২. রাগে ঘৃণায় অনিচ্ছায় আর হতাশায়

রাগে ঘৃণায় অনিচ্ছায় আর হতাশায় আমাকে উঠে আসতে হয়েছিল, আমি একেবারে একা ছিলাম, বন্ধুরা সঙ্গে থাকলে কী করতাম আমি জানি না, মনে মনে যা তা গালাগাল দিতে দিতে এসেছিলাম আর বাবার মুখটা মনে হতেই, মনে মনে বলে উঠেছিলাম, ভারী একেবারে বাবাগিরি দেখাচ্ছেন, আমি একেবারে ধন্য হয়ে গেলাম, বুন্ধু! কিন্তু আশ্চর্য তখনই আমার হাসিও পেয়ে গিয়েছিল বুন্ধু কথাটা বলে, আমি যেন বাবার মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম, হঠাৎ বুদ্ধ শুনে কী রকম হয়ে গিয়েছে, ভদ্রলোক একেবারে হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, যেন ঠিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না প্রকৃতই পুত্র এবম্বিধ সম্বোধন করিয়াছে কি না, এবং সেটা ভাবতে পেরে, কথঞ্চিৎ শান্তি বোধ করিয়াছিলাম, কিন্তু, বাড়ি আমি যাইনি, হস্টেলে ফিরে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যাবেলার দিকে তখন অনেক ছেলেরাই হস্টেলে ছিল না, অনেকে অ্যারেস্ট হয়েছিল, যারা হয়নি, তারা মাঠে ময়দানে কাফে রেস্তোরাঁতে নিশ্চয় জমিয়ে বসে নানারকম আলোচনা করছিল, আর যারা এ সবের মধ্যে থাকে না তারাও অনেকেই বেড়াতে ঘুরতে বেরিয়ে গিয়েছিল, যে যার নিজের সন্ধানে কীসের সন্ধানে? তাহা হইলে বলিতে হয়, বুঝহ রসিক জন, যে জান সন্ধান, যেমন পরেশটা ট্যাঙরায় যেত, ওর মাসতুতো বোনের সঙ্গে প্রেম করতে আপন মাসতুতো বোন প্রকৃত ভ্রাতা-ভগিনীর প্রেম এবং ওরা আবার চিঠি লেখালেখি করত প্রিয়তম প্রিয়তমা সম্বোধন করে। অহো প্রেমের কী বিচিত্র গতি, অবিশ্যি কী-ই বা যায় আসে, দুটো ছেলে আর মেয়ে তো, বেশ করত। নেই মামার চেয়ে কানা মামাই ভাল, না জুটলে মাসতুতো বোনই ভাল, তবু প্রেম তত হচ্ছিল। প্রেম! হ, পরেশ, বুজচি বুজচিআর কিছু ছেলে ছিল, তারা জানত যেন, পৃথিবীটা বই খাতা পরীক্ষা দিয়ে ঠাসা, পড়ছে তো পড়ছেই। ওদিকে চোখের কোণে কালি। সবথেকে বেশি ক্লাস নেওয়া লেকচারারের মতো মুখখানি, মধ্যপ্রান্তে ক্লান্ত বিষণ্ণ বলদ যেন। কাহাকেও কিছু বলিবার নাই, কাহাকেও নালিশ জানাইবার নাই, দানা জুটাইতে হইলে, এইরূপ করিয়া যাইতে হইবে, মুখের ভাবগুলো ওদের সেইরকম, কিন্তু আমার মনে হয়, আসলে ওরা অন্য কিছু করত, আপন অঙ্গসমূহকে ঈদ্রিশ ভালবাসিত, সমুদয় দিবস সন্ধ্যায় রাত্রে। সেই ভালবাসার খোয়ারিতেই, চোখের কোণে কালি পড়িত। ওই ধরনের সব ছেলেই হয়তো সেরকম ছিল না, তবে সত্য নামে ছেলেটা যে ছিল, তাতে আমার একটুও সন্দেহ নেই, ওকে আমি নিজে চোখেই দেখেছিলাম, সে কী বিশ্রী ভঙ্গি, আর ঘর ছেড়ে বেরুত না প্রশান্ত আর রাজীব, হস্টেলের সবাই জানত, অমন প্রেমের জুটি আর হয় না। ওরা এক বছরের সিনিয়র জুনিয়র ছিল, ওদের কথা নিয়ে কত হাসাহাসি হত, ওদের ও সবে কিছুই মনে হত না। প্রশান্ত রাজীব প্রমত্ত তরণীর ন্যায় ছুটিতেছিল। গোলমাল হত তখন, যখন কোনও কারণে ওদের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যেত, মান অভিমানের পালা চলিত, ওহো, সে কী মর্মান্তিক শুষ্ক বিষণ্ণ মুখ দুইজনের।

হস্টেলে ফিরে আমি সেই রকম কয়েকজনকে দেখেছিলাম–দেখিনি, জানতাম ওরা আছে ওরা কোনও কিছুতেই নেই। ওরা ঘরেতে বইয়েতে পড়াতে বিছানাতে আছে একমাত্র একজন ছাড়া, ভোলানাথ। ও যে সত্যিই ছাত্র, কিছুতেই মনে হত না, বেশ দাড়ি-গোঁফ কামানো মোটাসোটা মানুষ, বুলডগ বুলডগ বোকা বোকা ভাবের হাসি মুখ, যেন কত ভার-ভারিক্কি বয়স্ক মানুষ। খুব সুন্দর করে গোঁফ কামাত, কালো পাড়ের তাঁতের ধুতি অদ্ভুতভাবে কোঁচাত্য আমি আমার সারা জীবনে পারব, কারণ ধুতি পরতেই জানি না, কোনও অকেশনে বছরে এক-আধবার পরতে হলে, কেউ না কেউ পরিয়ে দেয়। সেই কোঁচা লুটিয়ে, গিলেকরা আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে এমনভাবে বেরুত, ঠিক যেন আমাদের বাড়ির পাশের, কোথাকার গোয়ালপাড়ার দত্তবাবু। যিনি আটতলা বাড়ি করেছেন গোয়ালপাড়া থেকে এসে, তিনিই বেরোলেন। আমি ভোলানাথের ঘরে গিয়ে দেখেছিলাম, ও ওর সেই বিখ্যাত ঢাকা দেওয়া চিনেমাটির গেলাসটি টেবিলে রেখে কাপড় কুঁচোচ্ছে। ওটা ওর প্রতিদিনের ব্যাপার, চিনেমাটির গেলাসে, যাতে না দেখা যায়, হুইস্কি খায়, ঢাকা দেওয়া থাকে বলে গন্ধও বেরোয় না। তারপরে সন্ধেটি হলে, পাটভাঙা ওইরকম ধুতি-পাঞ্জাবি পরে উত্তর কলিকাতায় গমন করে, ফিরিয়া আইসে ঠিক সময় মতো। একেবারে সুবোধ বালকটি, ওকে নিয়ে সুপারিন্টেন্ডেন্টকে কোনও দিন ঝামেলা পোয়াতে হয়নি। অবিশ্যি ও ব্যাপারে একলা ভোলানাথ নয়, চিনেমাটির গেলাস সকলের না থাক, কয়েকজনের প্রায়ই চলত।

ভোলনাথ আমাকে দেখে প্রায় আঁতকে উঠেছিল, বলেছিল, একী, তোমাকে তো বেদম মেরেছে দেখছি, মুখ-টুখ ফুলে গেছে, শিগগির একটু টেনে নাও, আরাম হবে। ৪৬২

আরাম হবে?

হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ব্যথা অনেক কমে যাবে। ব্রান্ডি থাকলে, তাই দিয়ে তোমার মুখ ধুইয়ে দিতাম, ইস, তোমার বাঁ-চোখটা তো প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে, দেখাই যাচ্ছে না।

তার আগে যে আমি কোনও দিন খাইনি তা নয়, তবে ভোলানাথের সঙ্গে কোনও দিনই খাইনি, ও আমাকে একটা গেলাসে খানিকটা ঢেলে দিয়েছিল, দেবনাথবাবুকে আমি জানলা দিয়ে ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম, আমাদের হস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট, ফিজিক্স পড়াতেন–উনি পায়চারি করছিলেন নীচে, ওঁর আবার হস্টেলে দু-তিনটে ছেলে স্পাই ছিল। সেই খচ্চর কটিকে আমরা ওদের খচ্চর ছাড়া কখনও কিছু বলতাম না, অলক বলত পায়াস খচ্চর কারণ ওদের আবার একটু ধর্মভাব ছিল, ধার্মিক ভাবের ছেলে, যে কারণে সুপার ওদের পছন্দ করতেন। কারণ উনি নিজেও ধার্মিক মানুষ, ভোজনাদি বিষয়ে বিশেষ নিবিষ্টচিত্ত ব্যক্তি এবং সেই জন্যই সুপার হিসাবে ওঁর নিয়োগই সর্বার্থে মান্যজ্ঞান করা হইয়া থাকে কেন না ইহাতে প্রমাণিত হইতেছে যে, ওঁর অন্তরের নৈতিক বল অতি প্রবল, পবিত্র ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন, অতএব ছাত্র আবাসে তাঁহার ন্যায় ব্যক্তিরই, সদাজাগ্রত প্রহরীর ন্যায় থাকা উচিত। সুপারের বয়স বেশি নয়, কিন্তু চোয়াল চিবিয়ে চিবিয়ে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে দিয়ে, মোটা সাদা প্যান্টের ওপর, ওদিকে কোমর ছাড়ানো, এদিকে কনুই ছাড়ানো হাওয়াই শার্ট গায় দিয়ে থাকতেন, আর সকলের দিকেই এমন চোখের কোণ দিয়ে তাকাতেন, যেন, জান, ছাল ছাড়িয়ে খেয়ে ফেলতে পারি তোমাদের। কিছু দিন ছুটি লইয়া তিনি বিবাহ করিতে গিয়াছিলেন, অন্তরের পবিত্রতার দ্বারা দশ মাস পূর্ণ হইবার পূর্বেই ঈশ্বর সদৃশ একটি পুত্রলাভ করিয়াছিলেন, কী রূপে এতাদৃশ ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহা একমাত্র তিনিই বলিতে পারেন, ফিজিক্স পড়াইতেন তো। আমরা তাঁহার স্ত্রীকেও দেখিয়াছিলাম, কিন্তু আমাদের মন বা দেহজগতে, কাষ্ঠপুত্তলিকা কৃশ কৃষ্ণমূর্তি সাড়া জাগাইতে পারেন নাই। আমি নীচে ওঁর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হুইস্কি খেয়েছিলাম, তারপরে নিজের ঘরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে, প্রথমটা যেন নিজেকে চিনতেই পারিনি, যদিচ সেটা আমারই মুখ, কিন্তু সে মুখটার মালিকও যেন আমি নই, নিষেধওয়ালারা সেটাকেও যা খুশি তাই করতে পারে। ব্যথার কথা আমার একবারও মনে হয়নি তখন, রাগে আর ঘৃণায় আমার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছিল, এমন বিচ্ছিরি রাগ আর ঘৃণা সত্যি দাঁতে দাঁত চেপেছিলাম, আমার চোখে জল এসে পড়েছিল, আমি আমার খালি ঘরে বিছানার ওপরে উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে পড়ে, বেডকভারটাকে খামচে ধরে, ফুঁপিয়ে উঠেছিলাম, দাঁত দিয়ে বেডকভারটাকে কামড়ে ধরেছিলাম। আর আমার চোখের সামনে গোটা কলকাতাটা যেন ভাসছিল। তারপরে হঠাৎ-ই আমি থেমে গিয়েছিলাম, এবং যেন নিজের মনেই অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এ আবার কী হচ্ছে, ছি।

আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, আর নিজের কাছে, নিজেরই যেন কেমন লজ্জা করেছিল, আমি হেসে উঠেছিলাম, আবার বলেছিলাম, ধূর রাস্কেল, উল্লুক, এ সব কী। ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে দিয়ে, জামা-প্যান্ট খুলে ফেলেছিলাম, প্রচুর ধুলো লেগেছিল, দেওয়ালের মাঝারি আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে কোমরে দোলা দিয়ে সামনেটা এগিয়ে দিয়েছিলাম। শিশুরা যে প্রকার রাগবশত আপন অঙ্গ দেখাইয়া থাকে, সেইরূপ আমি নিজেকে দেখিয়েছিলাম, বলেছিলাম, হু দ্য হেল ইউ আর, চল চান করতে।

স্নান করতে গিয়ে গায়ে জল পড়তেই গাটা এমন শিউরে উঠে শিরশিরিয়ে উঠেছিল, যেন জ্বরো গায়ে জল লাগার মতো। তবু তো ভোলানাথের জিনিস একটু পেটে পড়েছিল। মুখে হাত দেবার উপায় ছিল না, এত ব্যথা হয়েছিল, ভুরুর কাছে ফোলা জায়গাটা একটা মাংস ফাটা ভাব হয়ে গিয়েছিল, অথচ দু-এক ফোঁটা ছাড়া রক্ত পড়েনি। আমি হাতে সাবান ঘষে, আস্তে মুখে দিয়েছিলাম। চান করার পরে আমার যেন সত্যি শীত করছিল। তাড়াতাড়ি ধোয়া জ্যামাপ্যান্ট পরেছিলাম, আর তখনই দরজায় ঠক-ঠক করে শব্দ হয়েছিল, দরজা খুলে দিয়ে দেখেছিলাম, ভোলানাথ নাগরবাবুটি সেজে, হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। বলেছিল, সুপার শালা দাঁড়িয়ে আছে, কী করে যাই, আমাকে এ বেশে দেখলেই চটে যায়।

আমি বলেছিলাম, মাথা নিচু করে চলে যাও।

সেও কয়েকদিন যেতে গিয়ে আটকে পড়েছি, খালি বলে, ইট ইজ এ শেম ফর ইউ, বরযাত্রী তো যাচ্ছ না, এরকম পোশাক পরতে তোমার লজ্জা করে না? আর কখনও যখন তখন এরূপ পোশাক পোরো না।বলো তো কী মুশকিল, আমাকে ওর মতো ঢলঢলে জামা পাতলুন পরতে হবে। আমি তো আবার কথা বলতে পারি না। আজ্ঞে, আচ্ছা করে কোনও রকমে কেটে পড়ি। তুমি একটু চলো না আমার সঙ্গে, গেট-অবধি চলো, তোমার সঙ্গে স্মার্টলি কথা বলতে বলতে চলে যাব। আমার হাসি পেয়েছিল ভোলানাথের কথা শুনে, আমি ওর সঙ্গে গিয়েছিলাম, আর সত্যি ও এমন এলোমেলো বকবক করতে করতে–আসলে নার্ভাস, বুঝতে পেরেছিলাম, বেরিয়ে এসেছিল, আর গেটের কাছে গিয়ে আমাকে বলেছিল, যাবে আমার সঙ্গে? তখন আমার কোথাও যাবার ছিল না, বাড়ির কথা যতবারই আমার মনে পড়ছিল, ততবারই আমার ঘাড় বেঁকে উঠেছিল, দাঁতে দাঁত চেপেছিলাম, অকথ্য কতকগুলো গালাগাল মনে মনে উচ্চারণ করেছিলাম, বাবার মুখটা আমার মনে পড়ছিল, উনি আমাকে উদ্ধার করার জন্য হাজত থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন। সত্যি কথা বলতে কী, আমি যে তখন কী করব, কী ইচ্ছা করছিল, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হয়তো ঘরে শুয়ে থাকতাম বা কারুর সন্ধানে যেতাম, সন্ধানে! কীসের সন্ধানে বাছা, কিন্তু কাউকেই হয়তো কোথাও পেতাম না, আর মুখটা এমন বিশ্রী দেখাচ্ছিল, কপালটা ফোলা, ঠোঁটের কোণটা ফাটা, তখন বেবির কথা আমার মনে পড়েছিল কয়েকবার। ওর সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করছিল, তখন ওর সঙ্গে আমার নতুন প্রেম হচ্ছে, হয়তো ও একটু দুঃখ করত আমার চেহারা দেখে। ওদের বাড়ি যেতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু খুব সন্দেহ ছিল, ওকে সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে গিয়ে পাব কি না। ওদের বাড়িটাও দূরে, হয়তো কোথাও বেরিয়ে গিয়েছে, যেমন গিয়ে থাকে, তখন হয়তো, কোনও রেস্তোরাঁয় কোনও ছেলের সঙ্গে বসে প্রেম করছিল, প্রেম তো করিতেই হইবে,তারপরে আবার বাড়ি ফিরে গিয়ে পড়াশোনা আছে, অতএব–কিন্তু ভোলানাথের সঙ্গে কোথায় যেতে বলেছিল ও, উত্তরে? মনে হতেই আমি মনে মনে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম, হাজত থেকে বেরিয়ে আসবার পরে, আমার যেন সবই ভীষণ ফাঁকা লাগছিল, পড়তে বসার কথা চিন্তাই করতে পারছিলাম না, পরের দিন কলেজে নিশ্চয়ই ধর্মঘট হবে, অনুমান করেছিলাম, কেন না, নির্যাতনের প্রতিবাদ হবেই। হস্টেলের ঘরে একলা থাকতে ভাল লাগছিল না, বেবির কাছে যাবার ইচ্ছা থাকলেও ভরসা পাচ্ছিলাম না। এবং ভিতরে ভিতরে একটা রাগ আর ঘৃণা যেন, খুব একটা তীব্র ব্যথা যেমন–যাকে বলে সারা শরীরটাকে আচ্ছন্ন রাখে, সেই রকম করে রেখেছিল, আর মুখটা খুব শক্ত হয়ে উঠেছিল আমার, বলেছিলাম, কোনও দিন যাইনি।

ভোলানাথ বলেছিল, না হয় আজ যাবে। আমি আবার তোমাদের মতো মেয়েদের সঙ্গে বসে বসে, কফি খেতে খেতে গল্প করতে পারি না। কী আছে বাবা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একটা কথাই তো…। আমি আবার তখন ঠিক অতটা–যাকে বলে মোহমুক্ত তা হয়ে উঠিনি, যদিচ, প্রেম সম্পর্কে, ছেলেবেলা থেকেই আমার তেমন কোনও ধারণা জন্মায়নি, আমার দিদি অর্পিতা-ই তার খেল দেখিয়ে দিয়েছিল এবং…না, সে মুখটার কথা আমি ভাবতে চাইনি, আর এখন আমার মনেই পড়ছে না। মোটের ওপর, আমার প্রেম-চিন্তার চন্দ্রে তখন হইতেই রাহুর ছায়া পড়িয়াছিল, তত্রাচ কবিতা পাঠ করিয়া, সংগীতাদি শ্রবণ করিয়া, এবং সাহিত্য পাঠ করিয়া, সিনেমা থিয়েটার দেখিয়া, কী রূপ একটা বিশ্বাস ছিল, হয়তো আমি তাহাদের মতো কিছু আবিষ্কার করিতে পারিব, কারণ বেবির জন্য তখন বুকের মধ্যে কেমন একরকম টনটন করিত, তাহাকে দেখিতে ইচ্ছা করিলে, দেখিতে না পাইলে, সহসা বক্ষভেদী দীর্ঘশ্বাস ঝরিত, ডাকিয়া না পাইলে, মন মুষড়াইয়া পড়িত, নিজেকে বড় হতভাগ্য বলিয়া বোধ হইত, মনে হইত, কাঁদিয়া ফেলিব।

কিন্তু আমি ভোলানাথকে সে কথা বলিনি, কেন না, ভোলানাথের সঙ্গে আমার কোনও কথা মিলবে, বা ওর ভাবনার সঙ্গে আমার মিল থাকবে, তা সম্ভব ছিল না, কারণ ভোলানাথকে আমি ভাবতাম, একটা অন্য জগতের মানুষ। তবে সেই সন্ধ্যায়, ঠোঁট ফোলা কপাল ফোলা, ভিতরে, একটা দাঁতে দাঁত পেষা ভাব, নিঃসঙ্গ আর–আর যাকে বলে একটা অন্ধের মতো অবস্থা, যেমন এখন মনে হচ্ছে, আমার ভাবনা চিন্তা ইত্যাদিগুলোতে যেন কেউ কালো মোটা পরদা ঢাকা দিয়ে রেখেছে সেইরকম অবস্থা, আমি বলেছিলাম, চলো যাই। আমরা বাইরে আসতে রাস্তার ওপরে, কে যেন বক্তৃতা করছিল, গলা যথেষ্ট জোরে চড়িয়ে মাইক ছাড়া, রাগত স্বরে, আজকের ছাত্র ও যুবক নির্যাতনের কথা বলছিল এবং যা ভেবেছিলাম, তা-ই পরের দিন সমস্ত শিক্ষায়তনকে একদিনের জন্য প্রতীক ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হচ্ছিল। আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখছিলাম, আমার অচেনা ছেলে একজন বলছে, আমি তাকে চিনি না, আর তখনই ভোলানাথ বলেছিল, দেখো ভাই, কাউকে যেন বোলো না আজকের কথা, তা হলে আমার ওপর সবাই চটে যাবে, বিশেষ করে অলক বা বিজন, ওদের আমি খুব ভয় পাই, জান তো, আমি বাবা ইউনিয়নের চাঁদা দিয়ে খালাস। আর তোমাদের ওই রুদ্র, ও শালা লেখাপড়া করে না বটে, বোধহয়, পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্র জীবনই কাটিয়ে যাবে ঠিক করেছে, এদিকে তো কোনও গুণে ঘাট নেই, কিন্তু ও আমার ওপর কেন যেন বড্ড চটা। সুপারের মতো, ও-ও চায় না, আমি এরকম জামাকাপড় পরি, আরে বাবা, তোমাদের মতো ড্রেন পাইপ যদি আমার পরতে ইচ্ছে না করে আর সত্যি, ওতে আমার ভারী অস্বস্তি হয়, মনে হয় কুচকিতে হাজা হয়েছে–এ পর্যন্ত শুনতে শুনতেই আমার ভীষণ হাসি পেয়ে গিয়েছিল, ওকে আমাদের পলেটিক্স-এর প্রফেসর হারাণ চৌধুরীর মতো লাগছিল, যে হারাণবাবু একজন অতি উৎকৃষ্ট নীতিবাদী মানুষ এবং জুয়োলজির সুরেশবাবুর সম্পর্কে যিনি আমাদের কাছে পর্যন্ত বলে ফেলতেন দেখ, সুরেশবাবুর কথা তোমাদের কী বলব, ওঁর স্ত্রী আমাদের বাড়ির মেড সার্ভেন্টটাকে পর্যন্ত ভাগিয়ে নিয়ে গেলেন, তার জন্য উনি একটা কথা তো বলেনইনি, উপরন্তু আমি বলেছি বলে, আমার ওপর তেরিয়ান হয়ে এলেন। আর উনি এমন অশ্লীল বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তার সময় শালা পর্যন্ত বলেন।..কী আশ্চর্য, সুরেস্বাবু সসালা পর্যন্ত বলেন। অবিশ্যি উনি আমাদের কয়েকজনকেই এ সব কথা বলতেন, সবাইকে নয়। বলতেন একটু হাসতে হাসতে, একটা নিরীহ ভাব নিয়ে, আসল উদ্দেশ্য সুরেশবাবুর বিরুদ্ধে আমাদের চটিয়ে তোলবার জন্য, অহিংস মানুষ তো।

ভোলানাথের সেরকম কোনও উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু কথার ভাবগুলো যেন সেইরকম, এবং আমাকে হেসে উঠতে দেখে, ও বলেছিল, সত্যি মাইরি বলছি, আমার তো শালা উরতের মাংসে ব্যথা ধরে যায়, পরেছি তো দু-একবার, কী করে যে তোমরা পর। সে যাক গে, রুদ্র শালা কেন আমাকে বলবে, তুই কি সুপার? বয়স তো হয়ে গেল সাতাশ-আঠাশ, এখনও সতেরো-আঠারোর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে চালিয়ে যাচ্ছে–ও যদি জানে, তুমি আমার সঙ্গে গিয়েছ, বলা যায় না ভাই, দালালটালাল বলে বসবে কি কী বলবে–ও হয়কে নয়, নয়কে হয় করতে পারে, ওর কথা শুনে তোমরাই হয়তো আমাকে পেঁদিয়ে উড়িয়ে দেবে।

ভোলানাথ অবিশ্যি কথাগুলো একেবারে মিথ্যে বলেনি, রুদ্র সেইরকমেরই, ও ইচ্ছা করলে, কোনও ছেলের পিছনে লেগে, তার লাইফ হেল করে দিতে পারে। বিপ্লব বা অলক-কানাইয়ের কথা আমি বাদই দিচ্ছি, কেননা, ওর নামটা আমি এক নিশ্বাসে ওদের সঙ্গে উচ্চারণ করতে চাই না, ও একটা ইন্ডিভিজুয়াল পার্সনালিটি, ওর কথা বাদ, আমি বিপ্লব অলকদের কথা বলছি, ওদের সেরকম প্যাঁচ জানা নেই, খানিকটা সোজাসুজি, কিন্তু রুদ্রর জাত আলাদা। নিজেদের মধ্যে ফ্র্যাকশনালিজম করতে ওস্তাদ, হিংসুটে, ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বিদ্রূপ করতে পারে সবাইকে, কাকে রাখবে কাকে এলিমিনেট করবে, এ সব চিন্তা সবসময়ে ওর মাথায় ঘোরে, আর এ সব করে শুধু নিজের নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য, তবু ছেলেরা ওকে মেনে নিয়েছে, ও সবাইকে বশে আনতে পারে, রাখতে পারে–যদি এটাকে গুণ বলতে হয়, তা হলে তা-ই, কিন্তু সমস্তটাই ওর ভঙ্গি, কথার চাতুরি–যে কারণে ও অ্যাজিটেশনটা ভাল জানে, ছেলেরা–আমিও, ওর কথা শুনলে ভুলে যাই, ওকে না মেনে পারি না, যদিচ, বিশ্বাসঘাতক, তোর দিন ঘনাইয়া আসিয়াছে। আগে আমি বুঝতাম না, আগে রুদ্র রুদ্র করে মরে যেতাম-এটা ঠিক যে ও আমাদের থেকে বয়সে বেশ কিছু বড়, কিন্তু এখনও ছাত্র, যে কারণে ভোলানাথ বলেছিল ও পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্র থাকবে, তা হলেও আগে ওর সবকিছুই ভাল লাগত, হয়তো এখনও লাগত, যদি না আমার কাছে ও ধরা পড়ে যেত, ও কী, ও কে, ও কী করে যাচ্ছে। ও নিজেও জানে না, কী ভাবে আমার কাছে ধরা পড়েছে, বন্ধুদের বললে, ওরা আমাকে বিশ্বাস করবে না, কারণ আমি দু-একজনকে বলতে চেষ্টা করেছিলাম, তারা একেবারে উড়িয়ে দিয়েছে এবং মিহির বলেছে, যদি সেরকমভাবে কিছু প্রমাণ না করতে পারিস, তবে রুদ্র তোর লাইফ হেল্ করে দেবে।

সেটা আমি নিজেও জানি, আমি বিপ্লব নই, কানাই নই, অলক বিজন নই, কেন না ওদের মতবাদ রাজনীতি ইত্যাদি আছে, ছাত্রজীবন থেকে বেরিয়ে যাবার পরেও, ওদের সে সব থাকবে, অতএব রুদ্র ওদের কোনওদিনই কিছু করতে পারবে না, কিন্তু আমার পিছনে ও লেগে থাকবে আমার ক্ষতি করবে। অবিশ্যি কী ক্ষতিই বা ও আমার করতে পারে, তাও জানি না, আসলে আমি বোধহয় ওকে ভয় করি, সন্দীপকে যেমন ভয় হয় না, কেননা রবিঠাকুর সন্দীপের চরিত্রের কথা যেভাবে লিখেছেন, সেটা শুধু ফাঁকি আর লোভ, তার ওপর রাগ আর ঘৃণা হতে পারে, কিন্তু তাকে ভয় হয় না, কারণ সন্দীপ এনিমি অব দ্য এজেন্ট ছিল না, সন্দীপ স্পাই ছিল না, কিন্তু গ্রেগরি পেক্ মাকা ভঙ্গি করে, আর বোম্বাই হিয়োর চালে, বিপ্লবের থেকেও বড় বৈপ্লবিক বুলি, রুদ্র একটা টিকটিকি মাত্র, বাস্টার্ড। পরে সরস্বতীর মুখে আমি শুনেছিলাম, তাহার জরায়ুমধ্যস্থিত পূণটি রুদ্রর দান ছিল, এবং সরস্বতী নিজে সেদিন মিছিলে আসতে চায়নি, রুদ্রর রেভ্যুলশনারি ভ্যানিটিতে নাকি আঘাত লাগত, তুমি আস্তে আস্তে একটু যেতে পারবে না? তাই গিয়েছিল এবং সরস্বতী স্বীকার করেছিল এই জন্য যে, রুদ্র তখন ওর কাছ থেকে সরে গিয়েছিল, কিন্তু আমি ভাবি, এমন অদ্ভুত আবদারই বা কেন করেছিল রুদ্র, সত্যি কি সরস্বতী না গেলে, ওর, যাকে বলে, নেতৃত্বের অভিমানে লাগত, না কি আর অন্য কোনও কারণ ছিল, যদিচ, আমি এটা ভাবতেই পারি না, সরস্বতীর এমন কোনও দায়িত্ব ওকে নিতে হবে, সেই ভয়ে, জেনেশুনে মরণের মুখে পাঠিয়ে দিয়েছিল, কারণ অ্যাবরশনের ব্যবস্থা সরস্বতী নিজেই করেছিল, এমনকী নার্সিংহোমের খরচটাও ও নিজে দিয়েছিল, অবিশ্যি, পুলিশ ওকে ওর কথামতো অ্যাম্বুলেন্সে করে নার্সিংহোমেই পাঠিয়ে দিয়েছিল, সেদিন ও আসলে সম্পূর্ণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেনি, এবং ডাক্তার ওকে উদ্ধার করেছিল। কিন্তু এই কারণে রুদ্রকে আমি খুব একটা দোষ দিই না, অর্থাৎ সরস্বতীর কনসেপশন হয়ে যাবার জন্য, মেয়েদের পেট তো এমনি হয় না, যদিচ, কন্যাসকরা এইরূপ বলিতে অভ্যস্ত, অমুকে আমার পেট করেছে বা ওদের কথার ভঙ্গিই এরকম, ওকে অমুকে মানে অমুক ছেলে কিছু করেছে, যেমন ছেলেরা বলে, আমি ওকে কিছু করেছি। ওরা করে না, ওদের করে, আমরা করি, এটা বোধহয় একটা-চি-চিরায়ত কথার ভঙ্গি, কিন্তু এর দ্বারা সন্দীপ বিমলার কথা আমি বলতে চাই না, হঠাৎ মনে এল, তাই ভাবলাম, আসলে সন্দীপকে যদি বা একটু আধটু চিনতে পারি, বিমলাকে চিনি না, বুঝি না, নিখিলেশ নামক ব্যক্তিরা কোথায় থাকে, আমার জানা নেই, আমি ভাবছি, রুদ্র কি এযুগের সন্দীপ, অথবা সন্দীপও একটা কল্পনার চরিত্রে ছদ্মবেশ পরানো, আমি জানি না, রুদ্র হইল বর্তমান যুগের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সর্বনাশ, সুচিক্কণ রজ্জবৎ নিরীহ দর্শন, কিন্তু বিষাক্ত সরীসৃপের ন্যায় দংশন করিয়া যাইতেছে। পুলিশে ঘিরে রাখা, আমাদের শিক্ষায়তনে, যেদিন আমরা আটকে ছিলাম, সেদিন আমি পরিষ্কার দেখেছিলাম, দক্ষিণের তিনতলা থেকে রুদ্র, রাস্তার ওপর পুলিশের গাড়িতে, ছোট কী একটা ছুঁড়ে দিয়েছিল। সেটা কী। তারপরেই একটা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে, কয়েকজনকে ছুটে বেরিয়ে পড়তে বলেছিল বিশেষ একটা জায়গা দিয়ে, যদিচ, পাঁচিল টপকাবার একটা ব্যাপার ছিল, কিন্তু সব কজনই ধরা পড়েছিল, সাঁ করে সেখানে পুলিশের গাড়ি এসে পড়েছিল, এবং প্রত্যেককে মারধোর করা হয়েছিল, এবং হঠাৎ কোথা হইতে বোমা বিস্ফোরিত হইয়াছিল পুলিশের গাড়ির কাছাকাছি, কেহ বলিতে পারে নাই এবং পুলিশ নেকড়ের ন্যায় প্রবেশ করিয়া আমাদের সবাইকে পিটাইতে পিটাইতে বাহির করিয়াছিল। রুদ্র রহস্যময় নহে, স্ফটিকস্বচ্ছ জলের ন্যায়, প্রমাণ উপস্থিত করিতে পারিব না, কিন্তু আমি ওকে ছাড়ব না, ওর সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া আছে। রুদ্রকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কী ছুঁড়ে ফেলেছিলেও এমন আশ্চর্য হয়ে, অবাক একটা হাসি হেসেছিল, যার মধ্যে বিদ্রূপ ঝলকে উঠেছিল, বলেছিল, ড্রিমিং? বিয়ার টিয়ার চাপিয়েছিলে নাকি? আমি দেখতে গিয়েছিলাম ওদের পজিশনটা। বটে! শ্রীহরির রেস্তোরাঁয়, যেখানে আমরা নিয়মিত বসি, সেখানে প্রায়ই রুদ্রর ফোন কল আসে, একদিন রুদ্র ছিল না, আমি আমার মধ্যে যে একটা ঘুঘু আছে-জানি না, ঘুঘুরা টিকটিকি খায় কি না, কিন্তু ফোনটা বেজে উঠতে, কাউন্টার থেকে যখন রিসিভারটা তুলে, কানে শুনে, ম্যানেজার বলেছিল, রুদ্রবাবু তৎক্ষণাৎ আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের ঘুঘুটা জেগে উঠেছিল, আমি রিসিভারটা নিয়ে, যথাসম্ভব রুদ্রর বিশেষ ভঙ্গিতেই বলেছিলাম, হুম-হ্যালোঁ-রুদ্র বলছি–ওপার থেকে, খসখসে গলা ভেসে এসেছিল, আচ্ছা, আমি ইউ বলছি, সতেরো তারিখে, কনসুলেটে যে মিছিলটা যাবে, তার অ্যাডভান্স রিপোর্টটা ইমিডিয়েটলি পাওয়া দরকার…। শুনতে শুনতে আমার কান দুটো গরম হয়ে উঠেছিল, আমার যেন গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, কে লোকটা, কে কে, কিন্তু আমি আসল ব্যাপারটাই ভুলে গিয়েছিলাম, তখনও শুনছিলাম, ডিটেল, রুট, লিডারস্হ্যালো… আমি রুদ্রর মতো কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, গলার স্বর নকল করতে পারছিলাম না, গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল, ওপার থেকে, কয়েকবার হ্যালো হ্যালো হ্যালো বেজে যাবার পরে একটা সন্দিগ্ধ প্রশ্ন কেবল শোনা গিয়েছিল, হু আর ইউ? তারপরেই কষ্ট করে লাইন কেটে দিয়েছিল, রিসিভার রেখে আমি সরে এসেছিলাম, এবং একটু পরেই মিহির এসেছিল, ওকে আমি সব কথা বলেছিলাম, মিহির প্রথমত ব্যাপারটাকে আমার মতো করে নিতে চায়নি, ভাবতেও পারেনি, ভেবেছিল, আমাদেরই কেউ চেনাশোনা কিছু বলেছে, তারপরে আমাকে বলেছিল, যদি সেরকম ভাবে কিছু প্রমাণ না করতে পারিস, তবে রুদ্র তোর লাইফ হে করে দেবে।..

আমিই ওর লাইফ হেল করব। আজ এখন আমার ভিতরটা কেমন হয়ে আছে, চারদিকে পরদা ঢাকা দেওয়া অন্ধকারের মতো, কিছুই মনে করতে পারছি না, কিন্তু আজ এখন, সেই ঘেরা অন্ধকারের মধ্যে, আটকা পড়া ফড়িং-এর মতো, পাখা ফরফরিয়ে এই চিন্তাটি আমার মধ্যে ঘুরছে। কিন্তু ভোলানাথ যখন রুদ্রর নামে ওরকম বলেছিল, তখন আমি বিশ্বাস করিনি, ভেবেছিলাম, ভোলানাথটা ওইরকম, নিজে একটা উল্লুক, কিছুই বোঝে না, বাজে বকবক করে, এবং আমি বলেছিলাম, ওর সঙ্গে যাবার কথা কাউকেই গল্প করব না, যদি আমাকে নর্থে নিয়ে যাওয়াটা ওর কাছে আসলে কোনও অন্যায় ছিল না, ওর ভয় ছিল, জানতে পারলে, রুদ্র ওর পিছনে লাগবে। আমি ওর সঙ্গে নর্থে গিয়েছিলাম, এবং সেই প্রথম, এবং গিয়ে পৌঁছুবার আগে পর্যন্ত আমি কোনও কৌতূহল বোধ করিনি, তখনও আমার মুখটা শক্ত হয়ে ছিল, ভিতরে রাগ আর ঘৃণা উথলে উঠছিল, পল্লীতে প্রবেশ করিয়া দেখিয়াছিলাম, গৃহের দরজায় জানলায় নানাবেশে স্ত্রীলোকসকল দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। কলিকাতা নগরের কী বিচিত্র রূপ, তখন পুরাতন দিনের সংবাদপত্রের একটি পত্রের কথা আমার মনে পড়িয়াছিল, পত্রলেখকের নাম শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন সিংহ, তিনি পত্ৰদ্বারা মতামত জ্ঞাপন করিয়াছিলেন, কলিকাতাতে বারাঙ্গনাগণ সর্বত্র ইতস্তত ছড়াইয়া রহিয়াছে–থাকিবেই, কারণ আপনাপন গৃহের সন্নিকটেই বাবুগণ তাহাদের উপপত্নীদের গৃহ নির্মাণ করিয়া দিতেন, এবং সেইসব উপপত্নীদিগকে কেন্দ্র করিয়া দেহব্যবসায়িনী অন্যান্য নারীগণ আসিয়া জুটিত, স্বভাবতই সেইসব গৃহে নানা ব্যক্তির আগমন ঘটিত, তাহাই পল্লীতে পল্লীতে বেশ্যালয় সৃষ্টি করিয়াছিল–অতএব, পত্রলেখক সুধীগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া জানাইতেছেন, কলিকাতাতে যে প্রকার বারাঙ্গনার সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং গৃহস্থের পল্লীসমূহে ছড়াইয়া রহিয়াছে, তাহাতে অন্যান্য পল্লীর পবিত্রতা নষ্ট হইতেছে, অনুরোধ, বারাঙ্গনাদের একটি বিশেষ জায়গায় সীমাবদ্ধ করার ব্যবস্থা হউক।

ভোলানাথের সঙ্গে যেখানে গিয়েছিলাম নর্থ, সোনাগাছি নয় কেন জানি না, তখন সেই পত্রের কথা মনে পড়েছিল, ভেবেছিলাম, এই তাহা হইলে সেই সমগ্ৰ কলিকাতার শুচিতা রক্ষার জন্য, নির্দিষ্ট অশুচি অপবিত্র স্থান! লিবার, সন্দেহ নাই। কিন্তু সেখানে যতই ঢুকছিলাম, ততই আমার ভিতরের ঘৃণা আর রাগের বদলে, একটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার ভাব মনের মধ্যে নেমে আসছিল। চারদিকে গোলমাল, ভিড়, দোকানে দোকানে আলো, রেডিয়োতে চিৎকার, নিরুপায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় বেতারে বাজছিল, এবং সত্যই কি, পল্লীতে যে সব ব্যক্তিরা আগমন করিতেছিল, নানা বেশে, নানা ভঙ্গিতে, শকটে বা পদব্রজে, এবং যে সকল স্ত্রীলোকেরা নানা বেশে সজ্জিত হইয়া, জানালায় বা বাটির অঙ্গনে দাঁড়াইয়া আপনাদিগকে দর্শাইতেছিল, তাহাদের একটাই মাত্র উদ্দেশ্য? আমি বিস্মিত হইতেছিলাম, কৌতূহল বোধ করিতেছিলাম, অহহ কলিকাতা কলিকাতা তুমি আমাদিগের কলিকাতা। উহা নিষিদ্ধ পল্লী–আগমন কর, কাতারে কাতারে আইস কিন্তু জানিবে ইহা নিষিদ্ধ পল্লী, নিষেধ, নিষেধহ্যাঁ আমার ভিতরে কেমন যেন একটা নিষেধের ছায়া পড়েছিল। একটা অন্ধকার অন্ধকার ভাব মনের মধ্যে, আমার কপাল ফোলা, ঠোঁট ফোলা। কিন্তু রাগ আর ঘৃণার বদলে, আমার ভিতরে একটা অন্যরকম ভাব লাগছিল, ভোলানাথের সঙ্গে আমি একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিলাম। দোতলায় উঠে ভোলানাথ একটা ঘরের মধ্যে ঢুকেছিল, একটি মেয়ে তাকে মেয়ে বলা যায় না কি না, আমি জানি না মেয়েমানুষ এই কথা আমার মনে হয়েছিল, একটা মেয়েমানুষ, শরীরে চেহারায় পোশাকে একরকমের মেয়েমানুষ, যার সবকিছুই মেয়েদের মতোই অথচ যেন মেয়েদের মতো নয়, কিংবা আমার নিজের সেইরকম মনে হয়েছিল, কিন্তু যাহাকে, কামভাব বলিয়া থাকে, তাহার কিছুমাত্র আমার মধ্যে উদয় হয় নাই, বরং আমার মনের অন্ধকারে, একটা বিতৃষ্ণা বোধ হইতেছিল। মেয়েমানুষটি একটা মোটা গদির বিছানায় বসেছিল, ভোলানাথের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিল, এসো। ইটি আবার কে? ভোলানাথ আমাকে ডেকে গদির ওপর বসেছিল, আমি তার কাছেই বসেছিলাম, ভোলানাথ বলেছিল, আমার বন্ধু। মেয়েমানুষটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, এর কপালে মুখে কী হয়েছে, মারামারি করে এসেছে নাকি কোথাও। বলতে বলতে দরজা বন্ধ করে, ভোলানাথের কোল ঘেঁষে বসেছিল, বেশ ভাল চেনা পরিচয় নিশ্চয় ছিল নইলে আর অমন করে কথা বলবে কেন, বসবে কেন, ভোলানাথ বলেছিল, না পুলিশে মেরেছে, ও ছিল তো সেখানে। ও মা, তাই নাকি, ইস্। হ্যাঁ শুনলাম, গুলি চলেছে নাকি? আমাকেই জিজ্ঞেস করেছিল, আর আমি যেন অদ্ভুত কিছু দেখছি, সেইভাবে তাকিয়ে বলেছিলাম, না। কেন জানি না, সে সময়ে মায়ের কথা আমার মনে পড়েছিল, আমার জ্যেষ্ঠা ভগিনীটির কথাও মনে পড়েছিল, বেবির কথা মনে পড়ছিল, সেদিনের অন্য সব ঘটনার কথা একেবারে যেন ভুলেই গিয়েছিলাম, ভোলানাথ মেয়েমানুষটির কোমরের কাছে হাত দিয়ে, আমার সামনেই তাকে ওর কাছে টেনেছিল, আর আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, একে চলবে? পরিষ্কার কথা, কিন্তু তখন এমন অদ্ভুত শুনিয়েছিল কথাটা আমার কানে, প্রায় যেন বুঝতেই পারিনি, অহো, এখন নিজেকে বলতে ইচ্ছা করে, মা কী হইয়াছেন, তখন কী ছিল, এখন ভোলানাথকে আমিই শেখাতে পারি, কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, অ্যাঁ?

মেয়েমানুষটি আমার দিকে চেয়ে, কেমন চোখে ঝিলিক দিয়ে তাকাচ্ছিল হাসছিল, আর ভোলানাথ আবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, একে ইচ্ছে হয়? আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিলাম, না না ঠিক আছে। শুনে ওরা দুজনেই হেসে উঠেছিল, আর ভোলানাথ বলেছিল, বাহু, ঠিক আছে আবার কী, একজন কাউকে চাই তো, আচ্ছা ঠিক আছে, গায়ত্রী গায়ত্রী! অহো কী পবিত্র নাম, এর জন্য কাউকে দেখ তো। মেয়েমানুষটি যার নাম গায়ত্রী, সে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি ভোলানাথকে বলেছিলাম, থাক না, আর একদিন আসব, মানে–গায়ত্রী একটি মেয়েকে নিয়ে ঢুকেছিল। জি স্ল্যাক পরা, ঘাড়ের দুপাশে দুটো বিনুনি দোলানো, বয়স বোঝার মতো নজর আমার এই পাপক্ষে ছিল না। গায়ত্রীর থেকে বয়সটা কিছু কম মনে হয়েছিল, যদিচ বারাঙ্গনাটি আমাদিগের উচ্চকোটি সমাজের আলোকপ্রাপ্তা তরুণীর মতো সাজিয়াছিল এবং নিজেকে বালিকাবৎ রূপে উপস্থিত করিতে চাহিতেছিল, তত্রাচ তাহার বক্ষস্থলের বিশালত্ব, সম্মুখে তীরের মতো তীক্ষ্ণতা দেখিয়া মনে হইয়াছিল, একটি খোঁচা লাগিলেই পৈতৃক প্রাণটি গত হইয়া যাইবে। অবিশ্যি অমন বুক রাস্তাঘাটে, আমাদের। চারপাশে, কলেজে, রেস্তোরাঁয়, সব জায়গাতেই দেখতাম, সম্ভবত পোশাকের জন্যই, অমন মারাত্মক দেখেছিলাম, কিন্তু স্বীকার করতে হবে তার চোখমুখ খুব খারাপ ছিল না, সব মিলিয়ে, চেনাশোনা অনেক মেয়েদের থেকে ভাল, যদিচ, আমার মনের অন্ধকারে কীরকম একটা একটা যেন অলৌকিক ভাব জাগছিল–যেমন অনেক সময়, ভীষণ অন্ধকারের মধ্যে একলা দাঁড়িয়ে থাকলে, যেরকম হয়, সেটা যে কীরকম একটা ভাব, শুধু ভয় নয়, তার সঙ্গে আরও কিছু, যা আমি বলতে পারি না, তবু আমার শরীরের মধ্যে দপদপ করে উঠেছিল। আমার শরীরের নীচে, একটা জায়গাতে যেন একটা জ্বলন্ত কয়লার চাংড়া জ্বলছিল, আর তার উত্তাপে আমার সমস্ত শরীরের রং বদলে যাচ্ছিল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু যেন বুঝতে পারছিলাম। এবং বেবির সামনে আমার ঠিক সেইরকম হয়নি, সেখানে যেরকম হয়েছিল। ভোলানাথ আমাকে জি স্ল্যাকের সঙ্গে তার ঘরে যেতে বলেছিল, আর সেও হেসে, যেন সিনেমার নায়িকাটি, বলেছিল, আসুন। পৃথিবীতে ইহা হইতে সহজ আর কী আছে, চলিয়া আসুন, চলিয়া আসুন, পথিক কেবল তো চলিয়া যাওয়া লইয়া কথা, পথ তো পড়িয়া রহিয়াছে। এবং ব্যাপারটা যেন অনেকটা সেইরকমই, আমি ভোলানাথের দিকে একবার দেখে, তার সঙ্গে গিয়েছিলাম, সে এমনভাবে বারান্দা দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল যেন কল্যাণী ডেয়ারির সৌরাটি বকনা–মানে যাকে বলে না বিয়নো গাভীবকনা, গাই কথাটা আমাকে নীতিশ শিখিয়েছিল আর সেটা কোনও কোনও মেয়েকে দেখিয়েই ও বলত, বালিকাটি বকনা ভগবতীর মতো পাছা দুলিয়ে যাচ্ছে–ওকে আজ খাব নীতিশটা সত্যি পারভার্ট, ও শুধু খায়, খাদ্য খাদক সম্পর্ক ছাড়া কিছু মানতে চায় না, এবং খাওয়া মানে, কন্যাটিকে স্মরণ করিয়া, কামচরিতার্থ করিয়া থাকে, মেয়েদের সম্পর্কে ওর কোনও বাছাবাছির বালাই নেই, ও অনেকটা ষাঁড়ের মতোই, দ্য বিগ বুল, বকনা সম্পর্কে সেইজন্যই বোধহয় দুর্বলতা একটু বেশী এবং বকনা ঠিক বাছুর বিয়নো গাভীর মতো ধীরে চলে না একটু তাড়াতাড়ি, যে কারণে তার নিতম্বের দোল একটু বেশি অথচ বিশাল নিতম্বিনী। জি স্ন্যাক-এর চলাটা দেখে আমার সেই রকমই মনে হয়েছিল, সে তার ঘরে ঢুকে, দরজা বন্ধ করেছিল, প্রথমেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কোথায় মারামারি করেছি, এই কথা জিজ্ঞেস করেছিল, যেন মারামারি করা ছাড়া আর কিছু ওরা চিন্তা করতে পারে না, এবং আমি একই কথা বলেছিলাম, ও আমার গায়ের কাছে দাঁড়িয়ে, সামনে থেকে মুখটা দেখেছিল, দু-একটা কথা কী বলেছিল, আমি ঠিক যেন শুনতে পাচ্ছিলাম না, আমার ভিতরে অন্ধকারটা যত ভারী আর জমাট হয়ে উঠছিল, কোমরের নীচে জ্বলন্ত কয়লার চাংড়াটা যেন তত গনগনিয়ে উঠছিল, আমার মস্তিষ্কে আর কিছু ছিল বলে মনে হচ্ছিল না, জানি না, তখন আমাকে কেমন দেখাচ্ছিল, যদিও বড় আয়না ছিল সামনে, কথা বলতে পারছিলাম না, সে সময়ে ছেলেদের কী সুন্দর দেখায়, লতিকা তা-ই বলে, ছেলেরা যখন উত্তেজিত হয়ে একটা মেয়ের সামনে দাঁড়ায়, তখন তাদের শিশুদের মতো বোকা আর মিষ্টি লাগে, তখন তাকে নিয়ে মেয়েদের খেলতে ইচ্ছা করে, আদর করতে ইচ্ছা করে, এবং হয়তো ব্যাপারটা তাই, কিন্তু আমার নিজের মনে হয়, তখন সে অন্ধের মতো একটা কিছু খুঁজে বেড়ায়, সেইজন্যই বোধহয় শুক্ৰদেব-দেবতাটি–তবে কি না, লোকটি অসুরের দেবতা, হতেই হবে কারণ এক চোখ কানা, একটা চোখ দিয়ে সে একটা জিনিসই দেখতে পায় এবং এক বর্গা একদিকে হুমড়ি খেয়ে পড়তে যায়, নিজেকে আমার তেমনি মনে হয়েছিল। জি স্ল্যাক আমার কাঁধে হাত দিয়েছিল, আমার হাত ধরে, তারও গায়ত্রীর মতো গদিটার ওপর টেনে নিয়ে গিয়েছিল, আর গুনগুন করে কী একটা গান করছিল, চোখে ঝিলিক হানছিল, যেমন সিনেমা টিনেমা দেখানো হয়, বোধহয় ওরকম করতে হয়। আমার সেইরকম ধারণা হয়েছিল, যদিচ, আমার নিজের থেকে ওর গায়ে হাত দেবার তেমন ইচ্ছা হচ্ছিল না, চুমো খাবার কথা তো মনেই হয়নি। ও ওর সেই বুক, যেন বড় একটা কাঁচির মুখ ফাঁক করলে, সোজা দুটো খোঁচা দেখা যায়, সেইরকম বুক দিয়ে আমার গা ছুঁয়েছিল, অন্ধকার অন্ধকার, বেবিকে কি আমি ভালবাসি না, এ কথা একবার মনে হয়েছিল, অন্ধকার, অন্ধকার, কিন্তু একটা প্রকাণ্ড আগুনের উত্তাপে আমি যেন পুড়ে যাচ্ছিলাম, গদির ওপর দাঁড়িয়ে, ও ওর গোটা শরীরটা দিয়ে আমার শরীরে চাপ দিয়েছিল, এবং কীভাবে কোথায় হাত দিয়ে বোতাম খুলেছিল জানি না, দেখেছিলাম ওর গায়ের থেকে জিন অ্যান্ড স্ল্যাক খুলে পড়েছিল, শুধু ব্রেসিয়ার বুকে আঁটা। ঘাড়ের দুপাশে দুটো বিনুনি, বুকে ব্রেসিয়ার, একটা উলঙ্গ মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আমি দেখছিলাম, আর তখনও ও সেই গানের কলি গুনগুন করছিল, কেন, আমি তা বুঝতে পারছিলাম না, আমাকে খুশি করার জন্য, না ওর নিজের মনের খুশিতে–খুশি! খুশি কি হয় ওরা, আমি জানি না, কিংবা ওটা হয়তো ওর নার্ভাসনেস–প্রথম যখন সমাজের শুচিতা রক্ষার্থে এই ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করিয়াছিল, তখন থেকেই হয়তো এই গুনগুনানির শুরু, যেন ওর কিছুই হয়নি, কিন্তু আমার কাছে সেটা মোটেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল না যে, মন থেকে গান করছে, একটা যন্ত্রের ভিতর থেকে যেন শব্দটা অনবরত বেরিয়ে আসছিল এবং ও পিছনে হাত দিয়ে ব্রেসিয়ারটা খুলেছিল, যা দেখলেই মনে হয়, সব মেয়ে এরকমভাবেই এটা খোলে, সব মেয়েই একরকম, আর ওর বড় বড় বুক দুটোবুক আবার দুটো হয় কেমন করে, বলিতে হয় স্তনদ্বয়, চেস্ট ব্রেস্ট তো আর এক নয়, তবু আমরা বুকই বলি, রবিটা–আমাদের বন্ধু, ঢাকায় ওদের বাড়ি ছিল ও কিছুতেই এদেশের কথা বলতে পারে না, ও বলে, দুধ দুইটাঅর্থাৎ স্তন জোড়া, ব্রেসিয়ারটা খুলতেই, যেন ঠাস করে দুটো থলথলে পিণ্ড পড়ে গিয়েছিল, তবে যতটা ভাবা গিয়েছিল, ততটা নয়, বৃন্ত দুইটি আমার চুতমুকুল বলিয়া মনে হয় নাই, বরং কেমন যেন মাঝারি আকারের রুদ্রাক্ষের মতো দেখাচ্ছিল, রংও যেন সেই রকম, আমার হাত দিতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু তখন আবার বেবির কথা আমার মনে হয়েছিল, কারণ বেবি ছাড়া তখন পর্যন্ত আর। কোনও মেয়ের বুকে আমি হাত দিইনি, অন্ধকার এত ভারী আর জমাট মনে হয়েছিল, আমি আর কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম না, তখন অন্ধকারের বোধটাই হারিয়ে গিয়েছিল, আর আমি শুধুমাত্র এক চাংড়া জ্বলন্ত কয়লাতে পরিণত হয়েছিলাম আর কোনও অস্তিত্বই আমার ছিল না, এবং ও সেই জ্বলন্ত চাংড়াটাকে খুঁচিয়ে আরও যেন উসকে দিয়েছিল, বলেছিল, কী হল খোকাবাবুর, এসো বলে গদির ওপরে চিত হয়ে শুয়ে একটা হাঁটু ভেঙে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তেমনিই ঝিলিক হানছিল, গুনগুন করছিল, যেন বড় সুখে ওরকম করছিল, কিন্তু সুখ কি ওর সত্যি ছিল, তারপরে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলেছিল, কী হল, ভোলানাথের বন্ধুকে কি পাতলুনও খুলে দিতে হবে বলে সত্যি সত্যি খুলে দিয়েছিল, আর ঠিক সে সময়েই বাইরের থেকে দরজায় ঠুকঠুক শব্দ হয়েছিল, আমি তাড়াতাড়ি প্যান্টটা পরতে যাচ্ছিলাম, ও বলেছিল, থাক পরতে হবে না। দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কে? বাইরের থেকে শোনা গিয়েছিল আমি গায়ত্রী, দরজাটা একটু ফাঁক কর, একটা জিনিস দেব। ও বলেছিল দাঁড়াবাঁপাশে সুই ছিল, সেটা অফ করে দিয়ে, দরজাটা সামান্য ফাঁক করেছিল, গায়ত্রী কী একটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিল, ভোলাবাবু বন্ধুকে এটা দিয়েছে। তারপরে দরজা বন্ধ করে, ও আবার আলো জ্বেলেছিল, আমার কাছে তখন আলো অন্ধকার সমান, কিন্তু ও কেমন সহজভাবে, দুটো বিনুনি দুলিয়ে, একেবারে উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করছিল, বাতি নেভাবার কোনও দরকারই মনে করছিল না, ছোট একটা প্যাকেট খুলে, আমার দিকে নীপলেস কন্ এগিয়ে দিয়েছিল, তার আগে আমি ও জিনিস কখনও ব্যবহার করিনি, এবং আমাকে হাত ধরে টেনে ও আবার শুয়েছিল, আর বলতে গেলে, ওর দুই উরু আর জংঘার মাঝখানে, জ্বলন্ত চাংড়াটাকে গ্রাস করছিল। ইহাকে বলে রতিলীলারূপ সমর সময় উপস্থিত হইল। তখন ভূজলতাতে আবদ্ধ হইয়া, স্তনভারে নিপীড়িত নখাঘাতে ক্ষতবিক্ষত ও নিতম্বতাড়নে বিষম আহত এইরূপ এক সংগ্রামের সময়ে, আমার কপালে যেখানে পুলিশের লাঠি পড়েছিল, সেখানে ঠুকে যাওয়ায় ভীষণ ব্যথা করে উঠেছিল।…

কেমন করে যে ভুরুর এখানটা ফুলে উঠেছে, কখন কোথায় কীভাবে লাগল, কিছুই মনে করতে পারছি না। রোদটা কি সত্যি, সিংহের মতো কেশর ফুলিয়ে গরগর করছে, অথচ আমার ঘাম হচ্ছে না, যেন তেল তেলে আঠা আঠা ভাবের কিছু মুখে হাতে জমে উঠছে, আর হাতে, ডানায়, আঙুলগুলো অসম্ভব ব্যথা, তলপেটের কাছেও যেন ব্যথা করছে, কিন্তু আমি তো কোনও রকম বেগ বোধ করছি না বা কয়েকদিনের মধ্যে আমিব্যাসিসের তাড়না ভোগ করিনি, ওটাই তো আমাকে ভোগায় এবং ডাক্তার বলে দিয়েছে, এটা জীবনে কখনও সারে না, বাড়ে কমে মাত্র, অতএব, মাঝে মাঝে তাড়না করবেই, কিন্তু এখন আমার কী হয়েছে। মুখের সেই দুর্গন্ধটা যাচ্ছে না, থু থু আর নেই ফেলবার মতো, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, আর রোদ–এই রোদটা নিশ্চয় আমার দিকে বড় বড় রক্তচোখে তাকিয়ে আছে, আমাকে খেতে চায় বোধহয়, তাই এরকম গরম হাওয়া ছাড়ছে এবং আশ্চর্য, কোথা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ–জেসমিন নাকি অন্য কিছু বুঝতে পারছি না, মাঝে মাঝে আমার নাকে এসে লাগছে। এই আগুনের মধ্যে, এই ভয়ংকর দুপুরে যেখানে একটা গাছপালা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, সেখানে এই ফুল ফুল গন্ধ কোথা থেকে আসছে। আমার চারপাশে কি কোনও অলৌকিক কিছু ঘটছে, কারণ এইরকম জ্বলন্ত দুপুরে, কাছেপিঠে একটা লোক নেই, নিঝুম, দরজা জানালা বন্ধ শহরটা যেন থমথম করছে, আর ডাইনোসরের মতো অতিকায় একটা কিছু যেন নিঃশব্দে আকাশ সমান উঁচু হয়ে, চুপি চুপি আমার দিকে আসছে, বহু যুগ আগের একটা কলকাতা শহর, সূর্যের এত নিকটে চলে গিয়েছে যে, কলকাতাবাসীরা সব পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। কালোমতো কী একটা এসে আমার সামনে দাঁড়াল দাঁড়াল না, আস্তে আস্তে চলছে, আর একটা শব্দ হতেই বুঝতে পারলাম, ট্যাক্সি, আমি হাত তুলতেই, আমাকে খানিকটা ছাড়িয়ে গিয়ে গাড়িটা দাঁড়াল।

আমি যেন জীবন পেলাম, এইভাবে ছুটে গিয়ে, গাড়িটার হাতল ধরলাম, রং ওঠা, লোহা বেরিয়ে পড়া, জংধরা পুরনো ঝরঝরে গাড়িটা, তেতে আগুন হয়ে আছে। আমি হাতলটা টিপে খোলবার চেষ্টা করলাম, খুলতে পারলাম না, ভিতর থেকে লক করা রয়েছে বোধহয়, আমি ড্রাইভারের দিকে তাকালাম, আর আমার যেন মনটা কেমন চমকে উঠল, এও কি, ট্যাক্সি ড্রাইভারের ছদ্মবেশে অন্য কেউ, সেই রিকশাওয়ালাটার মতো। লোকটা মোটা, কালো কালো সানগ্লাস চোখে লাগানো, কালো রঙেরই। একটা জামা, এবং জামার বুক খোলা, সেখানে কালো কোঁকড়ানো ঘন লোম। আমি ওর চোখের দৃষ্টি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু যেন ওর দৃষ্টি আমার টেরিকটের জামা ভেদ করে গায়ে বিধছে। লোকটা আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না, ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে দরজাটা খুলে দিল, আমি ভিতরে ঢুকতে গেলাম, কিন্তু ভাঙা পুরনো গাড়িটার দরজায় একটা খোঁচামতো কী বেরিয়েছিল, তাতে আমার প্যান্টের পকেটের কাছে একটু ছিঁড়ে গেল। লোকটা মিটার ডাউন করল অথচ আমি কোনওরকম টিঙ শব্দ পেলাম না, পুরনো ঝরঝরে গদির গর্তে, আমি যেন কোনও অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে গেলাম আর চমকে উঠলাম, সাপের মতো একটা কিছু দেখে, আসলে সেটা গাড়ির ভিতরে বডির লাইনিং-এর খসে পড়া রবারটা ঝুলছে। গাড়িটা চলতে আরম্ভ করল, অথচ সে আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না, দৃষ্টি তার সামনের দিকে। যেন আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই, ওর যেখানে ইচ্ছা, আমাকে নিয়ে যাবে, কিন্তু আমি কোথায় যাব, তা কিছুই ভাবিনি। আমার এখন কোনও ঠাণ্ডা অন্ধকার ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না, কোনও এয়ারকন্ডিসনড সিনেমা বা বারে বা রেস্তোরাঁয় নয়, নিরিবিলি কোথাও, যেখানে কেবল আমি আর রিনা বা বেবি বা লতিকা এরকম কেউ থাকবে, যে-ই হোক, একজন কেউ না থাকলে, আমি একলা থাকতে পারব না, আমি কিছুতেই যেন এখন একলা থাকতে পারছি না, কাউকে, কোনও মেয়েকেই আমার কাছে পেতে ইচ্ছা করছে, দরকার হলে নর্থে যেতেও রাজি। কিন্তু ওদের কাউকে কি এখন আমি বাড়িতে পাব। লতিকার কথা আলাদা।

কোথায় যেতে হবে?

আমি এমন চমকে উঠেছিলাম, ঠিক যেন ম্যাকবেথের ভূমিকায় জনৈক পরিচিত অভিনেতার গলার মতো শুনিয়েছিল স্বরটা। রাস্তাটা সামনে বন্ধ, ডাইনে আর বাঁয়ে চলে গিয়েছে, তাই বোধহয় জিজ্ঞেস করেনি আগে। আমি বললাম ডাইনে।

কিন্তু ডাইনে গিয়েই বা আমি কোথায় যাব। ওদের কাউকে কি আমি বাড়িতে পাব এখন। অবিশ্যি বেবি বা রিনাদের সঙ্গে, ওদের বাড়িতে বসে আড্ডা দেবার বা গল্প করার কোনও প্রশ্নই নেইমানে সেভাবে নেই, যাতে নিজেদের ইচ্ছামতো সবকিছু করতে পারি। এমনি বসে কথাবার্তা বলা যেতে পারে, তা বলে, যাহাকে বলিয়া থাকে হামসানি, একটু অধরসুধা পানাপান, কামকলস স্তনযুগে ও বৃন্তে একটু নখরাঘাত, আর দেহে নিতান্ত চাঞ্চল্য বোধ হইলে, চাঞ্চল্যজনিত ক্রিয়ার দ্বারা অচঞ্চল হওয়া, সে সব বাড়িতে বসে হয় না, যে কারণে হোটেলের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। টী অ্যান্ড বাথ হচ্ছে, হোটেলে কাটানোর পক্ষে সবথেকে ভাল উপায়। যা হোক, ঠাণ্ডা ঘর পাওয়া যায় কয়েক ঘণ্টার জন্য। টাকাটা বেশি লাগে, তার জন্য আর কী করা যাবে। তবে চৌরঙ্গি পাড়ায় তো বাড়ির অভাব নেই, যেখানে হোটেলের নামে আসলে অন্য ব্যাপারটাই বেশি চলে, বান্ধবীদের লইয়া সেখানে যাইলেই, ঘর পাওয়া যাইবে। বান্ধবী না থাকিলে, বান্ধবী পাওয়া যাইবে, সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক যাহা কিছু প্রয়োজন, আটপৌরে ভাষায় বলিতে গেলে, মাল এবং চাট, তাহাও মিলিবে, কলিকাতার ন্যায় বন্দর আর ভারতবর্ষে কোথায় পাইবে, এইখানে সব মিলিবে। মহামানবের সাগরতীরে, এমন দেশটি কোথাও তুমি পাবে নাকো খুঁজে। এও সেই কথার মতো, আসুন চলিয়া আসুন, পথিক পথ পড়িয়া রহিয়াছে, চলিয়া যাওয়া লইয়া কথা, কলিকাতা ছাড়া এমন আমন্ত্রণ আর কোথাও পাইবেন না। হ্যাভ উ সিন্ দ্য পোর্ট? মাগিটার গতরে পোকা ধরে গেল, তবু যৌবন মরে না, কলিকাতা ইহার নাম। আমরা ভারতবাসীরা হইতে পারি বয়স্ক, কিন্তু শিষ্ট। পোকা পড়িলেও জানিবে, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি লইয়া আমরা বিশেষভাবে গর্বিত। দেখ, হাজার বছর হইয়া গেল, আমরা কোনও যুদ্ধ করি নাই, মুঘল, পাঠান, হুন, উহারা যুদ্ধ করিয়া মরিয়াছে, রাজত্ব করিয়াছে, তাদের সঙ্গে আরও অন্য বিদেশিরা লড়িয়াছে, রাজত্ব করিয়াছে, আমরা বয়স্ক দার্শনিকের দৃষ্টি লইয়া তাহা দেখিয়াছি, কিন্তু সেই যে বহুকাল পূর্বে বিদেশিরা আসিয়া আমাদের অস্ত্রাদি কাড়িয়া লইয়াছে, আমরা আর কোনও দিন উহা হাতে করি নাই, কিন্তু সিংহ পদবি যদি কোথাও পাইতে হয়, এদেশেই পাইবে, মি. অমুক লায়ন লায়নোভস্কি কোথাও পাইবে না। দু-একটা বিদ্রোহ হয়তো করিয়াছি, তাহা ঠাণ্ডা হইতে বেশি সময় লাগে নাই এবং ফল যা হইয়াছে, তাহাই বর্তমান ভারতবর্ষের রূপ বলিয়া দিতেছে, আর বিপ্লব? বিপ্লব আমরা কোনওদিনই করি নাই, ইচ্ছা আছে করিব, তবে সন্তানগণের নাম তো রাখিতেছি। আমরা মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেরা, যাহারা ভারতবর্ষের সকল গৌরব মাথায় করিয়া রাখিয়াছি, তাহারা থাকিতে বিপ্লব না হইয়া পারে না, আমরাই তো সব, অতএব এই মধ্যবিত্তের স্বর্গ ভারতবর্ষ, তাহার শ্রেষ্ঠ নগরী কলিকাতা, অ্যান আনড্যামেজড পোর্ট–আনড্যামেজড! অক্ষত যোনির মতো বুঝি। সেই জন্যই যত অক্ষত যোনিদের সঙ্গে লইয়া, টি অ্যান্ড বাথ সারা যায়, অন্য পেরকারের ব্যবস্থাও আছে, চলিয়া আসুন, সব পাইবেন।

কিন্তু রিনা বেবিকে কোথায় পাব এখন, বাড়িতে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, কারণ, আমার সঙ্গে আবার সত্যিকারের প্রেম করে তো, তাই আগে থেকে জানানো না থাকলে, হঠাৎ দেখা পাওয়া মুশকিল, কেননা, মিথ্যে প্রেমগুলো তা হলে করবে কবে বা কখন। এখন একমাত্র লতিকাকেই বাড়িতে পাওয়া সম্ভব–ওদের অনেকটা হাফ গেরস্থ বলা যায়। লতিকার সঙ্গে লতিকার ঘরে, দরজা বন্ধ করে থাকলেও, ওদের বাড়িতে কেউ কিছু মনে করে না, এবং এই লতিকাও এক বছরের জন্য কলেজে পড়তে গিয়েছিল একদা। এখন লতিকার অনেক খদ্দের, এদিকে ওদিকে একটু নাটক-টাটক করে বেড়ায়, অ্যামবিশন আছে অনেক, আর যাহা না করিলে নহে, তাহাই করে, পুরুষবন্ধুদের সঙ্গে একটু আদানপ্রদান করিয়া থাকে, না করিলে চলিবেই বা কেন। ব্যাপারটা এমন সহজ করে নিয়েছে লতিকা, যেন এমন কিছু নয়। ওর কাছে, প্রায়ই খুব মজার মজার গল্প শোনা যায়। ভাল ভাল মানুষদের গল্প, সজ্জন ভদ্রলোক, কেলাবে আপিসে যারা নাটক করে, এবং যাদের সঙ্গে লতিকাও নাটক করে, তাদের প্রেম নিবেদনের মজার মজার কাহিনী, রিয়্যাল স্টোরি। অবিশ্যি জানি, লতিকা আবার যেমন বলে, ঘটনাগুলো হয়তো তেমনই নয়, ও নিজেকে একটু বেশি বাঁচিয়ে বলে বাঁচিয়ে নয় ওটাকে ঝাঁজিয়ে বলা চলে, কারণ লোকগুলো বোকার মতো ওর রূপে মজে, এবং ও তাদের কিছুই দেয় না, এটা বোধহয় সত্যি নয়। এটাও ওর হাফ গেরস্থ চরিত্রের মধ্যে পড়ে। তবে এটা ঠিক, লতিকা যেভাবে দৈহিক সুখ দান করিয়া থাকে তাহা কোনও বান্ধবীর নিকটে প্রাপ্ত হওয়া যায় না, কারণ তাহার আচরণের মধ্যে একটি যত্নসহকারে সমর্পণের ভাব ফুটিয়া উঠে। কিন্তু, না, লতিকা বা রিনা বা অন্য কেউ নয়, বেবিবেবিকে পেতে ইচ্ছা করছে, বেবি, কেন জানি না, কোনও মেয়ের কথা মনে হলেইমানে, সঙ্গ পেতে ইচ্ছা করলেই, বেবির কথাই মনে হয়, বেবি আগে, সকলের আগে বলে নয়, আমার জীবনে, মেয়ে বলতে বেবি প্রথম। সেইজন্যই কি, যে কোনও অবস্থাতেই আগে বেবির কথা মনে হয়…।

এবার কোন দিকে?

আবার সেই গলা, কিন্তু লোকটার মুখ আমার দিকে ফেরানো নয়। লোকটার জিজ্ঞেস করার সুরের মধ্যে, যেন একটা অনুন্ধানের ভাব, কোথায় তুমি যেতে চাও, সেটাই আমি দেখছি, তারপরে তোমাকে আমি দেখব এরকম একটা চাপা শাসানোর ভাব আছে যেন, এবং বাইরে রোদটা সেরকম থাকলেও সবুজ মাঠ আর গাছপালার সীমানার মধ্যে এসে পড়ায় মনে হচ্ছে, সেই গরগরানে সিংহটা কোথাও সরে গিয়ে গাঢাকা দিয়েছে। বাঁদিকে রেসকোর্স-এর মাঠ, ডানদিকে হাসপাতাল। যদি বেবির কাছে যেতে হয়, তবে আর সোজা যাওয়া চলে না। আমি বললাম, ডানদিকে।

গাড়িটা ঝকরঝকর করে ডানদিকে বেঁকে চলতে আরম্ভ করল এবং এই প্রথম আমার নজরে পড়ল, লোকটার গায়ের জামাটা ঠিক কালো নয়, ময়লা, এত ময়লা যে, তাতেই কালো দেখাচ্ছে বা, এত রোদে ছিলাম তখন, আমি ঠিক রং চিনতে পারছিলাম না, এবং রং, জনৈক পণ্ডিত ব্যক্তির মতে, বৌদ্ধ ইকনোগ্রাফি সম্পর্কে যিনি পণ্ডিত, সম্প্রতি তাঁর সম্পর্কে একটা কথা আমি শুনেছিলাম, তিনি নাকি লোকের ফটো দেখে, ডায়গোনসিস করেন। রং-ই হচ্ছে প্রধান, ফটোটার মধ্যে সাতটা রং নাকি, ফুটে ওঠার কথা, যার সব ডিটেল আমি জানি না। মোটের ওপর তাঁর পেশেন্টের ফটোটা এমনভাবে কোথাও রাখেন, যাতে তার ভিতরে সাতটা রংফুটে উঠতে পারে, যার থেকে বলা যায়, মানুষের শরীরে মূল সাতটা রং-ই আসলে আছে এবং ফটোর মধ্যে যদি কোনও একটা বা একটার বেশি রং না ফুটে ওঠে তা হলে সেই রঙের ডিফিসিয়েন্সিটাই ওষুধ দিয়ে সারান, আর যদি ফটোটায় একটা রংও না ফুটে ওঠে, তা হলে সেটা একজন মৃতের ফটো বলে মনে করা হবে। আশ্চর্য, আমি জানি না এরকম কোনও চিকিৎসা পদ্ধতি হতে পারে কিনা, কিন্তু আমার খুব ভাল লেগেছিল শুনে, এবং আমি এমন কল্পনা করেছিলাম, আমার ফটোটা পাঠিয়ে দেখা গেল, কোনও রং নেই, তার মানে আমি মৃত, আর সেটা হয়তো আমি নিজের চোখেই দেখলাম। অবিশ্যি, এখন কথাটা ভাবতে আমার সেরকম কিছু একটা গা শিউরনো ভাব লাগছে না, কেন না এখন আমি অতীত বা ভবিষ্যৎ, এগুলোর বাইরে, কেবল বর্তমানে এই মূহুর্তেই আছি, এই মুহূর্তে, যখন জীবন মরণ বোধের ভয় বা দুঃখ, আমার মনে কোনও কী বলব, কোনও তরঙ্গ তুলছে না। আর এই কারণেই বোধহয় আমি এখন রংকানা হয়ে গিয়েছি। লোকটার জামাটা দেখছি, কালোনয়, বা তার গায়ের রংটাও সেরকম কালো নয়, তখন যেরকম দেখেছিলাম এবং এখন তার চোখে আর সানগ্লাসটা নেই। যদিচ তার গলার স্বরের কোনও পরিবর্তন হয়নি…।

কিন্তু বেবিকে এখন পাব কি না, জানি না, অথচ এখন–এখন বলে নয়, যে কোনও মুহূর্তেই, এবং এখন বিশেষ করে, বেবিকেই আমার পেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু পাই না। বেবিকে পাই না। বেবিকে ভুলিতেও পারি না। ভুলিব মনে করি, ভুলিতে পারি না। ভাবিলে নিজেকে কেমন অভিশপ্ত বলিয়া মনে হয়, কে অভিশাপ দিল, কেন দিল, তাহা বুঝিতে পারি না, বেবিকে পাই না। এখন আর বুক টনটন করে না, করিলেও সে-অনুভূতি নাই, তাহা আমার মস্তিষ্কে যাইয়া যেন আঘাত করে না, একদা দুঃসহ বোধ হইত, দেখিতে ইচ্ছা করিলে, না দেখিতে পাইলে, বুকের মধ্যে ব্যথা করিয়া উঠিত, মনে হইত, কোথাও পলাইয়া গিয়া, একলা একলা, দুই দণ্ড কাঁদিয়া আসি। রবীন্দ্রনাথের যাহা ঈশ্বরে অর্পিত আমি তাহা বেবিকে অর্পণ করিতাম, তাহার উদ্দেশে, আমার মনের মধ্যে নিঃশব্দে গুনগুন করিত, মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না। গানের এই কলি মনে হইলে, উনিশ কুড়ি বৎসর বয়সে, আমার চোখ ঝাপসা হইয়া উঠিত, কেন মেঘ আসে, হৃদয় আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না। গান গাহিতে পারি না, কিন্তু আমি যেন আমার ভিতরে, আশ্চর্য সুন্দর একটি কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইতাম, করুণ সুর, গভীর। স্নিগ্ধ সেই স্বর, চোখের জল দিয়া ভিজানো। শুনিতাম, ক্ষণিক আলোকে, আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে, হারাই হারাই সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফিরি চকিতে।.. ঈশ্বর কী তাহা কোনওদিন জানি নাই, বেবিকে অতএব ঈশ্বরের আসনে বসাইয়াছিলাম, তাহাও বলিতে পারি না, বেবি শুধু বেবি।

কেন, বেবি আমার জীবনে প্রথম এসেছিল বলে কি, এইরকম মনে হত প্রথম আসা মানে, ছেলেরা মেয়ে বলতে যা বোঝে, প্রেম প্রেম, ওহ প্রেম, বলছি তোতা ওর সঙ্গে আমার প্রথম হয়েছিল বলে কি এমন হত। কে জানে। যদি তা-ই হয়, তবে প্রথম দেখা অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে হলেই হত। এই দেখাদেখির কারবারি দেবতাটি কে আমি জানি না, যদি কেউ থেকে থাকে, তবে তাকেই বলি, তুমি তো বাবা পার্ক স্ট্রিটের শুড়িখানার সেই বুড়ো মাতালটি নও, এমন একটি কারবার তুমি কেন করলে তুমি তো জানতে, মানে এটাই যখন তোমার কারবার, তুমি তো জানতে বেবির হৃদয় এবং অঙ্গসমূহ, বহু না হইলে ভরে না, সে হইল সর্বজনীন পূজার দেবী, অথচ বেশ্যা নহে, মনে রাখিতে হইবে, সে ভুজঙ্গভূষণের কন্যা, বাৎসরিক আশি হাজার টাকার কন্ট্রাক্টের চাকরি, নিজেদের চারিতল অট্টালিকা, মোটরযান এবং পিতার বন্ধুদেরও বেবি গৃহে অভ্যর্থনা করিয়া থাকে, হেলো আঙ্কল, হোয়াট ডু ইউ ফেবার, হুইস্কি, জিন অর বিয়র।.. ও লতিকা নয়, রিনাও নয়। রিনাও নিতান্ত মধ্যবিত্ত, কিন্তু নিজের পরিবেশটাকে ওর পছন্দ নয়। ওর বাবার পাঁচশো টাকা মাসিক আয়ের মধ্যে ও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। ও বেবি হতে চায়, অথচ বেবির বাবা ওকে জন্ম দেয়নি, ওকে চেনা যায়, বেবিকে আমি চিনি না। চিনি না! সত্যি? বেবির হৃদয় আর অঙ্গসমূহ যদি বহুতে ভরে, আমারটা কী? আমি যখন অন্য মেয়ের কাছে যাই, আমি যখন একটি রবারের আবরণী নিয়ে নর্থে যাই, সেটা কি, একটি একনিষ্ঠ হৃদয় আর একজনের জন্য একটি অঙ্গ। আমি একটি ধোয়া তুলসী পাতা। কেবল কুকুরের মূত্রের কিছু গন্ধ আছে, পদাঘাত, পদাঘাত তোর পশ্চাদ্দেশে।

কিন্তু বেবির সঙ্গে তবু আমি নিজেকে মেলাতে পারি না। এই সমাজের সঙ্গে যেমন পারি না, রাষ্ট্ররীতিনীতি, কোনও কিছুর সঙ্গেই যেমন পারি না, তেমনি পারি না। কারণ, আমি জানি, আমি একটা তুচ্ছ ছেলে, আমার তুচ্ছতাকে ওরা সবাই পায়ে মাড়িয়ে চলেছে। অনেক ভেবে দেখেছি, এটা আমার কোনও কমপ্লেক্স কি না, কিন্তু কলকাতার চেহারাটা কি শুধু কমপ্লেক্স-এর আয়না! তবু, আমি বেবির সঙ্গে লড়তে পারি না, রাগে আর ঘৃণায় যখন আর সবখানে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভেঙে তছনছ করে দিতে ইচ্ছা করে, সেরকম পারি না। বরং লতিকার কাছে ছুটে গিয়ে, ওকে ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে হেসে, অপমানকর কথা বলি, তুমি সোনাগাছিতে গিয়ে বসলেই তো পার, বা লতিকা, আমার ইচ্ছা করে, তুমি নেকেড হয়ে শুয়ে আছ, তোমাকে একটা আলসেসিয়ান, বিচকে যেরকম করে সেই রকম করছে। কিংবা, এমন সব ব্যবহার করি, যাদে কোনও কোনও সময় ওর চোখে জল এসে পড়ে। অস্বাভাবিকভাবে হয়তো একটা কিছু করতে বলি, কিংবা ওর শরীরের ওপর পীড়ন করি। রিনাকেও অনেক সময় ওরকম করি, আর তখন আমার ভিতরে সেই একটা রাগ আর ঘৃণা পাক খেতে থাকে, অথচ আমি মিটিমিটি হাসি আর বিচ শুয়োরি হোর মনে মনে এই সব বলি। এবং বুঝতে পারি না লতিকা রিনাকেই গালাগালগুলো দিই কি না বা পীড়নগুলো সত্যি সত্যি ওদেরই করি কি না, কারণ মেয়ে মানে তো বেবি। যার সঙ্গেই শুই, চোখের সামনে, তার মুখ দেখলেও, মুখটা যেন বেবির মতো হয়ে ওঠে, শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ আর প্রত্যঙ্গ, ভিতরে আর বাইরে, বুকে ঠোঁটে যোনিদেশে সমস্ত অনুভূতির মধ্যে যেন বেবিই জেগে থাকে, অথচ সত্যি সত্যি যখন বেবির কাছে যেতে পাই, বেবিকে পাই, তখন আমি ওরকম করি না। ঠিক যেমন করে প্রথম দিন পুলিশের হাতে ভীষণ মার খেয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল–সেটা একরকমের তাড়িয়ে দেওয়া বলেই আমি মনে করি, সেই সন্ধ্যায় একলা ঘরে, যেভাবে ভীষণ রাগে আর ঘৃণায় বিছানায় মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম, ঠিক সেইরকম একটা কান্নার ভাব আমার ভিতরে জাগে যদি সত্যি কাঁদি না।

বেবি-বেব–ওকে কি এখন বাড়িতে পাওয়া যাবে। এখন আমার আর কারুর কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না। বেবি–বেবির কাছে যেতে ইচ্ছা করছে। এবার আমাকেই আগে বলতে হল। বাঁয়ে যাব। সামনে গিয়ে, বাঁয়ে।

লোকটা কোনও কথা বলল না। যেন শুনতেই পায়নি, এবং এখন আমি দেখছি লোকটাকে যতটা মোটা ভেবেছিলাম তা নয়। সে বাঁয়ে বেঁকিয়ে নিল গাড়িটাকে। আর আমি বেবিদের বাড়িটা দেখতে পেলাম। বেবিদের বাড়ির সামনে গাড়িটাকে দাঁড়াতে বললাম, নোকটা না তাকিয়েই গাড়িটাকে দাঁড় করাল, আর কুকুর চাপা পড়ার সময় যেরকম ডেকে ওঠে, সেরকম একটা শব্দ করল, আমি বললাম, এক মিনিট দাঁড়াতে হবে।

কোনও জবাব না দিয়ে লোকটা একটা ময়লা ঝাড়ন তুলে, তার মুখটা মুছতে লাগল। আমি নেমে গিয়ে, কলিং বেল-এর বোতামে আঙুল টিপতে গিয়েও একবার থমকালাম। কেমন যেন একটু লজ্জা করল, এমন ঘোর দুপুরে কারুর বাড়িতে কলিং বেল বাজাতে খারাপ লাগে কিন্তু আমি একবার না দেখে পারব না, যদি–যদি বেবি থাকে, একবার তবু সঙ্গে যেতে বলতে পারব। বেল টিপলাম, আমার গায়ে রোদ লাগছে মাথার ওপরে কোনও কভার নেই গোটা রাস্তাটা রোদে পুড়ছে। প্রায় এক মিনিট উহ্ একটা মিনিট যে কী জঘন্য লাগতে পারে, এই দারুণ রোদে, মুখটা বাঁ দিকে ফিরিয়ে নীচের দিকে তাকালাম, যাতে রোদ না লাগে। দরজাটা খুলল, সুখন যার নাম সে-ই খুলল। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম, কারণ বেবি না থাকলে সে বলে দেবে, অথবা দরজাটা খুলে সরে দাঁড়াবে। একটা মুহূর্ত যেন থাকে যেন থাকে, ঘড়ির টিকটিক শব্দের মতো অথবা বলা যায়, টাইম বমের শব্দহীন টিকটিক করার মতোই বাজতে লাগল আর সুখন দরজাটা খুলে, সরে দাঁড়াল, বলল, দেখে আসছি, বেবি জি আছে কি না আপনি বসুন।

সুখন বাংলা ভালই বলতে পারে, এবং ওর কথা শুনে মনে হল, ও জানে বেবি জি আছে ঠিকই, তা নইলে প্রথমেই বলত, বেবি জি তো ঘরে নাই, অতএব বেবির মা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করা না করা বা কথা বলার কিছু থাকে না। বিশেষ অকেশন ছাড়া, ওর বাবাকে তো বলতে গেলে বাড়িতে কোনওদিন দেখিইনি। আসলে সুখন গিয়ে বেবিকে আমার নাম করে জিজ্ঞেস করবে, ও আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় কি না, এবং সম্মতি পেলে, বসতে বলবে, বা ঘরে যেতে বলবে। ট্যাক্সিটা বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। তখনও। আমার বসতে ইচ্ছা করল না, ফ্যানের সুইচটা অন করে, একটা প্রকাণ্ড জাপানি এমব্রয়ডারিরর ছবির সামনে দাঁড়ালামলীল আর সবুজ আমার রোদে জ্বলে যাওয়া চোখদুটোকে যেন জুড়িয়ে দিল। নিবিড় বন, সবুজ গাছপালা, নীল হ্রদ আর মাথার ওপরে নীল আকাশ ইচ্ছা করল, যেন ছবিটার মধ্যে ঢুকে পড়ি, ওই যে কী বলে জলাশয়ে গিয়ে ডুব দিই গাছের ছায়ায় গিয়ে বসে পড়ি। ওখানে যাই ওই নীলে আর সবুজে কিন্তু আমার সঙ্গে যেন বেবি থাকে, তপোবন নহে, তপোবন চাহি না, বন চাহি, কোনও পুণ্য সলিল চাহি না, টলটল মিষ্টি জল চাহি, সেখানে আমি আর বেবি…

কী ব্যাপার।

মুখ ফিরিয়ে দেখি পরদাটা গায়ের কাছে সরিয়ে বেবি এসে দাঁড়িয়েছে। যেন অন্য এক বেবি। সাজগোজ নেই, চোখ দেখে মনে হল, ঘুমোচ্ছিল বা শুয়েছিল কিংবা জানি না, ঘরে কেউ নেই-তো ওর সঙ্গে, মানে কারুর সঙ্গে শুয়েছিল না তো। কিন্তু বাড়িতে কি তা সম্ভব। আমি ফিরে দাঁড়াতে, পরদাটা ছাড়িয়ে ও এক পা এগিয়ে এল। ঘাড় থেকে ইঞ্চি দুয়েক নামানো চুল খোলা, খোলাই তো থাকে, বাঁধাবাঁধিতেই যত, নিজেকে অগোছালো করলে, অগোছালো দেখাবার সম্ভাবনা, এক ইঞ্চি পরিমাণ হাতার জামা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে জামার ভিতরে কিছু নেই। যাহাকে অন্তর্বাস বলিয়া থাকে, শাদা পাতলা একটা কাপড়, আঁচলটা হাতেই ধরা, পাট খোলা–এখন তো শুধু পেট খোলা, বাইরে বেরোবার সময়ে নাভির নীচে নেমে যায় শাড়ির বাঁধন, আর একটু যদি নামায়, তা হলে ক্যাবারের নাচুনির মতো দেখাতে পারে, তার পরেও যদি নামায়, ওহ, থাক, বড় উন্মাদনা বোধ করিতেছি, বেবির সেই অপরূপ সুন্দর বস্তিদেশ আমার চোখের সামনে ভাসিতেছে, বস্তিদেশের নিম্নে, তাহার সেই বিরল-কেশ যৌন-অঙ্গ, লতিকা আমাকে শিখিয়েছে, গ্রামীণ মেয়েদের একটা কোড নিজেদের মধ্যে চালু আছে, তাকে বলে আসকেঅর্থাৎ আসকে পিঠের বিপরীত দিকের অংশের মতো সুডৌল, আরও হয়তো কিছু। কিন্তু আমি কোনওদিন সে পিঠে খেয়েছি বলে মনে পড়ে না, কেবল রবি বলে, হহ জানি, চিতই পিঠা।..বেবির কাপড়চোপড় প্রায় অগোছাল, কোঁচকানো, নরম রেশমি চুলগুলো মুখের আশেপাশে ছড়ানো, আর নীচে ওর সায়ার ফ্রিল দেখা যাচ্ছে, আমি বললাম, ঘুমোচ্ছিলে নাকি।

ঘুমোচ্ছিলাম, একটু আগেই জেগেছি, তুমি—

 তোমার কোনও এনগেজমেন্ট আছে এ-বেলা, মানে বিকেলের দিকে।

 কেন?

ওর ভুরু একটু কোঁচকাল, ঠোঁটের কোণ টিপল। ওর মুখটা কেমন, ঠিক কী বলে বোঝানো যায়, জানি না। চোখ দুটো বড়ই, কিন্তু লতিকার মতো নয়, লতিকার চোখ বড় বড়, অত বড় ভাল লাগে না, বেবির চোখদুটো আসলে টানা, নাকটা খুব চোখা বোঁচা কিছু না, অথচ কী বলব, যেন একটা টিকোলো ভাব সব মিলিয়ে, বলিতে দ্বিধা নাই, একটি পবিত্রতার ছাপ রহিয়াছে, ইহাতে পবিত্রতাকে নিরুপায় বলিব কি না জানি না, কিংবা আমি হয়তো বেবিকে পবিত্র দেখিয়া থাকি যদিচ বন্ধুরা সবাই বলে, বেবি নিমফোম্যানিয়াক, তবু এ কথা মানতেই হবে যে সব মুখ দেখলে, কন্যাটিকে সুশ্রী সুন্দরী এবং মিথ্যা বলিয়া সকলে বিবেচনা করে, বেবিকে দেখিতে সেইরূপ। এখন ওর চোখে কাজল নেই, ঠোঁটে রং নেই, অলঙ্কারের কোনও চিহ্ন নেই এমনকী ওর কাপড়ের পাড় পর্যন্ত কালো যেন সেবিকার মতো। ওর কেন জিজ্ঞাসার সঙ্গে সঙ্গেই, ঠোঁটের কোণ টিপে একটু হাসি, অথচ ভুরুর কোঁচকানিতে, একটা –একটা অনুসন্ধিৎসা, আমাকে যেন এখনও কোনও ভরসা দিচ্ছে না। আমি বললাম, তা হলে চলো না, কোথাও একটু যাই। বলতে বলতে আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম, ওর হাতটা ধরতে গেলাম, ও চোখের ইশারা করে পিছনে দেখাল, তাতে কার অস্তিত্ব প্রমাণ করল, আমি বুঝতে পারলাম না। হাতটা সরিয়ে নিয়ে এলাম। ও জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

যেখানেই হোক, কোথাও, আমার কিছুই ভাল লাগছে না।

বেবি আমার মুখের দিকে তাকাল, বলল, তোমাকে যেন কেমন লাগছে।

 আমি বললাম, চলো না, চান করতে আর চা খেতে যাই।

ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, চোখের পাতা একটু কোঁচকাল, বা একেই হয়তো চোখের পাতার নিবিড়তা বলে। আবার বললাম, ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে রেখেছি।

ও অবাক হয়ে বলল, কেন ওটাকে ছেড়ে দাও।

 যাবে না?

না, তুমি এসো।

কোথায়, বাড়িতে? বাড়িতে ভাল লাগে না, মানে, বেব

তুমি ট্যাক্সিটা বিদায় করে এসো না আগে, আমি বেরুলেও তো তৈরি হতে হবে। চান করতে যেতে হবে বলে, এ-বেশে তো আর যেতে পারি না।

আমি বাইরের দরজার মোটা পরদাটা সরিয়ে, ব্যাক পকেটে থেকে টাকা বের করে দিলাম। লোকটা আমার দিকে একবারও তাকাল না, যেন আমি ওর কাছে, একটা কিছুই নই, মিটারটা দেখে, ভাড়া কেটে বাঁ হাতে পয়সাটা দিয়ে, একটা বিশ্রী শব্দ করে চলে গেল। শেষ পর্যন্ত সেই ছদ্মবেশী ভাবটাই ও আমার মনে রেখে গেল। কে লোকটা, যেন আমার ওপর ওর একটা নির্বিকার ভাব, অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিল, না তাকিয়েও। আমি ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম, বেবি তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটা ছায়া-ছায়া অন্ধকার মতো, তার মধ্যে বেবিকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ও আমাকে আবার বলল, তোমাকে কেমন যেন লাগছে, তোমার কী হয়েছে।

বললাম, জানি না, আমার গায়ে হাতে কেমন ব্যথা করছে, দাঁতের গোড়ায় ব্যথা করছে, আর একটা কেমন বিচ্ছিরি ভাব লাগছে, ঠিক বোঝাতে পারি না, বেব, তুমি আমার সঙ্গে কোথাও চলো।

ও অন্য কথা জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথা থেকে এলে?

আমি–আমি আলিপুর থেকে এলাম।

বাড়ি থেকে বলো।

অ্যাঁ? হ্যাঁ, তা-ই।

ও আমার গলার কাছে হাত দিল, ফ্লু নাকি? খুব খারাপ বাপু, বড্ড ছোঁয়াচে। যদি বেবির হয়, তা-ই, লোকে তো কথায়ই বলে, রোগের সঙ্গে পিরিত করা চলে না, এটা তো একটা সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক মনের কথা। তারপরে আবার নিজেই বলল, না জ্বর আছে বলে মনে হচ্ছে না, তবে একটু গরম আছে। এসো, ভেতরে এসো।

ভেতরে? ভেতরে না, বেব। চলো আমরা অন্য কোথাও যাই। তোমাকে, তোমাকে।

আমি ওর বগলের নীচে, জামার অনেকখানি কাটা জায়গায় হাত দিয়ে টান দিলাম, ও ঘাড় ফিরিয়ে, ভুরু কুঁচকে আমাকে একটু শাসনের ভঙ্গি করল, তারপরে যেন এমন কিছু কথা নয়, এমনি একটা সুরে বলল, বাড়িতে কেউ নেই।

শুনে আমার বুকের কাছটা এমন চলকে উঠল, কী যে চলকে ওঠে, তা জানি না, রক্তই হবে বোধহয়, বুকটা ধকধক করতে লাগল। বললাম, কেউ নেই মানে?

মা নেই, ভাই নেই।

ওর দিদির তো বিয়েই হয়ে গিয়েছে, বাবার তো কোনও প্রশ্নই নেই। আমি আর কথা বলতে পারলাম না, ওর মুখের দিকেই চেয়ে রইলাম, ও আবার বলল, মার ফিরতে রাত হবে।

হউক হউক, ফিরিবারই বা প্রয়োজন কী। কোথায় গিয়েছে, সে কথা আমি আর জিজ্ঞেস করলাম না, বেবি ডাকল, এসো।

ঘরটার ভিতরের দরজা গিয়ে ঢুকলেই, ওপরে ওঠার সিঁড়ি। রবার স্লিপার পায়ে দিয়ে মোজাইকের সিঁড়ি দিয়ে বেবি উঠতে লাগল, বেবির কোমরের দিকে আমার দৃষ্টি পড়ল, আমি ওর একটা স্টেপ নীচে। ওর কোমরে হাত দিলাম ও পিছন ফিরে ভুরু কোঁচকাল, তার মানে, সুখন বা আর কেউ দোতলায় আছে। আমি হাতটা সরিয়ে নিয়ে এলাম, আর শাড়িতে সায়াতে যেন ফিসফিস আয় আয় শব্দের মতো শব্দ হতে লাগল, আমি–হ্যাঁ একটা পোষা কুকুরের মতোই ওর পিছু পিছু উঠতে লাগলাম, এখন খাবার সময় হয়েছে। কুকুরের খাবার সময় হলে যেমন ছোটে, তেমনি। দোতলায় সুখন দাঁড়িয়েছিল, আমরা তেতলায় উঠলাম। নিঝুম বাড়ি, দরজা জানলাগুলো সব বন্ধ, বাড়িটা যেন একটা উঁচু সমাধি মন্দিরের মতো উঠেছে। চারতলাতে বেবি থাকে। তিনতলাতেই, বেবি আমাকে জিজ্ঞেস করল, কিছু চাই নাকি?

জিজ্ঞাসার ইঙ্গিতটা জানা, তাই বললাম, ঠাণ্ডা বিয়র খেতে ইচ্ছে করছে।

বেবি বলল, তা হলে তুমি ওপরে যাও, আমি যাচ্ছি।

বেবিকে যেন আজ, এখন অন্যরকম লাগছে। সাজের ঘটা নেই, অলস অলস ভাব, কেমন যেন ঘরোয়া–আহ, হঠাৎ কেমন করে উঠছে মনটা, বাইরে নয়, বাড়িতে, বেবির নিজের ঘরে, আর বেবি কেমন আলগা আলগা ঘরোয়া পোশাকে রয়েছে। এ যেন চক্ষের সম্মুখে কোনও এক অপরিচিত কালের ছবি ভাসিয়া উঠিতেছে, এক দূর কালের, যাহা পশ্চাতে ফেলিয়া আসি নাই, সম্মুখে যাইতেও পারিব না, কেবল দূর হইতে দেখিব। অস্পষ্ট, ঝাপসা একটি ছবি, তাহার বুকে, গাছের নিবিড় ছায়ায় কাহারা ঘুরিয়া ফিরিতেছে, পুকুরের জল টলমল করিতেছে, জলে আকাশ গাছপালার প্রতিবিম্ব, অথচ কিছুই স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পারিতেছি না।

আমি বেবির ঘর চিনি। দরজাটা খোলা, পরদাটা ফেলা। পরদা সরিয়ে ভিতরে ঢুকলাম, আর প্রায় আমার পিছনে পিছনেই বেবি এল। ওর হাতে ফ্রিজের ঠাণ্ডায় ঝাপসা একটা বিয়রের বোতল, আর দুটো কাচের গেলাস। ঘরে আসবাবপত্র সেরকম নেই। একটা আয়না লাগানো বড় লোহার আলমারি, একটা সিঙ্গল খাট, এমব্রয়ডারির ফুল তোলা বেড কভার ডানলোপিলোর গদির ওপর। গোল একটা টেবিল, এক কোণে, ঢাকার কাপড়টা ডোরাকাটা। পিতলের ফুলদানি, গন্ধহীন, রংবেরঙের কিছু ফুল। আর এক পাশে, বেঁটে কাচ লাগানো ছোট একটা বইয়ের র‍্যাক, তাতে কিছু বই। বেবি এখনও শিক্ষায়তনের ছাত্রী। সেই জন্যে পড়াশোনাটা একেবারে একতলায়, এখানে কেবল শয়ন। মোজাইক মেঝের ওপরে কটন গালিচা।

গোল টেবিলের ওপর বিয়রের বোতল গেলাস রেখে, বেবি ওর খাটের মাথার কাছ থেকে, ছোট ড্রয়ার টেনে, একটা স্টেইনলেস স্টিলের ওপনার বের করল, যে ওনারটার অবয়ব হল একটি নুড-এর, বুক আর গলার ফাঁকে আটকে বোতলের মুখ খোলা যায়। ও যখন বিয়রের বোতল খুলছে, আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর কোমরের ওপরে খোলা জায়গায় হাত দিলাম। ও কিছু বলল না, কিন্তু একটু ফেনা গড়িয়ে পড়ল, আর পটু হাতে একটা গেলাস পুরো করে, আর একটাতে অল্প করে ঢালল। তারপরে আমার দিকে ফিরে যখন বিয়রের গেলাসটা তুলে দিতে গেল তখনই আমার গলার দিকে চেয়ে বলে উঠল তোমার গলার পাশে লাল মতো ওটা কী। একী, তোমার ভুরুর কাছে এমন ফুলে উঠল কী করে? কী করে? কী করে, আমি তো কিছুই জানি না, বললাম, হ্যাঁ, হাত দিয়ে দেখেছি, কী ভাবে লেগে গেছে।

মানে?

 ও আমার দিকে একবার সন্দেহের চোখে তাকাল, বলল, তুমি কি ড্রিংক করে কোথাও আউট হয়ে গেছলে?

না তো। আমি তো কিছু খাইনি।

 বেবি আমার আরও কাছে এল, বলল, দেখি তো, এ কী, তোমার গলার কাছে যেন রক্ত লেগে আছে দু ফোঁটা।

রক্ত? ঠিক এই মুহূর্তেই আমি যেন শুনতে পেলাম একটা গলা, অনেক দূর থেকে, চুপি চুপি ফিসফিস গলা, কেন মারছিস খোকা।..মনে হতেই আমার সমস্ত চিন্তা ভাবনা, মস্তিষ্কের সমস্ত দরজাগুলো ঢাকা মোটা কালো পরদা যেন দুলে উঠল, কেঁপে উঠল, যেমন হঠাৎ দমকা বাতাসে পরদায় ধাক্কা লাগে আর স্লাপ স্লাপ শব্দ হয়, সেইরকম শব্দ যেন পেলাম। কোথা থেকে এল কথা কয়টি, কে বলল। কিছুই মনে করতে পারছি না, অন্ধকার, সেই অন্ধকারই আমার ভিতরে জমাট বেঁধে আছে, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, এবং হঠাৎ আমি বেবির গলা শুনতে পেলাম, কী হয়েছে তোমার, কী ভাবছ, এরকম ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কেন?

আমি বললাম, না, মানে, কী জানি, দাও, বিয়র দাও।

কিন্তু বিয়রের গেলাসটা ও টেবিলের ওপরে রেখে দিয়েছিল, আর কাপড়ের কোণ দিয়ে আমার গলাটা ঘষে দিল, আর এই ঘরে, ঘরোয়া পোশাকে, বেবি ওর আঁচল তুলে, আমার গলাটা ঘষছে, আমার যেন অন্যরকম লাগছে সব, আর ব্রেসিয়ার না পরা ওর বুক আমার গায়ে ঠেকছে, অন্য সময় হলে, যে ছোঁয়ার জন্য, অনেক চেষ্টা করতে হত, অবিশ্যি একটা সময় আসেই, যখন আর চেষ্টা করতে হয় না, আমার হাতের ওপর ও অনায়াসে সব ভরে দেয়, তখন নখাঘাতে মর্দিত হইবার জন্য, তাহার কামকলসযুগল আপনা হইতেই যেন উন্মুখ হইয়া উঠে। ও আমার গলার পাশটা মুছে, চোখের কাছে নিয়ে দেখে বলল, রক্তই তো।

রক্ত? আবার সেই মুহূর্তেই, সেই রকম ফিসফিস চুপি চুপি গলা শুনতে পেলাম, খোকা, কেন মারছিস আমাকে। তৎক্ষণাৎ আর একবার আমার মনের এবং মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনার ওপরে ঢাকা দেওয়া মোটা কালো পরদাগুলো যেন দমকা বাতাসে দুলে উঠল, কেঁপে উঠল, আর বাতাসের ঝাপটার শব্দ হল কিন্তু তারপরেই আবার নিথর হয়ে গেল। কার গলায় কথাগুলো বেজে উঠল, কোথা থেকে আসছে, কিছুই বুঝতে পারছি না, মনে করতে পারছি না।

আবার বেবির গলা আমি শুনতে পেলাম, কী আশ্চর্য, তুমি আমার কথাও শুনতে পাচ্ছ না, আমি যে তোমাকে ডাকছি। কী হয়েছে তোমার?

আমি বললাম, কিছু হয়নি তো।

বেবি যেন একটু বিরক্ত হল অথচ ওর চোখে একটা সন্দেহের জিজ্ঞাসাও রয়েছে, আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কি ওখানে গিয়েছিলে নাকি?

কোথায়?

সে কি তুমি জান না, পুলিশের সঙ্গে তো আজ আবার লেগেছে। ঘণ্টাখানেক আগে জয়া আমাকে ফোন করেছিল।

আমার মনে পড়ে গেল, আজ যেন কী একটা অকেশন ছিল, রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের। আজকাল আমার সবসময়ে সব অকেশনগুলো মনে থাকে না, যদি আমি সব ক্ষেত্রেই থাকি, অংশগ্রহণ করি, কেন না, আমি জানি, কোনওরকম নিষেধ বা শাসনের বিরুদ্ধেই লড়বার জন্য ডাকা হয়েছে। আমি কানাই নই। হয়তো বিপ্লবও নই, কিন্তু বর্তমানের যা কিছু, সবকিছু ভাঙবার জন্য আমি ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, জয়া কী বলেছে?

বেবি বলল, রাইটার্স বিল্ডিং পর্যন্ত যেতে পারেনি, তার আগেই পুলিশ বাধা দিয়েছে, ওরা সব পেছিয়ে এসে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। পুলিশ ওদের ঘিরে রেখেছে, যে কোনও মুহূর্তেই একটা গোলমাল লাগতে পারে।

তার মানে, শিক্ষায়তনের মধ্যে ছেলেরা ঢুকে পড়েছে আর পুলিশ ঘিরে রয়েছে, পুরনো ছবি, কিন্তু রুদ্র কোথায়। আমি বিয়রের গেলাসটা তুলে নিলাম। বেবি আবার আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি ওখানে গেছলে?

না।

 তবে তোমার কপালে লাগল কেমন করে, গলার পাশে রক্তই বা লাগল কী করে।

আমি বললাম, জানি না।

 বেবি অবাক হয়ে একটু সময় আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপরে বলল, মিথ্যে কথা বলছ, আমাকে বলতে চাও না, তা-ই।

আমি মুখটা বাড়িয়ে নিয়ে গেলাম ওর গলার কাছে, ওর গলার চিকচিকে চামড়ায় একটু ঠোঁট ছোঁয়াবার জন্য। কিন্তু গলার কাছে এগিয়ে, আমি ওর গলার দিকে তাকিয়ে রইলাম, ও সরে গেল, আর বলল, তোমাকে খুব নোংরা লাগছে, বাথরুম থেকে ঘুরে এসো না।

বোধহয় আমার মুখের সেই দুর্গন্ধটা ও পাচ্ছে, রত্নার কথা আমার মনে পড়ল, তাই তাড়াতাড়ি মুখে বিয়র নিয়ে কুলকুচো করে গিলে ফেললাম। বেবি বলল, এটা আবার কী হল।

মুখে গন্ধ পাচ্ছিলে তো।

না না, তোমার গোটা গাটাই তো ঘামে আর ধূলোয় নোংরা মনে হচ্ছে।

 তবু আমি মুখটা নামিয়ে নিয়ে গেলাম ওর বুকের কাছে। এই বক্ষ মুকুলিকা নহে, তথাপি আমার কাছে মুকুলিকা সদৃশ, আমি তাহার কলিকা বৃন্তে ওষ্ঠ দ্বারা স্পর্শ করিলাম, ও তখন গেলাসে চুমুক দিচ্ছিল, তাই শব্দ করল, উম, আহ্!

 আমি সমস্ত বিয়রটা এক চুমুকে খেয়ে ফেললাম। আয়নার দিকে চোখ পড়তে দেখলাম, চোখ দুটো লাল হয়ে উঠল। বেবি ওর গেলাসটা নামিয়ে রাখল, আমি ওর কোমরের কাছে দু হাত দিয়ে ধরে, কাছে টেনে নিয়ে এলাম, চুমো খেলাম ওর ঠোঁটে। ওর বাধা দেবার ইচ্ছা হল যেন, কিন্তু বিয়রের তেতো স্বাদটুকু সব ওর ঠোঁট থেকে মুছে নিতে দিল। তারপরে আমার বুকে ঠেলা দিয়ে একটু সরিয়ে দিল আমাকে, বলল, তোমার জামাকাপড়গুলো পর্যন্ত ময়লা।

বলেই কিন্তু ও একটা গান গুনগুনিয়ে উঠল, আর আমি যেন কেমন অলসতা বোধ করলাম। আমি বোতাম খুলে জামাটা টেনে তুলে খুলে ফেললাম। বেবি আমার গেঞ্জি পরা গায়ের দিকে তাকাল। আমি ওর এ্যাটাচ বাথরুমে গেলাম। গায়ের থেকে সবকিছু খুলে শাওয়ারটা খুলে দিলাম। উহ্, উহ্, কী সাংঘাতিক গরম জল, তাড়াতাড়ি সরে এলাম, খানিকক্ষণ জলটা পড়ল, হাত দিলাম, একটু ঠাণ্ডা হয়েছে, আবার মাথা পেতে দিলাম। সাবান মাখতে ইচ্ছা হল না, যদিচ, স্নানের সবরকম সামগ্রীই রয়েছে, পেস্টশ্যাম্পু থেকে, প্রকাণ্ড তোয়ালেটা পর্যন্ত। ছোট ভোয়ালেতে গা মাথা মুছে বড় ভোয়ালেটা জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। প্যান্ট বাইক গেঞ্জি ভেতরেই পড়ে রইল, আমি এসে দেখলাম, ও বিছানায় বসে পা দুলিয়ে ছোট ছোট চুমুকে, সেই বিয়রটুকুই খাচ্ছে। আমার পরনের তোয়ালেটা একেবারে শুকনো, তাই সোজা ওর বিছানায় গিয়ে এলিয়ে পড়লাম, ও বলে উঠল, ও কী অসভ্যতা, প্যান্ট পরলে না?

আমি হাত বাড়িয়ে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরে বললাম, ওগুলো ময়লা। এদিকে এসো না।

আহ্, আমার বিয়র পড়ে যাবে।

 একটা চুমুকে খেয়ে ফেলল।

ও তা করল না, খাটের মাথার কাছে, গ্লাসদানিতে গ্লাসটা রাখল। আমি ওকে টেনে আমার বুকের কাছে নিয়ে এলাম, জানি ও রাগ করবে, তবু। কিন্তু ও আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, তোমাকে আমার নরমাল লাগছে না, কী হয়েছে বলবে না?

আমি ওকে আমার বুকের তলায় টেনে নিয়ে, ওর মুখোমুখি হয়ে বললাম, কিছু হয়নি।

তবু ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, আমার যেন কেমন অস্বস্তি হতে লাগল, আমি চোখ নামালাম, আর ওর বুকের দিকে আমার চোখ পড়ল। কিন্তু আমি যেন অলস, আমি যেন কেমন ভাঙাচোরা, আমার মনটা দপদপ করছে, অথচ শরীরে তার কোনও আঁচ লাগছে না। আমি ওর জামাটা নীচের দিকে সরালাম, বাড়িতে বিশ্রামের জন্য ওর এই জামাটাও ঢলঢলে, সরাতে, স্তনান্তরের মধ্যবর্তী প্রদেশ হইতে দুইটি বর্তুলাকার শৃঙ্গ জাগিয়া উঠিল, ও আমার মাথায় হাত দিল, আমি ওর দিকে তাকালাম, ওর এই চাউনি আমার পরিচিত। কিন্তু তবু ওকে যেন আজ আমার অন্যরকম লাগছে। আমি ওর দুই ঠোঁট আমার মধ্যে নিলাম, ও বাধা দিল না, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, আমি ওর গালের দিকে তাকালাম আর জামাটা বুক থেকে সবটুকু নামিয়ে দিলাম, ও একটা হাত আমার পিঠের ওপর রাখল, কিন্তু আমি আমার শরীরটা যেন শব, এই মুহূর্তে একবার শিক্ষায়তনের কথা আমার মনে হল, আমি মুখ তুলে নিয়ে এলাম, কিন্তু ও আমার নীচের ঠোঁটে একটা চুমো খেয়ে দিল, আমি উঠে ওর পায়ের দিকে গেলাম, ও বলল নিচু গলায়, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো।

আমি দরজাটা বন্ধ করলাম, ফিরে এলাম ওর কাছে, আমি উহার বস্ত্ৰসমূহ সকল হরণ করিলাম, কিন্তু আমি-আমি কি সেই মানুষ না, যে বেবির নামে মরা জাগে, অথচ আমি যেন শব, আমার শরীরে যেন রক্ত নেই, রক্তবাহী শিরা নেই, সবই চুপচাপ, নিথর যাকে বলে, মৃত্যুপুরীর মতো হয়ে আছে। আমি নিশ্বাস নিতে গেলাম, সেই-সেই, বুকে নিশ্বাস নেবার যেন জায়গা নেই, সেইরকমই হচ্ছে, আমার সারা গায়ে ব্যথা, হাতে, আঙুলে, তলপেটে, দাঁতের গোড়ায়, আমার মুখে দুর্গন্ধ, বিস্বাদ, আমি আমার নীচে বেবির নরম হাতটা অনুভব করলাম। বেবি জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

জানি না।

তোমার কি শরীর খারাপ?

হ্যাঁ, বোধহয় কিন্তু

 আশ্চর্য, এমন কখনও দেখিনি।

বেবির গালের রং বদলে গিয়েছে, চোখের রং বদলে গিয়েছে, আমার মনে হল, ওর সমস্ত শরীরের রং বদলে গিয়েছে, ও যেন বরফের মতো গলছে, আর আমার যেন মনে হল, একটা মরা নেংটি ইঁদুরকে ও সমস্ত শরীর দিয়ে, হাত দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে চাইছে, কিন্তু মরা ইঁদুরটার বাসি রক্ত ছাড়া আর কিছুই বোধহয় ওর গায়ে লাগছে না, আমি ওর বুকের ওপর মাথাটা পেতে দিয়ে চোখ বুজে রইলাম, আমি এখনও হাঁপাচ্ছি।

.

কতক্ষণ পরে, আমি জানি না, শরীরটা ঘসটাতে ঘসটাতে, যেন কোনও আহত নির্জীব পশুর মতো আমি নেমে এলাম, বাথরুমে গেলাম, প্যান্ট পরে বেরিয়ে এলাম, আর বেবি যেন হঠাৎ শুকিয়ে গিয়েছে, রংটা যেমন ঝলকে উঠেছিল, তেমনি হঠাৎ-ই নিভে গিয়েছে, ও যেমন ছিল, তেমনি আমার কাছে আবার উঠে এল, আমার কাঁধে হাত দিল, আহ্, আমি কখনও ওকে এমন দেখেছি বলে মনে হয় না, বা দেখেছি, এই চোখ ছিল না, ও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে?

মনে হল, আমার চোখে জল এসে পড়বে, কেন না, সমস্তই অর্থহীন মনে হচ্ছে, অথচ ওর এই সমস্ত খোলা শরীরের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ফেরাতে ইচ্ছা করে না, আমি কিছু না বলে, কেবল ঘাড় নাড়লাম, আমার কিছু হয়নি। জামাটা গায়ে দিলাম, কিন্তু গোঁজার কথা মনে এল না। ওকে সেইভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে, আমি চলে গেলাম বাইরে। সমস্ত ব্যাপারটা কেমন যেন অলৌকিক, আমি নিজেকেই বুঝতে পারছি না। বেবিও কেমন যেন অবাক হয়ে রইল, ওর কথা জোগাল না মুখে, কেবল বেরিয়ে আসবার মুহূর্তে আমি ওর চোখে যেন একটা ভয়ের ছায়া দেখলাম, ও কি শিউরে উঠল, আমি বুঝতে পারলাম না।

শিক্ষায়তনের দূর থেকেই, পুলিশকে আমি ছুটোছুটি করতে দেখলাম মাথায় হেলমেট আর হাতে লাঠি নিয়ে। রাস্তার একটা জায়গাতে লোক ভিড় করে আছে, মাঝখানটা ফাঁকা, আমি অন্য রাস্তা ধরলাম। আমার চোখদুটো জ্বালা করে উঠল, টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে। জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখদুটো জ্বলেই উঠল। এখনও টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে, ইট ছোঁড়াছুড়ি চলছে উভয় পক্ষে। তখনই আমার দৃষ্টি চলে গেল রাস্তার ওপরে, ইট থান ইট কোথায়। এদিকে নেই, আমি আবার রাস্তা বদলালাম, আর সেই সময়েই কে আমার নাম ধরে ডেকে উঠল। দেখলাম রঞ্জন ওর টু ডোরস গাড়িটা নিয়ে রাস্তার এক পাশে, আমাকে ডাকছে। ও গাড়ির বাইরে, গাড়িটার কাচ তোলা, বন্ধ, বলল, ভেতরে ঢুকতে হবে। কিন্তু পুলিশের ওই গাড়িটা থেকে আমাদের দেখতে পাবে।

গাড়িটা তোর, ওরা জানে কী?

না।

তবে, গাড়িটার ছাদে উঠে, ওই গাছের ডালটা ধরতে পারবি না? তা হলে তো আমরা টপকে ভেতরে চলে যেতে পারব।

সেটা আমিও ভেবেছি, কিন্তু একবার ফসকে গেলে, পড়ে যাব, ধরে তখন ঠ্যাঙাবে। জানিস, ওরা কানাই বিজন অলককে অ্যারেস্ট করেছে রাস্তা থেকে। অলককে কোমরের কাছে এমন মেরেছে ও চিৎকার করে উঠেছিল।

শাসন! আমার দাঁতে দাঁত চেপে বসল, বললাম, চল টপকাই, ফসকাবে না। একবার উঠতে পারলে পাঁচিলটা পেয়ে যাব, ভেতরে জাম্প করব।

বলে আমি প্রায় দেড়শো হাত দূরে পুলিশের গাড়িটার দিকে তাকালাম। গাড়ি থেকে আমাদের দিকে চোখ রেখেছে, তবে ঠিক আন্দাজ করতে পারছে না, আমরা কারা।

রঞ্জন বলল, পারবি?

পারব।

আমি লাফ দিয়ে গাড়িটার মাথায় উঠলাম, গাছের ডালটা ধরতে না ধরতেই, রঞ্জনও উঠে পড়ল, তখন ছুটে আসা বুটের শব্দ আমাদের কানে ঢুকেছে, আমি ডালটা ধরে ঝুলছি, পরের ডালটা একটু দুরে, সেটাতে পা রাখতে না পারলে হবে না, বুটের শব্দ কাছে এগিয়ে আসছে। কিন্তু প্রায় একই সঙ্গে, আমি আর রঞ্জন অন্য ডালটা পেয়ে গেলাম, এবং রঞ্জন আমার থেকে তাড়াতাড়ি উঠতে লাগল, আর দুটো সেপাই, গাড়ির ছাদের ওপরে যখন লাঠি চালাল, তখন আমরা তাদের নাগালের বাইরে। ইতিমধ্যে, আর একটা সেপাই ছুটে এসে, আমাদের দিকে ঢিল ছুঁড়তে লাগল এবং রাষ্ট্রীয় ভাষায় গালি দিতে লাগল, একটা ইট এসে আমার পাঁজরে লাগল। পাঁচিলে উঠেই দেখলাম, কেউ যেন তিন-চারটে আধলা ইট আমাদের জন্যই চওড়া পাঁচিলের ওপরে রেখে দিয়েছিল, আমি ওদের লক্ষ্য করে, আধলা ইট ছুঁড়ে মারলাম একটা, চিৎকার করে বললাম, হারামি।

চুতিয়া! প্রতি উত্তর এল, এবং একটার কাঁধে গিয়ে রঞ্জনের ইট পড়েছিল, সে রঞ্জনের মাকে গালাগাল দিল, আমার বোনকে–মানে অর্পিতাকে, এবং আমাদের আধলা ইট আবার আমাদের গায়েই ফিরে এল। সেটা কারুরই গায়ে লাগল না, আবার আমরা ইট ছুড়লাম, তখন আরও কয়েকজন সেপাই এদিকে দৌড়ে এগিয়ে আসতে লাগল, আমরা ভিতর দিকে লাফিয়ে পড়লাম। পড়তেই এক দল জয়ধ্বনি করে উঠল আমাদের নামে, আর শিক্ষায়তনের অন্য দিকে তখন শ্লোগান চলছে। আমি সেই দিকে যাবার জন্য, পিছনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম, রঞ্জনটা অন্য দিকে কোথায় চলে গেল। আমার পাঁজরের কাছে ব্যথা করছে, পাথরের ঢিলটা বেশ জোরেই লেগেছে, আমি একটু দাঁড়ালাম, সেখান থেকে, নীচের দিকে তাকালাম। এ সিঁড়িটা নির্জন, সেকেলে, পুরনো, শ্যাওলা-ধরা ঠাণ্ডা, কোনও কারণেই প্রায় আর ব্যবহার করা হয় না। কয়েক ধাপ উঠে দাঁড়িয়ে, পাঁজরার কাছে হাত বোলাতে লাগলাম, দেখলাম, নীচে দুর্বাঘাসের ওপর রোদ পড়েছে, বেলা শেষের রোদ, ঘাসগুলো চিকচিক করছে আর ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে লাল মাটি–লাল মাটি আর কলকাতায় কোথা থেকে আসবে, কোনও সময়ে ওখানে বোধহয় সুরকি ফেলা হয়েছিল, তাই দেখা যাচ্ছে। পিছনের এই পোডোটায়, একটা কী গাছ রয়েছে দেওয়াল ঘেঁসে, বেঁটে ঝাড়ালো গাছ, কতগুলো চড়ুই তার ঝোপের মধ্যে ঝাঁপাঝাঁপি করছে, ডাকাডাকি করছে। বেবির কথা আমার মনে পড়ল, ওকে যেন দেখতে পেলাম, ঘরের মধ্যে, খালি গায়ে, একেবারে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে–ওর চোখে একটা ভয়ের ছায়া। বেবি আজ একেবারে অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল যেন, আজ–আজই সেই দিন, বেবি একেবারে অন্য রকম আর ওর কী বলব–ওর–ওর প্রার্থনা শেষ পর্যন্ত একটা মরা নেংটি ইঁদুরের কাছে…।

আমি তাড়াতাড়ি সিঁড়িতে উঠতে লাগলাম, তিন বাঁকের পরে এখানকার বারান্দায় কাউকে দেখতে পেলাম না, কিন্তু বারান্দার শেষেই, কয়েকজন ছেলে-মেয়েকে একদিক থেকে আর একদিকে দৌড়ে যেতে দেখলাম, এবং হঠাৎ আমার পিছনে শব্দ হতেই তাকিয়ে দেখলাম, পিছনের ডান দিকের একটা সরু দালান, যেটা রাস্তার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, পুরনো ঘরের কোল দিয়ে, যেখানে অনেকগুলো পুরনো বেঞ্চি আর টেবিল চেয়ারের ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে আছে, তার ওপর দিয়ে রুদ্র এগিয়ে আসছে। কোথায় গিয়েছিল ও। আমি ওর দিকে তাকালাম, ও একটু হাসল মাত্র, ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হেসে, কোনও কথা না বলে, আমার সামনে দিয়েই তাড়াতাড়ি চলে গেল। কোথায় গিয়েছিল ও। টিকটিকি, বাস্টার্ড, ওর সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া আছে, ওকে আমি ছাড়ব না। কানাই বিজন অলককে ধরিয়ে দিয়ে এসে, এখানে, নির্জনে একলা ঘুরছে, মতলব সিদ্ধি হচ্ছে, এবং সেনাপতির ন্যায় লড়াই করিতেছে। আমি এগিয়ে গেলাম, সামনের বারান্দায়, ঘরে, রাস্তার দিকের জানলায়, সর্বত্র একটা ভাঙাচোরা অবস্থা। সবখানে ইটের টুকরো ছড়ানো, এখানে উভয় পক্ষে লড়াই চলছে, সমস্ত জায়গায় টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া, সকলের চোখ লাল। সকলেই চোখ মুছছে ভেজা রুমাল দিয়ে, শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে। দু-তিনজনকে দেখলাম, কপালে ফেটি বাঁধা, মাথা ফেটে গিয়েছে। মিহিরকে দেখলাম, তিন-চারটে বড় বড় ইটের টুকরো নিয়ে ছুটে যাচ্ছে, আমি ওর সঙ্গে গেলাম। সামনের ঘরে গিয়ে, ভিড় ঠেলে জানলা দিয়ে উঁকি দিতে যেতেই, দুম করে শব্দ হল, টিয়ার গ্যাসের শেল এসে ভিতরে পড়ল, এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন সেটা তুলে নিয়ে আবার জানলা দিয়ে পুলিশের দিকে ছুঁড়ে দিল, নিপাত যা। নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের মধ্যে একটা ঘরে বৈঠক বসেছে, তার পাশের ঘরেই, কয়েকজন অসহায় ব্যক্তি, শিক্ষায়তনের অধ্যাপকবৃন্দ, কাতর হইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। তাঁহাদের কেহ আটক করে নাই, তাঁহারা বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে, আটক হইয়া পড়িয়াছেন।

আমি আবার মিহিরের কাছে ফিরে গেলাম, ওকে জিজ্ঞেস করলাম, বিপ্লব কোথায়, ওকে দেখছি না তো।

মিহির ঘরের মেঝে থেকে ইটের টুকরো কুড়োচ্ছিল, আমিও কুড়োতে লাগলাম, মিহির বলল, বিপ্লবটা এসে পৌঁছুতে পারল না, ও আজ ইন্টারভিউ দিতে গেছে।

কীসের ইন্টারভিউ?

চাকরির, ক্যালকাটা পুলিশ সার্জেন্টের পোস্টে কয়েকজন…

কথাটা ঠিক শুনেছি কি না, বুঝতে পারলাম না, বিপ্লব ক্যালকাটা পুলিশে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছে। মিহির যেন নির্বিকার, ইট কুড়োতে কুড়োতে বলল, ওকে দিচ্ছে সার্জেন্টের চাকরি। পুলিশ রিপোর্টেই কেঁচে যাবে।

আর যদি হয়ে যায়?

তবে বেঁচে যাবে, ওর বাবা তো মর মর, অতগুলো ভাইবোন…

কথা শেষ না করেই, জানালা দিয়ে ইট ছুড়ল ও। আমিও ওর সঙ্গে ছুঁড়তে লাগলাম। কিন্তু পুলিশ অনেকটা নাগালের বাইরে রয়ে গিয়েছে, যত জোরেই ছুড়ি, ওদের গায়ে লাগছে না। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ঢালের আড়াল দিয়ে, এগিয়ে এসে ইট ছুঁড়ে দিয়ে আবার পেছিয়ে যাচ্ছে, ছেলেরা তখন চিৎকার করে উঠছে, ধর ধর, শালাকে ধর!.বিপ্লবের কথা তার মধ্যেই দুই-একবার মনে পড়তে লাগল, যাও বৎস, জীবনে অনেক খেলা খেলিয়াছ, এইবার সেই খেলা সাঙ্গ করিয়া, প্রকৃত জীবন সংগ্রামে গিয়া অবতীর্ণ হও।…এই সময়ে, মাইকে গলা শোনা গেল, আমরা ছাত্রদের অনুরোধ করছি, আপনারা বেরিয়ে আসুন, শান্তিপূর্ণভাবে সকলেই বাড়ি ফিরে যান। শিক্ষায়তনের কর্তৃপক্ষ পুলিশকে অনুমতি দিয়েছেন, পনেরো মিনিটের মধ্যে যদি আপনারা এখান থেকে না চলে যান, তবে আমরা ভেতরে ঢুকে, শিক্ষায়তন খালি করব।

ছেলেরা ভীষণ জোরে ধিক্কার দিয়ে চিৎকার করে উঠল, শিক্ষায়তনের শাসকদের নামে গালাগাল দিতে লাগল, শ্লোগান উঠতে লাগল এবং নেতাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শিক্ষায়তন ত্যাগ না করা সাব্যস্ত হল। একদল আগে থেকেই নীচে ছিল, আরও অনেকের সঙ্গে আমি গেলাম, দরজার সামনে বাধা সৃষ্টি করার জন্য। অনেক টেবিল চেয়ার দরজার সামনে জড়ো করা হয়েছিল, নতুন করে আরও আনা হল। ইতিমধ্যে, বাতি জ্বলে উঠতে আরম্ভ করেছে, সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। ঠিক পনেরো মিনিট পরে, আর একবার মাইকে একই কথা জানানো হল, যাকে বলে, আবেদন করা হল, এবং পাঁচ মিনিট পরেই গেটের ওপর পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ল, আবার কয়েক দফা টিয়ার গ্যাসিং। বড় বড় বাঁশ দিয়ে চেয়ার টেবিল খুঁচিয়ে দিচ্ছিল ওরা, একটা স্টিলের পাত দিয়ে ঘেরা ট্রাক দরজার কাছে ঠেলে এল, তার হেড লাইটটা আমাদের ওপর পড়তেই, হঠাৎ একসঙ্গে অনেকগুলো লাঠিবৃষ্টি হতে লাগল আমাদের পিঠে, কে যেন চিৎকার করে বলল, পুলিশকে কে অন্য দরজা খুলে দিয়েছে। পুলিশ পাঁচিল টপকাচ্ছে।.তারপরে দেখতে দেখতে মনে হল চারদিকে পুলিশ, চারদিকে লাঠির মার, চিৎকার আর আর্তনাদ। কারুর জামা টেনে ছিঁড়ে ফেলছে, কারুর চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং আমি দেখলাম আমরা সকলেই, দরজার দিকে একটা লাইন হয়ে গিয়েছি, কী করে এমন একটা ফর্মে আমাদের নিয়ে এল বোঝা গেল না, আর ধাক্কা দিয়ে, মেরে একে একে বের করে দিতে লাগল, আমি যখন বাইরে তখন আমার পশ্চাদ্দেশে একটি সবুট পদাঘাতের আঘাত বাজিতেছে।…

বাইরে এসেও, পেভমেন্টের ওপরে, আশেপাশে পুলিশ, পুলিশের গাড়ির ছোটাছুটি, কাছাকাছি কোথাও কয়েকটা দুম দুম করে শব্দ হল। মনে হল, ক্র্যাকার ফাটছে।

এই দাঁড়া!

তাকিয়ে দেখলাম, মিহির। আমি আর মিহির খানিকটা গিয়ে দাঁড়ালাম। ও বলল, এখন কী করা যায়।

আজ রাত্রে কি আর কিছু হবে?

মনে হয় না। চল কোথাও গিয়ে একটু বসি, আমার মুখে একটা ঘুষি লেগেছে।

আমরা দুজনে হাঁটতে লাগলাম, প্রায় এসপ্লানেডের কাছে এসে, আমরা একটা বার-এ ঢুকলাম, দু বোতল বিয়র চাইলাম। একটু পরেই, নীতিশের সঙ্গে রুদ্র সেখানে এল। রুদ্র-রুদ্র–প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল এই কথাটা আমার মনে এল। কতক্ষণ সেখানে ছিলাম, জানি না, বেশিক্ষণ নয়, কিন্তু আমার মাথার মধ্যে একটা কথাই এমন পাক খাচ্ছিল, আমি আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল…চারজনেক বোতল বিয়র খাওয়া হল, আমার খেয়াল নেই। সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা সবাই ময়দানের দিকে গেলাম। একে একে মিহির আর নীতিশ চলে গেল, রুদ্র তখনও আমার সঙ্গে, আমার দাঁতে দাঁত চেপে বসল, আমরা তখন মাঠে, একটা অন্ধকারমতো জায়গা দিয়ে চলেছি, আমার পিছনে একটা প্রচণ্ড গোঁ গোঁ গর্জন, এগিয়ে আসছে খুব জোরে, আমি রুদ্রর দিকে ফিরে তাকালাম। ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী রে, কী হয়েছে?

গর্জনটা একটা প্রচণ্ড বেগে আমার সামনে আসতেই রুদ্রকে আমি জোরে ধাক্কা দিলাম, একটা ঝলকে দেখলাম, ও ট্রামের নীচে চলে গিয়েছে, আর ট্রামটা থামতে থামতেও অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে, আমার কানে, রুদ্রর একটা অস্ফুট শব্দ বাজছে, আমি তখন নানা রাস্তায়, অন্ধকারে অন্ধকারে ছুটছি, আর আমার নাকে কেমন দুর্গন্ধ লাগল, মরা টিকটিকির গন্ধ, তার গায়ে পোকা থিকথিক করছে, প্রাণপণে পৃথিবীর…।

হস্টেলের গেটে এসে দাঁড়াতেই দরোয়ান আমাকে একটা চিঠি দিল, তাতে লেখা ছিল, তোমার মাকে তার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। বিকেল থেকে কোথাও তোমার সন্ধান পাচ্ছি না, সংবাদ পেয়েই বাড়ি চলে এসো,বাবা। আহ, সেই কথাটা আবার আমি শুনতে পেলাম, কেন আমাকে মারছিস খোকা।…গেটের কাছ থেকে এসে, আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠলাম, বললাম আলিপুর।

হ্যাঁ, এখন আমার চোখের সামনে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে, দুপুরে আমি বাড়ি গেলাম, দেখলাম, বাইরের দরজাটা ঠেলতেই তা খুলে গেল। কেন, দরজা খোলা কেন। চাকরটা বোধহয় বাইরে গিয়েছে। আমি ওপরে উঠলাম। বারান্দা দিয়ে আস্তে আস্তে শেষের ঘরে গেলাম, দেখলাম, এক নারী শুয়ে, বিস্ত, এলোমেলো, অডিকলন, অন্য কোনও সেন্ট-এর গন্ধ আর তার সঙ্গে সিগারেটের হালকা গন্ধ। দেখলাম, নারী আমার মা। আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ি উঠে বসল, নিজেকে গোছাবার জন্য, জামা কাপড় ঠিক করল, বড় সুখী মুখ, বড় সুন্দর এখন কেমন অলস, ঘুম ঘুম ভাব, লিপস্টিক উঠে যাওয়া ঠোঁটে হাসি ছোঁয়ানো স্বামী তার অন্য এক নেশায় অন্যখানে রয়েছে আমার সামনে, যেন আমারই পরিচিতা বান্ধবীদের আর এক মূর্তি। কিন্তু খাটের উঁচু রেলিং-এ কেন আলস্যে মাথা রাখিলে, তোমার নরম চুল ছড়াইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু ওখানে কেন মাথা রাখিলে, ঠোঁটের কোণে হাসিয়া কী দেখিতেছ, ওখানে কেন মাথা রাখিলে–যূপকাষ্ঠে-হ্যাঁ, যুপকাষ্ঠে মাথা রাখিলে। আমি এগিয়ে গেলাম, মা তাকাল। আমি দু হাতে মাথাটা ঘাড়ের কাছে চেপে ধরলাম ও কী রে…চুলগুলো রেলিং-এর বাইরে এলিয়ে পড়ল, ওহ খোকা–খোকা কেন আমাকে মারছিস…না, ফিরিয়া দেখিব না, চাহিব না মুখের দিকে, মাতৃবক্ষের ঋণ শুধিবার নহে, সহস্র অমৃতধারায় বহিতেছে–কিন্তু আমি কোথায় অবগাহন করিলাম, জানি না, আমার অবগাহন হয় নাই, ঋণ লইয়া আমি ফিরিব, যাহারা মিটাইতেছে, মিটাইয়া যাউক, আমি ফিরিয়া চাহিব না, দেখিব না, জননী, বাহিরে বড় রৌদ্র, চলিলাম। বেরিয়ে এলাম, নীচে এসে দেখলাম, বাইরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, কাছেপিঠে কেউ নেই। নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম, একটা ট্যাক্সি…।

নটা বাজবার আগেই বাড়ি পৌঁছুলাম, দরজার কাছে একজন পুলিশ, আমার নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করল, বলে আমি বাড়িতে ঢুকলাম। দিদি জামাইবাবু, আর ওদের ছেলেমেয়েরা এসেছে। আমাকে দেখেই দিদি কেঁদে উঠল, কে এমন সর্বনাশ করলে? আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কোথায়, শুনলাম তিনি মায়ের ঘরে একলা বসে আছেন, আমি এলেই সেখানে গিয়ে দেখা করতে বলেছেন, আমি ওপরে গেলাম, দেখলাম বাবা ঘরের কোণে একটা চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে দেখে চোখ তুলে তাকালেন, খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপরে মাথা নেড়ে কেবল বলে উঠলেন, তুমি, তুমি-ই।

আমি চুপ করে রইলাম। বাবা আমার কাছে উঠে এলেন। চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি না?

হ্যাঁ।

কেন?

পারলাম না। অনেকদিন চেষ্টা করেছি, আর পারলাম না।

কেন, তোমার কী অধিকার ছিল?

তা জানি না। অধিকার কার কীসে, আমি জানি না।

বিস্ট!

তুমি বলছ আমাকে?

হোয়াট?

বাবা এক পা সরে গেলেন। তারপরে নিচু স্বরে গর্জে উঠলেন, ইউ আটার্ড ইট?

বাবা আমাকে মারতে লাগলেন। ক্রুদ্ধ পিতা, তাঁহার এত ক্রোধ ছিল জানিতাম না, কিন্তু এত ক্রোধ কেন, এত মারিতেছেন কেন, সকল দোষ দায়িত্ব তিনি তাঁহার পুত্রের কাঁধেই চাপাইলেন? তারপরে হাঁপিয়ে উঠলেন, আমাকে বললেন, গেট আউট আউট।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার আগে, একবার মায়ের খাটের দিকে তাকালাম, বাইরে এসে দেখলাম, দিদি জামাইবাবু চাকর ঠাকুর ঝি সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এ সময়েই ঘোষণা হল, পুলিশ কুকুর নিয়ে এসেছে। বাবা বেরিয়ে এলেন, আমাদের সবাইকে নিয়ে গেলেন একটা আলাদা ঘরে। ঘরের দরজাটা টেনে দেওয়া হল, ঠাকুর চাকরের জন্যই বোধহয় কুকুরের ব্যবস্থা, কিংবা কাছাকাছি থেকে কোনও লোক যদি বাড়ি ঢুকে থাকে।

কয়েকটা পায়ের শব্দ ওপরে উঠে গেল। বাবা বললেন, কুকুরটাকে ওর ঘরে নিয়ে গেল, সব এঁকে বেরিয়ে আসবে।

একটু পরেই, আমাদের দরজায় নখের আঁচড় শোনা গেল, আর দরজাটা খুলে গেল, আমি দেখলাম, কালো নেকড়ের মতো একটা কুকুর, তার লাল টকটকে জিভটা বেরিয়ে আছে, কিন্তু না। ডগ নয়, একটা বিচ। কুকুরটার গলার চেইন খোলা, সে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল, সকলের দিকে তাকাল, ঠাকুর চাকর ঝি ভয়ে প্রায় কাঁপছে, কুকুরটা মুখ নিচু করে শুঁকতে শুঁকতে বাবার কাছে গেল, একবার থমকাল, আর সেখান থেকেই আমার দিকে তাকাল। তাকাতেই, তার চোখের চাউনি বদলে গেল, গরগর করে চাপা গর্জন করে উঠল, আর একটা বড় ছায়া ফেলে, একেবারে আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল, আমার হাতটা আলগা করে কামড়ে ধরল, যাতে দাঁত না বসে।

পুলিশের লোকেরা, বাড়ির সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। কেবল বাবা ছাড়া। বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ইন্সপেক্টর বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ কে, আপনার ছেলে?

হ্যাঁ।

ওর মুখে এত কাটাকুটি ফোলা কেন?

আমি বললাম, মারামারি করেছি।

কোথায়?

 পুলিশের সঙ্গে।

একজন কুকুরটাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। ইন্সপেক্টর মুখ ফিরিয়ে বললেন, মি. ধর, জিমিকে আর একবার ছেড়ে দেখবেন?

মি. ধর বললেন, কোনও দরকার আছে কি?

ইন্সপেক্টর আমার দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আজ বাড়ি এসেছিলে?

 বললাম, এসেছিলাম।

 কখন?

দুপুরে।

 তোমাকে কেউ দেখতে পায়নি?

না।

 ইন্সপেক্টর অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালেন। বাবার মুখ অন্যদিকে ফেরানো। দিদি জামাইবাবু আর সকলে আমার দিকে, ভয়ের চোখে তাকাল। ইন্সপেক্টর এসে আমার হাত ধরে বলল, তোমাকে আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

চলুন।

সমস্ত ব্যাপারটাই এত সহজে হচ্ছিল, আর এত চুপচাপ সবাই, যে, পুলিশের লোকেরা, এমনকী বিচটাও যেন অবাক হল। আমি কারুর দিকে না তাকিয়ে, ইন্সপেক্টরের সঙ্গে এগিয়ে গেলাম, ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আমার কানে বাজল। বাবাকে দেখলাম, আমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির বাইরে এলেন। পুলিশের গাড়িতে ওঠবার আগে, বাবা ডাকলেন, খোকা।

তাকিয়ে দেখলাম, বাবার চোখে জল। একটা গালাগাল প্রায় আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু আমি মুখ ফিরিয়ে গাড়িতে উঠলাম। রাস্তার ওপরে, পাশের বাড়িগুলোতে তখন অনেক লোকের ভিড়, এমন নহে যে দেহ তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া আমার দিক হইতে চোখ ফিরাইয়া লইতেছে।

গাড়ি ছাড়িল, শব্দ হইল, আমি দেখিলাম, চলন্ত ট্রামের নীচে রুদ্র দলা পাকাইয়া গেল। বহু ঋণ করিতে হইল, জীবন ব্যাপিয়া কেবল ঋণ করিয়াছি। জননী, তুমিই প্রথম ঋণশোধের কারণ হইলে, ঋণশোধ শুরু হইল। আজ হইতে ঋণশোধ শুরু হইল। কানাই বিজন অলকরাও এখন জেলে, উহারাও ঋণশোধ করিতেছে, উহারা আমার ঋণশোধ করিতেছে, রুদ্রর ঋণশোধ করিতেছে, সময়ের ঋণও।…আমার সমুখে যেন সীমাহীন সমুদ্র জাগিয়া উঠিতেছে, ফেনিলোচ্ছল, তরঙ্গসঙ্কুল, আকাশে নক্ষত্ররাজি, বিশ্বসংসারের সেই অন্ধকারের মধ্যে, তিক্ত লবণাক্ত জলরাশি দুলিতেছে, হাসিতেছে, যেন অন্ধকার দুলিয়া দুলিয়া সুন্দর হইয়া উঠিতেছে, অন্ধকার আপনার রূপে, আপনি পুষ্পের মতো ফুটিতেছে। ছলছল কলকল করিয়া বহিয়া যাইতেছে। আজ কত তারিখ? কী জানি। কত তারিখ আসিবে যাইবে, ইহার শেষ নাই। ইতি বলিয়া কিছু নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *