তৃতীয় খণ্ড
অধ্যায় ১
সে জানে না সে কোথায়। ধারণা করছে ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই তার অবস্থান, কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার কোনো পথ নেই। মাথার ওপর উঁচু সিলিংয়ের জানালাবিহীন একটি কুঠুরি। সাদা সিরামিকের ঝকঝকে দেয়াল। কোথাও গোপন স্থানে বসানো বাতি থেকে একটি ঠাণ্ডা আলো এসে কক্ষটাকে ভরে রাখে সারাক্ষণ, আর টানা একটা ঝিম ধরা শব্দ কানে আসে। হতে পারে বায়ু আসার পথেই উৎপত্তি এই শব্দের। দেয়ালের চৌদিকটা ঘুরিয়ে পেতে রাখা একটি বেঞ্চ, কিংবা তাকিয়াও বলা চলে। পশ্চাৎদেশ পেতে দেয়ালে পিঠ দিয়ে সটান বসার জন্য যথেষ্টই চওড়া। প্রবেশপথ আর তার ঠিক উল্টোদিকে পায়খানার দরজার কাছে বেঞ্চিটি কাটা পড়েছে। পায়খানার প্যানে নেই কাঠের আসন। প্রতিটি দেয়ালে চারটি করে টেলিস্ক্রিন।
হালকা একটা পেটব্যথা চলছেই। সেই যখন ওরা তাকে বেঁধে বদ্ধ একটি ভ্যানে চড়িয়ে রওয়ানা দিল তখন থেকেই ব্যথাটা শুরু। তবে ক্ষুধাও পেয়েছে তার, যন্ত্রণাদায়ক ফালতু রকমের ক্ষুধা। শেষ খেয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা হয়ে গেছে হয়ত, নয়ত হতে পারে ছত্রিশ ঘণ্টাও। এখনও সে জানে না, হয়ত কখনোই জানতেও পারবে না, তার গ্রেফতার ঠিক কখন হয়েছিল সকালে, নাকি সন্ধ্যায়। তবে এটা জানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তার পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি।
সরু বেঞ্চটিতে যতটুকু বসা যায় ততটুকুই বসে আছে, হাত দুটো হাঁটুর ওপরে ক্রস করে ফেলে রাখা। চুপচাপ অনড় বসে থাকা এরই মধ্যে সে শিখে গেছে। কোনো রকম অপ্রত্যাশিত নড়াচড়া হলেই টেলিস্ক্রিনে ওদের তারস্বর ভেসে আসে। কিন্তু ক্ষুধার ব্যাকুলতা ক্রমেই তাকে পেয়ে বসছে। এখন তার আর কিছুরই নয়, স্রেফ এক টুকরো রুটির অপেক্ষা। তার ধারণা আলখেল্লার পকেটে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া রুটি কিছুটা রয়েছে। হতেও পারে—কারণ পায়ের ত্বকে কিছু একটা অনভূতও হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা রয়েছে পকেটে। ভাবতে ভাবতে ভয়কেও কিছুটা অতিক্রম করেছে সে, আর আলগোছে পকেটে হাতটি ঢুকিয়ে দিয়েছে মাত্র—
‘স্মিথ!’ টেলিস্ক্রিন থেকে ভেসে এলো তীব্র আওয়াজ। ‘৬০৭৯ স্মিথ ডব্লিউ! কারা প্রকোষ্ঠে হাত পকেটে নয়!’
ফের অনড় বসে রইল সে, হাত দুটো হাঁটুর ওপরে আড়াআড়ি হয়ে পড়ে আছে। এখানে আনার আগে তাকে আরেকটি স্থানে নেওয়া হয়েছিল, হতে পারে সেটি সাধারণ কারাগার অথবা টহলদারদের অস্থায়ী লক-আপ। জানে না সেখানে কতক্ষণ ছিল; তবে ঘণ্টা কয়েক তো হবেই; সেখানে কোনো ঘড়ি ছিল না, ছিল না দিনের আলোও, ফলে সময় হিসাব করা কঠিন। ভীষণ শোরগোলে, পুঁতি-গন্ধময় স্থান ছিল সেটি। ওই প্রকোষ্ঠটির আকার এইটির মতোই ছিল তবে ওটি ছিল নোংরা আর আরো দশ পনেরো জনে ঠাসা। ওদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ অপরাধী, তবে গুটিকয় রাজনৈতিক বন্দিও ছিল। দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে থেকে নিশ্চুপ হয়ে ছিল তারা সবাই, নোংরা শরীরের গন্ধ নাকে লাগছিল কিন্তু পেটের ব্যথা আর ভয়ের চোটে নিজেই এত বেশি কুঁকড়ে ছিল যে ওগুলোয় ধ্যান দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে দলের কারাবন্দি ও সাধারণ বন্দিদের মধ্যে যে ফারাকটি থাকে তা খুব করে লক্ষ্য করেছে সে। দলের বন্দিরা ভয়ে কুঁকড়ে নিশ্চুপ হয়ে থাকে, কিন্তু সাধারণ অপরাধীরা কেউ কাউরে কিছুতেই পাত্তা দেয় না। ওরা নিরাপত্তা কর্মীদের সঙ্গেও খিস্তিখেউর করে, নিজেরটা ঠিক মতো না পেলে ভয়ঙ্কর হামলা চালায়, গোপনে পাচার করে আনা খাবার খায়, নিজেদের কাপড়ের মধ্যেই কেমন করে কোনো রহস্যময় লুকোনো স্থানে করে বয়ে আনে সেই খাবার, আর টেলিস্ক্রিনে কোনো নির্দেশনা, হুমকি ধমকি এলে পাল্টা চিৎকার শোরগোল বাজিয়ে দেয়। এছাড়াও এদের কারো কারো নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে বেশ খাতির। ওরা তাদের ডাকনামে ডাকে, কারো কারো হাতে দরজার গুপ্তফুঁকো দিয়ে এসে পড়ে দু’চারটি সিগারেটও। নিরাপত্তা রক্ষীরাও এই সাধারণ কয়েদীদের বেশ ধৈর্যের সাথে সামলায়, এমনকি যখন তাদের ওপর চড়াও হতে হয় তখনও। বহুল আলোচিত জবরদস্তিমূলক শ্রম ক্যাম্পও রয়েছে যেখানে অধিকাংশ কয়েদীকেই যেতে হয় অবধারিতভাবে। সে জেনেছে, এসব ক্যাম্পে সবই সই, কোনো ভাবনা নেই যতক্ষণ আপনার কিছু ভালো যোগাযোগ আছে, হাতে পেয়ে যাচ্ছেন ধরার মতো রশি। এখানে ঘুষ চলে, চলে পক্ষপাতিত্ব, আছে সব ফন্দি-ফিকির, সমকামিতা, পতিতাবৃত্তিও; আলু দিয়ে এখানে তৈরি হয় চোলাই মদ। আস্থার সবটুকুই এই সাধারণ অপরাধীদের ওপর ন্যস্ত, বিশেষ করে যারা গ্যাংস্টার, খুনি, যারা তৈরি করেছে এক ধরনের আভিজাত্য। আর এই সকল নোংরা কাজই ঘটে চলে রাজনীতির নামে।
যত রকমফের রয়েছে তার সব ধরনের অপরাধীদের আনাগোনা এখানে। মাদক ব্যবসায়ী, চোর, জোচ্চর, দস্যু, চোরা-কারবারি, মাতাল, মদ্যপ, বারবনিতা সব। কোনো কোনো মদ্যপ আবার এতটাই সহিংস ও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে তাদের দমাতে অন্য কয়েদীরা একজোট হয়।
ষাটের কাছাকাছি বয়স হবে এমন এক বিশালদেহী, থলথলে স্তন, আর মাথা ভর্তি সাদা চুলের জটওয়ালা এক নারীকে অনেকটা চ্যাংদোলা করে, লাথি-গুঁতো দিতে দিতে আর খিস্তি-খেউর করতে করতে প্রকোষ্ঠে ঢোকাল চার কারারক্ষী। বুটসহ দুই পা দুজন মুচড়ে ধরে আছে, তারই মাঝে নারীটি ওদের লাথি দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবেই ঠিক উইনস্টনের কোলের ওপর ঝপ করে তাকে ফেলল কারারক্ষীরা। প্রচণ্ড চাপে তার রানের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার দশা। নারীটি নিজেকে সোজা করে তুললেন আর চিৎকার করে বললেন, ‘ফা… বাস্টার্ডস!’ তখনই খেয়াল করলেন অস্বাভাবিক কিছুর ওপর বসে আছেন, আর দ্রুতই উইনস্টনের হাঁটুর ওপর থেকে হড়কে গিয়ে বেঞ্চিতে বসলেন।
‘মাফ করো, প্রিয়’—বললেন তিনি। ‘আমি তোমার ওপর বসে পড়িনি, ওই জারজগুলো আমাকে তোমার ওপর ফেলেছে। একটা মেয়ে মানুষের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা ওরা জানে না, তুমিই বলো, জানে নাকি?’ একটু থামলেন, বুকের ওপর হালকা চাপড় দিতে দিতে, বড় একটা ঢেঁকুড় তুললেন। ‘মাফ করো, সত্যি বলছি আমি নিজে কিন্তু বসিনি’—ফের বললেন নারীটি।
এরপর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে মেঝেতে হড়হড় করে বমি করে দিলেন।
‘ভালোই হলো’—চোখ বন্ধ করে পেছনে হেলান দিতে দিতে বললেন তিনি। ‘জিনিসটা পেটে পড়লে আর নিচে থাকতে চায় না, ঠিক বের হয়ে আসে। ’
আরেকটু ধাতস্ত হলে ফের উইনস্টনের দিকে তাকালেন আর তার প্রতি যেন একটু আগ্রহীই হয়ে উঠলেন। বিপুল দুটি বাহু তার কাঁধের ওপর ফেলে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন তাকে, মুখের ওপর এসে লাগছে বিয়ার আর বমির গন্ধের ধাক্কা।
‘তোমার নাম কী, বলো তো’—বললেন তিনি।
‘স্মিথ’—বলল উইনস্টন।
‘স্মিথ?’ বিস্ময় নারীটির কণ্ঠে। ‘মজার তো। আমার নামও স্মিথ। কেন’—একটু আবেগমাখা উচ্চারণ তার, ‘তাহলে হতে পারে আমি তোমার মা!’
এই নারী হতেই পারেন তার মা, ভাবল উইনস্টন। বয়স আর শরীরের গঠনে মিলে যায়, আর জবরদস্তি শ্রমের ক্যাম্পে বিশ বছর কাটালে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন তো আসবেই।
আর কেউ অবশ্য তার সঙ্গে কথা বলেনি। বিস্ময়করভাবেই সাধারণ অপরাধীরা দলের কয়েদীদের অবজ্ঞার চোখে দেখে। ‘দ্য পলিটস’ এই নামেই ওরা তাদের ডাকে, যেন তাদের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই। পার্টির কয়েদীরা কারো সঙ্গে কথা বলতে স্রেফ আতঙ্কিত বোধ করে, আর নিজেদের মধ্যে একে অপরের সঙ্গেও নয়। কেবল একবারই, পার্টির দুই নারী সদস্য ঠেলাঠেলিতে কিছুক্ষণের জন্য পাশাপাশি হয়ে পড়েছিল, তখন সে এই শোরগোলের মধ্যেও শুনতে পেল কিছু শব্দ অতি দ্রুততায় চালাচালি হয়ে গেল। তাদের যা বলতে শোনা গেল তা ছিল অনেকটা এরকম ‘রুম ওয়ান-ওহ-ওয়ান’—যা বস্তুত তার বোধগম্য হলো না।
হতে পারে, ঘণ্টা দুই কিংবা তিনেক আগে ওরা তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। পেটের ব্যথাটি এক লহমার জন্যও বন্ধ হয়নি, তবে ক্ষণে ক্ষণে কিছুটা কম অনুভূত হয়েছে আবার মাঝে মাঝে চাগাড় দিয়ে উঠছে, তার সঙ্গে মিল রেখে ভাবনার গাড়িও কখনো স্তিমিত কখনো জোর বেগে চলছে। যখন ব্যথাটি বাড়ে তখন ব্যথা আর খাবারের প্রত্যাশা ছাড়া অন্য কিছুই আর ভাবনায় থাকে না। আর যখন ব্যথাটি ধরে আসে তখন মন জুড়ে জেঁকে বসে আতঙ্ক। কোনো কোনো মুহূর্তে তার ভাবনায় ভর করে যা কিছু ঘটতে যাচ্ছে তার কপালে সে সবের কল্পনা। আর এতে তার হৃদযন্ত্রটি লাফাতে থাকে আর শ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। অনুভবে আসে কনুইয়ে লাঠির আঘাত, লোহার পাত বসানো জুতোয় জঙ্ঘাস্থিতে কষে বসানো লাথি, নিজেকে সে দেখতে থাকে মেঝের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে আর ভেঙ্গে ফেলা দাঁতের ফাঁকা দিয়ে করে যাচ্ছে ক্ষমার চিৎকার। জুলিয়ার কথা তার মনেই আসে না। এলেও ওর ওপর মনকে স্থির করতে পারে না। জুলিয়াকে সে ভালোবাসে আর তার সঙ্গে প্রতারণা করবে না, কিন্তু সে তো সত্য মাত্র, সেটা সে জানে ঠিক যেমনটি জানে অঙ্কের নিয়ম।
কিন্তু এখন এই মুহূর্তে তার প্রতি কোনো ভালোবাসা সে অনুভব করছে না, এমনকি তার কী হয়েছে সে নিয়ে কৌতূহলও হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে ও’ব্রায়েনকেও মনে পড়ে, সূক্ষ্ম একটা আশা জাগানিয়া সে ভাবনা। ও’ব্রায়েন জানলেও জানতে পারেন সে এখন ধৃত। তিনি তো বলেইছিলেন, ব্রাদারহুড কখনোই তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে না। তবে একটি রেজর ব্লেডের কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন ওরা যদি পারে একটি রেজর ব্লেড তোমাকে পৌঁছে দেবে। আর নিরাপত্তারক্ষীরা ছুটে কারা প্রকোষ্ঠে পৌঁছানোর আগে পাঁচ সেকেন্ড সময়ও পাওয়া যাবে। এই ব্লেড তাকে জ্বলন্ত এক শীতল কামড় বসাবে, যে আঙুলে সেটি ধরা থাকবে সেটি কেটে যাবে হাড্ডি অবধি। কল্পনায় সবকিছুই যেন ফিরে এসেছে তার অসুস্থ শরীরে, সামান্য ব্যথা বেড়ে এখন কম্পমান অসহনীয় রূপ নিয়েছে। রেজর ব্লেড হাতে পেলেও তার ব্যবহার করবে কি না তা মোটেই নিশ্চিত নয় সে। নির্ঘাত নির্যাতন জেনেও আরও দশটি মিনিটের জীবন প্রত্যাশিত। একটি মুহূর্ত থেকে আরেক মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
কুঠুরীতে কতগুলো ইট তা গুনে দেখে কখনো কখনো। গুনে ফেলাটা কঠিন কিছু কাজ নয়, কিন্তু প্রতিবারই কোনো না কোনো পর্যায়ে খেই হারিয়ে ফেলে। বারবার কৌতূহল জাগে, কোথায় সে, কয়টা বাজে এসব জানার। একটা সময় তার নিশ্চিত করেই মনে হয় বাইরে এখন রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিবালোক, আবার একটু পরে একই নিশ্চয়তায় তার মনে হয় বাইরে ঘুঁটঘুটে আঁধারের রজনী। এইখানে, গভীর উপলব্ধিতে সে বুঝতে পারে, আলো কখনোই নেভে না। এ এক স্থান যেখানে কোনো আঁধার নেই: এখন সে বুঝল কেন ও’ব্রায়েন সেদিনের সেই পরোক্ষ কথার মানে ঠিক ধরে ফেলেছিলেন। ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ে কোনো জানালা নেই। তার প্রকোষ্ঠটি হতে পারে ভবনের ঠিক মাঝখানটিতে, অথবা পাশের কোনো দেয়াল ঘেঁষাও, হতে পারে মাটির নিচে আরো দশতলা গভীরে, কিংবা মাটি থেকে আরো ত্রিশ তলা উপরে। মনে মনে সে বিচরণ করতে লাগল ভবনের এখান থেকে সেখানে, আর শরীর ও মনানুভূতি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল কোথায় সে, অতি উচ্চে বায়ুতে নাকি অতি গভীর তলদেশে।
বাইরে থেকে অনেক বুটের ঝম-ঝম আওয়াজ আসছে। বিকট শব্দ তুলে খুলে গেল ইস্পাতের দরজা। তরুণ এক অফিসার, কালো উর্দিতে টান টান শরীর, ঝকঝকে চামড়ার পোশাকে আরো চকচকে, কঠোর, নির্জীব চেহারাটি স্রেফ মোমের মুখোশ, দরজাপথে দৃঢ় পা ফেলে ভিতরে ঢুকলেন। সঙ্গে আনা অপর বন্দিকে প্রকোষ্ঠে ঢোকাতে নিরাপত্তারক্ষীদের নির্দেশ দিলেন। ধাক্কাতে ধাক্কাতে ভেতরে ঢোকানো হলো কবি অ্যাম্পলফোর্থকে। আর তখনই বিকট শব্দ তুলে ফের বন্ধ হলো দরজা।
অ্যাম্পলফোর্থ প্রথমেই কুঠুরীর দেয়াল ঘেঁষে কয়েকবার এপাশ থেকে ওপাশে অনিশ্চিত নড়াচড়া করল যেন মনে করেছে এই কক্ষে বাইরে যাওয়ার আরেকটি দরজা ঠিকই আছে, আর অতঃপর কুঠুরীর উপর থেকে নিচটা কয়েকবার দেখে নিল। তখনো উইনস্টনের উপস্থিতি তার নজরে আসে নি। তার পর্যুদস্ত চাহনি তখনও উইনস্টনের মাথারও এক মিটার উপর থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে। পায়ে জুতো নেই, বড় বড় নোংরা দুটি বুড়ো আঙুল মোজা ছিঁড়ে বাইরে বের হয়ে আছে। তারও বেশ কিছুদিন দাঁড়ি কামানো হয়নি। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভরে আছে মুখ-চোয়াল। সব মিলিয়ে চেহারাটি হিংস্র রাফিয়ানোদের মতো মনে হচ্ছে, তবে দুর্বল বপু আর ভয়ার্ত নড়াচড়ার সঙ্গে যা একেবারেই বেমানান।
জড়িমা ভেঙ্গে নিজেকে কিছুটা টেনে তুলল উইনস্টন। অ্যাম্পলফোর্থের সঙ্গে তার কথা বলা উচিত, জানা আছে টেলিস্ক্রিন ঝাঁঝিয়ে উঠবে, তারপরেও। এমনও তো হতে পারে সে-ই মূলত রেজর ব্লেডের বাহক।
‘অ্যাম্পলফোর্থ,— বলল সে।
টেলিস্ক্রিন কোনো রা করল না। অ্যাম্পলফোর্থ থমকাল, কিছুটা চমকালোও। আর ধীরে ধীরে নজর ফেলল উইনস্টনের ওপর।
‘অ্যাহ, স্মিথ!’ বলল সে। ‘তুমিও’
‘তুমি কেন এখানে?’
‘তোমাকে সত্যি কথাটি জানাতে’—বলতে বলতে উইনস্টনের উল্টোদিকে বেঞ্চিতে বসে পড়ল সে। ‘অপরাধ তো ওই একটাই, নাকি?’
‘তাহলে তুমি কি সে অপরাধ করেই ফেলেছো?’
‘মনে হয় করে ফেলেছি। ’
একটি হাত কপালে রেখে একপাশে চাপ দিতে লাগল, যেন কোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করছে।
‘এভাবেই ঘটনাগুলো ঘটে’—ভাসাভাসা শুরু তার। ‘একটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে, হ্যাঁ সম্ভবত একটিই ঘটনা। নিঃসন্দেহে সেটা ছিল অসাবধানতাবশত। আমরা কিপলিংয়ের কবিতার একটি নির্দিষ্ট সংস্করণ তৈরির কাজ করছিলাম। তারই একটি পংক্তির শেষে ‘গড’ শব্দটিকে রেখে দিয়েছিলাম। আসলে উপায় ছিল না!’—উইনস্টনের পানে মুখ তুলে তাকিয়ে অনেকটা ক্রোধের উচ্চারণ তার। ‘লাইনটি পাল্টানো অসম্ভবই ছিল। ছন্দের অপর শব্দটি ছিল “রড”। তুমি জানো গোটা ভাষায় এই “রড”-এর সঙ্গে মিল হয় মাত্র বারোটি শব্দের। কয়েক দিন ধরে এ নিয়ে মাথা খাটিয়ে আর একটি শব্দকেও মেলানোর মতো পাইনি। ’
ওর মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল। একটা বিরক্তির ভাব মুখের ওপর দিয়ে বয়ে গেল ঠিকই, তবে এক দণ্ডের জন্য তাকে সন্তুষ্টও মনে হলো। নোংরা উশকোখুশকো চুলের মাঝেও এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক উষ্ণতা, পাণ্ডিত্যের আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছিল।
‘তোমার কি কখনো মনে হয়েছে, বলো’—বলল সে, ‘ইংরেজি পদ্যের ইতিহাসে কি এই সত্যের মুখোমুখি কেউ হয়েছে কভু যে, এই ভাষায় অন্ত্যমিল শব্দের অভাব রয়েছে?’
নাহ, উইনস্টনের ক্ষেত্রে এমনটা কখনোই ঘটেনি। তবে এই এখন বিষয়টি তার কাছে খুব একটা গুরুত্বের কিংবা আগ্রহেরও মনে হচ্ছে না।
‘তুমি কি জানো দিনের কোন সময়টা এটা?’—প্রসঙ্গ পাল্টে প্রশ্ন তার।
ফের চমকাতে দেখা গেল অ্যাম্পলফোর্থকে। ‘এ নিয়ে ভাবিনি। ওরা আমাকে বন্দি করেছে দিন দুয়েক আগে, দিন তিনেকও হতে পারে। ’ দেয়ালের চারিদিকে ঘুরছে তার চোখ, যেন এখনো তার মাঝে আধা প্রত্যাশা জাগ্রত যে, এই দেয়ালের কোথাও মিলে যাবে একটি জানালা। ‘এইখানে রাত আর দিনে কোনো ফারাক নেই। কেউ সময় হিসাব করতে পারবে এমন কোনো পথ এখানে দেখছি না। ’
বাইরে থেকে অনেক বুটের ঝম-ঝম আওয়াজ আসছে। বিকট শব্দ তুলে খু
তাদের এমন অসংলগ্ন কথাবার্তা চলল মিনিট কয়েক, অতঃপর, আচমকা টেলিস্ক্রিন চিৎকার পাড়লো, আর সাথে সাথে দুজনই চুপ মেরে গেল। নিশ্চুপ বসে উইনস্টন, হাতদুটো আগের মতোই হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। সরু বেঞ্চটি বিশাল বপুর অ্যাম্পলফোর্থের জন্য আরামদায়ক হওয়ার কথা নয়, একটি হাঁটু ঘিরে দুই হাতের আঙুল কেচকি মেরে একবার এদিক আরবার ওদিক তাকাচ্ছে সে। ফের ঘেউ করে উঠল টেলিস্ক্রিন, অ্যাম্পলফোর্থকে সটান হয়ে থাকার নির্দেশ। সময় বয়ে যাচ্ছে। বিশ মিনিট কিংবা এক ঘণ্টা—হিসাব কষা কঠিন। আরো একবার বাইরে থেকে বুটের শব্দ এলো। উইনস্টনের অন্ত্র বার্তা দিল, খুব শিগগিরই, হতে পারে পাঁচ মিনিটে, হতে পারে এখনই এই যে বুটের ভারী শব্দ, যার মানেই হলো তার নিজের পালা এসে গেছে।
দরজা খুলে গেল। শীতল হলুদমুখো কর্মকর্তা প্রকোষ্ঠে পা ফেললেন। হাতের সামান্য ইশারায় তিনি অ্যাম্পলফোর্থকেই ইঙ্গিত করলেন।
‘রুম ১০১’—বললেন তিনি।
অনভ্যস্ত ভঙ্গিমায় নিরাপত্তারক্ষীদের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেল অ্যাম্পলফোর্থ, তার চেহারায় একটা অস্পষ্ট উদ্বেগ আছে তবে ভয়ের দেখা নেই।
মনে হচ্ছিল দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে। পেটের ব্যথা ফিরে এসেছে উইনস্টনের। একই কৌশলকে ঘিরে তার মনটাও ঘুরপাক খাচ্ছে; ঠিক যেমন করে একই গর্তের ভেতরে পড়ে একটি বল একইভাবে ঘুরপাক খায়। তার চিন্তা জগতকে ঘিরে রয়েছে মোটে ছয়টি বিষয়। পেটের পীড়া; এক টুকরো রুটি; রক্ত আর চিৎকার; ও’ব্রায়েন; জুলিয়া; আর একটি রেজর ব্লেড। আবারও অন্ত্রে খিঁচুনি অনুভব করল। বুটের শব্দগুলো এগিয়ে আসছে। দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকে পড়া বাতাস বয়ে আনল শীতল ঘামের তীব্র কটু গন্ধ। পারসন্সের প্রবেশ কয়েদ খানায়। পরনে খাকি শর্টস আর স্পোর্টস-শার্ট। নিজের অজান্তেই এবার চমকাল উইনস্টন।
‘তুমি এখানে!’—বলল সে।
উইনস্টনের দিকে এক নজর তাকাল পারসন্স, তাতে নেই কোনো বিস্ময়, কোনো আগ্রহও, তবে রহস্যটুকু ঝুলে আছে। উপর-নিচে ঝাঁকি মেরে মেরে হাঁটহাঁটি জুড়ে দিল, সোজা হয়ে থাকা তো তার পক্ষে অসম্ভবই। থলথলে হাঁটু তুলে প্রতিবার পা ফেলার সময় কাঁপছে। চোখ দুটো বিস্ফোরিত, স্থির চাহনি, যেন কাছে ধারের কোনো একটা কিছু চোখ পাকিয়ে দেখছে।
‘তোমাকে ঢুকিয়েছে কেন?’—বলল উইনস্টন।
‘চিন্তা অপরাধ!’—বলল পারসন্স। অনেকটা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ তার। তবে কণ্ঠস্বরই বলে দিচ্ছিল সে মেনে নিয়েছে যে, সে অপরাধী। আর এমন একটা শব্দ তার জন্যই খাটে। উইনস্টনের ঠিক উল্টোদিকে খানিকটা থামল সে, আর বলতে শুরু করল, ‘মনে করো না ওরা আমাকে গুলি করবে, ঠিক তাই বুড়ো ভাম! তুমি কিছু না করলে, ওরা তোমাকে গুলি করবে না—মোটে তো চিন্তা করা, চিন্তার ওপর তো তোমার নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি জানি ওরা তোমার কথা শুনবে। ওদের ওপর এ ব্যাপারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস! ওরা আমার নথিপত্র ঘাটবে, তাই না? তুমি তো জানো কেমন লোক ছিলাম আমি। আমি তো খারাপ ছিলাম না। মেধাবী নই কিন্তু বুদ্ধি তো ছিল। পার্টির জন্য যা কিছু করা সম্ভব ছিল করেছি, বলো করি নি? পাঁচ বছরের মধ্যে আমি ছাড়া পেয়ে যাব, তোমার কী মনে হয়? অথবা হতে পারে দশ বছর। শ্রম-শিবিরে আমার মতো লোক বেশ কাজে লাগবে। একবার লাইনচ্যুত হওয়ার জন্য ওরা নিশ্চয়ই আমাকে গুলি করে মারবে না?’
‘তুমি কি দোষী?’—বলল উইনস্টন।
‘অবশ্যই আমি দোষী!’ টেলিস্ক্রিনের দিকে বশংবদ দৃষ্টি রেখে কাঁদো কাঁদো উচ্চারণ পারসন্সের। তুমি নিশ্চয়ই মনে করো না, পার্টি কোনো একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে আটক করবে, তাই না?’ তার ব্যাঙ-সদৃশ মুখখানি আরো শান্ত হয়ে উঠতে থাকল, আর অভিব্যক্তি স্রেফ বকধার্মিকের রূপ নিতে থাকল। ‘চিন্তাঅপরাধ একটা ভয়ঙ্কর কাজ, বুড়ো ভাম’—বলল সে। ‘এটা বিশ্বাসঘাতকতা। অজান্তেই তোমার ভেতরে এটা ঢুকে পড়তে পারে। তুমি জানো আমার ভেতরে কী করে ঢুকল এই অপরাধ চিন্তা? আমার ঘুমের মাঝে! হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আমি যেমন ছিলাম, সারাক্ষণ কাজ করে যেতাম, যতদূর পারি—কখনো কি জানতাম আমার মনের ভেতরে রয়েছে এক কু-এর বাস। এরপর আমি ঘুমের মাঝে কথা বলতে শুরু করলাম। তুমি কি জানো, ওরা আমাকে কী বলতে শুনেছে?’
কণ্ঠ নামিয়ে আনল এবার, কেউ যখন স্রেফ চিকিৎসার কারণে কিছু অশ্লীল উচ্চারণে বাধ্য হয় ঠিক তেমনই তার অভিব্যক্তি।
‘বিগ ব্রাদার নিপাত যাক!”—হ্যাঁ, ঠিক সে কথাটাই বলেছি আমি। একবার না, বারবার বলেছি। দ্যাখো বিষয়টা স্রেফ তোমার আর আমার মাঝে, বুড়ো ভাম, আরো বাড়াবাড়ি কিছু করে ফেলার আগেই ওরা আমাকে ধরে ফেলেছে, এতেই আমি খুশি। তুমি কি জানো ওরা আমাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর আগেই আমি কী বলতে যাচ্ছি? “তোমাদের ধন্যবাদ”—ঠিক এই কথাটিই আমি ওদের বলব, বলব “খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই তোমরা আমাকে রক্ষা করেছো এই জন্য ধন্যবাদ”। ’
‘কে ধরিয়ে দিল তোমাকে?’—প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘আমার ছোট মেয়ে’—বলল পারসন্স। দুঃখভরা গর্বের উচ্চারণ তার। ‘চাবিপথে আড়ি পেতে ও শুনে ফেলেছে। ও শুনতে পেয়েছে আমি কথাগুলো বলেছি, আর পরের দিনই তা টহলদারদের কাছে বলে দিয়েছে। সাত বছরের এই দুধের বাচ্চার জন্য এ এক দারুণ কাজ, কী বলো? এ জন্য ওর প্রতি আমার এতটুকু অভিযোগ নেই। আসলে ওর জন্য আমি গর্বিতই বোধ করছি। এতে বোঝা গেল, আমি ওকে সঠিকভাবেই বড় করে তুলতে পেরেছি। ’
আবারও উপর-নিচে ঝাঁকি দিতে দিতে কয়েক পা হাঁটল সে, পায়খানার প্যানটির ওপর দৃষ্টি ফেলে রেখে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করল। এরপর হুট করেই শর্টসের ফিতা খুলে নামিয়ে দিল।
‘ক্ষমা করো, বুড়ো ভাম’—বলল সে। ‘আর পারছি না ধরে রাখতে। ’
বৃহৎ পাছাখানি পায়খানার প্যানে ঝুলিয়ে দিল সে। আর উইনস্টন দুই হাতে মুখ ঢাকল।
‘স্মিথ!’—চিৎকার দিয়ে উঠল টেলিস্ক্রিন। ‘৬০৭৯ স্মিথ ডব্লিউ! মুখ খোলো। কারাকক্ষে মুখ ঢাকা চলবে না। ’
মুখ থেকে হাত সরাল উইনস্টন। পারসন্স পায়খানা সারছে অঢেল আর সশব্দে। অতঃপর দেখা গেল ফ্ল্যাশ কাজ করছে না, ফলে পরের কয়েক ঘণ্টা হাগার ভয়াবহ গন্ধে ডুবে থাকল পুরো কারাকক্ষ।
পারসন্সকেও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রহস্যজনকভাবে এমন আরো বন্দি এলো আর গেল। এক নারী বন্দিকেও আনা হয়েছিল। তাকে যখন বলা হলো ‘রুম ১০১’—উইনস্টন লক্ষ্য করল, শব্দ দুটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার মুষড়ে যাওয়া শরীর আর রঙ পাল্টে যাওয়া চেহারার অভিব্যক্তি। একটা সময় এলো, তাকে যদি এখানে সকালে আনা হয় তাহলে তখন বিকেল, আর যদি বিকেলে আনা হয়, তাহলে তখন মধ্যরাত। তখন নারী পুরুষ মিলিয়ে প্রকোষ্ঠে ছয় কয়েদী। সবাই স্থির বসে আছে। উইনস্টনের উল্টোদিকে বসে এক ব্যক্তি, চোয়ালবিহীন দাঁতাল চেহারা, যেন কাঠবিড়ালির বড় অহিংস্র রূপ। তার থলথলে, ঝুলে থাকা গালদুটো নিচের দিকে এতটাই ভারী যে ওখানে কিছু খাবার জমিয়ে রাখা হয়েছে সে কথা মনে না করাটাই কঠিন। ফ্যাকাশে ধূসর চোখদুটো ভয়ার্ত চাহনিতে একের পর অন্যের মুখের ওপর কিছুটা লটকে রেখে অন্যপক্ষ টের পাওয়ার আগেই সরিয়ে নিচ্ছিলেন।
দরজা খুলে গেল, আরেকজন কয়েদীকে ঢোকানো হলো যাকে দেখে উইনস্টনের ভেতরে একটি হিম শীতল অনুভূতি বয়ে গেল। বৈশিষ্ট্যহীন, সাধারণ চেহারার লোকটি প্রকৌশলী বা কারিগর গোছের কিছু একটা হবেন। তবে তার চেহারায় ফুটে ওঠা দুর্বলতা ছিল চমকে দেওয়ার মতো। ওটা যেন স্রেফ একটা খুলি। মুখমণ্ডল এতটাই শুকনো যে চোয়াল আর চোখদুটো মনে হচ্ছিল অপেক্ষাকৃত বড়, আর সে চোখে মেখেছিল কারো কিংবা কোনো কিছুর প্রতি তীব্র ঘৃণা।
উইনস্টনের অদূরেই বেঞ্চির ওপর বসলেন তিনি। উইনস্টন তার দিকে দ্বিতীয়বার তাকাচ্ছিল না, কিন্তু খুলির মতো দেখতে মুখখানি তার মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে থাকল যেন সেটি ঠিক তার মুখের সামনে। হঠাৎই তার মাথায় এলো ঘটনাটা আসলে কী। লোকটি মূলত ক্ষুধার কারণেই মরতে চলেছে। কারাকক্ষের বাকিদের মাঝেও যেন একই সময়ে সেই একই চিন্তা বয়ে গেল। কারণ বেঞ্চির চারিদিকে সকলের মুখেই তখন একই থমথমে ভাব। চোয়ালবিহীন লোকটিও চোখ দুটো খুলিমুখো মানুষটির ওপর কিছুক্ষণ স্থির করে রেখে অপরাধীর মতো আস্তে সরিয়ে নিলেন, এরপর এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে আবার চোখ দুটো ঘুরিয়ে নিলেন তার দিকে। এসময় বসে বসে দুলছিলেন তিনি। অবশেষে তিনি সটান উঠে দাঁড়ালেন, অস্থিরভাবে প্রকোষ্ঠের ভেতর এদিক-ওদিক করলেন, আলখেল্লার পকেটে একবার হাত ঢুকিয়ে দিলেন, আর, অতি লজ্জিত মুখে হাতে তুলে আনা এক টুকরো কালচে রুটি খুলিমুখো লোকটির সামনে ধরলেন।
তীব্র তারস্বরে ক্রোধান্বিত গর্জন বেরিয়ে এলো টেলিস্ক্রিন থেকে। চোয়ালবিহীন লোকটি লাফ মেরে নিজের আসনের সামনে। খুলিমুখো মানুষটি দ্রুতই দুটি হাত লুকিয়ে ফেললেন পিছনে, যেন গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চান, ওই উপহার তিনি নিতে চান নি।
‘বামস্টিড!’ গর্জে উঠল কণ্ঠস্বর। ‘২৭১৩ বামস্টিড জে.! রুটির টুকরোটি নিচে ফেলে দাও!’
চোয়ালহীন মানুষটি রুটির টুকরোটি মেঝেতে ফেলে দিলেন।
‘ঠিক যেখানে রয়েছো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো’—নির্দেশ কণ্ঠস্বরের। ‘দরজার দিকে মুখ করো, আর কোনো নড়াচড়া নয়। ’
ঠিক ঠিক মানলেন চোয়ালহীন লোকটি। তার বড় ঝুলে থাকা গালদুটি থরথর করে নিয়ন্ত্রণহীন কেঁপে চলেছে। ক্যাঁচ করে খুলে গেল দরজার পাল্লা। তরুণ কর্মকর্তাটি ভিতরে ঢুকেই পাশের দিকে সরে গেলে বিশাল বাহু আর কাঁধের এক ষণ্ডামার্কা নিরাপত্তারক্ষী ঢুকল। চোয়ালহীনের ঠিক সামনে ততক্ষণে দাঁড়িয়ে সে, আর তখনই, কর্মকর্তার ইশারা পেয়ে, শরীরের সব শক্তি দিয়ে চোয়ালহীন মুখটির ওপর কষে এক ঘুষি বসিয়ে দিল। ঘুষির চোটে লোকটি মেঝেতে পড়ে ছিটকে পায়খানার প্যানের সঙ্গে ধাক্কা খেলেন। হতভম্বের মতো কিছুটা সময় সেভাবেই পড়ে থাকলেন, মুখ আর নাক দিয়ে ততক্ষণে কালো ঘন রক্ত বেরিয়ে এসেছে। একটা অতি হালকা শব্দ গুমড়ে উঠল, অসচেতনতায় তা বেরিয়ে এলো লোকটির মুখ থেকে। এরপর হাত ও হাঁটুতে ভর দিয়ে অবিন্যস্তভাবে নিজেকে তুলে ওঠালেন। রক্ত আর লালা সমেত দুই পাটি দাঁত মুখ থেকে ঝরে পড়ল।
বাকি কয়েদীরা সবাই স্থির বসে আছে। প্রত্যেকের হাত হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। হামাগুড়ি দিয়ে চোয়ালহীন মানুষটি নিজের স্থানে ফিরলেন। মুখের নিচের দিকে একটি অংশে মাংস ততক্ষণে কালচে রঙ ধরেছে। ধীরে ধীরে পুরো মুখটি চেরি-রঙা একটি কদাকার রূপ নিল, যার ঠিক মাঝখানে একটি কালো গর্ত।
একটু পর পর কিছুটা রক্ত আলখেল্লার বুকের ওপর পড়ছে। তার ধূসর চোখ দুটো তখনও মুখ থেকে মুখে ফিরছে, তাতে আগের চেয়েও বেশি অপরাধের অভিব্যক্তি, যেন আবিষ্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছেন তার এই অপদস্থতায় অন্যদের অবজ্ঞা কতখানি।
দরজা খুলে গেলো। সামান্য ইশারায় খুলিমুখো লোকটিকে নির্দেশ করলেন তরুণ কর্মকর্তা।
‘রুম ১০১’—বললেন তিনি।
উইনস্টনের দিকটায় একটা হাঁপানি আর ব্যাকুলতার শব্দ উঠল। লোকটি তার দুই হাত জোর করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।
‘কমরেড! অফিসার!’—কান্না জুড়ে দিলেন তিনি। ‘আমাকে ওখানে নেওয়ার প্রয়োজন নেই! আমি তো আগেই আপনাদের সব বলেছি। এর বাইরে আর কী জানতে চান আপনারা? স্বীকার করে নেওয়ার মতো আর তো কিছুই নেই, কিচ্ছু না! আমাকে বলুন আর কী জানতে চান? আমি সোজা সব স্বীকার করে নেব। লিখে দিন আমি সই করে দেই—যা কিছু! কিন্তু ওই ১০১ নম্বর রুমে নেবেন না!’
‘রুম ১০১’—বললেন কর্মকর্তাটি।
লোকটির চেহারা ততক্ষণে ফ্যাকাশে হয়ে এমন রঙ ধরেছে যে উইনস্টনের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে, এমনটা হতে পারে। নিশ্চিত আর নির্ভুলভাবে সে রঙটি ছিল সবুজাভ।
‘আমাকে নিয়ে যা মন চায় করুন’—চিৎকার করে উঠলেন লোকটি। ‘আপনারা আমাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে না খাইয়ে রেখেছেন। এবার ক্ষ্যামা দিন, আমাকে মরতে দিন। আমাকে গুলি করুন, ফাঁসি দিন। পঁচিশ বছরের কারাদণ্ড দিন। আর কার কথা আপনারা আমার কাছে জানতে চান? বলুন কে? আপনারা যা চান আমি তাই বলব। কাউকে নিয়ে আর আমার চিন্তা নেই, কে তা নিয়েও আমি পরোয়া করি না। আমার এক স্ত্রী আর তিন সন্তান। সবচেয়ে বড়টির এখনো ছয় বছর হয়নি। আপনারা ওদেরও নিয়ে যেতে পারেন, আমার সামনেই ওদের জিহ্বা কেটে ফেলতে পারেন, আমি স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। কিন্তু আমাকে ওই ১০১ নম্বর রুমে নেবেন না!’
‘রুম ১০১’—শীতল উচ্চারণ কর্মকর্তাটির।
ক্ষিপ্ত চাহনি দিয়ে কক্ষের অন্য কয়েদীদের বিঁধতে থাকলে লোকটি, চোখের ভাষা যেন বলছে, তার স্থানে এদের মধ্য থেকে আরেকজনকে পাঠিয়ে দিতে পারবেন কিনা সেটাই খুঁজছেন। এরপর চোখদুটি গিয়ে স্থির হলো চোয়ালহীন থেঁতলানো মুখটির ওপর। সব ক্ষোভ যেন তারই ওপর। ওর দিকে ক্ষীণকায় একটি বাহু ছুঁড়তে শুরু করলেন।
‘আমাকে নয়, তোমাদের উচিত ওঁকে নিয়ে যাওয়া!’—চিৎকার করে বললেন তিনি। ‘তোমরা শোনোনি, মুখখানি থেঁতলে দেওয়ার পর সে কী বলেছে। আমাকে বলতে দাও, ওর প্রতিটি শব্দ আমি তোমাদের বলে দেব। আসলে আমি নই, সেই হচ্ছে পার্টি বিরোধী। ’
নিরাপত্তা রক্ষীরা সামনে এগিয়ে এলো। লোকটির কণ্ঠ তীক্ষ্ণতর হলো, তোমরা শুনতে পাচ্ছো না আমার কথা! বারবার বলতে লাগলেন তিনি। ‘টেলিস্ক্রিনে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। তোমরা আসলে আমাকে নয় ওকে নিতে চাচ্ছো। ওকেই নিয়ে যাও, আমাকে নয়!’
দুই রক্ষী লোকটির দুই বাহু লক্ষ করে এগিয়ে গেল আর ধরতে উদ্যত হলো। কিন্তু ঠিক তখনই মেঝেতে শুয়ে পড়লেন তিনি আর বেঞ্চিটির একটি লোহার পায়া দুই হাতে শক্ত করে ধরে ফেললেন। এবার কোনো কথা নেই। মুখ থেকে ভেসে আসছে পশুর মতো গোঙানির শব্দ। রক্ষীরা তাকে ধরে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু বিস্ময়কর শক্তি দিয়ে তিনি আঁকড়ে ধরে আছেন লোহার পায়া। সম্ভবত বিশ সেকেন্ড রক্ষীরা তাকে টানাটানি করল। বাকি কয়েদীরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন, যার যার হাত হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি করে রাখা। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ সম্মুখপানে দৃষ্টি। গোঙানি থেমেছে। ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য প্রয়োজনীয় নিঃশ্বাসটুকু ছাড়া লোকটির কাছে তখন আর অবশিষ্ট কিছুই নেই। এরপর শুরু হলো ভিন্ন রকমের কান্না। রক্ষীদের একজনের কষে মারা বুটের লাথিতে লোকটির একহাতের সবগুলো আঙুল ভেঙে গেল। এরপর তার পা ধরে ওরা দুজন তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করল।
‘রুম ১০১’—বললেন কর্মকর্তাটি।
লোকটিকে বাইরে নেওয়া হলো। মাথা হেট করে, জখম হাতটি ডলতে ডলতে অবিন্যস্ত পায়ে নিজেই এগিয়ে গেলেন, সংগ্রামের সকল শক্তিই তখন শেষ তার।
এরপরও কেটে গেল দীর্ঘ সময়। খুলিমুখো মানুষটিকে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন যদি মধ্যরাত হয়ে থাকে তাহলে এখন সকাল। আর যদি তখন সকাল হয়ে থাকে, তাহলে এখন বিকেল। উইনস্টন এখন একা। কয়েক ঘণ্টা ধরেই সে একা। সরু বেঞ্চিতে বসে থাকতে থাকতে যখন পশ্চাৎদেশে ব্যথা ধরে যায় তখন মাঝে মধ্যে সে উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করে। তাতে অবশ্য টেলিস্ক্রিনের কটুকাটব্য শুনতে হয় না। রুটির টুকরোটি চোয়ালহীন ব্যক্তি মেঝের ঠিক যেখানটায় ফেলেছিলেন সেখানেই পড়ে আছে। শুরুতে ওটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা কঠিন হলেও এখন পারছে। এখন তার ক্ষুধার চেয়ে পানির তেষ্টাটাই বেশি অনুভব হচ্ছে। মুখের ভেতরটায় কেমন চটচটে আর বিস্বাদ ঠেকছে। ঝিম ধরা শব্দটি আর একই সাদাটে আলো তার মাথার ভেতরে এক ধরনের অচেতনতা ও শূন্যতাবোধ তৈরি করেছে।
এবার একটু উঠতেই হলো কারণ হাড্ডিতে ধরে যাওয়া ব্যথা আর সহ্য করা যাচ্ছিল না; তবে পরক্ষণেই বসেও পড়তে হলো কারণ পায়ের ওপর দাঁড়িয়েও থাকতে পারছিল না। শরীরের যন্ত্রণা যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে ঠিক তখনই আতঙ্ক ফিরে এলো। কখনো কখনো আবছা আশায় বুক বেঁধে সে ও’ব্রায়েন আর রেজর ব্লেডের কথা ভাবে। ভাবছে রেজর ব্লেডটি তার কাছে আসবে খাবারের মধ্যে করে, যদি কিনা আদৌ তাকে কখনো খেতে দেওয়া হয়। আরো ক্ষীণভাবে তার ভাবনায় আসে জুলিয়া। কোথাও বা অন্যত্র সে হয়ত তার চেয়েও চরম ভোগান্তিতে সময় কাটাচ্ছে। এখনই হয়ত প্রচণ্ড ব্যথায় সে কাতরাচ্ছে, চিৎকার পাড়ছে।
‘যদি নিজের কষ্টকে দ্বিগুণ করে নিয়ে জুলিয়াকে বাঁচানোর সুযোগ পাই, তাহলে কি তা করব? হ্যাঁ, করব’—ভাবল সে।
কিন্তু সেতো স্রেফ এক বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্ত, সে নিয়েছে কারণ সে ভাবছে তার নেওয়াই উচিৎ। সে তো এটা অনুভব করতে পারছে না। এইখানে আপনি কিছুই অনুভব করতে পারবেন না, স্রেফ ব্যথা ছাড়া, আর ব্যথার ধারণা ছাড়া। এছাড়াও, এও কি সম্ভব, ঠিক যখন আপনি কষ্টে ভুগছেন তখন এমন একটি কারণও কি থাকতে পারে যার জন্য আপনি চাইবেন এই কষ্ট বেড়ে যাক? সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ারও সুযোগ এখন নেই।
বুটের ভারী শব্দ আসছে। দরজা খুলে গেল। ও’ব্রায়েন ঢুকলেন।
উইনস্টনের চোখ তার পায়ের দিকে। এই দৃশ্য দেখার পর তার সতর্কতার সকল শক্তিই উবে গেছে। অনেক অনেক বছরে এই প্রথম টেলিস্ক্রিনের উপস্থিতির কথা ভুলে গেছে সে।
‘ওরা আপনাকেও ধরে ফেলেছে!’—চিৎকার করে বলল সে।
‘ওরা আমাকে অনেক আগেই ধরে ফেলেছে’—ক্ষীণ অথচ দুঃখিত স্বরে উচ্চারণ ও’ব্রায়েনের। পা ফেলে একদিকে সরলেন তিনি। তার পেছন থেকে চওড়া বুকের এক রক্ষী লম্বা কালো লাঠি হাতে ঢুকলেন।
‘তুমিও জানো, উইনস্টন’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘নিজেকে ধোঁকা দিও না। তুমি জানতে, তুমি বরাবরই সব জানতে। ’
হ্যাঁ, এখন সে দেখছে, সে তো বরাবরই সব জানত। কিন্তু তা নিয়ে ভাবার সময় এখন নয়। এখন তার চোখ আটকে আছে রক্ষীর হাতের লাঠির ওপর। এখানে সেখানে আঘাত পড়ছে। মাথা, কানের লতিতে, বাহুতে, কনুইয়ে—
কনুই! হাঁটুর ওপর ধপ করে নিজেকে ছেড়ে দিল সে। জরাগ্রস্ত প্রায়, আঘাতপ্রাপ্ত কনুই ডলছে অন্য হাতে। সবকিছুই এক হলুদ আলোয় বিস্ফোরিত হয়ে গেল। অসহনীয়, একটি ঘুষিতেই এত অসহনীয় ব্যথা! এরপর আলো পরিষ্কার হয়ে এলো, তখন সে দেখতে পাচ্ছে অন্য দুজন তার দিকে তাকিয়ে।
রক্ষীটি তার মুষড়ে পড়া দেখে হাসছে। যেভাবেই হোক একটি প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। কখনো, পার্থিব কোনো কারণেই, আপনি আপনার ব্যথা বা কষ্ট বাড়াতে চাইবেন না। ব্যথার বিষয়ে আপনার একটিই প্রত্যাশা থাকবে তা হচ্ছে ব্যথা বন্ধ হওয়া। শারীরিক কষ্টের কিংবা ব্যথার চেয়ে খারাপ কিছু এই পৃথিবীতে আর নেই। ব্যথার সামনে কোনো বীরত্ব চলে না, থাকে না বীরের সাহস, মেঝেতে কুঁকড়ে পড়ে থেকে, অকেজো বাম বাহুটি অকারণ চেপে ধরে রেখে সেসবই ভাবতে থাকল সে।
অধ্যায় ২
পিঠ বলছে যার ওপর শুয়ে আছে সেটি ক্যাম্প খাট গোছের কিছু হবে, মেঝে থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে, আর শরীরটাকে এমনভাবে আটকে রাখা হয়েছে যাতে সে নড়তেও না পারে। সাধারণের চেয়েও একটি শক্তিশালী আলো তার মুখমণ্ডলের ওপর। পাশে ও’ব্রায়েন দাঁড়িয়ে, গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। অন্যপাশে সাদা কোট পরা একজন দাঁড়িয়ে, হাতে একটি ইনজেকশন সিরিঞ্জ।
চোখ খোলা থাকলেও আশেপাশের অবস্থাটা বুঝে উঠতে সময় লাগল। মনে হচ্ছিল কোনো এক ভিন্ন জগৎ থেকে সাঁতরে এই কক্ষে এসেছে সে, পানির তলদেশেরও অনেক গভীরের কোনো জগৎ থেকে। ওই গভীরতায় কতটা সময় তলিয়ে ছিল তার জানা নেই। গ্রেপ্তার হওয়ার পর এপর্যন্ত কোনো আঁধার সে দেখেনি, দেখেনি দিনের আলোও। তার স্মৃতিও সবকিছু ধারাবাহিক ধরে রাখতে পারছে না। কখনো কখনো চেতনা, ঘুমের মাঝেও যে চেতনাটুকু জাগরূক থাকে, মৃত্যুসম লোপ পেয়ে যায়, আবার জেগে ওঠে শূন্যতা ভরা বিরতিতে। তবে সেই বিরতি কয়েক দিনের, কয়েক সপ্তাহের নাকি কয়েকটি ক্ষণের তা বোঝার পথ নেই।
সেই যে, কনুইয়ে প্রথম আঘাত পড়ল তখন থেকেই দুঃস্বপ্নের শুরু। পরে সে অবশ্য বুঝতে পারে এই যা কিছু ঘটছে তা স্রেফ শুরু মাত্র, সব কয়েদীর ক্ষেত্রেই জিজ্ঞাসাবাদের এ এক সাধারণ প্রাথমিক প্রক্রিয়া। অপরাধের অন্ত নাই—ষড়যন্ত্র, নাশকতা আর এমন আরো অনেক—যা প্রত্যেককেই এক পর্যায়ে স্বীকার করে নিতে হবে। এই স্বীকারোক্তি স্রেফ এক আনুষ্ঠানিকতা, তবে নির্যাতন অবশ্যই এক বাস্তবতা। কতবার তাকে প্রহার করা হয়েছে, কতক্ষণ ধরে চলেছে সে প্রহার, সে মনে করতে পারে না। প্রতিবারই পাঁচ/ছয় জন কালো ষণ্ডামার্কা উর্দিধারী তাকে ঘিরে সক্রিয় হয়েছে। কখনো খালি হাতে কিল-ঘুষি, কখনো লাঠি কিংবা ইস্পাতের রড দিয়ে বেদম প্রহার, কখনো শক্ত বুটে কষে লাথি। মাঝে মাঝে সে কুঁকড়ে মেঝেতে পড়ে থেকেছে, পশুর মতো গড়াগড়ি খেয়েছে, আর শরীরকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে একেকটি লাথি আর লাঠিপেটা থেকে নিজেকে রক্ষা করার অবিরাম, নিষ্ফল চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আর তার ফল হিসেবে পেয়েছে আরো লাথি, পেট, পাঁজর, কনুই, জঙ্ঘা, কুঁচকি, অণ্ডকোষ, মেরুদণ্ডের মূল হাড়—কোনোটিই বাদ যায়নি। কখনো কখনো যখন এমনটা চলতে থাকত তখন তার কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, বাজে আর অক্ষমার্য বলে মনে হতো একটি বিষয়কে, তা হচ্ছে—রক্ষীরা তাকে পেটাচ্ছে কিন্তু এরপরেও সে অচেতন হয়ে যাচ্ছে না, কিংবা নিজেকে অচেতন করে ফেলতেও পারছে না। কখনো কখনো মস্তিষ্কানুভূতি তাকে এতটাই ছেড়ে চলে যেত যে সে ক্ষমার জন্য চিৎকার করতে থাকত। এমনকি মারধর শুরুর আগেই চিৎকার জুড়ে দিত। একেকটি ঘুষির জন্য হাত পাকানো দেখেই তার মন বাস্তব আর কল্পিত সকল অপরাধের জন্য স্বীকারোক্তি দিতে প্রস্তুত হয়ে যেত। আবার অন্যকোনো সময় সে সাব্যস্ত করে ফেলত—কিছুই স্বীকার করবে না। কষ্ট আর বেদনার্ততার মাঝ থেকেও একটি শক্তি বেরিয়ে আসত। আবার অন্যসময়, যখন কিছুটা দুর্বলচিত্ত হয়ে পড়ত, তখন নিজেই নিজেকে বলত, ‘স্বীকারোক্তি দেব, তবে এখনই নয়। এই যন্ত্রণা যতক্ষণ না পুরোপুরি অসহনীয় হয়ে পড়ে ততক্ষণ আমাকে শক্তি ধরে রাখতে হবে। আরো তিনটি লাথি, আরো দুটি লাথি বসবে, তারপর আমি সেই কথা বলব যা ওরা শুনতে চায়। ’
কখনো কখনো ওরা পেটাতে পেটাতে তার চলৎশক্তিটুকুও কেড়ে নিত, আর আলুর বস্তার মতো তাকে কোনো একটি কয়েদখানার মেঝেতে ছুড়ে ফেলে যেত, যাতে অবসাদ কাটিয়ে উঠতে পারে এরপর আবারও বের করে এনে আর আবারও পূর্ণোদ্যমে প্রহার শুরু করতে পারে। মাঝে মাঝে সময়টা একটু বেশিই পাওয়া যেত। তবে সেসময়ের কথা অতি অল্পই মনে পড়ে কারণ সে সময়টুকু ঘুমে কিংবা সংজ্ঞাহীনতায় কেটেছে তার। একটি কয়েদখানার কথা মনে পড়ে সেখানে ছিল তক্তার বিছানা, দেয়ালে ঝুলে থাকা তাকিয়া, টিনের বেসিন। খাবার হিসেবে পেত গরম স্যুপ, রুটি, কখনো কখনো কফিও মিলত। তার মনে আছে খিটমিটে মেজাজের এক নাপিত আসত দাঁড়ি কামিয়ে দিতে আর চুল কাটতে, আর কারবারিদের মতো দেখতে, অসহমর্মী সাদা কোটধারী লোকগুলো আসত কখনো নাড়ি দেখতে, তার ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়াগুলো যাচাই করতে, চোখের পাতা উল্টে, কর্কশ আঙুলগুলো দিয়ে ভাঙা হাড়গুলোর ওপর নির্মমভাবে ঘষাঘষি করে তারা দেখত আর পেশিতে সুঁই ফুটিতে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখত।
প্রহারের পৌনপৌনিকতা আর মাত্রা এক পর্যায়ে কমে আসে, কিন্তু সেটাই তখন হয়ে ওঠে আতঙ্কের আরেক নাম—এই বুঝি ফের শুরু হবে। কোনো একটি উত্তর মনঃপুত না হলেই প্রহারের ব্যবস্থা। এখন আর কালো উর্দিধারী ষণ্ডারা নয়, প্রশ্ন করছেন পার্টির বোদ্ধারা। নাদুসনুদুস চেহারার লোকগুলো দ্রুত হাত-পা নাড়িয়ে আর চশমায় ঝিলিক তুলে দীর্ঘ সময় ধরে প্রশ্নবান চালিয়ে যান। নিশ্চিত নয়, তবে তার ধারণা, একেক দফায় দশ-বারো ঘণ্টা ধরে চলে একেকটি জিজ্ঞাসাবাদ। এই প্রশ্নকারীরা তাকে নির্যাতনে জর্জরিত দেখেছেন কিন্তু তাতেও হয়ত তাদের মন যেন ভরে না। সে কারণেই তারা মুখে চাপড়ে, কান মলে, চুল টেনে, এক পায়ে খাড়া করিয়ে রেখে, প্রশ্রাবের বেগ চাপলেও আটকে রেখে, চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসা পর্যন্ত কড়া তীর্যক আলো ফেলে কষ্ট দিয়েছেন।
এসবের একটাই উদ্দেশ্য ছিল—তাকে অপদস্থ করা আর যুক্তি তর্ক চালানোর শক্তি কিংবা যৌক্তিকতার বোধ ধ্বংস করে দেওয়া। মূল অস্ত্রই ছিল নির্মম সব প্রশ্নবাণ, আর একের পর এক, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই বাণ হেনে চলতেন তারা। থমকে দিয়ে, কথার ফাঁদ পেতে, বক্তব্য বিকৃত করে, পদে পদে মিথ্যাচারের দোষ দিয়ে, স্ববিরোধিতার ধুয়ো তুলে এই চেষ্টা চালিয়ে যান তারা, যতক্ষণ না স্নায়ু দৌর্বল্য কিংবা লজ্জায় ফুপিয়ে কেঁদে দিত—ততক্ষণ। কখনো একদফায় অন্তত আধা ডজনবার তাকে কাঁদতে হয়েছে। প্রতিবারই তারা চিৎকার করে ভর্ৎসনা করেছেন কিংবা উত্তর দিতে সামান্য ইতস্তত করলেই হুমকি-ধমকি দিয়েছেন, ফের নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে তুলে দেবেন এটাই ছিল হুমকি। আবার কখনো তাদের সুরটা পাল্টেও গেছে—তাকে কমরেড সম্বোধন করেছেন, ইংসক আর বিগ ব্রাদারের দোহাই দিয়ে অনুনয় বিনয় করে, দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানতে চেয়েছেন পার্টির প্রতি তার আর এতটুকু আনুগত্যও কি নেই?
যে অপরাধ সে করেছে তা আর করবে না সে প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদে স্নায়ুতে যখন জ্বালা ধরে যেত, তখন এইসব অনুনয় বিনয়েও তার কান্না পেত। এইসব আদুরে গলা তার ভেতরটা যতখানি ভাঙচুর করে দিত, নিরাপত্তারক্ষীদের বুটের লাথি আর ওজনদার ঘুষিগুলোও ততখানি কাবু করতে পারত না। ততক্ষণে সে স্রেফ একটি মুখ ছাড়া আর কিছু নয় যা শব্দ করে, একটি হাত ছাড়া কিছু নয় যা ইশারা করে। তার কাছে যেমনটি চাওয়া হয় সেই শব্দ কিংবা সেই ইশারাটি করে যাওয়াই তার কাজ। তার একটাই উদ্বেগ আর চাওয়া, তা হচ্ছে—সে বুঝতে চায় আসলে ওরা কী জানতে চায়, কোন স্বীকারোক্তিটি পেতে চায় তার কাছে। আর যখনই বুঝতে পারে তখনই, নতুন করে অপদস্থ হওয়ার আগেই দ্রুত স্বীকারোক্তি দিয়ে দেয়।
এরই মধ্যে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের হত্যা করার স্বীকারোক্তি সে দিয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহী প্যাম্ফেলেট বিলি, সরকারি তহবিল তসরুপ, সামরিক গোপন তথ্য বিক্রি আর সব ধরনের নাশকতা চালিয়েছে বলেও স্বীকার করে নিয়েছে। সে আরো স্বীকার করেছে ইস্টেশীয় সরকারের বেতনভোগী চর ছিল সেই ১৯৬৮ সাল থেকে। স্বীকার করেছে, সে ছিল এক ধর্মবিশ্বাসী, পুঁজিবাদের সমর্থক আর বিকৃত যৌনাচারী। সে স্বীকার করেছে সে ছিল তার স্ত্রীর হন্তারক, যদিও সে জানে এবং প্রশ্নকর্তারাও অবশ্যই জানবেন তার স্ত্রী এখনো জীবিত। স্বীকারোক্তিতে সে আরো জানিয়েছে, গোল্ডস্টেইনের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ, গোপন সংগঠনেরও সে একজন সক্রিয় সদস্য আর এর সবাইকেই সে চেনে। সব কিছু স্বীকার করে নেওয়া আর সবাইকে জড়িয়ে ফেলাই ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। তবে, এক অর্থে এর সবকিছুই তো সত্য। এত সত্যি যে, মনে মনে সে ছিল পার্টি বিরোধী, আর পার্টির চোখে কোনো কিছু মনে ভাবা আর কাজে করার মধ্যে কোনো ফারাক নেই।
অন্য ধরনের কিছু স্মৃতিও রয়েছে। সেগুলো যেন তার মন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলে আছে, ঠিক যেভাবে অন্ধকারে ঘিরে ঝুলে থাকে কিছু ছবি।
একটি কয়েদখানায় তাকে রাখা হয়েছিল সেখানে আলো ছিল, আবার অন্ধকারাচ্ছন্নও হয়ে থাকতে পারে, কারণ সেখানে একজোড়া চোখ ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পেত না। হাতের কাছে কিছু একটা যন্ত্র অবিরাম ধীর লয়ে টিক টিক শব্দ করে চলত। চোখ দুটো ক্রমেই বড় আর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত। হঠাৎই বিছানা ছেড়ে ভেসে উঠত তার গোটা শরীর, আস্তে আস্তে চোখ দুটির ভেতরে ঢুকে পড়ত, আর মনে হতো ওগুলো যেন তাকে গিলে খাচ্ছে।
কর্কশ আলোর নিচে ডায়াল ঘেরা একটি চেয়ারে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সাদা কোট পরা একজন সারাক্ষণ সেইসব ডায়াল থেকে রিডিং নিতেন। বাইরে ভারী বুটের টানা শব্দ। ক্যাচ-ক্যাচ শব্দ তুলে দরজা খুলে গেল। মোমমুখো অফিসার ভেতরে ঢুকলেন, পেছনে পেছনে ষণ্ডামার্কা দুই রক্ষী।
‘রুম ১০১’—বললেন অফিসারটি।
সাদা কোটধারী কিন্তু ঘুরলেন না, উইনস্টনের দিকে ফিরেও তাকালেন না, তখনও তার চোখ ডায়াল গুলোতেই স্থির।
একটি বিশাল বারান্দাপথ ধরে তাকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, এক কিলোমিটার প্রশস্ত সেই পথ জ্বলজ্বলে সোনালি আলোয় ঝলমল, চারিদিক থেকে হাসি-ঠাট্টার গর্জন ভেসে আসছে। আর ভেসে আসছে উচ্চস্বরের সব স্বীকারোক্তি। সব কিছুই স্বীকার করে নিচ্ছিল সে। এতদিনে শত নির্যাতনের পরও যা কিছু নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পেরেছিল তাও এবার গড়গড় করে বলে দিল। নিজের জীবনের গোটা ইতিহাস সে তাদের সামনেই আবার তুলে ধরছিল যা তারা আগে থেকেই জানে। তার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীরা, প্রশ্নকর্তারা, সাদা কোটধারীরা, ও’ব্রায়েন, জুলিয়া, মি. চ্যারিংটন সবাই একই করিডোরে অট্টহাস্যে চিৎকার করে করে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছু কিছু বিষয় কখনো কখনো ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা হতো, কিন্তু পরে তা কী করে যেন ভুলে এড়িয়ে চলে যেত, ফলে আর কখনোই ঘটত না। এক পর্যায়ে সবকিছুই যেন ঠিকঠাক হয়ে যায়, আর কষ্ট-বেদনা নেই, তার তখন শুধুই খালি পড়ে পড়ে থাকা, জেনে যাওয়া, ক্ষমা করে দেওয়া এক জীবন।
শক্ত তক্তার বিছানায় একটু নড়ে উঠল সে, অনেকটা আধা নিশ্চয়তায় মনে হলো, ও’ব্রায়েনের কণ্ঠই শুনতে পেয়েছে। পুরো জিজ্ঞাসাবাদে সে ও’ব্রায়েনকে আর একবারও দেখেনি, তবে তার মন বলত ও’ব্রায়েন ঠিক তার কনুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে, তবে দেখা যাচ্ছে না। ও’ব্রায়েনের নির্দেশেই সবকিছু হচ্ছে। এ যেন তিনিই, যিনি উইনস্টনের জন্য রক্ষীদের নিয়োজিত করছেন, তিনিই ওদের হাতে তার মৃত্যু ঠেকিয়েছেন। এ যেন তিনিই যিনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন উইনস্টন কখন ব্যথায় কাতরাবে, কখন শ্বাস নেবে, কখন তাকে খাবার দেওয়া হবে, কখন ঘুমাবে, কখন তার বাহুতে ওষুধ ঢোকানো হবে। এ যেন তিনিই যিনি প্রশ্নগুলো করছেন আর উত্তর কী হবে তাও জানিয়ে দিচ্ছেন। তিনিই যন্ত্রণাদানকারী, তিনিই রক্ষাকারী, তিনিই অনুসন্ধানদাতা, আবার তিনিই বন্ধু। হঠাৎই—উইনস্টন মনে করতে পারে না ওষুধের প্রভাবে, ঘুমের ঘোরে, নাকি সে স্বাভাবিক ঘুমের মাঝে, নাকি পুরোপুরি সজাগ অবস্থাতেই—তার কানে বিড়বিড় করে একটি কণ্ঠ ধ্বনিত হলো: ‘ভয় নেই উইনস্টন, তুমি আমার জিম্মায় আছো। সাতটি বছর আমি তোমার ওপর নজর রেখেছি। এখন ক্রান্তিকাল এসে গেছে। আমিই তোমাকে রক্ষা করব, আমিই তোমাকে সঠিক পথে নিয়ে যাব। ’
সে নিশ্চিত না, কণ্ঠটি ও’ব্রায়েনেরই ছিল কিনা। কিন্তু এটি ছিল সেই একই কণ্ঠ যা তাকে সাত বছর আগে স্বপ্নের মাঝে বলেছিল, ‘আমাদের দেখা হবে কোনো একখানে, যেখানে কোনো অন্ধকার থাকবে না। ’
এই জিজ্ঞাসাবাদ কোথায় শেষ হয়েছিল সে মনে করতে পারে না। একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় ছিল, এরপর তাকে নেওয়া হয় আরেকটি কারা প্রকোষ্ঠ কিংবা কামরায়, যেখানটাতেই সে এখন আছে; আর ধীরে ধীরে তার চারিপাশের বাস্তবতা বুঝে উঠতে শুরু করেছে। স্রেফ চিৎ হয়েই পড়ে আছে সে, একটু নড়ার ক্ষমতা নেই। শরীরের প্রতিটি প্রয়োজনীয় অংশেই তাকে বেঁধে আটকে রাখা হয়েছে। আর মাথার পেছনটা একভাবে স্থির করে রাখা। ও’ব্রায়েন তার দিকে গভীর কিন্তু দুঃখময় চাহনিতে তাকিয়ে। নিচ থেকে তার মুখখানা দেখা যাচ্ছে, বেশ মোটা, বদখত, চোখের নিচে দাগ, নাকে, চোয়ালে ক্লান্তির ছাপ। ওর বয়স উইনস্টনের চেয়ে বেশিই, ভাবল সে, হতে পারে আটচল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ। তার হাতের নিচে একটি ডায়াল যার ওপরে একটি হাতল আর ডায়ালের ভেতরে কতগুলো সংখ্যা মুখের ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে।
‘আমি তোমাকে বলেছিলাম’—বললেন ও’ব্রায়েন, ‘ফের যদি আমাদের দেখা হয় তা হবে এখানেই। ’
‘জ্বি’—বলল উইনস্টন।
ও’ব্রায়েনের হাতটি সামান্য নড়ল আর কিছুই নয়, কিন্তু তাতেই একটি ব্যথার ধমক তার গোটা শরীরের ভেতর বয়ে গেল। ভয়াবহ সেই ব্যথা। এতটাই যে তাতে কী ঘটছে তাও সে দেখতেও পারছে না, তবে তার মনে হলো এক মরণআঘাত হানা হয়েছে তার ওপর। সে বুঝতে পারছে না কোনো কিছু আদতেই ঘটল কিনা, নাকি বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে কিছু সৃষ্টি করা হলো। তবে তার শরীরখানা নিজের কাঠামো ভেঙ্গে মুচড়ে যাচ্ছে, শরীরের জোড়াগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। যদিও ব্যথায় তার কপালে ঘাম জমেছে, তবে সবচেয়ে ভয়ের হয়ে উঠেছে যে, তার মনে হচ্ছিল মেরুদণ্ডটি খান খান হয়ে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে নাসিকা রন্ধ্র দিয়ে ভারী শ্বাস নিতে শুরু করল সে, আর নীরবে ব্যথা সহ্য করে যাওয়ার জন্য মনে প্রাণে চেষ্টা চালাতে থাকল।
‘তোমার ভয় হচ্ছে’—ঠিক মুখের দিকে চোখ রেখে বললেন ও’ব্রায়েন, ‘অল্পক্ষণেই কিছু একটা ভাঙচুর হয়ে যাবে। তোমার বিশেষ ভয় তোমার মেরুদণ্ড নিয়ে। তোমার মনের চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তোমার শিরদাঁড়া ভেঙ্গে ভেঙ্গে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, মেরুদণ্ডের মজ্জাগুলো ফোঁটায় ফোঁটায় গলে পড়ছে। এসবই তো তুমি ভাবছো, নয় কি, উইনস্টন?’
সে কোনো উত্তর করল না। ডায়ালের হাতলটি ফের টেনে পেছনে নিলেন ও’ব্রায়েন। যেমন হঠাৎ করে এসেছিল ব্যথার ধমক তেমনই হঠাৎ করেই তা থেমে গেল।
‘ওটা ছিল চল্লিশ’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘তুমি দেখতে পাচ্ছো এই ডায়ালের নম্বরের ঘর একশ’ পর্যন্ত। তুমি কি দয়া করে একটু স্মরণ করবে, আমাদের যে কথা হয়েছিল তার মধ্য থেকে, আমি বলেছিলাম, আমি তোমার ওপর ব্যথা আরোপ করতে পারি যেকোন সময়, আমার মনের মতো যেকোন মাত্রায়? তুমি যদি মিথ্যা বলো, কিংবা সত্য বলা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করো, কিংবা তোমার স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তার নিচে থাকার চেষ্টা করো, তাৎক্ষণিকভাবে তোমাকে ব্যথায় কাঁদতে হবে। বুঝতে পেরেছো?’
‘হ্যাঁ পেরেছি’—বলল উইনস্টন।
ও’ব্রায়েনের আচরণ কিছুটা কম ভয়ঙ্কর হতে শুরু করল। চিন্তিত ভঙ্গিমায় চশমা জোড়া নেড়েচেড়ে বসালেন, আর বারেক কিংবা বার দুয়েক উপর-নিচে, এদিক-ওদিক চোখ ঘোরালেন। যখন কথা বলছিলেন তার কণ্ঠস্বর ছিল নম্র ও শান্ত। মনে হচ্ছিল একজন চিকিৎসক, শিক্ষক, এমনকি ধর্মযাজকের মতো, যিনি আসলে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে শিক্ষা দিতে কিংবা বোঝাতেই বেশি করে চান।
‘তোমার জন্য আমাকে ম্যালাই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে, উইনস্টন’—বললেন তিনি, ‘কারণ তুমি ঝামেলা পাকাচ্ছো। তুমি ভালো করেই জানো, তোমার বিষয়টা ঠিক কী। অনেক বছর ধরেই তা জেনে আসছো, তুমি তোমার জ্ঞানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছো। মানসিকভাবে তুমি বিক্ষিপ্ত। তুমি স্মৃতিশক্তির বিঘ্নে ভুগছো। তুমি সঠিক ঘটনা মনে করতে সক্ষম নও অথচ নিজেকেই নিজে প্রভাবিত করো সেইসব ঘটনা স্মরণ করে যা আদৌ ঘটেনি। তোমার সৌভাগ্য যে, এই রোগ নিরাময়যোগ্য। তবে তুমি নিজে কখনোই এর উপশম করাওনি, কারণ তুমি চাওনি। একটি সামান্যতম চেষ্টাও তুমি চালাতে প্রস্তুত ছিলে না। এমনকি এখনো, আমি ভালো করেই জানি, তুমি তোমার এই রোগেই অনুরক্ত হয়ে আছো এই ভেবে যে এতেই উৎকর্ষ। আসো উদাহরণস্বরূপ একটা পরীক্ষা হয়ে যাক, বলো তো ঠিক এখন, ওশেনিয়া কোন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত?’
‘আমাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন ওশেনিয়া ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। ’
‘ইস্টেশিয়ার সঙ্গে। বেশ। তাহলে এবার বলো ওশেনিয়ার যুদ্ধ বরাবরই ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে, নয় কি?’
লম্বা শ্বাস নিল উইনস্টন। কিছু বলবে বলে একবার মুখ খুলল কিন্তু বলল না। ডায়াল থেকে চোখও সরিয়ে নিতে পারছিল না।
‘সত্য বলো উইনস্টন। তোমার সত্যটি বলো। আমাকে তাই বলো যা কিছু তুমি ভাবছো, যা কিছু স্মরণ করতে পারছো। ’
‘আমার মনে আছে, আমি গ্রেপ্তার হওয়ার এক সপ্তাহ আগে আমরা আদৌ ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলাম না। ওদের সঙ্গে ছিল আমাদের মিত্রতা। যুদ্ধ ছিল ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে। তাও চলে আসছিল চার বছর ধরে। তার আগে—’
হাতের সামান্য ইশারায় ও’ব্রায়েন থামালেন তাকে।
‘আরেকটি উদাহরণ নেব’—বললেন তিনি। ‘বছর কয়েক আগে তোমার বড় ধরনের একটি মতিভ্রম ঘটে। তোমার বিশ্বাস ছিল, তিনটি লোক, জোন্স, অ্যারনসন, রাদারফোর্ড নামে এক সময়ের তিন পার্টি সদস্য—যারা পুরোপুরি স্বীকারোক্তি দিয়ে ষড়যন্ত্র আর নাশকতার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, তারা কোনোভাবেই ওই অপরাধে অপরাধী ছিলেন না। তোমার বিশ্বাস তুমি এমন নির্ভুল প্রমাণ দেখেছো যা নিশ্চিত করে যে ওদের স্বীকারোক্তি ছিল মিথ্যা। একটি বিশেষ ছবি ছিল যা দেখেই তোমার ওই বিভ্রম সৃষ্টি হয়। তোমার বিশ্বাস সত্যিই তুমি সেই প্রমাণ তোমার হাতে পেয়েছিলে। সেটি একটি ছবি বা তেমনই কিছু একটা ছিল।
ও’ব্রায়েনের আঙুলের ফাঁকে ততক্ষণে একটি সংবাদপত্রের ছেঁড়া অংশ। সম্ভবত উইনস্টনের দৃষ্টিসীমার মধ্যে পাঁচ সেকেন্ডের মতো সেটি ধরা ছিল। এটি একটি ছবি, আর সেটি কিসের সে নিয়ে প্রশ্নেরই কোনো অবকাশ নেই। এ তো সেই ছবিটিই। জোন্স, অ্যারনসন ও রাদারফোর্ডের নিউইয়র্কের পার্টি অনুষ্ঠানের আরেকটি কপি, যা তার হাতেও পড়েছিল আর তাৎক্ষণিকভাবে স্মৃতিগহ্বরে ফেলে ধ্বংসও করে দিয়েছিল। চোখের সামনে মাত্র একবার দেখা গেল আর দ্রুতই তা দৃষ্টি থেকে সরে গেল। কিন্তু সে এটি দেখেছে, প্রশ্নাতীতভাবেই সে ওটা দেখেছে! শরীরের উপরের অংশটা সামান্য একটু নাড়ানোর ব্যথার্ত চেষ্টাই সে করল। কিন্তু কোনো একদিকেও এক সেন্টিমিটার পর্যন্ত নড়া সম্ভব ছিল না। এইক্ষণে ডায়ালটির কথাও ভুলে গেল সে। তার মনজুড়ে তখন একটাই ইচ্ছা, ওই ছবিটিকে আরো একবার যদি আঙুলের ফাঁকে পেয়ে যায়, নয়ত অন্তত একবার সেটি দেখতে পায়।
‘ওটি এখনো আছে!’—বিস্ময়ের প্রকাশ তার মুখে।
‘না, নেই’—বললেন ও’ব্রায়েন।
এবার কামরার ওদিকটায় হেঁটে গেলেন। উল্টোদিকের দেয়াল ঘেঁষে একটি স্মৃতি গহ্বর। ও’ব্রায়েন আস্তে করে ওপরের লোহার ঢাকনাটি তুললেন। আর দেখা না গেলেও ঠিক বুঝে নেওয়া যায়, কাগজের টুকরোটি ততক্ষণে তপ্তবায়ুর স্রোতে পড়ে খাবি খাচ্ছে আর আগুনের লেলিহান শিখায় তা ছারখার হয়ে যাচ্ছে। দেয়াল থেকে মুখ ঘোরালেন ও’ব্রায়েন।
‘স্রেফ ভস্ম’—বললেন তিনি। যে ভস্ম আর চিহ্নিত করারও নয়। এর কোনো অস্তিত্ব নেই, ছিল না কোনোকালেই। ’
‘কিন্তু এর অস্তিত্ব ছিল! অস্তিত্ব আছে! স্মৃতিতেই টিকে আছে এর অস্তিত্ব। আমার ঠিক স্মরণ আছে। আপনারও স্মরণে আছে। ’
‘কই আমার তো স্মরণে নেই’—বললেন ও’ব্রায়েন।
‘উইনস্টনের হৃদয়খানি অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। ওটাই দ্বৈতচিন্তা। ভীষণরকম অসহায়বোধ হতে লাগল তার। যদি নিশ্চিত হতে পারত ও’ব্রায়েন মিথ্যা বলছেন তাহলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু এটাও সত্যিই সম্ভব, ও’ব্রায়েন ঠিকই ছবিটির কথা ভুলে গেছেন। আর তা যদি হয়, তাহলে তো এইমাত্র তিনি বিষয়টি মনে থাকার কথা যে অস্বীকার করলেন তাও ভুলে যাবেন, আর এই ভুলে যাওয়ার বিষয়টিও ভুলে যাবেন। কে কিভাবে নিশ্চিত হবে এসবই কূট-কৌশল? হতে পারে মনের এই মতিভ্রম সত্যিই ঘটে; আর এসব ভাবতে ভাবতে নিজেকে তার পর্যুদস্ত মনে হচ্ছিল।
ঠিক ওর দিকেই তাকিয়ে ও’ব্রায়েন, চাহনিতে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা স্পষ্ট। পণ্ডিত মশাই ভাবটা অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন বেশি বলেই মনে হলো তার। স্কুলে বেয়াড়া কিন্তু মেধাবী শিশু ছাত্রটির প্রতি শিক্ষক যেভাবে তাকান তেমনই।
‘অতীতের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পার্টির একটা স্লোগান আছে’—বললেন তিনি। ‘দয়া করে আরেকবার বলবে। ’
‘অতীত যার নিয়ন্ত্রণে, ভবিষ্যতেরও নিয়ন্ত্রক তিনি: বর্তমান যার নিয়ন্ত্রণে, অতীতেরও নিয়ন্ত্রক তিনি’—বাধ্য ছেলের মতো আওড়ে গেল উইনস্টন।
‘বর্তমান যার নিয়ন্ত্রণে অতীতেরও নিয়ন্ত্রক তিনি’—মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন ও’ব্রায়েন। ‘এটা তোমার মত, উইনস্টন, তুমি বলতে চাও অতীতের সত্যিই অস্তিত্ব রয়েছে?’
একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ মনই কেবল বাস্তবতা দেখতে পায়, উইনস্টন। তুমি মনে করো বাস্তবতা বস্তুগত, বাহ্যিক, আর তার নিজের অধিকারে অস্তিত্ব পায়। তোমার এও বিশ্বাস বাস্তবতা স্ব-প্রমাণে ভাস্বর। যখন তুমি কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছো বলে নিজেকে কোনো ভাবনায় মগ্ন করো, তখন তুমি ধরে নাও তুমি যেমনটা দেখছো, অন্যরাও তাই দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, উইনস্টন, বাস্তবতা বাহ্যিক কিছু নয়। বাস্তবতা মানুষের মনের মাঝে থাকে, আর কোথাও নয়।
আবারও একটা অসহায়বোধ উইনস্টনকে পেয়ে বসল। তার চোখ ডায়ালে স্থির হয়ে আছে। ব্যথা থেকে পরিত্রাণ পেতে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’র কোনটা হবে উত্তর, সেটা কেবল জানে না তাই নয়, সে এও জানে না, এর মধ্যে কোন উত্তরটি সঠিক বলে সে নিজে বিশ্বাস করে।
ও’ব্রায়েনের মুখে মৃদু হাসি। ‘তুমি অধিবিদ্যায় বিদ্বান নও, উইনস্টন’—বললেন তিনি। ‘এই মুহূর্ত অবধি অস্তিত্ব বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে তুমি কখনোই ভাবোনি। আমি বিষয়টি আরো সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরছি। অতীত কি সুনির্দিষ্টভাবে টিকে থাকে, মহাকাশে? অন্য কোথাও কিংবা আর কোনোখানে, এই পদার্থের বিশ্বে, যেখানে অতীত এখনও ঘটে চলেছে?’
‘না। ’
‘তাহলে কোথায় অতীতের অস্তিত্ব, যদি আদৌ তা থেকে থাকে?’
‘নথিতে। লিখিতভাবে। ’
‘নথিতে। আর—?’
‘মনে। মানুষের স্মৃতিতে। ’
‘স্মৃতিতে। খুব ভালো, তাহলে। আমরা, এই পার্টি, সব নথিই নিয়ন্ত্রণ করি, এবং আমরা সকল স্মৃতিও নিয়ন্ত্রণ করি। তাহলে আমরা অতীতকেও নিয়ন্ত্রণ করি, নয় কী?’
‘কিন্তু কোন পথে আপনারা মানুষকে অতীত মনে করা থেকে বিরত রাখতে পারবেন?’—ডায়ালের কথা এক মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হয়ে বেশ জোর কণ্ঠেই বলল উইনস্টন। ‘এটা স্বেচ্ছাকর্ম, নিজস্বতারও বাইরে। আপনি কী করে স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করবেন? আপনি তো আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি!’
ও’ব্রায়েনের চেহারা ফের কঠোর হয়ে উঠল। হাতটি ডায়ালের ওপর রাখলেন তিনি।
‘পক্ষান্তরে’—বললেন তিনি, ‘তুমিই আসলে নিয়ন্ত্রণে আসোনি। আর ঠিক সে কারণেই আজ তোমাকে এখানে ধরে আনা হয়েছে। তুমি এখানে, কারণ তুমি বিনয়ী হতে পারোনি, তুমি নিজেকে শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে পারোনি। তোমার ন্যায়পরায়ণতার মূল্য যে আত্মসমর্পণে তা তুমি করোনি। বরং তুমি পাগলাটে হয়ে থাকতে চেয়েছো, সংখ্যালঘিষ্ঠ হতে চেয়েছো। একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ মনই কেবল বাস্তবতা দেখতে পায়, উইনস্টন। তুমি মনে করো বাস্তবতা বস্তুগত, বাহ্যিক, আর তার নিজের অধিকারে অস্তিত্ব পায়। তোমার এও বিশ্বাস বাস্তবতা স্ব-প্রমাণে ভাস্বর। যখন তুমি কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছো বলে নিজেকে কোনো ভাবনায় মগ্ন করো, তখন তুমি ধরে নাও তুমি যেমনটা দেখছো, অন্যরাও তাই দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, উইনস্টন, বাস্তবতা বাহ্যিক কিছু নয়। বাস্তবতা মানুষের মনের মাঝে থাকে, আর কোথাও নয়। কোনো ব্যক্তির মনে নয়, যে মন ভুল করতে পারে, কিন্তু যে কোনো পথে শিগগিরই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: একমাত্র পার্টির মনেই বাস্তবতার স্থান, যে পার্টি সমন্বিত ও অবিনশ্বর। পার্টি যাকে সত্য বলে ধরে নেবে, সেটাই সত্য। পার্টির চোখ দিয়ে না দেখলে বাস্তবতা দেখা অসম্ভব। এটা সেই সত্য যা তুমি এখন শিখতে যাচ্ছো, উইনস্টন। এর জন্য তোমার আত্মবিনাশ দরকার, ইচ্ছাশক্তি দরকার। তোমার বুদ্ধি আসবে তখনই, যখন তুমি হবে বিনম্র বিনয়ী। ’
কয়েক দণ্ড থামলেন তিনি, যেন যা বলেছেন তা একটু দমে যেতে দিলেন।
‘তোমার মনে পড়ে’—ফের শুরু করলেন, ‘তুমি ডায়রিতে লিখেছো, “স্বাধীনতা হচ্ছে দুই আর দুইয়ে চার হয়, সে কথা বলতে পারার স্বাধীনতা?’
‘জ্বী’—বলল উইনস্টন।
ও’ব্রায়েন তার বাম হাতটা তুললেন। হাতের পেছনের দিকটা উইনস্টনের দিকে। বুড়ো আঙুলটা গোটানো বাকি চারটি আঙুল সোজা হয়ে আছে।
‘এখানে আমার কয়টি আঙুল তুলেছি, উইনস্টন?’
‘চারটি। ’
‘এখন পার্টি যদি বলে এখানে চারটি নয় পাঁচটি—তাহলে কয়টি?’
‘চারটি। ’
ভয়াবহ একটি ব্যথা শুরুর মধ্য দিয়ে শব্দের উচ্চারণটি শেষ হলো তার। ডায়ালের কাঁটা তখন পঞ্চান্নর ঘরে। উইনস্টনের সারা শরীর থেকে ঘাম যেন ছিটকে বেরিয়ে এলো। বাতাস তার ফুঁসফুঁস বিদীর্ণ করে দিল আর গভীর গোঙানি শুরু হলো, দাঁতগুলো চেপে রেখেও উইনস্টন তা ঠেকাতে পারল না। ও’ব্রায়েন তাকে দেখছেন। চারটি আঙুল তখনও মেলে ধরা। হাতলটি ঘুরিয়ে নিলেন তিনি। এবার ব্যথার সামান্য উপশম হলো মাত্র।
‘কয়টি আঙুল, উইনস্টন?’
‘চারটি। ’
ডায়ালে কাঁটা ষাটের ঘর ছুঁলো।
‘কয়টি আঙুল, উইনস্টন?’
‘চারটি! চারটি! আর কী বলব আমি? চারটি!’
কাঁটা আবারও বেড়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু এবার সে আর ওদিকে তাকিয়ে নয়। ভারী কঠোর মুখখানি আর চারটি আঙুল তার দৃষ্টি ঢেকে রেখেছে। তার চোখের সামনে আঙুলগুলো বড়, ভারী পিলারের মতো দাঁড়িয়ে, অস্পষ্ট কিছুটা কম্পমানও মনে হচ্ছে। কিন্তু ভ্রান্তিহীনভাবেই সেখানে চারটি আঙুল সে দেখতে পাচ্ছে।
‘কয়টি আঙুল, উইনস্টন?’
‘চারটি, বন্ধ করুন, বন্ধ করুন এসব। যেভাবেই যা কিছুই আপনি করুন না কেনো ওখানে চারটিই আঙুল। চারটি!’
‘কয়টি আঙুল, উইনস্টন?’
‘পাঁচটি! পাঁচটি! পাঁচটি!’
‘না, উইনস্টন, ওই বলে ফায়দা নেই। তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি এখনো ভাবছো ওখানে চারটি। দয়া করে আবার বলবে, কয়টি আঙুল?’
‘চারটি! পাঁচটি! চারটি! আপনার যেটা মনে হয়। আপনি শুধু ওটা বন্ধ করুন, ব্যথা থামান!’
এপর্যায়ে সে বসে আছে। কাঁধ দুটি জড়িয়ে ও’ব্রায়েনের একটি বাহু। কয়েকদণ্ডের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল বুঝি। শরীরের যেসব জায়গায় বেঁধে রাখা ছিল সেগুলো এখন ঢিলা। খুব শীত লাগছে। থরথর করে কাঁপছে, কোনোভাবেই থামিয়ে রাখা যাচ্ছে না। দাঁতগুলোও ঠকঠক করছে। চোখের পানি নেমে এসেছে দুই গাল বেয়ে। হঠাৎ একটু সময়ের জন্য ছোট্ট শিশুর মতো ও’ব্রায়েনকে জড়িয়ে ধরল সে। ওর ভারী হাতদুটি দুই কাঁধ জড়িয়ে থাকায় আরাম পেয়েই বুঝি এমনটা করল। আর মন বলছে, ও’ব্রায়েনই তার রক্ষাকর্তা, যে ব্যথা তাকে দেওয়া হচ্ছে ওটা বাইরের চাপ, অন্যের প্ররোচনা। আর ও’ব্রায়েনই সেই ব্যক্তি যিনি তাকে এসব কিছু থেকে বাঁচাবেন।
‘তুমি ভীষণ ধীর শিখিয়ে, উইনস্টন’—শান্তস্বরে বললেন ও’ব্রায়েন।
‘কিন্তু আমি কী করতে পারি?’ আদুরে গলা তার। ‘চোখের সামনে যা দেখছি তাই তো বলব? দুই আর দুইয়ে চারই হয়। ’
‘কখনো কখনো, উইনস্টন, কখনো কখনো তাতে পাঁচ হয়। কখনো তাতে তিন হয়। আবার কখনো ওগুলো সব মিলে এক হয়ে যায়। তোমাকে আরো কঠোর চেষ্টা করতে হবে। পুরোপুরি পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠা সহজ কাজ নয়। ’
উইনস্টনকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন তিনি। তার শরীরের বিভিন্ন অংশ আবার শক্ত হয়ে বাঁধা পড়ল। তবে ব্যথা উবে গেছে, আর কাঁপুনিও থেমেছে। এখন তার কেবল একটু দুর্বল লাগছে আর শীত শীত করছে। ও’ব্রায়েন মাথাটি সাদা কোটধারীর দিকে ঘোরালেন, পুরো সময়টি জুড়েই যিনি স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা কোটধারী এবার ঝুঁকে পড়লেন আর উইনস্টনের চোখের দিকে তাকালেন, তার নাড়ি পরীক্ষা করলেন, একটি কান বুকের ওপর চেপে ধরে থাকলেন কিছুটা সময় আর শরীরের এখানে সেখানে টিপে টিপে দেখলেন আর ও’ব্রায়েনের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে ইঙ্গিত করলেন।
‘আবার’—বললেন ও’ব্রায়েন।
তার শরীর জুড়ে ব্যথার ধমক বয়ে গেল। এবার ডায়ালের কাঁটা সত্তর কিংবা পঁচাত্তর ছুঁয়েছে নিশ্চয়ই। এবার সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে জানে আঙুলগুলো তখনও সেখানে ধরে রাখা, আর চারটিই আঙুল। যতক্ষণ এই খিঁচুনি চলবে ততক্ষণ বেঁচে থাকতে পারার চিন্তাটাই এখন তার কাছে মুখ্য। চিৎকার করে উঠছে কি উঠছে না সে নিয়ে ভাবনা এবার সে ছেড়ে দিয়েছে। ফের ব্যথা কমে এলো। সে চোখ খুলল। ও’ব্রায়েন হাতলটি পেছনে ঘুরিয়ে দিলেন।
‘কয়টি আঙুল, উইনস্টন?’
‘চারটি। আমার ধারণা চারটি। তবে আমি চাই পাঁচটি দেখতে। পাঁচটি দেখতে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ’
‘তুমি আসলে কোনটা চাইছো, আমাকে প্রভাবিত করতে, যেন আমি ভাবি তুমি পাঁচটি দেখছো, নাকি আসলেই তুমি পাঁচটি দেখতে চাইছো।
‘সত্যিই পাঁচটি দেখতে চাই। ’
‘আবার’—বললেন ও’ব্রায়েন।
হতে পারে কাঁটা এবার আশির ঘরে—নব্বুইও হতে পারে। উইনস্টন তৎক্ষণাৎ ভুলে গেল কেন এই ব্যথার ব্যবস্থা। তার বুঁজে থাকা চোখের পাতার পেছনে এক দঙ্গল আঙুল যেন নাচানাচি করছে, দোল খাচ্ছে, একটি পেছনে অন্যটি এই লুকোচ্ছে, এই বেরিয়ে আসছে। সে ওগুলো গোনার চেষ্টায় রত, কিন্তু সে মনে করতে পারছে না কেন এই গণনা। সে শুধুই জানে এই গণনার চেষ্টা বৃথা, আর তা হয়ত হতে পারে, চার আর পাঁচের রহস্যময় পরিচিতির কারণেই। ফের উবে গেল ব্যথা। যখন সে চোখ খুলল, তখনও তার একই জিনিস দেখার কথা। অসংখ্য আঙুল, ঘুর্ণায়মান গাছেদের মতো তখনও হেলছে দুলছে, এবার এদিক থেকে ওদিকে আরবার ওদিক থেকে এদিকে যাচ্ছে। ফের চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।
‘কয়টি আঙুল আমি তুলে ধরেছি, উইনস্টন?’
‘আমি জানি না। আমি জানি না। আপনি যদি আবারও একই কাজ করতে চান তো আমাকে মেরে ফেলেন। চার, পাঁচ, ছয়—সত্যি বলছি, সততার সাথে বলছি আমি জানি না। ’
‘কিছুটা ভালো’—বললেন ও’ব্রায়েন।
উইনস্টনের বাহুতে একটি সূঁচ ঢোকানো হলো। ঠিক তখনই একটি সুখময়, প্রশান্তির উষ্ণতা শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে গিয়ে সবকিছুর উপশম করে দিল। ব্যথার কথা ততক্ষণে আধাটা ভুলেই গেছে সে। চোখ খুলল আর কৃতজ্ঞতার চাহনিতে তাকাল ও’ব্রায়েনের দিকে। ভারী, দাগভর্তি, কদাকার আর বুদ্ধিদীপ্ত মুখখানি দেখে তার হৃদয় যেন গলে গেল। সে যদি নড়তে পারত একটি হাত ও’ব্রায়েনের বাহুতে রাখত। এই মুহূর্তে যতটা লাগছে, এতটা ভালো ও’ব্রায়েনকে আর কখনোই লাগেনি তার, কারণ তিনিই তার ব্যথা থামিয়েছেন। পুরনো ভাবনাটি, ও’ব্রায়েন আসলে বন্ধু, নাকি শত্রু, ফের এসে ভর করল তার মনে। ও’ব্রায়েন এমন একজন যার সঙ্গে কথা বলা চলে। কেউ কারো কাছে যতটা ভালোবাসা চায় তার চেয়ে হয়ত বেশিই চায় তাকে বুঝতে পারুক। ও’ব্রায়েন তার ওপর পাগলের মতো নির্যাতন চালিয়েছেন। কিছু সময়ের জন্য সে নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিল, তিনি ওকে মেরে ফেলতে চান। এতে কিছুই যেয়ে আসে না। অন্য কিছু রয়েছে যা তাকে বলে দেয় তাদের মধ্যে বন্ধুতার চেয়ের গভীর কিছু রয়েছে, তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ: কোথাও বা অন্য কোনোখানে, যদিও সঠিক শব্দগুলো কখনোই হয়ত বলা হবে না, একটি স্থান মিলে যাবে যেখানে তাদের দেখা হবে, কথা হবে। একটি অভিব্যক্তি দিয়ে ও’ব্রায়েন তার দিকে তাকিয়ে, যা বলে দেয়, ঠিক একই ভাবনা তারও মন জুড়ে। যখন কথা বললেন তখন তা সহজ, কথোকথনের ভঙ্গিমায় কাজে বাজল।
‘তুমি কি জানো তুমি এখন কোথায়, উইনস্টন?’—বললেন তিনি।
‘জানি না। তবে ধারণা করছি ভালোবাসা মন্ত্রণালয়েই হবে। ’
‘তুমি কি জানো কতদিন ধরে তুমি এখানে?’
‘জানি না। কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস—আমার ধারণা কয়েক মাসই হবে। ’
‘তুমি কি বুঝতে পারো কেন আমরা মানুষদের এখানে আনি?’
‘স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য। ’
‘নাহ! ওটা কারণ নয়। ফের চেষ্টা করো। ’
‘তাদের শাস্তি দিতে। ’
‘নাহ!’—বিস্ময়ের উচ্চারণ ও’ব্রায়েনের। তার কণ্ঠ অস্বাভাবিকভাবে বদলে গেল। আর তার চেহারাটি হঠাৎই একইসঙ্গে কঠোর আর চঞ্চল হয়ে উঠল। ‘না হে, কেবলই তোমার স্বীকারোক্তি নিতে নয়, তোমাকে সাজাও দিতে নয়। বলব, কেন আমরা তোমাকে এখানে এনেছি? তোমার নিরাময়ের জন্য! তোমাকে পরিশুদ্ধ করে তোলার জন্য! বুঝেছো হে, উইনস্টন, এখানে আমরা যাকেই নিয়ে আসি তার রোগের নিরাময় না করিয়ে ছাড়ি না। ওইসব ফালতু যে অপরাধ তুমি করেছো তাতে থোড়াই পাত্তা আমরা দেই। কারো বাড়াবাড়িতেও পার্টির নেই সামান্য আগ্রহ, আমাদের কাজের স্থান একটাই তোমার চিন্তা। আমরা আমাদের শত্রুদেরও ধ্বংস করি না, আমরা তাদের পাল্টাই। বুঝেছো আমি কী বলতে চাইছি?
উইনস্টনের দিকে অনেকটা ঝুঁকে পড়েছিলেন তিনি। এতটাই কাছে যে তার মুখটি বিশাল বলে মনে হচ্ছিল, আর আরো কদাকার, কারণ নিচ থেকে সে ওটি দেখছিল। উপরন্তু তাতে মেখেছিল এক ধরনের পরমানন্দ আর পাগলাটেপনা। এতে উইনস্টনের হৃদয়খানি সংকুচিত হলো। হতে পারে এই বিছানাতেই সে গলে যাবে। অনেকটা নিশ্চিত করেই যেন বুঝতে পারছে ও’ব্রায়েন স্রেফ খেয়ালিপনায় আবার টেনে দেবেন ডায়ালের কাঁটা। তবে সেটা না করে ঠিক তখনই ও’ব্রায়েন পেছনে ঘুরলেন। এক-দুই পা আসা যাওয়া করলেন। আর অতঃপর কিছুটা কম উগ্রতায় ফের বলতে শুরু করলেন:
‘প্রথমেই তোমাকে বুঝতে হবে এটা এমন এক জায়গা যেখানে শাহাদৎ লাভের কোনো সুযোগ নেই। অতীতের ধর্মীয় নিপীড়নের কথা তুমি পড়েছো। মধ্যযুগের বিচারসভার কথাও জানো। ওসব কিছুরই কোনো মানে এখানে নেই। ওদের কাজ ছিল উৎপথগামিতার অবসান, আর কেবল অবসানই নয়, পুরোপুরি বিস্মৃত করে ছাড়া। প্রতিটি উৎপথগামিতায় তখন মৃত্যুআজ্ঞাপ্রাপ্তকে বেঁধে রাখা খুঁটিসমেত পুড়িয়ে দেওয়া হতো, আর তাতে অবদমিত হতো আরো হাজারো উৎপথগামী। কেন জানো? কারণ শত্রুদের প্রকাশ্যেই হত্যা করা হতো, আর তাদের এমন সময় হত্যা করা হতো যখনও তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অননুতপ্ত। সেই অননুতপ্ততাই হতো তাদের মৃত্যুর কারণ। মানুষগুলোও মৃত্যুকে বরণ করে নিত কারণ তারা তাদের সত্যিকারের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকত। আর স্বাভাবিকভাবেই যত যশ তাও ওই ভুক্তভোগীর পক্ষেই যেত আর ঘৃণা বা লজ্জাই জুটত বিচারকর্তার কপালে যারা তাকে পুড়িয়ে মারত। এরপর, বিংশ শতকে, এলো সমগ্রতাবাদীরা। হ্যাঁ ওই নামেই তাদের ডাকা হতো। জার্মানির নাৎসি আর রাশিয়ার সাম্যবাদীরাও ছিল। রুশরা উৎপথগামীদের বিচার করত ধর্মযাজকদের চেয়েও নিষ্ঠুরতায়। তারা মনে করত, অতীত থেকেই তাদের শিক্ষা, তারা জানত, যেভাবেই হোক কারো শহীদান লাভের সুযোগ দেওয়া হবে না। প্রকাশ্য বিচারে তারা যখন কোনো অপরাধীর সাজা দিত, তখন ইচ্ছা করেই তাদের মর্যাদার শেষ তলানিটুকুও খর্ব করে ছাড়ত। নির্যাতনে নির্যাতনে ওদের জর্জরিত করে দিত, যতক্ষণ না পর্যন্ত মাটিতে শুয়ে পড়ে, যা কিছু স্বীকার করে নিতে বলা হতো তাই ওদের মুখে ফুটত, নিপীড়নে, আঘাতে, অপদস্থতায় ওরা একজন অন্যজনের পেছনে লুকোত আর বিড়বিড় উচ্চারণে কেবল ক্ষমা চেয়েই চলত। এর কয়েক বছর পর একই ঘটনা আবারও ঘটত। তখন মৃত ব্যক্তিটি পেত শহীদের মর্যাদা, তাদের অপকৃষ্টতার কথাও সবাই ভুলে যেত। এরপর আবারও, কেন এমন হতো? প্রথমত কারণ তারা যে স্বীকারোক্তি দিয়েছিল তা ছিল ভয় দেখিয়ে আদায় করা আর নিঃসন্দেহেই অসত্য। আমরা এ ধরনের কোনো ভুল করি না। এখানে যে স্বীকারোক্তি উচ্চারিত হয় তার সবই সত্য। আমারাই তাকে সত্যে পরিণত করি। আর এমনকি মৃতদেরও আমরা আমাদের বিরুদ্ধে জাগ্রত হওয়ার সুযোগ দেই না। উত্তরপুরুষ তোমার জন্য ন্যায্যতা এনে দেবে সে অলীক কল্পনা তোমায় বন্ধ করতেই হবে, উইনস্টন। উত্তরপুরুষরা তোমার কথা জানতেই পাবে না। ইতিহাসের স্রোত থেকে তোমাকে পুরোপুরি তুলে নেওয়া হবে। আমরা তোমাকে গ্যাসে পরিণত করব আর আন্তর-আকাশে মিলিয়ে দেব। তোমার কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, রেজিস্ট্রারে থাকবে না, জীবন্ত কোনো মস্তিষ্কেই থাকবে না কোনো স্মৃতি। অতীতে এবং ভবিষ্যতে দুইয়েই তুমি বিলীন হয়ে যাবে। তুমি কখনোই বিরাজিত ছিলে না, নেই, থাকবে না। ’
তাহলে কেন আমাকে এত নির্যাতন? এক লহমার তিক্ততায় ভরা ভাবনা উইনস্টনের। ও’ব্রায়েন থমকালেন, যেন উইনস্টনের ভাবনার কথাটি সশব্দে বেজেছে তার কানে। তার বৃহৎ কদাকার মুখটি, কিছুটা সংকুচিত চাহনি নিয়ে ক্রমেই কাছে আসতে লাগল।
‘তুমি ভাবছো, আমরা যদি তোমাকে ধ্বংসই করে দেই, তাহলে তুমি যা বলছো বা করছো তাতে কিছুই যেয়ে আসে না। আর তাই যদি হয়, কেনই আমরা তোমার ওপর এত কষ্টের জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছি? সেটাই তো তো তুমি ভাবছো, নয় কি?’
‘জ্বী’—বলল উইনস্টন।
ইষৎ হাসলেন উইনস্টন। ‘তুমি একটা ঝামেলার মানুষ, উইনস্টন। তুমি একটা কলঙ্ক যা মুছে ফেলতেই হবে। একটু আগেই তোমাকে বললাম না, অতীতের যন্ত্রণাদাতাদের মতো নই আমরা? নেতিবাচক আনুগত্যে আমাদের আস্থা নেই, এমনকি সর্বান্তকরণ সমর্পণের পরেও নয়। সবশেষে তুমি যখন আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে তখন তোমাকে নিজের ইচ্ছাতেই করতে হবে। আমরা উৎপথগামীকে ধ্বংস করে দেই না, কারণ সে আমাদের প্রতিহত করে। যতদিন সে প্রতিহত করতে থাকে ততদিন আমরা তাকে ধ্বংস করি না। আমরা তাকে পাল্টে দেই। তার ভেতরের মনটাকে কব্জা করি, তাকে নতুন একটা গড়ন দেই; ভেতরের সকল দুষ্টু চিন্তাকে পুড়িয়ে দেই, আর ভেতর থেকে সকল ভ্রম বের করে আনি; আমরা তাকে পুরোপুরি আমাদের পক্ষে নিয়ে আসি, দেখানোয় নয়, বাস্তবে, মনে আর প্রাণে। আমরা তাকে আমাদেরই একজন করে ফেলি কারণ আমরা তাকে হত্যা করি। বিশ্বের কোথাও একটি ভ্রান্ত ভাবনা টিকে থাকুক তা আমাদের কাছে সহনীয় নয়, হোক সে গোপনে কিংবা অক্ষমতায়—যে কোনোভাবে। একই মৃতের ক্ষেত্রেও আমরা কোনো ব্যত্যয় মেনে নেই না। আগের উৎপথগামীরা মৃত্যু দুয়ারের দিকে এগিয়ে যেত একজন উৎপথগামী হিসেবেই, নিজেদের অবস্থান ঘোষণা দিতে দিতে, উল্লসিত ভঙ্গিমায়। রুশ শুদ্ধিকরণ অভিযানের যারা শিকার তারাও মাথায় বুলেটবিদ্ধ হওয়ার জন্য পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময়ও মস্তিষ্কে বিদ্রোহের আগুনই বহন করত। কিন্তু আমরা মস্তিষ্কটি উড়িয়ে দেওয়ার আগে সেটিকে শুদ্ধ করেই ছাড়ি। অতীতের অসীম ক্ষমতাধারীদের নির্দেশ ছিল “তুমি করবে না” সমগ্রতাবাদীদের নির্দেশ ছিল “তুমি করবে”। আমাদের নির্দেশ হচ্ছে, “তুমি রপ্ত করবে”। এই পর্যন্ত এইখানে আমরা যাদেরই এনেছি তাদের কেউই আমাদের বিরুদ্ধে থাকে নি। প্রত্যেককেই ধুয়ে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। এমনই সেই তিন হতভাগা ষড়যন্ত্রী, যাদের তুমি নির্দোষ বলেই একদা ভাবতে—জোন্স, অ্যারনসন, আর রাদারফোর্ড—তারাও শেষমেষ এখানে মাথাকুটে পড়েছিল। ওদের জিজ্ঞাসাবাদে আমি নিজেই অংশ নেই। আমি ওদের ধীরে ধীরে ভাঙতে দেখেছি, গুমড়াতে দেখেছি, আত্মমর্যাদা ভুলে দয়াভিক্ষা চাইতে দেখেছি, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছি—শেষে আর ব্যথা কিংবা ভয়ে নয়, স্রেফ ধৈর্যশীলতায় তারা ওসব চালিয়ে গেছে। আর ওদের সঙ্গে আমাদের কাজ যখন শেষ হলো তখন ওরা মানুষের কাঠামো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাদের মধ্যে দুঃখবোধ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। আর সেই দুঃখবোধ ছিল তাদের কৃতকর্মের জন্য আর বিগ ব্রাদারের প্রতি ভালোবাসার জন্য। ওরা তাকে যতটা ভালোবেসেছিল তা ছিল মর্মগ্রাহী। তখন তাদের একটাই প্রার্থনা ছিল, তাদের মন পরিষ্কার থাকতে থাকতে, ফের কলুসিত হওয়ার আগেই যেন তাদের গুলি করা হয়।
এক্ষণে তার কথাগুলো অনেকটা স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। পরমানন্দ, পাগলাটে একটা উদ্দীপক ভাব লেগেই আছে তার চোখেমুখে। তার কথায় কোনো ছল চাতুরি নেই, ভাবল উইনস্টন, তিনি ভণ্ড নন, যা কিছু বলছেন তার প্রতিটি শব্দেই তিনি বিশ্বাস করেন। এখন যা কিছু তাকে অবদমিত করে রাখছে তা হচ্ছে তার নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক অধস্তনতা বোধ। বিশাল ভারী মার্জিত মানুষটি তখনও একবার এদিক, একবার ওদিক করে চলেছেন। একবার তার দৃষ্টিসীমা থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন, আবার ঢুকছেন। সব দিক থেকেই ও’ব্রায়েন তার চেয়ে বড়। অনেক আগেই যা কিছু জেনে, পরীক্ষা করে, বুঝে ও’ব্রায়েন বাতিল করেছেন তা সে কখনো করতে পেরেছে কিংবা পারবে বলেও তার ধারণা হয় না। তার মন ধারণ করে আছে উইনস্টনের মন। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে কী করেই সত্য হয় যে, ও’ব্রায়েন পাগল? আসলে পাগল হচ্ছে সে নিজে, উইনস্টন। ও’ব্রায়েন থামলেন আর নিচে তার দিকে তাকালেন। তার কণ্ঠ আবারও কঠোর হয়ে উঠল।
‘ভেবো না, তুমি নিজে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে, উইনস্টন, বরং নিজেকে আমাদের কাছে পুরোপুরি সমর্পণ করো। ছাইদানীতে যারা নিজেদের নিয়ে গেছে তারা কেউ ছাড় পায়নি। আর আমরা যদি তোমাকে তোমার প্রাকৃতিক জীবনের বাইরের জীবনটিও যাপন করতে দেই, তুমি পার পাবে না। এই এখানে তোমার ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটছে তা ঘটেই চলবে। বিষয়টা আগেভাগেই বুঝে নাও। আমরা তোমাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে ধুলিস্মাৎ করে দেব যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ নেই। তোমার ক্ষেত্রে এমন সব কিছু ঘটবে যা থেকে তোমার পরিত্রাণের আর কোনো উপায় থাকবে না, তা যদি তুমি হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকো, তাহলেও না। সাধারণ মানুষের অনুভব ফিরে পাওয়ার যোগ্যতাই তোমার থাকবে না। তোমার ভেতরের সবটাই হবে মৃত। তুমি আর কোনোদিনই ভালোবাসতে পারবে না, বন্ধুত্ব করতে পারবে না, জীবনের আনন্দ খুঁজে পাবে না, হাসি-ঠাট্টা, কৌতূহল, সাহস, মর্যাদা কোনোটারই কোনো বোধ তোমার মাঝে জাগ্রত থাকবে না। তুমি হয়ে যাবে স্রেফ ফাঁকা। আমরা তোমাকে শূন্যতায় সংকুচিত করে দেব, এরপর তোমার ভেতরটা আমাদের দিয়ে ভরে দেব।
থামলেন এবং সাদা কোটধারীর দিকে ইঙ্গিত করলেন। উইনস্টন বুঝতে পারছিল তার মাথার পেছন দিকটাতে ভীষণ ভারী কিছু একটা বস্তু ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ও’ব্রায়েন বিছানার পাশে বসে পড়েছেন ফলে তার মুখখানি এখন ঠিক উইনস্টনের মুখের সামনে।
‘তিন হাজার’—উইনস্টনের মাথার উপর দিয়ে সাদা কোটধারীর উদ্দেশ্যে উচ্চারণ তার।
ইষৎ আর্দ্র দুটি নরম প্যাড উইনস্টনের কপালের দুই দিক থেকে নেমে এসে চেপে ধরল। ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে। ব্যথা আসছে, নতুন ধরনের এক ব্যথা। ও’ব্রায়েন তার গায়ের ওপর একটি হাত রাখলেন, নিশ্চয়তার হাত, অনেকটাই দয়াশীলতার সে হাত।
‘এবার তুমি ব্যথা পাবে না’—বললেন তিনি। ‘চোখ দুটো আমার চোখে রাখো। ’
এইক্ষণে তার মনে হলো ঘটে গেছে প্রলয়ঙ্কারী এক বিস্ফোরণ, বিস্ফোরণই, তবে নেই কোনো শব্দ। নিঃসন্দেহে চারিদিকে চোখ অন্ধ করে দেওয়ার মতো আলোর ঝলকানি। উইনস্টন আহত নয় তবে ধরাশায়ী। যদিও আগে থেকেই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, তারপরেও তার মনে হলো বিস্ফোরণের ধাক্কায়ই এমন চিৎপাৎ অবস্থা তার। একটি ব্যথাহীন ভয়াবহ ঘুষিতে সে পুরোই কুপোকাত। এছাড়াও তার মাথার ভেতরেও ঘটে গেছে কিছু একটা। চোখ যখন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল তখন বুঝতে পারল কে সে, আর কোথায় সে, চিনে ফেলল তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা মুখটিও। কিন্তু কোথাও বা অন্য কোনোখানে একটি বড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, যেন হতে পারে তার মস্তিষ্কের ভেতর থেকে একটি অংশ খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
‘এটাই শেষ নয়’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমার চোখের দিকে তাকাও। ওশেনিয়ার যুদ্ধ এখন কোন দেশের সঙ্গে?’
উইনস্টন ভাবল। তার মনে আছে ওশেনিয়া বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। সে নিজে ওশেনিয়ার একজন নাগরিক। ইউরেশিয়া ও ইস্টেশিয়ার কথাও তার মনে পড়ল। কিন্তু যুদ্ধ কার সঙ্গে চলছে তা তার জানা নেই। আসলে এখন সে আর জানেই না, যুদ্ধ বলে কিছু একটা আদৌ চলছে।
‘আমার মনে নেই। ’
‘ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে ইস্টেশিয়ার সঙ্গে। তোমার কি সে কথা এখন মনে পড়ে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘বরাবরই ওশেনিয়ার যুদ্ধ ছিল ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে। তোমার জীবনের শুরু থেকে, পার্টির জন্মের শুরু থেকে, সেই ইতিহাসের শুরু থেকে যুদ্ধ চলছে অবিরাম, বরাবরই একই যুদ্ধ। তোমার কি তা মনে পড়ে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘এগার বছর আগে তুমি তিন ব্যক্তিকে নিয়ে এক কাহিনী বানিয়েছিলে যাদের ষড়যন্ত্রের দায়ে ঘৃণ্য-মৃত্যু হয়েছে। তোমার মনে হচ্ছিল তুমি একটি কাগজের টুকরো দেখেছিলে যা প্রমাণ করে ওরা ছিল নির্দোষ। কিন্তু এমন কাগজের কোনো টুকরোর অস্তিত্ব কখনোই ছিল না। ওটা ছিল স্রেফ তোমার মনগড়া, আর পরে সেটাই তোমার বিশ্বাসে পরিণত হয়। তোমার কি এখন মনে পড়ে ঠিক কখন ওই কাগজের টুকরোটি আবিষ্কার করেছিলে। তোমার মনে আছে?
এখন আমি তোমার সামনে আমার হাতের আঙুলগুলো তুলে ধরব। তুমি পাঁচটি আঙুল দেখতে পাবে। মনে থাকবে?’
‘জ্বী। ’
ও’ব্রায়েন তার বাম হাতের আঙুলগুলো তুলে ধরলেন, বুড়ো আঙুলটি গুটিয়ে রাখা।
‘এখানে পাঁচটি আঙুল। তুমি কি পাঁচটি দেখতে পাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ। ’
সে তাই দেখছিল, মনের দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়ার আগে এক লহমার জন্য হলেও সে কিন্তু তাই দেখেছে। পাঁচটি আঙুল দেখতে পেয়েছে, আর তাতে নেই সামান্য ভুলও। এরপর অবশ্য সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। হতভম্বতা কাটিয়ে আবার সব ফিরে আসে। কিন্তু একটি মুহূর্ত ছিল—সে জানে না কতক্ষণ স্থায়ী ছিল সেই ক্ষণ, ত্রিশ সেকেন্ড হতে পারে—জাজ্জ্বল্য নিশ্চয়তায় সে বুঝতে পেরেছে ও’ব্রায়েন তখন যা বলেছেন তার সবটাই তার মস্তিষ্কের ফাঁকা অংশটুকুতে জায়গা করে নিচ্ছিল, আর হয়ে উঠছিল সম্পূর্ণ সত্য, আর তখন দুই আর দুইয়ে তিনও হতে পারত আর প্রয়োজন হলে অতি সহজেই হতে পারত পাঁচ। ও’ব্রায়েন তার হাতটি নামিয়ে আনার আগেই সেসব কিছু উবে যায়; তবে ওই অবস্থায় ফিরে যেতে না পারলেও, পুরোটাই মনে করতে পারে সে, কোনো ব্যক্তির জীবনের জাজ্জ্বল্যময় কোনো স্মৃতি মন থেকে যেমন কখনোই সরে না, ঠিক তেমনই।
‘দেখলে তো’—বললেন ও’ব্রায়েন, ‘যেভাবেই হোক এটা সম্ভব। ’
‘জ্বী’—বলল উইনস্টন।
চোখেমুখে সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি মেখে উঠে দাঁড়ালেন ও’ব্রায়েন। তার বাম দিকে সাদা কোটধারী লোকটিকে এবার একটি অ্যাম্পল ভেঙে সিরিঞ্জ দিয়ে ওষুধ ঢোকাতে দেখছে উইনস্টন। মুখে হাসি মেখে তার দিকে ফিরলেন ও’ব্রায়েন। অনেকটা আগের মতোই নাকের ডগায় চশমাটিকে ঠিকঠাক বসিয়ে নিলেন।
‘তোমার ডায়রি লেখার কথা মনে আছে’—বললেন তিনি, ‘লিখেছিলে আমি শত্রু নাকি মিত্র তাতে কিছু যায় আসে না। যেহেতু অন্ততপক্ষে আমি এমন একজন যিনি তোমাকে বুঝি আর আমার সঙ্গেই তোমার কথা বলা চলে। তোমার মনের ওই কথাগুলো আমার কাছে একটা আবেদন তৈরি করেছে। এতে আমার নিজের মনেও তৈরি করেছে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া, তবে তোমার শুদ্ধবাদিতাটুকু বাদ দিয়ে। আমাদের এই জিজ্ঞাসাবাদের ইতি টানার আগে তুমি চাইলে আমাকে কিছু প্রশ্ন অবশ্যই করতে পারো। ’
‘যা মন চায় সেই প্রশ্নই?’
‘যেকোন কিছু। ’—উইনস্টনের চোখ ডায়ালের ওপর স্থির হয়ে আছে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘ওটি বন্ধ আছে। তো বলো তোমার প্রথম প্রশ্নটি কী?’
‘জুলিয়াকে আপনারা কী করেছেন?’—বলল উইনস্টন।
ফের হাসলেন ও’ব্রায়েন। ‘ও তোমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, উইনস্টন। তখনই—সামান্য ইতস্ততাটুকুও ছাড়া। এত দ্রুত আমাদের কাছে এসেছে, এমনটা আমরা কদাচই দেখেছি। ওকে দেখে তুমি আর চিনতেই পারবে না। তার সব বিদ্রোহ, তার ঘৃণা, বোকামি, নোংরা মননশীলতা—সবকিছু তার থেকে উবে গেছে, ভেতর থেকে পুড়িয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। একদম খাঁটি পাল্টে যাওয়া বলতে যা বোঝায়। পাঠ্যবইয়েই তুমি কেবল এমনটা দেখতে পাবে। ’
‘আপনারা ওকে নির্যাতন করেছেন?’
জবাব দিলেন না ও’ব্রায়েন। ‘পরের প্রশ্ন করো’—বললেন তিনি।
‘বিগ ব্রাদার বলে কি কেউ আছেন?’
‘অবশ্যই আছেন। তিনি আছেন, পার্টি আছে। বিগ ব্রাদার হচ্ছেন পার্টির মূর্ত প্রকাশ। ’
‘তার অস্তিত্ব কি ঠিক তেমনই যেমনটা আমার অস্তিত্ব?’
‘তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই’—বললেন ও’ব্রায়েন।
অসহায়ত্বের বোধ ফের তাকে নিমজ্জিত করল। সে জানে, কিংবা সে কল্পনা করতে পারে, এইসব বিতর্কই তার অনস্তিত্বের প্রমাণ; কিন্তু ওরা বড়ই নির্বোধ, ওরা কেবলই বাক্যবাণে খেলে। ‘তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই’ বলে এই যে উক্তি তাতে কি কোনো যৌক্তিক অযৌক্তিকতা নেই? কিন্তু এই বলায় কীই হয়? যে সদুত্তরহীন ক্ষ্যাপাটে যুক্তি দেখিয়ে ও’ব্রায়েন তাকে ধ্বংস করে দিতে চাইলেন সে নিয়ে ভাবতে গিয়ে তার মন শুকিয়ে এলো।
‘আমি মনে করি আমি আছি’—নিজে নিজেই বলল সে। ‘আমার নিজের পরিচয় নিয়ে আমি সচেতন। আমার জন্ম হয়েছে আর আমি মারা যাব। আমার হাত আছে, পা আছে। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আমি এতটুকু হলেও স্থান দখল করে আছি-থাকি। আমি যখন আছি তখন আর কোনো ঘন বস্তু সেখানটাতে একসঙ্গে দখল নিতে পারে না। আর সেই বিবেচনায়, আদৌ কী বিগ ব্রাদারের অস্তিত্ব আছে?’
‘এসব কথা গুরুত্বহীন, তিনি আছেন এটাই যথেষ্ট। ’
‘বিগ ব্রাদারের কি কখনো মৃত্যু হবে?’
‘অবশ্যই না। তার মৃত্যু কী করে সম্ভব? পরের প্রশ্ন। ’
‘ব্রাদারহুডের কি অস্তিত্ব আছে?’
‘এটা, উইনস্টন, তুমি কখনোই জানতে পারবে না। আমরা তোমার সঙ্গে সব প্রয়োজনীয়তা শেষ করে যদি তোমাকে ছেড়েও দিই, আর যদি তুমি নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচেও থাকো, তাহলেও তুমি কখনো এই প্রশ্নের হ্যাঁ কিংবা না, কোনো উত্তরই খুঁজে পাবে না। যতদিন তুমি বেঁচে থাকবে এই ধাঁধা প্রহেলিকার মতো তোমার মন জুড়ে থাকবে। সমাধান পাবে না। ’
চুপ করে পড়ে থাকল উইনস্টন। তার বুকটা একবার ফেঁপে উঠে একটু দ্রুতই আবার পড়ে গেল। প্রথম যে প্রশ্নটি তার মনে এসেছিল সেটি এখনো সে জিজ্ঞাসা করেনি। সে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার জিহ্বা থেকে তা এখনো উচ্চারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ও’ব্রায়েনের চোখেমুখে এক ধরনের আনন্দের ক্ষীণ রেখা সে দেখতে পাচ্ছে। এমনকি তার চশমার কাচেও লেগে আছে এক ধরনের শ্লেষাত্মক দীপ্তি। উনি জানেন, ভাবল উইনস্টন, উনিই জানেন আমি কী জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম! আর সে কথা যখন ভাবছিল তখনই তার মুখ থেকে বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এলো:
‘রুম নম্বর একশ একে কী আছে?’
ও’ব্রায়েনের মুখের ভঙিমা পাল্টাল না। শুষ্ক কণ্ঠে তার উত্তর:
‘তুমি জানো ১০১ নম্বর রুমে কী আছে, উইনস্টন। প্রত্যেকেই জানে ১০১ নম্বর রুমে কী হয়। ’
সাদা কোটধারীর উদ্দেশ্যে তর্জনি তুললেন তিনি। এই দফা জিজ্ঞাসাবাদের স্পষ্টত এখানেই সমাপ্তি। উইনস্টনের বাহুতে ঝাকি দিল একটি সুঁই। আর অনেকটা তৎক্ষণাৎই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
অধ্যায় তিন
‘তোমার পুনারাবির্ভাব প্রক্রিয়ার তিনটি ধাপ,’ বললেন ও’ব্রায়েন। ‘একটি শিক্ষণ, একটি অনুধাবন, অন্যটি গ্রহণ। এবার সময় এসেছে দ্বিতীয় ধাপে ঢুকে পড়ার।
আগের মতোই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে উইনস্টন। তবে শরীরের বিভিন্ন অংশের বাঁধনগুলো এখন অপেক্ষাকৃত ঢিলা। ওরা এখনও তাকে বিছানাতেই আটকে রেখেছে। কিন্তু চাইলে হাঁটু দুটি সামান্য নাড়াচাড়া করাতে পারে, মাথাটিও এদিক ওদিক ঘোরানো যায়, আর হাত দুটি কনুই অবধি তুলতে পারে। ডায়ালটির ওপর আতঙ্কও ক্রমে কমেছে। দ্রুত একটু মাথাটা কাজ করাতে পারলে যন্ত্রণায় কাতরতার মাত্রাটা নিজেই কিছুটা কমাতে পারে; বিশেষ করে ও’ব্রায়েন যখন হাতলে হাত দেন তখনই সে চেহারায় এক ধরনের নির্বোধের ভাব ফুটিয়ে তোলে। মাঝে মাঝে ওরা জিজ্ঞাসাবাদের পুরো একটি অধিবেশন কাটিয়ে দেয় কিন্তু একটিবারও ডায়ালটি ব্যবহার করে না। সে মনে করতে পারে না, মোট ক’টি অধিবেশনে জিজ্ঞাসাবাদ চলেছে। তরে পুরো প্রক্রিয়াটি চলছে দীর্ঘ একটি সময় ধরে, অনির্দিষ্টকাল ধরে- আবার মোটে কয়েক সপ্তাহ ধরেও হতে পারে- আর দুটি অধিবেশনের মাঝে কখনো কয়েক দিন কেটে যায় আবার কখনো মাত্র দুই-এক ঘণ্টার ব্যবধানেই শুরু হয়ে যায়।
‘শুয়ে থাকতে থাকতে,’ বললেন ও’ব্রায়েন, ‘মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই তোমার কৌতূহল জাগে— দুয়েকবার আমার কাছে জানতেও চেয়েছ— এই ভালোবাসা মন্ত্রণালয় কেন তোমার পেছনে এত সময় খাটাচ্ছে, কেনই বা দিচ্ছে এত যন্ত্রণা! যখন তুমি মুক্ত জীবনে ছিলে তখনও মাঝে মধ্যে এমন ধন্ধে পড়ে যেতে এই একই প্রশ্নে। যে সমাজে তুমি বাস করেছ তার কলা কৌশল ঠিকই রপ্ত করেছ, কিন্তু এর পেছনে যে উদ্দেশ্য তা ধরতে পারনি। তোমার কি মনে আছে ডায়েরিতে লিখেছিল, “আমি জানি কীভাবে, কিন্তু জানি না কেন”? এই যে কেন নিয়ে তোমার ভাবনা সেটাই তোমার পরিশুদ্ধতার ওপর সন্দেহের কারণ। তুমি তো গোল্ডস্টেইনের দ্য বুক পড়েছ, অন্তত অংশ বিশেষ হলেও পড়েছ। ওই বই কি তোমাকে এমন কিছু জানাতে পেরেছে, যা তুমি আগে জানতে না?’
‘আপনি পড়েছেন বইটি?’ প্রশ্ন উইস্টনের।
‘ওটি আমি লিখেছি। বলা যায় আমিই, কারণ বইটি লিখতে আমি সহায়তা করেছি। তুমি তো জান কোনো বই কেউ একা তৈরি করতে পারে না।’
‘ওতে যা আছে, তা কি সত্য?’
‘বর্ণনা মতে সত্য। তবে যে কর্মসূচি এতে দেওয়া হয়েছে তা স্রেফ ফালতু। জ্ঞানের গোপন প্রসার— ক্রমে আলোকিত হয়ে ওঠা – তার মধ্য দিয়ে এক সময় প্রলেতারিয়েতদের বিদ্রোহ— আর পার্টির ক্ষমতাচ্যুতি। তুমি নিজেই নিজের কাছে জানতে চাও, দেখবে এই যা কিছু বলা হয়েছে তা স্রেফ ফালতু। প্রলেতারিয়েতরা কখনোই বিদ্রোহ করবে না, হাজার বছরেও না, লক্ষ বছরেও না। ওরা পারে না। কারণ কী? সে কথা তোমাকে আমার বলতে হবে না, তুমিও নিশ্চয়ই ওদের ওপর আশা ছেড়ে দিয়েছ। আর সে কারণেই পার্টিকে সরিয়ে দেওয়ার আর কোনো পথ নেই। পার্টির শাসন চিরস্থায়ী। আর সেটাই হোক তোমার চিন্তার সূচনা বিন্দু।’
বিছানার সন্নিকটে এগুলেন তিনি। ‘চিরস্থায়ী!’ ফের উচ্চারণ তার। ‘আচ্ছা চলো ফের আমরা সেই “কীভাবে” ও “কেন” প্রসঙ্গে ফিরি। তুমি ভালো করেই জান পার্টি কীভাবে এই ক্ষমতা ধরে রাখছে। এখন বলো কেন আমরা ক্ষমতা আঁকড়ে আছি। আমাদের উদ্দেশ্য কী? কেন আমরা ক্ষমতা চাই? বলো, কথা বলো,’ উইনস্টনের নীরবতার মুখে বলতেই থাকলেন তিনি।
আরো এক কিংবা দু’টি ক্ষণ নীরব হয়েই থাকল উইনস্টন। এক ধরনের বিপর্যস্ততাবোধ তাকে জাপটে ধরেছে। ও’ব্রায়েনের চোখে মুখে সেই আবছা ক্ষ্যাপাটে আমুদে ভাবটা ফিরে এসেছে। আগে থেকেই সে জানে কী বলবেন ও’ব্রায়েন। তিনি বলবেন, পার্টি কিন্তু তার নিজের জন্য ক্ষমতা চাইছে না, পার্টির এই চাওয়া স্রেফ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভালোর জন্য। পার্টির ক্ষমতা দরকার কারণ তার মানুষেরা খারাপ আছে, তারা সব ভীতু জীব যারা স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারে না, সত্যের মুখোমুখি হতে পারে না, আর সে কারণেই তাদের অবশ্যই শাসন করতে হবে, প্রক্রিয়াগতভাবে অপেক্ষাকৃত শক্তিধরদের হাতে তারা থাকবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। তিনি বলবেন স্বাধীনতা আর সুখ এই দুইয়ের মাঝখানেই থাকে মানুষের পছন্দ। আর অধিকাংশই সুখটাকেই বেশি ভালো বলে বেছে নেয়। তিনি বলবেন, পার্টি দুর্বলদের সার্বক্ষণিক ও চিরায়ত অভিভাবক, একটি বিশেষ নিয়োজিত গোষ্ঠী অপকর্মে লিপ্ত হয়ে ভালোর পেছনে ছুটছে, কিন্তু তারা আসলে তাদের নিজেদের সুখকেই অন্যদের জন্য বিলীন করে দিচ্ছে। ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে, ভাবল উইনস্টন, ভয়াবহ হচ্ছে ও’ব্রায়েন যখন এটা বলবেন, সেও তাতেই বিশ্বাস করবে। আপনি ওর চোখেমুখে তাকিয়ে এটাই দেখতে পাবেন। ও’ব্রায়েন সব জানেন। বিশ্বটা কেমন তা উইস্টনের চেয়ে তিনি হাজার গুণ ভালো জানেন, তিনিই জানেন, অধিকাংশ মানুষ কী দুরবস্থায় রয়েছে, পার্টি তাদের কোন মিথ্যার জগতে, বর্বরতার মাঝে ফেলে রেখেছে। এ সব কিছুই তিনি বোঝেন, পরিমাপ করতে পারেন, আর তাতেও কিছু যায় আসে না: কারণ এর সবকিছুরই ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে পার্টির আসল উদ্দেশ্য দিয়ে। একজন ক্ষ্যাপার বিরুদ্ধে আপনি কীই করতে পারেন, ভাবল উইনস্টন, যিনি আপনার চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান, যিনি আপনার সব যুক্তি মনোযোগ দিয়ে শোনেন আর ক্ষ্যাপাটেপনাটাই চালিয়ে যান।
‘আমাদের ভালোর জন্যই আপনারা আমাদের শাসন করছেন’ ক্ষীণস্বরে বলল সে। ‘মানুষ নিজে নিজেকে শাসন করতে পারে না এটাই আপনাদের বিশ্বাস, আর সে জন্য—’
তীব্র একটা ঝাঁকি খেয়ে সজোরে চিৎকার করে উঠল সে। প্রদাহের একটি প্রবাহ শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। ও’ব্রায়েন ডায়ালের হাতলটি পঁয়ত্রিশ মাত্রা অব্দি টেনে দিয়েছেন।
‘নির্বুদ্ধিতা!, উইনস্টন, স্রেফ নির্বুদ্ধিতা!’ বললেন তিনি। ‘এসব কথা না বলা ভালো সেটা তোমার জানা উচিত।
হাতলটি পেছনে টেনে আনলেন আর বলেই চললেন:
‘এবার আমি তোমাকে আমার প্রশ্নগুলোরই উত্তর জানাব। হ্যাঁ তাই। পার্টি ক্ষমতা চায় স্রেফ তার নিজের জন্য। অন্যের ভালো কিসে সে নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের আগ্রহ ক্ষমতাকে ঘিরেই। সম্পদে, বিলাসে, সুখের দীর্ঘ জীবনে কোনো কিছুতে নয়, স্রেফ ক্ষমতায়, খাঁটি ক্ষমতায়। খাঁটি ক্ষমতা বলতে ঠিক কী বুঝায় তা তুমি এখন বুঝতে পারছ। অতীতের সকল শাসক গোষ্ঠীর চেয়ে আমরা ভিন্ন, আর আমরা জানি, আমরা কী করছি। অন্য সবাই, এমনকি যাদের হাতে আমরা গড়ে উঠেছি তারাও ছিল কপট, কাপুরুষ। জার্মান নাৎসি আর রুশ সমাজবাদীরা তাদের শাসন পদ্ধতি নিয়ে আমাদের অনেকটা কাছাকাছি এলেও তাদের নিজেদের উদ্দেশ্য স্বীকার করে নেওয়ার সাহস কখনো দেখাতে পারেনি। ওরা ভান করে, হতে পারে বিশ্বাসও করে যে অনিচ্ছাতেই তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে, আর তা সীমিত সময়ের জন্যই। আর মনে করে, এর শেষ প্রান্তে রয়েছে এক স্বর্গীয় সময় যেখানে মনুষ্য জীব স্বাধীন আর সমতায় বাস করবে। আমরা তেমনটি নই। আমরা মনে করি, কেউ ক্ষমতা উৎসর্গ করার জন্য ক্ষমতা দখল করে না। ক্ষমতা কোনো উপায় নয়, ক্ষমতা হাতে পাওয়াই শেষ কথা। বিদ্রোহ থেকে নিরাপদে থাকতে কেউ স্বৈরাচারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে না, বরং স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেই বিদ্রোহের জন্ম। এই যে যন্ত্রণা দেওয়া তার উদ্দেশ্য যন্ত্রণা দেওয়াই। এই যে নির্যাতন, তার উদ্দেশ্য নির্যাতনই। এই যে ক্ষমতা তার উদ্দেশ্য ক্ষমতাই। এবার কি তুমি আমাকে বুঝতে শুরু করেছ?
ভাবনার মূলে আঘাত পেল উইনস্টন, ও’ব্রায়েনের ক্লান্ত মুখটি দেখে আগে যেমন আঘাত পেয়েছিল ঠিক তেমনই। একসময় এই মুখটি ছিল কর্কশ, মাংসল আর বুদ্ধিদীপ্ত, এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত অনুরাগও ছিল কিন্তু এখন সেটি তার কাছে অসহায় লাগছে, ক্লান্ত মনে হচ্ছে। চোখের নিচটা দেবে গেছে, গালের হাড্ডিগুলো থেকে চামড়া কুচকে এসেছে। ও’ব্রায়েন তার ওপর ঝুঁকে পড়লেন, ইচ্ছা করেই শীর্ণ মুখখানি আরও কাছে নিয়ে এলেন।
‘তুমি ভাবছ,’ বললেন তিনি, ‘আমার চেহারাটা বড় বুড়ো আর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তুমি ভাবছ আমি ক্ষমতার কথা বলছি কিন্তু নিজের শরীরের ক্ষয়ে যাওয়াকেই ঠেকাতে পারছি না। একটু বুঝতে চেষ্টা করবে, উইনস্টন, প্রতিটি মানুষ মূলত একেকটি কোষ? কোষের এই কুচকে যাওয়ার সঙ্গে তেজ কমে যাওয়ার সম্পর্ক নেই। হাতের নোখ কাটলে তুমি নিশ্চয়ই মরে যাবে না!
বিছানার দিক থেকে ফের মুখ ঘোরালেন তিনি, আবারও পায়চারি শুরু করলেন। এবার একটি হাত পকেটে।
‘আমরা হচ্ছি ক্ষমতার পুরোহিত,’ বললেন তিনি। ‘ঈশ্বরই শক্তি। কিন্তু এখন শক্তি হচ্ছে স্রেফ একটি শব্দ। তুমি ঠিক যতটা বুঝে নাও ততটাই এর শক্তি। শক্তি বলতে কী বুঝায় তা বুঝে নেওয়ার জন্য তোমার এখনই সময়। প্ৰথমই তোমাকে বুঝতে হবে, শক্তি সমষ্টিবাচক। ব্যক্তির শক্তি স্রেফ তখনই যখন সে ব্যক্তিসত্তা থেকে বেরিয়ে আসে। পার্টির স্লোগান তো তুমি জানই: — স্বাধীনতা দাসত্ব’। তোমার কী কখনো মনে এসেছে এই কথাটিকে উল্টে দেওয়া যায়? দাসত্বই স্বাধীনতা। একা— মুক্ত— মানুষ মাত্রই পর্যুদস্ত, পরাজিত মানুষ। এমনটা হতেই হবে, কারণ প্রতিটি মানুষের শেষ মৃত্যুতে। আর সেটাই সকল ব্যর্থতার চেয়ে বড় ব্যর্থতা। কিন্তু সে যদি পুরোপুরি নিজেকে সঁপে দিতে পারে, যে যদি নিজের পরিচয় থেকে পালাতে পারে, সে যদি নিজেকে পার্টিতে বিলীন করে দিতে পারে, যেন সেই পার্টি, তাহলে সেই সব শক্তির অধিকারী, অবিনশ্বর। তোমার জন্য দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে অনুধাবন। তোমাকে অনুধাবন করতে হবে ক্ষমতা আসলে মানুষের ওপরে প্রয়োগের একটি বিষয়। শরীরের ওপর- আর সর্বোপরি মনের ওপর প্রয়োগের বস্তুই হচ্ছে ক্ষমতা। কোনো কিছুর ওপর- যেটা তুমি বলছ বাহ্যিক কিছুর ওপর ক্ষমতার প্রয়োগের আদৌ কোনো গুরুত্ব নেই। বস্তুর ওপর আমাদের ক্ষমতা অনেক আগেই পুরোমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত।
একদণ্ডের জন্য ডায়ালের প্রতি অবজ্ঞা দেখাল উইনস্টন। সহিংস ভঙ্গিতে সে নিজেকে একটু তুলে বসানোর চেষ্টা করল, তবে তাতে ভীষণ ব্যথা লাগিয়ে শরীরটিকে সামান্য নাড়াতে পারল মাত্র।
‘কিন্তু আপনি কীভাবে বস্তুতে নিয়ন্ত্রণ আনবেন?’ একটু জোর স্বরেই বলল সে। ‘আপনি তো জলবায়ুতে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেন না, অভিকর্ষে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেন না। রোগে, বেদনায়, মৃত্যুতে-’
হাতের সামান্য ইঙ্গিতে তিনি থামালেন উইনস্টনকে। ‘আমরা বস্তুতে নিয়ন্ত্রণ করি কারণ আমাদের নিয়ন্ত্রণ মনের মাঝে স্থাপিত। বাস্তবতার অবস্থান মানুষের খুলির অভ্যন্তরে। তুমি তার মাত্রা দিয়ে শিক্ষা নেবে উইনস্টন। আমরা পারি না এমন কিছুই নেই। ভোজবাজির মতো অদৃশ্য করে দেওয়া, শূন্যে ভাসিয়ে রাখা- যে কোনো কিছু। এই যে কক্ষ আর এর মেঝে, চাইলে আমি সাবানের বুদবুদের মতো ভাসিয়ে দিতে পারি। তবে আমি চাই না, কারণ পার্টিও তা চায় না। ওই সব উনবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতির নিয়মের কথা তোমাকে ভুলে যেতে হবে, ওগুলো থেকে মুক্ত হতে হবে। এখন প্রকৃতির নিয়ম আমরাই তৈরি করি।’
‘আসলে কিন্তু আপনারা নন! আপনারা এই গ্রহের মালিক নন। ইউরেশিয়া আর ইস্টেশিয়ার কথা তাহলে কী বলবেন। আপনারাতো এখনও ওদের দখলে নিতে পারেননি।’
‘গুরুত্বহীন। সুবিধামতো সময়ে আমরা ওদের দখলে নেব। আর যদি তা নাও নেই, কীই ফারাক তাতে? আমরা ওদের অস্তিত্বকেই ঘুচিয়ে দিতে পারি। এই ওশেনিয়াই মূলত গোটা বিশ্ব।’
‘কিন্তু বিশ্বটাইতো সেফ ধূলিকণা মাত্র। মানুষ সেখানে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র-অসহায়। কতদিনই আর মানুষ টিকে থাকবে? মিলিয়ন মিলিয়ন বছর এই পৃথিবীতে কেউ ছিল না।’
নির্বোধ। পৃথিবী আসলে আমাদের সমান বয়সী, এর চেয়ে বেশি বয়স পৃথিবীর নয়। এর বড় হবেই কী করে? মানুষের সচেতন বোধের ভেতরে যতটুকু তার বাইরে তো আর কিছুরই অস্তিত্ব নেই ‘
‘কিন্তু পাথরগুলো তো বিলুপ্ত প্রাণীর হাড্ডিরই জমাটরূপ– প্রকাণ্ড লোমশ হাতি আর জংলি জন্তু অতিকায় সরীসৃপ বাস করত যখন মানুষের নাম গন্ধও ছিল না।’
‘ওইসব হাড্ডি কি তুমি কখনো দেখেছ, উইনস্টন? ‘নির্ঘাত দেখনি। উনবিংশ শতাব্দীর জীব বিজ্ঞানীদেরই আবিস্কার ওসব। মানুষের আগে আর কিছুই ছিল না। মানুষের পরে, তুমি যদি সত্যিই অন্তে পৌঁছাতে পার, আর কিছু থাকবেও না। মানুষের বাইরে আসলে আর কিছু নেই।’
‘কিন্তু গোটা বিশ্বই তো আমাদের বাইরে পড়ে আছে। ওই আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন! তাদের কোনো কোনোটি মিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরে। ওরা চিরতরেই আমাদের নাগালের বাইরে।’
‘কী এই তারকারাজি?’ বললেন ও’ব্রায়েন। ‘ওগুলো স্রেফ কয়েক কিলোমিটার দূরের আলোক ছটা। আমরা চাইলেই ওগুলোর কাছে যেতে পারি। নয়তো ওগুলোর অস্তিত্ব মুছে দিতে পারি। বিশ্বের মাঝে এই পৃথিবীর অবস্থান। সূর্য আর তারাগুলোই একে ঘিরে ঘুরপাক খায়।’
‘আরেকবার প্রবলভাবে নড়ার চেষ্টা করল উইনস্টন। তবে এবার কোনো শব্দ করল না। ও’ব্রায়েন তার কথা চালিয়ে গেলেন যেন তাকে বলতেই হবে:
‘কোনো বিশেষ কারণে নিঃসন্দেহে তা সত্য নয়। আমরা যখন সমুদ্রে জাহাজ চালাই, অথবা আমরা যখন কোনো গ্রহণ হবে বলে ধারণা করি, তখন আমরা পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে সেটাকেই সঠিক বলে দেখতে পাই, বুঝতে পারি তারাগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে। কিন্তু তাতে কীই হয়? তোমার কি মনে হয় এই যে জ্যোতিষ্কমণ্ডল এর একটি প্রতিরূপ বানানো আমাদের পারঙ্গমতার বাইরে? ওই তারকাগুলো আমাদের প্রয়োজন মাফিক আমাদের কাছেও থাকতে পারে আবার দূরেরও হতে পারে। তুমি কি মনে করছ আমাদের গণিতজ্ঞরা তা করতে পারবে না? তাহলে তুমি কি দ্বৈতচিন্তার কথা ভুলে গেছ?’
বিছানায় শুয়ে পিঠে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল উইনস্টন। কী উত্তর তার মুখ থেকে বের হয়েছিল সেটা ধর্তব্যের নয়। যে উত্তরই হোক না কেন, সে উত্তরই তাকে এখন মুগুর মেরে গুঁড়িয়ে দিল। তবে এখনও সে জানে, নির্ঘাতই জানে, যা সে বলেছে সেটাই সত্য। তোমার মনে যা কিছু আছে তার বাইরে আর কিছুই থাকতে পারে না— এমনই বিশ্বাস- নিঃসন্দেহে কোনো না কোনো একটি পথ রয়েছে যা দিয়ে এই বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করা সম্ভব। অনেক আগেই কি ওই ভাবনা ভ্রান্তিমূলক বলে প্রমাণিত হয়নি? এর একটা নামও দেওয়া হয়েছিল, অবশ্য নামটি সে এখন ভুলে গেছে। একটি আবছা হাসির রেখা খেলে গেল ও’ব্রায়েনের মুখে। তখনও তিনি উইনস্টনের দিকে ঝুঁকে পড়ে টানা তাকিয়ে আছেন।
‘আমি তোমাকে বলেছি, উইনস্টন,’ বললেন তিনি, ‘বলেছি যে, অধিবিদ্যা তোমার শক্ত পয়েন্ট হতে পারে না। তুমি যে শব্দটি স্মৃতিতে হাতড়ে বেড়াচ্ছ ওটা আত্মজ্ঞানবাদ। কিন্তু তুমি ভুল করছ। এই যা কিছু তুমি ভাবছ তা আত্মজ্ঞানবাদ নয়। একে তুমি যৌথ আত্মজ্ঞানবাদ বলতে পার। তবে ওটি ভিন্ন বিষয়, ভিন্ন শুধু নয়, ঠিক উল্টো। এসব কিছুই অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা,’ একটি ভিন্ন কণ্ঠে বললেন তিনি। ‘প্রকৃত ক্ষমতা, দিনরাত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে যে ক্ষমতা আমরা ধারণ করি, তা বস্তুর ওপর প্রয়োগের ক্ষমতা নয়, তা মানুষের ওপরেই প্রয়োগযোগ্য।’ একটু থামলেন, আবারও ঠিক সেই সম্ভাবনাময় মেধাবী ছাত্রটিকে স্কুলশিক্ষকের প্রশ্ন করার ভঙ্গিমায় বললেন: ‘একটি ব্যক্তি ঠিক কীভাবে অন্যের ওপর তার ক্ষমতা খাটায়, উইনস্টন?’
উইনস্টন ভাবল কিছুটা ক্ষণ। ‘তাকে কষ্ট দেওয়ার মধ্য দিয়ে,’ বলল সে।
‘ঠিক তাই। তাকে কষ্ট দেওয়ার মধ্য দিয়েই। আনুগত্যই শেষ কথা নয়। সে যদি ভোগান্তিতে না পড়ে, তাহলে কী করেই তুমি নিশ্চিত হবে সে তার নিজের নয় তোমার ইচ্ছায় এই আনুগত্য দেখাচ্ছে? দুর্বিষহ বেদনা আর অপদস্থতার মাঝেই নিহিত থাকে ক্ষমতা। মানুষের মনকে বহুধা বিভক্ত করে, ছিন্নভিন্ন করে ফের নিজের পছন্দ মতো সেই মন গড়ে তোলাই ক্ষমতা। তাহলে, এখন তুমি কী দেখতে শুরু করেছ, ঠিক কী ধরনের বিশ্ব আমরা গড়ে তুলছি? এটা যারা সুখ বা প্রীতিকেই পরমার্থ ভাবত সেই সেকেলে সংস্কারবাদীদের ইউটোপীয় প্রেয়বাদের ঠিক উল্টো। এটি ভয়, প্রতারণা আর নিদারুণ যন্ত্রণার এক বিশ্ব, পদদলন আর পদদলিত হওয়ার এক বিশ্ব, প্রতিটি পরিশোধনে নির্মমতা কমার নয় বরং ক্রমেই বেড়ে চলার এক বিশ্ব। আমাদের এই বিশ্বে অগ্রগতি মানেই হচ্ছে কষ্ট বাড়ার অগ্রগতি। পুরনো সভ্যতাগুলো দাবি করতে পারে তারা ভালোবাসা আর ন্যায়পরায়ণতার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠা ঘৃণার ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। আমাদের এই বিশ্বে ভয়, ক্রোধ, বিজয়োল্লাস আর নীচ মনোভাবাপন্নতা ছাড়া আর আবেগের স্থান নেই। এর বাইরে আর যা কিছু সবই আমরা ধ্বংস করে দেব- সবকিছু। এরই মধ্যে বিপ্লব পরবর্তী যে ভাবনাগুলো টিকে ছিল তা আমরা মানুষের মগজ থেকে গুঁড়িয়ে দিতে পেরেছি। আমরা বাবা-মা আর সন্তানের মধ্যে সম্পর্কের ছেদ টেনে দিয়েছি, আলাদা করে দিয়েছি পুরুষে পুরুষে কিংবা পুরুষে নারীতে যে সম্পর্ক তাও। এখন আর কেউ নিজের স্ত্রীকে, শিশুটিকে কিংবা বন্ধুকে বিশ্বাস করার ভরসাটুকুও পায় না। আর ভবিষ্যতে কোনো স্ত্রীও থাকবে না, কোনো বন্ধুও থাকবে না। শিশুদের জন্মের পরপরই মায়ের কোল থেকে নিয়ে নেওয়া হবে, ঠিক যেভাবে মুরগির ওম থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ডিম। যৌনতার চাহিদা ঘুচিয়ে ফেলা হবে। সহবাস আর জনন হবে স্রেফ বাৎসরিক এক আনুষ্ঠানিকতা। আমরা যৌনতায় রাগমোচনেরও কোনো অস্তিত্ব রাখব না। আমাদের স্নায়ুতত্ত্ববিদরা এ নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। পার্টির প্রতি আনুগত্য ছাড়া আর কোনো আনুগত্যের অবকাশ থাকবে না। বিগ ব্রাদারের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া ভালোবাসা বলেও আর কিছু থাকবে না। হাসি-ঠাট্টার অস্তিত্ব থাকবে না, কেবল টিকে থাকবে শত্রুপক্ষের পরাজয়ের পর অট্টহাসিতে ফেটে পড়া। কোনো কলা থাকবে না, সাহিত্য থাকবে না, বিজ্ঞান থাকবে না। আমরাই যখন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাব তখন আমাদের বিজ্ঞানের আর দরকারই হবে না। সুন্দর আর কদাকারের মধ্যে কোনো ভেদ আমরা রাখব না। আমাদের জীবন প্রক্রিয়ায় কোনো কৌতূহলের স্থান থাকবে না, আনন্দিত হয়ে ওঠার মতোও কিছু রাখা হবে না। আনন্দময়তার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু সদাই— ভুলে যেয়ো না, উইনস্টন— সদাই তুমি দেখতে পাবে ক্ষমতার উন্মত্ততা, সারাক্ষণই চলছে, আর ক্রমাগত অব্যাহতভাবে তা আরও আরও বেড়ে চলছে। সদাই, সারাক্ষণ, জয়ের রোমাঞ্চকর শিহরণ চলতে থাকবে, আর চলবে শত্রুর অসহায় পরাজয়ে খুশির ফল্গুধারা। তুমি যদি ভবিষ্যতের একটি চিত্র এখনই পেতে চাও- স্রেফ কল্পনা কর, বুটের নিচে নিরন্তর নিষ্পেষিত মানুষের মুখ।’
থামলেন তিনি, যেন চাইছেন উইনস্টন কিছু একটা বলুক। বিছানা থেকে আরও একবার পিঠটাকে তুলতে চেষ্টা করল উইনস্টন। সে কিছুই বলতে পারল না। তার হৃদযন্ত্র যেন হীম শীতল হয়ে এসেছে। ও’ব্রায়েন তার কথা চালিয়ে গেলেন:
‘আর মনে রাখবে এটা চিরন্তনভাবেই চলবে। মুখগুলো পায়ের নিচেই নিষ্পেষিত হতে থাকবে। উৎপথগামীরা, সমাজের শত্রুরা সদাই দলিত হবে বুটের নিচে, যাতে তাদের বারবার পরাজয় হয়, বারবারই তারা হয় অপদস্থ। এই যে আমাদের হাতে ধরা পড়ার পর থেকে তোমার সঙ্গে যা কিছু চলছে— তা চলতেই থাকবে, আর ক্রমেই তা হয়ে উঠবে আরও ভয়ংকর। এই যে গুপ্তচরবৃত্তি, প্রতারণা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, হত্যা, গুম যা কিছু দেখছ তা কমবে না কস্মিনকালেও। এটা যেমন সন্ত্রাসের রাজত্ব হবে তেমনি হয়ে থাকবে জয়োল্লাসের রাজত্বও। পার্টি যত বেশি ক্ষমতাধর হবে, ততই বেশি হয়ে উঠবে অসহিষ্ণু : বিরোধিতা যত দুর্বল হবে স্বৈরতন্ত্র ততই জেঁকে বসবে। গোল্ডেস্টেইন আর তার নব্যতান্ত্রিকরাও টিকে থাকবে চিরস্থায়ীভাবে। প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে তারা পরাজিত হতে থাকবে, অপদস্থ হতে থাকবে, দায় নিতে থাকবে সকল অপরাধের, তাদের ওপর নেমে আসবে ধ্বংসের খাড়া, আবার অতঃপর বরাবারই তারা টিকে যাবে। সাতটি বছর ধরে আমি যে নাটক নাটক খেলা তোমার সাথে খেলে গেছি সেই নাটকই চলতে থাকবে বার বার, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে, সর্বদাই আরও কঠোরতায়। বরাবরই আমরা উৎপথগামীদের টিকিয়ে রাখব আমাদের ক্ষমাভিক্ষা চাওয়ার জন্য, নির্যাতনে ব্যথায় চিৎকার পাড়ার জন্য, ভেঙে কুঁকড়ে যাওয়ার জন্য- আর যখন সব শেষ হবে তখন আবার তারাই হবে অনুতপ্ত, তাদের জন্যই তাদের রক্ষা করা হবে, তারা যেন অন্তত হামাগুঁড়ি দিয়ে হলেও আমাদের পায়ের কাছে চলে আসতে পারে, মাথা কুটতে পারে। এটিই হচ্ছে এক বিশ্ব যা আমরা তৈরি করছি, উইনস্টন। এমন এক বিশ্ব যেখানে জয়ের পর জয়ই শুধু আসবে। আর চলবে জয়োল্লাসের পর আবার জয়োল্লাস অতঃপর আবারও জয়োল্লাস: ক্ষমতার মর্মমূলে এভাবেই আমরা আরও সিঁধিয়ে যাব আর যেতেই থাকব। আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি বুঝতে শুরু করেছ ঠিক কোন বিশ্বটিই আমাদের পছন্দ। আর শেষ পর্যন্ত তুমি যতটা না বুঝবে তার চেয়ে বেশি করে এই বিশ্বকে মেনে নেবে, স্বাগত জানাবে, হবে এই বিশ্বেরই অংশ।’
এবার বুঝি কথা বলার জন্য একটু শক্তি পেল উইনস্টন। ‘আপনারা পারবেন না!’ ক্ষীণকণ্ঠে বলল সে।
‘এই কথা দিয়ে তুমি কী বোঝাতে চাইছ, উইনস্টন?’
‘যে বিশ্বের বর্ণনা এতক্ষণ ধরে দিলেন তেমন কোনো বিশ্ব আপনারা সৃষ্টি করতে পারবেন না। এটা নিছকই স্বপ্ন। এটা অসম্ভব।’
‘কেন?’
“ভয়, ঘৃণা আর হিংস্রতার কোনো সভ্যতা কস্মিনকালেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, কখনোই এমন অবস্থা টিকেও থাকবে না।’
‘কেন নয়?’
‘কারণ এর কোনো বৈধতা থাকবে না। এসব কিছু ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে। আত্মহত্যায়ই হবে এর অবসান।’
‘স্রেফ বোকা তুমি। তোমার মনে যে বোধ বাসা বেঁধে আছে তা বলছে ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণা আগে ফুরিয়ে যাবে। কেন তা হবে? আর যদি তা হয়ও, কীই বা ফারাক তাতে? ধরে নাও আমরা দ্রুতই ফুরিয়ে গেলাম, আমরা ত্রিশেই বার্ধক্যে উপনীত হলাম। তাতেই কী আসে যায়? তুমি কি বুঝতে পারছ না, কোনো ব্যক্তির মৃত্যুতে এসবের মৃত্যু ঘটে না? পার্টি তো অবিনশ্বর।’
আগের মতো, এই কণ্ঠ উইনস্টনকে আবারও অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিল। উপরন্তু একটা ভয়ও হতে লাগল যে যদি অস্বীকার করে ও’ব্রায়েন আবারও ডায়ালের হাতল টেনে দেবেন। তবে সে চুপও থাকতে পারল না। ক্ষীণ কণ্ঠে, যুক্তিহীনভাবে, ও’ব্রায়েনের কথায় সৃষ্ট ভয়টুকুও উপেক্ষা করে পাল্টা আঘাতেই ফিরল সে।
‘আমি জানি না- আমি পাত্তাও দেই না। যেভাবেই হোক পরাজয় আপনাদের হবেই। কিছু না কিছু এসে আপনাদের পরাস্ত করবে। জীবনের কাছেই আপনারা হবেন পরাজিত।’
‘আমরাই জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করি, উইনস্টন, সর্বত্র, সবক্ষেত্রে। তুমি ভাবছ মানব চরিত্র বলে একটা কথা আছে, আর আজ আমরা যা করছি তা-ই এক সময় চরম নিষ্ঠুরতায় আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমরাই মানব চরিত্র গঠন করি। মানুষ কিন্তু নিরন্তর নমনীয়। অথবা হতে পারে, তুমি তোমার সেই পুরনো ধারণায় ফিরে গেছ, প্রোলেতারিয়েতরা কিংবা ক্রীতদাসরা এক সময় জেগে উঠবে আর আমাদের ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলে দেবে। এসব ভাবনা মন থেকে হটাও। ওরা অসহায়, স্রেফ পশুর মতো। পার্টিই হচ্ছে মানবতার অপর নাম। বাকি সব কিছু বাহ্যিক- অপ্রযোজ্য।’
‘তাতে আমার কিছু যায় আসে না। শেষমেশ ওরাই আপনাদের পরাজিত করবে। খুব শিগগিরই নয়তো আরও পরে, ওরা ধরে ফেলবে আপনাদের আসল চেহারা, আর অতঃপর ওরা আপনাদের বহুধা খণ্ডে ছিন্নভিন্ন করে দেবে।’
‘এমনটা যে ঘটতে যাচ্ছে তার কোনো প্রমাণ কি তুমি দেখতে পাচ্ছ? অথবা কোনো কারণ কি দেখাতে পার যা বলে দেয় এমনটা ঘটবে?’
‘না তা নেই। এটা আমার বিশ্বাস। আমি জানি আপনাদের পতন হবেই। এই ব্রহ্মাণ্ডে কিছু একটা আছে— আমি ঠিক জানি না, কোনো অশরীরী আত্মা, কোনো মূলমন্ত্র— যাকে আপনারা কখনোই জয় করতে পারবেন না।’
“তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস কর, উইনস্টন?’
‘না।’
‘তাহলে কি সেটা, কী সেই মূলমন্ত্র যা আমাদের পরাস্ত করবে?’
‘আমি জানি না। হতে পারে মানুষেরই আত্মা।
‘আর তুমি কি তোমাকে একজন মানুষ ভাব?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি যদি মানুষ হও তাহলে তুমিই তাদের মধ্যে শেষ মানব সন্তান। তোমার মতোরা আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে; আমরা হচ্ছি তাদের উত্তরাধিকার। তাহলে এবার কি বুঝতে পারছ, তুমি স্রেফ একা। তুমি এখন ইতিহাসেরও অতীত, তুমি অস্তিত্বহীন।’ তার আচরণ পাল্টে গেল আর আরও কর্কশ স্বরে উচ্চারণ করলেন: ‘আর তুমি নিজেকে আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাব, আমাদের মিথ্যাচার আর নিষ্ঠুরতার বিচারেই তুমি তা ভেবে চলেছ?’
‘হ্যাঁ, আমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলেই বিবেচনা করি।’
ও’ব্রায়েন কথা বলছেন না। অন্য দুটি কণ্ঠ তখন কথা বলছে। একটু পরে উইনস্টন চিনতে পারল দুটি কণ্ঠের একটি তার নিজের। এটি আসলে ও’ব্রায়েনের সঙ্গে তার ঘটে যাওয়া কথোপকথনের সাউন্ড ট্র্যাক। সেই রাতের, যে রাতে সে ব্রাদারহুডের সদস্য হয়েছিল। সে শুনতে পাচ্ছে মিথ্যাচার, চুরি, প্রতারণা, হত্যা, মাদকাসক্তি, পতিতাবৃত্তি, সংক্রমণ রোগ ছড়ানো, শিশুর মুখে দাহ্যবস্তু ছুড়ে মারার মতো সব কাজ করার অঙ্গীকার করে চলেছে। একটু অসহিষ্ণু অভিব্যক্তি ফুটে উঠল ও’ব্রায়েনের চেহারায়, যেন বলতে চাইছেন এই কথাগুলো শোনানোর কোনো মানে হয় না। এরপর একটি সুইচ বন্ধ করে দিলেন আর তাতে কথোপকথন থেমে গেল।
‘বিছানা থেকে ওঠো,’ বললেন তিনি।
বাঁধনগুলো আপনা-আপনি শিথিল হয়ে গেল। উইনস্টন নিজেকে মেঝের দিকে নামিয়ে নিল আর একটু কেঁপে কেঁপে উঠে দাঁড়াল।
তুমিই শেষ মানব সন্তান,’ বললেন ও’ব্রায়েন। ‘তুমিই মানব আত্মার অভিভাবক। এবার তুমি যেমন, নিজেকে ঠিক তেমনটাই দেখতে পাবে। কাপড়গুলো খুলে ফেল।’
আলখেল্লার ফিতার গিট্টুটা খুলে দিল উইনস্টন। জিপারটি অনেকদিন খোলা হয়নি। সেই আটক হওয়ার পর সব কাপড় একবারে আর খোলা হয়েছিল কিনা তার মনে পড়ে না। আলখেল্লার নিচে তার গায়ে নোংরা ঘিনঘিনে হলুদ রঙ ধরা শীর্ণ গেঞ্জি জাঙ্গিয়া, অন্তর্বাসের নামে ওগুলো চেনা যাবে এটুকুই মাত্র। কাপড়গুলো খুলে মেঝেতে ছুড়ে দেওয়ার পরই তার নজরে এল রুমের শেষ দিকের তিন-দিকওয়ালা আয়নাটি। ওটির দিকে একটু এগিয়েই থমকে দাঁড়াল সে। নিজের অজান্তেই ভেতর থেকে একটি চিৎকার বেরিয়ে এল।
‘এগিয়ে যাও,’ বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আয়নার দুটি পাতের মাঝামাঝি দাঁড়াও। তাতে সাইডভিউটাও দেখতে পাবে।’
ভীষণ ভয় পেয়েই থামল সে। একটি ঝুঁকে পড়া ধূসর-রঙা কঙ্কালসার দেহ তার দিকে এগিয়ে আসছে। এতই ভয়ংকর যে সে ভাবতেও পারছে না ওটাই সে। আয়নার আরও কাছাকাছি এগিয়ে গেল। কুঁজো হয়ে পড়ার কারণে মনে হচ্ছে আয়নার ভেতরের জন্তুটির মুখটা যেন সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। একটা দুঃখী, কারাভোগী চেহারায় এক সময়ের অভিজাত কপালটি যেন খুলির ভেতর ঢুকে পড়েছে। বেঁকে যাওয়া নাক, আর ভাঙা চোয়ালের উপরে চোখ দুটো বেশ ভয়ংকর আর তীক্ষ্ণ ঠেকছে। গাল চিমসে গেছে, মুখখানি চুপসে গেছে। নিশ্চয়ই ওটি তারই চেহারা, তবে মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে নিজে যতটা পাল্টেছে তার চেয়ে একটু বেশিই পাল্টে গেছে চেহারাটি। ভেতরের যে অনুভূতি, আর চেহারায় তার যে প্রকাশ তাতে বেশ পার্থক্যই বোধ হচ্ছে। মাথায় কিছুটা টাক পড়ে গেছে। প্রথম মনে হলো গোটা শরীরটা কেমন ধূসর ধূসর লাগছে, এরপর মনে হলো ঠিক মাথার চামড়াটি ধূসর হয়ে এসেছে। এবার মনে হচ্ছে হাত আর মুখমণ্ডলটুকু ছাড়া তার সারা শরীরেই ময়লা বসে গিয়ে ধূসর রঙ নিয়েছে। জমে যাওয়া ময়লার নিচে এখানে ওখানে আঘাতের লালচে চিহ্ন, আর গোড়ালির কাছে সেই দগদগে ঘা আরও বিস্তৃত হয়ে চামড়া পুড়ে আগুনের রূপ নিয়েছে। তবে সত্যিকারের ভীতিকর হয়ে উঠেছে তার শরীরের দুর্বলতা। তার পাঁজরের হাড় ঠিক কঙ্কালের মতো মনে হচ্ছে, পা দুটো কুঁচকে-শুকিয়ে এমন হয়েছে যে তার হাঁটুর কাছটা এখন রানের দিকের চেয়ে মোটা। এবার তার নজরে এল ও’ব্রায়েন তার সাইড ভিউ বলতে আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। মেরুদণ্ডটি বিস্ময়করভাবে বেঁকে গেছে। সরু কাঁধ দুটো সামনে ঝুঁকে যাওয়ায় বুকের দিকটা যেন গর্তে ঢুকে গেছে। হাড্ডিসার ঘাড়টি খুলির ভারেই যেন দ্বিগুণ ঝুঁকে পড়েছে। নিজেকে তার মনে হলো মারাত্মক রোগভোগে কাতর ষাটোর্ধ কোনো ব্যক্তি।
‘তুমি মাঝে মধ্যে ভাবতে,’ বললেন ও’ব্রায়েন, ‘আমার চেহারাটি— ইনার পার্টির একজন সদস্যের এই চেহারা বুড়িয়ে যাওয়া ভাঙাচোরা লাগে। এখন তুমি তোমার নিজের চেহারা নিয়ে কী ভাবছ?’
উইনস্টনের কাঁধটি চেপে ধরলেন তিনি আর তাকে ঘুরিয়ে নিলেন যাতে তারা মুখোমুখি হতে পারেন।
‘দেখো কোন দশায় এখন আছ তুমি,’ বললেন তিনি। ‘তোমার সারা শরীরের এই ঘিনঘিনে নোংরা ময়লাগুলো দেখো। বৃদ্ধাঙ্গুলের ফাঁকে জমে যাওয়া ময়লা দেখো। তোমার পায়ের দগদগে ঘা দেখো। তুমি কি জান তোমার গা থেকে এখন ছাগলের মতো গন্ধ বের হচ্ছে? সম্ভবত এসব আর তুমি দেখতে চাও না। তোমার শরীরের দুর্বলতা দেখো। দেখতে পাও? আমার বুড়ো আঙুল আর তর্জনি দিয়ে যতটুকু ফাঁকা বানানো যায় তোমার হাত তার ভেতর দিয়েই চলে যাবে। তোমার ঘাড়টাকে আমি ঠিক একটা গাজরের মতো টস করে ভেঙে ফেলতে পারি। তুমি কি জান আমাদের হাতে ধরা পড়ার পর তোমার ২৫ কেজি ওজন কমে গেছে? এমনকি তোমার চুলে হাত দিলে তা মুঠো ভরে উঠে আসবে। দেখো!’ উইনস্টনের মাথায় হাত দিয়ে এক গোছা চুল তুলে আনলেন তিনি। ‘তোমার মুখ খোলো, নয়, দশ, এগারোটা দাঁত অবশিষ্ট রয়েছে। আমাদের কাছে যখন এসেছিল তখন কয়টা ছিল? আর যে ক’টা এখনও টিকে আছে তাও টপাটপ পড়ে যাচ্ছে। এই দ্যাখো!’
উইনস্টনের বাকি থাকা সামনের দাঁত ক’টির একটি বৃদ্ধাঙুল আর তর্জনীর মাঝে চেপে ধরলেন তিনি। গোটা চোয়ালটা ব্যথায় টনটন করে উঠল উইনস্টনের। আর ও’ব্রায়েন তার দুই আঙুলের মাঝে চেপে ধরে গোড়াসমতে বের করে আনলেন একটি দাঁত। আর সেটি মেঝেতে টুপ করে ফেলে দিলেন।
‘তুমি পচে যাচ্ছ,’ বললেন তিনি; ‘তুমি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছ। তুমি কী? এক বস্তা ঘিনঘিনে নোংরার দলা। এবার ঘোরো আর ফের আয়নায় তাকাও। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ কে তাকিয়ে তোমার দিকে? ওটাই শেষ মানুষটি। যদি তুমি মানব সন্তান হও, তাহলেও ওটাই মানবতা। এবার আবার কাপড় পরে নাও।’
খুব ধীরে হাত-পা চালিয়ে উইনস্টন কাপড় পরতে শুরু করল। তখনো পর্যন্ত তার জানা ছিল না কতটা দুর্বল সে হয়ে পড়েছে। কেবল একটা চিন্তাই তার মনে জুড়ে ঝড় তুলে যাচ্ছিল: তা হচ্ছে সে আসলে যতটা কল্পনা করতে পারছে তার চেয়েও বেশি সময় থেকে এখানে রয়েছে। আর ঠিক যখন আলখেল্লার ফিতাটি কোমরে বাঁধছিল তখনই হঠাৎ তার পচে যাওয়া শরীরটার জন্য একটা করুণাবোধ কাজ করতে শুরু করল। কী করতে যাচ্ছে তা বুঝে ওঠার আগেই সে বিছানার কাছে পাতা একটি টুলের ওপর বসে পড়ল আর হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তার কদাকার চেহারা, অশোভন শরীর আর নোংরা অন্তর্বাসের নিচে একগাদা হাড্ডি কর্কশ সাদা আলোর নিচে বসে গুমরে কাঁদছে; কিন্তু সে তা থামাতে পারছে না। ও’ব্রায়েন তার কাঁধের ওপর একটি হাত রাখলেন, অনেকটাই দয়ার সে হাত।
‘এমনটা সবসময় থাকবে না,’ বললেন তিনি। ‘তুমি চাইলেই এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পার। সবকিছুই নির্ভর করছে স্রেফ তোমার নিজের ওপর।’
‘আপনিই এটা করেছেন!’ ফুঁপিয়ে উঠে বলল উইনস্টন। ‘আপনিই আমাকে শুকিয়ে ফেলে এই দশা করে দিয়েছেন।’
‘না, উইনস্টন, তুমি নিজেই নিজেকে এভাবে শুকিয়ে ফেলেছ। যখন তুমি নিজেকে পার্টির বিরুদ্ধে দাঁড় করালে তখনই তুমি এমন একটা পরিণতি মেনে নিয়েছিলে। এর সব কিছুই সেই প্রথম কাজটির মধ্যে নিহিত। এমন কিছুই ঘটেনি যা তুমি আগে ভেবে রাখনি।
একটু থামলেন তিনি, আর আবারও বলেই চললেন:
‘তুমি নিজেই তোমাকে মেরেছ, উইনস্টন। তুমিই তোমাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছ। এখন তুমি যা দেখলে, ঠিক সেটাই তোমার শরীরের দশা। কিন্তু তোমার মন রয়ে গেছে একই অবস্থানে। আমি মনে করি না এখন আর গর্ব করার মতো অবশিষ্ট কিছু রয়েছে। তোমাকে লাত্থানো হয়েছে, চাবকানো হয়েছে, অপদস্থ করা হয়েছে, তুমি ব্যথায় চিৎকার করেছ, মেঝেতে নিজের রক্ত আর বমির মাঝে গড়াগড়ি খেয়েছ। তুমি গুমরে গুমরে কেঁদেছ আর ক্ষমাভিক্ষা চেয়েছ। আর এসবের মধ্য দিয়ে তুমি সবাইকে প্রতারণা করেছ, সবকিছুর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তুমি কি ভাবতেও পার এমন কোনো হীন আচরণ নেই যা তোমার সঙ্গে করা হয়নি?’
কান্না থামিয়েছে উইনস্টন। তবে অশ্রু তখনও অঝোর ধারায় নামছে তার দুচোখ বেয়ে। মাথা তুলে ও’ব্রায়েনের দিকে তাকাল সে।
‘আমি জুলিয়ার সঙ্গে প্রতারণা করিনি,’ বলল সে।
নিচে সোজা তার চোখে চোখ রেখে তাকালেন ও’ব্রায়েন। ‘না,’ বললেন তিনি; ‘না, সে তুমি নিতান্তই সত্য বলেছ। জুলিয়ার সঙ্গে কোনো প্রতারণা করো নি তুমি।’
ও’ব্রায়েনের প্রতি সেই গভীর শ্রদ্ধাবোধ, যা কোনো কিছুতেই নষ্ট হবে বলে মনে হয় না, আবারও তা উইনস্টনের হৃদয়খানিরে ভাসিয়ে দিল। কী জ্ঞানী, ভাবল সে, কী বুদ্ধিমান একটি মানুষ। ও’ব্রায়েনকে সে যখন যা কিছু বলতে চেয়েছে সেটাই তিনি বুঝে নিয়েছেন। এ পৃথিবীতে আর যে কেউ বলবে, জুলিয়াকে প্রতারণাই করেছে সে। এমন কী আছে, যা তারা নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তার ভেতর থেকে বের করে আনেনি? মেয়েটির সম্পর্কে সে যা কিছু জানে তার সবটাই ওদের বলে দিয়েছে, তার অভ্যাস, তার চরিত্র, তার অতীত জীবন, তাদের প্রতিটি সাক্ষাতে যা কিছু ঘটেছে তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলোও ওদের বলে দিয়েছে, সেই সব কথাও জানিয়ে দিয়েছে যা জুলিয়া তাকে বলেছে কিংবা সে বলেছে জুলিয়াকে, কালো-বাজারে তাদের খাবার খাওয়া, তাদের যৌনাচার, পার্টির বিরুদ্ধে তাদের সব গালিগালাজ— সবকিছু। আর এতকিছুর পরেও তার মন থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই কথাটিই যে, সে জুলিয়াকে প্রতারণা করেনি। তার ভালোবাসা মরে যায়নি, জুলিয়ার প্রতি তার অনুভূতি সেই একই রকম রয়েছে। ব্যাখ্যাতীতভাবে সে যেই কথাটি বলেছে ঠিক সেটাই ধরতে পেরেছেন ও’ব্রায়েন।
‘আমাকে বলবেন,’ বলল সে, ‘কবে, কত দ্রুত ওরা আমাকে গুলিটা করবে?’
‘অনেক সময় লেগে যেতে পারে,’ বললেন ও’ব্রায়েন। ‘তোমার মামলাটা বেশ জটিল। তবে আশা ছেড়ো না। সবারই রোগ নিরাময় হয়, দ্রুত নয়তো একটু দেরিতে। যখন সব শেষ হয়ে যাবে তখনই আমরা তোমাকে গুলিটা করব।’
অধ্যায় চার
আগের চেয়ে বেশ ভালো আছে, গায়ে গতরে কিছুটা বাড়ছে আর শক্তিও ফিরে পাচ্ছে, এখনের কথা এমনটাই বলা যথার্থ হবে।
সাদা আলোটা আর টানা ঝিমধরা শব্দটা সেই একইরকম, তবে এবারের কয়েদখানাটি আগেরগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত আরামের। তক্তার খাটিয়ার ওপর একটা তোশক পড়েছে, শিথানে একটা বালিশও মিলেছে। আর বিছানা ছাড়ার বসার জন্য একটা চৌকি পেয়েছে। গোসলেরও ব্যবস্থা হয়েছে, আর টিনের বেসিনে যখন ইচ্ছা ধোয়াধুয়িও করার অনুমতি আছে। ওরা তাকে নতুন কিছু অন্তর্বাস আর পরিষ্কার একটা আলখেল্লাও দিয়েছে। একটা মলম লাগিয়ে পায়ের দগদগে ঘায়ের অংশটি ড্রেসিং করে দিয়েছে আর বাদবাকি যে ক’টা দাঁত ছিল ওগুলোও তুলে ফেলে পুরো দুই পাটি কৃত্রিম দাঁত লাগিয়ে দিয়েছে।
কয়েক সপ্তাহ কিংবা হতে পারে কয়েক মাস গত হয়েছে। এখন অবশ্য সময়ের বয়ে চলার হিসাব কষা চলে, যদি আদৌ সে কষতে চায়। যেহেতু এখন তার পেটে দানাপানি পড়ে আর একটি নিয়মমাফিক বিরতি দিয়ে দিয়ে তা দেওয়া হয় তাই এই হিসাব সহজ। তার হিসেবে প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় তাকে তিন দফা খাবার দেওয়া হচ্ছে, তবে কখনো কখনো তার মনে সামান্য হলেও কৌতূহল জাগে কোন বেলার খাবার সে খাচ্ছে- দিনের নাকি রাতের। খাবারের মেন্যু বিস্ময়করভাবেই ভালো, প্রতি তৃতীয় বেলায় মাংস থাকছে। একবার তো এক প্যাকেট সিগারেটও মিলল। তার কাছে দেয়াশলাই ছিল না, কিন্তু মুখে সদা কপাট লাগিয়ে রাখা যে কারারক্ষীটি তাকে খাবার এনে দেয় সেই একটা লাইটারের ব্যবস্থা করে দিল। প্রথমবার ধূমপান করতে গিয়ে একটু অসুস্থও হয়ে পড়েছিল সে। তবে প্যাকেটটা যত্ন করে রাখল আর প্রতিবেলা খাবারের পর আধখানা করে সিগারেট ফুঁকে বেশ কিছুদিন এক প্যাকেটে চালিয়ে দিল। একটি স্লেট আর একটি পেন্সিলও দিয়েছে তাকে। কামরার এক কোনায় বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা। প্রথম দিকে ব্যবহারও করেনি। সে সময় জেগে থাকার সময়টিতেও অলস পড়ে থাকত বিছানায়। কখনো কখনো এক বেলা খাবারের পর আরবেলা খাবার আসা অব্দি সামান্য নড়াচড়াটুকুও করত না, কতকটা ঘুমিয়ে, কতকটা অস্পষ্ট দিবাস্বপ্ন দেখে দেখে কাটিয়ে দিত। চোখ দুটো সামান্য খুলেও তাকাত না। মুখের ওপর প্রকট আলো রেখেও ঘুমিয়ে পড়ার দীর্ঘ অভ্যাস হয়ে গেছে, আলোর কারণে কিছুই আটকায় না, তাছাড়া স্বপ্নগুলোও আসত আসঞ্জনশীলতায়। পুরো সময়টা জুড়ে ম্যালা স্বপ্ন সে দেখেছে, তার সবগুলোই ছিল আনন্দ স্বপ্ন। সেই সোনালি দেশে সে আছে, ভীষণ গৌরবময় সূর্যালোকিত কোথাও সে বসে আছে, তার মা, জুলিয়া, ও’ব্রায়েনের সঙ্গে— কোনো কাজ নয়, স্রেফ বসে শান্তিময় বিষয়াদি নিয়ে কথা বলে কাটছে তাদের সময়। আর যখন জেগে থাকত তখনও তার চিন্তা জুড়ে থাকত স্বপ্নে দেখা বিষয়গুলো। বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো কিছু ভাবার বা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, এমনটাই বোধ করত সে, তবে সেই ভয়াবহ ব্যথাটাও এখন উবে গেছে। একঘেঁয়ে লাগছে না, কারো সঙ্গে কথা বলতে মন চায় তেমনও নয়, কিংবা চিত্তবিনোদনেরও নেই আকাঙ্ক্ষা। স্রেফ একা একা পড়ে থাকা, জিজ্ঞাসাবাদ নেই, মারধর নেই, উদোরপূর্তি খাবার আছে, পরিচ্ছন্ন গা-গতর, সব মিলিয়ে পূর্ণ সন্তুষ্টি।
ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে থাকার ভাগটা কমে এল, তবে বিছানা ছাড়তে মন চায় না। তখন তার একটাই চাওয়া শান্ত হয়ে শুয়ে থাকা, আর শরীরে ধীরে ধীরে যে শক্তি ফিরে আসছে তা অনুভব করা। শরীরের বিভিন্ন অংশে আঙুল ঘঁষে ঘঁষে দেখত আর বুঝতে চেষ্টা করত তার পেশিগুলো যে ডাঁটো হয়ে উঠছে, চামড়াগুলো যে টানটান হচ্ছে তা কোনো বিভ্রম নয়। অবশেষ, সন্দেহের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই প্রতিষ্ঠিত হলো যে সে মোটা হচ্ছে যখন দেখতে পেল তার হাঁটুর তুলনায় রানের দিকটা অপেক্ষাকৃত মোটা। এরপর প্রথম দিকে ছাড়া ছাড়া, পরে বেশ নিয়মিতই ব্যায়াম শুরু করল সে। কিছু দিনের মধ্যে দিনে তিন কিলোমিটার করে হাঁটতে শুরু করল। কামরার ভেতরেই এর মাপ রেখে হাঁটার এই দূরত্ব মাপত সে। আর তার ঝুঁকে পড়া কাঁধও ততদিনে অনেকটা সোজা হয়ে উঠল। এরপর আরও কিছু শারীরিক কসরত করার উদ্যোগ নিল কিন্তু লক্ষ্য করল ওগুলোর কোনোটাই করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। স্রেফ হণ্টন ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। হাতের নাগালের মধ্যে ছোট্ট টুলখানিরে তুলে সরাতে পারছে না, একপায়ে দাঁড়াতে গেলে পড়ে যাচ্ছে। গোঁড়ালিতে ভর দিয়ে একবার একটু বসেছিল, আর তাতে পায়ের গুল ও ঊরুতে ভীষণ ব্যথা পেল, তখন কোনোরকমে নিজেকে তুলে দাঁড় করাল। একবার পেটের ওপর চাপ দিয়ে শুয়ে পড়ে হাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু বৃথাই সে চেষ্টা, এক সেন্টিমিটার ও উপরে তুলতে পারল না নিজেকে। তবে আর কিছু দিন পর- আরও কিছুদিন খেয়েদেয়ে— শরীরের এই দুর্বলতাও কাটিয়ে উঠল সে। একটা সময় এল যখন সে আরও ছয়গুণ বেশি দৌড়াতে পারে। এসময় সে তার শরীর নিয়ে গৌরব বোধ করতেও শুরু করল, আর ভেতরে ভেতরে এক বিশ্বাসও লালন করতে লাগল তার মুখমণ্ডলও ফিরে পেয়েছে স্বাভাবিক রূপ। তবে যখনই টাক মাথার ওপর হাত রাখত তার মনে পড়ে যেত আয়নার ভেতরে দেখা সেই বিধ্বস্ত মুখখানির কথা।
মনটা ধীরে ধীরে আরও সক্রিয় হয়ে উঠছিল। তক্তার বিছানায় দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে বসে হাঁটুর ওপর স্লেট রেখে, নিজেকে ফের শিক্ষিত করে তোলার কাজ শুরু করল।
এটা সম্মত যে সে আত্মসমর্পণ করেছে। বাস্তবে, ঠিক এখন যেমনটা দেখছে, সে আসলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেক আগেই এই আত্মসমর্পণে প্রস্তুত হয়ে ছিল। যে মুহূর্তে ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ে সে প্রথম ঢুকল সেই মুহূর্ত থেকে- আর হ্যাঁ বিশেষ করে সেই মুহূর্ত থেকে তো বটেই, যখন জুলিয়া আর সে নিশ্চুপ অসহায় দাঁড়িয়ে আর লৌহকঠিন কণ্ঠটি বলে যাচ্ছিল তাদের কী করতে হবে। পার্টির বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করতে যাওয়ার ছেবলামি, ছেলেমানুষি সে নিজেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে জানে সাতটি বছর থট পুলিশ তাকে আঁতশ কাচের মধ্য দিয়ে মৌমাছির মতো নজরদারি করে গেছে। একটিও শারীরিক অঙ্গভঙ্গি নেই, নেই একটি শব্দেরও সশব্দ উচ্চারণ যা তারা লক্ষ করেনি, এমন কোনো চিন্ত াধারাও ছিল না যার ভেতর ওরা ঢুকে পড়েনি। এমনকি তার দিনপঞ্জীর মলাটে সাদা ধুলোর আবছা আবরণটিও তারা অতি যত্নে নিশ্চিত করে রেখেছে। তারা তাদের নেওয়া রেকর্ডের সাউন্ড ট্র্যাক তাকে বাজিয়ে শুনিয়েছে, দেখিয়েছে সব ধরনের আলোকচিত্র। তার মধ্যে জুলিয়া আর তার একান্তের ছবিগুলোও রয়েছে। হ্যাঁ, এমনকি… পার্টির বিরুদ্ধে এতটুকু লড়াইও সে আর করতে পারবে না। তাছাড়া, পার্টিই তো সঠিক কাজটি করেছে। তেমনটা হতেই হবে; কারণ কী করেই-বা একটি অবিনশ্বর, সমন্বিত মস্তিষ্ক ভুল করতে পারে? কোন বাহ্যিক মানদণ্ডের আলোকে আপনি এর বিচারগুলোর বিচার করবেন। শুদ্ধবাদিতা পরিসংখ্যানিক। এ স্রেফ এক পদ্ধতি যার মাধ্যমে ওরা যা ভাবে সেই ভাবনাটিই ভাবার কৌশল রপ্ত করা। কেবলই—!
পেন্সিলটিকে হাতের আঙুলের মাঝে কিছুটা মোটা আর অস্বাভাবিক বোধ হচ্ছিল। মস্তিষ্কে যে ভাবনাগুলো আসছে সেগুলোই লিখতে শুরু করল সে। প্রথম অবিন্যস্তভাবে বড় হরফে সে লিখল:
স্বাধীনতাই দাসত্ব
এরপর একেবারে না থেমেই এর নিচে লিখল:
দুই আর দুই মিলে পাঁচ হয়।
ঠিক তখনই কামরা পরিদর্শনের কিছু একটা বিষয় এলে ভাবনাটা বিঘ্নিত হলো। আর এ বিষয়ে ধ্যান রাখা গেল না। সে জানে এরপরে কী আসে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে মনে করতে পারল না। যখন মনে এল, তখন তা আবার সচেতনতার যুক্তিতে যা হওয়া উচিত তাই এল: স্বপ্রোণোদিত হয়ে কিছু এল না। সে লিখল:
ঈশ্বরই শক্তি
সব মেনে নিয়েছে। অতীত পাল্টে দেওয়া যায়। তবে অতীত কখনোই পাল্টানো হয়নি। ওশেনিয়ার যুদ্ধ ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধেই। বরাবরই ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ চলে আসছে ওশেনিয়ার। জোন্স, অ্যারনসন আর রাদারফোর্ড তাদের বিরুদ্ধে আনীত অপরাধেই অপরাধী ছিলেন। তাদের অপরাধ অপ্রমাণ করে এমন কোনো ছবি কস্মিনকালেও দেখেনি। এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না, ও ছিল তারই আবিষ্কার। পরস্পর বিরোধী যেসব বস্তু মনে আসত সেসবও এখন তার মনে পড়ে যায়, তবে সেগুলোর সবই ভ্রান্ত স্মৃতি, আত্মপ্রতারণার ফসল। কত সহজেই এসব তার ক্ষেত্রে ঘটে গেছে! কেবল আত্মসমর্পণ, এরপর সবকিছুই এসেছে তার অনুসরণে। এ ছিল স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে চলার সামিল, তা যতই কঠোর সংগ্রামই তুমি করো না কেন তোমাকে পিছনের দিকেই টেনে নিয়ে যাবে, আর অবশেষে দৈবাৎ তুমি উল্টোঘুরে স্রোতের অনুকূলেই চলতে শুরু করবে। তাতে তোমার নিজের আচরণটুকু ছাড়া আর কিছুই পাল্টাবে না; যা কিছু অবশ্যম্ভাবী তা ঘটবেই। সে কদাচই জানত কেন সে বিদ্রোহী হয়েছিল। সবকিছুই ছিল সহজ, কেবল—!
যেকোনোটাই সত্য হতে পারে। তথাকথিত প্রকৃতির বিধান স্রেফ ফালতু কথা। মহাকর্ষের তত্ত্বও ফালতু। ‘আমি যদি চাই,’ বলেছিলেন ও’ব্রায়েন, ‘এই কামরার মেঝেটিকে স্রেফ বুদ্বুদের মতো ভাসিয়ে দিতে পারি।’ কথাটির মানে বুঝেছে উইনস্টন। ‘যদি তিনি ভাবেন মেঝেটিকে ভাসিয়ে দেবেন, আর একই সঙ্গে আমিও যদি ভাবি, তিনি মেঝেটিকে ভাসিয়ে দিয়েছেন, তাহলেই এটি ভাসবে।’ পানির ওপর ঝপাৎ শব্দে কোনো কিছু পড়লে যেমন হকচকিয়ে যেতে হয়, তেমনি হকচকিয়ে দিয়ে একটি ভাবনা শব্দ তুলল তার মনের গভীরে: ‘বাস্তবে ঘটনাটি ঘটে না। আমরা কল্পনা করি মাত্র। এটা স্রেফ মতিভ্রম।’ দ্রুতই ভাবনাটি ধাক্কিয়ে সরিয়ে দিল। এই ভ্রান্তি অবশ্যম্ভাবী। আর তা বলে দেয়, কোথাও কিংবা অন্য কোনোখানে, কারো নিজ জগতের বাইরে, রয়েছে এক ‘আসল’ জগত যেখানেই ‘আসল’ ঘটনাগুলো ঘটে। কিন্তু কীভাবেই থাকবে এমন এক জগত? এমন কোন জ্ঞান রয়েছে যা আমাদের মন দিয়ে সংরক্ষিত? আসলে সকল ঘটনার বাস আমাদের মনে। আর মানুষের মনে মনে যা কিছু ঘটে চলে, সত্যিকারের ঘটনা সেসবই।
এসব ভ্রান্তি পরিত্যাগে কষ্ট হয় না তার, আর এমন ভ্রান্তিতে বশীভূত হওয়ার বিপদও তার নেই। সে বুঝতে পারছে, এমনটা ঘটা তার ক্ষেত্রে উচিতও নয়। মনকে স্রেফ একটি অন্ধ পর্দা তৈরি করতে হবে যা দিয়ে যখনই কোনো বিপজ্জনক ভাবনা ভেতরে জেগে ওঠে তখনই ঢাকা দিতে পারে। আর সে প্রক্রিয়াটি হতে হবে স্বয়ংক্রিয়, সহজাত। নিউস্পিকে ওরা যাকে বলে ‘ক্রাইমস্টপ’।
নিজে নিজেই ক্রাইমস্টপের কিছু চর্চা করবে বলে মনোস্থির করল সে। চর্চাগুলো এরকম— ‘পার্টি বলছে পৃথিবী চ্যাপ্টা’, ‘পার্টি বলছে বরফ পানির চেয়েও ভারী’- এখন তার কাজ হচ্ছে— নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তোলা যাতে সে একটি যুক্তিও বুঝতে বা দেখতে না পায়, যা দিয়ে এই বক্তব্যের বিরোধীতা করা চলে। কাজটা সোজা নয়। এর জন্য যুক্তিবোধ আর প্রত্যুৎপন্নমতিতা দরকার। গাণিতিক জটিলতাও রয়েছে, যেমন, ‘দুই আর দুই মিলে পাঁচ হয়’ কথাটি তার বুদ্ধিবৃত্তিক উপলব্ধির ঊর্ধ্বে। এর জন্য মনেরও এক ধরনের মল্লক্রীড়া দরকার হয়ে পড়ে। এইমাত্র যৌক্তিকতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যবহার আর পরমুহূর্তেই ভ্রান্ত যুক্তির স্থুল অসচেতন ব্যবহারের যোগ্যতা থাকতে হয়। এখানে বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি নির্বুদ্ধিতারও সমান প্রয়োজন, যা অর্জন করা কঠিন।
সারাটি ক্ষণ, মনের একটি অংশ দিয়ে সে ভাবে, কত দ্রুত ওরা তাকে গুলি করে মারবে। ‘সবকিছুই তোমার ওপর নির্ভর করছে,’ বলেছিলেন ও’ব্রায়েন; কিন্তু তিনিও জানেন, সচেতনতায় এমন একটি কাজও সে করতে পারবে না, যা দিয়ে ঘটনাটি কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়। হতে পারে দশ মিনিটে, আবার দশ বছরও লেগে যেতে পারে। এভাবে একা বন্দীদশায় ওরা তাকে রেখে দিতে পারে বছরের পর বছর, কোনো জবরদস্তিমূলক শ্রম-ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিতে পারে, কিছু দিনের জন্য মুক্তিও দিতে পারে; ঠিক যেমনটা ওরা মাঝেমধ্যে করে। এও সম্ভব, হত্যা করার আগে এই গ্রেফতার হওয়া আর জিজ্ঞাসাবাদের দীর্ঘ নাটক আরও একবার পুরোমাত্রায় মঞ্চস্থ করা হবে। একটি বিষয়ে সে সুনিশ্চিত, মৃত্যু কখনোই কোনো প্রত্যাশিত মুহূর্তে আসবে না। প্রচলিত আছে- অব্যক্ত এক প্রচলন: কোনোভাবে সে জেনে গেছে, তবে কখনো কাউকে বলতে শোনেনি— পেছন থেকে গুলিটা করে ওরা। সবসময়ই মাথার পেছনের দিকটাতে, সামান্য সতর্ক না করেই, এক কয়েদখানা থেকে অন্য কয়েদখানায় নেওয়ার সময় ঘটনাটি ঘটে যায়।
একদিন- ‘একদিন’ বলা সঠিক হবে না, কারণ সেটা হতে পারে কোনো মধ্যরাতেও: একদা— একটি সময়ে এক অদ্ভুত পরমানন্দ বোধ করছিল উইনস্টন। বারান্দা ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তাকে, আর তখনই মনেপ্রাণে একটি বুলেটের অপেক্ষা করছিল সে। মনে হচ্ছিল যে কোনো মুহূর্তেই আসতে পারে সেই কাঙ্ক্ষিত বুলেটের আঘাত। সবকিছুই ঠিকঠাক, যথাবিহিত, মিটমাট হয়ে গেছে। সন্দেহ বলে আর কিছু নেই, নেই যুক্তি-তর্কের বালাই, আর কোনো কষ্ট নয়, নয় কোনো ভয়ও। তার শরীরও তখন বেশ হৃষ্টপুষ্ট। স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে চলছিল, মনের মধ্যে আনন্দ খেলা করে যাচ্ছিল, অনুভব হচ্ছিল যেন সূর্যালোকে হেঁটে চলেছে। তার মন আর সেই ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের সরু করিডোরে পড়ে থাকল না, বরং তা ছুটে গেল কোনো বিস্তৃত সূর্যালোকে আলোকিত পথে, সে পথ এক কিলোমিটার প্রশস্ত, মাদকাসক্তির চিত্তবিভ্রমে ঠিক যেমনটা হয় তার তেমনই মনে হচ্ছিল। ততক্ষণে সে সেই সোনালি দেশে, খরগোশের আঁচড়ে তোলা মাটির ঢিবির মধ্য দিয়ে সৃষ্ট পায়ে চলা পথ ধরে হাঁটছে। পায়ের তলায় সে অনুভব করছে ছোট লাফানো স্প্রিংয়ের টার্ফটিও, হালকা সূর্যালোক এসে পড়েছে তার মুখমণ্ডলে। মাঠের কিনারে ঝিরিঝিরি হাওয়ায় দেবদারু গাছেদের হালকা দোল খাওয়া, আর তার ওপাশে কোথাও একটি ছোট্ট ঝরনাধারার বয়ে চলা যেখানে উইলো গালোর নিচে সবুজ ছায়ায় মাছেরা সাঁতার কাটছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড ভীতিময় এক ধাক্কা খেল। মেরুদণ্ড বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করল। নিজে নিজেই শুনতে পেল সজোরে চিৎকার করে চলছে
‘জুলিয়া! জুলিয়া! জুলিয়া! আমার জুলিয়া!
এক লহমার জন্য তার মতিভ্রম ঘটে গিয়েছিল আর বোধ হচ্ছিল জুলিয়াও সেখানে উপস্থিত। তবে সে তার সঙ্গে নয়, তার ভেতরে অবস্থান করছে। যেন মনে হচ্ছিল তার ত্বকের জেল্লাইয়ের মধ্যেই জুলিয়া ফিরে এসেছে। ঠিক ওই মুহূর্তে জুলিয়ার জন্য তার যতটা ভালোবাসা বোধ হচ্ছিল তেমনটা আর কখনোই হয়নি, যখন তারা একসঙ্গে ছিল, মুক্ত ছিল তখনও না। এও জানে, কোথাও নয়তো অন্য কোনোখানে সে এখনও বেঁচে আছে, আর তার সহায়তাই জুলিয়ার প্রয়োজন।
বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল আর নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। এ কী করেছে সে? মাত্র ক’মুহূর্ত দুর্বলতায় কত বছরের কারাবাস যোগ করল সে?
পরমুহূর্তেই কামরার বাইরে বুটের ভারী শব্দ শুনতে পেল। এমন একটা ঘটনায় ওরা তাকে শাস্তি না দিয়ে ছাড়তেই পারে না। আগে যদি না জেনেও থাকে এখন ঠিক জেনে যাবে যে, ওদের সাথে করা সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করেছে সে। পার্টির সে অনুগত ঠিকই, কিন্তু এখনও ভেতরে ভেতরে পার্টিকে ঘৃণাই করে। অতীতে প্রথাপন্থী চেহারার আড়ালে এক ধরনের প্রথাবিরোধী মনোভাব সে লুকিয়ে রাখত। এবার সে আরও এক ধাপ এগুলো। মনটাকে সে সমর্পণ করে দিলেও, ভেতরের হৃদয়টাকে রেখে দিয়েছে স্রেফ অক্ষত। সে জানে ভুল করছে, কিন্তু সেই ভুলটাই সে করতে চাইছে। ওরা এখন ঠিক বুঝে যাবে- ও’ব্রায়েন ঠিক ঠিক বুঝে যাবেন। ওই একমাত্র বোকার ক্রন্দনে এখন সব কিছুই স্পষ্ট, সব কিছুই স্বীকার করে নেওয়া হয়ে গেছে।
সবকিছু ফের গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। যা শেষ হতে লেগে যাবে আবারও বছরের পর বছর। একটি হাত মুখমণ্ডলে বুলিয়ে নিল সে, নিজের মুখের নতুন আকারটি বুঝে নিতে চেষ্টা করল। গালের ওপর গভীর বলিরেখা হাতে লাগল, আর গালের হাড্ডি দুটো দুদিক থেকে তীক্ষ্ণ উঁচু হয়ে আছে, নাকটি চ্যাপ্টা মনে হলো। শেষ যখন নিজেকে আয়নায় দেখেছে তারপর মুখে দুইপাটি নতুন দাঁত বসেছে তার। মুখমণ্ডলটা দেখতে ঠিক কেমন তা না জানা থাকলে চেহারার রহস্যময়তা ধরে রাখা যায় না। এটা সে বুঝেছে, অভিব্যক্তিতে নিয়ন্ত্রণ রাখাই শেষ কথা নয়। এই প্রথমই তার মনে হলো, কিছু গোপন রাখতে হলে, নিজের কাছ থেকেও তা লুকিয়ে রাখতে হবে। সারাক্ষণই জানা থাকবে, বিষয়টি আছে, কিন্তু যতক্ষণ না দরকার পড়বে ততক্ষণ তা এমন কোনো আকার নিয়ে সচেতনতাবোধে জাগ্রত হবে না, যার নাম দেওয়া চলে। এখন থেকে তাকে কেবল সঠিক ভাবলেই হবে না, সঠিক অনুভবও করতে হবে, স্বপ্নটিও দেখতে হবে সঠিক। আর সারাটিক্ষণ তাকে তার ঘৃণাবোধগুলোকে নিজের ভেতরে তালা লাগিয়ে রাখতে হবে, শরীরের ভেতরে যেমন কোনো মাংসপিণ্ড আলাদা হয়ে বেড়ে উঠে লুকিয়ে থাকে ঠিক তেমনি, যা শরীরের অংশ কিন্তু শরীর থেকে আলাদা।
একদিন ওরা গুলি করার সিদ্ধান্ত নেবেই। কিন্তু বলার জো নেই কখন ঘটবে সে ঘটনা। তবে ঘটনাটি ঘটার ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে বিষয়টি টের পাওয়া যায়। এটা জানা সব সময়ই ঘটনাটি ঘটে আসছে বারান্দা পথে। হেঁটে যাওয়ার সময় পেছন থেকেই গুলিটা আসবে। দশ সেকেন্ড আগে বুঝতে পারলে তা কিন্তু কম সময় নয়। এই সময়টুকুর মধ্যেই তার ভেতরের জগতটি উল্টে যেতে পারে। এরপর হঠাৎ, একটি শব্দও উচ্চারণ না করে, ঠিক ঠিক পা ফেলতে ফেলতে, মুখের একটি বলিরেখায়ও পরিবর্তন না এনে- আচমকা কপটবেশ ঝেড়ে ফেলে বিকট শব্দে ফেটে পড়তে হবে! ঘটিয়ে চলতে হবে সকল ঘৃণার প্রকাশ। ঘৃণার গর্জনে তখন হয়ে উঠবে এক জ্বলন্ত লেলিহান শিখা। আর অনেকটা সেই বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই গর্জে উঠবে ওদেরও বুলেট। অনেক দেরিতে, নয়তো খুব কাছাকাছি সেই ক্ষণ। তখন তাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার এমনটি ভাবার আগেই ওরা তার খুলিটি উড়িয়ে দেবে। আর তার উৎপথগামী ভাবনাগুলো থেকে যাবে শাস্তিহীন, অনুশোচনাহীন। চিরতরের জন্য তা চলে যাবে ওদের নাগালের বাইরে। এর মধ্য দিয়েই ওরা ওদের নিজেদের শুদ্ধবাদিতায় নিজেরাই ক্ষত সৃষ্টি করবে। ওদের ঘৃণা করতে করতে কারো মৃত্যু যখন ঘটবে, সেটাই হবে তার স্বাধীনতা।
চোখ বন্ধ হলো তার। বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খলা মেনে চলার চেয়েও কঠিন একটি কাজ। নিজেকে নিজে ছোট করা আর নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা ছাড়া এ আর কিছু নয়। জঘন্যতার মাঝে জঘন্যতম সব কাজ। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ও অসুস্থ দিকটি হচ্ছে বিগ ব্রাদার নিয়ে তার ভাবনা। সেই অতিকায় মুখ (সারাক্ষণ পোস্টারটি চোখে পড়ায় তার মনে হতো মুখটি এক মিটার প্রশস্ত হবে), সেই ঘন কালো গোঁফ, আর সারাক্ষণ পাকিয়ে থাকা দুটি চোখ নিজে নিজেই তার মনের গহিনে ঢুকে সাঁতার কাটতে থাকে। বিগ ব্রাদারের প্রতি তার সত্যিকারের অনুভূতি কী?
বাইরে পথে বুটের ভারী শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিকট ক্যাচ শব্দ করে ইস্পাতের দরজা খুলে গেল। ও’ব্রায়েন ঢুকলেন কয়েদখানায়। তার পেছনে মোমের মুর্তিমুখো দুই অফিসার আর কয়েকজন কালো উর্দিধারী নিরাপত্তারক্ষী।
‘ওঠো,’ বললেন ও’ব্রায়েন। ‘এদিকে এসো।’
তার সামনে উইনস্টন উঠে দাঁড়াল। শক্তিশালী দুটি হাতের মাঝখান দিয়ে উইনস্টনের কাঁধের দিকে তাকিয়ে ও’ব্রায়েন।
‘তুমি আমাকে বিভ্রান্ত করার কথা ভেবেছ,’ বললেন তিনি। ‘স্রেফ নির্বোধের কাজ। সোজা হয়ে দাঁড়াও। আমার চোখের দিকে তাকাও।’
একটু থামলেন, অপেক্ষাকৃত শান্ত স্বরে এবার বললেন:
‘তোমার উন্নতি হচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে তোমার মাঝে ত্রুটি আর সামান্যই আছে। স্রেফ আবেগের জায়গাটিতে তুমি অগ্রগতি করতে পারছ না। আমাকে বলো, উইনস্টন— মনে রেখো কোনো মিথ্যা বলা চলবে না: তুমি জান মিথ্যা আমি সহজেই ধরে ফেলতে পারি- আমাকে বলো- বিগ ব্রাদারের প্রতি তোমার সত্যিকারের ভাবনাটি কী?’
‘আমি তাকে ঘৃণা করি।’
‘তুমি তাকে ঘৃণা করো। বেশ ভালো। তাহলে তোমার জন্য শেষ পদক্ষেপটি নেওয়ার সময় এসে গেছে। বিগ ব্রাদারকে তোমার ভালোবাসতেই হবে: তুমি অবশ্যই তাকে ভালোবাসবে।
উইনস্টনের গায়ে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে রক্ষীদের দিকে ঢেলে দিলেন তিনি। ‘রুম নম্বর ১০১,’ বললেন ও’ব্রায়েন।
অধ্যায় পাঁচ
কয়েদি জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই সে জানত, বলা যায় ধারণা করতে পারত, এই জানালাবিহীন অতিকায় ভবনের ঠিক কোনখানে তার অবস্থান। হতে পারে বায়ুর চাপের তারতম্য থেকেই বিষয়টি বুঝে নিত। যেই কয়েদখানাগুলোতে রক্ষীরা তাকে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন চালিয়েছে ওগুলো গ্রাউন্ড লেভেলের নিচেই হবে। যে কক্ষে ও’ব্রায়েন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন সেটি ছাদের কাছাকাছি কোনো একটি তলায় ছিল। আর এখন তাকে যেখানে নেওয়া হয়েছে সেটি আন্ডারগ্রাউন্ডেরও অনেক অনেক গভীরে, বলা যায় যতটা গভীরে সম্ভব তার পুরোটাই নিচে অবস্থান এই কয়েদখানার।
এর আগে যতগুলো কুঠুরিতে সে ছিল তার যে কোনোটির চেয়ে এটি অপেক্ষাকৃত বড়। তবে আশপাশে কী আছে তা কদাচই তার চোখে পড়েছে। যা সে দেখেছে তা হচ্ছে— ঠিক সামনে পেতে রাখা দুটি ছোট টেবিল। দুটোর ওপরেই সবুজ রঙের মোটা পশমি কাপড় বিছানো। প্রথমটি তার কাছ থেকে এক কিংবা দুই মিটার দূরে হবে। আরেকটি আরেকটু দূরে, দরজার কাছাকাছি। একটি চেয়ারে পিঠমোড়া বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। এতটাই শক্তভাবে যে কার্যত শরীরের কোনো অংশই নড়াচড়া করাতে পারে না, এমনকি মাথাটিও না। একটা নরম কিছু পেছন থেকে মাথাটি টেনে চেপে রেখেছে। আর সে কারণে স্রেফ সোজা তাকিয়ে থাকতে পারছে। আশপাশে কিছুই দেখার জো নেই।
কিছুক্ষণ সে একাই ছিল, এরপর দরজাটি খুলে গেল আর ও’ব্রায়েন ঢুকলেন।
‘সেবার তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে,’ বললেন ও’ব্রায়েন, ‘রুম নম্বর ১০১ এ কী আছে? আমি বলেছিলাম, তুমি কিন্তু এরই মধ্যে জেনে গেছ। প্রত্যেকেই জানে। বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ কিছুই রয়েছে এই রুম নম্বর ১০১ এ।’
ফের খুলে গেল দরজা। একজন রক্ষী ঢুকলেন, হাতে কিছু একটা, দেখে মনে হলো তার দিয়ে তৈরি, বাক্স বা ঝুড়ির মতো কিছু একটা। অপেক্ষাকৃত দূরের টেবিলটির ওপর সে রাখল ওটি। ওই টেবিলটির কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিলেন ও’ব্রায়েনও। উইনস্টন দেখতে পাচ্ছিল না, কী ওটি।
‘বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ কিছু,’ ফের বললেন ও’ব্রায়েন, ‘তবে ব্যক্তিভেদে তা ভিন্ন ভিন্ন রকম। হতে পারে জীবন্ত কবর দেওয়া হয় ওখানে, আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়, চুবিয়ে মারা হয় পানিতে, নয়তো শূলবিদ্ধ করা হয়, এমন আরও পঞ্চাশ ধরনের মৃত্যুর আয়োজন। আরও কিছু আছে যা অপেক্ষাকৃত হালকা গোছের, প্রাণনাশক নয়।’
একদিকে একটু সরলেন ও’ব্রায়েন, তাতে টেবিলের ওপর বস্তুটি ভালো করে নজরে এল উইনস্টনের। একটা আয়তকার হাতলওয়ালা ঝুড়ি। সামনে ঢাকনার মতো কিছু একটা বাইরের দিকে ভাঁজ হয়ে এসেছে। তার থেকে তিন কিংবা চার মিটার দূরে হলেও দেখতে পারছে ঝুড়িটির ভেতরে দুটি অংশ, যার প্রতিটির মধ্যেই একটি করে জন্তু রয়েছে। দু’টি ইঁদুর।
‘তোমার জন্য,’ বললেন ও’ব্রায়েন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে ইঁদুর।’
ঝুড়িটির ওপর প্রথম নজর ফেলেই এক ধরনের কাঁপুনি, আর অনিশ্চিত ভীতি বয়ে গেল উইনস্টনের গোটা শরীর দিয়ে। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে ওই ঢাকনার মতো দেখতে অংশটুকুই তার গভীরে ঢুকে পড়ল। মনে হলো তার অস্ত্রগুলো গলে গলে পানি হয়ে যাচ্ছে।
‘আপনি এটা করতেই পারেন না!’ সজোরে চিৎকার করে উঠল সে। ‘আপনি পারেন না, আপনি এটা পারেন না, এটা অসম্ভব।’
‘তোমার মনে আছে,’ বললেন ও’ব্রায়েন, ‘তোমার স্বপ্নগুলোতে একধরনের ভীতি তোমায় পেয়ে বসত? তোমার ঠিক সামনে অন্ধকারের একটি দেয়াল তুমি দেখতে পেতে, আর কানে আসত এক ধরনের ভয়ংকর গর্জন। তুমি বুঝতে পারতে ভয়াবহ কিছু একটা রয়েছে দেয়ালের ওপারে। তুমি এও জানতে যে, ওগুলো কী তা তোমার জানা, কিন্তু তা প্রকাশ্যে আনার সাহস তোমার হতো না। দেয়ালের ওপারে যা ছিল তা ইঁদুর বৈ কিছু নয়।
‘ও’ব্রায়েন!’ বলল উইনস্টন, কণ্ঠস্বর একটু সংযত রাখার চেষ্টা করল, ‘আপনি জানেন এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে দিয়ে কোন কাজটি করানোর ইচ্ছা হচ্ছে আপনার?’
সরাসরি কোনো উত্তর ও’ব্রায়েন দিলেন না। যখনই কথা বলেন ওই স্কুল মাস্টার গোছের লাগে, কখনো কখনো ওই ভাবভঙ্গিতে আক্রান্তও হয়ে যান তিনি।
‘যন্ত্রণা দেওয়া সবসময় যথেষ্ট নয়। কখনো কখনো মানব সন্তান যন্ত্রণার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে, এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সে থামে না। কিন্তু প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে এমন কিছু একটা থাকে যা সে সহ্যই করতে পারে না- এমন কিছু যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। সাহস আর ভীরুতা আলাদা বিষয়। তুমি যখন উপর থেকে পড়ে যাবে তখন হাতের কাছে রশি পেয়ে তা ধরে ফেলা ভীরুতা নয়। পানির গভীর থেকে উঠে এসে ফুসফুস ভরে বাতার নেওয়াও ভীরুতা নয়। এগুলো কিছু সহজাত পথ যা কখনোই ধ্বংস করা যাবে না। ঠিক এই ইঁদুরের মতো। তোমার জন্য, ইঁদুর স্রেফ অসহনীয়। ওগুলো সামনে এলে এমন কিছু হয়ে যায় যা তুমি আদৌ ধারণ করতে পার না, তুমি চাইলেও না। আর তখন তোমাকে যা করতে বলা হবে তুমি তাই করবে।
‘কিন্তু কী করতে হবে, কী? বলুন, আমি যদি নাই জানব, তো আমি কী করেই তা করব?’
‘ও’ব্রায়েন ঝুড়িটি তুললেন আর সেটি এনে অপেক্ষাকৃত কাছের টেবিলটির ওপরে রাখলেন। নিজের সবুজ পশমি কাপড়ের ওপর সাবধানেই ঝুড়িটি বসালেন তিনি। নিজের কানেই নিজের রক্ত চলাচলের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল উইনস্টন। তার মনে হচ্ছিল ভীষণ একা হয়ে বসে আছে সে। কোনো এক বিস্তৃত বিশাল শূন্য সমতলে স্রেফ একাই বসে আছে। এক প্রশস্ত মরুভূমিতে তপ্ত সূর্যালোকের নিচে, আর তার কানের মধ্যে এসে বাজছে দূর থেকে ভেসে আসা সব অসহনীয় শব্দ। দুটি ইঁদুর সমেত খাঁচাটি তখন তার থেকে দুই মিটারও দূরে নয়। অতিকায় একেকটা ধারি ইঁদুর। যথেষ্টই বয়সী যে মুখটা ভোতা আর হিংস্র দেখাচ্ছে, আর গায়ের লোমগুলো ধূসরতা হারিয়ে বাদামি হয়ে গেছে।
‘ইঁদুরেরা,’ বললেন ও’ব্রায়েন, যে অদৃশ্য শ্রোতার উদ্দেশ্যেই বলা, ‘কাঠবেড়ালি গোছের হলেও মাংসাসী। আর তুমি সেটা ভালো করেই জান। তুমি নিশ্চয়ই এ শহরে গরিব পরিবারগুলোর ঘরে ঘরে কী ঘটেছে তা শুনেছ। কোনো কোনো এলাকায় মায়েরা তাদের শিশু সন্তানটিকে, পাঁচ মিনিটের জন্যও একা ফেলে রাখতে সাহস করেন না। স্রেফ ইঁদুরের নিশ্চিত হামলার ভয়ে। আর কোনো মানব সন্তান যখন অসহায় থাকে তখন ওরা তা বুঝে ফেলার বিস্ময়কর ক্ষমতা দেখায়।
খাঁচার ভেতর হঠাৎই বিকট কিচকিচ শব্দ তুলল জন্তু দুটি। যেন দূর থেকেই তারা উইনস্টনের ওপর হামলে পড়তে চায়। তবে ততক্ষণে ও’দুটো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। খাচার মাঝখানের বেড়ার ভেতর দিয়েই একটির ওপর চড়াও হতে চায় অন্যটি। অসহায়ত্বের গভীর গোঙানি তার কানে আসছিল। আর সে শব্দ আর কারো নয়, তার ভেতর থেকেই বেরিয়ে আসছে।
খাঁচাটি উপরে তুললেন ও’ব্রায়েন, আর তখনই ওটির ওপরে একটা চাপ বসালেন। খট করে একটা আওয়াজ কানে এল। উইনস্টন উন্মত্ত হয়ে চেয়ার থেকে নিজের বাঁধনগুলো ছিঁড়ে ফেলতে চেষ্টা করল। কিন্তু সবই বৃথা; তার শরীরের কোনো অঙ্গ, এমনকি মাথাটিও সামান্য নড়ানো সম্ভব নয়। ও’ব্রায়েন খাঁচাটি আরও কাছে আনলেন। তখন সেটি উইনস্টনের মুখের এক মিটারও দূরত্বে হবে না।
‘আমি প্রথম হরকাটিতে চাপ দিয়েছি,’ বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আর তুমি জান এই খাঁচাগুলো কীভাবে তৈরি হয়। মুখটা ঠিক তোমার মাথার ওপর বসানো হবে, বের হওয়ার কোনো পথ না রেখে। আমি যখন ঠিক দ্বিতীয় হরকাটিতে চাপ দেব, খাঁচার দরজাটি আস্তে করে উপরে উঠে আসবে। আর এই ক্ষুধার্ত জন্তুগুলো ঠিক বুলেটের মতো ছুটে বের হয়ে আসবে। তুমি কখনো ইঁদুরের লাফ দেখেছ? ওগুলো ঠিক তোমার মুখমণ্ডলের ওপর লাফিয়ে পড়বে, আর সেখানেই শুরু হবে ওদের হিংস্রতা। সাধারণত শুরুটা ওরা করে চোখ দিয়ে। কখনো কখনো ধাঁরালো দাঁতে গালটাকেই ছিদ্র করে ফেলে আর জিভ পর্যন্ত খেতে থাকে।
আরও কাছাকাছি নিয়ে এলেন খাঁচাটিকে, ক্রমেই আরও কাছে। কর্ণবিদারী এক হিংস্র শব্দ যেন তার মাথার ওপর দিক থেকে বয়ে আসছে। নিজের ভয়ের বিরুদ্ধে নিজেই ভীষণ লড়াই করে চলেছে সে। এক লহমার জন্য হলেও এখন তাকেই ভাবতে হচ্ছে, ভাবতেই হচ্ছে- কারণ ভাবনাই এখন তার একমাত্র ভরসার স্থল। তখনই ভীষণ ঘিনঘিনে একটা কটু গন্ধ এসে লাগল তার নাসিকারন্ধ্রে। ভীষণ এক বিবমিষা বোধ হতে লাগল তার, মনে হচ্ছিল পেট গুলিয়ে সব বের হয়ে আসবে, আর সব মিলিয়ে প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছিল সে। এ পর্যায়ে চারদিকটা অন্ধকার হয়ে এল। এক মুহূর্তের জন্য হলেও সে পাগল হয়ে গেল, তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল আক্রান্ত পশুর আর্তনাদ। এরপর অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে এল সে, সঙ্গে সঙ্গী হয়ে এল একটি ভাবনা। নিজেকে বাঁচানোর একটিই মাত্র পথ তার খোলা। তাকে আরেকটি মানব সন্ত নিকে সামনে ডেকে আনতে হবে, আরেকটি মানুষের শরীরকে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে ঠিক তার ও ইঁদুর দুটির মাঝখানে।
খাঁচার মুখটি যতটুকু খুলে গেছে তাতে চোখ বন্ধ করে ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। দরজাটি তার মুখমণ্ডল থেকে সামান্য দূরে। ইঁদুর দুটোও জেনে গেছে এখন ওদের কী করণীয়। একটি তো এরই মধ্যে উপর নিচে লাফালাফি জুড়ে দিয়েছে, অন্যটি ঘিনঘিনে নর্দমাবাসী বুড়ো টেকো দাদাভাইয়ের মতো যেন সবকিছু পরখ করে দাঁড়িয়ে আছে, গোলাপি রঙা একটি থাবা দিয়ে খাচার একটি দণ্ড ধরে রেখে জঘন্যভাবে বাতাসে নাক সিটকাচ্ছে। মুখের গোঁফ আর হলুদ দাঁতগুলোও নজরে এল উইনস্টনের। ফের সেই আঁধার করে দেওয়া ভয় তাকে পেয়ে বসল। অতি দ্রুতই সে দৃষ্টিহীন, অসহায় আর মনশূন্য হয়ে পড়ল।
চীন সাম্রাজ্যে এটা একটা সাধারণ সাজা,’ বললেন ও’ব্রায়েন, আগের মতোই সেই শিক্ষামূলক বাচনভঙ্গি তার।
খাঁচার মুখটি তখন তার আরও কাছে আনছেন তিনি। খাঁচার তারগুলো একবার তার গালে ঘষা লাগিয়ে গেল। আর তখনই— না, কোনো স্বস্তি নয়, স্রেফ আশা, একটি অতি সূক্ষ্ম আশাজাগানিয়া ভাবনা জেগে উঠল তার হৃদয়ে। দেরিই হয়ে গেছে, হয়তো খুবই দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎই সে বুঝে গেল এই গোটা পৃথিবীতে মাত্র একটিই মানুষ আছেন যার ওপর সে তার এই শাস্তি আরোপ করে দিতে পারে— একটিই মাত্র শরীর তার ও এই ইঁদুরদ্বয়ের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। এবার ভীষণ উগ্রতায় সে চিৎকার জুড়ে দিল— জোরে আরও জোরে।
‘আরে জুলিয়ার কাছে নিয়ে যাও! জুলিয়ার সঙ্গে এগুলো করো! আমাকে নয়! জুলিয়াকে! ওর কী হলো না হলো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। ওর মুখ তোমরা ছিবড়ে ফেলো, গা থেকে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে হাড্ডি বের করে দাও। আমার না! জুলিয়ার! আমার না!’
ক্রমেই পেছনের দিকে পড়ে যাচ্ছে সে, অতল গভীরতায় পড়ছে আর পড়ছে, ইঁদুর দুটো থেকে দূরে আরো দূরে। তবে তখনো চেয়ারের সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা সে। সেসব নিয়েই ভবনের দেয়াল ভেঙে, মাটি ফুঁড়ে, সমুদ্রের পানির মধ্য দিয়ে, বায়ুমণ্ডল চিড়ে, এই জ্যোতিষ্কমণ্ডল থেকে অন্য জ্যেতির্মণ্ডলে অসংখ্য তারকারাজির মধ্য দিয়ে— দূরে দূরে আরও দূরে ঘৃণ্য দুটি ইঁদুরের কাছ থেকে সবচেয়ে দূরে। ততক্ষণে যে অনেক আলোকবর্ষ দূরে সরে গেছে, কিন্তু ও’ব্রায়েন তখনও তার পাশে দাঁড়িয়ে। তার গালে তখনও সেই লোহার খাঁচার স্পর্শের ঠান্ডা অনুভূতি। অন্ধকার পুরো গ্রাস করে রাখলেও এরই মধ্যে ধাতব হরকায় আরও একটি চাপের শব্দ তার কানে এল। আর সে জানে খাঁচার দরজাটি এবার খুলল না, বন্ধই হলো।
অধ্যায় ছয়
একটা পত্রশূন্য চেস্টনাট গাছ খাড়া দাঁড়িয়ে। জানালা পথে সূর্যের তীর্যক আলো এসে পড়েছে ধূলিজমা টেবিলটির পাটাতনে। বিকেল তিনটার নিঝুম একাকিত্বের সময়। টেলিস্ক্রিন একটা হালকা সুরধ্বনি ছড়াচ্ছে।
অভ্যাসমতো কক্ষের এক কোনায় বসে উইনস্টন। একটি খালি গ্লাসের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ। তবে একটু পরপর চোখ যাচ্ছে উল্টো দিকের দেয়ালেও। সেখানে অতিকায় একটি মানুষের মুখ ঠিক তারই দিকে তাকিয়ে। ‘বিগ ব্রাদার তোমায় দেখছেন’ লেখা আছে ছবির ক্যাপশানে। না ডাকতেও ওয়েটারদের একজন এলেন আর গ্লাসটি ভরে দিলেন ভিক্টরি জিনে। আরেকটি বোতল হালকা ঝাঁকি দিয়ে মুখে কর্ক চেপে ধরে কয়েক ফোঁটা তরল ফেললেন গ্লাসের ভেতর। ওটা লবঙ্গের গন্ধযুক্ত স্যাকারিন, এই ক্যাফের বিশেষত্ব।
টেলিস্ক্রিনেই কান পাতা উইনস্টনের। তখনও তাতে স্রেফ সুরধ্বনিই বাজছে, কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে শান্তি মন্ত্রণালয়ের একটা বিশেষ বুলেটিন শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। আফ্রিকান যুদ্ধক্ষেত্রের খবর। সেখানে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। আর দিনভর সে নিয়েই উদ্বেগে কেটেছে উইনস্টনের। ইউরেশীয় এক সেনা (ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে: আর বলাই বাহুল্য ওশেনিয়ার যুদ্ধ বরাবরই ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে) ভীষণ শক্তি আর গতি নিয়ে দক্ষিণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দুপুরের বুলেটিনে ঠিক কোথায় তার অবস্থান তা বলা হয়নি; তবে হতে পারে এরই মধ্যে কঙ্গো যুদ্ধক্ষেত্রের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে। এতে বিপদের মুখে পড়েছে ব্রাজিভিল ও লিওপল্ডভিল। এর মানে কী তা বুঝে নেওয়ার জন্য কারো ম্যাপ ঘাঁটতে হবে না। আর এ খবর স্রেফ দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর প্রশ্নেই নয়, সমগ্র যুদ্ধে এই প্রথম বারের মতো ওশেনিয়া নিজেই হুমকির মুখে পড়েছে সে প্রশ্নেও ভয়াবহ।
একটা সহিংস অনুভূতি, ঠিক ভয় নয়, এক ধরনের অনির্দিষ্ট উত্তেজনা তার মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, যা একবার জাগ্রত আবার স্তিমিত হচ্ছে। এবার যুদ্ধ নিয়ে ভাবনাই বন্ধ করে দিল। আজকাল আর কোনো একটি বিষয়ে দণ্ড কয়েকের বেশি সময় ধরে ভাবতে পারে না। গ্লাসটা তুলে নিয়ে গোটাটাই এক ঢোকে পেটে চালান করে দিল। বরাবরের মতোই পেটে গিয়ে একটা ঝাঁকুনি দিল জিন, কিছুটা বমনউদ্রেকও সৃষ্টি করল। জঘন্য একটা পানীয়। লবঙ্গ নির্যাস আর স্যাকারিনও তাদের নিজেদের অখাঁটিত্বে অখাদ্য, আর তাতে তেলতেলে গন্ধটা থেকেই গেছে; তবে সবচেয়ে খারাপ দিকটি হচ্ছে এই জিনের গন্ধ, তার মধ্যে যে গন্ধের বাস দিবারাতি, মনের মধ্যেও মিশে আছে যে গন্ধ, সেই—
কখনো এর কোনো নাম দেয়নি সে, এমনকি চিন্তায়ও আনেনি, আর যতটা সম্ভব প্রত্যক্ষবৎ স্মরণও করেনি। তবে তার পরেও সদা আধা-সচেতনতায় তা আর জেগে থাকে তার মাঝে, যা চোখ-মুখের সামনেই ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ তুলে চলে, একটা বিকট গন্ধ নাসিকা রন্ধ্রে যেন লেগেই থাকে। ঢেঁকুরের মধ্য দিয়ে একটু জিন তার রক্তবর্ণ ঠোঁটের ফাঁক বেয়ে বেরিয়ে এল। ওরা ছেড়ে দেওয়ার পর একটু মুটিয়ে গেছে সে, আর পুরনো গাত্রবর্ণটাও ফিরে পেয়েছে— বলা যায় ফিরে পাওয়ার চেয়েও একটু বেশি কিছু। তার শরীরের ভাঁজ আর খাঁজগুলো আগের চেয়ে স্থূল। নাকের ডগা আর গালের হাড় দুটির ওপরটা বেশ লাল, এমনকি টেকো মাথাটিও এখন গাঢ় গোলাপি। একজন ওয়েটার আবারও এলেন, অনাহুত, হাতে একটি দাবার কোট নিয়ে, আর অন্যহাতে ‘দ্য টাইমস’র সবশেষ সংখ্যা। পত্রিকাটির যে পাতায় দাবা সমস্যা নিয়ে আয়োজন সেটি খোলা। তখনই ওয়েটারের চোখে পড়ল উইনস্টনের সামনের গ্লাস খালি, আবারও জিনের বোতল এনে সেটি ভরে দিলেন। অর্ডার দেওয়ার দরকার নেই, ওরা তার অভ্যাসটা জানে। দাবার বোর্ডটি আগের মতোই তার চালের অপেক্ষায় সাজান, কোনার এই টেবিলটি তার জন্য সংরক্ষিত; এমনকি গোটা ক্যাফে যখন ভরে থাকে তখনও এটিতে সে একাই বসে; আসলে অন্য কেউ তার কাছেধারে এসে বসতেও চায় না। কয়বার বা কয় পেগ পান করল তা সে গুনেও দেখে না। একটা অনির্দিষ্ট অনিয়মিত সময়ের ব্যবধানে ওরা একটা নোংরা কাগজের টুকরো ওর হাতে ধরিয়ে দেয়; ওটাই বিল। তবে কেনই যেন মনে হয় ওরা তার কাছ থেকে কম দাম নিচ্ছে। তবে যদি ওরা বেশিও নিত তাতেও কিছু যেত আসত না। এখন তার হাতে অর্থ অফুরান। একটা কাজও তার আছে, দায়-দায়িত্বহীন একটি সম্মানি পদ, আগের কাজের চেয়ে অনেক অনেক বেশি বেতনের।
টেলিস্ক্রিনে গানের সুর থেমে গেল আরেকটি কণ্ঠের উপস্থিতিতে। উইনস্টন তার মাথা তুলল আর সতর্ক হয়ে কান পাতলো শোনার জন্য। তবে, যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো বুলেটিন নয়, প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের ছোট্ট একটি ঘোষণা পাঠ হলো। বলা হলো গত কোয়ার্টারে দশম ত্রি-বার্ষিক পরিকল্পনায় জুতোর ফিতে বাবদ যে কোটা বরাদ্দ ছিল তার ৯৮ শতাংশের বেশি পূরণ হয়েছে।
টাইমসের দাবার পাতায় মন দিল সে। খুবই একটা কৌশলী সমস্যা দেওয়া হয়েছে, এক জোড়া ঘোড়ার চালেই খেলা শেষ হবে। ‘সাদা পক্ষের চাল আর আর দুই চালেই খেলা মাত।’ উইনস্টন চোখ তুলে একবার বিগ ব্রাদারের ছবিটি দেখল। সাদাই সবসময় খেলা মাত করে, এক ধরনের ধোঁয়াশা মাখা রহস্যময়তায় ভাবনাটি মনে এল তার। সবসময়, একটি ব্যতিক্রমও পাওয়া যাবে না, খেলাটা এভাবেই সাজান। সভ্যতার সেই শুরু থেকে আজতক দাবা খেলায় কালোপক্ষ কখনোই জেতেনি। এই দিয়ে কি দুষ্টের দমন শিষ্টের জয়কেই নির্দেশ করা হয়নি? পেছন থেকে অতিকায় মুখটি চোখ পাকিয়ে তাকেই দেখছে, শান্ত শক্তির পূর্ণতায়। সাদা পক্ষই করবে বাজিমাত।
টেলিস্ক্রিনের কণ্ঠটি একটু থামল আর একটা ভিন্ন আরও গম্ভীর স্বরে বলতে শুরু করল: ‘ঠিক সাড়ে তিনটায় একটি জরুরি ঘোষণা আসছে, সবাইকে সব কিছু বন্ধ রেখে তা শুনে নেওয়ার জন্য হুঁশিয়ার করা হচ্ছে। তিনটা ত্রিশ মিনিট! অতি গুরুত্বপূর্ণ খবর পেশ করা হবে। খেয়াল রাখতে হবে, কারো এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। বেলা তিনটা ত্রিশ মিনিট!’ আগের সেই মৃদু সুরসংগীত ফের বাজতে শুরু করল।
উইনস্টনের হৃদযন্ত্র রীতিমত লাফাতে শুরু করেছে। ওটাই হতে যাচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রের বিশেষ বুলেটিন, আর তার মন বলছে, খারাপ খবর আসছে। সারাদিন মৃদু উত্তেজনা নিয়ে তার মনের মধ্যে খেলে যাচ্ছে একটিই ভাবনা, আফ্রিকায় পরাভূত হচ্ছে ওশেনিয়া। সে যেন দেখতে চায় ইউরেশীয় সেনারা অজেয় সীমান্ত পদদলিত করেই পিঁপড়ার দলের মতো সারিবেঁধে আফ্রিকার ভেতর ঢুকে পড়ছে। কোনো পথে কেনই ওদের ঘিরে ফেলা যাবে না? গোটা আফ্রিকান উপকূলের সীমারেখা তার মুখস্ত। একটি সাদা ঘোড়া হাতে তুলে নিল আর সেটিকে দাবা কোর্টের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি চালিয়ে দিল। আছে নিশ্চয় এক মোক্ষম জায়গা। এমনকি যখন কালো মানুষগুলোকেও দক্ষিণের পানে ছুটে যেতে দেখে, সে দেখতে পায় আরও একটি শক্তি, রহস্যজনকভাবে তারা পুঞ্জীভূত হচ্ছে, আর হঠাৎই তারা পিছনে ঘুরে যাচ্ছে, স্থল আর সমুদ্র উভয় পথে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ভাবল এই ইচ্ছা দিয়ে সে আসলে অন্য শক্তিটিতে অস্তিত্বে ফিরিয়ে আনতে চায়। তবে কাজটি করতে হবে খুব দ্রুত। তারা যদি গোটা আফ্রিকার ওপর দখল নিশ্চিত করতে পারে, আর যদি অন্তরীপে তাকে সাবমেরিন বেজ আর আকাশ পথে শক্তি থাকে, ওশেনিয়া ঠিক দুই খণ্ড হয়ে যাবে। এর মানে হতে পারে যে কোনো কিছু: পরাভূত, পর্যুদস্ত, ব্রহ্মাণ্ডের নতুন বিভাজন, পার্টির বিনাশ! গভীর শ্বাস টেনে নিল সে। একটা অনন্যসাধারণ মিশ্র অনুভূতি — ঠিক মিশ্র নয়; বরং বলা চলে অনুভূতির ধাপানুসার, যেখানে কোন ধাপটি সবচেয়ে নিচে তা বলা কঠিন— তার ভেতরে যুদ্ধ করে চলছে।
উত্তেজনা কেটে গেছে। সাদা ঘোড়াটিরে আগের জায়গায় বসাল, কিন্তু এ মুহূর্তে দাবার চালের এই জটিল সমস্যায় মন দিতে চাইছে না। তার চিন্তা আবারও গতি পাল্টাল। আর অনেকটা অসচেতনতায় ধূলি জমে থাকা টেবিলের ওপর আঙুল ঘুরিয়ে লিখে ফেলল:
২+২=৫
‘ওরা তোমার ভেতরে ঢুকতে পারবে না,’ মেয়েটি বলেছিল। কিন্তু ওরা ভেতরেই ঢুকে যায়। ‘এখানে তোমার ক্ষেত্রে যা কিছু হচ্ছে ওটাই স্থায়ী,’ বলেছিলেন ও’ব্রাযেন। এটাই সত্য কথা। নিজের কিছু কাজ থাকে, যা থেকে কখনোই রেহাই মেলে না। বুকের ভিতরে বিষয়গুলো মেরে ফেলা হয়, ভস্ম করে দেওয়া হয়, ক্ষার কিংবা গরম লোহার ছ্যাক দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
মেয়েটির সাথে তার দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে। এতে আর কোনো বিপদের কারণ নেই। সে ভালো করেই জানে ওরা আর তার কাজ-কর্ম নিয়ে আগ্রহী নয়। দুজনের মধ্যে কারো ইচ্ছা থাকলে দ্বিতীয়বার দেখার আয়োজনও করা যেত। তবে তাদের দেখাটি হয়েছিল ঘটনাক্রমেই। একটি পার্কে, মার্চের তীব্র বীভৎস এক শীতের দিনে, মাটি তখন লোহার মতো শক্ত, ঘাসগুলো মরে গেছে, একটি অঙ্কুরেরও দেখা নেই কোথাও, গুটিকয় প্রথম বসন্তের ফুল ঠেলেঠুলে ফুটে বের হলেও বাতাসের তীব্রতায় ছিন্নভিন্ন। প্রথম দেখতে পেয়ে তার বরফ জমা হাত আর অশ্রুভেজা চোখ দুটো কী তাড়াহুড়োই না করছিল। সে ছিল মাত্র মিটার দশেক দূরে। ওর বদখত করে দেওয়া চেহারাটা দেখামাত্রই ভীষণ আঘাত পেল। দুজন দুজনকে প্রায় অতিক্রমই করে যাচ্ছিল কিন্তু কারো মধ্যেই প্রকাশিত হলো না কোনো অভিব্যক্তি, এরপর সে ঘুরল আর ওর পিছু নিল, তবে খুব যে একটা আগ্রহে তা নয়। তার জানা, বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই, তাকে নিয়েও নেই কারো কোনো আগ্রহ। মেয়েটি সামান্য কথাও বলল না। ঘাস মাড়িয়ে কোনাকুনি পথে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল যেন তাকে এড়াতে পারলে বাঁচে, এরপর আবার যেন ইচ্ছা পাল্টাল আর তাকে এগিয়ে গিয়ে পাশাপাশি হাঁটার সুযোগ করে দিল। এক পর্যায়ে দুজন পৌঁছে গেল পত্রপল্লববিহীন গুল্মোদ্যানের ভেতরে, এখানে আর নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টাই বৃথা। দুজনই থামল। তীব্র শীত যেন কামড় বসাচ্ছে শরীরে। ন্যাড়া ন্যাড়া গাছগুলোর মধ্য দিয়ে শীষ তুলে বইয়ে হিম হাওয়া। বাহু দিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরল সে।
কোনো টেলিস্ক্রিন নেই। কিন্তু লুক্কায়িত মাইক্রোফোন তো অবশ্যই রয়েছে: তাছাড়া, বাইরে থেকেও তাদের দেখা যাচ্ছে। তবে তাতে কিছুই যায় আসে না, কিছুই না। ওরা মাটিতে শুয়ে পড়তে পারত, আর চাইলে ওসব কিছুও করতে পারত। কিন্তু সে ভাবনা আসতেই তার রক্ত-মাংস স্রেফ হিমায়িত হয়ে গেল। আর কটিদেশে বাহুর চাপ পেয়েও ওর কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না, আবার নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সামান্য চেষ্টাও ছিল না। সে জানে ওর ভেতরে এখন কী পরিবর্তন এসে গেছে। তার মুখটা এখন আরও পাংশুবর্ণ নিয়েছে, কিছুটা চুলে ঢাকা পড়লেও কপাল থেকে পাশের দিকে আঘাতের একটা লম্বা দাগও দেখা যাচ্ছে, তবে পরিবর্তন সেখানে নয়। তার কোমড়ের দিকটা একটু মোটা হয়ে গেছে, আর, অদ্ভুতভাবে, কিছুটা শক্ত। মনে পড়ে কীভাবে একবার, রকেট বোমা বিস্ফেরণের পর, ধ্বংসস্তুপ থেকে সে একটি মরদেহ বের করে এনেছিল, আর সে মরদেহটির অবিশ্বাস্য ওজনই কেবল নয়, শক্ত হয়ে থাকায় নড়াচড়া করানোই হয়ে পড়ে ভীষণ মুশকিল, তখন ওই শরীরের মাংস তার কাছে পাথরের চেয়েও শক্ত মনে হয়েছিল। মেয়েটির শরীরে হাত দিয়ে আজ তার সে কথাই মনে পড়ে গেল। তার মনে হলো ওর গোটা শরীরের কাঠামোটাই আগে যেমন ছিল তার চেয়ে পাল্টে গেছে।
ওকে চুমু দেওয়ার সামান্য চেষ্টাটিও সে করল না, কথা বলারও না। যখন তারা ঘাস মাড়িয়ে আবার ফিরে যাচ্ছিল তখনই মেয়েটি তার দিকে প্রথমবার চোখ তুলে তাকাল। মাত্র এক লহমার দৃষ্টি, তবে তা ভরা ছিল অমর্যাদা আর অপছন্দে। তার জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল এই অপছন্দ কি অতীতের সব কিছু থেকে উৎসারিত, নাকি তার এখনের বদখত চেহারা, আর তীব্র হিমবায়ে জমে যাওয়া অশ্রু দেখেই এই অমর্যাদার উদ্রেক। দুটি লোহার চেয়ারে পাশাপাশি বসেছিল তারা, তবে ঘেঁষাঘেঁষি করে নয়। একবার দেখল মেয়েটি কথা বলতে চাইছে। কিন্তু তখনই আবার বেমানা জুতো পরা একটি পা কয়েক সেন্টিমিটার উপরে তুলে একটি শুকনো কাঠির ওপর ফেলল। তার মনে হলো পাটি একটু বেশিই চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।
‘আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করেছি,’ খটখটে গলায় বলল মেয়েটি।
‘আমিও তোমার সঙ্গে প্রতারণা করেছি,’ বলল সেও।
আরও একবার তীব্র অপছন্দের চাহনি হানল সে।
‘কখনো কখনো,’ বলল সে, ‘ওরা তোমাকে এমন কিছু দিয়ে ভয় দেখাত যে তুমি সহ্যও করতে পারতে না। আর তখন তুমি বলতে, “আমার সঙ্গে এগুলো কোরো না, অন্য কারো সঙ্গে করো, এমন সবই তো।” আর পরে হয়তো তুমি বুঝতে পারতে এসব স্রেফ ওদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই বলতে, আসলে তুমি ওমনটা চাইতে না। তুমি ভাবতে এমনটা ছাড়া আর কোনো পথই ছিল না তোমার নিজেকে রক্ষা করার, আর সেভাবে নিজেকে বাঁচানোর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতই তুমি ছিলে। তুমি চাইতে ঘটনাগুলো অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটুক। তখন তোমার মনেও হতো না অন্যরা কী ভোগান্তিতে আছে। তুমি স্রেফ নিজের কথাই ভাবতে।’
‘তুমি আসলে স্রেফ নিজের কথাই ভাব,’ ওর কথারই প্রতিধ্বনি তার কণ্ঠে।
‘কিন্তু পরে আর তাকে নিয়ে তোমার ভাবনাটি একই রকম থাকে না।’
‘না,’ বলল, ‘তোমার ভাবনা একই রকম থাকে না।’
এরপর মনে হলো কারোই আর কিছু বলার নেই। তীব্র বাতাস এসে পাতলা আলখেল্লা শরীরের সঙ্গে বসিয়ে দিল। ঠিক তখনই নীরবে বসে থাকাটা অসহনীয় ঠেকতে লাগল। তাছাড়া, এত ঠান্ডা যে স্থির হয়ে বসে থাকাও যাচ্ছিল না। মেয়েটি, টিউব ধরতে হবে, বা তেমন কিছু একটা বলতে বলতে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।
‘আমাদের অবশ্যই ফের দেখা হবে,’ বলল সে।
‘হ্যাঁ,’ বলল মেয়েটি, ‘আমাদের অবশ্যই ফের দেখা হবে।’
কদ্দূরখানেক সেও তার পিছু পিছু গেল, কিছুটা দূরত্ব রেখে। তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হলো না। তাকে বারণ করার চেষ্টা সে করল না, তবে এমন গতিতে হাঁটল যেন কাছাকাছি ঘেঁষতেও না পারে। উইনস্টন ভাবল অন্তত টিউব স্টেশন অব্দি যাবে ওকে সঙ্গ দিয়ে, কিন্তু হঠাৎই তার মনে হলো এই অনুসরণ স্রেফ অহেতুক আর অসহনীয়ও বটে। জুলিয়ার কাছাকাছি থাকার চেয়ে চেস্টনাট ট্রি ক্যাফেতে যাওয়ার উচ্ছ্বাসটাই বেশি কাজ করছিল। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে আজকাল জায়গাটি তার বেশি ভালো লাগে। কোনার টেবিলটিতে খবরের কাগজ আর দাবার কোট নিয়ে বসা আর জিনের অফুরন্ত সরবরাহ তাকে কিছুটা নস্টালজিকও করে দেয়। আসলে জায়গাটির উষ্ণতা কখনোই ফুরায় না। এসব ভাবতে ভাবতে ঠিক পরের মুহূর্তেই, সব মিলিয়ে দৈবাতও বলা যাবে না, একটি ছোট্ট ভিড়ের মাঝে সে জুলিয়াকে হারিয়ে যেতে দিল। মন যে খুব করে চাইছিল ফের ওকে খুঁজে বের করে, তেমনও নয়। এরপর গতি কমিয়ে দিয়ে এক পর্যায়ে ঘুরল আর উল্টো পথ ধরল। পঞ্চাশ মিটারের মতো এগিয়ে একবার পিছনে ফিরে তাকাল, সড়কটিতে খুব যে ভিড় ছিল তা নয়, কিন্তু তাকে আর চিহ্নিত করা গেল না। ডজন খানেক মানুষের যে অবয়ব দেখা যাচ্ছে তার যে কোনোটিই হতে পারে জুলিয়ার। সম্ভবত তার মুটিয়ে যাওয়া শক্ত শরীরটি আর পেছন থেকে চেনার উপায় নেই।
‘ঘটনাটি যখন ঘটে,’ ও বলছিল, ‘তুমি কিন্তু কাজটা ঠিকই করতে চেয়েছিলে।’ সেও আসলে তাই করতে চেয়েছিল। স্রেফ কথার কথা ছিল না, তার ইচ্ছাই ছিল অমন কিছু একটা ঘটুক। তার মনে হয়েছিল তাকে নয় বরং মেয়েটিকেই সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হোক-
টেলিস্ক্রিনের সুরধ্বনি কিছুটা পাল্টে গেল। একটা কর্কশ শব্দ তুলে স্ক্রিনটা হলদে রঙ নিল। আর তখন— হতে পারে এমনটা ঘটেও নি, অথবা সে ছিল স্রেফ স্মৃতি থেকে উৎসারিত কোনো শব্দমালা। সে শুনতে পেলে ওটা গাইছে:
‘ছড়িয়ে পড়া চেস্টনাট গাছের ছায়ায়
আমি তোমাকে বেচলাম, তুমি বেচলে আমায়-’
অশ্রুতে তার দুচোখ ছল ছল করে উঠেছে। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল যে ওয়েটার, লক্ষ্য করল তার গ্লাসটি খালি। দ্রুতই এক বোতল জিন নিয়ে এল সে।
গ্লাসটি তুলে নিল আর চুমুক বসাল। যতবারই মুখে নেয় এই বস্তু আগের চেয়ে কখনোই কম নয়, বরং অনেক বেশি অখাদ্য ঠেকে তার কাছে। কিন্তু এটাই একমাত্র বস্তু যাতে সে সাঁতারে চলে। এই জিনেই এখন তার জীবন, তার মৃত্যু, আর তার পুনরুত্থান। এর মধ্যেই প্রতিরাত সে ডুব দেয়, আর জিনই তাকে প্রতি ভোরে জাগিয়ে তোলে, তবে সকাল এগারোটার আগে কখনোই না। তার লেগে থাকা চোখের পাতা, এঁটো মুখ আর ভাঙা পিঠ নিয়ে বিছানা ছাড়া অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়ে যদি কিনা বিছানার পাশে রেখে দেওয়া এককাপ জিন পেটে চালান করতে না পারে। দুপুর নাগাদ বিছানায় ঢুলুঢুলু চোখে উঠে বসে সে, হাতে উঠে আসে পুরো বোতল, আর কান পাতে টেলিস্ক্রিনে। আর বিকেল তিনটা থেকে বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত চেস্টনাট ট্রি ক্যাফেতে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে। সে কী করছে তা নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই, তাকে জাগিয়ে তোলার জন্য কোনো হুইসেল বাজে না, টেলিস্ক্রিনে তাকে নিয়ে আসে না কোনো নির্দেশনা। মাঝে মধ্যে, হতে পারে সপ্তাহে দুবার, সে সত্য মন্ত্রণালয়ের একটি ধুলোজমা অফিসে যায়, যেটি দেখে মনে হয়, এর কথা সবাই বুঝি ভুলেই গেছে, আর কিছু কাজবাজ করে, অথবা সেই আসলে একে কাজ বলে মনে করে, আর কেউ না। একটি উপ- কমিটির উপ-কমিটিতে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যা এমন অগুনতি কমিটির একটি আর তার কাজ হচ্ছে নিউস্পিকের এগারোতম সংস্করণে যেসব ছোট ছোট অসঙ্গতি পাওয়া যাচ্ছে তা একত্রিত করা। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন তৈরি করা, আর বাস্তবতা হচ্ছে যে বিষয়ে তাদের এর প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে, তেমন সুনির্দিষ্ট কিছু এ পর্যন্ত তার চোখেই পড়েনি। এখানে কাজটা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় কমাটি ব্রাকেটের ভিতরেই পড়বে নাকি বাইরে তা ঠিক করা। এই কমিটিতে তার সঙ্গে আরও চারজন রয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের অবস্থা তারই মতো। কোনো কোনো দিন তাদের একসঙ্গেও দেখা হয়, আর দ্রুতই তারা একমত হয়ে চলে যায় যে, তাদের আসলে করার কিছুই নেই। তবে কোনো কোনো দিন তারা বেশ আগ্রহ নিয়ে কাজটি করতে বসে, আর ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আর বিশাল এক স্মারকলিপি তৈরির কাজ শুরু করে, যা আদতে কখনোই শেষ হয় না। কখনো কখনো তাদের মধ্যে সামান্য বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে যায়, ধীরে ধীরে তা তুঙ্গে রূপ নিয়ে ভীষণ ঝগড়ায় পরিণত হয়, একে অন্যকে দেখে নেওয়ার হুমকি ধমকি দিতে থাকে এমনকি ঊর্ধ্বতনে নালিশ ঠুকে দেওয়ার হম্বিতম্বিও চলে। এরপর হঠাৎই তাদের জীবন আর তাদের হয়ে থাকে না, দপ করে সবার তেজ নিভে যায়, যে যার আসনে বসে পড়ে আর কুতকুতে চোখে একে অপরের দিকে তাকাতে থাকে, অবশেষে ভূত যেমন কাক বনে যায়, তেমনই অবস্থা দাঁড়ায় প্রত্যেকের।
একটু ক্ষণ নীরব হয়ে থাকল টেলিস্ক্রিন। ফের মাথা তুলল উইনস্টন। এবার বুলেটিন! কিন্তু ওরা বাজনায় কোনো পরিবর্তন আনল না। তার চোখের পাতার পেছনে লটকে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাপ। সেনাবাহিনীর একটি চক্রাকার দল এগিয়ে যাচ্ছে একটি কালো তীর দক্ষিণমুখো হয়ে উপরের দিকে তাক করা, অপরটি সাদা তীর, আড়াআড়ি তাক করা রয়েছে পূর্বমুখে। প্রথমটির ঠিক লেজের মধ্য দিয়ে। যেন নিশ্চিত হতে চায়, সেভাবেই চোখ তুলে পোট্রেইটের শীতল মুখটির দিকে আরেকবার তাকাল সে। এটা কী হতে পারে, দ্বিতীয় তীরটির আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই?
তার আগ্রহ ফের পতাকা ওড়ালো। মুখ ভরে আরেক ঢোক জিন পেটে চালান করে দিল, সাদা ঘোড়াটিকে তুলে নিয়ে একটি চাল দিল। চেক। তবে নিঃসন্দেহে এটি সঠিক চাল ছিল না, কারণ-
অজান্তেই, অযাচিতভাবে একটি স্মৃতি তার মনকে ভাসিয়ে দিল। সে দেখতে পাচ্ছে মোমের আলোয় আলোকিত একটি কক্ষ, সাদা চাদর বিছানো বিশাল বিছানা, আর সে, নয়-দশ বছরের এক বালক, মেঝেতে বসে একটি ডাইস বক্স সজোরে ঝাকাচ্ছে আর উত্তেজনায় হাসছে। মা তার সামনে বসে আছেন; তিনি ও হাসছেন।
মেয়েটি যে হারিয়ে গেল তার পরে মাস খানেক গত হয়েছে। সেটি ছিল সমঝোতার এক মুহূর্ত, যখন পেটের ক্ষুধার কথাও সে ভুলে যায়, আর সাময়িকভাবে তার মধ্যে ওর জন্য মায়া জেগে ওঠে। দিনটির কথা ভালোই মনে করতে পারে সে। ভেজা স্যাতস্যাতে একটি দিন, জানালার শার্সি বেয়ে পানি নেমে আসছে আর ভেতরের আলোতে পড়া দায়। অন্ধকার, ঠাসাঠাসির একটি শয়নকক্ষে দুটি শিশুর একঘেয়ে আচরণ ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠেছে। উইনস্টন খাবারের জন্য টানা ঘ্যানঘ্যান করে চলছে, আর রুমের এদিক ওদিক ছুটে যেখানে হাতের কাছে যা পাচ্ছে ছুড়ে মারছে, দরজার পাল্লায় টানা লাথি মেরে চলছে, তাতে ছুটে এসেছে প্রতিবেশীরা, ‘আর অপর শিশুটি স্রেফ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে সব দেখছে। অবশেষে তার মা বললেন, ‘এবার থামো শান্ত হও, আমি তোমাকে খেলনা কিনে দেব, খুব সুন্দর খেলনা- তোমার ভালো লাগবে’; আর সে কথা বলে মা বৃষ্টির মধ্যেই ঘরের বাইরে বের হয়ে গেলেন, কাছেই একটি দোকানে গিয়ে সেখান থেকে একটি সাপ আর মই বসানো একটি লুডুর বক্স নিয়ে এলেন। ছাতড়াপড়া সেই কার্ডবোর্ডের গন্ধ আজও তার নাকে লেগে আছে। বাইরেটা একেবারেই ফালতু। বোর্ডটির এখানে সেখানে হাচড়া-খাচড়া আর ছোট কাঠের ছক্কাটি এতটাই ফালতু করে কাটা যে ছুড়ে দিলে কোনো একটা পাশই ঠিকমতো বসতে পারে না। গোমড়ামুখে অনাগ্রহের চোখে ডিজনিসটি দেখছিল উইনস্টন। কিন্তু তখনই তার মা একটি মোমবাতি জ্বালালেন আর মেঝেতে বসে পড়লেন খেলবেন বলে। কিছুক্ষণের মধ্যে সাপলুডুর উত্তেজনায় মগ্ন সে আর যতবার মই বেয়ে উপরে উঠছিল আর সাপের গ্রাসে পড়ে লেজ বেয়ে প্রায় শুরুর দিয়ে নেমে পড়ছিল ততবারই হাসিতে ফেটে পড়ছিল। মোট আট দান খেলল মা- ছেলে। তাতে দুজনই চার দান করে জিতল। তার ছোট্ট বোনটি, এই খেলা যে কী যা বোঝারই বয়স তার ছিল না সেও পাশে বসে অন্যদের হাসির দেখাদেখি খিলখিল করে হাসছিল। গোটা বিকেলটি তারা সবাই মিলে সে কী আনন্দেই না কেটেছিল তাদের, ঠিক তেমনি যেমন ছিল তার আরও ছোটবেলার প্রতিটি বিকেল।
ছবিটি ধাক্কিয়ে মনের বাইরে বের করে দিল। এটি ছিল আসলে এক মিথ্যা স্মৃতি। ইদানীং প্রায়ই এমন মিথ্যা স্মৃতি এসে তাকে জ্বালাতন করে। কেউ অনেক আগে কী ছিল তাতে এতদিন পর কিছুই আসে যায় না। কিছু ঘটনা ঘটেছে, আর কিছু ঘটনা হয়তো ঘটেইনি। ভাবতে ভাবতে ফের দাবার কোর্টের দিকে ফিরল আর সাদা ঘোড়াটি আবারও হাতে তুলে নিল। ঠিক তখনই সেটি শব্দ করে বোর্ডের ওপর পড়ে গেল। আর তার মনে হলো শরীরের ভেতরে একটি সুঁচ তার বিঁধে গেছে। তীব্র তূর্যধ্বনি বাতাস বিদীর্ণ করে দিল। বুলেটিন শুরু হবে। বিজয়ের ঘোষণা! তূর্যধ্বনি বেজে ওঠার পর খবর আসলে তা বিজয়েরই হয়ে আসছে। গোটা ক্যাফেতে এক ধরনের বৈদ্যুতিক ঝাঁকুনি খেয়ে গেল। এমনকি ওয়েটাররাও থমকে গিয়ে কান পাতল।
তূর্যধ্বনি এবার কিছুটা দমে গিয়ে ভীষণ শোরগোলের শব্দ আসতে লাগল। তৎক্ষণাৎ একটি উত্তেজনাপূর্ণ কণ্ঠ টেলিস্ক্রিন থেকে ভেসে আসতে শুরু করেছে; কিন্তু সে কণ্ঠও সামান্য বেজে উঠে বাইরের আনন্দোল্লাসের ধ্বনিতে ঢাকা পড়ল। ম্যাজিকের মতো চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ল। টেলিস্ক্রিন থেকে যেটুকু শব্দ তার কানে পশল তাতে সে বুঝে নিল, যা ঘটার তা ঘটে গেছে, যা ছিল তার পূর্বপরিজ্ঞেয়; সমুদ্রপথে আসা এক বিশাল রণতরীর বহর গোপনে শত্রুপক্ষের পশ্চাৎভাগে ঢুকে পড়েছে, আর একটি সাদা তীর কালো তীরের লেজের দিকটা গেঁথে দিয়েছে। তাদের জয়োল্লাস প্রকাশে নানা পরিচিত শব্দের ফুলুরি ছুটে আসছে: ‘বিশাল কৌশলগত অভিযান- সঠিক সমন্বয়- চরম পরাজয়— অর্ধলক্ষ কারাবন্দী— মনোবল পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া— গোটা আফ্রিকার নিয়ন্ত্রণ— যুদ্ধকে শেষের কাছাকাছি নিয়ে আসা- বিজয়- মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিজয়- বিজয়- বিজয়- বিজয়।
টেবিলের নিচে উইনস্টনের পা দুটো ততক্ষণের বিক্ষুব্ধের আচরণ করে চলেছে। চেয়ার ছেড়ে একটু নড়েনি সে, কিন্তু তার মন ছুটে চলছিল, ক্ষিপ্ৰ গতিতে ছুটছে, সেও ততক্ষণে বাইরে ভিড়ের মাঝে মিশে গেছে, আর আনন্দ চিৎকারে নিজেকে বধির করে তুলেছে। ফের মুখ তুলে বিগ ব্রাদারের ছবি দেখে নিল সে। যে অতিকায় মূর্তি গোটা বিশ্বকে ডিঙিয়ে গেছে! যে পাথরটির গায়ে বৃথাই হেলান দিয়ে রয়েছে এশিয়ার মানুষ। সে ভাবল কীভাবে, মোটেই দশ মিনিট আগে, হ্যাঁ দশ মিনিটই বটে— তার মনের মধ্যে হৃদয় জুড়ে ভাবনায় জয় আর পরাজয় উভয়েরই ছিল সমান আনাগোনা। আহা, ধ্বংস হয়ে যাওয়া একজন ইউরেশীয় সেনার চেয়েও এটা বাড়াবাড়ি! ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের প্রথম দিনটির পর থেকে তার ভেতরে অনেক কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু চূড়ান্ত অপরিবর্তনীয় পরিবর্তন কখনোই আসেনি, অন্তত এই মুহূর্ত পর্যন্ত নয়।
টেলিস্ক্রিন থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ তখনও বন্দী, লুটতরাজ, জবাইয়ের গল্প শুনিয়ে চলেছে, তবে বাইরে চিৎকার-শোরগোল কিছুটা কমে এসেছে। ওয়েটাররাও নিজ নিজ কাজে ফিরেছে। তাদেরই একজন একটি জিনের বোতল হাতে এগিয়ে এল। গ্লাস ভরে দিয়ে চলে গেল কিন্তু পরম সুখস্বপ্নে বিভোর উইনস্টন সেদিকে ফিরেও তাকাল না। এখন আর তার মন দৌড়াচ্ছে আর আনন্দ করছে না। সে ফিরে গেছে ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ে, তার সবকিছু ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে, তার আত্মা এখন তুষারের মতো সাদা। তাকে গণশুনানিতে হাজির করা হয়েছিল, আর সবকিছুই সে স্বীকার করে নিয়েছে, জড়িত সকলের কথা বলে দিয়েছে। সাদা টাইলস বসানো বারান্দা ধরে সে হেঁটে যাচ্ছিল, যেন হেঁটে যাচ্ছে সূর্যালোকিত কোনো পথে, আর এক সশস্ত্র প্রহরী তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে। আর দীর্ঘ প্রত্যাশিত বুলেটটি তার মস্তিষ্কে ঢুকে পড়েছে।
ফের অতিকায় মুখটির দিকে তাকাল সে। কালো ঘন গোঁফের আড়ালে লুক্কায়িত এ কোন হাসি যা বুঝতে চল্লিশটি বছর কেটে গেল। হে নিষ্ঠুর, অহেতুক অবুঝ! হে একগুঁয়ে, ভালোবাসার বুক থেকে নির্বাসিত স্বার্থপর! জিনের গন্ধময় দু’ফোঁটা অশ্রু তার নাকের দুদিক বেয়ে নেমে আসল। তবে এই ভালো, সবকিছুই আছে ঠিকঠাক, সংগ্রামের অবসান ঘটেছে। তার নিজের বিরুদ্ধে হয়েছে নিজেরই জয়। বিগ ব্রাদারকে সে ভালোবাসে।
pls complete the book, it`s really interesting book.