৩. অদ্ভুত এক সৃষ্টি
সমস্ত দেহটা যেন হঠাৎ একসময়ে কেঁপে উঠল। চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবে কি মড়া বাঁচল? তার সাধনা কি সফল হল?
না, চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভ। চোখ দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না সে জীবিত না মৃত। তিনি অধীর আগ্রহে সেই মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
হাতটা একবার যেন নড়ে উঠল। পরক্ষণেই মৃতদেহটি তার হাত তুলতে চেষ্টা করল। হাতটি কিছুদূর উঠে আবার পড়ে গেল!
তিনি আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন! যুগ যুগ ধরে সমগ্র মানবের যে কামনা ছিল–মানুষের প্রাণদান–তাই আজ তিনি সফল করেছেন। মড়া বেঁচেছে!!!
চোখদুটো কিন্তু এখনো তেমন পীতাভ, তেমন স্থির, জ্যোতিহীন, নিষ্প্রভ। হাত-পা–সবই অসাড়। যেন যোগাবিষ্ট হয়ে শুয়ে আছেন এক মহামানব। আর কত সময় লাগবে? বাঁচবে কখন, জাগবে কখন তাঁর সৃষ্ট এই মানুষ?
গাঁ গাঁ গাঁ…
গাঁ গাঁ গাঁ…
অস্ফুট এক শব্দে তিনি চমকে ওঠেন। সেই মড়াটির গলার ভিতর ঘড় ঘড় করে ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে তার হাত নড়ে উঠল। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তার হাত এগিয়ে দিলেন তার দিকে। সে তার দুটি আঙুল দিয়ে সজোরে ধরল তার হাত। তিনি অসহ্য যন্ত্রণায় হাত ছাড়িয়ে নিলেন। হাতে তার কালশিরা পড়ে গেছে। কী অমানুষিক শক্তি তার হাতে! এত শক্তি তিনি তার দেহে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন?
একবার তার ভয় হল–যে এখনো ভালোভাবে বাঁচেনি, তারই যখন এত শক্তি যে সামান্য দুটি আঙুলের জোরে সে তার হাতে কালশিরা ফেলে দিতে পারে–সে যখন বাঁচবে তখন সে তো অজেয় হয়ে উঠে যেখানে-সেখানে যা-খুশি তাই করে বেড়াবে, তাকে কেউ বাধা দিতে পারবে না–এমনকি নরহত্যাও করে বেড়াতে পারবে।
কিন্তু তারপর মনে হল: শক্তি আর হবেই, কিন্তু সে বেঁচে উঠলে মানুষই হবে— তার শক্তির অপপ্রয়োগ সে তো না করতেও পারে। তার সাধনাও তো এক শক্তিশালী অতিমানুষ তৈরি করা।
গাঁ গাঁ গাঁ…
গাঁ গাঁ গাঁ…
তীক্ষ্ণ চিৎকারে চমকিয়ে ওঠেন তিনি। টেবিলের উপর শুয়ে শুয়ে সেই মড়াটি ছটফট করছে। চোখদুটো তার ঠেলে যেন বেরিয়ে আসছে নাক দিয়ে তার ফোঁস ফোঁস শব্দ হচ্ছে। মড়া জাগে–মড়া জাগে!–
ঘোঁ…ওঁ…ওঁ…ওঁৎ
মড়াটি আবার চিৎকার করে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে মড়াটি হাত তুলল, আবার টেবিলের উপর রাখল। হাঁ করে দাঁত বের করতে লাগল–তারপর ধীরে ধীরে পা তুলল।
ফ্ল্যাঙ্কেনস্টাইন একদৃষ্টে তার দিকে নীরব বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন।
মড়াটি এবার আস্তে আস্তে উঠে টেবিলের উপর বসল। একবার চারপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল। এ সে কোথায় এসেছে। এই ঘর, এই বাড়ি-এর মধ্যেই কি সে মানুষ হয়েছে।
চারদিক অন্ধকার, বাইরে সারা আকাশ কান্নায় ভেঙে পড়ছে। দিকচক্রবালরেখা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কুয়াশায়। মড়াটি একবার পরিপূর্ণভাবে শীতল বাতাস অনুভব করল। তারপর টেবিলের উঠে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি পড়ল ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ওপর। চোখদুটো তার আনন্দে জ্বলে উঠল। তার স্রষ্টা! তার ভগবান!!
তার মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু তার স্রষ্টার মুখ ওরকম পাণ্ডুর কেন? চোখেমুখে ভয়ার্ত বিহ্বলতা কেন? সে টলতে টলতে এগিয়ে গেল ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, তার স্রষ্টার দিকে।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর থাকতে পারলেন না। দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে দরজাটা জোরে ভেজিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মড়াটি তখন দরজার ওপর প্রচণ্ডবেগে ধাক্কা দিচ্ছিল।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ক্ষোভে দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে তার শোবার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। এ কী হল? প্রাণসঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে এত সুন্দর মূর্তি এত কুৎসিত হয়ে গেল কী করে? এত সুন্দর চোখে তার ওই বীভৎস দৃষ্টি সে পেল কী করে? তার আজীবন সাধনার ব্যর্থতার কথা মনে করে তিনি কাঁদতে লাগলেন।
হল না, কিছুতেই মানুষ হল না–শেষপর্যন্ত কি না তিনি এক পিশাচ গড়ে ফেললেন! তার ভয় হতে লাগল, যখনই মড়াটি এক পা এক পা করে টলতে টলতে হাঁটবে, তখনই তার শরীর থেকে গলিত মাংসখণ্ড এপাশ ওপাশ ছড়িয়ে পড়বে–আর ওর পোশাকের মধ্যে যে শবকীট কিলবিল করছে, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে সেগুলো ছড়িয়ে পড়বে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন তার এই শোচনীয় ব্যর্থতার কথা। মাঝে মাঝে মনে করেন, ও-কথা আর ভাববেন না। তাই জোর করে ভাবতে বসেন। বাড়ির কথা–তার বাবা তাকে বারবার করে বাড়িতে ফিরতে লিখেছেন। ছোটভাই। আর্নেস্ট তার আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে একই কথা লিখেছে। উইলিয়ম লেখেনি, লিখতে পারলে নিশ্চয়ই ওই একই কথা লিখত। আর এলিজাবেথ! এলিজাবেথ লিখেছে– শবরীর প্রতীক্ষা করছে সে।
হঠাৎ তার মনে হল এলিজাবেথ যেন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি তাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করছেন।–কিন্তু এ কী! এ তো অনিন্দ্যসুন্দরী এলিজাবেথ নয়, এ যেন এক বহুদিনের মৃত কুশ্রী শব। আতঙ্কে তাঁর সমস্ত শরীর আড়ষ্ট হয়ে উঠল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল।
টেবিলের উপর রাখা বাতির অল্প আলো ঘরটাকে আবছায়া করে তুলেছে। হঠাৎ তিনি দেখেন জানলা ভেঙে তাঁর জীবন-ভোর সাধনার ফল, তারই অতুলনীয়। সৃষ্টি সেই মড়াটি সেই ঘরে প্রবেশ করল, তারপর তার অস্থি-সর্বস্ব আঙুল দিয়ে তাঁর মশারি তুলে ধরল। ভয়ে তখন তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। কী নিষ্প্রভ তার চোখ–যদি তাকে চোখ বলা যায়!
তার চোয়ালদুটো খুলল, আস্তে আস্তে মুখ হাঁ করল, কালো ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে সাদা দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠল। তারপর সে যেন কী বলার চেষ্টা করল কিছুই তিনি বুঝতে পারলেন না। সেই জীবন্ত কঙ্কালের মুখ দিয়ে শুধু বের হল খট খট করে কতগুলো শব্দ, যেন সমস্ত হাড়গুলো তার প্রচণ্ড বাতাসে নড়ে উঠল।
কোনো মানুষই এইরকম এক অপার্থিব জানোয়ারকে সহ্য করতে পারে না, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনও আর সহ্য করতে পারলেন না। ভয়ে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে তাড়াতাড়ি লেপ দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা দিলেন। কী বিভীষিকা সৃষ্টি করেছেন তিনি! লেপে একটু টান পড়াতে তিনি বুঝতে পারলেন যে সেই দৈত্যটা তা টেনে খুলতে চাইছে। তাই তিনি জোর করে সেটি টেনে ধরে থাকলেন। ধীরে ধীরে লেপের ওপর টান চলে গেল।
চারদিক নিস্তব্ধ রইল কিছুক্ষণ। তারপর খটখট শব্দে তিনি বুঝতে পারলেন সেই কঙ্কালটি চলে গেছে। তবু ভয়ে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না–কখন আবার সেই পিশাচ এসে পড়বে! কান পেতে তিনি সজাগ হয়ে রইলেন, কিন্তু কোনো শব্দই আর পেলেন না। ভয়ে তার বুক ধুকধুক্ করতে লাগল। মানুষের বদলে এ তিনি কী সৃষ্টি করেছেন? সৃষ্টির এ কী বিজাতীয় পরিহাস!
কখন একসময় ক্লান্তিতে ও আতঙ্কে তার ঘুম এসেছে, কিন্তু সেই ঘুমে কী যন্ত্রণা! মনে হল যেন লক্ষ লক্ষ নরকঙ্কাল হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠে সমস্ত পৃথিবী মাড়িয়ে, ভেঙেচুরে খানখান করে দিচ্ছে। মানুষের রক্তে এই শ্যামল পৃথিবী রাঙা হয়ে উঠছে, তিনি একা সেই রক্তসাগরে দাঁড়িয়ে এই তাণ্ডবলীলা দেখছেন, আর তারা তার দিকে তাকিয়ে বলছে–হে প্রভু, হে স্রষ্টা! তুমি দ্যাখো, তুমি দ্যাখো–তোমার সৃষ্টি পৃথিবীর কী সৌন্দর্য এনে দিয়েছে! তুমি যা চেয়েছিলে তা পেলে কি না!
হঠাৎ তীক্ষ্ণ আর্তনাদে তার ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে তিনি উঠে বসলেন তার বিছানায়। পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলেন ডক্টর নীল–চোখদুটো আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, মুখের সমস্ত রক্ত ব্লটিং দিয়ে কে যেন নিঃশেষ করে মুছে নিয়েছে।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে দেখে তিনি বললেন–ভূত, ভূত!
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলেন–ভূত নয়, ভূত নয়, ডক্টর নীল! আমার সৃষ্টি অতিমানব। উহ্, আমি কী করেছি। মানুষ গড়তে গিয়ে আমি এক পিশাচ গড়েছি!
ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন ডক্টর নীল। বললেন–এ সেই–সেই–
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উঠে বসলেন, বললেন–হ্যাঁ, সেই। এতদিনের প্রচেষ্টা, এতদিনের সাধনা—সব মিথ্যা, সব ব্যর্থ হয়ে গেল। কী নিদারুণ পরাজয়, ডক্টর নীল।
কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব।
হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–চলুন। দেখা যাক আমরা ওকে কী করতে পারি।
দুজনে ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দেখেন সেই পিশাচটা টলতে টলতে একটা ঘরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। তার পায়ের নিচে সমস্ত মেঝে যেন মটমট করে উঠছে।
পিশাচটা তাঁদের দেখে থামল। সেই বিবর্ণ পীতাভ চোখদুটো যেন কেমন হয়ে উঠল! সে আস্তে আস্তে দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। অস্থির মুখটা বোবা কথায় শুধু খটখট করে উঠল।
তাঁরা বিপদ গণলেন। ওই পিশাচের শক্তি-পরীক্ষা আগেই হয়ে গেছে। পিশাচটাকে এগিয়ে আসতে দেখে তাঁরা পিছু হটতে লাগলেন। ডক্টর নীল আর পারলেন না, একটা চেয়ার তুলে নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারলেন ওই দৈত্যটাকে।
এই হঠাৎ-আঘাতে দৈত্যটা থমকে দাঁড়াল। মুখ দিয়ে বের হল এক তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, তারপর দুহাত বাড়িয়ে সে দুজনের দিকে তেড়ে এল। চোখের দৃষ্টি তার যেন আরো নিষ্প্রভ, আরো করুণ হয়ে এসেছে।
বাইরে বেরিয়ে এসে তারা দরজা বন্ধ করে দিলেন। দৈত্যটা দরজা খোলার জন্য সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে। ঘরের ভেতর রাগ ও ক্ষোভের চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছে।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ছুটলেন দুটো হান্টার আনতে। ডক্টর নীল গেলেন তার কুকুর স্পর্কিকে আনতে। হান্টার আর কুকুর এনে তারা দরজা খুলেই দরজার দুদিকে লুকিয়ে পড়লেন।
দানবটা দরজা খুলে বাইরে এল। স্পর্কি সঙ্গে সঙ্গে তার ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ল; কিন্তু দৈত্যটা তাকে ঘাড় ধরে সজোরে আছড়িয়ে ফেলল মাটির উপর। তার আর নড়বার সামর্থ্য রইল না। সে আতঙ্কে ও বেদনায় কেউ কেউ করে করুণ নয়নে ওই অদ্ভুত জীবটির দিকে তাকিয়ে রইল।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এবং ডক্টর নীল হান্টার দিয়ে তাকে সপাং-সপাং করে মারতে লাগলেন। যন্ত্রণায় এবং রাগে সে আর্তনাদ করে উঠে দুহাত বাড়িয়ে দিল তাদের ধরবার জন্য কিংবা হয়তো সে আকুল মিনতি জানাতে চাইল এই অত্যাচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের! কিন্তু হান্টারের অসহ্য পিটুনিতে সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। কোথায় যাবে সে? কোথায় গিয়ে সে লুকোবে? তারা দুজন নিষ্ঠুর করালের মতো হান্টার চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু আর সে বেশিক্ষণ এই হান্টারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারল না–টলতে লাগল। তার হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে সে পড়ে গেল। পাশেই কুকুরটা ভয়ে কেউ কেউ করছিল। জ্ঞান হারাবার আগে দানবটা একবার তার হাত বাড়িয়ে কুকুরের গলা টিপে ধরল। স্পর্কি আর চিৎকার করতেও পারল না।
তাঁরা দুজন নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
.
৪. ল্যাবরেটরির বিভীষিকা
যখন তাদের সম্বিৎ ফিরে এল তখন তারা তাকে দড়ি দিয়ে খুব ভালো করে বেঁধে সেই ঘরে আটকিয়ে রেখে চলে গেলেন। বাইরের দরজায় ভালো করে লাগালেন তালা; সমস্ত জানালাগুলো ভালো করে আটকে রাখলেন। থাক সে কয়েকদিন বন্দিভাবে, অনাহারে। পরে নিজে থেকেই সে শান্ত হয়ে আসবে। তাকে ভয় করবার তখন আর কোনো কারণই থাকবে না। তারপর নিচের ঘরে গিয়ে তারা বসলেন।
.
এই দানবের কাহিনী আর গোপন রাখা চলবে না। এর কুৎসিত মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ তাকে ক্ষমা করবে না। দৈত্যটা যে জগতের একটা বিভীষিকা হয়ে থাকবে, তা ভালো করেই বুঝতে পারলেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। এখন একে হত্যা করা কী করে সম্ভব?
আকাশ পাতাল ভাবছেন তারা। এমন সময়ে দেখা গেল একটি বেয়ারার বিবর্ণ মুখ। তার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, হাত-পা ঠঠক্ করে কাঁপছে।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল–একটা ভূত জলের পাইপ বেয়ে নামছে।
ভূত! তারা তক্ষুনিই বুঝতে পারলেন কে সে! দুজনেই সচকিত হয়ে উঠলেন। কখনই-বা তার জ্ঞান হল, আর কী করেই-বা সে পালাল! ছুটে গেলেন দোতলায়, দরজায় তালা লাগানো ঠিকই আছে। দুজনে হান্টারদুটো তুলে নিলেন, বেয়ারাটাকে নিয়ে আসতে বললেন একটা কম্বল।
তিনজনে ছুটে বাগানে জলের পাইপটার নিচে এসে দাঁড়ালেন। ডক্টর নীল নিলেন কম্বলটা। তাঁদের হাতে আবার সেই হান্টার দেখে দানবটা পাইপ বেয়ে নামতে নামতে একবার থমকে দাঁড়িয়ে গোঁ-গোঁ করে উঠল, তার চোখদুটোতে এক উন্মত্ত হিংস্রতা ফুটে উঠল। বোধহয় একটু সে দ্বিধান্বিত হল–উপরে উঠে যাবে, না নিচে নামবে। তারপর হঠাৎ সে লাফিয়ে পড়ল বাগানের ওপর।
ডক্টর নীল ঠিক এই মুহূর্তের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলেন। দৈত্যটি মাটির উপর থেকে উঠবার চেষ্টা করার আগেই তিনি কম্বলটা নিয়ে তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে তার সর্বশরীর ঢেকে ফেললেন। দৈত্যটাকে কিছু বুঝতে দেওয়ার আগেই তাকে বন্দি করা হল, তারপর হান্টারদুটো তার গায়ে সাপের মতো লাফিয়ে উঠল।
দানবটা রুদ্ধ আক্রোশে ছটফট করতে লাগল কিন্তু হান্টারের তীব্র জ্বালায় ধীরে ধীরে আবার সে নিশ্চল হয়ে এল। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–কী বোকামিই-না করেছি! শুধু শক্তি দিয়েছি, প্রাণ দিয়েছি, কিন্তু বুদ্ধি আর বিবেচনা দিতে পারলাম না!!
দৈত্যটাকে নিয়ে গিয়ে আবার সেই ঘরে বন্ধ করে রাখা হল। এবার তাকে খুব ভালো করে বেঁধে রাখা হয়েছে, যাতে আর সে কোনো রকমে মুক্তি না পায়। সেই ঘরের বাইরে একটা বেয়ারাকে পাহারা রাখা হয়েছে তার ওপর লক্ষ রাখার জন্য, যাতে পালাবার সামান্যতম চেষ্টা করলেই তারা প্রস্তুত হতে পারেন।
দুদিন তাকে রাখা হল একেবারে অনাহারে। জলও তাকে দেওয়া হয়নি একফোঁটা। খেতে না পেলে সে নরম হবে, তার আগে নয়। তারপর অপারেশন করে এর শক্তি কমানোর না-হয় চেষ্টা করবেন।
তৃতীয় দিনে দানবটি নির্জীবের মতো হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের উপর। তার চোখ শুধু স্থির রয়েছে বেয়ারাটির দিকে। সে শুধু একবার মুক্তি চায়… মুক্তি, মাত্র একবার। তারপর সে দেখে নেবে কোথায় মানুষের অত্যাচারের সীমা, কতটুকু মানুষের ক্ষমতা কেমন-বা তাদের পৃথিবী!
বেয়ারাটি এক গ্লাস জল তুলে নিল। দৈত্যটির তাই দেখে চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়তে লাগল। যেন শত শত শতাব্দীর পিপাসা তার বুকে। কত থর, গোবি, সাহারা যেন সে নিরস্তু উপবাসে পার হয়ে এসেছে। আজ যেন শত শত যুগের তৃষাতুর মরু-যাত্রী দেবদারু ও দারুচিনি সমাকীর্ণ একটি ছায়াময় শীতল উপবন দেখেছে, তার মাঝে এক সুন্দর দিঘি জলে টলটল করছে।
একবার সে তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করল বাঁধন হেঁড়বার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে বিকট এক গর্জন করল–আঁ আঁ আঁ…
চমকে উঠল বেয়ারাটি। সেই পিশাচটির চোখে তখন দানবের ক্ষুধা, বাহুতে দানবের শক্তি, বুকে তার দানবের পিপাসা। প্রবল টানে বাঁধন গেল ছিঁড়ে, সে আর একবার আকাশ ফাটিয়ে বিজয়গর্বে চিৎকার করে উঠল–আঁ আঁ আঁ….
একনিমেষে সে জানলার গরাদ ভেঙে ফেলল, তারপর সেই দৈত্যটি কেড়ে নিল জলের গ্লাস। এক চুমুকে সে তা নিঃশেষ করল। তারপর ভয়-বিহ্বল মূক বেয়ারাটিকে তুলে নিল দুহাত দিয়ে এবং মাটিতে আছড়াতে লাগল। বেয়ারাটি চিৎকার করে উঠল। কিন্তু আজ সে রক্তের স্বাদ পেয়েছে। তার হাত থেকে বেয়ারাটির রক্ষার কোনো আশা ছিল না।
হঠাৎ সে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। বুঝতে পারল, তাকে ধরবার জন্যই এরা ছুটে আসছে। সে পালাবার জন্য দরজার দিকে এগোতে লাগল। দরজার সামনে এসেই কিন্তু সে থমকিয়ে দাঁড়াল। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এবং ডক্টর নীল তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। হতাশায় এবং বেদনায় সে আর্তনাদ করে উঠল।
‘ফায়ার প্লেস’ থেকে দুটো জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিলেন তারা। কাঠদুটোকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখে সে ভয়ে পিছু হটতে শুরু করল, সারা ঘর কাঁপিয়ে তার বিরক্তি জানাল–আঁ আঁ আঁ…
তারাও সেই আগুন নিয়ে তাকে কোণঠাসা করতে লাগলেন। আর উপায় নেই। দেখে নতুন শক্রর সঙ্গে বোঝাঁপড়া করবার জন্য সে আগুনের ওপর মারল এক থাবা। কিন্তু শত্রু যেন সমস্ত শরীরে তার বিষাক্ত সুচ ফুটিয়ে দিল। কী অসহ্য যন্ত্রণা!
চারদিকে তার শত্রু। আগুন তার লকলকে জিভ বের করে তেড়ে আসছে। হতাশায়, রাগে ও ক্ষোভে সে গর্জন করতে লাগল।
এ কোন্ জীব সে বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু এটি যে তার শত্রু, তা সে স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। তারা যে প্রকৃতির মতো নিষ্ঠুর হয়ে অসহায় নিরস্ত্রের ওপর পাশবিক উল্লাসে অত্যাচার করতে পারে, তা সে দেখেছে। কুকুরের মতো জীবের সঙ্গেও তার পরিচয় হয়েছে। কিন্তু এ কী ধরনের শত্রু যার চোখের জ্যোতিতে সমস্ত ঘর জ্বলে ওঠে–যার নিশ্বাসে অসহ্য তাপ, আর যার ললকে জিভ সমস্ত শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। মানুষ তাকে ভয় পায়, কুকুর তাকে ভয় পায়, কিন্তু এই নতুন শত্রু যেন তার দিকে রাক্ষসের মতো তেড়ে আসে। একবার এই আগুনকে তার শক্তি সে দেখিয়ে দেবেই।
.
সর্বাঙ্গ জ্বলতে শুরু করলেও সে সেই অগ্নিব্যুহ ভেদ করবার জন্য প্রবল বিক্রমে সংগ্রাম চালাল। কিন্তু কতক্ষণ সে আর অনাহারে দুর্বল শরীরে দাঁড়াবে? তার মাথা ঘুরছে, পা কাঁপছে–একবার সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বললেন–আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে। এখনি একে অপারেশন করে ফেলতে হবে।
ডক্টর নীল জিজ্ঞাসা করলেন–কিন্তু তাতে কি বিশেষ কোনো লাভ হবে?
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উত্তর দিলেন–দেখা যাক্। যদি না হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হত্যা করব।
দুজনে ধরাধরি করে অপারেশন টেবিলে দৈত্যটাকে তুললেন। দৈত্যটি মড়ার মতন নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে। এই অস্ত্রোপচার সে সহ্য করতে পারবে কি না সন্দেহ! যদি না পারে, যদি তার মৃত্যু হয়–সে-ও তবু ভালো। যার সাধনায় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তাঁর সমস্ত জীবন, বিদ্যা, বুদ্ধি ও শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন–সে যে তাকে এত বেদনা দেবে, তা তিনি ধারণা করতে পারেননি। তিনিই তার প্রাণ দিয়েছেন, যদি তার প্রাণ যায়ই–যা তাঁরই হাতে। তিনি পাশের ঘর থেকে অপারেশনের সাজসরঞ্জাম আনতে গেলেন।
.
ঘরে যেন চকিতে বিদ্যুৎ খেলে গেল। দৈত্যটি মুহূর্তের মধ্যে উঠে বসল এবং পরক্ষণেই ডক্টর নীলকে একটুও সময় না দিয়ে প্রবল শক্তিতে তার গলা টিপে ধরল। ডক্টর নীল একটুও শব্দ করতে পারলেন না। মুখের কষ বেয়ে এক ঝলক রক্ত নেমে এল শুধু।
দৈত্যটি তাকে মাটিতে ফেলে টেবিল থেকে নেমে দাঁড়াল। এখনি তার জীবনদাতা, তার স্রষ্টা আসবেন এ-ঘরে। আর এ-ঘরে থাকা তার পক্ষে উচিত হবে না। বড় কৌশলী আর বুদ্ধিমান এই মানুষ জাতটা। সে জানলা দিয়ে বাগানে লাফিয়ে পড়ল। পরক্ষণেই রাস্তায়। আজ মুক্তি মুক্তি!! তাকে বাধা দিতে আর কেউ কোথাও নেই। তার চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। তারপর দ্রুতগতিতে সে ঘনায়মান অন্ধকারে মিশে গেল।