১১.
এখানে একটা বড় সুবিধে হল সব ইনফরমেশনই চট করে খুঁজে পাওয়া যায়। অ্যান আবারের লাইব্রেরিতে 2002-এর 19 এপ্রিলের খবরের কাগজটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। ডিজিটাল কপি আর্কাইভ করা ছিল। সেটাতে চোখ বোলাল পিকু।
নিউইয়র্ক থেকে ডেট্রয়েট যাচ্ছিল আমেরিকান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট E120। তিরিশ জন যাত্রী ছিল তাতে। বেশিরভাগই বিজ্ঞানী। জেনেটিক সায়েন্সের ওপর এক কনফারেন্সের পর ডেট্রয়েট ফিরছিলেন তারা। পথে প্লেন দুর্ঘটনা হয়–সকাল সাড়ে ছটার সময়। ডেডবডিগুলো সনাক্ত করা যায়নি। নামের লিস্ট আছে–চোখ বোলাতেই তাতে ঝাপসা চোখের সামনে জয়ন্ত চ্যাটার্জির নামটা দেখতে পেল পিকু। খবরটা তাহলে মিথ্যে নয়। অন্যান্য যাত্রীর নামের মধ্যে আরেকটা পরিচিত নাম পেল পিকু। ডেভ জর্ডন। এরই নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার, বাবার ডায়েরিতে পেয়েছিল পিকু।
আচ্ছা, এই নাম-অ্যাড্রেস তো পিকুর কাছেই আছে। বাড়িটা যখন অ্যান আবারে, যাওয়াটা শক্ত কিছু নয়। একবার গিয়ে খোঁজ নেবে কি?
হয়তো ডেভ জর্ডনের পরিবারের কেউ এখনও ওখানে থাকেন। হয়তো বাবার সম্বন্ধেও কিছু বলতে পারবে।
পরের দিন কাগজটা খুলল পিকু। 20 এপ্রিল 2002। ক্র্যাশের খবরটা নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতা জুড়ে। ক্র্যাশসাইটের কয়েকটা টুকরো ছবি। প্লেনের ছোট ছোট কয়েকটা টুকরো। একটা আধপোড়া জুতো। এ ধরনের প্লেনে আগে কখনও এরকম বিপর্যয় ঘটেনি। প্রাথমিকভাবে যেভাবে হঠাৎ করে ভেঙে পড়েছে তা দেখে অনুমান করা হচ্ছে বিমানে কোনও বিস্ফোরণ হয়েছিল। ডেটা রেকর্ডার–ভয়েস রেকর্ডার খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। টেররিস্টদের হাত থাকলেও থাকতে পারে।
22 এপ্রিলের কাগজের দ্বিতীয় পাতায় বড় করে বিমান দুর্ঘটনার প্রতিবেদন। তাতে প্লেনের সব যাত্রীদের ছবিও আছে। বাবারও ছবি আছে দ্বিতীয় সারিতে। চুপ করে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল পিকু। কত আপনজন একমুহূর্তে কত দূরে চলে যায়। বাবার মুখে সেই ছেলেমানুষি হাসি। তাহলে খবরটায় কোনও ভুল নেই। অন্তত প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে বাবার মৃত্যু নিয়ে কোনও রহস্য নেই। তবু–তবু কেন পিকুর আজও মনে হয় সব তথ্য ভুল। আজও মনে হয় মানুষটা সামনেই জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছে।
আরেকটা কথা খেয়াল হল, বাবার পাসপোর্ট নাম্বার আর আমেরিকার স্যোশাল সিকিওরিটি নাম্বার তো পিকুর কাছেই আছে। তার থেকেও যদি কিছু সূত্র পাওয়া যায়। গত কয়েকবছর আমেরিকাতে প্রত্যেকের বায়োমেট্রিক আইডেনটিফিকেশনের জন্য কার্ড চালু হয়ে গেছে। কিন্তু আগের স্যোশাল সিকিওরিটি নাম্বার দিয়েও যে কারও সব তথ্য খুঁজে বের করা যায়।
পিকু ইন্টারনেটে সার্চ করল ওই নাম্বার ধরে। ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে এরকম একটা বিশেষ সংস্থা ওই নাম্বারের ওপর নির্ভর করে কোনও ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য সামান্য চার্জের বিনিময়ে জানিয়ে দেয়। তাতে সার্চ করতে জয়ন্ত চ্যাটার্জির আমেরিকায় থাকার যাবতীয় ইতিহাস চট করে পেয়ে গেল পিকু। 86 থেকে 93 বস্টন। দুটো ডিফারেন্ট অ্যাড্রেস। তারপর 93 থেকে 97 ডেনভার কলোরাডোতে। 97-এর শেষের দিকে কলকাতায়।
কিন্তু এসব অ্যাড্রেসের বাইরেও আরেকটা অ্যাড্রেস দেখাচ্ছে জয়ন্ত চ্যাটার্জির নামের সঙ্গে। 91 থেকে 2002। আর সেটা অ্যান আবারের অ্যাড্রেস, অর্থাৎ যেখানে পিকু এখন আছে।
অ্যান আর্বারে বাবার থাকার কী কারণ? আর তা কেউ জানত না কেন? দ্রুত ওই অ্যাড্রেসটা নোট করে নিল পিকু।
আর মিনিট পাঁচেক বাদে পিকু লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল। সুবীরবাবু বাইরে অপেক্ষা করছেন।
কী কাকু, আপনি ভেতরে এলেন না কেন?
এসেছিলাম বাবা। একজনের সঙ্গে একটু আলাপ করছিলাম। লোকটাকে আমার চেনা। চেনা মনে হচ্ছিল। জিগ্যেস করছিলাম কোথায় থাকে, কী করে ইত্যাদি। তারপর সুপারবোল খেলা, আজকের ওয়েদার এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলছি, হঠাৎ দেখি লাইব্রেরির সিকিউরিটি এগিয়ে আসছে। কথা বলা বারণ। তাই আমাকে নাকি বাইরে বেরিয়ে কথা বলতে হবে। বোঝো! লোকটাকেও আসতে বললাম বাইরে। তা তার নাকি ভেতরেই একটু কাজ আছে। এলো না। অগত্যা একা দাঁড়িয়ে। যত সব নিয়ম! তা এবার কোথায় যাবে?
–এই অ্যাড্রেসটায় যেতে পারলে ভালো হত। তা এখন আপনার সময় হবে কি?
কীসের অ্যাড্রেস?
বাবা কোনও একটা সময়ে ওই ঠিকানায় ছিলেন। ইন্টারনেটে পেলাম। অ্যান আবারেই। তাই ভাবলাম যদি যাওয়া যায়।
–আরে অবশ্যই, এখনই চলো।
সুবীর বাবুর ফোর্ড গাড়িতে উঠে বসল পিকু। উনি ধারাভাষ্য শুরু করলেন, বুঝলে পিকু, অ্যান আবার কিন্তু খুব পুরোনো শহর। মিসিগান ইউনিভার্সিটির বয়সই তো কয়েক হাজার বছর।
বলে পাশে বসা পিকুর মুখের হাসিটা দেখে বলে উঠলেন,–আহা, দুশো বছর কি কম হল! 1817 সালে মিসিগান ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানকার ইঞ্জিনিয়ারিং, সারা বিশ্বের সেরা।…
জিপিএস অনুযায়ী গাড়ি ছুটে চলল অ্যান আবারের রাস্তা ধরে। ইউনিভার্সিটি, মিসিগান হসপিটাল পেছনে ফেলে গাড়ি এগিয়ে চলল দক্ষিণ শহরতলীর দিকে। প্রায় আধঘণ্টা বাদে একটা মাটির রাস্তায় এসে পড়ল ওরা। প্রাইভেটলি মেনটেন্ড রাস্তা। ধারে সাইনবোর্ডে লেখা দেখে বোঝা গেল যে হরিণ যে-কোনও সময়ে রাস্তা পেরোতে পারে। বাঁদিক-ডানদিকে বেশ খোলা খোলা মাঠ, ভুট্টাখেত। একটা বড় খামারবাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করালেন সুবীরবাবু।
–এসে গেছি। দুম করে ঢুকো না। ট্রেসপাসিং হবে। বাড়ির লোক সেরকম সহৃদয় না হলে গুলিও চালাতে পারে।
অগত্যা দূরে থেকেই অপেক্ষা। তিনতলা বিশাল বাড়ি পাম গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। মাঝে সুরকি ফেলা পথ। গেটের ওপরে বড় করে লেখা স্ট্রাইবারস।
বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। এক বিশাল চেহারার মাঝবয়সি কালো মহিলা গেটের দিকে আসছেন। নিশ্চয়ই গেটে বসানো সিকিওরিটি ক্যামেরায় দেখেছেন। বেশ কড়া গলায় বলে উঠলেন, কী দরকার? কাকে চাই?
সুবীরবাবু থতমত খেয়ে বলতে শুরু করলেন।
পিকুর বাবার এয়ারক্র্যাশে মৃত্যু থেকে শুরু করে পিকুর আমেরিকায় আসা আর বাবার নাম দিয়ে সার্চ করে এখানকার অ্যাড্রেস খুঁজে পাওয়া–পুরোটাই সুবীরবাবু বললেন। যখন ওনার বলা শেষ হল, তখন ওই মহিলার চোখে জল।
মিসেস স্ট্রাইবার পিকু ও সুবীরবাবুকে নিয়ে বাড়ির দিকে চললেন। স্ট্রাইবারদের এক ছেলে। সে বাইরে একটা কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। ওনারা এ-বাড়িতে আসেন 2004-এ। ব্যাঙ্কের থেকে কেনেন। এর আগের মালিক জয়ন্ত চ্যাটার্জি ব্যাঙ্কের লোন শোধ করতে না পারায় প্রপার্টিটা ব্যাঙ্কের হাতে চলে যায়। তাই খানিকটা কম দামেই বাড়িটা স্ট্রাইবারদের কাছে চলে আসে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথমেই বিশাল ড্রয়িংরুম। ডান দিকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি উঠে গেছে। তার পাশে একটা চওড়া প্যাসেজ এগিয়ে গেছে কিচেনের পাশ দিয়ে।
পিকুর দৃষ্টি লক্ষ করে মিসেস স্ট্রাইবার বলে উঠলেন,–এ বাড়ির আর্কিটেকচারটা খুব অদ্ভুত ছিল। বেসমেন্টের পুরোটা জুড়ে কোনও একটা ল্যাব ছিল। আমি যখন কিনি তখন কোনও যন্ত্রপাতি ছিল না, কিন্তু দেখেই বোঝা যায়। দশ একরের ওপর এত বড় বাড়ি। কিন্তু ঘর মোটে পাঁচটা। সবকটা ঘরই বড় বড় ছিল। আমরা ডিজাইনে বেশ কিছু চেঞ্জ করি। তা তোমার বাবা কি সায়েন্টিস্ট ছিলেন? রিসার্চ করতেন নাকি ল্যাবে?
এর উত্তর পিকুর অজানা। তবু মাথা নেড়ে সায় দিল পিকু। হঠাৎ বাইরের দিকে চোখ পড়ল পিকুর।
বাইরে কালো মেঘ জড়ো হয়েছে। লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে। যে-কোনও সময়ে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে। অনেক রহস্য যেন লুকিয়ে আছে ওই মেঘের ঘন কালো অবয়বে। মিসেস স্ট্রাইবার জয়ন্তর সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারলেন না। এই বাড়িতে কখনই জয়ন্তর নামে কোনও চিঠিও আসেনি। কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি। স্ট্রাইবাররা অবশ্য ব্যাঙ্ক থেকে শুনেছিল যে জয়ন্ত প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। আরও কিছু কথাবার্তার পর ওরা উঠতে যাবে হঠাৎ ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন,আরে ভুলেই গিয়েছিলাম। বাড়ি কেনার পর একটা ছবির অ্যালবাম ওপরের ঘরে পেয়েছিলাম। ওটা তোমাদেরই হবে। দাঁড়াও এনে দিই।
বলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন। বেশ খানিক বাদে একটা অ্যালবাম হাতে নিয়ে নীচে নামলেন।
ছোট অ্যালবাম, হাতে নিল পিকু। বাবার ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে বস্টন কলোরাডো-এখানকার কিছু ছবি। এই ড্রয়িংরুমেরও ছবি আছে। মার সঙ্গে ছবি। সঙ্গে ওর। দাদাও আছে।
–আরে, এই তো তোমারও ছবি আছে। তুমিও এখানে ছিলে ছোটবেলায়!
পিকু আর বলল না যে ওটা পিকুর নয়। ঠিক ওরই মতো দেখতে ওর দাদার ছবি। এরই ছবি বাড়ির আলমারিতেও পিকু পেয়েছিল। প্রশ্নটা হল, এর কথা মা ও বাবা কেন কোনওদিন বলেনি। আর কেনই-বা এর সঙ্গে পিকুর এতটা মিল!
গাড়িতে উঠেই সুবীরবাবু প্রশ্নটা করে উঠলেন,–ওটা কি তোমার ছবি? তুমি তো এখানে আগে আসোনি? তোমার কি দাদা আছে নাকি?
–ছিল, মারা গেছেন সংক্ষেপে জানাল পিকু।
সুবীরবাবু পিকুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,–ওহ স্যরি। কীভাবে?
পিকু চুপ করে রইল। সুবীরবাবু আর প্রশ্ন না করে গাড়ির চাবি ঘোরালেন। বলতে শুরু করলেন–আমার দাদা বছর পনেরো হল মারা গেছেন। আমি তখন এখানে।…
.
১২.
দূর থেকে মনে হয় পরিত্যক্ত বাড়ি। বাড়িতে ঢোকার রাস্তাতেও আবর্জনা পড়ে আছে। এদিক ওদিক থেকে কাটা ঝোঁপগুলো মাথাচাড়া দিয়েছে।
গ্যারেজে অনাথের মতো দাঁড়িয়ে আছে এক পুরোনো গাড়ি। নিসানের বহু পুরোনো মডেল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বেল টিপল পিকু।
–তুমি শিওর এটাই ডেভ জর্ডনের বাড়ি? সুবীরবাবু বলে উঠলেন।
–হ্যাঁ, এ অ্যাড্রেসটাই ডায়েরিতে ছিল। বাবার ডায়েরিতে।
–নাহ্, এখন আর কেউ থাকে বলে মনে হচ্ছে না। ফেরা যাক।
–আরেকটু দেখি।
আরও মিনিট দুয়েক কোনও সাড়াশব্দ নেই। ফিরতে যাবে, ঠিক সেসময় বাড়ির দরজা খুলল। মাঝবয়সি এক ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলার বয়স বছর পঞ্চাশ হবে। দেখেই বোঝা যায়। একসময় খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন। চেহারাতে শিক্ষা আর সম্রান্তির ছাপ।
–আচ্ছা এখানে কি ডেভ জর্ডন থাকতেন?
মহিলা ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর মাথা নেড়ে সায় দিলেন। আপনারা?
সুবীরবাবু হয়তো অনেক কিছু বলতে যাচ্ছিলেন; পিকু শুধু বলে উঠল, আমার বাবা হলেন জয়ন্ত চ্যাটার্জি।
–জয়ন্ত? মহিলা বিস্ফারিত চোখে পিকুর দিকে তাকালেন।
সুবীরবাবু বলতে শুরু করছিলেন,–বুঝিয়ে বলছি। জয়ন্ত চ্যাটার্জিকে আপনি চেনেন কিনা জানি না। খুব দুঃখের ঘটনা। এ ছেলেটি যখন খুব ছোট, 2002-তে ওর বাবা
ভদ্রমহিলা ডান হাত তুলে সুবীরবাবুকে থামিয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলে উঠলেন, প্লিজ কাম ইন।
মহিলার পেছন পেছন সুবীরবাবু ও পিকু ঘরের মধ্যে ঢুকল। ঢুকেই ড্রয়িংরুম। পুরোনো কার্পেট পাতা। বেশ কিছু জায়গায় কার্পেট ছিঁড়ে কাঠের মেঝে দেখা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যে বহু পুরোনো একটা লেদার সোফাসেট।
সুবীরবাবু সোফাটা খুঁটিয়ে দেখে বসবেন কি বসবেন না ভাবছেন, এর মধ্যে ভদ্রমহিলার গলা শোনা গেল,–বসতে পারেন। ভেঙে পড়বে না।
সামনের রিক্লাইনারে হেলান দিয়ে বসে মহিলা বললেন,–আমি ডেভ জর্ডনের স্ত্রী। জুলি জর্ডন। ডেভ এয়ার ক্র্যাশে মারা যায় 2002-এ। একই ফ্লাইটে জয়ন্তও ছিল। ডেভের মৃত্যু আমার কাছে একটা বিশাল আঘাত। আজও বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাই না। বাড়ির চেহারা দেখেই টের পেয়েছেন হয়তো। সময় এখানে গত কুড়ি বছর ধরে থেমে আছে। বলে জুলি একটু থামলেন।
জুলি ফের বলে উঠলেন,জয়ন্ত আমাদের খুব ক্লোজ বন্ধু ছিল। ও ছিল ব্রিলিয়ান্ট সায়েন্টিস্ট। কোনওদিন নোবেল প্রাইজ পেলেও অবাক হতাম না।
পিকু অবাক হয়ে বলল,আচ্ছা, বাবা তো সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন বলে আমরা জানতাম।
জুলি কষ্ট করে হেসে বললেন,–ও ওর আসল পরিচয়টা লুকোত। কেন জানি না। এমনকী বিতানও ওর কাজের ব্যাপারটা কতটা জানত জানি না। বিতানই তো তোমার মায়ের নাম, তাই না?
পিকু মাথা নেড়ে সায় দিল।
জুলি বললেন,–ওর রিসার্চের সাবজেক্ট ছিল বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। এ বিষয়ে ও ছিল প্রথম সারির বিজ্ঞানী। ও আর ডেভ মিলে ডিএনএ সিকোয়েন্সের ওপর বেশ কিছু অসাধারণ গবেষণা করেছিল। শুধু মানুষ নয়, নানান জন্তু-জানোয়ারও ডিএনএ-এর ঠিক কী বৈশিষ্ট্যের জন্য কী স্পেশাল ক্ষমতা পায় তা নিয়েও ওদের গবেষণা অনেকদূর এগিয়েছিল। এই যেমন ধরো, কুকুরের ঘ্রাণশক্তি কিংবা গিরগিটির রং বদলানোর ক্ষমতা, বা পুমার লাফানোর ক্ষমতা–এ তো তাদের ডিএনএ-র বিশেষ সিকোয়েন্সেরই জন্য। ডেভ আর জয়ন্ত সেই সিকোয়েন্স। কী তা প্রায় জেনে গিয়েছিল। মানুষের ডিএনএ-তে কীভাবে সেই একই পরিবর্তন আনা যায় তা নিয়ে ছিল ওদের গবেষণা।
কিন্তু এসব রিসার্চ তো এখন নিষিদ্ধ। সুবীরবাবু বললেন।
–আমি তো এখনকার কথা বলছি না। তখন এসব নিষিদ্ধ ছিল না। এসব করলে কী সাংঘাতিক ফলাফল হতে পারে তার সম্বন্ধে কেউ সচেতন ছিল না।
–তা এসব করে লাভ কী হত? সুবীরবাবু ফের প্রশ্ন করলেন।
কী আবার! মানুষ যদি ঈগলের মতো দূর থেকে দেখতে পেত বা আঙুল কেটে গেলে নিজের থেকে তৈরি করতে পারত তাহলে নিশ্চয়ই ভালো হত, তাই না? কেউ যদি চিতাবাঘের মতো দৌড়োতে পারত আর সিংহের মতো শক্তিশালী হত তাহলে তাকে কি আর সাধারণ মানুষ প্রতিযোগিতায় হারাতে পারত? হয়তো ওরা অতিমানব তৈরি করার চেষ্টা করছিল।
–কিন্তু আমার বাবাই কখনই এরকম কিছু করতে পারে না। বাবাইকে যতটুকু দেখেছি, বাবাই সম্বন্ধে যা শুনেছি বাবাই কখনও অন্যায় কিছু করত না। এভাবে অতিমানব তৈরি করা এতো একধরনের অন্যায়। সাধারণ মানুষ কি টিকে থাকতে পারবে এদের সঙ্গে লড়াই করে?
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। জয়ন্ত নিজের ইচ্ছেতে এরকম কিছু করত না। ও মানুষ হিসেবেও ছিল খুব বড়। দার্শনিকের মতো কথা বলত মাঝেমধ্যে। খুব দূরদৃষ্টি ছিল। আমার মনে হয় না ওরা এই ভুল করত। কিন্তু আমার কেন জানি না মনে হত ওরা খুব ভয়ে ভয়ে ছিল শেষের কয়েকটা বছর। কেউ যেন আড়াল থেকে ওদের কন্ট্রোল করত। ডেভ আমার সঙ্গে কোনও কথা বলত না। কথায় কথায় অন্যমনস্ক হয়ে যেত। কলিংবেল-এর আওয়াজে নার্ভাস হয়ে পড়ত। অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলে ধরত না।
–এটা কোন সালের কথা?
–এই ধরো, 2000 থেকে 2002–এই দু-বছর। তখন ওকে আমি দেখেছি সম্পূর্ণ। অন্যরকম হয়ে যেতে।
–আমার বাবা তো ওই সময় ভারতে চলে যান।
–হ্যাঁ, কিন্তু ও এখানে প্রায়ই আসত। ওরা দুজনে মিলে ওপরের ঘরে বসে অনেক রাত অবধি কীসব আলোচনা-গবেষণায় ব্যস্ত থাকত। এখানে তোমাদের একটা বাড়িও ছিল, তা জানো তো? সেখানেও ডেভ আর জয়ন্ত অনেক সময় একসঙ্গে কাটাত। তারপর একদিন হঠাৎ সব শেষ হয়ে গেল। এয়ার ক্র্যাশে।
জুলি থামলেন। ঘরে পিনড্রপ সাইলেন্স। খানিকবাদে পিকুই নীরবতা ভঙ্গ করল।
–আপনি গিয়েছিলেন ক্র্যাশ সাইটে?
–হ্যাঁ, কিন্তু ওখানে তো ওরা একেবারে কাছে যেতে দেয়নি। বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে প্লেনের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়েছিল। পুরো জায়গাটা ঘিরে রেখেছিল ওরা।
–ডেডবডি দেখেছিলেন?
সবাই এত পুড়ে গিয়েছিল যে কাউকে চেনার উপায় ছিল না। তবে ক্রেডিট কার্ড, আইডি–এসব থেকে ক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশন টিম ওদের সনাক্ত করে। তবে ওরা যে মারা গিয়েছিল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
–আপনার কি সত্যিই কোনও সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে? পিকু বলে উঠল। ওর কেন জানি না মনে হল ভদ্রমহিলা নিজেই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। তা না হলে হঠাৎ ওকথা বললেন কেন?
খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে পিকুর দিকে তাকিয়ে রইলেন জুলি। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,কফি চলবে? কফি খেতে খেতে বলব।
ঘরের পরিবেশ বেশ ভারী হয়ে আছে। সেই ভার খানিকটা কাটাতেই পিকু সায় দিল।
খানিকবাদে কফি, কিছু স্ন্যাকস আর সসেজ নিয়ে ফিরে এলেন জুলি। পিকুর কেন জানি না মনে হল বহু বছর বাদে জুলি যেন কথা বলার লোক খুঁজে পেয়েছেন। যে সব কথা কাউকে কোনওদিন বলা যায়নি, সেসব যেন বলার সময় এসেছে।
কফিতে চুমুক দিয়ে জুলি বলে উঠলেন,আচ্ছা কেউ কি এরকম অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার আগে মৃত্যু টের পায়? আমার কেন জানি মনে হয় ডেভ বুঝতে পেরেছিল যে আমাকে চিরকালের মতো ছেড়ে চলে যাবে। তাই ওর সব ভালোবাসা-দরকারি সব কথা ও যেন জানিয়ে গিয়েছিল শেষের কদিনে। দরকারি সব কম্পিউটারের ফাইল নিউইয়র্কে যাওয়ার কয়েকদিন আগে দেখিয়ে দিয়েছিল। আমি তখন খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম।
নিউইয়র্ক?
–হ্যাঁ, ও শেষ এক সপ্তাহ নিউইয়র্কে ছিল। একটা মেডিক্যাল কনফারেন্সে। সেখান থেকে ফিরতে গিয়েই এই এয়ারক্র্যাশ হয়। তোমারও কি তোমার বাবার সম্বন্ধে একথা মনে হয়েছিল?
পিকুকে চুপ থাকতে দেখে জুলি ফের বলে উঠলেন,–অবশ্য তুমি আর কী বুঝবে? তুমি তো তখন অনেক ছোট।
পিকু একটু চুপ থেকে বলল,ছোটবেলায় কিছু বুঝতে না পারলেও সম্প্রতি আমারও একই কথা মনে হয়েছিল, আর তাই আমি এখানে–
বলে ও ছোটবেলার লুডোর কথাটা খুলে বলল।
মন দিয়ে শুনে জুলি বললেন,–এই এয়ারক্র্যাশটার ব্যাপারে যে চিফ ইনভেস্টিগেটর ছিল তার সঙ্গে আমি দেখা করি। প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। কিন্তু আমি কয়েকমাস ধরে লেগে থাকি। জানতে পারি ওনার বেশ কিছু সন্দেহ হয়েছিল। ওনারও মনে হয়েছিল ফ্লাইটে কোনও ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। অজানা কারণে ব্ল্যাকবক্সে কিছুই ধরা পড়েনি। টেররিস্ট অ্যাকটিভিটি-ও হতে পারে। কিন্তু ওনাকে সেটা প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া উনি দেখেছিলেন সেদিনকার ওই ফ্লাইটে ফাইনালি কারা উঠেছিল সেই নামের লিস্টও নেই। ওনার মনে হয়েছিল যে কেউ যেন ওই ডেটা এয়ারলাইনস-এর ডেটাবেস থেকে ইচ্ছে করেই উড়িয়ে দিয়েছে যাতে কেউ না জানতে পারে প্লেনে কে কে ছিল।
আশ্চর্য! কিন্তু আপনি এটা জানার পর কিছু করেননি?
–চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। ইনভেস্টিগেশন জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
কফির কাপটা টেবিলের ওপর রেখে জুলি যেন প্রসঙ্গ বদলানোর জন্যই বললেন, তা, তোমার নাম কী?
–পিকু।
বাহ, সুইট নেম। তোমার বাবার কথা নিশ্চয়ই খুব মনে পড়ে।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে পিকু বলে,–আচ্ছা আমার দাদাকে কি আপনি দেখেছিলেন?
–হ্যাঁ, তোমার দাদা এখানেই মারা যায়, চার কি পাঁচ বছর বয়সে। তখন তোমার বাবা-মা কলোরাডোতে। খুব সম্ভবত 1996-এ। হঠাৎ দুদিনের এক অজানা জ্বরে তোমার দাদা মারা যায়। ভারি মিষ্টি ছিল ছেলেটা। তোমার বাবা-মা খুব ভেঙে পড়েছিল। প্রথম সন্তান বলে কথা! তোমার বাবা ওর ডিএনএ পর্যন্ত সংগ্রহ করে রেখে দিয়েছিল। তুমি বাড়িতে ওর কোনও ছবি দ্যাখোনি?
না, আগে দেখিনি। কিছুদিন আগে ইন্ডিয়াতে একটা আলমারির ভেতর থেকে প্রথম ওর একটা ছবি পাই। প্রথমে ভেবেছিলাম আমারই ছোটবেলার ছবি। পরে খুঁটিয়ে দেখে বুঝি যে ওটা আমার নয়, কিন্তু অবিকল আমারই মতো দেখতে।
–তোমারই মতো? দ্যাট মিনস–বলে চুপ করে গেলেন জুলি।
কী?
দ্যাট মিনস–তুমি হোচ্ছ তোমার দাদার ক্লোন। তোমাদের দুজনেরই একই ডিএনএ। তাই একরকম দেখতে। তোমার দাদার ডিএনএ তো ছিলই। তা থেকে ক্লোনিং টেকনোলোজি ব্যবহার করে সেই ভ্রুণ থেকে তোমাকে তৈরি করা হয়। ক্লোনিং কী করে করতে হয় তা জয়ন্ত তার মানে জেনে গিয়েছিল।
–1997-এ ক্লোনিং! হেসে উঠলেন সুবীরবাবু।
–অন্য কেউ হলে আমিও বিশ্বাস করতাম না। এখনই যেটা সম্ভব হয়নি তা পঁচিশ বছর আগে! জুলি একটু থেমে ফের বলেন, জয়ন্ত ওর সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। বুদ্ধির দিক থেকে ও নিজেই ছিল অতিমানব। ওর পক্ষে কিছুই অসম্ভব ছিল না। তা ছাড়া এখনও আমার মনে পড়ে ও আর বিতান তোমার দাদা মারা যাওয়ার পর কীরকম ভেঙে পড়েছিল। তার কিছুদিন পরের কথা, আমরা জানতে পারি যে জয়ন্ত তোমার দাদার ডিএনএ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছে। তখন আমি জিগ্যেস করতে তোমার বাবা বলেছিলেন, আমি শান্তনুকেই ফিরে পেতে চাই। ছেলে হলে ওরকমই ঠিক হতে হবে। আমি ওকে ফিরিয়ে আনবই। কথাটার মধ্যে এমন একটা একগুয়েমি ছিল যে আমি খুব অবাক হয়ে যাই।
–আমারও ছোটবেলাতে কেন জানি মনে হত আমার সঙ্গে অদৃশ্য কারুর যেন তুলনা চলছে। আমি যেন ঠিক তারমতো হলে বাবা-মা খুব খুশি হন। বলতে বলতে থেমে গেল পিকু।
যেখানে পিকু বসেছে তার সামনেই ইউরোপিয়ান ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বড় জানলা। খানিকটা দূরে একটা ওক গাছ। ও দিকটা পুরো জঙ্গল হয়ে আছে। কেন জানে না ওর মনে। হল গাছের ঝোপের মধ্যে কেউ একটা দাঁড়িয়ে ছিল। এদিকে লক্ষ করছিল। দ্রুত অন্য একটা ঝোপের পেছনে চলে গেল। মনে হল লোকটার গায়ের রং যেন সবুজ। আর তাই আগে চোখে পড়েনি। জানলার কাছে গিয়েও চোখে কিছু পড়ল না।
কথাটা আর বলল না পিকু, কিন্তু আলোচনার সুর যেন কেটে গেল। আরও আধঘণ্টা পরে ওরা জুলির কাছ থেকে বিদায় নিল। জুলি গাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে এসে বলে উঠলেন, আবার এসো। অনেকদিন বাদে মনে হল আমি যেন সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে পেরেছি। আমার নাম্বারটা রেখেছ তো? কোনও দরকারে ফোন কোরো। আমি ডেভ-এর পুরোনো ডায়েরি, অ্যালবাম ঘেঁটে দেখব যদি ওখান থেকে কোনও সূত্র মেলে। এর পেছনে বড় কোনও শক্তি, বড় কোনও রহস্য আছে। আমার মনে হয় ডেভ আর জয়ন্ত দুজনকেই মার্ডার করা হয়েছে। ওরা হয়তো সেটা আগে থেকেই টের পেয়েছিল। প্রশ্নটা এখানেই যে কেন ওদের মারা হল, আর সব জেনেও ওরা চুপ করে বসে রইল কেন? বিপক্ষশক্তি কি সত্যিই এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ওদের কোনও বাঁচার উপায়ই ছিল না? আমার এক বন্ধু ইউ এস সেক্রেটারি অফ ডিফেন্সকে ভালো করে চেনে। আমি তার সঙ্গে আবার কথা বলব, যাতে তদন্ত আবার চালু করা হয়।
গাড়িতে উঠে বসল ওরা। সুবীরবাবু হঠাৎ করে 40 স্পিড লিমিটের রাস্তায় 100 তুলে বলে উঠলেন,বুঝলে পিকু, সারা জীবনটা বড্ড একঘেয়ে ভাবে কাটালাম। রোজই এক রুটিন। রোজই নিয়ম মেনে সব কিছু করা। না আছে কোনও চমক, না আছে কোনও অ্যাডভেঞ্চার। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে বড় একটা রহস্যের মধ্যে ঢুকে গেছি।
ওনার জেমস বন্ড স্টাইলের ড্রাইভিং অবশ্য বেশিক্ষণ চলেনি। পেছনে লাল-নীল আলো জ্বেলে একটা পুলিশের গাড়ি তাড়া করেছে। পরের আধঘণ্টা ঠিক রুটিনমাফিক হয়নি।
.
১৩.
রবার্ট ওর কম্পিউটারে অফিসের পুরোনো ফাইলগুলো দেখছিল। সিআইএ-র ডিরেক্টর হিসেবে ওর হাতে বেশ কিছু পুরোনো প্রোজেক্টের ইনফরমেশন এসেছে। বেশিরভাগই খুব সেনসিটিভ ডেটা। প্রত্যেকটা ফাইল খোলার আগে ডানহাতের পাঁচটা আঙুলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর রেটিনা স্ক্যান করার দরকার হচ্ছে। তা ছাড়া নানান ধরনের পাসওয়ার্ড তো আছেই।
প্রসেসটা খুব স্লো। কিন্তু উপায় নেই। সাবধানতার কোনও বিকল্প নেই। প্রত্যেকটা প্রোজেক্টের ইনফরমেশন ওর জানা দরকার। অন্যান্য অফিসের মতো আগের বিদায়ী ডিরেক্টর কোন প্রজেক্টের কী স্ট্যাটাস তা বুঝিয়ে হ্যান্ডওভার করবে–তা তো আর CIA-তে হয় না! ইনফ্যাক্ট আগের জন কে ছিলেন, তাও জানে না রবার্ট। এতটাই গোপনীয়তার সঙ্গে এখন পুরো তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়। এখানে যার যতটুকু জানা দরকার, তার থেকে একটুও বেশি কেউ জানবে না।
গত এক সপ্তাহে বাকি সব প্রোজেক্টের লেটেস্ট স্ট্যাটাস জেনে নিয়েছে রবার্ট–শুধু একটা বাদে। প্রোজেক্ট এইচ। ফাইলটা ব্ল্যাঙ্ক। ওই একটা অক্ষরের বাইরে কোথাও কোনও ইনফরমেশন নেই। অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্টের লিস্টে প্রোজেক্ট এইচ নামটা দিব্যি জ্বলজ্বল করছে।
একটা বিশেষ নাম্বারে ডায়াল করলেন রবার্ট। বিশেষভাবে সুরক্ষিত হেল্পডেস্ক। একটা স্পেশাল কোড আর বায়োমেট্রিক স্ক্যানের পরে প্রোজেক্ট এইচ-এর তথ্য জানানোর জন্য অনুরোধ করলেন রবার্ট। উলটোদিক থেকে যান্ত্রিক গলায় একটা কোড শোনা গেল। বিশাল বারো ডিজিটের কোডটা শোনার পর অবাক হয়ে বসে রইলেন রবার্ট। কোড থেকে একটা জিনিসই জানা যাচ্ছে যে প্রোজেক্ট এইচ খুবই গোপনীয় কোনও প্রোজেক্ট। এই প্রোজেক্টের ইনফরমেশন পেতে রীতিমতো কাঠখড় পোড়াতে হবে।
ফোনে রিং হচ্ছে। ফোনটা ধরলেন রবার্ট।
–হ্যালো।
–কোডটা জানান। যান্ত্রিক গলা বলল।
ফোনের কি প্যাডে কোডটা ডায়াল করলেন রবার্ট। খানিক আগেই পাওয়া প্রোজেক্ট এইচ-এর কোডটা। আরও নানান ধরনের ভেরিফিকেশনের পর উলটোদিক থেকে শোনা গেল– প্রোজেক্ট এইচ হচ্ছে সিআইএ ও ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রোজেক্ট এজেন্সির (DARPA) যুগ্ম উদ্যোগে একটা বিশেষ প্রোজেক্ট। মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধের জন্য স্পেশাল আর্মি তৈরি করা, যারা বুদ্ধিতে, শক্তিতে, গতিতে সাধারণ সৈন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে থাকবে।
উদ্দেশ্য?
–যাতে আমেরিকা যে-কোনও বিদেশি শক্তির বা টেররিস্ট আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। আর পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান বজায় রাখতে পারে। শুধু তাই নয়, কখনও যদি মানুষের অস্তিত্ব রোবট বা যান্ত্রিক শক্তির কাছে বিপন্ন হয়ে পড়ে তাহলে এরাই হবে ভরসা।
–এ প্রোজেক্ট কি আমারই আন্ডারে পড়বে?
–অবশ্যই, তা না হলে এতটা ইনফরমেশন আপনাকে দেওয়া হত না।
–তা প্রোজেক্টের বর্তমান অবস্থা কী?
–শেষের দিকে। শেষ পর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
–কোথায় হচ্ছে প্রোজেক্টটা?
–জানানো যাবে না।
–কিন্তু আমি না জানলে চলবে কী করে?
দরকার মতো প্রোজেক্টের স্ট্যাটাস আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে। কোনওভাবে কাউকে এ প্রোজেক্ট সম্বন্ধে জানানো যাবে না।
–এ প্রোজেক্ট কবে শুরু হয়েছিল? কার আন্ডারে আছে?
–2001-এর 11 সেপ্টেম্বরের পরে এ প্রোজেক্ট শুরু হয়। তিনজন DARPA-র বিজ্ঞানী আর দুজন সিনিয়ার মিলিটারি অফিসার নিয়ে এর কোর টিম। তারাই এ প্রোজেক্ট পরিচালনা করে।
তাদের পরিচয় জানা যাবে?
না।
–প্রেসিডেন্ট কি এ প্রোজেক্টের ব্যাপারে জানেন?
–খুব সামান্য। আপনি ঠিক যতটা জানলেন। ওই কোর টিমের বাইরে কেউ এই প্রোজেক্ট সম্বন্ধে জানে না।
–আপনার নাম? আপনিও কি এ প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত আছেন?
উলটোদিকের ফোন কেটে গেল।
–ননসেন্স! বলে রবার্ট উঠে দাঁড়ালেন। দায়িত্বও নিতে হবে, আবার কোনও কিছু জানাও যাবে না। কোনও মানে হয়? সেক্রেটারিকে পলকে ঘরে ডেকে নিলেন রবার্ট।
–পল, প্রোজেক্ট এইচ-এর যাবতীয় ইনফরমেশন আমার চাই। গত একসপ্তাহ ধরে আমার যত সোর্স ছিল আমি ভালো করে দেখেছি–তেমন কোনও তথ্য নেই। তুমি তো অভিজ্ঞ লোক। আশাকরি বলতে হবে না, কী করে এর সম্বন্ধে ডিটেলস বার করতে হয়। দরকার হলে আমাদের দেশের বেস্ট কম্পিউটার হ্যাঁকারদের নিয়োগ করো। আই মাস্ট হ্যাভ দিস ইনফরমেশন।
–ঠিক আছে। রবার্টের স্থির দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে পল বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারল। আর কোনও প্রশ্ন না করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
.
১৪.
রাত বারোটা। লাসভেগাস। শহর যেন সবে ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে। আলোর রোশনাই মুখ থুবড়ে পড়েছে চওড়া চওড়া রাস্তায়। ঝকমকে আলো, হাজারো পথচারী, লাসভেগাস বুলেভার্ডের। ধারে আলোয় ভাসা ফোয়ারা সবমিলিয়ে চারদিকে উৎসবের আবহ। এখানে কেউ কোন দিকে যাচ্ছে তা জেনে হাঁটে নাকী দেখতে যাচ্ছে ভেবে এগিয়ে যায় না। পুরো শহরটাই ঘুরে দেখার। আনন্দের উত্তাপই এখানে বড় প্রাপ্তি। চারদিকে আকাশচুম্বী হোটেল আর ক্যাসিনো। নানান ধরনের শো হচ্ছে। সাধারণ লোকের সঙ্গেই মিশে আছে পুলিশের লোক। রোবট পুলিশ কন্ট্রোল করছে হামাগুড়ি দিয়ে এগোনো ট্রাফিককে। এখানে প্রতি মুহূর্তে কোটি টাকা হাত বদলাচ্ছে ক্যাসিনোর মধ্যে।
এরকমই একটা ক্যাসিনোর নাম হল লা রোমা। ঝাঁ-চকচকে হোটেলের পুরো নীচের ফ্লোরে প্রায় এক বর্গমাইল জুড়ে বিশাল ক্যাসিনো। ক্যাসিনোর ভেতরে প্রচুর সিকিউরিটি জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে অত্যাধুনিক বন্দুক। দরকার হলে গুলি চালাতে দ্বিধা করবে না।
জন এ হোটেলের সিকিউরিটি হেড হিসেবে প্রায় দশ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। অন্য বেশিরভাগ রাতের মতো আজকের রাতও ঘটনাহীন। পেশাদারি গ্যাম্বলারদের ভিড় বেশিরভাগ খেলায়। এরা কোটি কোটি টাকা বাজি ধরে খেলে। লক্ষ টাকা হারলেও এরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে না। কিছু নতুন অচেনা মুখ কৌতূহলী হয়ে মাঝেমধ্যে খেলছে।
সেরকমই একটা নতুন মুখকে বেশ খানিকক্ষণ ধরে দেখছে জন। ভারি সুন্দর দেখতে। ফরসা মাঝারি হাইট। তীক্ষ্ম বুদ্ধিদীপ্ত নীল চোখ। মাথা ভরতি কঁকড়া চুল। হাঁটাচলা দেখলেই বোঝা যায় সে ক্যাসিনোতে কখনও আসেনি। সবরকম খেলা ঘুরে ঘুরে দেখছে। নিয়ম বোঝার চেষ্টা করছে। টেবিলের শুটারদের মাঝেমধ্যে জিজ্ঞাসা করছে। এখানে এরকম অনেকেই আসে। কিন্তু জনের অভিজ্ঞ চোখ তাদের সবাইকে অনুসরণ করে না।
তার কারণ ছেলেটা খেলছে, আর নতুন হলেও বেশিরভাগই জিতছে। আর বেটও করছে। বড় বড় টাকার অঙ্ক–যা বড় জুয়াড়ি ছাড়া কেউ করে না।
জন শুধু সিকিউরিটি হেড নয়, বিজ্ঞানের ভালো ছাত্র। এই খেলাগুলোর পেছনে ভাগ্য ছাড়াও বুদ্ধি কাজ করে। তার থেকেও বড় কথা যে এরকম বারবার জিতছে, সে কোনও চুরি করছে না তো? প্রযুক্তি এখন এতটাই এগিয়ে গেছে যে কে কীভাবে তাকে প্রয়োগ করে তাও বোঝা মুশকিল। এই তো মাসখানেক আগে একজন এখানে রেটিনাতে মিনি ভিডিয়ো রেকর্ডার। ইমপ্ল্যান্ট করে এসেছিল।
ছেলেটা এক বোর্ডে বেশিক্ষণ খেলছে না। দু-তিনবার জেতার পরে অন্য বোর্ডে চলে যাচ্ছে। বোর্ডের চারদিকে লুকিয়ে রাখা আছে মাইক্রো-ভিডিয়ো ক্যামেরা। যে-কোনও জাল কারচুপি ওতে ধরা পড়ে যায়। তাতেও খুঁটিয়ে বেশ খানিকক্ষণ দেখল জন। নাহ্, ছেলেটার কাছে তো সেরকম কোনও যন্ত্র নেই!
ছেলেটা এবার স্কিল জোনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আগের ক্যাসিনোর গেমগুলোতে ভাগ্যই একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল। যতই বুদ্ধি থাকুক না কেন, ভাগ্য সঙ্গে না থাকলে জেতা শক্ত। কিন্তু স্কিলজোন অন্যরকম। এই গেমে লাকের থেকে আগে থাকে স্কিল, ইনটেলিজেন্স।
ছেলেটা ওখানে গিয়েও একের পর এক জিততে শুরু করল। কালার রেস। একটা গোলাকার জায়গার নানা অংশে বারবার নানান রং ফুটে উঠছে খুব দ্রুত। দু-মিনিটের মধ্যে কোন রং কতবার হয়েছে সেটা বলতে হবে।
যে ঠিক সংখ্যার সব থেকে কাছাকাছি বলবে সে জিতবে। ছেলেটা এটাও তিনবার জিতল। তারপর প্রায় বিরক্ত হয়েই পাশের গেমটার দিকে এগিয়ে গেল। নাম্বার সিকোয়েন্স গেম। একটার পর একটা সংখ্যা ফুটে উঠেছে, আর তার মধ্যে আছে দুর্বোধ্য প্যাটার্ন। মাঝে মাঝে ওই সিকোয়েন্সের পরের সংখ্যাটা অনুমান করতে হচ্ছে। সময় খুব কম। তারমধ্যে যে আগে ঠিক বলতে পারবে সেই জিতবে।
জন জানে যে এসব গেমে যারা যোগ দেয় তারা প্রত্যেকেই এ বিষয়ে এক্সপার্ট। মাসের পর মাস-বছরের পর বছর প্র্যাকটিসের পরে এখানে আসে। বিশেষ করে এসব ক্যাসিনোতে এসে যারা বেটিং করে তারা সবরকম সাবধানতা নিয়েই নামে। কিন্তু এ ছেলেটা এসে যেন আজকে সবার প্ল্যান ভণ্ডুল করে দিয়েছে। এটাও হেসেখেলে দুবার জিতে নিল। তারপর আরেকটা বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল।
এবার জন এগিয়ে এল। আর আড়াল থেকে দেখার দরকার নেই। নিশ্চিত কিছু গন্ডগোল আছে। জনকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে ও এখানকার সিকিউরিটিতে আছে। সাধারণ পোশাক।
জন ছেলেটার কাছে গিয়ে বলে উঠল, বাহ, তুমি তো দেখলাম অসাধারণ প্লেয়ার। একের পর এক জিতছ। তোমার নাম কী?
–পল। একঝলক জনের চোখের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল ছেলেটা। তারপর অন্য কোনও বোর্ডের দিকে না তাকিয়ে ক্যাসিনোর ফ্লোর থেকে বেরোতে গেল।
জন দ্রুত পায়ে পিছু নিয়ে ফের বলে উঠল, তুমি কোথা থেকে এসেছ?
ক্যালিফোর্নিয়া।
আমি এখানকার সিকিউরিটি। তোমার আইডিটা দেখি।
ছেলেটা কোনও দ্বিধা না করে ওয়ালেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স বার করে তুলে ধরল। জন একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। নাহ, আইডিতে কোনও গন্ডগোল নেই। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের লাইসেন্স। ছেলেটার বয়স মোটে কুড়ি। তবু একে এত সহজে ছাড়া যাবে না। জানা দরকার কীভাবে সমানে জিতে চলেছে।
–তুমি আমার সঙ্গে একবার আমাদের সিকিউরিটি রুমে চলো। দরকার আছে।
জন ভেবেছিল যে ছেলেটাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভয় দেখাতে হবে। বলপ্রয়োগেরও দরকার হতে পারে। তাই এক বিশালদেহী গার্ডকে ইতিমধ্যেই ডেকে নিয়েছিল। কিন্তু তার কোনও দরকার হল না। ছেলেটা বেশ হাসিমুখেই ওর পিছু পিছু এগিয়ে চলল।
বিশালদেহী কালো গার্ডটা ছেলেটার পাশে পাশে হাঁটছিল। এসক্যালেটরের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ পেছনে একটা আওয়াজ হল। জন মাথা ঘুরিয়ে দেখল যে গার্ডটা মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
জন দেখতে না পেলেও আরেকটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন গার্ডের চোখ এড়ায়নি ঘটনাটা। সে আঙুল তুলে ছেলেটার দিকে ছুটে এল।
–ও ঘুষি মেরে জোকোকে ফেলে দিয়েছে।
বলে রিভলভারটা ছেলেটার দিকে তুলে ধরল। তুলে ধরার চেষ্টা করল বলাই ভালো। কারণ, তার আগেই ছেলেটা বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে গিয়ে রিভলভারটা কেড়ে নিয়ে ওর হাত ধরে এমনভাবে হ্যাঁচকা টান দিল যে গার্ডটা পাঁচ হাত দূরে ছিটকে পড়ল। আর কেউ এগিয়ে আসার আগেই তিন-চার লাফে কুড়ি ধাপের সিঁড়ি টপকে বেরিয়ে গেল। ক্যাসিনো থেকে বেরোনোর দরজা বেশ খানিকটা দূরে। কিন্তু খানিকটা ছুটে গিয়েও জন বা কোনও সিকিউরিটি গার্ড ছেলেটার টিকিও আর দেখতে পেল না। কর্পূরের মতো হাওয়ায় উবে গেছে যেন।
.
১৫.
সুবীরবাবু মিসিগান ইউনিভার্সিটি দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন পিকুকে। বহু পুরোনো ইউনিভার্সিটি। চারটে জায়গায় ছড়ানো ক্যাম্পাস। নর্থ সাউথ, সেন্ট্রাল আর মেডিক্যাল। পুরোনো বিল্ডিংগুলোর। পাশাপাশি নতুন বিল্ডিং হয়েছে একই ধাঁচের। এমনভাবে তৈরি করেছে যে কোনটা পুরোনো আর কোনটা নতুন ভেতরে না ঢুকলে বোঝার উপায় নেই। ওখানে প্রায় একঘণ্টা কাটিয়ে ইউনিভার্সিটির আশেপাশের এলাকা দেখাতে শুরু করলেন সুবীরবাবু।
ইউনিভার্সিটি ছেড়ে খানিকটা এগোতে হঠাৎ পিকু দেখল পাশের একটা সরু রাস্তা ব্লক করে রাস্তাতে চেয়ার টেবিল পেতে চেস খেলা হচ্ছে। এরকম দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না, গাড়ি পার্ক করে ওরা দুজনেই নেমে এল।
ওপেন চেস টুর্নামেন্ট। যে কেউ খেলতে পারে। সবে শুরু হয়েছে, চলবে রাত অবধি। পুরস্কার মূল্য পাঁচ হাজার ডলার। একটা লোকাল কোম্পানি স্পনসর করছে।
–কি, খেলবে নাকি? সুবীরবাবু জিগ্যেস করলেন।
হ্যাঁ, খেললে খারাপ হয় না। আমি খারাপ খেলি না।
–তা খেলো না! আমিও বসে বসে দেখি। বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। ওই তো দর্শকদের বসার জায়গাও আছে।
দাবাটা চিরকালই পিকুর প্রিয় খেলা। বাবাও নাকি খুব ভালো দাবা খেলত। পিকু স্কুলে বরাবর চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে। তবে বড় টুর্নামেন্ট কখনও খেলেনি। খানিকক্ষণের মধ্যে পিকুও যোগ দিল। আর জিততেও শুরু করল। স্পিড চেস। একেকটা ম্যাচ দশমিনিটের।
বেশিরভাগই সাধারণ মানের প্লেয়ার। চারটে রাউন্ডের পরে সেমিফাইনাল। সেমিফাইনালে উঠে একটা ছেলের কাছে পিকু হেরে গেল। সেই ছেলেটাই পরে টুর্নামেন্টটা জিতল। অসাধারণ খেলে। চাল দিতে এক সেকেন্ডও টাইম নেয় না। সেরকমই বুদ্ধির ছাপ চালে। পিকু ভেবে রেখেছিল টুর্নামেন্টের পরে ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করবে। কিন্তু হঠাৎ ওর চোখ পড়ল সুবীরবাবুর দিকে। খানিকদূরে একজন মোটা গোলগাল চেহারার সাহেবের সঙ্গে পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছেন। সাহেবের চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে আর সেই অশ্রুসজল চোখে সাহেব পিকুর দিকেই তাকিয়ে আছে। আন্দাজ করতে দেরি হল না কী হয়েছে। সুবীরবাবু হাত নেড়ে পিকুকে ডাকলেন।
–এনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ইনি মিসিগান ল স্কুলের লাইব্রেরিয়ান। সাইমন। তোমার কথাই হচ্ছিল।
সাইমন কোনও কথা না বলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন পিকুকে।
–ঈশ্বর তোমার সঙ্গে থাকুন। বাবার খোঁজে দশ বছর ধরে তুমি দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছ। আর আমি কীরকম অভাগা দেখ! আমার ছেলে একই শহরে থাকে–অথচ খোঁজই নেয় না।
ভদ্রলোকের কান্না একটু কমলে পাশ থেকে সুবীরবাবু বলে উঠলেন,–যে ছেলেটা জিতল তার নাম ড্যানিয়েল। ও পড়াশোনাতেও নাকি খুব ভালো। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। প্রথম হয়। ওর সঙ্গে যাকে সবসময় দেখা যায়,–ওর সেই বন্ধু আজকে আসেনি। সে আবার সম্প্রতি নাকি এখানকার একটা রেসে একশো মিটারে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভেঙেছে। তা নিয়ে এখনও অনেক কাগজে লেখালেখি চলছে। সে-ও পড়াশোনায় খুব ভালো।
সাহেব বসে চোখমুখ রুমালে মুছতে মুছতে বলে উঠলেন,–ওরা দুজনেই একটা অরফানেজে বড় হয়েছে। তোমারই মতো। দুজনেই অসম্ভব ট্যালেন্টেড। অলরেডি বেশ কিছু পাথব্রেকিং রিসার্চও করছে। তা তুমিও তো খুব ভালো খেলছিলে। ওই ছেলেটা না থাকলে তুমিই জিততে।
একটু থেমে সাইমন সুবীরবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ইউনিভার্সিটির সব ইনফরমেশন ঘেঁটে দেখব। যদি পিকুর বাবার কোনও খোঁজ পাই, জানাব। আজ উঠি। ওকে দেখলেই…। বলে আবার কেঁদে ফেললেন, আরেকবার পিকুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
পিকু সুবীরবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,আপনি কী কী বলেছেন বলুন তো? দশ বছর ধরে দেশ-বিদেশে খুঁজছি! সারা শহরকে কাঁদিয়ে বেড়াচ্ছেন।
–আহা, ওই হল। উনিশ-বিশ। চলো গাড়িতে ওঠা যাক। সারাদিন আজ বেশ কাটল। সাইমন লোকটাও বেশ ভালো।
গাড়ির দিকে দুজনে এগোতে যাবে, দেখতে পেল টুর্নামেন্টে জেতা ছেলেটা পাশেই ওর গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে। পিকুকে দেখে এগিয়ে এল। হ্যান্ডশেক করে বলে উঠল–আমি ড্যানিয়েল।
–তুমি খুব ভালো খেলছিলে। আমি না থাকলে তুমিই জিততে। তুমি কি এখানেই থাকো?
না, আমি এখানে একটা রিসার্চের কাজে এসেছি। তুমি তো শুনলাম ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্টুডেন্ট। খুব ভালো রিসার্চ করছ।
–হ্যাঁ, ওই আর কী! দাবাটা হল আমার প্রাণ। তা, তোমার সঙ্গে যে জন্য কথা বলতে এলাম,–আমি যেখানে বড় হয়েছি, সেখানে একজনকে চিনতাম যাকে দেখতে ঠিক তোমার মতো। খুব আশ্চর্য মিল।
তুমি বড় হয়েছ কোথায়?
ক্যালিফোর্নিয়ায়। ওখানে এক অরফানেজে। যার কথা বলছি সে আমাদের থেকে কয়েকবছর বড়। এক কাজ করা যাক, চলো। আজ তো আর তেমন কথা বলা গেল না। খুব ক্লান্ত লাগছে। একদিন জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।
বলে ছেলেটা একটা ছোট কাগজে ওর নাম্বার আর ঠিকানা দিয়ে বলে উঠল,–একবার ফোন করে চলে আসবে। এখান থেকে খুব কাছেই। পিকুও ওর ঠিকানা কাগজে লিখে দিল। হ্যান্ডশেক করে এবারে ছেলেটা ওর গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
গাড়িতে উঠেই সুবীরবাবু বলে উঠলেন কি সাংঘাতিক ছেলে রে বাবা ড্যানিয়েল! চাল দিচ্ছিল কি স্পিডে! তুমি ছাড়া আর কেউ দু-মিনিটও টিকতে পারেনি। এক একবার সাইমনের দিক থেকে চোখ সরাই, দেখি ছেলেটা আরেকজনের সঙ্গে খেলতে বসে গেছে। যারা ভালো হয়, সবেতে ভালো হয়।
পিকু যেন শুনে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কোথাও কি দেখেছে আগে ছেলেটাকে? একবার জুলির সঙ্গে কথা বলা দরকার।
ও সুবীরবাবুকে বলল,আচ্ছা, মিসেস জুলিকে একবার ফোন করে দেখবেন–কোনও খবর পেয়েছেন কিনা। কাল যখন কথা হল তখন উনি বলেছিলেন যে উনি চেনাজানার মাধ্যমে আপিল করবেন এয়ারক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশন ফের চালু করার জন্য।
–হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। একবার ফোন করে দেখি। গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে জুলির নাম্বার ডায়াল করলেন সুবীরবাবু। ফোনটা অনেকক্ষণ রিং হয়ে গেল। খানিকক্ষণ বাদ দিয়ে আবার ডায়াল করলেন। ফের অনেকক্ষণ রিং হয়ে গেল।
–এত তাড়াতাড়ি তো শুয়ে পড়ার কথা নয়। একবার ওনার বাড়িতে যাওয়া যাবে? পিকু বলে উঠল।
–এখন? রাত নটার সময়?
–হ্যাঁ, গিয়েই দেখা যাক না! আমার মনে হচ্ছে ওনার কিছু বিপদ হয়েছে।
ওরা সুবীরবাবুর বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিল। সুবীরবাবু গাড়ি ঘোরালেন। যখন জর্ডনদের বাড়িতে ওরা পৌঁছোল তখন রাত প্রায় দশটা। বাগানের কয়েকটা আলো জ্বলছে, তবে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় তারা ম্রিয়মান। চারদিকে অনাদরে বেড়ে ওঠা গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে বাড়িটাকে দেখলে কেমন রোমাঞ্চ হয়। মনে হয় জীবনের চঞ্চলতা থেকে বহুদূরে একা যেন দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির ভেতরে আলো জ্বলছে। বেল বাজাল ওরা।
আগের দিনও ওনার দরজা খুলতে দেরি হয়েছিল। কিন্তু আজ প্রায় দশমিনিট কেটে গেল। বারবার বেল বাজানো সত্ত্বেও কোনও উত্তর নেই। তাহলে কি জুলি বেরিয়েছেন? কিন্তু। গাড়ি তো গ্যারেজেই! জুলি সেলফোনেও সাড়া দিচ্ছেন না।
বাধ্য হয়ে 911 ডায়াল করলেন সুবীরবাবু। পাঁচমিনিটের মধ্যেই পুলিশ এসে গেল। দরজা খুলে পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়ল ওরা।
জুলি রিক্লাইনারে হেলান দিয়ে নিস্পন্দভাবে বসে আছেন। মুখটা একদিকে কাত। দেখেই বোঝা যায় প্রাণ নেই। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্স এসে গেল। ওখানেই ডাক্তাররা ওনাকে মৃত ঘোষণা করল। ঘণ্টা তিনেক আগে জুলি মারা গেছেন। হার্ট অ্যাটাকে।
সুবীরবাবু ও পিকু যখন হাসপাতাল হয়ে বাড়ি ফিরল, রাত তখন তিনটে। গাড়িতে প্রায় একঘণ্টা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেনি।
ঘরে ঢোকার পরে সুবীরবাবুই প্রথমে কথা বললেন।
–যতই বলুক হার্ট অ্যাটাক, আমার সন্দেহ হচ্ছে। কালই ফোনে যখন কথা হল, তখনই উনি বললেন একটা দরকারি জিনিস খুঁজে পেয়েছেন। ডেভের লেখা একটা ছোট নোট। তাতে পাম স্প্রিং বলে একটা জায়গার উল্লেখ ছিল। এটা নাকি নিউইয়র্ক যাওয়ার দু-তিনদিন আগে লেখা। তার নীচে জয়ন্তর নামও ছিল। আমি যখন আরও জিগ্যেস করলাম, উনি ফোনে বলতে দ্বিধা করলেন। বললেন দেখা হলে বলবেন।
–তা আপনি আগে বলেননি কেন?
–তখন কি আর মারা যাবেন বুঝেছি! ভেবেছিলাম দু-একদিনে তো যাবই।…জুলির মৃত্যু সম্বন্ধে তোমারও কি সন্দেহ হয়?
–এটা হার্ট অ্যাটাক নয়। প্লেন অ্যান্ড সিম্পল মার্ডার। আর একটা কথা বলে রাখি। আমরাও ওদের টার্গেট। ওরা যে-কোনওভাবে আসল সত্য লুকোতে চায়। বাবাই-এর রিসার্চ থেকে এয়ারক্র্যাশ–আসল ঘটনা যেন কোনওভাবে প্রকাশ না হয়।
হু! বলে সুবীরবাবু পিকুর দিকে এগিয়ে এসে বললেন, কুছ পরোয়া নেহি। আমি তোমার সঙ্গে আছি। এই ডালরুটির জীবনে আমার এমনিতেই আগ্রহ নেই। রহস্য উদ্ধার করতেই হবে। যে-কোনও মূল্যে।
একটু থেমে সুবীরবাবু ফের বলে উঠলেন,–আরেকটা কথা। আমাকে সব কথা বলো। এই যেমন তোমার ছোটবেলার লুডোর কথাটা আমাকে আগে বলোনি। খুব বড় রহস্য বুঝলে! দাঁড়াও সবগুলো পয়েন্ট একটু একজায়গায় নোট করে নিই।
বলে ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা একটা ছোট নোটবুক বার করে লিখতে থাকলেন।
এক, তোমার লুডোতে কী ভেবে তোমার বাবা ওই দুটো সংখ্যাতে আগে থেকে ক্রশ করলেন। আর তা কী করে মিলে গেল ওনার মৃত্যুর দিনের সঙ্গে!
দুই, ওনার মৃত্যুর পরে কে টাকা পাঠাল ইনোভেটিভ সলিউশনসের নামে।
তিন, তোমার বাবা কেন এত গোপনীয়তার সঙ্গে ওনার আসল পরিচয়টা তোমাদের থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
চার, ওনার বন্ধু ডেভ জর্ডন–তিনিও কীভাবে টের পেলেন যে ওনারও সময় ফুরিয়ে আসছে।
পাঁচ, ডেভের লেখা নোটে আসলে কীসের উল্লেখ ছিল। ছয়, জুলির মৃত্যু, জুলি কি কিছু টের পেয়েছিল?
সাত, তুমি ও তোমার দাদা। কেন তোমাকে ঠিক তোমার দাদার মতো দেখতে? উ অনেকগুলো খেয়াল করার মতো পয়েন্ট।
পিকু বলে উঠল–তা লিখছেন যখন–আরও লিখুন। আট-ড্যানিয়েল কী করে আমার নাম জানল?
তাই নাকি? ওই চেস চ্যাম্পিয়ন ছোঁড়াটা?
–হ্যাঁ–খেলতে খেলতে হঠাৎ করে পিকু বলে ফেলেছিল। অন্যমনস্ক হয়ে পিকু ফের বলে উঠল–নয় নম্বর শুধু দাদা নয়। আমার মতো দেখতে আরেকজন কেউ কি আছে? যেমন ড্যানিয়েল বলল। সে-কে?
খানিকক্ষণের নীরবতা কাটিয়ে সুবীরবাবু বলে উঠলেনঃ, জটিল রহস্য। তবে বুঝলেন, ডিটেকটিভ হিসেবে আমি খারাপ নই। কত রাত শার্লক হোমস, ফেলুদা, ব্যোমকেশের বই বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছি। আর ডিটেকটিভগিরি আমার রক্তেও আছে। আমার এক নিকট আত্মীয় দাদুর মামাতো ভাইয়ের শালা পুলিশের বড় ডিটেকটিভ ছিল। তা আবার ব্রিটিশ আমলের সময়, ভাবো তো! দেখো এ-রহস্যের আমার হাতেই ফয়সালা হবে।
শুতে যাওয়ার সময় পিকু শুনতে পেল নীচের বেসমেন্ট থেকে আওয়াজ আসছে। উঁকি মেরে দেখল সুবীরবাবু ডন বৈঠক দিচ্ছেন। যদিও দুবার করার পরেই তিন মিনিট করে বিশ্রাম।