প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

২.১১-১৫ ধানকাটার মধ্যে

২.১১

ধানকাটার মধ্যে সময় করে একে একে সুধা, সুনীতি এবং ঝিনুককেও ভর্তি করে দিলেন হেমনাথ। সুধা সুনীতিকে কলেজে, ঝিনুককে মেয়েদের স্কুলে।

স্থির হয়েছে, আপাতত ঝিনুক এই বাড়িতেই থেকে যাবে। এখানে থেকেই লেখাপড়া করবে। পরে যা-হয় ভেবে ঠিক করা যাবে। ভবতোষও এতে রাজি হয়েছেন। না হয়ে উপায়ই বা কী? তার কলেজ খুলে গেছে। ফাঁকা বাড়িতে ঝিনুককে কার কাছে রাখবেন? কে তাকে দেখবে? সব দিক বিবেচনা করে এই ব্যবস্থাই ভবতোষের ভাল মনে হয়েছে।

সবাই ভর্তি টর্তি হয়ে যাবার দিনকয়েক পর এক সন্ধেবেলায় লারমোর এসে হাজির। এ বাড়িতে তাঁর অনিয়মিত যাতায়াত নিয়ে স্নেহলতার অভিমান আছে। অবশ্য সে অভিমানের ভেতর অভিযোগ নেই, স্নিগ্ধ কৌতুকের আভায় তা ঝলমলে।

অনেক দিন পর লারমোর আজ এ বাড়ি এলেন। দীর্ঘকাল না আসার জন্য যথারীতি অনুযোগ করলেন স্নেহলতা, ঠাট্টা-টাট্টাও করলেন।

হাতজোড় করে পুরোপুরি আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে লারমোর বললেন, এইবার–এইবারটা শুধু ক্ষমা করে দিন বৌঠাকরুন। কদিন পর থেকে দেখবেন, বোজ আসছি।

লারমোরের সারল্য, কাঁচুমাচু মুখভঙ্গি, করুণ ক্ষীণ কণ্ঠস্বর–সব মিলিয়ে এমন একটা আবহাওয়া তৈরি করে যাতে না হেসে কেউ পারে না। আজও সবাই হাসল। স্নেহলতা কিন্তু হাসলেন না। তীক্ষ্ণ কুটিতে লারমোরকে বিদ্ধ করতে করতে বললেন, যেদিন থেকে সাহেব তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে সেদিন থেকেই তো এ কথা শুনে আসছি। তা প্রায় চল্লিশ বছর হতে চলল।

যা হবার হয়ে গেছে। এবার থেকে আমি সুবোধ বালক হয়ে যাব।

ঠিক?

ঠিক।

কতবার তো প্রতিজ্ঞা করা হল! সে যাক গে, এতদিন পর কোত্থেকে উদয় হলেন? করছিলেন কী?

রোগী-টোগী ছিল। তার ওপর ধান উঠছে। নানা ঝঞ্ঝাটে আর আসা হচ্ছিল না।

স্নেহলতা শুধোলেন, আজ হঠাৎ কী মনে করে?

লারমোর একটু যেন অবাকই হলেন, আহতও। বললেন, বা রে, সব ভুলে গেছেন?

তবু মনে করতে পারলেন না স্নেহলতা। অপ্রস্তুত মুখে বললেন, কী বলুন তো?

হেমনাথ খানিক দূরে বসে ছিলেন। তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, পরশু পঁচিশে ডিসেম্বর, বড়দিন। তাই না?

হা। আস্তে মাথা হেলিয়ে দিলেন লারমোর। স্নেহলতা লজ্জিত, বিব্রত। বললেন, সত্যি, আমার একেবারেই খেয়াল ছিল না। মন আজকাল যে কি বেভুলো হয়ে যাচ্ছে!

হেমনাথ বললেন, বড়দিনের নেমন্তন্ন করতে এসেছ বুঝি লালমোহন? লারমোর বললেন, হ্যাঁ। পরশু আমার ওখানে সবাই যাবে।

একটু ভেবে হেমনাথ বললেন, গির্জা পরিষ্কার টরিষ্কার করিয়েছ? চারধার যা নোংরা করে রেখেছিলে।

না। কোথায় আর করানো হল! লারমোর বলতে লাগলেন, ধানকাটা শুরু হয়ে গেল, তাই নিয়ে মেতে উঠলাম।

চমৎকার! হেমনাথ অত্যন্ত রেগে গেলেন, পরশু বড়দিন, এখনও নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছ! গির্জা ঘোয়ামোছা মাজা-ঘষা হবে কবে?

কাল সকালবেলা তুমি যদি একবার আসো—

যেতেই হবে। ভাবছি যুগলকে নিয়ে যাব।

তা হলে খুব ভাল হয়। আমার ওখানে পরানের মা আছে। সবাই হাত লাগালে কতক্ষণ আর লাগবে?

একটু চুপ করে থেকে হেমনাথ বললেন, যা দেখছি, গির্জা সাফটাফ করে সাজিয়ে-গুজিয়ে কাল আর আমার ফেরা হবে না।

কাল তোমাকে ফিরতে দিচ্ছে কে? তুমি ফিরবে পরশু বিকেলে। বলতে বলতে লারমোরের হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল, ভাল কথা—

কী?

আমরা না-হয় পরিষ্কার টরিষ্কার করব। গির্জা সাজানোর ভার সুধাদিদি সুনীতিদিদিকে দিলে কেমন হয়?

খুব ভাল, খুব ভাল–

তা হলে কাল বিকেলে সুধা সুনীতিকে নিয়ে যাবার জন্যে গাড়ি পাঠিয়ে দেব। বাকি সবাই পরশু যাবে।

আচ্ছা।

একধারে বসে বসে চুপচাপ সবার কথা শুনে যাচ্ছিল বিনু। হঠাৎ সে বলে উঠল, কাল সকালে দাদুর সঙ্গে আমিও যাব।

সুরমা ওধার থেকে তাড়াতাড়ি বললেন, না। কাজের মধ্যে গিয়ে তোমাকে আর ঝঞ্জাট করতে হবে না। আমাদের সঙ্গে তুমি পরশু যাবে।

বিনুর মুখখানা কালো হয়ে গেল।

লারমোর বিনুকে লক্ষ করছিলেন। সস্নেহ গলায় বললেন, না না, পরশু নয়, কালই তুমি যাবে।

ঝিনুক এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। বিনুর যাবার ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে দেখে হিংসুটি মেয়েটা আর মুখ বুজে থাকতে পারল না। কান্নার মতো সরু গলায় হঠাৎ বায়না জুড়ে দিল, বিনুদাদা গেলে আমি যাব, আমি যাব।”

অত্যন্ত বিরক্ত চোখে বিনু ঝিনুকের দিকে তাকাল। মেয়েটা তার পেছনে সবসময় প্রায় জোঁকের মতো লেগে আছে।

লারমোর বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাবি। নিশ্চয়ই যাবি।

সুধা সুনীতিও এ ঘরেই ছিল। সুধা হঠাৎ বলল, বড়দিনে আমাদের ক্রিসমাস কেক খাওয়াবেন তো লালমোহন দাদু?

লারমোর হাসলেন, এই গ্রামদেশে কেক কোথায় পাব দিদি? তবে—

কী?

চমচম খাওয়াব, পাতক্ষীর খাওয়াব, রসগোল্লা খাওয়াব। দেখব, কে কত খেতে পারিস।

সুধা কিন্তু খুঁতখুঁত করতে লাগল, বড়দিনে কেক না হলে ভাল লাগে না।

.

পর দিন ভোরবেলা ফিটন পাঠিয়ে দিলেন লারমোর।

ধানকাটা এখনও চলেছে। একশ’ কানি জমির ফসল তো অল্প সল্প ব্যাপার নয় যে মুখের কথা খসলেই খেত থেকে উঠে এল।

ঠিক হল, কুষাণদের সঙ্গে জমিতে গিয়ে অবনীমোহন আজকের দিনটা ধানকাটা তদারক করবেন। কাল ভোরবেলা যুগল ফিরে আসবে। যুগল ফিরলে অবনীমোহন বাড়ির বাকি সবাইকে নিয়ে গির্জায় যাবেন। কালকের দিনটার ধানকাটা দেখাশোনার ভার থাকবে যুগলের ওপর।

এত ভোরে রোদ ওঠেনি। কুয়াশায় চারদিক আচ্ছন্ন। পৌষের হাওয়া এত ঠাণ্ডা, মনে হয় বরফের দেশ থেকে ছুটে আসছে। ভেজা মাটি থেকে এমন হিম উঠছে যে পা ফেলা যায় না। সারা গায়ে গরম জামাকাপড়, তবু শীত কাটে না। হি হি কাঁপতে কাঁপতে বিনু ঝিনুক হেমনাথ এবং যুগলের। সঙ্গে ফিটনে গিয়ে উঠল।

গির্জায় পৌঁছতে পৌঁছতে রোদ উঠে গেল। শীতের রোদ–নিস্তেজ, উত্তাপহীন। তবু তো রোদ। পকেট থেকে হাত বার করে সিটনো আঙুলগুলো সেঁকে নিতে লাগল বিনু।

গির্জায় এসে এক মুহূর্তও বসলেন না হেমনাথ। যুগল আর লারমোরকে সঙ্গে নিয়ে ঝাড়পোঁছ শুরু করে দিলেন। দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার সময়টুকু বাদ দিলে সারাদিন ধোয়ামোছা চলতে লাগল।

বিকেলে সুধা সুনীতি এল। ততক্ষণে ঘষে মেজে গির্জাকে ঝকঝকে করে তোলা হয়েছে। চারদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

সুধারা আসতে না আসতেই বিনুকে সঙ্গে নিয়ে যুগল, বেরিয়ে পড়ল। ঘুরে ঘুরে রাজ্যের ফুল, লতা পাতা যোগাড় করে গির্জার সামনে পাকার করল। নদীপাড়ের মনিহারি দোকান থেকে লাল নীল-সবুজ, নানা রঙের কাগজ কিনে আনল।

লারমোর বললেন, সুধাদিদি সুনীতিদিদি, আর কী লাগবে বল—

সুধা সুনীতি একসঙ্গে বলল, আর কিছু না।

এবার তা হলে সাজাতে শুরু কর।

দু’বোন কোমর বেঁধে লেগে গেল। ফুল এবং লতাপাতায় চমৎকার নকশা করে গেট সাজাল, তিন চারটে তোরণ বানালো। নানা রঙের কাগজ কেটে অসংখ্য শিকলি বানিয়ে চারদিকে টাঙিয়ে দিল। দেওয়ালে আর মেঝেতে আলপনা আঁকল অনেক। একটা ক্রিসমাস ট্রি বানাল, তার তলায় কাগজ টাগজ দিয়ে বুড়ো সান্তা ক্লজ তৈরি করে দাঁড় করিয়ে দিল। সব চাইতে সুন্দর করে সাজাল যিশুখ্রিস্টের ছবিখানা। অবশ্য যুগল-লারমোর-বি-ঝিনুক, যার যেমন সাধ্য সুধা সুনীতিকে সাহায্য করেছে।

রাত পোহালেই বড়দিন। কোথায়, কত শতাব্দী আগে বেথেলহেমের আকাশে উজ্জ্বল তারাটি দেখা দিয়েছিল। তারপর এই ধূলিধূসর মর্তে আবির্ভাব হয়েছিল মানবপুত্রের। আপন রক্তে এই রিপুতাড়িত জগৎকে তিনি শুদ্ধ করে গেছেন।

সেই জ্যের্তিময় পুরুষটিকে কৃতজ্ঞ মানুষ আজও ভোলেনি। বহু শতাব্দী পরও বসুন্ধরার এক প্রান্তে রাজদিয়া নামে এক অখ্যাত নগণ্য জনপদে তার পূণ্য জন্মদিন স্মরণ করে তারা ধন্য হচ্ছে।

লারমোর ঘুরছেন, ফিরছেন আর সুসজ্জিত গির্জা বাড়িটাকে দেখছেন, যিশুর ছবিখানা দেখছেন। দেখে দেখে সাধ যেন তার মেটে না।

দেখেন আর ঘন আবেগের গলায় লারমোর বলেন, চল্লিশ বছর ধরে রাজদিয়ায় আছি। সব বছরই তো বড়দিনের উৎসব হয়। কিন্তু কোনও বার এমন করে গির্জাবাড়ি সাজাতে পারিনি। ভাগ্যিস সুধাদিদি সুনীতিদিদিরা রাজদিয়া এসেছিল। কী আনন্দ যে হচ্ছে!

কঘন্টা পরেই বড়দিন। গির্জার চারধারে ক’টি মানুষ তার জন্য হৃদয় বিছিয়ে রেখেছে।

গির্জা সাজাতে সাজাতে অনেক রাত হয়ে গেল। তারপর খেয়ে দেয়ে সবাই শুয়ে পড়ল। কতক্ষণের জন্যই বা শোওয়া! খানিক পরে, তখনও রাতের অন্ধকার রয়েছে, লারমোর উঠে পড়লেন। এমন যে ঘুমকাতুরে বিনু, সেও শুয়ে থাকতে পারল না।

শীতের এই শেষ রাতে চারদিক যখন বরফের মতো ঠান্ডা, পেছনের নদী থেকে লারমোর এবং হেমনাথ স্নান করে এলেন। সুধা সুনীতিও স্নান করতে চেয়েছিল, হেমনাথ করতে দেননি। অভ্যেস তো নেই। শেষে অসুখ বিসুখ হয়ে যেতে পারে। দু’একখানা বেশি জামাকাপড় নিয়ে এসেছিল ওরা। তাড়াতাড়ি মুখটুখ ধুয়ে কাপড় বদলে নিল।

এত ঠান্ডায় প্যান্টজামা বদলাতে ইচ্ছা করছিল না বিনুর। হেমনাথ বললেন, কী ছেলে রে তুই, উৎসবের দিনে কেউ বাসি জামা টামা পরে থাকে! যা যা, পরিষ্কার জামাপ্যান্ট পরে নে–

অগত্যা কী আর করা, চটকানো বাসি জামাটামা ছাড়তেই হল বিনুকে। দেখাদেখি ঝিনুকও চট করে ফ্রক বদলে নিল।

এদিকে যিশুর ছবির সামনে অসংখ্য মোমবাতি জ্বেলে দিয়েছেন লারমোর। একসময় সবাইকে ডেকে পবিত্র শুদ্ধ মনে চোখ বুজে আশ্চর্য সুরেলা গলায় বড়দিনের প্রার্থনা শুরু করে দিলেন। যিশু বন্দনার পর বাইবেল থেকে তাঁর প্রিয় কটি পদ আবৃত্তি করলেন :

Make a joyful noise
unto the Lord, all ye lambs
Serve the Lord, with gladness.
Come before his presence with singing.
Know ye that the Lord he is
God. it is he that hath made us.
And not we ourselves; we are his
People, and the sheep of his pasture.

আবৃত্তি শেষ হলে অসংখ্য পবিত্র প্যারাবেল শোনালেন লারমোর। ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্ট থেকে অনেক কথা শোনালেন। যিশুর জন্ম থেকে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ পর্যন্ত পুণ্য জীবনকাহিনী বর্ণনা করলেন। বুড়ো সান্তা ক্লজের কথা বললেন। হেমনাথ-সুধা-সুনীতি-বি-ঝিনুক, সবাই অভিভূত হয়ে শুনতে লাগল।

যিশুভজনা শেষ হতে ভোর হয়ে গেল। ঘন করে বোনা কুয়াশার ভারী পর্দাগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে রোদ উঠল।

রাত থাকতে থাকতেই যুগল বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। তাকে আবার কৃষাণদের সঙ্গে মাঠে যেতে হবে।

বেলা বাড়লে সুরমা স্নেহলতাকে নিয়ে অবনীমোহন গির্জায় এলেন। শিবানী আসেননি, ক’দিন ধরে তার জ্বর। তা ছাড়া, সবাই চলে এলে তো হয় না, বাড়ি পাহারা দেবার জন্য এক-আধজন থাকা দরকার।

শুধু হেমনাথদের বাড়ির লোকজনই নয়, বেলা যত চড়তে লাগল রাজদিয়া এবং দূর-দুরান্তের গ্রাম-গঞ্জ থেকে কত মানুষ যে আসতে লাগল গির্জায়! চেনাজানা যাকে পেয়েছেন তাকেই নেমন্তন্ন। করেছেন লারমোর।

যে আসছে তারই হাতে ফল-টল মিষ্টি-টিষ্টি দিচ্ছেন লারমোর, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরিচ্ছন্ন সুসজ্জিত গির্জাবাড়ি দেখাচ্ছেন আর বলছেন, কেমন দেখলে বল তো?

চোমকার! কতকাল ধইরা এই গিজ্জায় বড়দিন দেখতে আছি। কিন্তুক অ্যামন সাজান-গুজান। কুনোদিন দেখি নাই।

কোত্থেকে দেখবে? আমরা কি সাজাতে টাজাতে জানতাম?

এইবার তাইলে অ্যামন সোন্দর কইরা সাজাইলেন ক্যামনে?

আমরা কি সাজিয়েছি?

তয়?

আমরা নাতনীরা সাজিয়েছ। বলে সুধা সুনীতির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসে সগর্বে সবাইকে দেখান লারমোর।

সারাদিনই লোক আসছে। একদল যায় তো আর একদল তক্ষুনি এসে পড়ে। জনস্রোতের আর বিরাম নেই। এ তো শুধু খ্রিস্টানদেরই উৎসব নয়, সমস্ত মানবজাতির কাছেই এক পরম পবিত্র দিন। অন্তত রাজদিয়ার মানুষ এইভাবেই দিনটিকে গ্রহণ করেছে।

লোক আসছে, যাচ্ছে। হেমনাথরা কিন্তু ছাড়া পেলেন না।

বেলা অনেকখানি চড়লে স্নেহলতা একবার বললেন, বড়দিনের উৎসব তো মিটল। এবার আমরা বাড়ি যাই?

তার কথা শেষ না হতেই চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন লারমোর, কোথায় মিটল! আজ সারা দিনই বড়দিন।

তার মানে কী বলতে চান আপনি?

কপাল কুঁচকে, কপট শঙ্কার গলায় স্নেহলতা বললেন, সারা দিন!

হ্যাঁ, সারা দিন। লারমোর ঘাড় হেলিয়ে দিলেন।

সন্ধে পর্যন্ত একটানা গল্পগুজব, খাওয়াদাওয়া, এবং হালকা সুরের ঠাট্টা টাট্টা চলল। স্নিগ্ধ মনোরম একটি দিন কাটিয়ে অনেক, অনেক রাত্তিরে বিনুরা ফিটনে উঠল। এতক্ষণে বাড়ি ফেরার অনুমতি মিলেছে।

.

২.১২

দিনকয়েক পর এক সকালবেলায় পুরের ঘরের তক্তপোষে বসে ছিল বিনু। নাকের ডগা এবং চোখদুটো বাদ দিলে গা গরম চাদরে ঢাকা। একটা পুঁটুলির মতো দেখাচ্ছিল তাকে। বাতাস এমন কনকনে যে চাদরের ভেতর থেকে হাত-পা বার করতে ইচ্ছে হয় না।

একটু আগে ঘুম ভেঙেছে বিনুর। স্কুলে ভর্তির সমস্যাটা মিটে যাবার পর আজকাল বই টই ছুঁচ্ছে না সে। বিনু জানিয়ে দিয়েছে, নতুন বছরে নতুন ক্লাস শুরু না হলে সে আর পড়ছে না।

দাদুর কাছে যদিও সে শোয়, ইদানীং এত ঠান্ডায় ভোরবেলা আর উঠতে চায় না। হেমনাথও টানাটানি করেন না। শীতকালের মাঝামাঝি এই হিমবর্ষী দিনগুলোর জন্য বিনুর সূর্যস্তব স্থগিত আছে।

এখন বেশ বেলা হয়েছে। আকাশের খাড়া দেওয়াল বেয়ে সূর্যটা অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল বিনু। উঠোনভর্তি এখন শুধু ধান আর ধান, হেমনাথের খেতের ধান–সোনার পাহাড়ের মতো স্তূপাকার হয়ে আছে। উঠোনের পর বাগান, তারপর পুকুর। অঘ্রাণের গোড়াতেই পুকুরের ওপারের মাঠ থেকে জল নেমে গিয়েছিল। এখন ওখানকার মাঠ একেবারে নিঃস্ব। কৃষাণেরা ধান কেটে নিয়ে গেছে। ধানকাটা ফাঁকা মাঠ কেমন যেন ধূসর দেখায়। শস্যকণার খোঁজে ঝাকে ঝাকে মোহনচূড়া পাখি আর বুলবুলি সেখানে চক্কর দিয়ে ফিরছে। এছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই।

হেমনাথ ঘরে ঢুকলেন। বললেন, কী করছিস বিনুদাদা?

দূর মাঠের দিকে চোখ রেখেই অনমনস্কের মতো বিনু উত্তর দিল, বসে আছি।

কৌতুকের গলায় হেমনাথ এবার বললেন, ফাঁকা মাঠের শোভা দেখছিস? বলে শব্দ করে হাসলেন।

একটু পর পেছন দিকে কিসের আওয়াজ হতে বিনু মুখ ফেরাল। তার চোখে পড়ল, তক্তপোষের তলা থেকে প্রকাণ্ড স্টিলের বাক্স বার করে খুলে ফেলেছেন হেমনাথ। এবং তন্ময় হয়ে ভেতরে কী সব দেখছেন।

আগেও বারকয়েক এই বাক্সখানা খুলে বিভোর হয়ে হেমনাথকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে বিনু। তখন কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

আজ পৌষ মাসের এই অলস সকালে হঠাৎ অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে উঠল বিনু। ডাকল, দাদু–

হেমনাথ প্রথমটা শুনতে পাননি। আরও দু’চারবার ডাকাডাকির পর মুখ তুললেন, কী বলছিস?

বাক্সের ভেতর কী দেখছ?

উত্তর না দিয়ে হেমনাথ জিজ্ঞেস করলেন, তুই দেখবি?

বিনুর কৌতূহল ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছিল। বলল, হ্যাঁ।

আয়—

জানালার পাশ থেকে উঠে পড়ল বিনু, পায়ে পায়ে হেমনাথের কাছে চলে এল।

বাক্সের ডালাটা পুরোপুরি মেলে ধরলেন হেমনাথ। বললেন, দ্যাখ

ভেতরে চমৎকার চমৎকার সব জিনিস স্থূপীকৃত হয়ে আছে। বেতের সাজি, নকশাকরা কাশ্মিরি শালের পাড়, বহুবর্ণময় ময়ূরের পালক, অসংখ্য ছবি, মাটির পুতুল, পট, ডাকের সাজের অগণিত নমুনা, কারুকার্য করা প্রাচীন কথা, নানারকম রঙচঙে পাথর, মণিপুরী চাদর, মোটা আর্ট পেপারে ঘন কালো কালির অতি সুন্দর হস্তাক্ষর, কাঠের এবং হাড়ের রমণীয় শিল্পকার্য–এমনি কত কী।

বিনু অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলল, এসব কার দাদু?

হেমনাথ বললেন, আমার। একটা বাক্স দেখলি তো?

হ্যাঁ।

এইরকম আরও পাঁচ ছ’টা বাক্স আছে। এখন আমার বয়স পঁয়ষট্টির মতো। কুড়ি পঁচিশ বছর বয়স থেকে এসব জিনিস জমাচ্ছি। যেখানে যা কিছুই ভাল, যা কিছু সুন্দর চোখে পড়েছে, চেয়ে চিন্তে বা পয়সা দিয়ে কিনে এনে জমিয়ে রেখেছি।

বিনু কী বলতে যাচ্ছিল, কোত্থেকে হঠাৎ ঝিনুক এসে হাজির। এক পলকে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে সুর টেনে টেনে বলল, বিনুদাদাকে কী দেখাচ্ছ গো?

বাক্সের ভেতরটা দেখিয়ে হেমনাথ বললেন, এই সব—

বিনুদাদাকে দেখালে আমাকেও দেখাতে হবে- ঝিনুক নাকে কান্না জুড়ে দিল।

কাঁদছিস কেন, দ্যাখ না–

এই এক মেয়ে হয়েছে। বিনু যা করবে, যা দেখবে, যেখানে যাবে, তারও তাই করা চাই, সেখানে যাওয়া চাই।

মনে মনে ঝিনুকের ওপর রেগে গেল বিনু। একবার ইচ্ছা হল, বঁটিটা টেনে ছিঁড়ে দেয় কিন্তু কিছুই করল না। ঝিনুককে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সে বলল, এত সব জিনিস জমিয়েছ কেন?

হেমনাথ বললেন, এমনি, শখ। একটু চুপ করে থেকে দূরমনস্কের মতো আবার বললেন,

ঠিক শখ না। ভাল ভাল, সুন্দর সুন্দর জিনিস যোগাড়ের নেশা থাকলে মন খারাপ দিকে যায় না। তা ছাড়া–

কী?

মাঝে মাঝে কোনও কারণে বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে থাকলে বাক্স খুলে বসি। এসব দেখতে দেখতে সব ভার কেটে যায়।

হেমনাথের শেষ কথাগুলো খানিক বুঝল বিনু, অনেকখানিই দুর্বোধ্য থেকে গেল। বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকল সে।

হেমনাথ আবার বললেন, জিনিসগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুধা সুনীতিকে বলব, যেন সাজিয়ে গুছিয়ে ঠিক করে রাখে।

.

২.১৩

দেখতে দেখতে ইংরেজি নতুন বছর পড়ে গেল। আজ থেকে বিনুদের ক্লাস শুরু হবে। একা বিনুর না, সুধা সুনীতি এবং ঝিনুকেরও।

চারজনেরই স্কুল আর কলেজ কাছাকাছি। খেয়ে দেয়ে দল বেঁধে তারা বেরিয়ে পড়ল।

প্রথমে পড়ে মেয়েদের স্কুল। সেখানে ঝিনুককে রেখে বাকি তিনজন এগিয়ে গেল। ঠিক হল, ফেরার পথে ঝিনুককে তারা নিয়ে যাবে।

ঝিনুকের পর বিনুর স্কুল। সুধা সুনীতি তার স্কুলে আর এল না। বড় রাস্তা ধরে সোজা কলেজের দিকে চলে গেল। বিনু ডান দিকের মাঠের ওপর দিয়ে স্কুলবাড়ির দিকে চলল।

মাঠের মাঝামাঝি আসতেই বিনু শুনতে পেল, পেছন থেকে কেউ ডাকছে। এখানে কে ডাকতে পারে তাকে? সবাই তো অচেনা। ঘুরে দাঁড়াতেই সে দেখতে পেল, হেডমাস্টার মোতাহার হোসেন চৌধুরি সাহেব আসছেন।

কাছে এসে মোতাহার সাহেব সস্নেহে হাসলেন, স্কুল খোলার দিনই চলে এসেছ?

বুক ঢিপ ঢিপ করছিল বিনুর। চোখ নামিয়ে আবছা গলায় বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ—

গুড, ভেরি গুড। বিনুর কাঁধে একখানা হাত রেখে মোতাহার সাহেব বললেন, কখন এলে?

এইমাত্র।

এখনও তা হলে ক্লাসে যাও নি?

আজ্ঞে না।

এস আমার সঙ্গে–বিনুকে সঙ্গে নিয়ে মোতাহার সাহেব তার ঘরে গেলেন।

সেদিন মনে হয়েছিল, এ ঘরখানা হেডমাস্টার সাহেবের জন্য আলাদা করে নির্দিষ্ট। কিন্তু আজ দেখা গেল, অন্যান্য মাস্টার মশাইরাও এখানেই বসেন। মোট কথা, এটাই রাজদিয়া হাই স্কুলের টির্চাস কমন রুম।

এখনও স্কুল বসার সময় হয়নি। সব মাস্টারমশাই এর মধ্যেই এসে গেছেন। তাঁদের সবার সঙ্গে বিনুর আলাপ করিয়ে দিলেন মোতাহার সাহেব। তো যে লম্বা নোগা মতো প্রৌঢ়টি, যার নাম আশু দত্ত–তিনি ইংরেজির টিচার এবং অ্যাসিস্টান্ট হেডমাস্টার। উনি সোমনাথ সাহা, অঙ্কের টিচার। উনি রজনী চট্টরাজ, ভূগোলের টিচার। ইত্যাদি—

মাস্টার মশাইদের পরিচয় টরিচয় দিয়ে মোতাহার সাহেব বললেন, এই ছেলেটির নাম বিনয় বিনয়কুমার বসু। আমাদের হেদাদার ভাগনীর ঘরের নাতি। এ বছর ক্লাস এইটে ভর্তি হয়েছে। আপনারা একটু লক্ষ্য রাখবেন। ছেলেটি বেশ ব্রাইট।

হেমনাথের নাতি এবং হেডমাস্টার সাহেবের প্রশংসা শুনে সবাই বেশ আগ্রহান্বিত হলেন। বিনুরা আগে কোথায় ছিল, হঠাৎ রাজদিয়ায় এসে ভর্তিই বা হল কেন, এমন নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন মাস্টারমশাইরা। বিনু উত্তর দিয়ে যেতে লাগল।

কথায় কথায় ক্লাসের সময় হয়ে গেল। দপ্তরী বাইরে ঘন্টা বাজিয়ে দিল।

মোতাহার সাহেব তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ক্লাস এইটের প্রথম ক্লাস কার?

অ্যাসিস্টান্ট হেডমাস্টার রোগা, লম্বামত আশু দত্ত বললেন, আমার—

বিনয়কে আপনার সঙ্গে নিয়ে যান। ছেলেমানুষ, আজ নতুন এসেছে—

বিনুর দিকে তাকিয়ে আশু দত্ত ডাকলেন, এস–

ক্লাসে আসতে দেখা গেল বেঞ্চিগুলো বোঝাই হয়ে গেছে। ছেলেরা আগেভাগে সেগুলো দখল করে বসে আছে।

বিনু লক্ষ করল, বেশির ভাগ ছেলেই তার চাইতে অনেক বড়। পেছন দিকে যারা বসে আছে তাদের মুখ দেখে মনে হল, নিয়মিত দাড়িগোঁফ কামায়। দু’একজন বিনুর সমবয়সী থাকতেও পারে, কিন্তু এত ছেলের ভিড়ে এই মুহূর্তে তাদের খুঁজে বার করা অসম্ভব।

ক্লাসের দিকে তাকিয়ে আশু দত্ত বললেন, তোমাদের নতুন এক বন্ধু এসেছে। আজই এর সঙ্গে সবাই আলাপ টালাপ করে নেবে। বলে বিনুকে দেখিয়ে দিলেন। তারপরেই হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে খুব দ্রুত ফের বলে উঠলেন, তবে হ্যাঁ, দু’জন এর সঙ্গে মিশবে না, কথাও বলবে না। বলেই ডাকলেন, রুস্তম–পতিতপাবন–

সঙ্গে সঙ্গে পেছন দিকের বেঞ্চ থেকে বাইশ তেইশ বছরের দুই গাট্টাগোট্টা জোয়ান উঠে দাঁড়াল। এত বড় বড় ধেড়ে ছেলেরা যে ক্লাস এইটে পড়তে পারে, বিনুর কাছে তা এক অভাবনীয় ব্যাপার। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল সে।

আশু দত্ত বললেন, তোমাদের দুজনকে সাবধান করে দিলাম, বিনয়ের পেছনে লাগবে না। ওর সঙ্গে মিশবে না।

আইচ্ছা স্যার–রুস্তম এবং পতিতপাবন দু’জনেই ঘাড় হেলিয়ে আবার বসে পড়ল।

আশু দত্ত কেন যে রুস্তম আর পতিতপাবনকে তার সঙ্গে মিশতে বারণ করে দিলেন, বিনু ভেবে। পেল না।

বেশিক্ষণ সেই ভাবনাটা নিয়ে থাকা গেল না। সামনের বেঞ্চের ছেলেদের একটু চেপেচুপে বসে বিনুকে জায়গা করে দিতে বললেন আশু দত্ত। বিনু বসলে বললেন, রোজ তুমি ওই জায়গায় বসবে।

আচ্ছা স্যার–বিনু মাথা নাড়ল।

অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর নতুন বছরে আজই প্রথম স্কুল বসেছে। এখনও ছেলেদের বইটই কেনা হয়নি। বই কেনা হবে কোত্থেকে? এখনও বুক লিস্টই দেওয়া হয়নি। কাজেই গল্প করে সময় কাটানো ছাড়া কাজ নেই।

অলস মন্থর গতিতে একটার পর একটা ক্লাস গড়িয়ে চলল। তারপর একসময় টিফিনের ঘন্টা বাজল। সঙ্গে সঙ্গে জলোচ্ছাসের দিশেহারা ঢলের মতো স্কুলবাড়ির সবগুলো ঘর থেকে হুড়মুড় করে ছেলেরা বেরিয়ে পড়ল। স্রোতে গা ভাসিয়ে বিনুও বাইরে এল।

ছেলেরা ছোটাছুটি করছে। একদল সামনের মাঠে দাড়িয়াবান্ধা’র কোটে নেমে পড়েছে। আরেক দল খেলেছে গোল্লাছুট। তবে বেশির ভাগই শীতের রোদে পিঠ দিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।

কারোর সঙ্গেই এখনও ভাল করে আলাপ হয়নি। চারদিকে আলতোভাবে ভেসে বেড়াতে লাগল বিনু। একবার ‘দাড়িবান্ধা’র কোটে, একবার ‘গোল্লাছুটে’র আসরে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে মাঠের প্রান্তে সারি সারি কাঠবাদাম গাছগুলোর কাছে এসে পড়েছিল, খেয়াল নেই।

হঠাৎ চাপা গলায় কারা যেন ডেকে উঠল বিনয়—

চমকে এদিকে তাকাতেই বিনু দেখতে পেল, ডান দিকের কাঠবাদাম গাছটার তলায় রুস্তম, পতিতপাবন এবং তাদের বয়সী আরও দু’তিনটে জোয়ান ছেলে বসে আছে।

মাস্টারমশাই তার সঙ্গে রুস্তমদের মিশতে বারণ করে দিয়েছেন। নিষেধটা একতরফা নয়। রুস্তমরা যেমন তার সঙ্গে মিশবে না, তাকেও তেমনি ওদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। বিনুর কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। রুস্তমদের কাছে যাবে কি যাবে না, ঠিক করে উঠতে পারল না।

তার মনোভাবটা রুস্তমরা যেন বুঝতে পারল। বলল, ডর নাই, এইহানে মাস্টারমশই আসব না। আসো—আসো–

অনিচ্ছাসত্ত্বেও কখন যে রুস্তমদের কাছে এসে বসেছে, বিনু টের পায়নি।

রুস্তম বলল, কইলকাতার থিকা আইছ?

হ্যাঁ–বিনু মাথা নাড়ল।

একটা ব্যাপার বিনু লক্ষ করেছে, রাজদিয়া আসার পর যার সঙ্গেই আলাপ হয়েছে, প্রথমেই তারা কলকাতার কথা জানতে চেয়েছে। কলকাতা সম্বন্ধে তাদের মনে অপার, অসীম বিস্ময়।

রুস্তমরাও কলকাতা সম্বন্ধে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করল। অবাক হয়ে বিনুর মুখে অজানা রহস্যময় শহরটির নানা চমকপ্রদ কাহিনী শুনল। শুনতে শুনতে পকেট থেকে বিড়ির বাণ্ডিল বার করে একটা করে ধরিয়ে নিল। বিনুর দিকেও একটা বাড়িয়ে দিল।

বিনু চমকে উঠল। প্রথমত, স্কুলের ছেলেরা বিড়ি খায়, এমন দৃশ্য আগে আর কখনও দেখে নি। তার পক্ষে এ এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা। তার ওপর তাকেও বিড়ি সাধছে। বিনুর বুকের ভেতরটা কাঁপতে লাগল। বলল, নানা–

বিড়ি বুঝি খাও না?

না। তয় কী খাও? সিগ্রেট?

না-না—

বিস্ময়ে চোখ গোল হয়ে গেল রুস্তমের, বিড়ি খাও না, সিগ্রেট খাও না, ক্যামন কইলকাত্তার পোলা।

বুক থরথর করছিলই, এখন মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। বিনু বলল, আমি এখন যাই–

খপ করে তার একটা হাত ধরে ফেলে রুস্তম বলল, আরে যাইবা কই? বসো-বসোআলাপ পরিচয়ই হইল না। বিড়িতে একখান টান দিয়াই দ্যাখো না, অ্যামন সুখ আর কিছুতে নাই–

না না, আমাকে ছেড়ে দিন—

আরে, কী আশ্চয্যি, আমাগো আপনে আইজ্ঞা কইরা কও ক্যান? এক লগে পড়ি, তুমি কইরা কইবা। তুইও কইতে পার।

বিনু স্তম্ভিত। পড়লই বা এক ক্লাসে, দামড়া মোষের মতো তাগড়া তাগড়া ওই জোয়ান দুটোকে কখনও তুমি কি তুই বলা যায়। বিনু উঠবার জন্য ছটফট করতে লাগল।

রুস্তম বলল, অ্যামন কর ক্যান? আমরা বাঘ না ভাল্লুক?

বিনু ফস করে বলে ফেলল, মাস্টারমশাই আমার পেছনে আপনাদের না লাগতে বারণ করে দিয়েছেন?

তাচ্ছিল্যের গলায় রুস্তম বলল, মাস্টারমশইরা অ্যামন কত কথাই কয়। হেই হগল ধইরা বইসা থাকলে চলে নিকি? আমাগো লগে মিশো, মজা পাইবা।

কিসের মজা?

রুস্তম উত্তর দিল না। পতিতপাবনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। বলল, তুই-ই কইয়া দে–

পতিতপাবন কিছুক্ষণ চোখ কুঁচকে থাকল। তারপর খুব চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে বলল, রুইমার তিন বিবি, আমারও বউ আছে। মেলা রসের কথা আমাগো জানা, তোমারে শিখাইয়া পড়াইয়া চালাক কইরা দিমু

কথাগুলো ঠিক যে বুঝল বিনু তা নয়। তবে টের পেল, এর ভেতর নোংরা অশ্লীল গন্ধ আছে। তার নাক-কান ঝা ঝা করতে লাগল।

রুস্তুমরা আবার কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় ঘন্টা বেজে উঠল। অর্থাৎ টিফিন শেষ।

টিফিনের ঠিক পরের ক্লাসটাই আবার আশু দত্তের। ক্লাসে ঢুকেই তিনি হুঙ্কার দিলেন, রুস্তম, পতিতপাবন–

শেষ বেঞ্চ থেকে দু’জন উঠে দাঁড়াল।

আগের স্বরই আশু দত্ত আবার বললেন, কী বলেছিলাম তোদের?

এস্ত চোখে একবার মাস্টারমশাইকে দেখেই ঘাড় নিচু করল রুস্তমরা। আবছা স্বরে বলল, আইজ্ঞা–

তোদের না বলেছিলাম, বিনয়ের পেছনে লাগবি না। নিজেরা তো জাহান্নামে গেছিসই, বছর বছর ফেল করে একেকটা ধর্মের ষাঁড় হয়ে উঠেছিস। নিজেরা যা খুশি কর, ছোট ছোট ছেলেগুলোর সর্বনাশ করা কেন?

আমরা তো কিছু করি নাই।

করিস নি! আবার মিথ্যে বলা হচ্ছে! রাগে চিৎকার করে উঠলেন আশু দত্ত, ভেবেছিস, আমার চোখে কিছুই পড়েনি! টিফিনের সময় বাদাম গাছের তলায় বিনয়কে ডেকেছিলি কেন? বল হারামজাদা বদের ধাড়িরা–

রুস্তম পতিতপাবন, দুজনই এবার চুপ। মুখ তুলে মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকাবার সাহসটুকুও তাদের আর অবশিষ্ট নেই।

রুস্তম আর পতিতপাবনের চেহারা অসুরের মতো। অথচ রোগা দুর্বল আশু দত্তর সামনে ভয়ে তারা সিটিয়ে গেছে। দৃশ্যটা খুবই মজাদার, বিনুর খুব ভাল লাগল।

আশু দত্ত থামেন নি, তোরা হলি দাগী আম। একসঙ্গে থাকলে বাকিগুলোরও বারটা বাজাবি। স্কুল থেকে তোদের তাড়াতে হবে, দেখছি। যা, এখন ক্লাসের বাইরে গিয়ে হাফ নীল ডাউন হয়ে থাক–

রুস্তম এবং পতিতপাবন সুড়সুড় করে বাইরের টানা বারান্দায় চলে গেল। তারপর ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে হাফ নীল ডাউন হয়ে রইল।

বিনুর খুব হাসি পাচ্ছিল। বাড়ি ফিরে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাটা রঙচঙ ফলিয়ে বলবার জন্য তার আর তর সইছিল না।

.

২.১৪

পৌষ মাস থাকতে থাকতেই মাঠগুলো ফাঁকা করে দিয়ে ধান উঠে গেল। বাড়ির উঠোনে এখন সোনার পাহাড় সাজানো।

যে পঁচিশ জন কৃষাণকে হেমনাথ কাজে লাগিয়েছেন তারা আজকাল আর চকে যায় না। খড়সমেত যে ধান কেটে এনেছে, সারাদিন ঝেড়ে ঝেড়ে তা থেকে শস্যের দানাগুলোকে আলাদা করে। তারপর রোদে শুকিয়ে ডোল বোঝাই করতে থাকে। আর খড়গুলো দিয়ে পালা সাজায়।

এদিকে অবনীমোহন মজিদ মিঞার যে জমি কিনেছেন তার ধানও উঠে গেছে। ফসল কেটে নিয়ে যাবার পর মজিদ মিঞা অবনীমোহনকে জমির দখল দিয়ে দিয়েছেন।

দেখতে দেখতে পৌষ সংক্রান্তি এসে গেল। সংক্রান্তির দিন বিনুদের স্কুল আর সুধা সুনীতির কলেজ ছুটি। এই দিনটিতে এ দেশে অনেকেই বাস্তুপুজো করে থাকে। হেমনাথরাও করেন। অবনীমোহন নতুন জমি কিনেছেন, ঠিক হয়েছে তিনিও বাস্তুপুজো করবেন।

আগের দিনই দু’জন পুরুত এবং দু’জন ঢাকীকে খবর দিয়ে রাখা হয়েছিল। সংক্রান্তির দিন সকালবেলা তারা এসে হাজির।

বাস্তুপুজোর প্রথাটি বেশ। প্রথম পুজোটি হয় বাড়ির মধ্যেই। পুরুত ঠাকুর চরু বেঁধে বাস্তুদেবকে উৎসর্গ করে। তারপর যেখানে যেখানে জমিজমা আছে, সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে পুজো হয়।

এবার দুই পুরুত, দুই ঢাকী এসেছে। কেননা, হেমনাথ আর অবনীমোহনের আলাদা আলাদা পুজো হবে।

বাড়ির পুজো সেরে দুই পুরুত দু’দিকে বেরিয়ে পড়ল। বাড়ির মানুষরা দু’ভাগ হয়ে দুই পুরুতের পিছু পিছু চলল। আর দুই ঢাকী বাজাতে বাজাতে আগে আগে চলেছে।

শুধু বিনুদেরই না, এখানে ঘরে ঘরে বাস্তুপুজো। চারদিকের মাঠ জুড়ে কত ঢাক বাজছে, কত পুরুতের মন্ত্রোচ্চারণ যে শোনা যাচ্ছে! একদল আধ-ন্যাংটো কালো কালো ছেলেমেয়ের দল একটু প্রসাদের আশায় এ খেত থেকে ও খেতে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে।

ঢাকের বাজনা শুনতে শুনতে, বাতাসে চরুর মধুর সুঘ্রাণ নিতে নিতে এবং জমিতে জমিতে ঘুরে পুজো দেখতে দেখতে পৌষের বেলা হেলে গেল। সারাদিনের ক্লান্তি গায়ে মেখে বিনুরা যখন বাড়ি ফিরল, শীতের সন্ধে নেমে গেছে।

.

মাঘ মাসের প্রথম দিকেই সব ধান ডোলে তুলে খড় দিয়ে সারি সারি পালা সাজিয়ে চরের মুসলমান কৃষ্ণাণরা চলে গেল।

তারপর একটানা অলস, মন্থর দিনযাপন। যুগল করিমকে এখন আর মাঠে যেতে হয় না। হেমনাথের অবশ্য কাজের শেষ নেই। বাড়ির কাজ তার যত, তার হাজার গুণ বাইরের কাজ। ইদানীং স্কুলবাড়ির জন্য গঞ্জে গঞ্জে ঘুরে টাকা তুলে বেড়াচ্ছেন। নাওয়াখাওয়ার ফুরসতটুকু পর্যন্ত তার নেই।

নতুন ধান উঠবার পর এ বাড়িতে পিঠে পায়েস বানাবার ধুম পড়ে গেছে। চালও অঢেল, দুধেরও অভাব নেই। কাজেই পিঠেটিঠে না বানিয়ে কি থাকতে পারেন স্নেহলতা?

পিঠেও কি এক আধ রকমের? ভাপা পিঠে, পাটি সাপটা, চিতই, রাঙা আলুর পুলি, সিদ্ধ পুলি, দুধ পুলি, মুগ পুলি, ভাজা পুলি–রকমের আর লেখাজোখা নেই। তা ছাড়া পায়েস আছে, চসি আছে।

নতুন ধান উঠবার পর আরেকটা পরিবর্তন ঘটেছে। আগে আগে সকালবেলা চিড়ে-মুড়ি-ক্ষীর দুধ খেতে দিতেন স্নেহলতা। আজকাল ভোর ভোর উঠেই মাটির হাঁড়িতে ফেনাভাত বসিয়ে দেন। চিড়ে মুড়ির বদলে নতুন চালের সুঘ্রাণময় ফেনাভাত, সর-বাটা ঘি আর আলুভাতে বা কাঁঠাল বিচি সিদ্ধ দিয়ে খেতে কী ভাল যে লাগে!

এরই মধ্যে এক রবিবার, স্কুলে যাবার তাড়া ছিল না বিনুর, দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর রোদ পোয়াচ্ছিল। কোথায় যেন খেজুর গুড় জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। বাতাসে তার সুগন্ধ ভেসে আসছে। হঠাৎ যুগল এসে সামনে দাঁড়াল, কী করতে আছেন ছুটোবাবু?

বিনু বলল, এই তো বসে আছি।

শুদাশুদি বইসা থাইকা কী করবেন? চলেন চকে যাই। এই সময় চকে সুন্দি কাউঠা বাইর হয়। খাইতে যা লাগে ছুটোবাবু, কী কমু! য্যামন সোয়াদ, ত্যামন ত্যাল–

বিনু লাফিয়ে উঠল, চল–

কবেই ধান কাটা হয়ে গেছে। শীতের দুপুরে এখন মাঠ জুড়ে শূন্যতা। ফসল নেই, ধানগাছের গোড়াগুলো শুকিয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। যেদিকেই চোখ ফেরানো যায়, সব কিছু বর্ণহীন। ঠিক বর্ণহীন নয়, ধূসর। শীতের আদিগন্ত মাঠের ওপর অসীম বিষাদ ঘন হয়ে আছে।

মাথার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে চড়াই আর বুলবুলি উড়ছিল। মাঝে মাঝে তারা নিচে নেমে মাটিতে ঠোকর দেয়, কিন্তু বৃথাই। কেউ তাদের জন্য একদানা শস্যও ফেলে রেখে যায় নি।

একটা বুড়ো গোসাপ আলের ওপর দিয়ে পেট টেনে ধীর মন্থর গতিতে যাচ্ছিল। ধানকাটার সময় সাপটাকে এই মাঠে আরও অনেক বার দেখেছে বিনু। আজ কী হয়ে গেল, চট করে একটা মাটির ঢিল কুড়িয়ে নিল। ছুঁড়তে যাবে, যুগল হাতটা চেপে ধরল, করেন কী ছুটোবাবু, করেন কী? ও হইল এই চকের দ্যাবতা, অরে মারলে সব্বনাশ হইয়া যাইব।

ঢিলটা আস্তে আস্তে ফেলে দিয়ে বিনু শুধলো, কী সর্বনাশ হবে?

জমিনে আর ফসল ফলব না। এইহানকার মাইনষেরে জিগাইয়া দেইখেন।

মানুষের বিশ্বাসের ওপর কথা নেই। বিনু আর কিছু বলল না। গোসাপটাকে ডান দিকে রেখে তারা এগিয়ে চলল।

আরও কিছুদূর যাবার পর সেই লোকটাকে দেখতে পেল বিনু, নাম যার তালেব। সেদিন ল্যান্ড রেজিস্ট্রি অফিসে একে প্রথম দেখেছিল সে।

এখন, শীতশেষের এই ফাঁকা মাঠে খুব মনোযোগ দিয়ে ইঁদুরের গর্তে কাঠি ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তালেব ধান বার করছে। সেদিন হেমনাথ বলেছিলেন, এইভাবেই নাকি লোকটা মাস তিনেকের মতো পেটের দানা, যোগাড় করে।

দূরে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ তালেবকে দেখল বিনুরা। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল। তালেব তাদের দেখতে পায় নি।

তারপর সারা দুপুর খোজাখুঁজি করে মোটে তিনটে ছোট ছোট সুন্দি কচ্ছপ পাওয়া গেল। তাদের পা বেঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে যুগল বলল, একখান কথা ছুটোবাবু’

কী কথা? বিনু জানতে চাইল।

আনন্দ-লজ্জা-সঙ্কোচ সব মিলিয়ে যুগলের মুখের ওপর দিয়ে পর পর অনেকগুলো ঢেউ খেলে গেল। তারপর খুব আস্তে করে সে বলল, কাইল গোপাল দাস আসব।

কে বললে?

পরশু লোক পাঠাইছিল।

আমি তো দেখি নি।

আপনে তহন ইস্কুলে

সত্যি সত্যি পরের দিন, ভাটির দেশ থেকে পাখির বাপ গোপাল দাস আর যুগলের সেই বোনাই ধনঞ্জয় এসে হাজির। প্রথমে তারা পণের আট কুড়ি টাকা গুনে গুনে নিল, তারপর বিয়ের দিন। ঠিক করল। মাঘ মাসের চব্বিশ তারিখে বিয়ে। এও স্থির হল, বিয়ে করতে অতদূরে ভাটির দেশে যেতে হবে না। মেয়ে নিয়ে একেবারে ধনঞ্জয়ের বাড়িতে চলে আসবে গোপাল দাস, সেখানেই শুভ কাজ সারা হবে।

.

২.১৫

যুগলের বিয়ে নিয়ে বিরাট কাণ্ড করে বসলেন হেমনাথ। রাজদিয়ার হেন বাড়ি নেই, হেন মানুষ নেই, যাদের নেমতন্ন করা হল না। দেখেশুনে কে বলবে, যুগল হেমনাথদের বাড়ির কামলা।

কেউ কেউ বলল, কামলার বিয়ায় অত ঘটা ক্যান?

হেমনাথ বললেন, যুগলকে তো আমি কামলা ভাবি নি, ও আমার বাড়ির ছেলে। তা ছাড়া, আমাদের বাড়িতে বহুকাল শুভ কাজ হয় না। বিয়েটা উপলক্ষ করে ঘটা না হয় করলামই।

বিয়ের আগের দিন থেকেই নিমন্ত্রিতদের আনাগোনা শুরু হল। বরণকুলো সাজিয়ে জনা কুড়ি এয়ো জুটিয়ে অধিবাসের গান শুরু করে দিলেন স্নেহলতা :

আইজ রামের অধিবাস কাইল রামের
বিয়া গো কমলা,
আমরা জল ভরিতে যাই,
সই আমরা জলে যাই।
তোমার রামের অধিবাসের
রানী সময় গেল।
গা তোল কৌশল্যা রানী
নিশি পরভাত হইল।
তোমরা সখি আন গো হলুদ, আন গো
হলুদ সকলে।
আমার রামেরে সিনান করাও
অতি সকালে।

একটু থেমে আবার শুরু হয়?

বরণকুলা আনো সখি, বরণকুলা আনো
আমরা শ্যামের ঘাটে যাই।
আমরা জল সইতে যাই।
ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালাও সখি,
ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালাও।
ধান দিয়া, দূর্বা দিয়া, রামের ওই
বরণডালা সাজাও।
আমরা জল সইতে যাই।
আমরা ফুল তুলতে যাই।

এয়োদের মধ্যে যারা স্নেহলতার সমবয়সিনী তারা বলে, পরের পুতের লেইগা এই! নিজে তো বিয়াইলেন না দিদি, বিয়াইলে না জানি কী করতেন!

স্নেহলতার ছেলেমেয়ে নেই। নিমেষে তার মুখে বিষাদের ছায়া পড়ে। পরক্ষণেই স্নিগ্ধ হাসিতে ঝলমলিয়ে ওঠেন, না বিয়োলে বুঝি ছেলে হয় না? রাজদিয়া জুড়ে এত ছেলেমেয়ে তবে কার?

হেয়া ঠিক, হেয়া ঠিক—

.

পরের দিন বিকেলবেলা বরযাত্রী আর বরকে নিয়ে রওনা হলেন হেমনাথ। বরযাত্রীদের ভেতর সুধা সুনীতি, বিনু ঝিনুকও রয়েছে।

বিয়ে উপলক্ষে যুগলের বাপ-মা-বোন এসেছে তাদের বাড়ি থেকে। বাপ ভাইরা বরযাত্রীদের সঙ্গে ধনঞ্জয়ের বাড়ি চলেছে। মা আর বোন থেকে গেছে হেমনাথের বাড়ি।

বর্ষাকাল হলে ডুবন্ত মাঠের ওপর দিয়ে নৌকোয় যাওয়া যেত। কিন্তু এই শীতে জল সরে গিয়ে ডাঙা জেগেছে, ডাঙার ওপর দিয়ে তো নৌকো চলে না, তাই হেঁটেই চলেছেন হেমনাথরা।

রাজদিয়া থেকে ধনঞ্জয়ের বাড়ি মাইল দুয়েকের রাস্তা। কোনাকুনি মাঠ পাড়ি দিলে কতক্ষণ আর লাগবে!

যেতে যেতে কৃষাণ গ্রাম চোখে পড়ে। কৌতূহলী কেউ কেউ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শুধোয়, কিয়ের মিছিল?

বরযাত্রীদের ভেতর থেকে কে যেন উত্তর দেয়, বিয়ার—

কার বিয়া?

হ্যামকত্তার বাড়ির যুগইলার।

আমরা যামু?

আসো।

নানা গ্রাম থেকে দু’জন চারজন করে জুটে বিরাট এক জনতা তৈরি হল। তারা বরযাত্রীদের পিছু পিছু চলতে লাগল।

সন্ধের কিছু পরে বিনুরা ধনঞ্জয়ের বাড়ি পৌঁছে গেল।

.

এ বাড়ি বিনুর অচেনা নয়। আশ্বিন মাসে সুজনগঞ্জের হাটে যাবার পথে যুগলের সঙ্গে এখানে এসেছিল সে।

তখন চারদিকে জল থইথই করছে। আশ্বিনের মাঠঘাট, ধানের খেত, শাপলাবন, মুত্রাবন–সব কিছু ভেসে গিয়ে একখানা সমুদ্র হয়ে গিয়েছিল যেন। ধনঞ্জয়ের বাড়িটা তার ওপর দ্বীপের মতো মাথা তুলে ছিল।

এত জল যে ঘরর উঠোন পর্যন্ত চলে এসেছিল। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাবার জন্য উঠোনের ওপর দিয়ে সাঁকো দেখেছে বিনু। তার ওপর বসে ধনঞ্জয়ের কালো কালো আধ-ন্যাংটো ছেলেদের ভাতের টোপ দিয়ে পুঁটি এবং বাঁশপাতা মাছ ধরতে দেখেছে।

এখন, এই মাঘের শেষে জল নেই কিন্তু উঠোনের সাঁকোগুলো আছে। সারা বছরই বোধ হয় ওগুলো থাকে। থাকবারই কথা। এদেশে শুকনোর মাস আর ক’টা? পৌষ মাঘ থেকে বৈশাখ পর্যন্ত। জষ্ঠির মাঝামাঝি মাঠঘাট ভাসিয়ে নতুন বর্ষার জল এসে পড়ে। তারপর থেকে অঘ্রাণ পর্যন্ত চারদিকে শুধু জল আর জল–অথৈ, অপার জলরাশি। কাজেই সাঁকো তুলে ফেলে কী লাভ? ক’মাস পরেই তো আবার বসাতে হবে। ধনঞ্জয় অতখানি পরিশ্রম করতে বুঝি রাজি নয়।

আজ বাড়িটার চেহারাই গেছে বদলে। হাজার হোক বিয়ে বাড়ি। বউ-ঝি, আত্মীয়-কুটুম, নাইওরি ঝিওরিতে বোঝাই।

উঠোনের চার কোণে চারটে এবং মাঝখানে একটা, মোট পাঁচটা হ্যাঁজাক জ্বলছে। উত্তরের ঘরের ঢালা বারান্দায় ধবধবে ফরাস পাতা। মনে হল, ওটাই বর এবং বরযাত্রীদের বসবার জায়গা।

বিনুরা পৌঁছুবার সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে গেল।

আসছে রে, আসছে। বরযাত্তররা আইসা পড়ছে।

বইতে দে, বইতে দে–

সিগ্রেট কই, পান তামুক বাইর কর—

হঠাৎ কে চেঁচিয়ে উঠল, বর আসছে, জোকার (উলু) দে ছেমরিরা—

তক্ষুনি ভেতর বাড়ি থেকে ঝক ঝক উলর সুমিষ্ট গ্যাল চিকন শব্দ ভেসে আসতে লাগল। আরেকজন কে যেন ব্যস্তভাবে বলল, ঢাকীগুলা গ্যাল কই? বাদ্যি বাজা–

বলার শুধু অপেক্ষা। তারপরেই পাঁচ ছ’টা ঢাকী উঠোনে লাফ দিয়ে পড়ল। জল-বাংলার এই সুদূর গ্রামের ভেতর ইংরেজি-বাজনা কোথায় পাওয়া যাবে? তাই হয়তো ঢাকীদের ডাকা হয়েছে।

নিমেষে ঢাকের শব্দে বিয়েবাড়ি সরগরম হয়ে উঠল, এবং বিনুদের কানে তালা লেগে যেতে লাগল।

এরই ভেতর গোপাল দাস, ধনঞ্জয় এবং ক’টি বৃদ্ধ এগিয়ে এল।

গোপাল দাস আর ধনঞ্জয়কে আজ চেনাই যাচ্ছে না। মুখ পরিষ্কার করে কামানো। দু’জনেই মাথায় প্রচুর তেল ঢেলেছে, ফলে চুলগুলো চপচপে। জুলপি ঘাড় এবং কপাল বেয়ে সেই তেল গড়িয়ে আসছে। পরনে ক্ষারে-কাঁচা ধুতি আর হাফ শাট, তার ওপর শস্তা পশমি চাদর। কন্যাপক্ষের কর্তা ওরাই, সাজগোজের একটু বাহার তো থাকবেই।

গোপাল দাসরা হাতজোড় করে বলল, আসেন আসেন উত্তরের ঘরের ঢালা ফরাসে বিনুদের নিয়ে এল তারা।

যুগলকে মাঝখানে বসিয়ে হেমনাথরা চারধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরাম করে বসলেন।

তৎক্ষণাৎ সিগারেট এল, পান-তামাক এল।

হেমনাথের কোনও নেশা নেই। অন্য বরযাত্রী যারা এসেছে সবাই তাকে মানে, শ্রদ্ধা করে। তার সামনে বসে সিগারেট বা তামাক খাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। নেশার সরঞ্জামগুলি বৃথাই ফরাসের ওপর পড়ে রইল।

যুগলের গা ঘেঁষে বসেছিল বিনু। তার কানের কাছে মুখ এনে চাপা নিচু গলায় যুগল ফিসফিস করল, বড়কত্তায় না থাকলে একখানা সিগ্রেট খাইতাম। কতক্ষণ বিড়ি বুড়ি খাই না, গলা খুচুর খুচুর করতে আছে।

বিনু বলল, আড়ালে গিয়ে খেয়ে এস না—

যুগল বলল, কী যে কন ছুটোবাবু—

বিনু অবাক, কী বলেছি!

আমি না এই বাড়ির জামাই হমু? আমার নি সক্রেট লইয়া আবডালে গিয়া খাওন মানায়। আমার এট্টা সোম্মান নাই?

আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল বিনু। এ দিকটা সে ভেবে দেখেনি। বলল, তাই তো।

ওদিকে ঝাঁক ঝাঁক উলুধ্বনি আর আর ঢাকের আওয়াজ চলছেই। ঢাকীগুলো উঠোনময় নেচেকুঁদে লাফিয়ে বিপুল উৎসাহে বাজিয়ে যাচ্ছে।

কানে হাত চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে হেমনাথ বললেন, হয়েছে হয়েছে। এবার ওদের একটু থামতে বল। কান ঝালাপালা হয়ে গেল।

শশব্যস্ত হয়ে গোপাল দাস ঢাকীদের বলল, হ্যামকত্তায় কইছে, বাদ্যি থামা ব্যাটারা, বাদ্যি থামা। কানের পোক (পোকা) না বাইর করলে আর হয় না!

তক্ষুনি বাজনা থামল।

এধারে আরও একটা ব্যাপার ঘটেছে। বরযাত্রীদের দলে সুধা সুনীতিকে দেখে বিয়ে বাড়িতে খুবই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। সাড়া পড়ে গেছে চারদিকে।

এদেশে বরযাত্রী হিসেবে মেয়েদের যাওয়ার রেওয়াজ নেই বললেই হয়। ফলে রীতিমতো ভিড় উত্তরের ঘরের দাওয়ার সামনে অনড় হয়ে আছে। দূর থেকে নানা বয়সের বউরা লম্বা লম্বা ঘোমটা অল্প একটু তুলে চকিতে সুধা সুনীতিকে দেখে নিচ্ছে এবং একজন আরেকজনকে ঠেলা দিয়ে চাপা গলায় ফিসফিস করছে, আউ আউ, মাইয়ামাইষে নি বরযাত্তর আসে!

আরেকজন বলল, আসে, আসে—

কই, আমরা তো যাই না।

মুখ বাঁকিয়ে দ্বিতীয় জন বলল, কিসের লগে কিসের তুলুনা! চান্দের লগে প্যান্দের। আমরা হইলাম বগার ঘরের বগী, বেঙ্গার ঘরের বেঙ্গী। আর উনারা বাবুগো ঘরের মাইয়া।

হে কথাখান ঠিকই।

শুদা (শুধু কি বাবুগো মাইয়া, কইলকাত্তার মাইয়া। তেনাগো চালই ভিন্ন।

ঠিকই।

কইলকাতার মাইয়ারা ক্যামন ধলা, ফকফইকা—

মেমসাহেবগো লাখান—

মেমসাহেব বাপের জম্মে দেখছস?

দেখি নাই, তাগো পরস্তাব তো শুনছি–

এই সময় গোপাল দাস, ধনঞ্জয় এবং কর্তাস্থানীয় জনকয়েক এসে বরযাত্রীদের কাছে জোড়হাত করে দাঁড়াল। বিশেষ করে হেমনাথের উদ্দেশে বলল, এইবার হুকুম করেন হ্যামকত্তা, বিয়ার যোগাড় হইয়া গ্যাছে। জামাই লইয়া যাই-

হেমনাথ বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

যুগলকে নিয়ে গোপাল দাসরা ভেতর-বাড়ির দিকে চলল। বিনুরাও তাদের পেছন পেছন গেল।

আলপনা এঁকে এঁকে ভেতর-বাড়ির উঠোনটাকে চমৎকার সাজানো হয়েছে। মাঝখানে চিত্রকরা বড় বড় দু’টো পিঁড়ে, সে দু’টো বর-কনের আসন। এ ছাড়া আছে দু’পক্ষের পুরুত, কন্যাকা, বরকর্তা এবং যে সম্প্রদান করবে তাদের সবার জন্য আসন।

যুগলকে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে শাঁখ বেজে উঠল, ঝক ঝক উলুধ্বনি শুরু হয়ে গেল। হেমনাথরা যাতে বসে বিয়ে দেখতে পারেন সেজন্য ক’খানা জলচৌকিও এসে গেল।

ঢাকীগুলো পুবের ঘরের দাওয়ায় বসে জিরোচ্ছিল। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ব্যাটারা কি ঘুমাইয়া পড়লি নিকি? বাজা-বাজা–

বলার শুধু অপেক্ষা। ঢাকীরা সঙ্গে সঙ্গে উঠোনে নেমে পড়ল। শাঁখ উলু এবং ঢাক, তিনে মিলে মুহূর্তে মাঘ মাসের রাত্তির সরগরম হয়ে উঠল।

এদিকে যুগল যে জামা কাপড় পরে এসেছিল সেগুলো বদলে মেয়ের বাড়ির নতুন পোশাক পরে নিল। তারপরেই ওদিকের কোনও একটা ঘর থেকে হাত ধরে মেয়েরা পাখিকে নিয়ে এল।

পাখিকে এর আগে মোটে একবারই দেখেছে বিনু, সেই আশ্বিন মাসে। স্বপ্নলোকের জলপরীর মতো সাঁতার কেটে কেটে যুগলের নৌকোয় এসেছিল সে।

আর আজ?

আজ চেনাই যাচ্ছে না পাখিকে। পরনে তার রাঙা পাটের শাড়ি আর লাল জামা, হাতে গোছা গোছা চুড়ি, গলায় মুড়কি হার, কানে ঝুমকো, আঙুলে চৌকো আংটি, নাকের পাটায় আগুনের ফুলকির মতো নাকছাবি। লজ্জায় মুখ তুলতে পারছে না পাখি। নতমুখিনী মেয়েটা যেন মর্তভূমির কেউ নয়, স্বর্গলোকের অপ্সরী।

ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকল বিনু।

ঘন ঘন উলুধ্বনি, পুরুতের মন্ত্রপাঠ এবং শাঁখের আওয়াজের মধ্যে পাখিযুগলের মালাবদল হয়ে গেল। তারপর শুভদৃষ্টি। দুজনের মাথার উপর পাতলা একটা চাদরের ঘেরাটোপ দিয়ে কে যেন বলল, তাকা যুগইলা, নয়ন মেইলা পরাণেশ্বরীরে দ্যাখ–

যুগল বড় বড় ড্যাবডেবে চোখ মেলে তাকাল, কিন্তু পাখি আর মুখ তোলে না।

সবাই কত সাধ্যসাধনা করল কিন্তু পাখির চোখের পাতা যেন সীসের পাতের মতো ভারী হয়ে গেছে। কিছুতেই তা মেলতে পারছে না মেয়েটা।

কেউ যখন পারল না তখন টুনিকে এগিয়ে আসতে হল। যুগলের পিসতুতো বোন টুনি। টুনিকেও আজ চেনা যাচ্ছে না। আশ্বিন মাসে তার গা থেকে খই উড়তে দেখেছিল বিনু। লাউয়ের মতো লম্বা স্তন ধরে কোলের বাচ্চাগুলোকে ঝুলতে দেখেছিল। আজ সে লাল-পাড় নতুন শাড়ি পরেছে, নীল জামা পরেছে, গয়নাগাটি পরেছে, এমনকি পাতা কেটে পরিপাটি একখানি খোঁপাও বেঁধেছে। গোসাপের মতো খসখসে কর্কশ চামড়া আজ মসৃণ, তেলতেলে। কপালে নতুন পয়সার মতো মস্ত সিঁদুর টিপ, সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুরের টান। সম্পর্কে টুনি হল পাখির ননাস। (স্বামীর বড় বোনকে বলে ননাস)। সে বলল, আ লো, ছেমরি তো গেলি! মুখ তোল মাইয়া–

পাখি তবু অবনতমুখী।

টুনি এবার ঠোঁটে ঠোঁট টিপে চোখ পাকিয়ে বলল, ও মাইয়া, অহন তোমার এত শরম! ধরুম একবার কিষ্ণবুলি (কৃষ্ণবুলি), ধরুম? ধরি? ভাদাই আশ্বিন মাসে আমার খালাসের সময় যহন এইখানে আছিলি তহন রোজ আইত যুগলা। তহন কী করতি দুই জনে? কই সভার মইদ্যে হেই। কথাখান কই–

টুনির কথা শেষ হবার আগেই টুক করে একবার যুগলের চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ নামাল পাখি।

বিয়ের পর বর কনেকে নিয়ে যাওয়া হল বাসর ঘরে। সেখানে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে এক গলা ঘোমটার তলা থেকে প্রথমে পাখির মা মেয়ে-জামাইর মুখ দেখল। মুখটুখ দেখা হলে বরণকুলো। ঠেকিয়ে ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করল। পাখির মায়ের পর একে একে অন্য এয়োরাও বরকনেকে আশীর্বাদ করল।

তারপর শুরু হল চালখেলা। পেতলের সরাভর্তি চাল এনে এয়োরা পাখিকে বলল, ছড়াইয়া দে–

পাখি প্রথমটা কিছুতেই ছড়াবে না। অনেক পীড়াপীড়ির পর সরা থেকে চালগুলো ঢেলে অল্প একটু ছড়িয়ে দিল।

এয়োদের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ও মা, বিয়া হইতে না-হইতেই সোয়ামীর উপুর অ্যাত টান! ভালা কইরা আউলাইয়া (ছড়িয়ে) দে–বলে নিজেই পাখির একখানা হাত ধরে চালগুলো যতদূর পারল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল। পরে যুগলকে বলল, এইবার চাউলগুলা গুছাইয়া একখানে কর।

বাধ্য ছেলের মতো চালগুলো এক জায়গায় জড়ো করে যুগল। আবার সেগুলো ছড়িয়ে দিল পাখি, আবার এক জায়গায় করল যুগল। এইভাবে বারকয়েক খেলা চলল।

কৌতুকমুখী এয়ার দল বলল, মনে রাইখো জামাই, আমাগো মাইয়া এই রকম আউল ঝাউল করব আর তুমি মানাইয়া গুছাইয়া নিবা। বুঝলা?

উত্তর না দিয়ে যুগল হাসল।

চালখেলার পর জলখেলা।

মস্ত একখানা পাথরের থালা জলে ভর্তি করে আনা হল। একজন এয়ো আঙুল দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে জল ঘোরাতে লাগল। জল যখন ঘূর্ণির মতো ঘুরছে সেই সময় বর আর কনের টোপর থেকে দু’টো শোলার টুকরো ছিঁড়ে তাতে ফেলে দেওয়া হল। কখনও দেখা গেল পাখির শোলাটা আগে যাচ্ছে, যুগলেরটা তার পিছু নিয়েছে। অমনি এয়োদের মধ্যে সাড়া পড়ে যাচ্ছে।

জামাই আমাগো বউ-অন্ত পরান। দ্যাখ ক্যামন মাইয়ার পিছন পিছন লৌড়াইতে আছে। মাইয়া আমাগো সুখে থাকব।

আবার যখন ঘূর্ণিতে পড়ে যুগলের শোলাটা আগে আগে যায়, পাখিরটা তাকে অনুসরণ করে তখন এয়োরা বলাবালি কের, দেখিস, মাইয়া জামাই ছাড়া আর কিছু চিনব না। জামাইর পিছে ঘুরতে ঘুরতে পিঙ্খীমির হগল ভুলব।

একজন বর্ষীয়সী ওধার থেকে বলে ওঠে, ভুলুক, তভু সুখে থাউক অরা।

ঘুরতে ঘুরতে ঘূর্ণির ভেতর শোলার টুকরো দুটো যখন এক হয়ে যায় তখন খেলা শেষ।

চালখেলার মতো বারকয়েক জলখেলাও চলল।

বিনুরা বাসরে চলে এসেছিল। নানা খেলার ফাঁকে হঠাৎ তাকে দেখতে পেল যুগল। বলল, ছুটোবাবু কতক্ষণ?

বিনু বলল অনেকক্ষণ এসেছি।

খাওন দাওন হইছে?

না।

একটু ভেবে যুগল এবার বলল, একখান কথা রাখবেন ছুটোবাবু?

কী? বিনু জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

আইজের রাইতখান এইখানে থাইকা যান। কাইল বিকালে আমার লগে বাড়ি যাইয়েন।

এখানে থেকে কী হবে?

বাসর ঘরে কুনোদিন রাইত কাটাইছেন?

না।

তয় তো আপনেরে আটকাইতেই হইব। বলতে বলতে মুখটা বিনুর কানের কাছে আরও ঘন করে আনল যুগল। গলার স্বর অতলে নামাল, বাসর ঘরে জবর মজা ছুটোবাবু, জবর মজা। দেইখেন রসের মেলা বইব।

বিনু উত্তর দিল না।

একটু ভেবে যুগল আবার বলল, আমার লাখান আপনেরেও একদিন বাসর ঘরে যাইতে হইব। হগল দেইখা-শুইনা-বুইঝা লন। পরে কামে দিব।

কিন্তু–

আবার কী হইল?

দাদু আর বাবা কি আমাকে থাকতে দেবে?

কইয়া দ্যাখেন না একবার। আপনে থাকলে আমার বড় ভালা লাগব।

আচ্ছা বলব।

একসময় খাবার ডাক পড়ল।

উত্তরের ভিটির প্রকাণ্ড ঘরখানায় বরযাত্রীদের আসন পড়েছে। বিনুরা গিয়ে সারি সারি বসে পড়ল।

গোপাল দাস মেয়ের জন্য আট কুড়ি টাকা পণ যেমন নিয়েছে, খরচও করেছে তেমনি দু’হাতে। খাওয়ার ব্যবস্থা প্রায় রাজসিক।

এই জলবাংলায় লুচি-টুচির তেমন চল নেই। ভাতের রেওয়াজ। কলার পাতায় জুই ফুলের মতো ধবধবে পানকাইজ চালের গরম ভাত, এখনও ধোঁয়া উড়ছে। সর-বাটা গাওয়া ঘি, আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, কপির বড়া, মুগের ডাল, রুই-চিতল-ইলিশ-ঢাইন-চার রকমের মাছ, চাটনি, পায়েস এবং রসগোল্লা।

যতক্ষণ খাওয়া চলল, এক ধারে গলবস্ত্র হয়ে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকল গোপাল দাস। আর ধানঞ্জয় হাঁক ডাক করে পরিবেশন করাতে লাগল। এই পাতে চিতল মাছের কোল দাও, উই পাতে মিষ্টান্ন দাও, হেই পাতে রসগুল্লা দাও–

খেতে খেতে হেমনাথ বললেন, খুব খাইয়েছ গোপাল–

ঘাড়খানা একধারে হেলিয়ে বিনীত সুরে গোপল দাস বলল, খুব খাওয়ামু, আমার সাইদ্য কী?

না না, চমৎকার আয়োজন হয়েছে।

আপনেগো লাখান মানুষ আমার বাড়ির কিয়া কম্মে পাত পাতছেন, এইতেই ভাগ্যি। কী আনন্দ যে পাইছি হ্যামকত্তা, মুখে কইয়া বুঝাইতে পারুম না। দিন যদিন ত্যামন থাকত, পরান ভইরা খাওয়াইতাম–

খাওয়াবার কথায় দেশ কালের কথা এসে পড়ল। কী দিন ছিল আর কী দিন এল! এখন জিনিসপত্র আক্রা, হাত ছোঁয়ানো যায় না, এমন আগুন দর। আগের দিন থাকলে গোপাল দাস তিন দিন আগে বরযাত্রীদের নিয়ে আসত, খাওয়ানো কাকে বলে দেখিয়ে দিত, সবই অদৃষ্ট, ইত্যাদি ইত্যাদি।

বরযাত্রীদের ভেতর থেকে একজন বর্ষীয়ান লোক জানাল, আগেকার দিনে বরযাত্রীদের বিয়ের চার পাঁচ দিন আগে মেয়ের বাড়ি যাবার রেওয়াজ ছিল। বরিশাল-খরিদপুর কুমিল্লা, এই জলের দেশের নানা জায়গায় সে এভাবে নেমন্তন্ন খেয়ে বেড়িয়েছে। তা সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও না।

খাওয়া দাওয়ার পর হেমনাথরা বাড়ি ফিরবেন, হঠাৎ বিনু বলে উঠল, আমি যাব না।

অবনীমোহন বললেন, যাবি না তো থাকবি কোথায়?

যুগল বোধ হয় তাকে তাকে ছিল। বাসর ঘর থেকে চট করে বেরিয়ে এসে বলল, আমার কাছে থাকব। কাইল আমি লইয়া যামু–

অবনীমোহন আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন। যুগলের মুখচোখ দেখে হেমনাথের মায়া হয়ে থাকবে। তিনি বললেন, আচ্ছা থাক, একটা দিন আমোদ-আহ্লাদ করুক। বলে যুগলের দিকে ফিরে একটু ঠাট্টাও করলেন, তুই আবার অপ্সরীদের মধ্যে গিয়ে মুণ্ডু ঘুরিয়ে বসে থাকিস না, আমার দাদাভাইটাকে একটু দেখিস।

.

রাত্রিবেলা বাসর ঘরে মজা বেশ ভালই জমল। দু’টি যুবতী মেয়ে সরু চিকন গলায় গাইল :

এক দিন শ্যাম নীল জলে,
রাধা বদন হেরব বলে
ধীরে ধীরে চলে শ্যাম রায়।
গিয়ে যুমনার কদম্বমূলে,
দাঁড়াইল কুতূহলে
কুটিলা তাই দেখিবারে পায়।
কুটিলা কয় শোন লো বউ
জল আনিতে যাইস না লো কেউ
ব্রজের যত আছে ব্রজাঙ্গনা।
কাল কুন্তীর এল যমুনাতে,
দেখে এলাম স্বচক্ষেতে
তাই তো তোদের যেতে করি মানা।

একটা মাজা-ভাঙা সধবা বুড়ি, সম্পর্কে যুগলের দিদিশাশুড়ি, পাকা চুলে তার সিঁদুর, কপালে সিঁদুর, কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে রগড় করে করে নাচতে লাগল। ঘরভর্তি যত যুবতী, যত কিশোরী, যত প্রৌঢ়া হেসে একেবারে কুটিপাটি। এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে বলতে লাগল, ঠাউরমা য্যান কী! একখান সং–

নাচগানের পর হঠাৎ ঘরভর্তি মেয়ের দল যুগলকে ছেড়ে বিনুকে নিয়ে পড়ল। একটি রঙ্গিণী স্বভাবের যুবতী চোখে চোখ রেখে বলল, অ বাবুগো পোলা, আপনের বিয়া হইচে?

চোখ নামিয়ে বিনু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল। গালে একটা করে হাত রেখে অন্য মেয়ের দল কলকল করে উঠল, আ লো, মা লো মা, অহন তরি বিয়াই করেন নাই! তয় করছেন কী?

বিনু চুপ। তার মুখ লাল হয়ে উঠতে লাগল।

সেই যুবতীটি আবার বলল, বিয়া তো করেন নাই, এই দিকে জামাইর লগে বাসরে আইসা ঢুকছেন। বাসরের রীত কানুন জানেন?

এবারও মাথা নেড়ে বিনু বুঝিয়ে দিল, জানে না।

যুবতী বলল, দুইখান ধান্দা (ধাঁধা) জিগাই, জবাব দ্যান—

এতক্ষণে বিনুর গলায় স্বর ফুটল, আমি ধাঁধা-টাদা জানি না। বলতে পারব না।

না কইলে হইব না। আইচ্ছা শোনেন:

রক্তে ডুবু ডুবু, কাজলের ফোঁটা
এক কথায় যে কইতে পারে
হ্যায় মজুমদারের ব্যাটা।

এইবার ক’ন বস্তুখান কী?

বিনু অনেকক্ষণ ভাবল। কিন্তু হাজার ভেবেও কিছুই বার করতে পারল না। বলল, জানি না। যুবতী বলল, আইচ্ছা আরেকখান জিগাই

ওপার থনে আইল টিয়া
সোনার টুপর মাথায় দিয়া
যদি টিয়ায় মন করে
মাঠের মাটি চুর করে।

বিনু এবারও পারল না।

হঠাৎ ভিড়ের ভেতর থেকে এক থুথুরে বুড়ি উঠে এসে বিনুর চিবুক ধরে নাড়তে নাড়তে বলল, একখান ধান্দারও জবাব দিতে পারলা না। তোমার শাস্তি হইব গোরাচান।

অন্য মেয়েরা চেঁচামেচি জুড়ে দিল, কী শাস্তি, কী শাস্তি?

বুড়ি বলল, আমারে বিয়া করতে হইব।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরময় হাসির রোল উঠল। আর বিনুর চোখ-মুখ-নাক-কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল।

হাসি টাসি থামলে মেয়েরা আবার যুগল এবং পাখিকে নিয়ে মাতল। গোপাল দাসের বউ অর্থাৎ যুগলের শাশুড়িকে তারা ঠেলতে ঠেলতে বাসর ঘরের বাইরে বার করে দিল, তুমি হাউড়ি মানুষ, তুমি এইখানে ক্যান? আমরা জামাই লইয়া কত কী করুম অহন, কত নীলাখেলা! যাও, যাও–

গোপাল দাসের বউ হাসতে হাসতে চলে গেল, যা ইচ্ছা তরা কর–

করুমই তো।

মেয়েরা এবার পাখিকে জোর করে যুগলের কোলে বসিয়ে সমস্বরে গান ধরে:

শ্যামের কোলে রাইকিশোরী
এ রূপ দেখে মরি মরি—

রাতের সঙ্গে সঙ্গে রঙ্গিণীদের মাতামাতি, কৌতুক এবং হাসিও পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল।

পরের দিন বাসি বিয়ে হল, আংটি খেলা হল, কাদা খেলা হল। কাদায় কাদায় যুগল আর পাখিকে, এমনকি বিনুকেও ভূত বানিয়ে ছাড়ল মেয়েরা।

বিকেলবেলা বাড়ির সবাইকে কাঁদিয়ে যুগলের সঙ্গে পাখি শ্বশুরবাড়ি রওনা হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *