আজ লাইনের অনেক লোক রাত জাগবে। বয়স্ক মানুষ মারা গেলে লাইনের সর্দার বাগানের সাহেবদের খবর দিয়ে আসে। রাতে মরলে আধবেলা ছুটি মঞ্জুর হয়। দিনে মরলে ছুটি নিলে রোজ কাটা হয়। তাই কথাটা চালু আছে, মরতে হলে মাঝরাতের আগেই মরো! এতোয়ারি দেখল, ধনুবু়ড়োর মৃতদেহ একপাশে কাপড়ে ঢেকে হাঁড়িয়া খাওয়া শুরু হয়ে গেল শোক ভুলতে। সে হাঁটতে শুরু করল।
চা-বাগানের ভেতরে রাত ঘন হলে বিচিত্র শব্দের জন্ম হয়। প্রথমে খুব মৃদু; শব্দ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে যায়। তারপর হঠাৎ চারধার চমকে দিয়ে কোনও রাতপাখি চিৎকার করে গাছের ডাল ছেড়ে ঝাপসা হয়ে পড়ে থাকা চা-বাগানের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। সেই শব্দ মিলিয়ে যেতেই চরাচর অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ডুবে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে, চারদিক দেখেশুনে, সাহস করে পেঁচারা ডেকে এ ওর খবর নেয়। সেই ডাক কানে যেতে, চা-বাগানের ভেতরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে, আজ এতোয়ারির মনে হল, পাখিদেরও বন্ধু আছে, তারাও বন্ধুর সঙ্গ চায়, কিন্তু তার কোনও বন্ধু নেই।
ছোটবেলায় এতোয়ারির কোনও বন্ধু ছিল না। সাত বছর বয়সেই চারমাসের বাচ্চা ভাইকে কাপড়ে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। শীতকাল এলে, শরীর একটু লম্বা হলে পিঠে ভাইকে নিয়ে নদী পেরিয়ে চলে যেত বাবুদের কোয়ার্টার্সের সামনের মাঠের পাশে। সেখানে বিকেলের রোদ মরে যাওয়ার আগেই বাবুদের ছেলেরা জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে খেলত। এতোয়ারি ভাইকে পিঠে নিয়ে খেলা দেখতে দেখতে দুটো দলের একটাকে নিজের দল ভেবে নিত। যখন খেলা শেষ করে বাবুদের ছেলেরা যে যার ঘরে চলে যেত, তখন গরম হয়ে চেপটে যাওয়া জাম্বুরাটাকে ফেলে দিত। নির্জন সেই খেলার মাঠে পড়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত ফলটাকে তুলে নিতেই হাতে রস লেগে যেত। দ্রুত ভাইকে পিঠে নিয়ে নদীর গায়ে চলে আসত সে। একটু চাপ দিতেই জাম্বুরার একটা দিক ফেটে গলগলিয়ে রস বের হত। ঘুমন্ত ভাইকে ডাকত সে, “এই রস খাবি?”
দিদির পিঠে গাল চেপে ঘুমিয়ে থাকা ভাইয়ের সাড়া পাওয়া যেত না। তখন বাতাবিটা মুখের ওপর তুলে চাপ দিতেই গলগল করে রস বেরিয়ে আসত মুখে। বেশির ভাগ জাম্বুরার রস এত টক থাকত যে ফেলে দিতে হত। মাঝে মধ্যে কম টক আর একটু মিষ্টি মেশানো রস পাওয়া গেলে তৃপ্তি করে অনেকটা পান করে নিত এতোয়ারি।
ভাইয়ের ওজন বাড়ছিল। পিঠে বয়ে নিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টের হয়ে উঠছিল। তা ছাড়া ও তখন ভাল হাঁটতে পারে বলে সহজে পিঠে উঠতে চাইত না। তখন ওকে জাম্বুরার রসের লোভ দেখিয়ে পিঠে নিতে পারত এতোয়ারি। ওকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, নদীর জল মাঝে মাঝে ওর গলাসমান হয়ে বয়ে যেত। আর বাবা-মা ওর ওপর ভাইয়ের দায়িত্ব ছেড়ে কাজে যেত বলে, এতোয়ারি একা বল খেলা দেখতে যেতে পারত না। ভাইকে পিঠে ওঠাতে হত লোভ দেখিয়ে, কষ্ট হলেও।
সেই ভাইয়ের এক রাতে জ্বর এল। ভাইয়ের মাথা জলে ধুয়ে দিচ্ছে মা, এই দৃশ্য দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল এতোয়ারি। ঘুম ভাঙল মায়ের কান্নার শব্দে। বাবার কোলে ভাই, মা এবং লাইনের আরও কয়েকজন পেছনে। এতোয়ারি শুনতে পেল, ভাইয়ের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, তাই ওকে নিয়ে সবাই বাগানের হাসপাতালে যাচ্ছে। কেউ তাকে ডাকেনি, তবু দলটার পেছন পেছন এতোয়ারি হাঁটতে লাগল।
জীবনে প্রথমবার সে হাসপাতালে গিয়েছিল। তাকে এবং অন্যদের বাইরে রেখে মা আর বাবা ভাইকে ভেতরে নিয়ে গেল। বেলা বাড়লে বাবা-মা ভাইকে হাসপাতালে রেখে তাকে লাইনে ফেরত নিয়ে এসেছিল ওরা। দুপুরের খাবার ওদের কাছ থেকেই পেয়েছিল সে। লাইন থেকে বেরোনোর মুখে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ির ওপর সারা দুপুর বসে থাকল এতোয়ারি। বিকেলে ওরা এল। পাগলের মতো কাঁদছিল মা। বাবাও। বাবার কোলে ভাই। সাদা কাপড়ে ঢাকা শরীর। জীবনে প্রথমবার কাউকে মরে যেতে দেখেছিল এতোয়ারি।
তার শরীরের সঙ্গে ভাইয়ের শরীর প্রতিটি দিনের বেশ কয়েক ঘণ্টা মিশে থাকত। ভাইয়ের শরীরের গন্ধ নাকে আসত তখন। এসব তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। মায়ের কান্না ধীরে ধীরে কমে এল, বাবাকে বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এতোয়ারি ঘরের দাওয়ায় পাথরের মতো বসে থাকত। ভাই ছাড়া তার কোনও সঙ্গী ছিল না। সে মরে যাওয়ার পরে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ইচ্ছেই হয়নি। সে জানত তার কপালের ওপর আব থাকায় সে অন্যদের চেয়ে আলাদা। ওই আবের জন্য সমবয়সি মেয়েরা তাকে এড়িয়ে যায়। ছেলেরা দূরে দূরে থাকে। মাকে বলতে শুনেছে, “ছেলেটাকে কেড়ে নিলে তুমি? কী পাপ করেছি আমি?”
বাবা শুয়ে শুয়ে বলত, “ভগবান মেয়েটাকে নিতে পারত। ওই আবওয়ালি মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে? চিরকাল ঘাড়ে বসে খাবে।”
কথাগুলো কানে যেত। কিন্তু শুনতে শুনতে মন আর খারাপ হত না। অভ্যেস হয়ে গেলে ব্যথাকে ব্যথা বলে মনে হয় না। যে-লোকটা তাকে দু’চোখে দেখতে পারত না ভগবান তাকেই শাস্তি দিলেন, কিন্তু পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও বাবার মুখের তেজ এতদিন কমেনি। কিন্তু বউয়ের হাতে মার খাওয়ার পর থেকে একদম চুপ করে গিয়েছে মানুষটা।
ফিনফিনে অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছিল এতোয়ারি। একবার তার ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পাথরে ধাক্কা খাওয়ায় ব্যথা সামলে সে সজাগ হল। অন্যমনস্ক হয়ে সে হাসপাতালের দিকেই হেঁটে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন ইমার্জেন্সির পেশেন্ট ছাড়া কাউকে হাসপাতালে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তাকে দেখলে চৌকিদার নিশ্চয়ই চিনতে পারবে, ঢুকতেও হয়তো দেবে কিন্তু বড় নার্স তার কৈফিয়ত চাইবেন। এমন কী প্রয়োজন হল যে, অত রাতে সে মাকে দেখতে এসেছিল!
দ্বিধায় পড়ল এতোয়ারি আর তখনই তার কানে খিলখিল হাসির শব্দ বাজল। মহিলার গলায় খুশির হাসি, অবাক হয়ে বাঁ দিকে তাকাল এতোয়ারি। তারপরেই মহিলাকণ্ঠে কথা শুনল, “যদি মরে যাই।”
এবার একটি পুরুষ কণ্ঠ নিচু গলায় যা বলল তা বুঝতে পারল না এতোয়ারি। খুব অবাক হয়ে গেল সে। এই রাতের অন্ধকারে লোকালয়ের বাইরে, নদীর ধারে নারী ও পুরুষ এভাবে গল্প করতে আসবে ভাবা যায় না। মহিলা যে আনন্দে আছে তা ওর হাসি থেকে বোঝা যাচ্ছে। কৌতূহলী হল এতোয়ারি। নিঃশব্দে সে নদীর দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা বড় ঝোপের আড়ালে দাঁড়াল। অন্ধকারে নদীর জল ভাল করে বোঝা না-গেলেও সেটা যে দ্রুত বয়ে যাচ্ছে, তা আঁচ করা যাচ্ছে। মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই নদীর পাশে ঝোপের গায়ে দুটো শরীরকে অস্পষ্ট দেখতে পেল এতোয়ারি। দু’জনে ঘনিষ্ঠ হয়ে শুয়ে আছে ঘাসের ওপর। ওরা কারা তা বুঝতে পারছিল না সে। নারীকণ্ঠ বলল, “আজ ওটা না। যদি লেগে যায় তা হলে পেটে যেটা আছে তার ক্ষতি হবে।”
“আহা,” পুরুষ বলল, “পেটে যে আছে তার বাবা কে?”
নারী হাসল, “তুমি, তুমি, তুমি।”
“বাবা হয়ে আমি ওর ক্ষতি চাইতে পারি?”
“জানি। শোনো, তোমার বন্ধুও বাচ্চার জন্যে খুব ভাবছে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ, আজ ওকে লুকিয়ে এখানে এসেছি। অবশ্য আমি যা বোঝাব তাই ও মেনে নেয়। নিজের যে ক্ষমতা নেই তা বুঝতেই চায় না।”
“ভাগ্যিস তোমার স্বামীর ক্ষমতা নেই, তাই আমি তোমাকে পেলাম,” পুরুষ এবার নারীর ঘনিষ্ঠ হল। নারী আনন্দিত এবং সতর্ক স্বরে বলল, “সাবধান, যেন বেশি চাপ দিয়ো না। দুষ্টু!”
সরে এল এতোয়ারি। সে বুঝতে পারছিল না তার কী করা উচিত। শেষপর্যন্ত মনে হল ঘরে ফিরে যাওয়াই ভাল। সে ঘরের পথ ধরল।
তখন কুলিলাইনে রাত ঘন হয়েছে। ধনুবুড়োকে কবর দিতে অনেকেই চলে গেছে কবরখানায়। এতোয়ারি দেখল ধনুবুড়োর নাতবউ আর একজন প্রৌঢ়া গাছতলায় বসে আছে, যেখানে ধনুবুড়োকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বসিয়ে রাখা হত। সম্ভবত কবরখানা থেকে লোকজন ফিরে না-আসা পর্যন্ত ওরা গম্ভীর মুখে ওখানে বসে থাকবে।
এতোয়ারিকে দেখে ধনুবুড়োর নাতবউ হাত নেড়ে কাছে ডাকল।
এতোয়ারি কাছে এলে প্রৌঢ়া ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, “তোর মা কেমন আছে?”
“ভাল।”
“সব কী যে হয়ে যাচ্ছে!” ধনুবুড়োর নাতবউ শ্বাস ফেলল। তারপর যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, “তোর সঙ্গে ধনুবুড়োর কোনও কথা হয়েছিল?”
“কোন কথার কথা বলছ?” এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল।
“মারা যাওয়ার একটু আগে ধনুবুড়ো নাকি দুটো কথা বেশ কয়েকবার বলেছিল! আমার ছেলের বউ খাবার দিতে গিয়ে শুনেছিল।”
“কী কথা?”
“তোর নাম বলছিল আর বলছিল মহুয়ামিলন,” বেশ ভেবে ভেবে বলল প্রৌঢ়া, “মহুয়ামিলন মানে কী তুই জানিস?”
মাথা নাড়ল এতোয়ারি, “না।”
অন্য মহিলা জিজ্ঞাসা করল, “তোমার ছেলের বউ ঠিক শুনেছিল?”
“হ্যাঁ। ঘরে ফিরে তখনই আমাকে বলেছিল। আমিও কথাটার মানে বুঝতে পারিনি। তুই কথাটা কখনও শুনিসনি?”
“না,” মাথা নাড়ল এতোয়ারি।
সঙ্গের মহিলা বলল, “কী বলতে কী বলেছে, মাথার কি ঠিক ছিল!”
ঘরে ফিরে এল এতোয়ারি। যেভাবে বাবাকে সে দেখে গিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই পড়ে আছে বাবা। এই কুলিলাইনে যে একটা ঘটনা ঘটে গেল, তার খবর বাবার কাছে এখনও পৌঁছয়নি। ঘরের বিপরীত দেওয়ালে বিছানা করে শুয়ে পড়ল এতোয়ারি। চোখ বন্ধ করতেই আচমকা নদীর গা ঘেঁষে শুয়ে থাকা দুই নারী-পুরুষের শরীর সামনে চলে এল। আসন্ন সন্তানসম্ভবা ওই নারীটি কে, সে গলা শুনে বুঝতে পারেনি। নিশ্চয়ই এই লাইনে থাকে না। পুরুষটিকেও সে চেনে না। কিন্তু সন্তানের পৃথিবীতে আসার দিন যখন বেশি দেরিতে নেই, তখনও ওরা শরীরের আনন্দ পেতে রাতের অন্ধকারে নদীর ধারে মিলিত হয়েছে। ওরা স্বামী-স্ত্রী নয়, ওদের সন্তান কখনওই বাবার নাম জানতে পারবে না। কিন্তু এতোয়ারির মনে আজ অন্য রকমের অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ছিল। তার স্বামী মুখে কাপড় চাপা দিয়ে শরীর ভোগ করত। সে-সময় ভয়ংকর যন্ত্রণা পেত সে। আজ ওই নারীর মুখ থেকে যেসব শব্দ বের হচ্ছিল, তাতে বিন্দুমাত্র যন্ত্রণা ছিল না। উলটে উপভোগের সুখ ঝরে পড়ছিল।
ঘুম ভেঙে গেল এতোয়ারির। শ্বাস ভারী হল। আর ঘুম আসছিল না।
একদম যন্ত্রের মতো অন্ধকার থাকতেই ঘুম থেকে উঠে নদীতে যাওয়া, ঝটপট সেদ্ধ ভাত আর ডাল রেঁধে তৈরি হয়ে বাবার সামনে খাবার রেখে দিয়ে এতোয়ারি শাড়ি বদলে যখন বাইরে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে, তখন সূর্য উঠে গেছে। উঠে বসে বাবা তার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছে, দেখেও দেখে না এতোয়ারি। হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায়।
মায়ের শরীর এখন স্বাভাবিক। সকালেই বড় নার্স ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এতোয়ারির অনুরোধে মাকে সন্ধে পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে দিলেন তিনি। এতোয়ারি ছুটির পরে মাকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে।
কাজ একটু হালকা হলে এতোয়ারি ছোট নার্সকে জিজ্ঞাসা করল, “দিদি, আপনি কি জানেন মহুয়ামিলন বলে যে-জায়গা আছে, সেটা কোথায়?”
ছোট নার্স অবাক হয়ে তাকাল, “মহুয়ামিলন?”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল এতোয়ারি।
“জায়গার নাম না ফুলের নাম?” ছোট নার্স জিজ্ঞাসা করল।
“জায়গার নাম,” এতোয়ারি জবাব দিল।
ঠোঁট ওলটাল ছোট নার্স, “বড়দিকে জিজ্ঞাসা করো, উনি হয়তো জানেন।”
বড় নার্সকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস হচ্ছিল না। ঘণ্টাখানেক পরে দুই দিদি যখন একসঙ্গে পেশেন্টদের দেখতে এলেন, তখন ছোট নার্স বলল, “এই কী নাম বলছিলি?”
বড় নার্স জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার?”
“ও একটা জায়গার নাম জিজ্ঞাসা করেছিল, নামটা আমার অচেনা,” ছোট নার্স হেসে কথাগুলো বলে সামনের রোগীর দিকে এগিয়ে গেল।
বড় নার্স তাকালেন, চোখে জিজ্ঞাসা।
এতোয়ারি নামটা বলল। বড় নার্স চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে মাথা নাড়লেন, “এরকম নামের কথা আমি শুনিনি। বোধহয় কোনও ছোট জায়গা বা গ্রামের নাম। কিন্তু তুমি জানতে চাইছ কেন? কোনও দরকার আছে?”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল এতোয়ারি, কোনও কথা বলল না।
“তুমি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করতে পারো,” বড় নার্স চলে গেলেন।
বিকেলে ডাক্তারবাবু যখন ওয়ার্ডে এলেন, তখন এতোয়ারি একজন জ্বরাক্রান্ত রোগীর কপালে জলপট্টি লাগিয়ে দিচ্ছিল। দেখতে পেয়ে ডাক্তারবাবু কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “জ্বর এখন কত?”
তাঁর পেছনে ছিল ছোট নার্স। বলল, “একশো এক।”
“তা হলে কিছুটা কমেছে। থাক, আর জলপট্টি দিতে হবে না। ওকে একবার ভেজা গামছা দিয়ে শরীর মুছিয়ে দাও,” বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক পা হেঁটেই ফিরে তাকালেন ডাক্তার, “বড়দিদি বলছিল তুমি মহুয়ামিলনের কথা জিজ্ঞাসা করেছ।”
নীরবে মাথা নাড়ল এতোয়ারি।
“এই নামটার কথা তুমি জানলে কী করে?”
“শুনেছি,” নিচু গলায় বলল এতোয়ারি।
“ও। মহুয়ামিলন নামে বোধহয় একটা জায়গাই আছে। সেটা এখান থেকে প্রায় আট-ন’শো মাইল দূরে বিহার প্রদেশে। আমার খুব অবাক লাগছে শুনে, তুমি কার কাছে জায়গাটার নাম শুনলে?” ডাক্তারবাবুর কথা শেষ হতে না-হতেই বড় নার্স দ্রুত ঘরে এসে বললেন, “ডক্টর, ম্যানেজার সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”
ডাক্তারবাবু চলে গেলেন কিন্তু আধ ঘণ্টা পরে এতোয়ারির ডাক পড়ল তাঁর ঘরে। সংকোচের সঙ্গে ঘরে ঢুকে দাঁড়াতেই ডাক্তারবাবু মুখ তুললেন। তাঁর সামনের টেবিলে একটা বই খোলা। বললেন, “হ্যাঁ, তুমি মহুয়ামিলন নামের জায়গাটার কথা জিজ্ঞাসা করছিলে তো?”
কথা না-বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল এতোয়ারি।
“বলছি। কিন্তু তার আগে বলো এই নাম তুমি শুনলে কার কাছ থেকে?”
একটু ইতস্তত করে এতোয়ারি বলল, “ধনুবুড়ো বলেছিল।”
“ধনুবুড়ো?” কপালে ভাঁজ পড়ল ডাক্তারবাবুর। তারপর অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “কাল যে-বৃদ্ধ মানুষটি মারা গিয়েছে তার নাম ধনুবুড়ো না?”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল এতোয়ারি।
“আচ্ছা!” ডাক্তারবাবু বললেন, “মহুয়ামিলন বিহারের রাঁচির কাছে একটা জায়গা। ওই নামে একটা স্টেশনও আছে। ধনুবুড়ো আর কী বলেছিল তোমাকে।”
“আমাকে বলেননি উনি। কিন্তু ওই জায়গায় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন।”
“কেন?”
“বোধহয় ওখানে ওঁর দেশ ছিল, সেই দেশ থেকে উনি এখানে এসেছিলেন।”
“হ্যাঁ। চা-বাগানের প্রয়োজনে শ্রমিকদের আনা হয়েছিল বিহারের ওইসব জায়গা থেকে। তোমার সঙ্গে ঠিক কী কথা হয়েছিল ধনুবুড়োর?” ডাক্তারবাবু কৌতূহলী হলেন।
মাথা নিচু করল এতোয়ারি। সে যেটুকু জানে, তা বলা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছিল না। কিন্তু ডাক্তারবাবু তার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে সে বলল, “উনি তো হাঁটাচলা করতে পারতেন না, এক জায়গায় সারা দিন বসিয়ে রাখা হত ওঁকে। কিন্তু ওঁর মন সবসময় চলে যেত ছেলেবেলায় যে-দেশ ছেড়ে এসেছেন, সেই দেশে। বয়সের জন্যে ভাল করে কথা বলতে পারতেন না। অনেক কথা ওঁর মন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। এমনকী, যে-দেশ থেকে উনি ছেলেবেলায় এসেছিলেন, সেই দেশের নামটাও মনে করতে পারতেন না। কাল যখন আমি বললাম, ওঁকে দেশে নিয়ে যেতে পারি, তখন খুব খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু যে-জায়গায় ফিরে যাবেন, তার কথা কিছুতেই মনে করতে পারেননি। পরে তাঁর হঠাৎ নাম মনে পড়েছিল। বাড়ির বউদের সেই নাম বলেওছিলেন। আমি তাঁর এক নাতবউয়ের মুখে নামটা শুনেছি।”
চুপচাপ শুনলেন ডাক্তারবাবু। তারপর শ্বাস ফেলে বললেন, “মহুয়ামিলন নামটা যদি কিছুদিন আগেও ওঁর মনে পড়ত, তা হলেও ওই শরীরে ট্রেনে চেপে যাওয়া সম্ভব হত না। ভেরি স্যাড। কিন্তু উনি তোমাকে বলেছিলেন যে ফিরে যেতে চান?”
“হ্যাঁ।”
“তা তো হল, কিন্তু তুমি জায়গাটা কোথায় তা জানতে চাইছ কেন?”
“উনি কতদূর থেকে এদেশে এসেছিলেন তা জানতে চাইছিলাম।”
“দ্যাখো, যখন চা-গাছের চাষ এদেশে চালু হল, তখন তা করার জন্যে শ্রমিক পাওয়া যায়নি। শ্রমিক আনা হয়েছিল বিহারের সেইসব অঞ্চল থেকে, যেখানে বছরের বেশির ভাগ সময় ফসল জন্মায় না। সেখানকার মানুষ জল আর খাবারের লোভে এদেশে চলে এসেছিল দালালদের সঙ্গে। যারা এসেছিল তারা ফিরে যাওয়ার কথা ভাবত না। চা-বাগানে কাজ করে দু’বেলা পেট ভরে খাবার খাওয়াটা তাদের কাছে এত মূল্যবান ছিল যে, তারা আর ছেড়ে আসা দেশের ভয়ংকর কষ্ট ভোগ করতে চাইত না। সেই সময় যারা এসেছিল, শুধু তারা কেন, তার পরের মানুষগুলোও এখানেই মরে গিয়েছে। হয়তো ধনুবুড়োর মতো অতিবয়স্ক কিছু মানুষ ডুয়ার্স কিংবা আমাদের চা-বাগানে এখনও অথর্ব হয়ে বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে,” কথা শেষ করে ডাক্তারবাবু তাকালেন এতোয়ারির দিকে।
মন দিয়ে শুনছিল এতোয়ারি। এই দেশ তার নয়, একথা সে-ও জানে। কিন্তু কীভাবে তাদের পূর্বপুরুষরা এদেশে এসেছিল, সেই কাহিনি সে কারও কাছে শুনতে পায়নি।
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “এসব কথা তুমি লাইনের বয়স্ক মানুষদের মুখে শোনোনি?”
মাথা নেড়ে নিঃশব্দে না বলল এতোয়ারি। তারপর ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, ওই মহুয়ামিলন নামের জায়গাটা কি এখনও আছে?”
“না থাকার তো কোনও কারণ নেই। যাদের প্রাণ আছে তাদের একসময় মৃত্যু হয়, এমনকী নদীর বুকে জলের যে-ধারা, তার প্রাণ না-থাকলেও শুকিয়ে গেলে গতি হারায়। পাহাড়ও ধ্বংস হয়। আর মাটির চেহারা পালটাতে পারে কিন্তু কখনওই ধ্বংস হয় না। তাই নাম বদলে গেলেও, মহুয়ামিলন নামের জায়গাটা নিশ্চয়ই আছে,” ডাক্তারবাবু কথা শেষ করে নিজের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
চুপচাপ সরে এল এতোয়ারি।
সন্ধের মুখে মাকে নিয়ে ফিরে এল এতোয়ারি। এখন মাকে অনেক ভাল দেখাচ্ছে। আসার পথে ধনুবুড়োর মৃত্যুর খবরটা সে মাকে দিয়েছিল। শুনে মা বলেছিল, “যাক, মানুষটা বেঁচে গেল এতদিনে।”
অবাক হয়েছিল এতোয়ারি, “এ কথা বলছ কেন?”
“বা রে! ওরকম পুতুলের মতো বেঁচে থেকে কী লাভ হত বুড়োর! কিছু ভাবতেও তো পারত না, কাজ করা দূরের কথা,” মা বলেছিল।
“ভাবতে পারত। নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবত।”
“নিজের দেশ আবার কী! যতসব ফালতু কথা,” মা হেসেছিল।
ঘরে ফিরে দেখল ভেজানো দরজার ওপারটায় অন্ধকার। এতোয়ারি হারিকেন জ্বালাতে গিয়ে বুঝল তাতে তেল নেই। হাতড়ে হাতড়ে ঢিবরি বের করে তার সলতেতে আগুন দিতে ঘরের অনেকটা দেখা গেল। বাবা শুয়ে আছে পাশ ফিরে। সকালে রেখে যাওয়া খাবার খেয়ে নিয়েছে।
মা বলল, “কুয়ো থেকে এক বালতি জল এনে দে।”
“নদীতে যাবে না?”
“না।”
“রাতে খাবে তো? আমি তিনটে ডিম হাসপাতাল থেকে ধার করে এনেছি।”
ডিমের কথা কানে যেতেই বাবাকে উঠে বসতে দেখল এতোয়ারি। মা বসে পড়লে সে বালতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
একটা মানুষ বছরের পর বছর চুপচাপ তিনমাথা এক করে বসে থাকত। গাছ, ঢিপি অথবা পাথরের মতো পড়ে থাকত সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। শুধু বৃষ্টি হলে মানুষটাকে দয়া করে বাইরে খোলা আকাশের নীচে আনা হত না। সেই মানুষটা আর নেই। এতোয়ারির মনে হচ্ছিল এই না-থাকায় কারও কিছু এসে যাচ্ছে না। এই ডুয়ার্সের চা-বাগানের শ্রমিকদের লাইনে বসে, মনে মনে ধনুবুড়ো চলে যেত তার বাল্যকালের মহুয়ামিলনে। এখন মহুয়ামিলনে কি পৌঁছে গিয়েছে ধনুবুড়োর আত্মা?
বালতিভরা জল মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে ঘরে পরার কাপড় এবং গামছা নিয়ে আধা অন্ধকারে এতোয়ারি নদীর ধারে চলে এল। কুলকুল আওয়াজ তুলে ছোট ছোট ঢেউ ধীর গতিতে চলে যাচ্ছে ডুডুয়া নদীর দিকে। সেই জলের পাশে বড় পাথরের ওপর বসে এতোয়ারির কেবলই ধনুবুড়োর কথা মনে পড়ছিল। দিনের পর দিন মানুষটা ভেবে গিয়েছিল যে, সে একদিন মহুয়ামিলনে যেতে পারবে। তার সেই ইচ্ছে পূর্ণ হল না।
জলে শব্দ হতে চমকে তাকাল এতোয়ারি। জলের ওপর অন্ধকার কি একটু পাতলা হয়ে যায়? এতোয়ারি সোজা হয়ে বসে দেখল তরতর করে লম্বা কিছু নদীর জলে সাঁতার কেটে ওপারে চলে গেল। ওটা যে একটা সাপ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দিনের বেলায় সে কোনওদিন এই নদীতে সাপ দেখেনি।
ঘরে ফিরে সে দেখল বাবা একদিকে আর মা অন্যদিকে শুয়ে আছে। টেবরিটার আলো কমে এসেছে। কাঠের আগুন জ্বেলে ভাত রাঁধতে বসল এতোয়ারি। আগুনটার দিকে তাকিয়েই মনে হল ধনুবুড়োর কথা। মরে গেলে হিন্দুদের দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়, খ্রিস্টানদের কবর। সেই কবে থেকে নাকি চা-বাগানের শ্রমিকদের বেশির ভাগই খ্রিস্টান। অনেকেই রবিবারে গির্জায় যায়। যত দিন যাচ্ছে, তত গির্জায় যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সে ছেলেবেলায় প্রতি রবিবারে গির্জায় যেত। আজকাল শুধু বড়দিনের সময় যায়। আর মরে গেলে খ্রিস্টান বলে কবর দেওয়া হয়। কিন্তু এতোয়ারি শুনেছে তাদের পূর্বপুরুষরা খ্রিস্টান ছিল না।
হাসপাতালে কাজের চাপ ছিল না। ছোট নার্স হাসতে হাসতে বলল, “মানুষের যত শরীর কম খারাপ হয়, তত হাসপাতালের ওপর চাপ কমে যায়। যদি কোনওদিন এই হাসপাতালে একটাও পেশেন্ট না-থাকে, তা হলে কোম্পানি গর্বের সঙ্গে বলবে, এই বাগানের মানুষের অসুখ হয় না,” বলে হাসল ছোট নার্স।
বড় নার্স ওপাশ দিয়ে যেতে যেতে কথাগুলো শুনতে পেয়ে বললেন, “এখন হাসছ, তখন কী করবে?”
“মানে?” ছোট নার্স হকচকিয়ে গেল।
“এই বাগানের কোনও কর্মচারীর যদি অসুখবিসুখ না-হয়, তা হলে আমাদের চাকরি থাকবে কি না ভেবে দেখেছ?” বলে গেলেন বড় নার্স।
শোনামাত্র জিভ কেটে সরে গেল ছোট নার্স।
প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেয়ে, এতোয়ারি জানে না কেন, চোখ উপচে জল বেরিয়ে এল। সেটা মুছে ঘরে ফিরে মায়ের হাতে টাকাটা তুলে দিলে মা বলল, “না, সবটা দিবি না। নিজের জন্যে রাখ। কালই ছুটি নিয়ে পোস্ট অফিসে গিয়ে নিজের নামে খাতা খুলবি। আমি তোর সঙ্গে যাব।”
বাবা তাকিয়ে দেখল। কিছু বলল না।
সেই রাতে চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল মা-মেয়ের। ধড়মড়িয়ে উঠে দেখল, বাবা নেই। চেঁচামেচি চিৎকারটা খানিকটা দূরে হচ্ছে। ওরা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। যে-মানুষটা একটা লাঠি নিয়ে কোনওমতে লেংচে লেংচে চলে, এত রাতে সে কোথায় গেল?
যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছিল সেদিকে বেশ অন্ধকার। তবু মা-মেয়ে সেদিকে যেতেই ছোট্ট ভিড়টাকে দেখতে পেল। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল লোকগুলো মাতাল। ওরা এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। আরও একটু এগোতেই বুঝতে পারল ওই লোকগুলোর মাঝখানে মাটিতে শুয়ে আছে একজন। লোকটা যে তার বাবা, বুঝতে পেরে মায়ের দিকে তাকাল সে। মা শক্ত মুখে তাকিয়ে দেখছে।
এতোয়ারি নিচু গলায় বলল, “আমি গিয়ে দেখছি।”
সে পা বাড়াতেই মা খপ করে তার হাত ধরল, “না, যাবি না।”
অবাক হল এতোয়ারি, “ওখানে বাবা পড়ে আছে।”
“থাক। আমাদের না-জানিয়ে নিজের ইচ্ছেয় ও ওখানে গিয়েছে। নিশ্চয়ই খুব হাঁড়িয়া গিলেছে। নিজেই তো গিয়েছে, ও নিজেই ফিরে আসবে। ঘরে চল,” মা তার হাত ধরে টানল।
অবাক হয়ে তাকাল এতোয়ারি। মাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হল সে। ঘরে ফিরে আবার শুয়ে পড়তে গিয়েও উঠে বসল মা। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “এই, তুই তোর মাইনের টাকা কোথায় রেখেছিস?”
“বালিশের নীচে,” এতোয়ারি বলল।
“ওগুলো আঁচলে বেঁধে রাখ শক্ত করে।”
হেসে ফেলল এতোয়ারি, “তোমার কী হল?”
“কী হল মানে?” মা বিরক্ত।
“এই ঘর থেকে চুরি করবে?” বলে বালিশের তলায় হাত ঢোকাল সে। কিন্তু হাতে কিছু ঠেকল না। চটপট বালিশ তুলে নিতে দেখতে পেল সেখানে কিছুই নেই। টাকাগুলো ভাঁজ করে রেখেছিল সে। উত্তেজিত হয়ে আশপাশে তন্নতন্ন করে খুঁজেও নোটগুলো চোখে পড়ল না।
মা জিজ্ঞাসা করল, “কী হল?”
“বালিশের নীচে টাকা রেখেছিলাম, এখন দেখছি নেই,” বেশ উত্তেজিত গলায় বলল এতোয়ারি।
“সর্বনাশ। এটাও দেখতে হল,” মা কপাল চাপড়াতে লাগল।
“তার মানে?”
“বুঝতে পারছিস না হতভাগী। তোর টাকায় দলবল জুটিয়ে লোকটা লেংচে লেংচে ভাটিখানায় গিয়ে মচ্ছব করেছে। এখন একগলা গিলে মাটিতে পড়ে আছে। ছি ছি ছি! লোকটা মরে না কেন? মেয়ের রোজগারের টাকা চুরি করে হাঁড়িয়া খাচ্ছে দলবল জুটিয়ে!” চিৎকার করে কথাগুলো বলল এতোয়ারির মা। ঠিক তখন বাইরে মাতালদের গলা শোনা গেল। এতোয়ারি দরজায় গিয়ে দেখল, চারটে লোক বাবার দেহটাকে টেনে এনে কোনওমতে ঘরের সামনে রেখে দিয়ে টলতে টলতে চলে গেল।
ঘরের দরজা বন্ধ করে মা বলল, “শুয়ে পড়, পড়ে থাক ওখানে।”
গরমকালে লাইনের অনেক পুরুষ খোলা আকাশের নীচে ঘুমিয়ে থাকে। যদি লাইনের কুকুরগুলো ঘুম ভাঙানো চিৎকার করে, তা হলে উঠে বসে সতর্ক হয়। মাঝে-মাঝেই চিতাবাঘ চলে আসে জঙ্গল থেকে, বাইসন তো আছেই। কুকুরগুলোর চিৎকার শুনে বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে চলে যায়। অতএব ঘরের বাইরে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকলেও বিপদের সম্ভাবনা খুব আছে তা বলা যায় না। এসব জানা সত্ত্বেও মনের মধ্যে কাঁটা ফুটছিল এতোয়ারির। নেশা যখন মানুষের সমস্ত বোধ কেড়ে নেয়, তখন তার মুখ খুব অসহায় দেখায়। বাবার মুখ সেরকম মনে হয়েছিল। ওর ইচ্ছে করছিল বাবার বেহুঁশ শরীরটাকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসতে।
“এক পয়সা রোজগার করার মুরোদ নেই অথচ মেয়ের গোটা মাসের মাইনের টাকায় লোক জুটিয়ে হাঁড়িয়া খেল। এই লোক মরে গেলে আমরা বেঁচে যেতাম,” তারপর খেয়াল হতে পাশ ফিরে মা বলল, “কী রে! চুপ করে আছিস যে! অতগুলো টাকা ও উড়িয়ে দিল, তোর রাগ দুঃখ কিছুই হচ্ছে না?”
শোনামাত্র টাকাগুলো যেন চোখের সামনে দেখতে পেল এতোয়ারি। চা-বাগানের কেরানিবাবু, যিনি বাক্সে টাকা ভরে নিয়ে আসেন হাসপাতালে, নাম ডেকে ডেকে সবাইকে মাইনে দেন, বলেছিলেন, “প্রথম মাসের মাইনে, সাবধানে রেখো। নইলে ফুড়ুৎ হয়ে যাবে।”
কেরানিবাবুর কথা সত্যি হয়ে গেল! হঠাৎ এতোয়ারির মনে হল, হাঁড়িয়ার দাম তো বেশি নয়, যে-ক’জন লোককে সে বাবার সঙ্গে দেখেছে, তাদের সবাই মিলে যদি খায়, তা হলেও কি অতগুলো টাকা শেষ হয়ে যাবে! ধন্দে পড়ল এতোয়ারি।
“কী হল? কী ভাবছিস? তুই যদি দয়া দেখাতে চাস…”
“না মা, আমি ভাবছি, অতগুলো টাকার হাঁড়িয়া নিশ্চয়ই ওরা খেতে পারেনি, তা হলে বাকি টাকা গেল কোথায়?” এতোয়ারির গলায় প্রশ্ন।
“ঠিক কথা!” মা উঠে বসল, “নিশ্চয়ই টাকাটা ওর কোমরে আছে। চল, দেখি।”
মায়ের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল এতোয়ারি। চিত হয়ে শুয়ে আছে বাবা। দুটো হাত দু’দিকে ছড়ানো, মুখ হাঁ করা। চোখ বন্ধ, কোনও হুঁশ নেই। উবু হয়ে পাশে বসে পড়ল মা। তারপর কোমরের কাপড় খুলে তল্লাশি করতে লাগল। শেষপর্যন্ত মাথা নেড়ে হতাশ গলায় বলল, “নাঃ, নেই। সব উড়িয়ে দিয়েছে রে!”
“কী করে সব উড়ল?” সন্দেহ যাচ্ছিল না এতোয়ারির।
মা একটু ভাবল। তারপর বলল, “চল তো!”
“কোথায় যাবে?” অবাক হল এতোয়ারি।
উত্তর না-দিয়ে মা হানহনিয়ে হাঁটা শুরু করলে, দ্রুত তাকে অনুসরণ করল সে। কুলিলাইনের শেষপ্রান্তে, নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে একটা ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সোমরা আর তার ছেলে এঁটো গ্লাস, প্লেট গুছিয়ে তুলছিল। মা এবং মেয়েকে ওইভাবে আসতে দেখে অবাক হয়ে সোমরা বলল, “আমাকে দোষ দিয়ো না। আমি তোমার মেয়ের বাবাকে অনেক নিষেধ করেছিলাম, সে কোনও কথা শুনতেই চায়নি, উলটে গালি দিয়েছিল। বলল, সবাইকে হাঁড়িয়া খাইয়ে জন্মের ঋণ শোধ করতে চায়। আমি কী করব বলো!”
“সে কোথায় টাকা পেল জিজ্ঞাসা করোনি কেন?” মা চেঁচিয়ে বলল।
“করেছিলাম,” সোমরা মাথা নাড়ল, “বলল, তুমি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছ বলে মেয়ে টাকা দিয়ে বলেছে, সবাই মিলে আনন্দ করতে। কিন্তু একটু খেয়ে সে সহ্য করতে পারল না।”
মা মেয়ের দিকে তাকাল। এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “বাবা যা টাকা এনেছিল তার সবটাই কি হাঁড়িয়া খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছে?”
সোমরা কিছু বলার আগে তার বালক ছেলে হাত নাড়ল, “না, না। অনেক টাকা বুধুয়াচাচার কাছে রাখতে দিয়েছিল। সব টাকা খরচ হয়নি।”
সঙ্গে সঙ্গে সোমরা ছেলেকে ধমক দিল, “অ্যাই চোপ! তোকে কে কথা বলতে বলেছে,” তারপর এতোয়ারির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাবা তো বুধুয়ার বন্ধু। তাই বোধহয় রাখতে দিয়েছিল। ভাগ্যিস বুধুয়া দাম দিয়ে আগেই চলে গিয়েছিল, না-হলে ওরা এত খেত যে, কেউ হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারত না।”
মা আর দাঁড়াল না। বলল, “তাড়াতাড়ি চল।”
কিছুটা যেতেই ওরা বুধুয়ার বউকে দেখতে পেল। দ্রুত হেঁটে আসছে। এতোয়ারির মা জিজ্ঞাসা করল, “এ কী, এত রাতে কোথায় যাচ্ছ?”
সে বলল, “আর কোথায়! আমি গলায় দড়ি দেব তবে তার আগে লোকটাকে নিজের হাতে মেরে তবে মরব। ভাটিখানার পাশ দিয়ে এলে তোমরা?”
“হ্যাঁ। ভাটিখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ওখানে কেউ নেই,” মা বলল।
কপালে বাঁ হাতের চড় মারল প্রৌঢ়া, “ওঃ, কী করি। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। নাতি-নাতনি হয়েছে তবু লোকটা বদলাল না। নিশ্চয়ই পুষির ঘরে গিয়ে ফুর্তি করছে। আজ ওকে শেষ করবই।”
মা মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। পুষিকে এই তল্লাটে সবাই চেনে। আগে ওরা লাইনেই থাকত। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পরে পুষির স্বভাবচরিত্র বদলে যায়। প্রায়ই এই বাগান সেই বাগানে চলে যায়। ফিরে আসে অনেক উপহার নিয়ে। স্বামী মারা যাওয়ার পরে কিছুদিন পাতি তোলার কাজ করে ছেড়ে দেয় পুষি। এখন সে চা-বাগানের লাগোয়া ফরেস্টের বস্তিতে ঘর ভাড়া করে একাই থাকে। পছন্দমতো লোককে সে তার ঘরে ঢুকতে দেয়। সেখানে নেশা করে। যেহেতু ওই বস্তি চা-বাগানের লাগোয়া হলেও, কুলিলাইন থেকে বেশ খানিকটা দূরে, তাই পুষিকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
মা বলল, “মাথা ঠান্ডা রাখো। আমি তোমার স্বামীকে খুঁজছি। সে আমার মেয়ের রোজগারের টাকা নিয়ে বোধহয় ফুর্তি করতে গিয়েছে। চলো,” মা হাঁটতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। দুটো হাত দু’দিকে বাড়িয়ে কিছু ধরতে চাইল। পাতলা অন্ধকারে প্রথমে ঠাওর করতে পারেনি এতোয়ারি। যখন পারল, তখন মায়ের শরীর কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, ছুটে এসে মাকে জাপটে ধরল সে। চিৎকার করে ডাকল, “মা!”
চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড থাকার পর মা চোখ খুলল, “ঠিক আছে।”
“কী হয়েছে তোমার?” জিজ্ঞাসা করল এতোয়ারি।
“মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। এখন ঠিক আছে,” মা জোরে শ্বাস ফেলল।
“চলো, ঘরে চলো। তোমাকে কোথাও যেতে হবে না,” মাকে জড়িয়ে পা ফেলল এতোয়ারি। এতক্ষণ বড়বড় চোখে দেখছিল বুধুয়ার বউ। এতোয়ারিদের ঘরের দিকে পা বাড়াতে দেখে, সে হনহন করে হাঁটতে লাগল ফরেস্টের দিকে। মাকে কোনওরকমে ঘরে নিয়ে এল এতোয়ারি। বাবা তখনও শুয়ে আছে, যেভাবে একটু আগে দেখে গেছে। শুধু পাড়ার দুটো কুকুর এসে বসে আছে বাবার মাথার পাশে। ঘরে ঢুকে মাকে শুইয়ে দিল এতোয়ারি।
টাকাগুলো হাতে আসতে না-আসতেই হাতছাড়া হয়ে গেল। বাবা এরকম করল কেন? পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর বাবা ঘরেই শুয়ে-বসে থাকত। হঠাৎ পুরনো বন্ধুদের হাঁড়িয়া খাওয়ানোর ইচ্ছে হল কেন?
উত্তরগুলো এতোয়ারির জানা নেই। দুটো কুকুরের পাশে বাবা প্রায় অচৈতন্য হয়ে শুয়ে আছে। বাবাকে তার পক্ষে একা তুলে ঘরে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। মাকে বললে সুস্থ অবস্থাতেই তাকে সাহায্য করতে রাজি হত না, এখন তো হবেই না। শ্বাস ফেলল এতোয়ারি। সে চোখ বন্ধ করল কিন্তু বন্ধ চোখে ঘুম এল না।
হঠাৎ মনে হল কেউ একজন দৌড়ে এসে তাদের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে থামল। এতোয়ারি চটপট উঠে বসল। তারপর গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, “কে?”
“আমি,” হাঁপাতে হাঁপাতে শব্দটা যেন কোনওমতে বের হল মহিলার গলা থেকে।
তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিভু নিভু ঢিবরি হাতে নিয়ে দরজা খুলে এতোয়ারি অবাক হয়ে দেখল বুধুয়ার বউ উবু হয়ে বসে আছে সামনে।
এতোয়ারি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে?”
কোমরে হাত দিয়ে বুধুয়ার বউ যা বের করে মাটিতে রাখল, সেটা যে পাকানো টাকার বান্ডিল, তা আন্দাজে বুঝতে পারল এতোয়ারি। হাত না-বাড়িয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় পেয়েছ?”
তখনও শ্বাস স্বাভাবিক নয়, হাত নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করেও পারল না। বোঝাই যাচ্ছিল তার শরীরে শক্তি নেই।
এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “তুমি জল খাবে?”
চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিতে নিতে মাথা নেড়ে ‘না’ বলল বুধুয়ার বউ। তারপর থেমে থেমে বলল, “টাকাটা দিয়ে গেলাম।”
“কোথায় পেলে টাকা? তোমার বর দিয়েছে?”
মাথা নেড়ে ‘না’ বলে উঠে দাঁড়াল বুধুয়ার বউ।
“তা হলে? কোথায় পেলে তাকে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করল এতোয়ারি।
“পুষির ঘরে।”
“তুমি চাইতেই টাকা দিয়ে দিল?”
অদ্ভুত হাসি যেন ছিটকে বের হল বুধুয়ার বউয়ের মুখ থেকে, “আর কোনওদিন সে কথা বলবে না। ওর শরীর থেকে প্রাণটা বের করে দিয়েছি। আচ্ছা…” কথাগুলো বলেই সে আবার দৌড়োতে লাগল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার ছোট্ট শরীরটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অবাক চোখে সেই অন্ধকার দেখে কুকুরের চিৎকারে সংবিৎ ফিরল এতোয়ারির। সে নিচু হয়ে টাকার বান্ডিলটা তুলতেই বুঝতে পারল ওগুলো যেন খানিকটা ভিজে আছে। সন্দেহ হতে ওটা নাকের কাছে আনতেই তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে এল সে। মায়ের ঘুম ভাঙেনি। ডাকতে গিয়েও থেমে গেল এতোয়ারি। অসুস্থ শরীরটার ঘুম দরকার। ডেকে তুললে আবার অসুস্থ হতে পারে। ঘরের কোণে টাকার বান্ডিলটাকে একটা বাটি চাপা দিয়ে রেখে দিল সে।
ঘণ্টাখানেক পরে চিৎকার চেঁচামেচিতে লাইনের লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পাশের লাইনের দুটো লোক বুধুয়াকে জঙ্গলের কাছে পড়ে থাকতে দেখে বয়ে নিয়ে এসেছে। বুধুয়ার বুকে একটা বড় ক্ষত যা থেকে রক্ত বেরিয়ে জামা ভিজে গিয়েছে। লোক দুটো যখন বুধুয়াকে দেখেছিল, তখনই ওর শরীরে প্রাণ ছিল না।
খবর পেয়ে বুধুয়ার ছেলেরা, ছেলের বউরা ছুটে এল। সবাই বলাবলি করছিল, হাঁড়িয়া খেয়ে মাতাল হয়ে কারও সঙ্গে মারপিট করতে গিয়ে ছুরির আঘাতে মারা গিয়েছে। বউগুলো কাঁদছিল। একজন বলল, “তোদের মা কোথায়? মাকে খবরটা দে।”
আর-একজন বলল, “বেচারা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে, জানতেই পারল না কী সর্বনাশ হয়ে গেল। কী আর করা যাবে, কপাল, কপাল!”
সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন প্রতিবাদ করে উঠল, “পুলিশে খবর দাও, ওকে খুন করা হয়েছে।”
মাথা নাড়ল একজন প্রবীণ মানুষ, “আমরা থানায় যাব কী করে? থানা তো বারো মাইল দূরে। এরকম ঘটনা ঘটলে প্রথমে বড়বাবুকে জানাতে হয়। তিনি বড়সাহেবকে জানাবেন। বড়সাহেব পুলিশকে ফোন করবেন। বুঝলে!”
এক যুবক বুধুয়ার ক্ষত দেখে মাথা নাড়ল, “ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। কার রাগ ছিল বুধুয়ার ওপর? চল, দু’জন চল আমার সঙ্গে, আমি যাচ্ছি বড়বাবুর বাসায়।”
একজন বলল, “এত রাতে গেলে বড়বাবু খুব রেগে যাবে। তার চেয়ে সকাল হলে যাওয়াই বোধহয় ভাল।”
সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ প্রতিবাদ করে উঠল। তারা বলল, একটা মানুষের প্রাণ চলে গিয়েছে শুনে যদি রাগ করে, তা হলে লোকটা মানুষ নয়।
এই সময় বুধুয়ার ছোট পুত্রবধূ ঘর থেকে ফিরে এসে জানাল সে তার শাশুড়িকে খুঁজে পায়নি। ঘরের আশপাশে কোথাও নেই।
একজন বলল, “হয়তো পেটখারাপ তাই নদীতে গিয়েছে। এখনই ফিরে আসবে। তোমরা বড়বাবুর কাছে যাও, দেরি কোরো না।”
তিনজন রওনা হওয়ার পর কিছু সময় চলে গেল, কিন্তু বুধুয়ার বউ ফিরে এল না। তখন লাইনের শিশুরা ছাড়া সবাই জেগে উঠে বুধুয়ার মৃতদেহের চারপাশে ভিড় করেছে। কিন্তু বুধুয়ার বউকে দেখা যাচ্ছে না।
যে-দু’জন লোক বুধুয়াকে বহন করে নিয়ে এসেছিল, তাদের প্রশ্ন করা হলে তারা বলল, বুধুয়ার বউকে দেখেনি। জল্পনা শুরু হল, বুধুয়ার বউ গেল কোথায়! কিন্তু কেউ ঠিকঠাক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিল না।
ভিড়ের মধ্যে মিশে থেকে এতোয়ারি এইসব কথা শুনছিল। এখন তার মনে হল, সে যা জানে, তা বলা উচিত। মনস্থির করে ভিড় ঠেলে পা বাড়াতেই দূর থেকে চিৎকার ভেসে এল, “জলদি এসো, পাওয়া গিয়েছে,” যারা বড়বাবুকে খবর দিতে নদী পার হয়ে যাচ্ছিল, তাদের একজনের কণ্ঠস্বর। সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের বেশির ভাগ মানুষ নদীর দিকে ছুটল। কিছুক্ষণ পরে কয়েকজন বুধুয়ার বউকে কাপড় জড়িয়ে নিয়ে এল।
বুধুয়ার বউয়ের শরীর নগ্ন। সে পরনের শাড়িটাই গাছের ডালে বেঁধে গলায় জড়িয়ে ঝুলে পড়েছিল। দুর্বল শরীর থেকে প্রাণ বেরিয়ে যেতে সময় লাগেনি। সেই পরনের কাপড়েই মৃতার শরীর গলা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে দেওয়া হল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পর বুধুয়ার ছেলে-বউরা গলা খুলে কাঁদতে শুরু করল। তাদের সঙ্গে গলা মেলাল কলোনির কিছু বউ। ছেলে, ছেলের বউরা বুধুয়ার বউয়ের চারপাশে বসে কাঁদতে লাগল।
মুখ খুলতে গিয়েও খুলতে পারল না এতোয়ারি। একটু আগে স্বামীকে খুন করে টাকা নিয়ে বউটা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তখন সে ভাবতেই পারেনি টাকা পৌঁছে দিয়ে বউটা নদীর ধারে গাছের ডালে ঝুলে আত্মহত্যা করবে। এতোয়ারির মনে হল সব কথা বলা ঠিক হবে না। বললে লোকে বিশ্বাস না-ও করতে পারে। বুধুয়াকে খুন করেছে তার বউ, একথা তার মুখ থেকে শুনলে লোকে নিশ্চয়ই প্রমাণ চাইবে। তার কাছে কোনও প্রমাণ নেই। তাই বললে সমস্যায় পড়তে হবে।
কী করবে তা এতোয়ারি বুঝতে পারছিল না। অথচ মৃত্যুর আগে বুধুয়ার বউ যা যা করেছিল তার কিছুটা মা জানে, সে অনেকটা।
লোকজন উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল। স্বামী খুন হয়েছে বলে বউ আত্মহত্যা করবে? কিন্তু বুধুয়ার বউ কী করে ঘরে বসে জানল তার স্বামী খুন হয়েছে? তা হলে তাকেও কি খুনি মেরে ফেলেছে। কেন? কী করেছিল বুধুয়া?
হঠাৎ একজন মৃতদেহ বয়ে নিয়ে আসা দু’জনকে জিজ্ঞাসা করল, “বুধুয়ার শরীর কোথায় পেয়েছ?”
“জঙ্গলের পাশে বস্তির সামনে,” একজন জবাব দিল।
লোকটা বুধুয়ার ছেলেদের জিজ্ঞাসা করল, “বুধুয়া ওইরকম জায়গায় কেন গিয়েছিল জানো?”
একটু চুপ করে থেকে দু’জনে মাথা নেড়ে না বলল।
ভিড়ের একজন বলল, “এত রাতে গিয়েছিল যখন, তখন নিশ্চয়ই কেউ ওখানে থাকে, যাকে সে চেনে। ওই বস্তিতে বুধুয়ার চেনাজানা কে থাকে তা কি তোমরা জানো?”
ছেলেরা বা ছেলের বউরা কাঁদছিল, জবাব দিল না।
ভোর হয়ে আসছিল। ধীরে ধীরে ভিড়টা হালকা হয়ে গেল। শুধু বুধুয়ার ছেলে, ছেলের বউ এবং তিন-চারজন আত্মীয়বন্ধু বসেছিল মৃতদেহের পাশে। এখন আর ওরা কাঁদছিল না। একটি বউ এতোয়ারিকে বলল, “আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ডিউটিতে যেতে পারব না,” সে চলে যেতে এতোয়ারি ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল।
তখন কলোনির ঘরগুলোকে আবছা দেখা যাচ্ছে। সূর্য ওঠেনি, হালকা অন্ধকার চারপাশে। ঘরের সামনে এসে এতোয়ারি অবাক, বাবার ঘুমন্ত শরীরটা মাটিতে পড়ে নেই। সে দরজা ঠেলে পাতলা অন্ধকারেও বুঝতে পারল ঘরের একপাশে বাবা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। উলটোদিকে মা ঘুমিয়ে আছে। কখন বাবার ঘুম ভাঙল, হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল তা কি মা জানতে পেরেছে? নিজের জায়গায় গিয়ে বসল সে।
হঠাৎ একটা ভাবনা তাকে ছোবল মারল। তার কপালে আব ছিল বলে স্বামী মারধর করত, টাকা নিয়ে যেতে বলত, সব টাকা পেয়ে গেলেও লোকটা অত্যাচার বন্ধ করত না। মায়ের সঙ্গে বাবার কোনও ব্যাপারেই মনের মিল হতে সে দেখেনি। সুস্থ থাকার সময় বাবা ঝগড়া করত, দু’-তিনবার মায়ের গায়ে হাত তুলতে সে দেখেছে। লাইনের অনেক স্বামী-স্ত্রীকে ঝগড়া করতে দেখে মনে হয়েছে, ওরা কেন বিয়ে করে একসঙ্গে আছে? তার আজ দুটো মেয়ে, নাতি-নাতনি, জামাইরা থাকা সত্ত্বেও কতখানি সম্পর্ক খারাপ হলে বুধুয়ার বউ স্বামীকে খুন করতে পারে!
মাথা নাড়ল এতোয়ারি। দশজনের মধ্যে আট-ন’জন স্বামী-স্ত্রীরই এই এক অবস্থা। এতোয়ারি বাবার দিকে তাকাল। বাবা কি নিজেই ঘরে উঠে এসে শুয়েছে? যে-অবস্থায় বাবাকে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে গিয়েছিল, তাতে এত তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে পেয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়বে, তা কল্পনা করতে অস্বস্তি হল। তা হলে কি মা বাবাকে বাইরে থেকে ঘরে তুলে নিয়ে এসেছে? অসম্ভব! বাবাকে মা এতটাই অপছন্দ করে যে, এই কষ্টটুকু করবে না। তা ছাড়া হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে আজ উত্তেজিত হওয়ার পর মায়ের শরীরে বাবাকে বয়ে ঘরে নিয়ে আসার শক্তি নেই।
আলো ফুটছে। এখনই উঠে নদী থেকে ঘুরে এসে রান্না না-চাপালে ঠিকসময় হাসপাতালের কাজে যাওয়া যাবে না। এতোয়ারি উঠল। মাকে ডাকতে গিয়েও ডাকল না সে। মায়ের এখন অনেকটা ঘুম দরকার।
নদীতে স্নান করতে গিয়ে এতোয়ারি দেখল, আজ অনেক মহিলাই এসেছে। কাল রাতের ঘটনাগুলো ঘুম কেড়ে নেওয়ায়, কাজে বেরোনোর আগে স্নান করে সবাই একটু ঝরঝরে হতে চাইছে। নদীর ধারে এসে ওদের মুখে বুধুয়া আর তার বউয়ের গল্প ছাড়া আর কিছু নেই।
টুনিয়াবুড়ি জলে নামেনি। পাড়ে বসে কপাল চাপড়াচ্ছিল। যারা কাছে ছিল, তারা জিজ্ঞাসা করল, “কী হল, ওরকম করছ কেন?”
“তোরা কেউ পুলিশকে বলে দিবি, বুধুয়ার শরীর যেখানে পড়েছিল তার পেছনেই ওই মেয়েমানুষটার বাড়ি,” টুনিয়াবুড়ি বলল।
“কোন মেয়েমানুষ?”
“যে-দু’জন ওকে বয়ে এনেছিল, তাদের মুখে শুনলাম,” কথাগুলো বলেই চুপ করে চোখের পাতা ওলটাল বুড়ি।
“কী শুনেছ?”
“যেখানে বুধুয়াকে পাওয়া গিয়েছিল তার পেছনেই ওই হারামজাদি পুষির ঘর। নিশ্চয়ই ওর কাছে গিয়েছিল বুধুয়া,” বলতে বলতে ফিক করে হেসে ফেলল বুড়ি, “আর কত মাথা খাবে পুষি তা কে জানে!”
এতোয়ারি স্নান করে ঘরে ফিরে দেখল, মা উঠে বসেছে। বোধহয় মুখ-হাত-পা ধুয়ে নিয়েছে। এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “এখন কেমন আছ মা?”
“একটু ভাল,” তারপর হতাশ গলায় বলল, “তুই দেখেছিস?”
“কী?” এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল।
“বুধুয়ার বউকে।”
“হ্যাঁ। গলায় কাপড় বেঁধে ঝুলেছিল নদীর পাশের গাছে।”
“হায় ভগবান!” শ্বাস ফেলল মা, “এরকম স্বামীকে আর কতদিন সহ্য করতে পারে।”
শুনে মাথা নাড়ল এতোয়ারি, “তা হলে তো প্রায় সব মেয়েকেই গলায় দড়ি দিতে হয় মা। আমাদের কুলিলাইনের বেশির ভাগ মেয়েরই তো এইরকম অবস্থা।”
“আমি যে কী করি!” নিচু গলায় বলল মা।
মায়ের দিকে তাকাল এতোয়ারি। তারপর বলল, “তুমি আজ সারা দিন ঘুমিয়ে থাকো। এই শরীরে কাজে যাওয়ার দরকার নেই।”
“পাগল!” মা শ্বাস ফেলল।
অবাক হয়ে তাকাল এতোয়ারি।
মা বলল, “একদিন না-গেলে টাকা কাটবে। তা ছাড়া কাজে না-গেলে ওই লোকটার সঙ্গে এই ঘরে সারা দিন থাকতে হবে! পারব না, পারব না আমি।!”
এতোয়ারি বাবার শরীর দেখল। তাদের দিকে পেছন ফিরে শুয়ে আছে।
“তা হলে কী করবে?”
“এখানে ওর সঙ্গে থাকা আর বুধুয়ার বউয়ের মতো গলায় ফাঁস দেওয়ার মধ্যে কোনও তফাত নেই রে! তুই বেঁচে গিয়েছিস। খুব কপাল করেছিলি বলে স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হাসপাতালে কাজ পেয়েছিস। সব মেয়ের যদি তোর মতো কপাল হত, তা হলে তারা বেঁচে যেত!” মা উঠল।
বাবাকে উঠে বসিয়ে হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে বেশ ঝাঁজালো গলায় এতোয়ারি বলল, “খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। নদীর ধারে যখন যাবে তখন দরজা বন্ধ করে যেয়ো।”
শোনামাত্র দু’হাতে মুখ ঢেকে ভেউভেউ করে কেঁদে উঠল বাবা। সঙ্গে সঙ্গে দরজার পাশে দাঁড়ানো মা চেঁচিয়ে উঠল, “শুনিস না, লোকটা মনভেজানো কান্না কাঁদছে,” এতোয়ারি ঘর থেকে বেরিয়ে এলে মা হাঁটতে শুরু করল।
এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি কোথায় যাবে?”
“হাসপাতালে।”
“সে কী! আবার শরীর খারাপ লাগছে?”
“ঘরে বসে থাকার চেয়ে ওখানে গেলে ভাল থাকব,” মা বলল।
লাইন ছাড়িয়ে চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে খুব ধীরে হাঁটতে হচ্ছিল এতোয়ারিকে। মায়ের শরীর যে পুরোপুরি সুস্থ নয়, তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না।
হাসপাতালের দরজায় ছোট নার্স দাঁড়িয়েছিল। মাকে দেখে চোখ কুঁচকে বলল, “কী হল তোমার? আবার শরীর খারাপ?”
“একটু। মাথা ঘুরছে!” মা দুর্বল গলায় বলল।
“শরীর দুর্বল, ঘরে শুয়ে থাকলে উপকার হত। এলে কেন?”
“ঘরে থাকলে অপকার হত,” বিড়বিড় করল মা।
“কী বললে?” চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল ছোট নার্স।
মাথা নাড়ল মা, “কিছু না।”
“ভেতরে গিয়ে বোসো। একটু পরে নাম লেখানো হবে,” ছোট নার্স চলে গেল। এতোয়ারি বলল, “নিজে যেতে পারবে?”
“হ্যাঁ। এখন একটু ভাল লাগছে।”
আজ কাজ করতে করতে কেবলই বুধুয়ার বউয়ের মুখ মনে পড়ছিল। এতদিন যে বুধুয়ার বউ লাইনে থাকত, তা কারও তেমনভাবে নজরে পড়ত না। সেই বউটা ওরকম রুগ্ণ শরীর নিয়েও মনের জ্বালা মেটাতে স্বামীকে খুন করে তার টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার পর নিজেকে মেরে ফেলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারল না। যতই স্বামীকে খুন করুক, আত্মহত্যা করা মানে তো নিজের কাছে নিজের হেরে যাওয়া। আত্মহত্যা না-করলে কী হত ওর? তাকে খুন করতে দেখেছে বলে কেউ সাক্ষী দিলে, পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে হয় ফাঁসি নয় সারা জীবন জেলে ঢুকিয়ে রাখত। জেলে ঢুকিয়ে রাখলে তো সে বেঁচে থাকত। তার বদলে বোকার মতো আত্মহত্যা করে ফেলল? কী লাভ হল!
দুপুরে ডাক্তারবাবু কোয়ার্টার্সে চলে যান স্নান-খাওয়া করতে। বিকেলে ফিরে আসেন হাসপাতালে। দুপুরে তেমন কাজ থাকে না। কিচেনে গিয়ে খাওয়ার প্লেট চেয়ে নিতেই এতোয়ারির মনে পড়ল মা না-খেয়ে আছে। সে প্লেট হাতে মাকে খুঁজতে বাইরে এসে হতাশ হল। মা কোথাও নেই। ডাক্তারবাবু যেখানে পেশেন্ট দেখেন, সেখানটা এখন ফাঁকা। মা কোথায় গেল, ভেবে পাচ্ছিল না এতোয়ারি।
সবে সে খাওয়া শেষ করেছে বড় নার্স সামনে এসে দাঁড়ালেন, “তুই তো ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার্স চিনিস!”
এতোয়ারি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
“শোন, এই প্যাকেটটা নিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়িতে দিয়ে আয়,” বড় নার্স বললেন, “তাড়াতাড়ি যাবি। বুঝলি?”
এখন আকাশে হালকা মেঘ। প্যাকেটটা নিয়ে একটু এগোতেই দূরে গাড়ির আওয়াজ হল। নতুন লালমুখো ম্যানেজার প্রায়ই গাড়ি নিয়ে চা-বাগানের ভেতরে ঘুরে বেড়ায়। লোকটির চরিত্র নাকি খারাপ। চাকরিতে যোগ দিয়ে প্রথমেই বাংলোর বয়স্ক মহিলা কর্মচারীদের ছাঁটাই করে অল্পবয়সি মেয়েদের চাকরি দিয়েছে। ক’দিন আগে লোকটা হাসপাতালে এসেছিল। বড় নার্স যখন ওঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন দূরে দাঁড়ানো এতোয়ারিকে লোকটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। পরে বড় নার্স তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ছোটসাহেবের বাংলো দেখাশোনার কাজে যেতে রাজি আছিস? এককথায় না বলে দিয়েছিল।
চটপট পাশের চা-বাগানের ভেতর লুকিয়ে পড়ল এতোয়ারি। জিপটা জোরে শব্দ তুলে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আর গাড়ির রাস্তা না-ধরে চা-বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে ডাক্তারবাবুর বাংলোয় পৌঁছে গেল। ডাক্তারবাবু নিজে দরজা খুলে চারপাশে নজর বুলিয়ে বললেন, “ভেতরে এসো। দেখি প্যাকেটটা!”
দরজা বন্ধ করে প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রেখে খুলে দেখলেন। এইসময় ভিতরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন ডাক্তারবাবুর স্ত্রী। এতোয়ারির দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন তিনি। তারপর স্বামীকে বললেন, “আর একবার ভেবে দ্যাখো।”
“আমি অমানবিক হতে পারব না। প্লিজ়, তুমি পাশে থাকো,” ডাক্তারবাবু এতোয়ারির দিকে তাকালেন, “আমি এখানে একটা অপারেশন করব। তোমাকে সাহায্য করতে হবে। আর এই অপারেশনের কথাটা বাইরের কেউ যেন না-জানে।”
মাথা নিচু করে এতোয়ারি বলল, “আচ্ছা।”
পাশের ঘরে এল সে ডাক্তারবাবুর পেছন পেছন। একটা চৌকিতে শুয়ে যে-লোকটা ছটফট করছে, তার মুখে কিছু ঢুকিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এক ডাক্তারবাবু হিন্দিতে বাংলা মেশানো ভাষায় বললেন, “আর-একটু কষ্ট করুন। একটু পরে কষ্ট অনেক কমে যাবে।”
লোকটা মাথা নাড়ল প্রবলভাবে। ডাক্তারবাবু আলমারি খুলে চামড়ার স্ট্র্যাপ বের করে এনে লোকটার হাতে একটা দিকে বেঁধে অন্য দিকটা চৌকির গায়ে শক্ত করে জড়িয়ে দিয়ে বললেন, “হাসপাতালে গেলে তোমাকে যেটুকু আরাম দিতে পারতাম, এখানে তো তা দিতে পারব না। গুলিটা বের করে দিচ্ছি, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করো ভাই।”
এতোয়ারির নিয়ে আসা প্যাকেট থেকে ইনজেকশন বের করে লোকটির হাতে সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে ওষুধ দিতেই ধীরে ধীরে লোকটি শান্ত হয়ে গেল, মাথা একপাশে এলিয়ে পড়ল। এতোয়ারি বুঝতে পারল ওকে অজ্ঞান করা হয়েছে। প্যাকেট থেকে যন্ত্রগুলো বের করে একটা ট্রে-তে রেখে ডাক্তারবাবু তাদের নাম বলে দিলেন। বললেন, “আমি যখন যে যন্ত্র চাইব, সেই যন্ত্র এগিয়ে দেবে। নামগুলো আবার বলব, না মনে থাকবে?”
গোটা চারেক অপারেশন করার ছুরি, কাঁচি, তুলো, ওষুধের শিশি আর ইনজেকশন। এতোয়ারি মাথা নাড়ল, মনে থাকবে। তারপর ডাক্তারবাবু লোকটার ক্ষতস্থানে বাঁধা কাপড়ের ব্যান্ডেজ খুলে সেখানে ওষুধ ঢাললেন। তারপর ছুরি দিয়ে ক্ষতস্থান কেটে ভেতর থেকে একটা ধাতব বস্তু বের করে এনে ভেতরে ওষুধ ঢেলে তুলো চেপে ধরে নতুন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। এরপর অন্য টেবিল থেকে একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ এনে লোকটার হাতে সুচ ঢুকিয়ে ওষুধ দিলেন। লোকটা এবার একটু নড়াচড়া করল। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “আহা, তোমার নামটা যেন কী!”
“এতোয়ারি।”
“হ্যাঁ, এতোয়ারি, তুমি এই লোকটাকে কি কখনও দেখেছ?”
ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না বলল এতোয়ারি।
“তুমি যে এখানে এসে লোকটার শরীর থেকে আমাকে গুলি বের করতে দেখলে, তা কাউকে না-বললে খুশি হব,” ডাক্তারবাবু বললেন।
মাথা নিচু করে এতোয়ারি বলল, “ওকে কে গুলি করল?”
“পুলিশ।”
“সে কী!” চোখ বড় হয়ে গেল এতোয়ারির।
“কিন্তু এই লোকটা চোর, ডাকাত, বদমাইশ নয়। ও বিপ্লবী। আমাদের দেশকে ওরা স্বাধীন করতে চায়। আচ্ছা, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্যে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করছে, তাদের কথা তুমি শোনোনি?”
কেউ কেউ যে বলাবলি করেনি তা নয়, কিন্তু এদিককার যত চা-বাগানের মানুষ ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করছে, এমন কথা এতোয়ারি শোনেনি। এদিককার সব চা-বাগানের মালিক সাদা চামড়ার সাহেবরা, বড় ম্যানেজার থেকে ছোট ম্যানেজারের গায়ের চামড়াও সাদা। ওরা যে সাগরপারের দেশের মানুষ, তা সবাই জানে। লাইনের বুড়োরা বলত, এই চা-বাগানে সাহেবরা এসেছে সাগর পেরিয়ে, বহুদূর থেকে। আর তারা, যারা চা-পাতা তোলে, ফ্যাক্টরিতে কাজ করে তারাও এখানকার মানুষ নয়। তারা এসেছে রেলগাড়িতে চেপে বহু দূরের দেশ থেকে। ওই সাদা চামড়ার মানুষগুলো চাকরির শেষে যে যার নিজের দেশে ফিরে যেতে পারে, তারা পারে না। দেশে ফিরে যাওয়ার রাস্তা যারা জানত, তারা কবে মরে গিয়েছে। আবার এই চা-বাগান যে কারও দেশ হতে পারে না, সেটাও তারা বুঝে গেছে।
“আঃ, আঃ,” লোকটার শরীর নড়ে উঠল। এতোয়ারি দেখল এবার চোখ খুলছে লোকটা।
ডাক্তারবাবু ঝুঁকে লোকটার মুখের বাঁধন খুলে চওড়া ধাতব বস্তু দাঁতের তলা থেকে বের করে বললেন, “আর ভয় নেই। গুলি বের করে দিয়েছি। চুপচাপ কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলে ব্যথা কমে যাবে, তার ওষুধ দিচ্ছি।”
লোকটা মুখ খুলল। ওর কথা শুনে এতোয়ারি বুঝতে পারল বাঙালি নয়, মদেশিয়া, মুন্ডা বা ওঁরাও হবে। কাতরে কাতরে লোকটা বলল, “আমি চলে যেতে পারব। আপনার এখানে ধরা পড়লে আপনি বিপদে পড়বেন।”
“ঠিক কথা। কিন্তু যে তোমাকে এখানে রেখে গেছে, সে সন্ধের পরে আসবে। ততক্ষণ তো এখানে থাকতে হবে ভাই। তা ছাড়া এই দিনের আলোয় তোমাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখলে সবাই তাকাবে। তুমি ধরা পড়বেই,” ডাক্তারবাবু বললেন, “কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে তুমি চলে যেয়ো।”
লোকটা মুখ ঘুরিয়ে এতোয়ারিকে দেখল। মুখে ভয় ফুটে উঠল তার, “এই মেয়েটা কে? এ বলে দেবে না তো?”
“ওকে নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না,” ডাক্তারবাবু আর-একটা ইনজেকশন দিলেন লোকটার হাতে। এতোয়ারি দেখল ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল লোকটা। ব্যবহৃত ওষুধগুলোর খালি প্যাকেট একটা কাগজে মুড়ে ডাক্তারবাবু বললেন, “এগুলো হাসপাতালের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ো। আর এগুলো বড় নার্সকে ফেরত দেবে,” বড় নার্সের পাঠানো জিনিসগুলো প্যাক করে দিলেন ডাক্তারবাবু।
দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “আজ তুমি খুব ভাল কাজ করলে। আর হ্যাঁ, বড়রাস্তা দিয়ে না-গিয়ে চা-বাগানের মধ্য দিয়ে হাসপাতালে যাবে। যাও।”
এতোয়ারি কথাগুলোর মানে বুঝতে পারছিল না। তবে কোনও মানুষের সঙ্গে দেখা হলে নানা প্রশ্ন শুনতে হবে, যার উত্তর ডাক্তারবাবু আর ওই লোকটির ক্ষতি করতে পারে, এটা বুঝতে পারল সে।