২. মেইন রেলপথ থেকে সরে

মেইন রেলপথ থেকে সরে লোকোমোটিভকে রেলওয়ে ওয়ার্কশপের পেছনকার শেডের ব্যক্তিগত অংশে নিয়ে এলেন ড্রাইভার। কোচ থামার সাথে সাথে ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন আব্রাহাম ওরফে অ্যাবি।

“সেনটেইন তুমি তো আগের চেয়েও বেশি সুন্দরী হয়ে গেছে।” সেনটেইনের হাত আর দুই গালে কিস করলেন অ্যাবি। ছোটখাটো লোকটার কান দুটো এমন খাড়া যেন অন্যেরা যে শব্দ না শোনে, উনি সেটাও শুনতে পান।

অ্যাবিকে অত্যন্ত পছন্দ করেন সেনটেইন। যখন তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল সাকুল্যে দশ পাউন্ড, তখনো তার পাশে ছিলেন অ্যাবি। তারপর হানি মাইন অধিকৃতের পর থেকে সেনটেইনের ব্যবসা ও ব্যক্তিগত অনেক কিছুই সামলাচ্ছেন এই লোক। আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের কাজে কখনো ভুল করেন না অ্যাবি।

“ডিয়ার অ্যাবি র‍্যাচেল কেমন আছে?”

“অসাধারণ।” উত্তরে জানালেন অ্যাবি। এই বিশেষণটা কেন যেন উনি বেশ পছন্দ করেন। ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকায়-”

 “ঠিক আছে।” মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন সেনটেইন। আব্রাহাম ভালোভাবেই জানেন যে এই নারী পুরুষ সঙ্গই বেশি ভালোবাসেন।

এবার লম্বা-চওড়া বাকি লোকটার দিকে তাকালেন সেনটেইন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

“ড, টুয়েন্টিম্যান জোনস।”

 “মিসেস কোর্টনি” বিড়বিড় করে উঠলেন জোনস।

নিজের সবচেয়ে মোহনীয় হাসিটা দিলেন সেনটেইন। কিন্তু তারপরেও জোনসের মনমরা ভাব কাটল না। শোকে যেন তিনি পাথর হয়ে আছেন।

পূর্বে ডি বিয়ারস ডায়মন্ড কোম্পানিতে কাজ করলেও দীর্ঘ পাঁচ বছর পেছনে লেগে থেকে অবশেষে হানি খনির রেসিডেন্ট ইনজিনিয়ার হিসেবে কাজ করার জন্য জোনসকে রাজি করিয়েছেন সেনটেইন। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে দক্ষ এই হিরে মানব সারা দুনিয়ার মাঝেই শ্রেষ্ঠ।

দু’জনকেই স্যালুনে নিয়ে গিয়ে বারম্যানকে ইশারা করলেন সেনটেইন।

“আব্রাহাম, এক গ্লাস শ্যাম্পেন?” নিজ হাতে ওয়াইন ঢেলে দিলেন, “আর ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস, একটু মাদিরা?”

 “আপনি সত্যিই কিছু ভোলেন না মিসেস কোর্টনি।”

“সকলের সুস্বাস্থ্যের উদ্দেশে, জেন্টেলম্যান” যে যার পানীয়তে চুমুক দেয়ার পর দরজার দিকে তাকালেন সেনটেইন।

ঘরে ঢুকল শাসা। মনোযোগ দিয়ে দেখলেন সেনটেইন। নাহ, ছেলে প্রত্যেকের সাথেই যথাযথভাবে পরিচিত হতে পেরেছে। হালকাভাবে মাথা নেড়ে সন্তুষ্টি জানিয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলেন। এটা এমন এক সংকেত যার মানে পরিচয়পর্ব শেষ। এবার কাজের ব্যাপারে কথা বলতে হবে। সবাই তার দিকে মনোযোগ দিলেন। “অবশেষে ঘোষণাটা এসেছে।” জানালেন সেনটেইন, “ওরা আমাদের কোটা আরো ছোট করে দিয়েছে। পুরুষ দুজন পরস্পরের দিকে চেয়ে তারপর সেনটেইনের দিকে তাকালেন।

 “আমরা তো প্রায় বছরখানেক ধরেই এর অপেক্ষায় আছি।” মনে করিয়ে দিলেন আব্রাহাম। “প্রত্যাশা আর ঘটনা ঘটার মাঝে নিশ্চয় ফারাক আছে।” তিক্ত স্বরে বলে উঠলেন সেনটেইন।

 “কত?” জানতে চাইলেন জোনস। “চল্লিশ শতাংশ।” সেনটেইনের উত্তর শুনে মনে হল ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙে পড়বেন।

 সেন্ট্রাল সেলিং অর্গানাইজেশন এ দর ঠিক করে। স্বাধীন উৎপাদকদের তাই এর বিরুদ্ধে কিছুই করার নেই।

“চল্লিশ শতাংশ ক্ষেপে উঠলেন আব্রাহাম, “এটা অন্যায়”

“ঠিক তাই ডিয়ার অ্যাবি, কিন্তু কিছুই করার নেই।

 “ক্যাটাগরিতেও কোনো পরিবর্তন নেই?” জানতে চাইলেন অ্যাবি।

“একই শতাংশ।” সেনটেইনের উত্তর শুনে ভেতরের পকেট থেকে নোটবুক বের করে হিসাব শুরু করলেন জোনস। পেছনে ছেলের দিকে তাকালেন সেনটেইন।

“আমরা কী নিয়ে কথা বলছি তুমি বুঝতে পারছো?”

“কোটা? হ্যাঁ।”

“কোনোকিছু না বুঝতে পারলে জিজ্ঞেস করবে।” সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়েই জোনসের দিকে তাকালেন।

“দশ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য আপিল করা যায় না?” জোনসের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়লেন সেনটেইন।

“ইতোমধ্যেই করেছি। কিন্তু ওরা প্রত্যাখ্যান করেছে।”

 আবারো নোট বুকের উপর খসখস করে ঝড় তুললেন জোনস।

“জোড় সংখ্যাটাকে ভাঙা যায় না?” আস্তে করে জানতে চাইলেন সেনটেইন। জোনসের চেহারা দেখে মনে হল উত্তরের বদলে আত্মহত্যা করতে পারলে বেশি খুশি হবেন।

“আমার বলতে ভয় হচ্ছে যে সামনে বেশ খারাপ দিন আসছে মিসেস কোর্টনি। শ্রমিক ছাঁটাই করতে হবে। তারপরেও যদি ডি বিয়ার ফ্লোর প্রাইসটা ইতিবাচক রাখে তাহলে হয়ত খানিকটা লাভ করা যাবে।”

 হঠাৎ করেই দুর্বল বোধ করলেন সেনটেইন। ডেস্ক থেকে হাত নামিয়ে কোলের ওপর রাখলেন; যেন অন্যরা তার কাঁপুনি টের না পায়। তারপর খানিক বাদে কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললেন,

“মার্চের এক তারিখ থেকে কোটা কার্যকর হবে। তার মানে ফুল প্যাকেজ ডেলিভারির জন্য আরো একটা মাস পাওয়া যাবে। এ সময়ে কী করতে হবে আপনি জানেন ড, টুয়েন্টিম্যান জোনস।”

“প্যাকেজ ভরে তুলব আমরা।”

“কীভাবে ড. জোনস? প্রথমবারের মত কথা বলল শাসা। সিরিয়াস ভঙ্গিতে ছেলেটার দিকে তাকালেন ইঞ্জিনিয়ার।

“প্রতিবার আমরা যখন হিরে তুলি তখন কয়েকটা থাকে সত্যিকারভাবেই অতুলনীয়। ভবিষ্যতের জন্য এগুলোর কয়েকটাকে সবসময় জমা করে রাখা হয়। তাই এখন এরকম হাই কোয়ালিটি হিরে সিএসও’কে পাঠিয়ে দেব।”

“বুঝতে পেরেছি।” মাথা নাড়ল শাসা, ধন্যবাদ ড. জোনস।”

“কাজটা করতে পেরে আমারও ভালো লেগেছে মাস্টার শাসা।”

 উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন।

“এখন আমরা ডিনারে যাবো।” সাইডিং ভোর খুলে ডাইনিংরুমের পথ দেখাল সাদা জ্যাকেট পরিহিত পরিচারক। রূপা আর ক্রিস্টাল ভর্তি লম্বা টেবিলের উপর অ্যান্টিক ভাসের মাঝে শোভা পাচ্ছে হলুদ গোলাপ।

***

সেনটেইনের কোচ যে রেলপথে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে এক মাইল দূরে ধোঁয়া ওঠা ক্যাম্প ফায়ারের পাশে বসে আছে দু’জন পুরুষ। চুলায় ফুটছে। পরিজ। তাদের আলোচনার সবটুকু জুড়ে আছে ঘোড়া। অন্তত পনেরোটা শক্তিশালী, টগবগে ঘোড়া দরকার।

“আমি যার কথা ভাবছি সে আমার বেশ ভালো বন্ধু।” বললেন লোথার।

“দুনিয়াতে তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুও পনেরটা তরতাজা ঘোড়া ধার দেবে না। পঞ্চাশের কমে তো নয়ই, আমার ধারণা একশ’ পাউন্ডেও কাজ হবে না।”

দুর্গন্ধযুক্ত মাটির পাইপে টান দিয়ে থু করে আগুনের মধ্যে পিক ফেললেন লোথার, “একশ’ পাউন্ড দিয়ে বরঞ্চ ভালো একটা চুরুট কিনব।”

“আমার একশ দিয়ে নয় কিন্তু।” মনে করিয়ে দিলেন হেনড্রিক।

*এখন ঘোড়ার কথা ছাড়ো। চলো লোকের খোঁজে যাই।” পরামর্শ দিলেন লোথার।

 “ঘোড়ার চেয়ে মানুষ পাওয়াই বেশি সহজ হবে।” দাঁত বের করে হেসে ফেললেন হেনড্রিক। “যে কোনো সৎ লোককেও খাবার দিয়ে কিনে ফেলা যাবে। আর তার বউকে তো পুডিং দিলেই পাবে। আমি এরই মাঝে সবাইকে ওয়াইল্ড হর্স প্যানে আসার জন্য বলে দিয়েছি।”

হঠাৎ করেই অন্ধকার ফুড়ে ম্যানফ্রেডকে এগিয়ে আসতে দেখে দুজনেই চোখ তুলে তাকাল। ছেলের ভাবভঙ্গি দেখে নোটবুক পকেটে রেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন লোথার।

“পাপা, তাড়াতাড়ি চলো।” কাকুতি জানালো ম্যানফ্রেড।

 “কী হয়েছে ম্যানি?”

“সারাহর মা আর একেবারে ছোট্ট বাচ্চাটা খুব অসুস্থ। আমি ওদেরকে তোমার কথা বলেছি।”

যে কোনো মানুষ কিংবা জন্তু-জানোয়ারকে সুস্থ করার ব্যাপারে লোখারের সুখ্যাতি আছে। গুলির আঘাত, হাম, ছুরির ঘা যে কোনো ধরনের ক্ষত সারিয়ে তোলার ব্যাপারে লোথার ওস্তাদ।

তাঁবুর মাঝ বরাবর তারপুলিনের ভাঙাচোরা চাদরের নিচে থাকে সারাহর পরিবার। ছোট দুই ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে তেল চিটচিটে কম্বলের নিচে শুয়ে আছে ওর মা। বয়স ত্রিশ না হলেও অনাহার আর পরিশ্রমে মহিলাকে প্রায় বুড়ির মত দেখাচ্ছে।

 হাঁটু গেড়ে মায়ের পাশে বসে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। সারাহ। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছেন ওর মা।

অন্যপাশে গিয়ে মেয়েটার মুখোমুখি বসলেন লোথার। “তোমার বাবা কোথায় সারাহ?”

“উনি খনিতে কাজ খুঁজতে গেছেন।”

“কখন।”

“বহুদিন আগে।” তারপর কী মনে করে আরো বলল, “কিন্তু কয়দিন পরেই আমাদের জন্য টাকা পাঠাবেন। তখন আমরা ভালো একটা বাসায় উঠে যাব।”

“তোমার মা কয়দিন ধরে অসুস্থ?”

“গত রাত থেকে।” আবারো ভেজা কাপড় রাখতেই দুর্বলভাবে সরিয়ে দিলেন ওর মা।

“আর বাচ্চাগুলো?” ফোলা মুখগুলো দেখলেন লোথার।

 “আজ সকাল থেকে।”

কম্বল সরাতেই লোথারের নাকে এল পাতলা পায়খানার দুর্গন্ধ।

“আমি পরিষ্কার করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরা একটু পরপরই নোংরা করে ফেলছে। বুঝতে পারছি না কী করব।” ফিসফিস করে জানাল সারাহ।

 ছোট্ট মেয়েটার কাপড় তুলে দেখলেন লোথার। অপুষ্টিতে ফুলে ঢোল হয়ে আছে পেট। গায়ের চামড়া পুরো সাদা।

অবচেতনের ঝাঁকি খেয়ে হাত সরিয়ে নিলেন লোথার। “ম্যানফ্রেড” তীক্ষ্ণস্বরে জানতে চাইলেন, “তুমি ওদের কাউকে স্পর্শ করেছ?”

“হ্যাঁ, পা। আমি পরিষ্কার করার সময় সারাহকে সাহায্য করেছি।”

“এক্ষুণি হেনড্রিকের কাছে যাও। গিয়ে বলে আমাদেরকে এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে।”

“কেন? কী হয়েছে পা?”

“যা বলছি তা করো।” রেগে গেলেন লোথার। ম্যানফ্রেড অন্ধকারে চলে যেতেই সারাহর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“তোমরা খাবার পানি ফুটিয়ে খাও না?” মাথা নাড়ল মেয়েটা।

গ্রামের সাদাসিধে মানুষগুলো যখন বাধ্য হয়ে অন্য অনেকের সাথে থাকতে শুরু করে তখন বুঝতেই পারে না যে কত রকমের বিপদ হতে পারে।

“কী হয়েছে ওম?” আস্তে করে জানতে চাইল সারাহ। “ওদের কী হয়েছে?”

 “টাইফয়েড জ্বর।”

“এটা কি খুব খারাপ?” অসহায়ের মত জানতে চাইল মেয়েটা। ওর চোখে তাকাবার সাহস পেলেন না লোথার। ছোট্ট বাচ্চা দুটোর দিকে তাকালেন। জুরে পুড়ে আর ডায়রিয়ায় পানিশূন্য হয়ে গেছে শরীর। মায়ের খানিকটা আশা থাকলেও দুর্বল হওয়ায় তাও সম্ভব না।

“এখন আমি কী করবো?” অনুনয়ের স্বরে জানতে চাইল সারাহ।

“ওদেরকে প্রচুর পরিমাণে ফোঁটানো পানি খাওয়াও।” যুদ্ধের সময় ইংরেজদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে টাইফয়েডের ভয়াবহতা দেখেছেন লোথার। যুদ্ধের চেয়েও বেশি মানুষ মারা গেছে এই জ্বরে। যেমন করেই হোক ম্যানফ্রেডকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

“আপনার কাছে ওষুধ আছে ওম?” পিছু নিল সারাহ। “আমি আমার মা আর ছোট্ট বোনটাকে মারা যেতে দিতে চাই না। কোন ওষুধ-” কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েটা।

ছোট্ট সারাহর সাহস দেখে লোথারের মন চাইল বলতে যে, “ওদের জন্য কোনো ওষুধ আর বাকি নেই। সবটুকু এখন ঈশ্বরেরই হাতে।”

লোথারের পিছনে এসে হাত ধরে মা আর ভাই-বোনদের কাছে নিয়ে যেতে চাইল সারাহ।

কিন্তু মেয়েটা, ধরতেই মনে হল তার নিজেরও দেহ তুক ভেদ করে শরীরে ঢুকে যাচ্ছে জীবাণু। নাহ্ তাঁকে সরে যেতে হবে।

“এখানেই থাকো।” নিজের মনোভাব লুকাতে চাইলেন লোথার।

“ওদেরকে পানি খেতে দাও। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি।”

“কখন ফিরে আসবেন?” মুখ তুলে তাকাল সারাহ। বিশ্বাস করেছে লোথারের কথা। মিথ্যেটা বলতে গিয়ে অত্যন্ত কষ্ট পেলেন লোথার। “যত তাড়াতাড়ি পারি।” আস্তে করে ছাড়িয়ে দিলেন সারাহর হাত।

পেছনে আর না তাকিয়ে এস্তপায়ে হেঁটে এলেন লোথার। পথিমধ্যে শুনতে পেলেন অন্যান্য চালাঘরের বাচ্চাদের গোঙানি, জ্বরের তাড়নায় কোনো এক নারীর প্রচণ্ড পেটব্যথার কাতর আওয়াজ। কে যেন হঠাৎ করে বের হয়েই লোখারের হাত চেপে ধরে বলল, “তুমি কি ডাক্তার? আমার ডাক্তার দরকার।”

কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাতটাকে সরিয়ে দৌড়ে চলে এলেন লোথার।

এরই মাঝে ব্যাগ গুছিয়ে ক্যাম্পফায়ার নিভিয়ে তৈরি হয়ে গেছেন হেনড্রিক। এক পাশে কাটাগাছের নিচে বসে আছে ম্যানফ্রেড।

“টাইফয়েড” ভয়ংকর শব্দটা উচ্চারণ করলেন লোথার, “পুরো ক্যাম্পে ছেয়ে গেছে।”

জমে গেলেন হেনড্রিক। আহত মদ্দা হাতির সামনেও ওকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন লোথার। অথচ এ জ্বরের নাম শুনেই ভয় পেয়ে গেছেন সোয়ার্ট।

“চলো ম্যানফ্রেড; আমরা চলে যাচ্ছি এখান থেকে।”

 “কোথায় বাবা?”

“এখান থেকে বহুদূর।”

“কিন্তু সারাহ?” কাঁধের ওপর মাথাটাকে উঁচু করে জেদের স্বরে জানতে চাইল ম্যানফ্রেড।

“ওর জন্য আমাদের আর কিছুই করার নেই।”

“ও মারা যাচ্ছে, মা আর ভাই বোনদের মতই তাই না?” বাবার দিকে চোখ তুলে তাকাল ম্যানফ্রেড।

“উঠে দাঁড়াও।” নিজের অপরাধবোধ লোথারকে ক্ষিপ্ত করে তুলল। “চলো।” ইশারা করতেই ম্যানফ্রেডকে তুলে দাঁড় করালেন হেনড্রিক।

“চলো ম্যানি, বাবার কথা শোনো।” ম্যানফ্রেডের হাত ধরে টানতে টানতে লোথারের পিছু নিলেন হেনড্রিক।

 রেলওয়ের বস্তি এলাকা পার হবার পরেই শান্ত হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। চুপচাপ বাধ্য ছেলের মত হাঁটতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পরেই মেইন রোডে পৌঁছে গেলেন সবাই। চাঁদের আলোয় নোংরা রুপালি নদীটার ধারে থেমে গেলেন লোথার।

“এখন আমি ঘোড়ার খোঁজে যাবো?” জানতে চাইলেন হেনড্রিক।

“হ্যাঁ।” মুখে বললেও চোখ ঘুরিয়ে ফেলে আসা পথের দিকে তাকালেন লোথার। সবার মাথা ঘুরে গেল সেদিকে।

 “আমি ঝুঁকিটা নিতে চাইনি” ব্যাখ্যা করলেন লোথার। “ম্যানফ্রেডকে ওদের কাছে যেতে দিতে চাইনি।” কেউই কোনো কথা বলল না। আমাদেরকে এখন নিজেদের প্রস্তুতি নিতে হবে, ঘোড়া জোগাড় করতে হবে”।

সোয়ার্টের আচমকা কী মনে হতেই কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে নিজের সার্জিক্যাল ইনস্ট্রমেন্টস আর মেডিসিন বের করে নিলেন লোথার।

 “ম্যানিকে নিয়ে যাও।” হেনড্রিককে আদেশ দিয়ে বললেন, “মার্চে উসাকস থেকে আসার সময় গামাস নদীর তীরে যেখানে ক্যাম্প করেছিলাম সেখানে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করো।”

মাথা নেড়ে হেনড্রিক জানতে চাইলেন, “তোমার কতদিন লাগবে?” “ওদের মরতে যতদিন লাগে।” উঠে দাঁড়িয়ে ম্যানফ্রেডের দিকে তাকালেন লোথার, “হেনড্রিকের কথামত চলবে।”

“আমি তোমার সাথে আসতে পারি না, পা?”

উত্তর দেবারও প্রয়োজন মনে করলেন না লোথার। ঘুরে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে দাঁড়িয়ে আবার রেলওয়ের তাবুর দিকে চলে গেলেন।

***

আগুনের পাশে উবু হয়ে বসে আছে সারাহ। কয়লার মত কালো পাত্রে ফুটছে পানি।

হঠাৎ করেই চোখ তুলে লোথারকে দেখে ফেলে। একদৃষ্টে খানিক তাকিয়ে থাকার পর গাল বেয়ে গড়িয়ে নামে চকচকে অশ্রুফোঁটা।

“আমি ভেবেছিলাম আপনি আর ফিরে আসবেন না।” ফিসফিস করে উঠল সারাহ।

 মাথা নাড়লেন লোথার। নিজের দুর্বলতায় এতটাই ক্ষেপে আছেন যে কথা বলতে ভরসা পেলেন না। তার বদলে আগুনের পাশে বসে নিজের পোঁটলা খুলে এক চামচ ডায়রিয়ার ওষুধ নিয়ে টিনের মগে গরম পানি মেশালেন।

“আমাকে সাহায্য করো,” সারাহকে আদেশ দিয়েই সবচেয়ে ছোট্ট বাচ্চাটাকে তুলে বসালেন। “ও হয়ত সকালের আগেই মারা যাবে।” মনে মনে ভাবলেও বাচ্চাটার ঠোঁটের কাছে মগ ধরলেন লোথার।

 ভোরেরও কয়েক ঘণ্টা আগেই মারা গেল মেয়েটা।

ছেলেটা দুপুর পর্যন্ত কোনোমতে টিকল। তারপর বোনের মতই চলে গেল।

কিন্তু সারাহর মা হার মানলেন না।

“ঈশ্বরই জানেন কেন সে এখনো বেঁচে থাকতে চাইছে। আর কিছু তো পাবার নেই।” জ্বরের ঘোরে গুঙ্গিয়ে উঠল সারাহর মা। তার জেদ দেখে বিরক্তই হলেন লোথার।

অথচ সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় মনে হল এই যাত্রায় বুঝি টিকে যাবেন। মহিলার গায়ের তাপ কমে গেছে। দুর্বলভাবে সারাহর হাত ধরে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেও কথাগুলো স্পষ্ট শোনা গেল না।

 তবু এই পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। মায়ের ঠোঁট মুছে হাত ধরে বসে রইল সারাহ্।

হঠাৎ করেই এক ঘণ্টা পরে উঠে বসে পরিষ্কারভাবে সারাহর মা জানতে চাইলেন : “সারাহ, বাছা আমার তুমি কোথায়?” সাথে সাথেই ধপ করে মাথা নামিয়ে লম্বা দম নিয়ে নিথর হয়ে গেলেন। গরম মোমের মত গলে গেল চেহারা।

এইবার কমুনাল কবরস্থানে লোথারের সাথে মায়ের মৃতদেহ নিয়ে গেল সারাহ। সমাধিস্থ করার শেষে আবার চালাঘরে চলে এল দুজনে।

ফিরে এসে নিজের ক্যানভাসের ব্যাগ ভাজ করে নিলেন লোথার। বিরস বদনে দাঁড়িয়ে সব দেখল সারাহ। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক কদম এগিয়েও কী মনে হতে ফিরে তাকালেন লোথার। কুকুরছানার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপলেও নিজের জায়গা থেকে এক চুলও নড়েনি সারাহ।

 “অল রাইট” ইশারা করলেন লোথার। “চলে এসো।” লাফাতে লাফাতে পাশে চলে এল সারাহ্।

 “আমি কোনো ঝামেলা করব না।” স্বস্তিতে হিস্টিরিয়ার মত চিৎকার করছে মেয়েটা, “আমি রান্না করব, সেলাই করব, কাপড় ধুয়ে দেব। কিন্তু কোনো ঝামেলা করব না।”

***

“তুমি ওকে নিয়ে কী করবে?” জানতে চাইলেন হেনড্রিক, “ওতো আমাদের সাথে থাকতে পারবে না।”

 “আমি ওকে ফেলে আসতে পারিনি।” আত্মপক্ষ সমর্থনে বলে উঠলেন লোথার। ..

“আমাদের জন্য সেটাই ভালো ছিল।” কাঁধ ঝাঁকালেন সোয়ার্ট।

খাদের নিচের ক্যাম্প ছেড়ে পাথুরে দেয়ালের উপরে উঠে এল সবাই। অনেক নিচে সবুজ শান্ত জলের পুলের কাছে আছে দুই ছেলে-মেয়ে।

দু’জনে পাশাপাশি উবু হয়ে বসে আছে। একটু পরেই সবুজ পানি থেকে কালো পিচ্ছিল একটা মাছ ধরল ম্যানফ্রেড। লাফ দিয়ে উঠল সারাহ্! মেয়েটার উত্তেজিত চিৎকার এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে।

“ওকে নিয়ে কী করা যায় তা পরে ঠিক করব।” আশ্বস্ত করতে চাইলেন লোথার। কিন্তু হেনড্রিক মানলেন না।

“যত জলদি হয় ততই ভালো। এখনো ঘোড়াও জোগাড় হয়নি।”

মাটির পাইপে টান দিয়ে কথাটা ভেবে দেখলেন লোথার। কোনো না কোনোভাবে ওকে তাড়ানোটাই ভাল হবে। হঠাৎ করেই কী মনে হতে চোখ তুলে তাকিয়ে হেসে ফেললেন।

“আমার কাজিন।”

দ্বিধায় পড়ে গেলেন হেনড্রিক। “তোমার যে কোনো ভাই-বোন আছে তাতো জানতাম না।”

“তাদের বেশিরভাগই ক্যাম্পে শেষ হয়ে গেলেও ট্রুডি যেন কেমন করে বেঁচে গেছে।”

“কোথায় থাকে তোমার প্রিয়তম বোন?”

“এই তো উত্তরের রাস্তায়। এবার মেয়েটাকে যত জলদি ঝেড়ে ফেলা যাবে।”

***

“আমি কোথাও যেতে চাই না” মন খারাপ করে ফিসফিসিয়ে জানাল সারাহ। “আমি তো তোমার ফুপুকে চিনি না; তোমার সাথে এখানেই থাকবো।”

“শশশ।” মেয়েটাকে সাবধান করে দিল ম্যানফ্রেড। “পাপা আর হেনি জেগে যাবে।” আগুন নিভে চাঁদটাও ডুবে গেছে। মাথার উপর কালো ভেলভেটের পর্দার ন্যায় আকাশে জ্বলছে কেবল মরুভূমির তারা।

কানের কাছ থেকে মাত্র ইঞ্চিখানেক দূরে থাকলেও সারাহর ঠোঁট নিঃসৃত কথা ম্যানফ্রেডের বহুকষ্ট করে শুনতে হচ্ছে। “তুমিই আমার একমাত্র বন্ধু। আর তাছাড়া আমাকে পড়াশোনা শেখাবে কে বলো তো?”

 নিজের উপর দায়িত্বের গুরুভার অনুভব করল ম্যানফ্রেড। মেয়েটার মত তার নিজেরও কোনো বন্ধু নেই। শিক্ষক বলতে কেবল বাবা। কখনো কোনো নারীসঙ্গও পায়নি।

যদিও সারাহর দুর্বলতা মাঝে মাঝে ওকে খুব বিরক্ত করে তোলে। যেমন পাহাড়ে ওঠার সময় বারবার অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু সারাহর কথায় ও প্রাণ খুলে হাসে। পড়াশোনাতেও মাথা ভালো।

তাই মনে হয় সারাহ্ মেয়ে না হয়ে ছেলে হলেই ভালো হত। কিন্তু আরেকটা কথা, সারাহর গায়ের গন্ধ আর চামড়ার মসৃণতা দেখলে কেমন যেন লাগে। রাতে যখন সবাই মিলে একসাথে ঘুমায় মাঝে মাঝে জেগে উঠে মেয়েটার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনে ম্যানফ্রেড।

ওকাহান্ডার দীর্ঘ, ধূলিভরা পথচলা বেশ কষ্টকর। পাঁচ দিন কেটে গেছে এরই মাঝে। ওরা খুব সকালে আর সন্ধ্যার পরে পথ চলে। দুপুর বেলায় পুরুষ দু’জন শেডে বিশ্রাম নেয়। আর ছেলে-মেয়ে দু’জন আশপাশে ঘোরাঘুরি কিংবা পড়াশোনা করে। অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের মত খেলা করে না সারাহ আর ম্যানফ্রেড। আর এখন তো বিচ্ছেদের আশঙ্কায় দু’জনেরই মন খারাপ। কম্বলের নিচে মাঝে মাঝে পাশাপাশি বসে মেয়েটার সরু কাঁধে হাত রাখে ম্যানফ্রেড গালে লাগে সারাহর মসৃণ চুলের ছোঁয়া।

 “আমি তোমাকে নেয়ার জন্য ফিরে আসবো।” ঠিক এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত ম্যানফ্রেড নিজেও ভাবেনি কখনো এ কথা বলবে।

“প্রমিজ করো” ম্যানফ্রেডের কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রতিশ্রুতি চাইল সারাহ।

“প্রমিজ করছি যে ফিরে আসব।” গদগদ কণ্ঠে ঘোষণা করল ম্যানফ্রেড।

 “কখন?” আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল সারাহ।

“আমাদেরকে কিছু করতে হবে।” বাবা আর হেনির পরিকল্পনা না জানলেও বুঝতে পেরেছি যে ব্যাপারটা বিদজ্জনক। “একটা জরুরি কাজ। এখন বলতে পারব না। কিন্তু শেষ হলে অবশ্যই ফিরে আসব।”

মনে হল সন্তুষ্ট হয়েছে সারাহ। ম্যানফ্রেডের মনে হল নরম হয়ে গেল মেয়েটার সারা শরীর।

“তুমি তো আমার বন্ধু, তাই না ম্যানি?”

 “হ্যাঁ।”

 “সবচেয়ে ভালো বন্ধু।”

 “হ্যাঁ। সবচেয়ে ভালো বন্ধু।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত বুলিয়ে দিল ম্যানফ্রেন্ড। কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা একটু বেশিই মেয়েসুলভ হয়ে যাবে দেখে কাঁদল না ম্যানফ্রেড।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা গোড়ালি পর্যন্ত সাদা ধুলায় ডুবিয়ে ছোট্ট সীমান্ত শহর ওকাহান্ডে পৌঁছালো সবাই।

আয়বুনের ছাদে ছাওয়া ঘরগুলো পড়ন্ত সূর্যের আলোয় আয়নার মত চকচক করছে।

 “রাত নামলে তারপর যাবো। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে সারাহর দিকে তাকালেন লোথার। মেয়েটার সুন্দর চুলগুলো ধুলা আর ঘামে ভিজে গাল আর কপালে লেপ্টে আছে। নগ্ন পায়েও সাদা ধুলা।

মন চাইল রাস্তার পাশের দোকান থেকে মেয়েটাকে একটা পোশাক আর জুতা কিনে দেবেন। তারপর কী মনে হতেই আবার বাতিল করে দিলেন এই আইডিয়া। কিন্তু ট্রুডি যদি মেয়েটাকে রাখতে রাজি না হয় তাহলে, আর ভাবতে চাইলেন না লোথার।

 “সারাহ্ সেখানে ট্রুডি বিয়ারম্যানের সাথে থাকবে। সে কিন্তু সত্যিই বেশ ভালো আর ধার্মিক।” গত তের বছরে একবারও বোনের সাথে দেখা করেননি লোথার। “উনিও কি আমাকে ম্যানির মত পড়ালেখা শেখাবেন?”

“হ্যাঁ অবশ্যই।” মেয়েটাকে আশ্বস্ত করার জন্য যেকোনো কিছু বলতে রাজি আছেন লোথার।

“তাহলে ম্যানিও আমার সাথে থাকুক।”

 “না, ম্যানিকে আমার সাথে যেতে হবে।”

 “প্লিজ, আমাকেও তাহলে সাথে নিয়ে যান।”

“না। তা হয় না। তুমি এখানেই থাকবে, এ ব্যাপারে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না।”

রাস্তার কাছের পাম্পের পানি দিয়ে হাত-পায়ের ধুলা ধুয়ে চুল ঠিক করে নিল সারাহ।

“আমি প্রস্তুত।” কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে অবশেষে লোথারকে জানাল সারাহ। মেয়েটা একটা আলগা বোঝা হলেও কেন যেন ওর উপর সবার মায়া পড়ে গেছে। ইশ! যদি আর কোনো উপায় থাকত। নিজেকে শক্ত করলেন লোথার।

 “চলো, তাহলে।” সারাহর হাত ধরে ম্যানফ্রেডের দিকে ফিরলেন, “তুমি এখানে হেনির সাথে অপেক্ষা করো।”

 “তোমার সাথে আসি পা? শুধু গেইট পর্যন্ত। সারাহকে গুডবাই বলে চলে আসব।” কাতর কণ্ঠে অনুনয় করল ম্যানফ্রেড। গম্ভীর মুখে রাজি হলেন লোথার, “ঠিক আছে। কিন্তু ভদ্র আচরণ করবে আর মুখটাও বন্ধ রাখবে।

 গির্জার পাশের বড়সড় বাড়িটার পেছন দিকে এসে থামলেন লোথার। গেইট খুলে রান্নাঘরের রাস্তায় উঠতেই কানে এল ধর্মীয় সঙ্গীতের সুর। স্ক্রিন ডোরের কাছে পৌঁছাতেই দেখা গেল ভেতরে লম্বা টেবিলে বসে একসাথে গান গাইছে একটা পরিবার।

 লোথার দরজায় নক করতেই গান থামিয়ে টেবিলের কাছ থেকে উঠে এলেন কালো স্যুট পরিহিত এক লোক।

“কে?” গমগম কণ্ঠে স্ক্রিন ছোর খুলেই অন্ধকারে উঁকি দিয়ে জানতে চাইলেন ভদ্রলোক, লোকটার কোটরে বসা তীক্ষ্ণ চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে ওল্ড টেস্টামেন্টের কোনো নবী।

“তুমি!” লোথারকে চিনতে পারলেন ভদ্রলোক। কিন্তু আর কোনো সম্ভাষণ করলেন না। ঘাড় ঘুরিয়ে ভেতরে চেঁচিয়ে বললেন, “মে, তোমার আহাম্মক কাজিনটা এসেছে।”

টেবিলের কাছ থেকে এগিয়ে গেলেন স্বামীর মতই লম্বা বছর চল্লিশের এক নারী। বিশাল পেটটার উপর ভাজ করে রেখেছেন মোটাসোটা দুটো হাত।

“আমাদের কাছে কী চাও লোথার ডি লা রে?” জানতে চাইলেন ট্রুডি, “এটা একটা ঈশ্বর ভীরু ক্রিশ্চিয়ান বাসা। তোমার বন্য আচরণ এখানে চলবে না।” ছেলে-মেয়েরা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে থেমে গেলেন ট্রুডি।

“হ্যালো ট্রুডি” সারাহকে সামনের আলোতে ঠেলে দিলেন লোথার। “অনেক বছর কেটে গেছে। তোমাকে সুখী দেখে সত্যিই ভালো লাগছে।”

“ঈশ্বরের ভালোবাসায় সত্যিই ভালো আছি” “সম্মত হলেন ট্রুডি।

“আমি তোমাকে আরেকটা ক্রিশ্চিয়ান দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিচ্ছি।” সারাহকে এগিয়ে দিলেন লোথার।” এই ছোট্ট মেয়েটা একদম একা, এতিম। ওর একটা ঘর দরকার। ওকে ভেতরে নিয়ে যাও ট্রুডি। ঈশ্বর তোমাকে আরো বেশি করে ভালোবাসবেন।

“এটা কি তোমার আরেকটা-” রান্নাঘরের ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকা নিজের দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে নিলেন ট্রুডি, “বেওয়ারিশ বাচ্চা?”

“ওর পরিবার টাইফয়েডের প্রকোপে মারা গেছে।”

কিন্তু ভুল করে ফেললেন, লোথার। শোনার সাথে সাথে আঁতকে উঠলেন ট্রুডি। তাই তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে নিলেন লোথার।

“এটা কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। মেয়েটা পুরোপুরি সুস্থ।

টুড়ি খানিকটা সহজ হলেন। “আমরা আসলে অন্য কোনো নারীর মত ওর দেখভাল করতে পারব না।” তাড়াতাড়ি বললেন লোথার।

“আমাদের ঘরে এমনিতেই খাবার মানুষের অভাব নেই করলেও তার স্বামী থামিয়ে দিলেন।

“এদিকে এসো বাছা” বজ্রকণ্ঠে আদেশ দিতেই লোথার সারাহকে ঠেলে দিলেন, “তোমার নাম কি?”

“সারাহ বেস্টার, ওম।”

“তার মানে তোমার শরীরে সত্যিকারের আফ্রিকান রক্ত বইছে?” জানতে চাইলেন ট্রুডির স্বামী, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ভদ্রলোক।

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সারাহ।

“তোমার মৃত মা আর বাবা রিফমর্ড গির্জায় বিয়ে করেছেন?” মেয়েটা আবারো মাথা নাড়ল। “আর তুমি কি ইস্রায়েলের প্রভু ঈশ্বরে বিশ্বাস করো?”

“ইয়েস, ওম। মা আমাকে শিখিয়েছে।” ফিসফিস করে জানাল সারাহ।

“তাহলে ওকে আমাদের ফিরিয়ে দেয়াটা উচিত হবে না।” স্ত্রীকে জানালেন লোকটা, “ওকে ভেতরে নিয়ে এসো। ঈশ্বরই সব ব্যবস্থা করবেন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারাহর হাত ধরলেন ট্রুডি, “এত পলকা মেয়েটা।”

 “আর তুমি লোথার ডি লা রে” লোথারের দিকে তাকালেন শিক্ষক মশাই, “দয়াময় ঈশ্বর এখনো তোমাকে সৎপথের রাস্তা দেখাননি?”

“এখনো না সাহেব।” নিজের স্বস্তি লুকিয়ে দরজা থেকে সরে এলেন লোথার।

হঠাৎ করেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যানফ্রেডের উপর চোখ পড়ল। জানতে চাইলেন, “এটা আবার কে?”

“আমার ছেলে ম্যানফ্রেড।” ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন লোথার কাছে এগিয়ে চোখ সরু করে ম্যানফ্রেডের ওপর তাকালেন ট্রুডির স্বামী। ম্যানফ্রেডও সরাসরি তাকাতেই দেখল ভদ্রলোকের চোখ দুটো ভর্তি সহানুভূতি আর উষ্ণতার ছোঁয়া।

“তুমি কি ভয় পেয়েছ?” শিক্ষকের উত্তরে মাথা নাড়লো ম্যানফ্রেড।

 “না, তেমন না।”

মিটিমিটি হাসলেন ট্রুডির স্বামী, “তোমাকে বাইবেল কে শেখায়?”

“আমার বাবা, ওম।”

“তার মানে ঈশ্বর তোমার প্রতি দয়া করেছেন। মেয়েটাকে না রেখে ছেলেটাকে দিয়ে যাও।” ভদ্রলোকের কথা শুনে ছেলের কাঁধে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন লোথার। লোকটা বললেন, “তোমার ছেলেটাকে দেখে বেশ ভালো বলে মনে হচ্ছে। ঈশ্বরের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের অনেক লোক দরকার।”

“এমনিতেই আমি ওকে বেশ ভালোভাবেই দেখাশোনা করছি।” নিজের উম্মা লুকালেন না লোথার। ডমিনি মানে কুঁডির স্বামী আবার ম্যানফ্রেডের দিকে তাকালেন,

“আমার মনে হয় ঈশ্বরেরও ইচ্ছা যে আমাদের পরে আবার কখনো দেখা হবে। যখন তোমার বাবা ডুবে মরবে কিংবা ইংরেজদের ফাঁসিতে ঝুলবে অথবা তাকে কোনো সিংহ খেয়ে ফেলবে তখন আবার এখানে ফিরে এসো। ওকে? আমার তোমাকে প্রয়োজন, ঈশ্বরেরও প্রয়োজন। আমার নাম ট্রম্প বিয়ারম্যান। এই ঘরে ফিরে এসো, কেমন!”

মাথা নাড়ল ম্যানফ্রেড, “আমি সারাহকে দেখার জন্য ফিরে আসব। ওর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি।”

 কথাগুলো শুনেই ভেঙে পড়ল সারাহ্। ফোপানির আওয়াজ শোনা গেল। চাইল স্টুডির হাত ছাড়িয়ে চলে আসতে।

 “চুপ করো। এমন বিড়বিড়ানি থামাও।” ট্রুডির ঝাঁকুনি খেয়ে চুপ করে গেল সারাহ্।

দরজা থেকে ম্যানফ্রেডকে সরিয়ে নিলেন লোথার। বোনকে বললেন, “মেয়েটা খুব পরিশ্রমী আর সব কাজে আগ্রহী। ওর প্রতি দয়া দেখিয়ে তুমি ঠকবে না।”

“দেখা যাবে।” ট্রুডির বিড়বিড় কণ্ঠ শুনে ফিরে তাকাল ম্যানফ্রেড।

“ঈশ্বরের বাণী স্মরণে রেখো লোথার ডি লা রে” পেছন থেকে শোনা গেল ট্ৰম্পের গলা, “আমিই পথ, আমিই আলো। যে আমাতে বিশ্বাস করে”।

বাবার হাতের মধ্যে নড়ে উঠল ম্যানফ্রেড। চোখ ঘুরিয়ে আবার পিছনে তাকাল। ট্রম্পের লম্বা দেহ ঢেকে রেখেছে রান্নাঘরের দরজা। কিন্তু তার কোমরের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল সারাহ।

মোমবাতির আলোয় চকচক করছে মেয়েটার অশ্রুমাখা মুখ।

***

গোপন স্থানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে চারজন লোক। গেরিলা কমান্ডো দলে যুদ্ধ করার সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও পুনরায় মিলিত হবার জন্য সবাই বিভিন্ন সে জোন জেনে রাখতে।

 সচরাচর এসব জায়গায় পানির যথেষ্ট মজুত থাকত। বুশম্যানদের কুয়ো কিংবা শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকে গর্ত করে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস লুকিয়ে রাখত সৈন্যরা। আস্তানার চারপাশ পরিষ্কারভাবে দেখা আর ঘোড়া আর মানুষ থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও রাখা হতো; যেন শত্রু অতর্কিতে হামলা চালাতে না পারে।

 লোথার এরকমই একটা জায়গা বেছে নিয়েছেন নিজেদের বর্তমান মিটিঙের স্থল হিসেবে আর এ পাহাড় থেকে কয়েক মাইল উত্তরে পারিবারিক বন্ধু জার্মান খামার ব্যবসায়ীর বাড়িও আছে।

শুকনো নদীখাত ধরে পাহাড়ে পৌঁছে গেলেন লোথার। ভোলা জায়গা দিয়ে হেঁটে আসছেন যেন বাকিরা তাকে দেখতে পায়। তাই দুই মাইল দূর থেকেই ছোট্ট একটা মানবসদৃশ শরীর উইন্ডমিলের মত হাত ঘুরিয়ে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাল। একটু পরেই বাকি তিনজনও চলে এল।

সবার প্রথমে “শুয়োর জন”। খোইসান যোদ্ধার হলদে কাঠামো দেখলেই বোঝা যায়, শরীরে নামা ও বার্গাডামা গোত্র ও তার গর্ব বুশম্যানের রক্ত বইছে। তার ঠিক পেছনেই আছে হেরেরো মায়ের গর্ভজাত সোয়ার্ট হেনড্রিকের অবৈধ সন্তান ক্লেইন বয়।

সোজা বাবার দিকে এগিয়ে এল ক্লেইন। বাবার মত লম্বা আর শক্ত সমর্থ হলেও মায়ের মত সুশ্রী হয়েছে। গায়ের রঙও বুনো মধুর মত। এই দুজনেই ওয়ালবিস বে’তে ট্রলারে কাজ করত। হেনড্রিক বাকিদেরকে জোগাড় করার জন্য তাদেরকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য দুজনকে দেখলেন লোথার। বারো বছর পর দেখা। স্বভাবে পুরোপুরি শিকারি কুকুরের মত লোক দুটো লড়াইও করে খাসা।

এবারে তিনি তাদের পুরনো সাংকেতিক নামেই অভিবাদন জানালেন, ওভাষো যার পাদুটো বকের মত হল স্টর্ক লেগস আর বাফেলো যার মাথাটা মনে হয় ঠিক এই জন্তুটার মতই ঘাড়ের কাছে লটকে আছে। পরস্পরের হাত আর কব্জি ধরে সম্ভাষণের পর লোথার খেয়াল করে দেখলেন যে বারো বছরের ব্যবধান আর আরাম-আয়েশে দু’জনেই মধ্যবয়স্ক আর মোটাসোটা হয়ে গেছে।

 “তো!” অট্টহাসি দিলেন লোথার, “বউ আর বিয়ার থেকে আলাদা করে নিয়ে এলাম।” হাসির হল্লা তুলল সবাই।

“শুয়োর জন আর ক্লেইন বয় তোমার নাম বলার সাথে সাথে ছুটে এসেছি।”

“অবশ্যই। আমাকে তোমরা কত ভালোবাসো তা তো আমি জানিই। শকুন আর শিয়ালের মত। মারতে পারলেই হল, মাংসের ব্যাপারে চিন্তা নেই।” আবারো চিৎকার করে হাসি শুরু করল সবাই। লোথারের কথার চাবুক তারা এতদিন অনেক মিস করেছে।

“শুয়োর জন অবশ্য সোনার কথাটাও বলেছে!” স্বীকার করল বাফেলো; হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আর ক্লেইন বয় তো বলেছে আবার নাকি যুদ্ধ হবে।”

“দুঃখের ব্যাপারটা কি জানো, আমার মত বয়স্ক মানুষ বউকে হয়ত দিনে একবার কি দু’বার আনন্দ দিতে পারে। কিন্তু পুরনো বন্ধুদের সাথে মিলে দিন রাত হল্লা করতেও ক্লান্ত হবে না আর তোমার প্রতি আমাদের বিশ্বস্ততা এই কালাহারির মতই বিশাল” বকের ঠ্যাঙের কথা শুনে হাসতে হাসতে একেকজনের গড়াগড়ি খাবার দশা।

এভাবেই একসাথে উপরে উঠে গোপন জায়গায় চলে এল পুরো দল। নিচু পাথুরে তাকের মত স্থানটা ক্যাম্পফায়ারের আগুনে কালো হয়ে আছে। ভেতরের দেয়ালে এখানে আশ্রয় নেয়া হাজারো হলদে বুশম্যানের হাতে আঁকা নকশা।

প্রথম চারজন এসে এরই মাঝে পাহাড়ের অন্যদিকে পাথুরে ফাটলের ভেতর লুকিয়ে রাখা গুপ্তভান্ডার খুলে ফেলেছে। এত বছর পরেও লুকিয়ে রাখা জিনিসগুলোর অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেলেন লোথার। টিনজাত খাবার, গোলাবারুদ, হলুদ গ্রিজে মোড়ানো মসার রাইফেল এমনকি কাপড়গুলোর পর্যন্ত কিছু হয়নি। আগে যুদ্ধের সময় প্রতিদিন খেতে খেতে একঘেয়ে লাগলেও আজ সবাই মিলে চেটেপুটে খেল বিকিট। মনের মাঝে ভেসে উঠল পুরনো স্মৃতি।

খাবার-দাবার শেষ করে পোকায় কাটা, মরচে পড়া জামা-কাপড়, বুট বাদ দিয়ে পুনরায় পলিশ আর সেলাইয়ের মাধ্যমে সবার জন্য অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি আলাদা করে নিল পুরো দল। কাজ করার সময় লোখারের মনে হল এরকম আরো বেশ কয়েকটা গুপ্তভান্ডার হয়ত আশপাশেই ছড়িয়ে আছে যেগুলোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে মজুত জিনিস পাওয়া যাবে। আগে কখনো নিজের প্রয়োজনে এগুলো লুট করার কথা মাথাতেও আসেনি।

কিন্তু এবার দেশপ্রেম ছাড়িয়েও মনে হল-যদি একটা নৌকা নিয়ে ওয়ালবিস থেকে উপকূল ধরে যাওয়া যায়, তারপর হঠাৎ করেই মনে হল, যাহ শালা, আমি তো এই ভূমি আর ওয়ালবিসকে আর কখনো দেখবোই না। যা করতে চাইছে তারপর আর ফিরে আসার কোনো উপায় থাকবে না।

ত্রস্ত পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি প্রবেশ মুখের দিকে চলে এলেন লোথার। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন পিঙ্গল বর্ণ, রৌদ্রতপ্ত সমভূমির দিকে। কেন যেন মনে হল যে সামনে খুব ভয়াবহ আর কষ্টকর সব দিন আসছে।

 “আর কোথাও কি সুখী হতে পারব?” আপন মনেই ভাবলেন লোথার; কেঁপে উঠল সকল প্রতিজ্ঞা। কিন্তু পেছনে তাকাতেই ম্যানফ্রেডকে দেখে মনে হল, “ছেলের জন্য এ সিদ্ধান্তটা কি ঠিক আছে? ওকে কি আমিই দেশান্তরীর পথে ঠেলে দিচ্ছি না?”

বহু কষ্টে মাথা ঝাঁকিয়ে সব দুশ্চিন্তা সরিয়ে দিলেন লোথার। তারপর ম্যানফ্রেডকে কাছে ডেকে আস্তে আস্তে আস্তানা থেকে বেরিয়ে একটু দূরে চলে এলেন। যেন অন্য কেউ তাদের কথা শুনতে না পায়। ছেলেকে জানালেন, “আমাদের সবকিছু চুরি করে নিয়ে নেয়া হয়েছে ম্যানি। আইনের চোখে হয়ত নয়; কিন্তু ঈশ্বর আর প্রকৃতির বিধাতা ঠিকই জানেন। তাই নিজেদের জিনিস আমরা আবার ফিরিয়ে আনব। কিন্তু এতে করে ম্যানি, ইংরেজদের আইন আমাদেরকে অপরাধী হিসেবে ধরে নেবে। আর এই কারণেই আমাদেরকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। তবে ওরাও ঠিক বুনো জানোয়ারের মত তাড়া করবে। তাই সাহস আর বুদ্ধি খাটিয়েই কেবলমাত্র টিকে থাকা সম্ভব।

 চোখ বড় বড় করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ম্যানফ্রেড। উনি যে তার সাথে সবকিছু শেয়ার করছেন তাতেই সে উত্তেজিত বোধ করছে।

 “আমরা উত্তরে এগোব। সেখানে ভালো খামারের জমি আছে। স্বগোত্রীয় অনেকেই এরই মাঝে চলেও গেছে। নাম বদলে নতুন একটা জীবন পাব তাহলে।”

“কিন্তু সারাহ?” বদলে গেল ম্যানফ্রেডের অভিব্যক্তি।

প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেলেন লোথার, “আমরা শিকার করব আর খামারের কাজ করব।” মনোযোগ দিয়ে শুনলেও নিষ্প্রভ হয়ে গেল ম্যানফ্রেড। সে রাতে অন্যরা ঘুমিয়ে পড়ার পরেও বহুক্ষণ জেগে থেকে সারাহর কথা ভাবল। কম্বলের নিচে যেন পাশেই টের পেল মেয়েটার অস্তিত্ব : “ওই আমার একমাত্র বন্ধু।”

কিন্তু হঠাৎ করেই অদ্ভুত একটা শব্দ কানে যেতেই বাস্তবে ফিরে এল ম্যানফ্রেড। নিচের সমভূমি থেকে আসা চিৎকারটা শুনে উঠে বসলেন লোথার। চট করে কম্বলটা সরাতেই কোমর অব্দি উনাক্ত হয়ে গেল। ভয়ংকর শব্দটা আবার শোনা গেল। কোথায় যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কোনো দানব।

“এটা কী পা?” সরসর করে দাঁড়িয়ে গেল ম্যানফ্রেডের ঘাড়ের লোম।

 “সবাই বলে সবচেয়ে সাহসী মানুষটাও নাকি প্রথমবার এই ডাক শুনে আধমরা হয়ে যায়।” নরম সুরে ছেলেকে জানালেন লোথার, “এটাই ক্ষুধার্ত কালাহারি সিংহের শিকারের গর্জন বেটা!”

***

সকাল হতেই পাহাড় থেকে নেমে এল পুরো দল। সবার আগে হাঁটছেন লোথার। সমভূমিতে পৌঁছে ছেলেকে নিজের পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, “তুমি তো ওর আওয়াজ শুনেছো, এবার দেখো পায়ের ছাপ।” হলদে নরম মাটিতে গভীরে দেবে গেছে ডিনার প্লেটের সাইজের একটা দাগ।

“এক নিঃসঙ্গ বুড়ো কেশরঅলা সিংহ।” রেখাটাকে হাত বোলালেন লোথার। আগেও তাকে বহুবার এমনটা করতে দেখেছে ম্যানফ্রেড। “দেখো কেমন করে গোড়ালির ওপর নিজের ভার দিয়ে হেঁটে বেড়ায় পশুরাজ। হয়ত র‍্যাঞ্চের কাছাকাছি থাকতে চায়। কারণ শাবকদেরকে ধরাটা সহজ।”

 নিচু হয়ে কাঁটা ঝোঁপের তলা থেকে কিছু একটা কুড়িয়ে নিলেন লোথার। তারপর সোনালি লাল চুলের ছোট্ট একটা গোছা ম্যানফ্রেডের হাতে দিয়ে বললেন, “দেখো, তোমার জন্য নিজের কেশরের নমুনা রেখে গেছে।”

এরপর সবাইকে নিয়ে র‍্যাঞ্চে চলে এলেন। পুরনো জার্মান দুৰ্গটাকে আসলে হেরোরো রেজিমেন্ট রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। বহুদূর থেকেই তাদের আসতে দেখেছেন কাউন্ট। লোথারের মায়ের প্রজন্মের হলেও ভদ্রলোক এখনো বেশ লম্বা আর ঋজুদেহী। সোয়ার্ট হেনড্রিককে কর্মচারীদের কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিলেও লোথার আর ম্যানফ্রেডকে ঠাণ্ডা আর অন্ধকার সেন্ট্রাল হলে নিয়ে এলেন। এখানে আগেই জার্মান বিয়ার আর জিনজার বিয়ার রেখে গেছেন কাউন্টেস।

গোসল করার পরে পরিষ্কার ইস্ত্রি করা পোশাক এনে দিল পরিচারকদের দল। ডিনারে এল এস্টেটের গরুর মাংস আর অত্যন্ত উপাদেয় রাইন ওয়াইন, আর তারপর হরেক পদের টার্ট আর পুডিং দেখে ম্যানফ্রেডের খুশি আর ধরে না। অন্যদিকে এতদিন পরে সভ্য জাতের বই আর সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে পেরে লোথারও আনন্দিত হলেন।

একটু পরে ম্যানফ্রেডকে হেরেরো পরিচারক সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর সিগার টানতে গিয়ে লোথারকে কাউন্ট জানালেন, “উইন্ডহক থেকে তোমার পাঠানো চিঠি পেয়েছি। দুর্ভাগ্যের কথা শুনে সত্যিই খারাপ লেগেছে। সময়টা আমাদের সবার জন্যই খারাপ আসলে। তোমার স্বর্গত মা অনেক ভালো একজন নারী ছিলেন। উনার ছেলের জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না। যাই হোক”।

কথাগুলো শুনে দমে গেলেন লোথার।

“তোমার চিঠি পাবার মাত্র দু’সপ্তাহ আগে সেনাবাহিনির পারচেজিং অফিসারের কাছে সমস্ত বাড়তি পশুদেরকে বিক্রি করে দিয়েছি। এখন কেবল নিজেদেরগুলো আছে।”

যদিও আসার সময় র‍্যাঞ্চের চারপাশে চল্লিশটা উকৃষ্টমানের ঘোড়া চড়তে দেখেছেন, কাউন্টের কথা শুনে মাথা নাড়লেন লোথার।

“কিন্তু আমার কাছে এক জোড়া অসাধারণ খচ্চর আছে বেশ বড়সড়। তোমাকে একেবারে স্বল্পমূল্যে দেব, ধরো পঞ্চাশ পাউন্ড।”

“জোড়া?” জানতে চাইলেন লোথার।

“না, না, একেকটা পঞ্চাশ পাউন্ড।” দৃঢ়তার সাথে জানালেন কাউন্ট, “বন্ধুকে কখনো টাকা ধার দিতে নেই। তাহলে টাকা আর বন্ধু দুটোই হারাবে।”

এ কথায় কান না দিয়ে পুরনো প্রসঙ্গটা তুললেন লোথার। “আর্মি অফিসার কি এ অঞ্চলের সব খামার থেকে ঘোড়া কিনেছে?”

“আমি শুনেছি প্রায় একশটা কিনে নিয়ে গেছে।” লোথার ভদ্রভাবেই তার প্রত্যাখ্যান মেনে নিয়েছেন দেখে কাউন্ট স্বস্তি পেয়েছেন।

“তাহলে রেলপথেই এগুলো দক্ষিণে নিয়ে যাবে, তাই না?

“না।” মাথা নাড়লেন কাউন্ট। “আপাতত সোয়াককা নদীতীরে রেখে দিয়ে আরো পঞ্চাশ জোগাড় করে একসাথে পাঠাবে।”

পরেরদিন সকালবেলা সসেজ, মাংস আর ডিম দিয়ে পেট ভর্তি নাশতা করে বের হয়ে এল লোখারের দল। আসার আগে বহু দর কষাকষি করে বিশ পাউন্ডে কিনে এনেছে একটা ছাই রঙা খচ্চর।

 “তো এখন কি তাহলে এই পিঠ-উঁচু প্রাচীন গাধায় করে ভাগবো নাকি? জানতে চাইলেন হেনড্রিক।

 “না, এটা দিয়ে শিকার করব।” হেনড্রিকের সরু চোখ দেখে হেসে ফেললেন লোথার।

পাথুরে গোপন আস্তানায় ফিরে দ্রুতহাতে অস্ত্র, খাবার-দাবার আর প্রয়োজনীয় জিনিসের বারোটা পোটলা করে ফেললেন। তারপর প্রবেশ মুখের কাছে এনে রাখলেন সব।

 “ওয়েল, লাগাম তো আছে। এখন কেবল ঘোড়া চাই।” টিপ্পনি কাটলেন হেনড্রিক।

 তাকে পাত্তা না দিয়ে লোথার জানালেন, “এখানে একজন গার্ড রেখে যাওয়া দরকার। কিন্তু সবাইকে নিয়েও যেতে হবে।”

শুয়োর জনের হাতে টাকা তুলে দিলেন লোথার। দলের সবচেয়ে অবিশ্বস্ত জন। বললেন, “শোনো, যদি তুমি মাতাল হয়ে পড়ে থাকো তাহলে কিন্তু সোজা মাথায় একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেব। পুলিশের জন্যও রেখে যাবো না। বুঝলে?”

নিজের টুপির মধ্যে ব্যাংকনোটগুলো খুঁজে জন জানাল, এক ফোঁটাও স্পর্শ করব না। বাস্ তুমি তো জানোই লিকার, নারী আর টাকা নিয়ে আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারো।”

ওকাহান্ডা শহর প্রায় বিশ মাইল দূরে। কিন্তু টাকা পেয়েই লোথারদের আগে শহরে পৌঁছানোর জন্য বের হয়ে গেল জন।

গতকাল তেমন বাতাস না থাকায় মাটির উপর সিংহের পদচিহ্ন এখনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ম্যানফ্রেড আর গাধাটাকে সবার আগে রেখে পাহাড় থেকে নেমে এল বাকি দল।

এক ঘণ্টার মধ্যেই এমন এক চিহ্ন পাওয়া গেল যাতে সবাই বুঝে গেল যে কাউন্টের একটা বকনা বাছুরকে মেরে গেছে সিংহ। কেবল বাছুরের মাথা, খুড় আর বড় হাড়গুলো পড়ে আছে।

দ্রুতপায়ে হত্যাস্থানের চারপাশে ঘুরে এলেন লোথার আর হেনড্রিক।

“কয়েক ঘণ্টা আগে মাত্র পার হয়েছে এলাকা।” জানালেন লোথার। কিন্তু একটা ঘাসের ডগা ভাঙা দেখে নিজেকে শুধরে নিলেন, “নাহ, আধঘণ্টা হবে, হয়ত আমাদের আসার শব্দ শুনতে পেয়েছে।”

“না।” নিজের হাতের লম্বা লাঠিটা দিয়ে সিংহের পায়ের ছাপ পরীক্ষা করলেন হেনড্রিক। “হেঁটে হেঁটে চলে গেছে। তার মানে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। আমাদের শব্দও পায়নি। পেট ভরা তাই কাছাকাছি জলের ধারেই গেছে।”

“দক্ষিণে।” রোদের মাঝেও চোখ পিটপিট করে পরীক্ষা করে জানালেন লোথার, “নদীর ধারে গেলে শহরের কাছে। আমাদের জন্য ভালোই হল।”

মসার বন্দুক কাঁধে ঝুলিয়ে লোকদের ইশারা করে আগে বাড়লেন লোথার। খানিক গিয়ে বালিয়াড়ির মাথায় পৌঁছাতেই দেখা দিল পশুজ। খোলা জায়গায় বিড়ালের মত হাটলেও পেটের দু’পাশে মাংসের ভারে সুবিধে করতে পারছে না।

লং রেঞ্জ হলেও গর্জে উঠল লোথারদের কাঁধের রাইফেল। কিন্তু লোথার প্রথম শটেই সিংহের পেটের নিচে ধূলিঝড় বইয়ে দিলেন। মরুভূমি অঞ্চলে রেঞ্জ নিয়ে সব সময় এ ভুলটা হয়।

পরের শটেই আহত হল সিংহ। গতি থামিয়ে বিশাল মাথাটা ঘুরিয়ে নিতম্বের আঘাত দেখতে যেতেই আরেকটা বুলেট গিয়ে বিধে গেল মাংসের ভেতরে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠেও আরো একবার লাফিয়ে লাফিয়ে উধাও হয়ে গেল সামনের দিকে।

“খুব বেশি দূর যেতে পারবে না!” সবাইকে সামনে এগোতে ইশারা করলেন হেনড্রিক।

লোথার হেনড্রিক আর ক্লেইন বয় মিলে সামনে এগোল।

 “রক্ত” একটু আগে যে জায়গায় সিংহটার গায়ে লোখারের বুলেট লেগেছিল সেখানে পৌঁছে চিৎকার করে উঠলেন হেনড্রিক।

“ফুসফুসের রক্ত!” ফেনাফেনা হয়ে আছে লাল রক্ত। চিহ্ন দেখে দৌড় দিল সকলে।

“দেখো! নিশ্চয়ই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে” সিংহটা যেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেছে সেখানে পৌঁছে লোথারের কথা শেষ হবার আগেই ওদের দিকে ধেয়ে এল আহত সিংহ।

পাহাড়ের শৃঙ্গের ঠিক পেছনেই মাটিতে শুয়ে থাকলেও লোথারদের শব্দ শুনে আবার উঠে পড়ল। দু’পক্ষের মাঝে এখন পঞ্চাশ কদমের দূরত্ব মাত্র।

লাল কেশরগুলো ফুলে ফেঁপে আরো বড়সড় দেখাচ্ছে। তীক্ষ্ণ দাঁতঅলা চোয়াল আর হাঁ করা মুখের ভেতর থেকে এমন এক গর্জন বেরোল যে ধীর হয়ে গেল লোথারের হাত। মসার রাইফেল কাঁধে তুলে নিতেই মাটি থেকে উঠে দাঁড়াল সিংহ।

মন চাইল গুলি করে বসেন। কিন্তু জোর করে নিজের এইম বদল করলেন লোথার। বুক কিংবা ঘাড়ে গুলি করেও এ পশুকে পরাস্ত করা যাবে না। এতটা কাছ থেকে কেবল ব্রেইনে গুলি লাগাতে পারলেই নিস্তেজ করা যাবে এ জন্তকে।

সিংহের নাকের উপরের গোলাপি অংশটাতে গুলি করলেন লোথার। বিড়াল চোখ দুটোর মাঝখান ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে মাখন রঙা হলদেটে মগজ আর হাড় ভেদ করে খুলির পেছন দিক দিকে ছিটকে বেরোল বুলেট, কিন্তু সিংহটা এখনো এগোচ্ছে। বিশাল পুরুষালি একটা দেহ এসে আছড়ে পড়ল লোখারের বুকের উপর। একপাশে পড়ে গেল হাতের রাইফেল। সিংহের মাথা আর কাঁধের বাড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন লোথার।

 হেনড্রিক এসে তাড়াতাড়ি তুলে লোথারকে বসিয়ে মাথা আর নাকের কাছ থেকে বালি ঝেড়ে দিলেন। লোথার দুর্বলভাবে হাত নাড়তেই তার ভয় কেটে গেল।

“তুমি দেখি ধীর আর বুড়োটে হয়ে যাচ্ছে বাস্।” হেসে ফেললেন হেনড্রিক।

 “ম্যানি দেখে ফেলার আগেই আমাকে তুলে ধরো।”

হেনড্রিকের কাঁধে ভর দিয়ে বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালেও একের পর এক ঠিকই অর্ডার দিয়ে চললেন, “ক্লেইন বয়! লেগস্! তাড়াতাড়ি গিয়ে সিংহের গন্ধ পেয়ে পাগল হয়ে ওঠার আগেই গাধাটাকে থামাও।”

তারপর হেনড়িককে সরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে সিংহের মতদেহের কাছে গেলেন। এরই মাঝে মাছি এসে ওড়াউড়ি শুরু করেছে সিংহের চুর্ণ-বিচূর্ণ মাথার উপর, “এটাকে লোড করার জন্য সবাইকে হাত লাগাতে হবে।” বালি থেকে নিজের রাইফেল তুলে নিয়ে সাবধানে মুছে ফেললেন লোথার। তারপর এটার উপর ভর দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন।

গাধাটাকে নিয়ে এগিয়ে আসছে ম্যানফ্রেড। দৌড় দিলেন লোথার।

 “তুমি ওটাকে ধরতে পেরেছে পা?” উত্তেজিত স্বরে জানতে চাইল ম্যানফ্রেড { গুলির শব্দ আগেই পেয়েছে।

“হ্যাঁ।” ছেলেকে গাধার পিঠ থেকে নামালেন লোথার, “ওইতো চুড়ার ওধারেই আছে।”

গাধার চিবুকের লোথার রিংয়ের সাথে বাড়তি দড়ি লাগিয়ে দুজনের হাতে ধরিয়ে দিলেন লোথার। তারপর খুব সাবধানে ক্যানভাসের কাপড় দিয়ে চোখও ঢেকে দিলেন।

“দেখা যাক। কেমন কাজ করে।” দুজন মিলে গাধাটাকে টানতে চাইলেও কেন যেন নিজের জায়গা থেকে একটুও নড়ল না জটা।

তাই লেজের নিচে খোঁচা দিলেন লোথার। তারপর খানিকটা এগিয়ে চূড়ার মাথা পর্যন্ত এলেও মৃদু বাতাসে ভেসে এল সিংহের তাজা গন্ধ।

সাথে সাথে উন্মাদ হয়ে গেল গাধা। তীক্ষ্ণ হেষা দিয়ে লাফ-ঝাঁপ শুরু করায় পা বেঁধে পড়ে গেল দড়ি ধরে রাখা দু’জন, পেছনের খুড়ের ভেতর আটকা পড়লেন লোথার। আর তারপরেই এক হ্যাঁচকা টানে চারজনসহ আধ মাইল দৌড়ে গেল গাধা। হাঁচোড়-পাঁচোড় করে চিৎকার দিচ্ছে লোথার আর তাঁর সহকারীরা। অবশেষে যখন নিজের তৈরি ধূলিমেঘের ভিতর থামল, দেখা গেল আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে বোবা গাধা।

চোখের পট্টি ভালোভাবে বসিয়ে টানতে টানতে আবার এটাকে ফিরিয়ে আনা হলেও সিংহের গন্ধ পাবার সাথে সাথে শুরু হল দৌড়। এবার অবশ্য কয়েকশ’ গজের বেশি যেতে পারল না। এরকম আরো দু’বার করার পর অবশেষে অবসন্ন হয়ে থেমে গেল গাধা। সুযোগ পেয়ে সবাই মিলে মৃত সিংহকে তুলে দিল কাঁধের উপরে। আর সাথে সাথে সিংহের থাবার স্পর্শ পেতেই লাথি দিয়ে দেহটাকে ফেলে দিল গাধা।

এভাবে ঘণ্টাখানেক যুদ্ধ করার পর অবশেষে সিংহের দেহ বাঁধা হল গাধার ওপর।

দড়ি ধরে আস্তে আস্তে গাধাটাকে নদী তীরে হটিয়ে নিয়ে এলেন লোথার।

***

সোয়াকোপ নদী আর ওপারের গ্রামের দিকে তাকালেন লোথার। নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে ঠিক সেখানেই তিনটা ছোট ছোট সবুজরঙা পুকুর। এখানেই ঘোড়াগুলোকে পানি খাওয়ানো হচ্ছে। কাউন্টের কথাই ঠিক। আর্মির ক্রেতা খুঁজে খুঁজে সেরাগুলোকেই নিয়ে এসেছে। দূরবিন চোখে দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন লোথার। বেশ লোভও জাগলো মনে। মরুভূমিতে জাত হওয়ায় এতদূর থেকেও স্পষ্ট আন্দাজ করা যাচ্ছে জম্ভগুলোর সামর্থ্য।

 মনোযোগ সরিয়ে সহিসদের দিকে তাকাতেই দেখা গেল সংখ্যায় পাঁচজন খাকি ইউনিফর্ম পরিহিত কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্য থাকলেও কোনো অফিসার নেই।

 “বোধ হয় ক্যাম্পের ভেতরে।” আপন মনেই বিড়বিড় করে আস্তাবলের পেছনে সারি সারি বাদামি তাবুর উপর ফোকাস করলেন লোথার।

 পেছনে হালকা হুইসেলের আওয়াজ পেয়ে কাঁধের উপর দিকে তাকাতেই দেখা গেল হেনড্রিক। রক্তাক্ত বোঝা নিয়ে শেডের ভেতরে বসে আছে গাধাটা। বাকিরা ক্যান থেকে খাবার খাচ্ছে। এমন সময় শুয়োর জন এল। কোপজে থেকে নিচে নেমে এলেন লোথার।

 “দেরি করেছো।” জনের বুকের কাছটায় খামচে কাছে টেনে গন্ধ শুঁকে জানালেন, “তোমার মত বদমাশ আর হয় না।”

“এক ফোঁটাও না মাস্টার। আমার বোনের কুমারীত্বের কসম।”

জনের পোঁটলা খুলে ভয়ংকর কেপ স্মোক ব্রান্ডির বোতল বের করলেন। লোথার। আলোর কাছে ধরতেই দেখা গেল ভেতরের গাঢ় বাদামি বিষাক্ত পানি।

“গ্রামে কি দেখলে?” বোতলটাকে আবার পোটলার ভেতরে রেখে দিয়ে জানতে চাইলেন লোথার।

“ক্যাম্পে সাতটা সহিস।”

“আমি তো শুনেছি পাঁচটা।

 “সাত।” একেবারে নিশ্চিত শুয়োর জন।

 “আর সাদা অফিসার?”

 “তারা সবাই গতকাল আরো ঘোড়া কেনার জন্য অটজিওনোঙ্গতে গেছে।”

“এক ঘণ্টার মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে।” সূর্যের দিকে তাকিয়ে হিসাব করে জানালেন লোথার, “যাও, পোটলা নিয়ে ক্যাম্পে যাও।”

“কী বলব?”

“বলবে অনেক কম দামে বেচছে, তারপর ফ্রি একটু টেস্ট করতে দেবে। মিথ্যে বলায় তো তোমার জুড়ি নেই। তাই যা খুশি বলে দিও।”

“আর যদি না খায়?”

 লোথার হাসলেও কোনো উত্তর দিলেন না। জানেন এর সম্ভাবনা শূন্য।

“চাঁদ গাছের মাথায় উঠে এলেই আমি চলে আসব। কাজ করার জন্য তুমি আর তোমার ব্র্যান্ডি হাতে চার ঘণ্টা সময় পাবে।”

শুয়োর জন কাঁধের ওপর পোঁটলাটা তুলে নিতেই কাঁচের বোতলের টুংটাং শব্দ শোনা গেল।

 “আরেকটা কথা শুয়োর, নিজে কিন্তু ভদ্র হয়ে থাকবে। নয়ত আমি তোমার গলা কাটব।”

এদিকে নিজের জায়গা থেকে দূরবিন দিয়ে সবকিছু দেখলেন লোথার। প্রথমে কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যের দল জনকে বাধা দিলেও একটু পরেই ঢুকতে দিল। একই সাথে শুয়োরের পোটলার মধ্যেও উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করল সবাই।

 এমনকি এতটা দূর থেকে আর সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতেও খুশিতে গার্ডের সাদা দাঁতের ঝলকানি স্পষ্ট দেখলেন লোথার। সঙ্গীদেরকে ডাকতেই বেরিয়ে এল আরো দু’জনে। নিজের সম্পদ দেখাতে অবশেষে জনকে সম্মানিত অতিথির মত টেনে নিল ভেতরে। লোখারের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল শুয়োর।

যেকোনো নাবিকের মতই সান্ধ্য বাতাসের শক্তি আর গতি ভালোই চেনেন লোথার। তাই রাত নামারও ঘণ্টাখানেক পর শিস দিয়ে হেনড্রিককে ডেকে বললেন, “নদী পেরিয়ে ক্যাম্পের চারপাশ ঘুরে এসো।”

ঠিক সেই মুহূর্তে নদীর ওপার থেকে অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসতেই চোখ তুলে তাকালেন দু’জনে। তাবুর সামনের ক্যাম্প ফায়ারের শিখা ধপধপ করে আকাশে উঠে যাচ্ছে। নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদের ছায়া। “পাগলগুলো করছেটা কী? নাচছে না যুদ্ধ করছে?” অবাক হলেন লোথার।

“আসলে নিজেরাই জানে না যে কী করছে।” মিটিমিটি হাসলেন হেনড্রিক। আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নামছে, ধুলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে আর হিহি করে হাসছে সব সেনা। একজন আবার পুরোই দিগম্বর।

“তোমার যাবার সময় হয়েছে। ম্যানিকে নিয়ে যাও। তোমার ঘোড়ার দড়ি ধরবে।” হেনড্রিকের কাঁধে চাপড় দিলেন লোথার।

হেনড্রিক ঢালু বেয়ে নামতে শুরু করলেও লোথারের কথা শুনে আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন, “ম্যানি কিন্তু এখন তোমার দায়িত্ব। কিছু হলে নিজের জীবন দিয়েই উত্তর দিতে হবে।”

উত্তর না দিয়ে রাতের আঁধারে হারিয়ে গেলেন হেনড্রিক। আধঘণ্টা দু’জনকে নদীর বালুতীর পার হতে দেখলেন লোথার।

ওদিকে ক্যাম্পের সৈন্যদের সবাই এখন বদ্ধ মাতাল। একজনকে দেখে শুয়োর জনের মত মনে হলেও মুখ নিচু করে থাকায় নিশ্চিত হওয়া গেল না।

 “এইবার ব্যাটা মরেছে।” দিগন্তে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে চাঁদ, উঠে দাঁড়ালেন লোথার। ঢালু বেয়ে নিচে নেমে গাধাটার কাছে এসে কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন।”

 “চল রে, সোনা, তোর কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।” কাঁধ থেকে রাইফেল নামিয়ে কার্টিজ ভরে নদীতীরে চলে এলেন লোধার। সাথে সিংহবাহী গাধা।

নিভে গেছে ক্যাম্প ফায়ারের আগুন। সামনের আস্তাবল থেকে কোনো এক জন্তুর মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দও কানে এল। লোথারের পেছন দিক থেকে বইছে বাতাস। এমন সময় গাধাটাকে সামনে ঠেলে দিলেন লোথার।

 আর যায় কোথায়। সাথে সাথে পাগলের মত আচরণ শুরু করল সবকটা ঘোড়া। রক্তাক্ত সিংহের গন্ধ নাকে যেতেই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে সবগুলো পশু। ভয়ার্ত চিৎকারের পাশাপাশি উন্মাদের মত পা ছুড়ছে ঘোড়ার দল।

 আস্তাবলের দেয়ালের কাছে এসে গাধার পিঠ থেকে দড়ি কেটে সিংহের দেহটাকে মাটিতে ফেলে দিলেন লোথার। ফুসফুসের বাতাস মরা সিংহের গলা দিয়ে খানিকটা গর্জন হয়ে বেরোতেই চিৎকার দিয়ে ঘূর্ণির মত ঘুরতে শুরু করল ঘোড়াগুলো।

সিংহের পেছনের পায়ের দু’ফাঁক থেকে শুরু করে পাঁজর অব্দি পেট একটানে চিরে ফেললেন লোথার। এমনকি ব্লাডারের মধ্যেও ঢুকে গেল ধারাল ফলা। সাথে সাথে গন্ধে ভারি হয়ে উঠল বাতাস।

পুরোপুরি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল ঘোড়ার পাল। কাঁধের উপর রাইফেল তুলে ফাঁকা গুলি করেই ম্যাগাজিন খালি করে ফেললেন লোথার। এবার একেবারে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে আস্তাবলের বেড়া ভেঙে অন্ধকার নদীতীর ধরে ছুটল সবকটা জম্ভ। সোজা একেবারে হেনড্রিকের কাছে।

তাড়াতাড়ি গাধাটাকে ধরে রাইফেল রি-লোড করে ক্যাম্প ফায়ারের আগুনের কাছে ছুটলেন লোথার। কিন্তু মাতাল অবস্থাতেও সবকিছু টের পেয়ে আস্তাবলের দিকে ছুটল এক সৈন্য।

“ঘোড়া ঘোড়া” চিৎকার জুড়ে দিল লোকটা, “ঘোড়াগুলোকে থামাতে হবে।” লোথারকে দেখে বলে উঠল, “আমাকে সাহায্য করে। আমাদের ঘোড়া”

ওর চিবুকের নিচে রাইফেলের হাতল ধরলেন লোথার। ভয়ে লোকটার দাঁতে দাতে বাড়ি খাওয়া শুরু হল। ঝুপ করে বালির উপর পড়তেই অন্যপাশে গড়িয়ে গেল কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্য।

 “শুয়োর জন!” তাড়াতাড়ি ডেকে উঠলেন লোথার, “তুমি কই?” দূর থেকে দেখা শরীরটাকে সোজা করতেই চাঁদের আলোয় পিটপিট করে তাকালো জন।

“ওহ ওঠো!” বুট জুতা দিয়ে সজোরে লাথি মারলেন লোথার। তারপরেও হাসতে শুরু করল জন; যেন কোনো ব্যথাই পায়নি। আমি কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি।” রাইফেলের নলটাকে জনের মাথার উপর ধরলেন লোথার। পুলিশ ধরলে কয়েকটা চাবুকের ঘায়েই পরিকল্পনার যতটুকু জানে সব গড়গড় করে বলে দেবে জন।

“তাই এটাই ওর জন্য ভালো হবে।” কিন্তু পারলেন না লোথার। তাড়াতাড়ি গিয়ে গাধাটাকে ধরে নিয়ে আসলেন।

পিঠের ভেজা কাপড়ের মত গাধার পিঠের দু’পাশে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রইল জন। পেছনে লাফ দিয়ে চড়ে বসলেন লোথার। তারপর গাধাটাকে এটার সর্বোচ্চ গতিতে ছোটালেন।

মাইলখানেক যাবার পর মনে হল বুঝি বাকিদেরকে হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু না, থামতেই সামনে বেরিয়ে এল হেনড্রিকের ছায়া।

“কয়টা ধরতে পেরেছো?” উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন লোথার।

 হেসে ফেললেন হেনড্রিক, “যতগুলোকে থামাতে পেরেছি।”

“ছাব্বিশ!” উল্লসিত হয়ে পঁড়িতে বাধা ঘোড়াগুলোকে দেখলেন লোথার। “সবচেয়ে ভালগুলোকে বেছে নেয়া যাবে। অল রাইট। এখন এখান থেকে সরে পড়তে হবে। সেনাবাহিনি ফিরে এলেই সর্বনাশ।” তাড়াতাড়ি নিজের আনন্দের লাগাম টেনে ধরলেন লোথার।

তারপর আস্তে করে গাধার মাথা থেকে দড়ি খুলে পিঠ চাপড়ে জন্তুটাকে মুক্ত করে দিলেন। আর সত্যি সত্যিই খুশিতে প্রথম একশ গজ টগবগ করে বাড়ির দিকে দৌড়ে গেল গাধাটা।

সবাই একটা করে ঘোড়ায় চড়ে পিছনে দড়ি বাঁধা আরো তিন-চারটা ঘোড়া নিয়ে চলে এল পাহাড়ের উপরের গোপন আস্তানাতে।

পরের দিন ভোরবেলা চেক করে দেখা গেল মাত্র দু’টো ঘোড়া আহত হয়েছে। আর শুয়োর জনও চেতনা ফিরে পেয়ে জেগে উঠেই বমি করে দুর্গন্ধযুক্ত ব্র্যান্ডি উগরে দিয়েছে পেট থেকে।

“তোমার সাথে আমার বোঝাপড়া এখনো বাকি আছে। বুঝলে শক্ত মুখে জনকে জানিয়েই হেনড্রিকের দিকে তাকালেন লোথার, “সবকটা ঘোড়াকে নিয়ে যাবো। তারপর মরুভূমিতে কয়েকটাকে ছেড়ে দেব।” এরপর কমান্ডো স্টাইলে ডান হাত নেড়ে বললেন, “মুভ আউট!”

 পাহাড় থেকে নামিয়ে সবকটা ঘোড়াকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খাওয়ানো হল। তারপর আবার আস্তানাতে ফিরে এসে সমস্ত বোঝাসহ নিজেরাও একেকটা করে ঘোড়া পছন্দ করে চড়ে বসল।

এই ফাঁকে হেনড্রিক জানতে চাইলেন, “হাতে ক’দিন সময় পাব?”

“কৃষ্ণাঙ্গরা তো অফিসার ছাড়া কিছু করতে পারবে না। তারা ফিরবে আবার উইন্ডহক থেকে অর্ডার আর বাড়তি সেনা আনাতে গিয়ে ধরো চার থেকে পাঁচদিন।”

“তিনদিনেই আমরা বহুদূর কেটে পড়ব।” সন্তুষ্ট হলেন হেনড্রিক।

“তো এখন যাব? জিজ্ঞেস করতেই লোথার জানালেন, “দাঁড়াও আরেকটা কাজ বাকি।” এরপর নিজের ব্যাগ থেকে বাড়তি চামড়ার একটা লাগাম টেনে বের করে শেডের ভেতর বসে থাকা জনের দিকে এগিয়ে গেলেন। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখায় পায়ের আওয়াজও পায়নি জন।

“আমি কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।” বলে হাতের চামড়া ফালিটাকে নাড়ালেন।

 “মাস্টার আমার কোনো দোষ নেই।” কেঁপে উঠে তাড়াতাড়ি পায়ের ওপর দাঁড়াতে চাইল জন।

লোথার লাগামটাকে ঘোরাতেই তামার তৈরি অগ্রভাগ গিয়ে পাঁজর ঘুরে পিছনে আঘাত করল। আর জনের বাহুমূলের নিচে মাংস কেটে গেল।

ঘোঁত ঘোত করে উঠল জন, “ওরাই তো আমাকে বাধ্য

পরের আঘাতেই পা ভাজ করে পড়ে গেল জন। ছিঁড়ে গেল শার্ট। এত আর্ত চিৎকার করছে যে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একের পর এক আঘাত করে হাঁপাতে হাঁপাতে থেমে গেলেন লোথার। জনও চিৎকার থামিয়ে দিল। তার কেটে যাওয়া ক্ষত দেখে অন্যরাও সাবধান হয়ে গেল।

 সবার আগে কথা বললেন হেনড্রিক, “একদম ঠিক হয়েছে। বাকিটা কি আমি সারব?”

 “না! ওর জন্য একটা ঘোড়া রেখে দাও। যদি মন চায় আমাদের পিছু নেবে। নয়তো মন যেখানে চায় সেই নরকে যাবে।” ছেলের দিকে একবারও তাকিয়ে নিজের ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন লোথার, “অল রাইট, এগোও সবাই।”

বহুদিন পরে এতটা উজ্জীবিত বোধ করছেন। মাদকের নেশার মত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে অ্যাড্রেনালিনের গতি। আবারো তিনি হয়ে পড়েছেন এক ফেরারি আসামি; সমাজের সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্ত।

“ওহ, ঈশ্বর, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে কাঁধে একটা রাইফেল আর দু’পায়ের নিচে একটা ঘোড়া থাকলে কেমন লাগে।”

 “আবারো নিজেকে পুরুষ বলে মনে হচ্ছে।” পাশ থেকে বলে উঠলেন হেনড্রিক। ঝুঁকে ম্যানফ্রেডের উদ্দেশে বললেন, “আর তুমিও। তোমার বয়সেই তোমার বাবা আর আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম। এখন আবার আরেক যুদ্ধে যাচ্ছি।” একটু আগেই দেখা দৃশ্য ভুলে গেল ম্যানফ্রেড। নিজেকে দলের একজন হিসেবে গণ্য করে গর্বে ভরে উঠল বুক।

সে রাতেই গভীর খাদের ক্যাম্পে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাবার পর হঠাৎ করেই পাহারাদারের মৃদু শিসে সবার ঘুম ভেঙে গেল। রাইফেল কাঁধে নিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিল সবাই। একটু পরেই আঁধার কুঁড়ে এগিয়ে এল শুয়োর জন। ফোলা মুখ নিয়ে এসে দাঁড়াল ক্যাম্প ফায়ারের কাছে। এবার ওর দিকে একবারও না তাকিয়ে সবাই আবার ফিরে এসে যে যার জায়গায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। যেন কখনোই কিছু ঘটেনি।

কেবল লোথার কর্কশ কণ্ঠে জানালেন, “আমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে শোও। গা থেকে ভুরভুর করে ব্র্যান্ডির গন্ধ বেরোচ্ছে।”

দলে পুনরায় জায়গা পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল জন। সকাল হতেই পুনরায় উত্তপ্ত মরুভূমির বুকে শুরু হল যাত্রা।

***

হানি খনির পথটাই হল পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ রাস্তা। আর এখানে এলে প্রতিবার সেনটেইন ভাবেন আর নাহ, এবার মেরামত করতেই হবে। কিন্তু পরক্ষণেই জোনসের হাতের বিশাল খরচের হিসাব দেখে উঠে যায়। এ সাধ। ভাবেন, “মাত্র তো তিনদিনের ব্যাপার। বেশ অ্যাডভেঞ্চারও হয়ে যায়।”

খনিকে উইন্ডহকের সাথে টেলিগ্রাফ লাইন বসিয়ে সংযুক্ত করার জন্যও অনেক খরচ করতে হয়েছে। তাছাড়া সীমাহীন পোলের লাইনের সাথে লাগানো তামার তার নষ্ট করে দিয়েছে কালাহারির বন্য সৌন্দর্য।

প্রথম বছরের ভূমি শয়ান আর পানি পরিবহনের কথা মনে হলে এখনো নস্টালজিয়ায় ভোগেন সেনটেইন। এখন তো গভীর গর্ত থেকে পানি ভোলার জন্য উইন্ডমিল, প্রত্যেকটি স্টেশনে স্থায়ী পরিচারকের দল আছে কালাহারির প্রচণ্ড শীতে গরম খাবার আর আগুন জ্বেলে দেয়ার জন্য। এমনকি রেফ্রিজারেটরও আছে।

যাই হোক, এই তপ্ত গরমে ডেইমলারের ভেতরে বসে গায়ে ফোস্কা পড়ার দশা। কোচের মত গাড়ির ভেতরেও যদি বাতাস ঠাণ্ডা করার মেশিন বসানো যেত, হেসে ফেললেন সেনটেইন। এখনো মনে আছে কেমন করে দু’জন বুড়ো বুশম্যান তাকে উদ্ধার করেছিল। মরুভূমির মধ্যাহ্নের দানবীয় গরম থেকে বাঁচার জন্য গায়ের উপর নিজেদের প্রস্রাব আর বালি মেখে দিয়েছিল।

“হাসছ কেন মা?” জানতে চাইল শাসা।

 “আরে ধুর, তোমার জন্মেরও বহু আগের কিছু কথা মনে পড়ে গিয়েছে।”

“বলো না, প্লিজ?” ছেলেটাকে যেন এই গরম আর উষ্ণতা একটুও ছুঁতে পারেনি। অবশ্য কেন পারবে? ও নিজেও তো এই মরুভূমিরই সৃষ্টি। শাসার দিকে তাকিয়ে হাসলেন সেনটেইন। তারপর সবকিছু খুলে বললেন। শুনে তো শাসার চোখ ছানাবড়া, “তোমার নিজের পী?”

 চুপচাপ বসে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেনটেইন। একটু পরেই বদলে গেল শাসার অভিব্যক্তি। বিতৃষ্ণার বদলে দেখা গেল শ্রদ্ধা।

“দেখো!” দূরের সিংহরঙা সমতল ভূমির দিকে ইশারা করলেন সেনটেইন। তারপর ডেইমলার থামিয়ে বের হয়ে এলেন বাইরে। সামনে যেন দারুচিনি রঙা পাতলা ধোঁয়ার আস্তরণ দিগন্ত ঢেকে ফেলেছে।

 “দক্ষিণ আফ্রিকার স্প্রিংবক হরিণ। এবার এই প্রথম দেখলাম।” একসাথে একই দিকে যাচ্ছে সুদৃশ্য হরিণের দল।

 “বোধ হয় হাজার হাজার হবে।”

“এগুলো এখন উত্তরে বাস করতে যাচ্ছে।” ছেলেকে জানালেন সেনটেইন, “নিশ্চয়ই সেখানে ভালো বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাই পানির সন্ধানে যাচ্ছে।”

 হঠাৎ করেই একেবারে কাছের একটা হরিণ মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে আতঙ্কিত চিৎকার জুড়ে বাকিগুলোকেও সচকিত করে দিল। পিঠ বাকা করে লম্বা মাথা নিচু করে ঠিক যেন উড়ে যাচ্ছে হরিণের পাল।

গাড়ির উপর থেকে নিচে নেমে এসে হাসতে হাসতে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল মাতা-পুত্র দু’জনে। তারপর গাড়িতে উঠে শাসাকে হুইল ছেড়ে দিলেন সেনটেইন। সমভূমি হাওয়ায় ছেলেটা চালালোও বেশ খানিক বাদে শাসা বলল, “মা, আমরা একাকী থাকলে তুমি একেবারে বদলে যাও। এত মজা করতে পারো যে আমার সবসময় এমনটাই দেখতে ইচ্ছে করে।”

“দীর্ঘ সময় ধরে একটা কাজ বারবার করলে তখন কিন্তু বিরক্ত লাগবে। যেমন ধরো কাল আমরা খনিতে পৌঁছাবো আর তারপর সে কাজে তুমি নতুন আরেক উত্তেজনা টের পাবে। অভিজ্ঞতাও হবে। তাই প্রতিটি মুহূর্তের কাছ থেকে যতটুকু পারো নিংড়ে নাও। বুঝলে?”

জোনস আগেই খনিতে পৌঁছে গেছেন। তাই পরিচারকদেরকেও সতর্ক করে দিয়েছেন। সন্ধ্যায় রেস্ট হাউজে পৌঁছে হট শাওয়ার নিলেন সেনটেইন। তারপর পছন্দের শ্যাম্পেনও পেলেন।

“ঠাণ্ডা পা আর গরম মাথা- ওয়াইন বলো আর মানুষ বলো কারো জন্যই। ভালো না।”

একটা বোতল থেকে সবসময় সিংগেল একটা গ্লাসই পান করেন সেনটেইন। এরপর চলে এল সবুজ বেনগুয়েলা স্রোতের সুস্বাদু লবস্টার। সাথে উইন্ডহকের মচমচে লেটুস, টমেটো আর পেঁয়াজ, আর সবশেষে বুনো ট্রাফল; যা কাঁচা খেলেই জিভে লাগে কালাহারির স্বাদ।

পরদিন ভোরেরও আগে নিকষ কালো আঁধার থাকতেই আবার শুরু হল যাত্রা। ধীরে ধীরে উপরে উঠে এল দিগন্তের সূর্য। বদলে গেল চারপাশের রঙ। হয়ে উঠল পুরো রুপালি সাদা।

হঠাৎ করেই গাড়ি থামাবার আদেশ দিলেন সেনটেইন, “স্টপ হিয়ার!” তাড়াতাড়ি নেমে ডেইমলারের ছাদে উঠে গেলেন। অবাক হয়ে গেল শাসা।

“কী হয়েছে মা?”।

 “দেখো, দেখো, ওই তো! দিগন্তের একটু উপরে।”

 পুরো আকাশ জুড়ে ভেসে উঠল অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য।

“ঠিক যেন আকাশের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।” বুঝতে পেরে শাসা নিজেও উত্তেজিত হয়ে উঠল।

“আকাশে ভেসে বেড়ায় যে পাহাড়।” আপন মনেই বিড়বিড় করলেন। এতবার দেখেছেন, তবু প্রতিবারই নতুন মনে হয়।

অতঃপর আবার ডেইমলারে চড়ে শুরু হল অন্তহীন পথ। আস্তে আস্তে বদলে গেল পাহাড়ের চেহারা। কেবল শক্ত আর কর্কশ পর্বত চারপাশে। এরকমই একটা পাথুরে পাহাড়ের নিচে অবস্থিত হানি খনি। যদিও প্রকতির মাঝে দালানগুলো কেমন যেন বিসদৃশ দেখায়।

সেনটেইন জোনসকে আদেশ দিয়েছেন যতটা সম্ভব সুশ্রী দালানকোঠা নির্মাণের জন্য; যেন কাজের ক্ষতি না করেও সৌন্দর্য বজায় রাখা যায়। কিন্তু শ্রমিকদের কম্পাউন্ড, স্টিলের টাওয়ার, এলিভেটর যেমন-তেমন হলেও স্টিম বয়লারটা খুবই জঘন্য লাগে। যাই হোক, খড়ে ছাওয়া অ্যাডমিন বিল্ডিংয়ের সামনে ডেইমলার থামতেই লাফ দিয়ে ছুটে এলেন জোনস।

“ভ্রমণ কেমন হয়েছে মিসেস কোর্টনি? নিশ্চয়ই হাত-পা ধুয়ে খানিক বিশ্রাম করতে চান?”

 “আপনি তো তা ভালোভাবেই জানেন ডা. জোনস। চলুন কাজ শুরু করা যাক।” চওড়া বারান্দা পেরিয়ে নিজের অফিসে চলে এলেন সেনটেইন, “আমার পাশে বসো।” মায়ের পাশে বসল শাসা।

রিকোভারী রিপোর্ট থেকে শুরু করে খরচের শিডিউল পর্যন্ত হাজারটা সংখ্যা শুনে হিমশিম খেল শাসা। এর ভেতরেই হঠাৎ করে সেনটেইন ছেলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “বলো তো যদি আমরা গড়ে প্রতি লোডে তেইশ ক্যারাট করে পাই, তাহলে প্রতি ক্যারাটের খরচ কত পড়বে?” আচমকা প্রশ্নটা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল শাসা। ছেলের আমতা আমতা ভাব দেখে ক্ষেপে গেলেন সেনটেইন। ক্রু কুঁচকে বললেন, এটা তো স্বপ্ন দেখার সময় নয়।” তারপর আবার জোনসের দিকে মনোযোগ দিলেন।

 একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে অবশেষে উঠে দাঁড়ালেন সেনটেইন। “কাল তাহলে এখান থেকেই আবার শুরু হবে।” বিড়ালের মত আড়মোড়া ভেঙে সবাইকে নিয়ে চওড়া বারান্দাটাতে সবাইকে নিয়ে চলে এলেন।

হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “যেমনটা আগেই বলেছি শাসা আপনার হয়ে কাজ করবে। আমার ধারণা পরিবহনের ব্যাপারগুলো ওর শিখে নেয়া উচিত।”

“আমিও সেটাই বলতে চাইছিলাম, ম্যাম।”

 “তাহলে কখন আসব?” এবারে জানতে চাইল শাসা।

“শিফট তো ভোর পাঁচটা থেকে শুরু হয়ে যায়। কিন্তু মাস্টার শাসা চাইলে এক ঘন্টা পরে আসতে পারবে।” সেনটেইনের দিকে তাকালেন জোনস। কিন্তু তিনি কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। এটা আসলে শাসার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ এই বয়সী ছেলেরা ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠাটাকে বিভীষিকা বলে মনে করে। তাই সিদ্ধান্ত নেবার ভার ছেলের উপরেই ছেড়ে দিলেন সেনটেইন।

“আমি ভোর সাড়ে চারটায় মেইন গেইটে থাকব স্যার” শাসার উত্তর শুনে স্বস্তি পেলেন সেনটেইন। হাত ধরে বললেন, “তাহলে চলো আজ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতে হবে।”

রাস্তায় নেমে এল ডেইমলার। সেনটেইন নিজেই চালাচ্ছেন। শেষ মাথায় টার্ন কটেজের দোরগোড়ায় বারান্দার কিনারে হাঁটু ছড়িয়ে বসে আছে একটা মেয়ে। পরনের স্কার্ট পায়ের বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেছে।

ডেইমলার পাশ দিয়ে যাবার সময় শাসাকে দেখে ভেংচি কাটল মেয়েটা। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল শাসা। মনে এল অপরাধবোধ। পাম্প হাউসের পেছনে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথা মনে হলে এখনো লাল হয়ে ওঠে গাল। যাক! মা সোজা রাস্তার দিকে চেয়ে আছে। নিশ্চয় কিছু দেখেনি। কিন্তু বিড়বিড় করে উঠলেন সেনটেইন, “কোনো ঝামেলা হবার আগেই হতচ্ছাড়া মেয়েটাকে এখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে।”

অবাক হয়ে গেল শাসা। কোনো কিছুই মায়ের চোখ এড়ায় না। তারপরেই মেয়েটাকে দূরে পাঠিয়ে দেয়ার কথা মনে হতেই কেন যেন মোড় দিয়ে উঠল বুক। আস্তে করে জানতে চাইল, “তাহলে ওদের কী হবে মা? মানে ওর বাবার চাকরি চলে যাবে।” মা আর জোনসের মুখে ব্যয় সংকোচের কথা শুনেছে শাসা। তখন কেবল সংখ্যা মনে হলেও মেয়েটাকে দেখে সংখ্যাগুলো রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে গেল।

“জানি না ওদের কী হবে।” শক্ত হয়ে গেল সেনটেইনের মুখে, “আর জানি যে এটা নিয়ে আমাদের চিন্তা না করলেও চলবে। বাস্তব অত্যন্ত কঠিন আর সবাইকে তা মেনে নিতেই হবে। তাই ভাবতে হবে ওদেরকে ছাঁটাই না করলে আমাদের কী হবে।”

“আমাদের লোকসান হবে।”

“ঠিক তাই। আর তাহলে খনি বন্ধ করে দিতে হবে আর এই স্বল্পসংখ্যকের জন্য সবাই একসাথে বেকার হবে। নিজেদের সবকিছু আমরা হারিয়ে ওদের মতই হয়ে যাবো। তুমি কি তাই চাও?”

হঠাৎ করে ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা রেলওয়ে ক্যাম্পের নোংরা ধূলিমাখা ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল। তার জায়গায় এমনকি নিজেকেই দেখল।

“না!” তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেও গলার স্বর নামিয়ে নিল শাসা; কেঁপে উঠে জানতে চাইল, “সত্যিই কি এমন হবে মা? আমরা কি গরিব হয়ে যাব?”

“হতেও পারি সোনা। প্রতিটি মিনিট যদি কাজে লাগাতে না পারি তাহলে ভয়ংকর ব্যাপারটা ঘটে যেতেও পারে। সৌভাগ্য তৈরি করা বেশ কষ্ট কিন্তু ধ্বংস করতে একটুও সময় লাগে না।”

নিজের ইয়ট, বিশপ স্কুলের বন্ধু-বান্ধব, পোলো খেলার ঘোড়া, ওয়েল্টেভ্রেদেনের আঙুর ক্ষেতের কথা ভেবে ভয় পেয়ে গেল শাসা।

“মা সত্যিই এমনটা হবে?”

“নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। হাত বাড়িয়ে ছেলের হাত ধরলেন সেনটেইন, “এটাই তো জীবনে খেলার মজা।”

“আমি গরিব হতে চাই না।”

“না!” ছেলের মতই জোর গলায় বললেন সেনটেইন। “আমরা সাহস আর সুচতুরতার সাথে যতণ কাজ করব ততক্ষণ পর্যন্ত এরকম কিছুই ঘটবে না।”

 “তুমি যে বললে ব্যবসা থেমে যাবে। কেউ আমাদের হিরে কিনবে না…” পূর্বে এগুলো নিছক শব্দ হলেও এখন সম্ভাবনা হয়ে দেখা দিল শাসার মনে।

“সবসময় মনে রাখবে যে কোনোদিন চাকা ভিন্ন দিকে ঘোরা শুরু করবে। তাই গোল্ডেন রুলসগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। মনে আছে সেগুলো কী কী? প্রথমটা বলো তো?” ছেলের কাছে জানতে চাইলেন সেনটেইন।

“যখন সবাই বেচবে তখন তুমি কিনবে, যখন সবাই কিনবে তখন তুমি বিক্রি করবে।” সাথে সাথে উত্তর দিল শাসা।

“গুড। আর এখন কী হচ্ছে বলো তো?”

“সবাই কেনার চেষ্টা করছে।”

ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই চওড়া হাসি হাসল শাসা।

 “আমার ছেলেটা আসলেই খুব সুন্দর আর সহজাত প্রতিভার অধিকারী।” আপন মনে ভাবলেন সেনটেইন। তারপর অপেক্ষা করলেন। দেখা যাক কতদূর পর্যন্ত বুঝতে পারে শাসা। কুণ্ডুলি পাকানো সাপের বিষদাঁত খুঁজে পাবে কিনা দেখা যাক। আর তৎক্ষণাৎ বিষণ্ণ হয়ে বদলে গেল শাসার অভিব্যক্তি।

“কিন্তু মা, আমাদের কাছে টাকা না থাকলে কীভাবে কিনব?”

রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে ইঞ্জিন বন্ধ করলেন সেনটেইন। তারপর সিরিয়াস ভঙ্গিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে ওর দু’হাত ধরলেন।

“এখন তোমাকে আমি যা বলব তা আমাদের বিজনেস সিক্রেট। এটা কারো সাথেই শেয়ার করা যাবে না। দাদু, অ্যানা, টুয়েন্টিম্যান জোনস, আব্রাহাম কারো সাথে না। শুধু আমার আর তোমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে ঠিক আছে?” শাসা মাথা নাড়তেই গভীরভাবে দম নিলেন সেনটেইন, বললেন, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে দুনিয়ার উপর নেমে আসা এ বিপর্যয় হচ্ছে। আমাদের উন্নতির কেন্দ্রস্থল। যে সুযোগটা সবাই পায় না। তাই গত কয়েক বছর ধরেই আমি এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। কীভাবে জানো?” মায়ের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে না সুলভ মাথা নাড়ল শাসা।

“আমি খনি আর ওয়েন্টেভেদেন ছাড়া বাকি সবকিছুকে ক্যাশ বানিয়ে ফেলেছি। এমনকি এগুলো দেখিয়ে প্রচুর ধারও করেছি।”

“এই কারণেই মাছের ফ্যাক্টরি, ওয়ালবিস বে’তে গিয়েছি? তুমি এখন টাকা চাও?”

“হ্যাঁ।” ছেলেকে উৎসাহ দিলেন সেনটেইন। এরপর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল শাসার চেহারা।

“তুমি কি এখন কিনবে?”

“আমি শুরুও করে দিয়েছি।” খুশি হলেন সেনটেইন, “জমি, মাছের ঘের, খনি এমনকি কেপটাউনে থিয়েটার পর্যন্ত। তবে সবচেয়ে বেশি কিনেছি জমি। মাত্র দুই শিলিং দিয়ে এক একর। চাইলে আরো কেনা যাবে। আর জমি-ই হল সম্পদ ধরে রাখার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায়, বুঝলে!”

 শাসা সবটুকু বুঝতে না পারলেও মায়ের চোখের দৃষ্টি দেখে এর বিশালতা ঠিকই অনুভব করল।

“এখন তুমি আমাদের সিক্রেট জেনে গেলে।” হেসে ফেললেন সেনটেইন, “আর আমার ধারণা যদি সঠিক হয় তাহলে আমাদের এই ভাগ্য দ্বিগুণ, তিনগুণ রূপ নেবে বুঝলে?”

“কিন্তু যদি পরিবর্তন না ঘটে” সঠিক শব্দটা স্মরণ করে শাসা বলল, “মন্দা চলতেই থাকে তাহলে কী হবে মা?”

ঠোঁট বাঁকিয়ে ছেলের হাত ছেড়ে দিলেন সেনটেইন, “কোনো কিছু নিয়েই এত ভাবিত হতে নেই, ডিয়ার।”

এরপর ডেইমলারের ইঞ্জিন স্টার্ট করলেন সেনটেইন। গাড়ি চালিয়ে চলে এলেন পথের শেষের একাকী বাংলোর কাছে।

 সিঁড়ির নিচে গাড়ি পার্ক করে ইঞ্জিন বন্ধ করে আবারো তাকালেন ছেলের দিকে।

“না, শাসা ডার্লিং, আমরা গরিব হব না। বরঞ্চ আগের চেয়েও বেশি ধনী হয়ে যাব। আর তারপর তোমার মাধ্যমে পাব ক্ষমতা। দোর্দণ্ডপ্রতাপ আর দারুণ সৌভাগ্য। ওহ, ডিয়ার এ সব কিছুই আমি প্ল্যান করে রেখেছি। খুব সাবধানে প্ল্যান করেছি!”

***

মায়ের কথাগুলোই ঘুরতে লাগল শাসার মাথায়। রাতে একটুও ঘুম হল না। স্বপ্নের ঘোরে নিজের গায়ে দেখল চিতার চামড়ার পোশাক আর প্রচণ্ড শক্তি। ছাড়া ছাড়া ঘুমের মাঝে কাছে এল অ্যানালিসা। নিজের স্কার্ট আস্তে আস্তে উঠিয়ে তাকিয়ে রইল শাসার চামড়ার পোশাকের দিকে। অবচেতনেই পাজামার নিচে চলে গেল ছেলেটার হাত। আর যতবার অ্যানার কথা ভাবছে তীব্র হচ্ছে সুখের অনুভূতি। অবশেষে উষ্ণ তরলে ভিজে গেল শাসার পাজামার কোমরের অংশ। এত অবসন্ন হয়ে পড়ল যে ওঠার শক্তিটুকুও রইল না।

ভোরবেলা কফি আর শক্ত মিষ্টি বিস্কিটের ট্রে হাতে ঘুম হতে জাগাল গৃহপরিচারক। বাইরে তখনো গাঢ় অন্ধকার। মাথার উপর বালিশ চাপা দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল শাসা।

কিন্তু ওভাম্বো পরিচারক জানাল, “ম্যাডাম আমাকে বলেছেন তুমি না ওঠা পর্যন্ত যেন দাঁড়িয়ে থাকি।” অগত্যা বহুকষ্টে বিছানা থেকে নিজেকে টেনে তুলল শাসা। তারপর বাথরুমে যাবার সময় এমনভাবে হাত দিয়ে ঢেকে রাখল যেন পাজামার সামনের অংশের শুকনো দাগ দেখা না যায়।

সহিসদের একজন টাট্ট ঘোড়া নিয়ে শাসার জন্য অপেক্ষা করছিল। বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে নেমে লাগাম হাতে নিল শাসা। সহিস আর ঘোড়া দুটোই যেহেতু পূর্ব পরিচিত তাই খানিকটা হাসি-তামাশাও হল।

এরপর পাইপগুলোকে অনুসরণ করে শর্টকার্ট রাস্তায় পাহাড়ের কাঁধে চড়ে উঠল শাসা। এই পাইপ লাইনের মাধ্যমেই পাহাড়ি ঝরনার পানি খনি ও ওয়াশিং গিয়ারে পৌঁছায়।

পাহাড়ের চূড়ায় দেখা দিল সূর্য। জীবন্ত হয়ে উঠল নিচের সমভূমি। পাহাড়ের এই অংশে সেনটেইনের নির্দেশে কোনো হাতই দেয়া হয়নি। তাই অরণ্য তার আপন মহিমা নিয়েই বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে। সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে লম্বা লম্বা সব মোপানি।

কিন্তু পাহাড়ের চুড়ার কোনা ঘুরে এদিকে এলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। সৌন্দর্যবিহীন চারকোনা সব লোথার দালান, ওয়াশিং গিয়ারের জঘন্য স্তূপ।

ঘোড়ার পেটে আস্তে করে গোড়ালি দিয়ে গুতো দিল শাসা। কয়েক মাইল দৌড়ে জন্তুটা তাকে মেইন গেইটে পৌঁছে দিল। মাত্র একটু আগেই গ্রাম থেকে এসে পৌঁছেছে টুয়েন্টিম্যান জোনসের পুরনো ফোর্ড। হেডলাইট পর্যন্ত এখনো জ্বলছে। গাড়ি থেকে নেমে হাতঘড়ি চেক করে মন খারাপ করে ফেললেন জোনস। শাসা ওনার চেয়ে তিন মিনিট আগে পৌঁছেছে।

“আর কখনো পরিবহন শিল্প দেখেছো মাস্টার শাসা?”

“না, স্যার।” উত্তরে জানাল শাসা। মন চাইল বলে যে মা কখনো দেয়নি। কিন্তু কেন যেন বলল না। তবে প্রথম বারের মত মনে খানিকটা উম্মাও এল মায়ের সর্বময় খবরদারির প্রতি।

এরপর শাসাকে শিফট বসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন জোনস। সাথে আদেশ দিলেন, “মাস্টার শাসা তোমার সাথে কাজ করবে। কিন্তু বাড়তি কোনো খাতিরের দরকার নেই। ওর সাথে অধীনস্ত যে কোনো তরুণদের মতই আচরণ করো। তবে হ্যাঁ, একদিন সেই হবে তোমার ম্যানেজিং ডিরেক্টর।” এতটা বিষণ্ণ চেহারা নিয়ে জোনস্ তামাশা করেন যে কেউ হাসার সাহসই পায় না।

যাই হোক, সাথে আরেকটা আদেশও দিলেন, “যাও, মাস্টার শাসার জন্য একটা টিনের হেলমেট নিয়ে আসো।” একটু পরে শাসাকে নিয়ে খাড়া চূড়ার পাদদেশে চলে এলেন জোনস। চূড়ার নিচের বাকানো টানেলের মধ্য দিয়ে স্টিলের রেলপথ খানিকটা এগিয়েই পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি মোচড় খেয়ে হারিয়ে গেছে গভীর অন্ধকারে। শাসাকে নিয়ে প্রথম ট্রাকে চড়ে বসলেন জোনস।

প্রথমদিকে চারপাশের অন্ধকার দেখে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করল শাসা। কিন্তু পেছনের ট্রাকগুলোতে গান গাইছে ধূলিমাখা ওভারঅল আর হেলমেট পরিহিত কৃষ্ণাঙ্গ ওভাষো শ্রমিক। তাদের সুরেলা কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পুরো টানেল জুড়ে। শাসার আচরণও তাই সহজ হয়ে এল।

“একশ’ টন উইন্ডিং গিয়ারে একেকবারে ষাট বার পর্যন্ত আকরিক লোড করা যায়। আমাদের টার্গেট হল প্রতি শিফটে ছয়শ’ বার লোড করা।”

 মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে শাসা। জানে মা সন্ধ্যাবেলায় নির্ঘাৎ প্রশ্ন করবে। কিন্তু অন্ধকার আর গানের সুরে মনোসংযোগ খানিকটা নষ্টও হচ্ছে। হঠাৎ করেই সামনের কয়েন সাইজের উজ্জ্বল আলোর বিন্দুটা বড় হতে হতে টানেলের শেষ মাথায় এত আলোকিত হয়ে উঠল যে, মনের অজান্তেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল শাসা। ওয়েল্টেভ্রেদেনে মায়ের ডেস্কে ছবি দেখলেও বাস্তবে জায়গাটা এত বিশাল হবে শাসা কল্পনাও করেনি।

পাহাড়ের মাঝখানে পুরোপুরি নিখুঁত গোলাকার একটি গর্ত পাশে ককপিটের মতই ধূসর পাথরের গোলাকার দেয়াল। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁক হয়ে এগিয়ে যাওয়া ট্র্যাক ধরে পুরো দুইশ ফুট নিচের খনন ক্ষেত্রের মেঝেতে নেমে এল সকলে। দু’পাশে তাকিয়ে শাসার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়।

টুয়েন্টিম্যান জোনস এখনো লেকচার দিয়ে চলেছেন, “এটা অগ্যৎপাতের ফলে সৃষ্ট একটা পাইপ। পৃথিবীর সূচনালগ্নে এই গর্ত দিয়েই উপরে উদৃগিরিত হতে উত্তপ্ত লাভা। সূর্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা আর বিশাল চাপে পরবর্তীতে লাভা থেকেই গড়ে উঠেছে হিরে।” সমানে মাথা ঘুরিয়ে এক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত খনির বিশালতু মাথায় ধারণ করার চেষ্টা করছে শাসা।” টুয়েন্টিম্যান বলে চললেন, “তারপর পাইপের নিচের গভীরের ম্যাগমা ঠাণ্ডা হয়ে জমে যায়। তো উপরের লেয়ার যেটা বাতাস আর সূর্যের কাছাকাছি এসেছে তা অক্সিডাইজড হয়ে পরিণত হয় “ক্লাসিকাল ইয়েলো গ্রাউন্ড”। এখানে এগারো বছর ধরে কাজ করার পর মাত্র সেদিন আমরা “রু গ্রাউন্ডে” এসে পৌঁছেছি। আর বুঝতেই পারছো এটাই হল সেই গভীরের ম্যাগমা যা শক্ত হয়ে হিরেতে পরিণত হয়েছে।”

ট্রাক থেকে লাফিয়ে নিচে নামল সবাই।

“আমাদের কাজ একেবারেই সোজাসাপ্টা।” বলে চললেন জোনস, “সূর্যের প্রথম রশির সাথে সাথে শুরু হয় নতুন শিফট। গত সন্ধ্যার বিস্ফোরণ দিয়েই এদের কাজের সূচনা হয়। প্রথমেই মেঝের ভাঙা অংশ উপরে পাঠিয়ে তারপর ড্রিল দিয়ে ছোট ছোট গর্ত করে চার্জ সেট করা হয়। সূর্য ডুবলে এ শিফট শেষ হয় আর শিফট বস ফিউজ জ্বালিয়ে দেয়। বিস্ফোরণের পর পরিবেশ শান্ত হবার জন্য সারারাত কাজ বন্ধ রাখা হয়। পরের দিন সকাল বেলা পুরো প্রক্রিয়াটা আবার নতুন করে শুরু হয়। এরপর ধূসর-নীল ভাঙাচোরা পাথরের একটা অঞ্চল দেখিয়ে জোনস বললেন, “এটা হল গত রাতের বিস্ফোরণ। আজ আমরা এখান থেকেই কাজ শুরু করব।”

 শাসা নিজেও বুঝতে পারেনি যে, পুরো কাজটাতে এতটা আনন্দ পাবে। তাই দিন গড়াতে লাগল আর তার আগ্রহ বাড়তে লাগল। এমনকি গরম আর ধূলাকেও গ্রাহ্য করল না। তবে ব্যাপারটাকে স্বীকার করলেন জোনস, “ধূলা শ্রমিকদের ফুসফুসে পৌঁছে পাথর হয়ে যায়। তাই আমাদের উচিত হোস পাইপ ব্যবহার করে আকরিককে ভেজা রাখা যেন ধূলা না ওড়ে। কিন্তু ওয়াশিং গিয়ারের জন্যও পর্যাপ্ত পানির অভাব আছে। তাই পানি নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। আর শ্রমিকেরা ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে পড়ে, মারা যায়। তবে হ্যাঁ, তাদেরকে কিংবা তাদের বিধবাদেরকে ভালো অংকের পারিশ্রমিকও দেই।”

এভাবেই কেটে গেল সারাদিন। দুপুরবেলা শাসাকে ডাক দিলেন জোনস, “তোমার মা তোমাকে মাত্র এক শিফট কাজ করতে বলেছেন। আমি এখন উপরে যাচ্ছি। তুমি যাবে?”

“না, স্যার।” দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিল শাসা, “ওরা কীভাবে বিস্ফোরণের জন্য গর্ত বানায় আমি সেটাও দেখতে চাই।”

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে চলে গেলেন জোনস।

যাই হোক সন্ধ্যাবেলা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে শাসাকে ফিউজ জ্বালাতে দিল শিফট বস। পেঁচানো সাদা ফিউজে আগুন ধরাতেই রঙ হয়ে গেল কালো। মাথার উপর দেখা গেল নীল ধোয়া।

কাজ শেষ করে শ্রমিকদের কণ্ঠে “ফায়ার ইন দ্য হোল!” শুনতে শুনতে উপরে উঠে গেল শাসা আর শিফট বস। খানিক বাদেই কেঁপে উঠল পায়ের নিচের মাটি।

পুনরায় ঘোড়ায় চেপে পাইপ লাইনের রাস্তা ধরে বাংলোতে ফিরে এল শাসা। কিন্তু গা ভর্তি ধূলা আর ঘাম ও ক্লান্তি সত্ত্বেও কেন যেন নিজেকে এতটা সুখী আর কখনোই বোধ করেনি।

 হঠাৎ করেই রুপালি রঙা পানির পাইপের উপর উঠে এল অ্যানা। ব্যাপারটা এতটাই আকস্মিক যে শাসার ঘোড়াও চমকে লাফ দিয়ে উঠল। আরেকটু হলেই পিঠ থেকে পড়ে যেত শাসা।

 চুলে বুনো ফুল গুঁজে রাখা অ্যানাকে দেখে ঠিক ওয়েল্টেভ্রেদেনের লাইব্রেরির সংরক্ষিত অংশে থাকা বইয়ের বনপরীদের মত লাগছে। মা সেগুলো পড়ার অনুমতি না দিলেও পকেট মানি বাঁচিয়ে শাসা ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে ঠিকই দেখেছে স্বচ্ছ পোশাক পরিহিত সেসব পরীদের ছবি।

 “হ্যালো, অ্যানালিসা” কেঁপে উঠে শাসার গলা। বেড়ে গেল বুকের ধুকপুকুনি। হাসলেও কিছু বলল না অ্যানা। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এল শাসা। কিন্তু স্কার্ট উপরে তুলে ক্রিম রঙা ঊরুর ঝলক তুলে পাইপ লাইনের ওপারে গভীর পাহাড়ে হারিয়ে গেল মেয়েটা। পিছু পিছু দৌড় দিল শাসা। কাঁটা ঝোপে বেঁধে গেল পা, কেটে গেল মুখের চামড়া। এমনকি পাথরের উপর ধাক্কা খেয়ে দুড়ম করে পড়ে গেল মাটিতে। তারপর যখন উঠল উধাও হয়ে গেছে অ্যানা।

খানিক পরে নিজের আবেগ সংযত করে আবার পাইপ লাইনের কাছে ফিরে এল শাসা। কিন্তু ততক্ষণে হাওয়া হয়ে গেছে ঘোড়াটা। নিজের উপরেই অসম্ভব রাগ করল শাসা।

এদিকে ঘোড়াটাকে একা ফিরতে দেখে বাংলোতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সেনটেইন। তাই গভীর রাত হয়ে গেলেও শাসাকে ফিরতে দেখে তৎক্ষণাৎ শান্ত হয়ে গেলেন। ভুলে গেলেন ক্রোধ।

এক সপ্তাহ ধরে নিয়মিত ধূলা আর গরমের মধ্যে কাজ করতে করতে একঘেয়ে হয়ে পড়ায় শাসাকে কপিকল রুমে পাঠিয়ে দিলেন জোনস। কিন্তু স্বল্পবাক গোমড়ামুখো কপিকল ড্রাইভার শাসাকে নিজের কন্ট্রোল সুইচ ছুঁতে দিতে চান না। তাই দু’দিন পরে শাসাকে উইদারিং গ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দিলেন জোনস।

এখানে হানি মাইনের মজুদ রাখা হয় আর কাজ করে কোমর সমান উদোম একদল ওভাষো শ্রমিক। চারটা পোলো মাঠের সমান জায়গায় ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার টন আকরিক। প্রথমে বেশ শক্ত থাকলেও সূর্যের আলোয় ছয় মাস রেখে দিলে তবেই কেবল ভাঙার মত নরম হয়। তারপর ফ্যাক্টরিতে নিয়ে ওয়াশিং গিয়ারে ঢালা হয়।

শুরুতেই চল্লিশজন ওভাষো শ্রমিকের চার্জ দেয়া হলেও শীঘ্রিই বস-বয়ের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে শাসা। কর্মক্ষেত্রে ওর নাম মোজেস। বয়স পনেরোর ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান, চটপটে আর ইংরেজি ও আফ্রিকান দুই ভাষাই বলতে পারে।

একসাথে লাঞ্চ ব্রেক কাটাবার সময় ছেলেটাকে পড়াশোনা সাহায্য করে শাসা। আর মোজেস ওকে নিজের ভাষা শেখায়।

 মজার ব্যাপার হল শাসার বয়স মাত্র চৌদ্দ। আর ওর অধীনস্তদের বেশিরভাগেরই বয়স তিনগুণ বেশি হলেও সবাই শাসার হাসি আর তাদের ভাষা শেখার কষ্টকর প্রয়াস দেখে খুশি হয়। কয়েকদিনের মাঝে দেখা গেল অন্য গ্রাউন্ড টিমদের চেয়ে একটা করে লোড বেশি করতে পেরেছে শাসার টিম। এমনকি নিগার লাভারস হিসেবেও খ্যাতি জুটে গেল। যদিও শ্বেতাঙ্গ সুপার ভাইজারের এ টিপ্পনীতে কান দিল না শাসা।

তৃতীয় শনিবারের দুপুর বেলায় শ্রমিকদের পাওনা মিটিয়ে দেয়ার পর মোজেসের আমন্ত্রণে ওর ঘরে গেল শাসা। মোজেসের লাজুক আর সুন্দরী বউ আবার মোর মিল্কও খেতে দিল। খানিক বাদে বাংলো থেকে লুকিয়ে নিয়ে আসা হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড বের করে মোজেসকে পড়তে সাহায্য করল শাসা।

তবে কিছুদূর পড়ার পর মোজেসের উপলব্ধি হল, “এটা বেশ দুরূহ কাজ। তার বদলে এটা পড়া যাক।” শাসাকে অত্যন্ত বাজে মানের হলদেটে নিউজ প্রিন্ট এনে ধরিয়ে দিল মোজেস। কোলের উপর পাতাটাকে মেলে ধরল শাসা। সম্পাদকীয় পড়ে বিস্মিত হয়ে গেল, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস কি? জাবাভু কে?” আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিল মোজেস। কিন্তু শুনে অস্বস্তিতে পড়ে গেল শাসা।

 “বান্টুর পিতা জাবাভু, সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের পিতা। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসই আমাদের ভালো-মন্দের খোঁজ রাখে।”

 “বুঝলাম না। মাথা নাড়ল শাসা। আলোচনা যেদিকে যাচ্ছে তা ওর ভালো লাগল না। এর উপরে আবার মোজেসের কবিতা শুনে কুঁকড়ে উঠল।

তোমাদের বাছুরেরা চলে গেছে। যাও এগুলোকে ধরে আনো। কলম হাতে তুলে নাও। কাগজ আর কালিও নাও। কারণ এটাই হবে তোমাদের ঢল। তোমাদের অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে কলম তুলে নিয়ে কালি ভরে নাও। কলম হাতেই যুদ্ধ করো।

“এটা তো রাজনীতি” মোজেসের গানে বাধা দিল শাসা, “এটা তো শ্বেতাঙ্গদের ব্যাপার।”

মোজেসের হাসি-খুশি ভাব দমে গেল। শাসার কোল থেকে সংবাদপত্র তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার পড়া শেষ হলে তোমার বইটা ফিরিয়ে দেব।” শাসার দৃষ্টি এড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেল বেচারা।

***

সোমবারে উদারিং গ্রাউন্ডের মেইন গেইটে শাসাকে থামিয়ে দিলেন জোনস, “আমার মনে হয় তুমি এখানকার সবকিছু জেনে গেছ মাস্টার শাসা, এখন মিল হাউস আর ওয়াশিং গিয়ার দেখার সময় হয়েছে।”

রেললাইনের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে মেইন প্লান্টে যাবার সময় অন্যমনস্কভাবে জোনস বললেন : “কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের খুব কাছে যাওয়াটা ঠিক নয় মাস্টার শাসা। ওরা কেবল তোমার কাছ থেকে ফায়দা লুটতে চাইবে।”

আচমকা কথাটা শুনে বিস্মিত হয়ে গেল শাসা, “মোজেস” আরে ধুর, ওতো বেশ মজার, স্যার।”

“হুম। আর তার নিজের পক্ষে ক্ষতিই বটে।” তিক্ত মুখে সম্মত হলেন জোনস, “সবচেয়ে বুদ্ধিমানরাই ঝামেলা বাধাতে ওস্তাদ। তোমার বন্ধু মোজেস কৃষ্ণাঙ্গ খনি শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ে তুলতে চাইছে।”

 দাদা আর মায়ের কাছ থেকে শাসা শুনেছে যে বলশেভিক আর ট্রেড ইউনিয়নিস্টরাই হল সবচেয়ে ভয়ংকর দানব, যারা সভ্য সমাজের কাঠামো ভেঙে দিতে চায়। তাহলে মোজেসও কি তাদের একজন? জোনস এদিকে বলেই চললেন, “আমাদের সন্দেহ সে “অবৈধ হিরে কেনা” জাতীয় ইউনিয়নের সাথেও জড়িত।”

কিন্তু শাসার মন কিছুতেই এ ধারণা মেনে নিতে চাইছে না। কিন্তু জোনসের পরের কথাটা শুনে তো মন একেবারে ভেঙে গেল।

এ মাস শেষে ছাঁটাইয়ের লিস্টে বোধ হয় মিঃ মোজেসকেই সবার আগে রাখা হবে। ছেলেটা বিপজ্জনক। সরিয়ে দেয়াই ভালো।”

“আমরা দু’জন বন্ধু, তাই ওরা মোজেসের সাথে এমন করছে।” কাতর হয়ে ভাবল শাসা, “এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না!” অপরাধবোধের পাশাপাশি মনে তীব্র রাগও জন্মালো। কিন্তু জোনসের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল যে কিছু বলাটা মোজেসের জন্য আরো খারাপ হবে।

তাই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আপনিই জানেন কোনটা ভালো হবে।” মনে মনে ভাবল, “মা, মা-কে বলতে হবে। ইশ, যদি আমি নিজেই ঠিক করতে পারতাম যে কী করা হবে!” তারপরেই খেয়াল হল মা বোধ হয় ক্ষমতা বলতে এটাকেই বুঝিয়েছে।

“ক্ষমতা” আপন মনেই বিড়বিড় করল শাসা, “একদিন আমার ক্ষমতা হবে, অনেক ক্ষমতা।”

***

মিল হাউজের কাজটা আরো বেশি ইন্টারেস্টিং। বিশাল বিশাল মেশিনগুলো বেশ শক্তিশালীও বটে। এখানে ওয়াশিংগিয়ারের জন্য আকরিকগুলোকে একটা সঠিক আকারে ভেঙে ফেলা হয়। প্রতি ঘন্টায় একশ পঞ্চাশ টন আকরিক নির্দিষ্ট সাইজে ভেঙে পড়ে।

অ্যানার ভাই স্টোফেলকে শাসার দায়িত্ব দেয়া হল। আর এতে তো ছেলেটা মহা খুশি।

 “রোলারের সেটিংস করার সময় তোমাকে কিন্তু বেশ সতর্ক থাকতে হবে। নয়ত এত সাধের হিরে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে গুড়ো পাউডার হয়ে যাবে!” গম্ভীর মুখে সদ্য প্রাপ্ত কর্তৃত্ব ঝরল স্টোফেল।

“চলো শাসা তোমাকে গ্রিজ পয়েন্ট দেখাই। প্রতি শিফটের শুরুতেই সমস্ত পয়েন্টে গ্রিজ লাগানো হয়।” গর্জনরত রোলারের নিচে ঢুকে চিৎকার করে শাসাকে জানাল, “গত মাসে এক শ্রমিক বিয়ারিংয়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আর যায় কোথায়, মুরগির পাখনার মত ছিঁড়ে গেছে বেচারার হাত। কত রক্ত যে গেছে তুমি যদি দেখতে!”

দুপুরবেলায় লাঞ্চের বাঁশি শুনে মিল হাউজের ওপাশে শেড দেয়া ঘরে চলে এল শাসা আর স্টোফেল। ওয়ার্কম্যানদের নীল ওভারঅল গায়ে দিয়ে ঘুরছে, লাঞ্চবক্স খুলে স্টোফেলের সাথে খোলামেলাভাবে খেতে বসেছে; সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বোধ করল শাসা। এ ক’দিনে বয়স যেন কয়েক বছর বেড়ে গেছে।

নিজের খাবার থেকে স্টোফেলকেও সাধল শাসা। কিন্তু ছেলেটা প্রত্যাখ্যান করে বলল, “নো ম্যান। ওই তো আমার দিদি লাঞ্চ নিয়ে আসছে।” হঠাৎ করেই বাংলো থেকে আনা চিকেন, স্যান্ডউইচ আর জ্যাম রোল শাসার কাছে অখাদ্য বলে ঠেকল।

মিল হাউজের গেইট দিয়ে ছন্দময় ভঙ্গিতে সাইকেল চালিয়ে ভেতরে এল অ্যানা। উন্মাতাল বাতাস এসে এলোমেলো করে দিল মেয়েটার পোশাক। ফলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যৌবনোদ্দীপ্ত ভরা বুক।

মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল শাসা। ভাইয়ের পাশে ওকে বসে থাকতে দেখে অ্যানার অভিব্যক্তিও বদলে গেল।

“লাঞ্চে কী এনেছে লিসা?” জানতে চাইল স্টোফেল।

“সসেজ আর ম্যাশ।” ভাইয়ের হাতে ক্যানটিন তুলে দিল অ্যানা, “সবসময় যা আনি।”

অ্যানার হাত-কাটা ড্রেসের নিচে শাসার চোখে পড়ল মেয়েটার বাহুমূলের কেশ।

“ধুর, রোজ রোজ সসেজ আর ম্যাশ,” সত্যিই বিতৃষ্ণা বোধ করল স্টোফেল।

“পরেরবার মাকে বলব স্টেক আর মাশরুম রান্না করতে।” শাসা বুঝতে পারল যে ও হাঁ করে তাকিয়ে আছে; কিন্তু চোখ নামাতেও পারছে না। মেয়েটা অবশ্য সরাসরি ওর দিকে এখনো একবারও তাকায়নি।

“তুমি চাইলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো” স্টোফেলকে প্রস্তাব দিল শাসা।

 “চলো তাহলে আজ অদল-বদল করে খাই।” শাসার প্রস্তাব লুফে নিল স্টোফেল। আর ওর বাড়িয়ে ধরা ক্যানটিনের মধ্যে শাসা দেখল পাতলা তেলতেলে ঝোলের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে একতাল আলু ভর্তা।

“আমার ক্ষুধা পায়নি প্রথম বারের মত অ্যানার সাথে কথা বলল শাসা। “তুমিও একটা স্যান্ডউইচ খাও অ্যানালিসা?”

কোমরের ওপর নিজের স্কার্টটাকে ঠিকঠাক করে বুনো বিড়ালের মত তাকাল অ্যানা। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি।

 “যখন আমি তোমার কাছ থেকে কিছু চাইব শাসা কোর্টনি তখন ঠিক

বেই শিষ দেব” বলে ঠোঁট দুটোকে গোল করে সাপুড়ের মত বাঁশি দিয়ে আঙুলে গোপন এক ইঙ্গিত করল অ্যানা।

 হাসতে হাসতে শাসার হাতে ঘুসি বসিয়ে দিল স্টোফেল, “তুমি এবার শেষ, বাছা?”

লজ্জায় বেগুনি হয়ে বসে রইল শাসা। নিজের সাইকেল নিয়ে চলে গেল আনা; কিন্তু ইচ্ছে করে এমনভাবে পেডাল চাপল যে নড়ে উঠল গোলাকার পশ্চাৎদেশ।

সেদিন সন্ধ্যায় ঘোড়া প্রিস্টর জনকে নিয়ে আবার পাইপ লাইনের ধারে এল শাসা। আশা নিয়ে এলেও ভাবছে যদি মেয়েটা না আসে। তাই আচমকা ওকে পাইপ লাইন খাড়া রাখার পিলারের কাছে দেখে চমকে উঠল শাসা।

 “আমার হাত ধরো” শাসাকে প্রস্তাব দিল অ্যানা। তারপর উঠে এল প্রিস্টরের কাঁধে, শাসার পাশে। “বাম দিকে যাও।” রাস্তা দেখিয়ে দিল কোথায় যেতে হবে। এভাবেই নিঃশব্দে কেটে গেল দশ মিনিট।

খানিক বাদে পাথুরে ছাওয়া ঢালের কিনারে এসে নিচে নেমে গেল অ্যানা।

“হেই নিচে যেও না। ব্যথা পাবে” সাবধান করে দিল শাসা। কিন্তু মেয়েটা শুনল না। নিচে নামতে গিয়ে হাঁফ ছাড়ল ছেলেটা। চোখ তুলে তাকাতেই দেখল মাথার উপর সুউচ্চ টাওয়ারের মত দুলছে পাহাড়ের চূড়া।

“চলো তোমাকে গোপন একটা জিনিস দেখাচ্ছি কিন্তু শপথ করো যে কাউকে বলবে না। ঠিক আছে।”

“ওকে। শপথ করে বলছি কাউকে বলব না।” সম্মত হল শাসা।

পাথরের একগাদা বড় বড় চাইঅলা একটা স্থানে শাসাকে নিয়ে এল অ্যানা। এখানে গাছের ডাল সরাতেই পাওয়া গেল একটা ফোকর। দেখা গেল মেঝেতে বেশ কয়েকটা কাঁচের জার পড়ে আছে। কিন্তু শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেছে ভেতরে রাখা বুনোফুল। এর পেছনে সাদা হাড়ের তৈরি ছোট্ট একটা পিরামিড যেটার একেবারে চূড়ায় একটা নরকংকাল।

“কে?” খানিকটা ভয় পেয়ে গেল শাসা।

 “পর্বতের অপদেবতা।” শাসার হাত ধরল অ্যানা।

 “তুমি কীভাবে জানো?”

 “আমার সাথে কথা হয়েছে তো!”

 শাসা এতটাই ভয় পেয়ে গেল যে আর কোন প্রশ্ন করার সাহস পেল না।

“তুমি চাইলে তোমার একটা ইচ্ছে এখানে পুরণ করতে পারো।” ফিসফিস করে বলল অ্যানা।

“যেকোনো কিছু?” একটু ভেবে জানতে চাইল শাসা।

 “হ্যাঁ। যেকোনো কিছু।” আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে অ্যানা।

খানিকটা এগিয়ে এসে নরকংকালের সাদা হাড়ের গায়ে হাত রাখল শাসা। আপনা থেকেই বুকের গভীরে ছড়িয়ে পড়ল এক ধরনের উষ্ণতা আর আনন্দ। প্রায় স্বপ্নতর কণ্ঠে বলে উঠল, “আমি অনেক ক্ষমতা চাই।” হঠাৎ করেই কেমন যেন চিনচিন করে উঠল আঙুলের ডগা; যেন বিদ্যুতের শক খেয়েছে। ঝট করে হাত সরিয়ে নিল শাসা।

ক্ষেপে উঠল অ্যানা, “ধুর! বোকা ছেলে! কেউ এরকম কিছু চায় নাকি?”

 “আচ্ছা চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদেরকে যেতে হবে।” আবারো পাহাড় চূড়ায় উঠে এল দু’জনে। পথশ্রমে উভয়েই হাঁপাচ্ছে।

কিছু না বলে নিজের স্কার্ট তুলে ধরল অ্যানা। দেখা গেল লম্বা একটা লাল আঁচড়ের দাগ। নিশ্চয়ই কাটা ঝোপে লেগে কেটে গেছে।

“খানিকটা থুথু লাগিয়ে দাও।” অ্যানার কথায় শাসার হুঁশ ফিরল। এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল অ্যানার ক্ষত।

 “উঁহু। জিভ দিয়ে।” শাসা হাঁটু গেড়ে বসে আঙুল থুথু দিয়ে ভিজিয়ে নিলেও পাল্টা আদেশ দিল অ্যানা।

 সামনে ঝুঁকে আদেশ মত কাজ করতেই শাসার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিল মেয়েটা।

***

আচমকা ঘুম ভেঙে যেতেই কেঁপে উঠল শাসা। প্রথমে বুঝতেই পারল না যে কোথায় আছে। পিঠের নিচে পাথুরে মাটি অত্যন্ত শক্ত আর বুকের উপরেও প্রচণ্ড ওজনদার কী যেন আছে। মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাতেই দেখল অন্ধকার হয়ে গেছে। তারা’র আলোয় একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে প্রিস্টর জন।

হঠাৎ করেই সবকিছু মনে পড়ে গেল। বুকের উপর এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে আছে অ্যানা। শাসা এত জোরে মেয়েটাকে ধাক্কা দিল যে চিৎকার করে জেগে উঠল অ্যানা।

 “অন্ধকার হয়ে গেছে! ফিরে যেতে হবে। মা- বোকার মত বলে উঠল শাসা। মাথা যেন ঠিকভাবে কাজ করছে না।

 পাশেই দাঁড়িয়ে প্যান্টি ঠিক করার চেষ্টা করছে অ্যানা। আকাশের দিকে তাকিয়ে সময়ের হিসেব করার চেষ্টা করল শাসা, “নয়টারও বেশি বাজে।”

“তুমি জেগে থাকতে পারলে না?” শাসার কাঁধে ভর দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছে অ্যানা!

কাধ ঝাঁকিয়ে অ্যানার হাত সরিয়ে দিল শাসা। মন চাইছে মেয়েটার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে। কিন্তু জানে পারবে না।

“সব ভোমার দোষ।” প্যান্টি আর স্কার্ট ঠিকঠাক করে নিল অ্যানা, “বাবাকে বলব যে সব তোমার দোষ। ওহ! এবার নিশ্চয় আমার চামড়া ছিলে নিবে।”

 প্রিস্টর জনের কাছে গেল শাসা। হাত দুটো এখনো কাঁপছে। আধো ঘুম আধো জাগরণভাবে বলল, “উনি তোমাকে কিছুই বলবেন না।”

মনে হল অ্যানার ক্রোধে ঘি পড়ল। ক্ষেপে উঠে বলল, “তুমি কী করবে? তুমি তো একটা বাচ্চা। যদি এমন হয় যে আমার পেটে বাচ্চা চলে এল? তাহলে কী হবে ভেবেছো?”

অ্যানার অভিযোগ শুনে অবাক হয়ে গেল শাসা, “তুমিই আমাকে দেখিয়েছে যে কী করতে হবে। নয়ত আমি জানতাম না।”

“ঈশ্বর জানেন আমাদের কী হবে” ফুঁপিয়ে উঠল অ্যানা।

“কাম অন,” অ্যানাকে প্রিস্টর জনের উপর তুলে দিয়ে নিজেও চড়ে বসল শাসা।

পাহাড় ঘুরে এদিকে আসতেই দেখা গেল নিচের সমভূমিতে মশাল নিয়ে সার্চ পার্টি বেরিয়েছে ওদের খোঁজে। রাস্তাতেও দেখা যাচ্ছে গাড়ির হেডলাইট।

 “বাবা এবার আমাকে মেরেই ফেলবে।” মেয়েটার ঘ্যানঘ্যান শুনে বিরক্ত হয়ে উঠল শাসা,

“কীভাবে জানবেন? উনি তো সেখানে ছিলেন না?”

“তোমার কি ধারণা তুমিই আমার প্রথম নাকি। আগেও কতজনের সাথে করেছি। বাবা দু’বার ধরেছে আমাকে।” শাসাকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইল অ্যানা।

শাসার মনে প্রথমে হিংসে এলেও পরে ঠিকই যুক্তি দিয়ে বলল, “তাহলে তো আর আমার উপরে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।” অ্যানা বুঝতে পারল যে নিজের ফাঁদে নিজেই পা দিয়েছে। তাই নাটকীয় ভঙ্গিতে ফোপানো ছাড়া আর কিছু করার রইল না।

***

বাংলোর ড্রইংরুমে পরস্পরের কাছ থেকে যত দূরে সম্ভব দূরে এসে বসল শাসা আর অ্যানা। খানিক বাদেই বাইরের নুড়ি পাথরের ওপর শোনা গেল ডেইমলারের চাকার আওয়াজ। চোখ ঘষে আবারো কাদার চেষ্টা করল অ্যানা।

দরজায় এসে দাঁড়ালেন অগ্নিমূর্তি সেনটেইন, পাশে জোনস্। তাদেরকে দেখেই গুঙ্গিয়ে উঠল অ্যানা। চটে গেলেন সেনটেইন, আস্তে করে বললেন, “অ্যাই মেয়ে একদম চুপ।” তারপর শাসার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা কেউ ব্যথা পেয়েছো?”

“না, মা।” মাথা দোলালো শাসা।

 “প্রিস্টর জন?”

“ও-ও ঠিক আছে।”

“তো ঠিক আছে, ড. টুয়েন্টিম্যান জোনস, এই ইয়াং লেডিকে ওর বাবার কাছে নিয়ে যান। কী করতে হবে সে নিশ্চয়ই জানে।”

 অ্যানার কব্জি ধরে দাঁড় করিয়ে দরজার দিকে নিয়ে গেলেন জোনস, বাইরে গর্জে উঠল ডেইমলারের ইঞ্জিনে।

মেয়েটা বেরিয়ে যেতেই আবার শক্ত হয়ে উঠল সেনটেইনের চেহারা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“তুমি কিন্তু বেশ অবাধ্য হয়েছে। আমি তোমাকে বলেছি এই বদমাশ মেয়েটা থেকে দূরে থাকতে?”

“হ্যাঁ, মা।”

“খনির অর্ধেক পুরুষের সাথে ওর শোয়া শেষ। উইন্ডহকে ফিরে গিয়ে তো তোমাকে রীতিমত ডাক্তারের কাছেই নিয়ে যেতে হবে।”

কী ঘটতে পারে ভেবে কেঁপে উঠল শাসা।

“অবাধ্য হওয়াটাই খারাপ। তুমি যেটা করেছে তা ক্ষমা করারও অযোগ্য?”

“গাধার মত কাজ করেছ বুঝেছো?” বলেই চললেন সেনটেইন, “হদার মত ধরা পড়েছে। এটাই হল সবচেয়ে বড় অপরাধ।”

 “খনির প্রত্যেকে এখন তোমাকে নিয়ে হাসবে। নিজেকে যদি এতটা সস্তা দরের করে ফেলে তাহলে আদেশ আর নেতৃত্ব দেবে কীভাবে?”

“আমি এতটা ভেবে দেখিনি মা। ব্যাপারটা এমনিই ঘটে গেছে।”

“ওয়েল, এবার ভাবো তাহলে,” জানালেন সেনটেইন, “হাফ বোতল ডিটারজেন্ট মেখে গোসল করার সময় ভেবো। গুড নাইট।”

“গুডনাইট মা।” মায়ের দিকে এগিয়ে এল শাসা। খানিক ভেবে গাল পেতে দিলেন সেনটেইন। মাকে কিস করে শাসা জানাল, “সরি মা, আমার জন্যে তোমাকে এত লজ্জায় পড়তে হল।”

মন চাইল ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু কিছু না করে শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন সিনটেইন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল শাসা।

হঠাৎ করেই বহু বছর বাদে মদের নেশা অনুভব করলেন সেনটেইন। দ্রুত বিশাল কেবিনেটের কাছে গিয়ে ঢকটক করে মুখ ভর্তি ক্যানকে খেয়েও শান্তি হল না। ধপ করে চেয়ারের উপর বসে পড়তেই মনে হল শেষ হয়ে যাবেন। নিজেকে বড় তুচ্ছ, শূন্য মনে হল।

“ব্যাপারটা ঘটেছে।” আপন মনেই ফিসফিস করলেন সেনটেইন, “নোংরা বেশ্যা মেয়েটা তৈরি হবার আগেই বের করে এনেছে এ রাক্ষস।”

“ওহ! মাই বেবি, মাই ডার্লিং” মনে হচ্ছে যেন নিজের কোনো একটা অংশ হারিয়ে ফেলেছেন।

 এই একাকিত্ব বুঝি কেউ আর গোছাবার নয়। কেননা মাইকেল কোর্টনি আর লোথার ডিলার দু’জনেই এখন তার কাছে মৃত।

চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে এগিয়ে গেলেন সেনটেইন। একদৃষ্টে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলেন, “আমি বুঝি আমার ছোট্ট সোনাটাকে হারাতে বসেছি। এরপর একদিন আরো একা, বুড়ি আর দেখতে জঘন্য হয়ে যাবো” ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠলেন সেনটেইন।

কিন্তু না; অন্ধকার আর নৈঃশব্দে মোড়ানো বাড়িটার ভেতরে দাঁড়িয়ে নিজেকে দিয়ে করালেন ইস্পাত-কঠিন প্রতিজ্ঞা “যে পথ বেছে নিয়েছি সেখানে দুর্বলতার কোনো স্থান নেই। ফিরে আসা নেই। এভাবেই শেষপর্যন্ত এগিয়ে যেতে হবে।

***

লাঞ্চের সময় স্টোফেলকে খুঁজল শাসা। “আসেনি কেন ছেলেটা?”

ওর প্রশ্ন শুনে সুপারভাইজার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “কে জানে? শুধু মেইন। অফিস থেকে নোট পেয়েছি যে ও আসবে না। হয়ত চাকরি চলে গেছে। যাই হোক, শয়তানটাকে নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। নিজের ভেতর অপরাধবোধের কাঁটা টের পেল শাসা।

 যাই হোক বিকেলে কাজ সেরে প্রিস্টর জনের উপর চেপে বসল। গন্তব্য অ্যানাদের বাসা। জানে এতে করে মায়ের হাতে ঝাড়ি খেতে হবে, কিন্তু ভেতরে কেমন যে একরোখা জেদ চেপে বসল। দেখা গেল ওর জন্য তাদের কতটা ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু মিল হাউজের গেইটে ওর গতি রোধ করা হল।

উইদারিং গ্রাউন্ডের বস বয়, মোজেস এগিয়ে এসে প্রিস্টর জনের মাথায় হাত বুলিয়ে শাসাকে বলল, “আমি তোমার বই নিয়ে এসেছি।” মোটা মোটা হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড শাসার হাতে ধরিয়ে দিল মোজেস।

“তুমি বোধ হয় বই পড়োনি” তাড়াতাড়ি ওকে বাধা দিল শাসা, “এত দ্রুত তো শেষ হবার কথা নয়। আমার তো কয়েক মাস লেগে যায়।”

“আমি এটা আর পড়ব না। আসলে হানি মাইনও ছেড়ে যাচ্ছি। কাল সকালে ট্রাকে চেপে উইন্ডহক চলে যাব।”

“ওহ, নাহ!” তাড়াতাড়ি ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এল শাসা, “কেন চলে যাচ্ছো মোজেস?”

 “এসব আসলে আমার হাতে নেই।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল লম্বা মোজেস, “কাল সকালে ট্রাকে অনেকেই চলে যাচ্ছে। জলা মানে জোনস্ বাছাই করেছে এদের সবাইকে। আর তোমার মা ছাঁটাইয়ের কারণ জানিয়ে আমাদেরকে এক মাসের পারিশ্রমিকও দিয়েছে।” তিক্তভাবে হাসল মোজেস, “এই নাও তোমার বই।”

“রেখে দাও। এটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার।” বইটা ফিরিয়ে দিল শাসা।

“ঠিক আছে। তোমার স্মৃতি হিসেবে রেখে দিলাম। ভালো থেকো।” অন্যদিকে ঘুরে হাঁটা শুরু করল মোজেস।

“মোজেস-” পেছন থেকে ডাক দিলেও কী বলবে ভেবে পেল না শাসা। কেবল নিজের হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু পিছিয়ে গেল ওভাম্বো। একজন শ্বেতাঙ্গ আর একজন কৃষ্ণাঙ্গ কখনো করদর্শন করতে পারে না।

“ভালো থেকো।” হাল ছাড়ল না শাসা। ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকিয়ে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করল মোজেস, ওর হাত এত ঠাণ্ডা শাসার অবাক লাগল ভেবে বুঝি সব কৃষ্ণাঙ্গেরই এমন হয়।

“আমরা তো বন্ধু, তাই না?” অনুনয় ঝরল শাসার কণ্ঠস্বরে।

 “জানি না,” উত্তর দিল মোজেস।

 “মানে?”

“জানি না আমাদের পক্ষে বন্ধু হওয়া সম্ভব কিনা।” আস্তে করে নিজের হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেল মোজেস। শাসার দিকে একবারও না তাকিয়ে চলে গেল কম্পাউন্ডের দিকে।

***

সমতল পথ ধরে এগিয়ে চলেছে মাইন থেকে আসা ট্রাকের কনভয়। পরস্পরের সৃষ্ট ধুলা থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের মাঝখানে অবশ্য যথেষ্ট দূরত্ব রেখেছে প্রতিটি ট্রাক, শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ উভয় পক্ষেরই চাকরিচ্যুত হতভাগ্য পরিবারসমূহ সমস্ত মালপত্রসহ ট্রাকে চড়ে চলেছে শহরের উদ্দেশে।

একদিন বয়সী চাঁদটার আলোয় গলিত প্লাটিনামের আলোয় ভেসে যাচ্ছে গোটা মরুভূমি, খুব কাছেই কোথাও ডেকে উঠল একজোড়া শিয়াল, ক্যাম্পে চুলার খাবারের ঘ্রাণে বুনো হয়ে উঠেছে জম্ভ দুটো।

 গিরিখাদের দেয়ালের পাশে উবু হয়ে বসে সিগারেট ধরালো ট্রাকের ড্রাইভার ফুরি গারহার্ড। এর আগে দিনের বেলায় অ্যানালিসার সাথে পাঁচ পাউন্ডের চুক্তি হয়েছে। এত দ্রুত আর সহজে অর্থ পাবার রাস্তা খুঁজে পেয়ে ফুরির কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা করেনি অ্যানা।

চোখের সামনে জ্যোৎস্নাস্নাত রুপালি, অনিন্দ্যসুন্দর মেয়েটাকে দেখে আনন্দে কেঁপে উঠল ফুরি।

কাছাকাছি পৌঁছে থেমে গেল অ্যানা। কামুক হাসি দিয়ে চাইল ফুরি ব্যাগ্রতা বাড়াতে।

“পাঁচ পাউন্ড কিন্তু।” ফুরিকে মনে করিয়ে দিল অ্যানা। ড্রাইভার টাকাগুলো বের করতেই ছো মেরে টান দিয়ে নিয়ে চাঁদের আলোয় পরীক্ষা করে দেখল অ্যানা। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে পোশাকের ভেতরে চালান করে দিয়ে এসে দাঁড়াল ফুরির সামনে।

কিন্তু ফুরি যেই না নিজের মাথা নিচু করে অ্যানার দিকে তাকাল, পেছন থেকে কিছু একটা যেন প্রচণ্ড আঘাত করে তার পাজর গুড়ো করে দিল। আকস্মিক এই আক্রমণে ফুসফুস থেকে বেরিয়ে গেল সমস্ত বাতাস। কানের কাছে বিড়বিড় করে উঠল ভয়ংকর একটা কণ্ঠ।

 “মেয়েটাকে এখনি চলে যেতে বলল।” গলার আওয়াজটা ঠিকই চিনতে পারল ফুরি।

তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল অ্যানা। ফুরির কাঁধের উপর দিয়ে একদৃষ্টে চোখ বড় বড় করে খানিক তাকিয়েই ভয় পেল, ক্যাম্পের দিকে দিল দৌড়।

কোনোমতে নিজের পোশাক ঠিকঠাক করে পেছনে ঘুরল ফুরি।

“ডি লা রে।” উদ্যত মসার রাইফেল হাতে দাঁড়ানো লোথারকে দেখেই বোকার মত বলে বসল ফুরি।

“কেন? আর কাউকে আশা করেছিলে নাকি?”

“না! না!” উদভ্রান্তের মত মাথা নাড়ল ফরি।” মানে একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছো, এই যা।” লোখারের সাথে শেষবার মিটিঙের পর থেকেই সে মনোযাতনায় ভুগছে। অবশেষে লোভের ওপর জয়লাভ করেছে কাপুরুষতা। এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে যে লোথারও নিশ্চয় কখনো এতটা পারবে না।

ভেবেছিল আর কখনো লোথারের সাথে দেখা হবে না। কিন্তু এখন তো যেন টোপাজ পাথরের মত জ্বলজ্বলে দুই চোখ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে স্বয়ং লোথার।

“তাড়াতাড়ি? কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে দোস্ত। সবকিছু ঠিকঠাক করতে যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি সময় লেগেছে। এবার শক্ত হয়ে গেল লোথারের গলা, “উইন্ডহকে এখনো হিরের চালান আনননি?”

“না, এখনো না কোনোমতে বলেই মনে মনে নিজেকে গাল দিল ফুরি। এটাই তো ছিল তার টিকে থাকার পথ। বলা উচিত ছিল, “হ্যাঁ। আমি নিজেই গত সপ্তাহে নিয়ে এসেছি।” কিন্তু মুখ থেকে বের হওয়া শব্দ তো আর ফেরত নেয়া যায় না। তার বদলে নিজের প্যান্টের বোতাম লাগানোর দিকে মনোযোগ দিল।

“কখন চালান আসবে তাহলে?” ফুরির চিবুকের নিচে মসারের নল রেখে মুখখানাকে উপরে তুলে ধরলেন লোধার। বোঝাই যাচ্ছে যে ফুরির কথা বিশ্বাস করছেন না।”

“উনারা ইচ্ছে করেই দেরি করছেন। আর কতদিন লাগবে জানি না। উড়া খবরে শুনেছি এবার নাকি পাথরের বেশ বড়সড় একটা প্যাকেজ আসবে।”

“কেন?” নরম স্বরে জানতে চাইলেন লোথার; কিন্তু ফুরি কাঁধ ঝাঁকাল “জানি না। শুধু শুনেছি যে বড় একটা চালান।”

“হুম, তার মানে আমি তোমাকে যা বলেছিলাম তাই সত্যি। ওরা খনি বন্ধ করে দিতে চলেছে।” খুব সাবধানে ফুরির চেহারা পরখ করে দেখলেন লোথার; কেন যেন মনে হল লোকটা দ্বিধায় ভুগছে। এবার তাহলে একটু টাইট দিতে হবে। যেন কোনো গড়বড় না করে। এটাই হবে শেষ চালান বুঝলে; তারপর তোমরা সবাই অডিট ট্রাকে করে যেসব বেচারাকে এনেছে তোমার অবস্থাও তেমনই হবে।”

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ফুরি, “হ্যাঁ, ওদের চাকরি গেছে।”

“তার মানে পরের বার তুমি, বন্ধু। আর পরিবারকে তো তুমি জান দিয়ে ভালোবাসো, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে তো ছেলে-মেয়ের খাবার আর পোশাকের জন্য টাকা দরকার এমনকি কাজ হারালে ওই ছুড়িকেও পাবে না।”

“ম্যান, এভাবে বলো না।”

“তাহলে আমাদের আগে যেমন কথা হয়েছে সেভাবে কাজ করো। তুমি জানো কী করতে হবে। ওরা তোমাকে চালানের তারিখ জানালেই পরিকল্পনা মত কাজ করবে।”

 ফুরি মাথা নাড়ল। কিন্তু লোথার নিশ্চিত হতে পারছেন না। তাই বললেন, “বলো কী কী করতে হবে। তারপর ফুরি বিরক্ত হলেও পুরো প্রক্রিয়াটা গড়গড় করে বলে গেল আর লোথার মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, এক-আধবার শুধরে দিতে হলেও অবশেষে সন্তুষ্টির হাসি হেসে বললেন, “কোনো ঝামেলা যাতে না হয় বন্ধু, ভুল করা আমার একদম ভালো লাগে না। কাছে এসে ফুরির চোখের দিকে তাকালেন লোথার। তারপর হঠাৎ করেই ঘুরে হাঁটা শুরু করলেন।

খানিক কেঁপে উঠে মাতালের মত টলতে টলতে ক্যাম্পের দিকে চলে গেল ফুরি। পথিমধ্যে মনে হল মেয়েটার কথা। টাকা নিয়ে ভেগে গেল কিন্তু তার কাজ হল না। অথচ কেন যেন এখন আর ওর কাছে যেতেও ইচ্ছে করছে না। লোথার ডিলারের কথা শুনে হিম হয়ে গেছে সারা শরীর।

***

চুড়ার ঠিক নিচের জঙ্গল দিয়ে চলেছে ওদের ঘোড়া। আগামী দিনগুলোর উত্তেজনার আনন্দে সবার চেহারাই বেশ হাসিখুশি। সেভেন এম এম ম্যানলিচার স্পোর্টিং রাইফেল নিয়ে প্রিস্টর জনের কাঁধে চড়ে বসেছে শাসা। আর সেনটেইনের স্ট্যালিয়নের রঙ ধূসর; নাম মেঘ। কিশোরী বয়সে বাবার দেয়া স্ট্যালিয়নটার নাম ও রেখেছিলেন মেঘ। গলার কাছে হালকাভাবে ইয়েলো স্কার্ফ পেঁচিয়ে রাখা সেনটেইনের চোখ দুটোও চকচক করছে,

“ওহ, শাসা, আমার নিজেকে ঠিক স্কুল গার্লদের মত মনে হচ্ছে। আগামী দুদিন পুরোপুরি নিজেদের মত করে কাটানো যাবে।”

“দেখো তোমার আগে ওই ঝরনার ধারে যাব।” মাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল শাসা। কিন্তু মেঘের সাথে পাল্লা দেবার ক্ষমতা প্রিস্টর জনের নেই। তাই ঝরনার ধারে পৌঁছে দেখা গেল স্ট্যালিয়ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেনটেইন।

ছেলে দুজনেই ঘোড়ায় চড়ে ঢুকে গেল কালাহারির একেবারে বুনো এলাকার গভীরে। স্যান-এর বুশম্যানদের কাছে প্রশিক্ষিত সেনটেইন এখনো সব কৌশল মনে রেখেছেন। তাই সব অরণ্যের গভীরে টিকে থাকার সমস্ত রহস্যই তার জানা আছে।

দুপুরের ঠিক পরপরই দিগন্তে দেখা গেল একপাল জেমসবক। এক সারিতে হাঁটতে থাকা জন্তুগুলোর উন্নত মাথা আর লম্বা শিং দেখে দূর থেকে মনে হচ্ছে ইউনিকর্ন।

অতঃপর সূর্য যখন মরুভূমির গভীরে ডুবে যেতে বসেছে একপাল স্প্রিংবক দেখলেন সেনটেইন। ছেলেকে বললেন, “আমাদের ক্যাম্প আর মাত্র আধ মাইল দূরে আছে। ডিনার রেডি করা দরকার।”

সাগ্রহে নিজের ম্যানলিচার তুলে নিল শাসা। “সাবধানে, একেবারে পরিষ্কার হওয়া চাই।” ছেলেকে সাবধান করে দিলেন সেনটেইন।

পিছনে দাঁড়িয়ে শাসাকে ঘোড়া থেকে নামতেও দেখলেন। হরিণের পালের কাছে থেকে দুইশ কদম দূরে গিয়ে উবু হয়ে বসল শাসা। তারপর কনুই দুটো হাটুর ওপর রাখল। আর সাথে সাথেই একটা হরিণকে পড়ে যেতে দেখে স্বস্তি পেলেন সেনটেইন। এর আগে একবার এমনভাবেই অনিন্দ্যসুন্দর এক হরিণকে গুলি করেছিলেন লোথার ডি লা রে। মনে পড়ে গেল সেই স্মৃতি।

 স্যার গ্যারি যেভাবে শিখিয়েছেন ঠিক সেভাবেই জন্তুটার কাঁধের পিছনে গুলি লাগাতে পেরেছে শাসা। কাঁধের পেছনে লেগে মোটা হৃৎপিণ্ডে চলে গেছে বুলেট। প্রিস্টর জনের কাঁধে তুলে দেয়া হল গোটা হরিণ। আরামদায়ক আর নিরাপদ ক্যাম্পটাতে গতকালই পৌঁছে গেছে তিনজন পরিচারকের দল।

 রাতের বেলা স্প্রিংকের গ্রিলড কাবাব দিয়ে ডিনার সারল মা আর ছেলে। তারপর ক্যাম্পফায়ারের কাছে বসে বহু রাত অব্দি কফি হাতে গল্প করল দুজনে।

পরের দিন সকালবেলা শীত পড়াতে গায়ে ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট পরে নিলেন সেনটেইন আর শাসা, আর তারপর যে যার ঘোড়ায় চেপে শুরু হল যাত্রা। মাইলখানেক এগোবার পরেই মেঘের লাগাম টেনে ধরে মাটির দিকে তাকালেন সেনটেইন।

“কী হয়েছে মা?” মায়ের মুড় সম্পর্কে সদা সচেতন শাসার চোখে পড়ল সেনটেইনের উত্তেজিত চাহনি।

“তাড়াতাড়ি এসো।” তারপর নরম মাটিতে পায়ের ছাপ দেখিয়ে জানতে চাইলেন, “বলো তো কী?”

ঘোড়া থেকে নেমে উপুড় হয়ে পরীক্ষা করে দেখল শাসা। “মানুষ?” দ্বিধায় পড়ে গেছে,

“কিন্তু বেশ ছোট তো। বাচ্চা?” চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাতেই বাকিটা বুঝে গেল।

“বুশম্যান!” সহাস্যে চিৎকার করে উঠল শাসা, “বুনো বুশম্যান।”

“হুম, ঠিক তাই।” সেনটেইনও হেসে ফেললেন।” একজোড়া শিকারি জিরাফের পেছনে লেগেছে দেখো!”

“আমরা ওদের পিছু নিতে পারি না মা? প্লিজ?” এবার শাসাও মায়ের মতই উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।

 “ঠিক আছে। পায়ের ছাপগুলো মাত্র একদিনের পুরনো, তাই তাড়াতাড়ি করলে ধরে ফেলা যাবে।” সম্মত হলেন সেনটেইন।

“দেখো একটা বুশম্যানের টুথব্রাশ।” তরতাজা গাছের ছোট একটা ডাল তুলে দেখালেন সেনটেইন। জিরাফের পায়ের ছাপের কাছেই পড়ে আছে চিবানো ডালটা।

“তার মানে এখানেই জিরাফটাকে প্রথম দেখেছে।”

“তুমি কীভাবে বুঝলে?”

“ওই তো ওদের ধনুকের চিহ্ন।”

“দেখো শাসা, ওরা এখান থেকে দৌড়াতে শুরু করেছে। যদিও শাসা ছাপ দেখে কিছু বুঝল না। সেনটেইন বলে চললেন, “শরীরের সমস্ত ভার বুড়ো আঙুলের ওপর দিয়ে শক্ত পায়ে এগিয়েছে সামনের দিকে। তারপর কয়েকশ কদম সামনে গিয়ে আবার ব্যাখ্যা করে বললেন, “এবার দেখো পেটের উপর ভর দিয়ে সাপের মত এগিয়েছে। তারপর ওখানে হাটু গেড়ে বসে তীর ছুঁড়েছে।” আরো বিশ কদম গিয়ে তো সেনটেইন মহাখুশি হয়ে উঠলেন, “দেখো এখানে এসে জিরাফ ফাঁদ বুঝতে পেরেছে। তারপর লাফ দিয়ে সরে গেছে, আরে দেখো শিকারিরাও পিছু পিছু দৌড়ে তীরের প্রভাব দেখার চেষ্টা করেছে।”

ছাপ দেখে দেখে খানিক দৌড়ে যাবার পর আচমকা ঘোড়র ওপর সিধে হয়ে বসলেন সেনটেইন।

“শকুন!”

 চার থেকে পাঁচ মাইল সামনে নীলাকাশ জুড়ে দেখা গেল কালো ফুটকির মেঘ। মাটি থেকে অনেক উপরে আস্তে আস্তে উড়ে বেড়াচ্ছে শকুনের পাল।

“এবার একটু ধীরে ধীরে যেতে হবে, শাসা।” ছেলেকে সাবধান করে দিলেন সেনটেইন। “ওদেরকে ভয় পাইয়ে দিলে কিন্তু ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।”

ঘোড়ার গতি হন্টনের পর্যায়ে নামিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন মা আর ছেলে।

খানিক দূরেই পড়ে আছে জিরাফের বিশাল মৃতদেই। আশপাশের ছোট ছোট কাটা ঝোঁপগুলোর ওপরে ঝুলছে মাংসের স্তূপ, জিরাফের নাড়ি-ভুড়ি। সূর্যের তাপে শুকানোর জন্যই এই ব্যবস্থা। ওজনের ভারে নুইয়ে পড়েছে ঝোঁপের ডালপালা। আর সর্বত্র চড়ে বেড়াচ্ছে বুশম্যানদের পায়ের ছাপ।

“মাংস কাটা আর বহন করার জন্য নারী আর শিশুদের কেউ নিয়ে এসেছে।” খর্বকায় বুশম্যানদের দেখে বলে উঠলেন সেনটেইন।

“ইয়াক। বিদঘুটে গন্ধ আসছে।” নাক কুঁচকালো শাসা, “কিন্তু ওরা কোথায়?”

“লুকিয়ে আছে।” জানালেন সেনটেইন, “মনে হয় পাঁচ মাইল দূর থেকেই আমাদেরকে আসতে দেখেছে।” তারপর মাথা থেকে চওড়া কানঅলা টুপিটা খুলে ফেললেন যেন তার চেহারা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এরপর অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলে চারপাশে ছড়িয়ে দিলেন নিজের মেসেজ।

হঠাৎ করেই একেবারে কাছ থেকে মাটি খুঁড়ে যেন উদয় হল এক বুশম্যান। আচানক এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল স্ট্যালিয়ন। লোকটার গায়ে কেবল এক টুকরো পশুর চামড়ার পোশাক। আকারে ছোটখাটো হলেও দেহের গড়ন একেবারে নিখুঁত।

মাথা উঁচু করে এগিয়ে এল মঙ্গোলিয়ানদের মত কুতকুতে চোখ আর উজ্জ্বল আম্বার রঙা বুশম্যান পুরুষ। ডান হাত তুলে অভিবাদনের ভঙ্গি করে প্রায় পাখির মত কিচির-মিচির করে বলে উঠল “আমি তোমাকে দেখেছি নাম চাইল্ড।” নামটা শুনেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন সেনটেইন,

“আমিও তোমাকে দেখেছি কিউয়ি!”

 “তোমার সাথে ও কে?” জানতে চাইল বুশম্যান।

“আমার ছেলে গুড ওয়াটার। তোমাকে বলেছিলাম না, ও এখানেই জননছে। ওয়া ওর পিতামহ আর হানি মাতামহ।”

শূন্য মরুভূমির দিকে তাকিয়ে সজোরে সবাইকে ডাক দিল কিউয়ি, “স্যানের মানুষেরা সত্যিই তাই। এই নারীর নাম চাউন্ড, আর ছেলেটা তো সেই কিংবদন্তী, ওদেরকে অভিবাদন জানাও।”

 শুষ্ক মাটির বুক থেকে উদয় হল খর্বকায় সোনালি সব দেহ। কিউয়িসহ মোট বারোজন হাসতে হাসতে পিলপিল করে এগিয়ে এল। ঘোড়া থেকে নেমে সবার সাথে আলিঙ্গন করলেন সেনটেইন। প্রত্যেককে নাম ধরে ডেকে সম্ভাষণ জানিয়ে সবশেষে দুটো বাচ্চাকে দুই কোমরের উপর নিয়ে আদরও করলেন।

“তুমি ওদেরকে এত ভালোভাবে কীভাবে চেন মা?” অবাক হয়ে জানতে চাইল শাসা।

 “কিউয়ি আর ওর ভাই ওয়ার আত্মীয়, তুমি ছোট থাকতেই ওদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। তারপর সবাই মিলে গড়ে তুলেছি হানি খনি, এটা ওদের শিকারের এলাকা।”

এভাবেই কেটে গেল বাকি দিন। ফেরার সময় হাত মুঠো করে সেভেন এম এমের পিতলের কার্টিজ বুশম্যান নারীদের বিলিয়ে এল সেনটেইন। যেন নেকলেসে লাগাতে পারে; যা তাদেরকে অন্যান্য স্যান নারীদের চোখে ঈর্ষার পাত্রী করে তুলবে। শাসা কিউয়িকে নিজের হান্টিং নাইফটা দিয়ে দিল। কিউয়ি তো বেশ খুশি।

কিউয়ির ভাই ফ্যাট কিউয়ি পেল সেনটেইনের বেল্ট। চকচকে পিতলের বাকলে নিজের চেহারার প্রতিবিম্ব দেখে তো মুগ্ধ মোটা কিউয়ি।

আসার সময় চোখ ঘুরিয়ে পেছনে নৃত্যরত ক্ষুদে মানুষগুলোকে দেখে শাসা ভাবল,

“আহারে ওরা কত অল্পতে খুশি হয়।”

“ওরা হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।” সেনটেইন বলে উঠলেন, “কিন্তু জানি না কতদিন থাকবে।”

“তুমি কখনো এভাবে থাকার চেষ্টা করেছিলে মা?” জানতে চাইল শাসা, সত্যিই কি চামড়ার পোশাক পরতে? শিকড়-বাকড় খেতে?”

“তুমিও তাই করেছিলে শাসা। মাঝে মাঝে ক্ষুদে বামনগুলোর মত গায়ে কিছুই রাখতে না।”

চোখ কুঁচকে কী যেন ভাবার চেষ্টা করল শাসা; তারপর বলল, “মাঝে মাঝে আমার খুব অন্ধকার, পানির গুহার মত একটা জায়গার কথা মনে পড়ে।”

“সেটাই হল উষ্ণপ্রস্রবন, যেখানে আমরা গোসল করতাম আর ওখানেই হানি মাইনের প্রথম হিরেটা পেয়েছি।”

“আমি আবার ওখানে যেতে চাই মা।”

“কিন্তু তা তো সম্ভব নয়।” মায়ের মুড বদলে যেতে দেখল শাসা, “ঝরনাটা হানি পাইপের একেবারে মাঝখানে। মাটি খুঁড়তে গিয়ে আমরা ঝরনাটাকে নষ্ট করে ফেলেছি।” খানিকক্ষণ দু’জনেই নীরব হয়ে রইল। “জায়গাটা ম্যানের জনগণের জন্যে পবিত্র ভূমি হলেও অদ্ভুত ব্যাপার হল আমাদের পরিকল্পনাতে কিন্তু ওরা বাধা দেয়নি।” খুলে বললেন সেনটেইন।

 “অনেক আগেই এ ব্যাপারে কিউয়ির সাথে কথা বলে নিয়েছি। তার মতে গোপন জায়গাটা তাদের নয়। এখানে যে আত্মা বাস করে সে-ই তাদের আপন কিন্তু বহু আগেই হয়ত বিরক্ত হয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে সেই আত্মা; তাই এখন আর এতে তাদের কোনো আক্ষেপ কিংবা আপত্তি নেই।”

“তুমি যে কখনো মানের মেয়েদের মত জীবন কাটাতে আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না মা।”

“ব্যাপারটা সত্যিই বেশ কঠিন।” নরম স্বরে জানালেন সেনটেইন, কিন্তু সেই কষ্ট ছাড়া আজকের আমি হতে পারতাম না। তুমি জানো শাসা। মরুভূমির বুকে আমি যখন সহ্যের একেবারে শেষ সীমায় চলে গিয়েছিলাম তখন একটা শপথ করেছি; আর তা হল আমার ছেলে কখনো অভাবে পড়বে না। আমি শপথ নিয়েছি যে ভয়ংকর দিনগুলো আর কখনো আমাদের জীবনে ফিরিয়ে আনব না।”

“কিন্তু তখন তো আমি তোমার সাথে ছিলাম না।”

“হ্যাঁ ছিলে” মাথা নাড়লেন সেনটেইন, “তোমাকে গর্ভে নিয়েই আমি স্কোলিনি কোস্টে গিয়েছি। আর উপকূলের বার্লি বাড়িতে তুমি আমার অংশ হয়েই ছিলে। আমরা এই মরুভূমির সৃষ্টি ডালিং তাই সবাই যখন ব্যর্থ হবে আমরা তখন কেবল সমৃদ্ধির পথেই এগোব। কথাটা মনে রেখো শাসা ডার্লিং।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *