এই দেড় ঘণ্টা পাগলের মতো এসপ্ল্যানেডের পথে পথে ঘুরেছে সোমনাথ। ভিতরের পুরোনো সোমনাথ তাকে জ্বালাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সোমনাথ এক ঝটকায় তাঁকে দূর করে দিয়েছে।
অন্ধকারে অনেকক্ষণ ঘরে ঘরে এখন আশ্চর্য এক অনুভূতি আসছে। নিজেকে আর সিংহশিশু মনে হচ্ছে না। হঠাৎ ক্লান্ত এক গরিলার মতো মনে হচ্ছে সোমনাথের। বৃদ্ধ গরিলার ধীর পদক্ষেপে সোমনাথ এবার দি গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলে ফিরে এলো। এবং নিরীহ এক গরিলার মতোই লাউঞ্জের নরম সীটে বসে পড়লো।
দেড় ঘণ্টা থেকে মাত্র দশ মিনিট সময় বেশি নিলেন গোয়েঙ্কা। এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের মাথায় ফোনে সোমনাথকে ডাকলেন। গোয়েঙ্কাজীর গলায় গভীর প্রশান্তি ঝরে পড়ছে। “হ্যালো মিস্টার ব্যানার্জি, উই হ্যাভ ফিনিশড্।”
ফিনিশড্। তার মানে তো সোমনাথ এখন ওপরে গোয়েঙ্কাজীর ঘরে চলে যেতে পারে। নষ্ট করবার মতো সময় এখন নয়। অথচ ঠিক এই গুরত্বপর্ণ মুহূর্তে ভিতরের পুরোনো সোমনাথ আবার নড়ে-চড়ে উঠবার চেষ্টা করলো। গরিলা সোমনাথকে সে জিজ্ঞেস করছে, ‘ফিনিশ কথাটার মানে কী?’ ওই সোমনাথ ফিসফিস করে বলছে, ‘ফিনিশড্, মানে তো শেষ হয়ে যাওয়া। গোয়েঙ্কাজী শেষ হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু উই হ্যাভ ফিনিশড্, বলবার তিনি কে? ওঁর সঙ্গে তাহলে আর কে কে শেষ হলো? “আঃ! ওই সোমনাথের ওপর ভীষণ বিরক্ত হলো সোমনাথ। তোমাকে হাতে-পায়ে দড়ি বেঁধে পাগল সুকুমারের মতো রেখে দিয়েছি-তাও শান্তি দিচ্ছে না।
ওই সোমনাথটার স্পর্ধা কম নয়—আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ওসব বাজে বকুনি শোনবার সময় কোথায় সোমনাথের? মিস্টার গোয়েঙ্কার সঙ্গে বিজনেস সংক্রান্ত জরুরী কথাগুলো এখনই সেরে ফেলতে হবে। পড়োনি? স্ট্রাইক দ্য আয়রন হোয়েন ইট ইজ হট। গোয়েঙ্কা এখনও ফারনেস থেকে বেরনো লাল লোহার মতো নরম হয়ে আছে, দেরি করা চলবে না।
একটু দ্রুতবেগেই সোমনাথ যাচ্ছিল। কিন্তু লিফটের সামনে নটবর মিত্র তাকে পাকড়াও করলেন। বেশ খুশীর সঙ্গে বললেন, “কোথায় গিয়েছিলেন মশাই? আমি তো আপনাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান! গোয়েঙ্কার ঘরও বন্ধ—‘ডোন্ট ডিস্টাব’ বোর্ড ঝোলানো—আমি জ্বালাতন করতে সাহস পেলাম না।”
সোমনাথ হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “গড়ের মাঠে ঘুরছিলাম।”
“বেশ মশাই! আপনি গড়ের মাঠে হাওয়া খাচ্ছেন। আমিতো ঊষা জৈনকে মিস্টার সুনীল ধরের ঘরে চালান করে দিয়ে দেড় ঘন্টা বার-এ বসে আছি। না বসে পারলাম না মশাই। মিস্টার ধর বিরাট গভরমেন্ট ইনজিনিয়ার। একেবারে কাঠ-বাঙাল। বিকেল থেকে মালে চুর হয়ে আছেন। ভদ্রলোক আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। নেশার ঘোরে বললেন, ‘মেয়েমানুষের গায়ে কখনও হাত দিইনি। আজ প্রথম ক্যারেকটার নষ্ট করবো। থ্যাংক ইউ ফর ইওর সিলেকশন!’ আমি ভাবলাম ঊষা জৈনকে পেয়ে খুব খুশী হয়েছেন। কিন্তু মিস্টার ধর যা শোনালেন, তাতে একটা শর্ট স্টোরি হয়ে গেলো। মিস্টার ধর বললেন, ‘গুড়ের নাগরীগুলো আমাদের এই সোনার দেশকে শুষে-শুষে সর্বনাশ করে দিয়েছে, টাকার দেমাক দেখিয়ে বেটারা ভূতের নৃত্য করছে। আমাদের অসহায় ইনোসেন্ট মেয়েগুলোকে পর্যন্ত আস্ত রাখছে। তাই আজ আমি প্রতিশোধ নেবো।’
“শুনে তো মশাই আমার হাসি যায় না! হাসি চাপা দেবার জন্যে বাধ্য হয়ে আমাকে একটা ড্রিঙ্ক নিয়ে বার-এ বসতে হলো।”
নটবর মিত্তির বললেন, “যান আপনি গোয়েঙ্কার কাছে। বিজনেস কথাবার্তা এই তালে সেরে ফেলুন। আমি পাঁচ মিনিট পরেই আপনাদের ঘরে গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আসছি—গোয়েঙ্কাকে যদি সন্তুষ্ট করে থাকে তাহলে ফিউচারে আমার কাছ থেকে কাজকর্ম পাবে।”
টোকা পড়তেই গোয়েঙ্কাজী দরজা খুলে দিলেন। কেমন মনোহর প্রশান্ত সৌম্য মুখে তিনি সোমনাথকে ভিতরে আসতে বললেন। শিউলিকে দেখা যাচ্ছে না। সে কোথায় গেলো? এখনও ভিতরের ঘরে শুয়ে আছে নাকি?
সোমনাথের আন্দাজ ঠিক হয়নি। শিউলি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। সমুদ্রের আলোড়নের মতো ফ্লাশের আওয়াজ ভেসে আসছে। শিউলি কারো দিকে তাকাচ্ছে না। সে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। বেচারাকে ক্লান্ত বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে।
কী আশ্চর্য! এই ঘরে শিউলি ছাড়া অন্য কারও চোখে-মুখে লজ্জার আভাস নেই। গোয়েঙ্কাজী শান্তভাবে একটা সিগারেট টানছেন। সোমনাথ মাথা উঁচু করে বসে আছে। যত লজ্জা শুধু শিউলি দাসেরই। তার প্রাপ্য টাকা অনেক আগেই চুকিয়ে দিয়েছে সোমনাথ। নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে মাথা নিচু করে আর একটিও কথা না বলে সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো শিউলি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
গোয়েঙ্কা এবার একটু কপট ব্যস্ততা দেখালেন। শিউলির যা প্রাপ্য তা অনেক আগেই চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এই বলে সোমনাথ তাঁকে আশ্বস্ত করলো।
সন্তুষ্ট গোয়েঙ্কা বললেন, “শিউলি ইজ ভেরি গুড। কিন্তু, লাইক অল বেঙ্গলী, নিজের ব্যবসায়ে থাকতে চায় না। বিছানাতে শুয়েও বলছে, একটা ছেলের চাকরি করে দিন।”
আজ কল্পতরু হয়েছেন মিস্টার গোয়েঙ্কা। সোমনাথের সঙ্গে করমর্দন করলেন। বললেন, “আপনার অর্ডারের চিঠি আমি টাইপ করে এনেছি। আপনি রেগুলার প্রতি মাসে কেমিক্যাল সাপ্লাই করে যান। দু-নম্বর মিলের কাজটাও আপনাকে দেবার চেষ্টা করবো। আর দেরি নয়। আমার শ্বশুরবাড়িতে এখন আবার ডিনারের নেমন্তন্ন রয়েছে,” এই বলে মিস্টার গোয়েঙ্কা নিজের জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করলেন।
প্রচণ্ড এক উল্লাস অনুভব করছে সোমনাথ। গোয়েঙ্কার লেখা চিঠিখানা সে আবার স্পর্শ করলো। সোমনাথ ব্যানার্জি তাহলে অবশেষে জিতেছে। সোমনাথ এখন প্রতিষ্ঠিত।
গোয়েঙ্কার ঘর থেকে বেরিয়ে সোমনাথ থমকে দাঁড়ালো। আবার চিঠিখানা স্পর্শ করলো।
করিডরেই নটবরবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। হুঙ্কার দিয়ে নটবর বললেন, “আজকেই চিঠি পেয়ে গেলেন? গোয়েঙ্কা তাহলে আপনাকে বিজনেসে দাঁড় করিয়ে দিলো! কংগ্রাচুলেশন, আমি ঠিক আন্দাজ করেছিলাম, ব্যাটা চিঠি তৈরি করে নিয়ে আসবে।”
সোমনাথের ধন্যবাদের জন্যে অপেক্ষা করলেন না নটবরবাবু। বললেন, “পরে কথা হবে। মিসেস বিশ্বাসের দেমাক আমি ভাঙতে চাই। মেয়েটাকে একটু দেখে আসি—ঘরে আছে তো?”
এইমাত্র যে শিউলি দাস বেরিয়ে গেলো তা জানালো সোমনাথ।
“এইমাত্র যে মেয়েটার সঙ্গে করিডরে আমার দেখা হলো? লাল রংয়ের তাঁতের শাড়ি পরা? চোখে চশমা? হাতে কালো ব্যাগ?”
সোমনাথ বললো, “হ্যাঁ। ওই তো শিউলি দাস।”
“শিউলি দাস কোথায়?” একটু অবাক হলেন নটবর মিত্র। “ওঁকে তো আমি চিনি। আমাদের যাদবপুরের পাড়ায় থাকে। তাহলে নাম ভাঁড়িয়ে এ-লাইনে এসেছে। এ-লাইনে কোনো মেয়েই অবশ্য ঠিক নাম বলে না। ওর নাম তো কণা।” নটবরবাবু বললেন, “দাস হলো কবে থেকে? ওরা তো মিত্তির। ওর বাবাকে চিনি—সবে রিটায়ার করেছে। আর ভাইটা মশাই ইদানীং ডাহা পাগল হয়ে গেছে—সুকুমার না কী নাম।”
অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের আনন্দে নটবর মিত্তির এখন বিমোহিত। বললেন, “কী আশ্চর্য দেখুন—সারা শহর খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত যাকে নিয়ে আসা হলো সে পাশের বাড়ির লোক। খুব অভাব ছিল ওদের, তা ভালোই করেছে।”
হঠাৎ ভীষণ ভয় লাগছে সোমনাথের। কাল যখন তপতী তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে তখন সোমনাথের মুখটা যদি গরিলার মতো দেখায়? তপতী তখনও কি ভালোবাসতে পারবে? তপতী যেন বলেছিল সোমনাথের নিষ্পাপ মুখের সরল হাসি দেখেই সে হৃদয় দিয়েছিল।
“কণা, কণা, কণা” পাগলের মতো কণাকে ডাকতে ডাকতে সোমনাথ গ্রেট ইন্ডিয়ান হোটেলের গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত ছুটে এসেছিল। কিন্তু কোথায় সুকুমারের বোন? সে চলে গিয়েছে।