1 of 2

৩৩. প্রথম চোখ মেলল জয়িতা

প্রথম চোখ মেলল জয়িতা। কয়েকমুহূর্ত একটু অগোছালো, কোন কিছুই যেন ঠিক মাথায় আসছে না, তারপর খেয়াল হল। বাতাসের শব্দ নেই কিন্তু মনে হচ্ছে তার নাক অসাড় হয়ে গেছে। ওটা আছে এমন অনুভূতিও নেই। একদম চাপা দিয়ে শোওয়ার অভ্যেস নেই, দম বন্ধ হয়ে আসে বেশিক্ষণ থাকলে। কল্যাণটা কি আরামে ঘুমাচ্ছে। বাকি দুজনেরও জেগে থাকার কোন লক্ষণ নেই। অথচ এখন, জয়িতা ঘড়ি দেখল, সকাল আটটা বাজে। এ ঘরে এখনও আবছায়া। কাল সারারাত মড়ার মত ঘুমিয়েও ক্লান্তি জড়িয়ে আছে। জয়িতার ঘুম ভাঙার কারণটা তাকে ঘেরা-উত্তাপের বাইরে আনল। ঘরের ভেতরই প্রচণ্ড কাঁপুনি লাগছে, বাইরে গেলে কি হবে। অথচ বাইরে যেতে হবেই। ছেলেদের যে সুবিধেগুলো তারা ঈশ্বরের হাত দিয়ে করিয়ে নিয়েছে সেখানেই তাদের হার।

আপাদমস্তক ঢেকে বাইরে আসতেই সিঁটিয়ে দাঁড়াল সে। এখন হাওয়া নেই। রোদও নেই। মাটিতে ভিজে শিশির যেন জমে আছে। ওপাশের হিমালয় সাদা বরফের চুড়ো নিয়ে যেন সন্ন্যাসীর মত চুপচাপ। সাদা দাড়ির মত কিছু খুচরো মেঘ চুড়ার গায়ে গায়ে ঝুলছে। চট করে যেন সব শীত উধাও। জয়িতার আফসোস হচ্ছিল। কতবার শোনা সেই গল্পটা মনে পড়তেই রাগ হল নিজের ওপর। সাড়ে তিনটে নাগাদ ঘুম ভাঙল না কেন? সূর্য ওঠার এক ঘণ্টা আগে থেকে আকাশের সাজগোজ দেখতে দেখতে ব্রাহ্মমুহর্তে ঈশ্বর দর্শনের আরাম তাকে কালকে পেতেই হবে।

সে মুখ ফেরাল। কোথায় মুরগী ডাকছে কিন্তু এছাড়া কোন প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে না। তাপল্যাঙের মানুষরা এখনও ঘরের বাইরে বের হয়নি। ঘোট ঘোট ঘরগুলো কাঠ এবং গাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি। শীতকালে নিশ্চয়ই প্রচুর বরফ পড়ে, বর্ষায় বৃষ্টি হয়, পাহাড় বলে ঝড়ও ওঠে কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই ঘরগুলো কি করে টিকে থাকে? যদিও গ্রামটা একটা পাহাড়ের আড়াল নিয়ে তৈরি তবু ঘরগুলোর দিকে তাকালে তো আস্থা রাখা যায় না। জয়িতা প্রায় দৌড়ে ঘরের পেছনে চলে এল। ওপাশে সেই ঝরনা থেকে জল পড়ছে। কোনরকমে একটা আড়াল তৈরি করে নিয়ে সে ভারমুক্ত হয়। এবং তারপরেই সে অস্বস্তিটা টের পেল। মাসের একটি বিশেষ সময়ে এই অস্বস্তিটা শুরু হয়। দিন-দুয়েক থাকে যন্ত্রণাটা। তিনদিন ক্রমাগত রক্তপাতের পর যন্ত্রণাটা কমে আসে। জয়িতা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আচমকা সে তিন বন্ধুর কাছ থেকে কয়েক লক্ষ মাইল দূরে সরে এল। এসব কথা কেবল মেয়েদেরই। তার প্রথম অভিজ্ঞতার পর সীতা রায় এমনভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যেন এটা অত্যন্ত গোপন ব্যাপার। ছেলেদের দৃষ্টি এবং কর্ণের সীমানায় আনা উচিত নয়। যদিও সীতা রায় মুখে বলেননি তবু ভঙ্গিতে মনে হয়েছে এটা মেয়েদের ওপর অর্পিত অপরাধ। রামানন্দ রায়কেও বলার প্রয়োজন নেই, শোভনও নয়। যতই সে সমস্ত সংস্কার ঝেড়ে ফেলতে পারুক ওই বয়সে ঢোকানো মায়ের মানসিকতা বোধ হয় এ জন্মে ত্যাগ করা সম্ভব হবে না। অথচ এখানে কোন আড়াল নেই। একই ঘরে তিনজন পুরুষের সঙ্গে তাকে চব্বিশ ঘণ্টা থাকতে হবে। মুখ ফুটে না বললে, নিজেরই বিপদ। এবং সেটা বলা মানে স্বীকার করে নেওয়া আমি তোমাদের থেকে আলাদা, যথার্থই মেয়ে। পৃথিবীর নিয়মটাই প্রকৃতি অনুকরণ করেছে এক্ষেত্রে। যাদের সুবিধে ভোগ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাদের জন্যে কোন কৃপণতা নেই কিন্তু যাদের মধ্যে বাধা তাদের আপাদমস্তক বেড়ি পরিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হয়নি।

অন্তত দুদিন নিশ্চিন্ত, অবশ্য ঠাণ্ডার জন্যে যদি নিয়মের ব্যতিক্রম না ঘটে। ঘরের দিকে ফিরে আসতে আসতে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ছেলেদের যেটাকে সুবিধে বলে ভাবা হয়ে থাকে, সেটা তারা সহজ করে নিয়েছে বলেই তো। কাল রাত্রে ঠাণ্ডায় ওরা বাইরে আসেনি। দরজা থেকেই অন্ধকারে শরীরের ভার কমিয়েছে। কিন্তু সেটা ছিল প্রত্যক্ষ চোখের আড়ালে, কিন্তু ঘটনাটা বোধের মধ্যে ঘটলেও ওইটুকু আব্রুর কারণেই ওরা সহজ ছিল। এই সুবিধে যদি ওরা আদায় করে নিতে পারে তাহলে শুধু মেয়ে বলেই সে সঙ্কোচ করে নিজেকে কষ্ট দেবে? ওরা যা করছে তার কোন্টা সে কম করছে? পরিশ্রম বুদ্ধি এবং শিক্ষায় সে তো পিছিয়ে নেই! নারী-স্বাধীনতার ব্যাপারটা তার কাছে হাস্যকর। তথাকথিত আরোপিত নারীমুক্তিই মেয়েদের কাম্য হওয়া উচিত। বিশেষ এই কষ্টের দিনগুলোর জন্যে সে দায়ী নয়। উপায় নেই বলে তাকে সহ্য করতে হবে। কিন্তু এটা তার লজ্জা হবে কেন? সে পরিষ্কার বলতে পারে আমি অসুস্থ, তোমরা আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও। জয়িতার মনে হল আমাদের অধিক সমস্যা বলতে না পারার জন্যে বেড়ে তীব্র এবং ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। কিন্তু একবার বলতে পারলে সেটার আর কোন ওজন থাকে না। মায়ের শেখানো বুলি এবার ঝেড়ে ফেলতেই হবে।

তোর কি হয়েছে? প্রশ্নটা শুনে জয়িতা চোখ তুলে তাকাল। সুদীপের মুখ ভাল করে দেখা যাচ্ছে পোশাকের প্রাবল্যে কিন্তু চেহারার আদলে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না।

জয়িতা পালটা প্রশ্ন করল, কিছু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে কেন? আমার চেয়ে আমার ব্যাপারটা দেখছি তুই বেশি বুঝতে পারছিস।

সুদীপ বলল, যাঃ বাবা! তাহলে তো নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। মুখ গোমড়া করে মাথা নামিয়ে এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস দেখে মনে হল তোর শরীর খারাপ, তাই প্রশ্ন করলাম। কিন্তু তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কিছু চেপে যাচ্ছিস। তোর ওপর কল্যাণটার ইনফ্লুয়েন্স পড়ছে এবার। কমপ্লেক্স। ঝেড়ে ফেল জয়।

আমার কোন কমপ্লেক্স নেই। কল্যাণকে তুই পছন্দ করিস না এই কথাটা বার বার বোঝস কেন? জয়িতা উঠে এল।

ওই নাকিকান্না আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারি না। জেনেশুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রতি পায়ে নাকিকান্না কাঁদছে। আমাদের উচিত ছিল ওকে কলকাতায় রেখে আসা। তুই লক্ষ্য করিস ও মনে মনে আমাকে ঈর্ষা করে। সুদীপ বলতে বলতে নেমে গেল নিচে। তারপর জয়িতা এবং বাড়িটার দিকে তাকিয়ে অবলীলায় ভারমুক্ত হল। সেদিকে তাকিয়ে জয়িতার জেদটা আরও বাড়ল। সম্ভ্রম, সঙ্কোচ, ভদ্রতা, আড়াল, মেয়েলি জগৎ, শালীনতা শব্দগুলো ছেলেরাই তৈরি করে নিজেদের সুবিধে মতন কোন এককালে মেয়েদের মধ্যে ঢুকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। আর মেয়েরা তার বোঝা টেনে চলেছে। আসলে মেয়েদের শত্রু হল মেয়েরাই। নিজেদের কাচের বাসন করে রেখেই তাদের তৃপ্তি। অন্তত আমাদের দেশের মেয়েদের বটেই। ফাপা বেলুনের মত সম্ভ্রম শব্দটাকে আঁকড়ে ধরে বড় হচ্ছে মরে যাচ্ছে। অথচ প্রতি পায়ে জীবনের অন্য ক্ষেত্রে যে অসম্মান তার কথা ধর্তব্যে আনছে না। একটি নারী তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বামীত্বের লাইসেন্স পাওয়া পুরুষটির দ্বারা ধর্ষিতা হলে সম্ভ্রমহানি হয়েছে বলে এদেশে মনে করে না, কিন্তু শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করেও যাবে অথচ কোন অবস্থায় পথ চলতে গিয়ে কারও বাড়িতে নক করে বলবে না, আপনার টয়লেট ব্যবহার করতে চাই। ওটাতে সম থাকবে না বলে শৈশবে তাকে বোঝানো হয়েছে এবং সেই বোঝ সে টেনে বেড়াচ্ছে। মেয়েদের এসব সংস্কার যতটা না তাদের নিজেদের জন্যে তার চেয়ে বহুগুণ ছেলেদের খুশী করতে।

সূর্য উঠে গেছে, না? সুদীপ কাছে এসে দাঁড়াল।

তোর জন্যে বসে থাকবে? জয়িতা সহজ হতে চাইল।

খোঁচাটা গায়ে মাখল না সুদীপ। চারপাশে নজর বুলিয়ে বলল, জায়গাটা দারুণ, না রে?

কাল আর একটু হলে তোর এই দারুণ বেরিয়ে যেত!

ছাড়! আমি বাচ্চা মেয়েটার উপকার করতে গেলাম আর তার বদলে–! মানুষ কত সহজে ভুল বোঝে। কিন্তু ভাবছি অন্য কথা। এই লোকগুলো এখানে বেঁচে আছে কি করে?

সুদীপের প্রশ্ন শুনে জয়িতা আবার বাড়িগুলোর দিকে তাকাল। এখানে ফসল ফলানোটাই কঠিন ব্যাপার। যা ফলে তাতে সারা বছর চলে না। মুরগী, পাহাড়ী ছাগল আর ভেড়া আছে। তাই খেয়ে ফেললে তো হয়ে গেল। জঙ্গলে ফল হয় বলেও মনে হয় না। কোনরকম ব্যবসাবাণিজ্য কেউ করে না, শহর তো দূরের কথা। চ্যাঙগাপুতেও যাওয়া আসা নেই। তাহলে?—সুদীপ বলল, এই লোকগুলো বেশিদিন বাঁচবে না। কাল যে মেয়েটাকে আমরা ওষুধ দিলাম তার মায়ের স্বামীকে দেখেছিস? ভাবা যায়? মহিলাটি বিধবা হবার পর স্বেচ্ছায় একটি কিশোরকে বিয়ে করেছিল একথা অনুমান করা যায়। ব্যাপারটা ভাল করে জানতে হবে। সুদীপ হাসল।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, জেনে তোর কি লাভ?

মাথা নেড়ে কৌতুকের গলায় সুদীপ বলল, এই গ্রামে মনে হচ্ছে পুরুষদের ডিম্যান্ড আছে।

জয়িতা ঠোঁট কামড়াল, মেয়েটার ঘা না শুকোলে ওরা আমাদের শেষ করে দেবে।

এই সময় আনন্দর গলা ভেসে এল, সুদীপ, জয়িতা তাড়াতাড়ি ভিতরে আয়।

ওরা ভেতরে ঢুকে দেখল আনন্দ বিভ্রান্তের মত চারপাশে তাকিয়ে দেখছে। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? কি হয়েছে?

আনন্দ ওদের দিকে তাকাল, ব্যাগটা নেই। অথচ কাল বিকেলে ওইখানে রেখেছিলাম।

কোন্ ব্যাগটার কথা আনন্দ বলছে বুঝতে অসুবিধে হল না। সুদীপ জিনিসগুলো উলটে-পালটে দেখল। তারপর বলল, আশ্চর্য! কে নেবে এখান থেকে!

কল্যাণ তখনও ঘুমোচ্ছ। সুদীপ চট করে যেখানে শুয়েছিল তার কাছে পৌঁছে হাতড়াল, আরে আমার রিভলভারটাও নেই। অদ্ভুত কাণ্ড।

আনন্দ বলল, আমারটাও পাচ্ছি না। যে গ্রেনেড এবং গুলির বাক্স নিয়ে গিয়েছে সে আমাদেরগুলো বাদ দেয়নি। একটা লোকের মুখই মনে পড়ছে। পালদেম।

ও কেন নেবে? এসব ব্যবহার করতে ও জানে না। তাছাড়া আমার জামাকাপড় এবং টাকার ব্যাগটায় হাত দেয়নি। শুধু বেছে বেছে আর্মস নিয়ে গেল? সুদীপ হতভম্ব।

ও প্রথম থেকেই ভয় পেয়েছিল আমাদের হাতে ওসব দেখে। ওগুলো থাকলে আমাদের কবজা করা যাবে না ও জেনেছিল। এখন কি করা যায়! আনন্দকে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল।

সুদীপ বলল, কিছু করার নেই। যে নিয়েছে সে চাইলে ফেরত দেবে না। মুশকিল হল, পুলিশ এলে আমাদের আর লড়াই করার উপায় থাকল না। কি ঘুম ঘুমিয়েছি, একটুও টের পেলাম না। ওটাকে ডাক তো। এখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে সহ্য করতে পারছি না।

এই সময় চোখ মেলল কল্যাণ, কটা বাজে রে? খুব খিদে পেয়েছে।

আনন্দ বলল, ওঠ। কাল রাত্রে এই ঘরে চোর এসেছিল। আমাদের রিভলভার, গুলি, গ্রেনেড় নিয়ে গেছে। তোর ব্যাগে যে রিভলভারটা রাখতে দিয়েছিলাম সেটা আছে কিনা দ্যাখ।

কল্যাণ তড়াক করে উঠে বসে ব্যাগ হাতড়াল। নিজের বিছানা দেখল। তারপর অদ্ভুত গলায় বলল, নেই।

সুদীপ বলল, এবার পেট ভরে খাও সবাই ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে। নিজের গালে নিজে চড় মারতে ইচ্ছে করছে।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপর আনন্দ বলল, এ নিয়ে ভেবে আর কি হবে? আমরা এমন ভাব দেখার যেন কিছুই হয়নি। কেউ চুরি করেছে বলে জানি না। এই ঘটনায় আমরা বিন্দুমাত্র নার্ভাস হইনি। তাহলেই চোর অবাক হবে। ভাববে কিছু আমাদের কাছে এখনও রয়ে গেছে। ওরা অস্ত্রের ব্যবহার জানে না। শুধু ভয় হচ্ছে গ্রেনেডগুলো না ফাটিয়ে বসে।

ওরা যখন কথা বলছিল তখন জয়িতা ধীরে ধীরে হাত নিজের কোমরের ওপর নিয়ে এল। সে আঙুলের চাপ দিতেই শক্ত হল। কোমরের কাছে রিভলভারটা রয়ে গেছে। আনন্দ তাকে দেওয়ার পরই সে কোমরে রেখেছিল। চোর বোধহয় মেয়ে বলে তার কোমরে হাত দিতে সাহস পায়নি। সে রিভলভারটার আদল আঙুলে অনুভব করে হাত সরিয়ে নিল। থাক, তার কাছে যে একটা অস্ত্র বেঁচে আছে সেটা এখন বলার দরকার নেই। এবং হঠাই তার মনে হল এই মুহূর্তে সে তার তিন পুরুষবন্ধুর চেয়ে অনেকটা বেশি সুবিধেজনক অবস্থায় আছে।

 

চা খেয়ে ওরা চারজনে বাইরে বেরিয়ে এল। একটু আগে আকাশ যেটুকু পরিষ্কার ছিল এখন আর তা নেই। দলে দলে কুয়াশা উঠে আসছে নিচের খাদ থেকে। ওরা চারজন নিচে নেমে আসছিল। দুটো পাহাড়ের কোলে এই গ্রাম। বস্তুত হাওয়া যেদিক দিয়ে তেজী হয়ে আসে সেদিকটাই পাহাড় আটকে রেখেছে। আনন্দ বলল, চল, গ্রামটাকে ভাল করে দেখে আসি। ওরা চুরি করুক আর যাই করুক গত রাত্রে এখানেই আশ্রয় পেয়েছি আমরা, খাবারও দিয়েছে। এখান থেকে চলে যেতে হলে চট করে কোথায় আশ্রয় পাওয়া যাবে জানি না।

কল্যাণ বলল, কেন, ওয়ালাঙচুঙে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল?

আনন্দ জানাল, উপায় না থাকলে সেখানেই শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই জায়গাই আমাদের পক্ষে বেশি নিরাপদের।

এখন গ্রাম জেগেছে। বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা ঘর এবং ক্ষেতের সংলগ্ন কাজে নেমে পড়েছিল। তারা এখন ওদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। একটি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দুটি মেয়ে হঠাৎ সুদীপের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ভেঙে পড়ল। এই ঠাণ্ডাতেও ওদের পা খালি, মাথা এবং মুখে কোন আবরণ নেই। গায়ের রঙ টকটকে লাল হবার উপক্রম। এই মেয়েদুটোর গলগণ্ড নেই। সুদীপ দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়ে দুটো হেসে যাচ্ছে সমানে আর সেইসঙ্গে সম্ভবত মন্তব্য ছুঁড়ছে। হঠাৎ ওপাশ থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ ধমকে ওঠায় ওরা চুপ করল। কিন্তু সুদীপের মনে হল নিঃশব্দে ওরা হাসছে। চারজনের মধ্যে ওকে বেছে নেওয়ার কারণটা সে অনুমান করতে পারল। সে ওই বালিকার হাত ধরে টেনেছিল এই গল্পটাই বোধ হয় ওকে হাস্যকর করেছে এদের কাছে। কিন্তু শুধুই কি হাস্যকর? ভাষা অবোধ্য হলেও মেয়েদের ভঙ্গিতে যে নিজস্ব ভাষা থাকে তা পৃথিবীর সব দেশেই এক। সেটা যে অন্য কথা বলছে।

কল্যাণ ডাকল, কি হচ্ছে কি? আর একটা ঝামেলা বাধাবে দেখছি।

সুদীপ হাসল। তারপর বন্ধুদের সঙ্গী হয়ে বলল, মাথা খারাপ, আমি ঝামেলার ধারে কাছে নেই।

ক্রমশ ওদের পেছনে একটি দুটি করে বাচ্চা জমে গেল। কাটা তরমুজের মত গাল, নোংরা পোশাক এবং সমস্ত শরীরে অভাব খোদাই হয়ে আছে ওদের অথচ ঠোঁটে হাসি নিয়ে পেছন পেছন ঘুরতে উৎসাহের অভাব নেই। আনন্দ বলল, এককালে সাহেবরা কলকাতার গলিতে হাঁটলে এই দৃশ্য দেখা যেত। মানুষগুলো কিভাবে বেঁচে আছে দেখেছিস?

মিনি ভারতবর্ষ। আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। খোঁজ নিলে দেখবি এখানেও একজন জোতদার বা ধর্মযাজক আছেন যিনি শোষণ চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই কাহন না কি বলে সে-ই হয়তো তাই।

সুদীপ বলতে বলতে থেমে গেল। কয়েকজন যুবক ওপরে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে ওদের ওপর নজর রাখছে। হয়তো এতক্ষণ লক্ষ করেনি কিন্তু তাদের ঘর থেকে বের হবার পরই ওরা পাহারা দিয়ে চলেছে। সুদীপ বন্ধুদের কিছু বলল না। তার ধারণা ভুল হলে আর একটা রসিকতায় সামনে দাঁড়াতে হবে।

পুরো গ্রামটা ঘুরতে ঘন্টাখানেক সময় লাগল। অবশ্য পাহাড়ের অন্য ভাঁজে ঘর-বাড়ি থাকলে সেটা অজানা থাকল। জায়গা বেশি নয় কিন্তু বারংবার চড়াই ডেঙে ওদের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়েছিল। খোলা একটা জমি পেয়ে ওরা চারজন বসে পড়ল। বাচ্চাগুলো খানিক দূরত্ব রেখে থেমে গিয়ে ওদের লক্ষ করছে। মাথার ওপর কুয়াশা ঝুলছে। রোদ নেই এক ফোঁটা। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, তোদের কি খিদে পায় না? আমার নাড়িভুড়ি জ্বলছে। কলকাতাতেও এমন খিদে পেত না।

জয়িতা বলল, তুই এক কাজ কর। আমাদের আস্তানায় ফিরে গিয়ে যে খাবার আছে তাই দিয়ে কিছু একটা বানিয়ে ফেল। আমরা আসছি। ইচ্ছে করলে ভাতও রাঁধতে পারিস। খুব সোজা।

সবাই ভেবেছিল কল্যাণ প্রতিবাদ করবে। কিন্তু সে উঠে দাঁড়াল। তারপর দিক ঠিক করে হাঁটতে লাগল। বসে থাকা বাচ্চারা কল্যাণকে চলে যেতে দেখে কেউ কেউ পিছু নিল। কল্যাণ খানিকটা হেঁটে বাচ্চাগুলোকে ধমকাল, কি চাই? আমরা কি আজব চীজ? ভাগ!

তার গলায় যে ঝাঁঝ ছিল তাতে বাচ্চারা থমকাল কিন্তু সরল না। দুবার পথ গোলানোর পর শেষ পর্যন্ত সে আস্তানাটায় পৌঁছাতে পারল। পৌঁছে দেখল পালদেম আর একটি কিশোর সেখানে বসে আছে। পালদেমকে দেখেই কল্যাণের মেজাজ বিগড়ে গেল। এই লোকটাই ওদের অস্ত্র চুরি করেছে। পালদেম মুখোমুখি হওয়ামাত্র জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কি গ্রাম দেখতে বেরিয়েছ?

হ্যাঁ। কিছু একটা করতে হবে তো। তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করব!।

নিশ্চয়ই। কিন্তু তার আগে তোমাকে জানাচ্ছি কাল রাত্রে তোমাদের ওইসব বাজে জিনিসগুলো আমি নিয়ে গেছি। ওগুলো তোমাদের সঙ্গে থাকলেই অযথা ভয় দেখাবে। যেদিন তোমরা এই গ্রাম ছেড়ে যাবে সেদিন সব ফেরত পাবে। এখানে তো আর ওসবের দরকার হচ্ছে না।

পালদেম যে সোজাসুজি স্বীকার করবে তা কল্যাণের অনুমানে ছিল না। সে এটা শোনার পর আর কি বলতে পারে! ঘরে ঢুকে ব্যাগ খুলে সে চাল আর আলু বের করল। হঠাৎ তার মনে হল স্টোভ ধরালে তেল শেষ হয়ে যাবে। পাথরের মধ্যে কাঠ জ্বেলে উনুন তৈরি করলে কেমন হয়! সে আবার বাইরে আসতে পালদেম জিজ্ঞাসা করল, তোমার বন্ধুরা কি এখনই ফিরবে?

হ্যাঁ। কোন দরকার থাকলে আমাকে বলতে পার। নিজেকে বেশ গুরুত্ব দিতে চাইল কল্যাণ।

ওর মেয়ে কাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি। ওই ঘা হওয়ার পর এমন কখনও হয়নি। আমরা সবাই খুব ভয় পাচ্ছি। যদি মেয়েটির কিছু হয় তাহলে তোমরা মারা পড়বে। কেন ঘুমোয়নি?

পালদেম বেশ কড়া গলায় প্রশ্ন করতে কল্যাণ একটু থিতিয়ে গেল। মেয়েটা ঘুমোয়নি? মারা গেলেই হয়ে গেল আর কি! সে কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলল, আমি ঠিক জানি না। আনন্দ এসব বোঝে। এখন মেয়েটা কি করছে?

এখন ঘুমাচ্ছে মড়ার মত। ওর মা তাই খোঁজ করতে পাঠিয়েছে। সকালে কি যেটা খেতে দিয়েছ তা খাওয়াবে? ভেবেচিন্তে বলল।

পালদেম প্রশ্ন করতে কল্যাণ মুখ তুলে তাকাতে ওদের আসতে দেখল। সে বলল, ডাক্তারবাবু আসছে, ওকে আসতে দাও, বলার ওই বলবে।

দূর থেকে আনন্দ পালদেমকে কল্যাণের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিল। ওরা সঙ্গে সঙ্গে স্থির করেছিল চুরির ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলবে না। কাছাকাছি এসে সুদীপ হাত তুলল, আরে পালদেম, কি খবর? তোমাকেই খুঁজছি। কাল রাত্রে চিৎকার করে কে কাঁদছিল বল তো? বাপরে বাপ!

পালদেমের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে কল্যাণকে ইশারা করল ব্যাপারটা জানাতে। আনন্দ লক্ষ করল আজ ওর ব্যবহারে বেশ কর্তৃত্ব এসে গেছে। কল্যাণ তাদের জানাল ব্যাপারটা। আনন্দ একটু চিন্তা করে বলল, এখন যখন ঘুমোচ্ছ তখন ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যেটা দিয়েছে তা এবার অর্ধেক করে খাইয়ে দাও। তোমরা মিছিমিছি চিন্তা করছ, মেয়েটা ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু কান্নাটা কিসের?

পালদেম বলল, ওটা পাহাড়ের দানোর। মাঝে মাঝেই গ্রামের কাছে এসে ওইভাবে কাঁদে। আর যখনই দানোটা এমন করে তখনই গ্রামের কেউ না কেউ মরে যায়। কাহুন আজ পুজো শুরু করেছে তাই।

জয়িতা বিস্মিত, দানো? দৈত্য? তোমাদের ওই পাহাড়ে বরফের মধ্যে দৈত্য থাকে? পাগল!

সঙ্গে সঙ্গে মুখ শক্ত হয়ে গেল পালদেমের, যা জানো না তা নিয়ে ঠাট্টা করো না। তুমি মেয়েছেলে বলে আমি কিছু বললাম না, এরা কেউ পাগল বললে আমি ছাড়তাম না।

সুদীপ ঠাট্টা করল, মেয়েছেলে ও মেয়েছেলেদের তুমি পাত্তা দাও না?

না। মেয়েছেলেকে আমরা বিছানা আর বাচ্চা তৈরির ক্ষেত হিসেবে ব্যবহার করি। আমাদের এখানকার নিয়ম হল চাষের জমি পাহাড় থেকে ছিনিয়ে নাও, বরফের জন্য মকাই, কোদো জমিয়ে রাখ আর পেট ভরে ছাং খেয়ে মেয়েছেলের কাছ থেকে আনন্দ পাও। পালদেম হাসল লাল দাঁত বের করে।

আনন্দ জয়িতার মুখ দেখে বুঝতে পারছিল ও এখনই রাগে ফেটে পড়বে। সে হাত বাড়িয়ে জয়িতাকে স্পর্শ করল, রাগ করে কোন লাভ নেই। ও এখন যা ইচ্ছে তাই বলতে পারে। এখানকার সত্যিটাও আমরা জানি না। কিন্তু পালদেম, তোমাদের ওই দৈত্যটাকে কেউ চোখে দেখেছে?

অনেকবার। ওর মুখ কেউ দেখতে পায় না, কিন্তু শরীর দেখেছে অনেকেই। তবে যারা দেখেছে তাদের শরীরে লোগ ঢুকে যায়। আমাদের এখানে অনেকের গলায় যে অসুখ সেটা ওর জন্যে। ও কাদলে সেই কান্না আমাদের গলা ফুলিয়ে দেয়। কাল তোমরা এলে আর ও কাদল। আমরা মেয়েটার জন্যে ভয় পাচ্ছি তাই। পালদেমকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। মনে হল ও পূর্ণ বিশ্বাস থেকেই কথা বলছে।

কিন্তু দৈত্যটাকে দেখতে কেমন? কল্যাণ বেশ কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞাসা করল।

গায়ে বড় বড় লোম, বিশাল চেহারা। কখনও চার হাত পায়ে কখনও দুই পায়ে হাঁটে। সব সময় বরফের মধ্যে থাকতে ভালবাসে। ঝড় বৃষ্টি ঠাণ্ডাতেই ওদের আরাম হয়। আমি ওর পায়ের ছাপ দেখেছি—এত বড় বড়! মাঝে মাঝে ওরা সবচেয়ে উঁচু বরফের পাহাড়ের ওপরে উঠে যায়।

কি করে বুঝলে?

পাহাড়ের চুড়োটা কালো হয়ে যায় আর পৃথিবী তখন কাঁপতে থাকে থর থর করে।

অনেক কষ্টে হাসি চাপল সুদীপ। বলল, তোমরা পাহাড়ি ভাল্লুককে দেখেছ!

ব্যঙ্গের হাসি ফুটল পালদেমের মুখে, আমাকে ভালু চেনাতে এসো না। এই দানোদের তিনজন মাঝে মাঝে এখানে আসে। যখন চলে যায় তখন খুব জোরে শিস বাজায়। কাল ওরা শিস দেয়নি, মানে এখনও এই এলাকাতেই আছে।

কল্যাণ বলল, ইয়েতি। ওটা নিশ্চয়ই ইয়েতি।

সুদীপ ধমকালো, ভাগ। ইয়েতি বলে কিছু নেই। হিলারি সমস্ত হিমালয় চষেছেন একটা ইয়েতির সন্ধানে। কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি শুধু পায়ের ছাপ ছাড়া। ওটা পরে পাহাড়ি ভাসুকের বলে মনে করা হয়েছে। ফালতু সংস্কার। কিন্তু পালদেম, আমরা তোমাদের ওই দানোকে মেরে ফেলতে পারতাম যদি তোমরা কাল আমাদের অস্ত্র চুরি না করতে।

সুদীপ আচমকা এই প্রসঙ্গে আসায় আনন্দ আর জয়িতা পালদেমের প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করল। পালদেম মাথা নাড়ল, তোমরা যাতে এখানে কোন খুনোখুনি না করতে পার তাই এই কাজ করতে হয়েছে। জানো আমাদের সঙ্গে বহু যুগ থেকে আছে।

এতক্ষণ কিশোর চুপচাপ শুনছিল। সে কিছু বলতেই পালদেম জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল অত অস্ত্র নিয়ে? তোমাদের মতলব ভাল নয় বলে মনে হচ্ছে।

আনন্দ বলল, আমরা খারাপ লোক নই। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমাদের বয়স বেশি নয়?

তাতে কিছু এসে যায় না। তোমরা কি ডাকাতি করে পালিয়ে এসেছ? পালদেমের চোখে সন্দেহ।

না, আমরা ডাকাত নই। তোমাদের কোন ক্ষতি আমরা করব না।

ঠিক আছে। মেয়েটার কি হয় তা আগে দেখা যাক।

পালদেম কিশোরকে ইশারা করতেই সে রওনা হচ্ছিল, জয়িতা তাকে থামাল,, দাঁড়াও। বিছানা হওয়া ছাড়াও মেয়েদের অনেক কাজ থাকে। ওকে বল আমি ওর সঙ্গে যাব মেয়েটাকে দেখতে।

পালদেম বেশ বিস্মিত, তুমি ওর বাড়িতে যাবে?

হ্যাঁ। কেন, তোমাদের কি আমার সম্পর্কেও ভয় আছে? ও কেন রাত্রে ঘুমায়নি দেখতে চাই।

জয়িতা কথা শেষ করে ঘরে ঢুকে গেল। তারপর ফার্স্টএইডের ব্যাগটা নিয়ে নেমে এল, ওকে বলে দাও আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।

খানিকটা ইতস্তুত করে পালদেম ছেলেটাকে কথাগুলো জানাতে সে অবাক হয়ে জয়িতাকে দেখল। আনন্দ বলল, কেন যাচ্ছিস বুঝতে পারছি কিন্তু সাবধানে থাকিস। বেশি দেরি করিস না।

জয়িতা কোন কথা না বলে ছেলেটিকে অনুসরণ করল। পালদেমের কথাগুলো শোনার পর থেকেই তার শরীর ঘিনঘিন করছিল। সেই মুহূর্তে ইচ্ছা হয়েছিল লোকটাকে গুলি করে মারে। তার কাছে যে আর একটা রিভলভার আছে তা কেউ জানে না। কিন্তু পালদেমকে মেরে ফেললে এই গ্রামে বাস করা যাবে না। আর একটা রিভলভার কতক্ষণ পুরো গ্রামটাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে! সমস্ত যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করে কি কৌশলে যুদ্ধ করা হচ্ছে তার ওপরে। এর বদলা সে নেবেই। জয়িতা তার সামনে হেঁটে যাওয়া ছেলেটাকে লক্ষ্য করল। বেশ বিভ্রান্ত হয়ে ও হাঁটছে। ওর শরীরের গড়ন বলে দিচ্ছে কিছুতেই কুড়ির কাছে পৌঁছাতে পারে না। অথচ ও ওই বালিকার বাপ এবং শেষ-যুবতীর স্বামী। কি করে সম্ভব? এখানে কি মেয়েদের চেয়ে ছেলে কম? সে অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে পেছনে তাকাল। তাদের আস্তানা বা বন্ধুদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জয়িতা হিন্দীতে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল, এই যে ভাই, তোমার নাম কি?

ছেলেটি মুখ তুলে তাকাল। ওর পরিষ্কার সরল মুখে হাসি ফুটল। তারপর দুবার নিচু গলায় সে উচ্চারণ করল, বাই, বাই! জয়িতা বুঝল ও ভাই শব্দটাকে ধরতে পেরেছে। পথ চলতে ওয়াংদের কাছে শেখা শব্দ ব্যবহার করল সে, তিমরো নাম?

দুগদুপ। নিজের বুকে হাত রেখে ছেলেটি বলল, মেরো নাম। এটা বুঝতে কোন অসুবিধে হল না জয়িতার। তার মনে হল কান খাড়া করে শুনলে আর ওরা যদি একটু ধীরে কথা বলে তাহলে অনেক কথাই বোঝা যেতে পারে।

ক্রমশ ওরা গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চারপাশে কৌতূহলী মেয়েপুরুষের ভিড়। এমন হতশ্রী চেহারা সত্ত্বেও মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তিগুলো ওরা আঁকড়ে আছে। পেছন পেছন মেয়েরা আসছে আর দুগদুপকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। দুগদুপ যেন হঠাৎ নিজেকে বেশ ক্ষমতাবান মনে করেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটা নিচু দরজার সামনে উপস্থিত হল। ততক্ষণে গতকালের সেই রমণীটি দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখেমুখে বিস্ময়। দুগদুপ তাকে জড়িয়ে কিছু বলল। জয়িতা সেই শব্দাবলীর মধ্যে শুধু পাদেমের নামটাই বুঝতে পারল। রমণীটি মাথা ঝুকিয়ে তাকে ভেতরে যেতে ইশারা করতে জয়িতা নিচু হয়ে পা বাড়াল। ঘরটা মাঝারি। কাঠ বাঁশ আর বড় খুঁটি দিয়ে শক্ত করে তৈরি। ঘরটির মাঝখানে একটা পার্টিশন। মেয়েটি শুয়ে আছে পার্টিশনের এপাশে একটা মাচার ওপরে। ওর শরীরের তলায় গরম বস্ত্র এবং বিছানা হিসেবে যা ব্যবহার করা হচ্ছে তার চেহারা দেখে আঁতকে উঠল জয়িতা। মেয়েটা তার ওপরে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ঘরে আরও মেয়ে বাচ্চা ঢুকেছিল। সেদিকে খেয়াল না করে জয়িতা মেয়েটার কপালে হাত রাখল। যদিও খুবই সামান্য ব্যান্ডেজের বাইরে ভোলা রয়েছে কিন্তু তাতে কোন উত্তাপ পেল না সে। অর্থাৎ মেয়েটার জ্বর আসেনি, শরীরে কোন অ্যালার্জি বের হয়নি। যদিও ওর হাতে পায়ে চর্মরোগের চিহ্ন ছড়িয়ে। সে দেখল ব্যান্ডেজের অনেকখানি ভিজে গেছে। ঘা-এর রস গড়িয়ে ভিজিয়েছে ব্যান্ডেজ। অথচ গতকাল যখন ওকে দেখেছিল তখন কোন রস গড়াচ্ছিল না। গতরাতে ওর না ঘুমানোর কারণ সে বুঝতে পারল। ময়লায় শক্ত হয়ে জমে থাকা আচ্ছাদনটা সরে যাওয়ায় ঘা নরম হয়ে রস গড়াচ্ছে। এটা অবশ্যই ভাল লক্ষণ। কিন্তু আজ আবার ব্যান্ডেজ পালটে ওষুধ লাগানো দরকার। কিন্তু কাল ওরা বলে গেছে যে ব্যান্ডেজ খুললে যদি দেখা যায় ওটা বেড়ে গেছে তাহলে! নরম ঘাকে ওদের বেড়ে যাওয়া বলেই মনে হবে। হোক, তবু যা করা উচিত তা করবে বলে ঠিক করল জয়িতা। কিন্তু মেয়েটার ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত অপেক্ষা করা দরকার। সে ইশারায় রমণীটিকে বলল ভিড় সরিয়ে দিতে। জয়িতা যেভাবে মেয়েটিকে পরীক্ষা করছিল তাতে নিশ্চয়ই আন্তরিকতা দেখতে পেয়েছিল রমণীটি। তাই সে এবারে চিৎকার করে ঘরের সবাইকে বের করে দিয়ে কিশোরটিকে কিছু নির্দেশ দিল। জয়িতা দেখল কিশোর-স্বামী বাইরে পাহারায় থাকল।

চিৎকার চেঁচামেচিতে মেয়েটির ঘুম ভাঙলেও সে কিছু শব্দ বিড় বিড় করে পাশ ফিরে আবার শুলো। রমণীটি ছুটে এল তার কাছে। উদ্বিগ্ন হয়ে দেখল। তারপর জয়িতার দিকে তাকিয়ে হাসল। জয়িতা হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বলল, কোন ভয় নেই। রমণীটি সেটা বুঝতে পারল না। জয়িতা হিন্দীতে ডর শব্দটা উচ্চারণ করে হাতের ইশারায় বাকিটা বোঝাল। এবার ইশারায় কথা বলা শুরু হল। দেখা গেল অসুবিধে হচ্ছে, বারংবার বিভিন্ন কায়দায় বোঝাতে হচ্ছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষ বুঝতে পারছে। এই ঘরটা দুগদুপের দাদার। সে মারা গেছে এক বছর আগে। গ্রামের নিয়ম মেনে ছোটভাইকে বিয়ে করতে হয়েছে রমণীকে। পাশের খোপে তারা শোয়। রমণী তিনবার ক্ষেতি শব্দটা উচ্চারণ করার পর জয়িতা বুঝতে পারল জমি যাতে ভাগ না হয়ে যায় তাই এই ব্যবস্থা।

সে জিজ্ঞাসা করল হিন্দীতে এবং ইশারায়, ছেলের বয়সী একটা ছোকরাকে স্বামী হিসেবে তোমার কেমন লাগছে?

রমণী হেসে গড়িয়ে পড়ল। তারপর চটপট জামা সরিয়ে কাধের কাছটা জয়িতার সামনে আনল। নগ্ন সাদা চামড়ায় দাঁতের দাগ স্পষ্ট। মেয়েটি খুব গর্বের সঙ্গে সেখানে আঙুল বুলিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ল শব্দ করে।

জয়িতা হতভম্ব হয়ে বাইরে দাঁড়ানো দুগদুপের দিকে তাকাল। ওই সরল নির্দোষ কিশোরকে ওই ভূমিকায় সে কল্পনাও করতে পারছিল না। আর এই সময় মেয়েটি চোখ মেলে উঠে বসতেই জয়িতা এগিয়ে গেল। মেয়েটির হাত দুটো হাতে জড়িয়ে ধরতেই সে লজ্জা পেয়ে হাসল। জয়িতা এবার ওর কপালে হাত বোলাল। মেহ বড় সংক্রামক, মেয়েটি আক্রান্ত হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *