নি আমাকে বিছা। ওরা সম্ভবত পালিয়ে গেছে।
তোমার লোকদের বলো ওদেরকে খুঁজে বের করে শেষ করে দিতে। আমি… কথা শেষ করতে পারল না সারওয়ার।
ছবি কাঁপতে শুরু করেছে কম্পিউটার মনিটরগুলোতে। মনে হচ্ছে এখনই নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যাবে ওগুলো। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সারওয়ার, কান পেতেছে। পাম্প চলার আওয়াজ একটু বদলেছে বলে মনে হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর বন্ধ হলো মনিটরের ডিসপ্লের নাচন।
আওয়াজের পরিবর্তন শুনেছে টেকনিশিয়ানরাও। কম্পিউটারের কিবোর্ডে সচল হয়েছে তাদের আঙুল। কী ঘটেছে জানার চেষ্টা করছে ওরা। সতর্কতামূলক ইয়েলো ফ্ল্যাগ দেখা দিয়েছে মনিটরগুলোয়।
কী হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল সারওয়ার।
কারেন্ট চলে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য, জানাল একজন টেকনিশিয়ান। সেকেণ্ডারি লাইন দিয়ে সমস্যার সমাধান করা হয়েছে।
কারেন্ট চলে গেল কেন?
শর্ট সার্কিট হয়ে থাকতে পারে মেইন কেবলে, বলল আরেক টেকনিশিয়ান। অথবা কোথাও হয়তো পড়ে গেছে সার্কিট ব্রেকার।
ছাগলের বাচ্চা কোথাকার! আবার চেঁচিয়ে উঠল সারওয়ার, এসব আমি বুঝি। শর্ট সার্কিট হলো কেন অথবা সার্কিট ব্রেকার পড়ল কেন সেটা বোঝা আমাকে!
কিন্তু কেউ কিছু বলার আগেই বিস্ফোরণের ভেতা একটা আওয়াজ শোনা গেল বাইরে।
থরথর করে কেঁপে উঠল সবকিছু।
একের পর এক গালি দিতে দিতে কন্ট্রোলরুম ছেড়ে বেরিয়ে এল সারওয়ার।
অর্ধেকের বেশি লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু কাজ করছে ইমার্জেন্সি সিস্টেম। অস্পষ্ট একটা গুড়গুড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এদিকেই এগিয়ে আসছেবড় কোনও ট্রাক।
সবচেয়ে কাছের টানেলের দিকে তাকাল সারওয়ার।
ফোর হুইলারের চেয়ে অনেক বড় কিছু একটা এগিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে, টানেলের চেয়েও বড় ওটা; শেষপর্যন্ত বের হতে পারবে না ওখান থেকে। জিনিসটা আসলে কী, দেখার জন্য মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে সারওয়ার। হঠাৎ জ্বলে উঠল অত্যুজ্জ্বল হেডলাইট, অন্ধ বানিয়ে দিল ওকে সাময়িকভাবে।
দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু সারওয়ার বুঝতে পারছে, চলমান ওই বিভীষিকা মোকাবেলা করতে ছুটে যাচ্ছে ওর কয়েকজন লোক। কিন্তু মাঝপথেই থেমে গেল লোকগুলো, লুটিয়ে পড়ল আর্তচিৎকার করে, কারণ ঠা-ঠা শব্দে গর্জাতে শুরু করেছে একটা মেশিনগান।
শোল্ডার হোলস্টারে আরেকটা ম্যাগনাম ঢুকিয়েছিল সারওয়ার, বের করল ওটা। এখনও কাটেনি ওর সাময়িক অন্ধত্ব, যদি কাটত তা হলে সবার আগে গুলি করে মারত আখতারকে।
নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকল সে আখতারকে। শুয়োরের বাচ্চা, এই তোর পরিকল্পনা? গর্তের বাইরে বের হওয়ার বদলে উল্টো হামলা করছে ওরা এখন!
বাইরে এসেছিল আখতারও, দৌড়ে গিয়ে ঢুকল কন্ট্রোল রুমে। একস্টা ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল। সেকশন ওয়ান! গলা ফাটিয়ে বলল, আখতার বলছি! সবাইকে নিয়ে এখনই হাজির হও কন্ট্রোলরুমে। হামলা চালানো হয়েছে আমাদের ওপর।
মেশিনগানের নল ঘোরানো হয়েছে। কন্ট্রোলরুমের দিকে গুলি চালানো হচ্ছে এখন। ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে কাঁচ আর একের পর এক মনিটর। মেঝেতে শুয়ে পড়তে বাধ্য হলো আখতার। কাঁচের টুকরো আর কাঠ-প্ল্যাস্টিকের গুড়ো বৃষ্টির মতো পড়ছে ওর উপর।
রাইফেল কাঁধে তুলে নিল সারওয়ারের দুজন লোক, যমদূতের মতো হাজির-হওয়া আর্মার্ড কার নিশানা করে ট্রিগার টানছে। কিন্তু মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত, তারপরই হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিতে বাধ্য হলো ওরা, কারণ সমানে ঝাঁকি খেতে শুরু করেছে ওদের শরীর-মেশিনগানের সহজ নিশানায় পরিণত হয়েছে।
ওটা আমাদের ভেহিকেল না, শুয়ে থাকা অবস্থাতেই চেঁচিয়ে সারওয়ারকে বলল আখতার, সামরিক বাহিনীর।
এল কোত্থেকে? আড়াল থেকে পাল্টা চিৎকার শোনা গেল সারওয়ারের।
জানি না।
গুলিবর্ষণ আপাতত থেমেছে। সুযোগ বুঝে চট করে আড়াল ছাড়ল সারওয়ার, একদৌড়ে গিয়ে ঢুকল আরেকটা টানেলে। কেন্দ্রীয় শবপ্রকোষ্ঠের দিকে গেছে ওটা।
ক্রল করে কন্ট্রোলরুমের পার্শ্বদরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আখতার। একটা নাইন মিলিমিটার পিস্তল আছে ওর হাতে। কন্ট্রোলরুমের আড়ালে-আবডালে আর্মার্ড কারের মুখোমুখি পজিশন নিয়েছে ওর কয়েকজন লোক।
কিন্তু ওই কাজ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আখতারের।
.
রানা, সোহেল আর লামিয়ার অবস্থা আখতারের ঠিক উল্টো। মরণপণ লড়াইয়ে নেমেছে ওরা, যা হওয়ার হবে।
রানা আর সোহেল মিলে ঘষামাজা করে কাজের উপযোগী বানিয়েছে একটা আর্মার্ড কারকে। মরুর শুষ্ক বাতাস তেমন একটা মরিচা ফেলতে পারেনি ওটার কলকজায়। ভিতরে মজুদ করা অবস্থায় ছিল সবরকমের টুলস আর স্পেয়ার পার্টস।
একমাত্র সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় জ্বালানি। আর্মার্ড কারটা চালাতে পেট্রোল বা গ্যাসোলিন যা-ই ব্যবহার করে থাকুক না কেন ইটালিয়ানরা, এত বছরে উবে গেছে তার প্রতিটা ফোঁটা। রানা আর সোহেল মিলে সাইফন করে ফোর হুইলারের সব পেট্রোল ঢুকিয়েছে আর্মার্ড কারের ফুয়েল ট্যাঙ্কে।
একের বেশি কার নিতে পারত ওরা, কিন্তু জ্বালানি সমস্যার কারণে পারেনি। মেরামত করে সারিয়ে-তোলা গাড়িতে, অন্য গাড়ি থেকে অস্ত্র আর গোলাবারুদ এনে এনে সেটার অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে ওরা তিনজন।
মেশিনগান পাওয়া গেছে কয়েকটা। বিশ রাউণ্ড কান্ট্রিজের বড় শেল ফায়ারে সক্ষম ওগুলো। ফায়ারিং প্লাটফর্মের সঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায় বিশ মিলিমিটার অ্যান্টিট্যাঙ্ক গান আছে। একটা। অ্যামিউনিশনের অভাব নেই, তবে যেগুলো কার্যক্ষম আছে শুধু সেগুলোই বেছে বেছে আলাদা করেছে ওরা।
উনিশ শ আঠারো মডেলের বেরেটা সাবমেশিনগান পাওয়া গেছে দুটো। এক্সপ্লোসিভ আছে অনেক। কী মনে করে তিনটা গ্যাস-মাস্কও ঢুকিয়েছে রানা ওদের আর্মার্ড কারে, মৃত ইটালিয়ান সৈনিকের ঠিক পাশের গাড়িতে পাওয়া গেছে। ওগুলো।
রণপ্রস্তুতি সেরে ফিরতি পথে রওয়ানা দেয় ওরা। গাড়ি চালানোর দায়িত্ব নেয় সোহেল। মেশিনগানের দায়িত্ব নিয়েছে লামিয়া। আর রানা তখন ওর দুই কাঁধে আড়াআড়িভাবে দুটো একে ফোর্টি সেভেন ঝুলিয়ে, কোমরে ম্যাগনামটা গুঁজে, হাতে একটা সাবমেশিনগান নিয়ে গাড়ির পাশে কখনও হাঁটছে কখনও দৌড়াচ্ছে। দৃষ্টি জমিনের দিকে-ফোর হুইলারের চাকার দাগ লক্ষ করে সোহেলকে বলে দিচ্ছে কোনদিকে যেতে হবে।
ফিরতি পথে কোথাও কোনও বাধা ছিল না, তাই যে টানেলে শত্রুপক্ষের কয়েকজন গার্ডের সঙ্গে লড়াই হয়েছিল ওদের সেখানে হাজির হতে একটুও অসুবিধা হয়নি ওদের। ওখানে কয়েকজন গার্ড নিযুক্ত করেছিল আখতার। ওরা আশা করছিল একটা ফোর হুইলার, কোনও আর্মার্ড কার না। বিস্ময় কাটিয়ে যতক্ষণে কাঁধে একে ফোর্টি সেভেন তোলে ওরা, ততক্ষণে গর্জাতে শুরু করেছে লামিয়ার মেশিনগান। ট্রিগার একবারও টানার আগেই লুটিয়ে পড়ে সব গার্ড।
মেইন হলে হাজির হওয়ার আগে ইনসুলেটেড পাওয়ার লাইন খুঁজে বের করে ওরা, একসঙ্গে এক্সপ্লোসিভ চার্জ করে কয়েক জায়গায়।
রানা ভেবেছিল প্লন্টটা ব্ল্যাকআউট হয়ে যাবে সম্পূর্ণভাবে, সেকেণ্ডারি পাওয়ার সাপ্লাইয়ের কথা জানা ছিল না ওর। ইতোমধ্যে আর্মার্ড কারে উঠে পড়েছে ও।
ওরা কি বিকল্প কোনও বিদ্যুত্ব্যবস্থা ব্যবহার করছে? রানাকে জিজ্ঞেস করল সোহেল।
মনে হয়। তবে ওটা নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে আপাতত। এখন আসল কাজ হলো, সারওয়ারকে ধরা যাতে পালাতে না পারে সে।
কন্ট্রোলরুম লক্ষ্য করে আবারও ফায়ার করতে শুরু করেছে লামিয়া। ওদিকে তাকাল রানা আর সোহেল। কয়েকজন গার্ড পজিশন নিয়েছিল রুমটার বিভিন্ন জায়গায়, থেমে থেমে গুলি চালাচ্ছিল আর্মার্ড কারের উদ্দেশে। লামিয়ার ফায়ারে স্তব্ধ হয়ে গেল ওদের কয়েকজন।
কন্ট্রোলরুমে ঢুকতে যাচ্ছি আমি, বলল রানা। কভার দে আমাকে। সাবমেশিনগান হাতে নিয়ে আর্মার্ড কার ছাড়ল সে, ছুটে যাচ্ছে।
কন্ট্রোলরুমের ভিতরে একটা কম্পিউটার কনসোলের নিচে লুকিয়ে আছে দুজন ইঞ্জিনিয়ার। রানার উপস্থিতি টের পেয়ে ওর দিকে অস্ত্র তাক করতে যাচ্ছিল বেঁচে থাকা তিনজন গার্ড, সাবমেশিনগানের গুলিতে ওদেরকে নিথর করে দিল রানা। এদিকওদিক চোখ বুলাল দ্রুত।
সারওয়ার বা আখতারের কোনও পাত্তা নেই।
অবস্থা বেগতিক বুঝে পালিয়েছে বুজদিলেরা, সোহেলের উদ্দেশে চেঁচাল রানা।
দুই ইঞ্জিনিয়ার ভয়ে কাঁপছে, ওদের দিকে তাকাল রানা। কোন্দিকে গেছে সারওয়ার?
জ…জানি না, তোতলাতে তোতলাতে বলল একজন।
কিন্তু অন্যজন বলে দিল কোনদিকে গেছে সারওয়ার।
কথাটা সোহেলকে জানিয়ে দিল রানা। চোখের কোনা দিয়ে দেখল, আর্মার্ড কারের মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে সোহেল।
কন্ট্রোলরুম থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও গেল না না, তাকাল কনসোলের উপরের দিকে। লামিয়ার এলোপাতাড়ি গুলি থেকে রেহাই পেয়েছে কয়েকটা স্ক্রিন, উত্তর আফ্রিকার আউটলাইন এবং পাম্প ও পাইপলাইনের নেটওয়ার্ক দেখা যাচ্ছে ওগুলোতে। অ্যাকুইফার কীভাবে খালি করছিল সারওয়ার, বোঝা গেল।
দুই ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকাল রানা। পাম্পগুলো বন্ধ করো।
ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে লোক দুটো, নড়ছে না।
ওদের পাশে, মেঝেতে গুলি করল রানা।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ইঞ্জিনিয়াররা। কম্পিউটারের কিবোর্ডে সচল হলো একজনের আঙুল। আরেকজন টিপছে বিভিন্ন সুইচ।
একটা চিন্তা খেলে গেল রানার মাথায়। দাঁড়াও! পুরো প্রসেসটা রিভার্স করো!
ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দুই ইঞ্জিনিয়ার, কর্তব্য স্থির করতে পারছে না।
সাবমেশিনগান নাচাল রানা। প্রসেসটা রিভার্স করো।
ওটা করলে কী হবে…জানি না, কাঁপতে কাঁপতে বলল এক ইঞ্জিনিয়ার। এর আগে কখনও রিভার্সাল প্রসেস চালাইনি আমরা।
আজ চালাও।
রানার কথামতো কাজ শুরু করে দিল দুই ইঞ্জিনিয়ার।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়ালের স্ক্রিনের দিকে তাকাল রানা। একটু আগে কয়েকটা নীল তীর চিহ্ন বুঝিয়ে দিচ্ছিল কোন্দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে কোনদিকে যাচ্ছে পানি, আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে সব চিহ্ন। কিন্তু একটু পরই দেখা দিল আবার। একটা একটা করে তীর ফুটে উঠছে স্ক্রিনে, পানিপ্রবাহের গতিপথ এখন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।
অ্যাকুইফার থেকে পানি উত্তোলন করার বদলে সেখানে তা ফেরত পাঠাচ্ছে পাম্পগুলো।
.
২৯.
আর্মার্ড কার আস্তে আস্তে আগে বাড়াচ্ছে সোহেল। গার্ডদের কেউ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেই তাকে মেশিনগান দিয়ে, শুইয়ে দিচ্ছে লামিয়া।
যে-টানেলে ঢুকেছে সারওয়ার, সেখানে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা মিলল একটা টি আকৃতির জাংশনের। এখানে দুটো ফোর হুইলারের আড়ালে অপেক্ষা করছিল কয়েকজন গার্ড, আর্মার্ড কারটা নজরে পড়ামাত্র একে ফোর্টি সেভেন দিয়ে সমানে গুলি করতে শুরু করল।
চট করে মাথা নিচু করে ফেলল সোহেল, যদিও প্রটেকশন শিল্ড তুলে দিয়েছিল আগেই। ব্যাকগিয়ারে দিয়ে আর্মার্ড কার পিছিয়ে নিয়ে এল কিছুটা। ততক্ষণে গাড়িটার নাকে অনেকগুলো ফুটো তৈরি করেছে প্রতিপক্ষের বুলেট। গাড়ির ইঞ্জিন যদি ওটার সামনের দিকে থাকত তা হলে এতক্ষণে অকেজো হয়ে যেত। কিন্তু ইঞ্জিনটা সৌভাগ্যক্রমে পেছন দিকে।
অ্যান্টিট্যাঙ্ক শেলগুলো কাজে লাগাও! লামিয়ার উদ্দেশে চেঁচাল সোহেল। ওদের হুইলার দুটো উড়িয়ে দিলে আর আড়াল পাবে না ওরা।
অ্যামুনিশন লকার থেকে গ্রেনেডের মতো দেখতে এক্সপ্লোসিভ শেলগুলো বের করল লামিয়া। কয়েকটা দিয়ে লোড করল অ্যান্টিট্যাঙ্ক গানটা, বাকিগুলো রাখল হাতের নাগালে।
আর্মার্ড কার আবার সচল করল সোহেল। একের পর এক বুলেট ছুটে আসছে ফোর হুইলার দুটোর আড়াল থেকে। বুলেটের আওয়াজ ছাপিয়ে ভারী একটা গর্জন শোনা গেল খুব কাছে–অ্যান্টিট্যাঙ্ক গানটা সচল করেছে লামিয়া। তাড়াহুড়োয় নিশানা ঠিক রাখতে পারেনি, প্রথম শেলটা বিস্ফোরিত হয়েছে একটা হুইলারের ফুট পাঁচেক সামনে।
ছিটকে উঠল মাটি, ধুলো দিয়ে ভরে গেল জায়গাটা।
আবার ফায়ার করল মিয়া, এবার দ্বিতীয় হুইলার লক্ষ্য করে। আসলে ভারী অ্যান্টিট্যাঙ্ক-গানটা নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হচ্ছে ওর, তাই এবারও জায়গামতো বিস্ফোরিত হলো না শেল। হুইলারের চাকার কাছে পড়ে ফেটেছে ওটা, একটুখানি লাফিয়ে উঠেছে হুইলারটা।
সময় নিল লামিয়া, আরেকটু কাছে যেতে দিল আর্মার্ড কারকে। অ্যান্টিট্যাঙ্ক গানের ট্রিগারে টান দিল আবার। এবার বিস্ফোরিত হলো একটা হুইলার, ওটার আড়ালে থাকা গার্ডদের একেকজন ছিটকে পড়ল একেকদিকে। আবার ট্রিগারে টান দিয়ে দ্বিতীয় হুইলারও ধ্বংস করল মিয়া।
একটা মুহূর্তও নষ্ট না করে এগিয়ে গেল মেশিনগানের দিকে, গার্ডদের নিশানা করে ট্রিগার চেপেছে। ওদের কেউ মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় মরল, কেউ উঠে দাঁড়ানোর সময় ঘায়েল হলো, আবার কেউ প্রাণ হারাল দৌড়ে পালাতে গিয়ে।
এখনও ধুলো উড়ে বেড়াচ্ছে টি-জাংশনের কাছে। ল্যাবে যাচ্ছি আমি, চিৎকার করে সোহেলকে বলল লামিয়া। চেষ্টা করে দেখি অ্যান্টিডোটের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নাকি।
ঠিক আছে, বলল সোহেল। একটা সাবমেশিনগান দিয়ে যাও আমাকে। দরকার পড়লে গাড়ি চালাতে চালাতে গুলি করব।
.
রানা খেয়াল করল, স্ক্রিনে জ্বলতে-নিভতে শুরু করেছে একটা আলো।
কী ওটা? জিজ্ঞেস করল ও।
এলিভেটর, বলল এক ইঞ্জিনিয়ার। নিচে নামছে। পাম্পহাউস থেকে টানেলে আসছে ওটা।
ওটা থামাতে পারবে?
মাথা নাড়ল দুই ইঞ্জিনিয়ার।
ওদেরকে দিয়ে আর কোনও কাজ নেই, বুঝতে পারছে রানা। চলে যাও তোমরা। আমার বিরুদ্ধে যারা অস্ত্র ধরে না তাদেরকে মারি না।
উঠে দাঁড়িয়ে কন্ট্রোলরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল দুই ইঞ্জিনিয়ার।
একটা পার্শ্বদরজা দিয়ে টানেলে বের হলো রানা, সেখান থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির হলো আর্মার্ড কারের কাছে। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে গতি কমাল সোহেল। গাড়িতে উঠে পড়ল রানা।
এলিভেটরের কথাটা সোহেলকে জানাল রানা। রিইনফোর্সমেন্ট আসছে। এদিকওদিক তাকাল। লামিয়া কোথায়?
ল্যাবে গেছে।
ল্যাবে?
হুঁ। অ্যান্টিডোটের কথা বলল। ওটা খুঁজবে ওখানে।
চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বোলর কামড় খেয়েছে রানা। কিন্তু অ্যান্টিডোট তো বানানো হয় না এখানকার ল্যাবে! মজুদও করা নেই সম্ভবত।
সে-কথা তো আমাদেরকে আগে বলিসনি তুই।
খেয়াল না করায় কী ভুল হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে রানা। ল্যাবে একা গেছে লামিয়া, বড় বিপদ হতে পারে ওর। এমনকী ওকে যদি ধরতে পারে সারওয়ার, জিম্মি হিসেবে কাজে লাগাতে পারে।
আমিও যাই ওদিকে, সোহেলকে বলল রানা। পারলে তুইও চলে আসিস। সাবমেশিনগানের জন্য একটা এক্সট্রা কার্টিজ তুলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দিল।
আর্মার্ড কারের মুখ ঘুরিয়ে নিল সোহেল।
ল্যাবে যাবে ও, তবে তার আগে খুঁজে বের করতে হবে এলিভেটরটা।
চায় না দলে ভারী হোক শত্রুপক্ষ।
.
টানেল ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে সোনার স্ফিংক্স আর পাথরের শবাধারওয়ালা ঘরে হাজির হয়েছে সারওয়ার আর আখতার। এই মুহূর্তে আখতারের উপর রাগ নেই সারওয়ারের, অথবা থাকলেও নিজস্বার্থে চেপে রেখেছে–রানাদের সঙ্গে হঠাৎ লড়াই বেধে গেলে অন্তত একজন সাহায্যকারী পাওয়া যাবে।
খেয়াল করল দুজনে, পানি উঠছে জমিন থেকে।
কী ব্যাপার? দৌড়ানোর গতি কমেছে সারওয়ারের।
পাম্প তো চলছে। আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি আমি।
কী ঘটেছে, বুঝে গেল সারওয়ার। প্রবাহ রিভার্স করে দিয়েছে ওরা।
দাঁড়িয়ে পড়ল আখতার। এই টানেলগুলো যখন খুঁজে পাই আমরা, বেশিরভাগই ছিল পানিতে ভরা। পানিপ্রবাহের গতি বিপরীতমুখী হলে ওই অবস্থা হবে আবার। তারমানে এখান থেকে যত জলদি সম্ভব বের হতে হবে আমাদেরকে।
তুমি আসলেই কাপুরুষ, আখতার। ওদের সংখ্যা মাত্র তিন। ওদেরকে খুঁজে বের করে খুন করার পর পানিপ্রবাহের গতি বিপরীতমুখী করে দিলেই সব ঝামেলা শেষ।
ওদের সঙ্গে একটা ট্যাঙ্ক আছে।
ছাগল! ওটা ট্যাঙ্ক না, আর্মার্ড কার। কোত্থেকে পেয়েছে। জানি না, কিন্তু এমন না যে, গাড়িটা ধ্বংস করা যাবে না। ফাঁদ পাততে হবে ওদের জন্যে, ওরা যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে তারচেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু কাজে লাগিয়ে মারতে হবে ওদেরকে। অস্ত্রাগারে যাও, রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড যতগুলো পারো নিয়ে এসো।
মাথা ঝাঁকিয়ে একজন গার্ডকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল আখতার।
আরেকজন গার্ড ছিল সারওয়ারের সঙ্গে, পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল অন্য একটা টানেলের দিকে। থাকো এখানেই, লোকটাকে বলল সারওয়ার, প্রয়োজনে লড়বে।
মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল লোকটা, পারবে না কাজটা করতে।
সঙ্গে সঙ্গে শোল্ডার হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে লোকটাকে গুলি করে মারল সারওয়ার। তারপর লাশটা টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল কুমিরের গর্তে।
.
কী-কোড ব্যবহার করে অস্ত্রাগারের দরজা খুলল আখতার। ভিতরে সারি সারি, ব্ল্যাক আছে; সেগুলোতে সাজানো আছে অ্যাসল্ট রাইফেল, অ্যামিউনিশন বক্স। একটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা আছে এক সেট রাশান আর.পি.জি.-রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড।
ওগুলোর একটা তুলে নিল আখতার, সঙ্গে-আসা গার্ডের হাতে দিল। এটা নিয়ে গিয়ে সারওয়ারকে দাও।
আর.পি.জি. নিয়ে ছুট লাগাল লোকটা।
খানিকটা সময় নিয়ে আরেকটা আর.পি.জি. চেক করল আখতার। তারপর এগিয়ে গেল টেলিফোনের দিকে। উপরের কন্ট্রোলরুমের সঙ্গে যোগাযোগ করল।
ফোন ধরল সেকশন লিডার।
বিছাকে দাও, বলল আখতার।
দুই স্কোয়াড লোক নিয়ে এলিভেটরের দিকে যাচ্ছি। আমি, হাই-হ্যালো বাদ দিয়ে শুধু কাজের কথা বলল বিছা।
ওদেরকে পাঠিয়ে দাও নিচে। তুমি আসবে না। কী করব তা হলে?
তিন নম্বর এক্সিটের কাছে আমার সঙ্গে দেখা করবে। তিন নম্বরটা কোটা, চিনেছ?
লবণখনির পুরনো টানেলটা যেখানে আছে সেখানে।
হুঁ। একটা ল্যাণ্ডরোভার নিয়ে আসবে।
ঠিক আছে।
লাইন কেটে দিল আখতার। তাকাল নিচের দিকে।
পানি বাড়ছে। আখতারের গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে গেছে। ডুবে মরার কোনও ইচ্ছা নেই ওর। অস্ত্রাগারের দরজা দিয়ে বের হলো সে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কেন্দ্রীয় শবপ্রকোষ্ঠের দিকে। তারপর দৌড়াতে শুরু করল উল্টোদিকে।
আগে জান বাঁচুক, তারপর লড়াই।
.
শবপ্রকোষ্ঠে অপেক্ষা করছে সারওয়ার। আরপিজি নিয়ে দৌড়ে হাজির হলো একজন গার্ড। আখতার কোথায়?
প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল সারওয়ার, কোনও একজনের ছুটন্ত পদশব্দ শুনতে পেয়ে কিছু বলল না।
মানুষটার পায়ে খুব সম্ভব বুট নেই। কারণ জমিনের উপর সেলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। তারমানে…
এমনিতেই আলো বেশি নেই, তাই এককোনার গাঢ় ছায়ায় নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে অসুবিধা হলো না সারওয়ারের। চিতাবাঘের মতো অপেক্ষা করছে। গা ঢাকা দিয়েছে গার্ডও।
শবপ্রকোষ্ঠে ঢুকল ইটালিয়ান মেয়েটা। হাঁপাচ্ছে, এদিকওদিক তাকাচ্ছে। আগেরবার কোন টানেল দিয়ে গিয়েছিল ল্যাবে, খুঁজছে সম্ভবত। শবপ্রকোষ্ঠে আলো কম আঁধার বেশি, তাই দিক ঠাহর করতে পারছে না। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে কুমিরের গর্তের দিকে।
মানুষের পায়ের আওয়াজ পেয়ে কুমিরগুলো ভাবল, খাবারের সময় হয়েছে আবার। হিংস্র আওয়াজ ছাড়ল ওগুলো। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ইটালিয়ান সুন্দরী। সারওয়ারের দিকে পিছন ফিরে আছে।
সুযোগ বুঝে আড়াল ছাড়ল সারওয়ার। ছায়ার মতো নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটার দিকে। হাতে প্রস্তুত অবস্থায় আছে আরপিজি।
গর্তের ভিতরে দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে কুমিরগুলো। সামান্য আওয়াজ যদি করেও থাকে সারওয়ার, তা ঢাকা পড়ে গেছে কুমিরগুলোর কারণে। মেয়েটার ঠিক পেছনে গিয়ে হাজির হলো সে, তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড থাবা চালাল মেয়েটার হাতেধরা সাবমেশিনগানে।
চমকে উঠল লামিয়া। সাবমেশিনগান ছুটে গেছে হাত থেকে। সারওয়ারের উপস্থিতি টের পেয়ে কনুই চালাল পেছন দিকে। কিন্তু প্রস্তুত ছিল সারওয়ার, এড়িয়ে গেল আঘাতটা। ওর দিকে চট করে ঘুরল লামিয়া, ঘুসি হাঁকিয়েছে চোয়ালে। আঘাতটা লাগল জায়গামতো, কিন্তু হেসে উঠল সারওয়ার। আরপিজি দিয়ে জোরে বাড়ি মারল মেয়েটাকে।
ছিটকে গিয়ে একটা পাথরের-শবাধারের উপর পড়ল মেয়েটা, গুঙিয়ে উঠল ব্যথায়। ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সারওয়ার। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে মেয়েটা। কাছে গিয়ে ওকে ঘুসি মারল সারওয়ার। লাগল না ঠিকমতো–হয়তো প্রস্তুত ছিল মেয়েটা। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারল না, পড়ে গেল। ওঁর উপর চড়ে বসল সারওয়ার। একের পর এক কিল-চড় মারছে মেয়েটার নাকেমুখে।
উঠবি না? দাঁতে দাঁত পিষে বলল সারওয়ার।
কথা শুনল না লামিয়া। আবারও জোর খাটাচ্ছে, চেষ্টা করছে উঠে দাঁড়ানোর।
মেয়েটাকে ছেড়ে দিল সারওয়ার, একটুখানি সরে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড এক লাথি মারল ওর পেটে। এবার ব্যথায় ককিয়ে উঠল মেয়েটা, চিৎ হয়ে পড়ে গেছে। শোল্ডার হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করল সারওয়ার, মেয়েটার মাথার দিকে তাক করে কক করল।
স্থির হয়ে গেল লামিয়া।
ভাবছে, এখনই গুলি করবে সারওয়ার। ওকে বাঁচিয়ে রেখে কোনও লাভ নেই লোকটার।
একগুলিতেই যাতে সব শেষ হয়ে যায়, মনে মনে প্রার্থনা করল সে।
কিন্তু গুলি করল না সারওয়ার। লামিয়াকে এখনই খুন করার বদলে অন্য একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়।
আরপিজি-টা দিল গার্ডের হাতে। এটা নিয়ে গিয়ে ওঠো স্ফিংসের উপর। পারফেক্ট শট নিতে পারবে ওখান থেকে।
.
এলিভেটরের সামনে হাজির হয়েছে সোহেল।
পাহাড়ি দেয়াল মাপমতো কেটে বসিয়ে দেয়া হয়েছে ধাতব ফ্রেম, বানানো হয়েছে এলিভেটর চলাচলের পথ। একনজরেই বলে দেয়া যায়, মালসামান, ভারী ইকুইপমেন্ট অথবা একসঙ্গে অনেক লোক বহন করতে পারে এলিভেটরটা। ওটা এসে পৌঁছায়নি এখনও, কিন্তু গিয়ার ঘুরছে। যান্ত্রিক ভোঁ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে একটানা।
আর্মার্ড কার পজিশনমতো দাঁড় করাল সোহেল। পেট্রোল বাঁচাতে বন্ধ করে দিল ইঞ্জিন। ইতোমধ্যে খেয়াল করেছে, জমিন ভেদ করে পানি উঠতে শুরু করেছে, জমছে বিভিন্ন টানেলে। পানির স্তর বাড়ছে আস্তে আস্তে। যদি দরকার হয়, রানা আর লামিয়াকে নিয়ে পালানোর জন্য কাজে লাগতে পারে ওই এলিভেটর। তারমানে উড়িয়ে দেয়া যাবে না ওটা।
আর্মার্ড কারের গানারস পজিশনে গিয়ে দাঁড়াল সোহেল। আর্মার্ড প্লেট তুলে দিয়ে আড়াল করল নিজেকে। অ্যান্টিট্যাঙ্ক গান আর মেশিনগান রেডি করল। অপেক্ষা করছে।
জায়গামতো এসে থামল এলিভেটর কারের চওড়া ধাতব বাক্সটা। দরজা নেই, সেটার জায়গায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে একটা কেঁচিগেট। ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে কম করে হলেও বিশজন গার্ড।
আর্মার্ড প্লেটের ছোট ফুটো দিয়ে তাকিয়ে আছে সোহেল, ইচ্ছা করলে এখনই ট্রিগার টানতে পারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা পড়বে সব গার্ড। কিন্তু অ্যামবুশ করতে রাজি না ও।
মেশিনগানের ট্রিগারে হাত রেখে চেঁচিয়ে বলল, তোমাদের জায়গায় আমি থাকলে এখনই ফিরে যেতাম উপরে। আর্মার্ড কারের হেডলাইট নিভিয়ে দিয়েছিল, সেটা জালাল।
কেঁচিগেট খুলে গেছে। ভিতরে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের সবাই সশস্ত্র। কিন্তু ওরা এত ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়েছে যে, সামনের দিকে যারা আছে তাদেরও সময় লাগবে অস্ত্র তুলতে।
সোহেলের কথা শুনতে পেয়েছে সবাই, থমকে গেছে। মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে কেউ কেউ। বুঝতে পারছে, ফাঁদে পড়ে গেছে। দৌড়ে বের হওয়া অথবা অন্য কোনও অ্যাকশনে যাওয়ার আগেই মারা পড়বে–গাদাগাদি করে থাকা এতগুলো লোককে শুইয়ে দিতে দশ সেকেণ্ডও লাগবে না আর্মার্ড কারের লোকটার।
সোহেল চাইছে ওদের কেউ একজন রাইফেল তুলে গুলি করুক। মেশিনগান চালানোর বাহানা পেয়ে যাবে তা হলে। কিন্তু কাজটা করল না গার্ডদের কেউই। কেঁচিগেটটা বন্ধ হয়ে গেল আবার, স্টিলের দড়ি উপরে টেনে তুলছে এলিভেটর কারকে।
মেশিনগানের নল ঊর্ধ্বমুখী করে ধাতব বাক্সটা কভার করছে সোহেল, গার্ডরা একটু এদিকওদিক করলেই টান দেবে ট্রিগারে। কিন্তু উপরে উঠতে উঠতে একসময় শাফটের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল এলিভেটর কার।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সোহেল, কিন্তু ফিরে এল না সৈন্যরা। আর্মার্ড প্লেটের আড়াল ছেড়ে ড্রাইভারের সিটে বসে পড়ল সোহেল। গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে ফিরে এল কন্ট্রোল রুমের কাছে। জমিনের পানির উচ্চতা ফুটখানেক হয়ে গেছে।
এত পানি কোত্থেকে আসছে? আর্মার্ড কারের মুখ ল্যাবের দিকে ঘোরানোর সময় ভাবল সোহেল। খুব সম্ভব নীল নদ থেকে। তারমানে সবগুলো পাম্প রিভার্স মোড়ে দিতে বাধ্য করেছে রানা কন্ট্রোলরুমের কাউকে-না-কাউকে। প্রচণ্ড প্রেশারের কারণে হয়তো পাইপলাইনের কোনও জায়গা দিয়ে লিক করছে পানি, জমছে টানেলগুলোতে।
লিবিয়া আর তিউনিসিয়ার শুকনো লেকগুলো আবার ভরে যাচ্ছে পানি দিয়ে, কল্পনার চোখে দেখল সোহেল।
.
একটা টানেলের ভিতরে বেকায়দায় পড়ে গেছে রানা। ওকে তিনদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে কয়েকজন গার্ড।
শত্রুপক্ষের একজন আছে রানার বাঁদিকে, চমৎকার একটা বেঁটে বোল্ডারের আড়ালে। দুজন পজিশন নিয়েছে রানার মুখোমুখি, অন্ধকার একটা টানেলের দেয়াল ঘেঁষে। ডানদিকে ঠিক কতজন আছে সে-ব্যাপারে নিশ্চিত না রানা, কারণ শত্রুপক্ষের বেশিরভাগ বুলেট ছুটে আসছে ওখান থেকেই। বিরতি ছাড়া এত গুলি করা একজনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব, যদি না মেশিনগান জাতীয় কিছু একটা থাকে তার কাছে।
রানা ঘাপটি মেরে পড়ে আছে একটা পাথরের-শবাধারের আড়ালে। শুনতে পাচ্ছে, ওকে ঘিরে-ধরা গার্ডরা আরবিতে আলোচনা সেরে নিচ্ছে নিজেদের মধ্যে। ডানদিকে যারা আছে তারা সম্ভবত ফায়ার চালিয়ে যাবে, সে-সুযোগে কাছিয়ে আসবে প্রতিপক্ষের বাকিরা।
একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ শোনা গেল এমন সময়। ভারী কিছু একটা এগিয়ে আসছে। বিভিন্ন টানেলের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আওয়াজটা। রানার ডানদিক থেকে গুলিবর্ষণ থামল।
টানেলের মুখে হাজির হলো সোহেল, হেডলাইটের আলোয় শবাধারের আড়ালে বেকায়দায় পড়ে থাকতে দেখল রানাকে। ব্রেক চেপেছে, বুঝে গেছে পরিস্থিতি।
আঙুলের ইশারায় সোহেলকে জানিয়ে দিল রানা শত্রুপক্ষের কে কোথায় আছে।
ড্রাইভিংসিট ছাড়ল সোহেল, গিয়ে দাঁড়াল আর্মার্ড প্লেটের আড়ালে। অ্যান্টিট্যাঙ্ক গান দিয়ে কয়েকবার ফায়ার করল বোল্ডারের আড়ালে থাকা গার্ডের উপরের দেয়ালে। ছোট-বড় পাথরের চাঁই খসে পড়ল দেয়াল থেকে, থেঁতলে দিল বোল্ডারের আড়ালে থাকা গার্ডকে।
আর্মার্ড প্লেটের গায়ে বুলেটের চুম্বন টের পাচ্ছে সোহেল–টানেলের ভিতরে থাকা গার্ড দুজন গুলি করছে। অ্যান্টিট্যাঙ্ক গানটা ছেড়ে দিয়ে মেশিনগানের দিকে হাত বাড়াল ও। খেয়াল করল শবাধারের আড়াল থেকে জবাব দিতে শুরু করেছে রানা। টানেলের স্ফুলিঙ্গগুলো নিশানা করে সমানে গর্জন করছে ওর সাবমেশিনগান।
টানেলের ভিতর থেকে বুলেট আসা বন্ধ হলো।
রানার ডানদিকে তাকাল সোহেল। ওখানে প্রায় অরক্ষিত অবস্থায় আছে তিনজন গার্ড। বিহ্বল হয়ে গেছে ওরা, কোন্দিকে পালাবে বুঝতে পারছে না। বাড়ন্ত পানিতে ছপছপ আওয়াজ তুলে একটা টানেলের দিকে ছুট লাগাল একজন। সঙ্গে সঙ্গে রণে ভঙ্গ দিয়ে ওকে অনুসরণ করল বাকি দুজন। মেশিনগানের ট্রিগারে চাপ দিল সোহেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তিন গার্ড।
ছপছপ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে আবার। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সোহেল। আর্মার্ড কারের দিকে দৌড়ে আসছে রানা।
ওকে উঠে পড়ার সুযোগ দিল সোহেল। তারপর আবার সচল করল গাড়িটা।
ল্যাবের দিকে যাচ্ছে।
.
সেন্ট্রাল বারিয়ার চেম্বারে হাজির হওয়ামাত্র চোখের কোনা দিয়ে একটা স্ফুলিঙ্গ দেখল রানা, হুশ আওয়াজ তুলে কিছু একটা ছুটে এল আর্মার্ড কারের দিকে।
প্রতিক্রিয়া দেখানো অথবা চিৎকার করার সুযোগ পেল না রানা বা সোহেল। গাড়ির ঠিক সামনেই ফাটল গ্রেনেড, আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা ছিটকে ওঠার কায়দায় লাফিয়ে উঠল একরাশ পানি, উল্টে গেল গাড়িটা।
জ্ঞান হারায়নি রানা, তবে ওর দুই কান ভোঁ-ভোঁ করছে। ফাপা মনে হচ্ছে মাথার ভিতরটা। টের পাচ্ছে, পানিতে পড়ে গেছে ও।
ড্রাইভারের সিটের দিকে তাকাল। ঠিক আছিস? দুই পায়ে কোনও সাড়া পাচ্ছি না, বলল সোহেল। তবে হাড্ডিগুড্ডি ভাঙেনি মনে হয়।
সিট আর স্টিয়ারিং-এর মাঝখানে আটকে গেছে সোহেল, শরীরটা এদিকওদিক মুচড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। ও মোটা না, কাজেই ওই জায়গায় ওর আটকা পড়ার কথা না; ঘটনাটা ঘটল কেন তা বোঝার চেষ্টা করল রানা। দেখল, বিস্ফোরণের ধাক্কায় বেঁকে গিয়ে সোহেলের দিকে দেবে এসেছে ধাতব ড্যাশবোর্ড, চেপে ধরেছে বেচারাকে।
মাথা ঝাঁকাল রানা, দূর করার চেষ্টা করল অস্বস্তিবোধ। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল সোহেলের দিকে, ডান কাঁধটা ড্যাশবোর্ডের সঙ্গে চেপে ধরে সর্বশক্তিতে ঠেলা দিচ্ছে। একটু ভিতরের দিকে ঢুকল স্টিয়ারিং, মোচড়ামোচড়ি করে বেরিয়ে আসতে পারল সোহেল।
আরপিজি যে-ব্যাটাই ফায়ার করে থাকুক, বলল হাঁপাতে হাঁপাতে, কপাল ভালো গাড়ির নিচের দিকে মেরেছে। সরাসরি আমাদের উপর মারলে দুইজন গলা ধরাধরি করে স্বর্গে চলে যেতাম এতক্ষণে।
শত্রুপক্ষের কেউ একজন পজিশন নিয়েছে এখানে, বলল রানা।
কেমন লাগল আমার লালগালিচা অভ্যর্থনা? প্রকোষ্ঠের একপাশ থেকে শোনা গেল কণ্ঠটা।
সারওয়ার বিন জামাল।
.
৩০.
অস্ত্র বলতে কী আছে হাতের নাগালে তা চট করে যাচাই করে নিল রানা।
উল্টে যাওয়ার কারণে হোল্ডিংমেটাল থেকে আলগা হয়ে গেছে অ্যান্টিট্যাঙ্ক গান, কাজেই ওটা বাতিল। মেশিনগানটা যেদিকে ছিল সেদিকে কাত হয়ে পড়েছে আর্মার্ড কার, এবং ইতোমধ্যে পানি ফুট দুই উঁচু হয়েছে, তাই ওটা ব্যবহারের অযোগ্য। সাবমেশিনগানটা হাতছাড়া হয়েছে কখন যেন। টানেলের শেষ লড়াইয়ের সময় একে ফোর্টি সেভেন দুটো কাঁধ থেকে খসিয়েছিল রানা, পরে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আর তোলা হয়নি।
এখন একমাত্র ভরসা কোমরে গুঁজেরাখা সারওয়ারের ম্যাগনাম।
আমাদেরকে মারো অথবা না মারো তাতে কিছু যায় আসে না, বলল রানা। আর কিছুক্ষণের মধ্যে পানিতে তলিয়ে যাবে সব টানেল, কলে আটকাপড়া ইঁদুরের মতো মরবে তখন। তুমি শেষ, সারওয়ার। তোমার পরিকল্পনা ব্যর্থ।
হা হা করে হেসে উঠল সারওয়ার। স্রষ্টাকে সৃষ্টি সম্বন্ধে জ্ঞান দিচ্ছ, মাসুদ রানা? পানি কীভাবে বন্ধ করতে হয়, আমি জানি না? আমাকে সাময়িক অসুবিধায় ফেলে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারোনি তুমি।
স্রষ্টা দেখা যাচ্ছে তার সৃষ্টি সম্বন্ধে আসলেই কম জানে।
হাসি মুছে গেল সারওয়ারের চেহারা থেকে। মানে?
তোমার কম্পিউটার সিস্টেম ব্যবহার করে আমার সুপিরিয়রদের কাছে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি। আমাদেরকে মেরে এবং সব টানেল পানিশূন্য করে যতক্ষণে উপরে যাবে, ততক্ষণে সারা দুনিয়া জেনে যাবে তোমার কুকীর্তির খবর। জানতে পারবে আলবার্তোসহ আর কে কে হাত মিলিয়েছে তোমার সঙ্গে। জানাজানি হবে আফ্রিকার কুলগ থেকে বানানো কালো কুয়াশার কথা। পরেরবার যখন ওই অস্ত্র ব্যবহার করতে যাবে কারও উপর, দেখবে আগেই সেটার অ্যান্টিডোট নিয়ে বসে আছে লোকটা।
পর পর দুবার গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। ঝাঁকুনি টের পাওয়া গেল আর্মার্ড কারের বডিতে।
পাগলাটা মনে হয় গ্যাসট্যাঙ্ক নিশানা করে গুলি করছে, নিচু গলায় বলল সোহেল।
কোনও লাভ নেই। কারণ পানিতে ডুবে গেছে ওটা। আমরা… কথা শেষ করতে পারল না রানা, চোখের কোনা দিয়ে অস্বাভাবিক একটা নড়াচড়া দেখতে পেয়েছে।
কুমিরের গর্তটা। পানি দিয়ে ভরে গেছে ওটাও, উপরে উঠে আসার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে কুমিরগুলো।
এবং ইতোমধ্যে অন্তত একটা গ্রহণ করেছে সে-সুযোগ।
কুমিরটাকে দেখতে পেয়েছে, সোহেলও। রানার দিকে তাকিয়ে জ্ব নাচাল, করণীয় সম্পর্কে জানতে চায়।
সারওয়ারের কণ্ঠ যেদিক থেকে এসেছে, আর্মার্ড কারের আড়াল থেকে সাবধানে সেদিকে তাকাল রানা। উঁচু একটা শবাধারের উপর দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, পায়ের কাছে পড়ে আছে কী যেন। ওই শবাধার ঢেকে দিতে সময় লাগবে বাড়ন্ত পানির।
গর্ত ছেড়ে বের হলো আরেকটা কুমির। তারপর আরও দুটো। সাঁতার কেটে চারটাই এগিয়ে গেল একটা টানেলের দিকে। টের পায়নি, উল্টেপড়া একটা আর্মার্ড কারের আড়ালে রয়ে গেছে দুই প্লেট সুস্বাদু খাবার।
মাসুদ রানা! উঁচু কণ্ঠে বলল সারওয়ার। তুমি আর তোমার বন্ধু হাত তুলে দাঁড়াও! কোনও চালাকির চেষ্টা করবে না। ইটালিয়ান মেয়েটা আছে আমার কাছে। তোমরা আমার কথা না শুনলে ওকে গুলি করে পানিতে ফেলে দেব।
রানা! শোনা গেল লামিয়ার দুর্বল কণ্ঠ। আমার কথা ভেবো না। তোমরা পালাও।
মাথা নামাল রানা। ফিসফিস করে সোহেলকে বলল কোথায় কীভাবে আছে লামিয়া। তারপর বলল, আরপিজি সারওয়ার চালায়নি। অন্য কোনও জায়গা থেকে ফায়ার করা হয়েছে ওটা।
দূরের ওই স্ফিংসের উপর থেকে, ফিসফিস করে বলল সোহেল। কপালের একটা পাশ কেটে গেছে ওর, রক্ত পড়ছে ওখান দিয়ে। বুকের একদিক চেপে রেখেছে হাত দিয়ে, উল্টে পড়ার সময় ব্যথা পেয়েছে পাঁজরে। অন্য হাত দিয়ে কী যেন তোলার চেষ্টা করছিল এতক্ষণ, মেশিনগানটা উদ্ধার করতে পেরে একটুখানি হাসল।
গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল লামিয়া।
পরের বুলেটটা কিন্তু মালাইচাকি গুঁড়ো করে দেবে মেয়েটার! হুঁশিয়ারি শোনা গেল সারওয়ারের।
চোখে চোখে কথা হয়ে গেল রানা আর সোহেলের।
উঠে দাঁড়াবে রানা, আর গাড়ির আড়াল থেকে মেশিনগান চালাবে সোহেল।
রানা জানে, সারওয়ারকে গুলি করার জন্য হয়তো একটা মুহূর্ত পাবে ও। জানে, জীবনের নিখুঁততম গুলিটা করতে হবে ওকে আজ।
প্রথমে বাঁ হাত তুলে গাড়ির বডি আঁকড়ে ধরল ও, শরীরের বাঁ পাশটা আস্তে আস্তে তুলছে। ডান হাঁটুর উপর ভর রেখে খাড়া করল শরীরের বাঁ দিকের বাকিটা, ডান হাত এখনও রয়ে গেছে পানির নিচে। শবাধারের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে, একটু একটু করে উপরে তুলছে শরীরের ডানপাশ। বাড়ন্ত পানি এখন ছুঁই ছুঁই করছে ওর কোমর, ম্যাগনামটা রয়ে গেছে পানির নিচে, সারওয়ারের দৃষ্টির আড়ালে।
হাসি চওড়া হচ্ছে লোকটার, রানার দিকে পিস্তল তাক করছে সময় নিয়ে।
আরেকটু সিধে হলো রানা, ম্যাগনামের নলটা কেবল বের হলো পানির বাইরে।
চোখের পাতা পড়ছে না রানার, মাথাটা একবার উপর নিচ করল সোহেলের উদ্দেশে, সঙ্গে সঙ্গে টান দিল ম্যাগনামের ট্রিগারে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ঠা ঠা শব্দে গর্জন করতে শুরু করল সোহলের মেশিনগান।
পর পর কয়েকটা ঘটনা ঘটল।
চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল সারওয়ারের। উপরে উঠতে উঠতে থমকে গেল ওর ম্যাগনামধরা হাত। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল বুকের বাঁ দিকে সদ্য-তৈরি-হওয়া গর্তের দিকে। ম্যাগনামের ট্রিগারে টান দিয়ে ফেলল, বুলেট এসে লাগল রানার একফুট সামনে আর্মার্ড কারের বডিতে। আস্তে আস্তে পেছনের দিকে কাত হয়ে যাচ্ছে সারওয়ার, তারপর উল্টে পড়ে গেল পানিতে।
পাস্টার দিয়ে বানানো হয়েছিল স্ফিংক্সটা; মেশিনগানের বুলেট ছিন্নভিন্ন করে দিল ওটার সোনার মস্তকাবরণ। মুহূর্তের ব্যবধানে উরু আর সোলার প্লেক্সাসে গুলি খেল আরপিজিওয়ালা। গাছ থেকে যেভাবে নারকেল খসে পড়ে, অস্ত্রটা ছেড়ে দিয়ে সেভাবে পড়ে গেল পানিতে।
পর পর দুটো পতনের শব্দ এবং পানিতে-জাগা কম্পন মনোযাগ আকর্ষণ করল কুমিরগুলোর। টানেল থেকে ফিরে এল ওগুলো, একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছে গার্ডটার উপর।
.
সময় নষ্ট না করে পানির নিচে হাতড়াতে শুরু করেছে সোহেল, এক্সট্রা কার্ট্রিজ-ক্লিপ খুঁজে পেয়ে সেটা লাগিয়ে নিল মেশিনগানে। তুই গিয়ে লামিয়াকে নিয়ে আয়, বলল রানার উদ্দেশে, নিজের শার্ট খুলে ছুঁড়ে দিল রানার দিকে। কুমিরগুলোকে শেষ করছি আমি।
ভোজে উন্মত্ত প্রাণীগুলোর দিকে তাক করল মেশিনগানের নল, ট্রিগার টানছে। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কুমিরগুলো।
ততক্ষণে শবাধারের কাছে পৌঁছে গেছে রানা। উঠে পড়ল ওটার উপর। লামিয়ার পায়ে গুলি করেছে সারওয়ার, প্রচণ্ড ব্যথায় অজ্ঞানের মতো হয়ে গেছে বেচারী। ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল রানা। সোহেলের শার্টটা ব্যাণ্ডেজের মতো করে পেঁচাল মেয়েটার ক্ষতস্থানে। তারপর ওকে তুলে নিল কাঁধে। লাফিয়ে নামল।
হাঁটু ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে পানি, দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে রানার। তারপরও যত জোরে সম্ভব ছোটার চেষ্টা করছে ও। একটু পর পেছনে ছপছপ আওয়াজ শুনে বুঝতে পারল, সোহেলও দৌড়ে আসছে।
টানেল ধরে মমিকরা ব্যাঙগুলোর প্রকোষ্ঠে পৌঁছাল ওরা। সবগুলো ব্যাঙ ভাসছে পানিতে। ওগুলো এড়িয়ে পাইপলাইন ধরে পৌঁছে গেল ট্রামকারের লাইনের কাছে। এখন পর্যন্ত এখানে পানি ওঠেনি। একটা কারে উঠে পড়ল সোহেল, ভিতরে নামিয়ে রাখল মেশিনগান, রানার সঙ্গে ধরাধরি করে তুলল লামিয়াকে। চালু করল কারটা।
হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রান্টে হাজির হতে বেশি সময় লাগল না।
.
হাঁ হয়ে খুলে আছে ওয়াল প্যানেলটা, কিন্তু ও-রকম হওয়ার কথা না।
মুখ চাওয়াচাওয়ি করল রানা আর সোহেল।
প্যানেল থেকে কিছুটা দূরে আছে, এমন সময় ট্রামকার থামাল সোহেল। নামল ট্রাম থেকে, হাতে মেশিনগান। ম্যাগনামটা কোমরে গুঁজে লামিয়াকে আবার কাঁধে তুলে নিল রানা।
ওয়াল প্যানেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রানা আর সোহেল।
কিন্তু কয়েক পা এগোনোর পরই একাধিক উজ্জ্বল ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠল অনতিদূরে, চোখ ধাঁধিয়ে গেল রানা ও সোহেলের।
ওদের অপেক্ষায় অন্ধকারে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল লোকগুলো।
একসঙ্গে একাধিক রাইফেল ক করার আওয়াজ শুনতে পেল রানা আর সোহেল।
নিচু হয়ে হাত থেকে মেশিনগানটা নামিয়ে রাখল সোহেল, ছায়ামূর্তিগুলোকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে। ব্যালেন্স রক্ষা করার জন্য একহাতে একদিকের দেয়াল ধরল রানা।
গুলি কোরো না! চিৎকার করে উঠল লুঙ্কর হোসেইনি। ওরা আমার বন্ধু।
রাইফেল উঁচিয়ে রাখা লোকগুলোকে ঠেলে রানাদের দিকে আসছে সে।
.
হোসেইনির কাছ থেকে জানা গেল, কমান্ডো টিম আর স্পেশাল এজেন্টদের নিয়ে ঝড়ের গতিতে ঢুকে পড়ে সে প্লান্টে। তখন ভিতরে যারা কাজ করছিল তাদের বেশিরভাগই টেকনিকাল লোক, অস্ত্রের ঝনঝনানির সঙ্গে পরিচিত না। উর্দিধারী যেসব লোক অস্ত্র উঁচিয়ে বাধা দিতে এসেছিল বা দিয়েছে, তাদের অনেকেই এখন পরপারে।
সঙ্গে করে ছোট একটা মেডিকেল টিম নিয়ে এসেছে হোসেইনি, ওদের হাতে লামিয়াকে তুলে দিল রানা। সারওয়ারের কী হয়েছে, জানাল।
জিতে গেছি আমরা, সব শুনে হাসল হোসেইনি।
পুরোপুরি না, বলল রানা। কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোট পাইনি এখনও। জ্যান্ত বা মৃত কোনও অবস্থাতেই পাওয়া যায়নি হুসাইন আখতারকে। আমার ধারণা পালিয়েছে সে।
লোকটা বেঁচে গেলে আবার একত্রিত করবে আমেনথেসের সদস্যদের, বলল সোহেল।
মাথা নেড়ে দ্বিমত পোষণ করল হোসেইনি। সহজে করতে পারবে না কাজটা। কারণ ওর সম্পর্কে অনেককিছু জেনে গেছি আমরা। ধরা-পড়া এক গার্ড জানিয়েছে, বিছা নামে পরিচিত এক লোককে সঙ্গে নিয়ে পালিয়েছে সে।
কোনদিকে গেছে? জিজ্ঞেস করল রানা।
বলতে পারেনি ওই গার্ড। তবে আমেনথেসের এক পাইলট একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলেছে। ইঙ্গিতে দেয়ালে ঝোলানো একটা ম্যাপ দেখাল হোসেইনি, ওটাতে পাম্পগুলোর অবস্থান নির্দেশ করা আছে। মোট উনিশটা প্রাইমারি স্টেশন আর কয়েক ডজন বুস্টার পাম্প আছে। পাইলট বলেছে, ওগুলোর একটা বাদে বাকি সব অটোমেটেড।
কোনটা অটোমেটেড না?
এগিয়ে গিয়ে ম্যাপের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আঙুল রাখল হোসেইনি, কায়রোর পশ্চিমপ্রান্তে ওটা। পাইলটের বক্তব্য অনুযায়ী, এখানে প্রায়ই যেত সে। খাবার, পানি আর অন্যান্য জিনিস দিয়ে আসত।
খাবার আর পানি? ভ্রূ কুঁচকে গেছে রানার। তারমানে লোকজন থাকে সেখানে।
মাথা ঝাঁকাল হোসেইনি। কথা হচ্ছে, সেই লোকগুলো কারা? পাইলট বলছে, বিশেষ এই জায়গায় আমেনথেসের নিজস্ব গার্ড যেমন আছে, তেমন আছে কয়েকজন বিজ্ঞানী। স্পেশাল প্যাকেজের ডেলিভারি বুঝে নিত ওরা প্রতি তিন দিন পর পর।
হেনরি কী বলে গেছে, মনে পড়ল রানার। বলল, আমার মনে হয় ওটাই সেই ল্যাব যেখানে কালো কুয়াশার অ্যান্টিডোট বানানো হচ্ছে। সোহেলকে নিয়ে যত-জদি-সম্ভব ওখানে যেতে চাই আমি।
সেক্ষেত্রে দুটো কাজ করতে তোমাদেরকে, বলল হোসেইনি। এক, হেলিপ্যাডে-থাকা একমাত্র হেলিকপ্টারটা কাজে লাগাতে হবে।
আর দুই? জিজ্ঞেস করল সোহেল।
সঙ্গে নিতে হবে আমাকেও।
.
৩১.
আমেনথেসের রঙ আর লোগো সংবলিত হেলিকপ্টারটা চালাচ্ছে হোসেইনি। কো-পাইলটের সিটে বসেছে সোহেল। জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে রানা, দেখছে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত নগ্ন, উষর মরুভূমি।
বালির উপর অনাবৃত পাইপলাইনগুলো একসময় চোখে পড়ল ওর। দেখে মনে হচ্ছে কালচে-ধূসর একটা বিল্ডিঙে গিয়ে ঢুকেছে ওগুলো, অথবা সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে।
হেলিকপ্টারের নাক বিল্ডিংটার দিকে ঘোরাল হোসেইনি।
বিল্ডিঙের আশপাশে কোনও গাড়ি অথবা অন্য কোনও যানবাহন পার্ক করা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে না। কোথাও কোনও মানুষ অথবা অন্য কোনও প্রাণীও দেখা যাচ্ছে না।
পরিত্যক্ত নাকি? বলল হোসেইনি।
না-ও হতে পারে, বলল সোহেল। এতক্ষণে হয়তো হেলিকপ্টারের আওয়াজ পেয়ে গেছে ওরা। আমাদেরকে লালগালিচা অভ্যর্থনা জানানোর জন্য পজিশন নিয়ে ফেলেছে সম্ভবত।
হেলিপ্যাড আছে, বলল রানা, আঙুলের ইশারায় দেখাচ্ছে ওটা।
নামছি, ল্যাণ্ড করতে শুরু করল হোসেইনি।
হেলিকপ্টারটা হেলিপ্যাড স্পর্শ করামাত্র দরজা খুলে লাফিয়ে নামল রানা, ঝুঁকে দৌড় দিয়েছে একদিকের দেয়ালের উদ্দেশে। যে-কেউ এখন চাইলে সহজ টার্গেটে পরিণত করতে পারে ওদেরকে।
একটা একে ফোর্টি সেভেন আছে রানার হাতে। দরজা জানালাগুলোর উপর চোখ বুলাল প্রত, ডান হাতের তর্জনী প্রস্তুত অবস্থায় আছে রাইফেলের ট্রিগারে। কিন্তু শত্রুপক্ষের কাউকে দেখা গেল না কোথাও।
দেয়ালে ভর দিয়ে সোহেল আর হোসেইনিকে এগোনোর ইঙ্গিত করল রানা। হেলিকপ্টার ছেড়ে বেরিয়ে দৌড়ে এসে রানার সঙ্গে যোগ দিল ওরা দুজন।
দড়াম করে একটা আওয়াজ হলো দূরে কোথাও।
দমকা বাতাসের ঝাপটায় খুলে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে বাড়ি খেয়েছে কোনও দরজা?
একসঙ্গে না থেকে নিজেদের মধ্যে গ্যাপ তৈরি করে নিল রানা, সোহেল আর হোসেইনি। সাবধানে এগোচ্ছে, প্রস্তুত অবস্থায় আছে প্রত্যেকের রাইফেল।
হ্যাঁ, একদিকের একটা দরজা খোলা, বাতাসে নড়ছে; বাড়ি খাচ্ছে। পুরোপুরি আটকে যেতে পারছে না, কারণ ওটার হ্যাঁযবোল্টটা বেরিয়ে আছে ইঞ্চি তিনেক।
দরজাটার দিকে ইঙ্গিত করল হোসেইনি। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানাল রানা আর সোহেল।
আরও এগিয়ে গিয়ে সাবধানে দরজাটা খুলল হোসেইনি, ততক্ষণে হাঁটু গেড়ে পজিশন নিয়ে রাইফেল তাক করে ফেলেছে রানা ও সোহেল। পাল্লার সঙ্গে পিঠ ঘেঁষে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল হোসেইনি, সুইচ টিপে জ্বেলে দিল লাইট।
কেউ নেই।
ঘরে ঢুকল রানা আর সোহেল।
ধূসর রঙ করা হয়েছে দেয়ালগুলোতে, মেঝে কংক্রিটের। কয়েকটা বাকা পাইপ মেইন লাইন থেকে আলাদা হয়ে এসে ঢুকেছে একটা হাইপ্রেশার বুস্টার পাম্পে। একটু দূরে দেখা যাচ্ছে একটা এলিভেটর, হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্লান্টে যে-রকম দেখেছিল ওরা সে-রকম।
একই সেটআপ, বলল হোসেইনি।
পাওয়ার সুইচ খুঁজে নিয়ে এলিভেটর চালু করল রানা, উঠে পড়ল ওটাতে। উঠল সোহেল আর হোসেইনিও। নিচে নামতে শুরু করল ওরা।
জমিনের দুশ ফুট নিচের একটা ল্যাবরেটরিতে হাজির হতে সময় লাগল মিনিট তিনেক।
কোথাও কেউ নেই, কন্ট্রোলরুমে ঢুকে বলল সোহেল। দেয়ালের স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলো এখনও রিভার্সাল মোডে কাজ করছে পাম্পগুলো। এখানকার সবাই বুঝতে পেরেছে অবস্থা বেগতিক, তাই পালিয়েছে কাজ ফেলে।
মূল ল্যাবরেটরির দরজায় গিয়ে দাঁড়াল ওরা তিনজন। ওটার বন্ধ দরজার সামনে একটা কী-প্যাড দেখা যাচ্ছে। তারমানে দরজার লকিংসিস্টেম পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড।
পাসওয়ার্ড চেপে দরজার লক খুলেছিল হেনরি, মনে পড়ে গেল রানার। কী পাসওয়ার্ড দিয়েছিল সে, মনে করতে পারল সেটাও। এগিয়ে গিয়ে ওটা টাইপ করল কী-প্যাডে।
একটা লাল আলো জ্বলছিল কী-প্যাডে, উধাও হয়ে গেল সেটা। এখন ডিসপ্লেতে হেনরির নাম দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সবুজ বাতি জ্বলল না, দরজাও খুলল না। তারমানে হেনরি যে-পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে তা এন্ট্রি করা আছে এখানকার সিস্টেমে, কিন্তু ওটা দিয়ে দরজা খোলা যায় না।
লাল আলোটা জ্বলে উঠেই নিভে গেল, এখন ডিসপ্লেতে সবুজ আলো দেখা যাচ্ছে। খুলে গেছে দরজা। ল্যাবৃকোট পরা দুজন পুরুষ আর একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।
হেনরি? ওই তিনজনের মধ্যে যার বয়স বেশি, জিজ্ঞেস করল সে।
না, বলল রানা।
স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিন বায়োলজিস্ট, হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। ওদের চেহারা বলে দিচ্ছে, হুমকি-ধমকি দিয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করানো হচ্ছে ওদেরকে।
কী হয়েছে এখানে? জিজ্ঞেস করল হোসেইনি। সারওয়ারের লোকেরা সব ফেলে পালিয়েছে?
মূল প্লান্ট থেকে যখন খবর এল হামলা হয়েছে সেখানে, বলছে বয়স্ক লোকটা, তখন খুব নার্ভাস হয়ে পড়ে এখানকার গার্ডরা। আপডেট আর করণীয় জানার জন্য বার বার ফোন করছিল ওরা ওখানে, কিন্তু একটা সময়ের পর কেউ রিসিভ করেনি ওদের ফোন। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গার্ডরা, অনুমান করে নেয় বড় রকমের হামলার শিকার হয়েছে ওদের নেতা সারওয়ার বিন জামাল। ল্যাবটা ধ্বংস করে দিতে চাইছিল ওরা, কিন্তু ভিতরে ঢুকে দরজা আটকে দিই আমরা তিনজন।
আমরা চাইনি কালো কুয়াশার অ্যান্টিভোট ধ্বংস হয়ে যাক, বলল মহিলাটা।
অ্যান্টিডোট বানাতেন কীভাবে? বয়স্ক লোকটাকে জিজ্ঞেস করল হোসেইনি।
হাইবারনেটিং বুলগের গায়ে যদি বৃষ্টির পানি লাগে, ওটার চামড়া থেকে একজাতের কাউন্টারঅ্যাক্টিং এজেন্ট নিঃসরণ হয়। বিশেষ সিগনাল পৌঁছে যায় ব্যাঙটার নার্ভাস সিস্টেমে, ওটা বুঝতে পারে শীতন্দ্রিা থেকে জেগে ওঠার সময় হয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে জেগে ওঠার ওই সিগনালের কিছুটা উন্নতি ঘটাতে হয়েছে আমাদের, তবে সেজন্য সাহায্য নিতে হয়েছে প্রাচীন লিপিফলকের।
কী পরিমাণ অ্যান্টিডোট আছে এখানে? জিজ্ঞেস করল রানা। হাইবারনেশন থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে শ পাঁচেক মানুষকে?
লিনোসার ঘটনার কথা বলছেন তো? …পারবে।
ওগুলো প্যাক করে নিতে স্পেশাল কোনও ইকুইপমেন্ট লাগে?
না। স্বাভাবিক রুম টেম্পারেচারে কিছু হয় না ওই অ্যান্টিডোটর।
চলুন তা হলে। হাতে সময় খুব কম আমাদের।
.
চাকাওয়ালা একটা কার্টে প্ল্যাস্টিকের অনেকগুলো ক্রেট ভোলা হয়েছে। প্রতিটা ক্রেটে আছে অ্যান্টিডোটের বারো ডজন শিশি। তিন বায়োলজিস্টের সহায়তায় ওগুলো হেলিকপ্টারে তুলল হোসেইনি।
কাজ শেষে বিল্ডিঙের ভিতরে গেল হোসেইনি। এখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল রানা আর সোহেল।
অ্যান্টিডোট নিয়ে লামিয়ার কাছে যাও তুমি, বলল রানা। তারপর কী করতে হবে তা তোমাকে বলে দেবে সে। আশাকরি এতক্ষণে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে মেয়েটা।
রানার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওর মনোভাব বুঝে নিল হোসেইনি। তুমি আর সোহেল থাকচ্ছ এখানে?
মাথা ঝাঁকাল রানা। আখতার আর বিছার সঙ্গে কিছু হিসাবনিকাশ আছে না?
আখতার! আশ্চর্য হয়েছে হোসেইনি।
আমার ধারণা আমেনথেস প্লান্ট থেকে বেশি দূরে যায়নি সে। তারমানে আমাদেরকে হেলিকপ্টার নিয়ে উড়তে দেখেছে। এখান থেকে যদি দশ মাইলের মধ্যেও থাকে লোকটা, হেলিকপ্টার আবার উড়তে দেখলে ধরে নেবে, এই জায়গা সম্পূর্ণ খালি।
তারমানে সোহেলকে নিয়ে ফাঁদ পাততে যাচ্ছ আখতার আর বিছার জন্য?
মাথা ঝাঁকাল রানা।
.
এলিভেটর দিয়ে নিচে এসেছে রানা আর সোহেল, সেটআপটা দেখেছে ভালোমতো।
আখতার আর বিছার সঙ্গে যে-কবার মোলাকাত হয়েছে আমাদের, বলল রানা, প্রতিবারই একজন স্নাইপার মজুদ করে রেখেছিল আখতার।
এবং আমার ধারণা প্রতিবারই লোকটা ছিল বিছা।
তারমানে একজায়গায় থাকা যাবে না আমাদের দুজনকে।
আমি থাকব কন্ট্রোলরুমে। দেখব কী করে আখতার। তুই কোথায় থাকবি?
জবাব দিল না রানা, এদিকওদিক তাকাচ্ছে। খেয়াল করল, এলিভেটরের ধাতব বাক্সটা নিচে নামার পরও ওটার সঙ্গে শাফটের দেয়ালের ফুটখানেক ব্যবধান রয়ে গেছে।
এলিভেটরের দিকে এগিয়ে গেল ও, ওটাকে পাশ কাটিয়ে ধাতব ফ্রেম বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর, অনেকটা রেললাইনের মতো, সমান্তরাল দুটো ফ্রেমকে অনুভূমিকভাবে সংযুক্ত করেছে আরেকটা ধাতব ফ্রেম। ও রকম প্রথম ফ্রেমে পাছা ঠেকিয়ে বসল রানা, একদিকের কাঁধ যতখানি সম্ভব ঠেকিয়ে দিয়েছে শাফটের দেয়ালে। দুপা ঝুলিয়ে না রেখে তুলে এনেছে অনুভূমিক ফ্রেমটার উপর।
এলিভেটরটা চালু কর তো, আওয়াজ দিল সোহেলকে।
রানার কোনও ক্ষতি হবে না নিশ্চিত হওয়ার পর এলিভেটর চালু করল সোহেল। রানার ফুটখানেক দূর দিয়ে চলে গেল ওটা। ধাতব বাক্সটা যখন চলে যাচ্ছে, তখন ওটা ভেদ করে ভিতরে দেখার চেষ্টা করল রানা। না, কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
তারমানে আখতার বা বিছা অথবা ওদের দুজনই যদি এলিভেটর দিয়ে নিচে নামে, ফ্রেমে ভর দিয়ে বসে থাকা রানাকে দেখতে পাবে না।
একে ফোর্টি সেভেনের বদলে এখন একটা বেরেটা কুগার পয়েন্ট ফোর ফাইভ অটোমেটিক পিস্তল রয়েছে রানার হাতে। অস্ত্রটা দ্রুত চেক করে নিল ও।
.
মরুর বুকে ঝড় তুলেছে ল্যাণ্ডরোভারটা, চালাচ্ছে বিছা। কোথাও অন্য কোনও ভেহিকেল নেই বলে স্টিয়ারিং ধরে গ্যাসপ্যাডেল চেপে রাখাই ওর কাজ, তাই গাড়ির পাশাপাশি চিন্তার ঘোড়াও ছুটিয়েছে।
নুমার ওই দুই এজেন্টের চেহারা যেন দেখতে পাচ্ছে সে চোখের সামনে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আমেনথেসের মতো শক্তিশালী একটা সংগঠনের উপর মরণকামড় হানল ওরা!
সারওয়ার বেঁচে আছে কি নেই তাতে কিছু যায়-আসে না বিছার। আখতারের কী হবে শেষপর্যন্ত তা নিয়েও খুব একটা চিন্তিত না। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছে সে। যদি বেঁচে থাকে, বদলা নেবেই সে ওই দুজনের উপর। প্রমাণ করে ছাড়বে, সে আসলেই বিছা! তারপর খেটেখুটে আবার দাঁড় করাবে দলটা। নেতৃত্বের দায়িত্ব তুলে নেবে নিজের কাঁধে। তারপর…
থাক, কাঁঠাল যখন গাছে তখন গোঁফে তেল দিয়ে লাভ নেই। নিজেকে সংযত করল বিছা।
প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে আখতার। একটা কথাও বলছে না। জানালার কাঁচ ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে আছে। কিছুই দেখার নেই, তারপরও কী দেখছে এত মনোযোগ দিয়ে, সে-ই জানে।
পাম্পিংস্টেশনটা নজরে আসামাত্র ব্রেক চাপল বিছা।
কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল আখতার।
স্টেশনের দিকে ইঙ্গিত করল বিছা।
একটা বিনকিউলার বের করল আখতার, তাকাল নির্দিষ্ট দিকে। হেলিপ্যাডে একটা হেলিকপ্টার দেখা যাচ্ছে।
ওটা তো আমাদের! বলল সে।
মাথা ঝাঁকাল বিছা। কী করছে ওটা ওখানে, সেটাই প্রশ্ন।
চোখ থেকে এখনও বিনকিউলার নামায়নি আখতার। দেখতে পাচ্ছে, একটা চাকাওয়ালা কার্ট ঠেলতে ঠেলতে বেরিয়ে এল ল্যাবের টেকনিশিয়ানরা। ওটা থেকে প্ল্যাস্টিকের ক্রেট তুলছে হেলিকপ্টারে। তিন বায়োলজিস্ট চড়ে বসল ওটাতে। আপাতদৃষ্টিতে যাকে পাইলট বলে মনে হচ্ছে, সে কিছুক্ষণের জন্য গিয়ে ঢুকল বিল্ডিঙের ভিতরে, তারপর বেরিয়ে এসে হেলিকপ্টার নিয়ে উড়াল দিল।
সব অ্যান্টিডোট নিয়ে গেল ওরা, বলল আখতার।
কিন্তু বড় কথা হচ্ছে, প্লান্টটা এখন সম্পূর্ণ খালি।
ঠিক বলেছ। মাস্টার পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে পাম্পগুলো রিপ্রোগ্রাম করব আমি। অ্যাকুইফার থেকে আবার পানি টানতে শুরু করবে ওগুলো। সবাইকে বুঝিয়ে দেব, এখনও কিস্তিমাত হয়নি আমেনথেসের।
আবার ছুটতে শুরু করল ল্যাণ্ডরোভারটা।
.
অপেক্ষা করছে রানা।
একসময় ঘুরতে শুরু করল এলিভেটরের গিয়ার, ওঠানামা করছে স্টিলের দড়ি। শাফটের দেয়ালের সঙ্গে যতখানি সম্ভব ঘেঁষে গেল রানা। ওকে ছাড়িয়ে আরও ফুট ত্রিশেক নিচে নামল এলিভেটর, থামল। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল দুজন লোক, হাঁটছে।
আখতারকে চেনে রানা, তাই বিছাকে চিনে নিতে অসুবিধা হলো না। ওদের দুজনের হাতেই ফায়ারআর্মস, উঁচিয়ে রেখেছে–ঝামেলার আশঙ্কা করছে সম্ভবত।
আখতারের হাতে মোটা নলের একটা পিস্তল। বিছা, বরাবরের মতো, বহন করছে লম্বা ব্যারেলের একটা স্নাইপার রাইফেল।
আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই এখানে, বলল আখতার, পিস্তল ঢুকিয়ে রাখছে হোলস্টারে। কোনও একটা জায়গা খুঁজে বের করে আমাকে কভার দাও। নুমার লোক দুটো তোমার চেয়েও বড় বিছা, কোন্ সময় হাজির হয়ে যাবে ঠিক নেই।
এদিকওদিক তাকাচ্ছে বিছা। রানার মতো এলিভেটর শাফটই পছন্দ হলো ওর, এগিয়ে গেল সেদিকে। রানার মতোই এলিভেটরের সামনে থামল, ওটার সঙ্গে শাফটের দেয়ালের ফারাকটা দেখছে।
অন্ধকার এখন একমাত্র আড়াল রানার। ইচ্ছা করলে দুই গুলিতে খুন করতে পারে বিছা আর আখতারকে, কিন্তু এখনও আক্রান্ত হয়নি ও। তা ছাড়া সম্ভব হলে জ্যান্ত ধরতে চায় ওই দুজনকে। তারপরও কুগার তাক করল বিছার চাদিতে, ট্রিগারে আঙুল।
কন্ট্রোলরুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আখতার। মেটাল ফ্রেম বেয়ে উঠছে বিছা। রানার ঠিক দশ ফুট নিচে থামল, রানার মতোই অন্ধকারের আড়াল নিল। কাঁধ থেকে খসিয়ে কোলের উপর রাখল স্নাইপার রাইফেলটা। চোখে অন্ধকার সওয়াতে সময় লাগছে ওর। কড়কড়ে রোদের মধ্যে গাড়ি চালিয়েছে এতক্ষণ, মরুর সাদা বালি সে-রোদের তেজ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
কন্ট্রোলরুমের দরজার সামনে থেমে দাঁড়িয়েছে আখতার। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, সম্ভবত বোঝার চেষ্টা করছে ঠিক কোথায় আছে বিছা। ওর মন বলছে দরকার নেই, তারপরও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় সাবধানে ঢুকল কন্ট্রোলরুমে।
অপেক্ষা করছে বিছা।
পাম্পগুলো মহাসমারোহে চলছে এখনও। অথচ এতক্ষণে কমে আসার কথা ছিল ওগুলোর আওয়াজ। করছে। কী আখতার? কীসের জন্য অপেক্ষা করছে?
বেশ খানিকটা ঝুঁকল বিছা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কন্ট্রোলরুমের দিকে। বিপদের আশঙ্কা করছে না, তাই রাইফেলটা আলগোছে ধরে আছে এখনও। একটা ছায়ামূর্তি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে কন্ট্রোলরুমের ভিতরে, কী যেন চেক করছে। একটু পর বসে পড়ল কন্ট্রোলের সামনে।
চমকে উঠল বিছা।
আরে! ওটা তো আখতার না!
বিছার দিকে পিঠ দিয়ে বসা ওই লোক অন্য কেউ।
কে সে?
একটাই মাত্র বিকল্পের কথা মনে পড়ল বিছার-মাসুদ রানা।
কোনও সন্দেহ নেই…হেলিকপ্টার নিয়ে উড়াল দেয়ার আগে পাইলট কী কাজে যেন ঢুকেছিল প্লান্টের ভিতরে। নিশ্চয়ই তখন ভিতরে ছিল রানা। নিশ্চয়ই আখতারের জন্য ফঁদ পেতেছে সে।
কিন্তু বিছার কথা ভুলে গেছে লোকটা।
রাইফেল তুলছে বিছা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই লাশ হয়ে গেছে আখতার। বিছার অনুমান, সাইলেন্সারওয়ালা পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়েছে লোকটাকে, তাই গুলির আওয়াজ শোনা যায়নি। কিন্তু বিছার কোনও সাইলেন্সারের দরকার নেই।
সে টের পাচ্ছে, ওর ধমনী আর শিরায় খরস্রোতা নদীর মতো ছুটছে রক্ত। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে অনেক, কী কারণে জানে না। একরাশ কালো চুলে ভরা মাসুদ রানার মাথা, নিশানা করল সে।
রাইফেলের ট্রিগার টানতে যাবে বিছা, এমন সময়, যে কাঁধে বাঁট ঠেকিয়েছে সেখানে আসল মাসুদ রানার প্রচণ্ড একটা লাথি খেল। ধাতব ফ্রেম বেয়ে নেমে এসেছে রানা টিকটিকির মতো নিঃশব্দে, অতি উত্তেজিত থাকায় কিছুই টের পায়নি বিছা।
রাইফেলটা ছুটে গেল বিছার হাত থেকে, নিচের আরেকটা ফ্রেমে আছড়ে পড়ে ধাতব সংঘর্ষের আওয়াজ তুলল ওটা। তারপর সোজা গিয়ে পড়ল জমিনে।
ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল বিছা ওর রাইফেলের মতো, দাঁতে দাঁত পিষে আঁকড়ে ধরল ফ্রেমটা। চট করে সরে এল কিছুটা দূরে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে, একইসঙ্গে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু আরেকটা ছায়ামূর্তির অস্তিত্ব ঠাহর করা যায়। বিছার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সে।
আত্মসমর্পণ করো, শান্ত গলায় বলল রানা।
কণ্ঠটা কার, চিনতে একটুও ভুল হলো না বিছার। আগুনলাগা বারুদের স্তূপের মতো বিস্ফোরিত হলো ওর রাগ।
বুদ্ধির খেলায় ওকে হারিয়ে দিয়েছে মাসুদ রানা। হারিয়ে দিয়েছে কৌশলেও। এবং লোকটা একবার না, একাধিকবার করেছে কাজটা।
কিন্তু সে জানে না, আত্মসমর্পণ করতে শেখেনি বিছা। ওকে শেখানো হয়েছে, হয় মারো নয়তো মরো, আমেনথেসের গুপ্তঘাতকদের একমাত্র নীতি।
একটা ছুরি বের করল বিছা, অন্যহাতে শাফটের দেয়ালে ভর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রানার দিকে।
আত্মসমর্পণ করো, আবারও বলল রানা।
জবাবে রানাকে লক্ষ্য করে ডাইভ দিল বিছা।
কুগারের ট্রিগারে পর পর তিনবার টান দিল রানা। আওয়াজটা এত দ্রুত হলো যে, মনে হলো মাত্র একবার গুলি করেছে ও।
রাইফেলের মতো বিছাও আছড়ে পড়ল জমিনে। ব্যথা টের পেল না–আগেই মারা গেছে।
.
যতক্ষণে কায়রোয় ফিরল রানা আর সোহেল, ততক্ষণে আমেনথেস ইন্টারন্যাশনালের ঠিকুজি বের করে ফেলেছে পুলিশ এবং অন্যান্য ডিটেকটিভ এজেন্সি। পেছনে থেকে ওদেরকে ব্যাকআপ দিয়েছে মিশরের সেনাবাহিনী।
একটা ডেটাবেই পাওয়া গেছে যাতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কবে, কার সঙ্গে, কত টাকার লেনদেন করেছে প্রতিষ্ঠানটা। কোন্ কাজের জন্য কাকে কত ঘুষ দেয়া হয়েছে, তা-ও লেখা আছে। অপারেটিভদের নাম পাওয়া গেছে। বিদেশি কোন কোন্ দেশের কোন্ কোন্ রাজনীতিক হাত মিলিয়েছিল, তা-ও জানা গেছে।
এসবে তেমন আগ্রহ নেই রানার; সোজা হাসপাতালে গেল ও লামিয়ার সঙ্গে দেখা করতে।
বেচারীর পায়ের মাংস ফুটো করে বেরিয়ে গিয়েছিল বুলেট, ক্ষতস্থান ভালোমত পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ করা হয়েছে। অনেক রক্ত হারিয়েছে, প্রচুর রক্ত দেয়ার পরও দুর্বলতা যায়নি। সুস্থ হতে সময় লাগবে।
রানাকে দেখে একটুখানি হাসল মেয়েটা। জ্ঞান হারানোর পর থেকে যা যা ঘটেছে, সব খুঁটিয়ে শুনল রানার কাছ থেকে।
ইটালি থেকে একটা মেডিকেল টিম হাজির হয়েছে। ওরা লামিয়াকে নিয়ে যাবে এয়ারপোর্টে, সেখান থেকে একটা বিশেষ প্লেনে করে ইটালিতে।
বেডস্ট্রেচারটা যখন বের করা হচ্ছে কেবিন থেকে, রানার একটা হাত ধরল লামিয়া। পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রানার দিকে। বলল, যদি একটা কথা জানতে চাই, কিছু মনে করবে?
মাথা নাড়ল রানা, বুঝতে পারছে কী বলবে লামিয়া। মেয়েটার হাত ধরে হাঁটছে।
কে তুমি?
মুচকি হাসল রানা, ওর অনুমান ঠিক হয়েছে। ধরে নাও তোমারই মতো কোনও ইন্টেলিজেন্সের লোক, অন্য কোনও দেশের।
চমকে ওঠার বদলে মিষ্টি হাসল মেয়েটা। আমার পরিচয় তোমার কাছে ফাঁস করল কে?
কেউ না। আমি বুঝে নিয়েছি।
কীভাবে?
যেসব তেলেসমাতি দেখিয়েছ তুমি এই কদিনে, সাধারণ একজন ডাক্তারের পক্ষে তা সম্ভব না কিছুতেই।
রানার হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরল লামিয়া। রানা, আসবে আমার সঙ্গে ইটালিতে?
অদ্ভুত কোনও আবেগ টের পেল রানা। ওটা ভালোবাসা না, মায়াও না। অল্প কিছুদিনের পরিচয়ে ওকে পছন্দ হয়ে গেছে মেয়েটার, ওকে শূন্যহাতে ফিরিয়ে দিতে খারাপ লাগছে।
সময় নেই, না? রানা চুপ করে আছে দেখে বলল লামিয়া।
কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে এখনও, বলল রানা।
কী কাজ?
আসিফ আর তানিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। অ্যাডমিরালের বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারে কী করল ওরা, জানতে চাই।
আফসোস হচ্ছে আমার। শেষপর্যন্ত থাকতে পারলাম না তোমার সঙ্গে।
ডিসুজার ওখানে বলেছিলে, তোমার অধীনে আছি আমি আর সোহেল। মিশন শেষ হয়নি এখনও, কাজেই এখনও তোমার অধীনেই আছি আমি। চিন্তা কোরো না, বিস্তারিত রিপোর্ট পৌঁছে দেব তোমার কাছে।
আমাকে খুঁজে পাবে কীভাবে?
পাব, একটুখানি হাসল রানা। ধরে নাও ওটা আমার এই মিশনের শেষ কাজ। তোমারও কিন্তু একটা কাজ বাকি রয়ে গেল।
কী?
আলবার্তো। তোমাদের ওই বদমাশ রাজনীতিবিদ। ধরাছোঁয়ার বাইরে যেন না থাকে সে।
থাকবে না। কথা দিলাম।
হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এসেছে ওরা। অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে লামিয়াকে। রানার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। রানাও দেখছে মেয়েটাকে।
কিছুক্ষণ পর প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ করতে করতে এয়ারপোর্টের দিকে ছুট লাগাল অ্যাম্বুলেন্সটা।
হোটেলের দিকে হাঁটছে রানা। কী যেন একটা কাঁটার মতো বিঁধে আছে মনে।
.
আসিফের সঙ্গে ফোনে কথা বলছে রানা। কী ঘটেছে দিনানে, জানাল আসিফ।
তারমানে লংবোটের পেইন্টিং এখনও রয়ে গেছে লাইব্রেরির ভিতরে? বলল রানা।
হ্যাঁ, মাসুদ ভাই।
ওটার ফ্রেমের কভার ছেঁড়ার সুযোগ পাওনি?
সুযোগ! প্রোক্টর খুনের ঘটনা নিয়ে মাতামাতি শুরু করেছে স্থানীয় পুলিশ। আমরা বলতে গেলে গা ঢাকা দিয়ে আছি। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত লাইব্রেরির কাছেও যেতে চাই না।
আচ্ছা, তোমাদের কেন মনে হলো ফ্রেমের ভিতরে মূল্যবান কিছু লুকিয়ে রেখেছেন অ্যাডমিরাল?
কারণ একটা চিঠিতে তিনি বলেছেন, সত্যি প্রকাশিত না হওয়াই ভালো। জানতে চেয়েছেন, তা হলে কি ওই অস্ত্র নৌকায় করে কোথাও পাঠিয়ে দেয়াই উচিত?
কী বললে? পিঠ খাড়া হয়ে গেছে রানার।
কথাটা আবার বলল আসিফ।
যত জলদি সম্ভব মাল্টায় চলে এসো তানিয়াকে নিয়ে, জরুরি গলায় বলল রানা। ডিসুজা দম্পতির বাসায় দেখা হবে তোমাদের সঙ্গে।
.
৩২.
টেলিভিশনের সামনে থেকে কিছুতেই সরতে পারছে না আলবার্তো। যা দেখছে, তা বিশ্বাস করতে পারছে না।
আমেনথেস হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রান্টে গিজগিজ করছে মিশরীয় পুলিশ আর সেনাবাহিনীর অফিসাররা। আমেনথেসের সব গোমর ফাঁস হয়ে গেছে। প্লান্টের পার্কিংলটে কিছুদিন আগেও দাঁড়িয়ে থাকত দামি দামি ল্যাণ্ডরোভার, এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে সেনাবাহিনীর জিপ, ট্যাঙ্ক আর ট্রাক।
খবরে বার বার বলা হচ্ছে, সব অপকর্মের হোতা সারওয়ার বিন জামাল নিহত হয়েছে। এবং ওর ডান হাত হুসাইন আখতার ধরা পড়েছে। ইন্টারোগেশনের জন্য ওকে নিজেদের জিম্মায় নিয়েছে মিশরের সেনাবাহিনী, কোনও সন্দেহ নেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে লোকটার। ভেঙে গেছে আমেনথেস, ধরা পড়েছে ওদের অনেকে, দেশি-বিদেশি আর কারা জড়িত ছিল ওদের সঙ্গে সে-তথ্য বেরিয়ে আসছে আস্তে আস্তে।
এখন কী করবে আলবার্তো? কী করা উচিত ওর? বুঝতে পারছে না সে।
টের পেল, প্রচণ্ড অস্থির হয়ে পড়েছে।
কলিংবেল বাজল এমন সময়। কেউ এসেছে।
কে? সদর-দরজায় গিয়ে জিজ্ঞেস করল পিয়োলা।
পুলিশ। দরজা খুলুন, সিনোর আলবার্তো।
আলবার্তোর মনে হলো, কয়েকটা স্পন্দন মিস্ করেছে ওর হৃৎপিণ্ড।
পুলিশ পৌঁছে গেছে ওর দরজায়? এত জলদি? তারমানে…।
সংসদের সদস্যপদ নিশ্চিত হারাবে আলবার্তো–যেন দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে। চোদ্দশিকের আড়ালে কাটাতে হবে বাকি জীবন, কোনও সন্দেহ নেই। সে মরার পরও চরম লাঞ্ছনা আর অপমান পিছু ছাড়বে না ওর।
সিনোর আলবার্তো! দরজায় কিল মারছে পুলিশের সদস্যরা। দরজা খুলুন!
ওয়ালকেবিনেটের দিকে এগিয়ে গেল আলবার্তো। একটা নাইন মিলিমিটার পিস্তল বের করল সেখান থেকে। মুখ হাঁ করে ভিতরে ঢোকাল পিস্তলের নল, টান দিল ট্রিগারে।
দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার পর পুলিশ বুঝল, দেরি হয়ে গেছে।
.
এটিন ডিসুজার আঁকা ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রানা। ওর একপাশে আসিফ, আরেকপাশে তানিয়া। আসিফের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার ডিসুজা, তানিয়ার সঙ্গে মিসেস ডিসুজা।
ছবিটা নামাতে হবে, বলল রানা।
কেন করতে হবে কাজটা, তা ইতোমধ্যেই জানিয়েছে রানা ডিসুজা দম্পতিকে।
সাবধানে নামানো হলো পেইন্টিংটা। ক্যানভাসের পেছনের লাইনিং কাটার কাজে ব্যবহৃত হলো একটা রেযর ব্লেড। ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিল রানা, বের করে আনল ভাজকরা বড় একটা পার্চমেন্ট। সেটার সঙ্গে আছে আরেকটা কাগজ, ওটাও ভাজকরা।
পার্চমেন্টের ভাঁজ খুলল রানী, নিয়ে গিয়ে বিছাল ডাইনিংটেবিলের কাঁচের উপর। হায়ারোগ্লিফিক্স চিনতে কষ্ট হয় না।
এবার অন্য কাগজটার ভাঁজ খুলল রানা। একেবারে শুরুতেই লেখা আছে:
কালো কুয়াশা।
নিচে লেখা: ডিসেম্বর, আঠারো শ পাঁচ।
তার নিচে বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে বানাতে হবে এবং সেটার অ্যান্টিডোট।
সত্যি প্রকাশিত না হওয়াই সম্ভবত ভালো, বলল রানা। টেবিলের কোনা ঘুরে চলে এল আরেকদিকে, মুখোমুখি হলে বাকি চারজনের। সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় হয়েছে আমাদের।
কীসের?
ইচ্ছা করলে ভয়ঙ্কর এই মারণাস্ত্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারি আমরা, ইচ্ছা করলে ধ্বংস করে দিতে পারি। কালো কুয়াশার ফর্মুলা যদি খারাপ লোকের হাতে পড়ে, তা হলে খারাপ কাজেই ব্যবহার করবে সে। সারওয়ার বিন জামাল তার প্রমাণ।
আগুন লাগিয়ে ছাই করে দিন এই পার্চমেন্ট আর কাগজ, বললেন ডিসুজা। আমার কোনও আপত্তি নেই।
আমারও না, বললেন মিসেস ডিসুজা।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রানা। সারওয়ারের ল্যাব ধ্বংস হয়ে গেছে, মারা পড়েছে ওখানকার বায়োলজিস্টরা, কাজেই আর উৎপাদিত হবে না কখনও।
কিন্তু অ্যান্টিডোট বানানোর তিন বায়োলজিস্ট তো… কথা শেষ করল না তানিয়া।
লাভ নেই। বানানোর থিয়োরি জানে ওরা, হাতেকলমে কখনও করেনি কাজটা। তিনজনে একসঙ্গে মিলেও কিছু করতে পারবে না। তা ছাড়া ও-রকম কোনও ইচ্ছাও নেই ওদের।
নিজ স্বার্থেই এবং সেটার অ্যান্টিভোট বানানোর জন্য আলাদা টিম গঠন করেছিল সারওয়ার, বললেন ডিসুজা।
মাথা ঝাঁকাল রানা।
.
বিসিআই হেডঅফিস, মতিঝিল, ঢাকা।
সোহেলের তৈরি-করা রিপোর্টের শেষাংশ পড়ছেন মেজর জেনারেল (অবঃ) রাহাত খান।
….এখনও রিভার্সাল মোডে চলছে আমেনথেসের সবগুলো পাম্প। নীল নদ থেকে পানি তুলে অ্যাকুইফারে ফেরত পাঠাচ্ছে ওগুলো। বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালন পানি দিয়ে ভরে যাচ্ছে লিবিয়ার লেক আর কুয়াগুলো।
প্রচণ্ড চাপে লিবিয়ার কোনও কোনও জায়গার মাটি ভেদ করে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো ছিটকে বের হচ্ছে পানি। ক্র্যাচে ভর দিয়ে ও-রকম এক আগ্নেয়গিরির কাছে গিয়েছিলেন খালিদ সাইফুল্লাহ, গোসল করেছেন সেটাতে, সে-দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করে পাঠিয়ে দিয়েছেন আসিফ আর তানিয়ার কাছে।
পানি ফিরে পাওয়ায় দাঙ্গা স্তিমিত হয়েছে দেশটাতে। গদি শেষপর্যন্ত হারায়নি বর্তমান সরকার। যারা কু করার চেষ্টা করেছিল তাদের বেশিরভাগকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দ্রুত পুনর্গঠিত হয়েছে তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়ার সরকার। আপাতত কোনও অশান্তি নেই দেশ দুটোতে।
বড় রকমের আন্তর্জাতিক ঝামেলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে গিয়েও বেঁচে গেছে মিশর। পদোন্নতি দিয়ে লুফর হোসেইনিকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীতে। আর্মি ইন্টেলিজেন্স পুনর্গঠনসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওকে।
আমেনথেস প্লান্টের মূল অফিসে ডিসুজার ডায়েরিটা রেখে আমাদেরকে মোকাবেলা করার জন্য নিচে নেমেছিল বিছা। ওটা পরে উদ্ধার করে হোসেইনি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে ওই ডায়েরি থেকে।
ফারাও আখেনেতেনের আমলে ওসিরিসের পুরোহিতরা প্রত্যক্ষ করেন, বুলফ্রগ খেলে যে-কোনও কারণেই হোক একরকম আচ্ছন্নতা পেয়ে বসে অল্পবয়সী কুমিরদের। ব্যাপারটা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে শুরু করেন তারা। ওই ব্যাঙের শরীর থেকে বিশেষ একজাতের ওষুধ বানিয়ে তা মানবদেহের উপর প্রয়োগ করে দেখেন, জীবন্মত অবস্থায় চলে যাচ্ছে সবাই। অস্ত্র হিসেবে নয়, বরং চিকিৎসার জন্য ওষুধটা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। নিজেদের মন্দিরে বুলগের গোপন সংরক্ষণাগার গড়ে তোলেন। এই ব্যাপারে কিছু লিপিফলক বানিয়ে সেগুলোও গোপনে সংরক্ষণ করা হয় কোনও কোনও মন্দিরে।
আমেনথেস প্লান্টের অদূরে গুহাব্যবস্থার উপস্থিতি টের পায় সারওয়ার বিন জামাল, পানি সরিয়ে ফেলে সেখানে নিজের গোপন ঘাঁটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। কেন্দ্রীয় শবপ্রকোষ্ঠে এমনকিছু লিপিফলক খুঁজে পায় সে, যা ওকে তৈরিতে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু প্রথম থেকেই ঠিক করে রেখেছিল সে, মানবজাতির বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে ওটা।
তবে আমরা অ্যান্টিডোট খুঁজে পাওয়ায় বেঁচে গেছে কালো কুয়াশার কবলে পড়া লিনোসার সব মানুষ। এখন আর কেউই ভর্তি নেই হাসপাতালে। সবাই ফিরে গেছে যার যার বাড়িতে, স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে…
ফাইলটা বন্ধ করলেন রাহাত খান। খালফানি গুলি করেছিল রানাকে। ওর ড্রাই স্যুটের ব্রেস্টপ্লেটে নিশ্চয়ই প্রতিহত হয়েছে বুলেট, না?
জী, স্যর, বলল সোহেল।
মাথা ঝাঁকালেন মেজর জেনারেল। ওয়্যারহাউসের ভিতরে ঢুকে পড়া সেই পুরুষ আর মহিলা কারা, জানা গেছে?
তখন আসলে আমার আর রানার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিল লামিয়া। ভেবেছিল, আমরা হয়তো নিজেদের দেখভাল নিজেরা করতে পারব না। তাই ওর টিমকে বলে দুজন এজেন্টকে নিয়ে আসে গেস্টের ছদ্মবেশে। ওরা যখন টের পায় নকল গার্ডদের নিয়ে ওয়্যারহাউস ঘিরে ফেলেছে আখতার, ঠেকাতে যায়।
হুঁ। রানা কোথায়?
আমার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে একজায়গায় গেছে।
তোমার কাছ থেকে ছুটি নিয়েছে! মানে?
আপনার কাছে চাইলে পাবে না, তাই আমাকে বলল ম্যানেজ করতে…
ভ্রূ কুঁচকে গেছে রাহাত খানের, টিপটিপ করতে শুরু করেছে কপালের একটা শিরা। কোথায় গেছে সে?
ইটালিতে। লামিয়ার কাছে।
কী!
বলল, মেয়েটাকে খুঁজে বের করা নাকি জরুরি…
কেন?
ওই ইটালিয়ান সৈন্যরা…টানেলের ভিতরে যাদের আর্মার্ড কার পেয়েছিলাম আমরা…ওরা ওখানে গেল কী করে সে-ইতিহাস জানতে চায়…ওদের আত্মীয়স্বজনকে জানানো…।
আরে রাখো তোমার ইতিহাস! আমি বুঝি না, না? রেগে গেছেন রাহাত খান, চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলেন কাঁচদেয়ালের দিকে। মতিঝিলের ব্যস্ত একটা রাস্তার উপর চোখ বুলাচ্ছেন। যাক-গে। ওকে আর শোধরানো গেল না। আর ওকেই বা দোষ দিই কী করে? চুম্বকের মত টানে ওকে ছুঁড়িগুলো।
মুচকি হাসল সোহেল, টেবিলের উপর থেকে ফাইলটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল মেজর জেনারেলের কামরা থেকে।