৩. তারস্বরে শ্যামাসংগীত

ভূপেন দারোগা স্নান করেন ঝাড়া আধঘণ্টা ধরে। তাতে অসুবিধা নেই, অসুবিধা হচ্ছে সেই সঙ্গে তিনি তারস্বরে শ্যামাসংগীত গাইতে থাকেন। ওই আধঘণ্টা ঘুঘুডাঙার লোকজন পারতপক্ষে থানার দিক মাড়ায় না। থানার দুই হাবিলদার হুকুমচন্দ এবং হরগোবিন্দ, সেকেন্ড অফিসার রতনলাল খাসনবিশ আর রান্নার লোক নুরু মিঞা কানে আঙুল দিয়ে ইষ্টনাম জপতে থাকেন। এমনকি লোকে নাকি সেই সময় ঘুঘুডাঙা থানার রেসিডেন্ট বেড়াল দধিমুখি আর পোষা ধেড়ে ইঁঁদুর কালনেমিকে থানার দেওয়ালের ওপর পাশাপাশি চুপটি করে বসে থাকতে অবধি দেখেছে।

আজ ভূপেন দারোগা গাইছিলেন, ‘শ্যামা মা কি আমার কালো রে, শ্যামা মা কি আমার কালো।’ চারিদিকের বাতাস সেই গানের গুঁতোয় আঁতকে আঁতকে উঠছিল। নুরুল ইসলাম তার ভ্যান নিয়ে বাজারে যাচ্ছিল। ‘শ্যামা’ শোনামাত্র সে ভ্যানটা থানার দেওয়ালে ঠেকিয়ে দে দৌড়। রামভজন গোয়ালা তার জরু’র নামে কী একটা নালিশ করতে আসছিল। গানের গমকের প্রথম টানেই সে মাটি নিয়েছে, তার আর ওঠার নামলক্ষণ নেই। নরহরি চক্কোত্তি এই রাস্তা দিয়েই তাঁর যজমানকে গ্যাঁড়াপোতার ওয়ার্ল্ড ফেমাস নেত্যকালী মন্দিরে নিয়ে যাচ্ছিলেন, একটা মানতের পূজা সাঙ্গ করতে। সামান্য খানিক শুনেই সেই যে লম্বা দিয়েছেন, তাঁর আর পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। যজমান অখিল সমাদ্দার দাঁত ছরকুটে থানার সামনে অসহায়ভাবে শুয়ে আছেন, তাঁকে তোলবার কেউ নেই। থানার চৌহদ্দির পাশেই পান্তীর মাঠ। তার পাশে একটা তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা তালগাছ আছে। ঘুঘুডাঙার নেড়িদের অবিসংবাদী লীডার কুমার বাঘা সেই তালগাছটার নীচে চার পা তুলে শুয়ে। তাকে ঘিরে বাকি নেড়িরা নীরবে অশ্রুবিসর্জন করছে। এইমাত্র তালগাছের ডগা থেকে ভূপেন দারোগার গানের গুণমুগ্ধ একটি কাক টুপ করে খসে পড়ল। শুধু থানার পাশের বাড়ির বিধবা পিসিমা রঙ্কিণীদেবী কানে শোনেন না, তিনি রোজকার মতো ছাত ঝাঁট দিতে এসে আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘রোজই তো এই সময়ে দিব্যি কালোয়াতি শুনতে পাই। তবুও যে অলম্বুষগুলো কেন যে বলে কানে শুনতে পাই না বুঝি না।’

গান শেষ হতে ভূপেন দারোগা প্রসন্ন মুখে গামছা দিয়ে গাত্রমার্জনা করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে চারদিক স্বাভাবিক হয়ে এল। প্রসন্ন মলয় সমীরণ বইতে লাগল, মাঠে সবৎস ধেনু চরতে লাগল, রামভজন জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ মুছতে মুছতে থানার বারান্দায় এসে বসল। নরহরি চক্কোত্তি তাঁর যজমান নিয়ে গেলেন, নুরুল ইসলাম তার ভ্যান। বাঘা আর তার সঙ্গীরা সোল্লাসে ঘেউ ঘেউ করতে করতে দৌড় দিল। শুধু কাকটাই জেগে উঠতে যা সময় নিল। সে পাঁচিলে বসে দধিমুখিকে মুখ ভেংচে বলল ‘ক্ক ক্কঃ’।

স্নানান্তে ভূপেন দারোগা ধরাচূড়া পরে নিজের আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। সামনের চেয়ারে বসে দুটি ছেলে। দুজনেরই দোহারা চেহারা। বয়েস খুব বেশি হলে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ। চোখমুখ বেশ শার্প। পরনে সাফারি স্যুট, চোখে সানগ্লাস। ভূপেন দারোগা হাঁক দিয়ে বললেন, ‘হুকুম সিং, তিনঠো চায় লেকে আও।’

দুজনের মধ্যে যার শরীর স্বাস্থ্য একটু ভালো সে চোখ থেকে চশমা খুলে বলল, ‘হুকুম সিং বাংলা বোঝে না?’

ভুপেন দারোগা বললেন, ‘হুকুম সিংকে হিন্দিতে হুকুম না করলে একটু গড়িমসি করে কী না, তাই হিন্দিতে বলা। তা আপনারা?’

প্রথম ছেলেটি বলল, ‘আমার নাম প্রবাল চ্যাটার্জি, আর ওর নাম দেবকান্ত মোহান্তি।’

‘তা এখানে কী মনে করে?’

‘আমরা একটা তদন্তের ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি মিস্টার আচার্য।’

‘কীসের তদন্ত?’ অবাক হলেন ভূপেন আচায্যি।

‘ব্রজনারায়ণ মিত্র আর লখাই সামন্তের মার্ডারের ব্যাপারে।’

ভূপেন দারোগার ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘সে ব্যাপারে আপনাদের আমি বলতে যাবোই বা কেন?’

প্রবাল চ্যাটার্জি ধীরেসুস্থে পকেট থেকে একটা আই কার্ড বার করে ভূপেন দারোগার সামনে মেলে ধরলেন। ভূপেন দারোগা সেটা দেখেই লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘স্যার, আপনি? আগে বলবেন তো।’ বলেই হাঁকডাক শুরু করে দিলেন, ‘আরে হুকুম সিং, চায়ে রেহনে দো, পেহলে ঝটাকসে দোঠো ডাব কাটকে লে আও। আর হরগোবিন্দ, বাজার সে একটা দেড়কেজি পাকা রুই, বড় দেখকে খান দশেক গলদা, আর একঠো কচি দেখে পাঁঠা লে আও দেখি। পাঁঠাটা কালো হোনা চাহিয়ে আর মিষ্টি করকে ব্যা ব্যা করনা চাহিয়ে। আর রতনলালবাবু, আপনি ঝট করে থানার জিপটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। মোল্লার চকের লাল দই আনবেন কিলো দুয়েক, কামিনীভোগ মিষ্টান্নালয়ের ‘আবার খাবো’ আনবেন একবাক্স, আর ঘুঘুডাঙার বাজারের হনুমান মিশিরের থেকে গরম বোঁদে আনুন দিকি হাফ কিলো। আরে ওই নুরু মিঞা, তুমি আলু আদা রসুন প্যাঁজ নিয়ে লেগে পড়ো। সাহেব যেন আবার কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমাদের রান্নার নিন্দেমন্দ না করেন।’

প্রবাল হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘আরে করেন কী মশাই। আমরা কী বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে এসেছি নাকি? এসেছি একটা তদন্তের কাজে…’

ভূপেন দারোগা গড়ুরহস্ত হয়ে বললেন, ‘সায়েবসুবোরা গরিবের ঘরে এসেছেন এই না কত ভাগ্যি। দাঁতে দুটি কুটো না কেটে গেলে যে থানার অকল্যাণ হবে স্যার।’

প্রবাল চ্যাটার্জি হতাশ হয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। দেবকান্ত বললেন, ‘খাওয়ার ব্যাপারটা না হয় পরে দেখা যাবে মিস্টার আচায্যি। আগে কয়েকটা পুছতাছ সেরে নিই?’

ভূপেন দারোগা চেয়ারে টানটান হয়ে বসলেন। উর্দির পাঁচ নাম্বার বোতামটা পটাং করে ছিঁড়ে গেল। সেদিকে দৃকপাত করলেন না ভূপেন দারোগা। গলাটা গম্ভীর করে বললেন, ‘বলুন স্যার।’

‘ব্রজনারায়ণ মিত্র খুন হলেন কী ভাবে?’

‘ওটা মোটেও খুন নয় স্যার। আপনি নিশ্চয়ই হোমওয়ার্ক করেই এসেছেন। তবুও অল্প করে বলি। ব্রজনারায়ণ মিত্তির হলেন এখানকার পুরোনো জমিদার মিত্তির বংশের ছেলে। বছর ছ’য়েক আগে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যান। মাস কয়েক আগে ফিরে আসেন। এসেই কয়েকজন বেশ মার্কামারা ক্যারেক্টারের সঙ্গে ভাব জমান। যেমন লখাই সামন্ত, এই এলাকার প্রখ্যাত গুণ্ডা। আমার মনে হয় এদের নিজেদের মধ্যেই কিছু একটা বখেরা নিয়ে গণ্ডগোল হয়ে থাকবে। সেই নিয়ে খুনোখুনি আর কী।’

‘হুম। এই নিয়ে এফ আই আর’টা কে লজ করেছিলেন?’

‘ব্রজনারায়ণের ব্যাপারে এফ আই আর করেছিলেন তাঁর বাবা, যতীন্দ্রনারায়ণ মিত্র।’

‘আর লখাইয়ের ব্যাপারে?’

একটু অস্বস্তির হাসি হাসলেন ভূপেন আচায্যি। ‘দেখুন স্যার, লখাই সামন্ত ছিল যাকে বলে একজন হিস্ট্রি শীটার, দাগী লোক। তার বিরুদ্ধে আগেও অনেক অভিযোগ ছিল। লোকটা দু-একটা রাত এই থানার লক আপেও কাটিয়েছে বটে। এসব লোক যে এই ভাবেই মারা যায় সেটা তো জানা কথাই স্যার। আর ওর নিজের লোক বলতে তো কেউ নেই, একটা নাবালক ভাইপো ছাড়া। তা সে ছোঁড়া বোধহয় পুলিশি ঝামেলা বলে আর এফ আই আর-টারের হুজ্জোতে যেতে চায়নি।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের গগলসটা পরে নিলেন প্রবাল। তারপর জিজ্ঞেস করেন, ‘এই পুলিশের চাকরিতে আপনার কত বছর হল ভূপেনবাবু?’

‘তা দু’কুড়ি পাঁচ ধরুন। প্রায় পঁচিশ বচ্ছর।’

‘তা এই পঁচিশ বচ্ছরে কখনও শোনেননি যে এরকম কেসে পুলিশ নিজেই এফ আই আর দায়ের করে তদন্ত করতে পারে?’

ভূপেন দারোগা দুঃখ দুঃখ মুখ করে বললেন, ‘এই তো থানার অবস্থা স্যার। একটা সেকেন্ড অফিসার আর দুটো কনস্টেবল। তার মধ্যে হুকুম সিং রাতের বেলা চোখে দেখে না, আর হরগোবিন্দের গেঁটে বাত। কদ্দিকে সামলাবো বলুন তো?’

‘তাই বলে দু’দু খানা খুনের তদন্তে আপনি হাত গুটিয়ে বসে আছেন?’

তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন ভূপেন দারোগা, ‘কে বলল হাত গুটিয়ে বসে আছি? ডি এস পি সাহেবকে রীতিমতো রিপোর্ট পাঠিয়েছি তো।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রবাল। দেবকান্ত গম্ভীরমুখে বললেন, ‘সে রিপোর্ট আমরা দেখে এসেছি মিস্টার আচার্য। আপনি রিপোর্ট দিয়েছেন দুই সমাজবিরোধী দলের মধ্যে গ্যাং ওয়ার বলে। তা ব্রজনারায়ণ মিত্রকে ঠিক কী কারণে আপনার সমাজবিরোধী বলে মনে হল ভূপেনবাবু?’

‘বললাম যে, অনেক ফিকটিশাস ক্যারেক্টারের সঙ্গে মেলামেশা করতেন….’

‘তাতেই কেউ সমাজবিরোধী হয়ে যায়? হতেও তো পারে তিনি তাদের সৎপথে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন।’

দ্রুতবেগে মাথা নাড়েন ভূপেন দারোগা, ‘কখখনো না। ব্রজ মিত্তির তেমন লোকই ছিল না।’

এবার প্রবাল চ্যাটার্জি মুখ খুললেন, ‘বিষ্ণুনারায়ণ তিওয়ারিকে চেনেন ভূপেনবাবু?’

‘চিনব না? বিলক্ষণ চিনি। অমন সরল, উদার, সাহসী, পরোপকারী, বন্ধুবৎসল, সচ্চরিত্র, দানবীর মহাপুরুষের সঙ্গে আলাপ হওয়াটাই তো অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।’

‘খবর পেয়েছি বিষ্ণুতিওয়ারির সঙ্গে ব্রজ মিত্তিরের বেশ ভালো দহরম মহরম ছিল। তা আপনি কি বিষ্ণুতিওয়ারিকেও সমাজবিরোধী ঠাওরান নাকি ভূপেনবাবু?’

ভূপেন আচায্যি আঁতকে উঠলেন, ‘কী বলছেন স্যার? অমন সজ্জন, দয়ালু, নিরহংকার, শিক্ষিত মানুষকে সমাজবিরোধী ঠাওরাবো? আমার কি বিবেকবুদ্ধি নেই? আমি কি অমানুষ পাষণ্ড?’

‘আমাদের কাছে যে অন্য খবর আছে যে ভূপেনবাবু। ইনি একটি বিশিষ্ট জালিয়াত এবং জোচ্চর মানুষ। চড়া সুদে লোককে ধার দিয়ে, এবং তারপর দলিল জাল করে অন্যের জমি দখল করা এনার পেশা। তার ওপর চালে কাঁকর, সর্ষের তেলে শিয়ালকাঁটার বীজ, ঘিতে ডালডা, ইত্যাদি মিশিয়ে বেচতে এঁর প্রতিভা গগনচুম্বী। আর গুণ্ডা বদমাশ পোষার ব্যাপারটা তো ছেড়েই দিলাম।’

ভূপেন দারোগার মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। তিনি না করার ভঙ্গিতে দ্রুতবেগে হাত নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘ছি ছি ছি, বিষ্টুবাবুর মতো একজন সদাশয়, দূরদর্শী, সমদ্রষ্টা, অকুতোভয়, নির্লোভ মানুষের ব্যাপারে এসব শোনাও পাপ।’

দেবকান্ত আর প্রবাল একে অন্যের দিকে তাকালেন একবার। তারপর দেবকান্ত গম্ভীরমুখে বললেন, ‘আমাদের কাছে এ খবরও আছে যে বিষ্টুবাবুর সঙ্গে আপনার মাখামাখিটা একটু বেশিই দৃষ্টিকটু। শুনলাম সদ্য নাকি আপনার মেয়ে দার্জিলিং -এ কনভেন্টে ভর্তি হয়েছে? আপনি আর আপনার গিন্নি নাকি ঘুঘুডাঙা থেকে দার্জিলিং অবধি গেছিলেন তাকে ছেড়ে আসতে? তাও আপনার নতুন কেনা মস্ত মোটরকারে? এত টাকা কোথায় পাচ্ছেন ভূপেনবাবু?’

ভূপেন দারোগার মুখটা একটু শুকিয়ে এলো। তিনি আমতা আমতা করতে লাগলেন।

সেই অবসরে প্রবাল চ্যাটার্জি একটু ঝুঁকে এসে বললেন, ‘অ্যাদ্দিন যা করছিলেন করছিলেন। কিন্তু এইবারে একটু বেশি ফেঁসে গেছেন ভূপেনবাবু। এবার কিন্তু আপনার ছাড়া পাওয়া একটু মুশকিল।’

ভূপেন দারোগা গলাটা খাঁকড়ে বললেন, ‘ধরা ছাড়ার প্রশ্ন উঠছে কেন স্যার?’

প্রবাল চ্যাটার্জি বললেন, ‘লখনৌর এক প্রফেসর, নাম রামশরণ গুপ্তা, মাসখানেকের ওপর উধাও, বুঝলেন তো?’

‘ইয়ে, কিন্তু তাতে আমি কী করব স্যার? লখনৌ তো আমার এরিয়া নয়!’

‘প্রফেসর গুপ্তা যে সে লোক নন। গভর্নমেন্টের বেশ হোমড়াচোমড়াদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা আছে। বুঝতেই পারছেন, উত্তর প্রদেশের পুলিশ একেবারে আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। সেই সূত্রেই কেসটা আমাদের হাতে এসেছে, বুঝলেন।’

‘ক্কে..ক্কেন স্যার? ইউ পি’র কেস বেঙ্গল পুলিশের হাতে কেন?’

‘কারণ ইউ পি’র পুলিশের বয়ান অনুযায়ী উধাও হওয়ার দিন তাঁকে শেষ দেখা গেছিল মুঘলসরাই’তে, দিল্লি কলকাতা রাজধানী এক্সপ্রেসে উঠতে। তারপর তাঁর মোবাইলের লোকেশন ট্রেস করে অনুমান করা হচ্ছে এই ঘুঘুডাঙার আশেপাশেই কোথাও তিনি আছেন।’

একটা ঢোঁক গিললেন ভূপেনবাবু, ‘কিন্তু তার সঙ্গে এই খুনের কেসের কী সম্পর্ক স্যার?’

‘সম্পর্ক আছে আচায্যিমশাই, গভীর সম্পর্ক আছে। জানা গেছে আজ থেকে দেড় বছর আগে ব্রজ মিত্তির দেখা করেছিল রামশরণ গুপ্তার সঙ্গে। তাদের মধ্যে কী আলোচনা হয় জানা নেই, কিন্তু তারপর থেকেই প্রফেসর গুপ্তা’র মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দেয়। এসব খবর ইউ পি’র পুলিশই আমাদের দিয়েছে। শুধু তাই নয় তারা খুঁজে পেতে এও বার করেছে যে ব্রজ মিত্তির তার আগের পাঁচ বছর কোথায় কোথায় চষে বেরিয়েছেন। সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা বেশ পেকে উঠেছে বুঝলেন।’

ভূপেন দারোগা কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, ‘তাতে আমি কী করব স্যার?’

‘আপনার উচিত ছিল ব্রজ মিত্তিরের খুন নিয়ে একটু খুঁটিয়ে তদন্ত করা। তার বদলে আপনি গ্যাং ওয়ার বলে কেসটা স্রেফ ধামাচাপা দিয়ে দিলেন। কার বা কীসের চাপ ছিল ভূপেনবাবু? বিষ্টু তিওয়ারির? নাকি কেউটের ভয়ে কেঁচো খুঁড়তে চাননি? কোনটা ঠিক?’

ভূপেন আচায্যি হাতজোড় করে কিছু বলে ওঠার আগেই প্রবাল চ্যাটার্জি কঠিন গলায় বললেন, ‘আপনাকে বোধহয় আর বাঁচানো গেল না ভূপেনবাবু।’

ভূপেন আচায্যি শুকনো ঠোঁট চেটে বললেন, ‘এ এ এ এরকম ক্কে ক্কে ক্কেন বলছেন স্যার?’

‘আপনার বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরেই অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে ভূপেনবাবু। বিষ্ণুবাবুুর সঙ্গে আপনার সখ্য এই এলাকার কারও অজানা নেই। লোকে আড়ালে আবডালে আপনাকে বিষ্ণুবাবুুর টেনিয়া বলে ডাকে জানেন তো? টেনিয়া মানে…’

ভূপেন আচায্যি বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘ অমন উজ্জ্বলচরিত্র, বিগতস্পৃহ, দেবতুল্য…’

‘সাসপেনশনের চিঠিটা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছি মিস্টার আচায্যি। সেটা কি এখনই দেব নাকি লাঞ্চের পর? ডিসিশন আপনার।’

ভূপেন আচায্যি খানিকটা উদভ্রান্ত হয়ে বললেন, ‘অমন নিষ্কলুষ কচি পাঁঠা, সচ্চরিত্র পাকা রুই, উদারহৃদয় গলদা চিংড়ি, দূরদ্রষ্টা লাল দই, সমদর্শী বোঁদে…’

প্রবাল চ্যাটার্জি শান্ত এবং স্থির গলায় বললেন, ‘ডিসিশনটা জানাবেন প্লিজ। কলকাতার গোটা কতক সাংবাদিক আবার আমার বিশেষ বন্ধু। তারা কিন্তু একটা স্কুপ নিউজের জন্য আমাকে ভারি ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে বুঝলেন। এই খবরটা পেলে তারা একেবারে লুফে নেবে।’

ভূপেন দারোগা করুণ চোখে বললেন, ‘কী করতে হবে স্যার?’

প্রবাল চ্যাটার্জি একটু ঝুঁকে এলেন, ‘ডাবল ক্রসিং শব্দটার মানে জানেন আশা করি। অ্যাদ্দিন সরকারের খেয়ে বিষ্টুবাবুর সেবা করেছেন। এবার বিষ্টুবাবুর খেয়ে একটু সরকারের সেবা করতে হবে এই যা। রাজি?’

ভূপেন দারোগা শুকনো মুখে ছলোছলো চোখে বললেন, ‘রাজি।’

* * *

পরের দিন সকালে দাঁত মুখ মেজে বাজারে যাচ্ছিল ভজন। বাড়ি থেকে বেরিয়েই গগন মল্লিক আর সতীশ ডাক্তারের মুখোমুখি পড়ে গেল সে। দুজনেই কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। ভজনকে দেখে চোখ টিপলেন গগন মল্লিক, ‘কী রে ভজন, বাজারে জোর খবর তুই নাকি কোন খুড়োর জমানো টাকা চুরি করে অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিস?’

ভজন হাঁউমাউ করে উঠে বলল, ‘একদম না স্যার, আমি কারও কিচ্ছু চুরি করিনি, মা কালীর কিরে।’

গগন মল্লিক চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে এখন এই দামি প্যান্ট শার্ট এল কোথা থেকে শুনি? দুদিন আগে তো খেতে পাচ্ছিলিস না শুনেছিলাম।’

ভজন দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল, ‘যখন খেতে পাচ্ছিলাম না তখন তো জিগোতে আসেননি স্যার কেন খেতে পাচ্ছি না? এখন প্যান্ট শার্ট দেখে টাকার কথাটা মাথায় এল স্যার?’

গগন মল্লিক কিছু একটা উত্তর দিতে গিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর বললে, ‘এর জবাব না হয় পরে দেব একদিন। আপাতত যেখানে যাচ্ছি সেখানে চল।’

ভজন একটু কৌতূহলী হয়ে বলল ‘কোথায় যাব স্যার?’

গগন মল্লিক কুপিত হলেন, যা তিনি স্বভাবতই হয়ে থাকেন। তিনি খপ করে ভজনের ঘেঁটি ধরে বললেন, ‘যেখানে নিয়ে যাব সেখানে যাবি। এনি কোয়েশ্চেন?’

ঘুঘুডাঙায় গগন মাস্টারের প্রতিপত্তি এখনও বড়ই প্রবল। ভজন ক্যাবলার মতো ঘাড় নেড়ে বলল, ‘আচ্ছা তাই যাব স্যার।’

তিনজনে যখন মিত্তিরবাড়িতে পৌঁছলেন তখন হেমনলিনীদেবী খুব মন দিয়ে আমের আচার বানাচ্ছিলেন। গগন মল্লিককে দেখে একগাল হেসে বললেন, ‘এসেছিস ভাই? আয়, দাওয়ায় বোস দিকিনি। সকালে নারকেল কুরে রেখেছি। ঘরে ডুমো ডুমো মুড়ি আছে। চিনি দিয়ে মেখে দিই?’

সতীশ ডাক্তার হাতের উলটোপিঠে একবার জিভের জলটা মুছে নিলেন। ভজন ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই পিসি ভজনের দিকে কুটিল চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ রে ভজন, শুনলাম তুই নাকি ম্যালা লোক লশকর নিয়ে তোর সামতাবেড়ের খুড়োমশাইকে মেরে দু টুকরো করে গঙ্গার চরে পুঁতে দিয়ে এসেছিস? তারপর নাকি ব্যাঙ্ক লুট করে সারা রাস্তাগুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘুঘুডাঙা পালিয়ে এসেছিস? সেই থেকে নাকি তোর ভয়ে সামতাবেড়ের রাস্তায় রাত্তিরে লোকজন চলাচল করে না। এসব কি সত্যি?’

ভজন এত স্তম্ভিত হয়ে গেল যে কোনও কথাই বলতে পারল না প্রথমে। গগন মল্লিক সস্নেহে হেসে বললেন, ‘না গো দিদি, ওসব গল্প কথায় কান দিও না। ভজনের যদি অতই হিম্মত থাকত তাহলে কি আর অ্যাদ্দিন রিকশা চালিয়ে খেতে হত ওকে? ওসব বাদ দাও, দেখো আজ ডাক্তারবাবুকে ধরে নিয়ে এলাম তোমাদের বাড়িঘর দেখাতে। নতুন লোক, বললেন আপনাদের মিত্তিরবাড়ির অনেক সুনাম শুনেছি। তাই দেখতে এলুম।’

হেমনলিনী কিছুক্ষণ রোষকষায়িত লোচনে সতীশ চাকলাদারের দিয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর ফিক করে হেসে বললেন, ‘এই দ্যাখ ডাক্তার, সেই দাঁত কুয়ো থেকে তুলে ফের পরেছি। কেমন ঝিলিক মারছে না?’

সতীশ ডাক্তারের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিল। তিনি কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, ‘খুব মারছে পিসিমা, একেবারে হ্যালোজেন ল্যাম্পের মতো ঝিলিক মারছে।’

হেমনলিনী সুপ্রসন্ন স্বরে হাঁক দিলেন, ‘ও বাবা, দেখে যাও, আমাদের ঘরবাড়ি দেখতে অতিথি এসেছে যে।’

ভিতর থেকে খালি গায়ে পাজামা পরা এক প্রৌঢ় বেরিয়ে এলেন। সতীশ ডাক্তার আন্দাজে বুঝলেন ইনিই যতীন্দ্রনারায়ণ। যতীন্দ্রনারায়ণ এসে সহাস্যে বললেন, ‘আরে কী সৌভাগ্য, ডাক্তারবাবু এসেছেন যে। আসুন ডাক্তারবাবু, আসুন।’

মিত্তিরবাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন সতীশ ডাক্তার। আগেকার দিনের জমিদার বাড়ি যেমন হয় তেমনই। উঁচু দেউড়ি পেরিয়ে মস্ত উঠোন। উঠোন ঘিরে টানা দালান। দালানের তিনপাশে দোতলা কোঠা। অনেকটাই ভেঙেচুরে গেছে। তবে এখনও ঠাহর করলে দেওয়ালে পঙ্খের সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখা যায়। দেউড়ির ঠিক উলটোদিকে নাটমন্দির। নাটমন্দিরের দুপাশের দুটো দুটো করে চারটে ঘর এখনও বাসযোগ্য, বর্তমান বাসিন্দারা সেখানেই থাকেন। পুরো বাড়িটা জুড়ে একটা ক্ষয়ে যাওয়া সময় থমথম করছে।

‘যতীনকাকা, কতবার বলেছি এ বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে গিয়ে ওঠো। বলি তোমাদের তো আর পয়সার অভাব নেই বাপু। তাহলে আর এই খণ্ডহরে পড়ে থাকা কেন?’ বললেন গগন মল্লিক।

সামান্য হেসে যতীন্দ্রনারায়ণ বললেন, ‘কী জানো গগন, এই দালানকোঠা ছেড়ে যেতে মন চায় না। চোখ বুজলে এখনও দেখি ওইখানে বসে মা ডালের বড়ি দিচ্ছেন। বাবা ইজিচেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। এই দালানে হেম আর ব্রজ চোর পুলিশ খেলছে। সেসব টান চুকিয়ে কী চলে যাওয়া যায় হে?’

নাটমন্দিরটা খুব খুঁটিয়ে দেখলেন সতীশ ডাক্তার। শূন্য নাটদালানে এখন কয়েকটা পায়রা গলা ফুলিয়ে বকবকম করছে। ভাবতে অবাক লাগে, এককালে এই মন্দিরই দুর্গাপুজোয় সেজে উঠত ঝলমল করে। সারা গ্রামের লোক ভেঙে পড়ত মিত্তিরবাড়ির পুজো দেখতে। আজ সেখানে থমথমে শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই।

নাটমন্দিরের দুপাশ থেকে দুটো ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। সিঁড়ির দুপাশে দুটো দুটো করে চারটে থাকার ঘর। ডানদিকের দুটো ঘরের প্রথমটা হেমনলিনীর, পরেরটা ব্রজনারায়ণের। বাঁদিকের একটা ঘর যতীন্দ্রনারায়ণের, তার পাশেরটা ফাঁকা।

ব্রজনারায়ণের ঘরে ঢুকলেন চারজনে। ঢুকেই চমক। বেশ বড় ঘর। সারা দেওয়ালে বাহারি ডিজাইনের ওয়ালপেপার। দখিনমুখী জানালার সামনে জমিদারবাড়ির সঙ্গে মানানসই এক পেল্লাই সাইজের ছত্রিওয়ালা খাট। তার পাশে একটা রাইটিং ডেস্ক। মেঝেতে দামি কার্পেটের বাহার। ঘরের কোণে আধুনিক ডিজাইনের একটা ওয়ার্ডরোব। জানালার ঠিক ওপরে একটা দেড় টনের এসি। বিছানার চাদর দেখলেই তার দাম আন্দাজ করা অসুবিধা হয় না।

‘ব্রজ ফিরে আসার পর ঘরটাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিল। এসি কার্পেট, ওয়ার্ডরোব এসব তো দেখতেই পাচ্ছেন। বাথরুমটা আপনাদের আর দেখাচ্ছি না। এরকম দামি টাইলস, কমোড আর শাওয়ারও আমরাই প্রথমবার দেখেছি এ জীবনে, গ্রামের বাকিদের জন্য তো কথাই নেই।’

কথা বলতে বলতে তিনজনে উঠে এসেছিলেন দোতলায়। দোতলার প্রায় প্রতিটা ঘরেই তালা দেওয়া। নাটমন্দিরের ঠিক ওপরের ঘর দুটো ভাঁড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নীচের দিকে তাকিয়ে রইলেন চারজনেই। মস্ত বড় উঠোনে বাড়িটার ছায়া পড়েছে। দেউড়ির পাশের মোটা থাম জুড়ে একটা রুগ্ন বোগেনভিলিয়ার ঝাড়। যেটা এককালে দারোয়ানের ঘর ছিল সেটায় এখন ডাঁই করে ভাঙা চেয়ার, ছেঁড়া সোফা, এসব রাখা। তার পাশে একটা বিড়াল শুয়ে শুয়ে নিবিষ্টমনে থাবা চাটছে। দেউড়ির বাইরে একটা রিকশা রাখা, তার চাকাটা দেখা যাচ্ছে সামনে। এমন সময় একটা কাক কোথা থেকে একটুকরো মাছের কাঁটা তুলে এনে উঠোনে ফেলতেই চিল চিৎকার করে হাতের ন্যাতাটা গদার মতো ঘোরাতে ঘোরাতে সেদিকে তেড়ে গেলেন হেমনলিনী।

বাকিরা সভয়ে ছাদে উঠে এলেন। জীর্ণ ভগ্ন ছাদ। জায়গায় জায়গায় রেলিং ভেঙে পড়েছে। বোঝা যায় যে এককালে এ রেলিং পাথরের ছিল। এখন মাঝেমাঝেই সিমেন্টের তালি তাপ্পা। ছাদ থেকে বাড়ির পেছন দিকে তাকালেই একটা বিস্তীর্ণ এলাকা চোখে পড়ে। মনে হয় আগে বাগান ছিল, এখন অনাদরে অযত্নে সেখানে ঝোপঝাড় আর বুনো গাছ ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই। বাগানের শেষপ্রান্তে একটা মন্দির। মন্দিরের পাশে একটা খুব পুরোনো বটগাছ, ঝুরি নামিয়ে যেন ঘিরে রেখেছে মন্দিরটাকে।

‘কীসের মন্দির ওটা?’ প্রশ্ন করলেন সতীশ চাকলাদার।

‘শিবমন্দির। আমরা বলি বুড়োশিবের মন্দির। বুড়োশিব আমাদের কুলদেবতা। এখন অবশ্য আর ওখানে পুজো আচ্চা হয় না। বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত বাণলিঙ্গ আছে। তাতেই পুজোআচ্চা সারা হয়।’

‘ডাক্তারবাবুকে ওই গল্পটা বল না দাদু,’ ভজনকে বেশ উৎসাহিত দেখায়।

‘কী গল্প?’ কৌতূহলী হন সতীশ ডাক্তার।

‘বলার মতো তেমন কিছুই না।’ অল্প হাসলেন যতীন্দ্রনারায়ণ, ‘বাংলার প্রায় প্রতিটি জমিদার পরিবারের উৎপত্তির পেছনে যে কোনও-না-কোনও আশ্চর্য গল্প আছে জানেন নিশ্চয়ই। সেসব গল্পের সবই যে খুব গৌরবের তা নয়। আমাদেরও সেইরকমই একটা ইতিহাস আছে আর কী!’

‘আচ্ছা? বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। গল্পটা শোনা যাবে?’

‘তা যাবে না কেন। আপনি হাওড়ার ভূরশুট রাজবংশের ইতিহাস জানেন তো?’

‘রাজা রুদ্রনারায়ণ আর রাণী ভবশঙ্করী?’

যতীন্দ্রনারায়ণ বেশ সপ্রশংস দৃষ্টিতে সতীশ ডাক্তারের দিকে তাকালেন, ‘দাঁতের ডাক্তার যে ইতিহাসের এত খোঁজ রাখেন সে তো জানতাম না। সে যাই হোক, রাণী ভবশঙ্করী-র চতুর্ভুজ চক্রবর্তী নামের একজন বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি ছিলেন সেটা জানেন তো? কথিত আছে যে আমাদের জমিদারির পত্তন যিনি করেন সেই রমেন্দ্রনারায়ণ মিত্তির ছিলেন এই চক্রবর্তী মশাইয়ের ডানহাত। রাণী ভবশঙ্করী সামনাসামনি যুদ্ধে পাঠানদের কচুকাটা করার পর প্রাণের ভয়ে রমেন্দ্রনারায়ণ পালিয়ে চলে আসেন এদিকে। সঙ্গে টাকাপয়সা তো ছিলোই, আর মানুষটাও ছিলেন বেশ মারকুটে লোক। ফলে আসর জমাতে বিশেষ দেরি হয়নি। এখানে আসার পর রমেন্দ্রনারায়ণের এক শাগরেদ জোটে, নাম রঘুপতি সামন্ত, পাঠান সৈন্যদলের এক নামকাটা সেপাই। লোকটির পেশা ছিল চুরি ছিনতাই রাহজানি ইত্যাদি, তাই এই এলাকার রাস্তাঘাট হালহকিকত সব ছিল তার নখদর্পণে। তার সাহায্যেই খানিকটা গায়ের জোরে, খানিকটা পয়সা ছড়িয়ে রমেন্দ্রনারায়ণ এই জমিদারির পত্তন করেন। এই জমিদারবাড়িও তাঁর তৈরি, ওই মন্দিরও।’

‘খুব ইন্টারেস্টিং তো।’

‘সে আর বলতে। আরও শুনুন, এই যে ওই বুড়োশিবের মন্দিরে আলাদা করে কোনও ব্রাহ্মণ পুরোহিত ছিলেন না, রমেন্দ্রনারায়ণ নিজেই পুজো করতেন। আর সেই পুজোয় সাহায্য করতেন তাঁর সেই শাগরেদ রঘুপতি সামন্ত। আরও ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, আমাদের এই ভজন হচ্ছে গিয়ে সেই রঘুপতি সামন্তর বংশধর।’

ভজন একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।

‘বাগানের একদম শেষে একটা ইঁদারা দেখতে পাচ্ছি মনে হচ্ছে?’ প্রশ্ন করলেন সতীশ ডাক্তার।

‘ঠিকই দেখছেন। তবে ওতে জল নেই বেশি। এককালে বাগানের ওপাশ দিয়েই ছিল গঙ্গার খাত। ইঁদারার সঙ্গে নাকি তার যোগাযোগ ছিল। এখন অবশ্য গঙ্গা সরে গেছে অনেকটা। ইঁদারাও কবেই মরে হেজে গেছে। এককালে ওই ইঁদারার জলেই ঠাকুর পুজো হত।’

‘এখন আর পুজো হয় না?’

‘সে তো মন্দিরের হাল দেখেই বুঝছেন আশা করি। তবে তার পেছনেও একটা ইতিহাস আছে।’

‘কীরকম?’

‘যে শিবলিঙ্গটিতে পুজো করা হত, তার আকৃতি ছিল বিশাল। প্রায় আট ফুট লম্বা, চার ফুট ব্যাস। দূর দূর থেকে লোকে ঘুঘুডাঙার বুড়োশিব দেখতে আসত। কিন্তু আজ থেকে প্রায় একশো তিরিশ বছর আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়।’

‘দুর্ঘটনা বলতে?’

‘সেবার বিজয়া দশমীর দিন বুড়োশিবের মন্দিরে চোর ঢোকে। এই এলাকার চোর না, বাইরের লোক। শিবলিঙ্গের মাথার দিকে তিনটে ত্রিপুন্ড্রক লাগানো থাকত। প্রায় একফুট চওড়া, ছয় ইঞ্চি লম্বা। রমেন্দ্রনারায়ণই লাগিয়েছিলেন। চোর সেই তিনটে সোনার ত্রিপুণ্ড্রক খুলে নিয়ে ভ্যানিশ হয়ে যায়।’

‘চোর ধরা পড়েনি?’

‘নাহ। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনেক খোঁজ করেছিলেন। লোক লাগিয়ে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে ইনাম ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু কোনও পাত্তা পাওয়া যায়নি। শুধু বছর দুয়েক পর চন্দননগর থেকে, তখন নাম ছিল ফরাসডাঙা, খবর এল যে সেখানকার হিরু স্যাকরা নাকি কার কাছে দেখেছে তিনটে অমন সোনার পাত। শুনে আমার পূর্বপুরুষেরা সেখানে দৌড়লেন। কিন্তু তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। অজাত কুজাতের চোরের ছোঁয়ায় অপবিত্র হয়েছে, এই অজুহাতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা মন্দিরটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন।’

‘খুব ইন্টারেস্টিং তো।’

‘সে তো বটেই। শুধু সোনার ওজন বা দামের জন্য না, ওই সোনার ত্রিপুণ্ড্রকের আরও একটা গুরুত্ব ছিল। আমাদের পারিবারিক ইতিহাস অনুযায়ী রমেন্দ্রনারায়ণ নাকি এই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে ঘোষণা করেন, যতদিন এই সোনার ত্রিপুণ্ড্রক বুড়োশিবের কপালে শোভা পাবে, ততদিন মিত্তির বংশের গৌরব অটুট থাকবে। বুঝতেই পারছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা ওটাকে আলাদা চোখে দেখতেন। মন্দির বন্ধ করে দেওয়ার সেটাও একটা কারণ।’

‘আর ওই গুমঘরের গল্পটা বল দাদু, ‘গগন মল্লিক উসকে দেয় ভজন।’

‘আরে ধুর, ছাড়ো তো ওসব গল্পগাছা, ‘যতীন্দ্রনারায়ণ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

‘এটা আবার কী জিনিস?’ কৌতূহলী হন সতীশ ডাক্তার।

‘আরে তেমন কিছু না। লোকজন বলে আমাদের এই জমিদার বাড়ির কোথাও নাকি মাটির নীচে একটা গুমঘর আছে। রমেন্দ্রনারায়ণ তাঁর অবাধ্য প্রজাদের সেই ঘরে গুম করতেন। ঘরটার আরও বিশেষত্ব হচ্ছে সেটা নাকি এমনি সাধারণ তালাচাবি দিয়ে খোলা যায় না। সে যুগে বানানো কম্বিনেশন লক দিয়ে ঘরটা বন্ধ করা।

‘বলেন কি?’

‘হুম। রমেন্দ্রনারায়ণের যে শাগরেদের কথা বললাম, সেই রঘুপতি সামন্ত ছিলেন এইসব কারিগরিতে একজন ধুরন্ধর মানুষ। তবে এ সবই শোনা কথা, সত্যিমিথ্যে জানা যায় না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনেকেই চেষ্টা করেছেন সেই গুমঘর খোঁজার। কিন্তু কেউই খুঁজে পাননি।’

তিনজনে নীচে নেমে এলেন। সতীশ ডাক্তার বললেন, ‘নাটমন্দিরটা একবার দেখা যায়?’

যতীন্দ্রনারায়ণ হেসে বললেন ‘দেখা যাবে না কেন, আসুন না।’

শূন্য মন্দির। দেওয়াল ঘেঁষে সিমেন্টের বাঁধানো বেদি। তার সামনে মেঝেতে সুন্দর ডিজাইন করা নকশা। বোঝা যায় যে ওখানে ঘট রাখা হত। পেছনের দিকে দেওয়ালে দুটো বড় বড় জানলা। সেখান থেকে আলো এসে মেঝের ওপর পড়ছিল। সেদিকে তাকিয়ে সতীশ ডাক্তার বললেন, ‘এখন আর এখানে পুজো হয় না, না?’

যতীন্দ্রনারায়ণ হাত উলটে বললেন, ‘কে করবে? দুর্গোপুজো করা কি চাট্টিখানি কথা? বাবা মারা গেছেন বিশ বছর হল। তার পরে পরেই মা-ও চলে গেলেন। ব্রজ তো সেই ছোট থেকেই বাউন্ডুলে, ঘরছাড়া। আমার গিন্নিরও বয়েস হয়েছে। এই বয়সে আর এত ধকল নিতে পারি না ডাক্তারবাবু। নইলে আমারই কি ইচ্ছে ছিল পুজো বন্ধ করার? একশো বছরের ওপর পারিবারিক পুজো, এককালে শুনেছি সাহেব সুবোরাও দেখতে আসতেন…..’

যতীন্দ্রনারায়ণ বক বক করে যাচ্ছিলেন। সেদিকে কান দিচ্ছিলেন না সতীশ। তাঁর নজরে পড়েছে যে বেদির ঠিক বাঁপাশে একটা রংচটা কাঠের দরজা, তার মাথায় শিকল লাগানো। শিকল থেকে একটা মর্চে পড়া মোটকা তালা ঝুলছে।

‘ওই ঘরে কী আছে যতীনবাবু?’ আঙুল তুলে দরজার দিকে নির্দেশ করলেন সতীশ ডাক্তার।

‘ও, ওই ঘরটায়? তেমন কিছুই না,’ হাত উলটোলেন যতীন্দ্রনারায়ণ। ‘আমাদেরই কিছু পুরোনো জিনিস পত্তর, ফ্যামিলি এয়ারলুম বলতে পারেন। তবে তেমন দামি কিছু না। দেখবেন তো চলুন। আপনার তো আবার হিস্ট্রিতে ইন্টারেস্ট আছে বলে মনে হচ্ছে। আপনার ভালো লাগবে আশা করি।’

দরজা খুলে আলো জ্বালালেন যতীন্দ্র। তারপর উলটোদিকের দেওয়ালে গিয়ে জানলাটা খুলে দিলেন। অমনি ঝকঝকে আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘরটার মধ্যে।

চারিদিকে তাকালেন গগন মল্লিক আর সতীশ ডাক্তার। সারা ঘর জুড়ে বিচিত্র সব জিনিসপত্র সাজানো। দেওয়াল জুড়ে বড় বড় র‌্যাক। তার মধ্যে পোর্সিলিনের পুতুল, রুপোর বাসন, পেতলের বড় পিলসুজ, ধাতুর তৈরি বিভিন্ন মূর্তি এসব তো আছেই। তার সঙ্গে আছে বিভিন্ন পানপাত্র, হাতির দাঁতের ছোটখাটো কারুকার্য, ছোরা আর তলোয়ার, ছোট ছোট টেবিল ঘড়ি। দেওয়ালে ঝুলছে কিছু অ্যান্টিক ওয়ালক্লক, তিন চারটে ছবি, কিছু টিবেটান থাঙ্কা এইসব।

চারিদিকে তাকিয়ে সতীশ ডাক্তার বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘করেছেন কী মশাই? এ তো পুরো ইতিহাসের খাজানা দেখছি। এ জিনিস নীলামে ওঠালে তো লালে লাল হয়ে যাবেন আপনারা।’

যতীন্দ্রনারায়ণ গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘নাহ, ডাক্তারাবুর দেখছি এই লাইনে ভালোই ইন্টারেস্ট আছে। আমি অবশ্য এসব তেমন বুঝি না। তবে এটুকু জানি আপনি যা বললেন তা বর্ণে বর্ণে সত্যি। এই ঘরে যা যা আছে সেসবের অ্যান্টিক ভ্যালু খারাপ না, অকশনে ওঠালে ভালো দামও পাব। তবে তার দরকারও নেই। বলতে নেই এখনও অবধি মিত্র বংশের খাওয়া পরার অভাব নেই কোনও।’

‘লাস্ট কবে খোলা হয়েছে এই তালা?’ প্রশ্ন করলেন সতীশ ডাক্তার।

‘বোধ হয় ব্রজ আসার পরে পরই। আমি আর হেম তো ওকে দেখে কেঁদেই ভাসালাম অনেকক্ষণ। তারপর দুই ভাইবোনের তো গল্প শেষই হয় না। দিল্লি আর লখনউ থেকে আমাদের জন্য অনেক কিছু এনেছিল ব্রজ। হেম-এর জন্য বিলিতি সাজগোজের জিনিস, আমার জন্য কোট প্যান্ট, একটা দামি মোবাইল। ঘরে একটা দামি টিভি লাগিয়ে দিয়ে বলল ‘বাবা, এবার একটু ভালো করে ক্রিকেট ম্যাচগুলো দেখো।’ আমি তো ভাবলাম শেষ বয়সে বোধহয় ভগবান মুখ তুলে চাইলেন। সেই ব্রজ যে তার কয়েকদিন মধ্যেই…’ গলাটা ধরে এল, কথাটা শেষ করতে পারলেন না যতীন্দ্রনারায়ণ।

গগন মল্লিক এগিয়ে এসে যতীন্দ্রনারায়ণের কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, ‘পুলিশ কী বলল কাকা?’

যতীন্দ্রনারায়ণ ধরা গলায় বললেন, ‘বলল তদন্ত চলছে। এদিকে আমি বুড়ো মানুষ, আর হেমকে তো জানই। কতকাল আর এই নিয়ে লেগে থাকব বল তো?’

চারজনে নাটমন্দির থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখলেন সিঁড়ির নীচে হেমনলিনী গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যতীন্দ্রনারায়ণকে দেখে বললেন, ‘বাবা, তুমি কাল পরশু’র মধ্যে একবার ব্রজ’র ঘরে ঢুকেছিলে নাকি?’

যতীন্দ্রনারায়ণ আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘কই, না তো? তা ছাড়া ওই ঘরের চাবি তো তোর কাছে থাকে।’

‘কী জানি বাপু। দিন দুয়েক আগে মনের ভুলে চিরুনিটা ফেলে এসেছিলুম ও ঘরে, পষ্ট মনে আছে যে খাটের ওপর ছিল। এখন গিয়ে দেখি নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর খাটের নীচে পেলাম। কেন বল তো?’

যতীন্দ্র কী বললেন শোনার আগেই সতীশ ডাক্তার আর গগন মল্লিক ভজনকে নিয়ে জমিদারবাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন। সামনে একটা সদ্য কেনা মোটরগাড়ি ধুলো উড়িয়ে যাচ্ছিল। ওঁদের দেখেই থেমে গেল। ড্রাইভারের সিটে বিশু গুছাইত, তার পাশে নরহরি চক্রবর্তী।

‘কী হে বিশু নতুন গাড়ি দেখছি। কিনলে নাকি?’ সহাস্যে প্রশ্ন করলেন গগন মল্লিক।

দু-কান এঁটো করা একটা হাসি উপহার দিল বিশু, ‘আপনাদের আশীর্বাদ দাদা, এই মাত্তর ডেলিভারি নিয়ে এলাম। ভাবলাম গোঁসাইপুরে জগদানন্দ স্বামীজির কাছ থেকে একটা আশীর্বাদ নিয়ে আসি। তা আপনারাও যাবেন নাকি?’

আর বলতে হল না, তিনজনে ঝটপট উঠে পড়লেন গাড়িতে। গাড়িতে উঠেই খুব মিষ্টি হেসে প্রথম কথা বললেন গগন মল্লিক, ‘এটা বোধ হয় মাস দুয়েকের আগের বন্যার বাজেট থেকে, তাই না বিশু? আশা করছি সামনের সাইক্লোনে একটা আস্ত প্লেনই কিনতে পারবে, কী বলো হে?’

* * *

গগন মল্লিক আর বাকিরা যখন গোঁসাইপুরে পৌঁছলেন, তখন বেশ বেলা হয়েছে। আশ্রমের সামনে মেলা লোক। ইতিউতি কয়েকটা দামি গাড়ি দাঁড়িয়ে। আশ্রমের পেছন দিকে শামিয়ানা টাঙানো, সেখানে বোধ হয় খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। অপূর্ব সুবাসে চারিদিকের বাতাস আমোদিত। আশ্রমের ফুলে ফুলে সাজানো গেটের সামনে দুটো স্পীকার বসানো, সেখানে চাপাস্বরে ‘মা কী আমার কালো রে’ ভেসে আসছে। চৌহদ্দির একধারে একটা খুঁটিতে দুটো ছাগল বেঁধে রাখা। তারা করুণস্বরে ব্যা ব্যা করছে। চারিদিকে বেশ একটা পবিত্র ভক্তিভাব ছড়ানো।

দরজা দিয়ে ধুতি আর ফতুয়া পরা এক ভদ্রলোক বেরিয়ে আসছিলেন, চোখেমুখে একটা ভাববিহ্বল ব্যাপার। তাঁকে দেখেই সোৎসাহে এগিয়ে গেলেন নরহরি, ‘কী হে পরেশ, আজ যে একেবারে নান্দিভাস্যি কাণ্ড দেখছি। বলছি আজ কি স্বামীজির কোনও বিশেষ লীলেটিলে আছে নাকি?’

পরেশ সাঁতরা বিগলিত স্বরে বললেন, ‘প্রভুজীর লীলা নিত্যই চলে চলে হে নরহরি। তাঁর প্রতিক্ষণ মাহেন্দ্রক্ষণ, প্রতি তিথি পুণ্যতিথি, তাঁর প্রতি লীলাই আশ্চর্যলীলা। জয় মহাকালী, জয় ভবানী, জয় বাবা জগদানন্দ স্বামী।’

গগন মল্লিক একটু অপ্রসন্ন গলায় বললেন, ‘তুমি না এককালে ঘুঘুডাঙা যুক্তিবাদী সমিতির একজন হর্তাকর্তা ছিলে পরেশ? তোমার এ কী অধঃপতন।’

পরেশ সাঁতরা প্রথমে গগন মল্লিককে দেখতে পাননি। এবার লক্ষ্য করে ত্রিভঙ্গমুরারি থেকে সামান্য সোজা হলেন, গ্যালগ্যালে ভাব উধাও হল। সুমিষ্টস্বরে বললেন, ‘আরে, গগনদা যে! অনেকদিন পর দেখা। ভালো আছেন তো দাদা?’

গগন মল্লিকের স্বভাবই হচ্ছে অল্পেতে উত্তেজিত হওয়া, তিনি একটু গলা তুলে বললেন, ‘আমার ভালো থাকা না থাকার কথা হচ্ছে না পরেশ। কথা হচ্ছে তোমার মতিভ্রম হওয়া নিয়ে। কোন আক্কেলে তুমি এই ফেরেব্বাজ বাবাজীর পাল্লায় পড়লে?’

বিশু গুছাইত শিহরিত হল, ভজন স্তম্ভিত। নরহরি আঁতকে উঠে গগন মল্লিকের মুখটা চেপে ধরলেন, ‘এসব কি এখানে না বললেই নয় গগন? বলি সুস্থ দেহে বাড়ি ফেরবার ইচ্ছে নেই বুঝি?’

পরেশ সাঁতরা থমথমে মুখে বললেন, ‘না জেনেশুনে কাউকে ফেরেব্বাজ বা ঠগ বলে দেগে দেওয়াটা মোটেও কাজের কথা নয় গগনদা। ওটাও একধরনের মূর্খামি। তিনি কোথাও কাউকে ঠকিয়েছেন বলে খবর পেয়েছেন?’

গগন মল্লিক একটু ম্রিয়মাণ হয়ে বললেন, ‘তা নয়। তবে এসব সন্ন্যাসী টন্ন্যাসী, গুরু গোঁসাই গোত্রের লোকজন প্রায়ই এসব করে বেড়ায় কি না।’

‘মানেটা কী? দু-একজন চুরি করে বলে সবাই চোর? বাহবা, বাঃ! এই আপনার যুক্তিবাদের শিক্ষা নাকি গগনদা?’

গগন মল্লিক একেবারে গুটিয়ে গেলেন। এই সুযোগে পরেশ সাঁতরা বেশ ওজস্বী ভাষায় হাত পা নেড়ে বলতে লাগলেন, ‘শুনুন গগনদা, প্রভুজি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন, আমাকে জ্ঞানযোগে দীক্ষা দিয়েছেন। ভুয়ো যুক্তিবাদের অন্ধ গোঁড়ামি ছেড়ে আজ আমি সত্যিই একজন মুক্ত পুরুষ। আজ আমার হৃদয় প্রভুজীর ভক্তিস্পর্শে কানায় কানায় ভরে উঠেছে। তাঁর ধৈর্য বিপুল, জ্ঞান অসীম, করুণা অপার…’

গগন মল্লিক হতাশ সুরে বললেন, ‘বুঝেছি। মাধ্যমিকে বাংলায় ভালো মার্কস পেয়ে পাশ করেছিলে। এখনও রচনা লেখার অভ্যেসটা যায়নি।’

এই সুযোগে সতীশ ডাক্তার এগিয়ে এলেন, ‘নমস্কার পরেশবাবু। আমি সতীশ চাকলাদার, দাঁতের ডাক্তার। জয়চণ্ডীতলায় রিসেন্টলি এসেছি। বলছি জগদানন্দ প্রভু’র সঙ্গে একবার দেখা করা যায় না?’

‘তা যাবে না কেন? প্রভু তো আর একচোখো রিটায়ার্ড মাস্টার নন, অকারণে কারও নিন্দেমন্দও করেন না। তাঁর কাছে সবার অবারিত দ্বার। ওই তো সোজা এগিয়ে যান, সামনের হলঘরেই কীর্তন হচ্ছে।’ বলে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন পরেশ সাঁতরা।

 আশ্রমের ভেতরে ঢুকেই একটা বড় হলঘর। দরজার বাইরে চটিজুতোর স্তূপ। চারজনে অতি সন্তর্পণে সেই স্তূপের একধারে নিজেদের চটি খুলে ভেতরে ঢুকলেন।

দরজার ঠিক উলটোদিকের দেওয়াল ঘেঁষে একটা বেদিমতন করা হয়েছে। তার ওপর দামি জাজিম পাতা। বেদির ওপর জগদানন্দ স্বামী বসে আছেন। অঘোরী সন্ন্যাসী বলতেই যেরকম মনে হয় সেরকম মোটেই দেখতে হয়। পাতলা ছিপছিপে চেহারা, মাথার জটাজূট আর কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফের জঙ্গল পেরিয়ে বয়স আন্দাজ করা বেশ মুশকিল। পরনে রক্তাম্বর, একটা লাল উত্তরীয়কে চাদরের মতো করে গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন। দু-হাতে দশটা আংটি। বেদির নীচে দুদিকে জনা দুয়েক গেরুয়া পরিহিত চেলা। তাদের দাড়িগোঁফের ঘনঘটা বেশ নজরে পড়ার মতোই। তাদের দৃষ্টি ঘুরছে সবার ওপর, বোধহয় প্রণামীর আশায়।

স্বামীজির সামনে কম করে জনা ত্রিশেক পুরুষ বসে। দশ বারোজন মহিলাও আছেন, তাঁরা একধার ঘেঁষে বসেছেন। তবে একদম সামনে বসেছিলেন হোঁতকা মতো এক ভদ্রলোক। অসম্ভব ফর্সা, মাথায় খোঁচা খোঁচা চুল, ঘাড়ে গর্দানে চেহারা। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় সিল্কের পাঞ্জাবি পরে একটা সাদা রঙের মোষ বসে আছে।

গগন মল্লিক বিশু গুছাইতের কান এড়িয়ে সতীশ ডাক্তারকে বললেন, ‘বিষ্ণুচরণ তিওয়ারি। যার কথা কালকে বলছিলাম তোমাকে। এই এলাকার প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ও গুন্ডা। বিশু’র পার্টি থেকে নেক্সট ইলেকশনের টিকিট পাওয়ার চেষ্টায় আছে।’

কথাটা কিন্তু বিশুর কানে গেল। চাপাস্বরে সে বলল, ‘আপনাদের পার্টিতে ঢালাও চাঁদা দেওয়ার সময় তো বিষ্টুদা’কে তো দলের সম্পদ বলতেন। এখন আমাদের পার্টির টিকিট চাইছে করে বলে গুন্ডা হয়ে গেলো?’

গগন মল্লিক বিশু’র দিকে একটা ভস্ম করে দেওয়ার দৃষ্টি দিলেন। সতীশ ডাক্তার ফিক করে হেসে ফেললেন।

জগদানন্দস্বামী বলছিলেন, ‘জগন্মাতার কাছে পৌঁছনোর সবচেয়ে সহজ উপায় হল অচলা শুদ্ধাভক্তি, তাঁর পাদপদ্মে অটল আস্থা। দেহমনআত্মা সবশুদ্ধু তাতে সমর্পণ না করলে মা ভক্তকে মুক্তির পথে টেনে নেন না।’

বিষ্ণুচরণ হাত জোড় করে বললেন, ‘আপনি তো জানেন বাবাজী, কাজ কাজ করে করে লাইফ একেবারে হেল হয়ে আছে। পাবলিককে সার্ভ করতেই চাই। কিন্তু বেওসা নিয়ে এত বিজি থাকি যে পাবলিককে সার্ভ করার তেমন টাইমই পাই না। বলছি কি আমাদের মতো লোকদের জন্য, মানে পাবলিক সার্ভেন্টদের জন্য কোনও ইজি ওয়ে আউট নেই?

সতীশ ডাক্তার গলা নামিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘বাংলার উঠতি জনসেবক কথায় কথায় এত ইংরেজি ঝাড়েন কেন?’

‘ইনি এককালে সাধারণ বাংলাই বলতেন। কিন্তু যবে থেকে নেতা হওয়ার চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগেছেন, তবে থেকেই ইংরেজি বলার প্রকোপটা একটু বেড়ে গেছে দেখেছি। অশিক্ষিত পার্টির নেতা হলে যা হয়।’ ফিসফিস করলেন গগন মল্লিক।

পেছন থেকে আরও মৃদুস্বরে ফিসফিস করল বিশু, ‘ইনি কিন্তু এককালে আপনার পার্টির লোকাল শিক্ষা সেলের কেষ্টবিষ্টু ছিলেন গগনদা, তাও আবার মোটা চাঁদা দিয়ে, ভুলে যাবেন না মাইরি।’

পাশ থেকে নরহরি চক্কোত্তি দাঁতে দাঁত ঘষলেন, ‘দুটোরই দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিতে হয়। এসেছে একটা শুভ কাজে, এখানেও শুম্ভ নিশুম্ভের লড়াই চলছে।’

ভজন খ্যাঁক করে হেসেই চুপ করে গেল। বিশু আর গগন মানে মানে চেপে গেলেন। ততক্ষণে বাজখাঁই গলায় বলতে শুরু করেছেন জগদানন্দস্বামী, ‘অন্য পথ আছে বিষ্টু। সে পথ কর্মের পথ, সে পথেই তোমার জয়, তোমার মুক্তি। যোগমার্গ, জ্ঞানমার্গ, ভক্তিমার্গ ছাড়াও পথ আছে, তার নাম কর্মমার্গ। তুমি নিঃস্বার্থভাবে জনগণের সেবা করে যাও, বিজয় তোমার হবেই।’

বিষ্ণুচরণ সামান্য ইতস্তত করে বললেন, ‘বিজয় তো আমার হয়েই আছে। কালকেই ডীল ফাইনাল হয়ে গেছে। কিন্তু…’

বিশু গুছাইত ফের খ্যাঁক করে হেসে চাপা গলায় বলল, ‘বিজয় মাহাতো, আপনাদের কালচারাল সেলের প্রেসিডেন্ট, সে কাল আমাদের পার্টি জয়েন করছে, খবরটা জানেন তো গগনদা?’

গগন মাহাতো দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, ‘খরচা কত পড়ল বিশু?’

‘সে তেমন কিছু নয়,’ ফিকফিক করে হেসে বিশু বলল, ‘এবছরের নিখিল ঘুঘুডাঙা সাহিত্য সম্মানটা গচ্চা গেল, এই আর কি। আর খরচাটরচার কথা বলছেন? টাকার হিসেবে সে সামান্যই। এমনিতেও স্টেজফেজ হল ভাড়ার খরচা পার্টিই দেয়। তার সঙ্গে একটা উত্তরীয়, একটা মালা, শ’দেড়েকের একটা মেমেন্টো আর একটা মিষ্টির প্যাকেট। শ’পাঁচেকের মধ্যে আপনাদের কালচারাল সেল আমাদের পকেটে।’

গগন মল্লিক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই মধুর হেসে জগদানন্দ বললেন, ‘হবে বিষ্টুবাবু, হবে। একেই তোমার রাহু প্রবল, তার ওপর তিনি আগামী দেড় বছর মঙ্গলের গোচরে থাকবেন। আগামী লোকসভা ইলেকশনে তোমার টিকিট পাক্কা, কাল রাত্রে স্বয়ং জগন্মাতা আমার স্বপ্নে এসে একথা বলে গেছেন। শুধু তাই নয়, তোমার ওপর মহামায়ার কৃপা আছে। কী বলা যায়, হয়তো রাজ্যে একটা মন্ত্রীটন্ত্রী হয়ে গেলে।’

বিষ্ণুচরণ কাটা কলাগাছের মতো জগদানন্দের পায়ে পড়ে গেলেন’ এখানে আপনার টেম্পল গড়িয়ে দেব গুরুদেব, সঙ্গে আপনার সোনার আইডল। জাস্ট ভোটটা দেখে নেবেন মাইরি।’

হলঘরে বিষ্ণুচরণের অনুগত চ্যালারা মৃদুস্বরে ইনকিলাব জিন্দাবাদ আওয়াজ তুলল। বাকি ভক্তরা সিঁটিয়ে রইলেন। বিষ্ণুচরণ সজল নয়নে প্রণামট্রনাম সেরে উঠে করিমকে সামনে পেয়ে কষিয়ে একটা থাবড়া লাগালেন ‘হতচ্ছাড়া, এখানে ইনকিলাব জিন্দাবাদ কী বে? এটা কি ইলেকশনের ময়দান পেয়েছিস নাকি?’

বিষ্ণুচরণ এবং তার চ্যালারা বেরিয়ে যেতেই হলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এল। এলাকার প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ গোলোকবিহারী মজুমদার বললেন, ‘প্রভু, আমার নাতিটার লেখাপড়া কিচ্ছু হচ্ছে না। উদ্ধার হওয়ার কোনও উপায়?’

‘হবে হবে গোলোক, সব হবে।’ উদাত্তস্বরে নিদান দিলেন জগদানন্দস্বামী, ‘যৌবনের ধর্মই হচ্ছে উচ্ছৃঙ্খলতা, ওতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। ওর কেতুটা ফেরোশাস হয়ে আছে, একটা ক্যাটস আই পরালে ভালো হয়। তবে সামনের চৈত্রটা যাক। তারপর না হয় পরিস্থিতি বুঝে একটা ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’

আরও অনেকে অনেক প্রশ্ন করতে লাগলেন। স্বামীজি বেশ হাসিমুখে ধৈর্য ধরে সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। সতীশ ডাক্তার কিন্তু সেদিকে মন দিলেন না। তিনি তীক্ষ্নচোখে স্বামীজির দিকে চেয়ে রইলেন।

কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবারের সময় হয়ে এল। গগন মল্লিক অ্যান্ড কোং বিদায় নিতে যাবেন, এমন সময় সতীশ ডাক্তার হঠাৎ উঠে এসে গোঁসাইজির পা জড়িয়ে পড়ে গেলেন, ‘প্রভু, আমার কী উদ্ধার হবে না?’

স্বামীজিকে এতক্ষণ বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল। কিন্তু এই অকস্মাৎ আক্রমণে যেন কিঞ্চিৎ ভেবলে গেলেন। খানিক গলা খাঁকড়ে বললেন, ‘আপনার কী সমস্যা?’

‘জীবনের মানে খুঁজে বেড়াচ্ছি প্রভু। মালটা আশেপাশেই আছে, কিন্তু ক্যাপচার করতে পারছি না। তার খোঁজ কি পাব না গুরুদেব?’

স্বামীজি এতক্ষণে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছেন। তিনি ঝট করে আপনি থেকে তুইতে নেমে এলেন। সতীশ ডাক্তারের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘পাবি রে পাগলা পাবি, মায়ের শরণ নে, তাহলেই হবে। তিনি দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী। তাঁর শরণ নিলে ত্রিতাপ নাশ হয়, তিনি আমাদের যাবতীয় রোগ শোক ক্লেশ হরণ করে থাকেন। তাঁর পায়ের কাছে বডি ফেলে দ্যাখ পাগলা, তোর মুক্তি আটকাবে কে?’

সতীশ ডাক্তার প্রণাম করে পিছু হটে এলেন। সভা ভেঙে গেল। ভক্তরা নিজেদের নিজেদের জুতো খুঁজে যেখানে প্রসাদ বিতরণ হচ্ছিল সেদিকে রওনা দিলেন।

.

নরহরি চক্কোত্তি গাড়িতে উঠেই গগন মল্লিককে চেপে ধরলেন, ‘কী হে মল্লিকমশাই, ঈশ্বরে বিশ্বাস কিছু এল?’

গগন মল্লিক গম্ভীরস্বরে উত্তর দিলেন, ‘বিশ্বাস আসার মতো কিছু হয়েছে কি?’

বিশু গুছাইত খুঁ খুঁ করে হাসতে হাসতে বলল, ‘সত্যি কথাটা স্বীকার করুন না গগনদা, বাবাজীর কাজকারবার দেখে আপনার চিত্তি চড়কগাছ হয়ে গেছে।’

শান্তস্বরে হুল ফুটোলেন গগন মল্লিক, ‘তোমার মতো বেআক্কেলে লোকেদের চিত্তি শুধু চড়কগাছ কেন, অনেক জায়গাতেই চড়ে বিশু। কিন্তু তাতে যে আমার চিত্ত বিন্দুমাত্র বিক্ষিপ্ত হয় না সে তোমরা ভালোভাবেই জানো।’

বিশু গুছাইত তখনই কিছু বলল না। ভজন, সতীশ ডাক্তার আর গগন মল্লিককে সতীশের ডাক্তারখানার সামনে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার আগে মধুরস্বরে বলে গেল, ‘সামনেই তো ইলেকশন, বিষ্টুদা এবার আমাদের হয়ে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন। তা ইলেকশনের ডিউটিতে থাকছেন তো গগনদা?’

গম্ভীরমুখে গগন মল্লিক বললেন, ‘আমি অনৈতিক কাজকারবারীদের প্রশ্রয় দিই না বিশু। চোখের সামনে ভোট লুঠ হতে দেখতে পারব না।

বিশু গুছাইত খ্যাঁক করে হেসে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল।

‘তোমার কী মনে হল ডাক্তার?’

মৃদু হাসলেন সতীশ চাকলাদার, ‘ভাবাভাবির কিছু নেই গগনদা। বাবাজী জাল।’

‘মানে?’ চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন গগন মল্লিক, ‘জাল বাবাজী? কী করে বুঝলে?’

‘একটু ভাবলে আর সামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকলে আপনিও বুঝতেন দাদা। বাবাজীর আবির্ভাবের গল্পটা মনে করে দেখুন, হরেন মুখুজ্জে যখন বাবাজীর খোঁজ পান তখন তিনি নাকি একা সাধনা করছেন। তাহলে তিনি চ্যালা জোটালেন কোথা থেকে? বাবাজী আর তাঁর চ্যালারা নতুন পাটভাঙা গেরুয়া কাপড়ই বা পেলেন কোথা থেকে? সাধুদের পরণের কাপড় তো সচরাচর এত নতুন হয় না।’

ইতস্তত করলেন গগন, ‘সে তো কোনও বা কোনও ভক্ত এঁদের নতুন কাপড় দিতেই পারে। তাই না?’

‘তা পারে বইকি,’ মাথা নাড়লেন সতীশ ডাক্তার, ‘তবে কি না বাবাজীর চ্যালাদের দাড়ি গোঁফ থেকে রীতিমতো স্পিরিট গামের গন্ধ বেরোচ্ছিলো। কাছে গিয়েই সেটা টের পেয়েছি।’

গগন মল্লিক খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন সতীশ ডাক্তারের দিকে। চিন্তিতস্বরে বললেন, ‘কয়েকদিন আগেই দুটো খুন হয়ে গেল গ্রামে। আজ আবার জাল বাবাজী এসে উপস্থিত। ঘুঘুডাঙায় এসব কী হচ্ছে ডাক্তার?’

সতীশ ডাক্তার গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘এখনও কিছু হয়নি মল্লিকদা, আমার ধারণা ঘুঘুডাঙায় শিগ্গিরিই কিছু হতে চলেছে, সাঙ্ঘাতিক একটা কিছু।’

ভজন ইতস্তত করে বলল, ‘গগন স্যার, আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল।’

‘কী কথা ভজন?’

‘একটা বিষয়ে আপনার পরামর্শ চাই। তার সঙ্গে বোধ হয় কাকা আর ব্রজকাকার খুন হওয়ার সম্পর্ক আছে।’

সতীশ ডাক্তার আর গগন মল্লিক দুজনেই চমকে তাকালেন ভজনের দিকে। ভজন শার্টটা একটু ওপরে তুলে তার পেটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা ছোট প্যাকেট বার করল। তারপর প্যাকেটা থেকে বেরোল একটা ছোট লাল রঙের ডায়েরি। সেটা গগন মল্লিকের হাতে তুলে দিয়ে ভজন বলল, ‘সব কিছুর শুরু এখান থেকেই।’

* * *

সেদিন রাতে কলকাতার সি আই ডি-র দপ্তরে একটা মস্ত ডেস্কটপ স্ক্রিনের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল একটা মাথা। খুব মন দিয়ে একটা সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখছিল কেউ। একটা জায়গা বার কয়েক দেখার পর একজায়গায় স্থির হল ভিডিওটা। স্ক্রিন জুড়ে একজনের মুখ। এবার আরেকটা উইনডো খোলা হল। তাতে একজন মানুষের পাসপোর্ট সাইজের ছবি। এবার কিছু একটা সফটওয়্যার রান করানো হল দুটো ছবি দিয়ে। কিছুক্ষণ পর স্ক্রীনে ফুটে উঠল একটা লেখা, ‘এইট্টি টু পার্সেন্ট ম্যাচ ফাউন্ড।’

পাশেই রাখা ছিল একটা ল্যান্ডলাইন। সেখান থেকে একটা মোবাইলে কল করা হল। ওদিক থেকে হ্যালো ভেসে আসতেই এপারের মানুষটি বলল, ‘চিড়িয়া স্পটেড স্যার।’

গ্যাঁড়াপোতা স্টেশনে এসেই একটা ফাঁকা ট্রেন পেয়ে গেল ভজন। কামরায় উঠে একদম শেষের দিকে জানলার পাশে একখানা ফাঁকা সিট দেখে বেশ জুত করে বসল সে। বেশ রাত হয়েছে, ফাঁকা কামরা ওপারে চারটে লোক বসে তাস খেলছে। এপারের সিটে তেমন কেউ নেই। ভজন বসেছে কামরার বাঁদিকের জানলা ঘেঁষে। ওর সঙ্গে আরও একটা লোক উঠল। সে বসেছে ডানদিকের জানলার কাছে।

ভজন সিটে বসে কাঁধের ঝোলাটাকে সাবধানে কোলের ওপর রাখল। ওর মধ্যে আছে স্টেশন বাজারের দাশরথি বুক স্টল থেকে কেনা ওর কয়েকটা পছন্দের বই। আর সেই কালান্তক ডায়েরিটা।

গত দুদিন ধরে এই ডায়েরিটা নিয়ে অনেক ভেবেচিন্তেও কিছু কূলকিনারা করতে না ভজন শেষমেশ কাল রাতে গগন মল্লিকের কাছে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলে। হাজার হোক গগন মল্লিক বুঝদার মানুষ, অনেক জানাশোনা আছে।

গগন মল্লিকের পরামর্শেই ভজন গ্যাঁড়াপোতায় এসেছিল ভূপেন দারোগার কাছে। ঘুঘুডাঙা, নবাবগঞ্জ, ময়নাতলা আর গ্যাঁড়াপোতা, এই চারটে গ্রাম মিলিয়ে থানাটা গ্যাঁড়াপোতাতেই। কাকা খুন হয়ে যাওয়ার পর পরই ভূপেন দারোগার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল বটে। কিন্তু ভূপেন দারোগা ব্যাপারটাকে মোটেই আমল দেয়নি, ‘তোর কাকা খুন হয়ে তোকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল রে ভজন, এবার একটু স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে কাজেকম্মে মন দে দিকি,’ বলে হাঁকিয়ে দিয়েছিল। আজও মোটেই কিছু সুরাহা হল না। ভূপেন দারোগা ডায়েরিটা দেখেই তেড়িয়া হয়ে, ‘আমার সঙ্গে মশকরা হচ্ছে মর্কট? এসব অং বং চং নিয়ে সরকারি কাজের সময় নষ্ট করা কীরকম বিপজ্জনক কাজ জানিস? পেনাল কোডের সাড়ে চুয়াত্তর নং ধারার একুশের বি উপধারায় লকআপে ঢুকিয়ে দেবো নাকি দুটো রামগাঁট্টা?’ এসব বলে টলে ওকে ভাগিয়ে দিলেন। গগন মল্লিকের কথা শুনে মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘যা যা, হাঁদাগোবিন্দ পাগলা মাস্টারটাকে বল আগে পরের ইলেকশনটা জিতে আসতে, তারপর যেন আমাকে লোক পাঠিয়ে চমকাতে আসে।’

ট্রেনের দুলুনিতে চোখ বুজে এসেছিল ভজনের। এই এলাকার লোকজন স্টেশনের দূরত্ব মাপে ঘুম দিয়ে। যেমন নবাবগঞ্জ থেকে ময়নাতলা এক ঘুম, চাপড়ামারি থেকে পোড়াপীরতলা দেড় ঘুম, এইরকম। মাঝেমধ্যে সেসব নিয়ে মহা ঝামেলা ঝঞ্ঝাটও হয়। এই তো সেদিনই কী কেলেঙ্কারি। এই এলাকার মহাপ্রসিদ্ধ হেকিম মইনুল খাঁ সায়েবের বয়েস হয়েছে নব্বইয়ের কাছাকাছি, তিনি প্রায়ই রোগী দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েন। সেদিন তিনি শেতলাতলা থেকে ট্রেনে উঠেছেন মসজিদ পাড়া যাবেন বলে, আড়াই ঘুমের রাস্তা। কিন্তু তার বদলে পৌঁছে গেছেন নিত্যানন্দনগর, তিন ঘুম পরের স্টেশন। ঘুম থেকে উঠে তো তাঁর চক্ষুস্থির! তারপর তো স্টেশন মাস্টার বলাই নন্দীর সঙ্গে মইনুলচাচা-র সে কী উস্তুমকুস্তুম লড়াই। বলাই নন্দী যতই টাইম টেবিল ঠেকায়, মইনুলচাচা ততই লাফিয়ে উঠে বলেন যে আশরাফুল মখলুকাতের পক্ষে হাফ ঘুম এমন কিছু গুণাহ নয়। ট্রেন কোম্পানীর উচিত ছিল গাড়ি ধীমেতালে চালানো। শেষমেশ মইনুলচাচার নাতনি এসে তার ঠাকুর্দাকে বকেঝকে বাড়ি নিয়ে যেতে ব্যাপারটা সেবারের মতো ঠান্ডা হয়।

ভজনের হিসেব আছে ঘুঘুডাঙা পৌঁছতে কতখানি ঘুমোতে হবে। কিন্তু চোখ বোজার কিছুক্ষণ পরেই ভজনের একটা অস্বস্তি হতে লাগল। চোখ খুলল সে, তারপর একবার হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙতেই চোখাচোখি হয়ে গেল লোকটার সঙ্গে।

ডানদিকের জানালায় বসা লোকটা সরে এসে এখন ঠিক ওর পাশে। শুধু যে পাশে বসে আছে তাই নয় ওর দিকে জুলজুল করে চেয়েও আছে বটে। লোকটার বয়েস পঞ্চাশের থেকে শুরু সত্তর আশি নব্বই যা খুশি হতে পারে। দড়কচা মারা চেহারা, মাথায় খোঁচাখোচা চুল, ভাঙা গালে এবড়োখেবড়ো দাড়ি। পরনে একটা নোংরা ফতুয়া আর ধুতি, চোখে একটা ভাঙা ডাঁটির চশমা। ভজনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ফিক করে হেসে ফেলল লোকটা, তারপর গ্যালগ্যালে হেসে প্রশ্ন করল, ‘কী দাদুভাই, আজ কী বই কিনলে?’

 লোকটার গলাটা যেন কেমন, ঘ্যাসঘ্যাসে, চেরা চেরা। তবে দাদুভাই ডাকটা শুনে ভজনের আচমকা রাগ হয়ে যাওয়াতে সেটাকে ঠিক আমল দিল না সে। গলাটা স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি গম্ভীর করে পাল্টা প্রশ্ন করল সে, ‘আপনাকে তো চিনলাম না।’

‘হে হে হে, সে আর কী করে চিনবি রে দাদুভাই। শেষ যখন তোকে দেখি, তখন তুই কত্তটুকুন,’ তুমি থেকে এবার সোজা তুইতে নেমে এল লোকটা। উঠলোও বটে, উঠে এসে চেপেচুপে ভজনের পাশটিতে গ্যাঁট হয়ে বসল। তারপর মধুমাখা হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘বলি আজ কীসের বই কিনলি দাদুভাই, গোয়েন্দাগল্প না ভূতের বই?’

ভজন ভুরু কুঁচকে বলল ‘আমি যে গোয়েন্দা বা ভূতের গল্পেরবই কিনেছি সে কথা আপনি জানলেন কী করে?’

লোকটা একটু খানিক দুলে দুলে হেসে বলল, ‘সব জানি রে দাদুভাই। শেষ বই কিনেছিলিস তোর কাকা বেঁচে থাকতে, নিঝুম পালের গোয়েন্দা উপন্যাস ‘হারানো লুঙ্গির খোঁজে।’ তার আগে কিনেছিলিস ভোম্বল সরখেলের ভয়াল ভয়ংকর ভৌতিক গল্পের সংকলন, ‘কঙ্কালের গায়ে কাঁটা।’ তার আগের হপ্তায় কিনেছিলিস জগাই তোপদারের সাড়া জাগানো অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস ‘উড়ন্ত সাবমেরিন’। তারও আগের সপ্তাহে.. কী দাদুভাই আর বলতে হবে?’

ভজন এত অবাক হয়ে গেল যে খানিকক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারল না। একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘আপনি এত সব জানলেন কী করে?’

লোকটা একটা আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বলল, ‘ওরে পাগল, ইথার তরঙ্গের নাম শুনেছিস? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চারিদিকে ইনফর্মেশনগুলো ইথার তরঙ্গে মৌরলা মাছের মতো কিলবিল করছে যে রে। মাঝেমধ্যে সাঁতরাতে সাঁতরাতে এদিকপানে চলে এলেই হল। খাপলা জাল ফেলে তুলে ফেলতে কতক্ষণ?’

ভজন অবিশ্বাসের সুরে বলল ‘আপনি খাপলা জাল ফেলে ইনফরমেশন না কীসব বললেন, সেসব ধরেন?’

লোকটা সামান্য ভাবুক হয়ে বলল, ‘সে তো অনেক লম্বা কাহিনী রে দাদুভাই। ও খাপলা জাল সামান্য নয়, ওকে বলে জ্ঞানজালিকা। প্রথমে নিরালম্ব বায়ুভূত দিয়ে কামনা বাসনার সুতোগুলোকে বেশ টাইট দিয়ে বাঁধতে হয়। তারপর তাতে দেহবন্ধনের জালকাঠি ফেলে, প্রজ্ঞা আর উপায়ের আড়বাঁশে টাঙিয়ে ব্রহ্মকৃপার রোদে শুকুর দেওয়াটাই দস্তুর। তারপর তাতে এট্টুসখানি কড়া করে হঠযোগের মোম মাখিয়ে নিলেই, ব্যস জ্ঞানজালিকা তৈরি।’

মুখের হাঁ টা সন্তর্পণে বুজিয়ে নিল ভজন। তারপর বেজার মুখে বলল, ‘আজ ভূতের বই কিনেছি। গণেশ হালুইয়ের, ‘পেত্নীর জিঘাংসা।’

লোকটা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলল, ‘বেশ ভালো বই। আমি তো প্রায়ই পড়ি। বিশেষ করে ওই শেষে যখন দেখা গেল চাটুজ্জেদের মেজবউ বামাসুন্দরীই আসলে পেত্নী, আর তাকে ওই মদন ওঝা হাঁকিনীবাণ দিয়ে বিস্তর নাজেহাল করল, সেটাই হল’ গে গল্পের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট, বুঝলি কি না।’

ভজন ভারি ব্যাজার হল। আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে যা হোক। গল্পের শেষটাই কেউ যদি আগেভাগে বলে দেয়, কারই বা মেজাজ ঠিক থাকে? ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়ল সে। এভাবে সব গল্পই যদি আগেভাগে বলে দেয়, তাহলে তো মুশকিল!

 ঘুঘুডাঙায় নেমে ভজন দেখল যে লোকটা ওর সঙ্গে সঙ্গেই নেমেছে। এমনকি তার পাশে দাঁড়িয়ে সেই গ্যালগ্যালে হাসি হেসে তার দিকে তাকিয়ে অবধি আছে। হাসিটা দেখে ভজনের পিত্তি জ্বলে গেলেও কিছু বলল না ও। লোকটা তো ওকে বিরক্ত করছে না।

স্টেশন থেকে নেমে রিকশাস্ট্যান্ড। সেখানে রামপিয়ারি তার নতুন কেনা টোটোর সিটে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। ভজনকে দেখে শশব্যস্ত হয়ে টোটো থেকে নেমে সসম্ভ্রমে বলল, ‘আইয়ে ভজনজি, আইয়ে। কুথায় ছেড়ে দিতে হোবে বোলেন।’

ভজন ভারি বিব্রত হল। বেশিদিন না, দিনকতক আগেই এই লোকটার কাছে কাজ করত সে। টোটো চড়ার আশা ছেড়ে দিয়ে স্টেশন চত্ত্বরের অন্য রাস্তাটা ধরা মনস্থ করল ভজন। ওটা ডাইনিজলার রাস্তা, অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল। একটু শুনশান হলে কী হবে, বাড়িতে তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায় বটে।

দু’পা ফেলেই ভজন টের পেল লোকটা ফের পাশে ঘনিয়ে এসেছে। একটু উদাস স্বরে বলল, ‘তোর বাপ বেঁচে থাকতে লস্কর বাড়িতে কী আদর যত্নটাই না পেতাম রে দাদুভাই। এই তেলেভাজা দিয়ে মুড়ি মাখা আসছে তো তারপরেই মাখা সন্দেশ। আর সে তেলেভাজার সাইজ কী! ঘুঁটের সাইজের আলুর চপ, হাওয়াই চপ্পল সাইজের বেগুনি। তারপর ধর শীতের সময় ফুলকপির শিঙাড়া আর গাজরের হালুয়া তো বাঁধা।’

ভজন শক্ত মুখে বলল, ‘আমার কাছে পয়সা নেই। আপনাকে কিছু খাওয়াতে টাওয়াতে পারব না।’

 লোকটা ছলো ছলো চোখে বলল, ‘টাকার কথা তুললি দাদুভাই? পারলি? ওরে তুই কী আমার পর রে? আহা সেই চোখ, সেই নাক, এমনকি মাথার সামনের দিকের টাকটা অবধি তোর বাপের কথা মনে করিয়ে দেয়। তোর কাছে কী আর টাকা চাইতে পারি রে পাগলা। আজ আমিই তোকে না হয় কিছু একটা খাওয়াব, চল।’

প্রস্তাবটা ভেবে দেখল ভজন। সেই কোন দুপুরে দুটো রুটি আর ঢ্যাঁড়সের তরকারি খেয়েছিল সে। সে কখন পেটের মধ্যে তলিয়ে গেছে। ট্রেনে ওঠবার আগে একটা পেয়ারা কিনে খেয়েছিল বটে। তবে তাতে পেটের খিদেটা তো কমেইনি, বরং দাউদাউ করে জ্বলে এখন প্রায় দাবানল। লোকটাকে সে চেনে না বটে, তবে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলাটাও বোধ হয় ঠিক হবে না।

তা খেল বটে ভজন। বইয়ের ব্যাগটা লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে রে রে করে নেমে পড়ল মাঠে। দুটো ডাবল এগরোল উড়িয়ে কুড়ি টাকার ঘুগনি খেল। ফুচকা খেল গোটা দশেক। তারপর চারটে আলুর চপ খেয়ে যখন দুটো ডিমের ডেভিলের অর্ডার দিচ্ছে, তখন লোকটা আর থাকতে পারল না। খপাত করে ভজনের হাতটা চেপে ধরে করুণ সুরে বলল, ‘একদিনে কি এতটা খাওয়া ঠিক হচ্ছে দাদুভাই? বলি পেটের ইলাস্টিসিটি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। তারপর নাইট যাকে বলে স্টিল ইয়াং, বাড়ি গিয়ে রাতের খাওয়ার কথাটাও তো ভাবতে হবে।’

ডিমের ডেভিলটা ধীরেসুস্থে চিবোতে চিবোতে নিমীলিত নয়নে ভজন বললো, ‘ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না দাদু। এখন তো তাও কম খাচ্ছি আজকাল, ডায়েটে আছি কি না। মাস ছয়েক আগে এলে দেখতেন।’

লোকটা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘না না থাক। আরেকটু দেখালেই আমার হার্টফেল করা ছাড়া উপায় থাকবে না রে দাদুভাই। আজ চলি রে, অনেক রাত হল। ওদিকে আবার তোর দিদা’র গাদাগুচ্ছের কাজ পড়ে আছে।’ বলে বইয়ের ব্যাগটা গদাইকে ফিরিয়ে দিয়ে লোকটা তড়বড় করে প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়ল ফের। তখনই ডাউন মুকুন্দপুর লোকাল দাঁড়িয়েছিল স্টেশনে। লোকটা লাফিয়ে একটা কামরায় উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

লোকটার ত্রস্ত পালিয়ে যাওয়া দেখে রাস্তায় দাঁড়িয়েই খানিকক্ষণ খ্যা খ্যা করে একটা ভারি জিঘাংসু হাসি হাসল ভজন। তারপর বইয়ের ব্যাগটা তুলে দুলকি চালে রওনা দিল ডাইনিজলার দিকে।

তবে তাকে বেশিদূর যেতে হল না। সবে ডাইনিজলার জঙ্গল পেরিয়ে গঙ্গার ঘাটের রাস্তাটা ধরেছে সে, এমন সময় অন্ধকারের আড়াল থেকে কারা যেন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ভজন একটুখানি লড়ার চেষ্টা করেছিল বটে, তবে তার নাকে কে যেন একটা ভেজা রুমাল চেপে ধরতেই একটা তীব্র মিষ্টি গন্ধ নাকে এল ভজনের। আর সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল সে।

* * *

গভীর রাত। অন্ধকার ঘরে দুজন মানুষ বসে আছেন। একজনের সামনে একটা ল্যাপটপ খোলা। সেখান থেকে মৃদু আলো তাঁর মুখে এসে পড়ছে। অন্যজন বসে আছেন ঘরের অন্যপ্রান্তে। তাঁকে দেখা যাচ্ছে না বটে, তবে তাঁর ঠোঁটে ধরানো আছে সিগারেট। তার ডগায় নেচে বেড়ানো আগুনের ফুলকিতে বোঝা যাচ্ছে যে তিনি জেগেই আছেন এবং ঈষৎ নড়াচড়াও করছেন।

‘কী পার্টনার, কীভাবে এগোবে এবার?’

‘বুঝতে পারছি না। একটা ক্লু না পেলে কোডটা ক্র্যাক করা খুব মুশকিল।’

‘তাই বললে হবে পার্টনার? তাহলে আর এত কাঠখড় বার্ন করে মাস্টারকে ডেকে আনাই বা কেন আর এত ট্রাবল ঘাড়ে নেওয়াই বা কেন?’

‘আমার তো মাথায় ঢুকছে না।’

‘ঢোকাও পার্টনার, ঢোকাও। মিত্তিরবাড়ির ওই সিক্রেট ট্রেজারের ভাগ দেব, এই বলে ভূপেন দারোগার মুখ ক্লোজ রেখেছি। কোড যদি ক্র্যাক না করতে পার, তাহলে আমার হাতে হ্যান্ডকাফ পরাতে দারোগার এক সেকেন্ড লাগবে না। আমি জেলে গেলে যে অ্যালোন যাব না, সেটা আশা করি বোঝো।’

‘এটা কি ধমকি?’

‘ধমকি বললে ধমকি, রিকোয়েস্ট বললে রিকোয়েস্ট।’

‘ডায়েরিটা যদি কয়েকদিন আগে হাতে পেতাম তাহলে সুবিধা হত। আরও কিছুটা টাইম পাওয়া যেত।’

‘আরে তার চেষ্টা কি করিনি হে? জানো তো, গোটা বাড়িটাই তো ক্যাপচার করার প্ল্যানে ছিলুম। শিওর ছিলুম যে বেজা মিত্তিরের কথা মতো লখাই এমন জায়গায় ডায়েরিটা হাইড করেছে, যেটার খোঁজ ইজিলি পাওয়া যাবে না। অন্তত ভজনের মতো ফ্যাট হেড ছেলের পক্ষে তো খুঁজে পাওয়া একেবারেই ইমপসিবল। বাড়িটা হাতে এলে খোঁজাটা ইজি হত। কিন্তু ছোকরা যে ওর কাকার ধারটা মিটিয়ে দেবে আর ডায়েরিটাও ফাইন্ড করে নেবে, কেই বা জানত?’

‘তার মানে আজ যদি মাস্টার নিজে গিয়ে ডায়েরিটা না উদ্ধার করে নিয়ে আসত, তাহলে এখনও আমাদের অন্ধকারে হাতড়াতে হত, তাই তো?’

‘হে হে হে। আরে আমার বিলিভ ছিল যে তুমি মাথা খাটিয়ে কিছু না কিছু একটা রোড বার করবেই। আরে মাস্টার আর এ লাইনের যাকে বলে বলে কিং।’

‘হুম, তা এবার কেসটা প্রথম থেকে খুলে বলতে হচ্ছে যে। মানে কাদের গুপ্তধন, কীসের গুপ্তধন, এসব জানা আছে বটে। কিন্তু ধোঁয়াশা যে তাতে পুরো মিটছে না।’

‘সে অনেক ওল্ড স্টোরি পার্টনার। সবাইকে বলাটা ঠিক না। কিন্তু আজ মাইন্ড হ্যাপি হয়ে আছে বলে তোমাকে বলছি।’

‘একটা রিকোয়েস্ট, কথার মধ্যে ইংরেজির ফোড়নটা না দিলেই নয়?’

বিষ্টুচরণ ব্যাজার হলেন। হাতের সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলতে শুরু করলেন,

‘আজ থেকে বছর সাত আটেক আগেকার কথা। ফাদার গ্র্যান্ড ফাদারের, মানে বাপ পিতেমোর পুরোনো দলিল দস্তাবেজ ঘাঁটছিলাম, পোড়াপীরতলার একটা জমি গাপ করব বলে, বুঝলে। এমন সময় একটা খুব পুরোনো ঝুরঝুরে একটা খেরোর খাতা আমার হাতে আসে। সে এমন জায়গায় ছিল যে আমি তো প্রথমে খুঁজে পেয়ে অবাক। প্রথমে ভেবেছিলাম এমনি ফালতু কিছু হবে। কিন্তু দুটো পাতা ওলটাবার পরেই বুঝলাম যে এর পেছনে অনেক গভীর রহস্য আছে।।

মিত্তিরবাড়ির বুড়োশিবের মাথায় যে এককালে সোনার ত্রিপুণ্ড্রক আঁটা থাকত, আর সেটা যে আজ থেকে একশো বিশ তিরিশ বছর আগে চুরি যায় সেটা এই এলাকার সবাই জানে। যেটা জানতাম না, সেটা হচ্ছে যে এর পেছনে আমারই এক পূর্বপুরুষ রামনারায়ণ তিওয়ারির হাত আছে।

রামনারায়ণ তিওয়ারি লিখে যান যে সেকালে রতিকান্ত মল্লিক নামে একজন বেশ উঁচু লেভেলের চোর ছিল। পুরো এশিয়া জুড়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক জিনিসপত্র চুরি করে বড়লোকদের কাছে বেচাই ছিল তার পেশা। লোকটি কোন দেশীয় তা জানা যায় না, শুধু এটুকু জানা যায় যে সেই সময় রতিকান্ত মল্লিক ছিল এই লাইনের মুকুটহীন সম্রাট।

এহেন রতিকান্ত মল্লিকের নজর পড়ে ঘুঘুডাঙার রাজবাড়ির বুড়োশিবের মাথায় সাঁটা সোনার ত্রিপুণ্ড্রকের ওপর। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সে এই তিনটে সোনার পাত চুরি করা মনস্থ করে। সঙ্গী হিসেবে পায় গ্রামেরই এক বাসিন্দা গঙ্গাপদ সামন্তকে। মজার ব্যাপার কী জানো পার্টনার? এই গঙ্গাপদ হচ্ছে মিত্তিরদের জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা রমেন্দ্রনারায়ণ মিত্তিরের ডানহাত রঘুপতি সামন্তর বংশধর।

‘মানে? এই লখাই সামন্ত রঘুপতি আর গঙ্গাপদর কেউ নাকি?’

‘একশোবার কেউ, আলবাৎ কেউ। লখাই ওই সামন্ত বংশেরই ছেলে বটে। সে যাই হোক। গঙ্গাপদর জিগরি দোস্ত ছিলেন আমার এক পূর্বপুরুষ রামনারায়ণ তিওয়ারি। তিনি গঙ্গাপদর কাছ থেকে এই অভিযানের পরিকল্পনা শুনে খানিকটা জোর করেই এতে শামিল হন। তাঁকে বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে রতিকান্ত মল্লিক আর না করেননি।

কিন্তু চুরি করার সময় একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে। তিন নম্বর পাতটা খোলার সময় জমিদার বাড়ির লোক টের পেয়ে যায় যে বুড়োশিবের মন্দিরে কেউ ঢুকেছে। গ্রামের সবাই তেড়ে আসতে রতিকান্ত, গঙ্গাপদ, আর রামনারায়ণ তিনজনেই পালাতে বাধ্য হন। তাড়াহুড়োয় রতিকান্ত ত্রিপুণ্ড্রকের তিনটে পাতের প্রথম দুটো নিয়ে পালাতে পারেন। তৃতীয় পাতটা রয়ে যায় রামনারায়ণের হাতে।

রামনারায়ণ তৃতীয় পাতটা খুঁটিয়ে দেখে বোঝেন যে এটা একটা গুপ্তধনের নকশা। এই এলাকায় কথা প্রচলিত ছিল যে, মিত্তিরদের জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা রমেন্দ্রনারায়ণ যখন রাণী ভবশঙ্করীর সৈন্যদল ছেড়ে পালিয়ে আসেন, তখন তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন বিপুল ধনসম্পদ। তার কিছুটা দিয়ে এই জমিদারির পত্তন হয়। বাকিটা তিনি কোনও কৌশলে ওই জমিদারবাড়ি মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে রাখেন।

রামনারায়ণ অনুমান করেন যে ওই তিনটে ত্রিপুন্ড্রকের মধ্যেই তার খোঁজ লুকোনো আছে। কিন্তু ততক্ষণে বাকি দুটো পাত উধাও। তিনি তৃতীয় পাতের লেখাটা একটা খেরো খাতায় লিখে রাখেন। পাতটা লুকিয়ে রাখেন বাড়ির একটা দেওয়াল গেঁথে, নইলে তাঁর ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তিনি এও লিখে যান যে এরপর তিনি গোপনে রতিকান্ত মল্লিকের অনেক খোঁজ করেন। কিন্তু লোকটা যেন কর্পূরের মতো উবে গেছিল।

রামনারায়ণের এই খেরোর খাতাটা আমার হাতে এসে পড়াতে আমি বুঝে যাই যে কী বিপুল সম্পদের খোঁজ আমার হাতে এসে পড়েছে। রাজনীতিতে আসার জন্য তখন থেকেই প্রিপারেশন নিচ্ছি, আর তার জন্য টাকার দরকার তো বটেই। তা ছাড়াও মিত্তিরবাড়ির গোপন সম্পদ উদ্ধার করে দেশের সরকারের হাতে তুলে দিতে পারলে সেটাও যে ভোটের ময়দানে আমার পক্ষে একটা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

আমি সব ভেবেচিন্তে সব কথা ব্রজ, মানে বেজাকে খুলে বললাম। ভাবলাম হাজার হোক ছোটবেলা থেকে জিগরি দোস্ত, তা ছাড়া সম্পত্তিটা তো আসলে ওদেরই।

বেজা ছোটবেলা যেমন ডাকাবুকো ছিল তেমনই গোঁয়ারগোবিন্দ। সে তো একেবারে উঠেপড়ে লাগল রমেন মিত্তিরের গুপ্তধন উদ্ধারের ব্যাপারে। কিন্তু তার জন্য সবার আগে রতিকান্ত মল্লিকের খোঁজপত্তর পাওয়াটা খুব জরুরি। বেজা নিয়মিত কলকাতা যেতে লাগল ব্রিটিশ আমলের পুরোনো লাইব্রেরি আর মহাফেজখানায় রাখা পুরোনো দলিল দস্তাবেজ খুঁজে দেখতে।

শেষমেশ বছর খানেকের মাথায় কলকাতা পুলিশের কোনও একটা মহাফেজখানা থেকে ব্রজ রতিকান্ত মল্লিকের উল্লেখ পায়। কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট যাঁর হাতে তৈরি, সেই স্যার স্টুয়ার্ট হগের নিজের হাতে লেখা একটা রিপোর্টে নাকি ‘দ্য গ্রেট রবার র‌্যাটিকাণ্টা মাল্লিক’ উল্লেখ আছে। তার বাড়ি নাকি লখনউ।

রিপোর্টে রতিকান্ত’র ব্যাপারে যা জানা গেছিল সেসব টুকলি করে, ব্রজ মিত্তির একদিন ধাঁ। সোজা লখনউ গিয়ে ওঠে। ব্যাপারটা আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। আমি আর বেজা পরস্পরকে কথা দিয়েছিলাম যে দুজনেই এই নিয়ে চুপ থাকব যতদিন না মিত্তিরবাড়ির গুপ্তধন পুরো উদ্ধার হয়।

বেজা কী করে ওখানে রতিকান্ত মল্লিকের বংশধরদের খোঁজ পায় বলা মুশকিল। তবে ওই যে বললাম, বেজা মিত্তিরের গোঁ ছিল সাঙ্ঘাতিক। সে শেষ পর্যন্ত ট্র্যাক করে যে রামশরণ গুপ্তা নামের এক রিটায়ার্ড প্রফেসরের কাছে রতিকান্ত শুক্লার চুরি করা সোনার ত্রিপুণ্ড্রকের দুটো পাত এখনও আছে।

প্রফেসরও গুপ্তার সঙ্গে বেজার কী কথা হয়েছিল বলা মুশকিল। শুধু আজ থেকে ছ’মাস আগে বেজা গ্রামে এসে উপস্থিত। আমাকে চুপিচুপি বলল, সোনার পাত দুটো সে পেয়েছে বটে। কিন্তু সেগুল সে আমাকে দেখাবে না। তার বদলে সেই পাতে লেখা নকশা আর লেখাগুলো সে একটা ডায়েরিতে টুকে রেখেছে।’

‘ইন্টারেস্টিং। তারপর?’

‘তারপরই শুরু হল খেল। বেজা হঠাৎ বেঁকে বসে বলল, আগে আমার পূর্বপুরুষের লুকিয়ে রাখা সোনার পাতটা ওকে দেখাতে দিতে হবে, তবেই ও ডায়েরিটা আমাকে দেবে। এই নিয়ে কিছুদিন টানাপোড়েন চলল। ইতিমধ্যে বেজা লখাইকে হাত করে ফেলেছে। তুমি তো জান, এই পরগণায় লাঠিয়াল হিসেবে লখাই সামন্তের নাম আছে। তার ওপর তার মেজাজখানাও বেশ শানানো। তাকে আমার করিম, হরেকৃষ্ণ সবাই ডরায়। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন মন কষাকষি হওয়ার পর একদিন একটা প্ল্যান ভাঁজলুম। বেজাকে ডাকলাম ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করার জন্য। বেজা সরল বিশ্বাসে এল। এদিকে আমিও তৈরি ছিলুম। করিম আর হরে ছাড়াও বাইরে থেকে আরও দুজন গুণ্ডা এনেছিলাম। ব্রজর সঙ্গে কথা কাটাকাটির মধ্যে তাকে কায়দা করে বেঁধেও ফেললাম। তারপর দুটো কড়কানি দিতেই জানা গেল বেজা ডায়েরিটা দিয়েছে লখাইকে, লুকিয়ে রাখার জন্য। এখন লখাই কোথায় সেটা সরিয়ে রেখেছে সেটা জানার আগেই দেখি কোত্থেকে সেই মূর্তিমান হা রে রে করে লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল একেবারে। বেজা যে লখাইকে সঙ্গে করে এনে দূরে লুকিয়ে রাখবে সেটা ভাবিইনি। ছোকরা যে একটু মাথামোটা জানই তো, যাকে বলে চোতক্ষ্যাপা টাইপের। সে এসে যা হুড়ুমদুড়ুম শুরু করে দিলো আর কহতব্য নয়। মিনিট খানেকের মধ্যে দেখি করিম আর হরে দুটোই মাটিতে পড়ে উরে বাবা রে মা রে করছে। লখাই হতচ্ছাড়াদুটোর ওপর আরও কিছু হাত মকশো করে নিত সন্দেহ নেই, কিন্তু তার আগেই ওই ভাড়া করা দুই স্যাঙাত ‘ধ্যাত্তেরি ছাই’, বলে দুটো পেটো ঝেড়ে দিল বেজা আর লখাইয়ের ওপর।’

‘বাহ বাহ, শাব্বাস। বেশ সরেস লোকজনকেই কাজে আনা হয়েছিল তাহলে।’

‘বেজাকে খুন করা কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল না পার্টনার, উদ্দেশ্য ছিল ওর ডায়েরিটা হাত করা। কিন্তু যে মুহূর্তে দেখলাম বেজা ওই মারাত্মকভাবে আহত অবস্থাতেও বাঁধন খুলে ফেলে ওই অকম্মাদুটোর দিকে নিজের রিভলবার দিয়ে ধাঁই ধাঁই করে দুটো গুলি দেগে দিল, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমিও আমার পিস্তলটা বার করে…’

‘বুঝেছি, আর বলতে হবে না। এতক্ষণে সবটা ক্লিয়ার হল।’

‘তারপর বাকিটা তো জানই, হেঁ হেঁ। সত্যি কথা বলতে কি, তোমার আর মাস্টারের হেল্প না পেলে তো আমি তো ওই গুপ্তধন উদ্ধারের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম প্রায়। সে যাই হোক, এই এতক্ষণে তোমার কাছে সবটা খোলসা করে বলে বেশ হ্যাপি হ্যাপি লাগছে বুঝলে পার্টনার। এবার বল তো, সবই তো হাতে এসে গেছে, আসল মালটা হাতে পাব কী করে?’

‘সেটা তো আমারও চিন্তা। এত মাথা খাটিয়েও তো ক্লুটা বুঝতে পারছি না। তবে চিন্তা কিন্তু একটা নয়।’

‘কীরকম?’

‘এই উড়ে এসে জুড়ে বসা ভেজাল লোকটা কে? লোকটা যে ভণ্ড সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মাস্টার অলরেডি ওর ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে খোঁজখবর নিয়েছে। এ এখানে কী করছে?’

‘ভূপেন দারোগাকে বলে লোকটাকে গ্রেফতার করাব পার্টনার?’

‘কোন অপরাধে?’

‘আহা, কিছু অপরাধ নাইবা করুক, লোকটা যে এখানে এসে বেশ একটা ফলাও ব্যবসা ফেঁদে বসেছে তার জন্য লোকটাকে ডেকে জবাবদিহি চাওয়া যায় না?’

‘যায় বইকি। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য কি সাধিত হবে কিছু? বড়জোর লোকটাকে হ্যারাস করা যাবে কিছুদিনের জন্য। তাতে আমাদের লাভ?’

‘তাহলে?’ বিষ্টুচরণের গলাটা একটু নিভু নিভু শোনায়।

‘একটা কথা বলি। আমার যা মনে হল, লোকটা ইতিমধ্যেই এই এলাকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। এখন একে ধরাধরি করতে গেলে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্যটাই কেঁচে যাবে। আমার পরামর্শ হচ্ছে যে আমাদের ওয়েট করতে হবে। লোকটার যদি সত্যিই আমাদের প্ল্যানে বাগড়া দেওয়ার মতলব থাকে তাহলে তাকে না হয় তখনই কাউন্টার করতে হবে। নইলে চাপ আছে।’

‘আর ও যদি আমাদের শত্রুপক্ষ হয়?’

‘শত্রুপক্ষ বলতে? বেজা মিত্তির তো ওপারে, লখাইও তাই। এই গুপ্তধনের ব্যাপারে এখন আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে বলে তো মনে হয় না। এখানে শত্রুপক্ষের কথাটা আসছে কোত্থেকে?’

‘সেটাও কথা বটে।’ বলতে বলতেই সোজা হয়ে উঠে আড়মোড়া ভাঙল বিষ্টুচরণ। কিছুটা অধৈর্য সুরে বলল, ‘কিন্তু টেনশন যে আর সহ্য হচ্ছে না পার্টনার। এবার তো কিছু একটা না করলেই নয়।’

অন্য লোকটি কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল শব্দ করে। মোবাইলটা নিয়ে বাইরে গেল সে। কিছুক্ষণ বাদেই দ্রুতপায়ে ফিরে এসে বলল, ‘মেসেজ ফ্রম ভূপেন। ফিউ সাসপেক্টস আর মুভিং টুওয়ার্ডস টার্গেট এরিয়া। লেটস মুভ নাউ।’

বিষ্টুচরণ এইটে শুনেই তড়াক করে উঠে বসল। দ্রুতহাতে একটা কালো টিশার্ট গলাতে গলাতে বললেন, ‘বুঝলে পার্টনার, আমার মন বলছিল আজই কিছু না কিছু একটা ঘটতে চলেছে, একটা হেস্তনেস্ত হয়েই যাবে।’

* * *

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *