৩. চাকরটি ঘরে এসে ঢুকতে

দশম পরিচ্ছেদ

চাকরটি ঘরে এসে ঢুকতেই একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটা কি পর্দার পেছনে আড়ি পেতে শুনছিল এতক্ষণ? লোকটির মুখের ওপরে কোনোরকম ভাবান্তর দেখা গেল না। সে নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। একটা সিগারেট ধরিয়ে আরশীর দিকে এগিয়ে গেলেন ডোরিয়েন। তাকিয়ে দেখলেন। ভিকটরের মুখটা বেশ সপষ্টই দেখা যাচ্ছিল আরশীর ওপরে। চাকরের মুখের মতনই সে মুখ নিবাত-নিষ্কম্পা ভয় করার মতো কিছু নেই সেখানে। তবু তাঁর মনে হল সাবধানে থাকাই ভালো।

ধীরে-ধীরে কথা বললেন ডোরিয়েন: রাঁধুনিকে পাঠিয়ে দাও, তারপরে তুমি ছবির যারা ফ্রেম তৈরি করে সেই দোকানে দুজন মিস্ত্রিকে এখনই আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলা তাঁর মনে হল, লোকটি চলে যাওয়ার সময় পর্দার দিকে একবার তাকিয়ে গেল। অথবা এটা তাঁর মতিভ্রম?

কিছুক্ষণ পরে কালো পোশাক পরে মিসেস লিফ লাইব্রেরিতে হাজির হল, স্কুলঘরের চাবিকাঠিটা তিনি চাইলেন।

মিসেস লিফ বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল, পুরনো স্কুলঘরের চাবি চাইছেন, মিঃ ডোরিয়েন? ঘর তো একেবারে ধুলোয় বোঝাই হয়ে রয়েছে। আপনি ঢোকার আগে ঝেড়ে-মুছে ঘরটাকে চলনসই করতে হবে। ওঘরে এখনই আপনি ঢুকতে পারবেন না। স্যার; না, না, নিশ্চয় না।

ঘর ঝাড়-পোঁচ করতে আমি চাইনে, লিফ, আমি যা চাই সেটা হচ্ছে চাবিকাঠি।

কিন্তু স্যার, ঘরের মধ্যে মাকডশার ডাল গিজ গিজ করছে। ঢুকলেই আপনার গোটা গা ভর্তি হয়ে যাবে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে ঘরটা খোলা হয়নি, সেই যেদিন হিজ লর্ডশীপ দেহত্যাগ করেছেন।

দাদামশায়ের কথা উঠতেই তিনি ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। দাদামশায়ের সম্বন্ধে তাঁর যে স্মৃতি রয়েছে তার মধ্যে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু নেই। তিনি বললেন: তাতে কিছু যাবে আসবে না। ডাযগাটা আমি কেবল দেখতে চাই। চাবিটা আমাকে দাও।

কাঁপা হাতে চাবির বান্ডিল ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা চাবি বার করে বৃদ্ধা লিফ বলল: এই যে। গোছা থেকে এখনই এটা আমি বার করে দিচ্ছি। কিন্তু ওখানে আপনি থাকবেন ঠিক করেননি তো? এ ঘরে তো আপনি ভালোই রয়েছেন।

না, না, রাত্রিবাস করার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। ধন্যবাদ, এবার তুমি এস।

কিন্তু তখনই সে চলে গেল না; দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সাংসারিক ব্যপার নিয়ে কিছুটা বকবক করল। তিনি মনে-মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন: বেশ তো; তোমার যেটা ভালো মনে হবে সেইভাবেই সংসার চালাও।

মিসেস লিফ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। চাবিকাঠিটা পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলেন ডোরিয়েন; ঘরের ভেতরে চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখলেন।

দেখতে-দেখতে লাল সাটিনের বিরাট একটা চাদরে তাঁর চোখ এসে পড়ল, চারপাশটা তার সোনালি বুটির কাজ, সপ্তদশ শতাব্দীর ভেনিস্যি কারুকলার একটি অপূর্ব নিদর্শন। বোলোচানার কনভেনট থেকে তাঁর দাদামশায় সেটি সংগ্রহ করেছিলেন। হ্যাঁ, সেই ভয়ানক বস্তুটাকে ওই চাদর দিয়ে স্বচ্ছন্দে ঢাকা দেওয়া যাবে। ওটা দিয়ে প্রায় মৃতদেহগুলিকে ঢাকা দেওয়া হত। এখন ওটা দিয়ে এমন একটা জিনিসকে চাপা দেওয়া হবে যেটা আপনা থেকে বিকৃত হয়ে ওঠে; মৃতদেহের বিকৃতির চেয়েও যার বিকৃতি অনেক বেশি ভয়ঙ্কর-যে নিজে না মরেও চারপাশে মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে দেয়। মৃতদেহের ওপরে পোকারা যে বিকৃতি ঘটায়, তাঁর পাপ ক্যানভাসের ছবিটির ওপরেও সেই রকম বিকৃতি ঘটাবে তাঁর পাপগুলি ছবিটির সৌন্দর্য নষ্ট করবে, ধ্বংস করে দেবে তার লাবণ্য। একেবারে কদর্য হয়ে যাবে জিনিসটা তবু তর মৃত্যু হবে না; তবু সে চিরকাল বেঁচে থাকবে।

ভাবতে-ভাবতে তিনি শিউরে উঠলেন। প্রতিকৃতিটাকে ঢেকে রাখার আসল কারণটা তিনি যে বেসিলকে বলেননি সে-জন্যে অনুশোচনা হল তাঁর। লর্ড হেনরির প্রভাব অথবা তাঁর নিজের প্রবৃত্তি থেকে যে সব পঙ্কিল চিন্তাগুলি বেরিয়ে তাঁকে পাপের পথে টেনে নিয়ে যেতে চায় সেগুলির প্রভাব থেকে বেসিল হয়তো তাঁকে বাঁচাতে পারতেন। তাঁর ভালোবাসার মধ্যে এমন কিছু নেই যা মহৎ নয়, মননশীলতা যার মধ্যে নেই। কারণ, কোনো খাদ নেই বেসিলের। ভালোবাসার ভেতরে। এই ভালবাসা দেহজ নয়। প্রবৃত্তিগুলি ক্লান্ত হয়ে উঠলেই দেহ ভলোবাসা নষ্ট হয়ে যায়। মাইকেল এঞ্জেলো, মনতেন উইনকিলম্যান এবং শেকসপীয়ন–এঁরা সবাই সেই আসল ভালোবাসারি পূজারী। হ্যাঁ, বেসিলই তাঁকে বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন আর সে সময় নেই। অতীতকে সব সময় বিনষ্ট করা। যায়। অনুশোচনা, আত্মাহুতি আর বিস্মৃতির মধ্যেই কবরস্থ করা যায় অতীতকে। কিন্তু ভবিষ্যতকে এড়ানো যায় না। তাঁর কামলা আর ভোগের উচ্ছ্বাসই তাঁর সামনে বিপদের নতুন পথ খুলে দেবে, আজ যে বিপদ অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে একদিন তাই রূপায়িত হবে ভয়ঙ্কর বাস্তব সত্য।

সোফার ওপর থেকে তিনি সোনালি কারুকার্য করা বিরাট চাদরটিকে হাতে করে তুলে নিলেন; তারপরে সেটি নিয়ে পর্দার পেছনে চলে গেলেন। ক্যানভাসের ওপরে যে মুখটি আঁকা রয়েছে, আগের সেটি কি আরো কুৎসিত রূপ ধারণ করেছে? দেখে তো মনে হল কোনোরকম পরিবর্তন দেখা দেয়নি, কিন্তু ছবিটির ওপরে তাঁর ঘৃণার মাত্রাটা যেন আরো বেড়ে গেল। সোনালি চুল, নীল চোখ, গোলাপ রাঙা দুটি ঠোঁট–সবই সেই আগের মতোই রয়েছে। নেই যা তা হচ্ছে মুখের ভাবটা একটা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার ছাপ মুখের ওপরে পড়েছে। সাইবিল ভেনকে নিয়ে বেসিল তাঁকে যে তিরস্কার করেছেন তার তুলনায় এই মুখের তিরস্কার কত বেশি, কত তীব্র। এই ছবির ভেতর থেকে তাঁর নিজের আত্মাই যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলছে–এই অন্যায়ের বিচার চাই। একটা যন্ত্রণায় তিনি আর্তনাদ করে চাদরটা ছবির ওপরে ছুঁড়ে দিলেন। ঠিক এমনি সময়ে দরজায় টোকা পড়ল। তিনি বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঘরে চাকরটি ঢুকে এসে বলল: জনকয়েক লোক এসেছেন মঁসিয়ে।

তাঁর মনে হল চাকরটিকে এখনই কোথাও সরিয়ে দিতে হবে। ছবিটা কোথায় রাখা হবে সে সংবাদ তাকে জানতে দেওয়া হবে না। এই উদ্দেশ্যে একটু চালাকি খেলতে হল তাঁকে। লেখার টেবিলে ধীরে সুস্থে বসে তিনি একখানা পত্র লেখার কাগজ টেনে নিলেন; লর্ড হেনরিকে উদ্দেশ্য করে কয়েকটি লাইন খসখস করে লিখেও ফেললেন; সেই চিঠিতে পড়ার জন্যে কিছু বই তাঁকে পাঠাতে বলেলন, সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিলেন সেদিন রাত আটটা পনেরোর সময় তাঁদের বিশেষ একটি জায়গায় মিলিত হওয়ার কথা রয়েছে।

চিঠিটা চাকরের হাতে দিয়ে বললেন: এটা তুমি লর্ড হেনরির কাছে নিয়ে যাও। তাঁর উত্তরটা নিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করো। ভদ্রোলোকদের আসতে বলে যাও।

দু’তিন মিনিটের মধ্যে আর একটা টোকা পড়ল। হাজির হলেন সাউথ অডলি স্ট্রিটের মিঃ হবার্ড স্বয়ং। পেশার দিক থেকে বেশ নামকরা ফটো ফ্রেম বাঁধাইকারী। তিনি একলা । আসেননি; সঙ্গে এসেছেন রুক্ষ চেহারার একটি যুবক সহকারীকে। চেহারার দিকে ভদ্রলোক বেঁটে; গোঁফ জোড়াটি লাল, পোশাক বেশ জাঁকালো আর্টের ওপরে। তাঁর যে শ্রদ্ধা তার উৎস হচ্ছে যে সব আর্টিস্টের সঙ্গে তাঁর লেনদেনের ব্যাপার ছিল তাঁদের অনেকেরই চরম দারিদ্র্য। নীতিগতভাবে কোনোদিনই তিনি দোকান ছেড়ে বেরোতেন না। খরিদ্দার বা অন্য লোকদের ডজন্যে তিনি দোকানেই অপেক্ষা করতেন। কিন্তু ডোরিয়েন গ্রের ব্যাপারে সব সময়েই তিনি এই নিয়ম ভেঙে চলতেন। ডোরিয়েন গ্রে-র মধ্যে এমন একটা জিনিস ছিল যা মানুষকে মুগ্ধ না করে পারত না। তাঁকে চোখে দেখেও আনন্দ পেত মানুষ।

তাঁর স্থূল হাত দুটিকে কচলিয়ে তিনি বললেন: আপনার জন্যে কী করতে পারি মিঃ গ্রে? ভেবেছিলেম আপনার এখানে আমি একাই আসব। আমার দোকানে অদ্ভুত সুন্দর একটা ছবির ফ্রেম রয়েছে, স্যার। এটাকে একটা সেল-এ কিনেছি আমি। মনে হয়, ফ্রন্টহিল থেকে আমদানি হয়েছে। ধর্ম সংক্রান্ত কোনো কিছু ছবির পক্ষে এই ফ্রেম খুব জুৎসই, স্যার।

 মিঃ হুবার্ড, আপনি যে কষ্ট করে নিজেই এসেছেন তার জন্যে আমি দুঃখিত। যদিও ধর্ম। সম্বন্ধীয় কোনো আর্ট নিয়ে বর্তমানে আমি মাথা ঘামাইনে তবু আপনার দোকানে একদিন গিয়ে নিশ্চয় আমি ফ্রেমটি দেখে আসব,কিন্তু আজকে আমার একটি ছবিকে বাড়ির ওপরতলায় নিয়ে যেতে হবে। ছবিটা বেশ ভারী, আপনি যদি ডনে দুই লোক পাঠিয়ে দিতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।

তাতে আর অসুবিধে কী রয়েছে, মিঃ গ্রে? আপনার কোনো সাহায্যে আসতে পারলে আমি খুশিই হবা কোন ছবিটার কথা বলছেন, স্যার?

পর্দাটাকে সরিয়ে ডোরিন বললেন: এইটা। চাপানসুদ্ধ, ঠিক যেমনটি রয়েছে, এটাকে নিয়ে যেতে পারবেন? ওপরে নিয়ে যাওয়ার সময় এর গায়ে কোথাও কোনো ঠোক্কর লাগুক তা আমি চাইলে।

কোনো অসুবিধে হবে না স্যার।

এই বলে সেই লোকটি তাঁর সহকারীকে নিয়ে যে পেতলের শেকল দিয়ে ছবিটি টাঙানো ছিল। তার পেরেকটা খুলতে লাগলেন।

এখন কোথায় এটিকে নিয়ে যাব, মিঃ গ্রে?

আপনি দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন। জায়গাটা আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, মিঃ হুবার্ড। তার চেয়ে আপনিই বরং আগে-আগে চলুন। যেতে হবে বাড়ির একেবারে ওপরতলায়। চলুন আমরা সামনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই। সিড়িঁটা বেশ চওড়া।

তাঁদের যাতে বেরিয়ে যেতে অসুবিধে না হয় সেইজন্যে দরজাটা তিনি ফাঁক করে দিলেন। হলঘরের মধ্যে ঢুকে তাঁরা সিঁড়িতে উঠতে লাগলেন। বিশেষ এবং বিশদ খুঁটিনাটির দিকে লক্ষ রাখার ফলে ছবিটা বেশ ভারী হয়ে পড়েছিল। পাচ্ছে সেটা ঠোক্কর লেগে ভেঙে যায় এই ভয়ে মাঝে-মাঝে ডোরিয়েন ছবিটাকে ধরছিলেন। কিন্তু মিঃ হুবার্ড বিনয়-নম্রভাবে নিষেধ করছিলেন তাঁকে তাঁর বোধ হয় কারণটা এই যে সত্যিকার ব্যবসাদারের মতো তিনি চাইতেন না কোনো ভদ্রলোক কোনো প্রয়োজনীয় কাজ করুক।

 সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠে সেই খুদে লোকটি হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন: সত্যিকাল ভারী, স্যার।

এই বলে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি।

ঘরের চাবি খুললেন ডোরিয়েন; এই ঘরেই তিনি তাঁর জীবনের একটি অদ্ভুত গোপন রহস্যকে লুকিয়ে রাখতে এসেছেন। সেই সঙ্গে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখবেন নিজের আত্মাটিকেও। দরজাটা খুলে দিয়ে তিনি বললেন, হ্যাঁ, তা বেশ ভারীই বটে।

এই ঘরে জীবনে তিনি বারো বছরের মধ্যে ঢোকেননি। শৈশবে এই ঘরে তিনি খেলতেন; কিছুটা বড়ো হওয়ার পরে এখানে তিনি পড়াশুনা করতেন। ঘরটি বিরাট এবং উপযুক্ত। মাপের। বাচ্চা নাতির জন্যেই মৃত লর্ড কেলসো ঘরটিকে তৈরি করিয়েছিলেন। ছেলেটির। মধ্যে তার মায়ের চেহারার দুপ থাকায় এবং অন্যান্য কারণে, ছেলেটিকে সূব সময় তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন। বিশেষ করে সেইজন্যেই ছেলেটিকে তিনি তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। ডোরিয়েনের মনে হল ঘরটির কিছুই পরিবর্তন হয়নি। তার গঠন, আসবাবপত্র–সব একইরকম রয়েছে। সাটিনের তৈরি বুককেসের মধ্যে এখনো তাঁর স্কুলের বইগুলি সাজানো রয়েছে। তার পেছনে দেওয়াল। সেই দেওয়ালের ওপরে অপরিচ্ছন্ন একটা পর্দা। পর্দায় গায়ে একটি বাজা আর রানির অস্পষ্ট ছবি; বাগানে বসে তাঁরা দাবা খেলছেন। পাশের রাস্তা দিয়ে কয়েকটি ফিরিওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। তাদের কব্জির ওপরে শেকল। বাঁধা কয়েকটা ঝুঁটিওয়ালা পাখি। সব মনে রয়েছে তাঁর স্পষ্ট মনে রয়েছে। ঘররে চারপাশে তিনি তাকিয়ে দেখলেন। শৈশবের প্রতিটি নিঃসঙ্গ মুহূর্ত তাঁর মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল তাঁর শৈশবের নিষ্পাপ দিনগুলির কথা। সেই ঘরের মধ্যে এই ধরনের যে একটা বিষাক্ত ছবিকে লুকিয়ে রাখতে হবে এটা ভাবতেই তাঁর মনটা আঁতকে উঠল। তাঁর কপালে এই লেখা রয়েছে–একথা কি কোনোদিন তিনি ভাবতে পেরেছিলেন?

কিন্তু কৌতূহলী দৃষ্টি থেকে কোনো জিনিস লুকিয়ে রাখার মতো এর চেয়ে ভালো জায়গা আর নেই। চাবিটা তাঁর কাছে রয়েছে সেই জন্যে অন্য কেউ সেখানে ঢুকতে পারবে না। এই লাল চাদরের নীচে প্রয়োজন মনে করলে ছবির মুখটা তার খুশি মতো পাশবিক মূর্তি গ্রহণ করতে পারে। তাতে কার কী যায় আসে? কেউ তা দেখতে আসবে না। নিজেও তিনি তা দেখবেন না। তাঁর আত্মার এই ভয়ঙ্কর বিকৃতি কেনই বা তিনি লক্ষ করবেন? তাঁর যৌবন বেঁচে থাকবে এইতো যথেষ্ট। তাছাড়া, তাঁর চরিত্র কি শেষ পর্যন্ত সুন্দর হয়ে উঠবে না? তাঁর ভবিষ্যৎটাও যে এই রকমেরই ক্লেদাক্ত থেকে যাবে এর পেছনেও তো কোনো কারণ নেই। নতুন কোনো প্রেম তাঁর ভেতরে দেখা দিতে পারে সেই প্রেম তাঁকে পবিত্র করে তুলবে এং যে পাপ তাঁর দেহ আর মনকে এমনভাবে ঝাঁকানি দিয়েছে–সেই অদ্ভুত অদৃশ্য পাপ যাকে আমরা বুঝতে পারিনি বলেই মনোহর বলে মনে করি–সেই পাপ থেকে তাঁকে রহস্কা করতে পারে। সেই রক্তিমাভ সপর্শকাতর মুখ থেকে হয়তো একদিন সেই নির্মম চাহনিটি মুছে যাবে এবং বেসিল হলওয়ার্ডের জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তিটিকে তিনি বিশ্বকে দেখাতে পারবেন।

না, সে অসম্ভব। ঘন্টার পর ঘন্টা, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, ছবিটির ওপরে বার্ধক্যের ছাপ পড়বে। পাপের ভয়ঙ্কর বিকৃতি থেকে ও মুক্তি পেতে পারে, কিন্তু বয়সের বিকৃতি থেকে ওর কোনো মুক্তি নেই। গাল দুটি চুপসে যাবে, হবে থলথলে; হলদে রঙের ছায়া নেমে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়বে নিষ্প্রভ দুটি চোখের কোটরে, বীভৎস দেখাবে তাদের। চুলগুলি হারিয়ে ফেলবে তাদের। উজ্জল বর্ণ, মুখের চোয়াল পড়বে ঝুলে, বৃদ্ধদের মুখের মতো সেই মুখ বোকাটে-বোকাটে দেখাবে। কণ্ঠে জাগবে কুঞ্চন, ঠান্ডা হাত দুটির ওপরে নীল শিরাগুলি জেগে উঠবে; দেহটা ভেঙে কুঁজো হয়ে যাবে। শৈশবে যে দাদামশায় তাঁর চোখে অত কঠোর প্রকৃতির ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে তিনিও ঠিক ওই জাতীয় প্রাণীতে পরিণত হয়েছিলেন। বেশ মনে রয়েছে তাঁর। সুতরাং ছবিটাকে লুকিয়ে ফেলতেই হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই তাঁর।

ঘুরে দাঁড়িয়ে বেশ ক্লান্ত স্বরেই তিনি বললেন: ওটাকে ভেতরে নিয়ে আসুন, মিঃ হুবার্ড, আপনাদের অনর্থক দাঁড় করিয়ে রাখরা জন্যে দুঃখিত, আমি অন্য কথা ভাবছিলাম।

মিঃ হুবার্ড পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছিলেন, তিনি বললেন: একটু বিশ্রাম পেয়ে ভালোই হয়েছে, মিঃ গ্রে। এটাকে কোথায় রাখব বলুন তো?

যে কোনো জায়গায়। এখানে, এখানে-ও রাখা যেতে পারে। আমি এটাকে ঝুলিয়ে রাখতে চাই নে। দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখুন। ধন্যবাদ।

কিন্তু ছবিটা কেউ দেখতে চাইতে পারে স্যার!

কথাটা শুনে চমকে উঠলেন মিঃ ডোরিয়েন; লোকটির দিকে চোখ রেখে বললেন: ওটা দেখতে আপনার ভালো লাগবে না।

যে জাঁকালো পর্দাটা তাঁর জীবনের একটি গোপন রহস্যকে ঢেকে রেখেছে, লোকটি যদি সেই পর্দাটা একটু সরিয়ে ছবিটি দেখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে তাহলে তাঁকে আচ্ছা করে ধোলাই দেওয়ার একটা বাসনা তাঁর মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে গেল।

আর আপনাকে কষ্ট দেব না। আপনি যে দয়া করে এসেছেন তার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মোটেই না, মোটেই না, মিঃ গ্রে। আপনার জন্যে সব সময়ে সব কাজ করতে আমরা প্রস্তুত।

এই বলে মিঃ হুবার্ড তাঁর সহকারীকে পেছনে নিয়ে নামার পথ ধরলেন। নামার পথে সহকারীটি তার সেই রুক্ষ আর বিশ্রী মুখ ঘুরিয়ে লজ্জা আর সেই সঙ্গে কিছুটা বিস্ময় মখালো। দৃষ্টি দিয়ে পেছনে ফিরে ডোরিয়েনের দিকে একবার তাকাল। এমন অপরূপ চেহারার মানুষ, আর কোনো দিন তার চোখে পড়েনি।

 তাদের পদশব্দ নীচে মিলিয়ে যাওয়ার পরে, দরজায় চাবি দিয়ে চাবিকাঠিটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন ডোরিয়েন। এখন অনেকটা নিরাপদ মনে হল তাঁরা এই ভয়ঙ্কর জিনিসটা আর কারও চোখে পড়বে না। নিজের ছাড়া আর কারও চোখ তাঁর এই লজ্জার ওপরে পড়বে না।

লাইব্রেরিতে নেমে আসার পরে তিনি দেখলেন পাঁচটা বেড়ে গিয়েছে। টেবিলের ওপরে চা-এর সরলাম সাজানো রয়েছে। প্রচুর পরিমাণে ঝিনুক দিয়ে গাঁথা সুগন্ধী কাঠের তৈরি ছোট্ট একটা টেবিলের ওপরে লর্ড হেনরির একটা চিঠি চাপা রয়েছে। তাঁর অভিভাবকের পত্নী লেডি ব্যাডল টেবিলটি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা গত শীতে কায়রোতে ছিলেন। লর্ড হেনরির চিঠির পাশে হলদে কাগজে মোড়া একখানা বই রয়েছে। বইটির মলাট সামান্য ছেঁড়া, বাঁধাইটা নোংরা। চা-এর ট্রের ওপরে দি সেন্ট জেমস গেজেটের তৃতীয় সংস্করণের একটি কপি চাপা দেওয়া। স্পষ্টতই বোঝা গেল যে ভিকটর ফিরে এসেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে দুজনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কিনা এবং হলে তাদের কাছ থেকে সে কোনো তথ্য সংগ্রহ করেছে কি না এটাই তিনি ভাবতে লাগলেন। ঘরের মধ্যে চা-এর সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখার সময় সম্ভবত ছবিটিকে সে দেখতে পায–সম্ভবত নয়, নিশ্চয়। পর্দাটাকেও সে ঠিক করে রাখেনি। ফলে দেওয়ালের সামনের জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। হয়তো কোনো রাত্রিতে লোকটা খুঁড়ি দিয়ে ওপরে গিয়ে দরজাটা ভাঙার চেষ্টা করবে। ঘরের ভেতরে গুপ্তচর। রাখাটা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। তিনি এমন কিছু ধনী মানুষদের কথা শুনেছেন যাদের বাড়ির চাকর চিরকাল তাঁদের ব্ল্যাকমেইল করেছে, কারণ তাঁদের কোনো গোপন চিঠি তারা পড়ে। ফেলেছিল, অথবা, মনিবের কিছু কথা তারা আড়ি পেতে শুনেছিল, অথবা ঠিকানা লেখা কোনো কার্ড তাদের হাতে পড়েছিল, অথবা বালিশের তলায় পাক বাঁধা কোনো চুলের ফিতে আবিষ্কার করে ফেলেছিল। এই জন্যে চাকরদের অনেক ঘুষ খাওয়াতে হয়েছে তাঁদের। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপরে চা ঢেলে লর্ড হেনরির চিঠিটা খুললেন। চিঠিতে কেবল লেখা ছিল যে সন্ধ্যার কাগজটা তিনি পাঠিয়ে দিলেন, সেই সঙ্গে পড়তে যদি ভালো লাগে এই আশায একখানি বই-ও পাঠালেন। তিনি যে তাঁর জন্যে ক্লাবে আটটা পনেরোতে অপেক্ষা করবেন সেকথা লিখতেও ভোলেননি তিনি। খবরের কাগজের পাতাগুলি উদাসীনভাবেই উলটোচ্ছিলেন তিনি; হঠাৎ পঞ্চম পৃষ্ঠার একটি কলামে লাল পেনসিলের দাগ কাটা থাকায় তাঁর কৌতহল কেমন বেড়ে গেল। তিনি সেটা পড়ে গেলেন।

“একটি অভিনেত্রীর মৃত্যুর সম্বন্ধে তদন্ত: হক্সটন রোডে বেল ট্রাভার্ণ-এ ডিস্ট্রিক্ট করোনার মিঃ ডানবি আজ সকালে সাইলি ভেন নাম্নী একটি যুবতী অভিনেত্রীর মৃত্যুর কারণ বার করার জন্যে অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। অভিনেত্রীটি হলবর্ন-এ রয়্যাল থিয়েটারে অভিনয় করতেন। নিছক একটা দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে যে তাঁর মৃত্যু হয়েছে এই মতই তিনি দিয়েছেন। মৃতার মা যখন সান্ধী দিতে এসেছিলেন তখন এই বিযোগের জন্যে অনেকেই তাঁর দুঃখে সহানুভুতি দেখান। ডঃ বিরেল ময়না তদন্ত করেন। তাঁর সাক্ষী দেওয়ার সময়েও শ্রোতারা গভীর দুঃখে ভেঙে পড়েন।”

 লেখাটা পড়ে ভ্রুকুটি করলেন তিনি, কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে ডানালার কাছে এগিয়ে গেলেন, তারপরে জানালার বাইরে সেগুলি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। কী কুৎসিত! কী ভয়ঙ্কর রকমের। কদর্য! সংবাদটা তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে লর্ড হেনরির ওপরে তাঁর রাগ হল। তাছাড়া। সংবাদটার চারপাশে লাল পেনসিল দিয়ে দাগ কেটে দেওয়াটাও নেহাৎ বোকামো হয়েছে। ভিকটর নিশ্চয় তা পড়েছে। ওটা পড়ে বোঝার চেয়ে অনেক বেশি ইংরেজি সে জানে।

সম্ভবত সে ওটি পড়েছে এবং পড়ে কিছু সন্দেহ করতে শুরু করেছে। কিন্তু তাতেই বা কী আসে যায়? সাইভিল ভেনের মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর সমপর্ক কী? না, কোনো ভয় নেই। ডোরিয়েন গ্রে তাকে মারেননি।

লর্ড হেনরি যে হলদে বুইটা পাঠিয়েছেন। সেই বইটার ওপরে নজর পড়ল তাঁরা বস্তুটা কী? তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন। ধূসর বর্ণের ছোটো অষ্টভুজা দাঁড়ানো বই রাখার জায়গাটার দিকে তিনি এগিয়ে গেলেন। দেখে সব সময় তাঁর মনে হত ইজিপ্টের কোনো শ্রমশীল মিস্ত্রি ওটিকে তৈরি করেছেন। গ্রন্থটিকে তুলে নিয়ে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিলেন তিনি, তারপরে পড়ায় গেলেন ডুবো ওরকম অদ্ভুত বই জীবনে আর কখনো তিনি পড়েননি। তাঁর মনে হল বাঁশীর মিষ্টি সুরের সঙ্গে তাল দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত পাপ নির্বাকভাবে নাচতে নাচতে তাঁর সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে জিনিসগুলি তিনি কল্পনায় দেখতেন সেগুলি যেন হঠাৎ রূপ পরিগ্রহ করে তাঁর সামনে উপস্থিত হল। যে জিনিসটা কোনোদিন তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি সেই জিনিস ধীরে ধীরে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করল।

ওটি একটি উপন্যাস কিন্তু প্লট বলে কিছু ওর নেই। চরিত্র বলতে একটিই–সেটি হচ্ছে প্যারিসের একটি যুবকের। ওটিকে একটি মনস্তত্ত্বমূলক গ্রন্থ বললেই বোধ হয় ঠিক বলা হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই যুবকটি একমাত্র তার নিজের যুগ ছাড়া অন্য সমস্ত যুগের ভাবধারা অনুধাবন করার চেষ্টা করেছিল। অর্থাৎ সেই সব কৃত্রিম আত্মত্যাগ যেগুলিকে মানুষ চিরকাল পুণ্য বলে ভুল করেছে অথবা মানুষের সেই সব স্বাভাবিক বিদ্রোহ যাদের মানুষ অবিবেচকের মতো পাপ বলে প্রচার করেছেন সেইগুলি আসলে কী তাই নিয়ে সে সারাজীবনটা গবেষণা। করেছিল। ভাষাটি মুক্তোর ঝালরের মতো তা প্রাচীন ব্যঞ্জনা আর আঙ্গিকে খোদাই করা। মাঝে-মাঝে বিশেষ অর্থে বিশেষ শব্দ প্রয়োগের চেষ্টা বেশ স্পষ্ট। সেই সঙ্গে রয়েছে বিশদ ব্যাখ্যা। জগতের শ্রেষ্ঠ লেখকরা বিশেষ করে ফ্রান্সে যাঁদের সিম্বোলিস্ট বলা হয়, এই জাতীয় দুর্বোধ্য রচনার ভেতর দিয়েই স্বীকৃতি লাভ করেছেন। অতীন্দ্রিয় দর্শনের মধ্যে দিয়ে রক্তমাংসের প্রবৃত্তিগুলিকে প্রকাশ করার চেষ্টা হয়েছে এখানে। পাঠক বুঝতে পারে না সে। মধ্যযুগের কোনো সাধুর আধ্যাত্মিক কোনো বক্তৃতা পড়ছে, না আধুনিক কোনো রুগ্ন পাপীর স্বীকারোক্তি পড়ছে। গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে বিষাক্ত ঘরের মধ্যে ধূপের ভারী গন্ধ বইটির পাতার। মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর চিন্তাধারাটিকে কিছুটা বিপর্যস্ত করে তুলেছিলা ভাষার ছন্দ আর বর্ণনার ঝঙ্কার তাঁর মনে এমন একটি সুর ভাগিয়ে তুলেছিল যে তিনি সব ভুলে একটি পরিচ্ছেদের পর আর একটি পরিচ্ছেদ অবলীলাক্রমে পড়ে যেতে লাগলেন।

মেঘমুক্ত আকাশ থেকে ধীরে-ধীরে অন্ধকার নেমে এল, জানালার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করল ঘরের মধ্যে সেই অস্পষ্ট আলোতে তিনি আরো কিছুক্ষণ পড়তে চেষ্টা করলেন; শেষ পর্যন্ত আর পারলেন না। এর মধ্যে তাঁর চাকরটি বারবার এসে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে সচেতন করে দিয়ে গিয়েছে। শেষকালে একসময় তিনি উঠে পড়লেন এবং বইটি তাঁর শোওয়ার ঘরে রেখে ডিনারের জন্যে তৈরি হলেন।

ক্লাবে গিয়ে পৌঁছতে তাঁর প্রায় রাত নটা বেজে গেল। তিনি দেখলেন লর্ড হেনরি যথারীতি সেখানে বসে রয়েছে। মুখে তাঁর বেজারের চিহ্ন।

 তিনি বললেন: দেরি হওয়ার জন্যে আমি সত্যিই বড়ো দুঃখিত, হেনরি। কিন্তু তুমি যে বইটা আমাকে পাঠিয়েছ সেটি পড়তে গিয়ে আমি কেমন যেন মশগুল হয়ে পড়েছিলাম। সময়ের জ্ঞান আমার ছিল না।

চেয়ার থেকে উঠে লর্ড হেনরি বললেন: আমি জানতাম, বইটি তোমার ভালো লাগবে।

ভালো লেগেছে সেকথা আমি বলিনি, হ্যারি; বলেছি আমাকে বইটি একেবারে অভিভূত করে তুলেছিল। দুটি কথার মধ্যে প্রভেদ রয়েছে।

দুজনে ডাইনিং রুমের দিকে যেতে-যেতে লর্ড হেনরি বললেন: তাই বুঝি! তুমি তাহলে তফাৎটা বুঝতে পেরেছ?

.

একাদশ পরিচ্ছেদ

তারপরে দীর্ঘ কয়েকটি বছর বইটির প্রভাব থেকে ডোরিয়েন গ্রে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি; নিজেকে মুক্ত করতে চাননি বললেই হয়তো কথাটা ঠিক বলা হবে। বইটির প্রথম সংস্করণের বড়ো-বড়ো প্রায় নটি কাগজের মোড়াই কপি তিনি প্যারিস থেকে আনলেন বিভিন্ন রঙের কভার দিয়ে সেগুলিকে বাঁধালেন। যে-সব বাসনা-কামনার হাতে নিজেকে তিনি বন্দী করে ফেলেছিলেন, বিভিন্ন ঋতুতে তাদেরই খুশি করার জন্যে তাঁর এই প্রচেষ্টা তাঁকে বেশ কিছুদিন একেবারে মশগুল করে রেখেছিল। প্যারিসের অধিবাসী সেই নায়কের রোমান্টিক এবং বৈজ্ঞানিক ভাবধারার মধ্যে তিনি তাঁর নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, তাঁর জন্মের অনেক আগে থাকতেই তাঁরই জীবনের কাহিনি নিয়ে কে যেন উপন্যাসটি রচনা করে গিয়েছেন।

উপন্যাসের সেই অদ্ভুত নায়কের চেয়ে একদিন থেকে তিনি বেশি ভাগ্যবান ছিলেন। আয়না, পালিশকরা চকচকে ধাতব জিনিস, অথবা শান্ত পরিষ্কার ভল খুব অল্প বয়স থেকেই ওই নায়কের মনে কেমন একটা অদ্ভুত ভীতির সৃষ্টি করেছিল। তাঁর দেহের সৌন্দর্য হঠাৎ নষ্ট হয়ে যাওয়াটাই এই ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এসব দিক থেকে ডোরিয়েন নির্ভয। দিলেন। বইটির শেষ দিকের অংশটি তিনি একটা নির্দয় আনন্দের সঙ্গে পড়তেন–সম্ভবত, প্রতিটি আনন্দে আর আমোদ-প্রমোদের মধ্যেই কিছু-না-কিছু নির্মমতা রয়েছে; অথচ, কিছুটা আতিশয্য থাকা সত্ত্বেও, এই অংশটিই সত্যিকার বড়ো করুণ। এইখানেই নায়ক একটি। অবশ্যম্ভাবী বস্তুর সত্যের সামনা-সামনি এসে পড়েছেন সেই সত্যটি হচ্ছে সৌন্দর্যের মৃত্যু। বিশ্বের সকলেই যে বস্তুটিকে সবচেয়ে মূল্যবান বলে মনে করে সেই বস্তুটিই তিনি যে। দিন-দিন হারিয়ে ফেলছেন এই নিষ্ঠুর সত্যটা নায়ককে নৈরাশ্যের অন্ধকারে দিশেহারা করে তুলেছে।

কারণ, যে অপরূপ সৌন্দর্য বেসিল হলোয়ার্ড এবং অনেক মানুষকেই মুগ্ধ করেছিল সেই সৌন্দর্য তাঁর অটুট ছিল। কুৎসাই বলুন অথবা ফিসফিসানিই বলুন, লন্ডন শহরে, ক্লাবে, বারে তাঁকে নিয়ে যারা দিনরাত মুকরোচক আলোচনা করত, তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র সেই সব মানুষরা সব ভুলে যেত; তারা ভাবতেই পারত না যে এমন একটি অপরুপ মানুষ কোনোরকম নিন্দনীয় কাজ করতে পারেন। তাঁর চেহারা দেখলে মনে হত তিনি একটি নিষ্পাপ কুসুম ছাড়া আর কিছু নন। কালিমার কোনো ছাপই তাঁর মুখের ওপরে পড়েনি। বরং একটা পবিত্রতার ছায়া তাঁর মুখটিকে স্নিগ্ধ করে রেখেছিল। সেই দেখেই কুৎসা রটনাকারীরা লজ্জিত হত, কেমন করে ওই রকম অপরূপ চেহারার একটি যুবক পৃথিবীর হাজার ক্লেদাক্ত পরিবেশ থেকে মুক্ত থাকতে পারে একথা ভেবেই তারা অবাক হয়ে যেত।

মাঝে-মাঝে অনেক দিন ধরে শহর থেকে টানা তিনি অনুপস্থিত থাকতেন। কোথায় যেতেন, কী করতেন সে-বিষয়ে কেউ কিছু জানত না। ওই নিয়ে নানান লোকে নানান গুজব ছড়াত, বিশেষ করে তাঁর বন্ধু আর বান্ধবীরা। তারপর হঠাৎ একদিন তিনি ফিরে আইসতেন, প্রায়। নিঃশব্দে ওপরে উঠে দরজার চাবি খুলতেন। তারপরে একটা আয়না নিয়ে তিনি বেসিলের আঁকা সেই প্রতিকৃতিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। প্রতিকৃতিটির মুখের ওপরে পাপের যে ক্লেদাক্ত চিহ্নগুলি ফুটে উঠেছে, একবার তিনি সেইগুলির দিকে তাকিয়ে দেখতেন, একবার দেখতেন আনার মধ্যে প্রতিফলিত নিপাপ সুন্দর তার নিজের মুখটাকে দেখে হাসতেন। দুটির মধ্যে তীব্র পার্থক্য তাঁর আনন্দ বাড়িয়ে দিত। ক্রমশ তিনি যেমন নিজের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে পড়লেন, তেমনি আগ্রহী হলেন নিজের আত্মার অধঃপতনে। পাপের এবং বয়সের যে ছাপগুলি প্রতিকৃতিটির কুঞ্চিত কপালের ওপরে বীভৎস হয়ে ফুটে উঠেছিল, বিকৃত করেছিল মুখের আদলটিকে সেইগুলি তিনি বেশ খুঁটিযে-খুঁটিয়ে দেখতেন, দেখে মাঝে-মাঝে একটা পাশবিক আনন্দে তাঁর মন নেচে উঠত। ছবিটির খসখসে মোটা হাতের পাশে নিজের পরিচ্ছন্ন হাত রেখে তিনি হাসতেন। সেই বিকৃত দেহ এবং বিবশ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখে বিদ্রূপ করতেন তিনি।

রাত্রিতে মাঝে-মাঝে তাঁর ঘরে সুন্দর বিছানায় যখন তিনি একা শুয়ে থাকতেন অথবা ডকের পাশে নোংরা ছোটো বস্তীর ঘরে নিজের নাম ভাঁড়িয়ে এবং গোপনে যখন তিনি রাত্রিবাস করতেন, প্রায়ই বেশ্যালয়ে যাওয়াটা যখন তাঁর কেমন একটা অভাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তখন মাঝে-মাঝে আত্মার অধঃপতনে তাঁর কেমন যেন একটা দুঃখ হত; এই দুঃখে তাঁর একান্ত ব্যাক্তিগত বলেই তা এত তিক্ত। কিন্তু এ রকম চিন্তাও তাঁর মনে খুব একটা বেশি আসত না। বেসিলের বাগানে বসে লর্ড হেনরি তাঁর মলে জীবনের যে কৌতূহল । ভাগিয়ে তুলেছিলেন সেই কৌতূহলই তাঁর বাড়তে লাগল আর সেই কৌতূহল যত তাঁর মিটতে লাগল ততই তিনি খুশি হতে লাগলেন। যতই তিনি জানতে লাগলেল ততই তাঁর জানার আগ্রহ বাড়তে লাগল। সেই বাসনার পূর্তির সঙ্গে-সঙ্গে নতুন বাসনা দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল।

কিন্তু তবু সত্যি কথা বলতে কি সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার দিক থেকে তিনি মোটেই উদাসীন ছিলেন না। শীতকালে মাসে দু’বার কি একবার এবং বুধবার সন্ধ্যার সময় বাড়িতে তাঁর গানের জলসা বসত; সেই জলসাঘ কেবল বিদগ্ধ মানুষদেরই তিনি আপ্যায়িত করতে না, সে-যুগের বিখ্যাত এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ সঙ্গীতকারদেরও নিমন্ত্রণ জানাতেন; তাঁরা তাঁদের সঙ্গীতে শ্রোতুবর্ণকে মুগ্ধ করতেন। মাঝে-মাঝে তিনি ছোটোছোটো ভোজ দিতেন। এই কাজে লর্ড হেনরি অবশ্য সব সময়েই তাঁকে সাহায্য করতেন। এখানেও সেই একই ব্যাপার। নিমন্ত্রিত থেকে শুরু করে খাবার টেবিল, ঘর সাজানো এবং খাদ্যের তালিকা প্রস্তুতিতে তিনি যথেষ্ট সুরুচি এবং শিল্পকলার পরিচয় দিতেন। সেই নিমন্ত্রিতদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায় তাঁর মধ্যে ইটন অথবা অক্সফোর্ডের আভিজাত্য খুঁজে পেতেন।

এবং একথা বললে অযৌক্তিক হবে না যে জীবনটাই তাঁর কাছে ছিল প্রথম আর শ্রেষ্ঠ-সকল কলার শ্রেষ্ঠ কলা; অন্য সমস্ত কলা সেই জীবনকে পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করার প্রস্তুতি মাত্রা সত্যিকার আজগুবি জিনিস ফ্যাশানের মাধ্যমেই সর্বজনীন হয়ে দাঁড়ায়; আধুনিক সৌন্দর্যকে জোর করে জাহির করাকেই বলা হয় বাবুগিরি। এই দুটি জিনিসই তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল। তাঁর পোশাকের গঠন এবং পোশাক পরার রীতিটি তখনকার “মেফেযার বল” এবং “পল মল” ক্লাবের যুবক সম্প্রদায়ের মনে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। তারা সবাই তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ, চলন-বলন অনুকরণ করার ব্যর্থ চেষ্টায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াত।

জনসাধারণের দেওয়া এই সম্মান তিনি গ্রহণ করেছিলেন। লন্ডনের বিভিন্ন ক্লাবে তিনি যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন এই ভেবে তিনি বেশ আনন্দ পেতেন। জীবনের সম্বন্ধে তিনি কিছু নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছিলেন, প্রচার করেছিলেন কিছু নতুন নীতি এবং এদেরই মাধ্যমে পূর্ণ সম্ভোগের প্রযোভনে কী করে প্রবৃত্তিগুলিকে আধ্যাত্মিকতার পথে। পরিচালিত করা যায় সে পথও বাতলে দেওয়ার চেষ্টা তিনি করেছিলেন।

প্রায় এবং ন্যায়তভাবেই প্রবৃত্তির পূজাকে মানুষ প্রশ্রয় দেয়নি; কারণ, ভোগলালসা মানুষকে তার দাসে পরিণত করে, খর্ব করে তাদের ব্যক্তিত্বকে। এরই জন্যে তার ওপরে মানুষের একটা ভীতি জন্মেছে। তাছাড়া, তারা মনে করে অশঙুল সামাজিক জীবনযাপনের পথে এই ভোগলালসা বিপজ্জনক একটা অন্তরাযের সৃষ্টি করে। কিন্তু ডোরিয়েনের মতে প্রবৃত্তির আসল রূপ আর চরিত্র বলতে ঠিক কী বোঝায় তা অনেকেই জানে না। অভুক্ত রেখে পৃথিবী মানুষকে তার দাস করতে চায় বলেই সে চিরকালই বন্য পশুই রয়ে গেল; তার মনে আধ্যাত্মিক। জ্ঞানের আলো না জ্বালিয়ে, সৌন্দর্য উপভোগ করাটাই যে মানুষের শ্রেষ্ঠ আকাঙ্খা হওয়া উচিত এই শিক্কা না দিয়ে পৃথিবী তাকে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করতে চায় বলেই না তার পাশবিক প্রবৃত্তিটা এত প্রবল হয়ে উঠেছে। মানুষের ইতিহাস আলোচনা করে তিনি ক্ষতির অনুভূতিতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কত অর্থহীন ক্ষুদ্র উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে কত বড়ো জিনিসই না মানুষকে পরিত্যাগ করতে হয়েছে। ইচ্ছা করে মানুষ উন্মাদের মতো অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে, অনেক নির্যাতন করেছে নিজেকে; তাদের মধ্যে সুস্থ কোনো জীবনবেদ অথবা বোধ নেই যে-সব কাজ করলে তার অধঃপতন ঘটতে পারে বলে সে মনে করে তার চেয়ে অনেক বড়ো অধঃপতনকে সে মনে নিয়েছে জীবনের এই নেতিবাচক উপলব্ধিতো যে অজ্ঞতাকে সে এড়াতে চেয়েছে ভীবলের বিরাট ভাঁওতাকে পাকে-প্রকারে তাকে সেই অজ্ঞতার কুপে লিপে করেছে। যারা ঘরে থাকতে চায় প্রকৃতি তাদের পাঠিয়েছে মরুভূমিতে–সেইখানে তারা বন্য ভক্তদের সঙ্গে বাস করেছে; আবার সঙ্গীর অভাব পূর্ণ করার জন্যে ঋষির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে বন্য প্রাণীদের। একে প্রকৃতির এক নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কী বলা যায়?

হ্যাঁ, পূর্ণ উপভোগরে জন্যে, লর্ড হেনরিও সেই রকমই আশা করেন, জীবনটাকে নতুনভাবে। ঢেলে সাজাতে হবে: সেই নির্মম, অশোভনীয় কৃচ্ছসাধনা, আধুনিক যুগে যে আবার মানুষের সমাজে কাযেমী হয়ে বসেছে, তাকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে। বোধের দিক থেকে, যুক্তিবাদের দিক থেকে এর প্রয়োজনীয়তা কিছুটা স্বীকৃতি পেলেও, এমন কোনো নীতি মানুষের থাকা। উচিত নয যা তার স্বাভাবিক কামানাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে অভিজ্ঞতা সঞ্চয; সেই সঞ্চযের ফল ভালো কি মন্দ তা যাচাই করা নয়। কৃচ্ছসাধন মানুষের প্রবৃত্তিগুলিকে বিনষ্ট করে বলেই, অথবা ব্যভিচার মানুষের সূক্ষম অনুভূতিগুলিকে ভোঁতা। করে দেয় বলেই, ওই দুটি জিনিসকেই মানুষের সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করা উচিত। জীবন নশ্বর-মহাকালের একটি মুহূর্ত। সত্যিকার সুস্থ জীবনবোধের নীতি হবে এই সহজ কথাটা তাকে জানিয়ে দেওয়া। দান্তের মতে সৌন্দর্যের পূজা করে যাঁরা পূর্ণতা অর্জন করেছেন তিনি। নিজেকে জনসাধারণের কাছে সেইভাবে আত্মপ্রকাশ করলেন। গযতিয়ারের মতো দৃশ্যমান ডগৎটিকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি।

আমাদের মধ্যে এমন কেউ-কেউ রয়েছেন যাঁরা প্রভাতের আগে ভাগে না। জানে না যে তার কারণ হচ্ছে হয় তাঁরা স্বপ্নহীন অবস্থায় সারা রাত মরার মতো ঘুমোন, অথবা সারা রাতই তাঁরা ভীতির আতঙ্ক মাঝে-মাঝে আঁতকে ওঠেন, বিকৃত আনন্দে মুষড়ে থাকেন। এই সময়ে তাঁদের মাথার মধ্যে বাস্তবের চেয়ে অনেক বিপজ্জনক ভৌতিক যারা ঘুরে বেড়ায়, প্রবৃত্তিগুলি সারা রাত ধরে তৈরি করে কল্পনার মিনার। দিবাস্বপ্ন দেখার লেশা যাঁদের ব্রেয়েছে তাঁদেরই মন এইভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। সাদা আঙুলগুলি ধীরে-ধীরে মশারির ভেতর দিয়ে নড়তে থাকে; ভয়ে-আশঙ্কায় কাঁপতে থাকেন তাঁরা। কিম্ভুতকিমাকার কালো কালো চেহারার ছায়াগুলি ঘরের এক কোণে গুঁড়ি দিয়ে ঢেকে, চুপচাপ বসে অপেক্ষা করে। বাইরে তখন পাখির কাকলি জেগে ওঠে, মানুষ কাজকর্ম শুরু করে, পাহাড়ের গা বেয়ে মৃদু বাতাসের তরঙ্গে কার যেন ফোঁপানির শব্দ শোন যায়; নিস্তব্ধ ঘরটির চারপাশে তারা ঘুরে বেড়ায়; যেন ঘুমন্ত মানুষটিকে জাগিয়ে দিতে তারা ভয় পাচ্ছে। তবু তাকে ভাগাতেই হবে। কর্মমুখর জগতে আর বেশিক্ষণ তাদের ঘুমিয়ে থাকাটা ভালো দেখায় না। ধীরে-ধীরে চারপাশের কুয়াশা কেটে যায়, রাত্রির অন্ধকার কেটে গিয়ে জেগে ওঠে প্রকৃতি প্রাচীন ঢঙে পৃথিবীটাকে আমরা চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। নিষ্প্রভ আয়নার বুকে জীবনের প্রতিবিম্ব ফুটে বেরোয়। নিবে-যাওয়া বাতিগুলি যে জায়গায় আমরা রেখেছিলেন ঠিক সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে। রয়েছে। তাদের পাশে অনাদরে খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে বই। ঘুমিয়ে পড়ার আগে এই বই হয়তো তাঁরা পড়ছিলেন। রাত্রির আসরে যে ফুলগুলি নিয়ে আমরা আনন্দ করেছিলেম সেই ফুলগুলি শুকিয়ে গিয়েছে, যে চিঠি আমরা পড়তে ভয় পাই অথবা অনেকবার পড়েছি সেটি হয়তো বিছানার ওপরে পড়ে রয়েছে। রাত্রির অবাস্তব ছায়ার মধ্যে থেকে আমাদের পরিচিত ডদগংটি ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। যেখান থেকে আমরা চলে এসেছিলেম আবার সেখান থেকে শুরু করি। আবার আগের মতোই গতানুগতিকভাবে দৈনন্দিন জীবন আমাদের যাপন করতে হবে এই অনস্বীকার্য সত্যটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় অথবা আমরা এই ভেবে চোখ খুলি যে নতুন একটি পৃথিবী নতুন আশা নিয়ে আমার কাছে প্রতিভাত হবে অথবা । আমাদের আনন্দের জলেই সেই পুরনো আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি নতুন রঙে সাজিয়ে তুলবে নিজেদের।

এই রকম একটি জগৎই ডোরিয়েনের কাছে সত্য ছিল অথবা জীবনে যা-যা আমরা পেতে চাই তাদের মধ্যে ছিল একটি এবং এই নতুল অথচ মেজাজি অনুভূতির সন্ধালে তিনি এমন কয়েকটি চিন্তার আশ্রয় নিলেন যেগুলি তাঁর কাছে একেবারে অপরিচিত ছিল। তিনি তা ডানতেনও কিন্তু তাদের প্রভাবের মধ্যে তিনি নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপরে কৌতূহল চরিতার্থ হওয়ার পরে তিনি সেগুলিকে চরম ঔদাসীন্যে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। মানসিক অবস্থার দিক থেকে এইটাই ছিল তাঁর মতো চরিত্রের মানুষের কাছে একমাত্র স্বাভাবিক জিনিস; অন্তত কিছু আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদেরা সেই কথাই বলেন।

একবার গুজব রটে গেল যে তিনি রোমান ক্যাথলিক প্রার্থনায় আসা-যাওয়া করছেন। সত্যি কথা বলতে কি রোমান ক্যাথলিক ধর্মীয় রীতিনীতিগুলি তাঁকে যথেষ্ট আকর্ষণ করেছিল। কেন? কারণ একানকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিতে প্রতিদিন যে আহুতি দেওয়া হত, প্রাচীন যুগের সমস্ত নির্মম বলিদানের চেয়েও ত কঠোর; তাছাড়া, এখানে যাতায়াত করার পেছনে আরো । একটা উদ্দেশ্য তাঁর ছিল। সেটাই হচ্ছে, মানুষের জীবনের যে অনন্তু ট্রাজিডি প্রকাশ করার জন্যে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে–এখানে তার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। এখানে গিয়ে তিনি মার্বেলে বাঁধাই মেঝের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে ভালোবাসতেন; ভালোবাসতেন পাদরীদের ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করতে ফুলের নক্সা কড়া ইস্ত্রিকরা ঢিলে জামা পরে পাদরী তাঁর সাদা হাত নেডে-নেডে মন্দিরের পর্দার পাশে ঘুরে বেড়ান; মাঝে-মাঝে। যিশুকে উদ্দেশ্য করে নিজের পাপের ভলো নিজের বুকের ওপরে তিনি আঘাত করেন–এই সব দেখতে তিনি ভালোবাসতেন। গির্জা থেকে বেরিয়ে আসার সময় কখনো বা কালো পোশাক পরা মানুষদের অবাক হয়ে তিনি দেখতেন, কখনো-কখনো ছায়াছন্ন জায়গায় তাদেরই পাশে বসে তাদের জীবনের অসংলগ্ন টুকরো টুকরো কাহিনি শুনতেন।

 কিন্তু কোনো বিশেষ নীতি অথবা রীতির পরিপোষক হয়ে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে নষ্ট করার মতো ভুল তিনি করতেন না। নিজের বাড়িটিকে কিছুতেই তিনি দু’দণ্ডের পান্থশালা বলে ভাবতে পারতেন না; অতি সাধারণ বস্তুকে আমাদের কাছে অদ্ভুতভাবে প্রকাশ করার। পরমাশ্চর্য ক্ষমতা অতীন্দ্রিয়বাদরে রয়েছে। কিছুদিনের জন্যে তিনি এর কবলে পড়েছিলেন; আবার কখনো-কখনো বা ডারউইনের বস্তুতান্ত্রিক নীতির পরিপোষক হয়ে মানুষের চিন্তা আর উচ্ছ্বাসের মধ্যে একটা অপরূপ সামঞ্জস্য খুঁজে বার করার চেষ্টায় তিনি মশগুল হয়ে থাকতেন। তবু যে কথা আগেই বলেছি, কোনো বিশেষ নীতিকেই তিনি বাস্তব জীবনের চেয়ে বড়ো করে দেখতে চাইতেন না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার বাইরে মানুষের সমস্ত ধীশক্তি যে কতটা মূল্যহীন তা তিনি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি জানতেন আধ্যাত্মিক রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারে আত্মার চেয়ে প্রবৃত্তির অবদান কম নেই।

আর সেই জন্যেই তিনি সুগন্ধী জিনিসের প্রকৃতি আর গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করতেন। এই গবেষণার ফলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মনের এমন কোনো অনুভূতি নেই আত্মিক জীবনের অনুভূতির সঙ্গে যার অমিল রয়েছে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি তাদের আসল রূপটি খুঁজে বার করার চেষ্টা করতেন; বার করার চেষ্টা করতেন কেন বিশেষ একটি উপাদান আমাদের কাছে বিশেষ একটি ভাবের প্রতীক হয়ে দেখা দেয়।

অন্য সময় নিজেকে তিনি গানের জলসার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ডুবিয়ে দিতেন। লম্বা জাফরি টানা ঘরের মধ্যে মাঝে-মাঝে তিনি অদ্ভুত ধরনের কনসার্ট-এর আয়োজন করতেন। এই ঘরের ভেতরে ছাদটির রঙ সোনালি দেওয়ালগুলি অলিভ-সবুজ বানিশ করা। এখানে বসে। উন্মত্ত ডিজপসিরা ছোটো-ছোটো তারের যন্ত্রে উদ্দাম ঝংকার তুলে গান করত, আবার কখনো। বা সবুজ শাল জড়িয়ে গম্ভীর মেজাজের টিউনিশিযান গাযকরা বিরাট বীণাযন্ত্রের কালে মোচড দিয়ে গান গাইত; সেই সঙ্গে নিগ্রোরা দাঁতে দাঁত চিপে তামার ঢাকের ওপরে একটানা কাঠি পিটিয়ে যেত, আর ঘন লাল মাদুরের ওপরে হাঁটু মুড়ে বসে মাথায় পাগড়ি বেঁধে রোগাটে ইডিমানরা পেতল অথবা শরকাঠির তৈরি লম্বা সানাই ফুকত; মনে হত বিরাট ফণাওয়ালা সাপও যেন তাদের সেই গান শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত। সেই অনার্য সঙ্গীতের রুক্ষ বিরতি আর কর্কশ অসঙ্গতি মাঝে-মা মন বিরক্তিতে ভরিয়ে দিত; তখন স্কুবার্ট, চোপিন অথবা বিটোফেন-এর বিরাট সুর-সঙ্গতিও তাঁর কাছে নেহাৎ জলো বলে মনে হত। প্রাচীন অবলুপ্ত ভাতির কবরখানা থেকে অথবা পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে যে-সব জাতির সম্পর্ক তখনো একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাযনি তাদের কাছ থেকে অনেক অদ্ভুত-অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। সেই যন্ত্রগুলিকে বাজাতে বেশ ভালো লাগত তাঁরা বাযযা নিগ্রো ইনডিযানদের অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। এই যন্ত্রটির দিকে চোখ মেলে তাকালো কোনো অধিকার ওদের মহিলাদের ছিল না; এমন কি রীতিমতো উপবাস এবং বিশুদ্ধ না হয়ে ওখানকার যুবকরাও ওই বাদ্যযন্ত্রটি সপর্শ করতে পারত না; পেরুভিযা থেকে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন মাটির পাত্র যেগুলি থেকে পাখির কর্কশ কণ্ঠের স্বর শোনা যেত অথবা চিলিতে আলফনসো মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি যে ফুটের সুর শুনেছিলেন সেই ফুট সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। কুমড়োর খোলের মধ্যে ছোটো-ছোটো নুডি বোঝাই করে সেই খোলগুলিকে তিনি রঙ মাখিয়ে দিয়েছিলেন। এগুলি ছাড়া আরো কত রকমের যে অদ্ভুত আর অপরিচিত, অর্ধপরিচিত বাদ্যযন্ত্র তিনি সংগ্রহ করেছিলেন তাদের একটি নিখুঁত তালিকা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। মেকসিকো থেকে লম্বা ‘ক্ল্যারিন’, আমাজন থেকে কর্কশ ‘তুরে’, সাপের চামড়ায় মোড়া লম্বা সিলিন্ডারের মতো ঢাক–ইত্যাদি ইত্যাদি। এই বাদ্যযন্ত্রগুলির অদ্ভুত চরিত্র তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। এই সব দেখে তাঁর কেমন যেন মনে হয়েছিল প্রকৃতির মতো। আর্টের উদগতেও দৈত্য-দানো, রাক্ষস-খোক্ত রয়েছে। তাদের স্বরও বেশ ভয়ঙ্কর। তবু কিছুদিনের মধ্যে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। সেই ক্লান্তি দূর করার জন্যে তিনি ছুটে যেতেন অপেরাতে; কখনো একা, আবার কখনো বা লর্ড হেনরির সঙ্গে। তানহাউসাররে নাটক দেখে কেমন যেন তন্ময় হয়ে যেতেন; সেই মহান নাটকের প্রস্তাবনায় নিজের জীবনের ট্র্যাজিডি দেখতে পেতেন।

একবার তিনি রত্ন আহরণে মনোযোগী হলেন, ফ্রান্সের অ্যাডমিরাল আনে দ্য ডায়যে যেমন তাঁর পোশাকে পাঁচশো ষাটটি রত্ন বসিয়েছিলেন সেই রকম একটা উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি একবার একটি নাচের পোশাক তৈরির কারখানায় হাজির হলেন। এই বাতিকটা তাঁকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলেছিল যে শেষ পর্যন্ত এটা থেকে মুক্তি পাননি তিনি। সারাদিন ধরে রত্নগুলিকে নানান ভাবে তিনি সাড়াতেন, গুছোতেন, খুলতেন, আবার বসাতেন; এগুলির মধ্যে ছিল অলিভ রঙের ক্রিসোবেরিল মণি; আলোর সামনে ধরলে এগুলি লাল হয়ে যায়; সিমোফেন; গোলাপ-রঙা বা মদের মতো হলুদ রঙের পোখরাজ; লাল টকটকে দারুচিনি পাথর; কমলা আর বেগনে রঙের সপাইনেল, সেই সঙ্গে ছিল নীলকান্ত আর পদ্মরাগ মণি। সানস্টোনের রক্তিমাভা, আর মুনস্টোনের মুক্তার মতো শ্বেত আভা অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি। আমস্টার্ডাম থেকে বিরাট মাপের তিনটি পান্না তিনি সংগ্রহ করেছিলেন।

এই রত্নগুলির সম্পর্কে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্পও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। অ্যালফেনসোর ‘ক্লেরিক্যালিস ডিসিপ্লিনা’তে একটি সাপের উল্লেখ রয়েছে। তার চোখের মণি দুটি সত্যিকারের মণি দিয়ে তৈরি; রঙ তার লালচে-কমলালেবুর মতো, ইমাথিয়া-বিজয়ী আলেকজান্দারের যে ব্রোমান্টিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে তাতে শোনা যায়, ডর্ডন উপত্যকায় এই ধরনের সাপ দেখা যায—’সত্যিকারের পাল্লা দিয়ে তাদের পিঠগুলি মোড়া’। ফিলোট্র্যাটাসের কাহিনি থেকে জানা যায় একরকমের ড্রাগন রয়েছে যাদের মাথায় সত্যিকারের হিরে বসানো রয়েছে। সোনালি অষ্কর আর লাল পোশাক দেখিযে এদের ঘুম পাড়িয়ে হত্যা করা হয়। প্রখ্যাত অপরসায়নবিদ পেরে দ্য বোনিফেস-এর মতে ওই হিরে মানুষকে অদৃশ্য করে দেয়; আর ভারতে অকীক নামে যে একরকম কঠিন আর মূল্যবান পাথর পাওয়া যায় তার সম্বন্ধে ভূয়সী প্রশংসা তিনি করেছেন। কর্নেলিয়ান নামে একরকম দামি পাথর রয়েছে যা মানুষের ক্রোধ নষ্ট করে, আর ঘুমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। হাসিনথ। সুরার মাদকতা নষ্ট করে পদ্মরাগ মণি। গারনেট জাতীয় মণি দৈত্য-দানোদের তাড়িয়ে দেয়, হাইড্রোপিকাসের ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যায় চাঁদ। চাঁদের তিথি অনুযায়ী সেলেনাইট পাথরের বাড়া-কমা চলো মেলোসিস নামে একরকমের পাথর রয়েছে চোর খুঁজে বার করার দুষ্কমতা যার অদ্ভুত বাচ্চাদের রক্ত গায়ে লাগলে এর গুণ নষ্ট হয়ে যায়। সদ্য নিহত একটা কোলাব্যাণ্ডের মাথার খুলি থেকে লিওনার্ডাস ক্যামিলা একটা দামি পাথর বার করতে দেখেছিলেন, বিষের ক্রিয়া প্রতিহত করার ক্ষেত্রে এর শক্তি যথেষ্ট। আরব দেশের হরিণের বুকের ভেতরে একভাতীয় পাথরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যার সম্পর্শেই প্লেগ সেরে যায় আরব দেশের পাখির বাসায় একরকমের পাথর রয়েছে, ডেমোক্রিটাসের মতে যা ধারণ করলে আগুন থেকে পোড়ার কোনো ভয় মানুষের থাকে না।

রাজ্যাভিষেকের সময় সিলেন-এর রাজা বড়ো একটা রুবি হাতে পরে শহরের মধ্যে দিয়ে ঘোড়ায় চেপে গিয়েছিলেন। ভন দি প্রিস্ট-এর প্রাসাদের তোরণ দুটি ছিল সার্ডিয়াস পাথরের তৈরি। কোনো মানুষ যাতে বিষ নিয়ে ভেতরে আসতে না পারে এই জন্যে তাদের গায়ে। শিংওয়ালা সাপের ছবি আঁকা রয়েছে। ঢালু ছাদ দিয়ে ঘেরা দেওয়ালের ওপরে ঝুলত দুটো সোনার আপেল, তাদের গায়ে বসানো ছিল দুটো পদ্মরাগ মণি। এর ফলে দিনের বেলায় চকচক করত সোলা; রাত্রিতে শোভা পেত নীলকান্ত মণি। এ মার্গারাইট অফ অ্যামেকি’ নামে লজ-এর একটি নামকরণ রোমান্টিক গ্রন্থে লেখা আছে যে রানির অন্তঃপুরে ক্রোসিলাইট, কারবাঙ্কালস প্রভৃতি যে সব মূল্যবান পাথর অথবা ধাতুর আয়না রয়েছে তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলে পৃথিবীর সতী-সাবিত্রীদের দেখতে পাওয়া যায়। জিপাংপুর অধিবাসীরা মৃতদের মুখের মধ্যে গোলাপী রঙের মুক্তো খুঁজে দেয়। মার্কো পোলো তা দেখেছেন। একটি ডুবুরি একটা সামুদ্রিক দৈত্যের কাছ থেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে একটা মুক্তো সংগ্রহ করে রাজা। পেরোজকে দ্যে। সেই মুক্তো চুরি হয়ে গেলে রাজা চোরকে হত্যা করে সাতদিন শোক করেন। প্রোকোপিয়ান্সের কাহিনি থেকে বোঝা যায় হুনেরা সেই মুক্তো ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে রাজাকে ভুলিয়ে বিরাট একটা গর্তের সামনে নিয়ে আসে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সেই মুক্তোটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। সেইটাকে খুঁজে বার করার জন্যে সম্রাট আনাস-টেসিয়াস পাঁচশ সোনার মোহর পুরস্কার দেবেন বলে ঘোষণা করেন, কিন্তু সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মালাবারের রাজাকে একজন ভেনিসবাসী একটা মুক্তোর মালা দেখিয়েছিলেন। সেই মালাতে তিনশ চারটি মুক্তো ছিল। প্রতিটি মুক্তোর দেবতা ছিল একটি। রাজা সেই সব দেবতাদের পূজা করতেন।

ব্রাতোর মতে ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই-এর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় ষষ্ঠ আলেকজান্দারের পুত্র ডিউক দ্য ভ্যালেনটিন-এর ঘোড়ার পিঠ সোনার পাত দিয়ে মোড়া ছিল। তাঁর মাথার টুপিতে গাঁথা ছিল দু’আর রুবি। সেই রুবিগুলি থেকে আলোর রোশনাই ফুটে বেরোত। ইংলন্ডের চার্লস-এর ঘোড়ার পাদানি থেকে চারশ কুডিটা হিরে ঝুলত। তিরিশ হাজার মার্কস দামের দ্বিতীয় রিচার্ড-এর একটি কোট ছিল; তার চারধারে বসানো ছিল রুবি। রাড্যাভিষেকের পূর্বে টাওয়ারে যাওয়ার পথে অষ্ঠম হেনরি যে সোনার ঝালর দেওয়া, অসংখ্য হিরে আর দামি-দামি পাথরে চুমকি বসানো পোশাক পরেছিলেন সেকথা হল’ সাহেব আমাদের জানিয়েছেন। প্রথম জেমস-এর প্রিয়পাত্রেরা কানে সোনার তারের সঙ্গে পাল্লা। বসানো দুল পরতেন। দ্বিতীয় এডওয়ার্ড পিয়ারস গ্যাভেস্টোনকে টকটকে লাল সোনার তৈরি কিছু যুদ্ধাস্ত্র দান করেছিলেন। সেই অস্ত্রগুলির গায়ে নীলকান্ত মণি বসানো। দ্বিতীয় হেনরি কব্জি পর্যন্ত যে দস্তানা পরতেন তাতে বসানো থাকত দামি-দামি পাথর, তাঁর একটি বিশেষ রকমের দস্তানা ছিল যার সঙ্গে গাঁথা ছিল বারোটি রুবি আর বাহান্নটি বেশ দামি পাথর। বার্গেন্ডি বংশের শেষ ডিউক চার্লস দি ব্লাশ-এর টুপিতে গাঁথা ছিল নাশপাতির গড়নের মুক্তো; তার মধ্যে বসানো ছিল অনেকগুলি নীলকান্ত মণি।

সেযুগের জীবনযাত্রা কী অপরূপই না ছিল! কত প্রাচুর্য আর আড়ম্বরই না ছিল সে যুগে! এমন কি মৃতদের বিলাস-বৈভবের কাহিনি পড়তেও ভালো লাগে কত।

 তারপরে তিনি সূচীশিল্পের দিকে ঝুঁকলেন। উত্তর ইওরোপ দেশগুলির ঠান্ডা ঘরের দেওয়ালে যে-সমস্ত প্রাচীরচিত্র আঁকা রয়েছে সেগুলি পর্যবেক্ষণ করার জন্যে তিনি উঠে পড়ে লাগলেন। গুণই বলুন আর অপগুণটি বলুন তাঁর চরিত্রের একটা অসামান্য বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে কোনো কিছু ধরার সঙ্গে-সঙ্গে সেটার একেবারে ভেতরে তিনি তলিয়ে যেতেন। সূচীশিল্পের মধ্যেও তিনি ঠিক তেমনিভাবেই ডুবে গেলেন। দেখলেন সেই অপরূপ প্রাচীরচিগুলিকে মহাকাল কী ভাবেই না নষ্ট করে দিয়েছে। দেখে মনে-মনে বেশ কষ্ট পেলেন তিনি। যে কোনোরকমেই হোক, তিনি কালের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। গ্রীষ্মের পর গ্রীষ্ম আসচ্ছে; ড্যাফোডিল ফুলগুলি ফুটছে আর বারবার শুকিয়ে যাচ্ছে। রাত্রির বিভীষিকা বারবার তার ঘৃণ্য কাহিনির পুনরাবৃত্তি করছে। কিন্তু তাঁর কোনো পরিবর্তন নেই। কোনো শীতই তাঁর মুখের আদল বিকৃত করতে পারেনি, স্নান করতে পারেনি তাঁর ফুলের মতো দেহ-লাবণ্যকে বাস্তব জগতের সঙ্গে তাঁর প্রার্থক্য কত! কোথায় তারা বিলীন হয়ে গিয়েছে? এথেনাকে খুশি করার জন্যে অল্পসীরা নব-বসন্তের রঙে ছুপিযে যে বিখ্যাত পোশাকটি তৈরি করেছিল, যার জন্যে দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল দেবতাদের–সেই পোশাকটা আজ কোথায়? সেই বিরাট ফিকে লাল নৌকার। পালটি কোথায়? রোমের কলোসিয়ামে নেরো এই পালটিকে বিছিয়ে রেখেছিলেন। এর গায়ে আঁকা ছিল তারকা খচিত আকাশ আর ছিল রথী অ্যাপোলোর ছবি, সোনালি লাগাম গলায় পরে সাতটি ঘোড়া সেই রথ টানছিল, সূর্যের খাবার টেবিলে পাতা সেই অদ্ভুত রুমালগুলি তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। এই টেবিলের ওপরে বিশ্বের সেরা রসালো খাবার পরিবেশন করা। হত। রাজা কিলপেরিকের শবাধারের ওপরে তিনশ সোনার মৌমাছি বসানো যে আচ্ছাদনটি সেইটাই বা আজ কোথায়? এই অদ্ভুত পোশাক দেখে পটান্সের বিশপ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। এর ওপরে আঁকা ছিল সিংহ, মঘাল সাপ, ভালুক, কুকুর, অরণ্য, ছোটো-ছোটো পাহাড়া, শিকারি–এক কথায় চিত্রকর প্রকৃতির যা কিছু অনুকরণ করতে পারেন–সেগুলির সব ছবি। আর সেই কোট–যে কোট অরলিনস-এর চার্লস একবার পূরেছিলেন–যার হাতের ওপরে। সুন্দর একটি গান লেখা ছিল। শুদু গানই নয়, তার স্বরগ্রামও। প্রতিটি স্বরগ্রাম লেখা ছিল সোনালি সুতো দিয়ে–প্রতিটির ছেদের মধ্যে গাঁথা ছিল চারটি করে মুক্তা। রানি যোয়ান অফ বারগেনডির ব্যবহারের জন্য রিমস-এ যে প্রাসাদটি তৈরি হয়েছিল সেই প্রাসাদের একটি ঘরের কথা তিনি পড়লেন। সুতোয় বোনা তেরোশ একুশটা টিয়াপাখি দিয়ে এই ঘরটি সাজানো ছিল, সাজানো ছিল রাজার অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে, আর ছিল একুশটি প্রভাপতি তাদের প্রতিটি ডানায আঁকা ছিল রানির হাত; এই সৰ নকশাগুলি আগাগোড়া সোনা দিয়ে তৈরি। ক্যাথারিন দ্য মেডিসির কালো ভেলভেটের একটি শোকশয্যা ছিল, তার ওপরে আঁকা ছিল। অসংখ্য বাঁকা চাঁদ আর সূর্য বুটিদার কাপড় দিয়ে তৈরি ছিল এর মশারি। সোনা আর রুপোর জমির ওপরে লতা আর ফুলের মালা ছিল আকা; তাদের ধারে-ধারে বসানো ছিল মুক্তোর। চিকন। রানির রুচিমতো রুপোর ঝালরের ওপরে কালো ভেলভেটের সারি-সারি পর্দার মধ্যে বিছানাটি পাতা ছিল। চতুর্দশ লুই-এর ঘরে পনেরো ফুট উঁচু অনেকগুলি নারীমূর্তি ছিল। তাদের ওপরে ছিল সোনার কারুকার্য। পোলান্ডের রাজা সোবিয়েস্কির রাজকীয় শয্যাটি তৈরি হয়েছিল নীলকান্ত মণির নকশা দিয়ে সঙ্গে সুতো দিয়ে লেখা ছিল কোরানের বাণী। এর। পাগুলো ছিল রুপোর; পা-দানিগুলি হিরে দিয়ে মোড়া। এটা নিয়ে আসা হয়েছিল তুর্কীদের শিবির থেকে এর বিরাট মশারির ছাউনির নীচে মহম্মদের পতাকা ছিল আঁটা।

এইভাবে পুরো একটি বছর ধরে তনুজ আর সূচীশিল্প নিয়ে তিনি অনেক গবেষণা করলেন, সংগ্রহ করলেন অনেক প্রাচীন স্মারক চিহ্ন, দিল্লির সূষ্ক মসলিন থেকে ঢাকার সুচারু। ফিনফিনে বস্ত্র–প্রতীচ্যে যার নাম ছিল ‘বাতাসৰষন’ এবং সন্ধ্যার শিশিব’–অদ্ভুত ছবি আঁকা ভয়ভার কাপড় চিনদেশের বেগলে পর্দা, সিসিলির বুটি, স্পেনের ভেলভেট, সবুজ সোনার জাপানি ব্যন শিল্প আর চমৎকার পালকের পাখি

গির্জা সংক্রান্ত অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতোই ধর্মী সাজপোশাক সম্বন্ধেও তাঁর বিশেষ একটা আগ্রহ জন্মেছিল। তাঁর বাড়ির পশ্চিম দিকের গ্যালারিতে অনেকগুলি সিডার কাঠের বাক্স সারিবন্দিভাবে সাজান ছিল সেইখানে অনেক দুষ্প্রাপ্য আর সুন্দর প্রাচীন স্মারক চিহ্ন তিনি সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি ওগুলি ব্রাইড অফ ক্রায়েস্ট-এর। পোশাকের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর উপবাসসর্দিষ্ট শীর্ণ দেহ এবং স্ব-নির্বাচিত দুঃখ আর হস্কৃত যে দেহটিকে জর্জরিত করে ফেলেছিল সেই দেহটিকে ঢেকে রাখার জন্যে কালো আর সাদায় মেশানো লাল রঙের পোশাক পরার প্রয়োডনীয়তা ছিল তাঁর। শুধু তাই নয়; সেই পোশাকটি সূম বস্ত্র দিয়ে তৈরি এবং হীরামণিমুক্তা খচিত। পাদরীরা ধর্মীয় । শোভাযাত্রার সময় যে রকম ফিকে লাল সিল্ক আর গোলাপী রঙের সোনার সুতো দিয়ে কাড করা জমকালো ঢিলে জামা পরতেন সেই জাতীয় কিছু পোশাকও সংগ্রহশালায় তাঁর ছিল। সেই সব ঢিলে জামার ধারে-ধারে ভার্জিনের জীবন থেকে নেওয়া কিছু কিছু টুকরো ঘটনার ছবিও ছিল আঁকা। মাথার টুপিতে রঙিন সিল্ক দিয়ে আঁকা ভার্কিলের অভিষেকের ছবিটিও সুচারুরূপে আঁকা ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর একটি ইতালিয়ান ভাস্কর্য এটি। আর একটি ওই জাতীয় জামার ধারে সবুজ ভেলভেটের আঁকা অ্যাকানথাস পাতরা কয়েকটি ছবিও ছিল। এই সব পাতার বিশদ নকশা আঁকা হয়েছিল রুপালি সুতো আর রঙিন ক্রিমট্যাল দিয়ে লাল আর সোনালি সিল্কের সুতো দিয়ে ঢিলে জামাগুলি বোনা হয়েছিল; তাদের ওপরে আঁকা ছিল। অনেক সাধু-সন্তের ছবি। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে সেন্ট সিবাসটিনেরপ্যাশন এবং ক্রায়েস্টের ক্রুশিফিকেশন-এর প্রতীক চিহ্ন হিসাবে তিনি যে ধর্মীয় পোশাকটি পরেছিলেন সেটি সবুজ রঙের সিল্ক দিয়ে তৈরি তার সঙ্গে মেশানো ছিল নীল সিন্ধ সোনার বটি গীত রঙের দামাস্কাস সিল্ক আর সোনার জাজিম। সেই সঙ্গে ছিল সিংহ, ময়ূর এবং অন্যান্য প্রতীক চিহ্ন।

এই সমস্ত এবং আরো অনেক অধুনা দুষ্প্রাপ্য রত্নগুলি তিনি যে সংগ্রহ করেছিলেন তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর নিজের মানসিক বিপর্যয় ভুলে যাওয়ার চেষ্টা। মাঝে-মাঝে যে। আতঙ্কটা তাঁর পক্ষে সহ্য করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াত সেই আতঙ্ক থেকে তাঁকে সাময়িকভাবে মুক্তি দিত ওই রত্নগুলি। তালাবন্ধ যে নির্জন ঘরটিতে তিনি তাঁর শৈশব কাটিয়েছিলেন সেই ঘরের দেওয়ালে নিজের হাতে তিনি সেই ভয়ানক প্রতিকৃতিটিকে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর জীবনের সত্যিকারের অধঃপতন পরিবর্তনশীল ওই প্রতিকৃতিটির ওপরেই প্রতিফলিত হত। এরই সামনে তিনি সেই সোনালি পর্দাটা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। পরপর কয়েকটি সপ্তাহ তিনি ও-ঘরে ঢুকতেন না। না ঢোকার ফলেই তিনি তাঁর সহড, আনন্দময় জীবনযাত্রায় ফিরে আসতেন। তারপরে হঠাৎ একদিন রাত্রিতে তিনি নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে “ব্লু গেট ফিলড”-এর কাছাকাছি সেই সব ভয়ানক পাড়ায় গিয়ে ঢুকতেন, বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতেন। ফিরে এসে তিনি সেই প্রতিকৃতিটির সামনে বসতেন; মাঝে-মাঝে ছবিটিকে তিনি নিজের মতোই ঘৃণা করতেন; অন্য সময়, ব্যক্তিত্বের গর্বে তাঁর বুক ফুলে উঠত, পাপের অর্ধেক মোহই বোধ হয় এই গর্বে। যে বিকৃতি তাঁকে সহ্য করতে হত সেই বিকৃতির সমস্ত জ্বালা আর যন্ত্রণা যে ওই প্রতিকৃতিটাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এই দেখে গোপনে আনন্দে তিনি হাসতেন।

কয়েক বছর পরে ইংলন্ডের বাইরে বেশি দিন থাকাটা তিনি সহ্য করতে পারলেন না। ত্রোভিল আর আলজিয়ার্সে লর্ড হেনরির সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা একসঙ্গে কয়েকবার শীতকালে বাস করেছিলেন। সেই দুটি বাড়ি তিনি ছেড়ে দিলেন। যে ছবিটি তাঁরই জীবনের একটি অঙ্গ তার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে হ্যাঁ ভালো। লাগত না। তাছাড়া, একটা কেমন ভয়ও ভন্মেছিল তাঁর মনে। যদিও দরজাটিকে সুরক্ষিত করার জন্যে তিনি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, দরজার গায়ে শক্ত মজবুত লোহার বেড়া দিয়েছিলেন, তবু তাঁর ভয় হচ্ছিল কেউ যদি তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে সেই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

একথা তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে ঘরে ঢুকেও কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। কথাটা সত্যি যে মুখের চেহারাটা কুৎসিত এবং কদাকার হওয়া সত্ত্বেও, ছবিটার ওপরে তাঁর। চেহারাটাই প্রতিফলিত হয়েছিল; কিন্তু ছবিটা দেখে কী বুঝবে তারা? কেউ তাঁকে এ নিয়ে বিরক্ত করার চেষ্টা করলে তিনি উপহাস করে তাদের উড়িয়ে দেবেন। তিনি এ ছবি আঁকেননি। সুতরাং সেটা কদাকার দেখালেই বা তাঁর কী? তাছাড়া সত্যি কথাটা বললেও কি তারা তাঁকে বিশ্বাস করবে?

তবু তিনি ভয় পেয়েছিলেন। নটিংহামশায়ারে তাঁর নিজস্ব প্রাসাদে সমগ্রোত্রীয় যুবকদের ভূরিভোজনে আপ্যায়িত করতে-করতে তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে যেতেন। তাঁর জীবনযাত্রার সেই অহেতুক উজ্জ্বলতা অথবা আড়ম্বর দেখে সবাই যখন অবাক হয়ে হ্যাঁ দিকে তাকিয়ে থাকত ঠিক সেই সময় হয়তো তিনি অতিথিদের পরিত্যাগ করে তাড়াতাড়ি শহর ছেড়ে বেরিয়ে আসতেন; তাঁর ভয় হত হয়তো বা কেউ দরজার তালা ভেঙে সেই ঘরে ঢুকে ছবিটি নিয়ে চম্পট দিয়েছে। কেউ যদি ওটিকে চুরি করে নিয়ে যায় তাহলে কী হবে? এই চিন্তা করার সঙ্গে তিনি ভয়ে হিম হয়ে যেতেন। তাহলে নিশ্চয় পৃথিবীর লোক তাঁর জীবনের গোপন রহস্যটি ডেনে যাবে। হয়তো তারা তাঁকে সন্দেহ করতে শুরুই করে দিয়েছে।

 কারণ, তাঁকে অনেকেরই খুব ভালো লাগত–এই কথাটা সত্যি বলে ধরে নিলেও, তাঁকে অবিশ্বাস করত এমন মানুষের সংখ্যাও কম ছিল না। তাঁর জন্ম এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে ‘ওয়েস্ট এনড’ ক্লাবে প্রবেশাধিকার পাওয়ার পূর্ণ অধিকার তাঁর ছিল, সেখানে। একবার প্রায় তিনি ধাক্কা খেয়েছিলেন। শোনা যায় একবার তাঁর একটি বন্ধু ধূমপান করার জন্যে তাঁকে নিয়ে ‘চার্চচিল’ ঘরে ঢোকেন। তাঁদের ঢুকতে দেখেই বারউইক-এর ডিউক এবং আর একটি ভদ্রলোক হঠাৎ উঠে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। ব্যাপারটা তাঁর চোখ এড়ায়নি। পঁচিশ বছর অতিক্রম করার পরে তাঁর সম্বন্ধে অদ্ভুত-অদ্ভুত কাহিনি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। গুজব রটল হোয়াইট চ্যাপল-এর মতো দূরে একটা ভাটিখানায় কতকগুলি বিদেশি নাবিকের সঙ্গে মদ খেয়ে হুল্লোড় করতে তাঁকে দেখা গিয়েছে। গুজব রটল, চোর-ডাকাত আর মুদ্রা জালকারীদের সঙ্গে তাঁর নাকি দোস্তি রয়েছে এবং তাদের ব্যবসার গোপন রহস্য কী তা তিনি জানেন। শহর থেকে দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি তাঁর চরিত্রে কলঙ্কলেপন করেছিল; যখন তিনি ফিরে আসতেন তখন তাঁকে নিয়ে চারপাশে বেশ কানাঘুষা চলত, দেখা হলে তারা একটা অবজ্ঞার দৃষ্টি দিয়ে আড়চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে যেত। ভাবখানা এই যে তাঁর গোপন রহস্যটা বার তারা করবেই।

অবশ্য এই সব ঔদ্ধত্য আর পরিকল্পিত উপহাসকে তিনি গ্রাহ্য করতেন না; এবং অধিকাংশ লোকের মতে তাঁর সহজ চালচলন, তাঁর পরিচ্ছন্ন নিরপরাধ হাসি, তাঁর অনবদ্য শাশ্বত। যৌবন তাঁর সমস্ত কুৎসার উপযুক্ত জবাব বলে মনে হত। লোকের মুখে শোনা যেত যে যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তাঁরাও কিছুদিন তাঁর সঙ্গে মেলামেশার পরে তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন। যে সমস্ত মহিলারা তাঁকে পাগলের মতো পছন্দ করত এবং তাঁর সঙ্গে নিবিড়ভাবে মেশার জন্যে কোনো সামাজিক কুৎসাকেই গ্রাহ্য করেনি এবং সমস্ত রীতিনীতি বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেনি, কিছুদিন পরে ডোবিয়েন গ্রে তাদের ঘরে ঢুকলে তারাও আতঙ্ক কিম্বা অপমানে বিবর্ণ হয়ে যেত।

তবু এই চাপা কুৎসা অনেকের চোখে তাঁর অদ্ভুত এবং বিপজ্জনক আকর্ষণটিকে বাড়িয়ে তুলেছিল। প্রচুর সম্পদ তাঁর অর্থনৈতিক জীবনে কিছুট নিশ্চয়তা এনেছিল। সমাজ, অন্তত যাকে আমারা সভ্য সমাজ বলি, যাঁরা ধনী এবং সেই সঙ্গে অপরকে মুগ্ধ করার হস্কৃমতা যাঁদের রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা শুনতে খুব বেশি একটা রাজি নয়। স্বভাবতই সে মনে করে যে চালচলনটাই যে কোনো মানুষের কাছে তার নীতির চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। তার মতে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্ভ্রম তার একটা ভালো রাঁধুনি থাকার চেয়ে কম দামি। আর তা ছাড়া, মানুষকে খারাপ খানা আর খারাপ মদ খাওয়ানোর পরেও কাউকে সমাজে তিরস্কার করা যাবে না। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার সময় লর্ড হেনরি একবার বলেছিলেন অনেক ভালো গুণ থাকা সত্ত্বেও, মানুষ যদি নিমন্ত্রিতদের গরম খাবার দিতে না পারেন তাহলে তাঁর দোষ তুমার্য নয়। কারণ আর্টের নীতি আর সৎ সমাজের নীতি একই অন্তত তাই হওয়া উচিত। এর প্রযোজনীয় অঙ্গ হচ্ছে আদিকা যা কিছু আমরা করি তার মধ্যে চাই নিখুঁত আয়োজনের মর্যাদা; সেই সঙ্গে চাই একটা অবাস্তব আবহাওয়া। কপটতা, সৌন্দর্য আর বুদ্ধি যেগুলির দৌলতে রোমান্টিক নাটক আমাদের আনন্দে দেয়-এর মধ্যেও সেগুলি থাকা চাই। প্রবঞ্চনা কি এতই বিপজ্জনক? আমার মনে হয় তা নয়। আমাদের বহুমুখী ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করার এটা একটা আঙ্গিক মাত্র।

অন্তত ডোরিয়েন গ্রে-র মতবাদ সেই রকমই। যারা মানুষের অহং বোধকে সহজ, সাধারণ, শাশ্বত এবং একই ধাতু দিয়ে গঠিত মনে করে তাদের সেই অগভীর মনস্তত্ত্বর কথা ভেবে তিনি অবাক হয়ে যেতেন। তাঁর মনে হত মানুষ নিজের মধ্যেই বহু জীবন যাপন করে, তার অনুভূতির সীমা নেই-তার চিন্তাধারা অদ্ভুত, তার উচ্ছ্বাস বাঁধনহারা; তার দেহ মৃতের বিপজ্জনক রুগ্ন বীজাণু দিয়ে গড়া। দেশের বিভিন্ন ডানহীন শীতল ছবির গ্যলারিতে তিনি ঘুরে বেড়াতেন এবং তাঁর ধমনীতে যে সব বংশের রক্ত প্রবাহিত ছিল সেই সব বংশের বিরাট-বিরাট প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখতেন। রানি এলিজাবেত এবং রাজা জেমস-এর রাজত্বের স্মৃতিচারণ” গ্রন্থে ফ্রান্সিস অসবর্ন ফিলিপ হারবার্ট-এর যে বিবরণ দিয়েছেন, সেই হারবার্টের প্রতিকৃতি সেখানে রয়েছে। এই সুন্দর যুবক ফিলিপ হারবার্টের জীবনই কি তিনি যাপন করছেন? কোনো বিষাক্ত বীডাণু কি দেহ থেকে দেহে সংক্রামিত হয়ে তাঁর শরীরে এসে উপস্থিত হয়েছে? সোনার জল দিয়ে আঁকা আঁটো জামার ওপরে আর হীরার বুটি দেওয়া বর্ম পরে স্যার অ্যানথলি শেরাজ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সাদা আর কালো রঙের অস্ত্রশস্ত্রের স্তূপ তাঁর পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে। এই মানুষটি ভবিষ্যৎ বংশধরদের। উন্যে কী রেখে গিয়েছেন? নেপলস-এর ডিযোভানার প্রেমিক কি তাঁর জন্যে পাপ আর লজ্জা গিয়েছেন দিয়ে? এই মৃত ব্যক্তিটি সাহস করে যা চিন্তা করতে পারতেন না, তাঁর নিজস্ব কাগুলি কি তারই স্বপ্ন? এইখানে রঙচটা ক্যানভাসের ওপরে লেডি এলিজাবেথ দেবার তাঁর জমকালো পোশাক আর মুক্তাখচিত কাঁচুলি পরে হাসছেন। তাঁর ডান হাতে একটি ফুল, বাঁ হাতে দামাস্কাস গোলাপের বন্ধনী। পাশে একটি টেবিল। সেই টেবিলের ওপরে একটি ম্যানডোলিন এবং একটি আপেল। সবুজ ফিতে দিয়ে তৈরি করা কয়েকটি বড়ো-বড়ো গোলাপ ফুল তাঁর সূচলো জুতোর ওপরে সেলাই করা ছিল তাঁর জীবনের কথা তিনি ডানতেন; তাঁর প্রেমিকদের সম্পর্কে যে অদ্ভুত কাহিনি লোকের মুখে-মুখে ঘুরে বেড়াত তাও তাঁর অজানা ছিল না। এলিজাবেথের চঞ্চল মানসিকতার কিছুটা কি তিনি নিজেও পেয়েছেন? সেই অণ্ডাকৃতি ভারী-ভারী চোখ দুটি গভীর কৌতুকের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। জর্জ উইলোবির প্রতিকৃতির কথাই ধরা যাক। কী ভয়ঙ্কর দেখতে মানুষটি! চুলে তাঁর পাউডারের প্রলেপ; মুখের ওপরে তাঁর অদ্ভুত ধরলের দাগ। তাঁর মুখের চেহারা কুর; রঙ কালো। কামনায ভরা তাঁর ঘৃণায় বঙ্কিম হয়ে উঠেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মার্কনি বলে তিনি পরিচিত ছিলেন। যৌবনে তিনি ছিলেন লর্ড ফেরারস-এর দোস্ত। দ্বিতীয় লর্ড। বেকেনহাম-এর সম্বন্ধেই বা তিনি কী বলবেন! প্রিন্স রিজেন্টের উদ্দাম উচ্ছল দিনের বন্ধু। ছিলেন তিনি; মিসেস ফিটডারবার্ট-এর সঙ্গে যুবরাজের গোপনে যে বিবাহ হয়েছিল তারও সাক্ষী ছিলেন তিনি। কী গর্বিত, সুন্দর চেহারা তাঁর। কী উদ্ধত তাঁর ভঙ্গিমা! তাঁর সেই উচ্ছ্বাসের কিছু অংশ কি তিনি ডোরিয়েনকে উইল করে দিয়ে গিয়েছেন? বিশ্বের লোক তাঁকে দুষ্ট চরিত্রের বলে জানে। কার্লটন হাউস-এ তিনিই রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর পাশে কালো পোশাক পরা বিশীর্ণ চেহারার আর একটি প্রতিকৃতি। এটি তাঁর স্ত্রীর। তাঁর রক্তের শিহরনও ডোরিয়েলের শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে কী অদ্ভুত! আর তাঁর মায়ের ছবি! ভদ্রমহিলার মুখটি ছিল লেডি হ্যামিলটনের মুখের মতো। তাঁর কাছ থেকে কী পেয়েছেন তিনি তা। জানেন। তিনি পেয়েছেন দেহের সৌন্দর্য, আর পেয়েছেন অপরের সৌন্দর্য উপভোগ করার তীব্র কামনা। ব্যাকানন্টি পোশাক পরে তিনি যেন তাঁকে উপহাস করছেন। তাঁর চুলে। আঙুলের পাতা জড়ানো। ছবির রঙটা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তাঁর অদ্ভুত চোখ দুটি তাঁর পিছু পিছু এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

তবু নিজের জাতের মতো সাহিত্যেও মানুষ তার পূর্বপুরুষদের সন্ধান পেত, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সম্ভবত বেশি নৈকট্য অনুভব করত সে এবং নিশ্চয় তাদের প্রভাব যে তার ওপরে পড়ত সেকথা সে জানত। মাঝে-মাঝে ডোরিয়েন গ্রের মনে হত যে সমস্ত ইতিহাসটাই যেন তাঁর জীবনের কর্মতালিকাযা তিনি করতেন সেগুলির নয়; যা তিনি করবেন বলে মনে করতেন। যে সমস্তু অদ্ভুত এবং বিপজ্জনক অভিনেতারা পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে পাপকে এমন রমণীয় করে তুলেছে, অমঙ্গল করেছে সূক্ষম কারুকার্যের সামিল যাকে ব্যাখ্যা করা সত্যিকার দুরুহ, তাঁর মনে হত তিনি যেন তাদের বেশ ভালোভাবেই চেনেন। তিনি ভাবতেন কোনো এক দুযে রহস্যের মাধ্যমে তাঁর জীবন তাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে।

অনবদ্য উপন্যাসের যে নায়ক তাঁর জীবনের ওপরে অতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তিনি তাঁর সেই অদ্ভুত খেয়ালের কথা জানতেন। উপন্যাসের সপ্তম পরিচ্ছেদ তিনি। বলেছেন-বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ভয়ে, ফুলের মুকুট পরে তাইবেরিয়াস-এর মতো তিনি ক্যাপ্রিয় বাগানে বসেছিলেন, বসে-বসে এলিফ্যানটিস-এর জঘন্ন বইগুলি পড়ছিলেন। বামন আর ময়ূরের দল তাঁর চারপাশে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আর বাঁশীর সুরের রেশ সুগন্ধী ধূপের বক্ৰগতিকে উপহাস করছিল। তার পরে ক্যালিগুলার মতো আস্তাবলে সবুজ শার্ট পরা ডাকিদের আদর করে ভাগিয়ে দিলেন এবং হিরে বসানো জিম দিয়ে মোড়া ঘোড়াটার সঙ্গে হাতির দাঁতের তৈরি গামলায় তিনি ভোজন করলেন। মার্বেল পাথরে বাঁধানো সারি-সারি আয়নার ধার দিয়ে ডোমিতিযেনের মতো লম্বা বারান্দার ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন; ভোগের আয়োজনে জীবনের পাত্র উপছে পড়ার ফলে যার জীবনে বাঁচার সমস্ত আনন্দে নষ্ট হয়ে যায় সেই রকম মানুষের মতো নিজের দেহটাকে নষ্ট করার জন্যে শীর্ণ দুটো চোখ দিয়ে সেই সারিবদ্ধ আয়নাগুলির মধ্যে তিনি ছোরার ছায়া খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। পরিষ্কার পান্নার ভেতর দিয়ে সার্কাসের রক্তাভ ধ্বংসাবশেষের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলেন; তারপরে সাদা খচ্চরবাহিত লাল মুক্তাখচিত পালকিতে চড়ে পমে গ্রনেটের রাস্তার ওপর। দিয়ে তিনি স্বর্ণ মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইলোব্যালাস-এর মতো নিজের মুখ তিনি। রঙ দিয়ে ছাপিয়ে নিলেন, মহিলাদের মধ্যে বার বার অবিশ্বাস ছড়ালেন, কার্থেজ নিয়ে এসে সূর্যের সঙ্গে বিয়ে দিলেন তাঁরা কী করে দিলেন সে রহস্য আডও কেউ বুঝতে পারেনি।

এই আজগুবি পরিচ্ছেদটি ডোরিয়েন বার-বার পড়তেন; তার ঠিক পরের দুটি পরিচ্ছেদ তাঁকে যথেষ্ট আকর্ষণ করেছিল। পরিচ্ছেদ তো নয়; সূক্ষ্ণ কারুকার্য করা জাজিমের মতো। তার ওপরে নিপুণ চাতুর্যের সঙ্গে আঁকা ছিল কতকগুলি ভীতিপ্রদ আর সেই সঙ্গে সুন্দর মূর্তি, সেই মূর্তিগুলিকে পাপ, রক্ত, আর ক্লান্তি দানবীয় অথবা উন্মত্ত করে তুলেছিল; সেই মূর্তিগুলির চরিত্রগুলির বলাই ভালো, একটি হচ্ছে মিলানের ডিউক ফিলিপোর। তিনি তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করে তাঁর ঠোঁটের ওপরে লাল রঙের বিষ মাখিয়ে রঙিন করে রেখেছিলেন। উদ্দেশ্য যে দেহটিকে তিনি আদর করতেন সেই স্ত্রীর মৃত ঠোঁট দুটি চুম্বন করে তাঁর প্রেমিক যেন মৃত্যু বরণ করেন। আর একটি চরিত্র হচ্ছে ভেনিসবাসী পিঘাত্রো বারবি-ইনি পরিচিত ছিলেন দ্বিতীয় পল নামে। দম্ভের বশবর্তী হয়ে তিনি ফরমোসাস-এর খেতাব গ্রহণ করতে। চেয়েছিলেন। তাঁর মুকুটের দাম দু’হাজার ফ্লোরিন। ওই মুকুটটি সংগৃহীত হয়েছিল ভয়ঙ্কর পাপের পথে আর একটি চরিত্র হচ্ছে গ্যিাঁ মারিযা ভাইকেতি। জীবন্ত মানুষের পেছনে তিনি ডালকুত্তা ছেড়ে দিতেন। তাঁর নিহত দেহটিকে তাঁর প্রেমিকা বারবনিতা গোলাপ ফুলে ঢেকে দিয়েছিলেন। সাদা ঘোড়ার পিঠে বর্জিয়াকেও দেখা যাবে সেখানে। তাঁর পাশে ঘোড়ার পিঠে চলেছেন ফ্রাট্রিসাইড। তাঁর বড়ো ঢিলে জামাটি পেরোত্তোর রক্তে ভেজা। আর রয়েছেন ফ্লোরেন্স-এর যুবক কার্ডিনেল আর্কবিশপ পিয়েত্রা রিয়েরিযো-ইনি হচ্ছেন চতুর্থ। সিক্সতাস-এর পুত্র এবং প্রিয়পাত্র। তাঁর সৌন্দর্য যেমন অপরূপ, লাম্পট্যও তেমনি সীমাহীন। সাদা এবং গাঢ় লাল সিল্কের তাঁবুতে আরাগনের লিওনোরাকে তিনি অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সেই তাঁবুতে ছিল অপ্সরীর দল, আর ছিল একরকমের জীব-প্রাচীন গ্রীক কাহিনিতে যারা ছিল অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ঘোড়া। গ্যানিমিড অথবা হাইলাস-এর মতো ভোডের সভায় উৎসর্গ করার জন্য একটি ছেলেকে তিনি সাজিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ছিলেন এভেলিন। মৃত্যুর দৃশ্য ছাড়া তাঁর বিষাদকে নষ্ট করা যেত না। মানুষের যেমন লাল মদের দিকে ঝোঁক থাকে তাঁর তেমনি ঝোঁক ছিল লাল রক্তের ওপরে। শয়তানের বাচ্চা বলে পরিচিত ছিলেন তিনি আরো শোনা যায় নিজের আত্মার সদগতির জন্যে নিজের বাবাকে পাশা খেলায় তিনি হারিয়ে দিয়েছিলেন। সেই জন্যে ছিলেন গিয়ামবাতিস্তা সিবো। মানুষটি রসিকতা করে নিজের নাম নিয়েছিলেন ‘ইনোসেন্ট’ বলে। তাঁর অসাড় শিরার মধ্যে একজন জুইস ডাক্তার তিনটি ছেলের দেহের রক্ত ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ইসোতার প্রেমিক এবং রামিনির লর্ড সিগিসমনদো মালাতেস্তাকেও দেখা যাবে সেখানে। দেবতার শত্রু হিসাবে রোমে তাঁর কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়। গলায় একখানা রুমাল বেঁধে তিনি পলিসেনাকে হত্যা করেছিলেন, পান্নার কাপে করে বিষ দিয়েছিলেন জিনেভ্রাকে এবং লজ্জাকর ভাবের আবেশে খৃশ্চানদের পূজা করার জন্যে একটি অখৃস্টান ধর্মমন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। ষষ্ঠ চার্লসকেও সেখানে আপনারা খুঁজে পাবেন। তিনি তাঁর ভাই-এর স্ত্রীকে এমন উন্মত্তের মতো ভালোবাসতেন যে তাই দেখে একজন কুষ্ঠরোগী তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল এই বলে যে উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হওয়ার বেশি দেরি তাঁর নেই। সেই চার্লস যখন সত্যি-সত্যিই পাগল হয়ে গেলেন তখন তাকে সান্ত্বনা দিতে পারত একমাত্র সারালেন তাস; সেই তাসের ওপরে আঁকা থাকত প্রেম, মৃত্যু, আর উন্মাদের ছবি। সেই সঙ্গে দেখতে পাওয়া যাবে ফিটফাট পোশাক পরা গ্রিফোনেতা ব্যাগলিযোনির ছবি; মাথায় তাঁর মণিমুক্তা খচিত টুপি, অ্যাকানথাসের মতো কোঁকড়ানো চুলের স্তবক। তিনি সস্ত্রীক অ্যাসটোরিকে খুন করেছিলেন, সিমোনেতোকে হত্যা করেছিলেন তাঁর চাকর সমেত। সিমোনেতে তাঁর মৃত্যুকে এমন সহজভাবে গ্রহণ করেছিলেন যে পেরুগিযায় মৃত্যুশয্যায় তাঁকে নির্লিপ্তভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কেউ চোখের জল না ফেলে পারেনি; আর যে আটালানটা তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন তিনিই শেষ পর্যন্ত আশীর্বাদ করেছিলেন তাঁকে।

এঁদের সকলেরই একটা ভয়ঙ্কর আকর্ষণ ছিল। রাত্রিতে ডোরিয়েন এঁদের ছবি দেখতেন; দিনের বেলায় এঁরা তাঁর কল্পনাকে বিব্রত করে তুলত। রেনাসাঁর যুগে অদ্ভুত-অদ্ভুত উপায়ে মানুষকে বিষ খাইয়ে মারা হত; কোথাও শিরস্ত্রাণে বিষ মাখিযে, কোথাও জ্বলন্ত টর্চ বিষাক্ত করে, কোথাও নকশাকাটা দস্তানা কোথাও মুক্তাখচিত পাখা দিয়ে। ডোরিয়েন গ্রে বিষাক্ত হয়েছিলেন বই পড়ে। এমন মুহর্তও তাঁর এসেছিল যখন নিছক সৌন্দর্য উপভোগের উপায়। হিসাবেই অমঙ্গলকে তিনি গ্রহণ করতেন।

.

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দিনটা হল নভেম্বর মাসের ন’তারিখ। যেদিন তিনি আটতিরিশ বছরে পড়লেন তার আগের রাত্রি। পরে এই দিনটির কথাই তাঁর বেশি মনে দিল।

রাত্রি প্রায় এগারোটা হবে। লর্ড হেনরির বাড়ি থেকে ডিনার খেয়ে ফিরছিলেন তিনি। রাত্রিটা ঠান্ডা কনকনে। ঘন কুয়াশা জমেছিল আকাশে। মোটা ফারের কোট ছিল তাঁর গায়ে। গ্রসভেনর স্কোয়ার আর সাউথ অডলি স্ট্রিটের কোণে সেই অন্ধকারে একটি লোক তাঁর পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেলেন। লোকটি বেশ দ্রুতই হাঁটছিলেন; ধূসর রঙের আলেস্টারের কলারটা তাঁর ওলটানো ছিল। তাঁর হাতে ছিল একটা ব্যাগ। চিনতে পারলেন ডোরিয়েন পথচারী হচ্ছেন বেসিল হলওয়ার্ড হঠাৎ কী ডানি কেন ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। পথচারীকে চেনার কোনো লক্ষণ না দেখিযে তিনি নিজের বাড়ির দিকে হন-ইন করে এগিয়ে চললেন।

কিন্তু তুলওযার্ড তাঁকে দেখতে পেলেন। ডোরিয়েন বেশ বুঝতে পারলেন হলওয়ার্ড ফুটপাতের ওপরে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তারপরেই তিনি দ্রুতগতিতে তাঁর দিকে এগিয়ে এলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাঁর হাত ডোরিয়েলের হাত সস্পর্শ করল।

ডোরিয়েন, কী ভাগ্য! প্রায় ন’টা থেকে তোমার লাইব্রেরিতে তোমার জন্যে আমি অপেক্ষা করছিলাম। শেষ পর্যন্ত তোমার চাকরের ওপরে কেমন যেন দয়া হল আমার বেরিয়ে আসার সময় সে দরজা খুলে দিল। আমি তাকে শুয়ে পড়তে বললাম। আজ রাত্রির ট্রেনেই আমি প্যারিসে চলে যাচ্ছিা যাওয়ার আগে বিশেষ করে তোমার সঙ্গেই আমি দেখা করতে। চেয়েছিলাম। আমার পাশ দিয়ে পেরিয়ে যেতে মনে হল তোমাকে আমি দেখেছি-অথবা, তোমার ওই ফার কোটটাকে। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। তুমি কি চিনতে পারনি আমাকে?

প্রিয় বেন্সিল, এই কুয়াশায়? কী যে বল! গ্রসভেনর স্কোয়ারটাকেও চিনতে পারছি নো মনে হচ্ছে আমার বাড়িটা এরই কাছাকাছি একটা ভাযায হবে; কিন্তু ঠিক কোন ভাষায় সেটা ঠাহর হচ্ছে না। অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। তাই তুমি চলে যা বলে বেশ কষ্ট হচ্ছে আমার। কিন্তু মনে হচ্ছে, তাড়াতাড়িই ফিরে আসছ তুমি!

না, ছ’মাসের জন্যে ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি। ঠিক করেছি প্যারিসে একটা স্টুডিযো নেব, সত্যিকার বিরাট একটা কিছু কাজ করার ইচ্ছে হয়েছে আমার। যতদিন না সেকাজ শেষ হয়। ততদিন পর্যন্ত স্টুডিয়ো ছেড়ে আমি বাইরে বেরোব না। যাই হোক, নিজের কোনো কথা । তামাকে আমি বলতে চাই তো তোমার বাড়ির সামনে এসে গিয়েছি আমরা। চল, একটু বসে যাই, তোমাকে কিছু বলার রয়েছে আমার।

খুব খুশি হব আমি। কিন্তু তুমি ট্রেন ফেল করবে না?

সিঁড়িতে উঠে “ল্যাচ কী” দিয়ে দরজাটা খুলতে-খুলতে বেশ ক্লান্ত স্বরেই প্রশ্ন করলেন ডোরিয়েন।

ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে বাতির আলো বেশ কষ্ট করেই বেরিয়ে এল বাইরে। সেই আলোতে হাত-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হলওয়ার্ড বললেন; এখনো অনেক সময় রয়েছে। বারোটা পনেরোর আগে ট্রেন ছাড়ছে না। সত্যি কথা বলতে কি তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই আমি ক্লাবের দিকে যাচ্ছিলাম; হঠাৎ রাস্তায় তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দেখতেই পাচ্ছ ভারী লাগেজ পাঠাতে আমার দেরি হবে না; সেগুলি আমি আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার কাছে রয়েছে কেবল এই ব্যাগটা। ভিকটোরিযা স্টেশনে পৌঁছতে আমার কুড়ি মিনিটের বেশি সময় যাবে না।

তাঁর দিকে তাকিয়ে ডোরিয়েন একটু হাসলেন।

তোমার মতো একজন শৌখিন চিত্রকরের এইভাবে বেড়াতে যাওয়ার রীতিটি নিঃসন্দেহে চমৎকার। একটা গ্লাডস্টোন ব্যাগ আর একখানা আলেস্টার। ভেতরে এস; দরজা খুলে রাখলে কুয়াশা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়বে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখা কোনো সিরিয়ান্স আলোচনা তুমি করবে না। আজকাল সিরিয়াস বলে কোনো জিনিসেরই অস্তিত্ব নেই। অন্তত, থাকা উচিত নয়।

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে হলওয়ার্ড নিজের মাথাটা নাড়লেন; তারপরে ডোরিয়েলের পিছু পিছু লাইব্রেরিতে হাজির হলেন। বড়ো খেলা উনুনে কাঠের আগুন গনগন করছিল। বাতি। জ্বালানো হল। একটা রুপোর ডাচ সিপরিট কেস-এর ওপরে সোডার বোতল, বড়ো গ্রাম। কয়েকটা বসানো ছিল।

ডোরিয়েন, তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার চাকর আমার যথেষ্ট সেবা করেছে। আমার সব কিছু প্রয়োজন সে স্বেচ্ছাতেই মিটিয়েছে; এমন কি তোমার সবচেয়ে দামি সিগারেট পর্যন্ত আমাকে দিতে সে কোনোরকম কুণ্ঠাবোধ করেনি। অতিথিবৎসল হিসাবে সে পয়লা নম্বরী। তোমার আগের সেই ফরাসি চাকরের চেয়ে একে আমার বেশি ভালো লেগেছে। আচ্ছা, সেই লোকটি কোথায়?

কাঁধ কুঁচকে ডোরিয়েন বললেন: মনে হচ্ছে, সে লেডি ব্রাডিলির ঝিকে বিয়ে করেছে। বৌকে সে প্যারিসে ইংরেজ দজি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, ওখানে এই জাতীয় ফ্যাশনের বেশ দাম রয়েছে। ফরাসিরা কী বোকা, তাই না? কিন্তু তুমি কি জান, চাকর হিসাবে লোকটি মোটেই খারাপ ছিল না। আমি তাকে কোনোদিনই পছন্দ করতাম না সত্যি কথা; কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো কিছু আমার ছিল না। মানুষে প্রায় এমন অনেক জিনিস কল্পনা করে থাকে যেগুলি চরিত্রের দিক থেকে উদ্ভট। সেও আমার খুব অনুরক্ত ছিল। চলে যাওয়ার সময় বেশ কষ্টই হয়েছিল তার। আর একটু ব্র্যানডি আর সোডা নাও। না, “হক আর সেলডার” নেবে? আমার কিন্তু হক আর সেলটজারই ভালো লাগে বেশি। পাশের ঘরে নিশ্চয় কেউ রয়েছে।

টুপি আর ওভারকোট খুললেন চিত্রকর; সেগুলিকে ব্যাগের ওপরে রাখলেন, ব্যাগটিকে তিনি আগেই একটা কোণে রেখেছিলেন। তারপরে বললেন: ধন্যবাদ। না; আর কিছু আমার চাই নে। এখন বন্ধু, তোমার সঙ্গে কিছু সিরিয়াল আলোচনা আমি করতে চাই। ওভাবে কুটি করো না। ওইরকম করার জন্যেই সত্যি কথাটা তোমাকে বলা আমার কাছে বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

সোফার ওপরে বসে তাঁর স্বাভাবিক খিটখিটে মেজাজের সঙ্গেই ডোরিয়েন বললেন: ব্যাপারটা কী বল তো? আশা করি, আমার বিষয়ে কিছু নয়। আজ রাত্রিতে আমি বড়ো ক্লান্ত, মেজাজটা বেশ ভালো নেই।

বেশ গম্ভীর ভাবেই হলওয়ার্ড বললেন: কথাটা তোমারই সম্বন্ধে, আর সে-কথা তোমাকে আমার বলতেই হবে। আধঘণ্টার বেশি সময় তোমার আমি নেব না।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন ডোরিয়েন; তারপরে একটা সিগারেট ধরিযে বললেন: আধঘন্টা!

ডোরিয়েন, বেশি কিছু বলার নেই আমার। তবে আমি যা বলছি সেটা তোমার নিজেরই ভালোর জন্যে। লন্ডনে তোমার সম্বন্ধে নানারকম গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। গুজবগুলি নোংরা। আমার মনে হয় সেগুলি কী তা তোমার জানা উচিত।

সেগুলি কী তা জানার কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। অন্য লোকের কুৎসা শুনতে আমার ভালো লাগে; কিন্তু নিজের কুৎসা শোনার কোনো আগ্রহ নেই আমার। এদের মধ্যে নতুন কিছু নেই।

সেগুলি জানার আগ্রহ তোমার থাকা উচিত ডোরিয়েন। সুনাম বজায় থাকুক এটা প্রতিটি ভদ্রলোকই চায়। লোকে তোমাকে নোংরা অশ্লীল ভাবুক এটা নিশ্চয় তুমি চাও না। অবশ্য সমাডে তোমার প্রতিষ্ঠা রয়েছে, রয়েছে সম্পদ-অভিজাত সম্প্রদায়ের আরো অনেক কিছু রয়েছে সম্ভবত। কিন্তু সামাজিক প্রতিষ্ঠা আর সম্পদই মানুষের পক্ষে যথেষ্ট নয়। মনে রেখো, এসব গুজবে আমি কান দিই নে। তোমাকে দেখলে সে-সব গুজব বিশ্বাস করতে পারি লে আমি। পাপ এমন একটা জিনিস যা মানুষের মুখের ওপরে নিজের অস্তিত্বের সমস্ত চিহ্ন ফুটিয়ে তোলে। পাপকে লুকিয়ে রাখা যায় না। অনেক সময় মানুষে গোপল পাপের কথা বলে; কিন্তু ওরকম কোনো বস্তু নেই। চোখ, মুখ, এমন কি হাতের বলিরেখার ওপরেও পাপের সমস্ত চিহ্ন ফুটে ওঠে। একটি ভদ্রলোক–তাঁর নাম আমি করব না-কিন্তু তুমি তাঁকে জান–গত বছর আমার কাছে এসেছিলেন তাঁর একটি প্রতিকৃতি এঁকে দেওয়ার জন্যে। ওর আগে কোনোদিনই তাঁকে আমি দেখিনি। দেখা দুরের কথা, কোনোদিন লামও পর্যন্ত শুনিনি তাঁর যদিও তার পরে তাঁর সম্বন্ধে অনেক কথা আমার কানে এসেছে। প্রতিকৃতিটি তৈরি করার পারিশ্রমিক হিসাবে অনেক টাকা তিনি আমাকে দিতে চাইলেন। রাজি হইনি আমি। তাঁর আঙুলের ওপর এমন একটা চিহ্ন ফুটে উঠেছিল যা দেখতে আমার ভালো লাগেনি। এখন আমি জানি তাঁর সম্বন্ধে তখন আমি যা সন্দেহ করেছিলাম সেগুলি সব সত্যি মানুষটির ব্যবহারিক জীবন ক্লেদাক্ত, পঙ্কিল। কিন্তু ডোরিয়েন, তোমার কথা স্বতন্ত্র। তোমার চরিত্র পবিত্র উজ্জ্বল, নিষ্পাপ, তোমার যৌবন বিকৃত ন্য। তোমার বিরুদ্ধে কোনো কুৎসাই বিশ্বাস করতে আমি রাজি নই। তবু তোমার সঙ্গে আজকাল আমার খুব কমই দেখা হয়; তুমি আজকাল আমার স্টুডিযোতে যাওয়া ছেড়েই দিয়ে। ঠিক এইকম একটি পরিস্থিতিতে তোমার বিরুদ্ধে যে-সব কুৎসা রটছে তাদের জবাব যে আমি কী দেব তা আমি নিজেই বুঝতে পারছিলো আচ্ছা ডোরিয়েন, তুমি ক্লাবে ঢুকলে ডিউক অফ বারউইকের মতো ভদ্রলোক কেন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান বলতে পার? লন্ডনের এতগুলি ভদ্রলোক কেন তোমাকে তাঁদের। বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন না, বা কেন তোমার বাড়িতে আসেন না সেকথা কি তুমি জান? লর্ড স্টেভিলির বন্ধু ছিলে তুমি। গত সপ্তাহে একটা ডিনারে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ডাডলির প্রদর্শনীতে তুমি যে কিছু টুকরো ছবি ধার দিয়েছিলে সেই প্রসঙ্গেই তোমার কথা উঠেছিল। স্টেভিলি তাঁর ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন–কিছু আর্টিস্টিক রুচি হয়তো তোমার রয়েছে; কিন্তু কোনো নিরপরাধ যুবতীর তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়াটা বাঞ্ছনীয় নয; অথবা, তোমার সঙ্গে একই ঘরে বসে থাকাট কোনো ভদ্রমহিলার পক্ষেই শোভনীয় দেখাবে না। তাঁকে আমি স্মরণ করিয়ে দিলাম যে তুমি আমার বন্ধু তাঁর মন্তব্যের গূঢ় অর্থ কী সেটাও জানতে চাইলাম আমি। কেন তিনি ওই মন্তব্য করলেন সেকথা তিনি আমাকে বললেন, কেবল আমাকেই নয়। সেখানে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সকলের সামনেই তিনি বললেন। তাঁর বক্তব্য শুনে। আমার খুব খারাপ লাগল। যুবকদের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব এতটা মারাত্মক কেন? সেপাই দলের সেই হতভাগ্য ছেলেটা সেদিন আত্মহত্যা করে বসল। তুমি তার খুব প্রিয় বন্ধু ছিলে। কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে স্যার হেনরি অ্যাসটনকে ইংলন্ড ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তোমরা দুজনে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলে। আদ্রিয়ান সিঙ্গ লটন আর তাঁর ভয়ঙ্কর পরিণতির কথাই বা কেন না জানে? লর্ড কেন্দ্রের একমাত্র পুত্র আর তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও ওই একই কথা খাটো সেন্ট ডেমস স্ট্রিটে তার বাবার সঙ্গে গতকাল আমার দেখা হয়েছিল। লজ্জা আর দুঃখে, মনে হল। ভদ্রলোক ভেঙে পড়েছেন। পার্থ-এর যুবক ডিউকের কথাই বা কী বলব? কী ভাবে সে জীবন কাটাচ্ছে তা তুমি জান? কোন ভদ্রলোক তার সঙ্গে মেলামেশা করবে?

দুটো ঠোঁট কামড়িয়ে ঘৃণার সঙ্গে ডোরিয়েন বললেন: বেসিল, চুপ করা এমন সব বিষয় নিয়ে তুমি আলোচনা করছ যাদের সম্বন্ধে তুমি কিছুই জান না। আমি ঘরে ঢুকলে বারউইক মেই ঘর ছেড়ে উঠে যায় কেন সে প্রশ্ন তুমি আমাকে করেছ। তার কারণ এই নয় যে সে আমার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে, তার কারণ হচ্ছে এই যে তার সম্বন্ধে আমি সব কিছু ভানি। ধমনীতে তার যে বিষাক্ত রক্ত বইছে তারপরেও সে কেমন করে পরিষ্কার থাকবে? হেনরি অ্যাসটন আর যুবক পার্থের কথা তুমি আমাকে বলেছ। আমি কি প্রথম লোকটিকে পাপ কাজ করতে শিখিযেছি না, লমপট হওয়ার মদত দিয়েছি দ্বিতীয় মানুষটিকে? যদি কেন্টের মুখ। ছেলে বন্তীর মেয়েকে বিয়ে করে তাতে আমার কী যায় আসে? যদি আদ্রিয়ান সিঙ্গলটন বিলের ওপরে তার বন্ধুর নাম ভাল করে তার জন্যে কৈফিযৎ দেওয়ার কথা কি আমার? ইংলন্ডের লোকেরা সব বিষয়েই কী রকম হইচই করে তা আমি জানি। নোংরা খাবার টেবিলের ধারে বসে এখানকার মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নিজেদের নৈতিক কুসংস্কার নিয়ে মহা আড়ম্বরে ঢাক-ঢোল পেটায; অভিজাত সম্প্রদায়ের লাম্পট্য নিয়ে তারা দেদার আলোচনা করে এইটা প্রমাণ করার জন্যে যে তারা অতিশয় চতুর, আর যাদের তারা কুৎসা করছে তাদের সঙ্গে তারা ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। এদেশে পরের কুৎসা কুড়ানোর যোগ্যতা তাদেরই রয়েছে যারা অভিজাত আর বুদ্ধিমান। যারা নিজেদের নীতি নিয়ে এত বড়াই করছে তাদের দৈনন্দিন জীবনটাই বা কী? বন্ধুবর, তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমরা সবাই কপট মানুষের সমাজে বাস করছি।

হলওয়ার্ড একটু জোরেই বললেন: ডোরিয়েন, কথাটা তা নয়। সেদিক থেকে ইংলন্ড যে যথেষ্ট খারাপ, আর এখানকার সমাজ যে ভুল ছাড়া কিছু ঠিক করে না তা আমি জানি। সেই জন্যেই আমি চাই তুমি পরিচ্ছন্ন হও। কিন্তু তুমি তা হতে পারনি। প্রভাব বিস্তারের ফলে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তারই পরিপ্রেস্কিতে মানুষকে বিচার করার অধিকার আমাদের রয়েছে। মনে হচ্ছে সম্ভ্রমবোধ, সততা, আর চারিত্রিক নিষ্কলুষতা সবই তুমি হারিয়ে ফেলেছে। তুমি তাদের ভোগের উন্মাদনায় উন্মত্ত করে তুলেছ, অধঃপাতের অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছে তারা। তুমি তাদের সেই পথে পরিচালিত করে। হ্যাঁ, তুমি তাদের পরিচালক। তবু তুমি হাসতে পার, ঠিক এখন যেমন তুমি হাসছ। কিন্তু বিপদটা এখানেই শেষ নয়। আমি জানি তুমি আর হেনরি অচ্ছেদ্য। অন্য কোনো কারণ না থাকলেও, ঠিক সেই কারণেই তার বোনের কলক রটনা করাটা তোমার উচিত হয়নি।

সাবধান বেসলি; তোমার কথার ঝাঁঝটা বড়ো বেশি তীব্র হয়ে পড়ছে।

তাহলেও, আমাকে তা বলতেই হবে; আর তোমাকে সেকথা শুনতেই হবে। শুনতে তুমি বাধ্য। তোমার সঙ্গে লেডি গিয়েনদোলেনের যখন প্রথম পরিচয় হয় তখন তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসার একটি বাণীও কারও মুখ থেকে বেরোয়নি। আডকে লন্ডনে এমন একটি ভদ্রমহিলাকেও কি খুঁজে পাওয়া যাবে যিনি তাঁর সঙ্গে গাড়িতে পাশাপাশি বসে পার্কে বেড়াতে যেতে রাজি হবেন? অপরের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকতে দেওয়া হয় না। তাছাড়া, তোমার সম্বন্ধে আরো অনেক কুৎসিত কথা প্রচারিত হয়েছে সেগুলির সম্পর্কেই বা বলার কী রয়েছে তোমার? শোনা যায় খুব সকালে নাকি বেশ্যাবাডি থেকে সে ঢাকা দিয়ে তুমি বেরিয়ে আস; আবার সন্ধের পরে লোকের চোখে ধুলো দিয়ে তুমি বারবনিতাদের বাড়িতে ঢুকে পড়া এসব কথা কি সত্যি? এসব কাহিনি কি সত্যি হতে পারে? এসব কথা যখন প্রথম আমার কানে এল তখন আমি হেসেছিলাম। এখন সে-সব কথা শুনে আমি ভয়ে কেপে উঠি। শহরের বাইরে যে বাগানবাড়ি রয়েছে সেটাই বা কী? সেখানে তুমি যে জীবন যাপন কর তার সম্বন্ধেই বা। বলার কী রয়েছে তোমার? ডোরিয়েন, লোকে তোমার নামে কী বলে তা তুমি জান না। তোমার কাছে আমি সৎ ভাষণ দেব না এমন কোনো কথা আমি বলব না। মনে আছে হেনরি একবার বলেছিল দু’দিনের যোগীরা সব সময়েই ওইরকম কথা বলেই এগিয়ে আসে; তারপরে প্রথম চোটেই সেটা তারা ভেঙে ফেলে। আমি তোমাকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনতে চাই। আমি চাই তুমি এমন জীবন যাপন কর যাতে সবাই তোমাকে সম্মান করতে পারে তোমার নামের সঙ্গে যে কলঙ্ক জড়িয়ে রয়েছে, আমি চাই সেই কলঙ্ক মুছে ফেলে তুমি একটি পরিচ্ছন্ন। জীবনের পথে এগিয়ে এস। যে সমস্ত নোংরা লোকের সঙ্গে তুমি মেলামেশা করছ, আমি চাই তাদের সঙ্গ তুমি পরিত্যাগ কর। ওভাবে উপহাস করো না আমাকে। নিজের সম্বন্ধে অতটা উদাসীন হয়ো না। মানুষের ওপরে তোমার প্রভাব নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য কিন্তু সেই প্রভাব কুপথে পরিচালিত না করে মানুষকে সুপথে পরিচালিত করুক। লোকে বলে যাদের সঙ্গেই তোমার হৃদ্যতা জন্মায় তাদেরই তুমি খারাপ পথে নিয়ে যাও; আর কারও বাড়িতে তুমি পা। দিলেই লোকে ধরে নেবে যে এবারে সেখানে একটা নোংরা জিনিস ঘটবে। এটা সত্যি কি না। তা আমি জানি নে কী করেই বা জানব? কিন্তু তোমার সম্বন্ধে এই রকমেরই একটা ধারণা। জন্মেছে সকলেরই মুনে। আমি এমন সব ঘটনার কথা শুনেছি যেগুলিকে মিথ্যা বলে উড়িযে দেওয়া অসম্ভব। সেই অক্সফোর্ড থেকেই লর্ড গ্লসেস্টার আমার একজন প্রিয় বন্ধ। তিনি। আমাকে একটি চিঠি দেখালেন। চিঠিটি তাঁর স্ত্রীর। মেনটোল-এর বাগানবাড়িতে নিঃসঙ্গ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে সেই চিঠিটি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি যে স্বীকারোক্তি করেছেন তার মধ্যে তোমার নাম কুৎসিত ভাবে জড়ানো রয়েছে। এরকম ভযানক স্বীকারোক্তি জীবনে আর কখনো আমি পড়িনি। আমি প্রতিবাদ করে। বলেছিলাম–এ কথা অসম্ভব, আমি বিশ্বাস করি নে, আমি তাকে ভালোভালেই জানি এরকম কাজ সে কোনোদিন করতে পারে না। তোমাকে কি আমি জানি? আমার অবাক লাগে ভাবতে তোমাকে সত্যিই আমি জানি কি না। এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে তোমার আত্মাটাকে আমার দেখা উচিত।

সোফা থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন ডোরিয়েন; ভয়ে মুখটা তাঁর প্রায় সাদা হয়ে উঠল, তিনি বিড়বিড় করে বললেন: আমার আত্মাকে দেখা!

গম্ভীরভাবে আর বেশ গভীর দুঃখের সঙ্গে হলওয়ার্ড বললেন, হ্যাঁ, তোমার আত্মাকে আমি দেখতে চাই কিন্তু একমাত্র ভগবানই তা পারেন।

ডোরিয়েনের ঠোঁটের ভেতর থেকে উপহাসের একটা তিক্ত হাসি বেরিয়ে এল।

তুমি নিজেই তা দেখবে এস, আজই, আজ রাত্রেই–টেবিল থেকে বাতিটা নিয়ে চিৎকার করে বললেন তিনি এস। এটা তোমার নিজের হাতেই তৈরি হয়েছে। তুমি তা দেখতে পাবে না। কেন? ইচ্ছে হলে পরে একথা তুমি বিশ্বাবাসীকে জানাতে পার। কেউ তোমাকে বিশ্বাস করবে না। যদি তারা তা করে তাহলে তারা আমাকে আরো বেশি পছন্দ করবে। এই যুগের পহষ্ক যত সাফাই-ই তুমি গাও না কেন আমি একে ভালো করেই চিনি। আমি বলছি, আমার সঙ্গে তুমি এস। ব্যভিচারের বিরুদ্ধে অনেক বকবক করেছ তুমি। এবার তুমি তা নিজের চোখে দেখতে পাবে।

তাঁর প্রতিটি কথার মধ্যে একটা গর্বের আবেগ ঝরে পড়ল। ছেলেমানুষের মতো দম্ভভরে তিনি মাটিতে পা ঠুকলেন। দ্বিতীয় কেউ তাঁর জীবনের গোপন রহস্যের অংশীদার হবে এই চিন্তায় তিনি একটা ভয়ঙ্কর আনন্দ পেলেন। তাঁর লজ্জা আর অপমানের মূলাধার সেই প্রতিকৃতিটি যিনি নিজের হাতে এঁকেছেন সেই কীর্তির ভয়ঙ্কর স্মৃতিটা তাঁকেও যে বাকি জীবনটা বযে। বেড়াতে হবে এই ভেবে ডোরিয়েনের মন পৈশাচিক উল্লাসে নেচে উঠল।

তাঁর কাছে সরে এসে এবং তাঁর কঠোর চোখ দুটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডোরিয়েন আগের কথারই পুনরুক্তি করলেন; হ্যাঁ। আমার আত্মা আমি তোমাকে দেখাব। যা একমাত্র ভগবানের দেখার কথা বলে তোমার মনে হয়েছিল সেই জিনিসটাই নিজের চোখে তুমি দেখতে পাবে।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন হলওয়ার্ড বললেন: ডোরিয়েন, ভগবানের কুৎসা করছ তুমি। ওরকম কথা বলা তোমার উচিত নয় কথাগুলি কেবল বিপজ্জনকই নয়, অর্থহীন।

আবার হাসলেন ডোরিয়েন: তাই মনে হচ্ছে তোমার?

 হ্যাঁ। আজ রাত্রে তোমাকে যে-সব কথা বললাম সেগুলি তোমারই মঙ্গলের জন্যে। তুমি জান, আমি চিরদিনই তোমার সত্যিকার বন্ধু।

আমাকে ছুঁয়ো না। তোমার বলা শেষ কর।

চিত্রকরের মুখের ওপরে বেদনার একটা জ্বালা তড়িৎগতিতে ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। একটু থামলেন তিনি। কেমন যেন মায়া হল তাঁর। ঘটনা যাই হোক, ডোরিয়েন গ্রের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামানোর কী অধিকার তাঁর রয়েছে! তাঁর সম্বন্ধে যে-সব কুৎসা ছড়িয়েছে তার কিছুটাও যদি সত্যি হয় তাহলেই কি কম কষ্ট তিনি পেয়েছেন? তারপরেই তিনি সোজা। হয়ে দাঁড়ালেন, এগিয়ে গেলেন ফায়ার প্লেসের কাছে; তাকিয়ে রইলেন জ্বলন্ত কাঠ, কুয়াশার মতো ছাই, আর কেঁপে-কেঁপে ওঠা আগুনের শিখাগুলির দিকে।

শক্ত এবং পরিচ্ছন্ন সুরে ডোরিয়েন বললেন, আমি অপেক্ষা করছি, বেসিল।

ঘুরে দাঁড়ালেন বেসিল, বললেন: তোমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠেছে সেগুলির উপযুক্ত জবাব তুমি আমাকে দেবে আমি কেবল এইটুকুই বলতে চাই। তুমি যদি বল গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত অভিযোগগুলি একেবারে মিথ্যা, আমি তাই বিশ্বাস করবা ডোরিয়েন, অভিযোগগুলি। অস্বীকার কর তুমি, কী গভীর উৎকণ্ঠায় আমি ভুগছি তা কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না? ভগবানের দিব্যি, তুমি আমাকে বলো না যে তুমি খারাপ, ব্যভিচারী, আর ঘৃণ্য।

 ডোরিয়েন গ্রে হাসলেন। তাঁর ঠোঁটের ওপরে ঘৃণার বাঁকা রেখা ফুটে বেরোল। তিনি শান্তভাবে বললেন: ওপরে চল বেসিল। প্রতিদিনের রোজনামচা আমি লিখে রাখি। যে-ঘরে এটি লিখি সে-ঘরের বাইরে সেটি যায় না। আমার সঙ্গে এলে আমি সেটি তোমাকে দেখাব।

তুমি যদি তাই চাও, আমি যাব ডোরিয়েন। মনে হচ্ছে ট্রেন ফেল করেছি আমি। তাতে কিছু যায় আসে না। কাল যেতে পারি। কিন্তু আজ রাত্রিতে কিছু পড়তে আমাকে বলো না। আমি যা চাই তা হচ্ছে আমার প্রশ্নগুলির সোজা উত্তর।

উত্তর আমি ওপরেই দেব। এখানে সে উত্তর আমি দিতে পারব না। বেশি পড়তে হবে না তোমাকে

.

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। তাঁর পিছু পিছু চললেন বেসিল হলওয়ার্ড। নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন তাঁরা। জ্বলন্ত বাতি থেকে বেরিয়ে ভূতুড়ে ছায়াগুলি সিঁড়ি আর দেওয়ালের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। বাইরের ঝড়ো বাতাসে জানালার খড়খড়িগুলো খটখট করে শব্দ করতে লাগল।

সিঁডির শেষ ধাপে উঠে ডোরিয়েন বাতিটাকে মেঝের ওপরে নামিয়ে রাখলেন; তারপর চাবি বার করে তালাটা খুলে ফেললেন। দরজা খুলে আস্তে-আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন তিনিঃ তুমি জানতে চাও, এই না বেসিল?

চাই।

হেসে বললেন ডোরিয়েন: তোমার কথা শুনে আমি খুশি হয়েছি।

তারপরে একটু রূঢ়ভাবেই তিনি বললেন: পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র মানুষ আমার সম্বন্ধে সব কিছু জানার যার অধিকার রয়েছে। তুমি যতটুকু ভাবছ আমার জীবন নিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করার প্রয়োজন তোমার রয়েছে।

এই পর্যন্ত বলে বাতিটা তুলে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন তিনি। একতাল ঠান্ডা বাতাস তাঁদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিশ্রী রকমের লাল হয়ে শিখাটা হঠাৎ কেঁপে একবার উঁচু হয়ে উঠল। শিউরে উঠলেন তিনি। বাতিটা টেবিলের ওপরে রেখে তিনি ফিসফিস করে বললেন: দরজাটা বন্ধ করে দাও।

ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে হলওয়ার্ড তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। চারপাশে বন্ধ ঘরটার অবস্থা দেখে মনে হল অনেক দিন সেখানে কেউ বাস করেনি।

একটি বিবর্ণ ফ্লেমিশ গালচে, পর্দা দিয়ে ঢাকা একখানা বড়ো ছবি, একটি পুরনো ইটালিয়ান ক্যাসোনি, আর প্রায় খালি একটা বুক-কেস-ঘরের আসবাবপত্র বলতে মোটামুটি এই; তা ছাড়া রয়েছে একটা চেয়ার আর একটা টেবিল। কুলুঙ্গির ওপরে আধপোড়া একটা বাতি ছিল; ডোরিয়েন সেটা জ্বালানোর সঙ্গে-সঙ্গে দেখা গেল সারা ঘরটার ওপরে পুরু ধুলো জমেছে, মাঝে-মাঝে কার্পেটটা ফুটো হয়ে গিয়েছে। তাঁদের শব্দ পেয়েই একটা ইঁদুর ছুটে পর্দার পেছলে লুকিয়ে পড়ল। ব্যাঙের ছাতার ভিড়ে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে।

বেসিল, তোমার ধারণা একমাত্র ভগবানই মানুষের আত্মা দেখতে পান? তাই না? ওই পর্দাটা একপাশে টেনে দাও; তুমি আমার আত্মাটা দেখতে পাবে।

স্বরটা কেবল নিরুত্তাপই নয়, যথেষ্ট নিষ্ঠুর।

তাঁর দিকে ভ্রুকুটি করে হলওয়ার্ড বললেন: ডোরিয়েন, হ্য তুমি উন্মাদ হয়ে গিয়ে; না হয় তো, অভিনয় করছ।

ডোরিয়েন বললেন: পর্দাটা তুমি সরাতে চাও না? তাহলে আমি নিজেই তা সরিয়ে দিচ্ছি। এই বলে একটা হেঁচকা টান দিয়ে পর্দাটা খুলে ফেললেন তিনি; তারপরে মেঝের ওপরে ছুঁড়ে দিলেন সেটাকে।

ভয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন হলওয়ার্ড। সেই স্বল্প আলোতে মনে হল ক্যানভাসের ওপর থেকে একটা বীভৎস মুখ তাঁর দিকে কুটিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সেই দৃষ্টির মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যা তাঁর মন ঘৃণা আর বিরক্তিতে ভরিয়ে তুলল। হায় ভগবান, যা তিনি দেখছেন তা কি ডোরিয়েন গ্রের মুখ? খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। সেই বীভৎসতার মধ্যে, চেহারা তার যত বিকৃতই হোক, সেই অপরূপ সৌন্দর্যকে একেবারে নষ্ট করতে পারেনি। ক্ষীয়মান কেশগুলির ওপরে এখনো কিছু রঙিন আভা ছড়িয়ে রয়েছে। ঠোঁট দুটির রঙ এখনো বিবর্ণ হয়ে যায়নি। ব্যভিচারে নিষ্প্রভ চোখ দুটি থেকে নীলাক্সন ছায়াটুকু এখনো একেবারে মুছে যায়নি; পাথরে কুঁদাই করার মতো সুন্দর নাক আর মসৃণ কণ্ঠ থেকে বঙ্কিম ভঙ্গিটির সৌন্দর্য এখনো নষ্ট হয়নি। হ্যাঁ, ডোরিয়েনের প্রতিকৃতিই বটে। কিন্তু কে একাজ করলে? এই রঙ-তুলি তো তাঁরই নিজের প্রেমের পরিকল্পনাও তো তাঁরই নিজস্ব। জ্বলন্ত বাতিটা তুলে নিয়ে প্রতিকৃতিটির সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ফ্রেমের বাঁ দিকের কোণে তাঁর নিজেরই নাম খোদাই করা রয়েছে।

ব্যাপারটা কেবল নিম্নশ্রেণির প্রহসনই নয়, ঘৃণ্য, নীচ বিদ্রূপও বটে। ঠিক এইরকম একটি ছবি তিনি আঁকতে পারেন না। তবু এ ছবি তাঁরই। তিনি তা জানতেন। মনে হল, মুহূর্তের মধ্যে তাঁর শরীরের সমস্ত গরম রক্ত জমে বরফ হয়ে গেল। এই কি তাঁর নিজের আঁকা ছবি? এর অর্থ কি? এর পরিবর্তন হল কেন? রুগ্ন মানুষের দৃষ্টি দিয়ে ডোরিয়েন গ্রের দিকে তিনি ফিরে তাকালেন। তাঁর মুখ বিকৃত হল; শুকিয়ে এল জিব। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোতে চাইল না। তাঁর। কপালের ওপরে তিনি হাত বুলোলেন। চিটচিটে ঘামে ভিজে গিয়েছে কপালটা।

কোনো বড়ো অভিনেতার অভিনয় দেখার সময় মানুষে যেরকম একাগ্র দৃষ্টি দিয়ে বমঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকে, কুলুঙ্গিতে ঠেস দিয়ে ডোরিয়েনও সেইভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে বইলেন। সেই দৃষ্টির মধ্যে সত্যিকার কোনো দুঃখ অথবা আনন্দ বলে কিছু ছিল না। দর্শকের দৃষ্টি দিয়ে তাঁকে দেখছিলেন; সেই দৃষ্টির মধ্যে বিজয় অভিযানের কিছু ইঙ্গিতও যে একেবারে ছিল না সে কথাও সত্যি নয়। কোটের বোতাম থেকে একটা গোলাপ ফুল তুলে নিয়ে তিনি তা দেখছিলেন অথবা মনে হল যেন শুকছিলেন।

শেষ পর্যন্ত হলওয়ার্ডই চিৎকার করে উঠলেন: এ সবের অর্থ কী?

সেই তীক্ষ্ণ স্বর তাঁরই কানে কেমন যেন বেখাপ্পা শোনাল।

ফুলটা হাতের ভেতরে চটকে ডোরিয়েন বললেন: অনেক দিন আগে, আমি তখন ছেলেমানুষ দিলাম, তোমার সঙ্গে যখন আমার প্রথম আলাপ হল সেই সময় আমার নিজের দেহের সৌন্দর্য সম্বন্ধে সজাগ থাকতে তুমি আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলো একদিন তোমার একটি বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলে। যৌবনের বিস্ময় বলতে কী বোঝায় সে-কথা আমাকে। বুঝিয়ে দিয়েছিল। তুমি আমার প্রতিকৃতি শেষ করলে। আমি যে কত সুন্দর সে কথা তখনই আমি বুঝতে পারলামা মুহূর্তের উত্তেজনায়, আমি এখনো ভানি নে তার জন্যে আমি দুঃখিত কি না, আশা করেছিলেম, তুমি সেটাকে প্রার্থনাও বলতে পার…

আমার তা মনে আছে। খুব ভালোভাবেই মনে রয়েছে। না, না, সে অসম্ভব। এই ঘরটা। স্যাঁতসেঁতো ক্যানভাসের ওপরে ব্যাঙের ছাতার মতো একটা আবরণ পড়েছে যে রঙ দিয়ে আমি এটা এঁকেছিলাম নিশচয তার ভেতরে কিছু ধাতব বিষ মেশানো ছিল। আমি তোমাকে বলছি–এ অসম্ভব ঘটনা।

জানালার ধারে এগিয়ে গিয়ে শিশির-ভেজা শার্সির গায়ে মাথাটা চেপে ডোরিয়েন বললেন; অসম্ভব ঘটনাটা কী?

ছবিটাকে তুমি নষ্ট করে ফেলেছ–এই কথাই তুমি আমাকে বলেছিলে।

 সেটা মিথ্যে কথা। ছবিটাই আমাকে নষ্ট করেছে।

আমি বিশ্বাস করি নে এটা আমার আঁকা ছবি।

ডোরিয়েন তিক্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন: তোমার আদর্শ এর মধ্যে খুঁজে পাচ্ছ না?

আমার আদর্শ, যা তুমি বলছ…

যা তুমি বলতে।

তার মধ্যে কোনো নোংরামি ছিল না, ছিল না ঘৃণা করার মতো কিছু জিনিস। তুমি আমার কাছে এমন একটি আদর্শ ছিলে ঠিক যেরকমটি আর কোনোদিনই আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু এই মুখটা তো দেখছি ছাগলের।

এটি হচ্ছে আমার আত্মার মুখ।

হায় ভগবান, এই জিনিসটাকে আমি এতদিনে পুজো করে এসেছি? এর চোখ দুটো তো শয়তানের।

নৈরাশ্যের ভঙ্গি করে ডোরিয়েন বললেন: আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই স্বর্গ আর নরক দুইই রয়েছে, বেসিল।

আবার প্রতিকৃতিটির দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন বেসিল; তাকিয়ে রইলেন তার দিকে; তারপরে চিৎকার করে বললেন: হায় ভগবান, এটাই যদি সত্যি হয়…তোমার জীবন নিয়ে যদি এইরকম খেলাই তুমি সত্যি-সত্যিই খেলে থাক থাহলে লোকে তোমার সম্বন্ধে যা ভাবে তার চেয়ে তো দেখছি তুমি অনেক বেশি খারাপ, অধঃপাতের আরও অনেক নীচে তুমি নেমে গিয়েছ।

এই বলে বাতিটি তুলে আবার তিনি ক্যানভাসটাকে পরীক্ষা করতে লাগলেন। ওপরটা মোটেই বিকৃত হয়নি। যেমন তিনি রেখেছিলেন ঠিক তেমনিই রয়েছে; বিকৃতি যা ঘটেছে তার সবটাই ওই ভেতর থেকে। অবচেতন মনের কোনো একটি বিশেষ আর রহস্যময় চোরা পথ দিয়ে পাপের কুষ্ঠ বাইরে বেরিয়ে এসে ছবিটিকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলছে। জলে বোঝাই কবরের মধ্যে মৃতদেহের পচনও এর মতো ভয়ঙ্কর নয়।

হাত কাঁপতে লাগল তাঁর; বাতিটা হাত থেকে মাটির ওপর পড়ে গেল; শিখাটা ছিটকে পড়ল চারপাশে পা দিয়ে মাড়িয়ে আলোটা নিবিয়ে দিলেন তিনি তারপরে টেবিলের পাশে যে সরু একটা চেয়ার ছিল সেইখানে বসে দুটো হাত দিয়ে মুখটাকে ঢেকে দিলেন। হায় ভগবান, ডোরিয়েন; এ কী শিক্ষা, এ কী ভয়ঙ্কর শিক্ষা!!

কোনো উত্তর এল না ডোরিয়েনের কাছ থেকে। জানালার কাছ থেকে একটা চাপা আর্তনাদে ফোঁপাতে লাগলেন তিনি।

হলওয়ার্ড বললেন: ডোরিযেত, ভগবানের কাছে প্রার্থনা কর। শৈশবে আমাদের কী কণ্ঠস্থ করতে হয় বল তো? “হে ভগবান, পাপের পথে আমাদের পরিচালিত করো না; আমাদের পাপ তুমি ক্ষমা কর; আমাদের পবিত্র কর তুমি।” এস, আমরা দুজনে মিলে সেই প্রার্থনাই করি। তোমার দম্ভের প্রার্থনা পূর্ণ হয়েছে, তোমার অনুতাপ করার প্রার্থনাও ভাবান পূর্ণ করবেন। তোমার সৌন্দর্যকে আমি খুব বেশি পূজা করতাম। শাস্তি পেয়েছি যথেষ্ট।

ধীরে-ধীরে ঘুরে দাঁড়ালেন ডোরিয়েন; অশ্রুসিক্ত লোচনে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে বললেন: অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, বেসিল।

প্রার্থনার সময়-অসময় নেই, ডোরিয়েন; এস, আমরা দুজনে একসঙ্গে হাঁটু মুড়ে বসে চেষ্টা করে দেখি প্রার্থনার কোনো পদ আমাদের মনে আসে কি না! “যদিও তোমার পাপ লাল টকটকে হয়ে উঠেছে, তবু তাকেই আমি বরফের মতো সাদা করে দেব”–এই ধরনের একটা প্রার্থনা রয়েছে না?

ও-পদ বর্তমানে আমার কাছে অর্থহীন, বেসিল।

চুপ! ওকথা বলো না। জীবনে অনেক পাপ তুমি করেছ। হায় ভগবান, ওই হতভাগা জিনিসটা। আমাদের যে ব্যঙ্গ করছে তা কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না?

ছবিটির দিকে তাকালেন ডোরিয়েন গ্রে। বেসিলের ওপরে একটা অদম্য আক্রোশ হঠাৎ চেপে বসল তাঁর মনে হল, ক্যানভাসের ওপরে আঁকা প্রতিকৃতিটা ঠোঁট বিকৃত করে বেসিলের। বিরুদ্ধে উত্তেজিত করল তাঁকে। বিরাট একটা উত্তেজনায় কেঁপে উঠলেন তিনি। একটা আহত পশুর উন্মত্ত জিঘাংসা তাঁকে অস্থির করে তুলল। ওই চেয়ারে যে মানুষটি বসে রয়েছে তাঁর ওপরে প্রচণ্ড একটা ঘৃণা এল তাঁরা মনে হল এত ঘৃণা জীবনেআর কাউকেই তিনি করেননি। পাগলের মতো তিনি চারপাশে তাকাতে লাগলেন। তাকের ওপরে একটা জিনিস তাঁর চোখে পড়ল। চকচক করছিল জিনিসটা। এটা কী তা তিনি জানতেন। এটা একটা ছোরা। কয়েকদিন আগে একটা দডি কাটার জন্যে তিনি এটাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন, তারপরে সরিয়ে। নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলেন। ধীরে-ধীরে হলওয়ার্ডের পাশ দিয়ে তিনি সেই দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর পেছনে গিয়ে ছোরাটা তুলে নিয়েই ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। হলওয়ার্ড একটু। নড়লেন; মনে হল তিনি এবারে উঠবেন। দ্রুতগতিতে এগিয়ে গিয়ে ডোরিয়েন সেই ছোরা বেসিলের কানের পেছনে যে বড়ো শিরাটা রয়েছে তার মধ্যে প্রচণ্ড বেগে ঢুকিয়ে দিলেন। মাথার ওপরে জোরে আঘাত করে ফেলে দিলেন মেঝেতে, তারপরে বারবার ছুরিকাঘাত করতে লাগলেন তাঁকে।

একটা চাপা গোঙানি শোনা গেল; মনে হল, চাপ-চাপ রক্তে কারও যেন কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। বেসিলের অসহায় দুটি হাত বার তিনেকের মতো কাঁপতে-কাঁপতে ওপরে উঠে শেষবারের মতো মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়ল। আরো দু’বার তাঁর বুকে ছোরাটা বসিয়ে দিলেন ডোরিয়েন। মৃত বেসিলের কাছ থেকে কোনো প্রতিবাদ এল না। মেঝের ওপর জলীয় একটা কিছু ঝিরঝির করে গড়িয়ে পড়ল। বেসিলের মাথাটা নীচের দিকে চেপে রেখে একটু অপেক্ষা করলেন তিনি; তারপর টেবিলের ওপরে ছোরাটা ছুঁড়ে দিয়ে কান পেতে রইলেন। কার্পেটের ওপরে ঝিরঝির করে রক্ত পড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছুই তাঁর কানে এল না। দরজা। খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। চারপাশ নিউন, চুপচাপ। আশেপাশে কাউকেই দেখা গেল না। কয়েক সেকেন্ড চারপাশের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তিনি বারান্দার রেলিং ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপরে চাবিটা বার করে আবার তিনি ভেতরে ঢুকলেন; তারপরে খিল দিয়ে দিলেন ঘরে।

মূর্তিটা তখনো চেয়ারের ওপরেই বসে রয়েছে, মাথাটা তার টেবিলের ওপরে নামানো; পিঠটা উঁচু হয়ে উঠেছে-হাত দুটি অদ্ভুতভাবে রয়েছে ছড়ানো। তার পিঠের ওপর গভীর একটা ইক্ষতচিহ্ন না থাকলে, আর তার ওপরে কালো রক্ত জমাট বেধে না উঠলে, সবাই ভাবত লোকটি ঘুমোচ্ছেন।

কত তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ হয়ে গেল! অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে গেলেন তিনি; জানালার ধারে এসে খুলে দিলেন শার্সিগুলো; তারপরে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। বাতাসে কুয়াশা উড়ে গিয়েছে; অজস্র সোনালি নক্ষত্রে খচিত হয়ে আকাশটাকে একটা দানবীয় ময়ূরের পেখমের মতো দেখাচ্ছে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলেন পুলিশ রোঁদে বেরিয়ে নিস্তব্ধ বাড়িগুলির বন্ধ দরজার ওপরে তার লম্বা লণ্ঠন ঘুরিয়ে-ঘুরিযে আলো ফেলছে। এক কোণে লাল রঙের একটা পুলিশের গাড়ি চকিতে দেখা দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। লম্বা আলোয়ান জড়িয়ে একটি মহিলা রেলিং-এর ধার দিয়ে সন্তর্পণে স্মৃতিপদে এগিয়ে এল। মাঝে-মাঝে সে থামল, যি তাকাল পেছনের দিকে পুলিশম্যান তার সামনে এগিয়ে এসে কী যেন বলল। হাসতে-হাসতে মেয়েটি টলতে টলতে চলে গেল। যাওয়ার সময় হেঁড়ে গলায় অতিস্থের মতো গানের কয়েকটা কলিও আওড়ালা একটা ঠান্ডা হাওযা পার্কের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। গ্যাসের আলোগুলি কাঁপতে লাগল, কাঁপতে কাঁপতে নীলচে হয়ে গেল তারা। পত্রহীন গাছগুলি তাদের সেই কালো কালো লোহার মতো শক্ত ডালগুলি এপাশে-ওপাশে নাড়াতে লাগল। কাঁপতে কাঁপতে পিছিয়ে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলেন তিনি।

দরজার সামনে গিয়ে চাবি দিয়ে তালাটা খুললেন তিনি। নিহত মানুষটির দিকে তিনি একবার ফিরেও তাকালেন না। তাঁর মনে হল ব্যাপারটা নিয়ে কোনোরকম চিন্তা না করাটাই হল আসল কথা। ওই ছবিটাই হল তাঁর সমস্ত দুঃখ আর দুর্দশার মূল কারণ। যে বন্ধুটি ওই বিপজ্জনক ছবি এঁকেছেন তিনি আজ মৃত। সেটাই যথেষ্ট।

তারপরে বাতিটার কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। মুর দেশের কারুকার্য করা অদ্ভুত সেই বাতিদান; মরা রুপো দিয়ে তৈরি; তার গায়ে নীলকান্তমণির বুটি। সেটাকে যথাস্থানে দেখতে না পেয়ে। চাকরটা হয়তো খোঁজাখুঁজি করবে। একটু ইতস্তত করলেন তিনি। তারপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে সেটি তুলে নিলেন। মৃত মানুষটির দিকে একবার চোখ না ফিরিয়ে তিনি পারলেন না। কী চুপচাপ পড়ে রয়েছে দেহটা। দীর্ঘ হাত দুটি কী ভয়ঙ্কর সাদাই না দেখাচ্ছে! মনে হল যেন একটা ভয়াল মোমের মূর্তি চেয়ারের ওপরে বসে রয়েছে।

দরজায় চাবি দিয়ে চুপি-চুপি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলেন তিনি। কাঠের সিড়িঁগুলি মচমচ করল; মনে হল, তারা যেন যন্ত্রণায় গোঙিয়ে উঠছে। কয়েকবারই তিনি থামলেন; উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়ালেন। না। চারপাশ নিস্তব্ধ। যে শব্দ তাঁর কালে ঢুকেছিল সেটা তাঁরই পায়ের।

লাইব্রেরিতে ঢুকে এলেন তিনি, ঘরের এক কোণে ব্যাগ আর কোটটা পড়ে রয়েছে। ওগুলিকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। ঘরের দেওয়ালের ভেতরে একটা গোপন কুঠরি ছিল। তার মধ্যে তিনি তাঁর গোপন ভিজনিসগুলি রাখতেন। সেই দেরাজটা খুলে ব্যাগ আর কোট তার ভেতর ঢোকালেন। পরে যথাসময়ে ওগুলিকে সহজেই পুড়িয়ে ফেলা যাবে। তারপরে তিনি ছোটো ঘড়িটা বার করে দেখলেন। দুটো বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি।

বসে পড়ে ভাবতে লাগলেন তিনি। যা তিনি করেছেন তার জন্যে ইংলন্ডে প্রতিটি মাসে প্রতিটি বছরে মানুষকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। আকাশে-বাতাসে হত্যার উন্মত্ততা ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো ধূমকেতু পৃথিবীর খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে।..তবু, তিনিই যে হত্যাকারী তার প্রমাণ কী? রাত্রি এগারোটার সময় বেসিল হলওয়ার্ড তাঁর বাড়ি থেকে। বেরিয়ে গিয়েছেন। তাঁকে ফিরে আসতে কেউ দেখেনি। অধিকাংশ চাকরই সেলবি রয়্যালে গিয়েছে। তাঁর নিজস্ব পরিচারক গিয়েছে ঘুমোতে প্যারিস! হ্যাঁ। বেসিল প্যারিসেই গিয়েছেন। তাঁরই সময়সূচী অনুযায়ী মাঝরাতের ট্রেনেই তিনি প্যারিসের পথে রওনা হয়েছেন। নিজেকে লোকচক্ষু থেকে লুকিয়ে রাখার স্বভাব যে তাঁর রয়েছে একথা কে না জানে। সুতরাং তিনি যে মারা গিয়েছেন সে-সন্দেহ মানুষের হতে কয়েক মাস সময় লাগবে। দীর্ঘ কয়েকটি মাস। তার ভেতরে তাঁর সমস্ত পশ্চাৎ চিই একেবারে নষ্ট করে ফেলা সম্ভব হবে।

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। ফার-এর কোট আর টুপি চড়িয়ে তিনি হলঘরে বেরিয়ে এলেন। একটু থাকলেন। ফুটপাতের ওপরে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। সে-শব্দ তাঁর কালে এল। তাদের লণ্ঠনের আলো গোল হয়ে শার্সির কাঁচের ওপরে পড়েছে তাও তিনি দেখলেন। নিঃশ্বাস টিপে অপেক্ষা করলেন তিনি।

তারই একটু পরে চাবিটা টেনে নিয়ে তিনি পকেটের মধ্যে ফেলে দিলেন; তারপরে খুব আস্তে-আস্তে দরজাটা বন্ধ করে, তিনি বেলটা বাড়াতে লাগলেন। মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই। তার ব্যক্তিগত পবিচারক গায়ে কোনোরকমে পোশাকটা উড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। চোখেমুখে তখনো তার বেশ ঘুম জড়িয়ে রয়েছে।

দু’পা এগিয়ে এসে তিনি বললেন: ফ্রান্সিস, তোমাকে ঘুম থেকে টেনে তোলার জন্যে আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি “ল্যাচ কীটা আনতে ভুলে গিয়েছি। কটা বাজে বল তো?

চোখ দুটো মিটমিট করে লোকটি বলল: দুটো বেড়ে দু’মিনিট হয়েছে স্যার।

 দুটো বেজে দু’মিনিট! বল কী! বড় রাত হয়ে গিয়েছে তো তাহলে তুমি কিন্তু কাল বেলা ন’টার সময় আমাকে তুলে দিয়ো। কিছু কাজ রয়েছে আমার।

দেব স্যার।

সন্ধের দিকে কেউ আমার খোঁজ করছিল?

 মিঃ হলওয়ার্ড, স্যার। তিনি এখানে রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত বসেছিলেন। তারপরে ট্রেন ধরতে হবে বলে উঠে গেলেন।

তাঁর সঙ্গে দেখা হল না বলে আমি দুঃখিত। কিছু বলে গিয়েছেন তিনি; অথবা কোনো চিঠি দিয়েছেন?

না স্যার। তিনি বলে গিয়েছেন ক্লাবে যদি আপনার সঙ্গে আজ দেখা না হয় তাহলে প্যারিস থেকে তিনি আপনাকে চিঠি দেবেন।

ঠিক আছে ফ্রান্সিস। কাল আমাকে সকাল ন’টায় ঢেকে দিতে ভুলো না।

না স্যার।

চটি পায়ে দিয়ে লোকটি টলতে-টলতে ঘুমের ঘোরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

 টুপি আর কোটটা টেবিলের ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে ডোরিয়েন লাইব্রেরিতে ঢুকলেন। ভাবতে-ভাবতে আর ঠোঁট কামড়াতে-কামড়াতে প্রায় মিনিট পনেরো ধরে তিনি পায়চারি। করলেন। তারপরে একটি ব্যাগ থেকে তিনি ব্লু বুকটা টেনে নিয়ে পাতা ওলটাতে লাগলেন। “অ্যালেন ক্যাম্পবেল, ১৫২, হার্ট ফোর্ড স্ট্রিট, মে ফেয়ার’। হ্যাঁ; এই লোকটিকেই তাঁর দরকার।

.

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

পরের দিন সকাল ন’টার সময় চাকরটি ট্রেতে করে এক কাপ চকোলেট নিয়ে ঘরে ঢুকে জানালার শার্সিগুলি খুলে দিল। ডান দিকে পাশ ফিরে একটা হাত গালের নীচে রেখে বেশ আরাম করেই ঘুমোচ্ছিলেন ডোরিয়েন। তাঁকে সেই অবস্থায় দেখলে মনে হবে যেন খেলা অথবা পড়ার পরে ক্লান্ত হয়ে একটা শিশু ঘুমিয়ে পড়েছে।

লোকটি তাঁর কাঁধে বার দুই ঠেলা দেওয়ার পরে তাঁর ঘুম ভাঙল। চোখ খোলার সঙ্গে-সঙ্গে। তাঁর ঠোঁট দুটির ওপরে একটি মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। মনে হল যেন একটা মিষ্টি স্বপ্নে এতক্ষণ তিনি বিভোর হয়ে ছিলেন। তবু স্বপ্ন তিনি মোটেই দেখেননি। আনন্দ বা দুঃখ কোনোটাই তাঁর রাত্রিটিকে ভারাক্রান্ত করে তোলেনি। কিন্তু অকারণেই যৌবন হাসো। এটাইটাই হচ্ছে তার সেরা সৌন্দর্য।

ঘুরে বালিশের ওপর কনুইটা রেখে চকোলেটে চুমুক দিলেন তিনি। নভেম্বর মাসের মিষ্টি রোদ তাঁর ঘরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরিচ্ছন্ন আকাশ; বাতাসে মিষ্টি রোদের আমেজ। দিনটা মে মাসের প্রভাতের মতোই উজ্জ্বল।

ধীরে ধীরে নিঃশব্দ রক্তাক্ত পদক্ষেপে গতরাত্রির ঘটনাগুলি তাঁর মাথার মধ্যে ভিড় করে। দাঁড়াল; পরিস্ফুট করে তুলল সেই বিপজ্জনক নাটকটিকে তিনি যে দুঃখ পেয়েছেন সেই দুঃখ আর বেদনার স্মৃতি হঠাৎ তাঁকে ভারাক্রান্ত করে তুলল; তারই উত্তেজনায় চেয়ারের ওপরে উঠে বসলেন তিনি এবং যে ঘৃণা বেসিল হলওয়ার্ডকে হত্যা করতে তাঁকে বাধ্য করেছিল। সেই নিদারুণ ঘৃণা আবার এসে দেখা দিল; তাঁর সমস্ত সহানুভূতি হিমশীতল হয়ে জমাট বেঁধে গেল। মৃত লোকটি এখনো সেইখানে একইভাবে বসে রয়েছে, তবে বর্তমানে রোদ এসে তার। গায়ের ওপরে পড়েছে। কী ভয়ঙ্কর! এইরকম ভয়ঙ্কর কাজের দোসর রাত্রির অন্ধখার, দিনের পরিচ্ছন্ন আলো নয়। তাঁর মনে হল গতরাত্রির কথা আবার যদি তিনি ভাবতে শুরু করেন। তাহলে হয় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন, আর না হয়, পাগল হয়ে যাবেন। এমন অনেক পাপ রয়েছে যাদের স্মৃতি সত্যিকারের কাজের চেয়ে অনেক বেশি মানুষকে মুগ্ধ করে। সত্যিকার ভোগ মানুষের প্রবৃত্তির আকাঙ্খা মেটায় সন্দেহ নেই; তাকে আনন্দ দেয়; কিন্তু এই সব। কাল্পনিক বিজয়, যাকে আমরা পাপের মনোচারণ বলি, তারা আমাদের আনন্দ দেয় অনেক বেশি, আমাদের কল্পনাকে অনেক বেশি রাঙিয়ে তোলে। কিন্তু বর্তমান স্মৃতিটা ঠিক সেই জাতীয় নয়। এই স্মৃতি ভযাবহ, বিপজ্জনক–মানুষকে আফিঙের নেশায় আচ্ছন্ন, একেবারে ধ্বংস করে ফেলে তাকে সেই ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে একে নষ্ট করে দিতে হবে।

আধঘণ্টা এইভাবে বসে থাকার পরে, কপালের ওপর হাতটা বুলালেন তিনি; তারপরে। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন; পরিপাটি করে পোশাক পরলেন, অন্যান্য দিনের চেয়েও বেশি যত্ন নিলেন প্রসাধনে; পছন্দমতো নেকটাই পরলেন, বাছাই করে নিলেন একটা আংটি। অনেকক্ষণ ধরে চিবিয়ে-চিবিয়ে প্রাতরাশ খেলেন, চাকরদের এবারে কী ধরনের পোশাক তৈরি করিয়ে দেবেন তাই নিয়ে চাকরের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন, চিঠিপত্র খুঁটিযে-খুঁটিয়ে পড়লেন। কয়েকটি চিঠি পড়ে তিনি হাসলেন; তিনটি চিঠি পড়ে বিরক্ত হলেন। একখানা চিঠি বারবার তিনি পড়লেন; তারপরে, ভ্রু কুঁচকে সেটিকে ছিঁড়ে ফেললেন। এই জাতীয় চিঠির সম্বন্ধেই লর্ড হেনরি একবার বলেছিলেন; একেই বলে মহিলাদের স্মৃতিচারণ। বাপরে বাপ, কী ভয়ানক!!

এক কাপ কালো কফি খাওয়ার পরে তোয়ালে দিয়ে ধীরে-ধীরে মুখ মুছলেন তিনি; চাকরকে অপেক্ষা করতে বলে লেখার টেবিলের দিকে উঠে গেলেন, সেখানে গিয়ে চিঠি লিখলেন দুটি। একটা তিনি নিজের পকেটে ঢুকালেন আর একটা তাঁর চাকরের হাতে দিয়ে বললেন: ফ্রান্সিস, এটা নিয়ে তুমি ১৫২ নং হার্ট ফোর্ড স্ট্রিটে যাও। মিঃ ক্যাম্পবেল যদি এখন শহরের বাইরে গিয়ে থাকেন তাহলে তাঁর ঠিকানাটা নিয়ে এস।

আবার তিনি একা, নিঃসঙ্গ। চাকরটি চলে যাওয়ার পরেই তিনি একটা সিগারেট ধরালেন; তারপরে এক টুকরো কাগজ নিয়ে ছবি আঁকতে বসলেন; প্রথমে আঁকলেন ফুলের ছবি, তারপরে ঘর-বাড়ির, তারপরে মানুষের মুখেরা আঁকতে আঁকতে হঠাৎ তিনি মন্তব্য করে বসলেন–বেসিল হলওয়ার্ডের মুখের সঙ্গে এই সব কটিরই কোথায় যেন একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ভ্রুকুটি করে উঠে পড়লেন তিনি, বুক-কেস-এর দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখান থেকে একখানা বই তুলে নিলেন। বাধ্য না হলে যা ঘটেছে তা নিয়ে আর তিনি আলোচনা করবেন না বলে মনোস্থির করে বসলেন।

সোফার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে তিনি গিটারের লেখা একখানা বই, জাপানি কাগজে ছাপানো ছবি ভ্যাকিমার্ট-এর; সবুজ চামড়া দিয়ে বাঁধাই। বইটি আদ্রিয়েন সিঙ্গলটল তাঁকে দিয়েছিলেন। বইটির পাতা ওলটাতে-ওলটাতে ল্যাসিন্যের-এর ঠান্ডা সবুজ, হাতের ওপরে লেখা একটি কবিতার ওপরে তাঁর চোখ পড়ে গেল। কবিতাটি পড়ে নিজের সাদা সূচালো। আঙুলগুলির দিকে তিনি একবার তাকিয়ে দেখলেন; দেখে, নিজের অজান্তেই কেমন যেন শিউরে উঠলেন। তারপরে পড়লেন ভেনিস-এর ওপরে লেখা সুন্দর একটি কবিতা।

কী সুন্দর বর্ণনা ভেনিস-এর কবিতাটা পড়তে-পড়তে পাঠকের মনে হবে সে যেন পাটল বর্ণের মুক্তার মতো শহরে নদীর ওপর দিয়ে পাল তুলে রূপালি দাঁড় লাগানো কালো গনডোলার ওপরে বসে ভেসে চলেছে; শরৎকালে ভেনিসে তিনি যে দিনগুলি কাটিয়েছিলেন সেইগুলির কথা মনে পড়ে গেল তাঁরা কী আনন্দেই না কেটেছিল দিনগুলি–অজস্র আনন্দ আর ভুলের উত্তেজনায় মাতোয়ারা হয়ে ছিলেন তিনি। প্রতিটি জায়গায় রোমান্স একেবারে থইথই করছে সেখানে; কিন্তু অক্সফোর্ডের মতো, ভেনিসও তার সমস্ত রোমান্সকে পেছনে সরিয়ে রেখেছে। আর সত্যিকার রোমান্টিক চিন্তাধারার মানুষের কাছে পটভূমিকাটাই আসল অথবা একমাত্র সত্য। কিছুদিন বেসিলও তাঁর সঙ্গে ওখানে কাটিয়েছিলেন। হতভাগ্য বেসিল! মানুষে যে এভাবে মারা যেতে পারে সেকথা ভাবতেও তাঁর হৃৎকম্প উপস্থিত হল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বইটা তুলে নিলেন তিনি। সব কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা। করলেন। একটার পর একটা পাতা ওলটাতে লাগলেন তিনি। দেশ-বিদেশের পাখির কাহিনি। পড়লেন; স্মার্নার ছোটো কাপের জানালার ভেতর দিয়ে চড়াই পাখিরা উড়ে বেড়ায–সেখানে। হ্যাঁডিসরা বসে-বসে হলদে রঙের মালা গণে, পাগড়িওয়ালা বণিকদের দল তাদের লম্বা-লম্বা পাইপ টানে; আর মাঝে-মাঝে গম্ভীরভাবে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সব পড়লেন তিনি। আরো অনেক কিছু পড়লেন তিনিঃ সূর্যহীন প্যালেস দ্য লা কনকোর্ড-এর ওবেলিক পাখির কথা, নীল নদের ধারে সিম্পনিকস-এর কথা, ইজিপ্টের শকুন আর কুমিরের কথা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বইটি তাঁর হাত থেকে পড়ে গেল। কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়লেন তিনি। বিরাট ভয় এসে তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। অ্যালেন ক্যাম্পবেল যদি ইংলন্ডের বাইরে চলে যায়? তাঁর ফিরে আসতে অনেকদিন লাগবে। তিনি নাও আসতে পারেন। তাহলে তিনি কী করবেন? প্রতিটি মুহূর্ত এখন জরুরি। পাঁচ-ছ’ বছর আগে তাঁদের মধ্যে অগাধ বন্ধুত্ব ছিল–যাকে বলে অচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব। তারপরেই হঠাৎ তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এখন মাঝে-মাঝে কোনো জায়গায় যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তাহলে ডোরিযেই পরিচিতির হাসি হাসেন অ্যালেন পরিচয়কে অগ্রাহ্য করে যান।

মানুষ হিসাবে অ্যালেন সত্যিকারের বুদ্ধিমান যুবক। কিন্তু বাস্তব কলার সৌন্দর্য তাঁকে কোনোদিনই আকর্ষণ করতে পারেনি; আর কাব্যিক সৌন্দর্য বলতে যেটুকু তিনি বুঝতেন। বলে মনে হত তার সবটুকুই তাঁর ডোরিয়েন-এর কাছ থেকে নেওয়া। বিজ্ঞানের দিকেই তাঁর ঝোঁকটা ছিল প্রবল। কেম্ব্রিজে পড়ার সময় বেশিরভাগ সময়টাই তিনি ল্যাবরেটরিতে কাটাতেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে তিনি ভালোই ছিলেন। এখনো পর্যন্ত তিনি রসায়নশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করতেন, নিজের একটি পরীক্ষাগারও তিনি তৈরি করেছেন এবং সেইখানেই দিনের অধিকাংশ সময় দরজা বন্ধ করে দিয়ে গবেষণায ডুবে থাকতেল অ্যালেন। তাঁর মা তাঁর এবম্বিধ ব্যবহারে বড়ো হব্ধ ছিলেন। তিনি মনে করতেন কেমিস্টরা কেবল রোগীর প্রেসক্রিপশন লেখে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র পার্লামেন্টের নির্বাচনে দাঁড়াক। গায়ক হিসাবেও অ্যালেনের যথেষ্ট নাম ছিল। অনেক শখের বাজিয়েদের চেয়ে অনেক ভালো তিনি। বেহালা আর পিয়ানো বাড়াতে পারতেন। সত্যি কথা বলতে কি এই গান বাজনার মধ্যে সেই ডোরিয়েন-এর সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়; আর অন্যান্য ক্ষেত্রে যা ঘটেছে–ডোরিয়েন-এর অদ্ভুত সৌন্দর্য আর সম্মোহনী শক্তিই তাঁকে তাঁর কাছে টেনে এসেছিল। লেডি বার্কশায়ারের বাড়িতে যে রাত্রিতে রুবিনস্টেন বাজনা বাড়িয়েছিলেন সেই রাত্রিতেই ওঁদের দুজনের পরিচয় হ্য; তারপরেই তাঁরা একসঙ্গে অপেরায় যেতে শুরু করেন; শুরু করেন গানের মজলিসে যোগ দিতে। আঠারো মাস ধরে তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল নিবিড়। এই সময় সেলবিরয়্যাল অথবা। গ্রসভেনর স্কোয়ারে প্রায় অ্যালেনকে দেখা যেত। তাঁদের মধ্যে কী কারণে কলহ হয়েছিল, অথবা কলহ কোনো আদৌ হয়েছিল কি না সে কথা কেউ জানে না। কিন্তু হঠাৎ শোনা গেল তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে; আর কোনো জায়গায় ডোরিয়েন হাজির হলে অ্যালেন অনেক আগেই সেখান থেকে চলে যান। অ্যালেন-এর ভেতরেও অনেক পরিবর্তন। দেখা দিয়েছে। সেই হাসিখুশি ভাবটা তাঁর আর নেই; সব সময়েই কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকেন। গান-বাজনার জলসায় বিশেষ দেখা যায় না তাঁকে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন বিজ্ঞানের গবেষণায় তিনি এতই ব্যস্ত থাকেন যে ও-সব দিকে মন দেওয়ার মতো সময় তাঁর আর নেই। কথাটা সত্যি। দিনদিন তিনি শরীরতত্ত্ব নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। মাঝে-মাঝে অদ্ভুত ধরনের গবেষণাও তিনি করতেন। বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকপত্রে তাঁর নামও মাঝে-মাঝে দেখা যেত।

এই মানুষটির জন্যেই ডোরিয়েন গ্রে অপেক্ষা করে বসেছিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটি একটি মিনিট গুনে যাচ্ছিলেন তিনি। মিনিটের পর মিনিট কেটে যাওয়ার পরেই তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। খাঁচায় পোরা একটি রমণীয় বস্তুর মতো তিনি উঠে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন। দুটি হাত অদ্ভুতভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে তিনি লম্বা-লম্বা পা ফেলে ঘুরতে লাগলেন।

প্রতীক্ষা অসহ্য হয়ে উঠল তাঁরা মনে হল, সময় যেন আর কাটে না। প্রতিটি মুহূর্তে একটি কালো ঝড়ো হাওয়া যেন তাঁকে ঠেলে-ঠেলে চড়াই-এর একেবারে কিনারের দিকে নিয়ে। চলেছে। তারপরেই নীচে বিরাট অন্ধকার তলহীন গহ্বর। সেখানে তাঁর জন্যে কী অপেক্ষা করে বসে রয়েছে তা তিনি জানতেন। সেই ভয়ে দুটি হাত দিয়ে জোরে-ডোরে তিনি তাঁর চোখ দুটো ঘষতে লাগলেন মনে হল তিনি তাঁর নিজের মাথাটা ভেঙে ফেলবেন, দুটি চোখকে ঢুকিয়ে দেবেন কোটরের ভেতরে। কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়ে গেল। দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেলেন না তিনি। দুশ্চিন্তার পঙ্গপাল তাঁরই চোখের সামনে নেচে-নেচে বেড়াতে লাগল। তারপরে হঠাৎ স্থবির হয়ে গেল সময়। সেই মরা সময় কবরখানা থেকে লঘুগতিতে তাঁর চোখের ওপরে যে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎটিকে টেনে নিয়ে এল তা দেখেই আঁৎকে উঠলেন তিনি। ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন। আতংকে পাথর হয়ে গেলেন তিনি।

অবশেষে দরজা খুলে গেল; ঘরে ঢুকল চাকর। তার দিকে চকচকে চোখে চেয়ে দেখলেন ডোরিযে।

লোকটি বলল: মিঃ ক্যাম্পবেল এসেছেন স্যার।

তাঁর সেই শুকনো ঠোঁট দুটির ভেতর থেকে একটা স্বস্তির স্বর ফুটে বেরল। বিবর্ণ গণ্ড দুটি ধীরে-ধীরে আবার তাদের পুরনো রঙ ফিরে পেল। কিছুটা সহজ হয়ে এলেন ডোরিয়েন।

তাঁকে এখনই পাঠিয়ে দাও ফ্রানসিস।

তাঁর মনে হল, আবার যেন স্বস্থানে ফিরে এসেছেন তিনি। তাঁর দেহ-মন থেকে ভীরুতা, দুর্বলতার সব চিহ্ন তখন অপহৃত হয়েছে।

মাথাটা নীচু করে লোকটি চলে গেল। কিছুক্ষণের ভেতরেই অ্যালেন ক্যাম্পবেল ভেতরে ঢুকে এলেন। আগন্তুকের মেজাজ বেশ রুক্ষ, কিন্তু মুখের রঙটি বিবর্ণ। ঘন কালো চুল আর ভুরু দুটির জন্যে তাঁর মুখের পাণ্ডুরতা আরো বেশি করে চোখে পড়ল।

অ্যালেন! তুমি যে দয়া করে এসেছ তার জন্যে ধন্যবাদ।

গ্রে, তোমার বাড়িতে আর কোনোদিন আসার ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু আমি চিঠিতে লিখেছিলে যে জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ।

তাঁর স্বরটি যে কেবল কঠোর তাই নয়; রীতিমতো নিরুত্তাপ। ধীরে-ধীরে চিবিয়ে-চিবিয়ে কথাগুলি বললেন তিনি। ডোরিয়েন গ্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন; সেই দৃষ্টি ঘৃণার, অবহেলারা হাত দুটি কোটের পকেটে ঢুকিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন; ডোরিয়েন গ্রের সাগ্রহ অভ্যর্থনাকে কোনোরকম আমল দিলেন না।

 হ্যাঁ, সত্যিই তাই-জীবন-মৃত্যুই বটে, আর আমার একারই নয়, আরো অনেকের। বস।

টেবিলের পাশে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন ক্যাম্পবেল: তাঁর মখোমখি বসলেন ডোরিয়েন। চোখাচোখি হল দুজনের। একটু করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ডোরিয়েন। তিনি জানতে যা। তিনি বলতে যাচ্ছেন তা সত্যিই ভয়ঙ্কর।

 কয়েক মুহূর্ত বিক্ষুব্ধ নিস্তব্ধতার পরে তিনি অ্যালেনের দিকে একটু ঝুঁকে শান্তভাবে বললেন, প্রতিটি কথা কী ভাবে তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তার করছে তাও লক্ করলেন তিনি; অ্যালেন, এই বাড়ির ছাদে একটা বন্ধ ঘর রয়েছে। সেই ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ ঢোকে না। সেইখালে টেবিলের ধারে একটা চেয়ারের ওপরে একটি মৃত মানুষ বসে রয়েছে। এখন থেকে ঘন্টা দশেক আগে তার মৃত্যু হয়েছে। উঠো না; আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থেকো না। লোকটি কে, কেন সে মারা গেল, কী ভাবে মারা গেল–সে-সব বিষয়ে জানার কোনো প্রয়োজন তোমার নেই। তোমাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে এই যে…

গ্রে, তুমি চুপ কর। আর কিছু আমি জানতে চাইনে। তুমি যা বললে তা সত্যি কি না তা ডানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। আসল কথা, তোমার জীবনের কোনো ঘটনার সঙ্গে নিজেকে আর জড়িয়ে রাখতে আমি নারাজ। যদি কোনো ভয়ঙ্কর গোপন কাহিনি তোমার থাকে তা তুমি নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখা সেটা জানার কোনো কৌতূহল আমার নেই।

অ্যালেন, তোমাকে তা জানতেই হবে; বিশেষ করে এই গোপন কথাটা তোমার জানা চাই। তোমার জন্যে সত্যিই আমার বড়ো দুঃখ হয়, অ্যালেন। কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই। একমাত্র তুমিই আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে পার। সেই জন্যে বাধ্য হয়েই তোমাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি। তাছাড়া অন্য কোনো পথ আমার ছিল না। অ্যালেন তুমি বৈজ্ঞানিক। রসায়ন আর ওই জাতীয় কিছু বিষয়ে তোমার জ্ঞান রয়েছে। এই সব বিষয়ে অনেক পরীক্ষা তুমি করেছ। ওপরে যে জিনিসটি পড়ে রয়েছে সেটিকে একেবারে লোপাট করে। দিতে হবে; এমনভাবে পুড়িয়ে ফেলতে হবে যেন তার কোনো চিহ্নটুকু পর্যন্ত আর না থাকে। এ বাড়িতে ঢুকতে লোকটিকে কেউ এখানে দেখেনি। সত্যি কথা বলতে কি, ঠিক এই সময় তার প্যারিসে থাকার কথা। বেশ ক’টা মাস তার প্যারিসে থাকার কথা। বেশ ক’টা মাস তার কেউ খোঁজখবর নেবে না। যখন লোকে তাকে খুঁজবে তখন তার কোনো চিহ্ন যেন এখালে না। থাকে। অ্যালেন, তুমি তাকে আর তার সমস্ত চিহ্নগুলিকে পুড়িয়ে ছাই করে দাও; সেই ছাই আমি বাতাসে ছড়িয়ে দেব।

ডোরিয়েন, তুমি উন্মাদ।

তুমি আমাকে ওই নামে ডাকবে তারই জন্যে অপেক্ষা করছিলাম এতদিন অ্যালেন।

তুমি উন্মাদ হয়েচ্ছ উন্মাদ না হলে ভাবতে পারতে না যে যা তুমি চাইছ তাই আমি করব উন্মাদ না হলে, এ প্রস্তাব তুমি আমাকে দিতে পারতে না। ঘটনাটা যাই হোক, তার মধ্যে আমি আর নেই। তুমি কি মনে কর, তোমাকে বাঁচানোর জন্যে একটি মিথ্যে দুর্নামের বোঝা আমি মাথায় তুলে নেব? তুমি যদি কিছু শয়তানি করে থাক তার দায়িত্ব আমার নয়।

অ্যালেন, লোকটি আত্মহত্যা করেছে।

শুনে খুশি হলাম। কিন্তু কে তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে? সম্ভবত, তুমি।

আমার জন্যে এতটুকু করতে কি তুমি এখনো নারাজ?

নিশ্চয়। তোমার জন্যে আমি কিছুই করতে রাজি নই। এর জন্যে তোমার কী দুর্নাম ঘটবে। তার দায়িত্ব আমার নেই। সেইটাই তোমার উপযুক্ত পুরস্কার। দশজনের কাছে তুমি যদি হেয় প্রতিপন্ন হও, সমাজে সবাই যদি তোমাকে দূর-দাই করে তাহলেও তোমার জন্যে আমার কোনো দুঃখ হবে না। পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে তোমার দুষ্কর্মের ভাগীদার হতে তুমি আমার শরণাপন্ন হয়েছ দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভেবেছিলেম অন্য মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে তোমার কিছু জ্ঞান জন্মেছে। তোমার বন্ধু লর্ড হেনরি ওটন তোমাকে যাই শিখিয়ে থাকুন মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে কিছুই শেখাননি। তোমাকে সাহায্য করার জন্যে একটা। আঙুলও আমি তুলতে রাজি নই। তুমি ভুল লোকের কাছে এসেছ। সাহায্যের জন্যে তুমি তোমার বন্ধুদের কাছে যাও–আমার কাছে এস না।

অ্যালেন, ব্যাপারটা হচ্ছে হত্যা। আমি তাকে হত্যা করেছি। তুমি জান না তারই জন্যে। জীবনে আমি কত যন্ত্রণা ভোগ করেছি। আমি আজ যে-অবস্থায় এসে পৌঁছেছি তার জন্যে হ্যারির অবদান যত তার চেয়ে অনেক বেশি অবদান ছিল তার ভালোর জন্যেও বটে, খারাপের জন্যেও বটোতার ইচ্ছে হয়তো তা ছিল না; কিন্তু হরে-দরে জিনিসটা একই দাঁড়িয়েছে।

হত্যা! হায় ভগবান! শেষ পর্যন্ত ডোরিয়েন, তুমি এতটা নীচে নেমে এসেছ? এদিক থেকে কোনো সাহায্য আমার তুমি পাবে না। ও কাজ আমার নয়। তা ছাড়া, আমার সাহায্য ছাড়াই পুলিশ তোমাকে শীঘ্রই গ্রেপ্তার করবে। মূর্খ ছাড়া কেউ কোনো পাপ কাজ করে না। কিন্তু এবিষয়ে আমার কিছুই করণীয় নেই।

তোমাকে কিছু একটা করতেই হবে। থাম, থাম; অস্থির হয়ো না। আমার কথা শোনো, শোনো না অ্যালেন। তুমি একটু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা কর। এ ছাড়া আর কি আমি চাইনে। তুমি হাসপাতালেও যাও, মর্গে যাও; সে-সব ভাযগায় তুমি যে বীভৎস মৃতদেহ দেখ সেগুলি তোমার ওপরে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কোনো নোংরা শবব্যবচ্ছেদগারের টেবিলের ওপরে যদি তুমি এই মানুষটিকে শায়িত অবস্থায় দেখতে তাহলে বস্তুটিকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার উপযুক্ত আধার ভেবে তুমি কেবল খুশিই হতো এতটুকু দ্বিধা করতে না তুমি তোমার একবারও মনে হত না যে তুমি কিছু অন্যায় করতে যাচ্ছ; বরং তোমার মনে। হত মনুষ্য জাতির একটা উপকার তুমি করছ। বিশ্বের জ্ঞান বাড়িয়ে দিচ্ছ অথবা চিন্তার। কিছুটা কৌতূহল মেটাস্থ বা ওই জাতীয় কোনো সৎ কাডে তুমি নিজেকে উৎসর্গ করেছ। যে। কাজ আগেও তুমি অনেকবারই করেছ সেই রকম একটা কাজই আমি তোমাকে আজ করতে বলছি। বরং, যে-কাজ করতে তুমি অভ্যস্ত, এ কাজ তার চেয়ে অনেক কম ভযুদ্ধর–এই পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়াটা। মনে রেখ, আমার বিরুদ্ধে এটাই একমাত্র সাী। এই মৃতদেহ যদি কেউ আবিষ্কার করে ফেলে তাহলেই আমরা শেষ; আর তুমি যদি আমাকে সাহায্য না কর, তাহলে আমি ধরা পড়ে যাবই।

তোমাকে সাহায্য করার কোনো বাসনা আমার নেই। সেই কথাটাই তুমি ভুলে যাচ্ছ। এই ব্যাপারটাতেই কোনো আগ্রহ নেই আমার। এর সঙ্গে নিজেকে আমি জড়াতে চাই নে।

অ্যালেন, তোমাকে আমি অনুরোধ করছি। আমি কী গাড্ডায় পড়েছি সেকথাটা একবার ভেবে দেখা তুমি এখানে আসার ঠিক আগে পর্যন্ত ভয়ে আমি আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকেও হয়তো একদিন এই অবস্থায় পড়তে হতে পারে। না, তা ভেব না। গোটা। ব্যাপারটিকে তুমি কেবল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা পরীক্ষা করতে গিয়ে কোথা থেকে মৃতদেহটি পাওয়া গিয়েছে সেই অনুসন্ধান কি তুমি কোনোদিন কর? সুতরাং এখনো তা জানতে চেয়ো না। তোমাকে আমি অনেক কথা বলে ফেলেছি। তোমাকে অনুরোধ করছি এই কাজটি তুমি করে দাও। অ্যালেন, আমরা একদিন বন্ধু ছিলেম।

ডোরিয়েন, সে-সব দিনের কথা আর তুলো না; সেগুলি আজ মৃত।

মাঝে-মাঝে মৃতেরাও বেঁচে থাকে। ওপরে যে-মালটি রয়েছে সে চলে যাবে না। মাথা নীচ করে হাত দুটি ছড়িয়ে সে টেবিলের ওপরে বসে রয়েছে। অ্যালেন, অ্যালেন–তুমি যদি আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে না আস তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাব। বুক ত পারছ না। যা করে ফেলেছি, তার জন্যে ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে।

এ নিয়ে আর বেশি কচকচি করে লাভ নেই। এ বিষয়ে কিছু করতে আমি রাজি নই। উন্মাদ না হলে এ অনুরোধ তুমি আমাকে করতে না।

রাজি নও তুমি?

না।

অ্যালেন, আমার অনুরোধ।

অনর্থক অনুরোধ করো না।

ডোরিয়েন-এর চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। তারপরেই তিনি হাত বাড়িয়ে এক টুকরো কাগজ টেনে নিলেন; তার ওপরে একটা কী যেন লিখলেন। বার দুই পড়লেন; ভালো করে ভাঁজ করলেন; তারপরে সেটিকে টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে দিলেন।

চিঠিটা ঠেলে দিয়ে উঠে পড়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।

তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ক্যাম্পবেল; তারপরে কাগজটা টেনে নিয়ে পড়লেন, পড়তে-পড়তে তাঁর মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠল; তিনি চেয়ারের ওপরে বসে পড়লেন। একটা ভয়াবহ অস্থিরতা গ্রাস করে ফেলল তাঁকে। মনে হল, একটা শূন্য গুহার দেওয়ালে তাঁর হৃৎপিণ্ডটা যেন অনবরত মাথা ঠুকে চলেছে।

দু’তিন মিনিটের মতো একটা ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা নেমে এল। তারপরে, ডোরিয়েন ঘুরে দাঁড়ালেন, ক্যাম্ববেলের পেছনে এসে তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন।

আস্তে-আস্তে বললেন ডোরিয়েন তোমার জন্যে আমি দুঃখিত, অ্যালেন, কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো পথআমার জন্যে তুমি খোলা রাখনি। আমি আগেই চিঠি লিখে রেখেছি। এই দেখ, কোথায় পাঠানোর কথা তাও তুমি দেখতে পাচ্ছ। যদি তুমি আমাকে সাহায্য না কর তাহলে এ চিঠি আমি যথাস্থানেই পাঠিয়ে দেব। এর ফল কী হবে তা তুমি জান। কিন্তু তুমি আমাকে সাহায্য করবে; বর্তমান পরিস্থিতিতে সাহায্য না করাটা তোমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। তুমি নিশ্চয় স্বীকার করবে যে তোমাকে আমি বাঁচতেই চেয়েছিলেম। কিন্তু আমার সঙ্গে ত্ব অত্যন্ত বুঢ় ব্যবহার করেছ। তুমি আমাকে যেভাবে অপমান করেছ ঠিক সেই ভাবে অপমান করার দুঃসাহস আজ পর্যন্ত কোনো জীবন্ত মানুষের হয়নি। আমি সব সহ্য করেছি। এখন বদলা নেওয়ার পালা আমার।

দু’হাতের মধ্যে মুখটাকে লুকিয়ে ফেললেন ক্যাম্পবেল; তাঁর শরীরটা কাঁপতে লাগল।

হ্যাঁ, অ্যালেন, এখন তুমি আমার হাতের মুঠোয়। তোমাকে কী করতে হবে তা তুমি জান। কাজটা খুব সহজ এস; অনর্থক উত্তেজিত হযো না. দুর্বল করে ফেল না। নিজেকে। কাজটা করতেই হবে। সুতরাং আর দেরি করো না।

ক্যাম্পবেলের ঠোঁটের ভেতর দিয়ে একটা মৃদু গোঙানি বেরিয়ে এল। সারা শরীরটা তাঁর কেঁপে কেঁপে উঠল। সেলফ-এর ওপরে ঘড়ির টিকটিক শব্দ মনে হল সময়টাকে যেন অসংখ্য টুকরো-টুকরো যন্ত্রণার অণুতে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলছে। সেই যন্ত্রণা সহ্য করা কষ্টকর। তাঁর মনে হল যেন একটা লোহার সাঁড়াশি ধীরে ধীরে তাঁর কপালের ওপরে চেপে বসছে। যে-কলঙ্কের ভয় তাঁকে দেখানো হয়েছে, তাঁর মনে হল সেই কলঙ্কের কালি ইতিমধ্যেই যেন তাঁর শরীরের ওপরে ছিটকে পড়েছে। তাঁর কাঁধের ওপরে যে হাতটি এসে পড়েছে সেটি সীসের মতো ভারী হয়ে উঠেছে। এ অসহ্য মনে হল, তিনি যেন গুঁড়িয়ে যাবেন।

অ্যালেন, কী করবে তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেল।

আমি করতে পারব না।

যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কথাটা বলে গেলেন অ্যালেন; নিছক কথা যেন সব কিছু ওলট-পালট করে দিতে পারে!

করতে তোমাকে-হবেই। অন্য কোনো পথ খোলা নেই তোমার দেরি করো না। এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন অ্যালেন; জিজ্ঞাসা করলেন: ওপরে আগুন রয়েছে? রয়েছে। গ্যাসের আগুন।

আমাকে বাড়ি যেতে হবে ল্যাবরেটরি থেকে কয়েকটা জিনিস আনতে হবে।

না অ্যালেন। এ ঘর ছেড়ে যাওয়া তোমার চলবে না। তোমার কী দরকার একটা কাগজে লিখে দাও। আমার চাকর গাড়িতে করে এখনই সে সব জিনিস নিয়ে আসবে।

কয়েকটা লাইন লিখলেন ক্যাম্বুবেল; তারপর ব্লটিং পেপার চিপে একটা খামের ভেতরে পুরলেন; খামের ওপরে নাম লিখলেন তাঁর সহকারী। ডোরিয়েন চিঠিটি ভালো করে পড়ে বেল বাজালেন। চাকর ঢুকতে তাকে নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।

দরজাটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ক্যাম্পবেল থর-থর করে কাঁপতে শুরু করলেন। তারপরে চেয়ার ছেড়ে উঠে চিমনি রাখার জায়গার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। মনে হল তাঁর জ্বর এসেছে। প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে কেউ কারোর সঙ্গে কথা কইলেন না। একটা মাছি ভনভন করে ঘুরতে লাগল; ঘড়ির টিকটিক শব্দ হাতুড়ির ঘা বলে মনে হল।

একটা বাজল। ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পবেল ডোরিয়েন-এর দিকে তাকালেন, দেখলেন তাঁর চোখ দুটি জলে ভরে উঠেছে। সেই মুখের ওপরে এমন একটা পবিত্র বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছিল। যে অ্যালেন না রেগে পারেননি। তিনি ফিসফিস করে বললেন: জঘন্য, নক্কারজনক তোমার জীবন।

চুপ অ্যালেন। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ।

 তোমাকে! হায় ভগবান! কী জঘন্য জীবন তোমার! একটা পাপ আর একটা পাপের মধ্যে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার শেষ পরিণতি হল নরহত্যায়। যা আমি করতে যাচ্ছি অথবা যা করতে। তুমি আমাকে বাধ্য করছ–সেটি কিন্তু তোমার জীবন বাঁচানোর জন্যে নয়। সে কথা আমি। চিন্তাও করছিনে।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ডোরিয়েন বললেন: তোমার ওপরে আমার যে করুণা রয়েছে তার একশ ভাগের এক ভাগও আমার ওপরে করুণা যদি তোমার থাকত!

এই বলেই ডোরিয়েন ঘুরে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কোনো উত্তর দিলেন না ক্যাম্পবেল।

আরো মিনিট দশেক পরে দরজায় একটা টোকা পড়ল বিরাট একটা মেহগনি কাঠের বাক্স নিয়ে চাকর ঘরে ঢুকল; সেই বাক্সের মধ্যে ছিল কেমিকেল, লম্বা ইসপাত আ প্ল্যাটিনাম তার; আর সেই সঙ্গে অদ্ভুত দেখতে দুটি লোহার আঁকশি।

ঘরে ঢুকেই সে ক্যাম্পবেলকে জিজ্ঞাসা করল:এগুলি কি স্যার এইখানেই রেখে যাব?

ডোরিয়েন বললেন, হ্যাঁ। তোমাকে আর একটা কাজ করতে হবে ফ্রান্সিস। রিচমনড-এর সেই লোকটির নাম কী বল তো–ওই যে, যে লোকটি সেলবিতে অরকিড দেয় হে।

তার নাম হার্ডেন, স্যার।

হ্যাঁ হ্যাঁ; হার্ডেন। তুমি এখনই রিচমনড-এ যাও; হার্ডেন-এর সঙ্গে দেখা করো; তাকে বলবে আমি যে ক’টা অরকিড পাঠাতে বলেছি তার যেন দ্বিগুণ পাঠায়; সাদা অরকিড যত কম হয় ততই ভালো-অন্তত, যতগুলি সম্ভব। সত্যি কথা বলতে কি, সাদা অরকিড আমি চাই নে! দিনটা বড়ো সুন্দর ফ্রান্সিস; রিচমনড জায়গাটাও ভারী চমৎকার। তা না হলে আমি তোমাকে কষ্ট করে যেতে বলতাম না।

না, না। আমার কোনো কষ্ট হবে না স্যার। কখন আমি ফিরব?

 ক্যাম্পবেল-এর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ডোরিয়েন: পরীষ্কাটা শেষ করতে তোমার কত সময় লাগবে ক্যাম্পবেল?

 স্বর তাঁর শান্ত, উদাসীন। ঘরের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি তাঁকে অদ্ভুত রকমের সাহসী করে তুলেছিল।

ভ্রূ কোঁচকালেন ক্যাম্পবেল; একটা ঠোঁট কামড়ালেন, বললেন: ঘণ্টা পাঁচেক।

সাড়ে সাতটার কাছাকাছি তোমার ফিরে এলেই চলবে, ফ্রান্সিস। কিম্বা দাঁড়াও আমার । জিনিসপত্র তুমি টেবিলের ওপরেই সাজিয়ে রেখে দাও। আজ তোমার ছুটি। আজ রাত্রিতে আমি বাড়িতে খাচ্ছি নে। তোমাকে আজ আর কোনো দরকার হবে না।

ধন্যবাদ, স্যার-ঘর থেকে বেরিয়ে গেল লোকটি।

অ্যালেন, একটি মুহূর্তও নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। বাক্সটা তো বেশ ভারী দেখছি। আমিই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। অন্য জিনিসগুলি তুমি নিয়ে এস।

নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি কথাগুলি বললেন তিনি। প্রতিবাদ করার মতো শক্তি ছিল না ক্যাম্পবেল-এর। তাঁরা দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ওপরের সিঁড়িতে এসে ডোরিয়েন চাবি বার করে তালা খুললেন; একটু থামলেন; একটা বিষণ্ণ দৃষ্টি তাঁর চোখের মধ্যে ফুটে বেরোল। কেঁপে উঠলেন তিনি; বিড়বিড় করে বললেন; অ্যালেন, ভেতরে ঢুকতে বড়ো অস্বস্তি লাগছে আমার।

ক্যাম্পবেল বেশ নীরস ভাবেই বললেন: আমার কাছে ব্যাপারটা কিছুই নয়। তোমাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।

দরজা অর্ধেকটা ফাঁক করলেন ডোরিয়েন; খোলার সময় প্রতিকৃতিটা চোখে পড়ল তাঁর। সূর্যের আলোতে সেটা আড়চোখে তাকিয়ে ছিল তারই সামনে মেঝের ওপরে পড়ে ছিল। ডো পর্দাটা। তাঁর মনে পড়ল আগের রাত্রিতে তিনি সেই বিপজ্জনক ছবিটাকে ঢাকতে ভুলে গিয়েছিলেন; জীবনে সেই তাঁর প্রথম ভুল। দৌড়ে তিনি ভেতরে ঢুকতে গেলেন; কিন্তু তারপরেই ভয় পেয়ে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।

ছবিটার হাতের ওপরে নোংরা লাল ফোঁটার মতো কী ওটা রোদে চকচক করছে? মনে হচ্ছে। তার হাতের ঘাম যেন রক্ত হয়ে ঝরে পড়ছে। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য! ওই যেন মূর্তিটি টেবিলের ওপর আড় হয়ে পড় রয়েছে এবং কার্পেটের ওপরে যার ছায়া দেখে মনে হচ্ছে সে একটুও নড়েনি, কিন্তু সেই একইভাবে পড়ে রয়েছে তার চেয়ে ভয়ানক।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, দরজাটা একটু ফাঁক করলেন, তারপরে মৃতদেহটির দিকে আদৌ তাকাবেন না এই রকম একটা দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে তিনি দৌড়ে ভেতরে ঢুকে নীচু হয়ে পর্দাটা তুলে ছবিটাকে ঢেকে দিলেন।

তারপরেই তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লেন, ঘুরে দাঁড়াতেই ভয় হল তাঁর। শব্দ শুনে তিনি বুঝতে পারলেন, ক্যাম্পবেল সেই ভয়ঙ্কর কাজটি শুরু করার জন্যে তাঁর জিনিসপত্রগুলি গোছাচ্ছেন। তিনি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন কোনোদিন কি সত্যি-সত্যিই তাঁর সঙ্গে বেসিল হলওয়ার্ড-এর দেখা হয়েছিল; হয়ে থাকলে, পরস্পরের সম্বন্ধে দুডনের কী ধারণা জন্মেছিল?

তাঁর পেছন থেকে একটা কর্কশ স্বর শোনা গেল: তুমি এখানে থেকে চলে যাও।

ডোরিয়েন ঘুরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন। বেরিয়ে আসার সময় তিনি বুঝতে পারলেন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

সাতটার অনেক পরে ক্যাম্পবেল লাইব্রেরিতে নেমে এলেন। তাঁর মুখ বিবর্ণ কিন্তু একেবারে শান্ত তিনি কোনোরকম উত্তেজনা দেখা গেল না তাঁর ভেতরে।

তিনি বিড়বিড় করে বললেন: আমাকে যা করতে বলেছিলে সে-কাজ আমি শেষ করছি। বিদায়। আর যেন কোনোদিন আমাদের দেখা না হয়।

ডোরিয়েন কেবল বললেন: ধ্বংসের হাত থেকে আমাকে তুমি বাঁচিযেছে, অ্যালেন। একথা আমি ভুলতে পারিনে।

ক্যাম্ববেল চলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই তিনি ওপরে উঠে গেলেন। ঘরের মধ্যে নাইট্রিক অ্যাসিডের ভয়ানক রকমের একটা উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু যে জিনিসটা টেবিলের ধারে এতক্ষণ বসেছিল সেটি আর নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *