দেবত্বের কিছু নির্ভুল পরীক্ষা আছে, যেগুলো কখনো ব্যর্থ হয় না। তার মাঝ একটা হচ্ছে জাদুকর এবং বিশেষ জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তিদের গোপন ভাষা বোঝার এবং বলার ক্ষমতা। দেবতা হার্মিস, যার আরেক নাম হচ্ছে মার্কারি; এই ভাষা মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। হার্মিস হলেন বজ্রদেবতা জিউসের প্রিয় পুত্র, যিনি নিজের ছেলেকে মানবজাতির ইতিহাস এবং বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ দিয়েছেন। সেগুলোর মাঝে সবচেয়ে দরকারি কাজগুলো হচ্ছে কথা, ভাষা শিক্ষা এবং বাগ্মিতার সৃষ্টি করা। অন্যদিকে জিউস হার্মিসকে মিথ্যাবাদিতার স্রষ্টা হিসেবেও রেখেছেন, একই সাথে তিনি কথার জালে ভোলানোয় পারদর্শীও বটে। এই নানাবিধ দায়িত্বের অংশ হিসেবেই হার্মিস তৈরি করেছেন দেবতাদের ভাষা, যার নাম তিনি দিয়েছেন তেনমাস।
খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না আমাকে। বেশির ভাগ সন্ধ্যাতেই রাজপরিবারের নারী সদস্যরা অর্থাৎ তেহুতি, বেকাথা এবং সেরেনা তাদের ঘোড়া নিয়ে লম্বা সময়ের জন্য চলে যায় নদীর পাড় ধরে বেড়াতে। ট্যাগেটাস পর্বতমালার দিকে যায় তারা, অথবা দ্বীপের উত্তর তীরে সোনালি বালিতে ঢাকা বেলাভূমির দিকে। রামেসিস আর আমাকেও তাদের সাথে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয় এখন। আমার মতোই সেরেনাও আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা পানিতে বাস করা নানা প্রাণী নিয়ে দারুণভাবে আগ্রহী। পাহাড় এবং জঙ্গলে বাস করা পাখি আর জীবজন্তু নিয়েও তার আগ্রহ কম নয়। পাহাড় আর জঙ্গলে বাসা বাঁধা পাখিগুলোর ডিম সংগ্রহ করে সে, সমুদ্রতীরে ভেসে আসা শামুক এবং ঝিনুকের খোলস কুড়াতে ভালোবাসে। প্রতিটি প্রজাতিকে একটা করে কাল্পনিক নাম দিয়েছে সে, নতুন কিছু খুঁজে পেলে তার আনন্দের আর সীমা থাকে না। বেশির ভাগ সৈনিক এবং পুরুষমানুষের মতো এসব ব্যাপারে রামেসিসের খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও সেরেনা তাকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে কখনো আপত্তি করে না সে।
সেই বিশেষ দিনটায় আমরা যখন সমুদ্রতীরে গেলাম, দেখলাম জোয়ারের পানি অন্যান্য দিনের চাইতে আজ বেশি ওপরে উঠে এসেছে।
এই দেখে সেরেনা অদ্ভুত এক তত্ত্ব খাড়া করল। পোসাইডনের তৃষ্ণা আজ বেশি বেড়ে গেছে বলে নয়, বরং সূর্য আর চাঁদ আজ কোনো রহস্যময় উপায়ে একই রেখায় চলে এসেছে এবং সাগরের পানির ওপর দ্বিগুণ টান প্রয়োগ করছে। আর সে কারণেই তীরের ওপর বেশি উঠে এসেছে জোয়ারের পানি।
জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছে এমন সব শিক্ষিত মানুষের মতো আমিও খুব ভালো করেই জানি যে সূর্য আর চাঁদ প্রকৃতপক্ষে একই বস্তু। দিনের বেলায় যখন এর শক্তি পূর্ণ সীমায় অবস্থান করে তখন তা সূর্যে পরিণত হয়। আর রাতের বেলা যখন তার আগুন ফুরিয়ে যায়, নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে, তখন তাকে আমরা চাঁদ হিসেবে দেখি। এই সময় যা দেখা যায় তা আসলে তার অগ্নিময় চেহারার ছায়া মাত্র।
এই কথা বলার সাথে সাথে সেরেনা আমার কথার প্রতিবাদ করে বসল। আমি তো আকাশে চাঁদ এবং সূর্যকে একই সাথে একই সময়ে আলাদা আলাদাভাবে দেখেছি। তাহলে তারা এক হয় কীভাবে? এমনভাবে প্রশ্নটা ছুড়ল ও, যেন এই এক কথাতেই সব বিতর্কের অবসান করে ফেলেছে।
নিজের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলাম আমি, ফলে সেরেনাও একই কাজ করতে বাধ্য হলো। তোমার হাতটা মুঠি পাকাও, সেরেনা, ওকে বললাম আমি। কিন্তু কথাটা বললাম তেনমাস ভাষায়। ও যখন আমার কথা অনুযায়ী কাজ করল তখন বললাম, এবার তোমার হাতটা সূর্যের দিকে তুলে ধরো।
এই যে, এভাবে? তেনমাসেই জিজ্ঞেস করল ও। প্রতিটা শব্দ ও নিখুঁতভাবে উচ্চারণ করছে; কিন্তু নিজেই বুঝতে পারছে না যে কথাগুলো অন্য এক ভাষায় বের হচ্ছে ওর মুখ দিয়ে।
এবার তোমার পায়ের কাছে, মাটির দিকে তাকাও। কী দেখতে পাচ্ছ? প্রশ্ন করলাম আমি।
কেবল আমার নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছি, আর কিছুই না, তেনমাসে জবাব দিল ও, কিছুটা বিভ্রান্তি ফুটেছে চেহারায়।
ওই গোলাকার ছায়াটা কীসের? ঘোড়ার পিঠ থেকে একটু ঝুঁকে এসে প্রশ্ন করলাম আমি।
আমার হাতের ছায়া।
তার মানে তুমি বলতে চাইছ আমরা একই সঙ্গে তোমার হাত এবং হাতের ছায়াটা দেখতে পাচ্ছি, ঠিক যেভাবে মাঝে মাঝে সূর্য এবং তার ছায়া অর্থাৎ চাঁদকে দেখতে পাওয়া যায়? প্রশ্ন করলাম আমি। আরো তর্ক করার জন্য সুন্দর মুখটা খুলল সেরেনা, তারপর কী ভেবে বন্ধ করে ফেলল আবার। নীরবে পথ চলতে লাগলাম আমরা। অদ্ভুত হলেও সত্যি, সেদিনের পর থেকে আর চাঁদ এবং সূর্য নিয়ে কথা হয়নি আমাদের মাঝে।
তবে আমরা যখন একা থাকতাম তখন প্রায়ই তেনমাসে কথা বলতাম, যদিও সেরেনা বুঝতে পারত না যে অপরিচিত এক ভাষা ব্যবহার করছি আমরা। কাজটা করতে পেরে দারুণ খুশি হলাম আমি, কারণ এতে করে স্পষ্ট প্রমাণ মিলে গেল যে সত্যিই সেরেনা দেবত্বের অধিকারী।
*
এই পৃথিবীতে একজনই আছে, যে আমাকে এই অলৌকিক জন্মের কথা খুলে বলতে পারে। তাকে এ ব্যাপারে কীভাবে প্রশ্ন করব সেটা নিয়ে দীর্ঘ সময় চিন্তা করতে হলো আমাকে। এই নাটকের প্রধান চরিত্রের সাথে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, তা সত্ত্বেও এভাবে সরাসরি জিজ্ঞেস করার অধিকার আমার নেই। এই প্রেক্ষাপটে আমার সম্পূর্ণ বুদ্ধিমত্তা আর চালাকি কাজে লাগিয়ে সত্যি কথাটা বের করতে হবে, এমন কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না যাতে পরে বিপদ হতে পারে। একবার এমনকি এটাও ভাবলাম যে, সত্যি কথাটা খুঁচিয়ে বের করার কোনো দরকার নেই। আমি শুধু এটাই পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই যে, ব্যাপারটা নিছক আমার কৌতূহলের বশে নয় বরং চারপাশের সবার মঙ্গলের জন্যই কাজটা করতে হয়েছিল আমাকে।
প্রথম যখন তেহুতি আর তার বোন বেকাথাকে আমি আঙুরের মোহনীয় রসের স্বাদ নেওয়ার অনুমতি দিই তখন তাদের বয়স ছিল পনেরো কী মোলো বছর। অনেক আগের কথা সেটা। মিশর থেকে তাদের ক্রিটে নিয়ে যাচ্ছিলাম আমি, মিনোসের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পথে ওরা প্রায়ই মিনতি করত যে এই বিয়ে করার থেকে আত্মহত্যা করাও ভালো। তখনই ওদের কষ্ট লাঘব করার জন্য মদ খাওয়ার অনুমতি দিই আমি। তাতে কাজ হয়েছিল, কারণ আমার জানা মতে এরপর আর কখনো আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেনি ওরা। ল্যাসিডিমনে ওদের সাথে আবার দেখা হওয়ার পরে আমি দেখেছি, এই দীর্ঘ সময়ে দ্রাক্ষারসের প্রতি আগ্রহ তো কমেইনি, বরং আরো বেড়েছে। তবে তফাত শুধু এটাই যে, এখন ওরা নিজেদের রুচির ব্যাপারে আরো বেশি খুঁতখুঁতে আর জেদি। কেবল প্রাসাদের আঙুর বাগান থেকে সাবধানে বাছাই করা আঙুরের তৈরি মদেই চুমুক দেয় ওরা, যদিও সেটা ওদের অধিকারও বটে।
শিকারের পানি খেতে আসার জায়গায় শিকারি যেমন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে তেমনি আমিও সঠিক সময়ের অপেক্ষায় রইলাম। তারপর একদিন পুবের এক দূর রাজ্যের রাজা এলো ল্যাসিডিমনে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার ছুতোয় এসেছে সে, যদিও সবাই জানে যে তার আসল উদ্দেশ্য রাজকুমারী সেরেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া। সেরেনার সৌন্দর্যের খ্যাতি ইতোমধ্যে দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তার বাগদান যে হয়ে গেছে এটা অনেকেই এখনো জানে না।
ল্যাসিডিমনে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে পারসিয়ান ভাষা জানে। এ কারণে আমার ওপরেই দায়িত্ব পড়ল রাজা সিমাশকি অর্থাৎ সেরেনার পাণিপ্রার্থীকে জানানো যে তার পছন্দের মেয়েটি ইতোমধ্যে আরেকজনের বাগদত্তা হয়ে গেছে। কথাটা শুনে এমন সুন্দর কাব্যিক ভাষায় সে দুঃখ প্রকাশ করল যে, পানি চলে এলো সেরেনার চোখে। তারপর সেরেনা এবং রামেসিস দুজনের গালেই চুমু খেয়ে তাদের জন্য শুভকামনা জানাল রাজা সিমাশকি। হবু দম্পতির সুখী জীবন কামনা করে তাদের বিয়ের উপহার হিসেবে তার নিজের আঙুর বাগান থেকে তৈরি বড় বড় বিশ পাত্রভর্তি লাল মদ উপহার দিল সে।
এই মদে প্রথম চুমুকটা দেওয়ার পরে তেহুতি তার স্বামীর কাছে মন্তব্য করল, এমন সুস্বাদু মদ যদি আরো বিশ পাত্র পাই তাহলে আমি সিমাশকিকে বিয়ে করতে রাজি আছি।
নিজের পেয়ালায় একটা চুমুক দিল রাজা হুরোতাস, তারপর মদটা মুখের ভেতর নেড়েচেড়ে স্বাদ পরীক্ষা করে মাথা ঝাঁকাল। আর আরো বিশ পাত্র পেলে আমিও তোমাকে তার হাতে তুলে দিতে রাজি আছি।
সৌভাগ্যক্রমে আমাদের অতিথি এক বর্ণও মিশরীয় ভাষা জানে না। রাজা এবং রানির এই সংলাপ বিনিময়ের পরেই উপস্থিত সবার মাঝে হাসির ঝড় বয়ে গেল। তবে কারণটা বুঝতে না পারায় সিমাশকি তাদের উদ্দেশ্যে হাতের পেয়ালাটা উঁচু করল কেবল, তারপর বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বাকি সবার সাথে হাসিতে যোগ দিল।
তেহুতির একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। সেটা হলো প্রতি সন্ধ্যায় দুই পেয়ালার বেশি মদ খায় না সে। তার ভাষ্য মতে, আমার মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট আবার এত বেশিও নয় যে বিছানা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য দুজনের বেশি পরিচারিকার সাহায্য লাগবে।
তবে সেই দিন সন্ধ্যায় ভোজসভার হইচই আর হট্টগোলের মাঝে সুযোগ বুঝে নিয়ে তার মদের পরিমাণ চার থেকে পাঁচ পেয়ালায় বাড়িয়ে দিলাম আমি। যতবারই সে আমার দিক থেকে অন্যদিকে তাকাল বা স্বামীকে চুমু খেতে গেল ততবারই নিজের পেয়ালা থেকে ওর পেয়ালায় মদ ঢেলে দিলাম। সুতরাং শেষ পর্যন্ত যখন তেহুতি সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তখন উঠে দাঁড়ানোর জন্য আমার হাত ধরতে হলো তাকে। পরিচারিকাদের বিদায় করে দিলাম আমি, তারপর কোলে করে নিয়ে এলাম ওপর তলার শোবার ঘরে। দুই হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হাসতে লাগল তেহুতি।
ওর পোশাক খুলতে সাহায্য করলাম আমি, তারপর সেই ছোটবেলায় যখন সে ছোট্ট একটা মেয়ে ছিল তখনকার মতো বিছানায় শুইয়ে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলাম। তারপর ওর পাশে বিছানার ওপর বসলাম আমি। আরো কিছুক্ষণ চলল আমাদের গল্প আর হাসিঠাট্টা। কিন্তু এর মাঝেই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে
আমাদের আলাপকে নির্দিষ্ট একটা দিকে নিয়ে যেতে লাগলাম আমি। আচ্ছা বেকাথার তো চার সন্তান। অথচ তোমার মাত্র একটা। তাও অনেক দিন পরে হয়েছে। কারণটা কী বলো তো? সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলাম একসময়।
এর উত্তর বোধ হয় বিচক্ষণ দেবতারাই কেবল বলতে পারবেন, জবাব দিল তেহুতি। গত ত্রিশ বছরে এমন কোনো রাত বোধ হয় খুব কমই আছে যখন আমি আর জারাস কিছু করিনি। এমনকি আমার লাল নিশান যখন দেখা দেয় তখনো। জারাসের ক্ষুধা রাক্ষুসে, আর আমিও কিছু কম যাই না। কী তীব্রভাবেই যে একটা বাচ্চা চাইতাম আমি! আর ওদিকে তুমি যেমন বললে, আমার ছোট বোন বেকাথা একের পর এক বাচ্চা বের করে যাচ্ছিল, ঠিক যেভাবে গরম রুটি বের করে রাঁধুনি। মাঝে মাঝে প্রায় ঘৃণাই করে বসতাম ওকে এর জন্য। প্রতি রাতে জারাস আমার বিছানায় আসার আগে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার দেবী তাওয়েরেতের কাছে প্রার্থনা করতাম আমি, পুজো দিতাম তাকে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছিল না, বলে একটু হাসল সে। যে দেবীকে দেখতে দুই পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানো জলহস্তীর মতো লাগে, তাকে কীভাবে বিশ্বাস করা যায় বলো? আমার সব পুজো নির্লজ্জের মতো গ্রহণ করছিল সে, কিন্তু কোনো জবাব দিচ্ছিল না। আমার নিজের কোনো বাচ্চা হোক এটা কখনোই বোধ হয় চায়নি সে।
তো তখন তুমি কী করলে? প্রশ্ন করলাম আমি। কিন্তু জবাব না দিয়ে হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে ফেলল তেহুতি।
ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করতে করতে যদি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিই আমি তাহলে নিশ্চয়ই তুমি কিছু মনে করবে না, টাটা? বিছানা থেকে নেমে কামরার এক কোণে রাখা বিশেষ পাত্রটার ওপর উবু হয়ে বসে পড়ল সে। কয়েক মুহূর্ত আমরা দুজনই চুপচাপ তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা তরল পদার্থের মিষ্টি শব্দটা শুনলাম। তারপর তেহুতি জানতে চাইল, তোমাকে যদি বলি তবে তুমি কাউকে বলবে না তো? অতিরিক্ত মদ খেয়ে ফেলায় খুব সামান্য জড়িয়ে গেছে ওর কণ্ঠস্বর।
এমন কাজ যদি কখনো করি তবে যেন দেবতাদের অভিশাপ নেমে আসে আমার ওপর, সাথে সাথে জবাব দিলাম আমি। আঁতকে উঠল তেহুতি।
এমন অলক্ষুনে কথা বলতে হয় না টাটা। এখনই ফিরিয়ে নাও কথাটা। দেবতাদের এভাবে খোঁচানো কখনোই উচিত নয়! অশুভ দৃষ্টি এড়ানোর জন্য বাতাসে একটা চিহ্ন আঁকল ও।
ইচ্ছে করেই ওর সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। কামরার অন্ধকার কোণে বসে যেসব অমর দেবতা এখন আমাদের কথা শুনছে বা যাদের শোনার সম্ভাবনা আছে তাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম, খবরদার হে বুড়ো দেবতাগণ, আমার গায়ে কেউ হাত দেবে না। তাহলে রানি তেহুতি উঠে এসে তোমাদের সবার কানের ফুটোয় মুতে দেবে!
আবার হাসিতে ফেটে পড়ল তেহুতি। এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। কোনোমতে নিজের হাসি থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলে উঠল সে। দেবতাদের নিয়ে কখনো ঠাট্টা করা উচিত নয়। তাদের রসবোধ খুবই কম, নেই বললেই চলে। আমাদের নিয়ে তারা কৌতুক করতে পারে ঠিকই; কিন্তু তাদের ব্যাপারে কেউ কিছু বললেই খেপে যায়।
ঠিক আছে, আর কোনো ঠাট্টা করছি না, বললাম আমি। তবে এখন এটা বলো যে গর্ভবতী হওয়ার জন্য কী করেছিলে তুমি। কথাটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমি। আর এটাও বলছি যে, কাউকে কিচ্ছু বলব না।
কাজটা আসলে একদম শুরুতেই করা উচিত ছিল আমার, বুঝলে? একজন দেবতার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম আমি, কোনো দেবীর কাছে নয়। তার নামে একটা ষাঁড় উৎসর্গ করে মাঝরাত পর্যন্ত হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করেছিলাম। তোমার স্বামী রাজা হুরোতাসের এ ব্যাপারে কী মতামত?
ও কিছুই জানতে পারেনি। সে সময় প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে যুদ্ধ করতে ব্যস্ত ছিল আমার স্বামী। আর বাড়ি ফেরার পরেও ওকে কিছু বলিনি আমি। সেই দেবতা কি তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন?
আমি যখন ঘুমিয়ে পড়লাম তখন তিনি আমার স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন, গলা খাদে নেমে এলো তেহুতির, লাল হয়ে উঠল গালগুলো। চোখগুলো নামিয়ে ফেলে বলল, ওটা স্রেফ একটা স্বপ্ন ছিল টাইটা। শপথ করে বলছি। আমি কখনো অন্য পথে পা বাড়াইনি। জারাস আমার স্বামী, সব সময় ওর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলাম আমি।
সেই দেবতা কে ছিলেন? তোমাকে নিজের পরিচয় জানিয়েছিলেন তিনি? প্রশ্ন করলাম আমি। সাথে সাথে আরো লজ্জা পেয়ে গেল তেহুতি, মাথা নামিয়ে ফেলল। আমার চোখে চোখ রাখতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল সে, তারপর এত আস্তে আস্তে কথা বলল যে, আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। জোরে বলো তেহুতি। কে ছিলেন তিনি? আবার জানতে চাইলাম আমি।
এবার আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল তেহুতি। পরিষ্কার গলায় বলল, সেই দেবতা বলেছিলেন যে তিনি অ্যাপোলো। উর্বরতা, সংগীত, সত্য এবং আরোগ্যের দেবতা। তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম আমি, কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা আঁকালাম আমি। দেবতার যে গুণগুলোর কথা তেহুতি বলেছে তার সাথে আরো কিছু গুণের কথা যোগ করতে পারি আমি। অসংখ্য গুণ এবং দোষ আছে তার, এবং এগুলোর পাশাপাশি অ্যাপোলো কাম এবং ক্রোধ, মদ এবং মাতলামি, অসুখ এবং মিথ্যার দেবতাও বটে।
তার মানে অ্যাপোলোর সাথে শারীরিক মিলন হয়েছিল তোমার, কথাটা প্রশ্ন নয় বরং মন্তব্যের সুরে বললাম আমি; যেন এটাই নির্ভেজাল সত্যি কথা। সাথে সাথে কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল তেহুতির মুখ।
তুমি কি বুঝতে পারছ না টাইটা, ওটা স্রেফ একটা স্বপ্ন ছিল? উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করল সে। পুরোটাই ছিল মায়া। সেরেনা আমার স্বামীর ঔরসজাত কন্যা, আমি আমার স্বামীর বিশ্বস্ত স্ত্রী। স্বামীকে ভালোবাসি আমি, ভালোবাসি আমার মেয়েকে। অলিম্পাস বা অন্য কোনো পৃথিবী থেকে নেমে আসা কোনো অস্তিত্ব আমার ভালোবাসা পেতে পারে না।
চোখে নীরব ভালোবাসা আর মায়া নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তেহুতি, দৌড়ে চলে এলো আমার কাছে। আমার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাতে আমার হাঁটু চেপে ধরল, মুখ ডোবাল আমার কোলে।
আমাকে ক্ষমা করে দাও প্রিয় টাটা, আমার কোলের মাঝে মুখ চেপে ধরে থাকায় অস্পষ্ট শোনাল তার কণ্ঠস্বর। পুরোটাই ছিল একটা স্বপ্ন, এবং যা ঘটেছিল তার ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সবই ছিল জাদুবিদ্যা, ডাইনির মায়া। ঝড়ের মাঝে উড়ে যাওয়া পালকের মতো অবস্থা হয়েছিল। আমার। একই সঙ্গে ভয়ানক এবং অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা ছিল সেটা। আমার দেহ আর মনের প্রতিটা অংশ তিনি একই সাথে তীব্র ব্যথা আর তীব্র আনন্দ দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। চোখ ধাঁধানো সোনালি আলো আর নিশ্চিদ্র শূন্যতার অন্ধকারে একই সাথে ঢেকে গিয়েছিলাম আমি। তার সৌন্দর্য একই সাথে যেমন শ্বাসরুদ্ধকর, তেমনি আবার পাপের মতোই ভয়ংকর বীভৎস। পুরো ব্যাপারটা যেন এক লহমায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, আবার স্থায়ী হয়েছিল হাজার বছর ধরে। সেরেনা নামের অলৌকিক সত্তাকে তিনিই আমার গর্ভে স্থাপন করেছিলেন এবং তাতে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম আমি। কিন্তু এটা তো বাস্তব ছিল না। আমার এই দুষ্টুমির জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না টাইটা?
ধীরে ধীরে ওর রেশমি চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম আমি। ফিসফিস করে বললাম, এখানে ক্ষমা করার কিছু নেই তেহুতি। তোমার স্বামী আর তোমার মেয়ে এরাই কেবল বাস্তব। বাকি সব তো ছায়ার খেলা মাত্র। ওদের দুজনকে তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি ধরে রেখো, ভালোবেসো। আর তোমার এই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা আর কোনো মানুষকে বলার দরকার নেই। এমনকি আমাকে যে বলেছ এটাও ভুলে যাও।
হুরোতাস যতটা ভেবেছিল, রামেসিস আর তেহুতির বিয়ের আয়োজন করতে তার চাইতেও বেশি সময় লেগে গেল। এই সময়ের মাঝে ছোট ছোট; কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত দুটো যুদ্ধে লড়াই করতে হলো আমাদের। হুরোতাস আর হুইয়ের ইচ্ছে হলো সাইক্লেডস এবং দক্ষিণ ইজিয়ান সাগরের সকল দ্বীপ এবং দেশকে নিজেদের দখলে রাখবে তারা। কিন্তু ত্রিশ বছর ধরে প্রায় সার্বক্ষণিক যুদ্ধের পরেও এই কাজের অর্ধেকও এখনো শেষ হয়নি। একটা দ্বীপপুঞ্জ যদিও বা দখলে এলো সাথে সাথে হয়তো রাজা হুরোতাসের সাম্রাজ্যের অপর প্রান্তে আরেকজন বিদ্রোহ করে বসল। তার ওপর আছে পারসিয়ানরা, যারা সেই শুরু থেকেই পুরো ব্যাপারটার ঝামেলা আরো বাড়িয়ে চলেছে। কোথাও কোনো দুর্বলতা পেলেই চোরের মতো ঢুকে পড়ে তারা, কিছু মানুষকে খুন করে জাহাজভর্তি লুটের মাল নিয়ে আবার চোরের মতোই পালিয়ে যায়। পৃথিবীর পুব প্রান্তে তাদের বিশাল এবং রহস্যময় সাম্রাজ্য, সেখানে একবার চলে গেলে তাদের আর খুঁজে বের করার উপায় থাকে না।
এরা সব অশিক্ষিত বর্বর আর রক্তপিপাসু জলদস্যুর দল, খ্যাপা গলায় আমাকে জানাল হুরোতাস।
কে জানে, আমাদের ব্যাপারেও হয়তো ওরা একই কথা বলে, শান্ত গলায়
জবাব দিলাম আমি। আমরা ওদের পথপ্রদর্শক, নতুন সাম্রাজ্যের নির্মাতা, গর্বে বুক ফুলিয়ে বলে উঠল হুরোতাস। আমাদের কাজই হচ্ছে যে সত্যিকারের দেব-দেবীদের আমরা উপাসনা করি, তাদের নামে এই পৃথিবীকে শাসন করা, সভ্যতার আওতায় নিয়ে আসা।
কিন্তু তুমি এবং তোমার লোকরা তো ওই বর্বরদের মতোই যুদ্ধ ভালোবাসে, জবাব দিলাম আমি। তুমি নিজেই সে কথা বলেছ আমাকে।
আমার লোকেরা লড়াইয়ের চাইতে বেশি ভালোবাসে শুধু একটা জিনিস, সম্মতি জানাল হুরোতাস। আর সেটা হচ্ছে কোনো উৎসব। তাই আমি ঠিক করেছি ওদের এমন এক বিবাহ উৎসব উপহার দেব, যা হবে ওদের দেখা সবচেয়ে বড় উদ্দাম আর বিখ্যাত বিয়ে। এমন উৎসবের কথা কেউ কোনো দিন স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারবে না। জীবিত প্রত্যেকটা মানুষ চাইবে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে।
মাথা ঝাঁকালাম আমি। তারপর তোমার অতিথিরা যখন ভালো মদ আর ভারি খাবারের ঘোরে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে সেই সুযোগে তাদের রাজ্যগুলো দখল করে নেবে তুমি।
প্রিয় টাইটা, তোমার রাজনৈতিক বুদ্ধির প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। দাড়িতে হাত বুলিয়ে উদাস ভঙ্গিতে হাসল হুরোতাস।
আমি বলে চললাম, তোমার সুন্দরী কন্যা সেরেনা যদি কোনো এক দ্বীপের প্রধানকে স্বামী হিসেবে বেছে নিত তাহলে বাকি পনেরোজনই তোমার শত্রুতে পরিণত হতো। কিন্তু এখন ওই ষোলোজনের সবাই তোমার মিত্র এবং অধীন হিসেবে থাকবে। সেরেনার বয়স হয়তো কম; কিন্তু বুদ্ধিতে ও অনেক বৃদ্ধ ব্যক্তিকেও হার মানিয়ে দিতে পারবে।
তোমার সম্পর্কে শেষ যে কথাটা বললাম সেটাই আরো একবার বলতে ইচ্ছে করছে আমার, হাসিটা ধরে রেখেই বলল হুরোতাস। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা পরিষ্কারভাবে দেখতে কখনোই অসুবিধা হয়নি তোমার।
যদিও এখানে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই তবু গলা নামিয়ে আনলাম আমি। ফলে আমার কথা শোনার জন্য সামনে ঝুঁকে আসতে হলো হুরোতাসকে। এই ষোলোজন মিত্র যদি তোমার সাথে থাকে, বললাম আমি, সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় মিশরকে সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করা এবং স্বৈরাচার উটেরিক টুরোকে শাস্তি দেওয়াটা কিন্তু মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
স্বীকার করছি এমন সম্ভাবনার কথা আমার মাথাতেও এসেছে। কিন্তু লুক্সর থেকে উটেরিককে সরানোর পর ফারাও পদে কাকে বসাতে চাইছ, টাইটা?
নিঃসন্দেহে তুমি, কোনো দ্বিধা না করেই জবাব দিলাম আমি। কিন্তু মুচকি হাসল হুরোতাস।
স্থায়ীভাবে মিশরে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার। ল্যাসিডিমনে এই নতুন প্রাসাদে বেশ সুখেই আছি আমি। এটা গড়ে তুলতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে। তা ছাড়া মিশরের সাথে আমার যে স্মৃতিগুলো জড়িয়ে আছে সেগুলোকে সুখের স্মৃতি বলা যায় না। কিন্তু কাজটা করতে পারে এমন যোগ্য ব্যক্তি আর কে আছে? প্রশ্ন করল সে। এক মুহূর্ত তার প্রশ্নটা নিয়ে চিন্তা করলাম আমি।
ফারাও রামেসিস নামটা শুনতে বেশ ভালোই লাগে, কী বলো? হঠাৎ করেই বলে উঠলাম আমি। হুরোতাসের মুখের ভাব বদলে গেল, কিছুটা যেন বিভ্রান্ত হয়ে উঠল সে। ভুলটা বুঝতে পারলাম আমি এবং সহজেই শুধরে নিলাম। অন্যদিকে আমি যত দূর জানি মিশরে কখনো কোনো নারী শাসক ছিল না। কিন্তু ফারাওইন সেরেনা নামটা শুনতে আরো বেশি অভিজাত এবং সুন্দর লাগছে আমার কানে। এবার আবার হাসি ফুটল হুরোতাসের মুখে। ইচ্ছে করলে ওরা যুগ্ম শাসক হিসেবেও দেশ শাসন করতে পারে। আমার এই কথা শুনে এবার হাসিতে ফেটে পড়ল হুরোতাস।
তোমার কথাগুলো শুনতে এত মজা লাগে, টাইটা। এসব চিন্তা কোথা থেকে আসে তোমার মাথায়? ঠিক আছে, যুগ্ম শাসকই হবে ওরা।
ল্যাসিডিমনে আমি এসে পৌঁছেছি মাত্র কয়েক মাস হলো; কিন্তু ইতোমধ্যে আমার উপস্থিতি এখানে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ত্রিশ বছর আগে আমার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নিত হুরোতাস। এই সময়ের মাঝে তার কোনো পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে। তফাত শুধু এটাই যে, এখন আমার শিক্ষাগুলোকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে পরামর্শ বলে ডাকা হয়।
এই পর্যায়ে এসে হুই এবং তার ছেলেদের ওপরে অবস্থান দেওয়ার জন্য খুব বেশি তাড়াহুড়ো করা যাবে না। তবে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ওকে ল্যাসিডিমনের সামরিক এবং নৌবাহিনী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঠিক মাঝখানে রাখার ব্যবস্থা করলাম আমি। এ ছাড়া মেমনন নামের সেই শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের নিয়ন্ত্রণ এখনো ওর হাতেই আছে, যাতে করে আমরা মিশর এবং উটেরিকের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিলাম এখানে। কাগজে-কলমে এখন রামেসিসের পদবি হচ্ছে সহকারী অ্যাডমিরাল, অর্থাৎ অ্যাডমিরাল হুইয়ের ঠিক নিচে। রাজকীয় বংশধারা এবং রাজকুমারী সেরেনার সাথে বাগদান হওয়ায় এখন বেশ উঁচুতে ওর অবস্থান। কিন্তু বয়স কম হলেও এখনই যে এই উঁচু অবস্থানের সুবিধা নেওয়া ঠিক হবে না এটা রামেসিস ঠিকই বোঝে। ইতোমধ্যে হুইয়ের পরিবারে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে সে। প্রায়ই ওকে দাওয়াত দেয় বেকাথা, খাওয়ার টেবিলে নিজের পাশে বসিয়ে খাওয়ায় পেট পুরে। রামেসিসকে রামি সোনা বলে ডাকে সে। তার ছেলেরাও ওকে নিজেদের পরিবারের একজন বলে ধরে নিয়েছে, কারো মাঝে কোনো হিংসা বা বিদ্বেষের চিহ্নমাত্র নেই। হুইয়ের নাতি নাতনিরা আরো একটা চাচা পেয়ে খুব খুশি,কারণ ইচ্ছেমতো জ্বালানোর জন্য আরো একটা মানুষ পেয়ে গেছে তারা। রামেসিসকে দেখলেই গল্প শোনার জন্য ঘিরে ধরে সবাই, ওর কাঁধে আর পিঠে উঠে বসে থাকে।
রাজা হুরোতাস আর রানি তেহুতিও এটা ভেবে খুব খুশি যে, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলেই রামেসিসের মাধ্যমে তাদের নিজেদের ঘরেও কিছু নাতি নাতনি আসবে। তার জন্য দুর্গে আমার ঘরে পাশেই আরেকটা কামরার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যদিও সেটা সেরেনার কামরা থেকে সবচেয়ে দূরের কামরাগুলোর একটা। রাজকুমারীকে যারা পাহারা দিয়ে রাখে তাদের সংখ্যা খুব সতর্কতার সাথে দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়েছে, যেন সেরেনার কুমারীত্ব রক্ষার জন্য আমার নিজের সতর্ক চোখের পাহারাদারি যথেষ্ট নয়।
আমার জন্য যে কামরার ব্যবস্থা করা হয়েছে তা বিলাসব্যসনের দিক দিয়ে প্রায় রাজা-রানির শোবার ঘরের সমান। যদিও আমার ধারণা রানি তেহুতি নিজেই এর জন্য দায়ী। প্রায় প্রতিদিনই আমার খাওয়ার কামরায় এসে হাজির হয় সে, সাথে থাকে মোটামুটি শ খানেক মানুষের উদরপূর্তি করতে পারে এই পরিমাণে খাবার। তার সাথে আরো থাকে প্রচুর পরিমাণে মদ, যা দিয়ে অনায়াসে এক বছর খেতে পারে একজন মানুষ। মাঝরাতের পরে মাঝে মাঝে শোয়ার পোশাক পরেই আমার ঘরে চলে আসে সে, হাতে থাকে মোমবাতি। লাফ দিয়ে আমার বিছানায় উঠে এসে বলে, মাত্র কয়েকটা মিনিট সময় নেব, টাটা। সত্যি কথা বলছি। খুব দরকারি একটা কথা জিজ্ঞেস করা দরকার তোমাকে, এবং সেটা এখনই।
কয়েক ঘণ্টা পর আমি যখন তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে করে তার নিজের বিছানায় রেখে আসি তখন ওর স্বামী গুঙিয়ে ওঠে, তোমার দরজায় তালা লাগিয়ে রাখতে পারো না টাইটা? তাহলেই তো আর ও ঢুকতে পারে না।
ওর কাছে অতিরিক্ত চাবি থাকে।
তাহলে ওকে তোমার কাছেই রেখে দিও।
নাক ডাকে যে?
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে হুরোতাস। তোমার কি মনে হয় সেটা আমি জানি না?
তবে যাই হোক না কেন, এই আরামদায়ক কামরায় থাকার বদলে মাঝে মাঝে যদি একটু কম ঘুমাতে হয় তাহলে সেটা খুব বেশি কিছু নয়। বিশাল দুর্গ প্রাসাদের সবচেয়ে ওপরের অংশে অবস্থিত আমার কামরা এখান থেকে তুষার ঢাকা পাহাড়চূড়া আর নিচের সবুজ উপত্যকা দুটোই দেখতে পাই। সেনাবাহিনীর আসা-যাওয়া, বন্দরের কর্মব্যস্ততা কিছুই আমার চোখ এড়ায় না। বুনো পাখিদের খুব ভালোবাসি আমি, প্রতিদিন সকালে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির জন্য বারান্দায় খাবার ছড়িয়ে রাখি। ওদের দেখে খুব আনন্দ লাগে আমার। বড় কামরাগুলোর একটাকে আমার গ্রন্থাগার এবং প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছি। তাকগুলো খুব দ্রুতই ভরে উঠল আমার বিভিন্ন পুঁথি আর প্যাপিরাসে। অতিরিক্ত যা বাকি থাকল সেগুলোকে কামরার কোনায় মাথা সমান উঁচু স্তূপ করে রেখে দেওয়া হলো।
*
উটেরিক টুরোর সেই কুখ্যাত কারাগার এবং ডুগের ভয়াবহ অত্যাচার থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিল ক্যাপ্টেন ওয়েনেগ। তার কাছে সত্যিই ঋণী আমি। কিন্তু এখানে এই ল্যাসিডিমনে সে বেশ অস্বস্তিতে ভোগে, কারণ নিজের কোনো অবস্থান সে # খুঁজে নিতে পারছিল না। তাই নিজের অভিজ্ঞতা, পদমর্যাদা এবং দক্ষতার সাথে মানানসই হয় এমন কিছু একটা কাজ খুঁজে দিতে অনুরোধ করেছিল আমাকে। সুতরাং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওয়েনেগ এবং তার ছোট্ট দলটিকে গোপনে মিশর ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেললাম আমি। সেখানে গিয়ে একটা গুপ্তচর দল গঠন করবে ওরা, এবং ফারাও উটেরিক টুরোর শাসনামলে আমার জন্মভূমি মিশরে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাঠাবে আমার কাছে।
ওয়েনেগ যেন তার বন্ধু এবং গুপ্তচরদের খুশি রাখতে পারে সে জন্য তার কাছে যথেষ্ট পরিমাণে রুপার ডেবেন পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম আমি। তাদের কাজে লাগানোর জন্য তিনটি ছোট কিন্তু দ্রুতগতির বাণিজ্যতরী কিনলাম। ওরা যখন গিথিয়ন বন্দর থেকে বিদায় নিল তখন সময় মাঝরাতের পরপর। বন্দরে দাঁড়িয়ে ওদের বিদায় জানালাম আমি, দক্ষিণমুখী এই সমুদ্রযাত্রায় ভাগ্য যেন ওদের সহায় থাকে সেই কামনা করলাম।
ছদ্মনাম এবং ঘন কোঁকড়া দাড়ির ছদ্মবেশে নিজের সুদর্শন চেহারা ঢেকে নিয়ে খুব অল্প সময়ের মাঝেই সব ব্যবস্থা করে ফেলল ওয়েনেগ। লুক্সরে উটেরিকের প্রাসাদের ঠিক পাশেই একটা মদের দোকানে নিজের আস্তানা গেড়ে বসল সে। ওর কাছে একগাদা কাঠের বাক্স দিয়ে দিয়েছিলাম আমি। প্রতিটায় ছিল অনেকগুলো পায়রা। সবগুলোর জন্ম হয়েছে ল্যাসিডিমনের রাজপ্রাসাদে, পায়রা রাখার খোপে। রাজা হুরোতাসের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে বড় করা হয়েছে তাদের। এই পাখিগুলোকে নিজের সাথে মিশরে নিয়ে গেল ওয়েনেগ। কয়েক মাসের মধ্যেই লুক্সরে নিজের অবস্থান পাকাঁপোক্ত করে নিল সে এবং দক্ষভাবে কাজ শুরু করে দিল। তার পাঠানো পায়রাগুলোর মাধ্যমে উত্তর সাগরের এই পারে বসেও নিয়মিতভাবে খবর পেতে লাগলাম আমি। এই সাহসী পাখিগুলো চার দিনেরও কম সময়ের মাঝে এই লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে। অনেকগুলো মূল্যবান তথ্য পাওয়া গেল ওদের বদৌলতে।
খবর পাওয়া গেল, উটেরিক তার নাম বদলেছে। এখন তার নাম ফারাও উটেরিক বুবাস্টিস। নিজের দেবত্ব অর্জনকে উদযাপন করার জন্য এই নাম নিয়েছে সে। বুবাস্টিস হচ্ছেন অনেকগুলো গুণের পাশাপাশি পুরুষালি সৌন্দর্য এবং সাহসের দেবতা। পায়রাদের মারফত এই ঘটনা ঘটার প্রায় সাথে সাথেই জেনে গেলাম আমি। তবে দেবতার অজস্র গুণগুলোর মাঝে কেবল একটা গুণকেই আমার হিংসে লাগে। সেটা হচ্ছে দেবতা বুবাস্টিস চাইলেই তার উখিত পুরুষাঙ্গকে এক শ কিউবিট পর্যন্ত লম্বা করতে পারেন, ফলে একবার তার চোখে পড়ে গেলে খুব কম নারীই রেহাই পায়।
দেবতা বুবাস্টিসকে প্রায়ই দেখানো হয় একটা পুরুষ অথবা মেয়ে বিড়াল হিসেবে। এর কারণ হলো তিনি ইচ্ছে করলে নিজের লিঙ্গও পরিবর্তন করতে পারেন। এবং সম্ভবত এ কারণেই এই বিশেষ দেবতাকে বেছে নিয়েছে উটেরিক।
ওয়েনেগের কাছ থেকে আরো জানা গেল, লুক্সর থেকে ভাটিতে নীলনদের বুকে একটা দ্বীপে নিজের জন্য এক বিশাল মন্দির নির্মাণ করছে ফারাও উটেরিক বুবাস্টিস। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে সেই দশ লাখ রৌপ্যখণ্ডের প্রায় পুরোটাই খরচ করছে সে, যেগুলো মেসি বিজয়ের পর খামুদির কাছ থেকে তাকে এনে দিয়েছিলাম আমি।
এর অল্প সময় পরেই জানা গেল গিথিয়ন বন্দরে মেমনন নামের সেই রণতরীর অবস্থানের কথা জেনে গেছে ফারাও উটেরিক বুবাস্টিসের গুপ্তচররা, যাতে করে মিশর থেকে পালিয়ে এসেছিলাম আমি আর রামেসিস। ওয়েনেগ জানিয়েছে ফারাওয়ের নৌ সেনাপতিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জাহাজটিকে পুনরুদ্ধার করে লুক্সরে ফিরিয়ে আনতে। তাদের ওপর আরো নির্দেশ আছে জাহাজ নিয়ে ফিরে আসার সময় তাতে যেন বিশ্বাসঘাতক টাইটাও উপস্থিত থাকে। শিকলে বেঁধে নিয়ে আসতে হবে তাকে। আমার মাথার ওপর পঞ্চাশ হাজার রৌপ্যখণ্ডের পুরস্কার ঘোষণা করেছে ফারাও। বোঝা যাচ্ছে আমাকে এখনো ভুলে যায়নি সে ক্ষমা করা তো দূরে থাক।
ইদানীং নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদাসীন হয়ে পড়েছি আমি। ভেবেছিলাম এই দুর্গে আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়ে দিতে পারব, নিরাপত্তার কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু এই বিশেষ খবরটা শুনে আমার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। এখন পর্যন্ত গিথিয়ন বন্দরের ঠিক মাঝখানে মেমননকে নোঙর করে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে রামেসিস, এবং নামে মাত্র কিছু নাবিক রাখা হয়েছে জাহাজে। ফলে জাহাজটা যে কারো চোখেই খুব সহজে ধরা পড়বে। এবার আমার নির্দেশে তাকে বন্দরের প্রাচীরের পাশে নিয়ে আসা হলো এবং পানির নিচে দিয়ে তার খোল বেঁধে রাখা হলো বন্দরের পাথুরে কাঠামোর সাথে। আমার কবজির সমান মোটা দড়ি ব্যবহার করা হলো এই কাজে। প্রতি মুহূর্তে বিশজন সশস্ত্র নাবিক পাহারা দিতে লাগল জাহাজটাকে, এবং প্রতি ছয় ঘণ্টা পর পর তাদের বদল করা হতে লাগল। মেমনন যেখানে নোঙর করা আছে সেখান থেকে মাত্র ত্রিশ কদম দূরে একটা পাথরের বাড়িতে আরো পঞ্চাশজন লোককে মোতায়েন রাখা হলো সব সময়ের জন্য। শত্রুদের কোনো দলকে তীরে উঠতে দেখলেই মুহূর্তের মধ্যে আক্রমণ চালাতে পারবে তারা।
দুই সপ্তাহের মধ্যেই লুক্সরে অবস্থানরত ওয়েনেগের কাছ থেকে আরো একটা পায়রা পেলাম আমি। পাখিটা যে খবর নিয়ে এসেছে তাতে জানা গেল পনেরো থেকে বিশজন লোকের একটা ছোট দল নীলনদের মুখ থেকে সাগর অভিমুখে রওনা দিয়েছে। ছোট একটা মাছ ধরার নৌকা নিয়ে গেছে তারা, যেটা দেখে কিছু সন্দেহ করবে না কেউ। আন্দাজ করলাম মেমননকে দখল করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই আসছে ওরা। এই অভিযানের দায়িত্বে থাকা লোকটার নাম জানিয়েছে ওয়েনেগ। পানমাসি নামে মহা ধূর্ত এক লোক। রামেসিস এবং আমি দুজনই তাকে আগে দেখেছি। এই মুহূর্তে সে উটেরিকের প্রিয় ব্যক্তিদের একজন। বয়স সবে পঁচিশ; কিন্তু ইতোমধ্যে শক্তপাল্লার লোক বলে খ্যাতি অর্জন করে নিয়েছে। ডান গালে একটা কাটা দাগ, খোঁড়াননা দেখে তাকে চেনা যায়। যুদ্ধে আহত হয়েছিল সে, ফলে ডান পা একটু টেনে টেনে হাঁটতে হয় তাকে।
এর কয়েক দিন পরেই ট্যাগেটাস পর্বতমালায় অবস্থিত পাহারাদারদের মারফত জানা গেল গিথিয়ন উপসাগরে একটা সন্দেহজনক চেহারার মাছ ধরার নৌকা দেখা গেছে। দেখে মনে হচ্ছিল জাল ফেলায় ব্যস্ত; কিন্তু সময়টা তখন প্রায় সন্ধ্যা এবং দূরত্বটা অনেক বেশি হওয়ায় নিশ্চিতভাবে কিছু বোঝা যায়নি। দুর্গে বসে এই খবর শোনার সাথে সাথেই আমি আর রামেসিস ঘোড়া নিয়ে পূর্ণ গতিতে বন্দরে এসে পৌঁছলাম। মেমননের পাহারায় নিয়োজিত লোকগুলো জানাল সব ঠিকই আছে। তার পরও ওদের সম্পূর্ণ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিলাম আমি। তারপর নিজেরাও নির্দিষ্ট অবস্থানে চলে এলাম, অপেক্ষা করতে লাগলাম এরপর কী ঘটে দেখার জন্য। আমি প্রায় নিশ্চিত যে মেমননকে দখল করার জন্য ভোরের ঠিক আগের সময়টা বেছে নেবে পানমাসি, কারণ সে আশা করবে যে ওই সময়টাতেই আমাদের প্রহরীদের শক্তি এবং উৎসাহ সবচেয়ে কম থাকবে। বরাবরের মতোই এ ব্যাপারেও আমার ধারণা সঠিক প্রমাণিত হলো। ভোরের প্রথম আলো ফোঁটার ঘণ্টাখানেক আগে পাশের জঙ্গল থেকে একটা রাতচরা পাখির কর্কশ ডাক ভেসে এলো আমার কানে, অথবা বলা যায় কেউ একজন অপটু গলায় পাখিটার ডাক নকল করার চেষ্টা করল। পাখিটা আমার অন্যতম প্রিয় পাখিগুলোর একটা, ফলে নকল গলাটা বোকা বানাতে পারল না আমাকে। নিঃশব্দে খবর ছড়িয়ে দিলাম আমি, প্রস্তুত হয়ে গেল সবাই।
কিছুক্ষণ নীরবে কাটল। পরে জেনেছিলাম এই সময়টায় পানমাসির সঙ্গীরা বন্দরের দরজায় নিয়োজিত প্রহরীদের পেছন থেকে এসে এক এক করে তাদের চুপ করিয়ে দিচ্ছিল। কারো গলায় ছুরি চালানো হয়, কারো মাথায় মারা হয় মুগুরের বাড়ি। তার পরেই বন্দরের মালপত্র রাখার ঘরগুলোর মাঝ থেকে প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো কিছু ছায়ামূর্তি। অস্ত্র বাগিয়ে ধরে এক দৌড়ে বন্দরের পাথুরে মেঝে পেরিয়ে মেমননের দিকে এগিয়ে এলো তারা, যেখানে জাহাজটা নোঙর করা রয়েছে। আমার নির্দেশ অনুযায়ী জাহাজের সিঁড়ি আগেই নামিয়ে রাখা হয়েছিল, যেন আগন্তুকদের জাহাজে ওঠার জন্য নীরব আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
এর সাথে সাথে বন্দরের ওপর বেশ কিছু পানির পিপা আর মালভর্তি বাক্সও রেখেছিলাম আমি, যেন সকালবেলা আলো ফোঁটার সাথে সাথেই সেগুলো জাহাজে ওঠানোর কাজ শুরু হবে। এর পেছনে লুকিয়ে বসে ছিল আমাদের তীরন্দাজ আর বর্শাধারী সৈনিকরা। ছায়ামূর্তিগুলোর সামনে তাদের দলনেতা পানমাসিকে চিনতে পারল আমার চোখ। তবে তারা সবাই একেবারে খোলা জায়গায়, জাহাজের সিঁড়ির সামনে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি। যেই দেখলাম ওদের, ওরা এখন যথেষ্ট সামনে চলে এসেছে এবং আমাদের দিকে পেছন ফিরে আছে সাথে সাথে আক্রমণের নির্দেশ দিলাম সৈন্যদের। পিপা আর বাক্সগুলোর পেছনে লুকানোর জায়গা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সবাই। প্রত্যেকে ধনুকে একটা করে তীর জুড়ে ফেলেছে, এবার একই সাথে ছোঁড়া হলো সেগুলো। এত কাছ থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগই নেই, প্রায় প্রতিটা তীরই শত্রুদের দেহে গিয়ে বিঁধল। ব্যথা আর আতঙ্কের চিৎকারে ভরে গেল চারদিক। প্রথম ধাক্কাতেই পানমাসির দলের প্রায় অর্ধেক লোক ভূপাতিত হলো। বাকিরা এবার ঘুরে দাঁড়াল আমাদের মুখোমুখি হতে। কিন্তু ওদেরকে চমকে দেওয়ার সুযোগটা খুব ভালোভাবেই নিতে পেরেছি। আমরা। প্রায় সাথে সাথেই শেষ হয়ে গেল যুদ্ধ। শত্রুদের যারা বেঁচে গেল তারা অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে, দুই হাত ওপরে তুলে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে প্রাণভিক্ষা চাইতে শুরু করল। আক্রমণকারীদের সংখ্যা ছিল পঁচিশজন। তীরের আঘাত থেকে বাঁচতে পেরেছে মাত্র ষোলোজন। পানমাসিও বেঁচে যাওয়া লোকগুলোর মাঝে রয়েছে দেখে খুশি হলাম আমি। লোকটার উদ্ধত সাহস এবং বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ওকে চরম শাস্তি দিতে চাই আমি। কিন্তু তখনো জানি না যে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা দিক থেকে আমার এই ইচ্ছে ভেস্তে যাবে পুরোপুরি।
*
বন্দিদের বাঁধার জন্য ক্রীতদাসদের শিকল নিয়ে এলো রামেসিসের লোকেরা। প্রথমে সবার অন্তর্বাস বাদে আর সব পোশাক খুলে ফেলা হলো। তারপর হাতগুলো বাঁধা হলো পিছমোড়া করে, গোড়ালিতেও বেঁধে দেওয়া হলো শিকল। ফলে ছোট ছোট পদক্ষেপে হাঁটা ছাড়া সামনে এগোনোর কোনো উপায় থাকল না কারো। তারপর আবর্জনা ফেলার দুটো বড় গাড়িতে তোলা হলো সবাইকে। একদল ষাড়ের সাহায্যে গাড়ি দুটো নিয়ে যাওয়া হলো দুর্গে।
দস্যুদের ধরা পড়ার খবর জানানোর জন্য কয়েকজনকে আগেই পাঠিয়ে দিলাম আমি। ফলে আমাদের এগোনোর পথের দুই পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে গেল জনতা, বন্দিদের গায়ে ছুঁড়ে মারতে লাগল কাদামাটি আর বিষ্ঠার দলা। অপরাধীদের কপালে এখন অপেক্ষা করছে বন্দিদশা, কঠোর বিচার এবং নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুর শাস্তি।
তিন দিন পর দুর্গের প্রাঙ্গণে বন্দিদের বিচারে বসল রাজা হুরোতাস। অবশ্য বিচার করার মতো তেমন কিছু নেই, কারণ রায় কী হবে তা মোটামুটি সবাই আগে থেকেই জানে। তার পরও বিচার অনুষ্ঠান দেখার জন্য দর্শকের অভাব হলো না। সেই দর্শকদের মাঝে রানি তেহুতি এবং রাজকুমারী সেরেনাও থাকল। মায়ের পায়ের কাছে একটা আসনের ওপর বসল সে।
বিচারে সাক্ষ্য দিলাম আমি এবং বন্দিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে সাজিয়ে-গুছিয়ে সমস্ত তথ্যপ্রমাণ হাজির করলাম। পানমাসি এবং তার দলের গুণ্ডাগুলোকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট হলো। ইচ্ছে করলে এগুলো ছাড়াই বিচারের রায় ঘোষণা করতে পারত রাজা হুরোতাস; কিন্তু সে আসলেই একজন দয়ালু মানুষ।
এই দস্যুদলের সবার জন্য শাস্তির বিধান ঘোষণা করা হবে এখন। তার আগে তাদের দলনেতার যদি কিছু বলার থাকে তবে বলতে পারে, ঘোষণা করল সে।
এতক্ষণ ধরে সিংহাসনের সামনে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে উবু হয়ে বসে ছিল পানমাসি। তার লোকেরাও সবাই একই অবস্থানে বসে ছিল। এবার সে উঠে দাঁড়াল। ইতোমধ্যে আমি বলেছি মহা ধূর্ত এক মানুষ সে। কিন্তু এবার সে যে তুখোড় অভিনয় শুরু করল তাতে এমনকি আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। প্রথমেই চেহারায় প্রচণ্ড দুঃখ এবং আফসোসের ভাব ফুটিয়ে তুলল সে, যেন নিজের অপরাধার জন্য সত্যিই অনুতপ্ত। খোঁড়া পা ইচ্ছে করেই অনেক বেশি টেনে টেন হাঁটছে, নিঃসন্দেহে উপস্থিত সবার সহানুভূতি কাড়ার জন্য। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ময়লা আর অশ্রু থুতনিতে এসে জমা হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে নিচে। কাঁপা গলায় মিশরে নিজের ফেলে আসা পরিবারের বর্ণনা দিতে শুরু করল সে। তিন স্ত্রীর কথা বলল, যাদের প্রত্যেকেই গর্ভবতী। বারোটা সন্তান আছে তার, তাদের মাঝে একজন আবার পঙ্গু একটা মেয়ে, যাকে সে অত্যন্ত ভালোবাসে। সে না থাকলে সবাই না খেয়ে মরবে। কথাগুলো এমনই অবিশ্বাস্য যে, অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলাম আমি। পানমাসি যে লুক্সরের বুকে অন্তত চারটি পতিতালয়ের মালিক, এ কথা নিশ্চিতভাবে জানা আছে আমার। এবং এটাও জানি যে, ওগুলোর সেরা খদ্দের সে নিজেই। শুধু বউদের আর্তনাদ শুনে মজা পাওয়ার জন্যই ওদের ধরে ধরে পেটায় সে। আর তার মেয়েটা পঙ্গু হয়েছে, কারণ সে ভালো করে হাঁটতে শেখার আগেই একবার তার মাথায় কোদাল দিয়ে বাড়ি মেরেছিল পানমাসি। সে যখন এই আবেগঘন বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে চলে এলো তখন আমার মতামত জানার জন্য আমার দিকে তাকাল রাজা হুরোতাস। মাথা নাড়লাম আমি। আমার আর তার প্রায় একই রকম, এটা বুঝতে পেরে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকাল হুরোতাস।
রায় শোনার জন্য সকল বন্দিকে উঠে দাঁড়াতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, বলল সে। অপরাধীরা সবাই উঠে দাঁড়াল, তবে এখনো সবার চোখ মাটির দিকে। আমার ধারণা হুরোতাসের মুখ থেকে উচ্চারিত হওয়ার আগেই তাদের কী শাস্তি হতে যাচ্ছে এ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে গেছে সবাই।
আজ থেকে ষাট দিন পর আমার মেয়ে সেরেনার সাথে বিয়ে হতে যাচ্ছে মিশরের রাজপরিবারের সদস্য যুবরাজ রামেসিসের। সেই আনন্দঘন উৎসবের দিনে আমার মেয়ের সুখ-শান্তিকে নিশ্চিত করার জন্য বিবাহ এবং বৈবাহিক সম্পর্কের অভিভাবক দেবী হেরার নামে এই ষোলোজন বন্দিকে উৎসর্গ করা হবে। প্রথমে মাছ ধরার বড়শির সাহায্যে বন্দিদের নাড়িভুড়ি তাদের পেছন দিক থেকে বের করে আনা হবে। তারপর তাদের শিরচ্ছেদ করা হবে। সব শেষে তাদের মৃতদেহকে আগুনে পুড়িয়ে সেই ছাই ভাটার সময় সমুদ্রের পানিতে ছুঁড়ে দেওয়া হবে। এই সময় দেবী হেরার পূজারিনিরা আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ সুখ কামনা করে প্রার্থনা সংগীত গাইবে হেরাকে উদ্দেশ্য করে।
রাজা হুরোতাসের রায়ে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকালাম আমি। অপরাধীদের অপরাধের মাত্রা বিচার করলে কোনো সন্দেহ নেই যে সঠিক শাস্তিই দেওয়া হয়েছে তাদের।
না!
জোর গলায় বলে ওঠা কথাটা শুনে সবাই চমকে উঠল, এমনকি আমি এবং রাজা হুরোতাসও। সবগুলো মাথা একই সাথে ঘুরে গেল রাজকুমারী সেরেনার দিকে, সবার মুখে একই রকম হতচকিত ভাব। ওদিকে সেরেনা তখন তার বাবার বিরোধিতা করতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
না! আবার বলে উঠল ও। এক শ বার না!
এই অভাবনীয় আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার পর সম্ভবত সবার আগে হুরোতাসই প্রাথমিক চমকটা কাটিয়ে উঠল। সেরেনা তার একমাত্র সন্তানই শুধু নয়, বরং একমাত্র দুর্বলতাও বটে। না কেন প্রিয় কন্যা আমার? প্রশ্ন করল সে। আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম নিজের মেজাজকে সামলে রাখতে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে তাকে। এই কাজ তো আমি তোমার সুখ নিশ্চিত করার জন্যই করছি।
আমি তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসি বাবা। কিন্তু এক সারিতে শুইয়ে রাখা ষোলোটা মাথাবিহীন লাশ দিয়ে আমাকে সুখী করা যাবে, এমনটা ভাবলে ভুল ভেবেছ তুমি।
ওদিকে প্রাঙ্গণে উপস্থিত আর সবার মতোই পানমাসি আর তার লোকেরাও প্রথমবারের মতো মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাকিয়ে আছে রাজকুমারীর দিকে। এবার তাদের চেহারায় আশার আলো ফুটতে দেখলাম আমি। কিন্তু তার চাইতেও বেশি স্পষ্ট হয়ে যেটা ফুটেছে সেটা হলো সেরেনার সৌন্দর্য দেখে তাদের অবিশ্বাস মেশানো বিস্ময়। তার ওপর এখন প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে আছে সেরেনা, ফলে তার টুকটুকে লাল গাল জ্বলজ্বলে চোখ আর ঈষৎ কাঁপতে থাকা সুন্দর ঠোঁট জোড়া- এগুলোকে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ওর কণ্ঠস্বর যেন কোনো স্বর্গীয় বাদ্যযন্ত্রের সুমধুর বাজনা, সম্মোহিত করে রেখেছে শ্রোতাদের। এমনকি ওর কণ্ঠস্বর শুনে অভ্যস্ত আমিও যেন বিমোহিত হয়ে পড়েছি।
তাহলে এই দস্যুদের নিয়ে কী করা উচিত বলে তোমার মনে হয়? হতাশামাখা গলায় প্রশ্ন করল হুরোতাস। ইচ্ছে করলে ওদেরকে রণতরীর দাঁড় বাওয়ার কাজে লাগিয়ে দিতে পারি আমি, অথবা তামার খনিতে পাঠাতে পারি শ্রমিক হিসেবে…
মিশরে ওদের স্ত্রী এবং পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দাও সবাইকে, তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল সেরেনা। যদি তুমি দয়াপরবশ হয়ে এই কাজটুকু করো তাহলে অনেক মানুষ খুশি হবে। এবং আমিও আমার বিয়ের দিনে সুখী হব, বাবা।
কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল হুরোতাস। দেখলাম রাগে জ্বলে উঠল তার চোখ জোড়া। তার পরেই হঠাৎ মুখ বন্ধ করে ফেলল সে। উভয় সংকটে পড়লে তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনেকেই যে কাজটা করে হুরোতাসও সেই একই কাজ করল। অসহায় চোখে আমার দিকে তাকাল সে। হা হা করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করল আমার। যুদ্ধের ময়দানে অভিজ্ঞ সেনানীকে সামান্য এক তরুণীর হাতে নাস্তানাবুদ হতে দেখলে হাসি পাওয়ারই কথা।
বহুদিন আগেই আমি হুরোতাসকে ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে কথা পড়তে শিখিয়েছিলাম। এবার নিঃশব্দে দুটো শব্দ উচ্চারণ করল আমার ঠোঁট। মেনে নাও! ওকে উপদেশ দিলাম আমি।
গম্ভীর চেহারায় সেরেনার দিকে ফিরল হুরোতাস। এটা কিন্তু একেবারেই বোকামি, কড়া গলায় মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল সে। আমি আর এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। এই দস্যুদেরকে তোমার বিয়ের উপহারের অংশ হিসেবে দান করা হলো। এবার তুমি ওদের নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারো।
দ্বীপের অন্য প্রান্তে সৈকতের কাছাকাছি খোঁজাখুঁজি করতেই সেই ছোট্ট মাছ ধরার নৌকাটা পাওয়া গেল, যাতে করে নীলনদের মুখ থেকে এ পর্যন্ত এসেছিল পানমাসি আর তার লোকেরা। নৌকাটা টেনে তীরে উঠিয়ে শুকনো পাতা আর শেওলা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল তারা। নৌকাটা দেখতে যেমন নড়বড়ে মনে হয় আদতে নিশ্চয়ই তার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। তা না হলে এত অল্প সময়ে এতগুলো লোক নিয়ে এই দূরের পথ পাড়ি দিতে পারত না। রাজকুমারী সেরেনার ইচ্ছে অনুযায়ী আমার লোকেরা পানমাসি এবং তার অবশিষ্ট সঙ্গীদের নৌকায় তুলে দিল। তবে অস্ত্র বা খাবারদাবার কিছুই দেওয়া হলো না তাদের। এবার দক্ষিণ দিকে নীলনদের অববাহিকা বরাবর আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলাম আমি।
আমাদের কাছে খাবার বা পানি কিছুই নেই, অনুনয় জানাল পানমাসি। ক্ষুধা তৃষ্ণায় মারা যাব আমরা সবাই। দয়া করো, হে টাইটা। তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি আমি।
তোমাকে বড়জোর কিছু উপদেশ দিতে পারি আমি। কিন্তু খাবার এবং পানি দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ ওগুলোর দাম বেশি, আর আমাদের কাছে খুব অল্প পরিমাণেই আছে। তবে প্রস্রাব ঠাণ্ডা করে রাখতে পারো। ওভাবে খেতে অনেক বেশি ভালো লাগে, বন্ধুত্বপূর্ণ গলায় তাকে বললাম আমি। চব্বিশ ঘণ্টার সময় দেওয়া হচ্ছে তোমাদের। তার পরই তোমাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য একটা রণতরী পাঠিয়ে দেব আমি। বিদায়, পানমাসি। মিশরে পৌঁছানোর পর ফারাও উটেরিককে আমার শুভেচ্ছা জানিও- অবশ্য যদি কোনো দিন পৌঁছতে পারো আর কি। এই বলে আমার লোকদের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকালাম আমি। এতক্ষণ বন্দিদের পাহারা দিচ্ছিল ওরা, আমার ইশারা পেয়ে এবার ঘোড়া থেকে নেমে নৌকাটাকে সৈকত থেকে সাগরে ঠেলে নামানোর প্রস্তুতি নিতে লাগল। কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা সুরেলা গলার চিৎকারে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হলো তারা।
দাঁড়াও টাইটা! এখনই যেতে দিও না ওদের! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি। দেখলাম ল্যাসিডিমনের রাজকুমারী সেরেনা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার পেছনে রয়েছে ছয়টা মালবাহী ঘোড়া, প্রত্যেকটার পিঠে বোঝাই খাবারের ঝুড়ি আর পানির মশক। জঙ্গলের মাঝ থেকে বেরিয়ে সৈকতের বালি পেরিয়ে এদিকেই আসছে তারা। ওদের কি খাবার বা পানির দরকার হবে না, বোকা কোথাকার? কাছে এসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল ও। মিশরে পৌঁছানোর আগেই তো খিদে তেষ্টায় মারা যেত সবাই!
আমি তো সেটাই আশা করছিলাম, বিড়বিড় করে বললাম আমি। কথাটা শুনেও না শোনার ভান করল সেরেনা। পরিস্থিতি আরো বিব্রতকর হয়ে উঠল যখন দেখলাম খাবার আর পানি ছাড়াও হুরোতাসের ভাড়ার থেকে বড় বড় দুই মশক ভর্তি সবচেয়ে ভালো লাল মদও নিয়ে এসেছে ও। আমার কাছে এটা একেবারেই বোকামি বলে মনে হলো।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সেরেনার পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল পানমাসি, তার সৌন্দর্য, মহানুভবতা আর দয়ার প্রশংসা করতে লাগল প্রাণ খুলে। সকল দেবতার আশীর্বাদ কামনা করল সে সেরেনার ওপর। কিন্তু ব্যাটা চোখের কোণ দিয়ে সেরেনার দিকে কীভাবে তাকাচ্ছে সেটা আমার চোখ এড়াল না, এবং বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম আমি। এগিয়ে গিয়ে দড়াম করে পানমাসির দুই নিতম্বের মাঝ বরাবর একটা লাথি কষলাম। উল্টে পড়ে গেল লোকটা। বললাম, এবার ভাগ এখান থেকে, ব্যাটা ধাড়ি ছুঁচো কোথাকার। আর কখনো যেন এই দিকে না দেখি তোকে, তাহলে মাটিতে পুঁতে রেখে দেব। চিরকাল তখন এখানেই থাকতে হবে তোকে!
পাছা ডলতে ডলতে তাড়াতাড়ি নৌকার দিকে ফিরে গেল পানমাসি, চিৎকার করে গালাগালি করছে নিজের লোকদের। দ্রুত দাঁড় বাইতে শুরু করল লোকগুলো, তারপর প্রবালপ্রাচীর পার হয়েই পাল খাটাল নৌকায়। দক্ষিণ দিকে ভেসে চলল তাদের নৌকায়। পানমাসি আর আমি পরস্পরের দিকে তাকিয়েই রইলাম, যতক্ষণ না দূরত্বটা অনেক বেশি হয়ে দাঁড়াল, তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে প্রিয় রাজকুমারীকে নিয়ে দুর্গ-প্রাসাদে ফিরে এলাম আমি। কেন যেন আমার মনে হতে লাগল ওই ধূর্ত শয়তানটার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা নয়, আবারও ওর মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।
পরবর্তী দিনগুলোর ব্যস্ততা আর আনন্দও আমার মন থেকে এই আশঙ্কা পুরোপুরি মুছে ফেলতে ব্যর্থ হলো। বেশ কয়েকবার সেরেনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙে ফেলতে মন চাইল আমার, ইচ্ছে করল মেমননকে নিয়ে ধাওয়া করি পানমাসির পেছনে, সব ঝামেলা চুকিয়ে দিয়ে আসি। আমি জানি, ইচ্ছে করলে রামেসিসকে আমার সাথে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারব। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার অর্থ হচ্ছে নিজের সম্মানকে বিনষ্ট করা। আমার মুখ দিয়ে একবার যে কথা বের হয় তাকে আমি পবিত্র বলে গণ্য করি।
এখন যখন চিন্তা করি যে ওই একবার যদি আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতাম তাহলে হয়তো সহস্র সাহসী এবং সম্মানিত মানুষের জীবন বেঁচে যেত। সেইসাথে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা আর কষ্ট থেকে বেঁচে যেত আমার কাছের প্রিয় মানুষগুলো। কিন্তু এই চিন্তাতে খুব সামান্যই সান্ত্বনা মেলে।
*
মিশরের যুবরাজ রামেসিস এবং স্পার্টার রাজকুমারী সেরেনার বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রায় সম্পূর্ণ দায়িত্ব পড়ল আমারই ঘাড়ে। যার অর্থ হচ্ছে যদি সব কিছু ঠিকভাবে ভালায় ভালোয় শেষ হয় তবে তার সম্পূর্ণ প্রশংসা পাবে স্পার্টার রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতি। আর যদি কোনো কারণে কোনো বিপদ দুর্যোগ বা ঝামেলা এসে হাজির হয় তাহলে অভিযোগের সবগুলো আঙুল সাথে সাথে তাক করা হবে আমার দিকে।
বিয়ের আসল অনুষ্ঠানের আগে এক মাস ধরে চলবে বিবাহপূর্ব উৎসবের বহর। এবং তার পরের এক মাস চলবে বিবাহ-পরবর্তী উৎসব। রানি তেহুতির অনুরোধ অনুসারে এই সব অনুষ্ঠানই উৎসর্গ করা হবে দেবতা অ্যাপোলোর নামে, যিনি উর্বরতা বা বহু সন্তান জন্মদানের দেবতা, যদিও তার অন্যান্য গুণের মাঝে অবিশ্বস্ততাও রয়েছে।
এই অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রধান অংশ হিসেবে থাকবে ভোজ এবং আনন্দ উৎসব, দেড় শ প্রধান প্রধান দেবতা এবং দেবীর পুজো, রথের দৌড় এবং নৌকাবাইচ, নাচগান, প্রচুর পরিমাণে মদপান, কুস্তি; গান, বক্তৃতা এবং ধনুর্বিদ্যার প্রতিযোগিতা, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি। সবগুলো অনুষ্ঠান এবং প্রতিযোগিতাতেই থাকবে বিজয়ীদের জন্য সোনা এবং রুপোর প্রচুর পরিমাণে পুরস্কারের ব্যবস্থা।
রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতির আমন্ত্রণে আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে আসছে তাদের মোলোজন করদ রাজা এবং তাদের পরিবার। উপরোক্ত কাজগুলোর দেখাশোনার সাথে সাথে তাদের উপযুক্ত বাসস্থান নির্মাণের তদারকিও করতে হবে আমাকে।
হুরোতাসের সাথে এসব রাজাদের সম্পর্কটা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। প্রায় ত্রিশ বছর আগে ক্রিট থেকে তেহুতিকে নিয়ে পালানোর পর হুয়োতাস পৃথিবীর বুকে এক টুকরো জায়গা খুঁজছিল, যেখানে সে রাজ্য বিস্তার করতে পারে, হয়ে উঠতে পারে শক্তিশালী। গিথিয়ন বন্দরে প্রথমবারের মতো নোঙর করার পর তৎকালীন রাজা ক্লাইডিসের কাছ থেকে তার রাজ্য দখল করে নেয় সে, বর্তমানে যার নাম ল্যাসিডিমন। কাজটা করার জন্য বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি তাকে, স্রেফ রাজার অসন্তুষ্ট প্রজাদের বিদ্রোহ করতে উৎসাহ দিয়েছে, তারপর হুরোতাস নদীর তীরে তিন দিন ধরে চলা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করেছে রাজাকে।
রাজ্যের উত্তরে আরো তিনটি রাজ্যের রাজাদের নিজের মিত্র হিসেবে পেয়েছিল ক্লাইডিস। তারা তিনজনই যুদ্ধে ক্লাইডিসের পক্ষে লড়তে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে। তবে তাদের বড় ছেলেরা নতুন রাজা হুরোতাসের কর্তৃত্ব মেনে নেয়। তবে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়নি হুরোতাস, অথচ সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তার বদলে তিনজনের কাছ থেকে আনুগত্যের শপথ দাবি করে সে। বলা বাহুল্য, তিনজনই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে সেই প্রস্তাব মেনে নেয়, কারণ তারা ভেবেছিল মরণই তাদের কপালে লেখা আছে। তারপর তাদের ট্যাগেটাস পর্বতমালার অপর পাশে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে অনুমতি দেয় হুরোতাস। রাজ্যগুলো ইতোমধ্যে তার দখল চলে এলেও তিন পুত্রকে স্বাধীনভাবে রাজ্য চালানোর অনুমতি দেয় সে, নিজের জন্য রাখে কেবল ক্লাইডিসের রাজ্যটুকু।
স্বাভাবিকভাবেই এরপর আজীবন নিজ নিজ রাজ্যের আয় থেকে বেশ বড় অঙ্কের একটা অংশ হুরোতাসকে দিতে আগ্রহী হয় সেই তিনজন। তাদের উত্তরাধিকারীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম চালু করা হয়। এমন এক ব্যবস্থা, যাতে সবাই লাভবান হচ্ছে, কেউ বেশি আর কেউ একটু কম- এই যা।
তিন রাজাকে তাদের জীবন এবং রাজ্য দুটোই নিজেদের দখলে রাখার অনুমতি দেয় হুরোতাস। ওদিকে তার নিজেরও তিন-তিনটে রাজ্যের অসংখ্য বর্বর গোত্রের অধিবাসীকে সামলানোর ঝামেলায় যাওয়া লাগছে না, যাদের আনুগত্য বা আত্মসমর্পণের অর্থ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। পরবর্তী বছরগুলোতে আশপাশের দ্বীপগুলোর মোলোজন রাজার সবাই হুরোতাসের আধিপত্য মেনে নেয় একই শর্তে: হয় আনুগত্য না হয় মৃত্যু। একমাত্র হুরোতাসই সবগুলো গোত্রের প্রধানকে একই হাতের শাসনের নিচে রাখার মতো বুদ্ধি এবং যোগ্যতা রাখে। সবাইকে শাসন করার জন্য যদি সে না থাকত তাহলে পরস্পরের মাঝে চিরন্তন বিবাদে লিপ্ত থাকত রাজ্যগুলো। তবে এখন তাদের নিজেদের মাঝে কিছুটা ঠাণ্ডা সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও কেউ যুদ্ধে নামতে সাহস পায় না। আর হুরোতাসের প্রতি তাদের সম্মান এবং ভয়ের পরিমাণ এত বেশি যে, তার কোনো নির্দেশ কখনো অমান্য করার কথা চিন্তাও করে না কেউ। এবং একই সাথে নির্দিষ্ট তারিখের অনেক আগেই তার প্রাপ্য কর দিয়ে দেয় সবাই।
এবং এরই ধারাবাহিকতায় আজ তিন দশকেরও বেশি সময় পর হুরোতাস তার ষোলোজন করদ রাজাকে অথবা তাদের উত্তরাধিকারীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তার মেয়ের বিয়েতে। আর আমার দায়িত্ব পড়েছে এই সব ঝামেলা সামলানোর।
শোমু ঋতু শুরু হওয়ার ঠিক ত্রিশ দিন আগেই সব কিছু প্রস্তুত করে রাখতে হবে। নীলনদের পানি যখন কমে যায় এবং আমাদের মিশরে গ্রীষ্মকাল নেমে আসে সেই সময়কে বলা হয় শোমু। ল্যাসিডিমন আলাদা একটি রাজ্য হলেও এখানে এখনো যথাযথভাবে মিশরের দিনপঞ্জি মেনে চলা হয়, কারণ হুরোতাস আর তার স্ত্রী তেহুতির জন্ম সেখানেই। এ ছাড়া তাদের মাতৃভাষাও মিশরীয়। বিয়ের কনের লাল চাঁদ শেষ হওয়ার দিনটি খুব সাবধানতার সাথে হিসাব করার পর তার সাথে আরো দশ দিন যোগ করেছে রাজকুমারী সেরেনা এবং রানি তেহুতি। কনে যেন বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীকে বিছানায় সঠিকভাবে স্বাগতম জানাতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্যই এই আয়োজন। এই হিসাবে শোমুর প্রথম দিনকে বিয়ের দিন হিসেবে ঠিক করা হয়েছে।
এর অর্থ হচ্ছে শোমুর আগের মাস থেকেই বিয়ের অতিথিরা সবাই এসে পৌঁছতে শুরু করবে এবং উৎসবও তখন থেকেই শুরু হবে। সেই মাসটার নাম হচ্ছে রেনওয়েত, নীলনদে বেশি পানি থাকার শেষ মাস।
চাবুক খাওয়া ক্রীতদাসের মতো খেটে চললাম আমরা সবাই, কারণ হাতে সময় খুব কম। তার ওপর আবার আমার দুই প্রিয় নারী তেহুতি এবং সেরেনার মাথায় কিছুক্ষণ পরপরই অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য নতুন নতুন সব বুদ্ধি আসছে, এবং প্রতিটি বুদ্ধিই তার আগেরটার চাইতে বেশি জটিল এবং কঠিন।
আমরা তো জানি, এসব করতে তোমার কোনো কষ্টই হবে না, টাটা। তুমি তো বুদ্ধিতে সবার সেরা। তুমি পারবে না এমন কোনো কাজ নেই। আমাকে নিরাশ করবে না তুমি, আমি জানি। হাজার হোক সেরেনার বিয়ের অনুষ্ঠান বলে কথা, প্রতিবার নতুন আবদার নিয়ে আসার পর আমার গালে চুমু খেয়ে এই কথা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছে তেহুতি।
শেষ পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক দিক থেকে দিগন্তে দেখা দিতে শুরু করল আমাদের অতিথিদের জাহাজ। গিথিয়ন উপসাগরের দিকে এগিয়ে আসছে তারা, যেখানে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিজ নিজ সেনাপতির সাথে অপেক্ষা করছে। তাদের স্বাগত জানানোর জন্য। তীরে নামার পর হুরোতাস নদীর তীর ধরে তাদের নিয়ে আসা হবে দুর্গ-প্রাসাদে, যেখানে সবার জন্য বিলাসবহুলভাবে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো ব্যাপারটা সামলানো বেশ জটিল হয়ে দাঁড়াল, বিশেষ করে একসাথে একের বেশি জাহাজ তীরে এসে যখন থামল। নিজেদের প্রাধান্যের বিচারে আমাদের অতিথিরা খুবই স্পর্শকাতর। প্রয়োজন হলে দাঁত খিঁচিয়ে খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে কে আগে এসেছে তার ফয়সালা করবে তারা। দুই পক্ষকেই বুঝিয়ে-শুনিয়ে সামলে রাখতে গিয়ে নিজের কুটনৈতিক জ্ঞানের সবটুকু প্রয়োগ করতে হলো আমাকে।
তবে শেষ পর্যন্ত আমার কারিশমায় মুগ্ধ হয়ে সবাই শান্ত হয়ে তীরে নামতে পারল। সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ায় আমার দক্ষতার কারণেই দাঙ্গা-হাঙ্গামা। থেকে বেঁচে গেলাম আমরা।
তীরে নামার সাথে সাথেই প্রধান প্রধান অতিথি এবং তাদের স্ত্রী ও রক্ষিতাদের তুলে দেওয়া হলো অপেক্ষমাণ রথ বাহিনীর জিম্মায়। তাদের সাথে থাকল অশ্বারোহী সৈন্যদের সারি, সেইসাথে বাদকদের দল। উল্লসিত জনতা ভিড় করে দাঁড়িয়ে রইল পথের দুই পাশে, তাদের সাথে আরো থাকল নৃত্যরত মেয়ের দল। গিথিয়ন বন্দর থেকে শুরু করে দুর্গ-প্রাসাদের প্রধান দরজা পর্যন্ত পুরো পথ ঢেকে দেওয়া হলো নানা রকমের ফুল দিয়ে।
দুর্গে অতিথিদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিল রাজা হুরোতাস এবং রানি তেহুতি। তাদের সাথে যুবরাজ রামেসিস এবং তার হবু স্ত্রীও ছিল। উপস্থিত অতিথিদের মাঝে খুব কম ব্যক্তিই এর আগে সেরেনাকে সচক্ষে দেখেছে। যদিও তার অপার্থিব সৌন্দর্যের কথা কারো অজানা নয়; কিন্তু তাকে সামনাসামনি দেখার জন্য বোধ হয় কেউই প্রস্তুত ছিল না। এমনকি এর আগে যারা সেরেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে ল্যাসিডিমন এসেছিল তারাও যেন সেরেনার সৌন্দর্যের কথা ভুলে গেছে, কারণ একই রকম বজ্রাহত চেহারা হলো তাদেরও। এক এক করে এলো তারা, আর সেরেনার সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল কেবল। কিন্তু কয়েক মিনিটের মাঝেই সেরেনার উষ্ণ এবং সহজ ব্যবহার আর উজ্জ্বল হাসি তাদের সবাইকে এই সম্মোহিত অবস্থা থেকে বের করে আনল।
সেরেনার অনেকগুলো গুণের মাঝে এটাও একটা; নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে যেন কোনো ধারণাই নেই ওর। একটুও অহংকার কখনো দেখা যায় না ওর মাঝে। এতে যে ওর আকর্ষণ আরো বাড়ে তাতে অবশ্য কোনো সন্দেহ নেই। ভিড়ের মাঝেও ওর অবস্থান খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায় জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়া উত্তেজনার জোয়ার দেখে। ও যেখানেই যায় সেখানেই ওর চারপাশের সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, ওর সৌন্দর্যের সুধা পান করতে চায় প্রাণ ভরে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, অন্য মেয়েদের মাঝে কখনো সেরেনাকে নিয়ে হিংসার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না। তাদের কেউই যেন সেরেনার সাথে পাল্লা দেওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না; সেরেনার সৌন্দর্য যেন ধূমকেতুর মতোই সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। মেয়েরা বরং নিজেদের মাঝে সেরেনাকে নারীসুলভ সৌন্দর্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন বলে ধরে নেয়, ওকে নিয়ে গর্ব করে। সেরেনার মোহনীয়তা মেয়েদের সবার মাঝে প্রতিফলিত হয়, আর এ জন্যই তারা ওকে আরো বেশি ভালোবাসে।
এভাবেই রাজকীয় বিবাহের সব আয়োজন শুরু হলো। বিয়ের দিন যত কাছে ঘনিয়ে এলো অতিথিদের উত্তেজনার পারদও তত চড়তে লাগল। আনন্দমুখর পরিবেশে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই। মনে হতে লাগল যেন প্রকৃতিও এই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে, তাই অনুষ্ঠান যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। বৃষ্টি হতে লাগল; কিন্তু শুধু রাতের বেলা। ছাদের ওপর বৃষ্টির সেই শব্দ শুনলেই ভালো হয়ে যায় মন। ভোর হওয়ার সাথে সাথে পরিষ্কার হয়ে যেতে লাগল আকাশ, সমস্ত দিন বিরাজ করতে লাগল সূর্যের কোমল আলো। দক্ষিণ দিক থেকে মৃদুমন্দ বাতাস বইতে লাগল। পানিতে হালকা ঢেউ উঠতে লাগল সেই বাতাসে, এবং শেষ অতিথিদের জাহাজগুলোও ধীরে ধীরে এসে ভিড়ল গিথিয়ন বন্দরে।
উৎসবমুখর এই পরিবেশে এখন শুধু একটাই আশঙ্কা কালো মেঘের মতো জমে আছে মাথার ওপর। সেটা হলো ফারাও উটেরিকের চরদের দ্বারা মেমননকে গিথিয়ন বন্দর থেকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। এর ফলে যুবরাজ রামেসিস এবং তার হবু স্ত্রীর ওপর বিপদের আশঙ্কা কেউ অস্বীকার করতে পারছে না।
ইতোমধ্যে সভ্য পৃথিবীর সবাই জেনে গেছে যে ফারাও উটেরিক এক বদ্ধ উন্মাদ, যার হাতের মুঠোয় রয়েছে এক শক্তিশালী সেনাদল ও নৌবাহিনী। সবাই এটাও বুঝতে পারছে যে, সামান্য কোনো ছুতো পেলেই এগুলো ব্যবহারে কোনো দ্বিধা করবে না সে।
যদিও রাজা হুরোতাস তার মেয়েকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে এবং বিয়ের এই উৎসব শুধু তার সম্মানেই আয়োজন করা হচ্ছে; তবু এই সময়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বগুলো এগিয়ে রাখার সুযোগটাকেও অবহেলা করল না সে। প্রতিদিন দুপুরে তার মন্ত্রণাকক্ষে বন্ধ দরজার ওপাশে গোপন অধিবেশনের আয়োজন করতে লাগল হুরোতাস, যেখানে উপস্থিত থাকল ল্যাসিডিমনে আগত সকল করদ রাজা এবং গোত্রপ্রধান। ইচ্ছে করেই দিনের এই সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে অধিবেশনের জন্য। কারণ দিনের শেষ দিকে অর্থাৎ বিকেল থেকে যখন উৎসবের নানা আয়োজন শুরু হয় সেইসাথে সবাই গলায় ঢালে রাজা হুরোতাসের আঙুর বাগান থেকে তৈরি করা উৎকৃষ্ট মদ, তখন আসলে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার ব্যাপারগুলো আলোচনা করার সময় নয়।
*
মিশরের যুবরাজ রামেসিস এবং স্পার্টার রাজকুমারী সেরেনার বিয়ের নির্দিষ্ট তারিখের দিন পনেরো আগে হুরোতাস এবং রামেসিসসহ সব মিলিয়ে আঠারোজন রাষ্ট্রপ্রধান সমবেত হয়েছে দুর্গের মন্ত্রণাকক্ষে।
এর আগের দিন এই পরিষদ নিজেদের মাঝে নির্বাচনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, উটেরিককে মিশরের ফারাও হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না, কারণ হচ্ছে তার উন্মাদগ্রস্ত অবস্থা। উটেরিকের বদলে রামেসিসকে ফারাও হিসেবে নির্বাচন করেছে তারা।
পরিষদের সদস্যরা সবাই আসন গ্রহণ করার পর হুরোতাস তার কথা শুরু করল। এই মুহূর্ত থেকে উত্তরের পরিষদের আলোচনা সভা শুরু হচ্ছে। আমি এই পরিষদের প্রধান সচিব প্রভু টাইটাকে আহ্বান জানাচ্ছি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তির শর্তগুলো পড়ে শোনাতে, যা ক্যালিপোলিসের রাজা টিন্ডারকাস আমাদের সামনে উত্থাপন করেছেন।
পরিষদের সদস্যদের মাঝে কেবল টিল্ডারকাস, রামেসিস এবং রাজা হুরোতাস পড়তে পারে। আর আমি একমাত্র ব্যক্তি যাকে কোনো কিছু পড়ার সময় ঠোঁট নাড়তে হয় না। সে জন্যই টিন্ডারকাসের মাধ্যমে চুক্তি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে হুরোতাস, আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে সেটা সবাইকে পড়ে শোনানোর। চুক্তিতে খুব বেশি হলে শ পাঁচেক শব্দ আছে। কিন্তু তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে উত্তর পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কোনো একটির সার্বভৌমত্ব বা তার নাগরিকদের ওপর যদি কোনো বাইরের শক্তির আক্রমণ ঘটে তাহলে বাকি সদস্য রাষ্ট্রগুলো তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে বাধ্য থাকবে।
চুক্তিনামা পড়ে শোনানোর পর কিছু টুকটাক আলোচনা চলল সবার মাঝে। তবে শেষ পর্যন্ত সবাই চুক্তির শেষে স্বাক্ষর করল অথবা নিজেদের চিহ্ন এঁকে দিল। পরিষদের সদস্যদের সবার মাঝেই বেশ হালকা মেজাজ বিরাজ করছে। কক্ষের ভেতরের কাজ শেষ হতে রাজা হুরোতাসের সাথে বাইরের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াল সবাই। এখানে আগেই বেঁধে রাখা হয়েছে একটা শক্তিশালী কালো ঘোড়া।
সদস্যদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে রুপার পেয়ালা তুলে দেওয়া হলো। ঘোড়ার চারপাশে জড়ো হলো সবাই। এবার নিজের যুদ্ধ কুঠারটা তুলে ধরে গায়ের জোরের ঘোড়ার খুলির ওপর একটা কোপ মারল হুরোতাস। সাথে সাথে মারা গেল ঘোড়াটা। এবার এক এক করে সমস্ত শাসক এবং রাজারা সামনে এগিয়ে এলো, হাতের পেয়ালাটা ধরল ঘোড়ার খুলি থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্তের সামনে। উষ্ণ রক্তভর্তি পেয়ালা মাথার ওপর তুলে ধরে তারা শপথ করল, যদি আমি এই পবিত্র শপথ ভঙ্গ করি তাহলে যেন আমার রক্তও একইভাবে প্রবাহিত হয়। এই কথা বলে এক চুমুকে পেয়ালা খালি করে ফেলল সবাই। কয়েকজন উচ্চ স্বরে হেসে উঠল ঠিকই তবে কাঁচা রক্তের স্বাদে অনেকেরই বমি আসার জোগাড় হলো। আমি নিশ্চিত, ওদের মাঝে কেউই ভাবেনি যে এই মাসটা শেষ হওয়ার আগেই শপথের শর্ত অনুযায়ী কাজে নামতে হবে ওদের।
*
রামেসিস এবং সেরেনার বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে এলো ততই বাড়তে শুরু করল উৎসবের তীব্রতা। বিয়ের ঠিক চৌদ্দ দিন বাকি থাকতে হুরোতাস ঘোষণা করল এবার ল্যাকোনিয়ান শূকর শিকার করার সময় হয়েছে। এই বিশেষ প্রাণীটার ইতিহাস অনেক পুরনো, এবং একই সঙ্গে হুরোতাসের পুরনো শত্রুও বটে।
জারাস এবং তেহুতি যখন বহু বছর আগে ল্যাসিডিমনে এসে পৌঁছাল এবং জারাস পরিণত হলো রাজা হুরোতাসে; তার অনেকগুলো কাজের মাঝে একটা ছিল প্রথম আঙুরের চাষ করা। সেই আঙুর বাগান থেকে এই দ্বীপের প্রথম মদ তৈরি করেছিল সে।
কিন্তু তার পরেই একটা বড় ভুল করে বসে রাজা হুরোতাস। আঙুর বাগানের নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধি কামনা করে সে সব দেব-দেবীর পুজো দেয় ঠিকই; কিন্তু সেই তালিকায় দেবী আর্টেমিসের নাম যোগ করতে ভুলে যায়। আর্টেমিসের অনেকগুলো দায়িত্বের মাঝে একটা হলো, তিনি সমস্ত অরণ্য এবং বুনো প্রাণীর দেবীও বটে। আঙুর বাগানের জন্য জায়গা করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলে হুরোতাস। যে সমস্ত প্রাণী তার বাগানের ক্ষতি করতে পারে, যেমন বুনো শূকর, তাদের সবাইকে তাড়িয়ে দেয় জঙ্গল থেকে। বুনো শূকর হচ্ছে দেবী আর্টেমিসের অন্যতম প্রিয় একটা প্রাণী। স্বভাবতই হুরোতাসের এই উদ্ধত ব্যবহারে দারুণ রেগে যান তিনি।
তখন হুরোতাসকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য, সেইসাথে তার আঙুরের বিশাল বাগান মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য ল্যাকোনিয়ান শূকরকে পাঠান দেবী আর্টেমিস। স্বাভাবিক কোনো বুনো শূকর নয় ওটা। কেবল দেহে রাজরক্ত বইছে এমন কেউ অথবা দেবত্বের অধিকারী কারো পক্ষেই সম্ভব এই শূকরকে হত্যা করা, এবং সেটাও নেহাত সহজে নয়। যতবারই এই ল্যাকোনিয়ান শূকরকে হত্যা করা হোক না কেন, দেবী আর্টেমিস প্রত্যেক বছর এর পুনর্জন্ম ঘটানোর ব্যবস্থা করেন। প্রতিবছর ওটা হুরোতাসকে জ্বালাতে ফিরে আসে। আর প্রতিবছর দেবীর পাঠানো এই প্রাণীর চেহারা হয় আগের বছরের চাইতে আরো বিশাল, একই সাথে আরো বেশি ভয়ংকর আর হিংস্র।
হুরোতাসকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য শেষবার দেবী আর্টেমিস যে শূকরটাকে পাঠিয়েছিলেন সেটার কাঁধ বরাবর উচ্চতা ছিল প্রায় ছয় কিউবিট, যা একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের উচ্চতার সমান। ওজন ছিল পাঁচ শ ডেবেন, অর্থাৎ বড়সড় একটা ঘোড়ার সমান।
ট্যাগেটাস পর্বতমালার উঁচুতে ঘন জঙ্গলে বাস করে ওটা, শুধু রাতের বেলায় নিচে নেমে আসে উপত্যকায় বাস করা লোকগুলোর ফসলের ক্ষেতে তাণ্ডব চালাতে। ফলে খুব কম মানুষই ওটাকে নিজের চোখে দেখেছে। এক রাতের মাঝেই পাঁচ থেকে ছয়জন ক্ষুদ্র কৃষকের চাষ করা ফসল সাবাড় করে দেয় প্রাণীটা, যা খেতে পারে না সেগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে নষ্ট করে দিয়ে যায়। শূকরটার গজদাঁতগুলো যুদ্ধের তলোয়ারের সমান লম্বা। ওই দাঁতগুলোর সাহায্যে বিদঘুঁটে আকৃতির মাথাটা একবার দুলিয়েই একটা ঘোড়ার নাড়িভুড়ি সব বের করে দিতে পারে। প্রচণ্ড পুরু আর শক্ত চামড়া, তার ওপর তারের মতো শক্ত আর ঘন লোমের আবরণ। ফলে একমাত্র সুদক্ষ হাতের প্রচণ্ড শক্তিশালী বর্শা ছাড়া আর সব কিছুর আঘাত প্রতিহত করতে পারে ওই চামড়া। খুরে প্রচণ্ড ধার, এক লাথি মেরে ফুটো করে দিতে পারে যুদ্ধের ঘোড়ার পেট। তাই সেরেনার দুই প্রাক্তন পাণিপ্রার্থী যখন শিকারে যোগ। দেওয়ার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিল তখন আমরা কেউ খুব একটা অবাক হলাম না। একজন অজুহাত দেখাল যে এসবের পক্ষে তার বয়স অনেক বেশি, আরেকজন বলল ইদানীং নাকি তার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তবে দুজনই দূর থেকে অথবা গাছের ওপর বসে শিকার অনুষ্ঠান দেখার আমন্ত্রণ খুশি হয়েই গ্রহণ করল।
যারা যারা শিকারে যাচ্ছে তাদের সবার মাঝে কিছুটা উদ্বেগ মেশানো উত্তেজনা কাজ করছে। ঘোড়ায় চড়ে ওই দানবকে শিকার করতে চলল সবাই।
স্বাভাবিকভাবেই সবার সামনে থাকল রাজা হুরোতাস এবং তার ডান পাশে রইল তার প্রিয় সঙ্গী অ্যাডমিরাল হুই। কয়েক দিন আগেই লুক্সরে হিকসস বাহিনীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ হয়েছিল তাতে আমাকে লড়াই করতে দেখেছে হুরোতাস, ফলে আমাকে যখন সে তার বাম পাশে রাখল তখন কেউ অবাক হলো না।
নিজের প্রিয় স্ত্রী এবং একই রকম প্রিয় কন্যাকে সবার পেছনে পেছনে আসতে নির্দেশ দিল হুরোতাস, এবং যুবরাজ রামেসিসকে তাদের প্রধান রক্ষাকর্তা হিসেবে তাদের সাথে সাথেই আসতে বলল। অবশ্য কাজটা করার আগে যদি আমার সাথে একটু কথা বলে নিত সে তাহলে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বেঁচে যেতে পারত। কিন্তু সেটা হুরোতাসের কপালে ছিল না বোধ হয়। কারণ এই নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই সেরেনা তেহুতি এবং রামেসিস তীব্র আপত্তি জানাল। ঝানু উকিলের দক্ষতা নিয়ে স্বামীর মুখোমুখি হলো তেহুতি। তা ছাড়া ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সে যে প্রাধান্য অর্জন করেছে সেটার গুরুত্বও নেহাত কম নয়।
প্রথম কবে যেন তোমার জীবন বাঁচিয়েছিলাম আমি, প্রিয়তম? মিষ্টি গলায় হুরোতাসকে জিজ্ঞেস করল সে। তখন তো এমনকি আমাদের বিয়েও হয়নি, তাই না? হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে। তখনো তুমি সেই সামান্য ক্যাপ্টেন, যার নাম ছিল জারাস। আল হাওয়াসাওয়ি নামের সেই ডাকাত, যে আমাকে অপহরণ করেছিল, তার হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করতে এসেছিলে তুমি আর টাইটা। কিন্তু নিজের মহান দায়িত্ব পালন করার আগেই ওই ডাকাতের হাতে পেটে ছুরি খেয়ে বসো তুমি। শেষ পর্যন্ত আমি আর টাইটা মিলে তোমাকে উদ্ধার করি! উদ্ধার কথাটার ওপর সে এত বেশি জোর দিল যে রাগে ফ্যাকাশে হয়ে গেল হুরোতাসের চেহারা। এমনকি তেহুতির মুখ থেকে সেই ঘটনার এমন রং চড়ানো বিবরণ শুনে আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝ থেকে কেউ প্রতিবাদ করে কিছু বলার আগেই আবার বলতে শুরু করল তেহুতি, আর সেটা ছিল কেবল প্রথমবার, এর পরেও আরো বহুবার তোমার জীবন বাঁচিয়েছি আমি… এই বলে আরো কয়েকটা ঘটনার কথা হুরোতাসকে মনে করিয়ে দিল সে।
এবার সেরেনা সামনে এগিয়ে এলো। মায়ের কথার খেই ধরে এত নিখুঁতভাবে সে নিজের কথা শুরু করল যে, মনে হতে পারে তারা দুজন আগে থেকে সব অনুশীলন করে রেখেছিল। বলল, আর মা এবং আমার মাঝে একটা চুক্তি আছে, যেখানে তার ভাইয়ের দেওয়া নীল তলোয়ারটা আমরা দুজন মিলে ব্যবহার করব বলে ঠিক করেছি। ইচ্ছে করেই আবেগপূর্ণ কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলছে ও। এখন এই শিকারে যদি আমরা একসাথে না থাকি তার অর্থ হবে যে আমাদের কোনো একজনের কাছে ওই অস্ত্রটা থাকবে না। অথচ সেটা থাকলে হয়তো তার জীবন বেঁচে যাবে। বলা যায় না, তাতে তোমারও প্রাণ বেঁচে যেতে পারে বাবা। ওই ভয়ংকর প্রাণীটার সামনে আমাদের এভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় নিশ্চয়ই ছেড়ে দেবে না তুমি, বাবা? বলো? স্ত্রীর কথার কোনো জবাব না দিয়েই মেয়ের দিকে ঘুরে তাকাল হুরোতাস। কিন্তু আরো একবার তার কথায় ছেদ পড়ল, কারণ এবার যুবরাজ রামেসিসের প্রতিবাদ জানানোর পালা।
সেরেনা আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রী। ওকে যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা করা আমার অবশ্য কর্তব্য মহামান্য রাজা। ওই শূকরটা যখন আমাদের সামনে পড়বে তখন আমি ওর পাশে থাকতে চাই।
তিনজনের দিকে জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রইল রাজা হুরোতাস। কিন্তু সেরেনা, তেহুতি আর রামেসিসও কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে, কেউ পিছু হঠতে রাজি নয়। সমর্থনের আশায় এদিক-ওদিক তাকাল হুরোতাস। এবার একটু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ওপরেই চোখ পড়ল তার। টাইটা, এই বোকাদের বোঝাও যে আমরা কত বিপজ্জনক একটা শিকারে নামতে যাচ্ছি। ওই শূকরের সামনে পড়লে সবার জন্যই অনেক বড় বিপদ নেমে আসবে।
হে রাজা, প্রতিপক্ষ যখন দলে এবং বুদ্ধিতে ভারী হয় তখন তাদের সাথে কেবল একজন বোকাই তর্ক চালিয়ে যায়। আমি সাক্ষ্য দিতে চাই যে, আপনি তেমন কোনো বোকা নন। তাই বলছি, যা হবেই তাকে মেনে নেওয়াই ভালো, জবাব দিলাম আমি। নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল হুয়োতাস, চোখের তারায় একই সাথে খেলা করছে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আর হাসির ঝিলিক। বুঝতে পারছে, এমনকি আমার সমর্থনও নেই ওর পক্ষে। অগত্যা ঘুরে দাঁড়াল সে, দুই পরিচারক যেখানে তার ঘোড়াটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে এগিয়ে গেল। এক লাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে লাগামটা চেপে ধরল সে। তারপর জ্বলন্ত চোখে তাকাল আমাদের সবার দিকে।
তাহলে এসো! মরার যদি এতই শখ হয়ে থাকে তো এসো আমার সাথে। আশা করি আর্টেমিস এবং অন্য সকল দেব-দেবী তোমাদের এই বোকামিকে ক্ষমা করবেন, যদিও তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
.
বিশাল এলাকা জুড়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে, এবং পুরো জায়গাটা উঁচু-নিচু পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ভর্তি। ঢালগুলোর গায়ে পুরু হয়ে জন্মেছে আঙুরলতা। ইচ্ছে করেই দ্রুতগতিতে চলছে হুরোতাস, সম্ভবত স্ত্রী আর কন্যাকে তার নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি দেওয়ার জন্য। তবে ওরা খুব সহজেই হুরোতাসের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমিও শিকারি দলের সামনেই থাকলাম, দুই নারীর ঠিক পেছনে। দলে আরো প্রায় শ খানেক লোক রয়েছে এবং আমাদের পেছনে বেশ কয়েক লিগ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তারা। তবে সবাই বেশ খোশমেজাজে আছে, কারণ প্রায় সবারই ধারণা যে প্রাণীটা সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তার বেশির ভাগই বাড়িয়ে বলা। ল্যাকোনিয়ান শূকরটা সম্ভবত স্বাভাবিক কোনো বুনো শূকরই হবে, কিছু তীর আর বল্লমের খোঁচা দিয়েই যাকে শিকার করা সম্ভব। শিকারের চাইতে সবার মাঝে বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে হাত থেকে হাতে ঘুরে বেড়ানো মদের পেয়ালার দিকে।
আমরা যারা একেবারে সামনে রয়েছি তাদের চোখে শূকরটার উপস্থিতির প্রচুর চিহ্ন ধরা পড়েছে। কিছুক্ষণ পরপরই অনেকখানি জায়গা জুড়ে আঙুরলতার ঝোঁপ উপড়ে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। সেচ দেওয়ার জন্য কৃষকরা যে ছোট ছোট নালা কেটেছিল সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভাঙা জায়গা দিয়ে পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে পানি, যেই নদী থেকে পানি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানেই গিয়ে মিশে যাচ্ছে আবার। যে লতাগুলো শূকরের আক্রমণ থেকে বেঁচে গেছে সেগুলো শুকিয়ে বাদামি রং ধারণ করেছে, খসে পড়ছে পাতাগুলো। পানির অভাবে মরতে বসেছে সব। যেসব কৃষকের ওপর পানি সরবরাহ ব্যবস্থার দেখাশোনার ভার ছিল তারা সবাই ভয়ে মাঠে কাজ করতে আসাই বাদ দিয়েছে। সবাই এখন ভয়ের চোটে ঘরে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে যে তারা, এমনকি হুরোতাসের চাইতেও শূকরটাকে বেশি ভয় পায়।
হুরোতাসের আঙুর বাগানে আক্রমণ চালানোর মাধ্যমে তার সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দুর্বল এবং দামি জায়গাটার ওপরই নিজের ক্রোধ ফলিয়েছেন দেবী আর্টেমিস। এই বাগান থেকে উৎপন্ন মদকে প্রায় নিজের কোষাগারে রক্ষিত সম্পদের মতোই ভালোবাসে হুরোতাস। লাল মদভর্তি একটা পেয়ালা যখন তার হাতে থাকে আর আরো এক পেয়ালা মদ থাকে তার পেটের ভেতরে, তখন আর কিছু দরকার হয় না তার। যদিও বাগানের পরিচর্যাকারীদের কাছ থেকে ধ্বংসযজ্ঞের কথা আগেই শুনেছে সে; কিন্তু তখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারেনি। অন্য কারো কাছ থেকে এ ব্যাপারে শোনা এক কথা আর নিজের চোখে সেটা দেখা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।
আমাদের শিকারি দলের সবার সামনে রয়েছে হুরোতাস। হাতে ধরা বিশাল বর্শাটা মাথার ওপর তুলে নাড়ছে সে, একই সাথে দেবী এবং তার পাঠানো প্রাণীটার ব্যাপারে অশ্রাব্য সব গালি ছুড়ছে। গালিগুলোর মাঝে সবচেয়ে সভ্য যেটা তা হলো শয়তান বেশ্যা-বুড়ি। আর সবচেয়ে খারাপ যেটা সেটা হলো দেবীর সাথে তার পাঠানো শূকরের অনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক কিছু একটা। কথাটা শুনে আমার কল্পনার চোখে যে ছবি ভেসে উঠল তাতে প্রায় বমি উঠে আসার জোগাড় হলো আমার। কিন্তু তেহুতি আর তার মেয়ে সেরেনার ভাব দেখে মনে হলো দারুণ মজার কোনো কথা শুনছে তারা।
তারপর হঠাৎ করেই এই হাসিঠাট্টার শব্দকে যেন ছুরি দিয়ে কেটে থামিয়ে দিল কেউ, কারণ অন্য একটা ভয়ংকর, আরো জোরালো শব্দ ভেসে এলো। প্রায় বধির হয়ে গেলাম আমরা। ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে হতচকিত চোখে এদিক ওদিক তাকাল হুরোতাস। স্বীকার করছি, এমনকি আমি নিজেও দারুণ অবাক হয়ে গেলাম, যদিও আমাকে ভয় পাওয়ানো খুব কঠিন।
এর আগে জীবনে মাত্র একবারই এমন ভয়াবহ শব্দ শুনেছি আমি। সেটা ছিল নীলনদের তীরে, ইথিওপিয়ায়। এমন এক শব্দ, যেটা যেকোনো সাহসী পুরুষের ঘাড়ের চুল খাড়া করে দিতে পারে, এমনকি তার প্রস্রাব আর পায়খানার রাস্তার মুখ ঢিলে করে দিলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সেটা ছিল কালো-কেশরওয়ালা এক পুরুষ সিংহের গর্জন। এখন যে শব্দটা শুনলাম সেটা সেই গর্জনের চাইতেও কয়েক গুণ বেশি জোরালো। মনে হলো যেন অনেকটা আপনাআপনিই আমার মাথাটা ঝটকা দিয়ে ঘুরে গেল, যেদিক থেকে বজ্রপাতের মতো শব্দটা ভেসে এসেছে সেদিকে তাকালাম আমি।
আঙুর বাগান যেখান থেকে শুরু হয়েছে আর যেখানে জঙ্গলের শেষ; সেখানে ধীরে ধীরে গাছপালার আড়াল থেকে উঁকি দিল একটা বিশাল চারকোনা মাথা। মনে হলো যেন পুরাণ থেকে উঠে এসেছে কোনো কাল্পনিক প্রাণী। কোঁকড়ানো কুচকুচে কালো পশমে ঢেকে আছে পুরো মাথাটা। বিশাল সুচাল কানগুলো খাড়া হয়ে আছে। চোখগুলো কুতকুতে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। চ্যাপ্টা নাকটা এখন সমান হয়ে আছে, ফুটোগুলো আমাদের গন্ধ পেয়েছে আগেই। গজদাঁতগুলো এত লম্বা আর বাঁকানো যে, ক্ষুরের মতো ধারালো শেষ প্রান্ত দুটো প্রাণীটার বিশাল মাথার ওপর গিয়ে শেষ হয়েছে, প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে পরস্পরকে।
আরো একবার সিংহের মতো একটা গর্জন বেরিয়ে এলো প্রাণীটার গলা থেকে। এবার আমি বুঝতে পারলাম এটা প্রকৃতির সৃষ্টি কোনো স্বাভাবিক প্রাণী নয়, বরং সত্যিই একজন দেবীর খেয়ালের ফসল। এই দানব যদি ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ গলায় ডেকে ওঠে বা ছাগলের মতো ম্যা-ম্যা করে ওঠে তাহলেও আমি অবাক হব না। জঙ্গলের গাছগুলোকে অবহেলায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বা কোনোটাকে উপড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে এলো প্রাণীটা, খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল। পেছনের অংশটা পুরু পেশিতে ভর্তি পিঠের ওপর দুই কাঁধের মাঝখানে ঠেলে উঠেছে ঘন লোমে ঢাকা কুজ। খুর দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল এবার, রাগের চিহ্ন। নীলনদে বেশ কয়েকবার বুনো মহিষ শিকার করেছি আমি; কিন্তু এর খুরগুলো সেই মহিষের চাইতেও কয়েক গুণ বড়। মাটি থেকে এবার বাদামি ধুলোর মেঘ উঠল, ঢেকে ফেলল শূকরটাকে। তাতে যেন আরো ভয়ংকর অপার্থিব হয়ে উঠল ওটার ভয়াবহতা। তারপর হঠাৎ করেই আঙুর বাগানের মাঝ দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তীব্র গতিতে দৌড়ে নেমে আসতে শুরু করল প্রাণীটা, চোখ হুরোতাসের দিকে। যেন এক মুহূর্তেই চিনে নিয়েছে। যে কে তার মালকিন আর্টেমিসের প্রধান শত্রু।
সাথে সাথে বর্শাটা তাক করে ধরল হুরোতাস, ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে গেল শূকরটার মুখোমুখি হতে। গলা চিরে যুদ্ধ হুংকার বেরিয়ে এলো তার, যদিও প্রাণীটাকে ভয় দেখাতে নাকি নিজেকে সাহস জোগাতে চিৎকার করল সে, বলা মুশকিল। প্রাণীটাও পাল্টা একটা রক্ত হিম করা চিৎকার ছেড়ে জবাব দিল হুরোতাসের হুংকারের।
ঢাল বেয়ে নেমে আসতে থাকায় আক্রমণের পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছে আর্টেমিসের শূকর। পুরো দেহটাকে ভূমিকম্পের ফলে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা পাথরের স্রোতের মতো ব্যবহার করছে সে। কাছাকাছি আসতেই রেকাবে পায়ের ভর রেখে দাঁড়িয়ে গেল হুরোতাস, ভারী বর্শাটা মাথার ওপর তুলল। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় শক্তিশালী ডান হাতের সমস্ত শক্তি ব্যবহার করে বর্শাটা ছুঁড়ে মারল সে। একেবারে নিখুঁতভাবে উড়ে গেল বর্শা, প্রাণীটার ভারী চামড়া আর পুরু লোমের আস্তরণ ভেদ করে প্রায় সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যের প্রায় অর্ধেকের মতো ঢুকে পড়ল বুকের ভেতর। আমার মনে হলো নিশ্চয়ই হৃৎপিণ্ডসহ অন্তত কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ জখম হয়েছে বর্শার আঘাতে।
কিন্তু হুরোতাসের কাছ থেকে এমন ভয়াবহ প্রাণঘাতী আঘাতের পরও শূকরটার মাঝে সামান্যতম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। একটুও হোঁচট খেল না, এক পলকের জন্য শিথিল হলো না ছুটে আসার গতি। অদম্য ভঙ্গিতে ছুটে এলো সে, তারপর আরো একবার ক্রুদ্ধ কান ফাটানো তীক্ষ্ণ গর্জন ছেড়ে এমনভাবে মাথা ঝাঁকাল, ঠিক যেভাবে অপরাধীর শিরচ্ছেদ করার জন্য এক টানে কুড়াল চালায় জল্লাদ। বিশাল বাঁকানো গজদাঁতগুলো ঝলসে উঠল আলোয়, তারপর ঢুকে গেল হুরোতাসের ঘোড়ার পাঁজরের ভেতর। একটা মাত্র ভয়ংকর আঘাত, সাথে সাথে চামড়া, মাংস আর হাড় ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেল দাঁতগুলো, পাঁজরের সবকটা হাড় চুরমার করে দিল। সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আর নাড়িভুঁড়ি খোলা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে এলো সাথে সাথে। তার পরেই পেছনের পা দুটো যেখানে জোড়া লেগেছে সেখানকার হাড় ভেঙে দিয়ে বেরিয়ে এলো দাঁতগুলো। দুই পা আলাদা হয়ে যাওয়ায় হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল ঘোড়াটা। এই আঘাতের ফলে হুরোতাসেরও একটা পা হারানো উচিত ছিল; কিন্তু আঘাতের প্রথম ধাক্কাতেই ঘোড়ার পিঠ থেকে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়েছে সে। তার পরেই দুটুকরো হয়ে গেছে তার ঘোড়া। নিরাপদ দূরত্বেই পড়েছে হুরোতাস। কিন্তু মাথার ওপর ভর দিয়ে পড়ার কারণে শিরস্ত্রাণ থাকার পরেও অজ্ঞান হয়ে গেছে সে।
মাটিতে পড়ে যাওয়া ঘোড়াটার ওপর এবার চড়াও হলো আর্টেমিসের শূকর, প্রচণ্ড ক্রোধের সাথে ছিন্নভিন্ন করে দিতে লাগল প্রাণীটার শরীর। খাড়া ঢাল বেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাণপণে নিজের ঘোড়াকে তাড়া দিলাম আমি। কিন্তু তেহুতি ইতোমধ্যে আমার অনেক সামনে চলে গেছে, নিজের নিরাপত্তার জন্য কণামাত্র তোয়াক্কা না করে আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে বিশাল শূকরটার ওপর। আমাদের দুজনের মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে সেরেনা আর আর্টেমিস। সবাই চিৎকার করছে পাগলের মতো। হুরোতাস মারা গেছে ভেবে তীব্র স্বরে শূকরটাকে শাপশাপান্ত করছে তেহুতি, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করার হুমকি দিচ্ছে। একই সাথে সেই নীল তলোয়ার তুলে ধরে রেখেছে মাথার ওপর। ওদিকে যুদ্ধের উন্মাদনা পেয়ে বসেছে রামেসিস আর সেরেনাকে, প্রচণ্ড উত্তেজনায় একে পরস্পরকে উৎসাহ দিতে দিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। এখন দুজনের কারো মাথাতেই তিল পরিমাণ যুক্তি কাজ করবে না। ওদের তিনজনকে সাবধান করার জন্য গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছি আমি, বলছি যে শূকরটার ভার আমার ওপর ছেড়ে দিতে। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও আমার কথায় কর্ণপাত করার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না কারো মধ্যে।
ঘোড়া নিয়ে সরাসরি শূকরটার পেছনে চলে এলো তেহুতি, তারপর ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝুঁকে পড়ে তলোয়ার ধরা হাত চালাল শূকরের পেছনের পায়ের রগ কেটে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেই একই মুহূর্তে তীব্র গতিতে পা ছুড়ল প্রাণীটা, ফলে তেহুতির তলোয়ার ধরা হাতের কবজিতে গিয়ে লাগল শক্ত খুরের লাথি। কবজি মচকে গেল, সাথে সাথে তলোয়ারটা হাত থেকে ছুটে গিয়ে উড়ে অন্য পাশে পড়ল। তেহুতি নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে, কারণ ঘোড়ার পিঠে বসে থাকতে পারল না সে, টলে উঠে পড়ে গেল নিচে। বলা যায় খ্যাপা শূকরটার প্রায় পিঠের ওপরই পড়ল সে, আহত হাতের কবজি চেপে ধরে আছে আরেক হাত দিয়ে। তবে রামেসিস ঠিক তার পেছনেই ছিল। তেহুতির বিপদ বুঝতে পেরে দ্রুত সামনে এগিয়ে গেল সে, তারপর নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝুঁকে এলো নিচে। নিজের গতিবেগকে ব্যবহার করে ছোঁ মেরে তেহুতিকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিল সে, তারপর শূকরটার ধারালো দাঁত আর শক্ত খুরের নাগালের বাইরে চলে গেল।
ওদিকে মায়ের বিপদ দেখে মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সেরেনা। শূকরটা যখন ওর ঘোড়াকে দেখে তেড়ে এলো তখন ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে উঠল ঘোড়াটা। ফলে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল ও। যদিও দুই পায়ের ওপর ভর দিয়েই নামতে পারল মাটিতে; কিন্তু ওর হাতে যে বর্শাটা ছিল সেটা ছুটে গেল হাত থেকে। আরেকটা অস্ত্রের খোঁজে, অথবা আসন্ন বিপদের হাত থেকে বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে এদিক-ওদিক তাকাল ও।
ছেঁড়া আঙুরলতা আর ঝোঁপের ভেতরে কাদার মাঝে নীল তলোয়ারটা কোথায় পড়েছে সেটা আমার চোখ এড়াতে পারেনি। তলোয়ারের রুপালি ফলায় রোদ ঝিলিক দিচ্ছে, যেন সদ্য ধরা পড়া টুনা মাছ। তাই দেখেই অস্ত্রটা চিনে নিয়েছি আমি।
ঘোড়ার পেটে হাঁটু দিয়ে পুঁতো দিলাম এবার, তীরগতিতে এগিয়ে গেলাম তলোয়ারটা লক্ষ্য করে। ঘোড়ার গতি না কমিয়েই ঝুঁকে এসে হাত বাড়িয়ে দিলাম। রত্নখচিত হাতলটার ওপর চেপে বসল আমার আঙুলগুলো। ঘোড়ার। পিঠে আবার সোজা হয়ে বসেই চিৎকার করে ডাক দিলাম আমি সেরেনা! হইচই আর চেঁচামেচির আওয়াজ ছাপিয়ে গেল আমার কণ্ঠ, আর্টেমিসের পাঠানো বিশাল শূকরের খুরের শব্দ আর গর্জন ছাপিয়ে পৌঁছে গেল সেরেনার কানে।
আমার কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে ঘাড় ঘোরাল সেরেনা। নীল তলোয়ারের হাতল ধরে একবার মাথার ওপর ঘোরালাম আমি। এই যে, সেরেনা! ধরো! তারপর শরীরে সমস্ত শক্তি দিয়ে অস্ত্রটা ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। শূন্যে একবার চক্কর কেটে সেরেনা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে এগিয়ে গেল অস্ত্রটা। সাবলীল ভঙ্গিতে শরীর মুচড়ে সেটাকে এগিয়ে আসতে দিল সেরেনা, তারপর খপ করে চেপে ধরল হাতল। অসাধারণ অস্ত্রটা এখন একজন শোভা পাচ্ছে। একজন অর্ধ-দেবীর ডান হাতে, আর্টেমিসের পাঠানো বিপদের যেন এবার অবসান হতে যাচ্ছে। শূকরের পরবর্তী আক্রমণের মুখোমুখি হতে সামনে ছুটে গেল সেরেনা। কম্পিত বুকে তার ছুটে যাওয়া দেখলাম আমি, একই সাথে দুলছি গর্ব আর আতঙ্কের দোলায়। গর্বিত ওর সৌন্দর্য আর সাহস দেখে, আর আতঙ্ক ওর বিপদের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে।
শূকরটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে যে সেরেনা এগিয়ে আসছে, কারণ এবার ঘোড়ার মৃতদেহকে ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াল সে, সেরেনার মুখোমুখি হলো। আক্রমণকারীর ওপর কুতকুতে চোখগুলো স্থির হওয়া মাত্রই লাফ দিল প্রাণীটা, দ্রুতবেগে এগিয়ে আসতে শুরু করল। আচমকা থমকে দাঁড়াল সেরেনা, পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করল। মনে হলো যেন বিশাল শূকরের সামনে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে ওর শরীর; কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে অপূর্ব দক্ষতায় সরে গেল এক পাশে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেই ভয়াবহ গজদাঁতগুলো আবার চালাল প্রাণীটা, যেগুলো দিয়ে একটু আগেই রাজা হুরোতাসের ঘোড়ার পেট চিরে দিয়েছে। সেরেনার টিউনিকে আটকে গেল একটা দাঁতের মাথা। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেরেনার ভারসাম্যের কোনো ক্ষতি না করেই কাপড় ছিঁড়ে বের হয়ে গেল আবার।
তারপর প্রাণীটা ওর পাশ কাটানো মাত্রই নীলচে-রুপালি তলোয়ারের ফলা দিয়ে ওটার পেছনের পায়ে আঘাত করল সেরেনা। উজ্জ্বল ফলাটা শূকরের পেছনের দিকের পায়ের গোড়ায় আটকে গেল, এবং পরিষ্কারভাবে দুই ভাগ করে ফেলল সাথে সাথে। কেটে আলাদা হয়ে যাওয়া পা-টা কাদায় গেঁথে যাওয়ায় খাড়া হয়ে রইল। চামড়ার ভেতরে পেশিগুলো দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার, থরথর করে কাঁপছে আর ঝাঁকি খাচ্ছে।
তবে চার পায়ে শূকরটা যেমন ভয়ংকর ছিল, তিন পায়েও যেন তার সেই ভয়াবহতার একটুও কমতি হলো না। পেছনের এক পায়ে ভর করেই চরকির মতো ঘুরে দাঁড়াল ওটা। এখন আর গর্জন করছে না, শুধু চোয়ালে চোয়ালে বাড়ি দিচ্ছে, ফলে গজদাঁতগুলো পরস্পরের সাথে বাড়ি খেয়ে ভীতিকর খটাখট আওয়াজ তুলেছে। এবারও প্রাণীটাকে আক্রমণ শানিয়ে কাছে আসার সুযোগ করে দিল সেরেনা, তারপর আগের মতোই একেবারে শেষ মুহূর্তে এক পাশে সরে গেল। ওর হাতের তলোয়ারটা যেন পারদের লম্বা একটা রেখায় পরিণত হলো, কোপ মারল শূকরটার সামনের ডান পায়ের হাঁটুর কাছে। পা-টা এমনভাবে আলাদা হয়ে গেল যেন হাড় বলতে কিছু ছিল না ওখানে, স্রেফ মাংস।
দুই পা হারিয়ে দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল শূকরটা। মাথাটা পড়ল প্রথমে, তারপর ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে পিঠ দিয়ে উল্টে পড়ল। ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টায় গলাটা লম্বা করে দিল কাদামাটিতে ভরা জমিনের ওপর। গলা তো নয় যেন প্রাচীন কোনো গাছের গুঁড়ি। এবার ওর সামনে এসে দাঁড়াল সেরেনা। দুই হাতে তলোয়ারের বাঁট চেপে ধরল শক্ত করে, তারপর মাথার ওপর তুলেই বাতাসে অর্ধবৃত্ত এঁকে এক টানে নামিয়ে আনল। মৃদু শিস কেটে নেমে এলো তলোয়ার, এত জোরে আঘাত করেছে সেরেনা। মনে হলো যেন শূকরের বিশাল মাথাটা এক লাফ দিয়ে আলাদা হয়ে এলো শরীর থেকে। মুখটা খুলে গেল হাঁ হয়ে, ধপ করে মাটিতে পড়ার সাথে সাথে একটা ভীতিকর শব্দ বেরিয়ে এলো- একই সাথে মরণ চিৎকার এবং তীব্র ক্রোধের গর্জন। কাটা গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ঝরনার মতো বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত, সেরেনার পোশাকের নিচের অংশ ভিজিয়ে দিল। বিজয়ীর ভঙ্গিতে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল ও।
বুনো আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম আমি। সাথে সাথে আরো শ খানেক গলার চিৎকার যোগ দিল আমার সাথে। দৌড়ে এগিয়ে এসে দারুণ স্বস্তির সাথে ওকে জড়িয়ে ধরল রামেসিস। নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল তেহুতি। মচকানো কবজিটা বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে; কিন্তু এবার তার ব্যথা অগ্রাহ্য করে দৌড়ে মেয়ের দিকে এগিয়ে গেল সে। অ্যাডমিরাল হুইয়ের নেতৃত্বে বিদেশি রাজা এবং সেনাপতিরা সবাই সামনে এগিয়ে এলো, সেরেনার সাহস এবং দক্ষতার প্রশংসা করছে সবাই শত মুখে। এক এক করে প্রত্যেকেই ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল, তারপর প্রশংসা আর স্তুতি গাইতে গাইতে ফেনা তুলে ফেলল মুখে। অল্প কথায় সবাইকে ধন্যবাদ জানাল সেরেনা, তারপর তেহুতির কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে, যেখানে ওর বাবা রাজা হুরোতাস এখনো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে এলো তার, ঝাপসা চোখে এদিক-ওদিক তাকাল সে। কেবল তখনই আমার প্রিয় দুই নারী, যাদের এই পৃথিবীর সব কিছুর চাইতে বেশি ভালোবাসি আমি, একই সাথে ফিরে তাকাল আমার দিকে। ভিড় আর কোলাহলের মাথার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল
তারা, কৃতজ্ঞতার হাসি। আর এতেই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট বোধ করলাম আমি।
*
হুরোতাসের করদ রাজাদের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী হচ্ছে থিবিসের বোয়েশিয়া থেকে আগত বের আর্গোলিদ। দারুণ ভারী একটা তলোয়ার ব্যবহার করার কারণে যার আরেক নাম বীরবাহু। নিজের চ্যালাদের সে নির্দেশ দিয়েছিল তার সিংহাসনটা শিকারে নিয়ে আসতে। অজুহাত দেখিয়েছিল যে কাজটা আরামের জন্যই করেছে সে; কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে সবাইকে নিজের গুরুত্ব বোঝানো। তবে এখন সে শূকর শিকারে সেরেনা যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে তার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে নিজের সিংহাসনে বসাতে চায় সে। বাকি রাজারাও পিছিয়ে থাকতে চাইল না, সেরেনাকে সিংহাসনে বসিয়ে সেটা পালাক্রমে বহন করল তারা। প্রতিবারে আটজন করে সেরেনাকে সিংহাসনসহ কাঁধে তুলে নিল, তারপর তার প্রশস্তি গাইতে গাইতে ট্যাগেটাস পর্বতমালা থেকে এগিয়ে চলল দুর্গের দিকে।
এই বীরত্বপূর্ণ শিকার অভিযানের গল্প ইতোমধ্যে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আমার কাছে মনে হলো যেন পুরো ল্যাসিডিমনের সবাই এসে জড়ো হয়েছে পথের পাশে, চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে সেরেনাকে, সেইসাথে ফুলের পাপড়ির বৃষ্টি বইয়ে দিচ্ছে তার ওপর। ওর বাম পাশে হাঁটছি আমি, যেটা হচ্ছে সম্মানের জায়গা। স্বভাবজাত সৌজন্যবোধের কারণে এত সামনে আসতে চাইনি আমি; কিন্তু সেরেনা জোর করায় না এসে পারিনি।
এভাবে বাড়ি ফিরতে প্রায় সারা দিন লেগে গেল। সেরেনার সিংহাসন যখন দুর্গের সামনের প্রাঙ্গণে তৈরি করা মঞ্চের ওপর নামিয়ে রাখা হলো তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে। তবে এমনকি তখনো সেরেনাকে সিংহাসনের ওপর থেকে নামতে দেওয়া হলো না।
ওর বাবা রাজা হুরোতাস ততক্ষণে শূকরের আক্রমণের ফলে আহত অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ সেরে উঠেছে। সদা সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি, এই সুযোগটা চিনতে ভুল হলো না তার। ষোলোজন রাজার পক্ষ থেকে স্পার্টান ল্যাসিডিমনের প্রতি আনুগত্যের শপথকে এই সুযোগে আরো শক্তিশালী করে তোলার সিদ্ধান্ত নিল সে। অনুষ্ঠানের গুরুত্ব এবং উত্তেজনা যেন চরমে পৌঁছে গেল। সেরেনার সৌন্দর্যকে আগে যদি বলা যেত চোখ-ধাঁধানো তাহলে অজস্র প্রশংসায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠার পর এখন তাকে ভুবনমোহিনী বললেও ভুল হবে না। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবক, সাধারণ মানুষ বা অভিজাত; কারো পক্ষেই সেই সৌন্দর্যের আকর্ষণকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। রাজকীয় অতিথি এবং সেরেনার প্রাক্তন পাণিপ্রার্থী- সবাই যেন সেই সৌন্দর্যের স্রোতে অসহায় হয়ে পড়ল। একই অবস্থা হলো আমাদের সবার।
আহত রানিকে পাশে নিয়ে রাজা হুরোতাস যখন সবার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল, তার প্রতিটি কথা অখণ্ড মনোযোগর সাথে শুনল সবাই, প্রতিটি বাক্যের শেষে হর্ষধ্বনি করে উঠল। আহত হাতের পরিচর্যা করার পর তা গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে রানি তেহুতি, দারুণ সাহসী আর অভিজাত লাগছে তাকে দেখতে। হুরোতাসের আরেক পাশে দাঁড়িয়েছে তার মেয়ে সুন্দরী সেরেনা। ফলে বক্তৃতার প্রভাবটা আরো ভালোভাবে পড়ল সবার ওপর। ইতোমধ্যে উপস্থিত রাজাদের বেশির ভাগই হুরোতাসের বাগান থেকে তৈরি দারুণ মদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গলায় ঢেলেছে এবং আরো ঢালছে। তাদের পেয়ালায় মদের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে আসার আগেই আবার পূর্ণ করে দিচ্ছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রীতদাসরা।
উপস্থিত সমস্ত রাজা, গোত্রপ্রধান এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে হুরোতাস জানাল, তাদের সবাইকে সে আপন ভাইয়ের মতো দেখে। সে জানে, আজ পারস্পরিক সমঝোতা এবং সম্মানের ভিত্তিতেই সবাই একত্র হয়েছে। এই কথার জবাবে আগের চাইতেও জোরাল গলায় হর্ষধ্বনি উঠল উপস্থিত দর্শকের মাঝে। উল্লসিত চিৎকারের শব্দ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসতে এবার রাজা বের আর্গোলিদ উঠে দাঁড়াল। হুরোতাসের আড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতার কাছে কিছুতেই হার মানতে রাজি নয় সে, নিজের কথায় সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে।
এই মুহূর্ত থেকে আমাদের একজনের প্রতি অপমানের অর্থ হবে আমাদের সবার অপমান, চেঁচিয়ে উঠল সে। এসো সবাই হাতে হাত রেখে পারস্পরিক প্রতিরক্ষার শপথ নিই!
কে সাক্ষী হবে আমাদের শপথের? জানতে চাইল হুরোতাস।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী আমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতে আর কারো দরকার আছে কি? জবাব দিল বের আর্গোলিদ। পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী নারী, যে ল্যাকোনিয়ান শূকরকে বধ করেছে; সেই সাক্ষী হবে আমাদের শপথের।
সুতরাং এক এক করে ষোলোজন রাজার সবাই সামনে এগিয়ে এলো, তারপর রাজকুমারী সেরেনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে শপথ নিল। এরপর শুরু হলো উৎসব এবং উদ্যাপন চলল অনেক রাত পর্যন্ত। কারো কারো কাছে মনে হতে পারে যে সারা দিনের পরিশ্রমের পর সবার এখন ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু না, এটা ছিল কেবল শুরু। নাচ-গান, মদপান আর আনন্দ কেবল শুরু হয়েছে। আর সবার মাঝে সেরেনার উৎসাহই যেন সবচেয়ে বেশি। সকল রাজার সাথে পালা করে নাচল ও, সেইসাথে ওর বাবা এবং রামেসিসের সাথেও, যে এখনো রাজা হয়নি। এমনকি আমার সাথেও একাধিকবার নাচতে এলো সেরেনা, এবং নাচ শেষে জানাল যে, যাদের সাথে এ পর্যন্ত নেচেছে তাদের মাঝে আমিই সবচেয়ে ভালো নাচতে পারি, শুধু রামেসিস বাদে। কিন্তু রামেসিসের সাথে যেহেতু ওর বাগদান হয়েছে, সেহেতু এই কথা তো ওকে বলতেই হবে, তাই না?
হুরোতাস যখন এক দফা পাঞ্জা লড়াইয়ের জন্য বীরবাহু বের আর্গোলিদকে আহ্বান জানাল তখন দেরি না করে নাচের মঞ্চ থেকে নেমে এলো সবাই, লড়াইয়ের ফলাফলের ওপর বাজি ধরতে শুরু করল। প্রচুর পরিমাণে অর্থ বাজি ধরা হলো এক একজনের পক্ষে। একই পরিমাণে উত্তেজনা নিয়ে সবাই তারস্বরে চিৎকার করে নিজ নিজ খেলোয়াড়কে উৎসাহ দিতে লাগল। এক টুকরো নেংটি বাদে সব কাপড় খুলে ফেলল দুই প্রতিযোগী, তারপর ভোজসভার জন্য রাখা ওক কাঠের টেবিলটার দুই পাশে বসে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের মাঝেই নানা রকম কর্কশ আওয়াজ বেরিয়ে আসতে লাগল দুজনের গলা দিয়ে, মনে হলো যেন পাঞ্জা লড়ছে না বরং পরস্পরের কাঁধ থেকে হাতটা খুলে আনতে চাইছে।
দুই প্রতিযোগী এবং তাদের সমর্থকদের হইহল্লা ভেদ করে অন্য কিছু শুনতে পাবে এমন তীক্ষ্ণ কান আমি বাদে আর কারো আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম, দুর্গ-প্রাচীরের ওপাশ থেকে খুব আস্তে আস্তে ভেসে আসছে মিষ্টি সুরেলা গলার গান।
প্রতিযোগিতার জায়গা থেকে সরে এলাম আমি, তারপর বাইরের দুর্গ-প্রাচীরের ওপর উঠে পড়লাম। ওপাশে উঁকি দিয়ে দেখলাম, পঞ্চাশেরও বেশি মহিলা সারি বেঁধে এগিয়ে আসছে সেখানে। সবার পরনে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা সাদা পোশাক। মুখেও একই রকম সাদা রং করা, কেবল চোখের চারপাশে কাজল দিয়ে কালো রং করা হয়েছে। এই মুহূর্তে দুর্গের প্রধান ফটকের সামনের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে তারা। প্রত্যেকের হাতে একটা করে জ্বলন্ত বাতি, মুখে দেবী আর্টেমিসের প্রশস্তি গান। তাদের চেহারা এবং পোশাক দেখে এক মুহূর্তেই বুঝে নিলাম এরা হচ্ছে দেবীর পূজারিনি। এবং এটাও বুঝতে পারলাম যে, হুরোতাস আর তার সঙ্গীরা দারুণ খেপে যাবে যদি তাদের উৎসবের মাঝখানে আর্টেমিসের পূজারিরা এসে তাদের প্রিয় শূকরের মৃত্যু নিয়ে শোক করতে শুরু করে। তাই দ্রুত নিচে নেমে এলাম আমি, ইচ্ছে যে প্রধান ফটকে দাঁড়ানো প্রহরীদের সাবধান করে দেব যেন ওদের ঢুকতে না দেয়। কিন্তু এসে দেখলাম ইতোমধ্যে অনেক দেরি করে ফেলেছি। পূজারিনিদের চিনতে পেরেছে প্রহরীরা এবং তাদের স্বাগত জানিয়ে খুলে দিয়েছে দরজা।
দরজা থেকে দুর্গের ভেতর পর্যন্ত পথটা ইচ্ছে করেই অত্যন্ত সরু করে বানানো হয়েছে, যাতে সম্ভাব্য শত্রুকে বাধা দিতে সুবিধা হয়। এখন সেই পথে ভিড় করে রয়েছে আর্টেমিসের পঞ্চাশজন পূজারিনি, সেইসাথে তার প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক সশস্ত্র প্রহরী। তাদের অগ্রযাত্রার মুখে পড়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলাম আমি, আরো একবার সেই প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালাম। এখানে হুরোতাস আর তার বন্ধুরা অর্থাৎ সেই করদ রাজাদের মাঝে এসে পড়তে হলো আমাকে, যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে বেন আর্গোলিদ। সবাই চেঁচাচ্ছে এবং তাদের সাথে সাথে আমিও। কিন্তু কেউই কারো কথা শুনছে না।
তারপর হঠাৎ করে অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার সুরেলা একটা গলা ভেসে এলো হইচই ছাপিয়ে। গলাটা এত সুন্দর যে প্রায় সাথে সাথেই নীরব হয়ে গেল সবাই। প্রত্যেকটা মাথা ঘুরে গেল শব্দের উৎস লক্ষ্য করে। ভিড়ের মাঝ বরাবর ফাঁকা হয়ে গেল, একটা পথ তৈরি করে দিল সবাই। সেই পথ দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল রাজকুমারী সেরেনার অনিন্দ্যসুন্দর অবয়বকে।
পূজারিনি মা! প্রধান পূজারিনির সামনে এসে হাঁটু ভাজ করে সম্মান দেখাল সে। আমার বাবার দুর্গে আপনাকে স্বাগতম।
প্রিয় রাজকুমারী, তোমার জন্য দেবী আর্টেমিসের কাছ থেকে শুভেচ্ছা এবং একটি সংবাদ নিয়ে এসেছি আমি। তুমি কি তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত? যদি তাই হয় তাহলে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসো, জবাব দিল ভগিনী হ্যাগনে। সোনালি ধনুক ভগিনীসংঘের প্রধান পূজারিনি মাতা সে। সোনালি ধনুক হচ্ছে দেবী আর্টেমিসের অনেকগুলো প্রতাঁকের একটা।
এবার রাজা হুরোতাস সামনে এগিয়ে আসতে শুরু করল, চেহারা গম্ভীর হয়ে আছে। চোখগুলো জ্বলছে রাগে। ওসব সংবাদের নিকুচি করি আমি… বলতে শুরু করল সে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তখন আমি তার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। খপ করে তার নগ্ন বাহুটা চেপে ধরলাম। একটু আগের পাঞ্জা লড়াইয়ের কারণে এখনো ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে সেটা।
নিজেকে সামলাও, জারাস, ফিসফিস করে বললাম আমি, যাতে সে ছাড়া আর কেউ কথাটা শুনতে না পায়। তার আগের নামটা ব্যবহার করার মাধ্যমে তার ওপর আমার অনেক আগের সেই কর্তৃত্বটা আবার বিস্তার করতে চাইলাম। সাথে সাথেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনল সে, সরে এলো এক পাশে। সেই মুহূর্তে বিরাজমান কড়া ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের কারণে আমাদের দুজনের এই সামান্য নাটকটুকু কারো চোখে পড়ল না।
বাধ্যগত মেয়ের মতো হ্যাগনের সামনে বসে পড়ল সেরেনা। এবার ওর কপালে তর্জনীর সাহায্যে সোনালি ধনুকের চিহ্ন আঁকল পূজারিনি। তারপর এমন গম্ভীর আর ভারী গলায় কথা বলতে শুরু করল যে, এমনকি আমারও গায়ের লোম সব দাঁড়িয়ে গেল সড়সড় করে। দেবী আর্টেমিস তোমাকে তার রক্ত এবং মাংসের বোন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন…
স্বামীর হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তেহুতির দিকে একবার না তাকিয়ে পারলাম না আমি। আমার মতোই সে নিজেও রাগ চেপে রাখার যথাসম্ভব চেষ্টা করছে। আমি তার দিকে তাকানোর সাথে সাথে সেও তাকাল আমার দিকে, দৃষ্টি বিনিময় হলো আমাদের মাঝে। তার পরেই তার চেহারা লাল হয়ে উঠল, নামিয়ে নিল চোখ। আমাদের দুজনেরই মনে পড়ে গেছে সেই অদ্ভুত প্রায় বাস্তব স্বপ্নের কথা, একমাত্র সন্তানের জন্মের গল্প বলতে গিয়ে যার কাহিনি আমাকে শুনিয়েছিল তেহুতি। তার পরেই আবার প্রধান পূজারিনির দিকে তাকালাম আমি। উপস্থিত আর সবার মতোই আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি সে কী বলে তা শোনার জন্য।
সমগ্র নারী জাতির সম্মান এবং অবস্থানকে আরো উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আজ তুমি যে কাজ করেছ তার আন্তরিক প্রশংসা করেছেন দেবী আর্টেমিস। তুমি প্রমাণ করেছ যে পুরুষরা আমাদের দাবিয়ে রাখতে চাইলেও আমরা আসলে তাদের চাইতে কোনো অংশে কম যাই না। দেখলাম এই কথা শোনার সাথে সাথে প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খুলল হুরোতাস। তবে ওর মুখ থেকে যেন কোনো ধর্মদ্রোহী কথা বের না হয় সে জন্য কিছু বলার আগেই দড়াম করে ওর পায়ে লাথি মারল তেহুতি। নিশ্চয়ই খুব জোরে লেগেছিল আঘাতটা, কারণ এমনকি আমি নিজেও ওটার শব্দ শুনতে পেলাম। আর ব্যথায় ককিয়ে উঠল হুরোতাস।
আরে! আমাকে জন্মের জন্য খোঁড়া বানানোর মতলব করেছ নাকি?
কিন্তু একই সাথে আমি নিজেও চেঁচিয়ে উঠলাম, আর হুরোতাসের তুলনায় আমিই ছিলাম পূজারিনির অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি। ফলে আমার কণ্ঠস্বরের আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেল হুরোতাসের গলা। আমাদের রাজার জীবন বাঁচিয়েছে এই মেয়ে!
বলে উঠলাম আমি। বাকি ষোলো রাজাও সাথে সাথে যোগ দিল আমার সাথে। আমাদের রাজার জীবন বাঁচিয়েছে রাজকুমারী সেরেনা! তার জয় হোক!
প্রশংসা শুনে দারুণ খুশি হলো প্রধান পূজারিনি। যদিও তার নাম হ্যাগনে, যার অর্থ হচ্ছে বিশুদ্ধ; সন্দেহ নেই যে নামটা তার সাথে একেবারেই খাপ খায় না। কাজল দিয়ে চোখের চারপাশে কালো করে রাখলেও যখন প্রথমবারের মতো রাজা বের আর্গোলিদের ওপর পড়ল তার দৃষ্টি তখন তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠার ব্যাপারটা আমার নজর এড়াল না।
*
দেবী আর্টেমিস একজন চিরকুমারী; কোনো পশু, মানুষ অথবা দেবতার অনুমতি নেই তার সতীত্বের ওপর আক্রমণ করার। তিনি এবং তার শরীর উভয়ই চিরপবিত্র। কোনো পুরুষ যদি তার সাথে দৈহিক মিলনে রত হওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তিনি চরম প্রতিশোধ নেন। তবে আর্টেমিসের পূজারিনিদের অন্যতম প্রধান একটি দায়িত্ব হচ্ছে তাদের প্রিয় দেবীর প্রতিভূ বা বিকল্প হিসেবে কাজ করা। দেবীর অনুমতিক্রমে তারা পৃথিবীর যেকোনো প্রাণীর সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হতে পারে, তা সে পুরুষ, মহিলা, মানুষ, পশুপাখি, মাছ বা অন্য যা কিছু হোক না কেন। এ থেকে তারা যে দৈহিক আনন্দ পায় তা সরাসরি পৌঁছে যায় আর্টেমিসের কাছে। কিন্তু দেবী আর্টেমিসের প্রতিভূরা যতই বিকৃত মিলনে লিপ্ত হোক না কেন, তিনি নিজে চিরকাল পবিত্রই রয়ে যান। এবং বলতে দ্বিধা নেই, এ ব্যবস্থাটা বরাবরই আমাকে বেশ আশ্চর্য করে তুলেছে। এমনকি আমার মতো দৈহিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত মানুষও এমন ব্যবস্থায় নিজের সামনে অনেকগুলো পথ খুঁজে পেতে পারে।
প্রধান পূজারিনিকে অনুসরণ করে বাকি পঞ্চাশ পূজারিনির সবাই দুর্গের প্রধান। কক্ষে এসে পৌঁছাল। এমনিতে তাদের সবাইকে ভদ্র শান্তই মনে হছে; কিন্তু ভেতরে ভেতরে এমন কিছু একটা রয়েছে, যা আমাকে নীলনদের পানিতে রক্তের গন্ধ পাওয়া রাক্ষুসে মাছের দলের কথা মনে করিয়ে দিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেখা গেল একটু আগের সেই ভদ্রতা এবং একই সঙ্গে পরনের কাপড়চোপড়ের সিংহ ভাগ; উভয়ই বিসর্জন দিয়েছে তারা। নাচের মুদ্রাগুলো দেখলে যে কারো কাছে মনে হতে পারে তা যৌন মিলনের অপর নাম। তবে এটা আমি স্বীকার করছি যে, একেবারে শেষ মুহূর্তে হলেও পাশের ছোট ঘরগুলোতে সবার চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার মতো ভদ্রতা লক্ষ্য করেছি জুটিদের মাঝে।
আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করে স্বস্তি পেলাম। সেটা হলো, বেকাথা এবং তেহুতি তাদের স্বামী এবং কন্যাদের পুরো সময়টা নিজেদের ঈগল চোখের আওতায় রেখেছে। তবে নিজের চার ছেলের ব্যাপারে বেশ ঢিল দিয়েছে বেকাথা। তাদের মাঝে সবচেয়ে ছোট যে জন তার সাথে সেরেনার কিছু টুকরো টুকরো কথা ঘটনাচক্রে আমার কানে চলে এলো। তখন সবে মাত্র বাইরের ছোট ঘরগুলোর একটা থেকে ফিরেছে সে।
কোথায় গিয়েছিলে পালমিস? কী করছিলে তুমি? জানতে চাইল সেরেনা। আমি তো তোমার সাথে এক দফা নাচতে চেয়েছিলাম।
আর্টেমিসের উদ্দেশ্যে একটু পুজো করতে গিয়েছিলাম, সরাসরি জবাব দিল ছেলেটা।
তাই নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম অ্যাপোলো ছাড়া আর কারো পুজো করো না তুমি।
মাঝে মাঝে রথের প্রতিযোগিতায় একই সাথে দুটো রথেও বাজি ধরতে হয়, বুঝলে?
তা ওই পুজোটা কীভাবে করতে হয় আমাকে একটু দেখাবে? দুষ্টুমির ছলে প্রশ্ন করল সেরেনা।
একবার দেখাতে চেয়েছিলাম, মনে আছে? কিন্তু তুমি তখন রাজি হওনি বোকা মেয়ে। এখন তোমার সামনে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই, অন্তত যত দিন না রামেসিস তোমাকে শিখিয়ে দেয়।
এক মুহূর্তে পালমিসের দিকে তাকিয়ে রইল সেরেনা, কথাগুলো ভেবে দেখছে। তার পরেই বুঝতে পারল, মনে হলো যেন দ্বিগুণ আকার ধারণ করল সবুজ চোখগুলো। তাদের গাঢ়তাও যেন বেড়ে গেল একই পরিমাণে। কী পরিমাণে দুষ্টু হয়ে উঠেছ তুমি পালমিস! বলে উঠল ও। ছোটবেলাতেও দুষ্ট ছিলে আর এখন বুড়ো হতে চললে; কিন্তু তোমার দুষ্টুমির কমতি নেই! বলেই চটাস করে ছেলেটার কানের নিচে একটা চাটি মারল ও। ব্যাপারটা এমন আচমকা ঘটে গেল আর এত জোরে যে যুগপৎ ব্যথা আর বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল পালমিস।
তবে সেদিন সন্ধ্যায় কিছু আনন্দের ব্যাপারও ঘটল। প্রধান পূজারিনি হ্যাগনের সাথে কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল রাজা বেন আর্গোলিদ, স্বাভাবিক সময়ের অনেক পরে আবার সবার সামনে উদয় হলো সে। চেহারায় বিশ্বজয়ের আনন্দ, চোখে পরিতৃপ্তির উজ্জ্বলতা। সরাসরি রাজা হুরোতাসের কাছে চলে এলো সে, জানাল যে হ্যাগনেকে সে বিয়ে করতে চায়। জানা গেল একটু আগেই সোনালি ধনুক ভগিনীসংঘের প্রধান পদ থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে হ্যাগনে।
আচ্ছা তুমি যে এর আগে আমাকে বললে, মিনোয়ান রোডসে অর্থাৎ তোমার নিজের দ্বীপদেশে ইতোমধ্যে দশজন সুন্দরী স্ত্রী তোমার অপেক্ষা করছে? দাঁত বের করে হেসে প্রশ্ন করল হুরোতাস।
প্রিয় হুরোতাস, ওদের সংখ্যাটা আসলে তেরোজন। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই জানো সংখ্যাতত্ত্বের অভিধানে এটা হচ্ছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক একটা সংখ্যা। অথচ চৌদ্দকে বলা যায় দ্বিগুণ সৌভাগ্যের প্রতীক।
সেই বিকেলেই তাদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দিল হুরোতাস। ফলে আরো একবার আনন্দ উৎসবের আয়োজন করার অজুহাত পেয়ে গেল সবাই। যদিও পরের দিন থেকে হিসাব করলে সেরেনা আর রামেসিসের বিয়ের আর তেরো দিন বাকি থাকে; কিন্তু তখন এ ব্যাপারে কোনো চিন্তাই আসেনি আমার মাথায়।
*
পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড মাথাব্যথা এবং অদ্ভুত একটা অস্বস্তি নিয়ে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে গতকালের চাইতে আজকে আমার মেজাজ এমন বদলে গেল কীভাবে তাই বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। এক চাকরকে পাঠালাম দেখে আসতে যে গতকাল যাদের বিয়ে হলো সেই রাজা বের আর্গোলিদ আর পূজারিনি মাতা হ্যাগনে কেমন আছে দেখে আসতে। কিন্তু সে ফিরে এসে জানাল তারা দুজন এখনো তাদের শোবার ঘর থেকে বের হয়নি। তবে ভেতর থেকে নানা রকম আনন্দসূচক শব্দ ভেসে আসছে, সেইসাথে মনে হচ্ছে ভারী আসবাব এদিক-ওদিক সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেউ অথবা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে। ফলে বোঝা যায় যে তারা আর যা-ই করুক, ঘুমোচ্ছে না। সেইসাথে রাজকুমারী সেরেনাসহ অন্য সকল নারী ও শিশু ভালো আছে এবং কারো ভাগ্যে কোনো দুরারোগ্য অসুখ বা অন্য কোনো বিপদ দেখা দেয়নি। সত্যি কথা বলতে আমি যখন চাকরের কাছ থেকে এসব কথাগুলো শুনছি ঠিক তখনই আমার জানালার নিচের উঠান থেকে উচ্ছ্বসিত হাসি আর হইচইয়ের শব্দ ভেসে এলো। জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে নিচে তাকালাম আমি।
দেখলাম রামেসিস এবং রাজকুমারী সেরেনা তাদের প্রিয় দুটো ঘোড়ায় বসে আছে। দারুণ স্বস্তি লাগল ওদের দেখে। সাথে আরো রয়েছে সেরেনার ব্যক্তিগত দুই পরিচারিকা এবং রামেসিসের এক দল সশস্ত্র প্রহরী। দুর্গের সদর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওদের দলটা, নিশ্চয়ই বনভোজন বা এমন কোনো অবসর বিনোদনে যাচ্ছে। মৃদু হাসলাম আমি। এখন মনে হচ্ছে ওই অস্বস্তির কারণ আর কিছু নয়, স্রেফ গতকাল সন্ধ্যায় হুরোতাস আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যে দুই তিন পেয়ালা মদ অতিরিক্ত খেতে বাধ্য করেছিল তার ফলাফল।
দুর্গ থেকে বের হয়ে নদীর কাছে চলে এলাম আমি, নগ্ন হয়ে বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কাটলাম কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে। মদের নেশা কেটে যাওয়ার পরবর্তী অস্বস্তি কাটানোর জন্য এর চাইতে ভালো মহৌষধ আর নেই। মাথা এবং মন পরিষ্কার হয়ে আসতে দুর্গে ফিরে এলাম, আবার হুরোতাস আর হুইয়ের সাথে যোগ দিলাম মন্ত্রণাকক্ষে। ষোলো রাজার মাঝে আজ আমাদের সাথে উপস্থিত রইল বারোজন। বাকি চারজন তাদের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেছে, বলেছে আজ একটু অসুস্থ থাকায় তাদের পক্ষে আলোচনায় যোগ দেওয়া সম্ভব নয়।
একটু পরেই রামেসিস একা একা ফিরে এলো দুর্গে। আমাদের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি বিষয়ক আলোচনায় যোগ দিতে এলো সে।
তাকে দেখার সাথে সাথে আমি প্রথম যে প্রশ্নটা করলাম সেটা হচ্ছে, রাজকুমারী সেরেনা কোথায়?
উত্তরের সৈকতে রেখে এসেছি ওকে, নীল খালের কাছে।
জায়গাটা খুব ভালো করেই চিনি আমি। নিশ্চয়ই একা রেখে আসোনি ওকে?
একাই বলতে পারো, হতাশ ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাল রামেসিস। সাথে আছে কেবল ওর দুই পরিচারিকা আর আমার লোকদের মাঝে সবচেয়ে দক্ষ আটজন। আশা করি আগামী কয়েক ঘণ্টার জন্য ও নিরাপদই থাকবে। আমার মনে হয়েছিল যুদ্ধে আমার জাহাজ এবং লোকদের কাজ এবং অবস্থান সম্পর্কে তোমার সাথে আলোচনায় বসা উচিত আমার। তা ছাড়া তোমার এটাও মনে রাখা উচিত যে, সেরেনা এখন আর শিশু নয়। নিজের দিকে খুব ভালোভাবেই খেয়াল রাখতে পারে ও। আমাকে বলেছে দুপুরের চার ঘণ্টা পরেই ফিরে আসবে এখানে।
রামেসিস ঠিকই বলেছে, ওদিকে হুরোতাসও আমাদের আলোচনায় যোগ দিল। সেরেনার নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই পর্যায়ে এসে হুইও তার লম্বা নাকটা আমাদের আলোচনার মাঝে গলিয়ে দেওয়া একান্ত কর্তব্য বলে বোধ করল। তা ছাড়া ওর দেহরক্ষীদের মাঝে আমার ছোট ছেলে পালমিসও রয়েছে। ছোট হলে কী হবে, সাহসে আর শক্তিতে মোটেই কম যায় না, বড়াই করল সে।
অনুভব করলাম আবার সেই অস্বস্তিটা ফিরে আসছে আমার মাঝে। কিন্তু বাকিরা ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবার। আমি যখন একটু আলাদা হয়ে থাকতে চাইলাম তখন আমাকে খোঁচানো শুরু করল, বলল যোগ দিতে। সবাইকে অগ্রাহ্য করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াল। একসময় নিজের অজান্তেই ওদের কথায় আগ্রহী হয়ে উঠলাম আমি, আলোচনায় যোগ দিলাম। এবং পুরো ব্যাপারটা এমন জটিল যে, কথায় কথায় কতটা সময় পার হয়ে গেল তার কোনো হিসাবই থাকল না মাথার ভেতর।
একসময় দুই দাসী ঢুকল মশাল নিয়ে, তেলের প্রদীপগুলো এক এক করে জ্বালিয়ে দিতে শুরু করল। এই দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম আমি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে দেখলাম অসাধারণ এক রূপ নিয়েছে ট্যাগেটাস পর্বতমালা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা শিখরের ওপাশে অস্ত যাচ্ছে জ্বলন্ত সূর্য।
জিউসের কসম! অবাক হয়ে বলে উঠলাম আমি, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি একই সঙ্গে। এখন বাজে কয়টা?
দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের অন্য পাশে রাখা পানিঘড়ির দিকে এগিয়ে গেল হুই। সেটার ওপর আঙুল দিয়ে একটা টোকা দিল সে। এই ঘড়িটায় নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে। পানি খুব বেশি তাড়াতাড়ি পড়ে যাচ্ছে। এতে বলছে দুপুরের পরেও আরো আট ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। এতটা নিশ্চয়ই হতে পারে না?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখো। সূর্যের কখনো ভুল হয় না, বললাম আমি। তারপর ফিরলাম রামেসিসের দিকে। সেরেনা আর বাকিদের ফেরার কথা ছিল কখন?
তীব্র অপরাধবোধ ফুটে উঠল রামেসিসের চেহারায়। উঠে দাঁড়াল সেও। বলল আমি নিশ্চিত যে ওরা ইতোমধ্যে দুর্গে ফিরে এসেছে। কয়েক ঘণ্টা আগেই ওদের ফেরার কথা। হয়তো আমাদের বিরক্ত করতে চায়নি সেরেনা। হুরোতাস সবাইকে পইপই করে বলে দিয়েছে…
আর শুনতে ইচ্ছে করল না আমার। ঘুরে দাঁড়িয়েই দৌড় দিলাম আমি। কামরার দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি এই সময় পেছন থেকে হুরোতাস ডাক দিল আমাকে। ফিরে এসো টাইটা। যাচ্ছ কোথায়?
প্রধান ফটকে। প্রহরীরা বলতে পারবে যে সেরেনা এখনো ফিরেছে কি না, ঘাড় ঘুরিয়ে চিৎকার করে জবাব দিলাম আমি। নিজের কণ্ঠস্বর শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। ভয়ে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে আমার গলা, কানে আঘাত করছে। এত অস্থির হচ্ছি কেন আমি জানি না; কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সারা দিনের যত অস্বস্তি ছিল সব শকুনের পাখায় ভর করে চক্কর দিতে শুরু করেছে আমার মাথার ওপর। বিপদের তীব্র গন্ধ এসে লাগছে আমার নাকে। শিকারি কুকুরের তাড়া খাওয়া হরিণের মতো দৌড়াচ্ছি আমি। পেছনে শুনতে পাচ্ছি জুতোর আওয়াজ বাকিরাও দৌড়ে আসছে আমার সাথে সাথে। দুর্গের প্রাঙ্গণে বের হয়ে এলাম আমি, এক শ কদম দূরে থাকতেই প্রহরীদের উদ্দেশ্য করে চিৎকার করতে শুরু করলাম। রাজকুমারী সেরেনা কি দুর্গে ফিরেছে? কয়েকবার প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার পর আমার কথা বুঝতে পারল ওরা।
এখনো না প্রভু টাইটা, প্রধান প্রহরী জবাব দিল আমার কথার। আমরা অপেক্ষা করে আছি…
লোকটার কথা আর একটুও শুনতে ইচ্ছা করল না আমার। তার পাশ কাটিয়ে এলাম আমি দৌড়াতে দৌড়াতেই চলে এলাম আস্তাবলের দিকে। হঠাৎ করে মনে পড়ল যে তলোয়ারটা সেই মন্ত্রণাকক্ষের দেয়ালেই ঝুলিয়ে রেখে এসেছি। কিন্তু এখন আর ওটা আনতে ফিরে যাওয়ার সময় নেই। এখন আমি প্রায় নিশ্চিত, ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছে সেরেনার ভাগ্যে। এই মুহূর্তে আমাকে দরকার ওর।
প্রিয় ঘোড়াটার মুখে লাগাম পরিয়ে দিলাম আমি। সুন্দর বাদামি রঙের একটা মাদি ঘোড়া, তেহুতি উপহার দিয়েছে আমাকে। তারপর ঘোড়ায় জিন পরানোর জন্য সময় নষ্ট না করে সরাসরি পিঠে উঠে বসলাম, দুই পায়ের গোড়ালি দিয়ে খোঁচা মারলাম প্রাণীটার পাঁজরে।
চল, চল! তাড়া দিলাম আমি। আস্তাবলের দরজা দিয়ে প্রায় উড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা, পাহাড় থেকে নেমে আসা পথটার মাঝখান দিয়ে যেই রাস্তাটা সৈকতের দিকে এগিয়ে গেছে সেটা ধরে এগিয়ে চললাম। পেছনে তাকালাম একবার। দেখলাম রামেসিস, হুরোতাস আর হুইয়ের নেতৃত্বে বাকি সবাই এখনো অনেক পেছনে। আমাকে ধরার জন্য প্রাণপণে ঘোড়া ছোটাচ্ছে সবাই। সৈকতের পাশে নীল খালের সামনে আমি যখন পৌঁছলাম তখন দিনের আলো মুছে আসতে শুরু করেছে। তখনো পাগলের মতো ঘোড়াটাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছি আমি, এই সময় হঠাৎ প্রাণীটা রাস্তা ছেড়ে এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যে একটু অনভিজ্ঞ কেউ হলে ঘোড়ার পিঠ থেকে উড়ে দূরে গিয়ে পড়ত। তবে আমি কোনোমতে দুই হাঁটু দিয়ে চেপে ধরলাম ঘোড়াটাকে, তারপর কোনোমতে শান্ত করে একপাশে থামালাম। এবার সেই জিনিসটাকে দেখার ফুরসত মিলল, যেটা ঘোড়াটাকে ভয় দেখিয়েছে। এবং তাকানোর সাথে সাথে বুঝতে পারলাম জিনিসটা আর কিছু নয়, একটা মানুষের মৃতদেহ। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে পড়লাম আমি, তারপর লাগাম ধরে এগিয়ে এলাম লাশটার দিকে। রক্তে ভিজে আছে মৃতদেহটা। এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলাম আমি, উল্টে দিলাম সেটাকে। এবং চিনতে পারলাম সাথে সাথেই।
পালমিস, হুই এবং বেকাথার ছোট ছেলে। সারা শরীরে একটা সুতোও নেই। জবাই করার আগে ওকে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে খেলেছে খুনির দল। পেট চিরে ভেতর থেকে বের করে এনেছে নাড়িভুড়ি। গোপনাঙ্গ কেটে ফেলেছে, কোটর থেকে তুলে নিয়েছে দুই চোখ। আগের সেই সুদর্শন চেহারার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এখন। ওর বাবা-মায়ের জন্য হঠাৎ প্রচণ্ড করুণা হলো আমার।
আবার উঠে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকালাম আমি। এবার বুঝতে পারলাম, কেন পালমিসের সাথে এই নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। জীবন দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মরার আগে লড়াই করে মরেছে ও। চার আক্রমণকারীর লাশ ছড়িয়ে পড়ে আছে পথের পাশে জন্মানো ঝোঁপগুলোর মাঝে। মৃত্যু-পরবর্তী দুনিয়ায় আনুবিসের কাছে যাওয়ার জন্য যে পথে গেছে পালমিস তাতে ওর সাথী হয়েছে এই লোকগুলো।
মনের সব ঝাল ঝেড়ে গালিগালাজ করলাম আমি; কিন্তু মুখের কথায় মৃত ব্যক্তির কিছুই আসে-যায় না। এবার আমার মনোযোগ ফিরল জীবন্তদের দিকে অবশ্য যদি কেউ থেকে থাকে আর কি। আক্রমণকারীদের সংখ্যা কত ছিল? মনে মনে ভাবলাম আমি। এখন কিছুই বোঝার উপায় নেই, অনেকগুলো পায়ের চাপে পথের ওপর থেকে সব চিহ্ন মুছে গেছে। আন্দাজ করলাম পালমিসের হাতে খুন হওয়া চারজনসহ কমপক্ষে ত্রিশজন তো হবেই।
কিন্তু আমার মাথার ভেতর আর সব চিন্তার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে সেরেনার জন্য দুশ্চিন্তা। ওর সাথে কেমন আচরণ করেছে আততায়ীরা? ওর কাপড় ছিঁড়ে ফেলার পর সেই নগ্ন সৌন্দর্য দেখে কেউ কি সামলাতে পেরেছে নিজেকে? মনে হলো যেন সেরেনার ওপর অত্যাচার করার সময় খুনিগুলোর পৈশাচিক উল্লাসের শব্দ নিজের কানে শুনতে পাচ্ছি আমি। অনুভব করলাম রাগ, ভয় আর করুণায় মিশ্রিত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে আমার গাল বেয়ে। তাড়াতাড়ি ঘোড়ায় উঠে বসলাম আমি, তারপর আবার চলতে শুরু করলাম নীল খালের দিকে এগিয়ে যাওয়া পথ ধরে।
পথের ওপর ছড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল আরো সাতটা মৃতদেহ। সবগুলোই পুরুষ এবং সবার ওপরেই মরার আগে ভয়াবহভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। রামেসিস যাদেরকে রেখে গিয়েছিল সেরেনাকে পাহারা দিতে এরা তারাই। এবার আর থেমে ওদের পরীক্ষা করার জন্য সময় নষ্ট করলাম না। মনের ভেতর ক্ষীণ একটু আশা জেগে আছে, কারণ এখনো সেরেনা বা তার দুই পরিচারিকার কারো কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। হয়তো আততায়ীরা মেয়েদের বাঁচিয়ে রেখেছে। হয়তো ওরা জানত যে অত্যাচার করে খুন করার চাইতে সেরেনাকে অক্ষত অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখলে অনেক বেশি মুক্তিপণ পাওয়া যাবে।
জঙ্গলের মাঝ থেকে সৈকতের কিনারায় বেরিয়ে এলাম আমি এবং এসেই থমকে দাঁড়ালাম। দিনের আলো দ্রুত কমে আসছে। তবে আবছা আলোতেও সোনালি সমুদ্রতটের ওপর আততায়ীদের রেখে যাওয়া পদচিহ্ন ঠিকই চোখে পড়ল আমার, এগিয়ে গেছে পানির কিনারার দিকে। কিন্তু আমার চোখের সামনে দ্রুত আঁধার হয়ে আসছে দিগন্তরেখা, ফলে সেখানে যদি কোনো অচেনা জাহাজ বা নৌকা থেকেও থাকে তার অস্তিত্ব বোঝার কোনো উপায় নেই। প্রথমে মনে হলো ঘোড়া নিয়ে পানির কিনারে এগিয়ে যাই। কিন্তু তার পরেই নিজেকে সামলে নিলাম, কারণ জানি যে এই কাজ করলে আমার ঘোড়ার পায়ের ছাপে দুবৃত্তদের চিহ্ন নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ঘোড়া থেকে নেমে পড়লাম আমি, লাগাম ধরে একটা গাছের মোটা ডালের সাথে বেঁধে রাখলাম। তারপর বালির ওপর তৈরি হওয়া ছাপগুলোকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম, যেন নষ্ট না হয়ে যায় সে জন্য নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছি। কিছু দূর যাওয়ার পরেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস ধরা পড়ল আমার চোখে। অনেকগুলো পায়ের ছাপ বিক্ষিপ্তভাবে তৈরি হয়েছে বালির ওপর কিন্তু তার মাঝেও একটা ছাপ স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। পা টেনে টেনে হেঁটেছে এই ছাপের মালিক। ছাপগুলো চিনতে একটুও বেগ পেতে হলো না আমাকে।
*
এর আগে আমার ধারণা হয়েছিল যে আততায়ীরা নিশ্চয়ই কোনো জলদস্যুর দল হবে, হুট করেই যারা সেরেনা আর তার সঙ্গীদের খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারলাম ঘটনা মোটেও সে রকম কিছু নয়। তবে সেই মুহূর্তে আমার মনোযোগ ছিন্ন হয়ে গেল ঘোড়ার পায়ের শব্দ আর আমার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে থাকা কিছু কণ্ঠস্বরের আওয়াজে। জঙ্গলের দিক থেকে আসছে শব্দগুলো। রামেসিস আর হুরোতাসের গলা চেনা গেল তাদের মাঝে। এই যে এখানে! চিৎকার করে ওদের ডাক দিলাম আমি।
জঙ্গলের মাঝ থেকে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলো সবাই।
আমাকে দেখার সাথে সাথে সামনে এগিয়ে এলো, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। একের পর এক প্রশ্ন বর্ষিত হচ্ছে আমাকে লক্ষ্য করে।
সেরেনা! পেয়েছ ওকে?
এখানে আছে ও?
না! জবাব দিলাম আমি। এখানে নেই ও। কিন্তু আমার ধারণা আমি জানি যে ও কোথায়।
করুণাময় আর্টেমিস সাক্ষী! ককিয়ে উঠল রামেসিস। ওই শয়তানগুলো যারাই হোক না কেন পালমিস এবং আমাদের অন্য সব লোককে খুন করে রেখে গেছে। ছেলের মৃতদেহের কাছে হুইকে রেখে এসেছি আমরা। একেবারেই ভেঙে পড়েছে সে। তোমার কাছে মিনতি করছি, আমায় দয়া করে এটা নিশ্চিত করো যে আমার সেরেনার সাথেও এমন কিছু ঘটেনি।
রামেসিসের বাম পাশে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে হুরোতাস। প্রচণ্ড রাগে থরথর করে কাঁপছে সে, মুখ দিয়ে একের পর এক অশ্রাব্য গালিগালাজ আর শপথের বন্যা ছুটছে। এই অমানুষিক কাজ যারাই করে থাকুক না কেন আমি তাদের খুঁজে বের করব। তাতে যদি আমার বাকি জীবন লেগে যায় তো লাগুক! বলে উঠল সে। একবার যদি ধরতে পারি তাহলে এমন শাস্তি দেব, যা দেখে দেবতাদেরও বুক কেঁপে উঠবে।
ঘোড়া নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল দুজন। কে করেছে এই কাজ টাইটা? সবই তো জানো তুমি। ঘোড়া থেকে এক লাফে নেমে এসে আমার কাঁধ চেপে ধরল রামেসিস, পাগলের মতো ঝাঁকাতে শুরু করল।
আমার কাঁধ ছাড়ো রামেসিস, নিজেকে শান্ত করো! ধমকে উঠলাম আমি, তারপর কোনোমতে ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। এই যে! নিজের চোখেই দেখো! বলে বালির ওপর পড়ে থাকা পায়ের ছাপগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি।
তোমার কথার কিছু আমার মাথায় ঢুকছে না! হুরোতাসও চোখ রাঙিয়ে চিৎকার করে উঠল। কী দেখাতে চাইছ আমাদের?
ছাপগুলোর একেবারে মাঝখানে যে ছাপটা রয়েছে দেখেছ? বোঝাই যাচ্ছে যে এই ছাপের মালিকের ডান পায়ে সমস্যা আছে। পা টেনে টেনে হাঁটে সে।
পানমাসি! আমার কথার অর্থ বোধগম্য হওয়ার সাথে সাথে উন্মত্ত ক্রোধে চিৎকার করে উঠল রামেসিস। সেই লোক, আমাদের কাছে যার প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল সেরেনা! হারামজাদা অকৃতজ্ঞ শূকরটা আবার ফিরে এসেছে এখানে, তারপর সেরেনাকে চুরি করে নিয়ে গেছে উটেরিকের আস্তানায়।
যাই হোক এখন অন্তত এটুকু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে সেরেনা বেঁচে আছে। এমন মূল্যবান একজন বন্দিকে কিছুতেই খুন করবে না পানমাসি, উটেরিক অনুমতি দেবে না তাকে, হুরোতাস আর রামেসিসকে সান্ত্বনা দিতে চেয়ে বলে উঠলাম আমি।
তোমার কথাই যেন সত্যি হয় টাইটা। কিন্তু এই মুহূর্তে ওদের পিছু ধাওয়া করতে হবে আমাদের। রামেসিসের কথা শুনে মনে হছে যেন ওর ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন চালাচ্ছে কেউ। সেরেনাকে ওদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনতেই হবে।
আমার মেয়ে আমার একমাত্র সন্তানকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ওই দস্যুরা। রামেসিস ঠিকই বলেছে। এখনই ওদের পিছু নেওয়া উচিত আমাদের। হুরোতাসও রাগ আর শোকে প্রায় পাগলের মতো হয়ে উঠেছে। দেবতারা সহায় হলে নীলনদের মুখে পৌঁছানোর আগেই ওদের ধরে ফেলতে পারব আমরা। এটা তো নিশ্চিত যে ওখানেই সেরেনাকে নিয়ে যাচ্ছে ওরা।
আমার অবস্থাও ওদের দুজনের চাইতে খুব একটা ভালো নয়; কিন্তু নিজের আবেগকে ওদের চাইতে ভালোভাবে সামলাতে জানি আমি। এখানে দাঁড়িয়ে যত কান্নাকাটি করব ততই আমাদের সময় নষ্ট হবে, কড়া গলায় বললাম আমি। চেষ্টা করছি দুজনের মাথায় কিছুটা বাস্তব বুদ্ধি ফিরিয়ে আনতে। এখান থেকে গিথিয়ন বন্দরে গিয়ে জাহাজ প্রস্তুত করে রওনা দিতে দিতে আমাদের চাইতে প্রায় দশ ঘণ্টার পথ এগিয়ে যাবে পানমাসি। সেইসাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে ওরা কী ধরনের নৌকা বা জাহাজ ব্যবহার করছে সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। সৈকতের ওপর তৈরি হওয়া একটা দাগের দিকে ইঙ্গিত করলাম। বোঝা যাচ্ছে যেকোনো জলযানের সামনের অংশ এখানে টেনে তুলে আনা হয়েছিল। এই চিহ্নটা বলছে কোনো একটা ছোটখাটো বাণিজ্যতরী। কিন্তু এখান থেকে মিশর পর্যন্ত সমুদ্রপথের পুরোটা এমন অসংখ্য জাহাজে ভর্তি। এবং আমাদের ওপর চোখ পড়ার সাথে সাথে প্রতিটাই ভাববে যে আমরা জলদস্যু এবং লেজ তুলে পালাবে। যতগুলো জাহাজ চোখে পড়বে তার প্রত্যেকটার পিছু ধাওয়া করতে হবে আমাদের, যা অত্যন্ত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ কাজ। আর ওদিকে পানমাসি তখন জাহাজের প্রত্যেকটা পাল তুলে দিয়ে প্রত্যেকটা দাঁড়ে দ্বিগুণ লোক লাগিয়ে ঊধ্বশ্বাসে ছুটে চলবে নীলনদের মুখের দিকে।
এই কথাগুলো শুনেই দুজনের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল স্পষ্টভাবে। পানমাসি যে সরাসরি নীলনদের দিকে নাও যেতে পারে এটা আর ওদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না। এমনও হতে পারে যে উত্তর আফ্রিকার উপকূলে যে অসংখ্য ছোট ছোট বন্দর রয়েছে সেগুলোর কোনো একটায় রথ বাহিনী অপেক্ষা করছে পানমাসির জন্য। সেখানে জাহাজ ভিড়িয়ে বন্দিনীকে নিয়ে লুক্সর পর্যন্ত বাকি রাস্তা স্থলপথে রথের সাহায্যে পাড়ি দিতে পারে সে। এবং পানমাসি যদি একবার মিশর সীমান্তের ভেতর অথবা নীলনদের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে তাহলে তার গায়ে আঙুল ছোঁয়ানোর আর কোনো উপায় থাকবে না আমাদের।
হুরোতাস ঠিকই বলেছে, গলায় যতটা সম্ভব জোর এনে বললাম আমি। এখন প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের জন্য মূল্যবান। এই মুহূর্তে গিথিয়ন বন্দরের দিকে রওনা দিতে হবে আমাদের। জাহাজ নিয়ে সাগরে নামব আমরা, বাতাসে একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগেই খুঁজে বের করার চেষ্টা করব পানমাসির গন্ধ।
তবে যতই সাহস বা দর্প দেখাই না কেন চাঁদ ছিল না সে রাতে। ফলে অন্ধকারের মাঝে পথ চলতে গিয়ে অনেক দেরি হয়ে গেল। আমরা যখন গিথিয়ন বন্দরে পৌঁছলাম তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে।
রামেসিস, হুরোতাস আর হুই মিলে সমুদ্রযাত্রার জন্য জাহাজ প্রস্তুত করতে শুরু করল। আর আমার ওপর পড়ল সেই কঠিন কাজের ভার; তেহুতি আর বেকাথাকে গিয়ে জানাতে হবে তাদের সন্তান হারানোর কথা। যদি বলি যে হুরোতাস এবং হুইয়ের কেউই কাজটা করার মতো সাহস দেখাতে পারল না তাহলে বোধ হয় একটু বেশি নিষ্ঠুরতা দেখানো হয়ে যাবে। তবে ইতোমধ্যে যে ভয়ানক ঘটনাগুলোর সাক্ষী হয়েছি আমি তাতে এখন আর কোনো কিছুই আমাকে বিচলিত করতে পারছে না।
প্রথমেই পালমিসের ক্ষতবিক্ষত লাশ নিয়ে বেকাথার কাছে গেলাম আমি। দাসীরা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার পর তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রাখলাম আমি, বলতে চাইলাম যে নিষ্ঠুর ভাগ্য তার ছোট ছেলেকে কেড়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু খুব সম্ভব সন্ধ্যার সময় পান করা মদের প্রভাব তখনো সম্পূর্ণ কাটেনি তার। বারবার আমাকে বলতে লাগল পালমিসকে রাতের খাবার খেতে দেখেছে সে। এখন বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে তার ছেলে।
ওকে নিয়ে সেই কামরায় চলে এলাম আমি, যেখানে আমার লোকেরা পালমিসকে শুইয়ে রেখেছে। যদিও ওর আহত স্থানগুলো ঢাকার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, মুখ থেকে রক্ত মুছে দিয়েছি, আঁচড়ে দিয়েছি চুলগুলো। শূন্য চোখের পাতাগুলো সেলাই করে বন্ধ করে দিয়েছি, সেলাই করতে হয়েছে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া পেট। কিন্তু তার পরও এখনো এই অবস্থায় কোনো সন্তানকে তার মায়ের সামনে হাজির করা যায় না। পালমিসকে দেখে চমকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরল বেকাথা, ওভাবেই রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলের মৃতদেহের ওপর। শোক আর কান্নার দমকে থরথর করে কেঁপে উঠছে শরীরটা।
কিছুক্ষণ পর অনেকটা জোর করেই বেকাথাকে একটা জোরালো ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলাম। আমার ওষুধের বাক্স থেকে তৈরি করেছি জিনিসটা। কাজ শুরু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম ওর পাশে। তারপর বাকি তিন ছেলের একজনকে ডেকে ওর দায়িত্ব নিতে বললাম। তারপর চললাম তেহুতির খোঁজে।
বেকাথার শোকার্ত অবস্থা দেখার চাইতেও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলো এবার আমাকে।
প্রথমে তেহুতির পরিচারিকাদের বাইরের ঘরে অপেক্ষা করতে বললাম আমি, তারপর ঢুকলাম ওর শোবার ঘরে। বিছানার ওপর শুয়ে ঘুমাচ্ছিল ও, পরনে একটা লম্বা রাতপোশাক। সুন্দর লম্বা চুলগুলো মাথার চারপাশে ছড়িয়ে আছে, ঠিক যেন ট্যাগেটাস পর্বতমালার ওপর চাঁদের আলোয় ঝলকাচ্ছে তুষারের শুভ্র স্তূপ। মনে হচ্ছে যেন আবার ছোট্ট একটা মেয়েতে পরিণত হয়েছে ও। ওর পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম আমি।
টাইটা! চোখ না খুলেই ফিসফিস করে বলে উঠল তেহুতি। আমি জানি তুমি ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। তোমার গায়ে কি সুন্দর একটা গন্ধ থাকে সব সময়!
ঠিকই ধরেছ তেহুতি। আমি।
ভয় লাগছে আমার, বলল ও। একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।
সাহস রাখো তেহুতি। সাহস রাখতে হবে তোমাকে।
পাশ ফিরে আমার মুখোমুখি হলো তেহুতি। খারাপ খবর নিয়ে এসেছ তুমি, আমি অনুভব করতে পারছি। সেরেনার কোনো বিপদ হয়েছে, তাই না?
আমি খুব দুঃখিত, সোনামণি, কথাগুলো বলতে গিয়ে গলায় আটকে গেল আমার।
বলো টাইটা। দয়া করে সত্য গোপন করার চেষ্টা কোরো না আমার কাছ থেকে।
চুপচাপ আমার কথাগুলো শুনল ও। চেহারা রক্তশূন্য পাথরের মতো চোখগুলো জ্বলতে লাগল রাতপ্রদীপের মৃদু আলোয়। সেই ছোটবেলার মতো এখনো ভূতদের তাড়ানোর জন্য মাথার কাছ একটা প্রদীপ জ্বেলে রাখে ও। আমার কথাগুলো যখন শেষ হলো তখন মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল তুমি বলছ যে এটা উটেরিকের কাজ?
সে ছাড়া আর কেউ নেই এই কাজ করার মতো।
সে কি সেরেনার ক্ষতি করবে?
না! নিজের অনিশ্চয়তাকে ঢাকতে গিয়ে আপনাআপনি জোরাল হয়ে উঠল আমার কণ্ঠস্বর। উটেরিক একজন উন্মাদ। অন্য স্বাভাবিক মানুষের মতো নয় তার চিন্তাভাবনা। মোটেই না। সেরেনা যদি মারা যায় বা ওর কোনো ক্ষতি হয় তাহলে উটেরিকের কোনো লাভ হবে না। কথাগুলো বলার সময় বাম হাতের তর্জনী দিয়ে মধ্যমাকে আঁকড়ে ধরে রাখলাম আমি। চাই না যে আমার কথা শুনে খেপে উঠুক কোনো রাগী দেবতা।
তুমি আমার খুকুকে খুঁজে এনে দেবে না, টাটা?
হা তেহুতি। নিশ্চয়ই দেব তুমি জানো।
ধন্যবাদ, ফিসফিস করে বলল ও। এখন তাহলে তুমি যাও। না হলে হয়তো বোকার মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করব আমি।
আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী নারী তুমি তেহুতি।
এখন বেকাথার আমাকে দরকার। ওর কাছে যেতে হবে আমাকে, বলে আমার গালে চুমু খেল ও। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর রাখা কাপড়টা পরে নিল, দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। কিন্তু আমার মনে হলো দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ার সময় একটা মৃদু ফোঁপানির শব্দ শুনলাম আমি। কে জানে হয়তো ভুলও হতে পারে। খুব কম সময়েই কান্নার কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেখেছি ওকে।
*
আমি যখন আবার গিথিয়ন বন্দরে পৌঁছলাম তখন সূর্য দিগন্তের ওপাশে উঁকি দিতে শুরু করেছে। দেখলাম হুরোতাস নিজের জাহাজে উঠে পড়েছে। আমি নিজেও যখন ওর সাথে কথা বলার জন্য জাহাজে উঠলাম, দেখলাম মোলোজন করদ রাজার সাথে সবে মাত্র পরামর্শ সেরে উঠছে ও। রাজাদের সবাই নিজেদের শপথের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ধরে রেখেছে এবং তা পালন করতে বদ্ধপরিকর। একের অপমান এখন প্রত্যেকের অপমান।
পরবর্তী দুই-এক দিনের মধ্যেই নিজ নিজ দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে সবাই। দেশে পৌঁছে প্রত্যেকে তাদের সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করবে, কারণ আমাদের সামনে এখন যুদ্ধ আসন্ন। খবরটা সত্যিই উৎসাহ জোগাল আমাদের। ব্যক্তিগতভাবে আমি ভেবেছিলাম আমাদের এই মিত্রদের মাঝ থেকে কমপক্ষে দুই কি তিনজন শপথ ভঙ্গ করবেই, বিশেষ করে যদি কখনো তাদের সাহায্য করার জন্য ডেকে পাঠানো হয়। সুতরাং হুয়োতাস আর হুইকে অভিনন্দন জানালাম আমি। এটাও জানালাম যে, সেরেনার অপহরণ আর পালমিসের খুন সম্পর্কেও তাদের প্রিয় স্ত্রীদের জানানোর কাজ শেষ হয়েছে। আমার প্রতি ওরা দারুণ কৃতজ্ঞ বোধ করল এবং একই পরিমাণে লজ্জিত হলো নিজেদের কথা চিন্তা করে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক বলে আশা করেছিলাম আমি। দুজনের কেউই তাদের স্ত্রীর সামনে দুঃসংবাদ নিয়ে দাঁড়াতে সাহস পায়নি, শোকের প্রথম ধাক্কাটা সামলানোর মতো শক্তিও খুঁজে পায়নি বুকের ভেতর।
যাই হোক, ওদের বললাম আমি। এবার তাহলে পানমাসির পিছু নেওয়ার সময় হয়েছে। কথা বলার সময় শেষ। এবার রক্ত ঝরানোর সময় চলে এসেছে।
ওদের দুজনের সাথে কথা বলা শেষ করে জাহাজ থেকে নেমে এলাম আমি, বন্দরের পথ ধরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললাম অন্য পাশে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মেমনন, আসন্ন যাত্রার প্রস্তুতি হিসেব নোঙরের দড়ি গুটাচ্ছে।
ভেবেছিলাম তোমার প্রস্তুতি নেওয়া আর শেষই হবে না, আমাকে জাহাজে উঠতে দেখে গম্ভীর গলায় বলে উঠল রামেসিস। সেরেনার অপহরণের খবর শোনার পর থেকে এ পর্যন্ত ওর মুখে হাসি দেখিনি আমি। মহান দেবতা জিউসের সম্মান আর মর্যাদার কসম, এতক্ষণ কোথায় লুকিয়ে ছিলে, টাইটা?
তুমি কি আমার ওপর কাপুরুষতার অভিযোগ আনছ? আমার গলায় এমন কিছু একটা ছিল, ফ্যাকাশে হয়ে গেল রামেসিসের মুখ। এক পা পিছিয়ে গেল সে।
ক্ষমা করো, টাইটা। এমন কথা বলা মোটেই উচিত হয়নি আমার, বিশেষ করে তোমাকে। কিন্তু কী করব, শোকে পাগল হওয়ার দশা হয়েছে আমার।
আমিও, রামেসিস। সে জন্যই তোমার একটু আগে বলা কথাটা আমি মাথা থেকে মুছে ফেলেছি। বলেই সরাসরি কাজের কথায় চলে এলাম আমি। আমার পায়রাগুলো তুলেছ জাহাজে?
বারোটা খাঁচার সবগুলোই তোলা হয়েছে। সবগুলোই মেয়ে পায়রা, কারণ ওগুলোই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী, দ্রুতগামী এবং আর সব মেয়েদের মতোই একগুয়ে, যেমনটা তুমি আমাকে প্রায়ই মনে করিয়ে দিতে। যেন ওর কথার জবাবেই পরিচিত বাক-বাকুম শব্দ ভেসে এলো জাহাজের নিচের ডেকের ওদিক থেকে। মৃদু হাসি ফুটল রামেসিসের ঠোঁটে, খুব সম্ভব সেরেনাকে হারিয়ে ফেলার পর এই প্রথম।
তোমার গলা শুনতে পেয়েছে ওরা। তোমাকে খুব ভালোবাসে পায়রাগুলো, ঠিক আমাদের মতো।
তাহলে এবার জাহাজটাকে বন্দর থেকে বের করো, এখনই তোমাদের ভালোবাসার একটু প্রমাণ দাও আমাকে, বলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম আমি। পায়রাগুলোকে একটু দেখা দরকার।
আমার কামরায় রাখা আছে খাঁচাগুলো। সেগুলোর পাশেই পাওয়া গেল আমার লেখার সরঞ্জাম রাখার বাক্স, সাজিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলের ওপর। তার পাশে গোল করে পাকিয়ে রাখা কিছু প্যাপিরাস। প্রায় সাথে সাথেই টেবিলে বসে পড়লাম আমি, লুক্সর শহরে উটেরিকের প্রাসাদের পাশে মদের দোকানে আস্তানা গেড়ে বসা ওয়েনেগের কাছে পাঠানোর জন্য একটা ছোট কিন্তু স্পষ্ট চিঠি লিখতে শুরু করলাম। চিঠিতে লিখলাম, আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে উটেরিকই সেরেনাকে অপহরণের নির্দেশ দিয়েছে। যদিও কাজটা হাতে-কলমে করেছে পানমাসি।
পানমাসি এখন মিশরের পথে রওনা দিয়েছে আর তার পিছু নিয়েছি আমরা। যদিও আমাদের চাইতে কমপক্ষে প্রায় বারো ঘণ্টার পথ এগিয়ে আছে সে। মিশর পৌঁছানোর আগে তাকে আমরা ধরতে পারব বলে মনে হয় না। আর যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে এটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই আশা করা যায় যে উটেরিক সেরেনাকে বন্দি করে রাখবে হয় দুঃখ-দুর্দশার ফটক নামের সেই ভয়ংকর কারাগারে আর না হয় লুক্সরের প্রাসাদে। ওয়েনেগকে নির্দেশ দিলাম আমার ধারণা কতটা সত্যি তা যাচাই করে দেখতে। সেইসাথে রাজকুমারীর উদ্ধারে কাজে আসতে পারে এমন যেকোনো তথ্য জানতে পারলে সেটাও সাথে সাথে আমাদের জানানোর নির্দেশ রইল তার ওপরে।
চিঠির লেখা নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার সাথে সাথে সেটাকে তিন টুকরো হালকা প্যাপিরাস কাগজে আলাদা আলাদা খসড়া করে ফেললাম। আমার চিঠিগুলোকে প্রতিবারই তিনটি করে কপিতে পাঠাই আমি। কারণ এতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে অন্তত একটা কপি অক্ষত অবস্থায় প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। স্বাস্থ্যবান পায়রাদের জন্য আকাশপথ বেশ বিপজ্জনক স্থান, কারণ সেখানে প্রায়ই বাজপাখি আর অন্যান্য শিকারির আনাগোনা দেখা যায়। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে তিনটির মাঝে কমপক্ষে একটা পাখি তার নির্দিষ্ট খোপে পৌঁছবেই, যেখানে ডিম ফুটে জন্ম নিয়েছিল সে।
এবার খাঁচা থেকে সবচেয়ে শক্তপোক্ত দেখে তিনটি পাখি বেছে নিলাম আমি, প্রতিটার পায়ে বেঁধে দিলাম একটা করে চিঠি। তারপর দুটোকে আবার খাঁচায় ফিরিয়ে দিয়ে একটাকে আলতো করে ধরে উঠে এলাম ডেকের ওপর।
ওপরে উঠে আসার সাথে সাথে একটা জিনিস দেখে খুশি হয়ে উঠল আমার মন। ইতোমধ্যে বন্দর থেকে বেরিয়ে এসেছে জাহাজ, এগিয়ে চলেছে খোলা সাগরের দিকে। এবার প্রথম পায়রাটাকে উড়িয়ে দিলাম বাতাসে। তিনবার জাহাজকে ঘিরে চক্কর দিল পায়রাটা, তারপর উড়ে চলল দক্ষিণ দিকে। এর এক ঘণ্টা পর পর বাকি দুটো পাখিকেও ছেড়ে দিলাম আমি, দেখলাম উড়তে উড়তে দিগন্তের ওপারে হারিয়ে গেল তারা। অপেক্ষাকৃত মন্থর গতিতে তাদের পিছু নিয়ে চলতে লাগল মেমনন।
উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে তাজা বাতাস বইছে, আর সেই বাতাসে ভর করে এগিয়ে চলেছি আমরা। ছয় দিন চলার পরেই ক্রিট দ্বীপ পার হয়ে আসতে পারলাম আমরা, এবং আরো পাঁচ দিনের মাথায় দেখা মিলল আফ্রিকান উপকূলের। এই সময়ের মাঝে মোট নয়টা অচেনা জাহাজকে মাঝ সাগরে থামিয়েছে আমাদের জাহাজ, তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করা হয়েছে সেগুলো। প্রত্যেকটা জাহাজই প্রথমে আমাদের জলদস্যু ভেবে পালানোর চেষ্টা করেছে। ফলে পিছু ধাওয়া করে ওদের থামাতে বাধ্য হয়েছি আমরা। এবং এই কাজ করতে গিয়ে বেশ লম্বা সময় নষ্ট হয়েছে আমাদের, গিথিয়ন বন্দর থেকে নীলনদের অববাহিকায় পৌঁছাতে স্বাভাবিকভাবে যত সময় লাগে তার চাইতে অনেক বেশি। নয়টা জাহাজের কোনোটাতেই অবশ্য সেরেনাকে পাওয়া যায়নি; কিন্তু রামেসিস আর আমি চাইনি যে ভাগ্যের ফেরে হাতের নাগালে পেয়েও হারিয়ে ফেলি ওকে।
আর্টেমিসের কাছে আমি প্রার্থনা করলাম, সেরেনাকে যদি সত্যিই দুঃখ-দুর্দশার ফটকে বন্দি করে রাখা হয়ে থাকে তাহলে দেবী যেন ওর ওপর অত্যাচার চালানো থেকে কুখ্যাত ডুগকে বিরত রাখেন। যদিও জানি যে ফারাও উটেরিক নিজে কখনো সেরেনার ওপর চড়াও হবে না; কিন্তু সেটা জানা সত্ত্বেও খুব একটা স্বস্তি পেলাম না। ফারাও উটেরিকের পছন্দ অন্যদিকে, সেরেনার সৌন্দর্য তাকে আকৃষ্ট করবে না বলেই আমার ধারণা।
নীলনদের অববাহিকায় পৌঁছানোর পর আরো তিন দিন সেখানে পাহারা দিলাম আমরা। দিনের বেলায় নদীর মুখ থেকে দূরে সাগরের মাঝে অবস্থান করলাম, রাতের বেলায় সরে এলাম কাছাকাছি। চতুর্থ দিন রামেসিস আর আমি দুজনই একমত হলাম যে, এখানে আর পাহারা দিয়ে লাভ নেই। আমরা জানি যে এই সময়ের মধ্যে সেরেনা প্রায় নিশ্চিতভাবেই মিশর পৌঁছে গেছে। ওর অপহরণের পর কম দিন তো পার হয়নি। তাই এবার উত্তর-পশ্চিম দিকে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে নিলাম আমরা, গন্তব্য সেই ল্যাসিডিমনের গিথিয়ন বন্দর। তবে এবার আর বাতাস আমাদের সাহায্য করল না। ফলে অসহ্য রকমের ধীর গতিতে চলতে লাগল জাহাজ, দিনগুলো যেন আর কাটতেই চায় না।