হয়তো সেই লাইব্রেরিয়ান বিরাম বক্সী নর্মদার অকপট হৃদয়ের প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করেছিল, হয়তো বুদ্ধি আর সরলতা এই দুটো বিপরীত বস্তুর একত্র সমাবেশ দেখে সে কিছুটা অভিভূত হয়েছিল, হয়তো বা তার মূল্যহীন একঘেয়ে জীবনের মাঝখানে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে হাতে-এসে-পড়া এই ঐশ্বর্যের লোভ সে সামলাতে পারে নি, তাই বেশ কতকগুলো দিন সে ওই নতুন সমুদ্রের তরঙ্গে ওঠা-পড়া করেছে, মাঝে মাঝে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে গেছে তীর ছাড়িয়ে, কিন্তু একেবারে নোঙর ছাড়লে তার চলবে কেন? লোকচক্ষুর সামনে নিজেকে খাড়া রাখবার চেষ্টা না করলেই বা টিকবে কি করে?
তাই এক ছুটির দিন, সারাদিন দুজনে কোথায় না কোথায় ঘুরে, ছোট রেলে চড়ে এক অখ্যাত গ্রামে বেড়িয়ে, একরাশ বুনো ফুল মাথায় গুঁজে, হাত ভর্তি নতুন ধানের শীষ আর মন ভর্তি আনন্দের আবেগ নিয়ে ছলছলিয়ে এসে ওর সঙ্গে যখন স্টেশনে নামল নর্মদা, তখন পেল এক অপ্রত্যাশিত আঘাত।
যে আঘাতে তার সোনারঙা পৃথিবী হঠাৎ যেন হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাচের বাসনের মত গুঁড়ো হয়ে গেল।
এর চাইতে কেন ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট হল না তার, কেন মাথায় নেমে এল না ভারী কোন লোহার বীম। ভাবল নর্মদা, তাহলে সোনারঙা পৃথিবীর কোলে পরিপূর্ণ আনন্দের পরম প্রসাদ নিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়তে পারত সে।
অথচ আঘাত যে দিল সে জানতেও পারল না আঘাত হেনেছে সে। জানতে পারল না, কারণ সে শুধু তার সামাজিক চেহারাটা লোকচক্ষে অবিকৃত রাখতে চেয়েছিল, এর বেশি আর কিছু না। ভয়ানক একটা পাষণ্ডজনোচিত কাজ কিছু করেনি। মানুষ মাত্রেই এইরকম অবস্থায় পড়লে এরকম করে থাকে।
নর্মদা আর বিরাম, এদের পাশাপাশি দেখতে দেখতে লোকের চোখ ক্ষয়ে গেছে। ট্রামে বাসে ট্যাক্সিতে, পায়ে হাঁটায়, কিসে নয়? আর কোথায় নয়? হাতের কাছে যতগুলো বেড়াবার ঠাই আছে, বেলুড়, দক্ষিণেশ্বর, দমদম, ডায়মণ্ড হারবার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বোটানিক, আর সিনেমা জলসা, এসব পুরোনো করে ওরা ছুটির দিনে পাড়াগাঁ বেড়াতে শুরু করেছে। এবং বিরাম যদিও ভেবে নিশ্চিন্ত আছে চেনা লোকেরা ওদের দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু চেনা লোকদের ওই যা বললাম-দেখে দেখে চোখ ক্ষয়ে গেছে।
কাজেই সেদিন ওই ঢাকুরিয়া না গড়িয়া কোথা থেকে যেন ফেরার সময় দুজনে যখন পাশাপাশি আসছে গল্প করতে করতে, আনন্দের আবীর মুখে মেখে, তখন বিরামের এক ভায়রাভাই দূর থেকে দেখতে পেল। দেখে চমকে উঠল না অবশ্য। শুধু বিরক্তিতে ভুরুটা কোঁচকালো। কিছুই হত না যদি হঠাৎ বিরামের চোখে ওই ভ্রুকুঞ্চিত মুখটি না পড়ত। কিন্তু পড়ল।
আর বিরাম ভাবল বুঝি এই প্রথম ও ধরা পড়ল লোকচক্ষে। তাও আবার সে চোখ বন্ধুজাতীয়ের নয়, সংসারের সবসেরা প্রতিদ্বন্দ্বী স্ত্রীর ভগ্নিপতির। ভয়ে দিশেহারা হল বিরাম। মৃদু অথচ দ্রুত উচ্চারণে নর্মদাকে একটু দূরত্বের ব্যবধান রেখে এগিয়ে যেতে বলে, যেন নিঃসঙ্গ চলেছে এই ভাবে ভায়রাভাইয়ের কাছে সহাস্যে গিয়ে দাঁড়াল।
আর তারপরই এল সেই মারাত্মক আঘাত।
নর্মদা এগিয়ে গিয়েও শুনতে পেল বিরামের কণ্ঠনিঃসৃত সেই কটি শব্দ। যে কষ্ঠ বহু অলৌকিক মুহূর্তে, বহু অপূর্ব ক্ষণে নর্মদার কানে স্বর্গের সুরঝঙ্কার বয়ে এনেছে, সেই কণ্ঠ নিয়ে এল একটি অগ্নিগর্ভ বাজ। নর্মদা শুনল, বোধ করি ভায়রাভাইয়ের কোনও তীক্ষ্ণ মন্তব্যে বিদ্ধ বিরাম কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর এনে উচ্চারণ করছে, আর বলল না ভাই। মেয়েটা আমার জীবন একেবারে মহানিশা করে তুলেছে। অ্যাভয়েড় করতেও পারা যায় না, এমন নাছোড়
একেবারে কুমীরের কামড়? কেমন? ভদ্রলোক শ্লেষের সুরে বলেন।
আর তার উত্তরে এবার বিরামের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, যা বলেছ ভাই। প্রায় তাই। অথচ ভদ্রতার দায়ে না করতেও পারা যায় না। উনি কবিত্ব করতে বাংলা দেশের পল্লীশোভা দেখে বেড়াবেন, আর আমার প্রাণান্ত।
না, বিরামের কোন লাভ হয় নি ওই বোকাটে কৈফিয়টুকু দিয়ে, কারণ দুনিয়াটা বোকা নয়। সেখানে ভাতই খায় সবাই, ঘাসের বীচি নয়। বিরামের কৈফিয়তে ভদ্রলোক একটু বাঁকা হাসি হেসে শুধু বলেছিলেন, মহিলাটি বেছে বেছে তোমার স্কন্ধেই ভর করলেন, এটা অবশ্য একটা আশ্চর্য রহস্য। কাজেই লাভ কিছু হল না বিরামের। কিন্তু যে বিরাট একটা লোকসান ঘটে গেল আর এক জায়গায়, তার আর তুলনা হয় না।
বিরাম আর কোন উত্তর দিয়েছিল কি না সে কথা জানে না নর্মদা। ওর শুধু মনে আছে, চোখটা অবিরত ঝাপসা হয়ে আসার দরুন বাড়ি ফিরে আসতে সেদিন ভারী অসুবিধে হয়েছিল।
ভায়রাভাইয়ের কবলমুক্ত হয়ে ভয়ঙ্কর রকম দ্রুত চলে এসেও বিরাম নর্মদাকে দেখতে পায় নি। শুধু ফুটপাথের একধারে কমুঠো বুনো ফুল আর গোছা কতক নতুন ধানের শীষ দেখে বুকটা হিম হিম হয়ে গিয়েছিল তার!
সেই হিম হিম বুক নিয়েই তখুনি নর্মদাদের বাড়ি গেল বিরাম, কিন্তু দোতলা থেকে কাকা বজ্রকণ্ঠে বললেন, ফেরেনি এখনো।
.
পরদিন আবার গেল অসময়ে। চাকরকে বলল, দিদিমণিকে ডেকে দিতে। চাকর মুখটা কালিপনা করে চলে গেল। আর তারপর দোতলা থেকে যিনি নেমে এলেন, তিনি নর্মদা নয়, তার কাকী।
কাকী গম্ভীর মুখে মৃদু কণ্ঠে বললেন, আপনিই বোধকরি বিরাম বক্সী?
বিরাম থতমত খেয়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
আমিও আন্দাজ করছিলাম। যাক আপনার জানা দরকার তাই জানাচ্ছি, নর্মদা কাল রাত্রে মারা গেছে।
বিরাম কেঁদে উঠল না, চেঁচিয়ে উঠল না, শুধু অবোধ্য বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়ে বলল, কী বলছেন!
বাংলা ভাষাটা ঠিকমত জানা নেই বুঝি? মারা যাওয়া কথার মানে জানেন না? ইংরিজি বললে বুঝতে পারবেন বোধহয়। কাল রাত্রে সে সুইসাইড করেছে। এবার বুঝতে পেরেছেন? আপনি এবার আসতে পারেন।
এবার বিরাম বক্সী রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠেছিল, আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি না।
কাকী মুখ আরও ভীষণ করে বলেছিলেন, বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছে। আমার জানানোর কথা জানিয়ে দিলাম। তবে এটুকু মনে রাখবেন, এ বয়সের মেয়েরা আত্মহত্যা করে বসলে পুলিশ কারণ আবিষ্কার করতে আগে তাদের প্রণয়ীকে সন্দেহ করে।
এ হেন কুলিশকঠোর স্পষ্ট কথার পর আর কে দাঁড়াতে পারে তার সামনা সামনি?
বিরামও পারেনি। চলে এসেছিল।
অবিশ্বাস্য কথাটা বিশ্বাস অবশ্য করেনি সে, তবু বুকটা কাঁপছিল বৈকি। কী জানি যদি সত্যি হয়, যা আবেগপ্রবণ মেয়ে!
অথচ কারণটা কিছুতেই বুঝতে পারে না বিরাম। গত সন্ধ্যায় নর্মদাকে সেই একা এগিয়ে যেতে বলাটাই কি তাহলে এত অভিমানের কারণ হল? এমন কি অপরাধ সেটা?
.
কাকী ফের দোতলায় উঠে আসতেই নর্মদা রুদ্ধকণ্ঠে প্রশ্ন করল, কি বলল?
বলবে আবার কি? মুখটা পেঁচার মত করে চলে গেল।
বিশ্বাস করল?
বিশ্বাস যে করেনি, সেটুকু বোঝবার মত বুদ্ধি কাকীর আছে, কিন্তু তিনি একটু প্যাঁচ খেললেন। বললেন, প্রথমে অবিশ্বাস দেখিয়েছিল, তারপর বলার গুণে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়লাম।
তাহলে করল বিশ্বাস?
করল বৈকি।
চেঁচিয়ে উঠল না, কাঁদল না, কিছু করল না?
কাকী মুখখানি অমায়িক করে বললেন, সে হয়ত বাড়ি গিয়ে কাঁদবে, চেঁচাবে! ভদ্রলোকের বাড়িতে তাই কি পারে?
না না, বাড়ি গিয়েও কিছু করবে না। চেঁচিয়ে উঠল নর্মদা নিজেই। বলল, বাড়ি গিয়ে ও ওর সেই ঘটির মতন বৌয়ের কাছে হেসে হেসে গল্প করবে, একটা দামী মেয়ে কী ভাবে তার জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে।
কাকী আরও অমায়িক কণ্ঠে বললেন, তা বলা যায় না, হতেও পারে। পুরুষ মানুষ বৈ তো নয়।
পুরুষ মানুষদের দ্বারা যে সব রকম অমানুষিকতাই সম্ভব, এই তথ্যটাই পরিবেশিত হল কাকীর কণ্ঠস্বরে।
তুমি এখন এ ঘর থেকে যাও, নর্মদা বলল, আর কাকাকে বলগে, ওঁর সেই কে কোথায় একটা লক্ষ্মীছাড়া পাত্তর ছিল, তার সঙ্গে কথার ঠিক করে ফেলতে।
কাকী গিয়ে তৎক্ষণাই বললেন।
কিন্তু কাকা উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, এমন লক্ষ্মীছাড়া কেউ কোথাও নেই যে ওই ধিঙ্গী অবতারের জন্যে পিত্যেস করে বসে থাকবে। তার বিয়ে হয়ে গেছে।
কাকী চুপ চুপ করে থামালেন। বললেন, যদি বা মেজাজ একটু বদলেছে, তুমি আর বিগড়ে দিও না। এই মোহাড়ায় বিয়েটা যে করে তোক দিয়ে ফেল, নইলে ও মেয়ে আবার কেলেঙ্কারী করে বেড়াবে।
ও মেয়ে বিয়ে হলেও তাই করে বেড়াবে।
কাকী মুচকে হেসে বললেন, তখন তো আর আমরা ভুগতে যাব না। কি করবে, বিধাতা পুরুষ তোমার ভাইঝির ভিতরে প্রেমটা একটু অধিক পরিমাণে দিয়ে ফেলেছেন, ওর দোষ কি?
কাকা জ্বলন্ত দৃষ্টি হানলেন।
কাকী অবশ্য ভয় পেলেন না এতে, বললেন, তা সেদিন যে বলছিলে, তোমাদের কোম্পানির কোন্ ডিরেক্টর নাকি বিয়ে করবে–বিদূষী সুন্দরী মেয়ে খুঁজছে বলে রব উঠেছে? আমাদের সঙ্গে জাতে মিলবে না?
কাকা অবাক হয়ে বললেন, মিস্টার পালিতের কথা বলছ?
পালিত বুঝি? তা অত জানতাম না। তাহলে তো জাতে আটকাচ্ছে না। দেখ না চেষ্টা করে, নমির মত সুন্দর মেয়ে তো আর ঘরে ঘরে নেই।
পাগল না কি? পালিত সাহেবের বয়েস কমসে কম পঁয়তাল্লিশ। বরং ওদিকে তো এদিকে নয়। উন্নতি উন্নতি করে সারা বয়েসটা শুধু কাজের পিছনেই ছুটেছে লোকটা, বিয়ের ফুরসৎ পায়নি। এখন টনক নড়েছে। কে দেবে সুন্দরী বিদূষী মেয়ে ওই বুড়োকে?
কে না দেবে শুনি? তুমি আর ন্যাকামী করো না। মাসিক আয় কত লোকটার?
সে বলে আর তোমার দুঃখ বাড়াই কেন? শুনে তুমি হয়তো নিঃশ্বাস ফেলে ভাববে, হায় হায়, ওই অফিসের কেরানীর বৌ না হয়ে, ডিরেক্টরের বৌ হলাম না কেন?
সে তো অহরহই ভাবি। যেখানে যত বড়লোকের বৌ আছে তাদের সকলকে দেখেই নিঃশ্বাস ফেলি আমি। সে যাক, বয়েস নিয়ে কি ধুয়ে জল খাবে?
চমৎকার!
বেশ তো, আমি না হয় চমৎকারিণী। জিগ্যেস করে দেখ তোমার ভাইঝিকে। কি তার পছন্দ। নিঃস্ব যুবক, না ধনী প্রৌঢ়। আমি হলে তো শেষেরটাই পছন্দ করতাম। তবে জানি না, তোমার প্রেমিকা ভাইঝি কি বলবেন।
তা ভাইঝি যে কারণেই তোক কাকীর পছন্দেই একাত্ম হল। বলল, মন্দ কি?
দেখতে অবশ্য খুব বুড়োটে নয়
হলেও আপত্তি ছিল না।
কাকী এঘরে এসে বললেন, দেখলে?
কাকা গম্ভীরমুখে বললেন, দেখলাম।
ডিরেক্টর শুনেই সব আপত্তি খণ্ডন হয়ে গেছে।
আমার তো সে কথা মনে হয় না। মনে হচ্ছে–এখন একটা ঝোঁকের বশে
থামো না, বকছ কেন? মেয়েমানুষ এটুকু বোঝে, সংসার করতে পয়সাই মূলাধার।
কাকা তিক্ত মুখে বললেন, একথা আগে জানা থাকলে বুঝে কাজ করতাম।
তাই করাই উচিত ছিল।
.
সে তো হল। কিন্তু আপাতত, কাকা তার ভাইঝির সমর্থনে যা করতে উদ্যত হলেন, সে কাজকেও আত্মীয়জন উচিত কাজ বলে অভিহিত করল না।
পালিত সাহেবের আয় পদমর্যাদা ইত্যাদি আত্মীয়ের চোখ টাটাবার এবং বুক ফাটাবার পক্ষে যথেষ্ট! অতএব যেটুকু নিয়ে ধিক্কার দেওয়া যায়, তা কে কবে ছাড়ে?
কেউ বলল, কে বলেছে পঁয়তাল্লিশ! পঞ্চান্নর এক হপ্তা কম নয়। কেউ বলল, বাপ নেই বলে বুড়ো বরে ধরে দেওয়া, এ দৃষ্টান্ত এ যুগে বিরল। কেউ কেউ বা একেবারে শিকড়সুদ্ধ টান দিয়ে বলল, কাকার কী দোষ? আধুনিক মেয়েরা ওই রকমই। তারা যতক্ষণ না একটি শাঁসাল বর জোটাতে পারে, ততক্ষণ প্রেম করে বেড়িয়ে সাধ মিটিয়ে নেয়, তারপর জোটাতে পারলেই, সেই ব্যাঙ্কের খাতার গলায় মালাটি পরিয়ে দিব্যি তার পিছু পিছু গিয়ে সংসারে ঢোকে। ব্যাঙ্কের খাতা রঙিনই হোক আর কালোই হোক, চকচকেই হোক কি ঢিলেঢালা পুরনোই হোক এসে যায় না কিছু। টাকার অঙ্কটাই আসল।
এ সব গল্প করে করে বীথিকা তার স্বামীকে বলে, আমরা তো ওই পালিত সাহেবের বয়েস শুনে ওকে বলতে লাগলাম, গলায় দড়ি দে নর্মদা, গলায় দড়ি দে
ওর স্বামী বাধা দিয়ে বলল, কেন, তুমিই তো বল, টাকা থাকলেই হল।
আহা, সে তো এখন বলি। তখন কি আর বলতাম? তখন মায়া-কাজল পরা চোখ, উন্নাসিক মন। তাই বলতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমাদের বলাবলিতে কিছু হল না। নর্মদা তখন বিয়েতেই বদ্ধপরিকর। এবার সে দেখতে চায়, বিবাহের ওই বৈদিক মন্ত্রগুলির মধ্যে সত্যিই কোন শক্তি আছে কি না। দেখতে চায়, তার পিতামহী প্রপিতামহীরা খাঁটি দুধ আর খাঁটি ঘিয়ের মত খাঁটি প্রেমও ভোগ করে গেছেন কি না।
সত্যিই এ সব বলত নাকি সে?
বলত বৈ কি। ওই রকম অদ্ভুত অদ্ভুত কথাবার্তাই তো তখন ছিল তার। এখনকার ওই মিসেস পালিতকে দেখে কে বলবে, এক সময় ও এই রকম এক কল্পনাপ্রবণ স্বাপ্নিক মেয়ে ছিল। অকৃত্রিমের সন্ধান করতে করতে নিজে যে একখানি কৃত্রিমতার খনি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ বোধও ওর নেই।
.
বীথিকার এ কথাটাও হয়তো নির্ভুল।
কারণ বিয়ের পর নর্মদা যখন পালিত সাহেবের ঘর করতে গেল, তখন ওকে ওর বন্ধুদের থেকেও তো বেশি দেখেছি আমরা। দেখছি ওর চেষ্টা আর হতাশা। দেখেছি আবার নতুন করে উদ্যম আর তার জন্যে নানা ছলাকলার আশ্রয় নেওয়া।
বিয়ের পর বেশ কিছুদিন ও ওর পিতামহীর জীবনকে অন্বেষণ করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওর বয়েস সাতাশ, আর পালিত সাহেবের, বয়েস সাতচল্লিশ। ওর চেয়ে আরও কুড়িটি বছর পৃথিবীকে বেশী দেখেছেন সাহেব। যে পৃথিবী তার কাছে পড়া বইয়ের মত আকর্ষণহীন হয়ে গেছে, ঘসা পয়সার মত রূপহীন।
নর্মদার যে প্রত্যাশার আবেগ, তার চাহিদা মেটাবার উপকরণও নেই তার মধ্যে।
পালিত সাহেবের যৌবনের উদ্দাম আবেগ যে প্রেয়সীর পিছনে ছুটোছুটি করে তাকে করায়ত্ত করে সাফল্যের হাসি হেসেছে, সে প্রেয়সী হচ্ছে তার কোম্পানির উন্নতি। সেই তার মানস-সঙ্গিনী। বিয়ে করেছেন কতকটা একটি জীবন-সঙ্গিনীর প্রয়োজনে, কতকটা বা সাংসারিক সৌষ্ঠবের প্রয়োজনে। অবশ্য বিয়ে করার পক্ষে বয়েসটা যে তার বেড়ে গেছে, এটুকু সত্য তিনি আপন মনের কাছেও স্বীকার করেননি।
স্বাস্থ্য আর শক্তিমত্তার গর্বে স্ফীত পালিত সাহেব এদিকে সেদিকে স্বাস্থ্যহীন যুবকদের দিকে তাকিয়ে অনুকম্পার হাসি হেসেছেন। আর স্ত্রীকে যথেষ্ট টাকা এবং যথেচ্ছ স্বাধীনতার মর্যাদা দিয়ে ভেবেছেন, অনেক দিলাম।
অন্য যে কোন সাধারণ মেয়ে হয়তো এই পেলেই খুশি হত, সন্তুষ্ট হত। কিন্তু নর্মদা অন্য রকম। তাই সে আরও কিছু চায়।
চায় স্বামীর অনন্যমুখিতা।
পালিত সাহেব নবপরিণীতায় বিভোর থাকুন, বিমুগ্ধ থাকুন, কোম্পানির কাজ ভুলে যান, সাংসারিক কর্তব্য ভুলে যান–তা নইলে নর্মদার জীবন ব্যর্থ। যৌবন অপমানাহত।
কিন্তু পালিত সাহেব ইস্পাতের মানুষ। তবু নর্মদা চেষ্টা করে। আর এই চেষ্টাই দেখা দেয় কৃত্রিম কৌশলের মূর্তিতে।
হয়তো ঠিক পালিত সাহেবের অফিস বেরোবার মুহূর্তে হঠাৎ নর্মদার হার্টের কষ্ট শুরু হয়। কাতর নর্মদা কাঁদো কাঁদো অস্ফুট গলায় বলে, আবার মনে হচ্ছে এক্ষুনি হার্টফেল করব আমি।
পালিত সাহেব সঙ্গে সঙ্গে ফোন তুলে নেন, পারিবারিক চিকিৎসককে তন্মুহুর্তে চলে আসতে বলেন এবং ফোনেই নির্দেশ দেন–তেমন দরকার বুঝলে ডাক্তার যেন তার অফিসে ফোন করেন, কারণ তার না বেরোলেই নয়। সঙ্গে সঙ্গে এ নির্দেশও দেন ডাক্তারকে, ডাক্তার যদি বোঝেন অন্য কোনও স্পেশালিস্টকেও কল দিতে পারেন।
সে কৌশল ব্যর্থ হয়।
তবে আবার কোন একদিন, পালিত সাহেব যখন হয়তো বাড়িতেই কোন এজেন্ট বা অ্যাটর্নি অথবা কোন পার্টনারের সঙ্গে বিশেষ আলোচনায় ব্যস্ত, চাকর গিয়ে খবর দেয়, মেমসাহেব বাথরুমে পড়ে গেছেন, কোন রকমে ঘরে এনে শোওয়ানো হয়েছে। সাহেব অবিলম্বে না গেলে
সাহেবের উপস্থিত সঙ্গীরা হাঁ হাঁ করে উঠেছেন, আলোচনা বন্ধ করে দিতে বলেছেন, এবং সাহেবও তৎপর হয়ে ভিতরে ঢুকে এসে ডাক্তারকে ফোন করতে করতে বারংবার প্রশ্ন করেছেন, হাড় ভেঙেছে বলে মনে হচ্ছে না তো?
এহেন সময় মাঝে মাঝে নর্মদা অজ্ঞানও হয়ে গেছে, কাজেই কথার উত্তর পাওয়া যায় নি। পালিত সাহেব নর্মদার খাস ঝিকে মুখে-চোখে জল দেবার নির্দেশ দিয়ে ফের বাইরে গিয়ে বসেছেন। ওরা ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করেছেন, চলে এলেন আপনি? বেশী কিছু আঘাত পাননি তো!
পালিত মৃদু গম্ভীর হাস্যে বলেছেন, নেহাৎ কম আঘাত পেয়েছেন বলেও মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কষ্ট দেবে।
সে কি! সে কী! তাহলে এখন আলোচনা বন্ধ থাক, আপনি বরং
পালিত সাহেব অমায়িক হাস্যে বলেছেন, আমি আর থেকে কি করব? আমি তো ডাক্তার নই? ডাক্তারকে ফোন করে দিয়েছি, এসে দেখুন যদি এক্স-রে করার প্রয়োজন বোঝেন।
.
ডাক্তারের সামনেও সেই কথাই বলেছেন পালিত সাহেব, পরম ব্যগ্রতা দেখিয়ে।
এক্স-রে করার দরকার হয় তো
ডাক্তার সবিনয় হাস্যে বলেছেন, দরকার হলে আপনাকে বলতে হবে কেন, আমিই বলব।
মুখে একথা বলেছেন, আর মনে মনে বলেছেন, বুড়োবয়সে বিয়ে করে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে লোকটার। স্ত্রৈণ আর কাকে বলে! আহ্লাদী গিন্নীর আহ্বাদেপনাটুকুও বোঝবার ক্ষমতা নেই।
ক্ষমতা যে নেই, সেটাই সাড়ম্বরে প্রকাশ করেছেন পালিত সাহেব তুচ্ছ ব্যাপারে চিকিৎসায় রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করে। কোনদিন অবিশ্বাসের ছায়ামাত্র উঁকি মারতে দেখা যায়নি তাঁর চোখের কোণে। বার বার সাবধানে থাকবার অনুরোধ জানিয়েছেন, নিটুট বিশ্রাম গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন, উচিত মত সেবার জন্য দাসীর উপর আবার নার্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির দিকে চোখ ফেলে বলেছেন, আমার তো সময় হয়ে গেল, চলছি তাহলে।
এ সময় হওয়ার জন্যে শুধু অফিসের কাজই একমাত্র নয়। সন্ধ্যায় ক্লাবে যাওয়া, অন্যান্য কোম্পানীর পার্টিতে যাওয়া ইত্যাদি বহুবিধ যে কাজ আছে পালিত সাহেবের, আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে তার উদয়াস্ত দিনগুলো, তার কোনটাই ব্যাহত হয় না।
আচ্ছা চলছি।-বলে ঘড়ির কাটা অনুযায়ী ঠিক চলে যান সাহেব। অবশ্য তেমন অবস্থায় যেখানেই যান, সেখান থেকে মাঝে একবার ফোন করে স্ত্রীর কুশলবার্তা নিতে ত্রুটি করেন না।
সর্বত্রই লোকে এই অনুমান করে, বুড়োবয়সে বিয়ে করে গোল্লায় গেছে লোকটা। লোকলজ্জাও নেই।
বন্ধুরা ঠাট্টা করেছে।
পালিত সস্নেহ হাস্যে বলেছেন, আহা, বেচারী বড্ড একলা। বাড়িতে তো আর কেউ নেই।
ফোন করলে নর্মদা কোনদিন কথা বলেছে, কোনদিন রাগ করে কথা বলেনি। নার্সকে দিয়ে বলিয়েছে, উনি ঘুমোচ্ছন।
যেদিন কথা বলেছে, তীব্র অভিমানে বলেছে, শুয়ে শুয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি এসে যেন আমার মরামুখ দেখ।
পালিত সাহেব লাইনের ওধারে হো হো করে হেসে উঠে বলেছেন, ন্যটি গার্ল!
.
এক একদিন এমন মনে হয়েছে নর্মদার, সাহেব ঠিক যে মুহূর্তে গাড়িতে উঠতে যাবেন, সেই মহা-মুহূর্তটি তাক করে সে একবার দোতলার বারান্দা থেকে রাস্তায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে দেখবে, তার যাওয়া আটকায় কি না। কিন্তু অতদূর আর সাহস হয়ে ওঠেনি। কাজেই হার্টের কষ্ট, মাথার যন্ত্রণা, সারা শরীরের মধ্যে কী রকম যেন করা আর দুর্বলতায় মূৰ্ছা যাওয়া, এই কটা পরিচিত ঘরের মধ্য দিয়েই তাঁতের মাকু আনাগোনা করতে থাকে।
কিন্তু আশ্চর্য যে, ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না পালিত সাহেবের।
কাজেই অভিযোগ করবার কোথাও কিছু নেই।
এমনি যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কিছুদিন কাটাবার পর কাবেরীর জন্মসূচনা দেখা দিল। আর নর্মদা আশায় উদ্বেলিত হয়ে উঠল, তবে এইবার বুঝি দেখা দেবে মস্ত একটা ওলট পালট। স্বামীর কাছে মহামূল্যবান হয়ে উঠবে সে। কিন্তু এমনি ভাগ্য নর্মদার যে তার নিজের স্বাস্থ্যই তার সঙ্গে বাদ সাধল। যে সময় সাধারণত মেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ে, সে সময় নর্মদার রূপ আর স্বাস্থ্য যেন বেড়ে গেল।
কাকী একদিন আচার আর ভাজা খাবারের সম্ভার নিয়ে দেখা করতে এসে ভবিষ্যৎবাণী করে গেলেন, নির্ঘাৎ মেয়ে হবে। রূপে বোঝায় বেটা বেটি, মেয়ের ছিরি পরিপাটি।
তারপর অবশ্য তিনি ধর্মের সাক্ষী একবার নর্মদাকে নিয়ে যাবার প্রস্তাবও করলেন। বললেন, এ সময় তো মেয়েরা বাপের বাড়ি যায়। মা বাপ না হয় নেই, আমরা তো আছি।
নর্মদা রাজী হল না।
ওর মনে হল এ সংসার থেকে সরে গেলে, ওর জায়গাটা বুঝি হারিয়ে যাবে।
পালিত সাহেব বললেন, ইচ্ছে হয়তো যাও না। না হয় দুদিন বেড়িয়েই এসো না।
নর্মদা ক্ষুব্ধ অভিমানে বলল, তুমি তো তাড়াতে পারলেই বাঁচো। তবু আমি যাব না। মরতে হয় এখানেই মরব।
পালিত বললেন, মরার কথা বলতে নেই।
.
নর্মদা আগে ঠাকুর-দেবতা সম্পর্কে সচেতন ছিল না, এখন অবিরত সেই অদৃশ্য অজানিত লোকে আবেদন পাঠাতে লাগল, যেন সেই ভয়ঙ্কর সময়ে, তার খুব ভয়ঙ্কর একটা কিছু হয়। যেন পালিত সাহেবের চৈতন্য জন্মায়।
কিন্তু কিছুই হল না।
একেবারে নেহাৎ সাধারণদের মত বিনা উদ্বেগে নির্বিঘ্নে নিরাপদে একটি হৃষ্টপুষ্ট কন্যা ভূমিষ্ট হল।
অবশ্য আড়ম্বর আয়োজনের ত্রুটি হল না, কিন্তু তাতে সুখ কোথায়? নর্মদার জন্যে যদি কেউ উদ্বিগ্ন দৃষ্টি মেলে রাতের পর রাত বিনিদ্র না কাটাল, নর্মদা বেঁচে ওঠার পর প্রাপ্তির বিহ্বল আনন্দে না বলল, উঃ কী দিনই গেছে–তবে আর কী হল নর্মদার?
অতএব জীবনের ঘোড়শোপচার আয়োজনের মধ্যেও এক বঞ্চিত দুঃখী হৃদয় নিয়ে দিন কাটাতে লাগল নর্মদা।
অনেকবার কল্পনা করল সে, সত্যিই যদি ভয়ঙ্কর একটা কিছু হত, কী এসে যেত পালিত সাহেবের?
ভেবে দেখল, কিছু না। কিছু না।
বিনিদ্র রজনীর প্রশ্ন উঠত না। উঃ কী দিনই গেছে–এ কথা কোথাও উচ্চারিত হত না।
এ দুঃখের মত দুঃখ আর কি আছে?
কিন্তু পালিত সাহেব?
সত্যিই কি লোকটা হৃদয়হীন?
না, সে দোষ তাঁকে দেওয়া যায় না। লোকটার দোষ শুধু সে প্র্যাকটিক্যাল। এসব ভাব বিলাসের মর্ম তার কাছে অস্পষ্ট।
সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সব কিছু থাকতেও একটা মানুষ মনগড়া দুঃখ নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে, এ দেখলে তার রাগ হয়, করুণা হয়।
নর্মদা যদি সেই এক অলৌকিক অমিয় মাধুরী দিয়ে গড়া বিহ্বল প্রেম না চাইত, যদি সুস্থ স্বাভাবিক একটা মেয়ে হত, পালিত সাহেব তাকে সুখী করতে পারতেন।
কিন্তু লোকটার ভাগ্যই বাদী।
তবু বুদ্ধিমান আর আত্মস্থ পুরুষ পালিত সাহেব ভাগ্যের এই পরিহাসে বিচলিত হন নি কোনদিন, খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়ে সকৌতুক উদারতায় সহ্য করে গেছেন।
আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, নর্মদাকে কোনদিন টের পেতে দেন নি, নর্মদার এই অসুখ আর দুর্বলতা, মূৰ্ছা আর প্রাণ কেমন করার কৃত্রিমতা টের পাচ্ছেন।
বরং অহরহ সাবধান হতে বলার জন্যেই মাঝে মাঝে ক্ষেপে যেত নর্মদা। আর স্বাস্থ্যবতী স্ত্রীর স্বাস্থ্যের জন্য অকাতরে অর্থব্যয় দেখে ক্ষেপে যেত আত্মীয়জন, ভৃত্যজন।
বাস্তবিকই নর্মদার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ করাটা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই সময় হেনাকে এখানে এনে রেখেছিলেন পালিত সাহেব। আর হেনাই প্রথম আবিষ্কার করেছিল কনক মিত্তিরের সঙ্গে নর্মদার হৃদয়গত জটিলতা।
কাবেরী তখন দোলনার শিশু।
.
কনক মিত্তিরের সঙ্গে নর্মদার প্রথম কি করে আলাপ হয় সে কথা আর এখন বোধকরি দুজনের কারোরই মনে নেই। তবু ভেবে মনে করলে মনে করা যায়, প্রায় আকস্মিক ভাবে পরিচয় হওয়ার সেই চেহারাটা এই ছিল। একদা বেশি রাত্রে কোথা থেকে যেন নিমন্ত্রণ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন পালিত দম্পতি, সহসা একটি প্রায় জনশূন্য এবং যানবাহন শূন্যও বটে, পথের ধার থেকে স্যুট পরা সিগারেট হাতে ধরা একটি স্মার্ট যুবক হাত তুলে গাড়ি থামানোর আবেদন করল।
গাড়িতে পালিত সাহেব নিজে এবং ড্রাইভার দুজনের রক্ষীবল, কাজেই ভয় পাবার কিছু নেই। গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিলেন পালিত।
যুবকের আবেদন অবশ্য গাড়ি থামানোতেই থেমে থাকল না, বসতে পেলে শুতে চায় নীতিতে সে বলল, অনুগ্রহ করে তাকে যদি একটু লিফট দেওয়া হয়।
কারণ?
কারণ, সে এখানে এসেছিল কোন প্রয়োজনে, নিজের এলাকা থেকে অনেকটা পথ ব্যবধানে, কিন্তু এখন যান-বাহন পাচ্ছে না। অথচ বাড়িতে তার রুগ্ন মা আছেন, ছেলে না বাড়ি ফিরলে তিনি নাকি আহার নিদ্রার কোনটাই করেন না।
এই এক মুশকিল! মৃদু হেসেছিল ছোকরা, কিছুতেই বুঝবেন না। এদিকে একখানা খালি ট্যাক্সি পাচ্ছি না।
মাতৃভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নর্মদার মন মুহূর্তে জয় করে নিল ছোকরা, পালিত সাহেবও খুব বেশি বিমুখতা বোধ করলেন না। শুধু দিব্যি পরিষ্কার গলায় একবার বললেন, নিতে আপনাকে পারি। ভাগ্যক্রমে আপনার আর আমার গন্তব্যস্থল যখন এক। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কলি বলি, কলকাতা শহরটিকে তো জানেন। আপনার এই সুন্দর চেহারাখানির মধ্যে কোন ভয়াবহ ব্যক্তির বাসা নেই, এ গ্যারান্টি কে দেবে? ধরুন ছোরা পকেটে নিয়ে উঠলেন আপনি।
ছোকরা হাস্যমুখে বলে, শুধু হাতে তো আর আপনাদের দু-দুটো লোককে ঘায়েল করতে পারব না? পকেট সার্চ করুন। করে দেখুন, যদি আপত্তিকর কিছু পান অবশ্যই নেবেন না।
সঙ্গে সঙ্গে নিজে নিজেই চটপট শার্টের পকেট উল্টে আর প্যান্টের পকেট থাবড়ে প্রমাণ দাখিল করল সে।
এদিকে নর্মদা স্বামীর বর্বর ব্যবহারে একেবারে স্তম্ভিত। কোন ভদ্রলোককে যে এভাবে সরাসরি এমন ভয়ানক প্রশ্ন করা যায়, এ তার ধারণার বাইরে। তাই নীচু গলায় স্বামীকে প্রায় শাসিয়ে বলে ওঠে, ছি ছি, অভদ্রতার কি একটা সীমা নেই? জানো, যে কোন সভ্য দেশে এ রকম অবস্থায় গাড়িবানেরা পথচারীদের নিজেই গাড়ি অফার করে। আর তুমি এই কথা বললে?
পালিত সাহেব মৃদু হাস্যে বলেন, পৃথিবীকে চিনতে তোমার এখনো বাকী আছে নর্মদা! কে বলতে পারে যাকে সাদরে গাড়ির বুকে আশ্রয় দেব, সে আদর ভরে আমার বুকে ছুরি বসাবে কি না।
বলেছিলেন, কিন্তু গাড়ির দরজা খুলে ধরেছিলেন।
কিন্তু যতই চতুর হোন পালিত সাহেব, তিনি কি এ আশঙ্কা করেছিলেন, ততক্ষণে তার ঘরণী পথচারীর জন্য তার হৃদয়-দুয়ার খুলে ধরেছে!
গাড়িতে সারাক্ষণ কথা বলল কনক মিত্তির, এবং সেই কথার মধ্যে এই কথাটাই পরিস্ফুট হল, রীতিমত অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে সে, তবে সম্প্রতি বাপ হঠাৎ মারা গিয়ে বেচারা একটু অসুবিধেয় পড়েছে। কারণ তিনি যে তার ব্যাঙ্কের খাতা, ইনসিওরের কাগজপত্র, বহুবিধ কোম্পানির শেয়ার সম্পর্কিত দলিল ইত্যাদি কোথায় রেখে গেছেন, সেটা ধরা যাচ্ছে না। আসলে বড় বেশি সাবধানী ছিলেন তিনি।
অ্যাটর্নি বলছেন, সন্দেহবাতিক লোকেদের ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে এই অবস্থা ঘটে। এমন কি শেষ অবধি লেপের চালি, ছাতের বরগার খাঁজ অথবা দেয়ালের গহ্বরেও হদিশ মেলে।
অন্য পক্ষে, অন্য কোনও অ্যাটর্নির সঙ্গেও যোগসাজস থাকতে পারে। অত্যন্ত বিরক্ত স্বরে অ্যাটর্নি এই কথাই বলেছিলেন, ডাক্তার আর উকিল ব্যারিস্টারের কাছে কথা লুকোনোর মত। বোকামী আর কি আছে?
আপনার মাও জানতেন না?
প্রশ্ন করে বসেছিল নর্মদা, ব্যগ্রকণ্ঠে।
কনক মিত্তির সামনের সীট থেকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে মৃদু কণ্ঠে বলেছিল, কিছু না। বাবা মাকে শুধু ছোট ছেলেমেয়েদের মত স্নেহ আর মমতা দিয়ে আরামে রেখে গেছেন, কখনো চিন্তা বা পরামর্শের ভাগ দেন নি।
ঠিক আমার মত। মনে মনে বলে উঠেছিল নর্মদা।
আর উচ্চারণে বলেছিল, তা হলে এখন কি হবে আপনার?
দেখা যাক। আমাদের পারিবারিক ডাক্তার আমার দূর সম্পর্কে জ্যাঠামশাই হন, মনে হয় তিনি কিছু জানেন। তাঁকেই ধরাধরি করছি। ভয় এই, জগতে কাউকে বিশ্বাস করা শক্ত।
তা যা বলেছেন। এতক্ষণে একটি কথা বলেন পালিত সাহেব।
আর এরপর থেকেই চুপ মেরে যায় কনক মিত্তির, নির্দিষ্ট জায়গায় এসে গাড়ি থেকে নেমে নমস্কার করে চলে যায়।
.
বাড়ি গিয়ে ফেটে পড়ে নর্মদা।
ভদ্রলোককে ওভাবে অপদস্থ করলে কেন?
পালিত সাহেব আকাশ থেকে পড়লেন, সে কি, সযত্নে গাড়িতে তুলে বাড়ি পৌঁছে দিলাম, অপদস্থ করলাম কখন?
করলে না? কি বলে বললে, পকেটে ছোরা আছে?
কী মুশকিল! আছে, এ কথা কখন বললাম? বললাম যে, থাকতে পারে।
ও একই কথা। তাছাড়া ভদ্রলোক যখন নিজের দুঃখের কথা বলছিল, একবারও একটু সহানুভূতি দেখালে না–
পালিত সাহেব হেসে উঠে বললেন, তাই নাকি, দেখাইনি বুঝি? তা, আমার ত্রুটিটা তুমি। পূরণ করে ফেললেই পারতে।
সেটা এমন কিছু শোভন হত না। কিন্তু আশ্চর্য, দরদ বস্তুটা তোমার মধ্যে এত কম!
পালিত সাহেব ফের হাসলেন। বললেন, খুবই স্বাভাবিক; কচি ডাবের মধ্যে জলের যে আধিক্য, ঝুনো নারকেলে তার অভাব। একটা লোক বিনা ভাড়ায় গাড়ি চড়তে পেয়ে যদি বিবেকের দংশনে কাতর হয়ে বেশ মজাদার কিছু গল্প শুনিয়ে দাম উসুল করতে চায়, তাতে কৌতুক অনুভব করতে পারি, দরদ জিনিসটাকে বাজে খরচ করব কেন?
তুমি তো ও জিনিসটা কোনখানেই বাজে খরচ করতে রাজী নও। কিন্তু গল্প কথাটার অর্থ কি?
গল্প কথাটার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে বানানো কাহিনী।
তার মানে ভদ্রলোক যা বললেন সব মিথ্যে?
বিলকুল।
এ সন্দেহের কারণ?
হাস্যকর কথা চিরদিনই অবিশ্বাস্য। আমি তো কষ্টে হাসি চাপছিলাম, ওর ওই ব্যাঙ্কের খাতা খুঁজে না পাওয়ার গল্পের সময়।
ওটা কি এতই অসম্ভব?
আমার তো তাই মনে হল। মা পর্যন্ত জানেন না। তাজ্জব!
হঠাৎ নর্মদা বিছানায় এলিয়ে পড়া শরীরকে খাড়া করে উঠে বসে বলে, তাজ্জব! কিন্তু কেন বল তো? ধর আজ রাত্রে তুমি যদি হঠাৎ হার্টফেল কর, আমার অবস্থা তার থেকে কিছু উঁচুদরের হবে?
কথা শুরু করলে শেষ করা ছাড়া গতি থাকে না, তাই শেষ করতে হল। আর শেষ করেই নর্মদা প্রায় লজ্জায় অধোবদন হল। এমন রূঢ় কথা বলে বসবার ইচ্ছে কি ছিল তার?
পালিত সাহেব কিন্তু রাগ দুঃখ অভিমান কিছুই করলেন না। শুধু মিনিট খানেক চুপ করে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, তা বটে। খুব জুৎসই কথাটা বলেছ, সত্যি। দেখ, খেয়াল নেই আমি নিজেই কত বেহুঁশ। একেই বলে প্রদীপের নীচেই অন্ধকার। লোকটার সঙ্গে আর যদি দেখা হয়, আমার বিশ্বাস হবেই, মার্জনা চেয়ে নিতে হবে।
নর্মদা লজ্জা কাটাতে জোর করে হেসে উঠে বলেছিল, হা, রোজ সে তোমার গাড়িতে চড়াও হতে আসবে।
পালিত সাহেব বলেছিলেন, গাড়িতে না হোক বাড়িতে হতে পারে। গাড়িটা চলন্ত, কিন্তু বাড়িটা তো অচল।
পালিত সাহেবের এ ভবিষ্যৎবাণী অবশ্য সেদিন বিশ্বাস করে নি নর্মদা, ভেবেছিল, হ্যাঁ তাই আর কি। জীবনে আর কখনোই হয়তো দেখা হবে না ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে।
কিন্তু দিনকয়েক পরেই লজ্জায় পুলকে বিস্ময়ে আনন্দে স্বীকার করতে হল নর্মদাকে, পালিত সাহেবের সংসার-জ্ঞান নর্মদার থেকে অনেক বেশি। নর্মদা তো স্বপ্নেও আশা করে নি, ভদ্রলোক আবার একদিন কষ্ট করে বাড়ি বয়ে আসবেন পুনশ্চ ধন্যবাদ দিতে।
কিন্তু এল সে।
তার নাম জানতে পারলেন নর্মদা। আর কয়েকদিন পরে এও জানলেন, পালিত সাহেবের শুধু যে সাংসারিক জ্ঞানই প্রবল, তা নয়। মনুষ্য চরিত্রেও প্রবল জ্ঞান।
কারণ কনক মিত্তিরই একদিন নিভৃতে হৃদয় উজাড় করে ধরল নর্মদার কাছে। বলল, সেদিন যা বলেছে তার আগাগোড়াই মিথ্যা, বানানো।
ব্যাঙ্কের যে খাতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে আর কোনদিনই পাওয়া যাবে না। কারণ তার বাবার মৃত্যু হয়েছে অকস্মাৎ ব্যবসা ফেল হয়ে যাওয়ার দুরন্ত আঘাতে।
যেখানে যা ছিল সবকিছু নীলাম করেও পাওনাদারদের পাওনা সম্পূর্ণ মেটে নি, মায়ের গহনা বিক্রি করে পিতৃঋণ শোধ করতে হয়েছে তাকে।
তুলোর গদি থেকে একেবারে নিষ্ঠুর পৃথিবীর কাকরের পথে নামতে হয়েছে কনককে।
কিন্তু জগতের সামনে তার সেই নিঃস্ব চেহারা দেখাতে মাথা কাটা যায় কনকের। তাই খেয়ে না খেয়ে, ভাল পোশাক পরে বেড়ায় সে। বেড়ায় মুখে এক আভিজাত্যের খোলস এঁটে। বেড়ায় এই আশা নিয়ে যে কোন একদিন যদি সেই হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারে।
সকলের কাছেই তার অভিনয়, নয় শুধু নর্মদার কাছে। প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকে নর্মদা তার কাছে দেখা দিয়েছে দেবীর মূর্তিতে।
বলতে বলতে চুপ করেছিল কনক মিত্তির।
নর্মদা ওর হাত চেপে ধরেছিল।
বলেছিল, আমায় যেমন তোমার বেদনার ভাগ দিলে, তেমনি ভাগ দাও তোমার অভাবের, অসুবিধের।
পাগলামি করতে নেই। বলেছিল কনক।
নর্মদা কিন্তু পাগলের জেদেই বলেছিল, কেন নেই? আমি বড়লোকের বৌ, কত টাকা আমার। হাত-খরচ করতে আলাদা কত টাকা পাই, সে টাকা যদি আমি ভালবেসে তোমায় দিই, দিয়ে ধন্য হই, কেন তাতে বাধা দেবে তুমি? তোমার পায়ে পড়ি কনক, এটুকু আমায় করতে দাও। জীবনের এতগুলো বছর যা খুঁজে বেড়িয়েছি, পাই নি, তুমি দিয়েছ তার আস্বাদ। তুমি তোমার দ্বিধাহীন মনকে মেলে ধরেছ আমার সামনে। এর মূল্যটুকুও অন্তত দিতে দাও আমায়। আর্থিক মূল্য বলে ভুল করো না। এ আমার দিয়ে ধন্য হবার সুখ, তোমাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করার সুখ।
এমনি অনেক ভাল ভাল কথা বলেছিল নর্মদা আর হৃদয়কে দিয়েছিল সম্পূর্ণ বিকিয়ে।
কাবেরী তখন দোলনার শিশু।
তারপর নর্মদা আর কনকের সেই অন্তরালবর্তী প্রেম, নানান পরিবেশের দোলায় দুলতে দুলতে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিল সে হিসেব কে রেখেছে।
শুধু হেনা ক্রমশ এ বাড়িতে আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল।
নর্মদা কোনদিন হেনার অনুপস্থিতির কারণ খুঁজতে যায় নি। বরং হেনার ওই গরীবীয়ানা চালের কঠিন-কঠিন মুখ দেখলেই রাগে হাড় জ্বলে যেত তার বলে, অনুপস্থিতিটা বেশ আরামেরই মনে করত। দৈবাৎ কোনদিন হেনা এলেও অপদস্থ করবার ফিকির খুঁজত।
হয়তো এও অবচেতন মনের একটা জটিল ব্যাখ্যা। যদিও নর্মদা মনে করত জগতের কেউ কনকের প্রতি তার সুগভীর ভালবাসার খবর টের পায় না, এবং টের না পাবার জন্যে, যত পারত সহজ সহজ কথা বলত কনকের সঙ্গে, আর যত সম্ভব সহজ ব্যবহার করত। তবু কোথায় কোনখানে যেন এ সন্দেহ কাঁটার মত ফুটত, হেনা বোধহয় বুঝতে পারে। হেনাটা ভারি চতুর। হেনার দৃষ্টি বড় তীক্ষ্ণ। হেনা যত না আসে ততই ভাল।
.
নির্বোধ নর্মদা স্বপ্নেও কি ভাবত দাসী-চাকর মহলে মেমসাহেবের আচার আচরণ একটা খোস গল্পের খোরাক, পালিত সাহেব স্ত্রীর সম্পর্কে আর কোন আশা পোষণ করেন না, আর তার সেই দোলনার শিশুটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার বন্ধুকে ভয়ঙ্কর ভালবাসতে বাসতে কোন এক অশুভ মুহূর্ত থেকে ভয়ঙ্কর রকমের ঘৃণা করতে শিখেছে।
স্বামীর কাছে দামী হবার জন্যে সেই হাস্যকর চেষ্টার নেশাটা নর্মদার ধীরে ধীরে কখন যে কমে এসেছিল, সেকথা নিজেই জানে না সে।
ক্রমশ আর এক নতুন নেশা জেগেছিল তার, সেটা হচ্ছে কারণে অকারণে বাড়িতে পার্টি দেওয়া। হ্যাঁ, পার্টি শব্দটাই পছন্দ করত নর্মদা। নিতান্ত দু-চারজন বন্ধুকে বাড়িতে ডাকলেও বলত পার্টি দিচ্ছি।
অবশ্য মাঝে মাঝে সমারোহও করত।
আরও একটা কাজ করত সে। সেটা হচ্ছে আক্ষেপ। স্বামী-কন্যা, চাকর-বাকর আর স্বাস্থ্য, এইগুলি হচ্ছে তার আক্ষেপের বস্তু। অনেক সময় এমনও মনে হত, এই আপেক্ষগুলি প্রকাশ করবার জন্যেই বুঝি এত লোককে বাড়িতে ডাকে সে।
হয়তো এও মনস্তত্ত্বের আর এক তত্ত্ব।
হয়তো কোথাও কোনখানে সূক্ষ্ম কোন অপরাধবোধ পীড়িত করত তাকে, হয়তো এই আশঙ্কা মনের গভীরতর স্তর থেকে ঠেলা মারত, আমাকে কেউ কিছু মনে করছে না তো?
যদি কিছু মনে করে? দি নর্মদার নাম নিয়ে হাসাহাসি করে? তার থেকে সর্বদা ওদের সবাইকে পরিপাটি ভোজে পরিতুষ্ট করো, আর নিজে সে কত দুঃখী, কত বেচারী, কত বঞ্চিত, সংসার-জ্বালায় কত জর্জরিত তার ফিরিস্তি দিয়ে দিয়ে আদায় করো সহানুভূতি আর সমবেদনা।
কিন্তু এত কথা ভেবেই কি এসব করত নর্মদা?
বোধহয় নয়। হয়তো এ শুধু অবচেতন মনের কারসাজি।
নইলে নিজেকে তো সে ভালই প্রবোধ দিয়ে রেখেছিল, আমি তো স্বামীর কাছে অবিশ্বাসিনী হচ্ছি না, আমি তো কোন পাপ করছি না।
মানুষ কী তার বন্ধুকে ভালবাসে না? ভালবাসে না দেবতাকে?
স্বামীর সংসার ভাসিয়ে দিয়ে আমি তো কোথাও চলে যাই নি? ওর কি বন্ধু-বান্ধব নেই? ও তাদের সঙ্গে গল্প করে না? আড্ডা দেয় না? তাদের জন্যে আকর্ষণ অনুভব করে না? একদিন ক্লাবে যাওয়া বন্ধ হলে ছটফট করে না?
তবে?
আমি যদি আমার কোন বন্ধুকে ভালবাসি, দোষ কোথায়?
কনক মিত্তির আর পার্টি–এই দুই নেশায় দুই-চক্ষু-অন্ধ নর্মদা ভুলে নিশ্চিন্ত ছিল যে দুনিয়াটা চক্ষুম্মান।
তবে এ সবই গোড়ার দিকের ব্যাপার।
ধীরে ধীরে নর্মদা থেকে মিসেস পালিত হয়ে উঠেছেন তিনি আর ক্রমশ বোধকরি কোনকিছু ভাবতেই ভুলে গিয়েছিলেন। সবকিছুই মজ্জাগত একটা অভ্যাসের মত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সেই অভ্যাসের বশেই দৈবাৎ যদি কোন সন্ধ্যায় কনক না আসত, রাত নটায় টেলিফোনের রিসিভার হাতে তুলে নিতেন মিসেস পালিত, গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে বলতেন, হা, আমি মিসেস পালিত কথা বলছি। এলে না কেন আজ? কী রকম রেগে গেছি তা বুঝতে পারছ না বুঝি? আচ্ছা, কাল এসো না-বুঝিয়ে ছাড়ব।
ওদিক থেকে আলস্য-বিজড়িত কণ্ঠ ভেসে আসত, পারলাম না আজ। শরীরটা কেমন একটু–না না, তা বলে যেন সক্কালবেলাই তল্লাস নিতে ছুটে এস না। যাব, যথানির্দিষ্ট সময়ে যাব। আশ্চর্য, এই জন্য এত রাত্রে! ও হো হো, তা বটে। আচ্ছা। আচ্ছা ছাড়লাম।
কনকের তাহলে নিজের টেলিফোন আছে! আসলে কনক কি তাহলে অবস্থাপন্ন?
নিজের সম্পর্কে যা কিছু সে বলেছে, তার কোনটাই খাঁটি নয়? তাই তার কথায় আর কাজে সামঞ্জস্যের অভাব?
না, তা নয়। ওর অবস্থা গড়ে দিয়েছেন মিসেস পালিতই। একদা ও যখন এসে বলেছিল ওর সেই রুগ্ন মা মারা গেছেন, আর বন্ধক দেওয়া বাড়িখানাও বিক্রি করতে হচ্ছে মায়ের শ্রাদ্ধ করতে তখন ব্যাকুল হয়ে ওর বাড়িতে যেতে চেয়েছিলেন মিসেস পালিত, যদি কোনরকমে সেটা রক্ষা করা সম্ভব হয়, তাই দেখতে। বলেছিলেন, আমরাও তো কিনে নিতে পারি কনক, একটা প্রপার্টি হিসেবে। তারপর না হয় তোমাকেই ভাড়াটে রাখব।
ভাড়াটে কথাটা বলে অবশ্য হেসেছিলেন।
কিন্তু কনক কিছুতেই নর্মদাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে রাজী হয় নি। বলেছিল, না, ওসব পুরোনো স্মৃতি ধুয়ে মুছে শেষ হোক। মার জন্যেই বাড়িটা ছাড়তে পারতাম না। এখন আর কি। মুক্ত জীবন। না না, তোমাকে আমি সেখানে নিয়ে যেতে পারব না, সেই আমার দুঃখের মধ্যে, দৈন্যের মধ্যে।
কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই তো ভালবাসার আসন কনক।
না না। ওটা আমার থিওরি নয়। আমি বুঝি, নেহাৎ গরীব লোকও যখন বিগ্রহের সেবা করে, আয়োজন করে যোড়শোপচারে।
অতএব কনকের বাড়ি মিসেস পালিতের আর দেখা হয় নি, প্রপার্টি হিসেবে কিনে রক্ষা করাও হয়নি। মাতৃ-শ্রাদ্ধের হাঙ্গামা মিটে যাবার পর মুক্তপুরুষ কনক মিত্তিরকে তিনি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন শহরের একটি ভাল হোটেলে। সেখানেই ছিল কনক মিত্তির, অর্থাৎ তিন বছর আগের সেই দিনটি পর্যন্ত ছিল।
কাজেই টেলিফোনও তার করায়ত্ত ছিল।
কিও এত টাকা কি শুধু নিজের খরচের টাকা থেকে জোগানো সম্ভব হত মিসেস পালিতের? কারণ সর্ব তোমার–এভাবে তো কখনো সবকিছু উজাড় করে দিতে অভ্যস্ত ছিলেন না পালিত সাহেব। তিনি স্ত্রীকে সংসার খরচ দিতেন, মোটা অঙ্কে হাত খরচ দিতেন, আর মাঝে মাঝে বাড়তি খরচ দিতেন, স্ত্রীর পার্টির সাধ বাবদ। সর্বস্ব তুলে দিতেন না। তার থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে অতটা পর্যন্ত হয় না।
অতএব মিসেস পালিতকে মাঝে মাঝেই লুকিয়ে বেচতে হত সোনার গহনা, রূপোর বাসন, এটা-ওটা-সেটা।
বড়লোকের স্ত্রীরা এমন অনেক করে থাকেন, কাজেই যেসব দোকানে এ ব্যাপার সংঘটিত হত, সেখানে খুব বেশি আশ্চর্য কেউ হত না, এবং ব্যাপারটা গোপন রাখার ব্যাপারে সততা রক্ষা করেই চলত।
এসব সময় ড্রাইভারকেও সাক্ষী রাখতে চাইতেন না মিসেস পালিত। নিজে শখের ভান করে একা ড্রাইভ করে বেড়াতে বেরোতেন।
না, কনককেও কোনদিন জানতে দেন নি এ টাকার উৎস কোথায়।
তবে ইদানীং একটু মুশকিল হয়েছিল এই পালিত সাহেব নানা উপলক্ষে স্ত্রীকে যে সব অলঙ্কার দিচ্ছিলেন সেগুলো আর সোনার হচ্ছিল না। সবই জড়োয়া। ফ্যাসান আর চাল বেড়ে গিয়েছিল পালিত সাহেবের। বলতেন, সোনা? সোনা সভ্যসমাজে অচল। সোনার গহনা পরবে কেরানীর স্ত্রী। তোমার প্রেস্টিজের জন্যে হীরে-মুক্তো-চুনী-পান্না এসব দরকার।
কিন্তু নর্মদার দরকার যে তাতে মেটে না। ওসব জিনিস ট করে বিক্রি করা যায় না। বিক্রি করতে নিয়ে যেতে সাহসও হয় না!
কাজেই ইদানীং স্বামীকে বাজারদরের অগ্নিমূল্য আর চাকরবাকরের পুকুরচুরির গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে মাঝে মাঝেই বাড়তি টাকা আদায় করতে হত মিসেস পালিতকে।
কনক মিত্তিরের নৈবেদ্য ঠিকই বজায় থাকত, যে নৈবেদ্য গ্রাস করে দিব্যি এক অদ্ভুত জীবন যাপন করত কনক মিত্তির। না, বিয়ের চিন্তা সে কোনদিন করে নি, নিজের কোন সংসার পাতবার স্বপ্নও দেখে নি। আরামে জীবন কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া উচ্চতর কোন লক্ষ্যও দেখা যেত না তার মধ্যে। সে পালিত সাহেবের টাকায় আমীরি চালে থাকত, পালিত সাহেবের চাইতেও দামী পোশাক পরত, আর পালিত সাহেবকেই নস্যাৎ করার ভঙ্গীতে ব্যঙ্গহাসির তীক্ষ্ণ ছুরি ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দিয়ে তারই বাড়িতে এসে বসে থাকত কায়দা করে।
মিসেস পালিতের অতিথি অভ্যাগতেরা কনক মিত্তিরকে ভিতরে ভিতরে যে দৃষ্টিতে দেখুক, সামনে পরম সমীহের দৃষ্টিতে দেখত।
আর কনক মিত্তির ওদের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকত, যেন হে ঈশ্বর, কী গতি হবে এদের, এই সব বোকা মুখ গ্রাম্যদের! হ্যাঁ, দৃষ্টিতে এমনি একটি বিশেষ ভঙ্গীই কনক মিত্তিরের আত্মরক্ষার বর্ম ছিল।
মিসেস পালিত মোহিত হতেন ওই দৃষ্টিতে। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন ওই দৃষ্টির দিকে। কারণ ওই বিশ্বনস্যাৎ দৃষ্টিটার মধ্য দিয়েই যেন কনক মিত্তিরের চেহারার জৌলুস বাড়ত, আকর্ষণ বাড়ত।
এইভাবেই চলছিল। চলে আসছিল।
যেন চন্দ্র সূর্যের অমোঘ নিয়মের মত! এর আর ব্যতিক্রম নেই। একটা দোলনার শিশু যে আস্তে আস্তে কিশোরী হয়ে উঠল, একটি তন্বী তরুণী যে তন্বীত্ব হারিয়ে ভার-ভারিক্কি মহিলা হয়ে উঠল, এসব ঘটনা এই নিয়মের উপর ছায়াপাত করল না। দীর্ঘ বারো তেরোটি বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল যেন।
তারপর এল সেই সন্ধ্যা।
কাবেরীর ত্রয়োদশ জন্মদিনের সেই সন্ধ্যা।
যে সন্ধ্যার কিছুদিন আগে থেকেই কনক মিত্তির বিদায় রাগিণী গাইতে শুরু করেছিল।
অনবরত নিভৃতে জানাচ্ছিল সে মিসেস পালিতের কাছে, এমন করে আর পারছে না সে। ধিক্কার এসেছে এ জীবনে।
এতদিন ধরে ভেবে এসেছিল আবার বাপের মত বিজনেস করে হৃত-গৌরব ফিরিয়ে আনবে, এই গ্লানির ভার থেকে মুক্ত হবে। কিন্তু এখন ক্রমশ বুঝছে সে ক্ষমতা তার নেই।
এই অক্ষমতার সত্য ধরা পড়ে গেছে তার নিজের কাছে।
অতএব সাধারণ একটা চাকরী-বাকরী জোগাড় করে চলে যেতে চায় সে। কলকাতা থেকে দূরে, পরিচিত জগৎ থেকে দূরে।
সেখানে একেবারে সহজ সরল মধ্যবিত্তের জীবনে থাকবে কনক মিত্তির, তার ধার করা পরিচয় ছেড়ে।
মিসেস পালিত ছল ছল চোখ তুলে বলতেন, পারবে?
পারতেই হবে।
আমি কি করে থাকব, তা ভাববে না?
ভাবতে গেলে পারব না। নিতান্ত প্রিয়জনও তো মারা যায় লোকের, এই ভেবে তোমাকে আর নিজেকে সান্ত্বনা দেব।
এত করবে, আর কলকাতায় থেকেই ভাগ্যকে ফেরানো যায় কি না সে চেষ্টা করবে না?
জানি ওটা হবে না।
মিসেস পালিত বলতেন, সারাদিন কি তুমি কর তুমিই জানো। কিন্তু তেমন করে চেষ্টা কোনদিন করলে না।
তখন কনক মিত্তির হেসে উঠত।
বলত, তেমন চেষ্টা করতে যেমন মূলধনের দরকার, সে আর তোমার ওই পকেট-মানিতে কুলোবে না মিসেস।
কে বলেছে?
সাধারণ বুদ্ধিই বলছে। তবে যদি, হেসে উঠত কনক, পালিত সাহেবকে বলল, তোমার ভাঁড়ারের সেরা রত্নটিই তো মিত্তিরকে দান করে বসে আছ, এবার ব্যাঙ্কের পাশ বইটাও তাকে দান করে ফেলল, তাহলে হয়তো
মিসেস পালিত বলতেন, তা বলে আমার ভাড়ার এখনো অত দুঃস্থ হয়ে যায়নি যে ওর ভাঁড়ারের দরজায় ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে দাঁড়াতে হবে।
হ্যাঁ, এই কথাই সেদিন বলেছিলেন মিসেস পালিত।
কিন্তু কোন সাহসেই যে বলেছিলেন!
অবিরাম গতিতে আর অবিরল ধারে অর্থোৎসর্গ করতে করতে ভিতরে ভিতরে যে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, এ কি জানতেন না? না বুঝতে পারতেন না?
শেষ সম্বল ছিল তো শুধু ওই জুয়েলারীগুলো!
তা সেই সম্বল ভেঙেই শেষরক্ষা করতে গিয়েছিলেন মিসেস পালিত।
কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
.
সেই শেষ সম্বলের নৈবেদ্য সহজভাবে গ্রহণ করে, পরদিন আবার সহজভাবে এ বাড়িতে এসে উদয় হল না কনক মিত্তির, সেই তার ব্যঙ্গ হাসির বর্মটি পরে।
ভয় পেয়ে উধাও হয়ে গেল।
একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেল।
একদিন আধদিন নয়, দীর্ঘ তিনটি বছর।
সমস্ত পরিকল্পনা ফেঁসে গেল মিসেস পালিতের। কী বললেন? কনক? কনক একাজ করেছে? নিজের চোখে দেখেছেন আপনি? হতে পারে না। বলে দৃঢ় প্রতিবাদে কনক মিত্তিরের নির্দোষিতা প্রমাণ করবার আর কোন উপায় তার হাতে রইল না।
মিসেস পালিতের অন্তর-জীবনের কথা থাক, বহির্জীবনেও দীর্ঘ একটা কলঙ্কের রেখা টেনে দিয়ে যে লোকটা বিদায় নিল, সে বেঁচে রইল কি মারা গেল তাও জানতে পারলেন না তিনি।
আশ্চর্য মানুষের মন!
যাকে একদিন মাত্র না দেখে থাকতে পারতেন না মিসেস পালিত, হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে তার মৃত্যু-সংবাদ কামনা করতে থাকলেন তিনি। অনেক দিন যাবৎ এ সংবাদ কামনা করেছেন মিসেস পালিত। খবর আসুক, নয়তো খবরের কাগজে খবর উঠুক–কনক মিত্তির নামক এক ব্যক্তি অমুক দিন ট্রেনের তলায় অথবা অজ্ঞাত ব্যক্তির দুর্ঘটনায় মৃত্যু! অমুক দিন অমুক সময়। তাহার সঙ্গের কাগজ-পত্রে জানা যায় লোকটির নাম–
প্রেমাস্পদের মৃত্যুর মূল্যে প্রেমাস্পদের সুনাম রক্ষা করতে চেয়েছিলেন মিসেস পালিত।
তা হল না।
কিন্তু যে লোক এতবড় একটা কলঙ্কের ছাপ মেখে বিদায় নিল, তার জন্য শোক করা যায়, অধীর হওয়া যায় না, ভেঙে পড়া চলে না।
মিসেস পালিতকে তার নিজের পরিচয়ে অটুট থাকতে হবে। এ এক ভয়ঙ্কর দায়।
এই দায়ের দায়েই তিল তিল করে নিঃস্ব হয়েছেন মিসেস পালিত, নিশ্চিন্ততার সহস্র উপকরণ মজুত থাকতেও দুঃসহ চিন্তার যন্ত্রণায় দিনে দিনে ক্ষয়িত হয়েছেন, অনবরত মিথ্যার জাল বুনে বুনে এক মিথ্যাময়ী হয়ে উঠেছেন, তবু পারেন নি এ দায় মুক্ত হয়ে পালিয়ে যেতে, অন্য নতুন পরিচয়ের মধ্যে নিজেকে সার্থক করে তুলতে।
সেই কিশোর কাল থেকে একখানি নির্ভেজাল খাঁটি ভালবাসার প্রাণ খুঁজতে খুঁজতে নিজেই তিনি বিলকুল ভেজাল হয়ে গেছেন, এ বোধ যে আসেনি মিসেস পালিতের নিজের মধ্যে তার একমাত্র কারণ ওই বাইরের পরিচয়ের ঠাট।
এ ঠাট বজায় রাখা চাই।
সেই ঠাট বজায় রাখতে কনক নামটাকে এ বাড়ি থেকে মুছে ফেলে নতুন করে হৈ হৈ-তে মেতে উঠলেন মিসেস পালিত। পার্টি দেওয়ায় কমতি হল না, এবং বিষণ্ণ বেদনার কোন ছায়াকে মুখের ধারে কাছে আসতে দিলেন না।
আর কিছুদিন পর থেকেই কাবেরীর গানের মাস্টারকে নিয়ে মাতলেন। তার সঙ্গে নিত্য গান শুনতে যাওয়া, অকারণ গল্প।
না, কেউ যেন না বোঝে কনক তার কেউ ছিল।
কনককে মিসেস পালিত কলকাতা ছেড়ে যেতে পায়ে ধরে নিষেধ করেছিলেন, কলকাতায় থাকার রসদ জোগাতে ধরে দিয়েছিলেন রত্নাভরণের সম্ভার, তবু সত্যিই কি ভেবেছিলেন তিনি, কনক নিশ্চয় ফিরে আসবে?
কনকের পশ্চাৎপট কি সে আশ্বাস দিয়েছিল মিসেস পালিতকে?
মূৰ্ছার অবকাশে অতীতের সমস্ত কথা ভেবে নিলেন মিসেস পালিত।
.
কিন্তু অনির্দিষ্ট কাল ধরে মূছাহত হয়ে পড়ে থাকা যায় না। চোখ মেলতে হল মিসেস পালিতকে।
বলতে হল, জল খাব।
বীথিকা তার স্বামীর কাছে সেই সুরের নকল করে হেসে উঠল। বলল, স্রেফ নাটকের নায়িকার মূৰ্ছাভঙ্গ। সোজা কথা নয়, সাতদিক থেকে সাত গ্লাস জল এল, তিনি এক চুমুক জল খেয়ে ক্ষীণভাবে বললেন, কনক, তোমাকে কে ডেকেছে?
কেউ না। আমি নিজেই এসেছি। বলল কনক মিত্তির।
নর্মদা বলল, এতদিন কোথায় ছিলে? খোঁজ নেই, খবর নেই, জানো তোমার এই হঠাৎ নিরুদ্দেশের ব্যাপার দেখে যে খুশি তোমার নামে রটিয়েছে। কেউ বলেছে চোর, কেউ বলেছে ডাকাত-গুণ্ডা-খুনে
যাক, আমার সম্বন্ধে লোকের ধারণাটা নির্ভুল দেখে খুশিই হচ্ছি। বলে হাসল কনক মিত্তির।
ভাবতে পারো? বীথিকা বলল, আরও হেসে আরও কি বলল জানো? না, সে তুমি স্বপ্নেও ধারণা করতে পারবে না।
বীথিকার স্বামী বিকাশ বলল, অনেক সত্যি কথাই আমাদের ধারণার অতীত। কি বলল তোমাদের হারানো মানিক?
যা বলল, সে শুনে আমাদের হাত-পা এলিয়ে এল। উঃ, ভাবা যায় না, এত নির্লজ্জ মানুষ হয়।
তোমার কথায় গৌরচন্দ্রিকাটা বেশি, বলল বিকাশ।
বীথিকা বলে উঠল, গৌর থাকলেই চন্দ্রিকা থাকবে। কী বলল শুনবে? বলল, তোমাকে বেঁধে রেখে তোমার জুয়েলারিগুলো যখন নিয়ে গেলাম, ভাবিনি যে আবার ফিরে আসব। কিন্তু
কথা শেষ হল না, ওর ওই স্বীকারোক্তির সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে যেন একটা চাঞ্চল্যের ঢেউ বয়ে গেল।
পালিত সাহেবের ভাইপো অশোক দাঁড়িয়ে উঠে লোকটার জামার কলার চেপে ধরতে যায় আর কি।
আশ্চর্য, একটু বিচলিত হল না লোকটা। বরং একটু হেসে বলল, থাক মাস্টার পালিত, নিজেই যখন ঘাড়টা নিয়ে হাজির হয়েছি তখন ওতে কোপ বসাবার জন্যে আপনাকে জামার কলার চেপে ধরতে হবে না।
পুলিশে দেওয়া হবে আপনাকে।
ফোড়ন কেটে উঠলেন মিস্টার রাহা : এতদিন পরে, রসদ ফুরিয়ে গেছে বলে আবার বুঝি এ বাড়িতে মাথা গলাতে চান নির্দোষী দার্শনিকের ভূমিকা নিয়ে! মিস্টার পালিত, আপনি এখনো কি করে নিশ্চেষ্ট হয়ে রয়েছেন? আশ্চর্য! এখনো একে পুলিশ ডেকে অ্যারেস্ট করাতে ইতস্তত করছেন? ধন্য আপনার ভদ্রতা আর ধৈর্য।
আমরা অবশ্য ভাবলাম, বীথিকা বলে, মিস্টার রাহার এত ফড়ফড়ানির দরকার কি? কিন্তু এও না ভেবে পারিনি, সত্যি, ধন্য মিস্টার পালিতের ধৈর্য আর ভদ্রতা। লোকটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তো বাঘের মত লাফিয়ে পড়ে ওর টুটি চেপে ধরা উচিত ছিল। আশ্চর্য যে, এর পরেও সে ধৈর্য তাঁর অটুট রইল। আর কনক মিত্তিরকে অগ্রাহ্য করে তখন গিন্নীকে সাবধান করতে লাগলেন, এসব বিশ্রী গোলমালের মধ্য থেকে সরে গিয়ে ওঘরে বিশ্রাম নিতে পারলেই তোমার ভাল হত নর্মদা। নানা কথার চাপে আবার হয়তো ফেন্ট হয়ে পড়বে তুমি।
কিন্তু নর্মদা মুখপুড়ি এত আদরের মর্যাদা উড়িয়ে দিয়ে সেই চোরটার দিকেই তাকিয়ে বলল, তুমি এখানে এলে কেন আবার? যাও, চলে যাও, আমি বলছি এখনই চলে যাও।
যাব, এখনই চলে যাব, শুধু
বলতে না বলতে মিস্টার রাহা আবার সর্দারী করে বলে উঠলেন, মাপ করবেন আমাকে মিস্টার মিত্তির, পালাবার চেষ্টা করলে বিপদে পড়বেন।
কনক মিত্তির কেমন যেন বিষণ্ণ হেসে বলল, আপনি তো দেখছি বড্ড রগচটা, পালাবার মতলব থাকলে আসব কেন? তবে আপনি বৃথা ব্যস্ত হচ্ছেন, মিস্টার পালিত পুলিশ ডাকবেন না।
ডাকবেন না! অনেকগুলো গলা একসঙ্গে বেজে উঠল।
কনক মিত্তির তেমনি হেসে বলল, না ডাকবেন না। সে ইচ্ছে থাকলে উনি তখনই ওয়ারেন্ট বার করে ধরে এনে ফাঁসি দিতেন আমায়। কী বলেন মিস্টার পালিত, তাই না? এই তিন তিন বছর অপেক্ষা করে বসে থাকতেন কি, আসামী কবে নিজে বামালসুদ্ধ এসে ধরা দেবে এই আশায়?
এই সময় নর্মদা হঠাৎ ঠিকরে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ঠিক আছে, আমিই তোমায় পুলিশে দেব। এতই যখন সাহস তোমার।
বিকাশ হেসে উঠে বলে, বাঃ, এ যে সত্যই রীতিমত একখানি নাটকের দৃশ্য।
হ্যাঁ, একেবারে ক্লাইম্যাক্স। কিন্তু এখনই শেষ হয়নি, আরও বাকি আছে। নর্মদা যেই টেলিফোনের কাছে যেতে গেছে, কাবেরীটা কোথা থেকে ছুটে এসে ওর সেই আহ্লাদে গলা ত্যাগ করে ভীষণ স্বরে বলে উঠল, বেশি বাড়াবাড়ি করো না মা। পুলিশ ডাকলে সত্যি কথা প্রকাশ পেয়ে যেতে দেরি হবে না তা মনে রেখো। আমিই দেব তাহলে সাক্ষী। আমি সব জানি। আমি সব দেখেছি।
নর্মদা পাঙাস মুখে বলল, সত্যি কথা? কী সত্যি কথা প্রকাশ হবে শুনি? কী তুই দেখেছিস? কী তুই জানিস?
বিকাশ হেসে উঠে বলে, আশ্চর্য বটে বীথিকা, এত সব হচ্ছে আর তোমরা সবাই চুপচাপ . বসে আছ?
তা থাকব না তো কী? বীথিকা বলে, আমরা তো চিত্রার্পিত পুত্তলিকাবৎ রঙ্গমঞ্চের অভিনয় দেখছি।
.
তা বীথিকা কথাটায় বিশেষ কিছু রং চড়ায়নি।
বাস্তবিকই তখন পালিত সাহেবের সেই ড্রয়িংরুমে প্রায় সকলেই চিত্রার্পিত পুত্তলিকাবৎ বসেছিল এক রঙ্গমঞ্চের সামনে।
মেয়ের এই অতর্কিত আক্রমণে মিসেস পালিত যখন পাঙাস মুখে বললেন, কী সত্যিকথা প্রকাশ হয়ে পড়বে? তখনও পালিত সাহেব একটা অগ্নিগর্ভ দৃষ্টি মেলে বসে রইলেন নির্বাক নিষ্কম্প। কথা কইলেন না। বোধকরি কথা থেকে কথা সৃষ্টি এই ভেবেই নীরবতা শ্রেয় মনে করলেন তিনি।
আর উপস্থিত সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে কনক মিত্তির রীতিমত হেসে উঠে বলে উঠল, বাঃ, এই কবছরে কাবেরী তো মস্ত লায়েক হয়ে উঠেছ দেখছি? অনেক কথা শিখেছ। কিন্তু কোন্ সত্যিটা প্রকাশ হয়ে পড়বার ভয়ে তুমি পুলিশ আসা আটকাচ্ছ বল তো? তোমার জানা সেদিনের সেই সত্যি কথাটা ছাড়া, আর একটা ভয়ঙ্কর সত্যি কথাও যে এই জুয়েলারিগুলোর মধ্যে গাঁথা আছে কাবেরী, সেটা জান না কি? বড় দুঃখিত নর্মদা সে সেই ভয়ঙ্কর সত্যিকথা এই ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। বিশ্বাস করো, ঠিক এ ইচ্ছে আমার ছিল না। ভেবেছিলাম তোমার জিনিস তোমাকে ফেরৎ দিয়ে, শুধু নেবার অক্ষমতা জানিয়ে ফিরে যাব। আর এও জানতাম নির্বিঘ্নেই যেতে পারব। কারণ পালিত সাহেব এত বুদ্ধিহীন নন যে এ নিয়ে হৈ-চৈ করবেন। কিন্তু
হঠাৎ এতক্ষণের স্তব্ধতা ভেঙে পালিত সাহেব গর্জন করে ওঠেন, চুপ।
কনক হঠাৎ ওর ঠোঁটের কোণে সেই পুরনো ব্যঙ্গের হাসি টেনে বলে, চুপ এখুনি আপনি আমায় করিয়ে দিতে পারেন পালিত সাহেব, চিরদিনের মতই কণ্ঠরোধ করে দিতে পারেন, কারণ পুলিশের কণ্ঠরোধ করে ফেলবার মত পয়সা আপনার আছে। জানি, তবু জানি, এ সবের কিছুই করবেন না আপনি। সাহস থাকলে অনেকদিন আগেই পারতেন আমার কণ্ঠরোধ করে ফেলতে। কিন্তু সে সাহস আপনার নেই। থাকে না আপনাদের মত বড়লোকদের। সমাজে মাথা উঁচু করে দশের একজন হয়ে থাকবার মোহে আপনারা না করতে পারেন এমন নীচ কাজ নেই। আপনার জন্যে, আপনাদের মত এই হতভাগ্যদের জন্যে আমার ভারি দুঃখ হয় মিস্টার পালিত, যারা সামাজিক সুনামে কালি পড়বার ভয়ে স্ত্রীর প্রেমিকের আধিপত্য সহ্য করে চলে, তাকে খাইয়ে পরিয়ে গোকুলে বাড়তে দেয়। কিন্তু আজ আর অস্বীকার করব না, আপনার স্ত্রী এতদিন আমায় যা ভেবে এসেছেন, আমি তা নই। প্রেমটা আমার ছল। আমি একজন পাকা জুয়াচোর, আমার নাম, আমার পরিচয় সবই ভূয়ো। হ্যাঁ, এই দীর্ঘদিন ধরে তোমায় আমি ঠকিয়ে এসেছি নর্মদা, তোমাকে ঠকিয়ে খেয়েই আমার জীবনের অনেকগুলো দিন আরামে কেটেছে। ওই আমার পেশা। অবিশ্যি এমন আরামের দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা আর কখনো জোটেনি।
কিন্তু ঠকাতে ঠকাতে কখন যে পালা বদল হতে শুরু করেছিল টের পাইনি। টের পেলাম তোমার এই অলঙ্কারের মধ্যেকার করুণ প্রহসন দেখে। দেখে পর্যন্ত অদ্ভুত এক মমতায় মনটা গলে যেতে লাগল। নিজের উপর ধিক্কার এসে গেল। ভাবলাম, ছি ছি, এত দিন ধরে আমি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে এসেছি! এই যে কাবেরী, চলে যেও না, সেই দ্বিতীয় সত্যটি দেখে যাও বলেই হাতের সেই রংচটা অ্যাটাচিটা হাতের চাপে খুলে ধরে কনক মিত্তির।
সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে হাঁ হয়ে যায় সবাই।
সীলিং জোড়া আলোয় ভর্তি ঘরে বাক্সভর্তি গহনাগুলো যেন ঝকমকিয়ে ঝলসে ওঠে।
খুব ঝকমক করছে, না? কনক মিত্তির বিষণ্ণ ব্যঙ্গের হাসি হাসে। এগুলো হচ্ছে ঠিক তোমার বাবার সামাজিক প্রতিষ্ঠার মত। মূল্য নেই, শুধু চকমকানি আছে। আপনার নির্বোধ স্ত্রীকে ঝুটো কাঁচের গহনাগুলো দিয়ে ভোলাতে পেরেছিলেন পালিত সাহেব, কিন্তু জহুরীদের চোখকে ভোলানো গেল না।
ঝুটো! আবার অনেকগুলো কণ্ঠ একসঙ্গে ধ্বনিত হয়।
হয়তো সে ধ্বনির মধ্যে বিস্ময় ছাড়াও রাগ ক্ষোভ অপমানের জ্বালাও আছে। প্রতারিত হয়েছে কি শুধু পালিত সাহেবের নির্বোধ স্ত্রী? তারা প্রতারিত হয়নি? কোনও উপলক্ষে যখন মিসেস পালিতের অঙ্গে এই চোখ ঝলসানো গহনাগুলো দেখেছে তারা, তখন কি অভিভূত বিস্ময়ে পালিত সাহেবের টাকার অঙ্ক পরিমাপ করতে বসেনি? আর সেই অঙ্কের হিসেবেই এযাবৎ মিসেস পালিতকে মান্য সমীহ খোসামোদ তোয়াজ করে আসেনি?
ঝুটো কাচ! কী লজ্জা! কী লজ্জা!
হঠাৎ এই পরিস্থিতিতে পালিত সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। উঠে বললেন, যাক মিত্তির সাহেব, আপনি একবিষয়ে খুব খাঁটি। আত্মপরিচয়টা যা দিয়েছেন, একেবারে কারেক্ট। আমাকেও প্রায় ঘাবড়ে দিয়েছিলেন। ভেবে আঁৎকে উঠছিলাম, শহরের সেরা জুয়েলার মার্চেন্টরা কি শেষ পর্যন্ত আমায় ঠকাল? যাক, ভয়টা কাটল। নর্মদা, দেখ তো পরীক্ষা করে, গহনাগুলো তোমার সেই হারানো জিনিস কি না।
নর্মদা একবার ঘরের চারিদিকে তাকাল। তাকাল সকলের মুখের দিকে। তারপর ভুরু কুঁচকে ওই ঝকঝকে জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে হেসে উঠে বলল, ফোঃ। এইগুলো আমার? কনক, তুমি বোধকরি সেগুলোর উপসত্বে এই বছর তিনেক চালিয়ে, উদ্বৃত্ত টাকায় গোটাকতক কাঁচের টুকরো কিনে একটা নতুন গল্প নিয়ে এলে নতুন কায়দায় আসর জমাতে? সে আশা ছাড়ো। কে আছিস, গেট বন্ধ করে দে।
পালিত সাহেব হাসলেন।
সেটা তোমার আদেশের অপেক্ষায় পড়ে নেই। মানুষের ধৃষ্টতার বহর কতদূর পর্যন্ত হতে পারে, সেটা দেখার জন্যই এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম আমি।
তারপর? চাঙ্গা হয়ে উঠে বসে প্রশ্ন করে বিকাশ।
বীথিকা বলে, তারপর আর কি! পালিত সাহেব পুলিশে ফোন করলেন। লোকটাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল। আমাদের আবার সাক্ষী দিতে হবে এই এক বিপদ।
সাক্ষী দিতে হবে?
তা হবে বৈকি। ছিলাম যখন। কী বলবে?
বলব আর কি। বীথিকা মৃদু হেসে বলে, গল্প বানাতে হবে। অবশ্য সে গল্প তখুনি তৈরী হয়ে গেছে। বলা হবে, আগে চুরি করে পালিয়েছিল, আবার চুরি করতে এসে ধরা পড়েছে।
এই বলবে?
তা গুছিয়ে একটা কিছু না বললে—
কিন্তু তোমার কি মনে হল? কার কথাটা সত্যি?
শোন কথা। পালিত সাহেবের মত গণ্যমান্য লোকটার কথা সত্যি হবে না তো কি ওই জোচ্চোরটার কথা সত্যি হবে?
আর পালিত সাহেবের মেয়ের ওই কথাটা?
ও ছেড়ে দাও। ও তো রাগের কথা। ওকেও তালিম দেওয়া হচ্ছে। আর সত্যি, মেয়েমানুষ তো! এত বোকা হবে না যে কোনও খাঁটি সত্যি কথা প্রকাশ করে বসে নিজের মান মর্যাদা ঘোচাবে।
চোর ধরা পড়ায় তোমার বান্ধবী তাহলে খুব প্রফুল্ল?
বীথিকা ঠোঁট উল্টে বলে, ওর কথা বাদ দাও। একের নম্বর ঢঙি। ইচ্ছে করে ধরিয়ে দেওয়া হল, আবার এমন ছল ছল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে যে দেখে গা জ্বলে যাচ্ছিল। ভাবটা যেন মনে বড় দাগ লেগেছে। আরে বাবা, মেয়েমানুষের ঢং বুঝতে আমাদের দেরী হয় না। বিকাশ হেসে উঠে বলে, তা সত্যি, তোমরা হলে পাকা জহুরী।