২. রক্তের দাগ

স্বীকারোক্তি – উপন্যাস – সমরেশ বসু

০১.

আমার এই হাতে যে রক্তের দাগ–না, কথাটা আমি ঠিক এভাবে বলতে চাইনি, বলতে নয়, লিখতে চাইনি, কারণ কথাগুলো আসলে আমি লিখতেই চাইছি। তার কারণ এই নয় যে, আমি একজন লেখক, আমার পক্ষে সেটা একটা অসম্ভব কল্পনা। লেখা তো অনেক দূরের কথা, যৌবনের একটা জায়গায় এসে, এই তিরিশের ওপরে এসে, গল্প উপন্যাস পড়া তো অনেক আগেই ছেড়েছি, কিংবা বলা যায় গল্প উপন্যাসগুলোই আমাকে ছেড়েছে; যদি এরকম ভেবে নেওয়া যায় যে, পাঠকের ভেতরে ঢোকবার, তার অনুভূতিকে কোনও না কোনও ভাবে কবজা করে নাড়া দেবার ইচ্ছে গল্প উপন্যাসগুলোরও আছে। মনে হয়, সে সব ইচ্ছেগুলো নিশ্চয়ই আছে তাই পাঠকের কাছে আসবার জন্যে তার বিজ্ঞাপনের হাতছানি–অবিশ্যিই সে সবকে আমি ছলচাতুরি বলব না, বা এমন কথাও বলব না, অন্তর্বাসের জোরেই যারা পীনোদ্ধতা কিংবা কলপ আর নকল দাঁতের জোরেই যারা জোয়ান, কারণ বিজ্ঞাপন ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, তবু প্রাণস্পর্শী গোছের শব্দগুলো অনেকটা হাতছানির মতোই, কিন্তু সে হাতছানিতে আমার প্রাণ আর ভোলে না। কারণ গল্প উপন্যাসগুলোর সে ক্ষমতা যদি বা থাকে, আমার প্রাণের নাড়া খাবার ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। দেশি বা বিদেশি, সাহিত্যের বই শেষবার কবে, কত বছর আগে পড়েছি, মনে করতে পারি না। তবে এইটুকু মনে করতে পারি, শেষ বই, সম্ভবত সেটাই শেষ, একটা উপন্যাস বলেই মনে হচ্ছে এখন, যার প্রথম পাতা থেকেই ধরতাই খুব চড়া সুরে বাঁধা ছিল, যাকে বলে, প্রথম কোপেই পাঠক ঘায়েল, তারপরে আরও চড়া, আরও, আরও, একদিকে শ্বাসরুদ্ধ, আর একদিকে পুলক এবং তার আশেপাশে কিছু প্রাকৃতিক আমেজ ও বিষণ্ণতা, এমনকী দু-একবার ঈশ্বরকে হাজির করে দার্শনিকতার গন্ধ–সব মিলিয়ে যে ইন্ড-স্পাত-এর মতো, অর্থাৎ ইন্ডিয়ান-স্পুতনিক নামে যে রেসের ঘোড়াটার কথা ইদানীং খুব শোনা যাচ্ছে, তার কথা ভেবেই বলছি, ইন্ড-পুত-এর মতো ছুটে চলেছিল, আমি ততই পেছিয়ে পড়ছিলাম। আমি বইটার কত পাতা অবধি শেষ পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম, মনে করতে পারি না, তবে অর্ধেকও নয়, এবং তাও মাসাধিককাল লেগেছিল। তারপরে সে বইটা যে কোথায় আছে, কে নিয়েছে, কিছুই জানি না। আজ এখন এই মুহূর্তে সে কথা মনে পড়ছে। আমি আমার অনেক পুরনো দিনের অভিজ্ঞতার থেকেই, বইটার চড়া সুরের ধরতাই বুঝতে পেরেছিলাম, অথচ নিজে চড়তে পারিনি, অনেকটা হাঁপিয়ে পড়া সওয়ারের মতোই এলিয়ে পড়েছিলাম। তার জন্যে আমি বইটার দোষ দিই না, আমার প্রাণেরই দোষ দিই, কারণ সেই প্রাণস্পর্শী পুস্তকটি যেদিকে দৌডুচ্ছিল, এবং একদা আমার প্রাণও যেদিকে দৌডুত, লক্ষ করছিলাম, ইনি, অর্থাৎ প্রাণটি কবে গুটি গুটি অন্য পথে যাত্রা করেছেন। আর সে যাত্রাকে কেউ শুভযাত্রা বলবে না নিশ্চয়ই, এবং সে কথা বলবার জন্যেই, আমার লিখতে চাওয়া, যে কারণে পড়বার প্রসঙ্গ এসে পড়ল।

আমি একটা ভয়ংকর গোলমালে পড়েছি, যে কারণে, আমার মনে হচ্ছে, সমস্ত ব্যাপারটা যদি আমি লিখে ফেলতে পারি, তা হলে, যে গোলমালের মধ্যে আমি জড়িয়ে পড়েছি, তার মোট চেহারাটা দেখতে পাব, আমার অবস্থাটা বুঝতে পারব। কিন্তু লেখক নই, যে কারণে ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব বলে বোধ হচ্ছে, যে কারণে চিঠি লেখার মতো কাউকে উদ্দেশ করেই লিখতে পারি, আর সেটাই আমার পক্ষে সম্ভব, কারণ লেখা মানে, এখন তো কেবল চিঠিই, আর যেগুলো, সেগুলো অনেকটা ছকের। কাজ, এবং কেন মুখোমুখি কাউকে মুখ ফুটে নয়, সেটা আমার কথাগুলো না পড়লে কেউ বুঝতে পারবে না।

কিন্তু কাকে উদ্দেশ করে লিখতে পারি, তা বুঝতে পারছি না। এমন একজন কাউকে ভেবে নিতে চাই, যাকে ঠিকমতো সব বলতে পারি, যার কাছে কোনও দ্বিধা ভয় বা সংকোচ থাকবে না। বাবাকে?

না, প্রথমত তিনি মৃত, তাঁকে বলার কোনও অর্থই হয় না। দ্বিতীয়ত, সত্যি বলতে কী, তাঁর কাছে দ্বিধা ভয় সংকোচ বরাবরই ছিল। তৃতীয়ত, তাঁর মুখ মনে করে, তাঁর উদ্দেশে আমার কথা আমি বলতেই পারব না, কারণ, আমি যেন দেখতেই পাচ্ছি, আমার কথা শুনে, কষ্ট পাচ্ছেন, কথা বলতে পারছেন না, এবং আমাকে বুঝতে পারছেন না, যেটা আরও ক্ষোভ দুঃখ ও ব্যথার কারণ হয়ে উঠছে।

মাকে উদ্দেশ করেও বলতে পারি না, কারণ কাশীবাসিনী মায়ের রেখায় রেখায় ভরপুর মুখটিও আমি দেখতে পাচ্ছি, যাঁর চোখের দৃষ্টি কমে এসেছে, চোখ দুটি যেন সবসময়েই ভেজা ভেজা, গলা গলা এবং এমনিতেই, তিনি যখন আমার দিকে তাকান, বুঝতে পারি, আমি তাঁর কাছে অপরিচিত। আমার দিকে তাকিয়ে, তাঁর চোখে যে একটা কোমলতা ফুটে ওঠে, যার ভিতরে খুঁজলে এমনকী একটা গর্বের ভাবও টের পাওয়া যায়, তার একমাত্র কারণ, তোমাকে আমি আর এখন বুঝতে বা চিনতে পারি না বটে, কিন্তু আমিই তোমাকে জন্ম দিয়েছি, আমার পেটেই তুমি হয়েছ। সম্ভবত আমার শরীর স্বাস্থ্য গলার স্বর, পোশাক-আশাক, সব কিছুরই মধ্যে আঁতুড় ঘরের ছবিটাও তাঁর চোখে একবার ভেসে ওঠে, কিন্তু যে কথা আমি বলতে চাই, তাঁকে তা বলা অর্থহীন। বাবার থেকে তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়বে।

নিজের বলতে যাদের বোঝায়, তাদের মধ্যে আছে আমার বোনেরা। আমার কোনও ভাই নেই, এবং বোনদের সবাইকেই পাত্রস্থ করা গিয়েছে, যদি সেটা আমার কৃতিত্ব নয়, বাবাই তাঁর মেয়েদের হিল্লে করে গিয়েছেন। কিন্তু আমি যে কথা বলতে চাই সে কথা, তাদের বা তাদের পাত্রদের বা পাত্রের সন্তান-সন্ততিদের বলতে পারব না, কারণ আমি মুখ খোলামাত্রই দেখতে পাচ্ছি তারা ভীষণ ভয়ে একটা অচেনা লোকের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যে লোকটাকে তারা ভাই বা শ্যালক বা মামা, কিছুই ভাবতে পারছে না। প্রথম মুখ খুলতে গিয়েই যদি তাদের মুখের চেহারা ওরকম দেখি, তা হলে তো আমি কিছুই বলতে পারব না।

না, আত্মীয় স্বজন বলতে যাদের বোঝায়, তাদের কিছুই বলা যাবে না। সত্যি বলতে কী, যাদের মধ্যে জন্মের থেকেই আছি, তাদের কাছে আমি আমার এ সব কথা, যে কথা বলতে চাইছি বলতে পারব না। যে দ্বিধা সংকোচ ভয় ইত্যাদির কথা বলছিলাম সেগুলো আমাকে কেবলই বাধা দেবে।

বন্ধুদের কাউকে বলতে পারি। পারি না কি? তা হলে আর এভাবে লিখে বলবার দরকার কী, অনেক আগেই তো কাউকে সব বলে ফেলতে পারতাম। কিন্তু আমি তো দেখছি, যে সব বন্ধুদের মুখ এই মুহূর্তেই মনে পড়ছে, তাদের সকলেরই মুখের চেহারা প্রায় আমার আত্মীয়দের মতোই হয়ে উঠছে। এখানেও সেই একই বাধা, আমরা যারা অনেকদিন ধরে একসঙ্গে মেলামেশা করেছি, অনেক মনের কথা বলাবলি করেছি বলে ধারণা করে রেখেছি, তাদের কাছেও দেখছি, অনেক কথাই না বলা রয়ে গিয়েছে, শুধু তাই নয়, চেষ্টা করেও বলা যায়নি, কারণ বলা যায় না। কেন যায় না, সে ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না, কারণ বন্ধুত্বের ব্যাখ্যাই আমার সঠিক জানা নেই, কারণ জীবনে অনেকবারই অনুভব করেছি, আমার নিজের সমস্ত ব্যাপারটাই, এত বেশি আমার যে, বন্ধু শত চেষ্টা করলেও তার কিছু করণীয় থাকে না, কিছুই করতে পারে না।

এরপরে যাঁরা থাকেন, তাঁরা আমার স্ত্রী, আমার অফিসের বস, আমার রাজনৈতিক নেতা, যাঁকে মাই ফিলজফার অ্যান্ড গাইড বলা যায়, কিংবা আমার প্রেমিকা–হ্যাঁ প্রেমিকাই বলতে হবে, কিন্তু এঁদের আর কখনওই কিছু বলা যাবে না, কারণ কারণ এঁদের কথা বলবার জন্যেই তো আমাকে লিখতে হবে। অবিশ্যি আমি যদি সেভাবে ভাবি, তা হলে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে, কারণ কথাগুলো যাকে বলতে যাব, তারই মুখের চেহারা বদলে যাবে, এবং দেখা যাবে, সেই একই অপরিচয়ের বেড়া একটা দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সে কথাই বা আমি ভাবছি কেন। অপরিচয় তো থাকবেই, এমনকী শেষ পর্যন্ত আমার কথাগুলো সে অনুধাবন করতে পারলেও ভাবনার শরিক হতে পারে না, এবং আমরা কেউ তা পারি না। তবে হ্যাঁ, আমি যদি এমন একজন কাউকে বলতে পারি, যাঁর সঙ্গে আমার কোনও পরিচয় নেই, জানা-শোনা নেই, নাম-ধাম কিছুই নয়, এবং তিনি বুঝতে পারলেন কি–পারলেন, তাতেও আমার কিছু আসবে যাবে না, অথচ তাঁকে উদ্দেশ করে লিখে ফেলার পর যে চেহারাটা আমি দেখতে পাব, আমার চেহারা, আমার অবস্থাটা বুঝতে পারব, তাতেই আমার কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি কে?

তিনি আমার মতোই একজন মানুষ। তাঁর ভিতরে কী আছে না আছে জানি না, তা দিয়ে আমার দরকারও নেই, আমি ধরে নিচ্ছি, আমার সামনে যে সব মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তিনি তাদের মধ্যেই একজন। হ্যাঁ, আমি এবার আপনি বলেই আরম্ভ করি, আপনাকেই বলছি, আপনি যে-ই হন, আমাকে তো আপনি চেনেন না।

.

দেখুন, আমার এই দুটো হাতের কথা বলছিলাম, না না, ওরকম ঘাড় বাঁকিয়ে যেন মুগ্ধ হয়ে, পুরুষের দুটো নিটোল শক্ত হাত, নিটোল আঙুল দশটা দেখছেন, সেভাবে আপনাকে আমি মোটেই দেখতে বলিনি, কিংবা এই ক্যাটস আই পাথরটাকে সোনা দিয়ে মোড়া আংটি দেখতেও আপনাকে আমি বলিনি, অবিশ্যি বেড়ালের চোখ কেন এই পাথরটাকে বলা হয়, তা আমি জানি না, আমার তো ধারণা, বাঘের চোখের রংও এইরকমই হয়, আর আমার আংটির পাথরের সাইজটাও বেশ বড়। আর এই আংটিটা আমাকে দিয়েছিল এক জ্যোতিষী, সে বলেছিল, এই পাথরটা পরলে আমার ওপর যে শয়তান চেপে আছে, সে নাকি দূর হবে, যদিচ শয়তানটা আরও বেশি করেই চেপেছে বলে আমার ধারণা–মোস্ট বোগাস! কিন্তু যাই হোক, আমি আপনাকে হাত দেখাচ্ছি মানে, হাত দুটোই মাত্র দেখাচ্ছি না, আমি জিজ্ঞেস করছি, আপনি আমার এই হাতে রক্তের দাগ দেখতে পাচ্ছেন কিনা।

চমকে উঠলেন কেন, রক্তের দাগ খুঁজছেন? রক্তের কথা শুনেই একটু ঘাবড়ে গিয়েছেন মনে হচ্ছে। তা অবিশ্যি আমরা সবাই যাই, রক্তের সঙ্গে আমরা দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারি না, এমনকী, রক্ত দান করলেও। কিন্তু আপনি দেখছেন, কোথাও রক্তের দাগ নেই, বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হাত, প্রত্যেকটি নখ পর্যন্ত মাফিকসই করে কাটা, এমনকী লিকুইড সাবান দিয়ে ধোয়া হাত থেকে আপনি একটা সুগন্ধও পেতে পারেন। তবু আপনাকে আমি সত্যি বলছি, আমার দুই হাতে অনেক রক্ত মাখা আছে, অনেক রক্তের দাগ আছে, আর সত্যি বলতে কী, সে রক্ত আমার নয়, অন্যের, হ্যাঁ, আমি অনেককেই।

ভয় পাচ্ছেন? পাবেন না প্লিজ! বুঝতে পারছি, এখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী খুঁজছেন। আপনি খুঁজে দেখতে চাইছেন, আপনি কোনও পাগলের সামনে বসে আছেন, না সত্যি কোনও খুনির কাছে, যদিচ খুনি আর পাগলে কতটুকুই বা তফাত করা যায়, যে কারণে, দুটোর যে কোনও একটা হলেই বা আপনার ভরসা কী। কিন্তু আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি, ভয় পাবেন না। প্রথম কথা হচ্ছে, আমি পাগল নই, অতএব প্রলাপ যখন বকছি না, ভরসা যখন দিচ্ছি, তখন সুস্থ মাথাতেই দিচ্ছি।

হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছেন, তা হলে আমি খুনি। না, ওরকম ভয় আর সন্দেহের চোখে তাকাবেন না, আপনাকে খুন করার আমার কোনও কারণই নেই, তা হলে আর আপনাকে ডেকে সে কথা বলতে যাব কেন। খুন করেছি বলেই, আপনাকে বলছিলাম, আমার হাতে আপনি রক্তের দাগ দেখতে পাচ্ছেন কিনা। ওটা অবিশ্যি জিজ্ঞেস করার কোনও মানে হয় না, আমার মতো খুনির হাতের রক্ত আপনি দেখবেন কী করে। যা আমি দেখতে পাই, পাচ্ছি, এবং তার সঙ্গে যাদের খুন করেছি, তাদের বাঁচবার জন্যে সেই সাংঘাতিক চিৎকার–বিশ্রী, একদিক থেকে দেখতে গেলে বাঁচবার জন্যে সেই প্রাণপণ চেষ্টার চেহারা আর শব্দ, কোনওটাই খুনের চেহারার থেকে সুন্দর বলে আমার মনে হয়।, সবই আমি এখন দেখতে আর শুনতে পাচ্ছি।…আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন, একটু স্থির হয়ে আমার কথা শুনুন, এবং তারপরে হয়তো দেখবেন, এরকম খুনের বিষয় শুনতে সত্যি ভয় পাচ্ছেন। হয়তো, এমনকী, আপনিও আপনার হাতে রক্তের দাগ দেখতে পাবেন, হ্যাঁ যাকে বলে, প্রায় আবিষ্কার।

কী আশ্চর্য, আপনি যে সত্যি আপনার হাত দেখতে লাগলেন। হ্যাঁ, একটু হাসুন তো, হাতের রক্তের দাগের কথা বলার পর থেকে সেই যে মুখ আড়ষ্ট করে, চোখ অনড় করে, ভুরু তুলে বসে রইলেন, যেন ভয়ে আর সন্দেহে একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছেন। আমাকে দেখে কি আপনার মনে হচ্ছে, আপনাকে আমি খুন করব? কী বললেন, আমাকে দেখে মনেই হচ্ছে না, আমি একটা পোকাকেও মারতে পারি! হাসালেন, নিশ্চয় ছারপোকার কথা বলছেন না, কারণ সত্যি ওই পোকাগুলোকে আমি হাত দিয়ে কিছুতেই মারতে পারি না, নিতান্ত মারতে হলে, পায়ের তলায়, তাও খালি পায়ের তলায় নয়, স্লিপারের তলায় ফেলে পিষে দিতে পারি, হাত দিয়ে অসম্ভব। আর পোকামাকড় মারতে সত্যি আমার কেমন গা ঘিন ঘিন করে। কী বললেন, মানুষ মারতেও আমার প্রবৃত্তি হতে পারে না? আমার চেহারা বলছে, অ্যা, আমার সুন্দর চোখ? সুন্দর মুখও দেখছেন? হাসিটাও সুন্দর? দাঁড়ান, দাঁড়ান, কী! এমনকী গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গিও আপনার সুন্দর লাগছে, তার মানে আমার দ্বারা খুন করা একেবারেই সম্ভব নয়? না, আপনি সত্যি হাসালেন, আপনি তা হলে চেহারা চোখমুখ দেখে মানুষ বিচারের আশা করেন। আচ্ছা, আপনি একটু চোখ বুজে, মন দিয়ে ভেবে দেখুন তো, যাদের যে সব কাজকে আপনার অন্যায় বা অপরাধ বলে মনে হয়েছে, তাদের চেহারা চোখমুখ কোনও কিছুরই সঙ্গে কি সেসব অন্যায় অপরাধের মিল আছে? একটু ভেবে দেখুন, নিতান্ত চলতি সস্তা কোনও উদাহরণ দিয়ে দেবেন না, একটু ভাল করে ভেবে বলুন, এমনকী, যদি কিছু না মনে করেন, আপনার এই যে শহুরে মানুষটির ছিমছাম ভদ্র মুখ, কেতাদুরস্ত হাসিটি, আপনি নিশ্চয়ই কেতাদুরস্ত, তা আমি বিশ্বাস করি, আপনার নিজের কথাই একটু ভেবে দেখুন না। হয়তো জীবনে দু-একটা অপরাধ করে ফেলেছেন, অবিশ্যি আমি জানি না আপনি আবার সেই দলের লোক কিনা, যারা বুক ফুলিয়ে বলে, আজ পর্যন্ত কোনও অপরাধ করিনি, কিংবা অপরাধ করেও বলে, তা মানুষ মাত্রেই অপরাধ করে থাকে, কী করা যাবে যার মানে দাঁড়ায়, অপরাধটাকে সে অনুভবই করেনি, কারণ আমার ধারণা, একবার অপরাধ কিছু করে ফেললে, আর সেটা যদি সে অনুভব করে তার অপরাধ হয়েছে, তা হলে নিষ্কৃতি নেই, সারা জীবনই তাকে সেই অপরাধবোধ খোঁচাতে থাকে, আর সেই খোঁচানোটাই তার জীবনকে অন্যভাবে তৈরি করে দিতে পারেন।

কী বললেন, ঠিক করতে পারছেন না কিছু? পারছেন? বাঃ! শুনে সত্যি খুব সুখী হলাম, আপনি আমার কথাটা আংশিক অন্তত স্বীকার করতে পারছেন। আমি অবিশ্যি, অন্যায় অপরাধের সঙ্গে চেহারার অমিলের ভূরি ভূরি গল্প বলে দিতে পারি, ইতিহাস থেকে শুরু করে, সাহিত্যে সিনেমায় খবরের কাগজের পাতায়, সবখানেই, আর বাস্তব জীবনে তো বটেই, প্রচুর পাবেন। কী বললেন, মনে পড়ছে অনেক কথা, অনেক মুখ? আপনার নিজের স্ত্রীর কথা বলছেন? থাক থাক–কেন মিছিমিছি…বলবেনই? বেশ বলুন। ও, খুব পবিত্র চোখ মুখ আপনার স্ত্রীর, দেখলে মনে হয়, দেবী? আর তিনিই, অবলীলাক্রমে আপনাকে ঠকিয়ে মিথ্যে কথা–আচ্ছা, থাক থাক বুঝতে পেরেছি। আরও মুখ মনে পড়ছে? পড়বেই মশাই, পড়বেই। তা হলেই বুঝতে পারছেন, আমার সম্পর্কে আপনি একটা ভুল ধারণা করে বসে আছেন, আমার মতো লোক খুন করতেই পারে না, এরকম হতে পারে না। অনেক বেশি করতে পারে কিনা, সে কথা আমি বলতে পারি না, কারণ কে খুন করবে সে কথা কেউ জোর করে বলতে পারে না। না, খুন করাটাকে যারা পেশা হিসাবে নিয়েছে, আমি তাদের কথা বলছি না, কারণ পেশাদার খুনি জানে, খুন তাকে করতেই হবে, ওটাই তার কাজ। কী রকম? এ তো আপনি খুব আশ্চর্যের কথা বললেন, পেশাদার খুনি দেখেননি, তাদের কথা শোনেননি? ধরুন কেউ যদি মনে করে, সে তার রাজ্যের সীমা বাড়াবে, আমি রাষ্ট্রনেতাদের কথাই বলছি, তা হলে তাকে ভেবে নিতেই হয়, সে তোক খুন করবে, কেননা তোক খুন না করলে রাজ্য বাড়ানো যায় না, কিংবা ধরুন ক্ষমতায় বহাল থাকতে হলে, একটার পর একটা খুন আপনাকে করে যেতে হতে পারে, এবং তা বেশ ভেবে চিন্তে, অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে, পরিবেশ তৈরি করে করতে হবে, এ অবস্থায় খুনটাও একটা পেশা হয়ে দাঁড়ায়, অথবা ধরুন না কেন আমি অমুককে সাফ করতে চাই, তার জন্যে অমুক লোকটাকে লাগাতে হবে এরকম অনেক তো আছে, যাদের লাগানো যায় অর্থাৎ অমুক লোকটার খুনই পেশা, তাকে দিয়ে কাজটা করাতে হবে। সম্ভবত এরকম লোকের খবর মাঝে মধ্যে এদিকে ওদিকে পেয়ে থাকেন, খবরের কাগজের রিপোর্টেও তাদের কথা ছাপা হয়।…না, আমি তাদের কথা বলছি না। আমি আপনাকে যে খুনের কথা – না খুনগুলোর কথা —

নাঃ, আবার আপনার চোখের চাউনি বদলে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে একটু সিটিয়ে যাচ্ছেন। কী বললেন, একটা খুন? না, আমি কয়েকটা খুনের কথা বলতে চাইছি, কারণ, আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমার এই হাতে অনেক রক্তের দাগ লেগে আছে, কারণ আমি অনেককেই মাথা নাড়ছেন যে, বিশ্বাস করতে পারছেন না? কেন, একটা হলেও বা কোনওরকমে বিশ্বাস করতে পারতেন? তার মানে আপনি একটা খুনের গল্প শুনবেন বলে ভাবছিলেন, আমার সে রকমই মনে হচ্ছে, যে রকম মিষ্ট্রি বা হরর ইত্যাদি গল্পের মধ্যে থাকে, সেই রকম, বেশ গুছিয়ে-গাছিয়ে কায়দা-কানুন করে, বুক দুরু দুরু করে, নিশ্বাস বন্ধ করে, একেবারে শেষ মুহূর্তের সুখটানের মতো–কিংবা সাপের ছোবলের নেশার মতো, একেবারে শেষ মুহূর্তের কৌটো ফাঁক আর একটা সুখের ঝাঁকানি, তারপরেই, আমার পা টলে টলে, ভেসে যায় জাহাজে মাস্তুলে, সেই গানটার মতো অবস্থা। কিন্তু আমি দুঃখিত, আপনি যে গল্প শোনার জন্যে মনকে প্রস্তুত করেছেন, আমি বোধহয় তার বিপরীত কথাই শোনাতে বসেছি, যার মধ্যে, সত্যি বলতে কী, খুনের গল্পের যে সব মজা বা রস থাকে, তা আপনি একেবারেই পাবেন না।

বুঝতে পারছি, আপনার মনের সংশয় বা সন্দেহগুলো এখনও কাটছে না, এবং আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, আপনার অবস্থাটা এখন এরকম, আচ্ছা, লোকটা কী বলছে, শোনাই যাক না। হ্যাঁ, সেটাই ভাল, আমিও তাই চাইছি, আপনি সে রকম একটা মনোভাব নিয়েই যদি দয়া করে শোনেন, তা হলেই হবে। না না না, অতটা ঝুঁকে নাকের পাটা ফোলাবার কোনও দরকার নেই আপনার, আমি মদ্যপান করিনি–আরে তাতে কী হয়েছে, লজ্জা পাচ্ছেন কেন, আচ্ছা আচ্ছা, আমি বিশ্বাস করছি আপনি আমাকে মাতাল ভাবেননি, তবে আপনাকে আমি এটুকু বলতে পারি, মদ্যপান করে আত্মহনন-টনন ব্যাপারের মতো হালকা অবস্থায় আমি এখন আর নেই, বা দুঃখ ভোলবার যে সব কথাবার্তা লোকেরা বলে, সে রকম দুঃখের মধ্যেও আমি ঠিক নেই।…কী বললেন, মদ্যপানকে খারাপ চোখে দেখেন না? সেজন্যে আপনার উদারতাকে ধন্যবাদ জানাই ও! আপনি ওতে অভ্যস্ত? না না, তাতে আমার মনে করার কিছু নেই, কারণ ওটা এক একজন এক এক অবস্থায় খায়, এবং কার কী অবস্থায় খেতে ইচ্ছা হয়, একমাত্র সে-ই সে কথা বলতে পারে, আর কৈফিয়তটাও তার নিজের কাছেই শেষ পর্যন্ত দিতে হয়, কারণ কোনও কারণেই বাড়াবাড়ি করে ফেললে, তার প্রতিফল পেতেই হয়। বিষয়টা আমি জানি, আমার মতো করেই জানি, কখন খেতে ইচ্ছা হয়।

অতএব আপনি খান বলে, যে আমাকে সন্দেহ করেছেন, এর কোনওটার জন্যেই আপনার লজ্জা পাবার কারণ নেই।

অ্যাঁ, বলুন, সবাইকে লুকিয়ে খান? বাড়িতে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গিয়েছে? স্ত্রীও পছন্দ করেন না? হ্যাঁ, সেটা তো বটেই, কেন যে খেতে ইচ্ছা করে, সেটা যদি ঠিকমতো জানতেই পারবেন, তা হলে তো কথাই ছিল না। তবু দেখুন, আপনার এ ব্যাপারের থেকে আপনি যখন ব্যাপারটাকে অপরাধের পর্যায়েই এনে ফেলেছেন–ফেলেননি? ও, আচ্ছা, আপনি ফেলেননি, সমাজ এনে ফেলেছে বলছেন। যাই হোক, সমাজের চোখেই না হয় ধরুন, মদ্যপানের থেকে খুনটা নিশ্চয় আরও বড় অপরাধ, আর আমি যখন সে কথাই বলতে পারছি তখন আর সে জন্যে অতটা কিন্তু কিন্তু করবেন না। আমি আপনাকে যে কথা বলছিলাম

কী বললেন? হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি যে খুনের কথা বলতে চাইছি, তার সঙ্গে পেশাদারি খুনের একটা তফাত আছে, কারণ খুনটা আমার পেশা নয়, তবু অনেকগুলো প্রাণের রক্তই তো এই দু হাতে লেগে আছে, যে কারণে আপনাকে আমি বলতে চাইছিলাম, আমার ব্যাপারে আপনি হয়তো কোনও নিটোল খুনের গল্প পাবেন না, যে রকমটা পেশাদারি ব্যাপারে পাওয়া যায়। একটা আয়োজন, একটা ব্যবস্থা, বিরাট একটা চক্রান্ত, যার প্রতিটি পদে পদেই একটা করে দমবন্ধ মোচড়, না, তা নয়। অবিশ্যি, এর থেকে আপনি ধরে নেবেন না, আমার খুনের ব্যাপারে, আমি কোনও কৌলিন্য দাবি করছি, খুনটা খুনই, সব খুনের পেছনেই কতগুলো কারণ থেকে যায়, কোনওটা ভেবে-চিন্তে, কোনওটা আচমকা, তার থেকে ধরে নেওয়া যায় না, হঠাৎ মেরে বসলেই মারবার কোনও ইচ্ছা ছিল না। অন্তত আমার ক্ষেত্রে সেরকম কথা আমি বলব না। যেমন ধরুন, গায়ে মশা বসলে আপনি মারেন, মশাটা যে কামড়ায় আর রক্ত খায়, এ কথা কেউ ভেবে হাত তোলে না, উঃ বলে হাতটা আপনিই উঠে যায়।

কী রকম? অবিশ্যি কথাটা হয়তো আপনাকে আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারলাম না। আচ্ছা, টোটা চাটুয্যে–হ্যাঁ শ্ৰীগোলক চাটুয্যের কথাই আমি বলছি, নামটা ইচ্ছে করেই আপনার কাছে আমি গোপন করলাম এবং দুটো নামই ফিকটিশাস, এ জন্যে আমাকে ক্ষমা করবেন, কেন গোপন করতে হল, সে কথা আপনি সবটা শোনবার পর বুঝতে পারবেন। যাই হোক, টোটা চাটুয্যেকে আমি যেদিন খুন করলাম, আমি স্রেফ কলকাতার একটা দেশি কোম্পানির কাগজকাটা হাতলসুদ্ধ এক ফুট ছুরিটা, মোড়া ঘাড়ের পিছনে শিরদাঁড়াটা যেখানে মিট করেছে, সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। না, ওই একদিনই যে মাত্র খুন করার কথা চিন্তা করেছিলাম, তা নয়। আরও অনেকবারই মনে হয়েছে। গণ্ডারটাকে দিই শেষ করে, আর সহ্য করতে পারছি না, এবং প্রত্যেকবারেই ভেবেছি, না, তা কী করে হয়, একটা লোককে এভাবে খুন করা যায় নাকি? নিজেকে খুবই ধিক্কার দিয়েছি, এবং ধিক্কার দিয়ে মনে মনে একটু শান্তিই পেতাম, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, লোকটার অস্তিত্ব আমাকে কষ্ট দিত না।…

.

০২.

কী বললেন, টোটা চাটুয্যে লোকটা কে, আর কেনই বা তাকে খুন করেছি? সে কথাই তো আপনাকে বলতে বসেছি, কিন্তু দাঁড়ান, আমি আপনাকে সমস্ত খুনের ব্যাপারগুলো ধারাবাহিকভাবে বলতে চাই। তার আগে অবিশ্যি আমি আপনার কৌতূহল নিবারণ করার জন্য বলছি। টোটা চাটুয্যে আমার নেতা, তামার গাইড, আমার ফিলজফার এবং এ সব আমরা কাদের বলি, আপনার নিশ্চয় খানিকটা সে বিষয়ে ধারণা আছে। নেই? কেন, আপনি কি কখনও রাজনীতি করেননি? কলেজের ছাত্র ছিলেন যখন, তখনও না? সে কী মশাই, আমরা তো ইস্কুল থেকেই শুরু করেছিলাম এবং বাংলা দেশের ছেলে, বিশেষত মিডল ক্লাস ঘরের ছেলে রাজনীতি করেনি, এমন তো আমি প্রায় দেখিইনি। কম বেশি হতে পারে, কিন্তু বয়সের একটা সময়ে তো সবাই দেশোদ্ধারে মাতে, যদিচ বাংলা দেশের ছেলেদের সম্পর্কে অন্য দুর্নামটাই বেশি শোনা যায়, আর সেটা দুর্নাম কিনা তাও আমি জানি না। ঠাট্টা হতে পারে যে, একটা সময়ে নাকি তারা সবাই কবিতা লেখে, আর সত্যি বলতে কী আমিও তা লিখেছি। ওই বয়সটায়, আমি আঠারো কুড়ির কথাই বলছি বা তার থেকে দু-এক বছর কম হতে পারে, বয়সটার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। ও বয়সে ছেলেরা সবকিছুই করে, সবকিছুই হতে চায়, আর তারপরে দ্যাখে, তার কোনওটাই সে প্রায় হয়নি। হয়তো সে কবিতা গল্প লেখা আরম্ভ করে, অভিনেতাদের নকল করতে আরম্ভ করে, নামকরা গাইয়ের নকল করে গলা কাঁপিয়ে গান করে, জনপ্রিয় নেতাদের মতো বক্তৃতা দেয়, তারপরে সে হয়ে ওঠে জীবনযাপনের একটা যন্ত্র, যখন সংসারটা হয়ে ওঠে খুব খারাপ জায়গা, আর মন ভরে থাকে নানান তিক্ততায়, যার ফলে সে সবকিছুকেই সমালোচনা করতে আরম্ভ করে। তার ধারণা সে সবই বোঝে, সব বিষয়েই তার কথা বলবার অধিকার আছে। কিন্তু সে যাই হোক, আমি যা বলছিলাম, কবিতা লেখাটা যদি সত্যি ও বয়সের মহামারী হয়–মাফ করবেন, মহামারী কথাটা আমি ঠিক ব্যবহার করতে চাইনি, সকলেরই যদি ওই ইচ্ছাটা হয়, রাজনীতিটাও সেই রকম! আপনি ভাবতে পারেন, আমাদের চৌদ্দ পনেরো বছরে–আপনিও আমার সমবয়সিই হবেন আশা করছি। তখন কোনও মিছিলে যাইনি, স্লোগান দিইনি, ইস্কুলে ইস্কুলে গিয়ে ধর্মঘট করিনি? করেছেন? আমি সেইরকমই বলছি, তারপরে কারুর কারুর পক্ষে সেটা বেড়ে যায়, কোনও বিশেষ লোকের বা মোটামুটি ভাবে দলের নীতি হয়তো তাকে ইনফ্লুয়েন্স করে, যা আমাকে করেছিল। টোটা চাটুয্যে হল সেই লোক, সে-ই আমাকে প্রথম পিক-আপ করে। পিক-আপ শব্দটাই এখানে চলে, সে নিজেও তাই বলত, তোমাকে আমি পিক-আপ করেছি। কিন্তু কেন বলে, তা আমি বলতে পারব না, মানে ওই পিক-আপ কথাটা। আমার সম্পর্কে যখন বাইরে কথা হয়, তখন লোকে বা দলের লোকেরা বলে, টোটা চাটুয্যের পিক-আপ। আর টোটা চাটুয্যে যে একজন খুব নামকরা রাজনীতিবিদ সে কথা আপনাকে আগেই বলেছি। দলের মধ্যে তার অসীম ক্ষমতা, নেতাদের সকলেই তাকে খাতির করে। এমনকী, যে তার মৃত্যু কামনা করছে প্রতিদিন, সেও তাকে ভীষণ খাতির করে চলত, আর এটা আপনি কখন করতে পারেন? এটা আপনি তখনই করতে পারেন, যখন আপনি সকলের দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে নিতে পারেন। সে দুর্বলতা, অর্থের জন্যে হতে পারে, ক্ষমতার জন্যে হতে পারে, স্ত্রীলোকের জন্যে হতে পারে, যে কোনও একটার জন্যে বা সবগুলোর জন্যেই হতে পারে এবং দুর্বলতা বলতে এ ব্যাপারগুলোই সবথেকে ভাইটাল বলে আমার ধারণা।

কী বললেন? আপনারও তাই মনে হয়? হবেই, তার কারণ আমরা যে সমাজে আর সময়ে বাস করছি, তাতে আমরা যে যাই করি, মোটামুটি ব্যাপারটা বুঝতে পারি। আর মানুষ মাত্রেরই, এ সব দুর্বলতাগুলো একটু বেশিই থাকে, যদি আপনি কাউকে কিছু বলতে যান, আপনাকে চিবিয়ে খেতে আসবে, কারণ তারা নিজেদের সবসময়েই খুব ভাল বলে জানে। কিন্তু লোকের কথা বলবার জন্যে আমরা বসিনি, আপনাকে হয়তো বোর করছি

করছি না? অশেষ ধন্যবাদ। তবু যাই হোক, আপনার যদি চোখ কান খোলা থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই দেখেছেন বা শুনেছেন, রাজনৈতিক লোকদেরও ও সব দুর্বলতাগুলো আর দশটা মানুষের মতোই আছে, ক্ষেত্রবিশেষে বরং বেশি, কারণ তার সুযোগ অনেক বেশি। টোটা চাটুয্যে দলের অন্যান্য নেতাদের সেই সব দুর্বল জায়গাগুলোর খোঁজ-খবর খুব ভাল নিতে পারত, সত্যি বলতে কী, সে বিষয়ে আমিই তাকে অনেক সাহায্য করেছি, মানে স্পাইং করা যাকে বলে, কিন্তু আমি জানি না, আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা, আমার সেই সব গুপ্তচরবৃত্তিকে, আমি সমর্থন করতে না পারলেও একটা গ্রেটার কজ বলে জানতাম। অসৎ লোকদের মুখোশ খুলে দেওয়া বা তাদের শাস্তি দেওয়া, শাসন করা, দল থেকে বের করে দেওয়া, দলের সুনামের জন্যে তার দরকার ছিল বলেই আমি মনে করতাম। আর সেজন্য, আমি খুব উৎসাহের সঙ্গেই, এবং যথেষ্ট সাহস আর বুদ্ধির সঙ্গেই সে সব কাজ করেছি। মশাই, লিখতে পারি না তাই, নইলে সে সব কাজের কথা লিখতে পারলে, গল্প উপন্যাসের থেকে তা খারাপ হত না। কিন্তু আমি যেগুলোকে গ্রেটার কজ বলে জানতাম, টোটা চাটুয্যের কাছে সে সব ছিল এক ধরনের চাবিকাঠি। কী রকম? এই যেমন ধরুন, আপনি একটা ঘরে ঢুকতে চান, মানে আপনার খুবই লোভ হচ্ছে অথচ ভয় পাচ্ছেন, পাছে কেউ দেখে ফেলে বা ঢুকে যদি আবার বেরোতে না পারেন; অথচ লোভটা আপনার এমনই যে, আপনি ঢুকবেনই শেষ পর্যন্ত, আর তারপরে, যে আপনাকে লক্ষ রাখছিল, সে এসে টুক করে সেই ঘরে চাবি এঁটে দিয়ে গেল। টোটা চাটুয্যে হচ্ছে এরকম লোক, চাবিটা সে নিজের হাতে রেখে দিত, এবং তারপরে আপনি হাজার হাতে পায়ে ধরলেও, সে আপনাকে কোনওদিনই সেখান থেকে খুলে দেবে না, কিন্তু আপনাকে সে ধরিয়েও দেবে না, আপনাকে দিয়ে সে তার কাজগুলো করিয়ে নেবে, তার মানে লোকটার হাতে আপনি চিরদিন আটকা পড়ে রইলেন।

আমাকেও সেরকম আটকে ফেলেছিল কিনা জিজ্ঞেস করছেন? না, আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি, আমি যা কিছু করেছি, একটা মহৎ উদ্দেশ্য–এখন ভাবলে অবিশ্যি হাসি পায়, তার চেয়ে বেশি, ঘৃণাও হয়, এবং সেটা নিজেকেও অনেকখানি, তবু সত্যি আমি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই করেছি, অতএব আমাকে আটকে ফেলার কিছু ছিল না। এখন আমি একটা জিনিস বুঝতে পারি, যারা কেবল লোকের দুর্বলতাই খুঁজে বেড়ায়, এবং সেই সুযোগে তাকে কবজা করে, তার মানে, ওটাই তার ক্ষমতার মূলধন, যেটাকে আমার শয়তানের মূলধন ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। সেটা আমার এখন মনে হয়। আগে মনে হয়নি, যে কারণে আপনি আমাকে ন্যাকা বলবেন কিনা জানি না বলবেন না? বেশ, বোকা বলবেন নিশ্চয়ই? তাও বলবেন না? বিশ্বাস করে ঠকা বলবেন? আমি তাও বলি না, সত্যি বলতে কী, আমার নিজেকে একটা বংশব্দ কুকুর বলতে ইচ্ছা–আচ্ছা, আচ্ছা মশাই, বলব না, কেউ নিজেকে কুকুর বললে আপনার রুচিতে লাগে। কিন্তু আমার নিজেকে প্রায় সেরকমই মনে হয়েছিল, যে কারণে, আপনাকে আমার বলবার উদ্দেশ্য এই, আমি তো সত্যি কুকুর নই, আমি যে মানুষ, এটাই ভুলে গিয়েছিলাম, আর সেটা যখনই নিজের কাছে ধরা পড়ে গেল, তখনই সব কাগজকাটা ভোঁতা ছুরিটা।

কী বললেন? কোন সময় থেকে আমি টোটা চাটুয্যের কাছে আসি? মানে কখন পিক-আপ করে? তা ছাত্রাবস্থাতেই কলেজে পড়ার সময়, প্রথম আমার দিকে তার নজর পড়ে। তার আগে ইস্কুলে পড়ার সময়েই টোটাদাকে–হ্যাঁ, আমরা সবাই তাকে টোটাদা-ই বলতাম, চিনতাম এবং বক্তৃতা শুনেছি। কলেজে পড়ার সময় সে আমাকে দলে নেয়। অবিশ্যি একটা কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে, লোকটার আরও কয়েকটা গুণ ছিল, সেটা হচ্ছে এই, আপনাকে দিয়ে কী কাজ হবে, কোন কাজটা আপনি ভাল করতে পারবেন, এটা সে বুঝতে পারত, আর আপনাকে কী ভাবে বললে, আপনি তাকে মানবেন, এটাও সে ভালই জানত, যে জন্যে আমাকে যখন সে বুঝিয়েছিল, দেশের কাজ মানে, সকলেই যে বাইরে ঘুরে বেড়াবে, বক্তৃতা দেবে, তা নয়, ভিতরেও অনেক কাজ আছে, এবং আসল রাজনীতি বোধহয় সেটাই। ভিতরে ভিতরে যেগুলো ঘটছে। সত্যি বলতে কী, বাইরে আমরা যা দেখি বা শুনি বা পড়ি, সেগুলো কিছুই নয়, সেগুলো হচ্ছে, অনেকটা ম্যানুফ্যাকচার, আসলে মেশিনটাই সব, মেশিনারি যাকে বলে, আর সেটা যাদের হাতে থাকে, তারাই আসল লোক। টোটা চাটুয্যে আমাকে সেই মেশিনারির মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয়, সে বুঝতে পেরেছিল, আমার পক্ষে সেটাই সুবিধা। আর আমাকে সে এটাও বোঝাতে পেরেছিল, দলের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত, তাদেরই ভিতরের কাজে নেওয়া যায়। বাইরে থেকে হয়তো লোকেরা তাদের চিনতে পারে না, চেনবার দরকারও নেই, তাতে অসুবিধা। এমনকী, অনেক সময়, দলের সব লোকেরাও তাকে চিনতে পারে না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, দল থাকলেই এক একজনের এক একটা চক্রও থাকে, টোটা চাটুয্যেরও তেমনি একটা চক্র ছিল কী বললেন? চক্র মানে জানেন না! নাঃ আপনি দেখছি সত্যি মশাই খুব সাধারণ মানুষ, মানে, সাধারণ মানে, আপনি কথাটাকে খারাপ অর্থে নেবেন না, অর্থাৎ খুবই ভাল মানুষ। দলটাকে তো আমরা বাইরে থেকে দেখছি, কিন্তু দলের ভিতরে তো আবার দল আছে মশাই, অর্থাৎ দলের ক্ষমতা হাতে রাখার জন্যে ভিতরে ভিতরে দল থাকে, যাকে আমি চক্র বলছি। আপনি যদি দলে ঢোকেন, তা হলে, আপনাকে একটা চক্রেও ঢুকতে হবে, আর আমি টোটা চাটুয্যের চক্রেরই লোক ছিলাম। টোটা চাটুয্যে প্রথমেই একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমি যেন দলের লোক মানেই, সবাইকে দলের শুভানুকাঙ্ক্ষী না মনে করি, যে কারণে সে আমাকে কয়েকজনের চরিত্র বা গতিবিধি বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, যারা দলেরই ক্ষতি করতে চায়। আসলে, তারা টোটা চাটুয্যের মতোই নিজেদের চক্র গড়ে তুলেছিল বা তুলতে চাইছিল, আর এই চক্রগুলো সবসময়েই নিজেদের মধ্যে লড়ে, সুযোগ পেলেই, একটা আর একটাকে এলিমিনেট করে, নয়তো নিজের তাঁবে এনে, ওই যে সেই চাবির কথা বলছিলাম, সেইভাবে আটকে রেখে নিজের কাজ করিয়ে নেয়।

পেরেছেন? বুঝতে পেরেছেন? কী বলছেন–আমি কবে থেকে বুঝতে পেরেছি? তা প্রায় কয়েক বছর লেগেছিল, কেননা, আমাকে তো আর প্রথমেই ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়নি, যদিচ আমি দলের মধ্যে টোটা চাটুয্যের শাকরেদ বলেই পরিচিত ছিলাম, কারণ সে-ই আমাকে প্রথম টেনে নিয়ে যায়, আমাকে বোঝাতে থাকে, এবং তার আশেপাশে যারা থাকত, তাদের সঙ্গেই বেশি মিশতাম, টোটাদারই লোক তারা। তা ছাড়া, আমি দেখেছিলাম, টোটাদাকে সবাই খাতির করে, ভয় পায়, বাইরেও সে জনপ্রিয় ছিল, যার অর্থ হল, তার চক্রটাই ছিল সব থেকে স্ট্রং। কিন্তু আমি মনে করতাম, টোটাদা-ই খাঁটি লোক, সেজন্যে তাকেই সবাই বেশি মানে। আর সত্যি বলতে কী, এ সব ব্যাপারের একটা মজা হল, মেশিনারির মধ্যে একবার পড়ে গেলে, ব্যাপারটা কী ঘটছে, আপনি অনেক সময় টেরই পাবেন না, সে অবকাশ আপনার থাকবে না। না না, আপনি যত ভাল লোকই হন, এ ব্যাপারে তাতে কিছুই যায় আসে, আসলে আপনার অপরাধ, আপনি বিশ্বাস করে বসে আছেন, যেমন একটা মানুষ ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে, সেইরকমই, যার ফলে আপনার ভাববার কথা তো আর মনেই নেই। আমার অবস্থাটাও সেইরকম হয়েছিল। আর দেখুন, ক্ষমতাবান মানুষ সম্পর্কে আমাদের সকলেরই কিছু দুর্বলতা থাকে। আপনারও কি নেই? আছে? থাকবেই মশাই, কারণ আমরা মোটামুটি বলতে গেলে সাধারণ ক্যালিবারের লোক, তবু তো অনেক ক্যালিবারওয়ালাদেরই দেখেছি, ক্ষমতাবানদের সম্পর্কে তাদের কী ভীষণ দুর্বলতা।…যেমন ধরুন, আমার চাকরি হ্যাঁ, চাকরি করি বইকী। আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমার একজন বস আছেন।…

কী বললেন, টোটাদাকেই আমার বস ভেবেছিলেন? তা বলতে পারেন, একদিক থেকে তো তাই, আর সে হিসেবে, আপনি যদি বলেন, তা হলে বস-এর তো অভাব নেই। তবে টোটাদাকে আমি ঠিক অতটা ছোট করতে চাই না, বস শব্দটা আমি নিতান্ত অন্যদিক থেকেই বলেছি। আমার চাকরির জায়গায় যিনি বস, তিনি আবার টোটাদারই অনুগত কি না! হ্যাঁ, টোটাদাকে ভয় পেতেন ভদ্রলোক, …সেটা অবিশ্যি আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম, কেননা, প্রথমেই আমার বোঝার উপায় ছিল না যে, একজন মাননীয় লোককে, ব্যবসায়ী লোকটি ভয় পাবেন কেন, নিশ্চয়ই টোটাদার গুণে, তার দেশপ্রেমে মুগ্ধ এবং যাকে বলে শ্রদ্ধান্বিত, তাই। বরং টোটাদাকেই ওই লোকটার বস মনে হত, যে কারণে, আমি টোটাদাকে আমার বস-এর থেকেও বেশি কিছু মনে করতাম।

কিন্তু যে কথা বলছিলাম, আমার যে বস, তার কী দরকার ছিল টোটাদাকে মানবার? হয়তো দরকার কিছু ছিল, যার অর্থ, টোটাদা যথেষ্ট ক্ষমতাবান লোক ছিল। এবং আমার বস-এর মতো একজন কোটিপতি লোক তাকে মানত, এবং তার এক কথাতেই আমার চাকরি হয়েছিল। আর সে চাকরিটা একটা যা তা চাকরি নয় মশাই, যাকে বলে ম্যানেজারিয়েল র্যাংক, তাই ছিল। কিন্তু ভাববেন না, আমি তাতে খুব লাভবান হয়েছিলাম। আমার স্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছিল নিশ্চয়ই, কাজ বেড়ে গিয়েছিল অনেক, কারণ, টোটাদার যে কোনও দরকারেই আমার বস আমাকে ছেড়ে দিতেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর অফিসের কাজ ষোলো আনাই পুষিয়ে নিতেন, আর সত্যি বলতে কী, সে সব কাজগুলোও যাকে আমরা ফেয়ার বলি, তা ছিল না। অবিশ্যি, এ কথা ঠিক, এখন তো বুঝতে পারছি, আমার কোন বিষয়টাই বা ফেয়ার ছিল। আনফেয়ার, সবখানে, সবকিছুতে আনফেয়ার এবং এখন বুঝতে পারি, সমস্ত জীবনটাই তাই। চাকরির ব্যাপারে বস-এর সঙ্গে আমার প্রায়ই ঠোকাঠুকি লাগত, কারণ তার বিজনেসের যে ডিপার্টমেন্ট আমাকে দেখতে দেওয়া হয়েছিল, সমস্তটাই ছিল একটা ভুয়া, একটা জোচ্চোরি আর রাহাজানির কারখানা। হিসাবের কোনও মা বাপই ছিল না, আর তার সঙ্গে জড়িয়েছিল একটা ফরেন ফার্মের নাম। সেই ডিপার্টমেন্টের আন্ডারে একটা কারখানা চলত, সেটাও আমাকে দেখাশোনা করতে হত, যে কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা দুশোর বেশি হবে না, অথচ কাগজপত্রে সবটাই অন্যরকম দেখানো হত। আমি এ যুগে, মানে আমাদের এই সময়ের কথা বলছি, এত পুয়োর পে, কোথাও দেখিনি, কারখানার শ্রমিকদের কথা বলছি, এমনকী, বললে বিশ্বাস করবেন না, চটকলেও অত কম মজুরি দেয় না, চা বাগানের কথা অবিশ্যি আমি জানি না, অথচ ক্যাটেগরির দিক থেকে ওটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাক্টরির মধ্যেই পড়ে। এর কারণ কী? না, আমার বস-এর বন্ধু টোটাদা যে কারণে, আমার চাকরিটা আসলে ছিল, দুশো লোককে সব সময় মজুত করে রাখা, বক্তৃতা দিয়ে তাদের বোঝানো। এ বিষয়ে আমার কোনওরকম গাফিলতি হলেই বস কৈফিয়ত তলব করতেন, যা মুখে আসত তাই বলতেন, এর ওপরে ছিল, একবার ভেবে দেখুন, এর ওপরে ছিল, সমস্ত ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব, আর সে দায়িত্বটাকে আপনি যা তা ভাববেন না, কোনওরকম এদিক ওদিক হলেই, শ্রীঘরে যাওয়া আমার আটকানো যেত না, যার ফলে, আমি সবসময়েই একটা নার্ভাস টেনশনে ভুগতাম। টোটাদাকে সে কথা বললে, সে বলত, তোমাকে তো ওই জন্যেই ওখানে দিয়েছি, যাতে সব ব্যাপারটা তুমি ম্যানেজ করতে পারো।

কিন্তু কী ম্যানেজ করব, আর কাকে ম্যানেজ করব। কী বললেন? টোটাদা ব্যাপারটার ভিতরের কথা জানতেন কি না? নিশ্চয়ই জানতেন, কিন্তু আমার তখন সে ধারণা ছিল না। কিন্তু ল্যাস-এর নামটা আমাদের দলের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়েছিল।

কী বললেন, ল্যাস কী? সরি, আপনাকে আমার বস-এর নামটা বলতেই ভুলে গিয়েছি। ল্যাস মানে lass ধরে নেবেন না স্যার। সেদিক থেকে চেহারায় উনি বিপরীত, খুবসুরত ছুকরির কিছুই ওঁর মধ্যে ছিল না, যদিচ পেটে মদ পড়লে, দেখেছি, উনি ওঁর মেয়েকেও চিনতে পারেন না, খালি হাঁক পেড়ে ওঠেন, হাপানমটি কে, আমার কাছে এসো। হাপানম মানে জিজ্ঞেস করছেন? কথাটা অবিশ্যি আমি ওঁর মুখেই প্রথম শুনেছি, মুণ্ডা ভাষায় হাপানম মানে সুন্দরী যুবতী, আর আপনি যদি আমাকে ক্ষমা করেন, তা হলে বলতে পারি, ল্যাস-এর কথার মানেটা দাঁড়ায় যেন, বাজখাই মাগি। আপনি হাসছেন, অ্যাঁ? এনজয় করছেন? তা করতে পারেন, কিন্তু ওঁর কথা থেকে ওই রোয়াকি ভাবটাই ফুটে উঠত, আর উনি কথাটা শিখেছিলেন, মাঝে মাঝে ওঁকে গিয়ে ছোটনাগপুরের জঙ্গলে ঘুরে আসতে হয় ব্যবসার জন্যে, সেখান থেকেই। কিন্তু যে কারণে নামের কথাটা উঠল, ওঁর আসল নাম লাল শাহ। ছোট করলে এল এস দাঁড়ায়, এল এস থেকেই ল্যাস হয়েছেন সকলের মুখে মুখে। ল্যাস-এর নামটা এমনভাবে আমাদের দলের সঙ্গে জড়িয়েছিল যে, তার বিরুদ্ধে মুখ খোলাও যাচ্ছিল না, যার ফলে তাঁর সঙ্গে আমার প্রায় রোজই কথা কাটাকাটি হত, আর ঠিক সে ভাবেই একদিন গাছের ডাল দিয়ে, মনে হয় সেটা নিম গাছের ডালই হবে, যার ওপরে ছাল বাকল কিছুই ছিল না, পিটিয়ে মেরে ফেলেছি।

আপনি ওভাবে মুখটা কুঁচকে চমকে উঠলেন কেন? আমি আবার দেখছি, আপনার চোখে ভয় আর সংশয় দেখা দিচ্ছে। বোধহয়, আবার আপনার মনে সেই প্রশ্নটাই দেখা দিচ্ছে, আপনি সত্যি কোনও পাগলের সামনে বসে আছেন কিনা। বিশ্বাস করুন, আমি পাগল নই। আমার কথা থেকে কি আপনার একবারও মনে হচ্ছে, আমি পাগল? মনে হচ্ছে না তো? কী বললেন? অথচ বিশ্বাস করতে পারছেন না, আমি সত্যি ওরকম ভয়ংকর কাজ করেছি। সত্যি আমার হাসতে ইচ্ছা করছেনা না, হাসব না, কারণ, আপনার মতো অবিশ্বাস আমার নিজেরও ছিল কিনা, সত্যি আমি তা করতে পারি না, অথচ করেছি, ল্যাসকে আমি পিটিয়েই মেরে ফেলেছি, এই হাত দিয়ে, এবং তখনও এই বেড়ালচোখ পাথর আংটিটা আমার হাতে ছিল।

কী বললেন? কোথায় পেলাম সেই গাছের ডাল? অ্যাঁ? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, তার অফিসের মধ্যেই আমি তাকে মেরেছি, আর গাছের ডালটা সেখানেই ছিল, দেয়ালের দিকে, একটা আলাদা র‍্যাকের ওপরে এবং র‍্যাকটা সেই গাছের ডাল রাখবার জন্যেই আলাদাভাবে তৈরি করে লাগানো হয়েছিল, কারণ, সেই গাছের ডালের আকৃতিটা একটা, যাকে বলে, কিম্ভুত জানোয়ারের মতো দেখতে ছিল, বিশেষ করে, ডালটার ছাল উঠে গিয়েছিল বলে, অনেকটা কৃমির গায়ের মতো তার রং হয়েছিল কী হল, শিউরে উঠলেন যে? গা ঘুলিয়ে উঠল? কিন্তু মাফ করবেন, তা ছাড়া আমার অন্য কোনও রঙের তুলনাই এল না, নইলে আপনাকে তো আমি আইভরি কালারের কথা বলতে পারতাম। কিন্তু আইভরিতে আর যাই হোক, একটা রেডিশ মানে, লাল ভাব থাকে না, কৃমিগুলো অনেকদিন পেটের মধ্যে রাজত্ব করার পর যেমন একটা রক্তের ছোপ লেগে যায়। কী বললেন, বুঝতে পেরেছেন এবার? কী করে, আর কেন সেটা ওখানে এল? সে কথাই আমি বলতে যাচ্ছি, ওটা একটা উপহার, ল্যাস-এর কোনও মেয়ে বান্ধবী ওটা তাঁকে প্রেজেন্ট করেছিল, কারণ তার আকৃতিটা নাকি অদ্ভুত দেখতে ছিল, যেন মাথা নুইয়ে, শরীর নিচু করে, একটা নেকড়ে পেছনের ল্যাজটিকে ঝুলিয়ে খুব আস্তে আস্তে, অনেকটা শিকার ধরার মতোই চলেছে। ওটা একটা পিস অব অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট হিসাবেই রাখা হয়েছিল, এবং বেশ বড়ই ছিল, ভারীও ছিল মন্দ না, আর নিম কাঠ বলেই বেশ শক্তও ছিল, মোটেই ঘুণ ধরেনি।

.

০৩.

সত্যি ওটা দিয়ে পিটিয়ে মেরেছিলাম নাকি? আপনি এখনও সন্দেহ পোষণ করছেন? না মারলে আপনাকে বলব কেন? কী কথাবার্তা হয়েছিল, কী ঘটেছিল, আর ডেডবডিটা কী করলাম? দাঁড়ান, এতটা ব্যস্ত হবেন না, আপনাকে আমি সবই বলব, সব, ঠিক পর পর আমি আসতে চাই, কারণ আমার স্ত্রীকে।

কী হল মশাই, উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন যে? এখন আমাকে উন্মাদ বলেই মনে হচ্ছে আপনার? কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি তা নই। কী বললেন, আমার স্ত্রীকে খুন করার কথাও আপনাকে বলব নাকি? অর্থাৎ আপনি ভয় পাচ্ছেন। লোকটা স্ত্রীকে মার্ডার করেছে, এরকম অবিশ্বাস্য কথাও আপনাকে বলবে। বসুন, দয়া করে বসুন, আমি জানি, আপনি খুব ভালমানুষ, স্ত্রীকে খুবই ভালবাসেন, পারিবারিক জীবনে, একটু এদিক ওদিক থাকলেও, সেই তখন যা বলছিলেন, আপনার স্ত্রীর পবিত্র মুখ। তবু–সে যাই হোক, আসলে আপনি একটি বেশ ভাল মানুষ। যত যা-ই হোক, খুনটুন আপনার একদম পছন্দ নয়। মশাই, আমারও কি খুব পছন্দ আপনি বলতে চান? আপনি নিতান্ত একটা সংস্কার আর ভয় থেকে রিঅ্যাক্ট করছেন, আমি বুঝতে পারছি, খুন সম্পর্কে আমাদের অধিকাংশ লোকেরই সেরকম মনোভাব, কিন্তু বিশ্বাস করুন, তার মধ্যে একটা জঘন্য যন্ত্রণা আছে। আপনাকে আমি পৃথিবীর সমস্ত খুনিদের হয়ে বলতে পারি, ওর মধ্যে কোনও সুখই নেই, তবে আপনাকে আগেই বলেছি, এখনও বলছি, সমস্ত খুনি বলতে আমি পেশাদার খুনিদের কথা বলছি না, আমি বলছি তাদের কথা, যারা, এই ধরুন, হঠাৎ চলতে চলতে ভাবল, আঃ, সামনে এটা কী? যেন একটা বাধা, একটা অসহ্য কিছু, যেগুলো দেখতে দেখতে ভাবতে ভাবতে, হঠাৎ সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে–কী বললেন? ভাবতেও খারাপ লাগছে আপনার? আমার মনে হয়, আপনি সব শুনলে, আর তেমন খারাপ লাগবে না আপনার। এমনকী, মনে হতে পারে, লোকটার, মানে আমার ইচ্ছের মধ্যে, কোথাও একটা যুক্তি আছে।

কী বললেন, টোটা এবং ল্যাস সম্পর্কে আপনার মনে হয়েছে যে, যেন একটা যুক্তি থাকতে পারে? বসুন বসুন, হ্যাঁ। একটু শান্ত হয়ে বসে আমার কথা শুনুন, আপনাকে কষ্ট দেবার জন্যে বা ভয় দেখাবার জন্যে এ সব কথা আমি বলতে বসিনি, তাতে আমার কোনও লাভ নেই। কিন্তু যে কথা বলছিলাম, খুনের মধ্যে সত্যি কোনও সুখ নেই বরং আপনি তাদের এক রকমের দুঃখী বলতে পারেন, কারণ, সে যা করছে, সেটাকে সে মোটেই সমর্থন করে না, তার ভিতর থেকে সে কিছুই পায় না, কেবল মনের একটা মরুভূমির মতো অবস্থা ছাড়া। হ্যাঁ, আমি শূন্যতার কথাই বলছি, যেটা ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক। এবং আপনাকে আমি সত্যি, সেই অবিশ্বাস্য কথাটাই বলতে চাই, আমি আমার স্ত্রীকে খুন করেছি।…

হ্যাঁ, বলুন? আমার আঙুলের এই ক্যাটস আইটাকে এখন আপনার বাঘের চোখ বলে মনে হচ্ছে? সত্যি, না হেসে পারছি না। মাফ করবেন, কারণ, মশাই বাঘ যখন কাউকে মারে, মানুষ বা পশু, যাই বলুন, তার জন্যে সে তার নিজের প্রবৃত্তি অনুযায়ী অনেক প্ল্যান প্রোগ্রাম করে। গজ ফিতে না থাক, চোখ দিয়ে ঠিক মাপজোক করে নেয়। কোনখান থেকে কোথায় লাফ মারবে, এবং কোনদিকে ছুটবে, ওটা তার খাওয়ার ব্যাপার। আমার তো তা নয়। সুতরাং আমি বাঘ হব কেন? তবে হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, আমার হাতে অনেক রক্ত লেগে আছে, আপনি যা দেখতে পাচ্ছেন না, এবং আমি যে খুন করেছি, তার পিছনে কতগুলো চিন্তা কাজ করেছে।

.

০৪.

কী ভাবে স্ত্রীকে মেরেছি জিজ্ঞেস করছেন? আমার পরিষ্কারই মনে আছে, ওর গলার পাশে আমার হাতের ধার দিয়ে খুব জোরে মেরেছিলাম। আর এক ঘায়েতেই, কী বলব আপনাকে, আমার অমন স্বাস্থ্যবতী এবং প্রতাপশালিনী বউটি ঠিক গোড়াকাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়েছিল, আর ওঠেনি। স্বাস্থ্যবতী বলতে আপনি সার্কাসের কাটখোট্টা মেয়েদের কথা ভাববেন না, একটি স্বাস্থ্যবতী মেয়ে বলতে যা বোঝায়, সে ঠিক তাই ছিল। আপনি যদি তার একটা বর্ণনা চান, তাও আপনাকে আমি দিতে পারি। সে বেশ দীর্ঘাঙ্গীই ছিল, কথাটা একটু বেশি ভাল শোনাচ্ছে হয়তো, কিন্তু সে বেশ মানানসই লম্বা ছিল, যেটা আরও বেশি মনে হত, ওর ছিপছিপে গড়নের জন্যে। রং? তা ফরসাই বলতে হবে, যদিচ, ওই সব সোনার বরন টরন কী সব বলে আমি বুঝি না মশাই, কিংবা আপনাদের ওই শাস্ত্রমতে আকুঞ্চিত কেশিনী, মুখ মণ্ডলাকার, নাভি দক্ষিণাবর্ত, কিংবা দেহকান্তি সুবর্ণের ন্যায়, নেত্রদ্বয় বিশাল, ওষ্ঠ বিম্বফলের ন্যায় রক্তবর্ণ এবং জংঘা ও উরু যুগল রোমশূন্য ও হস্তিশুণ্ডের ন্যায় সুবৃত্ত…! বুঝতে পারছেন আশা করি, আর তার সঙ্গেই নাভি গভীর, ত্রিবলী উদর, স্তন ও হৃদয় রোমশূন্য, ইত্যাদি ইত্যাদি জানিটানি না মশাই।

কী বললেন, মেয়েদের বর্ণনাগুলো বেশ ভালই লাগল আপনার? কোথা থেকে আর জানব মশাই। একটু সংস্কৃত কাব্যটাব্য পড়ার বাতিক হয়েছিল এক সময়ে, যখন নিজের রোমরাজি শরীরে গজাতে আরম্ভ করেছে, তখন ও সব দিকে সকলেরই একটু ঝোঁকটাক যায়–অ্যা, আপনার যায়নি? ইংরেজি পড়েছেন স্রেফ? কিন্তু ওই একটা ব্যাপারে মাফ করবেন, ভারতবর্ষের রসিকেরা অনেক বেশি ডিপ আর ডিটেল, যেটা বহুকাল বোরখা আর হারেমওয়ালা এবং কুইন মৌমাছিদের হাঁটুগেড়ে বসাওয়ালাদের পাল্লায় পড়ে, ধোপার গাধার মতো গোল্লায় চলে গিয়েছে। কিন্তু মনে করবেন না, কথাটা আমি এজন্যেই বললাম, আমরা মেয়েদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আর তেমন জুতসই কথা খুঁজে পাই না।

যাই হোক, আমার স্ত্রী বেশ ফরসাই ছিলেন, গড়ন-পিটনও ভাল ছিল এবং পুরুষেরা যে সব জিনিসগুলো দেখতে চায়, সে সবও ওর শরীরে ভালই ছিল। সেদিক থেকে বলব, আমি বেশ সুখীই ছিলাম, আর সত্যি বলতে কী, আমার ধারণা, সেও বেশ ভালই ছিল। কী বললেন? ইউনিটি? হ্যাঁ, তা বলতে গেলে বলতে হয়, দুজনের মধ্যেই ও ব্যাপারে একটা ইউনিটি অব সাকসেসও ছিল। না না, আপনি যা ভাবছেন, ও সব ব্যাপারে আমাদের মধ্যে কোনও ঝগড়া-বিবাদ দেখা দিয়েছিল, তা মোটেই নয়। দেখুন, সত্যি বলতে কী, আমাদের এই যুগে ওটাকে কি সত্যি আর আমরা সমস্যা বলে মনে করি? আমার তো ধারণা, ও ব্যাপারে সকলেরই একটা মোটামুটি ধারণা হয়ে যায়, নিতান্ত অসুস্থ, শরীরে বা মনে, যেখানেই হোক, তাদের কথা অবিশ্যি আলাদা। অন্যথায় স্বাভাবিক মেয়ে পুরুষ, তাদের পরস্পরের আর্জ থেকে মিট করে। এ ব্যাপারে মানুষকে আমি জীব-জগতের একটা অঙ্গ বলেই মনে করি, আর জীবজগতে ওটা কোনও সমস্যা নয় বলেই আমার ধারণা, বরং মানুষ ব্যাপারটাকে বোধহয় কিছু বেশি সুখ খুঁজতে গিয়ে জটিল করে ফেলেছে। আমার তো সেরকমই মনে হয়, কেননা ওটা তো ভেবে-চিন্তে কিছু তৈরি করার বিষয় নয়, সময়মতো ওটা আপনিই আসে, আপনিই উদয় হয়। প্রথম প্রথম হয়তো কিছু অসুবিধা থাকে। তা শিশুরা কি আর একদিনেই হাঁটতে শেখে। মোটের ওপর, আমি এই মেয়ে পুরুষের ব্যাপারটাকে খুব সহজভাবেই নিতে চাই এবং আমার মনে হয়, ব্যাপারটা সহজ আর স্বাভাবিক। তবে হ্যাঁ–আমাদের ক্ষেত্রে মনের ব্যাপারটা অনেকখানি আছে, তা মানতেই হবে, তাই পছন্দ অপছন্দের বিষয়টা বিশেষ ভাবেই দেখতে হয়, যেটা অনেক সময়েই গোলমাল পাকিয়ে তোলে। তাও আপনি ভেবে দেখবেন, মনের খবরই বা আমরা কতটুকু আর রাখি, অবিশ্যি যদি নিজের মনের মতো মেয়ে ছাড়াও আপনি কখনও কারুর সঙ্গে মিট করে থাকেন, তা হলে নিশ্চয়ই আপনার সে অভিজ্ঞতা আছে। আর মন দেওয়া-নেওয়া, ওটার কথা আমি বাদই দিচ্ছি, কারণ মনের এক্সচেঞ্জে শরীরের এক্সচেঞ্জ, সে তো মশাই, কোথাও দেখি না অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে আমি পরস্পরকে জানবার কথাই বলছি, যাকে মন জানাজানি বলে। আমার তো ধারণা, সত্যি সত্যি মন জানাজানির ব্যাপার থাকলে শরীর জানাজানির ব্যাপার ঘটতেই পেত না, যে কারণে আমরা অনেক সময়েই দেখতে পাই, দশ বছর ঘর করার পর স্বামী-স্ত্রী একদিন দু মেরুতে যাত্রা করল।

কী বললেন, কথাটা আপনি মানতে পারছেন না? না পারার কোনও কারণ নেই, কারণ এটা তো আর আমি আপনাকে তৈরি করে বলছি না, এ তো আমরা চোখেই দেখতে পাচ্ছি। নিজেরাও অনেক সময় এইসব কষ্টের অভিজ্ঞতা ভোগ করছি। কী বললেন? দুই মেরুতে যাত্রা না করে, একই ছাদের তলায়, আর একই বিছানায়, দুজন মেয়ে-পুরুষকে স্বামী-স্ত্রীরূপে সারাজীবন বাস করতে দেখেছেন? আহা, সত্যি আমি খুব দুঃখিত, আপনি আমার কথাই বলছেন? আপনাদের মন জানাজানির কোনও ব্যাপারই নেই? অথচ শয়ন মিলন উৎপাদন সব একটা যান্ত্রিক নিয়মেই চালিয়ে গিয়েছেন? না, অবিশ্যি আমি তা বলতে পারি না, এটাই সাধারণ চেহারা কি না, তবে এ সব জানা বা অনুভব করা খুব কষ্টের। যে কারণে মানুষটার সাধারণত্ব, আমরা যাকে সাধারণ বলি, যদিচ সেই বলাটা ঠিক কিনা, তাও আমি বলতে পারব না, তবে মানুষটার সাধারণত্ব নষ্ট হয়ে যায়। কেননা, আমরা ধরেই নিয়েছি কিনা সাধারণ মানুষ এ সব ভাবতে চায় না, জীবনটা নিয়ে সে কোনওরকমে, যাকে বলে অতিবাহিত করা, তাই করে চলেছে। ও সব ভাবনাগুলো তার ওপরে অনেকটা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো হয়ে উঠতে পারে। কী বললেন, আপনারও তাই হয়েছে? তবে তো মশাই আপনাকে বিষফোঁড়ার যন্ত্রণা ভোগ করতেই হবে।

আপনি যা বলছেন, সেটা তো একটা ফান্ডামেন্টাল বিষয়, তার জন্যে এখন আর আমাদের ডলস হাউসের দ্বারস্থ হতে হয় না, আমরা নিজেরাই সেটা বুঝি, যে কারণে আমার বক্তব্যের বিষয়ে মন জানাজানির ও পর্যায়টা আপাতত আমি বাদই দিতে চাই। আমি মন জানাজানিটাকে পছন্দ অপছন্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই, যেমন আমাদের বিয়ের সম্বন্ধ দেখার সময়, পছন্দের কথাটাই বলা হয়ে থাকে, মনের খোঁজ তারপরে করা যাবে, তখন লাগে তাক, না লাগে তুক! আমি বলতে চাইছিলাম, দুজনকে দুজনের পছন্দ হয়ে গেলে, ভাল লেগে গেলে, যে কারণে মানুষকে মানুষ বলতে হয়, সে জীবজগতের সেরা, কারণ পশুদের মধ্যে এ ব্যাপারটা নেই বলেই আমার ধারণা কী বললেন? আপনারও তাই ধারণা? ধন্যবাদ!…আরে না না মশাই ঠাট্টা করব কেন, আমাকে তো আপনি সমর্থনই করলেন, তবু ধন্যবাদটাকে একটা নিতান্ত ফর্মালিটি হিসাবেই নেবেন, আপনাকে কেন শুধু শুধু ঠাট্টা করব। এ সব কমপ্লেক্স রাখবেন না, তা হলে আমি মন খুলে কথা বলতে পারব না। যাই হোক, মানুষের পছন্দের পরেই, পছন্দের কারণ কিন্তু একটাই, এটা মনে রাখবেন, তারপর সমস্ত ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘটে। দুজনে দুজনের কাছে যা চায়, সেটা আদায় করে নেয়, কিংবা বলতে পারেন, দেয়। এরকম একটা স্বাভাবিক ব্যাপারকে নিয়ে যারা গোলমাল পাকাতে চায়, আমার মনে হয়, তারা নিজেরাই গোলমেলে, মানে তাদের নিজেদেরই কোথাও গোলমাল আছে। তাদের বরং উচিত, গোলমালের মূলটা জানা, অন্যথায় সেকেলে লোকদের মতো যৌন বিষয়ের বই পড়া কিংবা কেস হিস্ট্রি পড়া অথবা পাঁজির বিজ্ঞাপন দেখা বা ওষুধ-বিষুধ খাওয়া, জড়ি বুটি নেওয়া, একেবারে বোগাস!

মশাই, আপনি যেদিকটার কথা আগেই ভেবেছেন, আমার আর দীপার মধ্যে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার স্ত্রীর নাম দীপা, অর্থাৎ দীপ্তি থেকে দীপা, ও ধরনের কোনও গোলমালই ছিল না, ও ব্যাপারে দুজনকেই দুজনের বেশ পছন্দ ছিল এবং সত্যি বলতে কী পুরুষ হিসেবে আমার একটা, কী বলব, গর্বই ছিল। যার থেকে বুঝতেই পারছেন, এ ব্যাপারে দুজনেই বেশ সহজ ছিলাম, কোনও কমপ্লেক্স বা অভিযোগ ছিল না।

কী বললেন, সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছিল কি না? একেবারেই না, ভীষণ প্রেম করে। আমার কথার ভঙ্গিতে হাসি পাচ্ছে আপনার? কিন্তু যদি শোনেন আমাদের বিয়ের ঘটনাটা, তা হলে মশাই আর হাসবেন না। মনে হবে, সত্যি ভীষণ প্রেম করেই বিয়ে হয়েছিল, কারণ কোনও পক্ষই আমাদের বিয়েতে রাজি ছিল না। আমার বাড়ি থেকে নয়, দীপাদের বাড়ি থেকেও নয়। আমার মা তো মুখই খোলেননি, বাবা মুখ খুলে যা বলেছিলেন, সেটা বোধহয় খানিকটা আন্দাজ করতে পারেন–পারেন না? ও, ও ব্যাপারে আপনি বাপ-মায়ের একেবারে অনুগত সুবোধ ছেলে ছিলেন? ভালই তো মশাই, তাতে আপনার গলায় অমন আক্ষেপের সুর বাজছে কেন। আপনার ওই বিষফোঁড়ার যন্ত্রণাটা, যেটা সত্যি, আমার মনে হয়, আপনি অনুভব করেই মরেছেন, প্রেম করে বিয়ে করলেও হতে পারত। আমি প্রেম করে বিয়ে করেও এক ঘায়েতেই তো তাকে খতম করে ফেলেছি। তার থেকে বেশি কিছু তো আপনি করেননি, তবু বরং আপনার একটা কনসোলেশন আছে, বাবা মায়ের অনুগত ছেলে ছিলেন। আর আমার দেখুন তো, কাউকেই খুশি করতে পারিনি। অতএব, আপনি ও ব্যাপারে কোনওরকম আক্ষেপ করবেন না, যদি বুঝতে পারছি, ওই যে বলে, নদীর এপার কহে…আপনারও সেরকম বরাবরই মনে হবে, হয়তো কেউ ছিল, হয়তো যদি নিজে দেখেশুনে, আলাপ করে, মানে আমরা যাকে প্রেম বলি, করতে পারতেন–অ্যাঁ? পারতেন না? কোনও মেয়েরই মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতেন না? তা হলে অবিশ্যি আপনার পক্ষে প্রেম করা একটু অসুবিধা ছিল কিংবা এমন কোনও মেয়ে যদি আসত আপনার জীবনে, যে আপনার বুলি ফুটিয়ে ছাড়ত, তা হলে হতে পারত। তবু আপনাকে আমি বলব, এ ব্যাপারে আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন, আক্ষেপ করবেন না, কারণ ভেবে দেখুন, কোথাও না কোথাও আপনার সারা জীবনে আপনি নিশ্চয় দেখেছেন, সম্বন্ধ করে বিয়ে হওয়া দম্পতিও সত্যি সুখী, অর্থাৎ সুখী বলতে, আন্ডারস্ট্যান্ডিং তাদের একটা হয়েছে, পরস্পরকে তারা বুঝতে পেরেছে, আর সেটাই তাদের মূলধন। দেখেছেন? তবে? তবে আপনি ওরকম আক্ষেপ করতে পারেন না, কারণ প্রেমের ক্ষেত্রেও আমি ওরকম দু-চারটে সফল দম্পতি দেখেছি।

কী বললেন, তা হলে প্রেম করে কী লাভ? লাভ লোকসানের কথাই আনবেন না, বরং ভাবুন, অমুকের প্রেম করে হয়েছে, আর একজনের সম্বন্ধ করে হয়েছে, অভিজ্ঞতা তো দুজনেরই এক হচ্ছে। প্রেম মানে আমরা যাকে প্রেম বলি আর কী! আপনি কত বছর বিয়ে করেছেন? বারো বছর? তার মানে এক যুগ, তার মধ্যেও মশাই প্রেম হল না, আর যারা দু-চার মাস বা বছর প্রেম করে, অর্থাৎ বিয়ের আগে মিশে বিয়ে করেছে, তাদেরই কি নিজেদের চেনবার সুযোগ হয়ে যায়? একদম ও সব বিশ্বাস করবেন না, তাদের ধারণা, তাদের চেনাচেনি হয়ে গিয়েছে, অতএব ভাসিয়ে দাও ভেলা। হায়, সেই ভেলা যে মশাই কোন ঘাটে ভেসে চলল, সেই ভেলাই জানে।

হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি, অবিশ্যি, যে অর্থে আপনাকে ভীষণ প্রেম করে বলেছি, সেরকম অর্থে আপনি আখচার বিয়ে দেখতে পাবেন আপনার আশেপাশে। দীপাকে মায়ের পছন্দ ছিল না, বাবার লেগেছিল ভ্যানিটিতে, বাবাদের যেরকম লেগে থাকে, কারণ শত হলেও তিনি বাবা, আর আমি ছেলে, আর বিয়ের মতো একটা ঘটনা, যা বাবা মায়েরাই ছেলেমেয়েদের দিয়ে থাকেন, সেটা আমি নিজে থেকে মেয়ে পছন্দ করছি, বাবার পক্ষে এটা লাগবারই কথা। কিন্তু বাবা আর ছেলে, এদের সম্পর্কের বিষয়ে বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, কারণ আমাদের ধারণাগুলো সহজে বদলাবার নয়, তবে আমি যে লোকটা, তা সবই যখন নিতান্ত আমার, মানে আমি আমার অস্তিত্বটার কথাই বলছি, তখন বিয়ে আমাকে করতেই হয়েছিল, অর্থাৎ করেছিলাম। দীপাদের বাড়ি থেকেই একটু বাড়াবাড়ি করেছিল, ওরা আমার নামে নানারকম কেস করে দিয়েছিল, যে কারণে আমাকে অন্তত কয়েকদিন হাজত বাস করতে হয়েছিল। অবিশ্যি, টোটাদাদের ঘটনাটা আমি জানাতে চাইনি, আর বিপদের সময়, জানাবার কোনও সুযোগও পাইনি, যদিচ পরে টোটাদাও আপত্তি করেছিল বিয়েতে, কারণ তার ধারণা ছিল, মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে যেখানে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে, সেখানে বিয়েটা সুখের নাও হতে পারে। কিন্তু দীপার বাপের বাড়ি কী করল না করল, তাতে আমার কী যায় আসে? তাদের ব্যবহারের শোধ তুলতে গিয়ে নিশ্চয় আমি দীপাকে কষ্ট দেব না। টোটাদা অনেকটা সেইরকমই ভেবেছিলেন। আমার বিরুদ্ধে কেন কেস করেছিল বলছেন? কারণ আমি দীপাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া আমার অবিশ্যি কোনও উপায়ও ছিল না। ওরকম একটা কিছু না ঘটলে ব্যাপারটা যেখানকার সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকত, অবিশ্যি সে বুদ্ধিটা দীপাই আমাকে দিয়েছিল। সত্যি বলতে কী, বিপদে পড়লে মেয়েদের মতো মাথা ঠাণ্ডা করে পথ বাতলাতে ছেলেরা কোনওদিনই পারে না। আর এত সহজেই ওরা কথাগুলো বলে, কেন নিজের মাথায় আসেনি, ভেবেই অবাক হতে হয়, যদিচ লাভ নেই, কারণ সে একটা বিষয়ের ওপরেই মন রেখেছে, একটা জায়গাতেই প্রায় বসে আছে, ছেলেদের মতো নানানখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই।…

কিন্তু দেখুন, এ সব কথা, এত ঘটনা আমি ঠিক বলতে চাইনি। আমি প্রধানত দীপার খুনের ব্যাপারটাই কী বললেন? আপনি সব শুনতে চান? যাতে আপনি সমস্ত ব্যাপারটা ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারেন? এত কথা না বলেও, আমি তা পারি মনে হয়, অর্থাৎ আসলে যা বলতে চাইছি, তবু যখন আপনার শোনার ইচ্ছে, বলা যাক। তারপর আর কী, তারপরে ওকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে একটা হোটেলে উঠলাম প্রথমে, সেখান থেকে কালীঘাট, যেখানে সব ছেলেমেয়েরাই যায়। যে কারণে, ও ধরনের ছেলেমেয়েরা যায় বলেই, অগত্যা পুলিশকেও যেতে হয়, কারণ জানে, কলকাতার ও ধরনের জুটি আসামিদ্বয় মা কালীর বড় ভক্ত হয়ে পড়ে, সেখানকার পুরোহিতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমাদের ব্যাপারটাও সেই রকমই ঘটেছিল। আমরা গিয়েছি, পুলিশও পিছনে পিছনে, তারপরেই দুটিকে নিয়ে সোজা থানায়। সেখানে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, দীপার বাবা দাদারাও রয়েছেন, কারণ তাঁরাই তো নারীহরণের অভিযোগ করেছিলেন। ওঃ মশাই, ইনস্পেক্টর লোকটির সে কী খারাপ খারাপ কথা, বলে কিনা, ভদ্দরলোকের মেয়েকে ফুসলে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার ফল কী হয়, তোমাকে দেখাচ্ছি রাসকেল।–হ্যাঁ মশাই, রাসকেল তো অনেক ভাল কথা, তার থেকে অনেক খারাপ কথাও বলেছিল, এমনকী, চাবকে তোমার পোঁদের মাফ করবেন স্যার, যা বলেছিল, তাই হুবহু বলে ফেলেছি, কিছু মনে করছেন না তো? আচ্ছা, ছাল তুলে দেব বদমাশ! বলেছিল।

নারী হরণের কেস হয় জানতাম, তা বলে সেখানে যে ও সব কথা হয় তা জানতাম না, কারণ খবরের কাগজে যা লেখা হয়, সে সব তো কোর্টের ঘটনা। থানার ঘটনা হলেও, খারাপ কথা তো আর লিখতে পারে না। এতই লজ্জা করেছিল, দীপার দিকে পর্যন্ত তাকাতে পারিনি। ইনস্পেক্টর অবিশ্যি দীপাকেও অনেক কথা বলেছিল, কিন্তু সেই বলা বা ধমকের মধ্যে, অপত্য স্নেহটি প্রচুর ছিল। আপনি হাসছেন, আমার মশাই তখন কাঁদবার অবস্থা, বলেছিল, তুমি মা লক্ষ্মী মেয়ে, এমন একটা লোফারের সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছ? ছি ছি ছি, এটা তো তোমার আমি ভাল বলতে পারি না।

তবে হ্যাঁ, আমাকে স্বীকার করতে হবে, দীপার গায়ে কথাগুলো বোধহয় লেগেছিল, যে কারণে ও বলে উঠেছিল, ও লোফার কেন, ও ভদ্রঘরের শিক্ষিত ছেলে।

দীপার কথা শুনে আমার তো তখুনি কান্না পেয়ে যায় আর কী, কেননা বুঝতেই পারছেন, যখন মনে হচ্ছিল, চারদিকে শত্রুরা আমাকে ঘিরে রেখেছে, তার মধ্যে মাত্র একজনই আমার সম্পর্কে, যাকে বলে, সহানুভূতিশীল, তার কথা শুনলে তখন সেরকমই মনে হয়, এবং দীপার কাছে, এই একটি মাত্র কথার জন্যেই আমার সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল। নিশ্চয় উচিত ছিল, আর আমি বোধহয় তা থাকতেও চেয়েছিলাম, কিন্তু সে কথা থাক, যা ঘটেছিল, তাই বলি। দীপার কথা শুনে, ওর দাদা তো তখুনি ওকে মারতে যায় আর কী। তুমি চুপ করো, আবার বড় বড় কথা! মুখ নাড়তে লজ্জা করছেনা?

এই বলে ধমকে ধমকে বলব না, খেঁকিয়ে উঠেছিল। আশ্চর্য জানেন, আমি ভেবেছিলাম, দীপা বুঝি লজ্জায় আর ভয়ে কুঁকড়ে যাবে। কিন্তু তা তো যায়-ই নি, বরং বেশ তেজের সঙ্গেই বলে উঠেছিল, না, চুপ করে থাকব না।

কী বলব মশাই আপনাকে, দীপার সেই চেহারাটা মনে করে, এখনই আমার মনে হচ্ছে, ওকে বুকের কাছে নিয়ে আদর করি, ওর সেই তেজের মুখখানি ভরে ভরে চুমো খাই।

কী হল আপনার, আশ্চর্য বলছেন কেন? তার মানে, বুঝেছি, আপনি ভাবছেন, যার প্রতি আমার মনের এই অবস্থা, তাকে কেমন করে হ্যাঁ, বলতে পারেন, এবং এমনকী, সব কথা শোনার পর, আপনি হয়তো আমার ওপর আরও খেপে উঠবেন, যদিচ, আমি আপনার কাছে কোনও সমর্থন আদায়ের কথা ভাবছিই না, মানে আমার খুন করার সমর্থনের কথা বলছি। আপনি তা করবেনই বা কেন। আমি আপনাকে বলছি মাত্র, এবং সমর্থক বা বিচারক, কার যে কে হতে পারে, সে বিষয়েও আমার কোনও ধারণা নেই।

কী বললেন? তারপরে কী ঘটল? হ্যাঁ, তাই বলি, দীপার কথা শুনে ওর দাদা তো আরও খেপে উঠল, আর থানায় দারোগা পুলিশের সামনেই মারতে যায় আর কী। জানি না, এই সব জীবগুলোকে কী বলে, যারা নিজেদের মনে করে, গায়ের জোরে আর নোংরা কথার জোরে সবকিছুই করা যায়, অবিশ্যি সে সবও তাদের কাছে, জানে যাদের হাত-পা অনেকখানি বাঁধা, এবং অনেকটা মনে করে, রক্তের সূত্রেই যা খুশি তাই করা যায়, যদিচ, এদের মনে যদি কান পাতা যেত, তা হলে টের পেতে অসুবিধে হত না, এরা নিজেকে ছাড়া কাউকেই ভালবাসে না, সবসময়েই ভাবছে ভাই-বোনদের মধ্যে কে কতখানি সুখ-সুবিধা আমার থেকে বেশি ভোগ করছে–তারপর এদের বাইরের জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলুন। দেখবেন, জলে ভেজা বেড়ালের থেকেও বেচারিদের অবস্থা কাহিল, যাদের পায়ে এবং হাতে এবং জিভে অনেক আত্মসুখের, হিংস্র প্রতিশোধের চিহ্নই লেগে আছে। কী বললেন, কথাটা ধরতে পারলেন না? আমি বলছি, গায়ের জোরে যারা ছোটদের ওপর হাত চালায়, এবং মুখের ভাষায় একটি আস্ত, কী বলব, পাইখানা বসান।

কিন্তু যাই হোক, গায়ের জোরে, চোখ লাল করে, হুমকে উঠলেও, দারোগা বলেছিল, আপনারা চুপ করুন, আমাকে কথা বলতে দিন।

বলে সে দীপাকে আবার বলেছিল, তোমার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ের মুখে তো এ সব কথা মানায় না মা, ভদ্রলোকের ছেলে হলেই ভদ্রলোক হয় না, লেখাপড়া শিখলেই শিক্ষিত হয় না। যে ঘরের মেয়ে বের করে নিয়ে যায়।

দীপা বলে উঠেছিল, ও বের করে নিয়ে যায়নি, আমি নিজেই গিয়েছিলাম।

এ কথা শুনে ওর দাদা আর একবার হুমকে উঠেছিল, দেখেছেন কত বড় কথা, ওর জিভ আমি সাঁড়াশি দিয়ে।

কথাটা ওকে শেষ করতে দেওয়া হয়নি। একমাত্র তখনই দীপার বাবা, তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, তুমি এ সব বলছ কেন। এ সব বলে তো কোনও লাভ নেই।

আর দারোগাকে দেখলাম, সেও সেইরকমই বলছিল, ঝগড়া বিবাদ করে লাভ নেই, আপনারা মেয়ে নিয়ে চলে যান বাড়িতে, এই কাগজপত্তরগুলো সই করে দিন।দীপাকেও কাগজ দেওয়া হয়েছিল সই করতে, এবং খুবই অদ্ভুত কথা, দীপা সোজা ডিনাই করেছিল, সে কোনও কাগজেই সই করবে না, যা আমার মাথাতেও আসেনি, এবং যে কারণে দারোগা তখন ধমকে উঠে বলেছিল, তা হলে সে দীপাকেও হাজতে পুরে দেবে। দীপা তাতেও অবিচল ছিল, আর শেষ পর্যন্ত ওকে বাবা দাদার সঙ্গে যেতে দেওয়া হয়েছিল। আমাকে হাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জীবনে সেই আমি একবারই হাজতবাস করেছিলাম সাতদিন, আপনি নিশ্চয় সে বিবরণটা শুনতে চান না, যদি পৃথিবীতে অমন নরক কমই দেখা যায়। ময়লা কম্বল, ছারপোকা, দুর্গন্ধ, এ সব তো সবাই জানে, কিন্তু একটা ঘরের মধ্যে অনেক লোক, চোর, পকেটমার, সব রকমই, এবং সকলের একই জিজ্ঞাসা, আমি কী অপরাধে হাজতে, কেউ হয়তো চিবুক নেড়ে পিঠে একটু চাপড়ে দিল, এবং শেষ পর্যন্ত যদি দেখেন কোনও দাগি অপরাধী, হাজতেই যার জীবন কাটে, সে এসে মাঝরাত্রে আপনার গায়েই একটি অপকর্ম করে…কিন্তু সে কথা থাক। আমাকে থানা থেকে জামিন দেওয়া হয়নি, সাতদিন বাদে, কোর্টের উকিলের মারফত জামিন পেয়েছিলাম, আমার জামাইবাবুই উকিল দিয়েছিলেন, যদিচ তাঁর নাকি খুবই মাথা হেঁট হয়েছিল অমন একটি কুলাঙ্গার শ্যালকের জন্যে, এবং অনেকদিন তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেননি, দিদিও না।

কী বললেন, তারপর কী হল? বলছি মশাই, দেখছি, আপনি একটু গল্পখোর আছেন। কী বললেন, সকলেই গল্প শুনতে ভালবাসে? তা ঠিক, আপনাকে আমার বেশ ভাল লাগছে, কেননা, আপনি বেশ স্বাভাবিক মানুষ, কিন্তু আমার কী হয়েছে জানেন, জীবন থেকে গল্প বিদায় নিয়েছে। আগে ছিল, অনেক গল্প ছিল জীবনে, একটা ব্যাপার থেকেই আপনি তা বুঝতে পারছেন, কিন্তু এখন দেখছি, গল্প অনেক আছে, আমি ছাড়াও, অজরে অজস্র গল্প আছে জীবনে, অথচ আমার কয়েকটি কথা বলা ছাড়া, আর বিশেষ কিছু নেই।…তবে সেই সাতকাণ্ড রামায়ণের পরিণতি আপনি তো বুঝতেই পারছেন, বিয়ে আমাদের হয়েছিল। দীপার বাবা, দাদারা, মা, সবাই ওকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছিল, বোধহয় একমাত্র দীপার হাতেই আমাকে ফাঁসাবার চাবিকাঠি ছিল, এবং সেটা যখন সম্ভব হয়নি, তখন ওদের পেছুতে হয়েছিল, অর্থাৎ কেস উইদড্র করতে হয়েছিল, কেননা পুলিশের পক্ষেও ওটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তারপরেও অবিশ্যি অনেক বাধা এসেছিল, বিশেষ করে, ওর দাদারা তো আমাকে মেরেই ঠাণ্ডা করবে ঠিক করেছিল, তবে তার জন্যে যোগ্যতা থাকা দরকার,..খালি গায়ের জোরে তা হয় না, কেননা, আমার টোটাদা ছিল।

কী বললেন, এত খুনই যদি করলাম, তা হলে ওর দাদাকে কেন খুন করলাম না? কিছু মনে করবেন না, কথাটা আপনি ঠিক গল্পপাঠক লোকের মতোই বলেছেন, অর্থাৎ একটা ভিলেন পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ওর দাদার সঙ্গে তো আমাকে বাস করতে হয়নি, কাজ করতে হয়নি, এবং পরস্পরকে জানবার কোনও দরকারও ছিল না, অর্থাৎ ওর দাদার অস্তিত্বের ব্যাপারটা আমার কাছে শূন্য। কেননা, সেই সময়ের কথা বাদ দিলে আমার অস্তিত্বের যে সব সংকট, সংকটই বলতে হবে, ঘটছিল, তার মধ্যে সে কোথাও ছিল না।..যাই হোক, আমাদের বিয়ের জন্যে শেষ পর্যন্ত কেউই এগিয়ে আসেনি, আমার দিক থেকেও না, ওর দিক থেকেও না, আমরা নিজেরাই বিয়ে করেছিলাম। আমি জানি, আমার আত্মীয়দের মধ্যে একটা চিন্তা বরাবরই রয়ে গিয়েছে, যে কারণে তারা আমাকে ক্ষমা করতে পারে না, আমি নাকি পিতৃঘাতী। অর্থাৎ আমার বিয়ের কয়েক মাস পরেই বাবা মারা গিয়েছিলেন, এবং তাদের ধারণা, একমাত্র ছেলের কাছ থেকে আঘাত পেয়েই নাকি তিনি মারা গিয়েছিলেন। কথাটা আমি পুরোপুরি অস্বীকার করব কিনা বুঝতে পারি না, কারণ তিনি মারা গিয়েছিলেন সাতষট্টি বছর বয়সে, আমাকে ঘরে ডেকেও নিয়ে গিয়েছিলেন, দীপার সঙ্গে তাঁর বেশ ভাবও হয়েছিল, যেমন ছেলের বউকে স্নেহ করতে হয়, সে রকমই করতেন। তা ছাড়া আমি সত্যি জানি না, মানুষ যে কেবলই সম্পর্কের কথা তোলে, এবং তার জন্যে যে সব কথা তারা বলে, তার কী মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। ধরুন, আমি বা আমার মন আর সম্পর্ক, এক্ষেত্রে রিলেশনের কথাই বলছি, সত্যি কি তার মধ্যে কোনও যোগাযোগ আছে? তা যদি থাকত, তা হলে আজ আপনাকে ডেকে নিয়ে আমার এত কথা বলতেই হত না।

কী বলছেন? ধরতে পারছেন না কথাটা? আচ্ছা আপনার সঙ্গে আপনার স্ত্রীর সম্পর্ক কী? না, সবাই জানে, আপনিও জানেন, সম্পর্কের দিক থেকে আপনারা স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু সেই সম্পর্কের সঙ্গে এবার আপনি আপনাকে মেলান, আপনার মনকে জিজ্ঞেস করুন, সেখানে আপনাদের যোগাযোগটার স্বরূপ কী। আসলে তিনি এবং আপনি, আপনারা নিজেদের মতো চলতে চাইছেন, কিন্তু রিলেশনের কথা ভেবে, আপনারা একজন আর একজনকে তা করতে দিতে চাইছেন না, অতএব সংঘর্ষ, যাকে বলে অনিবার্য, তাই হয়ে উঠছে। সংঘর্ষ যদি আপনারা এড়িয়ে যেতে চান, তা হলেও নিশ্চয় এরকম দাবি করবেন না, রিলেশন বলতে আমরা যা দাবি করছি, সেগুলো সব টায়টিকে বজায় থাকছে। তা মোটেই নয়, আর রিলেশন বলতে নিশ্চয় এরকম বোঝায় না, পরস্পরের ইচ্ছাগুলোর বাধা স্বরূপ হয়ে উঠবে সেটা, অবিশ্যি ইচ্ছাগুলো নিশ্চয়ই এমন নয় যে, ব্ল্যাকমার্কেটিং-এর ইচ্ছা বা চক্রান্তের ইচ্ছা, ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা, ধর্ষণের ইচ্ছা বা চুরি বা বাটপাড়ির ইচ্ছা। এক্ষেত্রে ইচ্ছাগুলোকে আমি মানুষের মুক্তি আর সার্থকতার ইচ্ছাগুলোর কথাই বলছি।…যাই হোক, আমার বাবার কথাতেই এ সব কথাগুলো এল, এবং আমার আত্মীয়দের পিতৃহন্তা অপবাদটা আমি মানি না। পরাজিত মানুষের বোধহয় একটা স্বভাব আছে, সে যদি আপনাকে কোনওরকমে একটা অপরাধে জড়িয়ে রাখতে পারে, তা হলে সে সবসময়েই নিজের অন্যায়গুলোকে ছোট করে দেখতে পারে, কিংবা তার অন্যায়টা অন্যায়ই নয়।

এবার আপনি বুঝতে পারছেন ভীষণ প্রেম কেন বলছিলাম। অনেক দুর্নাম অপমান হাজতবাস ইত্যাদির পরে বউটি পেয়েছিলাম, আর সেই বউটিকেই কিনা যাকে বলে, প্রায় এক কোপে কী বললেন? না না, এক কোপে বলছি মানে, সত্যি কোপ নয়। হাতের ধার দিয়ে প্রায় কোপ মারার মতোই মেরেছিলাম কিনা, তাই বলছি।

কী আশ্চর্য, বলুন না কী বলতে চাইছেন, এত কিন্তু কিন্তু করছেন কেন? দীপা আমার সঙ্গে কোনওরকম বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল কিনা? না, ও ধরনের কোনও ঘটনা ঠিক হয়নি, তা ছাড়া বিশ্বাসঘাতকতা বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন? অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে ওর কোনও যোগাযোগ ছিল কিনা? আরে মশাই, বুঝেছি বুঝেছি, আপনি যোগাযোগ বলতে কী বোঝাতে চাইছেন, তা আমি ঠিকই বুঝেছি, আপনি বলতে চাইছেন, যাকে বলে পরপুরুষ-গামিনী, দীপা তাই ছিল কিনা। দেখুন, পরপুরুষ গমনটা সব ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা কি না, সেটা একটু ভেবে দেখবেন। এক্ষেত্রে আপনি একটা চুক্তির প্রশ্ন তুলছেন, আমার স্ত্রী বলে তুমি অন্য পুরুষের সঙ্গে কিছু করতে পারবে না, আর এই প্রথাটা সেই পিতৃতান্ত্রিক যুগ থেকেই আমরা বেশ ভোগ করে আসছি। চুক্তিটা আছে বলেই, পরপুরুষের কথাটা এসেছে, আবার ঘুরে ফিরে সেই রিলেশনের প্রশ্নেই আমাদের আসতে হচ্ছে।

হ্যাঁ, এটা ঠিক, দীপার জীবনে পুরুষ একমাত্র আমিই নই, কিন্তু যদি চুক্তির প্রশ্ন তোলেন, তা হলে বলব, সে ব্যাপারে ও একান্তই একনিষ্ঠ, যেমন এইভাবে যদি বলা যায়, আমাদের সেই রূপকথার মতো গাছ! এখন তুমি কার? গাছ বলল, যে আমার ভেতরে, তার। তবে তুমি উড়ে চলে যাও অমুক রাজ্যে। গাছ অমনি উড়তে আরম্ভ করল। কথাটা আপনি বুঝতে পেরেছেন আশা করি?…

আচ্ছা, তার আগে আসুন, আমরা ঠিক করি, দীপার কথা দিয়েই শুরু করে খুনের ঘটনাগুলো একে একে বলা যাক। কারণ দীপাকেই আমি সকলের আগে মেরে ফেলেছি। আশ্চর্য, এখনও আপনার মুখে চমকে ওঠার ভাবটা ফুটে উঠছে। এখন বরং দয়া করে আপনি মনের ও সব ভাবগুলো ত্যাগ করুন, শুনে যান। হ্যাঁ, দীপাকেই আমি আগে মেরেছি, কারণ ওটাই যে আমার তিক্ততম জায়গা, তা নয়। বোধহয়, খুনের ইচ্ছার যে মুহূর্তগুলো আসে, দীপার সামনেই সে মুহূর্তগুলো বেশি এসেছে, সেইজন্যেই প্রথম ঘটনাটা ওর ওপর দিয়েই ঘটেছে। কী বললেন? সিগারেট খেয়ে নেবেন একটা? খেয়ে নিন।

আচ্ছা, এবার আপনাকে বলি, ওই চুক্তির ব্যাপারটাতেই আমার গোলমাল লেগেছিল, আর সেটা লেগেছিল, আমার নিজের একটা ঘটনার ভিতর দিয়েই, আমার একটা প্রেম হয়েছিল। কী, আপনি ওরকম একটা শব্দ করলেন কেন? ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছেন? কী বললেন, আমি প্রেমের কাঁটা সরাবার জন্যে…সত্যি, মাফ করবেন, না হেসে পারছি না, কারণ সব কথাগুলো শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন ঘটনাটা মোটেই তা নয়। আপনার মনটা ঘুরে ফিরে কেবলই একটি নিটোল গল্পের দিকে চলে যাচ্ছে। এতে করে অবিশ্যি আপনার সরলতাই প্রমাণ হচ্ছে না না, সরলতাকে আমি বোকামি মনে করি না। বোকামিটা আলাদা জিনিস। আপনাকে দিয়ে আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি, যে অগণিত মানুষের ভিতর থেকে আপনাকে আমি ডেকে নিয়ে এসেছি, যারা অনেক ঘা খেয়েছে, কিন্তু কানাভাঙা বা টোল খাওয়া কলসির মতোই নিজেকে ভরে রাখতে চাইছে, আঘাতের সাড় বোধ নেই, আপনি সেরকম একজন। আমি একটা কথা কিন্তু বললেই, আপনার ভিতর থেকে আপনার আঘাতগুলো কথা বলে উঠতে চাইছে, আপনার চিন্তাগুলো একটা রূপ নিয়ে ফুটে উঠতে চাইছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, হয়তো আপনাকে আমি কিছু গুরুতর অপরাধের কথাই বলতে বসেছি, তবে তার মধ্যে প্রেমের কাঁটা কাটবার মতো ঘটনা কিছু নেই। কথাগুলো শুনুন, তা হলে বুঝতে পারবেন।

আমার যদি একটা প্রেম না হত কী হয়েছে? প্রেম হয়েছে বলছি কেন? কী বলব তবে, কিরছি বলব? ওই ওখানেই আর একটা গোলমাল আছে আমার। আমার ক্ষেত্রে দেখেছি, ওটা করব বলে কিছু করিনি, ওটা হয়েছে। কিছু করতে হলে কিছু ভাবতে হয়, কারণ করার একটা কর্তা থাকা দরকার, যে ভাবে যে, আমি করব। তা হলে তো, গোলমাল অনেক চুকেই যায়, মানুষ তার কষ্ট থেকেও অনেক বেঁচে যায়। বড় জোর, মানুষের একটা দুঃখ থেকে যায় করতে চেয়েছিলাম, পারলাম না, কিন্তু আবার সে পূর্ণোদ্যমে লাগতে পারে, আর সে ঘটনা তো আখচারই আমরা দেখতে পাচ্ছি। আর এতে অনেক সুবিধেও আছে, ইচ্ছে থাকলে, অনেক করা যায়। কিন্তু যেখানে ইচ্ছার প্রশ্ন নেই, করার প্রশ্ন নেই, ব্যাপারটা হয়ে যায়–সেখানে আপনি কী করবেন? যেমন ধরুন, অভিনয়ের কথা তুলবেন না, আপনি ইচ্ছা করলেই কি কাঁদতে পারেন, এমনকী হাসতেও পারেন? পারেন না। আপনার কান্না এসে যায়, হাসি পেয়ে যায়, ভেবে দেখবেন, সে ক্ষেত্রেও আপনি অনেকটা অসহায়। আমার বক্তব্য হল, প্রেম ব্যাপারটা একটা অসহায়তা, কোনও মেয়ে বা পুরুষের, যারই হোক, ভীষণ অসহায়তা, কারণ ওটা হয়, ওটা করা যায় না। তা যদি না হত, তা হলে সংসারে অনেক ট্র্যাজেডিই ঘটত না। যদি বলেন, এর ভূরি ভূরি প্রমাণ আপনাকে আমি দিয়ে দিতে পারি, এমনকী, যাঁদের আপনারা মানুষের অন্তর্যামীর মতো সাহিত্যিক মনে করছেন, তাঁদের লেখা থেকেও তুলে দিতে পারি, বাস্তব জীবনে তার থেকেও ঢের বেশি।

কী বললেন, আপনি মানছেন আমার কথা, সত্যি অসহায়তা বলে মনে হচ্ছে আপনার?…কিন্তু, কিন্তু আপনি মুখখানি ওরকম গম্ভীর করছেন কেন? একী, আপনার মুখে এত অন্ধকার কেন, এত কষ্ট কেন? ওঃ বুঝেছি, আপনার চোখে, আপনার স্ত্রীর সেই ডাগর চোখ, সুন্দর নিষ্পাপ পবিত্র মুখখানি ভেসে উঠছে, যাঁর সঙ্গে আপনার হয়েছে, আপনি করেননি অথচ তিনি, দিন, আপনার হাতটা আমাকে দিন, চোখ শুকনো রাখুন। আমি বুঝেছি, আপনি অসহায়, তবু চোখ শুকনো রাখুন, এবং আমার বলবার যোগ্যতা হয়তো নেই, তবু বলছি, আপনার স্ত্রীর কথাটাও একটু ভাববেন, ওদিকেও হয়তো সমান অসহায়তাই কোথাও থাকতে পারে, যদিচ এ কথা আমি বলব না, আপনার অসহায়তা তাতে বিন্দুমাত্র কমে, কারণ আপনার কষ্টটা আপনারই, এবং তাঁরটা তাঁরই। নইলে মশাই, নিজের কাছে নিজের কী আর দায় কেঁদে যায়। দিব্যি ভাল মানুষ, খাচ্ছি-দাচ্ছি, দু পয়সা রোজগার-টোজগার করছি, সন্তান মানুষ করছি, তার মধ্যে কে ঝাটে পড়তে চায়। কিন্তু মুশকিল হল এই, জীবনটাই একটা ঝাট বলে আমার ধারণা, সে কখনও ঠিক মরা গাঙের মতো একেবারে অনড় নিশ্চল, রোদের দিকে মুখ করে চিত হয়ে পড়ে থাকতে পারে না, বহুতর ঝঞ্ঝাট সেখানে থাকবেই। আপনাকে চুপচাপ পড়ে থাকতে দেবে না।

অতএব আপনি বুঝতে পারছেন, কেন প্রেম হয়েছিল বলছিলাম? কী বলছেন, হয়েছিল কেন বলছি, এখনও নেই কিনা? আমার তো বিশ্বাস, আছে, যদি প্রেমিকাটি আর বেঁচে নেই জেনেও, প্রেম থাকাটাকে আপনি বিশ্বাস করেন, কারণ–ভয় পাচ্ছেন, না? আমি আবার সেই একটা কথাই, এক্ষেত্রেও বলব কিনা। কিন্তু কী করব বলুন, যা সত্যি বলব বলে মনে করেছি, তা আমাকে বলতেই হবে, হ্যাঁ, প্রেমিকার রক্তও এই হাতে আছে।

.

০৫.

আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন, কিন্তু বিরক্ত হচ্ছেন, আমার ওপরে আপনার এবার একটা রাগ আর ঘৃণা ফুটে উঠছে, না? আপনি তা না করে পারছেন না? তবু আপনাকে আমি অনুরোধ করব, আপনি একটু শুনুন। জানি ইতিমধ্যেই আপনি আমাকে একটা লোমহর্ষক কাহিনীর নায়ক ভেবে, যাকে বলে ক্ষমাহীন হয়ে উঠেছেন, তবু দয়া করে শুনুন।

কিন্তু আমাদের কথা হয়েছিল, দীপার কথা দিয়েই শুরু করব, তারপরে একটার পর একটা বলে যাব। আপনাকে আমি বলেছিলাম, চুক্তিটাই আমার মনে গোলমাল পাকিয়েছে, আর এ কথাও বলেছি, কুঁড়ির সঙ্গে কুঁড়ি আমার প্রেমিকার নামকুঁড়ির সঙ্গে প্রেম হওয়ার পরেই, প্রথম চুক্তির প্রশ্নটা একটা কাঁটার মতো আমার মাথায় বিধল। কারণ বুঝতেই পারছেন, প্রেম হওয়ার পরে প্রথমেই আমার মনে হল, এটা কেন হচ্ছে, এটা তো দীপার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হচ্ছে, আমরা বিবাহের দ্বারা পরস্পর চুক্তিবদ্ধ, অথচ–এটা হবে কেন। তার মানে এই নয় যে, এ কথা মনে হয়েছিল বলেই আমি হওয়ার হাত থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলাম, কারণ হওয়াটার থেকে ফিরে আসা যায় না, করাটার হাত থেকে ফিরে আসা যায়। আসলে নিজের মধ্যে কোনও সংকট দেখা না দিলে, অপরেরটা বোঝা যায় না।

দীপার একটা অহংকার ছিল, ও নিজে সেটাকে গর্বের বিষয় বলে বারে বারে বলত বলেই অহংকারের কথাটা বলছি, একটা অহংকার ছিল যে, ও আমার প্রতি অত্যন্ত একনিষ্ঠ। সুযোগ পেলেই, ধরুন মেয়ে-পুরুষের নীতিজ্ঞান, কিংবা কোনও স্বামী-স্ত্রীর কথায়, যে কোনও কারণেই ওই ধরনের কথা উঠলেই, দীপা ওই কথাটা বলত। বিয়ের প্রথম অবস্থায়, কথাটা তেমন কানে লাগত না, বরং বলা ভাল, ভালই লাগত। কথায় কথায় দ্বিচারিণীদের সমালোচনা করত, অর্থাৎ যারা স্বামী ছাড়া অন্য কারুর প্রতি আসক্ত হয়েছে, বা কোনও প্রেমিকা তার প্রেমিকাকে ত্যাগ করেছে, তাদের সম্পর্কে ওর খুব বিতৃষ্ণা দেখা যেত, যে কারণে এক এক সময় মনে হত, আমার মা কিংবা ওর মা, তাঁদের মতোই ও কথা বলত। এমনকী, ওর এক ছোট ভাই, একটি মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিল, এইমাত্র কয়েকমাস আগের কথা বলছি, দেখলাম, দীপার ভীষণ আপত্তি। আমাদের বিয়ের বছরখানেক পরেই, ওর বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল, অতএব ওর যাতায়াত ছিল, এবং বাপের বাড়ির পারিবারিক ব্যাপারে, ওর মতামত চাওয়া হত। ওর ছোট ভাইয়ের প্রেমিকাটির কয়েকটি দোষের মধ্যে, সে কলোনির মেয়ে, অর্থাৎ রেফিউজি, দ্বিতীয়, মেয়েটি দীপার বাপের বাড়ির সম্পর্কে খুব একটা আহামরি ভাব পোষণ করত না, তৃতীয়, মেয়েটির অতীতে হয়তো কোনও ঘটনা ছিল, যে কারণে কলোনিতে তার নামে একটু দুর্নাম ছিল। আমি দেখেছিলাম, দীপার মা দাদারা, তখন ওর বাবা মারা গিয়েছেন, এবং দীপা, সবাই একমত হয়েছিল, একজোট হয়েছিল, ওই মেয়ের সঙ্গে কিছুতেই ছোট ভাইয়ের বিয়ে হতে পারে না। যদিচ ওর ছোট ভাই বা সেই মেয়েটি, তারা দুজনেই অ্যাডাল্ট, তাদের বাধা দেবার কোনও উপায়ই ছিল না, বিশেষত তাদের কারুরই যখন আগে কোনও বিয়ের ব্যাপার ছিল না। কিন্তু আমি সে কথা ভাবছিলাম না, আমি শুনছিলাম দীপার ভাষাগুলো, ছি, একটা কোথাকার কোন বাজে মেয়ে। সংসারে কি মেয়ের অভাব আছে? মেয়েটার তো আগেও কী সব ঘটেছে, লোকে কী বলবে? ও সব প্রেম না হাতি। ইত্যাদি ইত্যাদি, তা ছাড়া বংশ বা পারিবারিক মর্যাদার কথা তো ছিলই, এবং মেয়েটির রূপের সমালোচনা বিশেষভাবেই করা হত, দীপা আর ওর মা, একই ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলেছিল, যে কারণে অবাক না হয়ে পারিনি, কারণ এই দীপার সঙ্গে, সেই পুরনো দীপা, যে আমাকে বিয়ে করেছিল, মেলাতে পারছিলাম না। নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, আমি ওর ঘোট ভাইকে সে বিয়েতে সমর্থন করায়, ও আমার ওপর রেগে গিয়েছিল, এবং পুরুষদের যে মেয়েদের সম্পর্কে কোনও বাছবিচার বা রুচিবোধ নেই, এটা শুনিয়ে দিয়েছিল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার আমি সে কথাতেই আসছি, মনে করিয়ে দিয়ে ভালই করেছেন–না না, কিছুই মনে করছি না, আমি নিজেই তো আপনাকে বলছিলাম, দীপার জীবনে আমি একমাত্র পুরুষ নই, আমার সঙ্গে বিয়ের আগেই ওর জীবনে ঘটনা ছিল, যদিচ ও সেটাকে অ্যাকসিডেন্ট বলে, প্রেমের অ্যাকসিডেন্ট হাসছেন কেন মশাই, তাও ঘটতে পারে মানুষের জীবনে, আমরা যাকে ভুল বলে আসছি এতকাল, জীবনে একটা ভুল করেছিল মেয়েটি এরকম বলে থাকি, যার অর্থ, অ্যাকসিডেন্ট, অ্যাকসিডেন্টাল। কিন্তু দীপার কথা থেকেই আমি জানতে পেরেছিলাম কী বললেন? দীপা নিজেই আমাকে সব কথা বলেছিল কিনা? হ্যাঁ, দীপা নিজেই আমাকে সব কথা বলেছিল, যদিচ আমি মোট ঘটনা প্রায় সবই জানতাম যে, ওর সঙ্গে নবনী–মানে ওর সেই আগের পুরুষটির, মাফ করবেন পুরুষ বলাতে কথাটা হয়তো কানে একটু ভালগার লাগে, মানে যাই হোক, নবনীর সঙ্গে ওর প্রেম আছে। না না, আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, নবনীকে আমি ভাল করে চিনিই না, এখনও না, সে অনেকদিনই বাংলাদেশ-ছাড়া, বম্বে না আমেদাবাদ কোথায় আছে শুনতে পাই, এবং ছেলেপিলে নিয়ে মোটামুটি নাকি ভালই আছে, তার সঙ্গে আমার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নেই, কারণ রাইভালরির কোনও সুযোগই ছিল না, কারণ দীপার নবনী পর্বটা তখন বলতে গেলে একেবারে চুকেই গিয়েছে। যদিচ চোকার পালা আর বুকের খেলা, একেবারেই আলাদা ব্যাপার। আমার সঙ্গে যখন দীপার পরিচয়,নবনীর সঙ্গে তখনই ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে, মানে বিয়েই হয়ে গিয়েছিল নবনীর, তবু ওই দৈবের কথাটাই বলছি যে, ওটা যে দৈব নয়, সেটা দীপার কথাতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম এবং সেদিক থেকে সত্যি বলতে কী, দীপা আমাকে প্রায় কোনও কথা গোপন না করেই সব কথা বলেছিল, যে কারণে ওটাও ওর একটা প্রতি পদে পদেই অহংকার ছিল। মিথ্যা কথাকে আমি ঘৃণা করি!না, এত বড় সাহস আমি আমার সারা জীবনেই কখনও করিনি যে, মিথ্যা কথাকে ঘৃণা করি, অতএব কোনওদিনই বলি না। আমার যে সত্যি বলার সাহস কত কম, আপনি পরে বুঝতে পারবেন, যখন আমার কথা শেষ হবে।

কী বললেন? না, না, আবার সেই একটা তথাকথিত মনস্তাত্ত্বিক গল্পের স্রোতে আপনার পা পড়ছে, নবনীর কথা ভেবেই, আমি ওকে খুন করিনি, যদিচ আমি জানি না, শেষ পর্যন্ত আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব কিনা, তবু কথাটা হচ্ছে, নবনীর কথাটা মোটামুটি তো আমার জানাই ছিল। প্রথমটায় অবিশ্যি জানতাম, ওটা একটা ভুল, ভুল হয়ে গিয়েছে, জানি না, এটা কোন পক্ষের সান্ত্বনা, স্বামীর না স্ত্রীর, কিংবা কোনও পক্ষেরই ওটা সান্ত্বনা হতে পারে কিনা, তবে কথাটা সান্ত্বনামূলক। এ সব ব্যাপারে পুরুষদের কোথাও একটা কমপ্লেক্স থাকে, বিশেষ করে মেয়ে-পুরুষ পরস্পরের ব্যাপারে, পুরুষের প্রকৃতির মধ্যেই একটা সংশয় থেকে যায়, যে সংশয়টা তার নিজেকে নিয়েই, এবং সেটা খুব স্বাভাবিক, প্রায় স্বাস্থ্যকর সংশয়ই বলা যায় তার দিক থেকে, কারণ ওটা তাকে স্বার্থপর হতে দিতে চায় না, দেহের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হবার জন্যে সে আর একটু বুদ্ধি এবং শ্রম খরচ করতে রাজি হয়। অবিশ্যি জানি না, এটাকেই কেউ আবার প্রেম বলতে চায় কিনা, তবে আপনার রুচিকে যদি আমি অশুচি না করি, আমার এক বন্ধুর কথা বলতে পারি, সে নগদ বিদায়ি স্বামীর মতো স্ত্রীলোকদের কাছে যাতায়াত করে বুঝতে পারলেন না? অর্থাৎ ব্রথেলে যাতায়াতের অভ্যাস আছে, এবং বেশ্যাটিকে সে খুশি করতে পেরেছে কি না, সেটাও সে না জিজ্ঞেস করে পারে না, যার মানে দাঁড়ায়, ওটা শ্রমের থেকে কমপ্লেক্সই বেশি, কিংবা কে জানে পারভারশন বলবেন কিনা।

কিন্তু এ বিষয়টাকে আমার এতদূর টানবার কোনও কারণ নেই, আমি বলতে চাইছি, নিশ্চয়ই এ কমপ্লেক্স নিয়ে পুরুষ দিনরাত্রি ভেবে ভেবে মরছে না, তথাপি রোজের মাসের বা বছরের জীবনে, কখনও কখনও তা জেগে ওঠে বইকী।…আপনি কিন্তু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন, আপনার নিজের ভাবনায় চলে যাচ্ছেন। যাবেন না, ওটা একটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু স্বামীর বা স্ত্রীর যদি প্রাকপর্ব কিছু থাকে, তা হলে মাঝে মধ্যে কথাটা হেসে বা ইয়ার্কি করেই উঠে পড়তে পারে এবং যেভাবেই নবনীর কথা আমার আর দীপার মাঝখানে উঠে পড়লে ও অশান্তি বোধ করত। শুধু তাই নয়। নবনীর বিরুদ্ধে হঠাৎ যদি কোনও কথা বলে ফেলতাম, এবং সেটা দীপার দিক থেকেই, আর তা জীবনে দু-একবারই হয়তো, বিদ্রূপ করেই নবনীকে পলাতক বা দীপার প্রতি অন্যায় করেছে এরকম বলেছি, তাতে ও খুব বিরক্ত হত এবং বলত, নবনী পালায়নি, আমিই নবনীকে যেতে দিয়েছিলাম। ওর উপায় ছিল না, কারণ যে মেয়েটিকে ও বিয়ে করেছে, তার জন্ম সময় থেকেই নবনীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। নবনীকে যদি আমি না ছেড়ে দিতাম, তা হলে সেই মেয়েটিকে আত্মহত্যা করতে হত।

এটা একটা মস্ত বড় উদারতা সন্দেহ নেই, যদিচ এ বিষয়ে আপনাকে আমি কোনও সাক্ষ্যই দিতে পারব না, দীপা সে উদারতা না দেখালেও নবনী ওকে ছেড়ে যেত কিনা! কিংবা ধরুন, দীপা বলত, নবনী কোনও অন্যায় ব্যবহার আমার সঙ্গে করেনি। সে রকম মিথ্যে কথা আমি ওর বিষয়ে বলতে পারি না। আমারই ভুল হয়েছিল।

অবিশ্যিই, এইসব কথাগুলোর সঙ্গে আমি কোনও অ্যাটাচমেন্ট আবিষ্কার করতে যাইনি, বরং এরকম ক্ষেত্রে সূর্যের এবং গাছের যে একটা ডিটাচমেন্ট থাকে, তাই ছিল, কিন্তু এই কথাগুলো থেকে একটা কথা আপনি নিশ্চয় পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, দীপার সঙ্গে নবনীর হয়েছিল। করা নয়, ওটা হওয়া হয়তো নবনীরও সেটাই হওয়া, আমি ঠিক জানি না, কারণ একমাত্র হওয়ার মধ্যে দিয়েই ক্ষমা এবং উদারতা আসে।

কী বললেন? দীপার বাড়িতে নবনীর বিষয় জানত কিনা? জানত নিশ্চয়ই এবং হয়তো ব্যাপারটা অনেকদিন গোপন ছিল, এবং যখন জানাজানি হয়, তখন ওদের ছাড়াছাড়িও আসন্ন হয়ে উঠেছিল, আসলে ও পর্বটার ডিটেল খবর এর বেশি আমি বলতে পারি না।…তবে আমার দিক থেকে তাঁদের এত আপত্তি ছিল কেন জিজ্ঞেস করছেন? এ তো আপনি খুব অদ্ভুত কথা বললেন মশাই মেয়ের জীবনে ঘটনা আছে বলেই তাদের অপছন্দ পাত্রকেও মেয়ে দিতে হবে নাকি? প্রথমত প্রেম করাটাই তো একটা মস্ত অবাধ্যতা, দ্বিতীয়ত প্রেম করলেই বিয়ে দিতে হবে নাকি? তৃতীয়ত তুমি যা বলবে তাই, কেন সংসার সমাজ পরিবার অভিভাবক কি নেই?

কিন্তু সে বিষয়ে আমার কিছু বলবার নেই, যেটা বলবার সেটা দীপার জীবনের একমাত্র ভালবাসাকে কেন্দ্র করেই আমি তাকে খুন করেছি, এরকম ভাবনা আপনি রাখবেন না। বরং আপনাকে আমি সত্যি বলছি, আমাদের বিয়ের দু-এক বছরের মধ্যে, দু-একবারই নবনীর কথা হয়েছে, এবং যখন থেকে বিষয়টা আমার বোধগম্য হয়েছে, তখন থেকে আমি আর ও বিষয়ে কিছু বলতে চাইনি। তবে আপনাকে আমি আগেই একটা কথা বলেছি, এ সমস্ত চিন্তাই আমার মধ্যে তখন থেকেই বেশি জট পাকায়, যখন কুঁড়ির সঙ্গে আমার প্রেম হয়, আর এই হওয়ার সূত্রেই আমার দৃষ্টিতে কিছু কিছু অচেনা দিগন্ত ধরা পড়ে এবং সেই প্রথম আমার মাথার মধ্যে অনেকটা ছুঁচোলো মাকুর মতো অনবরত চলাফেরা করত, চুক্তি একনিষ্ঠতা, চুক্তি-একনিষ্ঠতা, চুক্তি-একনিষ্ঠতা! আর এ সবগুলো আমি যখন গর্বিত গলায় শুনতাম, তার সঙ্গে পরের সমালোচনা এবং নিজেকে সবসময়েই উঁচু গলায় হিন্দু নারীর মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা, তখন আমার হাতের পেশিগুলো সত্যি সত্যি একটা রক্তের তৃষ্ণায় কিলবিলিয়ে উঠত। তা ছাড়া আমার আর একটা গোলমাল ছিল, আমার নিজেকে দিয়েই কয়েকটা ব্যাপার এমন জঘন্যভাবে, হ্যাঁ, তাকে আমি জঘন্যই বলতে চাই, কারণ ওটা একটা বিশ্রী দুঃখের ব্যাপার যে, আপনি যদি একটি মেয়ের সঙ্গে মেশেন ও কথা বলেন, তা হলে আপনি তাকে শ্রদ্ধা করছেন, না ভক্তি করছেন, না মুগ্ধ হচ্ছেন, না পেতেই চাইছেন, আমি সেটা অনেকখানি বুঝতে পারি, আর সত্যি বলতে কী, মানুষের এ সব ভাবনা-চিন্তাগুলো ভেবে আসে না, আপনিই এসে পড়ে, এবং মনের দিক থেকে এ সব ব্যাপারকে আমি খুব স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছি, কারণ ও সব আমি অপরের মধ্যে দেখবার আগে নিজের মধ্যেই দেখতে পেয়েছি। আমি আর ঘটনার সংখ্যা বাড়াতে চাই না, তবে ওই হওয়ার সূত্রে আমার এই বিচ্ছিরি দেখতে পাওয়ার চোখ দুটো থেকে দীপাও বাদ যায়নি, যে কারণে, তাকে যদি আর দশটি স্বাভাবিক মানবীই ভাবা যায়, তা হলে ক্ষতি কী, কিন্তু চুক্তির সেই অহংকার, গাছ তুমি কার…এবং একনিষ্ঠতা, এবং সেইটি হল নাকি ভালবাসা, চুক্তি+একনিষ্ঠতা=ভালবাসা, এবং এবার আড়ালের মানুষটির কথা ভাবুন, এবং আর একবার, চুক্তি+একনিষ্ঠতা-ভালবাসা এবং তারপরেই একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে একদিন আমার অজান্তেই এই রক্তপিপাসু হাত উঠে গেল, আমাদের পরিচিত একটি দম্পতির মধ্যে বিবাদে স্ত্রীটি স্বামীকে ত্যাগ করে গেল, কারণ স্ত্রীটির একটি মাত্রই যুক্তি ছিল, সে তার স্বামীর প্রতি কোনও ভালবাসা বোধ করছেনা, এবং সম্ভবত আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, একমাত্র এই যুক্তিতে স্বামী ত্যাগ করা মেয়েদের পক্ষে কত কঠিন, তবু ব্যাপারটা ঘটেছিল এবং দীপা সেই মহিলাটির সমালোচনা করায় আমাদের মধ্যে এই রকম কথা হয়েছিল:

দীপা: এটা অনাচার।

আমি: আমার তা মনে হয় না!

দীপা: হওয়া উচিত। আজ তোমার এখানে ভালবাসা আছে বলে মনে হচ্ছে না, কাল তোমার আর এক জায়গায়ও তাই মনে হবে, তার মানে তুমি কেবলই ভালবাসা খুঁজে বেড়াবে?

আমি: ভালবাসার এরকম কোনও পেশাদারি ব্যাপার ঘটতে পারে না।

দীপা: তবে এটা কী?

আমি: খুবই সরল, মহিলাটি নিজের মধ্যে ভালবাসার অভাব বোধ করেছিলেন।

 দীপা: কেন?

এ কথা বলার সময় দীপা ওর স্বভাব অনুযায়ী চিৎকার করেছিল।

আমি: এ কথার কোনও জবাব হয় না।

দীপা: কিন্তু আমরা তার জবাব চাইব।

দীপার মুখে একটা নিষ্ঠুরতা দেখা দিয়েছিল, আমার চোখও লাল হয়ে উঠেছিল বলে আমার ধারণা, এবং আমার গলার স্বর ক্রমেই নীচে–অনেক নীচে-যেন একটা গর্তের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল, শোনাচ্ছিল বিশ্রী মোটা।

আমি: তা হলে এই বলতে হয়, একজনের মধ্যে ভালবাসা না থাকলে, আর একজন অভাব বোধ করে।

দীপা: প্রমাণ?

আমি: কথাটা তিনি বলতে পেরেছিলেন।

দীপা: আরও পুরুষের সঙ্গ পাবার লোভে নয় কেন?

আমি: মানুষকে স্বাভাবিক বলে বিশ্বাস করাই উচিত।

দীপা: করব না, এটা ইতরামি, নোংরামি।

আমি: মহিলাটির তিনটি সন্তান, স্বামী বিত্তবান—

দীপা: ও সব চালাকি ছাড়ো, আমি এদের চিনি।

আমি: জানি।

আর যে মুহূর্তে আমি জানি কথাটা উচ্চারণ করলাম, সেই মুহূর্তেই আমার হাত উঠল এবং ওকে আঘাত করল, আর লুটিয়ে পড়ে, ঘাড় এলিয়ে শেষ হয়ে গেল।…

কী হল, আপনি অমন চোখ দুটো বড় করে তাকিয়ে আছেন কেন? কী বললেন, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল আপনার? আপনাকে খুবই কষ্ট দিচ্ছি আমি, তবু নিরুপায়, আমি সব কথাই আপনাকে বলতে চাই। কী বললেন, দীপা কুঁড়ির বিষয় জানত কি না? সম্ভবত জানত না, আর জানলেও তার সঙ্গে আপনি এটাকে মেলাবার চেষ্টা করবেন না, কারণ আপনাকে আগেই বলেছি, ব্যাপারটাকে কাঁটামুক্ত হওয়ার চোখে দেখবেন না। ঠিক ওভাবে কাঁটামুক্ত হবার চেষ্টায় যে আমি প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে মারিনি, তা বুঝতেই পারছেন, কারণ তারপরে আমি ব্যাপারটা যতই ভেবেছি, ততই নিজের হাতটাকে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছি, ঘেঁচে ছিঁড়ে দিতে চেয়েছি, অথচ সেই হাত কুঁড়িকেও–কিন্তু তার আগে ল্যাস মানে আমার ব–এর কথাই হোক। কারণ তারপরে আমি লাল শাহকেই মেরেছিলাম। সেই নিম ডালের অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের টুকরোটা দিয়ে,–যেটাকে দেখলে অনেকটা নেকড়ের মতোই মনে হয় আমার, অথচ রঙের দিক থেকে কৃমির মতো।

কী বললেন, দীপার পরেই ল্যাস-কে কেন? তা ঠিক বলতে পারি না, হতে পারে, যাদের নিয়ে দিন এবং রাত্রির সবথেকে বেশি সময়টা কাটাতে হত, এরা তারাই এবং এদের সঙ্গেই ভিতরে ভিতরে বিরোধটার বেশি মুখোমুখি হতে হত, সেই জন্যে। দীপা যেমন আমার সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তই ছিল, ল্যাসও তাই। কী ধরনের জিজ্ঞেস করছেন? যেমন নিশ্চিন্ত থাকতে হয়, নিজের অনুগত সম্পর্কে মানুষ নিশ্চিন্ত থাকে, সেইরকমই। আপনি যখনই কারুর সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে যান, তখন সে আর আপনার মস্তিষ্কে তেমন ক্রিয়া করে না, আপনি নিজে যেমন তার কাছে যান্ত্রিক হয়ে ওঠেন, তাকেও সেই রকমই যন্ত্র ভাবতে শুরু করেন। সকালবেলার প্রথম বেড-টি থেকে শুরু করে, রাত্রে পাশ ফেরার আগে শেষ চুমোটি পর্যন্ত, এমনভাবেই সব কিছু বেঁধে ফেলেছেন যে, বরং তাতে কোনও ব্যতিক্রম ঘটলেই ভুরু কুঁচকে যায়, বোধহয় যান্ত্রিকতার এটাই বিপদ, কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন, এই নিশ্চিন্ত হওয়ার অন্য দিকে আপনি যেখানে খুবই ক্রিয়াশীল, আর একজনেরও ঠিক সেই রকমই ঘটবে।

কথাটা ঠিক ধরতে পারলেন না? আচ্ছা, যদি কথাটা আপনাকে এভাবে বলি, ধরুন দীপা ভাবছে, ও মানে আমি আসবে, চা দিতে হবে, বাথরুমে যাবে, বেরিয়ে এলে কয়েকটা কথা হবে বা বাইরে যাওয়া হতে পারে, বেড়ানো হতে পারে। লোকজন দেখে একটু কথা বলাবলি, একটু হাসা, এমনকী ফাজলামি ইয়ার্কি করতে করতে এক-আধটা খারাপ কথা। কী যে অসভ্য না তুমি ইত্যাদি, তারপরে, খাওয়া, শোয়া…ঝগড়াও হতে পারে কোনও বিষয়ে! এগুলো যান্ত্রিক মানুষ করছে, এর আড়ালে আর একটা মানুষ থেকে যাচ্ছে আর একজন দীপা, সেখানে তার অন্য চেহারা। এই রকম ভাবেই, ল্যাস-এর কাছে আমি একটা যন্ত্র, অনেকটা ক্রীতদাসের মতো হয়ে পড়েছিলাম, আমাকে নিয়ে সে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়েছিল, এবং নিশ্চিন্ত হওয়ার আর একটা দোষ, সে নিজের মর্জিটাকেই একমাত্র দাম দেয়, যেন অপরের সবকিছুই তার জানা হয়ে গিয়েছে যে, সে কী, সে কী চায়।

আপনি এরকম করে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কি আপনাকে ব্যাপারটা বোঝাতে পারিনি? কী বললেন, বুঝতে চেষ্টা করছেন? যেন বুঝেও উঠতে পারছেন না? কেন মশাই, আমি তো খুব সোজা কথাই বলছি। আমি বলছি, আপনি যদি আমাকে একটা বিশেষ মাপের নাট ভাবতে আরম্ভ করেন, তা হলে একটা বিশেষ মাপের বোলটের সঙ্গেই আমাকে জুড়ে দেবার কথা চিন্তা করবেন, যন্ত্র নিয়ে এই ভাবনাটাই স্বাভাবিক, নয় কি? আর যান্ত্রিকতায় নিয়ম হচ্ছে, তাতেই আপনি নিশ্চিন্ত। যার অর্থ হল, আমরা যান্ত্রিক হতে পারলেই নিশ্চিন্ত, কিন্তু তার ফলে যে অঘটনগুলো ঘটে বা ঘটতে পারে, সে সম্পর্কে আমাদের মোটেই খেয়াল থাকে না। যেমন ধরুন না কেন, একটা ছোট ছেলে বা মেয়ে, আপনার বাবী বা বুবনি কী বললেন, আপনার বাচ্চাদের নাম সুসি আর ল্যাসি? চমৎকার! ধরুন সুসি ল্যাসিকে আপনি একটা মোটামুটি ধারণা নিয়ে পালন করতে লাগলেন, ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে আপনার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে বলেই জানেন, আপনি নিশ্চিন্ত, তারপরে দেখলেন সুসি ল্যাসিকে আপনি যা ভেবেছিলেন, ওরা তার উলটো কিছু হয়েছে! কী বললেন, বুঝতে পেরেছেন? হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ঠিক তাই বলতে চেয়েছি, আমাদের নিশ্চিন্ত হওয়ার পিছনে একটা, স্বার্থের সুখ লুকিয়ে থাকে, যাকে আমরা ঠিক চিনি না!

আপনাকে আমি আগেই বলেছি, ল্যাস আমাকে দিয়ে এমন কতগুলো কাজ করাত, যেগুলো রীতিমতো বিপজ্জনক, কিন্তু সে জানত, আমি তা ঠিকই করে যাব। তাকে ফাঁস করে দিতে আমার কোনও অসুবিধা ছিল না, কারণ আপনাকে বলেছি, আমাকে তার যে ডিপার্টমেন্ট দেখতে হত, সেটা একটা মস্ত বড় জোচ্চোরির কারখানা, তার ম্যান-পাওয়ার, হিসাব-নিকাশ, আর তার সঙ্গেই, একটা রাজনৈতিক দলের লোক হওয়া সত্ত্বেও ল্যাস আমাদের দলেরই লোক। তার যে কারখানাটা আমাকে দেখতে হত, তাদের ঠকানো, কেননা, তারা ল্যাস-এর কারখানার লোক, অতএব তাদেরই তো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, অথচ তারা যখন গোলমাল করে, তখন আমাকেই সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়, এই সব মিলিয়ে তার সঙ্গে গোড়া থেকেই একটা বিরোধ আমার লেগেছিল। এর ওপরে যেটা সব থেকে বিপজ্জনক, সেটা হল, এই ডিপার্টমেন্টের সব দায়িত্বটা ছিল আমার ওপর, আমার কনফার্মেশন করা সই না থাকলে, ল্যাস কোনও কিছুতেই সই করতেন না, যার মানে, সে একটা টাটের ঠাকুর, কেবল হাত তুলে অন্ধের মতো আশীর্বাদ করা ছাড়া তার আর কিছু নেই, অতএব জোচ্চোরির জন্য যদি জেলে যেতে হয়, তা হলে আমাকেই যেতে হবে, যে কারণে আপনাকে বলেছিলাম, চাকরির ব্যাপারে আমাকে সবসময়েই একটা নার্ভ টেনশনে ভুগতে হত। এরকম একটা ঘটনার পরিণতিতেই, ল্যাসকে মরতে হল। একটা ব্যাপার এমনভাবে ধরা পড়ল যে, ইচ্ছা করলেই আর তাকে চাপা যায় না এবং তখন সেই ব্যাপারের মাঝখানে যে সব নথিপত্রগুলো ছিল, সেগুলো তিনি আমাকে সই করতে বললেন। হ্যাঁ, অফিসেই, ল্যাস তার চেম্বারে বসেছিলেন, আর কাগজপত্রগুলো সামনের টেবিলের ওপরে ছিল। ল্যাস-এর চেহারাটা মোটেই মোটা নয়, রোগা রোগা, মাথায় অল্প চুলগুলো কোঁকড়ানো, আর তাতে তিনি তেল মাখতেন না, সবসময়েই খুব ছোকরা সেজে থাকার ইচ্ছা তাঁর, কিন্তু চোখগুলো অদ্ভুত। কী রকম বলি, চোখের মণিগুলো বিশেষ নড়াচড়া করত না, সেগুলো যেন ঘষা ঘষা, আর চোখের সাদা জায়গাগুলো তার লাল হয়েই থাকত। অফিসে যতক্ষণ তিনি থাকতেন, ততক্ষণই গম্ভীর হয়ে থাকতেন, কথা কম বলতেননা না, আপনার ও সব সিগারেট বা পাইপ কামড়ে ধরা, কথার চটপটি নাটুকে বস তিনি মোটেই ছিলেন না, কিন্তু আচমকা একটা গরগর শব্দ তার গলা থেকে উঠলেই, বুঝতে হত, এর পরেই টুটি কামড়ে ধরার পালা।

কী বললেন, এই শ্রেণীর লোক, মানে আপনি নিশ্চয় ক্লাস মিন করছেন, এই শ্রেণীর লোককে কেন আমাদের রাজনৈতিক দলে নেওয়া হয়েছিল। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি, আপনি শ্রেণীবিন্যাসের কোন স্তরের কথা বলছেন, কিন্তু দেখুন ও সব কথাটথা বলবেন না। দলের প্রয়োজনে সবকিছুই করা যায়, মনে করুন না কেন, দলের বক্তব্য হচ্ছে, ল্যাসকে ইউটিলাইজ করা হচ্ছে, টোটাদা তো আমাকে তাই বুঝিয়েছিলেন। যাই হোক, সেই অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের ভারী মুগুরটা-মুগুরের মতোই কাজ দিয়েছিল ওটা, ওটা দিয়ে পিটিয়ে মারার আগে ছবিটা আপনার চোখে তুলে ধরি।…আমি ল্যাস-এর উলটো দিকে বসেছিলাম, তিনি সব কাগজপত্রগুলো দেখে, আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, বললেন, সই করে পাঠিয়ে দাও। আমি একবার পুলিশের সঙ্গে কথা বলে দেখি, ব্যাপারটা নিয়ে তারা কতদূর মাথা ঘামাচ্ছে।

আমি: মাথা যা ঘামাবার, তা তারা ঘামিয়েই রেখেছে, কারণ ব্যাপারটা এখন আর তাদের হাতেও নেই, ওটা ইতিমধ্যেই জনসাধারণের হাতে চলে গেছে।

ল্যাস: হ্যাঁঙ দিস জনসাধারণ, তুমি সই করো।

আমি: তা হলে আমাকেই বিপদে পড়তে হয়। আপনি ডিরেক্টর, সবই আপনার মতে হয়েছে, অতএব

কথাটা আমি শেষ করিনি, ল্যাস-এর চোখে তার ঘোলাটে মণি আর লাল রংটা সব তখন একাকার হয়ে উঠেছিল এবং সেই গর গর শব্দটা শোনা গিয়েছিল। আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, অ্যাবস্ট্রাক্ট মুগুরটা পেড়ে নিয়ে এসে, প্রথমেই তার মাথা লক্ষ্য করে মেরেছিলাম, কিন্তু সে মাথাটা সরাবার চেষ্টা করতেই সেটা তার মুখের ওপর পড়েছিল, আর মুখটা ফেটে গিয়েছিল। কিন্তু আমি আর থামিনি। সে চেয়ারে ঢলে পড়তেই তার মাথায় মেরেছিলাম। একবার নয়, অনেকবার, কেননা, সত্যি বলতে কী, আমার এরকম কোনও চিন্তাই ছিল না যে আগের থেকে ভেবে নেব, কোথায় কত ঘা মারলে লোকটা মরতে পারে। আমি তখন এমন একটা অবস্থায়, মেরেই চলেছি, মেরেই চলেছি, যে কারণে পরে দেখেছিলাম, আমার দাঁতে ব্যথা হয়ে গিয়েছে, কারণ এত জোরে দাঁতে দাঁত চেপেছিলাম।

.

০৬.

কী বললেন, তারপরে কী করলাম, ডেডবডিটা কোথায় ফেললাম? কেন–মানে, কোথায় আবার, অফিসেই ওখানে ওভাবেই ফেলে রাখলাম, আর অ্যাবস্ট্রাক্ট মুগুরটা, বাথরুম থেকে রুমালটা ভিজিয়ে, মুছে যেখানকার জিনিস সেখানেই রেখে দিলাম। ওঃ, আপনার মুখটা দেখছি একেবারে বেঁকে কুঁচকে কেমন হয়ে গিয়েছে। আপনি যেন দেখতে পাচ্ছেন, কীভাবে লোকটাকে মারা হচ্ছে? চিৎকার করেছিল কিনা? না, সে অবসর তাকে আমি দিইনি।…আর ঠিক সে সময়েই টেলিফোন বেজে উঠেছিল, এবং চেষ্টা করে আমি ল্যাস-এর মতোই আস্তে আস্তে উচ্চারণ করেছিলাম, লোঁ!

কী বললেন, পুলিশের গলা কি না? খুব জমাটি হয় গল্পটা তা হলে, না? দুঃখিত, গলাটা শোনা গিয়েছিল টোটাদার, এবং টোটাদা একদম ধরতে পারেনি, আমি শব্দ করেছি, তাই তিনি তারের ওপার থেকে চিৎকার করে উঠেছিলেন। এখন কী করবে ভাবছ? কথা বলছ না কেন? হ্যালো হ্যালো।

আমি আবার শব্দ করেছিলাম, লোঁ।

টোটাদার গলা শোনা গিয়েছিল, একেবারে বোবা হয়ে গেলে যে? তুমি জানো, ব্যাপারটা কতদূর দাঁড়াতে পারে। লোভে পড়ে নিজে তো ডুবেইছ, এখন তোমার সঙ্গে আমাদের দলের দুর্নামকী, কথা বলছ না কেন, মনে করেছ এরকম মৌনী বাবা হলেই পার পেয়ে যাবে? এখন তোমার মুখটা মনে করে, আমার ইচ্ছে করছে, তোমার মুখে।

কিছু মনে করবেন না, টোটাদা যা বলেছিলেন, তাই বলছি, পেচ্ছাব করে দিই। তুমি ভাবছ দলে এসে তুমি খুব উদ্ধার করেছ, আর তোমার সব পাপের বোঝা আমরা বইব। হ্যালো হ্যালো শাহ কথা বলো বলছি, এখনও একটা রাস্তা বাকি আছে, যদিও তোমার মতো একটা শকুনকে।

আমি ফোনটা নামিয়ে রেখেছিলাম, কারণ শেষের কথাতেই বুঝতে পেরেছিলাম, টোটাদার এত গালাগাল মেজাজের কারণ আর কিছুই নয়, একটা রাস্তা সে হাতড়ে পেয়েছে, সেই সুখেই, হ্যাঁ, সুখেই অনেক সময় অনেকে রুক্ষ হয়ে ওঠে, অর্থাৎ নিষ্কৃতি পেয়ে যাবার চেহারাটা এক একজনের এক একরকম হয় তো। ফোনটা রেখে, আমি আমার ঘরে চলে গেলাম কী বললেন? কেউ দেখতে পেয়েছিল কিনা? তা ঠিক লক্ষ করিনি, তবে বেয়ারাটা দরজায় ছিল না। রিসিভারটা মুছে রেখে এসেছিলাম কিনা? ও, হাতের ছাপ থেকে যাবে? তা হলে হয়তো ছিল, কারণ মুছে রেখে আসার কথা আমার মনে ছিল না। সেখান থেকে আমি যখন আমার ঘরে এলাম, তখন সেখানেও টেলিফোন বাজছে, আমি রিসিভারটা তুলে নিলাম, টোটাদার গলা শুনতে পেলাম, ভাকু, শোনো

ভাকু আমারই ডাকনাম, কেন যে এরকম একটা ডাকনাম আমার রাখা হয়েছিল জানি না। আপনার কি মনে হয় না, নামটা অনেকটা কুকুরের ডাকের মতো শোনায়? হাসছেন কেন, আমার তো তাই মনে হয়। যাই হোক, শুনতে পেলাম, ভাকু শোনো, যে ব্যাপারটা ঘটেছে, তার জন্যে তোমাকে কী করতে হবে, সেটা পরে জানাব। এখন তুমি একবার এখানে চলে এসো, আমার কাছে, একটা জরুরি কথা আছে, বুঝলে?

এখনি?

হ্যাঁ এখুনি।

আমি রিসিভার রেখে, আমার সাবর্ডিনেটকে জানিয়ে দিলাম, বেরিয়ে যাচ্ছি এবং আমার ভকসলটি। নিয়ে, হ্যাঁ, পিতৃসম্পত্তি হিসাবে আমার একটা পুরনো গাড়ি আছে, বহুদিনের পুরনো গাড়ি, যে গাড়ি দিয়ে কিছুদিন আগেই আমি একটা নয়া অ্যামবাসাডরকে কিন্তু সে কথা থাক, পরে বলব; গাড়িটা নিয়ে আমি টোটাদার সঙ্গে দেখা করলাম। তখন টোটাদার ঘরে আর কেউ ছিল না, যাতে বোঝা গেল, সে আমার জন্যেই অপেক্ষা করছে। কিন্তু টোটাদার মুখটা এতই গম্ভীর ছিল, যেন কথাই জোগাচ্ছে না তার মুখে, কেবল টেবিলের ওপরে হাত ঘষছিল, এমনকী আমাকে বসতে বলতেও মনে ছিল না। প্রথমেই বলল, তোমার সঙ্গে বিশেষ জরুরি কথা আছে, ইট ইজ বিটুইন ইউ অ্যান্ড মি। আচ্ছা, শাহ তোমাকে কী বলছে।

আমি বললাম, সইসাবুদ করে, সব দায়িত্ব আমাকে নিতে বলছে, তার মানে–।

টোটা: বুঝেছি। আচ্ছা, দরজাটা বন্ধ করে এসে তুমি বসো।

আমি তাই করেছিলাম। টোটাদা বলেছিল, দেখো, শাহ্-এর ব্যাপার থেকে তোমাকে আমি বাঁচাতে পারব, কিন্তু অন্য একটা দায় তোমাকে নিতে হবে।

আমি: কী?

টোটা: কেলেঙ্কারিটা ওর ঘাড়ের ওপর দিয়েই যাবে, কিন্তু আমাদের দলের একটা দুর্নাম, যেটা ভীষণ ক্ষতি করবে, তাই দল তোমার কাছে একটা স্যাক্রিফাইস আশা করে।

আমি: কী রকম?

টোটা: তুমি একজন বিশিষ্ট সভ্য বলেই সবাই জানে তোমাকে। অন্তত দলের মধ্যে তোমার একটা বিশেষ প্লেস। এরকম একটা সম্ভাবনা আছে, শাহকে আমার গ্রুপের লোক বলে চার্জ করা হবে। অর্থাৎ আমাকেই চার্জ করবে, যার ফলে দলের মধ্যে আমার পজিশনটা যাচ্ছেতাই হয়ে যাবে। তুমিও নিশ্চয় সেটা চাও না। অতএব, দলের সঙ্গে শাহ-এর যোগাযোগ, তার একমাত্র সূত্র তুমি, পার্টিকে এটা তোমার জানাতে হবে।

আমি: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, একটা নোংরা লোকের সঙ্গে আমি এমনভাবে জড়িয়ে ছিলাম যে, তাকে আমি পার্টির মেশিনারিটাও দরকার মতো ব্যবহার করতে দিয়েছি। আর পার্টিকে তার মান বাঁচাতে আমার নামে একটা স্টেটমেন্টও দিতে হবে। আর লোকে আমাকে আঙুল দেখিয়ে বলবে, এই সেই, শয়তান বিশ্বাসঘাতকটা, এই তো?

টোটা: তা ব্যাপারটা সেইরকমই খানিকটা দাঁড়ায় বটে। কিন্তু তা ছাড়া তো কোনও রাস্তাও দেখছি না।

আমি: কেন, রাস্তা তো রয়েছে, আপনি নিজে যা করেছেন, তার দায়িত্বটাও আপনিই নিন।

 টোটা: আমি তোমার সঙ্গে বেশি কথা বলব না। আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম কেউ যদি অপরাধ স্বীকার করে, স্বভাবতই তার সাজাটা কম হয়। তোমার বেলাতেও, স্বীকার করলে তাই হবে। তুমি না জেনে বুঝে একটা ভুল করে বসে আছ। আর একেবারেই যদি অস্বীকার কর, তা হলেও একই ব্যাপার হবে। তবে মোর বিটার অ্যান্ড রিভেঞ্জফুল হবে। এই আর কী!

আমি: কিন্তু আমার দ্বারা তো স্বীকার-অস্বীকারের কোনও প্রশ্নই আসছে না। আমাদের পার্টিও তো জানে, শাহ আপনার রিক্রুট। আপনার লোক। তবে পার্টিই বা আমার কাছে তা দাবি করবে কেন?

তখন টোটাদা একবার হেসেছিলেন এবং বলেছিলেন, কারণ আমি টোটা, তুমি ভাকু।

সত্যি বলতে কী, কথাটা শুনে তখন আমার মনে হয়েছিল, টোটা মানে বুলেট, আর ভাকু মানে কুকুর। এবং এ কথাও সবাই মানবে নিশ্চয়, একটা কুকুরকে একটা বুলেটই মাত্র বিদ্ধ করতে পারে। আপনি বোধহয় অনুমান করতে পারেন, আমার তখনকার অবস্থাটানা না, রাগের থেকেও বেশি। কারণ রাগ হয়ে গেলে তো মানুষ তার শেষ সীমান্তেই পৌঁছে গেল। তখন তার আর কিছুই করার থাকে না, তখন সে একমাত্র রাগই করতে পারে। যে কারণে রাগকে আমরা চণ্ডাল বলি, এবং রাগের পরিণতি হচ্ছে, মানুষ তখন নিজেকে একেবারেই হারিয়ে ফেলে, কী করে তা নিজেই জানে না। আমার মনে হয়েছিল, আমি ভীষণ অসহায়। আমার আপন বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই, আমাকে চারদিক থেকে সবাই আক্রমণ করছে। জীবনে আমি বোধহয় কোনওদিন এতটা ভয় আর অসহায় বোধ করিনি। আমার চোখে জল এসে পড়েছিল। আমি উঠে টোটাদার কাছে গিয়ে তার হাত দুটো চেপে ধরেছিলাম, বলেছিলাম, টোটাদা, আমাকে বাঁচান। আপনি আমাকে পার্টিতে এনেছিলেন, এমন কোনও কাজ নেই, যা আপনার জন্যে করিনি। আমি জানি আপনি সব পারেন। দলের মধ্যে আপনার সে ক্ষমতা আছে, আমাকে বলি দেবেন না। এই মিথ্যা দুর্নামের হাত থেকে আমাকে বাঁচান, আপনার পায়ে পড়ি।

টোটাদা তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, দিস ইজ পলেটিকস, এ সব কথা এখানে অচল, তুমি বিশ্বাস করতে পারো। তুমি যদি কিছু টাকা চাইতে বা এমনকী কোনও মেয়ের ব্যাপারেও সাহায্য চাইতে, তাও আমি করতে পারতাম। কিন্তু এখানে কোনও উপায় নেই।

তখন আপনি যে রাগের কথা বলেছিলেন, অ্যাঙ্গার, তাই আমার ভিতরে ধুইয়ে উঠছিল। তবু আমি করুণভাবেই বলেছিলাম, আমি যে আদর্শের জন্যে এতদিন পার্টির কাজ করে এসেছি, সে আদর্শগুলো তা হলে কী। তার কি কোনও দামই নেই।

এই কথা যখন বলছিলাম, তখনই সেই কাগজ কাটা ছুরিটা আমার চোখে পড়েছে। আমি জানি, ওটা ভোঁতা, কিন্তু ডগাটা বেশ ছুঁচোলো, জোর করে মাংসের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে, ওটা শেষ অবধি যাবে। টোটাদা বলেছিল, আদর্শগুলোর দাম নেই, তা বলব না, তবে দলের রাজনীতি আর রাজনৈতিক আদর্শ এ দুটোতে জোড় খাওয়ানো খুব কঠিন, কথাটা তুমি বুঝতে পারছ আশা করি!

আমি ততক্ষণে ছুরিটা তুলে নিয়েছি এবং টোটাদাকে বাধা দিয়ে বলে উঠেছিলাম, কিন্তু তাই যদি হয়, তবে তার জন্যে আমিই কেবল পে করব না। আপনাকেও তার দাম দিতে হবে।

এই কথা বলেই আমি কাগজ কাটা ছুরিটা ঘাড় আর শিরদাঁড়ার ঠিক মাঝখানে সমস্ত গায়ের জোরে বসিয়ে দিয়েছিলাম। সেই মুহূর্তে সে একবার বোধহয় আমার নাম ধরে ডাকতে চেয়েছিল, যে কারণে ভা উচ্চারণ করে আর কু পারেনি, ক একটা উ-কারের গোঙানিতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, এবং ওর সেই মোটা কাচ পাতা বড় টেবলটার ওপর দু হাত বাড়িয়ে লুটিয়ে পড়েছিল।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *