অধ্যায় ৬
২৩শে জুন
সূর্যোদয়-৩:০৮
পেটের গর্জনে ঘুম ভেঙে গেল। অন্তত এটা আশা করছি, ওটা পেটের গর্জনই হবে। না-হলে আশেপাশের যেরকম বুনো পরিবেশ অন্য কিছুর গর্জনের কথা ভাবতেই কেমন যেন লাগল।
কিন্তু ক্ষুধার চেয়ে অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছে।
আমার পা।
গড়ান দিয়ে ক্যানোর নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম।
“ধ্যাত্।”
অন্তত হাজারটা মশার কামড়ের দাগ। প্রতিটা ইঞ্চি লাল হয়ে ফুলে আছে। নখ দিয়ে পাগলের মত চুলকালাম কিছুক্ষণ।
এতটা গাধার মতন কাজ করলাম কিভাবে আমি? ঐ ভেজা কাপড়গুলোই পরে ঘুমানো উচিত ছিল আমার।
মিয়াও। ঘুরে তাকালাম। ল্যাসি এখনও ক্যানোর নিচে গুটিসুটি মেরে আছে।
“না, কুষ্ঠরোগ হয়নি আমার,” এই বলে আরেকবার চুলকালাম। “শালার মশার দল বিনামূল্যে খাবার পেয়ে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে।”
মিয়াও।
“আমার চেহারা? ওটায় আবার কি সমস্যা?”
হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম কপালের আশেপাশে। শুকনোমত কী যেন উঠে এল। চামড়া। নাকে হাত দিয়ে দেখলাম ওখানেও একই অবস্থা।
মিয়াও।
“না, সাপের মত খোলস বদলায় না মানুষ!”
মিয়াও।
“বিড়ালও না।”
মিয়াও।
“হ্যাঁ রে, আমারও ক্ষুধা পেয়েছে,” একটা জুসের জন্যে কী না করতে পারি এখন আমি। এমনকি ঐ জঘন্য সবুজ রঙের জুস হলেও চলবে।
মিয়াও।
“নাহ, ভালো কোন খাবারের বন্দোবস্ত নেই আমার কাছে। তুই গিয়ে নাস্তার জন্যে কিছু একটা শিকার করে নিয়ে আসছিস না কেন?”
মিয়াও।
“তোর পা? কি হয়েছে তোর পায়ে?”
এই প্রথম ভালোমত খেয়াল করে দেখলাম কিভাবে বসে আছে ল্যাসি। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে, সামনের ডান পাটা ভেতরের দিকে গোটোনো।
নিচু হয়ে আলতো করে হাত বুলালাম ওটাতে।
গুঙিয়ে উঠল ও।
“কিভাবে হল?”
মিয়াও।
“আমার জন্যে? আমি কিভাবে করলাম?”
মিয়াও।
“আমি তোকে মোটেও মাইকেল জর্ডান যেভাবে বাস্কেটবল ছুঁড়ে মারে ওভাবে ক্যানোর ভেতর ছুঁড়ে মারিনি।”
মিয়াও।
“আরে, ওটা তো তোকে বাঁচানোর জন্যেই করেছিলাম। নাড়াতে পারছিস পা’টা?”
একটু নাড়ানোর চেষ্টা করে আবার গুঙিয়ে উঠল বেচারা। না ভাঙলেও নিশ্চয়ই ভালোমত মচকে গেছে পাটা। যাই হোক না কেন, কয়েকদিনের মধ্যে কিছুই শিকার করতে পারবে না ও।
আরো তিরিশ সেকেন্ড পা চুলকানোর পর উঠে গিয়ে পাথরের ওপর থেকে ট্রাউজারটা হাতে নিলাম। শুকিয়ে গেছে। পরে নিলাম, আশা করছি ওগুলোর সংস্পর্শে চুলকানি কিছুটা হলেও কমবে। একটুও কমল না। জুতো মোজা পরে ক্যানোর কাছে ফিরে গিয়ে ল্যাসিকে তুলে নিলাম।
“আমাদের দুটো রাস্তা আছে,” বললাম তাকে। “হেঁটে রওনা হতে পারি ফেয়ারব্যাঙ্কসের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমরা প্রায় একশ মাইলের মত দূরে আছি। এক দিনে সর্বোচ্চ চার মাইল যেতে পারব আমি, বালুতট ধরে হাঁটলে সর্বোচ্চ পাঁচ মাইল। তার মানে, এক মাসের কাছাকাছি। আর তা না-হলে আবার ক্যানোতে চেপে বসতে পারি আমরা। ওটাতে অনেক দ্রুত এগোতে পারব, কিন্তু কোথায় যাচ্ছি তার কোন ঠিক-ঠিকানা থাকবে না। এমনও হতে পারে, কয়েকশো মাইল যাওয়া সত্ত্বেও কোন জনবসতির দেখা মিলল না।”
মিয়াও।
“এখন গরমকাল। আর এখানে কোন ইগলু মানব নেই।”
মিয়াও।
“জানি না, হয়ত কুড়েঘরে থাকে।”
“আমাদের যেতে হবে এখন। তো, তুই কি বলিস? পানি নাকি ডাঙা?”
ডাঙাতে আমি জানি সামনে কি পড়বে। নদীর তীর ধরে যদি পূর্বদিকে হাঁটতে থাকি তাহলে এক সময় না এক সময় ফেয়ারব্যাঙ্কসে পৌঁছে যাব। এমনকি পথিমধ্যে কারো সাথে দেখাও হয়ে যেতে পারে। আর ক্যানোতে করে পশ্চিমে এগোলে অজানার উদ্দেশ্যে পারি জমাতে হবে। সামনে হয়ত দেখা যাবে আরো খরস্রোতা নদীর সাথে মিলেছে সেইনা নদী, কিংবা ঝর্ণা। সোজা কথা তখন আমাদের ভাগ্য পুরোপুরি নদীর হাতে।
মিয়াও।
“নাহ, আমার মনে হয় ডাঙাই ভালো হবে।”
মিয়াও।
“তুই হাঁটতে পারবি? নাকি ক্যানোতে দাঁড় বাইতে পারবি?”
মিয়াও।
“তাহলে তোর ভোট গোণায় ধরা হবে না।”
এরপরের পাঁচ মিনিটে ক্যানোর কাছাকাছি বালুতে একটা সাহায্য বার্তা লিখে পূর্বদিকে ফেয়ারব্যাঙ্কসের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলাম।
হেনরি বিনস, ২৩শে জুন
মিয়াও।
“আচ্ছা বাবা, আচ্ছা।“
…সাথে ল্যাসিও আছে।
সঙ্গে কি কি আছে হিসেব করে নিলাম। একটা ট্রাউজার, একটা হুডি, একটা টিশার্ট, জুতা, মোজা, একটা লাঠি, একটা ঘড়ি আর একটা বিড়াল।
“ঠিক আছে তাহলে,” নিচু হয়ে ল্যাসিকে তুলে নিলাম। “চল, যাওয়া যাক।”
নদীর পানি কম এখন, বালুতট সূর্যের তাপে শুকিয়ে আছে। হাঁটতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। এরকম শুকনো বালু আর নুড়ি পাথর যদি পুরোটা তীর জুড়ে থাকত তাহলে হয়ত দুই সপ্তাহেই পৌঁছে যেতাম আমরা। কিন্তু তা নেই। আধ মাইল পরপর বালুতট উধাও হয়ে যায় আর আমাকে বাধ্য হয়ে কোমর সমান উঁচু ঘাসের মধ্যে দিয়ে সামনে এগোতে হয়। পাশে থাকে বার্চ, পাইন গাছ। প্রতিটা পদক্ষেপ বুঝে শুনে ফেলতে হয়। গতি আরো কমে যায় পোকামাকড়ের কারণে, অনবরত ঘাড়ে, হাতে, চেহারায় কামড় বসানোর চেষ্টা ওগুলোর।
ল্যাসিকে বাম হাতে আগলে রেখেছি। ঠাস করে ঘাড়ে একটা চাপড় বসালাম ডান হাত দিয়ে। এরপর সূর্যের আলোয় পরীক্ষা করলাম। পোকাটার আকার প্রায় ছোটখাট একটা পাখির সমান।
মিয়াও।
“না, এটা বাদুড় না,” হেসে বললাম। “খুশি থাক যে, তোর সারা গায়ে ওরকম খাড়া খাড়া লোমে ভর্তি।”
মিয়াও।
“আরে, মজা করছিলাম। কিন্তু মারডকের কিন্তু ওরকমই।”
মিয়াও।
“হতে পারে। হয়ত সে এখন আরামসে একটা কাউচে শুয়ে আছে।”
মিয়াও।
“বিড়ালদের সর্দি লাগে না। গুল মারবি না একদম। কোন প্রমাণ দেখাতে পারবি?”
নেই কোন প্রমাণ ওর কাছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ল্যাসির উদ্দেশ্যে বললাম, “তোকে একটা কথা বলতে চাই আমি।”
মিয়াও।
“আমি তোকে মিথ্যে বলেছিলাম। মারডকের সর্দি লাগেনি।”
মিয়াও।
“ওকে খোঁজা করা হয়েছে।”
মিয়াও।
“মানে, ওর অণ্ডকোষ দুটো ফেলে দেয়া হয়েছে।” ল্যাসি লাফ দিয়ে আমার মুখে খামচি দেয়ার চেষ্টা করল। শান্ত না হওয়া পর্যন্ত ওকে চেপে ধরে রাখলাম। “আরে, ওটা আমি করিনি।”
মিয়াও।
“কারণ ও পাশের বাসার কুকুরটাকে আরেকটু হলে মেরেই ফেলেছিল।”
মিয়াও।
“হ্যাঁ, লোলাকে।”
মিয়াও।
“না, ওর শারীরিক কোন অসুবিধা হবে না। ওর ওজন শুধু দুই পাউন্ড কমে যাবে, এই আর কি।”
মিয়াও।
“ওর পৌরুষ ছিনিয়ে নেয়ার অধিকার বাবার নেই মানে? উনি ওর মালিক। ওর জন্যে যেটা ভালো সেটাই করেছেন। যাই হোক, তোকে সত্যিটা জানাতে চেয়েছিলাম, একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম।
কোন কারণে যদি আমরা লক্ষ্যে না পৌঁছাই? এটাই যদি আমাদের একসাথে কাটানো শেষ দিন হয়?
এখন মনে হতে লাগল ইনগ্রিডকে এরকম পরিস্থিতিতে আমি কি বলতাম।
ঘড়ির দিকে তাকালাম।
তিনটা বত্রিশ।
কি বলতাম আমি ওকে যদি আমাদের হাতে মাত্র আটাশ মিনিট থাকত?
বলতাম এই দুনিয়ায় সবকিছু থেকে ওকে বেশি ভালোবাসি আমি। মাঝে মাঝে ওর কারণেই নিজের এই মাত্র ষাট মিনিটের দিনের কথা ভেবে নিজের ওপর রাগ লাগে। কিন্তু আমি সৌভাগ্যবান, এই সীমিত মিনিটগুলো ওর মতন একটা মেয়ের সাথে কাটাতে পারি। আর আমি দুঃখিত ওর সাথে ওভাবে কথা বলার জন্যে। বাচ্চা নিলেও আমার ওর পক্ষেই থাকতাম আমি। সেটা আমার জন্যে যত কঠিনই একটা কাজ হোক না কেন, ঐ ষাট মিনিটের জীবনেই বাচ্চার সাথে সবকিছু গুছিয়ে নিতাম আমি। স্বার্থপরের মত এটা ভাবতাম না যে, বাচ্চাটা আমার জীবনের মিনিটগুলো নষ্ট করছে কোনভাবে। আর আজ থেকে ত্রিশ বছর পরে বাচ্চাটা বড় হলে তার জীবনে কি কি ঘটবে ওগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা করে সময়ও নষ্ট করতাম না। সব পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতাম বাচ্চাটার জীবনে। একটা সাইকেল নিয়ে প্লেনের সাথে পাল্লা দেয়ার মত করে হলেও। আর ওতে ইনগ্রিডের কোন দোষ নেই।
হতাশায় মাথা নাড়তে লাগলাম আমি।
আবার ইনগ্রিডের দোষের কথা কিভাবে ভাবতে পারলাম? এতটা স্বার্থপর আমি?
একটা স্বস্তিদায়ক দৃশ্য দেখে আমার চিন্তার বাঁধন ছিঁড়ে গেল। সামনে আবার বালুতট দেখা যাচ্ছে। হাটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে প্রায় দেড় মাইলের মতন সামনে এগোলাম।
তিনটা পঞ্চান্নর সময় থেমে গেলাম আমরা। মনে মনে হিসেব কষে দেখলাম প্রায় পাঁচ মাইলের মত এগিয়ে গেছি আজ।
ল্যাসিকে নদীর পাড়ে নামিয়ে দিয়ে দু-জনই পানি খেয়ে নিলাম।
ল্যাসি সামনের পা-টা আস্তে করে নিচে রাখার চেষ্টা করেই আবার ব্যথায় গুটিয়ে নিল।
“দরকার নেই,” আমি বললাম ওকে, “তোকে নিয়ে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে না আমার,” তিনদিন না খেয়ে থাকার পর ওর ওজন কমে চার পাউন্ড হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
মিয়াও।
মাথা নেড়ে সায় জানালাম ওর সাথে। আমারও প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে।
আমাকে আরেকটা লাঠির খোঁজ করতে হবে। আগেরটা মশা তাড়াতে তাড়াতে ভেঙে গেছে। আশেপাশে তাকিয়ে নদীর তীরে ওরকম একটা লাঠি পড়ে থাকতে দেখলাম। আগাটা চোখাই হয়ে আছে। তবুও একটা পাথরের গায়ে ঘষে ওটাকে আরো চোখা করলাম যাতে একটা মাছ অন্তত গাঁথতে পারি।
জুতা-মোজা খুলে ট্রাউজারটা হাটু অবধি গুটিয়ে পানিতে নেমে সন্তর্পণে এগোতে লাগলাম। ঠাণ্ডা পানির প্রভাবে মশার কামড়ের জায়গাগুলোতে একটু আরাম লাগছে। এসময় পানিতে একটা রঙিন মাছকে সাঁতরে বেড়াতে দেখে চট করে লাঠিটা ছুঁড়ে দিলাম।
কাছাকাছি দিয়েও গেল না সেটা।
*
অধ্যায় ৭
সূর্যোদয়-৩:০৯
ঘুমিয়ে পড়ার সময়ই ক্ষুধায় পেট চো-চো করছিল। ওঠার পর কেমন লাগছে সেটা বলে বোঝাতে পারব না।
ল্যাসি আমার পাশেই ঘাসের ওপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। পাঁজরের প্রতিটা হাড়ি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমার নিজের অবস্থাও এই কয়দিনে বেশ খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু আমার শরীর এরকম দীর্ঘক্ষণ খাবার না পেয়ে অভ্যস্ত। অন্যদিকে ল্যাসি একটা ছোটখাট বিড়াল, বেচারার শরীর খাবার ছাড়া একদম দূর্বল হয়ে পড়ছে।
উঠে বসে পাইনের কাঁটাগুলো শরীর থেকে ঝেড়ে ফেললাম। ঘাড়ে, হাতে আর পায়ের কিছু জায়গায় ভয়ঙ্কর চুলকাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলাম। ইচ্ছে করছে পাইনের কাঁটাগুলো দিয়ে যেসব জায়গা চুলকাচ্ছে। সেখানে ফালা ফালা করে ফেলি। লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করছি।
দশ সেকেন্ড পর আর আটকাতে পারলাম না। দীর্ঘ এক মিনিট চুলকাতে চুলকাতে লাল করে ফেললাম জায়গাগুলো। এরপর আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে কাঁধের ওপর থেকে দুটো পাইনের কাঁটা নিয়ে মুখে দিলাম। খুব কষ্ট করে চিবিয়ে গিলে ফেলার চেষ্টা করছি। উঠে আসতে চাইছিল কয়েকবার, কিন্তু তা হতে দিলাম না। নিচে তাকিয়ে দেখি ল্যাসি তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
“কিরে? তুইও খেয়ে দেখবি নাকি?”
“না, এগুলো খেতে জেলিবিনের মত লাগছে না মোটেও।”
মিয়াও।
“না, আমার কাছে কোন জেলিবিন নেই আপাতত।”
মিয়াও।
“মনে হয় না কাছাকাছি কোথাও পাওয়া যাবার সম্ভাবনা আছে।”
ওকে তুলে নিয়ে নদীর পারে গিয়ে প্রতিদিন সকালে আমরা যা করি সেটা সারলাম। আমার হৃৎপিণ্ড এখনও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বেগে স্পন্দিত হচ্ছে। আর মনে হচ্ছে যেন কেউ আমার চোখে অটোফোকাস লেন্স ফিট করে দিয়েছে। মাঝে মাঝেই ঝাপসা দেখছি। শেষ কখন ভালো কিছু মুখে দিয়েছিলাম?
এটুকু মনে আছে, স্যান্ডউইচ, জুস আর ক্যারামেল কর্ন খেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা কি পাঁচ দিন আগে? নাকি ছয়দিন? আমার মগজ, যেটা কিনা ব্রুস লি’র মত ক্ষিপ্রতায় কাজ করে, এখন একটা সুমো রেসলারের চেয়েও ধীরে কাজ করছে। একবার ঠোঁট চেটে নিয়ে উপরের উজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম।
“চার দিন,” মাথা নেড়ে বললাম, “চার দিন হয়ে গেল কিছু খাইনি।”
ল্যাসিকে তুলে নিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম।
.
মাছ দুটোই প্রায় এক ফিটের মত লম্বা হবে। একটা রূপালি আরেকটা লাল। পানিতে একটা বৃত্ত সৃষ্টি করে সাঁতার কেটে চলেছে। নদীর মধ্যে একটা তিন ফিট লম্বা পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে লাঠিটা, আরো চোখা করে নিয়েছি ঘষে ঘষে। ল্যাসি তীর থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে দেখছে। ওর চোখজোড়া আমাকে নীরবে আকুতি জানাচ্ছে যেন একটা মাছ ধরতে পারি ওর জন্যে।
আরো কিছুক্ষণ মাছ দুটোর বিচরণক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করে ওদের সম্ভাব্য অবস্থান বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম। যেন একদম ঠিক মুহূর্তে ঠিক জায়গায় লাঠিটা ছুঁড়ে গেঁথে ফেলতে পারি। কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও কিছু বুঝতে পারলাম না। চুলোয় যাক!
“তোদের থেকে যেকোন একজন আজ রাতে আমাদের খাবার হতে যাচ্ছিস,” চিবিয়ে ওদের উদ্দেশ্যে বললাম।
দুবার লম্বা শ্বাস নিয়ে হাতের বর্শাটা ছুঁড়ে মারলাম চকিতে।
“শিট!” চেঁচিয়ে উঠলাম।
রূপালি মাছটা ছটফট করছে লাঠির মাথায়।
“ধরে ফেলেছি!”
আমি চাই না মাছটা আবার পানিতে পড়ে যাক। আস্তে আস্তে লাঠিটা ওঠালাম। চোখা মাথাটা মাছটার পেট ভেদ করে ওপাশে তিন ইঞ্চি বেরিয়ে আছে। ঘুরে গর্বিত ভঙ্গিতে ল্যাসিকে দেখালাম। যেন যুদ্ধ জয় করে ফেলেছি। ও দু-পায়ে ভর দিয়ে যতটা সম্ভব উঁচু হয়ে বসে আছে। চোখ চকচক করছে।
মাছটা পানির নিচে যতটা বড় মনে হয়েছিল আসলে অতটা বড় নয়। তবে আট ইঞ্চির কম হবে না। আর ওজনে এক পাউন্ডের একটু বেশি। আরাম করে খাওয়া যাবে।
মিয়াও।
“আসছি, আসছি! শান্ত হয়ে বস্,” আমাকে এখনও ত্রিশ ফিটের মত হাটু পানি মাড়িয়ে তীরে পৌঁছতে হবে। সাবধানে এগোতে লাগলাম।
ল্যাসির দিকে তাকিয়ে না হেসে পারলাম না। উত্তেজনার চোটে ও একদম কিনারায় এসে পড়েছে।
মিয়াও।
“বল্প? ওটা আবার কি? মাছের নাম?”
মিয়াও।
“আচ্ছা বাবা। বন্ধু মাছের নাম, মানছি,” এই বলে আরেকটু সামনে এগোলাম।
মিয়াও।
“একটা বন্ধু মানে?”
মিয়াও।
ঘুরে তাকালাম।
আমার বিশ ফিট পেছনে, প্রায় দেখা যায় না এমনভাবে একটা বিশাল বন্ধু হরিণ পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। আসলেই বিশাল। কমসেকম হাজার পাউন্ড। শিংগুলো পাঁচ ফিটের মতন লম্বা। সরাসরি আমার দিকে দৃষ্টি ওটার। হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। তিনফিট, পাঁচ ফিট, দশ ফিট এগিয়ে গেলাম।
আর অর্ধেক পথ বাকি আছে এমন সময় পেছনের দিকে তাকালাম।
পুরো বন্ধু হরিণটার শরীর এখন পানির ওপর উঠে এসেছে। আমার চেয়ে পনের ফিট পেছনে থাকলেও দূরত্বটা দ্রুতই কমছে। ওর উদ্দেশ্য আমাকে শিং দিয়ে গুতো মেরে নিচে ফেলে দেয়া, এরপর পা দিয়ে আটার মত কাই করা।
হোঁচট খেলাম এমন সময়। একদম পানির মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম। বাম হাতের ওপর শরীরের সব ভর পড়ল। কিন্তু তখনও ডান হাত দিয়ে মাছ সমেত লাঠিটা শক্ত করে পানির ওপরে উঠিয়ে রেখেছি। ঠিক এমন সময়ে পানির ওপর বিশাল একটা ছায়া দেখে বুঝতে পারলাম ভুল হয়ে গেছে। একটা শিং ঠিক আমার হাটুর নিচে দিয়ে এসে আমাকে উপড়ে ফেলল। কিছুক্ষণ পানির ওপর ভাসমান অবস্থায় থেকে আবার পানিতেই ডুবে গেলাম। বাকি পথটুকু কোনমতে হামাগুড়ি দিয়ে পার হয়ে তীরে এসে হাঁপাতে লাগলাম।
উঠে দেখি বন্ধু হরিণটা আমার ঠিক ছ’ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ আমার লাঠিটার ওপর।
রূপালি মাছটা তখনও কাতরাচ্ছে। দশ সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে এই দুনিয়ায় আর কোন চিহ্নও থাকল না ওর।
আমার দিকে কিছুক্ষণ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকল বন্ধু হরিণটা। এরপর গাছগাছালির দিকে ছুট দিল।
.
“মাছটার জন্যে দুঃখিত।”
মিয়াও।
“হ্যাঁ, কিন্তু কিছু একটা খেতে পারলে আসলেই ভালো লাগত।”
মিয়াও।
“কি? আমি ওভাবে তোর দিকে তাকাচ্ছি কেন মানে?”
মিয়াও।
“আমি মোটেও তোকে খাবারের দৃষ্টিতে দেখছি না!”
মিয়াও।
“আমারই বরং তোকে নিয়ে চিন্তা করা উচিত। আমি দিনে তেইশ ঘন্টা ঘুমাই। কোনদিন উঠে দেখব দুটো আঙুল গায়েব।”
কোন জবাব দিল না ও।
“ও কথা মাথায়ও আনবি না।”
মিয়াও।
“প্রমিস কর, আমরা একজন আরেকজনকে খাব না?”
ও আমার আঙুলে ওর একটা আঙুল ছুঁয়ে প্রমিস করল।
“একটা জিনিস ভেবে অবাক হচ্ছি। তুই হরিণটার সাথে কোন লাইন মারার চেষ্টা করলি না।”
মিয়াও।
“পরের বার? দেখবনে।”
এক মিনিট পরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
আর জেগে উঠব কিনা সন্দেহ আছে।
*
অধ্যায় ৮
সূর্যোদয় ৩:১১
মুখের ওপর থেকে টি-শার্টটা সরিয়ে ফেললাম। সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। কয়েকবার মাথা ঝাঁকি দিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলাম। এখনও সূর্য ওঠেনি, অনেকটাই অন্ধকার। সেই আবছা আলোয় হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তালুরেখাগুলো একবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আবার পরমুহূর্তেই ঘোলা হয়ে যাচ্ছে।
উঠে বসলাম। ল্যাসি আর আমি বালুর ওপরই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মুখের ওপর টিশার্টটা দিয়ে রেখেছিলাম যাতে সানবার্ন না হয় আবার। টিশার্টটা নিচ থেকে তুলে মাথার পেছন দিকে লেগে থাকা বালুওগুলো মুছে ফেললাম।
নিচু হয়ে বাম পায়ে হাত বোলালাম। বড় একটা জায়গা কেটে গেছে। কিন্তু এর চেয়েও খারাপ হতে পারত পরিস্থিতি। বন্ধু হরিণটা আমাকে অল্পের ওপর দিয়েই ছেড়ে দিয়েছে। কেবল মাছটার দিকে নজর ছিল ওটার।
নদীর ধারে গিয়ে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারলাম।
এরপর জাহাজের ক্যাপ্টেনের লগবুকে লিখে রাখার মত করে বললাম, “আজ ২৫শে জুন। আলাস্কার বুনো অঞ্চলে চতুর্থ দিন। কোন প্রকার খাবার ব্যতিত পঞ্চম দিন। দশ মাইল পাড়ি দিয়েছি আমরা। ল্যাসির পক্ষে এখনও হাটা সম্ভব হচ্ছে না। আমাকে একটা বন্ধু হরিণ আক্রমণ করেছিল। প্রতি রাতে মশারা রক্ত খেয়ে চলেছে। অসহ্য রকমের চুলকানি…”
আরো কিছুক্ষণ এরকম বকে যখন ঘড়ির দিকে তাকালাম তখন তিনটা ছয় বাজছে। ঘুরে ল্যাসি যেখানে ঘুমিয়ে আছে সেদিকে হাটা দিলাম। কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছেই থমকে গেলাম আমি। ভালোমত দেখার চেষ্টা করলাম।
“এটা কিভাবে সম্ভব?”
আমি আর ল্যাসি যেখানে ঘুমিয়েছিলাম তার পাঁচ ফিট ওপরে নুড়ি পাথরের মত কালো কালো কী যেন স্তূপ করে রাখা। নিচু হয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। নুড়ি নয় ওগুলো। একধরণের বেরি জাতীয় ফল।
ল্যাসিকে ধরে ঝাঁকুনি দিলাম। আস্তে করে চোখ খুলল ও।
“কোথায় পেলি তুই এগুলো?”
মিয়াও।
“এই যে, এই ফলগুলোর কথা বলছি। কোথায় পেলি এগুলো? আর কিভাবে? আমি তো ভেবেছি তুই হাঁটতে পারিস না।”
মিয়াও।
“আমি আনিনি এগুলো।”
তাহলে কি নদীতে ভেসে এসেছে এগুলো? নাকি কোন গাছ থেকে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এখানে এসে জমা হয়েছে?
না, এটা সম্ভব না। তাহলে এরকম স্তূপাকারে সাজানো থাকত না।
প্রায় একশোটার মত হবে। যেখান থেকেই আসুক, খাওয়া গেলেই হল। মিয়াও।
“তুই আগে একটা খা।”
মিয়াও।
“মাঝে মাঝে মনে হয় তুই আসলেই গিনিপিগ হলে ভালো হত।”
মিয়াও।
“কালো মানেই মৃত্যুর রঙ না।”
“ঠিক আছে, আমি বললাম। “দুজনই একই সময় মুখে দিব।” ওকে একটা দিলাম। মিয়াও।
“আমাকে একটার বেশি খেতে হবে কেন?”
মিয়াও।
“আচ্ছা, একটার বেশিই খাবো আমি। যাতে দুজন একই সাথে মরতে পারি।”
মুঠো করে কয়েকটা ফল হাতে নিলাম।
“এক…দুই…তিন।”
মুখে পুরে দিলাম।
মিষ্টি ফলগুলো, সেই সাথে মেটে একধরণের গন্ধ। আগে কখনো এরকম বেরি খাইনি আমি। কিন্তু এটা বোঝা গেল না, এগুলো বিষাক্ত কিনা।
ল্যাসি আর আমি একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছি। অপেক্ষা করছি কার দেহে আগে বিষক্রিয়া দেখা দেবে।
এক মিনিট পরে বুঝতে পারলাম ওগুলো আসলেও বিষাক্ত নয়। ক্যালোরির প্রভাব সাথে সাথে পড়ল আমার শরীরে। চোখে ঝাপসা দেখা বন্ধ হয়ে গেল।
এখন যখন পেটটা একটু হলেও ঠাণ্ডা হল, তখন আবার আগের প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। বেরিগুলো আসলো কোথা থেকে?
উঠে দাঁড়ালাম।
সূর্য উঠে গেছে। সেই আলোয় আশেপাশের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হেঁটে বালুতটের কিনারায় ঘন ঘাসের জঙ্গলের কাছে গেলাম।
উত্তরটা এখানেই শুয়ে আছে।
আসলেই শুয়ে আছে।
নরম ঘাসের উপর, গুটলি পাকিয়ে শুয়ে আছে একটা ছোট্ট ছেলে।
একটা ছোট্ট এস্কিমো ছেলে।
.
ছেলেটার পরণে একটা হলুদ রঙের টি-শার্ট। ওটার গায়ে অলিম্পিকের রিঙগুলো আঁকা। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে ছেলেটা রেড ইন্ডিয়ান, এস্কিমো নয়। প্রথমে বুঝতে পারিনি কারণ আমার মাথায় ছিল আলাস্কা মানেই হয়ত এস্কিমো হবে।
পা টিপে টিপে ল্যাসি যেখানে বসে আছে সেখানে ফেরত আসলাম, “ঘাসের ওপর একটা ছোট্ট ছেলে শুয়ে আছে। ওর গায়ে একটা ইন্ডিয়ান এস্কিমো অলিম্পিকের টি-শার্ট। তারমানে, স্রোতে ভেসে গেছিল ছেলেটা ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে।”
মিয়াও।
“এই অলিম্পিকে অদ্ভুত কিছু খেলায় অংশ নেয় ওরা। ভূমিকম্প যেদিন হল, তার পরের দিন শুরু হবার কথা ছিল ওটার।”
মিয়াও।
“হ্যাঁ, আমার মনে হয় এটা ছেলেটারই কাজ। না-হলে অন্য কে এখানে এত বেরি রেখে যাবে আমাদের জন্যে?”
মিয়াও।
“না, ওর পকেট হাতড়ে দেখতে পারব না আরো আছে কিনা, আবার তীরের দিকে হাটা দিলাম। এখানে অপেক্ষা কর, আমি দেখি ছেলেটাকে জাগানো যায় কিনা।”
ঘড়ির দিকে তাকালাম।
আমার দিন শেষ হতে আরো একচল্লিশ মিনিট বাকি।
আস্তে আস্তে হেঁটে ঘাসের কাছে গেলাম। মনে মনে আশা করেছিলাম গিয়ে দেখব, ছেলেটা নেই। আছে ছেলেটা, হাত দিয়ে হাটু চেপে ধরে গোল হয়ে শুয়ে আছে। ওর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। পরীক্ষা করে দেখলাম ছেলেটার গায়ের রঙ হালকা বাদামি আর চুল একদম কালো। পরণে একটা হলুদ টিশার্ট-যেটার কথা আগেই বলেছি, সাদা হাফপ্যান্ট, সাদা মোজা-যেটা গোড়ালির একটু ওপরে উঠে শেষ হয়ে গেছে। অনুমান করলাম ছেলেটার বয়স হবে পাঁচ।
দুই কদম সামনে গিয়ে বললাম “এই বাবু?”
নড়লও না ছেলেটা।
আরো কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গেলাম, একদম ছেলেটার পাশে। বুকটা নিঃশ্বাসের তালে তালে ওঠানামা করছে। নিচু হয়ে সাবধানে ওর ডান কাঁধে হাত রেখে আলতো করে ঝাঁকুনি দিলাম।
চট করে খুলে গেল ছেলেটার চোখ।
ভেবেছিলাম ছিটকে পেছনে সরে যাবে ছেলেটা, কিন্তু তা করল না। বরং গাঢ় বাদামি রঙের চোখজোড়া আমাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে এরপর আমি ওর কাঁধে যেখানে হাত রেখেছি সেখানে তাকাল।
সরিয়ে নিলাম হাতটা।
আস্তে করে উঠে পা ভাজ করে বসল ও। তাকিয়েই আছে আমার দিকে।
“হ্যালো।”
উত্তরে কিছু একটা বলল। কিন্তু ওরকম শব্দ আগে কোনদিন শুনিনি আমি।
“তুমি কি ইংরেজি বলতে পার?”
আরো কিছু দুর্বোধ্য আওয়াজ।
ওহ্ খোদা।
মাটির ওপর থেকে কিছু একটা তুলে মুখে দেয়ার ভঙ্গি করে বললাম, “বেরিগুলোর জন্যে ধন্যবাদ।”
উত্তরে হাসল ছেলেটা।
দাঁতগুলো ছোট ছোট, সমান।
উঁচু হয়ে দাঁড়ালাম।
সে-ও দাঁড়াল।
বড়জোর আমার কোমর অবধি লম্বা হবে ছেলেটা।
হাটা শুরু করলাম। কয়েক কদম হেঁটে পেছনে তাকিয়ে দেখি ছেলেটা এখনও ঐ জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। “আসো আমার সাথে, একটা জিনিস দেখাব,” এই বলে হাত দিয়ে ইশারা করলাম। আমার কথা না বুঝলেও ইশারায় কাজ হল। দৌড়ে আমার পাশে চলে আসলো ছেলেটা। হাঁটতে লাগল একসাথে।
দশ সেকেন্ড পরে বালুতটে ফিরে আসলাম।
“পুসি!” ছেলেটা জোরে বলে উঠল।
ল্যাসির কাছে দৌড়ে গেল ও, যার মুখটা এখন ভয়ে হা-হয়ে আছে। কিন্তু আহত পা নিয়ে নড়তেও পারছে না ব্যাটা। হাটু গেড়ে বসে পড়ে
ল্যাসিকে চেপে ধরে আদর করতে লাগল ছেলেটা।
“পুসি হিব্রু ভাষা-হিব্রু ভাষা পসি হিব্রু ভাষা- হিব্রু ভাষা পসি।” আমি হাসলাম। মনে হচ্ছে একটা এস্কিমো শব্দ শিখে গেছি।
ল্যাসি ভাগ্যের হাত সবকিছু ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আদর খেতে লাগল।
দীর্ঘ এক মিনিট পরে ওকে ছাড়ল ছেলেটা।
ইশারা করে ওর দিকে দেখাল ল্যাসি। আরো বেরি চায় হারামিটা।
একটু আগে বেরিগুলো দিয়ে ছোটখাটো একটা ভোজের পর একটু স্বাভাবিক হয়েছি বটে, কিন্তু ক্ষুধা বেড়ে গেছে বহুগুণে। “আরো বেরি কোথায় পাব?” মুখে জিজ্ঞেস করলেও হাত দিয়ে গাছ থেকে বেরি ছিঁড়ে মুখে দেয়ার অভিনয় করে দেখালাম।
মাথা নেড়ে ছেলেটা পাহাড়ের দিকে দেখাল।
ঘড়ির দিকে তাকালাম।
তিনটা একত্রিশ।
উনত্রিশ মিনিট।
নিচু হয়ে ল্যাসিকে তুলে নিয়ে তিনজন মিলে ঝোপগুলোর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
.
বেরির ঝোপগুলো বেশি দূরে নয়। পাহাড়গুলোর দিকে পাঁচ মিনিট হাটলেই।
ল্যাসি ছেলেটার কোলে যাওয়ার জন্যে জোর করায় ওকে দিয়ে দিয়েছি ছেলেটার কাছে। যাওয়ার পথে অর্ধেক রাস্তায় পোকামাকড়ের দল ঘিরে হরে আমাকে। হুডটা মুখের উপর তুলে দিলেও হাত আর পাতলা ট্রাউজারের ভিতর দিয়ে ঠিকই শুড় ঢুকিয়ে কামড় দিতে লাগল ওগুলো। কিন্তু ছেলেটার আশেপাশে একটা পোকামাকড়ও নেই। যেন পকেটে করে সে একটা অদৃশ্য স্প্রে নিয়ে এসেছে।
কিছুক্ষন পরে পোকামাকড়ের উৎপাত একটু কমে আসলে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। ওদের চেয়ে পেছনে পড়ে গেছিলাম আমি।
ছেলেটা একটা ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওটা থেকে একটা লাল বেরি ছিঁড়ে নিয়ে কী যেন বলল। একটা শব্দ না বুঝলেও ছেলেটার মাথা ঝাঁকানো দেখে যা বুঝলাম, ওগুলো খাওয়া যাবে না। এরকম আরো কয়েক ধরণের বেরি দেখাল ছেলেটা যেগুলো খাওয়া যাবে না। তারপর কতগুলো দেখাল যেগুলো খাওয়া নিরাপদ। আমার হুডিটা থলের মত করে পেঁচালাম। আর এরপরের দশ মিনিট ধরে যে বেরিগুলো খাওয়া যাবে সেগুলো দিয়ে ভর্তি করতে লাগলাম ওটা।
বালুতটে যখন পৌঁছলাম তখন তিনটা পয়তাল্লিশ বাজছে।
দেখলাম ছেলেটা ল্যাসির দিকে একটা বেরি বাড়িয়ে ধরে একদম শেষ মুহূর্তে ওটা সরিয়ে নিল। রাগ করে ছেলেটার উদ্দেশ্যে আস্তে করে থাবা দিল ও। এরপরে ছেলেটার মুঠো থেকে একটা বেরি মুখে চালান করল।
নদীর কাছে গিয়ে এক আঁজলা পানি উঠিয়ে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, আমার ঠোঁট পানি স্পর্শ করবে এমন সময় তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজ শুনে ফিরে তাকালাম।
ছেলেটা দৌড়ে আমার কাছে আসলো। মাথা ঝাঁকাচ্ছে জোরে জোরে।
ও চায় না আমি এই পানিটা খাই।
“গত চারদিন ধরে তো এই পানিই খাচ্ছি আমরা,” চার আঙুল দেখিয়ে বললাম।
আমার পেটে হাত বুলিয়ে আবার মাথা ঝাঁকালো ছেলেটা। এরপরে বালুতটের কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে খুড়তে লাগল হাত দিয়ে। দুই মিনিটের মধ্যে প্রায় তিন ফুটের একটা গর্ত খুড়ে ফেলল।
ওর পাশে এসে গর্তের ভেতরে তাকালাম।
দীর্ঘ এক মিনিট কিছুই হল না।
এরপরে আস্তে আস্তে গর্তটা পানি দিয়ে ভরে উঠতে লাগল। নিচ দিয়ে উঠছে পানি। বালি ফিল্টারের মত কাজ করছে এখানে।
ওখান থেকে পানি নিয়ে মুখে দিল ছেলেটা। আমাকে ইশারা করলে আমিও ওর পথ অনুসরণ করলাম।
আগের চেয়ে অন্যরকম লাগছে এখন পানির স্বাদ। শুকনো বালুর মধ্যে দিয়ে আসায় পলিমাটির টুকরো নেই পানিতে। সরাসরি নদী থেকে পানি খাবার তুলনায় এভাবে পানি খাওয়াটা কতটা নিরাপদ সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমার। কিন্তু হাজার বছরের এস্কিমো পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আমি কে?
তিনটা আটান্নর সময় আমার ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে উঠল।
ছেলেটা হাতে করে ল্যাসিকে পানি খাওয়াচ্ছে।
একটা লম্বা শ্বাস নিলাম।
এখন এই বাবুটাকে কিভাবে বোঝাব আমি, আগামি তেইশ ঘন্টা আমাকে ঘুমিয়ে কাটাতে হবে? কিভাবে বলব, আমাকে এখানে রেখে ফেয়ারব্যাঙ্কসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে ওর উদ্ধার হবার সম্ভাবনা বেশি? কিভাবে বলব, আমি একটা বোঝা ছাড়া কিছু না?
এসব কথা ভাবতে ভাবতে অন্য চিন্তা মাথায় ভিড় জমাল।
ইনগ্রিড কোথায়? ও কি ভূমিকম্পে মারা গেছে? নাকি বেঁচে আছে, আমাকে হন্য হয়ে খুঁজছে? আমার বাবার কাছে কি খবর পৌঁছেছে? আমি বেঁচে ফিরলে কি হবে? আমাদের বাচ্চাটা হলে কি হবে? কিভাবে ওকে বলব আমি, ওর বাবা এখন তেইশ ঘন্টার জন্যে ঘুমোবে?
ছেলেটা ল্যাসির আহত পাটা মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ল্যাসি হালকা কেঁপে উঠলে ওর উদেশ্যে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ছেলেটা।
একটা লাঠি নিয়ে ওদের দিকে গেলাম আমি।
কাছাকাছি পৌঁছে এস্কিমো স্টাইলে (নাকি ইন্ডিয়ান স্টাইল?) পা ভাজ করে বসলাম। হাতটা সামনে বাড়িয়ে ঘড়ির দিকে ইশারা করে বললাম, “আমার এখন শুয়ে থাকতে হবে,” হাতদুটো একসাথে করে তার ওপর বালিশের মত মাথা রাখার ভঙ্গি করে বললাম, “আগামি তেইশ ঘন্টা ঘুমোতে হবে আমাকে।”
ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকল আমার দিকে।
আমার ঘড়ির দিকে আবার দেখালাম। ওটা একই সাথে ডিজিটাল আর অ্যানালগ। ঘন্টার কাঁটার ওপর আঙুল দিয়ে বললাম, “এটা দু-বার পুরো ঘুরে আসা অবধি ঘুমোবো আমি,” এই বলে দু-বার আঙুল ঘুরিয়ে দেখালা।
কিন্তু ছেলেটা বুঝলো না আমি কী বলতে চাচ্ছি।
প্রথমে দুই আঙুল, এরপরে তিন আঙুল দেখালাম, “এতক্ষণ ঘুমাব আমি।”
মাথা ঝাঁকাল ছেলেটা।
বুঝতে পারেনি। বোঝার কথাও না। অর্ধেক মানুষই ঠিকমতো বোঝে না, আর ও তো একটা বাচ্চা। তা-ও ইংরেজি না জানা একজন।
আমি ওর দিকে ইশারা করলাম, এরপর নদীর দিকে হাত নাড়লাম, “তুমি এগোতে থাকো, আমার জন্যে অপেক্ষা করার দরকার নেই।”
আবার মাথা ঝাঁকাল ও। যাবে না।
“যাও,” ওকে সামনের দিকে ঠেলা দিয়ে বললাম, “যেতেই হবে তোমাকে।”
কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল ছেলেটা। এরপর বন্ধু হরিণটার মত ঝোপঝাড়ের মধ্যে দৌড় দিয়ে উধাও হয়ে গেল।
*
অধ্যায় ৯
সূর্যোদয়-৩:১৩
অবশিষ্ট বেরিগুলো দিয়ে নাস্তা সারছি আমি আর ল্যাসি।
বেরিগুলো অর্ধেক শেষ হবার পরে আমার দিকে তাকাল ও। কিছু একটা বলতে চায়।
“কিরে? জিজ্ঞেস করলাম, “ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন আমার দিকে?”
মিয়াও।
“কি মিস করছিস?”
মিয়াও।
“ওপিক (opik) আবার কি? কোন বিড়ালের খাবারের নাম?”
মিয়াও।
“বাচ্চা ছেলেটা? ওর নাম ওপিক বলছিস কেন?”
মিয়াও।
“সে বলেছে তোকে? এখন তুই এস্কিমোও শিখে গেছিস নাকি?”
মিয়াও।
“আমি মোটেও ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করিনি। আমাদের ছাড়াই ওর বাঁচার সম্ভাবনা বেশি। আমরা বোঝা ছাড়া কিছু না।”
মিয়াও।
“আচ্ছা। আমি একটা বোঝা ছাড়া কিছু না, খুশি?”
মিয়াও।
ওর দিকে একটু বেরি বাড়িয়ে দিয়ে শেষ মুহূর্তে সরিয়ে নিলাম।
মিয়াও।
“ছেলেটা করাতে তো খুব খুশি হয়েছিলি।”
মিয়াও।
“কি এক না?”
জবাবে কেবল মাথা নাড়ল ও।
লম্বা করে একটা শ্বাস নিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজেও ওপিকের শূন্যতা অনুভব করছি। যদিও আমি ওকে চলে যেতে বলেছি, বলেছি তোমাকে যেতেই হবে। তবুও আশা করিনি, আসলেই চলে যাবে ছেলেটা। কতটা স্বার্থপর আমি? মনে মনে চাইছিলাম যাতে আশেপাশে থেকে সাহায্য করে আমাদের ছেলেটা। এটা জানা সত্ত্বেও যে, আমাদের ছাড়াই নিরাপদ থাকবে ও। এতক্ষণে হয়ত কেউ খুঁজে পেয়েছে ওকে। হয়ত বসে বসে অলিম্পিকের অদ্ভুত কোন খেলা দেখছে।
কিন্তু ওসবে কিছু যায় আসে না এখন। চলে গেছে ও।
ল্যাসিকে তুলে নিলাম, কিন্তু ও আমার হাতে বারবার নড়াচড়া করে বিরক্তি প্রকাশ করতেই লাগল।
“অবুঝের মত আচরণ করিস না।”
মিয়াও।
“ও তোর সর্বকালের সর্বসেরা বেস্টফ্রেন্ড না মোটেও,” বললাম আমি। “কষ্ট পেলাম কিন্তু কথাটা শুনে।”
বেরি ঝোপগুলোর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম আমি। ওখানে পাঁচ মিনিট নানা রকমের বেরি সংগ্রহ করে ফিরে আসলাম আমাদের ক্যাম্পে।
এখন তিনট সতের বাজছে।
বালুতে একটা গর্ত খুঁড়লাম, ওপিকের গর্তটা থেকে দুই ফিট দূরে। বেশ খানিকটা পানি খেলাম ওখান থেকে। ল্যাসিকে নিয়ে গর্তের কাছে ধরলাম। ব্যাটা মুখ পেঁচার মত করে রেখেছে। বললাম, “খা, সামনে বালুতট পাব নাকি জানি না।”
চুকচুক করে পানি খেতে লাগল ও।
একটা লাঠি নিয়ে বালিতে লিখলাম :
২৬ শে জুন। নদীর পাশ দিয়ে পূর্ব দিকে যাচিছ। হেনরি বিনস আর ল্যাসি
মিয়াও।
“না, ওপিকের নাম যোগ করব না আমি।”
মিয়াও।
“কারণ ও চলে গেছে। এখান থেকে অন্তত বিশ মাইল দূরে ও এখন।”
মিয়াও।
ঘুরে তাকালাম।
ওপিক দাঁড়িয়ে আছে বহাল তবিয়তে।
হাসছে।
আর ওর হাতে দুটো তাজা মাছ।
.
ল্যাসি আর আমি দেখছি ওপিক কিভাবে চোখা লাঠি দিয়ে মাছের পেটটা ফেড়ে ফেলল। ভেবেছিলাম নাড়িভুড়ি পরিস্কার করার জন্যে ও কাজ করছে, কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, নাড়িভুড়ি সহজে বের করে আনার জন্যে কাজটা করেছে। ওগুলো বের করে এনে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
“না, তুমিই খাও,” মাথা নেড়ে বললাম। “তুমি ধরেছ ওগুলো।”
জীবনে একবারই শুশি খেয়েছিলাম, আর ওতেই শিক্ষা হয়ে গেছে।
মাছের নাড়িভূঁড়ি, ধীরে ধীরে গলা দিয়ে নামছে।
না, মাফ চাই।
ওপিক ল্যাসির দিকে বাড়িয়ে দিল ওগুলো। মুহূর্তে সাবাড় করে ফেলল ব্যাটা।
ওপিক যখন বুঝতে পারল, মাছের চোখ, হৃৎপিণ্ড, কিডনি খাওয়ার প্রতি কোন আগ্রহ নেই আমার, তখন মাছের পেট থেকে বড় একটা অংশ কেটে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
হাতে নিলাম, সম্পূর্ণ সাদা মাছের ভেতরটা। চামড়ার ওপর দিয়েই কামড় দিলাম।
পাঁচ দিনের অভুক্ত থাকার পরে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করে ফেললাম ওটুকু। এমনকি মাছের কিডনিও মুখে দিলাম। যতটা ভেবেছিলাম অতটা খারাপ না। কিন্তু চোখ পর্যন্ত গেলাম না। বললাম, “পরে না-হয়…” সাথে সাথে ল্যাসি চালান করে দিল ওটা পেটে।
ওপিকের ঘাড়ে আস্তে করে হাত রেখে বললাম, “ধন্যবাদ।”
ও হাসল জবাবে।
“আমার নাম হেনরি, নিজের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, “হেনরি।”
“ওন-রি,” ও বলল।
“কাছাকাছি।”
“ওপিক,” নিজের দিকে নির্দেশ করে বলল ও।
মাথা নেড়ে আমিও বললাম ওর নামটা।
এবার ল্যাসির দিকে দেখিয়ে বললাম, “ল্যাসি।”
“পুসি!” উৎসাহের সাথে বলল ছেলেটা। “কাছাকাছি,” হেসে বললাম।
ল্যাসিও কিছু মনে করেছে বলে মনে হল না। ওপিক যদি এভাবে খাবার এনে দেয় আর পেটে আদর করে দেয় তাহলে তার যা খুশি তা-ই ডাকতে পারে।
ওপিক ঝোপের ওদিকে গিয়ে আমার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে ওকে অনুসরণ করতে বলল।
ল্যাসিকে তুলে নিয়ে বললাম, “চল্ পুসি।”
আমি ওপিকের পেছন পেছন যেতে লাগলাম। ও আমার জন্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। ওকে ঘড়িটা দেখালাম। চারের ঘরের ওপর টোকা দিয়ে বললাম, “আমাকে চারটার আগেই ফেরত আসতে হবে।”
ও মাথা নাড়ল জবাবে।
ও কি বুঝেছে নাকি আমি কি বললাম? এটা কি সম্ভব, কাল চলে যাওয়ার পর ও ঠিক এমন সময়ই ফেরত আসলো যখন আমি ঘুম থেকে জেগেছি। তা-ও তেইশ ঘন্টা পর।
না, কাকতালিয় হতে পারে না এটা।
ওপিকের পেছন পেছন যেতে যেতে বুনো ঘাসের ময়দানে চলে আসলাম। পেট ভরা থাকার কারণে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছি। ভূমিকম্পের পরে বোধহয় এই প্রথম আবার সূর্যের কারিশমায় মুগ্ধ হলাম। কি সুন্দর সোনালি রঙের আভা ছড়াচ্ছে পাহাড়ের পেছন থেকে।
আমার হাতে কে যেন টোকা দিল। ওপিক। ওর সাথে গেলাম, ছোট্ট হাতটা আমার মুঠোয়।
দশ মিনিট পর একটা ঘন ঝোপের কাছে পৌঁছলাম আমরা। ওপিক আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ঝোপটা দেখতে লাগল। কী যেন খুঁজছে।
“কি খুঁজছ, বাবু?” জিজ্ঞেস করলাম।
আরো বেরি খুঁজছে? নাকি আলু গাছে ধরে? বাদাম? ঝোপের ভেতরে কোন প্রাণি নেই তো? সাবধান হয়ে গেলাম।
ওপিক একটা হলুদ রঙের ফুল ছিঁড়ল। এরপর গন্ধ শুঁকে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
আবার আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল ওটা। এবার গন্ধ নিলাম। মিষ্টি একটা গন্ধ।
ও মাথা ঝাঁকিয়ে ফেলে দিল ফুলটাকে।
পঞ্চাশ ফিট সামনে গিয়ে আরেকটা ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। এগুলোর গায়ে বেগুনি রঙের ছোট ছোট ফুল। গন্ধ শুকল, এবার সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নেড়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। বুনো একটা গন্ধ।
একটা ডাল ভেঙে নিল ও, লম্বা লম্বা পাতাসহ।
বালুতটে যখন ফেরত আসলাম আমরা, তখন বাজছে তিনটা সাতচল্লিশ।
ওপিক পানির কাছে দাঁড়িয়ে ডাল থেকে পাতা আলাদা করছে। প্রায় বিশ পঁচিশটার মত পাতা জমেছে ওর পাশে।
ল্যাসি আর আমি চুপচাপ বসে ওর কাজ দেখছি। মিয়াও।
“জানি না, হয়ত ওগুলো খেতে হবে আমাদেরর। কোন ঔষধি গুণ আছে।”
ইনগ্রিডের কথা মনে পড়ে গেল। কোথায় মেয়েটা? ও কি আশা ছেড়ে দিয়েছে, আমি বেঁচে আছি? আলেক্সান্দ্রিয়ায় আমার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গেছে এতদিনে? কাজে ফিরেছে? আজ রাতে কি খাবে ও?
ওপিক ফুলসহ ডালটা নদীতে ফেলে দিল। এরপরে নিচু হয়ে পাতাগুলো তুলে পানিতে ভেজাল। হাত দিয়ে পিষতে লাগল যতক্ষণ না সবুজ রঙের জেলের মত কিছু একট গড়াতে লাগল পাতাগুলো থেকে। এরপরে আমাদের কাছে এসে বসে পড়ল। হাতে পাতার জেলের মত পদার্থ। ল্যাসির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
ওর থাবা।
ভয়ে ভয়ে থাবাটা সামনে বাড়িয়ে দিল ল্যাসি।
ওপিক ওর পুরো পায়ে সবুজ জেল লাগিয়ে দিল ভালোমত। থাবাটা হাতে নিয়ে কী যেন বলল বিড়বিড় করে, এরপর উঠে দাঁড়িয়ে উধাও হয়ে গেল।
আমি যখন ঘুমিয়ে পড়লাম তখনও ফেরত আসেনি ও।
*
অধ্যায় ১০
২৭ জুন
সূর্যোদয়-৩:১৫
ঘুম থেকে জেগে দেখি আমাদের চারপাশে রাজ্যের খাবার সাজানো। মাছ,
বেরি ফল, নানা জাতের বাদাম।
আমাদের থেকে বিশ ফিট দূরে ওপিক লক্ষ্মি ছেলের মত ঘুমাচ্ছে। হাতদুটো মাথার নিচে বালিশের মত করে রাখা। ঠিক যেমনটা সিনেমায় দেখা যায়। এই আবছা অন্ধকারে নিষ্পাপ মুখটাকে আরো নিষ্পাপ মনে হচ্ছে। কোন পঙ্কিলতার ছোঁয়া নেই ওখানে। কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল ভেতরটা। আমি যখন ঘুমিয়ে থাকতাম বাবারও কি এমন লাগত?
ল্যাসিকে বুকের ওপর থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কী যেন একটা অন্যরকম লাগছে। গত পাঁচদিনে এমন লাগেনি।
ভ্রু কুঁচকে গেল।
চুলকানি।
কোথাও চুলকাচ্ছে না। আমার কাপড়ের দিকে তাকালাম। ওগুলোর ওপরে এক ধরণের সাদা রঙের পাউডার ছিটানো। আমার হাতেও দেখলাম একই অবস্থা। না হেসে পারলাম না।
এগুলো যা-ই হোক না কেন, গত তেইশ ঘন্টা যাবত মশাদের ঠিকই দূরে রেখেছে।
ওপিকের পাশে গিয়ে ওর আলতো করে ওর ঘাড়ে হাত রাখলাম।
চোখ খুলল ও।
“বাবু।”
সুন্দর একটা হাসি দিল।
“ঐ পাউডারের জন্যে ধন্যবাদ,” আমার কাপড়চোপড়ের দিকে ইশারা করে বললাম।
জবাবে ও ওর হাত গলার চারপাশে জড়িয়ে ধরল।
“বুঝতে পেরেছি, মশাদের দম বন্ধ করে দেয়।”
ওকে উঠে দাঁড়ানোয় সাহায্য করে খাবারের পাশে এসে বসলাম দু’জনে। এরপর খাবারের স্তূপ থেকে খাওয়া শুরু করলাম। ওপিক ল্যাসির পা কোলে নিয়ে দেখতে লাগল। ল্যাসির মতে এখন নাকি একটু ভালো লাগছে। বাকি পাতাগুলো দিয়ে আবার জেল বানিয়ে ল্যাসির পায়ে মুড়ে দিল ছেলেটা। আমি নদীর দিকে দুই আঙুল দিয়ে হাটার ইশারা করে দেখালাম।
তিনটা সাতের সময় ক্যাম্প গুটিয়ে রওনা হলাম আমরা।
আগামি পঞ্চাশ মিনিটে বেশ ভালো দূরত্ব অতিক্রম করে, বালুতটে সুন্দর একটা জায়গা খুঁজে পেলাম শোবার মত। ল্যাসি আর ওপিক ঝোপের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। কিন্তু কোন দুশ্চিন্তা হল না যে, আমার অবর্তমানে ওরা দু-জন কী করবে। যতক্ষণ ওরা খাবার জোগাড় করছে আর এই জাদুর পাউডার বানাচ্ছে ততক্ষণ চিন্তা করার কিছু নেই।
আর সেটাই করেছে ওরা।
পরের দিন উঠে দেখি তিনটা মাছ, নানা জাতের বেরি আর ক্যাকটাস জাতীয় একটা গাছ (যেটার ভেতরের শাঁসটা খেতে দারুণ সুস্বাদু) অপেক্ষা করছে।
সকালে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব খেয়ে নেই আমরা। এরপর যাত্রা শুরু করি, একদিনে যতটা সম্ভব বেশি দূরত্ব পাড়ি দেয়া যায়। ল্যাসি ওর তেইশ ঘন্টা ওপিকের সাথে কিভাবে কাটাল এগুলো আবার আমার কাছে রিপোর্ট করে। কিভাবে ওপিক একটা গাছে উঠে সুস্বাদু বাদাম পাড়ল। কিভাবে ল্যাসির পায়ে সুন্দর মতন ম্যাসাজ করে দিল। এখন নাকি ঐ পায়ে ভরও দিতে পারে ও। সবচেয়ে অবাক হলাম ওপিক কিভাবে মাছ ধরে সেটা শুনে। হাত দিয়ে আলতো করে টোকা দেয় পানির ওপরে। ঠিক যেমনটা একটা পোকা বসলে হয়। মাছ আকৃষ্ট হয়ে আশেপাশে ঘোরা শুরু করে। তখন লাঠি দিয়ে জোরসে একটা বাড়ি দিয়ে অসার করে দেয়। তারপর ছোঁ মেরে তুলে আনে।
আমার হিসেবমতে গত তিন দিনে গড়ে ছয় মাইল করে পাড়ি দিয়েছি আমরা। আর ওপিকের সাথে দেখা হবার আগে আরো আট-দশ মাইল। এখন যেভাবে সবকিছু চলছে, তাতে আগামি দশদিনে আমরা ফেয়ারব্যাঙ্কসে পৌঁছে যাব।
আমার আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গেল যখন ল্যাসি নদীতে একটা পতাকা ভাসতে দেখাল। ব্রিজের ওপর ঝোলান পতাকাগুলোর একটা বলে মনে হল।
ঠিক পথেই যাচ্ছি আমরা।
আরো এক মাইল বালুতট ধরে হাটলাম। এরপর বালুতট কমতে কমতে নদীর সাথে মিশে গেল একসময়। সামনে ঘাস।
লম্বা বুনো ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে আমার অস্বস্তির কথা বুঝতে পেরে হাতটা ধরল ওপিক। এই ঘাসের মধ্যে যে কোন কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে। এই যেমন বন্ধু হরিণ! সেদিন আরেকটু হলেই আমার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছিল। বালতটের ওপর দিয়ে হাটলে আশপাশটা অন্তত ঠিকমতো নজর দেয়া যায়। হঠাৎ করে কিছু বেরিয়ে আসলে প্রস্তুতির একটা সময় থাকে। কিন্তু এই ঘাসের মধ্য নিজেকে কেমন যেন আফ্রিকার বুনো অংশে শিকার হবার অপেক্ষায় থাকা হরিণের মত মনে হয়।
ঘন ঝোপঝাড় ভেঙে সামনে এগোচ্ছি আমরা। কখনো পাথরের ওপর দিয়ে, কখনো আবার ডাল আঁকড়ে ধরে।
তিনটা তেতাল্লিশের সময় ওটাকে দেখলাম আমরা।
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
ওটার আশেপাশে এমনভাবে বুনো গাছগাছালি জন্মেছে, দেখে মনে হয় জঙ্গলেরই অংশ। কিন্তু ভুল হবার অবকাশ নেই।
একটা কাঠের কেবিন।
.
কেবিনটার পুরো ভগ্নদশা।
কাঠগুলো শুকিয়ে ধূসর হয়ে গেছে। কয়েক জায়গায় ছাদের কাঠ ধ্বসে পড়েছে। আর মেঝেতে বেশ কয়েকটা গর্ত, সাবধানে পা ফেলতে হয়। ঠিক থাকতে মনে হয় দশ ফিটের মত লম্বা ছিল। এখন ছয় ফিট। কাঠের দেয়ালের একপাশে একটা মই ঠেস দিয়ে রাখা। জানালা আর দরজাগুলোর জায়গায় ফাঁকা।
ওপিক দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লে আমি আর ল্যাসিও ওর পিছু পিছু গেলাম।
জানালা আর ছাদের খালি জায়গাগুলো দিয়ে বেশ ভালো আলো বাতাস ঢুকছে।
বাইরের ভগ্নদশার তুলনায় ভেতরটা বেশ গোছানো মনে হল। ঝুলঝাড়, মাকড়সার জাল আর কিছু ছোট আগাছার কথা বাদ দিলে ভেতরটা দেখে বোঝা যাচ্ছে, আগে যে-ই থাকুক না কেন, খুব সাজানো গোছান ছিল। দেয়ালের সাথে একটা আয়না আর একটা ঝুলন্ত শেলফে কিছু হার্ডকভার বই ঝুলছে। আয়নার ওপরে হাত বুলিয়ে তিন ইঞ্চি ধুলোর আস্তরণ সরালাম। আমার মুখটা দেখা যাচ্ছে। প্রতি দুই দিন অন্তর অন্তর ইলেক্ট্রিক্যাল রেজর দিয়ে শেভ করতাম আমি। আর সবসময় চাপদাড়ি থাকত। কিন্তু এই আটদিনে বেয়ারাভাবে বেড়ে উঠেছে দাড়ি। আর সূর্য থেকে বাঁচার জন্যে মুখের ওপর কাপড় দিয়ে ঘুমালেও গতানুগতিকের চেয়ে পাঁচগুণ কালো দেখাচ্ছে।
আমাকে দেখতে একজন স্বাভাবিক খেটে খাওয়া মানুষের মত লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে না, আয়নার ভেতর থেকে যে তাকিয়ে আছে সে দিনে তেইশ ঘন্টা ঘুমিয়ে টায়।
আপনমনে একবার হেসে ঘরের এক কোনায় রাখা স্টোভের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাসন কোসনগুলো এখনও তাকে গুছিয়ে রাখা। পাশে লবণ আর গোলমরিচদানি। বেশ কয়েকটা ক্যানজাত খাবারের কৌটো দেখলাম। কোনটায় ছাতা ধরে গেছে আবার কোনটা মরিচায় জরাজীর্ণ। ওগুলোর পাশে একটা কাঁচের বোতল রাখা। হাত দিয়ে ওটার গায়ের ধুলো পরিস্কার করে মৃদু হাসলাম।
ল্যাসি আর ওপিককে ডাক দিলাম।
তথ্যটা কোথায় দেখেছিলাম মনে নেই। এই পৃথিবীতে একটা খাবার কখনো নষ্ট হয় না।
মধু।
ক্যাপ খুলে এক আঙুলে ভরিয়ে মুখে দিলাম অল্প একটু। একদম ঠিকঠাক।
বোতলটা ওপিকের হাতে দিয়ে দিলাম। ওখান থেকে কিছুটা নিজে খাবার পর বাকিটা আঙুলে ভরিয়ে ল্যাসিকে খাওয়াতে লাগল ও। জানালার নিচে একটা বড় কুঠরি দেখতে পেলাম। ওটার হাতল ধরে জোরে বেশ কয়েকবার টান দিতেই খুলে গেল। একটা জুতো, পশমি জ্যাকেট আর লণ্ঠন-ওরকম বিশেষ কিছু না। কিন্তু একটা জিনিস দেখে বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল। একটা ম্যাপ!
.
এখন তিনটা সাতান্ন।
দৌড়ে গিয়ে টেবিলের ওপর ম্যাপটা বিছালাম। এর আগে বেশ কয়েকবার রাস্তার ম্যাপ দেখেছি। এটা ওগুলো থেকে এক দিয়ে অন্যরকম। নদীর ম্যাপ এটা।
ওপিক আর ল্যাসি আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
একটা কালো বিন্দুর চারপাশে বৃত্ত আঁকা দেখে ধারণা করলাম ওটাই এই কেবিনটা। দীর্ঘ এক মিনিট ম্যাপটার দিকে বিহ্বলের মত তাকিয়ে থাকলাম।
“হায় ঈশ্বর।”
হাত দিয়ে জোরে টেবিলের ওপর একটা ঘুষি মারলাম। ল্যাসি লাফ দিয়ে ওপিকের কোলে উঠে গেল।
“আমরা ভুল নদী ধরে এগিয়ে গেছি!” চিক্কিার করে বললাম।
আমি ধারণা করেছিলাম, এতদিন সেইনা নদীর পাশ দিয়েই এগিয়ে গেছি। সেরকম নয় মোটেও।
ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সেইনা নদী হচ্ছে একটা উপনদী যেটা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গিয়ে তানানা নদীর সাথে মিশেছে। তানানা নদী আবার উত্তর-পশ্চিমে নব্বই মাইলের মত গিয়ে ইয়োকু নদীতে পড়েছে যেটা কানাডা থেকে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে বেরিং সাগরে।
আমি যখন ক্যানোতে ভাসছিলাম তখন ইয়োকু নদীতে ছিলাম। এরপরে আমি আর ল্যাসি উল্টোদিকে দশ মাইল হেঁটে ওপিককে পাই। এরপরে নদীর উত্তর পাশের তীর ধরে উল্টোদিকে হাটছিলাম আমরা। এক পর্যায়ে বালুতট শেষ হয়ে যাওয়াতে ঘাসের ভেতর দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হই, যেকারণে টানানা আর ইয়োকু নদীর মোহনা চোখে পড়েনি আমাদের। সবচেয়ে মারাত্মক ভুলটা হয়েছে ইয়োকু নদী ধরে উত্তর পূর্বদিকে যাওয়া, যেখানে আমাদের যাওয়া উচিত ছিল দক্ষিণপূর্বদিকে তানানা নদী ধরে। তাহলে কিছু পরে সেইনা নদীর দেখা পেতাম আমরা। আর তার কিছু পরেই ফেয়ারব্যাঙ্কস।
হলুদ পতাকাটার কথা ভাবলাম। ওটা মোটেও ভেসে আসেনি এদিকে। কারণ স্রোতের বিপরীত দিকে ভাসা অসম্ভব। অন্য কোন পতাকা ওটা।
ম্যাপের ডানদিকে দূরত্ব মাপার ছকের ওপর হাত রেখে আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে ফেয়ারব্যাঙ্কসের দূরত্ব মাপলাম।
“একশ বিশ মাইল,” হতাশ হয়ে টেবিলের ওপরেই শুয়ে পড়তে পড়তে বলতে লাগলাম, “একশ বিশ মাইল!।”