1 of 2

৩৬. চীনের প্রথম ঐতিহাসিক রাজা

অধ্যায় ৩৬ – চীনের প্রথম ঐতিহাসিক রাজা

১২০০ সাল নাগাদ চীনে শ্যাং কামাররা ব্রোঞ্জের শিলালিপি তৈরি করছিলেন, সন্ন্যাসীরা হাড়গোড়ে খোদাই করে উপাসনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং শ্যাং রাজা ইন শহর থেকে রাজ্য শাসন করছিলেন। প্রায় ১০০ বছর পর নতুন কোনো শ্যাং রাজার নামধাম শোনা যায় ইতিহাসের পাতায়, যার নাম ছিল উ টিং।

এই ঘটনা ঘটার ১০০ বছর পর প্রাচীন ইতিহাসের বই ‘শু চিং’ লেখা হয়। সিমা কিয়ান তার ইতিহাস বইয়ের সূত্র হিসেবে একে ব্যবহার করেছেন। শু চিং-এর বর্ণনা অনুযায়ী, উ টিং তার জীবনের প্রথম বছরগুলো ‘নিম্নগোত্রের মানুষের সঙ্গে পার করেছেন, যাদের মধ্যে ছিল দরিদ্র কৃষকরা। এরপর নিশ্চুপ অবস্থায় তিনি তার শাসন শুরু করেন। ইতিহাস আমাদেরকে জানায়, ‘তিনি ৩ বছর কোনো কথাই বলেননি।’

এরপরেও তার কথা বলার কোনো ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু যখন তিনি কথা বলতেন, তখন সেগুলোতে থাকত সংগীতের মূর্ছনার মতো সুবিন্যস্ত প্রজ্ঞা। তিনি কখনোই অকারণে বিশ্রাম নিতেন না। তিনি এমনভাবে সমগ্র ইন অঞ্চলে রাজত্ব করতেন যে, কোথাও কোনো ফিসফিস শব্দও হত না।

নীরবতার সঙ্গে কথা কম বলার প্রবণতা, এ দুটি গুণ রাজা-বাদশাহদের ক্ষেত্রে খুবই বিরল। যেমনটা বিরল ছিল প্যান কেংয়ের বারবার রাজধানী পরিবর্তনের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চারের দাবি। সে-যুগে হিট্টিট, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয় ও মিশরীয় শাসকদের সারাক্ষণ হুমকি-ধামকি, অনুরোধ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, চিঠি, প্রতিনিধি ও কূটনীতিক আদান-প্রদানের মাঝে শ্যাংদের শক্তিমত্তার সঙ্গে টিকে থাকার জন্য বিশেষ কোনো শক্তির উৎস ছিল।

কিন্তু উ টিং-এর মতো, ইন শহরে শ্যাংদের রাজত্বের সময়টা নিয়ে ইতিহাস প্রায় নিশ্চুপ বলা যায়। চিঠি ও ট্যাবলেট রেখে যাওয়ার বদলে শ্যাংরা কিছু বাড়িঘর, হাড়গোড় ও ব্রোঞ্জের তৈরি জিনিসপত্র রেখে গেছে। এগুলো থেকে আমরা শ্যাংদের জীবনযাপন সম্পর্কে সামান্য ধারণা পাই, তবে তা যথেষ্ট নয়।

শ্যাংদের বানানো বেশিরভাগ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তৈরি হয়েছে ব্রোঞ্জ দিয়ে। এর মধ্যে রয়েছে যানবাহন, অস্ত্র, চাষাবাদে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও গয়না। এগুলোর মাধ্যমে শ্যাং শাসকদের আধিপত্য প্রকাশ পায়। পিরামিড বানানোর মতো, ব্রোঞ্জের খোদাই-করা উপকরণ তৈরি করার জন্য এমন একজন শাসকের প্রয়োজন ছিল, যিনি নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হাজারো মানুষকে এই কষ্টকর ও কায়িক শ্রমনির্ভর কাজগুলো করিয়ে নিতে পারতেন (একদম ফারাওদের মতো)। শুধুমাত্র ইয়েলো নদীর কাছাকাছি অবস্থিত খনিগুলো থেকে ব্রোঞ্জ আহরণ করতেই অসংখ্য মানুষকে উদয়াস্ত খাটতে হত।

খনিতে খননকাজে ব্যস্ত শ্রমিক ও কারিগররা ‘মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে শৈল্পিক অর্জন’ তৈরি করলেন বলে দাবি করেন প্রাচীন চীনের একজন বিদ্বান। তার মতে, অন্য কোনো প্রাচীন জাতি ব্রোঞ্জ ঢালাই করে এত জটিল কারুকাজ করতে পারেনি। ব্রোঞ্জের হাতলওয়ালা বর্শার উপর ফিরোজা পাথর ও সাদা জেড পাথরের ব্লেড বসানো হয়েছিল। ব্রোঞ্জের ফিতে দিয়ে ঘোড়ার লাগাম বেঁধে রেখেছিলেন তারা। এছাড়াও ব্রোঞ্জের তৈরি মুখোশগুলো যোদ্ধাদের এক বিচিত্র অভিব্যক্তি দিয়েছিল। খাদ্য ও পানীয়র পাত্রগুলোতে সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্রোঞ্জের নকশা ব্যবহার করা হত। এগুলো কখনও ড্রাগন, ষাঁড় বা অন্যান্য প্রাণীর আকারে তৈরি হত। এদের গায়ে ও হাতলে থাকত জটিল ও সূক্ষ্ম কারুকাজ। কিছু পাত্রে নাম অথবা পাত্রের ব্যবহার বোঝানোর জন্য লিখিত বর্ণনা থাকত। মাঝে মাঝে কিছু লেখনীতে কোনো বছরের নাম বা উৎসবের নাম সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হত।

এই ছড়ানোছিটানো তথ্য পরিমাণে কম হলেও তা প্রমাণ করে, শ্যাংরা লেখনীর ব্যবহারে বেশি উন্নত ছিল। চীনেও মেসোপটেমিয়া ও ক্রিটের মতো, একইভাবে লেখালেখির প্রচলন হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালে সম্পদের মালিকানা প্রকাশের জন্য শুরুতে এর প্রচলন হলেও পরে বিভিন্ন জটিল কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। তবে চীনা লেখনীর ধারার সঙ্গে পৃথিবীর বাকি অংশের কোনো প্রভাব পড়েনি। ইয়েলো নদীর কাছে পাওয়া চিহ্নগুলো দেখতে ছবির মতো হলেও, চীনের লেখনীতে প্রথমবারের মতো একাধিক ছবি জুড়ে লেখালেখির বিষয়টি আসে। একক ছবির পরিবর্তে বেশকিছু ছবির সন্নিবেশে মনের ভাব প্রকাশের বিষয়টি প্রাচীন চীনেই প্রথম দেখা যায়।

‘কম্পোজিট ইডিওগ্রাম’ নামে পরিচিত এই লেখাগুলো ইন শহরে রাজধানী স্থানান্তরের সময়কালে যথেষ্ট পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। ফলে বিভিন্ন প্রশ্নের দৈব উত্তর দেওয়ার মতো সক্ষমতাও অর্জন করে এই ভাষা। শ্যাং রাজধানীর ধ্বংসস্তূপে প্রত্নতত্ত্ববিদরা হাড়গোড়ের ওপর খোদাই করা হাজারো লেখনী পেয়েছেন। শ্যাং রাজসভার পূজারিদের কাছ থেকে বিভিন্ন জাগতিক সমস্যার সমাধান চাইতে আসতেন নর-নারীরা। তখন তারা গরু, ভেড়া অথবা কচ্ছপের পরিষ্কার করা ও শুকানো হাড় নিয়ে আসতেন। এই হাড়গুলোতে বিভিন্ন নকশা ও লেখনী থাকত। তারপর তারা এই হাড়গুলোকে একটি উত্তপ্ত লোহার দণ্ড দিয়ে স্পর্শ করতেন। তখন উত্তাপে হাড়ের ওপর ফুটে উঠত তাদের ‘সমাধান’।

এই অতিপাত বলে দেওয়া হাড়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রশ্ন যাই হোক-না কেন আর যিনিই জিজ্ঞাসা করুক-না কেন, উত্তরের সঙ্গে সবসময় ক্ষমতাসীন রাজার নাম জড়িয়ে থাকত।

প্রাচীন ইতিহাসবিদ শু চিং রাজা উ টিংয়ের প্রশংসা করেন তার কঠোর পরিশ্রম করার জন্য, ভোগবিলাসে মত্ত না-হওয়ার জন্য এবং তার সমগ্র শাসনামলে মানুষের মনে শান্তি এনে দেওয়ার জন্য। ‘সামান্য কোনো শব্দও ছিল না’ তার আমলে। একই সময় দর্শনশাস্ত্রের ওপর লেখা বই ই চিং (পরিবর্তনের বই)-এ উ টিং-এর ইতিবাচক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই বইয়ের ঘটনা অনুযায়ী, তিনি উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে কিছু বিদ্রোহী গোত্রকে শায়েস্তা করতে গিয়েছিলেন। আরও ৭০০ বছর পর লেখা শিহ চিং (গানের বই)-এ তাকে একটি বিশাল ভূখণ্ডের শাসনকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

তার এই দুই ধরনের চিত্রায়ন বেশ সাংঘর্ষিক বলা যায়। একাধারে তাকে একজন ভদ্র ও কঠোর পরিশ্রমী রাজা হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যিনি দেশের মানুষের স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করতে ব্যস্ত আবার অপরদিকে বিদ্রোহীদের দমন করে তাদের কাছ থেকে উপঢৌকন চাওয়া ব্যক্তির ভূমিকায় তিনি যেন খুবই বেমানান। তাকে নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলোতে দ্বৈত ভাব সুস্পষ্ট। ইতিহাসবিদরা নিশ্চিত নন, তিনি কি চীনের ধর্মীয় নেতা ছিলেন, নাকি একজন সেনাপতির মতো যুদ্ধবাজ ছিলেন।

রাজধানী ইনে স্থানান্তর করার পর শ্যাং রাজা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শক্তিমত্তা জোগাড় করতে পেরেছিলেন। এ বিষয়ে তেমন কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। রাজধানী থেকে কিছুটা উত্তরে অবস্থিত রাজকীয় কবরস্থানে রাজাদের এমনভাবে কবর দেওয়া হয়েছিল, যা মিশরীয় পিরামিড থেকে বেশ খানিকটা ভিন্ন। আকাশচুম্বী পিরামিডের পরিবর্তে চৈনিক রাজাদের কবর দেওয়া হয়েছিল সুবিশাল গর্তে। এগুলো এত গভীর ছিল যে একেকটি কবর খুঁড়তে বেশ কয়েক বছর করে সময় লেগে গেছিল। এই গর্তগুলোতে ছিল প্রচুর মানব-বলিদানের নিদর্শন। এই মানুষগুলো তাদের রাজার সঙ্গে অবিকৃত মরদেহসহ কবরস্থ হননি। তাদেরকে এমন কোনো আশ্বাস দেওয়া হয়নি যে তাদের রাজা একসময় জেগে উঠে তাদেরকে পরবর্তী জীবনে সঙ্গে রাখবেন। বরং আমরা এখানে দেখতে পাই অঙ্গচ্ছেদকৃত, বিকৃত দেহাবশেষ। একটি কবরে ৭৩টি খুলি ৪টি সারিতে সাজানো অবস্থায় পাওয়া যায়। অন্য একটি অংশে মাথা ছাড়া ৫৯টি কঙ্কাল পাওয়া যায়। ইন শহরে প্রত্নতত্ত্ববিদরা একটি বেদি খুঁজে পেয়েছেন, যেখানে খুব সম্ভবত বলিদানের কাজগুলো হত।

এসবই আমাদেরকে ইঙ্গিত দেয়, সে আমলের রাজারা বেশ একনায়কসুলভ ছিলেন। বিশেষত, নিজে দেহত্যাগ করার পরেও যেভাবে অন্যদের মৃত্যুর (বলির মাধ্যমে) কারণ হতে পেরেছেন তারা, তাতে জীবিত অবস্থায় তাদের নিষ্ঠুরতা প্ৰমাণিত হয়।

তারপরেও একনায়ক রাজার পাশাপাশি ইতিহাসবিদ সিমা কিয়ান বারবারই রাজসভার বিভিন্ন কর্মকর্তা ও অভিজাত শ্রেণির অন্যান্য বড়কর্তাদের কথা বলেছেন। খুব সম্ভবত, খুব অল্প পরিমাণ এলাকাজুড়ে শ্যাং রাজার নিজস্ব প্রভাব- বলয় বিস্তৃত ছিল। এর বাইরের পুরো অংশটিতে এসব অভিজাত পরিবারের সদস্য ও কর্মকর্তারা তার নামে শাসনের কাজ চালাতেন, কিন্তু আদতে তারা তাদের নিজের ইচ্ছেতেই সবকিছু করতেন। শুধুমাত্র রাজাকে সময়ে সময়ে কিছু পরিমাণ নজরানা পাঠিয়ে তাকে তুষ্ট রাখতেন। মাঝে মাঝে কেউ রাজার কথা ভুলে গেলে রাজা সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাদের আওতাধীন গ্রামে বা শহরে লুটতরাজ চালিয়ে তাদেরকে নিজের অস্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দিতেন।

শ্যাং রাজার এই দুটি সাংঘর্ষিক চিত্রায়নকে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়, শ্যাং রাজা আক্ষরিকভাবে পুরো অঞ্চলের নেতা ছিলেন, কিন্তু তার বাস্তবসম্মত ও প্রকৃত ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত ছোট একটি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। উ টিং নিজে অন্যের সহায়তা ছাড়া রাজ্যশাসন করতে পারেননি। সিমা কিয়ানের মতে, তিনি তার ৩ বছরের নীরব থাকার সময়কালে এমন একজন কর্মকর্তার খোঁজ করেছেন, যিনি তার ডান হাত হিসেবে কাজ করবেন।

অবশেষে তিনি তার যোগ্য সহযোগী খুঁজে পেলেন। তিনি হলেন ফু ইয়েহ নামে এক ঋষি। ইনের পূর্বদিকে অবস্থিত এক শহরে একজন সাধারণ শ্রমিকের সঙ্গে কাজ করছিলেন তিনি। তখনই উ টিং তার ৩ বছরের নীরবতা ভেঙে দেশের শাসনভার কাঁধে তুলে নিলেন। রাজার আধ্যাত্মিক গুণাবলি যতই থাকুক- না কেন, তাকে দেশশাসনের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। শুধু ঋষিসুলভ সহকারীই নয়, তাকে শ্যাং-রাজত্বের দূরদূরান্তের অঞ্চলগুলো শাসন করার জন্য সেসব অভিজাত শ্রেণির মানুষ ও তাদের সামরিক শক্তিমত্তার সহায়তা নিতে হয়েছিল।

তবে এর সবই জল্পনাকল্পনা, কারণ উ টিং-এর গল্পগুলো আমরা খুঁজে পেয়েছি ব্রোঞ্জ ও হাড়গোড়ের মাঝে, এবং তাও ঘটনাগুলো ঘটার অন্তত ১ হাজার বছর পরে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *