২. পুজোর ছুটির পর

সেবার পুজোর ছুটির পর ইউনিভার্সিটি খুললে কলকাতায় এলেন অবনীনাথ। আগের দিন রাতে টেনে উঠেছিলেন। হাওড়ায় পৌঁছেছিলেন ভোরে। মামার বাড়িতে গিয়ে স্নান-টান করে খেয়ে-দেয়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটিতে। ছুটির পর প্রথম দিনটা যে-যার মতো ক্লাস করতে যেত। পরের দিন থেকে কার কখন ক্লাস শুরু, জেনে নিয়ে একজন আরেকজনের জন্য অপেক্ষা করত।

ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সেদিন অনীতার সঙ্গে দেখা হয়নি। দুটো বছরে সামার ভেকেসান, পুজো ভেকেসান, এক্সমাস ইত্যাদি মিলিয়ে কম ছুটি পড়ত না। যে ছুটিই পড়ুক, তারপর ইউনিভার্সিটি খুললে প্রথম দিনেই এতকাল অনীতার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু সেবার কী হয়ে গিয়েছিল, কে জানে! অনীতার সঙ্গে দেখা না-হওয়ায় খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন অবনীনাথ। বাড়ি ফিরে মামিকে অনীতার কথা জিগ্যেস করেছিলেন। মামি বলেছিলেন, ও এখন আর এখানে থাকে না। কদিন হল ব্যারাকপুরে ওর দূর সম্পর্কের মাসির কাছে চলে গেছে।

অবনীনাথ চমকে উঠেছিলেন, কেন?

ওই যে সেই বদমাইশটা, যার সঙ্গে ওর বিয়ের কথা হয়েছিল ভীষণ উৎপাত শুরু করে দিয়েছিল। তার সঙ্গে ছিল ওর সত্য। অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি ছেড়ে ওকে চলে যেতে হয়েছে।

অনীতার বাবা এখানে নেই?

না। ডিব্রুগড়ে গেছেন কদিনের জন্য।

সেই মুহূর্তে অনীতাকে দেখার জন্য খুবই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন অবনীনাথ। জিগ্যেস করেছিলেন, ব্যারাকপুরে ওর মাসির বাড়িটা কোথায়?

মামি সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। আস্তে করে বলেছিলেন, কেন?

অবনীনাথ পারতপক্ষে যা কখনও করেননি তাই করেছিলেন। চোখ-কান বুজে মিথ্যে বলেছিলেন, অনীতার কাছে ওর এক বন্ধুর অনেকগুলো নোট আছে। কালই সেগুলো চাই, খুব জরুরি দরকার।

মামি বলেছিলেন, ঠিকানাটা বলতে পারব না। তবে ওর মেসো ডাক্তার; স্টেশনের খুব কাছেই তাঁর চেম্বার। পুরো নাম জানি না; ডাক্তার চক্রবর্তী বললেই নাকি ওখানকার লোক চিনে ফেলবে। কিন্তু একটা কথা

কী?

যদি সত্যিই সেখানে যাও, নোটগুলো নিয়েই চলে আসবে। নিজেকে কোনো ব্যাপারে জড়াবে না। তোমার ওপর তোমাদের সংসারের ভবিষ্যৎ সবকিছুই নির্ভর করছে।

মামি কী ইঙ্গিত করেছিলেন বুঝতে অসুবিধা হয়নি অবনীনাথের। তিনি মুখে কিছু বলেননি, আস্তে মাথা নেড়েছিলেন শুধু।

যাই হোক, সেদিন আর ব্যারাকপুর যাননি অবনীনাথ।

পরের দিনও ইউনিভার্সিটিতে আসেনি অনীতা। ছুটির পর অবনীনাথ সোজা শিয়ালদা গিয়ে ব্যারাকপুরের ট্রেন ধরেছিলেন।

সন্ধের সময় গাড়ি থেকে নেমে স্টেশনের গায়ে ডাক্তার চক্রবর্তীর চেম্বার খুঁজে বার করতে অসুবিধা হয়নি। অনীতার কথা বলতেই ডাক্তার চক্রবর্তী প্রায় কেঁপে উঠেছিলেন, তুমি আবার কে? সেই হারামজাদার বাচ্চাটার মতো আরেকজন ক্যান্ডিডেট না কি?

অবনীনাথ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, মানে আপনি কার কথা বলছেন?

সেই যে শূকরের শাবকটি কী যেন নাম, ও হ্যাঁ, নবকুমার। মেয়েটা আসার পর এখানে রোজ হানা দিচ্ছে। ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া উচিত। তোমার মতলবটা কী হে ছোকরা?

অনীতা সম্পর্কে অবনীনাথের উৎকণ্ঠা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। নবকুমার তা হলে এখানে এসেও ঝামেলা পাকাচ্ছে। তিনি ডাক্তার চক্রবর্তীকে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে জানিয়েছিলেন, কোনও রকম মতলব নিয়েই তিনি এখানে আসেননি। তাঁরা ইউনিভার্সিটিতে পড়েন, কলকাতায় এক পাড়ায় থাকেন, এখন কিছু ক্লাসনোট সম্পর্কে অনীতার সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়া দরকার।

ডাক্তার চক্রবর্তী পাগলাটে টাইপের মানুষ। যত দ্রুত তিনি খেপে ওঠেন তত দ্রুতই শান্ত হয়ে যান। বলেছিলেন, দ্যাটস ফাইন। মতলব না থাকলেই হল। তুমি তো অনুর বাপকে চেনো?

চিনি।

এরকম স্পাইনলেস ভেঁড়ুয়া লোক ওয়ার্ল্ডে দ্বিতীয়টি জন্মায়নি। তরুণী ভার্যার ভয়ে সবসময় কাঁপছেন। আসলে সেক্স বুঝলে, সেক্সের জন্যে মানুষ ছাগল বনে যায়। ছাগল হ, পাঁঠা হ, কেন্নো হ, ছুঁচো হ, কিছু যায় আসে না। তুই ব্যাটা একটা ফাদারও তো। কোথায় লুচ্চা বদমাইশটার চামড়া খুলে নিবি, তা না, নানারকম ফেরেব্বাজি করে মেয়েকে তার হাত থেকে বাঁচাতে চাইছিস!

অবনীনাথ বুঝতে পারছিলেন, অনীতার পাকা দেখার অনুষ্ঠানটা যে একটা বিরাট ক্যামোফ্লেজ সেটা টের পেয়ে গেছেন ডাক্তার চক্রবর্তী। তিনি এবার বলেছিলেন, চলো হে ছোকরা, অনুর সঙ্গে দেখা করতে চলো।

সাইকেল রিকশায় করে গঙ্গার ধারে ছিমছাম একটা দোতলা বাড়িতে অবনীনাথকে নিয়ে এসেছিলেন ডাক্তার চক্রবর্তী।

অবনীনাথ যে ব্যারাকপুর পর্যন্ত আসবে, অনীতা ভাবতে পারেনি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল সে।

অবনীনাথ নরম গলায় বলেছিলেন, কেঁদো না অনীতা, কেঁদো না—

 অনীতা বলেছিল, জানো, ওই লোকটা এখানে এসেও গোলমাল করছে।

ডাক্তার চক্রবর্তী যে অনীতা সম্পর্কে খুবই সহানুভূতিশীল তা আগেই টের পেয়েছিলেন অবনীনাথ। মিসেস চক্রবর্তীও যে দূর সম্পর্কের মৃত বোনের মেয়ের ব্যাপারে উদাসীন নন, সেটাও বোঝা গিয়েছিল।

অনীতার মাসি মিসেস চক্রবর্তী বলেছিলেন, ইচ্ছা করে পুলিশ ডেকে বজ্জাতটাকে ধরিয়ে দিই। কিন্তু ভয় হয় এই নিয়ে পরে কেলেঙ্কারি হবে; মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই মুখ বুজে সব সয়ে যেতে হচ্ছে।

অবনীনাথ কী বলতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় বাইরে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ পাওয়া গেল। তারপরেই সদরে কড়া নাড়ার শব্দের সঙ্গে জড়ানো গলা ভেসে এল, দরজা খুলুন

নবকুমারের গলা। অবনীনাথ লক্ষ করেছিলেন, ডাক্তার চক্রবর্তী, তাঁর স্ত্রী এবং ছেলের মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে। আর ভয়ে উদ্বেগে এবং দুশ্চিন্তায় শ্বাসরুদ্ধের মতো দেখাচ্ছিল অনীতাকে। তার মনোভাবটা বুঝতে পারা যাচ্ছিল। এমনিতেই সে এখানে চলে আসার জন্য লজ্জায় মাথা তুলতে পারে না। তার ওপর যদি তার জন্য আশ্রয়দাতাদের রোজ ঝঞ্ঝাটে পড়তে হয়, তাহলে সংকোচের শেষ থাকে না।

ওদিকে ডাক্তার চক্রবর্তী সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে সদর দরজা খুলে দিয়ে কর্কশ গলায় বলেছিলেন, আবার তুমি এসেছ! তোমাকে না বারণ করে দিয়েছি, এখানে আসবে না।

নবকুমারের চোখ-মুখ তখন আরক্ত এবং ঢুলুঢুলু। দারুণ টলছিল সে। দেখেই টের পাওয়া গিয়েছিল, প্রচণ্ড মদ্যপান করে এসেছে।

নবকুমার জড়ানো গলায় বলেছিল, মাইরি আর কি, আপনি বললেই আসব না! আমার উড-বি ওয়াইফকে আনলফুলি আপনি আটকে রেখেছেন। এটা কি ভালো হচ্ছে–

গেট আউট রাসকেল, গেল আউট-~~

আমি তো গেটের ভেতর ঢুকিনি, গেটের বাইরেই আছি। তাহলে আর আউট হতে বলছেন কেন?

মাতাল জন্তু কোথাকার?

ফর নাথিং গালাগাল দিচ্ছ কেন বৃদ্ধ! কদিন বাদে যে আমার ধর্মপত্নী হবে তাকে এভাবে আটকে রাখার মানে হয়। দিস ইজ ক্রুয়েলটি।

ডাক্তার চক্রবর্তী দুম করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু হাত বাড়িয়ে আটকে দিয়েছিল নবকুমার। বলেছিল, তুমি মাইরি অতি খচ্চর বুড়ো। এক ফোঁটা রসকস নেই। বিয়ে ফাইনাল হয়ে যাবার পর তুমি হলে তোমার শালা উড়-বি বউয়ের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করত না?

জানোয়ারের মতো এই লোকটার অত্যন্ত ইতর কথাবার্তা শুনতে শুনতে আর তার নানারকম অঙ্গভঙ্গি দেখতে দেখতে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল অবনীনাথের। নবকুমারের কথাগুলো শেষ হবার আগেই সে ক্ষিপ্তের মতো চিৎকার করে উঠেছিল, কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না হারামজাদা! জুতিয়ে তোমার মুখ আমি ভেঙে দেব!

আচমকা ইলেকটিক শক খাওয়ার মতো ঝট করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল নবকুমার। দুচোখ থেকে নেশার টুলুঢুলু ভাবটা মুহূর্তে ছুটে গিয়েছিল তার। চোখের পাতা টানা করে কয়েক সেকেন্ড অবনীনাথকে লক্ষ করেছিল সে। তারপর বলেছিল, চেনা চেনা লাগছে যেন। ও তুমি সেই খচ্চরটা না? এখানে এসে হাজির হয়েছ চাঁদ! বলেই গলার স্বরটা দুম করে দশ গুণ চড়ায় তুলে চেঁচিয়ে উঠেছিল, শুয়ারকা বাচ্চা! তুমি কোন তালে এখানে ঘুর ঘুর করছ আমি জানি না? আমাকে জুতবি? বেজন্মা যদি না হোস, বেরিয়ে আয়

নিজের মধ্যে সেই মুহূর্তে কী প্রতিক্রিয়া ঘটে গিয়েছিল, এতকাল পর আর মনে পড়ে না। কেউ কিছু বলা বা বাধা দেবার আগেই উন্মত্তের মতো অবনীনাথ বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে এসেছিলেন; তারপর ডাক্তার চক্রবর্তীকে এক ধাক্কায় সরিয়ে একেবারে নবকুমারের মুখোমুখি।

…জ্ঞান যখন ফিরল তখন সারা মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে নবকুমারের; হাড় এবং চোয়ালের হাড় ভেঙে গেছে। আর তার বুকের ওপর বসে ঘুষির পর ঘুষি মেরে চলেছেন তিনি।

ডাক্তার চক্রবর্তী, তাঁর ছেলে, স্ত্রী এবং অনীতাই শেষ পর্যন্ত টানাটানি করে দুজনকে আলাদা করে দিতে পেরেছিলেন। রক্তাক্ত মুখে কোনোরকমে পুঁকতে ধুঁকতে তার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়েছিল নবকুমার। যাবার সময় মুখ বাড়িয়ে বলে গিয়েছিল, সান অব এ বিচ, তোর কথা আমার মনে থাকবে।

অবনীনাথ বলেছিলেন, আমিও তাই চাই। এবার তবু উঠে যেতে পারলি। এরপর অনীতার পেছনে তোকে দেখলে শিরদাঁড়া গুঁড়ো করে দেব।

যা-যা–অকথ্য একটা খিস্তি দিয়ে চলে গিয়েছিল নবকুমার।

মদ্যপ জন্তুটাকে মারধোর করে হাত-পা কেটে-কুটে রক্ত ঝরছিল অবনীনাথের। ডাক্তার চক্রবর্তী তাঁকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে রক্ত-টক্ত মুছিয়ে ড্রেস করে দিতে দিতে জিগ্যেস করেছিলেন, কী ব্যাপার বলো তো?

অবনীনাথ তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, কী?

হঠাৎ ওই জানোয়ারটার ওপর তুমি ওরকম খেপে গেলে কেন? খিস্তি খেউড় ও যা করেছিল তা তো আমাকে।

তা ঠিক। কিন্তু শুনতে শুনতে নিজেকে আর চেক করতে পারিনি।

 আমার কিন্তু অন্যরকম মনে হচ্ছে

কী?

এখন বলব না। প্রচুর মারদাঙ্গা করেছ, যথেষ্ট ব্লিডিং হয়েছে। আগে কিছু খেটে-টেয়ে শক্তি সঞ্চয় করো। তারপর যাবার সময় গোপনে বলে দেব। বলে একটু থেমে পরক্ষণে আবার শুরু করেছিলেন ডাক্তার চক্রবর্তী, হারামজাদাটাকে রাইটলি সার্ভ করেছ। এরকম লেসন ওর অনেক আগেই পাওয়া উচিত ছিল। তা হলে এতটা বাড়তে সাহস পেত না। সমস্ত দোষ আমার স্পাইনলেস ভায়রাটির। যাই হোক, কনগ্রাচুলেসন্স ফর অ্যান একসেলেন্ট পারফর্মেন্স।

অনীতার মাসি বলেছিলেন, লোকটা শাসিয়ে গেল। তুমি একটু সাবধানে থেকো বাবা।

 অনীতা বসেছিল, খুব খারাপ লোক। ও না-পারে হেন কাজ নেই।

অবনীনাথ বলেছিলেন, মরালি কাওয়ার্ড লোকদের মুখই সর্বস্ব। কিছু করার ক্ষমতা ওদের নেই। দেখলে না কেমন কুকুরের মতো পালিয়ে গেল।

তবু সাবধানে থাকবে।

আমার জন্যে ভেবো না। কাল থেকে ক্লাস করতে যেও। আমার ধারণা বদমাশটার শিক্ষা হয়েছে। ও আর তোমার পেছনে লাগতে সাহস করবে না।

রক্তপাতের জন্য ব্র্যান্ডি এবং প্রচুর মিষ্টি-টিষ্টি খাইয়ে ব্ল্যাকআউটের রাত্তিরে অবনীনাথকে লাস্ট ট্রেনে তুলে দিতে গিয়েছিলেন ডাক্তার চক্রবর্তী। ট্রেন আসার আগে অন্ধকার ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, এবার সেই কথাটা বলা যেতে পারে। তুমি ছোকরা মনে মনে অনুকে ভালোবাসো। নইলে এমন একটা কাণ্ড বাধাতে পারতে না–

অবনীনাথ চমকে উঠেছিলেন, এ আপনি কী বলছেন? ওই লোকটা খিস্তি দিচ্ছিল, আপনার সঙ্গে ইতরামো করছিল। তাই

আমার ব্যাপারটা উপলক্ষ্য। বলে একটু চুপ করে থেকেছেন ডাক্তার চক্রবর্তী। তারপর কী ভেবে আবার বলেছেন, অনুর কাছে শুনেছি তুমি তার সত্যিকারের বন্ধু-রিয়েল ফ্রেন্ড ইন নিড। দেখো ছোকরা, আমি ওল্ড স্কুলের লোক; নাইন্টিনথ সেঞ্চুরিতে জন্মেছি, আমার ধ্যানধারণা–সব সেকালের মতো। আমি বাপু একজন যুবক-যুবতীর মধ্যে নিরামিষ বন্ধুত্বের রিলেশানে বিশ্বাস করি না। দেয়ার মাস্ট বি সামথিং এলস। এই যে তুমি ওই বজ্জাত ছোকরাটাকে বেধড়ক ঠ্যাঙালে তার পেছনে রয়েছে খুব সূক্ষ্ম একটা জেলাসি বা রাইভ্যালরি। এনিওয়ে, আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি।

অন্ধকারে কেউ কাউকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন না। পেলে ডাক্তার চক্রবর্তী বুঝতে পারতেন, অবনীনাথের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। বিব্রতভাবে তিনি বলেছিলেন, আপনি যা বলছেন তা ঠিক না।

হানড্রেড পারসেন্ট ঠিক। সাইকোলজিটা আমি একটু-আধটু বুঝি হে ছোকরা, এই ইনসিডেন্টটা থেকে আমি কোন ধারায় পৌঁছুলাম জানো?

উত্তর না দিয়ে তাকিয়েছিলেন অবনীনাথ।

ডাক্তার চক্রবর্তী বলেছিলেন, অনুর বাবার পক্ষে মেয়েকে সেভ করা সম্ভব না কিন্তু তুমি পারবে। সে গাটস আর সাহস তোমার আছে। কীভাবে কী করলে মেয়েটা পার্মানেন্টলি বেঁচে যায় একটু ভেবে দেখো তো।

অবনীনাথ কিছু বলার আগেই ট্রেন এসে গিয়েছিল।

বাড়ি ফিরে সারারাত ঘুমোতে পারেননি অবনীনাথ। কেমন যেন আচ্ছন্নতার মধ্যে কেটে গিয়েছিল। ডাক্তার চক্রবর্তী যেন এক টানে পর্দা সরিয়ে দিয়ে তাঁকে তাঁর মনেরই একটা গোপন অনাবিষ্কৃত অংশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

অনীতা সম্পর্কে তাঁর গভীর সহানুভূতি রয়েছে। কিন্তু তাকে কি সত্যি সত্যিই তিনি ভালোবাসেন? এটা ঠিক, ছুটিছাটায় দেশের বাড়িতে গেলে সারাক্ষণ অনীতার মুখ তাঁর চোখের সামনে ভাসতে থাকে। প্রায়ই ভাবেন, যে নোংরা দম-আটকানো পরিবেশে অনীতা রয়েছে, সেখানে থেকে সে মুক্তি পাক। শুভেচ্ছা বা সহানুভূতির বাইরে স্পষ্টভাবে এতকাল আর কিছু ভেবে দেখেননি অবনীনাথ। কিন্তু মনের যে দিকটা তাঁর নিজের কাছেই অজানা এবং সঙ্গোপন, আচমকা তার ওপর থেকে ঢাকনা খুলে দিয়েছেন ডাক্তার চক্রবর্তী। অনীতাকে পার্মানেন্টলি বাঁচাবার ব্যাপারে একটা ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন। সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তাঁর কী করা উচিত সেটাই ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না অবনীনাথ। তবে বার বার এটা তাঁর মনে হচ্ছিল, যেমন করেই হোক অনীতাকে বাঁচানো দরকার।

সারারাত অনীতার কথা ভেবে পরের দিন প্রায় ঝিমুতে ঝিমুতে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। একটা ক্লাসের পর অন্য একটা ক্লাসরুমে যাবার সময় বাইরের করিডরে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অনীতার বাবা অনিমেষ মুখার্জি দাঁড়িয়ে আছেন। অবনীনাথকে দেখামাত্র দ্রুত কাছে চলে এসেছিলেন। বলেছিলেন, আজ ভোরে ডিব্ৰুগড় থেকে এসেছি। এসেই যা শুনলাম তাতে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। এ তুমি কী করেছ অবনী?

জোরে জোরে গলা চড়িয়ে কথা বলছিলেন অনিমেষ। বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল, অবনীনাথের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যেভাবে অনিমেষ চেঁচিয়ে কথা বলছেন তাতে চারপাশে ছেলেমেয়েরা শুনতে পাবে। অবনীনাথ তাঁকে নিয়ে সোজা কলেজ স্কোয়ারে চলে গিয়েছিলেন।

অনিমেষ ফের বলেছিলেন, তুমি নবকুমারকে এমনভাবে মেরেছ যে তাকে কম করে দশ দিন বিছানায় পড়ে থাকতে হবে। কেন ওকে এভাবে মারলে?

অবনীনাথ বলেছিলেন আপনার সঙ্গে ডাক্তার চক্রবর্তীর দেখা হয়েছে?

না। কেন?

আপনি তো আপনার স্ত্রী আর নবকুমারের ইনস্টিগেশনে আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে এসেছেন

অনিমেষ খতমত খেয়ে গিয়েছিলেন না, তা কেন। সব শুনে আমার ভীষণ খারাপ লাগল। আফটার অল এটা পারিবারিক স্ক্যান্ডাল

তাঁকে শেষ করতে না-দিয়ে অবনীনাথ বলেছিলেন, স্ত্রী আর নবকুমারের মতো একটা স্কাউড্রেলের কথায় না নেচে ডাক্তার চক্রবর্তীর সঙ্গে আগে কথা বলুন।

হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই বলব।

আপনার মেয়ে কেন বাড়ি ছেড়ে দূর সম্পর্কের মাসির বাড়ি চলে গেছেন তার খোঁজ নিয়েছেন?

না, মানে আমি অফিসের কাজে ডিব্রুগড়ে চলে গিয়েছিলাম। তখন ব্যাপারটা ঘটেছে। আজ বিকেলে একবার ব্যারাকপুর গিয়ে শুনে আসব।

হ্যাঁ। তাই শুনে আসুন, তারপর আমার যা কৈফিয়ত দেবার তাই দেব। তবে একটা কথা, মোটে দশ দিনের জন্য নবকুমার বিছানায় পড়ে থাকবে বলে আপশোস হচ্ছে। আগে বুঝতে পারলে হোল লাইফ ওকে বিছানায় শুইয়ে রাখার ব্যবস্থা করতাম।

যত দোষই করুক, ও কিছুদিন বাদে আমার জামাই হতে চলেছে। তাকে যদি মেয়ের এক বন্ধু মেরে মুখ ভেঙে দেয় তার রিপারকাশান কী হতে পারে, ভেবে দেখেছ! আত্মীয়-স্বজনরা যা-তা বলছে।

ওই বিয়ের ব্যাপারটা তো সাজানো, সময় কাটাবার জন্যে টেম্পোরারি একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট। অনীতা আমাকে সব বলেছে।

অনিমেষ চমকে উঠেছিলেন, তুমি তাহলে সব জানো।

অবনীনাথ উত্তর দেননি।

অনিমেষ এবার প্রায় ভেঙে পড়েছিলেন, ওইরকম একটা ডিবচ মাতাল বদমাস ছেলের হাতে কী করে নিজের মেয়েকে তুলে দিই, তুমিই বলো। প্রথমেই যদি না বলি, নানারকম অশান্তি হবে, তাই এই ব্যবস্থাটা নিয়েছি। আচ্ছা, পরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।

বুঝতেই পারছেন, আপনাদের বাড়ি আমার পক্ষে যাওয়া ঠিক হবে না। যদি আমাকে দরকার হয়, তাহলে কোথায় দেখা করব, বলবেন। আমি নিজে গিয়ে দেখা করব। শুধু দয়া করে আমার মামার ওখানে গিয়ে এসব নিয়ে ডিসকাস করবেন না।

ঠিক আছে।

পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে এসে অবনীনাথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন অনিমেষ। আবার কলেজ স্কোয়ার গিয়েছিলেন দুজনে। অনিমেষ বলেছিলেন, কাল ব্যারাকপুর গিয়েছিলাম। চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা হল। উল্লুকটাকে মেরে তুমি ঠিক কাজই করেছ। খানিকক্ষণ চিন্তা করে ফের বলেছিলেন, অনুটাকে কী করে বাঁচানো যায় বুঝতে পারছি না। নবকুমারের কথা আমি ভাবছি না। এম. এ টা পাশ করর পর মেয়েটা চাকরি-টাকরি নিয়ে উইমেন্স হোস্টেলে চলে যাবে, তা-ও একরকম ঠিক করা আছে। কিন্তু সেটা তো কমপ্লিট সলিউশান না। হাজার হোক, মেয়ে তো; তার নিজস্ব ঘর-সংসার-স্বামী দরকার। তারপর হঠাৎই গলা নামিয়ে বলেছিলেন, চক্রবর্তী একটা সাজেশান দিয়েছে, কিন্তু তোমাকে বলতে সাহস হয় না।

কী সাজেশান?

তুমি নাকি অনুর সম্বন্ধে খুব ভাবো। কীভাবে ওকে বাঁচানো যায়, সে সম্বন্ধে আরেকটু ভালো করে ভেবো।

ঠিক এই কথাটাই যে ডাক্তার চক্রবর্তী বলেছেন, সেটা আগেই আন্দাজ করে নিয়েছিলেন অবনীনাথ। বলেছিলেন, আপনার কথা আমার মনে থাকবে।

এরপর দুটো দিন গভীর অন্যমনস্কতার মধ্যে কেটে গেছে অবনীনাথের। শেষ পর্যন্ত নিজের মতো করে তিনি স্থির করে ফেলেছিলেন, অনীতাকে বাঁচাতে হলে বিয়েটা করতেই হবে। তৃতীয় দিন দুপুরে অনিমেষের অফিসে গিয়ে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন। অনিমেষের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বলেছিলেন, তুমি আমাকে বাঁচালে বাবা। কিন্তু

কী?

এর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে–বলতে বলতে কণ্ঠস্বর বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিল অনিমেষের।

অবনীনাথ দ্বিধান্বিতের মতো জিগ্যেস করেছিলেন, কী ব্যাপার?

উত্তর না দিয়ে অনিমেষ বলেছিলেন, আচ্ছা, এখন তোমার সময় আছে?

অবনীনাথ বলেছিলেন, আছে। কেন?

আমার সঙ্গে একবার ব্যারাকপুর যেতে হবে। ওখানে বসেই কিছু কথা বলতে চাই। চক্রবর্তীও থাকবে।

ব্যারাকপুরে এসে ডাক্তার চক্রবর্তী, তাঁর স্ত্রী, অনীতা, অবনীনাথ আর অনিমেষ–এই পাঁচজন ড্রইংরুমে বসেছিলেন। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর অনিমেষ বলেছিলেন, তুমি অনীকে বিয়ে করতে চেয়েছ এর চাইতে বড় রিলিফ আমার কাছে কিছু নেই। কিন্তু তুমি কি জানো, আমরা ক্রিশ্চান? অনুকে বিয়ে করলে তোমাকে ধর্মত্যাগ করে ক্রিশ্চান হতে হবে।

প্রায় দুবছরের মতো অনিমেষদের দেখছেন অবনীনাথ। ওদের মধ্যে শাঁখা-সিরের চল আছে। অনীতাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদী, এমনকী রামপ্রসাদের গান পর্যন্ত গাইতে দেখেছেন। এমন কোনো লক্ষণ এতদিন চোখে পড়েনি যা দেখে শনাক্ত করা যায় ওঁরা হিন্দু নন।

আচমকা মাথার ওপর আকাশ ধসে পড়ার মতো একটা অনুভূতি হয়েছিল অবনীনাথের, পায়ের তলার মেঝে পৃথিবীর দীর্ঘতম ভূমিকম্পে যেন ঢেউয়ের মতো দুলে যাচ্ছিল। চোখের সামনে সিনেমার স্লাইডে একের পর এক তান্ত্রিক বাবার মুখ, মায়ের মুখ এবং ভাইবোনেদের মুখ ক্রমাগত ফুটে ফুটে উঠছিল। আজন্ম যে ধর্ম এবং সংস্কারের মধ্যে তিনি বড় হয়ে উঠেছেন, তা ছাড়তে হবে। কিন্তু অনু–অনীতা—

তাঁর ভাবনার মধ্যেই অনীতা বলে উঠেছিল, না, আমার জন্যে কাউকে ধর্ম ছাড়তে হবে না।

অনিমেষ বলেছিলেন, কিন্তু

কোনো কিন্তু না। অবনীর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত বাবা। আমাকে বিয়ে করতে চেয়ে ও কত বড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে, ভাবতে পারো? আমি ওর বাড়ির কথা সব শুনেছি। এ বিয়ে হলে চিরকালের জন্য বাড়ির সঙ্গে ওর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। তার ওপর ধর্ম বদলিয়ে ওর ক্ষতি করা ঠিক না।

ডাক্তার চক্রবর্তী এই সময় জানিয়েছিলেন, নিজের নিজের ধর্মের মধ্যে থেকেও কোর্টে গিয়ে সিভিল ম্যারেজ সম্ভব এবং অনীতা আর অবনীনাথের ব্যাপারে সেটাই বাঞ্ছনীয়।

আরও কিছুক্ষণ আলোচনার পর সিভিল ম্যারেজেরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এবং এটাও ঠিক করা হল, বিয়ের ব্যাপারটা আপাতত এই কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে জানানো হবে না। বিয়ের পর অনীতা ব্যারাকপুরেই থাকবে; এখান থেকেই ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত করবে। বিয়ে হয়ে গেছে বলে নবকুমারকে বিন্দুমাত্র ঘাঁটানো হবে না। শুধু তাকে জানিয়ে দিতে হবে ব্যারাকপুরে এসে এর পর অনীতা বা ডাক্তার চক্রবর্তীদের বিরক্ত করলে বিয়ে ভেঙে যাবে। নবকুমারকে জানানোর দায়িত্ব দেওয়া হল অনিমেষকে। মেয়ের বিয়ে যখন ঠিক হয়ে গেছে তখন নিজের লড়বড়ে মেরুদণ্ডে অনেকখানি জোর পেয়েছেন অনিমেষ। বোঝা যাচ্ছিল, নবকুমারকে তিনি ওই কথাগুলো মুখের ওপর বলে দিতে পারবেন।

এক সপ্তাহের মধ্যেই কোর্টরুমে অনীতার সঙ্গে অবনীনাথের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল গোপনে। চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে এমন নিরুৎসব বিয়ে কোনও মেয়ের জীবনেই বোধ হয় ঘটে না। অবশ্য বাড়িতে ডাক্তার চক্রবর্তীরা সেদিন খুব খাইয়েছিলেন। পরের দিন স্বাভাবিক যেভাবে মামাদের বাড়ি ফেরেন সেভাবেই ফিরে এসেছিলেন অবনীনাথ। তাঁর জীবনে যে এত বিশাল একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে সেটা মামারা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি।

এরপর লজ্জায় ব্যারাকপুরে আর যেতেন না অবনীনাথ। অনীতা ইউনিভার্সিটিতে আসত; সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হত।

কোর্টরুমের সঙ্গোপন বিয়ের পর মনের দিকটা রাতারাতি বদলে গিয়েছিল অবনীনাথের। তখন অনীতাকে সর্বক্ষণ কাছে পেতে ইচ্ছা করত; অনীতারও সেই একই ইচ্ছা। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। এম. এ-র রেজাল্ট পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষা করতেই হবে। তারপর বিয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে কোন বিস্ফোরণের মুখে পড়তে হবে, কে জানে!

মাসখানেক কাটার পর আচমকা বাড়ি থেকে একটা টেলিগ্রাম এল। বাবা তাঁকে যেতে লিখেছেন।

মানুষের জীবন যে কী মারাত্মক এবং জটিল এক নাটক, বাড়ি গিয়ে টের পাওয়া গিয়েছিল। বাবা আর মা অবনীনাথকে একটা ঘরে নিয়ে যা জানিয়েছিলেন তা এই রকম। শেষ যে তিরিশ বিঘা জমি এবং বাড়িটা কোনোক্রমে টিকে ছিল, কিছু দিন হল বাঁধা পড়েছে। সুদে-আসলে অঙ্কটা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে এই সম্পত্তি ছাড়ানো অসম্ভব। যার কাছে এইসব জমিজমা বাঁধা রয়েছে পাশের গ্রামের সেই উঠতি ধনী মাখনলাল গাঙ্গুলি দুটি শর্ত দিয়েছে। পনেরো দিনের মধ্যে টাকা শোধ না করলে বিষয় সম্পত্তি ক্রোক করে নেবে। তাতে ছেলেমেয়েদের হাত ধরে রাস্তায় গিয়ে বসতে হবে বাবাকে। মাখন গাঙ্গুলির দ্বিতীয় শর্ত, অবনীনাথ তাঁর মেয়ে চিন্ময়ীকে যদি বিয়ে করেন, যৌতুক হিসেবে বাড়ি এবং জমিজমার দলিলপত্র ফেরত দেবে। এখন কোনটা বেছে নিলে সুবিধা হয় সেটা বাবার অভিরুচি। তবে এর মাঝামাঝি কোনো ব্যবস্থা নেই। এখন এই পরিবারের সব কিছু নির্ভর করছে অবনীনাথের ওপর। অবনীনাথ যদি এ বিয়েতে রাজি হন, সংসারটা বেঁচে যাবে; নইলে ভেসে যেতে হবে।

শুনতে শুনতে একটা ধারালো ফলা যেন আমূল অবনীনাথের মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। রক্তাক্ত কোনও জন্তুর মতো তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন, কিন্তু গলার ভেতর থেকে অবরুদ্ধ গোঙানির মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এসেছিল। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, এ হয় না, হতে পারে না। আমি বিবাহিত; অনীতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। কিন্তু তাঁর কথা কেউ বোঝেনি।

এরপর কটা দিন কীভাবে যে কেটে গিয়েছিল তিনিই জানেন। একবার ভেবেছিলেন কলকাতায় পালিয়ে যাবেন কিন্তু অদৃশ্য এক ফাঁদে তিনি যেন আটকে গিয়েছিলেন। অবনীনাথের ওপর তাঁর নিজের কোনো ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কাজ করছিল না। আশ্চর্য এক ঘোরের মধ্যেই যেন মাখন গাঙ্গুলির মেয়ে চিন্ময়ীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।

এ বিয়েতে কলকাতা থেকে মামা-মামি এসেছিলেন। অবনীনাথ তাঁদের হাত ধরে অনুনয়ের গলায় বলেছিলেন, বিয়ের কথা যেন তাঁরা কলকাতায় কাউকে না বলেন। বিশেষ করে অনীতা বা তার মা-বাবাকে। মামা-মামি কথা দিয়েছিলেন, বলবেন না। ওঁদের হয়তো ধারণা হয়েছিল, পড়াশোনার মধ্যেই বিয়ে করতে হচ্ছে বলে অবনীনাথ হয়তো লজ্জা পাচ্ছেন। সেটাই স্বাভাবিক।

বিয়ের আগের দিন মা বলেছিলেন, সংসারের জন্যে তোকে বলি দিলাম। তোর দিকটা একবারও আমরা দেখলাম না। স্বার্থপর মাকে ক্ষমা করিস বাবা। তাঁর দুচোখ দিয়ে অবিরল জল ঝরে যাচ্ছিল। অবনীনাথ উত্তর দেননি।

বিয়ের পর ফুলশয্যার রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়া মিটে গেলে দূর সম্পর্কের বউদি, বোন আর মাসি-পিসিরা অবনীনাথকে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন।

সতেরো বছরের স্ত্রী চিন্ময়ী গয়না এবং লাল বেনারসীতে শরীর মুড়ে ফুল দিয়ে সাজানো নতুন মকরমুখী খাটের একধারে নত মুখে বসে ছিল। অবনীনাথ ঘরের দরজায় খিল আটকে সোজা তাঁর কাছে যাননি। জানলার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। সেটা পূর্ণিমাপক্ষ। আকাশে রুপোর থালার মতো গোল চাঁদ উঠেছে। মাঠ-ঘাট শস্যক্ষেত্র অলীক কোনো স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল।

কিন্তু পৃথিবীর কোনো দৃশ্যবলীই যেন চোখে পড়ছিল না অবনীনাথের। ব্যারাকপুরের এক দুঃখী অসহায় মেয়ের মুখ আকাশের ক্যানভাসে বার বার ফুটে উঠছিল। তাঁর কাছে গিয়ে কী যে বলবেন, কেমন করে তাঁকে মুখ দেখাবেন, ভাবতে পারছিলেন না।

কত ক্ষণ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন, রাত কতটা গম্ভীর হয়েছিল খেয়াল ছিল না অবনীনাথের। হঠাৎ মৃদু গলা কানে আসতে চমকে উঠেছিলেন।

শুনুন–

ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়েছিল–চিন্ময়ী। কখন যে খাটের কোণ থেকে উঠে এসেছে, টের পাননি অবনীনাথ।

চিন্ময়ী তাঁর অচেনা নয়। পাশের গ্রামের মেয়ে, ছেলেবেলায় অনেকবার দেখেছেন। কিন্তু বড় হবার পর দেখা প্রায় হতই না; বিশেষ করে কলকাতায় এম, এ পড়তে যাবার পর।

চিন্ময়ী কিন্তু আশ্চর্য রূপসি। টকটকে লাল বেনারসী, গা-ভর্তি গয়না আর শাঁখা-সিঁদুরে তাকে কোনো মায়াকাননের ফুলের মতো দেখাচ্ছিল। অবনীনাথ তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারেননি। বলেছিলেন, কিছু বলবে?

চোখ নামিয়ে চিন্ময়ী বলেছিল, হ্যাঁ।

সেই নাইন্টিন ফটিওয়ানে অর্থাৎ এখন থেকে আটত্রিশ বছর আগে কোনো মেয়ের পক্ষে ফুলশয্যার রাত্তিরে স্বামীর সঙ্গে নিজের থেকে কথা বলতে আসা খুবই অভাবনীয়। সাধারণত এমন একটি রাত্তিরে স্বামীরাই এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীর সংকচ লজ্জা ভাঙাত। এখানে উলটো ব্যাপার ঘটেছিল। কয়েক পলক অবাক তাকিয়ে থেকে অবনীনাথ বলেছিলেন, বেশ তো, বলো–

মুখ নীচু করেই চিন্ময়ী আস্তে আস্তে বলেছিল, আমি ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি। আপনি এম, এ পড়েন। ছাত্র হিসেবে আমাদের এখানে কত নাম আপনার। আমি কোনো দিক থেকেই আপনার যোগ্য না। বাবা টাকার জোরে এই বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমি জানি, আমাকে আপনার ভালো লাগতে পারে না।

এই গ্রাম্য মেয়েটির কাছে এ জাতীয় কথা প্রত্যাশা করেননি অবনীনাথ। তিনি যতটা অবাক হয়েছিলেন তার চাইতে অনেক অনেক বেশি মুগ্ধ।

চিন্ময়ী বলে যাচ্ছিল, বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তখন দয়া করে আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না; আপনাদের বাড়ির এক কোণে একটু থাকতে দেবেন। আমি এমন কিছু করব না, বলব না, যাতে আপনাদের অমর্যাদা হয়।

নিজের মুখেই চিন্ময়ী বলেছে সে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছে। কিন্তু যেভাবে সে কথা বলছিল তাতে মনেই হয়নি তার লেখাপড়া এত কম। মার্জিত, শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমতী মনে হচ্ছিল তাকে। সেই সঙ্গে প্রবল অনুভূতিসম্পন্নও।

চিন্মীয় আবার বলেছিল, বাবাকে আমি অনেক বারণ করেছিলাম। বাবা শুনলেন না। তাঁকে দোষ দিচ্ছি না; সব বাবাই নিজের মেয়েকে সুখী দেখতে চান। কিন্তু টাকা দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার আকাশপাতাল পার্থক্য ঘোচানো যায় না। যাক গে, আমি যে এখন থেকে আপনাদের বাড়িতে থাকব সেটা ইচ্ছা না হলে মনে রাখার দরকার নেই। আপনার যেভাবে খুশি চলবেন, আমি বাঁধা দেব না।

চিন্ময়ীর জন্য হঠাৎ খুব মমতা বোধ করেছিলেন অবনীনাথ। গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, তোমার মতো মেয়ে আগে কখনও দেখিনি।

চিন্ময়ী উত্তর দেয়নি।

অবনীনাথের ইচ্ছা হয়েছিল, নতুন এই স্ত্রীকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেন। তৎক্ষণাৎ অনীতার মুখ তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। বুকের গভীর থেকে নিশ্বাস ফেলে বলেছেন, অনেক রাত হয়েছে, শুয়ে পড়ো।

বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়েছে চিন্ময়ী।

ফুলশয্যার পর দিন তিনেক বাড়িতে ছিলেন অবনীনাথ। এর মধ্যে চিন্ময়ীকে যত দেখেছেন ততই মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে চিন্ময়ীর শ্রদ্ধা, সংসার সম্পর্কে কর্তব্যবোধ, মা-বাবাকে সেবা, ছোট ছোট দেওর এবং ননদদের যত্ন–তার আচরণে বা কথাবার্তায় কোথাও এতটুকু ত্রুটি নেই। বোঝাই যেত না–সে লক্ষপতি মাখন গাঙ্গুলির বাড়ি থেকে হতদরিদ্রের ঘরে এসে পড়েছে। তার বাবার অনুগ্রহই যে অবনীনাথরা ছাদের নীচে বাস করতে পারছে, চিন্ময়ীর আচারে ব্যবহারে তা এক মুহূর্তের জন্যও ফুটে উঠত না।

চিন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে সর্বক্ষণ অবনীনাথের মনে হত, এই সরল নিষ্পাপ কর্তব্যপরায়ণ মেয়েটাকে তিনি অনবরত ঠকিয়ে যাচ্ছেন। বড় ভালো চিন্ময়ী, বড় বেশি রকমের ভালো। তাকে প্রতারণা করার অধিকার তাঁর নেই।

রাত্তিরে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে নতুন এই স্ত্রীকে ছুঁতে ইচ্ছা করত অবনীনাথের। কতবার হাত বাড়িয়ে তিনি যে গুটিয়ে নিয়েছেন, ঠিক নেই। চিন্ময়ীকে ছুঁতে গেলেই অনীতাকে মনে পড়ে যায়। জীবনের এক মেরুতে রয়েছে অনীতা, আরেক মেরুতে চিন্ময়ী। অবনীনাথের সমস্ত অস্তিত্ব উদভ্রান্তের মতো দুই প্রান্তে যেন ছোটাছুটি করতে শুরু করেছিল। দারুণ এক পাপবোধ তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল। প্রায়ই ভাবতেন, অনীতার কথা গোপন করে রাখা ঠিক হবে না। চিন্ময়ীকে সব কিছু খুলে বলবেন। কিন্তু বলতে গেলেই অদৃশ্য হাতে কেউ যেন মুখ চেপে ধরত।

শেষ পর্যন্ত কলকাতায় ফেরার আগের দিন রাত্রে অবনীনাথ মনস্থির করে ফেলেছিলন। বলেছিলেন, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে চিন্ময়ী–

চিন্ময়ী তাঁর দিকে পরিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে ছিল, বলুন

তোমাকে এমন কিছু বলব যাতে আমাকে সারাজীবন তুমি ঘৃণা করবে। কিন্তু না বলে উপায় নেই; আমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি।

আপনি বলুন। কথা দিচ্ছি, সব শোনার পরও আপনাকে আমি চিরদিন শ্রদ্ধা করেই যাব।

সব শোনার পর তোমার শ্রদ্ধা করার ইচ্ছাটা থাকবে না।

নিশ্চয়ই থাকবে। আপনি দেখে নেবেন।

এই গেঁয়ো মেয়েটা, ক্বচিৎ কখনো যে রামপুরহাটের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে গেছে, –কোত্থেকে মনের এত অলৌকিক জোর পায়? অবনীনাথ বলেছিলেন, যা বলব তাতে তোমার ভীষণ দুঃখ হবে। সে দুঃখ সহ্য করতে পারবে তো?

চিন্ময়ী বলেছিল, আমি সব কিছুর জন্য প্রস্তুত।

এরপর অবনীনাথ অনীতার সঙ্গে তার আলাপ থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত সব কিছু বলে দিয়েছিলেন।

অনেকক্ষণ চুপচাপ। তারপর অবনীনাথ ফের বলেছিলেন, আশা করি বুঝতেই পারছ, অনীতাকে বিয়ে না করে আমার উপায় ছিল না। নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার?

বিষণ্ণ ভারী গলায় চিন্ময়ী বলেছিল, হ্যাঁ হচ্ছে। কোনো মেয়েই তার স্বামীর ভাগ অন্যকে দিতে চায় না।

আমার সম্বন্ধে ধারণাটা এবার বদলে ফেলো চিন্ময়ী।

পারব না। আপনি অন্যায় বা পাপ কিছু করেননি। অনীতাদিকে বিয়ে করে তাঁকে বাঁচিয়েছেন। আমাকে বিয়ে করে বাঁচিয়েছেন নিজের মা-বাবা ভাই-বোনকে। আপনার ওপর আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল।

কিন্তু তোমার তোমার কী হবে?

আমি তো আপনাকে আগেই বলে দিয়েছি, আমার কোনো দাবি নেই।

হঠাৎ কী হয়ে গিয়েছিল অবনীনাথের, ইচ্ছা-অনিচ্ছা কোনোটাই তাঁর নিজের আয়ত্তে ছিল না। প্রগাঢ় আবেগে চিন্মীয়কে দুহাতে বুকের গভীরে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, তুমি কেন এত কথা শুনে যদি খেপে উঠতে, আমাকে ঘেন্না করতে, তাহলে আমার একটা সান্ত্বনা ছিল। ভাবতে পারতাম, যে অন্যায় আমি করে ফেলেছি তার কিছুটা প্রাপ্য পেয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এত ভালো থেকে তুমি আমার পাপের কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছ। তুমি আমাকে একটু ঘেন্না করো চিন্ময়ী, একটু ঘেন্না করো।

চিন্ময়ী তাঁর মুখে হাত রেখে আস্তে করে বলেছিল, এমন কথা বলতে নেই। তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো, অনেক বড়। অবনীনাথকে সেই প্রথম চিন্ময়ীর তুমি বলা।

অনেকটা সময় স্ত্রীকে বুকের ভেতর ধরে রেখে অবনীনাথ এক সময় বলেছিলেন, অনীতার সঙ্গে আমার বিয়ের কথাটা বাড়ির কেউ জানে না।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছিল চিন্ময়ী। সে বলেছে, এটা গোপনই থাকবে। অন্তত আমার মুখ থেকে কেউ শুনতে পাবে না। লোকের কাছে তোমার মাথা নীচু হয়ে যাবে, তাই কি আমি করতে পারি!

এই মেয়েটাকে বেশি করে ব্যাখা করে কিছুই বলতে হয় না। একটু ইঙ্গিত পেলেই সে সব ধরে নিতে পারে। পূর্ণিমা পক্ষের অঢেল মায়াবী জ্যোৎস্নার মতো চিন্ময়ী তাঁর জীবনে এসেছে। একে নিয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না অবনীনাথ। প্রাথমিক আবেগ কিছুটা কমে এলে তাঁর মনে হয়েছিল, এভাবে চিন্ময়ীকে বুকের ভেতর টেনে আনা ঠিক হয়নি। তাকে বুঝতে না দিয়ে আস্তে আস্তে বিছানার একধারে সরে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। আবছা গলায় এবার বলেছিলেন, আমাকে কলকাতায় চলে যেতে হবে।

চিন্ময়ী বলেছিল, নিশ্চয়ই যাবেন, পরীক্ষা সামনে।

কলকাতায় গেলে অনীতার সঙ্গে আমার রোজ দেখা হবে।

 দেখা তো হবেই।

অবনীনাথ বলেছিলেন, তুমি একটা মেয়ে তো!

চিন্ময়ী হেসে ফেলেছিল, আমার তো সেইরকমই ধারণা। লোকেও সেই কথাই বলে। মেয়ে না হলে একজন পুরুষের সঙ্গে বিয়েটা হল কী করে?

অবনীনাথ বিছানায় উঠে বসেছিলেন। বলেছিলেন, ঠাট্টা নয়। নিজের কথা একবার ভেবে দেখেছ?

দেখেছি। তুমি কলকাতায় থাকবে, আমি এই গ্রামের বাড়িতে। যদি এখানে কখনও-সখনও আসো, দেখতে পাব। তখন ভীষণ ভালো লাগবে।

তোমাকে নিয়ে পারা যায় না। অনীতা যদি তার দাবি না ছাড়ে, আমাকে আসতে না দ্যায়, তাহলে তোমার কী হবে–সেটাই জানতে চাইছি।

কোনো মেয়েই তার স্বামীকে ছাড়তে চায় না। অনীতাদিই বা ছাড়বেন কেন? তাঁর সঙ্গে তোমার আগে বিয়ে হয়েছে। তাঁর দাবি আমার চাইতে বেশি। তিনি যদি তোমাকে আসতে দেন, দেখা হবে। নইলে জীবন একভাবে-না-একভাবে এখানে কেটে যাবেই।

অবনীনাথ গভীর দুঃখের গলায় বলেছিলেন, চিরকাল তোমার কাছে আমি অপরাধী হয়েই থাকব।

.

পরের দিন কলকাতায় চলে এসেছিলেন অবনীনাথ। ভোরের ট্রেনে আসতে পারেননি, দুপুরের ট্রেন ধরে পৌঁছেছিলেন রাত্তিরে। ফলে সেদিন আর ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি। তার পরের দিন যেতেই উৎকণ্ঠিতের মতো অনীতা জিগ্যেস করেছিল, কী হয়েছিল বাড়িতে? খারাপ কিছু?

মুখ তুলে তাকাতে পারছিলেন না অবনীনাথ। শ্বাসকষ্টের মতো একটা যন্ত্রণা তাঁর বুকের ভেতর থেকে উঠে এসে সারা শরীরে যেন ছড়িয়ে পড়ছিল।

অনীতা জিগ্যেস করেছিল, কী হয়েছে বলছ না যে?

বলতে অনেকক্ষণ সময় লাগবে। তোমার অফ পিরিয়ড কখন?

একটায়।

তখন কোথাও গিয়ে বসে বলতে হবে।

ঠিক একটার সময় অনীতাকে নিয়ে কলেজ স্কোয়ারের এক কোণে গিয়ে মুখোমুখি বসে ছিলেন অবনীনাথ। কলকাতার সেই সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের সময় নিগ্রো আর আমেরিকান টমিতে গিজ গিজ করছে। এয়ার রেইডের ভয়ে প্রত্যেকটা পার্কে লম্বা লম্বা ট্রেঞ্চ খোঁড়া। মিলিটারির জন্য কোথাও বসার উপায় নেই। সেই তুলনায় ইউনিভার্সিটির উলটোদিকে সেই পার্কটা ছিল অনেক নিরিবিলি।

অনীতা বলেছিল, এবার শুরু করো।

অবনীনাথ বলেছিলেন, দেশে গিয়ে আমি তোমার সর্বনাশ করে এসেছি অনু।

অনীতা চমকে উঠেছিল। তারপর বিমূঢ়ের মতো বলেছে, তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।

সব শুনলেই পারবে। এরপর অবনীনাথ চিন্ময়ীর সঙ্গে তাঁর বিয়ের ব্যাপারটা বলে গিয়েছিলেন। চিন্ময়ীর সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে তার কিছুই বাদ দেননি।

শোনার পর দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল অনীতা।

অবনীনাথ বলেছিলেন, এখন আমি কী করব, তুমিই বলে দাও।

 অনীতা উত্তর দেয়নি।

অবনীনাথ আবার বলেছিলেন, ভাবছি তোমার বাবাকে সব জানাব। তারপর কোর্টে গিয়ে তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটা যাতে খারিজ হয়ে যায় তার জন্য আপিল করব। কিংবা তোমরা যা শাস্তি দেবে তা মাথা পেতে নিতে আমি রাজি।

অনীতা কেঁদেই যাচ্ছিল, কেঁদেই যাচ্ছিল। কান্নাটা একটু কমে এলে বলেছে, বাবা বা আর কাউকে তোমার এই বিয়ের ব্যাপারটা জানাবার দরকার নেই। কোর্টেও তোমাকে যেতে হবে না। যা হয়ে গেছে সেটাকে ডিসটার্ব করে লাভ নেই। তাতে প্রবলেম অনেক বেড়ে যাবে।

কিন্তু

এম.এ পর্যন্ত এখন চুপচাপ থাকো। তারপর চিন্ময়ীর কাছে চলে যেও।

চিন্ময়ী তো তোমার কাছেই আসতে বলেছে।

সেটা তার মহানুভবতা। একটা মেয়ের কাছে এমন মহত্ত্ব ভাবা যায় না। তাকে আমার শ্রদ্ধা জানিও।

একটু চুপ করে থেকে অবনীনাথ বলেছিলেন, তোমার কী হবে?

অনীতা চোখ-টোখ মুছে খুব শান্ত গলায় বলেছিল, দেখো, আমি খানিকটা লেখাপড়া জানি। ইউনিভার্সিটির লাস্ট ডিগ্রিটা কিছুদিনের মধ্যেই আমার হাতে এসে যাবে। আর যা সময় আসছে তাতে ছেলেদের তো নিশ্চয়ই, মেয়েদের চাকরি-বাকরির স্কোপও অনেক বেড়ে যাবে। এম.এ-র ডিগ্রিটা হাতে থাকলে একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবই। কিন্তু চিন্ময়ীর তো কলেজ-ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নেই। বড় ভালো মেয়ে ও; তুমি না দেখলে ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।

অবনীনাথের বুকের অসংখ্য স্তর ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এসেছিল। তিনি আস্তে আস্তে বলেছিলেন, তোমরা দুজনেই বড় ভালো। কেন তোমরা স্বার্থপর হিংসুক হলে না?

অনীতা উত্তর দেয়নি।

অবনীনাথ বলেছিলেন, এত ভালো থেকে তোমরা দুজনে আমাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করালে, একবার ভেবে দেখেছ।

অনীতা এবার বলেছিল, তোমার জন্য শুধু দুঃখই হয়।

সময় কেটে যেতে লাগল। এম.এ পাশ করার পর একটা দিনও অনীতা বা অবনীনাথকে বসে থাকতে হয়নি। অনীতা পূর্ণিয়ার একটা কলেজে লেকচারারের কাজ পেয়ে গেল। আর অবনীনাথ বেশ ভালো একটা চাকরি পেলেন সিভিল সাপ্লাইজে।

অনীতাকে অবশ্য কলকাতার দু-তিনটে কলেজে লেকচারারের চাকরি দেবার জন্য ডেকেছিল, কিন্তু সে পাটনার কাজটাই বেছে নিয়েছিল। কারণটা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। অবনীনাথ বলেছিলেন, তাহলে দুরেই চললে!

অনীতা বলেছিল, এতে সবারই ভালো হবে। আমি কলকাতায় থাকলে জটিলতা আর প্রবলেম বাড়বে। চাকরি পেয়েছ; বাড়ি ভাড়া করে চিন্ময়ীকে কলকাতায় নিয়ে এসো।

তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে দিলাম অনু। যদি কিছু মনে না করো, একটা কথা বলব।

বলল না।

কোর্ট থেকে এই বিয়েটা খারিজ করিয়ে দিচ্ছি। তুমি আর কাউকে বিয়ে করে নতুন লাইফ স্টার্ট করো।

তা আর হয় না।

কেন হয় না?

তোমার সঙ্গে আমার জীবন যেভাবেই হোক জড়িয়ে গেছে। ওটা ছেঁড়া যাবে না।

এভাবে দিন কাটবে?

কাটবে বলেই মনে হয়।

একটু চিন্তা করে বিষণ্ণ গলায় অবনীনাথ বলেছিলেন, যদি কখনও ভাবো এই বিয়েটা খারিজ করা দরকার–বোলো।

অনীতা বলেছিল, নিশ্চয়ই বলব।

অনীতা যেদিন পাটনা গেল সেদিন তাকে তুলে দেবার জন্য হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে জানলার ধারে বসে আছে অনীতা আর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন অবনীনাথ।

অনীতার চোখ জলে ভরে যাচ্ছিল। সে বলেছিল, চলি–

অবনীনাথ ভাঙা গলায় বলেছিলেন, সত্যিই এত দূরে চলে যাবে, এ আমি ভাবতে পারছি না।

ট্রেনে উঠে পড়েছি। এক মিনিটের ভেতর গাড়ি ছেড়ে দেবে। আর তুমি কিনা এখনও ভাবতে পারছ না! অনীতার ঠোঁটে মলিন একটু হাসি ফুটে উঠেছিল।

জানলার কার্নিসে অনীতার একটি হাত পড়ে রয়েছে। সেই হাতের ওপর নিজের হাতটা রেখে অবনীনাথ কাঁপা গলায় বলেছিলেন, এখনও সময় আছে, নেমে এসো। তুমি চলে গেলে আমার কষ্ট হবে।

অনীতা ভাঙা গলায় বলেছিল, আমাকে দুর্বল করে দিও না। তোমাকে অনেক বেশি করে পাব বলেই তো দুরে চলে যাচ্ছি।

এই সময় গার্ডের হুইসিল বেজে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সুবিশাল সরীসৃপের মতো দিল্লি মেল চলতে শুরু করেছিল।

যতক্ষণ সম্ভব গাড়িটার সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন অবনীনাথ। আর জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে থেকেছিল অনীতা। এক সময় ট্রেনটা, হাওড়া স্টেশন পিছনে ফেলে ছোট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আর প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন অবনীনাথ।

কতক্ষণ পর মনে নেই ক্লান্ত পা টেনে টেনে ফিরতে শুরু করেছিলেন তিনি। সেই যুদ্ধের সময় হাওড়া স্টেশনে গিজগিজে ভিড়। ইকুয়েশন তখন সবে আরম্ভ হয়েছে। বিহার উড়িষ্যা আসাম সেন্ট্রাল প্রভিন্স রাজস্থান–সব জায়গার মানুষ জাপানি বোমার ভয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সব সময় হাওড়ায় তখন হাট বসে আছে। তা ছাড়া রয়েছে মিলিটারি। অনবরত ট্রেন বোঝাই হয়ে গুর্খা বা জাঠ রেজিমেন্টের সোলজার কিংবা আমেরিকান আর নিগ্রো টমি হয় কলকাতায় আসছে, নইলে অন্য কোনো ডেস্টিনেশনে চলে যাচ্ছে।

এত মানুষ, এত থিকথিকে ভিড়–তবু অবনীনাথের মনে হয়েছিল চারদিক আশ্চর্য ফাঁকা। সমস্ত পৃথিবী জোড়া শূন্যতার মধ্যে সর্বস্ব খোয়ানো একটি মানুষের মতো ক্লান্ত পা টেনে টেনে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি।

.

এরপর কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে একদিন চিন্ময়ীকে দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন অবনীনাথ। ক্রমে পৃথিবী কাঁপানো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ একদিন থেমে গেছে। শোনা যাচ্ছিল, ইংরেজরা এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। স্বাধীন হলও একদিন। তারপর অবনীনাথের সংসারে একে একে ছেলেমেয়েরা আসতে লাগল।

সারা পৃথিবীতে আর অবনীনাথের সংসারে এত বড় বড় ঘটনা ঘটে গেল কিন্তু সেই যে অনীতা পাটনায় চলে গিয়েছিল, আর ফেরেনি। তবে প্রতি সপ্তাহেই চিঠি লিখত সে। অবনীনাথকে না, চিন্ময়ীকে। ছেলেমেয়েদের খবর নিত সে, অবনীনাথের খবর নিত। বড় বোনের মতো চিন্ময়ীকে অনেকরকম পরামর্শ এবং উপদেশ দিত।

অবনীনাথ লুকিয়ে দু-একবার অনীতাকে চিঠি দিয়েছেন। উত্তর পাওয়া যায়নি। চিন্ময়ীর সেবাযত্নের তুলনা ছিল না। কীসে অবনীনাথের সুখ কীসে আরাম সব দিকে তার হাজার চোখ মেলা ছিল। তবু বুকের ভেতর কোথায় যেন খানিকটা জায়গা ফাঁকা থেকেই গিয়েছিল। অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে এই বলে চিন্ময়ীকে লুকিয়ে দু-একবার পাটনায় গিয়ে অনীতার সঙ্গে দেখা করেছেন অবনীনাথ।

অনীতা বলেছে, তুমি এভাবে এসে আমাকে লোভ দেখিও না।

 কলকাতায় ফেরার পর চিন্ময়ী বলেছে, তুমি পাটনায় অনুদির কাছে গিয়েছিলে?

অবনীনাথ চমকে উঠেছেন, কে বললে?

অনুদি চিঠি লিখেছে।

অবনীনাথ চিন্ময়ীর দিকে তাকাতে পারেননি।

চিন্ময়ী বলেছে, অনুদির কাছে নিশ্চয়ই যাবে। তবে আমাকে লুকিয়ে না। তুমি তো অন্যায় কিছু করোনি।

অবনীনাথের মাথা আরও নীচু হয়ে যেত।

মনে পড়ে জীবনে একবারই মাত্র অনীতার সঙ্গে চিন্ময়ীর দেখা হয়েছে। সেটা বোধ হয় নাইন্টিন ফিফটি-টিফটি হবে। মাকে বাড়ি থেকে আনিয়ে ছেলেমেয়েদের ভার তাঁর ওপর দিয়ে চিন্ময়ীকে সঙ্গে করে পুজোর ছুটিতে রাজগীর গিয়েছিলেন অবনীনাথ। অনীতাও তার কলেজেরে মেয়েদের নিয়ে ওখানে এক্সকার্শানে এসেছিল। আরও কয়েকজন অধ্যাপিকাও ছিলেন সেই দলে।

অবনীনাথ দুই স্ত্রীর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন, কটা দিন পরস্পরকে নিয়ে তারা মেতে ছিল। নিজের হাতে কতরকম রান্না করে অনীতাকে কাছে বসে খাওয়াত চিন্ময়ী। অনীতাও তার জন্য কদিনেই স্কার্ফ বুনে দিয়েছিল। বিকেলে চিন্ময়ীকে জড়িয়ে ধরে বেড়াতে যেত সে। ওদের দেখতে দেখতে চোখে জল এসে যেত অবনীনাথের। কত ভালো ওরা, কত সুন্দর।

চিন্ময়ী একদিন অনীতাকে বলেছিল, তুমি আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাবে দিদি। তোমার ছেলেমেয়েদের তো দেখোনি? দেখে আসবে।

অনীতা প্রথমে রাজি হয়নি। চিন্মীয় অনবরত জোরজার করতে শেষ পর্যন্ত বলেছিল, আচ্ছা যাব।

কিন্তু কলকাতায় ফেরার আগের দিন ওদের দলের একজন অধ্যাপিকার হাতে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল অনীতা।-আমি পাটনায় ফিরে যাচ্ছি চিনু। কলকাতায় যাওয়া আমার পক্ষে উচিত না। আমি একটা সামান্য মেয়ে তো। ওখানে গেলে তোমার সুখের সংসার দেখলে আমার লোভ আর ঈর্ষা যে হবে না, এমন মনের জোর আমার আছে মনে করি না। অকারণ জটিলতা বাড়িয়ে কী হবে। তোমাকে আগে দেখিনি, তবে তোমার সম্বন্ধে কোনো কথা জানতে বাকি নেই। তোমাকে দেখে বুক ভরে গেছে। তোমার মতো একটা বোন পাওয়া কজনের ভাগ্যে ঘটে! এই পাওয়াটা যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্য পাটনা চলে গেলাম। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। ইতি তোমার অনুদি।

বিষণ্ণ অবনীনাথ চিন্ময়ীকে নিয়ে রাজগীর থেকে সেবার ফিরে এসেছিলেন।

.

এরপর ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে হয়ে স্কুল, স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে লাগল। তারপর একে একে ওরা চাকরি-বাকরিতে ঢুকল। ফরেন সারভিসে ঢোকার পর বড় ছেলে অভীকের বিয়ে হল মৃদুলার সঙ্গে। বড় মেয়ের বিয়ে হল এম বি বি এস পাশ করার পর। ছোট ছেলে অঞ্জনও কমার্শিয়াল ফার্মে একজিকিউটিভ হবার পর বিয়ে করল।

ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এবং মেয়েদের বিয়েতে কত টাকা যে অনীতা পাঠিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। নইলে যেভাবে এতগুলো ছেলেমেয়েকে অবনীনাথ মানুষ করেছেন তার খরচ চালানো কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। অনীতার কাছ থেকে টাকা নিতে তিনি কুণ্ঠিত হয়েছেন কিন্তু অনীতা শোনেনি। লিখেছে, চিন্ময়ী আর অবনীনাথের ছেলেমেয়েরা কি তারও সন্তান নয়?

এইসব নানা ঘটনার মধ্যে বিরাট একটা পারিবারিক ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেখে যেতে পারেনি চিন্ময়ী, বছর দশেক আগে ক্যান্সারে দারুণ কষ্ট পেয়ে সে মারা যায়।

যাই হোক, ছেলেমেয়েরা সবাই এখন প্রতিষ্ঠিত। বাকি ছিল ছোট মেয়ে রঞ্জনা। এক মাস আগে তার বিয়েও দিয়েছে অবনীনাথ। পৃথিবীতে সব দায়-দায়িত্ব এবং কর্তব্য তাঁর প্রায় পূর্ণ হয়েছে। শুধু বাকি রয়েছে শেষ একটি কাজ।

.

নিজের জীবনের দীর্ঘ সুগোপন এক ইতিহাস ছেলেমেয়ে পুত্রবধূ এবং জামাইদের সামনে মেলে ধরার পর অবনীনাথ বললেন কিছুই তোমাদের কাছে লুকোলাম না। হতে পারে–আমার সমন্ধে তোমাদের মনে এত কাল যে মিথটা ছিল ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। হয়তো এখন থেকে তোমরা আমাকে আগের মতো শ্রদ্ধা করতে পারবে না। তবু টুথ-টুথ-ই। তার মুখোমুখি একদিন দাঁড়াতেই হবে।

অভীক, মৃদুলা, রঞ্জনা, চৈতী–সবাই শ্বাসরুদ্ধের মতো অবনীনাথের দিকে তাকিয়ে ছিল। কেউ একটা কথাও বলল না।

অবনীনাথ আবার বললেন, আমি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছি। অনীতাও রিটায়ার করে পরশু কলকাতায় এসেছে। একটা হোটেলে উঠেছে সে। আমি তাকে আমার এই বাড়িতে আজই নিয়ে আসব। জীবনের সব কর্তব্য শেষ করার পর আমার এই একটা কর্তব্যই বাকি রয়েছে। সমস্ত পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে এই দুঃখী মেয়েটাকে আমি স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই। তোমরা তাকে গ্রহণ করতে পারবে কিনা জানি না। কিন্তু আমার কাজ আমাকে করতেই হবে। একটু থেমে ঘড়ি দেখে ফের বললেন, সাতটা বাজে। অনীতা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি যাই। অবনীনাথ উঠে পড়লেন।

.

০২.

কিছুক্ষণ পর অবনীনাথ সেন্ট্রাল ক্যালকাটার একটা হোটেলে এসে অনীতার ঘরে ঢুকলেন।

সেদিনের তরুণী অনীতা নয়, জীবনের দীর্ঘ ম্যারাথন দৌড় শেষ করে আসা প্রৌঢ়া অনীতা বিছানায় বসে ছিলেন। চুলের আধাআধি সাদা হয়ে গেছে, চোখে মোটা ফ্রেমের বাই-ফোকাল চশমা। শরীরে বয়সের ভার পড়েছে।

অবনীনাথ দেখলেন, একটা বেতের বাস্কেট আর ফোমের মাঝারি একটা সুটকেশ একধারে দাঁড় করানো রয়েছে। দেখেই টের পাওয়া যায়, সব গুছোনোই রয়েছে।

অবনীনাথ বললেন, চলো—

 অনীতা যেন ভয়ে ভয়েই বললেন, অভীক, রঞ্জনা, মৃদুলা, চৈতী–ওরা সব?

ওদের সব বলেছি।

কী বললে ওরা?

কিছুই বলেনি। কেউ কিছু বলুক আর না-ই বলুক আমার যায় আসে না–অনেক দুঃখ তোমাকে দিয়েছি। এবার প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও–অবনীনাথ সুটকেশ আর বাস্কেটটা তুলে নিয়ে বললেন, এসো

অনীতা ভীরু পায়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর অবনীনাথের পিছু পিছু বেরিয়ে এলেন।

অনীতাকে নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে যেতে ভীষণ ভালো লাগছিল অবনীনাথের। এই পৃথিবীতে আর কদিনই বা আছেন। আয়ুর সীমার মধ্যে অনীতাকে যে মর্যাদা দিতে পারছেন, তাতেই তিনি সুখী। জীবনের অনিবার্য সমাপ্তিকে এবার তিনি দুহাত বাড়িয়ে গ্রহণ করতে পারবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *