৩.২৬-৩০ পুরো দুটো দিন ভুগিয়ে

৩.২৬

পুরো দুটো দিন ভুগিয়ে ধুম জ্বরটা ভোরের দিকে ছেড়ে গিয়েছিল হিরণের। আজ সকালে শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। মাথার টিপটিপ, কপালের দুপাশের রগগুলোর দপদপানি কি হাত পায়ের জোড়গুলোর চিবনো ভাব এখন আর নেই।

যুদ্ধের সময় অবনীমোহন রাজদিয়ায় হেমনাথের বাড়িতে সেই যে চা খাওয়া চালু করেছিলেন সেই অভ্যাস বিনুরা ছাড়তে পারে নি।

আজ সকালে জমাট মজলিশ বসেছিল। বিনু, হিরণ, সুধা, ঝিনুক। হিরণ বলছিল, দু’দিন জ্বরের জন্যে অফিসে যাই নি। ঝিনুকের অনারে আরও দুদিন যাব না। রবিবার এমনিতেই ছুটি। অফিসে যেতে যেতে সেই সোমবার।

কাল পর্যন্ত যে মেয়ে কুঁকড়ে ছিল, সেই ঝিনুককে এখন প্রায় চেনাই যায় না। ভয় লজ্জা অনিশ্চয়তা তার কাছ থেকে অনেক কিছু হরণ করে নিয়েছিল। ফের সেগুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে। কঠিন খোলা ভেঙে সে বেরিয়ে আসছে। বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে তাকে।

ঝিনুক বলল, খুব ভাল হয় তা হলে। এ ক’দিন আমরা অনেক গল্প করব। সে ভীষণ চাপা ধরনের মেয়ে। সেই কোন ছেলেবেলায় মা-বাবার সম্পর্কটা যখন থেকে বিষিয়ে উঠল, কেমন শুকিয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ চুপচাপ। জড়সড়। ভয়কাতর। স্নেহলতা, শিবানী, হেমনাথ এবং পরে সুরমা সুধা সুনীতি, এবং বিনু ছাড়া অন্য কারোর সঙ্গে সহজে কথা বলত না। তারপর দাঙ্গার সময় তার জীবন একেবারে তছনছ হয়ে গেল। তখন ঘরের কোণে কখনও আচ্ছন্নের মতো বসে থাকত। কখনও অফুরান কান্না।

একদৃষ্টে লক্ষ করছিল বিনু। বহুকাল পর ঝিনুককে কী ভালই না লাগছে! এমন উচ্ছ্বসিত শেষ কবে তাকে দেখা গেছে! মনে পড়ে না।

হিরণ বলছিল, শুধু ঘরে বসে বসে গল্পই করব নাকি? একেক দিন একেক জায়গায় তোমাদের বেড়াতে নিয়ে যাব। আজ বিকেলে যাব লেকের ধারে।

ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, লেক কী?

বাংলায় যাকে হ্রদ বলে। বেশ কয়েক বছর আগে মাটি কেটে কেটে ওটা করা হয়েছিল। চমৎকার বেড়াবার জায়গা।

হিরণ ধারাবাহিক ভ্রমণসূচি জানাতে থাকে। কাল সবাইকে নিয়ে সন্ধেবেলায় গানের জলসায় যাবে। পরশু যাদুঘর আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। আপাতত এই তিন দিনের কথা ভেবে রেখেছে।

তারপর হাওড়ায় বোটানিক্যাল গার্ডেন আছে। আছে দক্ষিণেশ্বর। বেলুড় মঠ। সার্কাস। সিনেমা। থিয়েটার। এই শহর হাজার দিকে হাজার মজা সাজিয়ে রেখেছে। যাও, ঢুকে পড়। দু’হাত ভরে আনন্দ তুলে নাও।

যত শুনছিল, চোখমুখ আলো হয়ে উঠছিল ঝিনুকের। তার জন্য এত আয়োজন, ভাবাই যায় না। মাথা থেকে স্থায়ী আতঙ্কটা ক্রমশ সরে যাচ্ছে। ত্রাসমুক্ত, ভারমুক্ত ঝিনুক ভেতরে ভেতরে যেন উচ্ছল বালিকা হয়ে উঠছিল।

বিনু তাকিয়েই ছিল। হিরণ আর সুধা ঝিনুককে অন্ধকার পাতাল থেকে আলোয় তুলে এনেছে। ছোটদি আর ছোট জামাইবাবুটির জন্য কৃতজ্ঞতায় তার বুক ভরে যাচ্ছিল। তারা সুনীতিদের বাড়ি গিয়ে কাল রাতে একটু কষ্ট করে, খুঁজে পেতে যদি সুধাদের কাছে চলে আসত! পরক্ষণে হালকা একটা ভাবনা বিনুর মাথায় ছায়া ফেলে যায়। হেমনলিনীর মতো সুধারাও যদি আবর্জনার মতো ঝিনুককে একধারে ফেলে রাখত! না, সে সব চিন্তা করার এখন আর কোনও মানে হয় না।

.

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর খানিকক্ষণ গড়িয়ে নিল হিরণরা। তারপর বেলা পড়ে এলে বেরিয়ে পড়ল। লেক এখান থেকে বেশি দূরে নয়। পায়ে হাঁটা দূরত্বে। হেঁটেই তারা চলে যাবে।

বড় রাস্তায় এসে ওরা ডানদিকের ফুটপাত ধরল। কাল আর আজ, মোট চার বার এখানে যাতায়াত করেছে বিনু। এখন ভাল করে লক্ষ করল, কলকাতার এদিকটায় তুলনায় মানুষজন কম। জমজমাট হয়ে উঠতে সময় লাগবে। ছাড়া ছাড়া বাড়িঘর, দোকানপাট, মাঝে মাঝে ফাঁকা জমি। উলটো দিকে খোলার চালের চাপ-বাঁধা বস্তি। অনেকটা এলাকা জুড়ে।

রাস্তাটা কিন্তু খুব পরিষ্কার। আবর্জনাশূন্য। মধ্যিখান দিয়ে ধাতব গুঞ্জন তুলে ট্রাম চলে যাচ্ছে। কোনওটা উত্তরে। কোনওটা দক্ষিণে। সেগুলোর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পাল্লা দিচ্ছে প্রাইভেট কার, ঘোড়ার গাড়ি আর পাবলিক বাস। কচিৎ দু’চারটে ট্যাক্সি। সেগুলোর স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে দাড়িপাগড়িওলা শিখ ড্রাইভার। বাস কন্ডাক্টররা সরু, মোটা আর খ্যাসখেসে গলায় যান্ত্রিক সুর টেনে টেনে হেঁকে যাচ্ছে, খালি গাড়ি। আসেন আসেন। কালীঘাট, ভবানীপুর, ধরমতল্লা’ কিংবা টালিগঞ্জ, রানীকুঠি, গড়িয়া–

এলোমলো কথা বলতে বলতে ওরা রেলব্রিজের তলায় চলে এল। মাথার ওপর রেল লাইন, তলায় মানুষজন এবং গাড়িঘোডা চলার পথ।

এই মুহূর্তে একটা ট্রেন কয়লার ধোঁয়ায় আকাশ কালো করে, সিটি বাজাতে বাজাতে পশ্চিম দিকে ছুটে যাচ্ছিল।

ঝিনুক জিজ্ঞেস করল, ট্রেনটা কোথায় যাচ্ছে হিরণদা?

হিরণ বলল, বজবজ।

অনেক দূর?

না, কাছেই। এখান থেকে সাত আট মাইল।

কী আছে সেখানে?

ওটা ছোট শহর। চারদিকে অবশ্য প্রচুর কলকারখানা–

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উলটো দিক থেকে আরেকটা ট্রেন এসে পড়ল। আগের ট্রেনটার পাশ দিয়ে হুস হুস ছুটে গেল পুব দিকে।

ঝিনুক জানতে চাইল, আর এই ট্রেনটা?

এটা যাবে শিয়ালদায়—

পরশু গোয়ালন্দ থেকে যেখানে এসে আমরা নেমেছিলাম?

হ্যাঁ।

দাঙ্গার সময় ঢাকা থেকে উদ্ধার করে আনার পর জগতের কোনও বিষয়ে লেশমাত্র আগ্রহ ছিল না ঝিনুকের। পৃথিবী নামে এই গ্রহের অস্তিত্ব একেবারে লোপ পেয়ে গিয়েছিল তার কাছে। ঘরের কোণে পড়ে থাকত অসাড় স্নায়ু নিয়ে। সারাক্ষণ মুহ্যমান। কখনও বুক নিঙড়ে বেরিয়ে আসত সকরুণ কান্নার ধ্বনি। সেই ঝিনুকই অপার কৌতূহলে জানতে চাইছে কোন ট্রেনের গন্তব্য কোথায়। হয়তো এই সব ট্রেনে কোনও দিনই তার চড়া হবে না।

কাল সন্ধে থেকে আজ বিকেল। মাত্র কুড়ি একুশ ঘন্টার মধ্যে ঝিনুককে আগাগোড়া বদলে দিয়েছে। সুধারা। অবাক চোখে ঝিনুককে লক্ষ করছিল বিনু।

রেল ব্রিজের তলা দিয়ে ডান ধারে খানিক গেলেই চিলড্রেন্স পার্ক। রংকরা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। ভেতরে কয়েক ডজন দোলনা। উঁচু থেকে গড়গড়িয়ে নামার জন্য বেশ ক’টা স্লিপ। পার্কটার কোণে কোণে সাজানো রয়েছে সিমেন্টের হাতি, ঘোড়া, হরিণ, এমনি নানা জীবজন্তু। একধারে। ডিমের আকারে ছোট সুইমিং পুল।

রঙিন পোশাক-পরা বাচ্চারা আঁক বেঁধে উদ্দাম ছোটাছুটি করছে। একটা দোলনাও কঁকা নেই। সেগুলো দখল করে দোল খাচ্ছে আরেকটা দল। দুঃসাহসী যারা, সিঁড়ি ভেঙে তেতলা সমান উঁচুতে উঠে স্লিপ কেটে তরতরিয়ে নেমে আসছে চোখের পলকে। তাদের ওপর নজরদারি করার জন্য রয়েছে মায়েরা কিংবা আয়ার দল। যে মেয়েদের বয়স একটু বেশি, সুইমিং পুল তোলপাড় করে তারা সাঁতার কাটছে। স্বপ্নের কটি জলপরী। কলরবে সারা পার্ক মুখর।

ঝিনুক বলল, কী সুন্দর বাগানটা–

সুধা বলল, হ্যাঁ। এটা শুধু বাচ্চাদের জন্যে।

পার্ক পেছনে ফেলে একটা নিচু লোহার গেট খুলে হিরণ যেখানে সবাইকে নিয়ে ঢুকে পড়ল, সেখানে বিরাট বিরাট সব গাছ। আকাশে ডালপালা মেলে কত কাল ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের তলায় নরম ঘাসে-ছাওয়া মাঠ। মাঠের পাশ দিয়ে সুবিশাল জলাশয়। হেমন্তেও প্রায় কানায় কানায় ভরা। সেটার কিনার ঘেঁষে বেড়ানোর জন্য ইট বাঁধানো রাস্তা। রাস্তার ধারে ধারে গ্যাস লাইটের সারি সারি পোস্ট।

হিরণ বলল, এই হল লেক–

ঝিনুক অনন্ত বিস্ময়ে বিপুল জলরাশির দিকে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, মাটি কেটে কেটে মানুষ এটা করেছে।

হিরণ হাসল, মানুষের অসাধ্য কিছু নেই ঝিনুক। ইচ্ছা করলে সে সব করতে পারে।

বিনুরাই শুধু নয়, চারপাশেরা ভ্রমণবিলাসীরাও চলে এসেছে এখানে। স্বাস্থ্য নিয়ে যাদের বাতিক, ফুসফুঁসে নির্মল বাতাস টানার জন্য তারাও হাজির। নানা বয়সের নারীপুরুষ। বড় বড় গাছের পেছনে জোড়ায় জোড়ায় তরুণ তরুণী। ওদের খুব সম্ভব একটু আড়াল দরকার।

আরও খানিকটা যাবার পর গাছপালা কমে এল। এখানে টানা ব্যারাকের ধাঁচে পর পর অনেকগুলো বাড়ি। কয়েকটা আস্ত রয়েছে। বাকিগুলো আধভাঙা।

ঝিনুক আঙুল বাড়িয়ে বলে, এগুলো কিসের বাড়ি?

হিরণ জানায়, বাড়িগুলো মিলিটারি ব্যারাক। যুদ্ধে গোড়ার দিকে সারা লেক জুড়ে টমিদের জন্য অগুনতি সেনাশিবির তৈরি হয়েছিল। যুদ্ধশেষে টমিরা চলে যায়। ব্যারাকগুলোর প্রয়োজনও ফুরোয়। এই ক’বছরে প্রায় সব ব্যারাকই ভেঙে ফেলা হয়েছে। যে কটা রয়েছে, সেগুলোর আয়ুও ফুরিয়ে এল বলে। লেকের পাড় থেকে মহাযুদ্ধের একটা স্মৃতি চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

ব্যারাকগুলো পেরিয়ে খোলামেলা বড় একটা জায়গায় এসে পড়ল সবাই। এখানে গাছপালা নেই, শুধু সবুজ ঘাসের গালিচা। একধারে লাইন দিয়ে বাদামওলা, ফুচকাওলা, আইসক্রিমওলা, ঝালমুড়িওলারা খদ্দের সামলাতে হিমসিম। এছাড়া রয়েছে গরম চা, গুলাবি রেউড়ি, ক্যান্ডি ফ্লস, কুড়মুড় ভাজা, এমনি রকমারি খাবার। হিরণ ঝিনুককে বলল, তোমাকে এমন একটা জিনিস খাওয়াব, জীবনে কখনও খাও নি। এমনকি চোখেও দেখ নি।

ঝিনুক উৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করে, কী জিনিস?

চলই না–

একটা ফুচকাওলার কাছে এসে সবাইকে ফুচকা দিতে বলল হিরণ। হাতে হাতে শালপাতার ঠোঙা ধরিয়ে, পরমাশ্চর্য দক্ষতায় ছোট ছোট লুচির সাইজের কড়কড়ে গোলকগুলো ফুটো করে, সেদ্ধ আলু মটর আর তেঁতুলগোলা জল ভেতরে ভরে, একের পর এক দিয়ে যেতে লাগল লোকটা।

এমন খাদ্যবস্তু সত্যিই আগে কখনও দেখে নি ঝিনুক। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লক্ষ করতে লাগল।

হিরণ তাড়া দেয়, কী হল, খাও–

ফুচকা তুলে মুখে পোরে ঝিনুক। সম-পরিমাণ টক ঝাল আর নুনের মিশ্রণে ভারি উপাদেয়। মুখের ভেতরটা অচেনা, অপূর্ব স্বাদে ভরে যায়। ঝিনুকের মনে হল, কলকাতায় কত কিছুই না পাওয়া যায়!

মাথাপিছু আটটা করে ফুচকা। সব মিলিয়ে চারজনে বত্রিশটা, মোট দাম ছ’আনা।

পয়সা মিটিয়ে দিয়ে হিরণ জিজ্ঞেস করে, ফুচকা কেমন লাগল?

মাথা অনেকখানি হেলিয়ে দেয় ঝিনুক, খুব ভাল–

ফুচকার পর হিমশীতল আইসক্রিম। চকোলটের পুরু কোটিং লাগান। একেকটা দু’আনা। আইসক্রিমের পর চার ঠোঙা ঝালমুড়ি কিনল হিরণ।

ফুচকা এবং আইসক্রিম খেয়ে পেট বোঝাই হয়ে গিয়েছিল। ঝিনুক সুধা বিনু, সবাই প্রবল আপত্তি জানায়। এখন আর কিছু খাওয়া সম্ভব নয়।

হিরণ বলল, এগুলো আমাদের জন্যে নয়। মাছেরা খাবে।

ঝিনুক অবাক, এখানে মাছ কোথায়?

আছে আছে। চল–

ফুচকাওলা আইসক্রিমওলাদের পেছনে ফেলে কোনাকুনি বাঁ দিকের সরু রাস্তা ধরে একটা পুলের কাছে চলে এল ওরা। কাঠের পাটাতন-বসানো ঝুলন্ত সাঁকোটা এত সরু, তিনজনের বেশি পাশাপাশি চলতে পারে না। লেকের মাঝখানে একটা ছোট্ট দ্বীপে গিয়ে ওটা নেমেছে। দ্বীপটার এক ধারে ছোট্ট মসজিদ। সাদা ধবধবে।

পুলের ওপর বেশ কিছু লোকজন। দু’ধারের রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে জলে মুড়ি ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে।

হিরণরা সাঁকোর মধ্যিখানে এসে ভিড়ের ভেতর জায়গা করে নেয়। নিচে আঙুল বাড়িয়ে সে বলে, ওই দেখ–

মুড়ি ফেললেই ঝাকে ঝাকে মাছ জলে ঘাই মেরে মেরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বেশির ভাগই বিরাট বিরাট আকারের বয়স্ক রুই, কাতলা আর মৃগেল। বেশ ক’টা কালবোসও। সেগুলোর গায়ে পুরু শ্যাওলা। ছোট মাছগুলোকে তারা কাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছে না।

এই সব বড় মাছের কয়েকটার দক্ষতার তুলনা নেই। মুড়ি জলে পড়ার আগেই জল থেকে দু’তিন হাত উঁচুতে লাফিয়ে উঠে হাঁ করে মুখের ভেতর পুরে ফেলছে।

হিরণ ঝিনুককে বলে, কিরকম প্র্যাকটিস করেছে, দেখেছ! দাও দাও, ওদের মুড়ি দাও–

ওপর থেকে মুড়ি ছড়াতে ছড়াতে একেবারে বালিকা হয়ে যায় ঝিনুক। তার দু’চোখে খুশি চলকাতে থাকে, উঃ, কত মাছ হিরণদা!

ঝিনুককে যত দেখছে, বিস্ময়টা ধাপে ধাপে বেড়েই চলেছে বিনুর। কত কাল পর তাকে এমন উচ্ছ্বসিত, এমন খুশি হবে দেখছে সে!

হিরণ বলল, সারা লেকটাই মাছে বোঝাই। মাঝে মাঝে ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট টিকেট বেচে বড়শি দিয়ে ধরতে দেয়। গেল বছর কী হয়েছিল, জানো?

কী?

একটা সাড়ে চার সের ওয়েটের কালবোস ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম–

সুধা ঠোঁট বাঁকিয়ে ভ্রুকুটি হানে, কাঁচকলা—

ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, মানে?

মাছ ধরেছে না, ছাই। লেক মার্কেট থেকে কিনে নিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন ধরে চার তৈরি করা, বন্ধুদের সঙ্গে দিনরাত হইহই করে পরামর্শ। তার রেজাল্ট কী হল? কপাল কুঁচকে বুড়ো আঙুল নাচাতে লাগল সুধা। পরক্ষণে বলল, খালি হাতে কী করে বাড়িতে ঢোকে! মুখরক্ষার জন্যে বাজারে ছুটেছিল।

হিরণ কপট রাগে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, এই, একদম বাজে কথা বলবে না। আমার সঙ্গে যারা মাছ ধরতে গিয়েছিল তারা তোমাকে বলে নি?

সুধা একটুও দমে না, চোরের সাক্ষী গ্রন্থিছেদক– বি. এতে তার সংস্কৃত ছিল। গ্রন্থিছেদক তারই নমুনা।

হিরণ এবং সুধার এই খুনসুটিটা বড়ই মনোরম। ভীষণ মজা পাচ্ছিল বিনু আর ঝিনুক। বিনু খুঁচিয়ে দেবার জন্য বলে, ছোটদি যা বলল তা কি সত্যি?

হিরণ বলল, তুমিও পেছনে লাগলে? ঠিক আছে, আসছে মাসে ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট আবার মাছ ধরতে দেবে। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আসব। সেবার সাড়ে চার সের ওজনের কালবোস ধরেছিলাম। এবার মিনিমাম দশ সেরের কাতলা তুলব। নিজের চোখে দেখলে বিশ্বাস হবে তো?

নিশ্চয়ই। ছোটদির টা ফো তখন আর চলবে না। কিন্তু—

আবার কী হল?

রাজদিয়ায় থাকতে কোনও দিন তো আপনাকে মাছ ধরতে দেখিনি।

কলকাতায় এসে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এই নতুন নেশাটা ধরেছি। নিষ্পাপ নেশা কিন্তু– বলতে বলতে হিরণের নজর গিয়ে পড়ল ঝিনুকদের হাতের দিকে, আরে, ঠোঙা এখনও অর্ধেক খালি হয় নি। মাছেদের দাও–

আবার মুড়ি ছিটনো শুরু হয়। একেকটা ঘাঘী মাছ চতুর খেলোয়াড়দের মতো মুড়ি লুফে নিচ্ছে আর মাথা ঝাঁকিয়ে মাকিয়ে হেসে কুটিপাটি হচ্ছে ঝিনুক।

মৎস্য ভোজন শেষ হলে হিরণ বলল, অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি হয়েছে। চল, ওধারে গিয়ে একটু বসি—

সবারই তাই ইচ্ছা। হাঁটাহাঁটিই শুধু নয়, বেশ খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছেদের খাওয়ানো হয়েছে। পা ধরে গেছে। এখন জিরানো দরকার।

পুল পেরিয়ে দ্বীপে এল হিরণরা। একধারে মসজিদ। আরেক দিকে জলের পার ঘেঁষে বাসার জন্য লম্বা, সাদা ক’টা বেঞ্চ। সেগুলোর পায়া সিমেন্টে গাঁথা।

সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ে। দ্বীপের দু’ধারে যতদূর চোখ যায়, দিগন্ত অব্দি অথৈ জলের বিস্তার। শেষ বিকেলের সোনালি আলো লেকের স্বচ্ছ জলে টলমল করছে। এখনও কুয়াশা পড়তে শুরু করে নি। মেঘলেশহীন আকাশের নীল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ডানা মেলে ভাসছে ক’টা পাখি। শঙ্খচিল? নিচের পৃথিবী থেকে চেনা যায় না। বাতাস বয়ে যাচ্ছে উত্তর থেকে। স্নিগ্ধ। ঝিরঝিরে। মালিন্যহীন। লেকের দক্ষিণ দিক দিয়ে একটা ট্রেন ধোঁয়ায় আকাশ মলিন করে ঝকর ঝকর ছুটে গেল। বেশিক্ষণ নয়, হেমন্তের হাওয়া কয়েক লহমায় সব ময়লা মুছে দিল। আকাশ ফের যেমনকে তেমন।

চারদিকের গাছপালার মাথায়, নিবিড় সবুজ ঘাসে, সামনের পুলটার গায়ে হেমন্তের অপার্থিব মায়া যেন মাখানো।

ঝিনুকের পুরনো কৌতূহলগুলো ফের ফিরে আসে, আচ্ছা হিরণদা, আসার সময় যে রেল লাইন দেখেছিলাম, সেটাই কি ওখান দিয়ে গেছে?

হিরণ মাথা নাড়ে, হ্যাঁ—

এই লেকটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে?

একধারে সেই চিলড্রেন্স পার্ক–কোনাকুনি হাত বাড়িয়ে হিরণ বলল, আর ওধারে ঢাকুরিয়া পর্যন্ত।

হঠাৎ চোখে পড়ল, পশ্চিম দিকে একজোড়া সরু লম্বা বোট ঝুলন্ত সাঁকোর তলা দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে এল। একেকটা বোটে চারজন। সবার একই রকম পোশাক। দুধসাদা হাফ প্যান্ট আর হাফ-হাতা গেঞ্জি। হাতে একই মাপের লম্বা লম্বা দাঁড়। দাঁড়গুলো একসঙ্গে জলে পড়ছে। একই ছন্দে। জল তোলপাড় হয়ে ঢেউ উঠছে উঁচু উঁচু। সাঁই সাঁই ছুটে যাচ্ছে বোট। হেমন্তের বোদ শতখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা লেকে।

মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল ঝিনুক। পলকে দুই বোট অনেক দূরে চলে যায়। সে জিজ্ঞেস করল, এখানেও আমাদের দেশের মতো বাইচ খেলা হয়?

হিরণ মাথা সামান্য হেলিয়ে দেয়, হু। ইংরেজিতে বলে রোয়িং। ওপারে গোলাপি রঙের একতলা একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, ওটা রোয়িং ক্লাব। ওখানে বোট চালাতে শেখানো হয়। সে আরও জানায়, মাসখানেক পর এখানে রোয়িং কমপিটিশন হবে। ভারতবর্ষের নানা অঞ্চল থেকে কমপিটিটররা এসে প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে।

ঝিনুক দেখতে পেল, ওখানে জলের ধার ঘেঁষে লাইন দিয়ে অনেকগুলো কঁকা ছিপ নৌকো। বেশ কিছু লোকজন রোয়িং ক্লাবের সামনের প্রশস্ত লনে বেতের চেয়ারে বসে আছে। অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তাদের হাতে লম্বা দাঁড়। খুব সম্ভব বোটে ওঠার তোড়জোড় চলছে।

রোদ আরেকটু মরে এলে হিরণ সবাইকে নিয়ে উঠে পড়ে। চল, সাদার্ন অ্যাভেনিউর দিকটা  দেখিয়ে আনি।

সেতু পেরিয়ে গল্প করতে করতে সবাই খুব চওড়া একটা রাস্তায় চলে আসে। দু’ধারে চওড়া ফুটপাত। কোথাও ধুলোময়লা জমে নেই। পরিচ্ছন্ন। ছিমছাম।

রাস্তাটার দুপাশে গাড়ি চলাচলের জন্য মসৃণ পথ। মাঝখানে বড় বড়, চতুষ্কোণ আইল্যান্ডগুলো ঘন সবুজ ঘাসে ঢাকা। কোনও কোনওটায় আঁকাবাঁকা, গভীর গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে। যেখানে যেখানে ঘাসের জমি, গর্ত নেই, সেখানে বাঁশের গোলপোস্ট পুঁতে ছেলেরা ফুটবল খেলছে।

যে আইল্যান্ডগুলোতে গর্ত, সেগুলো দেখিয়ে ঝিনুক বলে, এত সুন্দর জায়গায় এমন বিশ্রী খোঁড়াখুঁড়ি করে রেখেছে কেন?

হিরণ বলল, ওগুলো ট্রেঞ্চ। যুদ্ধের সময় জাপানি বোমার হাত থেকে বাঁচার জন্যে সাইরেন বাজলেই লোকজন গর্তগুলোর ভেতর ঢুকে পড়ত। সে বলতে লাগল, সাদার্ন অ্যাভেনিউর মাঝখানে যত আইল্যান্ড দেখছ, সবগুলোতে ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছিল। যুদ্ধের পর বেশির ভাগ বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। সেগুলোতে এখন ছেলেরা ফুটবল কি ক্রিকেট খেলে। বাকি গর্তগুলোও কর্পোরেশন শিগগিরই বুজিয়ে দেবে।

কিছুক্ষণ আগে লেকে ঢুকে ভাঙাচোরা সেনাশিবির দেখেছিল ঝিনুকরা, এখন দেখল ট্রেঞ্চ। মনে হল, মহাযুদ্ধের এমন স্মৃতি এখনও হয়তো এ শহরে আরও কিছু কিছু থেকে গেছে।  

যে ফুটপাত দিয়ে ওরা হাঁটছিল তার উলটো দিকে সারি সারি মস্ত মস্ত বাড়ি। বেশির ভাগেরই সামনের দিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগান।

রাস্তা পার হয়ে হিরণরা হাঁটতে হাঁটতে যেখানে চলে এল তার পাশে বিশাল এলাকা জুড়ে সাদা রঙের অগুনতি ব্যারাক। সেগুলোর মাথায় অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। রাস্তার দিকে বিরাট গেট।

ঝিনুক জিজ্ঞেস করে, এখানে কারা থাকে? মিলিটারিরা? খানিক আগে লেকের ও-প্রান্তে যে আধভাঙা ব্যারাক দেখেছিল সেগুলোর কথা তার মনে পড়ে গেছে। এই প্রশ্নটাই হয়তো তার মাথায় এসেছে, ওধারের ব্যারাক ভেঙেচুরে ফেললেও, এগুলো এখনও অটুট কেন? শুধু তাই নয়, বেশ সাজানো গোছানো। সব সেনা কি তা হলে চলে যায় নি?

হিরণ জানায়, যুদ্ধের আমলে এখানে তড়িঘড়ি মিলিটারি হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল। মালয় সিঙ্গাপুর বর্মা, কি দূর প্রাচ্যের রণাঙ্গনে যে সব ব্রিটিশ বা আমেরিকান সোলজাররা মারাত্মক জখম হয়ে পড়ত, তাদের চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে উড়িয়ে আনা হত।

যুদ্ধশেষে মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনী কবেই দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু হাসপাতালটা বন্ধ করা হয় নি। এর দরজা সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

হিরণ প্রায় বলতে যাচ্ছিল, ফি বেস্পতিবার যুগল এই হাসপাতালে আসে। পায়ের ঘা ড্রেস করিয়ে তাদের টালিগঞ্জের বাড়িতে চলে যায়। বলতে গিয়েও থমকে গেল।

যুগলের নাম শুনলে ঝিনুকের কী প্রতিক্রিয়া হবে, কে জানে। হিরণ শুনেছে, চেনাজানা কারোর সামনেই বেরুতে চায় না মেয়েটা। তার আতঙ্ক, পরিচিতেরা যেন তার দিকে আঙুল উঁচিয়ে জানিয়ে দেবে, ঢাকায় তোমার কী হয়েছে, আমরা সব জানি, সব জানি। তখন লজ্জায় গ্লানিতে দম বন্ধ হয়ে আসবে ঝিনুকের।

সামনের বেস্পতিবার অবধারিত নিয়মে যুগল তাদের বাড়ি আসবে। ঝিনুকের সঙ্গে তার দেখাও হবে। তখন কী হতে পারে, পরিষ্কার আঁচ করে নেওয়া যায়। চিন্তাটাকে এতটুকু আমল দিল না হিরণ। ভাবল, যা হবার হবে। বহুকাল বাদে যে ঝিনুক খুশিতে ঝলমল করছে, তার এই ক্ষণিক আনন্দটুকু এই মুহূর্তে যুগলের কথা তুলে কেড়ে নেওয়া যায় না।

আরও কিছুক্ষণ পর পশ্চিম দিকের উঁচু উঁচু বাড়ি আর গাছপালার পরপারে সূর্য ডুবে যায়। মিহি হিম পড়তে শুরু করে। ধীর পায়ে নেমে আসে হেমন্তের সন্ধে। চারদিকে অজস্র আলো জ্বলে ওঠে।

এই সময় হিরণরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বার বার বিনুর চোখ চলে যাচ্ছে ঝিনুকের দিকে। মাত্র একটা দিনের ভেতর কত বদলে গেছে মেয়েটা। কত উজ্জ্বল, কত জীবন্ত।

সুধা আর হিরণের সঙ্গে সমানে কল কল করছে ঝিনুক। হেসে উঠছে কথায় কথায়। মাঝখানের ক’টা বছর তার ভেতর যে জলপ্রপাতটা চাপা পড়ে ছিল, হঠাৎ সেটা বেরিয়ে পড়েছে।

হিরণ আর সুধার পরিকল্পনাটা অনেক আগেই ধরে ফেলেছিল বিনু। এই যে লেকে বেড়াতে নিয়ে আসা, ফুচকা আর আইসক্রিম খাওয়া, মাছেদের মুড়ি খাওয়ানো, জলের কিনারে বসে বাইচের নৌকোর ছোটাছুটি দেখা, সাদার্ন অ্যাভেনিউর ফুটপাত ধরে উদ্দেশ্যহীনের মতো ঘোরাঘুরি–অতি সামান্য, অতি তুচ্ছ এই ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে সুধাদের একটাই লক্ষ্য। দুঃস্বপ্নের মতো ঢাকার সেই কটা দিন তার স্মৃতি থেকে যাতে মুছে যায় সেজন্য সর্বক্ষণ, শতভাবে তাকে অন্যমনস্ক রাখা।

হিরণ বলছিল, আজ লেকে বেড়ানো হল। কাল তোমাদের কোথায় নিয়ে যাব, মনে আছে তো?

ঝিনুক ভুলে গিয়েছিল। উৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করল, কোথায় হিরণদা?

হিরণ বলল, জলসায়।

জলসা কী?

কাল গেলেই দেখতে পাবে।

.

৩.২৭

পরদিন সকালে চায়ের পর্ব চুকিয়ে হিরণ বলল, চল বিনু, বাজারটা সেরে আসি।

কাছেই দুটো বেতের মোড়ায় বসে ছিল ঝিনুক আর সুধা। বিনুর চোখ ঝিনুকের দিকে ঘুরে গেল। হয়তো নিজের অজান্তে, কিংবা স্বয়ংক্রিয় কোনও অভ্যাসে। সামান্য ইতস্তত ভাব। জিজ্ঞেস করল, হিরণদার সঙ্গে ঘুরেই আসি, কী বল?

রাজদিয়ায় হেমনাথের পুকুরঘাটে রাজেকের নৌকোয় ওঠার পর থেকে এক লহমাও বিনুকে চোখের আড়াল করতে চাইত না ঝিনুক। সবসময় তাকে আঁকড়ে থাকত। কোনও জরুরি কাজে কোথাও গেলে ভীষণ উতলা হয়ে উঠত। কেঁদেকেটে পৃথিবী উথলপাথল করে ফেলত। তখন দিবারাত্রি তার আতঙ্ক, বিনু কোথাও গিয়ে যদি ফিরে না আসে, কে তাকে দেখবে? চারপাশের সহস্র বিপদ থেকে কে তাকে রক্ষা করবে? এই বিপুল পৃথিবীতে সে হয়ে পড়বে সম্পূর্ণ একা, একেবারে অসহায়। ঢাকার সেই ধর্ষক বাহিনীর মতো অগুনতি হানাদার জগৎ জুড়ে থিক থিক করছে। বিনু আগলে না রাখলে জন্তুগুলো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে তার শরীরটা।

সেই ঝিনুকই হেসে বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে? যাও না—

হিরণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কাল থেকে ঝিনুককে যত দেখছে, বিস্ময়ের মাত্রাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যে মেয়েটা অসীম ত্রাসে আর উৎকণ্ঠায় নিজেকে শক্ত আবরণের মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছিল, খোলা ভেঙে একদিনেই সে বেরিয়ে এসেছে। ভালবাসার উত্তাপ কি সব শঙ্কা হরণ করে নেয়?

সুধার কাছ থেকে মাছ এবং আনাজপাতির জন্য আলাদা দু’টো চটের ব্যাগ নিয়ে বিনুকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়ল হিরণ।

রাস্তায় এসে পানের দোকান থেকে ছ’আনায় এক প্যাকেট ক্যাপস্টান নেভি কাট সিগারেট কিনে, একটা স্টিক বার করে ধরিয়ে নিল।

বিনু হাঁ হয়ে গিয়েছিল। রাজদিয়ায় থাকতে হিরণ ছিল নিপাট ভাল ছেলে। ছোট ছোট করে মাথায় কদমফুল ছাঁট দিত। বিলাসিতা বলতে কিছু ছিল না। নেশাভাঙের ধারেকাছে ঘেঁষত না। এমনকি দাঁতে সুপরি পর্যন্ত কাটত না। মুখশুদ্ধি বলতে শুধু যোয়ান কি লবঙ্গ। সেই হিরণ কিনা সিগারেট ধরেছে!

মজা করতে ইচ্ছা হল বিনুর, কলকাতায় এসে আপনার কিন্তু বেশ উন্নতি হয়েছে হিরণদা–

ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিল হিরণ। তার মুখে অপ্রতিভ হাসি ফোটে। মাথা চুলকে বলে, ডিফেন্সের চাকরিতে ঢুকে বন্ধুদের পালায় পড়ে বদভ্যাসটা হয়ে গেছে। হেমদাদু জানতে পারলে ঘাড় থেকে মুন্ডুটা ঘচাং করে নামিয়ে দেবেন। কতবার ভেবেছি, সিগারেটটা ছেড়ে দেব। কিন্তু হ্যাঁবিট একবার কাঁধে চেপে বসলে ছাড়ানো মুশকিল। কামড়ে ধরে থাকে।

বিনু উত্তর দিল না। হাসতে লাগল। নানা অচেনা অলিগলি দিয়ে তাকে নিয়ে ট্রামরাস্তায় চলে এল হিরণ। সেটা পেরিয়ে আরেকটা রাস্তা ধরে চওড়া একটা খালের ধারে পৌঁছতেই মস্ত বাজার। লম্বা, টানা টানা টিনের চালার তলায় দোকানের সারি। মাছের। মাংসের। ফলের। সবজির। কাঁসা এবং পেতলের বাসনের। এ ছাড়া মুদিখানা। দশকর্মা ভান্ডার।

চালাগুলোর বাইরেও খালের কিনার ঘেঁষে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা জুড়ে বিরাট বিরাট ঝকা বোঝাই করে নানা ধরনের আনাজ নিয়ে বসেছে দোকানিরা। দেখেই বোঝা যায়, এরা চাষী শ্রেণীর মানুষ। নিজেরাই সবজি ফলিয়ে বেচতে এসেছে।

খালে এখন ভরা জোয়ার। দু’কুল ছাপিয়ে ঘোলা জল খলবল করতে করতে ছুটে চলেছে।

হিরণ বলল, এটা হল আদিগঙ্গা। উত্তর দিকে আঙুল বাড়িয়ে জানায়, জলের এই ধারাটা কালীঘাটের পাশ দিয়ে চলে গেছে। ওপারে নিউ আলিপুর। যুদ্ধের পর ওখানে নতুন টাউনশিপ গড়ে উঠেছে। কলকাতার পয়সাওলা লোকেরা চমৎকার সব বাড়ি বানিয়ে ওখানে থাকে।

চাষীদের কাছে ঘুরে ঘুরে প্রচুর আনাজ নিল হিরণ। আলু, মোচা, পালং, ধনে পাতা, লাউশাক, সোনালি কুমডোর ফালি। হেমন্তের শুরুতেই ফুলকপি উঠতে শুরু করেছে। তাও চারটে কিনল। সতেজ, টাটকা সবজি। সেগুলোর গায়ে ভোরের শিশির আর মাটি এখনও লেগে আছে।

সবজির পর মাছ। তিন রকম. মাছ কিনল হিরণ। পাকা রুইয়ের পেটি। আড়াই টাকা সের। সঙ্গে মুড়োটা ফাউ। বড় পার্শে, সের দুটাকা। আর মৌরলা। মৌরলাটা অবশ্য সের দরে নয়। ভাগা দিয়ে রাখা ছিল। একেক ভাগায় পোয়া দেড়েকের মতো। দাম এক আনা।

বিনু অবাক হয়ে যাচ্ছিল। সুজনগঞ্জের হাটে কিংবা রাজদিয়া বা তালতলির বাজারে হেমনাথ আর যুগলের সঙ্গে কতবার সে গেছে। কিন্তু কোনও দিন দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে মাছ বেচতে দেখেনি। মাছ কেটে বিক্রির রেওয়াজই সেখানে নেই। আস্ত আস্ত রুই কাতলা গরমা বোয়াল কি কোড়াল ব্যাপারিরা বাঁশের কি বেতের বড় বড় চারিতে সাজিয়ে রাখত। দরদাম করে তারা কিনত।

বিনু বলল, সের দরে মাছ বিক্রি হয়, এই প্রথম দেখলাম।

হিরণ বলে, কলকাতায় অনেকদিন এই নিয়ম চালু আছে। বড় মাছ কেটে ওজন করে বিক্রি হয়। চুনো মাছ থাইকো।

খুব ছেলেবেলায় কয়েক বছর বিনু কলকাতায় ছিল। তখন এখানকার বাজারে কখনও যায় নি। মাছ কিভাবে বিক্রি হত, তার ধারণাই নেই। ভাল করে জ্ঞান হবার পর থেকেই তো সে রাজদিয়ায়।

বিনু বলল, দু’টাকা দিয়ে যে রুই মাছের টুকরোটা কিনলেন, ওই টাকায় সুজনগঞ্জের হাটে বিরাট একটা রুই কি কালবাউস পাওয়া যেত। কম করে সেটার ওজন চার থেকে পাঁচ সের।

হিরণ বলল, এটা কলকাতা শহর। এখানে সব জিনিসের দাম ইস্ট বেঙ্গলের চাইতে কয়েক গুণ বেশি।

নিজের চোখেই তা দেখেছে বিনু। সে আস্তে মাথা নাড়ে।

হিরণ থামে নি, যুদ্ধের সময় যখন চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসি, কাটা পোনা বার আনায় এক সের পাওয়া যেত। ক’বছরে দাম কত বেড়ে গেছে। এই যে বাড়া শুরু হয়েছে, আর কোনও দিন নামবে না।

বিনু উত্তর দিল না।

বাজার সেরে মিষ্টির দোকান থেকে হাঁড়িবোঝাই রাজভোগ আর সাদা ধবধবে চিনিপাতা দই কিনল হিরণ। দই-মিষ্টির হাঁড়ি বিনুকে দিয়ে মাছ আর আনাজের ব্যাগ নিজের হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছে সে। বলল, এক্ষুনি আমরা কিন্তু বাড়ি ফিরছি না।

বিনু বলল, কখন ফিরবেন?

হিরণ বলল, তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। সেখান থেকে বাড়ি ফিরতে হয়তো মিনিট পনের সময় বেশি লাগবে।

বিনু অবাক হচ্ছিল। থলে বোঝাই আনাজপাতি মাছটাছ নিয়ে কার সঙ্গে দেখা করতে চলেছে হিরণ? কৌতূহল হলেও কোনও প্রশ্ন করল না বিনু।

মুখ দেখে বিনুর মনোভাব আন্দাজ করে নিয়েছে হিরণ। একটু হেসে বলল, আমরা কারোর কাছেই যাচ্ছি না। তোমাকে একটা জিনিস দেখাব। সেই জন্যেই যাওয়া

কী দেখাবেন?

অত অধৈর্য কেন? চলই না–

ফের তারা ট্রামরাস্তায় চলে আসে। যে অলিগলি দিয়ে খানিক আগে বাজারে এসেছিল, সেদিকে গেল না হিরণ। অন্যদিকের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে চলতে লাগল।

এখানে ঝোপঝাড়ে ভরা কিছু কিছু ফাঁকা মাঠ, পানা পুকুর, ডোবা যেমন চোখে পড়ে, তেমনি রয়েছে খাপরা কি টিনে ছাওয়া চাপ বাঁধা বস্তি। পুরনো একতলা দোতলা তেতলাও রয়েছে। অনেকগুলো। দূরে একটা মাজারও দেখা যাচ্ছে।

বস্তির পাশ দিয়ে যেতে যেতে টের পাওয়া যায়, এগুলোতে গরিব মুসলমানেরা থাকে। দিন আনা, দিন-খাওয়া সব মানুষ। সামনের দিকে প্রচুর বাচ্চাকাচ্চা ছোটাছুটি করছে। মেয়েদের গায়ে শস্তা ময়লা ফ্রক। ছেলেদের দড়ি-লাগানো ছেঁড়াফাটা ইজের, জামা কি গেঞ্জি। এক পাল মুরগি তাদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিচ্ছে।

নানা বয়সের কিছু পুরুষ আর মেয়েমানুষও রয়েছে। পর্দার তেমন কড়াকড়ি নেই। সবাই একদৃষ্টে বিনুদের লক্ষ করছে। চোখে মুখে অস্বাচ্ছন্দ্য। নাকি ভয়? কিংবা শঙ্কা? ইন্ডিয়ায় নিরাপত্তার অভাবে কি তারা ভুগছে?

বস্তিটা পেরিয়ে এসে হিরণ বলল, ফর্টি সিক্সের ডাইরেক্ট অ্যাকশানের দিন এখান থেকে মিছিল বেরিয়ে গড়ের মাঠের দিকে গিয়েছিল।

বিনু চকিত হয়ে ওঠে। কলকাতার ডাইরেক্ট অ্যাকশান বা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ইতিহাস তার খুব ভাল করেই জানা। এই তো সেদিনের কথা। লোকের মুখে তো শুনেছেই, এখান থেকে ডাক এডিশনের যে খবরের কাগজ রাজদিয়ায় যেত সেগুলোতে শুধু দাঙ্গার ভয়াবহ বিবরণ। আগুনে-পোড়া বাড়িঘর আর রাস্তায় রাস্তায় সারি সারি মৃতদেহের ছবি। পাতার পর পাতা জুড়ে।

হিরণ বলছিল, পার্টিশানের পর এখান থেকে অনেকে চলে গেছে। কেউ ইস্ট পাকিস্তানে, কেউ ওয়েস্ট পাকিস্তানে। যাদের যাবার উপায় নেই, তারা পড়ে আছে।

বিনু নিজের চোখে দেখে নি, তবে শুনেছে, ইন্ডিয়া থেকে বর্ডার পেরিয়ে বহু মুসলমান ওপারে চলে গেছে। তাদের বেশির ভাগই উঠেছে ঢাকায়, খুলনায় কিংবা চট্টগ্রামে।

মুসলমানদের ওপারে যাওয়া নিয়ে আর কোনও কথা হল না। আরও মিনিট তিনেক হাঁটার পর একটা বেশ চওড়া রাস্তায় সাবেক ধাঁচের তেতলা বাড়ির সামনে এনে বিনুকে দাঁড় করাল হিরণ। বাড়িটার চারপাশ ঘিরে বেশ খানিকটা করে ফাঁকা জায়গা। এককালে হয়তো ফুলের বাগান ছিল। ফুল শুকিয়ে, পাতা ঝরে গাছগুলো এখন কাঠিসার। উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল কোথাও কোথাও ভাঙাচোরা। রাস্তার দিকের লোহার গেটে মস্ত তালা ঝুলছে। দরজা জানালা সব বন্ধ। বোঝা যায়, অনেকদিন ফাঁকা পড়ে আছে।

আশেপাশে এমন জনমানবহীন, তালাবন্ধ বাড়ি আরও ক’টা চোখে পড়ল। তবে কাছে দুরে অন্য বাড়িগুলোতে অবশ্য লোকজন আছে। দরজা বা জানালা দিয়ে কৌতূহলী কিছু মুখ উঁকি দিচ্ছে। চোখাচোখি হলেই আড়ালে সরে যাচ্ছে।

যে বাড়িটার সামনে বিন্দুরা দাঁড়িয়ে আছে সেটার গেটের গায়ে পাথরের ফলকে ইংরেজি হরফে লেখা : খান মঞ্জিল। প্রতিষ্ঠা : ১৮৮২। একেবারে নিচে : রহমত আলি খান, এম.এ, বি.এল।

একটা নিঝুম প্রাচীন ইমারতের সামনে কেন হিরণ তাকে টেনে এনেছে, কে জানে। চারদিক দেখেশুনে মনে হল, শিক্ষিত, ভদ্র মুসলমানদের এলাকা।

হিরণ জিজ্ঞেস করল, বাড়িটা কেমন দেখছ বিনু?

সমস্ত ব্যাপারটা হেঁয়ালির মতো। হিরণের উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। বিনু কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, হিরণ ফের বলল, প্রায় সত্তর বছর বয়েস হতে চলল বাড়িটার, কিন্তু এখনও বেশ মজবুত। চার তলার ভিত, দেওয়ালগুলো বিশ ইঞ্চি চওড়া, শ্বেত পাথরের মেঝে। ভেতরে বর্মা টিকের আসবাব। একটু সারিয়ে সুরিয়ে রং করে নিলে আরও পঞ্চাশ ষাট বছর নিশ্চিন্তে কেটে যাবে। তা ছাড়া, ছ’কাঠার ওপর জায়গা।

কোনও মুসলিম পরিবারের আদ্যিকালের সাদামাঠা এক বাড়ির গুণকীর্তন বিনুর ধন্দ শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। সে বলে, এই বাড়িটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?

হিরণ বলে, কারণ আছে। জানো, পার্টিশানের পর কলকাতার জমি-বাড়ির দাম কী সাঙ্ঘাতিক বেড়ে গেছে। এই এলাকায় এক কাঠা জমি এখন তিরিশ হাজার টাকা। দু’চার বছরের মধ্যে ষাট সত্তরে উঠে যাবে। চল, বাড়ি যাওয়া যাক। যেতে যেতে সব বলছি।

ওরা যে পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে চলেছে। ধীরে ধীরে রহস্যের আবরণ উন্মোচন করতে থাকে হিরণ। ‘খান মঞ্জিল’-এর পাথরের ফলকে যাঁর নাম লেখা আছে সেই রহমত আলি খান ছিলেন আলিপুর কোর্টের বাঘা উকিল। বিরাট পশার ছিল তার। বিপুল আয়।

রহমত আলিদের আদি বাড়ি বিহারের হাজারিবাগ ডিস্ট্রিক্টে। কয়েক পুরুষ কলকাতায় থেকে প্রায় বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। রহমতের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে শওকত আলি খান মঞ্জিল’-এর মালিক হন। বাবার মতো তিনি কৃতী নন। লেখাপড়ায় মনোযোগ ছিল না। কোনও রকমে ম্যাট্রিকুলেট। টেরিটি বাজারে কী সব যন্ত্রপাতির মাঝারি একটা দোকান আছে।

দাঙ্গার সময় টালিগঞ্জের বাড়িতে তালা লাগিয়ে শওকত বিবি আর ছেলেমেয়ে নিয়ে পার্ক সার্কাসে চলে যান। সেখানে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। খান মঞ্জিল’-এ আর ফিরে আসেন নি। তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন, ইন্ডিয়ায় থাকবেন না। টেরিটি বাজারের দোকান এক বন্ধুকে দিয়ে খান মঞ্জিল এক্সচেঞ্জ করে ইস্ট বেঙ্গলে চলে যাবেন।

হিরণের সঙ্গে হঠাৎই তার যোগাযোগ ঘটে গিয়েছিল। তিনি রাজদিয়ায় হিরণদের বাড়ি এবং জমিজমার সঙ্গে টালিগঞ্জের এই বাড়িটা এক্সচেঞ্জ করতে চান।

পূর্ব পাকিস্তানে আবহাওয়া যেভাবে বিষময় হয়ে উঠেছে, সেখানে গিয়ে জমিজমা ঘরবাড়ি বেচে টাকা নিয়ে আসা অসম্ভব। হিরণের কানে এসেছে, হিন্দুদের ফেলে আসা বাড়ি টাড়ি এনিমি প্রপার্টি বা শত্রু সম্পত্তি হিসেবে খুব শিগগিরই ঘোষণা করা হবে।

দেশের ভিটেমাটি সম্পর্কে সব আশা যখন প্রায় শেষ, অযাচিতভাবে শওকত আলি খানের প্রস্তাবটা এসেছে। হিরণ ভীষণ উত্তেজিত। সম্ভব হলে আজকালের মধ্যে সে এক্সচেঞ্জটা করে ফেলতে চায়। তার ঠাকুরদা দ্বারিক দত্তও রাজি। কিন্তু জেঠিমা আর সুধার খুবই আপত্তি। একমাত্র হেতু, ‘খান মঞ্জিল’ মুসলমানদের বাড়ি।

হিরণ বলছিল, তুমিই বল বিনু, এত বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া করার কোনও মানে হয়? ইস্ট বেঙ্গল থেকে যে হিন্দুরা এপারে চলে এসেছে তাদের অনেকে প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছে। আমাদের দেরি হলে অন্য কারোর সঙ্গে হয়তো শওকত সাহেব এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থা করে ফেলবেন। তখন আপসোসে হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না।

রাজদিয়ায় থাকতে হিরণ ছিল আলাভোলা ধরনের। নিজের পড়াশোনা ছাড়া পার্থিব অন্য কোনও দিকেই তার বিশেষ নজর ছিল না। কিন্তু কলকাতায় এ কোন হিরণকে দেখছে বিনু? মাত্র ক’বছরে যেন অনেক বয়স্ক হয়ে উঠেছে। অত্যন্ত অভিজ্ঞ। এখন তার প্রখর বিষয়বুদ্ধি। প্রবল বাস্তব বোধ। চতুর্দিকে তার সজাগ দৃষ্টি।

হিরণ ফের বলে, আরে বাবা, এক্সচেঞ্জ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কি আমরা খান মঞ্জিল’-এ ঢুকে পড়ছি? আগে বাড়িটা রিপেয়ার করে রং করাব। ভেতরকার অনেক কিছু বদলাতে হবে। তারপর তো এখানে বাস করতে আসা। খান মঞ্জিল’ তখন আর খান মঞ্জিল থাকবে না।

হিরণ বুঝিয়ে দিল, দুতিন পুরুষ যারা এখানে থেকেছে তাদের বসবাসের যাবতীয় চিহ্ন মুছে দেবে সে। অতীতের সমস্ত স্মৃতি নির্মূল না করে এ বাড়িতে ঢুকবে না।

দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষবৃক্ষ অনেকদিন আগেই বিনুর রক্তের ভেতর কখন নিঃসাড়ে ডালপালা মেলে দিয়েছিল। সে দ্বিধার সুরে বলল, কিন্তু–

হিরণ চলতে চলতে একটু থমকে বিনুর চোখের দিকে তাকায়। জিজ্ঞাসু সুরে বলে, কিন্তু কী?

বিনু বলল, বাড়িটা যে এলাকায় সেখানে কিন্তু হিন্দুরা থাকে না।

ফের সামনের দিকে পা বাড়িয়ে হিরণ বলে, কে বলল, থাকে না? ওটা মিক্সড লোকালিটি। প্রচুর হিন্দুও ওখানে আছে। বেশ কিছু মুসলিম ফ্যামিলি পার্টিশানের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের কাছে বাড়ি বেচে পাকিস্তানে চলে গেছে। বাকি অনেকেই এখন এক্সচেঞ্জ করছে। সেই সব বাড়িতে ওপারের হিন্দুরা আসছে। একটু ভেবে বলল, এর মধ্যেই এখানে সেভেনটি পারসেন্ট হিন্দু হয়ে গেছে। কোনও রকম দুশ্চিন্তার কারণ নেই।

বিনু উত্তর দিল না।

হিরণ বলল, যাতে কোনও খিচ না থাকে, বাড়ির নামও পালটে দেব। মালিকানাই যখন বদলে যাবে, আগের নামই বা থাকবে কেন?

বিনু এবারও চুপ।

হিরণ থামে নি, তোমার ছোটদিকে ভাল করে বোঝাও। এক্সচেঞ্জ না করতে পারলে, এ জীবনে। কলকাতায় আমাদের নিজস্ব বাড়ি কোনও দিনই হবে না। ভাড়া বাড়িতেই লাইফ কাটিয়ে দিতে হবে।

হিরণ যা বলল তা উড়িয়ে দেবার মতো নয়। যথেষ্ট সারবত্তা আছে তাতে। ইতস্তত ভাবটা পুরোপুরি না কাটলেও বিনু বলল, ঠিক আছে, ছোটদিকে বোঝাব।

একসময় দু’জনে বাড়ি পৌঁছে যায়।

.

৩.২৮

লক্ষ্মীপুজোর পর থেকেই সারা কলকাতা জুড়ে জলসার ধুম পড়ে যায়। চলে সেই ফাল্গুনের শেষ অব্দি। একটানা। কখনও এপাড়ায়, কখনও ওপাড়ায়। কোথাও সন্ধেবেলায় শুরু হয়ে মাঝরাতে শেষ হয়। কোথাও সমস্ত রাত চলে। বড় অনুষ্ঠানগুলোর মেয়াদ পুরো দু’রাত। একদিন লাইট মিউজিক, কমিক, ম্যাজিক, এমনি রকমারি মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা। আরেকদিন শুধুই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত।

দেশভাগ হয়ে গেছে। হাজার হাজার শরণার্থীর ঢল নেমেছে কলকাতায়। শিয়ালদা স্টেশনে, রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে কত যে মানুষ পচে গলে মরে ঝরে যাচ্ছে। না খেতে পেয়ে। বিনা চিকিৎসায়।

পার্টিশানের জের এখনও কাটে নি। কবে কাটবে, কেউ জানে না। কিছুদিন চুপচাপ। মনে হয়, সব বুঝি স্বাভাবিক হয়ে এল। বিষবাষ্প সরে গিয়ে এবার নির্মল বাতাস বইবে।

কিন্তু মানুষের মনে ক’বছর ধরে যে গরল জমা হয়েছে তা কি সহজে নিশ্চিহ্ন হয়? এত তাড়াতাড়ি দুরারোগ্য ব্যাধির উপশম কি সম্ভব?

দু’দশ দিন কি মাসখানেক পর পর আচমকা মানুষের গনগনে আক্রোশ ফেটে বেরোয়। তখন দেশের কোথাও দাঙ্গা। কোথাও আগুন। কোথাও হত্যা।

কিন্তু কলকাতার বিশেষ তাপ-উত্তাপ নেই। উদাসীন এই শহরের খাঁটি নাগরিকেরা নিজেদের আমোদ ফুর্তি নিয়েই মজে আছে।

হিরণের অফিসের এক বন্ধু থাকে ভবানীপুরে। হরিশ মুখার্জি রোডে। ওখানকারই হরিশ পার্কে মস্ত প্যান্ডেল বানিয়ে জলসার আয়োজন করা হয়েছে। বন্ধুটি অনুষ্ঠানের বড় পান্ডা। সে হিরণকে চারখানা কার্ড দিয়েছিল।

হিরণ ঠিক করে রেখেছিল, সুধাকে নিয়ে জলসায় যাবে। বিনুরা আসায় ভালই হয়েছে। সবগুলো কার্ডই কাজে লাগানো যাবে। নইলে দুটো নষ্ট হত।

.

সন্ধে সাতটায় অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা। আজকাল দিন ছোট হয়ে এসেছে। সাড়ে পাঁচটা বাজতে না বাজতেই সন্ধে নামে, বাতাসে হালকা সরের মতো কুয়াশা ভাসতে থাকে।

বেলা পড়ে এলে ঝিনুককে সাজাতে বসল সুধা। এখন টানের সময়। শুকনো হাওয়ায় গা চড়চড় করে। মুখের চামড়া খসখসে হয়ে যায়।

ভেজা ভোয়ালে চেপে চেপে ঝিনুকের মুখটা পরিষ্কার করে মুছে, সযত্নে ক্রিম মেখে দিল সুধা। বিনুনি করে লম্বা ঘন চুল বাঁধল। কপালের মাঝখানে বড় গোলাপি টিপ আঁকল পরিপাটি করে। আলমারি থেকে নিজের দামী সিল্কের শাড়ি, কোট আর ব্লাউজ বার করে দিয়ে বলল, পরে ফেল–

মাত্র দু’দিন এ বাড়িতে আছে ঝিনুক। মনে হচ্ছিল, জন্মাবধি সুধারা তাকে নিবিড় মমতায় জড়িয়ে রেখেছে। গাঢ় আবেগ কান্না হয়ে গলার কাছে জমাট বেঁধে যাচ্ছে। বেরিয়ে আসতে পারছে না। ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে, তবু কত যে সুখ!

শাড়ি ব্লাউজ কোটটোট বুকে আঁকড়ে রাখে ঝিনুক। ঠোঁট দুটো থরথর কাঁপছে। অজান্তেই বুঝি চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরে যাচ্ছে।

ঝিনুকের আবেগ সুধার মধ্যেও চারিয়ে যায়। ধরা গলায় সে বলে, এই মেয়ে, চোখের জল মোছ–

সম্বিত ফিরে আসে ঝিনুকের। ত্বরিত হাতে চোখ মুছে মৃদু হাসে সে, তোমার কাছে এসে বেঁচে গেছি ছোটদি—

বোকা মেয়ে। ওসব কী কথা! সুধার ধমকে স্নেহ মাখানো, আমি তোমার দিদি হই না? এমন কথা আর কখনও বলবে না। অনেক দূর যেতে হবে। শাড়িটা পরে নাও–

ঝিনুক শাড়িটা পরল ঠিকই। কিন্তু কেমন যেন অগোছাল, জবরজং। গেঁয়ো ভাব ফুটে বেরিয়েছে।

পাশে দাঁড়িয়ে লক্ষ করছিল সুধা। তার মোটেও পছন্দ হয় নি। কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল। উঁহু উঁহু, এটা রাজদিয়া নয়। এভাবে কলকাতার মেয়েরা শাড়ি পরে না। নিপুণ হাতে নিজেই ঝিনুককে শাড়িটা পরিয়ে দিল সে।

শাড়ি পরার ধরন পালটে দিতেই অনেকখানি বদলে গেছে ঝিনুক। পেঁয়ো ভাবটা উধাও। এখন তাকে বেশ সপ্রতিভ দেখাচ্ছে। রীতিমতো আধুনিকা।

ঝিনুককে সাজিয়ে নিজের সাজসজ্জা চুকিয়ে ফেলল সুধা। সাজতে ভীষণ ভালবাসে সে। এরই ফাঁকে ফাঁকে অনবরত হিরণ আর বিনুকে তাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। অগত্যা ওদেরও পোশাক টোশাক বদলে নিতে হল।

উমার হাতে বাড়ির দায়িত্ব সঁপে ওরা যখন বেরুল, ছটাও বাজে নি। তবে কুয়াশা আরও একটু ঘন হয়েছে। হেমন্তের শেষ আলোটুকু অনেক আগে একটানে কেউ যেন গুটিয়ে নিয়েছিল। সারা শহর মুড়ে দিয়ে হালকা অন্ধকার নেমে এসেছে। অবশ্য রাস্তায় রাস্তায় কর্পোরেশনের টিমটিমে আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। দু’ধারের বাড়িঘরে জ্বলছে বেশি পাওয়ারের বিজলি বাতি।

হিরণ বিনুকে বলল, তোমার ছোটদির সমস্ত ব্যাপারে তাড়াহুড়ো। কোথাও যাবার হলে সবার আগে পৌঁছনো চাই। জলসা শুরু হবে সাতটায়। এখান থেকে হরিশ পার্ক ট্যাক্সিতে মাত্র পনের মিনিট। এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার মানে হয়?

সুধা ভেবেছিল, বাস কি ট্রামে যাওয়া হবে। ট্যাক্সির কথা আগে জানায় নি হিরণ। সুধা খুবই উৎফুল্ল। কি আশ্চর্য, ট্যাক্সি করে নিয়ে যাবে, বল নি তো?

হিরণ উত্তর দিল না।

সুধা বলতে লাগল, ফাংশানে আগে আগে যাওয়া ভাল। স্টেজের সামনের দিকের চেয়ারে বসা যায়। আমার বাপু, কাছে থেকে দেখতে না পেলে ভীষণ খারাপ লাগে।

বড় রাস্তায় এসে ট্যাক্সি ধরল হিরণ। সামনের সিটে শিখ ড্রাইভারের পাশে বসেছে বিনু। পেছনে সুধা ঝিনুক আর হিরণ।

বিনু কাত হয়ে বসে হিরণদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোরা দৃষ্টিতে ঝিনুককে দেখছিল। অবশ্য বাড়ি থেকে বেরুবার আগেই তার চোখ মেয়েটার ওপর আটকে ছিল। কালকের চেয়ে মেয়েটা আজ আরও ঝলমলে। খুশিতে আরও ভরপুর। ভাবল, সুধাদের কাছেই যদি বাকি জীবনটা থাকা যেত! পরমুহূর্তে মনে পড়ল, দিন কয়েকের মধ্যে অবনীমোহন কলকাতায় ফিরে আসবেন। তখন কি আর বোনের বাড়িতে পড়ে থাকা ঠিক হবে? বিষাদে, দুশ্চিন্তায় মাথার ভেতরটা হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠে।

হিরণ বলছিল, পঙ্কজ মল্লিকের নাম শুনেছ ঝিনুক?

তার বাবা ভবতোষের মার্ফি কোম্পানির বড় একটা রেডিও ছিল। ব্যাটারিতে চলত। সেই রেডিওতে পঙ্কজ মল্লিকের প্রচুর গান শুনেছে ঝিনুক। সবই অবশ্য রবি ঠাকুরের গান। কার কাছে যেন শুনেছিল, ‘ডাক্তার’ বলে একটা সিনেমায় এই পঙ্কজ মল্লিকই নাকি অভিনয়ও করেছেন। তবে সে ছবি তার দেখা হয়নি।

ঝিনুক বলল, শুনব না কেন? রাজদিয়ায় থাকতাম বলে এতটা পেঁয়ো ভাববেন না। রেডিওতে তাঁর কত গান শুনেছি।

শচীনদেব বর্মন?

বিরাট গায়ক। তার নাম কে না জানে। দু’একদিন পরপরই রেডিওতে তার গান বাজায়।

একে একে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সত্য চৌধুরি, রবীন মজুমদার, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, এমনি আরও অনেকের নাম করে গেল হিরণ।

ভবতোষের শুধু রেডিওই না, বড় চোঙাওলা গ্রামোফোন কোম্পানির একটা কলের গানও ছিল। সেটার গায়ে লেখা ও হিজ মাস্টার্স ভয়েস। একটা মুগ্ধ কুকুরের ছবিও ছিল তাতে। একাগ্র চিত্তে সে গান শুনছে।

হিরণ যাঁদের কথা বলল, ভবতোষ মাঝে মাঝেই কলের গানে তাঁদের রেকর্ড বাজাতেন। বাবার কাছে যখন ঝিনুক থাকত, এঁদের অনেকেরই গান শুনেছে। তবে বেশ কয়েকজন তার অচেনা। সুদূর কোনও গ্রহের মতো পূর্ব বাংলার নগণ্য শহর রাজদিয়ায় তখনও তাঁদের নাম পৌঁছয় নি।

ঝিনুক বলল, এই সব সিঙ্গারদের নাম করছেন কেন হিরণদা?

উত্তর না দিয়ে হিরণ জিজ্ঞেস করে, এঁদের কখনও নিজের চোখে দেখেছ?

কী করে দেখব? এঁরা কি কোনও দিন রাজদিয়ায় গেছেন?

আজ এঁদের সবাইকে দেখতে পাবে। কাছে বসে ওঁদের গানও শুনতে পাবে।

হিরণ জানিয়েছিল, জলসা ব্যাপারটা পরে বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু ঝিনুক এর মধ্যেই মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছে, জলসা হল গান বাজনার মজলিশ। সারা শরীরে শিহরন খেলে যাচ্ছিল তার, চোখেমুখে প্রবল উত্তেজনা। হিরণের মুখে শোনার পরও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য বলল, সত্যি বলছেন, ওঁরা আসবেন!

হিরণ বলে, না এলে ওঁদের দেখবেই বা কী করে? কাছে বসে গান শোনার সুযোগই বা পাবে কিভাবে?

হাতের মুঠোয় অযাচিত স্বপ্ন যেন নেমে এসেছে। নিমেষে সময়ের সীমানা পেরিয়ে অনেক কাল আগের এক বালিকা হয়ে যায় ঝিনুক। উচ্ছল। ভারমুক্ত। কারণে অকারণে যে রোমাঞ্চিত হতে ভালবাসে। প্রবলবেগে মাথা ঝাঁকাতে আঁকাতে ঝিনুক কলকলিয়ে ওঠে, উঃ, এ আমি ভাবতেও পারি না হিরণদা—

ঝিনুকের ছেলেমানুষি, তার উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে হিরণ হাসে। মেয়েটা যে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠছে, এতে খুব ভাল লাগছে তার।

হরিশ পার্কে এসে দেখা গেল, গোটা পার্কটা জুড়ে ত্রিপল টিন বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে ঘেরা বিশাল মন্ডপ। রাস্তার দিকে অস্থায়ী কোলাপসিবল গেট, ফুললতাপাতা দিয়ে সাজানো। মাইকে সানাইয়ের রেকর্ড বাজানো হচ্ছে। বাতাসের কাঁধে চেপে মধুর সুর ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে নানা দিকে। মাঝে মাঝে সানাই থামিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে, যারা প্যান্ডেলে এসেছেন, অনুগ্রহ করে শান্ত হয়ে বসুন– কিংবা ঠিক সাতটায় আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। শিল্পীরা কিছুক্ষণের মধ্যে এসে যাবেন। ক্রমান্বয়ে সানাই। তারপর ঘোষণা। আবার সানাই। আবার ঘোষণা।

চারদিকে উৎসব উৎসব আবহাওয়া। স্বপ্নের পরিবেশ। অপলক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ঝিনুক।

গেটের মুখে মাঝারি ভিড়। সুধাই শুধু নয়, তার মতো দূরদর্শী আরও অনেকেই রয়েছে। মঞ্চের কাছাকাছি ভাল জায়গা দখল করার জন্য আগেভাগেই তারা হাজির।

হিরণের বন্ধুটির নাম আদিত্য। তেমন লম্বা না হলেও বেশ সুপুরুষ। ধারাল, সপ্রতিভ চেহারা। ধুতি আর কাজ করা পাঞ্জাবিতে চমৎকার দেখাচ্ছে।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ভিড় সামলাচ্ছিল আদিত্য। হিরণদের দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল, একটু আগে এসে ভাল করেছিস। পরে এলে পেছন দিকে বসতে হত।

চোখ সামান্য ছোট করে স্বামীর দিকে তীর হানল সুধা। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। কেন তাড়া দিয়েছিলাম, এবার বুঝতে পারছ?

বোকাটে হাসি ফুটিয়ে ঘাড় চুলকোয় হিরণ। সুধা যে ঢের বেশি বুদ্ধি ধরে তা মেনে নিতেই হয়।

ঝিনুকদের দেখিয়ে আদিত্য জিজ্ঞেস করে, এদের তো ঠিক চিনতে পারলাম না।

সুধা আদিত্যর সঙ্গে বিনুদের পরিচয় করিয়ে দেয়। ঝিনুক সম্বন্ধে বলে, ও সম্পর্কে আমার বোন হয়। পাকিস্তান থেকে কদিন হল ওরা এসেছে। বাড়িতে বসে থেকে কী করবে! বাড়তি কার্ডও ছিল। ফাংশানে নিয়ে এলাম। বলেই ভয় হল, আদিত্য যদি পাকিস্তানের পরিস্থিতি জানতে চায়। এবং কথায় কথায় এমন প্রসঙ্গ উঠে পড়ে যাতে ঝিনুক ফের নিজেকে গুটিয়ে নেয়? তার ঝলমলে ভাবটা লহমায় উধাও হয়?

কিন্তু আদিত্য এ সবের ধারকাছ দিয়েও গেল না। এখন তার ভীষণ ব্যস্ততা। বলল, ওদের নিয়ে এসে খুব ভাল করেছেন বৌদি। চলুন, আপনাদের বসিয়ে দিই।

হিরণ বলল, তোর বউ এসেছে?

দুপুর থেকে বাবার জ্বর। ডাক্তারকে কল দিয়ে এসেছি। এদিকে ফাংশান নিয়ে এখানে এমন আটকে গেছি যে বাড়িতে থাকতে পারলাম না। ডাক্তার এলে ওষুধ টোষুধের ব্যবস্থা করে সবিতা পরে আসবে। আমরা যতক্ষণ না ফিরছি, পিসি বাবাকে দেখবে। আশা করি, দু’এক ডোজ ওষুধ পড়লে জ্বরটা নেমে যাবে।

হিরণরা জানে, আদিত্যদের বাড়ি খুব কাছেই। পার্কের ঠিক উলটো দিকে। ওর মা নেই। মাস ছয়েক হল বিয়ে হয়েছে। এখনও ছেলেপুলে হয় নি। বাড়িতে চারজন মানুষ। আদিত্য, সবিতা, আদিত্যর বাবা আর এক বিধবা পিসি। একজন আধ্যবয়সী রান্নার লোকও আছে। আদিত্যদের কাছেই থাকে। বাড়িরই একজন হয়ে গেছে।

আদিত্যর সঙ্গে প্যান্ডেলে চলে এল সুধারা। ভেতরটা চমৎকার সাজানো। মনোরম আলোয় ভরে আছে চারপাশ। একধারে উঁচু মঞ্চে বড় বড় পেতলের ফুলদানিতে অজস্র টাটকা রজনীগন্ধার ঝড়। দুটো মাইকও রয়েছে। পেছনে মস্ত সোনালি ফেস্টুনে বড় বড় নীল হরফে লেখা : তরুণ সঙ্ঘের উদ্যোগে বিচিত্রানুষ্ঠান। দু’পাশে উইংস দিয়ে মঞ্চে যাতায়াতের পথও রয়েছে। সামনের দিকে শ্রোতাদের জন্য চেয়ারের সারি।

থোকায় থোকায় বেশ কিছু লোকজন এধারে ওধারে বসে আছে। আরও অনেকে আসছে।

মঞ্চের সামনের প্রথমটা বাদ দিয়ে দ্বিতীয় সারিতে হিরণদের বসিয়ে আদিত্য বলল, তোদের পাশের একটা চেয়ারে কাউকে বসতে দিবি না। বলবি লোক আছে। সবিতা এলে বসবে।

হিরণ বলল, ঠিক আছে।

আর শোন, প্রচুর আর্টিস্ট আসবেন। ফাংশান শেষ হতে হতে পোর হয়ে যাবে। রাত্তিরে তোরা এখানেই খাবি।

সে কী! মেলোমশায়ের জ্বর। এর ভেতর ওসব ঝামেলা করতে গেলি কেন? আমরা ভোর অব্দি থাকব না। সাড়ে দশটা, এগারটায় ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব।

আদিত্য বলল, অত তাড়াতাড়ি চলে যাবি মানে! বড় বড় আর্টিস্টরা আসবেন দশটার পর থেকে। তাদের গান না শুনে কে তোদের যেতে দিচ্ছে?

সুধাও বেঁকে বসল, ঠিক বলেছেন আদিত্যদা। ফাংশান শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঝিনুক, বিনু আর আমি এখান থেকে এক পা-ও নড়ছি না। যার ইচ্ছে সে ফিরে যেতে পারে।

এরপর ফেরার কথা মুখে আনা বৃথা। হাত উলটে নিরুপায় একটা ভঙ্গি করল হিরণ।

আদিত্য মজার সুরে টিপ্পনি কাটে, ক্ষমতা থাকলে চলে যাস। একটু থেমে জানায়, নিজেদের বাড়িতে তারা রান্নাবান্নার ঝাট করে নি। রাতে ঢালাও ভূরিভোজের ব্যবস্থা করা হয়েছে ক্লাবের তরফে। শিল্পীদের তো আপ্যায়ন করা হবেই, সপরিবারে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা এবং তাদের গেস্টরাও খাবে। অতএব হিরণদের সঙ্কোচের কারণ নেই।

চকিতে গেটের দিকটা এক পলক দেখে নিয়ে আদিত্য চঞ্চল হয়ে ওঠে, তোরা বোস। গেটে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। যাই। সে চলে গেল।

এমন সুসজ্জিত মন্ডপে এত মানুষ গান শুনতে আসছে, রাজদিয়ায় থাকলে তা ভাবাই যেত না। দ্রুত ফাঁকা চেয়ারগুলো ভরে যাচ্ছে। চারপাশে টুকরো টুকরো কথা। হাসির শব্দ। গোটা প্যান্ডেল জুড়ে অদ্ভুত এক গুঞ্জন। অবাক দৃষ্টিতে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখছিল ঝিনুক। কী ভাল যে তার লাগছে!

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সবিতা এল।

সুধা জিজ্ঞেস করে, মেলোমশাই এখন কেমন আছেন?

সবিতা বলল, কার্তিকের হিম লেগে জ্বর। ডাক্তার দেখে গেছেন। বললেন, চিন্তার কিছু নেই। এক দাগ মিক্সচার খাইয়ে এসেছি।

সুধা ঝিনুক আর বিনুর সঙ্গে সবিতার আলাপ করিয়ে দিল।

শ্যামবর্ণ, কিন্তু ভারি মিষ্টি চেহারা সবিতার। মুখে প্রতিমার আদল। স্বভাবটা মধুর। তার কথাবার্তা এবং হাসিতে এমন এক আপন করা ভাব আছে যা মুহূর্তে ঝিনুক আর বিনুকে জয় করে নিল। পাকিস্তান থেকে এসেছে শুনে প্রথমটা শিউরে উঠল সবিতা, উঃ, ওখানে যা চলছে, খবরের কাগজে পড়তে পড়তে ভয়ে দম আটকে যায়। তোমরা যে চলে আসতে পেরেছ, সেটা ভগবানের অসীম কৃপা। বোঝা যায়, সে ঈশ্বরবিশ্বাসী।

বিনু বা ঝিনুক উত্তর দিল না। নীরবে মাথা নাড়ল শুধু।

যেখানে আনন্দের এমন ব্যাপক আয়োজন, সমস্ত পরিবেশ খুশির প্লাবনে ভাসার জন্য উন্মুখ, সেখানে পাকিস্তানের প্রসঙ্গ হঠাৎ যেন তাল কেটে দিয়েছে।

সবিতা আর কিছু জানতে চাইবে কিনা, কে জানে। হিরণরা ত্রস্ত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের স্মৃতি যতই তারা আড়াল করে রাখতে চাক না, বিষবাষ্পে-ভরা এই ভূখন্ড ঝিনুকের পিছু ছাড়ে না। যেন অনিবার্য নিয়তি।

খুব সরল মনেই কথাগুলো বলেছে সবিতা। তা ছাড়া, সে জানেও না ঝিনুকের জীবন কিভাবে, কতখানি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর হিরণ সুধা এবং বিনু তিল তিল করে কিভাবে তাকে বাঁচিয়ে তুলতে চাইছে।

সবিতা ঝিনুককে বলল, পাকিস্তানে আবার ফিরে যাবে নাকি?

সুধা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল, না না, যাবার প্রশ্নই নেই।

সবিতা বলল, যা ভয়ঙ্কর অবস্থা, ওখানে কক্ষনো যাবে না। দেশের কথা একদম ভুলে যাও।

এবারও সুধাই বলল, ওরা চিরকালের মতো ইন্ডিয়ায় চলে এসেছে।

খুব ভাল করেছে।

একটু চুপচাপ।

তারপর একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল সবিতা। সুধাকে জিজ্ঞেস করল, কে তোমার সবচেয়ে ফেভারিট আর্টিস্ট?

পাকিস্তানের প্রসঙ্গ ওঠায় হিরণদের শ্বাস আটকে গিয়েছিল। এবার তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আস্তে আস্তে বুকের ভেতরকার আটকানো বাতাস বার করে দিল।

ফেভারিট এবং আর্টিস্ট, দুটো শব্দেরই মানে ঝিনুকের জানা। কে তার প্রিয় শিল্পী, কখনও তা ভেবে দেখে নি। জানালো, অনেকের গানই তার ভাল লাগে।

সবিতা নিরপেক্ষভাবে জানায়, আমার ভাই সবাই প্রিয়। পঙ্কজ হেমন্ত ধনঞ্জয় শচীনদেব, কাকে বাদ দিয়ে কার কথা বলব! কয়েকজন গায়কের বিখ্যাত কটি গানের নাম করে জিজ্ঞেস করল, এগুলো শুনেছ?

দাঙ্গার সময় সেই যে ঢাকা থেকে তাকে উদ্ধার করে আনা হয়েছিল, তারপর আর গানবাজনার কথা ভাবে নি ঝিনুক। ভাবার সময়ও নয় সেটা। সারা পৃথিবী তার কাছে শ্বাসরোধী অন্ধকার এক কুঠুরি। ঘরের কোণে নিজেকে লুকিয়ে রাখত সে। অসাড়, ম্রিয়মাণ। চারদিকে যা কিছু সুন্দর, মধুর, স্বপ্নমাখানো, সে সবের সঙ্গে তার যাবতীয় সম্পর্ক ছিঁড়ে গিয়েছিল।

ঝিনুক আস্তে মাথা নাড়ে, না–

সবিতা বলল, আজ ওঁদের দিয়ে এই গানগুলো গাওয়াব।

ঝিনুকের কৌতূহল হচ্ছিল। সে শুনেছে, শিল্পীরা নিজেদের খেয়ালে তাদের পছন্দমতো গানই গেয়ে থাকেন। শ্রোতাদের বেছে দেওয়া গান কি ওঁরা গাইবেন? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না সে।

বাঙালির সময়জ্ঞান বলতে কিছু নেই। দশটায় কিছু করবে বললে গড়াতে গড়াতে বারটায় টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু তরুণ সঙ্রে বিচিত্রানুষ্ঠান কাঁটায় কাঁটায় সাতটাতেই শুরু হল।

গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্যান্ডেলের কোনও চেয়ারই এখন খালি নেই। যারা বসার জায়গা পায় নি, বিশাল মন্ডপের দু’ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লাবের দায়িত্বশীল মেম্বাররা মঞ্চের কাছাকাছি থেকে সব দিকে লক্ষ রাখছে। তাদের মধ্যে আদিত্যকেও দেখা গেল।

মঞ্চের একধারে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দরী ঘোষিকা বলছিল, আমাদের প্রথম শিল্পী অনুরাধা শেঠ। তিনি নতুন হলেও যথেষ্ট প্রতিভাময়ী। আশা করি, তার গান আপনাদের ভাল লাগবে।

মঞ্চের ঠিক মধ্যিখানে লাল গালিচা পাতা। শিল্পীদের বসার জন্য। উইংসের ভেতর দিয়ে একটি তরুণী সেখানে এসে বসল। বেশ দেখনদার চেহারা। প্রচুর সেজেছে। খোঁপায় জুইয়ের মালা জড়ানো।

একটি তবলচিও সঙ্গে এসেছে। হারমোনিয়াম নিয়ে অন্য একজন।

মেয়েটি একটি আধুনিক গাইল। সুরেলা কণ্ঠস্বর। প্যান্ডেলের একোণ সেকোণ থেকে কিছু হাততালির শব্দ উঠল।

এরপর গায়ক গায়িকারা ঘোষণা অনুযায়ী মঞ্চে আসতে লাগল। একের পর এক। সবাই প্রায় নতুন। আধ-চেনা দু’চারজন। মাথাপিছু একটি করে গান বাঁধা। কেউ গাইল আধুনিক। কেউ পল্লীগীতি। কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত। কয়েকজনের বেশ রেওয়াজকরা গলা। বেশির ভাগই মাঝারি। তবে একজনও ফেলনা নয়।

আদিত্য বলেছিল, দশটা সাড়ে-দশটার আগে বড় আর্টিস্টরা আসবেন না। কিন্তু অনেক আগেই তারা এসে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে আসর জমে গেল।

নামীদের ভেতর প্রথম মঞ্চে উঠলেন জগন্ময় মিত্র। শুরু করলেন তার সেই বিখ্যাত গানটি। দিয়ে, তুমি আজ কত দূরে, আঁখির আড়ালে চলে গেছ, তবু রয়েছ হৃদয় জুড়ে– লহমায় গোটা প্যান্ডেল জুড়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে গেল।

জগন্ময়ের নামটা ঝিনুকের খুব ভাল করেই জানা। পনের কুড়ি হাত দূরে বসে তিনি গান শোনাচ্ছেন। স্বচক্ষে দেখেও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তার। নিশ্বাস পড়ছে না। চোখের দৃষ্টি স্থির। আচ্ছন্নের মতো মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

বিনুরা ঝিনুককে লক্ষ করছিল। কেউ তাকে কিছু বলল না।

গানটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে প্যান্ডেল হাততালিতে ফেটে পড়ল। চারপাশ থেকে চিৎকার উঠছে। সবার এক দাবি, আরেকটা আরেকটা

নতুনদের জন্য একটা করে গান। বড় আর্টিস্টদের বেলায় সে নিয়ম খাটে না। একখানা গান গেয়ে তাদের রেহাই নেই। শ্রোতাদের আবদারের কি শেষ আছে? পর পর ছ’খানা গাইতে হল জগন্ময়কে।

এর ফাঁকে চিরকুটে খস খস করে একটা গানের দুলাইন লিখে ফেলল সবিতা। আদিত্যকে ডেকে বলল, এই গানটা গাইতে বল–

চিরকুট হাতে হাতে ঘুরে মঞ্চে পৌঁছে গেল। এক পলক সেটা দেখে একটু হাসলেন জগন্ময়। অনুরাগী শ্রোতার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে হারমোনিয়ামে সুরের ঢেউ তুলে গানটা ধরলেন, আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, তুমি যে বহ্নিশিখা। মরণের ভালে এঁকে দিয়ে যাই জীবনের জয়টিকা–

জগন্ময়ের পর একে একে রবীন মজুমদার, উৎপলা সেন, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের নামকরা গানগুলি গাইতে লাগলেন। এঁদের কাছেও চিরকুট পাঠাতে লাগল সবিতা। সে একাই শুধু নয়, শ্রোতাদের ভেতর থেকে আরও অনেকেই। শিল্পীরা কাউকেই নিরাশ করলেন না। পরম উদারতায় সবার অনুরোধ শিরোধার্য করলেন।

দশটা বাজলে আদিত্য এসে বলল, চল, এখন খেয়ে নেবে।

সুধা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এত তাড়াতাড়ি!

কারণটা বুঝিয়ে দিল আদিত্য। আজ কলকাতায় কম করে পনের কুড়িটা ফাংশান হচ্ছে। বিখ্যাত আর্টিস্টদের বিরাট চাহিদা। এখানে যাঁদের গাওয়া শেষ হয়েছে তারা অন্য ফাংশানে গাইতে ছুটবেন। আর আগে ওঁদের খাইয়ে দিতে হবে। উদ্যোক্তাদের বাড়ির লোকজন এবং তাদের গেস্টদের যে ক’জনকে পারা যায়, একসঙ্গে বসিয়ে দেওয়া হবে। এইভাবে রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত খেপে খেপে খাওয়ার পর্ব চলবে। লোক তো কম নয়।

সুধাদের একেবারেই নড়ার ইচ্ছা নেই। সে বলল, আরও কত ভাল আর্টিস্ট গাইবেন। খেতে গেলে তাদের গান শুনব কী করে?

আদিত্য জানালো, আপাতত গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে না। এখন চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট শুধুই বাজনা। একজন মাউথ অর্গান বাজাবেন। একজন বাঁশি। একজন জলতরঙ্গ। একজন স্প্যানিশ গিটারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর। খেতে খেতে সব শোনা যাবে।

.

খাওয়ার ব্যবস্থা কাছেই। পার্কের পেছন দিকে একটা প্রকান্ড সেকেলে বনেদি বাড়ির মস্ত হল ঘরে। লম্বা লম্বা উঁচু বেঞ্চ আর চেয়ার পাতা রয়েছে সারি সারি।

আদিত্যই শুধু সুধাদের আনে নি, তরুণ সঙ্ঘের অন্য ক’জন মেম্বারও তাদের স্ত্রী ছেলেমেয়ে এবং অতিথিদের নিয়ে এসেছে। একধারে দেওয়ালের ধার ঘেঁষে বার চোদ্দটা চেয়ার ফাঁকা রেখে বাকিগুলোতে সবাইকে বসিয়ে দেওয়া হল।

এরপর আদিত্য এবং তাদের ক্লাবের কয়েকজন হল-ঘরের বিরাট দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর দিকে চলে গেল। ফিরে এল মিনিট দুয়েক পরেই। সঙ্গে রবীন মজুমদার, উৎপলা সেন, জগন্ময় মিত্র, এমনি অনেকে। খুব সম্ভব বাড়ির অন্দরমহলের কোনও ঘরে তারা বিশ্রাম করছিলেন। ওঁদের সমাদর করে ফাঁকা চেয়ারগুলোতে বসানো হল।

ভোজের এলাহি আয়োজন। লুচি, পোলাও, আলুর দম, ভেটকি মাছের ফ্রাই, মুরগির মাংস, চাটনি এবং নলেন গুড়ের সন্দেশ।

ঝিনুক খাবে কী, উৎপলা সেন, রবীন মজুমদার, জগন্ময় মিত্রদের দিকে তাকিয়েই আছে, তাকিয়েই আছে। পলকহীন। অভিভূত। এতকাল এঁরা ছিলেন দূর আকাশের নক্ষত্র। ধরাছোঁয়ার বাইরে। আজ কিনা সামনাসামনি বসে তাদের গান শুনেছে সে। একই হল-ঘরে একসঙ্গে খেতেও বসেছে। সব যেন অলৌকিক স্বপ্নের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে।

একটা মাইকের মুখ এধারে ঘোরানো। তাই মাউথ অর্গান, বাঁশি কি জলতরঙ্গের সুর হেমন্তের বাতাসে ভেসে আসছে।

সুধা আর সবিতা মাঝে মাঝে তাড়া দিচ্ছে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। একটু পরেই কিন্তু ফের গান শুরু হয়ে যাবে।

ব্যস্তভাবে লুচির একটা কোনা ভেঙে নিয়ে কিংবা একমুঠো পোলাও মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় ঝিনুক। চোখ কিন্তু শিল্পীদের দিকেই স্থির।

খাওয়ার পালা চুকিয়ে ফের প্যাণ্ডেলে ফিরে আসে সুধারা।

যন্ত্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান শেষ হয় গেল। এবার যে শিল্পীটি মঞ্চে এলেন তিনি শচীনদেব বর্মন। শরীর ভাল নেই। দু’খানা গানই শুধু গাইলেন। নিশীথে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা’ আর প্রেমের সমাধি তীরে নেমে এল শুভ্র মেঘের দল, তাজমহলের মর্মরে গাঁথা কবির অশ্রুজল–

শ্রোতাদের দাবি অফুরান। তারা সহজে ছাড়তে চায় না, আরও শুনতে চায়। হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিলেন শচীনদেব।

সবিতা প্রচুর খবর রাখে। ঝিনুকের কানে মুখ ঠেকিয়ে নিচু গলায় বলল, শচীন কর্তা এখন কলকাতায় থাকেন না। যুদ্ধের সময় বম্বে চলে গিয়েছিলেন। বিরাট বিরাট সব হিন্দি বইয়ের মিউজিক ডিরেক্টর। সারা ইণ্ডিয়ায় ওঁর কত নাম। কত সম্মান। তোমার আদিত্যদাকে ভীষণ ভালবাসেন। ও

আবদার করলে না বলতে পারেন না। শরীর খারাপ নিয়েও তাই বম্বে থেকে আজকের ফাংশানে। গাইতে এসেছেন।

শচীনদেবের পর পঙ্কজ মল্লিক। তাঁরও ভারতজোড়া খ্যাতি। কণ্ঠস্বর গম্ভীর। উদাত্ত। বার খানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন। তের নম্বর গানটা হল ‘ডাক্তার’ ছবির চৈত্রদিনের ঝরাপাতার পথে দিনগুলি মোর কোথায় গেল–

একের পর এক চমক। পঙ্কজের পর এলেন ধনঞ্জয়। তাকেও দশ এগারখানা গাইতে হল। শেষ গানটি হল ‘শহর থেকে দূরে’ ছবির ‘রাধে, ভুল করে তুই চিনলি না তোর প্রেমের শ্যাম রায়, ঝাঁপ দিলি তুই মরণ যমুনায়—’

একটানা দুঘন্টা গানের পর কমিক। সেটি পরিবেশন করলেন অজিত চট্টোপাধ্যায়।

কৌতুক-নকশাটি এইরকম। অল ইণ্ডিয়া রেডিও’র পাক্ষিক ম্যাগাজিন ‘বেতার জগৎ’-এ তারিখ, সময় এবং শিল্পীদের নাম সমেত প্রতিদিনের প্রোগ্রামের আগাম তালিকা প্রকাশ করা হয়। ভুল করে একবার ছাপা হল, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবেন শচীনদেব বর্মন আর পঙ্কজ মল্লিক পল্লীগীতি।

দুই শিল্পী মহা ফাঁপরে পড়ে গেলেন। ‘রেডিও’র কর্মকর্তাদের ভুলটা ধরিয়ে হাজার কাকুতি মিনতিতেও ফল হল না। ছাপা যখন হয়ে গেছে, দু’জনকে সেইমতোই গাইতে হবে। তা ছাড়া, শ্রোতাদের এই নিয়ে তুমুল উৎসাহ। মুহুর্মুহু অল ইণ্ডিয়া রেডিও’র দপ্তরে ফোন করে তারা নাকি জানাচ্ছে, শচীনদেবের রবীন্দ্রসঙ্গীত আর পঙ্কজ মল্লিকের পল্লীগীতি শোনার জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে আছে।

অগত্যা নিরুপায় শচীনদেব পঙ্কজের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিম নিতে ছুটলেন। পঙ্কজ যতই শেখান, তিনি কিছুতেই কায়দা করতে পারছেন না। পল্লীগীতির সুরে বার বার গেয়ে উঠছেন রবি ঠাকুরের গান। ওদিকে পঙ্কজও দৌড়চ্ছেন শচীনদেবের বাড়ি। গলদঘর্ম হয়ে শিখছেন পল্লীগীতি। তার হালও তথৈবচ। ভারী, ভরাট গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে তিনি গাইছেন ভাটিয়ালি। ভুল ধরিয়ে দিয়েও কেউ কাউকে শোধরাতে পারছেন না।

দুই নাজেহাল শিল্পী পরস্পরের কাছে কিভাবে তালিম নিচ্ছেন, সুরের গোলমাল করে কিভাবে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন, হুবহু নকল করে গেয়ে গেয়ে শোনালেন অজিত চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে নানা মজাদার অঙ্গভঙ্গি।

সারা প্যাণ্ডেলে ঝড় বয়ে গেল। দশ মিনিট ধরে হাসির আতসবাজি ফাটতে লাগল। অবিরল।

বিনু লক্ষ করল, পেটে হাত চেপে সমানে হেসে চলেছে ঝিনুক। হেসেই চলেছে। মুখ লাল হয়ে উঠেছে তার। চেয়ারে বসে থাকতে পারছিল না। ঠিকরে নিচে পড়ে যাবে যেন। কোনও রকমে নিজেকে সামলে সামলে রাখছে।

কত কাল বাদে ঝিনুককে এমন প্রাণ খুলে হাসতে দেখলে বিনু? এমন স্বচ্ছ? এমন নির্মল? হাসিটা যেন সহস্র ধারায় ছড়িয়ে পড়ছে। ঝিনুককে যত দেখছে তত ভাল লাগছে তার।

কমিকের পর আবার গান। একে একে মঞ্চে আসতে লাগলেন সুপ্রভা সরকার, সত্য চৌধুরি, অখিলবন্ধু ঘোষ, পান্নালাল ভট্টাচার্য, দিলীপ সরকার, শ্যামল মিত্র। সবার শেষে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি আরও কয়েকটা ফাংশানে গেয়ে এসেছেন। তাই এখানে পৌঁছতে দেরি হয়ে গেছে। আধুনিক এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত মিলিয়ে তাকে গাইতে হল মোট পনের খানা। শেষ গান, কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোন, রূপকথা নয় সে নয়। জীবনের মধু মাসের কুসুম ছিঁড়ে–

হেমন্তের গানের পর ফাংশান যখন শেষ হল, ভোর হতে বেশি দেরি নেই। এবার বাড়ি ফেরার পালা। আদিত্য আর সবিতা হিরণদের সঙ্গে রাস্তা পর্যন্ত চলে এল।

সবিতা ঝিনুককে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগল ফাংশান?

ঝিনুকের চোখেমুখে ঘোর লেগে আছে। বিহ্বলের মতো বলল, কী ভাল যে লেগেছে, বলে বোঝাতে পারব না।

তোমার সঙ্গে সেভাবে তো কথাই হল না। একদিন অনেক গল্প করব।

কতটুকু সময় আর সবিতাকে দেখেছে। কিন্তু এর মধ্যে তাকে খুব পছন্দ হয়েছে ঝিনুকের। আস্তে মাথা নাড়ল সে। অর্থাৎ সবিতার সঙ্গে গল্প করার ইচ্ছা তারও।

সবিতা সুধাকে বলল, কবে বিনু আর ঝিনুককে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসছ?

সুধা মুহূর্তে সতর্ক হল। সবিতাদের বাড়ি যখন ইচ্ছে যাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু আদিত্যর পিসির ভীষণ নাক-গলাননা স্বভাব। জাগতিক সমস্ত ব্যাপারেই অনন্ত কৌতূহল। নতুন কাউকে দেখলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার পেটের ভেতর থেকে যতক্ষণ না সব খবর টেনে বার করছে, শান্তি নেই। মহিলা লেখাপড়া শিখে ওকলতি করলে জেরায় জেরায় সাক্ষীদের জেরবার করে দিতে পারতেন। কথার মারপ্যাঁচে ঢাকার প্রসঙ্গ চলে আসবে কিনা, কে জানে।

সুধা নির্দিষ্টভাবে কোনও তারিখের কথা বলল না। ভাসা ভাসা ভাবে জানালো, সবে তো ওরা এসেছে। কদিন যাক। পরে নিয়ে যাব।

মিনিট পাঁচেক দাঁড়াতেই একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পেয়ে উঠে পড়ল হিরণরা। ফাংশান চলার সময় প্রতিটি লহমায় ছিল চমক। তীব্র উত্তেজনা। ঘুমের কথা কারোর খেয়াল ছিল না। কষে বাঁধা তারের মতো টান টান স্নায়ুগুলো এখন আলগা হয়ে আসছে। ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে চোখ।

বাড়ি ফিরে ঝটিতি পোশাক পালটে হাত পায়ে জল দিয়ে সবাই শুয়ে পড়ল।

.

৩.২৯

প্রায় সারারাত জাগার কারণে পরদিন ঘুম ভাঙতে ঢের বেলা হয়ে গেল। এর মধ্যে আকাশের গা বেয়ে সুর্য অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে। যদিও ঋতুটা হেমন্ত, বেলা চড়লে রোদ এখনও বেশ কড়া হয়ে ওঠে।

বাথরুমের কাজ চুকিয়ে চা খেতে খেতে কালকের ফাংশানের সবিস্তার আলোচনা চলছিল। জগন্ময় হেমন্ত উৎপলা পঙ্কজ শচীনদেব– ঘুরে ফিরে এই সব নাম উঠে আসছে। প্যাণ্ডেলে ওঁদের দেখার পর থেকে ঝিনুক এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিল যে তার রেশ এখনও কাটে নি। সে শুধু বলছে, ছোটদি, তোমাদের জন্যে এই শিল্পীদের দেখতে পেলাম। আবার কোথাও ফাংশান হলে আমাকে নিয়ে যেতে হবে কিন্তু—

সুধা বলল, নিশ্চয়ই।

আজ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মিউজিয়াম এবং সময় পেলে দক্ষিণেশ্বরে বেড়াতে যাবার কথা ছিল। কিন্তু ঘুমের অনেকটাই দু’চোখ জুড়ে লেগে আছে। ক্লান্তি এখনও পুরোপুরি কাটে নি।

ঠিক হল, আজ আর এক পা-ও বাড়ি থেকে বেরুনো নয়। আপাতত ঝিনুকরা তো এখানেই আছে। অন্য একদিন তাদের ভিক্টোরিয়া, যাদুঘরটর দেখিয়ে আনবে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আরেক প্রস্থ না ঘুমোতে পারলে শরীর ঝরঝরে লাগবে না।

হঠাৎ একতলায় কড়া নাড়ার শব্দ। কেউ একজন ডাকাডাকি করছে, হিরণভাই আছেন নিকি? অ হিরণভাই–

গলাটা অপরিচিত। কিন্তু ডাকটার মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ সুর আছে। কথায় পদ্মাপাড়ের টান। লোকটা নিশ্চয়ই হিরণকে চেনে।

হিরণ উমাকে ডেকে বলল, দেখ তো, কে এসেছে—

উমা বলল, লোকটাকে কি ওপরে নিয়ে আসব?

কী ভেবে হিরণ বলল, না। আগে নামটা জেনে এস–

উমা তর তর করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেল। পরক্ষণে ফিরে এসে বলল, রাজদিয়ার নিত্য দাস এসেছে।

সবাই চকিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বিনু আর ঝিনুক। রাজদিয়া থেকে সাত মাইল উজানে সুজনগঞ্জের হাট। সেখানে মস্ত দোকান ছিল নিত্য দাসের। নদীর ধার ঘেঁষে ছোটখাটো একটা আড়তও। রাজদিয়ার বাজারেও ছিল তার আরেকটা দোকান। চাল ডাল তেল নুন আর নানাবিধ মশলাপাতির খুচরো এবং পাইকারি কারবার করত।

যে দুশ্চিন্তাটা ত্বরিত গতিতে বিনুর মাথায় ভর করে তা হল, নিত্য দাস কি ঝিনুকের চরম সর্বনাশের খবরটা জানে? জানাই সম্ভব। কেননা, রায়টের সময় নিত্য দাস রাজদিয়াতেই ছিল। তা ছাড়া, ঝিনুক যে আপাতত এ বাড়িতে আছে, সেটাও কি তার কানে পৌঁছে গেছে?

উদ্বিগ্ন মুখে বিনু জিজ্ঞেস করে, নিত্য দাস কি আগে কখনও এখানে এসেছে?

হিরণ বলল, না। এই প্রথম।

মতলব কী লোকটার? কী চায় সে?

তা কেমন করে বলব?

ঝিনুককে নিয়ে বিনুর উৎকণ্ঠাটা হিরণের মধ্যেও চারিয়ে গিয়েছিল। নিত্য দাস ঝিনুককে দেখলে কী বলতে কী বলে বসবে, কে জানে। মেয়েটা ভয়, আতঙ্ক কাটিয়ে সবে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ৫৫৯ হিরণরা সবাই মিলে তার যে দুঃস্বপ্নের স্মৃতিটাকে মুছে দিতে চাইছে, নিত্য দাসকে দেখে ফের সেটাই যদি তাকে গ্রাস করে ফেলে? তাদের এত চেষ্টা সব ব্যর্থ হয়ে যাবে।

হিরণ পলকে কর্তব্য স্থির করে ফেলে। সুধাকে বলে, তুমি ঝিনুককে নিয়ে ভেতরের ঘরে চলে যাও। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। সে চায় না, নিত্য দাস ওপরে এসে ঝিনুককে দেখুক।

সুধা লক্ষ করেছিল, ঝিনুকের ঝলমলে ভাবটা উধাও হয়ে গেছে। নিত্য দাসের নাম শোনামাত্র সে ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। অস্থির। শঙ্কাতুর।

ঝিনুকের কাঁধে হাতের বেড় দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল সুধা। বিনু চুপচাপ বাইরের ঘরে বসে থাকে।

হিরণ ফের উমাকে নিচে পাঠাল। একটু পর নিত্য দাসকে সঙ্গে করে ফিরে এল সে।

বিনু তাকে সতর্ক চোখে দেখছিল। চেহারা প্রায় একই রকম আছে। ছোটখাটো। শক্তপোক্ত। নিরেট। পোশাক আশাক বলতে তেমনই খাটো ধুতি। রাজদিয়ায় থাকতে নিমা (ফতুয়া জাতীয় জামা) পরত। কলকাতায় এসে একটু উন্নতি হয়েছে। নিমার বদলে হাফ-হাতা পাঞ্জাবি। পায়ে শস্তা স্যাণ্ডেল।

আগে যতবার দেখা হয়েছে, বিনয়ে সর্বক্ষণে নুয়ে থাকত নিত্য দাস। মুখে বিগলিত হাসি। লোকটা বাইরের দিকে একটুও বদলায় নি। অবিকল তেমনই হাসি। সেই বিনীত ভঙ্গি।

হাতজোড় করে, ঘাড় ঝুঁকিয়ে নিত্য দাস বিনুকে বলল, কত কাল পর দেখা। কী ভালা যে লাগতে আছে ছুটোবাবু, মুখে কইয়া বুঝাইতে পারুম না। হিরণকে বলল, নমস্কার হিরণভাই আপনেরে দেইখাও বড় আনন্দ–

তাকে থামিয়ে দিয়ে হিরণ বলল, আগে বসুন নিত্যবাবু–

একটা চেয়ারে জড়সড় হয়ে বসল নিত্য দাস। হিরণ বসল বিনুর পাশে। বলল, আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে, ভাবতে পারি নি। আমাদের বাড়ির খোঁজ পেলেন কী করে?

নিত্য দাস বলতে লাগল, কত কষ্ট কইরা যে আপনেগো বিচরাইয়া বাইর করছি, তার ঠিক ঠিকানা নাই। তয় (তবে) পরানের টান থাকলে কী না করন যায়। এরপর সে যা বলতে লাগল তা এক ব্যাপক অভিযানের কাহিনী। পাকিস্তানের হালচাল, মানুষের মতিগতি ভাল নয় বুঝে বছরখানেক আগে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে ইণ্ডিয়ায় চলে আসে। বুদ্ধি করে কিছু টাকাপয়সা আনতে পেরেছিল। না, শিয়ালদা স্টেশনে হাজার হাজার শরণার্থীর ভিড়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে নি। রিফিউজি ক্যাম্পেও ওঠে নি। মাসকয়েক চেতলায় এক ভাড়া বাড়িতে কাটিয়েছে। সেটা অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া টানা ব্যারাক ধরনের বাড়ি। সারি সারি ঘর। গুচ্ছের ভাড়াটে। পরিবেশ দমবন্ধকরা। চল্লিশ পঞ্চাশ জন মানুষের জন্য দুটো মোটে পায়খানা। ঘরের বাইরে পা ফেলার মতো এক ফোঁটা জায়গা নেই। পোকামাকড়ের মতো মানুষ থিক থিক করছে।

নিত্য বলল, আমরা কি অ্যামন জাগায় থাকতে পারি? আমাগো বাড়ির উঠানখানই আছিল আধা কানি। পিছনে আলিসান পুকৈর (পুকুর), ফলফলারির বাগান। হেই সব ফেলাইয়া ফুলাইয়া য্যান নরকে আসলাম। উয়াস আটকাইয়া আসতে লাগল। আমার পরিবারে (স্ত্রী) আর পোলমাইয়ায় (ছেলেমেয়ে) দিনরাইত ঘ্যানঘ্যানায় আর কান্দে, কয় উইখানে থাকব না।

সুতরাং হাত-পা ছড়িয়ে থাকা যায়, মোটামুটি এমন একটা খোলামেলা বাড়ির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগল নিত্য দাস। ভাড়ায় পেলে ভাল, নইলে কিনেই নেবে।

বালিগঞ্জ ভবানীপুর শ্যামবাজার ঢাকুরিয়ায় জমিবাড়ির দাম আগুন। ভাড়াও মারাত্মক। কিন্তু কসবার দিকটা ফাঁকা ফাঁকা। ওধারে লোকের নজর এখনও তেমন পড়ে নি।

পাকিস্তান থেকে যা টাকাপয়সা নিয়ে এসেছিল, তাই দিয়ে কসবায় তিন কামরার একটা সাবেক কালের আধভাঙা একতলা বাড়ি কিনে সারিয়ে সুরিয়ে নিল নিত্য। জায়গাও বেশ খানিকটা। সাড়ে চার কাঠার মতো।

কলকাতার মতো শহরে মাথা গোঁজার পাকা বন্দোবস্ত হয়েছে। বাড়ি কেনার পর যা বেঁচেছে, বসে খেলে আর ক’দিন? সামনে লম্বা ভবিষ্যৎ। ইণ্ডিয়ায় আসার পর থেকে সে শুনতে পাচ্ছিল, উদ্বাস্তুদের ব্যবসাপত্র করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার জন্য থোক কিছু টাকা গভর্নমেন্ট থেকে দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া কিসের ব্যবসা, কোথায় ব্যবসা, এসব ঠিকঠাক দেখাতে পারলে ব্যাঙ্ক থেকেও লোন পাওয়া যায়।

মাস দুয়েক আহার নিদ্রা ভুলে, চারদিকে দৌড়ঝাঁপ করে, একে ধরে তাকে ধরে সরকারি টাকা আর ব্যাঙ্ক লোন বার করেছে নিত্য দাস। সেই মূলধন খাঁটিয়ে গড়িয়াহাটে রেডিমেড জামা প্যান্টের ছোটখাটো দোকান খুলে বসেছে। কলকাতা এমন এক শহর যা নিয়েই বসা যাক, খদ্দের ঠিক জুটে যায়। বাতাসে টাকা উড়ছে। কারবার ভালই চলছে নিত্য দাসের।

এক বছরে সব দিক সুচারুভাবে গুছিয়ে নেবার পর তার মনে হল, দেশের মানুষজনের খোঁজখবর নেওয়া দরকার। ফি সপ্তাহে দোকান একদিন বন্ধ থাকে। সেই ছুটির দিনটা তো বটেই, অন্য দিনও কাজের ফাঁকে সময় বার করে সে শিয়ালদা স্টেশনে কিংবা কাছে পিঠের রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে যায়।

রাজদিয়া এবং তার চারপাশের গিরিগঞ্জ হাবিবপুর আমতলি তাজহাটি মাইনকার চর কমলাঘাট, এমনি পঁচিশ ত্রিশটা গ্রাম উজাড় করে মানুষ চলে আসছে এপারে। প্রতিদিন। বিরতিহীন।

কতকাল ওদের পাশাপাশি বাস করেছে নিত্য দাসেরা। পুরুষানুক্রমে। এই ছিন্নমূল মানুষগুলোর মধ্যে হাজারে একজনও সঙ্গে এক কুচি সোনা বা বিশ পঞ্চাশটা টাকা সঙ্গে আনতে পারে নি। নিত্য দাসের একান্ত ইচ্ছা, ওদের পাশে দাঁড়ান। সাধ্যে কুলোলে সাহায্য করা। কী করলে, কোন উপায়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তার সন্ধান দেওয়া। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও এই মানুষগুলো তার আপনজনই তো।

রাজদিয়ায় থাকতে নিত্য দাসকে তেমন পছন্দ করত না বিনু। ভীষণ ধূর্ত। ধড়িবাজ। বাইরে বিনয়ের মুখোশ সাঁটা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সারাক্ষণ নানা ফন্দি আঁটছে।

বিনুব মনে আছে, সেই যুদ্ধের সময় এস. ডি. ও’র বাংলোয় দিনরাত ধরনা দিয়ে, তাকে ঘুষ খাইয়ে, পারমিট বার করে কনট্রোলের দোকান খুলেছিল নিত্য দাস। চাল, চিনি, কেরোসিন তেল, কাপড় তখন খোলা বাজারে মেলে না। কনট্রোলের দরে সামান্য কিছু লোকজনকে বিলি করে, বাকিটা দশ গুণ দামে কালোবাজারে বেচে দিত। শুধু তাই না, আমেরিকান টমিতে টমিতে যখন রাজদিয়া ছেয়ে গেল, চারদিকে রাতারাতি মিলিটারি ব্যারাক উঠছে, সরকারি লাইসেন্স নিয়ে একটা মদের দোকানও দিয়েছিল। হেমনাথ বাড়িতে ডাকিয়ে এনে কতবার নিষেধ করেছেন, কিন্তু তাঁর কথা নিত্য দাসের এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যেত। সেই লোক সীমান্তের এপারে এসে মহানুভব হয়ে উঠেছে, ভাবা যায় না।

ভোঁতা, খসখসে গলায় একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে নিত্য দাস। ক্লান্তি বোধ করছিল বিনু। কান মাথা ঝিমঝিম। কিভাবে তাকে থামানো যায়, কে জানে।

হিরণ হঠাৎ বলে ওঠে, আমাদের ঠিকানা কী করে পেলেন তা কিন্তু এখনও বলেন নি।

নিত্য দাস হেসে হেসে বলে, এইবার হেইটা কমু। য্যামন মাঝে মইদ্যে যাই, ত্যামন পরশু সন্ধ্যাবেলা শিয়ালদায় গেছিলাম। দেখি, ঢাকা মেইল থিকা রিফুজিগো লগে তৈলক্য স্যানরা (ত্রৈলোক্য সেনরা) লাইমা আসল। ওনারা দ্যাশ ছাইড়া বরাবরের লেইগা চইলা আসছে। একটু নেমে বলল, হগলে যহন ভিটামাটি ফেলাইয়া আসতে আছে, ওনারা কুন ভরসায় দ্যাশের মাটিতে থাকব?

বিনুর স্নায়ুতে তীব্র ঝাঁকুনি লাগে। এতক্ষণে সে রীতিমতো উৎসুক হয়ে ওঠে।

বহুকাল আগে প্রথম মহাযুদ্ধের ঠিক পরে পরে ঢাকা জেলার নগণ্য শহর রাজদিয়া ছেড়ে রেঙ্গুনে পাড়ি দিয়েছিলেন ত্রৈলোক্য সেন। সঙ্গে স্ত্রী এবং একটি ছেলে। সেখানে ব্যবসা ট্যবসা করে অঢেল পয়সা করেন। সংসারও বড় হতে থাকে। রেঙ্গুনে আরও দুটি ছেলে হয়েছে তার। তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের কারবারে বসিয়েছেন। তাদের বিয়ে দিয়েছেন। তিন ছেলে, তিন পুত্রবধু, নাতিনাতনী নিয়ে তাঁর জমজমাট সংসার। রেঙ্গুন থেকে দেশে ফেরার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। বর্মা তখন তাঁদের নতুন স্বদেশ। রাজদিয়ার স্মৃতি ধূসর হতে হতে প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি পূর্ব রণাঙ্গনে যখন তোজোর ঝটিকা বাহিনী দুরন্ত গতিতে ধেয়ে আসছে, দিবারাত্রি মেশিন গান আর কামানের কানফাটানো গর্জন, আকাশ ঢেকে দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমানের অবিরল হানাদারি, অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটের পালটা আক্রমণ, ক্রমাগত পিছু হটে হটে মিত্রবাহিনীর পিঠ যখন দেওয়ালে প্রায় ঠেকে গেছে, সেই সময় রেঙ্গুন পেগু মান্দালয়, অর্থাৎ গোটা বর্মা মুল্লুক থেকে পালানোর হিড়িক পড়ে যায়।

সারা জীবন বিপুল পরিশ্রমে, তিল তিল করে ত্রৈলোক্য সেন যা যা করেছিলেন–টাকাপয়সা, বিষয়আশয়, বিশাল বাড়ি, অফুরান ঐশ্বর্য–সব ফেলে, প্রায় খালি হাতে চলে আসতে হয়েছিল তাঁদের।

গোটা রাজদিয়া জুড়ে তখন সে কী তুমুল চাঞ্চল্য! প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতে যে ত্রৈলোক্য সেন দেশ ছেড়েছিলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি বর্মা মুল্লুক থেকে তাঁর ফিরে আসাটাই এক চমকপ্রদ ঘটনা। রাজদিয়ার মানুষ এক দুঃসাহসী যুবককে চলে যেতে দেখেছে। যিনি ফিরলেন তিনি এক সর্বস্বান্ত বৃদ্ধ। তার ওপর দুর্গম পাহাড় এবং জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে, বমী দস্যুদের নজর এড়িয়ে নিদারুণ আতঙ্কে কয়েক শমাইল পাড়ি দেবার পর ভারতবর্ষের নিরাপদ ভূখন্ডে যখন তাঁরা পা রাখলেন, দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই। মৃতপ্রায়। বুকের খাঁচায় প্রাণটা কোনও রকমে ধুকধুক করছে।

ত্রৈলোক্য সেনের মুখে এই বর্ণনা শুনতে শুনতে রাজদিয়াবাসীদের রক্তে শিহরন জাগত। তখন ত্রৈলোক্যদের চারপাশে চাপ-বাঁধা ভিড়। একই বিবরণ শতবার শুনেও তৃপ্তি নেই।

ত্রৈলোক্য সেনের বড় নাতি শ্যামল রাজদিয়া হাইস্কুলে বিনুদের ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের শেষাশেষি অক্ষশক্তির হার যখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে, ত্রৈলোক্যর তিন ছেলে তাদের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিল। রাজদিয়ায় পড়ে থেকে কী হবে? যুদ্ধে যা ধ্বংস হয়ে গেছে, নতুন করে ফের তা গড়ে তুলতে হবে। কলকাতা ছাড়া গতি নেই।

বাড়ির সবাই চলে এলেও ত্রৈলোক্য সেন এবং তার স্ত্রী রাজেশ্বরী কিন্তু আসেন নি। বহুকাল বাদে বর্মা মুলুক থেকে রাজদিয়ায় ফিরে এসে দেশের মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদেরও থাকা সম্ভব হল না। লক্ষ লক্ষ উৎখাত মানুষের মতো জন্মভূমি থেকে শিকড় তুলে তাদেরও চলে আসতে হয়েছে। আর কখনও তাদের দেশে ফেরা হবে না।

নিত্য দাস বলতে লাগল, তৈলক্য স্যানের মুখে শুনলাম, ছুটোবাবু কয়দিন আগে কইলকাতায়। চইলা আইছে। তেনার তিনখানে (তিন জায়গায়) ওঠনের কথা। ভবানীপুরে তেনার বালের কাছে। নাইলে সুনীতি বইন কি সুধা বইনের বাড়ি। তৈলক্য স্যান হ্যামকত্তার কাছ থিকা তিন জাগারই ঠিকানা নিয়া আসছে।

নিত্য দাস আরও জানায়, সে ত্রৈলোক্য সেনের কাছ থেকে এই তিনটি ঠিকানা লিখে নেয়। কাল সে ভবানীপুরে গিয়েছিল। সেখানে কেউ নেই। বাড়ি তালাবন্ধ দেখে ছুটেছিল সুনীতিদের বাড়ি। ওখানেই জানতে পারে, বিনু সুধা আর হিরণের কাছে চলে এসেছে। কাল আর সময় করে উঠতে পারে নি। আজ তাই সকাল হতে না হতেই বিনুদের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে।

নিত্য দাস থামে না। বিনুর দিকে ফিরে একটানা বলে যায়, রাজেক মাঝির নায়ে (নৌকোয়) তারপাশায় আইসা গোয়ালন্দের ইস্টিমার ধরছেন, এই তরি খবর পাইছেন হ্যামকত্তায়। পথের গতিক জবর খারাপ। খুনীরা চাইর দিকে রাম দাও (রাম দা), সড়কি, বন্দুক লইয়া ঘুরতে আছে। হেইর (তার) মইদ্যে পরান  বাঁচাইয়া কইলকাতায় আইতে পারলেন কিনা, তেনি (তিনি) জানেন না। বড় দুচ্চিন্তায় আছেন হ্যামকত্তায়। পৌঁছ সম্বাদ নি তেনারে দিছেন?

বিনু জানে, হেমনাথরা তাদের জন্য পূর্ব বাংলার সুদুর প্রান্তের এক নগণ্য শহরে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। সারাক্ষণ ছটফট করছেন। তাঁকে চিঠি লেখার কথা বেশ কয়েক বার ভেবেছে সে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে, ওপারের চিঠি এপারে আসছে না, এপারের চিঠি ওপারে যাচ্ছে না। হেমনাথের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও রাস্তাই খোলা নেই।

বিনু বলল, পৌঁছনোর খবর কী করে দেব? চিঠি লিখলে দাদু পাবেন না। সে জানায়, দুই দেশের ডাক বিভাগ এই নিয়ে কোনও কাজই করছে না।

নিত্য দাস বলে, চিন্তা কইরেন না ছুটোবাবু। একখান চিঠি লেইখা আমারে দিয়েন। আমি রাইজদায় হ্যামকত্তার কাছে পাঠাইয়া দিমু। আপনেগো সম্বাদ তেনি পাইয়া যাইবেন।

লোকটা কি ভেলকি জানে! বিনু আর হিরণ কিছুক্ষণ হতবাক নিত্য দাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বিনু বলে, পোস্ট অফিস যেখানে কিছু করতে পারছে না, আপনি কী করে চিঠি পাঠাবেন?

নিত্য দাসের সারা মুখ জুড়ে রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে পড়ে। বলে, হেই বন্দবস্ত আছে ছুটোবাবু।

কী বন্দোবস্ত?

বুঝাইয়া কই। আমার হাতে অ্যামন মেলা (অনেক) লোক আছে যারা হপ্তায় একবার বডারের উই পারে যায়। তাগো হাতে চিঠিপত্তর পাঠাই। হেরা (তারা) পাকিস্থানের চিঠি কি দরকারী খবর লইয়া ইণ্ডিয়ায় পৌঁছাইয়া দ্যায়।

বিনু থ হয়ে যায়। দেশভাগের পর যে বহুলোক নিয়মিত সীমান্তের এপারে ওপারে যাতায়াত করছে, তার ধারণা ছিল না। জিজ্ঞেস করে, কী জন্যে পাকিস্তানে যায় এই সব লোকজন?

পরিষ্কার করে ভাঙল না নিত্য দাস। বলল, নানান কামে যাইতে হয়। লাখ লাখ মানুষ অহনও তো উই ধারে পইড় আছে। ধরেন, এক বংশের দশ জন আসতে পারছে। পাঁচজন পারে নাই। হেরা ভালা আছে না মোন্দ আছে, নিকি খুন হইয়া গ্যাছে, কেউ না গ্যালে তাগো খবর আনব ক্যাঠা?

বিনু তাকিয়েই থাকে।

নিত্য দাস থামে নি, অবশ্য এইর মইদ্যে একখান কথা আছে ছুটোবাবু।

কী কথা?

যে লোকগুলা যায় তাগো কিছু টাকাপয়সা দিতে হয়। পাকিস্থানের অবস্থা হগলই জানেন। নিজের চৌখে দেইখা আসছেন। হেইখানে পরানের ঝুঁকি লইয়া যাইতে হয় তো৷

হিরণ জিজ্ঞেস করে, আপনার লোকজনেরা কি শুধু রাজদিয়া তার তার চারপাশের গ্রামগুলোতেই যায়?

নিত্য দাস বলল, তা ক্যান? ফরিদপুর নুয়াখালি বরিশাল সিলট–কুনখানে না যায়? আপনে যেইখানের খবর জানতে চাইবেন, ঠিক আইনা দিব।

বলে কি লোকটা? হিরণ জানে, খুব বেশি লেখাপড়া করে নি নিত্য দাস। অল্প বয়সে রাজদিয়ার ইউনিয়ন বোর্ডের স্কুলে দু’চার বছর যাতায়াত করেছিল। কিন্তু খুবই তুখোড়। ক্ষুরধার বুদ্ধি। সামান্য বিদ্যের পুঁজি নিয়ে দেশভাগের আগে কী না করেছে সে? সুনামগঞ্জের হাটে আর রাজদিয়ার বাজারে দোকান, আড়ত। যুদ্ধের আমলে কনট্রোল শপ, মদের দোকান। পার্টিশানের পর কত মানুষ– দেশে যাদের বিশ পঞ্চাশ কানি ধানজমি ছিল, ছিল পাঁচ সাতটা দীঘির মতো পুকুর, মস্ত বাড়ি, ফলের বাগান–শিয়ালদা স্টেশনে কি রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে তারা ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভেবেছে এটাই নিয়তি। নিত্য দাস কিন্তু আকণ্ঠ হতাশায় ডুবে ভাগ্যের কাছে নিজেকে সঁপে দেয় নি। এপারে এসে সুচারুভাবে আখের গুছিয়ে নিয়েছে। দেশ থেকে কোনও কূট কৌশলে টাকা এনেছিল। সরকারের কাছ থেকে অনুদান বার করেছে, ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়েছে। ব্যবসা ফেঁদেছে। বাড়ি কিনেছে। শুধু তাই না, পাকিস্তানের সঙ্গে সুচতুর, গোপন যোগাযোগের একটা ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। যার লোক এই মারাত্মক সময়ে সুদূর বরিশাল নোয়াখালি সিলেট পর্যন্ত চলে যায়, সে যে কতখানি ধুরন্ধর, মোটামুটি আন্দাজ করা যেতে পারে। শুধু এপারের লোক দিয়ে এসব হয় না। নিশ্চয়ই পাকিস্তানের লোকজনও এর সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে যোগাসাজশ না থাকলে এ ধরনের দুঃসাহসিক কাজ অসম্ভব। কলকাতায় বসে কিভাবে একটা প্রায়-অশিক্ষিত লোক পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মেলাল, কে জানে।

সুধা প্লেটে মিষ্টি আর চা নিয়ে এল। চা সবার জন্য। মিষ্টি নিত্য দাসের। রাজদিয়ার চেনাজানা মানুষ বাড়িতে এসেছে। তাকে আপ্যায়ন না করলে নিন্দা হয়।

বিগলিত হাসে নিত্য দাস, উঃ, কত বচ্ছর পর দেখা হইল সুধা বইন। আপনের আর সুনীতি বইনের বিয়ায় হ্যামকত্তার বাড়িত কী আনন্দ যে করছিলাম! হ্যামকত্তায় তিন দিন ধইরা কী আদরযত্ন না করছিল! যদ্দিন বাচুম, মনে থাকব।

সুধা আড়ষ্টভাবে একটু হাসে। তার ভয়, লোকটা হুট করে ঝিনুকের কথা না জিজ্ঞেস করে বসে।

নিত্য দাস অফুরান উদ্যমে ফের শুরু করে, পাট্টিশানের পর ফির দেখা হইব, ভাবি নাই। ভাইগ্য ভালা, তৈলক্য স্যানেরে পরশু শিয়ালদায় পাইয়া গেলাম। নাইলে আপনেগো ঠিকানাই জানতে পারতাম না। আপনেরা হ্যামকত্তার নাতি, নাতিন আর নাতিন জামাই। আমাগো বড় আপনজন। অহনই কইয়া রাখি, মাঝে মইদ্যে আপনেগো বাড়ি আসুম কিলাম–

সুধা কাপ প্লেট আগেই টেবলে সাজিয়ে দিয়েছিল। বলল, আসবেন। আপনারা কথা বলুন। ভেতরে আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। যাচ্ছি–

নিত্য দাস ব্যস্তভাবে বলল, হ হ, যান। একদিন আমাগো কসবার বাড়িত্ আপনেগো লইয়া যামু। না কইতে পারবেন না।

আচ্ছা– সুধা চলে গেল।

নিত্য দাস চোখের পলকে মিষ্টিগুলো সাবাড় করে চায়ের কাপ তুলে নেয়। সুড়ক সুড়ক আওয়াজ করে চা খেতে খেতে বলল, ছুটোবাবু, হিরণভাই, এতকাল পর আপনেগো যহন পাইয়াই গ্যাছি, একখান কামের কথা কই। মন দিয়া শোনেন—

লোকটা যে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চক্কর মেরে শুধুমাত্র প্রাণের টানে দেশের পরিচিত জনদের দেখতে টালিগঞ্জে এসে হাজির হয়নি, তা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। তার আসার পেছনে অভিসন্ধি না থাক, গভীর কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে।

নিত্য দাস সম্বন্ধে বিনুদের ধারণা খুব পরিষ্কার। স্বার্থ ছাড়া একটি পাও সে ফেলবে না। ভেতরে ভেতরে দু’জনে সতর্ক হয়ে যায়।

বিনু জিজ্ঞেস করে, কী কথা?

নিত্য দাস প্রথমে হিরণকে বলল, ববাঝেনই তো পাকিস্থানের যা হাল, হেইখানে আর কুনো কালে ফিরন যাইব না। দ্যাশ জম্মের মতো গ্যাছে। তা রাইজদায় আপনেগো জমিজেরাত, বাড়ি, পুকৈর, নাইকল (নারকেল) সুপারির বাগিচা–এই হগলের কী ব্যবোস্তা করছেন?

লোকটাকে বাজিয়ে নেবার জন্য হিরণ বলল, আমরা আছি কলকাতায়। জমি বাড়ি সব রইল পাকিস্তানে। এখানে বসে কী-ই বা করতে পারি?

চা আধাআধি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বাকিটা লম্বা চুমুকে শেষ করে নিত্য দাস বলল, হের (তার) ফিকির আছে হিরণভাই। যদি আপনেগো মত থাকে, এইহানে থাইকাই হগল বন্দবস্ত হইয়া যাইব।

আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না।

খবর পাইছি রাজাকাররা রাইজদায় হিন্দুগো জমিন জুমিন দখল কইরা লওনের লেইগা উইঠা পইড়া লাগছে। বাপ-দাদার সোম্পত্তি তো আর ভোগ করতে পারবেন না। অহনও সোময় আছে।  দ্যাশের বাড়িঘরের বদলে যদিন কইলকাতায় কিছু করতে চান তো আমারে কান

ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছে হিরণ। তবু জিজ্ঞেস করল, আপনি কী করবেন?

নিত্য দাস সবিস্তার ব্যাখ্যা করল। এপার থেকে বহু মুসলমান পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। তাদের বাড়িটাড়ির সঙ্গে ওপার থেকে আসা হিন্দুদের সম্পত্তি তারা বদলাবদলি করে নিচ্ছে। কোনও রকম হাঙ্গামা নেই। পাকিস্তানেও যেতে হবে না। এখানেই হস্তান্তরটা নির্বিঘ্নে চুকিয়ে দেবে নিত্য দাস। ওপারের বিষয় আশয়ের বিনিময়ে এপারের বিষয় আশয়।

হিরণরা আন্দাজ করে নিল, এই যে নিত্য দাস দেশের মানুষের খোঁজে শিয়ালদা স্টেশনে বা রিফিউজি ক্যাম্পে ক্যাম্পে হানা দিচ্ছে, কিংবা তাদের বাড়িতেও ছুটে এসেছে তার উদ্দেশ্য একটাই। সম্পত্তি বিনিময় করানো। লোকটাকে যত দেখছে, তার গতিবিধির কথা যত শুনছে, বিস্ময়ে ততই হতবাক হয়ে যাচ্ছে হিরণ আর বিনু।

নিত্য দাস বলল, এয়ারে (একে) এংরাজিতে কয় এচ্চেঞ্জ (এক্সচেঞ্জ)। মেলা মাইনষের সম্পত্তি এচ্চেঞ্জের বন্দবস্ত আমি কইরা দিছি।

এর মধ্যেই যে তাদের বাড়ি এবং জমিজমা এক্সচেঞ্জের ব্যাপারে এই অঞ্চলের শওকত আলির সঙ্গে কথাবার্তা মোটামুটি পাকা করে ফেলেছে সেটা আর ভাঙল না হিরণ। জিজ্ঞেস করল, এই যে আপনি এত কষ্ট করে, নিজের দোকান ফেলে, এত লোকের কাছে যাচ্ছেন, এক্সচেঞ্জের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছেন, এতে আপনার কী লাভ?

বোঝেনই তো হিরণ ভাই– নিত্য দাস সামান্য বিব্রত হয়। কাঁচুমাচু মুখে বলে, আমি হইলাম ব্যবসায়ী মানুষ। দুই চাইর পহা পাওনের আশা না থাকলে এই বস্যে (বয়সে) অমন খাটাখাঁটি করুম ক্যান? যাগো সম্পত্তি এচ্চেঞ্জ’ করি হেরা দুই পক্ষই আমারে কিছু কিছু দ্যায়।

অর্থাৎ লোকটা বড় ধরনের দালাল। ইণ্ডিয়া এবং পাকিস্তান, দুই দেশেই বিরাট করে জাল বিছিয়েছে। নিপুণভাবে। এপারে ওপারে বিনিময় করিয়ে টাকা লুটছে। পার্টিশান কত মানুষকে শেষ করে দিয়েছে, আবার নিত্য দাসের মতো লোকেদের সামনে টাকা করার কী সুবর্ণ সুযোগই না এনে দিয়েছে!

হিরণ জিজ্ঞেস করে, কিরকম টাকা পয়সা নিয়ে থাকেন?

ধরাবান্ধা কিছু নাই। হগলই বাড়ি জমিনের মাপ বুইঝা। সোম্পত্তি বড় হইলে বেশি টাকা, ছোট হইলে কম টাকা। বলে একটু থেমে ফের শুরু করে নিত্য দাস, আসল কথাখান তো জিগাই নাই।

কী?

দ্যাশের বাড়ির দলিলগুলা কি মনে কইরা আনছেন, না রাইজদায় ফেলাইয়া আসছেন?

দাদু আর জেঠিমা নিয়ে এসেছে।

জবর বুদ্ধির কাম করছে। এক্ষেঞ্জে’র সোময় দলিল, দাখিলা, পরচা কি খাজনার রসিদ দরকার। এট্টা কিছু সরকারি কাগজ না দেখাইলে গাহেকে (খদ্দের) বুঝব ক্যামনে রাইজদার উই সম্পত্তি সত্য সত্যই আপনেগো কিনা।

তা তো ঠিকই।

তাড়া দেবার সুরে নিত্য দাস এবার বলে, দেরি কইরেন না হিরণ ভাই। রাজাকার একবার আপনেগো জমিনে বইসা গ্যালে আর উঠান যাইব না কিলাম। আমার হাতে মেলা গাহেক (অনেক খদ্দের) আছে। আপনেরা রাজি হইলে পনর বিশ দিনের মইদ্যে সব কাম হইয়া যাইব। খানিক চিন্তা করে ফের বলল, আমার পাওনাগন্ডার লেইগা ভাইবেন না। আপনেরা আমার নিজের জন। অন্যেরা যা দ্যায়, আপনেগো কাছ থিকা হের (তার) অনেক কম নিমু। ধরেন আদ্ধেক। পাকা কথা দিলাম।

হিরণ দ্রুত ভেবে নিল, শওকত আলির সঙ্গে যদি কোনও কারণে কাজটা শেষ পর্যন্ত না হয়, নিত্য দাসকে হাতে রাখা ভাল। বলল, দাদু আর জেঠিমা তো কলকাতায় নেই। ওঁদের জিজ্ঞেস না করে কিছু করা যাবে না। ওঁরা ফিরে আসুন, দেখি কী বলেন–

ওনারা কবে ফেরবেন?

কুড়ি বাইশ দিন পর।

দেরি হইয়া যাইব হিরণভাই। মেলা (অনেক) মুসলমান পাকিস্থানে যাওনের লেইগা ছটফট করতে আছে। আইজ পারলে আইজই চইলা যায়। কাইলের লেইগা বইসা থাকব না। এই দিকে আমার লাখান (মত) আরও অনেকে এচ্চেঞ্জে’র কারবারে লাইমা (নেমে) পড়ছে। যত দেরি হইব, আমার গাহেকরা তাগো কাছে চাইলা যাইব। তহন আর কিছু করনের থাকব না, এক কাম করেন

কী?

যত তরাতরি পারেন, দাদু আর জেঠিমারে কইলকাতায় লইয়া আসনের চ্যাষ্টা করেন-

দেখি—

নিত্য দাস এবার বিনু সম্পর্কে মনোযোগী হয়ে ওঠে। তার দিকে ঘুরে বলে, একখান মোন্দ সম্বাদ আছে ছুটোবাবু। আমার যে লোকেরা বডারের উইপারে যায়, শুনাশুন তাগো কানে আইছে, হামকত্তার নিকি বড় বিপদ–

বুকের ধকধকানি পলকে শতগুণ বেড়ে যায় বিনুর। এস্ত হয়ে সে জিজ্ঞেস করে, কিসের বিপদ?

পাকিস্থান গরমেন (গভর্নমেন্ট) হিন্দুগো বড় বড় সোম্পত্তি জোর কইরা কাইড়া নিব। হামকার জমিজেরাতের দিকেও নিকি তাগো নজর পড়ছে।

বিনুও কার কাছে যেন এই একই কথা শুনেছে। পাকিস্তান সরকারের অভিসন্ধিশত্রুসম্পত্তি ঘোষণা করে হিন্দুদের প্রপার্টি দখল। হিরণ বলেছিল কি? নাকি দেশ থেকে আসার সময় স্টিমার কিংবা কলকাতাগামী ট্রেনে অন্য কেউ?

এই সেদিন দেশ থেকে এপারে এসেছে বিনু। পার্টিশানের পর থেকেই রাজদিয়া এবং চারপাশের গ্রামগুলোতে ভাঙন ধরেছিল। ভিটেমাটি ফেলে কাতারে কাতারে মানুষ চলে যাচ্ছিল আসামে, ত্রিপুরায়, তবে বেশির ভাগই এপার বাংলায়।

বিনু দেখে এসেছে, আবহাওয়া খুবই উত্তপ্ত। চারদিকে প্রবল উত্তেজনা। ভয়। আতঙ্ক। কিন্তু হেমনাথের গায়ে এতটুকু আঁচড় পড়ে নি। কেউ তাকে হুমকি দেয়নি, দেশ ছেড়ে চলে যান। সরকার থেকে তার বিষয় সম্পত্তি গ্রাস করার চক্রান্ত ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায় নি।

মাত্র এই কদিনে হঠাৎ অবস্থার কি এমনই অবনছি ঘটে গেছে? রাজদিয়াকে ঘিরে তিরিশ চল্লিশ মাইলের মধ্যে হেমনাথ সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ। তারও কি তা হলে এবার নিস্তার নেই?

সন্ত্রস্ত বিনু জিজ্ঞেস করে, গভর্নমেন্ট থেকে দাদুর বাড়ি টাড়িগুলো শত্রু সম্পত্তি বলা হচ্ছে?

অহনও হয় নাই। কিন্তু হইতে কতক্ষণ? বিপদ ঘটনের আগে কাম সাইরা ফেলাইতে হইব।

আপনি কী করতে বলেন?

নিত্য দাস জানায়, তার হাতে একজন মস্ত বড় খদ্দের আছে। শাজাহান সাহেব। হুগলি জেলায় তার একশ’ বিঘের ওপর জমিজমা। হাওড়া শহরে বিরাট দুমহল বাড়ি। পুরনো আমলের একখানা মোটর গাড়িও আছে। ধান ওঠে বছরে দুশ মণেরও বেশি। তা ছাড়া তিল, তিসি, সর্ষে। কিছু আখ আর ডালও। তিরিশ চল্লিশটা গরুর গাড়ি। মোটামুটি মাঝারি ধরনের জমিদারই বলা যায়।

শাজাহান সাহেব পাকিস্তানে চলে যাবেন। তিনি চাইছেন প্রচুর জমিজমা সমেত বাড়ি। যেমনটি এ বাংলায় আছে, সীমান্তের ওপারে প্রায় তেমনই চাইছেন। ঢাকা শহরে চাষের খেত কোথায় পাওয়া যাবে? তিনি ঢাকার চল্লিশ পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে কোনও মফস্বল শহরে বাড়ি এবং তার কাছাকাছি। জমির খোঁজ করছেন। হেমনাথরা চাইলে একমাসের ভেতর এক্সচেঞ্জ হয়ে যাবে।

নিত্য দাস বলল, আমন সুযুগ হারান উচিত হইব না ছুটোবাবু। আপনে হ্যামকত্তারে শাজাহান সাহেবের কথা জানাইয়া এচ্চেঞ্জের ব্যাপারে চিঠি ল্যাখেন।

বিনু যখন এপারে চলে আসে, হেমনাথ তখনও তার সিদ্ধান্তে অবিচল। কোনও কারণেই দেশ ছাড়বেন না। এর মধ্যে যদি খবর পেয়ে থাকেন, পাকিস্তান সরকার শত্রুসম্পত্তির আইন জারি করতে চলেছে, তার মত পালটাতেও পারে। অযাচিত যে সুযোগ নিত্য, দাস নিয়ে এসেছে, হেলায় সেটা নষ্ট করা ঠিক হবে না।

হিরণ নীরবে শুনে যাচ্ছিল। এবার সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ, লিখেই দাও। উঠে গিয়ে ভেতরের ঘর থেকে কাগজ, কলম, সাদা বড় খাম আর আঠার শিশি এনে দিল।

বসার ঘরের একধারে চেয়ার টেবল রয়েছে। সেখানে গিয়ে চিঠিটা লিখেই ফেলল বিনু। রাজদিয়া থেকে এপারে আসার সময় ঝিনুককে নিয়ে প্রতি মুহর্তে কী নিদারুণ সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ তো দিয়েছেই। আরও জানিয়েছে, কলকাতায় পৌঁছে অবনীমোহনকে না পেয়ে সুনীতিদের বাড়ি গিয়েছিল। সেখান থেকে আপাতত সুধাদের কাছে এসে আছে। হেমনাথ কষ্ট পাবেন, তাই হেমনলিনীর নির্দয় আচরণের কথা জানায় নি।

চিঠির শেষ দিকে এক্সচেঞ্জের ওপর জোর দিয়ে বিনু লিখেছে, দেশের যা হাল, অবিলম্বে খুব সাবধানে সম্পত্তির দলিলগুলো নিয়ে ক দিনের জন্য যদি হেমনাথ কলকাতায় আসতে পারেন, খুব ভাল হয়। বিনিময়ের ব্যবস্থা এখানেই হয়ে যাবে। আপাতত তিনি একাই আসুন। স্নেহলতারা রাজদিয়ায় থেকে যাবেন। হেমনাথের আসার খরবটা ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ টের না পায়। কাজ চুকে যাবার পর স্নেহলতাদের দেশ থেকে নিয়ে আসা হবে।

চিঠিটা খামের ভেতর পুরে আঠা দিয়ে মুখ আটকে ফের হিরণদের কাছে এসে বসল বিনু। হঠাৎ তার মনে সংশয় দেখা দেয়। বলে, এই চিঠি যদি অন্যের হাতে পড়ে, দাদুর ভীষণ বিপদ হয়ে যাবে। খুব সাবধানে, গোপনে এটা যেন তার হাতে পৌঁছয়। আর হেমনাথও যেন তার মতামত লিখে খামের ভেতর পুরে পত্রবাহককে দেন। তার উত্তরের জন্য বিনু অপেক্ষা করে থাকবে।

জিভ কেটে নিত্য দাস বলল, হামকত্তায় আমার বাপের লাখান। তেনারে কত সোম্মান করি। তেনার ক্ষতি হউক, এইটা আমি চিন্তাও করতে পারি না। একটু থেমে ফের বলে, বিশ্বাসী লোকের হাত দিয়া আপনের পত্তরখান পাঠামু। পরান থাকতে এইটা হেয় (সে) হাতছাড়া করব না।

খামটা নিত্য দাসকে দেয় বিনু। সেটা সযত্নে পকেটে পুরে সে বলে, অনেকখানি সোময় আপনেগো কাছে কাটাইয়া গ্যালাম। বড় ভালা লাগল। হ্যামকত্তার চিঠির জবাব লইয়া দশ পনর দিনর ভিতরে আবার আসুম। আইজ চলি–

নিত্য দাসের সঙ্গে একতলায় নেমে এল বিনু আর হিরণ।

হঠাৎ নিত্য একটু কুণ্ঠিতভাবে বলল, একখান কথা জিগামু ছুটোবাবু?

বিনু বলল, কী?

শুনাশুন কানে আইছে, ঝিনুক বইনে নিকি আপনের লগে পাকিস্থান থিকা চইলা আইছে? এতক্ষণ কত কথাই না বলেছে নিত্য দাস। কাজের কথা, অকাজের কথা। কিন্তু ঝিনুক সম্পর্কে একটি শব্দও মুখে আনে নি। কিন্তু যাবার সময় আচমকা একটা শেল হেনে বসল।

হৃৎস্পন্দন পলকের জন্য থমকে যায় বিনুর। চিরদুঃখী মেয়েটাকে কতভাবেই না আড়াল করে রাখতে চাইছে সে, কিন্তু পারছে কই? ঝিনুকের চলে আসার খবর যখন পেয়েছে, ঢাকায় তার লাঞ্ছনার কথা কি নিত্য দাসের এখনও অজানা?

লোকটার হয়তো খারাপ কোনও অভিসন্ধি নেই। নেহাতই কৌতূহলের বশে ঝিনুকের কথাটা তুলেছে। কিন্তু হঠাৎ মাথার ভেতরটা তপ্ত হয়ে ওঠে বিনুর। পৃথিবীতে কত কত বিষয় তো রয়েছে। সে সব ফেলে ঝিনুককে নিয়ে টানাটানি কেন? রূঢ় গলায় সে বলে, ঝিনুকের কথা জানতে চাইছেন যে? কোনও দরকার আছে?

বিনুর মারমুখী চেহারা দেখে ঘাবড়ে যায় নিত্য দাস। দূরে সরে গিয়ে বলে, না না, অ্যামনেই জিগাইতে আচ্ছিলাম। দ্যাশের মাইয়া। জন্মাইতে দেখছি। আইচ্ছা, যাই

বিনু মনস্থির করে ফেলে। ঝিনুককে কতদিন আর পরিচিত মানুষজনের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে? রাজদিয়া এবং তার চারপাশের গ্রামগুলো উজাড় করে তোক চলে আসছে এপারে। তাদের অনেকেই ঝিনুকের খবর জানে। যারা জানে না, তারাও জেনে ফেলবে। এবং বিশ্বময় চাউর করে দেবে।

আগেও বিনু ভেবেছিল, কিন্তু সাহসে কুলোয় নি। যাই ঘটুক, এবার আর কুঁকড়ে থাকা নয়, সমস্ত কিছুর মুখোমুখি দাঁড়াবে সে। অবশ্য যুগলকে ঝিনুককে নিয়ে আসার খবরটা দিয়েছে। কিন্তু নিত্য দাসের সঙ্গে যুগলের অনেক তফাত।

নিত্য দাস চলে যাচ্ছিল, তাকে ডেকে বিনু বলল, শুনুন, ঝিনুক আমার সঙ্গে এসেছে। এ বাড়িতেই আছে।

.

৩.৩০

যুদ্ধের আমলে ডিফেন্সের প্রচার বিভাগে চাকরি নিয়ে এসেছিল হিরণ। মিত্রশক্তি তখন সিঙ্গাপুরে মালয়ে বর্মায় জাপানিদের হাতে কচুকাটা হচ্ছে। যারা বেঁচে আছে তারা বর্মা বর্ডার পেরিয়ে প্রাণভয়ে পালাচ্ছে কলকাতার দিকে। যে ব্রিটিশ সিংহ একদা সারা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াত, তোজোর ঝটিকা বাহিনী তার নাক কান এবং লেজ হেঁটে দিচ্ছে। কিন্তু যাদের রাজত্বে সূর্যাস্ত হয় না তাদের এই চরম হেনস্থার খবর রটে গেলে, গালে চুনকালি লেগে যাবে। কাজেই মুখরক্ষার জন্য পালটা প্রচার দরকার। যখন অ্যালায়েড ফোর্স ল্যাজ গুটিয়ে পঞ্চাশ মাইল পিছিয়ে এসেছে তখন জানানো হচ্ছে, মিত্রবাহিনী আশি মাইল এগিয়ে গেছে। যখন বিশটা ট্যাঙ্ক আর তিরিশটা বোমারু বিমান ধ্বংস। হয়েছে, তারস্বরে উলটোটাই প্রচার করা হচ্ছে। কখনও কখনও অবশ্য বলা হচ্ছে, ‘সাকসেসফুল রিট্রিট’ অর্থাৎ মিত্রশক্তি সাফল্যের সঙ্গে পশ্চাদপসরণ করেছে।

প্রচার দপ্তর থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বোঝাই এই জাতীয় প্রেসনোট তৈরি করতে হত হিরণকে। সেগুলো ছাপার জন্য পাঠানো হত খবরের কাগজের অফিসে।

যুদ্ধের পর প্রচার দপ্তরের কাজ নেই। ইংরেজ তখন পালাই পালাই করছে। জার্মান বোমায় লন্ডনের অর্ধেক মাটিতে মিশে গেছে। আর্থিক দিক থেকে একেবারে হাড়ির হাল। এই অবস্থায় কয়েক হাজার মাইল দূরে অন্য গোলার্ধে কলোনি আগলে রাখা অসম্ভব।

প্রচার দপ্তর গুটিয়ে ফেলা হল। যুদ্ধের দু’আড়াই বছরের মাথায় রেশনিং চালু হয়ে গিয়েছিল। প্রচার দপ্তর থেকে ফুড কনট্রোলে পাঠানো হল হিরণকে। এখন সেই ডিপার্টমেন্টেরই সে অফিসার।

জ্বরের জন্য কদিন অফিসে যেতে পারেনি হিরণ। বিনুরা আসার পর আরও দিন কয়েক ছুটি নিয়েছিল।

এখনও প্রচুর মেডিক্যাল আর আর্নড লিভ জমা হয়ে আছে। হিরণ ছুটিটা আরেক সপ্তাহ বাড়িয়ে নিল।

নিত্য দাস সেই যে এসেছিল, তারপর কটা দিন বিনু আর ঝিনুককে নিয়ে সারা কলকাতায় চরকির মতো ঘুরে বেড়াল হিরণ আর সুধা। গঙ্গার ধার। ইডেন গার্ডেন। হাওড়া ব্রিজ। বোটানিক্যাল গার্ডেন। দক্ষিণেশ্বর। কালীঘাট। মার্বেল প্যালেস। মনুমেন্ট। দু’দিন নাইট শো’য়ে সিনেমাও দেখল। ‘দেবী চৌধুরানী’ আর ‘কবি’।

যার জন্য এত ছোটাছুটি সেই ঝিনুকের দিনগুলো যেন ঘোরের মধ্যে কেটে যাচ্ছে। কলকাতার চারদিকে কত যে ইন্দ্রজাল! ঝিনুকের মনে হয়, কোনও স্বপ্নদৃশ্যে সে ডানা মেলে ভাসছে। সুধাদের কাছে এসে বড় ভাল লাগছে তার।

.

আজ বেস্পতিবার।

ক’দিন সারা কলকাতায় অবিরল পাক খাওয়ার পর আজ শরীর একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ি থেকে কারোরই বেরুতে ইচ্ছা করছে না।

তা ছাড়া, ফি বেস্পতিবার যুগল আসে। যুদ্ধের আমলের মিলিটারি হাসপাতালে পা ড্রেস করিয়ে এ বাড়িতে দুপুরটা কাটিয়ে যায়। অতদূর থেকে এসে হিরণদের কাউকে না পেলে জখম পা নিয়ে এতটা ছোটাছুটিই সার। খুবই কষ্ট হবে যুগলের।

সকালে এক দফা চা হয়ে গেছে। এখন সাড়ে দশটার মতো বাজে। বাইরের ঘরে আরও একবার। চা নিয়ে বসেছে বিনু আর হিরণ।

ভেতরে রান্নার তোড়জোড় চলছে। সেখান থেকে ঝিনুক আর সুধার অস্পষ্ট কথাবার্তা ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে কোনও মজার কথায় দু’জনে হেসে কুটিপাটি হচ্ছে।

বিনু খুব একটা চা খেত না। সকালে এক কাপ, বিকেলে এক কাপ। কিন্তু হিরণদের কাছে এসে সঙ্গগুণে চায়ের মাত্রাটা অনেক বেড়ে গেছে।

জানালার বাইরে পরিষ্কার নীলাকাশ। সকালের দিকে যে কুয়াশা ছিল, এখন তার লেশমাত্র নেই। ঝলমল রোদ ছড়িয়ে আছে চারদিকে, তবে আগের মতো আঁঝ নেই। উত্তরে বাতাস ক্রমশ শীতল হচ্ছে। শীতঋতু যে লম্বা পায়ে এগিয়ে আসছে, টের পাওয়া যায়।

এ ক দিন যেখানে যেখানে ঘোরা হয়েছে, যে কটা সিনেমা দেখা হয়েছে, সে সব নিয়ে লঘু মেজাজে গল্প হচ্ছিল। হঠাৎ হিরণ বলল, কলকাতায় চলে এসেছ। আর কখনও রাজদিয়ায় ফেরার প্রশ্নই নেই। কী করবে, কিছু ঠিক করেছ?

হিরণ কী জানতে চাইছে, বুঝতে না পেরে বিনু বলল, কী করব বলতে?

তুমি তো বি. এ পাস করেছ।

হ্যাঁ।

কিসে অনার্স ছিল?

ইংরেজিতে।

হিরণ জিজ্ঞেস করল, পড়াশোনা কি চালিয়ে যাবে? তা হলে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ফর্ম টর্ম এনে অ্যাডমিশানের ব্যবস্থা করতে হয়। একটু ভেবে বলল, এ বছরের ক্লাস অবশ্য অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। শুনেছি, উদ্বাস্তু ছাত্রদের ব্যাপারে ইউনিভার্সিটি খুব সিমপ্যাথেটিক। দেরিতে হলেও ভর্তি করে নিতে পারে।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে বিনু। ছেচল্লিশের দাঙ্গার পর থেকে পূর্ব বাংলার আবহাওয়া বিষবাষ্পে ভরে যাচ্ছিল। সারাক্ষণ উৎকণ্ঠা। সারাক্ষণ মৃত্যুভয়। সবচেয়ে বড় সংকট তখন ঝিনুককে নিয়ে। প্রায় বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল সে। কী করে তাকে সুস্থ, স্বাভাবিক করে তুলবে সেটাই ছিল বিনু। হেমনাথ স্নেহলতা এবং শিবানীর একমাত্র চিন্তা। তারপর তো বিরাট ঝুঁকি নিয়ে প্রবল আতঙ্কের মধ্যে ঝিনুককে নিয়ে এপারে চলে এল বিনু। এর ভেতর অন্য কিছু ভাবার সময় পায় নি সে।

কিন্তু এটা তো ঠিক, সামনে বিপুল ভবিষ্যৎ। একটি যুবকের পক্ষে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা তো সম্ভব নয়। সুধাদের কাছে আসার পর কটা দিন হইচই আর অফুরান আনন্দে যেন আকাশে উড়ছিল বিনু। সেখান থেকে একটানে হিরণ তাকে বাস্তবের কঠিন জমিতে নামিয়ে এনেছে।

বিনু বলল, বাবা ফিরে আসুন। তিনি কী বলেন, শুনি—

হিরণ সায় দেয়, তা তো বটেই। হঠাৎ কী মনে পড়ায় দ্বিধান্বিতভাবে বলে, তবে–

কী?

তোমার ছোটদিকে কিছু বলল না। আমি যতদূর জানি, শ্বশুরমশাইর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ।

বিনু চমকে ওঠে। যে অবনীমোহন যুদ্ধের আমলে দাপটে আসামে গিয়ে কনট্রাক্টরি করেছেন, তিনি যে আর্থিক দিক থেকে দুরবস্থায় পড়েছেন, রাজদিয়ায় থাকতে এমন খবর তাদের কাছে পৌঁছয় নি। ইদানীং না হয় চিঠিপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ছমাস আগেও ডাক চলাচলে কোনও গোলমাল ছিল না। সুধারা, সুনীতিরা নিয়মিত চিঠি লিখত। কিন্তু তারাও কেউ ঘুণাক্ষরে কিছু জানায় নি।

হিরণ বলছিল, চিন্তা করো না, তোমার পড়ার ব্যাপারটা আমি দেখব।

বিনুর আত্মসম্মানে বাধছিল। ভগ্নিপতির পয়সায় পড়াশোনা চালাতে তার মন মোটেও সায় দিচ্ছে না। সে বলল, দেখুন হিরণদা, এটা হয় না।

হিরণ বুঝতে পারছিল, বিনুর কোথায় আটকাচ্ছে। সে জোর করল না। শুধু বলল, আর দেরি করলে ইউনিভাসির্টিতে ভর্তি হতে মুশকিল হবে।

বিনু উত্তর দিল না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর হিরণ বলল, তোমার আপত্তিটা কোথায়, আন্দাজ করতে পারছি। ঠিক আছে, ইচ্ছে যখন নেই, আমার সাহায্য নাই নিলে। আমার অন্য একটা কথা ভেবে দেখতে পার।

হিরণ যে তার সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী, বিনু তা জানে। উৎসুক সুরে জিজ্ঞেস করল, কী কথা?

একটা চাকরি বাকরি করলে। ফাঁকে ফাঁকে পড়ে প্রাইভেট এম.এ’টা দিলে।

এই পরামর্শটা মনে ধরল বিনুর। অবনীমোহন সম্পর্কে যে খবরটা পাওয়া গেল, তাতে তার বোঝা বাড়ানো ঠিক হবে না। ঝিনুক আর সে গিয়ে থাকবে। দুটো মানুষের দায়িত্ব তো কম নয়। তার ওপর পড়াশোনার খরচ। না, রোজগারের একটা ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে।

বিনু ব্যগ্রভাবে বলল, আমি তো এখানকার কিছুই চিনি না। চাকরি পেতে হলে কী করতে হবে?

আমাদের ফুড ডিপার্টমেন্টে মাস দুয়েকের ভেতর কিছু লোক নেওয়া হচ্ছে। রিফিউজিদের প্রায়োরিটি দেওয়া হবে। তুমি গ্র্যাজুয়েট, তার ওপর অনার্স। তোমার চাকরি আশা করি হয়ে যাবে। বর্ডার স্লিপটা আছে তো?

আছে।

ইন্টারভিউর সময় ওটা দেখতে চাইবে।

ভেতরে ভেতরে উদীপ্ত হয়ে উঠেছে বিনু। সে হাসল, আমি যে ওপার থেকে এসেছি তার প্রমাণ চাই, এই তো?

হ্যাঁ। হিরণ আস্তে মাথা নাড়ে, ও, আসল ব্যাপারটাই তো বলা হয় নি। তোমার ম্যাট্রিকুলেশন, আই.এ, বি.এ’র সার্টিফিকেট আর ডিগ্রি নিয়ে এসেছ তো?

আমি তো সেদিনই আপনাকে বললাম, তারপশায় আসার সময় দাঙ্গাবাজরা নৌকো থেকে সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। তার ভেতর আমার ডিগ্রিটিগ্রিও ছিল।

হঠাৎ ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে হিরণ। মনে পড়ল, ডিগ্রিগুলো খোয়া যাবার কথা বিনু তাকে জানিয়েছিল। তার খেয়াল ছিল না। বলল, সর্বনাশ। ওগুলো ছাড়া চাকরি হবে কী করে?

সব উৎসাহ নিমেষে বিলীন। পাংশু মুখে বসে থাকে বিনু।

খানিক ভেবে হিরণ বলে, একটা উপায় অবশ্য আছে। রাজদিয়া কলেজের প্রিন্সিপ্যাল যদি লিখে দেন তুমি ওখান থেকে বি. এ পাস করেছ, কাজ হতে পারে। ইস, নিত্য দাস হেমদাদুর চিঠি লিখিয়ে নিয়ে গেল। তখন আমার একেবারেই খেয়াল হয় নি। চিঠিতে এই সমস্যার কথাটা লিখে দিলে হেমদাদু প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে দেখা করে ব্যবস্থা করতে পারতেন। ভীষণ ভুল হয়ে গেছে।

বিনু উত্তর দিল না।

কী যেন চিন্তা করে হিরণ। চকিতে আলোর একটা সংকেত চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে যায়। ইন্টারভিউতে ডাকতে অনেক দেরি। তুমি একটা দরখাস্ত তো করে দাও। তার মধ্যে নিত্য দাস হেমদাদুর জবাব নিয়ে আসবে। তখন তাকে আরেকখানা চিঠি লিখে দেওয়া যাবে। প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে তিনি যেন সব ব্যবস্থা করেন।

নিচের বাগান থেকে যুগলের গলা ভেসে এল, ছুটোদিদি, ছুটো জামাইবাবু, দরজা খুইলা দ্যান– সেই সঙ্গে কড়া নাড়ার খটখটানি।

হিরণ বলল, যুগল এসে গেছে। উমাকে ডেকে একতলায় পাঠিয়ে দিল সে।

খানিক পরে উমার সঙ্গে দোতলায় উঠে এল যুগল। মেঝেতে ঝুপ করে বসে বিনুকে দেখে খুশিতে সারা মুখ জুড়ে হাসল, আপনের কথাই ভাবতে ভাবতে আসতে আছিলাম ছুটোবাবু।

বিনু লক্ষ করেছে, বসার জন্য সেদিনের মতো কষ্ট করতে হয় নি যুগলকে। ঊরুর ব্যান্ডেজটাও বেশ ছোট। ব্যাথাটাও মনে হচ্ছে, অনেক কমে গেছে।

বিনু বলল, আমরাও তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। ছোটদি আর হিরণদার মুখে শুনেছি, তুমি অন্য বেস্পতিবার দুপুরের আগে আসো না। আজ এত তাড়াতাড়ি যে?

হাসপাতালে আইজ তরাতরি হইয়া গেল। ঘাওখান (ঘাটা) শুকাইয়া আসছে। ডাক্তারে কইছে আর দুই বিষুদবার দেইখা পায়ের পট্টি (ব্যান্ডেজ) খুইলা দিব।

খুব ভাল খবর। তোমাদের মুকুন্দপুরের কী অবস্থা?

একই। জমিনের দখল কি এত সহজে মিলে? জমিদারের লগে কতকাল লইড়া যাইতে হইব, ক্যাঠা জানে। যুগল বলতে লাগল, উই হগল কথা থাউক। আইজ মনে মেলা আশা নিয়া আসছি। একে একে কই। বড়দিদির বাড়ি থিকা ঝিনুক বইনেরে নিয়া আসছেন?

বিনু বলল, হ্যাঁ। নিয়ে আসব যে, সেদিনই তো তোমাকে বলেছি।

যুগল প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, কই হেয় (সে)?

রান্নাঘরে, ছোটদির সঙ্গে কী যেন করছে—

অহনই ডাইকা আনেন। দুই জনেরেই।

বিনু ভেতরে চলে গেল। ঝিনুক কিছুতেই আসবে না। যুগলের কাছে সঙ্কোচের কারণ নেই। প্রাণ গেলেও সে কোনও রকম ক্ষতি করবে না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে বাইরের ঘরে নিয়ে এল বিনু। সঙ্গে সুধাও এসেছে।

আনন্দে দু’চোখ চিক চিক করতে থাকে যুগলের। বলে, উঃ, কত ডাঙ্গর (বড়) হইয়া গ্যাছ ঝিনুক বইন। বসো, বসো–

ঝিনুকের জন্য সারা বিশ্বব্রহ্মান্ডের যে কোনও পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে বিনু। কিন্তু ঝিনুকের মধ্যে তেমন সাহস নেই। চেনাজানা মানুষের সামনে সে ভীষণ গুটিয়ে যায়। আড়ষ্টের মতো একটা সোফায় নিঃশব্দে বসে পড়ল। নতমুখ। যুগলের দিকে সে তাকাতে পারছিল না।

যুগল পলকহীন ঝিনুককে দেখছিল। বলল, আমারে দেইখা অ্যামন লাজ (লজ্জা) ক্যান? আমি তোমাগো যুগইলা না? হেই ছুটোকালে তোমারে কতখানে লইয়া গ্যাছি, কত কী দেখাইছি, মনে পড়ে?

এক টানে স্মৃতির ঝাপি খুলে ফেলল যুগল। রাজদিয়ায় থাকতে তার কাছে ঝিনুক কত না আবদার করেছে! কত যে তার বায়না! আকাশ-উঁচু গাছের মাথা থেকে তাকে পেড়ে এনে দিতে হয়েছে। পাকা কাউফল। কখনও বিলিতি গাব। কখনও গহীন বেতঝোপের ভেতর থেকে থোকা থোকা বেথুন (বেতফল)। কখনও হলুদ-বর্ণ রোয়াইল, পাকা বরই, ডেউয়া, কামরাঙা। কখনও বা অথৈ জল থেকে তুলে আনতে হয়েছে শাপলা শালুক কি জলপদ্ম। ভাসানের পরদিন হেমনাথের সঙ্গে বাইচ দেখতে ঝিনুক যখন বড় গাঙে যেত, সেই নৌকো বেয়ে নিয়ে যেত কে? যুগল। চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় যখন কাঠের পুতুল, জ্যান্ত টিয়াপাখি বা তিলা কদমা চিনির মঠ কিনতে যেত, সঙ্গে থাকত কে? যুগল।

ছোট ছোট কত ঘটনা। টুকরো টুকরো কত আনন্দের স্মৃতি। যুগল যেন লহমায় ঝিনুককে সারি সারি স্বপ্নদৃশ্যের ভেতর টেনে নিয়ে গেল। সরল, অকপট, ম্যারপ্যাঁচহীন এই যুবকটির স্বভাবে কোথায় যেন একটা ঝড়ো হাওয়া আছে। এক ঝাঁপটায় ঝিনুকের সব আড়ষ্টতা উধাও। শক্ত খোলার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে সে। পুরনো দিনের সুখস্মৃতি তাকে যেন শতদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যে সব ঘটনা যুগলের মনে পড়ে নি, সেগুলো মনে করিয়ে দেয়। মজার মজার কথায় হেসে। কুটিপাটি হতে থাকে। ঢাকায় তার চরম লাঞ্ছনার খবরটা যুগল জানে কিনা, সে সম্বন্ধে আর খেয়াল। থাকে না ঝিনুকের।

যুগল মাথা ঝাঁকিয়ে কঁকিয়ে বলে, ঝিনুক বইন, অহন কী ভালা যে লাগতে আছে! এই হাসন আছিল কই? এই ব্যস্যে (বয়সে) শোকাঁপা (শোকগ্রস্ত) মাইনষের লাখান মাটিতে চৌখ নামাইয়া বইসা থাকলে আমার মন খারাপ হইয়া যায়।

ঝিনুকই শুধু নয়, হিরণ আর সুধাও হাসছিল। তারা হাসতেই থাকে।

যুগল বলল, ঝিনুক বইনের লগে দেখা হইয়া গেল। এইবার পরের কথাখান কই ছুটোবাবু–

বিনু জিজ্ঞেস করল, কী কথা?

আমার লগে আইজ আপনেরে আর ঝিনুক বইনেরে মুকুন্দপুরে লইয়া যামু। উদ্দীপ্ত মুখে যুগল বলতে লাগল, আমাগো উইখানের মানুষজন আপনেগো দ্যাখনের লেইগা পথের দিকে তাকাইয়া আছে।

বিনুর মনে পড়ল, আগের বেস্পতিবার তাকে মুকুন্দপুরে নিয়ে যাবার কথা বলেছিল যুগল। কিন্তু সেটা যে আজই, ভাবতে পারে নি। বলল, এত তাড়াহুড়ো কেন? এখন তো আমরা কলকাতায় থাকছিই। অন্য একদিন যাব।

যুগল ব্যগ্রভাবে বলল, অন্য দিন না। আইজই যাইবেন। পাখি মাথার কিরা (দিব্যি) দিয়া কইয়া দিছে, আপনেগো দুইজনেরে লইয়া যাইতে হইব। আপনেরা না গ্যালে আমার ঘেটিতে (ঘাড়ে) মাথাখান থাকব না।

পাখি যুগলের বউ। ওদের বিয়েতে কী ধুমধামই না হয়েছিল! রাজদিয়াবাসীরা, হিন্দুই হোক কি মুসলমান, সবাই তিনদিন হেমনাথের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়েছে। সকাল দুপুর বিকেল রাত্রি, চারবেলা করে।

যুগল থামে নি, হেয়া (তা) ছাড়া, আমাগো রাইজদা আর চাইরপাশের গেরামগুলা থিকা কত মানুষ মুকুন্দপুরে গিয়া উঠছে। তাগো নৈরাশ কইরেন না ছুটোবাবু’ একটু ভেবে তক্ষুনি আবার শুরু করে, নিশিকান্ত আচায্যির কথা মনে আছে? তাজপুরে তেনাগো বাড়ি আছিল।

রাজদিয়ার দক্ষিণ দিকে তিনখানা গ্রামের পর তাজপুর। নিশিকান্ত আচার্যকে বেশ কয়েক বার হেমনাথের কাছে যাতায়াত করতে দেখেছে বিনু। যখন আসত তার সঙ্গে সামান্য দু’একটা কথা বলত। ব্যস, এই পর্যন্ত। তার সম্বন্ধে এর বেশি কিছু মনে নেই।

হঠাৎ এত মানুষ থাকতে আলাদা করে নিশিকান্ত আচার্যর কথা কেন তুলল, জিজ্ঞেস করায় যুগল বলে, পাখি আপনেগো দুইজনের খাওনের লেইগা চাউল তরিতরকারি মাছ ডাইল তেনাগো কাছে দিয়া আসছে। ওনারা বামন (ব্রাহ্মণ)। আপনেগো লেইগা রাইন্ধা (বেঁধে) দিব।

পাছে তাদের হাতে না খায় সেজন্য ব্রাহ্মণদের দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করেছে যুগলরা। শুনেই মাথার ভেতরটা তপ্ত হয়ে ওঠে বিনুর। গলার স্বর চড়িয়ে বলে, তোমার কী করে মনে হল, তোমরা বেঁধে দিলে আমরা খাব না?

উচা জাইতের মাইনষে আমাগো ছুয়া খায় না। হেইর লেইগা– বলতে বলতে যুগলের সারা মুখে হাজার বাতি জ্বলে উঠল, খাইবেন আমাগো হাতে ছোটবাবু! সত্যই খাইবেন!

খাব, খাব, খাব। আমি তোমাদের হেমকর্তার নাতি। তিনি সবার বাড়িতে খেতেন। জাতপাত মানতেন না। আমিও মানি না। কিন্তু আজ আমাদের মুকুন্দপুরে না গেলেই ভাল হয়।

যুগল সব আপত্তি খারিজ করে দিল। তার মধ্যে এমন এক ব্যগ্রতা, সারল্য আর আন্তরিকতা রয়েছে যে শেষ পর্যন্ত বিনুকে রাজি হতেই হল। যুগলের বিশ্বাস, তার এই ছোটবাবুটির ওপর সে জোর খাটাতেই পারে। যাকে একদিন পূর্ব বাংলার খালে বিলে নদীতে এবং নানা ভূখণ্ডে ঘুরিয়ে। ঘুরিয়ে ফুল ফল এবং নানা ধরনের বৃক্ষলতা চিনিয়েছে, দিয়েছে জলতলের অপার রহস্যের সন্ধান তার ওপর যুগলের দাবি অফুরান।

তবে ঝিনুককে কোনও মতেই রাজি করানো গেল না। যুগলের কাছে তার যাবতীয় আড়ষ্টতা আর সঙ্কোচ কেটে গিয়েছিল। কিন্তু সে জেনে গেছে, মুকুন্দপুরে রাজদিয়া এবং তার চারপাশের অনেকে জমি দখল করে বসেছে। এরা সবাই তার চেনা। এই লোকগুলো কি আর ঢাকার সেই ঘটনার খবর পায় নি? তাকে দেখলে ওরা কী করে বা বলে বসবে, কে জানে। পরিচিত মানুষজনের কাছে সে আদৌ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।

যুগল বলল, আমার আশাখান আধাআধি পূরণ হইল। তয় (তবে) ঝিনুক বইন, একদিন না একদিন আমি তোমারে মুকুন্দপুরে লইয়া যামুই।

ঝিনুক হাসল, উত্তর দিল না।

যুগল সুধাকে বলল, এটু তরাতরি বাইর হমু ছুটোদিদি। আপনের রান্ধন (রান্নার) কত দূর?

সুধা বলল, হয়ে এসেছে। কেন?

যা হইছে হেই দিয়া দ্যান। মুকুন্দপুর কাছে পিঠে না। যাইতে সোময় লাগে। হেয়া (তা) ছাড়া পথে একখান কাম সারতে হইব।

খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে কাপড়ের ঝোলায় বাড়তি দু’একটা জামাকাপড় এবং টুকিটাকি জিনিস ভরে যুগলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল বিনু।

হিরণ বলল, তোমাদের ছোটবাবুকে বেশি দিন আটকে রেখো না কিন্তু।

যুগল সবেগে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না না, বড় জোর চাইর পাঁচদিন। হের (তার) পর আমি নিজে লগে কইরা দিয়া যামু।

হিরণের মাথায় পর পর নানা চিন্তা উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। চাকরির ব্যাপারে বিনুর দরখাস্ত লেখা হয় নি। সেটা তাড়াতাড়ি লিখে জমা দেওয়া দরকার। অবনীমোহনের ফেরার সময় হয়ে এসেছে। বিনুকে সঙ্গে করে ভবানীপুরে গিয়ে একবার তার খোঁজ নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া, এ ক’দিন সারা কলকাতায় প্রচুর ঘোরাঘুরি করা হয়েছে। অঢেল আনন্দ। প্রচণ্ড হই হই। এবার তাকে দিয়ে একটা কাজ করিয়ে নিতে হবে। দেশের বাড়ির সঙ্গে শওকত আলিদের এক্সচেঞ্জ করার ব্যাপারে সুধার এখনও প্রবল আপত্তি। সে একেবারে ঘাড় বাঁকিয়ে রেখেছে। যে পরিবেশে, যে আবহাওয়ায় সুধা বড় হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে কোনও রকম সংস্কার থাকার কথা নয়। কিন্তু কার ভেতর কী। যে থেকে যায়! হিরণের ইচ্ছা, বিনুকে দিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এক্সচেঞ্জের ব্যাপারে সুধাকে রাজি করাবে। সেটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভাল।

হিরণ বলল, চার পাঁচদিন নয়, আজ যাচ্ছে। কালকের দিনটা থেকে পরশু বিনু চলে আসবে। ওকে আর আটকে রাখবে না। ওর এখানে অনেক কাজ।

যুগল বলল, আইচ্ছা আইচ্ছা, আগে তো ছুটোবাবু যাউক। হের (তার) পর দেখা যাইব।

বিনু লক্ষ করল, মুকুন্দপুরে গিয়ে তার দু’একদিন থেকে আসার ব্যাপারে এতটুকু আপত্তি করে নি ঝিনুক। রাজদিয়ায় রাজেকের নৌকোয় ওঠার পর থেকে এক লহমাও তাকে কাছছাড়া করতে চাইত না সে। কিছুক্ষণের জন্য বিনু কোথাও গেলে কেঁদেকেটে জগৎ সংসার তোলপাড় করে ফেলত। বিনুই তখন তার একমাত্র ভরসা। একমাত্র অবলম্বন। তাকে বাদ দিয়ে বেঁচে থাকার কথা ভাবতে পারত না মেয়েটা। মনে হত, দিকদিশাহীন, অথৈ সমুদ্রে ভেসে যাবে।

কিন্তু সুধাদের কাছে এসে পায়ের তলায় শক্ত জমির স্পর্শ পেয়েছে ঝিনুক। এখানে সে নিরাপদ। বিঘহীন। সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত। দু’তিন দিন কেন, বিনু যদি পুরো একটি সপ্তাহও মুকুন্দপুরে কাটিয়ে আসে, সে বাধা দেবে না। বিনুকে ছাড়াও দুই ডানায় তাকে ঘিরে রাখার মতো আরও দু’জনকে সে পেয়ে গেছে। সুধা আর হিরণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *