1 of 2

৩৯. নতুন রাজত্বের অবসান

অধ্যায় ৩৯ – নতুন রাজত্বের অবসান

১১৮৫ থেকে ১০৭০ সালের মাঝে রামসেস তৃতীয় সমুদ্রবাসীদের পরাজিত করে, কিন্তু মিশরের ক্রমাবনতি চলতে থাকে।

১৯তম রাজবংশের শেষভাগে সেতনাখতে নামে একজন পুরোপুরি অজ্ঞাতনামা রাজা মিশরের সিংহাসনে বসে সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সম্ভবত রামসেস দ্বিতীয়র নাতি ছিলেন। আবার এমনও হতে পারে তিনি হয়তো একজন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, যার অধীনে প্রচুর সেনা ছিল।

তার বংশপরিচয় যাই হোক-না কেন, তিনি মিশরের বদ্বীপে এশিয়া থেকে এসে হামলা চালানো দস্যুদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। সে আক্রমণ এতটাই সফল হয়েছিল যে তিনি এরপর সিংহাসন দখলে নেওয়ার দাবি তুললেন।

যে প্যাপিরাসে মিশরের ১৯তম রাজবংশের শেষের দিকের গণআন্দোলন বিষয়ে বলা হয়েছিল (সেতনাখতের নাতির রাজত্বের সময়ের প্যাপিরাস), সেই একই প্যাপিরাসে দাবি করা হয়, সেতনাখতে সাময়িকভাবে মিশরের সমস্যাগুলো ঠিক করতে পেরেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র অশুভ এশিয়াটিকদের বিদায় করেননি, সঙ্গে দেশে আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। তার এসব কাজের কারণে জমির দখল নিয়ে গোত্রপ্রধানদের যুদ্ধ বন্ধ হয়। তিনি দারিদ্র্যের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া মন্দিরগুলো আবারও চালু করেন এবং পূজারিদের কাজে ফিরিয়ে আনেন। প্যাপিরাসের বর্ণনা অনুযায়ী, এইসব কাজ তিনি ৩ বছরের মধ্যেই করে ফেলেন। তারপর তার মৃত্যু হয় এবং তিনি তার ছেলের কাছে সিংহাসন রেখে যান।

নতুন রাজা ‘রামসেস তৃতীয়’ নাম ধারণ করেন। এর মাধ্যমে তিনি ১০০ বছর আগে মারা যাওয়া মহান ফারাও রাজা রামসেস দ্বিতীয়র অনুকরণ করেন। এছাড়াও, তিনি রামসেস দ্বিতীয়র স্মরণে একটি মন্দির এবং আমুন দেবতার উদ্দেশে অনেকগুলো মন্দির বানান। পূজারিদের খুশি রাখতে তাদেরকে অনেক জমির মালিকানা দান করেন। তার আশা ছিল, এসব কাজের বিনিময়ে তিনি ঈশ্বরের পছন্দের মানুষ হতে পারবেন। ৩ নাম্বার রামসেসের রচিত একটি প্রার্থনায় (যেটি তার সন্তান লিপিবদ্ধ করেন) জানা যায়, ‘হে আমুন! তুমি আমাকে আমার পিতার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছ, যেমনটা তুমি হোরাসকে ওসাইরিসের সিংহাসনে বসিয়েছিলে। এ কারণে আমি তোমার জন্য একটি বাসস্থান নির্মাণ করেছি, যেখানে রয়েছে পাথরের তৈরি মিনার, যেগুলো স্বর্গ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আমি তার সামনে একটি প্রাচীর বানিয়েছি। কোষাগারে স্বর্ণ, রৌপ্য, বার্লি ও গম দিয়ে ভরে দিয়েছি। এর জমি ও পশুর পালগুলো সমুদ্রতীরের বালুকণার মতো।’

তবে আমুনকে এত উপহার দেওয়া সত্ত্বেও লুটেরাদের দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। আগের রামসেসের মতো ৩ নং রামসেসকেও উত্তর থেকে আসা হানাদারদের বিরুদ্ধে বড় বড় যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। তবে আগের রামসেসের মতো উত্তরাঞ্চলে পশ্চিমা সেমাইটদের ভূমিতে নয়, বরং মিশরের সীমান্তেই তাকে যুদ্ধ করতে হয়।

রামসেস তৃতীয় তার শাসনামলের ৫ম বর্ষে বড় আকারের হুমকির সম্মুখীন হন। একটি শান্তিপূর্ণ অভিবাসী দল হঠাৎ করেই হামলাকারীতে রূপান্তরিত হয়। পশ্চিমের মরুভূমি থেকে লিবিয়ার কিছু গোত্রের সদস্যরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মিশরে আসছিলেন। হিকসোসের বিপর্যয়ের পর মিশরের সীমানার ভেতর কোনো বিদেশি মানুষকে শাসন করতে দেওয়া হতো না। যখন এই অভিবাসী লিবিয়ানরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের নিজেদের একজন রাজা নির্বাচন করতে উদ্যত হল—এই সংবাদে ক্ষুদ্ধ হয়ে রামসেস লিবিয়ানদের কচুকাটা করার জন্য সেনা পাঠালেন। ছত্রভঙ্গ হয়ে লিবিয়ানরা আবারো মরুভূমিতে পালিয়ে গেল। অনেকেই পরিণত হলেন দাসে।

পশ্চিম থেকে আসা এই হুমকির মোকাবিলা করতে-না-করতেই উত্তর-পূর্ব দিকে এক নারকীয় পরিস্থিতির সূত্রপাত ঘটে। সেতনাখতে এশিয়াটিকদের বিদেয় করলেও বস্তুত তা সাময়িক একটি ব্যবস্থা ছিল। পশ্চিমের সেমাইটদের ভূখণ্ডটি ছিল গোলযোগের আখড়া। সেখানে বিভিন্ন দেশের ছোটখাটো গোত্র ও বাহিনী এসে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ট্রয়, আসসুর, ব্যাবিলন থেকে আসা গোত্রপ্রধানদের নিজ নিজ এলাকার দখল নেওয়া, হিট্টিটদের সীমানা সংকোচন, আসসুর ও ব্যাবিলনের সম্পর্কের অবনতি, পূর্ব সীমান্তে এলামাইটদের ধ্বংসযজ্ঞ, এবং সার্বিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করতে, এইজিয়ান ও কৃষ্ণসাগর (এখন যে এলাকাটিকে আমরা পূর্ব-ইউরোপ বলি) থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসা অভিবাসীদের নিরন্তর ঢেউ—সব মিলিয়ে এই অঞ্চলে ঝামেলার কোনো শেষ ছিল না।

এক্ষেত্রে বলা যায়, প্রাচীন পৃথিবীর যাযাবররা থিতু হয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীকে পরাভূত করার পথে অনেকদূর এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

রামসেস তৃতীয় তার মন্দিরের দেয়ালে লিখলেন, ‘তাদের সামনে কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। তারা সারা পৃথিবীর সব ভূখণ্ড দখলের চেষ্টা চালাল।’

‘সমগ্র পৃথিবী’ বলতে তিনি যে-অঞ্চল বুঝিয়েছিলেন, তার বেশিরভাগ অংশে প্রায় এক দশক ধরে নিয়মিত বিরতিতে খরা চলছিল। খরার কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ লিবিয়ানদের বদ্বীপের দিকে অগ্রসর হতে আগ্রহী করে তুলেছিল। এই তৃষ্ণার্ত যাযাবরদের কাছে নীলনদের পানিতে সিক্ত মিশরকে স্বর্গ বলে মনে হতে লাগল। রামসেস তিনের রাজত্ব শুরুর অল্পদিনের মধ্যে হামলাকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে মিশরের দিকে অগ্রসর হল।

মিশরীয় বদ্বীপে বহিঃশত্রুর হামলা কোনো নতুন ঘটনা নয়। তবে এই হামলাকারী বাহিনীতে আশ্চর্যজনকভাবে বেশকিছু গোত্র জোট গঠন করে অংশগ্রহণ করে। আফ্রিকার বিভিন্ন গোত্র ও মাইসেনীয় নৌবাহিনী (এরা খুব সম্ভবত ভাড়াটে যোদ্ধা ছিল। মাইসেনীয় শহরগুলো দারিদ্র্যের ছোবলে পড়লে তারা গ্রিক উপদ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হন) একীভূত হয়ে মিশরে হামলার জন্য প্রস্তুত হয়। এই হামলাকারীদের রামসেস যে নাম দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে আমাদের জানা নামগুলো কিছুটা ভিন্ন। ‘শেকেলেশ’ খুব সম্ভবত ছিল এইজিয়ানদের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দারা। অপরদিকে, ‘পেলেসেত’ ছিল সমুদ্রের তীরে বসবাসকারী এইজিয়ান বংশোদ্ভূত ভিন্ন একটি জাতি। পেলেসেতরা মাইসেনীয় বিদ্রোহের শুরুতে ক্রিট দ্বীপ থেকে চলে এসেছিলেন। ধারণা করা হয়, এই পেলেসেতরা এই আগ্রাসী বাহিনীকে অস্ত্র ও বর্মে সজ্জিত করার জন্য দায়ী। মিশরের চিত্রায়নে হামলাকারী বাহিনীর সেনাদের পরনে ক্রিটের স্টাইলে ক্রেস্ট বসানো হেলমেট দেখা যায়।

সামগ্রিকভাবে, এই ‘হানাদার’ বাহিনীর ছিল ঈর্ষণীয় শক্তিমত্তা। রামসেস ৩ লিখলেন, ‘একজনও তাদের হাত থেকে নিস্তার পেল না। তাদের হাতে ছিল আগুন এবং মিশর দখলের সব প্রস্তুতি নিয়েই তারা এসেছিলেন।’

রামসেস তার গুপ্তচরদের কাছ থেকে আরও একটি আশঙ্কাজনক তথ্য পেলেন। মিশরের দিকে অগ্রসরমান সেনাবাহিনীর পেছনের দিকে গরুর গাড়িভর্তি নারী ও শিশুর দলও অগ্রসর হচ্ছিল। এই গোত্রগুলো শুধু মিশর আক্রমণ করতে আসেনি, তারা পাকাপাকিভাবে এখানে বাসস্থান গাড়তে এসেছিল।

মিশরীয় সেনারা সীমান্ত এলাকায় হামলাকারীদের সঙ্গে মোকাবিলা করলেন এবং প্রথম পর্যায়ে তাদের জয় হল। এই জয় নিয়ে বিজয়গাথাগুলো রামসেস তৃতীয়র মন্দিরে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। দাবি করা হল, ফারাও তাদেরকে এক ‘বিশাল’ বিজয়রথে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

খোদাই-করা ছবি ও বার্তায় দেখা যায় জয়োল্লাসরত মিশরীয় যোদ্ধাদের চারপাশে কাটা হাতের পাহাড়। সে-যুগের প্রথা ছিল, জয়ী সেনারা মৃত শত্রুর ডান হাত কেটে পুঁথি-লেখকদের কাছে ফিরিয়ে আনতেন। ফলে তারা নিহত শত্রুর সঠিক সংখ্যার হিসেব রাখতে পারতেন।

কিন্তু মিশরের জন্য তখনও অপেক্ষা করছে অপ্রিয় সত্য—সমুদ্রপথে হামলার আশঙ্কা।

হামলার ২য় পর্যায়ের নেতৃত্ব দেন জোটের অভিজ্ঞ নাবিকরা। খুব সম্ভবত তারা এইজিয়ান থেকে এসেছিলেন। তাদের নৌযুদ্ধকৌশল এতটাই উন্নত ছিল, নৌযুদ্ধে অপটু ও অনভিজ্ঞ মিশরীয়রা আর কিছু না-পেরে এই জোটকে ‘সমুদ্রের মানুষ’ বলে অভিহিত করল। উল্লেখ্য, মিশরের তখন একটিও যুদ্ধজাহাজ ছিল না। এই যুদ্ধের পেইন্টিংগুলোতে দেখা যায়, জাহাজে করে আসা ‘সমুদ্রের মানুষ গুলো মিশরের দাঁড়টানা নৌকার নাবিকদের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। মিশরীয় নৌকাগুলো নদী-নালায় চলার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু আক্রমণকারীদের ছিল সমুদ্রযাত্রা- উপযোগী, পাল ও বাতাসে চালিত বড় আকারের জাহাজ। এগুলোর সামনের দিকের অংশটি পাখির মাথার মতো নকশায় তৈরি করা হয়েছিল।

তবে রামসেস তিনের প্রতিরক্ষাকৌশলও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। তিনি তার বাহিনীর নৌযুদ্ধের অনভিজ্ঞতা ও এ-সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা জেনে সমুদ্রতটটি অসংখ্য নৌকা দিয়ে ঘিরে ফেললেন। প্রতিটি নৌকার সর্বোচ্চ পরিমাণ সেনা বসানো হল। এই নৌকাগুলো পুরো উপকূলীয় এলাকায় একটি প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করলেন। তাদের পেছনে পদাতিক বাহিনীকে তিনি তির-ধনুক ও বর্ণায় সজ্জিত করলেন। তাদের ওপর নির্দেশ, শত্রুবাহিনীর যেকোনো অগ্রসরমান জাহাজকে তির ও বর্শায় জর্জরিত করে ফেলতে হবে। রামসেস গর্ব করে বললেন, ‘একটি সীমান্তবর্তী ধাতব দেয়াল তাদেরকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলল।’

এই কৌশল কাজে লাগে। সমুদ্রের যোদ্ধারা প্রতিপক্ষের বাহিনীর বিশাল আকার দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। শিলালিপিতে লেখা হল, ‘তাদেরকে ধরে নিয়ে আসা হল, ফিরিয়ে দেওয়া হল এবং সমুদ্রসৈকতে ফেলে রাখা হল। তাদেরকে হত্যা করে তাদেরই নৌযানগুলোতে লাশের স্তূপ তৈরি করা হল।’

মন্দিরে আঁকা ছবিতে দেখা যায়, হাতকড়া পরিহিত সারি সারি বন্দিদের রামসেসের সামনে হাজির করা হচ্ছে। তাদের পায়ে কোনো জুতো নেই। এভাবেই কাদেশের পর মিশরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হুমকির মোকাবিলা করলেন তৃতীয় রামসেস।

তবে ততদিনে পরাক্রমশালী মিশর সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূলে চিড় ধরে গেছে। রামসেস তৃতীয়র এই বিজয় ও বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প কিছুদিনের জন্য এই দুর্বলতা ঢাকতে পারলেও, একটা ব্যাপার সবসময়ই সত্য থেকেছে, এবং তা হল, ক্ষমতাসীন রাজা ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র তার পিতার ক্যুর কারণে। সুতরাং, তিনিও ক্ষমতার পালাবদলের ঝুঁকি থেকে মুক্ত ছিলেন না।

রাজত্বের শেষের দিকে তারই এক স্ত্রী তাকে হত্যা করার চক্রান্ত করলেন। এই নিমগোত্রীয় নারী ভেবেছিলেন, জনতাকে উসকে দিয়ে এই কুকর্ম ঘটাবেন। রামসেসের উত্তরসূরির রাজসভার লেখকরা লিখেছেন, ‘তিনি চেয়েছিলেন জনগণকে রাজার বিরুদ্ধে খেপিয়ে দিতে, যাতে তারা তাদের প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সেই নারীর ধারণা ছিল, উত্তেজিত জনতা শুধু তার স্বামীকেই নয়, সঙ্গে তার নির্ধারণ-করা উত্তরসূরিকেও (অপর এক স্ত্রীর ছেলে) হত্যা করবে। ফলে সেই নারীর ছেলে সিংহাসনে বসবেন—এমনটিই ভেবেছিলেন।

এ-ধরনের চক্রান্তকে বলা হয় ‘হারেম চক্রান্ত’ এবং ফারাওদের হত্যা করার জন্য এরকম চক্রান্ত এর আগেও হয়েছে। তবে নিম্নগোত্রের রানির এই চক্রান্তটি উল্লেখযোগ্য, কারণ এতে অনেক মানুষ জড়িত ছিলেন। সভার লেখকের বর্ণনা মতে, এতে দুইজন রাজকীয় পতাকাবাহক, একজন আর্দালি ও সভার প্রধান লেখক একযোগে কাজ করেছেন। এছাড়াও রাজার মোমের পুতুল বানিয়ে মিশরীয় কালো জাদু করার অভিযোগ আসে বিভিন্ন গোত্রের তত্ত্বাবধায়কের পদে থাকা এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। প্রধান স্টুয়ার্ডের বিরুদ্ধে ভিন্নমত প্রচারের অভিযোগ আসে। এমনকি এই ষড়যন্ত্র সুদূর নুবিয়া পর্যন্ত প্রসারিত হয়। নুবিয়ার তিরন্দাজদের সাবেক অধিনায়ক নেনেমউইসে তার বোনের কাছ থেকে চিঠি পেয়ে মিশরের উদ্দেশে রওনা হন। তার হেরেমবাসী বোন তাকে লেখেন, ‘জনগণকে উসকে দাও। তাদেরকে রাজার বিরুদ্ধে নিয়ে যাও।’

ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ও এর বিচারিক কার্যক্রমের বর্ণনা বেশ ক্লান্তিকর। কেউ ‘আত্মহত্যা করেন’, কাউকে ‘মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়’। একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে ৩ ষড়যন্ত্রকারীর কথা বলা হয়, যারা শুধু নাক ও কান হারিয়েছিলেন এবং হোরি নামের একজন পতাকাবাহক বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন। তিনি তার বাকি জীবন দায়মুক্তির অবিশ্বাসের সঙ্গে পার করেন।

বিচারিক কার্যক্রম পুরোপুরি সমাপ্ত হওয়ার আগেই তথাকথিত ভুক্তভোগী, রামসেস তৃতীয় স্বাভাবিক কারণে মৃত্যুবরণ করেন।

পরবর্তী ৮০ বছরে ৮ জন ‘রামসেস’ নামের ফারাও রাজত্ব করেন। কিন্তু তাদের আমল এতটাই গোলযোগপূর্ণ ও বিবর্ণ ছিল যে, ইতিহাসের পাতায় তাদের বিষয়ে তেমন কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। মিশর নুবিয়ার দখল বজায় রাখতে পেরেছিল, কিন্তু একে একে বাকি সব অঞ্চলের আধিপত্য তাদের হাত থেকে চলে যায়। সিনাইয়ের চারপাশের খনিগুলো নিশ্চুপ হয়ে পোড়ে।

পরবর্তীতে নুবিয়ার স্বর্ণখনিগুলোও পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১১৪০ সাল নাগাদ মিশর তার পশ্চিমাঞ্চলের সেমাইটদের ভূমির দখল বজায় রাখার চেষ্টাও বাদ দিয়ে দেয়। বদ্বীপের সামনের দিকের দুর্গগুলো শূন্য হয়ে পড়ে।

ভ্যালি অব কিংস-এর সমাধিগুলো শুধুমাত্র উন্মোচিতই হয়নি, চোর-ডাকাতের কবলেও পড়েছে ততদিনে। পশ্চিম সীমান্তের ধারেকাছে কোনো মিশরীয় আসলেই তাদেরকে আক্রমণ করে তাড়িয়ে দেওয়ার পবিত্র কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে শুরু করে লিবিয়ানরা। সেসময় ওয়েনামুন নামের এক সভাসদ উপকূলীয় অঞ্চলে যাত্রা করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল বিবলোস থেকে দরদাম করে সিডার কাঠ কেনা। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি ডাকাতির শিকার হন। ডাকাতদল মিশরের প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ নেওয়ার সম্ভাবনাকে বিন্দুমাত্রও ভয় পেত না।

সঙ্গে আনা অর্থ হারালেও অবশেষে বিবলোসে পৌঁছান ওয়েনামুন। কিন্তু তাকে বাকিতে কাঠ দিতে রাজি হলেন না বিবলোসের রাজা। তিনি রূঢ়ভাবে তাকে বললেন, ‘আমি আপনার চাকর নই। এমনকি, আপনাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তারও নই। আমাদের গাছের গুঁড়ি আমাদের কাছেই থাকবে।’

ইতোমধ্যে, আমুনের পূজারিরা আরও ধনী হতে লাগলেন। তুতানখামেনের আমলে আমুনকে আবারও মূল দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ফলে প্রত্যেক ফারাওকে আমুনের মন্দিরে বড় আকারে ভেট দিতে হত। রামসেস তৃতীয় আমুনকে (প্রকারান্তরে, পূজারিদের) এত বেশি জমি দিয়েছিল যে, তার মৃত্যুর সময় মিশরের ফসলি জমির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ছিল পূজারিদের দখলে।

উল্লেখ্য, হোরেমহেব সামরিক কর্মকর্তাদের মন্দিরের পূজারি বানিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন রাজপ্রাসাদে পূজারিদের মতো আনুগত্য নিয়ে আসবেন। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত শাঁখের করাতে পরিণত হয়। রামসেস একাদশের শাসনামলের দ্বাদশ বছরে হেরিহোর নামের এক সেনাপতি আমুনের সর্বোচ্চ পূজারির পদে অধিষ্ঠিত হন। অর্থাৎ, তিনি একইসঙ্গে মিশরের সেনাবাহিনী ও সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হন। তারপর তিনি বিভিন্ন দাবি-দাওয়া জানাতে থাকেন, যেগুলো মেনে নিতে রামসেস ১১ একটুও দ্বিধান্বিত হননি। ৫ বছর পর তিনি কুশের ভাইসরয় (বড়লাট) হন। এরপর তিনি নিজেকে মিশরের উজির হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১০ বছর পর আরও মজার ঘটনা ঘটে—সমগ্র মিশর জুড়ে তার নাম ‘সহ- শাসক’ হিসেবে উচ্চারিত হতে শুরু করে। রামসেস ১১’র পাশাপাশি হেরিহোরের প্রতিকৃতি সব মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করা হল—দুজনেরই সমান ক্ষমতা

তবে ৫ বছরের ব্যবধানে দুইজনই মারা গেলেন। একজনেরও কোনো পুত্রসন্তান বা নির্ধারণ-করা উত্তরসূরি ছিল না। তাদের জামাতারা একে অপরের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ শুরু করল। রামসেস ১১’র জামাতা নিজেকে উত্তরের রাজা হিসেবে ঘোষণা দিলেন। অপরদিকে হেরিহোরের জামাতা দক্ষিণাঞ্চল থেকে শুরু করে থেবেস পর্যন্ত শাসন করার স্বর্গীয় ক্ষমতার দাবি জানালেন।

তবে এবার আর এই দুইপক্ষকে একীভূত করার মতো কোনো বৃহত্তর শক্তির আবির্ভাব ঘটল না। নতুন রাজত্বের অবসান ঘটল। মিশর বিভাজিত থেকে গেল এবং খুব শিগগির একটি দ্বিধান্বিত, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হল। এর পরের পর্যায়কে বলা হয় তৃতীয় মধ্যবর্তী পর্যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *