৩৭. দ্য বিগিনিং

৩৭. দ্য বিগিনিং 

যখন সে পেছন ফিরে তাকায়, এমনকি মাত্র এক মাস পরেও, হ্যারির মনে হলো অনেক কথাই মন থেকে মুছে গেছে। তার মনে রাখার মতো এতো বিষয় যে আর নতুন করে ধারণ করার শক্তি নেই। সবই তো দুঃখের ঘটনা। হয়তো ওর জীবনে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাটি ছিল পরের দিন সকালে সেডরিকের বাবা মা’র সঙ্গে দেখা হওয়াটা। 

তারা কখনোই সেডরিকের হত্যা সম্বন্ধে হ্যারির ওপর কোন রকম দোষারোপ করেননি। বরং সেডরিকের মৃতদেহ নিয়ে আসার জন্য আকুণ্ঠ ভালবাসা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। যতক্ষণ মি. ডিগরি ওর সঙ্গে কথা বলছিলেন সমানে কাঁদছিলেন। ডিগরির মা’র পুত্রশোকে কান্নার চাইতে অনেক অনেক বেশি শোকাভূত মনে হয়েছিল। 

সেডরিকের মৃত্যুর কথা বলাতে ওর মা বলেছিলেন- তাহলে তো বেশিক্ষণ ওকে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি… আমোস… ওর মৃত্যু হয়েছে টুর্নামেন্টে জেতার পর। জয়লাভে নিশ্চয়ই ও তখন খুব খুশি হয়েছিল। 

হ্যারি চলে যাবার আগে সেডরিকের মা বললেন- বাবা তুমি এখন থেকে খুব সাবধানে থাকবে বুঝলে? 

হ্যারি ফাজের দেওয়া স্বর্ণমুদ্রার ব্যাগ পাশের টেবিলে রেখে বললো- আপনি এটা নিন। এটা সেডরিকের প্রাপ্য। ও প্রথম হয়েছিল, দয়া করে এগুলো নেবেন। 

সেডরিকের মা স্বর্ণমুদ্রা স্পর্শ না করে বলেছিলেন- না না তোমার প্রাপ্য, লক্ষ্মী ছেলে, এগুলো আমরা নিতে পারবো না। তোমার কাছে রেখে দাও। 

***

পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় হ্যারি গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে ফিরে এল। হারমিওন ও রন বলল- প্রফেসর ডাম্বলডোর সকালে ব্রেকফাস্টের সময় স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীদের ঘটনাটা বলেছেন। ওদের অনুরোধ করেছেন, তোমাকে যেন বিরক্ত না করে। আর কি ঘটেছিল সে সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন না করে। 

হ্যারি লক্ষ্য করল- বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে করিডলরে ওকে দেখলে এড়িয়ে চলে, ওর দিকে তাকায় না। কেউ কেউ আবার ওকে দেখিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে। 

ও লক্ষ্য করলো বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী করিডলরে ওকে দেখলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, ওর দিকে তাকাচ্ছে না। ওকে কেউ কেউ দেখলে হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে ফিসফিস করে কিছু বলছে। ও বুঝতে পারলো রিটা স্কীটারের লেখা পড়ে ওরা প্রভাবিত হয়েছে… ও একটি বিপজ্জনক ছেলে। সম্ভবত সেডরিক কেমন করে মারা গেছে… তা যে যার নিজের মনের মতো গল্প তৈরি করে নিয়েছে। হ্যারি অবশ্য ওদের অদ্ভুত ব্যবহারের কোনও ভোয়াক্কা করে না। রন- হারমিওনের সঙ্গে অবসর সময়ে আড্ডা দিয়ে, তর্ক করে, দাবা খেলে কাটায়। ওরা ঠিক করেছে কারও সঙ্গে অযথা কোনও আলোচনা করবে না। ওরা সকলেই ধীরস্থিরভাবে বসে রয়েছে, হোগার্টের বাইরে কিছু একটা ঘটনার বা ইঙ্গিতের প্রতীক্ষায়। কিন্তু কোন কথা নয় যদি না সত্যতা থাকে। সেই রাতের ঘটনা সম্বন্ধে শুধু একটি বার প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেলো যখন রন, হ্যারি, বাড়ি ফেরার আগে মিসেস উইসলির ডাম্বলডোরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এই কথাটা যখন জানালো। 

– মা জানতে চেয়েছিলেন, তুমি গরমের ছুটিটা আমাদের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে কাটাতে পার কি না। অবশ্য ডাম্বলডোর বলেছেন, তোমার ডার্সলেদের কাছে থাকা ঠিক হবে, অন্তত পক্ষে প্রথমে সেখানে যাওয়া ঠিক হবে। হ্যারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- কেন? রন মাথা ঝাকিয়ে বললো, মা বললেন, ডাম্বলডোর নিশ্চয়ই কিছু একটা ভেবে বলেছেন। 

– রন বলল- আমাদের মনে হয় তার কথা মেনে চলাই ভাল।

রন আর হারমিওন ছাড়া আরেকজনের সঙ্গে হ্যারি কথা বলে- হ্যাগ্রিড। কাল জাদুকর’ প্রতিরোধে কোনও শিক্ষক না থাকলেও ওরা হ্যাগ্রিডের কাছ থেকে কিছু কিছু শিখছে। গত বৃহস্পতিবার হ্যাগ্রিডের কেবিনে গিয়ে দেখা করার আগে ওরা সেটা ব্যবহার করেছে। দিনটা ছিল অতি মনোমুগ্ধকর, ফকফকে সূর্যালোকে ভরা দিন। ফ্যাংগ ঘেউ ঘেউ করতে করতে এসে দরজার গোড়ায় ওদের দেখে খুশি হয়ে প্রবলভাবে ল্যাজ নাড়তে লাগল। 

হ্যাগ্রিড দরজার কাছে আসতে আসতে বললেন- কে?… ও হ্যারি!

হ্যাগ্রিড হ্যারিকে দেখে খুব খুশি। ওর একটা হাত ধরে কাছে টেনে এনে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললেন-… আহা: বন্ধু তোমাদের দেখে খুব ভাল লাগছে। ওরা দেখল, খাবার জায়গায় ফায়ার প্লেসের সামনে রাখা কাঠের ডাইনিং টেবিলের ওপর রয়েছে দুটো ছোট বালতির মতো কাপ, আর বড় বড় প্লেট। 

হ্যাগ্রিড বললেন, ওলিমপের সঙ্গে চা খাচ্ছিলাম। এই মাত্র ও চলে গেছে।

রন কৌতুহলের সঙ্গে বলল- কে? কার সঙ্গে?

হ্যাগ্রিড বললেন- অবশ্যই ম্যাডাম ম্যাক্সিম!

রন বলল- আপনাদের তাহলে ঝগড়া মিটে গেছে? 

– জানি না তুমি কি বিষয়ে বলছ, হ্যাগ্রিড বললেন। তারপর পোশাক রাখার ঘর থেকে আরও কয়েকটি কাপ বের করে চা বানালেন, ডাফি বিস্কুট প্লেটে সাজিয়ে ওদের চা খেতে বলে নিজের চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে তার ফোলা ফোলা কালো চোখে হ্যারির দিকে তাকালেন। 

বললেন- হ্যারি তুমি এখন কেমন আছ?

হ্যারি বলল- খুব ভাল আছি। 

হ্যাগ্রিড বললেন- না, তুমি ঠিক নেই, এখনও একটু দুর্বল মনে হয়, তবে দু’একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে মনে হয়। 

কথাটা শুনে হারি চুপ করে রইল।

জানতো ও আবার ফিরে এসেছে, হ্যাগ্রিড বললেন। 

হ্যারি, রন, হারমিওন কথাটা শুনে হ্যাগ্রিডের মুখের দিকে তাকাল। বছরখানেক ধরে চেষ্টা করছে। ফিরে এসেছে, এখন আমাদের ওকে খতম করতে হবে। আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠার আগে ওর শক্তি খর্ব করতে হবে। ডাম্বলডোরের এটাই প্ল্যান, ডাম্বলডোর শুধু ভালমানুষ নয়, মহান ব্যক্তি। যতদিন আমাদের কাছে তিনি থাকবেন আমাদের কোনও চিন্তার কারণ নেই। 

ওরা মনে হয় খতম করার কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না। ভোল্ডেমট দারুণ শক্তিশালী, ওর আছে অনেক সাঙ্গপাঙ্গ। হ্যাগ্রিড ওদের চিন্তান্বিত মুখের দিকে তাকালেন। 

– আগে থেকে ওসব চিন্তা করে লাভ নেই। সময় বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে। ডাম্বলডোর তোমার সব কথা আমাকে বলেছেন হ্যারি। তুমি তোমার বাবার মতো সাহসের কাজ করেছ। আমি উনার চেয়ে বেশি তারিফ তোমাকে করতে চাই না। 

হ্যারি কথাটা শুনে হাসল। অনেকদিন পর রন- হারমিওন ওর মুখে হাসি দেখল। 

ডাম্বলডোর আপনাকে কি করতে বলেছেন হ্যাগ্রিড? ম্যাডাম ম্যাক্সিম আর প্রফেসর ম্যাকগোনাগলকে সেই রাতে তো আপনার সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়েছিলেন।

গ্রীষ্মের ছুটিতে কিছু কাজ করার ব্যাপারে, হ্যাগ্রিড বললেন- গোপন, আমি কারও সঙ্গে ওই ব্যাপারে কোনও কথা বলতে পারি না, তোমাদের সঙ্গেও না। মাদাম ম্যাক্সিম তোমাদের কিছু বলতে চান মনে হয় পরে কথা বলবেন। ডার্কলর্ড ভোন্তেমর্টের ব্যাপারে? 

নামটা শুনে হ্যাগ্রিড নাক সিঁটকালেন।

হতেও পারে; যেন ওর নামটা শুনতে চান না এমনভাবে বললেন। 

এখন আমার সঙ্গে স্ক্রিউট দেখতে যাবে? ওদের মুখ দেখে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,- আরে না না তোমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। 

***

প্রিভেট ড্রাইভে যাবার আগের দিন রাতে অতি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হ্যারি ওর ট্রাঙ্ক গুছোতে লাগল। ইন্টার-হাউজ চ্যামিস্পয়নশিপের নাম ঘোষণার আগে সাধারণত প্রতিবছরের এক ভোজসভা হয়। সেই ভোজে অংশগ্রহণ করতে ওর একটুও মন চাইছে না। হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর ও গ্রেট হলের ভোজে যোগ দেয়নি। বহু ছাত্রছাত্রী এবং আরও অনেকে এসেছিলেন। সকলেই ওর দিকে তাকায়, ওর একটুও ভাল লাগে না তাই ঘর খালি হয়ে গেলে ও একা একা খেয়ে ডরমেটরিতে চলে আসে। 

রন, হারমিওনের সঙ্গে হ্যারি খাবারের হলে ঢুকে দেখল যেমন প্রতিবার যেমন সুন্দর করে সাজান হয় এবার সেটা হয়নি। যে হাউজ চ্যাম্পিয়ন হয় সকল সময় সে হাউজের রং এ খাবারের হলটি সাজানো হয়। এবার তা হয়নি। তার বদলে স্টাফ টেবিলের পিছনে ঝুলছে কাল রঙের কাপড়। সেডরিকের জন্য সম্মান প্রদর্শনের জন্য হল ঘর না সাজিয়ে কাল কাপড় ঝোলানোর মর্ম হ্যারি বুঝতে পারলো। 

আসল ম্যাড আই মুডি স্টাফ টেবিলে বসে আছেন। তার কাঠের পা, আর ম্যাজিক্যাল আই যথাস্থানে এসে গেছে। হ্যারি, ম্যাড আই মুডির মনের খবর জানে। একটানা দশ মাস তাকে বন্দি থাকতে হয়েছিল নিজের ঘরে, তারই ট্রাঙ্কে। প্রফেসর কারকারফের চেয়ার শূন্য। হ্যারি গ্রিফিন্ডরদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে বসতে বসতে কারকারফের কথা ভাবল। কে জানে কারকারফ এখন কোথায়। 

ভোমের্টের ওকে ধরেছেন? 

ম্যাডাম ম্যাক্সিম তখনও ফিরে যাননি। বসে রয়েছেন।তার পাশে হ্যাগ্রিড। ওরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছেন।… অন্যধারে প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের পাশে স্নেইপ। হ্যারি স্নেইপের দিকে তাকালে, তিনিও হ্যারির দিকে তাকালেন। তাকে দেখে বোঝা শক্ত কি ভাবছেন। সব সময় তিনি গম্ভীর। হ্যারি বারবার তার দিকে তাকাতে লাগল। খানিকটা পরে স্নেইপ মুখ ফিরিয়ে বসলেন। 

যে রাতে ভোন্ডেমর্ট ফিরে এসেছে- ডাম্বডোরের আদেশ পাবার পর স্নেইপ কি করছেন? কে জানে কেন, কেন ডাম্বলডোর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন স্নেইপ সত্য সত্যই তার পক্ষে। পেনসিভে’ ডাম্বলডোর হ্যারিকে বলেছিলেন, স্নেইপ এক সময় ডোভেমর্টের গুপ্তচর ছিলেন, এখন তিনি ভোমের্টের বিরুদ্ধে গুপ্তচরের কাজ করেন। বলা যায় নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে। তাহলে কি ও সেই পুরনো। কাজ আবার শুরু করেছেন? ডেথইটারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছেন। আর তাদের বলছেন যে, তিনি ডাম্বলডোরের পক্ষাবলম্বন করেননি- অথবা এমনওতো হতে পারে ভোল্ডেমর্টের মত সময়ের অপেক্ষা করছেন।

ডাম্বলডোর স্টাফ টেবিলে বসার সঙ্গে সঙ্গে হ্যারির মনের সব জল্পনা-কল্পনা বন্ধ হল। অন্যান্য বারের তুলনায় গ্রেট হলে তেমন হই-চই, হাসি-ঠাট্টা হলো না। সকলেই চুপচাপ খাওয়া শেষ করল। 

ডাম্বলডোর বললেন, আজ শেষ দিন, তারপর ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললেন- আবার নতুন বছর শুরু হবে। 

খুব সামান্য সময়ে চুপ থেকে হাফলপাফের টেবিলের দিকে তাকালেন। তিনি দাঁড়াবার আগে হাফপাফের টেবিলের ছাত্র-ছাত্রীরা চুপ ছিল। হলের মধ্যে সেই হাউজের ছাত্র-ছাত্রীদের মুখ সবচাইতে বিষন্ন বেদনায় ভরা। 

– আমি তোমাদের কাছে আমার অনেক কিছু বলার ছিল, ডাম্বলডোর বললেন। কিন্তু আমি অতি দুঃখের সঙ্গে বলছি আমাদের এক অতি ভদ্র, অতি সুন্দর ছাত্রবন্ধুকে এই বছরে হারিয়েছি হাফলপাফ টেবিলে তার বসার জায়গাটা শূন্য। ডাম্বলডোর হাফলপাফ টেবিলের দিকে তাকালেন। তারপর আবেগের সঙ্গে বললেন,- ও আমাদের সঙ্গে একত্রে আর কোনদিন ফিস্টে যোগ দেবে না। তিনি বেদনাহত হৃদয়ে হাফপাফের টেবিলের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, এবার আমি অনুরোধ করছি তোমরা সকলে দাঁড়াও, তোমাদের পানীয় গ্লাস তুলে সেডরিক ডিগরিকে স্মরণ কর। 

ছাত্রছাত্রীরা সকলে উঠে দাঁড়াল। হাতের গবলেট (পান পাত্র) তুলল, সকলে সমস্বরে ধীরে ও ভাবগম্ভীর কণ্ঠে বলল- ‘সেডরিক ডিগরি। লং লিভ সেডরিক…! 

ভিড়ের মধ্যে হ্যারির চোর দিকে দৃষ্টি পড়ে গেল। দেখল ওর দু’গাল দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। ও মাথা নিচু করল, তারপর সকলেই বসে পড়ল। 

ডাম্বলডোর মিনিটখানেক সকলকে দেখে নিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বলে চললেন সেডরিক এমন একটি ছেলে ছিল যার সততা, নিষ্ঠার জন্য সকলেই গর্ববোধ করতে পারে- যারা ওকে জানে শুধু তারা নয়- অপরিচিতরাও। ও তার কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের স্কুলের হাফলপাফ হাউজকে আলাদা এক স্থানে পৌছে দিয়েছে। বন্ধুবৎসল, পরিশ্রমী, স্পোর্টসম্যান সেডরিক হোগার্টে স্কুলে চিরপরিচিত হয়ে থাকবে। 

আগেই বলেছি তার মৃত্যু তোমাদের সকলকে প্রত্যক্ষ- পরোক্ষভাবে অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে। তাই আমার মনে হয়, তোমাদের জানার অধিকার আছে মৃত্যুর আসল কারণ। 

হ্যারি ওর হাত তুলে ডাম্বলডোরের দিকে তাকাল।

– সেডরিক ডিগরিকে ভোল্ডেমর্ট হত্যা করেছে।

সমস্ত গ্রেট হলে এক অনিরাপত্তার বাতাবরণ শুরু হল শুধু নয়, অনেকেরই ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল, আতঙ্কিত হয়ে ডাম্বলডোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। 

– ম্যাজিক মন্ত্রণালয়, ডাম্বলডোর বলে চললেন- তারা চান না আমি তোমাদের কাছে সব কথা বলি। না বলার জন্য কিছু কিছু মা-বাবা হয়ত খুশি হবেন, কারণ তারা বিশ্বাস করেন না ভোল্ডেমর্ট ফিরে এসেছে, আবার অনেকেই বিশ্বাস করলে আতঙ্কিত হবেন। তাছাড়া তোমরা সবাই ছেলেমানুষ- না বলাই ভাল হবে। আমার বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত মত এই যে সত্যকে মিথ্যার আবরণে ঢাকা অপরাধ। সেডরিক দুর্ঘটনায় বা নিজের কোনও ভুলে মারা গেছে বললে তার স্মৃতির প্রতি অবমাননা করা হবে। 

হলের সকলেই ভয়ে স্তব্ধ হয়ে ডাম্বলডোরের দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যারি স্নিদারিন টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখল ড্যাকো ম্যালফয়- ক্র্যাব আর গোয়েলের কানে কানে কিছু বলছে। হ্যারির সেই দৃশ্য দেখে রাগে মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। ও একরকম জোর করে ডাম্বলডোরের দিকে তাকিয়ে রইল। 

– আমাদের মধ্যে এখানে কেউ বসে আছে আমাদের কিছু বলতে চায়, সে অবশ্যই সেডরিকের মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু বলতে চায়। আমি অবশ্যই হ্যারি পটারের কথা বলছি, ডাম্বলডোর পটারের দিকে তাকালেন।

হলের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। অনেকেই ডাম্বলডোরের দিক থেকে মুখ সরিয়ে হ্যারি পটারের দিকে তাকাল। 

– হ্যারি পটার কোনও রকমে লর্ড ভোল্ডেমর্টের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচে ফিরে এসেছে। হোগার্টে সেডরিকের মৃতদেহ নিয়ে আসার জন্য নিজেকে বিপন্ন করেছিল। প্রতিটি ব্যাপারে হ্যারি পটার অসামান্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা খুবই কম জাদুকর আছেন যারা লর্ড ভোল্ডেমর্টের সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস দেখিয়েছেন এবং তার সাহসের জন্য আমি পটারকে সম্মানিত করছি। 

ডাম্বলডোর হ্যারির দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে পানপাত্র (গবলেট) হ্যারি পটারের উদ্দেশ্যে তুললেন।… অধিকাংশ গ্রেট হলের ছাত্রছাত্রীরা ডাম্বলডোরের মতো পানপাত্র তুলে ধরলো। সেডরিকের মতো হ্যারিপটারের নামও সকলে সমস্বরে বললো… তার শুভকামনায় পানপাত্র তুলে সুরা পান করলো।

হ্যারি আড়চোখে দেখল ম্যালফয়, ক্র্যাবে, গোয়েলে তাদের গবলেট তুললো না শুধু নয়, একরকম মুখ ভেংচে হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইল। ডাম্বলডোরের তো মুডির মতো ম্যাজিক্যাল আই’ নেই যে ওদের দেখতে পাবেন! 

সকলে অভিনন্দন জানাবার পর নিজেদের জায়গায় স্থির হয়ে বসলে ডাম্বলডোর বললেন- ট্রিউইজার্ড প্রতিযোগিতা করা হয়েছিল আমাদের মধ্যে জাদুর প্রচার পরস্পরের প্রতি বোঝাপড়া, সৌহার্দ্য আনার জন্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোল্টেমর্টের পুনরাগমনের জন্য, আমাদের বোঝাপড়া, সৌহার্দ্য পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের প্রতি সচেষ্ট থাকতে হবে। 

ডাম্বলডোর মাথা ঘুরিয়ে ম্যাডাম ম্যাক্সিম আর হ্যাগ্রিড থেকে শুরু করে ফ্লেউর আর সতীর্থ (বক্সবেটনের), ভিক্টর ক্রাম, ডারমস্ট্রাংগ ও স্লিদারিনদের পর্যন্ত তাকালেন। ক্রাম আর হ্যারি একটু আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। ওরা ভেবেছিল আরও কঠিন কথা আরও কিছু বলবেন ডাম্বলডোর। 

আমাদের প্রতিটি সম্মানীয় অতিথি হলে যারা উপস্থিত আছেন, ডাম্বলডোরের চোখ ডারমাংগ ছাত্রছাত্রীদের ওপর পড়ল। 

– তারা যখন খুশি আমাদের কাছে আসতে পারেন। আমাদের সাদর নিমন্ত্রণ রইল। আমি আবার আপনাদের, আমার ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের প্রতি বিনীত অনুরোধ করছি- ভোমের্টের পুনরায় আগমনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এক হতে হবে… তাহলে শক্তিশালী হব… বিভক্ত হলে দুর্বল হব-তাতে ভোল্টেমর্টের সুবিধে হবে। 

– লর্ড ভোল্টেমর্টের বিভেদ এবং শত্রুতা সৃষ্টি করার কৌশল প্রবল। আমাদের ভাষা, আচার- বিচার ভিন্ন হলেও… আমাদের লক্ষ্য যেন অভিন্ন থাকে। হৃদয়ের দুয়ার উন্মুক্ত থাকে। 

– আমার বিশ্বাস- আমি কখনও ভাবি না যে আমি ভুল পথে চলেছি… আজ আমরা অতি কঠিন ও জটিল সমস্যার ভেতর দিয়ে চলেছি। এই হলে অনেকেই উপস্থিত আছেন যারা লর্ড ভোল্টেমর্টের হাত থেকে সরাসরি অত্যাচারিত হয়েছেন। অনেকের পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে আমাদের কাছ থেকে এক ছাত্রকে ও ছিনিয়ে নিয়েছে। 

– সেডরিককে তোমরা কিন্তু ভুলবে না, চিরকাল মনে রাখবে। মনে রাখবে তোমাদের মতো ছোট একটি ছেলে… অতি সাহসী, দয়ালু ও সৎ ছেলেকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে, কারণ সে ভোল্টেমর্টের নির্দেশিত পথে চলেনি। আবার বলছি মনে রাখবে, আমাদের বন্ধু সেডরিক ডিগরিকে। 

হগসমেড স্টেশনে যাবার জন্য বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে প্রিয় প্যাঁচা হেডউইগকে নিয়ে রন, হারমিওনসহ হ্যারি এনট্রেন্স হলে আরও ফোর্থইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ক্যারেজের অপেক্ষায় বসে রয়েছে। ক্যারেজ ওদের স্টেশনে পৌঁছে দেবে। আরও একটি প্রাণচঞ্চল সুন্দর গ্রীষ্মের দিন। হ্যারির মনে হল সন্ধ্যাবেলাতেই ও যখন পৌছবে। প্রিভেট ড্রাইভ শুধু গরম নয় পত্রাচ্ছিদিতও হবে, ফুলের বাগানে নানা রঙের ফুল ফুটবে। এই সুখকর ভাবনা ওকে কোন আনন্দ দিল না, বরং বিষন্নতায় ভরে গেল মন। 

অ্যারি (হ্যারি)। হ্যারি দেখল ফ্লেউর ডেলাকৌর ওর দিকে একরকম দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। আরও দেখল হ্যাগ্রিড, ম্যাডাম ম্যাক্সিমকে তাদের দুটো পেল্লায় ঘোড়াকে জিন পরাতে সাহায্য করছেন। একটু পরই বক্সটেনের ঘোড়ার গাড়ি হোগার্ট ছেড়ে চলে যাবে। 

ফ্লেউর বলল- আশাকরি আবার আমাদের দেখা হবে। ফ্লেউর ওর একটা হাত বাড়িয়ে হ্যারির হাত ধরল। আমি আশাকরছি এখানে আবার আসব ইংরেজিটা ভাল করে শেখার জন্য। 

রন বলল- কেন তুমি তো ভালই বল। বলার সময় ফ্লেউরের ইংরেজি বলার ঢংয়ে থেমে থেমে বলল। কথাটা শুনে ফ্লেউর হাসল। হারমিওন চোখ রাঙাল।। 

তাহলে চলি হ্যারি, যাবার জন্য ফ্লেউর পেছন ফিরল। এত দিন আমরা খুব আনন্দে কাটালাম… বিশেষ করে তোমাদের সঙ্গে। 

ফ্লেউর হন্তদন্ত হয়ে অন্য ছাত্রছাত্রীদের দিকে ছুটল। রোদ পড়ে ওর মাথার রূপালী ঢেউ খেলান চুলগুলো আরও চক চক করতে লাগল। 

রন বলল- আহা ডারমস্ট্রাংগ-এর জাহাজ চলবে কেমন করে বলতো। কারকারফ তো নেই… কে চালাবে? 

পেছন থেকে কে যেন বলল- কারকারফ জাহাজ চালায় না। নিজে কেবিনে আরাম করে বসে আমাদের দিয়ে কাজ করান। ক্রাম, ওদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য এসে বলল। বিশেষ করে এসেছে হারমিওনের কাছে বিদায় নিতে। তোমাকে একটা কথা বলব? ক্রাম হারমিওনকে বলল। 

ওরা দু’জন ভিড়ের মধ্যে চলে গিয়ে একটু পর ফিরল। হ্যারি দেখল হারমিওনের মুখটা অনুভূতি শূন্য! 

ক্রাম বলল- আমার ডিগরিকে খুব ভাল লাগত। আমার সঙ্গে খুব নম্র, ভদ্র ব্যবহার করত। যদিও আমি ডারমস্ট্রংগের, কারকারফের সঙ্গে এখানে এসেছি। 

হ্যারির মন ভাল নেই, তবু খুব আস্তে আস্তে বলল- এবার তোমাদের নতুন হেডমাস্টার কে হচ্ছেন? 

ক্রাম কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে জানে না বলে- ফ্লেউর, রন, হ্যারি আর হারমিওনের সঙ্গে করমর্দন করল। 

রন যেন ক্রামের অভাব বড় বেশি বোধ করছে। মনের ভেতর থেকে এক অব্যক্ত ব্যথা উঠে আসছে। অনেক কষ্টে বলল- ক্রাম তোমার একটা অটোগ্রাফ দেবে? 

হারমিওন হেসে ঘোড়াবিহীন ক্যারেজের দিকে তাকিয়ে রইল। ক্রাম কথাটা শুনে একটু যেন হকচকিয়ে গেল। তাহলেও মুখ দেখে মনে হয়, যাবার দিনে অনুরোধটা শুনে খুব খুশি হয়েছে। ছোট একটা পার্চমেন্টে রনের জন্য ও দস্তখত করলো। 

***

এখন কিংক্রসের আবহাওয়া, গত সেপ্টেম্বরে হোগার্টে আসার সময়ের থেকে খুব একটা তফাৎ মনে হলো না। আকাশে এক টুকরো মেঘ ছিলো না। হ্যারি, রন আর হারমিওন ম্যানেজ করেছে তাদের আলাদা এক কমপার্টমেন্ট। পিগউইডজিওন রনের আলখেল্লার ভেতরে লুকারো যেন ওকে বকাঝকা করতে না পারে। হেডউইগ ঝিমুচ্ছে। মাথাটা ডানার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে, আর কুকশ্যাংকস আরাম করে একটা বার্থে কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে আছে। রন, হারমিওন আর হ্যারি প্রাণ খুলে জোরে জোরে গল্প করে চলেছে। গত সপ্তাহে নানা ব্যাপার তেমন প্রাণ খুলে কথাবার্তা বলতে পারেনি। ওদের ট্রেন তীব্র গতিতে দক্ষিণে চলেছে। ওদের কথা হচ্ছিল ডাম্বলডোর ভোমের্টের কার্যকলাপ বন্ধ করতে কি ব্যবস্থা নিতে পারেন। কথাবার্তার ছেদ পড়ল লাঞ্চ ট্রলি আসাতে। 

হারমিওন ট্রলি থেকে খাবার নিয়ে এসে ফেরত অর্থ স্কুল ব্যাগে রেখে সদ্য কেনা ডেইলি প্রফেটটা হাতে নিয়ে বসল।

হ্যারিকে খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হারমিওন বলল- না, খবর কিছু নেই, আমি তো রোজই পড়ি, তৃতীয় টাস্কের পর ছোট করে খবর ছেপেছিল- হ্যারিপটার টুর্নামেন্ট জিতেছে। সেডরিকের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেনি, তার সম্বন্ধে কিছুই না। এর কারণ যদি আমাকে জিজ্ঞেস কর তাহলে বলবো- ফাজ ওদের ওপর চাপ দিয়েছে চুপ থাকার জন্য। 

হ্যারি বলল- হতে পারে; কিন্তু রিটা স্কীটারকে উনি চুপ করিয়ে রাখতে পারবেন? 

ওহ কেন মাথা খারাপ করছ। তৃতীয় টাস্কের ব্যাপারে কিছুই লেখেনি স্কীটার, হারমিওন বলল, ওর একই রকম স্বরে। -আমার থুথু খেতে চাওয়ার আগে রিটা স্কীটার কিছুই লিখবে না। 

রন বলল- কি সব বলছ…? 

– আমি অনেক তথ্য সগ্রহ করেছি, ও মাঠে না এসেও কেমন করে আমাদের গোপন কথা শুনল, হারমিওন এক নিশ্বাসে বলল। 

হ্যারি ভেবেছিল, হারমিওন এ বিষয়ে বলার জন্য আঁকুপাকু করছে… কিন্তু ও নির্বিকার। রন বলল- কেমন করে? আমাদের তো তুমি কিছুই বললে না। 

– সেটা কি হতে পারে তুমিই আমাকে আইডিয়াটা দিয়েছিলে, হ্যারি, হারমিওন বলল। 

– আমি? হ্যারি বলল। কেমন করে, কখন?

হারমিওন হাসতে হাসতে বলল- গোপনে স্থাপিত ধ্বনি বির্ধক… যাকে বলে মাইক্রোফোন বাগিং! 

– কিন্তু তুমিই তো বলেছিলে ওটা কাজের নয় 

– আরে না না ইলেকট্রনিক্স নয়। শোন, …রিটা স্কীটার একজন বেআইনি অ্যানিমেগাস, ও পারে। কথাটা বলে হারমিওন ওর ব্যাগ থেকে সিল করা ছোট একটা কাঁচের জার বের করল। 

পারে, মানে নিজেকে গুবড়েপোকা বানাতে পারে। 

তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছ, রন বলল 

হারমিওন কাচের ছোট জারটা ওদের সামনে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল- ও করেছে। 

কাচের জারের মধ্যে একটা মোটা-সোটা নোমওয়ালা গুবড়েপোকা ছাড়া রয়েছে ছোট ছোট গাছের ডাল আর পাতায়। আমি এটাকে হসপিটালের জানালাতে ধরেছি। খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করে দেখ এর গায়ের চারধারে সূক্ষ্ম ‘এ্যানটেনা’ আছে সেটা ও যে নোংরা চশমা পরে ঠিক তারই মতো। 

হ্যারি দেখল হ্যাঁ ও ঠিকই বলছে। ওর মনে পড়ে গেল যেদিন হ্যাগ্রিড ম্যাডাম ম্যাক্সিমকে ওর মায়ের কথা বলছিল- মূর্তির ওপর একটা গুবড়েপোকা আমরা দেখেছিলাম। 

– ঠিকই বলেছে, হারমিওন বলল।-লেকের ধারে বেড়াবার সময় ভিক্টর ক্রাম আমার মাথার চুলের ওপর একটা গবড়েপোকা দেখেছিল- ভবিষ্যৎ কথনের ক্লাসে তোমার মাথার যন্ত্রণার সময় রিটাও সেদিন সারা বছরের খবর সংগ্রহের জন্য জানালার ধারে, মাঠে স্কুলের আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। স্নিদারিনরাও বেআইনি কাজকর্ম করছে জেনেও তাকে মদৎ দিয়েছিল।…আমি লন্ডনে গিয়ে ওর বিরুদ্ধে বলব, ও খবর সংগ্রহের জন্য অনবরত বেআইনি কাজ করে। আমি ওকে বলেছি, ভবিষ্যতে যা ইচ্ছে তাই লিখলে বিপদে পড়বে। 

কামরার দরজা ঠেলে ঢুকল ম্যালফয়, ক্রেব আর গোয়েলে। ওদের মুখ চোখের চেহারা অত্যন্ত কুৎসিত আর অভদ্ৰজনক। 

– গ্রেঞ্জার তুমি নিজেকে খুব চালাক মনে করেছ? ড্র্যাকো ম্যালফয় বলল, তারপর কম্পার্টমেন্টে ঢুকে ওদের দিকে তাকাল। শুনলাম তুমি কতগুলো তৃতীয় শ্রেণীর রিপোর্টারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ, পটার ডাম্বলডোরের এখন আবার দারুণ প্রিয় পাত্র। 

ম্যালফয়ের দিকে তাকিয়ে হ্যারি বলল- এখান থেকে বের হও, আমাদের এই কামরা থেকে বলছি, বেরিয়ে যাও। 

 সেডরিকের মৃত্যুর শোকসভায় ডাম্বলডোরের ভাষণের দৃশ্য’ হ্যারির চোখের সামনে ভেসে উঠল। এখনও ওদের হালকা হালকা ব্যঙ্গাত্মক হাসি ওর কানে ভেসে আসছে। 

হ্যারির হাত নিশপিশ করে উঠল। ও আলখেল্লার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে জাদুদণ্ডে হাত দিল। 

ম্যালফয় বলল- পটার তুমি অতি মূখ ও হেরে যাওয়া লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছ। আমি আগেই তোমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম ভেবে-চিন্তে বন্ধু ঠিক করবে- সেই প্রথম দিন, যেদিন হোগার্টে যাবার সময় তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। মনে আছে কি বলেছিলাম? কথাটা বলে ও রন আর হারমিওনের দিকে মাথা ঝাকিয়ে তাকাল। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে পটার! ডার্কলর্ড ফিরে এসেছেন- এখন ওদের বিদায় নেবার পালা। প্রথমে মাডব্লাডস আর মাগলপ্রেমী… দ্বিতীয়… ওয়েল প্রথম বলি ডিগরি…। 

হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ মনে হলো কে যেন কম্পার্টমেন্টে এক সাথে অনেকগুলো পটকা ছুঁড়তে শুরু করল। দারুণ শব্দ করে আঘাত হানল ম্যালফয়, আর গোয়েলের ওপর। হ্যারি দেখল ওরা চেতনা হারিয়ে কম্পার্টমেন্টের মেঝেতে চিৎপটাং হয়ে পড়ে রয়েছে। 

হারমিওন, রন ও হ্যারি ওরা তিনজনই আলাদা আলাদা সম্মোহনী জাদু প্রয়োগ করেছে ওদের ওপর। 

কামরার দিকে ফ্রেড আর জর্জকে আসতে দেখা গেল। 

জর্জ বলল- দারুণ ইন্টারেস্টিং তোমাদের মধ্যে কে ফার্নানকুলাস কার্স প্রয়োগ করলে? 

হ্যারি বুক ফুলিয়ে বলল- আমি।

বাজে ধরনের খারাপ এটি, জর্জ হালকা চালে বলল। 

আমি জেলী লেগস ব্যবহার করেছি ওদের মুখে একটু একটু করে সরু সরু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জন্মাবে। ওদের এখানে রাখা ঠিক হবে না। যে দেখবে ভয় পাবে। সরিয়ে দাও করিডলরে। 

রন, হ্যারি আর জর্জ ম্যালফয়, ক্র্যাব আর গোয়েলের চেতনাহীন দেহে লাথি মেরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। 

ফ্রেড পকেট থেকে এক প্যাকেট তাস বের করে বলল- তাস চলবে? 

খেলা যখন অর্ধেক হয়ে গেছে হ্যারি মনস্থির করল একটা কথ ওকো জিজ্ঞেস করে। জর্জকে জিজ্ঞেস করল, এবার কাকে ব্ল্যাকমেল করলে? 

জর্জ বলল- ওহ সেই ব্যাপার? 

ফ্রেড বলল- বাদ দাও, খুব একটা বিশেষ ব্যাপার নয়। পরে আলোচনা করলেও চলবে। 

জর্জ কাঁধ নাচিয়ে বলল- ওসব ছেড়ে দিয়েছি। 

হ্যারি, রন বা হারমিওন কেউ ওকে ছাড়ে না, চাপাচাপি করে। বলতেই হবে শেষ পর্যন্ত ফ্রেড বলল- ঠিক আছে ঠিক আছে, যদি সত্যি সত্যি জানতে চাও লাডো বেগম্যানকে। 

বেগম্যান, হ্যারি বলল- তাহলে তুমি কী বলতে চাও? ও জড়িত ছিল…! 

একদম না, জর্জ বিষন্ন মুখে বলল। সেরকম কিছু নয়। মূর্খ অপদার্থ। মাথায় গোবর পোরা। 

রন বলল- তাহলে…? 

কিডিচ কাপের খেলার সময় ওর সঙ্গে আমরা যে বাজি ধরে ছিলাম? আমরা বলেছিলাম, আয়ারল্যান্ড জিতবে কিন্তু ক্রাম স্নিচ পাবে। তা-ই হয়েছিলো আর ও বাজিতে হেরেছিলো। 

হ্যারি, রন বলল- খুব মনে আছে। 

মূখ অপদার্থটা হেরে গিয়ে আমাদের আইরিশ ম্যাক্সটদের কাছ থেকে পাওয়া লেপরেচাউন সোনা দিয়েছিল। 

তাহলে?

তাহলে কী হল? 

তারপর ও অদৃশ্য হয়ে গেল, তাই না? পরের দিন সকালে লেপরেচাউন সোনা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। 

হারমিওন বলল- দুর্ঘটনাও তো হতে পারে, হতে পারে না? 

জর্জ তিক্তভাবে হাসল, হঁ্যা, সেই রকমতো প্রথমে ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম ওকে লিখে জানাই ও কোথায় একটা ভুল করেছে, চিঠিটা পড়ে ও হাসতে পারে। কিন্তু কোনও উপায় নেই। চিঠির পাত্তাই দিলো না। হোগার্টে, ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু নানা ধানাই-পানাই করে আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে লাগল। 

– শেষে আরও উৎপটাং কাজ করতে লাগল, ফ্রেড বলল। বলল- আমরা নাকি বাচ্চা ছেলে… বাজিটাজি ধরার বয়স হয়নি, তাই সে বাজির টাকা দেয়নি। 

জর্জ ভ্রুকুটি করে বলল- কথাটা শুনে টাকা ফেরত চাইলাম। 

হারমিওন ওকে কথাটা শেষ না করতে দিয়ে দ্রুত বলল, অস্বীকার তো করেনি। 

ফ্রেড বলল, তা একরকম সত্যি।

রন বলল, সেটাই তো তোমাদের সঞ্চয় ছিল। 

জর্জ বলল- যাকগে… শেষে আসল ব্যাপার আমরা ধরতে পারলাম। লী জোর্ডানের বাবার বেগম্যানের কাছ থেকে পাওনা-টাওনার একটা ব্যাপার ছিল। জানা গেল ওর গবলিনদের সঙ্গেও বেশ গোলমাল চলছে। ওদের কাছ থেকে গোল্ড ধার নিয়েছে। ওয়ার্ল্ডকাপ শেষ হবার পর ওদের একদল ওকে জঙ্গলের মধ্যে চেপে ধরে, যা কিছু ওর কাছে ছিল সব কেড়ে-কুড়ে নিল। তাহলেও ওর কাছে যা পাওনা ছিল তার সবটা পেলো না। ওরা হোগার্টে পর্যন্ত ওকে ধাওয়া করল। ও তো জুয়ো খেলে সর্বস্বান্ত। হাতে দুটো গ্যালিয়নও নেই। তোমরা জান সেই ধূর্ত ইডিয়টটা কেমন করে গবলিনদের দেনা পরিশোধের চেষ্টা করেছিল? 

হ্যারি আগ্রহের সঙ্গে বলল- কেমন করে?

ফ্রেড বলল, টুর্নামেন্টেকে জিতবে এ বিষয়ে গবলিনদের সঙ্গে বাজি রেখে…।

– ও বুঝেছি… ও কেন আমি জিতি তার চেষ্টা করছিলেন! 

হ্যারি বলল, তো আমি জিতেছি… জিতিনি?… তাহলে তো তোমার ধার ফেরত দিতে পারে। 

কোনো আশা নেই, জর্জ বলল,। গবলিনরা বোকা নয়, বলল, তুমি তো একা জেতোনি ভিগরি আর তুমি একসঙ্গে জিতেছ। বেগম্যান তো তুমি জিতবে সেই বাজি ধরেছিল। 

জর্জ বড় একটি শ্বাস নিয়ে তাশ ‘সাফল’ করতে লাগল।

হ্যারির মোটেই চায় না ট্রেনটা কিং ক্ৰশে থামুক। সমস্ত গরমের ছুটিটা রন, হারমিওন, ফ্রেড, জর্জের সঙ্গে ট্রেনে আড্ডা মারতে মারতে কাটিয়ে দিক। 

হ্যারি শুনেছে, অপ্রীতিকর জিনিসের সামনে পৌছুতে সময়, বছর যে গতিতে চলে তেমনই চলে যায়, একটুকুও বিলম্ব হয় না। ঠিক নটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে হোগার্ট এক্সপ্রেস ধীরে ধীরে প্লাটফরমে থামল। ছাত্রছাত্রী বাড়ি ফিরছে, মনে তাদের আনন্দের শেষ নেই। বাক্স প্যাটরা, জিনিসপত্র নিয়ে হইচই করতে করতে ট্রেন থেকে প্লাটফরমে নামল। হারমিওন ও রন… ম্যালফয়, ক্রেব আর গোয়েলেকে ডিঙিয়ে নামতে একটু অসুবিধেতে পড়ল। 

হ্যারি না নেমে বলল,- ফ্রেড, জর্জ এক সেকেন্ড দাঁড়াবে।

হ্যারি ওর ট্রাঙ্কটা খুলে ‘ট্রাইউইজার্ড প্রাইজ বের করল। 

– এটা নাও, হ্যারি বলল। ব্যাগটা জর্জের হাতে দিল। আমার এটা দরকার নেই। 

– পাগল, তোমার মাথা ঠিক আছে তো? জর্জ ব্যাগটা হ্যারির হাতে ফেরত দিতে গেল। 

হ্যারি বলল,- না ওটা আমি নেবো না।… তুমি নাও।

ফ্রেড বলল- কী বলছ? হতবুদ্ধি হয়ে হ্যারির মুখের পানে তাকাল। 

– না, আমি নেবো না। প্লিজ তোমরা নাও, এটা দিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার কর, জোকশপের জন্য দিলাম। 

– সত্যি ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ফ্রেড অদ্ভুত এক স্বরে বলল। 

হ্যারি আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলল- শোন, তোমরা যদি এই সোনাগুলো না নাও তাহলে আমি নর্দমায় ফেলে দেব। আমি এটা চাই না, এটা আমি নেবোও না। আমার দরকার নেই। সোনাগুলো নিতে পারলে আমি সবচেয়ে খুশি হতাম- হাসতে পারতাম। তোমরাও পারতে। আমার মন বলছে আমার না নেওয়াই ভাল। 

জর্জ ক্ষীণ স্বরে বলল- হ্যারি। ব্যাগটার ওজন পরীক্ষা করতে করতে বলল এক হাজার গ্যালিওন তো হবেই। 

হ্যারি হেসে বলল- তাই হবে।… ভাবতে পার কতগুলো ক্যানারি ক্রিম’ হবে। 

যমজ ভাইরা হ্যারির দিকে তাকাল। 

– তোমাদের মাকে বলবে কোথা থেকে পেয়েছ, তাহলে তোমাদের ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ে চাকরি নেবার মোটেই উৎসাহ দেখাবেন না। ভেবে দেখ। 

– হ্যারি, ফ্রেড বলল।

কথাটা শেষ করবার আগেই হ্যারি ওর জাদুদণ্ড বের করল। 

যদি না নাও, তাহলে তোমাকে সম্মোহিত করব। হ্যা আরও একটা কথা, রনের জন্য দু’একটা ভাল আলখেল্লা কিনে দেবে। আমি দিয়েছি বলবে না। 

ও কমপার্টমেন্টে পড়ে থাকা ম্যালফয়, ক্রেব আর গোয়েলের দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওদের ওপর দিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে প্লাটফরমে নামল। 

স্টেশনে আঙ্কেল ভার্নন এসেছেন… একটু দূরে দাঁড়িয়ে। মিসেস উইসলি ওর কাছে আসলেন। হ্যারিকে সস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললেন- মনে হয় গরমের ছুটির শেষ দিকে ডাম্বলডোর তোমাকে আমাদের বাড়িতে আসতে দেবেন। হ্যারি, আমাদের খবরাখবর দিও। 

হ্যারির পিঠে চাপড় মেরে রন বলল- দেখা হবে বন্ধু। 

হারমিওন বলল- বাই হ্যারি। কথাটা বলে আগে কখনও যা করেনি তাই করল। ও হ্যারির গালে চুম্বন করল। 

ফ্রেড জর্জ ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল- ধন্যবাদ হ্যারি। 

হ্যারি ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। তারপর আঙ্কেল ভার্ননের সঙ্গে নিঃশব্দে স্টেশন থেকে বাইরে চলল। আঙ্কল ভার্ননের গাড়িতে উঠতে উঠতে হ্যারি নিজেকে আশ্বস্ত করলো এই ভেবে যে অযথা শঙ্কা করে কি লাভ। 

হ্যাগ্রিড ওকে সব সময় বলেন, যা হবার তা হবেই। দুঃখ, অসুবিধে, বিপদ সামনে এসে দাঁড়ালে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করবে, ভীরুর মতো পিছু হটবে না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *