২.০১ লিঙ্গভিত্তিক সমাজ সংগঠন

দ্বিতীয় খণ্ড – সরকার ধারণার ক্রমবিকাশ

প্রথম পরিচ্ছেদ – লিঙ্গভিত্তিক সমাজ সংগঠন

সরকার গঠনের বিষয়ে জানতে গেলে আমাদের প্রথমে দেখতে হবে গোষ্ঠী সংগঠন, যা ছিল আত্মীয় সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। আদিম যুগে প্রায় ক্ষেত্রেই যা একমাত্র ভিত্তি হিসেবে দেখা গেছে। কিন্তু তার পূর্বে আরো এক ভিত্তি ছিল, তা হল লিঙ্গভিত্তিক সম্পর্ক। আমরা প্রথমে এ সম্বন্ধেই আলোচনা করতে চাই। ব্যাপারটাকে প্রথমে স্থান দেওয়া হচ্ছে এর নতুনত্বের জন্যে নয় বরং এর মাঝেই গোষ্ঠী সংগঠনের সূত্র সুপ্ত ছিল। এই অনুমানকে যদি বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করা যায় তা হলে দেখা যাবে দুটি জিনিস, এক, পুরুষভিত্তিক দুই স্ত্রীভিত্তিক। আদি অস্ট্রেলিয়াবাসীদের মধ্যে এই ভিত্তি এখনো বিদ্যমান। মানবজাতির আদি গোষ্ঠীসমূহের সংগঠনের মধ্যে যা ছিল প্রায় সর্বজনীন।

আমরা আদিম সমাজের নিম্ন পর্যায়ে গেলে দেখতে পাব সমাজ-পদ্ধতির মূল সূত্র হল বিশেষ নিয়মের মধ্যে থেকে দলগত স্বামী ও স্ত্রীদের নিয়ে। স্বামী-স্ত্রীর অধিকার সুযোগ-সুবিধা (জুরা কনজুগিয়ালিয়া)[১] দলের মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল, যা বিরাট এক কর্ম-পরিকল্পনার স্থান দখল করে এবং যা সংগঠনের একটা প্রধান সূত্র হয়ে দাঁড়ায়। যার ওপর নির্ভর করে সমাজ গড়ে উঠেছিল। এই অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা এমন দৃঢ়ভাবে তাদের মনে গেঁথে গিয়েছিল যে ধীরে ধীরে তা থেকে পরিবর্তিত হয়ে সংস্কারলাভ করেছে। যা প্রায় ঘটেছে। অগোচরে। এর ফলে দেখা গেছে পরিবার ক্রমশ নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ে উঠছে। শেষে দেখা গেল এই দাম্পত্য-পদ্ধতি বা সম্পর্ক ক্রমশ হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে। প্রথম পরিবার পদ্ধতি শুরু হয় ভাই-বোনদের বিবাহে। দ্বিতীয় অধ্যায় হল পুনালুয়ান পদ্ধতি যা অষ্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে দেখা যায়। যেখানে আপন ও দূরসম্পর্কের সব ভাই অন্যান্য সব বোনের স্বামী, তাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী, সবাই সবার স্বামী-স্ত্রী। এই দুই পদ্ধতিতেই আমরা দেখছি বিয়ে ঘটছে একই দলের ভেতর। এখানে সংগঠন হল লিঙ্গভিত্তিক। তারপর বিভিন্ন গোষ্ঠী মিলে এরচেয়ে বড় সংগঠন গড়ে তোলে। সংগঠনের দিক থেকে রক্ত বা আত্মীয় সম্পর্ক থেকে যা বিরাট অগ্রগতি। অজান্তেই ব্যাপারটা প্রাকৃতিক নির্বাচনকে মেনে চলেছে। এই সমস্ত কারণে অস্ট্রেলীয় পদ্ধতির দিকে আমাদের গভীর মনোযোগ দিতে হচ্ছে, যদিও তা নিম্ন শ্রেণীর মানব-জীবনধারা, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের সামাজিক ইতিহাসের একটা বিশেষ পর্যায় তুলে ধরে।

বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসীদের যে অংশ কামিলারোই ভাষায় কথা বলে তাদের মাঝে লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণী সংগঠন আছে এবং আত্মীয় সম্পর্কিত গোষ্ঠী সংগঠন মাত্র শুরু হয়েছে। তারা সিডনির উত্তরে ডার্লিং রিভার জেলায় বাস করে। এই দুই ধরনের সংগঠন। অন্যান্য অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীদের মধ্যেও দেখা যায় এবং তা এতই প্রচুর যে মনে হয় প্রাচীনকালে এদের সবার মাঝেই এই সংগঠন ছিল সর্বজনীন। এ থেকে দেখা যাচ্ছে পুরুষ ও নারীর শ্রেণীবিভাগ গণ সংগঠনের পূর্বের ঘটনা। গণ সংগঠন লিঙ্গভিত্তিক সংগঠনের চেয়ে উন্নত। দ্বিতীয়ত, কামিলারোইদের মধ্যে পূর্বের পদ্ধতি পরবর্তী পদ্ধতিকে হটিয়ে দেবার প্রক্রিয়ায় রত। তাদের সমাজ পদ্ধতিতে পুরুষ ও নারীই একক, যা পূর্ণ গণ সংগঠনে পরিণত হয়ে স্থান দখল করে নিচ্ছে। তাই দুটি পদ্ধতিই আমরা একই সাথে দেখতে পাচ্ছি। লিঙ্গ ও গণ ভিত্তিক সমাজ একই সাথে বিদ্যমান। প্রথমোক্তটি কেন্দ্রবিন্দু, কিন্তু দ্বিতীয়টি ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে এবং পূর্ণ গণ সংগঠন সংঘটিত হয়ে গেলে পূর্বের ধারার ওপর স্থান করে নেবে।

অষ্ট্রেলিয়ার বাইরে লিঙ্গভিত্তিক সমাজ আর কোথাও দেখা যায় নি, কিন্তু এই লিঙ্গভিত্তিক সমাজের ওপর গোষ্ঠী সংগঠন ক্রমশ জায়গা করে নিচ্ছে। এ থেকে মনে হয় পূর্বোক্ত সমাজ সংগঠন গণ ভিত্তিক সংগঠনের পূর্বে মানবসমাজে ছিল সর্বজনীন। যদিও লিঙ্গভিত্তিক পদ্ধতি যখন সম্পূর্ণভাবে আবিষ্কৃত হয় তার মাঝে যথেষ্ট জটিলতা ছিল। পুরোনো সামাজিক সংগঠন হিসেবে এর গুরুত্ব এই জন্যে যে আমাদের আদি আর্য পরিবারগুলোও এইভাবেই সংগঠিত হয়েছিল তা ধারণা করে নেওয়া যায়।

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা পলিনেশীয় এমনকি আমেরিকান আদিবাসীদের চেয়েও নিম্ন পর্যায়ে, এমনকি তারা নিগ্রোদের চেয়েও নিচে ছিল। মানবসমাজের সবচেয়ে নিচের ধাপে। বর্তমান যে কোনো আদিবাসীদের চেয়েও তারা আদি স্তরে রয়েছে।[২]

পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা গণ সমূহ কীভাবে সংগঠিত ছিল সে সম্বন্ধে আলোচনা করব। এখন তাদের বিশদ আলোচনা না করেই উল্লেখ করা হবে। শুধু শ্রেণীসমূহের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যার জন্যেই আলোচিত হবে।

কামিলারোইরা ছয়টি ‘গণে’ বিভক্ত। বিয়ের সম্পর্কে তাদের আবার দুই ভাগে ভাগ। নিম্নে তাদের নাম দেয়া গেল :

(ক) ১–ইগুয়ানা (ডুলি) ২–ক্যাঙ্গারু (মুররিরা) ৩–ওপোসাম (মিউট)।

(খ) ৪–এমু (ডিনাউন) ৫–ব্যাণ্ডিকট (বিলবা) ৬-–ব্ল্যাকস্নেক (নুরাই)।

প্রথমোক্ত গণত্রয়ের মধ্যে পরস্পর বিবাহ চলত না, কারণ তারা একই গণ থেকে সৃষ্ট। কিন্তু তারা অন্য যে কোনো গণের সাথে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। তেমনই দ্বিতীয় দলের যে-কেউ প্রথম দলে বিয়ে করতে পারত। কামিলারোইদের এই প্রাচীন নিয়ম কিছুটা বদলে গেছে, কিন্তু গণের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে পুরো মত পাওয়া যায় না। মেয়ে বা পুরুষ কেউই তাদের নিজস্ব গণের মাঝে বিয়ে করতে পারবে না–এটা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। উত্তরাধিকার ঠিক করা হয় স্ত্রী-ধারায়। ছেলেমেয়েরা মায়ের গণের সদস্য। এই পদ্ধতি প্রায় সমস্ত গণেই চলত। তাই কামিলারোইদের জন্যেও এটা পুরোপুরি সত্য।

কিন্তু এদের আরো প্রাচীন বিভাগ ছিল আট ভাগে, যার চারটে সম্পূর্ণ পুরুষদের, বাকি চারটে সম্পূর্ণ মেয়েদের। বিয়ের ব্যাপারে এরা রীতিনীতি বেশ মেনে চলত এবং উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা গণ সংগঠনের ক্ষেত্রে অনেকটা বাধার সৃষ্টি করত, তাই দেখা গেল পরবর্তী সংগঠনে এটা ন্যায়সঙ্গত রূপ গ্রহণ করে। পুরুষ বিভাগ বিশেষ একটিমাত্র মহিলা বিভাগের সাথে বিয়ে করতে পারত। ফলত দেখা যাচ্ছে একটা পুরুষ শ্রেণীর সবাই অপর একটি স্ত্রী শ্রেণীর স্বামী, যাদের সাথে তাদের বিয়ে সম্ভব। অধিকন্তু যদি কোনো পুরুষ প্রথমোক্ত তিন গণের মধ্যে থাকে, সে অবশ্যই অন্য তিন গণের এক গণের মহিলাদের জন্যে নিদিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে এক গণের এক অংশের পুরুষদের জন্যে অপর গণের মেয়েদের এক অংশের মধ্যে বিয়ে সীমিত হয়ে যাচ্ছে, যা গণ-সমূহের সত্যিকার সংগঠনের তত্ত্ববিরোধী–কারণ আপন গণের মধ্যে বিয়ে বাদে প্রতিটি গণের মেয়ে-পুরুষের যে কোনো গণের মেয়ে পুরুষের সাথে বিয়ে হবার অধিকার থাকা উচিত। নিম্নে শ্রেণীগুলো দেয়া হল :

পুরুষ শ্রেণী

১–ইপ্পাই
২—কুম্বো
৩-মুররি
৪-কুববি

স্ত্রী শ্রেণী

১–ইপ্লাটা
২–-বুটা
৩–মাটা
৪–কাপোটা

যে কোনো গণের হোক, ইপ্পাইরা পরস্পর ভাই। কারণ, তারা একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত। কুষোরাও তাই। তেমনই মুররি ও কুববিরাও। ঠিক একইভাবে যে কোনো গণেরই হোক ইপ্লাটারা পরস্পর বোন। তেমনই বুটা, মাটা ও কাপোটারা পরস্পর বোন। এরপরে আমরা দেখি সব ইপ্পাই ও ইপ্পাটারা ভাই-বোন, একই মায়ের ছেলেমেয়ে হোক বা না হোক। কুম্বো আর বুটারা পরস্পর ভাই-বোন, এইভাবেই মুররি আর মাটারা ও কুববি আর কাপোটারা ভাই-বোন। যদি কোনো ইপ্পাই আর ইপ্পাটার দেখা হয়, যারা হয়তো কেউ কাউকে কোনোদিন দেখেও নি, সম্বোধন করবে ভাই-বোন বলে। তাই দেখা যাচ্ছে কামিলারোইরা চারটে ভাই-বোনের প্রাথমিক দলে বিভক্ত হয়েছিল। প্রতিটি দলে একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী-শাখা, কিন্তু একই কর্মক্ষেত্রে তারা পরস্পর মিশ্রিত হয়ে কাজ করত। আত্মীয় সম্পর্ক ছাড়া। শুধু লিঙ্গভিত্তিক সংগঠন নিশ্চয় গণ সংগঠনের চেয়ে প্রাচীন সংগঠন। এই ধরনের সমাজ সম্বন্ধে আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি।

এই শ্রেণীসমূহ ‘গণ সংগঠনে বীজ হিসেবে কাজ করছে, কিন্তু সত্যিকার গণ সংগঠনে রূপান্তরিত হতে পারে নি। আসলে ইপ্পাই ও ইপ্লাটা দুই শাখা মিলে একটা শ্ৰেণী–কিন্তু তারা পরস্পর বিয়ে করতে না পারায় তারা গণ সংগঠনের ভিত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু তারা পুরো গণ সংগঠন করছে না, কারণ তাদের নিজেদের পৃথক নাম এবং ছেলেমেয়েরাও ভিন্ন নাম গ্রহণ করছে। তাই এই শ্রেণীবিভাগ লিঙ্গভিত্তিক আত্মীয়তাভিত্তিক নয়–আর তা প্রাথমিকভাবে একটি বিবাহ-রীতিকেন্দ্রিক।

যেহেতু ভাই-বোনে বিয়ে নিষিদ্ধ তাই এই শ্রেণীগুলো স্থাপিত হয়ে বিয়ের রীতি তৈরি করছে। বিয়ের ক্ষেত্রে এটাই ওদের মূল নিয়ম। নিয়মটি নিম্নে দেয়া গেল :

ইপ্পাইরা কাপোটাকে বিয়ে করতে পারে, এ ছাড়া আর কাউকে নয়।

কুম্বোরা বিয়ে করতে পারে মাটাকে, এ ছাড়া আর কাউকে নয়।

মুররিরা বিয়ে করতে পারে বুটাকে, এ ছাড়া আর কাউকে নয়।

কুববিরা ইপ্পাটাকে বিয়ে করতে পারে, এ ছাড়া অন্য কাউকে নয়।

এই নির্দিষ্ট নিয়ম পরে কিছুটা পরিবর্তিত হয়, যেমন, প্রতিটি পুরুষ শ্রেণীর জন্যে আর একটা বাড়তি মেয়ে শ্রেণী ঠিক হচ্ছে যাদের সাথেও তাদের বিয়ে হতে পারে। এই তথ্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে ‘গণ’ সংগঠন শ্রেণী সংগঠনকে সরিয়ে দিয়ে ক্রমশ নিজের জায়গা করে নিচ্ছে।

এইভাবে দেখা যাচ্ছে কামিলারোইদের মধ্যে একজন পুরুষের জন্যে স্ত্রী হিসেবে মাত্র এক-চতুর্থাংশ মেয়ে থাকছে। এটা অবশ্য এই পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রতিটি কাপোটা মেয়েই প্রতিটি ইপ্পাই পুরুষের স্ত্রী। প্রতিটি মাটা স্ত্রীলোক কুম্বো পুরুষের স্ত্রী। এইভাবে বুটা মেয়েরা মূররি পুরুষের এবং ইপ্লাটা মেয়ে কুবি পুরুষের স্ত্রী। এই বস্তুগত তথ্যটাই বিশিষ্ট। মিঃ ফিসনকে লেখা মিঃ ল্যান্সের চিঠিতে আছে : “যদি অপরিচিত ইপ্লাটার সাথে কোনো কুববির দেখা হয় তারা পরস্পর ‘গোলির’, অর্থাৎ পতি বা পত্নী বলে সম্বোধন করে। এইভাবে কোনো কুববি কোনো ইপ্পাটা মেয়ের সাথে স্ত্রীর মতো ব্যবহার করবে এবং সেই মেয়ের গোষ্ঠীও তা মেনে নেবে।” কাছেপিঠের অন্যান্য ইপ্লাটা মেয়েরাও তার স্ত্রীর মতো।

এখানে আমরা পুনালুয়া ধরনের বিয়ে দেখতে পাচ্ছি, সারা দলের মধ্যেই যা ব্যাপ্ত। ছোট ছোট দলে বিভক্ত এর প্রতিটিই একটা অনুকৃতির মতো। এই জোড়-পদ্ধতি কামিলারোই গোষ্ঠীতে এক-চতুর্থাংশ পুরুষকে এক-চতুর্থাংশ মেয়ের সাথে মিলিত করছে। আদিম জীবনের এই ছবি আদিবাসীদের কাছে কোনোরকম বেমানান মনে হত না, কারণ তাদের কাছে ছিল এটাই বিবাহ সম্পর্ক। এটা পুরুষের বহু বিবাহ ও নারীর বহু পুরুষ গ্রহণেরই বিস্তৃতি–যা আদি গোষ্ঠীসমূহে আরো সীমিতভাবে ছিল সর্বজনীন। এদের সাক্ষ্য এখনো দেখা যায় নানা রীতি-প্রথার মধ্যে। প্রাথমিক পদ্ধতি থেকেই এগুলো অবরোহিত হয়েছে। এখানে একটা জিনিস গোচর হচ্ছে যে এই অন্তর্বিবাহ অজাচার থেকে এক ধাপ সরে আসা। কারণ আগে কোনো পদ্ধতি ছিল না, এখন একটা পদ্ধতির সৃষ্টি হয়েছে। অধিকন্তু এটা একটা বিয়ের নির্দিষ্ট পদ্ধতি দিচ্ছে এবং জন্ম দিচ্ছে পরিবারের। এখান থেকেই সত্যিকার বৃহৎ সমাজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ধারণা করা যায়, আগে যা ছিল শুধু ভাই-বোন ও জ্ঞাতিদের বিয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ।[৩]

যদিও ছেলেমেয়েরা তার মায়ের ‘গণে’ থাকে, তারা কিন্তু সেই একই ‘গণে’র মধ্যে অন্য শ্রেণীভুক্ত হয়ে যায়, যা তাদের মা-বাবা থেকে পৃথক। নিচের তালিকায় তা স্পষ্ট হবে :

পুরুষ      স্ত্রী      পুরুষ     স্ত্রী

ইপ্পাই বিয়ে করে কাপোটাকে–তাদের ছেলে হয় মুররি ও মেয়ে মাটা।

কম্বো বিয়ে করে মাটাকে–তাদের ছেলে কুববি ও মেয়ে কাপোটা।

মুররি বিয়ে করে বুটাকে–তাদের ছেলে হয় ইপ্পাই ও মেয়ে ইপ্পাটা।

কুবি বিয়ে করে ইপ্লাটাকে–তাদের ছেলে হয় কুম্বো ও মেয়ে বুটা।

এইভাবে যদি উত্তরাধিকার সূত্র চলতে থাকে তা হলে আমরা দেখব যে মেয়েদের লাইনে কাপোটা মাটার মা, আর ঠিক তেমনিভাবে চলতে চলতে মাটাও কাপোটার মা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একইভাবে ইপ্পাটা বুটার মা, আর বুটাও এক সময় ইপ্পাটার মা হচ্ছে। পুরুষ শ্ৰেণীদের ব্যাপারেও তাই, কিন্তু যেহেতু কামিলারোই গোষ্ঠীরা মাতৃধারায় উত্তরাধিকার নির্ণয় করে, কামিলারোই গোষ্ঠীরা মনে করে তারা দু জন মহিলা পূর্বপুরুষের বংশধর, যার জন্যে দুটো গণের সৃষ্টি হচ্ছে। এইসব উত্তরাধিকার সূত্র ধরলে দেখা যাবে প্রতিটি শ্রেণীর রক্তই সমস্ত শ্রেণীর মাঝ দিয়ে বয়েছে।

যদিও প্রতিটি লোক উপরোক্ত শ্রেণীর নামের একটা নামে পরিচিত হত, তবে আরো একটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো, সবার একটা ব্যক্তিগত নামও ছিল। আদিম ও বর্বর উভয় গোষ্ঠীদের মধ্যেই এই ব্যাপার দেখা গেছে। লিঙ্গভিত্তিক এই সংগঠনের দিকে যত খুঁটিয়ে। লক্ষ করা হয় আদি মানবদের এই সংগঠনকে ততই অত্যাশ্চর্য বলে মনে হয়। একবার এটা যখন স্থাপিত হয়ে যায় এবং কয়েক পুরুষ ধরে চলতে থাকে তখন একে বদলানো খুবই শক্ত। কেননা ততদিনে তা বিরাট এক সামাজিক শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। এই অবস্থায় পৌঁছতে বহু শতাব্দী লেগে গেছে, বিশেষ করে দাম্পত্য পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হতে।

গণ সংগঠন শ্রেণীভিত্তিক সংগঠন থেকে উচ্চ পর্যায়ের কারণ গণ সংগঠন শ্রেণীভিত্তিক সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। সময়ের দিক থেকেও এটা শ্রেণীভিত্তিক সংগঠনের পরবর্তী। কেন্দ্রে শ্রেণীভিত্তিক গোষ্ঠী থাকলেও বিভিন্ন ‘গণ’ নিয়ে বৃহত্তর ‘গণ-সংগঠনের রূপ নিচ্ছে।

পূর্ববর্তী তথ্য অনুযায়ী গণের সম্পর্ক বোঝা যাবে যখন তাদের সাথে শ্রেণী সম্পর্কটাও তুলে ধরা হবে। শ্ৰেণী হচ্ছে জোড়া ভাই-বোন যারা একে অপরের কাছ থেকে আসছে। আর গণেরা নিজেরাই আসছে শ্রেণীর মাঝ দিয়ে, জোড়া-জোড়াভাবে। নিম্নে এর একটা। তালিকা দেওয়া গেল।

–– স্ত্রী – পুরুষ – স্ত্রী

 গণসমূহপুরুষ স্ত্রী পুরুষ স্ত্রী
ইগুয়ানা : সবাইমুররিমাটাঅথবাকুববিকাপোটা
এমু : সবাইকুম্বোবুটাঅথবাইপ্পাইইপ্পাটা
ক্যাঙ্গারু : সবাইমুররিমাটাঅথবাকুববিকাপোটা
ব্যাণ্ডিকট : সবাইকুম্বোবুটাঅথবাইপ্পাইইপ্পাটা
ওপোসাম : সবাইমুররিমাটাঅথবাকুববিকাপোটা
ব্ল্যাকস্নেক : সবাইকুম্বোবুটাঅথবাইপ্পাইইপ্পাটা

বিবাহ আইনের জোরেই সন্তান কোন গণে হবে তা নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে। তাই, ইগুয়ানা-মাটা অবশ্যই কুম্বোকে বিয়ে করবে। তার ছেলেমেয়েরা হবে যথাক্রমে কুববি ও কাপোটা, অবশ্যই তারা হবে ইগুয়ানা গণের লোক। কারণ উত্তরাধিকার ঠিক হচ্ছে মায়ের দিক থেকে। ইগুয়ানা কালোটা অবশ্য বিয়ে করবে ইপ্পাইকে। তার ছেলেমেয়ে হল যথাক্রমে মুররি ও মাটা এবং একই কারণে তারাও ইগুয়ানা গণের লোক। এইভাবে দেখা যায় এমু বুটা অবশ্যই মুররিকে বিয়ে করবে। তার ছেলেমেয়ে হল ইপ্পাই-ইপ্পাটা এবং তারা এমু গণের লোক। এইভাবে এমু-ইপ্পাটা অবশ্যই কুববিকে বিয়ে করবে। তাদের ছেলেমেয়ে কুম্বো ও বুটা এবং এমু গণের সদস্য। এইভাবে গণ তার মেয়েদের সব ছেলেমেয়েদেরই রেখেছে। বাকি গণগুলোর ব্যাপারেও এই একই নিয়ম। আমরা দেখতে পাই যে প্রতিটি গণই মনে করে তারা তাদের দুই মহিলা পূর্বপুরুষ থেকে জন্ম নিয়েছে এবং চারটে শ্রেণীকে অন্তর্ভুক্ত করে দেখা যাচ্ছে তারা জন্ম নিয়েছে আটটি মহিলা থেকে। সম্ভবত প্রথমে দু জন পুরুষ ও দু জন মহিলার শ্রেণী ছিল যাদের বিয়ে হত বিপরীত দলের সাথে। সেই চার শ্ৰেণীই। পরে আট ভাগে বিভক্ত হয়। বেশ বোঝা যাচ্ছে প্রাচীন সংগঠন হিসেবে শ্রেণীগুলো ছিল গণের আওতায়, কিন্তু ‘গণ’ বিভক্ত হয়ে তা ঘটে নি।

অধিকন্তু, ইগুয়ানা, ক্যাঙ্গারু ও ওপোসাম গণগুলোর যেসব শ্রেণী আছে তা একে অপরের পরিপূরকের মতো। এ থেকে মনে হয় তারা কোনো এক প্রাথমিক গণ থেকে বিভক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এমু, ব্যাণ্ডিকট ও ব্ল্যাকস্নেকের ক্ষেত্রেও এটা খাটে। তাই শেষ পর্যন্ত দুটি মাত্র অংশ থাকছে : ছ’টা গণকে মূল দুটো গণে নামাচ্ছে। এক অংশ অপর অংশের সাথে বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে। তাদের নিজেদের মধ্যে বিয়ে হত না। এটা আরো ভালোভাবে বোঝা যায় যখন দেখা যায় প্রথম তিনটি গণের মধ্যে বিয়ে হয় না এবং বাকি তিনটি গণের মধ্যেও বিয়ে হয় না। কারণ, একই ‘গণ’ ভেঙে তিন ভাগ হয়েছে। পরে নামেই তাদের পার্থক্য ঘটে।[৪] ঠিক একই ব্যাপার দেখা যায় সেনেকা-ইরোকোয়াদের মধ্যে।

যেহেতু বিয়ে বিশেষ এক শ্ৰেণীদের মধ্যে নিষিদ্ধ, যখন দুটো গুণ থাকে অনুমান করে নেওয়া যায় এক অংশের অর্ধেক মেয়ে অপর অংশের অর্ধেক পুরুষদের স্ত্রী। ছ’টা গণে বিভক্ত হবার ফলে গণের বাইরে বিয়ে করার সুবিধে দেখা দেয়। এই সুবিধাটা শ্রেণীর উপস্থিতির জন্যে অতটা প্রাধান্যলাভ করতে পারে নি। তাই দেখা গেছে আপন ভাই-বোনের পর যারা সবচেয়ে কাছাকাছি তাদের মধ্যে বিয়ে শুরু হয়। গণসংগঠন শ্রেণীসংগঠনকে সম্পূর্ণ বিলোপ করতে পারলে এই অসুবিধা দূর করতে পারে। শ্রেণীসংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য দেখা যাচ্ছে যাতে ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে না হতে পারে। কিন্তু এই উদ্দেশ্য সফল হলেও তারা তারপর যে-পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল তা-ও ভীষণ জটিল ধরনের ও আপত্তিকর।

অবশ্য আসল শ্রেণী সংগঠনের মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায় এবং যা সত্যিকার গণ সংগঠনের পক্ষে দাঁড়ায়, যদিও তখনো তা বহু দূর পথের লক্ষ্যবস্তু। এ সম্বন্ধে দুটো বিষয় বিশেষ করে দেখা যায় : প্রথমত, ত্রি-গণের পরস্পরের মধ্যে বিয়ে সংঘটনের অনুমতি সীমিতভাবে হলেও পাওয়া যাচ্ছে–দ্বিতীয়ত, সেইসব শ্রেণীতে বিয়ে করা যাচ্ছে আগে যা একেবারেই সম্ভব ছিল না। এইভাবে এখন দেখা যাচ্ছে ইগুয়ানা-মুররি ক্যাঙ্গারু গণের মাটাকে বিয়ে করতে পারে, যারা তাদের সমান্তরাল বোন। অথচ আগে বিপরীত তিনটির মধ্যে শুধু বুটার সাথে তাদের বিয়ে নির্দিষ্ট ছিল। এইভাবে ইগুয়ানা-কুববি তার সমান্তরাল বোন কাপোটাকে বিয়ে করতে পারে। এমু-কুম্বো বুটাকে বিয়ে করতে পারে এবং এমু ইপ্পাই এখন ব্ল্যাকস্নেক গণের ইপ্লাটাকে বিয়ে করতে পারে, আগে যে বাধা ছিল এখন সম্পূর্ণ তার বিপরীত। প্রতিটি ত্রি-গণের পুরুষ বাকি ত্রি-গণের অন্য দুই-এর মাঝ থেকে আরো একটা বাড়তি স্ত্রী-শ্রেণী পাচ্ছে, আগে যাদের থেকে তারা সম্পূর্ণভাবে পৃথক ছিল। মি. ফিসন অবশ্য যেসব তথ্য পাঠিয়েছিলেন তাতে সম্পূর্ণ পরিবর্তনের চিত্র পাওয়া যায় নি।[৫]

এই পরিবর্তন অনেকটা বিপরীতমুখী হলেও তা শ্ৰেণীগুলোকে ভাঙার দিকেই নিয়ে গিয়েছিল। প্রগতির ধারা এখানে দেখা যায় শ্রেণী থেকে গণকেই গণ সংগঠনের ভিত্তি হিসেবে নেবার চেষ্টা করছে। কামিলারোইদের সামাজিক সংগঠনে এ কথা স্পষ্ট। এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একমাত্র যে জিনিসটা দাঁড়ায় তা হল স্বামী-স্ত্রী সহবাস পদ্ধতি। এই পদ্ধতিকে বদল না করতে পারলে প্রগতি সম্ভব ছিল না। যেমন সম্পূর্ণ বাধা হয়েছিল শ্রেণীগুলো। কামিলারোইদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর দাবি বা অধিকার এই শ্রেণীগুলোর মতোই একটা অহেতুক ভার হয়ে ছিল। এর বদল না হলে তারা আরো হাজার বছর এই একই অবস্থায় থাকত।

হাওয়াইদের পুনালুয়া পদ্ধতি অনেকটা এই ধরনের। আদিম অবস্থার প্রাথমিক ও মধ্য পর্যায়ে সব জায়গাতেই এই ধরনের বিয়ের পুরো বা কিছু অদল-বদল ঘটে এবং দলের মধ্যে বিভিন্ন রীতি-প্রথার মধ্যে তা ছিল সীমাবদ্ধ। ছোট বড় সব দল এই রীতি-প্রথা মেনে চলত। আদিম অবস্থার নীতি ও প্রথা মেনে যদি স্বামী ও স্ত্রীরা সম্প্রদায়গত হয়ে বাস করে তা হলে আমরা ধরে নিতে পারি তখন সমাজের অবস্থা ছিল আদিম অবস্থায় এবং আমাদের আদি পূর্বপুরুষরা সেই একই অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে গেছে।

এই ধরনের প্রথা আর রীতিনীতির মাঝ দিয়ে আদিম যুগের রূঢ় অবস্থার একটা পরিচয় আমরা পাই। মানুষের এই অবস্থা যদি পৃথিবীর আনাচেকানাচে বিচ্ছিন্ন হয়ে না থাকত মানুষের অতীত সম্বন্ধে একটা নিশ্চিত ধারণা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। এখানে একটা অনুমানের কথা আপনা থেকেই উঠে পড়ে যে মানুষ সব সময় একটা প্রতিষ্ঠানগত প্রগতির মাঝ দিয়ে ক্রমশ অগ্রসর হয়েছে। ফলে, মানুষের অজ্ঞাতেই একটা সংস্কারের কাজ হয়ে যাচ্ছে। এই আলোকেই মানবসমাজের পাঠ করতে হবে। অষ্ট্রেলিয়ানরা যে অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়েছে তখন তাদের অবস্থা দেখে মনে করা ঠিক হবে না যে তারা একেবারে নিম্ন অবস্থায় ছিল। এ কথা মনে করাও ঠিক হবে না যে তারা ওপরে ওঠার পর ক্রমশ অধঃপাতে গেছে, কারণ এ ধরনের ধারণার পেছনে মানুষের অভিজ্ঞতার সায় মেলে না। বহু গোষ্ঠী বা জাতির শারীরিক ও মানসিক অধঃপাতের বহু নজির দেখা গেছে এবং তাদের কারণও জানা যায়; কিন্তু তাদের উদাহরণ দিয়ে মানবজাতির সাধারণ প্রগতি ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। মানুষের অভিজ্ঞতা ও সমস্ত তথ্য এ কথাই প্রমাণ করে যে মানুষ ক্রমশ নিম্ন অবস্থা থেকে ধীর গতিতে প্রগতির পথে এগোচ্ছে। আদিম মানুষেরা যেসব হাতিয়ার, তৈজসপত্র দিয়ে। জীবন কাটিয়েছে যতদিন না আরো উন্নত হাতিয়ার লাভ করেছে তা একেবারে নষ্ট করে নি। এই সমস্ত হাতিয়ার ও সামাজিক সংগঠনের সাহায্যে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভ করে তারা ক্রমশ উন্নতি করেছে। যদিও একেকটা উন্নতির মাঝে হাজার হাজার বছর কেটে গেছে। অবশ্য বহু গোষ্ঠী ও জাতি তাদের জাতিতাত্ত্বিক জীবন নষ্ট হওয়ায় ধরাপৃষ্ঠ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

লেখকের জানা মতে অস্ট্রেলিয়ান শ্রেণীগুলোই মানবজাতির একমাত্র অংশ যাদের। সংগঠনে পরিবর্তনের সূত্রপাত দেখতে পেয়েছেন, যেখানে গণ সংগঠনের মাত্র আভাস দেখা গেছে। প্রাচীন লিঙ্গভিত্তিক সংগঠনও মাত্র তাদের মাঝেই দেখা গেছে। অতি আদিম অবস্থার সমাজের চেয়ে ওপরে উঠেছে এই সমাজ। অন্যান্য গোষ্ঠীতে গণ সংগঠন বেশ অগ্রসর হয়ে গেছে, যেখানে স্বামী-স্ত্রী দলগত পদ্ধতিকে কিছুটা কাটছাট করেছে। এইভাবে পরিবার পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়ে এগোতে থাকে। সমাজ সংগঠনের অন্তর্দেশে সময়ে সংস্কার বা পরিবর্তন প্রয়োজন হতে থাকে।

অষ্ট্রেলিয়ানরা আবিষ্কৃত হবার আগে হাজার হাজার বছর ধরে হয়তো শ্রেণী সংগঠনকে কোনোরকম প্রভাবিত করে নি। এদিকে মহাদেশীয় গোষ্ঠীরা বহু পূর্বেই গণ সংগঠনকে সম্পূর্ণ করে নিয়েছে। সভ্যতায় এসে তারা এসব ঝেড়ে ফেলে। লিঙ্গ ও জ্ঞাতিভিত্তিক সামাজিক সংগঠন জাতিতাত্ত্বিক পাঠে সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান। অতীত সমাজের ইতিহাস যদি আমাদের পুনরুদ্ধার করতে হয় এই তথ্য আমাদের কী ইশারা করছে তা-ও জানা প্রয়োজন।

পলিনেশীয় গোষ্ঠীসমূহে গণ পদ্ধতি অজ্ঞাত ছিল। কিন্তু অস্ট্রেলীয় শ্রেণী সংগঠনের প্রায় সমান্তরাল হল হাওয়াইদের পুনালুয়া প্রথা। পূর্বের পদ্ধতির ধারণা ও অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে কোনো মৌলিক ধারণার জন্ম হতে পারে, কিন্তু তেমন ব্যাপার সংখ্যায় খুবই নগণ্য। যে সমস্ত ধারণা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে গড়ে উঠেছে তার দু-একটাই মাত্র আকস্মিক। উন্নয়ন হল মানব প্রগতির একটি প্রক্রিয়া।

এই আলোকে দেখলে দেখা যাবে সভ্যতার বহু অংশ এখনো আদিমতাযুক্ত, যেমন, মরমোনবাদ (আমেরিকার উটাহ নামে ধর্মীয় শাখা, যারা খোলাখুলিভাবেই বহু বিবাহ করে), অতীত যুগের আদিম ও বর্বর মস্তিষ্ক উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের মধ্যে বর্তেছে। আমাদের মস্তিষ্ক সেই মৌলিক সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আজ যথেষ্ট আকার বাড়িয়েছে। বর্বর যুগের এইসব গুণাবলি পূর্বপুরুষের চরিত্র হিসেবে আমাদের মধ্যে দেখা যায়।

অল্প কয়েকটা ধ্যান-ধারণা ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে মানুষ যাত্রা শুরু করে এবং তাকে কেন্দ্র করেই মানুষ ক্রমশ ওপরে উঠেছে। তাদের যাত্রা শুরু হয় আদিম যুগে, তারপর বর্বর যুগে তা বিশিষ্টভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে, ক্রমশ তাই বাড়তে বাড়তে সভ্য যুগে আরো ডালপালা মেলে। চিন্তা বা ধ্যান-ধারণার এই বীজ বিবর্তিত হয়ে স্বাভাবিকভাবে মস্তিষ্কের একটা অবশ্যম্ভাবী অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এই ব্যাপারটা এমনভাবে সংঘটিত হয়েছে যে, এর ফলাফল বেশ সমতা রক্ষা করে চলেছে এবং তার স্রোত খুঁজে বের করাও খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। এই সমস্ত ফলাফল মানব প্রজাতির উৎসের এক সূত্র একসময় পরিস্ফুট করে তুলবে। মানবজাতির মানসের ইতিহাস, যা তার প্রতিষ্ঠান রীতিনীতি, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তা দেখেই ধরে নিতে হয় যে এসব একই প্রজাতির ইতিহাস, যা ব্যক্তির মাধ্যমে চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছে এবং ব্যক্তির অভিজ্ঞতার জোরে যার ক্রমোন্নতি ঘটেছে। যেসব মৌলিক চিন্তাধারার বীজ মানব মনে পালিত হয়ে মানুষকে ক্রমশ তার গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে তা হল সরকার, পরিবার, ভাষা, ধর্ম ও সম্পত্তি। এসব আদিম যুগেই জন্ম নিয়েছে এবং তার স্বাভাবিক উন্নয়ন সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু তা এখনো পুরোপুরি শেষ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে নি, কারণ এইসব ধারণা এখনো এগিয়ে চলছে এবং চিরকাল প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে।

——
১। রোমানরা ‘কনিউবিয়াম’ অর্থাৎ বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের সাথে ‘কনজুগিয়াম’-এর পার্থক্য করেছিল, শেষোক্তটির অর্থ শুধুই দৈহিক মিলন।

২। অস্ট্রেলীয় পদ্ধতির খুঁটিনাটি জানতে পেরেছিলাম ইংরেজ মিশনারি রেভারেণ্ড লারিমার ফিসন-এর কাছ থেকে, তিনি আবার এর বেশ কিছুটা জানতে পারেন বেভারে ডব্লিউ, রিলে ও টি. ই. লান্স-এর কাছ থেকে, যারা অনেক দিন ধরে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে ছিলেন এবং এদের পর্যবেক্ষণ করার প্রচুর সুযোগ পেয়েছিলেন। ফিসন এই পদ্ধতি সম্বন্ধে লেখককে একটা বিশ্লেষণসহ যে লেখাটি পাঠান তা ছাপা হয় “আমেরিকান শিল্প ও বিজ্ঞান একাডেমির কার্যবিবরণী ১৮৭২”-এ সপ্তম ও দ্রষ্টব্য, পৃঃ ৪১২। ম্যাকলিন্যান তার “আদিম বিবাহ” (পৃঃ ১১৮) রচনায় কামিলারোই শ্রেণীসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। টাইলর-এর “মানবজাতির প্রাচীন ইতিহাস” পৃঃ ২৮৮ দ্রষ্টব্য।

৩। “জ্ঞাতি পদ্ধতিসমূহ এবং মানব পরিবারের বিবাহজনিত কুটুম্বিতা জ্ঞানের ক্ষেত্রে স্মিথসোনিয়ান অবদান।” ১৭শ খণ্ড, পৃঃ ৪২০।

৪। উদাহরণস্বরূপ যদি ইপ্পাই ও কাপোটার বংশধারার চতুর্থ প্রজন পর্যন্ত তুলে ধরা হয় এবং যদি ধরে নেওয়া হয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে হয়েছে তা হলে ফল দাঁড়াবে নিম্নরূপ : ইপ্পাই ও কাপোটার ছেলেমেয়েরা মাররি ও মাটা। ভাই-বোন হিসেবে তারা বিয়ে করতে পারবে না। দ্বিতীয় পর্যায়ে মাররির ছেলেমেয়েরা যারা বুটার সাথে বিবাহবন্ধ হয় তারা হল ইপ্পাই ও ইন্নাটা–এদিকে মাটারা কুম্বের সাথে বিবাহিত হয় এবং তাদের ছেলেমেয়েরা কৃবি ও কাপোটা। এদের মধ্যে ইপ্পাই বিয়ে করছে তার জ্ঞাতিবোন কাপোটাকে এবং কুববি বিয়ে করছে জ্ঞাতিবোন ইপ্পাটাকে। কুম্বো ও বুটাকে বাদ দিয়েই দেখা যাবে যে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মেই দুটি থেকে আটটি শ্রেণী তৈরি হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী বা তৃতীয় পর্যায়ে দেখা যাবে দুটো মাররি, দুটো মাটা, দুটো কুম্বো এবং দুটো বুটা। এদের মধ্যে মাররি তাদের দ্বিতীয় জ্ঞাতিবোন বুটাকে বিয়ে করছে এবং কুববিরা তাদের দ্বিতীয় জ্ঞাতিবোন মাটাকে বিয়ে করছে। চতুর্থ প্রজন্মে ইপ্পাই কাপোটা কুববি এবং ইন্নাটা এরা তৃতীয়। জাতিসমূহ। এদের মধ্যে ইপ্পাই বিয়ে করছে কাপোটাকে এবং কুববিরা ইন্নাটাকে। এইভাবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলতে থাকে। যেসব শ্রেণীর মধ্যে বিয়ে হয় তাদের বিয়ের ফল এমনি- ধারা তালিকার জন্ম দেবে। এই বিস্তৃতি বিরক্তিকর, কিন্তু এ থেকে একটা জিনিস জানা যায় যে আদিম সমাজের এই অবস্থায় তারা শুধু সব সময় আন্তর্বিবাহই করছে না বরং লিঙ্গভিত্তিক সংগঠনের দরুন এরকম করতে বাধ্য হত। সব সময় এই নিয়ম ধরেই দাম্পত্য বন্ধন ঘটত না, কারণ সমগ্র স্ত্রী ও পুরুষ শ্রেণী দলগত বিবাহে আবদ্ধ হত। এই পদ্ধতির আওতায় নিশ্চয় এরকম সব সময় ঘটত। গণের অন্যতম প্রাথমিক নিয়ম তাই ব্যর্থ হয়, কারণ একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত জনদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ, বিয়ে করতে হয় ভিন্ন গণে।

৫। “আমেরিকান শিল্প ও বিজ্ঞান একাডেমির কার্যবিবরণী”, অষ্টম ৰণ্ড, পৃঃ ৪৩৬।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *