1 of 2

৩৩. যুদ্ধ ও বৈবাহিক সম্পর্ক

অধ্যায় ৩৩ – যুদ্ধ ও বৈবাহিক সম্পর্ক

খ্রিস্টপূর্ব ১৩৪০ থেকে ১৩২১ সালের মাঝে অ্যাসিরীয় ও হিট্টিটরা মিটানিদের ধ্বংস করল। তুতানখামুন মিশরের ধর্মীয় সংস্কারকে বিদেয় করলেন এবং একজন হিট্টিট রাজপুত্র ‘প্রায়’ ফারাওতে পরিণত হলেন।

মিটান্নিদের ভূমিতে রাজা টুশরাট্টা ক্রমশ হিট্টিটদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন। তাদের প্রাণশক্তিতে ভরপুর নতুন রাজা সুপ্পিলুলিউমা টাউরাস পর্বতমালার ওপর পাশে নিজের সেনাবাহিনী গড়ে তুলছিলেন। টুশরাট্টার জন্য হিট্টিটদের তার ভূমি থেকে দূরে রাখা খুবই জরুরি ছিল।

মিত্র হিসেবে সবচেয়ে যৌক্তিক বিকল্প ছিল মিশরীয়রা। তখনও আখেনাতেন সে-অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের রাজা ছিলেন। তিনি একই সঙ্গে টুশরাট্টার ভাগ্নেও ছিলেন এবং একই সঙ্গে আরও জটিল কিছু আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল তাদের মাঝে। দুই প্রজন্ম ধরে মিটান্নি নারীরা মিশরের রাজপরিবারের সদস্যদের বিয়ে করে আসছিলেন।

টুশরাট্টা আরও একটি বিয়ের প্রস্তাব দেন। তিনি ফারাওর সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলেন এবং আখেনাতেন সে প্রস্তাবে রাজিও হলেন। ফলে টুশরাট্টার মেয়ে দক্ষিণের দিকে যাত্রা করলেন।

তবে মিটান্নি রাজা ধীরে ধীরে তার ভাগ্নের ওপর বিরক্ত হতে লাগলেন। দুই রাজার পত্র-বিনিময়ে দেখা যায় টুশরাট্টা অভিযোগ করেছেন, বিয়ের খরচ হিসেবে পাঠানো স্বর্ণ যথেষ্ট নয়। এক চিঠিতে তিনি বলেন, ‘একে দেখে সোনা বলে মনে হচ্ছে না।’ আরেক চিঠিতে তিনি মন্তব্য করেন, ‘আমার দেশের মানুষরা বলে, আপনার দেশে ধুলার চেয়েও সোনা বেশি সাধারণ একটি পণ্য। তার মানে কী, এই যে আপনি আমাকে এত বেশি ভালোবাসেন যে এত সাধারণ একটি জিনিস আমাকে না পাঠিয়ে ধুলো পাঠিয়েছেন?’

এই তিক্ত মন্তব্যের পর তার নতুন জামাতার কাছে পাঠানো প্রতিটি চিঠিতে বিরক্তির পরিমাণ আরও বাড়তে দেখা যায়। তিনি আখেনাতেনকে মনে করিয়ে দেন, তার পিতা আমেনহোটেপ চতুর্থ টুশরাট্টার বন্ধুত্বকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন তবে একথা বলাতে হিতে বিপরীত হয়েছে বলেই মনে হয়, কারণ আখেনাতেন সকল বিষয়ে তার পিতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যত্নবান ছিলেন। তিনি আরও অভিযোগ করেন, তার প্রতিনিধিরা ফারাওর দরবারে ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধর্না দিচ্ছেন, কিন্তু ফারাও তাদের দিকে নজর দিচ্ছেন না। এছাড়াও, ৬ বছর আগে দূত মারফত পাঠানো প্রশ্নের উত্তর বহনকারী চিঠিটি তখনও এসে পৌঁছেনি—এমন দাবিও করেন টুথমোসিস।

বিয়ের সম্পর্কে জড়ালেও ধীরে ধীরে মিটানিদের সঙ্গে মিত্রতা ছিন্ন করছিলেন আখেনাতেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কল্যাণে আগেভাগেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন উত্তরের বাতাস কোন্ দিকে বইছিল। হিট্টিটরা অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছিল। তারা খুবই শক্তিশালী একটি জাতি ছিল এবং তাদের রাজা সুপ্পিলুলিউমাও ছিলেন একজন তুখোড় রণকৌশলী। হিট্টিট রাজা ইতোমধ্যে নতুন ফারাও সিংহাসনে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার উদ্দেশে বিভিন্ন উপহার পাঠাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে এই সৌহার্দ্যমূলক আচরণের নেপথ্যে ছিল আখেনাতেনকে মনে করিয়ে দেওয়া, ‘মনে রেখো, মিশর ও হাটুসাসের মধ্যকার গোপন চুক্তি কিন্তু এখনও কার্যকর রয়েছে।’ কিছুদিনের মাঝেই সুপ্পিলুলিউমা লিখলেন, ‘যেভাবে আপনার পিতা আর আমি দুই জাতির মাঝে শান্তিরক্ষায় আগ্রহী ছিলাম, ঠিক একইভাবে আমরা একে অপরের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি। আসুন আমরা একে অপরকে সহায়তা করি।’

আখেনাতেন মিটান্নি ও হিট্টিটদের মধ্যে পরের রাজ্যটিকেই বেছে নিলেন মিত্র হিসেবে।

টুশরাট্টা গোপন চুক্তির ব্যাপারে খুব সম্ভবত কিছুই জানতেন না। তবে খুব শিগগির তিনি নিজের চোখে এর ফলাফল দেখতে পেলেন। সুপ্পিলুলিউমা নিশ্চিত ছিলেন মিটান্নির প্রতিরক্ষায় মিশর এগিয়ে আসবে না। তিনি পূর্বদিকে অবস্থিত রাজধানী ওয়াশুক্কানির উদ্দেশে সেনাবাহিনী নিয়ে যাত্রা করলেন। টুশরাট্টা দক্ষিণ থেকে সাহায্য আসার জন্য বৃথা অপেক্ষা করলেন। আখেনাতেনের রাজসভা তাদের প্রতিরক্ষায় একটা আঙুলও তুলল না।

সাহায্য তো এলই না, বরং নিজেদের ঘরেই আগুন জ্বলতে দেখলেন টুশরাট্টা। দীর্ঘদিন ধরে মিটানিদের অধীনস্থ আসসুরকে অস্ত্রসহায়তা দিয়ে আসছিল মিশরীয়রা। সুযোগ পেয়ে অ্যাসিরীয়দের রাজা আসসুর-উবাল্লিত (খুব সম্ভবত আমেনহোটেপ তৃতীয়র কাছ থেকে যে রাজা প্রথম সাহায্য পেয়েছিলেন, তার নাতি) সেনাবাহিনী জড়ো করে হিট্টিটদের সঙ্গে যোগ দিলেন এবং দক্ষিণপ্রান্ত থেকে ওয়াশুক্কানিতে আক্রমণ করলেন।

দক্ষিণ ও পশ্চিম, দুইদিক থেকে আগ্রাসনের শিকার হয়ে টুশরাট্টা উত্তর মেসোপটেমিয়া থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আসসুর-উবালিত সে অঞ্চলকে আসসুরের অংশ হিসেবে ঘোষণা করলেন। শামসী-আদাদের রাজত্বের পর প্রথমবারের মতো আসসুর একটি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হল। সে মতে, তার পরবর্তী চিঠিতে আসসুর-উবালিত মিশরের কাছে দাবি জানালেন তাকে ‘মহান রাজার’ উপাধি ফিরিয়ে দিতে। একই সঙ্গে তিনি আরও ধনসম্পদের আর্থিক সহায়তা চাইলেন। ‘আসসুর-উবালিত, আপনার ভাই এবং অ্যাসিরীয়ার রাজা, মহান রাজার কাছ থেকে এসেছে এই বার্তা। আপনার দেশে সোনা হচ্ছে ধুলোর মতো সহজলভ্য; চাইলেই যে-কেউ তা সংগ্রহ করতে পারে। তাহলে কেন এটির ব্যাপারে আপনার এত কার্পণ্য? আমি নতুন এক রাজপ্রাসাদ বানাচ্ছি, যার জন্য অনেক স্বর্ণের প্রয়োজন। যখন আমার পূর্বসূরি আসসুর-নাদিনাহহে আপনার পিতার কাছে পত্র দিলেন, তখন তিনি ২০ ট্যালেন্ট (১ ট্যালেন্ট = ১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওজনের সমপরিমাণ বা গড়ে ৫০ কেজি) সোনা পাঠিয়েছিলেন। যদি আপনি আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়তে চান, তাহলে একই পরিমাণ সোনা পাঠাবেন।’

তবে টুশরাট্টার চিঠিগুলোর মতো এই চিঠিতে আখেনাতেন একটুও অপমানিত বা রাগান্বিত হননি। খুব সম্ভবত আখেনাতেন অ্যাসিরীয়দের কাছ থেকে এ-ধরনের আচরণই প্রত্যাশা করছিলেন।

ইতোমধ্যে, পশ্চিমের যুদ্ধক্ষেত্রে টুশরাট্টার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে হিট্টিটরা ওয়াশুক্কানির প্রাচীরের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছিল।

এ-ধরনের হামলার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না টুশরাট্টা। প্রাচীর ভেঙে শত্রুপক্ষ অনুপ্রবেশ করার আগে রাতের আঁধারে অল্পকিছু সঙ্গীসাথিসহ শহর ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। তবে তার সঙ্গী নির্বাচনে ভুল ছিল; তাদেরই একজন ছিলেন আততায়ী, যার নির্মম আঘাতে নিহত হন হিট্টিটদের নেতা।

তার উত্তরাধিকারী বড়ছেলে বুঝতে পারলেন, এই প্রবল আক্রমণের প্রতিরোধ করতে যাওয়া বৃথা। তিনি শত্রুপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন এবং তার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা হল। তবে তিনি কোনো সিংহাসন পেলেন না। বস্তুত, ওয়াশুক্বান্নির পতনের পর মিটানিদের আর কোনো অস্তিত্বই রইল না। হুররিয়ান নামের একটি উপজাতিভিত্তিক সেনাবাহিনী মিটান্নিদের পক্ষে ছিল, তবে তারাও হিট্টিটদের অগ্রসরের মুখে ইউফ্রেটিসের অপর পারে সরে গেল। তারা জাগরোস পর্বতমালা থেকে এসেছিল, সেখানেই তারা ফিরে গেল এবং লুকিয়ে থাকল। ছোট ও দুর্বল বাহিনী হওয়ায় সে আমলের বড় বড় শক্তিগুলো তাদেরকে কমবেশি উপেক্ষা করল।

ইতোমধ্যে সুপ্পিলুলিউমা দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে আগাতে লাগলেন। যতদূর পর্যন্ত মিশরীয়দের সঙ্গে বিবাদে না জড়িয়ে আগানো যায়, তিনি ততদূর এগোলেন। মিটান্নিদের দখলে থাকা অনেকগুলো শহর দখল করে নিলেন। তবে এ যাত্রায় তিনি নির্বিঘ্নে ‘মিত্র’ মিশরের ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে সেনা নিয়ে পার হয়েছেন, তবে কোনো যুদ্ধে জড়াননি।

আখেনাতেনও তার এই সাম্রাজ্য-বিস্তারে কোনো আপত্তি জানাননি। তবে ততদিনে, বন্ধুত্ব থেকে নয়, বরং বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেই তিনি চুপচাপ থেকেছিলেন। মিশরীয় বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে কোনো যুদ্ধে যায়নি। আমেনহোটেপ চতুর্থর আমল থেকেই তারা শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছিল এবং আখেনাতেনের আমলে তো তাদের শরীরে রীতিমতো মেদভুঁড়ি জমে গেছে! সেনাবাহিনী যুদ্ধে অনভ্যস্ত ছিল এবং ভূমধ্যসাগরের উপকূল থেকে সারা মিশরে মহামারি ছড়িয়ে পড়ছিল। প্লেগের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আসে দুর্ভিক্ষ। একজন নিম্নপর্যায়ের সেমাইট রাজা উপঢৌকন হিসেবে তামা পাঠানোর সময় ক্ষমা প্রার্থনা করে লেখেন, প্লেগের কারণে তার শ্রমিকবাহিনী সংখ্যায় অনেক কমে গেছে, ফলে খনি থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ধাতুর উত্তোলন সম্ভব হয়নি।

রাজকীয় পরিবারেও নেমে এসেছিল দুর্দশা। আখেনাতেনের শাসনামলের ১৪তম বছরে তার প্রথম ও প্রধান স্ত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অল্পদিন পরে ২য় স্ত্রীও দেহত্যাগ করেন। আখেনাতেনের ৩ জন মেয়ে ছিল, কিন্তু কোনো ছেলে ছিল না। সে-যুগের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী, আখেনাতেন ঠিক করলেন একজন পুরুষ বংশধর পেতে শেষ ভরসা হিসেবে ৩ রাজকন্যাকে অন্তঃসত্ত্বা করতে হবে।

দৈবক্রমে, তার এই কৌশল ব্যর্থ হয়। ৩ মেয়েই কন্যাসন্তানের জন্ম দেন এবং মেজোমেয়ে প্রসবকালে মারা যান।

আখেনাতেন তার বড়মেয়েকে তার এক দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন তড়িঘড়ি করে এবং সেই তরুণকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বড় রাজকন্যা মহামারির আঘাতে মারা গেলেন। অল্পদিন পরে অসুস্থ হয়ে বৃদ্ধ ফারাও নিজেও মেয়েকে অনুসরণ করলেন। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, সেই অখ্যাত চাচাতো ভাই সিংহাসনে বসলেন। তবে তিনিও অল্পদিনের মাঝে মৃত্যুবরণ করলেন। পুরো রাজপ্রাসাদ ততদিনে মহামারিতে আক্রান্ত।

সভাসদরা রাজা হিসেবে ৯ বছরের বালক তুতানখাতেনকে নির্বাচন করলেন। তার শরীরে কোনো রাজকীয় রক্ত ছিল কি না, তা খুবই অস্পষ্ট। তবে নিশ্চিতভাবেই তিনি আখেনাতেনের সন্তান ছিলেন না। সে সম্ভবত রাজপ্রাসাদে বেড়ে উঠেছিল। নয় বছর বয়সে তাকে তার বিদ্যালয়কক্ষ থেকে একপ্রকার ধরে এনে ফারাও বানিয়ে দেওয়া হল। সিংহাসনের দাবিকে দৃঢ় করতে তার সঙ্গে আখেনাতেনের একমাত্র জীবিত, ও সবচেয়ে ছোটমেয়ের বিয়ে দেওয়া হল, যে ছিল তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। সে রাজকন্যারও একটি মেয়ে ছিল, যার বাবা ছিলেন প্রয়াত আখেনাতেন।

তুতানখাতেনের চারপাশে ছিল বিভিন্ন উপদেষ্টা ও সভাসদ, যারা মিশরকে উত্তরের দখল ছাড়তে দেখেছেন। তারা একইসঙ্গে দেখেছেন একদিকে মহামারিতে দেশের মানুষ মরে সাফ হয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে আখেনাতেন আতেনের উদ্দেশে মন্দির নির্মাণে ব্যস্ত। তুতানখাতেন তার ৯ বছরের ছোট জীবনে নিজের চোখে পুরো রাজপরিবারকে একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছেন। তার কাছে সিংহাসনকে এক মৃত্যু-পরোয়ানা বলে মনে হলে খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু নেই। এবং এর সঙ্গে ‘পুরাকালের দেব-দেবীদের’ অভিশাপকে দায়ী করলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

সুতরাং, তিনি উত্তরে সুপ্পিলুলিউমার যুদ্ধযাত্রাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করলেন এবং তার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জরুরি বিষয়গুলোর সমাধানে মনোযোগ দিলেন। প্রথমেই তিনি তুতানখাতেন নাম পরিত্যাগ করে নিজের নতুন দিলেন তুতাংখ- আমুন বা তুতানখামুন। এই নামের মাধ্যমে তিনি প্রাচীন উপাস্য আমুনের প্রতি আবারও আনুগত্য প্রকাশ করলেন। তিনি তার উপদেষ্টাদের কথা অনুযায়ী সবধরনের স্মৃতিস্তম্ভ ও শিলালিপি থেকে আখেনাতেনের নাম মুছে ফেললেন। তার মূর্তিগুলোও ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা নিলেন। বৃহত্তম শহর আতেনের নতুন নাম হল আমারনা। এসব কাজ শেষ হওয়ার পর সময় এল আবারও বৈশ্বিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করার।

মিটান্নিরা তখন আর কোনও হুমকির উৎস নয়। কিন্তু হিট্টিটরা তখন অত্যন্ত শক্তিধর হয়ে উঠেছে এবং তারা মিশরের উত্তরাঞ্চলের জন্য ঝুঁকি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিল। আসসুর-উবাল্লিত আসসুর শহরে বসে সম্রাটের মতো আচরণ করছিলেন। মেসোপতেমিয়ার দক্ষিণ-অংশে ব্যাবিলনের কাসসাইট গোত্রপ্রধান বুর্নাবুরিয়াশ প্রথম সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিবাদ জানানোর। তিনি তরুণ তুতানখামুনের কাছে ফরিয়াদ জানালেন, নতুন রাজার উচিত আসসুর-উবালিতকে সম্মান না দেওয়া। এবং তার নিজেকে ‘মহান রাজা’ হিসেবে অভিহিত করা একেবারেই উচিত কাজ নয়। এছাড়াও, তুতানখামুনের উচিত নয় আসসুরের কাছ থেকে কোনো দূত বা বার্তা গ্রহণ করা, কারণ তাদের নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতির চর্চা করার কোনও অধিকার নেই। বুর্নাবুরিয়াশ বলেন, ‘আমি এসব অ্যাসিরীয় দূতদের আপনার কাছে পাঠাইনি। তাহলে কেন, তারা তাদের নিজেদের অধিকারবলে আপনার দেশে গেছে? যদি আপনার আমার প্রতি কোনো অনুরাগ থাকে, তাহলে তাদেরকে আপনি কোনো ছাড় দেবেন না। তাদেরকে ঘাড় ধরে খালিহাতে আমার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন।’

তবে তুতানখামুন তার এই উপদেশ অবজ্ঞা করেন, কারণ অ্যাসিরীয় দূতরা সময়ে সময়ে মিশরের রাজসভায় ধর্না দিতে লাগলেন। আসসুর-উবালিত রাজার মতোই জীবন যাপন করতেন। তিনি তার পূর্ণশক্তি ধরে রেখে এক বিশাল সেনাবাহিনী তৈরি করলেন এবং প্রায় ৩০ বছর প্রবল প্রতাপের সঙ্গে রাজ্য শাসন করলেন।

অবশেষে বুর্নাবুরিয়াশ বুঝতে পারলেন, অ্যাসিরীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলে তিনি মিশরকে পাশে পাবেন না। তখন তিনি অন্য এক কৌশলে আগালেন। তিনি আসসুর-উবালিতের কাছে প্রস্তাব পাঠালেন নিজের কন্যাসন্তানকে ব্যাবিলনের রাজপুত্র কারাইনদাসের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার। আসসুর-উবালিত সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন এই বিয়ে তার নতুন রাজত্বকে দক্ষিণের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে। মহাধুমধামে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হল। বুর্নাবুরিয়াশের ছেলে কারাইনদাস শিগগির পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন এবং দুই রাজ্য, অ্যাসিরীয়া ও ব্যাবিলনের দৈনন্দিন কার্যক্রম শান্তিপূর্ণভাবে চলতে লাগল।

এই শান্তি ততদিনই টিকে ছিল, যতদিন বুর্নাবুরিয়াশ বেঁচে ছিলেন। তার মৃত্যুর ঠিক আগে, তিনি তার পুত্রের বদলে তার নাতিকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্ধারণ করে দিলেন। এই নাতি ছিলেন অর্ধেক অ্যাসিরীয় ও অর্ধেক ব্যাবিলনীয়। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, মিশ্ররক্তের নাতি আসসুরের সিংহাসনেও বসতে পারবে কোনোদিন। সেক্ষেত্রে ব্যাবিলন ও আসসুর একই পতাকার নিচে চলে আসত।

কিন্তু কোনোকিছুই তার পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়নি। নাতিকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে প্রকারান্তরে তিনি তার বিরুদ্ধে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করলেন। সেনাবাহিনীর সদস্য কাসসাইটরা বিদ্রোহ করলেন। তাদের মতে, নতুন রাজার শরীরে দুই জাতের রক্ত মিশ্রিত ছিল এবং ব্যাবিলনের সিংহাসনে বসার কোনো অধিকার তার ছিল না। তারা প্রাসাদে আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করেন এবং একটি সামরিক সরকারকে ক্ষমতায় বসান।

এই পরিস্থিতিতে আসসুর-উবালিত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সেসময় তার নেওয়া উদ্যোগগুলো সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। অল্পকিছু চিঠি ও শিলালিপি থেকে ধারণা করা যায়, তিনি তার নাতির হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে হত্যা করেছিলেন। তারপর একজন নতুন রাজার হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। তবে এই রাজা কে ছিলেন, তা আর আজ সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। এমনকি, এই রাজার ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে আসসুর-উবালিতের ভূমিকা নিয়েও রয়েছে সংশয়।

তবে এটুকু হলফ করে বলা যায়, অ্যাসিরীয়া ব্যাবিলনের কর্তৃত্ব দখল করার কোনো চেষ্টা করেনি।

শেষপর্যন্ত একজন কাসসাইট রাজা (খুব সম্ভবত বুর্নাবুরিয়াশের সবচেয়ে ছোটছেলে) শহরের সিংহাসনে বসেন। এসব গোলযোগের একপর্যায়ে কারাইনদাসকেও সম্ভবত হত্যা করা হয়।

অ্যাসিরীয় ও ব্যাবিলনীয়দের বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে একত্রীকরণই সে-যুগের একমাত্র উদ্ভট বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না।

এক যুগেরও কম সময় ক্ষমতায় থেকে হঠাৎ করে, অপ্রত্যাশিতভাবে তুতানখামুন মারা গেলেন। তবে তিনি ঠিক কীভাবে মারা গেলেন, তা কখনোই কেউ জানতে পারেনি। হয়তো তিনি তিরের আঘাতে দেহত্যাগ করেন। তবে তাকে অনেক শানশওকতের সঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়।

হয়তো তার পূর্বসূরিদের কবরও তার মতোই ঐশ্বর্যে ভরপুর ছিল। তবে অন্যদের মতো, তার কবরটি লুটপাট হয়নি। অন্তত ১৯২২-এর নভেম্বরের আগে না।

তার কোনো সন্তান ছিল না। স্ত্রী আখেসেনামুন দুইবার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন, তবে দুবারই তিনি মৃত সন্তানের জন্ম দেন। অশেষ যত্নের সঙ্গে মৃত দুই সন্তানকে বাবা তুতানখামেনের পাশে মমিকরণের পর কবর দেওয়া হয়েছিল।

স্বামীর মতো আমুনকে সম্মান জানাতে নিজের নাম বদলিয়েছিলেন আখেসেনামুন। তার স্বামীর অকালমৃত্যুতে তিনি পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েন। তার কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না এবং পুরো রাজপরিবারে কোনো পুরুষ-আত্মীয়ও ছিল না। স্পষ্টতই, তিনি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

মিশরের রাজসভায় উচ্চাভিলাষী মানুষের অভাব ছিল না। তাদের মাঝে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তার নিজের নানা, ‘এই’। এই ছিলেন আখেনাতেনের মুখ্যমন্ত্রী। তুতানখামুনের উপদেষ্টা হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন এবং তখনও তিনি বহাল তবিয়তে রাজসভার সদস্য রাজপ্রাসাদে জীবন যাপন করছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বৃদ্ধ ও সন্দেহজনক চরিত্র। কাকে কোথায় সমাধিস্থ করা হয়েছে, তার খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে ছিল। সেনাপ্রধান হোরেমহেবও সমপর্যায়ের শক্তিমান ছিলেন। তিনি আমেনহোটেপ তৃতীয়র আমল থেকে সেনাবাহিনীতে কাজ করে আসছিলেন। যদিও দীর্ঘদিন ধরে তিনি ফারাওর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন, তার বয়স তখনও ৪০-এর কোঠা পেরোয়নি। তার একমাত্র সীমাবদ্ধতা ছিল, তিনি ‘এই’ এর মতো কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন না।

আখেসেনামুন এই দুইজনের ভয়ে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েন, এবং মরিয়া হয়ে এক ভয়ংকর পরিকল্পনা আঁটেন। তিনি হিট্টিট রাজা সুপ্পিলুইলিউমার কাছে চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ করেন তার যেকোনো একজন ছেলেকে মিশরে পাঠাতে। তিনি হলফ করে জানান, তিনি যদি এটি করেন, তাহলে আখেসেনামুন সেই সন্তানকে বিয়ে করে ফারাও বানাবেন।

মিশরে এ চিঠির কোনো অনুলিপি খুঁজে পাওয়া যায়নি, যার অর্থ, এটি একটি গোপন ব্যবস্থা ছিল। হিট্টিটদের রাজধানী হাটুসাসের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা চিঠিতে লেখা ছিল

‘আমার স্বামী মারা গেছেন এবং আমার কোনো ছেলে নেই। কিন্তু আপনার অসংখ্য ছেলে আছে। আপনি যদি তাদের মধ্য থেকে একজনকে আমার কাছে পাঠান, তাহলে আমি তাকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নেব। আমি চাইলেই আমার কোনো ভৃত্যকে স্বামী হিসেবে বেছে নিতে পারছি না এবং আমি খুবই ভীত।’

এই চিঠি একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল, এবং এটি হাতে পেয়ে সুপ্পিলুলিউমা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান। হ্যাঁ, মিশরের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু এতটা তিনি প্রত্যাশা করেননি। তার নিজস্ব নথিতে প্রকাশ, চিঠি পেয়ে তিনি বেশ কয়েকজন গুপ্তচরকে দক্ষিণে পাঠান। তাদের কাজ ছিল যাচাই করা, আখেসেনামুন-এর প্রস্তাবে কোনো মিথ্যাচার লুকিয়ে আছে কী না। গুপ্তচররা যখন খবর আনলেন যে প্রকৃতপক্ষে মিশরের মসনদের কোনো পুরুষ দাবিদার নেই, তখন সুপ্পি লিউমা প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং তার এক সন্তানকে দক্ষিণে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করলেন।

তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, হিট্টিট রাজপুত্র কখনোই তার হবু স্ত্রীর মুখ দেখার সুযোগ পাননি। হোরেমহেব মিশরের সীমান্তে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর ব্যবস্থা করেন। আখেসেনামুনের প্রস্তাবে একমত পোষণ করে সুপ্পিলুলিউমা একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সে চিঠি ও তার পরিকল্পনার বিস্তারিত তথ্য ততদিনে আখেসেনামুন সবাইকে জানিয়েছেন, এবং তাতেই সব ভেস্তে যায়।

১৩ বছর বয়স থেকে সেনাবাহিনীতে কাজ করে হোরেমহেব এটুকু বুঝেছিলেন, সবসময় সম্মুখযুদ্ধ প্রত্যাশিত ফল এনে দেয় না এবং এতে ঝুঁকির পরিমাণও বেশি।

হিট্টিট রাজপুত্র এক বদ্বীপের ওপর দিয়ে তার বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান।

এরপর মিশরের মসনদকে ঘিরে ঠিক কী ধরনের দরকষাকষি চলেছে, তা অজানা। তবে এ ঘটনার পরপরই এই তার প্রয়াত নাতির স্ত্রীকে বিয়ে করে নিজেকে ফারাও হিসেবে ঘোষণা করলেন। তার প্রথম কাজ ছিল সুপ্পিলুলিউমাকে চিঠি লিখে জানানো, রাজপুত্রের মৃত্যুর সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই। তিনি এ ঘটনার পুরো দায় হোরেমহেবের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন। সুপ্পিলুলিউমা এ ঘটনা বিশ্বাস না-করলেও পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার মতো কোনো সুযোগ তিনি পাননি। তিনি সেনা নিয়ে দক্ষিণে যাত্রা করার আগেই হিট্টিটদের ঘাঁটিতে মহামারি আক্রমণ করল এবং সর্বকালের সর্বসেরা হিট্টিট রাজা দেহত্যাগ করলেন।

অল্পদিনের মাঝে ‘এই’ বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেলেন। ৪ বছরও তিনি দেশ শাসন করতে পারেননি। প্রত্যাশিতভাবেই, ‘এই’-কে কবর দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হোরেমহেব নিজেকে ফারাওর পদে অধিষ্ঠিত করলেন। তবে তার আমলে আখেসেনামুনের কপালে কী ঘটে, সে-বিষয়টি পুরোপুরি রহস্যময়। বস্তুত, মিশরের ইতিহাসে বৃদ্ধ ‘এই’-কে বিয়ে করার পর আর কখনোই তার বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *