২. মানুষকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা

মীরার মানুষকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা স্বভাব বন্ধ করতে চাইলে সবার আগে আমাকে অন্ধ বিশ্বাস করা বন্ধ করাতে হবে। তখনই কেবল ও বুঝবে যেখানে রাফিকেই বিশ্বাস করা যায় না সেখানে অন্য কাউকে কীভাবে বিশ্বাস করা যাবে? কিন্তু সেটা কিভাবে করা সম্ভব? আমি অনেক ভেবেছি এ ব্যাপারে। ভেবেচিন্তে একটা উপায় পেলাম। এরচেয়ে ভালো উপায় আর হয় না। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। মীরার মনে বড় রকমের একটা ভয়ও ঢুকানো যাবে। আর ওর সঙ্গে অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটানো যাবে। মা বাসায় নেই, বাবা থাকে সারাদিন অফিসে। রাহি রূপ তো কোনো ব্যাপার না। সুতরাং মীরাকে বাসায় নিয়ে আসি। ওর স্কুলের পিকনিক আছে সামনে। ও নাকি সারাদিনের জন্য বাইরে থাকতে পারবে। এটাই সুযোগ। সারাদিন রেখে বিকেলে বাসায় দিয়ে আসব। আর রাতের বেলায় বলব আমি ওকে ভয়ংকর এক কুমতলবে বাসায় এনেছিলাম কিন্তু পরে কোনো কারণে সিদ্ধান্ত বদলেছি। কী বলিস? অন্যকোনো কিছু দিয়ে কোনো মেয়ের মনে এতটা ভয় ঢোকানো সম্ভব না। যতটা এভাবে সম্ভব। আরে খারাপ ভাবলে ভাবুক। ছেড়ে তো আর যেতে পারবে না, বদ্ধপাগল হয়েছে সে আমার জন্য। ছাড়া সম্ভব না। তা ছাড়া সত্যি তো আর কিছু করছি না। ওকে শক্ত করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে এই মেয়ে ভেসে যাবে।

এই প্ল্যানটা যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারি তাই এক্ষুনি মীরাকে বলছি যে ও নির্দোষ সেই প্রমাণ আমি পেয়েছি। কদিন পরে বলব। কী বলিস?

রাফসান শিকদার
০৪ ডিসেম্বর, ২০০৯

আজকে একসঙ্গে এতকিছু ঘটেছে যে কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব বুঝতে পারছি না। ইচ্ছে করছে সব লিখি। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব সেটাও বুঝতে পারছি না। আজকের দিনের এত ভালো ভালো মুহূর্তের মধ্যে একটা অঘটনও ঘটে গেছে। মীরাকে সময়মতো বাসায় পৌঁছে দিতে পারিনি। জ্যামের ভয়ে কত আগে বেরোলাম! কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অনেকগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর মীরাকে সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় পৌঁছে দিলাম। ওর বড় ভাই ওকে কৌশলে বাঁচিয়েছেন। শুধু এই একটি কারণে এই মানুষটিকে আমি আজীবন কৃতজ্ঞতা। জানাব।

খুব ভোরে আমি মীরাকে আনতে ঢাকা গিয়েছিলাম। নাখালপাড়া থেকে ব্যাংক টাউন অনেকটা রাস্তা। এতটা রাস্তা আসার পথে পুরোটা সময় ও আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বসে ছিল। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। আমি একবার বলায় একটা মেয়ে আমার হাত ধরে এতদূর চলে এলো! ভাবা যায়!

প্রথম দিন থেকেই আমার মীরার কণ্ঠের ওপর আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি ছিল। তাই আমি ওর আর আমার সব কনভার্সেশন রেকর্ড করেছিলাম। ওকে বলতাম আমি তোমার কণ্ঠস্বর নিচ্ছি। ও এই নেয়ার মানে বুঝত না। আজ রেকর্ডিং শুনিয়ে সেই মানেটা বুঝিয়ে দিয়েছি। অবশ্য ও কতটা বুঝেছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই। সবটা খুলে না বললে তো কিছুই বোঝে না। আর আমার কেন যেন সবটা বলে দিতে ইচ্ছা করে না। কিছু বলে কিছু বাকি রেখে একটা রহস্য তৈরি করতে ভালো লাগে। রহস্য বিনে জীবন পানসে।

আমি ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই দরজার ছিটকিনি তুলে দিলাম যাতে সন্দেহ করে। জিজ্ঞেস করেছে দরজা কেন লাগালাম। বললাম, খেয়ে ফেলব তাই। কিন্তু হায়! এই খাওয়ার মানে সে বুঝল না। কোনো সন্দেহই করল না। এতই অন্ধ বিশ্বাস তার আমার প্রতি!

মীরা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নদী দেখছিল। আমি দেখছিলাম সিনেমার মতো সুন্দর একটি দৃশ্যের ফ্রেম। যে ফ্রেমের প্রান্তে একটি জানালা। জানালা দিয়ে দেখা যায় প্রবাহিত নদী। জানালার গ্রিলে চিবুক ছুঁইয়ে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী। কিছু আমলকি পাতা সেই কিশোরীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জানালার গ্রিল ছুঁয়ে দিচ্ছে। গাছের ডালে বসা ছোট্ট চড়ই। বাতাস বইছে। কিশোরীর বাধা চুল খোলা হলেই দৃশ্যটি সয়ংসম্পূর্ণ হয়। আমি এগিয়ে গেলাম। ক্লিপ খুলে দিতেই চুলগুলো এলিয়ে পড়ল ওর পিঠজুড়ে। ও সঙ্গে সঙ্গে তাকাল আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল, আমার নেশা হয়ে গেল। ইচ্ছে করল এভাবে কেটে যাক অনন্তকাল। মীরা এক পলক দেখে আবার চোখ নামিয়ে নিল। আমি বললাম, আশপাশের সব দেখো শুধু আমাকে ছাড়া। আজ একটু আমাকে দেখো তো। এরপর ও তাকল। এই প্রথম আমরা একইসঙ্গে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম, অনেকক্ষণ। আমি যদি আগেই ওকে ভালো না বেসে ফেলতাম তবে এই মুহূর্তেই ভালোবেসে ফেলতাম। এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেল তা বলতে পারব না। কখন যেন আমার এই অবাধ্য চোখ দুটো একবার ওর ঠোঁটেও ঘুরে এলো। সেখানেই সর্বনাশটা হলো। আমার ইচ্ছে করতে লাগল একবার চুমু খাই। শুধু একবার। সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে যেতে লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল আজ ওকে যে উদ্দেশ্যে এখানে নিয়ে এসেছি তাতে আজ চুমু খাওয়া যায় না। নিজের সঙ্গে নিজের অসততা হয়ে যায়! আমি নিজেকে বোঝালাম আজ নয় রাফি, আজ নয়। অন্য কোনোদিন। সঙ্গে সঙ্গে ওকে নিয়ে ছাদে চলে গেলাম।

ছাদে গিয়েও আমি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। ভীষণ অস্থির লাগছিল। সূর্যের আলোকরশ্মি গাছের ফাঁক দিয়ে তীর্যকভাবে এসে পড়ল ওর মুখে। অসহ্যরকম সৌন্দর্য কাকে বলে জানিস বকুল? যে সৌন্দর্য সহ্য করতে কষ্ট হয়! মীরার সৌন্দর্যকে মুহূর্তেই ওই সূর্যটা অসহ্যকর করে দিয়েছে। ইচ্ছে হচ্ছিল পুরো দুনিয়াকে একপাশে ফেলে রেখে ওকে বুকে টেনে নিই। একটা গাঢ় চুমু খাই। শুধু একবার। আর কিছু চাই না। লোকে দেখলে দেখুক, জানলে জানুক। আমার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় হোক। কী যায় আসে! কিন্তু আজীবন মনের আগে মস্তিষ্ক চলেছে আমার। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আসলে যায় আসে অনেক কিছুই! বন্ধ ঘরে কিছু করলাম না এখানে করব? অসম্ভব। রাস্তায় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। যেটার ডাল এসে পড়ে আমাদের ছাদে। সেখান থেকে এক গোছা ফুল ছিঁড়ে ওর কানের পাশে গুঁজে দিলাম। ওর হাসি দেখে মনে হলো বিশ্বজয় করে ফেলেছে। মেয়েরা অল্পতেই এত খুশি কী করে হয়? ওকে বলার জন্য কিছু কথা ভেবে করে রেখেছিলাম। সেগুলোই বললাম। ওকে শক্ত করার জন্য এই কথাগুলো ভীষণ প্রয়োজন।

এক পর্যায়ে শুধু বললাম, আমি থাকি বা না থাকি আমার বলা প্রত্যেকটা কথা তুমি মনে রাখবে। এটা শুধু কথার কথা ছিল। আমি থাকব না কেন? এই মেয়েকে ছাড়া কি আমার চলবে? কিন্তু ওই কথা শোনামাত্র মেয়ের কাঁদো কাঁদো ভাব। ও ফোনে কাঁদলেই আমার যেমন অস্থির লাগে, যদি চোখের সামনে কেঁদে ফেলে আমি কি ঠিক থাকতে পারব? ওকে ধমকে বললাম, একদম কাঁদবে না। কান্নাকাটি আমার একদম পছন্দ না। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সে কেঁদেই ফেলল। দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়াচ্ছে। আমার বুকের ভেতরটা হঠাৎ ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল। নিজের অবচেতন মনেই আমি ওকে টেনে সিঁড়িঘরের ভেতরে নিয়ে আসলাম। তারপর জড়িয়ে ধরলাম। মীরাও আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার মনে হতে লাগল দীর্ঘ খড়ার পর ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বিড়ালছানার মতো গুটিশুটি মেরে ও আমার বুকে লুটিয়ে পড়েছে। আমার সমস্ত শরীর জেগে উঠল। কিন্তু আমি সবকিছুকে উপেক্ষা করে ওকে বোঝাতে লাগলাম, আমি কোথাও যাচ্ছি না। ওর সঙ্গেই আছি। কিন্তু ওকে শক্ত হতে হবে।

আজ আমি ওর নাম দিয়েছি হাওয়াই মিঠাই। জড়িয়ে ধরতেই যেভাবে গলে পড়ল হাওয়াই মিঠাই ছাড়া কিইবা ডাকা যায়?

রাফসান শিকদার
০৭ ডিসেম্বর, ২০০৯

***

কি জ্বালা! এই মেয়েকে বললাম যে তাকে আমি ভোগ করার জন্য বাসায় এনেছিলাম, অথচ সে রাগল না। ঝগড়া করল না। এমনকি অভিমানও করল না। ভয় পেল শুধু। ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করল। কিন্তু ওর মধ্যে দেখা যাচ্ছে বিন্দুমাত্র আত্মসম্মানবোধ নেই! এখন কি এই মেয়ের সব রকমের বোধ তৈরি করার দায়িত্বও আমার নিতে হবে নাকি?

রাফসান শিকদার
 ০৮ ডিসেম্বর, ২০০৯।

আমার অতি সৌভাগ্য যে উনি ভয়টা পেয়েছেন। না হলে পুরো প্ল্যানটাই মাটি হয়ে যেত। ওর মধ্যে এই ভয়টা ঢোকানো খুব দরকার ছিল, যাতে সহজেই কাউকে বিশ্বাস না করে।

রাফসান শিকদার
০৮ ডিসেম্বর, ২০০৯

আমরা ভেবেছিলাম রূপের বেশি কষ্ট হবে মাকে ছাড়া। কিন্তু ঘটনা তেমন ঘটল না। ছোট মানুষ তো তাই হয়তো ওকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখা যাচ্ছে। ওর যখন মাকে মনে পড়ে তখন কথা বলিয়ে দিই, অমনি শান্ত হয়ে যায়। বেশি কষ্ট হচ্ছে বাবার। আর তারপর আমাদের দুই ভাইয়ের। আবার আমরা সেটা সেভাবে প্রকাশও করতে পারছি না। রাহি তাও কিছু হলেও প্রকাশ করতে পারে, আমি আর বাবা তাও পারি না। এমনকি এটাও বলতে পারি না, মা তাড়াতাড়ি চলে আসো। তোমাকে ছাড়া সব ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

রাফসান শিকদার
১৩ ডিসেম্বর, ২০০৯

আর কদিন বাদেই মীরার এসএসসি পরীক্ষা শুরু। অথচ ছোটবোন স্কুলে গেলেই, পড়ায় ছুঁতোয় সে দরজা আটকে আমার সঙ্গে কথা বলে। আবার রাতে ইরা ঘুমিয়ে পড়লে বারান্দায় গিয়ে মীরা সারারাত আমার সঙ্গে কথা বলে। বুঝি

দিনরাত এত ফোনে কথা বললে পড়বে কখন? তাই সপ্তাহখানেক যাবৎ কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি। এখন প্রতিবার কেবল ২-৩ মিনিট করে কথা হয়।

আজ ও আমাকে জিজ্ঞেস করল,

তোমার কষ্ট হয় না?

আমি বললাম,

কষ্ট কীসের? মাত্র অল্প কয়টা দিনের ব্যাপার। এত ইমোশনাল হলে জীবন চলেনা মীরা। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। কথা বলা দেখা করার জন্য জীবনে অনেক সময় পাওয়া যাবে কিন্তু এই সময়গুলো আর ফিরে আসবে না।

কিন্তু কেউ না জানলেও আমার কষ্ট হয়, আমি মিস করি তাকে। মাত্র এ কয়টা দিনে মেয়েটা কখন কীভাবে আমার জীবনে এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল নিজেই টের পেলাম না।

রাফসান শিকদার
১৮ ডিসেম্বর, ২০০৯

মীরার পরীক্ষার আগে আজকেই আমাদের শেষ দেখা ছিল। আবার দেখা হবে পরীক্ষার পরে। সিদ্ধান্তটা আমারই। পরীক্ষার মধ্যে দেখা করার কথা থাকলে দেখা যাবে অর্ধেক পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে আসবে সে। যে প্রকারের পাগল সে হয়েছে, তাতে এখনই এই মেয়ের লাগাম টেনে না ধরলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।

রাফসান শিকদার
০২ জানুয়ারি, ২০১০

মা জানালেন তার ফিরতে আরো সময় লাগবে। নানাভাই আজ আছে কাল নেই অবস্থা। তিনি মাকে অনুরোধ করছে আরো কিছুদিন থাকার জন্যে। এ কথা শুনে বাবা বললেন, কোনো সমস্যা নেই। তুমি থেকে এসো যতদিন দরকার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়লেন। বাবাকে দেখে অসহায় লাগছে। ভালোবাসার শক্তি কি অদ্ভুত তাই না? আত্মীয়তাবিহীন দু প্রান্তের দুটি মানুষকে এক করে দেয়। এরপর একজন বিনে আরেকজনের বেঁচে থাকা দায়!

রাফসান শিকদার
২৭ জানুয়ারি, ২০১০

কি ভয়ানকভাবে মিস করছি মাকে এবং মীরাকে! এখন বোধহয় আমার প্রিয় মানুষদের মিস করার সময়! মাকে দেখতে পারাটা ভিডিও কলেই সীমাবদ্ধ। চাইলেও আমি ছুটে যেতে পারব না। অবশ্য মীরাকে দেখতে চাইলেই ছুটে যেতে পারি। কিন্তু তাতে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। তখন ওকে শক্ত রাখা মুশকিল হয়ে যাবে। কী করা উচিত আমার?

রাফসান শিকদার
০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১০

মীরার পরীক্ষা শেষ হবে দুপুর একটায়। তা জানা স্বত্ত্বেও ১২টা বাজেই পৌঁছে গেলাম ওর পরীক্ষাকেন্দ্রে। কেন যে এত আগে গেলাম নিজেও জানি না। এমনকি আমি আমার শেষ ক্লাসটা না করে চলে গিয়েছি। হাসছিস বকুল? হাস, এখন তো তোর হাসারই সময়। তুই শালা বন্ধুদের চেয়েও বেশি টিজ করিস।

আমি বেশ চিন্তায় ছিলাম মীরাকে পাব কি পাব না ভেবে! পরীক্ষা শেষে শত শত পরীক্ষার্থী বের হচ্ছে। এর মধ্যে মীরা আমাকে না দেখে চলেও যেতে পারে। আমিও মীরাকে মিস করে যেতে পারি। তাছাড়া মীরাকে ওর ভাই নিতে আসার কথা। কে জানে আমার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাই ওর ভাই কি না! অবশ্য আমি মীরাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হতে দেখলাম। আমাকে দেখে ও চমকে উঠল। কিন্তু নিজের ভাইকে দেখামাত্রই সামলে নিল। আমাকে পাশ কাটিয়ে রাস্তার উল্টোপাশে চলে গেল মীরা। সেখানে ওর ভাই দাঁড়িয়ে ছিল। কথা হলো না ঠিকই তবু দেখা তো পেয়েছি! প্রাণে শান্তি তো মিলেছে।

রাফসান শিকদার
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১০

মীরা ডায়েরি হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সেদিন তো রাফির কোনো কাজ ছিল এদিকে। কাজ শেষে নাকি মনে হয়েছে এত কাছে যখন এসেছে দেখা করে যাক। সেদিন রাতে যখন ফোনে কথা হচ্ছিল তখন হঠাৎ আসার কারণ জিজ্ঞেস করার পর রাফি এমনটাই বলেছিল। তবে কি সে আসলে রাফিকে বুঝতে ভুল করত না, কেবল রাফি যেটা বুঝাতে চাইত সেটাই বুঝত?

***

আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস। আমার জীবনের ২২তম ভাষা দিবস এবং ২২তম জন্মদিন। কিন্তু এই মাতৃভাষাটা আমার বেলায় সবার মতো জন্মদাত্রী মায়ের ভাষা নয়। এই মাতৃভাষাটা আমার দেশ মায়ের ভাষা। মাঝেমাঝে মনে হয় আজও ভাষাটা ঠিকঠাক শিখে উঠতে পারলাম না। তবে চেষ্টা করে চলেছি।

আজকের দিনে গর্ববোধ হয় এই ভেবে যে আমার নিজের এমন একটা শ্রুতিমধুর ভাষা আছে, যার জন্য প্রাণ দিয়েছে কত যুবক, লড়েছে শত যুবক। আবার আফসোস হয় এই ভেবে যে সেই সব যুবকদের মধ্যে আমি ছিলাম না। আমার জন্ম এত দেরিতে কেন হলো?

আহা বাংলা!
আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি…

রাফসান শিকদার,

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০

কৃষক শিকদার সাহেবের তরকারি বিক্রির ব্যবসা লাটে উঠেছে। মা যাওয়ার পর থেকে বাবা আমার হাতে বাজারের টাকা দেন। তা শিকদার সাহেবের তরকারির যা দাম! মায়ের কাছে ১০ টাকার লাউশাক রাখত ৩০ টাকা। এখন মা থাকলে ২০ টাকার ফুলকপি নিশ্চিত ৫০ টাকা রেখে ছাড়ত। মা কীভাবে ম্যানেজ করত মা-ই জানেন। আমার পক্ষে সম্ভব না। সবজি কিনতে বাজারে যাচ্ছিলাম তা দেখে শিকদার সাহেব কিছুটা ছাড় দিলেন। ন্যায্য দামে দিলেন তবেই আমি কিছু শাকসবজি কিনতে পারলাম। এইতো কৃষক শিকদার সাহেব বনাম মায়ের সংসার সামলানো শিকদার সাহেবের গল্প!

রাফসান শিকদার
১৩ মার্চ, ২০১০

আজ মীরা একটি দুঃসাহসিক কাজ করেছে। ফুলার রোডের ফুটপাতে আমার হাত ধরে হেঁটেছে। পাবলিক লাইব্রেরি অডিটরিয়ামে চলচ্চিত্র উৎসব হচ্ছিল। আমরা একটা সিনেমা দেখলাম। এরপর হাঁটতে হাঁটতে টিএসসি গেলাম। সেখান থেকে ফুলার রোড। ফুলার রোডে ঢুকেই ও আমার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল। শুধু হাতে হাত নয়, আমার হাতটা দু হাতে জড়িয়ে ধরে আমার বাহুতে মাথা রেখে হেলেদুলে হাঁটছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ভয় করছে না মীরা?

কীসের ভয়?

কেউ তোমার পরিচিত কেউ যদি দেখে ফেলে?

দেখলে দেখুক।

আমি চমকে উঠে ওর দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে চেয়ে বলল,

তুমি পাশে থাকলে কী যেন হয় আজকাল! দুনিয়ার কোনো কিছুকেই ভয় লাগে না! কে দেখবে কী হবে–এসব হিসেবনিকেশও করতে পারি না।

ওর সেই চোখে কি অদম্য ভালোবাসা! এক জীবনে কত পুণ্য করে পেয়েছি ওকে আমি?

মীরা আজ বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছে বলে বেরিয়েছিল। মেয়েটার বুদ্ধি-শুদ্ধি কিন্তু একটু বেড়েছে বল? বাসায় কী বলে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যাবে সেটা আর আমাকে শিখিয়ে দিতে হচ্ছে না। প্রথম প্রথম তো কতকিছুই শেখানো লাগল। দুজনের দিকই আমাকে ভাবতে হচ্ছে। কি জ্বালা! দেখে নিস বকুল এই মেয়েকে আমি এমন ভাবে তৈরি করে নেব যাতে সংসারের কোনো কিছু নিয়ে আমাকে না ভাবতে হয়। প্রেমের সময় যেমন দুদিক একা ভেবেছি তেমনি বিয়ের পর দুদিক ওকে দিয়ে ভাবাব। একা নিজের মাথাটা কেন খাটাব? আমি পোলাপান নিয়ে আমোদ-ফুর্তিতে থাকব। কী বলিস আইডিয়া কেমন?

রাফসান শিকদার
২৭ এপ্রিল, ২০১০

মীরা মুচকি হেসে পাতা উল্টাল। পরের পাতায় অনেক এলোমেলো আঁকিবুকি। যার কোনো অর্থ দাঁড় করাতে পারল না মীরা। আবার পাতা উল্টাল,

আজ ঠিক কী হয়েছিল আমার? কোনো নেশাদ্রব্য তো গ্রহণ করিনি। অসুস্থও না। মানসিকভাবেও সম্পূর্ণ সুস্থ। তবে? কেন মীরার সঙ্গে অসভ্য কথাগুলো বলতে বলতে প্রায় মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলাম? ভাগ্যিস মীরা আমার সব কথার অর্থ বোঝেনি। না হলে কী যে হতো! আমার দোষ না। সব দোষ বয়সের। বিয়ের বয়স হয়ে গেছে কিন্তু!

রাফসান শিকদার
০৮ মে, ২০১০

মীরা ডায়েরি থেকে চোখ তুলে ভ্রু কুচকে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল রাফি কবে তার সঙ্গে অসভ্য কথা বলেছিল? না তো, এরকম তো কিছু মনে পড়ছে না! নাকি বলেছিল কিন্তু সরাসরি বলেনি বলে সে বুঝতে পারেনি?

***

আরে মীরার এসএসসি রেজাল্ট দিয়েছে আজ। সারাবছর প্রেম করে এত ভালো রেজাল্ট করল কীভাবে মেয়েটা! অভিনন্দন শিকদার সাহেব, আপনি এক জাতে মাতাল তালে ঠিক প্রজাতির বউ পেতে চলেছেন।

রাফসান শিকদার
১৪ মে, ২০১০

সাভারে আমার খুব পছন্দের একটা জায়গা আছে। গ্রামের দিকে খুব সুন্দর বিল। সেই বিলে কত যে সাদা সাদা বক! চোখ জুড়িয়ে যায়, মন ভেসে বেড়ায় কোনো অলীক জগতে। মীরাকে সেখানে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যখনই আমিনবাজারের সেই বিভত্স জ্যামের কথা মনে পড়ে তখন ইচ্ছেটা ভেতরেই মরে যায়।

যেভাবে কংক্রিটের প্রতিযোগিতা চলছে, যখন তোমাকে নিয়ে যেতে পারব ততদিন কি আর বকগুলো আসবে মীরা?

রাফসান শিকদার
১৯ মে, ২০১০।

মায়ের তুরস্ক থাকার সময়সীমা কেবল বাড়ছেই। আমার ভালো লাগছে না। একদম ভালো লাগছে না। কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছি না। কী করলে মন ভালো হবে? এনি আইডিয়া?

রাফসান শিকদার
২৩ মে, ২০১০

শালার মামুইন্যারে আমি একদিন সুযোগ মতো এমন ঘঁাচা দেব যে ওর বাসার লোকজনও ওর চেহারা চিনতে পারবে না। এতবছর ধরে ওর সেলুনে যাই আমি, অথচ ছাগলটা আমার দাড়ির কি হাল করেছে! গত ৪ বছর ধরে আমি কখনোই ক্লিনশেভ করি না, সবসময় ট্রিম করি এবং মামুনের কাছেই করি। চুল কাটার সময় আমার একটু তন্দ্রামতো এলো। অমনি শালা আমার দাড়িতে খুর বসিয়ে দিল! এক পোচ দেয়ার পরই ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু তখন কি শেভ না করে উপায় আছে? শেভ করে এলাম। ছাগলের মতো দেখাচ্ছে এখন! কমসে কম আগামী ৬-৭ দিনে মীরার সঙ্গে দেখা করতে পারব না, ভাবা যায়! ক্যাম্পাসেও তো পোলাপান হাসবে! ধুর!

রাফসান শিকদার
০৪ জুন, ২০১০

মীরা দেখা করার জন্য খুব চাপ দিচ্ছিল। ওকে তো আর বলতে পারি না আমি দাড়ি কেটে ছাগলের রূপ ধারণ করেছি। তাই বিভিন্ন রকম অজুহাত দিয়ে দেখা করাটা পিছিয়ে দিচ্ছিলাম। যেহেতু এতদিনে ছোট ছোট দাড়ি গজিয়ে গেছে, এখন দেখা করাটা নিরাপদ বোধ করেছি। অবশেষে আজ দেখা করে এলাম। রিকশায় চড়ে ঢাকা শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়িয়েছি। মেয়ের সাহস আছে বটে রে বকুল! চলন্ত রিকশায় আমার ঘাড়ে মাথা রেখে অনেকক্ষণ ছিল। আরেকটু হলেই ত একটা চুমু খেয়ে ফেলতাম।

রাফসান শিকদার
১৩ জুন, ২০১০

বকুল,

একটা কেচালে পড়ে যাচ্ছি সম্ভবত। বাবা সকালবেলা অফিসে চলে যায়। রূপকে রাখি আমি আর রাহি। এতদিন দুজনের এক সময়ে ক্লাস পড়ে গেলে হয় ও মিস দিত না হয় আমি মিস দিতাম। কার কবের ক্লাস বেশি জরুরি সেই হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতাম। কিন্তু আজ দুজনের পরীক্ষা একসঙ্গে পড়ে গেল। আমার পরীক্ষা সকালে। রাহিরটা ১২টায় হলেও এর আগে আমি আসতে পারব না। রাহি বলল, কিছুক্ষণের তো ব্যাপার। পাশের বাসায় রূপকে রেখে যাবে আমি এসে নিয়ে আসব। ওই বাসায় নাকি রূপকে সবাই অনেক আদর করে। আমিও জানি অবশ্য। রূপ প্রায়ই ওই বাসায় যায়। তবে রাহি দিয়ে আসে আবার রাহিই নিয়ে আসে। কখনো কখনো রাহি যাওয়ার আগেই রূপ ফিরে আসতে চায় তখন ওই বাসার কেউ দিয়ে যায়। আমি রাজি হলাম। এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে আসার পর যখন রূপকে আনতে ওই বাসায় গেলাম তখন দেখি রূপ সেই মেয়েটার সঙ্গে খেলছে। সেই মেয়েটা মানে বুঝেছিস বকুল? সেই মেয়েটা যার সঙ্গে ছাদে দেখা হয়েছিল, আমার ফোন। নাম্বার চেয়েছিল। মেয়েটা আমাকে দেখে রূপকে নিয়ে এগিয়ে আসছিল। রূপ ওর হাত ছেড়ে ছুটে এসে আমার কোলে উঠল। মেয়েটা কাছাকাছি এসে হাসি হাসি মুখ করে মৃদু গলায় বলল,

আপনি আমাকে পছন্দ না করলেও আপনার বোন কিন্তু আমাকে খুব পছন্দ করে।

আমি একদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সেদিন ছাড়া আর কখনো তার সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। এভাবে কথা বলে কীভাবে? আমি বললাম,

আমার মনে হয় না এরকম কোনো বিষয় আছে। আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়ই নেই, পছন্দ অপছন্দ অনেক দূরের কথা।

পরিচিতই হতে চেয়েছিলাম।

সে হয়তো আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল। আমি সুযোগ না দিয়ে তার কথার মাঝেই বলে উঠলাম,

রূপকে দেখে রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি ভীষণ ক্লান্ত। আজ

তাহলে আসি?

মেয়েটি হেসে বলল,

নিশ্চয়ই।

চলে যাওয়ার সময় রূপ হাত নেড়ে বলল,

বাই বাই টগর আপু।

হোয়াট আ কো-ইন্সিডেন্স! আমি সেদিন টগর গাছ লাগিয়েছিলাম। মেয়েটা বলেছিল টগর ফুল চেনে না। নিজের নামে যদি কোনো ফুল থাকে তবে তা না চিনে পারে না কেউ। ভাব জমানোর জন্যই সেসব কথা।

প্লিজ তাড়াতাড়ি চলে আসো না মা। এমন হলে তো কারো মুখাপেক্ষী হওয়া চলে না। দুই ভাইয়েরই পরীক্ষা কেবল শুরু। রাহির দুইটা গেছে, আর আমার শুধু আজকেরটাই। বাকি পরীক্ষাগুলো কীভাবে ম্যানেজ করব কিছুই বুঝতে পারছি না।

রাফসান শিকদার,
২১ জুন, ২০১০

মীরার একটু মেজাজ খারাপ হলো। এই মেয়ের কথা রাফি বলেনি কেন তাকে? মেজাজ খারাপ নিয়েই সে পৃষ্ঠা ওল্টালো…

এই মুহূর্তে ওই বাসাতেই রূপকে রেখে যেতে হচ্ছে আমাদের। এ ছাড়া আর উপায় রইল না। মেয়েটাকে কি সরাসরি বলে দেব যে আমার মীরা আছে? না থাক। যদিও সবকিছু বুঝাই যাচ্ছে তবুও মেয়ে তো সরাসরি কিছু বলেনি আমাকে। এভাবে বলা যায় না। কিন্তু মেয়েটা এমন দৃষ্টিতে তাকায় আমার অস্বস্তি হয়। আরেকটা পরীক্ষা বাকি। এটা গেলে বাঁচি!

রাফসান শিকদার,
২৮ জুন, ২০১০

ফাইনালি একটা ম্যাচ জিততে পেরেছি। সিরিজ জিতব না জানি। তবু তো একটা ম্যাচ জিতেছি! এটাই আনন্দের।

অভিনন্দন বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম!

রাফসান শিকদার
১০ জুলাই, ২০১০

***

আজ সকালে আমি বাগানে কাজ করছিলাম, তখন মীরা ফোন করল। কী করি জিজ্ঞেস করতেই বললাম,

গোলাপ গাছের সেবা করি।

মীরা বলল,

গত এক মাস ধরে তো তুমি গোলাপ গাছের সেবাই করে যাচ্ছে। কী হয়েছে তোমার বলো তো? গোলাপের এডিকশন হয়নি তো? সকাল থেকে একবারও ফোন করোনি! ভুলেই তো গেছে আমাকে।

আমি হেসে বললাম,

গোলাপ গাছগুলো এই সিজনে বাঁচিয়ে রাখা মুশকিল মীরা। গোলাপের ডাইব্যাক নামে এক রোগ আছে। এটা হলে গাছ বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে যায়। তবে একটু যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে পুরো শীত ভরে ফুল দেয়। একেকটা ফুল কলি থেকে শুরু করে পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হওয়া পর্যন্ত প্রায় দু মাস গাছে থাকে। তখন সকালবেলা বাগানে এলে মনে হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। সেজন্যই এই কষ্টগুলো করা। গোলাপ বড় অভিমানী গাছ। যত্ন না করলে অভিমানে শেষ হয়ে যায়। ঠিক যেমন তুমি যত্নে টান পড়লেই অভিমানের বৃষ্টি ঝরাও। রাতেও কয়েক ঘন্টা কথা হয়েছে। এখন বাজে সকাল ১০টা। এরমধ্যে ফোন দিইনি বলেই অভিমান তুঙ্গে।

ইশ!

মীরা একটু হাসল। বলল,

তুমি কথা কম বলো। কিন্তু কথা জানো। কথা দিয়ে একদম গলিয়ে ফেলতে পারো।

আমি হাসলাম। তবে আর কিছু বললাম না। কী আর করা যাবে। ফোন দিতে পারিনি এখন তো কথা দিয়েই গলাতে হবে। পকেটের অবস্থা খারাপ। এ মাসের পকেটমানি শেষ। বাজারের টাকা থেকে টাকা মেরে ফোনে ভরতে হবে। এরপর ফোন দিতে পারব। মাঝেমাঝে আমার এক লাফে বড় হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এই সব পড়াশোনা, সীমিত পকেটমানি দিয়ে হাজারটা হিসেবনিকেশ করে চলা আর ভালো লাগে না।

রাফসান শিকদার,
২৯ জুলাই, ২০১০

কেমন আছিস বকুল? অনেকদিন কথা হয় না। কী করব! আমি যে আর আমার মাঝে নেই। যেদিন থেকে মায়ের খোঁজ পাই না সেদিন থেকে আমি স্বাভাবিক নেই। শুধু আমি কেন বাড়ির কেউই ঠিক নেই সেদিন থেকে। সবচেয়ে বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে বাবা। প্রথমদিকে কদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা সামলে উঠেছে। আবার অফিস করছে। হঠাৎ করেই মায়ের ফোন বন্ধ পাচ্ছি। শেষ যখন কথা হলো সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ করে কী হলো বুঝে উঠতে পারছি না। বাবা অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগের কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারেনি। মায়ের বাড়িতে কেউই বাবা-মায়ের বিয়েটা মেনে নেয়নি তাই কারো সঙ্গেই বাবার বা আমাদের যোগাযোগ নেই। নানা, নানু ও মামাদের সঙ্গে দু-একবার কথা হয়েছে তবে সেটা মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলবার সময়। মা ডেকে কথা বলিয়ে দিয়েছিল, তা না হলে তাও হতো না। তারা আমাদের বিষয়ে তেমন একটা আগ্রহবোধ করেন না। মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার পর নানাবাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছে বাবা। কোনো উত্তর আসেনি। আচ্ছা বকুল কী হতে পারে মায়ের? এত বছর বাদে তিন সন্তানের জননীকে নিশ্চয়ই আটকে রাখেননি তারা? সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাহলে কি মায়ের কোনো বিপদ হয়েছে? মায়ের বিপদ সম্পর্কিত কিছু ভাবতে পারছি না। চাইছিও না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও তিনি যেন ভালো থাকেন, মনেপ্রাণে এই প্রার্থনা করি।

রাফসান শিকদার
১১ সেপ্টেম্বর, ২০১০

আজ বিকেলে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে। ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। আমাকে দেখে রূপ ছুটে এসেছে। আমি বাড়ি ফিরলেই ওর গল্পের ঝুড়ি খুলে যায়। কিন্তু সেসব দিকে না গিয়ে আজ ও সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করল,

লাফি বাইয়া মা কি মরে গেছে?

আমি চমকে উঠে বসলাম। রূপকে ধমকে বললাম,

এসব কী বলছিস? কে বলেছে তোকে এই সব?

আচমকা আমার ধমক খেয়ে রূপ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। জীবনে এই প্রথম আমি রূপকে ধমক দিলাম এবং তুই করে বললাম। রূপ কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল রাহির কাছে। রাগে আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। কী করলাম আমি? আমার কলিজার টুকরাটাকে এভাবে কষ্ট দিলাম? দু চোখ ভেঙে কান্না এলো আমার। ছুটে গেলাম রাহির ঘরে। রূপ রাহিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। রাহি আমার দিকে চেয়ে বলল,

কী হয়েছে ভাইয়া?

পরে বলছি।

আমি রূপকে সরি বললাম, কোলে নিলাম। রূপ শুধু কাঁদছেই না, সঙ্গে ভয়ে কাঁপছে। আমি অনেকক্ষণ ওকে নিয়ে বাগানে হাঁটলাম। ওকে শান্ত করে সামনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

রাফি ভাইয়াকে ভয় লাগছে?

রূপ চুপ করে আছে। তবে কান্না থেমেছে। আমি রূপের ছোট ছোট হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বললাম,

ভাইয়া সরি। তুমি একটা পচা কথা বলেছ, তাই ভাইয়া রেগে গিয়েছিলাম। কিন্তু আর কখনো তোমাকে বকা দেব না প্রমিস। তুমি ভয় পেয়ো না।

রূপ বলল,

একন আল ভয় লাগছে না।

গুড গার্ল। এখন আমাকে বলো তো, তোমাকে কে বলেছে মা মরে গেছে?

কেউ বলেনি। আমি তিভিতে দেকেছি কেউ মরে গেলে আল আসে না। মাও তো আল আসে না। তাই আমি ভেবেছিলাম মা আবাল মরে গেল কি না।

আমি রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

আমাদের মায়ের কিছু হয়নি রূপ। মা একদম ভালো আছে।

তা হলে মা ফোন কলে না কেন?

মা তো অন্য একটা দেশে গেছে ভাইয়া। ওই দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের নেটওয়ার্কটা হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই মা ফোন করতে পারছে না। নেটওয়ার্ক ঠিক হয়ে গেলেই আবার কথা বলতে পারব।

লাফি বাইয়া শুনো, আমি যখন বল হব তখন একতা নেতওয়াক বানাবো যেতা কোনোদিন নষ্ট হবে না। সব বাবুরা মার সাতে কতা বলতে পালবে।

অবশ্যই বানাবে।

নিশ্চয়ই খুব দ্রুত মা ফিরে আসবে আর রূপের কাছে আমার প্রতিনিয়ত মিথ্যে বলার দিন শেষ হবে।

রাফসান শিকদার
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১০

কিছুক্ষণ আগে বাবা আমার ঘরে এসেছিলেন। আমার পাশে বসে বললেন,

আমি যদি কিছুদিনের জন্য তুরস্ক যাই তুই কি এদিকটা সামলাতে পারবি রাফি?

আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। বাবা চলে গেলে আমরা তিন ভাইবোন কীভাবে থাকব? কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম। কারণ বাবার কথায় কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলাম। বাবার চিঠির উত্তর আসেনি ঠিকই কিন্তু বাবা গেলে তো নিশ্চয়ই একটা খবর আনতে পারবে। আমি বললাম,

কেন পারব না বাবা তুমি অফিসে গেলে এদিকের সব তো আমিই সামলাই। তোমার ছোট ছেলে তো লাটসাহেব। কোনো দিকে তার নজর নেই। সব আমাকেই করতে হয়।

বাবা আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে খানিক হেসে বললেন,

যার এমন দায়িত্ববান বড় ভাই আছে সে তো একটু লাটসাহেব হবেই বাবা।

আমি মাথা চুলকে হেসে ফেললাম। তারপর বললাম,

তুমি যদি যেতে পারো তো যাও। কিন্তু বাবা তোমার কাছে কি যাওয়া আসার মতো টাকা-পয়সা আছে?

বাবা চিন্তিত হয়ে বললেন,

টাকা-পয়সা যদি থাকতই, এই দু মাস কি বসে থাকতাম রে বাপ? কবেই চলে যেতাম তোর মাকে খুঁজতে। টাকা ধার করেছি। সপ্তাহখানেকর মধ্যে পেয়ে যাব। টাকাটা হাতে পেলেই যাব। কিন্তু তোদের এভাবে একা রেখে যেতে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

আমি বাবাকে অভয় দিয়ে বললাম,

তিনজন মানুষ কখনো একা হয় না বাবা। তুমি নিশ্চিন্তে যাও। তোমার ছেলেমেয়েদের আমি দেখে রাখব কথা দিচ্ছি।

রাফসান শিকদার
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০

মীরা এখন কলেজে পড়ে ভাবতেই কেমন অবাক লাগছে তাই না? মেয়েটা কিন্তু দিন দিন বড় হচ্ছে। ওর পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ার মতো। এইতো দু বছর পর ভার্সিটিতেও উঠে যাবে। তখন ছেলেদের নজর থেকে ওকে রক্ষা করব কি করে? ওকে ভালোবসে ওর চোখে যদি কেউ তাকায় সে মরবে নিশ্চিত!

রাফসান শিকদার
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১০

মীরা দেখা করতে চাচ্ছে। এই মাসে একবারও দেখা হয়নি। সেমিস্টার ব্রেক চলছে তাই ঢাকা যাওয়া হচ্ছে না। তা ছাড়া এই মুহূর্তে আমার কাছে একদম টাকা-পয়সা নেই তাই দেখা করতে পারছি না। খালি হাতে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কোথায় যাব আমি? বাবা অন্য একটা দেশে যাচ্ছে কিছু বাড়তি টাকা বাবার কাছে থাকা ভালো-তাই এ মাসে হাত খরচের টাকা নিইনি। দেখা না করার জন্য একের পর এক অজুহাত দিয়ে যাচ্ছি মীরাকে। ও আজ আমাকে বলল, আমি নাকি বদলে গেছি। আমি নাকি ওকে আগের মত আর ভালোবাসি না।

ওকে বোঝাতে পারি না যে আমি বদলে যাইনি, আমার পরিস্থিতি বদলে গেছে। আর কটা দিন কষ্ট করো মীরা। বাবা যখন মাকে নিয়ে ফিরে আসবে, তখন সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে। তুমিও ফিরে পাবে তোমার আগের রাফি কে।

রাফসান শিকদার
৩১ সেপ্টেম্বর, ২০১০

***

আর কী কী দেখা বাকি আছে আমার এই জীবনে, সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান। মাকে হারিয়েছি, আজ বাবাকেও হারালাম। মা ফিরে আসবেন কি না-আমি জানি না তবে বাবা আর ফিরবেন না। সবকিছু গুছিয়ে ফেলেছিলেন বাবা, তুরস্ক যাওয়ার জন্য যে টাকা ধার করেছিলেন তাও পেয়ে গিয়েছিলেন দুদিন আগে। এখনই কেন হার্টঅ্যাটাকে দুম করে মরে যেতে হলো? দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে স্বার্থপরের মতো পালাচ্ছে একেকজন। কেন সব দায়িত্ব আমার একার নিতে হবে? রূপ বারবার জিজ্ঞেস করছে বাবা কখন আসবে? বাবার অফিস শেষ হচ্ছে না কেন? কী উত্তর দেব আমি ওকে?

সহজ সুন্দর পৃথিবীটা হঠাৎ করে এত কঠিন হয়ে উঠল কেন আমার? রাহি তো আমার চেয়ে খুব বেশি ছোট নয়। তবে সেও কেন রূপের মতো আমার কাছে এসে পাগলের মত কাঁদছে? আমি কার কাছে গিয়ে কাঁদব?

রাফসান শিকদার
১১ অক্টোবর, ২০১০

বাবা নেই সংসার কিভাবে চলবে জানি না। এরই মধ্যে আজ জানতে পারলাম আমাদের বাড়ির লোনটা নাকি শোধ হয়নি এখনো। এখন আমার মাথায় বারবার কিছু প্রশ্ন চক্রাকারে ঘুরছে। সংসার কিভাবে চলবে? আমাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনা কিভাবে চলবে? কদিন বাদে রূপকেও তো স্কুলে দিতে হবে।

বাবা-মা, তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ? তোমাদের এই শক্তপোক্ত ছেলেটা কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে? বাবা, তুমি তো আল্লাহর কাছে আছো, আল্লাহকে বলো না আমাকে একটা পথ দেখাতে। প্লিজ বাবা প্লিজ।

রাফসান শিকদার
১৮ অক্টোবর, ২০১০

আজ অনেকদিন পর মীরার সঙ্গে দেখা করলাম। অনেকদিন না বলে অনেক মাস বলা ভালো। বাবা মারা যাবার পর এ কদিনে ও আর দেখা করার জন্য জোরাজুরি করেনি। আমিই দেখা করার কথা বললাম। বাবার অফিসে যাওয়ার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলাম আজ। আবার কবে না কবে যেতে পারব তার কোনো ঠিক নেই।

ওকে দেখে ওর কথাবার্তা শুনে মনে হলো আমার জীবনে হঠাৎ এত পরিবর্তন ওর মধ্যেও অনেক প্রভাব ফেলেছে। ও হয়তো বা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। আগে যেখানে দিনের মধ্যে চৌদ্দ বার ওকে ফোন করতাম সেখানে এখন রাতে একবার ফোন করি। কোনোদিন সে সুযোগও পাই না। আমি ফোন করার আগেই ও করে। ভেবে দেখলাম ওর অভিযোগ সত্যি। আমি বদলে গেছি। আগে ঘন ঘন দেখা করতে চাইতাম, কত মধুর কথা বলতাম। এখন এর কোনোটাই পারি না। কেবল ওর প্রতি ভালোবাসাটা আগের মতোই রয়ে গেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো কিছু। ও আগে শুধু আমার ভালোবাসা ছিল, এখন আমার ভাইবোনের মতোই আমার বাঁচার অবলম্বনও!

মা নিখোঁজ একথাটা ওকে আজ বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর এই অবস্থা দেখে শেষ পর্যন্ত আর বলিনি। বললে হয়তো আরো বেশি দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে। আরো বেশি অনিরাপদ বোধ করবে। আরেকটু বড় হোক, এরপর নাহয় ওর ওপর ভর করে আমি নির্ভার হব।

রাফসান শিকদার
২৫ অক্টোবর, ২০১০

আমাদের সবার পড়াশোনা কীভাবে চলবে, ইউটিলিটি বিল, বাজার খরচ এসব কোত্থেকে আসবে সেসব নিয়ে ভাববার একেবারেই সুযোগ পাচ্ছি না। মাথার ওপর হোম লোনের বোঝাটা সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে আছে। বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা বেশ ভালো অ্যামাউন্ট এসেছে। কিন্তু তার চেহারাও দেখব না। টাকাটা হোম লোন পরিশোধে কাটা যাবে। কিন্তু তাতেও ব্যাপারটার দফারফা হবে না। আরো কিছু টাকা লাগবে লোন শোধ করতে। এই টাকাটা যে কোত্থেকে দেব সেটা বুঝতে পারছি না। রাহি বলছে বড় চাচার থেকে ধার নিতে। অবশ্য আমাদের ধার নেয়ার মতো আর কেউ নেইও। কিন্তু কারো থেকে টাকা-পয়সা ধার চাওয়ার অভ্যাস আমার নেই। তার ওপর ধার শোধ করব কীভাবে তাও জানি না! এমন ধার কি চাওয়া যায়?

রাফসান শিকদার
২৬ অক্টোবর, ২০১০

জীবনের এক অচেনা পথে হাঁটছি। পথটা কোন দিকে গেছে জানি না। কিভাবে চলতে হয় এ পথে তাও জানি না। হারিয়ে যাব না তো? অবশ্য হারিয়েই বা যাব কোথায়?

রাফসান শিকদার
০২ নভেম্বর, ২০১০

সন্ধ্যার পর মীরা খুব উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

কাল সকালে কি কোনো ভাবে দেখা হতে পারে রাফি?

আমার অবস্থা কাউকে বোঝাতে সবসময়ই আমি অপারগ। আমার ভেতর কত ধরনের দুশ্চিন্তা চলছে তার কিছুই তো মীরা জানে না। বলতেও পারি না। উল্টো বলে ফেললাম,

কেন কিছুদিন আগেই না দেখা হলো?

ওর বোধহয় মন খারাপ হলো। বলল,

কাল একটা বিশেষ দিন তাই বলছিলাম।

কাল কী?

ওর মন খারাপ এবার তীব্রতর হলো। বলল,

তুমি কালকের দিনটা ভুলে গেলে?

আমি শত চেষ্টা করেও মনে করতে পারছিলাম না কাল কী এমন বিশেষ দিন? মীরার জন্মদিন তো না। বললাম,

সরি মনে করতে পারছি না। কাল কী?

কাল আমাদের সম্পর্কের এক বছর হবে।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ও হয়তো ভাবছিল আমি আজকের দিনে দেখা করব, ওর জন্য বিশেষ কিছু করব! ভাবাই স্বাভাবিক। অন্য ছেলেরা তো করে। আগের রাফি হলে আমিও করতাম। অথচ এখন আমি দিনটা মনেও রাখতে পারলাম না। এমনকি আমি কাল কিছুই করতে পারব না ওর জন্য। দেখা করাটাও সম্ভব হবে না। কাল বড়চাচা টাকা দেবেন বলেছেন। টাকা আনতে ধামরাই যেতে হবে। সেখানে কতক্ষণ লাগবে তার কোনো ঠিক নেই।

আচ্ছা বকুল, দিন দিন আমি কি এমনই অনুভূতিহীন হয়ে যাব? আমি কি আর কোনোদিন স্বাভাবিক মানুষ হয়ে উঠতে পারব না?

রাফসান শিকদার
০৬ নভেম্বর, ২০১০

***

দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় রূপ বলল,

আমি ভাত কাবো না কাবো না কাবো না। বাবাকে আসতে বলো আগে। বাবা না আসলে আমি কিছুতেই ভাত কাবো না।

রাহি আমাকে বলল,

বলে দাও। ও তো বড় হচ্ছে। কতদিন এভাবে চলবে?

রূপ জানতে চাইল,

কীবাবে চলবে?

আমারও মনে হলো রূপকে আসলে বলে দেয়াই উচিত। আর কত মিথ্যে বলে ভোলাব? এমন চলতে থাকলে ওর অপেক্ষা তো আর শেষ হবে না। বললাম,

বাবা মরে গেছে আপু। আর কখনো আসবে না।

রূপ কাঁদল না। ও হয়তো মরে যাওয়াটা বোঝে না। শুধু বোঝে মরে গেলে কেউ আর ফিরে আসে না। কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল এরপর হাত উলটে বলল

কিন্তু বাবা মরে যাওয়াল আগে আমাকে যে বলে গেল না?

রাফসান শিকদার
১৬ নভেম্বর, ২০১০

আমার হাতে যে কটা টাকা ছিল তা শেষ। এখন বাকি দিনগুলো কীভাবে চলবে- বুঝতে পারছিলাম না। এর মধ্যে মীরা দেখা করার জন্য প্রচণ্ড চাপাচাপি করছে। এইতো কিছুক্ষণ আগে কথা হচ্ছিল।

রাফি একবার দেখা করো প্লিজ।

এখন সম্ভব না।

কেন?

পরিস্থিতি অনুকূলে নেই।

অনুকূলে আনেনা।

অন্য কোনো কথা না থাকলে এখন রাখি মীরা।

দুই মাস হয়ে গেছে আমাদের দেখা হয়েছে।

দুই বছরও হতে পারে। প্রেম করলে দুদিন পর পর দেখা করতে হবে এ কথা কোন কিতাবে লেখা আছে?

তোমার কি এখন আর আমাকে ভালো লাগে না?

তোমার যদি তাই মনে হয় তাহলে তাই।

রাফি তুমি বুঝতে পারছো কত বড় কথা তুমি বললে?

তুমিই বলালে। কথাটা তুমি তুলেছে।

এমনটাই ছিল মীরার সঙ্গে আমার আজকের কথোপকথন। আমাদের সম্পর্কের কতটা অবনতি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। এর জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু আমি কিছুই ঠিক করতে পারছি না। সবকিছু কেমন আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। মীরাকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু প্রতিনিয়ত শুধু কষ্টই দিচ্ছি।

রাফসান শিকদার
২৪ নভেম্বর,২০১০

অনেক চিন্তা করেও কোনো আয়ের উৎস খুঁজে পাইনি। রূপ মুরগির মাংস ছাড়া ভাত খেতে চায় না। কিছুদিন আগে ফ্রিজে থাকা শেষ মুরগিটুকু রান্না করেছিলাম। আমরা না খেয়ে একটু একটু করে রূপকে দিয়েছি। গতকাল তাও শেষ। রাতে মুরগির মাংস ছিল না বলে রূপকে ভাত খাওয়াতে পারিনি। আজকে একটা ব্যবস্থা না করলেই না। ভোরবেলা রাহি ঘুম থেকে ওঠার আগে আমি উঠে বাগানে চলে গেলাম। যত গাছে ফল ছিল সব পাড়লাম, নারকেল, বারোমাসি পেয়ারা, জলপাই, আমলকী। ফলগুলো নিয়ে বাজারে গেলাম। আমাদের এদিকে ভোরবেলা রাস্তার দু ধারে বাজার বসে। অদূরের গ্রামের লোকেরা তাদের গাছের ফল ও সবজি ঝুড়িতে করে নিয়ে রাস্তার দু-ধারে বসে থাকে। আমিও তাদের সঙ্গে বসে গেলাম। পরিচিত অনেকেই আমাকে সেখানে দেখে ভালোমন্দ অনেক কথা বলতে লাগলেন।

আহারে হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায় ছেলেটার কি দশা হলো!

ছি ছি রাফি তুমি এখানে এসব নিয়ে বসে আছো কেন? একটা চাকরি খোজো। আমাদের মহল্লার ছেলে এসব করলে কেমন দেখায়?

তোমার শেষ পর্যন্ত এই দশা? বাবা কি তোমাদের জন্য কিছু রেখে যাননি নাকি?

সত্যি করে বলতে রাফি তোমার মা ফিরছেন না কেন? তোমার বাবা-মার কি ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল নাকি?

সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করেও শেষ কথাটা সহ্য করতে পারলাম না। কথাটা বলেছে আমাদের গলিরই এক চাচা। আমি রক্তচক্ষু করে তাকে বললাম,

চাচা আপনি এখান থেকে যান, নাহলে আমার হাত উঠে যাবে। আর কোনদিন আমাকে দেখলে কথা বলবেন না।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, কত্ত বড় বেয়াদব ছেলে!

আপনার চেয়ে কম বেয়াদব আছি। আমি অন্যের বাপ-মা তুলে আজেবাজে কথা বলি না। যান এখান থেকে।

অসভ্য লোকটা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল।

আজকের অভিজ্ঞতা এখানেই শেষ নয়। ওই সময়টাতে পাশের বাসার টগর সম্ভবত কলেজে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রথমে অবাক হলেও পরে স্বাভাবিকভাবেই আমাকে জিজ্ঞেস করল,

আপনি কি এগুলো বিক্রি করছেন?

আমি সম্মতি জানাতেই বলল,

এগুলো আপনার গাছের লাল পেয়ারা না? ওইযে ভেতরটা লালচে হয়?

হ্যাঁ।

এত ভালো স্বাদ! রাহি একবার দিয়েছিল। লাল পেয়ারাগুলো যা আছে সব আমাকে দিন।

আমার একটু বিরক্ত লাগল করুণা করছে ভেবে। বললাম,

আপনি সব নেবেন কেন? আপনার যতটুক দরকার আপনি ততটুক নেবেন।

টগর বলল,

আমার সব দরকার তাই সব নেব। আপনার কি সমস্যা? আপনি তো বিক্রিই করছেন। তাই কিনতে চাচ্ছি।

কথা সত্য। বিক্রি করছি বলেই কিনতে এসেছে। করুণা কেন হবে? আমিই বেশি ভাবছি। আর কথা বাড়ালাম না। মেপে দেখলাম দুই কেজির কিছু কম আছে। সেই হিসাবেই দিলাম। টগর পেয়ারা কিনে নিয়ে চলে গেল। সব ফল বিক্রি হতে হতে বেশ বেলা হলো। এরপর বাজার করে বাসায় ফিরলাম। কিন্তু গাছের সব ফল তো শেষ, এরপর কী করব?

রাফসান শিকদার
২৯ নভেম্বর, ২০১০

বাজার করার পর সামান্য কিছু টাকা আমার হাতে ছিল। কিন্তু পরবর্তী প্রয়োজনটা এমনই এসে দাঁড়াল, যা সেই টাকায় মিটবে না। রাহি জানাল ওর এইচএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করতে হবে। এদিকে আমার সম্ভবত এই সেমিস্টার গ্যাপ যাবে। রেজিস্ট্রেশনের সময় হয়ে এসেছে, এত টাকা তো নেই। কিন্তু রাহিরটা তো না করলেই নয়। আমি এক সেমিস্টার গ্যাপ দিলেও খুব একটা ক্ষতি হবে না। পরবর্তী সেমিস্টারগুলোতে একটা করে বাড়তি কোর্স নিলে সময়ের মধ্যেই শেষ করা যাবে। কিন্তু রাহির গ্যাপ পড়ে গেলে তো পুরো একটা বছর পেছনে পরে যাবে। ডিপ্রেশনে পড়ে যাবে বেচারা। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। যেভাবেই হোক টাকা ম্যানেজ করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে?

রাফসান শিকদার
৩০ নভেম্বর, ২০১০

দেখা করা নিয়ে আবার চাপাচাপি শুরু করল মীরা। আমার একদম কিছু ভালো। লাগছে না। শেষমেশ বলেই ফেললাম আমার কাছে টাকা নেই। মীরা বলল,

টাকা লাগবে কেন? আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব। টিএসসি গিয়ে বসে থাকব।

এখান থেকে ঢাকা যেতে তো টাকা লাগবে। আমার হাত একদম খালি মীরা।

তুমি কোনোভাবে কারো থেকে ধার করে ঢাকা আসো। আমার কাছে কিছু। জমানো টাকা আছে। ওটা তোমাকে দিয়ে দেব।

তোমার টাকা আমি কেন নেব?

আমার একটু মেজাজ খারাপ হলো। মীরা নরম গলায় বলল,

আমার টাকা আর তোমার টাকা তো একই হলো।

কখনোই না। তোমার টাকা তোমার টাকাই, আর আমার টাকা আমার টাকাই। এটা তোমার বাবার টাকা তুমি কোনোভাবে জমিয়েছে। যদি তোমার নিজের আয় করা টাকাও হতো তবুও সেটা তোমার টাকাই হতো। সুতরাং তোমার টাকা আমি কখনোই নেব না। আর কখনো এসব বলবে না।

মীরা দমে গেল। আর কথা বাড়াল না। টাকা যে এত প্রয়োজনীয় জিনিস তা আগে কোনোদিন বুঝিনি। কোন গাধা বলেছে টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না? দুনিয়াতে একমাত্র টাকা দিয়েই সুখ কেনা যায়।

রাফসান শিকদার
০২ ডিসেম্বর, ২০১০

মীরা কিছুক্ষণ আগে আমাকে মনে করাল আজকের দিনে নাকি ও আমাদের বাসায় এসেছিল। অন্যসময় হলে হয়তো সেদিনের মধুর স্মৃতি মনে পড়ত। কিন্তু আজ মনে পড়ল, মাকে ছাড়া আছি এক বছর!

রাফসান শিকদার
০৭ ডিসেম্বর, ২০১০

আচ্ছা মা কি কখনোই ফিরবে না? আমি অনেকবার ভেবেছি ঠিক কি কারণে মা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে না? আমি কোনো কারণ খুঁজে পাই না। আমার শুধু মনে হয় এমন কিছু একটা হয়েছে, যা আমরা কেউ ভাবতে পারছি না। মায়ের বিষয়ে ভাবতে গেলে এখন দিনরাত কেবল দুটো চিন্তা আসে। এক, যদি মা কখনো ফিরে না আসে তাহলে আমি ছোট ছোট দুটো ভাইবোন নিয়ে কীভাবে জীবনধারণ করব? দুই, যদি মা ফিরে আসে বাবার মৃত্যুর খবরটা তাকে কীভাবে দেব?

রাফসান শিকদার
১০ ডিসেম্বর, ২০১০

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *