৩৫. নকোয়া গ্রাম থেকে রাঙসুঙ

৩৫.

নানকোয়া গ্রাম থেকে রাঙসুঙ সরাসরি এসে উঠল পোকরি কেসুঙে। সাঞ্চামখাবার বাইরের ঘরে জাঁকিয়ে বসল। রাঙসুঙের সঙ্গে জনকয়েক জোয়ান ছেলে এসেছে। তাদের হাতে বড় বড় বর্শার ফলা ঝকমক করছে।

রাঙসুঙ মেজিচিজুঙের বাপ।

সমস্ত কেসুঙটাকে কাঁপিয়ে একটা হুঙ্কার ছাড়ল রাঙসুঙ, নসু কেহেঙ মাসে বউপণ পাঠালুম। এখনও তোর মেয়ের বিয়ে দিলি না! খারে বর্শাগুলো মেরে দেবার মতলব নাকি? এদিকে আমার ছেলেটা পাহাড়ে বাঘ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘরে থাকে না।

বিয়ে তো দেব, কিন্তু আমার মেয়েটা যে উধাও হয়েছে।

উধাও হয়েছে।

হু-হু, মেহেলীটা কেলুরি বস্তিতে পালিয়ে গেছে। হুই বস্তির সেঙাইকে বিয়ে করতে চায়।

সেঙাইকে বিয়ে করলেই হল! আমরা আগে মেয়ের বায়না দিয়ে গেছি। রক্তচোখে তাকাল রাঙসুঙ।

অপরাধীর মতো মুখ করে সাঞ্চামখাবা বলল, হু-হু, সে কথা তো একশো বার মানি। মেহেলীটা বস্তিতে থাকলে এই মাসেই বিয়ে দিতুম। কিন্তু এখন কী করি, তোরাই বল?

হুঙ্কারটা এবার আরো জোরাল শোনাল। প্রথমে ধিক্কারে গলাটা দপ করে জ্বলে উঠল রাঙসুঙের, তোরা একেবারে মাগীরও অধম। ঘর থেকে মেয়ে কেমন করে পালায়! বর্শা ছিল না? ফুড়ে রাখতে পারলি না!

ছিল। বর্শা হাঁকড়েই তো রাখতে চেয়েছিলাম মেহেলীকে, কিন্তু তার আগেই যে শয়তানের বাচ্চাটা জঙ্গলে ভাগল।

হুঃ! বিকট শব্দ করে রাঙসুঙ বলল, তারপর?

তারপর সেদিন সন্ধের সময় পলিঙা এসে খবর দিল, মেহেলী হুই কেলুরি বস্তিতে ভেগেছে। আমরা কী করি বল? সাঞ্চামখাবাকে বড়ই ম্রিয়মাণ দেখাতে লাগল।

হু–হুস করে আবার একটা লম্বা আওয়াজ করল রাঙসুঙ। খরধার বর্শার বাজুটা বাগিয়ে ধরে বলল, একেবারে ছাগী হয়ে গেছিস তোরা। কত বড় বংশ তোদের! তোদের বংশের মেয়ে ছিনিয়ে নিতে এসে কেলুরি বস্তির জেভেখাঙ মরেছিল। মেয়ে নিতে এসে তোদের কাছে কত মানুষ মাথা রেখে গেছে। এমন বনেদি বংশ তোদের, সেই বংশের নামডাক শুনে একটা মেয়ে নিয়ে ছেলের বউ করব ভেবেছিলুম।

হু-হু, বংশটা আমাদের সত্যিই বনেদি। লোটারা, সাঙটামরা, আওরা, কোনিয়াকরা–এই নাগা পাহাড়ের সব জাতের মানুষই আমাদের বংশকে খাতির করে চলে। কথাটা ঠিকই বলেছিস রাঙসুঙ। বংশগৌরবে রীতিমতো উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল সাঞ্চামোবা।

রাঙসুঙের মেজাজটা বড়ই বেয়াড়া ধরনের। নিমেষে সাঞ্চামখাবার উদ্দীপনা নিভিয়ে দিল। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে হুমকে উঠল রাঙসুঙ, থাম থাম, বেশি ফ্যাকর ফ্যাকর করতে হবে না। হুই মুখে মুখেই তোদের বংশের যত কেরামতি। না হলে ঘরের মেয়ে পিরিতের ঠেলায় শব্দুরদের বস্তিতে গিয়ে উঠতে পারে! মাগীটাকে আর ওর পিরিতের ছোঁড়াটাকে কুপিয়ে মুণ্ডু কেটে মোরাঙে ঝুলিয়ে রাখতে পারলি না?

হু-হু, কী করি বল। কেলুরি বস্তিতে তাগড়া তাগড়া সব জোয়ান ছোকরা রয়েছে। বর্শা হাঁকড়ায়। সুচের একটা কোপ ঝাড়লে অনিজার বাপের সাধ্যি নেই যে বাঁচায়। কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ল সাঞ্চামখাবা।

কী বললি! জানের ভয়ে বস্তির ইজ্জত বংশের ইজ্জত, সব সাবাড় করতে হবে–এমন মরদ তুই! আহে ভু টেলো। সমস্ত কেসুঙটাকে কাঁপিয়ে, ছোট্ট পাহাড়ী জনপদ সালুয়ালাকে আচমকা ভয় পাইয়ে দিয়ে বীভৎস গলায় গর্জে উঠল রাঙসুঙ, ওরে টেফঙের বাচ্চা, তোর মেয়েটার জন্যে যখন বউপণ পাঠিয়েই দিয়েছি তখন ও আমার ছেলের বউ হয়ে গেছে। আমাদের বস্তি তো বেশি দূরে নয়। তিনটে চড়াই আর দুটো খাড়াই পাহাড় পেরুলেই যাওয়া। যায়। একটা লোক পাঠিয়ে দিতে পারলি না? পাঁচশো জোয়ান এনে মাগীটাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতাম। হুই সেঙাই ছোকরাটাকে এনে ওর মাংস দিয়ে কাবাব বানিয়ে খেতাম।

হু-হু, ঠিক বলেছিস। এই বুদ্ধিটা তখন ঠিক জোগায়নি। নইলে ঠিক খবর দিতুম। যাক ও সব। তোর মেজাজটা বিগড়ে গেছে। একটু রোহি মধু গিলে সেটাকে চাঙ্গা করে নে। ভীরু, ফিসফিস গলায় সাঞ্চামখাবা বলল।

হু-হু, তাই নিয়ে আয়। ইজা হুবতা! নির্বিকার ভঙ্গিতে গালাগালিটা আউড়ে কটমট করে তাকাল রাঙসুঙ। বলল, খবরটা শুনে মন একেবারে খিঁচড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, তোর মুণ্ডুটাই বর্শার মাথায় গেঁথে বস্তিতে নিয়ে যাই।

আহে ভু টেলো! কুৎসিত গলায় খেউড় গেয়ে উঠল সাঞ্চামখাবা। এতক্ষণ চুপচাপ, ভীরু এবং কুণ্ঠিত হয়ে থাকার পর চিৎকার করে উঠল সে। তার গলায় যেন বাজ চমকাল, ওরে টেফঙের বাচ্চা, আমার মুণ্ডু কেটে নিয়ে যেতে এসেছিস!

এসেছি তোবাদামি পাথরের আসন থেকে লাফিয়ে উঠল রাঙসুঙ। বিরাট মাথাটা ঘনঘন নড়ছে। দোলানিতে আউ পাখির পালকের অদ্ভুত মুকুটটা দুলছে। পরনে আরি পী কাপড়। নরমুণ্ড, বাঘের মাথা, চিতাবাঘের থাবা, বুনো মোষের শিঙ–পাহাড়ী পৃথিবীর ভয়াল সব ছবি সেই কাপড়ে আঁকা রয়েছে। ছোট ছোট চাপা চোখে পিঙ্গল রঙের মণিদুটো জ্বলছে। পুরু পুরু কালো ঠোঁটের ফাঁকে লালচে দাঁতগুলো ভয়ানকভাবে খিঁচিয়ে রয়েছে। বর্শার ফলায় হত্যার প্রতিজ্ঞাটা যেন ঝকমক করছে। নানকোয়া বস্তি থেকে আসার আগে সে কি ভাবতে পেরেছিল, তার থাবার এই বর্শাটার জন্য এমন একটা রক্তের ভোজ এই সালুয়ালাঙ পাহাড়ে অপেক্ষা করছে! রাঙসুঙ প্রচণ্ড শব্দ করে গর্জন করল, আজ তোর রক্ত নিয়ে গিয়ে মোরাঙ চিত্তির করব। আর মুণ্ডু গেঁথে রাখব টেটসে আনিজার চত্বরে।

সামনে দাঁড়িয়ে খোঁচা খাওয়া জখমী জানোয়ারের মতো ফুঁসছিল সাঞ্চামখাবা। উত্তেজনায় রাগে কোমর থেকে জঙগুপি কাপড়ের বাঁধন শিথিল হয়ে ঝুলে পড়েছে। শরীরের পেশীতে পেশীতে আদিম, হিংস্র ক্রোধ ফুলে ফুলে উঠছে। চক্ষের পলকে বাঁশের দেওয়াল থেকে সেও একটা বিশাল সুচেন্যু টেনে নিল।

মুখোমুখি দুই প্রতিপক্ষ। দুই পাহাড়ী হিংসা। সালুয়ালাঙ আর নানকোয়া বস্তি। সাঞ্চামখাবা আর রাঙসুঙ। একটু আগে তাদের দুজনের মনে একটা মধুর সম্পর্ক পাতাবার ইচ্ছা ছিল। রাঙসুঙ আর সাঞ্চামখাবা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিল, আত্মীয় হতে চেয়েছিল। কিন্তু পাহাড়ী মন দ্রুত পরিবর্তনশীল। নিমেষে তার মেজাজ বদলে যায়। এই মুহূর্তে সাঞ্চামখাবা আর রাঙসুঙ দু’টি প্রবল প্রতিপক্ষ, পরস্পরের সাঙ্ঘাতিক শত্রু।

পশ্চিম পাহাড়ের চুড়ায় বেলাশেষের রোদ নিভে আসতে শুরু করেছে। উপত্যকা মালভূমি বন-সব ঝাপসা দেখাচ্ছে। ধূসর রঙের পর্দার নিচে একটু একটু করে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে এই ছোট্ট পাহাড়ী জনপদ সালুয়ালাঙ, দূরের নীল টিজু নদী, আরো দূরের কেলুরি গ্রাম। ছয় আকাশ ছয় পাহাড়ে ঘেরা এই নাগা পাহাড় দৃষ্টির সামনে থেকে একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে।

বেলাশেষের খানিকটা ফ্যাকাসে আলো যাই-যাই করেও এখন পর্যন্ত বাইরের ঘরটায় আটকে রয়েছে। সেই আলোতে সাঞ্চামখাবা আর রাঙসুঙের দুজোড়া চোখের মণি দপদপ করে জ্বলছে। আর জ্বলছে একটি সুচেন্যু আর একটি বর্শার খরধার ফলা।

মারাত্মক কিছু একটা ঘটে যেতে পারত। এই পোকরি কেসুঙটা রক্তে মাখামাখি হত। কিন্তু তার আগেই সাঁ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল সালুয়ালা গ্রামের বুড়ো সর্দার। সুচেন্যু আর বর্শার শাণিত ফলায় দুটো নিশ্চিত হত্যার শপথ আচমকা বিচলিত হয়ে গেল। চমকে উঠল রাঙসুঙ এবং সাঞ্চামখাবা।

পাথর কাটা রুক্ষ মেঝেতে বসে হুস হুস করে বারকয়েক নিশ্বাস ছাড়ল বুড়ো সর্দার। হাঁপাতে হাঁপাতে যোলাটে চোখে দুজনকে দেখতে দেখতে হাঁ হাঁ করে উঠল, ইজা হুবতা! এই বিকেলবেলা দুই বেয়াই খুনখারাপি করবি নাকি? এই রাঙসুঙ, এই সাঞ্চামখাবা, বর্শা আর সুচে নামা রে মরদেরা। ওসব দেখলে মেজাজ বিগড়ে যায়।

টেনে নটুঙ! সাঞ্চামখাবা গর্জে উঠল, তুই এসেছিস সদ্দার, খুব ভালো হয়েছে। এই দ্যাখ না, শয়তানের বাচ্চা রাঙসুঙটা আমার মুণ্ডু নিয়ে যেতে চায়।

রাঙসুঙও তারস্বরে চেঁচাল, কতদিন হল বউপণ পাঠিয়ে দিয়েছি। এখনও মেয়ে বিয়ে দেবার নাম নেই। খারে বর্শাগুলো গায়েব করার মতলব। মেয়ে না পেলে ওর মুণ্ডু নেবই নেব। তুই কী বলিস সদ্দার?

হুঙ্কার দিল সাঞ্চামখাবা, তুই শুধু বল সদ্দার, রাঙসুঙটার ঘাড়ে একটা সুচের কোপ ঝাড়ি। নানকোয়া বস্তি থেকে এখানে ফুটুনি ফুটোতে এসেছে!

বিশাল দুখানা হাত দু’দিকে বাড়িয়ে দিল সর্দার। বলল, থাম শয়তানের বাচ্চারা। নানকোয়া, সালুয়ালাঙদুই বস্তিতে কতকালের খাতির। কতদিনের দোস্ত আমরা। নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি করলে চলবে কী করে?

উল্কি-আঁকা বীভৎস মুখ। সেই মুখটায় একটা বিজ্ঞ-বিজ্ঞ ছায়া পড়েছে বুড়ো সর্দারের, বোস তোরা, কারো মুণ্ডু নিতে হবে না। আমার কথা শোন। মজাদার সব খবর আছে।

কী খবর? কিসের খবর? হল্লা করতে করতে দু’পাশে ঘন হয়ে বসল সাঞ্চামখাবা আর রাঙসুঙ। বুড়ো সর্দার দুজনের হাত থেকে বর্শা এবং সুচে ছিনিয়ে নিল।

বুড়ো সর্দারের কাছে মনোরম গল্প আছে। গল্প! গল্প! পাহাড়ী মানুষেরা এই গল্পের নামে অদ্ভুত এক মৌতাতের সন্ধান পায়।

হু-হু। হুন্টসিঙ পাখির পালকের মুকুটটা অল্প অল্প নেড়ে বুড়ো সর্দার বলল, সেসব অনেক খবর, অনেক গল্প। একটু রোহি ধু নিয়ে আয় সাঞ্চামখাবা। গলাটা ভিজিয়ে নিই। সেই সঙ্গে গোটাকয়েক আউ পাখি ঝলসে আনিস। বড় খিদে পেয়েছে। মেজাজটাকে একটু চাঙ্গা করে নিতে হবে। কী বলিস রাঙসুঙ?

হু-হু। সমস্ত দেহ নাড়িয়ে রাঙসুঙ বলে, আমারও বড় খিদে পেয়েছে। সেই নানকোয়া বস্তি থেকে কখন বেরিয়েছি। অনেক চড়াই উতরাই ডিঙিয়ে আসতে হয়েছে। পেটটা খিদেতে কামড়াচ্ছে।

সাঞ্চামখাবা বলল, আউ পাখি নেই, বনমোরগ আছে।

খুব ভালো, খুব ভালো। শিগগির নিয়ে আয়। লোভে খুশিতে ঘোলাটে চোখজোড়া জ্বলতে লাগল বুড়ো সর্দারের।

সাঞ্চামখাবা ভেতরের ঘরে চলে গেল। খানিক পর বাঁশের তিনটে চোঙা রোহি মধুতে টইটম্বুর করে এবং কাঠের বাসনে কাবাব আর বনমোরগের মাংসের স্তূপ সাজিয়ে বাইরের ঘরে চলে এল। সদ্য ঝলসানো বনমোরগ। ধোঁয়া উড়ছে, লালচে রং। রোহি মধুর মাদক গন্ধে সমস্ত পোকরি কেসুঙটা ভরে উঠেছে। তর সইছেনা আর, বুড়ো সর্দার লাফিয়ে উঠল। সাঞ্চামখাবার হাত থেকে মাংস আর রোহি মধু ছিনিয়ে নিতে নিতে অস্ফুট লুব্ধ গলায় বলল, হু-হু, ভালো, খুব ভালো।

নানকোয়া বস্তি থেকে জনকয়েক জোয়ান ছেলে এসেছিল রাঙসুঙের সঙ্গে। তারা জঙ্গলের দিকে বেড়াতে গিয়েছে। রাঙসুঙ বলল, খাবারগুলো শিগগির সাবাড় করে ফেলি। নইলে

শয়তানরা এসে ভাগ বসাবে।

তিনজনে তরিবত করে রোহি মধু খেতে শুরু করল। সেই সঙ্গে কন মোরগের মাংস।

ধারাল নখ দিয়ে একখণ্ড মাংস ছিঁড়তে ছিঁড়তে বুড়ো সর্দার বলল, মেহেলীকে এবার কেলুরি বস্তি থেকে ছিনিয়ে আনতে পারব রে সাঞ্চামখাবা।

কেমন করে? উত্তেজনায় সাঞ্চামখাবার হাতের চোঙা থেকে খানিকটা রাহি মধু চলকে পড়ল।

হু-হু, কোহিমা শহর থেকে ফাদার আসবে, ফাদারের লোক আসবে, বন্দুক আসবে। হু-হু, হুই কেলুরি বস্তির ফুটুনি একেবারে খতম করে দেব না! আমাদের বস্তির মেয়ে ভাগিয়ে আটক করে রাখে!নখ দিয়ে কলিজা ফেঁড়ে রক্ত খাব।বুড়ো সর্দার দরজার কাছে ছুটে গেল। কেলুরি বস্তির দিকে মুখ করে দাঁত খিঁচিয়ে কুৎসিত ভঙ্গি করে চেঁচাতে লাগল, আসছি টেফঙের বাচ্চারা, তোদের সব কটাকে ফুড়ব। সব কটার মাথা নিয়ে আসব।

ফাদার আবার কে রে সদ্দার? রাঙসুঙের দুচোখে অপার বিস্ময়, বন্দুক কী জিনিস?

ফাদার, বন্দুক–অপরিচিত দু’টি শব্দ, রহস্যময় দু’টি নাম। এই মুহূর্তে অদ্ভুত বিস্ময়কর শব্দ দুটো রাঙসুঙের অস্ফুট পাহাড়ী চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।

নিজের জায়গায় ফিরে বুড়ো সর্দার বলল, হু-হু, সব বুঝতে পারবি। আগে তো আমাদের বস্তিতে ফাদারকে নিয়ে আসি। তারপর মেহেলীটাকে কেড়ে আনি কেলুরি বস্তি থেকে। তখন টের পাবি, ফাদার কে, বন্দুক কী। বলতে বলতে সহসা গলাটা করুণ এবং শিথিল হয়ে গেল, আমার মেয়েটা তো বেপাত্তা হয়েই রইল। বাঘের পেটে গেল, না বুনো মোষের গুঁতোয় সাবাড় হল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। থাক, লিজোমুর কথা এখন থাক। লিজোমু যখন নেই, মেহেলীই আমার মেয়ে। কেলুরি বস্তি থেকে ওকে এনে বিয়েটা দিতে পারলে হয়। একটা তপ্ত, লম্বা নিশ্বাস বুড়ো সর্দারের বুকটাকে মুচড়ে বেরিয়ে এল।

এবার দস্তুরমত উৎসাহিত হয়ে উঠেছে রাঙসুঙ। কর্কশ মেঝের ওপর দিয়ে ভারী দেহটাকে টানতে টানতে বুড়ো সর্দারের কাছে ঘন হয়ে বসল। বলল, হু, খুব ভালো হবে। এই তো সেদিন আমার ছেলেটার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যে সাঞ্চামখাবাকে বউপণ পাঠিয়ে দিলুম। খারে বর্শা, এরি কাপড়, আরুখা, কড়ি আর শঙ্খের কত গয়না দিলুম। তুই ফাদার না কী, তাকে এনে মেহেলীকে ছিনিয়ে নিয়ে আয় কেলুরি বস্তি থেকে। কেলুরি বস্তির সঙ্গে লড়াই বাধলে আমরা তোদের দলে থাকব।

হু-হু। গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল বুড়ো সর্দার। বলল, ঠিক, ঠিক বলেছিস। তোরা আমাদের দলে থাকবি। আমরা তোদের বন্ধু।

হু-হু, বন্ধু। একশো বার বন্ধু। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল রাঙসুঙ, তা ছাড়া, তোরা আমাদের কুটুম হতে যাচ্ছিস।

ভালো কথা বলেছিস রাঙসুঙ, বড় খুশির কথা। মেহেলীকে তোর ছেলের সঙ্গে নির্ঘাত বিয়ে দেব। সাঞ্চামখাবা বউপণ নিয়েছে। কথার খেলাপ করা কিছুতেই চলবে না। তবে আমার একটা কথা তোকে রাখতে হবে রাঙসুঙ। ভুরু দুটো কুঁচকে, ঘোলাটে চোখে কুটিল দৃষ্টি ফুটিয়ে বুড়ো সর্দার তাকাল।

কী কথা? ফাদারকে তোদের বস্তিতে যেতে দিবি তো?

নির্ঘাত দেব। ফাদার আমার ছেলের বউকে কেলুরি বস্তি থেকে এনে দেবে, আর তাকে যেতে দেব না? তেমন বেইমান আমরা পাহাড়ীরা নই রে সদ্দার।

বেশ, বেশ। ভালো কথা বলেছিস। দেখিস, তোদের বস্তির কেউ যেন ফাদারকে বর্শা হাঁকড়ে না বসে।

কে হাঁকড়াবে? একেবারে জানে খেয়ে ফেলব না তাকে। আমি হলাম নানকোয়া বস্তির সদ্দার। আমার ছেলে মেজিচিজুও বাঘমানুষ। সবাই আমাদের ভয় করে। আমরা যা বলব তাই। হবে। কেউ ওস্তাদি করতে গেলে মোষের মতো ছাল উপড়ে ফেলব।কুদ্ধ জানোয়ারের মতো গর্জে উঠল রাঙসুঙ।

ভালো বলেছিস। আরো একটা কথা আছে। সে কথাটাও তোকে রাখতে হবে। তা না হলে ছেলের সঙ্গে মেহেলীর বিয়ে দেব না।

আবার কী কথা! চোখেমুখে এবার ভীষণ বিরক্তি ফুটে উঠল রাঙসুঙের।

তোদের বক্তির পাশে তো অনেক বক্তি আছে। তাদের সঙ্গে খাতির রেখেছিস তো?

হু-হু, সব বক্তির সঙ্গেই আমাদের খাতির আছে। জুকুসিমা বস্তি, পেরুমা বস্তি, ইটিলাক বস্তি, এ ছাড়া আরো অনেক আছে। এ কথা জানতে চাইছিস কেন রে সদ্দার?

শোন তবে। যেমন করে গোপন মন্ত্র দেওয়া হয়, ঠিক তেমনই সতর্ক ভঙ্গিতে রাঙসুঙের কানের কাছে মুখটাকে নামিয়ে আনল বুড়ো সর্দার। বলল,কোহিমা পাহাড়ে এক ডাইনি আছে, তার নাম হল গাইডিলিও। খবদ্দার, তার কাছে কেউ যেন না যায়। এই কথাটা খাতিরের লোকদের মধ্যে রটিয়ে দিবি। বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে বলে আসবি। যদি এই কাজটা করতে পারিস, তা হলে তোদের বরাতে অনেক মজা আছে। ফাদারের কাছ থেকে অনেক কিছু পাবি। খাবার পাবি, কাপড় পাবি, টাকা পাবি।

ডাইনি গাইডিলিও। বিড় বিড় করে শব্দ দুটো উচ্চারণ করল রাঙসুঙ। তারপর চেঁচিয়ে বলল, তাই করব। বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে দুই কোহিমা পাহাড়ের গাইডিলিও ডাইনির নাম রটিয়ে দেব।

ভালো, খুব ভালো। পরম খুশির আবেশে গলাটা জড়িয়ে জড়িয়ে আসছে বুড়ো সর্দারের।

বাইরে আকাশ, দূর পাহাড়ের উপত্যকা আর বুনো মালভুমি জুড়ে এখন সন্ধ্যা নিবিড় হয়ে নামছে। ঘন হচ্ছে পার্বত্য অন্ধকার। পোকরি কেসুরে এই ছোট্ট ঘরখানায় ফ্যাকাসে আলোটুকু নিভে গিয়েছে। তিনটি মানুষ বড় ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে।

হিংস্র আনন্দে একজোড়া ঘোলাটে চোখ ময়ালের চোখের মতো জ্বলছে। এইমাত্র রাসুঙ নামে এক সরল পাহাড়ী মানুষের মনে লোভ উসকে দিয়ে তাকে শিকার করে ফেলেছে বুড়ো সর্দার।

.

৩৬.

উপত্যকা আর মালভূমি। চড়াই আর উতরাইয়ে তরঙ্গিত এই নাগা পাহাড়। সেই পাহাড়ের ওপর কয়েক দিনের মধ্যেই নেমে এল লো শি মাস। এল ফসল বোনার ঋতু। এই শিলাময় পৃথিবীর কঠিন আবরণের নিচে জীবনরসের ধারা বয়ে চলেছে। সে খবর জানা আছে নাগা কৃষাণদের। তারা জানে, সেই প্রাণরস লক্ষ শিকড়ের জিভ দিয়ে শুষে শুষে বীজদানা থেকে সবুজ ফসল জন্ম নেবে। প্রাণের মহিমায় পুলকময়ী হয়ে উঠবে পার্বতী মৃত্তিকা।

লো শি মাস। বীজ বোনার মরশুম, পরিশ্রমের মরশুম। লো শি মাসের এই বীজদানা লো ফুঁ মাসে বিশাল নাগা পাহাড়কে সোনালি লাবণ্যে ভরে দেবে। সেই ফসলের প্রত্যাশায়, অদ্ভুত খুশির মৌতাতে পাহাড়ী মানুষগুলো ঝুঁদ হয়ে থাকে।

সালুয়ালা গ্রামেও বীজ বোনার ধুম পড়েছে। উপত্যকায় উপত্যকায় শোরগোল শোনা যাচ্ছে। জোয়ান ছেলেরা, যুবতী মেয়েরা ধাপে ধাপে কাটা সিঁড়িখেতে বিউলা ধানের বীজ বুনছে।

লো শি মাসের রোদ আশ্চর্য উজ্জ্বল। বর্শার ফলার মতো ঝকমকে, দীপ্ত। পাহাড়ে পাহাড়ে সেই রোদ ছড়িয়ে পড়েছে।

একসময় সিঁড়িখেতে গানের সুর শোনা গেল। একই গানে সকলে সুর মিলিয়েছে। পাহাড়ী গান, পাহাড়ী সুর, পাহাড়ী গমক। সুরটা বাতাসে দোল খেতে খেতে দক্ষিণ পাহাড় পেরিয়ে সুদূর আকাশের দিকে উধাও হয়ে যাচ্ছে।

ম্যুখে রেনি মুকেশে লে হো,
সুলে ফুফুলুগি।
এল হো নায়েঙ কোহালুগি লে হো,
আমহু রেমিন্যু!

কয়েকটি যুবতী পরস্পরের কাঁধ ছুঁয়ে নাচের ভঙ্গিতে পা ছুঁড়ে ঘুড়ে আলপথ ধরে এগিয়ে এল। তাদের সুরেলা গলায় গানের ধুয়ো :

সুলে ফুচুলুগি।
সুলে ফুচুলুগি।

একপাশে একখণ্ড বড় পাথরের ওপর জাঁকিয়ে বসে রয়েছে বুড়ো সর্দার। কোঁচকানো মুখে খুশির ভঙ্গি। মাথা ঝাঁকিয়ে, বিরাট বর্শাটা হাত দিয়ে দুলিয়ে, কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও বসে গানটার তারিফ করতে লাগল।

এদিকে সেদিকে গোটাকয়েক পোষা শুয়োর ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে চরে বেড়াচ্ছে। ধারাল ঠোঁটের ঘায়ে মাটি চিরে বীজদানা খুঁজছে লালকুঁটি মোরগের ঝক। কিছু খাদ্যের আশায় পাথরের ভাঁজে ভাঁজে হন্যে হয়ে শুঁকে বেড়াচ্ছে পোষা কুকুরেরা।

হা-আ-আ-হু-ও কে? কে রে? গানের তারিফ থামিয়ে চিৎকার করে উঠল বুড়ো সর্দার।

সঙ্গে সঙ্গে ফসল বোনার গানটা ফালা ফালা হয়ে ছিঁড়ে গেল। সকলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

একটা জোয়ান বলল, এটোঙা বলেই তো মনে হচ্ছে রে সদ্দার।

এটোঙা! তড়াক করে বাদামি পাথরখানা থেকে লাফিয়ে উঠল বুড়ো সর্দার। এতক্ষণ দক্ষিণ পাহাড়ের চূড়ায় একটা চলমান বিন্দুর মতো দেখাচ্ছিল, একটু একটু করে সেই বিন্দুটা স্পষ্ট হল। সিঁড়িখেতে এসে একটা পরিচিত মানুষের রূপ নিল–এটোঙা।

এটোঙার চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়াল সালুয়ালা গ্রামের জোয়ান ছেলেমেয়েরা। সকলের চোখেমুখে বিস্ময়, কৌতূহল এবং কিছুটা ভয় মেশানো কৌতুক ফুটে বেরিয়েছে।

এটোঙার সমস্ত দেহে অদ্ভুত সাজপোশাক ঝলমল করছে। নীলচে হাফ প্যান্ট, মাথায় সাহেবি টুপি, সবুজ জামা, কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত ঝোলানো একটা মণিপুরী ঝোলা। পায়ে পাঁশুটে রঙের বুট জুতো। প্যান্ট, টুপি, শার্ট, জুতো–পাহাড়ী মানুষের জ্ঞানে অভিজ্ঞতায় এই রহস্যময় বস্তুগুলোর অস্তিত্ব নেই। পাহাড় বন ঝরনা-সিঁড়িখেত ছাড়া এই সব অদ্ভুত জিনিস তারা কোনোদিনই দেখে নি। কেউ কেউ এটোঙার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার অনেকেই সসম্ভ্রম দূরত্ব বজায় রেখে নির্নিমেষে তাকে দেখছে।

বুড়ো সর্দার জোয়ান ছেলেমেয়েদের জটলাটা কনুই দিয়ে গুতিয়ে ভেঙেচুরে সামনে এগিয়ে এল। সালুয়ালা গ্রামের সে-ই সবচেয়ে প্রাচীন মানুষ। প্রাজ্ঞও বটে। জীবনে তার অনেক অভিজ্ঞতা। অনেক কিছু দেখেছে সে। অজস্র ভূয়োদর্শন হয়েছে তার।

কোহিমা শহরে, জুনোবট, মোককচঙ এবং আঙুনেটিতে এমন সব সাজপোশাকের বাহার সে অসংখ্য বার দেখেছে।

বুড়ো সর্দার এটোঙার বুকে একখানা হাত রেখে বলল, হু-হু, অ্যাদ্দিন তুই কোথায় ছিলি

মৃদু হাসল এটোঙা। বলল, তা অনেক বছর হল বস্তি থেকে ভেগেছিলুম, কি বলিস সদার? কতদিন হবে বল দিকি?

অত হিসেব জানি না। তবে অনেক বছর তুই বস্তিতে ছিল না। ছিলি কোথায়? যে অঙ্গামী মাগীটাকে নিয়ে দক্ষিণের পাহাড়ে সাত মাস কাটিয়েছিলি সেটা গেল কোথায়? :

চার বছর ইম্ফলের জেলখানায় কাটালাম। অঙ্গামী মেয়েটাকে তার বাপ নিয়ে গেছে তাদের বস্তিতে। পরে সব বলব। সে অনেক কেচ্ছা। এটোঙা বলতে লাগল, আমার বাপ-মা কোথায়? আমাদের কেসুঙটা কোন দিকে? চার বছরে বস্তির অনেক কিছু বদলে গেছে, দেখছি। আমাদের কেসুঙের খবর বল। বাপ-মায়ের খবর দে।

পাঁজরটা চুরমার করে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল বুড়ো সর্দারের, তোদের কেসুঙ কি আর আছে! সেবার পাহাড়ে সুঙকেনি (ভূমিকম্প) হল। পাথর চাপা পড়ে তোদের ঘর গুঁড়ো গুড়ো হয়ে গেল। একটা খাসেম গাছে তলায় পড়ে তোর বাপ-মা চ্যাপ্টা হল। সবই বরাত। তোদের অত বড় বনেদি নগুসোর বংশটা একেবারে লোপাট হয়ে গেল। আর তোরও কোনো পাত্তা ছিল না।

হু-হু, ভালোই হল। দুনিয়ার সব লোপাট হয়ে যাওয়াই ভালো। বল দিকি, বাপ-মা কেমন করে চ্যাপ্টা হয়েছিল। ছবিটা এঁকে নিই। ক্ষিপ্র হাত চালিয়ে মণিপুরী ঝোলা থেকে খানকয়েক সাদা কাগজ আর সরু পেন্সিল বার করল এটোঙা।

ছবি! ছবি কী হবে! কৌতূহলে এবং আগ্রহে আরো কাছে এগিয়ে এল বুড়ো সর্দার।

হু-হু, সব দেখতে পাবি। গম্ভীর মুখে এটোঙা বলল।

চারপাশ থেকে জোয়ান-জোয়ানীরা আরো ঘন হয়ে এসেছে। সকলে সমস্বরে চেঁচামেচি শুরু করে দিল, তোর হাতে ওগুলো কি রে এটোঙা?

এগুলোর নাম হল কাগজ আর এটার নাম পেন্সিল। এইবার দ্যাখ কী করি। আমার বাপ মা আতামারী গাছ চাপা পড়ে মরেছিল তো? দ্যাখ, দ্যাখ–সাদা কাগজের ওপর কালো পেন্সিলের দাগে একটা গাছ-চাপা বিধ্বস্ত পুরুষ এবং নারীর ছবি ফুটিয়ে তুলল এটোঙা। সামনের দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কি রে সদ্দার, অনেকটা এইরকম না?

হু-হু–মাথা দুলিয়ে, সমস্ত দেহ ঝাঁকিয়ে ছবিটার তারিফ করল বুড়ো সর্দার। সাদা কাগজ এবং পেন্সিলের কয়েকটি নগণ্য টানেটোনে এমন ভেলকি যে লুকিয়ে থাকতে পারে, চোখের সামনে তা দেখে একেবারে তাজ্জব বনে গেল। সালুয়ালা গ্রামের সবচেয়ে পুরনো মানুষ সে। সুদীর্ঘ জীবনে অনেক কিছুই দেখেছে, কিন্তু এমনটি আগে আর তার চোখে পড়েনি। সম্ভ্রমে, বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল বুড়ো সর্দার।

কিন্তু একটু পরেই ঘোর কাটল। ভুরু দুটো কুঁচকে সন্দেহ-ভরা দৃষ্টি দিয়ে এটোঙার দেহটা কুঁড়ে তন্ন তন্ন করে কী যেন খুঁজল সে। ভাবতে লাগল, এই চারটে বছরে কোনো ডাইনির কাছ থেকে এই ভোজাবাজি শিখে এল নাকি এটোঙা!

চারপাশের জোয়ান ছেলেমেয়েরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। লো শি মাসের এই উজ্জ্বল রোদের দিন এমন একটা মজাকে তাদের সালুয়ালা গ্রামে নিয়ে আসবে, তা কি তারা জানত?

হু-হু, হুই ইম্ফলের জেলখানায় একটা মণিপুরীর কাছ থেকে এই ছবি আঁকা ভালো করে শিখেছি রে সদ্দার। মণিপুরীটার নাম থাম্বাল সিং। আমার চেয়ে থাম্বাল অনেক ভালো ছবি। আঁকে।

অদ্ভুত এক কাহিনী শুরু হল। এটোঙা আরম্ভ করল এভাবে। ইম্ফলের জেলখানায় চার চারটে বছর বাদ দিয়েও একুশ বছরের একটা বিপুল অতীত আছে এটোঙার। সালয়ালা গ্রামের মানুষদের সেই একুশ বছরের অতীত সম্বন্ধে যতটা ধারণা আছে, তার চেয়ে রয়েছে। অনেক বেশি বিস্ময়। অনেক বেশি ঔৎসুক্য। এই রহস্যময় মানুষটা সম্বন্ধে তারা বিশেষ কিছুই জানে না। এই না-জানার ফাঁকটুকু বুনো মনের অস্ফুট কল্পনা দিয়ে ভরিয়ে তুলতে না পেরে তারা হিমসিম খায়।

এখন যেখানে খোখিকেসারি কেসুঙ, ঠিক তার পাশ থেকে পাটকিলে রঙের বিরাট একখণ্ড পাথর খাড়া উঠে গিয়েছে। সেই পাথরের মাথাটা যেখানে সমতল সেখানে ঘন ওক বন ছিল এক কালে। জায়গাটা নিঝুম, শান্ত। ওক বনের ঠাণ্ডা ছায়ায় ছিল নগুসোরি বংশের বাড়ি। সোনালি খড়ের চাল, মোটা মোটা ইজুম বাঁশের দেওয়াল, এবড়োখেবড়ো মেঝে। ওই ঘরে একদিন বুনো মায়ের কামনা এবং পাহাড়ী বাপের আদিম পৌরুষ রক্তে মিশিয়ে জন্ম নিয়েছিল এটোঙা।

কবে, কখন এই পাহাড়ী পৃথিবীর ছোঁয়া প্রথম পেয়েছিল, বুক ভরে এর বাতাস নিয়েছিল, সে কথা অন্য দশটা জোয়ানের মতো তারও মনে নেই।

মায়ের কোল থেকে একদিন মাটিতে নামল এটোঙা। একটু একটু করে তার বিচরণের সীমানা বড় হতে লাগল। এই পাহাড়ের আলোবাতাস-রোদ, কনঝরনা-উপত্যকা থেকে কণায় কণায় প্রাণরস গ্রাস করতে লাগল।

শিশু এটোঙা থেকে কিশোর এটোঙা। তারপর যৌবন এল। পেশী সবল হল। চামড়ায়। চিকন আভা ফুটল। মনের মধ্যে বয়সের ধর্ম তার কতকগুলো স্থল দাবির জানান দিয়ে গেল। এটোঙার দেহমনের কোষে কোষে জন্ম নিল এক রূপময় বুনো জোয়ান।

কিন্তু আশ্চর্য! সালুয়ালা গ্রামের অন্য জোয়ানদের থেকে সে আলাদা। একেবারেই স্বতন্ত্র। মোরাঙের বাঁশের মাচানে সকলের সঙ্গে সে-ও অবশ্য পাশাপাশি শোয়। অবিবাহিত জোয়ান ছেলের অবশ্য পালনীয় প্রথাগুলিকে মেনে চলে। দেহমনকে পাপের গ্রাস থেকে বাঁচাতে, নারীর লালসা এবং রিপু থেকে রক্ষা করতে, মোরাঙ হল সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। অন্যান্য ছেলেরা পাশাপাশি শুয়েছে, তাদের গরম নিশ্বাস পড়েছে গায়ে। তবু ভুল করেও কোনোদিন তাদের সঙ্গে রসরঙ্গ কি তামাশার কথা বলত না। পারতপক্ষে মোরাঙে রাত্রি কাটাবার সময় ছাড়া তাদের কাছে ঘেঁষত না। মোট কথা, সকলকে এড়িয়ে চলত এটোঙা। নিজের চারপাশে একটা দুয়ে রহস্য সৃষ্টি করে রাখত।

এই বন্য জীবনের আশা-নিরাশা, এই পাহাড়ী পৃথিবীর ভীষণতা সম্পর্কে কোনো মোহই ছিল না এটোঙার মনে। কৌতূহলও নয়। লম্বা বর্শা বাগিয়ে ঘন বনে বাঘ কি হরিণ শিকার করতে কোনোদিন সে যেত না। মোরাঙের সামনে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে বুনো মোষ ঝলসে সকলের সঙ্গে আধপোড়া মাংস খাবার উৎসাহ ছিল না তার। শত্রুর মুণ্ডু কেটে আনার পর সমস্ত গ্রামে যে আদিম উল্লাস জাগত, হুল্লোড় হত, তার মধ্যে কোনদিন নিজেকে একাকার। করে মিলিয়ে দিতে পারে নি এটোঙা।

এটোঙার বাপ রিজিমাখুঙ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গর্জে উঠত, তুই কী হয়েছিস বল দিকি? শিকারে যাবি না, সিঁড়িখেতে বীজদানা বুনবি না, মোষ বলির সময় মোরাঙে থাকবি না, কারো বাড়ি ভোজ খেতে যাবি না, আবাদ করবি না। তা হলে চলবে কী করে? আমাদের এতবড় নগুসোরি বংশ! দুচারটে শত্রর মুণ্ডু কেটে না আনলে ইজ্জত থাকে না। একটা ব্যাঙ মারতে পারিস না তো শত্রুর মুণ্ডু! আমাদের সব ইজ্জত তুই ডোবাবি।

আমি ও-সব পারব না। বলেই চক্ষের পলকে সামনে থেকে উধাও হয়ে যেত এটোঙা।

একটা টেফঙের বাচ্চা। আহে ভু টেলো। চাপা চাপা চোখদুটো জ্বলে উঠত রিজিমাখুঙের, শয়তানটাকে পেলে কুপিয়ে কুপিয়ে সাবাড় করব। হু-হু। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বর্শা বাগিয়ে এটোঙাকে ধাওয়া করত রিজিমাখুঙ।

তিনটে ঢেউখেলানো চড়াই আর ছোট ছোট দুটো পাহাড় পেরিয়ে রোজ সকালে দক্ষিণের পাহাড়ে চলে যেত এটোঙা। একখানা বাদামি রঙের পাথরের ওপর বসে দুচোখের দৃষ্টি দিয়ে পাহাড়ের বড় ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর রূপটি শুষে নিত। নিচে, অনেক নিচে আঁকাবাঁকা টিজু নদী গর্জে গর্জে বইত। আকাশে খণ্ড ছিন্ন সোনামুখি মেঘ ভেসে বেড়াত। আতামারী ঝোঁপের ফকে হরিণের চোখ দেখা যেত। কোথাও উতরোল প্রস্রবণ। কোথাও নিঃশব্দ ঝরনা। এই পাহাড়, এই নদী ঝরনা বন-উপত্যকা, সব মিলিয়ে এই নিসর্গ এটোঙার অধস্ফুট বন্য চেতনায় দুর্বার আবেগে রিমঝিম করত। দক্ষিণের ওই পাহাড়চূড়া প্রতিদিন কী এক অদ্ভুত নেশায় মাতিয়ে তাকে টেনে আনত।

একসময় সকাল পেরিয়ে যেত। রোদ ঝকঝকে হত। সামনের বন থেকে বুনো কলা আর টক টক আখুশি ফল ছিঁড়ে খেতে শুরু করত এটোঙা। পাহাড় থেকে যখন দিনের রং মুছে যেত, আবছা অন্ধকারে ঢেকে যেত নাগা পাহাড়, তখন গ্রামে ফিরত এটোঙা। এ একেবারে নিয়মিত। এ নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল না।

খাড়া খাড়া বাদামি পাথরের দেওয়াল। আশ্চর্য, একদিন নিজের অজান্তেই সেই পাথরের দেওয়ালে এক টুকরো নুড়ি দিয়ে দাগ কেটে কেটে টিজু নদী আঁকল সে, আঁকল সম্বরের মাথা, : আতামারী বন। তারপর ছবিগুলোর দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল।

নিজের উদাস মনটার মধ্যে শিল্পের যে আবেগ সঙ্গোপনে লুকিয়ে ছিল তার প্রকাশ দেখতে পেয়ে মোহিত হয়ে গেল এটোঙা।

এরপর থেকে বিচিত্র নেশায় পেয়ে বসল এটোঙাকে। খাড়া খাড়া পাহাড়ের গায়ে নরম নুড়ি দিয়ে দেগে দেগে নদীবন-পশু-পাখি আঁকতে লাগল। রাশি রাশি ছবির অক্ষরে নিজের আবেগকে মূর্তি দিল এটোঙা।

এই সব ছবি, নিজের মধ্যে শিল্পীকে খুঁজে পাওয়ার আমোদ, সুন্দর আকাশ-পাহাড়, এগুলো বাদ দিয়ে আরো একটা বিস্ময় ছিল। আজও সেই চমকপ্রদ বিকেলটা স্নায়ুতে এবং রক্তে রক্তে দোল খায় এটোঙারভালো লাগে, খুব ভালো। মন এবং এই সতেজ শরীর ঝিমঝিম করে।

দক্ষিণ পাহাড়ের চড়াইতে অঙ্গামীদের বিরাট গ্রাম সাঞ্জুবট। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এবং টক আখুশি ফল খেতে খেতে সাজুবট গ্রামের বুড়ো সর্দারের মেয়ে একদিন। পাহাড়ের চূড়ায় এসে পড়েছিল। মুগ্ধ চোখে খাড়া পাথরের গায়ে নদীবন ঝরনার ছবি দেখছিল।

বিশাল উপত্যকাটা বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে এটোঙার ছোট ছোট চাপা চোখজোড়া মোহিত হয়ে গিয়েছিল। দক্ষিণ পাহাড়ের চূড়ায় শেষ বেলার আমেজী রোদে উজ্জ্বল তামাটে। রঙের একটি যুবতী দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেদিনের সেই বিকেল এমন একটা সুন্দর মোহ নিয়ে তার জন্য যে অপেক্ষা করছিল, তা কি আগেভাগে জানত এটোঙা? অবাক, নির্নিমেষ কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইল সে। একটু পরে এই আবেশের ভাবটা কেটে গেলে মনের মধ্যে সন্দেহ। উঁকি মারল। মেয়েটা কে? তাদের সালুয়ালাঙ বস্তিতে কোনোদিন একে তো দেখে নি! কী মতলব নিয়ে এসেছে মেয়েটা, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

নিমেষে মন থেকে সন্দেহটা ঝেড়ে সামনের বড় টিলা বেয়ে চূড়ায় উঠে এল এটোঙা। মেয়েটার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। বলল, কে তুই?

চমকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ঘুরে দাঁড়াল মেয়েটা। তীক্ষ্ণ, অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে এটোঙার সমস্ত দেহ খুঁড়ে হাড়-মজ্জা-স্নায়ু, এমনকি তার ভাবনা এবং চিন্তাগুলিকেও যেন তন্নতন্ন করে দেখে নিয়েছিল। ছোট, চাপা কপালটা গভীর সন্দেহে কুঁচকে গিয়েছিল।

অনেকক্ষণ দুজনে পরস্পরকে যাচাই করে নিল। একসময় সন্দেহ ঘুচল, সংশয় চুকল।

দুটো ছোট পিঙ্গল চোখের মণিতে প্রশ্রয়ের হাসি ঝিকঝিক করে উঠেছিল মেয়েটার। আউপাখির মতো সুডৌল ঘাড়খানা বাঁকিয়ে, কানের লতায় নীয়েঙ গয়নায় দোলন দিয়ে, সুঠাম। দেহটিকে বাঁকা ছাঁদে ঘুরিয়ে সে বলেছিল, আমার নাম হ্যাজাও, অঙ্গামী সদ্দারের মেয়ে। হুই সাজুবট বস্তিটা আমাদের।

এটোঙা বলেছিল, আমাদের বস্তি হল সালুয়ালাঙ। আমরা রেঙমা। নগুসোরি বংশ। আমার নাম এটোঙা।

এপারে সালুয়ালাঙ, ওপারে চড়াই উপত্যকায় অঙ্গামীদের বড় গ্রাম সাজুবট। মাঝখান দিয়ে বিশাল একটা বর্শামুখের মতো উঠে গিয়েছে দক্ষিণের পাহাড় চূড়া। ভিন সম্প্রদায়ের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে মুখোমুখি হয়েছিল দুই গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায়।

হ্যাজাও বলেছিল, রোজ দেখি এই পাহাড়ে আসিস। আমি হুই আখুশি ঝোপে দাঁড়িয়ে তোকে আসতে দেখি। নুড়ি দিয়ে পাথরের গায়ে কী সব দাগ কাটিস। খালি ভাবি, এসে দেখব, কী করিস তুই, কিন্তু সাহস পাই না।

কেন রে হ্যাজাও, সাহস পাস না কেন? এক পা দু’পা করে হ্যাজাওর পাশে এসে দাঁড়াল এটোঙা।

ভয় হয়, হয়তো তোর কাছে বর্শা আছে। যদি হাঁকড়ে দিস, একেবারে জানে সাবাড় হয়ে যাব। সেই জন্যেই তো আসি না।

আরে না, না। সুচেন্যু বর্শা আমার ভালো লাগে না। রক্তারক্তি, খুনোখুনি, শিকার, এসবে মজাও পাই না। মেজাজও বিগড়ে যায়। একা একা এই পাহাড়ে এসে নুড়ি দিয়ে পাথরের গায়ে বন, পাহাড়, নদী আঁকতে বড় ভালো লাগে।

খুব ভালো। আমার হুই সব খুনখারাপি ভালো লাগে, আবার তোর এই দাগগুলোও ভালো লাগে। তোর দাগগুলো ভারি সুন্দর। এটা ঠিক চিতাবাঘের মতো হয়েছে। আরে, এটা ঠিক সম্বর হরিণের মতো। আর এটা, এটা কী? ময়াল নাকি? না আশুমি? হ্যাজাওর দৃষ্টিটা পাথরের দেওয়ালের গায়ে সারি সারি ছবির ওপর দিয়ে সরে সরে যেতে লাগল।

আরে না–না–একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠল এটোঙা। ব্যস্ত হয়ে হ্যাজাওর ভুলটা শুধরে দিল, এটা ময়ালও নয়, আশুমিও নয়। এটা হল টিজু নদী।

হু-হু। পাথরের গায়ে এটোঙার ছবিগুলো দেখতে দেখতে অঙ্গামী সর্দারের মেয়ের চোখজোড়া বিভোর হয়ে গিয়েছিল। তার চোখমুখের ভঙ্গিতে প্রচুর মজা পাওয়ার আভাস রয়েছে, তুই কী সুন্দর দাগ কাটিস! ঠিক ঠিক চিতাবাঘ, ঠিক ঠিক হরিণ হয়ে যায়। কী মজার লোক তুই। আমি রোজ তোর কাছে আসব।

হু-হু, খুব ভালো। রোজ আসবি তুই। তোকে আমার মনে ধরেছে। তোতে আমাতে খুব মিল হবে, কি বলিস হ্যাজাও? অদ্ভুত চোখে হ্যাজাওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে এটোঙা। তাকিয়েই থেকেছে।

হু-হু। হ্যাজাও মাথা নেড়ে সায় দিয়েছে, খুব মিল।

তারপর দক্ষিণ পাহাড়ের ওপর দিয়ে একটার পর একটা দিন উধাও হয়ে গেল। রোদের ঋতু সেন্যুঙ, বৃষ্টিঝরা মৌসুমি বাতাসের দিন, তুষারঝরা সাঙসু ঋতুর মাসগুলি একে একে চলে গেল।

অনেক ঘনিষ্ঠ হল এটোঙা এবং হ্যাজাও; অঙ্গামী আর রেঙমা সম্প্রদায়ের দু’টি মুগ্ধ পাহাড়ী যৌবন। বাদামি পাথরগুলো নুড়ির আঁকে আঁকে ভরে গেল। দেখতে দেখতে আরো মোহিত হল হ্যাজাও, আরো আবিষ্ট হল এটোঙা। দক্ষিণ পাহাড়ের বুনো চূড়াটা দুটো পাহাড়ী মানুষ-মানুষীর ভালোবাসার উত্তাপে মধুর হয়ে গিয়েছিল। পাহাড়ের খাড়া গায়ে খেয়ালের ছবি আঁকতে আঁকতে কখন যে হ্যাজাওর মনে দুর্বার কামনার অব্যর্থ ছবিটা এঁকে ফেলেছিল এটোঙা, আজ আর মনে নেই।

একদিন সাঙসু ঋতুর এক হিমাক্ত দুপুরে বনের ছায়ায় চুপচাপ বসে ছিল এটোঙা। সামনের ঢালু উপত্যকাটা বেয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটে আসছিল হ্যাজাও। চমকে এটোঙা তাকিয়েছিল, কি রে হ্যাজাও, কী ব্যাপার?

সব্বনাশ হয়েছে। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে হ্যাজাও হাঁপাতে লাগল।

কী সব্বনাশ হল? জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল এটোঙা।

ওরা সব জানতে পেরেছে। আমাদের বস্তির হুই হালুং শয়তানটা তোকে আর আমাকে একসঙ্গে দেখে বস্তিতে গিয়ে বলে দিয়েছে। হালুংটা আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি রাজি হইনি। তোকে বিয়ে করতে চাই; সেই রাগে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখে বাপের কাছে। লাগিয়েছে। আমার বাপ বস্তির সদ্দার। আমাকে পেলে সাবাড় করবে। বস্তির ছোঁড়ারা আমাকে খুঁজছে, তাই তোর কাছে পালিয়ে এলুম।

ঠিক করেছিস। হু-হু, আমাদের বস্তির সদ্দারও জানতে পেরেছে। তোর সঙ্গে আমার এই পিরিত তার দুচোখের বিষ। তোরা আমরা তো ভিন জাত। তোরা অঙ্গামী, আমরা রেঙমা। তাই সদ্দার আমাকে বস্তি থেকে ভাগিয়ে দিয়েছে। আমি শিকার করি না, বস্তির জোয়ান ছোকরাদের সঙ্গে মিশি না, জমিতে আবাদ করতে যাই না, সেই জন্যে সবাই আমার ওপর গোসা করে রয়েছে। আমি ঠিক করেছি, এখান থেকে আর যাব না।

আমিও যাব না। তোর কাছেই থাকব। তুই শিকার করতে পারিস না, আমি পারি। তুই পাথরের গায়ে নুড়ি ঘষে মজার মজার দাগ কাটবি। আমি বন থেকে হরিণ মেরে আনব, পাখি ফুঁড়ে আনব, ফলপাকুড় নিয়ে আসব। দুজনে ভাগ করে খাব। কেমন? গোল তামাটে ঘাড়খানা বাঁকিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিল হ্যাজাও। বসবার ভঙ্গিটি বড়ই অন্তরঙ্গ। তার দু’টি কপিশ চোখের মণিতে তখন একটি অনুগত পাহাড়ী জোয়ানের ছায়া পড়েছে।

ভালো, হু-হু, খুব ভালো। আরো কাছাকাছি সরে এসেছিল এটোঙা। দ্বিধাভরা গলায় বলেছিল, কিন্তু এই খোলা পাহাড়ে কোথায় থাকব? যা শীত! রাত্তিরে আবার বরফ পড়ে।

খিলখিল শব্দ করে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিল হ্যাজাও, পাহাড়ী জোয়ান,না একটা বাড়ি টেফঙ তুই?

কেন? এটোঙার চোখজোড়া ধক করে জ্বলে উঠেছিল, ইজা হুবতা! খবদ্দার হ্যাজাও, খিস্তি খেউড় কবি না। একেবারে আছাড় মেরে খাদে ফেলে দেব।

খিস্তি করব না তো কী করব শুনি? বেশি ফ্যাকার ফ্যাকর করবি না এটোঙা। তোরা রেঙমারা, বড় বোকা। একটু যদি মগজ থাকত তোদের! এই পাহাড়ে কত সুড়ঙ্গ রয়েছে। তার মধ্যে ঢুকে আতামারী পাতা বিছিয়ে আমরা যোব।

ঠিক বলেছিস, ঠিক বলেছিস। হু-হু, তোদের অঙ্গামীদের বুদ্ধি বড় সাফ। মাথা নেড়ে তারিফ করেছে এটোঙা, জানিস হ্যাজাও, হুই পাথরের গায়ে নুড়ির দাগ কাটা ছাড়া অন্য কিছু আমার মাথায় ঢোকে না। হু-হু– মাথাটা এত ঝাঁকিয়েছে এটোঙা, মনে হয়েছিল, এ ঝাঁকানি আর থামবে না।

এরপর দক্ষিণের পাহাড় চূড়ায় দু’টি পাহাড়ী মানুষ-মানুষী সংসার পাতল। অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে আদিম মানুষের সংসার। ওপরে নিরেট পাথরের ছাদ, নিচে রুক্ষ মেঝে। সামনের দিকে সুড়ঙ্গের মুখ। হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়।

সুড়ঙ্গের মধ্যে মা-গি কাঠ এল। পেন্য কাঠের মশাল এল। সমস্ত শীতকালটার জন্য খাবার জোগাড় করল হ্যাজাও। বুনো মোষের মাংস, সম্বরের মাংস, পাহাড়ী আপেল, নীলচে রঙের বুনো কলা। রাশি রাশি আখুশি আর তেরুঙা ফল। পাথরের খাঁজে খাঁজে আর মেঝের ওপর স্তূপাকার করে রাখা হল মোষের ছাল, বাঘের ছাল, হরিণের ছাল। রাতের অন্ধকারে অঙ্গামীদের গ্রাম থেকে লুকিয়ে কিছু খড় এনেছিল হ্যাজাও। সেগুলো বিছিয়ে অসহ্য শীতের জন্য বিছানাকে উত্তপ্ত করে রাখা হল।

রেমা সম্প্রদায় কি অঙ্গামী সমাজ, কেউ এটোঙা এবং হ্যাজাওর সংসারকে মেনে নেয়নি, স্বীকৃতি দেয়নি তাদের উষ্ণ আরামের যুগল শয্যাকে। তবু রেঙমা আর অঙ্গামীদের সমস্ত রোষ, রাগ এবং ভয়ঙ্কর বর্শাগুলিকে অগ্রাহ্য করে দু’টি মুগ্ধ পাহাড়ী যৌবন দক্ষিণ পাহাড়ের সুড়ঙ্গে নিজেদের অন্তরঙ্গ জগৎ সৃষ্টি করেছিল।

সাঙসু ঋতুর শেষে আকাশ থেকে বরফ ঝরার সমস্ত কারসাজি বানচাল করে আবার উজ্জ্বল রোদের দিন এল। এটোঙার রোমশ বুকে মুখ ঘষে সোহাগ করতে করতে সুন্দর একটা কথা বলেছিল হ্যাজাও, আমার বাচ্চা হবে রে এটোঙা। তুই বাপ হবি, আমি মা হব।

ঠিক বলছিস! বিস্ময়ে, খুশিতে চেঁচিয়ে উঠেছিল এটোঙা।

হু-হু– আবেগে চোখজোড়া বুজে এসেছিল হ্যাজাওর।

বিস্ময়টা থিতিয়ে এলে এটোঙার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বলেছে, কী করে বুঝলি তোর ছানা হবে?

শুধু শুধু কি বলি তুই একটা টেফঙের বাচ্চা। হু-হু, দেখছিস না, আমার পেট আর কোমরটা কেমন ফুলেছে।

হু-হু–বোকা বোকা, অবাক দৃষ্টিতে হ্যাজাওকে দেখতে লাগল এটোঙা। স্ফীত উদর, গুরুভার পাছা, টসটসে স্তন। তামাটে দেহটা ছাপাছাপি করে ভরে উঠেছে। অনেক সুন্দর হয়েছে হাজাও। চামড়া মসৃণ হয়েছে। আগে চঞ্চল ছিল; বিদ্যুতের মতো পাহাড়ে বনে চমক দিয়ে ছুটে বেড়াত। এখন দেহ থেকে বিদ্যুৎ মুছে গিয়েছে। মদিরতা এবং গাম্ভীর্য এসেছে। আলস্যের ভারে চোখের পাতা দুটো ভারী হয়েছে। অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল এটোঙা। তাকিয়েই ছিল।

হ্যাজাও বলেছে, আমার মেয়ে হবে।

আরো খানিকটা ঘেঁষে বসেছে এটোঙা। বলেছে, কী করে বুঝলি?

কাল রাত্তিরে মজার স্বপ্ন দেখেছি। একটা ময়াল সাপ চিতি হরিণের মাথা গিলছে হাঁ করে।

হু-হু– অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এটোঙা বলেছে, সবই তো বুঝলুম, তাতে হল কী?

আমার মা বলেছে, পোয়াতী মাগী স্বপ্নে যদি ময়াল সাপকে হরিণের মাথা গিলতে দেখে, তার মেয়ে হয়। কী মজা বল দিকি। মেয়ের জন্যে তুই অনেক পণ পাবি। আর–খুশি গলায় কথাগুলো বলতে বলতে মুখচোখ করুণ হয়ে এসেছে হ্যাজাওর। উজ্জ্বল মুখখানায় কালো ছায়া এসে পড়েছে। হঠাৎ একেবারে চুপ করে গিয়েছে সে।

কি রে, কথা বলতে বলতে থামলি কেন? কী হল তোর? ভুরু কুঁচকে দুচোখে সংশয় ফুটিয়ে এটোঙা জিগ্যেস করেছে।

মেয়ে তো হবে। কিন্তু তার বিয়ে দেব কেমন করে? আমরা এই সুড়ঙ্গে লুকিয়ে রয়েছি। তোদের বস্তিতে যাবার উপায় নেই। আমাদের বাড়িতে ঢুকলেও বাপ টুকরো টুকরো করে কাটবে। তাহলে মেয়ের বিয়েতে পণ পাবি কী করে?

পণের দরকার নেই। বস্তিতে আমরা যাব না। ভিন জাত হয়ে পিরিত করেছি বলে সদ্দারেরা যখন আমাদের কোপাতে চায় তখন হুই সব শয়তানদের বস্তিতে গিয়ে কী হবে? আমাদের মেয়েটা এই সুড়ঙ্গেই বড় হবে। কেউ যদি পিরিত করে বিয়ে করতে চায় তাকেই দেব মেয়ে। তার বদলে একটা বর্শাও নেব না। বেশ জোর দিয়ে এটোঙা বলেছিল। সেই সঙ্গে খুব দ্রুত বারকয়েক শ্বাস টেনেছে। শান্ত, নির্লিপ্ত মানুষ এটোঙার চোখজোড়া তখন জ্বলছিল। .

কিছুক্ষণ চুপচাপ। তার পর আবার এটোঙা বলতে শুরু করেছে, তুই মা হবি, আমি বাপ হব। আয়, এবার আমরা একটা ঘর বানিয়ে নিই। খাদে বাঁশ আছে। সাঙলিয়া লতা আছে। রাত্তির বেলায় আমাদের হুই সালুয়ালাঙ বস্তি থেকে লুকিয়ে খড় নিয়ে আসব। একখানা খাসা ঘর হবে। সুড়ঙ্গের মধ্যে সাতটা মাস লুকিয়ে রয়েছি। আর ভালো লাগছে না হ্যাজাও। মেয়েটা জন্মাবে। এই সুড়ঙ্গের মধ্যে অন্ধকারেই হয়তো সাবাড় হয়ে যাবে।

টেমে নটুঙ! হ্যাজাও দাঁত খিঁচিয়ে হুমকে উঠেছে, এমনি এমনি বলি, তুই একটা টেফঙের বাচ্চা। সাত মাস এই সুড়ঙ্গের মধ্যে লুকিয়ে না থাকলে বেঁচে থাকতে পারতিস? কতবার দুই বস্তির শয়তানেরা আমাদের খোঁজে এসেছিল, মনে নেই? এই সুড়ঙ্গটা তারা খুঁজে বার করতে পারে নি। পারলে—

হু-হু, ঠিক বলেছিস। এটোঙা শিউরে উঠেছে। তার চোখের সামনে দিয়ে কতকগুলো ছায়া সরে গিয়েছিল। সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে ওরা দেখেছে, যেদিন হ্যাজাওকে নিয়ে সে এই সুড়ঙ্গে র মধ্যে লুকিয়েছে, ঠিক তখন থেকেই সালুয়ালাঙ এবং অঙ্গামীদের গ্রাম সাঙুবট থেকে হাতের থাবায় বর্শা বাগিয়ে দলে দলে জোয়ান ছেলেরা এসেছে। বর্শা, সুচেন্যু, তীর, দা। ভীষণ, হিংস্র এবং সাঙ্ঘাতিক। একটি পাহাড়ী জোয়ানী আর একটি বুনো জোয়ান–এই দুটো মানুষের হৃৎপিণ্ড উপড়ে নেবার জন্য, এই দুটো অনাচারী প্রেমিক প্রেমিকাকে শিকার করে নিয়ে যাবার জন্য, বার বার দক্ষিণ পাহাড়ের চূড়ায় এসে তারা হানা দিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত সতর্ক হয়ে পরস্পরকে পাহারা দিত হ্যাজাও আর এটোঙা। সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে চারপাশ ভালো করে দেখে, নিঃসন্দেহ হয়ে তারা খাবারের সন্ধানে উপত্যকায় নামত। বাঁশের চোঙা ভরে জল আনতে যেত দূরের টিজু নদীতে। এই সাতটা মাস ইন্দ্রিয়গুলোকে সজাগ রেখে দু’টি পাহাড়ী জীবন পরস্পরকে নিরাপদ রেখেছে। দু’টি বিদ্রোহী বন্য প্রেম পরস্পরকে পাহারা দিয়েছে। দুই গ্রামের বর্শাগুলোর কথা মনে পড়তেই আতঙ্কে শরীরটা ছমছম করে।

অনেকদিন তুই পাথরের গায়ে দাগ কাটিস না এটোঙা। তোর দাগগুলো কিন্তু ভারি সুন্দর। সাঙস ঋতুর এক সকালে এটোঙাকে জড়িয়ে সোহাগ করতে করতে হ্যাজাও বলেছিল।

কেমন করে দাগ কাটব? তুই তো আমাকে এই সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে বেরুতেই দিস না।

হু, বেরুতে দিলে কেউ যদি তোকে সাবাড় করে। এখন ও-সব দাগ কাটা থাক; মেয়েটা। বিইয়ে নিই। তখন এই পাহাড় থেকে অন্য কোথাও চলে যাব। সেখানে যত পারিস দাগ কাটাকাটি করিস।

হু-হু, ঠিক বলেছিস। একটুক্ষণ নীরব থেকে আচমকা উৎসাহিত হয়ে উঠেছে এটোঙা, দ্যাখ হ্যাজাও, আমি একটা কথা ভাবছি। পাথর খুদে খুদে আমাদের বাচ্চাটাকে ফুটিয়ে তুলব। আমার কাছে একটা চোখা লোহা আছে। সেটা দিয়েই খোদাই করব।

হু-হু, খুব ভালো হবে। এটোঙার বুকের কাছে আরো নিবিড় হয়ে বসেছে হ্যাজাও।

ভালো হবে! ইজা হুবতা! সুড়ঙ্গমুখের সামনে হঠাৎ একটা গর্জন শোনা গিয়েছিল। সে গর্জনে মনে হয়েছে, এই পাহাড়টা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

সুড়ঙ্গের মধ্যে শিউরে উঠেছে হ্যাজাও। চমকে উঠেছে এটোঙা। তারপর দু’টি বিদ্রোহী পাহাড়ী প্রেম পরস্পরের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। তাদের শিরায় শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছিল। ভয়ে আতঙ্কে তখন দুজনেই কাঁপছে।

ফিসফিস গলায় এটোঙা জিগ্যেস করেছে, কি রে হ্যাজাও, ব্যাপারটা কী? আনিজার গলা নাকি?

বেশি ফ্যাকর ফ্যাকর করিস না শয়তান। ভাবগতিক বুঝতে দে। সুড়ঙ্গমুখের দিকে চোখ রেখে উৎকর্ণ হয়ে ছিল হ্যাজাও।

এবার অনেক গলায় শোরগোল শোনা যাচ্ছিল। প্রচণ্ড হইচই। উদ্দাম, বিশৃঙ্খল, ভয়ানক চিৎকার।

সামনের দিকে বিরাট একখণ্ড পাথর দিয়ে সুড়ঙ্গের মুখটা আটকানো। ভেতরে পেন্যু কাঠের মশাল জ্বলছে। অদ্ভুত রহস্যময় আলো পাথরের ভাঁজে ভাঁজে অস্থিরভাবে নড়ছে। হ্যাজাও এবং এটোঙার ছায়া সঙ্কীর্ণ, দম-চাপা সুড়ঙ্গে কাঁপছে।

মনে হচ্ছিল, পাহাড়ে ধস নামতে শুরু করেছে। সুড়ঙ্গমুখের কাছে গোলমাল আরো বেড়ে গিয়েছে।

হু-হু, সদ্দার, এই সুড়ঙ্গটার মধ্যেই দুটোতে রয়েছে। একটু আগে ওদের গলা শুনছিলাম।

রামখোর বাচ্চা! ভীষণ গর্জন শোনা গিয়েছিল এবার। সুড়ঙ্গের মধ্যে আতঙ্কে আশঙ্কায় বুকটা ছমছম করে উঠেছে হ্যাজাওর। এ গলা তার অত্যন্ত পরিচিত। এ গলা অঙ্গামী সর্দারের–তার বাপের।

বাপের চেহারাটা একবার ভাবার চেষ্টা করেছিল হ্যাজাও। চওড়া পুরু থাবায় লম্বা বর্শা। মোষের শিঙের মুকুটে আউ পাখির পালক গোঁজা। কোমর থেকে জানু পর্যন্ত ঢোলা আরি পী কাপড় ছাড়া সারা দেহে আর কিছু নেই। লাল লাল অসমান দাঁতের সারি। গলায় বুনো বাঘের গর্জন। কোমর থেকে বাঁশের খাপে ধারাল সুচেন্যু ঝুলছে। দুটো ঘোলাটে চোখ সব সময় জ্বলে। এই তার বাপ। না না, একটা মারাত্মক আনিজা!

সেই আনিজার গলা আবার হুমকে উঠেছিল। সুড়ঙ্গের ভেতর থেকেও পরিষ্কার বুঝতে পারা যাচ্ছিল, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে অঙ্গামী সর্দার চেঁচাচ্ছে, সুড়ঙ্গের মধ্যে থাকলে টেনে বার কর।

না, টেনে নয়, বর্শা দিয়ে শয়তান দুটোকে ছুঁড়ে বার কর। সাত মাস ধরে ওদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। এই পাপ আর সইব না।

হ্যাজাও আর এটোঙার হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠেই থেমে গিয়েছে যেন। ততক্ষণে সুড়ঙ্গমুখ। থেকে পাথরের ঢাকনাটা সরিয়ে দিয়েছিল বাইরের মানুষগুলো। খানিকটা আবছা ফ্যাকাসে আলো এসে পড়েছিল গুহার ভেতর।

অঙ্গামীরা হিংস্র গলায় হট্টগোল করছিল। সাত-সাতটা মাস দক্ষিণ পাহাড়ের অন্ধিসন্ধি। তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাত্তা পায়নি। এতদিন পর বর্শার সীমানায় হ্যাজাও এবং এটোঙা নামে দুটো শিকারকে পেয়ে গিয়েছে তারা। আজ তাদের উল্লাসের দিন বৈকি।

হুই, হুই শয়তান দুটো জড়াজড়ি করে বসে রয়েছে।

রামখোর বাচ্চাদের খুঁড়ে ফেল তোরা। অঙ্গামী সর্দার হুমকে উঠেছিল।

সুড়ঙ্গের মধ্যে সেই আবছা, ঘেঁড়া-ছেঁড়া অন্ধকারে, ভয়ে আতঙ্কে সমস্ত শরীরটাকে দলা পাকিয়ে এটোঙার বুকের মধ্যে খুঁজে রেখেছিল হ্যাজাও। নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিল। আর দুটো কঠিন হাত দিয়ে হ্যাজাওর দেহটাকে ঘিরে, বর্শার তীক্ষ্ণ ফলা থেকে আড়াল করে নির্নিমেষ সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল এটোঙা।

এটোঙার বুকের মধ্যে নিজের শরীরটাকে লুকিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল হ্যাজাও, আমাদের মারিস না বাপ, আমাদের মারিস না।

মারব না! দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চোখদুটো কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠেছিল অঙ্গামী সর্দার।

না, আমার পেটে তোর নাতি রয়েছে।

নাতি! হাঃ—হাঃ–হাঃ–বিরাট মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বিকট অট্টহাসি হেসেছিল অঙ্গামী সর্দার। সেই হাসিতে সামনের খাসেম বন থেকে ডানা ঝটপট করে এক ঝাঁক আউ পাখি উড়ে গিয়েছিল। ভয় পেয়ে গোটা কয়েক দাঁতাল শুয়োর চেঁচিয়ে উতরাই-এর দিকে ছুটে পালিয়েছিল।

মোটা মোটা, বেঢপ ঠোঁট দুটো ফাঁক করে লাল দাঁতের পাটি বেরিয়ে পড়েছিল অঙ্গামী সর্দারের, টেফঙের বাচ্চারা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? দে আমাকে বর্শাটা। কেমন করে ফুড়তে হয়, দেখিয়ে দিচ্ছি।

সামনের একটা জোয়ান ছেলের হাত থেকে খারে বর্শা নিজের থাবার ছিনিয়ে নিয়েছিল অঙ্গামী সর্দার। এই পাহাড়ে করুণা নেই, মমতা নেই। সামাজিক বিচারে অন্যায় কিংবা পাপ সাব্যস্ত হলে তার একমাত্র শাস্তি হল মৃত্যু। এই অমোঘ বিধানের হেরফের হবার উপায় নাই। অঙ্গামী সর্দারও সমাজপতি। সবরকম দণ্ডমুণ্ডের অধিকর্তা। তার মুখখানা ভয়ানক হয়ে উঠেছে। অব্যর্থ লক্ষ্য। সঙ্গে সঙ্গে একটা অমানুষিক আর্তনাদ শোনা গিয়েছিল। সে আর্তনাদ সঙ্কীর্ণ সুড়ঙ্গের মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে গোঙাতে লাগল, আ-উ-উ-উ–

এটোঙা লুটিয়ে পড়েছিল। তার কণ্ঠার হাড়ের ফাঁকে খারে বর্শাটা বঁড়শির মতো আটকে রয়েছে।

আশ্চর্য! এতটুকু চিৎকার করে ওঠেনি হ্যাজাও। যে হাত দুটো দিয়ে তাকে ঘিরে রেখেছিল এটোঙা, বর্শামুখ থেকে বাঁচাচ্ছিল, সে দুটোও শিথিল হয়ে ঝুলে পড়েছে। সেদিকে বিন্দুমাত্র ক্ষেপ নেই। আচমকা ধক করে চোখ জ্বলে উঠেছে তার। পাশ থেকে একটা ধারাল সুচেন্যু হাতে তুলে নিয়েছিল হ্যাজাও। সুচের ফলাটা কী ভয়ানক! কী নিষ্ঠুর!

হ্যাজাও কিছু ভাবছিল। পাহাড়ী মানুষের ভাবনা সুষ্ঠু কিংবা শৃঙ্খলাবদ্ধ নয়। হ্যাজাওর তখনকার ভাবনাগুলি গুছিয়ে নিলে মোটামুটি এইরকম দাঁড়ায়। তার দেহের রক্তে-মাংসে একটি প্রাণকণা আলোড়ন তুলেছে। সেই প্রাণকে যে উপহার দিয়েছে, তার যৌবনকে যে প্রথম মাতৃত্ব দিয়েছে, সেই এটোঙাকে তার বাপ বর্শা দিয়ে খুঁড়েছে। হোক তার বাপ, তবু প্রতিশোধ চাই। নির্মম প্রতিশোধ। একটা জখমী বাঘিনীর মতো ফুঁসে ফুঁসে উঠছিল হ্যাজাও।

হাঃ-হাঃ-হাঃ–অঙ্গামী সর্দারের অট্টহাসি এবার আরো ভীষণ হয়ে উঠেছে। সেই হাসি উপত্যকা এবং চড়াই-উতরাইতে আছাড়ি পিছাড়ি খেতে খেতে টিজু নদীর দিকে মিলিয়ে গিয়েছিল, আমি হলাম অঙ্গামী সদ্দার। হু-হু, লোহটাদের সঙ্গে, সাঙটামদের সঙ্গে, ডাফলাদের সঙ্গে কত লড়াই আমি করেছি। আর আমার মেয়ে হুই শয়তানের বাচ্চাটা আমাকেই কোপাতে চায় সুচেন্যু দিয়ে! হাঃ-হাঃ-হাঃ–হাসতে হাসতেই সে ফের বর্শা ছুঁড়েদিল। এবার তার সঙ্গে হ্যাজাও।

বর্শার লম্বা বাজুদুটো বাইরে বেরিয়ে ছিল। সে দুটো ধরে অঙ্গামী জোয়ানেরা হেঁচড়ে হেঁচড়ে হ্যাজাও এবং এটোঙাকে সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে বার করে এনেছিল। এটোঙার কণ্ঠার ফাঁকে আর হ্যাজাওর পাঁজরায় বাঁকা বঁড়শির মতো ফলা দুটো গাঁথা রয়েছে। দেহ রক্তে মাখামাখি। দুজনেরই জ্ঞান নেই। কিছুই শুনতে, বুঝতে বা দেখতে পাচ্ছিল না তারা।

অঙ্গামী সর্দার আবার আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠেছে। সাফল্যে উল্লাসে তার অস্ফুট বুনো মনটা উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। সাত-সাতটা মাস ধরে যে শিকার দুটোর খোঁজে হিংস্র জানোয়ারের মতো পাহাড়ে পাহাড়ে তারা ঘুরে বেড়িয়েছে, এইমাত্র তাদের অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে যুঁড়তে পেরেছে।

অঙ্গামী সর্দার বলল, শয়তানের বাচ্চা, রেঙমা হয়ে অঙ্গামী মাগীর দিকে নজর দেয়। এই পাপ রাখব না। দুটোকেই সাবাড় করব।

না না, জানে মারিস না রে সদ্দার। সায়েবরা বারণ করে দিয়েছে। রেঙমা শয়তানটাকে ধরে সায়েবদের হাতে তুলে দেব। তারাই ওটাকে সাবাড় করবে। পাশ থেকে একটা জোয়ান ছেলে বলেছিল।

এতক্ষণ নিষ্পলক হ্যাজাওর সমস্ত দেহে তন্ন তন্ন করে কী যেন খুঁজছিল অঙ্গামী সর্দার। এবার সে হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে, দ্যাখ দ্যাখ, হুই রেঙমা শয়তানটা আমার মেয়েটার পেটে বাচ্চা বানিয়েছে। খুনই করে ফেলে দিই। হু-হু–উত্তেজনায় রাগে রোষে একটা লোহার মেরিকেতসু ধাঁ করে এটোঙার মাথার ওপর তুলে ধরেছিল অঙ্গামী সর্দার। সঙ্গে সঙ্গে পাশের জোয়ান ছেলেটা হাতিয়ারসহ তার হাতটা ধরে ফেলেছে।

জোয়ান ছেলেটা বলেছিল, কী করছিস সদ্দার! জানিস না, মানুষ খুন করার জন্যে সায়েবরা সেদিন ইমপাঙ বস্তি থেকে দশটা পাহাড়ীকে ধরে নিয়ে গেছে। খবদ্দার ওকে মারিস না। তার চেয়ে ওকে বস্তিতে নিয়ে চল।

রক্তাভ, রুষ্ট চোখে জোয়ান ছেলেটির দিকে তাকিয়েছে অঙ্গামী সর্দার। লাল লাল দাঁতগুলো খিঁচিয়ে বদখত মুখভঙ্গি করে গর্জে উঠেছে, ইজা হুবুতা! নে, শয়তান দুটোকে টানতে টানতে বস্তিতে নিয়ে চল।বলতে বলতে উদ্যত মেরিকেতসুটা একান্ত অনিচ্ছায় নামিয়ে ফেলেছিল অঙ্গামী সর্দার।

কণ্ঠার হাডের ফাঁকে বাঁকা বঁড়শির মতো বর্শার ফলা। বাজু ধরে টানতে টানতে ঢালু উপত্যকার দিকে দৌড়তে শুরু করেছিল অঙ্গামী জোয়ানেরা। দুটো দেহ, দুটো পাহাড়ী প্রেম–হ্যাজাও এবং এটোঙা, বর্শার ফলায় বিদ্ধ হয়ে কর্কশ পাথুরে পথে আছাড় খেতে খেতে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছিল। সকলের আগে আগে বিরাট একটা বল্লম আকাশের দিকে বাগিয়ে ধরে সদর্পে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল অঙ্গামী সর্দার।

বিদ্রোহী পাহাড়ী প্রেম। এই পার্বতী পৃথিবীর মতোই আদিম। ভয়ঙ্কর এবং দুর্বার। এ প্রেম সমাজের শাসন, শান্তি এবং বিধান মানে না। এ প্রেম বর্শার ফলা কিংবা কোনোরকম প্রতিকূলতাকে পরোয়া করে না। রেঙমা এবং অঙ্গামী–এটোঙা আর হ্যাজাও নামে দুটো বুনো প্রেম সমাজের সমস্ত অনুশাসন উপেক্ষা করে দক্ষিণ পাহাড়ের সুড়ঙ্গে সংসার পেতেছিল। দুটো মানুষ-মানুষীর হৃদয়ের উত্তাপে সে সংসার বড় মধুময়। পরস্পরের ওপর নির্ভরতায় সে সংসার বড় সুন্দর।

কিন্তু পাহাড়ী পৃথিবী এবং তার সমাজ বড় নির্মম, বড় নিষ্ঠুর। সেখানে একটুকু ক্ষমা, বিন্দুমাত্র করুণা আশা করা যায় না। এইমাত্র একটা অসামাজিক এবং অসঙ্গত পিরিতকে হত্যা করে, সুড়ঙ্গ-গর্ভের সুখী অথচ অবৈধ দম্পতির সংসারকে একপাল দাঁতাল শুয়োরের মতো ছিন্নভিন্ন করে উল্লাসে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল এই পাহাড়, এই পাহাড়ের ভয়াবহ বিচারবোধ।…..

তারপর কী হল? অঙ্গামীরা তোকে সাবাড় করে ফেললে! চারপাশে জোয়ান ছেলেমেয়েরা রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে ছিল। এটোঙা থামলে সকলে সমস্বরে জিগ্যেস করল। সিঁড়িখেতে কেউ নেই। সবাই এটোঙাকে ঘিরে ধরেছে। এমনকি শিকারি কুকুর এবং পোষা শুয়োরগুলো পর্যন্ত খাদ্যের সন্ধান ছেড়ে ভিড় জমিয়েছে।

হো হো করে হেসে উঠল এটোঙা। বলল, তোরা সব এক একটা টেফঙের বাচ্চা। মগজে যদি একটু বুদ্ধিও তোদের থাকত! আমাকে মেরে ফেললে গাঁয়ে ফিরে এলুম কী করে?

হু-হু, ঠিক বলেছিস। মগজটা তোর খাসা। তারপর কী হল, তাই বল। সালুয়ালা গ্রামের সর্দার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। আমেজী গলায় বলল, গল্পটা বেড়ে জমেছে রে এটোঙা। অঙ্গামীরা তোকে যে এমন করে খুঁড়েছে তা তো জানতাম না। আমরাও তোকে খুঁড়তে গিয়েছিলাম। অঙ্গামী মাগীটাকে নিয়ে লুকিয়ে ছিলি, খুব রাগ হয়েছিল। তুই আমাদের বক্তির ছেলে। তোকে আমরা যা খুশি করব। মারব, কুঁড়ব, দরকার হলে সাবাড় করব। তাই বলে ভিন জাতের শয়তানেরা কোপাবে? টেমে নটুঙ! নাঃ, এর শোধ তুলতেই হবে। সাঞ্জুবট বস্তি থেকে তিনটে অঙ্গামীর মুড়ো চাই। হু-হু–উত্তেজনায় বুড়ো সর্দারের দেহটা থরথর কাঁপছে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আগুনের ফুলকি ফুটছে।

হো-ও-ও-ও-আ-আ–অঙ্গামীদের তিনটে মুণ্ডু চাই। চারপাশ থেকে জোয়ান-জোয়ানীরা হট্টগোল করতে লাগল।

থাম এবার। এটোঙা বলতে শুরু করল, পুরোপুরি বেহুশ হয়ে গিয়েছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরল, দেখি কোহিমায় শুয়ে আছি। চারপাশে সাদা সাদা অনেক মানুষ। পরে জেনেছিলাম, ওরা সায়েব। সারা গা কেটে কুটে একশা হয়ে গিয়েছিল। দিনকয়েক পর সায়েরা আমাকে ইম্ফলে চালান করে দিল। সেখানে চার বছর কাটিয়ে আজ বস্তিতে ফিরছি। একটু থেমে আবার বলল, অঙ্গামীরা আমাকে সায়েবদের হাতে তুলে দিয়েছিল, বলেছিল, আমি ওদের মেয়ের ইজ্জত নিয়েছি।

ইম্ফলে কোথায় ছিলি? সমস্বরে সকলে জিগ্যেস করল।

জেলখানায়। সারি সারি ঘর। সেখানে একটা মণিপুরী চোর ছিল। তার কাছে ছবি আঁকাটা ভালো করে শিখে এসেছি।

বুড়ো সর্দার বলল, জেলখানা কাকে বলে? সেখানে মানুষ থাকে কেন?

হুই সায়েবরা জেলখানা বানিয়েছে। চুরি করলে, খুন করলে, মেয়েমানুষের ইজ্জত নিলে হুইখানে আটক করে রাখে সায়েবরা। ভারি মজার জায়গা। জেলখানার গল্প আর একদিন বলব। চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিল এটোঙা। বলল, কি রে সদ্দার, আমার বাপ-মা মরেছে, কেসুঙটাও লোপাট হয়েছে। তাই না?

হু-হু–মাথা ঝাঁকিয়ে জানালো বুড়ো সর্দার।

আমি তবে যাই।

কোথায় যাবি?

হুই দক্ষিণ পাহাড়ের মাথায়। দেখি, যদি হ্যাজাওকে পাই। চার চারটে বছর ওর সঙ্গে দেখা নেই। ওর পেটে আমার বাচ্চা ছিল। নিশ্চয়ই সে বাচ্চাটা অ্যাদ্দিনে বড়সড় হয়েছে। বলতে বলতে পা বাড়িয়ে দিল এটোঙা। পাহাড়ী মানুষগুলোকে অবাক করে দিয়ে টুপি-প্যান্ট-জুতো পরা এই অদ্ভুত মানুষটা সামনের উপত্যকায় অদৃশ্য হয়ে গেল। চার বছর আগের সেই জানাশোনা পাহাড়ী ছেলে কী এক ভোজবাজিতে দুর্বোধ্য এবং রহস্যময় হয়ে গিয়েছে। বুনো মানুষগুলো ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হয়ে যেতে লাগল।

.

৩৭.

মোরাঙের মধ্যে একখানা তিনকোনা পাথরের ওপর বসে গল্প বলছে সেঙাই। কোহিমা শহরের গল্প, পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি এবং পিয়ার্সনের গল্প। মাথোলালের গল্প, রানী গাইডিলিওর গল্প। অস্ফুট পাহাড়ী মনের সবটুকু কৌতুক এবং ব্যঙ্গ মিশিয়ে মিশিয়ে সেই গল্পকে রীতিমতো সরস করে তুলেছে সেঙাই। কখনও বিভীষিকার রং মিশিয়ে ভয়ানক করছে।

বুড়ো খাপেগা এখনও মোরাঙে আসেনি। পাহাড়ী জোয়ানেরা গল্পের মৌতাতে কুঁদ হয়ে সেঙাই-এর চারপাশে গোল হয়ে বসেছে। মাঝে মাঝে চুক চুক শব্দ করে রোহি মধু খাচ্ছে। অদ্ভুত, বিস্ময়কর সব কাহিনী। এমন গল্প এর আগে তারা কোনোদিনই শোনে নি। শুনতে শুনতে তাদের তামাটে মুখগুলোর ওপর দিয়ে কখনও কষ্টের ভঙ্গি ফুটে উঠছে। কখনও কপিশ চোখগুলো করুণ দেখাচ্ছে। কখনও ক্রুদ্ধ পেশীগুলো ফুলে ফুলে উঠছে। হাতের থাবাগুলো কঠিন হচ্ছে। আবার খুশিতে পাথুরে মুখে হাসি ফুটছে।

দু’দিকে পেন্য কাঠের মশাল জ্বলছে। বাইরের উপত্যকায় রাত্রি একটু একটু করে ঘন হচ্ছে। বাতাসে এখনও শীতের দাপট মিশে রয়েছে। চড়াই-উতরাই-এর ওপর দিয়ে জঙ্গলের মাথাগুলো এলোপাথাড়ি ঝাঁকিয়ে দিয়ে হু-হু–বাতাস ছুটছে। আছড়ে পড়ছে দূরের, আরো দূরের বনভূমিতে।

এখন সাঙসু ঋতুর শেষের দিক। কিছুদিন পরেই ঝুম আবাদের পার্বণ শুরু হবে। আসবে মরশুমি খেয়ালখুশির দিন।

সেঙাই-এর ডানপাশের মাচান থেকে ওঙলে বলল, হুই যে গাইডিলিওর কথা বললি–বেশ খাসা মেয়ে, না?

হু-হু–মাথা নেড়ে সায় দিল সেঙাই।

দেখতে কেমন?

খুব সুন্দর।

পিরিত টিরিত জমিয়ে এসেছিস নাকি রে? কোহিমায় গিয়ে আরো একটা ভালোবাসার জোয়ানী বাগিয়ে ফেললি? লোভর্ত, কুতকুতে চোখে পিটপিট করে তাকাতে লাগল ওঙলে।

কী বললি! আহে ভু টেলো! সেঙাই গর্জে উঠল, জানে খতম করে ফেলব তোকে। গাইডিলিওকে পিরিতের জোয়ানী বলছিস! জানিস, সে হল এই পাহাড়ের রানী। শয়তানের বাচ্চা–পাশ থেকে ধাঁ করে একটা বর্শা তুলে নিল সেঙাই। বলল, গাইডিলিওর ইজ্জত তুলে কথা বলছিস ধাড়ি টেফঙ!

মুহূর্তে মোরাঙের মধ্যে গল্পের আমেজটা ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে গেল। একটা খণ্ডযুদ্ধের সূচনা। ওপাশ থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছে ওঙলে। রক্তারক্তি করার উৎসাহে তার শিরাস্নায়ুগুলোও চনচন করে উঠেছে।

ঘটনার আকস্মিকতায় চারপাশের জোয়ানেরা হতবাক হয়ে গিয়েছে। কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র। চকিতে সকলে লাফিয়ে উঠল। তারপর মোরাঙ ফাটিয়ে হল্লা করতে লাগল, হো-ও-ও-ও-আ-আ–

পাহাড়ী মনের উত্তেজনা। যে-কোনো মুহূর্তে যে-কোনো ঘটনায়, যে-কোনো কথায় দপ করে জ্বলে উঠতে পারে। কেলুরি গ্রামের এই মোরাঙে সাংঘাতিক কিছু ঘটে যেত পারত। বর্শা নিয়ে দুদলে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল জোয়ান ছেলেরা। কিন্তু তার আগেই মোরাঙের মধ্যে ঢুকে পড়ল বুড়ো খাপেগা।

খাপেগা হুমকে উঠল, এই শয়তানের বাচ্চারা, মোরাঙের ভেতর চিল্লাচিল্লি বাধিয়েছিস কেন? ঘোলাটে দৃষ্টিতে সকলকে দেখতে দেখতে চেঁচামেচির কারণটা খুঁজতে লাগল সে, কী হয়েছে? কী ব্যাপার?

ইজা হুবুতা! দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বিকট ভঙ্গি করল সেঙাই, হবে আবার কী? ওঙলেটাকে আমি খুন করব।

ওপাশ থেকে ওঙলের গলায় একই দাবি শোনা গেল, সেঙাইটাকে সাবাড় করব।

জানিস, এটা হল মোরাঙ। এখানে খুনখারাপির কথা হলে আনিজার গোসা এসে পড়ে। বেশি ফ্যাকর ফ্যাকর করলে দুটোকেই বর্শা দিয়ে কুঁড়ব। বুড়ো খাপেগা গর্জাতে লাগল।

কনুই দিয়ে গুতিয়ে পথ করে খাপেগার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল সেঙাই। বলল, হুই ওঙলেটা রানী গাইডিলিকেও আমার পিরিতের মেয়ে বলল। ওকে বর্শা হাঁকাব না? তুই একবার হুকুম দে সদ্দার।

ক্ষয়া, বদখত কয়েকটা দাঁত কড়মড় শব্দ করে বেজে উঠল। রক্তচোখে তাকাল বুড়ো খাপেগা, হু-হু, তাতে কী হয়েছে সেঙাই? গাইডিলিওকে তোর পিরিতের জোয়ানী বলতে অমন করে রুখে উঠলি কেন?

জানিস সদ্দার, হুই গাইডিলিও হল এই নাগা পাহাড়ের রানী। ওর দিকে তাকালে পিরিতের কথা মনে আসে না। কোহিমায় যখন আসান্যুরা আমাকে মারল তখন হুই গাইডিলিও আমাকে বাঁচাল। এই পাহাড়ের সব ব্যারামী মানুষ তার ছোঁয়ায় বেঁচে ওঠে। তার ইজ্জত নিয়ে কথা বলব, এমন খারাপ আমি না। একটু একটু করে সম্ভ্রম এবং অস্ফুট মনের সবটুকু আনুগত্য মিশিয়ে কোহিমা পাহাড়ের, রানী গাইডিলিওর, মাধোলাল ও পাদ্রী সাহেবদের গল্প নতুন করে বলল সেঙাই।

সব শুনে বুড়ো খাপেগা বলল, খবদ্দার ওঙলে, গাইডিলিও রানীকে নিয়ে আর কোনোদিন পিরিতের কথা বলবি না। বললে মাথা কেটে মোরাঙে ঝোলাব।

একটু পরে সকলে ফের বসে পড়ল।

সেঙাই-বলল, জানিস সলার, দুই সায়েরা মোটেও ভালো না।

কেন? কী করে বুঝলি? তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল বুড়ো খাপেগা।

ওদের জন্যেই তো আমাকে আর সারুয়ামারুকে মারল আসান্যুরা। তা ছাড়া মাথোলাল বললে, রানী গাইডিলিও বললে, হুই সায়েবরা অনেক দূর দেশ থেকে এসে আমাদের এখানে সদ্দারি করে চলেছে।

খানিক আগে মোরাঙের মধ্যে যে উত্তেজনা ছিল, এখন আর তা নেই। নতুন গল্পের নেশায় জোয়ানেরা আবার মেতে উঠেছে।

আচমকা বুড়ো খাপেগা চিৎকার করে উঠল, তোর বাপ সিজিটোটাকে আমি আগেই বলেছিলাম, সায়েবরা নোক ভালো নয়। শয়তানেরা এখানে সদ্দারি ফলাচ্ছে। সিধে কথা, হুই সব আমাদের পাহাড়ে চলবে না। পাথরের চাই মেরে মেরে সায়েবদের শেষ করব। একটু থেমে খাপেগা আবার বলল, তোকে মেরেছে, না রে সেঙাই?

হু-হু, এমন মেরেছে, হুঁশ ছিল না। হুই গাইডিলিও রানী আমাকে বাঁচিয়ে দিল। ও না থাকলে বস্তিতে আর ফিরে আসতে হত না।

বুড়ো খাপেগা হুঙ্কার ছাড়ল, তোকে মেরেছে সায়েরা! হুই সায়েবদের দশটা মাথা চাই। এর বদলা নিতে হবে। অনেক দিন বড় রকমের লড়াই বাধছে না। হাতটা নিশপিশ করছে। শয়তানদের মুণ্ডু এনে মোরাঙের সামনে বর্শার মাথায় গেঁথে রাখব। রক্ত দিয়ে দেয়াল চিত্তির করব। বুড়ো বয়েসে রক্তটা ঝিমিয়ে এসেছিল। আবার তাতে আগুন ধরে গেছে। মনে মনে ফের লড়াইয়ের তাগিদ পাচ্ছি রে সেঙাই। বলতে বলতে বুড়ো খাপেগা একটু থামল। দৃষ্টিটাকে মোরাঙের চালের ফোকর দিয়ে ঝাপসা আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিল। তার ঘোলাটে চোখের সামনে যেন এই পাহাড় কিংবা জনপদ নেই। এই বনময় উপত্যকা, চড়াই-উতরাইয়ে দোল খাওয়া পাহাড়ী পৃথিবীর এক ভয়াল অতীতে সে ফিরে গেল। কেলুরি গ্রামের অতীত কাল সে। আবেগ-ভরা গলায় ফের পুরনো দিনের গল্প শুরু করল, এই পাহাড় থেকে সেসব দিন চলে যাচ্ছে রে। লড়াই বাধত অঙ্গামীদের সঙ্গে, কোনিয়াকদের সঙ্গে, সাঙটামদের সঙ্গে। পাহাড়ের মাথা আর টিজু নদী রক্তে লাল হয়ে যেত। সেই দিনকাল আর নেই, সেসব রেওয়াজও উঠে যাচ্ছে। আগে শরদের দুটো মাথা কেটে না আনলে জোয়ান ছেলেরা বিয়ের জন্যে মেয়ে পেত না। সেবার তো অঙ্গামীদের সঙ্গে লড়াই বাধল। শোন তবে সে গল্প।

ফেলে-আসা দিনগুলোর নানা তাজ্জব কাহিনী শুরু হল। সে কাহিনী পাহাড়ী মানুষের হৃৎপিণ্ড-ছেঁড়া রক্তে সিক্ত। বুড়ো খাপেগা বলতে লাগল, দক্ষিণ পাহাড়ের হুই দিকে অঙ্গামীদের বস্তি সাঞ্জুবট। একবার হল কি, ওদের এক পাল গরু এসে আমাদের সিঁড়িখেত থেকে পাকা ধান খেয়ে গেল। তখন আমার জোয়ান বয়েস। মোরাঙে বসে অন্য জোয়ানদের সঙ্গে জটলা করছিলাম। আমাদের বস্তির সদ্দার ছিল সিজিটোর ঠাকুরদা। সে বলল, ওদের গরু আমাদের ধান খেয়েছে। সাবট বস্তি থেকে দুটো মাথা কেটে আনতে হবে। অঙ্গামীদের বস্তিতে গিয়ে দেখি, একটা ঘরে শয়তানের বাচ্চারা মড়ার মতো ঘুমুচ্ছে। একটুও শব্দ করলাম না। সুচেন্যু দিয়ে কুপিয়ে চারটে মাথা চুলের ঝুঁটি ধরে নিয়ে এলাম। সদ্দার আমাকে খুব সাবাস। দিলে, রোহি মধু দিলে, কুকুরের মাংসের কাবাব দিলে গরম গরম, আর সেই সঙ্গে তার সুন্দর মেয়েটাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিলে। আমার বিয়ে তো হল। তার দিনকতক বাদেই নড্রিলোদের বাড়ি থেকে মড়াকান্না উঠল। রাত্তিরবেলা অঙ্গামীরা তাদের সাতটা মাথা নিয়ে গেছে। শোধ তুললাম দুবছর বাদে অঙ্গামীদের কুড়িটা মাথা এনে। এককুড়ি মাথার শোধ এখনও ওরা তুলতে পারেনি। কত বছর পার হল, অত হিসেব আর মনে নেই। তখন কাঁচা জোয়ান ছিলাম, এখন বুড়ো হয়েছি। যাক সে কথা। অঙ্গামী শয়তানেরা এখনও তাকে তাকে রয়েছে। বাগে পেলে ভীষণ বিপদ। খুব সাবধান।

কেলুরি গ্রামের একালের জোয়ানেরা এ গল্প অনেক বার শুনেছে। বার বার শুনেও তাদের অরুচি ধরে না। যতবার শোনে ততবারই আরো ভালো লাগে, নতুন লাগে।

সেঙাই বলল, সেসব কথা আদ্দিনে অঙ্গামীরা ভুলে গেছে।

আরে না, না। পাহাড়ী নাগা অত সহজে মাথা কাটার কথা ভোলে না। এক জন্মে না হোক আর এক জন্মে, বাপ না পারুক ছেলে, ছেলে না পারুক নাতি, তার শোধ তুলবেই। এই তো সালুয়ালাঙের খোনকেকে মেরে তোর ঠাকুরদাকে মারার শোধ তুলে এলি। অঙ্গামীরা লোপাট হোক। সায়েবদের সঙ্গে লড়াইটা তা হলে বাধছে? উল্লাসে বুড়ো খাপেগার চোখজোড়া চকচক করতে লাগল।

সেঙাই বলল, হু-হু, আসান্যুরা লড়াই বাধিয়ে দিয়েছে।

কে বললে? বাদামি পাথরখানায় খাড়া হয়ে বসল বুড়ো খাপেগা।

কোহিমা পাহাড়ের মাধোলাল বলছিল। আসাদের সদ্দারটার নাম গান্ধা–না কি যেন। আমার ঠিক মনে নেই। সারুয়ামারু জানে। সে বলতে পারবে।

সারুয়ামারু, এই সারুয়ামারু–তারস্বরে চিৎকার করে উঠল বুড়ো খাপেগা, আসাদের সদ্দারটার নাম জানা দরকার। লড়াই বাধলে তার কাছে লোক পাঠাতে হবে।

ওঙলে বলল, সারুয়ামারু মোরাঙে আসেনি।

আচ্ছা থাক, কাল সকালেই তার কাছ থেকে জেনে নেব।

আচমকা সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, নামটা মনে পড়েছে সে সদ্দার–গান্ধিজি। সে লড়াই বাধিয়ে দিয়েছে সায়েবদের সঙ্গে।

হু-হু, সাবাস দিতে হয় নোকটাকে। আমরা পাহাড়ী মানুষগুলো হুই সায়েবদের সঙ্গে এখনও লড়াই বাধাই নি। আর আসারা বাধিয়ে দিলে! আপশোশে হা-হুঁতাশ করতে লাগল বুড়ো খাপেগা।

আমরাও বাধিয়েছি। হু-হু। গম্ভীর গলায় সেঙাই বলল।

আমরা আবার কবে বাধালাম! বিস্ময়ে বুড়ো খাপেগার গলাটা কেমন যেন শোনায়।

হু-হু, রানী গাইডিলিও বাধিয়ে দিয়েছে। আমাদের বস্তিতে সে আসবে বলেছে। নতুন বিস্ময়কর একটা খবর দিয়ে, সেঙাই বলতে লাগল, আমি নিজেও আসতে বলেছি রানীকে। ঠিক করিনি? তুই আবার রাগ করে বর্শা হাঁকড়াবি না তো সদ্দার?

আরে, না না। এই কদিন শহরে থেকে তোর মগজটা একেবারে খুলে গেছে রে সেঙাই। যাক, অ্যাদ্দিনে রানীকে দেখা যাবে। ওর ছোঁয়ায় নাকি সব ব্যারাম সেরে যায়।

হু-হু। এই দ্যাখ না, আমাকে আর সারুয়ামারুকে কী মার দিলে সায়েবের লোকেরা। সারা গা ফেটে রক্তে মাখামাখি হয়েছিল। হুঁশ ছিল না। রানীই আমাদের বাঁচাল। তার ছোঁয়াতেই তো সেরে গেলাম। হু-হু–অসীম কৃতজ্ঞতায় সেঙাইর মনটা ভরে গেল।

বুড়ো খাপেগা বলল, রানী গাইডিলিও যখন সায়েবদের সঙ্গে লড়াই বাধিয়েছে তখন আমরা তার দলে। তোদের দুজনকে সে বাঁচিয়ে দিয়েছে; তার হয়েই আমরা লড়ব। হুই সায়েবরা পাহাড়ী জোয়ানদের ফুসলে পর করে দিচ্ছে। আমাদের সিজিটোটাকে কেমন বদলে দিয়েছে। সে আর বস্তিতেই ফেরে না। হুই সায়েবরা হল এক-একটা আনিজা, এক-একটা ডাইনি। একটু থেমে একদলা থুতু সামনের অগ্নিকুণ্ডটার দিকে ছুঁড়ে আবার সে বলল, আমাদের বস্তিতে রানী গাইডিলিও আসবে। কাল থেকে বর্শা, সুচেন্যু আর তীর-ধনুক বানাতে শুরু করে দে তোরা।

হো-ও-ও-ও-আ-আ–জোয়ানদের গলায় ঝড়। আসন্ন একটা লড়াইয়ের সূচনা। নাগা পাহাড়ের শিখরে শিখরে আছাড় খেতে খেতে তাদের হুঙ্কার দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। বাইরে যে অসহ্য রাত্রি স্তব্ধ হয়ে রয়েছে, তার হৃৎপিণ্ড শিউরে উঠল, চমকে উঠল।

.

৩৮.

ডাইনি নাকপোলিবার গুহা।

এখান থেকে দক্ষিণ পাহাড়ের ঢালু উপত্যকাটা অনেক নিচে নেমে সমতল হয়ে গিয়েছে। ওদিকে টিজু নদীর বাঁকা রেখাটা একটা নীল ঝিলিকের মতো দেখায়। খানিকটা হালকা সাদা কুয়াশা পাহাড়ের চূড়া ঘিরে ঝুলছে। চারপাশে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠছে আউ পাখির ঝাক। খাসেম বনে ধারাল ঠোঁট দিয়ে ঠকঠক শব্দ করছে খারিমা পতঙ্গের দল। নাকপোলিবার গুহা থেকে যতদূর নজর ছড়ানো যায়, শুধু একটানা অবাধ এবং উদ্দাম বন। সেই বনে পৃথিবীর প্রাণশক্তির আদিম শ্যামায়িত প্রকাশ।

নাকপোলিবার গুহা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পাহাড়ী জনপদগুলি গড়ে উঠেছে।

একটু একটু করে অন্ধকার সরে যাচ্ছে। পুবের আকাশটা আবছা দেখাতে লাগল। সামনের বনভূমি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

গুহার মধ্যে চুপচাপ বসে রয়েছে দু’টি উলঙ্গ নারীদেহ। ডাইনি নাকপোলিবা আর সালুনারু। দুজোড়া চোখ সামনের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রয়েছে।

পাথরের ভাঁজে ভাঁজে রক্তাভ আগুনের আভাস। একপাশে একটা অগ্নিকুণ্ড। সেটাতে খাটসঙ কাঠ পুড়ছে। রহস্যময় আলো ছড়িয়ে রয়েছে গুহার মধ্যে।

ডাইনি নাকপোলিবা শীর্ণ শরীরটাকে ঘষতে ঘষতে সালুনারুর কাছাকাছি টেনে আনল। এর মধ্যে সালুনারুর সমস্ত দেহে, গলায়, বুকে, পেটে, জানুতে, আরেলা পাতার রস দিয়ে অজস্র উল্কি আঁকা হয়েছে। পৃথিবীর আদিম শিল্প। কঙ্কাল, বুনো মোষের মাথা, বাঘের থাবা এবং বানরের চোখের ছবি।

সালুনারুর বুকের ওপর একটা কঙ্কালসার হাত বিছিয়ে দিল ডাইনি নাকপোলিবা। কিছুদিন আগে হলেও আতঙ্কে হৃৎপিণ্ডটা ধক করে উঠত সালুনারুর। কিন্তু এর মধ্যে দেহে মনে অনেকখানি সাহস সঞ্চয় করে নিয়েছে সে।

নিদাঁত দুটো মাড়ি খিঁচিয়ে নাকপালি বলল, এই কদিনে তুই সব মন্ত্রতন্ত্র শিখে নিলি। মাগী-মরদ বশ করার মন্ত্র। বুকের রক্ত জল করার মন্ত্র। আনিজা ডাকার মন্ত্র। ভূমিকম্প থামানোর মন্ত্র। ঝড়তুফান ডাকার মন্ত্র। বাঘ আর বুনো মোষ পোষ মানাবার মন্ত্র। বৃষ্টি থামাবার, বৃষ্টি নামাবার মন্ত্র। পাহাড়ের ধস থামাবার মন্ত্র। রক্ত বমি করাবার মন্ত্র। মাগীদের বিয়োবার সময় আসান্যু দেবার মন্ত্র।

হু-হু। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সায় দিল সালুনারু। তারপর পলকহীন, ভয়ানক দৃষ্টিতে নাকপোলিবার দিকে তাকিয়ে রইল।

নাকপোলিবা আরো বলল, তুই তো এখন রীতিমতো ডাইনি হয়ে গেলি। কত বছর ধরে এই গুহায় বসে রয়েছি, তার কি হিসেব আছে! সেবার ভূমিকম্পের দাপটে টিজু নদীর মুখ ঘুরে গেল। আগে কি এখানে বন ছিল? ছিল না। সেই বন গজাতে দেখলাম। দক্ষিণ পাহাড়ের মাথায় অঙ্গামীদের বস্তি ঘেঁষে লাল রঙের একটা পাহাড় উঠল। তা দেখলাম। সেসব তিরিশ কি পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তখন তো গুহা থেকে বার হতুম। পাহাড়ের ডগায় দাঁড়িয়ে দেখতুম অঙ্গামীদের বস্তিতে সাদা সাদা সব মানুষ আসতে লাগল। হুন্টসিঙ পাখির পালকের মতো ধবধবে রং। তাদের নাম নাকি সায়েব। কত দেখলাম রে সালুনারু। কত বছর ধরে এই পাহাড়ে বেঁচে রয়েছি। জীর্ণ, হাড়সার দেহটাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। নাকপোলিবা ডাইনির।

খানিকক্ষণ চুপচাপ কাটল। তারপর আবার শুরু করল নাকপোলিবা, এতদিন তো এই পাহাড়ে রইলাম। এত মন্ত্র শিখলাম, এত গুণতুক শিখলাম। এত ওষুধ করা শিখলাম। সারাদিন এই গুহায় বসে থেকে ভাবতুম, কাকে এত সব মন্ত্র, এত ওষুধ শিখিয়ে যাই। তোকে এসব দিয়ে এবার ভাবনা দূর হল। অনেক কাল বাঁচলাম। এবার নির্ঘাত লোপাট হয়ে যাব।

এই কটা মাসের প্রতিটি মুহূর্ত পরম মনোযোগে, অখণ্ড একাগ্রতায় ডাইনি নাকপোলিবার কাছ থেকে পৃথিবীর আদিম মন্ত্রগুলির সন্ধান নিয়েছে সালুনারু। একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ নিয়েছে ভীষণের, ভয়ঙ্করের, মন্ত্রের, তন্ত্রের এবং ওষুধের। এই পাহাড়ের কোন অন্ধিসন্ধিতে, কোন গুহায় কি সুড়ঙ্গে, কোন উপত্যকায়, কোন জঙ্গলের আড়ালে-আবডালে রয়েছে গুণু পাতা, রয়েছে সাঙলিক লতা, রয়েছে খুঙা গাছ, কোন জলপ্রপাতের নিচে রয়েছে কমলারঙের পাথর, কোথায় রয়েছে সাদা পিঁপড়ের ঢিবি, রয়েছে তিনশো বছরের পুরনো মানুষের করোটি, রয়েছে মন্ত্রসিদ্ধির অসংখ্য উপকরণবানরের মেটলি, বাঘের হাড়, তাজা জোয়ানের হলদে মগজ, জোয়ানী মেয়ের কলিজা, সব–সবই জেনে নিয়েছে সালুনারু।

সালুনারু বলল, সবই তো শিখলাম। এবার এই মন্ত্র আর ওষুধ কেলুরি আর সালুয়ালাঙ বস্তির সব শয়তানগুলোর ওপর চাপাব। সব কটার রক্ত জল করে খতম করব। হু-হু, তবে আমি পাহাড়ী ডাইনি। চোখের মণিদুটো বনবন করে পাক খেতে লাগল সালুনারুর। এই মুহূর্তে তাকে একটা জখমী সাপিনীর মতো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। গলার শিরাগুলো ফুলিয়ে সে চেঁচাতে লাগল, কেলুরি বস্তির সদ্দার আমাকে ভাগিয়ে দিল। সালুয়ালাঙ বস্তির উপকার করতে গেলাম। সেখানেও শয়তানরা আমাকে খুঁড়তে চায়। আমার মাংস দিয়ে কাবাব বানিয়ে বস্তিতে ভোজ দেবে বলেছে। দুটো বস্তির একটা কুত্তাকেও আমি জ্যান্ত রাখব না। হু-হু–উল্কি-আঁকা উত্তেজিত বুকখানা ফুলে ফুলে উঠতে লাগল সালুনারুর। ক্রোধে দাঁতে দাঁতে কড়মড় শব্দ হতে লাগল। বলল, একটা বস্তিতেও আমাকে টিকতে দিল না টেফঙের বাচ্চারা।

কোটরের মধ্যে দুটুকরো জ্বলন্ত অঙ্গার। নাকপোলিবার চোখ। একটু একটু করে চোখজোড়া বুজে এল। মাথা নাড়তে নাড়তে সে বলল, হু-হু, আমাকেও একদিন বস্তিতে টিকতে দেয়নি শয়তানেরা।

কেন, তোর আবার কী হয়েছিল? তুই বস্তিতে ছিলি নাকি? লোকে বলে, জন্মের পর ডাইনি হয়ে তুই এই গুহার মধ্যে আছিস সারা জীবন। সালুনারুর গলাটা বিস্ময়ে কেঁপে গেল।

ইজা হুকুতা! দাঁতহীন মাড়িজোড়া বার করে খেঁকিয়ে উঠল নাকপোলিবা, জন্মেই কেউ ডাইনি হয় নাকি! আমি যখন জন্মেছিলাম তখন এই কেলুরি বস্তিও ছিল না, সালুয়ালাঙও নয়। দুটো মিলিয়ে একটা বড় বস্তি ছিল। তার নাম কুরগুলাঙ। সেই কুরগুলাঙে আমার জন্ম। সেই। সময়কার একটা মানুষও আজ বেঁচে নেই।

থাক ওসব কথা।অসহিষ্ণু গলায় সালুনারু বলে উঠল, তুই কেমন করে ডাইনি হয়েছিস সেই গল্পটাই বল দিকি। বড় মজা লাগছে সে কথা শুনতে। প্রবল ঔৎসুক্যে নাকপোলিবার কাছে এগিয়ে এল সালুনারু।

শোন তবে। আমিও এক কালে তোদের মতো জোয়ান মাগী ছিলাম। মনে সোয়ামী, পুত্তুর আর ঘরের জন্যে সাধ-আহ্লাদ ছিল।

আশ্চর্য! ডাইনি নাকপোলিবার চোখজোড়া এখন আর জ্বলছে না। কী এক কোমল আবেগে মনটা তার মাখামাখি হয়ে গেল। একটা কঙ্কালদেহ, নিখাদ হাড় আর চামড়ার কাঠামো। এতটুকু মাংস নেই নাকপোলিবার শরীরে। একটা ভয়ঙ্কর ডাইনি, একটা জীবন্ত প্রেতিনী। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে একেবারে মন্দ দেখাচ্ছে না। তার জীর্ণ বুকের নিচে হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকুনিতে এককালে যে আর দশটা কুমারী মেয়ের মতোই বাসনা এবং কামনা জলদ বাজনার মতো একযোগে বেজে উঠত তা যেন মিথ্যে নয়। ডাইনি না, এই মুহূর্তে নাকপোলিবার মধ্য থেকে চিরকালের এক তৃষাতুর নারীমন হাহাকার করে উঠেছে। সে নারীর সুঠাম দেহে রূপ ছিল, মনের পরতে পরতে রং ছিল। আশা ছিল ভোগের, বাসনা ছিল আর দশটা মেয়ের মতোই জীবনকে গড়ে তোলার। কামনা ছিল একটি বলিষ্ঠ পুরুষের, একটি প্রেমিক স্বামীর। তার নির্দয় পেষণের, নির্মম সোহাগের।

ভাঙা ভাঙা, কিছুটা বিষণ্ণ গলায় নাকপোলিবা বলে চলল, বিয়েও হয়েছিল। কিন্তু তখনও কি জানতাম, আমি বাজা! এক বছর গেল, দুবছর গেল। তিন বছর সোয়ামীর সোহাগ ভোগ করেও একটা বাচ্চার জন্ম দিতে পারলাম না। বর্শা উঁচিয়ে সোয়ামী আমাকে ভাগালে। বাজা বউ ঘরে পুষলে নাকি আনিজার গোসা এসে পড়ে। চলে এলাম বাপের কাছে। বাপ লম্বা দা বাগিয়ে ধরলে। তিন বছর সোয়ামীর ঘর করে যে মাগী বাচ্চা বিয়য়াতে পারে না, নির্ঘাত তার ওপর আনিজার খারাপ নজর আছে। তাকে ঘরে জায়গা দিলে সব জানে সাবাড় হয়ে যাবে। ভয়ে এই দক্ষিণ পাহাড়ে পালিয়ে এলাম। তিন দিন, তিন রাত বনে বনে ঘুরে, আখুশি ফল খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। তারপর দেখা হল রসিলটাকের সঙ্গে।

রসিলটাক আবার কে? অপরিসীম কৌতূহলে এবং গল্প শোনার নেশায় আরো ঘন হয়ে বসল সালুনারু।

এই গুহায় সে থাকত, সে-ও ডাইনি ছিল। আমাকে সব মন্ত্রতন্ত্র শেখাল সে, ওষুধ শেখাল, গুণতুক শেখাল। পোয়াতি মাগীর পেট খসাবার কায়দা শেখাল। সব শিখে সোয়ামীকে মারলাম আগে। তারপর বাপকে। বলতে বলতে ডাইনি নাকপোলিবা একটু থামল। উত্তেজনায় তার ছোট্ট, জীর্ণ বুকটা ওঠানামা করছে। ঘন ঘন, দ্রুত তালে বুক ভরে বারকয়েক বাতাস নিল নাকপোলিবা। বলল, একদিন রসিলটাক মরল। তার জায়গায় আমি রয়েছি। বাঁজা বলে সোয়ামী আর বাপ ঘরে থাকতে দিলে না। নইলে কি আর ডাইনি হতাম! যাক সে কথা। আমি মরলে আমার জায়গায় তুই থাকবি। তোর মরার সময় তোর জায়গায় নতুন ডাইনি বানিয়ে যাবি। যারা আমাদের বস্তিতে থাকতে দেয় না, তাদের শায়েস্তা করতে হবে। নিজেদের দোষ নেই, এই ধর আমি বাঁজা, তুই আনিজার নামে রুখে উঠেছিলি, অমনি আমাদের বস্তি থেকে ভাগিয়ে দিল। ওরাই তো আমাদের ডাইনি করে। যেমন আমাদের ডাইনি বানায় তেমনি তার ঠ্যালা সামলাক।

হু-হু, ঠিক বলেছিস। মাথা নেড়ে নেড়ে নাকপোলিবর কথায় সায় দিল সালুনারু। বলল, হুই রামখোর বাচ্চারাই তো আমাদের ডাইনি বানায়। একটু একটু করে তার শোধ তুলব। তোর কাছে ওষুধ শিখলাম, মন্তর শিখলাম। এবার কেলুরি আর সালুয়ালাঙ বস্তির সব শয়তানগুলোকে উজাড় করে ছাড়ব।

হু, সব লোপাট করে দে। এই পাহাড়ে একটা মানুষও জ্যান্ত রাখবি না। সবগুলোকে মেরে তাদের হাড়ের ওপর, মাংসের ওপর বসে, মজা করে খুলি বাজাবি। এই পাহাড়ী শয়তানগুলো আমাদের ঘর দেয়নি, একটু থাকবার জায়গা দেয়নি। একটু ভালোবাসেনি। তাদের সঙ্গে কোনো খাতির নেই। তুই আর আমি সব সাবাড় করে এই পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াব, কি বলিস? হিঃ হিঃ হিঃ–বীভৎস গলায় টেনে টেনে হেসে উঠল ডাইনি নাকপোলিবা। সালুনারুর মনে হল, হাসির দমকে বুকের হাড়গুলো তার মটমট করে ভেঙে যাবে।

অবিরাম হাসি, খুরধার হাসি। সে হাসি গুহার ছমছমে আলোছায়ায় মিশে যেতে লাগল। একটু আগে ডাইনি নাকপোলিবার হিসাবহীন বয়সের অতল স্তর থেকে যে কোমল নারীমনটি, যে সুন্দর আকাঙ্ক্ষাগুলি উঁকি মেরেছিল, এই ভীষণ হাসির হুমকিতে তারা আবার উধাও হয়েছে।

কিছুদিন আগে হলেও ভয়ে আতঙ্কে শিউরে উঠত সালুনারু, কিন্তু কমাস ধরে নাকপোলিবার শরীরে শরীর ঠেকিয়ে, একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে মন্ত্রতন্ত্র, গুণতুক, বশীকরণ শিখতে শিখতে ভয়ডর চলে গিয়েছে। আজকাল নাকপোলিবাকে তেমন ভয়ঙ্কর মনে হয় না। হয়তো মনেপ্রাণে নাকপোলিবার সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছে সালুনারু। নির্বিকার ভঙ্গিতে পাথরের ওপর বসে রইল সে। অপলক চোখে দেখতে লাগল, কেমন করে ডাইনি। নাকপোলিবার কোটরে-ঢোকা চোখে একজোড়া আগুনের গোলক জ্বলছে আর নিভছে।

একসময় হাসি থামল। আশ্চর্য সহজ গলায় নাকপোলিবা বলল, আচ্ছা সালুনারু, আমার সব বিদ্যে তো তোকে দিলাম। একেবারে প্রথমে কার ওপরে এই বিদ্যে হাঁকড়াবি, কি রে? অন্তরঙ্গতার সুর ফুটে উঠল কথাগুলোতে।

কার ওপর হাঁকড়াব? কঠিন চোখে তাকাল সালুনারু। তার তামাটে কোমল দেহটা একটু একটু করে শক্ত এবং নির্মম হয়ে উঠতে লাগল। মুখটা হিংস্র হয়ে উঠল। একটা আদিম এবং কুটিল প্রতিজ্ঞা জ্বলতে লাগল দুচোখে। দাঁতে দাঁত ঘষে, ভুরু কুঁচকে সালুনারু বলল, সবচেয়ে আগে হাঁকড়াব তোর ওপর। তুই আমার সোয়ামীকে খাদে ফেলে মেরেছিস। সোয়ামী মরেছে। বলে আমি বস্তিতে টিকতে পারলাম না। আমাকে ডাইনি হতে হল। তোকেই–

আহে ভু টোলো! সাঁ করে একপাশে সরে গেল ডাইনি নাকপোলিবা। বলল, আমাকে মারবার জন্যে এখানে এসে ডাইনি হয়েছিস! মাড়ি খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠল নাকপোলিবা। তারপরেই পাশ থেকে একটা বুনো মোষের হাড় বার করে আনল। হাড়টার দু’পাশ পাথরে ঘষে ঘষে রীতিমতো ধারাল করা হয়েছে। তীব্র গলায় গর্জে উঠল ডাইনি নাকপোলিবা, আমাকে সাবাড় করতে এসেছিস! এই গুহার ভেতর থেকে জান নিয়ে ফিরতে হবে না। একেবারে টুকরো টুকরো করে কাটব তোকে। মোষের হাড়খানা সালুনারুর মাথার ওপর তুলে ধরল নাকপোলিবা।

ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে যেত, কিন্তু তার আগেই প্রবলভাবে গুহাটা কেঁপে উঠল। বাইরে বিরাট বিরাট পাথরের চাই গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ হচ্ছে গুমগুম শব্দে।

কাতর গলায় চেঁচিয়ে উঠল ডাইনি নাকপোলিবা, ভূমিকম্প, ভূমিকম্প শুরু হয়েছে লো সালুনারু।

চমকে উঠল সালুনারু। একটি মাত্র মুহূর্ত। সঙ্গে সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল একটা উলঙ্গ যুবতীদেহ। সামনের উপত্যকায় যে বন নিবিড় হয়ে রয়েছে, তার মধ্যে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল সালুনারু।

গুহার ভেতর একটা করুণ গলা শোনা গেল। ডাইনি নাকপোলিবা ককিয়ে উঠেছে, তুই একা যাস না সালুনারু। আমাকে বাঁচা, পাহাড়টা নেমে আসছে। আমি যে বেরুতে পারছি না।

বাইরে একটানা বিরাট বিরাট পাথর পড়ার শব্দ হয়েই চলেছে। বিকট আওয়াজে পাহাড়ী অরণ্য ধরাশায়ী হচ্ছে। এগুলোর সঙ্গে জলপ্রপাতের গর্জন একাকার হয়ে মিশে গিয়েছে। একটা ভয়াবহ প্রলয় এই পাহাড়কে গুঁড়িয়ে, চুরমার করে দেবার জন্য ধেয়ে আসছে। এই সব শব্দ ছাড়া উপত্যকা থেকে কোনো পশুপাখি বা মানুষের গলা শোনা গেল না। সালুনারু তো আগেই পালিয়ে গিয়েছে।

পাহাড়ী ভূমিকম্প। ভয়াল এবং ভয়ঙ্কর। নাকপোলিবার গুহার ছাদ একটু একটু করে নেমে আসছে। ভাজে ভাজে পাথর ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। পেন্য কাঠের মশাল দুটো নিভে গিয়েছে। নিচ্ছেদ অন্ধকার। সেই কঠিন, জমাট বাঁধা আঁধারে এই গুহার একটা আদিম প্রাণকে খতম করে দেবার উল্লাসে পাহাড়টা নেমে আসছে মাথার ওপর।

বিকট গলায় আর্তনাদ করে উঠল ডাইনি নাকপোলিবা, কিন্তু সেই আওয়াজ ধস নামা আর বন-ভাঙার শব্দের মধ্যে চাপা পড়ে গেল। নাকপোলিবা গোঙাতে গোঙাতে বলতে লাগল, আমি তোকে মারব না সালুনারু। তুই আমাকে বাঁচা। আমি–আমি পথ দেখতে পাচ্ছি না। সব অন্ধকার। ছাদটা যে নেমে আসছে। আ-উ-উ-উ–

এবড়োখেবড়ো ছাদটা ক্রমশ মাথার কাছে চলে এসেছে। হাত থেকে বুনো মোষের হাড়খানা খসে পড়ল ডাইনি নাকপোলিবার। কয়েকটা মাত্র মুহূর্ত, তারপরেই কর্কশ মেঝের ওপর দিয়ে বুকে হেঁটে হেঁটে সুড়ঙ্গমুখের দিকে এগুতে লাগল সে।

বাইরে বিরাট বিরাট পাথরের চাঙড় নামছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে খাসেম বন। অসংখ্য শিকড় মেলে পাথুরে মাটি আঁকড়ে যে পাহাড়ী আরণ্য উদ্দাম হয়ে উঠেছিল, ভূমিকম্পের এলোপাথাড়ি বাড়ি খেয়ে তারা লুটিয়ে পড়ছে।

বুক হেঁচড়ে সামনের দিকে এগুতে এগুতে আচমকা সমস্ত শরীরটা ঝংকার দিয়ে উঠল ডাইনি নাকপোলিবার। জীর্ণ বুকের মধ্যে যে নিথর হৃৎপিণ্ডটা ধুকধুক করত সেটাকে বঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে অদ্ভুত শিহরন খেলে গেল। শুকনো শরীরের শীর্ণ শিরায় শিরায় আচমকা রক্তের মাতামাতি শুরু হল। এগিয়ে আসতে আসতে থমকে গেল ডাইনি নাকপোলিবা। এতক্ষণে তার মাথাটা গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু ধড়টা সুড়ঙ্গের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে।

একটু আগে সে ভয় পেয়েছিল। পাহাড়ী ভূমিকম্প তাকে মৃত্যুর আতঙ্কে জর্জর করে তুলেছিল। ডাইনির জীবনে, তার দেহ-মন-বোধ কিংবা চেতনায় এবং ভাবনায় এসবের অস্তিত্ব নেই। ভয় নামে কোনো অনুভূতি, আতঙ্ক নামে কোনো শিহরন, মৃত্যু নামে কোনো বিভীষিকা ডাইনির মনে থাকতে নেই।

ডাইনি নাকপোলিবা। এই পাহাড়ী পৃথিবীর সমস্ত মন্ত্র-তন্ত্র, সমস্ত আদিমতা এবং হিংসাকে শ্রুতিতে, স্মৃতিতে, ভাবনায় ধারণ করে এই গুহায় নির্বাসিত হয়ে রয়েছে সে। সে নিজেই তো এক বিভীষিকা, ভয়ের জীবন্ত মূর্তি। এই পাহাড়ে সমস্ত মৃত্যু এবং অপঘাত তো তারই একটি ইঙ্গিতের অপেক্ষায় ওত পেতে থাকে। সে ডাইনি নাকপোলিবা, তবু সে ভয় পেয়েছে। তার শিক্ষাদীক্ষা এবং কর্তব্য সে ভুলে গিয়েছিল। ভীষণ এক অপরাধবোধে, মারাত্মক এক ধরনের পাপাঁচরণের অনুভূতিতে সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল নাকপোলিবার। ডাইনি হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। রসিলটাকের মন্ত্রশিষ্য হওয়ার সামর্থ্যও না। রসিলটাকের নির্দেশগুলো সে ভুলে যাচ্ছে। ভুলে যাচ্ছে সমস্ত মন্ত্রতন্ত্র।

আচমকা বহুকাল আগের এক জোয়ানী মেয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল। বাঁজা হওয়ার অপরাধে এই পাহাড় তাকে আশ্রয় দেয় নি, সোয়মী স্বীকৃতি দেয়নি স্ত্রীর, বাপ স্বীকৃতি দেয়নি মেয়ের। সেদিন সেই যুবতী জনপদ থেকে অনেক, অনেক দূরে দক্ষিণ পাহাড়ের এই নির্জন উপত্যকায়, এই গুহায়, ডাইনি রসিলটাকের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। রসিলটাকের উত্তরকাল সে। সেই যৌবনবতী নারীর ভাবনা এই মুহূর্তে বড়ই অসত্য, বড়ই অবাস্তব এবং নিছক মনোবিলাস ছাড়া আর কিছু নয়। তবু নাকপোলিবা তার কথা ভাবল। কেন ভাবল, সে-ই জানে। আরো ভাবল সেদিনের তামাটে রঙের বাঁজা জোয়ানীর চেয়ে আরো একটা ভয়ানক সত্য আছে। সেই রঙে রসে ভরপুর যুবতী আজ মিথ্যে এবং অতীত। ডাইনি নাকপোলিবাই আজ সত্য, ভীষণ এবং সাআতিক সত্য।

ডাইনি নাকপোলিবা ভয় পেয়েছে। তবে কি এই পাহাড়ে অসংখ্য বছর কাটিয়ে জীবনের অন্তিম সময়ে আনিজার ক্রোধ এসে পড়ল তার ওপর! বুকের ভেতরটা কি ভয়ে ছমছম করে উঠছে ডাইনি নাকপোলিবার!

না, ভয় পেলে চলবে না। রসিলটাকের শিক্ষা এবং এই পাহাড়ের আদিম মন্ত্রতন্ত্রগুলিকে সে ব্যর্থ হতে দেবে না। রসিলটাক তাকে ভূমিকম্প থামানোর মন্ত্র শিখিয়েছিল। মন্ত্র পড়ে এই ভূমিকম্পকে দক্ষিণ পাহাড় থেকে চিরকালের জন্য খেদিয়ে দেবে নাকপোলিবা। গুহা থেকে সে বাইরে যাবে না। কিছুতেই এখান থেকে সে পালাবে না।

পাহাড়ের অন্তরাত্মা থরথর করে কাঁপছে। গুহাটা টলমল করছে। ওপর থেকে নিরেট ছাদ নেমে আসছে। না, কিছুতেই ছাদকে আর নামতে দেওয়া হবে না। সুড়ঙ্গের বাইরে মাথাটা এবং ভেতরে বাকি দেহটা পড়ে রয়েছে ডাইনি নাকপোলিবার।

নাকপোলিবা ভাবল, রসিলটাকের এই গুহাকে কিছুতেই ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না। আচমকা একটানা তীক্ষ্ণ গলায় মন্ত্র পড়তে শুরু করল সে :

ওহ-ই-য়ি–এ-য়ে–এ-এ
ওহ-ই-ই-য়ি–সুঙকেনি–ই-ই-ই–
আমহু লেখসু—সুঙকেনি–ই-ই-ই–
অমুকেবঙ সঙ—সুঙকেনি–ই-ই-ই–
ওহ-ই–ই-ই-য়ি –এ-হে-এ-এ
সঙ-সুঙকেনি-ই-ই-ই—

ছাদটা আরো নেমে আসছে। ডাইনি নাকপোলিবার পিঠে তার হিমাক্ত ছোঁয়া এসে লেগেছে।

বাইরে ধস নামার গর্জন, অরণ্য ধ্বংসের আর্তনাদ, জলপ্রপাতের তর্জন। সব মিলিয়ে একটা বিকট প্রলয়। সমস্ত কিছু ছাপিয়ে উঠেছে নাকপোলিবার গলা। অনেক, অনেক দিন পরে সে মন্ত্র পড়তে শুরু করেছে। একটু আগে ভয় পেয়ে শিক্ষা-দীক্ষা সব ভুলে গিয়েছিল ডাইনি নাকপোলিবা। এই মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। আরো, আরো জোরে, দেহমনের সমস্ত উত্তেজনা ও শক্তি গলায় একত্র করে চিৎকার করতে লাগল নাকপোলিবা। না, রসিলটাকের। শিক্ষাকে এবং এই নাগা পাহাড়ের গুহায়-সুড়ঙ্গে-উপত্যকায়-মালভূমিতে আদিম জীবনের যে মন্ত্রগুলি ছড়ানো রয়েছে তার কিছুই বিফল হতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই নয়। এই ভূমিকম্পকে সে শাসন করবে।

পাথুরে ছাদটা আরো নেমে এল। আচমকা, একান্তই আচমকা, ডাইনি নাকপোলিবার মন্ত্র থেমে গেল। একটা ভয়ঙ্কর, আদিম প্রাণ চিরকালের জন্য স্তব্ধ হল।

.

৩৯.

উপত্যকায় ক্ষয়িত চাঁদের রাত্রি। ছায়া-ছায়া ফিকে জ্যোৎস্না। মোরাঙের এই মাচাগুলো থেকে দূরের বন এবং পাহাড়ের চূড়াকে বড়ই রহস্যময় মনে হয়। টিজু নদীর আঁকাবাঁকা নীল শরীরটাকে কেমন ঝাপসা দেখায়। পুব-পশ্চিম-উত্তর এবং দক্ষিণ পাহাড়ের মাথায় মাথায় বিবর্ণ চাঁদের আলো পাতলা পর্দার মতো জড়িয়ে রয়েছে।

বাঁশের মাচানে শুয়ে শুয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে দৃষ্টিটা ছড়িয়ে দিয়েছিল সেঙাই। কিন্তু কিছুই যেন দেখছিল না সে। শুধু ভাবছিল। তার মনে হচ্ছিল, সামনের বনে আরেলা ফুলের মতো একটি পরম রমণীয় মুখ ফুটে রয়েছে। সে মুখের রূপে এই পাহাড়ী পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠেছে। শুধু এই পাহাড়ই নয়, সেঙাই-এর অস্ফুট বুনো মনটাও আমোদিত হয়ে উঠেছে।

সেঙাই ভাবল, মাঝখানে আর দুটো মাত্র মাস। একটি মাত্র ঋতুর ব্যবধান, সে ঋতু। বর্ষার মরশুম। অশ্রান্ত বৃষ্টির দিনগুলো পেরিয়ে আসবে তেলেঙ্গা সু মাস। সেই মাসের শেষের দিকে তাদের বিয়ে। মেহেলী–এক অপরূপা জোয়ানী, এক পার্বতী মনোরমা। সালুয়ালাঙ গ্রামের মেয়ে সে, তাদের শত্রুপক্ষ। দুটো মাস পরে সে ঋতুর উৎসব শেষ হলে মেহেলী তার কাছে ধরা দেবে। দেহমন সঁপে দেবে, নিবিড় হবে, অন্তরঙ্গ হবে। এই মোরাঙের মাচানে শুয়ে শুয়ে তার যে পৌরুষ সমস্ত রাত্রি অতৃপ্ত এবং উত্তেজিত হয়ে থাকে সেগুলি তৃপ্ত, শান্ত এবং সার্থক করে তুলবে মেহেলী।

খাসেম বনের ঘন ছায়ায় একটি নিভৃত সংসার। খড়ের চাল আর বাঁশের দেওয়ালে ঢাকা সুন্দর ঘর। সামনে দুষ্ট আনিজা বিতাড়নের জন্য গোলাকার বিড়ুই পাথর পোঁতা হবে। ঘরের পাটাতনের নিচে বাঁশের খাটাল বানিয়ে শুয়োর আর বনমোরগ রাখা হবে। সুস্বাদু গৃহস্থালির কল্পনায় মনটা উদ্বেল হয়ে উঠল সেঙাই-এর। ধীরে ধীরে উঠে বসল সে।

বুড়ো খাপেগা আর বুড়ি বেঙসানু দুটো পাকা মাথা এক করে, রোহি মধু ভরা বাঁশের চোঙায় তারিয়ে তারিয়ে চুমুক দিতে দিতে তাদের বিয়ের দিন ঠিক করে দিয়েছিল। তেলেঙ্গা সু মাসে আকাশে যেদিন স্পষ্ট হয়ে ছায়াপথটা ফুটে উঠবে, তারায় তারায় আকাশ ছেয়ে যাবে, রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠবে, সেই সুলু (শুক্ল) পক্ষে তাদের বিয়ে হবে।

উত্তর দিকে গোটা পাঁচেক পাহাড় পেরিয়ে গেলে ইটিয়াগা নামে একটা বড় রকমের গ্রাম রয়েছে। সেখানে আশেপাশের বিশটা গ্রামের বিয়ের পুরুত বুড়ো হিবুটাক থাকে। সকলের কাছে তার খুব খাতির। বুড়ো খাপেগা এবং বুড়ি বেঙসানু বিয়ের মন্ত্র পড়ার দরুন নগদ দশটা বর্শা, চাকভাঙা খাঁটি মধু আর খান দুই এরি কাপড় তাকে আগাম দিয়ে এসেছে।

বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে একটা হাহাকার যেন বেরিয়ে আসতে চায় সেঙাই-এর। দু দুটো মাসের ব্যবধান। ওঃ, কতদিন! শেষ পর্যন্ত অস্থির আর উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। বিয়ের রীতি অনুযায়ী এই দুটো মাস তার সঙ্গে মেহেলীর কথাবার্তা বলা কিছুতেই সম্ভব নয়। যে তারিখে বিয়ের লগ্ন ধার্য হয় তার পর থেকে সেই লগ্ন না আসা পর্যন্ত পাত্রপাত্রী মুখোমুখি হলে, কিংবা একজন অপরকে দেখে ফেললে, সে বিয়ে অসিদ্ধ হয়। সে বিয়েতে পাপের স্পর্শ লাগে। কলঙ্ক লাগে স্বলনের, চরিত্রদোষের। পাহাড়ী প্রথা বড় নির্মম, নিষ্ঠুর।

দু’দুটো মাস। অথচ মাত্র পাঁচটা টিলা পেরিয়ে গেলে বুড়ো খাপেগার কেসুঙ পাওয়া যাবে। সেখানে ভেতরের ঘরে মেহেলী থাকে।

আচমকা সেঙাই-এর মনটা যেন কেমন করে উঠল। কোহিমা থেকে ফিরে আসার পর মনের মধ্যে নতুন এক ধরনের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। গুছিয়ে ভাবতে শিখেছে সে। শুয়ে, বসে কিংবা অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে বেশ লাগে। নিজের অজান্তেই ভাবনার ক্রিয়া চলে।

এতকাল প্রত্যক্ষ জগৎ, স্থল ইন্দ্রিয়গোচর বস্তুগুলো ছাড়া অন্য কোনো কথা ভাবতে পারত না সেঙাই। কিন্তু কোহিমায় গিয়ে তার চিন্তাধারার এবং ভাবনার জগতে তীব্র আলোড়ন লেগেছে। আজকাল দৃষ্টিগ্রাহ্য বস্তু ছাড়া আরো অনেক কিছু সে ভাবে, ভাবতে পারে। অন্তত ভাবতে চেষ্টা করে। ভাবনাগুলো হয়তো শৃঙ্খলাবদ্ধ হয় না। তবু ভাবতে ভালো লাগে।

এখন, এই মুহূর্তে মেহেলীর মনের কথা ভাবতে লাগল সেঙাই। মেহেলী কি তারই মতো ক্ষয়িত চাঁদের আকাশে দৃষ্টি ছড়িয়ে তার কথাই চিন্তা করছে? সেঙাই যেমন অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে রয়েছে, ঠিক তেমনই কি মেহেলীর দেহ-মনে আলোড়ন চলছে?

চোখদুটো বাইরের আকাশ থেকে মোরাঙের মধ্যে নিয়ে এল সেঙাই। মোরাঙের দেওয়ালে বুনো মোষের মাথা, মানুষের করোটি, শুকনো কালো রক্তের নানা চিত্র এবং হরিণের মুণ্ডু গাঁথা রয়েছে। ক্ষয়িত চাঁদের আবছা আলোতে মোরাঙকে ভৌতিক দেখায়। এখন মাঝরাত। আকাশ, চারপাশের পাহাড় এবং বনস্থলী আশ্চর্য নিঝুম।

পাশের মাচানগুলোতে অঘোরে ঘুমোচ্ছে জোয়ান ছেলেরা। ভোস ভোঁস শব্দে নাক ডাকছে। নাক ডাকার আওয়াজটা কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে। জোয়ানদের মুখের উপর দৃষ্টিটাকে পাক খাইয়ে আনল সেঙাই। বুড়ো খাপেগা আজকাল মোরাঙে শুতে আসেনা। মেহেলী তাকে ধরমবাপ ডেকেছে। তার চরিত্র রক্ষার জন্য, বিয়ের আগে পর্যন্ত তার কৌমার্যকে অক্ষত রাখার কারণে, সমস্ত রাত জেগে বুড়ো খাপেগা তাকে পাহারা দেয়।

সেঙাই-এর বাঁ পাশের মাচানে শুয়ে রয়েছে ওঙলে। নাক ডাকার প্রতিযোগিতায় সে-ই সবচেয়ে বেশি শব্দময়।

আচমকা ওঙলের নাকের আওয়াজ থেমে গেল। মাচানের ওপর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল সে। ঢুলুঢুলু চোখে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে ঘুমজড়ানো গলায় ডাকল, সেঙাই, এই সেঙাই–কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে। তারপর বলল, রাত জেগে বসে বসে কী করছিস?

ভাবছি। নির্বিকার ভঙ্গিতে সেঙাই বলল।

পাহাড়ী জোয়ান হয়ে রাত্তির জেগে ভাবছিস! এ তো বড় তাজ্জবের কথা। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল ওঙলে।

সেঙাই গলা চড়িয়ে বলল, মেহেলীর কথা ভাবছি।

তা-ই বল। এ তো ভাববারই কথা। দুমাস পর তোর বিয়ে হবে। বউ পাবি। তোর কী মজা। আমাদের তো বিয়ে হবে না। এই মোরাঙের মাচানে শুয়ে শুয়েই সারা জনম কাবার করতে হবে। বুকের হাড়গুলোকে মটমট করে গুঁড়িয়ে বড় রকমের একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওঙলের।

তোরও বিয়ে হবে। সদ্দার তোর বিয়েও ঠিক করে দেবে। সেঙাই সান্ত্বনা দিল।

না রে, না। হুই সদ্দার হল আস্ত একটা সাসুমেচু। ও কিছুতেই আমার বিয়ে দেবে না। আমার বিয়ে দিতে হলে ঘর থেকে যে নগদ বউপণ খসাতে হবে। জান থাকতে একটা বর্শা খরচ করবে হুই সদ্দার! হুঃ! নিরাশাব্যঞ্জক একটা শব্দ করে থেমে গেল ওঙলে। আবছা আলোতে তার চোখজোড়া জ্বলতে লাগল। সেঙাই-এর কাঁধে ঝকানি দিয়ে ওঙলে আবার বলল, দেখছিস না, মেহেলীর জন্যে তোদর কাছ থেকে কতগুলো খারে বর্শা বাগাল সদ্দার। মেহেলী তো ওর মেয়েই নয়। শরদের মেয়ে। তবু রেহাই দিলে না তোদের। হুঃ, ও দেবে আমার বিয়ে!

একটুক্ষণ চুপচাপ। একসময় শান্ত গলায় ওঙলে বলতে শুরু করল, আমার বিয়ের কথা চুলোয় যাক। যা বলছিলাম, মেহেলীর কথা কী ভাবছিলি রে সেঙাই?

দুমাস পরে বিয়ে হবে। এই দুটো মাস মাগীটার সঙ্গে দেখাও করতে পারব না। মনটা কেমন যেন করছে। চোখের সামনে ছুঁড়িটার মুখ খালি ভেসে উঠছে। একদম ঘুম আসছে না। কাতর মুখভঙ্গি করল সেঙাই।

মোটে তো দুটো মাস। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তারপরেই তেলেঙ্গা সু মাসে তুই ঘর বানিয়ে বউ নিয়ে মোরাঙ থেকে ভাগবি। এর জন্য অত ভাবিস না। কোহিমা থেকে ফিরে তোর ভাবাভাবিটা বড্ড বেড়েছে রে সেঙাই। তাগড়া জোয়ান, রাক্ষসের মতো গিলবি। ভোস ভোস করে ঘুমুবি। ভেবে তো লাভ নেই। ওঙলে বলতে লাগল, ভাবাভাবি থামিয়ে এবার। ঘুমো দিকি। মাঝরাত পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। বাঁশের মাচানে ফের টান টান শুয়ে পড়ল। ওঙলে। সঙ্গে সঙ্গে তার নাক ডাকা শুরু হল। ঘুমটাকে প্রচুর সাধনায় আয়ত্ত করেছে ওঙলে।

কিন্তু ঘুম আসছে না সেঙাই-এর। মাচানের ওপর বসেই আছে সে। ব্যগ্র গলায় ডাকল, এই ওঙলে–এই, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? এই তো কথা বলছিলি!

ওঙলে নিরুত্তর। নাকের গর্জন তার প্রমত্ত হয়ে উঠেছে। মাচান থেকে নেমে ওঙলের পাঁজরায় একটা ধারাল নখ বসিয়ে দিল সেঙাই, এই ওঙলে, এই–

আহে ভু টেলো! লাফিয়ে উঠল ওঙলে, টেফঙের বাচ্চাটা তো ঘুমুতে দেবে না দেখছি। বিরক্তিতে ভ্রুকুটি ফুটে বেরুল ওঙলের।

মোলায়েম গলায় সেঙাই বলল, থাম, থাম শয়তানের বাচ্চা। বেশি চেঁচামেচি করলে বর্শা হাঁকড়ে সাবাড় করে ফেলব। এই জম্মে আর ঘুমুতে হবে না। যা বলছি তার জবাব দে দিকি।

ভারি রগচটা মানুষ ওঙলে। ক্রুদ্ধ, রক্তাভ চোখে তাকাল সে।

দাঁতে দাঁত ঘষে সেঙাই বলল, তুই তো রোজ সদ্দারের বাড়ি যাস। মেহেলী কী বলে রে? তার কাছে যাওয়া আমার বারণ। সেই ফাঁকে মাগীটার সঙ্গে পিরিত টিরিত জমাসনি তো?

মাচানের পাশ থেকে সাঁ করে একটা বর্শা টেনে উঠে বসল ওঙলে। হুমকে উঠল, একেবারে লোপাট করে ফেলব। পরের মাগীর সঙ্গে আমি পিরিত টিরিত জমাই না।

তা তো জানি। তুই আমার আসাহোয়া (বন্ধু। তুই কি তা করতে পারিস? চেঁচামেচি করছিস কেন? বর্শাটা নামিয়ে রাখ। আপসে কথা বল।

মাথার ওপর উদ্যত বর্শার ফলা। অথচ গলাটা একটুও কাঁপছেনা সেঙাই-এর, ভয় পায়নি সে। বলতে লাগল, দুমাস ঘুড়িটার সঙ্গে দেখা হবে না। কী করি বল তো?

কী আবার করবি, মোরাঙে পড়ে পড়ে ঘুমুবি। আর যদি তা না পারিস লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করবি। নে, এবার ঘুমুতে দে। আবার যদি খুঁচিয়ে জাগাস তা হলে জানে বাঁচতে হবে না। ভয়ানক গলায় সেঙাইকে শাসিয়ে মাচানের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল ওঙলে। শুয়ে শুয়ে গজগজ করতে লাগল, কেসুঙে গেলে হুই মেহেলী যুঁড়িটা সেঙাই-এর কথা বলবে। আর মোরাঙে এলে এই শয়তানটা হুই মাগীটার কথা বলবে। টেফঙের বাচ্চা দুটো মেজাজটাকে খিঁচড়ে দিচ্ছে। ঘুড়িটাকে ব্যারামে ধরে ঘ্যানঘ্যানানি আরো বেড়েছে।

তরিবত করে শোওয়ার ফিকিরে ছিল সেঙাই। ওঙলের শেষ কথাগুলো শুনে ঘুরে বসল, কী ব্যারাম? কার ব্যারাম রে ওঙলে?

বিড়বিড় করে জড়িত গলায় ওঙলে বলল, কার আবার ব্যারাম, হুই সালয়ালাঙের মাগীটার। তোর বউ হবে যে, তারা চোখ লাল, গায়ে আগুন ছুটছে। সকালে তামুন্যু এসেছিল। খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শুয়ে শুয়ে মাগীটা কী যেন বকে দিনরাত। বলতে বলতে থেমে গেল ওঙলে। নির্ঘাত ঘুমিয়ে পড়েছে সে।

চুপচাপ বসে রইল সেঙাই। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা হিমধারা ছুটল যেন তার। ব্যারাম হয়েছে মেহেলীর। চোখ লাল। শরীরে ভয়ানক তাপ। প্রলাপ বকছে। তবে কি খোনকের মতো তার বোন মেহেলীকেও আনিজাতে পেল? কেলুরি গ্রামের তামুন্যুও কি তাকে খাদে ফেলে দেবার বিধান দেবে? ভাবতে ভাবতে অস্ফুট বুনো মনটা কেমন যেন অসাড় হয়ে গেল সেঙাই-এর।

খানিকটা সময় কাটল। আচমকা সেঙাই-এর মনে পড়ল রানী গাইডিলিওর কথা। চওড়া কপাল। দুটো টানা চোখে মধুর মমতা। তার ছোঁয়ায় রক্ত-মাংসের দেহ থেকে রোগ ব্যারাম। আধিব্যাধি নিমেষে উধাও হয়। রানী গাইডিলিওকে আজ বড় দরকার সেঙাই-এর। তার মন একটা স্থির এবং স্পষ্ট সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে। কোহিমা পাহাড়ে যেদিন সাহেবদের নির্দেশে মণিপুরী, বাঙালি আর অসমীয়া পুলিশেরা বেয়নেট আর ব্যাটনের বাড়িতে তার দেহটা ফাটিয়ে কোহিমার হিমাক্ত পথে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সেদিন রানী গাইডিলিও তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।

মেহেলীর ব্যারামের কথা শোনার আগে পর্যন্ত সেঙাই-এর মনটা কামনায় বাসনায় রঙদার হয়ে ছিল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে, নিজের সংসারের কথা ভেবে, আবেগে খুশিতে সমস্ত চেতনা ঝুঁদ হয়ে ছিল। বনস্থলীর ছায়ায় তারা ঘর বাঁধবে। দু’টি সুখী জোয়ান-জোয়ানী আশায় আনন্দে সে-ঘর ভরে রাখবে। কিন্তু কোথায় লুকিয়ে ছিল এই ভয়ঙ্কর দুর্বিপাক? খোকের রোগের পরিণাম দেখেছে সেঙাই। সে ছবি তার মনে শিলালিপির মতো অক্ষয় হয়ে রয়েছে। মেহেলীও কি তবে খোনকের মতো খাদের নিচে পড়ে মরবে? নাঃ, মনটা কঠিন হয়ে গেল সেঙাই-এর। নিমেষে সমস্ত চেতনা একাগ্র হয়ে উঠল। স্নায়ুতে-শিরায়-মেদে-মজ্জায় আর রক্তে রক্তে একটা প্রতিজ্ঞা ঝনঝন করে বাজতে শুরু করল। মেহেলীকে কিছুতেই মরতে দেবে না সে। মেহেলীর মৃত্যুর মধ্যে নিজের যৌবনের স্বপ্নকে শেষ হতে দেবে না। দেহমনের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেহেলীর মৃত্যুকে সে আটকাবে।

আপাতত রানী গাইডিলিওকে দরকার থাকলেও পাওয়া যাবে না। কিন্তু পাঁচটা টিলা পেরিয়ে এখনই বুড়ো খাপেগার ভেতরের ঘরে মেহেলীর কাছে তাকে যেতে হবে।

চারপাশের মাচানগুলোর ওপর চোখদুটো একবার ঘুরিয়ে আনল সেই। জোয়ান ছেলেরা নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। কানের কাছে বাজ পড়লেও এ ঘুম ভাঙবে না।

বাঁশের দেওয়াল থেকে একটা বর্শা টেনে নিল সেঙাই। তারপর বনবিড়ালের মতো সন্তর্পণে পা টিপে টিপে বাইরের উপত্যকায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

তিনটে টিলা পেরিয়ে এসে একটা উদ্দাম বুনো কলার বন আর পাহাড়ী আপেলের ঝাড় শুরু। এই উপত্যকার জলবাতাস-রোদ থেকে কণায় কণায় প্রাণ সঞ্চয় করে তারা উচ্ছ্বসিত হয়ে রয়েছে। এই ক্ষয়িত চাঁদের রাত্রিতেও পরিষ্কার নজরে আসে, অজস্র ফল পেকে আছে। বুনো কলা এবং আপেলের বন থেকে একরাশ ফল ছিঁড়ে নিল সেঙাই। তারপর আরো দুটো বড় টিলা পেরিয়ে বুড়ো খাপেগার কেসুঙের পাশে এসে দাঁড়াল।

সমস্ত উপত্যকাটা নিঝুম। চাঁদের আবছা আলোয় বন এবং পাহাড়ের মাথা এখন মাখামাখি। পেছনের উতরাই থেকে জলপ্রপাতের গর্জন আসছে। কোথায় একটা ডোরাকাটা হুমকে উঠল। পাশের খাসেম বনে ময়ালের ফোঁসফোসানি শোনা যাচ্ছে। সুখাই ঘাসের ওপর সরসর শব্দ করে কী একটা সরীসৃপ খাদের দিকে নেমে গেল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সেঙাই। তারপর সামনের পাথুরে চত্বরটা পেছনে ফেলে মেহেলীর ঘরখানার সামনে চলে এল। তক্ষুনি চমকে উঠল সে। ফিকে, অস্পষ্ট আলল। তবু ঠিক ঠিক দেখা গেল। বুড়ো খাপেগার কেসুঙের পাশে দুটো পাহাড়ী জোয়ান সতর্কভাবে পা।

ফেলে ফেলে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে।

চট করে বাঁশের দেওয়ালের পাশে সরে গেল সেঙাই। প্রখর থাবায় বর্শার বাজুটা চেপে ধরল। উত্তেজনায় ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। বুকটা তোলপাড় হচ্ছে। চোখের মণিতে শিকারের ছায়া পড়েছে। সে শিকার দুটো পাহাড়ী জোয়ান।

ওপাশ থেকে ফিসফিস গলা ভেসে আসছে।

হু-হু–খাঁটি কথা। আমদের বস্তির মেয়ে অন্য বস্তিতে লুকিয়ে থাকবে, এ কেমন ব্যাপার। এতগুলো জোয়ান ছোকরা রয়েছি আমরা, গায়ে রক্ত আছে, তবু বসে বসে দেখছি। ইজ্জত লোপাট হয়ে গেল সালুয়ালাঙ বক্তির। মান আর রইল না। গলার স্বর একটু থামল। তার পরেই আবার পর্দায় পর্দায় চড়তে লাগল, আশেপাশের সবাই জানতে পেরেছে। অঙ্গামীরা জেনেছে, সাঙটামরা জেনেছে। মেহেলী যে কেলুরি বস্তিতে পালিয়ে এসেছে, এ খবর জানতে কারো আর বাকি নেই।

কী করে বুঝলি ওরা জেনেছে? অপর জোয়ানটা কৌতূহলী হয়ে উঠল।

সেদিন বর্শা বদল করে অঙ্গামীদের বস্তি থেকে মাটির হাঁড়ি, কোদাল আর নীয়েঙ দুল আনতে গিয়েছিলাম। ওরা বদলে দিল । তারপর গেলাম সাঙটামদের বক্তি ইটিয়াগাতে। তারাও দিলে না।

কেন দিলে না? একেবারে বর্শা হাঁকড়ে সাবাড় করে ফেলব না রামখোর বাচ্চাদের। দ্বিতীয় জোয়ানটা ভয়ানক গলায় চেঁচিয়ে উঠল।

চুপ চুপ। খবদ্দার চিল্লাবি না। গলা টিপে ধরব। এটা সালুয়ালাঙ বস্তি। চাপা গলায় ইমটিটামজাক ধমক দিল।

চিল্লাব না কেন? সাঙটামরা অঙ্গামীরা আমাদের হাঁড়ি দেবে না, কোদাল দেবে না,নীয়ে দুল দেবে না। আমাদের কী করে চলবে তা হলে?

কী বলেছে অঙ্গামীরা? কেন জিনিস দিতে চায় না সাঙটামরা?

ওরা বললে, তোদের বস্তির মাগী পালিয়ে অন্য বস্তিতে গিয়ে থাকে। তোদের আবার ইজ্জত আছে নাকি। তোদের সঙ্গে আমরা কোনো কারবার করব না। সিধে কথা। সেই জন্যেই তো আমাদের সদ্দার মেহেলীকে কেলুরি বস্তি থেকে ছিনিয়ে নেবার জন্যে বলেছে। আজ সাঙটামরা আর অঙ্গামীরা জিনিস বদল করছে না। কাল যদি কোনিয়াকরা এ খবর জানতে পেরে ধান না দেয়, তা হলে না খেয়ে সবাইকে লোপাট হতে হবে। হু-হু, বস্তির মেয়েকে যদি বস্তির মধ্যেই আটকে না রাখতে পারি তাহলে কেমন পাহাড়ী মানুষ আমরা!

ক্ষয়িত চাঁদের রাত আরো নিবিড় হয়েছে। উত্তেজনায় সেঙাইর শিরায় শিরায় ঝা ঝা করে রক্ত ছুটছে। বুকটা তোলপাড় হচ্ছে। বিরাট থাবা দিয়ে বর্শার বাজুটা আরো প্রবলভাবে চেপে ধরেছে সে।

একটু চুপচাপ। জলপ্রপাতের আওয়াজ ছাড়া সমস্ত পাহাড় এবং বনভূমি একেবারেই নিস্তব্ধ।

তারপরই ওপাশ থেকে একটি জোয়ানের গলা ভেসে এল, নে, আর দেরি করিস না। আজ কদিন ধরে মেহেলীর তল্লাশে আসছি কেলুরি বস্তিতে। মাগীটাকে যে নিয়ে যাব, তেমন জুত করে উঠতে পারছি না। আজ যেমন করে পারি, নিয়ে যাবই। আয়, এই বস্তির খাপেগা সদ্দারটা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। খবর পেয়েছি হুই বুড়ো শয়তান সারা রাত ধরে মেহেলী হুঁড়িটাকে পাহারা দেয়। আজ মনে হয়, জেগে থাকতে পারেনি। শুনেছি, ওর বর্শার তাক নাকি মারাত্মক। কাছে ঘেঁষতে ভয় হয়। আয় আয়, আর দেরি করিস না। ভেতরের ঘরেই শুয়ে রয়েছে। মেহেলী–

ঘোঁত ঘোত করে খাপেগা সদ্দারের ভেতরের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল জোয়ান দুটো।

রাগ, হিংস্রতা, উত্তেজনা–আদিম মনের সমস্ত বৃত্তিগুলিকে এতক্ষণ অতি কষ্টে লাগাম পরিয়ে রেখেছিল সেঙাই। এবার বাঁশের দেওয়ালের পাশ থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল সে। তারপরেই তার হাতের মুঠি থেকে বর্শাটা ছুটে গেল নির্ভুল লক্ষ্যে। ফলাটা একটা পাহাড়ী জোয়ানের কোমরে গেঁথে গেল।

সেঙাই-এর চোয়াল কঠিন হল। দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ শোনা গেল। হিংস্র গলায় সে গর্জে উঠল, ইজা হুবতা, মেহেলীকে নিতে এসেছে! একেবারে খতম করে ফেলব।

আ-উ-উ-উ-উ–ক্ষয়িত চাঁদের রাতটাকে ভীষণভাবে চমকে দিয়ে আর্তনাদ করে উঠল সালয়ালাঙের জোয়ানটা। তার পরেই রুক্ষ ধারাল পাথুরে টিলাটার ওপর লুটিয়ে পড়ল। । আর অন্য জোয়ানটা নিজের প্রাণ বাঁচাবার আদিম এবং একমাত্র তাড়নায় সামনের উতরাইটার দিকে ছুটে গেল। সেখান থেকে বিরাট খাসেম কনটার মধ্যে নিমেষে মিলিয়ে গেল। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে টিলাবন চড়াই-উতরাই পার হয়ে যাচ্ছে সে। সালুয়ালা গ্রামের নিরাপদ সীমানায় না পৌঁছুনো পর্যন্ত এ-দৌড় বোধ হয় থামবে না।

আ-উ-উ–এদিকে আহত জোয়ান ছেলেটার চিৎকার থেমে গিয়েছে। এখন গোঙাচ্ছে সে। পী মঙ কাপড়ের ভাজ থেকে বুনো কলা আর নীলচে আপেলগুলো পড়ে গিয়েছিল। পাথুরে মাটির ওপর সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ফলগুলো কুড়িয়ে কোঁচড়ে ভরে জোয়ান ছেলেটার কাছে এসে দাঁড়াল সেঙাই। তাজা রক্তে পাথুরে মাটি লাল হয়ে গিয়েছে।

নিজের কীর্তি দেখে খুশিতে আনন্দে হিংস্রতায় চোখজোড়া জ্বলে উঠতে লাগল সেঙাই এর। একদলা থুতু জোয়ান ছেলেটার গায়ে ছুঁড়ে দিল সে। তারপর নিজের চোখেমুখে ঘৃণার ভঙ্গি ফুটিয়ে ধিক্কার দিয়ে বলল, থু–থু–আহে ভু টেলো! এই মুরাদ নিয়ে আমার বউকে ছিনিয়ে নিতে এসেছিস? থু থু, চোরের মতো চুরি করে নিতে চাস! লড়াই করে ছিনিয়ে নেবার সাহস নেই?

জোয়ানটার দিকে আরেক দলা থুতু ছিটিয়ে, পায়ের নখ দিয়ে পাঁজরায় খোঁচা মেরে বুড়ো খাপেগার বাড়িটার দিকে চলে গেল সেঙাই।

ভেতরের ঘরটা পাথুরে মাটির চত্বর থেকে অনেক উঁচুতে। নিচে আস্ত বাঁশের পাটাতন। পাটাতনের তলায় এসে দাঁড়াল সেঙাই। বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে উঠল। বুড়ো খাপেগা কি জেগে আছে এখনও? রাত জেগে পাহাড়ী দুনিয়ার লালসা থেকে মেহেলীর কৌমার্যকে পাহারা দিচ্ছে? সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটা ভাবনা মনের মধ্যে ছটফট করতে লাগল। তাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। বিয়ের আগের দিনগুলিতে ভাবী বর বউর মেলামেশা সমাজ এবং ধর্মের চোখে মারাত্মক অপরাধের। এতে টেটসে আনিজার গোসা হয়। আশঙ্কায় শিরায় শিরায় কী একটা যেন ছোটাছুটি করতে লাগল। তারপরেই কর্তব্য ঠিক করে ফেলল সেঙাই। মাথার ওপর বাঁশের পাটান। সেখানে মাচানে শুয়ে রয়েছে মেহেলী। বাতাসে তার নিশ্বাস, তার দেহের গন্ধ মিশে আছে।

কী এক দুর্বোধ্য তাড়নায় দেহমন বিকল হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে একবার সতর্ক চোখে তাকাল সেঙাই। পাটাতনের নিচে শুয়োরের খোঁয়াড়। শীতের আমেজ-লাগা রাত্তিরে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়োরগুলো ঘুমুচ্ছে। গাদাগাদি করে ঘন হয়ে শুয়েছে গোটাকয়েক পোষা কুকুর। একটু উত্তাপের আশায় গায়ে গা লাগিয়ে দলা পাকিয়ে রয়েছে জানোয়ারগুলো।

টেটসে আনিজা! তার ক্রোধ! তার কোপ! সমস্ত শরীর থরথর কেঁপে উঠল সেঙাই-এর। তেলেঙ্গা সু মাসে মেহেলীকে নিয়ে সে ঘর বাঁধবে, গৃহস্থালি পাতবে। সমাজ তাদের সংসার ও বিবাহিত জীবনকে মেনে নেবে। যদি সেই ঘর-গৃহস্থালির ওপর টেটসে আনিজার কোপ এসে পড়ে! তার বিবাহিত জীবন যদি ছারখার হয়ে যায়! তার আর মেহেলীর পাহাড়ী কামনার মধ্যে যে স্বপ্নটা ফুটি ফুটি করছে তা যদি সাবাড় হয়!

এতদূর এসেও কী করবে, কী না করবে, স্থির এবং স্পষ্টভাবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না সেঙাই। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সে।

হঠাৎ বাঁশের পাটাতনের ওপাশে গোঙানি শোনা গেল, আ-উ-উ-উ—

চমকে উঠল সেঙাই। এ গোঙানি নির্ঘাত মেহেলীর। আচমকা, একান্তই আচমকা, নিজের অজান্তে সেঙাই ডেকে ফেলল, মেহেলী, এই মেহেলী–

কে? পাটাতনের ওপাশে মেহেলী চেঁচিয়ে উঠল, কে রে?

আমি সেঙাই। কতদিন তোকে দেখি না। মেজাজটা একেবারে বিগড়ে রয়েছে। একবার বাইরে আয় না। টিলায় বসে গল্প করব। ব্যাকুল সুরে সেঙাই বলল।

না না। তোর আর আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তোর সঙ্গে এখন আমার দেখা হওয়া ঠিক না। টেটসে আনিজা খেপে যাবে। মাঝখানে তো মাত্র দুটো মাস। এই কটা দিন শিকার করে, ন পুড়িয়ে আর ঘুমিয়ে কাটা। তেলেঙ্গা সু মাসে বিয়ে তো হবেই। এখন যা। খাপেগা সদ্দার পাশের ঘরে শুয়ে আছে। তার ঘুম ভারি ঠুনকো।

টেমে নটুঙ। বেরিয়ে আয় মাগী। এত রাত্তিরে আরামের ঘুম ছেড়ে ইয়াখোনা (ধর্মকথা) শুনতে এলাম বুঝি! সেঙাই হুমকে উঠল। বলল, কদ্দিন তোকে দেখি না। বলছি, মেজাজটা বেয়াড়া হয়ে রয়েছে। চেহারাখানা ঠিক রেখেছিস তো? মনটা আবার খিঁচড়ে যাবে না তো

তোর দিকে তাকালে?

ইজা হুতা। মেহেলীর ক্ষীণ গলাটা এবার গর্জে উঠল, খুব যে চিল্লাচ্ছিস, আমার কি তোকে দেখতে ইচ্ছা করে না? খুব করে। আবার ভাবি, টেটসে আনিজা যদি আমাদের ওপর খারাপ নজর দেয়?

আহে ভু টেলো! আমি হুই টেটসে আনিজাকে মানি না। নিজের বউর সঙ্গে গল্প করব, হুই টেটসে আনিজা বাগড়া দেবে কেন? কথাগুলোর মধ্যে সেঙাইর মনের তীব্র অসন্তোষ ফুটে বেরুল।

কোহিমা থেকে ফিরে তোর কী হল–আনিজাকে মানছিস না! এমন কথা বলতে নেই রে সেঙাই। দুমাস পরে আমাদের বিয়ে হবে, ঘর বাঁধব, ছেলে হবে। টেটসে আনিজা আমাদের ওপর খেপে গেলে সব লোপাট হয়ে যাবে। দুটো মাস সবুর কর। ক্ষীণ অথচ মধুর গলায় আগামী দিনের একটি পরম সুন্দর স্বপ্নের কথা বলে যেতে লাগল মেহেলী, তখন আমাকে। তুই কত দেখবি, কত আদর করবি। আমি তোকে কত আদর করব। যা এবার, যা। খাপেগা সদ্দার টের পেলে কিন্তু আস্ত রাখবে না। খুন করে ফেলবে। একটু থেমে আবার বলল মেহেলী, আমার ব্যারাম হয়েছে। তামুন্যু (চিকিৎসক) কিছু খেতে দেয় না। শরীরটা বড় কাহিল লাগছে। একদম জোর পাচ্ছি না।

হু-হু, তোর ব্যারামের কথা ওঙলে বলেছে। এই নে, তোর জন্যে বন থেকে ফল এনেছি। আপেল আর বুনো কলা। খেয়ে গায়ে তাগদ কর।

কই? দে দে–পাটাতনের ফাঁক দিয়ে একটা নরম হাত বেরিয়ে এল। খুশি খুশি, ব্যগ্র গলায় মেহেলী বলল, বড় খিদে পেয়েছে রে সেঙাই, পেটটা জ্বলে যাচ্ছে।

নীলচে রঙের পাহাড়ী আপেল এবং একরাশ বুনো কলা মেহেলীর হাতে দিতে দিতে সেঙাই বলল, তোর ব্যারাম হয়েছে। রানী গাইডিলিওকে এনে একবার যদি তোকে ছুঁইয়ে দিতে পারতাম, সেরে যেত।

রানী গাইডিলিও। সে আবার কে?

হু-হু– জানবি, পরে সব জানবি। আমাদের বস্তিতে সে আসবে বলেছে। সায়েবদের সঙ্গে তার লড়াই বেধেছে। হু-হুরহস্যময় গলায় সেঙাই বলল। একটু পর বলার ভঙ্গিটা সহজ করে ফেলল, যাক সেকথা। আমি রোজ রত্তিরে তোকে খাবার দিয়ে যাব।

খুশি গলায় মেহেলী সায় দিল, দিয়ে যাস।

খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর সেঙাই বলতে শুরু করল, জানিস মেহেলী, তোদের সালুয়ালাঙ বস্তি থেকে তোকে চুরি করে নিয়ে যাবার জন্যে দুটো শয়তানের বাচ্চা এসেছিল। এই ঘরটার কাছেই ঘুরঘুর করছিল।

বলিস কী! মেহেলীর গলাটা চমকে উঠল। বেশ বোঝা যায়, ধড়মড় করে পাটাতনের ওপর উঠে বসেছে সে। উত্তেজনায় শঙ্কায় গলার স্বর কাঁপতে লাগল মেহেলীর, তারপর কী হল?

কী আবার হবে, বর্শা দিয়ে একটাকে ফুড়লাম। আর একটা জান নিয়ে জঙ্গলের দিকে পালাল। হু-হু। বলতে বলতে আক্ষেপের সুর ফুটল সেঙাই-এর, বড় আপশোশ হচ্ছে রে মেহেলী, ওটাকেও বর্শা হাড়ড়ে রাখতে পারলাম না।

এবার অনেকটা স্বস্তি পেল মেহেলী। বড় রকমের একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আপশোশের কী আছে। একটাকে তো যুঁড়তে পেরেছিস। আমারও মনে হচ্ছিল, শয়তানের বাচ্চারা সালুয়ালাঙ বস্তি থেকে আমার খোঁজে আসবে। অল্পক্ষণের জন্য থামল মেহেলী। তারপর বলতে শুরু করল, মেজাজটা বিগড়ে ছিল রে সেঙাই। আমি হলাম সালুয়ালাঙ বস্তির সেরা মেয়ে, আর তুই হলি কেলুরি বস্তির সেরা ছেলে। তোর আমার বিয়েতে একটু রক্ত ঝরবে না? আমার সোয়ামী দু-একটা শত্তুরকে বর্শা দিয়ে ফুঁড়বে না–এ কেমন কথা! তুই শয়তানদের কুঁড়েছিস। শুনে মেজাজটা খাসা হয়ে গেছে।

হাঃ-হাঃ-হাঃ–ক্ষয়িত চাঁদের রাতটাকে ভয়ঙ্করভাবে চমকে দিয়ে শব্দ করে হেসে উঠল সেঙাই। বলল, হু-হু–বড় মজার কথা বলেছিস মেহেলী। তুই হলি এই পাহাড়ের সবচেয়ে সেরা মেয়ে। তোর জন্যে একটা নয়, আরো অনেক মানুষের কলিজা খুঁড়তে হবে। বুঝলি মেহেলী–

ওপাশের ঘরে বুড়ো খাপেগা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কে? কোন রামখোর বাচ্চা এসেছে? আমার ধরম-মেয়ের ইজ্জত নিচ্ছে কে? এই মেহেলী, এই টেফঙের ছা, সুচেন্যু দিয়ে কুপিয়ে একেবারে সাবাড় করব। দাঁড়া, মশালটা ধরিয়ে আমি যাচ্ছি।

পাটাতনের নিচে হাসি থেমে গেল। বুকের মধ্যে নিশ্বাস আটকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সেঙাই। মেহেলীর বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা যেন হঠাৎ জমাট বেঁধে গেল। নিঝুম হয়ে সে-ও পাটাতনের ওপর পড়ে রইল। এই মুহূর্তে একটি পাহাড়ী জোয়ান এবং একটি জোয়ানীর শিরা স্নায়ু-ইন্দ্রিয় অথর্ব হয়ে গিয়েছে। দেহমনে কোনো সাড় নেই যেন।

পাশের ঘরে বুড়ো খাপেগা ভাঙা ফ্যাসফেসে এবং ঘুম-ঘুম গলায় সমানে চেঁচাচ্ছে, এই মেহেলী, কথা বলছিস না যে! কে এসেছে তোর ঘরে? কোন শয়তানের বাচ্চা? বল না মাগী

একেরারে নিথর পড়ে ছিল মেহেলী। মুখখানা পাটাতনের বাঁশে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে সে বলল, এই সেঙাই, ভেগে যা। ধরমবাপ তোকে দেখলে খুন করবে। তোর সঙ্গে কথা বলছি দেখলে বিয়ে ভেঙে দেবে। যা এখন, কাল আবার আসিস।

ইজা হুবতা! পাটাতনের তলায় চাপা গলায় হুমকে উঠল সেঙাই, নিজের বউর সঙ্গে কথা বলব, তা-ও শয়তানের বাচ্চারা বাগড়া দেবে! আমি যাব না এখান থেকে।

ওরে ধাড়ি টেফঙ, যা বলছি। কাল আবার আসবি। মেহেলী অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠল।

কাল আমার সঙ্গে পশ্চিমের চড়াইতে বেড়াতে যাবি তো?

তুই যখন বলছিস, নির্ঘাত যাব। এখন পালা, সদ্দার তোকে দেখলে সাবাড় করে ফেলবে। পালা, পালা–করুণ গলায় মিনতি করতে লাগল মেহেলী।

যাচ্ছি। কাল কিন্তু আমার সঙ্গে পশ্চিমের পাহাড়ে বেড়াতে যেতে হবে।

কাল ক্ষয়িত চাঁদের আলোয় উপত্যকা-মালভূমি-উতরাই পেরিয়ে মেহেলীকে নিয়ে সেঙাই যাবে পশ্চিমের চড়াইতে। বুনো ঝরনার পাশে ঘুরতে ঘুরতে বিয়ের কথা, ভবিষ্যৎ জীবনের কথা, ঘরসংসার, বিয়ের সময়কার উৎসব এবং ভোজের কথা বলবে। অস্ফুট পাহাড়ী মন রতিকলায় এবং উদরপূর্তিতে চরম আনন্দ পায়, পরিতৃপ্ত হয়। দৈহিক এবং মানসিক স্থূল ভোগের জন্য মদ-মাংস-খাদ্য, যে যে উপকরণ দরকার, সেগুলোর কথা বলবে সেঙাই। ভাবতে ভাবতে একান্ত অনিচ্ছুক পায়ে সামনের চড়াইটার দিকে উঠে গেল সে।

পাশের ঘরে একটা পেন্য কাঠের মশাল দপ করে জ্বলে উঠল।বুড়ো খাপেগা হুঙ্কার ছাড়ল, কি রে মেহেলী, এখনও কথা বলছিস না যে? কে এসেছে তোর ঘরে?

নির্জীব গলায় মেহেলী বলল, কই, কেউ আসেনি তো। তুই দেখে যা না ধরমবাপ।

তবে মানুষের গলা শুনলাম যে! বিড়বিড় করে বকতে শুরু করল বুড়ো খাপেগা, ভুল শুনলাম না কি? নাঃ, এমন মৌজের ঘুমটা ভেঙে গেল। গজর গজর করতে করতে বিরক্ত গলায় ধমকে উঠল, নে, এবার ঘুমো মেহেলী। শয়তানের বাচ্চারা যদি জ্বালায়, আমাকে ডাকিস।

আচ্ছা।

পেন্যু কাঠের মশালটা নিভে গেল। বাঁশের মাচান মচমচ শব্দ করে উঠল। মেহেলী বুঝল, বুড়ো খাপেগা ফিরে গিয়ে আবার শুয়ে পড়েছে।

আর উঁচু চড়াইয়ের মাথায় পৌঁছে চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল সেঙাই-এর। একটু আগে সালুয়ালা গ্রামের যে জোয়ানটাকে সে বর্শা দিয়ে কুঁড়ে গিয়েছিল, এই ক্ষয়িত চাঁদের আলোতে তার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। শুধু খানিকটা তাজা রক্ত পাথুরে মাটির ওপর সেঙাই এর আদিম হিংস্রতার সাক্ষী হয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *