২. সুখ দুঃখ চক্রবৎ

গণৎকার তখন কহিতেছিলেন,–সুখ দুঃখ চক্রবৎ…দুঃখ যাইবেই, আবার দুঃখ তোমার গৰ্ব্ব হইবে, তুমি অপেক্ষা কর, তোমার স্বামীর এত দুশ্চিন্তার কোন কারণ দেখি না, পুত্রের পুনরায় বিবাহ অহেতুক, তোমাদের সলিতা আসিতেছে, তোমাদের কখনই অন্ধকারে ভ্রমণ করিতে হইবে না, পুত্রবধূ বীজ ধরিয়াছে…তোমাদের ধর্ম্মকর্ম যথেষ্ট দানধ্যান আছে…!

সুঘরাই নভোস্থলের প্রতি মন রাখিতে বাধ্য হয় কেননা গণৎকার ছোট একটি ছড়ি দ্বারা উর্ধের ঐ লোক দর্শাইয়া গ্রহর গতিবিধি উল্লেখ করিতেছিলেন, অতএব সে ইহাতে সেই ছবির নীল রঙকে স্পন্দিত অনুভব করিয়া রোমাঞ্চিত।

সুঘরাই, কল্পনা করিল–এখন মনিব মহাশয় এই গণকারকে শুধাইলেন,–মহাশয়, আপনি যখন এক মহিলার সংশয় দূর করা নিবন্ধন, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান বলিতেছিলেন, ঠিক যখন পুলিশ কর্তৃক ধৃত সেই স্বর্ণকার ও সেই ধৰ্ম্ম-বৈপ্লবিক নেতাকে লইয়া যাওয়া হইতেছিল, তখনই আমি দূর হইতে দেখিলাম একটি বালক এখানে আপনার ক্রিয়াকলাপ দেখিতে উদগ্রীব, ক্ষণেকেই মহা হট্টগোল শ্রুত হয়, পথের সকলেই সেইদিকে মুখ ফিরায়, আমিও চাহিলাম, আমার আর ডাকা হইল না, পরক্ষণেই আমি আপনার সান্নিধ্যে ভীড় কাটাইয়া আসি, দেখি বালক নাই, একবার মনে হইল আমি কি ভুল দেখিলাম, না, তাহা নহে; তখনই ঐ ভীড়ের মধ্যে অনুসন্ধানক্রমে যাইলাম উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলাম! সেই দুইজন ব্যক্তির কদর্য্য কাণ্ডে আমি সম্বিৎশূন্য, অনতিবিলম্বে ঐ সুন্দরগুলির পাষণ্ড পরিণতিতে আমি হতস্নায়ু, মুচিস্থ ভক্তি-নিদর্শনগুলি আমারে আঁচড়াইতেছিল, কেন না সেখানে প্রাণিপাত যোগভ্রষ্ট হইয়াছে, চেতনা রেখা-ছাড়া হওয়ত পিণ্ড, সঙ্গে সঙ্গে মদীয় খোঁজার প্রেরণা যুক্তি, আরোহীপ্রথা দারুভূত, কেন না ঐ দৃশ্য সর্বৈব সংজ্ঞা-বিঘাতক!

আমি যেমন যে অন্যকিছু, আমার সুকৃতি সকল বিনষ্ট, অতঃপর স্খলিত পদে চলিতেছিলাম, অবলীলাক্রমে আপনকার নভঃমণ্ডলের চিত্র আমার চোখে পড়িল, আমার দিক-নিশ্চয় হইল; আমি সন্ধানে প্রবৃত্ত হই। ইতিমধ্যে বালক আসিল, আপনার বিবাহ শব্দ তাহাকে কিস্তৃত করে, তখনই আবার যেন সে সেই চীৎকার করিতে চাহে, কিন্তু আপনার সলিতা কথা তাহাকে বড় আতান্তরে ফেলে, সে নিজে সলিতা গড়ন জানে, অথচ ইহার মানে কি, অথচ বর্ষীয়সী মহিলা ইহাতে যারপরনাই খুসী; সে সুঘরাই আবার নীল ছবিখানির দিকে তাকায়…তাহার গতিবিধি কি আপনি…!

.

শিবগঙ্গার পশ্চিমে যেখানে আছার নাপিতগণের চোখ কভু ছোট কভু বড়, কেহ বা চুল ছাঁটে, কেহ খেউরী হয়, কেহ চক্ষু বুজাইয়া উৰ্দ্ধবাহু বগল কামায়, কেহ মস্তক মুণ্ডন করায়; মনিব মহাশয় স্বাভাবিক ধারণায় এই সুদীর্ঘপথব্যাপী কর্মতৎপরতা ঈষৎ কৌতূহলে নজর করিলেন, এখন নিকটস্থ এক ক্রন্দনের শব্দ বহুত কাঁচির আওয়াজ ভেদ করত আসে, দেখিলেন একটি বালক যাহার দন্তে কুটা যাহা পাছে পতিত হয় তাই তাহা এখন দন্তে চাপিয়া কাঁদে, নাপিত সান্ত্বনাবাক্য বলিতেছিল,–ছিঃছি কান্দিও না, তিনি শিবের কাছে গিয়াছেন, তাহা ব্যতীত এরূপভাবে কান্দিলে অঘটন হইবে!

সুঘরাই অবাক চোখে পিতৃহারা বালককে দেখিল। বালকও সুঘরাইকে দেখে!

এই নাপিতের কাজের শেষে মনিব মহাশয় প্রশ্ন করিলেন, হে নাপিত একটি বালক যে অনেকক্ষণ যাবৎ গুরুদশা প্রাপ্ত (পিতৃবিয়োগ) এখনই যে ছেলেটি চুল ফেলিতেছিল তাহার ক্রন্দনে স্বীয় নয়নের অশ্রু মোচন করত অভিনিবিষ্টচিত্তে তাহাকে দেখিতেছিল।

ও যে সেই সময়তে, ক্ষৌরকর্মের মারাত্মক করাল শব্দ শুনিতে থাকিয়া চালনা কৌশলও অনুধাবন করিতেছিল, যে এবং এই সকল সূত্রে আশ্চৰ্য্য এতাদৃশও ভাবে যে, হায় আমি কি পৰ্য্যন্ত বঞ্চিত! আমার কোনই খেই নাই, এমন কোন আমার উর্দ্ধতন কেহ নাই, যাহার নিমিত্ত আমার মস্তক মুণ্ডনের সুযোগ আসিবে! হায় আমি ঝড়ের মুখে এঁটো-পাতারও অধম! হে নাপিত, ইহা লোকপ্রসিদ্ধ যে, তোমরা দারুণ চতুর, এখন তোমার হাতের ক্ষুর চালনা রাখিয়া, একটু ভাবিয়া দেখ ত, কেন না বালককে তুমি খদ্দের ভাবিয়া থাক, এখন মনে কি হয় সে কি রিখিয়ার রাস্তার দিকে গিয়াছে।

হায় যদি মনিব মহাশয়, সুঘরাই যখন এখানে, তখন এক বিলাইতী বাজনা একটি ব্যাগ-পাইপসহ ঢাকের শব্দ শুনিতেন, নিশ্চয়ই তিনি মুগ্ধ হইয়া দ্রুত সেই দিকে লক্ষ্য করিতেন, কিন্তু আদতে বাজনার হেতু দর্শনে-সুঘরাই অবিকল এখন যেন দেখিল–তিনি মুহ্যমান, একধারে আশা ও দুঃখ তাহারে কালো করিল, এ কারণ যে উহা এক শবযাত্রা, চারপাইটি অদ্ভুত সাজান বাঁখারি নির্ম্মিত ছোট ছোট খিলান করা, উপরে চেলি-ঢাকা (পাটের কাপড়) যাহার আবির রঙ সকলকেই মোহিত করে।

মনিব মহাশয় বুঝিলেন সম্ভবত ইহা ডোম জাতির মৃতদেহ, ইহাদের সহিত কি সুঘরাইএর সাক্ষাৎ হইয়াছে; হয়ত ইহাদের মধ্যে সুঘরাইএর কোন জ্ঞাতি সম্পর্কের লোক থাকিতে পারে, তথাপি তাহাদের তিনি প্রশ্ন করেন না, নিশ্চয়ই তিনি সুঘরাইএর বিকার বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে যদি ইহা বাঁশ বাঁধা শব হইত তাহা হইলে সুঘরাই নিশ্চয় অনুসরণ করিত, ভাগাড়ে যাইত, সেখানে সে দাঁড়াইয়া থাকিত, স্বজাতি তাহাকে দেখিয়া ঘোট এক হাড় ছুঁড়িয়া মারিত–হিঃ রে! সেও আহ্লাদে অধীর হওয়ত একটি হাড় ছুঁড়িয়া জানাইত যে, সেও খুসী। দুজনেই আনন্দিত খুসী আত্মীয় দর্শনে। তখনই শিশির দেখা যাইবে। বাজনা শ্মশান অভিমুখে চলিল, মনিব মহাশয়ের মস্তক উন্নীত হইল, তিনি অদূর শ্মশান হইতে উখিত কুণ্ডলীকৃত ধূমরাশির গাম্ভীর্য্যের পানে তাকাইলেন, নিশ্চয় কোন জিজ্ঞাসা তাঁহার ছিল না।

মনিব মহাশয় সত্যই নিরাশ হইয়াছেন, সামান্য এক ভৃত্যের জন্য এত তল্লাস কেহ করে না, কিন্তু যেহেতু ইনি পরম ধার্মিক তাই এতেক ব্যগ্রতা; যখন তিনি অবনত মস্তক চলিতেছিলেন, তখন সহসা শিব-জয়ধ্বনি উঁচাইয়া অস্বাভাবিক স্বরে গীতের বিস্তার হইল, এই গান নিশ্চয় সর্দার পাণ্ডাঠাকুর লিখিত যাহা–

‘আজু জাগরণে রাতিয়া বিতল সখী যে ভৈল ভোর গে, হায় রাম’–

এই মাঙ্গলিক সুললিত পদবন্ধ শ্রবণে তাকাইলেন–যে এবং কিয়ৎ রশি দূরে দৃশ্যমান হইল, ঘোর লাল পাটের সাড়ী পরিহিত, কালো তেলাল চুলে পাতাকাটা ও পাতায় চুমকী, নাকে ফাঁদি নথ ও নানাবিধ পিতলের অলঙ্কারে ভূষিত পাঁচটি হিজড়া একজন স্ত্রীলোককে, যাহার মাথায় বটপল্লবসহ ঘট, তাহাকে, মণ্ডলাকারে খেমটা নৃত্যে পরিক্রমণ করত, ঐ গীত সহকারে ক্রম অগ্রসর হয়; এই দলের পিছনে এক সুরম্য ডুলি ও যাহার অনুগমনে কুসুম-রঙ-ছোপান বস্ত্র শৌভিত আর রৌপ্য অলঙ্কার সজ্জিত দাসীরা যাহাদের হস্তে পূজা উপচার রহিয়াছে। সুঘরাইও ঐ সকল কিছু এইভাবেই দেখে! তার পর শোভাযাত্রা এক কারণে থামিয়াছে বসিয়াছে, হিজড়ার দল চুটা ধরায়। ঐ এখন আবার চলিতে সুরু করিল।

মনিব মহাশয় সবিস্ময়ে এহেন চমৎকার দলকে পর্য্যবেক্ষণ করিলেন যে তাঁহার ইদানীন্তন বৃত্তি বশবর্ত্তী তাহাদের কাছে খবর করিতে ইচ্ছা হইল; তিনি নির্ঘাত যে সুযোগ অপেক্ষায় তাহাদের অনুসরণে খানিক পথ যাইলেন, শিবগঙ্গার নিকট যখন পুনরায় সেই দল রুখিল, তৎকালে তিনি তাহাদের, ঐ হিজড়াদের কাছে–যেহেতু শোভাযাত্রার অন্য সকলেই মৌনী–সুঘরাইএর সংবাদ জানিতে গিয়া অস্বস্তিতে ইতস্তত অন্যত্র মনস্ক হইলেন। অনেকটা দূরে খোলার চালের বাড়ী, খোলার পলা-রঙা চালা ও তদুপরি পরমদ্ভূত দর্শন পোড়ামাটির হাতী ও পায়রা তদীয় দৃষ্টি ব্যাহত করে, সহসা এইগুলিতে তাহার বুকে আশ্চর্য পথে ভরসা আনিল। যে তাঁহার সঙ্কোচ আর নাই, তিনি মধুর বচনে হিজড়াদের কাছে ইহা উল্লেখে বলিলেন,–তোমরা কি আমার কথার উত্তর দিবে, যে বালক আপন গাত্র হইতে গেঞ্জীটি উন্মোচিয়া সেই গেঞ্জী দ্বারা আপন চক্ষু মুছিতে কালে তোমাদের প্রত্যক্ষ করে, এবং ভাবিয়াছিল, অনেক সময় যাবৎ তোমাদের দেখিলে মঙ্গল হয়, এবং সে আমাদের সাক্ষাৎ পাইবে এরূপ বিশ্বাসেই সে স্বাভাবিক! মনিব আরও বলিলেন, যে তোমাদের কুহকময় অঙ্গুলি আছে যেটি তোমরা আপন সুপুরু ওষ্ঠদ্বয়ে স্থাপনে আমাদের নিমিত্ত কর, মানুষের নিছক ধারাবাহিকতা পরোক্ষে স্মরণ করাও, যে তোমরা চম্পক অঙ্গুরীয় বৈপরীত্য; অঙ্গুরীয় আলো, তোমরা চমকপ্রদ স্তব্ধতা!…এখন সেই বালক, তোমাদের বিশ্রামের কারণ বুঝিয়া আপন পাপস্খলনের জন্যও মানুষের গলাতে ও স্বরে কি নোনা আছে–বলিল, যে সে মন্দির সমীপস্থ অঘটন দেখিয়াছে, যে সে চন্দ্রকলা ভূমিতে-বাঁকাচাঁদ এককলা জ্ঞানের প্রতীক যেমন শিবের মাথায় থাকে–পতিত হইতে দেখিয়া বৃক্ষে উঠিতে চাহিয়াছে, ঐ কীৰ্ত্তির চন্দ্রকলার মনোরমত্ব তাহাকে মুগ্ধ করে, সত্যই যাহা মননে যে কোন হিন্দুজনম সার্থক তখনই!

যে এবং, যে সে অবলোকন করে, এক অপূৰ্ব্ব কন্যাকে পদব্রজে আসে, যাহারা ধর্ম্মতাত্ত্বিক সাধক সন্ন্যাসী যাহারা নিজ নিজ স্তব ‘মহামহিম্ন’ ও ‘নির্ব্বান ষটক’ পাঠ করিতেছিল তাহারা কন্যাদর্শনে উহা থামাইয়া—’অহো ভগবতী তনু ভগবতী তনু’ উচ্চারণে আকাশ বিদীর্ণ করিল, যাহারা এখানে সেখানে পদ্মাসনে বসিয়া নিমীলিত নয়নে ধ্যানস্থ ছিলেন তাহাদের গাত্রে ঐ শুদ্ধ শব্দে মুহুর্মুহুঃ রোমাঞ্চিত হইতে থাকে, এমত সময় নেতৃবর্গসহ হরিজনরা আসিল, প্রলয় কাল আসিল, কন্যা ন যযৌ ন তস্থৌ হইলেন কিয়ৎক্ষণ, অতঃপর শুভমিলনের কারণে ধাবিত হইলেন, এ সব ব্যাপার অনেকক্ষণকার, এখন নিশ্চয় শাস্ত্রমতে বিবাহ কাৰ্য্য চলিতেছে! আর সেই দুবৃত্তরা অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে, তাহারা দন্তঘর্ষণ করিতেছে, তোমরা আর কালবিলম্ব করিও না, অদ্য অনেক দুগ্ধ ঘৃত পূজা উপচারাদি নষ্ট হইয়াছে, হোমকাষ্ঠের অভাব, সত্বর যাও, ভোগের আর বেশী দেরী নাই, জয় বাবা বৈদ্যনাথ!–সেই বালকটির কথা, যে আপন হঠকারিতায়ে অধোবদন, অনুতপ্ত যে সে-ও হরিজনদের সহিত চীৎকার করে, সেই বালকের কথা তোমরা বলিতে পার…!

হায় আমার চক্ষুর মধ্য দিয়া নিয়ত বাদুড় প্রবেশ করিতেছে, হায় আমার নাম সুঘরাই, যাহা ক্রমাগত শিব জয়ধ্বনির মধ্যে ডুবিতেছে, হায় এ পৃথিবীতে পচাগলিত দুর্গন্ধ কিছু নাই, ঐ ধ্বনি সকল কিছু গ্রাস করিতেছে, যে আওয়াজ ভেদ করত আমিও বহুসময় শালা বলিয়াছি, যেহেতু আমি ডোম, কিন্তু তাহারা আরও পাপ করে যাহারা উচ্চৈঃস্বরে বৈষয়িক কথা ঐ ধ্বনি সময় কহে, আমি শুনিয়াছি; আমিও ত আমার নাম ধরিয়া অনেক অনেক বার ডাকিয়াছি! হায়! মনিব মহাশয় যদি ঐ ব্যাঙটি দেখেন তাহা হইলে কি ভাবিবেন, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমা করিবেন, যে আমি মহা আক্ষেপে আপশোষে ক্রোধে উহারে আহত করিয়াছি!

এখন তিনি অসংখ্য ভিখারীদের সামনে, যে সুন্দর রৌদ্র উহাদের এড়াইতে পারে নাই, যে শুধুমাত্র একের ছায়ায় অন্য ভারী কালো, একদম উদ্ভীজ, বিবিধ ভাষায় আশীৰ্বাদ কল্যাণ বচনে ইহারা বিকট, অবিলম্বেই আবার ম্লান, তিনি এই নিকৃষ্ট অবহেলিতদের নম্র বচনে প্রশ্ন করিলেন,–বাবা বৈদ্যনাথ তোমাদের মঙ্গল করুণ, বিশেষ যে, তোমাদের জিজ্ঞাসা করি যে চীৎকাঠ নিবাসী বজ্রাহত ভিখারী যাহার নাম জাঙকী সেই অষ্টবক্র বিকলাঙ্গকে চেন কি না…তাহারে কি স্মরণ আছে? বোবা ভিখারীটি যে বালসরাইএর, তাহার কথা নিষ্প্রয়োজন! অবশ্যই অগণিত তীর্থযাত্রী তোমাদের আশ্চর্য্য নেত্রে নিরীক্ষণে করজোড় করে, বুঝে তোমরা জাঙকীর মতই পূৰ্ব্বজন্মকৃত পাপ বহিতেছে; যে এবং সুঘরাই সিদ্ধান্ত করে, যেহেতু পাপ সে করে নাই তাই তাহার দেহ নিখুঁত, যদি ভবিষ্যতে কখনও সে কোন পাপ সঙঘটন করে, তন্নিবন্ধন সঙ্কল্প করে, সে আপনার হাত পদদ্বয়কে সংযত করিবে, কেননা হাতে নোনা আছে–উহারাই নচ্ছার! এমন যদি, কভু অজ্ঞানে সে পাপ করে তাই আগামী পৌষ সংক্রান্তিতে ভাগলপুরের গঙ্গায় স্নান করিয়া তাহা স্খলন করিবে।

যদিও তাহারা ডোম, নানান বিচার আচার তাহাদের নাই, তথাপি যে এবং আরও, এই মানসিক করে যে যখন সে আধ সের চাউল প্রত্যহ খাইবে তখন তোমাদের নিমিত্ত প্রতি হাটবারে এক পালি চাউল (!) আনিবে, গামছাও দান করিবে, তাহারা ডোম, যদিও তাহাদের ভিক্ষা গৃহীত হয় না, তবু। মুহূর্তের জন্য সে উচ্চবর্ণের হইবে, সেই দেশওয়ালী বালক সহসা অদ্ভুত সঙ্কুচিত হয়, এ কারণ যে। অচিরাৎ কাহারও সম্ভ্রান্ত করে ভর্ৎসনা তাহার কানে আসে; শনৈঃ ঐ তিরস্কারবাক্য সে অনুধাবনেই ত্বরিতেই নিদারুণ চমকৃত, যে ক্ষণেক ইহা সংস্কার জন্মে যে, যে সে যেমন বা হারাইয়া যায় নাই।

সে দেখিয়াছিল যে, অনতিদূরে জনৈকা উচ্চবংশসস্তৃতা গৃহিণী বোধ হয় তদীয় নাতনী, যে ফ্ৰকপরা, তাহারেই তিক্ত সমালোচনায় বলিতেছিলেন,–ছি ছি লজ্জা রাখিবার জায়গা পাই না, ইহারা (ভিখারী) সাক্ষাৎ নারায়ণ! ইহাদের ঘৃণা ছি ছি তোমার ঐ বাপটিস মিসনে এই বুঝি শিক্ষা, ছি ছি, নরকেও স্থান হবে না, ভিখারী বলিয়া…ছুঁড়িয়া ঘুড়িয়া অবজ্ঞা করিয়া দেওয়ার মত পাপ আর নাই; শতজন্ম তপস্যার ফলে মানুষ ভিক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাইয়া থাকে, উহারা কানা খোঁড়া কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত কি ইচ্ছা। করিয়া হইয়াছে! বলে কুকুর বিড়ালরে অবধি হুঁড়িয়া কিছু দিতে নাই। ছি ছি! উহাদের নমস্কার কর…!

ইত্যাকার কথার সহিত গৃহিণীর উৎকৃষ্ট স্বর্ণালঙ্কারগুলির মৃদু অনুরণনও মিশ্রিত হইতে থাকে, যে। উপস্থিত সুঘরাই সদ্যস্নাত সুন্দর দেখিতে কন্যার জন্য তটস্থ হয়–এবম্বিধ উক্তিতে তাহার ডোম জন্মে আশ্চৰ্য্য এক অপরাধ জানিয়েছিল; আর তোমরা হে ভিখারীগণ, গৃহিণীর রূঢ়তায়ে বালিকার জড়তা বুঝিয়া, তোমরা গৃহিণীপ্রতি বালিকার নিমিত্ত সমবেদনায়, ক্ষমাপরবশ, অতীব করুণায়ে আশ্বাস দিয়াছিলে, থাক থাক্ উহাতে দোষ বিচ্যুতি ঘটে নাই, সে বালিকা, আমরা তিন সত্য করিতেছি উহার অপরাধ আমরা লই নাই, যে বালিকারে আমরা আশীর্বাদ করি, সে শিবলোকে যাইবে, শিবকে পতিরূপে পাইবে, উহার জীবন আমরণ দেবসেবায় ধন্য হইবে, অজস্র দান ধ্যান করিবে, উহার সন্তানরা ত্রিলোক-বিখ্যাত ধার্মিক হইবে, অমর হইবে মাগো!

তোমাদের এতাদৃশ মেহবচনে সেই বালক সুঘরাই যেন এই মাত্র স্নান করিতে চাহিল, কেননা সে চীৎকারে শিবকে পতিরূপে পাইবে, বাক্যকে তছনছ ইতিপূৰ্বেই করিয়াছে, সে কম্পিত, সে তোমাদের নমস্কার করে, তাহারে কোন দিকে যাইতে দেখিয়াছ।

অনবরত পুণ্যকামী আর ঢাকের শব্দে মনিব মহাশয় স্বতঃই বিভ্রান্ত, নূতন করিয়া যে এখন তাঁহার কোথাও গিয়া শুধাইতে ভয়ঙ্কর রাগ হইল; বিশেষত মোহিলির ব্যবহারে বৃথা ভয়ের জন্য–যে সেই কলেরা ইনজেকশন ক্যাম্প রোহিণীর ঐ দিকে না অন্যত্রে উঠিয়া গিয়াছে–গরুর গাড়ীটি থাকিলে কোন গোলই ঘটিত না, সুঘরাই অনায়াসে তাহাতে ঘুমাইতে পারিত; ওষ্ঠদংশন করত তিনি চারিদিকে চাহিলেন, নাঃ একবার শেষ চেষ্টা করি, যদি সে রিখিয়ায় ফিরিয়া গিয়া থাকে; কিন্তু ইহাতে তাঁহার অবশ্যই মনে পড়িবেই যে সুঘরাই কোন উপায়েই একা একা রিখিয়ায় ফিরিতে পারিবে না, অবশ্য যদি কোন সহায় সম্বল পাইয়া থাকে, ভিখারীদের কথা উঠে না, যদি অন্য কাহাকেও পাইয়া থাকে তাহা হইলে সে আর এক কথা।

এমনও যে বিসরিয়ার বাপ, যে প্রত্যহ শহরে পায়ে ঘুঙুর এবং বিরাট ঢাক ঘাড়ে আসিয়া থাকে, ঢাক বাজানই তাহার ব্যবসা, ক্রমাগত তীর্থযাত্রীদের সমক্ষে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ঢাক বাজাইয়া শুভ অভিনন্দন জানায়, এবং এইভাবে শিবগঙ্গা পর্যন্ত যায়; তীর্থযাত্রীদের কি আদরের স্মৃতি সে, ভারতের দিকে দিকে চন্দন গন্ধের পাশেই সে; তাহার মত অনেকে। সে ফাষ্ট ট্রেন ধরিবার জন্য রাত থাকিতে আসে, অদ্য তাহারও সাক্ষাৎ নাই।

তবু তিনি অবশেষে এই রিখিয়া তত্ত্ব করিবার স্থির করিলেন; তিনি দুমকার চৌরাহা গিয়া পর্য্যবেক্ষণে জানিলেন, সকাল বেলাতেই বহু কাঠের ভারী, বহু দুধওয়ালা বিষণ্ণ চিত্তে ফিরিয়া গিয়াছে। ও যে দু-চারজন সুদূর ভাগলপুর হইতে বা গঙ্গার নিকটবর্ত্তী এলাকা হইতে গঙ্গাজল, বাবা বৈদ্যনাথকে তদ্বারা পূজা করিবার মানসে আনয়ন করে, তাহারাও শহরে প্রবেশ করে নাই, ক্ষুণ্ণ মনে বালসরাইএর দোকানে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে; যে আজ ঐ পথে একেবারে লোক চলাচল নাই, সর্বৈব নিশুতি; এখন এরূপ পথ সুঘরাইএর পক্ষে অতিক্রমিয়া যাওয়া আষাঢ়ে, কিছুতেই ঘটিবার নহে, সেরূপ সাহসও সে পাইবে না–কেন না লকড়!

.

কোন এক সাংঘাতিক সুচতুর লকড়ের উপদ্রবে রিখিয়ার আশপাশ অনেক মৌজা সৰ্ব্বদা আতঙ্কিত হইয়া আছে, যে সেখানে ঘুম নাই, ক্রমাগত নিদারুণ ফেউএর ডাকে সকলেই শঙ্কিত, কুকুররা গ্রাম হইতে বাহির হয় না, কোথাও পাতালতা তূপীকৃত করিয়া আগুন দেওয়া হয়; সকলেই একযোগে ভয় পাইয়াছে–একে অন্যকে কাছে টানিয়াছে–ঢাকীরা ঢাক ও অন্যান্যেরা, ছোট-রা, ক্যানেস্তরা টিনের কৌটা ইত্যাদি ঘুম চোখে বাজাইয়াছে, এই সঙ্গে সকলেই থরহরি! রাত্রিগামী গরুর গাড়ীর চাকার শিকে একটি কাঠের সহিত লাগিয়া যাহাতে শব্দ হয়, তজ্জন্য তাহাতে আড়ভাবে চালকরা কাঠ বাঁধিয়াছে, ইহাতে চলাকালে উৎকট আওয়াজ হয়, ফলে কোন জন্তুই গাড়ীর সমীপে আসে না। ঐ লকড় হেতু এমন কি চেঞ্জার বাবুরা কেহ কেহ বন্দুক হস্তে সান্ধ্য ভ্রমণ করেন।

কয়েকদিন হইল এই লকড় এতেক দুর্ধর্ষ হইয়া উঠিয়াছে যে দিনমানেও তাহাকে দেখা যায়, মাঠে গরু পর্য্যন্ত চরান ভাবনার হইয়াছে, তাই অড়হর ক্ষেত যদি পশ্চিমে হাওয়ায় নড়িল, যুগপৎ সকলেই লাফাইয়া উঠিয়াছে, ও হো হো হৈ লকড় হে-হাঁক পড়িয়াছে!

বিদ্রাবিত অসহায় গ্রামবাসীরা গাছের গায়ে নূতন করিয়া সিন্দুর দিয়াছে; বিশেষত এ কারণে যে বালসরাইএর রাস্তার কাছেই কয়েক ঘর ডুমনীর বাস, যে ঠিক সেইখানেতে দিন তিনেক পূৰ্ব্বে এই লকড় দ্বারা এক নৃশংস ব্যাপার সঙ্ঘটিত হয়।

ঐ সকল ডুমনীদের ঘরের সামনে রোজই রাত্রে একটি বোবা ভিখারী ঘোরাফেরা করিত, যে ডুমনী মাগীদের সঙ্গে তাহার ভাব ছিল; ডুমনীরা তাহাকে মহুয়া বা গাঁজার কল্কী দিত; বোবা সারারাত এখানেই তাহাদের ঘরের কাছে ঘোরাফেরা করে।

কোন ডুমনীর ঘরে খদ্দের (বাবু!) আগমনে যখন ঝাঁপ বন্ধ হইত, সেই ক্ষেত্রে ঐ বোবা ঝাঁপের ফাঁসা ফুটো দিয়া আভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ দেখিতে ভালবাসিত; বোবা সে বটে কিন্তু লালা ত ছিল! যেদিন তাহার কাল হয়, সেদিন কোন কোন ডুমনী তাহারে রাত বারোটার ট্রেন যখন যায় তখন দেখিয়াছে, একজন ডুমনী তাহাকে একটু মহুয়াও দেয়, যেহেতু সে কাছেই ছিল মানে ঐ ডুমনীর ঘরের ঝাঁপে আড়ি পাতিয়াছিল; যে ইহার পর যখন সে হয়ত পুনরপি ঐ ভাবে ঝাঁপের ফাঁক দিয়া দেখিতে একমনা তখনই নির্ঘাত লকড় কর্তৃক আক্রান্ত হয়!

বেচারী বোবা!

লকড়টি, ইহা জীবিতরা ধারণা করে যে, গরুর গাড়ী বা অন্য কিছুর নিমিত্ত বোবার খানিক-খাওয়া। দেহ রাখিয়া চম্পট দিয়াছে, এবং উহার মর্মন্তুদ চীৎকার পশু পাখীর সহিত এক! যে সেই কুৎসিত বিভীষিকা সারাদিন রাস্তায় রহে–দূর দূর গ্রামে এই হিম দুঃসংবাদ পৌঁছিয়াছে; যাহারা অনেক পথ ভাঙ্গিয়া আসে এহেন বীভৎস দুর্দৈব প্রত্যক্ষ জন্য, তাহাদের অন্তর আত্মা পাঁশুটে হইয়াছিল; সুঘরাই উহাদের সঙ্গে খানিক পথ যায়–এই ঔৎসুক্যের হেতু মনিব পত্নীর নিকট বকুনিও খাইয়াছে!

উহাদের দর্শকদের মধ্যেই কেহই সেই মর্মন্তুদ দেহ অবলোকনে ‘বেচারী’ পৰ্য্যন্ত বলিতে পারে নাই; যে অন্যপক্ষে কোন নীতিজ্ঞান আব্রাহ্মণ কেহই তাদৃশ দুর্দশা হইতে মন্থনে শক্ত হয় নাই। সকলে কাতর নয়নে শকুনির পরিক্রমণ দেখিতেছিল।

শুধু মাত্র ভীতি! ভীতি তাহাদের–গ্রামবাসীদের অমোঘ অহংতা; আর যে বিশেষত তাহারা যাহারা পূৰ্ব্বজন্মজনিত পাপ বিধায় অতীব নিম্নশ্রেণীর এই জন্মে, ইহা ধ্রুব যে ভীতি তাহাদের পুণ্যও; সুঘরাই ঐ ঘটনাস্থলের খানিক পথ হইতে ফিরিয়া সৰ্ব্বপ্রথম খড় কুড়াইয়াছে, যে একটি সুদীর্ঘ দড়ি তাহার চাই, খড় দ্বারা একটি কদাকার, রশি বানায় ও যে পাখীর খাঁচাটিকে মটকায়–খিলানের লোহাতে তুলিতে চাহিয়াছিল।

.

যে, লকড় হইতে ভীতি, ভীতি চড়াই উত্রাই-এর নিঃসঙ্গতা পার হইয়াই পাখী! যে চকিতে ইহাতে সুঘাইএর নেত্র অভাবনীয় বিস্ফারিত যে যাহাতে একাধারে উদ্বেগ ও অপ্রত্যাশিত পাখী না থাকার দরুণ আপশোষ বিদ্যমান; যে সে এতাবৎকার অনভ্যস্ত মানসিকতা হইতে অধুনা সে মুক্ত, অত্রাহি ভাবান্তর এখন ধূলিসাৎ হইয়াছে, তাহার ডোমত্ব ঘুচিয়াছে।

ইহা যথার্থ যে সে নাড়ীর যোগসূত্র পাখী শব্দে প্রাপ্ত হইয়াছে; যে সে আতা গাছকে আতা গাছ। বলিয়া চিনিয়াছে, যে সে রিখিয়ার কোন সিন্দুর-লাঞ্ছিত মহুয়া গাছকে এখান হইতে নমস্কার করিল; আশ্চৰ্য্য যে এক কুকুর তাহারে দেখিয়া অজস্র চীৎকার পাড়িয়াছে কেন না সে সুঘরাই নাচিয়া উঠে যাহাতে ইহা সিদ্ধ হয় যে সে অব্যর্থ, সে আছে!

এবং এখন, সে মনিবের প্রিয় দাস, সে স্পষ্টত শুনিল, এই হারামজাদা!–আঃ হা পাপ কাহাকে বলে! এবং যে তাবৎ বিশ্বাস যে সে আছে, এই বিশ্বাস তখনই সম্যক, যখন তাহার পাখী আছে, তখনই স্থাবর জঙ্গম সবই সংখ্যায়ে, যে যাহা মননে তদীয় অব্যবস্থিত প্রকৃতি ইদানীং সাধারণ।

আর যে ঐ লকড় কারণে ভয় হইতে শহরের এতক্ষণকার যে একাকিত্বের ভয়ে সে দিকভ্রান্ত থাকে, তাহাতে আর সেই বৈলক্ষণ্যের তেমন চেহারা নাই; এখনই সুঘরাই আপনার দেহ হইতে হাতের পানে চাহিল, ইহা নিমেষেই ওতপ্রোত যেমন যে সেই হস্তে একটি খাঁচা আছে এবং আদতে নিজের গেঞ্জীটি তাই ডান হাতে লয়, যাহা যেন খাঁচা আর যে তবুদ্ধিতে নাচাইলে, যে সে এমন কি খাঁচার ভার অনুভবিয়াছিল; আশ্চর্য্য সে কি পাগল! এত সময়, হায় সে এক রকম নিজ নাম হইতে, এবং যে মাথায় সে এমন অর্থাৎ উচ্চতায় এতখানি যে এরূপ তাহারে দেখিতে হইতে, শুধুমাত্র স্থানবাচক হইয়া সর্বত্রে ব্যাকুলভাবে দৃষ্টি সঞ্চালন করিয়াছে! আঃ তাহাতে বৃত্তি আসিল, সৎসাহস আসিল যে সে চিবাইতে জানে।

এই প্রকার আক্ষেপে সুঘরাই স্বীয় বক্ষে চাপড় মারিলেক, যে হায় যদি পাখীটি থাকিত! ইহাতে তাহার ডোমত্ব নিশ্চিহ্ন হইল; আর একদিকে সে দশাসই ডোম যদি অপি, তবুও সে এখন অনায়াসে ফুল চয়ন করিয়া কানে পরিতে পারে, কোন বাধা নাই এবং সে সেই-যে ছেলেটির সহিত একটি পাখী আছে, যাহাতে সে বাস্তব, যাহাতে সে এই জড় পূর্ব পশ্চিমাদি দিকের অপেক্ষা নহে।

এ পর্যন্ত যত কিছুকে–মানে যাহাতে তাহাকে সহজে খুঁজিয়া পাওয়া যায়–সে আপন শরীরের অঙ্গীভূত করিতে আপ্রাণ ছিল, তৎসমুদয়ের ঠিক লইল এবং তাহাতে বুঝে, দেহ তদীয় সীমা আর নহে–দেহে সে আটকাইয়া নাই, ইদানীং সমস্ত কিছু মিশিয়া মিলিয়া এক অত্যদ্ভুত রূপ ধারণ করিয়াছে, যাহা দেখার তথা অনুভবের সঙ্গেই সে বলিয়া উঠিল যে, ছেলেটির সহিত একটি পাখী আছে।

এই দৈব সমাধান অহহা কীদৃশী বিস্ময়াবহ! যে সুঘাই নিজেকে নিজেই জবর ডাগর রূপে প্রস্তুত করিতে থাকে এই বাক্যাবলী: যে ছেলেটির একটি পাখী আছে, তুমুলভাবে উচ্চারণ উদ্দেশ্যে সুমহান স্বর তাহার কণ্ঠে গঠিত হইল, ঝটিতি ধ্বনিত উহা হইল, যাহাতে ধৰ্ম্মত ইহাই, ন্যায়ত ইহাই, ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, ঐ পাখীটি কোন একদিনের, সত্যযুগের, যেক্ষণে দেবতা মানুষ অভেদ! ও সুঘরাই যাহার সূত্র ইহাতে, ঝটিতি সুঘরাই-এ চাকচিক্য ছটা ধরিল, যে সে সুদারুণ নির্ভয়ে সে পুনরায় কহিল, যে, ছেলেটির একটি পাখী আছে। আর যে ইহাতে সে এই বসুন্ধরাকে অভয় দান করিল! যে তুমি ভীত কেন–আমি আছি!

.

ইহা এখানকার অবিশ্রান্ত স্তব স্তোত্র মন্ত্র পাঠে, গম্ভীর জয় বাবা বৈদ্যনাথজী জয়ধ্বনি মহিমাতে, অধুনা, যাহা সুদূর কুম্ভকাণম আগত তীর্থযাত্রী কর্তৃকও শব্দিত, এহেন পরম শুদ্ধ উদাত্ত স্বরবিভঙ্গে, এবমুক্তবচন যাহা সে বলে, যে ছেলেটির একটি পাখী আছে, চিরতরে আটকাইয়া গেল, সংমিশ্ৰিত নহে, কদাচ ডুবে নাই!

এবং সে কান পাতিয়া শুনিতে যাহা উদগ্রীব, ঐ সকল তপোলভ্য উচ্চারণে তাহার আপনকার নির্ম্মিত সঙ্গীতময় পদবন্ধ বিঘোষিত শুনিল, যাহার অনুরণন দেহে হওয়া মাত্রই, তাজ্জব যে, ইহা যেমন সংস্কার, যে সে মোটেই উৎচকিত ছিল না, এ যাবৎ কিঞ্চিত্র সে হা হা রবে কাঁদে নাই।

এখন গেঞ্জী যাহা খাঁচাতে পরিণত–যাহা সে বহুক্ষণ পূৰ্ব্বে গাত্র হইতে খুলিয়াছে, এমন ভাবনায় যে উহা পরিয়া থাকিতে তাহার নিশ্চয়ই চেহারার পরিবর্তন ঘটিয়াছে, কেন না ইহা খুব ফর্সা, আর তজ্জন্য মনিব মহাশয় তাহাকে, কিছুই অবিশ্বাস্য নহে, চিনিয়া লইতে পারিতে অসমর্থ নির্ঘাত, আর সে তদীয় দুর্লভ ঘৃণা হইতে বঞ্চিত!

সেই গেঞ্জী উপস্থিত বড় খুসী মনে পরিয়াছে! সে পূর্ণ! গেঞ্জীর আর্দ্র স্থান নিজ ত্ব সংস্পর্শ হইতেই সে হাসিল; অধিকন্তু খাদ্যসামগ্রীর যাবতীয়, ও দোকানের বোতলগুলি দূরে থাকিয়া দর্শনেও সে সাবধান, প্যাঁড়ার গন্ধে সে অধীর, চমৎকৃত।

আবার মনিব মহাশয়ের স্বর শুনিল–এই হারামজাদা…

মনিব পত্নী বলিলেন–কি পাপ!

এ শহরে ধূলা উড়ে, পলাশ পত্র যত্রতত্র হইতে আছে; এ শহর মুহুর্মুহুঃ উৎকৃষ্ট ঘণ্টাধ্বনি নিনাদিত, পুষ্পমাল্য দীপ দেদীপ্য, ধূপ কর্পূর চুয়া চন্দন গন্ধ এই স্থানে আছার, তীর্থযাত্রীদের কণ্ঠস্বর সুললিত; তাঁহার সেই একের সৰ্ব্বব্যাপিত্ব এই তীর্থ দ্বারা অস্বীকৃত হয় নাই! এ শহরে ব্রাহ্মণগণের গাত্রবর্ণে জৌলুস চিকন দিব্য।

এই শহরে, নিকটে কোথাও যেমন বা নিঃশঙ্কচিত্ত মৃগশিশু সকল পরিভ্রমণ করে, যে শিবগঙ্গায় অনেক চক্রবাক সকল, আর উন্মুখী পদ্ম কম্পন, আর যে সেই শহরে সে এতকাল পিতৃহন্তা পাপীর তুল্য অশরীরী ছিল! সম্প্রতি বালক এই শহর তীর্থকামীর চোখে দেখিল, যে সে সজীবতা, যে ঈদৃশী পুণ্যভাক নগরে তাহার হারাইয়া যাওয়ার কারণ যাহা আদত তাহা নির্ণীত হইল, যাহা আমি ও আমার সম্বন্ধ, তাহা বোধগম্য হইল– মানুষ এই নোংরা লইয়া দেশ-দেশান্তর করে!

যদিস্যাৎ তাঁহারা, মনিবরা উক্ত ধরণের সংজ্ঞা, যে তাহার একটি পাখী আছে, নির্ধারণ করিতে পারিতেন, অর্থাৎ কিনা তাহার ব্যাপারে সংজ্ঞা রচনার সুযোগ ঘটিত, তাহা হইলে কাহারও প্রশ্ন এতশত করিবার কথাই আসিত না, তাঁহারা মন্দির হইতে বাহিরে আসিয়া, সুঘাইকে না দেখিয়া, এদিক সেদিক চাহিয়া, পাণ্ডাঠাকুরের পরামর্শ শুনিয়া, নিশ্চয় ডাহিনে অতঃপর বামে এঁদো দুগন্ধযুক্ত সঙ্কীর্ণ গলি, ও যে কতিপয় জীর্ণ ফাটা দেওয়াল অতিক্রম করত যে রকে ছাগল ঝিমায়, তাহার পাশ দিয়া বড় রাস্তায় চর্বিত চর্বণকারী ষাঁড়কে–ইহারা নমস্কার করিয়াই দেখিতেন অসংখ্য কবুতর উড্ডীয়ান হইল এবং আলোছায়ার পর পুনরায় আলো ঘটিল, আর তথায় সুঘরাই, ওষ্ঠে তাহার স্মিত হাস্যরেখা ও সে তাহার পাখী লইয়া স্থিতবান, এই সেই সুঘরাই যে কখনই মন্দিরে হাঙ্গামাকারী হরিজনদের সহিত জিগীর দেয় নাই, ইহা এক ছত্র ডাগর দৃশ্য, আর পিছনে শিবগঙ্গা!

.

সুঘরাই এখানে বৈদ্যনাথে, পাখী আনিতে বায়না ধরিয়াছিল, মনিব মহাশয়কে এই কথা–সুঘরাইএর ইচ্ছা–তদীয় পত্নী নিবেদনও করিয়া থাকেন, কিন্তু তদুত্তরে তিনি, মনিব মহাশয় বলেন,–দুর,–তুমি কি উন্মাদ হইলে, একে উহা দেবস্থান মানে আমরা দেব দর্শনে যাইতেছি সেখানে কোন হুজ্জত লইয়া যাওয়া যায়…!

তাতে কি হয়েছে, ছোট ছেলে বলছে, আহা বেচারী পাখীটাকে এক মুহূর্তও ছেড়ে থাকতে পারে না…আর জমে নিশ্চই কেউ ছিল ও ছোঁড়ার…এক মুহূর্ত কাছছাড়া করতে পারে না…ছোঁড়া দেখ না বাহ্যে যাবে তাও পাখী…ওগো অমত কর না, ওর ভারী সাধ পাখীটাকে বোদ্দিনাথ দশ্‌শন করিয়ে আনে…।

না না তুমি বড়ই উহারে আহ্লাদ দাও–কোথাকার এক ডোম ছোঁড়া, তাহার জন্য…উহাকে রাখিয়া দেখিতেছি মহা বিপদে পড়িয়াছি…।

.

মনিব মহাশয় ও মনিব পত্নী এখানে আসিয়া এক গ্রাম্য বালকদের ভোজন দেন, ইহাতে কেয়ারি করা বাগানের কিছু নষ্ট হইয়াছিল–কিন্তু ব্রাহ্মণ হইতে সকলেই আসিয়াছিল, মনিব মহাশয়ের খাদ্যাখাদ্য বিচার নাই জানিয়াও খুব হৈ হট্টগোল হয়, তবু আসিয়াছিল! উচ্চবর্ণের বালকরা একটি বালকের সংস্পর্শ এড়াইয়াছে–যেহেতু সে ডোম, উহারা হাড়িয়াল ডোম।

এই বালকের চেহারায় নিদারুণ দুঃস্থতার ছাপ ছিল, অভাবিত নির্জনতা তদীয় অঙ্গে আছে, এখানকার জংলী বৈচিত্র্যও ছিল এবং তাহার হাতে একটি পাখী ছিল–ফলে সেই বালককে উপস্থিত উচ্চবর্ণের ঘৃণা অন্যদিকে তাহার ইহাদের প্রতি মায়া এক অপূর্ব দুঃখ বোধ দিয়াছে, আঃ তাহার দাঁড়াইবার ভঙ্গীও চমকপ্রদ, যাহাতে পশ্চাতের অজস্র মৌসুমী ফুলের চরিত্রকে সে আটকাইয়াছিল। অন্ন নহে, বহুদিনের ঘুমের পুষ্টি তাহার চোখে ছিল। সে একান্তে নিজেই বসিয়াছিল–মনিব পত্নী জিজ্ঞাসিলেন, তুমি এখানে কেন।

সে দাঁড়াইয়া উত্তর দেয়,আমি ডোম।

মনিব পত্নী তৎক্ষণাৎ আঃ মাধব আঃ ঠাকুর বলিয়া উঠিলেন।

মনিব মহাশয় কহিলেন–এই ব্যাপারের পঙক্তি ভোজনের তুমি আমি কিছুই করিতে পারিব না! তাহাকে একান্তে খাইতে দেওয়া হয়–মনিবপত্নী পরিবেশন করেন, সে যখন খাইতেছিল তখন তাহার পাখীটিও তাহার পাতেই খাইতে আছে, এই ছবি গ্রাম্য বালকদের কলরোল, রন্ধনের গন্ধ, পাখী কুকুরের চেঁচামেচি ছাড়াইয়া উঠে–ইহাতে শাস্ত্রের উদাহরণ দেখিয়া মনিব পত্নী তদীয় পতিকে উহা প্রত্যক্ষ করিতে ডাকিলেন! ঠাকুর আঃ তুমি দেখাইলে! তাহাদের সাধন নির্দেশে প্রত্যেকের পাতা ফেলিয়া দিলেন–মনিব পত্নী ঐ ডোম বালকের উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করেন।

.

মনিব মহাশয় কহেন–না, না, ইহা হইবার নহে, পাখী লইয়া কোথায় যাইবে। ঐ ভীড়ে তুমি ক্ষেপিয়াছ দেখি…।

না, কেন ভীড় তাতে কি, পাখীটা নিক্‌ না বাপু, ওর দিদি ত মরে ভূত হয়ে গেছে, সেখানে যে ওটা কার কাছে রেখে যাবে দেখভালের জন্যে, ফিত্‌তে কত বেলাই না হবে কে জানে–আর ঐ পাষণ্ড ভগনীপতি লোকটাও ভাল নয়, শুধু বাড়ীতে থাকতেই যা ঐ লোকটা ছোঁড়াকে দেয়, সেও পাখীটাকে দেখতে পারে না…আর তা’ যে মাগী এখন যারে ওর ভগনীপতি রেখেছে, সে’ও পাখীটাকে দেখলে পরে কাঁইমাই করে, তা’ সঙ্গে সঙ্গে মিনষে মুখ পোড়াও ধুয়ো ধরবে খনে… সিদিন নাকি বলেছে বাবুরা চলে যাক্‌, তুই ফিরে ত আসবি, পাখীটা আর একটু বড় হোক…তখন একদিন খুব মহুয়া তাড়ি মিশিয়ে খাব, খুব বমি করব, বৌকে, মানে মাগীকে, খুব মারব আর পাখীটাকে কেটে, কাঁচা কাঠে ঝসে খাব…অথচ ও ছোঁড়া রোজ দুপুরে ভাত নিজে কম খেয়ে ওদের জন্যে নিয়ে যায়…হ্যাঁগা পোষা তিতির আবার খায় নাকি…এখন বেচারা…বেচারী ভয়ে কাঁটা…।

সত্যই দুঃখের কথা বটে, তবে ইহা ত অনায়াসেই হইতে পারে…যে সে এখানেতে পাখীটা রাখিয়া যাইতে পারে। এখানেই ত থাকে ও হারামজাদা! ওর পাখী থাকিবে!

ও বাবা এখানে! ঐ মালী বেটা তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, শনিচারোয়া (চাকর), বামুন ঠাকুর সব্বাই ওকে হিংসে করে, বলেছে তুই চলে গেলে পাখীটাকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসব’খন…সহিস পৰ্য্যন্ত, আর আর সবাই বলেছে…!

ইহা কি একটা কথা হইল, ঐ সব কথা মস্করা মাত্র, তাহারা আমাদের ভৃত্য, কখনও সাহস করিবে না…বৃথা চিন্তা করিও না…।

কি যে বল, সে কথা কি আমি বুঝি না, তবে যদি বল কেন, তাহলে বলি…তা’ উত্তুর এই, যে, দেবস্থানে গিয়ে ও ছোঁড়া শান্তি পাবে না, হরি কথা শুনতে এসে পুঁই আড়ায় (মাচায়) মন; তাতে পাপ হয়, ও’র ত হবেই আমাদেরও…রিলি মধুর ও…।

দেখ, তুমি দেখি বড়ই মায়াপ্রবণ, তুমি যাহাতে দুঃখ না পাও তাই সুঘরাই ডোম জানা সত্ত্বেও অর্থাৎ ইহা জানিয়াও যে, যদি ঐ হারামজাদা পাপকে কেহ যদি আঘাত দেয়, ছোট করে, তাহা হইলে নিশ্চয় আমরা দুজনেই মরমে মরিব…ইহা বুঝিয়াও রাজী হই, কোন আপত্তি করি নাই, কিন্তু পাখী কোথায় বহিবে…আচ্ছা পাখীটি গাড়ীতে যদি…।

খেপেছ, গাড়ীতে সে ছোঁড়া রাজি হইবে না…সে শিবগঙ্গার জল ছিটুবে, মন্দির দেখাবে…কত সাধ ওর!

সত্যই তুমি দেখিতেছি, স্নেহে অন্ধ হইলে, আমারে ভুল বুঝিও না, উহাকে মন্দির কি কথা, সে রাস্তায় প্রবেশ করিতে দেয় কি না দেখ, এতদ্ব্যতীত ঐ ঢাউস পৰ্ব্বতপ্রমাণ পিঞ্জর লইয়া, সেই জনারণ্যে, ভীড়ের চাপে কি খেলার কথা, কোথায় ঘুরিবে… ।

অবশ্য যে সে পাখীটিকে লওয়ার জন্য আর পীড়াপীড়ি করে নাই। এখন বুঝিল যে সে ভালই করিয়াছে এবং ইহা ভাবিতেই অচিরাৎ অলৌকিক বিবাহ, মিলন, যাত্রা দেখিল, মুহুর্মুহুঃ আমলকী আদি পুষ্পবৃষ্টিও হয়, জয় ভগবতী তনু জয় জয়, এবং তখনই আচম্বিতে পাহাড় ধ্বসিয়া পড়িল, যে বন্যফল হরিতকী আমলকাদি ছিন্ন হইয়া উৎক্ষিপ্ত হইল, খাঁচাটি হস্তচ্যুত হইল, বিদ্যুতেই পায়ের চাপে ভাঙ্গিয়া নয়ছয় নিশ্চিত, পাখীটি থরহরি, বিশেষত মুখোসটির ভৌতিক গতিবিধি দেখিয়া, এখন মুখোস পরিহিত ভিক্ষুক ও হরিজন ও নেতৃবর্গের পায়ের চাপে সে পাখীটি মরিতই, পালাইবার পথ পাইত না, আর যে অন্যপক্ষে সুঘরাইও সরিয়া আসিতে বাধ্য হইত, এবং সে ক্ষেত্রে মনিব মহাশয় কি বলিয়া খুঁজিতেন; সুঘরাই কোন কথাই গঠনে সফলকাম হয় না।

ক্রমে ইহাও বিচারিত হয়, যে যদি সে অনন্য উপায়ে মোহিলির গাড়ীতে রাখিত যখন সে মোহিলি রিখিয়া প্রত্যাবর্তনে প্রস্তুত তখন পাখীটিকে রাখিয়া আসিত, তাহা হইলে নির্ঘাত বৈকালে রিখিয়ায় পৌঁছিয়া শুনিত, মোহিলি লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলিয়া চলাফেরা করত, এক অঘটন বর্ণনা করিয়া, পরে শান্ত কণ্ঠে উপসংহারে বলিত, সিটা ভুলাই গে রে। ইহাতে বনস্পতি অসুখী হইতেন, এবং বরং বারবার ইহাই তদ্বারা অনুমিত হইল যে পাখীটি হাতে থাকিলে মহারাষ্ট্রীয় তীর্থযাত্রিণীদের অঞ্চলে অঞ্চল যেরূপ বাঁধা, সেইরূপ এই বন্ধনের ছবিত্বটি, তত্ত্বটি যাহা তাহাদের, তাহার ও মনিবদের মধ্যে অলক্ষ্যে জাগিয়া থাকিত, এমন যে আঁধি উঠিলেও সূৰ্য্য ডুবিলেও তাহা কভু ভ্রান্ত হইবার নহে!

.

এই সময় কোন পাণ্ডাঠাকুরকে, বগলে যাহার খেরোর খাতা, যে যাহাকে এক যাত্রীর পশ্চাদ্ভাবনে মহা উত্ত্যক্ত করিতে দেখিল, এবং অন্যত্রে ইহা, যে আর একজন পাণ্ডাঠাকুর স্বীয় বাম উরুদেশ উপরে ঐরূপ এক খেরোর খাতা খুলিয়া ছড়া-পড়া সুরে এক যাত্রীবর্গের বহুপূর্ধ্বতন পুরুষের নাম সাকিম। শাখাপ্রশাখার নাম ইত্যাদি পাঠ করিতেছে, শ্রোতৃবর্গ সকলে একে অন্যের মুখ অবলোকনে অদ্ভুত গৌরবান্বিত, তাহারা সকলেই প্রীত, যে তাহারা বহুদিন এই পৃথিবীতে বসবাস করিতেছে, তাহাদের বংশধারায় সময়ের অবাক ঐশ্বৰ্য্য, সৌরমণ্ডলের প্রতিটি নক্ষত্র তাহাদের চিনিতে পারে, তাহারা কুসুমের জন্ম দেখিয়াছে, নদী যখন প্রথম ধাবমানা হইল সে কথাও মনে পড়ে, তাহাদের পরিচয় অতীব মহান, অত্যন্ত সুন্দর।

শ্রোতা সমুদয়ের মুখ নিরীক্ষণে সুঘরাই সনিষ্ঠ হইতেই এক চমৎকার ক্ষুরের আওয়াজ শুনিতে পাইল এবং যে, হায় তাহাদের পাণ্ডা হয় না এমত খেদ তাহাতে আসিয়াছে, এবং তৎক্ষণাৎই ইহাও যে দুঃখের কিছু নাই এরূপ তাহাতে দৃঢ়তা দেখা দিল; এ কারণ যে তাহার পাখী আছে যাহাই তাহার নিজস্ব, তাহাই বংশধারা, সেও শ্রোতাদের মতই, যাহারা মধ্যে মধ্যে মহা শূন্যতায় আপনাদের ধারা দেখে, তেমনই সেও যেন পাখীটিরে লক্ষ্য করিল যে এবং তখনই দেখিল পথপার্শ্বে কোন মাতা সন্তানকে স্তন্যদান করিতেছে।

সুঘরাই এখন বুঝিল সে ক্লান্ত; একদিকে রিখিয়ার রাস্তা অন্যদিকে এই ধৰ্ম্ম উদ্দাম শহর তাহারে যেমন চাপিয়া ধরিয়াছে, দক্ষিণ দিক ধরিয়া মীনাবাজারের দিকে বা ইস্টিশানের দিকে যাওনের ভরসা। কখনই পায় নাই, যেহেতু তবু এদিকে গাছপালা, তবু এদিকে ঝিঁঝির শব্দ, ইহারা তাহার বড় জানাশুনা, বেশী করিয়া হারাইবার সম্ভাবনা এখানে নাই, আর কারণ যে এই পথেই মনিবদের রিখিয়ায় ফিরিতে হইবে; যে অনবরত মাথা ঘুরাইয়া দৃষ্টি ফিরাইতে তদীয় ঘাড়ে ব্যথা, এতক্ষণ এই পথে ডাক্তারবাবুর গাড়ী ব্যতীত অন্য ভাড়াটে গাড়ীও যায় নাই; এদিকে ক্রমে বেলা পড়িয়া আসিতেছে, ইদানীন্তন পাখী ব্যাপারে সমাধান সত্য, তবু অন্তঃস্থল ঝি, হাতে ঘাম হইয়াছিল।

সে ধীরে চলিতে থাকিল, যে সে তির্যকভাবে একদল দুবৃত্ত পদবাচ্য যুবকদের দেখিল, ইহারা মলিন বস্ত্র পরিহিত, ইহাদের রাশিকৃত চুলে তেল নাই, এখন ইহাদের হাতে হাতে তাস, যে ইহারা জুয়া খেলিতেছে। নিশ্চয়ই মনিব মহাশয় এখানে আসেন, ইহাদের প্রতি তিনি যারপরনাই ঘৃণাভরে তাকাইলেন, যে ছিঃ এহেন শ্ৰীসম্পন্ন শহরে যেখানে শিব নিজে বর্তমান, যেখানে সেদিন গতবছর (১৯৩৪) ভূমিকম্পে যাহার ক্ষতিসাধন করিতে পারে নাই, এই স্থানের সব কিছু শিব, তোমরা কেন সেই পুণ্যকে পরিহাস কর! এই মনোভাব এই জন্য যে ইহারা কেহ তাস ফেলিতে সময়ে শিব জয়ধ্বনি দিয়াছিল।

তত্ৰাচ তিনি কিন্তু যেহেতু আপন দায়ে বাধ্য; তাই উহাদের অতিশয় নম্রভাবে, ইস কি লজ্জা! জিজ্ঞাসিলেন,–ভাই যে ছেলেটি তোমাদের তাস খেলা দেখিতে আগ্রহশীল হয়, এ কারণ যে সে মনস্থ করে যে, তাহার ভাগ্য যাহা ইতঃপূৰ্ব্বে গণৎকারকে সে প্রশ্ন করিতে পারে নাই, এখন তাহার অভীষ্ট কল্পিত দান দর্শনে, যাহা নিশ্চয়ই তোমাদের কেহ ফেলিবে, তাহাতে স্থিরীকৃত হইবে।

সে জানে না এইভাবে সময়ক্ষেপ হয়, সম্ভাব্যের খেলার মধ্যে নিয়ত ঋতুপরিবর্তনের আঙ্গিক চরিত্র রূপ আরোপ করা বৃথা, যখন সে বুঝিবে তখন সে তাই ক্রোধপরায়ণ হইবেই, যেমন স্বীয় যুক্তি খণ্ডিত হইলে, যেমন আশা ভগ্ন হইলে, যেমন মানুষে বিকারপ্রাপ্ত হয়! তোমরা তাহাকে বলিলে, তোমাকে কি দারোগাবাবু পাঠাইয়াছে।

সে, সুঘরাই, উত্তর দিয়াছে, তাহা নহে, ঐ যে তোমাদের পিছনে যে ঢাকী ঢাক আঁকড়াইয়া ঘুমাইতেছে, তাহার ঘুম ভাঙ্গিলে, মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাঙ্গিবে, কেন না উহার পায়ের ঘুঙুর ইতস্তত নড়িতে আছে, ঘুম ভাঙ্গিলে জিজ্ঞাসিব যে, বিসরিয়ার বাপ যে ডোম এবং ঢাকী, নিবাস রিখিয়ায়, যে নিত্য এখানে আসে তাহারে দেখিয়াছে কি না। ইতিপূৰ্ব্বে কর্মব্যস্ত ঢাকীরা কেহ বলিয়াছে জানি না।

তোমরা কহিলে, উহার, সেই ঢাকীর এখন জাগিবার সম্ভাবনা নাই, আমরা জানি, সে অহিফেন সহযোগে মদ্যপান করিয়াছে। ইহার পর তোমাদের একজন ঘুমন্তর নাসিকার নিকট উৎকট চরসের ধোঁয়া ছাড়িলে তাহার পর বালকের উদ্দেশে কূট মুখ খারাপ করিলে–বালক যেন তোমাদের স্বরে। আপন চীৎকারের আওয়াজ পাইল, সে তাই মাথা ঘুরাইয়া আত্মরক্ষা করে যেমন, বলিতে পার সে কোনদিকে গেল।

আঃ বেচারী মনিব মহাশয়!

তেমনই ম্যাজিকওয়ালাকেও একটি বালককে দর্শাইয়া নিবেদন তিনি করিয়াছেন,–এইরূপ একটি বালক ক্রমাগত বলদ চোখে অনেকক্ষণ ধরিয়া তোমার নৈপুণ্যে একদম নিঃসাড় জড়; এমনও যে, যে সে হারাইয়াছে তাহা সে ভুলিয়াছে; অবশ্য যখন মাঝে মধ্যে সম্বিৎ আসে, সে তোমায় সিদ্ধ মহাপুরুষ জ্ঞান করিতেছিল, অগোচরে সেও অলৌকিকতাকামী; যে এবং তুমি তাহারে তোমার কোন বিশেষ ছল–হাতসাফাই, প্রদর্শন জন্য দর্শক সাধারণের মধ্যে তাহারে মনোনীত করত আহ্বান করিতেই, বালক ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠে। তুমি অভয়দানে কহিলে,–আরে ডরো মৎ, ডর কেয়া। ডর এই যে, প্রথমত তাহা গ্রাম্যভীরুতা, এবং যে চিরতরে নূতন করিয়া সে হারাইতে চাহে নাই, সে কান্দিতেছে কেন না এখানকার সমবেতকণ্ঠে, তদীয় কান্নায়, হাস্যরোলের মধ্যে শুনে যে,যাও এখনই ভেড়া হইয়া যাইবে। বালকরা পুনৰ্ব্বার যোগ দিয়াছে,যাও না উহাতে ঐ মাথায়, স্থাপিত কঙ্কালটিতে মিলাইয়া যাইবে। এই বলিয়া সকলেই ভূমি উপরে রক্ষিত চমকপ্রদ করোটি কঙ্কালের দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়াছে। আর যে সে বোন্ধান চোখে, সেই করোটি কঙ্কালের পানে লক্ষ্য করে, প্রত্যক্ষ করে যে তাহার ঘরপথ সকল, সে নহে, বোকার মত উহাতে ক্রমান্বয়ে ঢুকিয়া যাইতে আছে। যে এবং ব্যাকুলভাবে কান্দিতে ব্যক্ত করিল যে,–সে বড় হতভাগ্য, সে দুঃখী, সে মনিব হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে।

কিন্তু ইহার পূর্বাহে মানে এই খেলা দেখার আগে–যে সে বনপ্রদেশে একদা হঠাৎ আতা ফল দর্শনে যেমন চিনিয়া লইতে অপারগ হয় এখন তেমনই তাহার ভাবান্তর, যে সে হারাইয়াছে কি না ইহাও বিস্মৃত; কিন্তু এখন সে হারাইয়াছে; তাহার কথা শুনিয়া সমবেত ভীড় হাসিয়া উঠে; যে সে খুসী, সে খুসী।

হে ম্যাজিকওয়ালা,–তুমি তাহারে অব্যাহতি দিলেও সে কোনক্রমে তোমারই পাশ বরাবর আসিয়া দণ্ডায়মান থাকে, এখানে সে ঐ পূৰ্ব্বদৃষ্ট সন্ন্যাসীর মতই নিশ্চিন্ত, ইহার আসল কারণ এই যে, আমি তাহার মনিব, তাহার খোঁজে আছি, এখানে যদি আসি, স্বভাবত আমি ঐ নরকপাল হেরিয়া কি খেলা চলে তাই ধারণার নিমিত্তই, তোমা পানে তাকাইব ইহাই মানুষের প্রকৃতি মানুষের চরিত্র, হৃত বস্তু সম্পর্কে নূতন করিয়া অবহিত হইব আর যে তাহাকে দেখিতে পাইব। সে অনেক সময় যাবৎ ঐ ভাবে ছিল, যেহেতুও সেখানে সম্ভবত হাড়ের খানিক ছিল। কখন সে চিন্তার রহস্য ছাড়াইয়া–বদ্ধজীব ডোম।

ইহা এক গূঢ় কারণেই যে সে এই পরিবেশ ত্যাগ করিতে চাহে নাই। তোমার বাঁশীতে তাহার মন ছিল না, সে শুধু এই স্থলকে কজা করিয়া দাঁড়াইয়াছিল, কেননা কিছুক্ষণ আগে তাহাতে কোন প্রকারের, ইহার সর্বথা উকট, কীদৃশী কুটিল, অভিনব অমানুষিক বিভীষিকার সঞ্চার হইয়াছিল।

এবং ইহা তৎকালেই ঘটিল, যে মুহূর্তে সে আমাদের প্রমত্ত হইয়া অন্বেষণের মধ্যে অবলীলাক্রমে, ঐ সুসাজান পানের দোকানের সৌখীন উৎকৃষ্ট আয়নাতে এক মায়াবী প্রতিফলন সাক্ষাতে নিশ্চল, যে সে ব্যামোহাবিষ্ট, যে সে পূর্ণ সম্মোহিত হইয়া থাকে; অবশ্য খানিক বাদেই এবার তাহার হৃৎপিণ্ড কাঁপিল, এবার তাহার তালু শুষ্ক হইল এবং যে সে পদমেক পশ্চাতে হটিল।

যে, আয়নাতে যে সে-ই, নিজেই, যে যাহাকে সুঘরাই নামে ডাকিলে সাড়া দেয়, যে জাতিতে হয় ডোম, গোত্র যাহাদের নাই, অতীব স্বাভাবিকভাবে প্রাকৃতিকভাবে সে হয় ডোম, যাহার দৈবাৎস্পর্শে পূজার্থিণী গরদ পরিহিতা করুণাময়ী সৰ্ব্বদা স্নেহশীলা মনিব পত্নীশিহরিত, জয়দেব পাঠ স্তব্ধ, হস্ত হইতে পুষ্প সাজিচ্যুৎ হয়, পুনরপি তিনি স্নান করেন–এই তিলেক পরিচয়ে অবধি লিখিত নাই সে বিজাতীয় ঘৃণা হইতেও বঞ্চিত হইয়াছে–আর উচ্চবর্ণের ঘৃণা যাহা তাহার জীবনই যে, যাহার পিতা নাই, মাতা নাই, ভ্রাতা ভগ্নী নাই, পত্নী নাই–যে যাহার মহান-হৃদয় মনিবরা আছেন; যে যাহাদের সমভিব্যাহারে এখানে আসিয়াছে; যে সে অধুনা হারাইয়া গিয়াছে; কিন্তু কিছুই বিশদ হইল না।

যে সে-আয়নাতে নেহারিল মাত্র যে এক ভূমিকৰ্ষণকৃত জমি, পূৰ্ব্ব ফসলের গোড়া পর্যন্ত যেখানে নাই, এইবার খর অকর্ষিত জমি মতন রঙের কাহাকে কোন অবয়বকে দেখিল, আশ্চর্য্য যে সে জল চাহিতেছে, ইহাতে সুঘরাই ঢোক গিলিল,-জল!

জল ত দান করা হইয়াছে–জল পিতৃলোকে গিয়াছে! কিন্তু সে এতই তৃষ্ণার্ল্ড–তৃষ্ণার্ত না ভীত– আয়নায় প্রতিভাত মূর্তি দেখা গেল ঢোক গিলিল, ইহাই তাহার পূর্বপুরুষ; যে উহা কাহার প্রতিবিম্ব, ঈদৃশ প্রশ্নে সে বিস্ফারিতনেত্রে প্রৌঢ়শীলা সদৃশ; এমনও সুতরাং ফলে মানে, অর্থাৎ, যে উহা আমিই ত, এহেন বাক্য নিশ্চয়ত্মক করিতে, বাস্তবিক করিতে, যে, স্বভাবত লোকে নিজ বক্ষে হস্ত স্থাপনে, অথবা এক্ষেত্রে অঙ্গুলি দ্বারা যেমন নির্দিষ্ট নিজেকে করে তেমনই এখন তাহার, সুঘরাই এর, সেই বৃত্তির অভাব। থাকে; আরও যে, ‘উহা’ এই শব্দ ব্যবহার করিতে আপনকার অজ্ঞাতেই সে মূঢ়মতি–আর যে ইহা অবিশ্বাস্য নহে। সম্মুখে তাহার শনৈঃ সংজ্ঞাবিধ্বংসী নিঃশব্দ!

চেঞ্জাররা যে কোন তুচ্ছ কিছু নিরখিয়া কহিল–ভাবা যায় না কি গ্র্যাণ্ড! ইহারা তাহারা যাহারা স্বপ্নের ভার বহে! যাহারা স্থাবরকে সংবেদনশীলতা দিয়াছে।

ইতঃমধ্যে সুঘরাই আপনার পিছনে তাকাইল, সেখানে কেহ নাই, সেখানে ধূলা উড়ে, সেখানে পাতা বিদ্যমান; তখনই সে সভয়ে নেত্রপাত করিল, অদূরে বিভিন্ন তিলকধারী লোকেরা একের পর এক সাধক যায় ও আসে, ইহাদের দর্শনেই বুঝা যায় যে কে কোন সম্প্রদায়ভুক্ত, সে অবাক নয়নে তিলমণ্ডিত ললাট লক্ষ্য করিল, এমনভাবে করে যাহাতে বুঝায়–যে তাহার আক্ষেপ হইল, যে সে তিলক পাঠে অপরিজ্ঞাত, ইহা ঠিক যে বিবিধকণ্ঠের জয়ধ্বনি তাহাকে এখন চালিত করিল এবং আবার সে আয়নায়, ইদানীং সে নিজ হাতের উল্কীকৃত নীলাভ ডাং-উদ্ধত কিদিম কাঠকোম-টি ভারী অঝাঁপসা দেখিল; এখনও উল্কী বিধায়ে তদীয় হাত কিঞ্চিৎ ফুলো, কেননা ঐ বিছা উল্কী দুই হাটবার আগে, হাটেতেই করান হয়; ইহা তাহা স্মরণেই আঁকান যে, ঠিক সেদিনই সকালবেলা তাহার তিতির, তাহার ভগ্নীপতির গায়ের প্রায় এক আঙুল নিকটে উপস্থিত এক কাঁকড়া-বিছাকে পড়িমরি করিয়া দৌড়াইয়া আসিয়া ঠোঁটে ধরিয়া লইয়া ঠুকিয়া তৎক্ষণাৎ খাইল।

আর যে ইহা দর্শনে গর্বিত সুঘরাই উল্কীকরণের সঙ্কল্প করে: যে একটি তিতির ও তাহার ঠোঁটে একটি বিছা! কিন্তু দুইটির খরচা ছ’ পয়সা, আপাতত অগত্যা শুধু বিছাতেই সন্তুষ্ট থাকে; তিতির সে আঁকাইবেই, আঃ! তাহার চঞ্চপুট দ্বারা বিছা আক্রমণ, আঃ তাহার পক্ষদ্বয় কি মনোহর প্রসারিত হয়, আঃ! যেমন তাহা অনাদিকাল যাবৎ অমনই অফুরন্ত পক্ষ মেলিয়া আছে।

এখন আয়নাতে সে ওতপ্রোত, এবং বিছা উল্কী সত্ত্বেও এখনও কিম্ভুত সন্দেহ তাহাতে বর্তমান; যে সে কিছুতেই কোন উপায় ঠাওরেও সে চিনিতে পারে না ঐ প্রতিবিম্বকে; কেবলই আরবার আপনকার নিরীহতা, ইনোস্যান্সএ ভ্র সটান করে। আবার অন্যপক্ষে নিজেকে নিশ্চয়ই “উহাই’ শব্দে অভিহিত করিতে, সনাক্ত করিতে, সে নিজে ভীতিপ্রদ প্রহেলিকা।

কি হেঁয়ালীপূর্ণ আবছায়া! অঙ্গভঙ্গী মুখবিকৃতির প্রয়াস সবই বিদ্রুপাত্মক অন্ধকারে পরিণত; ক্রমে ইহা তাহার মনে পড়ে মানে অস্বস্তি হয়, যাহা এই যে, তাহার কেহই, এমনও যে তাহাদের জাতের মোড়ল, এমনও যে অনেক–তাহাদের অপেক্ষা উচ্চবর্ণের, যাহা এই জল-চল জাতের লোক যেমন আপন বয়ঃক্রম জানে না, ঠিক তেমনই, তেমন সেও যেমন নিজ বয়স জানে না, তেমনই নিশ্চয়ই সেও আপনার চেহারাবিষয় কিছুই জ্ঞাত নহে, যে চেহারা কুয়োর কাঁচ-জলে প্রতিবিম্ব, আর অন্যসূত্র হইতে তাহার শোনা-দেখা নহে!

সুঘরাই এর মনে হইল, সে যেমত ভাসিয়া আছে, তাহার দেহ নাই, মৃত্তিকা নাই, এবং হঠাৎ সে আপনার বিছা-আঁকা হাত আঘ্রাণিল; যুগপৎ দেখিল ঐখানে, আয়নাতে যে উহা, যে সে সে-ই, যে হারাইয়াছে, ইতিমধ্যে একদা যে মনে হয় আমার চেহারা নাই, তবে আমি হারাইব কেমন–এবম্বিধ ধারণা সর্বৈব বলদ!

আমি উহা, আমিই উহা এবং ইত্যাকার বলিতে ও ভূমিতে পাবাজাইয়া কবুল করিতে, সবিশেষ আত্মপ্রত্যয়-নিবন্ধন সে মরিয়া হইল; আমি ও উহা যে অলৌকিক বিবাহযাত্ৰা আমি দেখিয়াছি, সেই চৈতন্য সত্তা তাহার জড়তা ভাঙ্গিল; ইতিমধ্যের ঘোর ব্যবধানকে সে পান করিল, সে ইহাতে বেসামাল হইল; সহসা শ্রুত হইল যে সে, সাদরে ‘আতিতি-তি’ শব্দে উহাকে তথা আপনাকে ডাকে; আবার আচম্বিতে ঘোষিয়া উঠিল,–আমি সেই যাহার এক পাখী আছে। ইহার সঙ্গেই জয় বাবা বৈদ্যনাথ ধ্বনি তুলিতে চাহিলেও বেচারা পারে না। যে এবং ধীরে কহিল,–উহা সেই আমি যাহার এক পাখী আছে। অথচ স্বরে কেন যেন মনে হয় পাখীটি বেহাত হইল।

তৎকালে পানের দোকান হইতে, হে ম্যাজিকওয়ালা তোমার ডম্বরু ও বাঁশী শ্রবণে সেই উচ্চবর্ণের ভাবনার দ্বন্দ্বের ছেদ পড়িল। ম্যাজিকওয়ালাই তাহার উত্তর। সঠিকভাবে বলিতে গেলে বলা যায় যে সে যেন বাঁচিল; ভাগ্যশঃ সে বালক, তাই তোমার ম্যাজিক দর্শন জন্য ঔৎসুক্য-পরতন্ত্র দৌড়াইয়া আসিতে এক নিমেষ ত্রিকূট পাহাড় তাহার চোখে পড়িল; তোমার এখানে সে অব্যাহতি লাভের পর একদিকে বড় স্বস্তি বড় স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে, তেমনই তোমার নৈপুণ্য দেখিতে তাহার মনে হয়, হায় মনিব মহাশয় ও তদীয় পত্নীর কত জিনিষ খোয়া যাইতে সে নিজে তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া বাহির করে, আর অদ্য সে নিজেই হারাইয়া গেল!

এবং লকড়কে সে যথেচ্ছা গালাগাল দিল; তাই সে ক্রমে পুনরায় বিমর্ষ এবং তজ্জন্যই তুমি যখন খেলা দেখানোর পর মহাচাতুরিতে নরকপালটি স্বীয় মুখের সন্নিকটে উন্নীত করত, তোমার বিড়ির ধোঁয়া, যাহা নীল, ঐ নর কপালের ছিদ্র দিয়া বালখিল্যতাবশত পাচার করাও, ফলে, কপালের করাল। দন্ত বহিয়া ধূম অনর্গল বহির্গত হয়, ইহা প্রত্যক্ষেও সে অন্যান্য সবস্ত্র ও উলঙ্গ বালক বালিকাদের মত হাসে নাই, সে কোন দিকে গেল জান! সে ম্যাজিকের কৌশল হইতে, জট হইতে, ক্রমশঃ খুলিয়া সহজ হইয়াছিল।

ইহা ধ্রুব বটে যে, আপনারে সনাক্তকরণে অকৃতকার্য হওয়াতে এবং যে আমার একটি পাখী আছে–এখন, উপস্থিত যাহা নাই ইহা ভাবিতে সে অধিকন্তু মুষড়াইয়া পড়িল, যেমত সে দ্বিগুণ হারাইয়া গিয়াছে; তাহাতে বিজাতীয় আক্রোশের ধমক উদগত হইতে চাহিল, সে দুবৃত্ত যেমন, কাহার উপর যে রুষ্ট সে ইহা বুঝিতে চাহে নাই; এমনও যে এখানে সেখানের মোটা নিম ডাল দিয়া পাথরে সিদ্ধি পেশাই করা দর্শনে প্রলুব্ধ হওয়ত, প্রসাদের নিমিত্ত কিয়ৎ দূরে দাঁড়াইতে সম্প্রতি কোন সুমধুর পাঠের আওয়াজে সে আকৃষ্ট হইল; এবার পাঠ বন্ধ হইয়া গীত হয়, যথা–

তুলসী উহাঁ যাইয়ে যাঁহা আদর ন করে কোই।
মান ঘটে মন মরে রাম কো শরণ হোই ।৷

আসমুদ্রহিমাচলে যে যেখানে রোমাঞ্চিত হইল, তাহার এই শুদ্ধ গীতের শব্দতরঙ্গই কারণ; এখানে অনেকের পুলকাতে নয়নযুগ সজল, অনবরত রামনামে স্থান সুন্দর হইয়া উঠে; ইহাতে সুঘরাই বুঝে যে সম্মুখে রামায়ণ গান হইতেছে, কিন্তু তদীয় মানসিকতা অত্রাহি সত্ত্বে সে স্থান পরিত্যাগ করে নাই, প্রথমত সে মর্মে মর্মে জানে, যে তাহার সন্ধানের মধ্যে দেবালয়, সন্ন্যাসী, অবধূত, গীতা বা রামায়ণ পাঠ আমাকে চুম্বকের মতনই টানিবে, যেহেতু আমি ও মদীয় পত্নী অতীব ধর্ম্মপরায়ণ, যদিও জানি সে নীচকুলোদ্ভব এবং এই ব্ৰণবিরহিত পবিত্র রামকথা যাহা মোক্ষ ও প্রীতিদায়িকা, তন্মিমিত্ত অবশ্য তাহার কোনই মতি নাই,–উহার বয়ঃক্রম ইহার কোন হেতুই নহে,–তবু তাই সে কিছুকাল বাধ্য হইয়া যাপন করিবে; এখন উক্ত গীতে সে আলোড়িত বিশেষত কথকের বিন্যাসই তাহার অনুপ্রেরণা হইয়াছে।

কথক ঠাকুর বলিয়াছিলেন, রে পাগল মন, ওরে তুলসী তুই ছায়া ত্যাগ করে রৌদ্রে যা; তুমি ভুজালিঙ্গন ছাড়িও, এমন স্থানে যাইও যেখানে অহঙ্কার অহরহ দলিত হয়, যেখানে তোমায় উচ্ছিষ্ট দেয়, লোকে দূরদূর করে, আগুনটুকু চাহিলে হাঁ হাঁ শব্দে তাড়না করে, কাহারও প্রজ্জ্বলিত দীপ হইতে দীপ জ্বালিতে যাইলে সে ভাবে আমি সর্বস্বান্ত হইলাম–সেখানে মন যাও, যেখানে মরমে তুমি ম’র, তোমার কেহ নাই, পরিজন নাই, তুমি একা সম্পূর্ণ তুমি যখন আপন বোঝা তখনই যখন ঠিক ঠিক দুঃখ পাইবে; তখনই রাম স্মরণ হইবে, অবশ্য দুঃখ অনুভবের মধ্যেও আমি আছে; তবে, এই আমি’র দোষ নাই, সেই আমি’তে রাম নাম স্মরণ হইবে। তেমন দুঃখের মধ্যে তেমন দুর্ভাগ্যের মধ্যে স্বতঃপ্রবৃত্ত হওয়ত হে মানুষ তুমি যাইও। রামের কথা স্মরণ হইবে। হায় রাম বলিতে পারিবে।

যথা ভূমি সব বীজময় নখত নিবাস আকাশ।
তথা রাম নাম সব ধরমময় জানত হি তুলসী দাস ॥

সুঘরাই এই গীতে ডোমসুলভ চোখে, বালক-উচিত ভঙ্গীতে গায়কদের মুখপানে চাহিয়া থাকে, ইহা অলোকসামান্য কাব্য, কাব্যত্ব ইহা তাহার নির্বুদ্ধিতা বশত সরলতায়ে নহে, তবু সে অন্যমনে দেখে। সরলতা যাহা ভক্তির বীজ, অবশ্য কোন শিশুরই সরলতা নাই, তাহার অপরিণত স্বভাব আছে, সরলতা সন্ন্যাসধৰ্ম্মের, সরলতা সন্ন্যাসীর, অবতারাদির ভাবই সরলতা–ঐ সুর উঠা পড়া দার্ভঙ্কুর রোমন্থনকারী মৃগশিশুর ন্যায় ক্রমে এখন দেখিতে লাগিল।

অবশ্য সে ডোমপুত্র, গীত শুনিতে ডিগরিয়ার পাহাড়, যেখানে সূর্য ডুবে তদবধি শঙ্খচিল যেখানে বিন্দুবৎ, পদ্মের কোরক যে পর্যন্ত গিয়া কুৎসিত, তদবধি ‘ভূমিতে পরিবর্তিত হইতে পারিল না, হায়! আমি ভূমি, বলিতে বিবেক তাহার হয় নাই; অন্যপক্ষে অবশ্য, আকাশ কথাতে, তদীয় শরীরমধ্যে বিপরীত পাকে, কি এক কিছু যেমন বা ঘুরিতে থাকে, কিন্তু ঐ প্রক্রিয়া অভাবনীয় ধীরে; সে অবশ্যই মশাল তৈয়ারী করে যদ্বারা আকাশকে দেখিবে, যে সে তখনই নিজেরে ঐরূপ কর্মে ব্যাপৃত অবস্থা বুঝিয়া ধড়েতে আর ছিল না, তাহার ওষ্ঠ শুষ্ক হইয়াছে, কেননা মধ্যে কোথাও, এই ব্যোমের, মেঘাশ্রয় নাই,–ক্রমান্বয় সন্ন্যাসীর দৃষ্টিতে নিশ্চিহ্ন হইয়াছে যাহা।

হায় সে ঐ পদবন্ধের যথা’র নিয়ন্ত্রিত, আনীত বাস্তবতায় আতান্তরে তাহাকে নিক্ষেপ করিল, সে গণৎকারের গলা যেন পাইল, যে এবং ইহাতে আরও মূঢ় সে হয়; তবু কোনওক্রমে কথকঠাকুরের দিকে দৃষ্টিপাত করিল।

ইনি বলিতেছিলেন, রাম নামে আঁখি ঝুরে…! এই সূত্রে, যদিও ঐ উপদেশ-ইঙ্গিত চমৎকার।

তবু বলি একদা, আমার পরমারাধ্য মাধব আমায় বলিয়াছেন, ‘ভগবানের নামে, আমার নামে শিশু গাত্রগন্ধ যে না পায়, সে আমারে পায় না’ আঃ শিশু গাত্রগন্ধই রাম!

কথকঠাকুর এমনভাবে, রাম উচ্চারণ করেন যেন চিরঞ্জীব হনুমানের চোখে জল আসিল।

ঐরূপ রাম উচ্চারণে যে সুঘারইএর অদ্ভুত রোমহর্ষাদি লক্ষণসমূহ উপস্থিত হইলেও, ওষ্ঠ এখন আর্দ্র হইলেও, কোথাও যেমত বা আড়ষ্টতা জড়তা সঙ্কোচ জাড্য কুণ্ঠা অপ্রতিভ, মেদাটে বৈলক্ষণ্য আছিল, এবার হঠাৎ সে ক্ষোভে অনুতাপে ক্ষিপ্ত, কেননা নেতৃবর্গশিক্ষিত কীদৃশী কদর্য্য, কি পর্য্যন্ত প্রমত্ত হিংসাপ্রযুক্ত, জগতের-নীচতম বৃত্তি সেই রাজনৈতিক রোলে তাহারই সুঘরাই স্বজাতিবৃন্দ বেচারী হরিজনরা, এহেন সুন্দর রাম নাম মধ্যে মধ্যে করে, তাহাদের সেই চীৎকারের সহিত তাহাদের উৎকট গাত্রগন্ধ স্থানকে অপবিত্র করে।

এবং সে হঠাৎ ‘আমি ডোম’ ‘আমি ডোম’ ইত্যাকার অনাৰ্য্য চীৎকারে–এখান হইতে নিষ্ক্রান্ত হয়, এইকথা মনে পড়িতে ‘আমি ডোম’ ‘আমি ডোম’ বলিতে ইহাই ধৰ্ম্মত অর্থাৎ ব্যক্ত হয় যে মনুগণের পূৰ্ব্বে বহুকাল হইতে আমি হারাইয়াছি!–তাহার পশ্চাতে সঙ্গে সঙ্গে রাম নাম নিশ্চিত গিয়াছিল। এবং মনিব মহাশয় যে ব্যক্তির নিকট সংবাদ লইতে এতেক বর্ণনা করেন, তাহাকে সুঘরাই বিষয়ে আরও প্রশ্ন করিলেন–এবং তৎসহ তাহার অন্তরে প্রার্থনা শ্রুত হইল, যে, হায় ঠাকুর তুমি অন্তৰ্য্যামী তুমি তাহার । শুভাশুভ সবই জান, তবু…।

.

অনন্তর তিনি, মনিব মহাশয়, যারপরনাই অবসন্নচিত্তে, পরিশ্রান্ত হওয়ত শিবগঙ্গার ধারে আসিলেন, এখানে তাঁহার গায়ে আদ্র মসৃণ বাতাস কিয়দংশে তাঁহার ক্লান্তির অপনোদন করিল, দেখিলেন উদ্বেলিত জলস্তর, অদূরে জনৈকা লোলচৰ্ম্মাঙ্গিণী অশীতিপর বৃদ্ধা, দেহ যাহার নজ, এখন জলে রহিয়া মুখ প্রক্ষালনে নিয়োজিতা, যে এবং তজ্জন্য তদীয় বিশুষ্ক কদাকার প্রলম্বিত নিৰ্বাপিত স্তনদ্বয় জল-ছোঁয়া, সুতরাং জলস্তরে ভাসমান ফুল ও পাপড়ি যাবতীয় উহাতে আসিয়া লাগিয়া ঠেকিয়া সরিয়া আঘাতিয়া । বিলি কাটে, অতএব এতাদৃশ সমাপতন, যদি অপি এলেবেলে, বড়ই কৌতুকপ্রদ, স্রেফ ফাজিল।

ইহা প্রত্যক্ষেও যে তিনি কোনই মজা আহরণ করেন না, এ কারণ যে সদাই তাঁহার মনে ইহা আঁচড়াইতে আছিল, ‘পুষ্পদন্তের’ শ্লোক আমার কণ্ঠস্থ করা বৃথা, কোথায় শিবই মদীয় অদ্বিতীয় স্মরণ মননের বিষয়ভূত হইবেন, না, কোথায় আমি ডোমপুত্র সুঘরাইএর সন্ধান করিয়া ফিরিতেছি। এই কি আমার নিয়তি।

মনিব মহাশয় ইদানীন্তন বৈচিত্তপরতন্ত্র সর্বত্র শ্যেনদৃষ্টিতে বিশ্লেষিত করিতে এক মহা আনন্দময় অগ্নিতুল্য দেদীপ্যমান যোগীকে দেখিলেন, দর্শনমাত্রই বিশ্বাস ইনি মহাপুরুষ, ইনি যে পরমহংস তাহাও নিশ্চয়, কেননা ঠাকুর রামকৃষ্ণ ইহাদের লক্ষণের কথা বলিয়াছেন; সেই মহাপুরুষের নিকট বেশ কিছু সবস্ত্র ও প্রায়ই উলঙ্গ বালক বালিকা; যাহাদের তিনি নিশ্চয়ই তদীয় সুদীর্ঘ ধীরনেত্ৰ মেলিয়া একদৃষ্টে দর্শনে আপনাতে বালকস্বভাবে আরোপ করিতেছিলেন, এবং মধ্যে মধ্যে মেওয়া মিছরি বিলাইতেছিলেন; তিনি নবাগত দেখিলেই,–ওঁ তৎ সৎ, এস এস আমার সমক্ষে দাঁড়াও, তোমারে আমি নয়ন ভরিয়া দেখি, খেলা কর, কথা বল, আমি শুনি, ওঁ তৎ সৎ।

মনিব মহাশয় সাষ্টাঙ্গে প্রণামের পর নিবেদন করিলেন,–ভগবান, আপনি করুণাময় ক্ষমাশীল, আমার অপরাধ মার্জনা করিবেন, যেহেতু আপনি বালকবালিকারে সাধন আদর্শ বলিয়া মান্য করেন, জ্ঞান করেন ও তদ্বারা অদ্ভুত সরলতা নির্মাণ ও তদ্বারা, ঐ সরলতার দ্বারা, অদ্ভুত রঞ্জু নির্মাণ করেন, তাই নির্ভয়ে আপনারে জিজ্ঞাসা করি, এক বালক–এই পৰ্য্যন্ত বলিতেই সেই মহাপুরুষ, মৃদু হাস্যে, ইহাতে সৃষ্টিতত্ত্ব যেন নড়িয়া উঠিল, কাব্যবৃত্তি বিকচ হইল এবং কহিলেন যে,–সে কাছে আসে নাই, প্রত্যেক বালকবালিকা তাহারে অভয় দেয় তবু,–আহা আমি তাহা দেখিয়াছি এক বালক যখন আর এক’কে অভয় দেয়–সে এক বলিহারি ছবি!…

তিনি সহাস্য বদনে আরও বলিলেন সম্ভবত এত ছোটদের মধ্যে যাহারা মাথায় ঘোট সেই সকলের উলঙ্গদের মধ্যে কি যাইব, ভাবিয়া সে চলিয়া গিয়াছে, আমার নিকট সে’ও ইহাদের মতই, তবু সে আমার আহ্বান বুঝে নাই…এখন এই মিছরি লও, মেওয়া লও, বেচারীর মুখ শুকনা। লও, তাহার মঙ্গল ইচ্ছাময় করিবেন।

মনিব মহাশয় সশ্রদ্ধায় করজোড়ে মেওয়া মিছরি গ্রহণ করত মহাপুরুষের পদাৰ্চ্চনার পর ধীরে কহিলেন,–প্রভো, আপনি সেই যিনি পত্র উদগম রহস্য দেখিয়াছেন, আপনার হাস্যে অচিন্ত্যনীয় শ্লোকপ্রবাহ, আপনার চাহনিতে শত বাত্যাতেও দীপশিক্ষা অস্পন্দ হয়, আপনি জ্ঞাত যে সেই অভাগা কেন আপনার সন্নিহিত হয় নাই; সে ঐ সময় এক দাঁড়কাকের রব শুনে যখন আপনি তাহারে আহ্বান করিলেন, সে দেখিল যে এখানেই আপনার নিকটেই বাঘেরা খেলোয়াড়ের ঘুম ভাঙ্গিল, অর্থাৎ আপনার নিকটেই উহার ঘুম থাকে, যে সে দেখিল এক উন্মাদ তুলা পিজিতেছে, এবং পরক্ষণেই আবার মহানন্দে অচেনা আকাশ লইয়া খেলা করিতেছে, আমার বুদ্ধি বলে, ইহা আপনি তাহারে দর্শাইলেন। সে অথচ ভীত হইল। সে কাষ্ঠচ্যুত কূৰ্ম্মবৎ এক অভিনব জীব, তাহারে রক্ষা করুন, হায় সে অবশ্যম্ভাবিতার দিকে ছুটিল!

তিনি, মনিব মহাশয়, অতঃপর চলিতে থাকিয়া আপন প্রসারিত করপুটে ঐ মিছরি ও মেওয়া দর্শনে অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিলেন না, ইহাতে অত্যাশ্চর্য্য ভালবাসা ছিল। এ কারণ যে পশ্চিমের পত্রভেদী সূর্যরশ্মিতে স্ফটিকতুল্য মিছরিখণ্ডে অজস্র রামধনুর আশ্রয় হইয়াছে, কিসমিসগুলিতে রঙ ধরিয়াছে, ইহারা বহু পুরাতন হইয়াছে।

এবং যে ইহা হইতে চক্ষু তুলিতেই তিনি থ, হস্ত হইতে তখনই প্রসাদী সকল মাটিতে পতিত হইল, যে সেইদিকে তাকাইবার সময় পর্যন্ত পাইলেন না, অথচ যে তিনি প্রসাদ পতিত হওয়ার অপরাধে আপন জিহ্বা দংশন করত আপন কর্ণদ্বয় মলিতে থাকিলেন, কেন না এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখিলেন: এক। মৃত ব্যাঙ, যাহারে লইয়া দু একটি কাক ছিন্ন করিতেছে, তিনি ইহা যে তীর্থক্ষেত্র তাহা ভুলিলেন, কোন। শিব জয়ধ্বনি আর শুনিতে পাইলেন না।

যে এহেন দৃশ্য তদীয় গৃহদ্বারকে পৰ্য্যন্ত আঘাত করিল, সাঁওতাল গৃহদ্বারে কত লতাপাতা, বাঙ্গলার গৃহদ্বারে এস মা আনন্দময়ী–এহেন দৃশ্য তদীয় মমত্ববোধকে পরিহাস করিল। এবং যে তিনি নির্ঘাত, তিনি নির্ঘাৎ হঠাৎ, যেন মনে মনে কলের গানের কাছে যাইলেন, আপন আসবাবপত্র জামাজুতা দেখিলেন, স্ত্রীর ফটোগ্রাফের নিকট দাঁড়াইয়া খানিক, তৎপর যেন পাইপ ধরাইয়া একটি টান দিয়া সিদ্ধান্ত করিলেন, যে ঈদৃশী নির্দয় দুষ্কৰ্ম্ম অভ্রান্ত যে সুঘরাই কর্তৃক সংসাধিত হইয়াছে।

তখনই তিনি স্রিয়মাণ ইহাতে; অবিলম্বেই বুঝিলেন যে সে যেন দারুণ শিক্ষিতের মত রূপান্তরিত, যে তাহার নিজের মস্তকের করোটি সম্পূর্ণরূপে বদল হইয়া গিয়াছে; যে সে নিজের উপর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হইয়াছে, একের পর এক সংস্থান সে ক্রমাগত আশাতে, কখনও কৌতূহল প্রবর্ত্তীত হইয়া ভাঙিয়াছে ও যে ইত্যাকারেই ক্রমবর্ধমান রাগে, বিশেষত নিজেরে অপাঙক্তেয় ক্কচিৎ জানিয়া, কভু নিরুপায় বুঝিয়া, সে মারাত্মক আধুনিক হইয়াছিল; অধুনা সে যে ডোম ইহাও বিস্মৃত; যে এবং সে মানসিক বৈগুণ্যে পথের কুকুরকে ঢেলা দ্বারা আক্রমণ করিয়াছে, যে অনেক নিরীহ কাঠবেড়ালীকে ক্রুর সর্পের হিস শব্দে খেদাইয়াছে।

যেমনভাবে সে তদ্রূপ বিষাক্ত আওয়াজে তাহার আপনকার প্রাণপ্রিয় জীবিত স্বরূপ তিতিরটিকে একদা ভয় প্রদর্শন ক্রমে খুসী হয়, মনিব মহাশয় বুঝিলেন, সেই প্রবৃত্তির নাশ হয় নাই, অথচ কিন্তু ঐ ব্যাপারের জন্য সে, সুঘরাই, তখন অপ্রতিভ হয়, তখন অধোবদন হয়; যাহা এইরূপ ঘটে: শনিচারোয়া সেদিন না আসাতে সুঘরাই ভিতরের বারান্দা ঝাঁট দিতেছিল, তদীয় পাখীটি নিকটেই এবং উহার গাত্রে সকালের রোদ খেলিতেছে, যাহা সহসা সুঘরাই অবলোকনে আবিষ্কার করিল; যাহাতে সে অতিশয় তন্ময়; এতদ্ভাবাপন্ন রহিতে ক্রমে, তাহার সারা দেহ এক যাদু আবেগে তছনছ হইল, রোমকূপে ঘোর শব্দ উঁচাইয়া হৈ দিয়া উঠিল।

যে আর, সে এরূপ বাক্যে আপনাকে, সে উচ্ছাসকে, প্রকাশিল,–ওরে আমার সোনার পক্ষী দেখ, দেখ, এখন আমার সর্বশরীর তোমার প্রীতিবর্ধন নিমিত্ত, তৃপ্তিসাধন হেতু, সম্পূর্ণ পতঙ্গরূপ ধারণ করিয়াছে, হে রে পক্ষী তুমি আমারে সত্বর খাও, হে রে তুমি আমারে বিনা লবণেই খাও, আমি সার্থক হই! ইহা বলিবার পর মহা আদরে গদগদভাবে সোহাগাত্মক ভাব জানাইল ও তৎসহ সে নিজ হস্ত প্রসারিত করিল, যাহাতে তাহার প্রিয়তম পাখীটি চঞ্চদ্বারা উহার হাতে মৃদু টোকা দেয়।

সে ভারী খুসী, যে এবং ইহাতে অঢেল উফুল্ল হওয়ত আপন দেহ, উপস্থিত তদীয় দেহ যাহা চতুষ্পদ ভঙ্গীতে ছিল, তাহাতে যেন গোপন কোন দুর্লভ কিছু ভোজ্য বস্তু পাকিয়া আছে, তাহাই দেহ। হইতে, অদ্ভুত ভাবে আন্দোলনে সুঘরাই উৎক্ষিপ্ত করিয়া তিতিরটিকে দিতে চাহিয়াছে, কি-যে-নিবেদন করে তাহা ব্যক্ত করিতে অনেকই বাস্তবতা, অনেক প্রাচপ্রত্যক্ষ প্রতীয়মানতা সে স্মরিয়াছে।

ও যে অবিচারিত চিত্তে অসাধনেই ডোমবুদ্ধিতে বলিয়াছিল,–ওরে পক্ষী, এখন আমি নিজেই ঐ যে দুইটি পাহাড় স্পর্ধাভরে একে অন্যের প্রতি চাহিয়া আছে সেই দুইটিই আমি, এখন আমি ত্রিকূট, এখন আমি ডিগরিয়া পাহাড়, এবার ইতোমধ্যে যে দিক সকল, যে রহস্য ব্যাপ্ত, তাহা কজা করিয়াছি, তুমি সত্বর তাহা গ্রহণ কর গ্রহণ কর, খাও আমি সুখী সার্থক ও ধন্য হই।

পরক্ষণেই বলিল, আয় আমরা কামড়াকামড়ি করি, কুকুররা যেরূপ করে! আমার ভগনীপতি ও তাহার স্ত্রীলোক যেরূপ করে।

এবম্প্রকার বচন সুঘরাইএর নিজেরই, হৃদয়ঙ্গম হইতেই সে হরষে কণ্টকিত, সে অতিকায় সুবিশাল, এখানেই এই দেহে সূৰ্য্য উঠে ডুবে ইহা প্রমাণিত হইতেই সে অধীর আছে; ভাগ্যে পক্ষী দূরে যায়, ভাগ্যে ঝাঁটা নিকটেই আছে, আর যেটি ধরিতেই সে প্রকৃতিস্থ হইল! তাই সাব্যস্ত হইল যে, সে ভীত ও যে এহেন ভীতি সম্পর্ক সুঘরাই একদমই অপরিজ্ঞাত ছিল; নিশ্চয়ই ইহা সর্প বিছা ব্যাঘ্র অন্ধকার ঝক্কা বজ্রপাত প্রেত পেয়াদা ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণ হইতে,বা ঠকিবার ভীতি হইতে ইহা, মোটর গাড়ী হইতে ইহা হয় অধিক কূট, বাঁকা!

এখন, সম্মুখে কোন কিছু কম্পনে অনুভবের পূৰ্বেই যে ঝাঁটার জলদি শব্দ কিন্তু তাহারে আকৃষ্ট করে, এখন দেশীয় ঘৃত মিশ্রিত মুরগীর মাংস পাকের গন্ধ তাহাকে প্রলুব্ধ করে নাই; যে অন্যবিধ গন্ধ হইতে ঘৃতগন্ধ যে স্বাদু তা বুঝে ইদানীং! ঝাঁটার আওয়াজে সে আর এক হইল; ফলে ত্বরিতে উহা অনুসরণ প্রাবল্যে অচিরাৎ কালান্তক গোখুরা সর্পের হিস্ সুঘরাইএর জিহ্বায় ঘটিল, আর সে তখনই পরমাশ্চৰ্য্য ভালবাসাতে ঐ বিভীষিতকারী করাল হিস্ শব্দে তিতির পাখীটিকে, আতঙ্কগ্রস্ত করিতে বাহাদুর! মহা আহ্লাদ তাহাতে, সে আপন কৌশল দেখাইবার নিমিত্ত চারিদিকে দেখিল, পরক্ষণেই হিস্ শব্দ খেলিয়া উঠিল, ইহাতে সকালের হাওয়া বজ্রাহত, মানুষের রক্ত নিস্তেজ প্রাপ্ত হইল।

অদূরে খাবার ঘরে মনিব পত্নী ষ্টোভেতে খানিক বাসি মুরগীর-মাংসর তলা-পুড়াইয়া পাক করা সকাল-বেলাকার জলখাবারের জন্য প্রস্তুত তদারক করিতেছিলেন, এবং নিজে ময়দা মাখিতে ছিলেন। ঐ শব্দে তাঁহার কান খাড়া হইল; সেই মারাত্মক ধ্বনি স্টোভ অথবা জাতীয় অন্য কোন আওয়াজের সহিত মিশিয়া যাইবার না, উহাতে নিয়তির পায়ের খস খস ধ্বনি আছে! শ্মশানভূমি যেন ফুঁসিতেছে!

অন্য ঘরে যে শব্দে, মনিব মহাশয় রাত্র-আঙরাখা পরণে পাইপ মুখে কলের গানে কমলা ঝরিয়ার গান শুনিবার মধ্যে পরিষ্কার অভিধানে বুঝিয়া থাকেন; ফলে দুজনেই, মনিব পত্নী ময়দার তাল সমেত হাতে ত্রস্ত হওয়ত দরজার গোড়ায়, ও যে মনিব মহাশয় শঙ্কিত পদে বারান্দায় আসিলেন–এখন ইনি হিস শব্দের কারণ নির্ধারণে অতি স্বাভাবিকভাবে পাইপ-ধৃত দাঁতেই কোনমতে হেই দিয়া উঠিলেন।

যাহাতে মনিব পত্নী অধিক উম্মামতি হন, তাহারে সুঘরাইকে, সাতিশয় তাড়নাপূৰ্ব্বক এই কথা বলেন, বলি পোড়ার মুখো নচ্ছার শয়তান বলি হচ্ছেটা কি, আবার দাঁত বার করে হাঁসছিস, লাজলজ্জার বালাই নেই, এই সাতসকালে বেচারা পাখীটার ‘পোঁদে’ লাগা, কি কাণ্ড! আমি ত ভয়ে কাঁটা, আর কাজ পেলি না, ঐ এক রত্তি পাখী, ছেলেমানুষ অবলা জীব, তাকে ভয় দেখাতে তোঃ বাধল না, তোঃ মতন শয়তান ত কখন দেখিনি, সাপ হয়ে হিস্‌ হিস্‌ হচ্ছে ছ্যা ছ্যা…দেখবি’খনে আঃ-জন্মে সাপ হয়ে জম্‌মাতে হবে…তোঃ ভালবাসার মুখে ঝাড়ু, তোদেঃ ছোট জাতের কি মায়া মমতা বলতে কিছুঃটি নেই র‍্যা, সাত সকালে ইকি কাণ্ড! ও ঘরে না ঁমা রয়েছেন, বুঝলি অনেক পুণ্যে মানুষ জন্ম, অনেক পাপে ছোটজেতের ঘরে জন্ম হয়, ডোম চাঁড়াল হয়, ওঁর আদরেই তুই এত বাড় বেড়েছিস্‌!

এবং ইহার সহিত আপন স্বামীর উদ্দেশে কহিলেন, তুমি ওরে কিছুটি বলনা বলেই ত এত আস্‌পদ্দা, ইস ভাবলে গা হিম হয়, কতবড় পাজি, তুই শয়তান না মানুষ, নিশ্চয়ই ডাকাত হবে…আবার ওকে তুমি বন্দুক সাফ করতে দেবে বলেছিলে (!) তুমি কিছু বল না বলেই ত…কি নরক যন্ত্রণা!

মনিব মহাশয় গান শুনিতে থাকিয়া উত্তর করিলেন,বলিলাম ত, এই সব রুক্ষু ঝামেলায় আমাদের কোন প্রয়োজন নাই, আমরা বেড়াইতে আসিয়াছি, আমরা খামখা পাদরীগিরির জন্য বরাত লইয়া আসি নাই, অতশত হুজুতে কোন কাজ নাই, আজ হিস করিতেছে, সেদিন পাখীটিরে পদাঘাত করিল, উহাকে এই মুহূর্তে এক কাপড়ে পাখীশুদ্ধ বিদায় কর, পাপ! তাড়াইয়া দাও হারামজাদাকে।

স্নেহশীলা মনিব মহাশয়া ইহাতে বিব্রতচিত্ত মর্মাহত হইয়া কর্ণে অঙ্গুলি প্রদানে প্রায় উদ্যত হইতে চাহিলেন, একদা তাহার খাঁচার প্রতি নজর গেল, যাহা তিনি সাজাইতে সাহায্য করিয়াছেন, ইনি শিহরিত আছেন!

‘নারায়ণ নারায়ণ’ এবং ‘তারা ব্ৰহ্মময়ী মাগো’ বলিয়া ‘আনন্দময়ী মাগো’ বলিয়া, আনন্দময়ী ঁশ্রীশ্রীমায়ের চরণ স্মরণে স্বামীর জন্য ক্ষমা চাহিয়া অত্রাহি হইয়া কহিলেন,–ছি ছি তোমার কি জ্ঞানগম্য হবে না কোনদিন, মাঠাকরুন কি ভাববেন! বকতে বললুম বলে ঐ সব অলুখুনে কথা, তোমায় বলতে যাওয়াই আমারই ঝমারি হয়েছে…সাত সকাল। এতবড় কথাটা কি করে তুমি মুখে তুললে; ছোঁড়া নয় ভুলই করেছে…।

যে এবং ঠিক এমত সময়ে তাঁহার কথার মধ্যে তিতিরটি মনিব পত্নীর পায়ের নিকট আসিয়া নখে ঠোকা মারিল, ইনি যন্ত্রচালিতের ন্যায় হস্তধৃত ময়দাপিণ্ড হইতে, কিঞ্চিত মাখা ময়দা লইয়া তাহারে দিয়া সুঘরাই উদ্দেশে ইহা বলিয়াছিলেন,–আঃ মরণ দশা! তুই অমনতারা হাঁ করে মূর্তিমান পাপের মত দাঁইড়ে রইলি যে, নে নে ঝটপট ঝাঁট দিয়ে, এরে, পাখীরে খাবার দিগে, দ্যাকদিকি কি খিদেটাই পেয়েছে…।

এবং পাখীটিকে আপন শিশুর ন্যায় সম্বোধনে কহিলেন ‘আহা খিদে পেয়েছে তোমাল বেচারী!’–এই সোহাগ বাক্যে পাখীটি আশ্চর্য যে, অদ্ভুতভাবে যে, মুখোনি তুলিয়াছিল।

বটেই উহাতে, ঐ হিস্ ধ্বনিতে, ভক্তিমতী মমতাময়ী সেই রমণী যারপরনাই ভীতা হইয়া থাকেন; যে কিন্তু অন্যপক্ষে, সুঘরাই এই তীব্র বকুনিতে ভারী জবুস্থবু!

কিন্তু যে এ পর্যন্তও তাহার সুঘরাইএর মুখে নীচজাতিসুলভ বাঁদুরে হাসি বিদ্যমান রহে, তত্রাচ এক সুদারুণ আত্মশ্লাঘা তদীয় সুন্দর নিটোল ললাটে প্রতিভাত, যাহা যেমন যে, এই পক্ষী হয় আমার, উহার যে পালক সকল অদ্যাবধি হাওয়াতে উড়িয়া গিয়াছে তাহাও, তাহাও; উহার হাঁটা চলা ঠোকরান ডাক্, উহার দুর্গতি, উহার কম্পন, উহার চাঁদ সর্বৈব কিছুই আমার, উহাতে অভ্রান্তই মদীয় প্রভুতা থাকে!

ও তৎপ্রভাবিত সুঘরাই আপনার প্রাণ অপেক্ষা বুকের পাখীকে মহা আহ্লাদে হেদাইয়া তির্যকে লক্ষ্য করিল; করিতেই, তন্মুহুর্তেই ঐ ভ্রম অদৃশ্য হইল; তৎপরিবর্তে পৃথগ্নিধ এক গম্ভীর চমক তাহার যুগে বৰ্ত্তাইয়াছে, তাহাতে ক্ষণেকজন্যই সে কুহকাম্বিত হইলেক, ও ঝটিতি পুনরপি সর্প হিস দিতে সে অধীর হইয়া থাকে; এই কারণেই যে, তৎকৃত ভুজঙ্গশব্দের ফলে অদৃষ্টপূৰ্ব্ব এক দুর্ধর্ষ ঘটনা ঐ পক্ষীতে, নিরীহতা মধ্যে, উদঘাটিত তদ্বারা আবিষ্কৃত হইয়াছিল; আর যাহা সাক্ষাতেই তাহাতে ভাব লাগিয়াছিল, যে সে, সুঘরাই, অবিনাশী গোপনতা সেইক্ষণে নেহারিয়াছে, ইহাতে সে নির্ঘাত আর ডোমপুত্র নহে!

যে ঐ শব্দে যুগপৎ পাখীটিতে কীদৃশী মনোরমত্ব উজাগর! কি এত অব্যর্থ অভয়, কি গৌরব, কি এক পেশী, ঝামরাইয়া তখনই উঠিল, ইহা যাহা অপরিসীম দিব্য, ইহা যাহা খাসা, কি ঘটা! সেই মুহূর্তে ঐ কাল সদৃশ ঘোর হিস আওয়াজে তিতিরটি চমকে উৎকর্ণ সচকিত হইল, কি যেমন তাহাতে! মাল্য মৃত্তিকা কুসুমাদি পতঙ্গ জুড়িয়া এক তুমুল কিছু প্রকট হইল, করতাল ঝাঁজিয়া উঠিল; সুঘরাই যেমন বনমধ্যে। আঃ পক্ষীর গ্রীবা কৌস্তুভ মণিময়, অখণ্ড তেজে দীপ্তদৃপ্ত সটান!

অয়ি শীর্ষস্থতা!

এরূপ দেখা, এই দেখার জন্য আত্মপ্রত্যয়, সুঘরাইকে ঐ দিবস বহুক্ষণ যাবৎ শ্ৰীযুক্ত, প্রজ্জ্বলিত রাখিয়াছিল; অনেকবারই সে সগর্বে পাখীটিরে কিয়ৎদুর হইতে অবলোকন করিয়াছে আর তখনই সেই শীষটান, ঐ লতেব গ্রীবার,–কোন প্রহেলিকার কম্পনে, তির্যক গতি ঝটিতি নিরেট সোজা উহাতে– যাহা তাহাকে নির্ভীক করে, সেও অজ্ঞাতে উহা রপ্ত করিতে অধ্যবসায়ী হইল।

যে এবং এই প্রথম, ডোম জীবনে যে এতাবৎ ভীত, সে জিজ্ঞাসু হয়, তন্নিষ্ঠ যখন সে –কুঞ্চিত করে, তৎক্ষণেই যে সে এক অনৈসর্গিক বিকট, ইহা প্রেততাড়িত-র অধিক, ভয়ে সে চেতনা বিনা; ইহার মধ্যে কি যেন মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়াছিল; আবার গর্বে সে ডোম! অবশ্য সেই দিন পুনৰ্ব্বার ঐ কাণ্ডের জন্যই বড়ই অবায়ুখ তাহারে হইতে হইয়াছিল, যখন সে হিরণার টিলায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *