সে-রাত্রে নয়, সে-রাত্রে কমলাক্ষ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন বাবুকে দেখলেন। ব্রজেনবাবু।
রোগা পাকসিটে চেহারা, মুখচোরা মুখচোরা স্বভাব, দেখলে মনে হয় একটু পানদোষের ব্যাপার আছে বোধ হয়। অন্তত ওই রাত করে ফেরা আর চেহারার ধরনটা একত্র করে তেমনই একটা ধারণা জন্মেছিল কমলাক্ষর। কিন্তু ধারণা-টারনা কদিনের জন্যেই বা? সেদিনও কি কমলাক্ষ স্বপ্নেও কল্পনা করেছিলেন সাতদিনের মাথায় ব্ৰজেনবাবুকে নিয়ে শ্মশানে আসতে হবে তাকে?
সেদিন বলেছিলেন, মানে কথা বলতে হয় তাই বলেছিলেন, বাড়িটা কিনেছিলেন, না করিয়েছেন?
ব্ৰজেনবাবু নিজের হাতের আঙুলগুলোর দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আস্তে উত্তর দিয়েছিলেন, ইয়ে, এই সামনের পোরশানটুকু কিনেছিলাম, তারপর আপনার গিয়ে আস্তে আস্তে পিছন দিকটা—মানে এখানেই যখন সেট করা হল, করতে হবে তো একটা কিছু!
একটা কিছু করতে হবে বলে হোটেল খুলতে হবে? আর কিছু করবার ছিল না? এ-প্রশ্ন তোলেননি কমলাক্ষ। ভদ্রমহিলাটিকে দেখে যেমন মনে হয়েছিল, মানে যেরকম উচ্চশ্রেণীর মনে হয়েছিল, ব্ৰজেনবাবুকে দেখে ঠিক তা মনে হল না।
যাক ও নিয়ে কে মাথা ঘামায়? কেনই বা মাথা ঘামাবেন?
এটা ওটা কথার শেষে বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ঠিক করেছেন সকাল বিকাল বেড়াবেন, আর দুপুর সন্ধ্যা বই পড়বেন। বেশ নিরিবিলি বাড়ি, আশেপাশে অন্য বোর্ডারদের ঝামেলা জোটেনি। বেশ লাগছে, বড়ো ভালো লাগছে।
খানিক পথ এগোতেই দাঁড়াতে হল। এক ভদ্রলোক পথরোধ করেছেন।
কী মশাই, আপনাকে যে একেবারে আনকোরা নতুন দেখাচ্ছে? কবে এসেছেন? নিশ্চয় বেশিদিন নয়। নইলে আমার চোখ এড়িয়ে
কমলাক্ষ সবিস্ময়ে এই আলাপী ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন। ভদ্রলোকের স্বভাবটি গায়ে-পড়া, সাজটি অদ্ভুত। সিল্কের লুঙ্গির ওপর একটা সুতির গলাবন্ধ কোট একটা চাপানো, পায়ে চপ্পল, মাথায় সোলা হ্যাট। এই সক্কালবেলাই ওনার মাথায় রোদ লাগছে নাকি?
কমলাক্ষ সবিনয়ে বললেন, এই কাল এসেছি।
কাল? কটার গাড়িতে?
বিকেলের।
বিকেলের! তা উঠেছেন কোথায়? মানে কার বাড়ির অতিথি? আমি তো মশাই এখানের পিঁপড়েটিকে পর্যন্ত চিনি—
কমলাক্ষ হেসে বললেন, হিসেব মতো আমি এখানের সকলেরই অতিথি। কারণ এখানে যখন বহিরাগত। তবে ঠিক অতিথি হিসেবে কারও বাড়ি উঠিনি।
ওঃ, বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন? উইথ ফ্যামিলি তাহলে? তা তারা সঙ্গে নেই যে? নেবেন, সঙ্গে নেবেন, বেড়াবার জন্যেই তো আসা। তা কার বাড়ি ভাড়া নিলেন? মানে কোন বাড়িটা? বাড়ির নাম বললেই বুঝব। আমার তো এখানের সবই নখদর্পণে।
কমলাক্ষ হেসে ফেলে বলেন, আপনার প্রশ্নগুলির একে একে উত্তর দিতে হলে বলতে হয়, বাড়ি ভাড়া নিইনি, উইথ ফ্যামিলি নয়, কাজেই তাদের সঙ্গে নেবার প্রশ্ন নেই। যে-বাড়িতে উঠেছি, তার নাম হচ্ছে প্রবাস আবাস–
প্রবাস আবাস! অ!
ভদ্রলোক নাক কেঁচকালেন। তা কলকাতা থেকেই ব্যবস্থা করে এসেছিলেন বুঝি?
কলকাতা থেকে কোনো ব্যবস্থা করে এসেছিলেন সেকথা আর বিশদ বলতে বাসনা হল না। কমলাক্ষর। বোকামির কথা—কেই বা ফাস করতে চায়? তাছাড়া কমলাক্ষ তো কথা কমই বলেন। বেশি কথা বলা তো স্বভাবই নয়। শুধু হঠাৎ এই অতিভাষী ভদ্রলোকের আকস্মিক আক্রমণে, আর বোধ করি পরিচিতি পরিবেশের অভ্যস্ত জীবনধারার বাইরে বলেই এতগুলো কথা একসঙ্গে বললেন।
এবারও বললেন, ব্যবস্থার মতো ব্যবস্থা ঠিক করে আসিনি, তা এসে জুটেই গেল ঈশ্বর কৃপায়। রিকশাওলাই সন্ধান দিয়ে নিয়ে এল–
তা বেশ! ভালোই। পেটের মধ্যে বেশ কিছু কথা চেপে রেখে, এবং সেটা যে চেপে রেখেছেন, তা না চেপে, ভদ্রলোক কথা শেষ করেন। দুদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছেন বেড়িয়ে যাবেন, এর আর কি। আজকাল তো হাড়ি ডোমও জল-চল হয়েছে। তা যাক, চলি। মশায়ের নামটি কি জানলাম না তো?
কমলাক্ষ বিরক্ত হচ্ছিলেন। কমলাক্ষ লোকটাকে অশ্রদ্ধা করছিলেন, তবু ভদ্রতার দায়েই উত্তরটা দিতে হয়, কমলাক্ষ মুখোপাধ্যায়।
মুখুজ্জে! ওঃ! একেবারে সাপের মাথার মণি! যাক প্রবাস হোটেলে উঠবেন একবার এই গগন গাঙুনী সঙ্গে যদি পরামর্শটা করতেন! আমি মশাই কখনও কারুর হিত বই অহিত চাই না। ওই যে আপনার ব্রজেন ঘোষ। যখন প্রথম এসেছিল এখানে—অভয় দিয়ে আশ্রয় দিয়ে কে এখানে শেকড় গাড়িয়েছিল ওকে? আর কেউ নয়—এই গগন গাঙুলী!
কমলাক্ষর মনে হল, যেন কোনো নাটকের একটি টাইপ চরিত্র এসে সামনে দাঁড়িয়েছে তার। বাচনভঙ্গি থেকে অঙ্গভঙ্গি পর্যন্ত যেন অতি পরিচিত। এক-মিনিট দাঁড়াতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তবু দাঁড়াতে হয়েছিল। কারণ গগন গাঙুলী ছাড়ছিলেন না।
আমিই পরামর্শ দিয়েছিলাম। ওই হোটেল খোলবার পরামর্শটি আমিই দিয়েছিলাম। বলি, লেখাপড়া যখন বেশিদূর নয়, আর কলকেতায় কোনো কাজকর্ম জোগাড় করতে পারনি, তখন এখানেই সেট করে ফেল। এটা ভালো ব্যবসা, স্বাধীন ব্যবসা, তা ছাড়া এই গেরস্ত পরিচালিত হোটেলের চাহিদাও বেশি। এই অঞ্চলে নেই তো বিশেষ। অথচ স্বাস্থ্যকর জায়গা, লোকে বেড়াতে আসে। লাগিয়ে দাও, পেছনে আমি আছি।…সত্যি বলব মশাই, আমার নিজেরই ঝোঁক ছিল।…নেহাত স্ত্রীর আপত্তি। বলেছিঃ, শেষে লোকে আমাকে বলবে হোটেলওলি! তা স্ত্রীই যদি খাপ্পা হন মশাই, পয়সা নিয়ে কি ধুয়ে জল খাব? বলুন? তাই ওই ব্ৰজেন ঘোষকেই সাহায্য করে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিলাম। তারপর মশাই—যাক! সে কথা যাক। কী করা হয় মশাইয়ের?
কমলাক্ষ মনে মনে ভাবেন, ওরে বুড়ো, তুমি ভাবছ ওই আধখানা কথা শুনিয়ে শুনিয়ে তুমি আমার কৌতূহল জাগ্রত করবে, আমিও তেমনি। কথাটি কইব না ও-সম্বন্ধে। তাই শুধু বলেন, এই ছেলেটেলে পড়াই।
পড়ান? ছেলেমেয়েদের—মানে টিউশানি? নাকি কোনো ইস্কুলে?
আজ্ঞে স্কুল ঠিক নয়। ইয়ে একটা কলেজে–
ওঃ তাই বলুন? প্রফেসর! তা বলতে হয় এতক্ষণ? আচ্ছা যান—বেড়াতে বেরিয়েছেন, আর জ্বালাতন করব না! দেখা হবেই অবিশ্যি আবার। এই পথেই তো পায়ের ধুলো দিতে হবে। একঘেয়ে মুখ দেখতে দেখতে অরুচি এসে গেছে মশাই! একটু নতুন মুখ দেখতে পেলে বর্তে যাই।
ভদ্রলোকের ব্যাকুলতাটা অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন কমলাক্ষ। বুঝেছিলেন, এরকম একটি মফঃস্বল টাউনে দীর্ঘকাল কাটাতে হলে একঘেয়ে মুখ দেখতে দেখতে এই রকমই অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়।
বুঝেছিলেন। কিন্তু গগন গাঙুলীকে নতুন মুখ দেখাবার পুণ্য অর্জন করা আর হয়ে ওঠেনি কমলাক্ষর। পরদিন অন্য পথ ধরে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। তার পরদিনও। পর পর চারটে দিনই অন্ধকার থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়েছিলেন ওই সব নাম-না-জানা পাহাড়ের ঢিবির দিকে।
হ্যাঁ চারদিন। তারপর তো দুটো দিন বাড়িতেই বন্দী।
কিন্তু কমলাক্ষ কেন বন্দী হলেন?
জ্বলন্ত চিতার আওতা থেকে একটু সরে গিয়ে বসে সেই কথাই ভাবছিলেন কমলাক্ষ। কমলাক্ষ এক নাম-না-জানা জায়গার শ্মশানে এসে, অজানা ব্ৰজেন ঘোষের শবদেহ দাহ করছেন। এই চাইতে আশ্চর্য ঘটনা কমলাক্ষর জীবনে আর কবে ঘটেছে? শ্মশানে যাওয়া সম্পর্কে আবাল্য একটা ভীতি আছে কমলাক্ষর। নিতান্ত নিরুপায় অবস্থা না হলে, ওই মৃতের বাড়ি থেকেই বিদায় কর্তব্য সারেন। আর সঙ্গে যেতে হলেও এই বীভৎস কাণ্ডটাকে চোখের সামনে দেখার যন্ত্রণাটা এড়াতে পারলে ছাড়েন না।
মাঝে মাঝে ভেবেছেন, ঈশ্বর রক্ষা করেছিলেন তাই নীরজা মারা যাবার সময় কমলাক্ষ বিলেতে ছিলেন। ফিরে এসে নীরজাকে আর দেখতে পেলেন না, এ বেদনা বড়ো বেশি বেজেছিল বটে, তবু নীরজাকে যে হাতে করে পোড়াতে হল না তাকে, এটার জন্যে যেন ঈশ্বরের কাছে একটা কৃতজ্ঞতা অনুভব করেছিলেন। উপস্থিত থাকলে পোড়াতে তো কমলাক্ষকেই হত! তখন তো পুণ্ডরীকের মায়ের মুখে আগুন দেবার বয়েস আসেনি।
আজ কমলাক্ষ ব্ৰজেন ঘোষের শব বয়ে নিয়ে শ্মশানে এসেছেন। যে-ব্ৰজেন ঘোষকে মাত্র সাতদিন আগে চোখেও দেখেননি। অথচ এ ছাড়া উপায়ও ছিল না।
কতরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিতেই পড়তে হয় মানুষকে!
করুণাপদ কাছে এসে বলল, মুখজ্জে বাবু, লোকগুলো তাড়ি খাবার পয়সা চাইছে।
তাড়ির পয়সা! এই দিন-দুপুরে তাড়ি খাবে ওরা! ভাবলেন কমলাক্ষ। কিন্তু কিছু বললেন না। পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা উঠল এগিয়ে ধরলেন করুণাপদর দিকে। করুণাপদ সরে গেল।
কমলাক্ষ ভাবলেন, শুধু কি ধোঁয়ার জন্যেই চোখ দিয়ে জল পড়ছে করুণাপদের? ব্রজেন ঘোষের মড়া বার করবার সময় ওর মাথা খোঁড়াখুঁড়ি কি সাজানো? করুণাপদ তো ওদের চাকর মাত্র। সামান্য একটা চাকরের মধ্যে এত ভালোবাসা থাকে?
কমলাক্ষও তো সারা জীবন চাকর রাখলেন, কত আসে কত যায়, কই তার মধ্যে এমন একটা মুখও তো মনে পড়ছে না—যে-মুখটা মনে রয়ে গেছে। চাকরবাকর সম্বন্ধে কমপ্লেন শোনা ছাড়া চাকর সম্পর্কিত আর কিছু মনে করতে পারলেন না কমলাক্ষ। এমনকি এখনই কলকাতায় তার বাড়িতে যে-লোকটা রয়েছে—তার নামই অনেক ভেবে মনে আনতে হল। কী যেন? ভবেশ? হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। যে-লোকটা খুব সম্ভব বছর তিনেক আছে, আর এই তিন বছরের মধ্যে তিনটে দিনও কমলাক্ষর জুতো জোড়াটা ঝেড়েছে আর মশারিটা টাঙিয়ে দিয়েছে কিনা সন্দেহ। ঘরের খাবার জলের কুঁজোটা না ভরে ভরে মাকড়শার জালে ঢাকা পড়ে গেছে। কমলাক্ষ রাতে শোবার আগে নিজেই কাঁচের গ্লাসে করে এক গ্লাস জল রাখেন। জুতোটা রুমাল দিয়ে ঝেড়ে নেন।
কমলাক্ষ ভাবলেন, আমি যদি হঠাৎ মারা যাই, ভবেশের চোখ দিয়ে জল পড়বে? তারপর ভাবলেন, খুব সম্ভব দোষ আমার নিজেরই। আমি কারোকে লক্ষ্য করি না, আমি কারও কাছে সেবা যত্ন প্রত্যাশা করি না, আর বোধ করি আমি কাউকে ভালোবাসতেও পারিনি। জানি না ভালোবাসতে।
গণ্ডমূর্খ ব্রজেন ঘোষ হয়তো ভালোবাসতে জানত। নইলে–
করুণাপদ কুণ্ঠিত পদে আবার এল, আর টাকা সঙ্গে আছে বাবু? একজনের ভাগে কিছু কম পড়ছে।
কমলাক্ষ আর একবার পকেটে হাত ঢোকালেন। কত কম পড়ছে?
আজ্ঞে তেরো আনা।
একটা টাকা এগিয়ে ধরলেন কমলাক্ষ। ভাবলেন, এই স্বভাব মানুষের। অপ্রতিবাদে পেলেই তার ভিতরের লোভের মন জেগে ওঠে। মোটা টাকা কবলেই ধরে এনেছিলেন ওদের। স্টেশনের ওদের। স্টেশনের ধারে ওই পানের দোকানটা থেকে। এটা ফাউ।
যাক। কাজটা হয়ে যাচ্ছে এই ঢের।
হয়ে যাচ্ছে। তা সত্যি। কিন্তু এর পরটা কি হবে? ভাবলেন কমলাক্ষ।
এক মাসের ছুটি নিয়ে চেঞ্জে এসেছিলেন না তিনি? তার সাতটা দিন কেটেছে। বাকি দিনগুলো নিয়ে এবার কি করবেন? কলকাতায় ফিরে যাবেন? গগন গাঙুলীর পরামর্শ নিতে যাবেন? না কি এক মাসের চার্জ অগ্রিম দিয়ে দিয়েছি এই অজুহাত দেখিয়ে প্রবাস আবাসের পিছনের দিকের ওই
পুব-দক্ষিণ খোলা ঘরখানা আঁকড়ে বসে থাকবেন?
রাত্রি হলেই যে-ঘরের জানলা দিয়ে মখমলের মতো মসৃণ মোলায়েম গাঢ় অন্ধকার দেখতে পাওয়া যায়, আর শেষ রাত্রি থেকে সে-অন্ধকার কাটবার যত কিছু আয়োজন সমস্তই দেখতে পাওয়া যায়, পর পর একটির পর একটি বইয়ের পাতা খোলার মতো। সূর্য ওঠার আগে যে এতরকম রঙের খেলা চলে, এটি কমলাক্ষ কোনোদিন দেখেননি?
হয়তো দেখেছেন। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই দেখেছেন। কিন্তু দেখার চোখ কি সব সময় খোলা থাকে?
***
বেলা পড়ে গিয়েছিল।
এখন আর আকাশে সূর্য ওঠার খেলা নয়, সূর্য ডোবার। সেটা দেখা যায় না এ-ঘর থেকে। একগ্লাস চিনির শরবত খেয়ে ঘরটান এসে বসলেন কমলাক্ষ।
গত দুদিন থেকে এ-ঘরে আর আসেননি মনে পড়ল। সেই পরশু দুপুরের সময় ব্রজেনের বাড়াবাড়ির সূচনা দেখা দিয়েছিল যখন-তখন থেকে।
করুণাপদর ডাকে ওদের ঘরে গিয়ে অবস্থা দেখে লজ্জায় মারা গিয়েছিলেন কমলাক্ষ। আগের রাত্তির থেকে নাকি ওইরকম ছটফট করছে ব্রজেন। বলছে, পেট বুক সব জ্বলে গেল।
বিষের জ্বালা? কিন্তু ব্ৰজেন ঘোষ কেন বিষ খাবে?
না না, ফুড পয়জনই হয়েছিল ব্রজেনের। ডাক্তারও তো তাই বলল। তা ফুড পয়জনের ওষুধই কি পড়েছিল ব্ৰজেন ঘোষের পাকস্থলীতে? ডাক্তারকে অনুরোধ উপরোধ করে ডেকে আনতে, আর স্টেশনের ধার থেকে ওষুধ আনতে, নাড়ি ছেড়ে গিয়েছিল।
ছেড়ে যাওয়া নাড়ি আর কোন ওষুধের জোর চাঙ্গা হয়ে উঠবে?
কমলাক্ষ তাকিয়ে দেখলেন চিনির শরবতের তলানিটায় একটা মাছি পড়ল। নীল রঙা বড়ো মাপের মাছি। ব্রজেন ঘোষ বলেছিল সেদিন দুপুরে নাকি সে দোকানে বসে তরমুজের শরবত খেয়েছিল। ব্ৰজেন ঘোষের সেই শরবতে কি ওই রকম বড়ো মাপের একটা মাছি পড়েছিল?
চমকে দাঁড়িয়ে উঠতে হল কমলাক্ষকে।
মানে উঠলেন।
আর কেউ হলে হয়তো হোটেলওয়ালার বউকে সম্মান দেখাতে দাঁড়িয়ে উঠত না। মহিলাই ভাবত না তাকে। বলতে মেয়েমানুষ। কমলাক্ষ তা বলেননি। কিন্তু কমলাক্ষই কি ভেবেচিন্তে সম্মান দেখাতে দাঁড়িয়েছিলেন? তা নয়। দাঁড়িয়েছিলেন আকস্মিক চমকে উঠে। বিনা ভূমিকায় কথাটা বলে বসেছিল কিনা লীলা।
ওখানে তো শুনলাম পয়সা পয়সা করে আপনাকে খুব জ্বালাতন করেছে।
কমলাক্ষ বোধ করি এসময় ঠিক এ-ধরনের কথার জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। তাই থতমত খেয়ে বলেন, না না, জ্বালাতন কি? জ্বালাতন কিছু না। মানে জ্বালাতন তো ওরা করবেই।
তা বটে। লীলা তার স্বভাবগত ভঙ্গিতে সেই একটু হাসির মতো সুরে বলে, জ্বালাতন করাই তো ওদের পেশা। কিন্তু আপনার কাছে আমার পেশাটাও প্রায় তাই দাঁড়াচ্ছে। ঋণশোধ কথাটা উচ্চারণ করবার ধৃষ্টতা নেই। কিন্তু একটু ধৃষ্টতা তো করতেই হচ্ছে। আগে, পরে, মাঝখানে, অনেক খরচপত্রই তো হয়ে গেল আপনার—
টেবিলের ওপর একগোছা দশটাকার নোট নামিয়ে রাখল লীলা। আর রাখার পর ঈষৎ হেসে বলে, আমি কিন্তু হিসেব করে মিটিয়ে দিতে পারব না। কম হলে কমই হল।
কমলাক্ষ একবার মুখ তুলে তাকালেন। মুখ দেখা গেল না। ভাবলেন লীলা যেন বড়ো বেশি প্র্যাকটিক্যাল। আজই তাড়াতাড়ি টাকাকড়ি
যদিও আজ সকাল পর্যন্ত নামটা জানতেন না কমলাক্ষ, শুধু শবদাহের সার্টিফিকেটের সূত্রে জেনেছেন, তবু ইতিমধ্যে ওকে লীলা ভাবতেই অভ্যাস হয়ে গেছে। তারপর ভাবলেন, এটাই স্বাভাবিক, আমি আর কে ওর? নিতান্ত পর বই নয়। পাকে চক্রে ওর বিপদের সময় একটু উপকারে লেগে গেছি বলেই কিছু আর আপনার লোক হয়ে যাইনি। ঋণ রাখতে চাইবে কেন?
তবু বললেন, এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনি এখুনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
ব্যস্ত কিছু না। রয়েছে হাতে—
তা হোক। এখন থাক।
আশঙ্কা করছিলেন হয়তো অনেক অনুরোধ আসবে, এবং শেষ পর্যন্ত নিতেই হবে। কিন্তু তা হল না। লীলা আস্তে নোটগুলো তুলে নিয়ে বলল, তবে থাক।
রাগ করলেন নাকি?
রাগ? তা হবে। যদি সেটাই সম্ভব বলে মনে হয় আপনার।
না না, মানে–
থাক। বুঝতে পেরেছি। কিন্তু শুনুন, আজ আর আপনি বাড়িতে খেতে পাবেন না। করুণাপদ চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। অথচ পরশু থেকে বাজার দোকান–
কী আশ্চর্য! আপনি কি আমাকে একটা জানোয়ার ঠাওরেছেন? তাই আজ আমার খাবার ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছেন?
কাল রাত থেকে তো খাওয়া হয়নি—
কমলাক্ষ খপ্ করে বলে ওঠেন, সে তো আপনারও হয়নি।
আমার? তা হয়নি বটে। বলে টাকাটা আঁচলে বাঁধতে লাগল লীলা।
একটু বেশিক্ষণ কি সময় লাগল তার? গিটটা কি বার বার আলগা হয়ে যাচ্ছিল? তা বাঁধার পরও দাঁড়িয়েই থাকল কেন?
কমলাক্ষ একটু চুপ করে থেকে বলেন, আপনি তো একটু শরবতও খেতে পারতেন!
তা পারতাম।
কি আর বলব। কমলাক্ষ একটা নিশ্বাস ফেলেন, এমন অবস্থা আপনার, কেউ যে একটু জল এগিয়ে দেবে–
কথাটা শেষ করা নিরর্থক বলেই হয়তো করলেন না কমলাক্ষ। লীলাও এই অসম্পূর্ণ কথার কোনো উত্তর দিল না। আস্তে বলল, যাই।
ও চলে গেলে কমলাক্ষর মনে হল কথাবার্তায় তিনি বড়ো অপটু। এরকম সদ্য শোকাহত মানুষকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে কথা বলা বোধ হয় উচিত ছিল। কিন্তু কী-ই বা বলবেন? বাজার চলতি সেই হেঁদো কথাগুলো? কী আর করবে! এই তো জগৎ-ইত্যাদি! ছিঃ!
ভাবলেন ব্ৰজেন ঘোষের বউ যদি ব্রজেন ঘোষের মতোই হত, হয়তো চেষ্টা করে ওরকম দুএকটা কথা বলতে পারতেন। অন্তত চেষ্টাও করতেন। আর ওই টাকাটা রাখতে এলে বলতে পারতেন, সে কি! বিপদের সময় মানুষ মানুষের করবে না? ও-টাকা আপনি রাখুন, শোধ দিতে হবে না।
কিন্তু ব্ৰজেন ঘোষের স্ত্রী ব্রজেন ঘোষের মতো নয়। কোথায় যেন আকাশ পাতাল তফাত। আশ্চর্য রকমের অন্যরকম। তাই কমলাক্ষ নিতান্ত অপটুর মতো বসে রইলেন। এটুকুও বলতে পারলেন না, করুণাপদ না উঠুক, আমিই যাচ্ছি। বাজার থেকে একটু মিষ্টি এনে দিচ্ছি, জল খান আপনি। বাঁচতে তো হবে।
অথচ ঠিক ওই কথাগুলোই বলতে ইচ্ছে করছিল। ওই রকমই কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছিল। কোনো মেয়ের খাওয়া হয়েছে কি হয়নি এ-খোঁজ কমলাক্ষ জীবনে কখনও করেছেন?
.
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাঠের দিকের সেই জানলাগুলো খুলে দিলেন কমলাক্ষ। খুব খানিকটা বাতাস এসে পড়ল একসঙ্গে। কমলাক্ষ দাঁড়িয়ে থাকলেন জানলার কাছে।
আর একবার ভাবলেন, কি উচিত তার এখন? থাকবেন, না চলে যাবেন? হোটেলের মালিক মারা যাবার পর, কেবলমাত্র অগ্রিম চার্জ দেওয়ার ছুতোয় মালিকের স্ত্রীর ওপর জুলুম চালিয়ে খাওয়াদাওয়া চালিয়ে যাওয়া সঙ্গত?
অথচ এটাও ভেবে পেলেন না, আত্মীয়স্বজন বলতে যার আর কেউ কোথাও নেই, পাড়ার লোকে যার মুখ দেখে না, তাকে একলা অসহায় এই মাঠের মাঝখানের একটা বাড়িতে ফেলে চলে যাওয়া যায় কি করে?
কমলাক্ষকে এ-দায়িত্ব কে দিল কে জানে! তবু কমলাক্ষ না ভেবে পারছেন না। ব্ৰজেন ঘোষের এই হোটেল এরপর আর কি চলবে? লীনা কি একা হোটেল চালাতে পারবে? কত রকমের লোক আসতে পারে, কত অসৎ লোক। আর চারিদিকেই তো শত্রু ওর।
নাঃ, অসম্ভব!
তা শুধু চারিদিকেই নয়, ওপর দিকেও শত্রু লীলার। নইলে করুণাপদ অমন ঘাড় ভেঙে জ্বরে পড়বে কেন?
দেখছি আপনাকেই আজ হাটে যেতে হবে–চায়ের পেয়ালাটি সামনে নামিয়ে রেখে কথাটি শেষ করল লীলা, করুণাপদ তো দিব্যি জ্বর বাধিয়ে বসল। অথচ আজ হাট
কমলাক্ষ চিরদিনই অন্যমনস্ক প্রকৃতির। কোনোদিনই সমাজব্যবস্থা আচার-নিয়ম সম্পর্কে মাথা ঘামাননি। তবু কমলাক্ষর চোখে পড়ল, মানে চোখে না পড়ে পারল না, নতুন বৈধব্যের বেশ ধারণ করেনি লীলা। আগেও যেমন ছিল তেমনিই রয়েছে দেখে বিস্ময় বোধ করলেন কমলাক্ষ। আবার কৃতজ্ঞও হলেন। সেই একটা কি যেন ভয়ঙ্কর ব্যাপার আছে! ভাবলেই হৃঙ্কম্প হয়।
আস্তে বললেন, হাটের দরকার বোধ হয় শুধু আমারই জন্যে? করুণাপদর তো জ্বর হয়েছে। আর আপনারও–
না, আমার আর জ্বর হল কই? আমি তো দিব্যি—ভালোই আছি! জানলার বাইরে তাকিয়ে বথ বলছে লীলা। কমলাক্ষর মনে হল, ও যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে।
একটু থেমে কুণ্ঠিতকণ্ঠে বললেন, না তা ভাবছি না। মানে আপনি তো আর ভাত-টাত—মানে ফল-টল ছাড়া আর কিছু তো–
লীলা হাসল। হাসির মতো নয়, সত্যিকার হাসি। হেসে বলল, আপনার মতো লোকের হেফাজতে যে-মেয়ে থাকতে পারে তার আর জীবনে কোনো দুঃখ থাকে না। আপনার স্ত্রীকে এত ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে যে
কমলাক্ষও হাসলেন। বললেন, যাই মনে হোক, এই মর্ত্যলোকের কোনো কিছুই আর তার কাছ পর্যন্ত পৌঁছবে না?
লীলার মুখের হাসিটা মিলাল! নেই বুঝি?
নাঃ, বহুকাল আগেই—
তাই হবে। সেটাই স্বাভাবিক। কমলাক্ষর মনে হয়, এখনও যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে লীলা, বাংলাদেশের মেয়ে তো! এত বেশি সৌভাগ্যের ভার কতদিন আর বইবে? তারপর সহসাই যেন সচকিত হয়ে বলে ওঠে, না, ফল-টল কিছু লাগবে না। আপনিও যা খাবেন, আমিও তাই খাব। অবাক হচ্ছেন? হওয়াই সম্ভব। কিন্তু কি জানি কেন হঠাৎ বড় ইচ্ছে হচ্ছে আপনাকে সত্যি কথাটা বলি–
সত্যি কথা! যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করেন কমলাক্ষ।
লীলা মুখ তুলে শান্ত গলায় বলে, হ্যাঁ, সত্যি কথা। যে-কথা আজ পর্যন্ত কাউকেই বলা হয়ে ওঠেনি। বলা যায়নি। সেই কথাটাই বলছি আপনাকে। উনি আমার স্বামী ছিলেন না।
.
মাথার ওপর হঠাৎ এসে লাগা একটা হাতুড়ির আঘাতের অনুভূতি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন কমলাক্ষ। সেই অসাড় অনুভূতি নিয়েই অনেকটা পথ চলেছিলেন। হঠাৎ আবার সেদিনের মতো পথরোধ হল।
আবার গগন গাঙুলী। চলেছেন হাটের পথে।
কী মশাই, রয়েছেন এখনও? তা হলে দেখছি—পাড়ার পাঁচজনের কথাই সত্যিই। আমি তো বিশ্বাস করতেই চাইছিলাম না। বলছিলাম, না না, ভদ্রলোকে আর একটি দিনের জন্যে দেখলাম না, নিশ্চয় চলে গেছেন। তা আছেন কোথায়?
কমলাক্ষর ইচ্ছে হল লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু এ-প্রনের সাধু ইচ্ছের পূরণ আর কবে কার হয়? তাই উত্তর দিতে হল। যেখানে ছিলাম, সেখানেই আছি।
অ! তা হলে ওদের সব কথাই বর্ণে বর্ণে সত্য। তা এত কাণ্ডের পরও ওখানেই রয়ে গেলেন তা হলে?
কমলাক্ষর ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল। রুক্ষ হয়ে উঠলেন তিনি।
কাণ্ড-টাণ্ডগুলোর খবর তা হলে পেয়েছেন আপনারা? আমি ভেবেছিলাম পাননি।
কেন, ছুটে গিয়ে ব্রজেন ঘোষের মড়ায় কঁধ দিইনি বলেই? দুদিন বেড়াতে এসেছেন, এখনও চোখে কলকাতার ঘোর লেগে রয়েছে, তাই মেজাজ এত শরী। বলি মশাই—যে লক্ষ্মীছাড়া লোক চাকর হয়ে মনিবের ঘরের মেয়েকে বার করে এনে স্বামী-স্ত্রী সেজে লোকের চোখে ধুলো দিয়ে, হাতে ভাত খাইয়ে জাত নষ্ট করে, আর মদের পয়সা জোটেনি বলে ইসপিরিট খেয়ে মরে কেলেঙ্কার করে, তার মড়ায় কে কাঁধ দেবে? দিইনি বলে মোটেই নিজেকে মস্ত একটা অপরাধী মনে করছি না।
কমলাক্ষ ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন। তাকিয়ে রইলেন গগন গাঙুলীর মুখের দিকে। কমলাক্ষর জন্যে আর কতগুলো হাতুড়ির ঘা আছে?
ওই হাঁ করা মুখের দিকে তাকিয়ে গগন গাঙুলী বড়ো আমোদ পাচ্ছেন। মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে।
রইলেন এতদিন, অথচ এলেন না তো মশাই একদিন! তা হলে ভেতরের সব ঘটনাটাই শোনাতে পারতাম।
শোনবার জন্যে খুব বেশি উদগ্রীব নই আমি। বলে জোর পায়ে এগিয়ে যান কমলাক্ষ, গগন গাঙ্গুলীকে প্রায় ঠেলেই।
অদ্ভুত লাগছে! ভারী অদ্ভুত লাগছে!
চারিদিক থেকে যেন জটিলতার জাল এসে ঘিরে ধরেছে। একটা সুটকেস ভর্তি বই এনেছিলেন কমলাক্ষ! শুধু পৃথিবীর একটুকু নিভৃত কোণ আর খানকতক বই এই সম্বল করে ছুটির একটা মাস কাটিয়ে দেবেন ঠিক করেছিলেন না?
সে দিন আর পাওয়া গেল না।
কিন্তু হিসেব করে দেখলে চার-পাঁচটা দিন তো একেবারে মনের মতো অবস্থাই পেয়েছিলেন কমলাক্ষ! কই, বইয়ের সুটকেস খুলেছিলেন কই! হাতও তো দেননি একখানা বইয়ে। কী করেছিলেন তবে সন্ধ্যা আর দুপুর?
কী করেছিলেন মনে করতে পারলেন না। মনে পড়ল ঘরের পিছনে মাঠের দিকে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন মাঝে মাঝে। হয়তো অনেকক্ষণ ধরে।
তবু কতক্ষণ? কি ভেবেছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?
কলকাতার কথা? কলেজের সমস্যা? খাতা দেখা ফাঁকি দেওয়া? কই? পলাশপুর আসার আগের কমলাক্ষকে কি মনে ছিল পলাশপুরে আসা কমলাক্ষর? এ তো বড়ো সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড! মাঝে মাঝে তো কত জায়গাতেই যান, কই এমন আত্মবিস্মৃত ভাব তো আসে না।
কমলাক্ষ কি পূর্বজন্ম মানবেন? মেনে ভাববেন পূর্বজন্মে তিনি এই পলাশপুরে ছিলেন? তাই জন্মান্তরের পথ বেয়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ভুলে যাওয়া স্মৃতির রেশ? সেই রেশ উন্মনা করছে কমলাক্ষকে, ব্যাকুল করছে?
হঠাৎ মনে হল শুধু পূর্বজন্মের স্মৃতিই নয়, পূর্বজন্মের শত্রুও কেউ ছিল। সে কমলাক্ষকে নিয়ে মজা দেখতে চায়। নইলে কত লোক এসেছে ব্ৰজেন ঘোষের প্রবাস আবাসে, ঠিক কমলাক্ষর উপস্থিতির অবসরেই মদের অভাবে স্পিরিট খেয়ে মরে কেলেঙ্কারি করবার বাসনা হল ব্রজেন ঘোষের?
তা গগন গাঙুলীর কথাই কি নির্ভেজাল? এই বিদঘুঁটে কথাটা সত্যি?
সত্যি নয়,—একথাও জোর করে ভাবতে পারলেন না কমলাক্ষ। এটা টের পেয়েছেন গগন গাঙুলী, এই পলাশপুরের গেজেটের খবর উনি যেমন সরবরাহ করেন, তেমনি খবর আসেও ওঁর কাছে। মনে পড়ল ব্রজেনের সেই ছটফটানি, বুক পেট জ্বলে গেল।
ডাক্তার বলল ফুড পয়জন। বলে দিল যা হয় একটা কিছু বুঝতে পারছি না বলতে হলে তো মান থাকে না। বিশেষ করে মফঃস্বলের হাতুড়েদের। আর সত্যি সে বেচারা ধারণাই বা করবে কি করে লোকটা স্পিরিট খেয়ে মরতে বসেছে।
আচ্ছা সত্যিই খেয়েছে? মদের পয়সার অভাব হল কেন? লীলার কাছে তো অনেকগুলো টাকা ছিল। লীলা দেয়নি? টাকা কার? লীলা মনিবের মেয়ে, ব্ৰজেন ঘোষ চাকর। চাকরের সঙ্গে চলে এসেছে লীলা? তাই তাদের আত্মীয় নেই বন্ধু নেই? তাই প্রতিবেশীরা তাদের দেখে না?
কিন্তু এতদিন ধরে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে চালিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ কমলাক্ষকে দেখেই বা সে-ধুলো উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করল কেন লীলার? ব্রজেন ঘোষ মারা গেল বলে?
রাস্তায় কেন বেরিয়েছিলেন মনে পড়ল না কমলাক্ষর। হঠাৎ যখন খেয়াল হল রোদটা বড়ো চড়া হয়ে উঠেছে, তখন ফিরতি মুখ ধরলেন। আর বাড়ির কাছাকাছি আসতে আসতে একটা আশ্চর্য সত্য আবিষ্কার করলেন।
এত কথা শোনার পর, আর সে-সব কথা প্রায় বিশ্বাস করে নেওয়ারও পরে লীলাকে লীলাই মনে হচ্ছে। ভয়ানক একটা ঘৃণ্য অপবিত্র কদর্য জীব বলে মনে হচ্ছে না।