সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সাহিত্য
১। প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র
ক। সামন্ত সমাজতন্ত্র
স্বীয় ঐতিহাসিক পরিস্থিতির কারণে ফ্রান্স ও ইংলন্ডের অভিজাতদের কাছে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে পুস্তিকা লেখা একটা কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৩০ সালের জুলাই মাসের ফরাসী বিপ্লবে এবং ইংলন্ডে সংস্কার আন্দোলনে ঘৃণ্য ভুঁইফোড়দের হাতে এদের আবার পরাভব হল। এরপর এদের পক্ষে একটা গুরুতর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালানোর কথাই ওঠে না। সম্ভব রইল একমাত্র মসীযুদ্ধ।
কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রেও রেস্টোরেশন (restoration)(1) যুগের পুরানো ধ্বনিগুলি তখন অচল হয়ে পড়েছে।
লোকের সহানভূতি উদ্রেকের জন্য অভিজাতেরা বাধ্য হল বাহ্যত নিজেদের স্বার্থ ভুলে কেবল শোষিত শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থেই বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ খাড়া করতে। এইভাবেই অভিজাতেরা প্রতিশোধ নিতে লাগল তাদের নতুন প্ৰভুদের নামে টিটকারি দিয়ে, তাদের কানে কানে আসন্ন প্রলয়ের ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী শুনিয়ে।
এইভাবে উদয় হয় সামন্ত সমাজতন্ত্রের : তার অর্ধেক বিলাপ আর অর্ধেক টিটকারি; অর্ধেক অতীতের প্রতিধ্বনি এবং অর্ধেক ভবিষ্যতের হমকি; মাঝে মাঝে এদের তিক্ত, সব্যঙ্গ ও সুতীক্ষ্ণ সমালোচনা বুর্জোয়াদের মর্মে গিয়ে বিঁধত; অথচ আধুনিক ইতিহাসের অগ্রগমন বোধের একান্ত অক্ষমতায় মোট ফলটা হত হাস্যকর।
জনগণকে দলে টানার জন্য অভিজাতবর্গ নিশান হিসাবে তুলে ধরত মজুরের ভিক্ষার থলিটাকে। লোকরা কিন্তু যতবারই দলে ভিড়েছে ততবারই এদের পিছনদিকটায় সামন্ত দরবারী চাপরাশ দেখে হো হো করে অশ্রদ্ধার হাসি হেসে ভোগে গেছে।
এ প্রহসনটা দেখায় ফরাসী লেজিটিমিস্টদের একাংশ এবং ‘নবীন ইংলন্ড’ গোষ্ঠী।(2)
বুর্জোয়া শোষণ থেকে তাদের শোষণ পদ্ধতি অন্য ধরনের ছিল এটা দেখাতে গিয়ে সামন্তপন্থীরা মনে রাখে না যে সম্পৰ্ণে পৃথক পরিস্থিতি ও অবস্থায় তাদের শোষণ চলত, যা আজকের দিনে অচল হয়ে পড়েছে। তাদের আমলে আজকালকার প্রলেতারিয়েতের অস্তিত্বই ছিল না দেখাতে গিয়ে তারা ভুলে যায় যে তাদের নিজস্ব সমাজেরই অনিবাৰ্য সন্তান হল আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণী।
তাছাড়া অন্য সব ব্যাপারে নিজেদের সমালোচনার প্রতিক্রিয়াশীল রূপটা এরা এত কম ঢাকে যে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে এদের প্রধান অভিযোগ দাঁড়ায় এই যে, বুর্জোয়া রাজত্বে এমন এক শ্রেণী গড়ে উঠছে, সমাজের পুরানো ব্যবস্থাকে আগাগোড়া নির্মূল করাই যার নির্বন্ধ।
বুর্জোয়া শ্রেণী প্রলেয়তারিয়েত সৃষ্টি করছে তার জন্য তত নয়, বিপ্লবী প্রলেতারিয়েত সৃষ্টি করছে এটাই হল এদের অভিযোগ।
সুতরাং রাজনীতির কার্যক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে দমনের সকল ব্যবস্থায় এরা যোগ দেয়; আর সাধারণ জীবনযাত্রায় বড় বড় বুলি সত্ত্বেও যন্ত্রশিল্পরূপ গাছের সোনার ফল কুড়িয়ে নিতে এদের আপত্তি নেই; পশম, বীটচিনি, অথবা আলর মদের(3) ব্যবসার জন্য সত্য, প্ৰেম, মর্যাদা বেচতে এদের দ্বিধা হয় না।
জমিদারের সঙ্গে পুরোহিত যেমন সর্বদাই হাত মিলিয়ে চলেছে, তেমনি সামন্ত সমাজতন্ত্রের সঙ্গে জুটেছে পাদরিদের সমাজতন্ত্র।
খৃষ্টানী কৃচ্ছ্রসাধনাকে সমাজতন্ত্রী রং দেওয়ার চেয়ে সহজ কিছু নেই। খৃষ্টান ধর্ম ব্যক্তিগত মালিকানা, বিবাহ ও রাষ্ট্রকে ধিক্কার দেয়নি কি? তার বদলে দয়া ও দারিদ্র, ব্রহ্মচর্য ও ইন্দ্রিয়দমন, মঠব্যবস্থা ও গির্জার প্রচলন করেনি কি তারা? যে পূণ্যোদকে পুরোহিতেরা অভিজাতদের হৃদয়জ্বালাকে পবিত্র করে থাকে তারই নাম খৃষ্টান সমাজতন্ত্র।
খ। পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র
বুর্জোয়াদের হাতে একমাত্র সামন্ত অভিজাত শ্রেণীরই সব নাশ হয়নি, তারাই একমাত্র শ্রেণী নয় আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের আবহাওয়ার যাদের অস্তিত্ব-শর্ত শুকিয়ে গিয়ে মরতে বসেছে। আধুনিক বুর্জোয়াদের অগ্রদূত ছিল মধ্যযুগের নাগরিক দল এবং ছোটো ছোটো খোদকস্ত চাষী। শিল্প বাণিজ্যে যে সব দেশের বিকাশ অতি সামান্য, সেখানে উঠন্ত বুর্জোয়াদের পাশাপাশি এখনো এই দুই শ্রেণী দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছে।
আধুনিক সভ্যতা যে সব দেশে সম্পূর্ণ বিকশিত সেখানে আবার পেটি বুর্জোয়ার নতুন এক শ্রেণী উদ্ভব হয়েছে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়ার মাঝখানে এরা দোলায়িত, বুর্জোয়া সমাজের আনুষঙ্গিক একটা অংশ হিসাবে বারবার নতুন হয়ে উঠছে এরা। এই শ্রেণীর অন্তর্গত বিভিন্ন লোক কিন্তু প্রতিযোগিতার চাপে ক্রমাগতই প্রলেতারিয়েতের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে, বৰ্তমান যন্ত্রশিল্পের পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে এরা এমন কি এও দেখে যে সময় এগিয়ে আসছে। যখন আধুনিক সমাজের স্বাধীন স্তর হিসাবে এদের অস্তিত্ব একেবারে লোপ পাবে; শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্যে এদের স্থান দখল করবে: তদারককারী কর্মচারী, গোমস্তা, অথবা দোকান কর্মচারী।
ফ্লাসের মতো দেশে, যেখানে চাষীরা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের অনেক বেশি, সেখানে যে-লেখকেরা বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে মজুরের দলে যোগ দিয়েছে তারা যে বুর্জোয়া রাজত্বের সমালোচনায় কৃষক ও পেটি বুর্জোয়া মানদন্ডের আশ্রয় নেবে, এই মধ্যবর্তী শ্ৰেণীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে অস্ত্র ধারণ করবে তা স্বাভাবিক। পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের উদয় হয় এইভাবে। এ দলের নেতা হলেন সিস্মন্দি, শুধু ফ্রান্সে নয়, ইংলন্ডেও।
আধুনিক উৎপাদন পরিস্থিতির অভ্যন্তরস্থ সববিরোধগুলিকে সমাজতন্ত্রের এই দলটি অতি তীক্ষ্ণভাবে উদঘাটন করে দেখিয়েছে। অর্থনীতিবিদদের ভণ্ড কৈফিয়তের স্বরূপ ফাঁস করেছে এরা। তারা অবিসংবাদিতরীপে প্রমাণ করেছে যন্ত্র ও শ্রমবিভাগের মারাত্মক ফলাফল; অল্প কয়েকজনের হাতে পুঁজি ও জমির কেন্দ্ৰীভবন; অতি উৎপাদন ও সংকট; পেটি বুর্জোয়া ও চাষীর অনিবার্য সর্বনাশ, প্রলেতারিয়েতের দুর্দশা ও উৎপাদনে অরাজকতা, ধন বণ্টনের তীব্ৰ অসমতা, বিভিন্ন জাতির মধ্যে পরস্পরের ধ্বংসাত্মক শিল্প লড়াই, সাবেকী নৈতিক বন্ধন, পুরানো পারিবারিক সম্বন্ধ এবং পুরাতন জাতিসত্তার ভাঙনের দিকে অঙ্গলি নির্দেশ করেছে তারা।
ইতিবাচক লক্ষ্যের ক্ষেত্রে কিন্তু সমাজতন্ত্রের এই রূপটি হয় উৎপাদন ও বিনিময়ের পুরানো উপায় ও সেই সঙ্গে সাবেকী সম্পত্তি-সম্পর্ক ও পুরাতন সমাজ ফিরিয়ে আনতে, নয় উৎপাদন ও বিনিময়ের নতুন উপায়কে সম্পত্তি সম্পর্কের সেই পুরানো কাঠামোর মধ্যেই আড়ষ্ট করে আটকে রাখতে সচেষ্ট, যা এই সব নতুন উপায়ের চাপে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, হওয়া অনিবার্য। উভয় ক্ষেত্রেই তা প্রতিক্রিয়াশীল ও ইউটোপীয়।
এর শেষ কথা হল: শিল্পোৎপাদনের জন্য সংঘবদ্ধ গিল্ড্ প্রতিষ্ঠান, কৃষিকার্যে পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক।
শেষ পর্যন্ত যখন ইতিহাসের কঠোর সত্যে আত্মবিভ্ৰান্তির সমস্ত নেশা কেটে যায় তখন সমাজতন্ত্রের এ রূপটার অবসান হয় একটা শোচনীয় নাকিকান্নায়।
গ। জার্মান অথবা ‘খাঁটি’ সমাজতন্ত্র
ফ্রান্সের সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সাহিত্যের জন্ম হয়েছিল ক্ষমতাধর বুর্জোয়া শ্রেণীর চাপে এবং এই ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অভিব্যক্তি হিসাবে। জার্মানিতে সে সাহিত্যের আমদানি হল যখন সামন্ত স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেখানকার বুর্জোয়ারা সবেমাত্র লড়াই শুরু করেছে।
জার্মান দার্শনিকেরা, হবু দার্শনিকেরা, সৌখীন ভাবকেরা (beaux esprits) সাগ্রহে এ সাহিত্য নিয়ে কাড়াকড়ি শুরু করল। তারা শুধু এই কথাটুকু ভুলে গেল যে ফ্রান্স থেকে এ ধরনের লেখা জার্মানিতে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফরাসী সমাজ পরিস্থিতিও চলে আসেনি। জার্মানির সামাজিক অবস্থার সংস্পর্শে এসে এই ফরাসী সাহিত্যের সমস্ত প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক তাৎপৰ্য হারিয়ে গেল, তার চেহারা হল নিছক সাহিত্যিক। তাই আঠারো শতকের জার্মান দার্শনিকদের কাছে প্রথম ফরাসী বিপ্লবের দাবিগুলি মনে হল সাধারণভাবে ‘ব্যবহারিক প্রজ্ঞার’ (Practical Reason) দাবি মাত্র, এবং বিপ্লবী ফরাসী বুর্জোয়া শ্রেণীর অভিপ্রায় ঘোষণার তাৎপৰ্য দাঁড়াল বিশুদ্ধ অভিপ্রায়, অনিবাৰ্য অভিপ্রায়, সাধারণভাবে যথাৰ্থ মানবিক অভিপ্ৰায়ের আইন।
জার্মান লেখকদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল নতুন ফরাসী ধারণাগুলিকে নিজেদের সনাতন দার্শনিক চেতনার সঙ্গে খাপ খাওয়ান, নিজেদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ না করে ফরাসী ধারণাগুলিকে আত্মসাৎ করা।
যেভাবে বিদেশী ভাষাকে আয়ত্ত করা হয় সেইভাবে, অর্থাৎ অনুবাদের মাধ্যমে এই আত্মসাতের কাজ চলেছিল।
প্রাচীন পেগান জগতের চিরায়ত সাহিত্যের পুঁথিগুলির উপরেই সন্ন্যাসীরা কী ভাবে ক্যাথলিক সাধুদের নির্বোধ জীবনী লিখে রাখত সে কথা সুবিদিত। অপবিত্র ফরাসী সাহিত্যের ব্যাপারে জার্মান লেখকেরা এ পদ্ধতিটিকে উলেট দেয়। মূল ফরাসীর তলে তারা লিখল তাদের দার্শনিক ছাইপাঁশ। উদাহরণস্বরপ, মুদ্রার অর্থনৈতিক ক্রিয়ার ফরাসী সমালোচনার তলে তারা লিখল ‘মানবতার বিচ্ছেদ’; বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ফরাসী সমালোচনার নিচে লিখে রাখল ‘নির্বিশেষ এই প্রত্যয়ের সিংহাসনচ্যুতি’ ইত্যাদি।
ফরাসী ঐতিহাসিক সমালোচনার পিছনে এই সব দার্শনিক বুলি জুড়ে দিয়ে তার নাম তারা দেয় ‘কর্মযোগের দর্শন’, ‘খাঁটি সমাজতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্রের জার্মান বিজ্ঞান’, ‘সমাজতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি’ ইত্যাদি।
ফরাসী সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট রচনাগুলিকে এইভাবে পুরোপুরি নির্বীর্য করে তোলা হয়। জার্মানদের হাতে যখন এ সাহিত্য এক শ্রেণীর সঙ্গে অপর শ্রেণীর সংগ্রামের অভিব্যক্তি হয়ে আর রইল না, তখন তাদের ধারণা হল যে ‘ফরাসী একদেশদর্শিতা’ অতিক্রম করা গেছে, সত্যকার প্রয়োজন নয় প্রকাশ করা গেছে সত্যের প্রয়োজনকে, প্রতিনিধিত্ব করা গেছে প্রলেতারিয়েতের স্বার্থের নয় মানব প্রকৃতির, নির্বিশেষ যে মানুষের শ্রেণী নেই, বাস্তবতা নেই, যার অস্তিত্ব কেবল দার্শনিক জলপনার কুয়াশাবত রাজ্যে তার স্বার্থের।
জার্মান এই যে সমাজতন্ত্র তার স্কুলছাত্রের কর্তব্যটাকেই অমন গুরুগম্ভীর ভারিক্কী চালে গ্রহণ করে সামান্য পশরাটা নিয়েই ক্যানভাসারের মতো গলাবাজি শুরু করেছিল তার পণ্ডিতি সারল্যাটাও কিন্তু ইতিমধ্যে ক্রমে ক্রমে ঘুচে গেছে।
সামন্ত আভিজাত্য ও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিপক্ষে জার্মান, বিশেষ করে প্রাশিয়ার বুর্জোয়া শ্রেণীর লড়াইটা, অর্থাৎ উদারনৈতিক আন্দোলন তখন গুরুতর হয়ে ওঠে।
তাতে করে রাজনৈতিক আন্দোলনের সামনে সমাজতন্ত্রের দাবিগুলি তুলে ধরবার বহুবঞ্ছিত সংযোগ ‘খাঁটি’ সমাজতন্ত্রের কাছে এসে হাজির হয়, হাজির হয় উদারনীতি, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, বুর্জোয়া প্রতিযোগিতা, সংবাদপত্রের বুর্জোয়া স্বাধীনতা, বুর্জোয়া বিধান, বুর্জোয়া মুক্তি ও সাম্যের বিরদ্ধে চিরাচরিত অভিশাপ হানবার সুযোগ; জনগণের কাছে এই কথা প্রচারের সংযোগ যে এই বুর্জোয়া আন্দোলন থেকে তাদের লাভের কিছু নেই, সবকিছু হারাবারই সম্ভাবনা। ঠিক সময়টিতেই জার্মান সমাজতন্ত্র ভুলে গেল, যে-ফরাসী সমালোচনার সে মূঢ় প্রতিধ্বনি মাত্র সেখানে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্ব আগেই প্রতিষ্ঠিত, আর তার সঙ্গে ছিল অস্তিত্বের আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক অবস্থা ও তদুপযোগী রাজনৈতিক সংবিধান, অথচ জার্মানিতে আসন্ন সংগ্রামের লক্ষ্যই ছিল ঠিক এইগুলিই।
পুরোহিত, পন্ডিত, গ্রাম্য জমিদার, আমলা ইত্যাদি অনাচর সহ জার্মান স্বৈর সরকারগুলির কাছে আক্রমণোদ্যত বুর্জোয়া শ্রেণীকে ভয় দেখাবার চমৎকার জুজু হিসাবে তা কাজে লাগল।
ঠিক একই সময়ে এই সরকারিগুলি জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর বিদ্ৰোহসমূহকে চাবুক ও গুলির যে তিক্ত ওষুধ গেলাচ্ছিল তার মধুরেণ সমাপয়েৎ হল এতে।
এই ‘খাঁটি’ সমাজতন্ত্র এদিকে এইভাবে সরকারগুলির কাজে লাগছিল জার্মান বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়ার হাতিয়ার হিসাবে, আর সেই সঙ্গেই তা ছিল প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থ, জার্মানির কূপমণ্ডূকদের স্বার্থের প্রতিনিধি। জার্মানিতে প্রচলিত অবস্থার প্রকৃত সামাজিক ভিত্তি ছিল পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী, ষোলো শতকের এই ভগ্নশেষটি তখন থেকে নানা মূর্তিতে বারবার আবির্ভূত হয়েছে।
এ শ্রেণীকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ হল জার্মানির বর্তমান অবস্থাটাকেই জিইয়ে রাখা। বুর্জোয়া শ্রেণীর শিল্পগত ও রাজনৈতিক আধিপত্যে এ শ্রেণীর নির্ঘাত ধ্বংসের আশঙ্কা–একদিকে পুঁজি কেন্দ্ৰীভূত হওয়ার ফলে, অপরদিকে বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের অভ্যুদয়ে। মনে হল যেন এই দুই পাখিকে এক ঢিলেই মারতে পারবে ‘খাঁটি’ সমাজতন্ত্র। মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ুল তা।
জল্পনাকল্পনার মাকড়সার জালের পোশাক, তার উপর বাক্যালঙ্কারের নক্সী ফুল, অসুস্থ ভাবালুতার রসে সিক্ত এই যে স্বর্গীয় আচ্ছাদনে জার্মান সমাজতন্ত্রীরা তাদের অস্থিচর্মসার শোচনীয় ‘চিরন্তন সত্য’ দুটোকে সাজিয়ে দিল, তাতে এই ধরনের লোকসমাজে তাদের মালের অসম্ভব কাটতি বাড়ে।
কূপমণ্ডূক পেটি বুর্জোয়ার বাগাড়ম্বরী প্রতিনিধিত্বটাই তার কাজ, জার্মান সমাজতন্ত্র নিজের দিক থেকে তা হ্রমেই বেশি করে উপলব্ধি করতে থাকে।
তারা ঘোষণা করল যে জার্মান জাতি হল আদর্শ জাতি, কূপমণ্ডূক জার্মান মধ্যবিত্তই হল আদর্শ মানুষ। এই আদর্শ মানুষের প্রতিটি শয়তানী নীচতার এরা এক একটা গূঢ় মহত্তর সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিল, যা তার আসল প্রকৃতির ঠিক বিপরীত। এমন কি কমিউনিজমের ‘পাশবিক ধ্বংসাত্মক’ ঝোঁকের প্রত্যক্ষ বিরুদ্ধতা ও সব ধরনের শ্রেণী-সংগ্রাম সম্বন্ধে পরম ও নিরপেক্ষ অবজ্ঞা ঘোষণায় তার দ্বিধা হল না। আজকের দিনে (১৮৪৭) যত তথাকথিত সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট রচনা জার্মানিতে প্রচলিত, যৎসামান্য কয়েকটিকে বাদ দিলে তার সমস্তটাই এই কলুষিত ক্লান্তিকর সাহিত্যের পৰ্যায়ে পড়ে।(4)
২) রক্ষণশীল অথবা বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র
বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্বটা ক্ৰমাগত বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই বুর্জোয়া শ্রেণীর একাংশ সামাজিক অভাব-অভিযোগের প্রতিকার চায়।
এই অংশের মধ্যে পড়ে অর্থনীতিবিদেরা, লোকহিতব্রতীরা, মানবতাবাদীরা, শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থার উন্নয়নকারীরা, দুঃস্থ-ত্রাণ সংগঠকেরা, পশুক্লেশ নিবারণী সভার সদস্যরা, মাদকতা নিবারণের গোঁড়া প্রচারকেরা, সম্ভবপর সবরকম ধরনের খুচরো সংস্কারকরা। সমাজতন্ত্রের এই রূপটি পরিপূর্ণ মতধারা হিসাবেও সংরচিত হয়ে উঠেছে।
এই রূপটার নিদর্শন হিসাবে আমরা প্রুধোঁ-র ‘দারিদ্র্যের দর্শন’-এর উল্লেখ করতে পারি।
সমাজতান্ত্রিক বুর্জোয়ারা আধুনিক সামাজিক অবস্থার সুবিধাটা পুরোপুরি চায়, চায় না তৎপ্রসূত অবশ্যম্ভাবী সংগ্রাম ও বিপদটুকু। তারা সমাজের বর্তমান অবস্থা বজায় রাখতে চায়, কিন্তু তার বিপ্লবী ও ধ্বংসকারী উপাদানসমহ বাদ দিয়ে। তারা চায় প্রলেতারিয়েতবিহীন বুর্জোয়া শ্রেণী। যে-দুনিয়ায় তারা সর্বেসবা, স্বভাবতই সেই দুনিয়াই তাদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ। এই প্রীতিকর প্রত্যয়টিকেই বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র নানাধিক পরিপূর্ণ নানাবিধ মতবাদে দাঁড় করায়। এরূপ মতবাদ কাজে পরিণত করে প্রলেতারিয়েত সামাজিক নব জেরুজালেমে যাক, এই বলে এরা আসলে এটাই চায় যে শ্রমিক শ্রেণী বৰ্তমান সমাজের চৌহদ্দির ভিতরেই থাকুক, কিন্তু বুর্জোয়া সম্বন্ধে তার সমস্ত বিদ্বেষভাব বিসর্জন দিক।
এই ধরনের সমাজতন্ত্রের আর একটা অধিকতর ব্যবহারিক অথচ কম সমসংবদ্ধ রূপে আছে; তাতে প্রতিটি বিপ্লবী আন্দোলনকে শ্রমিক শ্রেণীর চোখে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় এই বলে যে নিছক রাজনৈতিক কোনো সংস্কারে নয়, অস্তিত্বের বৈষয়িক অবস্থার, অর্থনৈতিক সম্পকের পরিবর্তনেই তাদের সংবিধা হতে পারে। অস্তিত্বের বৈষয়িক অবস্থার পরিবতন বলতে অবশ্য এই ধরনের সমাজতন্ত্র কোনোক্রমেই বুর্জোয়া উৎপাদন-সম্পকের উচ্ছেদ বোঝে না, যে উচ্ছেদ কেবল বিপ্লব দিয়েই সম্পন্ন হওয়া সম্ভব; বোঝে বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার ভিত্তিতে শুধু শাসনতান্ত্রিক সংস্কার। অর্থাৎ এহেন সংস্কার যা পুঁজি ও মজুরি-শ্রমের সম্পৰ্কটাকে কোনো দিক থেকেই আঘাত করে না, শুধু বড়ো জোর বুর্জোয়া সরকারের প্রশাসনের খরচ কমার ও তাকে সরল করে আনে।
বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের সর্বোত্তম প্রকাশ শুধু তখন, যখন তা একটা বাক্যালঙ্কার মাত্র।
অবাধ বাণিজ্য : শ্রমিক শ্রেণীর উপকারের জন্য। সংরক্ষণ শুক্ল : শ্রমিক শ্রেণীরই উপকারের জন্য। কারাগারের সংস্কার : শ্রমিক শ্রেণীর উপকারের জন্য। বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের এই হল শেষ ও একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কথা।
সংক্ষেপে তা এই : বুর্জোয়ারা শ্রমিক শ্রেণীর উপকারের জন্যই বুর্জোয়া।
৩। সমালোচনী-ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম
আধুনিক যুগের প্রতিটি বড় বড় বিপ্লবে যে সাহিত্য প্রলেতারিয়েতের দাবিকে ভাষা দিয়েছে, যেমন বাবেফ ও অন্যান্যদের রচনা, আমরা এখানে তার উল্লেখ করছি না।
সামন্ত সমাজ যখন উচ্ছেদ হচ্ছে তখনকার সার্বজনীন উত্তেজনার কালে নিজেদের লক্ষ্যসিদ্ধির জন্য প্রলেতারিয়েতের প্রথম সাক্ষাৎ প্রচেষ্টাগুলি অনিবার্যভাবেই ব্যথা হয়, কারণ প্রলেতারিয়েত তখন পর্যন্ত সবিকশিত হয়নি, তার মুক্তির অন্যকুল অর্থনৈতিক অবস্থাও তখন অনুপস্থিত। তেমন অবস্থা গড়ে উঠতে তখনও বাকি, আসন্ন বুর্জোয়া যুগেই কেবল তা গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল। প্রলেতারিয়েতের এই প্রথম অভিযানসমহের সঙ্গী ছিল যে বিপ্লবী সাহিত্য তার প্রতিক্রিয়াশীল একটা চরিত্র থাকা ছিল অনিবাৰ্য। সে সাহিত্য প্রচার করত সর্বব্যাপী কৃচ্ছ্রসাধন, স্থূল ধরনের সামাজিক সমতা।
প্রকৃতপক্ষে যাকে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট মতাদর্শ বলা চলে, অর্থাৎ সাঁ-সিমোঁ, ফুরিয়ে, ওয়েন ইত্যাদির মতবাদ, জন্ম নিল প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়ার সংগ্রামের সেই অপরিণত যুগে, যার বর্ণনা আগে দেওয়া হয়েছে (প্রথম অধ্যায় ‘বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত’ দ্রষ্টব্য)।
এই জাতীয় মতের প্রতিষ্ঠাতারা শ্রেণীবিরোধ এবং প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিধ্বংসী উপাদানগলির ক্রিয়াটা দেখেছিলেন। কিন্তু প্রলেতারিয়েত তখনও তার শৈশবে; এদের চোখে বোধ হল সে শ্রেণীর নিজস্ব ঐতিহাসিক উদ্যম এবং স্বতন্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলন নেই।
শ্রেণীবিরোধ বাড়ে যন্ত্রশিল্প প্রসারের সঙ্গে সমান তালে; সেদিনের অর্থনৈতিক অবস্থা তাই তখনো এদের সামনে প্রলেতারিয়েতের মুক্তির বৈষয়িক শত গুলি তুলে ধরেনি। সুতরাং এরা খুঁজতে লাগলেন সে শত সৃষ্টি করার মতো নতুন সমাজবিজ্ঞান, নতুন সামাজিক নিয়ম।
তাঁদের ব্যক্তিগত উদ্ভাবন-ক্রিয়াকে আনতে হল ঐতিহাসিক ক্রিয়ার স্থানে। মুক্তির ইতিহাস-সৃষ্ট শর্তের বদলে কল্পিত শর্ত, প্রলেতারিয়েতের স্বতঃস্ফীত শ্রেণী সংগঠনের বদলে উদ্ভাবকদের নিজেদের বানানো এক সমাজ-সংগঠন। তাদের কাছে মনে হল ভবিষ্যৎ ইতিহাস তাঁদেরই সামাজিক পরিকল্পনার প্রচার ও বাস্তব রূপায়ণ।
পরিকলপনা প্রস্তুত করার সময় সর্বাধিক নিগৃহীত শ্রেণী হিসাবে প্রধানত শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার চেতনা তাঁদের ছিল। তাঁদের কাছে প্রলেতারিয়েতের অস্তিত্বই ছিল কেবল সর্বাধিক নিগৃহীত শ্রেণী হিসাবে।
শ্ৰেণী-সংগ্রামের অপরিণত অবস্থা এবং তাঁদের স্বকীয় পরিবেশের দরুন এই ধরনের সমাজতন্ত্রীরা মনে করতেন যে তাঁরা সকল শ্রেণীবিরোধের বহু ঊর্ধ্বে। তাঁরা চেয়েছিলেন সমাজের প্রত্যেক সদস্যের, এমন কি সবচেয়ে সুবিধাভোগীর অবস্থাও উন্নত করতে। সেইজন্য সাধারণত শ্রেণী:নির্বিশেষে গোটা সমাজের কাছে আবেদন জানানো; এমন কি তুলনায় শাসক শ্রেণীর কাছেই আবেদন-নিবেদন ছিল এঁদের পছন্দ। কেননা, এঁদের ব্যবস্থাটা একবার বুঝতে পারলে লোকে কেমন করে না দেখে পারবে যে এইটাই সমাজের সর্বোত্তম-সম্ভব ব্যবস্থার জন্য সর্বোত্তম-সম্ভব পরিকল্পনা?
সেইজন্য সকল রাজনৈতিক, বিশেষত সকল বিপ্লবী প্রচেস্টাকে এঁরা বর্জন করলেন; এদের অভিলাষ হল শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজেদের উদ্দেশ্যসাধন; চেষ্টা হল দৃষ্টান্তের জোরে, এবং যার ভাগ্যে ব্যর্থতাই আনিবাৰ্য এমন ছোটখাট পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন সামাজিক বেদের (Gospel) পথ কাটতে।
ভবিষ্যৎ সমাজের এ ধরনের উদ্ভট ছবি আঁকা হয় এমন সময়ে যখন প্রলেতারিয়েত অতি অপরিণত অবস্থার মধ্যে ছিল, নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে তাদের ধারণাও ছিল উদ্ভট; সমাজের ব্যাপক পুনর্গঠন সম্বন্ধে এ শ্রেণীর প্রাথমিক স্বতঃস্ফীত আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এ ধরনের ছবির মিল দেখা যায়।
কিন্তু সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট এই সব লেখার মধ্যে সমালোচনামলেক একটা দিকও আছে। বর্তমান সমাজের প্রত্যেকটি নীতিকে এরা আক্রমণ করল। তাই শ্রমিক শ্রেণীর জ্ঞানলাভের পক্ষে অনেক অমল্য তথ্যে তা পরিপূর্ণ। শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে প্রভেদ, পরিবার প্রথা, ব্যক্তিবিশেষের লাভের জন্য শিল্প পরিচালনা ও মজুরিশ্রমের উচ্ছেদ, সামাজিক সৌষম্য ঘোষণা, রাষ্ট্রের কাজকে কেবলমাত্র উৎপাদনের তদারকে রূপান্তরিত করণ ইত্যাদি যেসব ব্যবহারিক প্রস্তাব এই লেখার মধ্যে আছে তাদের সবকটাই শ্রেণীবিরোধের অন্তৰ্ধানের দিকেই কেবল অঙ্গলি নির্দেশ করে, অথচ সে বিরোধ সেদিন সবেমাত্র মাথা তুলছিল, এই সব লেখার মধ্যে ধরা পড়েছিল তাদের, আদি অস্পষ্ট আনিদিলন্ট রপটুকু। প্রস্তাবগলির প্রকৃতি তাই নিতান্তই ইউটোপীয়।
সমালোচনামূলক-ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের যা তাৎপৰ্য তার সঙ্গে ঐতিহাসিক বিকাশের সম্বন্ধটা বিপরীতমখী। আধুনিক শ্রেণী-সংগ্রাম যতই বিকশিত হয়ে সুনিদিষ্ট রূপে নিতে থাকে, ঠিক ততই এই উদ্ভট সংগ্রাম-পরিহারের, শ্রেণীসংগ্রামের বিরদ্ধে এইসব উদ্ভট আক্রমণের সকল ব্যবহারিক মাল্য ও তাত্ত্বিক ব্যক্তি হারায়। সেইজন্যই, এই সমস্ত মতবাদের প্রবর্তকেরা অনেক দিক দিয়ে বিপ্লবী হলেও তাঁদের শিষ্যরা প্রতিক্ষেত্রে কেবল প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীতেই পরিণত হয়েছে। প্রলেতারিয়েতের প্রগতিশীল ঐতিহাসিক বিকাশের বিপরীতে তারা নিজ নিজ গুরুর আদি মতগুলিকেই আঁকড়ে ধরে আছে। তাই তাদের অবিচল চেষ্টা যেন শ্রেণী-সংগ্রাম নিস্তেজ হয়ে পড়ে, যেন শ্রেণীবিরোধ আপসে মিটে যায়। তারা এখনও তাদের সামাজিক ইউটোপিয়ার পরীক্ষামলক রূপায়ণের স্বপ্ন দেখে; বিচ্ছিন্ন ‘ফালানস্টের’ প্রতিষ্ঠা, ‘হোম কলোনি’ স্থাপন, ‘ছোট আইকেরিয়া’(5) প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখে, নব জেরুজালেমের ক্ষুদ্ৰাদপি ক্ষদ্র সংস্করণ হিসাবে; — আর এই আকাশকুসম বাস্তব করার জন্য আবেদন জানায় বুর্জোয়া শ্রেণীর সহানভূতি ও টাকার থলির কাছে। আগে যে প্রতিক্রিয়াপন্থী বা রক্ষণশীল সমাজতন্ত্রীদের বর্ণনা করা হয়েছে এরা ধীরে ধীরে নেমে যায়। সেই স্তরে; তফাৎ শুধু তাদের আরও প্রণালীবদ্ধ পাণ্ডিত্যে, এবং সমাজবিদ্যার অলৌকিক মাহাত্ম্যে অন্ধ ও সংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসে।
শ্রমিক শ্রেণীর সমস্ত রাজনৈতিক প্রচেস্টার এরা তাই তীব্র বিরোধী; এদের মতে সে প্রচেষ্টা কেবলমাত্র নব বেদে অন্ধ অবিশ্বাসের ফল।
ইংলন্ডে ওয়েনপন্থীরা এবং ফ্রান্সে ফুরিয়েভক্তরা যথাক্রমে চার্টিস্ট ও সংস্কারবাদীদের বিরোধী। (6)
৪। বর্তমান নানা সরকার-বিরোধী পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্বন্ধ
শ্রমিক শ্রেণীর যে সব পার্টি এখন বিদ্যমান, যেমন ইংলন্ডে চার্টিস্টগণ ও আমেরিকায় কৃষি সংস্কারবাদীরা, তাদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্বন্ধ দ্বিতীয় অধ্যায়ে পরিষ্কার করা হয়েছে।
উপস্থিত লক্ষ্যসিদ্ধির জন্য, শ্রমিক শ্রেণীর সাময়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য কমিউনিস্টরা লড়াই করে থাকে, কিন্তু আন্দোলনের বর্তমানের মধ্যেও তারা আন্দোলনের ভবিষ্যতের প্রতিনিধি, তার রক্ষক। ফ্রান্সে রক্ষণশীল এবং র্যাডিকাল বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে তারা সোশ্যাল-ডেমোক্রাটদের(7) সঙ্গে হাত মেলায়, কিন্তু মহান ফরাসী বিপ্লব থেকে ঐতিহ্য হিসাবে যে সব বাঁধা বুলি ও ভ্রান্তি চলে আসছে তার সমালোচনার অধিকারটুকু বর্জন না করে।
সুইজারল্যান্ডে সমর্থন করা হয় র্যাডিকালদের, কিন্তু এ সত্য ভোলা হয় না যে এ দলটি পরস্পরবিরোধী উপাদানে গঠিত, এদের খানিকটা ফরাসী অর্থে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী আবার খানিকটা হল র্যাডিকাল বুর্জোয়া।
পোল্যান্ডে তারা সেই দলটিকে সমর্থন করে যারা জাতীয় মুক্তির প্রাথমিক শর্ত হিসাবে কৃষি বিপ্লবের ওপর জোর দেয়, সেই দল যারা ১৮৪৬ সালের ক্রোকোভ বিদ্রোহে ইন্ধন জুগিয়েছিল।
জার্মানিতে বুর্জোয়ারা যখন বিপ্লবী অভিযান করে তখনই কমিউনিস্টরা তাদের সঙ্গে একত্রে লড়ে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র, সামন্ত জমিদারতন্ত্র এবং পেটি বুর্জোয়ার(8) বিরুদ্ধে।
কিন্তু বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের মধ্যে যে বৈর বিরোধ বৰ্তমান তার যথাসম্ভব স্পষ্ট স্বীকৃতিটা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সঞ্চার করার কাজ থেকে তারা মুহূর্তের জন্যও বিরত হয় না; এইজন্য যাতে, বুর্জোয়া শ্রেণী নিজ আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আসতে বাধ্য, জার্মান মজুরেরা যেন তৎক্ষণাৎ তাকেই বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারে; এইজন্যই যাতে, জার্মানিতে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীগুলির পতনের পর যেন বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধেই অবিলম্বে লড়াই শুরু হতে পারে।
কমিউনিস্টরা প্রধানত জার্মানির দিকে মন দিচ্ছে কারণ সে দেশে একটি বুর্জোয়া বিপ্লব আসন্ন, ইউরোপীয় সভ্যতার অধিকতর অগ্রসর পরিস্থিতির মধ্যে তা ঘটতে বাধ্য, এবং ঘটবে সতেরো শতকের ইংল্যান্ড ও আঠারো শতকের ফ্রান্সের তুলনায় অনেক বিকশিত এক প্রলেতারিয়েত নিয়ে। এবং এই কারণে যে, জার্মানির বুর্জোয়া বিপ্লব হবে অব্যবহিত পরবর্তী প্রলেতারীয় বিপ্লবের ভূমিকমাত্র।
সংক্ষেপে বলা যায় যে, কমিউনিস্টরা সর্বত্রই বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিটি বিপ্লবী আন্দোলন সমৰ্থন করে।
এই সব আন্দোলনেই তারা প্রত্যেকটির প্রধান প্রশ্ন হিসাবে সামনে এনে ধরে, মালিকানার প্রশ্ন, তার বিকাশের মাত্রা তখন যাই থাক না কেন।
শেষ কথা, সকল দেশের গণতন্ত্রী পার্টিগুলির মধ্যে ঐক্য ও বোঝাপড়ার জন্য তারা সর্বত্র কাজ করে।
আপন মতামত ও লক্ষ্য গোপন রাখতে কমিউনিস্টরা ঘৃণা বোধ করে। খোলাখালি তারা ঘোষণা করে যে তাদের লক্ষ্য সিদ্ধ হতে পারে কেবল সমস্ত প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সবল উচ্ছেদ মারফত। কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে শাসক শ্রেণীরা কাঁপুক। শৃঙ্খল ছাড়া প্রলেতারিয়েতের হারাবার কিছু নেই। জয় করবার জন্য আছে সারা জগৎ।
দুনিয়ার মজুর এক হও!
—————-
ডিসেম্বর, ১৮৪৭ থেকে জানিয়ারি, ১৮৪৮-এর মধ্যে মার্কস ও এঙ্গেলস কর্তৃক লিখিত, ফেব্রুয়ারি ১৮৪৮ সালে লণ্ডনে প্রথম প্রকাশিত।
১৮৮৮ সালে লণ্ডনে প্রকাশিত ও এঙ্গেলস কর্তৃক সম্পাদিত ইংরাজী অনুবাদের ভাষান্তর।
—————-
1) ১৬৬o থেকে ১৬৮৯ সালের ইংরেজী রেস্টোরেশন নয়, ১৮১৪ থেকে ১৮৩০ সালের ফরাসী রেসেন্টারেশন। (১৮৮৮ সালের ইংরেজী সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা।)
2) লেজিটিমিস্ট–অভিজাত ভূস্বামীদের পার্টি বুরবোঁ রাজবংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী। ‘নবীন ইংলণ্ড’—১৮৪২ সাল নাগাদ গঠিত ইংরেজ অভিজাত, রাজনৈতিক ও সাহিত্যিকদের একটি গোষ্ঠী, মতামতে রক্ষণশীল পার্টির কাছাকাছি। এর বিশিষ্ট প্রতিনিধি হলেন ডিজরেলি, টমাস কালাইল প্রভৃতি।– সম্পাদক
3) কথাটা বিশেষ করে জার্মানি সম্বন্ধে খাটে। সেখানে অভিজাত ভূস্বামী ও জমিদাররা বড় বড় মহাল নিজেরাই গোমস্তা রেখে চাষ করায়, তাছাড়া নিজেরাই ব্যাপকভাবে বীটচিনি ও আলুর মদ তৈরি করে। এদের চেয়ে অবস্থাপন্ন ইংরেজ অভিজাতেরা এখনও ঠিক এতটা নামেনি; কিন্তু তারাও কমতি খাজনার ক্ষতিপূরণের জন্য কমবেশী সন্দেহজনক জয়েন্ট-স্টক কোম্পানি পত্তন করার কাজে নিজেদের নাম ধার দিতে জানে। (১৮৮৮ সালের ইংরেজী সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা।)
4) ১৮৪৮ সালের বিপ্লবী ঝড় এই সমগ্র নোংরা ঝোঁকটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিয়ে, সমাজতন্ত্র নিয়ে আরও কিছু জল্পনার বাসনাটুকুও ঘুঁচিয়ে দিয়েছে এর প্রবক্তাদের। এই ঝোঁকের প্রধান প্রতিভূ ও ক্লাসিকাল প্রতিচ্ছবি হলেন কার্ল গ্র্যূন মহাশয়। (১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা)
5) ‘ফালানস্টের’ (phalansteres) হল ফুরিয়ের কল্পিত সমাজতন্ত্রী উপনিবেশ; কাবে তাঁর ইউটোপিয়া এবং পরবর্তী আমেরিকাস্থিত কমিউনিস্ট উপনিবেশকে আইকেরিয়া নাম দেন। (১৮৮৮ সালের ইংরেজী সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা।)
ওয়েন তাঁর আদর্শ কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলিকে ‘হোম কলোনি’ বলতেন; ফুরিয়ের কল্পিত সর্বভোগ্য প্রাসাদের নাম ‘ফালানস্টের’। যে ইউটোপিয় কল্পরাজ্যের কমিউনিস্ট প্রতিষ্ঠান কাবে বর্ণনা করেছিলেন, তার নাম ‘আইকেরিয়া’। (১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা)
6) La Réforme পত্রিকার অনগামীদের কথা বলা হচ্ছে। পত্রিকাটি ১৮৪৩ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত প্যারিসে প্রকাশিত।
7) পার্লামেণ্টে এই পার্টির প্রতিনিধিত্ব করতেন লেদ্রু-রলাঁ, সাহিত্য ক্ষেত্ৰে লুই ব্লাঁ, দৈনিক সংবাদপত্রে জগতে Réforme পত্রিকা। সোশ্যাল-ডেমোক্রেট নামের উদ্ভাবকদের কাছে নামটির অর্থ হল গণতন্ত্রী বা প্রজাতন্ত্রী দলের একাংশ, যার মধ্যে সমাজতন্ত্রের কমবেশি রং লেগেছে। (১৮৮৮ সালের ইংরেজী সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা।)
এই সময় ফ্রান্সে যে পার্টি নিজেকে সোশ্যালিস্ট-ডেমোক্রোট বলত, তাদের রাজনৈতিক জীবনে প্রতিনিধি ছিলেন লেদ্রু-রলাঁ আর সাহিত্য জগতে লুই ব্লাঁ; সুতরাং আজকের দিনের জার্মান সোশালডেমোক্রাসির সঙ্গে এর ছিল দুস্তর পাৰ্থক্য। (১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা।)
(8) মূল জার্মানে Kleinburgerel. মার্কস ও এঙ্গেলস কথাটা ব্যবহার করেছিলেন শহরবাসী পেটি বুর্জোয়ার প্রতিক্রিয়াশীল অংশগুলির অর্থে।–সম্পাদক