মানুষটির কথা শুনে রত্না ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মত চমকে উঠল। সে যেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিল ঠিক সেটাই ঘটেছে। টেলিফোনের অন্য পাশে একজন মানুষ ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে এক্ষুনি ছয়তলা থেকে লাফিয়ে পড়বে। সেই মানুষটি বেঁচে থাকবে নাকি মারা যাবে সেটি এখন নির্ভর করছে তার উপর। তার উপর? সে আঠারো বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে। সারা জীবনে সে কোনো বড় কাজ করেনি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেনি। কোনো সাহসের কাজ করেনি। এখন তাকে টেলিফোনে কথা বলতে হবে একজন মানুষের সাথে-যার কাছে জীবনের কোনো মূল্য নেই, জীবনের কোনো অর্থ নেই। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে পার্থক্য একটি সেকেন্ড, কিংবা এক সেকেন্ড থেকেও কম। একটি মুহূর্ত? কী করবে সে? রত্না অসহায়ভাবে সবার দিকে তাকালো।
সবাই বুঝে গেল কী হচ্ছে। একটু আগের তাদের হাসি হাসি মুখটি মুহূর্তের মাঝে গম্ভীর হয়ে গেল। ইমরান এসে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে যায়, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “ইমার্জেন্সি?”
রত্না মাথা নাড়ল। ইমরান জিজ্ঞেষ করলো, “লেভেল?”
রত্না হাতের সবগুলো আঙুল মেলে ধরল। লেভেল পাঁচ। সবচেয়ে ভয়ংকর। যখন একজন সুইসাইডের প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় সেটি হচ্ছে লেভেল ফাইভ।
রুনু রত্নার চোখের দিকে তাকিয়ে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করল। ফিসফিস করে বলল, “কথা বলে যাও।”
রত্না চোখ বন্ধ করল, একটা বড় নিঃশ্বাসকে আটকে রেখে গলার
স্বরটা শান্ত করার চেষ্টা করল, বলল, “আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”
অন্য পাশ থেকে কোনো কথা শোনা গেল না। রত্না আবার বলল, “একটু কথা বলবেন আমার সাথে?”
এবারেও কোনো উত্তর নেই। শুধু একটা নিঃশ্বাসের শব্দ শুনল।
”বলবেন, প্লীজ?”
এবারে উত্তর শুনতে পেলো, “কী কথা বলতে চাও?”
রত্না বুকের ভেতর আটকে রাখা শ্বাসটি সাবধানে বের করল। মানুষটি শেষ পর্যন্ত কথা বলেছে, এখন রত্না প্রটোকল ধরে কথা বলতে পারবে।
রত্না বলল, “যেহেতু আপনি আমাদের ফোন করেছেন, হয়তো আপনি আমাদের সাথে কিছু একটা শেয়ার করার কথা ভাবছিলেন-”
রত্না শুনলো অন্য পাশ থেকে মানুষটা হঠাৎ প্রায় ধমকে উঠল, “আমি মোটেও তোমাদের ফোন করতে চাই নাই–এটা ভুলে হয়ে গেছে।”
রত্না বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ হতে পারে আপনি ফোন করতে চাননি-হতে পারে আপনি কথা বলতে চান না, কিন্তু কিন্তু” রত্না কথা বলতে বলতে থেমে গেল।
অন্য পাশে মানুষটা কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল, রত্না কথাটা শেষ করল না বলে মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী?”
“কিন্তু যেহেতু ফোন করেই ফেলেছেন। একটু কি কথা বলা যায় না?”।
“তুমি আমার সাথে কী কথা বলবে? আমাকে লম্বা লম্বা উপদেশ দিবে?”
রত্না ব্যস্ত হয়ে বলল, “না, না, না। মোটেও উপদেশ দিব না। একবারও উপদেশ দিব না।”
“তাহলে?”
“শুধু একটু কথা বলব।”
“শুধু কথা বলবে? কী নিয়ে কথা বলবে?”
রত্না একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে অন্যদের দিকে তাকালো। রুনু আর ইমরান দুই হাত মুঠি করে রত্নাকে উৎসাহ দিল, ফিসফিস করে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক! চালিয়ে যাও”
রত্না বলল, “এই তো, মনে করেন আগে পরিচয় দিয়ে শুরু করতে পারি। আমার নাম পরী। আপনি যদি আপনার নামটা বলতে চান।”
“না, আমি তোমাকে মোটেও আমার নাম বলতে চাই না।”
“না বলতে চাইলে বলতে হবে না। আমরা কখনো কাউকে কারো নাম বলি না। পুরোপুরি গোপন। শুধু আমি জানব, আর কেউ জানবে না আমাদের।”
মানুষটি রত্নাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার বয়স কতো মেয়ে?”
রত্না একটু থতমত খেয়ে বলল, “বয়স?”
“হ্যাঁ।”
“আসলে–আসলে-” রত্না ইতস্তত করে থেমে গেল।
“আসলে কী?”
“আসলে আমাদের নাম ছাড়া আর কিছু কখনো বলার পারমিশান নাই–”
“কার পারমিশান নাই?”
“আমাদের অর্গানাইজেশন, সুইসাইড হটলাইনের—”
অন্য পাশে মানুষটা কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, “তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে তুমি স্কুলে পড়। তোমার মতো বাচ্চা একটা মেয়েকে এ রকম সিরিয়াস কাজে লাগিয়ে দিয়েছে এটা কী রকম অর্গানাইজেশন?”
রত্না মানুষটাকে কথা শেষ করতে দিল, তারপর শান্ত গলায় বলল, “আপনি আসলে ঠিকই অনুমান করেছেন। আমি একটু ছোট, কিন্তু আমি আসলে স্কুলে পড়ি না-আমি আরো বড়।”
“কতো আর বড় হবে? এ রকম সিরিয়াস কাজে লাগিয়ে দিয়েছে তুমি তোমার বাপের বয়সী মানুষকে উপদেশ দিবে? কাউন্সেলিং করবে?”
রত্না গলার স্বর শান্ত রাখল, বলল, “আমি তো আপনাকে বলেছি! আমি মোটেও উপদেশ দিব না। কাউন্সেলিং করার তো প্রশ্নই আসে না!
“উপদেশ দিবে না? কাউন্সেলিং করবে না?”
“না।”
“না?” মানুষটা একটু অবাক হল বলে মনে হল।
রত্না নরম গলায় বলল, “না।”
“কেন?”
“আমি তো আপনার সম্পর্কে এখনো কিছুই জানি না। এ রকম তো হতেই পারে যে আপনি অনেক চিন্তাভাবনা করে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর একটা কারণ আছে। হয়তো কারণটা ঠিক কারণ। হয়তো আপনি এমন একটা কষ্টের ভেতরে আছেন যেটা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। হয়তো আত্মহত্যা করলে আপনি সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবেন আমি কে আপনাকে উপদেশ দেবার? কেন দিব? কীভাবে দিব?”
টেলিফোনের অন্য পাশে কিছুক্ষণ কোনো কথা নেই। তারপর মানুষটা আবার কথা বলল, “তাহলে এই হটলাইনে তোমরা কী কর?”
“আমরা শুধু একটুখানি কথা বলার চেষ্টা করি। একটু কথা শোনার চেষ্টা করি। আর কিছু না।”
“কেন?”
“কারণ-কারণ-অনেক সময় দেখা গেছে কথা বলে একজন একটু সান্ত্বনা পায়।”
“সান্ত্বনা পায়?”
“জী।”
“আমি তোমার সাথে কথা বলে সান্ত্বনা পাব?”
রত্না একটু ইতস্তত করে বলল, “সেটা এখনো জানি না-কিন্তু-কিন্তু হতেও তো পারে।”
“তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে তোমাকে জানি না শুনি না–”
”সে জন্যেই–”
“সে জন্যেই কী?”
“যেহেতু আপনি আমাকে জানেন না, চিনেন না, সে জন্যে হয়তো আপনি আমাকে অনেক কথা বলতে পারবেন যেটা আপনি কখনো কাউকে বলেননি। বলতে পারেননি”।
অন্য পাশে মানুষটা চুপ করে রইল। রত্না প্রায় অনুনয়ের স্বরে বলল,
“বলবেন? বলবেন একটু কথা?
“ঠিক আছে। বল।”
রত্না বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে অন্যদের দিকে তাকালো। অন্যরা হাত নেড়ে রত্নাকে সাহস দিল। রত্না জিব দিয়ে তার ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে বলল, “আপনি এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন?”
“কেন? কার্নিশে?”
“কার্নিশে?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি কি কার্নিশ থেকে একটু সরে আসবেন?”
“কেন?”
“এমনিই। এমনিই-কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে একজন আমার চিন্তা করতেই কেমন জানি গা শিরশির করছে। সেই জন্যে। আর কিছু না।”
“আমি কার্নিশে থাকি না কোথায় থাকি তাতে তোমার কী?”
“না আমার কিছু না। কিন্তু মানে তবু-”
“তবু কী?”
“না, কিছু না। কিছু না।”
“তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও।”
“যে কোনো কিছু নিয়ে। আপনার যেটা ইচ্ছা।”
“আমার কোনো ইচ্ছা নাই।”
“ঠিক আছে তাহলে আমি বলি?”
“বল।”
রত্না বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিল। তারপর সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি বলবেন কেন এতো বড় একটা ডিসিশন নিলেন?”
টেলিফোনের অন্য পাশ থেকে মানুষটা মেঘ স্বরে বলল, “তুমি সেটাই জানতে চাও?”
“আপনি যদি বলতে চান তাহলে। বলতে না চাইলে বলতে হবে না। আপনার ইচ্ছা।”
“আমি বলতে চাই না।”
রত্না তাড়াহুড়ো করে বলল, “তাহলে বলতে হবে না। আপনাকে বলতে হবে না। অন্য কিছু বলি। অন্য কিছু।”
“তুমি আসলেই শুনতে চাও? শুনতে চাও মেয়ে?”
“পরী। আমার নাম পরী।”
“শুনতে চাও পরী?” মানুষটা ভারী গলায় বলল, “শুনতে চাও তুমি?”
“হ্যাঁ। শুনতে চাই।”
“আমি সুইসাইড করতে চাই, কারণ-”, মানুষটা থেমে গেল।”কারণ?”
“কারণ আমি আমার স্ত্রী আর ছেলেকে খুন করেছি। খুন মানে জান?”
রত্না ঢোক গিলল। ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ, মানে ইয়ে-”
মানুষটা আবার হিংস্র একটা শব্দ করল। বলল, “খুন।”