তৃতীয় দিন
রথী, ২৯ জুন: সকাল
পাশের মেয়েটা কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে। কী আছে দৃষ্টিটার মধ্যে? যে ক’বারই চোখে চোখ পড়েছে ও সরিয়ে নিয়েছে চোখ। সি ফোরটিন বাই ওয়ান বিজন সেতু টপকাচ্ছে এখন। সারা রাতের অনিদ্রা হঠাৎ-হঠাৎ ভোঁতা করে দিচ্ছে রথীর মাথা। কষ্ট হচ্ছে রথীর শরীরে। মনেও।
ব্লসম কেন শুনল না ওর পুরো কথা? তারপর ফোনও ধরল না? মেসেজের রিপ্লাইও দিল না? ওকে কি ছেঁটে ফেলে দিল জীবন থেকে? মানুষের আনন্দের অংশীদার হওয়ার চেয়ে কষ্টের অংশীদার হওয়া অনেক গভীর সম্পর্ক ইঙ্গিত করে। তা হলে? কেন ব্লসম নিজের কষ্টটাতে রথীকে যোগ করছে না? পাশের মেয়েটা উঠে ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল আর খালি সিটটায় ঝপ করে একটা লোক বসে পড়ল। তার মুখে এখনও ছেলেমানুষি আর অনিশ্চয়তার ছাপ। একসময় রথীর মুখেও এমন ছাপ ছিল। এখন রথী বছর তিরিশেকের লোক। আত্মবিশ্বাসী লোক। তাই কি? গতকাল বিকেলের পর থেকে কি আর নিজেকে আত্মবিশ্বাসী বলা যায়? আত্মবিশ্বাসী লোকদের ছেড়ে তাদের প্রেমিকারা কি কাঁদতে-কাঁদতে চলে যায়?
“না স্যার, যায় না।”
চমকে উঠল রথী। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল ওর চিন্তারই কি উত্তর দিচ্ছে ছেলেটা? ভাল করে পাশে তাকাল রথী। রোববার সকালেও স্নান সেরে পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। সঙ্গে ঝোলানো ব্যাগ। কানে সস্তার মোবাইল আর গলায় নীলের ওপর সাদা টিপটিপ টাই।
“না, স্যার, ওটা সি-এইট্টিন। সি ফোরটিন বাই ওয়ান নয়। এটা মধ্যমগ্রাম অবধি যাবে। সেখান থেকে স্যার আমি অন্য কিছু ধরে আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাব। সি-এইট্টিন তো পেলাম না যে ডাইরেক্ট বারাসাত যাব, তাই এটা ধরতে হল। স্যার, আপনি তো করাচ্ছেনই। আপনার দুই ভাইকেও বলবেন।”
মুখটা ঘুরিয়ে নিল রথী। বড্ড বেশি অন্যের কথা শুনছে। ওকে মনঃসংযোগ করতে হবে। কাজটা করতে হবে সুষ্ঠুভাবে।
আজ এবং কাল। এই দু’টো দিন কলকাতাতেই লুকিয়ে থাকতে হবে রথীকে। তার জন্য খুব একটা চিন্তা করছে না রথী। এটা শেষ কাজ ওর, এতে ভুল হলে চলবে না।
গতকাল অফিসে কাজের কথা বলতে গিয়ে শিবি বলেছিল, “শোন রথী, হাতকাটা বলাই কার জন্য বেশি কাজ করে জানিস?”
“না তো! ও তো পার্টির হয়ে…” রথী আমতা-আমতা করছিল।
“ছাইয়ের পার্টি। সুতনু রায়ের নাম শুনেছিস?”
“সুতনু? ওই যার দু’নম্বরি কেস রয়েছে? যার…”
“হ্যাঁ রে, হ্যাঁ। ঝাপুবাবু খচে টং হয়ে আছে ওর উপর।”
“কেন?” খানিকটা কৌতূহলবশতই প্রশ্নটা করে ফেলেছিল রথী।
“স্ক্র্যাপ আয়রন। লিলুয়া ইয়ার্ডের কয়েক কোটি টাকার স্ক্র্যাপ এতদিন ঝাপুবাবুর হাতে ছিল। হাতের মালকে সুতনু রায় নাকের তলা থেকে মেরে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।”
“দ্যাখো শিবিদা, আমি খুন, জখম বা মারপিট করতে পারব না কিন্তু।” ফস করে উঠে দাঁড়িয়েছিল রথী।
“আরে, বোস না,” শিবি অধৈর্য হয়েছিল বেশ, “না শুনেই চিৎকার করছিস কেন? ও সব কিচ্ছু করতে হবে না। হলে তোকে বলতাম না। খুনজখম যে তোর লাইন নয়, তা কি আর আমি জানি না? এ হল গায়েব করার কাজ। তোকে তো বলেইছি যে একটা মাল হাপিস করতে হবে।”
“কী হাপিস করতে হবে?”
“সুতনু রায়ের চোরাই ডলারের ব্যবসা আছে। সেই জন্য তিরিশ লাখ টাকা নিয়ে ওর লোক কাল, মানে রোববার সকালে, প্রথম লটের জন্য ডলার তুলতে যাবে। আমরা ওদের সায়েন্স সিটির কাছে ধরব।”
“আমরা মানে?” রথী চমকেছিল একটু।
“মানে তুই আর সুতনুর লাল গাড়ির ভেতরের আমাদের লোকটা। যে কায়দা করে সায়েন্স সিটির কাছে গাড়ি থামাবে। এই নে গাড়ির নম্বর। গাড়ি থামলে তুই জাস্ট এগিয়ে গিয়ে একটু জোর করে ব্যাগটা ছিনিয়ে পালিয়ে যাবি। দেখবি, ওর থেকে ফুট তিরিশ-চল্লিশ দূরে সাদা রঙের একটা গাড়ি রাখা থাকবে। দরজা খোলা থাকবে। তুই তাতে উঠে দেখবি স্টিয়ারিংয়ের সঙ্গে সুতো দিয়ে গাড়ির চাবি ঝুলছে। সেটা দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে পছন্দমতো জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে থাকবি। বুঝেছিস? তারপর সোমবার যে অ্যাড্রেস বলব, সেখানে টাকা পৌঁছে দিবি। খুব সোজা কাজ।”
রথী গম্ভীর মুখে মাথা নিচু করেছিল। মিনিটখানেক পর বলেছিল, “তা তোমরা ডলার করার পর তো কাজটা করতে পারো। ডলার হল আসল জিনিস। তিরিশ লাখের বদলে ডলার তুলতে পারলে তো লাভ হত বেশি।”
হেসেছিল শিবি। হাসির চোটে বিড়ালের চোখ দু’টো পিংপং বলের মতো লাফিয়েছিল যেন। শিবি বলেছিল, “ডলার করার পর পাঁচ-ছয়জন থাকবে টাকার সঙ্গে। তাই হেবি লোড হয়ে যাবে। তার চেয়ে যা বলছি শোন।”
“গাড়িতে আর কেউ থাকবে না তো?” রথী জিজ্ঞেস করেছিল।
“না, রামন বলে একজনের প্রথম থেকেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে উঠবে এয়ারপোর্টের সামনে থেকে। জাস্ট একজনকে ভয় দেখিয়ে টাকাটা নিয়ে সরে পড়বি। কাজটা কর আর তিরিশ হাজার তোর।”
“পঁয়তাল্লিশ হাজার,” বলেছিল রথী, “সুতনু রায় যন্তর জিনিস। রিস্ক বেশি, রেটও বেশি। রাজি থাকলে বলো।”
“তুই দরদাম করছিস? কে শিখিয়েছে? ব্লসম?” হেসেছিল শিবি।
“এসবের মধ্যে ব্লসমকে টানবে না তুমি। তিরিশ লাখের এক পারসেন্ট দিচ্ছ, সেখানে দেড় বলেছি। খুব বেশি কিছু বলেছি কি?”
শিবি ওর বিড়ালের মতো চোখ দু’টো ছোট করে বলেছিল, “তুই যদি তিরিশ লাখ নিয়ে ভেগে যাস? তোকে যে এতটা বিশ্বাস করছি, তার সম্মান দিবি না?”
“সম্মান ধুয়ে কি জল খাব নাকি? আর ভেগে কোথায় যাব শিবিদা? আমাদের বাড়ি চেনো। দিদি, মুনিয়া সবাইকে চেনো। এখন ব্লসমের খবরও জেনে গেলে। আর এতদিন কাজ করছি, কোনওদিন এক পয়সার এদিক-ওদিক করেছি? ফালতুগিরি করতে গিয়ে ছ’মাস জেলে খেটে এলাম। তোমার নাম একবারও নিয়েছি? টাকা নিয়ে দু’দিন চেপে বসে থাকব আর সুতনুর লোকজন খুঁজবে না আমায়? সুতনুর চেলাচামুণ্ডারা ধরতে পারলে আমার হালত খারাপ করে দেবে, আর তুমি এমন কথা বলছ?”
শিবি হো-হো করে হেসে চেয়ার থেকে উঠে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, “আরে বাপ, হেভি সেন্টু হয়ে বসে আছিস যে! আরে, আমি তো এমনি বললাম। পঁয়তাল্লিশই পাবি। এখন পনেরো দিচ্ছি। কাজ হয়ে গেলে আরও তিরিশ। ঠিক আছে?”
রুবি থেকে বাঁ দিকে বাঁক নিল বাস। আর সঙ্গে-সঙ্গেই পকেটের ফোনটা বেজে উঠল। রথী বের করল ফোনটা। শিবি হঠাৎ? এখন তো ফোন আসার কথা নয়। তবে কি প্ল্যান চেঞ্জ হল?
“বলো?” রথী আড়চোখে পাশে তাকাল। নীল টাই ডায়েরি খুলে ফোন নম্বর দেখছে।
“ছোট্ট কেস হয়েছে। গাড়িতে লোক বেশি আসছে। আমি চাই না কোনও রিস্ক নিতে। ওখানে দু’জন ছেলে থাকবে। হলুদ আর নীল গেঞ্জি পরা। ওদের সঙ্গে বাইক থাকবে। টাকার গাড়িটা থামলে ওরা গাড়ির ভিতরের লোকদের সামলাবে আর তখন টাকাটা নিয়ে সাদা গাড়িতে করে চম্পট দিবি, কেমন?” শিবি হাসল।
আরও লোক? মানে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ হয়ে গেল। ঝঞ্ঝাট হলে হাত দিয়ে সামলে দিতে পারবে রথী। শুধু ওরা মেশিন বের করলেই ঝঞ্ঝাট। অবশ্য শিবি যে ছেলে দু’টোকে ফিট করেছে, তারা নিশ্চয়ই তৈরি হয়ে থাকবে। দেখা যাক কী হয়। টেনশন হচ্ছে রথীর।
টাকাটা নিয়ে কী করবে, তা একরকম ঠিক করে রেখেছে রথী। গতকালের পনেরো হাজার টাকা থেকে তিন হাজার দিদিকে দিয়ে সঙ্গে রেখেছে বাকিটা। এখান থেকে গাড়ি নিয়ে ও হাওড়া যাবে। সেখানে সুযোগমতো গাড়ি ছেড়ে বাস ধরে কালীঘাটে হিমির কাছে আসবে। ওখানে দু’টো দিন কাটিয়ে দিতে পারবে ও। তবে কোনও গণ্ডগোল বুঝলে ওকে পালাতে হবে। তখন টাকাটা কাজে লাগবে। তবে সব যদি প্ল্যান মতো চলে, তা হলে চিন্তা নেই।
লুকিয়ে থাকার মেয়াদ শেষে টাকাটা যথাস্থানে পৌঁছে, তবে ওর ছুটি। এ ব্যাপারে ওকে সাহায্য করবে ছানু। দুপুরবেলা বাড়ি ফিরে রথী প্রথম ফোন করেছিল হিমিকে।
হিমির যে মেজাজ খারাপ, তা গলা শুনেই স্পষ্ট বুঝেছিল রথী। হিমি গম্ভীর গলায় বলেছিল, “হঠাৎ ফোন করলে?”
“করতে বারণ আছে?” রথী হেসেছিল।
“বারণ আর কী? শালা তোমাদের জাতটা বারণ শোনে? তোমাদের নেতা, বরেনের লোক এসে জোর করে তোলা নিয়ে যায়। আর তেমন হয়েছে এই ঢ্যামনার বৃষ্টি। কামধান্দা সব ডকে উঠেছে।” হিমি শ্বাস নিয়েছিল।
“খুব রেগে আছ দেখছি!” রথী হালকা গলায় বলেছিল।
“বাদ দাও। হঠাৎ আমায় মনে পড়ছে? প্রেমে পড়লে?”
“সে যোগ্যতা কি আমার আছে?” রথী হেসেছিল আবার।
“ফালতু ভ্যানতাড়া ছেড়ে কাজের কথা বলো।”
রথী গলাটা করুণ করে বলেছিল, “আমায় দু’দিন থাকতে দেবে হিমি? বাড়িতে খুব অশান্তি হয়েছে।”
“দু’দিন এখানে থাকবে?” হিমি আশ্চর্য হয়েছিল একটু।
“আজ এক বন্ধুর বাড়ি আছি। কাল তোমার ওখানে গিয়ে সোমবার পর্যন্ত জ্বালাব। ব্যস, তারপর আর কিছু করব না।
“কিন্তু বাড়িতে কী হয়েছে?”
“ওই, দিদি…এমন করে যে, পারা যায় না…” ছদ্ম-কষ্টে চুপ করেছিল রথী।
“ঠিক আছে। এখন কাস্টমারও তেমন হচ্ছে না। আর তুমি তো পাশের ঘরে থাকবে।” হিমি আশ্বস্ত করেছিল।
রথী গভীর কৃতজ্ঞতার ভান করে বলেছিল, “তুমি যা করলে, তা আমি কোনও দিন ভুলব না। সত্যি বলছি।”
মিথ্যে! মিথ্যে বলেছে রথী। কিন্তু এ নিরুপায় মিথ্যে। টাকা নিয়ে পালিয়ে এসে লুকোচ্ছে জানলে কি হিমি থাকতে দিত?
তবে মিথ্যে বলে খারাপ লাগছে রথীর। যে বিশ্বাস করে, তাকে ঠকাতে ভাল লাগে না ওর। শেষ কাজটা ঠিকমতো করে দিতে পারলে আর এই পাঁকে থাকতে হবে না ওকে। ব্লসমের সঙ্গে কথা বলতে পারবে চোখে চোখ রেখে।
হিমিকে রাজি করিয়ে ছানুকে ফোন করেছিল রথী। দু’বার রিং হতেই ফোনটা ধরেছিল ছানু, “কী রে শালা, সকালেই তো দেখা হল। আবার কী কেস?”
“তুই কী করছিস?” রথী জিজ্ঞেস করেছিল।
“বাড়িতে আছি। শালা যা ওয়েদার, বাড়িতে সেভেন ফিফটির হাফ আছে, ঢক করে মেরে দেব ভাবছি।”
“ভরদুপুরে মাল টানবি?”
“নতুন দেখছিস নাকি আমায়? তা বল কী কেস?” ছানুর গলায় সামান্য বিরক্তি।
রথী বলেছিল, “সোমবার আমার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হবে। শিবির মালের ডেলিভারি আছে। আর্জেন্ট।”
“কী মাল?”
“ক্যাশ। অনেকটা। একা ঠিক সেফ হবে না।”
ছানু গম্ভীর হয়েছিল সামান্য, “ওই শিবি শালার কথা আমায় বলবি না। তুই অফিস থেকে চলে আসার পর আমায় ধরেছিল। বলে কিনা আমি পুরিয়ার ব্যবসা করছি, তাতে ওর কমিশন চাই। শুয়োরের বাচ্চা!”
রথী একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, “বাদ দে না। বললেই দিতে হবে নাকি? মাথা গরম করিস না। সোমবার তোর সময় হবে তো?”
কিছুক্ষণ চুপ করে ছানু বলেছিল, “ঠিক আছে, যাব।”
রথী গলা নামিয়ে বলেছিল, “আমি কালীঘাটে হিমির ডেরায় থাকব। সময়মতো তোকে ফোন করে দেব। তুই কালীঘাট ব্রিজে চলে আসবি একটা গাড়ি জোগাড় করে।”
“সোমবার কখন?” ছানু জিজ্ঞেস করেছিল।
“আরে, সময় তো জানি না। শিবিদা কনফার্ম করবে।”
“শালা শিবিদা! হিমির বাড়ির ঠিকানাটা দে। স্ট্রেট বাড়ি চলে যাব। তুই ওখানে গ্যারেজ হচ্ছিস কবে?”
“আরে কাল। এটাই শেষ কাজ, বুঝলি? তবে এই কাজটা তোকে এমনি করতে বলছি না, হিস্যা দেব তোকেও।”
“ভাগ। টাকা চেয়েছি আমি?” ছানু হঠাৎ ফস করে উঠল, “খুব টাকা চিনেছিস, না রে রথী? এসব বলবি না। হারামের পয়সায় লোভ নেই আমার। সোমবারটা ফ্রি রাখছি। ফোন করিস। পৌঁছে যাব।”
কিন্তু সোমবারের আগে আছে রোববার, মানে আজ। আজকের কাজটাকে ঠিকভাবে করতে হবে রথীকে। প্ল্যানমতো সায়েন্স সিটির এক স্টপ আগে নেমে গেল রথী।
বৃষ্টি জাঁকিয়ে এসেছে শহরে। দু’দিকের নতুন বাড়িঘরগুলোর সানশেডের তলায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে কিছু পাখি। রথী মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগল। হঠাৎ কেমন ভয় লাগছে ওর। ব্লসম কাঁদছিল গতকাল বিকেলবেলা। ব্লসম কি জানে, এক রাস্তা বৃষ্টির ভিতরে কীভাবে হাঁটছে রথী, ওর শেষ কাজের দিকে?
দূরে সাদা একটা গাড়ি। ছোট্ট-ছোট্ট পুতুলের মতো দু’টো মানুষ, পাশে বাইক। ওখানেই কি ঘটনাটা ঘটবে?
রথী হাঁটতে লাগল। চোখ বন্ধ করে ও যেন মনে-মনে দেখতে পেল, একটা লাল গাড়ি দূরের রাস্তায় বাঁক নিয়ে আসছে ওদের দিকে। গা শিরশির করে উঠল রথীর। তবু কাজটা শেষ করতে হবে। ভয়টাকে প্রাণপণে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল রথী।
জয়, ২৯ জুন: সকাল
গোটা দৃশ্যপটের উপর কে যেন স্কেল বসিয়ে অজস্র রুপোলি দাগ তেরছা ভাবে কেটে দিয়েছে। দূরে ইডেন গার্ডেন্সের লাইট টাওয়ারটা ঝাপসা লাগছে। ভিক্টোরিয়ার ডোমটাও ঘষা কাচের আড়ালে চলে গিয়েছে যেন। গঙ্গার লঞ্চ আর স্টিমারগুলোকে মনে হচ্ছে ঝুলনের নৌকা। একদম সামনে বিদ্যাসাগর সেতু। এই রাস্তা দিয়ে মাঝে-মাঝেই যেতে হয় ওকে। আজ ও ধুলাগড় যাচ্ছে সুতনুর পরিবর্ত হিসেবে।
এ গাড়িটা ছোট আর পুরনো। তবু বিশ্বস্ত। তাই এটাকেই নিয়েছে জয়। মিটিংটায় সুতনুর পরিবর্তে গেলেও জয়কে তো আর কিছু বলতে হবে না। বলবে ওদের ম্যানেজার সাহেব, মদন সরখেল।
এ লোকটা কাজকর্ম বোঝে, বিশ্বাসীও খুব, তবু কোথায় যেন সুতনু জয়কে বেশি ভরসা করে। তাই তো জয়ও সুতনুর কোনও কথা ফেলতে পারে না। সুতনুর কিছু হলে সবার আগে দৌড়ে যায়।
গতকাল যখন জয়ের কাছে জিনার ফোনটা এসেছিল তখন এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেনি ও। সোজা বেরিয়ে গিয়েছিল। কাউকে কিছু বলেনি। বেরনোর সময় গেটের কাছে ঢাউস প্যাকেট হাতে আধভেজা বিষাণকেও দেখেছিল। কিন্তু অন্যদিনের মতো সামান্য কথাটাও বলেনি। সুযোগই ছিল না। জিনার গলার স্বরে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল জয়।
গাড়িটা নিজেই চালাচ্ছিল জয়। সিগন্যালের আলো বদল, ট্র্যাফিক পুলিশের ছাতা, চাঁদনি চক মেট্রো পেরিয়ে জ্যামের মধ্যে হেঁচকি তুলে-তুলে এগোচ্ছিল গাড়ি। তার মধ্যেই জিনাকে ফোন করে খবর নিচ্ছিল, ডাক্তার এল কি না, সুতনুর জ্ঞান ফিরল কি না ইত্যাদি-ইত্যাদি।
মেডিক্যাল কলেজের সামনে যখন গাড়ি, তখন সিমিও ফোন করেছিল। সিগন্যালে আটকে থাকা অবস্থায় ফোনটা ধরেছিল জয়, “হ্যাঁ বউদি, বলুন।”
“তুমি কোথায় জয়?” সিমির গলায় উদ্বেগ ছিল যথেষ্ট।
“আমি?” দু’-এক মুহূর্ত কী বলবে ভেবেছিল জয়, তারপর বলেছিল, “কাজের জায়গায় একটা সমস্যা হয়েছে বউদি। আমায় আর্জেন্টলি চলে আসতে হল।”
“কোন জায়গায়?” সিমির গলায় সামান্য সন্দেহ আঁচ করতে পেরেছিল জয়।
এই রে! সিমি মানুষটা এত ভাল যে একে মিথ্যে বলতে খারাপ লাগে জয়ের। তবু নিরুপায় হয়ে বলেছিল, “ওই জোড়াসাঁকোর কাছে একটা প্রজেক্ট হচ্ছে, তাই…”
সিগন্যাল সবুজ হয়ে গিয়েছিল সামনে। পিছনের অধৈর্য কলকাতা নানারকম স্বরে হর্ন দিয়ে যাচ্ছিল। ও বলেছিল, “বউদি, পরে কথা বলছি। ভীষণ ট্র্যাফিক।”
“শোনো…” সিমি আরও কিছু বলতে চাইছিল।
“কিছু শুনতে পাচ্ছি না,” বলে জয় কেটে দিয়েছিল ফোন। সিমির সামনে গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারে না ও।
জিনার ফ্ল্যাটে ওঠার সিঁড়িটা লাফিয়ে-লাফিয়ে ভেঙে উঠেছিল জয়। জিনা বসেছিল বাইরের ঘরে। মনে হচ্ছিল, যেন মেলায় বাবা-মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া একটা একরত্তি মেয়ে। কে বলবে, এই মেয়েটার বেঁচে থাকার গল্পটাই অন্যরকম।
জয়কে দেখে জিনা প্রায় ঝাঁপিয়ে এসে পড়েছিল ওর বুকে। জয় কিছু বলার বা সরে যাওয়ার সুযোগটুকুও পায়নি। নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে জয় দেখছিল, ওর বুকের সঙ্গে লেপটে খুব কাঁদছে জিনা। ওর বাদামি কালো চুলগুলোর থেকে অদ্ভুত এক ভাপ উঠছিল। চোখের জলে ভিজে যাচ্ছিল জয়ের টি-শার্টের বুকের কাছটা। জিনার নরম শরীরের ওঠা-পড়া নিজের শরীরে টের পাচ্ছিল জয়। এত বিপদের মধ্যেও আচমকা শরীর উত্তর দিচ্ছিল। কতদিন পর কোনও মেয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে? কতদিন পর কেউ এমন করে সমর্পণ করল নিজেকে ওর কাছে? যৌনতার সম্পূর্ণ তৃপ্তি কি আসে এই সমর্পণ বোধ থেকেই?
জয়ের কষ্ট হচ্ছিল। নিজেকে সামলানোর মতো কষ্ট খুব কম আছে পৃথিবীতে। ইন্দ্রিয়ের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর কষ্ট গতকাল টের পেয়েছিল জয়। একটা মানুষের মনে কতটা বর্ষাকাল লুকিয়ে থাকে? কার কাছে সে এমন সর্বস্ব দিয়ে কাঁদতে পারে?
জিনার কান্না কমছিল না একদম। জয়ের শরীরের ভিতরে যেন ঢুকে পড়তে চাইছিল মেয়েটা।
“চুপ করো!” জয় জিনার হাত দু’টো ধরে ঝাঁকিয়ে ওকে সরিয়ে দিয়েছিল নিজের শরীর থেকে। নিজের উপর বিরক্ত লাগছিল। এমন সময় কেউ এরকম কথা মাথায় আনতে পারে? মানুষ আদতে পশু, তা বলে এতটা?
ঝাঁকুনি খেয়ে জিনা থতমত মুখে তাকিয়েছিল জয়ের দিকে। সাজানো ভুরুর উপর ভেঙে পড়া চুলগুলো যেন আরও বিভ্রান্ত।
জয় বলেছিল, “স্টেডি হও, জিনা। দাদার কী হয়েছে? ডাক্তার এসেছিল?”
জিনা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলেছিল, “ডাক্তার এসেছিল, মাইল্ড অ্যাটাক। রেস্ট নিতে বলেছে। বলেছে কোনওরকম টেনশন না নিতে।”
জয় তাকিয়েছিল জিনার দিকে, “তা দাদা কোথায়?”
“বেডরুমে, ঘুমোচ্ছে।” জিনা এবার নিজেকে সামলাচ্ছিল।
“কী করে হল?” জয় ঘড়ি দেখছিল।
জিনা মাথা নিচু করে নিয়েছিল এই প্রশ্নে।
“কী হয়েছিল? খুলে বলো।”
নার্ভাস মুখ নিয়ে সোফায় বসে পড়েছিল জিনা। কী বলবে তা ঠিক করে ফেললেও সেটা কীভাবে বলবে তা যেন ঠিক বুঝতে পারছিল না।
জয় হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসেছিল, “কী হয়েছে জিনা? আমায় বলতে পারো। কেউ জানবে না। একটু স্টেডি হও। দাদাকে ততক্ষণে দেখে আসি একবার।”
“আর কতক্ষণ লাগবে?” মদন সরখেল একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। আড়চোখে ওকে দেখছিল জয়; কিন্তু জাগায়নি। জয় বলল, “আপনি ঘুমোন। আরও অনেকক্ষণ লাগবে।”
“তাই? বেশ!” মদন সরখেল আর এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে মাথা কাত করে চোখ বন্ধ করল, চল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে পুরপুর শব্দে নাক ডাকতে লাগল।
অবাক হয়ে মদনের দিকে তাকাল জয়। এতদিন ইনস্ট্যান্ট নুড্লস দেখেছে, কিন্তু এমন ইনস্ট্যান্ট কুম্ভকর্ণ দেখেনি। গতকাল রাতে একদম ঘুম হয়নি ওর। হবে কী করে? সারা রাত তো সুতনুর সঙ্গে বসেছিল।
জিনাকে ঘরে বসিয়ে বেডরুমে গিয়েছিল জয়। গায়ে পাতলা চাদর টেনে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রয়েছে সুতনু। দেখে জয়ের মনে হয়েছিল ঘুমোচ্ছে। ও আবার পা টিপে-টিপে ফিরে এসেছিল বসার ঘরে।
“বলবে?” জয় জিনাকে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করেছিল।
“পারফরম্যান্স এনহান্সার।” জিনা বলেছিল।
“মানে?” জয় ঠিক বুঝতে পারেনি। একটু এদিক-ওদিকের ইংরেজিটা ওকে এখনও ধাঁধায় ফেলে।
“মানে…আমি…” জিনা ইতস্তত করে বলেছিল, “সুতনুকে নিয়ে ঠাট্টা করতাম। বলতাম, ও ঠিকমতো পারে না। একটুতেই হাঁপিয়ে যায়। তাই আজ নীল ডিমের আকারের একটা ওষুধ খেয়েছিল। তারপর… হঠাৎ বাঁ দিকের বুকটা চেপে ধরল…মুখটা বেঁকে গেল, বিছানায় পড়ে গিয়ে …আমি কী করব বুঝতে না পেরে…প্রথমে ডাক্তারকে আর তারপর তোমায় ফোন করলাম। ওষুধটা খাওয়ার আগে ওকে বারণ করেছিলাম, শোনেনি। কেউ জেনে ফেললে কী হবে জয়?” জিনার গলা কান্নায় বুজে এসেছিল।
জয় জিনার মাথায় হাত রেখে বলেছিল, “কেউ জানবে না। তুমি টেনশন কোরো না। আমি ডাক্তারকে ফোন করে দিয়েছি, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সে আসছে।”
“ওর যদি কিছু হয়ে যায়। তা হলে তো…আমায় এই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিতে হবে। বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারব না। কলকাতায় থাকবই বা কোথায়? সুতনুর কিছু হয়ে গেলে আমি পথে বসব, আমি…” কথা শেষ না করে কেঁদে ফেলেছিল জিনা।
সুতনুকে নিয়ে ফেরার পর বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে ওকে ঢুকিয়েছিল জয়। আনন্দীর জন্মদিনে যাতে কোনও প্রভাব না পড়ে তা মাথায় ছিল ওর। সিমি শুধু তাকিয়েছিল অবাক হয়ে। হার্টে চাপ পড়েছে বলে ডাক্তার কোনও টেনশন ছাড়া কমপ্লিট রেস্ট নিতে বলেছিল।
মাঝে যেটুকু সময় সুতনু দু’-একটা কথা বলেছিল তাতে আজকের এই মিটিং আর ডলারের কথাটা ছিল। জয় সুতনুর হাত ধরে বলেছিল, “আমি সব সামলে নেব।”
তা সামলেছে জয়। নিজে মদনকে নিয়ে এসেছে এখানে, শামিমের সঙ্গে লাল গাড়িটায় নিজের বিশ্বস্ত দু’জনকে পাঠিয়েছে। রামনের এয়ারপোর্ট থেকে ওঠার কথা।
গতকাল সুতনুর বাড়িতে বসেই সব প্ল্যান করে নিয়েছিল। সকালে শামিমকে বলেছে, “আমি যেতে পারব না রে। বদলে দু’জন পাঠাচ্ছি। কেমন?”
তবে গতকাল রাতে সুতনুর ব্যাপারটা সামলে দিয়ে জয় ভেবেছিল সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সুতনু ঘুমিয়ে পড়লে জয়কে বসার ঘরে ডেকে নিয়েছিল সিমি। সিমিকে বসার ঘরে দেখে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল জয়। এমন মুখ তো ও কোনওদিন দেখেনি সিমির! সিমি খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, “বলো জয়, কী করে এমন হল?”
জয় কী বলবে বুঝতে পারছিল না। যে মানুষটা মিটিংয়ে যাচ্ছিল তাকে কোত্থেকে অসুস্থ অবস্থায় অ্যাম্বুল্যান্সে করে নিয়ে এল সেটা বলবে বা বোঝাবে কী করে? জয় ডাকাবুকো। বেআইনি কাজকর্মও যথেষ্ট করে, কিন্তু মিথ্যে কথা বলার খুব তো দরকার পড়ে না। বেআইনি কাজটাও তার নিজস্ব ওয়ার্ক-এথিক্স মেনেই করে। সিমির সামনে মাথা নিচু করে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার ছিল না জয়ের।
সিমি বলেছিল, “লেডিজ় পারফিউম আমি চিনি জয়। লিপস্টিক মার্কসও চিনি। তা ছাড়া স্ত্রীরা আরও অনেকভাবে বুঝতে পারে স্বামী তাকে কতটা গুরুত্ব দেয়। মেয়েটা কে জয়? কার জন্য সুতনু পার্ল সেট কেনে?”
জয় কোনও কথা বলছিল না। মাথা নিচু করে বসেছিল।
সিমি হেসেছিল সামান্য। দুর্বল, ক্লান্ত হাসি। বলেছিল, “ভালই তো। বাড়ির রান্নায় স্বাদ না থাকলে তো মানুষ বাইরে খাবেই। সুতনুর কোন কাজটা নিয়ম মেনে হয়?”
সিমি আর বসেনি ওখানে, সুতনুর কাছে গিয়ে বসেছিল। বসার ঘরের সোফায় আধশোয়া হয়েছিল জয়। ঠিক করেছিল আজ থেকেই যাবে। সেরকম ফোন করে জানিয়েও দিয়েছিল জগৎকে। তখনই শুনেছিল যে কেয়া ফেরেনি। শনিবার, এমন ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টির জঘন্য আবহাওয়া, এমন দিনে কেয়া এখনও ফেরেনি! ওর মনে হয়েছিল, নেলো কি ওর কাজটা করছে? সিমি ছেড়ে দিতে পারে, বৈরাগী মন নিয়ে দেখতে পারে পৃথিবীকে, কিন্তু ও পারে না। নেলো কী খবর দেয় ও শুনবে। তারপর দেখবে কী করতে পারে। রাতটা ওখানেই কাটিয়ে সকাল সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরেছিল জয়। আসার আগে সুতনুর সঙ্গে কথাও বলেছিল। আর আশ্বস্ত করেছিল যে, ধুলাগড় আর ডলার দু’টোই সামলে দেবে।
বাড়িতে ফিরে একটু আশ্চর্য হয়েছিল জয়। সাতসকালে এত সুন্দর পুতুলের মতো একটা মেয়ে কেন এসেছে কেয়ার কাছে? দরজার কাছে খুলে রাখা সাদা রঙের রেনকোটটা থেকে জল ঝরছিল। জয়ের মনে হয়েছিল মেয়েটা নিডি। কৌতূহল হয়েছিল জয়ের। এদিক-ওদিক যাওয়ার অছিলায় শুনেছিল, কেয়ার নতুন বিউটিপার্লারে কাজ করতে চায় মেয়েটি। কেয়া খুব খুশি মনে কথা বলছিল মেয়েটার সঙ্গে আর মাঝে-মাঝে ঘড়ি দেখছিল। মেয়েটাও হাসছিল। মেয়েটার হাসি দেখে বারবার ভোরবেলায় শিশিরের ফোঁটা সাজানো গন্ধরাজের কথা মনে পড়ছিল। কী যেন নামে কেয়া ডাকছিল মেয়েটাকে? ও, হ্যাঁ মনে পড়েছে। অদ্ভুত নাম। ব্লসম!
বুকপকেটের ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। মদন সরখেলের ঘুম-ভাঙা বিরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ফোনটা ধরল জয়। বলাইয়ের ফোন। মানে, খবর আছে।
বলাই বলল, “গুরু, খারাপ খবর আছে। সরি, কিন্তু কী করব? আমাকেই তো দিতে হবে!”
বুকটা কেঁপে উঠল জয়ের। খারাপ খবর? কেয়ার খবর কি? জয়ের তো মনে হচ্ছিল কেয়া কোথাও বেরবে, না হলে অমন বারবার ঘড়ি দেখছিল কেন? তা হলে কি নেলো বাঁশিকে ফলো করে কোনও কিছু দেখেছে?
বলাই বলল, “তিরিশ লাখ টাকা আর নেই জয়দা। শিবি লোক দিয়ে তুলিয়ে নিয়েছে।”
“কী?” চিৎকার করে উঠল জয়, “কী আবোল-তাবোল বকছিস?”
“হ্যাঁ, আজ একটু আগে। সায়েন্স সিটির কাছে।”
“দিনের বেলায়? খোলা রাস্তায়?”
“এমন ওয়েদার, রাস্তা তো প্রায় ফাঁকা। তখনই তোমায় বললাম, আমার তিনটে ছেলে নাও। এখন বোঝো!”
জয়ের হাত ঠান্ডা হয়ে গেল। এবার কী বলবে সুতনুকে? শামিমের কাছে তো বন্দুক ছিল। যারা এসেছিল, তারা কারা? শিবি কাকে পাঠিয়েছিল? আর শিবিই যে পাঠিয়েছিল তার প্রমাণ?
বলাই আবার বলল, “আর একটা ছোট খবর আছে?”
জয় চুপ করে রইল। এমন জঘন্য দিনে আর কী খবর দেওয়ার আছে?
“নেলো ছোট একটা খবর দিয়েছে। জানি না কতটা গুরুত্বপূর্ণ…তবে তোমায় বলতে ইচ্ছে হল।”
জয় এখনও চুপ। আন্দুল রোড ধরে ছুটে চলেছে গাড়ি। বলাই সাবধানী গলায় বলল, “গতকাল রাতে নেলো বাঁশিকে দেখেছে। একটা জিনিস কিনছিল।”
জয় এখনও চুপ। সরখেল আবার নাক ডাকছে। গাড়ির কাচে বৃষ্টির আঙুল টোকা দিয়ে চলেছে অবিরাম। যেন ডাকছে জয়কে, যেন যেতে বলছে ওদের সঙ্গে।
“জানো কী কিনছিল?” বলাই সাবধানে বলল।
কী বলতে চায় বলাই? এত নাটক করছে কেন?
বলাই সাবধানে মৃদু গলায় বলল, “কন্ডোম।”
বিষাণ, ২৯ জুন: সকাল
এই বৃষ্টিতে স্পেশাল সেল্স মিটিং! ওদের অফিসের কনফারেন্স রুমের কাচের জানলায় অবিরাম বৃষ্টির জল গড়িয়ে চলেছে। রুমের দিকে মুখ ফেরাল বিষাণ। বড় কাঠের টেবিল। তার চারধারে রাখা সব চেয়ার। খালি চেয়ার। মিটিং শেষ হয়েছে মিনিট দশেক আগে। যদিও মৃত সৈন্যের বেশি কিছু পার্ট ছিল না বিষাণের। ওকে তো বলেই দেওয়া হয়েছে যে, আর এক মাস ওর মেয়াদ। মাসে তিরিশটা ওয়াটার পিউরিফায়ার বিক্রি করা কি মুখের কথা? এক-একটার দাম ন’হাজার পাঁচশো টাকা। বাজারে একই জিনিস কিছু কোম্পানি দেড় হাজার টাকা কম দামে দিচ্ছে। ম্যানেজমেন্টের বক্তব্য, যারা কম দামে দিচ্ছে তাদের কোয়ালিটি খারাপ। দামের জন্য এই কোম্পানি কখনও কোয়ালিটির সঙ্গে সমঝোতা করবে না। দাম কমানোটা কোনও অপশনই নয়। পিছনের সারিতে বসে এসব ম্যানেজমেন্ট পলিসি আর সেল্স জার্গন শুনতে-শুনতে বিরক্তি ধরে যাচ্ছিল বিষাণের। মনে হচ্ছিল, দিল্লির জেনারেল ম্যানেজারকে একবার গল্ফগ্রিনের মাসিমা, চেতলার বউদি, ঝাউতলার মিসেস রয়ের কাছে নিয়ে যায়। ম্যানেজমেন্ট স্কুলের বিদ্যে চেটে সাফ করে দেবে। যেখানে একই মাপের প্রোডাক্ট কম দামে পাচ্ছে, অন্য ধরনের দেড়-দু’ হাজার টাকার পিউরিফায়ারে মার্কেট ছেয়ে গিয়েছে, সেখানে ওদের কাছ থেকে ওই দামে পিউরিফায়ার কে কিনবে?
ম্যানেজমেন্টের বক্তব্য হচ্ছে, বিক্রি সব কিছুই হয়। করতে জানতে হয়। জিনিস বিক্রি করার আগে নাকি মানুষের কাছে নিজেকে বিক্রি করতে হয়। সেল্সম্যান যদি ক্লায়েন্টকে ইমপ্রেসই না করতে পারে, তা হলে সে প্রোডাক্ট নিয়ে এগোবে কী করে?
আর এখানেই তো চার গোল খেয়ে যায় বিষাণ। ওর চেহারা ভাল। দেখতেও আজ পর্যন্ত কেউ খারাপ বলেনি। গায়ের জোরের সঙ্গে নাকি কনফিডেন্সও আসে মানুষের। কিন্তু ওর তো আসেনি? এখনও কেমন যেন নেতিয়ে থাকে ও। সেই জন্য বোধ হয় কুমুর কাছেও নিজেকে পৌঁছে দিতে পারে না।
গতকাল থেকে কেবলই ঘুরেফিরে কুমুর কথা মনে পড়ছে বিষাণের। গতকাল অমন কেন করছিল কুমু? বুঝতে পারছিল না যে বিষাণের কষ্ট হচ্ছে?
গতকাল কুমুর সঙ্গে অচেনা ছেলেটিকে দেখে বুকের ভিতরে আবার পুরনো দিনের স্টিম ইঞ্জিনেরা ফসফস শুরু করেছিল। বিষাণের মনে হচ্ছিল, ওর হাতের বড় কেকটা ছেলেটার মাথায় বসিয়ে দেয়। কিন্তু অন্য অনেক ইচ্ছের মতো এটাও সামলে নিয়েছিল।
কাজের লোকদের হাতে কেকটা তুলে দিয়ে বিতনুদের ড্রইংরুমে বসেছিল বিষাণ। ব্যাগ থেকে কাগজপত্তর বের করে সেলস রিপোর্টটা শেষ করায় মন দিয়েছিল। ঠিক তখনই অজু আর তার পিছনে কুমু আর সেই ছেলেটা এসে দাঁড়িয়েছিল বিষাণের সামনে। অবাক হয়ে সবার দিকে তাকিয়েছিল বিষাণ।
কথাটা প্রথম অজুই বলেছিল, ‘কী রে শালা, আবার চিত্রগুপ্তের খাতাপত্তর বের করেছিস?”
“একটু কাজ ছিল। কাল সকালে স্পেশাল সেল্স মিটিং আছে। ডেটা আপটু-ডেট করে না রাখলে পুরো ঝাড় হয়ে যাবে।” বিষাণ কথাটা বলে দেখেছিল পিছন থেকে কুমু স্থিরদৃষ্টিতে ওকে দেখছে।
অজু বলেছিল, “কী বললি, ঝাড় হয়ে যাবে? তোর তো পুরোটা বাঁশঝাড় হয়েই আছে। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মাসিমা, আন্টি, ম্যাডাম করে কি সারাটা জীবন কাটাবি? এ তোর লাইন নয়। বুঝেছিস?”
বিষাণ কিছু না বলে শুধু হেসেছিল। নিজেই বুঝতে পারছিল যে হাসিটা একদম বোকা-বোকা হয়ে গেল।
হঠাৎ অজু বলেছিল, “দাঁড়া, দাঁড়া, কী বললি? কাল সকালে, এমন কুত্তা-খেদানো ওয়েদারে, তোর সেল্স মিটিং আছে? তাও স্পেশাল! শুনলে মনে হয় চায়ের দোকানে টেবিলে-টেবিলে ডিমটোস্ট আর চা দিয়ে বেড়াস। তোকে বলেছিলাম, মনে নেই? কাল একবার তোকে নিয়ে বরানগর যাব। লেখা আনতে।”
“আমাকে বলেছিলি?” অবাক হয়েছিল বিষাণ।
“কেন বলিনি? ভুলে গেলি এর ভিতরে? আমি ঢপ মারছি?” অজু চোখ পাকিয়েছিল।
বিষাণ নিশ্চিত যে অজু বলেনি। কিন্তু ও এখন মানবে না। তাই আর কথা বাড়ায়নি। সোজা মেনে নিয়েছিল, “ও, আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তবে প্রবলেম নেই। আটটা থেকে দশটা অবধি মিটিং, তারপর আমি ফ্রি। তুই আমার অফিসে চলে আসতে পারবি?”
“নট আ প্রবলেম। আন্টি তো বলেছে যে গাড়ি নিয়ে যেতে। না হলে এমন বৃষ্টিতে কে যাবে গুরু? বাই দ্য ওয়ে, তুই কুমুর সেই অ্যাড্রেসে গিয়েছিলি?”
“কোন অ্যাড্রেস?” হঠাৎ করে অজু এমনভাবে প্রসঙ্গ পালটে ফেলেছিল যে খেই ধরতে পারেনি ও। কোন অ্যাড্রেসের কথা বলছে অজু?
“আরে, এ তো দেখছি টোটাল ফিউজ়! সেই গতকাল সকালে যেটা…”
অজু শুরু করলেও শেষটা করেছিল কুমু, “লিভ ইট। ওর ইন্টারেস্ট নেই। ওকে যেতে হবে না।”
ও, সেই ব্যাপারটা? সকালেই তো এই নিয়ে কথা বলেছিল কুমুর সঙ্গে।
গত সাতাশ তারিখ সকালে পাড়ার মোড়ে কুমু আর অজুকে দেখে অবাক হয়েছিল বিষাণ। কুমু তো কথাই বলছিল না ওর সঙ্গে। তা হলে হঠাৎ পাড়া অবধি এসেছে!
ও অবাক হয়েছিল, “তুমি?”
“কেন অপদার্থদের কাছে মানুষদের আসতে নেই? এই নাও একটা অ্যাড্রেস। এখানে গিয়ে দেখা করবে। এদের প্রাইভেট টিউটর দরকার।”
“এইজন্য এসেছ?” বিষাণ বিষণ্ণ হয়েছিল। এইজন্যই শুধু এসেছে কুমু?
কুমু একদৃষ্টিতে বিষাণের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “হ্যাঁ শুধু এই জন্য। গাধা।”
অজু সেটার কথাই তুলেছিল গত সন্ধেবেলা। কুমুর রাগ সামলানোর জন্য বিষাণ বলেছিল, “তোমায় তো বলেছিলাম যে রোববার সন্ধেবেলা যাব। তুমি তো বললে ঠিক আছে।”
কুমু সামান্য অপ্রস্তুত হয়েছিল। তারপর কোনও উত্তর না দিয়ে সুন্দর মতো ছেলেটার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল হলে।
অজু বলেছিল, “কী কেস বল তো তোদের? এই কুমু রাগ করছে। এই সকালবেলা আমার হাত থেকে লেখার বান্ডিল নিয়ে তোর কাছে যাবে বলে লাফাচ্ছে। আবার সন্ধেবেলা তোকে ঝাড় দিচ্ছে। কেস কী? তোদের কি তার কেটেছে?”
বাইরে বৃষ্টিটা বাড়ছে ক্রমশ। বিষাণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কুমু কেন এমন করছে? প্রোপোজ় করার সময় তো রীতিমতো অপমান করেছিল ওকে। এখন এমন করছে কেন?
এখনও ওর ভাবলে অবাক লাগে, সেদিন কোন ভূতের খপ্পরে পড়ে যে কুমুকে প্রোপোজ করতে গিয়েছিল! এখনকার মতো মানসিক অবস্থায় থাকলে তো পারতই না।
সেটা ছিল এগারোই মে। দিনটা স্পষ্ট মনে আছে বিষাণের।
একটা শূন্য বিকেল পড়েছিল একা। অজু কলকাতার বাইরে ছিল। এ ছাড়া বিশেষ বন্ধুবান্ধব কোনওদিনই ছিল না বিষাণের। বাড়িতেও ফিরতে ইচ্ছে করছিল না ওর। শুধু কুমুর কথা মনে পড়ছিল। ওর হাত দু’টো মনে পড়ছিল। টোল-পড়া থুতনিটা মনে পড়ছিল। কেমন যেন সম্মোহনে পড়ে গিয়েছিল। পাঁজরের নীচে কে যেন টাইম বোমা ফিট করে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এ বোমার সময়, ওর জীবনের নিয়ন্ত্রণ একমাত্র কুমুদ্বতীর হাতে রয়েছে। কী করে যে ওর পা দু’টো ওকে টানতে-টানতে লেক গার্ডেন্স নিয়ে গিয়েছিল ও নিজেই জানে না।
এক-একটা দিন থাকে, যখন যা হলে ভাল হবে না, তা সহজেই হয়ে যায়। সেদিনটাও তাই ছিল। অতবড় প্রাসাদের মতো বাড়িটা প্রায় পুরোটাই খালি ছিল। সিঁড়িতে পা রেখেই হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল বুকটা। নীচে কাজের লোকের কাছে তো জেনেছে কুমু একা আছে। কিন্তু কুমুর কাছে গিয়ে কী বলবে? কুমু যা মেয়ে, যদি চড়-থাপ্পড় মেরে দেয়? কিন্তু মনের আর-এক অংশ যে চিরকাল ঝুট-ঝামেলা পছন্দ করে, সে ওকে খোঁচাচ্ছিল। বলছিল, “কুমুকে আজ বলেই দে। যদি রাজি হয়ে যায় তো জানবি জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য পেলি।” বলছিল, “রিস্ক নিতে শেখ বিষাণ। কতদিন কেন্নোর মতো শরীর গুটিয়ে থাকবি?”
অজু বলে, “তুই বড্ড বাড় খেয়ে যাস। নর্মাল থাকতে পারিস না?”
নর্মাল অবস্থায় তো মানুষ নর্মাল থাকবে! কিন্তু এমন একটা ঝলসানো বিকেল, এত বড় গাছ-ঘেরা নির্জন বাড়ি, স্বপ্নের মতো একটা মেয়ে, এ কি বিষাণের মতো ছাপোষা মানুষের কাছে নর্মাল ব্যাপার? এখন যদি আধপেটা খেয়ে দিন-কাটানো মানুষকে সেভেন কোর্স ডিনার দেওয়া হয় সে কি আর ভুলভাল খেয়ে পেটের ব্যামো বাধিয়ে বসবে না?
বিষাণেরও পেটের ব্যামো হয়েছিল। অন্তত মা তো তাই মনে করেছিল। মুখের উপর এমনভাবে কুমুর রিজেকশন নিতে পারেনি ও।
কুমু ওর ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে বসেছিল। কলকাতার মাথা থেকে তখন ঢালু বেয়ে নামছিল সূর্য। ফেলে-যাওয়া আলোর কয়েকটা কুচি জড়িয়েছিল কুমুর গালে, গলায়।
“তুমি?” কুমু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে।
“হ্যাঁ, আমি।” কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছিল না বিষাণ। পার্ট ভুলে-যাওয়া অভিনেতার মতো দরদর করে ঘামছিল বিষাণ।
“মা তো নেই।”
“যদিও বলার ইচ্ছে ছিল না, তবু না বলেও থাকতে পারছি না। তোমায় আমার খুব ভাল লাগে কুমু। আমি তোমায় খুব পছন্দ করি। ভালবাসি। আমার সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। তোমায় দেখলেই যায়। আমি কী করব?” বিষাণের সমস্ত ডায়ালগ হঠাৎ করে মনে পড়ে গিয়েছিল।
কুমুর মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ, “হাউ ডেয়ার ইউ? আয়াম অলরেডি ইন আ রিলেশনশিপ। তুমি আমায় প্রোপোজ করছ! ডু সামথিং রিয়েল, তারপর আসবে। ইচ্ছে ছিল না মানে? আমি কি তোমার কাছে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়েছিলাম যে, আমায় প্রোপোজ করো? তুমি জানো না কীভাবে এসব বলতে হয়? আনস্মার্ট, ক্যাবলা কোথাকার!”
তার পরের সাতদিন বাড়ির টয়লেটেই বেশির ভাগ সময় কাটাত বিষাণ। সবাই ভাবে টয়লেটে ঘন-ঘন যাওয়া মানেই পেটের ব্যামো। মনের ব্যামোতেও যে টয়লেট একটা উপযুক্ত পারগেশন স্পট সেটা কেউ বুঝতে পারে না। শুধু কপিল একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “আচ্ছা, টয়লেটে কী আছে বল তো? বেরনোর সময় প্রতিবার তোর চোখ দু’টো কেমন যেন লাল হয়ে থাকে। ওখানে ঢুকে নেশাভাঙ করিস নাকি?”
সেই কুমু এখন এমন করে কেন? এই ভাল, এই খারাপ। মাথায় ছিট নেই তো? যদি বিষাণ ক্যাবলা, আনস্মার্ট হয়েই থাকে তা হলে ও লাবানার সঙ্গে কথা বলল, না অন্য কারও সঙ্গে কথা বলল, তাতে কী এসে যায় কুমুর?
গোটা অনুষ্ঠানটায় বিষাণ এককোণেই দাঁড়িয়েছিল। ভাল লাগছিল না। কুমু, ঋষভের, মানে ওই সুন্দর দেখতে ছেলেটার সঙ্গে এমন গা ঘেঁষে কথা বলছিল যে, চিকেন তন্দুরি ও শুকনো চিঁড়ের মতো লাগছিল ওর। তারপর অবশ্য অনুষ্ঠানের তাল কেটে গিয়েছিল। অসুস্থ সুতনুকে নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স করে ফিরেছিল জয়। তারপর কারও পার্টিতে মন ছিল না।
রাতে ফেরার আগে বিষাণের সামনে অজুকে কুমু বলেছিল, “ঋষভ আবার প্রোপোজ করেছে আমায়। কী করি বল তো?”
“আমার আর কিছু করার নেই!” সন্তোষদা কনফারেন্স রুমে ঢুকে চেঁচিয়ে বলল।
“অ্যাঁ?” ঘাবড়ে চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে ব্যাগটা শব্দ করে ফেলল বিষাণ।
“বলছি, আমার আর কিছু করার নেই। দিল্লিওলাদের বলেছিলাম, তোকে রাখার কথা। বাট দে ওয়ান্ট ইউ আউট।” সন্তোষদার দুঃখের অ্যাকটিংটা ঠিক জমছে না।
বিষাণ মাথা নিচু করল, “ঠিক আছে। তুমি তো আগেই বলেছিলে।”
“বলেছিলাম?” সন্তোষদা এমন মুখ করল যেন মিথ্যে বলছে বিষাণ, “তা হবে হয়তো। এক মাস আছিস। তারপর তুই স্বাধীন। কমার্সের ছেলে হয়ে এসব লাইনে আসতে গেলি কেন?”
বিষাণ মাথা নিচু করল আবার। কেন আসতে গেল তা আর অন্যদের বলবে কী করে? বেগার্স আর নো চুজ়ার্স। এখন ভাবে, পড়াশোনাটা যদি মন দিয়ে করত! তা হলে পথ বাছার স্বাধীনতা থাকত ওর নিজের হাতে।
“কী আর করা যাবে? সামনের মাসটাও আছিস যখন, নিজের মতো থাক। ইচ্ছে হলে ফিল্ডে নামিস, না হলে নামিস না।” সন্তোষদা শেষের কথাগুলো বলে সন্তোষ প্রকাশ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ঘরটা হঠাৎ শ্মশানের মতো নিস্তব্ধ লাগল বিষাণের। চেয়ার থেকে উঠে ও নীচে যাবে বলে এগোল। এখন তো আবার অজুর সঙ্গে বরাহনগর যেতে হবে। ভাবতে-ভাবতেই পকেটের ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা ধরল বিষাণ, “হ্যালো!”
“তুই কোথায় বিষাণ?” মায়ের গলা। তাতে সমস্ত রকম ভয় আর কষ্ট মিলেমিশে আছে।
“কী হয়েছে মা?”
“দোয়েল,” মা হাঁপাচ্ছে, “দোয়েল… দোয়েলকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে চন্দ্র। দোয়েল এক কাপড়ে বেরিয়ে রাজারহাটে ওর বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছে।”
“মানে? মাথা-ফাটা নিয়ে?”
“পথে নাকি ব্যান্ডেজ করিয়ে নেবে।”
“কী যা তা বলছ? পথে ব্যান্ডেজ করাবে মানে? দাদাই বা মাথা ফাটিয়েছে কেন?” বিষাণ বিশ্বাস করতে পারছে না।
মা আবার বলল, “তুই তাড়াতাড়ি আয়, বড্ড বিপদ।”
“আসছি মা। কিন্তু আমি এলেই তো আর বউদি ফিরে আসবে না।”
“শোন না। তোকে খুব দরকার। দোয়েল শাসিয়ে গিয়েছে যে, চন্দ্রকে পুলিশে দেবে। তুই আয়।”
ও সামলাতে পারে অবস্থা? জানলার দিকে তাকিয়ে রইল বিষাণ। ফোনের ওপারে বৃষ্টি নেমেছে। আর এপারেও বৃষ্টি এসেছে ঝেঁপে। সব কিছু ভীষণ আবছা লাগছে। কোনও পথ নজরে আসছে না।
রথী, ২৯ জুন: রাত
গাড়িটা ছোট আর পুরনো। তবে বর্ষার ক্ষেত্রে আদর্শ। জলে বন্ধ হওয়ার চান্স নেই। তাই তো এতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রথীকে। বাইরে বৃষ্টিটা এখনও হয়ে চলেছে। দেখে ওর মনে হয়েছিল, গোটা শহরটার মেঝে কে যেন আয়না দিয়ে মুড়ে দিয়ে গিয়েছে।
আজ এই ছোট্ট গাড়ির ভিতর বসে বাবার কথা মনে পড়ছে রথীর। মায়ের কথাও মনে পড়ছে। দিদি, মুনিয়া, এমনকী নিজের ঘরের খাটটার জন্যও মনখারাপ করছে। মনে হচ্ছে, যদি একবার ফিরতে পারত ওখানে! মনে পড়ছে ব্লসমের মুখটা। ওর কান্নাটা। ওভাবে কষ্ট পেয়ে চলে যাওয়াটা। কী এমন চেয়েছিল ও? রথী ওর জন্য এটুকু করতে পারল না?
কিছু পারেনি রথী। ও একজন ব্যর্থ মানুষ। একজন খারাপ মানুষ। ওর ইচ্ছে হচ্ছে আর একটা সুযোগ পেতে। আর একবার শুরু করতে ইচ্ছে হচ্ছে জীবন। যেখানে সব স্বাভাবিক মানুষেরা থাকবে। ভালবাসার জন্য ব্লসম থাকবে। যেখানে এমন বন্দুকের নল তাক করে থাকবে না ওর দিকে।
“কী রে শুয়োরের বাচ্চা? ভয় লাগছে?” খ্যাক-খ্যাক করে হাসল বলাই। মুখ দিয়ে কাঁচা মদের গন্ধ বেরচ্ছে ওর।
ও চুপ করে রইল।
“আচ্ছা, তোরা কী ভাবিস? সুতনু রায়ের টাকা ওড়াবি আর আমরা কেউ ধরতে পারব না?” বলাই কনুই দিয়ে খোঁচা দিল রথীকে। রথী কিছু বলল না। বলাই যে অবস্থায় আছে তাতে কোনও কথা শুনবে না।
জীবনে নানা রকম ভুলভাল কাজ করেছে রথী; কিন্তু খুন করেনি কোনওদিন। ওকে হাতে বন্দুক ধরিয়ে একবার হাত-পা বাঁধা একজনকে গুলি করতে বলেছিল শিবি। রথী পারেনি। শিবি বলেছিল, “তোর দ্বারা এসব হবে না। তোর ভিতরে সেই জন্তুটা নেই।”
কিন্তু বলাইয়ের ভিতরে সেই জন্তুটা আছে। ওর মুখ এই গাড়ির আবছায়ায় দেখা না গেলেও গলা দিয়ে জন্তুটা নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। রথী বুঝতে পারছে আজ ওর মৃত্যু নিশ্চিত। বলাই ওকে বাঁচতে দেবে না।
“দেখলি তো, শিবি যতই নিজেকে রুস্তম ভাবুক, আমরা ওর বাপ। ওর চোদ্দোগুষ্টিকে একসঙ্গে ভোগে পাঠাব। কী ভেবেছিল, সব আরামসে করে বেরিয়ে যাবে? আমরা বসে-বসে দাঁত ক্যালাব? আজ দ্যাখ শালা, আমার হাত তোরাই কেটেছিলি না? আজ কে কাকে কাটে দ্যাখ।” বলাই হাতে ধরা প্লাস্টিকের বোতল থেকে গলায় মদ ঢালল। ছোট্ট গাড়ির ভিতর দমচাপা পরিবেশে জঘন্য গন্ধটা পাক খেয়ে উঠল। রথীকে এমন কিছু একটা খাওয়ানো হয়েছে যাতে ও সব বুঝতে-শুনতে পেলেও হাত-পা ঠিক নাড়াতে পারছে না। সব কেমন অসাড় লাগছে ওর।
আজ সকালটা যেভাবে শুরু হয়েছিল তাতে কিন্তু বুঝতেও পারেনি রাতটা এমনভাবে শেষ হবে!
সকালে বৃষ্টির মধ্যে ঠিক জায়গায় পৌঁছনোর পাঁচ মিনিটের ভিতরেই একটা লাল গাড়ি এসে ওদের ক্রস করে আরও দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে একজন বেরিয়ে সামনের ঝোপের দিকে এমনভাবে এগিয়ে গিয়েছিল যেন পেচ্ছাপ করতে যাবে। লোকটার পিছনটা দেখে চেনা-চেনা মনে হলেও চিনতে পারেনি বৃষ্টিতে লোকটা মাথায় ছাতা নিয়ে থাকায়।
গাড়িটা থামতেই রাস্তার ওপারে দাঁড়ানো ছেলে দু’টো রথীকে হাত দিয়ে ইশারা করে দৌড়েছিল গাড়ির দিকে। রথী নিজে রাস্তা পার হয়ে পিছু নিয়েছিল ওদের। ছেলে দু’টো গাড়ির কাছে গিয়েই বন্দুক বের করে পিছনের সিটে বসা দু’জনকে নামিয়ে এনেছিল রাস্তায়। তারপর রথীকে বলেছিল, “ব্যাগটা পিছনের সিটেই আছে। নিয়ে কেটে পড়ো তাড়াতাড়ি।”
কিন্তু কেটে পড়া সহজ হয়নি। পিছনের সিট থেকে টাকার হলুদ ব্যাগটা তুলতে যেতেই সামনের সিট থেকে ড্রাইভার প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর উপর। লোকটার গায়ে অসুরের মতো শক্তি। রথীর একটা হাতে ব্যাগ থাকায় কিছুতেই এঁটে উঠছিল না ওর সঙ্গে। তার মধ্যে লোকটা ছুরি বের করার চেষ্টা করছিল। রথীকে সাহায্য করতে আসা ছেলে দু’টো গাড়ি থেকে দু’জনকে নামিয়ে পথের পাশের টিলাগুলোর দিকে নিয়ে গিয়েছিল। রথীর চিৎকার পৌঁছচ্ছিল না ওদের কাছে। রথী বুঝতে পারছিল কোনও অস্ত্র ছাড়া এমন কাজে নামা ঠিক হয়নি।
ড্রাইভার ছুরি বের করে ফেলেছিল এর মধ্যে। আর রথীর দিকে সেটা উঁচিয়ে চালাতেও গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে জানলা দিয়ে একটা লাল শার্ট পরা হাত এসে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মেরেছিল ড্রাইভারের মাথায়। আর তার সঙ্গে রথী শুনেছিল, “পালাও!”
ব্যাগটা নিয়ে প্রাণপণে দূরে দাঁড়ানো সাদা গাড়ির দিকে দৌড়েছিল রথী। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে ক্লাচ ছাড়তে গিয়েও পারেনি। চমকে দেখেছিল, ওর পাশে এসে প্রায় ঝাঁপিয়ে সিটে বসে পড়েছিল সেই লাল শার্ট পরা মানুষটি। লোকটা বলেছিল, “চলো, পালাও, দেরি কোরো না।”
রথী গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। এর তো যাওয়ার কথা ছিল না ওর সঙ্গে! কিন্তু বুঝতে পেরেছিল যে, ওকে বাঁচাতে গিয়ে লোকটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। তাই ওকে বাঁচানোর দায়িত্বও রথীর। কিছুটা গিয়ে ভাল করে লোকটাকে দেখেছিল রথী। আর সঙ্গে-সঙ্গে চিনতে পেরেছিল। আরে লোক কোথায়? আসলে চাপ দাড়ি আর মোটা গোঁফের জন্য এমন লাগছে। মাস-ছ’য়েক আগে তো কয়েকবার ওকে শিবির অফিসে দেখেছে রথী। তখন তো ক্লিন-শেভ্ন ছিল। আরে, এ যে শামিম!
“শুয়োর, কী ভেবেছিলি, শামিমকে আমাদের দলে গুঁজে দিয়ে সব কাজ হাসিল করে নিবি? ভেবেছিলি তোদের দলে আমাদের কোনও লোক নেই?” খিকখিক করে হেসে উঠল বলাই। হাত বাড়িয়ে ড্রাইভারকে মদের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে হেলান দিয়ে বসল।
প্রথমে রথী ভেবেছিল হাওড়া যাবে। কিন্তু শামিম গাড়িতে ওঠায় প্ল্যান বদলেছিল। বি কে পাল অ্যাভিনিউর কাছে শামিমকে নামিয়ে দিয়েছিল, তারপর গাড়িটাকে নিয়ে গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউর একটা পার্কিংয়ে রেখে হেঁটে এসে মেট্রো ধরেছিল চাঁদনি থেকে। যতীন দাস পার্কে নেমে যখন হিমির কাছে পৌঁছেছিল, হিমি রান্না বসিয়েছিল সবে। ওকে দেখে বলেছিল, “ঝগড়া করার আর দিন পেলে না? এমন বর্ষায় কেউ ঝগড়া করে ঘর থেকে বেরোয়? পাগল নাকি?”
রথী কোনও উত্তর দেয়নি। চুপ করে বসেছিল চৌকির ওপর।
হিমি বলেছিল, “সঙ্গে করে তো একটা মাত্র ব্যাগই শুধু এনেছ দেখছি। এতে দু’দিন থাকার মতো জামাকাপড় আছে তো?”
প্রায় তিনটে নাগাদ ভাত দিয়েছিল হিমি। সঙ্গে মুসুর ডাল, পটলভাজা আর চুনো মাছের ঝাল। দিব্যি লাগছিল রথীর। এমন বৃষ্টির দিনে গরম খাবার, ভাবাই যায় না। সারাদিনের মানসিক ধকলের পর বিছানাটা খুব টানছিল রথীকে।
রথী বলেছিল, “আমি একটু শোবো? ঘুম পাচ্ছে। তবে তোমার খদ্দের এলে ডেকে দিয়ো আমায়, আমি ঘর ফাঁকা করে দেব।”
“খদ্দের?” হেসেছিল হিমি, “আজ আমার শরীর ভাল নেই। কাউকে নেব না। আমি পাশের ঘরে ছেলের কাছে আছি। তুমি যত ইচ্ছে ঘুমোও।”
বিছানা চুম্বকের মতো টেনে নিয়েছিল রথীকে। একনিমেষে ঘুম এসে জুড়ে বসেছিল চোখে। শুধু ঘুম আসার ঠিক আগের মুহূর্তে রথীর মনে হয়েছিল, হিমি তো চুনো মাছের ঝালটা খেল না!
আচমকা দেওয়ালে ধাক্কা লাগার মতো কষ্ট আর হতভম্ব ভাব নিয়ে ভেঙেছিল ঘুমটা। কারা জানি চেপে ধরেছিল ওকে। উপুড় করে শুইয়ে ওর হাত দু’টো বাঁধছিল পিছন দিকে। কে যেন পিছন দিক থেকে ওর ঘাড়টা চেপে ধরে ছিল বিছানার সঙ্গে। প্রাণপণ শক্তি দিয়ে ওদের থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করেছিল রথী। কিন্তু এক ফোঁটা জোর পাচ্ছিল না গায়ে। কী হয়েছে ওর?
রথী চিৎকার করার চেষ্টা করেছিল। আরে! ওর মুখও কখন বেঁধে দিয়েছে এরা? কারা এসব করছে? কেন করছে? দু’জন আচমকা শোওয়া অবস্থা থেকে ধরে বসিয়ে দিয়েছিল রথীকে। আর ঘোর-লাগা চোখে, অশক্ত শরীর নিয়ে রথী দেখেছিল, দু’জন ষণ্ডামার্কা ছেলে ওকে খাটের উপর বসিয়ে রেখেছে। আর ওর সামনে কোমরে হাত দিয়ে হ্যারিকেনের ভুতুড়ে আলোয় দাঁড়িয়ে রয়েছে ছানু!
রথী বুঝতে পারছিল না কিছু। কে যেন ওকে বিরাট এক ধাঁধার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ছানু? ছানু ওকে লোক দিয়ে বাঁধছে! সোমবার না ছানু ওকে এখান থেকে বের করে নির্দিষ্ট জায়গায় টাকাগুলো পৌঁছে দেবে কথা দিয়েছিল! সেই ছানু এখানে? হিমি কোথায়? হিমির কোনও ক্ষতি হয়নি তো? ওর বিস্মিত চোখের দিকে তাকিয়ে ছানু ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলেছিল, “শুয়োরের বাচ্চা, বেড়ালের চামচা। তোর টাকা ছ’মাস ধরে নিজের কাছে রাখলাম। তোর দায়ে তোর পাশে দাঁড়ালাম। আর শিবির কাছে দিলি আমার পুরিয়ার খবর ফেচকে? চল শালা, তোর যম অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
বাইরের সরু গলি দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে যখন ওকে বের করছিল ছানুর সঙ্গের ছেলেরা, ঘোলাটে ধোঁয়া-লাগা চোখ নিয়ে রথী দ্বিতীয়বার বিস্মিত হয়েছিল। ও দেখেছিল, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে হিমি।
“কী কাকা? ঘাবড়ে যাচ্ছ?” এবার নেলো কথা বলল।
“শোনো রথী ভাই, বেশি মাগিবাজি করলে, বিড়ি না খেলে, এমন ভাবেই লোকে বাঁশ দিয়ে যাবে, বুঝেছ? চেহারাই বানিয়েছ, বুদ্ধি একরত্তি হয়নি দেখছি! ছানু তো বলাইদার লোক। প্রথমে ছিল না অবশ্য। পরে হয়েছে। টাকা যেখানে শিবি পৌঁছে দিতে বলত, সেখানে চুপচাপ পৌঁছে দিলেই হত। এতে ছানুর মতো মালকে জড়ালে কেন? ছানু তোমার থেকে হিমির ঠিকানা পেয়ে ওকেও টাকা দিয়ে হাত করল। সেই হিমি খাবারে ওষুধ মিশিয়ে তোমায় কাত করল। তুমি? বোকা ছেলে কোথাকার! তিরিশ লাখ নিয়ে যুধিষ্ঠির হয়ে শিবির কথা শুনলে। কেন, টাকাটা মেরে অন্য কোথাও পালাতে পারলে না? সত্যি, যে ছেলে মুখে গন্ধ হয় বলে বিড়ি খায় না, তাকে এভাবেই লাথ খেতে হয়, বুঝেছ?”
হিমিও? আবছায়া অন্ধকারে বসে হঠাৎ কষ্ট হল রথীর। হঠাৎ রথীর মনে পড়ল ব্লসমের মুখ। মেয়েটা তো সব ছেড়ে দিতে বলেছিল। কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল শেষ কাজটা করার? মা মারা গিয়েছে অল্প বয়সে। তারপর থেকে একমাত্র ব্লসম ওকে ভালবেসেছে। তার কথাই ও শুনল না? তাই কি ভগবান ওকে এমনভাবে শাস্তি দিল?
আর হিমি এমন করল ওর সঙ্গে? মাছটা কেন হিমি খায়নি বুঝতে পারছে রথী। হিমিই না একদিন বাঁচিয়েছিল ওকে?
বলাইয়ের লোকদের তাড়া খেয়ে যে টিনের দরজা দেওয়া চৌকো জায়গার ভিতরে নিজেকে ছুড়ে দিয়েছিল রথী, সেটা আসলে ছিল কমন বাথরুম। শ্যাওলা মেঝে, স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল আর পুরনো চৌবাচ্চা-সমেত ঘরটায় ঢুকে ও দেখেছিল শুধুমাত্র গামছা পরে একটা মেয়ে বসে রয়েছে সাবান হাতে। রথী হাঁপ-ধরা গলায় বলেছিল, “আমায়…ওরা…খুন করবে…বাঁচান…প্লিজ়…”
চৌবাচ্চার ভিতরে ওকে লুকিয়ে হিমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল দ্রুত। কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বাথরুমের দরজা পিটিয়ে যখন বলাইয়ের লোকজন চিৎকার করছিল, হিমি শুধু সামান্য কাপড়টুকু পরে ওদের মুখোমুখি হয়ে ভাগিয়ে দিয়েছিল ওদের। নিজের প্রাণের মায়া করেনি।
এমন হিমিও টাকার বিনিময়ে ওকে ধরিয়ে দিল? মাথা নিচু করল রথী। কাকে মানুষ বিশ্বাস করবে তবে?
বলাই বলল, “মালটাকে কিন্তু হেভি চমকেছি বল? তিরিশ লাখ শালা বাপের জন্মে দেখেছে, যে হজম করবে?”
নেলো হাসল, তারপর বলল, “যাই বলো বলাইদা, সেই রাজারহাটের ফাঁকা মাঠে এই দুর্যোগে না নিলেই চলছিল না মালটাকে? আরামসে গলাটা কেটে টালি নালায় ভাসিয়ে দিতাম। কোনও ল্যাঠা থাকত না।”
বলাই সামনে-বসা ড্রাইভারকে বলল, “ওরে হারামজাদা বিনা পয়সায় পেয়েছিস বলে আর মাল টানিস না। এবার অ্যাক্সিডেন্ট করবি।” তারপর নেলোকে বলল, “শোন, রাজারহাটের নিউ টাউনের ফাঁকা মাঠ আমাদের পয়া জায়গা। রাতে মাল নিয়ে যাও, মাঠে নামাও, দানা ভরে ফেলে চলে এসো। জয়দার প্রিয় জায়গা ওটা। ওর সঙ্গে থাকতে-থাকতে আমারও ওটাই প্রিয়।”
“জয়দা?” নেলো হাসল, “বাঁশি কন্ডোম কিনছে শুনে তো ওর খোপরি জ্বলে গিয়েছে একদম। আচ্ছা, এই টাকাটা কি আমাদের ফেরত দিতেই হবে? চলো না মেরে পালাই।”
অঝোর বৃষ্টির ভিতর গাড়ির ওয়াইপার চলছে, তবু কাচ পরিষ্কার হচ্ছে না ঠিকমতো। তার ভিতর দিয়েও রথী দেখল নিউ টাউনের রাস্তা দিয়ে হু-হু করে গাড়ি ছুটছে। নেলো গাড়ির সামনের সিটের পিছনে পকেট মতো জায়গা থেকে রিভলভার বের করল। কির-কির শব্দে ছ’টা চেম্বার ঘুরিয়ে হাসল। বলল, “বহুদিন পর… নার্ভাস লাগছে।”
বলাই বলল, “চিন্তা নেই। দু’টো বুকে আর দু’টো মাথায়।” তারপরই ড্রাইভারকে বলল, “আস্তে চালা। মাল টেনে হুঁশ নেই তোর?”
“হুঁশ?” ড্রাইভার ছেলেটা হাসল, “ভয় পাচ্ছ কেন বলাইদা? মাল খেলেও হাত স্টেডি আছে।”
বলাই বলল, “চোপ শালা, পাশের লেনটায় কাজ হচ্ছে। এই লেনটাই খোলা শুধু। সাবধানে চালা।”
ড্রাইভার হাসল, তারপর পিছনে ফিরে বলল, “তুমি বলাইদা এমন ডরপোক যে…”
ড্রাইভারের কথা শেষ না হতেই, “দেখে…” বলে আচমকা চিৎকার করে উঠল নেলো।
রিফ্লেক্সে নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল রথী। বলাই কুঁকড়ে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করল, “এই…”
সামনে জোরালো একটা আলো দ্রুত কোনাকুনি হয়ে ঘুরে এসে মারল ওদের ছোট্ট গাড়িটার ডান দিকে। সব তালগোল পাকিয়ে গেল নিমেষের মধ্যে। গাড়িটা লাফিয়ে উঠে হাওয়ায় পাক খেল, তারপর বাতিল দেশলাই বাক্সের মতো ছিটকে পড়ল রাস্তার কোনায়। গাড়ির পিছনের কাচের শিল্ডটা ভেঙে ছিটকে পড়ল দূরে। গাড়ির দেওয়াল তুবড়ে এল ভিতর দিকে। একটা তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল রথীর মাথায়। অসাড় হাত-পাগুলোয় যেন সাড় ফিরে এল আচমকা। রথী দেখল, গাড়ির পিছনের কাচ দিয়ে ওর শরীরটা অর্ধেক বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। বাকিরা কই? ঘাড় নাড়াতেও যেন লাগছে। সারা শরীরে যন্ত্রণাটা তীব্র হচ্ছে ক্রমশ। জিভ শুকিয়ে আসছে রথীর। চটচটে নোনতা কিছু গড়িয়ে আসছে মুখে। দূরের লাইটপোস্টের আলোগুলো উলটে গিয়ে কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথার ভিতরের ঘরে কারা যেন আলো নিভিয়ে দিচ্ছে একে-একে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে রথীর। বুক ভেঙে যাচ্ছে যেন। মঞ্চের পর্দা কে যেন নামিয়ে আনছে। এই কি মৃত্যু? এভাবেই কি মৃত্যু আসে?
রথী শুয়ে রইল বৃষ্টির নীচে। চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ওর মনে হল, এ আসলে মৃত্যু না ছুটি? এবার কি তবে ব্লসমের কাছে যেতে পারবে ও?
জয়, ২৯ জুন: রাত
খুন একটা পদ্ধতি। একটা বিজ্ঞান। নির্দিষ্ট কিছু ধাপ পরপর ঠিক মতো না সাজালে খুন প্রক্রিয়াটিকে পূর্ণ রূপ দেওয়া যায় না। বিশেষ করে এমন একটা খুন।
জয় আড়চোখে পাশে বসা বাঁশিকে দেখল। এমন খবর পেয়েও ছেলেটা কানে ইয়ারফোন গুঁজে একমনে গান শুনে চলেছে! হাতে ধরা মোবাইলটা থেকে গান ওই তার বেয়ে পৌঁছে যাচ্ছে কানে। মোবাইলটার বোতামে নীল আলো জ্বলে রয়েছে। গাড়ির অন্ধকারে অদ্ভুত লাগছে আলোটা। জয় জানে, মোবাইলটা কেয়া দিয়েছে বাঁশিকে।
লোকটার নাম ছিল মনোহর। কেউ-কেউ বলত মনোহরণ। বাংলা, গুজরাতি, কন্নড়, তামিল আর হিন্দিতে অনর্গল কথা বলে যেতে পারত লোকটা। একটা ছোট্ট ঘরে থাকত এই মনোহর। আর ঘরের অর্ধেকই ছিল নানা দেবদেবীর ছবিতে ভর্তি। মনোহর একাহারী ছিল। রাতে কোনওদিন রুটি-ডাল আর কোনওদিন আলুসেদ্ধ-ভাত দিয়ে মেখে খেত। কোনও নেশা করত না। সময় পেলে গ্রহনক্ষত্রের ছবিওলা মোটা-মোটা বই পড়ত লোকটা।
উত্তরপ্রদেশের ছোট এক গ্রামে একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির হয়ে কাজ করতে গিয়ে জয়ের আলাপ হয়েছিল মনোহরের সঙ্গে। কী করত লোকটা তা জানতে পারেনি জয়। আর সেই উনিশ বছর বয়সে জানতে ইচ্ছেও করেনি। শুধু, সৌম্যদর্শন মানুষটার প্রতি একটা অদ্ভুত টান অনুভব করত জয়। ফ্যাক্টরি কনস্ট্রাকশনের প্রতিদিনের কাজ শেষ হলে ও পায়ে-পায়ে চলে যেত মনোহরের কাছে। নানারকম গল্প শুনত। উপদেশ শুনত। মনোহর ওকে বলত শক্ত হতে। বলত, জয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধে হল ওর আগে-পিছে কেউ নেই। বলত, এই না থাকাটাই জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে ওকে। বলত, জয়ের মধ্যে অন্য একটা মানুষকে দেখতে পায় মনোহর। অসম বয়স হলেও দু’জনের মধ্যে অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আর এই মনোহরকেই ফ্যাক্টরি কনস্ট্রাকশনের প্রায় শেষ পর্যায় একদিন আচমকাই অন্য রূপে দেখে ফেলেছিল জয়।
মনোহরের ছোট্ট ঘরের দরজাটা সেদিন ভিতর থেকে বন্ধ ছিল না। তাই অন্যদিনের মতো টোকা না দিয়েই দরজা ঠেলে সরাসরি ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল জয়। আর ঢুকেই থমকে গিয়েছিল। দেখেছিল, নিজের ছোট্ট চৌকির উপর হাঁটু মুড়ে বসে মনোহর একটা বন্দুক পরিষ্কার করছে।
দরজার আওয়াজে মনোহর ঘুরে তাকিয়েছিল। জয়ের চোখ যেন আটকে গিয়েছিল মনোহরের অদ্ভুত সুন্দর দু’টো চোখে। দৃষ্টিবন্ধন। পায়ে-পায়ে গিয়ে জয় বসেছিল মনোহরের সামনে।
মনোহর হেসে বন্দুকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল জয়ের দিকে। ঠান্ডা ধাতুটা ধরে হাত কেঁপে গিয়েছিল জয়ের। তবু হাত থেকে বন্দুক নামিয়ে রাখেনি ও। অদ্ভুত এক শান্তি আর আত্মবিশ্বাস এসেছিল জয়ের। মনে হয়েছিল, এমন একটা কিছু থাকলে আর কেউ নেই মনে হবে না কোনওদিন।
মনোহর ওর মৃদু কিন্তু ছন্দোময় স্বরে বলেছিল, “এটা লুগার। নাৎসি পিস্তল। পুরনো, কিন্তু খুব মসৃণ। আমার বহুদিনের বন্ধু।”
“বন্ধু?” অবাক হয়েছিল জয়, “কী করো তুমি?”
“আমি?” অদ্ভুতভাবে হেসেছিল মনোহর, “আমি কনট্র্যাক্ট কিলার। পয়সা নিয়ে খুন করি। সামান্য দূরত্ব থেকে গুলি করে মানুষ মেরে ফেলি। এটাই আমার পেশা।”
জয় অবাক হয়ে দেখেছিল মনোহরকে। কেউ এত স্বাভাবিক গলায় এমন একটা কথা বলতে পারে? এমন সাধুসন্তের মতো জীবন কাটায় যে মানুষটা সে কি না একজন খুনি!
“তোমার ভয় লাগে না?” জয় অবাক গলায় জিজ্ঞেস করেছিল।
মনোহর বন্দুকটা পরিষ্কার করতে-করতে বলেছিল, “প্রথম যখন মানুষ মেরেছিলাম তখন আমার বয়স তোমারই মতো। মানুষটাকে মেরে, ওর থ্যাঁতলানো মাথা দেখে গা গুলিয়ে উঠেছিল আমার। ভয়ে হাত-পা জমে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য যেন ভুলেই গিয়েছিলাম যে পালাতে হবে। যখন পালালাম তখনও ভয় পিছু ছাড়েনি। কেবলই মনে হচ্ছিল, সবাই সব জেনে যাবে। এই বুঝি পুলিশ আসবে। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর কোথাও আমি সেফ নই। ঘুম আসছিল না আমার। বই উলটোচ্ছিলাম, কিন্তু পড়তে পারছিলাম না একটা শব্দও। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে শুয়েছিলাম সারারাত। আর বমি পাচ্ছিল ভীষণ। গা পাক দিয়ে পেটের সব বেরিয়ে আসতে চাইছিল। কিন্তু পেটে কিছু ছিল না যে বেরবে। অনেক কষ্টে ঘুম এসেছিল আমার, পরদিন ঘুম ভেঙে উঠে দেখেছিলাম পৃথিবী নিজের মতোই চলছে। কোথাও কোনও বদল নেই। কোনও তফাত নেই আগের দিনটার চেয়ে।”
জয় বন্দুক হাতে বসেছিল চুপ করে। ওর কেমন অদ্ভুত লাগছিল। এমন মানুষ তো ও আগে দেখেনি।
মনোহর বলেছিল, “ভগবান তোমায় সৎবুদ্ধি দিন। এমন কাজ যেন তোমায় করতে না হয়। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্যও যদি কোনওদিন তোমায় অন্যকে মারতে হয়, তা হলে বন্দুকই ব্যবহার কোরো। এটা কুপিয়ে বা গলা টিপে মারার চেয়ে কম নৃশংস। বন্দুক চালাবার সময় মনে রাখবে তোমার থেকে মানুষটার দূরত্ব যেন এমন হয়, যাতে তার গায়ের রক্ত তোমার শরীর অবধি ছিটকে না আসে। কেমন?”
বাঁ দিকের সিটটা বড্ড কাছে। এখান থেকে গুলি করলে বাঁশির রক্ত ছিটকে এসে লাগবে জয়ের গায়ে। ওকে গাড়ির থেকে নামিয়ে মারতে হবে।
বাঁশি গান শুনে যাচ্ছে এখনও। বৃষ্টির শব্দও হয়ে চলেছে অবিরাম। দু’পায়ের মাঝে রাখা হিপ কেস থেকে খানিকটা হুইস্কি গলায় ঢালল জয়। ও জানে ড্রিঙ্ক করে গাড়ি চালানো উচিত নয়। কিন্তু আজ নার্ভ স্টেডি রাখতে গেলে ওকে এই আগ্নেয় তরলের সাহায্য নিতে হবে। কারণ খুন তো জীবনে আগে করেনি।
না, করেছে। সেই চোদ্দো বছর বয়সে একবার একটা হত্যা করেছিল বটে জয়। মামার বাড়ির পাশে টুলি বলে ওরই বয়সি একটা মেয়ে থাকত। রোগা, ফরসা, আর অদ্ভুত সুন্দর মুখের একটা মেয়ে। জয়ের খুব ভাল লাগত টুলিকে। ওর এই মামার বাড়ির কঠিন জীবনের ভিতর টুলিই ছিল ওর আনন্দ।
টুলির স্কুল যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকত জয়। ওর স্কুল থেকে ফেরার পথেও দাঁড়িয়ে থাকত। নানা ছুতোয় টুলিদের বাড়িতে যেত। টুলির ঠাকুরমার ফাইফরমাস খেটে দিত। ছাদের উপর রাখা টুলিদের পায়রার খোপগুলো পরিষ্কার করে দিত। টুলির সবচেয়ে প্রিয় লক্কা পায়রাটার জন্য এনে দিত লাল-নীল রিবন। ওদের গাছ থেকে সুপুরি পেড়ে দিত জয়। পুকুরে ঘটিবাটি ডুবে গেলে তা জলের গভীর থেকে তুলে এনে দিত। প্রয়োজনে কেরোসিন তেলও ধরে দিত। আর এসব কাজের ফাঁকে ও দেখত টুলিকে। ছাদের পাঁচিলে বসে চালতার আচার খাওয়া টুলি। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মাথা নিচু করে অঙ্ক করা টুলি। সরস্বতী পুজোয় বাসন্তী শাড়ি পরা টুলি। বৃষ্টির দিনে ভেজা ফ্রকের ভিতর থেকে বিপজ্জনক হয়ে ওঠা টুলি…
এই সব দৃশ্যের সামনে কতবার যে মরে গিয়েছে জয়। কত রাত যে একা ওর ছোট্ট তক্তপোশে শুয়ে কাটিয়েছে টুলিকে চিন্তা করে। কতবার যে ও মনে-মনে চুমু খেয়েছে টুলির ছোট্ট ঠোঁট দু’টোয়। কতবার যে কেঁদেছে একা-একা।
তারপর একদিন, এক দুর্গাপুজোর ভোরে, টুলিদের বাড়ির ছাদে টুলির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল জয়। সমস্ত দ্বিধা, ভয় আর লজ্জা কাটিয়ে ও টুলিকে বলেছিল, “টুলি, টুলি আমার খুব কষ্ট হয়। আমি তোমায়…”
“সমীদা, ওই সমীদা এসেছে!” টুলি জয়কে কথা শেষ না করতে দিয়েই ছাদের অন্যদিকে দৌড়ে গিয়েছিল।
সমীদা। টুলির দাদা রূপঙ্করের বন্ধু। লম্বা, কালো। টুলি সমীদাকে দেখে কী যে খুশি হয়েছিল! সারাটা পুজো টুলি সমীদার সঙ্গে ঘুরে বেড়াল সেবার। আর দূর থেকে জয় মরে গেল একদম।
বিজয়ার সন্ধেবেলা পাড়ার সবাই ঠাকুর নিয়ে ভাসানে গেলেও জয় গেল না। বরং সন্ধে একটু গাঢ় হলে ও গিয়েছিল টুলিদের বাড়ি। টুলিকে দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব। সারা বাড়ি ঘুরে টুলিকে কোথাও না পেয়ে ছাদে উঠে গিয়েছিল জয়। আর দেখেছিল, নিঝুম ছাদে পায়রার খোপের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো টুলির উপর ঝুঁকে আছে সমীদা। দু’জনেই যেন ছায়ার তৈরি। যেন দু’জনেই আর এই পৃথিবীতে নেই। জয় দেখেছিল, টুলি দু’হাত দিয়ে ধরে রেখেছে সমীদার পিঠ আর সমীদার হাত ধরে রেখেছে টুলির নরম শরীর। চুম্বনবদ্ধ দু’জনের মাঝে নিজেকে বড্ড ছোট আর বোকা মনে হয়েছিল জয়ের। মনে হয়েছিল, যেন চুরি করে ঢুকে পড়েছে অন্য কারও জীবনে।
অসহায়তাই কখনও-কখনও রাগের জন্ম দেয়। সারারাত শরীরে লাভা ফুটছিল জয়ের, মনে হচ্ছিল টুলি ভীষণ অন্যায় করেছে। ওর শাস্তি পাওয়া দরকার। জয়ের ভালবাসাকে গুরুত্ব না-দেওয়ার শাস্তি।
ভোর থাকতে-থাকতে টুলিদের বাড়ি চলে গিয়েছিল জয়। টুলিদের পিছনের ভাঙা পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে নিঃশব্দে উঠে গিয়েছিল ওদের ছাদে। পায়রার খোপের থেকে হাত ঢুকিয়ে বের করে এনেছিল টুলির প্রিয় লক্কা পায়রাটাকে। তখনও পাখিটার গলায় জয়ের এনে দেওয়া লাল রিবন বাঁধা ছিল। পাখিটা একটুও ছটফট করেনি। ও তো চিনত জয়কে। জয় পাখিটাকে মাটিতে রেখে আলতো করে দু’টো হাত দিয়ে ধরেছিল গলাটা। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল গত সন্ধেবেলাটা। দু’টো শঙ্খলাগা ছায়া। বিদ্যুৎ বয়ে গিয়েছিল জয়ের শরীর দিয়ে। ও চোখ বন্ধ করে নিমেষে মুচড়ে ছিঁড়ে এনেছিল টুলির প্রিয় লক্কার গলাটা। গরম রক্ত ছিটকে লেগেছিল ওর মুখে, শরীরে। তখন ওর জীবনে কোনও মনোহর ছিল না যে ওকে বলে দেবে, দূর থেকে, হত্যা করতে হয় দূর থেকে।
তবে সে-হত্যার থেকেও আজকের হত্যা অনেক গম্ভীর। সেদিন সমীদাকে মারতে চায়নি জয়; কিন্তু আজ বাঁশিকে মারতে চায়। তাই সমস্ত রকম সতর্কতা নিয়ে ও এসেছে। জয় জানে, সতর্কতা যে-কোনও পদ্ধতির অঙ্গ। আর খুন একটা পদ্ধতি। একটা বিজ্ঞান। নির্দিষ্ট কিছু ধাপ পরপর ঠিকমতো না সাজালে খুন প্রক্রিয়াটিকে পূর্ণরূপ দেওয়া যায় না। বিশেষ করে এমন একটা খুন।
সেদিন গাড়ির ভিতরে বসে বলাইয়ের ফোনটা কেটে ঝুম হয়ে বসেছিল জয়। একই সঙ্গে এমন দু’টো খবর! তিরিশ লাখ টাকা উধাও। আর বাঁশি কন্ডোম কিনছে। পরের দিনই না কেয়ার সঙ্গে বাঁশির কোথায় যেন যাওয়ার কথা আছে? কোথায় যাবে ওরা? কোনও রিসর্টে? কোনও হোটেল-রুম ভাড়া নেবে? জয়ের সারা শরীরে পেট্রোল ভরে কেউ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, বাঁশির মাথাটাও সেই পায়রার মতো ছিঁড়ে নেয়। এত বড় সাহস কেয়ার সঙ্গে শোবে জানোয়ারটা! এর ফল ভোগ করতে হবে বাঁশিকে। নিমেষে কর্তব্য স্থির করে নিয়েছিল জয়। ঠিক করে নিয়েছিল, বাঁশির চরম শাস্তি।
আবার বেজে উঠেছিল ফোন। বলাই। ও বলেছিল, “আরে কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোন কেটে দিলে কেন? শোনো, টাকাটার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে মনে হচ্ছে…”
“মানে? কী বন্দোবস্ত?”
“কেন, আমরাও তো ফিল্ডিং লাগিয়েছি। ওটা নিয়ে চিন্তা কোরো না। বরং ওই বাঁশির ব্যাপারটা…”
“কিচ্ছু করতে হবে না। যা করার আমি করব।” জয় গম্ভীর গলায় বলেছিল।
“তুমি?” অবাক হয়েছিল বলাই, “তুমি কেন ফালতু ঝামেলায় জড়াবে?”
“এটা আমাকেই করতে হবে বলাই। এই নিয়ে অন্য কাউকে ভাবার দরকার নেই।”
“ঠিক আছে,” বলাই যেন নিরাশ হয়েছিল একটু, তারপর বলেছিল, “তবে সন্দেহের বশে হুট করে কিছু কোরো না। খোঁজখবর নিয়ে নাও আর একটু।”
হুঁঃ, খোঁজখবর! আর তার আগেই বাঁশি বিছানায় নামিয়ে ফেলুক কেয়াকে। বলাইকে আর কিছু না বলে ফোন কেটে দিয়েছিল জয়। ভেবেছিল, টাকাটা নিয়ে যখন ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলাই বলেছে, তখন আর তা নিয়ে অসুস্থ সুতনুকে বিব্রত করবে না। আর বাঁশির ব্যাপারটা নিয়ে আজকেই একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলবে ও।
সেই মতো সব সাজিয়েছে জয়। মিটিং থেকে ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে প্রথমেই ঘুমন্ত কেয়ার পাশ থেকে আলতো করে ওর মোবাইলটা নিয়ে তার ভিতরের সিমকার্ডটা খুলে ভেঙে ফেলেছে। যাতে বাঁশি কোনওরকম যোগাযোগ না করতে পারে কেয়ার সঙ্গে। এর পর নিজের বন্দুকটা বের করে ভাল করে পরিষ্কার করে, গুলি ভরে, ছোট্ট ব্যাগে ভরে নিয়েছে। তারপর অপেক্ষা করেছে। বাঁশিকে জালে তোলার সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছে।
বাঁশির ফোন নম্বর আগের থেকেই ছিল জয়ের কাছে। জয় ঠিক রাত ন’টা নাগাদ একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে ফোন করেছিল বাঁশিকে। জয় সাধারণত ফোন করে না। তাই জয়ের ফোন পেয়ে খুবই আশ্চর্য হয়েছিল বাঁশি। অন্তত বাঁশির গলা শুনে তো তাই মনে হয়েছিল।
বাঁশি জিজ্ঞেস করেছিল, “হ্যালো, জয়দা, হঠাৎ আপনি?”
জয় নিখুঁত অভিনয় করেছিল, “আরে, একটা বিপদ হয়েছে। কেয়ার ছোট্ট অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই খুব বিপদে পড়ে তোমায় ফোন করলাম ভাই।”
“অ্যাক্সিডেন্ট? কীভাবে?” ফোনের ওপাশ থেকে চিৎকার করে উঠেছিল বাঁশি।
“আরে, ডিটেল তো জানি না। আমি বাইরে আছি। তুমি কোথায় আছ?”
“আমি তো এয়ারপোর্টের কাছে আছি। এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছি।” বাঁশির গলাটা বিভ্রান্ত শোনাচ্ছিল।
“এয়ারপোর্ট!” এক মুহূর্ত সময় নিয়েছিল জয়। এত দূর! ওকে তা হলে এই ভারী বৃষ্টির ভিতরে অতটা ঠ্যাঙাতে হবে? কিন্তু এখন তো আর পিছিয়ে আসা যাবে না। জয় বলেছিল, “আমি কাছেই আছি, মধ্যমগ্রামে। সঙ্গে গাড়ি আছে। আমি আসছি। তুমি একটু যাবে ভাই আমার সঙ্গে?”
“নিশ্চয়ই! এ আবার বলতে? আমি এক নম্বরের সামনে গিয়ে দাঁড়াব। জয়দা, আপনি ওখান থেকে আমায় পিক-আপ করে নেবেন, কেমন? বাই দ্য ওয়ে কী হয়েছে? কোন নার্সিংহোমে ভর্তি আছে?”
জয়, যেন তাড়া আছে, এমন গলায় বলেছিল, “নার্সিংহোমে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় ভর্তি হবে জানি না। পড়ে গিয়ে মাথায় লেগেছে। জ্ঞান নেই। শোনো, এর বেশি ঠিক জানি না। আমি আসছি, তুমি একটু কষ্ট করে এক নম্বরে এসে দাঁড়াও।”
ফোনটা কেটে এবার বলাইকে ধরেছিল জয়, “কী খবর ওখানের? টাকা কত দূর?”
বলাই চাপা গলায় বলেছিল, “কাজ চলছে, শেষ হলে জানাব। টেনশন নিয়ো না।”
দোকান থেকে বেরিয়ে গলায় হুইস্কি ঢেলেছিল জয়। টেনশন হচ্ছিল খুব। নার্ভটা শক্ত রাখা দরকার। ও জানত যে, বাঁশি কেয়াকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু মোবাইলে পাবে না। তা ছাড়া বাড়িতে ল্যান্ডলাইন নেই জয়ের। তাই ও নিশ্চিত ছিল যে কেয়াকে আর যোগাযোগ করতে পারবে না বাঁশি।
“আপনি এমন ড্রিঙ্ক করবেন না।”
হুইস্কিতে চুমুক দিতে গিয়েও থমকে গেল জয়। বাঁশি কান থেকে ইয়ার ফোন খুলে ওর দিকে তাকিয়ে বলল কথাটা।
“কেন?”
“এমন খারাপ ওয়েদার। রাস্তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তাই বললাম আর কী। জানি দিদির জন্য আপনার টেনশন হচ্ছে। তবু ড্রিঙ্ক না করাই ভাল। আচ্ছা, দিদির ফোনটা নট রিচেব্ল বলছে কেন?”
জয় বলল, “আমি কেমন করে বলব? চলো, তারপর দেখা যাবে।”
কাজি নজরুল ইসলাম সরণি থেকে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে গাড়িটা রাজারহাট নিউটাউনের দিকে নিয়ে নিল জয়। এটা ওর পছন্দের জায়গা। অন্ধকার, নির্জন। বাঁশিকে এখানেই কোনও মাঠে শুইয়ে দেবে।
নিউটাউনের রাস্তায় গাড়ি ছোটাল জয়। বৃষ্টিটা যেন বাড়ছে খুব। ডান দিকের দরজা আর সিটের মাঝে গোঁজা রয়েছে ছোট্ট ব্যাগটা। ওর ভিতর রয়েছে বন্দুক।
অতি বৃষ্টিতেই কিনা কে জানে, রাস্তাঘাট শুনশান। সব ক’টা স্ট্রিটলাইটও জ্বলছে না। তবু জোরে গাড়ি ছোটাল জয়।
“জয়দা একটু আস্তে,” বাঁশির গলায় ভয়, “একটু আস্তে চালান। জানি, দিদির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কিন্তু এভাবে চালালে তো…”
“চোপ শুয়োরের বাচ্চা!” হিসহিসে গলায় বলল জয়, “দিদি? আমার সামনে দিদি আর পিছনে…”
“কী বলছেন জয়দা?” বাঁশি ঘাবড়ে গেল খুব।
“ন্যাকা না শালা? হারামিপনা হচ্ছে? আজ শুয়োরের বাচ্চা তোকে আমি…” রাগের বোমটা দুম করে ফাটল জয়ের মাথায়। ও পাশের ব্যাগটার চেন ধরে টান মেরে সেটা খুলতে গিয়ে ফসকাল আর ঠক করে ব্যাগটা গিয়ে পড়ল ওর পায়ের কাছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে নিচু হয়ে ব্যাগটা তুলতে গেল জয় আর তখনই বাঁশির আর্তনাদ শুনল, “জয়দা!” বাঁশির হাতটা ও অনুভব করল স্টিয়ারিংয়ের উপর নিজের হাতের পাশে। মাথা তুলে রাস্তা দেখতে গিয়ে ব্রেকের বদলে অ্যাক্সিলারেটরে পা পড়ে গেল জয়ের। গাড়িটা বোঁ করে ঘুরল, তারপর একই লেনে উলটো দিক দিয়ে আসা একটা ছোট্ট গাড়িতে কোনাকুনি গিয়ে ধাক্কা মারল জোরে।
ছাদটা আজও নিঝুম। আজও দু’টো ছায়া চুম্বনবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে। পাতলা একফালি চাঁদ দ্বিধা নিয়ে মুখ বাড়িয়েছে আকাশের কোণ থেকে। ছায়া দু’টো কিছুতেই ছাড়ছে না একে অপরকে। জয় চিৎকার করে উঠল, “টুলি, আমায় ছেড়ে যাস না টুলি! টুলি তুই…” জয় দেখল ছায়ার জোট ভেঙে একটি মেয়ে এগিয়ে এল ওর দিকে। ছায়া সরে গিয়েছে তার মুখের উপর থেকে। জয় দেখল, কোথায় টুলি? এ তো কেয়া!
অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার আগে জয় বুঝল, আর কোনওদিন কেয়াকে দেখতে পাবে না ও।
বিষাণ, ২৯ জুন: রাত
বহুদিন পর স্কুটার চালাচ্ছে বিষাণ। হাত একটু কাঁপছিল প্রথমে, কিন্তু এখন স্টেডি হয়ে গিয়েছে। শুধু একটাই চাপ যে সঙ্গে লাইসেন্স নেই। অবশ্য এত বৃষ্টিতে কী-ই বা হবে? পুলিশদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই এমন ওয়েদারে রাস্তায় বেরিয়ে লোকের লাইসেন্স চেক করবে।
তবে এভাবে স্কুটার নিয়ে আসতে ইচ্ছে ছিল না বিষাণের। কেন অন্যের গাড়ি নিয়ে আসবে? যদি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যায়? তখন তার ড্যামেজ চার্জ কে দেবে? একেই তো এই চাকরিটা গেল। ভবিষ্যতে কী হবে, কে চাকরি দেবে ওকে, কে জানে!
বৃষ্টিটা ঝেঁপে এসেছে। রেনকোট ভেদ করে জলের ছুঁচ গায়ে ফুটছে ওর। রাজারহাটের ভিতর থেকে বেরিয়ে নিউটাউন অবধি আসতে-আসতে রেনকোট থাকা সত্ত্বেও একদম ভিজে গিয়েছে বিষাণ। মেজাজ খারাপ হয়ে আছে খুব। শালা, আজ কার মুখ দেখে যে ঘুম ভেঙেছিল। মায়ের ফোন পেয়ে যে কী অস্বস্তিতে পড়েছিল ও! বরানগর যেতেই হবে বলে অজু গাঁইগুঁই করছিল। কিন্তু বিষাণ শোনেনি। দোয়েল চন্দ্রকে পুলিশে দেবে? শেষ পর্যন্ত থানাপুলিশ হবে নাকি? আর আজকাল গৃহবধূ নির্যাতনের কেসগুলো খুব জটিল হয়। পুলিশে ধরলে একদম বাঁশ হয়ে যায়।
বাড়ির দরজার কাছে মা দাঁড়িয়েছিল। ফরসা মানুষটার মুখ লাল হয়েছিল টেনশনে। চন্দ্র ছোট থেকেই মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার আর মারপিট করে রাস্তার ঝামেলা ঘরে টেনে আনতে ওস্তাদ। বাবা বেঁচে থাকলেও এসব ঝঞ্ঝাট বারবার সামলেছে মা। বিষাণের মনে হয় চন্দ্রর এমন হওয়ার পিছনে মায়ের প্রশ্রয়ও কিছুটা দায়ী। তবে বুড়ো বয়সে মায়ের এই অশান্তি পোহানোর কোনও মানে নেই।
বিষাণকে দেখেই মা কাঁদতে শুরু করেছিল। বিষাণ দু’হাতে মায়ের দু’টো হাত ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে মা? কী করে এসব হল?”
মায়ের চোখ দিয়ে দরদর করে জল বেরচ্ছিল। তার ভিতরেও মা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলেছিল, “চন্দ্রটা আর মানুষ নেই। একদম জানোয়ার হয়ে গিয়েছে।”
“কেন? আমি যখন বেরলাম তখন তো ঠিকই ছিল সব। তা হলে?” বিষাণের অবাক লাগছিল খুব। অবশ্য এ বাড়িতে চন্দ্রর কৃপায় আবহাওয়া বদলাতে সময় লাগে না।
ও মাথা ঠান্ডা রেখে মাটিতে হাঁটু গেড়ে মায়ের কাছে বসে বলেছিল, “মা, ঠিক করে শুধু ঘটনাটা বলো। অন্যগুলো বাদ দাও। কারণ তুমি তাড়াতাড়ি না বললে আমি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারব না। তাই সংক্ষেপে গুছিয়ে বলো।”
মা অবস্থাটা বুঝেছিল এবার। তারপর যতটা সম্ভব নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলেছিল, “সকালে ডিমের অমলেট দিয়ে পাঁউরুটি খেতে চেয়েছিল চন্দ্র। আমার হাতজোড়া ছিল, মানে ওই অনেকদিনের খবর কাগজ জমে গিয়েছিল তো, ওগুলো গুছিয়ে রাখছিলাম। তাই…”
“আঃ, তারপর?” বিষাণ বিরক্ত হয়েছিল।
“ও,” মা আঁচল দিয়ে চোখটা আবার মুছেছিল, “দোয়েল পাঁউরুটি সেঁকে, ডিমের ওমলেট করেছিল। কিন্তু নুন কম দিয়েছিল আর লঙ্কা-পেঁয়াজটা বেশি। তাই…”
“মানে? নুন কম, লঙ্কা-পেঁয়াজ বেশি। এর মানে?” বিষাণ অবাক হয়েছিল।
“চন্দ্রর সেটাতেই তো রাগটা হয়েছিল,” মা আবার কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিষাণের অবাক আর বিরক্তি একই সঙ্গে এসেছিল, “লঙ্কা-পেঁয়াজ বেশি, নুন কম তাতেই মাথা ফাটিয়েছে? এমন ছেলের গালে দু’টো থাপ্পড় বসাতে পারোনি? এ তো জানোয়ারেরও অধম!”
“না, মানে,” মা ইতস্তত গলায় বলেছিল, “সারা সপ্তাহ খাটাখাটনি করে তো। রোববারও যদি ঠিক মতো ব্রেকফাস্ট না করতে পারে…”
“তা বলে মাথা ফাটিয়ে দেবে?” এ কেমন যুক্তি ঠিক বুঝতে পারছিল না বিষাণ।
“না, মানে…” মা চন্দ্রর স্বপক্ষে কী বলবে যেন বুঝতে পারছিল না।
‘তাও তো বউদি তোকে বলেনি, মারামারি আটকাতে গেলে চন্দ্র কেমন করে বৌদিকে মেরেছে,” কপিল ফুট কেটেছিল মাঝখানে।
“কী?” বিষাণ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। চন্দ্র মাকেও মেরেছে? আর সেটা মা এতক্ষণ বলেনি! এত পুত্রস্নেহ! ধৃতরাষ্ট্রের ফিমেল এডিশন!
বিষাণ এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি আর। ছিটকে ঢুকেছিল চন্দ্রর ঘরে। একটা হেস্তনেস্ত করা খুব দরকার। বিষাণ মন শক্ত করে চন্দ্রর ঘরে ঢুকেও হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এ কী দেখছে ও? এ কোন চন্দ্র?
চন্দ্র বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। চুল এলোমেলো। মুখটা মাথার বালিশে গোঁজা। পিঠটা কেঁপে-কেঁপে উঠছে। একটা চাপা শব্দের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বিষাণ অবাক হয়ে দেখেছিল চন্দ্র কাঁদছে। আর অস্ফুটে গোঙানির মতো শব্দে বলছে, “মা…মা…”
মাথায় রক্ত-পড়া অবস্থা নিয়ে মেয়েটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছে। মা বারণ করলেও শোনেনি। বলেছে চন্দ্রকে জেলের হাওয়া খাইয়ে ছাড়বে। বিষাণ দুপুরবেলা পৌঁছেছিল দোয়েলের বাড়ি। বাস পালটে, অটো ধরে যখন দোয়েলের বাপের বাড়ি পৌঁছেছিল, বিষাণের শরীরের গোটাটাই ভিজে গিয়েছিল।
বিষাণের টেনশন হচ্ছিল খুব। এ বাড়িতে দোয়েলের বাবা-মা আর দাদা-বউদি থাকে। সবাই খুব ভদ্রমানুষ। কিন্তু মেয়ের এমন অবস্থা হয়েছে দেখলে তারা কীভাবে রি-অ্যাক্ট করবে ভগবান জানে। অবশ্য তাদেরও তো দোষ দেওয়া যায় না। সত্যিই খুব অন্যায় করেছে চন্দ্র। আর দোয়েল যতই চলে আসতে চাক মায়েরও ওকে এ অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরতে দেওয়া উচিত হয়নি। বিষাণের খুব খারাপ লাগছিল। সারা জীবন ওকেই এই সমস্ত অস্বস্তিকর ঘটনার সামনে পড়তে হয়। নোংরা করবে চন্দ্র আর পরিষ্কার করবে বিষাণ। দোয়েলদের কলিংবেলে হাত দিতে পর্যন্ত লজ্জা লাগছিল বিষাণের। ভয়ও লাগছিল। কোন মুখে দাঁড়াবে ও দোয়েলদের বাড়ির লোকের সামনে? কী বলবে দোয়েলকে? যে, এখন চন্দ্রর অনুতাপ হচ্ছে? এখন চন্দ্র ক্লাস ওয়ানের বাচ্চার মতো কাঁদছে? কাঁদলে, অনুতাপ করলেই কি সব দোষ স্খালন হয়ে যায়? সব খারাপ কাজ মাফ হয়ে যায়? দোয়েলকে কী বলবে বিষাণ? কোন অজুহাত দেবে?
দরজা খুলেছিল দোয়েলের বউদি। তারপর বিষাণের দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বলেছিল, “তুমি খবর পেলে কী করে? দোয়েল তো বলল কাউকে জানায়নি?”
“মানে?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল বিষাণ। বলে কি মহিলা? কী জানায়নি? দোয়েল কী বলেছিল? বিষাণ উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল, “বউদি কোথায়?”
“দোয়েল? নিজের ঘরে। রেস্ট নিচ্ছে।”
“কে গো বউদি?” বিষাণ দোয়েলের গলা শুনেছিল পিছনে।
“এই বিষাণ এসেছে। একদম ভিজে গিয়েছে ছেলেটা।”
“বিষাণ!” দোয়েল যেন চমকে উঠেছিল। তারপর দ্রুত পায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল বিষাণের সামনে। খুব অবাক গলায় বলেছিল, “আরে, তুমি খবর পেলে কী করে যে আমার রাস্তায় একটা দোকানের চালায় লেগে মাথা ফেটে গিয়েছে? দ্যাখো তো, কিচ্ছু হয়নি, আর তখন থেকে বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে।”
“না, অস্থির হবে না,” দোয়েলের বউদি কিচিরমিচির করে উঠেছিল, “চন্দ্র যদি শোনে বাপের বাড়ি আসার পথে এমন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, আর কোনওদিন এভাবে তোকে এখানে একা আসতে দেবে? তুই এমন ছেলেমানুষের মতো কথা বলিস না মাঝে-মাঝে!”
বিষাণ কিছু বুঝতে পারছিল না কোন নাটকের অভিনয় চলছে সামনে। ও একবার দোয়েলকে দেখছিল আর একবার দোয়েলের বউদিকে দেখছিল। এক অদ্ভুত পিংপঙের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিষাণ।
বউদি বলেছিল, “তা বিষাণ তুমি খবর পেলে কী করে যে দোয়েলের মাথায় চোট লেগেছে?”
বিষাণ কিছু বলার আগেই দোয়েল বলেছিল, “আরে, ওকে আমিই তো ফোন করেছিলাম। এয়ারপোর্টের কাছে এসেছিল। বলল, আমায় দেখে যাবে।”
“তাই বলো!” বউদি হাঁপ ছেড়েছিল। তারপর বিষাণকে বলেছিল, “তা যেমন ভিজে এসেছ, জ্বর এসে যাবে। যাও স্নান করে নাও, দু’টো ভাত খাবে।”
বউদির গলা শুনে দোয়েলের পিছনে বাড়ির অন্যান্যরাও বেরিয়ে এসেছিল। সবাই বিষাণের কর্তব্যজ্ঞান দেখে ও চন্দ্র, দোয়েলের মাথা ফেটে গিয়েছে বলে ব্যাকুল হয়ে পড়বে জেনে খুশি মনে ঘরে চলে গিয়েছিল। শুধু বিষাণ খুশি হতে পারছিল না।
স্নান সেরে খেতে বসার আগে দোয়েলকে ঘরে একা পেয়েছিল বিষাণ। মাথায় ব্যান্ডেজ করা দোয়েলকে নিস্তেজ লাগছিল খুব। মুখচোখে ক্লান্তি আর কষ্ট এক সঙ্গে ফুটে বেরচ্ছিল। বিষাণ জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি তো জেল, পুলিশ অনেক কথা বলে এসেছিলে। তা হলে এসব কেন? দাদা সত্যিই অন্যায় করেছে। শাস্তি তো পাওয়াই উচিত।”
হেসেছিল দোয়েল, “বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে বিষাণ। দাদা-বউদির কোনও সন্তান হল না, সেই চিন্তায় দু’জনেই কষ্টে আছে। তার উপর যদি জানে আমারও এমন অবস্থা, তা হলে? তোমার দাদা কেন এমন করে জানি না। হয়তো আমায় পছন্দ নয়। হয়তো ভিতরে চাপা কোনও দুঃখ আছে। মানুষকে কি চট করে খারাপ বলে বাতিল করা উচিত? আমার মাথা ফাটেনি, একটু গভীর করে কেটেছে। কাল রেগে গিয়ে পুলিশ-টুলিশ বলেছিলাম। তারপর পথে আসতে-আসতে ভাবলাম, “কী হবে রাগটা বয়ে বেড়িয়ে? এত তুচ্ছ কারণে আমি সবাইকে কষ্ট দেব? শুধু নিজের জন্য বাবা-মা’র চিন্তা আরও বাড়িয়ে দেব?”
“কিন্তু তা বলে অন্যায় সহ্য করবে?”
“এটা অন্যায় সহ্য করা হলে, তাই। কিন্তু কী করব, আমার যে এমনটাই করতে ইচ্ছে করছে। তোমার দাদা যেমনই হোক, তাকে তো ভালবাসি আমি। ক্ষণিকের একটা ঘটনা সম্পর্কটাকে মিথ্যে করে দেবে? এই যে আমি এলাম আর তুমি খোঁজ নিতে এলে, সেটা কিছু না? তোমরা আমায় যে ভালবাস, বুঝি না? জীবনে অসঙ্গতি থাকবেই। কিন্তু যদি ভুলচুকগুলো ছোটবেলার মতো ইরেজ়ার দিয়ে মুছে নেওয়া যায়, দেখবে মোটের ওপর জীবনটা ভালই। একটা রাগের মুহূর্ত দিয়ে গোটা মানুষকে বিচার না করাই ভাল।”
স্কুটারটা পুরনো। বেশি স্পিডও তোলা যাচ্ছে না। লম্বাচওড়া বিষাণের শরীরটা দোয়েলের বেঁটেখাটো দাদার ওয়াটার প্রুফ পুরোটা ঢাকেইনি।
আসলে এই দুর্যোগে বিষাণকে আর আসতে দিতে চায়নি দোয়েল। কিন্তু বিষাণই জোর করেছে। তার আগে অবশ্য মাকে ফোন করে চিন্তার কিছু নেই তা জানিয়েও দিয়েছে। সন্ধেবেলা তো দোয়েল ফোনে কথাও বলেছে চন্দ্রর সঙ্গে। দেখলে কে বলবে সকালে এমন হাঙ্গামা হয়েছে? দোয়েল ভাল বলে অল্পের উপর দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছে। তেমন কঠিন মেয়ের পাল্লায় পড়লে চন্দ্রকে মজা দেখাত। বিষাণ নিজে মনে-মনে একটু হতাশই হয়েছে যেন। যতই কাঁদুক, চন্দ্রর একটু শাস্তি হওয়া উচিত ছিল।
রাস্তাটা একদম নির্জন। রাতে না খাইয়ে ছাড়েনি দোয়েলরা, তাই দেরি হল বেরতে। অবশ্য বৃষ্টির ফ্যাক্টরটা বাদ দিলে দেরিটা তেমন কিছু নয়। নির্জনতা খুব একটা খারাপ লাগছে না বিষাণের। আর এমন নির্জন, একা অবস্থায় হঠাৎ ওর কুমুর কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটা টিউশনির জন্য যেখানে যেতে বলেছিল, আর যাওয়া হল না। আরও রেগে যাবে কুমু। সত্যি কুমুর কাছে একের পর এক দোষ করে যাচ্ছে ও। কিন্তু কী করবে? অবস্থা এমন তৈরি হচ্ছে যে উপায়ও তো থাকছে না। সেই যে কুমু ওর উপর রাগ করে মুখ দেখবে না বলেছিল, তাতেই বা কী করার ছিল বিষাণের?
আনন্দী আন্টির বাড়িতে আর-একটা পার্টি ছিল সেদিন। যথারীতি লাবানা বেশি ড্রিঙ্ক করে উলটোপালটা বকতে শুরু করেছিল। সবাই বারণ করেছিল আর ড্রিঙ্ক করতে। কিন্তু লাবানা শুনছিল না। আরও মদ খাচ্ছিল। একসময় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। এক কোনায় দাঁড়ানো বিষাণকে কোনওমতে বলেছিল, “বাথরুম।”
বিষাণ প্রায় কোলে করে বাথরুম নিয়ে গিয়েছিল লাবানাকে। বিষাণের জামা ধরে বমি করেছিল লাবানা। বমির পর সারা শরীরের ভার লাবানা ছেড়ে দিয়েছিল বিষাণের উপর। লাবানার ঘাড়ে-মুখে জল দিয়ে বিষাণ ওকে ধরে-ধরে এনে বসিয়েছিল ছোট একটা ঘরে। তারপর বিশ্রাম নিতে বলে চলে আসতে গিয়েছিল আর তখনই একদম আচমকা বিষাণকে এক হ্যাঁচকায় নিজের কাছে টেনে এনে ঠোঁট কামড়ে চুমু খেয়েছিল লাবানা। সেই ভেজা স্বাদ। অ্যালকোহলের গন্ধ। জিভ। দাঁত। ভাল লাগছিল না বিষাণের। জামার উপর দিয়ে লাবানার নখ গেঁথে বসছিল ওর শরীরে। বিষাণের মাথাটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মুহূর্ত পুরো পাথর হয়ে গিয়েছিল ও।
সংবিৎ ফিরতেই নিজেকে লাবানার থেকে উপড়ে নিয়ে এসে দেখেছিল দরজায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে কুমুদ্বতী।
লাবানা কেন এমন করেছিল বিষাণ জানে না। সেদিনের পর লাবানা এ নিয়ে মুখ খোলেনি কখনও। এমন ভাব করেছিল যেন কিচ্ছু হয়নি। আর কুমু তারপর কোনও কারণ ছাড়াই ওকে অপমান করেছিল। মুখদর্শন পর্যন্ত করতে চায়নি। বলেছিল, “অপদার্থ একটা। আর কোনওদিন আমায় তোমার মুখ দেখাবে না। আর কোনওদিন আসবে না আমার সামনে।”
বিষাণ ভেবেছিল জিজ্ঞেস করে, আমায় তো তুমি ফিরিয়েই দিয়েছ কুমু। তা হলে? এত রাগ কেন অন্য মেয়ে আমায় ধরলে? বাতিল জিনিসের উপর কীসের জন্য তুমি অভিমান করো?
বিষাণ বোঝে, সবার ভিতর একটা কপিল থাকে। এক লক্ষ প্রশ্ন থাকে। বোঝে পৃথিবীতে উত্তরের চেয়ে প্রশ্ন বরাবরই বেশি।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল বিষাণ। কিন্তু আচমকাই প্রায় মাটি ফুঁড়ে একজন সামনে এসে পড়ায় তড়িঘড়ি ব্রেক কষল ও। রাজারহাট নিউ টাউনের এই রাস্তাটায় আজ পরপর বেশ কিছু স্ট্রিটলাইট অকেজো হয়ে আছে। দু’টো লেনের একটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে রাস্তার কাজের জন্য। অন্যটা দিয়েই যাচ্ছিল বিষাণ। তা ছাড়া পুরনো স্কুটারটার হেড লাইটও ঠিক মতো আলো দিচ্ছে না। জন্ডিসের রুগির মতো ম্যাটমেটে হলুদ রং নিয়ে চেয়ে আছে শুধু। তাই ছায়ামূর্তিটাকে ঠিক আগে দেখতে পায়নি।
লোকটা লম্বা। কালো। অন্ধকারে মুখটা স্পষ্ট না দেখা গেলেও বিষাণ বুঝল লোকটা টলছে ভীষণভাবে। মাতাল নাকি? কিন্তু এমন বৃষ্টিতে কোনও মাতাল আসবে কী করে?
বিষাণ স্কুটার থেকে নেমে এগিয়ে গেল। আরে, একী! আঁতকে উঠল বিষাণ। লোকটার গায়ে রক্ত? ভাল করে দেখল বিষাণ। সর্বনাশ। এ যে ভয়ংকর কাণ্ড! অ্যাক্সিডেন্ট!
বিষাণ লোকটাকে ধরল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে আপনার?”
“গাড়িতে দাদা…দাদা…প্লিজ়…হেল্প…” লোকটার কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে। অসীম মনের জোর বলে তাও বলছে।
বিষাণ দেখল দু’টো গাড়ি উলটে আছে একটু দূরে। ছোট গাড়িটার তো একটা দিক বলে কিছু নেই। আর এ লোকটা যে গাড়িটা দেখাচ্ছে সেটারও একটা দিকের অবস্থা শোচনীয়। দু’টো গাড়ি মিলিয়ে ক’জন আছে? বেঁচেই বা আছে ক’জন? এলোমেলো পা ফেলে এগোনো লোকটার পিছনে গিয়ে গাড়ির ভিতরে ঝুঁকল বিষাণ। ড্রাইভারের সিটে বসা মানুষটার অর্ধেক শরীর রাস্তায়, অর্ধেক ভেতরে। আবছা আলোয় দেখল মাথাটা ফেটেছে। রক্ত বেরচ্ছে। লোকটা বলল, “বের করতে…সাহায্য…বেঁচে আছে…বেঁচে…”
বিষাণ নিচু হয়ে লোকটাকে টেনে বের করল গাড়ি থেকে। আর তখনই চিনতে পারল। আরে জয়দা!
“জয়দা!” বিষাণ ডাকল।
উত্তর নেই।
“আপনি…আপনি চেনেন?” লোকটা হাঁপাচ্ছে বেশ।
“অন্য গাড়ির কাউকে চেক করেছেন?”
“আমি…জানি না…জয়দাকে বাঁচাতে হবে…কেয়াদি…কেয়াদি…”
বিষাণ নিমেষে ঠিক করে নিল কী করবে। কোনও গাড়ি গেলে আগে সেটাকে থামিয়ে জয়দা আর এই লোকটিকে হাসপাতালে পাঠাবে আর তারপর ফোনে আনন্দী আন্টিকে যোগাযোগ করে হেল্প নেবে। আনন্দী আন্টির কানেকশন খুব ভাল। তবে আগে যে-কোনও গাড়ি দরকার। কিন্তু রাস্তায় গাড়ি কই? বিষাণ দ্রুত আনন্দী আন্টিকে ফোন করে সব ঘটনা সংক্ষেপে বলল। আনন্দী বলল যে পুলিশকে খবর দিচ্ছে। ফোনটা রেখেই দূরে একটা গাড়ির হেড লাইট দেখল বিষাণ। যাক! কিন্তু অন্য গাড়িটা? ওটাকেও তো দেখা কর্তব্য।
“আপনি ওই গাড়িটাকে আটকান। আমি এ দিকটা দেখছি।” বিষাণ জখম লোকটাকে সামনে থেকে ধেয়ে আসা গাড়িটা দেখিয়ে বলল, তারপর নিজে দৌড়ল অন্য গাড়িটার দিকে।
অন্ধকারে ঠাহর করা যাচ্ছে না স্পষ্ট করে। ছোট গাড়ির ভিতরটা কেমন যেন মণ্ড পাকিয়ে আছে। সামনের সিটে স্টিয়ারিংয়ের সঙ্গে মানুষটা জড়িয়ে রয়েছে। পিছনের দিকেও মনে হচ্ছে তিনজন। হ্যাঁ, তিনজনই তো। ভাল করে দেখল বিষাণ, কেউ কি বেঁচে আছে?
“শুনছেন? শুনছেন?” বিষাণ ডাকল।
ওদিকে গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে। তার হেডলাইটের আলোয় চারিদিক এখন কিছুটা স্পষ্ট। ছোট গাড়ির ভিতরটা দেখল বিষাণ। একজন কি নড়ছে? ওই পিছনের সিটের মধ্যিখানের মানুষটি? যে গাড়ির পিছনের ফাঁক দিয়ে অর্ধেক বেরিয়ে রয়েছে রাস্তায়?
পেছনের ভাঙা উইন্ডশিল্ড দিয়ে লোকটাকে পুরোটা টেনে বের করল বিষাণ। মুখের একটা দিক ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে। চোখটাও ফোলা। ঠোঁট ঝুলে পড়েছে। তবু মানুষটা নড়ছে। হাত তুলে কিছু বলতে চাইছে।
ওদিকে দাঁড় করানো গাড়ির চালক আর জখম লোকটা মিলে জয়দাকে তুলছে গাড়িতে। এ লোকটাকেও নিতে হবে। তার আগে লোকটা কী বলতে চাইছে সেটা শুনতে হবে একবার। অন্তত শোনার চেষ্টা করতে হবে।
লোকটার মুখটা এমন হয়ে আছে যে, চেনার উপায় নেই। তবু নড়তে থাকা ঠোঁটের কাছে কানটা নিয়ে গেল বিষাণ। শুনল লোকটা বলছে, “টাকা…হলুদ ব্যাগ…টাকাটা গাড়ির ভিতরে…বের করে…নিন। …লেক গার্ডেন্স….”
টাকার ব্যাগ? বিষাণ গাড়ির ভিতর দেখল। ওই তো পায়ের কাছে। হলুদ রঙেরই তো মনে হচ্ছে। বিষাণ ব্যাগটা বের করল। রক্ত লেগে একটা দিক চ্যাটচ্যাট করছে।
“আপনার ব্যাগ এটা?” বিষাণ নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করল।
লোকটার ঠোঁট নড়ছে আবার। গাড়ির ড্রাইভার আর জখম লোকটা ওকে ডাকছে। যেতে বলছে।
বিষাণ ঝুঁকে পড়ে কান পাতল রাস্তায় শোওয়া লোকটার ঠোঁটের কাছে।
“আমার…পৌঁছে দেবেন…অনেক…টা…দরকারি…পাপ…”
“কার টাকা? কোথায় পৌঁছে দেব?”
গাড়ির ড্রাইভার আবার ডাকছে। লোকটাকে নিয়ে আসতে বলছে। বিষাণ দ্বিধায় পড়ল। নিতে গিয়ে যদি অজ্ঞান হয়ে যায়? থ্যাঁতলানো গাড়ির ভিতরের লোকগুলো তো আর বেঁচে নেই দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এও যদি না বাঁচে? কথাটা তো জানাই হবে না।
বিষাণ দেখল লোকটার ঠোঁট নড়ছে আবার, “অনেক টাকা…লেকগার্ডেন্স…বলবেন…বলবেন… রায়…রায়…সু…সুতনু রায়। টাকাটা… সু… সুতনু রায়ের।”
তারপর ঠোঁট দু’টো স্থির হয়ে গেল।
মাথার উপর দিনের আলোর ছাতা বন্ধ করে আনছে সন্ধে। তিনদিন বৃষ্টির পর আর বৃষ্টি নেই আজ। পশ্চিম আকাশে আহত মোষের মতো কিছু মেঘ পড়ে রয়েছে আর তার রক্তে ভেসে যাচ্ছে চরাচর। আজ বড় অন্যরকম একটা হাওয়া বইছে কলকাতায়। ভিজে জড়োসড়ো গাছেরা যেন নড়ার সাহস পাচ্ছে আস্তে-আস্তে। লেকের মাঝের ওই দ্বীপখণ্ডটায় ছায়া আজ অন্য কিছুর সংকেত পাঠাচ্ছে। হাওয়াও বয়ে আনছে অন্য ইশারা। কীসের সংকেত পাঠাচ্ছে এই হাওয়া? ওই দ্বীপখণ্ড? এই সাহসী গাছপালারা? কী কথা ওরা বলতে চাইছে মানুষকে?
প্রশ্ন। গোটা পৃথিবীটাই আসলে নানা প্রশ্নের সমষ্টি। যেন একটা গোলকধাঁধার ভিতর রাখা আর একটা গোলকধাঁধা। এই সব প্রশ্নসমষ্টির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে কপিল। এখনও যেমন তাকিয়ে রয়েছে এই আবছা হয়ে আসা দিনের দিকে। একটা দিনের শেষ দেখলে কি বোঝা যায় তার শুরুটা কেমন হয়েছিল? বোঝা যায়, এক একটা নতুন দিন কতরকমের গল্প তার ঝোলায় পুরে ধীরে-ধীরে আকাশ বেয়ে ওঠে? নার্সিংহোম। অ্যাক্সিডেন্ট। এমার্জেন্সি। তিনটে শব্দ আর বিষাণের ফোন নিয়ে আজ শুরু হয়েছিল দিন। বিষাণ কাউকে যেতে বলেনি তবু অদম্য কৌতূহল নিয়ে সল্টলেকের সেই নার্সিংহোমে ছুটেছিল কপিল। বৃষ্টি সকাল ছ’টায় থেমে গিয়েছিল। তবু স্থির জমা জল নিয়ে শহরটাকে রাংতায় মোড়া মনে হচ্ছিল।
নার্সিংহোমে পৌঁছে অবাক লেগেছিল কপিলের। এত পুলিশ! টিভি ক্যামেরা! আর তারা প্রশ্ন করছে বিষাণকে! এদেরও এত প্রশ্ন জমা থাকে? কাদের ভর্তি করা হয়েছে? জয়? রথী? এরা কারা? বিষাণ রাস্তার অ্যাক্সিডেন্ট থেকে এদের কীভাবে উদ্ধার করে এনেছে?
পুলিশ আর বিষাণকে ঘিরে থাকা লোকজনদের ভিতর কৌতূহলবশত নিজেকেও গুঁজে দিয়েছিল কপিল। বিষাণ ইশারায় যথাসম্ভব দূরে থাকতে বলেছিল। তবু কপিল শোনেনি। ঘটনাটা ওর জানতে ইচ্ছে করছিল যে ভীষণ!
ও শুনছিল, রথী নামে লোকটির সঙ্গে যে তিনজন ছিল, তারা নাকি সমাজবিরোধী! অ্যাক্সিডেন্টে তিনজনেরই মৃত্যু হয়েছে। শুনছিল রথীও জেল থেকে বেরিয়েছে দু’-চার দিন হল। পুলিশ সন্দেহ করছে, কোনও অসৎ উদ্দেশ্যেই তারা রাত্রিবেলা বেরিয়েছিল। কিন্তু কী উদ্দেশ্য তা জানার উপায় নেই। রথীর অবস্থা সংকটজনক। আটচল্লিশ ঘণ্টার আগে বলা যাচ্ছে না কিচ্ছু।
ও শুনছিল জয়ের কথাও। লোকটি নাকি মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। এর অবস্থাও ভাল নয়। তবে বেঁচে যাবে। দু’টো গাড়ির ধাক্কার জায়গা থেকে দু’টো বন্দুকও পাওয়া গিয়েছে। যদিও বন্দুক দু’টো কার জানা যাচ্ছে না। পুলিশ এখন আহতদের জ্ঞান আসার অপেক্ষা করছে।
হঠাৎই জগতের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল কপিলের। একজন মহিলার সঙ্গে বসেছিল জগৎ। মহিলাটি কাঁদছিল খুব। কিছু বলছিল জড়িয়ে-জড়িয়ে। জগতের কে হয় মেয়েটি? জগৎ এদের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত? জগৎ কখনওই বাড়ির কথা বলে না বিশেষ।
কপিল গিয়ে জগতের পাশে বসেছিল। মহিলাটি কান্না মেশানো গলায় আবছাভাবে বলছিল, “এত সন্দেহ? শেষে বাঁশি…একবার জিজ্ঞেসও করল না আমায়…বাঁশি লুকিয়ে বিয়ে করেছিল…ওদের নতুন ঘর ঠিক করে দেব বলেছিলাম…আর ভাবল…ওর সঙ্গে আমার…তাই মারতে গেল? আমি কেন অন্য কাউকে…বাবুই নেই…ও ছাড়া কে আছে আমার? ও এত অবুঝ…রাগ এভাবে কেউ দেখায়? কেন বুঝল না আমার কষ্টটা? কেন…মামু, কেন? জয় কেন সন্দেহ করত আমায়? কেন বুঝত না যে ওকে কত ভালবাসি?”
এত প্রশ্ন! না বোঝার প্রশ্ন! আর টুকরোটুকরো কথাগুলো কী-ই বা বলতে চায়? সম্পূর্ণ হচ্ছে না। কিচ্ছু সম্পূর্ণ হচ্ছে না। পাশের সোফায় আর একজন মহিলা ও সুন্দর ফুলের মতো একটা মেয়ে বসে কাঁদছিল। ওরা কার বাড়ির লোক? রথীর নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, রথীরই তো। পুলিশ এসে তো জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনারা রথীর বাড়ি থেকে আসছেন তো?”
মহিলাটি বলেছিল, “হ্যাঁ, আমি ওর দিদি…আর…”
“আমি ব্লসম। রথীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা আমার।” দাঁড়িয়ে পড়া সুন্দরমতো মেয়েটার কথা শুনে পুলিশ অফিসারের কঠিন মুখটায় অদ্ভুত এক বিস্ময় দেখেছিল কপিল। কেন বিস্মিত হয়েছিল পুলিশটি? জেল-খাটা কয়েদির এমন সুন্দরী প্রেমিকা থাকতে পারে না? কপিল অবাক হয়ে দেখেছিল ব্লসম এবার গিয়ে কেয়ার পাশে বসেছিল। কেয়ার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, “শক্ত হও। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কপিলের জানতে ইচ্ছে করছিল মেয়েটি কে হয় কেয়ার?
“কী করছ তুমি? চলো!” বিষাণ এসে হাত ধরেছিল কপিলের, “আমি তো কোথায় কী অবস্থায় আছি জানিয়ে ফোন করেছিলাম। তোমায় এখানে সশরীরে আসতে কে বলল? চলো, ছোট একটা কাজ সেরে বাড়ি ফিরব।”
কপিল জগতের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলেছিল, “তুমি তো…মানে… কোনও দিন এদের সম্পর্কে…” আজ যে কথা শেষ না-করার দিন। কপিলের আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, এমনি সময় হাজার কথা বলেও মানুষকে নিজের মনের ভাব বোঝানো যায় না। আর বিপর্যয়ের সময় অর্ধ-সমাপ্ত কথা কী দ্রুত বুঝে নেয় মানুষ!
জগৎ বলেছিল, “আমার ভাগনি এটি। কেয়া। জয় আমাদের জামাই। দেখো তো কী হল। ঈশ্বর পরম করুণাময়, তবু তাঁর করুণার ধরন আমি বুঝে উঠতে পারলাম না আজও! পরে কথা হবে। আজ আর ভাল লাগছে না।”
কেয়া কাঁদছিল খুব, তার সন্দেহপ্রবণ স্বামীর জন্য। জগৎ পাশে বসেছিল মাথা নিচু করে। পরম করুণাময় কি দেখতে পাচ্ছিলেন এই দু’জনকে? দেখতে পাচ্ছিলেন ওই সুন্দরমতো মেয়েটিকে?
স্কুটার! কত দিন স্কুটারে চড়েনি কপিল। বিষাণ জোরে চালাচ্ছিল গাড়িটা আর ওকে শক্ত করে ধরে বসেছিল কপিল। কী ভীষণ ভাল যে লাগছিল কপিলের! বিষাণের স্কুটার গিয়ে থেমেছিল লেকগার্ডেন্সের একটা বড় বাড়ির সামনে। স্কুটারটা বাইরে রেখে বিষাণ তালাবন্ধ খোপ থেকে ময়লা লাগা হলুদ একটা ব্যাগ বের করেছিল।
“কী রে এটা?” কপিল ভাবছিল, এমন দিনে একটা ব্যাগ দিতে হঠাৎ এখানে এল কেন বিষাণ? বাড়িটা কাদের? ওই ময়লা হলুদ ব্যাগে কী আছে?
বিষাণ কপিলকে গেটের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ঢুকে গিয়েছিল বড় বাড়িটার ভিতরে।
প্রায় আধঘণ্টা পর বাড়ি থেকে খালি হাতে বেরিয়ে এসেছিল বিষাণ। কেমন অদ্ভুত লাগছিল ওকে। কোনও দিকে না তাকিয়ে স্কুটার স্টার্ট করেছিল ও। কপিলকে পিছনে বসতে বলে নিজে বসেছিল সিটে। আর যখন কপিল বসতে যাবে ঠিক তখনই লোহার গেট খুলে একটা ভীষণ সুন্দর মেয়ে প্রায় দৌড়ে এসে দু’হাত দিয়ে ধরেছিল স্কুটারের হ্যান্ডেলটা। মেয়েটার ফরসা মুখটা গোলাপি হয়ে ছিল। দ্রুত শ্বাস নিচ্ছিল সে।
কে যেন মনের ভিতর থেকে কপিলকে বলেছিল, “সরে দাঁড়াও, সরে দাঁড়াও। তুমি এখানে অতিরিক্ত।”
কপিল এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে শুনেছিল, মেয়েটা প্রায় চিৎকার করছে, “কেন তুমি নিলে না বাবার দেওয়া চাকরিটা? লাবানার চাকরিটা তুমি ছাড়তে পারো না?”
“কেন নেব?” বিষাণ শান্ত গলায় বলেছিল, “আমি আনস্মার্ট, ক্যাবলা হতে পারি, কিন্তু এটুকু আত্মসম্মান তো সবারই থাকে। তুমি বলেছিলে না অপদার্থতার কথা? আর অপদার্থ থাকতে ইচ্ছে করে না।”
“ও তুমি সেটাই ধরে বসে আছ? আর কিছু বোঝো না? আর কিছু…ওঃ, তোমার তো আবার ইচ্ছেও করে না…বুঝতেও কি ইচ্ছে করে না?”
“কুমু, তুমি বলেছিলে, ‘গেট আ লাইফ’। তা সেটা নিজের মতোই দেখি না। ব্যাগটা ফেরত দিলাম বলেই তোমার বাবা বিশ্বাসী ভাবলেন আমায়? ব্যস! টাকাই বিশ্বাস-অবিশ্বাস নির্ণয় করে শুধু? গ্রিডি কি না নির্ণয় করে? সাফল্য— ব্যর্থতা নির্ণয় করে? মানুষের নিজস্ব কোনও মূল্য নেই?”
“আমায় কষ্ট দিয়ে খুব আনন্দ পাও, না?” কুমুর গলায় অভিমান দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল কপিল। মেয়েটা এমন করছে কেন? এবার তো কেঁদে ফেলবে!
“আনন্দ? তাই মনে হয় তোমার?” বিষাণ ক্লান্ত চোখ দু’টো তুলেছিল, “তুমি কী চাও কুমু?”
কুমু কান্নাভেজা গলায় বলেছিল, “তুমি বোঝো না?”
প্রশ্ন, লক্ষ লক্ষ প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে কলকাতার হাওয়ায়। তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কপিল। দূরের উঁচু বাড়ির মাথার ওপর থেকে আলো মুছতে-মুছতে এগিয়ে আসছে সন্ধে।
সম্পর্ক কী? খুব শীতের মধ্যে দু’হাত দিয়ে ধরে থাকা গরম চায়ের গেলাস? জ্যৈষ্ঠের দুপুরে পাঁচ টাকার অরেঞ্জ আইসক্রিম? নাকি ওই সামনে বসা সেই নীলের উপর সাদা ফুটকির টাই পরা ছেলেটা ও মেয়েটার বহুদিন পর একসঙ্গে হাসির মুহূর্ত?
মানুষ কি বড্ড জটিল করে ফেলে না এই সম্পর্কগুলোকে? কম্প্রোমাইজ়, ফিলিংস, আন্ডারস্টান্ডিং ইত্যাদি নানা জটিল কথা বলে সে কি ঘোলাটে করে দেয় না দৃষ্টি?
সম্পর্ক কি এই মুহূর্তের ওই ছেলেটা আর মেয়েটার মতো হতে পারে না? সম্পর্ক কি পাখিদের মতো হতে পারে না? আলো-ফুরিয়ে-আসা পৃথিবীর পাখিদের মতো? সময় থাকতে-থাকতে ভাগ করে নিতে পারে না সব কিচিরমিচির, সব ভালবাসা?
পারেই তো! না হলে কেন ক্রিমিন্যাল ছেলেটির জন্য অমন ফুলের মতো মেয়েটি দাঁড়িয়ে ওঠে? কেন সন্দেহপ্রবণ স্বামীর জন্য কান্নায় ভেঙে পড়ে কেয়া? কেন এত কিছুর পরও দোয়েল ঢেকে রাখতে চায় চন্দ্রর দোষ? কী কথা বিষাণকে বোঝাতে চেয়ে কান্নায় ডুবে যায় অমন রাগী মেয়েটির গলা?
প্রশ্ন। সত্যি, জীবনে উত্তরের চেয়ে প্রশ্নগুলো চিরকালই বেশি। তাই হয়তো উত্তর খোঁজার জন্য রোজ সকালে আকাশে বেরোয় পাখিরা, মানুষ বেরোয় জীবনে। এই উত্তর খুঁজতে-খুঁজতেই হয়তো রাগ, কষ্ট, সন্দেহ আর অভিমানের আড়াল থেকে সে খুঁজে পায় আনন্দ, খুঁজে পায় ভালবাসা, খুঁজে পায় নিজের ভিতরের পাখিটিকে!
(গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কোনও ব্যক্তি বা ঘটনার সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং আকস্মিক)