কাল কী হবে কে জানে। হয়তো মারাত্মক কিছুও ঘটতে পারে।
বসে বসে ভাবলো তসলিম।
জীবনে এই প্রথম অনুভূতির জন্ম নিলো তার মনে।
একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙতেই হবে। নইলে আন্দোলন এখানেই শেষ হয়ে যাবে।
বাংলা ভাষাকে চিরতরে নির্মূল করে দেবে ওরা।
আর একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙতে গেলে হয়তো পুলিশ গুলিও চালাতে পারে।
হয়তো তসলিম মারা যাবে।
নিজের মৃত্যুর কথা ভাবতে গিয়ে সহসা শিউরে উঠলো সে।
মনে হলো যেন নিজের মৃত্যুকে সে এ-মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করছে।
ভাত খাবেন না!
সালমার কণ্ঠস্বরে চমকে তাকালো তসলিম।
সালমা বলল–
তরকারি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, চলুন।
বলে চলে যাচ্ছিলো সালমা।
সহসা পেছন থেকে তাকে ডাকলো তসলিম—
সালমা, শোনো! তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
সালমা ফিরে তাকালো।
নীরব দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো—
কি, বলুন?
সে-চৌখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না তসলিম।
চোখ নামিয়ে নিয়ে ধীরেধীরে বললো—
কথাটা আমার তুমি কিভাবে নেবে জানি না, হয়তো তুমি রাগ করবে–।
বলতে গিয়ে থেমে গেলো সে।
সালমা নীরব।
কয়েকটি নীরব মুহূর্ত।
সহসা তসলিম আবার বললো—
বহুবার ভেবেছি বলবো তোমাকে। বলা হয়নি। হয়তো কোনোদিন বলতাম না। কিন্তু আজ কেন জানিনা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে আমার!
আবার নীরব হলো তসলিম।
সালমা মাটির দিকে চেয়ে চুপ করে আছে।
মনে হলো ও মুখখানা কৃষ্ণচূড়ার রঙে ভরে গেছে।
সালমা বললো—
চলুন, এখন খেয়ে নিন।
না না সালমা, যদি কাল কোনো অঘটন ঘটে? ধরো যদি আমি মারা যাই। তাহলে?
মেয়েটি শিউরে উঠলো।
চোখজোড়া মুহূর্তে ছলছল করে উঠলো তার।
ছিঃ। এসব কী বলছেন আপনি! মরবেন কেন? আপনি অনেক অনেক দিন বাঁচবেন।
আসুন, এখন খেয়ে নিন। চলুন।
কথাটা শুনবে না?
না এখন না। পরে শুনবো।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই সামনে থেকে সরে গেল সালমা।
তুমি কি কাল বাইরে বেরুবে, না ঘরে থাকবে?
বিছানায় শোবার আগে মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে স্বামীকে প্রশ্ন করলেন বিলকিস বানু।
হ্যাঁ, বেরুবো বৈ কী। বেরুবো না কেন?
না, বলছিলাম কী–যদি হরতাল হয় তাহলে?
হরতাল মোটেও হবে না। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।
বিজ্ঞের মতো জবাব দিলেন মকবুল আহমদ।
হরতালের সব রাস্তা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।
যে হরতাল করবে তার লাইসেন্স আমরা কেড়ে নেবো। কেউ যদি অফিসে না আসে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবো। আমরা জানিয়ে দিয়েছি। পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছি সবাইকে। তারপরও কি কেউ হরতাল করবে বলে মনে হয় তোমার?
স্লিপিং সুটটা পরে নিয়ে বিছানায় এসে শুলেন মকবুল আহমদ। কিন্তু ছাত্ররা হয়তো একটু-আধটু গোলমাল করতে পারে।
তাও আমরা ভেবে রেখেছি। ক্রিম ঘষা শেষ হলে বিলকিস বানু বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে বসলেন।
আমার কি মনে হচ্ছে জানো? কাল কোনো একটা কিছু হয়তো হতেও পারে। তুমি যেদিকে খুশি যেয়ে, কিন্তু ওই ছাত্রদের পাড়ায় গাড়ি নিয়ে যেয়ো না। তুমি মিছেমিছি ভাবছে। শুয়ে পড়ো এখন। চোখ বন্ধ করে ঘুমোবার চেষ্টা করলেন মকবুল আহমদ।
ভোর হবার আগেই ঘুম ভেঙে গেলো গফুরের।
চেয়ে দেখলো পৃথ-ঘাটগুলো তখনো জনশূন্য।
দুটো কুকুর রাস্তার মাঝখানে বসে ঝগড়া করছে।
গফুর উঠে বসলো।
পুঁটলিতে রাখা জিনিসপত্রগুলো পরখ করে দেখলো একবার।
পুবের আকাশে সবে ধলপহর দিয়েছে।
দু-পাশের উঁচুউঁচু দালানগুলোকে আকাশের পটভূমিতে ছায়ার মতো মনে হচ্ছে।
দুএকটা কাক গলা ছেড়ে চিৎকার করছে।
মাঝে মাঝে রাস্তায় নেমে এসে খাবার খুঁজছে।
আবার উড়ে গিয়ে বসছে টেলিগ্রামের তারের উপর।
দুটো মেয়ে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ঝাড়ু দিচ্ছে।
আবর্জনা পরিষ্কার করছে।
রাস্তার পাশে একটা কল থেকে হাতমুখ ধুলো গফুর।
ততক্ষণে লোকজন পথে চলতে শুরু করেছে।
দু-একটা রিকশার টুংটাং আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
একটা-দুটো করে দোকান-পাট খুলছে।
টাউন সার্ভিসের বাসগুলো মানুষ ভর্তি করে ছুটছে উর্ধ্বশ্বাসে।
হরতাল।
কোথায় হরতাল?
গফুর অবাক হয়ে তাকালো চারপাশে।
সেলিম তার রিকশাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়।
যাবার সময় বৌকে বলে গেলো—
কালুকে আজ রাস্তায় বেরুতে দিস না। গোলমাল হতে পারে।
কালু ওর ছেলের নাম।
মকবুল আহমদও বেরুলেন বাইরে।
স্ত্রী বিলকিস বানুকে সঙ্গে নিয়ে।
ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন রেসকোর্স ঘুরে সেক্রেটারিয়েটের দিকে যাবার জন্য।
পুরোনো শহরেও একবার যাবেন তিনি।
কারখানায় যাবেন।
অফিসপাড়াগুলো ঘুরবেন।
হরতাল ব্যর্থ হয়েছে কি হয়নি তাই তদারক করবেন তিনি।
বিলকিস বানু সহসা শব্দ করে হেসে উঠলেন।
ওই যে দ্যাখো দ্যাখো। একটা বাস আসছে। দুটো রিকশা। একটা ঘোড়ার গাড়ি। ওটা একটা প্রাইভেট কার, না!
দুজনের মুখে হাসি।
চারপাশে সন্ধানী-দৃষ্টি নিয়ে কী যেন খুঁজছেন তারা।
রাস্তায় গাড়ি দেখলে কিম্বা দোকান খুলছে নজরে এলে উল্লাসে ভরে উঠছে তাদের চোখ-মুখ।
তোমাকে বলিনি আমি।
সগর্বে স্ত্রীর দিকে তাকালেন মকবুল আহমদ।
কেউ হরতাল করবে না। দেশের দুশমনদের সাথে কেউ যোগ দেবে না। স্বামীর একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিলেন বিলকিস বানু।
তুমি কি সত্যিসত্যি আজ অফিসে যাবে না?
বাইরে বেরুবার মুহূর্তে প্রশ্ন করলো সালেহা।
একটা কথার আর কবার উত্তর দেবো বলো তো?
কবি আনোয়ার হোসেন রেগে গেলেন—
বলছি তো যাবো না।
তাহলে এখন বেরুচ্ছো কোথায়?
পথ রোধ করে দাঁড়ালো সালেহা।
বাইরে হরতাল কেমন হলো দেখতে যাবো।
তারপর?
তারপর ইউনিভার্সিটিতে যাবো। ছাত্ররা কী করছে।
না। আমি তোমাকে বেরুতে দেবো না।
সালেহা দৃঢ়কণ্ঠে বললো—
শেষে কোথায় গিয়ে কী করবে—পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। তখন আমার কী অবস্থা হবে শুনি?
দ্যাখো, বাজে বকো না। পথ ছাড়ো। পুলিশে ধরবে। আমি তার তোয়াক্কা করি না। আর আমার যদি কিছু হয় তাহলে তুমি বাপের বাড়ি চলে যেয়ো।
উত্তরের আর অপেক্ষা করলেন না আনোয়ার হোসেন।
বাইরে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ভোররাতে পুলিশের পোশাক পরে কোমরে পিস্তল এঁটে বাইরে বেরিয়ে গেছেন বাবা।
আজ তার বড় ব্যস্ততার দিন।
তসলিমও ব্যস্ত।
তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার পথে সালমার সঙ্গে দেখা হলো তসলিমের।
আজ বাইরে না গেলেই কি নয়?
এই একটি কথা বলার জন্য হয়তো সিঁড়ির গোড়ায় অপেক্ষা করছিলো মেয়েটি।
তসলিম থমকে দাঁড়ালো।
তুমি তো সবই জানো সালমা। জানো, আমি যাবো। তবু কেন বাধা দিচ্ছে।
দৃষ্টি নত করলো সালমা।
খালু বলছিলেন আজ গোলমাল হতে পারে।
বলতে গিয়ে গলার স্বরটা কেপে গেলো তার।
তসলিম সেটা লক্ষ করলো।
এ-মুহূর্তে অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করছিলো তার।
কিছুই বলতে পারলো না। শুধু বললো–
চলি সালমা। আবার দেখা হবে।
বলে সালমার দিকে আর তাকালো না সে। নীরবে বেরিয়ে গেলো।
এরা মানুষ!
মানুষ না সব জানোয়ার।
রাস্তার মধ্যে একরাশ থুথু ছিটালো কবি আনোয়ার হোসেন।
সব শালা বেঈমান। টাকা খেয়ে হরতাল ভেঙে দিয়েছে। বুঝবে। যেদিন ওদের ঘাড়ে ঊর্টুর জোয়াল চাপিয়ে দেয়া হবে, সেদিন বুঝবে শালারা।
রাগে থরথর করে কাঁপছিলো কবি আনোয়ার হোসেন।
যাবেন নাকি সাব।
তাকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা রিকশাওয়ালা শুধালো।
না।
সহসা বিকটভাবে চিৎকার করে উঠলেন কবি আনোয়ার হোসেন।
তার ইচ্ছে হলো এক ঘুসিতে রিকশাওয়ালার নাক, মুখ ভেঙে দিতে!
সব শালা বেঈমান। মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ।
রাস্তায় থুথু ছিটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন তিনি।
তখন দুপুর।
আকাশে একটুকরো মেঘ নেই।
সূর্যটা জ্বলছে।
ছাত্ররা সবাই স্কুল-কলেজ বর্জন করে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে একে-একে এসে জমাতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়।
মধুর রেস্তোরাঁ।
ইউনিয়ন অফিস।
পুকুরপাড়।
গমগম করছে অসংখ্য কণ্ঠস্বরে।
বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের সামনের রাস্তায় ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলো নিচে অনেকগুলো পুলিশের গাড়ি সার বেঁধে এসে দাড়িয়েছে।
পুলিশের কর্তারা পায়চারি করেছেন রাস্তায়।
আর কন্সটেবলগুলো হুকুমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।
রাইফেলের নলগুলো দুপুরের রোদে চিকচিক করছে।
ইউক্যালিপ্টাসের ডাল থেকে অসংখ্য পাতা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে নিচে।
সহসা অসংখ্য কণ্ঠের চিৎকারে চমকে সেদিকে তাকালেন পুলিশের বড়কর্তারা।
আমতলায় ছাত্রদের সভা শুরু হয়েছে।
আমরা কোনো কথা শুনতে চাই না।
কোনো বক্তৃতার এখন প্রয়োজন নেই।
আমরা একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙবো।
ভাঙবো।
ভাঙবো।
অনেকগুলো কণ্ঠ বজ্রের মতো ধ্বনি তুললো।
নেতারা বলছেন—
না, একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙা যাবে না। আইন অমান্য করা ঠিক হবে না। আমরা স্বাক্ষর সগ্রহ অভিযান চালাবো। স্বাক্ষর সংগ্রহ করেই আমরা আমাদের প্রতিবাদ জানাবো।
না!
না!!
না!!!
আমরা তোমাদের কথা মানবে না।
বিশ্বাসঘাতক!
এরা সব বিশ্বাসঘাতক!!
তোমাদের কথা আমরা শুনতে চাই না।
আমরা একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙবো।
আইনের বেড়ি আমরা ভাঙবো।
ভাঙবো!
ভাঙবো!!
ভাঙবো!!!
অসংখ্য কণ্ঠের চিৎকারে চমকে উঠলেন পুলিশের বড়কর্তারা।
পিস্তলে হাত রাখলেন।
ছোটকর্তারা ছুটে এসে দাঁড়ালেন কন্সটেবলগুলোর পাশে।
সেপাইদের চোখেমুখে কোনো ভাবান্তর নেই।
হুকুমের ক্রীতদাস ওরা।
কর্তাদের মুখের দিকে নির্লিপ্ত-দৃষ্টিতে চেয়ে।
সূর্য জ্বলছে।
রাইফেলের নলগুলো চিকচিক করছে রোদে।
ইউক্যালিপ্টাসের ডাল থেকে পাতা ঝরছে।
কোনো নেতার কথা আমরা শুনবো না।
টেবিলে উঠে দাঁড়িয়ে সহসা চিৎকার করে উঠলো তসলিম।
আমরা একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙবো, কিন্তু বিশৃঙ্খলভাবে নয়। দশজন দশজন করে আমরা বেরিয়ে যাবো রাস্তায়। মিছিল করে এগিয়ে যাবো এসেম্বলির দিকে। এই আমাদের আজকের সিদ্ধান্ত। এই আমাদের আজকের শপথ।