৩য় খণ্ড – ভালোবাসা মন্ত্রণালয়

তৃতীয় খণ্ড

অধ্যায় ১

সে জানে না সে কোথায়। ধারণা করছে ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই তার অবস্থান, কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার কোনো পথ নেই। মাথার ওপর উঁচু সিলিংয়ের জানালাবিহীন একটি কুঠুরি। সাদা সিরামিকের ঝকঝকে দেয়াল। কোথাও গোপন স্থানে বসানো বাতি থেকে একটি ঠাণ্ডা আলো এসে কক্ষটাকে ভরে রাখে সারাক্ষণ, আর টানা একটা ঝিম ধরা শব্দ কানে আসে। হতে পারে বায়ু আসার পথেই উৎপত্তি এই শব্দের। দেয়ালের চৌদিকটা ঘুরিয়ে পেতে রাখা একটি বেঞ্চ, কিংবা তাকিয়াও বলা চলে। পশ্চাৎদেশ পেতে দেয়ালে পিঠ দিয়ে সটান বসার জন্য যথেষ্টই চওড়া। প্রবেশপথ আর তার ঠিক উল্টোদিকে পায়খানার দরজার কাছে বেঞ্চিটি কাটা পড়েছে। পায়খানার প্যানে নেই কাঠের আসন। প্রতিটি দেয়ালে চারটি করে টেলিস্ক্রিন।

হালকা একটা পেটব্যথা চলছেই। সেই যখন ওরা তাকে বেঁধে বদ্ধ একটি ভ্যানে চড়িয়ে রওয়ানা দিল তখন থেকেই ব্যথাটা শুরু। তবে ক্ষুধাও পেয়েছে তার, যন্ত্রণাদায়ক ফালতু রকমের ক্ষুধা। শেষ খেয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা হয়ে গেছে হয়ত, নয়ত হতে পারে ছত্রিশ ঘণ্টাও। এখনও সে জানে না, হয়ত কখনোই জানতেও পারবে না, তার গ্রেফতার ঠিক কখন হয়েছিল সকালে, নাকি সন্ধ্যায়। তবে এটা জানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তার পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি।

সরু বেঞ্চটিতে যতটুকু বসা যায় ততটুকুই বসে আছে, হাত দুটো হাঁটুর ওপরে ক্রস করে ফেলে রাখা। চুপচাপ অনড় বসে থাকা এরই মধ্যে সে শিখে গেছে। কোনো রকম অপ্রত্যাশিত নড়াচড়া হলেই টেলিস্ক্রিনে ওদের তারস্বর ভেসে আসে। কিন্তু ক্ষুধার ব্যাকুলতা ক্রমেই তাকে পেয়ে বসছে। এখন তার আর কিছুরই নয়, স্রেফ এক টুকরো রুটির অপেক্ষা। তার ধারণা আলখেল্লার পকেটে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া রুটি কিছুটা রয়েছে। হতেও পারে—কারণ পায়ের ত্বকে কিছু একটা অনভূতও হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা রয়েছে পকেটে। ভাবতে ভাবতে ভয়কেও কিছুটা অতিক্রম করেছে সে, আর আলগোছে পকেটে হাতটি ঢুকিয়ে দিয়েছে মাত্র—

‘স্মিথ!’ টেলিস্ক্রিন থেকে ভেসে এলো তীব্র আওয়াজ। ‘৬০৭৯ স্মিথ ডব্লিউ! কারা প্রকোষ্ঠে হাত পকেটে নয়!’

ফের অনড় বসে রইল সে, হাত দুটো হাঁটুর ওপরে আড়াআড়ি হয়ে পড়ে আছে। এখানে আনার আগে তাকে আরেকটি স্থানে নেওয়া হয়েছিল, হতে পারে সেটি সাধারণ কারাগার অথবা টহলদারদের অস্থায়ী লক-আপ। জানে না সেখানে কতক্ষণ ছিল; তবে ঘণ্টা কয়েক তো হবেই; সেখানে কোনো ঘড়ি ছিল না, ছিল না দিনের আলোও, ফলে সময় হিসাব করা কঠিন। ভীষণ শোরগোলে, পুঁতি-গন্ধময় স্থান ছিল সেটি। ওই প্রকোষ্ঠটির আকার এইটির মতোই ছিল তবে ওটি ছিল নোংরা আর আরো দশ পনেরো জনে ঠাসা। ওদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ অপরাধী, তবে গুটিকয় রাজনৈতিক বন্দিও ছিল। দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে থেকে নিশ্চুপ হয়ে ছিল তারা সবাই, নোংরা শরীরের গন্ধ নাকে লাগছিল কিন্তু পেটের ব্যথা আর ভয়ের চোটে নিজেই এত বেশি কুঁকড়ে ছিল যে ওগুলোয় ধ্যান দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে দলের কারাবন্দি ও সাধারণ বন্দিদের মধ্যে যে ফারাকটি থাকে তা খুব করে লক্ষ্য  করেছে সে। দলের বন্দিরা ভয়ে কুঁকড়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকে, কিন্তু সাধারণ অপরাধীরা কেউ কাউরে কিছুতেই পাত্তা দেয় না। ওরা নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গেও খিস্তিখেউর করে, নিজেরটা ঠিক মতো না পেলে ভয়ঙ্কর হামলা চালায়, গোপনে পাচার করে আনা খাবার খায়, নিজেদের কাপড়ের মধ্যেই কেমন করে কোনো রহস্যময় লুকোনো স্থানে করে বয়ে আনে সেই খাবার, আর টেলিস্ক্রিনে কোনো নির্দেশনা, হুমকি ধমকি এলে পাল্টা চিৎকার শোরগোল বাজিয়ে দেয়। এছাড়াও এদের কারো কারো নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে বেশ খাতির। ওরা তাদের ডাকনামে ডাকে, কারো কারো হাতে দরজার গুপ্তফুঁকো দিয়ে এসে পড়ে দু’চারটি সিগারেটও। নিরাপত্তা রক্ষীরাও এই সাধারণ কয়েদীদের বেশ ধৈর্যের সাথে সামলায়, এমনকি যখন তাদের ওপর চড়াও হতে হয় তখনও। বহুল আলোচিত জবরদস্তিমূলক শ্রম ক্যাম্পও রয়েছে যেখানে অধিকাংশ কয়েদীকেই যেতে হয় অবধারিতভাবে। সে জেনেছে, এসব ক্যাম্পে সবই সই, কোনো ভাবনা নেই যতক্ষণ আপনার কিছু ভালো যোগাযোগ আছে, হাতে পেয়ে যাচ্ছেন ধরার মতো রশি। এখানে ঘুষ চলে, চলে পক্ষপাতিত্ব, আছে সব ফন্দি-ফিকির, সমকামিতা, পতিতাবৃত্তিও; আলু দিয়ে এখানে তৈরি হয় চোলাই মদ। আস্থার সবটুকুই এই সাধারণ অপরাধীদের ওপর ন্যস্ত, বিশেষ করে যারা গ্যাংস্টার, খুনি, যারা তৈরি করেছে এক ধরনের আভিজাত্য। আর এই সকল নোংরা কাজই ঘটে চলে রাজনীতির নামে।

যত রকমফের রয়েছে তার সব ধরনের অপরাধীদের আনাগোনা এখানে। মাদক ব্যবসায়ী, চোর, জোচ্চর, দস্যু, চোরা-কারবারি, মাতাল, মদ্যপ, বারবনিতা সব। কোনো কোনো মদ্যপ আবার এতটাই সহিংস ও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে তাদের দমাতে অন্য কয়েদীরা একজোট হয়।

ষাটের কাছাকাছি বয়স হবে এমন এক বিশালদেহী, থলথলে স্তন, আর মাথা ভর্তি সাদা চুলের জটওয়ালা এক নারীকে অনেকটা চ্যাংদোলা করে, লাথি-গুঁতো দিতে দিতে আর খিস্তি-খেউর করতে করতে প্রকোষ্ঠে ঢোকাল চার কারারক্ষী। বুটসহ দুই পা দুজন মুচড়ে ধরে আছে, তারই মাঝে নারীটি ওদের লাথি দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবেই ঠিক উইনস্টনের কোলের ওপর ঝপ করে তাকে ফেলল কারারক্ষীরা। প্রচণ্ড চাপে তার রানের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার দশা। নারীটি নিজেকে সোজা করে তুললেন আর চিৎকার করে বললেন, ‘ফা… বাস্টার্ডস!’ তখনই খেয়াল করলেন অস্বাভাবিক কিছুর ওপর বসে আছেন, আর দ্রুতই উইনস্টনের হাঁটুর ওপর থেকে হড়কে গিয়ে বেঞ্চিতে বসলেন।

‘মাফ করো, প্রিয়’—বললেন তিনি। ‘আমি তোমার ওপর বসে পড়িনি, ওই জারজগুলো আমাকে তোমার ওপর ফেলেছে। একটা মেয়ে মানুষের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা ওরা জানে না, তুমিই বলো, জানে নাকি?’ একটু থামলেন, বুকের ওপর হালকা চাপড় দিতে দিতে, বড় একটা ঢেঁকুড় তুললেন। ‘মাফ করো, সত্যি বলছি আমি নিজে কিন্তু বসিনি’—ফের বললেন নারীটি।

এরপর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে মেঝেতে হড়হড় করে বমি করে দিলেন।

‘ভালোই হলো’—চোখ বন্ধ করে পেছনে হেলান দিতে দিতে বললেন তিনি। ‘জিনিসটা পেটে পড়লে আর নিচে থাকতে চায় না, ঠিক বের হয়ে আসে। ’

আরেকটু ধাতস্ত হলে ফের উইনস্টনের দিকে তাকালেন আর তার প্রতি যেন একটু আগ্রহীই হয়ে উঠলেন। বিপুল দুটি বাহু তার কাঁধের ওপর ফেলে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন তাকে, মুখের ওপর এসে লাগছে বিয়ার আর বমির গন্ধের ধাক্কা।
‘তোমার নাম কী, বলো তো’—বললেন তিনি।
‘স্মিথ’—বলল উইনস্টন।
‘স্মিথ?’ বিস্ময় নারীটির কণ্ঠে। ‘মজার তো। আমার নামও স্মিথ। কেন’—একটু আবেগমাখা উচ্চারণ তার, ‘তাহলে হতে পারে আমি তোমার মা!’

এই নারী হতেই পারেন তার মা, ভাবল উইনস্টন। বয়স আর শরীরের গঠনে মিলে যায়, আর জবরদস্তি শ্রমের ক্যাম্পে বিশ বছর কাটালে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন তো আসবেই।

আর কেউ অবশ্য তার সঙ্গে কথা বলেনি। বিস্ময়করভাবেই সাধারণ অপরাধীরা দলের কয়েদীদের অবজ্ঞার চোখে দেখে। ‘দ্য পলিটস’ এই নামেই ওরা তাদের ডাকে, যেন তাদের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। পার্টির কয়েদীরা কারো সঙ্গে কথা বলতে স্রেফ আতঙ্কিত বোধ করে, আর নিজেদের মধ্যে একে অপরের সঙ্গেও নয়। কেবল একবারই, পার্টির দুই নারী সদস্য ঠেলাঠেলিতে কিছুক্ষণের জন্য পাশাপাশি হয়ে পড়েছিল, তখন সে এই শোরগোলের মধ্যেও শুনতে পেল কিছু শব্দ অতি দ্রুততায় চালাচালি হয়ে গেল। তাদের যা বলতে শোনা গেল তা ছিল অনেকটা এরকম ‘রুম ওয়ান-ওহ-ওয়ান’—যা বস্তুত তার বোধগম্য হলো না।

হতে পারে, ঘণ্টা দুই কিংবা তিনেক আগে ওরা তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। পেটের ব্যথাটি এক লহমার জন্যও বন্ধ হয়নি, তবে ক্ষণে ক্ষণে কিছুটা কম অনুভূত হয়েছে আবার মাঝে মাঝে চাগাড় দিয়ে উঠছে, তার সঙ্গে মিল রেখে ভাবনার গাড়িও কখনো স্তিমিত কখনো জোর বেগে চলছে। যখন ব্যথাটি বাড়ে তখন ব্যথা আর খাবারের প্রত্যাশা ছাড়া অন্য কিছুই আর ভাবনায় থাকে না। আর যখন ব্যথাটি ধরে আসে তখন মন জুড়ে জেঁকে বসে আতঙ্ক। কোনো কোনো মুহূর্তে তার ভাবনায় ভর করে যা কিছু ঘটতে যাচ্ছে তার কপালে সে সবের কল্পনা। আর এতে তার হৃদযন্ত্রটি লাফাতে থাকে আর শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। অনুভবে আসে কনুইয়ে লাঠির আঘাত, লোহার পাত বসানো জুতোয় জঙ্ঘাস্থিতে কষে বসানো লাথি, নিজেকে সে দেখতে থাকে মেঝের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে আর ভেঙ্গে ফেলা দাঁতের ফাঁকা দিয়ে করে যাচ্ছে ক্ষমার চিৎকার। জুলিয়ার কথা তার মনেই আসে না। এলেও ওর ওপর মনকে স্থির করতে পারে না। জুলিয়াকে সে ভালোবাসে আর তার সঙ্গে প্রতারণা করবে না, কিন্তু সে তো সত্য মাত্র, সেটা সে জানে ঠিক যেমনটি জানে অঙ্কের নিয়ম।

কিন্তু এখন এই মুহূর্তে তার প্রতি কোনো ভালোবাসা সে অনুভব করছে না, এমনকি তার কী হয়েছে সে নিয়ে কৌতূহলও হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে ও’ব্রায়েনকেও মনে পড়ে, সূক্ষ্ম একটা আশা জাগানিয়া সে ভাবনা। ও’ব্রায়েন জানলেও জানতে পারেন সে এখন ধৃত। তিনি তো বলেইছিলেন, ব্রাদারহুড কখনোই তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে না। তবে একটি রেজর ব্লেডের কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন ওরা যদি পারে একটি রেজর ব্লেড তোমাকে পৌঁছে দেবে। আর নিরাপত্তারক্ষীরা ছুটে কারা প্রকোষ্ঠে পৌঁছানোর আগে পাঁচ সেকেন্ড সময়ও পাওয়া যাবে। এই ব্লেড তাকে জ্বলন্ত এক শীতল কামড় বসাবে, যে আঙুলে সেটি ধরা থাকবে সেটি কেটে যাবে হাড্ডি অবধি। কল্পনায় সবকিছুই যেন ফিরে এসেছে তার অসুস্থ শরীরে, সামান্য ব্যথা বেড়ে এখন কম্পমান অসহনীয় রূপ নিয়েছে। রেজর ব্লেড হাতে পেলেও তার ব্যবহার করবে কি না তা মোটেই নিশ্চিত নয় সে। নির্ঘাত নির্যাতন জেনেও আরও দশটি মিনিটের জীবন প্রত্যাশিত। একটি মুহূর্ত থেকে আরেক মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

কুঠুরীতে কতগুলো ইট তা গুনে দেখে কখনো কখনো। গুনে ফেলাটা কঠিন কিছু কাজ নয়, কিন্তু প্রতিবারই কোনো না কোনো পর্যায়ে খেই হারিয়ে ফেলে। বারবার কৌতূহল জাগে, কোথায় সে, কয়টা বাজে এসব জানার। একটা সময় তার নিশ্চিত করেই মনে হয় বাইরে এখন রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিবালোক, আবার একটু পরে একই নিশ্চয়তায় তার মনে হয় বাইরে ঘুঁটঘুটে আঁধারের রজনী। এইখানে, গভীর উপলব্ধিতে সে বুঝতে পারে, আলো কখনোই নেভে না। এ এক স্থান যেখানে কোনো আঁধার নেই: এখন সে বুঝল কেন ও’ব্রায়েন সেদিনের সেই পরোক্ষ কথার মানে ঠিক ধরে ফেলেছিলেন। ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ে কোনো জানালা নেই। তার প্রকোষ্ঠটি হতে পারে ভবনের ঠিক মাঝখানটিতে, অথবা পাশের কোনো দেয়াল ঘেঁষাও, হতে পারে মাটির নিচে আরো দশতলা গভীরে, কিংবা মাটি থেকে আরো ত্রিশ তলা উপরে। মনে মনে সে বিচরণ করতে লাগল ভবনের এখান থেকে সেখানে, আর শরীর ও মনানুভূতি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল কোথায় সে, অতি উচ্চে বায়ুতে নাকি অতি গভীর তলদেশে।

বাইরে থেকে অনেক বুটের ঝম-ঝম আওয়াজ আসছে। বিকট শব্দ তুলে খুলে গেল ইস্পাতের দরজা। তরুণ এক অফিসার, কালো উর্দিতে টান টান শরীর, ঝকঝকে চামড়ার পোশাকে আরো চকচকে, কঠোর, নির্জীব চেহারাটি স্রেফ মোমের মুখোশ, দরজাপথে দৃঢ় পা ফেলে ভিতরে ঢুকলেন। সঙ্গে আনা অপর বন্দিকে প্রকোষ্ঠে ঢোকাতে নিরাপত্তারক্ষীদের নির্দেশ দিলেন। ধাক্কাতে ধাক্কাতে ভেতরে ঢোকানো হলো কবি অ্যাম্পলফোর্থকে। আর তখনই বিকট শব্দ তুলে ফের বন্ধ হলো দরজা।

অ্যাম্পলফোর্থ প্রথমেই কুঠুরীর দেয়াল ঘেঁষে কয়েকবার এপাশ থেকে ওপাশে অনিশ্চিত নড়াচড়া করল যেন মনে করেছে এই কক্ষে বাইরে যাওয়ার আরেকটি দরজা ঠিকই আছে, আর অতঃপর কুঠুরীর উপর থেকে নিচটা কয়েকবার দেখে নিল। তখনো উইনস্টনের উপস্থিতি তার নজরে আসে নি। তার পর্যুদস্ত চাহনি তখনও উইনস্টনের মাথারও এক মিটার উপর থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে। পায়ে জুতো নেই, বড় বড় নোংরা দুটি বুড়ো আঙুল মোজা ছিঁড়ে বাইরে বের হয়ে আছে। তারও বেশ কিছুদিন দাঁড়ি কামানো হয়নি। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভরে আছে মুখ-চোয়াল। সব মিলিয়ে চেহারাটি হিংস্র রাফিয়ানোদের মতো মনে হচ্ছে, তবে দুর্বল বপু আর ভয়ার্ত নড়াচড়ার সঙ্গে যা একেবারেই বেমানান।

জড়িমা ভেঙ্গে নিজেকে কিছুটা টেনে তুলল উইনস্টন। অ্যাম্পলফোর্থের সঙ্গে তার কথা বলা উচিত, জানা আছে টেলিস্ক্রিন ঝাঁঝিয়ে উঠবে, তারপরেও। এমনও তো হতে পারে সে-ই মূলত রেজর ব্লেডের বাহক।
‘অ্যাম্পলফোর্থ,— বলল সে।
টেলিস্ক্রিন কোনো রা করল না। অ্যাম্পলফোর্থ থমকাল, কিছুটা চমকালোও। আর ধীরে ধীরে নজর ফেলল উইনস্টনের ওপর।
‘অ্যাহ, স্মিথ!’ বলল সে। ‘তুমিও’
‘তুমি কেন এখানে?’
‘তোমাকে সত্যি কথাটি জানাতে’—বলতে বলতে উইনস্টনের উল্টোদিকে বেঞ্চিতে বসে পড়ল সে। ‘অপরাধ তো ওই একটাই, নাকি?’
‘তাহলে তুমি কি সে অপরাধ করেই ফেলেছো?’
‘মনে হয় করে ফেলেছি। ’
একটি হাত কপালে রেখে একপাশে চাপ দিতে লাগল, যেন কোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করছে।
‘এভাবেই ঘটনাগুলো ঘটে’—ভাসাভাসা শুরু তার। ‘একটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে, হ্যাঁ সম্ভবত একটিই ঘটনা। নিঃসন্দেহে সেটা ছিল অসাবধানতাবশত। আমরা কিপলিংয়ের কবিতার একটি নির্দিষ্ট সংস্করণ তৈরির কাজ করছিলাম। তারই একটি পংক্তির শেষে ‘গড’ শব্দটিকে রেখে দিয়েছিলাম। আসলে উপায় ছিল না!’—উইনস্টনের পানে মুখ তুলে তাকিয়ে অনেকটা ক্রোধের উচ্চারণ তার। ‘লাইনটি পাল্টানো অসম্ভবই ছিল। ছন্দের অপর শব্দটি ছিল “রড”। তুমি জানো গোটা ভাষায় এই “রড”-এর সঙ্গে মিল হয় মাত্র বারোটি শব্দের। কয়েক দিন ধরে এ নিয়ে মাথা খাটিয়ে আর একটি শব্দকেও মেলানোর মতো পাইনি। ’

ওর মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল। একটা বিরক্তির ভাব মুখের ওপর দিয়ে বয়ে গেল ঠিকই, তবে এক দণ্ডের জন্য তাকে সন্তুষ্টও মনে হলো। নোংরা উশকোখুশকো চুলের মাঝেও এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক উষ্ণতা, পাণ্ডিত্যের আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছিল।

‘তোমার কি কখনো মনে হয়েছে, বলো’—বলল সে, ‘ইংরেজি পদ্যের ইতিহাসে কি এই সত্যের মুখোমুখি কেউ হয়েছে কভু যে, এই ভাষায় অন্ত্যমিল শব্দের অভাব রয়েছে?’
নাহ, উইনস্টনের ক্ষেত্রে এমনটা কখনোই ঘটেনি। তবে এই এখন বিষয়টি তার কাছে খুব একটা গুরুত্বের কিংবা আগ্রহেরও মনে হচ্ছে না।
‘তুমি কি জানো দিনের কোন সময়টা এটা?’—প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন তার।

ফের চমকাতে দেখা গেল অ্যাম্পলফোর্থকে। ‘এ নিয়ে ভাবিনি। ওরা আমাকে বন্দি করেছে দিন দুয়েক আগে, দিন তিনেকও হতে পারে। ’ দেয়ালের চারিদিকে ঘুরছে তার চোখ, যেন এখনো তার মাঝে আধা প্রত্যাশা জাগ্রত যে, এই দেয়ালের কোথাও মিলে যাবে একটি জানালা। ‘এইখানে রাত আর দিনে কোনো ফারাক নেই। কেউ সময় হিসাব করতে পারবে এমন কোনো পথ এখানে দেখছি না। ’

বাইরে থেকে অনেক বুটের ঝম-ঝম আওয়াজ আসছে। বিকট শব্দ তুলে খু

তাদের এমন অসংলগ্ন কথাবার্তা চলল মিনিট কয়েক, অতঃপর, আচমকা টেলিস্ক্রিন চিৎকার পাড়লো, আর সাথে সাথে দুজনই চুপ মেরে গেল। নিশ্চুপ বসে উইনস্টন, হাতদুটো আগের মতোই হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। সরু বেঞ্চটি বিশাল বপুর অ্যাম্পলফোর্থের জন্য আরামদায়ক হওয়ার কথা নয়, একটি হাঁটু ঘিরে দুই হাতের আঙুল কেচকি মেরে একবার এদিক আরবার ওদিক তাকাচ্ছে সে। ফের ঘেউ করে উঠল টেলিস্ক্রিন, অ্যাম্পলফোর্থকে সটান হয়ে থাকার নির্দেশ। সময় বয়ে যাচ্ছে। বিশ মিনিট কিংবা এক ঘণ্টা—হিসাব কষা কঠিন। আরো একবার বাইরে থেকে বুটের শব্দ এলো। উইনস্টনের অন্ত্র বার্তা দিল, খুব শিগগিরই, হতে পারে পাঁচ মিনিটে, হতে পারে এখনই এই যে বুটের ভারী শব্দ, যার মানেই হলো তার নিজের পালা এসে গেছে।

দরজা খুলে গেল। শীতল হলুদমুখো কর্মকর্তা প্রকোষ্ঠে পা ফেললেন। হাতের সামান্য ইশারায় তিনি অ্যাম্পলফোর্থকেই ইঙ্গিত করলেন।
‘রুম ১০১’—বললেন তিনি।
অনভ্যস্ত ভঙ্গিমায় নিরাপত্তারক্ষীদের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেল অ্যাম্পলফোর্থ, তার চেহারায় একটা অস্পষ্ট উদ্বেগ আছে তবে ভয়ের দেখা নেই।

মনে হচ্ছিল দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে। পেটের ব্যথা ফিরে এসেছে উইনস্টনের। একই কৌশলকে ঘিরে তার মনটাও ঘুরপাক খাচ্ছে; ঠিক যেমন করে একই গর্তের ভেতরে পড়ে একটি বল একইভাবে ঘুরপাক খায়। তার চিন্তা জগতকে ঘিরে রয়েছে মোটে ছয়টি বিষয়। পেটের পীড়া; এক টুকরো রুটি; রক্ত আর চিৎকার; ও’ব্রায়েন; জুলিয়া; আর একটি রেজর ব্লেড। আবারও অন্ত্রে খিঁচুনি অনুভব করল। বুটের শব্দগুলো এগিয়ে আসছে। দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকে পড়া বাতাস বয়ে আনল শীতল ঘামের তীব্র কটু গন্ধ। পারসন্সের প্রবেশ কয়েদ খানায়। পরনে খাকি শর্টস আর স্পোর্টস-শার্ট। নিজের অজান্তেই এবার চমকাল উইনস্টন।

‘তুমি এখানে!’—বলল সে।

উইনস্টনের দিকে এক নজর তাকাল পারসন্স, তাতে নেই কোনো বিস্ময়, কোনো আগ্রহও, তবে রহস্যটুকু ঝুলে আছে। উপর-নিচে ঝাঁকি মেরে মেরে হাঁটহাঁটি জুড়ে দিল, সোজা হয়ে থাকা তো তার পক্ষে অসম্ভবই। থলথলে হাঁটু তুলে প্রতিবার পা ফেলার সময় কাঁপছে। চোখ দুটো বিস্ফোরিত, স্থির চাহনি, যেন কাছে ধারের কোনো একটা কিছু চোখ পাকিয়ে দেখছে।

‘তোমাকে ঢুকিয়েছে কেন?’—বলল উইনস্টন।

‘চিন্তা অপরাধ!’—বলল পারসন্স। অনেকটা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ তার। তবে কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছিল সে মেনে নিয়েছে যে, সে অপরাধী। আর এমন একটা শব্দ তার জন্যই খাটে। উইনস্টনের ঠিক উল্টোদিকে খানিকটা থামল সে, আর বলতে শুরু করল, ‘মনে করো না ওরা আমাকে গুলি করবে, ঠিক তাই বুড়ো ভাম! তুমি কিছু না করলে, ওরা তোমাকে গুলি করবে না—মোটে তো চিন্তা করা, চিন্তার ওপর তো তোমার নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি জানি ওরা তোমার কথা শুনবে। ওদের ওপর এ ব্যাপারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস! ওরা আমার নথিপত্র ঘাটবে, তাই না? তুমি তো জানো কেমন লোক ছিলাম আমি। আমি তো খারাপ ছিলাম না। মেধাবী নই কিন্তু বুদ্ধি তো ছিল। পার্টির জন্য যা কিছু করা সম্ভব ছিল করেছি, বলো করি নি? পাঁচ বছরের মধ্যে আমি ছাড়া পেয়ে যাব, তোমার কী মনে হয়? অথবা হতে পারে দশ বছর। শ্রম-শিবিরে আমার মতো লোক বেশ কাজে লাগবে। একবার লাইনচ্যুত হওয়ার জন্য ওরা নিশ্চয়ই আমাকে গুলি করে মারবে না?’

‘তুমি কি দোষী?’—বলল উইনস্টন।

‘অবশ্যই আমি দোষী!’ টেলিস্ক্রিনের দিকে বশংবদ দৃষ্টি রেখে কাঁদো কাঁদো উচ্চারণ পারসন্সের। তুমি নিশ্চয়ই মনে করো না, পার্টি কোনো একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে আটক করবে, তাই না?’ তার ব্যাঙ-সদৃশ মুখখানি আরো শান্ত হয়ে উঠতে থাকল, আর অভিব্যক্তি স্রেফ বকধার্মিকের রূপ নিতে থাকল। ‘চিন্তাঅপরাধ একটা ভয়ঙ্কর কাজ, বুড়ো ভাম’—বলল সে। ‘এটা বিশ্বাসঘাতকতা। অজান্তেই তোমার ভেতরে এটা ঢুকে পড়তে পারে। তুমি জানো আমার ভেতরে কী করে ঢুকল এই অপরাধ চিন্তা? আমার ঘুমের মাঝে! হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আমি যেমন ছিলাম, সারাক্ষণ কাজ করে যেতাম, যতদূর পারি—কখনো কি জানতাম আমার মনের ভেতরে রয়েছে এক কু-এর বাস। এরপর আমি ঘুমের মাঝে কথা বলতে শুরু করলাম। তুমি কি জানো, ওরা আমাকে কী বলতে শুনেছে?’

কণ্ঠ নামিয়ে আনল এবার, কেউ যখন স্রেফ চিকিৎসার কারণে কিছু অশ্লীল উচ্চারণে বাধ্য হয় ঠিক তেমনই তার অভিব্যক্তি।

‘বিগ ব্রাদার নিপাত যাক!”—হ্যাঁ, ঠিক সে কথাটাই বলেছি আমি। একবার না, বারবার বলেছি। দ্যাখো বিষয়টা স্রেফ তোমার আর আমার মাঝে, বুড়ো ভাম, আরো বাড়াবাড়ি কিছু করে ফেলার আগেই ওরা আমাকে ধরে ফেলেছে, এতেই আমি খুশি। তুমি কি জানো ওরা আমাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর আগেই আমি কী বলতে যাচ্ছি? “তোমাদের ধন্যবাদ”—ঠিক এই কথাটিই আমি ওদের বলব, বলব “খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই তোমরা আমাকে রক্ষা করেছো এই জন্য ধন্যবাদ”। ’
‘কে ধরিয়ে দিল তোমাকে?’—প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘আমার ছোট মেয়ে’—বলল পারসন্স। দুঃখভরা গর্বের উচ্চারণ তার। ‘চাবিপথে আড়ি পেতে ও শুনে ফেলেছে। ও শুনতে পেয়েছে আমি কথাগুলো বলেছি, আর পরের দিনই তা টহলদারদের কাছে বলে দিয়েছে। সাত বছরের এই দুধের বাচ্চার জন্য এ এক দারুণ কাজ, কী বলো? এ জন্য ওর প্রতি আমার এতটুকু অভিযোগ নেই। আসলে ওর জন্য আমি গর্বিতই বোধ করছি। এতে বোঝা গেল, আমি ওকে সঠিকভাবেই বড় করে তুলতে পেরেছি। ’

আবারও উপর-নিচে ঝাঁকি দিতে দিতে কয়েক পা হাঁটল সে, পায়খানার প্যানটির ওপর দৃষ্টি ফেলে রেখে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করল। এরপর হুট করেই শর্টসের ফিতা খুলে নামিয়ে দিল।
‘ক্ষমা করো, বুড়ো ভাম’—বলল সে। ‘আর পারছি না ধরে রাখতে। ’
বৃহৎ পাছাখানি পায়খানার প্যানে ঝুলিয়ে দিল সে। আর উইনস্টন দুই হাতে মুখ ঢাকল।
‘স্মিথ!’—চিৎকার দিয়ে উঠল টেলিস্ক্রিন। ‘৬০৭৯ স্মিথ ডব্লিউ! মুখ খোলো। কারাকক্ষে মুখ ঢাকা চলবে না। ’

মুখ থেকে হাত সরাল উইনস্টন। পারসন্স পায়খানা সারছে অঢেল আর সশব্দে। অতঃপর দেখা গেল ফ্ল্যাশ কাজ করছে না, ফলে পরের কয়েক ঘণ্টা হাগার ভয়াবহ গন্ধে ডুবে থাকল পুরো কারাকক্ষ।

পারসন্সকেও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রহস্যজনকভাবে এমন আরো বন্দি এলো আর গেল। এক নারী বন্দিকেও আনা হয়েছিল। তাকে যখন বলা হলো ‘রুম ১০১’—উইনস্টন লক্ষ্য করল, শব্দ দুটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার মুষড়ে যাওয়া শরীর আর রঙ পাল্টে যাওয়া চেহারার অভিব্যক্তি। একটা সময় এলো, তাকে যদি এখানে সকালে আনা হয় তাহলে তখন বিকেল, আর যদি বিকেলে আনা হয়, তাহলে তখন মধ্যরাত। তখন নারী পুরুষ মিলিয়ে প্রকোষ্ঠে ছয় কয়েদী। সবাই স্থির বসে আছে। উইনস্টনের উল্টোদিকে বসে এক ব্যক্তি, চোয়ালবিহীন দাঁতাল চেহারা, যেন কাঠবিড়ালির বড় অহিংস্র রূপ। তার থলথলে, ঝুলে থাকা গালদুটো নিচের দিকে এতটাই ভারী যে ওখানে কিছু খাবার জমিয়ে রাখা হয়েছে সে কথা মনে না করাটাই কঠিন। ফ্যাকাশে ধূসর চোখদুটো ভয়ার্ত চাহনিতে একের পর অন্যের মুখের ওপর কিছুটা লটকে রেখে অন্যপক্ষ টের পাওয়ার আগেই সরিয়ে নিচ্ছিলেন।

দরজা খুলে গেল, আরেকজন কয়েদীকে ঢোকানো হলো যাকে দেখে উইনস্টনের ভেতরে একটি হিম শীতল অনুভূতি বয়ে গেল। বৈশিষ্ট্যহীন, সাধারণ চেহারার লোকটি প্রকৌশলী বা কারিগর গোছের কিছু একটা হবেন। তবে তার চেহারায় ফুটে ওঠা দুর্বলতা ছিল চমকে দেওয়ার মতো। ওটা যেন স্রেফ একটা খুলি। মুখমণ্ডল এতটাই শুকনো যে চোয়াল আর চোখদুটো মনে হচ্ছিল অপেক্ষাকৃত বড়, আর সে চোখে মেখেছিল কারো কিংবা কোনো কিছুর প্রতি তীব্র ঘৃণা।

উইনস্টনের অদূরেই বেঞ্চির ওপর বসলেন তিনি। উইনস্টন তার দিকে দ্বিতীয়বার তাকাচ্ছিল না, কিন্তু খুলির মতো দেখতে মুখখানি তার মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে থাকল যেন সেটি ঠিক তার মুখের সামনে। হঠাৎই তার মাথায় এলো ঘটনাটা আসলে কী। লোকটি মূলত ক্ষুধার কারণেই মরতে চলেছে। কারাকক্ষের বাকিদের মাঝেও যেন একই সময়ে সেই একই চিন্তা বয়ে গেল। কারণ বেঞ্চির চারিদিকে সকলের মুখেই তখন একই থমথমে ভাব। চোয়ালবিহীন লোকটিও চোখ দুটো খুলিমুখো মানুষটির ওপর কিছুক্ষণ স্থির করে রেখে অপরাধীর মতো আস্তে সরিয়ে নিলেন, এরপর এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে আবার চোখ দুটো ঘুরিয়ে নিলেন তার দিকে। এসময় বসে বসে দুলছিলেন তিনি। অবশেষে তিনি সটান উঠে দাঁড়ালেন, অস্থিরভাবে প্রকোষ্ঠের ভেতর এদিক-ওদিক করলেন, আলখেল্লার পকেটে একবার হাত ঢুকিয়ে দিলেন, আর, অতি লজ্জিত মুখে হাতে তুলে আনা এক টুকরো কালচে রুটি খুলিমুখো লোকটির সামনে ধরলেন।

তীব্র তারস্বরে ক্রোধান্বিত গর্জন বেরিয়ে এলো টেলিস্ক্রিন থেকে। চোয়ালবিহীন লোকটি লাফ মেরে নিজের আসনের সামনে। খুলিমুখো মানুষটি দ্রুতই দুটি হাত লুকিয়ে ফেললেন পিছনে, যেন গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চান, ওই উপহার তিনি নিতে চান নি।

‘বামস্টিড!’ গর্জে উঠল কণ্ঠস্বর। ‘২৭১৩ বামস্টিড জে.! রুটির টুকরোটি নিচে ফেলে দাও!’

চোয়ালহীন মানুষটি রুটির টুকরোটি মেঝেতে ফেলে দিলেন।

‘ঠিক যেখানে রয়েছো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো’—নির্দেশ কণ্ঠস্বরের। ‘দরজার দিকে মুখ করো, আর কোনো নড়াচড়া নয়। ’

ঠিক ঠিক মানলেন চোয়ালহীন লোকটি। তার বড় ঝুলে থাকা গালদুটি থরথর করে নিয়ন্ত্রণহীন কেঁপে চলেছে। ক্যাঁচ করে খুলে গেল দরজার পাল্লা। তরুণ কর্মকর্তাটি ভিতরে ঢুকেই পাশের দিকে সরে গেলে বিশাল বাহু আর কাঁধের এক ষণ্ডামার্কা নিরাপত্তারক্ষী ঢুকল। চোয়ালহীনের ঠিক সামনে ততক্ষণে দাঁড়িয়ে সে, আর তখনই, কর্মকর্তার ইশারা পেয়ে, শরীরের সব শক্তি দিয়ে চোয়ালহীন মুখটির ওপর কষে এক ঘুষি বসিয়ে দিল। ঘুষির চোটে লোকটি মেঝেতে পড়ে ছিটকে পায়খানার প্যানের সঙ্গে ধাক্কা খেলেন। হতভম্বের মতো কিছুটা সময় সেভাবেই পড়ে থাকলেন, মুখ আর নাক দিয়ে ততক্ষণে কালো ঘন রক্ত বেরিয়ে এসেছে। একটা অতি হালকা শব্দ গুমড়ে উঠল, অসচেতনতায় তা বেরিয়ে এলো লোকটির মুখ থেকে। এরপর হাত ও হাঁটুতে ভর দিয়ে অবিন্যস্তভাবে নিজেকে তুলে ওঠালেন। রক্ত আর লালা সমেত দুই পাটি দাঁত মুখ থেকে ঝরে পড়ল।

বাকি কয়েদীরা সবাই স্থির বসে আছে। প্রত্যেকের হাত হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। হামাগুড়ি দিয়ে চোয়ালহীন মানুষটি নিজের স্থানে ফিরলেন। মুখের নিচের দিকে একটি অংশে মাংস ততক্ষণে কালচে রঙ ধরেছে। ধীরে ধীরে পুরো মুখটি চেরি-রঙা একটি কদাকার রূপ নিল, যার ঠিক মাঝখানে একটি কালো গর্ত।

একটু পর পর কিছুটা রক্ত আলখেল্লার বুকের ওপর পড়ছে। তার ধূসর চোখ দুটো তখনও মুখ থেকে মুখে ফিরছে, তাতে আগের চেয়েও বেশি অপরাধের অভিব্যক্তি, যেন আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন তার এই অপদস্থতায় অন্যদের অবজ্ঞা কতখানি।

দরজা খুলে গেলো। সামান্য ইশারায় খুলিমুখো লোকটিকে নির্দেশ করলেন তরুণ কর্মকর্তা।

‘রুম ১০১’—বললেন তিনি।

উইনস্টনের দিকটায় একটা হাঁপানি আর ব্যাকুলতার শব্দ উঠল। লোকটি তার দুই হাত জোর করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।

‘কমরেড! অফিসার!’—কান্না জুড়ে দিলেন তিনি। ‘আমাকে ওখানে নেওয়ার প্রয়োজন নেই! আমি তো আগেই আপনাদের সব বলেছি। এর বাইরে আর কী জানতে চান আপনারা? স্বীকার করে নেওয়ার মতো আর তো কিছুই নেই, কিচ্ছু না! আমাকে বলুন আর কী জানতে চান? আমি সোজা সব স্বীকার করে নেব। লিখে দিন আমি সই করে দেই—যা কিছু! কিন্তু ওই ১০১ নম্বর রুমে নেবেন না!’

‘রুম ১০১’—বললেন কর্মকর্তাটি।

লোকটির চেহারা ততক্ষণে ফ্যাকাশে হয়ে এমন রঙ ধরেছে যে উইনস্টনের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে, এমনটা হতে পারে। নিশ্চিত আর নির্ভুলভাবে সে রঙটি ছিল সবুজাভ।

‘আমাকে নিয়ে যা মন চায় করুন’—চিৎকার করে উঠলেন লোকটি। ‘আপনারা আমাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে না খাইয়ে রেখেছেন। এবার ক্ষ্যামা দিন, আমাকে মরতে দিন। আমাকে গুলি করুন, ফাঁসি দিন। পঁচিশ বছরের কারাদণ্ড দিন। আর কার কথা আপনারা আমার কাছে জানতে চান? বলুন কে? আপনারা যা চান আমি তাই বলব। কাউকে নিয়ে আর আমার চিন্তা নেই, কে তা নিয়েও আমি পরোয়া করি না। আমার এক স্ত্রী আর তিন সন্তান। সবচেয়ে বড়টির এখনো ছয় বছর হয়নি। আপনারা ওদেরও নিয়ে যেতে পারেন, আমার সামনেই ওদের জিহ্বা কেটে ফেলতে পারেন, আমি স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। কিন্তু আমাকে ওই ১০১ নম্বর রুমে নেবেন না!’
‘রুম ১০১’—শীতল উচ্চারণ কর্মকর্তাটির।

ক্ষিপ্ত চাহনি দিয়ে কক্ষের অন্য কয়েদীদের বিঁধতে থাকলে লোকটি, চোখের ভাষা যেন বলছে, তার স্থানে এদের মধ্য থেকে আরেকজনকে পাঠিয়ে দিতে পারবেন কিনা সেটাই খুঁজছেন। এরপর চোখদুটি গিয়ে স্থির হলো চোয়ালহীন থেঁতলানো মুখটির ওপর। সব ক্ষোভ যেন তারই ওপর। ওর দিকে ক্ষীণকায় একটি বাহু ছুঁড়তে শুরু করলেন।

‘আমাকে নয়, তোমাদের উচিত ওঁকে নিয়ে যাওয়া!’—চিৎকার করে বললেন তিনি। ‘তোমরা শোনোনি, মুখখানি থেঁতলে দেওয়ার পর সে কী বলেছে। আমাকে বলতে দাও, ওর প্রতিটি শব্দ আমি তোমাদের বলে দেব। আসলে আমি নই, সেই হচ্ছে পার্টি বিরোধী। ’

নিরাপত্তা রক্ষীরা সামনে এগিয়ে এলো। লোকটির কণ্ঠ তীক্ষ্ণতর হলো, তোমরা শুনতে পাচ্ছো না আমার কথা! বারবার বলতে লাগলেন তিনি। ‘টেলিস্ক্রিনে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। তোমরা আসলে আমাকে নয় ওকে নিতে চাচ্ছো। ওকেই নিয়ে যাও, আমাকে নয়!’

দুই রক্ষী লোকটির দুই বাহু লক্ষ করে এগিয়ে গেল আর ধরতে উদ্যত হলো। কিন্তু ঠিক তখনই মেঝেতে শুয়ে পড়লেন তিনি আর বেঞ্চিটির একটি লোহার পায়া দুই হাতে শক্ত করে ধরে ফেললেন। এবার কোনো কথা নেই। মুখ থেকে ভেসে আসছে পশুর মতো গোঙানির শব্দ। রক্ষীরা তাকে ধরে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু বিস্ময়কর শক্তি দিয়ে তিনি আঁকড়ে ধরে আছেন লোহার পায়া। সম্ভবত বিশ সেকেন্ড রক্ষীরা তাকে টানাটানি করল। বাকি কয়েদীরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন, যার যার হাত হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ সম্মুখপানে দৃষ্টি। গোঙানি থেমেছে। ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য প্রয়োজনীয় নিঃশ্বাসটুকু ছাড়া লোকটির কাছে তখন আর অবশিষ্ট কিছুই নেই। এরপর শুরু হলো ভিন্ন রকমের কান্না। রক্ষীদের একজনের কষে মারা বুটের লাথিতে লোকটির একহাতের সবগুলো আঙুল ভেঙে গেল। এরপর তার পা ধরে ওরা দুজন তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করল।
‘রুম ১০১’—বললেন কর্মকর্তাটি।

লোকটিকে বাইরে নেওয়া হলো। মাথা হেট করে, জখম হাতটি ডলতে ডলতে অবিন্যস্ত পায়ে নিজেই এগিয়ে গেলেন, সংগ্রামের সকল শক্তিই তখন শেষ তার।

এরপরও কেটে গেল দীর্ঘ সময়। খুলিমুখো মানুষটিকে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন যদি মধ্যরাত হয়ে থাকে তাহলে এখন সকাল। আর যদি তখন সকাল হয়ে থাকে, তাহলে এখন বিকেল। উইনস্টন এখন একা। কয়েক ঘণ্টা ধরেই সে একা। সরু বেঞ্চিতে বসে থাকতে থাকতে যখন পশ্চাৎদেশে ব্যথা ধরে যায় তখন মাঝে মধ্যে সে উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করে। তাতে অবশ্য টেলিস্ক্রিনের কটুকাটব্য শুনতে হয় না। রুটির টুকরোটি চোয়ালহীন ব্যক্তি মেঝের ঠিক যেখানটায় ফেলেছিলেন সেখানেই পড়ে আছে। শুরুতে ওটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা কঠিন হলেও এখন পারছে। এখন তার ক্ষুধার চেয়ে পানির তেষ্টাটাই বেশি অনুভব হচ্ছে। মুখের ভেতরটায় কেমন চটচটে আর বিস্বাদ ঠেকছে। ঝিম ধরা শব্দটি আর একই সাদাটে আলো তার মাথার ভেতরে এক ধরনের অচেতনতা ও শূন্যতাবোধ তৈরি করেছে।

এবার একটু উঠতেই হলো কারণ হাড্ডিতে ধরে যাওয়া ব্যথা আর সহ্য করা যাচ্ছিল না; তবে পরক্ষণেই বসেও পড়তে হলো কারণ পায়ের ওপর দাঁড়িয়েও থাকতে পারছিল না। শরীরের যন্ত্রণা যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে ঠিক তখনই আতঙ্ক ফিরে এলো। কখনো কখনো আবছা আশায় বুক বেঁধে সে ও’ব্রায়েন আর রেজর ব্লেডের কথা ভাবে। ভাবছে রেজর ব্লেডটি তার কাছে আসবে খাবারের মধ্যে করে, যদি কিনা আদৌ তাকে কখনো খেতে দেওয়া হয়। আরো ক্ষীণভাবে তার ভাবনায় আসে জুলিয়া। কোথাও বা অন্যত্র সে হয়ত তার চেয়েও চরম ভোগান্তিতে সময় কাটাচ্ছে। এখনই হয়ত প্রচণ্ড ব্যথায় সে কাতরাচ্ছে, চিৎকার পাড়ছে।

‘যদি নিজের কষ্টকে দ্বিগুণ করে নিয়ে জুলিয়াকে বাঁচানোর সুযোগ পাই, তাহলে কি তা করব? হ্যাঁ, করব’—ভাবল সে।

কিন্তু সেতো স্রেফ এক বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্ত, সে নিয়েছে কারণ সে ভাবছে তার নেওয়াই উচিৎ। সে তো এটা অনুভব করতে পারছে না। এইখানে আপনি কিছুই অনুভব করতে পারবেন না, স্রেফ ব্যথা ছাড়া, আর ব্যথার ধারণা ছাড়া। এছাড়াও, এও কি সম্ভব, ঠিক যখন আপনি কষ্টে ভুগছেন তখন এমন একটি কারণও কি থাকতে পারে যার জন্য আপনি চাইবেন এই কষ্ট বেড়ে যাক? সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ারও সুযোগ এখন নেই।

বুটের ভারী শব্দ আসছে। দরজা খুলে গেল। ও’ব্রায়েন ঢুকলেন।

উইনস্টনের চোখ তার পায়ের দিকে। এই দৃশ্য দেখার পর তার সতর্কতার সকল শক্তিই উবে গেছে। অনেক অনেক বছরে এই প্রথম টেলিস্ক্রিনের উপস্থিতির কথা ভুলে গেছে সে।

‘ওরা আপনাকেও ধরে ফেলেছে!’—চিৎকার করে বলল সে।
‘ওরা আমাকে অনেক আগেই ধরে ফেলেছে’—ক্ষীণ অথচ দুঃখিত স্বরে উচ্চারণ ও’ব্রায়েনের। পা ফেলে একদিকে সরলেন তিনি। তার পেছন থেকে চওড়া বুকের এক রক্ষী লম্বা কালো লাঠি হাতে ঢুকলেন।

‘তুমিও জানো, উইনস্টন’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘নিজেকে ধোঁকা দিও না। তুমি জানতে, তুমি বরাবরই সব জানতে। ’

হ্যাঁ, এখন সে দেখছে, সে তো বরাবরই সব জানত। কিন্তু তা নিয়ে ভাবার সময় এখন নয়। এখন তার চোখ আটকে আছে রক্ষীর হাতের লাঠির ওপর। এখানে সেখানে আঘাত পড়ছে। মাথা, কানের লতিতে, বাহুতে, কনুইয়ে—
কনুই! হাঁটুর ওপর ধপ করে নিজেকে ছেড়ে দিল সে। জরাগ্রস্ত প্রায়, আঘাতপ্রাপ্ত কনুই ডলছে অন্য হাতে। সবকিছুই এক হলুদ আলোয় বিস্ফোরিত হয়ে গেল। অসহনীয়, একটি ঘুষিতেই এত অসহনীয় ব্যথা! এরপর আলো পরিষ্কার হয়ে এলো, তখন সে দেখতে পাচ্ছে অন্য দুজন তার দিকে তাকিয়ে।

রক্ষীটি তার মুষড়ে পড়া দেখে হাসছে। যেভাবেই হোক একটি প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। কখনো, পার্থিব কোনো কারণেই, আপনি আপনার ব্যথা বা কষ্ট বাড়াতে চাইবেন না। ব্যথার বিষয়ে আপনার একটিই প্রত্যাশা থাকবে তা হচ্ছে ব্যথা বন্ধ হওয়া। শারীরিক কষ্টের কিংবা ব্যথার চেয়ে খারাপ কিছু এই পৃথিবীতে আর নেই। ব্যথার সামনে কোনো বীরত্ব চলে না, থাকে না বীরের সাহস, মেঝেতে কুঁকড়ে পড়ে থেকে, অকেজো বাম বাহুটি অকারণ চেপে ধরে রেখে সেসবই ভাবতে থাকল সে।

অধ্যায় ২

পিঠ বলছে যার ওপর শুয়ে আছে সেটি ক্যাম্প খাট গোছের কিছু হবে, মেঝে থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে, আর শরীরটাকে এমনভাবে আটকে রাখা হয়েছে যাতে সে নড়তেও না পারে। সাধারণের চেয়েও একটি শক্তিশালী আলো তার মুখমণ্ডলের ওপর। পাশে ও’ব্রায়েন দাঁড়িয়ে, গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। অন্যপাশে সাদা কোট পরা একজন দাঁড়িয়ে, হাতে একটি ইনজেকশন সিরিঞ্জ।

চোখ খোলা থাকলেও আশেপাশের অবস্থাটা বুঝে উঠতে সময় লাগল। মনে হচ্ছিল কোনো এক ভিন্ন জগৎ থেকে সাঁতরে এই কক্ষে এসেছে সে, পানির তলদেশেরও অনেক গভীরের কোনো জগৎ থেকে। ওই গভীরতায় কতটা সময় তলিয়ে ছিল তার জানা নেই। গ্রেপ্তার হওয়ার পর এপর্যন্ত কোনো আঁধার সে দেখেনি, দেখেনি দিনের আলোও। তার স্মৃতিও সবকিছু ধারাবাহিক ধরে রাখতে পারছে না। কখনো কখনো চেতনা, ঘুমের মাঝেও যে চেতনাটুকু জাগরূক থাকে, মৃত্যুসম লোপ পেয়ে যায়, আবার জেগে ওঠে শূন্যতা ভরা বিরতিতে। তবে সেই বিরতি কয়েক দিনের, কয়েক সপ্তাহের নাকি কয়েকটি ক্ষণের তা বোঝার পথ নেই।

সেই যে, কনুইয়ে প্রথম আঘাত পড়ল তখন থেকেই দুঃস্বপ্নের শুরু। পরে সে অবশ্য বুঝতে পারে এই যা কিছু ঘটছে তা স্রেফ শুরু মাত্র, সব কয়েদীর ক্ষেত্রেই জিজ্ঞাসাবাদের এ এক সাধারণ প্রাথমিক প্রক্রিয়া। অপরাধের অন্ত নাই—ষড়যন্ত্র, নাশকতা আর এমন আরো অনেক—যা প্রত্যেককেই এক পর্যায়ে স্বীকার করে নিতে হবে। এই স্বীকারোক্তি স্রেফ এক আনুষ্ঠানিকতা, তবে নির্যাতন অবশ্যই এক বাস্তবতা। কতবার তাকে প্রহার করা হয়েছে, কতক্ষণ ধরে চলেছে সে প্রহার, সে মনে করতে পারে না। প্রতিবারই পাঁচ/ছয় জন কালো ষণ্ডামার্কা উর্দিধারী তাকে ঘিরে সক্রিয় হয়েছে। কখনো খালি হাতে কিল-ঘুষি, কখনো লাঠি কিংবা ইস্পাতের রড দিয়ে বেদম প্রহার, কখনো শক্ত বুটে কষে লাথি। মাঝে মাঝে সে কুঁকড়ে মেঝেতে পড়ে থেকেছে, পশুর মতো গড়াগড়ি খেয়েছে, আর শরীরকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে একেকটি লাথি আর লাঠিপেটা থেকে নিজেকে রক্ষা করার অবিরাম, নিষ্ফল চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আর তার ফল হিসেবে পেয়েছে আরো লাথি, পেট, পাঁজর, কনুই, জঙ্ঘা, কুঁচকি, অণ্ডকোষ, মেরুদণ্ডের মূল হাড়—কোনোটিই বাদ যায়নি। কখনো কখনো যখন এমনটা চলতে থাকত তখন তার কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, বাজে আর অক্ষমার্য বলে মনে হতো একটি বিষয়কে, তা হচ্ছে—রক্ষীরা তাকে পেটাচ্ছে কিন্তু এরপরেও সে অচেতন হয়ে যাচ্ছে না, কিংবা নিজেকে অচেতন করে ফেলতেও পারছে না। কখনো কখনো মস্তিষ্কানুভূতি তাকে এতটাই ছেড়ে চলে যেত যে সে ক্ষমার জন্য চিৎকার করতে থাকত। এমনকি মারধর শুরুর আগেই চিৎকার জুড়ে দিত। একেকটি ঘুষির জন্য হাত পাকানো দেখেই তার মন বাস্তব আর কল্পিত সকল অপরাধের জন্য স্বীকারোক্তি দিতে প্রস্তুত হয়ে যেত। আবার অন্যকোনো সময় সে সাব্যস্ত করে ফেলত—কিছুই স্বীকার করবে না। কষ্ট আর বেদনার্ততার মাঝ থেকেও একটি শক্তি বেরিয়ে আসত। আবার অন্যসময়, যখন কিছুটা দুর্বলচিত্ত হয়ে পড়ত, তখন নিজেই নিজেকে বলত, ‘স্বীকারোক্তি দেব, তবে এখনই নয়। এই যন্ত্রণা যতক্ষণ না পুরোপুরি অসহনীয় হয়ে পড়ে ততক্ষণ আমাকে শক্তি ধরে রাখতে হবে। আরো তিনটি লাথি, আরো দুটি লাথি বসবে, তারপর আমি সেই কথা বলব যা ওরা শুনতে চায়। ’

কখনো কখনো ওরা পেটাতে পেটাতে তার চলৎশক্তিটুকুও কেড়ে নিত, আর আলুর বস্তার মতো তাকে কোনো একটি কয়েদখানার মেঝেতে ছুড়ে ফেলে যেত, যাতে অবসাদ কাটিয়ে উঠতে পারে এরপর আবারও বের করে এনে আর আবারও পূর্ণোদ্যমে প্রহার শুরু করতে পারে। মাঝে মাঝে সময়টা একটু বেশিই পাওয়া যেত। তবে সেসময়ের কথা অতি অল্পই মনে পড়ে কারণ সে সময়টুকু ঘুমে কিংবা সংজ্ঞাহীনতায় কেটেছে তার। একটি কয়েদখানার কথা মনে পড়ে সেখানে ছিল তক্তার বিছানা, দেয়ালে ঝুলে থাকা তাকিয়া, টিনের বেসিন। খাবার হিসেবে পেত গরম স্যুপ, রুটি, কখনো কখনো কফিও মিলত। তার মনে আছে খিটমিটে মেজাজের এক নাপিত আসত দাঁড়ি কামিয়ে দিতে আর চুল কাটতে, আর কারবারিদের মতো দেখতে, অসহমর্মী সাদা কোটধারী লোকগুলো আসত কখনো নাড়ি দেখতে, তার ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়াগুলো যাচাই করতে, চোখের পাতা উল্টে, কর্কশ আঙুলগুলো দিয়ে ভাঙা হাড়গুলোর ওপর নির্মমভাবে ঘষাঘষি করে তারা দেখত আর পেশিতে সুঁই ফুটিতে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখত।

প্রহারের পৌনপৌনিকতা আর মাত্রা এক পর্যায়ে কমে আসে, কিন্তু সেটাই তখন হয়ে ওঠে আতঙ্কের আরেক নাম—এই বুঝি ফের শুরু হবে। কোনো একটি উত্তর মনঃপুত না হলেই প্রহারের ব্যবস্থা। এখন আর কালো উর্দিধারী ষণ্ডারা নয়, প্রশ্ন করছেন পার্টির বোদ্ধারা। নাদুসনুদুস চেহারার লোকগুলো দ্রুত হাত-পা নাড়িয়ে আর চশমায় ঝিলিক তুলে দীর্ঘ সময় ধরে প্রশ্নবান চালিয়ে যান। নিশ্চিত নয়, তবে তার ধারণা, একেক দফায় দশ-বারো ঘণ্টা ধরে চলে একেকটি জিজ্ঞাসাবাদ। এই প্রশ্নকারীরা তাকে নির্যাতনে জর্জরিত দেখেছেন কিন্তু তাতেও হয়ত তাদের মন যেন ভরে না। সে কারণেই তারা মুখে চাপড়ে, কান মলে, চুল টেনে, এক পায়ে খাড়া করিয়ে রেখে, প্রশ্রাবের বেগ চাপলেও আটকে রেখে, চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসা পর্যন্ত কড়া তীর্যক আলো ফেলে কষ্ট দিয়েছেন।

এসবের একটাই উদ্দেশ্য ছিল—তাকে অপদস্থ করা আর যুক্তি তর্ক চালানোর শক্তি কিংবা যৌক্তিকতার বোধ ধ্বংস করে দেওয়া। মূল অস্ত্রই ছিল নির্মম সব প্রশ্নবাণ, আর একের পর এক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই বাণ হেনে চলতেন তারা। থমকে দিয়ে, কথার ফাঁদ পেতে, বক্তব্য বিকৃত করে, পদে পদে মিথ্যাচারের দোষ দিয়ে, স্ববিরোধিতার ধুয়ো তুলে এই চেষ্টা চালিয়ে যান তারা, যতক্ষণ না স্নায়ু দৌর্বল্য কিংবা লজ্জায় ফুপিয়ে কেঁদে দিত—ততক্ষণ। কখনো একদফায় অন্তত আধা ডজনবার তাকে কাঁদতে হয়েছে। প্রতিবারই তারা চিৎকার করে ভর্ৎসনা করেছেন কিংবা উত্তর দিতে সামান্য ইতস্তত করলেই হুমকি-ধমকি দিয়েছেন, ফের নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে তুলে দেবেন এটাই ছিল হুমকি। আবার কখনো তাদের সুরটা পাল্টেও গেছে—তাকে কমরেড সম্বোধন করেছেন, ইংসক আর বিগ ব্রাদারের দোহাই দিয়ে অনুনয় বিনয় করে, দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানতে চেয়েছেন পার্টির প্রতি তার আর এতটুকু আনুগত্যও কি নেই?

যে অপরাধ সে করেছে তা আর করবে না সে প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদে স্নায়ুতে যখন জ্বালা ধরে যেত, তখন এইসব অনুনয় বিনয়েও তার কান্না পেত। এইসব আদুরে গলা তার ভেতরটা যতখানি ভাঙচুর করে দিত, নিরাপত্তারক্ষীদের বুটের লাথি আর ওজনদার ঘুষিগুলোও ততখানি কাবু করতে পারত না। ততক্ষণে সে স্রেফ একটি মুখ ছাড়া আর কিছু নয় যা শব্দ করে, একটি হাত ছাড়া কিছু নয় যা ইশারা করে। তার কাছে যেমনটি চাওয়া হয় সেই শব্দ কিংবা সেই ইশারাটি করে যাওয়াই তার কাজ। তার একটাই উদ্বেগ আর চাওয়া, তা হচ্ছে—সে বুঝতে চায় আসলে ওরা কী জানতে চায়, কোন স্বীকারোক্তিটি পেতে চায় তার কাছে। আর যখনই বুঝতে পারে তখনই, নতুন করে অপদস্থ হওয়ার আগেই দ্রুত স্বীকারোক্তি দিয়ে দেয়।

এরই মধ্যে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের হত্যা করার স্বীকারোক্তি সে দিয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহী প্যাম্ফেলেট বিলি, সরকারি তহবিল তসরুপ, সামরিক গোপন তথ্য বিক্রি আর সব ধরনের নাশকতা চালিয়েছে বলেও স্বীকার করে নিয়েছে। সে আরো স্বীকার করেছে ইস্টেশীয় সরকারের বেতনভোগী চর ছিল সেই ১৯৬৮ সাল থেকে। স্বীকার করেছে, সে ছিল এক ধর্মবিশ্বাসী, পুঁজিবাদের সমর্থক আর বিকৃত যৌনাচারী। সে স্বীকার করেছে সে ছিল তার স্ত্রীর হন্তারক, যদিও সে জানে এবং প্রশ্নকর্তারাও অবশ্যই জানবেন তার স্ত্রী এখনো জীবিত। স্বীকারোক্তিতে সে আরো জানিয়েছে, গোল্ডস্টেইনের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ, গোপন সংগঠনেরও সে একজন সক্রিয় সদস্য আর এর সবাইকেই সে চেনে। সব কিছু স্বীকার করে নেওয়া আর সবাইকে জড়িয়ে ফেলাই ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। তবে, এক অর্থে এর সবকিছুই তো সত্য। এত সত্যি যে, মনে মনে সে ছিল পার্টি বিরোধী, আর পার্টির চোখে কোনো কিছু মনে ভাবা আর কাজে করার মধ্যে কোনো ফারাক নেই।

অন্য ধরনের কিছু স্মৃতিও রয়েছে। সেগুলো যেন তার মন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলে আছে, ঠিক যেভাবে অন্ধকারে ঘিরে ঝুলে থাকে কিছু ছবি।

একটি কয়েদখানায় তাকে রাখা হয়েছিল সেখানে আলো ছিল, আবার অন্ধকারাচ্ছন্নও হয়ে থাকতে পারে, কারণ সেখানে একজোড়া চোখ ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পেত না। হাতের কাছে কিছু একটা যন্ত্র অবিরাম ধীর লয়ে টিক টিক শব্দ করে চলত। চোখ দুটো ক্রমেই বড় আর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত। হঠাৎই বিছানা ছেড়ে ভেসে উঠত তার গোটা শরীর, আস্তে আস্তে চোখ দুটির ভেতরে ঢুকে পড়ত, আর মনে হতো ওগুলো যেন তাকে গিলে খাচ্ছে।

কর্কশ আলোর নিচে ডায়াল ঘেরা একটি চেয়ারে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সাদা কোট পরা একজন সারাক্ষণ সেইসব ডায়াল থেকে রিডিং নিতেন। বাইরে ভারী বুটের টানা শব্দ। ক্যাচ-ক্যাচ শব্দ তুলে দরজা খুলে গেল। মোমমুখো অফিসার ভেতরে ঢুকলেন, পেছনে পেছনে ষণ্ডামার্কা দুই রক্ষী।
‘রুম ১০১’—বললেন অফিসারটি।
সাদা কোটধারী কিন্তু ঘুরলেন না, উইনস্টনের দিকে ফিরেও তাকালেন না, তখনও তার চোখ ডায়াল গুলোতেই স্থির।

একটি বিশাল বারান্দাপথ ধরে তাকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, এক কিলোমিটার প্রশস্ত সেই পথ জ্বলজ্বলে সোনালি আলোয় ঝলমল, চারিদিক থেকে হাসি-ঠাট্টার গর্জন ভেসে আসছে। আর ভেসে আসছে উচ্চস্বরের সব স্বীকারোক্তি। সব কিছুই স্বীকার করে নিচ্ছিল সে। এতদিনে শত নির্যাতনের পরও যা কিছু নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পেরেছিল তাও এবার গড়গড় করে বলে দিল। নিজের জীবনের গোটা ইতিহাস সে তাদের সামনেই আবার তুলে ধরছিল যা তারা আগে থেকেই জানে। তার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীরা, প্রশ্নকর্তারা, সাদা কোটধারীরা, ও’ব্রায়েন, জুলিয়া, মি. চ্যারিংটন সবাই একই করিডোরে অট্টহাস্যে চিৎকার করে করে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু কিছু বিষয় কখনো কখনো ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা হতো, কিন্তু পরে তা কী করে যেন ভুলে এড়িয়ে চলে যেত, ফলে আর কখনোই ঘটত না। এক পর্যায়ে সবকিছুই যেন ঠিকঠাক হয়ে যায়, আর কষ্ট-বেদনা নেই, তার তখন শুধুই খালি পড়ে পড়ে থাকা, জেনে যাওয়া, ক্ষমা করে দেওয়া এক জীবন।

শক্ত তক্তার বিছানায় একটু নড়ে উঠল সে, অনেকটা আধা নিশ্চয়তায় মনে হলো, ও’ব্রায়েনের কণ্ঠই শুনতে পেয়েছে। পুরো জিজ্ঞাসাবাদে সে ও’ব্রায়েনকে আর একবারও দেখেনি, তবে তার মন বলত ও’ব্রায়েন ঠিক তার কনুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে, তবে দেখা যাচ্ছে না। ও’ব্রায়েনের নির্দেশেই সবকিছু হচ্ছে। এ যেন তিনিই, যিনি উইনস্টনের জন্য রক্ষীদের নিয়োজিত করছেন, তিনিই ওদের হাতে তার মৃত্যু ঠেকিয়েছেন। এ যেন তিনিই যিনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন উইনস্টন কখন ব্যথায় কাতরাবে, কখন শ্বাস নেবে, কখন তাকে খাবার দেওয়া হবে, কখন ঘুমাবে, কখন তার বাহুতে ওষুধ ঢোকানো হবে। এ যেন তিনিই যিনি প্রশ্নগুলো করছেন আর উত্তর কী হবে তাও জানিয়ে দিচ্ছেন। তিনিই যন্ত্রণাদানকারী, তিনিই রক্ষাকারী, তিনিই অনুসন্ধানদাতা, আবার তিনিই বন্ধু। হঠাৎই—উইনস্টন মনে করতে পারে না ওষুধের প্রভাবে, ঘুমের ঘোরে, নাকি সে স্বাভাবিক ঘুমের মাঝে, নাকি পুরোপুরি সজাগ অবস্থাতেই—তার কানে বিড়বিড় করে একটি কণ্ঠ ধ্বনিত হলো: ‘ভয় নেই উইনস্টন, তুমি আমার জিম্মায় আছো। সাতটি বছর আমি তোমার ওপর নজর রেখেছি। এখন ক্রান্তিকাল এসে গেছে। আমিই তোমাকে রক্ষা করব, আমিই তোমাকে সঠিক পথে নিয়ে যাব। ’

সে নিশ্চিত না, কণ্ঠটি ও’ব্রায়েনেরই ছিল কিনা। কিন্তু এটি ছিল সেই একই কণ্ঠ যা তাকে সাত বছর আগে স্বপ্নের মাঝে বলেছিল, ‘আমাদের দেখা হবে কোনো একখানে, যেখানে কোনো অন্ধকার থাকবে না। ’

এই জিজ্ঞাসাবাদ কোথায় শেষ হয়েছিল সে মনে করতে পারে না। একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় ছিল, এরপর তাকে নেওয়া হয় আরেকটি কারা প্রকোষ্ঠ কিংবা কামরায়, যেখানটাতেই সে এখন আছে; আর ধীরে ধীরে তার চারিপাশের বাস্তবতা বুঝে উঠতে শুরু করেছে। স্রেফ চিৎ হয়েই পড়ে আছে সে, একটু নড়ার ক্ষমতা নেই। শরীরের প্রতিটি প্রয়োজনীয় অংশেই তাকে বেঁধে আটকে রাখা হয়েছে। আর মাথার পেছনটা একভাবে স্থির করে রাখা। ও’ব্রায়েন তার দিকে গভীর কিন্তু দুঃখময় চাহনিতে তাকিয়ে। নিচ থেকে তার মুখখানা দেখা যাচ্ছে, বেশ মোটা, বদখত, চোখের নিচে দাগ, নাকে, চোয়ালে ক্লান্তির ছাপ। ওর বয়স উইনস্টনের চেয়ে বেশিই, ভাবল সে, হতে পারে আটচল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ। তার হাতের নিচে একটি ডায়াল যার ওপরে একটি হাতল আর ডায়ালের ভেতরে কতগুলো সংখ্যা মুখের ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে।

‘আমি তোমাকে বলেছিলাম’—বললেন ও’ব্রায়েন, ‘ফের যদি আমাদের দেখা হয় তা হবে এখানেই। ’
‘জ্বি’—বলল উইনস্টন।

ও’ব্রায়েনের হাতটি সামান্য নড়ল আর কিছুই নয়, কিন্তু তাতেই একটি ব্যথার ধমক তার গোটা শরীরের ভেতর বয়ে গেল। ভয়াবহ সেই ব্যথা। এতটাই যে তাতে কী ঘটছে তাও সে দেখতেও পারছে না, তবে তার মনে হলো এক মরণআঘাত হানা হয়েছে তার ওপর। সে বুঝতে পারছে না কোনো কিছু আদতেই ঘটল কিনা, নাকি বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে কিছু সৃষ্টি করা হলো। তবে তার শরীরখানা নিজের কাঠামো ভেঙ্গে মুচড়ে যাচ্ছে, শরীরের জোড়াগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। যদিও ব্যথায় তার কপালে ঘাম জমেছে, তবে সবচেয়ে ভয়ের হয়ে উঠেছে যে, তার মনে হচ্ছিল মেরুদণ্ডটি খান খান হয়ে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে নাসিকা রন্ধ্র দিয়ে ভারী শ্বাস নিতে শুরু করল সে, আর নীরবে ব্যথা সহ্য করে যাওয়ার জন্য মনে প্রাণে চেষ্টা চালাতে থাকল।

‘তোমার ভয় হচ্ছে’—ঠিক মুখের দিকে চোখ রেখে বললেন ও’ব্রায়েন, ‘অল্পক্ষণেই কিছু একটা ভাঙচুর হয়ে যাবে। তোমার বিশেষ ভয় তোমার মেরুদণ্ড নিয়ে। তোমার মনের চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তোমার শিরদাঁড়া ভেঙ্গে ভেঙ্গে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, মেরুদণ্ডের মজ্জাগুলো ফোঁটায় ফোঁটায় গলে পড়ছে। এসবই তো তুমি ভাবছো, নয় কি, উইনস্টন?’

সে কোনো উত্তর করল না। ডায়ালের হাতলটি ফের টেনে পেছনে নিলেন ও’ব্রায়েন। যেমন হঠাৎ করে এসেছিল ব্যথার ধমক তেমনই হঠাৎ করেই তা থেমে গেল।

‘ওটা ছিল চল্লিশ’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘তুমি দেখতে পাচ্ছো এই ডায়ালের নম্বরের ঘর একশ’ পর্যন্ত। তুমি কি দয়া করে একটু স্মরণ করবে, আমাদের যে কথা হয়েছিল তার মধ্য থেকে, আমি বলেছিলাম, আমি তোমার ওপর ব্যথা আরোপ করতে পারি যেকোন সময়, আমার মনের মতো যেকোন মাত্রায়? তুমি যদি মিথ্যা বলো, কিংবা সত্য বলা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করো, কিংবা তোমার স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তার নিচে থাকার চেষ্টা করো, তাৎক্ষণিকভাবে তোমাকে ব্যথায় কাঁদতে হবে। বুঝতে পেরেছো?’

‘হ্যাঁ পেরেছি’—বলল উইনস্টন।

ও’ব্রায়েনের আচরণ কিছুটা কম ভয়ঙ্কর হতে শুরু করল। চিন্তিত ভঙ্গিমায় চশমা জোড়া নেড়েচেড়ে বসালেন, আর বারেক কিংবা বার দুয়েক উপর-নিচে, এদিক-ওদিক চোখ ঘোরালেন। যখন কথা বলছিলেন তার কণ্ঠস্বর ছিল নম্র ও শান্ত। মনে হচ্ছিল একজন চিকিৎসক, শিক্ষক, এমনকি ধর্মযাজকের মতো, যিনি আসলে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে শিক্ষা দিতে কিংবা বোঝাতেই বেশি করে চান।

‘তোমার জন্য আমাকে ম্যালাই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে, উইনস্টন’—বললেন তিনি, ‘কারণ তুমি ঝামেলা পাকাচ্ছো। তুমি ভালো করেই জানো, তোমার বিষয়টা ঠিক কী। অনেক বছর ধরেই তা জেনে আসছো, তুমি তোমার জ্ঞানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছো। মানসিকভাবে তুমি বিক্ষিপ্ত। তুমি স্মৃতিশক্তির বিঘ্নে ভুগছো। তুমি সঠিক ঘটনা মনে করতে সক্ষম নও অথচ নিজেকেই নিজে প্রভাবিত করো সেইসব ঘটনা স্মরণ করে যা আদৌ ঘটেনি। তোমার সৌভাগ্য যে, এই রোগ নিরাময়যোগ্য। তবে তুমি নিজে কখনোই এর উপশম করাওনি, কারণ তুমি চাওনি। একটি সামান্যতম চেষ্টাও তুমি চালাতে প্রস্তুত ছিলে না। এমনকি এখনো, আমি ভালো করেই জানি, তুমি তোমার এই রোগেই অনুরক্ত হয়ে আছো এই ভেবে যে এতেই উৎকর্ষ। আসো উদাহরণস্বরূপ একটা পরীক্ষা হয়ে যাক, বলো তো  ঠিক এখন, ওশেনিয়া কোন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত?’

‘আমাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন ওশেনিয়া ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। ’
‘ইস্টেশিয়ার সঙ্গে। বেশ। তাহলে এবার বলো ওশেনিয়ার যুদ্ধ বরাবরই ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে, নয় কি?’
লম্বা শ্বাস নিল উইনস্টন। কিছু বলবে বলে একবার মুখ খুলল কিন্তু বলল না। ডায়াল থেকে চোখও সরিয়ে নিতে পারছিল না।
‘সত্য বলো উইনস্টন। তোমার সত্যটি বলো। আমাকে তাই বলো যা কিছু তুমি ভাবছো, যা কিছু স্মরণ করতে পারছো। ’
‘আমার মনে আছে, আমি গ্রেপ্তার হওয়ার এক সপ্তাহ আগে আমরা আদৌ ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলাম না। ওদের সঙ্গে ছিল আমাদের মিত্রতা। যুদ্ধ ছিল ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে। তাও চলে আসছিল চার বছর ধরে। তার আগে—’
হাতের সামান্য ইশারায় ও’ব্রায়েন থামালেন তাকে।
‘আরেকটি উদাহরণ নেব’—বললেন তিনি। ‘বছর কয়েক আগে তোমার বড় ধরনের একটি মতিভ্রম ঘটে। তোমার বিশ্বাস ছিল, তিনটি লোক, জোন্স, অ্যারনসন, রাদারফোর্ড নামে এক সময়ের তিন পার্টি সদস্য—যারা পুরোপুরি স্বীকারোক্তি দিয়ে ষড়যন্ত্র আর নাশকতার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, তারা কোনোভাবেই ওই অপরাধে অপরাধী ছিলেন না। তোমার বিশ্বাস তুমি এমন নির্ভুল প্রমাণ দেখেছো যা নিশ্চিত করে যে ওদের স্বীকারোক্তি ছিল মিথ্যা। একটি বিশেষ ছবি ছিল যা দেখেই তোমার ওই বিভ্রম সৃষ্টি হয়। তোমার বিশ্বাস সত্যিই তুমি সেই প্রমাণ তোমার হাতে পেয়েছিলে। সেটি একটি ছবি বা তেমনই কিছু একটা ছিল।

ও’ব্রায়েনের আঙুলের ফাঁকে ততক্ষণে একটি সংবাদপত্রের ছেঁড়া অংশ। সম্ভবত উইনস্টনের দৃষ্টিসীমার মধ্যে পাঁচ সেকেন্ডের মতো সেটি ধরা ছিল। এটি একটি ছবি, আর সেটি কিসের সে নিয়ে প্রশ্নেরই কোনো অবকাশ নেই। এ তো সেই ছবিটিই। জোন্স, অ্যারনসন ও রাদারফোর্ডের নিউইয়র্কের পার্টি অনুষ্ঠানের আরেকটি কপি, যা তার হাতেও পড়েছিল আর তাৎক্ষণিকভাবে স্মৃতিগহ্বরে ফেলে ধ্বংসও করে দিয়েছিল। চোখের সামনে মাত্র একবার দেখা গেল আর দ্রুতই তা দৃষ্টি থেকে সরে গেল। কিন্তু সে এটি দেখেছে, প্রশ্নাতীতভাবেই সে ওটা দেখেছে! শরীরের উপরের অংশটা সামান্য একটু নাড়ানোর ব্যথার্ত চেষ্টাই সে করল। কিন্তু কোনো একদিকেও এক সেন্টিমিটার পর্যন্ত নড়া সম্ভব ছিল না। এইক্ষণে ডায়ালটির কথাও ভুলে গেল সে। তার মনজুড়ে তখন একটাই ইচ্ছা, ওই ছবিটিকে আরো একবার যদি আঙুলের ফাঁকে পেয়ে যায়, নয়ত অন্তত একবার সেটি দেখতে পায়।
‘ওটি এখনো আছে!’—বিস্ময়ের প্রকাশ তার মুখে।
‘না, নেই’—বললেন ও’ব্রায়েন।

এবার কামরার ওদিকটায় হেঁটে গেলেন। উল্টোদিকের দেয়াল ঘেঁষে একটি স্মৃতি গহ্বর। ও’ব্রায়েন আস্তে করে ওপরের লোহার ঢাকনাটি তুললেন। আর দেখা না গেলেও ঠিক বুঝে নেওয়া যায়, কাগজের টুকরোটি ততক্ষণে তপ্তবায়ুর স্রোতে পড়ে খাবি খাচ্ছে আর আগুনের লেলিহান শিখায় তা ছারখার হয়ে যাচ্ছে। দেয়াল থেকে মুখ ঘোরালেন ও’ব্রায়েন।
‘স্রেফ ভস্ম’—বললেন তিনি। যে ভস্ম আর চিহ্নিত করারও নয়। এর কোনো অস্তিত্ব নেই, ছিল না কোনোকালেই। ’
‘কিন্তু এর অস্তিত্ব ছিল! অস্তিত্ব আছে! স্মৃতিতেই টিকে আছে এর অস্তিত্ব। আমার ঠিক স্মরণ আছে। আপনারও স্মরণে আছে। ’
‘কই আমার তো স্মরণে নেই’—বললেন ও’ব্রায়েন।
‘উইনস্টনের হৃদয়খানি অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। ওটাই দ্বৈতচিন্তা। ভীষণরকম অসহায়বোধ হতে লাগল তার। যদি নিশ্চিত হতে পারত ও’ব্রায়েন মিথ্যা বলছেন তাহলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু এটাও সত্যিই সম্ভব, ও’ব্রায়েন ঠিকই ছবিটির কথা ভুলে গেছেন। আর তা যদি হয়, তাহলে তো এইমাত্র তিনি বিষয়টি মনে থাকার কথা যে অস্বীকার করলেন তাও ভুলে যাবেন, আর এই ভুলে যাওয়ার বিষয়টিও ভুলে যাবেন। কে কিভাবে নিশ্চিত হবে এসবই কূট-কৌশল? হতে পারে মনের এই মতিভ্রম সত্যিই ঘটে; আর এসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে তার পর্যুদস্ত মনে হচ্ছিল।

ঠিক ওর দিকেই তাকিয়ে ও’ব্রায়েন, চাহনিতে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা স্পষ্ট। পণ্ডিত মশাই ভাবটা অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন বেশি বলেই মনে হলো তার। স্কুলে বেয়াড়া কিন্তু মেধাবী শিশু ছাত্রটির প্রতি শিক্ষক যেভাবে তাকান তেমনই।

‘অতীতের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পার্টির একটা স্লোগান আছে’—বললেন তিনি। ‘দয়া করে আরেকবার বলবে। ’
‘অতীত যার নিয়ন্ত্রণে, ভবিষ্যতেরও নিয়ন্ত্রক তিনি: বর্তমান যার নিয়ন্ত্রণে, অতীতেরও নিয়ন্ত্রক তিনি’—বাধ্য ছেলের মতো আওড়ে গেল উইনস্টন।
‘বর্তমান যার নিয়ন্ত্রণে অতীতেরও নিয়ন্ত্রক তিনি’—মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন ও’ব্রায়েন। ‘এটা তোমার মত, উইনস্টন, তুমি বলতে চাও অতীতের সত্যিই অস্তিত্ব রয়েছে?’

একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ মনই কেবল বাস্তবতা দেখতে পায়, উইনস্টন। তুমি মনে করো বাস্তবতা বস্তুগত, বাহ্যিক, আর তার নিজের অধিকারে অস্তিত্ব পায়। তোমার এও বিশ্বাস বাস্তবতা স্ব-প্রমাণে ভাস্বর। যখন তুমি কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছো বলে নিজেকে কোনো ভাবনায় মগ্ন করো, তখন তুমি ধরে নাও তুমি যেমনটা দেখছো, অন্যরাও তাই দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, উইনস্টন, বাস্তবতা বাহ্যিক কিছু নয়। বাস্তবতা মানুষের মনের মাঝে থাকে, আর কোথাও নয়।

আবারও একটা অসহায়বোধ উইনস্টনকে পেয়ে বসল। তার চোখ ডায়ালে স্থির হয়ে আছে। ব্যথা থেকে পরিত্রাণ পেতে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’র কোনটা হবে উত্তর, সেটা কেবল জানে না তাই নয়, সে এও জানে না, এর মধ্যে কোন উত্তরটি সঠিক বলে সে নিজে বিশ্বাস করে।

ও’ব্রায়েনের মুখে মৃদু হাসি। ‘তুমি অধিবিদ্যায় বিদ্বান নও, উইনস্টন’—বললেন তিনি। ‘এই মুহূর্ত অবধি অস্তিত্ব বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে তুমি কখনোই ভাবোনি। আমি বিষয়টি আরো সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরছি। অতীত কি সুনির্দিষ্টভাবে টিকে থাকে, মহাকাশে? অন্য কোথাও কিংবা আর কোনোখানে, এই পদার্থের বিশ্বে, যেখানে অতীত এখনও ঘটে চলেছে?’
‘না। ’
‘তাহলে কোথায় অতীতের অস্তিত্ব, যদি আদৌ তা থেকে থাকে?’
‘নথিতে। লিখিতভাবে। ’
‘নথিতে। আর—?’
‘মনে। মানুষের স্মৃতিতে। ’
‘স্মৃতিতে। খুব ভালো, তাহলে। আমরা, এই পার্টি, সব নথিই নিয়ন্ত্রণ করি, এবং আমরা সকল স্মৃতিও নিয়ন্ত্রণ করি। তাহলে আমরা অতীতকেও নিয়ন্ত্রণ করি, নয় কী?’
‘কিন্তু কোন পথে আপনারা মানুষকে অতীত মনে করা থেকে বিরত রাখতে পারবেন?’—ডায়ালের কথা এক মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হয়ে বেশ জোর কণ্ঠেই বলল উইনস্টন। ‘এটা স্বেচ্ছাকর্ম, নিজস্বতারও বাইরে। আপনি কী করে স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করবেন? আপনি তো আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি!’

ও’ব্রায়েনের চেহারা ফের কঠোর হয়ে উঠল। হাতটি ডায়ালের ওপর রাখলেন তিনি।

‘পক্ষান্তরে’—বললেন তিনি, ‘তুমিই আসলে নিয়ন্ত্রণে আসোনি। আর ঠিক সে কারণেই আজ তোমাকে এখানে ধরে আনা হয়েছে। তুমি এখানে, কারণ তুমি বিনয়ী হতে পারোনি, তুমি নিজেকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে পারোনি। তোমার ন্যায়পরায়ণতার মূল্য যে আত্মসমর্পণে তা তুমি করোনি। বরং তুমি পাগলাটে হয়ে থাকতে চেয়েছো, সংখ্যালঘিষ্ঠ হতে চেয়েছো। একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ মনই কেবল বাস্তবতা দেখতে পায়, উইনস্টন। তুমি মনে করো বাস্তবতা বস্তুগত, বাহ্যিক, আর তার নিজের অধিকারে অস্তিত্ব পায়। তোমার এও বিশ্বাস বাস্তবতা স্ব-প্রমাণে ভাস্বর। যখন তুমি কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছো বলে নিজেকে কোনো ভাবনায় মগ্ন করো, তখন তুমি ধরে নাও তুমি যেমনটা দেখছো, অন্যরাও তাই দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, উইনস্টন, বাস্তবতা বাহ্যিক কিছু নয়। বাস্তবতা মানুষের মনের মাঝে থাকে, আর কোথাও নয়। কোনো ব্যক্তির মনে নয়, যে মন ভুল করতে পারে, কিন্তু যে কোনো পথে শিগগিরই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: একমাত্র পার্টির মনেই বাস্তবতার স্থান, যে পার্টি সমন্বিত ও অবিনশ্বর। পার্টি যাকে সত্য বলে ধরে নেবে, সেটাই সত্য। পার্টির চোখ দিয়ে না দেখলে বাস্তবতা দেখা অসম্ভব। এটা সেই সত্য যা তুমি এখন শিখতে যাচ্ছো, উইনস্টন। এর জন্য তোমার আত্মবিনাশ দরকার, ইচ্ছাশক্তি দরকার। তোমার বুদ্ধি আসবে তখনই, যখন তুমি হবে বিনম্র বিনয়ী। ’

কয়েক দণ্ড থামলেন তিনি, যেন যা বলেছেন তা একটু দমে যেতে দিলেন।

‘তোমার মনে পড়ে’—ফের শুরু করলেন, ‘তুমি ডায়রিতে লিখেছো, “স্বাধীনতা হচ্ছে দুই আর দুইয়ে চার হয়, সে কথা বলতে পারার স্বাধীনতা?’
‘জ্বী’—বলল উইনস্টন।

ও’ব্রায়েন তার বাম হাতটা তুললেন। হাতের পেছনের দিকটা উইনস্টনের দিকে। বুড়ো আঙুলটা গোটানো বাকি চারটি আঙুল সোজা হয়ে আছে।

‘এখানে আমার কয়টি আঙুল তুলেছি, উইনস্টন?’
‘চারটি। ’
‘এখন পার্টি যদি বলে এখানে চারটি নয় পাঁচটি—তাহলে কয়টি?’
‘চারটি। ’

ভয়াবহ একটি ব্যথা শুরুর মধ্য দিয়ে শব্দের উচ্চারণটি শেষ হলো তার। ডায়ালের কাঁটা তখন পঞ্চান্নর ঘরে। উইনস্টনের সারা শরীর থেকে ঘাম যেন ছিটকে বেরিয়ে এলো। বাতাস তার ফুঁসফুঁস বিদীর্ণ করে দিল আর গভীর গোঙানি শুরু হলো, দাঁতগুলো চেপে রেখেও উইনস্টন তা ঠেকাতে পারল না। ও’ব্রায়েন তাকে দেখছেন। চারটি আঙুল তখনও মেলে ধরা। হাতলটি ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। এবার ব্যথার সামান্য উপশম হলো মাত্র।

‘কয়টি আঙুল, উইনস্টন?’
‘চারটি। ’
ডায়ালে কাঁটা ষাটের ঘর ছুঁলো।
‘কয়টি আঙুল, উইনস্টন?’
‘চারটি! চারটি! আর কী বলব আমি? চারটি!’

কাঁটা আবারও বেড়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু এবার সে আর ওদিকে তাকিয়ে নয়। ভারী কঠোর মুখখানি আর চারটি আঙুল তার দৃষ্টি ঢেকে রেখেছে। তার চোখের সামনে আঙুলগুলো বড়, ভারী পিলারের মতো দাঁড়িয়ে, অস্পষ্ট কিছুটা কম্পমানও মনে হচ্ছে। কিন্তু ভ্রান্তিহীনভাবেই সেখানে চারটি আঙুল সে দেখতে পাচ্ছে।

‘কয়টি আঙুল, উইনস্টন?’
‘চারটি, বন্ধ করুন, বন্ধ করুন এসব। যেভাবেই যা কিছুই আপনি করুন না কেনো ওখানে চারটিই আঙুল। চারটি!’
‘কয়টি আঙুল, উইনস্টন?’
‘পাঁচটি! পাঁচটি! পাঁচটি!’
‘না, উইনস্টন, ওই বলে ফায়দা নেই। তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি এখনো ভাবছো ওখানে চারটি। দয়া করে আবার বলবে, কয়টি আঙুল?’
‘চারটি! পাঁচটি! চারটি! আপনার যেটা মনে হয়। আপনি শুধু ওটা বন্ধ করুন, ব্যথা থামান!’

এপর্যায়ে সে বসে আছে। কাঁধ দুটি জড়িয়ে ও’ব্রায়েনের একটি বাহু। কয়েকদণ্ডের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল বুঝি। শরীরের যেসব জায়গায় বেঁধে রাখা ছিল সেগুলো এখন ঢিলা। খুব শীত লাগছে। থরথর করে কাঁপছে, কোনোভাবেই থামিয়ে রাখা যাচ্ছে না। দাঁতগুলোও ঠকঠক করছে। চোখের পানি নেমে এসেছে দুই গাল বেয়ে। হঠাৎ একটু সময়ের জন্য ছোট্ট শিশুর মতো ও’ব্রায়েনকে জড়িয়ে ধরল সে। ওর ভারী হাতদুটি দুই কাঁধ জড়িয়ে থাকায় আরাম পেয়েই বুঝি এমনটা করল। আর মন বলছে, ও’ব্রায়েনই তার রক্ষাকর্তা, যে ব্যথা তাকে দেওয়া হচ্ছে ওটা বাইরের চাপ, অন্যের প্ররোচনা। আর ও’ব্রায়েনই সেই ব্যক্তি যিনি তাকে এসব কিছু থেকে বাঁচাবেন।

‘তুমি ভীষণ ধীর শিখিয়ে, উইনস্টন’—শান্তস্বরে বললেন ও’ব্রায়েন।
‘কিন্তু আমি কী করতে পারি?’ আদুরে গলা তার। ‘চোখের সামনে যা দেখছি তাই তো বলব? দুই আর দুইয়ে চারই হয়। ’
‘কখনো কখনো, উইনস্টন, কখনো কখনো তাতে পাঁচ হয়। কখনো তাতে তিন হয়। আবার কখনো ওগুলো সব মিলে এক হয়ে যায়। তোমাকে আরো কঠোর চেষ্টা করতে হবে। পুরোপুরি পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠা সহজ কাজ নয়। ’

উইনস্টনকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন তিনি। তার শরীরের বিভিন্ন অংশ আবার শক্ত হয়ে বাঁধা পড়ল। তবে ব্যথা উবে গেছে, আর কাঁপুনিও থেমেছে। এখন তার কেবল একটু দুর্বল লাগছে আর শীত শীত করছে। ও’ব্রায়েন মাথাটি সাদা কোটধারীর দিকে ঘোরালেন, পুরো সময়টি জুড়েই যিনি স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা কোটধারী এবার ঝুঁকে পড়লেন আর উইনস্টনের চোখের দিকে তাকালেন, তার নাড়ি পরীক্ষা করলেন, একটি কান বুকের ওপর চেপে ধরে থাকলেন কিছুটা সময় আর শরীরের এখানে সেখানে টিপে টিপে দেখলেন আর ও’ব্রায়েনের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে ইঙ্গিত করলেন।

‘আবার’—বললেন ও’ব্রায়েন।

তার শরীর জুড়ে ব্যথার ধমক বয়ে গেল। এবার ডায়ালের কাঁটা সত্তর কিংবা পঁচাত্তর ছুঁয়েছে নিশ্চয়ই। এবার সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে জানে আঙুলগুলো তখনও সেখানে ধরে রাখা, আর চারটিই আঙুল। যতক্ষণ এই খিঁচুনি চলবে ততক্ষণ বেঁচে থাকতে পারার চিন্তাটাই এখন তার কাছে মুখ্য। চিৎকার করে উঠছে কি উঠছে না সে নিয়ে ভাবনা এবার সে ছেড়ে দিয়েছে। ফের ব্যথা কমে এলো। সে চোখ খুলল। ও’ব্রায়েন হাতলটি পেছনে ঘুরিয়ে দিলেন।

‘কয়টি আঙুল, উইনস্টন?’
‘চারটি। আমার ধারণা চারটি। তবে আমি চাই পাঁচটি দেখতে। পাঁচটি দেখতে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ’
‘তুমি আসলে কোনটা চাইছো, আমাকে প্রভাবিত করতে, যেন আমি ভাবি তুমি পাঁচটি দেখছো, নাকি আসলেই তুমি পাঁচটি দেখতে চাইছো।
‘সত্যিই পাঁচটি দেখতে চাই। ’
‘আবার’—বললেন ও’ব্রায়েন।

হতে পারে কাঁটা এবার আশির ঘরে—নব্বুইও হতে পারে। উইনস্টন তৎক্ষণাৎ ভুলে গেল কেন এই ব্যথার ব্যবস্থা। তার বুঁজে থাকা চোখের পাতার পেছনে এক দঙ্গল আঙুল যেন নাচানাচি করছে, দোল খাচ্ছে, একটি পেছনে অন্যটি এই লুকোচ্ছে, এই বেরিয়ে আসছে। সে ওগুলো গোনার চেষ্টায় রত, কিন্তু সে মনে করতে পারছে না কেন এই গণনা। সে শুধুই জানে এই গণনার চেষ্টা বৃথা, আর তা হয়ত হতে পারে, চার আর পাঁচের রহস্যময় পরিচিতির কারণেই। ফের উবে গেল ব্যথা। যখন সে চোখ খুলল, তখনও তার একই জিনিস দেখার কথা। অসংখ্য আঙুল, ঘুর্ণায়মান গাছেদের মতো তখনও হেলছে দুলছে, এবার এদিক থেকে ওদিকে আরবার ওদিক থেকে এদিকে যাচ্ছে। ফের চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।

‘কয়টি আঙুল আমি তুলে ধরেছি, উইনস্টন?’
‘আমি জানি না। আমি জানি না। আপনি যদি আবারও একই কাজ করতে চান তো আমাকে মেরে ফেলেন। চার, পাঁচ, ছয়—সত্যি বলছি, সততার সাথে বলছি আমি জানি না। ’
‘কিছুটা ভালো’—বললেন ও’ব্রায়েন।

উইনস্টনের বাহুতে একটি সূঁচ ঢোকানো হলো। ঠিক তখনই একটি সুখময়, প্রশান্তির উষ্ণতা শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে গিয়ে সবকিছুর উপশম করে দিল। ব্যথার কথা ততক্ষণে আধাটা ভুলেই গেছে সে। চোখ খুলল আর কৃতজ্ঞতার চাহনিতে তাকাল ও’ব্রায়েনের দিকে। ভারী, দাগভর্তি, কদাকার আর বুদ্ধিদীপ্ত মুখখানি দেখে তার হৃদয় যেন গলে গেল। সে যদি নড়তে পারত একটি হাত ও’ব্রায়েনের বাহুতে রাখত। এই মুহূর্তে যতটা লাগছে, এতটা ভালো ও’ব্রায়েনকে আর কখনোই লাগেনি তার, কারণ তিনিই তার ব্যথা থামিয়েছেন। পুরনো ভাবনাটি, ও’ব্রায়েন আসলে বন্ধু, নাকি শত্রু, ফের এসে ভর করল তার মনে। ও’ব্রায়েন এমন একজন যার সঙ্গে কথা বলা চলে। কেউ কারো কাছে যতটা ভালোবাসা চায় তার চেয়ে হয়ত বেশিই চায় তাকে বুঝতে পারুক। ও’ব্রায়েন তার ওপর পাগলের মতো নির্যাতন চালিয়েছেন। কিছু সময়ের জন্য সে নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিল, তিনি ওকে মেরে ফেলতে চান। এতে কিছুই যেয়ে আসে না। অন্য কিছু রয়েছে যা তাকে বলে দেয় তাদের মধ্যে বন্ধুতার চেয়ের গভীর কিছু রয়েছে, তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ: কোথাও বা অন্য কোনোখানে, যদিও সঠিক শব্দগুলো কখনোই হয়ত বলা হবে না, একটি স্থান মিলে যাবে যেখানে তাদের দেখা হবে, কথা হবে। একটি অভিব্যক্তি দিয়ে ও’ব্রায়েন তার দিকে তাকিয়ে, যা বলে দেয়, ঠিক একই ভাবনা তারও মন জুড়ে। যখন কথা বললেন তখন তা সহজ, কথোকথনের ভঙ্গিমায় কাজে বাজল।

‘তুমি কি জানো তুমি এখন কোথায়, উইনস্টন?’—বললেন তিনি।
‘জানি না। তবে ধারণা করছি ভালোবাসা মন্ত্রণালয়েই হবে। ’
‘তুমি কি জানো কতদিন ধরে তুমি এখানে?’
‘জানি না। কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস—আমার ধারণা কয়েক মাসই হবে। ’
‘তুমি কি বুঝতে পারো কেন আমরা মানুষদের এখানে আনি?’
‘স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য। ’
‘নাহ! ওটা কারণ নয়। ফের চেষ্টা করো। ’
‘তাদের শাস্তি দিতে। ’
‘নাহ!’—বিস্ময়ের উচ্চারণ ও’ব্রায়েনের। তার কণ্ঠ অস্বাভাবিকভাবে বদলে গেল। আর তার চেহারাটি হঠাৎই একইসঙ্গে কঠোর আর চঞ্চল হয়ে উঠল। ‘না হে, কেবলই তোমার স্বীকারোক্তি নিতে নয়, তোমাকে সাজাও দিতে নয়। বলব, কেন আমরা তোমাকে এখানে এনেছি? তোমার নিরাময়ের জন্য! তোমাকে পরিশুদ্ধ করে তোলার জন্য! বুঝেছো হে, উইনস্টন, এখানে আমরা যাকেই নিয়ে আসি তার রোগের নিরাময় না করিয়ে ছাড়ি না। ওইসব ফালতু যে অপরাধ তুমি করেছো তাতে থোড়াই পাত্তা আমরা দেই। কারো বাড়াবাড়িতেও পার্টির নেই সামান্য আগ্রহ, আমাদের কাজের স্থান একটাই তোমার চিন্তা। আমরা আমাদের শত্রুদেরও ধ্বংস করি না, আমরা তাদের পাল্টাই। বুঝেছো আমি কী বলতে চাইছি?

উইনস্টনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে পড়েছিলেন তিনি। এতটাই কাছে যে তার মুখটি বিশাল বলে মনে হচ্ছিল, আর আরো কদাকার, কারণ নিচ থেকে সে ওটি দেখছিল। উপরন্তু তাতে মেখেছিল এক ধরনের পরমানন্দ আর পাগলাটেপনা। এতে উইনস্টনের হৃদয়খানি সংকুচিত হলো। হতে পারে এই বিছানাতেই সে গলে যাবে। অনেকটা নিশ্চিত করেই যেন বুঝতে পারছে ও’ব্রায়েন স্রেফ খেয়ালিপনায় আবার টেনে দেবেন ডায়ালের কাঁটা। তবে সেটা না করে ঠিক তখনই ও’ব্রায়েন পেছনে ঘুরলেন। এক-দুই পা আসা যাওয়া করলেন। আর অতঃপর কিছুটা কম উগ্রতায় ফের বলতে শুরু করলেন:

‘প্রথমেই তোমাকে বুঝতে হবে এটা এমন এক জায়গা যেখানে শাহাদৎ লাভের কোনো সুযোগ নেই। অতীতের ধর্মীয় নিপীড়নের কথা তুমি পড়েছো। মধ্যযুগের বিচারসভার কথাও জানো। ওসব কিছুরই কোনো মানে এখানে নেই। ওদের কাজ ছিল উৎপথগামিতার অবসান, আর কেবল অবসানই নয়, পুরোপুরি বিস্মৃত করে ছাড়া। প্রতিটি উৎপথগামিতায় তখন মৃত্যুআজ্ঞাপ্রাপ্তকে বেঁধে রাখা খুঁটিসমেত পুড়িয়ে দেওয়া হতো, আর তাতে অবদমিত হতো আরো হাজারো উৎপথগামী। কেন জানো? কারণ শত্রুদের প্রকাশ্যেই হত্যা করা হতো, আর তাদের এমন সময় হত্যা করা হতো যখনও তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অননুতপ্ত। সেই অননুতপ্ততাই হতো তাদের মৃত্যুর কারণ। মানুষগুলোও মৃত্যুকে বরণ করে নিত কারণ তারা তাদের সত্যিকারের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকত। আর স্বাভাবিকভাবেই যত যশ তাও ওই ভুক্তভোগীর পক্ষেই যেত আর ঘৃণা বা লজ্জাই জুটত বিচারকর্তার কপালে যারা তাকে পুড়িয়ে মারত। এরপর, বিংশ শতকে, এলো সমগ্রতাবাদীরা। হ্যাঁ ওই নামেই তাদের ডাকা হতো। জার্মানির নাৎসি আর রাশিয়ার সাম্যবাদীরাও ছিল। রুশরা উৎপথগামীদের বিচার করত ধর্মযাজকদের চেয়েও নিষ্ঠুরতায়। তারা মনে করত, অতীত থেকেই তাদের শিক্ষা, তারা জানত, যেভাবেই হোক কারো শহীদান লাভের সুযোগ দেওয়া হবে না। প্রকাশ্য বিচারে তারা যখন কোনো অপরাধীর সাজা দিত, তখন ইচ্ছা করেই তাদের মর্যাদার শেষ তলানিটুকুও খর্ব করে ছাড়ত। নির্যাতনে নির্যাতনে ওদের জর্জরিত করে দিত, যতক্ষণ না পর্যন্ত মাটিতে শুয়ে পড়ে, যা কিছু স্বীকার করে নিতে বলা হতো তাই ওদের মুখে ফুটত, নিপীড়নে, আঘাতে, অপদস্থতায় ওরা একজন অন্যজনের পেছনে লুকোত আর বিড়বিড় উচ্চারণে কেবল ক্ষমা চেয়েই চলত। এর কয়েক বছর পর একই ঘটনা আবারও ঘটত। তখন মৃত ব্যক্তিটি পেত শহীদের মর্যাদা, তাদের অপকৃষ্টতার কথাও সবাই ভুলে যেত। এরপর আবারও, কেন এমন হতো? প্রথমত কারণ তারা যে স্বীকারোক্তি দিয়েছিল তা ছিল ভয় দেখিয়ে আদায় করা আর নিঃসন্দেহেই অসত্য। আমরা এ ধরনের কোনো ভুল করি না। এখানে যে স্বীকারোক্তি উচ্চারিত হয় তার সবই সত্য। আমারাই তাকে সত্যে পরিণত করি। আর এমনকি মৃতদেরও আমরা আমাদের বিরুদ্ধে জাগ্রত হওয়ার সুযোগ দেই না। উত্তরপুরুষ তোমার জন্য ন্যায্যতা এনে দেবে সে অলীক কল্পনা তোমায় বন্ধ করতেই হবে, উইনস্টন। উত্তরপুরুষরা তোমার কথা জানতেই পাবে না। ইতিহাসের স্রোত থেকে তোমাকে পুরোপুরি তুলে নেওয়া হবে। আমরা তোমাকে গ্যাসে পরিণত করব আর আন্তর-আকাশে মিলিয়ে দেব। তোমার কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, রেজিস্ট্রারে থাকবে না, জীবন্ত কোনো মস্তিষ্কেই থাকবে না কোনো স্মৃতি। অতীতে এবং ভবিষ্যতে দুইয়েই তুমি বিলীন হয়ে যাবে। তুমি কখনোই বিরাজিত ছিলে না, নেই, থাকবে না। ’

তাহলে কেন আমাকে এত নির্যাতন? এক লহমার তিক্ততায় ভরা ভাবনা উইনস্টনের। ও’ব্রায়েন থমকালেন, যেন উইনস্টনের ভাবনার কথাটি সশব্দে বেজেছে তার কানে। তার বৃহৎ কদাকার মুখটি, কিছুটা সংকুচিত চাহনি নিয়ে ক্রমেই কাছে আসতে লাগল।

‘তুমি ভাবছো, আমরা যদি তোমাকে ধ্বংসই করে দেই, তাহলে তুমি যা বলছো বা করছো তাতে কিছুই যেয়ে আসে না। আর তাই যদি হয়, কেনই আমরা তোমার ওপর এত কষ্টের জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছি? সেটাই তো তো তুমি ভাবছো, নয় কি?’

‘জ্বী’—বলল উইনস্টন।

ইষৎ হাসলেন উইনস্টন। ‘তুমি একটা ঝামেলার মানুষ, উইনস্টন। তুমি একটা কলঙ্ক যা মুছে ফেলতেই হবে। একটু আগেই তোমাকে বললাম না, অতীতের যন্ত্রণাদাতাদের মতো নই আমরা? নেতিবাচক আনুগত্যে আমাদের আস্থা নেই, এমনকি সর্বান্তকরণ সমর্পণের পরেও নয়। সবশেষে তুমি যখন আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে তখন তোমাকে নিজের ইচ্ছাতেই করতে হবে। আমরা উৎপথগামীকে ধ্বংস করে দেই না, কারণ সে আমাদের প্রতিহত করে। যতদিন সে প্রতিহত করতে থাকে ততদিন আমরা তাকে ধ্বংস করি না। আমরা তাকে পাল্টে দেই। তার ভেতরের মনটাকে কব্জা করি, তাকে নতুন একটা গড়ন দেই; ভেতরের সকল দুষ্টু চিন্তাকে পুড়িয়ে দেই, আর ভেতর থেকে সকল ভ্রম বের করে আনি; আমরা তাকে পুরোপুরি আমাদের পক্ষে নিয়ে আসি, দেখানোয় নয়, বাস্তবে, মনে আর প্রাণে। আমরা তাকে আমাদেরই একজন করে ফেলি কারণ আমরা তাকে হত্যা করি। বিশ্বের কোথাও একটি ভ্রান্ত ভাবনা টিকে থাকুক তা আমাদের কাছে সহনীয় নয়, হোক সে গোপনে কিংবা অক্ষমতায়—যে কোনোভাবে। একই মৃতের ক্ষেত্রেও আমরা কোনো ব্যত্যয় মেনে নেই না। আগের উৎপথগামীরা মৃত্যু দুয়ারের দিকে এগিয়ে যেত একজন উৎপথগামী হিসেবেই, নিজেদের অবস্থান ঘোষণা দিতে দিতে, উল্লসিত ভঙ্গিমায়। রুশ শুদ্ধিকরণ অভিযানের যারা শিকার তারাও মাথায় বুলেটবিদ্ধ হওয়ার জন্য পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময়ও মস্তিষ্কে বিদ্রোহের আগুনই বহন করত। কিন্তু আমরা মস্তিষ্কটি উড়িয়ে দেওয়ার আগে সেটিকে শুদ্ধ করেই ছাড়ি। অতীতের অসীম ক্ষমতাধারীদের নির্দেশ ছিল “তুমি করবে না” সমগ্রতাবাদীদের নির্দেশ ছিল “তুমি করবে”। আমাদের নির্দেশ হচ্ছে, “তুমি রপ্ত করবে”। এই পর্যন্ত এইখানে আমরা যাদেরই এনেছি তাদের কেউই  আমাদের বিরুদ্ধে থাকে নি। প্রত্যেককেই ধুয়ে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। এমনই সেই তিন হতভাগা ষড়যন্ত্রী, যাদের তুমি নির্দোষ বলেই একদা ভাবতে—জোন্স, অ্যারনসন, আর রাদারফোর্ড—তারাও শেষমেষ এখানে মাথাকুটে পড়েছিল। ওদের জিজ্ঞাসাবাদে আমি নিজেই অংশ নেই। আমি ওদের ধীরে ধীরে ভাঙতে দেখেছি, গুমড়াতে দেখেছি, আত্মমর্যাদা ভুলে দয়াভিক্ষা চাইতে দেখেছি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছি—শেষে আর ব্যথা কিংবা ভয়ে নয়, স্রেফ ধৈর্যশীলতায় তারা ওসব চালিয়ে গেছে। আর ওদের সঙ্গে আমাদের কাজ যখন শেষ হলো তখন ওরা মানুষের কাঠামো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাদের মধ্যে দুঃখবোধ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। আর সেই দুঃখবোধ ছিল তাদের কৃতকর্মের জন্য আর বিগ ব্রাদারের প্রতি ভালোবাসার জন্য। ওরা তাকে যতটা ভালোবেসেছিল তা ছিল মর্মগ্রাহী। তখন তাদের একটাই প্রার্থনা ছিল, তাদের মন পরিষ্কার থাকতে থাকতে, ফের কলুসিত হওয়ার আগেই যেন তাদের গুলি করা হয়।

এক্ষণে তার কথাগুলো অনেকটা স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। পরমানন্দ, পাগলাটে একটা উদ্দীপক ভাব লেগেই আছে তার চোখেমুখে। তার কথায় কোনো ছল চাতুরি নেই, ভাবল উইনস্টন, তিনি ভণ্ড নন, যা কিছু বলছেন তার প্রতিটি শব্দেই তিনি বিশ্বাস করেন। এখন যা কিছু তাকে অবদমিত করে রাখছে তা হচ্ছে তার নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক অধস্তনতা বোধ। বিশাল ভারী মার্জিত মানুষটি তখনও একবার এদিক, একবার ওদিক করে চলেছেন। একবার তার দৃষ্টিসীমা থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন, আবার ঢুকছেন। সব দিক থেকেই ও’ব্রায়েন তার চেয়ে বড়। অনেক আগেই যা কিছু জেনে, পরীক্ষা করে, বুঝে ও’ব্রায়েন বাতিল করেছেন তা সে কখনো করতে পেরেছে কিংবা পারবে বলেও তার ধারণা হয় না। তার মন ধারণ করে আছে উইনস্টনের মন। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে কী করেই সত্য হয় যে, ও’ব্রায়েন পাগল? আসলে পাগল হচ্ছে সে নিজে, উইনস্টন। ও’ব্রায়েন থামলেন আর নিচে তার দিকে তাকালেন। তার কণ্ঠ আবারও কঠোর হয়ে উঠল।

‘ভেবো না, তুমি নিজে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে, উইনস্টন, বরং নিজেকে আমাদের কাছে পুরোপুরি সমর্পণ করো। ছাইদানীতে যারা নিজেদের নিয়ে গেছে তারা কেউ ছাড় পায়নি। আর আমরা যদি তোমাকে তোমার প্রাকৃতিক জীবনের বাইরের জীবনটিও যাপন করতে দেই, তুমি পার পাবে না। এই এখানে তোমার ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটছে তা ঘটেই চলবে। বিষয়টা আগেভাগেই বুঝে নাও। আমরা তোমাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে ধুলিস্মাৎ করে দেব যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ নেই। তোমার ক্ষেত্রে এমন সব কিছু ঘটবে যা থেকে তোমার পরিত্রাণের আর কোনো উপায় থাকবে না, তা যদি তুমি হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকো, তাহলেও না। সাধারণ মানুষের অনুভব ফিরে পাওয়ার যোগ্যতাই তোমার থাকবে না। তোমার ভেতরের সবটাই হবে মৃত। তুমি আর কোনোদিনই ভালোবাসতে পারবে না, বন্ধুত্ব করতে পারবে না, জীবনের আনন্দ খুঁজে পাবে না, হাসি-ঠাট্টা, কৌতূহল, সাহস, মর্যাদা কোনোটারই কোনো বোধ তোমার মাঝে জাগ্রত থাকবে না। তুমি হয়ে যাবে স্রেফ ফাঁকা। আমরা তোমাকে শূন্যতায় সংকুচিত করে দেব, এরপর তোমার ভেতরটা আমাদের দিয়ে ভরে দেব।

থামলেন এবং সাদা কোটধারীর দিকে ইঙ্গিত করলেন। উইনস্টন বুঝতে পারছিল তার মাথার পেছন দিকটাতে ভীষণ ভারী কিছু একটা বস্তু ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ও’ব্রায়েন বিছানার পাশে বসে পড়েছেন ফলে তার মুখখানি এখন ঠিক উইনস্টনের মুখের সামনে।

‘তিন হাজার’—উইনস্টনের মাথার উপর দিয়ে সাদা কোটধারীর উদ্দেশ্যে উচ্চারণ তার।

ইষৎ আর্দ্র দুটি নরম প্যাড উইনস্টনের কপালের দুই দিক থেকে নেমে এসে চেপে ধরল। ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে। ব্যথা আসছে, নতুন ধরনের এক ব্যথা। ও’ব্রায়েন তার গায়ের ওপর একটি হাত রাখলেন, নিশ্চয়তার হাত, অনেকটাই দয়াশীলতার সে হাত।

‘এবার তুমি ব্যথা পাবে না’—বললেন তিনি। ‘চোখ দুটো আমার চোখে রাখো। ’

এইক্ষণে তার মনে হলো ঘটে গেছে প্রলয়ঙ্কারী এক বিস্ফোরণ, বিস্ফোরণই, তবে নেই কোনো শব্দ। নিঃসন্দেহে চারিদিকে চোখ অন্ধ করে দেওয়ার মতো আলোর ঝলকানি। উইনস্টন আহত নয় তবে ধরাশায়ী। যদিও আগে থেকেই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, তারপরেও তার মনে হলো বিস্ফোরণের ধাক্কায়ই এমন চিৎপাৎ অবস্থা তার। একটি ব্যথাহীন ভয়াবহ ঘুষিতে সে পুরোই কুপোকাত। এছাড়াও তার মাথার ভেতরেও ঘটে গেছে কিছু একটা। চোখ যখন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল তখন বুঝতে পারল কে সে, আর কোথায় সে, চিনে ফেলল তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা মুখটিও। কিন্তু কোথাও বা অন্য কোনোখানে একটি বড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, যেন হতে পারে তার মস্তিষ্কের ভেতর থেকে একটি অংশ খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

‘এটাই শেষ নয়’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমার চোখের দিকে তাকাও। ওশেনিয়ার যুদ্ধ এখন কোন দেশের সঙ্গে?’

উইনস্টন ভাবল। তার মনে আছে ওশেনিয়া বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। সে নিজে ওশেনিয়ার একজন নাগরিক। ইউরেশিয়া ও ইস্টেশিয়ার কথাও তার মনে পড়ল। কিন্তু যুদ্ধ কার সঙ্গে চলছে তা তার জানা নেই। আসলে এখন সে আর জানেই না, যুদ্ধ বলে কিছু একটা আদৌ চলছে।

‘আমার মনে নেই। ’

‘ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে ইস্টেশিয়ার সঙ্গে। তোমার কি সে কথা এখন মনে পড়ে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘বরাবরই ওশেনিয়ার যুদ্ধ ছিল ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে। তোমার জীবনের শুরু থেকে, পার্টির জন্মের শুরু থেকে, সেই ইতিহাসের শুরু থেকে যুদ্ধ চলছে অবিরাম, বরাবরই একই যুদ্ধ। তোমার কি তা মনে পড়ে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘এগার বছর আগে তুমি তিন ব্যক্তিকে নিয়ে এক কাহিনী বানিয়েছিলে যাদের ষড়যন্ত্রের দায়ে ঘৃণ্য-মৃত্যু হয়েছে। তোমার মনে হচ্ছিল তুমি একটি কাগজের টুকরো দেখেছিলে যা প্রমাণ করে ওরা ছিল নির্দোষ। কিন্তু এমন কাগজের কোনো টুকরোর অস্তিত্ব কখনোই ছিল না। ওটা ছিল স্রেফ তোমার মনগড়া, আর পরে সেটাই তোমার বিশ্বাসে পরিণত হয়। তোমার কি এখন মনে পড়ে ঠিক কখন ওই কাগজের টুকরোটি আবিষ্কার করেছিলে। তোমার মনে আছে?

এখন আমি তোমার সামনে আমার হাতের আঙুলগুলো তুলে ধরব। তুমি পাঁচটি আঙুল দেখতে পাবে। মনে থাকবে?’
‘জ্বী। ’
ও’ব্রায়েন তার বাম হাতের আঙুলগুলো তুলে ধরলেন, বুড়ো আঙুলটি গুটিয়ে রাখা।
‘এখানে পাঁচটি আঙুল। তুমি কি পাঁচটি দেখতে পাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ। ’

সে তাই দেখছিল, মনের দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়ার আগে এক লহমার জন্য হলেও সে কিন্তু তাই দেখেছে। পাঁচটি আঙুল দেখতে পেয়েছে, আর তাতে নেই সামান্য ভুলও। এরপর অবশ্য সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। হতভম্বতা কাটিয়ে আবার সব ফিরে আসে। কিন্তু একটি মুহূর্ত ছিল—সে জানে না কতক্ষণ স্থায়ী ছিল সেই ক্ষণ, ত্রিশ সেকেন্ড হতে পারে—জাজ্জ্বল্য নিশ্চয়তায় সে বুঝতে পেরেছে ও’ব্রায়েন তখন যা বলেছেন তার সবটাই তার মস্তিষ্কের ফাঁকা অংশটুকুতে জায়গা করে নিচ্ছিল, আর হয়ে উঠছিল সম্পূর্ণ সত্য, আর তখন দুই আর দুইয়ে তিনও হতে পারত আর প্রয়োজন হলে অতি সহজেই হতে পারত পাঁচ। ও’ব্রায়েন তার হাতটি নামিয়ে আনার আগেই সেসব কিছু উবে যায়; তবে ওই অবস্থায় ফিরে যেতে না পারলেও, পুরোটাই মনে করতে পারে সে, কোনো ব্যক্তির জীবনের জাজ্জ্বল্যময় কোনো স্মৃতি মন থেকে যেমন কখনোই সরে না, ঠিক তেমনই।

‘দেখলে তো’—বললেন ও’ব্রায়েন, ‘যেভাবেই হোক এটা সম্ভব। ’
‘জ্বী’—বলল উইনস্টন।

চোখেমুখে সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি মেখে উঠে দাঁড়ালেন ও’ব্রায়েন। তার বাম দিকে সাদা কোটধারী লোকটিকে এবার একটি অ্যাম্পল ভেঙে সিরিঞ্জ দিয়ে ওষুধ ঢোকাতে দেখছে উইনস্টন। মুখে হাসি মেখে তার দিকে ফিরলেন ও’ব্রায়েন। অনেকটা আগের মতোই নাকের ডগায় চশমাটিকে ঠিকঠাক বসিয়ে নিলেন।

‘তোমার ডায়রি লেখার কথা মনে আছে’—বললেন তিনি, ‘লিখেছিলে আমি শত্রু নাকি মিত্র তাতে কিছু যায় আসে না। যেহেতু অন্ততপক্ষে আমি এমন একজন যিনি তোমাকে বুঝি আর আমার সঙ্গেই তোমার কথা বলা চলে। তোমার মনের ওই কথাগুলো আমার কাছে একটা আবেদন তৈরি করেছে। এতে আমার নিজের মনেও তৈরি করেছে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া, তবে তোমার শুদ্ধবাদিতাটুকু বাদ দিয়ে। আমাদের এই জিজ্ঞাসাবাদের ইতি টানার আগে তুমি চাইলে আমাকে কিছু প্রশ্ন অবশ্যই করতে পারো। ’
‘যা মন চায় সেই প্রশ্নই?’
‘যেকোন কিছু। ’—উইনস্টনের চোখ ডায়ালের ওপর স্থির হয়ে আছে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘ওটি বন্ধ আছে। তো বলো তোমার প্রথম প্রশ্নটি কী?’
‘জুলিয়াকে আপনারা কী করেছেন?’—বলল উইনস্টন।

ফের হাসলেন ও’ব্রায়েন। ‘ও তোমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, উইনস্টন। তখনই—সামান্য ইতস্ততাটুকুও ছাড়া। এত দ্রুত আমাদের কাছে এসেছে, এমনটা আমরা কদাচই দেখেছি। ওকে দেখে তুমি আর চিনতেই পারবে না। তার সব বিদ্রোহ, তার ঘৃণা, বোকামি, নোংরা মননশীলতা—সবকিছু তার থেকে উবে গেছে, ভেতর থেকে পুড়িয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। একদম খাঁটি পাল্টে যাওয়া বলতে যা বোঝায়। পাঠ্যবইয়েই তুমি কেবল এমনটা দেখতে পাবে। ’
‘আপনারা ওকে নির্যাতন করেছেন?’
জবাব দিলেন না ও’ব্রায়েন। ‘পরের প্রশ্ন করো’—বললেন তিনি।
‘বিগ ব্রাদার বলে কি কেউ আছেন?’
‘অবশ্যই আছেন। তিনি আছেন, পার্টি আছে। বিগ ব্রাদার হচ্ছেন পার্টির মূর্ত প্রকাশ। ’
‘তার অস্তিত্ব কি ঠিক তেমনই যেমনটা আমার অস্তিত্ব?’
‘তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই’—বললেন ও’ব্রায়েন।

অসহায়ত্বের বোধ ফের তাকে নিমজ্জিত করল। সে জানে, কিংবা সে কল্পনা করতে পারে, এইসব বিতর্কই তার অনস্তিত্বের প্রমাণ; কিন্তু ওরা বড়ই নির্বোধ, ওরা কেবলই বাক্যবাণে খেলে। ‘তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই’ বলে এই যে উক্তি তাতে কি কোনো যৌক্তিক অযৌক্তিকতা নেই? কিন্তু এই বলায় কীই হয়? যে সদুত্তরহীন ক্ষ্যাপাটে যুক্তি দেখিয়ে ও’ব্রায়েন তাকে ধ্বংস করে দিতে চাইলেন সে নিয়ে ভাবতে গিয়ে তার মন শুকিয়ে এলো।

‘আমি মনে করি আমি আছি’—নিজে নিজেই বলল সে। ‘আমার নিজের পরিচয় নিয়ে আমি সচেতন। আমার জন্ম হয়েছে আর আমি মারা যাব। আমার হাত আছে, পা আছে। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আমি এতটুকু হলেও স্থান দখল করে আছি-থাকি। আমি যখন আছি তখন আর কোনো ঘন বস্তু সেখানটাতে একসঙ্গে দখল নিতে পারে না। আর সেই বিবেচনায়, আদৌ কী বিগ ব্রাদারের অস্তিত্ব আছে?’
‘এসব কথা গুরুত্বহীন, তিনি আছেন এটাই যথেষ্ট। ’
‘বিগ ব্রাদারের কি কখনো মৃত্যু হবে?’
‘অবশ্যই না। তার মৃত্যু কী করে সম্ভব? পরের প্রশ্ন। ’
‘ব্রাদারহুডের কি অস্তিত্ব আছে?’
‘এটা, উইনস্টন, তুমি কখনোই জানতে পারবে না। আমরা তোমার সঙ্গে সব প্রয়োজনীয়তা শেষ করে যদি তোমাকে ছেড়েও দিই, আর যদি তুমি নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচেও থাকো, তাহলেও তুমি কখনো এই প্রশ্নের হ্যাঁ কিংবা না, কোনো উত্তরই খুঁজে পাবে না। যতদিন তুমি বেঁচে থাকবে এই ধাঁধা প্রহেলিকার মতো তোমার মন জুড়ে থাকবে। সমাধান পাবে না। ’

চুপ করে পড়ে থাকল উইনস্টন। তার বুকটা একবার ফেঁপে উঠে একটু দ্রুতই আবার পড়ে গেল। প্রথম যে প্রশ্নটি তার মনে এসেছিল সেটি এখনো সে জিজ্ঞাসা করেনি। সে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার জিহ্বা থেকে তা এখনো উচ্চারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ও’ব্রায়েনের চোখেমুখে এক ধরনের আনন্দের ক্ষীণ রেখা সে দেখতে পাচ্ছে। এমনকি তার চশমার কাচেও লেগে আছে এক ধরনের শ্লেষাত্মক দীপ্তি। উনি জানেন, ভাবল উইনস্টন, উনিই জানেন আমি কী জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম! আর সে কথা যখন ভাবছিল তখনই তার মুখ থেকে বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এলো:
‘রুম নম্বর একশ একে কী আছে?’
ও’ব্রায়েনের মুখের ভঙিমা পাল্টাল না। শুষ্ক কণ্ঠে তার উত্তর:
‘তুমি জানো ১০১ নম্বর রুমে কী আছে, উইনস্টন। প্রত্যেকেই জানে ১০১ নম্বর রুমে কী হয়। ’

সাদা কোটধারীর উদ্দেশ্যে তর্জনি তুললেন তিনি। এই দফা জিজ্ঞাসাবাদের স্পষ্টত এখানেই সমাপ্তি। উইনস্টনের বাহুতে ঝাকি দিল একটি সুঁই। আর অনেকটা তৎক্ষণাৎই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

(অসমাপ্ত)

1 Comment
Collapse Comments

pls complete the book, it`s really interesting book.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *