৩. ছোটো বোনটি

ছোটো বোনটিকে মেরে রেখে দিয়েছে; এ তো নিশ্চিত কথা।

তাই ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে নীলা, ন্যাকামী রাখ, বিয়ের যেন বয়স হয়নি বাছার, তাই আমাদের মাথা খারাপ দেখছেন। কেন, ফটোটা অপছন্দ হয়েছে?

ইলা ঠোঁট উলটে বলে, ফটো আমি দেখিইনি।

নীলা আর একবার ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, ওঃ, তাই তো, ফটোটা দেখেইনি! আর দর বাড়াতে হবে না, ঢের হয়েছে। কাল ওরা আসতে পারে–

দিদি, ভালো হবে না বলছি। রিসার্চটা শেষ না হলে–

নীলা গম্ভীর হয়।

বলে, তোদের জামাইবাবু কি একটা নিরক্ষরের ঘরে সম্বন্ধ করছে তোর? তাই বিয়ে হলেই রিসার্চ বন্ধ হয়ে যাবে তোর? শিক্ষিত পরিবার, তাদের মেয়েরাও এম-এ বি-এ পাস! ছেলের এক বোনও তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। খুব শিক্ষিত পরিবার।

শিক্ষিত পরিবার।

তাদের মেয়েরাও সব এম-এ বি-এ পাস।

ইলার চোখের সামনে সম্বুদ্ধর বিদ্বেষ-বিদ্দিষ্ট মুখটা ভেসে ওঠে, আমাদের বাড়ির কথা আর তুলো না। অর্ধশতাব্দী পূর্বের মনোভাব নিয়ে কাল কাটাচ্ছেন তাঁরা দু-চোখে ঠুলি এঁটে।

ইলার কণ্ঠে অবশ্য নীরবতা।

নীলা আবারও বলে, ওরা বিয়ের জন্যে ব্যস্ত। কারণ ছেলে আবার মাস আষ্টেক পরে আমেরিকায় চলে যাবে। অবিশ্যি বউ নিয়েই যাবে। মা-বাপের ইচ্ছে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে নিয়ে, এই কটা মাস সাধ-আহ্লাদ করা। এমন সম্বন্ধ আর জুটবে চট করে?

ইলাকে কষ্ট করে হাসতে হয়।

আর সেই কষ্ট হাসির সঙ্গে বলতে হয়, তোমার যা উৎসাহ দেখছি দিদি, মনে হচ্ছে তোমার বিয়েটা হয়ে গেছে বলে আপশোস হচ্ছে।

মা শুনছ! শুনছ তোমার ছোটোমেয়ের কথা?

নীলা বকছে, হাসছে, একটা কড়া বর, আর জাঁদরেল শাশুড়ি হচ্ছে তোর উপযুক্ত।

দিদি এলেই বাড়িটা সরগরম হয়। হাওয়ায় আনন্দ ভাসে।

কারণ দিদি সুখী।

কিন্তু দিদি ভীষণ জেদীও। এই বিয়ে নিয়ে যখন লেগেছে, উঠে পড়ে চেষ্টা করবে। গোড়াতেই তবে মূলোচ্ছেদ করা উচিত।

কিন্তু কখন? কোন্ অবসরে?

কিভাবে পাড়বে কথাটা? ঝপ করে? বিনা ভূমিকায়? বলবে বিয়ে বিয়ে করে অস্থির হয়ো না দিদি, সে-কাজটা আমি তোমাদের জন্যে রেখে দিইনি।

নাঃ! হচ্ছে না।

তবে কি ভূমিকা করে? দিদি, একটা কাণ্ড হয়ে গেছে। মাকে তো বলতে সাহস হচ্ছে না, তোমাকেই বলি—

বলল।

কিন্তু তারপর? দিদির আর জামাইবাবুর ঘৃণার চোখ থেকে কোথায় সরে যাবে ইলা। মা-বাবার সামনে কি করে মুখ তুলে দাঁড়াবে? ছোটো ভাই রমুটা পর্যন্ত হয়তো ঘৃণার দৃষ্টিতে চাইবে ছোড়দির দিকে।

ইলা যদি প্রেমে পড়ে গিয়ে ব্যক্ত করত সেই পড়ে যাওয়ার খবর, ইলার জন্যে বিরক্তি জমে উঠতে পারত, কিন্তু ঘৃণা নিশ্চয় নয়। ইলা তা করেনি। ইলা নিজের জন্যে সঞ্চয় করেছে ঘৃণা, করেছে তাদের কাছ থেকে, যারা ইলাকে প্রাণতুল্য ভালোবাসে।

একটু পরেই ইলার বাবা এলেন বাজার করে।

রবিবারের বিশেষ বাজার।

রবিবারে দুপুরের খাওয়াটা এখানেই খায় দিদি-জামাইবাবু। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ওর আর নড়চড় নেই।

ইলার বাবা ভোরবেলা বাজারে চলে যান, বেছে দেখে পছন্দ করে কিনে নিয়ে যান মাছ-তরকারি মেয়ে যা ভালোবাসে, জামাই যা ভালোবাসে।

এত স্নেহ নীলা-ইলার বাবার।

এতদিন এমন স্পষ্ট করে অনুভবে আসেনি ইলার। ওই শান্ত স্বল্পভাষী মানুষটার মধ্যে কী অগাধ স্নেহসমুদ্র! খুব একটা অবস্থাপন্ন অবস্থা নয় বাবার, তবু সন্তানদের কোনোদিন বুঝতে দেননি সে-কথা। নীলা ইলা রমু যখন যা প্রয়োজন সব পেয়েছে। বিশেষ করে ইলা।

দিদির তো আই-এ পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তবু তত খরচের দায় ছিল না।

ইলার জন্যে বাবা কত খরচ করে চলেছেন। এম-এ পড়ল, রিসার্চ করছে, একদিনের জন্যে বাবার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হতে শোনেনি ইলা আর পারা যাচ্ছে না।

অথচ ইলার বরাবরের সহপাঠিনী দীপা?

বাবা তার কত বড়লোক, তার পোশাক-পরিচ্ছদ আর টিফিন দেখে তাক লেগে যেত এদের।

কিন্তু বইখাতা কিনতে হলেই নাকি তার মা-বাপ খেপে উঠতেন, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলির নামে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করতেন, এবং অন্য মেয়েদের কাছ থেকে পুরানো বই কিনতে পাওয়া যাবে কি না তার সন্ধান নিতে বলতেন মেয়েকে।

ইলার বাবা চিরদিন মাসকাবার হলেই নিজে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ইলুবাবু, তোমার কি কি চাই?

বাবার ইলুবাবু তার প্রতিদান দিল বাবাকে।

বাবাকে দেখে মন কেমনের বাষ্পে বুকটা উথলে ওঠে ইলার।

আর হঠাৎ আজই প্রথম এমন স্পষ্ট করে মনে হল, এই সমস্ত কিছুর বদলে আমি কী পেলাম? এই অগাধ স্নেহ-সমুদ্র, এই ভালোবাসায়-ভরা মাতৃহৃদয়। এই আমার চিরদিনের পরিবেশ, আর আমার চিরদিনের সুনাম, এতগুলোর বিনিময়ে?

প্রেম?

এই সমস্ত কিছুর পূরণ হবে সেই প্রেমে? সম্বুদ্ধর আছে তেমনি প্রেম? প্রেমের শক্তি?

আর কিছুক্ষণ পরে হেমন্ত এল।

বলল, ইলা, ভাগো। তোমরা উপস্থিতি এখানে নিষ্প্রয়োজন।

ইলা বলল, নিষ্প্রয়োজন কাজই তো সর্বদা করে থাকি আমরা জামাইবাবু!

তবে শোন বিয়ের গল্প। কান পেতে শোন।…বুঝলেন মা, ইলার ছবি দেখেই ওদের মতো হয়ে গেছে, বলছিল, আর কি দরকার নিয়মমাফিক কনে দেখায়? আমিই বললাম, তা হোক, ও কোনো কাজের কথা নয়, চোখে দেখে যান একবার।..ছেলেকেও নিয়ে আসুন, দু-পক্ষেরই চক্ষু-কর্ণের বিবাদ-ভঞ্জন হয়ে যাক।

ছেলে।

মানে, সেই ছবির মানুষটা।

না না, এভাবে ইলা ঘটনার স্রোতে ভেসে যেতে পারবে না।

ইলা জামাইবাবুকে বলবে।

বলবে সকলের আড়ালে। এই একটা জায়গাই তবু সহজ মনে হচ্ছে। যাক, এখন সকলের সামনেও তো সম্মতি লক্ষণের লক্ষণ দেখানো যায় না। তাই বকে উঠে বলে, ধন্যবাদ জামাইবাবু, আপনাদের রুচিকে ধন্যবাদ। এখনও ওই পচা-পুরনো ঘৃণ্য প্রথাটাকে কি করে যে বরদাস্ত করেন আপনারা! ছিঃ!

হেমন্ত অবশ্য এই ছিঃতে বিচলিত হয় না। হেসেই ওঠে বরং। বলে, এখনও যখন সেই পচা-পুরনো ঘৃণ্য প্রথায় দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খাই, সেই পচা-পুরনো সেকেলে প্রথায় বালিশে মাখা রেখে ঘুমোই, বরদাস্ত করতে বাধে না, তখন এ-সব ছোটোখাটো ব্যাপারগুলোকে বড়ো করে দেখে লাভ কি?…বিয়ে হেন ব্যাপার, নিজের চোখে একবার দেখে নেবে, এটা কি খুব অস্বাভাবিক?

একবার চোখে দেখলেই সব বুঝে ফেলা যায়?

হেমন্ত একবার নীলার দিকে কটাক্ষপাত করে, জীবনভোর দেখলেই কি বুঝে ফেলা যায়? বোঝাবুঝিটা তুলে রাখতে হয় বিবাহ-পরবর্তী কালের জন্য। বোঝাবুঝি সারাজীবন।…তুমি যদি কারও সঙ্গে প্রেম করে দু-চার বছর কাল পূর্বরাগ চালিয়ে যাও বুঝতে পারবে তাকে?

ইলা কেঁপে ওঠে।

একি সাধারণ তর্ক-যুক্তির কথা? না, কোনো উদ্দেশ্যমূলক কথা? জামাইবাবু কি সব জেনে ফেলেছেন? কিন্তু তাই কি? তাহলে জামাইবাবু তার বন্ধুর ভাইপোর সঙ্গে এ-সব কথা চালাচ্ছেন কেন?

নাঃ, সাধারণ তর্কেরই কথা।

ওই যে বলেই চলেছেন জামাইবাবু ইলার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি না ফেলেই।

বলছেন, পারা যায় না। যতক্ষণ না তুমি তার স্বার্থের সঙ্গে মুখোমুখি হচ্ছ, তার আটপৌরে জীবনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছ, পাঁচ বছর মেলামেশা করলেও বুঝতে পারবে না তাকে। অতএব ও তোমার গিয়ে শীতকালে ঠাণ্ডা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো একবার চোখ-কান বুজে ঝাঁপিয়ে পড়াই ভালো।

ইলা ঈষৎ শ্লেষের সুরে বলে, তারপর ভাগ্য, কি বলুন?

এই স্বভাব ইলার, শ্লেষাত্মক বচনে মনোভাব প্রকাশ। বিশেষ করে জামাইবাবুর সঙ্গে।

ঝগড়া। কেবল ঝগড়া চলে।

জামাইবাবুর সঙ্গে ঝগড়া না করলে দিনটাই বৃথা যায় ইলার।

কিন্তু কিছুদিন থেকে নিজেই কেমন ভিতরে ভিতরে অপ্রতিভ হয়ে গেছে ইলা। ঝগড়া জমাতে পারে না।

প্রেমে পড়ে বুঝি কথার তীক্ষ্ণতাও হারিয়ে ফেলেছে সে।

প্রেমে পড়েও ততটা নয়, ওই রেজিস্ট্রির ব্যাপার ঠিক হয়ে গিয়ে পর্যন্ত। অথচ ইলার জানাশুনো বেশ দু-চার জন মেয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়ে অবলীলায় হাসছে খেলছে বেড়াচ্ছে। আসল কথা উপাদান।

সকলের উপাদানে সব কিছু খাটে না। ছেলেবেলায় ইলা একবার বাবাকে লুকিয়ে কুলপি বরফ খেয়েছিল। খাবার পর থেকেই উথলে উথলে কান্না উঠেছিল ইলার বুক থেকে, মাথার ভিতর থেকে, বাবা বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই হাউহাউ কেঁদে বলে ফেলেছিল ইলা বাবাকে, বাবা, আমি কুলপি বরফ খেয়েছি।

সেই উপাদান।

তবু এখন জোর করে পুরনো সহজ কৌতুকের অভ্যাসকে ফিরিয়ে আনে। বলে, তারপর ভাগ্য, কি বলুন?

হেমন্তও জোর দিয়ে বলে, নিশ্চয়? তারপর ভাগ্য, আবার কি? তবে হ্যাঁ, যারা তোমার হিতৈষী, যারা তোমার প্রিয়জন, তাদের শুভেচ্ছার ওপর একটু আস্থা রেখ।

জামাইবাবু আজ রেখেছেন।

পাগল, রাগ কিসের! হেমন্ত হাসে, তুমি অবশ্য ভেবেছিলে রাগিয়ে দিয়ে কাজ পণ্ড করে দেবে—সেটি হবে না।

হল না পণ্ড।

আরও বহুবিধ কথার পরও সেই কথাই স্থির রইল। কাল কনে দেখবে ওঁরা।

তবে কি আর সেই ঘাড় গুঁজে বসে, ভয়ে ভয়ে বরপক্ষের বিটকেল বিটকেল সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া? না, অতটা নয়। ভদ্রলোক বেড়াতে আসার মতো আসবে, ইলা বাড়ির মেয়ে হিসেবে, স্বচ্ছন্দ গতিতে চা-খাবার এগিয়ে দেবে, এই পর্যন্ত।

ইলার আপত্তি? মানছে কে?

কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব একটা আপত্তিই কি করল ইলা?

ইলা ভাবল যাক গে এটুকু একবার দেখাই যাক! হাজার লোকের সামনে বেরোচ্ছি, দু-একটা লোক এলই বা বাড়িতে। বেরোলাম বা তাদের সামনে। ক্ষয়ে যাব না তো।

বরং সম্বুদ্ধকে খেপাবার একটা বিষয়-বস্তু পাওয়া যাবে।

নিজে থেকে আর যাব না ওর কাছে—এ সঙ্কল্প করেছিল ভুলে গেল। ভাবতে লাগল হোক কালকের মজাটা, তারপর আচ্ছা করে রাগানো যাবে।

এতক্ষণ পরে মন কেমন করল সম্বুদ্ধর জন্যে। বেচারা!

ওর কি কাল কম কষ্ট হয়েছে? নেহাত অসুবিধেয় আছে তাই।

দাদারা আছে সম্বুদ্ধর, এবং বড়দার প্রকাণ্ড একটি আইবুড়ো মেয়ে আছে। সেইটির জন্যেই আরও জ্বালা। অতবড়ো ভাইঝি পড়ে থাকতে নিজে বিয়ে করল সম্বুদ্ধ, এত স্বার্থপরতা নাকি কেউ ক্ষমা করবে না।

অথচ নিজেরাও কিছু কম স্বার্থপরতা দেখাচ্ছেন না।

তারপর ইলা স্পন্দিত হতে লাগল, এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবার আশায়। আবার হাসলও মনে মনে।

যাক, কিছুই তো হয়নি আমার। কোনো পরিচিত অনুষ্ঠান। এ-একটা হয়ে যাবে তবু। কনে দেখা।

কুমকুম বিবেকের দংশনে দগ্ধাচ্ছিল।

বেচারী ইলা!

সারারাত বাইরে কাটিয়ে সকালবেলা বাড়ি ফিরে না জানি কী অভ্যর্থনা জুটেছিল তার ভাগ্যে। সম্বুদ্ধ কি সঙ্গে গিয়ে লুকোচুরির পালাটা সাঙ্গ করে ফেলেছে?

নাকি ইলার মা-বাবা এই অনিয়মের মূর্তি দেখে শাসনে আগুন হয়ে উঠেছিল। গিয়ে খবর নেবার সাহস হল না অথচ। তার চেয়ে সম্বুদ্ধর বাসায় যাওয়া সোজা।

সেদিনই পারল না। পরদিন সন্ধ্যায় গেল।

আর সমুদ্ধর মুখে প্রকৃত ঘটনা শুনে গালে হাত দিল।

রাতেই ফিরিয়ে দিয়ে এলে তুমি তাকে? বলিহারী! এত কাণ্ড, এত ইয়ে করবার দরকার কি ছিল তাহলে?

সম্বুদ্ধ লজ্জা পেল।

নিজের মান বাঁচাতে অনৃতভাষণের আশ্রয় নিল। বলল, আর বল না। যা অস্থিরতা করছিল। আশ্চর্য ভয়।

তুমি একটা কাওয়ার্ড। অসীম বলে ওঠে, আমি বলব, তোমার এখন বিয়ে করা উচিত হয়নি। নিজেরই যখন দাঁড়াবার জায়গা নেই।

সম্বুদ্ধ বলে, ভালো লাগছিল না। না করে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।

এখন খুব স্বস্তি পাবে? আকণ্ঠ পিপাসা, সামনে অগাধ সমুদ্র, কিন্তু লবণাক্ত।

করা যাচ্ছে কি! ইলা যে একবারে মা-বাপের ভয়ে তুমিও দাদা-বউদিদের ভয়ে—

সেটা ভয় নয়, বিতৃষ্ণা।

ফলাফল একই। ক্রমশ ইলারও তোমার প্রতি বিতৃষ্ণা আসবে দেখ।

অর্থাৎ?

অর্থাৎ, মেয়েরা কাপুরুষ পুরুষকে ভালোবাসতে পারে না। বরং বর্বরকে ভালোবাসবে, অসভ্যকে ভালোবাসবে, তবু তোমার মতো কাপুরুষকে নয়। যাক, তুমি কলকাতা থেকে বিদায় হচ্ছ কবে?

ওই তো, ওইখানেই তো মুশকিল। অফিস তো ছাড়তে চাইছে না।

তুমি ছাড়বে।

বলছে মোটা ইনক্রিমেন্ট দেবে।

কেন, লোক আর জুটছে না তাদের? দেখছি তো তাই।

অসীম বিরক্ত ভাবে বলে, কিন্তু এখান থেকে বিদেয় না হলে বউকে তো তুমি নিয়ে যেতে পারছ না?

সেই তো চিন্তা।

কুমকুম বলতে যাচ্ছিল, চিন্তাটা কিছু আগে হলে হত না? এখন—

বলা হল না।

ইলা এসে হাজির হল।

ইলার মুখে-চোখে প্রসাধনের আভাস। আর মুখের চেহারা কৌতুকের।

কুমকুম হই হই করে ওঠে, যাক, বেঁচে আছিস তাহলে? উঃ আমি তো ভাবলাম—

কি ভাবলি?

না, মানে ভাবিনি কিছু। কি ভাবা উচিত ছিল তাই ভাবছিলাম।

চমৎকার! তা, এতক্ষণ কিসের মজলিশ হচ্ছিল?

তোর নিন্দের। তুই যা লোমহর্ষণ কাণ্ড করেছিস পরশু–

পরশু? ইলা বলে, পরশু আমি কিছু লোমহর্ষণ কাণ্ড করিনি। তবে হ্যাঁ, আজ একটা করে এলাম বলে বটে। মিটিমিটি হাসতে থাকে ইলা।

জ্বালাবে। খুব জ্বালাবে ইলা সম্বুদ্ধকে। শোধ নেবে সে-রাত্রের।

অসীম বলে, ব্যাপারটা কি? ঘটনাটা প্রকাশ করে এলে?

উঁহু। সম্পূর্ণ উলটো। কনে দেখা দিয়ে এলাম।

কি? কি দিয়ে এলে? সম্বুদ্ধ বলে ওঠে।

ইলা হেসে হেসে বলে, কনে দেখা দিয়ে এলাম। বাবার কনিষ্ঠা কন্যার বিয়ের জন্যে বাবা অবশ্যই ভাবিত হচ্ছেন, এবং বাবার জ্যেষ্ঠা কন্যা অবশ্যই তাতে সাহায্য করবেন। যোগ ফল এই। পাত্র আর পাত্রের বাবা দুজনে এসে দেখে গেলেন। আমিও গুড গার্লের মতো তাদের চা দিলাম, খাবার দিলাম, দু-চারটে প্রশ্নেরও যে উত্তর দিলাম না তা নয়। তারা তো একেবারে বিগলিত! বাসায় ফিরে না মরে থাকে।

কুমকুম রুদ্ধকণ্ঠে বলে, ঠাট্টা করছিস না সত্যি বলছিস?

বাঃ, খামোকা এমন অদ্ভুত ঠাট্টা পাবই বা কোথায়?

এসবের বিপদটা বুঝছিস না? এরপর আর এগোতে গেলে—

তা, আর এগোনো চলবে না সেটাই বলতে এলাম। এখন ও বলুক কি করবে?

সম্বুদ্ধ এতক্ষণ সিগারেট ধ্বংসাচ্ছিল, আর বোধ করি ভিতরে ভিতরে নিজেও ধ্বংস হচ্ছিল। এবার ব্যঙ্গ তিক্তকণ্ঠে বলে, আমাকে কি করতে বলা হচ্ছে? দাবি ছেড়ে দিতে?

থাম্‌ বুদ্ধু! অসীম বলে, ওর অবস্থাটা বুঝছিস না? বাড়িতে যদিও কিছু না বলে, বা বলতে না পায়, স্বভাবতই এ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। কেলেঙ্কারি আরও কতদূর গড়াবে তাও বোঝ! যা এইবেলা তুই ওর বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলগে!

সম্বুদ্ধ তীক্ষ্ণ হয়।

বলে, ইলার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না খুব একটা চিন্তাকাতর। বরং যেন বেশ মজা পেয়েছে মনে হচ্ছে। পাত্রটি বোধ হয় খুব সুকান্তি?

ইলা ভালোমানুষের গলায় বলে, তা সত্যি ফার্স্টক্লাস চেহারা। কথাবার্তা? অতি চমৎকার। বিদেশ-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার, বিয়ে করে শীঘ্রই আবার বউ নিয়ে বিদেশে যাবে। অবস্থা ভালো, শিক্ষিত পরিবার, মা-বাপ আছেন, কলকাতায় বাড়ি, গাড়ি–

ইলা যেন আর কাকে পাত্রের সন্ধান দিচ্ছে। কথা শেষ করতে পারে না।

সমুদ্ধ রূঢ় গলায় বলে, খুব আপশোস হচ্ছে এখন তাই না?

ইলা আরও অমায়িক গলায় বলে, খু-ব।

দুঃখের বিষয়, এক্ষুনি ডাইভোর্স কেস আনতে পারবে না–

সেই তো দুঃখ

থাম ইলা, কুমকুম ঝঙ্কার দেয়, এখন বসল ইয়ার্কি মারতে। ভেবে দেখছিস না আর বেশি গড়ালে তার বাবার মুখটা কি রকম পুড়বে? পছন্দ যখন হয়েছে তখন–

পছন্দ?

ইলা হেসে উঠে বলে, আজ তো লোকটা রাতে ঘুমোতেই পারবে না।

হু। তা, লোকটার নামটা কি?

ইন্দ্রনীল। ইন্দ্রনীল মুখার্জী।

মুখার্জী।

সম্বুদ্ধ ঘোষ যেন ক্রমশই হেরে যাচ্ছে। তার মুখে সেই পরাজিতের কালো ছাপ। তার গলায় ঈর্ষার কুটিলতা।

থাকে কোথায়?

সর্বনাশ? ওইটি বলছি না। কে জানে গুণ্ডা লাগিয়ে ফিনিশ করবার তাল করবে কি না।

ঝগড়া রাখ ইলা।

কুমকুম সামলায়। সামলেই থাকে সখীরা। শ্রীরাধিকার আমল থেকে।

পরামর্শের কথা পাড়ে সে। এবং অনেক বাদ-বিতণ্ডার পর ঠিক হয় কালই সম্বুদ্ধ ইলাদের বাড়ি যাক। পরিচয় দিক। ইলার বাবা যদি মেনে নেন ব্যাপারটা উত্তম, আর যদি অপমান করেন ইলাকে, নিয়ে চলে আসবে সম্বুদ্ধ। তারপর যা হয় হবে। অসীমের বাড়ি রয়েছে, কুমকুমের বাড়ি রয়েছে। অবশ্য এ-সব ফ্যাসাদ কারও অভিভাবক-কুলই পছন্দ করেন না, তব তাড়িয়ে দিতে তো পারবেন না।

আর সম্বুদ্ধর যদি এখানের অফিসেই উন্নতি হয়, থেকে যাক। খুঁজুক একটা ফ্ল্যাট। মা-বাপের নাকের সামনে সুন্দর করে সংসার করুক ইলা।

কাল? কাল থাক।

ইলাই বাধা দেয়।

বলে, কাল নয়। দেখি চেষ্টা করে যদি জমিটা কিঞ্চিৎ প্রস্তুত করে রাখতে পারি।

যাই করো দেরি করো না অসীম বলে, ব্যাপারটা ছেলেখেলা নয়। এর সঙ্গে তোমার বাবার মান-সম্মান জড়িত।

.

ঠিক এই কথাই ঘণ্টা দুই পরে নীলা বলে, সব কিছুই ছেলেখেলা নয় ইলা, মনে রাখিস এর সঙ্গে তোর জামাইবাবুর মান-সম্মান জড়িত। উনি উপযাচক হয়ে তাদের বলেছেন, এখন আবার গিয়ে বলবেন, আমার শালী এখন বিয়ে করতে রাজী নয়। তুই পাগল হতে পারিস, উনি তো তা হতে পারেন না।

বাঃ, পড়া শেষ না করে বিয়ে করব না খুব একটা অযুক্তির কথা বুঝি?

খুব। ওটা এমন কিছু বাধা নয়। তাছাড়া এত যদি ইয়ে, আগে কেন বললি না?

বলেছিলাম দিদি।

বলেছিল।

কিন্তু তেমন করে বলেনি, সে-কথা নিজেই জানে ইলা। কোথায় যেন একটা বাসনার কাঁটা ছিল বিঁধে। নইলে সকাল থেকে মনটা এমন উদ্বেলিত হচ্ছিল কেন?

কেন অমন পরিপাটি প্রসাধনে রাজী হয়েছিল? আর কেন লোকটা যখন এল স্পষ্ট সহজ চোখে তাকাতে পারেনি তার দিকে? সে কি শুধুই একটা অস্বাভাবিকতার অস্বস্তি? না, ভালো লাগার সুখ? অথবা ভালো লাগার অসুখ?

আমি জানি না। নীলা বলে, যা বলবার নিজেই জামাইবাবুকে বল গে।

ওরে বাবা, রক্ষে কর।

তবে বল গে যা মাকে, বাবাকে। তবে জেন, তোমার বিয়ের মধ্যে আর নেই আমরা।

হঠাৎ হেসে ফেলে ইলা। বলে আচ্ছা। তারপর চলে আসে।

.

হেমন্ত আসতেই নীলা ফেটে পড়ে।

শুনেছ তোমার শালীর আদিখ্যেতার কথা? এখন বলছে রিসার্চ শেষ না করে বিয়ে করবে না।

হেমন্ত অফিসের পোশাক ছাড়তে ছাড়তে অম্লান গলায় বলে, শালীরা অমন বলে থাকে।

জানি না। এখনকার মেয়েদের বোঝা ভার। কী দরকার তোমার এর মধ্যে থাকবার?

হেমন্ত সহজ পোশাকে সুস্থ হয়ে বলে, কেন মাথা খারাপ করছ? মেয়েরা অমন দর বাড়িয়েই থাকে। তুমি যেমন শাড়ির দোকানে গিয়ে দামী শাড়িখানায় হাত বোলাতে বোলাতে বল, মোটে কিন্তু বেশি খরচ করবে না, সস্তা দেখে একখানা–

বলি আমি ওই কথা?

সত্যভাষণের অপরাধে ফাঁকির হুকুম না দিলে বলব, বলে থাকো। তোমার বোনও—

আমি তোমার মতো অত ইয়ে নই। আমি বলে দিয়েছি, যা বলবার মাকে বল গে।

হেমন্ত আরামের হাই তুলে বলে, বলবার কিছু নেই। তারা পাকা দেখার দিন ঠিক করে গেছে।

.

পাকা দেখার দিন ঠিক করে গেছে।

উৎফুল্ল অমলা মেয়েকে দেখেই বলে ওঠেন, ওরা যেতে না যেতেই কোথায় বেরোলি? বলে গেলি না?

আর বলা। তুমি কি আর তখন আমায় চিনতে পারতে মা?

অমলা হেসে ফেলেন।

অমলা বলেন, তা যা বলেছিস। ওরা তো যাবার সময় পাকা দেখার দিন ঠিক করে গেল।

অমলার মুখে পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্না।

অমলার কণ্ঠে সপ্তস্করা বেণুর ঝঙ্কার ….

এমন ভদ্র জীবনে দেখিনি বাপু। এই যে হেমন্ত, নিজে সে খুব ভালো। বিয়ের সময় কাকা-টাকা খুব ইয়ে করেছিল। কিন্তু এরা যেন আলাদা জাতের। কনের বাপ হাতজোড় করবে, তা নয় ওরাই করছে, তাড়াহুড়ো করে আপনাদের খুব অসুবিধেয় ফেলেছি, বুঝছি কিন্তু বড্ড ইচ্ছে—আমি তোর বাবাকে বলেছি, ওরা ভদ্র, ওরা কিছু চাইবে না, তা বলে তুমি যেন কমে সেরো না। ধারকর্জ করেও সাধ-আহ্লাদ করবে।…তা, গোছালো মানুষ তো। হাসলেন। বললেন, মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, এ কি আর আমার মাথায় ছিল না? তুই বাপু আর অমন রোদে রোদে হটহটিয়ে বেড়াস নে। যখন-তখন বেরনোটাও বন্ধ কর। চেহারাটা একটু ভালো কর।

অমলার মুখে-চোখে আহ্লাদের ঝিলিক খেলে।

এই অমলার মুখের ওপর বলবে ইলা, থামো মা, পাগলামী রাখো। এ-বিয়ে হবে না। বিয়েই দিতে হবে না তোমার ছোটো মেয়ের। বাবার জমানো টাকা খরচ করতে হবে না।

বলা যায় না।

ইলার মুখ দিয়ে বেরোয় ইলার অভাবিত একটা কথা। আর চেহারা ভালো হয়ে কী হবে? খারাপেই তো–

চলে যায় তাড়াতাড়ি।

অমলা মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের দিকে। যৌবনবতী মেয়ের মধ্যেই তো মা জন্ম নেয় নতুন করে। ইলা অমলার সার্থক স্বপ্ন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *