০৩.
ভাইমারের নির্দেশিত শুঁড়িপথ ধরে আধঘণ্টা মতো চলার পর সেই রাস্তা পেয়ে গেল অনীশ। যে রাস্তা দিয়ে ক্যাম্পে এসেছিল সে। নির্জন রাস্তা। একপাশে পাইনবনের ঢাল। অন্যদিকে পাথরের প্রাচীর। ড্রাইভার ছেলেটার কথা অনুযায়ী ওদিকটাই চীন। গত রাতে তুষারপাত হয়েছে। যদিও সূর্যালোকে তা এখন গলতে শুরু করেছে তবুও এখনও রাস্তার খানাখন্দে, পাথরের দেওয়ালের গায়ে তার চিহ্ন লেগে আছে।
বেশ কিছুক্ষণ ক্যাম্পের উলটোপথে হাঁটার পর রাস্তার পাশে একটা বড় পাথরের ওপর বসল অনীশ। কাছেই বন থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
পাইনবনের দিকে তাকিয়ে অনীশ ভাবতে লাগল গ্রামবাসীরা কি সম্মত হবে তার কথায়। অমন সুন্দর প্রাণীগুলোকে কি শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যাবে। একসময় এ তল্লাটের আদি বাসিন্দাদের অন্যতম ছিল এই টিবেটিয়ান নেকড়েগুলোই। প্রচুর সংখ্যায় ছিল ওরা। কিন্তু কয়েকশো বছর ধরে চামড়ার জন্য নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে ওদের। ওয়্যার উলফ ভেবেও স্থানীয় মানুষরা পুড়িয়ে মেরেছে প্রকৃতির এই সন্তানদের। এখন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফের রিপোর্ট অনুযায়ী এই তিব্বতী নেকড়ের সংখ্যা মাত্র তিনশোতে এসে ঠেকেছে।
আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণ সংস্থার দুষ্প্রাপ্য বণ্যপ্রাণীদের যে তালিকা আছে তাতে একদম প্রথম দিকেই আছে এই প্রাণী। দেশের সরকার শেষ পর্যন্ত খামারের প্রাণীগুলো সম্বন্ধে যাই সিদ্ধান্ত নিক না কেন অনীশদের সংস্থার তরফ থেকে তাকে অনুরোধ করা হয়েছে যে সে যেন শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে প্রাণীগুলোকে রক্ষা করার। অনীশ সেই চেষ্টাই করবে।
প্রাণীগুলোর সম্বন্ধেই ভাবছিল অনীশ। হঠাৎ একটা জিপের হর্ন শুনতে পেল সে। সামরিক বাহিনীর সাঁজোয়া গাড়ি। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে চলন্ত গাড়িটাতে ড্রাইভারের পাশের আসনে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামরিক বাহিনীর এক জওয়ান। অনীশকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে গাড়িটা এসে থামল অনীশের ঠিক সামনে।
ইন্ডিয়ান আর্মির গাড়ি। বেশ কয়েকজন লোক আছে তাতে। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামল ধোপদুরস্থ সামরিক পোশাক পরা ছোটখাটো চেহারার একজন মাঝবয়সি লোক। হাতে একটা ফাইল। সম্ভবত লোকটা পাহাড়ি দেশের মানুষই হবে। অনীশ তার বুকে লাগানো কাপড়ের পটিগুলো দেখেই বুঝতে পারল যে লোকটা সামরিক বিভাগের কোনও উচ্চপদস্থ কর্মচারী হবে। তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল অনীশ।
লোকটা এগিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। তারপর ইংরাজিতে জানতে চাইল, আপনিই তো মিস্টার অনীশ মুখার্জী? ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফের প্রতিনিধি হয়ে এখানে এসেছেন?
অনীশ বলল, হ্যাঁ। আপনি? এই বলে সে পকেট থেকে তার আইডেন্টিটি কার্ড বার করে সেটা দেখাতে যাচ্ছিল ভদ্রলোককে, কিন্তু তিনি বললেন, থাক ওটা দেখাবার প্রয়োজন। নেই। আপনার পরিচিতি সম্পর্কে কাগজ আমাদের কাছে সরকারের তরফ থেকে আছে। সেখানে আপনার ছবিও আছে। দেখেই চিনতে পেরেছি। আমি লেফটানেন্ট ছেত্রী। এই সেক্টর, মানে এই অঞ্চলের সামরিক বাহিনীর দায়িত্বে আছি। এখানে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স আর আমরা একসঙ্গে কাজ করি। এই বলে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
করমর্দন পর্ব মেটার পর অনীশ বলল, আপনি কি এখানকারই লোক? আমার সঙ্গে কোনও দরকার আছে?
ভদ্রলোক হেসে বললেন, না, না, আমি কার্শিয়াং-এর লোক। তবে বেশ কয়েকবছর ধরে এখানে পোস্টেড।
এরপর একটু থেমে লেফটানেন্ট বললেন, দরকার মানে আপনাকেই খুঁজছিলাম আমি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে আপনার ওপর নজর রাখতে বলা হয়েছে আমাকে।
অনীশ বিস্মিতভাবে জানতে চাইল, নজর রাখতে বলা হয়েছে কেন? আমি অপরাধী, নাকি গুপ্তচর?
ভদ্রলোক হেসে বললেন, না, না, তেমন ব্যাপার নয়। আপনি এ দেশের নাগরিক হলেও একটা গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি। এ জায়গা সীমান্তবর্তী অঞ্চল। এখানে বিপদ ঘটতে বেশি সময় লাগে না। তাই আপনার নিরাপত্তার স্বার্থেই আপনার ওপর নজর রাখার নির্দেশ এসেছে। তাছাড়া আপনি যে জায়গাতে উঠেছেন সে জায়গাটা ভালো নয় বলেই আমাদের ধারণা।
অনীশ বলে উঠল, ও জায়গা ভালো নয় কেন? গ্রামের মানুষদের মতো আপনিও কি ওয়্যার উফের তত্ত্বে বিশ্বাস করেন? আপনাদেরও কি আপত্তি আছে এই উলফ রিহ্যাবিলিটেশন ক্যাম্পটা নিয়ে? তার বন্ধুর মুখে শোনা গোপন খবরটা যাচাই করার চেষ্টা করল অনীশ।
একটু চুপ করে থেকে লেফটানেন্ট ছেত্রী জবাব দিলেন, না, আমি ওসবে বিশ্বাস করি না। আপনি নিশ্চয়ই দেশপ্রেমিক একজন নাগরিক?
অনীশ জবাব দিল, হা, নিশ্চয়ই। এ বিষয়ে আপনি ভরসা রাখতে পারেন।
লেফটানেন্ট আবারও একটু চুপ করে থেকে যেন একটু ইতস্তত করে বললেন, হ্যাঁ, আমরাও চাই যে উলফ রিহ্যাবিলিটেশন ক্যাম্পটা এখান থেকে উঠে যাক। সেটা ওয়্যার উলফের কারণে নয়। আমাদের ধারণা বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ আছে মিস্টার ভাইমারের। একটা সময় পর্যন্ত তিনি যোগাযোগ রাখতেন আমাদের সঙ্গে, কিন্তু বেশ কিছুদিন হল তিনি সব যোগাযোগ ছিন্ন করেছেন।
অনীশ প্রশ্ন করল, যোগাযোগ ছিন্ন করাই কি আপনাদের সন্দেহের কারণ?
লেফটানেন্ট বললেন, না, ওটাই একমাত্র কারণ নয়। আরও কারণ আছে। তবে সামরিক বাহিনীর সব খবর বাইরের লোককে বলা যায় না। ক্ষমা করবেন আমাকে। তা ফার্মটা কেমন দেখলেন? পশুগুলোকে দেখলেন?
অনীশ জবাব দিল, দেখেছি। বেশ সুস্থ সবল সুন্দর প্রাণী সেগুলো।
আর মানুষগুলো? জানতে চাইলেন ছেত্রী।
অনীশ বলল, মিস্টার ভাইমার আর তার দু-জন সহকর্মীর সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে আমার। যদিও ভাইমারের সঙ্গীদের সঙ্গে বাক্যালাপ হয়নি। তবুও বলি তাদের কোনও অস্বাভাবিক আচরণ আমি দেখিনি।
লেফটানেন্ট এবার তার হাতের ফাইলটা খুলে তার একটা পাতা মেলে ধরলেন অনীশের সামনে। সেখানে রয়েছে বেশ কয়েকজন লোকের রঙিন ফোটোগ্রাফ। তাদের ছবি দেখে অনীশের মনে হল তারা চীনা সামরিক বাহিনীরই কেউ হবে। কারণ, লাল পট্টিঅলা, তারকা খচিত এই কালচে সবুজ পোশাক পরা লোকদেরই সে আসার পথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল চীন ভূখণ্ডে।
ছবিগুলো দেখিয়ে লেফটানেন্ট তাকে প্রশ্ন করলেন, ছবিগুলো ভালো করে দেখে বলুন তো এই ছবিগুলোর মধ্যে কাউকে আপনি ওই উলফ ক্যাম্পে দেখেছেন কিনা?
তাঁর কথা শুনে পাঁচটা ছবিই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল অনীশ। তার সঙ্গে কল্পনা করল তাকে খাবার দিতে আসা লোক দুজনের মুখ।
তারপর সে বলল, আমার কাছে যে ফাইল আছে তাতে বলা আছে ভাইমার সাহেবের চারজন কর্মচারী আছে ওই নেকড়ে ক্যাম্পে। তাদের ছবিও আছে আমার ফাইলে। তাদের মধ্যে আমি দু-জন কর্মচারীকে দেখেছি। আপনার ফাইলের লোকগুলোর মুখের সঙ্গে সে দু-জন লোকের মুখের মিল নেই।
লেফটানেন্ট এবার তার ফাইলটা বন্ধ করে বললেন, যদি বাকি অন্য দু-জনের সঙ্গে এই ছবিগুলোর কারও মিল পান অথবা এদের মধ্যে কাউকে ওখানে দেখতে পান তবে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এটা প্রয়োজন। আপনার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিন, আর আমারটাও রাখুন আপনার কাছে।
দুজনের মধ্যে ফোন নম্বর বিনিময়ের পর লেফটানেন্ট ছেত্রী জানতে চাইলেন, আপনি এখন কোথা থেকে এলেন? কোথায় যাবেন?
অনীশ বলল, ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে গেছিলাম। আবার এরপর নেকড়ে খামারে ফিরব।
গ্রামের মানুষরা কী বলল? জানতে চাইলেন ছেত্রী।
অনীশ বলল, ওদের ধারণা ক্যাম্পের নেকড়েগুলো আসলে ওয়্যার উলফ! ভাইমার বলেছেন যে অভিযোগপত্র তুলে নিলে তিনি তাদের অর্থ সাহায্য করবেন। সেটাও তাদের জানালাম। দেখা যাক…।
লেফটানেন্ট বললেন, আমরা এই ওয়্যার উফের ব্যাপারটা বিশ্বাস না করলেও হয়তো বা ভাইমারই এ ব্যাপারটার জন্য কিছুটা দায়ী। এই মাস ছয়েক আগেই একবার একদিন রাতে মিস্টার ভাইমার আমাকে উত্তেজিত ভাবে ফোন করে বলেছিলেন, জানেন আমার ধারণা হচ্ছে। যে আমার নেকড়েগুলো সব ওয়্যার উন। তার কথা শুনে আমি হেসে ফেলায় তিনি ফোন রেখে দিলেন। সেই তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। তিনি আমার ফোন আর ধরেন না। ফোনও করেন না। হয়তো তিনি গ্রামবাসীদেরও কাউকে খেয়ালবশে কোনও কারণে একথা বলেছিলেন। সেটাই প্রচারিত হয়েছে। তবে গ্রামবাসীরা একবার ক্যাম্পটা আক্রমণ করার চেষ্টা করে সফল না হলেও কিন্তু নেকড়ে নিধন যজ্ঞে নেমে পড়েছে।
অনীশ বলল, সেটা কেমন?
লেফটানেন্ট বললেন, এ অঞ্চলে একটা বিশেষ ব্যাপারে তল্লাশি চালাচ্ছিলাম আমরা। জিনিসটার খোঁজে কাছেই এক জায়গায় মাটি খুঁড়েছিলাম। সেখান থেকে চারটে টিবেটিয়ান উফের চামড়া কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে। আমার ধারণা গ্রামবাসীরা তাদের মেরে মাটিতে পুঁতে দিয়েছে।
অনীশ চমকে উঠে বলল, এমন দুষ্প্রাপ্য পাঁচটা প্রাণীকে মেরে ফেলল ওরা?
ছেত্রী বললেন, আমার ধারণা তাই। তবে ওদের তেমন দোষ দেওয়া যায় না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ওয়্যার উল সম্বন্ধে কুসংস্কার কি এত সহজে দূর করা সম্ভব? যদিও ব্যাপারটা ওরা ভয়ে স্বীকার করতে চাইছে না কেউ। কারণ সরকারি তরফ ছাড়া বন্যপ্রাণী হত্যা আইন বিরুদ্ধ।
অনীশ প্রশ্ন করল, কীসের খোঁজে গিয়ে আপনারা নেকড়েগুলোর মৃতদেহর সন্ধান। পেলেন?
লেফটানেন্ট মৃদু হেসে বললেন, কীসের খোঁজে আমরা গেছিলাম সেটা বলা যাবে না আপনাকে। এটাও সামরিক বাহিনীর গোপন ব্যাপার।
অনীশ বলল, সরি। ব্যাপারটা জিগ্যেস করা আমার উচিত হয়নি।
লেফটানেন্ট এরপর আর বেশি কথা বাড়ালেন না। তিনি বললেন, এবার আমাকে যেতে হবে। কোনও অসুবিধায় পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানিয়ে দেবেন।–এই বলে অনীশের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন তিনি। পথের বাঁকে হারিয়ে গেল তার গাড়ি। অনীশও এরপর ক্যাম্পে ফেরার জন্য এগোল।
ক্যাম্পে পৌঁছে গেল অনীশ। বাড়িটার সামনের জমিটায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। গতকাল তালা খুলে দিয়েছিলেন ভাইমার। কিন্তু অনীশ খেয়াল করল আজ দরজায় তালা দেওয়া নেই। হয়তো বা তার জন্যই তালাটা খুলে রাখা হয়েছে। গেটের ফাঁক দিয়ে ওপাশে হাত গলিয়ে ওপাশের ছিটকিনি খুলে ভিতরে প্রবেশ করল অনীশ। ঠিক সেই সময় মাথার ওপরের আকাশটাতে কেমন যেন অন্ধকার হয়ে এল। পাহাড়ি অঞ্চলে সারাদিনই এমন মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা চলে। ফাঁকা জমি পেরিয়ে বারান্দায় উঠল অনীশ। সেখানেও কোনও লোকজন নেই।
নিজের ঘরে ঢুকে কিন্তু অনীশ দেখতে পেল তার টেবিলে খাবার রাখা আছে। ধোঁয়া উঠছে তার থেকে। অর্থাৎ কিছুক্ষণ আগেই খাবার দিয়ে গেছে কেউ। ভাইমার কি ফিরেছেন বাইরে থেকে। বেশ বেলা হয়ে গেছে। এতটা পথ হাঁটার ফলে বেশ খিদেও পেয়েছিল তার। কাজেই খাওয়া সেরে নিয়ে বিছানায় বসল সে।
জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন আধো-অন্ধকার ভাব। পিছনের বরফ পাহাড় থেকে ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে অনীশ লেফটানেন্ট ছেত্রীর সঙ্গে তার কথোপকথনগুলো ভাবতে লাগল। ছেত্রী কি সন্দেহ করছেন এ বাড়িতে অন্য কেউ ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে? কথাটা মনে হতেই নিজের সঙ্গে আনা ফাইলটা খুলল অনীশ। ভাইমার সহ তার কর্মচারী চারজনের ছবি আর পাঁচটা নেকড়ের ছবি আছে ফাইলটাতে। ভাইমারের যে দুজন। সঙ্গীকে অনীশ ইতিমধ্যে দেখেছে তাদের মধ্যে দুজনের ছবি দেখে চিনতে পারল অনীশ। মনে মনে সে ভেবে নিল ভাইমারের কর্মচারীদের মধ্যে বাকি দুজনের চেহারাও মিলিয়ে নিতে হবে ফাইলের ছবির সঙ্গে।
ফাইলটা ঘাঁটছিল অনীশ। দরজা খোলাই ছিল। হঠাৎ যেন দরজা বেয়ে আসা আলোটা আরও ক্ষীণ হয়ে গেল। অনীশ তাকিয়ে দেখল দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন ভাইমার। তাকে দেখে ফাইল বন্ধ করে অনীশ বলল, আপনি কখন ফিরলেন?
ভাইমার বললেন, মানে?
অনীশ বলল, পাইনবনে যে আপনার সঙ্গে দেখা হল তারপর কখন ক্যাম্পে ফিরলেন?
ভাইমার একটু চুপ করে রইলেন। বেশ চিন্তাক্লিষ্ট লাগছে তার মুখ। তিনি বললেন, ও, হা, বেশ কিছুক্ষণ হল।
জবাব দিয়ে ভাইমার ঘরের ভিতর ঢুকতে গিয়েও হঠাৎই থমকে গেলেন। বেশ কয়েকবার নাক টেনে ঘরের ভিতর তাকালেন তিনি। তার নজর গিয়ে থামল অনীশের খাটের ওপর পড়ে থাকা কাঠ গোলাপের বোকেটার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আঁতকে উঠে বললেন, ফেলে দিন বোকেটা, এখনই জানলা দিয়ে ফেলে দিন। কারা দিল ওটা?
বিস্মিতভাবে অনীশ বলল, গ্রামবাসীরা। কেন কী হল?
ভাইমার দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বার করে নাক চাপা দিয়ে বলল, ওতে আমার ভয়ানক অ্যালার্জি। এখনই আমার হাত মুখ চুলকাতে শুরু করবে। প্লিজ ফেলে দিন ওটা।
অনীশ ব্যাপারটা এবার বুঝতে পেরে জানলা দিয়ে বোকেটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলল।
ঘরে ঢুকলেন ভাইমার। অনীশও খাট ছেড়ে নামল। মুখ থেকে রুমাল সরালেন ভাইমার। এর মধ্যেই তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। বিশেষ বিশেষ ফুলের গন্ধে অনেকেরই অ্যালার্জি হয়। অনীশের এক পরিচিত বন্ধুর কাঠালি-পা ফুলের গন্ধেও এমন অ্যালার্জি হত।
রুমাল সরিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন ভাইমার। তাই দেখে অনীশ বলল, আপনাকে বেশ চিন্তান্বিত লাগছে! কিছু হয়েছে?
ভাইমার বললেন, হ্যাঁ। মাথায় চিন্তা ঘুরছে। ওপার থেকে তিব্বতী চীনাদের দলটার রসদ নিয়ে ভোরবেলাই পৌঁছোনোর কথা। তারা এখনও এল না। এদিকে আকাশের যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে আজ সন্ধ্যা থেকেই ভারী তুষারপাত শুরু হবে। বরফে পাস আটকে গেলে তারা আর আসতে পারবে না। এদিকে রসদও শেষ। আমাদের কথা বাদ দিন প্রাণীগুলোকে তো খাবার দিতে হবে। আমার কর্মচারীরা তো বটেই প্রাণীগুলোও গত দুদিন ধরে না খেয়ে। আছে বলা চলে।
অনীশের বেশ লজ্জা লাগল ভাইমারের কথা শুনে। তাদের নিজেদের খাদ্য সংকট অথচ তারা দু-বেলা অনীশের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন বলে।
সে বলল, আমার খাবার নিয়ে কিন্তু আপনি ভাববেন না। সঙ্গে শুকনো খাবার আছে। প্রয়োজনে গ্রাম থেকে খাবার সংগ্রহ করে নেব।
ভাইমার মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, আসলে প্রাণীগুলোর ভবিষ্যতের চিন্তা সবসময় মাথায় ঘুরছে, তার ওপর আবার এই সমস্যা! মাথার ভিতর সব কিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা কী বলল আমাকে আর একবার বলুন তো?
অনীশ বলল, ওই তো তখন আপনাকে যা বললাম। আপনার প্রস্তাব ওদের বললাম। ওরা ভাববে বলল, দেখা যাক কী হয়?
ভাইমার মৃদু চুপ করে থেকে প্রশ্ন করলেন, ওদের সঙ্গে কথা বলে আপনার কী মনে হল? আমার ক্যাম্পের ওপর ওদের এত রাগ কেন?
অনীশ জবাব দিল, ওদের ধারণা আপনার ক্যাম্পের নেকড়েরা আসলে ওয়্যার উলফ।
আবারও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন ভাইমার। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এই কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে এই সুন্দর প্রাণীগুলোকে যে কত হত্যা করা হয়েছে তার হিসাব নেই। এখন এ সত্ত্বেও যদি সরকার এদেরকে সমর্থন করেন তবে আর কিছু বলার নেই।
ভাইমারের কথায় অনীশের মনে পড়ে গেল লেফটানেন্টের কথা। সে বলল, আপনি কখনও কাউকে মজা করেও বলেননি তো যে আপনার নেকড়েরা ওয়্যার উলফ??
ভাইমার বললেন, না, বলিনি। তবে আমার নাম করে কেউ যদি সে কথা ছড়িয়ে থাকে তবে তা আমি জানি না।
অনীশ এরপর আর এ প্রসঙ্গে কথা না বাড়িয়ে বলল, আচ্ছা আপনার তো চারজন কর্মচারী। দু-জনকে দেখলাম। অন্য দুজন কোথায়?
ভাইমার হেসে বললেন, আপনার কি মনে হয় তারা দু-জন ওয়্যার উলফ? গ্রামের লোকরা বলেছে নাকি এ কথা?
ভাইমারের এ কথা শুনে অনীশ একটু লজ্জিতভাবে বলল, না, না, সে কথা নয়। আমি এ সবে বিশ্বাস করি না। আসলে তাদের দেখিনি তাই বললাম।
ভাইমার বললেন, নানা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে সবাই। ঠিক আছে আপনার কৌতূহল নিরসনের জন্য ওদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। এবার চলি তাহলে। বাইরেটা অন্ধকার হয়ে আসছে।
ভাইমার বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সত্যি দু-জন লোক এসে দাঁড়াল ঘরের সামনে। ভাইমার তাদের পাঠিয়েছেন। তাদের দেখেই অনীশ বুঝতে পারল ভাইমারের আগের দু-জন কর্মচারীর সঙ্গে এ দু-জন লোকেরও ছবি আছে তার ফাইলে। অর্থাৎ চারজন লোককেই দেখা হয়ে গেল তার। সে দুজন লোকের মধ্যে একজন একটু ইতস্তত করে অনীশের উদ্দেশ্যে বলল, স্যার, আমাদের কোনও প্রশ্ন করবেন? সাহেব আমাদের পাঠালেন।
তার তেমন কিছু প্রশ্ন করার নেই লোকগুলোকে। সে শুধু তাদের দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু লোকগুলো অনীশের কাছে জানতে চাওয়ায় সে প্রশ্ন করল, তোমরা এখানে কী কাজ করো?
একজন লোক জবাব দিল, পশুগুলোর যত্ন নিই। তাছাড়া ক্যাম্পের নানা কাজ।
অনীশ বলল, এই ক্যাম্প যদি না থাকে তখন?
তার কথা শুনে অন্য লোকটা ভয়ার্তভাবে বলল, ক্যাম্প না থাকলে আমরা কোথায় যাব স্যার? পেটের ব্যাপার। আমাদের কথা ভাববেন স্যার। ভাইমার সাহেবের দয়ায় এই ক্যাম্পে আমরা খেতে পরতে পারছি।
বাইরেটা আরও অন্ধকার হয়ে আসছে। খোলা দরজা-জানলা দিয়ে তীক্ষ্ণ কনকনে বাতাস ঢুকছে ভিতরে।
অনীশ লোক দুজনের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা এখন যাও। আমি দেখছি কী করা যায়। আর সাহেবকে বোলো রাতে খাবার লাগবে না। সঙ্গে খাবার আছে সেগুলো খাব।
অনীশকে সেলাম ঠুকে চলে গেল লোকদুটো। দরজা-জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল অনীশ।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল অনীশ। তার যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকাল গড়িয়ে অনেকক্ষণ হল সন্ধ্যা নেমেছে। জানলার বাইরে থেকে কীসের যেন অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসছে।
অনীশ জানলা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ বাতাসের সঙ্গে জানলার গরাদের ফঁক গলে বিন্দু বিন্দু কী যেন এসে পড়ল তার গায়ে। তুষার! তুষারপাত যেন শুরু হয়েছে কখন। পিছনের পাহাড়ের মাথায় ইতিমধ্যে চাঁদ উঠেছে। তার আলোতে মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাইরেটা। তুষারে ঢেকে গেছে পিছনের জমিটা। নিশ্চয়ই সামনের জমিটাও একইভাবে বরফে ঢেকে গেছে। অনীশ এর আগে কোনওদিন তুষারপাত দেখেনি। জানলাটা বন্ধ করে খাট থেকে নেমে সে দরজাটা খুলল। হা, সামনের ফাঁকা জমিটা সাদা হয়ে গেছে তুষারে। তারপরই সে দেখতে পেল এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য।
বারান্দার বাইরে তুষারপাতের মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে পাঁচটা নেকড়ে। ফাঁকা জমিটার মধ্যে উল্লাসে ছোটাছুটি করছে তারা। কখনও বা একে অন্যের পিছু ধাওয়া করছে খেলার ছলে। তাদের পায়ের আঘাতে তুষার উড়ছে বাতাসে। এই নেকড়ের দলের মধ্যেই ধবধবে সাদা বিশালাকার একটা নেকড়ে দেখতে পেল অনীশ। আকারে সেটা অন্য চারটে নেকড়ের থেকে অনেক বড়। অনীশ আগে তাকে দেখেনি। সম্ভবত এটাই সেই পঞ্চম নেকড়ে যেটা খাঁচার গতাঁর ভিতর লুকিয়ে ছিল। একমাত্র এই নেকড়েটাই কিন্তু ছোটাছুটিতে অংশ নিচ্ছে না। এক জায়গাতে চুপচাপ বসে অন্যদের ওপর নজর রাখছে।
দূর থেকে একবার যেন ঘাড় ফিরিয়ে অনীশের ঘরের দিকে তাকাল সে। তারপর একবার মুখটা হাঁ করল। এত দূর থেকেও যেন তার টকটকে লাল জিভ আর তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো দেখতে পেল অনীশ। শ্বাপদের দাঁত! মুহূর্তের জন্য কেমন যেন শিরশির করে উঠল অনীশের গা। এরপর চাঁদের দিকে মুখ তুলে অদ্ভুত স্বরে ডেকে উঠল প্রাণীটা। আর সঙ্গে সঙ্গে অন্য চারটে নেকড়ে যে যেখানে ছিল থমকে দাঁড়িয়ে গলা মেলাল তার সঙ্গে। তুষারপাতের মধ্যে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে যেন আদিমতা জেগে উঠল প্রাণীগুলোর মধ্যে।
হাজার বছর ধরে, যুগ যুগ ধরে এমনই রাত্রির আহ্বানে সাড়া দিয়ে এসেছে তারা। রাত্রির সন্তানদের অপার্থিব সঙ্গীত মূৰ্ছনা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল নির্জন পাহাড়ের বুকে। এ অভিজ্ঞতা অনীশের কোনওদিন হয়নি। মাঝে মাঝে একটু থেমে থেমে একইভাবে ডেকে উঠতে লাগল প্রাণীগুলো। সে ডাক শুনে অনীশের কোনও সময় মনে হল তা যেন প্রকৃতির সন্তানদের উল্লাসধ্বনি আবার কোনও কোনও সময় মনে হতে লাগল সেটা তাদের আত্মবিলাপ, ক্রন্দনধ্বনি। অনীশ দরজা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল তাদের।
সময় কাটতে লাগল। কিন্তু একসময় প্রচণ্ড তুষারপাত শুরু হল। বাতাসও বইতে লাগল শনশন করে। তার ঝাপটায় তুষার এসে লাগতে লাগল অনীশের মুখে। তার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাও প্রচণ্ড। অনীশ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দরজা বন্ধ করে বাতি জ্বালাল সে। তারপর সঙ্গে আনা বিস্কুট, শুকনো খাবার খেয়ে বাতি নিভিয়ে রাত আটটা নাগাদ শুয়ে পড়ল।
মাঝরাতে হঠাৎ কীসের যেন একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল তার। দরজার কাছ থেকে শব্দটা আসছে। কেমন যেন একটা অদ্ভুত খসখসে শব্দ! সঙ্গের টর্চটা জ্বালিয়ে দরজার দিকে আলো ফেলল অনীশ। তারপর বলে উঠল, কে? পুরোনো কাঠের প্যানেলঅলা দরজাটা একবার যেন কেঁপে উঠল। তারপর সব শব্দ থেমে গেল। হয়তো বা বাতাসের আঘাতেই শব্দটা হচ্ছে। দরজা কেঁপে উঠছে। টর্চ নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়ল অনীশ। কিন্তু ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝেই যেন শব্দটা কানে বাজতে লাগল। তার। অদ্ভুত একটা খসখস্ শব্দ!