৩. এই যে দেখছ পথটা

এই যে দেখছ পথটা, এটা ক্রমশ ওপর দিকে উঠে গেছে। আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বড় ছোট পাথরের স্থূপ। মাঝে মাঝে জল চলে আসছে অদৃশ্য সব উৎস থেকে। এটা তীর্থযাত্রীদের পথ নয়, সাধুদের পথ। এইটা পেরোতে পারলেই অদ্ভুত এক চাতাল। সেখান থেকে মাথা তুলেছে ওই বিরাট পাহাড়টা। উঁচু, কত উঁচু, যেন আকাশে ঠেকে গেছে। ওই পাহাড়ে একটা বড় গুহা আছে। সেই গুহায় ধ্যানস্থ এক সাধু। তাঁর পার্থিব শরীর কতটা প্রাচীন, কেউ বলতে পারবে না।

আপনি আগে গেছেন?

অনেকবার।

কথা হয়েছে?

না, একবার শুধু তাকিয়েছিলেন। সে দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারিনি। অন্তর্ভেদী।

আমি কি উঠতে পারব? এ তো দুর্গম!

আমি পারলে, তুমিও পারবে। শরীরটা হালকা করে নাও।

কি করব? হালকা? কেমন করে করব?

শ্বাস নিয়ে ধরে রাখো, কুম্ভক। দেখবে শরীর হালকা হয়ে গেছে। আগেই ভাববে না, পারব না। ভাববে, এ আমার পক্ষে কিছুই নয়। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে থাকবে। এপাশে ওপাশে গাছের শেকড় ঝুলে আছে। সাহায্য নিতে পারো। কখনও পাহাড়ে উঠেছ?

না।

এই তোমার প্রথম। আমি তোমার পেছনেই আছি। আজকের দিনটা খুব সুন্দর। রোদ ঝলমলে। দূরের পাহাড় সব ঝকঝক করছে; যেন এক-একজন দেবতা। শিব শিব বলতে বলতে ওঠো। হিমালয় হল শিবভূমি। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় পাহাড় আছে, পাহাড় দেবতা কোথাও নেই। এ হল ঋষিদের অবদান। দেবতারা এখানে মানুষকে কৃপা করে আসতে দেন। সাহায্য করেন। সে-ই আসতে পারে যার সংসার বন্ধন ঘুচে গেছে। এ-পথ গাড়ি-ঘোড়ার পথ নয়, পায়ের পথ। এই দেখ, তুমি কত সহজে উঠে এলে। কিছু বুঝতে পারলে?

আমি উঠিনি। উঠেছেন আপনি।

আমিও উঠিনি। উঠেছেন তিনি।

তিনি? তিনি কে?

যে যেমন বোঝে। শক্তি, শক্তি। মা আর বাবার একত্র শক্তি। জগতের আড়ালে কেমন বসে

আছেন। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় আলোর খেলা খেলছেন। মুঠো মুঠো ছুঁড়ে দিচ্ছেন মহাকাশে, গ্রহ, চন্দ্র, তারা। ওই দেখ, দেখ। তোমার কী ভাগ্য! গুহার বাইরে তিন দেবশিশু। আজ এসেছে, আজ এসেছে।

আশ্চর্য!

তুমি দেখতে পাচ্ছ তো?

ওই তো। কোথা থেকে এল?

গুহার ভেতরে বসে আছেন যে সাধক, তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে এসেছে তিনটি কাল–

অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। তিনটিই শিশু। দেহ দিয়ে আমরা কাল মাপি–আমার শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য। আসলে এসব কিছুই নেই। স্তব্ধ বিশাল মহাকাল। তিনি চিরকিশোর। ওই দেখ, তিনজনে কেমন বিশাল চাতালে মহানন্দে ছোটাছুটি করছে!

এ কি সম্ভব?

অবিশ্বাস, অবিশ্বাস! সঙ্কারে বহু জন্মের সংসারী মানুষের প্যাঁচ। ভেতরটা জট পাকিয়ে আছে। এসো তোমাকে আমি এই পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে ঠেলে ফেলে দি। আমি খুনি। এখানে কেউ নেই। ওই দেখ, তোমার মুখটা ভয়ে কেমন যেন হয়ে গেল। শোনো, যে মানুষ সত্যকে জেনেছে সে খুন হয়ে গেছে। তার আর কোনও বোধ থাকে না, মরে গেছে, না বেঁচে আছে! কী চাও তুমি? আমার সন্ধান তোমাকে কে দিয়েছে?

এই প্রশ্ন আপনার কাছ থেকে আশা করিনি। সন্ধান দিয়েছেন ভগবান। আপনার বিশ্বাস এখনও পাকা হয়নি। কিছু অলৌকিক শক্তি পেয়েছেন, এই মাত্র।

হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। একেবারে ঠিক। তুমিই তাহলে আমার গুরু।

আবার ভুল করলেন। একমাত্র গুরু ভগবান, সচ্চিদানন্দ। কেউ কারও গুরু নয়। তিনি যাকে কৃপা করবেন, যখন করবেন।

বাঃ, বাঃ, এই তো, এই তো, আমার সন্দেহে তোমার বিশ্বাস বেশ পাকা হয়েছে। তুমি এই জ্ঞান পেলে কার কাছ থেকে? তুমি আলোকিত হয়েছ। তিনি একই সঙ্গে জ্ঞানী ও ভক্ত। তিনি বেলুড় মঠের প্রবীণ সন্ন্যাসী। তিনিই আমাকে শ্রীরামকৃষ্ণের জগতে নিয়ে গেছেন। তিনি কত সহজ, কত উদার! আমি ওই মহাপুরুষের আশ্রয়ে বেশ কিছুদিন ছিলুম। সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলুম। তিনি এক কথায় বলে দিলেন, শান্ত, সুন্দর, পবিত্র গৃহী হও। ঠাকুর চলে যাওয়ার পর গৃহীর বড় অভাব। শ্রীহীন পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। সমাজ দূষিত হচ্ছে। জানি না, তিনি আমার স্বভাবে, সংস্কারে কি দেখেছিলেন। তবে এ-ও ঠিক, আপনি একেবারে অন্যরকম রহস্যময়। আপনার আসল দিকটা ধরা যাচ্ছে না।

আরে আমিই কি জানি কি হয়েছে আমার? আমার তো জেলে থাকার কথা। আমি তো আসামি! এই দেখ তোমার মুখের চেহারা বদলে গেল। ঘৃণার ভাব।

ভুল করলেন। আপনার পড়াটা ঠিক হল না। আমি খুনিদের ডেরা থেকে পালিয়ে এসেছি। মিথ্যা অপরাধে আমাকেও ফাঁসানো হত। সে খবরও আমি পেয়েছি। ওই সব বলে আমাকে আর পরীক্ষা করবেন না। একটু আগে পাহাড়ে ওঠার সময় আমি অনুভব করেছি আমি উঠছি না, অদৃশ্য শক্তি আমাকে নিমেষে এই পাথরের চাতালে তুলে দিল। আপনি কোথায় কোন শ্মশানে, কোন গুহায় সাধনা করেছিলেন?

তুমি একটি আধুনিক ছেলে, কি সাধনা, সাধনা করছ। ভোগের দুনিয়ায় চুটিয়ে ভোগ করো, বুড়ো হয়ে মরে যাও। আমিও মরে গিয়েছিলুম, এটি একই শরীরে দ্বিতীয় জীবন। ভাবছ গাঁজাখুরি গল্প! তা ভাবতে পারো। বিশ্বাস তো মনেরই একটা স্তর।

ওই যে বললুম, আপনি এক রহস্য। আমরা গুহায় ঢুকে মহাপুরুষকে দেখব না?

এমন কিছু ঘটবে, যাতে তুমি ভীষণ ভয় পাবে। তুমি তাঁর বালক রূপ দেখলে। তিনি কৃপা করে দেখালেন। আজ এই পর্যন্ত থাক। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, তিনি ওই গুহায় নেই, বসে আছেন তোমার পাশে! না, না, ভয় পেয়ো না, আশ্চর্য হয়ো না। হতে পারে, এমন হতে পারে। তুমিও তো একদিন বালক ছিলে, সেই বালকটা কোথায় গেল? তুমি খুন করেছ? এই, এই, দেখেছ আমরা সবাই খুনি। অদৃশ্য খুনি। বিচার হবে না কোনও আদালতে।

আপনি আমার মাথাটা খারাপ করে দেবেন। এইবার আমার সত্যি সত্যি ভয় করছে।

ভয় নেই। তুমি নিরাপদ। এসো, বসা যাক।

আমরা গুহার ভেতরে যাব না?

ভেতরে যাব কেন? ওই তো তিনি এখন পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, দেখতে পাচ্ছ না?

অনেকটা উঁচুতে, ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো। ওখানে কেন? ওখানে নয় কেন?

ঠিক ঠিক। বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলেছি।

আমরা যে স্তরের মানুষ, সেই স্তরে শুধুই কার্য-কারণ। কারণ ছাড়া কাজ অকাজ। উনি ভগবানের মতো নিঃসঙ্গ। সেইটাই উপভোগ করছেন। কেউ কোথাও নেই শুধু আমি আছি। উরেব্বাপরে! ভাবা যায়! পাগল হয়ে যাবে, আত্মহত্যা করে ফেলবে। ভগবানের মন আর। মানুষের মনে অনেক তফাত। তাঁর ভেতর থেকে হু-হুঁ করে কত কি বেরিয়ে আসছে। ওই দেখ, দু-হাত মেলে বুক চওড়া করে কেমন দাঁড়িয়ে আছেন। বড় বড় সাদা চুল, দাড়ি। বাতাসে বুকের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে। দেহ নেই, তাই মৃত্যুভয় নেই।

ওটা তাহলে কী?

আকার।

তার মানে বাষ্প, ধোঁয়া?

আলো হতে পারে, ছায়াও হতে পারে। জড়িয়ে ধরলে দেখা যাবে কিছুই নেই।

মরীচিকা?

তাও হতে পারে। যোগীরা কখন কী করে বসবেন কে বলতে পারে? ওই গুহায় খবরদার ঢুকো না। ওখানে মাঝে মাঝে একটা বাতাস আসে, অজগরের শ্বাস। তোমাকে টেনে নেবে। ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। একদিন আমাকে এই পাথরের ওপর বসে থাকতে বলে আমার গুরুদেব ওই গুহায় প্রবেশ করলেন, আর বেরুলেন না। আমি বসেই রইলুম। তিনটে দিন কীভাবে কেটে গেল। একদিন শেষ রাতে একটা কঠিন আদেশকানে এল, বসে আছিস কেন?যা দেওয়ার দিয়েছি, এবার নিজের পথে এগিয়ে যা। আমার ওই কুঠিয়ায় থাকবি। একদিন ওটাও থাকবে না। তখন পথই বলে দেবে পথ। কালের চিন্তা কালই করবে। আমাদের পথে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। সময়ের বাইরে যাওয়াই আমাদের সাধনা। আমি তো সেই জায়গাটায় যেতে পারিনি। ও কি সহজ নাকি? দেহ আছে মৃত্যু নেই, জন্ম নেই। এই শরীরটাও তো একদিন জন্মেছিল, একটু একটু করে বেড়েছে। সবকটা ইন্দ্রিয়ের তোড় সহ্য করছে, তাহলে?

আশ্চর্য! আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন? আমার কাছে সব কিছুই তো দুর্বোধ্য। আমি জানি, আমি মরার জন্যে জন্মেছি। যে জগতে সবাই বেঁচে আছে, সেই জগতেই আমিও আছি। দিন আর রাত ঘুরে ঘুরে আসছে। বয়েস বাড়ছে।

সে ঠিক আছে; কিন্তু, তুমিই বা এখানে কেন? আমিই বা এখানে কেন? ওই হরিদ্বারের গঙ্গার ধার। সম্পূর্ণ অচেনা একজন। ওঠো, চলো আমার সঙ্গে। এ-পথে অনেকে গেছে। তুমিও চলো। এ কোনও মন্দিরে যাওয়া নয়। জগতের এক স্তর থেকে আর-এক স্তরে যাওয়া। যেমন ফলের পোকা! ক্রমশ ঢুকছে। গভীরে, আরও গভীরে। হরিদ্বার যেন উঠান। হাজার মানুষের মিলন। কোনও ভয় নেই। যে মানুষ এসেছিল, সেই মানুষই ফিরে চলল। কিন্তু, ওখানে ফাঁদ পাতা আছে। সেই ফাঁদে পড়লে তোমার মুখ ঘুরে যাবে। জগতের সব শাস্ত্র সেখানে অচল। পৃথিবীর কোনও ঘড়িতে সেখানকার সময় ধরা যাবে না। সবাই চলছে, যাচ্ছে না কোথাও। দেখলে না, গুহা থেকে তিনটি বালক বেরিয়ে এসেছিল।

সব, সব আমি শুনছি। কয়েকদিন ধরে শুনছি, আর আপনাকে দেখছি। আপনি খাবো বলে খাচ্ছেন না, ঘুমোব বলে ঘুমোচ্ছেন না, অথচ কী সুন্দর আছেন! এই অদ্ভুত অবস্থায় এলেন কী করে? এই স্বাধীনতা! এ তো শুনে বা পড়ে হয় না।

তা হলে স্থির হয়ে বসে শোনো কী হয়েছিল? আমি শহর কলকাতার মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। জ্ঞান হওয়া থেকেই শুনছি–লেখা, পড়া, পরীক্ষা, পাশ, চাকরি, টাকা, বিয়ে, ছেলেপুলে, সংসার। এর বাইরে বিশেষ কিছু নেই। দম দেওয়া কলের পুতুল। দম দিয়ে ওই পেটাই করা লম্বা রাস্তায় ছেড়ে দাও। গড়গড় করে চলবে। দম হল টাকা। পালিশ হল গোটাকতক ডিগ্রি। বা, বা, বেশ যাচ্ছে, বেশ যাচ্ছে। তালি বাজাও, তালি বাজাও। গুড বয়, স্বার্থপর বয়, শয়তান বয়। আদর্শ বলে কিছু আছে কি? আদর্শ আবার কী? মেয়ে ধরে, খামচাখামচি করে বেঁচে থাকো। দরকার হলে মিথ্যে কথা বলো, ক্ষমতাশালীকে তেল দাও। মোসায়েবি করো। কাজ আদায় হয়ে গেলে স্রেফ ভুলে যাও। এইভাবেই বেশ চলছিল। হঠাৎ একদিন বাস থেকে নামতে গিয়ে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে গেলুম। কেউ আমাকে পেছন থেকে জোরে ধাক্কা মেরেছিল। তারপরে কী হল আমি জানি না। ব্রেক কষার বিকট শব্দ। কিছু চিৎকার। এর পর যখন জ্ঞান হল, দেখলুম, পথের ধারে একটা ঝুপড়িতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। একটি মেয়ের মুখ আমার মুখের ওপর ঝুঁকে। আমার ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে হাওয়া পুরে দিচ্ছে। চোখ চাইতে দেখে বলল, বেঁচে গেছে, বেঁচে গেছে। সুন্দর ধারালো মুখ, পাতলা খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট, এলো চুল আমার মুখের ওপর ঝুলে আছে। যুবতী। আমার মাথাটা তার কোলে।

আমার নাকি প্রাণ ছিল না। পেছনের একটা গাড়ি আর একটু হলেই আমাকে শেষ করে দিত। সবাই মিলে ধরাধরি করে আমাকে তুলে এনেছে। মেয়েটার মধ্যে অলৌকিক একটা শক্তি ছিল। শিবের ভক্ত। প্রত্যেক বছর বাঁক নিয়ে তারকেশ্বরে যায়। তার শক্তির কথা। সকলেই জানে। সবাই সমীহ করে। যে-কোনও বিপদে মানুষ তার কাছে আসে। ঝকঝকে দুটো চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। বেশ বুঝতে পারলুম, আমার ভেতরে কিছু আসছে। তার শ্বাসে ছিল কর্পূরের গন্ধ। আমার মনে হল, এই মেয়েটিকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না। আমার নতুন জন্ম হয়েছে। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে। আদানপ্রদান। কোনও কথা বলতে পারছি না। শব্দ বেরোচ্ছে না। তাকিয়ে আছি সেই রমণীর দিকে। জ্যান্ত মা দুর্গা। সাদা কাঁচুলি। হালকা নীলরঙের পাতলা শাড়ি। সাজিয়ে দিলে সিংহাসনে মহারানি। কালো কুচকুচে চুল পিঠ ছাপিয়ে কোমর পেরিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে উঠে বসলুম। মাথা ঘুরছে। মালভরতি একটা বড় বস্তায় ঠেসান দিয়ে বসলুম। সারা শরীরে ব্যথা। হাঁটু দুটোয় বেশি লেগেছে। হাতের তালু দুটো জখম। দুজনে মুখোমুখি বসে আছি। দেখছি, শুধু দেখছি। সে জিগ্যেস করলে, কোথায় থাকো?

কী আশ্চর্য! আমি সব ভুলে গেছি। অতীত মনে পড়ছে না। নাম ভুলে গেছি। জিগ্যেস করলুম, কী হয়েছে আমার?

তুমি মরে বেঁচ্ছে। তোমার নাম কী?

এইবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেলুম। নাম মনে পড়ছে না। সর্বনাশ! ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঘুসের টাকার পাহাড়। কাগজপত্তর। পকেটে অনেক টাকা। সঙ্গে এমন কোনও কাগজ নেই, যা দেখে বলতে পারি, নামধাম ঠিকানা। মেয়েটি খিলখিল করে হাসছে আর বলছে, সাধে লোকে আমাকে নাগিনী বলে। আমার ছোবলে বিষ আছে। আমার লালার রং নীল। মুখে ঢুকলে ঘোর হয়। ভর হয়। আমি কী করব? আমার কী করার আছে? সব বাবার কৃপা। সেই বললে কি হয়েছিল আমার। এই মেয়েটি সেই সময় রাস্তা পার হচ্ছিল। যে গাড়িটা আমাকে পিষে দিতে পারত, সেটার টায়ার ফেটে গেল। আমাকে ধরাধরি করে এখানে তুলে আনা হয়েছে। বললে, কোথায় আর যাবে! আমার সঙ্গে নিমতলার শ্মশানেই চলল, এখন। সেখানেই আমি থাকব কিছুদিন। তোমার একটা লক্ষণ আমার ভালো লেগেছে, যা খুব কম। মানুষেই থাকে। তোমার জিভের ডগাটা চেরা। তুমি যদি কারোকে কামড়াও সে মরে যাবে। আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। সে বললে, তোমার পূর্বজন্মের কোনও একটি তোমার ভেতর এসেছে। যেটা ছিল সেটা তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

ঝুপড়িতে কেউ নেই। সে আর আমি বসে আছি। পেছন দিকে অনেকটা জংলা জায়গা তারপর এক জোড়া রেললাইন। তারপর জমিটা ঢালু হয়ে গেছে একটা জলায়। একটা ভয়ের জায়গা। তাকালেই মৃত্যুর চিন্তা আসবে। প্রেত-পিশাচে গলা টিপে ধরছে। রক্তচোষা বাদুড় এসে গলায় দাঁত ফুটিয়ে রক্ত শুষে নিচ্ছে। মেয়েটি আমার খুব কাছে সরে এসে বললে, আমার সঙ্গে যাবে? তোমার খোঁজ তো ওরা করবেই, তোমার বাড়ির লোক। হাসপাতালে যাবে, থানায় যাবে, কাগজে কাগজে ছবি ছাপবে। তখন তো তুমি ধরা পড়ে যাবে। তা হলে?

নিজেকে কেমন শিশুর মতো অসহায় মনে হল। পূর্বস্মতি একেবারে মুছে গেছে। অন্য স্মৃতি জাগছে। পরিষ্কার ধুতি, গোল গলা ফতুয়া পাঞ্জাবি, কাঁধে পাট করা সাদা চাদর, পায়ে চটি, আমি সেরেস্তা থেকে ফিরছি একটা ফিটনে চেপে। একটা নাম বারে বারে মনে পড়ছে সুধা। সুধা কে?নদীর ধারে বাগানঘেরা বাড়ি। পাশেই কালীমন্দির। ঘোরটা কেটে যেতেই বললুম, আমি তোমার। এমন জায়গায় নিয়ে চলো যেখানে আমাকে কেউই খুঁজে পাবে না। কিন্তু তোমাকেও যদি ভুলে যাই?

তা ভুলবে না। জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে এইবার যা-যা হবে সব মনে থাকবে।

নাম কি হবে? ঠিকানা কি হবে?

সন্ন্যাসীর ওসব থাকে না।

আমি তো সন্ন্যাসী হইনি।

হবে।

যে বস্তাটায় ঠেসান দিয়ে বসেছিলুম তার মধ্যে তুলো আর কাপড় দিয়ে জড়ানো ছিল মড়ার মাথা, হাড়গোড়। পঞ্চমুন্ডি আসনের জিনিসপত্র। সেইটা তুলে নিয়ে বললে, চলল। হাঁটতে পারবে? নিমতলা শ্মশানের উত্তর পাশে একেবারে গঙ্গার ধারে একসার কাঠের গুমটি ঘর। তারপরই যত কাঠ আর বাঁশগোলা। জায়গাটা খুবই অপরিষ্কার। বেশি আলোও নেই, অন্ধকার, অন্ধকার। বাতাসে চিতার গন্ধ, ফুলের গন্ধ, দিশি মদের গন্ধ। ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছিল, অনেকদিনের পরিচিত জায়গা। সব যেন চেনা চেনা। মাথাটা ভারী হয়ে আছে। নাকটা থেবড়ে গিয়েছিল। মনে হয় ফুলে গেছে। জোর করে টেনে টেনে শ্বাস নিতে হচ্ছে। অদ্ভুত লাগছিল, আমি কে জানি না। অথচ হাঁটছি, কথা বলছি, গা ছমছম করছে, আবার মেয়েটির খুব কাছে থাকতে ভীষণ ভালো লাগছে। দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। আলো জ্বলল। ঘরে কিছুই নেই। কাঠের মেঝের ওপর একটা মাদুর পাতা। গঙ্গায় জলের শব্দ। শ্মশানের দিকে বহু মানুষের কলরব। হরিধ্বনি। চিতায় চিতায় কাঁচা কাঠ। ভল ভল করে ধোঁয়া উঠছে। আলো পড়েছে। মহাদেবের জটার কুণ্ডলী। খুব ক্লান্ত লাগছিল। মাদুরে শুয়ে পড়লুম। মেয়েটি দরজা বন্ধ করে, আলো নিবিয়ে আমার পাশে শুয়ে পড়ল। নিচু গলায় আদেশ করলে, কেউ আসবে না, জামা-টামা সব খুলে ফেলল। রাস্তার ধুলো, ময়লা, রক্ত, জল সব লেগে আছে। আমিও সব খুলে ফেলছি। তোমাকে অনেকটাই বলে ফেললুম, আর না। এইবার নামার চেষ্টা। ওপর পাহাড়ে মেঘ জমেছে। জোর বৃষ্টি হবে, তখন এই চাতালের ওপর দিয়ে এত বেগে জল ছুটবে, আমরা ভেসে যাব। পাহাড়ে খুব সাবধানে, হিসেব করে। চলতে হয়। পদে পদে মৃত্যু। তুমি আগে নামো, আমি পেছনে আছি। ঝুঁকে নামবে না। পেছন দিকে শরীরটাকে টেনে রাখো, একটুও ভয় পাবে না। আমি আছি।

গুহার ভেতরে শব্দ হচ্ছে।

ভেতরে নয়, জল নামছে। নামো নামো। কুইক, কুইক।

হড়কে, হড়কে প্রায় ধপাস করে নীচে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কোমরে অদৃশ্য একটা দড়ি বাঁধা রয়েছে। রাস্তা ঢালু হয়ে কিছুটা নামার পর আবার ওপর দিকে ঠেলে উঠছে। একেবারে উঁচুতে আমাদের সেই খাবার জায়গা। আকাশ আজ তেমন পরিষ্কার নয়। দূরে। গভীর খাদ কুয়াশায় চাপা পড়ে গেছে। ওপরের আলো সব নীচে নেমে এসেছে। পথটা তাই ভীষণ স্পষ্ট। বড়-ছোট পাথরগুলোকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। ঠান্ডাও খুব। যে কথা বলছে, তারই মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। পাশ দিয়ে কে একজন ঘোড়ায় চেপে ওপর দিকে চলে। গেল। ধাবার মেয়েদের আজ যেন আরও ফর্সা দেখাচ্ছে। গালগুলো সব টাটকা আপেলের মতো লাল। মেয়েরা সব অপ্সরী। সেই তুলনায় পুরুষরা সব কাঠখোট্টা। মুখগুলো ফাটা ফাটা। কপালে বয়েসের ভাঁজ। মেয়েরা সব দশভুজা। খাটুনির শেষ নেই। নীচের নদীটা আজ রহস্যের আড়ালে। জলের শব্দ বেড়েছে। এক ধরনের সাদা ফুলে কিছু কিছু গাছ ছেয়ে গেছে। একেই বোধহয় বলে মন্দার। কয়েকটা পাখি উঁচু ডালে বসে বিষণ্ণ ডাক ডাকছে।

আপনি তখন থেকে একেবারে চুপ। কি ভাবছেন?

বুঝলে, আমি শেষ আদেশের অপেক্ষায় আছি।

সে আদেশ আসবে কোথা থেকে?

আসবে, আসবে। ঘড়ির মতো নিষ্ঠাবান, মনোযোগী হতে হবে। এক মুহূর্তের জন্যেও টিক টিক ছাড়ে না। কোনও ফাঁক নেই। সরু একটি সুতোও গলাতে পারবে না। খড়খড়ে কাঠের বেঞ্চি। কাঠ খুব পবিত্র। সব কাঠেই আগুন আছে। সবই জলেই স্নিগ্ধতা। আবার বিদ্যুৎও আছে। কিশোরী মেয়েটি দু-গেলাস চা দিয়ে গেছে। রান্নার জায়গায় কর্মযজ্ঞ চলছে। হিমালয়ের মশলায় অন্যরকম সুগন্ধ।

আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনি অনেক অতীতের কথা বলেছেন, আপনার সম্পর্কে লোকের ধারণার কথা বলেছেন, জীবিকার কথা বলেছেন। সেও সবই আপনার প্রথম আমি। তারপর বিস্মৃতি। দ্বিতীয় আমির শুরু। ওই স্মৃতি তো মুছে যাওয়ার কথা। মৃত্যুর পর কিছু মনে থাকে না। থাকে জাতিস্মরদের। তা হলে?

ঠিক। এ প্রশ্ন তুমি অবশ্যই করতে পারো। উত্তরও পাবে, তবে তার আগে আমার কাহিনি আরও কিছুটা বাকি আছে। এখন আমরা দুপুরের খাওয়াটা গরম গরম খেয়েনি। আজ আর বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যাবে না।

জীবনে এক একটা সময় আসে যে সময় খাবার ঝোঁকটা অনেক কমে যায়। কনখলের বটতলায় নিরঞ্জনী সাধুদের আখড়ার পাশে এই উদাস মানুষটির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে জীবনটা ক্রমশই পালটে যাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজন সকলের কথাই ভুলতে বসেছি। এখন একমাত্র তুলসীই স্পষ্ট। তাও এক তরফা। তুলসী আমাকে মনে রাখবে কেন? ঠিক সময়ে পণ্ডিতমশাই তার বিবাহ দেবেন। পণ্ডিতমশাইয়ের বয়েস হচ্ছে। সংস্কৃত আর কেউ তেমন শিখবে না। টোল উঠে যাবে। জমিদারিও গুটিয়ে আসছে। জমিদারবাড়িটা খুব সুন্দর ছিল। খিলানের পর খিলান। ঘরের পর ঘর। বড় বড় দালান। লম্বা লম্বা বারান্দা। জাফরি। রোদ পড়লে জাফরি মেঝেতে নকশার ছায়া ফেলত। ঘরে ঘরে দামি আসবাবপত্র। সব মেঝেই মার্বেল পাথরের। এক-একটা অংশ এতটাই নির্জন, দিনের বেলাতেও ভয় করত। সুন্দর। গোপাল-মন্দির, শিবমন্দির, রাধামাধব। বাড়িটা কিন্তু পাপে ভরা। গণিকারাও বেশি রাতে আসত কারও কারও লালসা মেটাতে। বেশিরভাগ মানুষ কামুক। ভোলা মালি নয়, ভোলা ভয়ংকর। ফুলের বাগানে রক্তমাখা ছুরি হাতে ঘোরে। ছোটবাবুর যত অপকর্মের সহকারী। মস্ত বড় একটা মিনার্ভা গাড়ি সদরে। সেই গাড়িতে চেপে নায়িকারা আসে। এই ভোলাই হয় তো একদিন তুলসীকে তুলে আনবে, আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা ঘর আছে, মদের ঘর। সেই ঘরের মেঝেতে দুপুরবেলায় আমি মাতাল সুন্দরীকে পড়ে থাকতে দেখেছি। মাইনে করা ফটোগ্রাফার ছবি তুলছে। শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশ অনাবৃত করে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি। মেঝেতে আমার পা আটকে গেছে। পরে নিজের দুঃসাহসকে তিরস্কার করেছি। ধরা পড়লেই জ্যান্ত কবর। প্রশ্ন করেছি, তোর এত কৌতূহল কেন? উপন্যাস লিখবি?

হঠাৎ এক ঝলক রোদ? চারপাশ যেন খলখল করে হেসে উঠল। কুয়াশা পালাবার পথ পাচ্ছে না। দূরে অন্নপূর্ণা রেঞ্জ। এভারেস্টের চূড়া দেখা যাচ্ছে। পেছন থেকে মাথা তুলে আছে। এ ডাকছে কুংকু, ও ডাকছে কুংকু। হলুদ পোশাক পরা মেয়েটি চরকিপাক খাচ্ছে। এতটুকু বিরক্তি নেই তার। সব সময় একটা সুর গুনগুন করছে। এরই ফাঁকে আমাকে একটা সাদা। ফুল উপহার দিয়ে গেল। কাজ করতে করতে দূর থেকে দেখছে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। কিছু বলতে চায় ফোঁটা ফুলের ভাষায়। আমি বিদেশি হলেও ফুলের ভাষা সর্বত্র এক।

কুংকু তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কদিন থেকে দেখছি। ষোলো থেকে কুড়ি বসন্তকাল। তিরিশের পর পাতা ঝরা। তারপর বরফ। শ্বেত ভল্লুক। ঝাঁপসা কুয়াশা। সব পাতা ঝরে। গেছে। আঁকাবাঁকা সরু সরু ডাল। তখন অন্য ভাষা, ভিন্ন সুর। ওকে নিয়ে একদিন বেড়াতে যাবে ওই ওপরে, চমৎকার একটা জায়গা আছে পাথরের আড়ালে, একেবারে আকাশের গায়ে। হৃদয়ে হৃদয় ঠেকিয়ে নারীর বুকের ভাষা শুনবে। সেই একই কথা আদি থেকে অন্তে।

আপনি কবিতা লিখতেন?

না, কখনই না। ভীষণ বিষয়ী, স্বার্থপর, ভোগী।

যাক, নিজেকে চিনতে পেরেছেন! কজন পারে!

কুংকুই খাবার নিয়ে এল। গরম ধোঁয়া ছাড়ছে। আজ তার সাহস বেড়েছে। যাওয়ার সময় এমন ভাবে ঘুরল, যাতে তার পেছনটা আমার কাঁধে ঠেকে যায়। এ আমার কি নিয়তি! জমিদারবাড়ির মন্দিরে রোজ সন্ধ্যারতির সময় ইচ্ছে করে আমার পা মাড়িয়ে দিত। একদিন আমার জামার পকেটে অজ্ঞাতে একটা কাগজের টুকরো ঢুকিয়ে দিয়েছিল। লেখা ছিল বোকচন্দর। আমার মা নেই। থাকলে জিগ্যেস করতুম, মা, ওরা কেন এমন করে!

কুংকু গরম ডাল এনেছে। আকুল করা গন্ধ। যাবার সময় আরও সাংঘাতিক কাণ্ড করে গেল। একটা চামচে ইচ্ছে করে মেঝেতে ফেলল, তারপর তোলার সময় হাঁটুতে হাতটা রেখে ঝট করে তুলে নিল। কীসের ইঙ্গিত! এত বড় একটা পৃথিবীতে ছোট্ট এতটুকু একটা ঘটনা। পৃথিবীতে কত বড় বড় শব্দ; তার মধ্যে ছোট্ট টুনটুনির এতটুকু ঠোঁটের টুইট টুইট শব্দ কান কেড়ে নেয়।

ঝলমলে রোদই যখন উঠল, আমরা তখন একটু নীচের দিকে নামতে পারি তো?

সবই আপনার ইচ্ছে। আমার ইচ্ছে বলে কিছু নেই।

যথেষ্ট ভেবেচিন্তে বলছ তো?

একেবারে।

নীচে ছোট্ট সুন্দর একটা বাজার আছে। পাহাড়ের ওপর থেকে দুধের ধারার মতো ওই যে ঝরনাটা নামছে, ওখানে ভারি সুন্দর ছোট্ট একটা নদী হয়েছে। সেই নদীর ধারে একটা। পাহাড়ি গ্রাম। মানুষগুলো খুব ভালো। কতরকমের সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করে। হাতের কাজ। এখানে মানুষের খারাপ হওয়ার উপায় নেই, উপাদান নেই। কিছু নেশা-ভাঙ আছে। তা থাক। মহাদেবের দান। জায়গাটা আমার ভালো লাগে। ওখানে তন্ত্র আছে। পার্বতীরা আছেন। তাঁদেরই আধিপত্য, শাসন। ভৈরবদের হম্বি-তম্বি করার উপায় নেই। মা কালীর তারার রূপ। শিবের বুকে চড়ে বসে আছেন। বড় রহস্যময় জায়গা। গেলেই বুঝতে পারবে। মহাভারতের যুগে ওখানে কি হত কে জানে!

প্রায় আধঘণ্টার উতরাই পথ। সত্যই সুন্দর। তাসের ঘর-বাড়ি। সুন্দর সুন্দর রং। সরু সরু পথ ভেতর দিকে, নদীটার দিকে চলে গেছে। কলকল, খলখল শব্দ। ছোট ছোট তাঁতে স্কার্ফ বোনা হচ্ছে। অপূর্ব রঙের বাহার। পুরুষের দেখা নেই। মেয়েদের রাজত্ব। চতুর্দিকে শক্তির খেলা।

এসো, খুব ভালো দেখে একটা স্কার্ফ কিনি।

কার জন্যে?

তোমার জন্যে।

আমি কী করব?

দেবে। একজনকে উপহার দেবে। তোমার প্রেমিকাকে।

আমার প্রেমিকা? সে কে?

তুমি অন্ধ নাকি? দেখতে পাও না! তার নাম কুংকু।

কি বলছেন আপনি।

একটু আগে কি বললে? আমি যেমন চালাব। কুংকুর সঙ্গে তোমার বিবাহ দেব।

এ আপনি কি বলছেন? এদের সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি সব আলাদা। এরা আমাকে গ্রহণ করবে কেন?

প্রেমের একটিই ভাষা, একটাই জাত, একটাই বিধান, অভিধান, একটিই কথা, ভালোবাসি। আবির্ভাব মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায় নয়, মানুষের অন্তরে, নদীর গর্জন নয়, ছোট ছোট তরঙ্গ, বিরাট বিরাট পাথর, ছোট ছোট রং-বেরঙের নুড়ি। ঝড় নয় পাতা কাঁপানো ছোট ছোট বাতাস, তোমার, আমার শ্বাসের মতো। ঘাড় ছুঁয়ে যায়, গলার কাছে খেলা করে। পাতলা দুটো ঠোঁটের তুলি-স্পর্শ, মৃদু দংশন। শরীরে কদম্বের জাগরণ। অত বড় নারায়ণ ছোট্ট একটি শালগ্রাম। মানুষের ভালোবাসায়, কুরুক্ষেত্রের গোপাল, যোদ্ধা শ্রীকৃষ্ণ, গৃহমাতার কোলে, চুকচুক করে দুধ খাচ্ছেন। ওহো! অধিক উচ্ছ্বাস ভালো নয়। দেখো, এই শালটা কি তোমার পছন্দ?

খুব সুন্দর।

আর তোমার জন্যে এই টুপিটা?

অপূর্ব! আর আপনার জন্যে এই সুন্দর চাদরটা?

পকেটে হাত ঢুকিও না। তোমার সঙ্গে আমার একটা অদ্ভূত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যদিও আমি তোমার নাম জানি না, তুমিও আমার নাম জানো না।

আপনার নাম সম্ভবত আমি জানি, প্রবোধ।

আশ্চর্য! কি করে জানলে?

গভীর রাতে আপনার কাছে অনেকে আসেন। মজলিশ বসে যায়। সে এক অন্য জগতের ব্যাপার। আপনাকে প্রবোধবাবু, প্রবোধবাবু বলে ডাকেন।

তুমি শুনতে পাও?

স্পষ্ট।

সে কী? তাহলে তুমি অনেকটা এগিয়ে আছে।

বিয়ে করা কি উচিত হবে!

আমি করেছি–পার্বতী আমার গুরু, আমার সহধর্মিণী। আমাকে সে গিলে ফেলে উগরে দিয়েছে। যেমন পার্বতী মহাদেবকে করেছিলেন।

আমার ভয় করছে। প্রথম কথা আমি আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। দ্বিতীয় কথা, আমার তো কোনও রোজগার নেই।

তোমরা আমার কাছেই থাকবে। তোমরা নীচে, আমি ওপরে। আর রোজগার? ওই দোকানের তুমিও একজন অংশীদার, কর্মী হবে। কত টাকা চাই? একবস্তা, দু-বস্তা। শঙ্কর! মেয়েটা দেবী। পরে বুঝবে।

আপনি আমার নাম জেনে ফেলেছেন?

এ আশ্চর্যের কিছু নয়। একদিন তুমিও পারবে।

আমাকে তো কিছুই করালেন না!

আমি তো তোমাকে দিয়ে যাব। তোমার কিছু করার দরকার নেই। আমার মতো জীবন-মরণ কষ্ট তোমাকে করতে হবে না। তুমি ভালোবাসো। ওর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সাধনা আর নেই। আজ পূর্ণিমা। ওই জায়গাটার মাথার ওপর থালার মতো চাঁদ। রুপোলি আলোর বন্যা। সেই আলোয় সবাই চকচক করছে। রং-বেরঙের পোশাক। গরম গরম খাবার ধোঁয়া ছাড়ছে। মশলার গন্ধ। চাঁদের পাশ দিয়ে সাদা পক্ষীরাজের মতো ভেসে যাচ্ছে হালকা একখণ্ড মেঘ। তোমাদের নিয়ে আজ আমরা খুব আনন্দ করব। মানুষই হাসে, মানুষই কাঁদে। ভগবানের সুখ-দুঃখ নেই, তাই তাঁর কিছু নেই। সাক্ষী পুরুষ। তুমিই মরবে, তুমিই বাঁচবে, তুমিই কাঁদবে, তুমিই হাসবে। প্রেমও তোমার, ঘৃণাও তোমার। তোমারই রোগ, তোমারই আরোগ্য। পাহাড় ঘেরা মধ্যপ্রদেশের ভীষণ অরণ্যে পার্বতী আমাকে বারোটা বছর সাধন করিয়েছে। তিন-তিনবার আমাকে সাপে কামড়েছে, তিনবারই পার্বতী আমার বিষ তুলে নিয়েছে। কাঁপালিকরা মহাকালের কাছে আমাকে বলি দিতে চেয়েছে। পার্বতী রক্ষা করেছে। অঘোরীরা আমার দেহ খণ্ড খণ্ড করতে চেয়েছে। পার্বতী চামুণ্ডা মূর্তি ধরে আমাকে রক্ষা করেছে। প্রেত পিশাচের দুনিয়ায় কুণ্ডলিনীর শক্তি ছাড়া তুমি এগোবে কি করে! সব শেষে এই হিমালয়।

তখন আর দেহ নয়, মন। পার্বতী কামরূপ-কামাখ্যার বজ্রযোগিনী। বৌদ্ধ-তন্ত্রে সিদ্ধা। মারণ, উচাটন-বশীকরণ, কামকলা তার আয়ত্তে। তার বশীকরণ শক্তিতে আমার স্মৃতি যেমন লোপ পেয়েছিল, আবার ফিরে এল শুধু এক জন্মের নয়, জন্ম-জন্মান্তরের স্মৃতি নিয়ে। কাল কী হয়েছিল এটা মনে রাখা অতীত জ্ঞান নয়। পূর্বজন্মই অতীত, পরজন্মই ভবিষ্যৎ। পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকারকে টেনে বের করে আনাই ডাকিনী বিদ্যা। তোমাকে বলিনি আগে, আজ বলছি, আমি হাততালি দিলে, যে শুনবে সে-ই সম্মোহিত হবে। সব ভুলে যাবে। যেটুকু মনে করাব, সেইটুকুই মনে পড়বে। দশমহাবিদ্যার সমস্ত রূপ পার্বতী আমাকে দেখিয়েছে। ক্ষুদ্র, সঙ্কীর্ণ সংসারে আমার স্থান হল না। আমার শেষ গতি ওই গুহায়। তোমাকে কেন যেতে দিইনি জানো, ঢুকলে আর বেরোতে পারবে না। তুমি এখনও যুক্তিবাদী, প্রচলিত বিজ্ঞানেই বিশ্বাসী। স্বাভাবিক। এখনও জীবনের অনেকটাই তোমার দেখা বাকি। যে-অরণ্যে আমাদের বারোটা ভয়ংকর বছর কেটেছে, সেখানেই মহাভারতের কালে মহামুনি বশিষ্ঠদেবের আশ্রম ছিল। শঙ্করাচার্য সাধনা করেছিলেন। এইখানেই অঘোরীরা তারা দেবীর শিলায় তাঁকে বলি দিতে গিয়েছিল। শঙ্কারাচার্যের অতি প্রিয়, অনুগত শিষ্য পদ্মপাদ তাঁকে রক্ষা করেন। পদ্মপাদনৃসিংহের উপাসক ও সিদ্ধ ছিলেন। তিনি নৃসিংহ মূর্তি ধারণ করে অঘোরীদের চক্র তছনছ করে দিয়েছিলেন। বর্তমান মুছে যায়, অতীত মোছেনা। বর্তমান অতীতে স্থায়ী হয়, তখন গল্প নয়, কল্পনয়, ইতিহাস। এত বড় ভূমিকার পর সেই অবিশ্বাস্য কথাটা বলি, ওই গুহার মধ্যে বুদ্ধদেবের আসন। অমিতাভ বুদ্ধ। তিনি আসেন, আবার চলে যান, আবার আসেন। কেউ জানেই না, ওখানে একটা গুহা আছে। কেউই আমাদের ছেড়ে চলে যাননি, বুদ্ধদেব, যিশু, মহাপ্রভু, পরমহংসদেব, স্বামীজি, সারদা মা, সিস্টার নিবেদিতা। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন। ডাকলেই দেখা দেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *