1 of 2

৪৩. স্বর্গ থেকে আসা আদেশ

অধ্যায় ৪৩ – স্বর্গ থেকে আসা আদেশ

খ্রিস্টপূর্ব ১০৪০ থেকে ৯১৮ সালের মাঝে চীনের ঝৌ রাজারা সাম্রাজ্য বিস্তার ও নিজেদের ভুলত্রুটি চিহ্নিত করার জন্য একটি যুক্তি খুঁজে পেল।

যদিও উ ছিলেন প্রথম ঝৌ রাজা, তবুও এই নতুন রাজত্বের প্রতীকী প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তার পিতা ওয়েন, যিনি শ্যাংদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধজয়ের আগেই দেহত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন পর কনফুসিয়াস মন্তব্য করেন : সম্রাট ওয়েন যে সংগীতের মাধ্যমে তার বিজয় উদযাপন করতেন, তা ছিল নিখুঁত ও সুন্দর। সে তুলনায় উ’র বিজয়-সংগীত ততটা সুন্দরও ছিল না, আর নিখুঁত হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। উ খুব সহিংসতার সঙ্গে শ্যাংদের রাজধানীতে লুটতরাজ ও হত্যাযজ্ঞ চালান, যা ছিল তার ওপর অর্পিত স্বর্গীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত বরখেলাপ।

কেউ চাননি অত্যাচারী শ্যাংরা ক্ষমতা ফিরে পাক। কিন্তু উ’র নতুন সাম্রাজ্যকে যত্নের সঙ্গে গড়ে তোলার বাধ্যবাধকতা ছিল। সিমা কিয়ান আমাদের জানান, উ তার রাজত্বের প্রথমদিকে স্বর্গের উদ্দেশে অনেক কিছু উৎসর্গ করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সর্বশেষ শ্যাং রাজের পাপ ধুয়ে-মুছে ফেলা। তিনি তার “ঢাল ও লম্বা কুড়ালগুলো একপাশে সরিয়ে রাখলেন, তার অন্যান্য অস্ত্রগুলো অস্ত্রাগারে সংরক্ষণ করলেন এবং সেনাদের বরখাস্ত করে অন্য কাজে নিয়োগ দিলেন। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে এই বার্তাই দিলেন যে-তার আর এসবের প্রয়োজন নেই।” সিংহাসনের দখল পেতে তিনি যে ‘পাগলামি’ করেছেন, এসব কাজ ছিল তারই প্রায়শ্চিত্ত।

নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে তিনি এসব উদ্যোগ নিলেও, এর প্রয়োজনীয়তাও ছিল। সিংহাসন ধরে রাখতে হলে উ-কে শুধু শক্তিমত্তা নয়, প্রভাব ও কৌশলেরও প্রয়োজন ছিল। শ্যাং রাজা গোত্রপ্রধানদের সম্মিলিত বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি। উ-কেও একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তিনি এমন এক রাজ্যের শাসক ছিলেন, যেখানে ছিল অসংখ্য শক্তিমান ব্যক্তিত্ব, যারা একনায়কসুলভ শাসকের শাসন মেনে নিতে প্রস্তুত নন। সিমা কিয়ান ‘৯ ভূখণ্ডের ৯ নেতার’ কথা বর্ণনা করেন। এরা ছিলেন ৯ জন গোত্রপ্রধান, যারা তাদের নিজ নিজ ভূখণ্ড শাসন করতেন এবং একইসঙ্গে রাজার প্রতিও অনুগত ছিলেন। ‘রেকর্ড অব রাইটস’ নামক গ্রন্থে (যেটি আরও শত শত বছর পরে লেখা হয়েছিল) ঝৌ রাজত্বের শুরুতে এরকম ১ হাজার ৭৬৩টি আলাদা আলাদা স্বায়ত্তশাসিত গোত্রের উল্লেখ রয়েছে।

উপহার ও উপঢৌকন দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি শিলালিপিতে ধারণ করে রেখে গেছেন সে-আমলের লোকেরা। সেখানে পুরো প্রক্রিয়াটিকে পিরামিডের মতো একটি জটিল কাঠামো দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। ৫টি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন কর্মকর্তা (পিরামিডের উপরে শীর্ষ কর্মকর্তা আর নিচের দিকে আরও নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তারা)। ২য় সারির কর্মকর্তাদের তাদের সেবার বিনিময়ে জমি দেওয়া হত।

অনেক ইতিহাসবিদ এই কর্মকর্তাদের ‘গোত্রপ্রধান’ বলে অভিহিত করেন। ঝৌ রাজার পুরো দেশের ওপর আধিপত্য ছিল, কিন্তু তিনি একজন মধ্যযুগীয় গোত্রপ্রধানের মতো চীনের সব জমির ‘মালিক’ ছিলেন না। তবে দেশ পরিচালনার পুরো অধিকার ও দায়িত্ব তার ছিল, যার মধ্যে জমিজমাও অন্তর্ভুক্ত। তিনি তার দেশের অভিজাত ও অবস্থাপন্ন নাগরিকদের ‘প্রশাসনিক অধিকার’ দিতেন, আর বিনিময়ে পেতেন তাদের বিশ্বস্ততা ও প্রয়োজনে সামরিক সহায়তার আশ্বাস। এভাবে একজন ‘জমিদার’ যখন ঝৌ রাজার সেবায় নিবন্ধিত হতেন, তখন তাকে শুধু জমির দায়িত্বই দেওয়া হত না, সঙ্গে কিছু প্রতীকী উপহারও দেওয়া হত, যার মাধ্যমে প্রমাণিত হত যে ঝৌ রাজা তার পবিত্র প্রশাসনিক অধিকারের কিছু অংশ তাকে দিয়েছেন। এই উপহারগুলো বেশিরভাগ সময়ই হত ব্রোঞ্জের তৈরি কোনো উপকরণ, যার মধ্যে শিলালিপি থাকত। কাউকে ব্রোঞ্জ উপহার দেওয়া হলে তা একইসঙ্গে ধনসম্পদ ও প্রতিপত্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত। এই ক্ষমতা এতটাই প্রবল ছিল যে, এর মাধ্যমে গোত্রপ্রধানরা শ্রমিকদের দিয়ে ভূগর্ভ থেকে ধাতু খুঁড়ে আনা, এগুলোকে বিভিন্ন আকার দেওয়া এবং এর গায়ে শিলালিপি লেখাতে পারতেন। ক্ষমতার সিঁড়ির একেবারে শীর্ষে ছিলেন উল্লিখিত ৯ গোত্রপ্রধান। তাদেরকে মহিমান্বিত করার জন্য ঝৌ রাজধানীতে ৯টি বিশেষ পাত্র তৈরি করা হয়েছিল।

এ-ধরনের ‘সামন্ততান্ত্রিক’ সম্পর্কের সঙ্গে পরবর্তী যুগের সামন্ততন্ত্রের বিস্তর পার্থক্য ছিল। পরবর্তী যুগের গোত্রপ্রধান, বা সামন্তপ্রভুরা শুধুমাত্র জমির ওপর নৈতিক কর্তৃত্ব নয়, একেবারে দলিলসহ মালিকানা দাবি করে বসতেন। নৈতিক অধিকার খুব শিগগির মুছে যেতে আপারে। উ নিজে তার ক্ষমতাকে সুসংহত রাখার জন্য রাজসভার ন্যায়পরায়ণতার ওপর অনেক বেশি ভরসা রেখেছিলেন। তিনি তার এক কনিষ্ঠ ভাইকে বলেন, ‘আমাদের মাঝে যারা অসাধু, তাদেরকে চিহ্নিত করে সরিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের পশ্চিমের ভূখণ্ডগুলোকে দখলে রাখার জন্য দিন-রাত মানুষকে পুরস্কার ও স্বস্তি দিতে হবে।’

তিনি শ্যাং রাজাদের রেখে যাওয়া ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতিও ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। উ তার দেশের রাজধানী সরিয়ে দুইটি শহরে নিয়ে যান। ফেং ও হাও শহরটি ফেংহে নদীর দুই পাড়ে ছিল। একইসঙ্গে তিনি উৎখাতকৃত রাজা চৌ’র ছেলে ও সিংহাসনের আগের উত্তরাধিকারীকে অন্যতম সামন্তপ্রভু হিসেবে নিয়োগ দেন। ছেলেটি পুরনো শ্যাং রাজত্বের একাংশের ওপর রাজত্ব করার অধিকার পেলেন। সিমা কিয়ানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সন্তানের নাম ছিল লু-ফু। তাকে প্রাক্তন রাজধানী ইন ও তার আশেপাশের এলাকার আধিপত্য দেওয়া হয়েছিল। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ইনে শান্তি নেমে এসেছিল, কিন্তু পরিস্থিতি তখনও ঘোলাটে ছিল।’

উ তার নিজের দুই ছোটভাইকে সাবেক-রাজপুত্রের সাহায্যকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। তবে আদতে এদের কাজ ছিল লু-ফুর গতিবিধির ওপর নজর রাখা। একপর্যায়ে উ মারা গেলেন এবং তার কর্তৃত্বের ফাটলগুলো সবার সামনে দৃশ্যমান হল। তার ছেলে তখনও বেশ কমবয়সি ছিল, যার ফলে ভাই ট্যান সিংহাসনের দায়িত্ব নিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে লু-ফু’র দায়িত্বে থাকা দুই ভাই পুরনো শ্যাং রাজত্বের মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটালেন।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুতুল-রাজ হিসেবে লু-ফুকে সিংহাসনে বসানো।

তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে ট্যান এই বিদ্রোহী বাহিনীকে দমন করলেন। লু-ফু ও ২ ভাইয়ের ১ ভাই সে-যুদ্ধে মারা পড়ল। ট্যান শ্যাংপন্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেন এবং রাজ্যের বিভিন্ন অংশে নির্বাসনে পাঠালেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শ্যাংদের ঐশ্বরিক ক্ষমতা বা অধিকারকে স্বীকৃতি দিলে তা শুধু বিপদই বাড়াবে।

প্রাচীন ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, ৭ বছর তরুণ রাজার প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করার পর ট্যান স্বেচ্ছায় রিজেন্টের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ততদিনে প্রাপ্তবয়স্ক যুবকে রূপান্তরিত হওয়া বৈধ শাসক চেং-এর কাছে ক্ষমতা বুঝিয়ে দেন। সব মিলিয়ে ট্যানের এই সিদ্ধান্ত বেশ ফলপ্রসূ হয়। দেশের জনগণ জানলেন, একজন নীতিপরায়ণ ও নির্লোভ মানুষ সুযোগ পেয়েও ক্ষমতা কুক্ষিগত করেননি, বরং অপর এক নীতিপরায়ণ মানুষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যাওয়ার কারণে উৎখাতকারী ও আগের রাজাকে হত্যার কালো ছায়া চেং-এর ওপর থেকে অনেকাংশেই সরে যায়।

ট্যাং তরুণ রাজা চেং-এর একজন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘ডিউক অব ঝৌ’ নামে পরিচিত ছিলেন। খুব সম্ভবত তিনি চীন রাষ্ট্রকে একটি উপযোগী ও কার্যকর আমলাতন্ত্র হিসেবে সুসংহত করে গড়ে তোলেন। সুসংহত করার অংশ হিসেবে ভূখণ্ডের নিরীক্ষণ, কর-ব্যবস্থা, বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও অন্যান্য জাগতিক উদ্যোগ ছিল। তবে ঝৌর ডিউকের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল রাজসভাকে ঘিরে সংঘটিত সব অনুষ্ঠানের বিস্তারিত বর্ণনা ‘দ্য বুক অব রিচুয়াল’ নামের একটি বইতে লিখে রাখা। ঝৌ রাজা চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণভাবে দেশ শাসন করতে; সর্বক্ষণ চাবুক হাতে বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার কোনো অভিপ্রায় তার ছিল না। এ-ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর হতে হলে তার স্বর্গীয় ক্ষমতা সবসময় সবার সামনে দৃশ্যমান থাকার প্রয়োজন। তাকে ঘিরে যেসব আয়োজন, সেগুলোই বহির্জগতের কাছে তার নৈতিক আধিপত্যের প্রমাণ।

রাজত্বের কেন্দ্রে নিজের ক্ষমতা সুসংহত হওয়ার পর চেং-এর জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াল কীভাবে এই ক্ষমতাকে সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আচার- অনুষ্ঠানের লিপিবদ্ধ বিবরণী দিয়ে সেসব মানুষকে চেং-এর আধিপত্য মানানো সম্ভব ছিল না, যারা রাজধানী শহর থেকে দূরে বসবাস করছিলেন। অন্য কোনো উপায়ের প্রয়োজনীয়তা ছিল।

চেং-এর জন্য তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের অংশটি সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল। সেখানে বসতি গড়েছিলেন শ্যাংদের অবশিষ্ট বংশধর ও সমর্থকরা। তাদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজন ছিল। এ কারণে ট্যান কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বপ্রান্তে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। এই দুর্গ একইসঙ্গে হোয়াংহো নদী দিয়ে কোনো শত্রু আসলে তাদের মোকাবিলা করতে পারত এবং একইসঙ্গে ঝৌ রাজধানীতে প্রবেশের পূর্বদিকের পথটিকেও সুরক্ষা দিতে পারত। এই দুর্গকে ঘিরে নতুন শহর লোয়াং গড়ে ওঠে।

চেং একইরকম কিছু স্থাপনা তৈরির জন্য তার রাজত্বের বিভিন্ন অংশে তার ভাইদের পাঠালেন। এতে দুইরকম সুবিধা ছিল। প্রথমত, তারা ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাওয়ায় তারা আর চেং-এর জন্য হুমকি রইলেন না। দ্বিতীয়ত, এই উদ্যোগের ফলে ঝৌ রাজত্বের বাইরের অংশগুলোও রাজকীয় আত্মীয়রা দেখভাল করতে লাগলেন। ফলে সার্বিকভাবে সাম্রাজ্যের ওপর ঝৌ-রাজের কর্তৃত্ব আরও দৃঢ় হল। জিন, ওয়েই, লু, কি ও ইয়েন নামের শহরগুলোকে ঘিরে প্রাচীন চৈনিক রাজত্বের বিস্তার ঘটতে লাগল। আজকের আধুনিক পিকিং (বেইজিং) শহর গড়ে ওঠেছে ইয়েনের ওপর।

যেসব গোত্র চেং-এর আধিপত্য মেনে নেয়নি, তাদের সঙ্গে তিনি এই সীমান্তবর্তী শহর থেকে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে নিজ রাজত্বকে নিরাপদ রেখেছেন। তবে একটি বিষয়ে তিনি সর্বদা সতর্ক ছিলেন। তিনি তার এই যুদ্ধকৌশলের পেছনে কখনো স্বর্গীয় অধিকার বা ক্ষমতার কথা উল্লেখ করতে ভুলতেন না। অর্থাৎ, কেন সহিংসতা ও রক্তপাতের দিকে অগ্রসর হলেন, এ প্রশ্নের সদাপ্রস্তুত জবাব ছিল : ‘আমাকে স্বর্গ থেকে এই অধিকার ও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, এর বরখেলাপ করার সাহস কীভাবে করি?’ তিনি তার অনুসারীদের সারাক্ষণ একথা বলে একের পর এক যুদ্ধযাত্রাকে ‘হালাল’ করতেন।

তিনিই ছিলেন প্রথম চৈনিক রাজা, যিনি স্বর্গ থেকে পাওয়া অধিকারের কথা বলেছিলেন। এই স্বর্গীয় ম্যান্ডেট চেংকে প্রয়োজন অনুযায়ী অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার দিয়েছিল। তিনি যুদ্ধে সফল হলে তার মধ্যে একটি স্বর্গীয় বিষয় থাকত। এটা একধরনের চক্রাকার যুক্তি ছিল (ঈশ্বরের জন্য যুদ্ধ করি, যুদ্ধ করলে তা ঈশ্বরের জন্যই করি), যার কোনো উদাহরণ এর আগে ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়নি।

৩০ বছর দেশ শাসন করার পর খ্রিস্টপূর্ব ৯৯৬ সালে চেং মারা গেলে তার ছেলে কাং সিংহাসনে বসলেন।

কাং রাজা তার সেনাপতির নৈপুণ্যে রাজত্বের উত্তর অংশটিকে আরও বিস্তৃত করেন। ঝৌ সেনাবাহিনী গিফাং নামের একটি উত্তরাঞ্চলীয় গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং তাদেরকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়। সেনাপতি গর্ব করে বলেন, ‘আমি ১৩ হাজার ৮১ মানুষ আটক করেছি। সঙ্গে অসংখ্য ঘোড়া, ৩০টি রথ, ৩৫৫টি ষাঁড় ও ৩৮টি ভেড়াও দখল করেছি।’

চীন দেশের মানুষের মুখ থেকে এ-ধরনের গর্বসূচক কথাবার্তা শুনে আমরা অভ্যস্ত নই। অ্যাসিরীয়রা এরকম বাগাড়ম্বরের জন্য বিখ্যাত ছিল। স্বর্গীয় অধিকারের বলে বলীয়ান ঝৌ-বাহিনীর নেতার মুখে এরকম কথা শোভা পায় না। ক্যাং-এর ছেলে ঝাও ৯৭৭ সালের দিকে ক্ষমতায় এলেন এবং তাৎক্ষণিক ভাবে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজ্য সম্প্রসারণের নতুন পরিকল্পনা হাতে নিলেন। ইতিহাস মতে, দক্ষিণাঞ্চলে অভিযান চালাতে তাকে প্রণোদিত করে একটি ধূমকেতুর আবির্ভাব। এ ঘটনাকে তিনি শুভ লক্ষণ হিসেবে ধরে নেন।

তবে আদতে এটি ধোঁকা হিসেবে প্রমাণিত হয়। বাঁশের গায়ে লিখে রাখা বয়ানে জানা যায়, ‘তিনি (ঝাও) ৬টি বাহিনী হারান এবং রাজা নিজেও নিহত হন।’ সিমা কিয়ান আরও এক ডিগ্রি বাড়িয়ে বলেন, ‘ঝাও রাজার আমল আসতে আসতে পূর্বে প্রতিষ্ঠিত সরকারব্যবস্থা ধসে পড়ে। রাজা ঝাও দক্ষিণাঞ্চলে অভিযানে যান এবং ফিরে আসতে ব্যর্থ হন। তার মৃত্যুসংবাদ সামন্তপ্রভুদের জানানো হয়নি। তার মৃত্যু নিয়ে কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। তারা রাজা ঝাও’র ছেলের অভিষেকের আয়োজন করলেন।’ শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও, এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয় ছিল। অপঘাতে বা যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর বিষয়টি ঠিক ‘স্বর্গীয় অধিকারের’ সঙ্গে খাপ খায় না।

ঝাও-এর ছেলে মু যখন টের পেলেন যে রাজধানীর প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ৬ বাহিনী পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে টিকে থাকতে হলে তাকে সেই স্বর্গীয় ম্যান্ডেটের রূপান্তর ঘটাতে হবে। তিনি যখন তার বাকি বাহিনীকে সমন্বয় করে আরও একটি উত্তরাঞ্চলীয় গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন, তখন চুয়ান-জাং নামের এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তি এর বিরোধিতা করলেন। তিনি দাবি করলেন, স্বর্গীয় অধিকার ‘অত দূর’ পর্যন্ত বিস্তৃত নয়। মু’ কে এই উচ্চবংশীয় ব্যক্তি বিশেষ জ্ঞান দিলেন। তিনি বললেন, তার সাম্রাজ্যটি একটি পেঁয়াজের মতো, যার ৫টি আবরণ বা খোসা আছে। রাজত্বের অভ্যন্তরে এর মূল অংশ। এর বাইরে হচ্ছে সতর্কতা অবলম্বনের অংশ, এর বাইরে কুক্ষিগত অঞ্চল, তার বাইরে বলিষ্ঠকৃত অঞ্চল এবং পরিশেষে, একেবারে বাইরের আবরণটি হচ্ছে বন্য অংশ।

মূল অংশ ছেড়ে যত বাইরে যাওয়া যাবে, ততই কমে আসবে স্বর্গীয় অধিকার বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা। এ বিষয়টি রাজধানী শহর থেকে শুরু করে বাইরের প্রতিটি অংশের বাসিন্দাদের পাঠানো উপঢৌকন বা নজরানার মাধ্যমে খুব সহজেই বোধগম্য হয়। যারা রাজধানীর একেবারে কেন্দ্রে থাকেন, তারা ‘সরবরাহ অঞ্চলের’ অন্তর্ভুক্ত, এবং তাদের কাছ থেকে দৈনিক নজরানা পাওয়াই হবে রাজার জন্য প্রত্যাশিত ব্যবহার। এরপর সতর্কতামূলক অংশ থেকে মাসিক ও কুক্ষিগত অংশ থেকে মৌসুমি উপহার এলেই রাজার খুশি থাকা উচিত। একইভাবে, বাকি দুই অংশের উপহার পাঠানোর কোনো বাধ্যবাধকতাই ছিল না। বলিষ্ঠকৃত অঞ্চল থেকে বছরে একবার উপঢৌকন আসত আর বন্য অংশ শুধু একবারই উপঢৌকন পাঠাতো, এবং তা রাজার মৃত্যুর পর শেষকৃত্যের সময়। চুয়ান-জাং ছিলেন বন্য অঞ্চলের বাসিন্দা এবং স্বর্গীয় অধিকার মতে তাদের ওপর নজরানা দেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। সুতরাং তাদেরকে আক্রমণ করাও হতো অহেতুক।

মু এই চিন্তাধারার সঙ্গে একমত হলেন এবং চুয়ান-জাং-এর কথা মেনে নিলেন। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে তিনি উত্তরে রাজকীয় পরিদর্শনে গেলেন এবং কিছু উপহারসহ (৪টি সাদা নেকড়ে ও ৪টি সাদা হরিণ) অক্ষত অবস্থায় রাজধানীতে ফিরে এলেন। তবে এখানেই ঘটনার শেষ নয়। সিমা কিয়ানের মতে,

এরপর থেকে, বন্য অঞ্চলের বাসিন্দারা আর কখনোই রাজধানীতে কোনো উপঢৌকন পাঠায়নি।’

স্বর্গীয় ম্যান্ডেটের চক্রাকার যুক্তি অবশেষে মু’র বিপরীতে চলে যায়। এই ম্যান্ডেটে যুদ্ধকে যুক্তিযুক্ত করা হয়েছে। এখানে স্বর্গ থেকে পাওয়া ক্ষমতা (ও রাজত্ব) রক্ষা করার জন্য সামরিক সক্ষমতা ব্যবহারের ‘স্বর্গীয়’ আধিপত্য ও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজয়ের পর এই ম্যান্ডেটটি সংশয়ের আবর্তে পড়ে যায়। এর পবিত্রতা ও যৌক্তিকতা বজায় রাখতে রাজাকে শুধুমাত্র সেসব যুদ্ধেই অংশ নিতে হত, যেগুলোতে তিনি নিশ্চিতভাবে জয়লাভ করবেন বলে ধারণা করতেন। তিনি তার রাজত্বের কেন্দ্রের শক্তিমত্তা বাড়াতে সক্ষম হন। সেখানে তার প্রজারা দৈনিক কর দিতে বাধ্য ছিল। সেখানে তার সভাসদরা তার জন্য প্রতিদিন স্বর্গীয় আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, কিন্তু এর বিনিময়ে তাকে রাজত্বের বাইরের দিকে অংশগুলোর মায়া ছেড়ে দিতে হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *