৩. ভটচায আয়োজন দেখে খুব খুশি

ভটচায আয়োজন দেখে খুব খুশি। পেটের রোগ আর প্রেশারের জন্য বাড়িতে খাওয়ার বড় ধরা করা। কিন্তু লোকটা খাইয়ে মানুষ।

মদের গেলাসটা সরিয়ে রেখে মেটুলির চাটটা টেনে নিয়ে বললেন, বড় খাওয়ার আগে আবার এই ছোট খাওয়ার ব্যাপারটা কেন মশাই?

দিগিন হেসে বললেন, এ হোট খাওয়া নয়, এ হল চাট, মদের মুখে একটু একটু খেতে হয়। নুন আর ঝাল স্বাদে তেষ্টা বাড়ে, তাতে মদটা খেয়ে আরাম।

কিন্তু ভটচায মদের মোটে স্বাদ পান না। দু-এক চুমুক কষ্টে খেয়ে বলেন, এ মশাই চলবে না। বড় লাউড জিনিস।

তা হলে চাটটাও খাবেন না। খামোখা খিদে নষ্ট হবে।—বলে দিগিন জলপান করার মতো দিশি মদ গলায় ঢালেন।

শুটকি মাছ আমি বড় ভালবাসি।

 একটু মাল টেনে নিন, আরও ভাল লাগবে।

 ভটচায কষ্টেসৃষ্টে আরও দু’-এক চুমুক খান। বলেন, মাথা ঝিমঝিম করছে।

তা হলে আর-একটু চালান। ঝিমুনিটা কেটে ফুর্তি লাগবে।

 ভটচায খেতে চেষ্টা করেন।

দিগিন উঠে গিয়ে পোর্টের একটা বোতল আনেন আলমারি থেকে। আলাদা গেলাসে ঢেলে দিয়ে বলেন, এটা খান। এটার স্বাদ ভাল।

পোর্ট ভটচাযের ভালই লাগে। অনেকখানি খেয়ে নেন একেবারো বলেন, হ্যাঁ, এটা বেশ।

আর-একটু দিই?

দিন।

দিগিন মৃদু হেসে বলেন, খুব দামি জিনিস। এই বোতলটা একশো টাকা।

বলেন কী! থাক থাক আর দেবেন না।

খান না মশাই, দামকে ভয় কী?

দামের জন্য নয়, নেশা হয়ে যাবে।

বোতলটা ভটচাযের হাতের নাগালে রেখে দিলেন, বুঝতে পারেন ‘দামি জিনিস’ কথাটাই ভটচাযকে কাত করবে।

করলও। ভটচায গেলাস শেষ করে বোতলটা হাত বাড়িয়ে নিলেন, বললেন, দিগিনবাবু, এর জোরেই না এখনও ফিট আছেন। নইলে এখানকার জলহাওয়া সহ্য করেন কী করে?

একজ্যাক্টলি।

ভটচায কথা বলতে থাকেন। প্রথমে চাকরির কথা। তারপর ঘর-সংসারের কথা। কী একটু দুঃখের কথা বলে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলেন। দিগিন চোখ ছোট করে চেয়ে গিনিপিগ দেখতে থাকেন। আজকাল তার বড় একটা নেশা হতে চায় না। কাল রাতে যেমন ঘুমের বড়ি খেয়েছিলেন তেমনি আজও একবার খাবেন নাকি?

ভটচা হেঁচকি তুলে বলেন, শুটকি মাছ!

আসছে।

খুব ভাল জিনিস।

 খুব।

বহুকাল খাইনি, আমার বাসায় ওর পাট নেই। ছেলেবেলায় খুব খেয়েছি। আপনার বাসায় রেগুলার হয়?

হয়।

সবাই খায়?

না। আমি খাই আর বড়বউদি। আর কেউ না।

বউ থাকলে সে যদি না খেত তবে আপনারও খাওয়া হত না।

 দিগিন হাসেন।

ভটচায হঠাৎ সংবিৎ পেয়ে বলেন, কিন্তু লোকে বলে আপনার কে একজন আছে।

দিগিন গম্ভীর হয়ে বলেন, কে থাকবে?

একজন মেয়েছেলে!

দিগিন হেসে বলেন, সে তো সবার থাকে।

সবার থাকে? ভটচায হেঁচকি তোলেন।

 বিয়ে করলেই থাকে।

না না, বিয়ে করা বউয়ের কথা নয়।

তবু কথা একই, বিয়ে করা বা না করা সবই এক কথা।

ভটচার্য অনেক ভেবে-চিন্তে মাথা নেড়ে বলেন, তা বটে। তা হলে আপনার একজন আছে?

একজন না, কয়েকজন।

 কয়েকজন? ভটচাখ চোখ বড় করে তাকাল।

 লোকে বলে না সে কথা?

না তো! একজনের কথাই শুনেছি।

লোকে কমিয়ে বলেছে।

 রাখেন কী করে? একজনেরই যা খরচ।

 রোজগার করি। রাখি!

 বেশ খরচা পড়ে, না?

তা পড়ে, ফুর্তিটাও তো কম নয়। মেয়েছেলে, কিন্তু বউ নয়, এর মধ্যে কি কম ফুর্তি নাকি?

ভটচায় মাত্রাহীন টানতে থাকেন পোর্ট। বলেন, বাড়িতে বসে এ সব খান, কেউ কিছু বলে না?

কী বলবে?

আপত্তি করে না?

বাড়িটা তো আমার।

তবু ফ্যামিলিতে কি এ সব চলে?

দিগিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, অত ভাবতে গেলে ফুর্তিই তো ফিকে হয়ে যায়।

তা বটে।

 ভাববেন না। কেউ কিছু বলে তো বলুক। আপনার কাজ আপনি করে যাবেন।

কী করব?

ফুর্তি!

এই বুড়ো বয়সে?

 ফুর্তির আবার বয়স কী? তা ছাড়া সারাজীবন যদি ফুর্তি না করে থাকেন তো এই শেষ বয়সেই তা পুষিয়ে নেওয়া উচিত। আর তো বেশি সময় নেই। আপনি কিন্তু একটু বেশি খাচ্ছেন।

না, আর খাব না।

 খান। ক্ষতি নেই। তবে আর বেশি টানলে খাবার খেতে পারবেন না।

দাঁড়ান। আর দুই চুমুক। আবার অনেকটা খেয়ে ভটচায় একটা প্রকাণ্ড ঢেকুর তুলে বললেন, ওই! গ্যাসটা বেরিয়ে গেল! পেটটা হালকা লাগছে।

লাগবেই তো। দেশিটা খেলে আরও বেরিয়ে যেত।

হ্যাঁ, ফুর্তির কথা কী যেন বলছিলেন? এইটাই ফুর্তির বয়স। মরার পর ওপারে গেলে স্বয়ং যম যখন সওয়াল করবে, বাপু, পৃথিবীর কী কী অভিজ্ঞতা হয়েছে তোমার, কী কী ভোগ করে এলে, তখন কী বলবেন? বলার কিছু আছে? ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান করে নাকিসুরে তখন পেটের রোগ, বউয়ের মেজাজ, প্রোমোশনের দেরি, ডেবিট, ক্রেডিট, এ সবই বলতে হবে। যম তখন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে, বলবে, যাও, দুনিয়াটা আবার দেখে এসো, কিছুই দেখনি।

ভটচাযের চোখ দুখানা রক্তাভ। সেই চোখে দিগিনের দিকে চেয়ে বলেন, শুটকি মাছ?

হবে। আর একটু খিদেটা চাগিয়ে নিন।

ভটচায মদে সম্পূর্ণ ভেসে যাওয়ার আগে আবেগ-খলিত কণ্ঠে বলেন, বাড়িতে বড় ধরাকাটা! কিছু খেতে-টেতে দেয় না মনের মতো। বহুকাল ধরে ডিপ্রেশনে আছি। যদি পেটটা ঠিক থাকত, যদি প্রেশারটা উৎপাত না করত।

খাবার দিয়ে গেল চাকর। ভটচায দু’চামচ ফ্রায়েড রাইস খেলেন, এক টুকরো মাংস, শুটকি মাছের চচ্চড়িটা মুখে তুললেন মাল, খেতে পারলেন না। তারপরেই গেলাস রেখে চেয়ারে এলিয়ে বসে চোখ বুজলেন। আস্তে করে বললেন, বউ বাচ্চা সব পাঠিয়ে দিয়েছি কোন্নগর। সেখানে আমার বাড়ি হচ্ছে। যে কদিন আছি রোজ আসব, বুঝলেন?

নিশ্চয়ই। দিগিন বলেন।

একটা রিকশা ডেকে ভটচাযকে তুলে দিতে রাত হয়ে গেল।

ভিতর বাড়িতে ফিরে আসবার সময়ে দেখলেন, শানুর ঘরে আলো জ্বলছে। বন্ধ দরজার সামনে একটু দাঁড়ালেন। ঘরটা নিঃশব্দ। আস্তে টোকা দিলেন দরজায়।

কে?

আমি।

 ছোটকাকা?

হা।

শানু উঠে এসে দরজা খোলে। এ সময়টা দিগিনকে সবাই সমঝে চলে। কারণ প্রতি দিনই সন্ধের পর দিগিন নেশা করেন।

কিন্তু আজ তার নেশা হয়নি। যথেষ্ট পরিষ্কার আছে মাথা। চিন্তাশক্তি চমৎকার কাজ করছে।

শানু সপ্রশ্ন চোখে চেয়ে বলে, কিছু বলবে?

হুঁ। বলে দিগিন শানুর ঘরে ঢোকেন।

ঘরটা ভাল। বারো বাই বারো মাপের ঘর। ফোম রবারের গদিপাতা খাট, সেক্রেটারিয়েট টেবিল, গদি-আঁটা চেয়ার, টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। শানু একটু শৌখিন মানুষ। অন্তত দশ জোড়া জুতো র্যাকে সাজানো। ওয়ার্ডরোবটা বেশ বড়সড়। তাতে প্রয়োজনের অনেক বেশি জামা কাপড় ঠাসা আছে।

সেক্রেটারিয়েটের সামনের চেয়ারটায় বসেন দিগিন। কথা বলেন না।

 শানু বিছানায় বসে। চেয়ে থাকে।

শানু।

 বলো।

 ময়নার কাছে কেন গিয়েছিলি?

শানু স্মার্ট ছেলে। ঘাবড়াল না, একটু হাসল। বলল, তুমি চিরটাকাল কাকিমাকে বড় হেলাফেলা করেছ।

কাকিমা!

নয়?

 দিগিন শ্বাস ফেললেন।

শানু বলে, মানুষ যা-ই বলে বলুক, আমি জানি কাকিমা বলেই।

একটু কর্কশ স্বরে দিগিন বলেন, বুঝলাম, কিন্তু গিয়েছিলি কেন?

সম্পর্কটা সহজ করতে।

সেটা নিয়ে তোর মাথাব্যথা কেন?

শানু গম্ভীর হয়ে বলে, ছোটকাকা, একটা মানুষের প্রতি সারাটা জীবন কেন অন্যায় করে যাচ্ছ?

অন্যায়?

অন্যায় ছাড়া কী? ভাত-কাপড়ের চেয়ে দামি জিনিস হচ্ছে মর্যাদা।

 থাক। টাকা চেয়েছিলি কেন?

 চেয়েছি ধার হিসেবে।

কেন?

সব টাকা লিকুইডেটেড হয়ে গেছে।

সেটা আমাকে বলিসনি কেন?

বললে তো বকতে।

এখন কি বকব না?

শানু শ্বাস ফেলে বলল, সোপস্টোনের লসটা হিসেব করছিলাম। তোমাকে যা বলেছি তার চেয়ে বেশি লস হবে। বাজারে ধারকর্জ একটু বেশি হয়েছে। জলঢাকায় যে ইরেকশনের কাজটা অর্ধেক বন্ধ রাখতে হয়েছে সেটার বিল আটকে দিয়েছে, লেবাররা খেপে আছে, যাওয়া যাচ্ছে না।

নিজের দু’খানা হাতের দিকে অন্যমনে একটু চেয়ে থাকেন দিগিন, শানুর কোনও কথাই তাকে স্পর্শ করে না। জলঢাকা এম-ই-এস, সোপস্টোন, টাকা, বিল, এ সব কথা একটা জীবনে তিনি অনেক ভেবেছেন। এখন আর ভাবতে ভাল লাগে না। জীবনে সব কিছুরই একটা কোটা থাকে। তার কোটা ফুরিয়েছে। আর কিছু করার নেই বোধহয়।

দিগিন তার চিন্তান্বিত মুখখানা তুলে বলেন, আমার অনেক দোষ ছিল। ছিল কেন বলি, এখনও আছে। লোকে বলে, আমার হৃদয় বলে বস্তু নেই। কিন্তু আমার সদগুণেরও কিছু অভাব ছিল না। আমি সেই জোরেই দু’হাতে টাকা রোজগার করেছি। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার কোনও শর্টকাট রাস্তা আমার জানা নেই। বাজে ফাটকায় বা অনিশ্চিত ব্যাপারে আমিও কিছু ক্ষতিস্বীকার করেছি, কিন্তু কোনও ব্যাপারেই আমার ফাঁকির ফিকির ছিল না। তাই আজও আমি টাকার ওপরে বসে আছি। তোমাদের আমলে তোমরা এই টাকার পাহাড় ধসিয়ে দেবে।

শানু মাথা নিচু করে থাকে। তারপর আস্তে করে বলে, চেষ্টা তো আমিও কিছু কম করি না।

কালিম্পঙে তোমার এখন কী কাজ হচ্ছে?

একটা ব্রিজ কনস্ট্রাকশন, তুমি তো জানোই।

জানি। কিন্তু সে বাবদে তোমার সেখানে গিয়ে পড়ে থাকার মানে হয় না। কাল আমি নিজে সেখানে যাব। তুমি জলঢাকায় যাবে। ইরেকশনের কাজটা শেষ করতেই হবে, মনে রেখো।

লেবাররা ছেড়ে দেবে না। ওদের অনেক টাকা বাকি পড়ে গেছে।

সেজন্য কে দায়ি?

আমরা নই। ইরেকশনের ভুলটা ডিটেকটেড হয়েছে অনেক পরে। এখন নতুন করে করতে গেলে খরচ দ্বিগুণ হত। তাই আমরা ছেড়ে এসেছি।

খরচের ভয় পেলে চলবে কেন? আমার নাম কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তার গুডউইল নষ্ট করার তুমি কে? কালই তুমি জলঢাকা যাবে।

শানু চুপ করে থাকে।

দিগিন বলেন, বুঝেছ?

শানু মাথা নাড়ল।

 কালিম্পঙে তোমাকে আর যেতে হবে না।

শানু মাথা তুলে বলে, জলঢাকায় কাজটা আবার হাতে নিলে আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাব।

হলে হব। তোমাকে ভাবতে হবে না।

ছোটকাকা।

 বলো।

আর-একটু ভেবে দেখো।

ভাববার কিছু নেই। কাজটা করতে হবে।

একটা পয়সাও আসবে না, ঘরের টাকা চলে যাবে।

জানি। আমি বোকা নই।

তবু যেতে বলছ?

 দিগিন রাগের গলায় বলেন, শুনতেই তো পাচ্ছ।

ঠিক আছে।

যদি লেবাররা গোলমাল করতে চায় তা হলে কী করবে?

কিছু ঠিক করতে পারছি না।

ব্যাঙ্ক আওয়ার্সের পরে রওনা হোয়ো। টাকা নিয়ে গিয়ে প্রথম লেবার পেমেন্ট করবে। আমাদের ওয়ার্ক অর্ডার এখনও ক্যানসেল করেনি, সুতরাং বাকিটা করতে ঝামেলা হবে না। আমি চেক লিখে রাখছি।

শানু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা।

মনে রেখো লেবার পেমেন্ট সবার আগে।

আচ্ছা।

আর সোপস্টোনের ব্যাপারটা তোমাকে ছেড়ে দিতে বলেছি। তুমি কিছু ভেবেছ?

অনেক টাকা ইনভেস্ট করেছি।

তবু ছেড়ে দাও।

এটাতে তোমার টাকা ছাড়াও পার্টনারদের টাকা আছে। তারা কী বলবে?

কী বলবে? যদি সন্দেহ করে তবে পার্টনাররা ইনিশিয়েটিভ নিক। তুমি ওটাতে আর টাকা ঢেলো না। ভুটান গভর্নমেন্ট দর কমাবে না।

ভেবে দেখি!

দেখো! আর শোননা, যদি ময়নাকে তোমার কাকিমা বলে ডাকতে ইচ্ছে হয় তো ডেকো। কিন্তু ওকে তোমার স্বার্থে জড়িয়ো না।

শানু মুখটা তুলেই নামিয়ে নেয়।

দিগিন বলেন, বুঝেছ?

শানু মাথা নাড়ল। বুঝেছে।

 ময়না আমাকে সবই বলেছে। কিছু গোপন করেনি।

দিগিন উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে এক বার থমকে দাঁড়ালেন। শানুর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, কিছু বলার আছে?

শানু তার ছোটকাকাকে চেনে। ভালমানুষ, স্নেহশীল, কিন্তু তবু ছোটকাকা যা চায় সংসারে তাই শেষ পর্যন্ত হয়। কখনও ঈশ্বর, কখনও শয়তান এই মানুষটাকে শানু খুব ভাল করে চেনে, আবার আদৌ চেনেও না। শানু তাই স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ বলে, তুমি যা চাও তাই তো হয় ছোটকাকা।

তাই হবে।

শানু শ্বাস ফেলে বলে, আমি প্রতিবাদ করছি না।

আমিও অবিহিত কিছু করছি না।

কালিম্পঙে আমার যাওয়াটা তুমি বন্ধ করতে চাও কেন?

 দিগিন ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। বললেন, বুঝে দেখো।

আমি খারাপ কিছু করছি না।

তবে ময়নার আশ্রয় চেয়েছ কেন? সেখানে আমি তো যাই। আমার চোখ এড়াবে কী করে?

 শানু চুপ করে থাকে।

দিগিন শান্ত গলায় বলেন, তুমি ভেবেছিলে তোমার ছোটকাকা যখন ময়নার সঙ্গে একটা অবৈধ সম্পর্ক রেখেছে তখন নিজের দুর্বলতাবশত তোমার যে-কোনও ভাগিয়ে আনা মেয়েকেও সহ্য করবে?

শানু চুপ।

বলো, তাই ভেবেছিলে?

না।

 তবে ময়নার কাছে তাকে রাখতে চেয়েছিলে কোন সাহসে?

আমি তোমাকে যথাসময়ে বলতাম।

না বললেও আমি জেনেছি। বলে রাখছি, তা হবে না।

 ঠিক আছে।— বলে শানু মুখ ফিরিয়ে নেয়।

দিগিন বলেন, কী ঠিক আছে? স্পষ্ট করে বলল।

আমি কাকিমার কাছে ওকে রাখব না।

তা হলে কোথায় রাখবে?

অন্য কোথাও।

রাখবেই?

শানু চুপ করে থাকে।

 দিগিন আস্তে করে বলেন, না।

শানু তাকায়। বলে, উপায় নেই ছোটকাকা।

 দিগিন উত্তেজনাটা রাশ টেনে ধরেন। বলেন, তুমি কাল যাচ্ছ কি না?

যাচ্ছি তো বললাম।

দিগিন মাথা নাড়েন। বলেন, কালিম্পঙ আর এম-ই-এস-এর কাজ আমি দেখব। ঠিক আছে?

 শানু মৃদুস্বরে বলে, কিন্তু কালিম্পঙে তুমি যে জন্যে যাচ্ছ তা হবে না।

কী জন্যে যাচ্ছি তা বুঝলে কী করে?

বুঝেছি। তুমি গোলমাল কোরো না। লাভ হবে না।

 দিগিন হাসেন, বলেন, শানু, দিগিন চ্যাটার্জি এখনও বহুকাল বাঁচবে।

শানু উত্তর দিল না।

দিগিন ধীরে ধীরে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তার ঘরে চলে আসেন। একটু ঠান্ডা পড়েছে আজ। একটা চাদর নিয়ে বিছানায় যাওয়ার আগে বিয়ার দিয়ে দুটো ঘুমের বড়ি খেলেন। বাতি নিভিয়ে কাচের শাসি দিয়ে চেয়ে রইলেন উত্তরদিকে। পাহাড় মুছে গেছে। একটা অদ্ভুত জ্যোৎস্না উঠেছে। কুয়াশার আবছায় ড়ুবে আছে শহর। নেশাটা আজ ধরছে না তেমন। তবু হাই উঠছে। ঘুম পাচ্ছে। তবু ঘুমোতে ইচ্ছে করে না। সংসারে কিছুই তার নয়। তবু সবই তাকে কেন যে ভাবতে হয়।

ঘুমচোখেই দুটো চেক লিখলেন দিগিন। একটা পুন্নির বাবার নামে। অন্যটা চ্যাটার্জি কনস্ট্রাকশনের শান্তি চ্যাটার্জির নামে। চেক দুটো সই করে রেখে দিলেন টেবিলে। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।

ভোরবেলা একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন তিনি। সেবকের করোনেশন ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। পায়ের নীচে, বহু নীচে তিস্তা। তিস্তার দু’ধারে খাড়া পাহাড় দুটোকে আঁকড়ে ধরে ঝুলছে বিখ্যাত করোনেশন ব্রিজ। হঠাৎ দেখেন একটু দুরে দুই পাহাড় থেকে কে যেন একটা দোলনা দুলিয়েছে। সেই দোলনায় স্কুল খাচ্ছে একটা লোক। লোকটা চেনা। বহুকাল আগে শিলিগুড়িতে যখন প্রথম এসেছিলেন তখনকার চেনা। ফটিক লাহিড়ি। লাহিড়ি দোল খাচ্ছে, আর ভয়ে চিৎকার করছে। দিগিন হাতের রাইফেল তুলে লাহিড়িকে একবার নিশানা করে গুলি করলেন। ফসকাল, দিগিন আবার নিশানা স্থির করেন.পর পর কয়েকটা গুলি করেন দিগিন। লাগল না, কিন্তু লাহিড়ি চিৎকার করতে লাগল।

ঘুম ভেঙে যায় অস্বস্তির সঙ্গে। শুনতে পান দল্লীর মা চেঁচিয়ে সুর করে গাইছে, ও স্বামী তুই মর, ও স্বামী তুই মর। বোধ হয় মাথাটা আবার গরম হয়েছে। সারা দিনই হাসে, কাঁদে, গায়। দীর বাপ চিৎকার করে ধমকাল। অশান্তি। সংসার জিনিসটার রহস্য কখনও বোঝেননি দিগিন। ঘুমভাঙা চোখে তিনি একটু অবাক হয়ে হঠাৎ ফটিক লাহিড়ির কথা ভাবলেন। লাহিড়িকে স্বপ্নে দেখার কোনও মানেই হয় না। বহুকাল আগে লাহিড়ি মারা গেছে, গুলি খেয়ে নয়, সাধারণ কতগুলো রোগে ভুগে। তাকে এতকাল পরে স্বপ্নে দেখার মানে কী?

.

রাতে ভাল ঘুম হয়নি। সেই যে লাহিড়িকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভাঙল তারপর থেকে দিগিন জেগেই ছিলেন। সকালে পুন্নি যখন চা করতে এল তখন দিগিন উত্তরমুখো ইজিচেয়ারে বসে নিজের পায়ের পাতার ফাঁক দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছেন। চোখে কটকট করে আলো লাগছে।

পায়ের পাতায় কাঞ্চনজঙ্ঘা ঢেকে দিগিন বলেন, আমার চায়ে দুধ-চিনি দিস না।

কেন?

লিকার খাব।

পুন্নি তা-ই এনে দেয়।

 দিগিন চায়ের লিকাবে খানিকটা হুইস্কি মিশিয়ে খেলেন। চুরুট ধরিয়ে নিলেন। শরীরটা ভাল নেই। কালিম্পং যেতে তার মোটেই ইচ্ছে করছে না। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।

কুষ্ঠিত পায়ে শানু এল। পরনে বাইরে যাওয়ার পোশাক। মুখটা একটু শুকনো।

ছোটকাকা।

উ।

ঘুমোচ্ছ?

না।

আমি জলঢাকা যাচ্ছি।

 কেন?

তুমি বললে যে।

 ও।

 যাচ্ছি।

 যাবে? যাও।

চেকটা লিখে রেখেছ?

হ্যাঁ। টেবিলের ওপর আছে। নিয়ে যাও।

শানু টেবিলের কাছে যায়। চেকটা নেয়। দিগিন ক্লান্তভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে চেয়ে থাকেন। চেকটা আজ ক্যাশ হয়ে যাবে, তারপর যা থাকবে তা ক্যাশ করে নেবে পুন্নির বাবা। তারপরও কিছু থাকবে। কিন্তু সে খুব বেশি কিছু নয়।

সেভিংস অ্যাকাউন্টের চেক। এত টাকার চেক কি বিনা নোটিশে কাশ করবে?–শানু জিজ্ঞেস করে।

দিগিন বুঝতে পারেন ভুল করে সেভিংসের চেক সই করেছেন কাল, আজকাল বড় ভুলভাল হচ্ছে।

ভ্রু কুঁচকে বললেন, করবো ভটচাকে একটা পার্সোনাল চিঠি লিখে দিচ্ছি। প্যাডটা দে আর কলমটা।

শানু প্যাড এনে দেয়। দিগিন খসখস করে দু লাইন লিখে দেন। শানু চলে যেতেই আবার ক্লান্তভাবে বসে থাকেন। সামনে আজ স্পষ্ট ও পরিষ্কার কাঞ্চনজঙ্ঘা। বরফাচ্ছন্ন, নিঃশব্দ, ভয়াল, ভয়ংকর। দিগিন চেয়েই থাকেন। কত বছর ধরে তিনি হিমালয়কে দেখেছেন আর দেখেছেন। ওই নিস্তব্ধতা কত বার তাকে কাছে টেনেছে। আজ যেন হিমালয় ছেড়ে তার কাছেই চলে আসছে। তুষারশুভ্র নিস্তব্ধতা। তিনি অপলক চেয়ে থাকেন পাহাড়ের দিকে।

কাল রাতে কেন ফটিক লাহিড়িকে স্বপ্ন দেখলেন তিনি? কোনও মাথামুণ্ডু নেই। তার জীবনের সঙ্গে ফটিক লাহিড়ির কোনও যোগাযোগ নেই।

পুনির বাপকে ডেকে পাঠালেন।

পুন্নির বাবা এসে দাঁড়াতে তেমনি ভটচাযকে দু’লাইনের চিঠি সমেত চেকটা দিয়ে বললেন, এটা আজই ক্যাশ করবেন।

চেকটা দেখে পুন্নির বাবা অবাক হয়ে বলেন, এখনই কেন?

আমি কালিম্পং যাচ্ছি আজই। বেশ কিছুদিন থাকব না। যদি ছেলের বাবা আসে তবে টাকাটা যে-কোনও অজুহাতে শো করবেন!

পুন্নির বাবা মাথা চুলকোন! অনিচ্ছুকভাবে বলেন, আচ্ছা।

দিগিন আর কোনও দিকে মনোযোগ দেন না। বেশ কিছুদিন থাকব না, এ কথাটা তিনি কেন বললেন? কালিম্পঙে তার তো থাকার কথা নয়! পুন্নির বাবা চলে যান। দিগিন সবিস্ময়ে আবার কাঞ্চনজঙ্ঘার নিস্তব্ধতার দিকে চেয়ে থাকেন। কালিম্পঙে যদি যেতে হয় তবে এক্ষুনি তোড়জোড় করা দরকার। জিনিসপত্র গোছাতে হবে, জিপটা রেডি রাখতে হবে, দু-চার জায়গায় দেখা করেও যেতে হবে। কিন্তু সেসব জরুরি কা পড়ে থাকে। দিগিন পুন্নিকে ডেকে এক কাপ চা করতে বলে বসে থাকেন চুপচাপ। ফটিক লাহিড়ির কথা অকারণে কেন যে মনে হচ্ছে। সরু মাদ্রাজি চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধের মধ্যে বসে থাকেন দিগিন। সামনে সোনালি সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর নীল আকাশ।

.

টাকা–এই শব্দটাই অদ্ভুত। মানুষের ভিতরে ওই শব্দটা ঢুকে গেলেই টরেটক্কা বেজে উঠতে থাকে, মানুষ আর মানুষ থাকে না।

মোটর-সাইকেলটার একটা পিন ভেঙেছে। পাঁচ-দশ টাকার মামলা। অমর সিংয়ের গ্যারেজে সারাতে দিয়ে দিগিন রাস্তায় পায়চারি করেন। মিস্ত্রিটা উঠে এসে বলল, একটু সময় লাগবে। আপনি চলে যান না, সারিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

দিগিন লোক চেনেন। চোখের আড়াল হলেই ওদের জো। তখন পিন-এর সঙ্গে এটা ভেঙেছে, ওটা পুরনো হয়েছে, সেটা পালটানো দরকার বলে নানারকম সারাইয়ের ফিরিস্তি দিয়ে বিল পাঠাবে বাড়িতে।

দিগিন মাথা নেড়ে বললেন, না রে, জেলখানায় ঢালাইয়ের কাজ হবে, এক্ষুনি যাওয়া দরকার।

উত্তর দিকে চেয়ে একটু দাঁড়িয়ে থাকেন দিগিন, শরতের মেঘকাটা আকাশ। বর্ষার জলে বাতাসের ধুলোকণা ধুয়ে গেছে। পরিষ্কার আকাশ দেখা যায়, আর ঝকঝকে পাহাড়। সামনের পাহাড়ের রং মোষের গায়ের মতো ভুষকো, তার পিছনে রুপোর কাঞ্চনজঙ্ঘা। ডান দিকে আরও কয়েকটা রুপোলি চূড়া, কত বছর ধরে দেখছেন, তবু পুরনো হয় না।

উত্তরবাংলার কিছুই পুরনো হয় না। তবু কিছু কিছু হারিয়ে গেছে মানুষের অবিমৃশ্যকারিতায়। ন্যারোগেজের একটা লাইন ছিল কালিম্পঙের দিকে, নদীর ধার দিয়ে, পাহাড়ের কোলে কোলে যেত ছোট্ট রেলগাড়ি গেইলখোলা পর্যন্ত। দার্জিলিঙের মতো অত চড়াই-উতরাই ছিল না, ছিল না। অত রিভার্স আর লুপ। মায়াবী মাঠ প্রান্তর, ছোট ঘোট কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়, নদীর খাত বেয়ে সেই ছোট ট্রেন বয়ে আনত সিকিমের কমলালেবু, কাঠ, আপেল। সেই লাইন নাকি তেমন লাভজনক হচ্ছিল না, তাই রেল কোম্পানি লাইন তুলে দিল। ওই স্বপ্নের রেলগাড়ি উঠে যাওয়ার পর বহুকাল দিগিনের মন খারাপ ছিল। মংপু বা কালিম্পঙে যেতে হলে বরাবর ওই ট্রেনে চেপে যেতেন দিগিন। রিয়াত স্টেশন থেকে একটা রোপওয়ে ছিল। সেই রোপওয়ে দিয়ে মাল এবং মানুষ দুই-ই যেত। দিগিনও গেছেন। আর যাওয়া যেত খচ্চরের পিঠে। তখনও কালিম্পঙে মোটর গাড়ির রাস্তা হয়নি। কিছুক্ষণ যেন রূপকথার রাজ্যে থেকে আসতেন। মাঝপথে একটা স্টেশন ছিল, নামটা মনে পড়ছে না, বহুকাল হল উঠে গেছে। এক দুপুরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছে, দিগিন চা খেতে নামলেন। তখন যৌবন বয়স। প্লাটফর্মের গায়ে প্রচণ্ড কৃষ্ণচূড়া ফুটেছে। ছোট্ট কাঠের স্টেশন ঘর, চারদিকে। খেলনা-খেলনা ভাব, ছোট লাইন, ছোট সিগন্যাল, ছোট নিচু প্লাটফর্ম। তার চারদিকে সেই খেলাঘরের স্টেশন, ডান দিকে নদীর খাত, দু’ধারে পাহাড়ের বিশাল ঢাল। দিগিন চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন, দেখলেন কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে। আড়াই কি তিন বছর বয়স, গোলগাল চেহারা, শীতের চিমটিতে গালদুটো লাল, ফাটা গা, শীতের সোয়েটার গায়ে, পরনে প্যান্ট। কিন্তু দুষ্টু ছেলে সোয়েটার টেনে তুলে ফেলেছে বুকের ওপর, পেটটা উদোম। দু’ মুঠিতে কিছু কঁাকর আর ধুলো কুড়িয়ে নিয়েছিল। তারপর হঠাৎ খেলা ভুলে চেয়ে আছে দুরের দিকে। দুই পাহাড়ের মাঝখানের খাত বেয়ে গর্জে চলেছে দুরন্ত ফেনিল তিস্তা, তার দুরন্ত শব্দ গমগম করে প্রতিধ্বনি হয়ে আসছে, কাজলপরা দুই চোখে শিশু হা করে দেখছে, কতকাল আগেকার সেই দৃশ্য, আজও ভোলেননি দিগিন। বড় মায়া ঘনিয়ে উঠেছিল বুকে, সেই শিশুটির ধারেকাছে কেউ ছিল না। একা। খেলতে খেলতে খেলা ভুলে একা মুগ্ধ-বিস্মিত চোখে দেখছে, দিগিন হাতের কাপে চুমুক দিতে ভুলে গেলেন, গাড়ির হুইসল যতক্ষণ না বাজল ততক্ষণ ভিখিরির মতো, কাঙালচোখে চেয়ে রইলেন তার দিকে। কোলে নেননি, আদর করেননি। কিন্তু আজও এত বছর পরেও প্রায়ই যখন মনে পড়ে, তখন কত আদর যে করেন। সে কত বড় হয়েছে। এখন, সংসারীও হয়নি কি! কিন্তু সে-সব মনে হয় না। কেবল দিগিনের মনের মধ্যে শিশুটি আজও অবিকল ওই কয়েক মুহূর্তের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, দু’হাতে দু’মুঠো ধুলো, আদুড় পেট, চোখ লেপটানো কাজল, আর তাব চারধারে বিশাল পাহাড়, গতিময় প্রচণ্ড নদী, তার শব্দ, একা সে দাঁড়িয়ে।

চোখে কেন জল আসে! দৃশ্যটা ভাবলেই আসে, অথচ করুণ দৃশ্য তো নয়। তবে বুঝি সৌন্দর্য জিনিসটাই ও রকম, বুক ব্যথিয়ে তোলে। না কি শিশুটি নাড়া দেয় অক্ষম পিতৃত্বকে? কী হয়, কে জানে! একটা কিছু হয়। নিজের সঙ্গে মিল খুঁজে পান নাকি। পৃথিবীর অঢেল সম্পদ নিজের জন্যে খেলার ছলে আহরণ করতে করতে তিনি নিজেও কি মাঝে মাঝে খেলা ভুলে চেয়ে থাকেন না কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে!

সেই লাইন নেই, গাড়ি চলে না, স্টেশন কবে উঠে গেছে। তবু রয়ে গেছে একটি বীজ! কবে যেন অতীতের বাতাসে খসে পড়েছিল দিগিনের হৃদয়ে। আজ বয়সের বর্ষা পেয়ে ডালপালা ছড়িয়েছে, দৃশ্যটা ভোলেননি দিগিন।

দিগিনের পাশ দিয়ে একটা জিপগাড়ি চলে যেতে যেতে থামল। দিগিন মুখ তুলে দেখলেন, তারই জিপ, শানুই এখন এটা ব্যবহার করে। ড্রাইভার রমণীমোহন গাড়িটা সাইড করিয়ে রাখল। জিপের পিছন থেকে কপিল নেমে এল।

কালো বেঁটে এবং মজবুত চেহারা কপিলের, চোখে ধূর্তামি, মুখে একটি নির্বিকার শয়তানি ভাব, বহুকাল কপিল দিগিনের কারবারে আছে।

কপিল দিগিনকে জানে। দিগিনও কপিলকে জানেন। এই জানাজানির ব্যাপারটা বহুকাল ধরে হয়ে আসছে, আজও শেষ হয়নি।

শিলিগুড়ির তল্লাটে কপিলের নাম কীর্তনিয়া বলে। ভালই গায়। বিভোরতা আছে, ভক্তিভাব আছে। অবরে সবরে গাঁ-গঞ্জ থানা থেকে তার ডাক আসে। ছোট মাপে সেও নামজাদা লোক। নিজের সেই মর্যাদা সম্পর্কে সে সচেতনও। মুখখানা সবসময়েই গম্ভীর হাসিহীন। কথাটথা কমই বলে। একমাত্র দিগিন ছাড়া সে আর কারও বড় বাধ্য নয়। শানু ওকে সামলাতে পারে না, প্রায়ই দিগিনকে এসে বলে, তোমার কপিলকে নিয়ে আর পারা যায় না, ওকে তাড়াও।

দিগিন তাড়ান না।

সে আজকের কথা তো নয়। তখন সাহেবদের আমল। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনে পুরনো আমলের ব্রডগেজের দার্জিলিং মেল এসে থামত সকালবেলায়। সাহেবদের বড় প্রিয় ছিল দার্জিলিং। ফার্স্ট ক্লাস বোঝাই লাল রাঙা সাহেবরা নামত কুকুর, মেমসাহেব আর নধর বাচ্চাদের নিয়ে। সরাবজির জাল-ঢাকা চমৎকার রেস্টুরেন্টে বসে ব্রেকফাস্ট খেত। তারপর দার্জিলিঙের ছোট গাড়িতে উঠত। টাউন স্টেশন তখন ঝকঝক করত। এখনকার মতো পাঁজরা-সার হায়-হতভাগা চেহারা ছিল না। কপিল ছিল সেই সময়কার টি-আই সাহেবের সেলুন বেয়ারা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান টি-আই সাহেব লোেক খারাপ ছিল না, কিন্তু কপিলটা ছিল হাড়-হারামজাদা। সরাবজি থেকে সাহেবের নাম করে দু’ বোতল বিলিতি হুইস্কি হাতিয়েছিল, তাই চাকরি যায়। চাকরি যাওয়ার পর কিছুকাল বড় কষ্টে গেছে। সেই কষ্টের দিনে একটামাত্র মেয়ে মল্লিকাকে রেখে কপিলের বউ মরল। মল্লিকা তখন দু-আড়াই বছরের, মা-মরা একলা, কপিল সেই মেয়ে রেখে কোথাও যেতে পারত না। পায়খানা পেচ্ছাপের সময়েও মেয়েকে কোলে নিয়ে গিয়ে বসত। আবার বিয়ে করবে তেমন। মুরোদ নেই, নিজেরই তখন প্রায় ভিক্ষে-সিক্ষে করে চলছে।

তখন দিগিনের বাড়ি আসত। ঘরদোর সাফ-সুতরো করত, পয়সাকড়ি হাতাত, ফাঁক পেলে চুরি করে দিগিনের বোতল ফঁাক করত। এখন দিগিনের বাড়িতে যেখানে বড়দাদা পাকা বাড়ি তুলেছে সেখানে কপিল একদা চমৎকার একটা বাগান করেছিল, মল্লিকাফুল যে আসলে বেলফুল তা কপিলই শিখিয়েছিল দিগিনকে, কপিলের জন্য দিগিনের মায়াদয়া তেমন ছিল না, ছিল ওই মেয়েটার জন্য। ট্যাপাটোপা দেখতে ছিল মেয়েটা, বাপ দিগিনের বাগান করত, মেয়েটা বাপের কোপানো জমির মাটির ঢেলা ছোট দুই হাতে চৌরস করত দিনভর রোদে বসে। বাপ ঘর ঝাট দিচ্ছে তো সেও একটা ন্যাতা বুলিয়ে কাঠের মেঝে মুছতে লাগত নিজের মতো করে। বদলে বাপ-বেটিতে পেটভরে ভাত খেত দুপুরে, রাতের ভাত গামছায় বেঁধে নিয়ে যেত। তখন মাঝে-মাঝে রাঁধতও কপিল, মুরগির ঝোল, ডিমের ডালনা, খিচুড়ি।

মেয়েটাই ছিল কপিলের জীবনসর্বস্ব। মেয়ে কঁাধে সর্বত্র চলে যেত সে। কাছছাড়া করত না। গ্রামগঞ্জে মেয়ে সঙ্গে করেই কীর্তন করে বেড়াত। বাপের গায়ের গন্ধে, শরীরের ছায়ায় মেয়েটা পাঁচ বছর পর্যন্ত বেড়ে উঠল। তারপর ধরল ম্যালেরিয়ায়। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার এক ধাক্কায় নিভে গেল মেয়েটা। মেয়ে-হারা বাপ সক্কালবেলায় কারও কাছে না গিয়ে খবরটা দিতে এল দিগিনকে। ডাকেনি, শব্দ করেনি। দিগিন তখনও ওঠেননি ঘুম থেকে, শেষরাতে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল টংগি ঘরের বারান্দায়। শিলিগুড়ির সেই দুর্দান্ত শীতে গায়ে গেঞ্জির ওপর কেবলমাত্র চ্যাটার্জি সাহেবের বুড়ি পিসি কীর্তন শুনে মরার আগে যে নামাবলীটা দান করে গিয়েছিলেন কপিলকে, সেইটে জড়াননা। দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। বাক্যহারা, বোধবুদ্ধি নেই, কেবল ঢোক গিলছে আর থুথু ফেলছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা আর কীর্তনের দলের বন্ধুরা মেয়েটাকে নিয়ে গেছে শ্মশানে। এই সময়টায় সারা দুনিয়ার মধ্যে কপিল কেবল দিগিনকে মনে রেখে তারই কাছে চলে এসেছিল।

আজও কপিলের দিকে তাকালে সেই কপিলকে দেখতে পান দিগিন, শানু তাড়াতে বলে, তাড়ানো কি সোজা? সেই মেয়ে-হারা বাপটিকে আজও দিগিন মনের কপাট খুললেই দেখতে পান যে।

দিগিন জানেন, কপিল লোেক ভাল নয়। চুরি-চামারি তো আছেই, চরিত্রের অন্য দোষও আছে। মেয়ে মরার পর কপিলকে নিজের কারবারে রাখলেন দিগিন। নানা রকম কনস্ট্রাকশনের কাজে বহু হাজার টাকার মালপত্র এখানে-সেখানে পড়ে থাকে। সে-সব পাহারা দেওয়ার জন্য চৌকিদার রাখতে হয়। সে আমলে নেপালিরাই এই কাজ করে বেড়াত। দিগিনেরও কয়েকজন নেপালি চৌকিদার ছিল। তাদের দলে কপিলকে ভিড়িয়ে নিলেন, কাঙালকে শাকের খেত দেখিয়ে দেওয়া হল। কৃতজ্ঞতাবোধ কিছু কমই ছিল কপিলের। রড, সিমেন্ট, কাঠ, রং, সে কিছু কম চুরি করেনি। তবু দিগিনের প্রতি তার একরকম আনুগত্য আর ভালবাসা আছে। জিনিস না-বেচলে তার চলত না। ধরলে টপ করে স্বীকার করত।

নেপালি আর ভূটিয়ার মিশ্রণে দো-আঁশলা একটা লোক এক বার একটা চায়ের দোকান করেছিল মহানন্দা ব্রিজের উত্তরে। খুবই রহস্যময় দোকান। লোকটার এক ছুকরি বউ ছিল, নাম ছিপকি। দু’ গালে অজস্র ব্রণ, রোগাটে চেহারা। অনাহার এবং অর্ধাহারের গভীর চিহ্ন ছিল চোখের কোলে, গালে। রহস্যময় সেই দোকানের সামনের দিকে সেই দো-আঁশলা লোকটা রুটি, চা, বিস্কুট এবং ডিম বেচত। আর পিছনের খুপরিতে বিক্রি হত ছিপকি আর চোলাই। সঙ্গে মেটে চচ্চড়ি কি তেলেভাজা। একটু নিচু শ্রেণির মানুষেরাই ছিল সেই দোকানের খদ্দের। সন্ধেবেলা বেশ ভিড় হত। ছিপকি তার স্বামীর সঙ্গে সামনের দোকান সামলাত, চোখে কাজল, চুল খোঁপা করে বাঁধা, হাতে কাচের চুড়ি, রঙিন সস্তা শাড়ি পরনে, খুব হাসত আর চোখ হানত। ভিতরের ঘর থেকে মাতালদের স্খলিত গলার নানান শব্দ আসত। ছিপকির স্বামী মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে নোংরা পরদার আড়ালে চোলাইয়ের খদ্দেরদের পরিচর্যা করে আসত। লোকটা ছিল আধবুড়ো, খুব গম্ভীর, দার্শনিকের মতো মস্ত কপাল ছিল তার। একসময়ে মিলিটারির ল্যান্সনায়েক ছিল বলে শোনা যায়। মিলিটারির মতোই আবেগহীন স্বভাব ছিল তার। পরনে চাপা পাজামা গায়ে কোমরের বহু ভাঁজের কাপড়ের বন্ধনীতে গোঁজা থাকত কুরি। নেপালিরা কোমরে যে চওড়া করে কাপড়ের বন্ধনী বাঁধে তার একটা কারণ পেটটাকে গরম রাখা। পাহাড়ি অঞ্চলে পেটে ঠান্ডা লেগে এক রকমের হিল-ডায়েরিয়া হয়, সহজে সারে না। দিগিনও পাহাড়ে গেলে কোমরে পেট ঢাকা কাপড় বাঁধতেন নেপালিদের দেখাদেখি।

মাতাল আর চা-পিপাসুদের সকলেই ছিপকিকে চাইত। কিন্তু সকলের পকেটে তো পয়সা নেই। যাদের আছে তারা একটু বেশি রাতের দিকে ছিপকির স্বামীর সঙ্গে দরদস্তুর ঠিক করে নিত। পিছনের খুপরিতে চলে যেত ছিকিকে নিয়ে। সামনের দোকানটায় লোকটা নির্বিকার বসে থাকত। তার সামনে উনুনে চায়ের জল ফুটছে, একটা ঘেয়ো কুকুর বসে আছে দোরগোড়ায়। সামনে অন্ধকার, নদীর জল ছুঁয়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এই রকমই ছিল লোকটা।

কপিল সেখান থেকে গরমি রোগ নিয়ে আসে। দিগিন তাকে দু’বার চিকিৎসা করে ভাল করলেন। অবশ্য চিকিৎসার খুব সুবিধে হয়ে গেছে আজকাল। সিফিলিসের অমোঘ ওষুধ পেনিসিলিনে বাজার ছাওয়া। কিন্তু দিগিন সেটুকু করে ক্ষান্ত হননি। মহানন্দা পূলের কাছে ওই দোকানটা যেতে-আসতে চোখে পড়ত, ভিড় দেখতেন, ছিপকিকেও দু-চারবার লক্ষ করেছেন, কপিলকে যেখানে প্রায়ই দেখা যেত।

একদিন শীতকালে শালবাড়ি থেকে ফেরার পথে জিপ থামালেন। হাড় ভেঙে যাচ্ছে উত্তরে বাতাসে। অন্তত চার-পাঁচ পেগ নিট হুইস্কি ছিল পেটে। মেজাজটা দুরন্ত ছিল। সোজা দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী পাওয়া যায়?

সে রাতে ছিপকির বোধ হয় খদ্দের জোটেনি। সাজগোজ করে একটা ভুটিয়া ফুলহাতা মেয়েলি সোয়েটার পরে ঘোমটায় কান-মুখ ঢেকে আগুন পোহাচ্ছিল। লোকটা একটা ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ কুচিয়ে রাখছে। দু-চার জন চায়ের খদ্দের বসে হাঁ করে ছিপকিকে দেখছিল, বিনা পয়সায় বিনা বাধায় যতটা দেখা যায়। ইয়ার্কি-টিয়ার্কিও বোধ হয় করছিল, কারণ দিগিন যখন ঢোকেন তখন ছিপকি একজনের দিকে চেয়ে হাসছিল। দিগিন দেখলেন মেয়েটির হাসি বড় চমৎকার। মুখটা পালটে যায়। কিশোরীর মতো সরলহৃদয়া হয়ে ওঠে। দিগিনকে অনেকে চেনে, দোকানে ঢোকা মাত্র খদ্দেরদের কয়েকজন পয়সা দিয়ে পালিয়ে গেল। এক-আধজন যারা বসে ছিল তারাও গরম চা হুস হাস করে মেরে দিয়ে উঠে গেলে ছিপকির চোখে একটু বিস্ময় ফুটে উঠেছিল, সামনে জিপ দাঁড়িয়ে, দিগিনের মতো সুপুরুষ চেহারার মানুষ, লোকটার চারদিকে যেন টাকা আলো দিচ্ছে, এ মানুষ এখানে কেন?

ছিপকির স্বামীর সে-সব নেই। দিগিন জিজ্ঞেস করলেন দ্বিতীয়বার, কী পাওয়া যায় এখানে?

লোকটা উনুন থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে নির্বিকার গলায় বলে, চা, রুটি, ডিম।

 আর কিছু না?

 লোকটা দিগিনের দিকে তাকাল না। মাথা নাড়ল। না।

দিগিনের পেটে হুইস্কিটা তখন কাজ করছে, হাতের দস্তানা দুটো খুলে রেখে বেঞ্চে বসে বললেন, মাংস পাওয়া যায় না? মেয়েমানুষের মাংস?

লোকটা ভয় খেয়েছিল ঠিকই। জিপটা দাঁড়িয়ে, দিগিনের চেহারাটাও তার ভাল ঠেকছিল না। তবু বিনয়হীন গলায় বলে, ও সব এখানে হয় না।

দিগিন ছিপকির দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার জিজ্ঞেস করলেন, দর কত?

 ছিপকি একটু দিশাহাবা হয়ে গেল। তার জীবনে এত বড় খদ্দের সে কখনও পায়নি। তাই স্বামীর দিকে চেয়ে নেপালিতে বলল, লোকটা কী বলছে শুনছ?

দিগিন দস্তানাটা টেবিলের ওপর ফটাস করে একবার আছড়ে বললেন, কুড়ি টাকা?

তখন টাকার দাম যথেষ্ট। অত টাকা কেউ দেয় না ছিপকিকে। মেয়েটা দিগিনের দিকে একবার চেয়ে স্বামীর কাছে গিয়ে নিচু স্বরে কী বলল।

 দিগিন গরম খেয়ে বললেন, পঞ্চাশ টাকা!

বলেই কোটের ভিতর-পকেট থেকে অন্তত সাত-আটশো টাকার একটা গোছা বের করে প্রকাশ্যে পাঁচখানা দশ টাকার নোট গুনে বের করে নিলেন। লোকটা আড়চোখে দেখল, ছিপকি তার কঁধ খামচে ধরে ঝাকুনি দিয়ে অস্ফুট গলায় কী যেন বলে। এত টাকা দেখে সে পাগল হয়ে গেছে। ছোটলোক, দুর্গন্ধযুক্ত, মাতাল এবং নীচ স্বভাবের লোকদের সঙ্গ করে সে ক্লান্ত। সেই মুহূর্তেই সে যেন সেই ক্লান্তিটা টের পেল। নতুন লোকটা তার কাছে শীতরাতে যেন স্বর্গ থেকে খসে-পড়া দেবদূত।

লোকটা উঠে গিয়ে ভিতরের ঘরের নোংরা পরদাটা কেবল তুলে যোবা হয়ে রইল। এক হাতে পরদা ধরা, অন্য হাতটা বাড়ানো। সেই বাড়ানো হাতে দিগিন টাকার নোটগুলো গুঁজে দিলেন।

ভিতরের খুপরিতে লণ্ঠন জ্বালা আলোয় ছিপকির দিকে তাকিয়ে তার প্রথম যে কথাটা মনে হল, এ হচ্ছে কপিলের মেয়েছেলে। চোর, হাভাতে ঘোটলোক কপিল।

দিগিন বিছানায় বসেছিলেন, গা ঘেঁষে ছিপকি, কাধে হাত। মুখে অদ্ভুত উত্তেজিত হাসি! সে জানে তার বাজার ভাল। কিন্তু এতটা ভাল তা সে কল্পনা করেনি। সে মুগ্ধ চোখে চেয়ে দিগিনের মুখের ওপরেই শ্বাস ফেলল। নিজের গালে আঙুল বুলিয়ে বলল, এ সব কিন্তু গরমি নয়। ব্রণ। আমি খারাপ লোকের সঙ্গে দোস্তি করি না।

দিগিন ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে চুরুট টানছিলেন। মেয়েটা ঘাড়ের ওপর হামলে পড়ে আছে। পঞ্চাশ টাকায় কেনা মেয়েছেলে, যা খুশি করতে পারেন। তবু এই মেয়েটা কপিলের এঁটো, কিংবা কপিলই এই মেয়েটার উচ্ছিষ্ট?

মেয়েটাকে এক ঝটকায় টেনে সামনে দাঁড় করালেন দিগিন। লণ্ঠনের আলোয় চেয়ে রইলেন ওর দিকে। শরীরে সীমাবদ্ধ মেয়েমানুষ। নদীর মতো, সবাই স্নান করে যায়। গহিন চুলের মস্ত খোঁপা, রোগা চেহারা, সর্বশরীরে চামড়ার ওপর খসখসে ভাব। গলার চামড়ার ভাজে ময়লা বা পাউডার জমে আছে।

নেপালিতে বললেন, ও লোকটা তোর কে হয়?

মেয়েটা লাজুক হেসে বলল, সঙ্গে থাকে।

স্বামী?

 ছিপকি মুখ ভ্যাঙাল।

দেখি তোর হাত।-বলে দিগিন ওর হাত টেনে নিবিষ্ট মনে ওর হস্তরেখা দেখলেন। ভ্রু কুঁচকে, কপালে ভাঁজ ফেলে অনেকক্ষণ ধরে দেখে-টেখে বললেন, দূর! তুই এখানে পড়ে আছিস কেন? তোর ভাগ্য তো খুব ভাল। এখন বয়স কত?

মেয়েটা হিসেব জানে না। অবাক হয়ে বলল, কত জানি না।

দিগিন বললেন, বাইশ-তেইশ হবে। আর এক বছরের মধ্যে তোর ভাগ্য ফিরে যাবে।

সকলেরই এই দুর্বলতা থাকে, ভাগ্য বিষয়ক। মেয়েটা মাতাল দিগিনকে সঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, মাতালরা কত কাণ্ড করে। তবু হাতটা চেপে ধরে বলল, কী হবে?

তোর বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, সব লেখা আছে। এ লোকটার সঙ্গে পড়ে আছিস কেন? পালা।

এই বলে দিগিন উঠে পড়লেন। দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, তোর সঙ্গে সময় কাটাতে এসেছিলাম, কিন্তু ভয় পেয়ে গেলাম রে। তুই একদিন খুব বড় হবি তো, তাই ভয় লাগল।

দিগিন বিদায় নেওয়ার আগে আরও পঞ্চাশটা টাকা ছিপকির হাতে গোপনে দিয়ে বললেন, তোর স্বামী তোর কষ্টের টাকা সব মেরে দেয় জানি। এটা রাখ। জানি তুই যখন বড় হবি তখন এ সব দশ-বিশ-পঞ্চাশ টাকা ভিখিরিকে দিয়ে দিবি। ভাল চাস তো কালই পালিয়ে যা!

কোথায় যাব?

কোথায় যাবি!

দিগিন একটু ভাববার ভান করেন। শেষে আবার দশটা টাকা বের করে ওর হাতে দিয়ে বলেন, শালবাড়িতে চ্যাটার্জির কাঠগোলায় চলে যাস। শনিবার-মঙ্গলবার থাকি। কলকাতায় পাঠিয়ে দেব। ফিলমে নামবি? আমার দোস্ত আছে।

হিপকির চোখ-মুখ কী রকম যেন উজ্জ্বল হয়েছিল ফিলমের নামে! অনেকখানি ঘাড় হেলাল, আর ছুটে এসে বুকে পড়ে একটু আদর করেছিল দিগিনকে।

মেয়েটা বোধ হয় পালিয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করেছিল। কয়েকদিন পর তার শরীরটা এক সকালে পাওয়া গেল মহানন্দার বিশুষ্ক নদীর খাতে। একটু একটু জল চুইয়ে বয়ে যাচ্ছে নালার মতো শীতের পাহাড়ে নদী। তারই জল ছুয়ে একবুক রক্ত ঢেলেছে ছিপকি। কুকরিতে পেটটা হাঁ হয়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *