৩.০৬-১০ রূপচাঁদ পক্ষী

৩.০৬ রূপচাঁদ পক্ষী

পরদিন সকালে পটলডাঙায় রূপচাঁদ পক্ষীর আজ্ঞায় গিয়ে উপস্থিত হল রাম বসু।

রূপচাঁদ পক্ষীর পিতৃদত্ত নাম সনাতন চক্রবর্তী বা ঐরকম একটা কিছু। মহাপুরুষগণের জীবনে প্রায়ই দেখা যায় যে, স্বোপার্জিত পরিচয়ের তলে কৌলিক পরিচয় চাপা পড়ে যায়—এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। স্বোপার্জিত রূপচাঁদ পক্ষী পৈতৃক সনাতন চক্রবতীকে চাপা দিয়ে লুপ্ত করে দিয়েছে।

সেকালে যে-সব মহাপুরুষ একাসনে বসে একশ আট ছিলিম গাঁজা খেতে পারত তারা একখানা করে হঁট পেত। এইভাবে উপার্জিত হঁটে বাসভবন নির্মাণ করতে পারলে পক্ষী পদবী পাওয়া যেত। তখনকার কলকাতায় দেড়জন পক্ষী ছিল। পটলডাঙায় রূপচাঁদ পক্ষী আর বাগবাজারে নিতাই হাফ পক্ষী। হাফ পক্ষীর অর্থ এই যে, বাড়ীর চার দেয়াল গড়বার পরে হঠাৎ সাধনোচিত ধামে প্রয়াণ করে নিতাই, তাই লোকে তাকে হাফ পক্ষী বলত। বস্তুত রূপচাঁদই একমাত্র পক্ষী। নিতাই-এর কথা উঠলে রূপচাঁদ দুঃখ করে বলত, ছোকরার এলেম ছিল, অকালে না মরলে একটা আস্ত পক্ষী হতে পারত। তার পরে ভবিষ্যতের জন্য খেদ করে বলত, এসব প্রাচীন প্রথা তো একরকম উঠেই গেল, আমার কত-দু-চারজন মরলেই সব ফরসা। এখনকার ছেলেরা সব গোঁফ না উঠতেই ‘এলে’ ‘বেলে’ পড়ে, ফিরিঙ্গির বেনিয়ান মুচ্ছুদি হতে যায়—কৌলিকপ্রথা রক্ষায় আর কারও আগ্রহ নেই। দিনে দিনে কি হতে চলল, অ্যাঁ! বলে সে ছিলিমের সন্ধান করে।

যাই হক, রূপচাঁদের ভরসা ছিল যে, তার জীবনকালে এ প্রথা লুপ্ত হতে সে দেবে না–বলা বাহুল্য, প্রতিজ্ঞা সে রক্ষা করেছিল।

শহরের বহু সন্ত্রান্ত ঘরের উঠতি বয়সের ছোকরা রূপচাঁদ পক্ষীর আজ্ঞায় নিয়মিত যাতায়াত করত—আর সেখানে যে শাস্ত্রচর্চা করত না তা বলা নিষ্প্রয়োজন। পাদ্রীদের সঙ্গে জোটবার আগে এক সময়ে রাম বসুও যাতায়াত করত তার আড্ডায়, সেই সূত্রে পরিচয়। রাম বসু জানত যে, মুখ্য গুণের আনুষঙ্গিক আরও অনেক গুণের অধিকারী রূপচাঁদ পক্ষী। তুকতাক মন্ত্রতন্ত্র তাবিজ-কবচ, ঝাড়ফুক এবং তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মে তার বিপুল অভিজ্ঞতা। বস্তুত তার ভরসাতেই রাম বসু জনের অনুরোধ স্বীকার করেছিল।

রাম বসু রূপচাঁদ পক্ষীর দরজায় ধাক্কা দিতে ভিতর থেকে ভাঙা গলায় কর্কশস্বরে ধ্বনি হল—ক্যা,–ক্যা, বলি এত সকালে ক্যা হে!

দরজা খুলুন পক্ষীমশাই, চেনা লোক।

দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল একটি মূর্তি। দীর্ঘ কঙ্কাল, হাঁটু পর্যন্ত মলিন ধুতি, পায়ে খড়ম, খালি গা, জীর্ণ উপবীত, অত্যুজ্জ্বল কোটরগত চক্ষু, মুখমণ্ডলের বাকি অংশ গাল, কপাল, চিবুক প্রভৃতি—অজস্র বলিচিহ্নিত, চুল সাদা, খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফও সাদা; বয়স পঁয়ত্রিশও হতে পারে আবার পঁচাত্তর হতেও বাধা নেই।

প্রণাম পক্ষীমশায়।

ঠাহর করে দেখে নিয়ে গলায় ভাঙা কাঁসর বাজিয়ে বলল পক্ষী, ক্যা, বসুজা যে! অনেক দিন পর, হঠাৎ চিনতে পারি নি। তার পর, ভাল তো? বস বস।

জীর্ণ তক্তপোশের উপরে দুজনে পাশাপাশি বসল।

কেমন আছেন পক্ষীমশায়?

আর থাকাথাকি, এখন গেলেই হয়।

সে কি কথা, এরই মধ্যে গেলে চলবে কেন?

আর থেকেই বা কি করছি? এখনকার বড়লোকের ছেলেরা আর এদিকে ঘেঁষতে চায় না, ফিরিঙ্গি বেটাদের দেখাদেখি সব মদ ধরছে। মদে কি আছে হ্যাঁ? বলে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাল বসুজার দিকে।

কিছু বলা কর্তব্য মনে করে বসুজা বলল–যুগের ধর্ম, কি করবেন বলুন!

এই কি একটা উত্তর হল! তুমি যে খিরিস্তান হলে হ্যাঁ!

কিছুক্ষণ এইভাবে সময়োচিত কথাবার্তার পরে পক্ষী শুধাল-তার পর, কি মনে করে?

রাম বসু তখন আগমনের উদ্দেশ্য বিবৃত করল! সমস্ত বিবরণ ধীরভাবে শুনে গম্ভীরভাবে পক্ষী বলল-তা হবে। কিন্তু এ যে খরচপত্রের ব্যাপার।

সেজন্যে ভাববেন না, আপাতত কিছু রাখুন, বলে জন-প্রদত্ত অর্থের কিয়দংশ পক্ষীর হস্তে সমর্পণ করল রাম বসু।

মুদ্রা-স্পর্শে তড়িৎস্পর্শের লক্ষণ ঘটল পক্ষী-দেহে, সে বেশ এঁটেসেঁটে জেঁকে বসল, বলল, আর কিছু নয়, প্রথমে একটা বগলা পুজা করে একটা বশীকরণ কবচ করতে হবে; কিন্তু সব প্রথমে চাই কালীঘাটে ষোড়শোপচারের একটা পূজা দেওয়া।

সে সব বাধবে না, কিন্তু মেমসাহেব কি কবচ তাবিজ পরতে চাইবে–তাকে লুকিয়ে সব করা হচ্ছে কিনা!

সে একটা কথা বটে। তার পরে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, দেখ শাস্ত্রে সব রকম বিধানই আছে। কবচটা গোপনে একবার মেমসাহেবকে মাথায় ঠেকিযে তার শয়ন-গৃহে রেখে দিতে পারবে তো?

রাম বস বলল, তা পারা যাবে।

তবেই হবে, বলল পক্ষী।

আচ্ছা পক্ষীমশায়, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, কলিকালে কবচ তাবিজে ফল ফলে?

দেখ বাপু, মানলে কেউটে, না মানলে ঢোঁডা–এই হচ্ছে গিয়ে তন্ত্রমন্ত্রের রহস্য।

তা তো বটেই, তবে কথা হচ্ছে কিনা, ম্লেচ্ছগুলোর উপরে এসব ফলদায়ক হয়ে থাকে?

কেন হবে না? এই যে স্টুয়ার্ট সাহেব, হিন্দু স্টুয়ার্ট বলে যার নাম পড়েছে, শালগ্রাম পূজো না করে যে জলগ্রহণ করে না, গঙ্গাজলে স্ব-পাক করে হবিষ্যি খায়—এসব কেমন করে সে খোঁজ রাখ?

রাম বসুকে স্বীকার করতেই হল যে, সে খোঁজ রাখে না।

উদগত পঞ্জর বুকের উপরে বারকতক চড় মেরে বলল-এই বান্দার কাজ। সব কথা বলব আর একদিন।

তার পরে বলল, সব ভালয় ভালয় হয়ে যাবে, সাহেবকে চিন্তা করতে নিষেধ করে দিও। মেমসাহেবের কপালে কবচটা স্পর্শ করবার সাত দিনের মধ্যে বেটী এসে সাহেবের পায়ে লুটিয়ে পড়বে না! অমন কত গঙ দেখলাম—হ্যাঃ!

রাম বসু বলল—তাহলে আজ উঠি। তাড়াতাড়ি গিয়ে সাহেবকে সুসংবাদ শুনিয়ে দিই।

কবে আবার আসছ?

কালকেই—না হয় পরশু।

পরশু আবার কেন-কালই এসো। অমনি গোটা পঞ্চাশেক টাকা হাতে করে এসো।

টাকা আনতে ভুলবে না বলে রাম বসু রওনা হয়ে গেল।

এমন সময় পিছন থেকে ভাঙা গলায় সজোরে বেজে উঠল—সিক্কা টাকা, ভায়া, সিক্কা টাকা।

রাম বসু ইঙ্গিতে জানাল, তাই হবে।

.

৩.০৭ সরল স্বাস্থ্যলাভ পদ্ধতি

বামুনগিন্নীকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছিল বটে অন্নদা কিন্তু তার উপদেশটা কিছুতেই ভুলতে পারল না, থেকে থেকে মনের মধ্যে খোঁচা দিতে লাগল—পুরুষমানুষ একটু গায়েগত্তি চায়, কাঠিপারা মেয়েছেলেয় তাদের মন ওঠে না। বলা বাহুল্য অন্নদা নিজেকে সুন্দরী মনে করত, কোন নারীই বা তা মনে না করে। পাড়ার পরিচিত মেয়েদের সঙ্গে নিজের তুলনামূলক আলোচনা করল মনে মনে, এমন কি যাদের সুন্দরী বলে খ্যাতি ছিল তাদের সঙ্গেও নিজেকে মিলিয়ে দেখল মনে মনে; একই সিদ্ধান্ত, সে সুন্দরী। তবে হ্যাঁ, বোধ হয় একটু রোগা। ভাল করে নিজের চেহারা দেখবার জন্যে বহুদিন অব্যবহৃত পুরনো আয়নাখানা বের করল।

পোড়ারমুখো আয়না, আছড়ে ফেলে দিল সে।

বহুদিনের অব্যবহারে কতক কতক পারদ উঠে গিয়েছে, মুখের খানিকটা দেখা যায় খানিকটা দেখা যায় না, সবসুদ্ধ মিলে যে ছায়া ভেসে ওঠে তা সন্তোষজনক মনে হয় না তার। দোষ অবশ্যই দর্পণের, আছড়ে ফেলে দেয় দর্পণখানা।

তখন সে স্থির করল একখানা নূতন আয়না কিনে আনতে হবে, একেবারে সাহেব বাড়ী থেকে। তার বিশ্বাস সাহেব দোকানের আয়নায় মেমের মত ছায়া ফুটবে।

ন্যাড়ার হাতে গোটা দুই টাকা দিয়ে অন্নদা বলল, একখানা আয়না কিনে আনতে পারিস?

এ আর কি কঠিন কাজ দিদিঠাকরুন।

একবারে সাহেবী দোকান থেকে আনবি।

খুব পারব, কসাইটোলা গিয়ে বলব give me one looking glass!

গেলাস নয় রে গেলাস নয়, আয়না।

নিজের জ্ঞানগর্বে স্ফীত ন্যাড়া বলল, গেলাস নয়, দিদিঠাকরুন, গ্লাস, মানে তোমরা যাকে বল আয়না। জান দিদিঠাকরুন, মাতুনি সাহেবের বাড়িতে এত্‌ত বড় একখানা আয়না ছিল, বলে লাফ দিয়ে উঁচু হয়ে উঠে আয়নার আয়তন নির্দেশ করে।

তবে যা লক্ষ্মীটি, দেখিস কেউ যেন না দেখে।

দেখলেই বা, নিজের পয়সায় কিনব তার আবার ছাপাহাপি কেন?

না না, লুকিয়ে নিয়ে আসিস–দৌড়ে যা।

.

সাহেব-বাড়ির নূতন আয়নায় নিভৃতে নিজেকে পরীক্ষা করে বুঝল তার সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত নয়, তবে নানা কারণে আপাতত সে কিছু রোগা হয়ে পড়েছে যেন। গাল দুটো তেমন পুষ্ট নয়, কার হাড়টাও বের হয়ে পড়েছে, হাত দুটোও শীর্ণ। তার ধারণা হল এই সামান্য এটি শোধরাতে পারলেই নিখুত সুন্দরী প্রতিপন্ন হতে পারে সে। তার মনে হল অভাব তার সৌন্দর্যের নয়, কেবল গায়ে কিছু গত্তি চাই। বামুনগিন্নীর উপদেশ মনে পড়ল, পুরুষ-মানুষ নাকি ওতেই ভোলে। তখন সে পৃথুল হবার উপায় সন্ধানে নিযুক্ত হল।

এমন সময়ে পাশের বাড়ির পাঁচ ছেলেটার কথা মনে পড়ল, এই কিছুদিন আগেও ছেলেটা হাড-জিরজিরে থোগা ছিল, এখন বেশ হৃষ্টপুষ্ট লাবণ্যময় হয়ে উঠেছে। ঐ পনেরো বছরের ছেলেটা যদি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠবার ফলে এমন লাবণ্যময় হয়ে উঠতে পারে, তবে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে আরও কত বেশী লাবণ্যময় হওয়ার সম্ভাবনা। মানসাক্তে সমস্যার অনুকুল সমাধান হওয়ায় সে অকারণে খুশি হয়ে উঠল। জরাবিজয়ী যযাতিও বোধ করি এতটা খুশি হয় নি।

পরদিন পাঁচুকে ডাকিয়ে চালভাজা খেতে দিয়ে জেরায় জেরায় তার স্বাস্থ্যের রহস্য উদ্ধার করে নিল সে।

হাঁরে পাঁচু, তোর শরীরটা আজকাল যেন ভালই চলছে?

খুশি হয়ে পাঁচু বলল, হবে না মাঠান? সকাল-বিকাল কুস্তি করি, মুগুর ভাঁজি, একশ-টা বৈঠক মারি।

অন্নদা বুঝল তার পক্ষে এসব সম্ভব নয়, তাই কিঞ্চিৎ হতাশ হল, তবু আশা ছাড়ল না, চলল জেরা।

আর কি করিস?

পাড়ার ছেলেদের জুটিয়ে কপাটি খেলি।

তা তো খেলিস দেখতেই পাই, আর কি করিস? বলি খাস কি?

খাব আর কি, ডাল ভাত মাছ!

সে তো আগেও খেতিস, বলি, স্বাস্থ্য ফিরল কিসে?

তা-ই বল মাঠান, সকাল-বিকাল ভিজে হোলা খাই।

ছোলাভিজে! বিস্ময় প্রকাশ করে অনুদা।

হাঁ মাঠান, ছোলাভিজে। রাতে ভিজিয়ে রাখি, সকালবেলা খানিকটা খাই, বাকিটা বিকালে। আবার ভিজিয়ে রাখি।

ওতেই তোর স্বাস্থ্য ফিরল?

ফিরবে না! গফুর মিঞা বলেছে—গফুর মিঞা আমাদের ওস্তাদ কিনা–ছোলাভিজেয় যে তাগদ আছে এমন মাছ মাংস হানা সন্দেশে নেই।

অন্ধকারে আলোর রেখা দেখে অন্নদা শুধায়, কতখানি করে খাস?

দু বেলা দু মুঠো।

যদি দু বেলায় চার মুঠো খাস, তবে?

তবে আর কি, শীগগিরই খাব, আরও গদ হবে, বুকের পাটা ইয়া চওড়া হবে।

বলিস কি রে! ছোলাভিজেয় এত গুণ?

বিশ্বাস না হয় খেয়েই দেখ মাঠান।

দূর বোকা ছেলে, ছোলভিজেয় কি আর আমার মত বুড়ির স্বাস্থ্য ফেরে!

দ্বিগুণ জোর দিয়ে বলে সে, বিশ্বাস না হয় খেয়েই দেখ মাঠান।

তার পরে বলে, তোমার আর কি বয়স, গফুর মিঞার বয়স পঞ্চাশ; যেমন বুকেব ছাতি তেমনি হাত-পায়ের গোছ।

সব কি ঐ ছোলভিজের গুণে?

চালভাজা শেষ হয়ে যাওয়ায় যে দীর্ঘশ্বাসটা কণ্ঠনালীতে জমে উঠেছিল সেটাকে উত্তরের মধ্যে আমূল সঞ্চারিত করে দিয়ে পাঁচুগোপাল বলল, স-ব!

গফুর বুঝি দু বেলা দু মুঠো করে খায়?

পাগল হয়েছ মাঠান! অতবড় জোয়ানের দু মুঠোয় কি হবে? দু বেলায় সের খানেক খায়।

তার পর বলে, যখন ছোলা জুটে ওঠে না, তখন ঘোড়ার বরাদ্দ থেকে চুরি করে খায়। ও বসাকবাবুদের ঘোড়ার সহিস কিনা। এদিকে বরাদ্দ ছোলা না পেয়ে ঘোড়া শুকিয়ে যাচ্ছে—আর চুরি করা ছোলায় গফুর ফুলে উঠছে! দুনিয়াটা না ভারি মজার মাঠান! খুব হাসে একচোট পাঁচুগোপাল।

পাঁচুর অন্যথা-বেকার রসনা আর থামতে চায় না। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মিঞা, ঘোড়র ছোলা যে চুরি কর, দোষ হয় না? মিঞা বলেছিল, দূর! ঘোড়ার ছোলা চুরি করলে বুঝি চুরি হয়? ওতে দোষ নেই। মানুষের জিনিস চুরিকেই চুরি বলে।

অন্নদার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল, পাঁচুর গল্প শোনবার আর তার প্রয়োজন ছিল না, সহজে স্বাস্থ্যলাভের উপায় সে অবগত হয়েছে, কাজেই পাঁচুকে বিদায় দিয়ে উঠে পড়ল এবং ঘরে ঢুকেই সেরখানকে ছোলা ভিজিয়ে লুকিয়ে রেখে দিল।

মালদ থেকে ফিরে পত্নীকে খুশি করবার অভিপ্রায়ে রাম বসু একদিন একটা শেমিজ কিনে এনেছিল।

অন্নদা তর্জন করে শুধাল, বলি ওটা কি?

রাম বসু হেসে বলল, খুলেই দেখ।

অন্নদা কাগজের মোড়ক খুলে দেখল, আলখাল্লার মত একটা বস্তু।

আমাকে বুঝি সঙ সাজাবার জন্যে এনেছ?

শেমিজ কখনও চোখে দেখে নি সে।

না গো না, এসব মেমসাহেবরা পরে, খাস সাহেবী দোকান থেকে খরিদ।

তখনই সেটা ফেলে দিয়ে সে গর্জন করে উঠল, ও ড্যাকরা মিলে, নিজে খিরিস্তান হয়ে সাধ মেটে নি, এখন আমাকে খিরিস্তান করবার মতলব! থুঃ থুঃ! তখনই সে গঙ্গাজল স্পর্শ করে পবিত্র হল।

অপ্রস্তুত হয়ে রাম বসু প্রস্থান করল। তার দুশ্চরিত্রতা সম্বন্ধে নূতন প্রমাণ পেল অন্নদা। মেমসাহেবদের অন্তর্বাসের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের আর কি অর্থ সম্ভব।

এতদিনে সেই বটার কথা মনে পড়ল অমদার। সেটা নষ্ট হয় নি, বসুজা তুলে রেখেছিল। এখন সেটাকে আবিষ্কার করে গোপনে বসে পর্যবেক্ষণ করল সে। রঙ, ফিতে, কাজ-করা পাড় সবসুদ্ধ মিলে মন্দ লাগল না তার চোখে। গায়ে দিয়ে দেখল বড় ঢিলে, ভাবল গায়ে আর একটু গত্তি লাগলেই পরবে। সেই শুভদিনের আশায় একখানা কাদার শাড়ি আর শেমিজটা (অন্নদা উচ্চারণ করে শামিজ) যত্ন করে তুলে রেখে দিল। পাড়ার ঠাকুরঝির উপদেশ মনে পড়ল, পুরুষ-মানুষ একটু সাজগোজ পছন্দ করে বউ, সাজগোজ পছন্দ করে।

সাধ্বী স্ত্রীর একটি প্রধান লক্ষণ এই যে, স্বামীর নিঃসপত্ন অধিকার সে চায়। সতীনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার চাইতে পতির নিঃসপত্ন মৃতদেহও তার কাছে বাঞ্ছনীয়। কিন্তু অন্নদার সমস্যা কিঞ্চিৎ ভিন্ন রকম। তার সতীন নেই, তবু কেন স্বামীর পুরো অধিকার পায় না বুঝতে পারে না সে। মানুষের ভয়ের চেয়ে ভূতের ভয় অনেক বেশি ভীষণ, কারণ তার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। এই রহস্যময় সমস্যা-সমুদ্রে যত বেশি সে হাঁসফাঁস করে, যত বেশি সে হাত-পা ছেড়ে, তত আরও তলায়-কলের দিকে অগ্রসর হয় না। স্বামীর মন পাওয়ার আশায় যত অধিক তরঙ্গ তোলে, সে মনটি তত অধিক দুরে গিয়ে পড়ে। শিল্পীর মন ঘুডির মত, তার লীলার জন্যে আকাশের ফাঁকের আবশ্যক, গেরস্তালির হাঁড়িকুঁড়ির মধ্যে তার যথার্থ স্থান নয়। রাম বসু জাতশিল্পী। এ কথা তার স্ত্রী বুঝবে কি করে, তখনকার দিনে কেউ বোঝে নি। অনাত্মীয় সমাজ আকাশের সেই অবকাশ, শিল্পীর মন যথেচ্ছ বিহারক্ষেত্র পায় সেখানে। আত্মীয় সমাজের হাঁড়িকুড়ি, ডালাধামার মধ্যে স্বভাবতই সে সঙ্কুচিত। শিল্পীর কাছে অনাত্মীয় আপন, আত্মীয় পর। কেন যে রাম বসু বাইরে ঘোরে অন্নদা তা বুঝবে কি করে? শিল্পী পত্নীর দুরুহ সৌভাগ্য।

.

৩.০৮ পলে চাঁদের ছায়া

সেদিন জন আসবামাত্র রোজ এলমার সাগ্রহে সানন্দে বলে উঠল, এস, এস জন, তোমাকে দু দিন দেখি নি কেন?

প্রত্যাশাতীত স্বাগতে অভিভূত হয়ে জন বলল, একটু ব্যস্ত ছিলাম। তা ছাড়া, আমার ধারণা কি জান?

কি তোমার ধারণা, শুনি?

আমার ঘন ঘন আসাটা তুমি পছন্দ কর না।

আমার প্রতি অবিচার করছ, জন। আমি সারাদিন অপেক্ষা করে থাকি কখন তুমি আসবে।

এই যদি সত্যই তোমার মনের কথা হয়, বেশ তাহলে আর কখনও আসা বাদ পড়বে না।

রোজ এলমার হেসে বলল, নিশ্চয় তো?

হাসতে হাসতে প্রত্যুত্তর দিয়ে জন বলল, দেখো নিশ্চয় কি না।

রোজ এলমার বলল, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি একখানা শাল নিয়ে আসি, তোমার সঙ্গে বেড়াতে বের হব।

জনের বিস্ময়ের আর অন্ত থাকে না। বলে, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকব।

না না, ততখানি ধৈর্যের প্রয়োজন হবে না, দশ মিনিটের মধ্যেই আসব, বলে হেসে লঘুছন্দে গৃহান্তরে যায় মিস এলমার।

অভিভূত জন ভাবে, হঠাৎ এ পরিবর্তন কেমন করে সম্ভব হল? তার পরে ভাবে, এই তো স্বাভাবিক, না হলেই তো বিস্ময়কর হত। সাধে কি আড়াইশ টাকা খরচ করে ইণ্ডিয়ান yogic ট্যালিসম্যান যোগাড় করেছি! মনে পড়ে তার রাম বসুর কথা। রাম বসু কবচখানা তাকে দেবার সময়ে বলেছিল, মিঃ স্মিথ, ফল না ফলে যায় না, মাদার কালী হচ্ছে এভার ওয়েকফুল গডেস! এখন জন রাম বসুর ভাষায় hand to hand fruit হাতে হাতে ফল পেয়ে মনে মনে বলে উঠল, “জয় মা কালী”। রাম বস শিখিয়ে দিয়েছিল, মাঝে মাঝে বলতে হবে “জয় মা কালী”।

আগের দিন মন্ত্রপূত তামার কবচখানা নিয়ে রাম বসু জনের সঙ্গে দেখা করে বলে, মিঃ স্মিথ, এ ট্যালিসম্যান অব্যর্থ, তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবেই।

জন শুধায়, এবারে কি করতে হবে?

এবারে নিয়ে গিয়ে এটা মিস এলমারের হাতে বেঁধে দাও।

বিভ্রান্ত জন বলল, তা কি করে সম্ভব? এ যে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধার মত। না, মুন্সী, তা কখনও সম্ভব নয়, ও রকম অদ্ভুত প্রস্তাব আমি মিস এলমারের কাছে করতে পারব না।

গম্ভীর হয়ে রাম বসু বলল, তবেই তো মুশকিল!

জন বলল, আর কি কোন উপায় নেই?

উপায় নেই সে কি হয়! আমাদের হিন্দুশাস্ত্র খুব উদার, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপায়ের নির্দেশ দিয়েছে!

তবে তারই একটা বল।

কিন্তু সে যে আবার খরচের ব্যাপার!

Damn it! কত চাই বল, বলে এক মুঠো টাকা বের করল জন।

বেশি নয়, আপাতত গোটা কুড়ি হলেই চলবে।

এই নাও। কিন্তু talisman কখন দেবে?

ট্যালিসমান এখনই নাও, পরে আমি পূজো দিয়ে দেব। এ রকম posthumous পূজার রীতি আমাদের দেশে আছে।

তবে দাও, বলে কবচখানা প্রায় ছিনিয়ে নিল রাম বসুর হাত থেকে, বল এবারে কি করতে হবে?

আর কিছু নয়, কোনরকমে মিস এলমারের বিছানার নীচে কবচখানা রেখে দিতে হবে।

আবার বিভ্রান্ত হয়ে জন বলল, তা কি করে সম্ভব? মিস এলমারের শয়নগৃহে আমি ঢুকব কি করে?

রাম বসু মনে মনে বলল, হাঁদারাম, তা কি আমি জানি নে, তার শয়নগৃহে যদি ঢুকতেই পারবে তবে কি আর আমার ফাঁদে পা দিতে এস! মনে মনে আরও বলল, তুমি ওর শয়নগৃহের বাইরে চিরদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবে। ঢুকবে ঐ বেটা জঙ্গী সেপাই। হয়তো এতদিন চুকেছে নইলে বেটী তোমাকে আমল দিতে চায় না কেন!

মুন্সীকে নীরব দেখে জন বলল, দেখ মুন্সী, আমার মাথায় এক বুদ্ধি এসেছে। রেশমী বিবি মিস এলমারের শয্যা প্রস্তৃত করে। সে ইচ্ছা করলে অবশ্যই গোপনে বিছানার তলায় রেখে দিতে পারে। সে তো তোমার হাতের লোক, তাকে দাও না কেন!

চমৎকার বলেছ মিঃ স্মিথ। আমাদের শাস্ত্রে বলেছে যে, প্রেমে পড়লে মানুষের বুদ্ধি খুলে যায়।

তখন স্থির হল যে, রেশমীকে দিয়ে কাজটা করাতে হবে।

রাম বসু রেশমীর সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাবটা করল। সব শুনে রেশমী রেগে উঠে বলল, কায়েৎ দা, তুমি কত লেখাপড়া শিখে এই সব বুজরুকিতে বিশ্বাস কর!

রাম বসু বলল, ওরে রেশমী, রাম বসু কিছুতেই বিশ্বাস করে না, আবার কিছুতেই অবিশ্বাস করে না, তবে কিনা লাগে তাক না লাগে তুক। যা বলছি কর।

রেশমী বলে—এ যে বিশ্বাসভঙ্গ করা হবে!

কেমন?

মিস এলমারকে না বলে তার বিছানার তলায় রাখলে–

দূর বোকা মেয়ে! বিশ্বাসভঙ্গ তো দূরের কথা, সামান্য নিদ্রাভঙ্গও হবে না। বলছি কর।

শেষে সত্যি যদি মিস এলমার জনকে বিয়ে করতে চায়?

বিয়ে করবে। তাতে তোরই বা কি আর আমারই বা কি!

আমার অবশ্য কিছু নয়। কিন্তু ধর এর পরে কর্নেল সাহেব যদি আবার তোমাকে ধরে একটা কবচ করে দিতে?

করে দেব।

তখন যদি আবার মিস এলমার—তখন অবশ্য মিসেস স্মিথ-কর্নেলকে বিয়ে করবার জন্যে ক্ষেপে ওঠে?

করবে কর্নেলকে বিয়ে। ক্ষতিটা কি! ওদের কতবার করে ডাইভোর্স আর বিযে হয় জানিস না কি?

কিন্তু তখন মিঃ স্মিথের কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছ?

রেশমীর কথা শুনে রাম বসু হো হো করে হেসে উঠল, কামিখ্যেয় ঝড় হল, কাক মরল ময়নাকাঁদিতে, সেইরকম কথা বলছিস যে! আচ্ছা, জনের অবস্থা যদি তখন খুব খারাপ হয় তখন তুই না হয় কষ্ঠিবদল করে ওকে বিয়ে করিস! এই বলে আবার হেসে উঠল রাম বস।

কি যে বলছ কায়েৎ দা, থাম।

আচ্ছা থামছি, এখন বল, কবচটা নিবি কি না!

কিছুক্ষণ নীরব থেকে হঠাৎ বলে উঠল, দাও।

যেমন বলেছি ঠিক-ঠিক করিস, শিয়রের দিকে বিছানার তলায়।

আচ্ছা, তাই হবে।

রাম বসু চলে গেলে রেশমী স্থির করল যে, কখনও সে বিশ্বাসভঙ্গ করবে না, কখনও সে মিস এলমারের বিছানার তলায় কবচ রাখবে না।

তার পরে মনে মনে বলল, আর ঐ বোকা হাঁদা মানুষটা বিয়ে করবে কিনা মিস এলমারকে। নিজের পৌরুষে যখন কুলোল না, তখন আন তাবিজ, আন কবচ। যত সব বুজরুকি! নাঃ, কখনই এমন হীন কাজের মধ্যে আমি নেই।

এইভাবে সঙ্কল্প স্থির করে নিজ শয়নগৃহে প্রবেশ করল আর কবচটা নিজের বালিসের তলায় চাপা দিয়ে রেখে বলল, আপাতত থাকুক এখানে। আর যাই হক, মিস এলমারকে আমি বিপন্ন করতে পারব না। তাবিজ কবচের ফলে অনেক সময়ে মানুষ মারা যায়।

এমন তিন-চারটি ঘটনা ঠিক সময় বুঝে মনে পড়ে গেল তার হঠাৎ।

রেশমী বেশ নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু জনের অপ্রত্যাশিত সাদর অভ্যর্থনায় তার আপাদমস্তক বিষিয়ে উঠল, বিস্ময়ে ও তিক্ততায় তার মন গেল ভরে। জন ও মিস এলমারের প্রীতিপূর্ণ আলাপের অন্তরায়িত পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বারংবার সে মনে মনে। বলতে লাগল-ওঃ সব্বাই এমন, ওঃ সব্বাই এমন!

সব্বাই বলতে কে কে আর এমন বলতে কি কি বিচার করবার মত মনের অবস্থা তখন তার ছিল না। নিজের ভদ্রাসন নীলাম-নহবতে উঠে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে দেখলে ধীরমস্তিষ্কে বিচার করতে পারে কয়জন?

জন ও রোজ এলমার বেড়াতে বেরিয়ে গেলে যতক্ষণ তাদের দেখা যায় দেখল। চেয়ে রেশমী, সাপে-কাটা মানুষ যেমন একদৃষ্টে চেয়ে দেখে ভয়াল সাপটার দিকে। তার পরে এক ছুটে সরে গিয়ে বের করে নিল কবচটা, হাতের চাপে দিল সেটাকে চেপটিয়ে, তার পরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বাড়ির প্রান্তের পুকুরটার* ধারে—সবলে ছুঁড়ে দিল সেই দীর্ণ কবচ গভীর জলের দিকে—যাঃ!

রেশমী ফিরে এসে দেখে, অপেক্ষা করছে কর্নেল রিকেট।

সে আভূমি নত হয়ে সেলাম করল।

মিস এলমার কোথায়?

বেড়াতে বেরিয়েছে।

একাকী?

না।

সঙ্গে কে গিয়েছে?

মিঃ স্মিথ। তার সঙ্গেই তো যায় মিস এলমার।

সে কি কথা! গতকাল পর্যন্ত আমি তো গিয়েছি তার সঙ্গে!

তবে আজ থেকেই শুরু হল।

এ কেমন হল? জানিয়েছিলাম যে, আমি আসব!

হয়তো সেইজন্যেই আগে বেরিয়েছে।

কি জন্যে?

তোমাকে এড়াবার জন্যে।

অসম্ভব।

সম্ভব তো হল।

মধুর সঙ্গে বিন্দু বিন্দু বিষ মিশিয়ে দিতে মেয়েরা কেমন পারে! মধুর অধরে কঠিন কথা কেমন অঙ্গুলিতে হীরের অঙ্গুরীয়ের মত শোভা পায়!

কর্নেলের আত্মম্ভরিতায় আঘাত পড়ায় তার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল, নতুবা বুঝতে পারত, সামান্য একজন পরিচারিকাকে এমন করে জেরা করা ভদ্রতাসম্মত নয়।

কার বেশি আগ্রহ দেখলে?

রেশমী একটু ভেবে বলল, দুজনেরই সমান মনে হল।

কখন ফিরবে জান?

বোধ হয় রাত হবে।

কেমন করে জানলে?

গায়ের শাল নিয়ে গিয়েছে।

টগবগ করে ফুটছিল কর্নেল-পায়চারি করছিল ঘরের মধ্যে।

আমার সম্বন্ধে কিছু বলল?

না। অনেক সময়ে উদাসীনতাটাই খারাপ।

রাইট! ময়দানের দিকে গিয়েছে?

না, বনের দিকে।

তার পরে প্রায় স্বগতভাবে—একটু নিরিবিলি চায় বোধ করি।

হেঁটে গিয়েছে?

হাঁ।

গাড়ি ছিল না?

ছিল।

তবে গেল না কেন?

নিতান্ত নির্বিকারভাবে রেশমী বলল, কোন কোন সময়ে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি বিড়ম্বনাজনক।

রাইট! আজ ছবিখানায় ফুল দেখছি না কেন?

আজ ফুল অন্যত্র শোভা পাচ্ছে।

কোথায়, শীঘ্র বল।

মিঃ স্মিথের বুকে।

কে দিল?

দিতে একজনই মাত্র পারে।

আমি স্কাউভেলটাকে দেখে নেব-বলে সগর্জনে ছুটে বেরিয়ে গেল কর্নেল রিকেট।

রেশমী জানলা দিয়ে দেখতে পেল কর্নেলের বগি গাড়ি নক্ষত্ৰবেগে হুটে বেরিয়ে গেল বেরিয়াল গ্রাউঙ ধরে পুবদিকে।

বোজ এলমার ফিরে এসে শুধাল, কর্নেল এসেছিল নাকি?

রেশমী বলল, এসেছিল।

আমার জন্যে কি অপেক্ষা করেছিল?

না।

অপেক্ষা করতে বলেছিলে কি?

আর অপেক্ষা করতে বলে কি হবে?

রেশমীর কথার ভঙ্গীতে কিছু বিস্মিত হয়ে এলমার শুধাল, কেন?

কেন আর কি! মনে হল, তুমিও চাও না, আর খুব সম্ভব মিঃ স্মিথও বিরক্ত হবে।

কি আশ্চর্য, আমিই বা চাই না কেন, আর মিঃ স্মিথই বা বিরক্ত হবে কেন?

কোনদিন তো কর্নেলকে উপেক্ষা করে তোমরা বেরিয়ে যাও না, তাই মনে হল।

হঠাৎ চমক ভাঙল এলমারের, সে বলে উঠল, ওঃ বুঝেছি। তুমি ভেবেছ আমি মিঃ স্মিথকে ভালবাসি!

আমার ভাবায় কি আসে যায়, কর্নেল তাই মনে করেছে।

কর্নেল একটি গোয়ার আর তুমি একটি নির্বোধ।

সে তো বরাবরই আছে, নূতন করে মনে পড়াবার কারণ কি?

মনে পড়াবার কারণ এই যে, আজ সকালে দেশ থেকে কবির একখানা চিঠি পেয়েছি।

নিরানন্দমুখে রেশমী বলল, বড় আনন্দের কথা।

আগে সবটা শোনাই, তার পরে উত্তর দিও। জন আর কর্নেলের কথা কবিকে খুলে লিখেছিলাম। উত্তরে কবি লিখেছে যে, কর্নেলের মত লোকের জন্যে চিন্তা করি নে, ওদের হাতে সব সময়েই একাধিক তীর থাকে, ওরা জন্মতীরন্দাজ লোক। তোমার কাছে প্রত্যাখ্যাত হলে ভগ্নহৃদয় হয়ে ও মরবে না, সমান উৎসাহে অন্য লক্ষ্যে তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করবে। চিন্তা করি অপর লোকটির জন্যে যার নাম লিখেছ জন স্মিথ। সংসারে মুষ্টিমেয় একদল লোক আছে যারা জন্মপ্রেমিক-স্মিথ সেই দলের। ভালোবাসার প্রত্যাখ্যান ওদের কাছে মৃত্যুতুল্য। ভালবাসতে ওকে যখন পারবেই না, অন্তত একটু আদর-যত্ন আত্মীয়তা কর। কবি লিখেছে, ওটা ভালবাসার বিকল্প নয় জানি তবু ওর বেশি তোমার হাতে তো নেই। সংসারে অনেক সময়েই চরমধন জোটে না, তখন কাছাকাছিটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা ছাড়া উপায় কি।

এই পর্যন্ত ধীরে ধীরে বলে রোজ এলমার কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকল। তার পরে আবার শুরু করল—কবির কথায় আমার চৈতন্য হল। তাই আজ জনকে নিয়ে একটু বেড়াতে বের হলাম। এর মধ্যে ভালবাসা-টাসা নেই। তোমার তো এতদিনে বোঝা উচিত, সংসারে আমার একমাত্র যে ভালবাসার লোক ঐ তার ছবি। যদি আমি কখনও কাউকে বিয়ে করি তবে ওকেই করব।

রোজ এলমারের কথার আন্তরিকতায় রেশমীর বুকের ভার নেমে গেল। সে স্বাভাবিকভাবে বলল, মিস এলমার, আমাকে ক্ষমা কর।

এর মধ্যে ক্ষমা করবার কি আছে? তুমি তো কোন অন্যায় কর নি, বড় জোর ভুল বুঝেছ।

রেশমী বিদায় হচ্ছিল এমন সময়ে এলমার বলল, Silken Lady, আমি লক্ষ্য করেছি যে, তুমি জনকে সহ্য করতে পার না। আর কিছু না হক, সে আমার বন্ধু বলেও অন্তত তাকে সহ্য করা তোমার কর্তব্য।

রেশমীও বলতে পারত, মিস এলমার, তুমিও আমাকে ভুল বুঝেছ।

সে-রাত্রে বিছানায় শুয়ে সুখতন্দ্রালীন জন যখন Coligot (Kalighat)-এর, Coli (Kali)-র উদ্দেশ্যে শত শত salutation জানাচ্ছিল, মনে মনে যখন বলছিল যে, হিঙু শাষ্ট্রের yogic rites সব অব্যর্থ, নতুবা এমন hand to hand fruit কি রকমে ফলল আগের দিন রোজ ছিল উদাসীন, আজ সে–প্রায় তার কণ্ঠলগ্ন, ঠিক সেই সময়েই রেশমী বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনে মনে কালীঘাটের মা কালীর উদ্দেশ্যে শত শত প্রণাম করে বলছিল-মা, তোমার লীলার অন্ত নেই, এই কবচের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়াও তোমার এক লীলা মা। হঠাৎ ভুল বুঝে তোমার উপর অবিশ্বাস করেছিলাম বলে অবোধ সন্তানের অপরাধ নিও না মা, নিও না। এইরকম কত কথা মনে মনে বলতে বলতে সুখনিদ্রায় কখন সে অভিভূত হয়ে পড়ল।

রেশমীর এই বিচিত্র মনোভাবের কারণ কি? সে কি মনে মনে জনকে ভালবেসে ফেলেছে? জন ও তার মধ্যে দুস্তর অবস্থা-ভেদে তা কি সত্যই সম্ভব? যদি সত্যই সম্ভব না হয় তবে কেন চাঁদের ছায়া পড়ে পলে?

————
* সেই পুকুর এখনও বর্তমান।

.

৩.০৯ পৃথুলা

রাম বসু শুধায়, নরুর মা, তোমার শরীরটা যেন ভাল দেখছি নে।

ভাঙা কাঁসর অধিকতর কর্কশ রবে বেজে ওঠে, কেন, আমাকে কি রামসিং পালোয়ান হতে হবে নাকি?

কি সর্বনাশ, এতেই তোমার যা প্রতাপ, এর পরে পালোয়ান হলে কি আর বাড়িতে টিকতে পারব।

আহা, সারাদিন যেন বাড়িতেই বসে আছ! কোন আলেডালে সারাদিন ঘুরে বেড়াও?

শ্যাওড়া গাছের ডালে নরুর মা, শ্যাওড়া গাছের ডালে।

তা জানি। বাজে ভাঙা কাঁসর, পেত্নী ভর করেছে তোমার কাঁধে।

তাহলে তো সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকার কথা।

কি, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা, আমি পেত্নী।

কি যে বল ছাই! পেত্নীরও তো গায়ে একটু গত্তি আছে; একবারে শাঁকচুমী।

গভীরতম মর্মে আঘাত লাগে অন্নদার। যে গত্তি অর্জনের আশায় সে এত করছে, তারই অভাবের অপবাদ। আগেকার দিন হলে সম্মার্জনী সন্ধান করত সে, এখন আর তা সম্ভব না হওয়ায় স্থানত্যাগ করে প্রস্থান করল সে।

এরূপ সম্ভব না হওয়ার সত্যই কিছু কারণ আছে। পাঁচুগোপালের উপদেশে, গায়ে মাংস লাগবার আশায় ভিজে ছোলা খেতে আরম্ভ করবার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল অজীর্ণ ও পেটের পীড়া। একদিন পাঁচুকে ডেকে অন্নদা জিজ্ঞাসা করল—হাঁরে পাঁচু, তোরা যে ছোলা ভিজে খাস, অসুখবিসুখ করে না?

করে না আবার মাঠাকরুন। প্রথম যখন আমি ছোলা ভিজে খেতে শুরু করি, হল হাম, তার পর সর্দি-কাশি, তার পরে পায়ের ব্যথা। ওস্তাদকে জিজ্ঞাসা করি—কি করব ওস্তাদ! ছেড়ো না বাবা ছেড়ো না-ও-রকম একটু আধটু প্ৰেথমে হয়েই থাকে। ওস্তাদ বলে, আমি যখন প্রথমে শুরু করি

অন্নদা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ওসব অসুখ নয় রে।

তবে আবার কি অসুখ?

ধর—এই অজীর্ণ আর-

ওঃ, এই কথা! ও তো একটু-আধটু হবেই, তাই বলে ছেড়ো নি মাঠাকরুন, খেতে যখন শুরু করেছ, খেয়ে যাও, ভবিষ্যতে

আবার তাকে থামিয়ে দিয়ে অন্নদা বলে, আরে আমি খেতে যাব কোন্ দুঃখে–

তবে আবার ভাবনা কি! ও পাড়ার লোকের যদি অজীর্ণ হয়, তবে তোমার মাথাব্যথা কেন!

পাঁচুগোপালের কাছে অভয় পেয়ে দ্বিগুণ বেগে ভিজে ছোলা চালায় অন্নদা, অবশ্য পেটের পীড়াও দ্বিগুণ বাড়ে।

মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় তার মনে, বুঝি মুষ্টিযোগে ফল ফলছে না, বুঝি আরও একটু রোগা হয়ে গিয়েছে। কখনও কখনও গোপনে সুতো দিয়ে মেপে দেখে হাত-পায়ের গোছ, ফল উৎসাহজনক মনে হয় না। তখন মুখশ্রীর সাক্ষ্য নেবার আশায় বের হয়। সাহেব-বাড়ির আরশিখানা। নাঃ, মুখশ্রীতে একটু লাবণ্য যেন ফুটেছে। মনে আশা হয়, অচিরে একদিন সেই শেমিজ ও শান্তিপুরে শাড়িতে সুসজ্জিত হয়ে যৌবনলাবণ্য-মুখশ্রীতে স্বামী-সম্ভাষণ করতে সক্ষম হবে সে। স্বামীর এমন আদর পাবে যে পাড়ার মুখপুড়ীর দল হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরবে। সেদিন নিমন্ত্রণ উপলক্ষে ডেকে এনে দেখাতে হবে ঐ তিনকালগত বামুনগিন্নীকে। ভারি গায়ে গত্তির অহঙ্কার হয়েছে।

কিন্তু আর চলে না, অবশেষে শয্যা গ্রহণ করতে হয় অন্নদাকে।

রাম বসু বৈদ্য ডেকে আনে। বৈদ্য লক্ষণ দেখে বলে, এ যে দারুণ অজীর্ণ ও পেটের পীড়ার ফল দেখছি।

এখন উপায়? জিজ্ঞাসা করে রাম বসু।

চিকিৎসা, অর্থাৎ ঔষধ ও সুপথ্য। আহার বিষয়ে বিশেষ সাবধান হতে হবে। একটু মাগুর মাছের ঝোল ও সুজি ছাড়া আর কিছু চলবে না।

অন্নদা শুধায়, ডাল?

কাঁচা মুগের ডালের জল একটু চলতে পারে।

কুঠিত কণ্ঠে শুধায় অন্নদা, ছোলার–

কথা শেষ হওয়ার আগেই সর্পচকিত হয়ে বৈদ্য চীৎকার করে ওঠে, ছোলার নাম করেছ কি ‘মৃত্যুরেব ন সংশয়ঃ!’

বৈদ্য চলে গেলে অন্নদা স্বামীকে বলে, মুখপোড়াকে আর ডাকতে হবে না, তার চেয়ে সোনারপুর থেকে ঠাকুরঝিকে আনতে লোক পাঠাও।

ঠাকুরঝিকে আনাবার প্রস্তাব শুনে রাম বসু শঙ্কিত হয়ে ওঠে, বোঝে যে অবস্থা সত্যই সঙ্কটাপন্ন।

রাম বসুর বিধবা বোন তার সংসারে থাকত। তাকে মুখের ধোঁয়া দিয়ে তাড়িয়েছিল অনুদা—এখন তাকেই আবার প্রস্তাব। এই রাজ্যে কখনও দুই রাজার বাস সম্ভব হলেও হতে পারে, কিন্তু এক সংসারে দুই স্ত্রীলোকের বাস শশবিষাণের চেয়েও অসম্ভব।

ঠাকুরঝি এলে শয্যাগতাকঙ্কালময়ী অন্নদা সংসারের ভার তাকে বুঝিয়ে দিল, স্বামীর পায়ের ধুলো নিল, নরুর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করল, তার পরে আগামী জন্মে পৃথুলা হয়ে জন্মাবার আশা নিয়ে ইউযন্ত্র জপ করতে করতে নির্ভয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল ভগ্নহৃদয় নারী।

নরু চীৎকার করে কেঁদে উঠল, মা, কার কাছে রেখে গেলে?

ন্যাড়া তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোর ন্যাড়াদা তো রইল নরু, ভয় কি!

সমস্ত ব্যাপারটা কাঠের পুতুলের মত ঠায় দাঁড়িয়ে দেখল রাম বসু। স্বভাবমুখর লোকের মুখে না যোগাল একটা কথা, না এস চোখে এক ফোঁটা জল।

ঠাকুরঝির কাছে একটু হেসে, একটু কুঠায়, একটু লজ্জায় অন্নদা ইচ্ছা জানিয়েছিল যে, তাকে যেন ঐ শাড়ি আর শেমিজে শেষবারের মত সাজিয়ে দেওয়া হয়।

.

৩.১০ বিপত্নীক রাম বসু

পত্নীর অন্ত্যেষ্টি সমাধা করে আলুথালু বেশে রাম বসু গিয়ে উপস্থিত হল টুশকির বাড়িতে। টুশকি শুধাল, এ কি বেশ কায়েৎ দা।

টুশকি রে, নরুর মা স্বর্গে গিয়েছে।

ওমা সে কি কথা! স্তম্ভিত হয়ে যায় টুশকি, শুধায়, এমন সর্বনাশ কখন হল?

আজ সকালে রে, এইমাত্র সব সেরে আসছি।

টুশকি কি বলবে ভেবে পায় না, গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। কিছু বন্সবার দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দিল রাম বসু, বলল, এতটা লাগবে ভাবি নি রে।

ঐ একটিমাত্র ক্ষুদ্র বাক্যে রাম বসুর আঘাতের গুরুত্ব বুঝতে পারল টুশকি। আঘাত যে সামান্য নয় তা অনুমান করেছিল প্রথম প্রবেশের মুখে তার ‘টুশকি রে’ সম্বোধনে। টুশকি জানে যে অনেক কথা বলা রাম বসুর অভ্যাস কিন্তু সে সমস্ত মনের উপরতলার কথা, সেখানে আকাশ-কুসুম ফোটে, মনের নীচেতলার কথা মুখে প্রকাশ করায় সে অভ্যস্ত নয়। তাই বলে সেখানকার সন্ধান তো টুশকির অনবগত নয়। ঐ ছোট্ট ‘রে’ ধ্বনিটির এতটুকু ফাঁক দিয়ে ভিতরকার দাবদাহ চোখে পড়ে টুশকির। গালে হাত দিয়ে সে মুটের মত বসে থাকে, ঘরের মধ্যে ইতস্তত পায়চারি করতে করতে রাম বসু অনর্গল বকে যায়।

সবাই অবাক হয়ে গেল তার ঐ স্থির নির্বিচল নির্বাক ভাব দেখে।

তারা বলে, একটু কাঁদ, হাকা হবে।

টুশকি, চোখের জলের স্বভাব বড় বিচিত্র। যে বৃষ্টি ভাদ্র মাসে থামতে চায় না, মাথা কুটে মরলেও তার দেখা পাওয়া যায় না অঘ্রাণে, বড় অদ্ভুত এই চোখের জল। আপনজনের মাথা ধরতে দেখলে আমার চোখ ছলছল করে আসে অথচ মৃত্যুতে এক ফোঁটা জল আসে না চোখে।

এই পর্যন্ত বলে সে থামে, জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়, চুপ করে তাকিয়ে থাকে সূর্য-ডোবার আলো যেখানে রাঙিয়ে তুলেছে চলমান নৌকার পালগুলোকে। কিছুক্ষণ পরে আবার শুরু করে।

শোকে যারা কাঁদতে পারে তাদের তো সৌভাগ্য, চোখের জলে রোখ শোধ করে দিব্যি হাল্কা হয়ে গেল তারা; আর আমি, এই চেয়ে দেখ এখানে, বলে বুকটা দেখায়, শোকের পাষাণভার বয়ে বেড়াচ্ছি, কতকাল এমন বেড়াতে হবে জানি নে, তবে জানি যে তিলে তিলে পলে পলে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরবে সারাজীবন ধরে। লোকে বলে আমি কাঁদি না কেন, ওরে কাঁদতে পারি কই!

টুশকি বুঝল এই অনর্গল বাক্য-প্রবাহই তার শোকপ্রকাশের রীতি, চোখের জলের বিকল্প। সে বলল, কয়েৎ দা, তুমি ব’স, একটু শরবৎ করে দিই।

শরবৎ খেয়ে একটু ঠাণ্ডা হলে টুশকি শুধাল, কি হয়েছিল বল তো, কই কোনদিন তো কিছু বল নি?

বলব কি, আমরাই কি ছাই কিছু জানতাম! মানুষটা চিরকালের রোগা। রোগা তো রোগা, এমন অনেকে থাকে। এদানীং কিছুদিন থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছিল, বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারে না। বদ্দি আনলাম—দিল তাড়িয়ে। শেষে যখন সোনারপুর থেকে আমার বোনকে আনিয়ে নিতে বলল তখন বুঝলাম আর আশা নেই। তার পরে আর দুটো দিনও সময় পাওয়া গেল না।

তাহলে বোঝাই গেল না কি হয়েছিল?

কেন যাবে না, অজীর্ণ, পেটের অসুখ।

এই সামান্য অসুখ চিকিৎসার অসাধ্য হয়ে উঠল?

সে যে নিজে করে তুলেছিল অসাধ্য, সারবে কেমন করে?

সে আবার কি রকম?

সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ভাঁড়ার থেকে বের হল এক হাঁড়ি ভেজানো ছোলা। ব্যাপার কি? শেষে পাড়ার একটা ছেলের কাছ থেকে রহস্য উদ্ধার হল। গায়ে মাংস লাগবে আশায় ঐগুলো খেত। এদিকে পেটের অসুখ চলছে, ওদিকে চলছে ছোলা ভিজে।

হঠাৎ এমন ইচ্ছা হতে গেল কেন কিছু শুনেছ?

শুনব আর কোথায়, তবে অনুমান করছি, একটু মোটাসোটা হলে স্বামীর ভালবাসা পাওয়া যাবে এই ভরসায় অখাদ্য খেয়ে প্রাণটা দিল সে। পরে পায়ে পায়ে টুশকির সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে দুই আঙুলে তার গাল টিপে ধরে বলল, তোরা এক অদ্ভুত জাত টুশকি, স্বামীর ভালবাসা পাওয়ার জন্যে সব করতে পারিস।

টুশকির চোখ ছলছল করে উঠিল। টুশকির চোখে জল দেখে এতক্ষণে এই প্রথম জল এল রাম বসুর চোখে।

রাম বসুর কথাই যথার্থ, বড় বিচিত্র স্বভাব চোখের জলের।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল, বাতি জ্বলল ঘরে, শাঁখ বাজল, কাঁসর-ঘণ্টা বাজল মদনমোহনতলায়। হঠাৎ রাম বসু বলে উঠল, টুশকি, আজ এখানে থাকব।

বিস্ময় চেপে রেখে টুশকি কুণ্ঠিত ভাবে বলল—আজ না থাকলে হয় না?

না না, আজই বিশেষ দরকার। হাঁরে, বোতলটায় কিছু আছে নাকি?

থাকবে কি করে? কতদিন আস নি!

আচ্ছা সে-ব্যবস্থা হবে এখন।

রাম বসুর মন ঘোরাবার আশায় আবার সে বলল, তুমি না গেলে নরুর খুব ফাঁকা লাগবে।

তার পিসি আছে, নেড়দা আছে, আমার অভাব সে অনুভব করবে না।

তারপর একটু থেমে বলল, আমার ফাঁক পূরণ করবার কে আছে বল!

এই বলে সবলে সে বুকের মধ্যে টেনে নিল টুশকিকে।

মৃত্যুর পরে মানুষের চৈতন্য যদি নির্মল ও সর্বব্যাপী হয় তবে অবশ্যই অন্নদা খুশি হত, এই মুহূর্তে তার স্বামীর আলিঙ্গনাবদ্ধ নারী টুশকি নয়, দেহান্তরে সে নিজেই, তার পরজন্মের আশা ফেলে-আসা জন্মে সার্থক হয়ে উঠল, পৃথুলারূপে সন্নিবিষ্ট হল সে স্বামীর বক্ষে।

রাত্রে আহারের পর টুশকি বলল, এবারে তোমার খুব অসুবিধা হবে কায়েৎ দা, তাই না?

রাম বসু বলল, এক কথায় এর কি উত্তর দেব বল!

এক কথায় না হয় নাই দিলে, বুঝিয়ে বল না।

তবে তাই বলি শোন্। অসুবিধা হবে এবং না।

টুশকি বলল, কথা একটার বেশি হল বটে, কিন্তু বুঝতে পারলাম না কিছু।

পারবি নে জানি, বুঝিয়ে দিচ্ছি। স্ত্রী স্বামীকে টেনে রাখে কিসের জোরে ব তো?

ভালবাসার জোরে।

ওটা বোকা মেয়ের মত কথা হল। হ্যাঁ, ভালবাসা দিয়ে পুরুষের মনের দরজাটা খোলে বটে, কিন্তু ঐ পর্যন্ত।

টুশকি শুধায়, তার পরে?

তারপরে অশিক্ষিত-পটুতায় ধীরে ধীরে তিলে তিলে দিনে দিনে স্বামীর ছোটখাটো দৈনন্দিন অভ্যাসগুলো জেনে নিয়ে, তার অজ্ঞাতসারে সেগুলো পূরণ করে তাকে অসহায় করে তোলে। সময়মত গাড়-গামছা এগিয়ে দেওয়া, সময়মত দাঁতনটি ভেঙে দেওয়া, স্নানের তেল, স্নানের পরে ধুতি, আহারের সময়ে বিশেষ পছন্দের ব্যঞ্জন হাতে তুলে দিয়ে দিয়ে নিজের উপর নির্ভরশীল করে তোলে স্বামীকে। সহস্র অভ্যাসের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিনা সূতায় বাঁধা পড়ে বনের বিহঙ্গ, তখন খাঁচার দরজা খোলা পেলেও আর বাইরে যেতে মন সরে না তার। যে স্ত্রী স্বামীর অজ্ঞাতসারে এই কাজটি করতে পারে সে সাধী, যে স্বামী অনায়াসে এই অবস্থায় আত্মসমর্পণ করে সে সুখী।

আর ভালবাসা? শুধায় টুশকি।

ওরে হাবা মেয়ে, ভালবাসার প্রাণ বড় দুর্বল, তার পাখা আছে পা নেই, সংসারে তার মত অসহায় আছে অল্পই।

তবে যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসার কথা শুনি!

অশ্বত্থামার দুধ বলে পিটুলি খাওয়ার কথা কি শুনিস নি?

চুপ করে থাকে টুশকি।

চুপ করে রইলি যে বড়?

সবই তবে ভুল?

কিছুই ভুল নয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অভ্যাসের বশ্যতার ঐ সম্বন্ধটাই বা তুচ্ছ কি!

কিন্তু আসল প্রশ্নের তো উত্তর পেলাম না, তোমার সুবিধা-অসুবিধার কথা বল।

আমি চিরকাল দূরে দূরে থেকেছি, অভ্যাসের দাস হয়ে পড়ি নি, সেই জন্যই তার রাগের অন্ত ছিল না আমার উপরে, কাজেই সেদিক থেকে আমার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

তবে?

তবে আর কি! এতদিন দেখছিস আমাকে, বুঝতে পারিস নি? আমি নিজের দুঃখ এক রকম করে সইতে পারি কিন্তু সেই দুঃখটা অপরের ঘাড়ে পড়তে দেখলে অসহ্য বোধ হয়। ছেলেটার কান্নাকাটি, ঘরদোরের খাঁ খাঁ ভাব-অসুবিধা ঐখানে।

কায়েৎ দা, তুমি বড় পাষাণহৃদয়।

সেকথা একেবারে মিথ্যা নয়। সংসারে আমার মন থাকলে এতদিনে দুঃখ-দুর্দৈবের ভারে ভেঙে পড়তাম।

তবে তোমার মন কোথায়?

খানকতক বই পেলে সব ভুলে যাই। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে শোভাবাজারের রাজবাড়ির গ্রন্থাগারে গিয়ে টুকি-এক মুহূর্তে সব ভুলে যাই।

প্রসঙ্গ বন্ধ করবার আশায় টুশকি বলল, বেশ কর ভুলে যাও, এখন দয়া করে ঘুমোও দেখি।

রাত অনেক হল, না?

হল বই কি।

শোন, এখন দিনকতক তোর বাড়িতেই থাকব। পাড়াপড়শীদের ঘ্যান ঘ্যান বড় অপছন্দ করি।

ভালই তো, থেকো।

.

পরদিন বিকালে ঘুরে এসে রাম বসু বলল, তোর এখানে থাকা হল না টুশকি।

হঠাৎ আবার মত বদলাল কেন?

কেরী সাহেবের চিঠি পেয়েছি, অবিলম্বে দেখা করতে লিখেছে।

আবার মালদ যাবে?

মালদ কোথায়, সাহেবরা চলে এসেছে শ্রীরামপুরে।

কিন্তু এমন জোর তাগিদ কেন?

সেটা গিয়ে শুনব।

আসবে কবে?

গিয়ে পৌঁছবার আগে তা বলি কেমন করে?

কবে রওনা হচ্ছ?

আগামীকাল, আর দেরি নয়।

টুশকি দুঃখ করে বলল, নরু তাহলে একেবারে একলা পড়ল!

একলা কেন, ন্যাড়া রইল, দুটিতে বেশ মিলেছে।

তোমার সংবাদ পাব কি করে?

পাবি নে বলে ধরে রাখ, পাস্ তো ভাল। ন্যাড়াকে বলে দিয়েছি মাঝে মাঝে এখানে এসে দেখা করে যেতে।

আজকের রাতটা তো এখানে থাকছ?

আর কোথায় থাকব বল!

কেরীর আকস্মিক আমন্ত্রণে সত্যই খুব আনন্দিত হয়েছিল রাম বসু, স্ত্রী-বিয়োগের দুঃখদায়ক পরিস্থিতি থেকে দূরে যাওয়া সম্ভব এটা প্রধান কারণ হলেও আরও কারণ আছে। কেরীর জ্ঞানচর্চার আবহাওয়া তার জীবন-ধারণের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। কলকাতায় সেই অভাবটাই তাকে পীড়িত করছিল প্রতি মুহূর্তে। অবশ্য কেরীর চিঠিতে যতই আনন্দিত হক, সে বিস্মিত হয় নি একটুও; সে জানত অচিরে কেরীর আহ্বান এসে পৌঁছবেই, সে বুঝে নিয়েছিল কেরীর পক্ষেও সে সমান অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

শ্রীরামপুরে গেলে কতকাল আর রেশমীর সঙ্গে দেখা হবে না ভেবে সে তখনই রওনা হয়ে গেল রাসেল সাহেবের কুঠির দিকে কোথায় যাচ্ছে জানাল না টুশকিকে। রাম বসু জানত রেশমীর স্মৃতি ছোট্ট একটি কাঁটার মত বেঁধে টুশকির বুকে। রাম বসু ভাবে, অকারণে দুঃখ দিয়ে কি লাভ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *