জিদ্দী
ফ্লোরাকে তার বাবা খুব ভালবাসতেন। কলজের টুকরার প্রতি স্নেহ থাকাটাই স্বাভাবিক। তার মেয়ের মতো মেয়ে লাখে একটা। কিন্তু ফ্লোরা তার বাবার প্রতি তেমন ভালবাসা প্রদর্শন করেনি কোনোদিনও। ফ্লোরার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ বাবা তার স্ত্রীকে বলতেন, দেখে নিও তোমার মেয়েটা খুবই লাজুক হবে-আমার সাথে কথা বলতে পর্যন্ত লজ্জা পায়। কিন্তু এই নিরীহ বাবা কোনদিন জানতে পারেন নি মেয়ের নির্লিপ্ততার কারণ। জানতে পারেননি নেপথ্যে তার খ্রীস্টত্বের তালিমের কথা।
কাজীর বিচার শুনে বাবার কলিজায় তীরাঘাত হয়। তার শোক তিনি একে অধিক স্নেহ করতেন দ্বিতীয়ত সেই মেয়েই আবার মুসলিম বিদ্বেষী। নজরকাড়া কালনাগিনী তার ঘরেই কি-না পেলে-পুষে বড়।
কাজীর নির্দেশমত তিনজন ধার্মিক মুসলিম মহিলাকে নিয়োগ দেয়া হলো। ফ্লোরার বাবা লিখিত দস্তাবেজে সই দেন।
তিনি রাজী হলেন। মেয়ের এই পরিণতির ধকল সইতে না পেরে তিনি শয্যাশায়ী হন। শয্যা থেকে আর তার ওঠা হলো না। একদিন মারা গেলেন। ফ্লোরার ভাই বদর রাগে শোকে অগ্নিশিখা হয়ে বোনের কাছে এসে বলে,
বাবা তোর শোকে মারা গেছেন।
শোকে আরো মানুষও মারা যায়। তিনি আমার বাবা– এ মুহূর্তের আফসোস কেবল এতটুকু, কিন্তু তিনি মুসলমান মনে পড়লে আমার এই আফসোস তিরোহিত হয়ে যায়।
এর মানে এই যে, তুমি সঠিক পথে আসছো না?
আমি সঠিক পথেই আছি। তোমরা এক বছর অপেক্ষা করো না। এক বছর পর আমার জিবে এ কথাই শুনবে। কাজীকে বলো, আমাকে জল্লাদের কাছে সোপর্দ করতে। আমার পয়গম্বর ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন আর আমি ফাঁসিকাষ্ঠে মরব। সত্য পথে থেকে সবার জন্য আমি তাকিয়ে আছি অধীর আগ্রহে।
তুমি জীবিত থাকবে ফ্লোরা মৃত্যুর দেখা পাবে না সহসাই। বাকী জীবন তোমাকে শ্ৰী ঘরেই কাটাতে হবে। জীবন্ত জাহান্নামে থাকবে। আমি তোমার ভাই। তাই শেষ করলাম আমার আখেরী দায়িত্ব। আমি বলতে চাই, বাতিলের ওপর থাকলে দুনিয়া-আখেরাতে শাস্তি পেতে থাকবে।
দুনিয়ার শাস্তি আমাকে আখেরাতের শান্তি থেকে বাঁচাবে। বলে ফ্লোরা পাহারাদার মহিলাদের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমাদের কি বলা হয়নি, এ ঘরে কোনো পুরুষ প্রবেশ করতে পারবে না? এ লোক কি করে ঢুকল?
উনি তোমার ভাই বলে আমরা বাধা দেইনি। জনৈকা মহিলা বললেন।
আমার কাছে ও অপরিচিত। কোনো মুসলমান আমার ভাই হতে পারে না। বের করে দাও ওকে এ ঘর থেকে।
বদর বোনের নিষ্ঠুর কথায় আহত হয়ে বেরিয়ে পড়ল।
***
মা! বদর মাকে বলল, আমার যা ধারণা, তুমিই ফ্লোরার দেমাগ খারাপ করেছ। বাবা বলেছেন, তুমি তার সাথে প্রতারণা করেছ।
শোনো বাবা! তোমার বাবাকে ধোকা দেইনি কোন দিনও। আমার কোনো আশ্রয় ও ঠিকানা ছিল না। তোমার বাবা আমার দুর্দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি তার সহধর্মিনী হলাম। একদিকে তার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা অন্যদিকে আমার ধর্মের টান একসাথে দুটি ভালবাসাই আমি মনে পুষেছি। সেই ভালোবাসার অর্ধেকটা ফ্লোরাকে দিয়ে এসেছি আশৈশব। ধর্মশিক্ষা সেই ভালবাসার প্রতীক। এক্ষণে তোমার বাবা নেই। কাজেই এ ঘরের প্রতি আমার আর আকর্ষণ নেই। আমি তোমার ছোট বোনকে সাথে নিয়ে ঘর ছাড়ছি।
কোনো মা কি তার সন্তানকে ছেড়ে যেতে পারেন যেভাবে যাচ্ছ তুমি? তোমার মমতা ও আবেগ মারা গেছে কি?
আমার সাথে যেতে চাইলে তুমি আমার ধর্মে এসে যাও। ধর্মের কারণে আমি আমার পুত্রকে কোরবান করতে প্রস্তুত।
আর আমিও ধর্মের কারণে আমার মা-বোনদের উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। চলে যাও ভোমরা। আমার ঘরে কাল নাগিনীদের ঠাঁই নেই। তোমাদের মুখ-দর্শনও করতে চাই না। বলে বাইরে চলে গেল। সন্ধ্যার পর সে ফিরে এলো। দেখল তার মা-বোন ঘরে ছেড়ে চিরদিনের তরে চলে গেছে।
অন্তরীণ অবস্থায় খামোশ ছিল ফ্লোরা, এতে প্রহরী তিন মহিলা বেশ স্বস্তি অনুভব করছিল। কোনো প্রকার জ্বালাতন না করাই তাদের স্বস্তির কারণ। ও বড় খেয়ালী, পাগল ও জেদী মেয়ে বলেই তাদের কাছে দেয়া হয়েছিল।
এক নারী তাকে জিজ্ঞেস করছিল, তোমার অপরাধ কি মা?।
আমার বাবা এক আইবুড়োর কাছে বিয়ে দিতে চেয়েছিল আমাকে। লোকটা কেবল বুড়ো নয় মদ্যপও। সে আমার বাবাকে সওদা করেছিল। আমি বেঁকে বসলাম। এ ধরনের বুড়োকে পতি করতে কি তোমরা? বেঁকে বসার দরুন আমার এই ভাই আমাকে বেদম মারপিট করেছিল। বাবার মারও কি কম খেয়েছি। আমি উভয়কে গালিগালাজ করেছি। বাবা আমাকে ধরে কাজী সাহেবের কাছে নিয়ে যান। বলেন, ও আমার বেটি। ধর্মের অবমাননা করেছে। রাগে আমি নিজকে হারিয়ে ফেলি। বলল, এ অবস্থায় তোমাদের কি গো আসত না? মহিলা হলে তার গোস্বা আসার কথা। গোর দরুন কাজী ও বাবা দুজনকেই গালমন্দ করি। কাজী সাহেব ফায়সালা করেন, মেয়েটা বেজায় মুখরা। কয়েদখানায় না পাঠিয়ে তাকে গৃহে অন্তরীণ করে রাখা হোক এবং তাকে সৎ-অসৎ শেখানো হোক।
তোমার বাবা মারা গিয়েছেন। তোমার ভাই এসেছিল কেন?
ওই আইবুড়োকে বিয়ের চাপ দিতে। ভাই আমাকে লোভ দিয়ে বলেছিল বিয়েতে রাজী হলে জলদি মুক্তির ব্যবস্থা করবে।
চীফ জাস্টিস কি তার রায় ফিরিয়ে নেবেন? কেন, তোমাকে তো ইসলাম অবমাননার দায়ে বন্দী করা হয়েছে বলল আরেক মহিলা।
ফ্লোরা সুযোগ বুঝে চীফ জাস্টিসের নিন্দাবাদ করে বলল, তোমরা এসব বিচারপতিকে ফেরেশতা জ্ঞান কর। কাজী সাহেব আমাকে যে দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, নারীরা প্রথম নযরেই তা বুঝে ফেলে। কাজীর ওই দৃষ্টির জবাব যথাযথভাবে আমি দিলে বাবার এই পরিণতি হত না এবং বন্দীও হতাম না। কাজী ও স্পেন আমীরগণ পর্দার অভ্যন্তরে নারী আর শরাবে ডুবে থাকবে, শান্তি আমার ভাগে আর সুফল ভোগ করবেন তারা।
সুন্দরী নারীর সৌন্দর্য-ই তার বড় অপরাধ। যৌবনই তোমার প্রধান অপরাধ। নজরকাড়া সৌন্দর্যও। স্পেন শাসক তোমাকে দেখামাত্রই তার হেরেমে নিয়ে নেবেন।
ওদিন হবে আমাদের জীবনের শেষ দিন।
এক্ষণে তোমার চিন্তা কি? কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে?
তোমাদেরকে বলতে চাই। আমি পলায়ন করব না। দেব না ধোকা। এতে শাস্তি পাবে তোমরা। নারী নারীকে ধোঁকা দেয় না। দিতে পারে না। তোমরা কিছুক্ষণের জন্য চলে গেলেও আমাকে এখানে পাবে। হ্যাঁ! আমি পালিয়ে গেলে যাব কোথায় তা পালানোর পরই ভেবে দেখব। সর্বান্ন তোমাদের তিনজনকে বলব, আমাকে তোমাদের আশ্রয় নিয়ে নাও।
***
প্রহরী তিন নারী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তারা ওকে চুপ চাপ দেখলেন। দেখলেন নিপ-নির্বিকার। সুতরাং ওরা যেমন একটা গা-ছাড়া ভাব দেখানো শুরু করলেন। ফ্লোরার খোদাপ্রদত্ত যাদুবলে আপনার মনগড়া অতীত কাহিনী শুনিয়ে সহানুভূতি পরায়ণ করে তুলেছিল।
পাঁচদিন পর পয়ত্রিশোর্ধ এক লোক এলেন। যৌবনপুষ্ট তার দেহ। মুখভর্তি দাড়ি। মাথায় পাগড়ী, চোখে ইলমের দূতি। চাল-চলন ও লেবাস-পোষাকে আলেম মনে হয়। হাতে দুটি কেতাব। তিনি দরজায় করাঘাত করলেন। প্রহরী দরজা খুলে দেয়। আলেম সাহেব সরকারী পরোয়ানা দেখান। ওতে লেখা, ইনি ফ্লোরাকে তালীম দেবেন এবং যথাযথ দীক্ষাও দেবেন।
তাকে ভেতরে ডেকে দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো এবং ফ্লোরার সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। ফ্লোরা তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। তৎক্ষণাৎ তার চেহারায় ঘৃণার কালো রেখা ফুটে ফুটে ওঠল। এতদসত্ত্বেও সে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে অভিনন্দন জানাল। আলেম সাহেব বললেন, শুনেছি তুমি নাকি আল্লাহ ও তার রসূলের নাফরমানি করেছ। যাচ্ছেতাই বলে গাল দিয়েছ। তোমাকে এর শাস্তি দেয়া ঠিক হয়নি। এক্ষেত্রে মূল অপরাধী তোমার বাবা, পরে তোমার মা। বসো৷ মন থেকে বন্দীদশার বেদনা মুছে ফেল, খোদা তায়ালাকে বক্রদৃষ্টিতে দেখার বয়স তোমার। রূপের গর্বে তুমি অন্ধ হয়ে গেছ। ধর্ম তোমার কাছে তাই ঠেকেছে বিরক্তির এক অধ্যায় হিসেবে। বলো আমার এই সন্দেহ অমূলক কি-না?
না। ফ্লোরা মনের কথা গোপন রেখে বললো, এই প্রথম কোনো পুরুষের মুখোমুখি হলাম, যে আমার সৌন্দর্যের অনুভূতি প্রকাশ করল। নিজকে কখনও খেলাঘরের ছোট্ট শিশুটি মনে করতাম– যুবতী নয়। আপনার কি মনে হয় বাচ্চা নই কি এখন?
হা! তুমি অবুঝ এখনো। এজন্যই বলেছি। তোমাকে শাস্তি দেয়া ঠিক হয়নি। তোমার বয়স কম দেখে কাজী সাহেব প্রথম শাস্তি দিতে চাননি। যা হবার হয়ে গেছে। তোমার শিক্ষাদীক্ষার ভার আমাকে দেয়া হয়েছে। সর্বান্তঃকরণে তুমি ইসলামকে মেনে নেবে তো?
ফ্লোরা অবুঝ নয়-সেয়ানার হাড়ি। দেহের চেয়ে তার মনের পরিপক্কতা বেশী। এই পরিপক্কতাবলে সে প্রতিবেশী এক যুবককে কুপোকাত করেছিল। পুরুষদের মাত করার কৌশল রপ্ত ছিল তার। ফ্লেরাকে সেই যুবকই পলায়ন করার সুযোগ করে দিয়েছিল। যদিও বেচারার প্রাণ হরণ করেছিল এই ফ্লোরা। কিন্তু এতো এক আলেম। যার কথার প্রতিটি ছত্র দ্বারা ধর্মানুরাগ টপকে পড়ছে। ফ্লোরা তার চোখে চোখ রাখল। ঠোঁটে এমন এক মুচকি হাসি টানল যাতে আলেমের দেহে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হল।
আমি ধর্ম গ্রহণ করব কি-না, তা নির্ভর করে এ কথার ওপর যে, প্রস্তাবকের গ্রহণযোগ্যতা কতখানি?
আলেম সাহেব এই অপ্রত্যাশিত কথায় চমকে উঠলেন।
ফ্লোরা বলল, আপনি দৈনিক আসলে গ্রহণ করতেও পারি। তবে শর্ত হচ্ছে, আমাকে নিরস ও কঠোর কথা বলতে পারবেন না। এ কথাও ভুলবেন না যে, আমি বন্দিনী। বিলকুল ওই বিহঙ্গের মত খাঁচায় আটকে যে আঁইটাই করে।
তুমি কি মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়াল দিতে চাও।
না। মুচকি হাসতে চাই। ধর্ম যদি আমার আবেগকে মেরে ফেলে তাহলে খুব সম্ভব আমি আপনার শিক্ষার প্রতি অনুকূল সাড়া দিতে পারব না।
তুমি কি আমার সাথে হাসি-খেলা করতে চাও?
আপনি আমার জরুরত পূরণ করলে আপনার বাদী হয়ে যাব, আপনার শিক্ষা আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিফলিত হবে।
আলেম সাহেবের মুখ থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসি বেরিয়ে এল, তুমি বড় বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমি তোমার শৈশব ফিরিয়ে আনব। এক্ষণে এসো শেখানোর পালা শুরু করা থাক। এসো বসবে।
***
স্পেন শাসক দ্বিতীয় আবদুর রহমানের শাহী হেকিম ছিলেন হুররাণী। ঐতিহাসিক বর্ণনায় তার পূর্ণ নাম অনুপস্থিত। সিরিয়ায় তার বাড়ী। স্পেনের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হলে তিনি এখানে আসেন। কর্ডোভায় ডাক্তারী পড়েন। অল্পদিনেই তার খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বড়ি ও সালসা বানিয়ে তিনি স্পেনে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেন। রাজপ্রাসাদে এ খবর পৌঁছলে তিনি শাহী হেকিমের পদ অলংকৃত করেন। ইতিহাস বলছে, তিনি আলেমও ছিলেন। কিন্তু আবদুর রহমান তাকে নিছক হেকিম হিসেবে মূল্যায়ন করেন তার জ্ঞান গরিমায় প্রভাবিত হননি কোন দিনও।
একবার তিনি বড় হতাশ ও পেরেশান অবস্থায় যিরাবের কাছে আসেন। বলেন, আমি শাহী হেকিম মুহতারাম যিরাব! রাসরি আলীজাহর কাছে যাওয়া দরকার, কিন্তু দরবারের ব্যাপার-স্যাপার আপনি ঠিক ততোটা ভালো জানেন, যতটা আমি জানি রোগ-ব্যামো বিষয়ে। আপনি আমায় সাহায্য করুন, আমি টেনশনে আছি; বললেন হেকিম হুররাণী।
হেকিম সাহেব টেনশনে থাকলে তো রোগীরা মরে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। বলুন। আপনার টেনশনটা কি?
সুলতানা আমাকে বলছেন, আমি যেন স্পেন শাসককে তার স্বাস্থ্য ক্রমশ যে দুর্বল হতে চলেছে তা বলে সতর্ক করি। তার উদ্দেশ্য, আবদুর রহমান যেন নতুন কোন অভিযানে না যান। শুধু কি তাই! তাকে যেন এমন এক রোগী বলে সাব্যস্ত করি যেন তিনি তাতে ভড়কে যান।
আপনি তাকে কি জবাব দিলেন।
সুলতানাকে বলেছি, আমার পেশা খুবই নিরপেক্ষ নিখাদ সেবাধর্মী ও পবিত্র। প্রাণঘাতী দুশমনকেও আমি ধোকা দিতে পারিনি, দেইনি কোন দিনও। আমি ওই রোগীদেরও সাথে মিথ্যা কথা বলতে পারি না, যারা আমার বন্ধু নয়। আর ইনি তো স্পেন শাসক। একেতো তার আনুগত্য আমার জিম্মায় ফরঅন্যদিকে আমি তার শাহী হেকিম। সুলতানাকে বলেছি, মাফ করবেন! আমার দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়। তিনি বললেন, যদি এটা গোনাহ হয়ে থাকে তাহলে এর মধ্যে ভালো দিকও আছে একটা। সেটা হচ্ছে, আমীরে স্পেন একজন অনন্য মানুষ। দুশমনের সামনে বুক উঁচিয়ে যুদ্ধ করে তিনি আহত হলে লাগাতার পরিশ্রম ও বিদ্রি রাত কাটাতে কাটাতে মারা যাবেন। স্পেনকে তার দরকার। তাঁর মত শাসক নেই আর। সুলতানকে বলেছি, যুদ্ধবিগ্রহ করতে হয়ত আমি তাকে সতর্ক করতে পারি। বলতে পারি, স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখবেন তথাপিও মিথ্যাচার আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
আপনি কি আমীর সাহেবের কাছে সুলতানার বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠুকতে চান?
আমার জিজ্ঞাসাও তাই আপনার কাছে। কথা এখানেই শেষ নয়। আমার প্রস্তাবে সুলতানা রেগে যান। তিনি আমাকে বললেন, মুহতারাম হেকিম। স্পেন-শাসক হেকিম আর কাউকে বানাতে পারেন। কিন্তু দ্বিতীয় সুলতানা কাউকে বানাতে পারবেন না। তার ওপর আমার যে প্রভাব তা কিন্তু আপনার নেই। একটি মাত্র ইশারায় আপনাকে তার কাছে বিতর্কিত করে তুলতে পারি। আমার কথামত আপনি আমল না করলে লোকেরা জানবে, প্রাসাদে হুররাণী নামী এক হেকিম ছিল। কাজেই যা বলছি তা করুন! করলে বহু এনাম পাবেন।
মুহতারাম যিরাব? আমীরের কাছে আমার মূল্যায়ন তেমন একটা নাই জানি, যতটা সুলতানার। হেকিম বহু আছে কিন্তু সুলতানা একজন। কাজেই তাকে আমি ক্ষ্যাপাতে চাইনা।
জনাব হুররাণী! সুলতানা যা বলছে তা আপনাকে করতে হবে। না করলে আপনার পরিণতির কথা আমি বলতে পারব না। শুধু কি তাই? তার কাছে আপনাকে বিতর্কিত করে তোলা হবে, আপনার চরিত্রে কালিমা লেপন করা হবে। শেষ পর্যন্ত এমন জেলে যেতে হবে যেখানে জীবন-মৃত্যু সমান। আমিও সুলতানার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছি, যেভাবে আমীরে আঃ রহমান দ্বিতীয় কোনো সুলতানাকে পাবেন না সেভাবে স্পেনও কোন দ্বিতীয় আবদুর রহমানকে পাবে না। কাজেই স্পেনের ভবিষ্যৎ ভাবনায় বৃহত্তম স্বার্থে আপনাকে মিথ্যাচার করতেই হয়।
হুররাণী খামোশ হয়ে যান। শেষতক বলেন, আমার আরো কিছু বলার ছিল– কিন্তু বলব না। আমাকে তা-ই করতে হচ্ছে যা করা উচিত নয় আমার জন্য।
***
তিনি মিথ্যাচারে রাজী হতে চাইছিলেন না। সুলতানাকে যিরাব বললেন, আমি তাকে রাজী করিয়েছি।
খুব সম্ভব সে আসছে। সুলতানা বলল, আমি তাকে ডেকে পাঠিয়েছি। স্পেন সম্রাটকে বলেছি, আপনার চেহারা হলদে বর্ণ ধারণ করেছে, চোখের দ্যুতি নিষ্প্রভ হতে চলেছে। হেকিম আগমনের সংবাদটাও তাকে আগাম দিয়ে রেখেছি।
তোমার কতদিন বাকী? প্রশ্ন যিরাবের
এক মাসের কিছু কম। আমার আশা, ছেলে হবে এবং সে আবদুর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হবে। আমার পুত্রকে ভাবী সম্রাট বানাব। এক্ষণে খ্রীস্টানদের সাহায্য দরকার। সাহায্য দরকার তোমারও।
ইতোমধ্যে জানা গেল হেকিম হুররাণী এসে গেছেন। সুলতানা ও যিরাব হররাণীকে তাদের কামরায় ডেকে আনলেন এবং আবদুর রহমানের কাছে যা বলা লাগবে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিলেন। ওই সময় মোদাচ্ছেরা আবদুর রহমানের কাছে বসলেন। আবদুর রহমান তার প্রতিও বেশ দুর্বল। মোদাচ্ছেরা তাকে ফ্লোরার বাহিনী শোনাতে লাগলেন। আবদুর রহমান বললেন,
এ ধরনের মেয়ের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত।
আপনি কাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চাচ্ছেন? ক্রুসেডাররা ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে চলেছে। এই সমস্যা নিরসন আপনার নিজ হাতে করতে হবে। কমান্ডার মাঠে লড়বে, কিন্তু সিদ্ধান্ত দিতে হবে আপনাকেই। ফ্রান্সে অতি শীঘ্র হামলা করা দরকার। বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে এই দেশটি– বললেন মোদাচ্ছেরা।
আমার জঙ্গী প্রস্তুতি এতদুদ্দেশ্যেই।
আমি দেখেছি, যুদ্ধে নামলে আপনার সুস্থতা এসে যায়। এখানে পড়ে থাকা আপনার স্বাস্থ্যহীনতার কারণ বলে মনে করি। স্মিতহাস্যে বললেন মোদাচ্ছেরা।
সত্যিই একটা ভালো কথা বলেছে। আল্লাহর দুশমনরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে আর আমি চুপচাপ বসে থাকব– তা হয় না। অভিযানে নেমে আমি প্রাণ দিতে চাই। দৌর্বল্যে আমার হাত কাঁপলেও তখন আমার হাতে তলোয়ার থাকবে। দেখবে ঘোড়ার পিঠে চাপতে।
মোদাচ্ছেরা সুন্দরী আকর্ষণীয়া যুবতী নারী। দেহসৌষ্ঠব, দীঘল কালো চুল, টানা টানা চোখ সর্বোপরি গোলাপ পাপড়ি সদৃশ তার প্রাণোচ্ছল হাসির প্রতি অগাধ আকর্ষণ ছিল আবদুর রহমানের। মোদাচ্ছেরা কেবল দৈহিক সুন্দরী নন, তিনি আত্মিক সৌন্দর্যেও আঃ রহমানকে মাত করেছিলেন।
তোমার ও সুলতানার মধ্যে একটা পার্থক্য অনুমান করছি আমি, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছি না। সেই পার্থক্য তোমার অজানা নয়।-বললেন আবদুর রহমান।
কখনও জানার চেষ্টা করিনি। পূর্ববৎ হেসে বললেন মোদাচ্ছেরা, কখনও এ খেয়ালে ডুবে থাকিনি যে, আপনি শুধু আমার। সুলতানা আর আমার মাঝে পার্থক্য ফুলের মত। প্রতিটি ফুলের ঘ্রাণ আলাদা। কখনও ভাবিনি, আমি সেই ফুল, বাগানে যে একা।
***
এই অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দরজার হালকা করাঘাত হলো। এই করাঘাত কার হতে পারে তা যেমন আবদুর রহমান জানেন তেমনি জানেন মোদাচ্ছেরাও। তিনি বললেন, বলো! এখন আসার কোন সময় হলো?
আসতে দিন।
তারও তো এখানে অধিকার আছে। বলে মোদাচ্ছেরা দরজা খুলে দিলেন।
সুলতানা দরজার দাঁড়ানো। বলল, হুররাণী এসেছেন। সুলতানার পেছনে যিরাব ও হেকিম হুরাণী। হুররাণী কামরায় ঢুকেই আবদুর রহমানের নাড়ীতে হাত রাখেন। তার চেহারায় কালো রেখা ফুটে উঠল। সে ক্রমে ক্রমে তার সিনায় হাত রেখে চাপ দিতে লাগল। জিভ বের করাল এবং চোখ খুলে পাতার দিকে তাকিয়ে কুঁচকালো।
হুররাণী! আবদুর রহমান বললেন, তুমি হয়ত দেখতে এসেছ, আমি রোগাক্রান্ত হচ্ছি না কেন। খোদা তায়ালা আমার ভেতরে এমন একটা প্রাইভেট রগ রেখেছেন, যা আমার প্রতিটি রোগকে উপশম করে দেয়। আমার অসুস্থতা নিয়ে তোমার এই অতি উ ৎসাহের কারণ কি?
আমরা এটাই দেখতে এসেছিলাম যে, ব্যাপারটা কি? কোনো প্রকার দুশ্চিন্তা আমাদের নেই। তবে এতটুকু আমাদের উদ্বেগ যে, খেলাফত ও স্পেনের জন্য সুস্থ আবদুর রহমানের দরকার বেশী বলল যিরাব।
আবদুর রহমান তো এদেশে অনেক–কিন্তু আপনার মত কজনা। অভিযান শেষ হয়েছে সেই কবে, কিন্তু চেহারা থেকে এখনও ক্লান্তির ছাপ মোছেনি। আমি মুহতারাম হুররাণীর সাথে কথা বললে তিনি বললেন, খুব সম্ভব স্পেনের কলিজা দুর্বল হতে চলেছে। তিনি অভিযানে যাওয়া বন্ধ না করলে ওই কলিজা নিস্তেজ হয়ে যাবে একেবারেই। বলল সুলতানা।
তোমার দৃষ্টিতে এতটা ফারাক কেন? অথচ মোদাচ্ছেরার দৃষ্টিতে আমি সুস্থ যুদ্ধ আমার সুস্থতা বাড়িয়ে তোলে-তার কথা এমনটা। কিন্তু তোমরা আমার সুস্থ কলিজায় ব্যামো আবিষ্কার করছো যে খুব। বললেন আবদুর রহমান। সুলতানা চোখ রাঙ্গা করে মোদাচ্ছেরার দিকে তাকাল।
স্পেন আমীরের দীর্ঘ বিশ্রামের দরকার। কলিজায় প্রেসার বাড়ছে। নাড়ির স্পন্দন বলছে, রম্ভে সঞ্চালন খুবই হালকা- দ্রত হওয়া চাই। হেকিম বললেন।
মুসলমানের রক্ত ঘরে বসে থাকলে দ্রুত হয় না। ময়দানে জেহাদে নামলেই কেবল রক্ত গরম হয় বললেন আবদুর রহমান।
আপনার সুস্থতার প্রতি নজর দিতে হবে মুহতারাম আমীর! বলল সুলতানা।
যদি কোনো চাটুকার আপনাকে সুস্থ বলে থাকে সে আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী নয়। মুহতারাম হেকিম! আপনি দাওয়া প্রস্তুত করুন– আমি তাকে সুস্থ করে তুলব। আরাম দেব।
যতটুকু আরামে তিনি এ মুহূর্তে আছেন খুব সম্ভব সেটুকুও তার থাকছে না। কোনো দরবারী যদি তার অসুস্থতার দোহাই পাড়েন তাহলে এতেও এক ধরনের চাটুকারিতার গন্ধ পাওয়া যায়! বললেন মোদাচ্ছেরা।
হুররাণী উঠে দাঁড়ালেন। মনে হলো, তার মন-মেধা অন্য কোথাও। তিনি বললেন, আমি দুটি দাওয়া দেব। আমীর মুহতারামের সুস্থতা অপরিহার্য। বলে বেরিয়ে গেলেন।
যিরাব ও সুলতানা অগাধ জ্ঞানের অধিকারী। আঃ রহমানের কলিজায় ঘুণ ধরছে এ মর্মেই তারা কথা বলল। স্রেফ আরামই নয় যুদ্ধ ও নারী তাকে ত্যাগ করতে হবে। সুলতানার এ কথার উদ্দেশ্য, সে ছাড়া আর কেউ যেন তাঁর সংশ্রবে না আসে।
***
তিনদিন পর।
হেকিম হুররাণী দেখা করতে চান বলে মোদাচ্ছেরার কাছে সংবাদ এলো। কিন্তু তিনি মহলে আসতে ভয় পেতেন। মোদাচ্ছেরা পেটের পীড়ার অজুহাতে তাকে মহলে আসার পথ সুগম করে দেন।
পরদিন মোদাচ্ছেরা কৃত্রিম পেটের পীড়ায় উহ্ আহ করতে লাগলেন। হুররানী এসে গেলেন। মোদাচ্ছেরা খাস কামরায় শায়িত। তিনি চোখের ইশরায় চাকরানীকে বেরিয়ে যেতে বলেন।
আপনার সাথে বোধ হয় এক্ষণে কথা বলতে পারব। আমার মন একটি দুঃসহ বেদনার বোঝা বয়ে নিয়ে চলেছে। আপনার সামনে কেবল ওটা পেশ করতে পারি। হুররাণী বললেন।
সেই বোঝা আমার অজানা নয়। স্পেন আমীরের কলিজায় কোন ঘুণ ধরেনি, অথচ দিব্যি আপনি তাকে রোগী বানিয়ে ফেলেছেন।
হুররাণী ভূত দেখার মত চমকে ওঠে মোদাচ্ছেরার দিকে তাকালেন।
আপনি তাকে এ কথা বলে দেবেন বুঝি? প্রশ্ন হেকিমের।
আমি তার সন্দেহ লাঘব করতে চেষ্টা করব। তবে একথা বলব না যে, সুলতানা বা যিরাব তার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে এবং শল্য বানাতে চাচ্ছে। ওরা দুশমনের সাথে সওদা পাকাপাকি করে ফেলেছে। আমি ব্যাপারটা তার কাছে গোপন রাখতে চাই। কেননা ওদের বিরুদ্ধে তিনি ক্ষেপে গেলে ওরা আরেক দিকে আমাকে ঘায়েল করতে চাইবে। আমি পরিণত হব ওদের টার্গেটে। এতে আত্মরক্ষাকল্পে আমাকে নানান ষড়যন্ত্র করতে হতে পারে। আমার চিন্তা-চেতনা এ মুহূর্তে দেশ ও জাতিকে নিয়ে। আপনি আপনার বোৰা অপসারণ করে ফেলেছেন। খুব ভাল করছেন। আরো ভালো করেছেন সুলতানার কথামত কাজ করে। ওর কথামত কাজ না করলে না জানি আপনার ওপর কি ভীষণ মুসিবত নেমে আসত! বললেন মোদাচ্ছেরা।
শ্রদ্ধেয়া মালেকায়ে আলীয়াহ! আপনি সত্যিই অনন্যা, প্রিয়ংবদা। আপনি আমার হৃদপীড়ন বন্ধ করেছেন। আমাকে আরেকটি কথা বলতে হয়। বলে তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, আরেকটি অপরাধ আপনার চরণে বিসর্জন দিতে চাই। আগামীকাল রাতে আপনার কোনো চাকরাণী আপনার কাছে দুধের গ্লাস নিয়ে আসবে। বলবে, এতে মিশরের মধু মিশ্রিত। ভাগ্যবানদের কপালেই এটা জুটে থাকে। এই দাওয়াই যৌবনকে চির অটুট রাখে। আগের যুগের রাজা-বাদশাহরা এটা সেবন করত। এতে রূপলাবণ্য বৃদ্ধি পায়। সে এই মধু আহরনের স্থানেরও উল্লেখ করবে। বলবে, এটা আমীরকে সেবন করাতে। আপনি ওই শরবত না খেয়ে তার মাধ্যমে কোনো পশুকে খাওয়াবেন।
এই বিষ সুলতানার পক্ষ থেকে আমার কাছে আসছে!
তবে কি বলছি। তিনি আমাকে বলেছেন, এই বিষ প্রয়োগের ব্যবস্থা না করলে এর চেয়ে মারাত্মক বিষ নিজ হাতেই আপনাকে খেতে হতে পারে। এটাও কি আপনি আবদুর রহমানের কাছে গোপন করতে চান?
না! এটা গোপন করব না। করলে স্পেনের কালসাপ সবাইকেই দংশন করবে। আপনি ওই নারীকে ভালোমত চিনতে পারেননি। তার সৌন্দর্যের চেয়ে ভেতরের রূপটা আরো ভয়াবহ। তা যাকগে। আপনি তাকে বিষ দিয়েছেন কি?
হ্যা! মোদাচ্ছেরার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হুররাণী তার হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বললেন, এরপরে কি বলবেন, হেকিম হুররাণী দুধে বিষ মিশিয়ে পাঠিয়েছেন? তার চেয়ে এক কাজ করুন! আমাকে জল্লাদের হাতে সোপর্দ করুন। আমি জীবিত থাকতে চাই না। আল্লাহ আমাকে রোগীর উপশমের দায়িত্বে রেখেছিলেন এতদিন, এক্ষণে আমার হাতে মানুষ মারার কায়দা-কাজেই জীবনের চেয়ে মরাই শ্রেয়। হুররাণী কেঁদে ফেলেন। বলেন, আমি এখান থেকে চলে যাব। এখানে থাকার পরিবেশ নাই।
আপনি এখানেই থাকবেন। মোদাচ্ছেরা বললেন, আপনাকে আমার বড় প্রয়োজন। সময় আসছে, যখন আপনার হাতে এই বিষ আমীরের মুখে তুলতে বাধ্য করা হবে। আপনি আমাকে যেভাবে আগেভাগে স্মরণ করালেন সেভাবে আবদুর রহমানের বেলায়ও তাকে স্মরণ করাবেন।
মাঝে মধ্যে মনে হয় সুলতানার মুখেই এই বিষ তুলে দেই। কিন্তু আমি হেকিম-যমদূত নই।
আপনি শান্ত হোন। আপনার প্রতি সুলতানার বিশ্বস্ত নষ্ট করে বসেন না যেন।
আমি ভেবে হয়রান সে খ্রীস্টানদের চর।
না! কালনাগিনী কারো প্রতি সহানুভূতিপরায়ণ নয়। সে যা কিছু করছে স্বার্থান্ধ হয়েই করছে। আপনি দেখবেন এক বুক আশা নিয়ে তার বেঁচে থাকা। ভাবী খলিফার গর্ভধারিণী সে। খ্রীস্টানদের ক্রীড়নক হয়ে তাদের থেকে একটি প্রদেশের মালিক হতে চাচ্ছে। এদিকে স্পেন আমীরের শয্যাশায়িনী হয়ে স্পেনের ভাবী সম্রাটের গর্বিত মা হবার স্বপ্ন দেখছে। ওদিকে আবদুর রহমান নারীর ছলনা ও কুমতলবে খোঁড়াই উপলব্ধি করতে পারছে। আমি তাকে কতভাবে বুঝতে চেষ্টা করলাম। আপনি আজ যে অকল্পনীয় সহমর্মিতা প্রদর্শন করলেন তার প্রতিদান একমাত্র আল্লাহই দিতে সক্ষম। নিশূপ নির্বিকার থেকে যান।
হুররাণী খামোশ বেরিয়ে যান, কিন্তু তার চলার গতি বলছিল, বড় বেচাইন তার মানসিকতা এই মুহূর্তে।
***
পরদিন।
হেরেমের বিশেষ এক চাকরাণী যে মোদাচ্ছেরার পরিচিত দেখা করল, সে বলল, তার এক ভাই মিশর থেকে এসেছে। নিয়ে এসেছে যৌন উত্তেজক মধু। এই মধু আগের যুগের ফেরাউনরা সেবন করত। এটা কেবল যুবতী রাজমহিষীরাই ব্যবহার করে থাকেন। এতে সৌন্দর্য-বৃদ্ধির পাশাপাশি শরীরে যৌবনের বান ডাকে। এখন ওই মধু মিশরের নির্জন এলাকায় পাওয়া যায়।
আপনি চাইলে দুধে মিশিয়ে আনব। মধু খুব কম : এক ঢোকেই সবটুকু পান করবেন- তাহলেই কেবল প্রতিক্রিয়া হবে।
নিয়ে এসো! এখনই। মোদাচ্ছেরা বললেন, চাকরাণীর চোখে আনন্দ দ্যুতি। চাকরাণী এক পেয়ালা দুধ নিয়ে এল। মোদাচ্ছেরা পেয়ালা দুধ হাতে নিয়ে বললেন, সুলতানা তোমাকে এই দুধ দিয়ে একথা কি বলেনি যে দেখ; দুধ খেয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি, না মাথা ঘুরে পড়ি? মনের চাপা পেরেশানি সংযত চাকরাণী বলল, আপনি একি বলছেন? সুলতানার সাথে এই দুধের সম্পর্ক কি?
ওহহো! দুধের প্রতিক্রিয়া দেখার পর বুঝি তাহলে তুমি পুরস্কার পাবে?
যতই চৌকস হোক না কেন চাকরাণী বুঝতে পারল, ইনি আবদুর রহমানের স্ত্রী। তার সন্দিহান মনোব দেখে সে কাঁপতে লাগল। মুদাচ্ছেরা হেসে পড়লেন।
ভয় নেই। বলো, এই বিষ তোমাকে কি সুলতানা দেয়নি?
হা! তিনিই দিয়েছেন। চাকরাণী কম্পিত কণ্ঠে বললো, এটা আমাকে দিয়ে দিন। আমিই পান করে নিচ্ছি। আসন্ন শাস্তির চেয়ে ওটা পান করে নেয়াই শ্রেয়। সে কেঁদে বলল, এ কাজ না করলেও তার শাস্তিও আমাকে পেতে হত।
চাকরাণী মোদাচ্ছেরার পায়ে আছড়ে পড়ল। বলল, আমার সন্তানদের প্রতি দয়া করুন। এখান থেকে পলায়ন করার সুযোগ দিন। হেরেম ছেড়ে চিরদিনের তরে চলে যাব। কর্ডোভার মুখ দেখব না কোন দিনও।
মোদাচ্ছেরা বললেন, তুমি হেরেমেই থাকবে। কেউ তোমাকে কোনো শাস্তি দিতে পারবে না।
বাইরে দাঁড়াও। আমি না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকবে। কারো সাথে কোনো কথা বলবে না।
দুধের পেয়ালা হাতেও ওঠালেন তিনি। চাকরাণী কাঁপছে বেতসপাত্র মাফিক।
***
সুলতানা ড্রেসিং টেবিলের সামনে রূপচর্চায় লিপ্ত। হেরেমের নারীরা সূর্যাস্তের পর এভাবে রূপচর্চায় লিপ্ত হতেন। সুলতানা ছিল রাতের স্বপ্ন। তার কামরায় আতরের ঘ্রাণ মৌ মৌ, জনগণ যার কল্পনাও করতে পারে না। রকমারী রঙিন আলোতে অন্দর ঝলমল।
লঘুপায়ে কামরায় প্রবেশ করলেন মোদাচ্ছেরা। আয়নায় তাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে সুলতানা চমকে ওঠেন। মোদাচ্ছেরার ঠোঁটে প্রশস্ত মুচকি হাসি।
আপনি এখানে? প্রশ্ন ও বিস্ময় দুটিই সুলতানার চোখে-মুখে, আর এই পেয়ালা?
তোমার জন্য এমন এক মধু এনেছি যা স্রেফ মিশরেই পাওয়া যায়। ফারাওদের হেরেমে এর ব্যবহার ছিল যথেচ্ছা– বলেই মোদাচ্ছেরা কারুকার্য খচিত টিপয়ে পেয়ালাটি রাখলেন, এই মধু সামান্য দুধে মিলিয়ে সেবন করলে নারীদের রূপলাবণ্য বেড়ে যায়, দেহের ভাঁজে ভাঁজে যৌবনের উন্মাদনা খেলে যায়। হেরেমের জনৈক চাকরাণীর ভাই মিশর থেকে এনেছেন। চাকরাণী এই দুধ আমার জন্য এনেছিলেন, কিন্তু আমি পান করিনি, এনেছি তোমার জন্য। তোমার দেহ ও যৌবনের প্রতি আমীরে স্পেনের যে টান সেটা চিরন্তন হোক-প্রত্যাশা আমার এই। আমার স্বামীকে খোশ দেখতে চাই। নাও পান করা। আমার নিজ দেহের প্রতি কোনোই আকর্ষণ নেই।
বুদ্ধিমতী সুলতানার বুঝতে বাকী রইল না যে, তার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেছে। তার বলার ছিল অনেক কিছু, কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বেরোল না। তার চেহারার ঔজ্জ্বল্যে কালো রেখা ফুটে উঠল। এ অপরাধ যেনতেন নয়।
সুলতানা! মোদাচ্ছেরা বললেন, নৈকট্য, লোভ ও হিংসা মানুষকে একদিন এ ধরনের নীচু কাজে নামায়, যেখানে নেমেছো তুমি। তোমার চেহারা যা তাতে এ শরবত তোমার মুখেই যাওয়া দরকার। তোমার অবস্থান বোধকরি অজানা নয়। আমি স্পেন আমীরের স্ত্রী। তুমি তার দাসী মাত্র। তোমার এই সর্বশেষ ষড়যন্ত্র কেবল তোমারই নয় বরং আগত সন্তানের মুখেও চুনকালি দিয়েছে।
সুলতানার মাথা চক্কর খেল। নির্বাক তার যবান। দড়াম করে সে পালংকে বসে গেল। ফ্যালফ্যাল করে মোদাচ্ছেরার প্রতি তাকাল।
বলো এ বিষ তুমি পাঠাওনি? মোদাচ্ছেরা প্রশ্ন করেন, যার হাতে এ দাওয়াই তুমি দিয়েছ, সে আমার চাকরাণী। তাঁকে জীবিত থাকতে হবে। কমপক্ষে তার সন্তানের জন্য হলেও। তোমার পদমর্যাদা ও অর্থলোভই তাকে এ পথে এনেছে। তার সাথে আমি মাত্র দুটি কথা বলেছি এতেই সে জাহান্নামের ভয় পেয়েছে। জীবনের মমতায় সে বেচাইন হয়ে গেছে। বিষের পেয়ালা রেখে সে আমার পায়ে পতিত হয়েছে। সে আমাকে পুরো কাহিনী শুনিয়েছে। আমাকে নয়, নিজকেই জিজ্ঞেস করো। হেরেমে তোমার অবস্থান কি? এখানকার চাকর-চাকরাণী কোনো দাসীর জন্য হেরেমের নারীকে ধোঁকা দিতে পারে না। তোমার যেমন সত্যকথা বলার সাহস নাই তেমনি নাই মিথ্যা বলারও। বলো না, আজ তোমার এই রাতটাকে জীবনের শেষরাত বানিয়ে দেই। ইচ্ছে করলে মাফও করে দিতে পারি। রূপ-লাবণ্যই তোমার জন্য কাল হল। বলল এ রূপ আজ কোন কাজে লাগছে?
সুলতানার চেহারায় বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। পটলচেরা চোখ রক্তজবার মত লাল। এতে এক সময় দেখা দেয় অশু। আচমকা উঠে সে বিষের পেয়ালা ধরল। ফোপানো কাদার সুরে বলল, আমি আর জীবিত থাকতে চাই না। মোদাচ্ছেরা সহসা উঠে তার ঠোঁট চেপে ধরেন একহাতে, আরেক হাতে পেয়ালা ছিনিয়ে নিয়ে বলেন,
এর মানে এই যে, বিষের পেয়ালা তাহলে তোমার মুখে আমিই তুলে দিয়েছি। অসহায় সুলতানা মোদাচ্ছেরার দুহাত ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। বলে, তুমি যদি শাহী খান্দানের মেয়ে হয়ে থাকো তাহলে এর প্রমাণ দাও এবং মাফ করে দাও। হ্যাঁ, আমিই তোমাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করতে চেয়েছিলাম। স্পেন ম্রাটের কানে এ খবর গেলে তিনি আমায় আস্ত রাখবেন কি?
হ্যা! তিনি তোমায় জীবিত রাখবেন– তবে কারার নিশ্চিদ্র কুঠরিতে। এমন কুঠরী যেখানে রাত-দিনের পার্থক্য বোঝায় উপায় নেই।
সুলতানা মোদাচ্ছেরার আরো শক্ত করে হু হু করে কাঁদতে থাকে।
কিন্তু আমি তোমাকে ওই মাহফিলেই জীবিত রাখতে চাই। স্পেন সম্রাটের জীবনে তোমার উপস্থিতি জরুরী। জানি, আমি যা বলছি একে আমার ধর্ম গোনাহ সাব্যস্ত করে, কিন্তু স্বার্থচিন্তা আমার জীবনে সবসময়ই কম। আমার মন উদার, চিন্তাধারাও তথৈবচ। নিজের নয় ভাবছি স্পেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ওঠো, পালংকে উঠে বসো। সুলতানা অবোধ প্রাণীর মত উঠে পালংকে বসল। মোদাচ্ছেরা বলল, ভাল করে শোন সুলতানা! এই পেয়ালা ভেঙ্গে যাবে। এই দুধ যমীন শুষে নেবে। সময় বয়ে যাবে আপন গতিতে। মাসের পর মাস বছরের পর বছর। কিন্তু তোমার অপরাধ মাটি শুষে নেবে না। সময়ের ইথারও এটা মুছতে দেবে না। বিষের এই পেয়ালা সর্বদা ঠোঁটে ছোঁয়ানো থাকতে দেখবে। সিংহশাবক
তোমার অপরাধ আমি ক্ষমা করতে পারি, তবে তা কিছু শর্তে আগামীতে সেই শর্তের একটারও বিরোধিতা করলে পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। (১) খ্রীস্টানদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করো। গোয়েন্দা আমারও আছে, যারা প্রতিনিয়ত আমার কাছে খবর পৌঁছিয়ে থাকে। যদি স্বপ্ন দেখে থাকো, খ্রীস্টানরা তোমাকে কোনো একটা প্রদেশের রাণী বানাবে তাহলে মন থেকে সেই স্বপ্ন মুছে ফেল। ওই কাফেরদের কারো সাথে যেন তোমার সম্পর্ক না থাকে। এলোগেইছ ও ইলিয়রের সাথে সম্পর্ক ছাড়। অবশ্য প্রতারণা করে ওদেরকে ধরিয়ে দিতে পারলে সেটা হবে এক মহান কাজ।
আমি তোমার প্রতিটি শর্ত মেনে নিলাম। আমায় ক্ষমা করে দাও। স্পেন সম্রাটকে কিছু বললো না।
বলব না। হুররাণীর সাথেও কোনো কথা বলো না। সে যেন আমীর সাহেবকে খামোকা রোগী সাব্যস্ত না করে। তাকে নয়া শরবত পান করাতে যেও না। রাজা ও রাজ্যের কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে যেও না। আমীর সাহেবের সামনে নিজকে একজন দাসী হিসেবেই পেশ করা। যিরাবকে ব্যবহার করা ছেড়ে দাও।
কিন্তু মোদাচ্ছেরা! যিরাব আমার প্রেম দিওয়ানা যে!
ভূমি তার প্রেমে তাহলে মজে যাও। তার প্রেম মাথা পেতে নিয়ে তার মাঝে নিজকে লীন করে দাও, তবুও আমীরে স্পেনকে মহলে বন্দী করতে যেও না। সুলতানা। তোমার দৃষ্টি আজ কেবল নিজকে লক্ষ্য করেই। জগতে আসার অর্থই হচ্ছে, দুনিয়ার স্বাদ লুটা, কিন্তু আমার দৃষ্টি ভবিষ্যৎ নিয়ে। সেটা নিজের নয় স্পেনের। আমার দৃষ্টি ওই ইতিহাসের দিকে, যা মরার পরে লেখা হবে। ইতিহাসের ওই ধূসর পাতাগুলো আমি রওশন করতে চাই, যাতে দিক নির্দেশনা খুঁজে পাবে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর। আমার কথা তোমার বোধগম্যের বাইরে হয়ত বা। খুব ভেবে দেখো– বুঝতে অসুবিধা হবে না।
বুঝি মোদাচ্ছেরা! আমি তোমার প্রতিটি শর্ত কবুল করে নিলাম।
আমার স্বামীর ও আমার মাঝে তোমাকে আসতে নিষেধ করছি না। আমি শ্রদ্ধা করি পতপত করে ওড়া ওই পতাকাকে যা মহলে উড়ছে এক্ষণে। হৃদয় মিনারে ভাসমান সেই পতাকাকে আমি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করি যা মুজাহেদীনে ইসলাম জেহাদের ময়দানে উড়িয়ে থাকেন। যাও সখি! তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।
মোদাচ্ছেরা পেয়ালা ওঠালেন এবং সুলতানার কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাতের আঁধারে ওই পেয়ালা ভেঙ্গে দেয়া হলো। মাটি শুষে নিল এর মধ্যকার বস্তু।
সুলতানার অবস্থা ওই নাগিনীর মত এক্ষণে, যার বিষদাঁতগুলো একে একে ভেঙ্গে নিয়েছে সুচতুর কোনো সাপুড়ে।
***
নজরবন্দী ফ্লোরা।
কেটে গেছে ইতোমধ্যে বেশ কিছুদিন।
আলেম সাহেব তাকে দীক্ষা দিতে আসতে থাকেন সকাল-সন্ধ্যা।
ফ্লোরার সান্নিধ্যে থাকার সময়সীমা রোজানাই বেড়ে চলছিল তার। ফ্লোরাও নিজকে তার সামনে মেলে ধরেছিল। সে তার গৃহশিক্ষককে বারদুয়েক বলেছেও, আপনার অপেক্ষায় আমার চক্ষু থিতু হয়ে গেছে। মাথা গেছে বিগড়ে। আপনার স্থলে কেউ হলে এই দীক্ষায় আমার আকর্ষণ এতটা হতো কিনা সন্দেহ।
দীক্ষার স্থলে আলেমের ধ্যান-খেয়াল এক্ষণে ফ্লোরার কাঁচা অঙ্গের দিকেই বেশী। অন্তরঙ্গ বান্ধবীর মতই সে ফ্লোরার সাথে রসালাপে লিপ্ত থাকত। পরে দিত ধর্মদীক্ষা। ফ্লোরা তার সম্মুখে বসত, পরে তার গা ঘেঁষে বসা শুরু করে। পাঠ নিতে সে এভাবে কাছাকাছি হত যাতে তার দীঘল কালো চুল আলেমের গালে আছড়ে পড়ত। গৃহশিক্ষকের হাত ফ্লোরার অজান্তেই তার কোমরের নীচে নেমে যেত। ফ্লোরা তার দিকে মুচকি হেসে এভাবে তাকাত যেন এই আবেদনে তার আপত্তি নেই। লাজুক মুখে সে বলে যায়, আপনি আমার হৃদয়ে খোদার মহব্বত সৃষ্টি করতে এসেছেন, কিন্তু আমার হৃদয়ে এক্ষণে আপনার মহব্বত। মনটা যেন আনচান করে বুক করে দুরুদুরু। এটা গোনাহ না, তো?
না! গৃহশিক্ষক বলেন।
ফ্লোরার দুঠোঁট গৃহশিক্ষকের গণ্ডে নেমে আসে। গৃহশিক্ষক তার শিক্ষাদীক্ষা ভুলে যান। সুচতুর ফ্লোরা তার দেহে আগুন ধরিয়ে সটকে পড়ে। পরবর্তী তিন দিন সে তার সনে প্রেমোন্মাতাল অভিনয় করে যায়। পুরোদস্তুর চেপে বসে তার দিলদেমাগে।
একদিন সে গৃহশিক্ষককে বলে বসে, নিঃসঙ্গতায় থাকতে থাকতে তার মাঝে একটা একঘেয়েমি ভাব জন্ম গেছে। মন চায় ঘরের সম্মুখস্থ দুবৃক্ষে ফুলনি করার, দোলনায় দোলার। কাজটি নেহাৎ মন্দ না। এক ঘেয়েমি কাটার যুৎসই হাতিয়ার। আপনাকে রশি আনতে হবে। গৃহশিক্ষক রাজী হয়ে যান।
কিন্তু প্রহরী নারীরা বেঁকে বসেন। তারা বলেন, এ মেয়ে নজরবন্দী। এই রশির দ্বারা সে পলায়নের সুযোগ পেতে পারে। গৃহশিক্ষক বলেন, কাল তোমরা নিজ হাতে ওই বৃক্ষদ্বয়ে দোলনা বানিয়ে দিও। এটা স্রেফ ফ্লোরার নয়, তোমাদেরও একঘেঁয়েমি কাটতে সহায়ক হবে। মহিলারা একে মেনে নিল। তারা দেখেছিল ফ্লোরা সাদাসিধে এক যুবতী। সে এ অবধি এমন এনো আচরণ করেনি যাতে সন্দেহ জন্মে।
সন্ধ্যার দিকে আলেম সাহেব চলে গেলেন। সন্ধ্যার জমকালো আঁধার পরিবেশকে থমথম করে তুলেছিল। প্রহরী দুনারী ঘুমিয়ে গেল, একজনই কেবল শুইল ফ্লোরার কামরায়। ফ্লোরা ঘুমযায়নি। দরজায় তালা। চাবি ওপাশের কামড়ায় ঘুমন্ত দুপ্রহরীর কাছে।
মধ্যরাতে ফ্লোরা উঠল। দেখল তার পাশে ঘুমন্ত নারী মরণ ঘুমে বিভোর। বিছানায় এগিয়ে এলো সে। চোখে মুখে হত্যার নেশা। তার শক্ত দুহাত এক সময় ঘুমন্ত প্রহরীর গলায় নেমে এলো। মহিলাটি গোঁ গোঁ করতে এক সময় নিথর হয়ে গেল।
ফ্লোরা রশি হাতে তুলে নিল। মৃদুপায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। উঠানে ছিল সিঁড়িপাতা। উঠানের কোণে কেল্লার প্রাচীর। ফ্লোরা সিঁড়ি সে দিকে নিয়ে গেল। প্রাচীরে রশি নিক্ষেপ করে শরীরটা বাতাসে ভাসিয়ে সে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলো। এখন সে যাবে কোথায়? অত ভাবার সময় নেই। অন্ধকার গলিপথে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ফ্লোরা যার দরজার কড়া নাড়ল ইতিহাস তার নামোল্লেখ করেনি। তবে সে একজন মোয়াল্লেদ খ্রীস্টান অতি অবশ্যই। মায়ের সাথে অসংখ্যবার এর কাছে এসেছে ফ্লোরা। লোকটা শেয়ালের মত ধূর্ত। লোকেরা একে দেখল সাদাসিধা ও নিরীহ। ইতিহাস বলছে, এলোগেইছ কর্ডোভা এলে এর বাড়ীতেই আশ্রয় নিত।
খ্রীস্টান লোকটা ফ্লোরাকে দেখে হতবাক হয়ে গেল। ফ্লোরাকে হাত ধরে সে ভেতরে নিয়ে গেল ও দরজা বন্ধ করে দিল। ফ্লোরা বলে গেল তার পলায়নের কাহিনী।
জানিনা কতদিন তোমাকে আমার ঘরে বন্দীর মত থাকতে হবে; মেজবান বলল, সকালে খবর পাঠাব। কেউ এসে তোমাকে কর্ডোভা থেকে নিয়ে যাবে।
আমার মায়ের সংবাদ কি? ফ্লোরা প্রশ্ন করে।
তোমার ভাই বদর মা ও বোনকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। দিন তিনেক তারা আমার এখানে ছিল। তাদেরকে বহুদূরে পাঠিয়েছি। কর্ডোভা ছাড়লে কোথাও না কোথাও তাদের দেখা যাবে। আমাদের দিক নির্দেশেক এলোগেইছ চারদিনের মধ্যেই এসে যাবেন। তিনি এখানেই ওঠবেন। তার সাথে তোমার পরিচয় হওয়া দরকার।
এলোগেইছ! ওহহ……………এলোগেইছ! আমার মা তার অনেক কথাই বলেছেন। বলেছেন, এলোগেইছ তার জীবন-যৌবন ও চাওয়া-পাওয়া ইসলামকে মূলো ৎপাটন ও খ্রীস্টবাদ পুনরুদ্ধারে ওয়াকফ করেছেন।
এলোগেইছ নজরকাড়া সৌন্দর্যের অধিকারী যুবক। তিনি অদ্যাবধি বিয়ে করেননি তিনি ঈসামসীহের জন্য দেওয়ানা। আবদুর রহমানের মহলের সুলতানা ও সংগীতজ্ঞ যিরাব ও তার ক্রীড়নক।
সত্যিই দুজন কাজ করে যেতে পারলে আমাদের কাজ ত্বরান্বিত হবে।
না! আমরা ওদের ওপর আস্থাবান হতে পারি না। কেননা ওরা মুসলমান এছাড়া যিরাব সংগীতজ্ঞ আর সুলতানা সামান্য দাসী মাত্র। এরা দরবারী চাটুকার। আমরা ওদের সাথে সতর্ক হয়েই কথা বলে থাকি। তোমাকে আগেই বলেছি, সুলতানা ভুবন মোহনী ও অতুলনীয় সৌন্দর্যের অধিকারিণী। এলোগেইছ নিঃসঙ্গতায় তার সাথে কাটিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও সুলতানার চোখ ঝলসানো রূপ তাকে মাত করতে পারেনি।
ফ্লোরার রূপ যৌবনও নজড়কাড়া বেনজীর। এ সেই রূপ যা নীতিবান আলেমকে নীতিচ্যুত করেছে। শুধু কি তাই তাকে গোলামে পরিণত করেছে। ফ্লোরা কখনও ভেবে দেখেনি তার রূপ যৌবনের একজন সাথী দরকার। দরকার একজন মনের মানুষ। ফ্লোরা নিজকে কখনো নারীই মনে করেনি। ধর্মোদ্দীপনাই তার নারীত্বকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হত, অদৃশ্য কোনো শক্তিবলে সে বলীয়ান।
হায়! মুসলিম জাতির মাঝে যদি এই উদ্দীপনা থাকত তাহলে সাহারা পেরিয়ে আটলান্টিকের অথৈ পানিরাশিতে ইসলাম আছড়ে পড়ত, কিন্তু তলোয়ারের স্থলে যখন এ জাতির হাতে শরাবের পেগ উঠে এলো তখন থেকে শুরু হলো এদের পতন। রণাঙ্গনের স্থলে মহলের নারীসঙ্গ বিভোর হওয়ায় তাদের ধর্মোদ্দীপনায় অনেকখানি ভাটা পড়ল। এক সময় তারা ওই সমুদ্রেই ডুবে গেল যেখানে একদিন জানবার্য জাতি তাদের রণতরীগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।
***
পরদিন।
কর্ডোভার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, বন্দিনী তরুণী ফেরারী হয়েছে। তার কক্ষে মৃত পড়ে আছে প্রহরী নারীর লাশ। কক্ষের পেছনে ঝুলে আছে রশি। অন্যান্য নারীদের পুলিশ গ্রেফতার করে। তারা জবানবন্দীতে জানায়, রশির যোগান দিয়েছেন দীক্ষাগুরু তথাকথিত গৃহশিক্ষক। ওই শিক্ষককেও গ্রেফতার করা হোল। তিনি অনুভব করলেন, মেয়েটা যেমনটা নজর কাড়া সুন্দরী এর চেয়েও অধিক ছলনাময়ী। সে তার সাথে প্রেমাভিনয় করে পালানোর পথ সুগম করেছে। কৃতকর্মের অনুতাপানলে অহর্নিশ জ্বলে মরেন তিনি। কখনও উন্মাদনা বশে চুল ছেড়েন; কখনও কাড়েন জামা। তাকে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি বদ্ধপাগল করে তোলে। সরকারী রিপোর্ট প্রকাশ করা হলো, ওই তরুণীকে দীক্ষাগুরুই পালাতে সহায়তা করেছে যদ্দরুন একজন অবলা নারীকেও প্রাণ দিতে হয়েছে।
ফ্লোরা যে বাড়ীতে আশ্রয় নেয় সে বাড়ীটি তার অপরিচিত নয়। তখন পর্যন্ত কেউ জানতে পারে নিয়ে এই তরুণীই কর্ডোভায় রক্তসাগরের পয়গাম নিয়ে আসবে এবং মোয়াল্লেদীনের ইতিহাসে নূতন ইতিহাসের জন্ম দেবে। ওদিকে কেউ ধারণাও করতে পারল না যে, যে নয়া উন্মাদ শহরের অলি গলিতে অদ্ভুত কথার গুঞ্জন তুলছে। কখনও অট্টহাসি দিচ্ছে, কখনও আকাশের দিকে তাকাচ্ছে- এক সাধারণ তরুণীই তাকে এ পথে নামিয়েছে। এ পাগল দিনকে দিন বদ্ধ উম্মাদে রূপ নিচ্ছিল। আত্মীয়-স্বজন তার ওপর বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের করে দিল।
একদিন শহরে তার মতই আরেক পাগলের আবির্ভাব ঘটল। সে কখনও মাঝপথে থেমে পড়ত। বেশ কিছু লোকের সাথে কথা বলত, মানুষের জটলায় সে খাবি খেয়ে ফেলত। এক সময় সে একটি চোরাগলির মোড়ে এসে থেমে গেলো। পরিচিত দরজার ছিটকিনিতে তার হাত উঠে এলো।
বাড়ীর মালিক দৌড়ে এলো এবং পরক্ষণ আগন্তুকের বুকে মিশে লাফিয়ে পড়ল।
এলোগেইছ! বেশ ভাবনায় ফেলেছেন আমাকে। অন্তর্ধানের একটা সীমা থাকা তো দরকার।
খানিকপর।
এলোগেইছের ছদ্মবেশ বদলে গেল। মুখের গালপাট্টা খুলে ফেলল। এলোগেইছ একটু বিশ্রাম নিতেই বাড়ীর ফ্লোরার পুরো কাহিনীও তাকে শুনিয়ে গেল। তার শাস্তি ও ফেরারী বাহিনীও বাদ থাকল না। বলল কাজীর দরবারে বলা ইসলাম বিদ্বেষী কথাগুলোও। এলোগেইছ নিতম্ব চাপড়ে বলল,
আমাকে এখনই তার কাছে নিয়ে চলো। ওকে তো কুমারী মরিয়মের পবিত্ৰাত্মার প্রতিবিম্ব বলে মনে হচ্ছে।
ফ্লোরা ও এলোগেইছের চার চোখের মিলন হতেই একে অপরের রূপসুধা পানে ডুবে গেল। কারো নজর যেন পড়তেই চায় না। ফ্লোরা আস্তে আগে বাড়ল। ইতিপূর্বে সে এলোগেইছের কথা শুনেছে। কদমবুচির জন্য হাঁটু গেড়ে সে বসে পড়লে এলোগেইছ তাকে বুকে তুলে নিল। বলল,
চরণে নয় তোমার স্থান এই বুকে। তুমি নিষ্পাপ তরুণী। বলে তরুণীর নিটোল গালে হস্তপরশ বুলিয়ে নিল। পবক্ষণে বলল, মেরীও এমন নিষ্পপ ছিলেন। হযরত ঈসাও ছিল আমার মত সহজ সরল। এতদসত্ত্বেও তিনি শুলে চড়েছেন তুমিও শূলে চড়বে।
আমি এ জন্যই পয়দা হয়েছি। ফ্লোরা বলল, আমার আমি শুলে মরতে চাই।
তুমি কি আমাকে এই গ্যারান্টি দিতে পারবে যে, আত্মোৎসর্গ আমার আকীদা মাফিক হবে? আমার শিরার খুন আরব থেকে আসলেও তাদেরই দেহে এটা কিরূপে বিষ হিসেবে প্রয়োগ করতে পারি- তাও বলতে হবে তোমাকে।
ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, অজেয় মনোবল ও অশ্রুতপূর্ব আত্মত্যাগ থাকলে কিই না হতে পারে? ফ্লোরাকে আরো কাছে টেনে বলল এলোগেইছ, কাজীর দরবারে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার তুলে তুমি আমাকে এক নয়া পথের সন্ধ্যান দিয়েছ। আমার আন্দোলন এক্ষণে তোমার আবেগের সাথে একাকার। এমন কর্মী তৈরী করব যারা জনাকীর্ণ চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে মুসলিম জাতি ও তাদের রাসূলকে গাল দেবে। ওরা হয়ত ধরা পড়বে, শাস্তিও একটু আধটু পাবে না-তাও কিন্তু নয়। একদলের শাস্তি শুরু হলে আরেকদল পূর্বের ন্যায় গালাগালির মহড়া চালিয়ে যাবে।
কিন্তু এতে লাভ? বাড়ী ওয়ালা প্রশ্ন করে।
এরা ধরা পড়লে শাস্তির হাত থেকে রেহাই পাবে না। এতে অন্যান্য কর্মীরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে। ওদিকে আমরা গীর্জা থেকে আওয়াজ ওঠাবো, মুসলিম কারাগারে সংখ্যালঘু খ্রীস্টানদের এমন নৃশংস অত্যাচার চলছে যা ভাষায় বর্ণনা করার মত নয়। গোটা বিশ্ব এতে চমকে উঠবে। স্পেনের আনাচে কানাচের খ্রীস্টজাতি বিদ্রোহে মাঠে নামবে। পড়ে যাবে গোটা দেশে হুলুস্থুল কাণ্ড কারখানা।
কিন্তু প্রশাসনের সাথে টক্কর দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ফ্লোরা বলল, মাদ্রিদে কি কিয়ামতে ছোগরা কায়েম হয়েছিল, তা তোমার অজানা নয়। খ্রীস্টানদের ঘর বাড়ী জ্বলেছে কি কম! আমরা সেনা ট্রেনিং দিয়ে তারপর কি মাঠে নামতে পারি না?
এ মুহূর্তে নয়। আমাদের অনেক জীবনহানি হয়েছে, তথাপিও বিদ্রোহাগ্নি নেভানোর এতটুকু ইচ্ছা নেই। আমাদের নিশূপ নির্বিকার বসে থাকতে দেখলে ওরা ফ্রান্সে হামলা করে লুই সাম্রাজ্যের ভিতে কাঁপন ধরাবে। পরে ইসলাম গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়বে। কোনো শক্তিবলেই ওই ঢেউকে রুখতে পারব না আমরা। স্পেনের ইতিহাস পড়ে দেখো, বেশ কিছুদিন আগে ফ্রান্সে হামলা হয়েছিল। এর কমান্ডার ছিলেন এই আবদুর রহমানই। তিনি ফ্রান্স বিজয় করেছিলেন। এবার আমরা তা হতে দেব না কিছুতেই।
আপনি কি ফ্রান্স থেকে সাহায্য পাচ্ছেন? প্রশ্ন ফ্লোরার।
বিদ্রোহ সেতো ফ্রান্সেরই মদদের ফসল। বর্তমান গভর্নর যিনি নিজকে স্পেন সম্রাট ঠাওরাচ্ছেন– অচিরেই ফ্রান্সে হামলা করতে যাচ্ছেন। মাদ্রিদে অত্যুত্থান ঘটিয়ে আমরা তাকে ও তার সালারদের ফ্রান্সের অগ্রযাত্রা রুখে দিতে সফল হয়েছিলাম। তারা প্যারিস ছেড়ে মাদ্রিদের পথ ধরেছিল। এভাবেই ফ্রান্স বেঁচে যায়। ফ্রান্স আমাদের চেতনা বিকাশকেন্দ্র, শক্তির প্রাণকেন্দ্র এবং ধর্মের সুতিকাগার।
এক্ষণে পরিকল্পনা কি? বাড়ীওয়ালা প্রশ্ন করে।
এতদুদ্দেশেই আমার কর্ডোভা আগমন। কিছুলোকের সাথে সাক্ষাৎ অভিপ্রায়। এক্ষণে টলেডোয় বিদ্রোহের পাঁয়তারা চলছে। শুধু পাঁয়তারা নয় বরং সাজ সাজ রব। আমাদের গেরিলা বাহিনীর সম্মুখে টলেডো বাহিনী পড়তেই তাদের ওপর অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করতে বলেছি। বলেছি, পরক্ষণে নিবিড় জঙ্গলে গা ঢাকা দিতে। ওখানকার গভর্নর মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিম। তিনি এই অগ্নিবাণকে তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। কেননা তিনি এদেরকে ডাকাত ও ছিনতাইকারী মনে করছেন। তবে আমাদের দুর্বলতা যা তা হচ্ছে এই যে, টলেডোবাসী বিদ্রোহের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। এর কারণ মাদ্রিদবাসীকে মুসলিম ফৌজ ঘর থেকে টেনে এনে প্রকাশ্য ময়দানে হত্যা করেছিল। এখানকারই কিছু লোক পলায়ন করে টলেডোয় আশ্রয় নিয়েছিল। তারা বড় ভয়ানক সংবাদ পবিবেশন করেছে। বলেছে, যে কোন পাপ করতে মনে চায় করো– তবে বিদ্রোহ নয়।
মানুষের এই দ্বিধা-ভীতি আমাদের বড় মুশকিলে ফেলে দিয়েছে। আমরা সংখ্যায় তেমন একটা আহামরি নই। এরা টহলদার সাঁজোয়া যান ও সেনাক্যাম্পে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করছে মাত্র। এক্ষণে দরকার মাদ্রিদের মত গোটা শহরবাসীর একসাথে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠা। ট্যাক্স-কর দিতে অস্বীকার করা। মোহাম্মদ ইবনে ওয়াসিমকে গ্রেফতার করে কোনো খ্রীস্টানকে গভর্নর বানানো। সম্রাট লুই বলেছেন, শহুরেদের ছদ্মাবরণে তিনি বাহিনী পাঠাবেন, কিন্তু এর আগে তাকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, মাদ্রিদের মত বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ করবে না। টলেডোবাসীর এই বিদ্রোহে ঢিমেতাল ভাবই এ মুহূর্তে আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। হায় হায়! আমি যদি শহরবাসীকে এই মহতী কাজে স্বতঃস্ফূর্ত করতে পারতাম। আহা! টলেডোবাসী যদি মাদ্রিদের ভূমিকা নিতে পারত।
হাশেম কর্মকার ওখানে চলে গেছে আগেভাগেই। লোকদেরকে সেও কি বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজী করতে পারবে না? বাড়ীওয়ালা বলল।
তার বড় কৃতিত্ব এখানেই যে, সে একদল তার মতাদর্শের বানিয়ে ফেলেছে। আমি তাকে নামবদল করতে দেইনি। বলেছি, মুসলমানরা যেন তাকে মুসলিমই মনে করে। আমি অবশ্য ভিন্ন একটি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি। ফ্লোরা আমাকে এক নয়া পথের সন্ধান দিয়েছে। আমি ওর থেকে ফায়দা লুটতে চাই। আর তা এভাবে যে, কর্ডোভার আঃ রহমান সুলতানার মাধ্যমে যে পরিস্থিতির শিকার সে পরিবেশ সৃষ্টি করব টলেডোর আমীরের বেলায়। এলোগেইছ বলে দম নিল।
সন্ধ্যার পর একে একে তিনজন লোক এলো। এলোগেইছ তাদের সাথে দীর্ঘ আলাপে ডুবে থাকল। এক নয়া পরিকল্পনার ক নিয়ে সকলে বেরিয়ে পড়ল।
***
বাড়ীটি প্রাসাদোপম। বাড়ীওয়ালা একটা কক্ষ এলোগেইছ, আরেকটা ফ্লোরার জন্য দিল। পরে সে শুয়ে গেল। ফ্লোরা ও এলোগেই কথা বলছিল। উভয়ে স্বধর্মের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। উভয়েই ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে স্পেনছাড়া করতে একপায়ে খাড়া। এক সময় এরা একে অপরের ব্যক্তি জীবন নিয়ে আলাপ শুরু করে। ফ্লোরার এক প্রশ্নের জবাবে এলোগেইছ জানাল, মিশন সফল করতেই তার আজো বিয়ে করার ফুরসত মেলেনি। তবে যোগ্য পাত্রীর অভাবও এক্ষেত্রে কিছুটা অন্তরায় যে হয়নি তাও কিন্তু নয়।
আমি আর যাই হই না কেন মানুষ তো। কেউ তার প্রেম বিলাসকে আবেগের বশে কোরবানী করতে পারে না। এ দাবী এক সময় আমি করতাম। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক এর উল্টো। তুমি কুমারী ফ্লোরা। আমার এ তাত্ত্বিক কথা তোমার বোধগম্য নাও হতে পারে। আমি জীবনোসর্গ করতে পারি। প্রেম-ভালবাসাও কেউ কেউ দুপায়ে দলতে পারে। সত্যি বলতে কি খ্রীস্টত্বের নামে আমি এতটাই উন্মাদ যে, দুনিয়ার কোনো কিছুই আমার সামনে ভাল লাগে না। সেই উম্মাদনাবশে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিয়ের সিঁড়িতে বসব না জীবনেও। তিনজন তরুণী আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। বিয়ে এক শেকল, যা আমার হাত-পা শৃঙ্খলাবদ্ধ করবে-সাফ জবাব দিয়েছি তাদের। বিয়ে আমার স্বপ্নীল– বর্ণিল রাজপথের কন্টক।
ফ্লোরা ভক্তি-শ্রদ্ধার সবটুকু অনুভূতি দিয়ে তার দিকে তাকায়। সে তাকানোতে করুণা, সে দৃষ্টি এলোগেইছের সন্ন্যাসব্রতের মাঝে লীন করার দৃষ্টি।
আমি মায়াকান্না জুড়ে দিতে চাইছি না ফ্লোরা। এলোগেইছ বলল, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে আমি এমন আত্মত্যাগ করছি; বলবে, কোনো মানুষ এমনটা করে না। এ ব্রত হাতে জ্বলন্ত অঙ্গার রাখার, এ সাধনা বিষের পেয়ালাকে অম্লত্বের মধু মনে করার, এ প্রতিজ্ঞা নিজের হাতে নিজের গলা টিপে দেয়ার। এ শিক্ষা আমি মুসলমানদের থেকে নিয়েছি। এ উপদেশ আমি ওদের থেকেই শিখেছি। পড়ে দেখেছি ওদের কোরআন। উল্টে দেখেছি তাফসীরেরও দুদশ পৃষ্ঠা। সেগুলো পড়ে আমি ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর আমার থেকে অন্য কাজ নিতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমি ইসলাম গ্রহণের স্থলে ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন সেজে বসলাম।
আরেকটা কথা তোমাকে বলে রাখি ফ্লোরা, যতক্ষণ মুসলমানরা তাদের স্বধর্মে অটল থাকবে ততক্ষণ এ ধর্মমত গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে। ওরা যে দেশেই গেছে সে দেশবাসী ওদের কর্মকাণ্ডে প্রভাবিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমাদের পূর্বসূরিরা ওদের হেরেমে নারী সুষমার ঝিলিক দেখানো শুরু করলে ওরা এর সম্মোহনীতে ডুবে গেল। ওদের পতন কার্যত এখান থেকেই শুরু। কিন্তু কিছু জানবার্য আজো টিকে আছে, কিছু মুসলিম এলোগেইছ এখনো বিচরণ করছে-ইসলাম সে কারণেই টিকে আছে। যেমন স্পেনের কমাণ্ডার-ইন-চীফ আরবের, স্পেন গভর্নরের স্ত্রী আরবের-এতেই রক্ষা; নতুবা স্পেন গভর্নর যেভাবে মুসলিম জাতির ভাগ্য শরাবের মটকায় ঢুকাচ্ছিলেন, যেভাবে নারী বিলাসে গলা অবধি ডুবে ছিলেন তাতে ইসলামের এতোদিনে আটলান্টিকে জলমগ্ন হবার কথা। আমি ওদের থেকে শিখেছি, জীবন ও আবেগ যদি কোরবানী করা যায় তাহলে বিজয়ের সোনার হরিণ পদচুম্বন করবেই করবে।
আমার প্রেমাবেগ ও হৃদ্যিক উত্তাপ ছিল ফ্লোরা। সেই শৈশবের কোনো এক ক্ষণে আমার বাবা-মার তিরোধান। ভালবাসার নির্মল উষ্ণ পরশের থেকে উপেক্ষিত আমি। আশৈশব মাঝে মধ্যে আমার পৌরুষে যৌবনের জয়গান বেজে ওঠে। হয়ে পড়ি তখন তীর্থের কাক। খুব সম্ভব এটি আত্মিক পিয়াসা। ওই সময়টাতে মনে করি! হায় আমাকে যদি কেউ এমন জগতের সন্ধান দিত, যে জগতের বদ্ধদুয়ার খুলিনি আমি। নির্জন কক্ষে বালিশে মাথা খুঁজে মনের সাথে বোঝাপাড়া করি। আমার আবেগ, আমার প্রেম, আমার পরিকল্পনার সামনে মাথা হেঁট করে নুইয়ে পড়ে। ওই সময় কেবল একটা চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খায়, কি করে উৎপাটিত করব গেড়ে বসা মুসলিম জাতির শেকড়। ওহ ফ্লোরা……….তোমার ঘুম আসছে। ওঠো কামরায় যাও। শুয়ে পড়গে।
ফ্লোরা খামোশ কামরা থেকে বেরিয়ে পড়ে।
***
গভীর রাত।
গোটা প্রকৃতি ঘুমের ঘোরে। আচমকা এলোগেইছের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফ্লোরা ঘুমাতে পারেনি। তার হৃদয় ও ঠোঁটে এই গুঞ্জন, এ লোক বড্ড তৃষ্ণাতুন। কি বিশাল ত্যাগ করে যাচ্ছে। প্রেমের উষ্ণ পরশ থেকে বঞ্চিত। ফ্লোরা উঠে বসল। ঘরে-বাইরে জমকালো অন্ধকার। তার জীবনে গভীর রাতের আদিম, অনুভূতি এই প্রথম। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে এলোগেইছের কক্ষ লক্ষ্য করে এগুতে থাকে সে। কামরাটি খুব একটা দূরে নয়। দরজায় হাত রাখতেই তা ফাঁক হয়ে যায়। আস্তে আস্তে সে এলোগেইছের খাটের কাছে এসে দাঁড়ায়। আরেকটু এগুতেই খাটে হোঁচট খায়। তার হাত গিয়ে পড়ে এলোগেইছের শরীরে। ধড়ফড়িয়ে ওঠে এলোগেইছ। ফ্লোরা শতদল সুকোমল দুহাত দ্বারা তার গালে পরম প্রশান্তি বুলায় এবং গণ্ডে গও ঘষে।
কে? অস্ফুট কন্ঠে বলে এলোগেইছ, ফ্লোরা?
হা! আমি ফ্লোরা।
এত রাতে এখানে কেন?
তোমার আত্মোৎসর্গের কিছুটা প্রতিদান দিতে। ফ্লোরার কঠে রাজ্যের কাকুতি, তোমাকে সাহারাম সম পিয়াসা নিয়ে মরতে দেব না এলোগেইছ। প্রেমের জন্য ছটফটিও না প্রিয়। আমি তোমার পায়ের জিঞ্জির হবো না। আপনার গোলাম বানাব না। সাময়িক তৃষ্ণা নিবারক মনে করে গ্রহণ করো।
এলোগেইছ ফ্লোরাকে বুকে চেপে ধরে। যে অনুভূতিকে এতদিন সে কল্পনায় হাতড়েছে ধ্যানঘোরে অনুসন্ধান করেছে সে অনুভূতির জীবন্ত সত্তা তো এই মানবীয় এক দিলাশ গোশতপিণ্ড।
ফ্লোরাকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে সে বলে, দাঁড়াও। আগুন জ্বালাতে দাও। তোমাকে স্বপ্নীল জীবনের বর্ণিল আলোতে আবিষ্কার করতে দাও।
কামরায় আলো জ্বলে উঠল।
ঐতিহাসিক পি, স্কট বলেছেন, এলোগেইছ ও স্পর্শকাতর ফ্লোরা প্রথম সাক্ষাৎ থেকে একই ছাদের নীচে ঘুমিয়ে আসছিল এবং ফ্লোরা নিজকে এলোগেইছের কাছে সঁপে দিয়েছিল। বিশেষ এক আত্মত্যাগের উদ্দেশে সে এলোগেইছের রুমে গিয়েছিল কিন্তু তার হৃদয়ে এমন এক অনুরাগের সৃষ্টি হয়, ওই যুগে যার নজীর মেলা মুশকিল। ওরা বিয়ে তো করেনি, কিন্তু একে অপরকে ছাড়া চলতে পারেনি কোন দিনও।
ফ্লোরা তার জীবন, যৌবন, সতীত্ব ও খ্রীস্টত্বের সবটুকুই এলোগেইছের কাছে সঁপে দিল।
দুতিন দিন তারা ওই রুমে বাস করল। এ সময় কজন খ্রীস্ট পাদ্রী তাদের কাছে এসে এক নয়া পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এলোগেইছ-ফ্লোরা কোনো এক সুযোগে ছদ্মবেশে কর্ডোভা ছেড়ে যায়।
***
এর পরবর্তী রোববার (খীস্টানদের জুমার দিন) থেকে সমস্ত গীর্জায় পাদ্রীদের মুখে একই কথার পুনরাবৃত্তি শোনা যেতে লাগল। তারা ভাষণে বলল, হযরত ঈসা (আ)-কে শূলে চড়ানো হয়েছে, এক্ষণে এখানকার সমস্ত খ্রীস্টানদের শূলে চড়ানোর পায়তারা চলছে। ফ্লোরা নামী এক নজরকাড়া সুন্দরী তন্বীকে স্রেফ একারণেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে যে, সে খ্রীস্টান। প্রকাশ্য জনাকীর্ণ আদালতে সে ইসলাম ও মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে কথা বলেছে। কয়েদখানার স্থলে তাকে অজ্ঞাত স্থানে বন্দী করে রাখা হয়। যতদূর সম্ভব জানা গেছে, এ মুহূর্তে মেয়েটি লাপাত্তা। কেউ জানে না কোথায় সে।
এসব ভাষণে সুকৌশলে ধর্মকে টেনে আনা হয়েছে। গীর্জায় যারা প্রার্থনা করতে এসে থাকত তাদেরকে উস্কে দেয়া হত। পাদ্রী বলত, সমগ্র খ্রীস্টজনগণকে ফ্লোরার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। করতে হবে তথাকথিত সেই অপরাধ যে অপরাধে ফ্লোরাকে বন্দী করে সাজা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ ও ধর্মোদ্দীপনার পথ কেবল এই একটাই।
গীর্জা থেকে ফুলে ফেঁপে ওঠা এই ধূম্রজাল এক সময় গোটা শহরে ছেয়ে যায়। এমনো একটি উদ্ভট কাহিনী প্রচারিত হয় যে,
ফ্লোরার বন্দীখানায় প্রতি রাতে মুসলিম অফিসারের আনাগোনা ছিল। সবচে মারত্মক কথা যা প্রচার হলো তা হলো, খোদ স্পেন গভর্নর আবদুর রহমান পর্যপ্ত তাকে হেরেমে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
এই অপপ্রচার মোয়াল্লেদীন আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিল। কর্ডোভার ঘরে ঘরে একথা পৌঁছে দেয়া হলো। পাদ্রীরা জনাকীর্ণ বাজারে বলতে লাগল, ইসলামে এমন কোন বিধান নেই যে, কোনো নারীকে বিশেষ কোন কক্ষে আটকে রেখে মুসলিম অফিসাররা তার সাথে রাত কাটাবে।
পাদ্রীরা খ্রীস্টবাদের শিক্ষা ও ইসলাম বিদ্বেষের বিষ ছড়াতে লাগল। বলল, আমরা ঈসা (আ)-কে খোদা ও খোদার পুত্র মনে করি। হযরত ঈসা (আ) বলেছেন, আমার পরে যত নবী আসবে (নাউযুবিল্লাহ) তারা সকলে মিথ্যাবাদী। ওসব পাদ্রীরা হযরত রাসূলে আকরাম (স) সম্পর্কে কুশ্রী মন্তব্যও করে যাচ্ছিল।
সমবেত মুসলমানেরা এই শ্রেণীর ধুরন্ধর পাদ্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বুদ্ধিজীবী শ্ৰেণীর শায়খরা ওদের এই বলে নিবৃত্ত করাতেন, দেখো আইনকে নিজের হাতে তুলে নিও না। ওকে কাজীর দরবারে নিয়ে চলো। একে কাজীর দরবারে হাজির করা হলো। কাজী সাহের তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিলে সে বিলকুল ও কথা পাশ কেটে বলল, না! আমি এ ধরনের একটি শব্দও মুখে আনিনি, কিন্তু সাক্ষীর মাধ্যমে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। কাজী সাহেব তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। ঈদের নামাযের পর এই পাদ্রীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এর কিছুদিন পর জান নামী জনৈক ব্যবসায়ী ও পূর্ববর্তী পাদ্রীর মত ওই অপকর্মে লিপ্ত হল। বাজারে রাসূল (স) ও কোরআনের নামে কসম খেতে লাগল। মুসলমানরা তাকে বাধা দিল। যেহেতু যে খ্রীস্টান। আর কোনো খ্রীস্টান ইসলামের নামে কসম খেতে পারে না। ইসলামের নামে সামান্য কিছু কুশ্রী ভাষা ব্যবহার করে মাফ চাইল। কাজীর দরবারেই ওঠানো হলে কাজী তাকে কমাসের জেল দিয়ে দিলেন।
***
সুলতানা বাচ্চা প্রসব করল।
মোবারক হে স্পেনশাহ! যিরাব আবদুর রহমানকে মোবারকবাদ দিতে গিয়ে বলল, বাচ্চাটি আপনার চেহারা পেয়েছে। মায়ের সৌন্দর্য নিয়ে দুনিয়ার মুখ দেখেছে। উ ৎসবের ব্যবস্থা করব কি? উৎসবটা প্রবাদ প্রতীম হওয়া চাই। সুলতানারও ইচ্ছে তার সন্তানের উৎসবটা চির জাগরুক করে রাখা দরকার।
তাতো দরকার। আবদুর রহমান বললেন, তবে আমি চিন্তা-ভাবনা করে তোমাদের বলব।
আমি তাহলে কাজ শুরু করে দেই।
মহলে খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, সুলতানার সন্তান উপলক্ষে উৎসব হতে চলেছে। মহলের উৎসব জাকজমকপূর্ণ হবে। দুহাতে এনাম দেয়া হবে। শরাবের বন্যা বইয়ে দেয়া হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাজারঘাট বন্ধ থাকবে দিনের পর দিন।
মোদাচ্ছেরা সালার ও মন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, আমি যদি আমীরে স্পেনের সাথে কথা বলি, তাহলে তিনি একে প্রতিহিংসা মনে করবেন। সুলতানা পুত্র সন্তান প্রসব করেছে বলে আপনাদের কাছে খবর পৌঁছে থাকবে এজন্য জন্মোৎসব পালনের পায়তারা চলছে। আপনারা এ বিষয়ে তাকে নিবৃত্ত করার পদক্ষেপ নেবেন কি?
আমরা পরস্পরে কথা বলেছি। সেনাপতি বললেন, কেউই জন্মোৎসবের পক্ষে নয়।
জন্মোৎসবের সময়ও তো হাতে নেই। মন্ত্রী বললেন, শহরে অনিরাপত্তা ও থমথমে ভাব বিরাজমান। প্রতিদিনই খ্রীস্টানদের লাশ ঝুলছে দুএকটা।
আপনারা নিজেরা যখন কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন তখন আর দেরী কেন? তাড়াতাড়ি তার কাছে যান। বললেন মোদাচ্ছেরা।
উবায়দুল্লাহ ও হাজে আবদুল করিম যখন দরবারে প্রবেশ করেন তখনও আবদুর রহমানের পার্শ্বে যিরাব বসা। সে তাকে বুঝাচ্ছে, শহরে কোন প্রকার অনিরাপত্তা নেই। সর্বত্রই শাস্তির ফোয়ারা বয়ে চলেছে। সমগ্র প্রদেশের অবস্থাও এমন।
সেনাপতি উবায়দুল্লাহ বললেন, আমীরে মুহতারাম! আমরা অনুষ্ঠিতব্য জানন্মাৎসব সম্পর্কে দুচারটি কথা বলতে এসেছি।
সেনানিবাসে কি জন্মোৎসব পালনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে? প্রশ্ন যিরাবের।
ফৌজ অভিযানে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শহরের ফঁসে ওঠা বিদ্রোহাগ্নি ফৌজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। বিপ্লবের আগুন এখানেও ধরতে পারে বলে ধারণা। মন্ত্রী বললেন।
আমীরে মুহতারাম। আমরা জানতে চাই ফৌজ জন্মোৎসবের প্রস্তুতি নেবে নাকি নেবে টলেডো যাত্রার প্রস্তুতি? আজ না হোক কাল ওখান থেকে খবর আসবে– কমান্ডো পাঠাও।
কিন্তু উৎসবে সময় নষ্ট হবে কতটুকু? কিছুদিনের প্রস্তুতি, উৎসবে একরাত-এই তো নাকি? যিরাব বলল।
পতাকা ভূলুষ্ঠিত হতেও তো সময় লাগে না খুব একটা যিরাব। সেনাপতি বললেন।
আর ওই দেশের পতাকা ভূলুষ্ঠিত হতে তো এক মুহূর্তও লাগার কথা নয় যে দেশের রাজার উপদেষ্টা এক সঙ্গীতজ্ঞ। কেন তুমি জানো না দেশের মহানগরীগুলোয় কি হচ্ছে?– প্রশ্ন মন্ত্রীর।
আমীর আবদুর রহমানের চেহারায় অস্বস্তির রেখা ফুটে উঠল। তিনি ধড়ফড়িয়ে উঠলেন। বললেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আমাকে জানাও। তিনি রাগতঃকণ্ঠে বললেন, যিরাব তো আমাকে এইমাত্র বলল, দেশে শান্তি বিরাজ করছে।
শহরে এক খ্রীস্টানের লাশ ঝুলছে। ইসলাম বিদ্বেষীর কর্মকাণ্ড তার নিজস্ব নয়- কোন না কোন ষড়যন্ত্রের ফসল এটা যা প্রতিহত করা না গেলে বিপ্লব, অভ্যুত্থান অনিবার্য।
বিদ্রোহ ফওরান আমরা প্রতিহত করব যিরা বলল।
নাচ-গান ও জন্মোৎসব পালনের দ্বারা বিদ্রোহ দমন করা যায় না যিরাব। সেনাপতি বললেন, আর তোমাদের মোটা ব্রেন একথা বুঝতে অপারগ যে, বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসের পেছনে কি কারণ থাকতে পারে?
আমীরে মুহতারাম। আমরা কথা বলছি আপনার সাথে। স্পেন ষড়যন্ত্রভূমিতে রূপ নিয়েছে।
আর সেই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য, আমাদের সুস্থ থাকতে না দেয়া-এইতো। ফ্রান্সের আক্রমণ মুলতবি রেখে ষড়যন্ত্র শেকড় উপড়ে ফেলা ষড়যন্ত্রের কারণ এটাই বুঝি। মনে রেখ ফ্রান্স আক্রমণ ভূলিনি আমি। ওই দেশে হামলা চালানো আমার জন্য ফরয। এ ফরয আমাকে আদায় করতে হবে………..কিন্তু আমীরে স্পেন খানিক থেমে বললেন, জন্মোৎসব পালন করলে এমন কি আসে যায়।
তেমন কিছু না। খানার কিছু উজাড় হবে মাত্র। জনগণ কদিন জন্মোৎসবে মেতে উঠবে। আমরা বলতে চাই, হেরেমে মানুষ পয়দা হতে থাকবে। উৎসব ও এনামের এই পরম্পরা আমাদের বন্ধ করতেই হবে। এক্ষণে খানার অর্থ যতটা দরকার ততটা দরকার হয়নি ইতিপূর্বে–বললেন মন্ত্রী,
এ উৎসব আমাদের মর্যাদার পরিপন্থী। আগামী বংশধরের জন্য এমন কিছু রেখে যাওয়া দরকার যা স্মরণ করে তারা গর্ববোধ করবে। আমীরে মুহতারাম! এই সন্তান এমন এক নারীর গর্ভজাত যিনি আপনার বিবাহিতা স্ত্রী নন। যেহেতু আমাদের হেরেমে অবিবাহিতাকে রাখার প্রচলন জায়েজ করে নেয়া হয়েছে সেহেতু একে নিখাদ ইসলামী দৃষ্টিকোণে বিচার করলে বলুন তো বিধর্মীরা কি বলবে? বলবে, এক জারজ সন্তানের জন্মোৎসব পালন চলছে স্পেন প্রাসাদে। কি বলবে আমাদের পরবর্তী বংশধর?
আমীরে মুহতারাম! দেশের সঠিক রিপোর্ট আপনাকে দিতে পারি কেবল আমরাই। যাকে তাকে আপনার উপদেষ্টা করলে আমাদেরকে আমাদের কাজ করার স্বাধীনতা দিন। আমরা আমাদের কাজ করে যাব। আমরা ঈমানী দায়িত্ব থেকে এতটুকু বিচ্যুত হব না। আমাদের স্বাধীনতার চেতনা ভিন্ন।
কাঁচা ঘুম ভাঙ্গার মত চমকে উঠলেন সিংহশাবক আবদুর রহমান। দ্বৈত সত্তার অধিকারী এই আবদুর রহমান। তার সত্তার একটা অংশ বিলাসিতার আরেকটা মৃজাহিদীর, বীরত্বের।
সেনাপতি ও মন্ত্রীগণ জানতেন আবদুর রহমানের দ্বৈত সত্তার দিকটি। তাই তারা সুকৌশলে অপূর্ব উপস্থাপনায় তার ভেতরের সিংহকে উজ্জীবিত করেন। তারা বিগত দিনে ভেবেছেন যিরাব ও সুলতানা আপদ দূর করতে, কিন্তু এতে ফল হবে উল্টো। এদের বিরহে আবদুর রহমান মদ নিয়েই কাটাবেন। হয়ে পারবেন নিয়মিত মদসেবী। ফলে নিজেও ডুববেন, জাতিকেও ডুবাবেন।
আমীর আবদুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন। টহল দিতে লাগলেন এই বলে, টলেডোর খবর কি। যিরাব! তুমি যেতে পার। জন্মোত্সব হবে না।
টলেডোর পরিস্থিতি ভালো না। এটি মাত্রীদের একটি শহর। আবদুর রহমানের বাবা আল-হাকামের যুগে এখানে একবার বিদ্রোহ হয়েছিল। প্রচুর খ্রীস্টানের হত্যা হয় তখন। হাশেম কর্মকার ছিল টলেডোবাসী। প্রথমে খ্রীস্টান থাকলেও পরে সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। শহরে বিদ্রোহীদের হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে হাশেমের বাড়ীও রক্ষা পায়নি। তার বিবি-বাচ্চা ঘরদোর ছেড়ে পালিয়েছিল কিন্তু পথিমধ্যে ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয়। পরিবার ছাড়া হাশেম কর্ডোভা এসে কর্মকারের কাজ নেয়। এবং তলে তলে মোয়াল্লেদীন আন্দোলন শুরু করে। ফ্লোরাকে সে-ই আশ্রয় দিয়েছিল। পরে করেছিল জনৈক পাদ্রীর কাছে হাওয়ালা। তার যবানে ছিল যাদু। একবার যে তার কথা শুনত সে পাগল হয়ে যেত।
কর্ডোভা ছেড়ে এক সময় সে টলেডো আসে। টলেডোর খ্রীস্টানদের জড়ো করে। এক মহান আন্দোলনের নেতা বনে বসে।
টলেডোয় ইতিপূর্বেও বিদ্রোহ হয়েছিল। এতে বিদ্রোহীদের প্রচুর জানমালও ক্ষয় হয়েছিল। টলেডোয় আচমকা একদিন আওয়াজ ওঠে যে, কবরস্থানে জনৈক দরবেশের আবির্ভাব ঘটেছে। যিনি হামেশা বলে চলেছেন, ঈসা মসীহের অনুসারী হে জাগো। তোমাদের হাতে ক্ষমতার আসছে। লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, এ হয়ত কোনো পাদ্রীর অশরীরী আত্মা। মানুষকে অমীয় বাণী শোনাচ্ছে। ওদিকে গীর্জার পাত্রীদের কাছে এ খবর শোনানো হলে তারা বলল, ওই আওয়াজদাতা অশরীরী আত্মাকে কবরস্থান থেকে তাড়ানো উচিত হবে না। এ ধরনের পুণ্যাত্মা মানুষকে সৎপথ দেখায়।
কদিনের ব্যবধানে জানা গেল কবরস্থান থেকে দিয়াশলাই-এর রশি উঠছে, সেই রশ্মি থেকে ভেসে আসছে, তোমাদের ঘুম হারাম করে দাও। জাগে, অপরকে জাগাও। সেই কেয়ামতকে রুখখা, যা তোমাদের দিকে ধেয়ে আসছে।
খ্রীস্টানরা অশরীরী আত্মা ও প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করত। ওযুগে এ বিশ্বাস সবার মনে বদ্ধমূল হত। তারা ধারণা করত প্রেতাত্মা মানুষের ক্ষতি করতে পারে আর পুণ্যাত্মা করতে পারে উপকার। কাজেই দলে দলে সকলে কবরস্থানের উদ্দেশ্যে যেতে থাকে। কবরস্থান খুবই প্রশস্ত। সেখানে রকমারী বৃক্ষ ঠাসা। লোকেরা এর বাইরে দাঁড়িয়ে রূহের আওয়াজ ও দিয়াশলাইয়ের রোশনাই দেখত।
এক রাতে উৎসুক মানুষের ঠাসা ভীড়। জলদগম্ভীর স্বরে ঘোষণা এলো, অশরীরী পুণ্যাত্মা আজ নয়া কোনো পয়গাম নিয়ে হাজির হবে। মানুষের ভীড় আরো তীব্র হলো। মোহাম্মদ ওয়াসিমের বাহিনী চৌকি পাহারায় ছিল। কাজেই তারা ব্যাপারটি আগাগোড়া কিছুই জানতে পারল না।
জমকালো আঁধারে ঢাকা কবরগাহের পরিবেশ। ভীত-স্ত্রস্ত মানবতা চূড়ান্ত মুহূর্তের অপেক্ষায়। সকলের মনে হাতুড়ি পেটা শুরু। আচমকা দেয়ালের ও পাশ থেকে পৌরুষবহুল কণ্ঠ চিড়ে বেরিয়ে এলো একরাশ কথা। ধর্মোদ্দীপনা জাগরুক করে তোল। কল্পনায় কুমারী মরিয়মক আনো এদিকে।
লোকেরা ধর্মসংগীত গাওয়া শুরু করল। সংগীতটি নেহাৎ হৃদয়স্পর্শী। কবরগাহের রশ্মি উপরে উঠতে লাগল। আগুনের আশে পাশে সাদা ধোয়ার আনাগোনা। যেন মেঘ খণ্ড কুন্ডলী পাকিয়ে ওঠা নামা করছে। এতে দেখা যাচ্ছে এক নারী প্রতিকৃতি। আগুনের রশ্মি আরো উঁচুতে উঠতে লাগল। ওতে দেখা গেল নারীর একরাশ চুল কাঁধে ছড়ানো।
সমবেত স্থানে পিন পতন নিস্তব্ধতা। ভক্তিভরে কেউ কেউ হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে বসে গেল। বলতে লাগল, গোনাহের কাফফারা আদায় করো। ওঠো খোদার পুত্রের রাজত্ব কায়েম কর। যদি না করো তাহলে আমি ব-বিজলী হয়ে তোমাদের ওপর আপতিত হবো।
এই কুমারী আত্মা ফ্লোরার।
আগুন এক সময় কমে এলো। কবরগাহে নেমে এলো পূর্বেকার জমকালো পরিবেশ। পরদিন সেটা টলেডোয় বিদ্রোহের ঘনঘটা শুরু হলে।