দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – নিম্নতর কোনো জৈবিক গঠন থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষে উত্তরণের ধরন
মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠনের পরিবর্তনশীল—উত্তরাধিকার—রূপান্তরের কারণসমূহ—মানুষ এবং নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে রূপান্তরের একই নিয়মসমূহ—জীবনের বিভিন্ন অবস্থার প্রত্যক্ষ ক্রিয়া—বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ধিত ব্যবহার ও অব্যবহারের ফলাফল—গতিরুদ্ধ বিকাশ—পুনরাবর্তন—পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত রূপান্তর–বৃদ্ধির হার–বৃদ্ধিকে রোধ করা—প্রাকৃতিক নির্বাচন—পৃথিবীতে মানুষই সবচেয়ে আধিপত্য বিস্তারকারী প্রাণী—তার শারীরিক কাঠামোর গুরুত্ব—তার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারার পিছনের কারণসমূহ—তার ফলে কাঠামোগত পরিবর্তন—শদন্তের আয়তনের ক্রমহ্রাস—করোটির বর্ধিত আয়তন ও পরিবর্তিত আকার-রোমহীনতা—লেজের অনুপস্থিতি—মানুষের প্রতিরোধহীন অবস্থা।
*
এটা এখন স্পষ্ট যে মানুষের মধ্যে নানা বৈসাদৃশ্য আছে। একই জাতের দুজন মানুষকে দু-রকম দেখতে। আমরা কয়েক লক্ষ মানুষের মুখ তুলনা করে দেখলে দেখব যে প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনুপাত ও আয়তনেও প্রচুর পার্থক্য রয়েছে, যেমন পায়ের দৈর্ঘ্যে।[১] পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে লম্বাটে ধরনের এবং অন্যত্র ছোট মাপের করোটি দেখা যায়, এমনকী একই জাতির সীমিত পরিসরেও গড়নের যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ করা যা, যেমন আমেরিকার ও দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে, বিশেষত অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে, ‘যারা রক্তের, আচার-ব্যবহারের এবং ভাষার বিশুদ্ধতায় ও সাদৃশ্যে সম্ভবত অদ্বিতীয়।’ এমনকী স্যান্ডউইচ দ্বীপের মতো চারপাশে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা স্থানের অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও করোটির গঠনে এই পার্থক্য লক্ষ করা যায়। একজন বিখ্যাত দন্তবিশারদের মতে, মুখাবয়বের মতো বিভিন্ন মানুষের দাঁতের গঠনেও প্রচুর পার্থক্য থাকে। বিভিন্ন মানুষের প্রধান প্রধান ধমনীর গতিপথ এত অস্বাভাবিক রকমের আলাদা যে অস্ত্রোপচারের কারণে ধমনীর গতিপথ সম্পর্কে একটা সাধারণ সূত্রে পৌঁছনোর জন্য ১০৪০টি শবদেহ পরীক্ষা করে দেখতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের। মাংসপেশি স্পষ্টতই পরিবর্তনশীল, যেমন অধ্যাপক টার্নার দেখেছেন পঞ্চাশজনের মধ্যে দুজনের পায়ের পেশিও একেবারে একরকম নয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই পার্থক্যগুলো রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। তিনি আরও বলেছেন, পায়ের সঠিক পেশিগত কার্যকলাপের ক্ষমতা অনেক সময়েই এসব পার্থক্য সাপেক্ষে পরিবর্তিত হয়েছে।
মি. জে. উড ৩৬ জন ব্যক্তির মধ্যে ২৯৫টি পেশিগত অসামঞ্জস্য এবং অন্য একটি ৩৬ জনের দলে প্রায় ৫৫৮টি পার্থক্য নথিভুক্ত করেছেন। শরীরের দু-দিকে একইরকম পার্থক্যকে এক্ষেত্রে একটি পার্থক্য হিসাবেই ধরা হয়েছিল। শেষের ঘটনাটিতে ৩৬টির মধ্যে একটিও ‘শারীরতত্ত্বের বইতে ছাপা পেশিব্যবস্থার সাধারণ বর্ণনার সঙ্গে সম্পূর্ণ মেলেনি।’ একটি বিশেষ ক্ষেত্রে একই দেহে ২৫টি সুস্পষ্ট অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা গেছে। অনেক সময় একই পেশিও নানাদিক থেকেই আলাদা হতে পারে। যেমন অধ্যাপক ম্যাকলিস্টার হাতের পামারিস অ্যাসেসোরিয়াস পেশিতে কম করে কুড়িটি সুস্পষ্ট পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন।
বিখ্যাত শারীরতত্ত্ববিদ অধ্যাপক উল্ফ জোর দিয়ে বলেছেন, শরীরের ভিতরের অংশগুলো (internal viscera) বাইরের তুলনায় অনেক বেশি পরিবর্তনশীল। অন্তর্বর্তী অংশের প্রচলিত উদাহরণ টেনে লেখা একটি প্রবন্ধে তিনি প্রায় মানুষের মুখসৌন্দর্যের মতো করে যকৃৎ, ফুসফুস, কিডনি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
ভিন্ন ভিন্ন জাতির মধ্যেকার গুরুতর পার্থক্যের কথা বাদ দিলেও একই জাতির মধ্যে মানসিক গঠনের বৈসাদৃশ্য বা ভিন্নতা এতই বেশি পরিচিত যে সে সম্বন্ধে এখানে আর নতুন কিছু বলার নেই। নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যেও এই পার্থক্য রয়েছে। জন্তু-জানোয়ার নিয়ে যাঁদের ওঠা-বসা, তাঁরাও একথা স্বীকার করেন এবং কুকুর বা অন্যান্য গৃহপালিত পশুর বেলাতেও একই জিনিস দেখতে পাই আমরা। ব্রেহ্ম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে তিনি আফ্রিকাতে যে-সমস্ত বানরকে পোষ মানিয়ে ছিলেন, তারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা প্রবণতা ও মেজাজের অধিকারী ছিল। উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন একটি বেবুনের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা আমাকে আমেরিকার একটি বানর দেখিয়েছিলেন যারও বুদ্ধিমত্তা ছিল রীতিমতো উল্লেখযোগ্য। অধ্যাপক রেঙ্গারও প্যারাগুয়েতে একই প্রজাতির কিছু বানরের আলাদা মানসিক বৈশিষ্ট্যর কথা জোর দিয়ে বলেছেন এবং তাঁর মতে এই পার্থক্য অংশত সহজাত এবং অংশত তাদের শিক্ষা ও প্রযুক্ত আচরণের ফল।
বংশগতি নিয়ে আমি অন্যত্র এত বিশদ আলোচনা করেছি যে এখানে দু- একটি কথা ছাড়া আর কিছু বলার নেই। নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের তুলনায় মানুষের ক্ষেত্রে বংশগতি সম্বন্ধে অনেক বেশি তথ্য জোগাড় করা হয়েছে, যার কিছু কিছু নিতান্তই তুচ্ছ, আবার কিছু কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের সম্বন্ধে সংগৃহীত তথ্যও খুব কম নয়। মানসিক গুণের ক্ষেত্রে বংশগতির প্রভাব আমাদের পোষা কুকুর, ঘোড়া বা অন্যান্য গৃহপালিত পশুদের মধ্যেও দেখা যায়। তাছাড়া বিশেষ রুচি ও অভ্যাস, সাধারণ বুদ্ধিমত্তা, সাহস ভালো ও বদমেজাজ প্রভৃতি নিশ্চিতভাবেই উত্তরপুরুষে বর্তায়। মানুষের মধ্যে এই ঘটনা প্রায় প্রতিটি পরিবারে দেখা যায়। মি. গ্যাল্টেনের[২] কাছ থেকে আমরা জেনেছি যে প্রতিভা বিবিধ মানসিক গুণের এক জটিল ও চমৎকার যৌগ মাত্র এবং তা উত্তরপুরুষে বর্তায়, আবার অন্যদিকে ক্ষমতার হ্রাস, মানসিক অসুস্থতা প্রভৃতিও নিশ্চিতভাবেই বংশগতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
পরিবর্তনের কারণ প্রসঙ্গে আমরা প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই অজ্ঞ, কিন্তু নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মতো মানুষের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, যে-অবস্থার মধ্যে দিয়ে প্রত্যেকটি প্রজাতিকে কয়েক প্রজন্ম ধরে যেতে হয়েছে, সেই অবস্থার সঙ্গে ওইসব পরিবর্তনের একটা সম্পর্ক আছেই। গৃহপালিত পশুদের মধ্যে বন্য পশুদের চেয়ে অনেক বেশি পার্থক্য থাকে এবং তা কার্যত তাদের বসবাসের ভিন্ন ভিন্ন ও পরিবর্তনশীল অবস্থার চাপেই হয়ে থাকে। মানুষের বিভিন্ন জাতির ক্ষেত্রেও এ-কথা একইভাবে সত্যি, এবং একই জাতির বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যেও তা দেখা যায়—যদি তারা আমেরিকার মতো কোনো-একটা বিরাট জায়গায় বসবাস করে। অধিকতর সভ্য জাতিগুলোর (পরিবেশগত) অবস্থার প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেহেতু তারা পদমর্যাদার বিভিন্ন ধাপে রয়েছে অথবা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নিযুক্ত, তার ফলে বর্বর জাতিগুলোর সদস্যদের চেয়ে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর পরিধিও হয়ে পড়ে অনেক বিস্তৃত। কিন্তু বর্বর জাতির সভ্যদের সমরূপতা নিয়ে প্রায়ই অতিরঞ্জন করা হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর কোনো অস্তিত্বই থাকে না।[৩] তথাপি, যে যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে মানুষকে যেতে হয়েছে, শুধু তা দেখেই যদি তাকে অন্যান্য জন্তুদের চেয়ে ‘অনেক বেশি গৃহপালিত’ বলা হয়, তাহলে ভুল হবে। অস্ট্রেলিয়ানদের মতো কোনো কোনো বর্বর জাতিকে খুব বেশি বিচিত্র অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি, বরং অন্যান্য অনেক প্রজাতিকেই তাদের থেকে অনেক বেশি বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। অন্য আর-একটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যে-কোনো গৃহপালিত প্রাণীর থেকে মানুষ বহুলাংশে আলাদা—তার যৌনমিলন কখনোই কোনো পদ্ধতির বা অসচেতন নির্বাচনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। মানুষের কোনো জাতি বা দলকে অন্য মানুষেরা কখনো এমনভাবে বশীভূত করতে পারেনি, যাদের কিছুটা অংশকে আলাদাভাবে সংরক্ষিত রেখে অচেতনভাবেই মিলনের জন্য নির্বাচন করা সম্ভব হয়। একমাত্র প্রাশিয়ান পাদতিক বাহিনীর বিখ্যাত ঘটনাটি ছাড়া কখনোই নির্দিষ্ট কিছু ছেলে ও মেয়েকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বেছে নিয়ে তাদের বৈবাহিকসূত্রে আবদ্ধ করা হয়নি। প্রাশিয়ার ঘটনাটিতে মানুষ আসলে প্রণালিবদ্ধ নির্বাচনের নিয়মটিই পালন করেছিল। জানা গেছে যে পদাতিক সৈন্য ও তাদের দীর্ঘঙ্গী স্ত্রীদের বসত-গ্রামগুলোতে বহু দীর্ঘদেহী মানুষ জন্ম নিয়েছিল। স্পার্টাতেও এক ধরনের নির্বাচন অনুসৃত হতো।
জন্মের পরপরই একটা প্রাথমিক পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। সুন্দর গঠন ও প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ শিশুদের সযত্নে রক্ষা করা হতো, বাদবাকিরা ছিল পরিত্যাজ্য।[৪]
যদি আমরা মানুষের সমস্ত জাতিগুলোকে একটিমাত্র প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নিই, তাহলে তার পরিসর বিশাল। আমেরিকাবাসী বা পলিনেশিয়াবাসীদের মতো কিছু স্বতন্ত্র জাতিরও অবশ্য বিস্তৃত পরিসর আছে। এটা আমাদের অজানা নয় যে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা যে-কোনো প্রজাতি সীমাবদ্ধ পরিসরের প্রজাতির চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তনশীল। মানুষের মধ্যেকার এই বিপুল ভিন্নতাকে গৃহপালিত প্রাণীদের তুলনায় বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে-থাকা প্রাণীকুলের প্রজাতিগুলোর সঙ্গে তুলনা করলেই সম্ভবত সঠিক হবে।
মানুষ ও নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে যে শুধুমাত্র একই সাধারণ কারণে বৈসাদৃশ্য ঘটে তা-ই নয়, উভয়ের ক্ষেত্রেই শরীরের একই অঙ্গ প্রায় সদৃশ ধরনেই পরিবর্তিত হয়। অধ্যাপক গডরন ও অধ্যাপক কাফোজ এত ব্যাপক গবেষণা করে এই বিষয়টি প্রমাণ করেছেন যে এখানে শুধু তাঁদের কাজ সম্পর্কে উল্লেখ করাটুকুই যথেষ্ট। অস্বাভাবিকতা উভয় ক্ষেত্রেই এত সমরূপভাবে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় যে মানুষ ও নিম্নশ্রেণির প্রাণী উভয়ের জন্য একই নাম এবং একই শ্রেণিবিভাগ ব্যবহার করা যেতে পারে, ঠিক যেমনটি দেখিয়েছেন ইসিডোর জিওফ্রয় সেন্ট-ইলেয়ার। গৃহপালিত পশুদের ভিন্নতা সম্পর্কিত প্রবন্ধে আমি নিম্নলিখিতভাবে একটু স্থূল পন্থাতেই পরিবর্তনের সূত্রগুলোকে রাখতে চেষ্টা করেছি : (ক) পরিবর্তিত পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রত্যক্ষ ও নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া যা একই প্রজাতির প্রত্যেকের ক্ষেত্রে বা প্রায় প্রত্যেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় এবং সদৃশ পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব তাদের উপর ক্রিয়া করে প্রায় একই ধরনে; (খ) দীর্ঘদিন যাবৎ শরীরের কোনো অংশের ব্যবহার বা অব্যবহারের ফলাফল; (গ) শরীরের অনুরূপ অঙ্গগুলোর সংযোগ প্রবণতা; (ঘ) শরীরের নানা অংশের পরিবর্তনশীলতা; (ঙ) বৃদ্ধির পরিপূরকনীতি—অবশ্য মানুষের ক্ষেত্রে এই সূত্রটির কোনো প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমি পাইনি; (চ) শরীরের একটি অংশের ওপর আর-একটি অংশের যান্ত্রিক চাপের ফলাফল, যেমন জরায়ুর মধ্যস্থিত ভ্রূণের মাথার খুলিতে পেভিস-এর চাপ; (ছ) বিকাশের গতিরোধ, যার ফলে শরীরের কোনো অংশের আকস্মিক হ্রাস বা অবনতি ঘটে থাকে; (জ) পুনরাবর্তনের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পুনরাবির্ভাবের প্রবণতা; এবং শেষত, (ঝ) পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবর্তন। এই সবক’টি সূত্রই মানুষ ও নিম্নশ্রেণির প্রাণী উভয়ের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য, এমনকী এর অধিকাংশ সূত্র উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। প্রত্যেকটি সূত্রের আলোচনা এখানে নিরর্থক।[৫] কিন্তু কয়েকটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তার জন্য দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন।
পরিবর্তিত অবস্থার প্রত্যক্ষ ও নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া
এটি খুবই জটিল বিষয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে সমস্ত জীবজন্তুর ক্ষেত্রেই পরিবর্তিত অবস্থা কখনো সামান্য, কখনো-বা যথেষ্ট মাত্রায় প্রভাব ফেলে এবং যথেষ্ট সময় দেয়া হলে সর্বক্ষেত্রে ফলাফল সম্ভবত প্রায় একই হতো। কিন্তু এর সপক্ষে আমি এখনও কোনো স্পষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারিনি। দেহগঠন বা কাঠামো সংশিষ্ট অসংখ্য বিষয়, যা নির্দিষ্ট কারণে অর্জিত হয়েছে, তার উপযুক্ত কারণগুলো অবশ্য জানার চেষ্টা করা যায়। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে অবস্থার পরিবর্তন অনির্দিষ্ট সংখ্যক রূপান্তরক্রিয়ার কারণ হতে পারে, যার ফলে কোনো কোনো শারীরিক গঠন কিছু পরিমাণে নমণীয় গুণের অধিকারী হয়।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে গত যুদ্ধের সময় প্রায় দশ লাখ সৈন্যের দৈহিক পরিসংখ্যান, কোন্ অঞ্চলে তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইত্যাদি নথিভুক্ত করা হয়েছিল। এই আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় যে দৈহিক উচ্চতার ওপর আঞ্চলিক প্রভাব প্রায় সরাসরিভাবে কাজ করে, এবং আমরা আরও জানতে পারি, ‘কোন কোন বিশেষ অবস্থা দৈহিক বৃদ্ধির অনুকূল এবং জন্মস্থান কীভাবে দৈহিক উচ্চতার ওপর তার স্পষ্ট প্রভাব রেখে যায়।’ যেমন ‘পশ্চিমঞ্চলের অধিবাসীদের দৈহিক বিকাশের কালে উচ্চতাবৃদ্ধির হার বেশ ভালো।’ অন্যদিকে, নাবিকদের জীবনে বিকাশের কাল অনেক দেরিতে আসে, কারণ দেখা গেছে, সতেরো- আঠারো বছরের স্থূলসৈন্যদের উচ্চতার সঙ্গে নাবিকদের উচ্চতার বিশাল তফাত রয়েছে।’ মি. বি. এ. গোল্ড উচ্চতার ওপরে কার্যকরী পরিবেশগত প্রভাবগুলোর প্রকৃতি নিরূপণ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র নঞর্থক কতকগুলো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, যেমন, দৈহিক উচ্চতা আবহাওয়া বা জলবায়ুর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, মৃত্তিকা বা ভূমির উচ্চতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমনকী জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব বা প্রাচুর্যের সঙ্গেও ততটা সম্পর্কযুক্ত নয়। এই শেষ সিদ্ধান্তটি অধ্যাপক ভিলের্মের সিদ্ধান্তের সরাসরি বিরোধী, যিনি ফ্রান্সের বিভিন্ন অঞ্চলে বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত পদাতিক সৈন্য ও নৌ সৈন্যদের উচ্চতার পরিসংখ্যান প্রস্তুত করেছিলেন। একই দ্বীপে বসবাসকারী পলিনেশিয়ান সর্দার ও সাধারণ সৈন্যদের দৈহিক উচ্চতার তুলনা করলে, কিংবা একই মহাসাগরের অন্ত র্ভুক্ত উর্বর আগ্নেয়াগিরিজাত দ্বীপ ও অনুর্বর প্রবালদ্বীপের অধিবাসীদের মধ্যে[৬] তুলনা করলে, অথবা পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের ফিজিয়ান অধিবাসীদের (যাদের জীবিকানির্বাহের প্রণালির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে) তুলনা করলে এ সিদ্ধান্ত নাকচ করা প্রায় অসম্ভব যে উত্তম খাদ্য ও অধিক স্বাচ্ছন্দ্য দৈহিক উচ্চতার ওপর স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু পূর্বোল্লিখিত বক্তব্যগুলো থেকে বোঝা যায় এ-ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কতটা অসুবিধাজনক। ড. বিড্ডো সম্প্রতি প্রমাণ করেছেন যে ব্রিটেনের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে শহরে এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বাসবাস করাটা তাদের উচ্চতার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে অর্থাৎ তাদের উচ্চতা কমে যায়, এবং তিনি মনে করেন আমেরিকার মতোই কিছুটা বংশগতির কারণেও এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। ড. বিড্ডো আরও মনে করেন যে যখন কোনো ‘জাতি দৈহিক বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন সে একইসঙ্গে প্রাণশক্তি ও নৈতিক শক্তিরও চরমে ওঠে।’
বাহ্যিক অবস্থা মানুষের ওপর সরাসরি অন্য কোনো প্রভাব ফেলে কিনা, তা সঠিক জানা যায় না। তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে জলবায়ুঘটিত তারতম্যেরও নির্দিষ্ট প্রভাব আছে, যেহেতু স্বল্প উষ্ণতা ফুসফুস ও মূত্রাশয়ের পক্ষে কম-বেশি সহায়ক এবং যকৃৎ ও শরীরের চামড়া অধিক উষ্ণতায় বেশি কার্যকরী। আগে ভাবা হতো ত্বকের রং ও চুলের বৈশিষ্ট্য বুঝি আলো ও তাপের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। অস্বীকার করা যায় না যে এর সামান্য কিছু প্রভাব অবশ্যই আছে, তবুও এ-কথা এখন সবজনস্বীকৃত যে এমনকী বহু বছর ধরে কার্যকরী থাকলেও তার প্রভাব নিতান্তই সামান্য। মানুষের বিভিন্ন জাতির সঙ্গে আলোচনার সময় এ-বিষয়ে আরও বিশদ আলোচনা করা হবে। গৃহপালিত পশুদের ক্ষেত্রে অবশ্য এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ঠাণ্ডা ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া তাদের রোমবৃদ্ধির ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এ-বিষয়ে এখনও তেমন কোনো প্রমাণ আমি পাইনি।
শরীরের কোনো অংশের বহুল ব্যবহার বা অব্যবহারের ফল
আমরা জানি, যথাযথ ব্যবহার যেমন পেশশক্তিকে উজ্জীবিত করে, তেমনই অব্যবহার বা নির্দিষ্ট কোনো স্নায়ুতন্তুর বিনাশ ক্রমশ পেশিগত শক্তিহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চোখ নষ্ট হলে চোখের স্নায়ুও ক্রমে ক্রমে শুকিয়ে আসে। কোনো-একটি শিরাকে বেঁধে দিলে তার পাশ্ববর্তী রক্তবাহী নালিগুলো শুধুমাত্র ব্যাসেই বেড়ে যায় না, তাদের বেধ ও শক্তিও বাড়ে। যখন একটি কিডনি অসুস্থতার কারণে কাজ বন্ধ করে তখন অন্যটি আকারে বেড়ে যায় এবং প্রায় দ্বিগুণ কাজ করে। অতিরিক্ত ভারবহনের দরুন হাড় শুধু মোটাই হয় না, দৈর্ঘ্যেও বেড়ে যায়। বিভিন্ন পেশা অভ্যাসগত কারণে শরীরের নানা অংশের আনুপাতিক পরিবর্তন ঘটায়। ইউনাইটেড স্টেট্স কমিশন পরীক্ষা করে দেখেছিল, গত যুদ্ধে যারা নাবিক হিসেবে কাজ করেছে, তাদের পা পদাতিক সৈন্যদের চেয়ে অন্তত ০.২১৭ ইঞ্চি বেশি লম্বা, যদিও নাবিকদের গড় উচ্চতা সাধারণত কম। এবং তাদের বাহুর মাপ ১.০৯ ইঞ্চি কম, অর্থাৎ তাদের স্বল্প উচ্চতার তুলনায়ও এই মাপ সমানুপাতিক নয়। বাহুর দৈর্ঘ্যের এই স্বল্পতা সম্ভবত অতিব্যবহারের ফল, যা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। কিন্তু নাবিকেরা প্রধানত দাঁড় টানে, সেই অথে কোনো ভারী জিনিস তারা বহন করে না। আবার পদাতিক সৈন্যদের তুলনায় নাবিকদের গলার বেড় ও পায়ের পাতার উপরিভাগের বিস্তৃতি অনেক বেশি, কিন্তু বুক, কোমর ও নিতম্বের পরিধি বেশ কম।
পূর্বোল্লিখিত পরিবর্তনগুলো বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে জীবনের একই অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘকাল অনুসৃত হল বংশানুক্রমিক হয়ে উঠত কিনা সঠিক জানা না গেলেও তা হওয়া বোধ হয় অসম্ভব নয়। অধ্যাপক রেঙ্গার দেখিয়েছেন—পায়াগাস ইন্ডিয়ানরা, যারা পুরুষানুক্রমিকভাবে সারা জীবন শরীরের নিম্নাংশকে অচল রেখে ডোঙা বা শালতি চালায়, তাদের কৃশ পা ও শক্তপোক্ত বাহু উত্তরপুরুষে বর্তায়। অন্যান্য লেখকরাও অনুরূপ ক্ষেত্রে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। অধ্যাপক ক্রাস, যিনি দীর্ঘদিন এস্কিমোদের সঙ্গে কাটিয়েছেন, তাঁর মতে, ‘এস্কিমোরা বিশ্বাস করে সীল-শিকারের জন্য (যা তাদের সর্বোৎকৃষ্ট শিল্প ও প্রধান ধর্ম) প্রয়োজনীয় উদ্ভাবনশক্তি ও হাতের কৌশল বংশানুক্রমিক। কথাটা বোধহয় একেবারে ভিত্তিহীন নয়, কারণ একজন বিখ্যাত সীলমাছ-শিকারির ছেলে শৈশবে বাবাকে হারালেও পরবর্তীকালে নিজের যোগ্যতা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে থাকে।’ কিন্তু এক্ষেত্রে মানসিক ক্ষমতাও ঠিক শারীরিক গঠনের মতোই বংশানুক্রমে প্রাপ্ত বলে মনে হয়। আবার ভদ্রলোকদের তুলনায় ইংরেজ শ্রমিকদের হাত জন্মাবধি দীর্ঘ বলে অনুমিত। অন্তত কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাত-পা ও চোয়ালের বিকাশের মধ্যে যে আন্তঃসম্পর্ক দেখা যায়, তা থেকে মনে হয় যে-সমস্ত শ্রেণির মানুষ হাত-পা খুব বেশি ব্যবহার করে না, তাদের চোয়াল আকারে এ-কারণে ক্রমশ ছোট হয়ে আসে। এ-কথা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে সভ্য ও মার্জিত ভদ্রলোকদের তুলনায় শারীরিকভাবে বেশি পরিশ্রমী মানুষ অথবা বর্বরজাতির মানুষদের চোয়াল অনেক বড় হয়। তবে, হার্বার্ট স্পেন্সারের মতে, বর্বররা রান্না-না-করা খাদ্য চিবিয়ে খায় বলে তাদের চোয়ালের অতিরিক্ত ব্যবহার হয়, ফলে সংশ্লিষ্ট পেশি (masticatory muscles) ও হাড়ের ওপর তার প্রভাব পড়ে। গর্ভাবস্থায় শিশুদের পায়ের পাতার চামড়া শরীরের যে কোনো অংশের চামড়ার চেয়ে পুরু থাকে এবং নিঃসন্দেহে তার কারণ বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার, অর্থাৎ বহু প্রজন্ম ধরে মানুষের পায়ের পাতার ওপর যে-চাপ পড়ে তারই ফল এটা।
ঘড়ি-প্রস্তুতকারক ও তক্ষণশিল্পীদের দৃষ্টিশক্তি সাধারণত কম হয়। অথচ যারা ঘরের বাইরে প্রকৃতির খোলা হওয়ায় বেশিক্ষণ থাকে তাদের, বিশেষ করে বর্বরদের, দৃষ্টিশক্তি খুবই তীক্ষ্ম।[৭] দৃষ্টিশক্তির স্বল্পতা বা তীক্ষ্ণতা নিশ্চতভাবেই বংশানুক্রমিক হতে পারে। দৃষ্টিশক্তি ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়ানুভূতির ক্ষেত্রে বর্বরদের তুলনায় ইউরোপীয়দের তুলনামূলক ক্ষীণতা ও নিঃসন্দেহে বহু প্রজন্ম ধরে ক্রমিক অব্যবহারেরই অর্জিত ফল। কারণ অধ্যাপক রেঙ্গার[৮] জানিয়েছেন যে তিনি বরাবর লক্ষ করে দেখেছেন, অনেক ইউরোপীয় অ-সভ্য ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সারা জীবন কাটিয়েও ইন্দ্রিয়ানুভূতির তীক্ষ্ণতায় তাদের সমকক্ষ হতে পারেনি। তিনি আরও লক্ষ করেছেন যে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে সঠিকভাবে গ্রহণের জন্য করোটিস্থিত ছিদ্রপথগুলো ইউরোপীয়দের চেয়ে আমেরিকার অধিবাসীদের মধ্যে অনেক বড় হয় এবং সম্ভবত এই তথ্যটি ইন্দ্রিয়গুলোর তুলনামূলক মাত্রাগত পার্থক্যের দিকেও অঙ্গুলিনির্দেশ করে। অধ্যাপক ব্লুমেনবাখ্-ও আমেরিকার আদিবাসীদের করোটিতে নাকের বৃহৎ গর্তের (nasal cavities) কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এই ঘটনা তাদের তীব্র ঘ্রাণশক্তির সঙ্গে যুক্ত। অধ্যাপক প্যালাস-এর মতে, উত্তর-এশিয়ার সমতলবাসী মঙ্গোলিয়ানদের ইন্দ্রিয়ানুভূতি আশ্চর্যরকম তীব্র। অধ্যাপক প্রিচার্ড মনে করেন গালের হাড় (zygoma) বরাবর করোটির বিস্তৃত বিস্তার তাদের অত্যুন্নত ইন্দ্রিয়শক্তিরই পরিচায়ক।
কেশুয়া ইন্ডিয়ানরা পেরুর উঁচু মালভূমিতে বসবাস করে। অধ্যাপক আলসিদ দ্যরবিনি বলেছেন যে সবসময় বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাসাগ্রহণের ফলে তাদের বুকের ছাতি ও ফুসফুস অস্বাভাবিক রকমের বড় হয়ে থাকে। ফুসফুসের বায়ুকোষগুলোও ইউরোপীয়দের চেয়ে আকারে বেশ বড় এবং সংখ্যায়ও অনেক বেশি। এ-তথ্য অবশ্য বেশ সন্দেহজনক মনে হতে পারে। কিন্তু মি. ডি. ফরবেস, দশ হাজার থেকে পনেরো হাজার ফুট উঁচুতে বসবাসকারী আইমারা নামক একটি সংকর জাতির ক্ষেত্রে বিষয়টি লক্ষ করে আমায় জানিয়েছেন যে, তাঁর দেখা অন্য সমস্ত জাতির মানুষদের চেয়ে শারীরিক পরিধি ও দৈর্ঘ্যে তারা অনেকটাই আলাদা। তাঁর তথ্যসারণিতে তিনি ১০০০ এককের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেকের শারীরিক উচ্চতা বিচার করেছেন এবং একই মানানুসারে অন্যান্য অঙ্গের মাপ নিয়েছেন। দেখা গেছে আইমারাদের অগ্রবাহু (extended arms) ইউরোপীয়দের চেয়ে দৈর্ঘ্যে ছোট এবং নিগ্রোদের তুলনায় আরও বেশি ছোট। একইরকমভাবে তাদের পা-ও বেশ ছোট। উল্লেখযোগ্য যে, প্রত্যেক আইমার পায়ের উপরের অংশের হাড়ও (femur) পায়ের নিম্নাংশের হাড়ের (tibia) চেয়ে ছোট। গড় হিসেব অনুযায়ী, ঊধ্বাংশ যদি ২১১ একক হয়, তাহলে নিম্নাংশ ২৫২ একক। অথচ একজন ইউরোপীয়ের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ২৪৪/২৩০ এবং তিনজন নিগ্রোর ক্ষেত্রে এই অনুপাত ২৫৮/২৪১ একক। আবার একইভাবে তাদের হাতের ওপরের অংশের হাড়ও (humerus) অগ্রাবাহুর তুলনায় ছোট। মি. ফরবেসের মতানুযায়ী, দেহকাণ্ডের নিকটবর্তী অঙ্গসমূহের এই ক্ষুদ্রতা সম্ভবত দেহের নিম্নাংশের অতিবৃদ্ধিরই আংশিক পরিপূরক। আইমারাদের কাঠামোগত আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গোড়ালির সামান্য অংশ বাইরে বেরিয়ে থাকার কথাও উল্লেখ করা দরকার।
আইমারা জাতির লোকেরা শীতল ও সুউচ্চ বাসভূমিতে থাকতে এত বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, যখন স্পেনীয়রা পূর্বদিকের নিচু সমতলভূমিতে তাদের নামিয়ে এনে অধিক মজুরির বিনিময়ে সোনার খনিতে কাজ করতে প্রলুব্ধ করল, তখন দেখা গেল তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে। তথাপি মি. ফরবেস এখানে এমন কয়েকটি বিশুদ্ধ পরিবারের সন্ধান পেয়েছেন যারা দু-পুরুষ ধরে টিকে আছে এবং এখনও তাদের মধ্যে বংশানুক্রমিক কিছু কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু কোনোরকম মাপামাপি ছাড়াই এ-কথা বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে তাদের ওই বৈশিষ্ট্যগুলো ক্রমহ্রাসমান এবং পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে উচ্চ-মালভূমির লোকেদের মতো তাদের শরীর-কাঠামো তত দীর্ঘ নয় এবং তাদের ফিমোরা দৈর্ঘ্যে কিছুটা বেড়ে গেছে, তার তুলনায় কম হলেও টিবিয়া-ও কিছুটা বেড়েছে। এ-বিষয়ে প্রকৃত পরিমাপগুলো জানা যেতে পারে মি. ফরবেস-এর স্মৃতিকথা থেকে। এরপরে সম্ভবত আর কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না। যে উচ্চ অঞ্চলে দীর্ঘ কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুভাবেই শরীরের আনুপাতিক গঠনবিন্যাসে বংশগত রূপান্তর দেখা দিতে পারে।[৯]
অস্তিত্বের পরবর্তীকালে কোনো বিশেষ অঙ্গের বেশি বা কম ব্যবহারের ফলে মানুষ্যদেহ তেমন কোনো রূপান্তর হয়তো না-ও ঘটতে পারে, কিন্তু উপরোল্লিখিত তথ্যগুলো থেকে বোঝা যায় যে এ-বিষয়ে তার প্রবণতা এখনও পুরোপুরি লোপ পায়নি এবং আমরা নিশ্চিত যে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে এই নিয়ম এখনও ক্রিয়াশীল। এ থেকে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে সুদূর অতীতে যখন মানুষের আদি পূর্বপুরুষরা পরিবর্তনশীল অবস্থায় ছিল এবং চতুষ্পদ থেকে ক্রমে দ্বিপদবিশিষ্ট প্রাণীতে পরিণত হচ্ছিল, তখন প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্ভবত শরীরের বিভিন্ন অংশের বেশি বা কম ব্যবহারের বংশগত প্রভাবের দ্বারা দারুণভাবে উপকৃত হয়েছিল।
গতিরুদ্ধ বিকাশ
গতিরুদ্ধ বিকাশ ও গতিরুদ্ধ বৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথম ক্ষেত্রে অঙ্গগুলোর সাধারণ বৃদ্ধির কোনো হানি ঘটে না, যদিও তারা বিকাশের প্রাথমিক অবস্থাতেই থেকে যায়। বিভিন্ন অস্বাভাবিক অঙ্গগুলো এর মধ্যে পড়ে এবং কোনো-কোনোটা, যেমন নাকের নিচে চেরা ঠোঁট, প্রায়শই বংশানুক্রমিক বলে পরিচিত। অধ্যাপক ফখৎ-এর বর্ণনানুযায়ী জড়বুদ্ধিসম্পন্ন নির্বোধদের গতিরুদ্ধ মস্তিষ্ক-বিকাশের কথাটা এখানে উল্লেখ করাই আপাতত যথেষ্ট। সাধারণ মানুষের তুলনায় এদের করোটি অনেক ছোট এবং মস্তিষ্কের ভাঁজ প্রায় জটিলতাহীন। এদের কপালের হাড় বা দুই ভ্রূ-র ওপরের প্রক্ষিপ্ত অংশ যথেষ্ট ছোট হয় এবং চোয়াল সামনের দিকে প্রায় ‘নির্লজ্জভাবে’ বেরিয়ে থাকে, অর্থাৎ এদের দেখলে মানুষের আদি পূর্বপুরুষদের কথাই মনে পড়ে। এদের বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য মানসিক ক্ষমতা খুবই দুর্বল। কথা বলার শক্তি নেই, বিশেষ কোনো বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ দিতে পারে না, তবে অনুকরণের কিছুটা ক্ষমতা এদের থাকে। সাধারণত এরা বেশ শক্তিশালী এবং যথেষ্ট কর্মঠ হয়, প্রায় সারাক্ষণ নেচে-কুঁদে-লাফিয়ে বেড়ায় এবং নানারকম মুখভঙ্গি করে। এরা প্রায়ই চার হাত-পায়ে সিঁড়ি চড়ে এবং আশ্চর্য ব্যাপার হলো, উঁচু আসবাব বা গাছে চড়তে এরা খুব ভালোবাসে। ভেবে দেখুন, ছাগল বা উচ্চ উপত্যকার যে-কোনো প্রাণীই ছোটখাটো টিলায় ওঠার সময় কীভাবে আনন্দ প্রকাশ করে। আরও কিছু কিছু বিষয়ে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের সঙ্গে এই জড়বুদ্ধিদের মিল আছে। এ-রকম অসংখ্য ঘটনা নথিভুক্ত আছে যে কীভাবে এরা প্রতি গ্রাস খাওয়ার আগে সতর্কভাবে তা একবার শুঁকে নেয়। এ-রকম করে জড়বুদ্ধি ব্যক্তি উকুন মারতে হাতের সঙ্গে মুখও ব্যবহার করত। এদের অধিকাংশই অত্যন্ত নোংরা ধরনের অভ্যাসে অভ্যস্ত, সৌন্দর্য বা শালীনতার কোনো বোধ থাকে না এবং এদের অনেকেরই শরীরময় রোমের আধিক্য দেখা যায়।[১০]
বংশগতির মাধ্যমে লুপ্তাংশের পুনরাবর্তন
এখানে যা লিখছি তার কিছু কিছু আগের অনুচ্ছেদেই (গতিরুদ্ধ বিকাশ প্রসঙ্গে) হয়তো বলা যেত। শরীরের কোনো-একটি অংশের স্বাভাবিক বিকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও যখন অংশটি ততক্ষণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ে চলে যতক্ষণ পর্যন্ত ওই একই প্রজাতির কোনো নিম্নশ্রেণির পূর্ণাঙ্গ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত প্রাণীর ওই অংশটির প্রায় সদৃশ রূপ সে না পায়, তখন এক অর্থে তাকে লুপ্তাংশের পুনরাবর্তন বলা যেতে পারে। যে-কোনও শ্রেণির অন্তর্গত নিম্নস্তরের প্রাণীদের দেখে তাদের সাধারণ পূর্বপুরুষদের গঠনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা যায়। এ-কথা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে শরীরের কোনো জটিল অংশ ভ্রূণের বিকাশের প্রাথমিক অবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মে গতিরুদ্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পুনরায় বাড়তে থাকবে, যাতে অবশেষে তার প্রকৃত কাজটি সে করতে পারে। এই ব্যাপারটিকে সম্ভবপর বলে মেনে নেওয়া যায় একমাত্র তখনই, যদি ধরে নেওয়া হয় যে এখানকার এই ব্যতিক্রমী বা গতিরুদ্ধ অংশটি বহু যুগ আগে যখন স্বাভাবিক অবস্থায় কার্যকরী ছিল, তখনই এই ক্ষমতা সে অর্জন করেছিল। জড়বুদ্ধিসম্পন্ন নির্বোধদের সরল মস্তিষ্ক বানরদের মস্তিষ্কগঠনের সঙ্গে এতটুকু পর্যন্ত সাদৃশ্যযুক্ত হতে দেখা যায় যে তাকে এই অর্থে পুনরাবর্তনের উদাহরণ বলা যেতে পারে।[১১] এ-রকম আরও অনেক ঘটনাই আমাদের বর্তমান শিরোনামে আলোচনার যোগ্য। শরীরের কিছু কিছু অংশ, যা হামেশাই মানুষের সঙ্গে একই শ্রেণিভুক্ত নিম্নস্তরের প্রাণীদের দেহে দেখা যায়, তা কখনো কখনো মানুষের মধ্যেও দেখা দিতে পারে, যদিও স্বাভাবিক মনুষ্যভ্রূণে তার দেখা পাওয়া যায় না। হঠাৎ যদিও-বা দেখা যায়, সেক্ষেত্রে সেগুলো অস্বাভাবিক নিয়মে বিকশিত হতে থাকে—অবশ্য মানব শ্রেণিভুক্ত নিম্নস্তরের প্রাণীদের ক্ষেত্রে বিকাশের ওই ধারাই স্বাভাবিক। পরবর্তী উদাহরণে এই মন্তব্যগুলো আরও পরিষ্কার হবে।
বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে জরায়ু ক্রমশ দুটি স্বতন্ত্র মুখ ও পরিসরসহ একটি যুগ্ম-অঙ্গ (যেমনটা দেখা যায় ক্যাঙারুদের ক্ষেত্রে) থেকে একক-অঙ্গে পরিণত হয়েছে। কিন্তু উচ্চশ্রেণির বানর বা মানুষের ক্ষেত্রে জরায়ুতে সামান্য একটি অর্ন্তবর্তী ভাঁজ যদিও দেখা যায়, তবুও তাকে কোনোভাবেই যুগ্ম-অঙ্গ বলা চলে না। ইঁদুরের ক্ষেত্রে এই উভয় সীমার মধ্যবর্তী একটি সঠিক পর্যায়ক্রমের উপস্থিত দেখা যায়। সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রেই জরায়ু ক্রমবিকশিত হয় দুটি প্রাথমিক নালি (primitive tubes) থেকে, যার নিম্নতর অংশ ‘করনুয়া’ (cornua) গঠন করে। ড. ফ্যারে বলেছেন, ‘অন্তঃসীমায় দু’টি করনুয়ার মিলনে মানুষের দেহে জরায়ু অঙ্গটি গঠিত হয়, আবার যে-সব প্রাণীর ক্ষেত্রে মধ্যাংশ নেই তাদের করনুয়া দু’টি একত্রিত হয় না। জরায়ুর ক্রমবিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করনুয়া দুটি হয় জরায়ুর সঙ্গে মিশে যায় অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ লুপ্ত না হচ্ছে ততক্ষণ ক্রমশ ছোট হতে থাকে।’ নিম্নশ্রেণির বানর ও লেমুর জাতীয় প্রাণী পর্যন্ত সকলের দেহেই জরায়ুর গঠনবৈশিষ্ট্য করনুয়া অংশ থেকেই লক্ষণীয়
স্ত্রীলোকদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা খুব বিরল নয় যেখানে পরিণত জরায়ুতেও করনুয়া দেখা যায় অথবা যেখানে জরায়ু অংশত দু’ভাগে বিভক্ত। অধ্যাপক ওয়েনের মতে এইরকম ঘটনায় ‘সুসংবদ্ধ ক্রমবিকাশের পর্যায়টিই পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়, যা একশ্রেণির ইঁদুরের (rodents) মধ্যে বেশি দেখা যায়। এখান থেকে সম্ভবত আমরা ভ্রূণের বিকাশপর্যায়ে একটি সাধারণ গতিরুদ্ধতা, যা একইসঙ্গে পরবর্তী সময়ে আশানুরূপ উন্নত ও সুষম কার্যকারিতার দিক থেকে যথেষ্ট বিকশিত, তার একটা উদাহরণ পাচ্ছি, কারণ এই অংশত যুগ্ম- জরায়ুর উভয় অংশই গর্ভধারণের প্রয়োজনীয় কাজ করতে সক্ষম। অন্যান্য কিছু বিরল ঘটনার ক্ষেত্রে দুটি স্বতন্ত্র জরায়ুর প্রতিটিকে সঠিক মুখ ও পরিসরসহ গঠিত হতে দেখা যায়। ভ্রূণের স্বাভাবিক বিকাশকালে এ-রকম কোনো পর্যায়ের মধ্য দিয়ে সাধারণত যেতে হয় না। এবং একথা বিশ্বাস করা কষ্টকর, যদিও তা একেবারে অসম্ভব নয় যে, দুটি সাধারণ, আদিম ও সূক্ষ্ম নালি নিজেরাই জানে (যদি এইভাবেই বলা যায়) কীভাবে তারা প্রত্যেকে সুনির্মিত মুখ ও পরিসরসহ অসংখ্য মাংসপেশি, স্নায়ুতন্ত্রী, গ্রন্থি, শিরা-উপশিরায় সজ্জিত দুটি স্বতন্ত্র জরায়ুতে পরিণত হতে পারে। এ ঘটনা ঘটতে পারে একমাত্র তখনই, যদি তারা পূর্বকালে বিকাশের ওই একই পর্যায়ক্রমের মধ্যে দিয়ে গিয়ে থাকে, যেমন ক্যাঙারু জাতীয় প্রাণীদের বেলায় দেখা যায়। কেউই বলতে পারে না যে স্ত্রীলোকদের যুগ্ম-জরায়ুর মতো এ-রকম অস্বাভাবিক অথচ নিখুঁতভাবে পরিপূর্ণ একটি গঠন-কাঠামো নিছক আকস্মিকতার ফল। পুনরাবর্তনের নীতি দিয়েই বরং তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব, যার ফলে দীর্ঘদিন আগে হারিয়ে যাওয়া কোনো অঙ্গ আবার পুনরাবির্ভূত হয় এবং দীর্ঘকালের ব্যবধানেও ওই কাঠামোর পূর্ণ বিকাশে সেটা সহায়তা করে।
উপরোল্লিখিত ঘটনাগুলো এবং অনুরূপ বহু ঘটনা প্রত্যক্ষ ও বিচার- বিবেচনা করার পর অধ্যাপক কানেত্রিনি একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তিনি আর একটি দৃষ্টান্তের কথাও উল্লেখ করেছেন। এটি হলো ম্যালার হাড় (malar bone)[১২], যা কোনো কোনো শ্রেণির বানর ও অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে সাধারণত দু’টি অংশ নিয়ে গঠিত। দু’মাস বয়সের মানুষের ভ্রূণে এই হাড় এইভাবেই থাকে, এবং গতিরুদ্ধ বিকাশের ফলে এমনকী পরিণত মানুষের ক্ষেত্রেও একই অবস্থায় তা দেখতে পাওয়া যায়, বিশেষ করে নিম্নশ্রেণির মানবজাতিগুলোর (prognathous) মধ্যে। তাই অধ্যাপক কানেত্রিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে মানুষের কোনো আদি-পুরুষের মধ্যে এই হাড়টি নিশ্চয়ই দুটি স্বাভাবিক অংশে বিভক্ত ছিল যা পরবর্তীকালে সম্মিলিত এককে পরিণত হয়েছে। মানুষের কপালের হাড় (frontal bone) একটিমাত্র অংশ দিয়ে গঠিত, কিন্তু মনুষ্যভ্রূণে বা শিশুদের ক্ষেত্রে এবং প্রায় সমস্ত নিম্নশ্রেণির স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, কপালের এই হাড়টি দু’টি অংশ দিয়ে গঠিত 1 প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের শরীরে এই দু’টি অংশের জোড়ালাগার চিহ্ন অনেক সময় বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় এবং এখনকার তুলনায় মানুষের আদি পূর্বপুরুষের মাথার খুলিতে এটা অনেক বেশি দেখা যায়। অধ্যাপক কানেত্রিনি এই বিষয়টি বিশেষ করে লক্ষ করেছেন ড্রিফ্ট-এর কবরখানা থেকে পাওয়া বানরজাতীয় প্রাণীর সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত মানুষের করোটির হাড়ে (brachycephalic type)। এ-ক্ষেত্রেও তিনি ম্যালার হাড়ের মতো একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এই উদাহরণটি বা এখানে উল্লিখিত অন্যান্য উদাহরণ থেকে বোঝা যায়—কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে মানুষের আধুনিক জাতিগুলোর তুলনায় আদিম জাতিগুলো সঙ্গে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের নিকট সাদৃশ্যের কারণ সম্ভবত আধুনিক জাতিগুলি ক্রমবিকাশের দীর্ঘ পর্যায়ক্রমে তাদের একেবারে প্রথম দিককার আধা-মানুষ পূর্বপুরুষদের থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছে।
পূর্বোল্লিখিত ঘটনাটির সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত মানুষের আরও অনেক অস্বাভাবিক গঠনবৈশিষ্ট্য নিয়ে বিভিন্ন লেখক আলোচনা করেছেন এবং সেগুলোকে পুনরাবর্তনের উদাহরণ হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু এ-সমস্ত ঘটনাই অল্পবিস্তর সংশয়ের কারণ হতে পারে, কেননা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দীর্ঘ সারণির একেবারে নিচের ধাপে পৌছনো পর্যন্ত এই একই গঠন-কাঠামোযুক্ত প্রাণীদের দেখা মেলে না।[১৩]
মানুষের ছেদক-দন্ত (canine teeth) চিবোনোর পক্ষে একেবারে আদর্শ। কিন্তু ওয়েন-এর মতে, তাদের প্রকৃত ছেদক দন্তসুলভ বৈশিষ্ট্য হলো ‘দাঁতের যে-অংশ মাড়ি থেকে বেরিয়ে থাকে তার আকার শঙ্কুর মতো, তলদেশ সামান্য সমুন্নত; যে ভোঁতা বিন্দুতে তা শেষ হয়, তার বাইরের দিক উত্তল এবং ভিতরের দিক সমতল বা সামান্য অবতল। মেলানিয়ান জাতি, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে এই শঙ্কু-আকৃতি সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যায়। কৃন্ত ক-দন্তের তুলনায় ছেদক-দন্ত অনেক গভীরে প্রোথিত এবং ধারালো।’ কিন্তু মানুষের এই ছেদক-দন্ত এখন আর শত্রুনিধন বা শিকারের প্রয়োজনে বিশেষ অস্ত্র হিসেবে কোনো সাহায্য করে না বলে সংশ্লিষ্ট কাজের বিচারে একে লুপ্তপ্রায় প্রাথমিক বা আদিম অঙ্গ বলা যেতে পারে। মনুষ্যকরোটির যে-কোনো বিশাল সংগ্রহের কোনো কোনোটিতে দেখা যায়, যেমন অধ্যাপক হ্যাকেল-ও লক্ষ করেছেন, মানুষের ক্ষেত্রে ছেদক-দন্ত বনমানুষের (anthropomorphus apes) মতোই অন্যান্য দাঁতগুলোর চেয়ে খানিকটা বাইরে বেরিয়ে থাকে, তবে বনমানুষের মতো অতটা বেরিয়ে থাকে না। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে চোয়ালের দাঁতের সারির মধ্যে ফাঁকা জায়গা থাকে যাতে করে বিপরীত দত্তপঙক্তির ছেদক- দন্ত ওই জায়গায় বসতে পারে। অধ্যাপক ভাগনারের উদাহরণে, এক কাফ্রির (আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্বাংশের অধিবাসী) চোয়ালের দাঁতের সারিতে এই ফাঁক যথেষ্ট বড়। আদিমকালের পরীক্ষিত করোটিগুলোর মত অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে ছেদক-দন্ত খুব বেশি সামনের দিকে এগিয়ে আছে (এখনকার করোটির তুলনায়) এবং নাউলেট (Naulette) মাড়ির ক্ষেত্রে বলা হয় যে তা একেবারে বিশালাকৃতি।
বনমানুষদের মধ্যে দেখা যায় যে শুধু পুরুষ-বনমানুষদের ছেদক-দন্তই পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে, কিন্তু স্ত্রী-গরিলাদের মধ্যে এবং আরও কম পরিমাণে স্ত্রী-ওরাংওটাংদের মধ্যে এই দাঁত অন্যান্য দাঁতের চেয়ে খানিকটা বেশি বাইরে বেরিয়ে থাকে। তাই নারীদের মধ্যে মাঝে মাঝে বেশ খানিকটা বেরিয়ে থাকা ছেদক-দাঁত দেখা যাওয়ার ব্যাপারটা সম্ভবত এই সিদ্ধান্তের পক্ষে কোনো মারাত্মক বাধা হয়ে ওঠে না যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব দাঁতের (ছেদক দাঁত) অনেকখানি বড় হয়ে ওঠাটা আসলে মানুষের বানরসদৃশ পূর্বপুরুষের কাছে ফিরে যাওয়ারই একটা নমুনা মাত্র। যে ব্যক্তি অবজ্ঞার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তকে নাকচ করেন যে তাঁর দাঁতের অনেকখানি বড় হয়ে ওঠার জন্য দায়ী আমাদের অতি-পূর্বপুরুষরাই—যাঁরা এই দাঁতকে ভয়ানক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন—অবজ্ঞা প্রকাশের জন্য তিনি হয়তো নিজের অজান্তেই দাঁত খিঁচিয়ে নিজের ক্রমবিকাশের ধারাকে প্রকাশ করবেন। এই দাঁতগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা তাঁর আর না থাকলেও অবচেতনভাবেই তিনি তাঁর দাঁত-খিঁচোনো পেশি বা ‘স্নারলিং মাস্ল’ (স্যর পি. বেল কর্তৃক নামাঙ্কিত) কুঁচকে দাঁতগুলোকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করে তোলেন, ঠিক যেভাবে কুকুররা ঝগড়ার জন্য প্রস্তুত হয় আর কি।
মানুষের দেহে মাঝে মাঝে এমন কতগুলো পেশি বিকাশ লাভ করে যেগুলো কেবলমাত্র বানরজাতীয় বা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যেই থাকার কথা। অধ্যাপক ভ্ল্যাকোভিচ চল্লিশজন পুরুষকে পরীক্ষা করে তাদের উনিশজনের মধ্যে একটি পেশি দেখতে পান যাকে তিনি চিহ্নিত করেন ইশ্চিও- পিউবিক নামে। আরও তিনজনের মধ্যে এই পেশির কিছু অস্তিত্ব থাকলেও অবশিষ্ট আঠারোজনের মধ্যে তার কোনো চিহ্ন ছিল না। বত্রিশজন স্ত্রীলোককে পরীক্ষা করে কেবলমাত্র তিনজনের শরীরের উভয় পাশে এই পেশি বিকশিত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল, আরও তিনজনের মধ্যে প্রাথমিক বন্ধনীর (ligament) আকারে এর অস্তিত্ব ছিল। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় যে এই পেশির উপস্থিতি স্ত্রীলোকের তুলনায় পুরুষের মধ্যে অনেক বেশি এবং নিম্নশ্রেণির কোনো আকার থেকে মানুষের ক্রমবিকাশের ধারণার সঙ্গে মেলালে এই বিষয়টিকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়, কারণ নিম্নশ্রেণির বহু প্রাণীর মধ্যেই এই পেশিটির সন্ধান পাওয়া যায় এবং তাদের সকলের ক্ষেত্রেই জননক্রিয়ায় পুরুষের পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক পেশি হিসেবে কাজ করে থাকে এটি।
মি. জে. উড তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্রে[১৪] অত্যন্ত যথাযথভাবেই মানুষের মধ্যে প্রচুর পেশিগত অস্বাভাবিকতা সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন, যেগুলো নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের স্বাভাবিক পেশির সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত। যে পেশিগুলো আমাদের নিকটতম সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন বানর জাতীয় প্রাণীদের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত, তাদের সংখ্যা এত বেশি যে আলাদা করে সেগুলোর কথা উল্লেখ করাও সম্ভব নয়। শক্তিশালী দৈহিক কাঠামো ও সুনির্মিত করোটি-যুক্ত একজন পুরুষের দেহে কম করে সাতটি অস্বাভাবিক পেশি লক্ষ করা গেছে, যেগুলো সাধারণভাবে বিভিন্ন শ্রেণির বনমানুষজাতীয় বানরদের মধ্যেই থাকে। যেমন, ওই লোকটির গলার দু’পাশে একটা প্রকৃত-শক্তিশালী ‘লেভাটর ক্ল্যাভিকুলা’ পেশি ছিল, যা প্রায় সমস্ত বানরজাতীয় প্রাণীদের মধ্যেই দেখা যায়, এবং বলা হয় যে প্রতি ষাটজন মানুষের মধ্যে অন্তত একজনের শরীরে এটা থাকে। আবার দেখা যায় ওই লোকটির পায়ে কড়ে আঙ্গুলের (fifth digit) হাড়ে (metatarsal bone) একটি বিশেষ অ্যাবডাক্টর (পিছনদিকে সরে-যাওয়া একটা পেশি) ছিল, যা অধ্যাপক হাক্সলি ও মি. ফ্লাওয়ার-এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী উচ্চশ্রেণির ও নিম্নশ্রেণির প্রায় সব বানরের মধ্যেই বর্তমান রয়েছে। এখানে আর মাত্র দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব আমি। একটি হলো অ্যাক্রোমিয়োব্যাসিলার পেশি, যা মানুষের থেকে নিম্নশ্রেণির সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে থাকে এবং এটা সম্ভবত চতুষ্পদ প্রাণীদের চলাফেরার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রতি ষাটজন মানুষের মধ্যে একজনের শরীরে এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। পরেরটি হলো মি. ব্রাড্লি কর্তৃক আবিষ্কৃত মানুষের দুই পায়ে অবস্থিত একটা পেশি—অ্যাবডাক্টর ওসিস মেটাটারসি কোয়ান্তি। এর আগে পর্যন্ত এই পেশিটি মানুষের শরীরে বর্তমান আছে বলে জানা যায়নি, কিন্তু জানা ছিল যে বনমানুষদের শরীরে এটা সর্বদাই থাকে। হাত ও বাহুর পেশিগুলো, যা মানুষের একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, মাঝে মাঝে এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের অনুরূপ পেশির প্রায় সমরূপ হয়ে ওঠে।[১৫] এই ধরনের সাদৃশ্য ত্রুটিযুক্ত অথবা ত্রুটিযুক্ত হতে পারে, কিন্তু ত্রুটিযুক্ত ক্ষেত্রেও এগুলো (পেশিগুলো) স্পষ্টতই পরিবর্তনশীল প্রকৃতির হয়ে থাকে। পুরুষদের শরীরে যেমন নির্দিষ্ট কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, তেমনি মেয়েদের শরীরেও নির্দিষ্ট কিছু পরিবর্তন জায়গা করে নেয়, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই এর কারণ আমাদের অজানা। অসংখ্য পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে মি. উড অবশেষে এই চমৎকার মন্তব্যটি করেছেন, ‘পেশির গঠনের সাধারণ অবস্থা থেকে কোনো নির্দিষ্ট খাতে বা দিকে পরিচালিত কোনো বিচ্যুতির পিছনের অজানা কারণটিকে উন্মোচন করা সাধারণ ও বৈজ্ঞানিক শারীরসংস্থানবিদ্যা সংক্রান্ত যথাযথ জ্ঞান অর্জন করার ব্যাপারে খুবই গুরত্বপূর্ণ।[১৬]
মানুষের ক্ষেত্রে এই অজানা কারণটিকে চিহ্নিত করা যায় অস্তিত্বের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া বা প্রত্যাবর্তন হিসেবে।[১৭] বংশানুক্রমঘটিত কোনো সম্পর্ক না থাকলে একজন মানুষের অন্তত সাতটি পেশির সঙ্গে কিছু বানরের পেশির সাদৃশ্যকে কোনোভাবেই নিছক সমাপতন বলে ধরে নেওয়া অসম্ভব। অন্যদিকে, বানরসদৃশ কোনো জীবন থেকে মানুষ ক্রমবিকশিত হয়ে থাকলে তার পক্ষে এমন কোনো বৈধ যুক্তি খাড়া করা যাচ্ছে না যে কেন কিছু পেশি কয়েক হাজর বছর বিরতির পর আবার আকস্মিকভাবে ফিরে আসবে না, ঠিক যেভাবে ঘোড়া, গাধা ও খচ্চরের পায়ে ও কাঁধের কালো রঙের ডোরাকাটা দাগের হঠাৎই আর্বিভাব হচ্ছে কয়েকশো অথবা কয়েক হাজার প্রজন্মের বিরতির পরে।
পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার এসব ঘটনাগুলো প্রথম পরিচ্ছেদে আলোচিত লুপ্তপ্রায় অঙ্গ বা প্রাথমিক অঙ্গের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত যে তাদের অনেকগুলোর সম্বন্ধেই হয়তো এখানে-সেখানে অসতর্কভাবে কিছু বলা হয়ে গেছে। এইভাবে করনুয়া দিয়ে গঠিত মানুষের জরায়ু সম্বন্ধে বলা যেতে পারে যে এটা আসলে প্রাথমিক বা আদিম অবস্থায় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ওই অঙ্গেরই সমতুল। মানুষের মধ্যে কিছু লুপ্ত বা আদিম অঙ্গ, যেমন উভয় লিঙ্গে অনুত্রিকাস্থি এবং পুরুষদের শরীরে দুগ্ধ-গ্রন্থি প্রায় সবসময় দেখা যায়। আবার অন্য কিছু অংশ, যেমন সুপ্রা-কন্ডিলয়েড ফোরামেন (হিউমারাস-এ অবস্থিত একটি ছিদ্র) কেবলমাত্র মাঝে মাঝে দেখা যায় এবং সেইজন্য এগুলোকে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া বা প্রত্যাবর্তনের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এইসময় প্রত্যাবর্তিত গঠন-আকৃতি এবং পুরোপুরি আদিম বা লুপ্তপ্ৰায় অঙ্গগুলো নিম্নশ্রেণির কোনো জৈবিক আকার থেকে মানুষের ক্রমবিকাশের ধারণাকেই সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে।
পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পরিবর্তন
নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মতো মানুষেরও বেশ কিছু গঠন-আকৃতি এত পরস্পর সম্পর্কযুক্ত যে একটি অংশ পরিবর্তিত হলে অন্যটিও পরিবর্তিত হতে শুরু করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা তার কোনো কারণ দর্শাতে অসমর্থ হই। আমরা বলতে পারি না যে একটি অংশ আর-একটিকে পরিচালিত করছে কিনা অথবা উভয়েই পূর্ব-বিকশিত তৃতীয় কোনো অংশ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে কিনা। অধ্যাপক আই, জিওফ্রয় তাই বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে দেহের বিভিন্ন অস্বাভাবিক অংশ পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। অনুরূপ গঠন- আকৃতিযুক্ত অংশগুলো একসঙ্গে পরিবর্তিত হতে বাধ্য, ঠিক যেমন আমরা দেখি দেহের দুই বিপরীত অংশে এবং ওপর ও নিচের হাত-পায়ের মধ্যে। অধ্যাপক মেকেল অনেক আগেই বলেছিলেন—যখন বাহুর পেশি তাদের প্রকৃত অবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়, তখন তাদের অধিকাংশই পায়ের পেশিকে অনুকরণ করে এবং বিপরীতক্রমে পায়ের পেশিও হাতে পেশিকে নকল করে। দেখা ও শোনার অঙ্গ, দাঁত ও চুল, চামড়ার রং, চুলের রং ও গঠন-সবকিছুই কম-বেশি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। অধ্যাপক শ্যাফহউসেনই সর্বপ্রথম পেশির গঠন ও বলিষ্ঠ সুপ্রা-অরবিটাল রিজের মধ্যে কার্যকরী সম্পর্ক সম্বন্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যা নিম্নজাতির মানুষদের মধ্যে খুব বেশি চোখে পড়ে।
যে-সমস্ত বৈসাদৃশ্যগুলোকে কম-বেশি সম্ভাব্যতাসহ পূর্বোল্লিখিত বিষয়গুলোর শিরোনামে বিন্যস্ত করা যায়, সেগুলো ছাড়াও বেশ কিছু বৈসাদৃশ্যকে আপাতভাবে বলা যেতে পারে স্বতঃস্ফূর্ত, কারণ তাদের আবির্ভাব সম্পর্কে উপযুক্ত কারণ আমাদের অজ্ঞানতার জন্য অজানাই রয়ে গেছে। তবে দেখানো যেতে পারে যে এই ধরনের বৈসাদৃশ্য, তা সে সামান্য কিছু ব্যক্তিগত পার্থক্য অথবা গঠন-আকৃতির উল্লেখযোগ্য ও আকস্মিক বিত্যুতিসহ পার্থক্য যা-ই হোক না কেন, সেগুলো প্রাণীদের বেড়ে ওঠার পরিবেশগত অবস্থার থেকেও অনেক বেশি নির্ভর করে, প্রাণীদের নিজস্ব গঠন-আকৃতির ওপর।
প্রজননসংখ্যা বৃদ্ধির হার
অনুকূল অবস্থায় সভ্য মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে গত পঁচিশ বছরে লোকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে এবং অধ্যাপক ইউলার-এর হিসেব অনুযায়ী আগামী বারো বছরে এই সংখ্যা আরও দ্বিগুণ হয়ে উঠবে। যদি পঁচিশ বছরের হিসেব ধরি, তাহলে আমেরিকার বর্তমান লোকসংখ্যা (প্রায় তিন কোটি) ৬৫৭ বছরের মধ্যে জল-স্থল সর্বক্ষেত্রে এত ব্যাপক পরিমাণে বেড়ে যাবে যে চারজন লোকের জন্য এক বর্গগজ জমি বরাদ্দ হবে। ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রাথমিক বা মৌলিক বাধা হয়ে দাঁড়ায় জীবিকানির্বাহ ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সমস্যা। এই বিষয়টি অনুমান করতে আমাদের বেগ পেতে হয় না যখন দেখি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে জীবন নির্বাহ করা অনেক সহজ এবং প্রচুর জমি-জায়গাও সেখানে রয়েছে। যদি এইসমস্ত জিনিস, অর্থাৎ জমি, জীবিকা- নির্বাহের উপায় ইত্যাদি, ব্রিটেনে হঠাৎই দ্বিগুণ হয়ে যেত, তাহলে আমাদের লোকসংখ্যা দ্রুতই দ্বিগুণ হয়ে যেত। সভ্য জাতিগুলো প্রধানত সংযত বিবাহপ্রথার মধ্য দিয়ে এই প্রাথমিক বাধাকে কার্যকরী করে। এছাড়া অত্যন্ত দরিদ্র শ্রেণিগুলোর মধ্যে খুব বেশি মাত্রায় শিশু-মৃত্যুর হারও এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইরকম গুরুত্বপূর্ণ হলো নানান রোগে আক্রান্ত প্রায় সকল বয়সের মানুষের একটি বড় সংখ্যার মৃত্যু, যারা খুব স্বল্প জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্যে বসবাস করে। আবার মহামারী ও যুদ্ধের ফলে যে লোকসংখ্যা হ্রাস পায় তা শ্রীঘ্রই পরিপূরণ হয়ে যায় এবং অনুকূল অবস্থায় বসবাসকারী জাতিগুলোর ক্ষেত্রে এই সংখ্যা পরিপূরণকেও ছাড়িয়ে যায়। দেশত্যাগের সংখ্যা সাময়িক একটা বাধা হিসেবে কাজ করলেও সত্যিকারের গরিব লোকদের ক্ষেত্রেও এটা খুব-একটা কাযকরী নয়। সভ্য লোকদের তুলনায় অ-সভ্য বুনো লোকদের প্রজনন প্রকৃতপক্ষে কম—বলেছেন ম্যালথাস। কথাটার মধ্যে একটা সত্যতা থাকতেও পারে। আমরা এ-ব্যাপারে সঠিক তথ্য কিছু জানি না, যেহেতু অ-সভ্য লোকেদের জন্য আদমসুমারের কোনো ব্যবস্থা নেই। পাদ্রি বা অন্যান্য যাঁরা দীর্ঘকাল এই ধরনের লোকেদের মধ্যে কাটিয়েছেন, তাঁদের নানান বিবৃতি থেকে মনে হয় এদের পরিবারগুলো সাধারণত ছোট হয়, বড় পরিবার ক্বচিৎ দেখা যায়। এদের স্ত্রীলোকেরা দীর্ঘসময় যাবৎ শিশুদের স্ত ন্যপান করায়—এই ঘটনা এদের মধ্যে জন্মহার কম হওয়ার একটা কারণ হতেও পারে। কিন্তু এটাও ঠিক যে অ-সভ্য লোকেরা প্রায় সবসময়ই নানান দুঃখ- দুর্দশায় ভোগার জন্য এবং সভ্য লোকেদের মতো পুষ্টিকর খাদ্য না-পাওয়ার জন্য এদের প্রজননক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে হ্রাস পায়। আগের একটি রচনায় আমি দেখিয়েছি যে সমস্ত গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু ও পাখি এবং কৃষিকার্য দ্বারা উৎপন্ন উদ্ভিদদের প্রজননক্ষমতা প্রকৃতির মধ্যে মুক্ত অবস্থায় থাকা ওই একই শ্রেণির প্রজাতিগুলোর থেকে অনেক বেশি। এই সিদ্ধান্তেরন বিরুদ্ধে এটা কোনো বৈধ আপত্তি বলে গ্রাহ্য হতে পারে না। যে পশুপাখিদের জন্য হঠাৎ অত্যধিক খাবারের যোগান বা তাদের খুব মোটা হয়ে পড়া এবং উদ্ভিদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত খারাপ মাটি থেকে হঠাৎই অত্যন্ত উর্বর মাটিতে স্থানান্তরকরণ, এগুলো তাদের কম-বেশি বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী। এ থেকে মনে করা যেতে পারে যে সভ্য লোকেরা, যারা একদিক থেকে খুব বেশি গৃহপালিত, তাদের প্রজননক্ষমতা বুনো ব অ-সভ্য লোকেদের তুলনায় বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। আরও মনে হয় যে সভ্য জাতিগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রজননক্ষমতা আমাদের গৃহপালিত পশুদের মতোই একটি বংশগত বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। তাছাড়া আমরা তো জানিই মানুষের মধ্যে যমজ সন্তান উৎপাদন একটি বংশগত প্ৰবণতা।
অ-সভ্য লোকেরা সভ্য লোকেদের তুলনায় কম প্রজননক্ষমতা হওয়া সত্ত্বেও অবশ্যই দ্রুত বৃদ্ধি পেত, যদি না তাদের জনসংখ্যা বিভিন্নভাবে প্রকৃতি- নিয়ন্ত্রিত হতো। সম্প্রতি মি. হান্টারের অনুসন্ধানে ভারতের সাঁওতাল বা পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যে এই ব্যাপারে একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে। বসন্ত রোগের টিকা আবিষ্কার হওয়ায়, প্লেগ ইত্যাদি মহামারী প্রশমিত হওয়ায় এবং নিজেদের মধ্যে লড়াই-টড়াই কমে যাওয়ার ফলে তাদের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। অবশ্য এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্ভব হত না, যদি তারা পার্শ্ববর্তী জেলা বা প্রদেশগুলোতে ভাড়া-খাটার কাজে ছড়িয়ে না পড়ত। বুনো বা অ-সভ্য লোকেরা প্রায় প্রত্যেকেই বিয়ে করে। তথাপি তাদের ক্ষেত্রে কিছু বাধা আছে, কারণ তাদের পক্ষে সাধারণত খুব কম বয়সে বিয়ে করা সম্ভব হয় না। বিবাহেচ্ছুদের প্রমাণ করতে হয় যে তারা তাদের স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ জোগাতে সমর্থ এবং সাধারণত বিয়ের কনেকে তার বাপ-মায়ের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত অর্থ তাদের উপার্জন করতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য উপকরণ সংগ্রহের সমস্যা সভ্য জাতিগুলোর তুলনায় অ-সভ্য জাতিগুলোর জনসংখ্যাকে অনেক বেশি সরাসরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, কারণ সমস্ত উপজাতিরাই কয়েক বছর অন্তর সাংঘাতিক দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। দুর্ভিক্ষের সময় অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে বাধ্য হয় তারা এবং অচিরেই তাদের শরীর ভেঙে পড়ে। দুর্ভিক্ষের সময় এবং পরে তাদের পেটের অস্বাভাবিক আকার ও কৃশকায় অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যাপারে অনেক খবরই প্রকাশিত হয়েছে। এইসময় তারা খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে এবং তাদের শিশুদের একটি বড় অংশ অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে—যেমনটি আমি নিজের চোখে দেখেছি অস্ট্রেলিয়ায়। যেহেতু দুর্ভিক্ষগুলো কয়েক বছর অন্তর কিছু বিশেষ ঋতুর ওপর নির্ভরশীল, সেইজন্য তাদের জনসংখ্যাও ওইসঙ্গেই বাড়ে-কমে। খাদ্যের নিয়মিত জোগান না থাকার দরুন তাদের জনসংখ্যা কখনোই দ্রুতহারে ও নিয়মিতভাবে বাড়তে পারে না। আবার যখন তারা খাদ্য সংগ্রহের জন্য বাধ্য হয়ে এক অপরের এলাকায় ঢুকে পড়ে, তখন তার মীমাংসা হয় লড়াইয়ের মাধ্যমে—অবশ্য প্রায় সব সময়ই তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকে। এছাড়া খাদ্য অন্বেষণের সময় তারা জলে-স্থলে নানা বিপদের সম্মুখীন হয় এবং কোনো কোনো দেশে জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণে তাদের প্রাণসংশয় হতেও দেখা যায়। এমনকী ভারতবর্ষের কোনো কোনো লোকালয় বাঘের আক্রমণে প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে বলেও জানা যায়।
অধ্যাপক ম্যালথাস জনসংখ্যা বৃদ্ধির এইসমস্ত বাধা নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু তিনি শিশুহত্যা, বিশেষ করে কন্যা-শিশুহত্যার-বিষয়টির ওপর যথেষ্ট জোর দেননি যা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এবং গর্ভপাত ঘটানোর বিষয়টি সম্পর্কেও প্রায় নিরুচ্চারই থেকে গেছেন। এই রীতিগুলো এখনও পৃথিবীর নানা অঞ্চলে টিকে আছে এবং সম্ভবত শিশুহত্যা, মি. স্লেন্যান্-এর তথ্যানুযায়ী, আগে আরও ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এই রীতিগুলো অ-সভ্য জাতিগুলোর মধ্যে প্রবর্তিত হওয়ার কারণ সম্ভবত এই যে, তারা বুঝতেপেরেছিল জন্ম নেওয়া সমস্ত শিশুকে প্রতিপালন করার সামর্থ্য তাদের নেই। লাম্পট্যও জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধের একটা কারণ হতে পারে, তবে এটা জীবনধারণের উপকরণ সংগ্রহের অক্ষমতা থেকে উদ্ভূত নয়। অবশ্য এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে কোথাও কোথাও (যেমন জাপানে) জনসংখ্যা কমানোর জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এই ল্যাম্পট্যকে প্ররোচনা দেয়া হতো।
মানুষ তার মনুষ্যত্বের উপলব্ধিতে পৌঁছনোর আগেকার সেই সুদূর যুগে যদি আমরা ফিরে যাই, তাহলে দেখতে পাব তারা সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা যতটা পরিচালিত হতো যুক্তির দ্বারা ততটা নয়, এমনকী আজকের দিনের একেবারে নিম্নশ্রেণির অ-সভ্য লোকেদের তুলনায়ও তাদের যুক্তিবুদ্ধির পরিমাণ ছিল অনেক কম। সেইসময় আমাদের আধা-মানুষ পূর্বপুরুষেরা শিশুহত্যা বা মেয়েদের বহু-স্বামী প্রথা রপ্ত করেনি, কারণ নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের সহজাত প্রবৃত্তি কখনো এত বিকৃত[১৮] নয় যে তারা নিয়মিত তাদের নিজেদের সন্তানকে হত্যা করবে কিংবা তাদের স্ত্রীর ওপর অন্যের আধিপত্য নির্দ্বিধায় মেনে নেবে। তাদের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে দূরদর্শিতাসঞ্জাত কোনো বাধা ছিল না এবং নারী-পুরুষরা অল্প বয়সেই একে অপরের সঙ্গে দৈহিক মিলনে প্রবৃত্ত হতো। তাই মানুষের পূর্বপুরুষেরা দ্রুত তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিল, কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যও নিশ্চয়ই সাময়িক কিংবা স্থায়ী কোনো-না-কোনো প্রাকৃতিক বাধাদানের ব্যবস্থা ছিলই, এমনকী বর্তমানের অ-সভ্য জাতিগুলোর তুলনায় ও তাদের ক্ষেত্রে এই বাধা আরও বেশি ছিল। অবশ্য অধিকাংশ জীবজন্তুর ক্ষেত্রে এইসমস্ত বাধার প্রকতির ব্যাপারে আমরা কতটুকুই বা জানি। মানুষের সম্বন্ধেও তার থেকে বেশি কিছু আমাদের জানা নেই। ঘোড়া ও গবাদি পশুদের প্রজননক্ষমতা বেশ কম, কিন্তু যখন তাদের দক্ষিণ আমেরিকায় খোলামেলা পরিবেশে ছেড়ে দেয়া হলো, দেখা গেল ব্যাপক হারে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের পরিচিত যাবতীয় প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে কম সন্তান-উৎপাদক হাতিরা এখন যে-হারে প্রসব করছে যদি সেইভাবেই করে যায়, তাহলে কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই সমস্ত পৃথিবী হাতিতে ভরে যাবে। বানরদের প্রতিটি প্রজাতির ক্ষেত্রে সংখ্যা বৃদ্ধি অবশ্যই কিছু উপায় দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত, তা বলে অধ্যাপক ব্রেহ্ম নির্দেশিত শুধুমাত্র শিকারি জন্তুদের আক্রমণের দ্বারা নয়। এটা অচিন্ত্যনীয় যে আমেরিকার বন্য ঘোড়া ও গবাদি পশুর বংশবৃদ্ধি করার প্রকৃত ক্ষমতা প্রথমদিকে স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত বেশি ছিল এবং প্রতিটি অঞ্চল তাদের বংশবৃদ্ধির দরুন ভরে যাওয়ার পরই সেই ক্ষমতা সীমিত হয়ে গেল। সন্দেহ নেই যে এক্ষেত্রে বা অন্যান্য বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধা দেখা দেয় এবং এই বাধাগুলোর প্রকার ভিন্ন ভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সম্ভবত প্রতিকূল ঋতু ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল পর্যায়ক্রমিক খাদ্যাভাবই এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এসব কারণেই হয়তো মানুষের আদি পূর্বপুরুষদের সংখ্যাও তেমন বাড়তে পারেনি
প্রাকৃতিক নির্বাচন
এখানে আমরা দেখলাম শারীরিক ও মানসিক গঠনে মানুষ বিভিন্ন হয় এবং এই বৈসাদৃশ্য ঘটে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে একই স্বাভাবিক কারণে ও একই স্বাভাবিক নিয়ম মেনে, ঠিক যেমনটি দেখা যায় নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের ক্ষেত্রে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে মানুষ এবং অবিরাম ছড়িয়ে পড়ার সময় বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে সে। একই গোলার্ধের একদিকে টিয়েরা দেল ফুয়েগো, উত্তমাশা অন্তরীপ ও তাসমানিয়া, এবং অন্য গোলার্ধে উত্তরমেরু অঞ্চলের অধিবাসীরা নিশ্চয়ই নানান প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেছে এবং নিজেদের বর্তমান বাসভূমিতে পৌঁছনোর আগে তারা নিশ্চয়ই বহুবার তাদের শারীরিক ও মানসিক অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। অন্যান্য জীবজন্তুর মতো মানুষের আদি পূর্বপুরুষেরাও নিশ্চয়ই যে-হারে সংখ্যা বৃদ্ধি করত তার তুলনায় তাদের জীবন ধারণের উপকরণ মোটেই পর্যাপ্ত ছিল না। ফলে প্রায়শই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইতে নামতে হতো তাদের এবং সক্রিয় হয়ে উঠত প্ৰাকৃতিক নির্বাচনের অমোঘ নিয়ম। এইভাবে সমস্ত রকমের সুবিধাজনক পরিবর্তনগুলো ঘটনাক্রমে বা নিয়মিতভাবে রক্ষা পেয়েছে এবং যেগুলো ক্ষতিকারক সেগুলো লুপ্ত হয়ে গেছে। আমি দৈহিক গঠনের এমন কোনো উল্লেখযোগ্য বিচ্যুতির কথা বলছি না যা শুধুমাত্র দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেই ঘটে থাকে, বলছি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পার্থক্যের কথাই। যেমন, আমরা জানি আমাদের হাত ও পায়ের পেশি যা আমাদের চলতে-ফিরতে সাহায্য করে, তা নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের[১৯] মতোই নিরন্তর পরিবর্তনশীল। সেক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের পূর্বপুরুষেরা বিশেষত যে-অঞ্চলের পরিবেশে কিছু প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটেই চলেছে, যদি দুটি সমান অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ত যার অর্ধাংশের অন্তর্ভুক্ত হত সেইসব মানুষেরা যারা তাদের জীবিকা নির্বাহ বা আত্মরক্ষার জন্য প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সবচেয়ে ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারত, তাহলে দেখা যেত যে কম মানসিক উৎকর্ষসম্পন্ন অন্য অর্ধাংশের তুলনায় নিজেদের অনেক বেশি সংখ্যায় বাঁচিয়ে রাখতে এবং অনেক বেশি সংখ্যায় বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হতো তারা।
পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়ার সময় থেকে শুরু করে যে-সব কঠিন বা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে এখন টিকে রয়েছে মানুষ তা থেকে বলা যায় যে সে-ই ইচ্ছে জীবজগতের সবচেয়ে প্রবল প্রাণী। অন্য যে-কোনো উন্নত প্রাণীর চেয়ে অনেক ব্যাপকভাবে সে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীময় এবং অন্যান্য সমস্ত প্রাণী তার কাছে নতিস্বীকার করেছে। স্পষ্টতই সে এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে তার শারীরিক কাঠামো, উন্নত বুদ্ধিমত্তা এবং সামাজিক অভ্যাসের মাধ্যমে, যা তাকে তার সঙ্গীসাথিদের সাহায্য ও রক্ষা করতে প্রণোদিত করে থাকে। এইসমস্ত বৈশিষ্ট্যের সুগভীর তাৎপর্য প্রমাণিত হয়েছে জীবনযুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফলের মধ্যেই। আবার তার বুদ্ধিমত্তার শক্তি দিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে স্পষ্ট ও সুবিন্যাস্ত কথা বলার ভাষা, যার ওপরেই তার এই চমকপ্রদ অগ্রগতি মূলত নির্ভরশীল। মি. চসি রাইট বলেছেন, ‘কথা বলার জন্য ভাষাকে রপ্ত করার প্রক্রিয়ার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে এমনকী এ-ব্যাপারে খুব সামান্য পারদর্শী হয়ে ওঠার জন্যও যে পরিমাণ মস্তি ষ্ক-খরচ করতে হয়, তা অন্য যে-কোনো ব্যাপারে পারদর্শী হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় মস্তিষ্ক-খরচের তুলনায় অনেক বেশি।’ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি, পশু ধরার ফাঁদ ইত্যাদি আবিষ্কার করেছে সে এবং সেগুলোকে ব্যবহার করতেও শিখেছে। এ-সবের সাহায্যে সে আত্মরক্ষা করে, জীবজন্তু ধরে বা শিকার করে এবং অন্যভাবে খাদ্য-সংগ্রহ করে। ভেলা বা ডোঙা তৈরি করেছে মাছ ধরা বা পার্শ্ববর্তী উর্বর দ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য। আগুন জ্বালানোর কৌশল আবিষ্কার করেছে, যার সাহায্যে কঠিন শিকড়বাকড়কে খাওয়ার উপযুক্ত এবং বিষাক্ত ফলমূলকে ত্রুটিমুক্ত করে তোলা যায়। সুপ্রাচীনকাল থেকে বিচার করলে দেখা যায়, একমাত্ৰ ভাষা আবিষ্কার বাদে এই আগুন জ্বালানোর কৌশল আবিষ্কারই মানুষকৃত সমস্ত আবিষ্কারের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এইসমস্ত আবিষ্কারের সাহায্যে মানুষ কঠিনতম পরিবেশ ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে এবং এই আবিষ্কারগুলো নিঃসন্দেহেই তার পর্যবেক্ষণশক্তি, স্মৃতিশক্তি, কৌতূহলস্পৃহা, কল্পনাপ্রবণতা ও যুক্তিনির্ভর কাজকর্মের ক্রমোন্নতিরই প্রত্যক্ষ ফল। আর তাই আমি বুঝে উঠতে পারি না কীভাবে মি. ওয়ালেস[২০] মন্তব্য করেন যে, ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা মানুষের পূর্বপুরুষদের মস্তিষ্ক বানরদের তুলনায় সামান্য উন্নত হয়েছিল।’
মানুষের মননগত ক্ষমতা ও সামাজিক অভ্যাসগুলো তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার দৈহিকগঠন-আকৃতির গুরুত্বকেও অস্বীকার করা যায় না। সেই কারণে এই বিষয়টি নিয়েই এই পরিচ্ছেদের বাকি অংশটুকুতে আলোচনা করছি আমরা এবং মননগত ও সামাজিক বা নৈতিক বিষয়ের উন্নতি সংক্রান্ত আলোচনা রাখা হয়েছে অন্য একটি পরিচ্ছেদে।
একটি হাতুড়িকে ঠিকঠাক চালানোও যে খুব সহজ নয়, তা ছুতোর মিস্ত্রির কাজ শিখতে যাওয়া যে-কোনো লোককে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। একজন ফুজিয়ানের মতো অব্যর্থ নিশানায় পাথর ছুঁড়ে নিজেকে রক্ষা করা বা পাখি শিকার করা আসলে হাত, বাহু ও কাঁধের পেশিগুলোর আন্তঃসম্পর্কিত কাজের চূড়ান্ত নৈপুণ্যেরই ফল এবং সেইসঙ্গেই একটি চমৎকার শিল্পগুণও বটে। একটি পাথর বা বর্শা ছোড়ার সময় এবং অন্যান্য কাজের সময় একজন মানুষকে দৃঢ় পায়ে দাঁড়াতে হয় এবং সেখানেও একই সময় যুগপৎ অসংখ্য পেশির পূর্ণ ব্যবহার দেখা যায়। স্থূল মন্ত্র বানানোর জন্য পাথর ভেঙে একটি ছোট্ট টুকরো বের করা অথবা হাড় দিয়ে কোনো ধারালো বর্শা বা বঁড়শি তৈরি করার জন্যও অত্যন্ত নিখুঁত কারিগরি জ্ঞানের দরকার হয়। মি. স্কুলক্যাফ্ট[২১]- এর মতো একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন যে পাথরের টুকরো দিয়ে বানানো ছুরি, বল্লম বা তিরের ফলা তৈরি করার জন্য প্রয়োজন হয় ‘অসাধারণ দক্ষতা ও সুদীর্ঘ অনুশীলন।’ আদিম মানুষের মধ্যে যে শ্রম-বিভাজন ছিল, তা এই কথার সত্যতাকেই প্রমাণ করে। প্রত্যেক মানুষ তার প্রয়োজনমতো পাথরের অস্ত্রশস্ত্র বা মৃৎপাত্র তৈরি করে নিত না, বরং নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি এইসমস্ত কাজে ব্যাপৃত থাকত এবং তার বিনিময়ে অবশ্যই তারা শিকারের ভাগ পেত। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, ঘষা পাথরের অংশ থেকে মসৃণ যন্ত্র তৈরি করার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষদের দীর্ঘ সময় লেগেছিল। নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে নিখুঁত নিশানায় পাথর ছোঁড়ার জন্য অথবা পাথর দিয়ে নানা স্থূল যন্ত্ৰ তৈরি করার জন্য মানুষ-সদৃশ প্রাণীরা হাত ও বাহুর এক দারুণ উৎকর্ষতায় পৌঁছেছিল এবং যথেষ্ট অনুশীলন করলে যান্ত্রিক দক্ষতার ব্যাপারে তারা অবশ্যই সুসভ্য মানুষের মতো প্রায় সবকিছুই তৈরি করতে পারত। এই প্রসঙ্গে হাতের গঠনের সঙ্গে স্বরযন্ত্রের তুলনা করা যেতে পারে। আমরা জানি, বানরদের স্বরযন্ত্র চিৎকার করে নানা সংকেত জানানোর কাজে লাগে, বা একটি প্রজাতির ক্ষেত্রে সুশ্রাব্য স্বরপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। মানুষের স্বরযন্ত্রও প্রায় একইরকম কিন্তু বংশপরম্পাক্রমে ব্যবহারের ফলে তা স্পষ্ট করে কথা বলার কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
মানুষের সঙ্গে নিকট-সাদৃশ্য আছে এমন চার হাত-পা যুক্ত প্রাণীদের বা আমাদের পূর্বপুরুষদের সবচেয়ে চমৎকার প্রতিনিধিদের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব ওইসমস্ত প্রাণীদের হাত আমাদের হাতের মতো একই সাধারণ নিয়মে গঠিত, কিন্তু বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের হাত ততটা উপযোগী হয়ে ওঠেনি। নিজেদের হাতকে তারা কুকুরের সামনের পায়ের মতো একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার কাজে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারে না। যেমন, শিম্পাঞ্জি ও ওরাংওটাং-এর মতো বানররা হাঁটার সময় হাতের তালুর বহিরাংশ বা আঙ্গুলের গাঁট ব্যবহার করে থাকে। তাদের হাত গাছে ওঠার পক্ষেই সব থেকে উপযোগী। বানরেরা যখন গাছের ডাল বা ঝুরি আঁকড়ে ধরে, তখন ঠিক আমাদের মতোই তাদের বুড়ো আঙ্গুল থাকে একপাশে আর অন্যপাশে থাকে বাকি চারটি আঙ্গুল ও হাতের তালু। এইভাবে তারা অনেক বড় বড় জিনিসপত্রও মুখের কাছে তুলতে পারে, যেমন বোতলের গলা ধরে মুখের মধ্যে জল ঢেলে দিতে পারে। বেবুনরা হাত দিয়ে পাথর সরাতে সক্ষম এবং মাটি আঁকড়ে গাছের শিকড় টেনে তুলতে পারে। এরা আবার বুড়ো আঙ্গুলকে অন্যান্য আঙ্গুলের বিপরীত দিকে রেখে বাদাম, পোকামাকড় ও নানারকম ছোট জিনিস ধরতে পারে এবং এসব তারা পাখির বাসা থেকে ডিম ও বাচ্চা তুলে আনে। আমেরিকান বানররা জংলি কমলালেবুকে গাছের ডালে জোরে জোরে ঠুকতে থাকে যতক্ষণ না ফলটার খোসায় চিড় ধরে, তারপর দু- হাতের আঙ্গুল দিয়ে খোসাটা ছাড়িয়ে ফেলে। শক্ত খোসাওয়ালা ফলগুলোকে পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে খোসাটা ভেঙে ফেলে ফলটা বার করে নেয়। কিছু কিছু বানর শামুকজাতীয় প্রাণীর খোলা দুই বুড়ো আঙ্গুলের সাহায্যে ছাড়ায়। তাছাড়া আঙ্গুল দিয়ে এরা শরীরের কোনো অংশে ফুটে যাওয়া কাঁটা-জাতীয় কিছু টেনে তোলে এবং একে অপরের উকুন ইত্যাদি বেছে দেয়। এরা পাথর গড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে অথবা শত্রুকে লক্ষ্য করে তা ছুঁড়ে দিতেও পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ-কথা বলতেই হয় যে এইসমস্ত কাজ এরা খুব-একটা পরিপাটিভাবে করতে পারে না, এবং আমি নিজের চোখে দেখেছি যে নিখুঁত লক্ষ্যে পাথর ছুঁড়তে এরা নিতান্তই অক্ষম।
যেহেতু বানররা ‘কোন-কিছুকে ঠিকমতো আঁকড়ে ধরতে পারে না’, অতএব ‘আঁকড়ে ধরার জন্য তাদের কোনো নিম্নতর মানের অঙ্গ’ থাকলে সেটা তাদের বর্তমান হাতের মতো একই কাজ করতে পারত—এই কথাটা আমার মোটেই সত্য বলে মনে হয় না। বরং নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে, আরও যথাযথভাবে গঠিত হাত তাদের পক্ষে যথেষ্টই সুবিধাজনক হতে পারত, অবশ্য তার ফলে তাদের গাছে চড়ার ক্ষমতা কমে গেলে আলাদা কথা। আমরা ধরেই নিতে পারি যে, মানুষের মতো এমন নিখুঁত গড়নের হাত গাছে চড়ার পক্ষে খুব একটা সুবিধাজনক নয়, কারণ পৃথিবীর অধিকাংশ বৃক্ষবাসী বানরদের ক্ষেত্রে—যেমন আমেরিকার এটেল্স, আফ্রিকার কলোবাস এবং এশিয়ার হাইলোবে—দেখা যায় যে, হয় তাদের বুড়ো আঙ্গুল নেই অথবা আঙ্গুলগুলো এমনভাবে জুড়ে থাকে যে হাত-পাগুলো স্রেফ ঝুলে থাকার আঁকশি হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।[২২]
জীবিকানির্বাহের ধারা পরিবর্তনের ফলে বা পারস্পরিক অবস্থার পরিবর্তনের দরুন উচ্চশ্রেণির বনমানুষদের পূর্বপুরুষেরা যেদিন গাছ থেকে নেমে এলো, সেদিন থেকেই তাদের বিকাশের স্বাভাবিক ধারাও বদলাতে শুরু করল এবং তার ফলে তারা আরও নির্দিষ্টভাবে চতুষ্পদ বা দ্বিপদ হয়ে উঠল 1 বেবুনরা সাধারণত পাথুরে ও পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করে, খুব প্রয়োজন না হলে উঁচু গাছে ওঠে না এবং তাদের চলনভঙ্গি প্রায় কুকুরের মতোই। একমাত্র মানুষই দ্বিপদ জীবে উন্নীত হয়েছে এবং আমরা এখন অন্তত খানিকটা বুঝতে পারছি কীভাবে সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখেছিল, যা তার একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। হাতের ব্যবহার না শিখলে মানুষ আজকের পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারত না, কারণ মানুষের হাত তার ইচ্ছার সঙ্গে তাল রেখে কাজ করার ব্যাপারে দারুণ উপযোগী হয়ে উঠেছে। স্যর সি. বেল জোর দিয়ে বলেছেন যে, (মানুষের) ‘হাত তাকে সমস্ত রকম রসদ জোগান দেয় এবং বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে হাতের নিবিড় সংযোগ মানুষকে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য অর্জনের ক্ষমতা।’ কিন্তু যতদিন পর্যন্ত মানুষের হাত ও বাহু শুধুমাত্র একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়া-আসার জন্য এবং শরীরের পুরো ভার বহন করার জন্য ব্যবহৃত হতো অথবা যতদিন পর্যন্ত এগুলো গাছে চড়ার পক্ষে দারুণ উপযোগী ছিল, ততদিন পর্যন্ত মানুষের হাতে ও বাহু অস্ত্র বানানো অথবা নিখুঁত লক্ষ্যে পাথর ও বর্শা ছোঁড়ার মতো কাজ করার উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। গাছে চড়ার মত রুক্ষ কাজকর্মের ফলে হাত ও বাহুর স্পর্শানুভূতিও ভোঁতা হয়ে যায়, আর এই অনুভূতির ওপরেই ওগুলোর চমৎকার ব্যবহার বহুলাংশে নির্ভর করে। এইসমস্ত কারণসমূহ নিঃসন্দেহে মানুষকে দ্বিপদ হতে বাড়তি সাহায্য করেছে। কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে যেগুলো করার জন্য বাহু তথা শরীরের ঊর্ধ্বাংশ মুক্ত থাকা একান্তই অপরিহার্য, আর তাই মানুষকে দু’পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখতে হয়েছে। এই বিশাল সুবিধেটা অর্জন করার জন্য তার পায়ের পাতা চ্যাটালো হয়ে উঠল এবং পায়ের বুড়ো আঙ্গুলও দারুণ রকম বদলে গেল। কিন্তু এর অনিবার্য ফলস্বরূপ তার গাছের ডাল আঁকড়ে ধরার বিশেষ ক্ষমতাটি প্রায় পুরোপুরিভাবে লোপ পেল। জীবজগতের সর্বত্র শারীরবৃত্তীয় শ্রমবিভাজনের যে-নীতি চোখে পড়ে, এই ঘটনা তার সঙ্গে পুরোপুরি সাযুজ্যপূর্ণ। নীতিটি হলো—আঁকড়ে ধরার কাজে হাত যতই পোক্ত হয়ে ওঠে, শরীরের ভার বহন করা এবং একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার কাজে পা-ও ততই পরিশীলিত হয়ে ওঠে। অবশ্য কিছু কিছু বন্য মানুষের মধ্যে দেখা যায় তাদের পায়ের আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা এখনও পুরোপুরিভাবে লোপ পায়নি। তাদের গাছে ওঠার ধরন ও আরও অনেক কাজের মধ্যে এটা লক্ষ করা যায়।[২৩]
দু’পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা এবং হাত বাহু মুক্ত হয়ে যাওয়া যদি মানুষের পক্ষে সুবিধাজনক হয় (এবং জীবনযুদ্ধে তার দারুণ সাফল্যের দিকে তাকালে এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহই থাকে না), তাহলে আমি এমন কোনো কার্যকারণ দেখতে পাই না যে কেন সেকালে মানুষের পূর্বপুরুষদের পক্ষেও ক্রমশ সোজা হয়ে দাঁড়ানো বা দ্বিপদী হয়ে ওঠাটা সুবিধাজনক হবে না। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জন্যই তারা আরও ভালোভাবে সমর্থ হয়েছে পাথর বা লাঠি দিয়ে আত্মরক্ষা করতে, শিকারের জন্তু-জানোয়ারদের আক্রমণ করতে এবং খাদ্য সংগ্রহ করতে। এবং সেই কারণেই সবচেয়ে উন্নত প্রাণীরাই পরবর্তীকালে সবচেয়ে বেশি সাফল্য লাভ করেছে এবং সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় টিকে থেকেছে। গরিলা ও তাদের সমগোত্রীয় কিছু প্রাণী যদি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত, তাহলে খুব জোরগলায় ও আপাত-সত্যতার সঙ্গে বলা যেত যে, কোনো প্রাণী তার চতুষ্পদ অবস্থা থেকে ক্রমশ দ্বিপদে রূপান্তরিত হতে পারে না, কারণ সেক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের কোনো-একটি মধ্যবর্তী অবস্থায় সেই প্রজাতির সকল প্রাণীই প্রগতির পক্ষে একেবারে অনুপযুক্ত হয়ে পড়ত। কিন্তু আমরা জানি (এবং এটা সত্যিই ভাববার মত বিষয়) যে, বনমানুষেরা প্রকৃতপক্ষে এখন একটি মধ্যবর্তী অবস্থাতেই রয়েছে এবং তারা মোটের ওপর জীবনের বিভিন্ন অবস্থার সঙ্গে বেশ ভালোভাবে খাপ খাইয়েও নিয়েছে। যেমন, গরিলারা সামনের দিকে এঁকেবেঁকে টলতে টলতে এগোয়, কিন্তু বেশির ভাগ সময় অগ্রসর হয় তাদের ঝুলে-থাকা হাতের সাহায্যে। আবার দীর্ঘবাহু বানররা মাঝে মাঝে তাদের হাত দুটোকে ক্রাচের মতো ব্যবহার করে, দু’হাতের মাঝখানে শরীরটাকে এদিক-ওদিক দুলিয়ে অগ্রসর হয়। কয়েক ধরনের হাইলোবে বানর আছে যাদেরকে না শেখালেও তারা বেশ জোরে হাঁটতে বা দৌড়তে পারে। অবশ্য তাদের এই হাঁটা বা দৌড়নো খানিকটা এলোমেলো, মানুষের মতো দৃঢ়ভাবে পা ফেলার ক্ষমতা তাদের নেই। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি পৃথিবীতে বিদ্যমান বানররা চতুষ্পদ ও দ্বিপদের মধ্যবর্তী একটি জায়গায় অবস্থান করছে, এবং কুসংস্কারমুক্ত মন নিয়ে বিচার করলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বনমানুষ জাতীয় বানরেরা আকৃতির দিক থেকে চতুষ্পদীর তুলনায় দ্বিপদীর (মানুষের) সঙ্গেই অনেক বেশি সাদৃশ্যযুক্ত।
মানুষের পুর্বপুরুষেরা যত বেশি সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখল, তাদের হাত ও বাহু যত বেশি মুঠো করে ধরা ও অন্যান্য কাজের উপযোগী হয়ে উঠতে লাগল, তাদের পা ও পায়ের পাতা যত বেশি করে ভর দিয়ে দাঁড়ানো ও হেঁটে চলার উপযুক্ত হয়ে উঠল, ততই তাদের শারীরিক গঠনের আরও অসংখ্য পরিবর্তন জরুরি হয়ে উঠল। কোমরের হাড়, বস্তিদেশ (pelvis) আরও চওড়া হতে লাগল, মেরুদণ্ড অদ্ভুতভাবে বেঁকে গেল এবং মাথার অবস্থানও পরিবর্তিত হলো। এই সমস্ত পরিবর্তনগুলোই মূর্ত হয়ে উঠল মানুষের শরীরে। অধ্যাপক শ্যাফহউসেন লিখেছেন, “মানব-করোটির শক্তিশালী ম্যাস্টয়েড প্রক্রিয়া (কানের ঠিক পিছনে মধ্যকর্ণের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য স্নায়ুকোষপূর্ণ ছোট ঢিবি) তার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ফলস্বরূপই সৃষ্টি হয়েছে।’ এই প্রক্রিয়াটি ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জি ইত্যাদির মধ্যে অনুপস্থিত, আর গরিলাদের মধ্যে এর দেখা মিললেও মানুষের তুলনায় তা বেশ ছোটই। মানুষের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আরও কিছু গঠনগত পরিবর্তনের কথাও এখানে আলোচনা করা যেতে পারে। অবশ্য পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এই পরিবর্তনগুলো কতটা প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফল আর কতটা কতকগুলো অঙ্গের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের অথবা একটা অঙ্গের ওপর আর-একটা অঙ্গের ক্রিয়ার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ফলাফল—সেটা বলা মুশকিল। পরিবর্তনের এসব উপায়গুলো প্রায়শই একে অপরকে সহযোগিতা করে থাকে। তাই যখন হাড়ের অন্ত্যাংশ (crest) ও তার সঙ্গে যুক্ত পেশিসমূহ নিয়মতি ব্যবহারের ফলে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, তখন বোঝ যায় যে নির্দিষ্ট কিছু কাজ অভ্যাসগতভাবে সম্পাদন করা হয়েছে এবং সেগুলো অবশ্যই সুবিধাজনক ছিল। তাই যে-সমস্ত প্রাণীরা এসব কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে সম্পাদন করতে পেরেছিল, তারা অনেক বেশি সংখ্যায় টিকে থাকতে পেরেছে।
হাত ও বাহুর স্বাধীন ব্যবহার, যা মানুষের সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আংশিক কারণ ও আংশিক ফলাফল, তা দৈহিক গঠনের অন্যান্য রূপান্তরগুলোকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছে। আগেই বলা হয়েছে যে মানুষের আদি পূর্বজদের মধ্যে পুরুষদের সম্ভবত বড় বড় কেনাইন বা ছেদক দাঁত ছিল। কিন্তু শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য তাদের মধ্যে পাথর, লাঠি ও অন্যান্য হাতিয়ার ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে ওঠার ফলে তাদের চোয়াল ও দাঁতের ব্যবহার ক্রমশ কমে এলো। এক্ষেত্রে দাঁতের সঙ্গে সঙ্গে চোয়ালের আকারও হ্রাস পেল। এই ধরনের অসংখ্য ঘটনা লক্ষ করলে এ-কথার সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। পরবর্তী একটি পরিচ্ছেদে আমরা এর সঙ্গে নিকট সাদৃশ্যযুক্ত একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। আমরা দেখতে পাব যে রোমন্থক গ্রন্থিগুলো প্রাণীদের (যেমন গরু) মধ্যে পুরুষদের কেনাইন দাঁতের ক্রমহ্রাসপ্রাপ্ত বা সম্পূর্ণ অবলুপ্তি আপাততভাবে তাদের শিঙের বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, এবং ঘোড়াদের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে যে ইন্সাইসর বা কৃন্তক-দাঁত ও ক্ষুরের সাহায্যে লড়াই করার অভ্যাসের সঙ্গে তাল মিলিয়েই তাদের কেনাইন দাঁত হ্রাসপ্রাপ্ত বা অবলুপ্ত হয়েছে।
অধ্যাপক রুতিমেয়ার এবং অন্যান্য আরও অনেকে জোর দিয়ে বলেছেন, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ-বনমানুষদের চোয়ালের পেশি যখন অত্যন্ত উন্নত অবস্থায় পৌঁছয়, তখন সেটা করোটির ওপর প্রভাব বিস্তার করে এবং তার ফলেই মানুষের সঙ্গে নানা বিষয়ে তাদের অনেক পার্থক্য দেখা দেয়, আর এই প্রজাতির প্রাণীদের ‘যথার্থই ভয়ানক মুখমণ্ডল’ গড়ে তোলে। মানুষের পূর্বপুরুষদের চোয়াল ও দাঁত আকারে ছোট হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিণত করোটি ক্রমশই আজকের মানুষের করোটির মতো হয়ে উঠল। পরে আমরা এ-ও দেখব যে পুরুষমানুষদের কেনাইন দাঁতের ক্রমহ্রাসপ্রাপ্তি বংশগতির মাধ্যমে নারীদের দাঁতকেও প্রভাবিত করেছে।
বিভিন্ন মানসিক ক্ষমতা ধীরে ধীরে উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের আয়তনও বেড়ে গেল। এ-কথা নিঃসংশয়েই বলা চলে যে গরিলা বা ওরাংওটাং-এর শরীরে মস্তিষ্কের যা আয়তন, তার তুলনায় মানুষের শরীরে মস্তিষ্ক অনুপাতে অনেক বড়, এবং তার উন্নততর মানসিক ক্ষমতার সঙ্গে এই ব্যাপারটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত। পোকামাকড়দের মধ্যেও প্রায় একইরকম ব্যাপার দেখা যায়। পিঁপড়েদের সেরিব্রাল গ্যাংলিয়া (মস্তিষ্কের স্নায়ু) অস্বাভাবিকভাবে রকমের বড় হয় এবং সমস্ত হাইমেনোপটেরার (পিঁপড়ে, বোলতা, মৌমাছি ইত্যাদি) মধ্যেই এই গ্যাংলিয়া অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণীদের চেয়ে (যেমন গুবরে পোকা) অনেক গুণ বড় হয়ে থাকে।[২৪] অন্যদিকে, দুটি জন্তুর কিংবা দু’জন মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে তাদের করোটির মোট অন্তর্বস্তুর সাহায্যে নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা যায় বলে কেউ মনে করে না। অত্যন্ত ছোট অথচ পূর্ণাঙ্গ স্নায়বিক উপাদানের সাহায্যেও কোনো অস্বাভাবিক মানসিক ক্রিয়াকলাপ চলতেই পারে। তাই দেখা যায় পিঁপড়েদের বিভিন্ন সহজাত প্রকৃতি, মানসিক ক্ষমতা ও সঙ্গীপ্রীতি অত্যন্ত উন্নত ধরনের হয়ে থাকে, যদিও তাদের সেরিব্রাল গ্যাংলিয়া একটি পিনের মাথার এক-চতুর্থাংশের চেয়ে বড় নয়। এই বিচারে পিঁপড়েদের মস্তিষ্ক পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার পরমাণুগুলোর অন্যতম, এমনকী হয়তো মানুষের মস্তিষ্কের চেয়েও চমৎকার।
মানুষের মস্তিষ্কের আকার এবং তার ধীশক্তির উন্নতির মধ্যে যে একটি নিকট সম্পর্ক রয়েছে—এই ধারণার সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় সভ্য ও অ-সভ্য জাতি, আদিম ও আধুনিক মানুষের করোটির মধ্যে তুলনা করলে এবং অন্য সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীদের করোটির সঙ্গে মানুষের করোটির তুলনা করলে। ড. জে. বার্নার্ড ডেভিস অত্যন্ত সযত্ন পরিমাপের সাহায্যে দেখিয়েছেন যে ইউরোপীয়দের করোটির গড়পড়তা আভ্যন্তরীণ আয়তন ৯২.৩ ঘন ইঞ্চি, আমেরিকানদের ৮৭.৫ ঘন ইঞ্চি, এশিয়ানদের ৮৭.১ ঘন ইঞ্চি এবং অস্ট্রেলিয়ানদের এই আয়তন মাত্র ৮১.৯ ঘন ইঞ্চি। অধ্যাপক ব্রকা লক্ষ করেছেন, প্যারিসের ঊনবিংশ শতাব্দীর কবরখানা থেকে পাওয়া করোটি দ্বাদশ শতাব্দীর ভল্টগুলো (পারিবারিক কবরখানা) থেকে পাওয়া করোটির তুলনায় আকারে বড় এবং এই দুই ভিন্ন সময়ের করোটির অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১৪৮৬ ও ১৪২৬। ব্রকা আরও বলেছেন যে, পরিমাপ করে দেখা গেছে এই পরিবর্ধনটা ঘটেছে শুধুমাত্র করোটির সম্মুখ অংশেই—অর্থাৎ যে-অঞ্চলটায় মানুষের বুদ্ধিমত্তা সঞ্চিত থাকে। অধ্যাপক প্রিচার্ড অনুসন্ধান করে দেখেছেন, ব্রিটেনের প্রাচীন অধিবাসীদের তুলনায় বর্তমান অধিবাসীদের ‘মস্তিষ্কের কোটর অনেক বেশি প্রশস্ত’। তা সত্ত্বেও এটা অনস্বীকার্য যে বহু প্রাচীনকালের কিছু করোটি, যেমন নিয়ানডারথালদের বিখ্যাত করোটি, যথেষ্ট উন্নত ও প্রশস্তই ছিল। অধ্যাপক এম. ই. লারটেট[২৫] আজ থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ বছর আগেকার ও বর্তমানের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের করোটির তুলনা করে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের ব্যাপারে এই উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সাম্প্রতিক কালের প্রাণীদের মস্তিষ্কের আয়তন সাধারণত বড় এবং তাদের মস্তিষ্কের ভাঁজ অনেক বেশি জটিল। অন্যদিকে, আমি আগেই দেখিয়েছি যে গৃহপালিত খরগোশের মস্তিষ্কের আয়তন বন্য খরগোশের তুলনায় যথেষ্ট ছোট। বহু প্রজন্ম ধরে এক জায়গায় আবদ্ধ থাকার ফলেই তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা, সহজাত প্রবৃত্তি, ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও স্বেচ্ছামতো চলাফেরা করার ক্ষমতাকে প্রায় কাজে লাগাতে পারেনি, আর তার জন্যই হয়তো এমনটা ঘটেছে।
মানুষের করোটি ও মস্তিষ্কের ক্রমবর্ধিত ওজন তার মেরুদণ্ডের বিকাশকে অবশ্যই প্রভাবিত করেছে, বিশেষ করে যখন সে সোজা হয়ে দাঁড়তে শিখছিল তখন তো বটেই। অবস্থানের এই পরিবর্তন (সোজা হয়ে দাঁড়ানো) ঘটার দরুন মস্তিষ্কের আভ্যন্তরীণ চাপ করোটির আকারকেও পরিবর্তিত করে থাকে। এ-রকম ঝুড়ি ঝুড়ি প্রমাণ আছে যার সাহায্যে দেখানো যেতে পারে করোটি কত সহজে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। অবশ্য মানব-জাতিতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে শিশুদের ঘুমোনোর দোলনার প্রকার অনুযায়ীই করোটির আকারের এই পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। আবার অভ্যাসগত পেশি-সংকোচন ও আগুনে-পোড়া শক্ত মুখের হাড়কে চিরদিনের জন্য বদলে দেয়। শিশুদের মাথা কোনো অসুখের জন্য পাশের দিকে বা পিছনের দিকে হেলে গেলে তাদের যে-কোনো একটি চোখ তা নির্দিষ্ট স্থান পরিবর্তন করে এবং মস্তিষ্কের চাপের ফলে করোটির আকার আপাতভাবে পরিবর্তিত হয়।[২৬] আমি দেখিয়েছি দীর্ঘ-কর্ণযুক্ত খরগোশরা যখন একটি কানকে দ্রুত সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়, তখন সেই সামান্য কারণেও সেই পাশের করোটির প্রায় প্রতিটি হাড় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, ফলে বিপরীত পাশের হাড়গুলো আর কিছুতেই ওই হাড়গুলোর সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ থাকে না। শেষত, যদি মানসিক শক্তির কোনোরকম পরিবর্তন ছাড়াই কোনো প্রাণীর সাধারণ আকার বৃদ্ধি বা হ্রাসপ্রাপ্ত হয় অথবা দৈহিক আকৃতির কোনো বড় রকমের পরিবর্তন ছাড়াই তার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি বা হ্রাস পায় তাহলে তার করোটির আকারও অবশ্যই পরিবর্তিত হবে। গৃহপালিত খরগোশদের পর্যবেক্ষণ করেই এই সিদ্ধান্তে এসেছি আমি। এদের কেউ কেউ বন্য খরগোশদের চেয়েও আকারে বড় হয় আর বাদবাকিরা তাদের স্ব-আকারেই থেকে যায়। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই শরীরের আকারের তুলনায় মস্তিষ্কের আয়তন যথেষ্ট হ্রাস পায়। ওইসমস্ত খরগোশদের করোটি যে দীর্ঘায়ত বা দীর্ঘ চোয়ালযুক্ত, তা দেখে প্রথমে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। যেমন, প্রায় সমান বিস্তৃতিবিশিষ্ট দুটি খরগোশের করোটির কথা উল্লেখ করা যায়, যাদের একটি ছিল বন্য ও অপরটি বেশ বড় জাতের গৃহপালিত খরগোশ। এদের করোটির দৈর্ঘ্য ছিল যথাক্রমে ৩.১৫ ইঞ্চি ও ৪.৩ ইঞ্চি। বিভিন্ন জাতির মানুষদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায় তাদের করোটির আকারে, কারও কারও ক্ষেত্রে তা লম্বাটে ধরনের, কারও কারও ক্ষেত্রে গোল, এবং এখানে খরগোশদের ঘটনাটি দিয়ে এই বিষয়টিকে বেশ ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে বলে মনে হয়। কারণ, ওয়েল্কার লক্ষ করেছেন, ‘খাটো লোকেরা অনেক বেশি ছোট চোয়ালযুক্ত (brachycephaly) হয়, আর লম্বা লোকেদের চোয়াল বেশ দীর্ঘ (dolichocephaly) হয়ে থাকে, আর সেইজন্য লম্বা লোকেদের তুলনা করা যেতে পারে চওড়া ও দীর্ঘ শরীরবিশিষ্ট খরগোশদের সঙ্গে, যাদের প্রায় সকলের মধ্যেই লম্বাটে কারোটি বা দীর্ঘ চোয়াল দেখা যায়।
এই সমস্ত ঘটনা থেকে আমরা খানিকটা হলেও বুঝতে পারছি কীভাবে মানুষ বৃহদাকার ও খানিকটা গোলাকৃতি করোটি লাভ করেছে এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টতই তাকে নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের থেকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে।
মানুষ ও নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মধ্যে আর একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য হলো মানুষের নির্লোম দেহত্বক। তিমিমাছ, শুশুক (সেটাসিয়া), তৃণভোজী সামুদ্রিক- স্তন্যপায়ী প্রাণী (সাইরেনিয়া) ও জলহস্তীর দেহে লোম থাকে না এবং এই লোম না-থাকার ফলে জলের মধ্যে চলাফেরা করতে তাদের সুবিধে হয়। এর জন্য অবশ্য তাদের শারীরিক উষ্ণতার কোনো ব্যাঘাত ঘটে না, কারণ ঠাণ্ডা অঞ্চলে বসবাসকারী প্রজাতির প্রাণীদের দেহে পুরু চর্বির একটি স্তর থাকে, যা সীলমাছ ও ভোঁদড়ের লোমের মতো একই কাজ করে থাকে। হাতি ও গণ্ডারের দেহ প্রায় লোমশূন্য। আবার কিছু কিছু বিলুপ্ত প্রজাতি, যারা আগে অত্যন্ত ঠাণ্ডা পরিবেশে বাস করত, তাদের দেহ লম্বা ও পশম বা লোম দ্বারা আবৃত ছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে এই উভয় ধরনের প্রাণীদের বর্তমান প্রজাতিগুলো প্রখর তাপের এলাকায় এসে পড়ার দরুনই নিজেদের লোম-আচ্ছাদন হারিয়েছে। সম্ভাব্যতার এই ভিত্তি আরও দৃঢ় হয় যখন দেখি যে ভারতীয় হাতিদের মধ্যে উচ্চভূমি ও ঠাণ্ডা অঞ্চলে বসবাসকারী হাতিরা নিম্নভূমির হাতিদের তুলনায় অনেক বেশি লোমাবৃত। তাহলে আমরা কি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে আদিম যুগে কোনো উষ্ণ অঞ্চলে বসবাস করার জন্যই মানুষ লোমবর্জিত হয়েছে? লোম বা চুল যে প্রধানত পুরুষদের বুকে ও মুখমণ্ডলে এবং স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে মধ্যশরীরসহ চারটি প্রত্যঙ্গের (হাত ও পা) সন্ধিস্থলে থাকে, তা এই সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করে, অর্থাৎ অনুমান করা যায় যে মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখার আগে থেকেই তার দেহে চুল বা লোমের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল, কারণ শরীরের যে-সব অংশে এখন সবচেয়ে বেশি চুল দেখা যায় সেগুলো নিঃসন্দেহেই সূর্যের তাপ না লাগতে পারে এমন অঞ্চলেই থাকত। কিন্তু এক্ষেত্রে মাথার চাঁদি একটি অদ্ভুত ব্যতিক্রম, কারণ প্রায় সবসময়ই চাঁদিতে সূর্যের তাপ লেগেছে, অথচ জায়গাটা ঘন চুল দ্বারা আবৃত। আবার, উন্নত শ্রেণির অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীরা (মানুষও যার অন্তর্ভুক্ত) বিভিন্ন গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে বসবাস করলেও তাদের শরীরে যথেষ্ট লোম বা চুল দেখা যায়, এবং তা সাধারণ শরীরের উপরাংশেই বেশি ঘন[২৭] হয়। এই ঘটনা স্বভাবতই মানুষের দেহ প্রায় লোমশূন্য হওয়ার পিছনে সূর্যের ভূমিকা থাকার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। মি. বেল্ট[২৮] মনে করেন যে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে লোমহীন হতে পারাটা মানুষের একটা বিশেষ সুবিধে করে দিয়েছে। কারণ এর ফলে তারা বেশ কিছু রক্তপায়ী কীট (acari) ও অন্যান্য পরজীবী প্রাণীদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে, যারা নালি-ঘা পচনের জন্য দায়ী। কিন্তু এই ঘটনা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তার দেহকে যথেষ্ট পরিমাণে নির্লোম করতে কার্যকরী হয়েছে কিনা, সে-বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কেননা গ্রীষ্মমণ্ডলে বসবাসকারী অসংখ্য চতুষ্পদীদের মধ্যে কেউই উপশমকারী কোনো বিশেষ উপায়ের অধিকারী হতে পারেনি। যে-দৃষ্টিভঙ্গিটি আমার সবথেকে সম্ভব বলে মনে হয় তা হলো—পুরুষেরা এবং বিশেষ করে স্ত্রীলোকেরা, লোমবর্জিত হয়েছে দেহের সৌন্দর্যবর্ধক কারণে, এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, অন্যান্য উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণীর চেয়ে লোমশতার ব্যাপারে মানুষ যে এত আলাদা, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ যৌন নির্বাচনের সাহায্যে চরিত্রের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত রূপের মধ্যেও প্রায়শই বিপুল পার্থক্য দেখা যায়।
প্রচলিত একটি ধারণা অনুযায়ী, লেজ না-থাকাটা মানুষের একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মানুষের সঙ্গে নিকট সম্পর্কযুক্ত কিছু বানরের মধ্যেও এই অঙ্গটির অস্তিত্ব নেই। অতএব এটি মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নয়। একই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন প্রাণীর লেজ দৈর্ঘ্যে কম-বেশি হয়। ম্যাকাকাস জাতের বানরদের কোনো কোনো প্রজাতির লেজ তাদের শরীরের চেয়েও লম্বা এবং ২৪ টি কশেরুকা দ্বারা গঠিত। আবার কারও লেজ প্রায় অদৃশ্য, যা মাত্র তিনটি বা চারটি কশেরুকা দ্বারা গঠিত। কিছু কিছু বেবুনের লেজে ২৫টি কশেরুকা থাকে, অথচ ম্যানড্রিলদের বেলায় খুব ছোট ছোট অবৃদ্ধিপ্রাপ্ত ১০টি করে কশেরুকা থাকে, তা কুভিয়ের মতে, কখনো কখনো মাত্র পাঁচটি কশেরুকা দিয়ে গঠিত হয়। ছোটবড় যে-কোনো লেজেরই প্রান্তভাগ ক্রমশ সরু হয়ে যায়, এবং আমার মনে হয় এর কারণ হলো অন্ত্য-পেশির (terminal muscles) অপুষ্টিজনিত ক্ষয়, এবং এই অঞ্চলের ধমনি ও স্নায়ুতন্ত্রের অব্যবহারজনিত ক্ষয়প্রাপ্তি। এ-সবের ফলেই অন্ত্য-অস্থিও ক্ষয়ে যায়। লেজের দৈর্ঘ্যের রকমফের সম্বন্ধে কোনো যথার্থ ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে আমরা মূলত বহিরাংশে লেজের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করছি। অধ্যাপক ব্রকা সম্প্রতি দেখিয়েছেন যে সমস্ত চতুষ্পদ প্রাণীর লেজ দুটি অংশে বিভক্ত। এই অংশ দুটি সাধারণত একে অপরের থেকে আকস্মিকভাবে পৃথক হয়ে পড়ে। ওপরের অংশে যে কশেরুকা থাকে সেগুলো কম-বেশি খাঁজকাটা ও সাধারণ কশেরুকার মতো রক্তবাহী নালি, স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদি দ্বারা সজ্জিত, অন্যদিকে অন্তিম অংশের কশেরুকাগুলো খাঁজকাটা নয়, সমস্তটাই প্রায় মসৃণ এবং সত্যিকারের কশেরুকার সঙ্গে মিল প্রায় নেই বললেই চলে। মানুষ ও বনমানুষদের দেহে লেজের কোনো বাহ্য অস্তিত্ব না থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তা আছে, এবং উভয়ের এই অদৃশ্য লেজ একইভাবে গঠিত আকারে ও সংখ্যায় অনেক, ছোট হয়ে গিয়ে শিরদাঁড়ার অন্তিম অংশের কশেরুকারা গঠন করে অনুত্রিকাস্থি, যা একটি বিকাশরুদ্ধ অঙ্গ। লেজের গোড়ার অংশের কশেরুকাগুলো সংখ্যায় অল্প, পরস্পরের গায়ে এরা শক্তভাবে আটকে থাকে এবং এদের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের লেজের এই ধরনের কশেরুকার তুলনায় এদের কশেরুকাগুলো অনেক চওড়া ও চ্যাপ্টা। ব্রকার মতে, এগুলো অতিরিক্ত সেক্রাল কশেরুকা দ্বারা গঠিত। এগুলো নির্দিষ্ট কিছু অভ্যন্তরীণ অঙ্গকে সহায়তা করে থাকে এবং অন্যান্য নানা উপায়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। দেখা গেছে মানুষ ও বনমানুষদের সোজা বা আংশিক-সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখার সঙ্গে এগুলোর পরিবর্তন বা রূপান্তর প্রত্যক্ষ সম্পর্কযুক্ত। এই সিদ্ধান্তটিই অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য, যদিও আগে ব্রকার অন্য ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যা তিনি বর্তমানে পরিত্যাগ করেছেন। তাই বলা যায় যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে মানুষ ও উচ্চশ্রেণির বানরদের (বনমানুষ) লেজের ওপরের অংশের কশেরুকাগুলো (basal caudal vertebrae) পরিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে।
কিন্তু অনুত্রিকাস্থি গঠনকারী লেজের অন্তিম অংশের লুপ্তপ্রায় পরিবর্তনশীল- কশেরুকা সম্বন্ধে আমরা কী বলব? এ সম্বন্ধে একটি মত চালু আছে যা বরাবর উপহাসের বস্তু হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। মতটি হলো—লেজের বহিরাংশ বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে ঘর্ষণের একটা সম্পর্ক আছে। তবে আজ আর এই মতটাকে ঠিক উপহাস করে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ড. অ্যান্ডারসন বলেছেন যে ম্যাকাকাস ব্রুনাস নামক বানরদের লেজ অত্যন্ত ছোট, কিন্তু উপরাংশের কশেরুকাসহ দৃঢ়ভাবে সংস্থাপিত এবং মোট এগারোটি কশেরুকা দ্বারা গঠিত। লেজের অন্তিম অংশটি পেশিবন্ধ দিয়ে তৈরি, সেখানেও কোনো কশেরুকা থাকে না। তারপরে থাকে ক্ষুদ্রাকৃতি পাঁচটি বিকাশরুদ্ধ লুপ্তপ্রায় কশেরুকা। এগুলো এতই ছোট যে পাঁচটি কশেরুকার মোট দৈর্ঘ্য মাত্র ৩/৮ ইঞ্চি। এই অংশগুলো স্থায়ীভাবে আঁকশির আকারে একদিকে হেলে থাকে। লেজের মুক্ত অংশটি দৈর্ঘ্যে এক ইঞ্চির থেকে সামান্য বড় এবং এটি মাত্র চারটি ক্ষুদ্রাকৃতি কশেরুকা দিয়ে গঠিত। এই সংক্ষিপ্ত লেজটি খাড়া হয়ে থাকে, কিন্তু এর মোট দৈর্ঘ্যের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বাঁদিকে ভাঁজ হয়ে থাকে। আঁকশির মতো দেখতে অংশটিসহ এই শেষাংশটি ওপরের বাঁকানো অংশের মধ্যবর্তী ব্যবধান কমাতে সাহায্যে করে। ফলে প্রাণীরা ওর ওপর ভর দিয়ে বসতে পারে, আর তাই এটি রুক্ষ ও শক্ত হয়ে ওঠে। ড. অ্যান্ডারসন তাঁর পর্যবেক্ষণগুলো সারসংক্ষেপ করেছেন এইভাবে: ‘এই ঘটনাগুলোর একটিই মাত্র ব্যাখ্যা দেয়া যায়। ব্যাখ্যটি হলো—লেজের ক্ষুদ্রাকৃতির ফলে বানরদের বসার সময় সেটা এগিয়ে আসে এবং প্রায়শই এই লেজের ওপরেই বানররা বসে থাকে। আর ইস্কিয়াল টিউবারোসিটির (যে দু’টি হাড়ের ওপর ভর দিয়ে বসে প্রাণীরা) শেষাংশ পেরিয়ে লেজের পক্ষে বাইরে বেরিয়ে থাকা যে সম্ভব নয়, তা থেকে মনে হয় নিতম্বের আভ্যন্তরীণ স্থানে বানরেরা ইচ্ছামতো তাদের লেজকে গুটিয়ে নিতে পারত, যাতে মাটিতে চাপ না লাগে, এবং এইভাবে বসার ফলে তাদের লেজের বক্রতা ক্রমে ক্রমে স্থায়ী রূপ নিয়েছিল, যার দরুন বসার সময় তাদের আর অসুবিধা হতো না।’
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে বোঝা যায় বানরদের গোটা লেজটার রুক্ষ ও শক্ত হয়ে যাওয়াটা কোনো আশ্চর্য ব্যাপার নয়। ড. মুরি চিড়িয়াখানায় এদের (বানরদের) এবং এদের সঙ্গে নিকট সাদৃশ্যযুক্ত সামান্য বড় লেজবিশিষ্ট আরও তিন ধরনের প্রজাতিকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে বলেছেন, ‘এই প্রাণীরা বসার সময় তাদের লেজটাকে সুবিধেমতো পশ্চাৎ দেশের যে-কোনো একদিকে ঠেলে দেয়। ফলে লেজ লম্বা বা খাটো যাই হোক না কেন, তার গোড়াতে ঘষা লাগে এবং ঘর্ষণজনিত ক্ষতের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অঙ্গহানির বংশগত প্রভাব[২৯] সম্পর্কিত তথ্যগুলো থেকে আমরা বলতে পারি যে খাটো লেজবিশিষ্ট বানরদের লেজের বেরিয়ে থাকা অংশের তেমন কোনো কার্যকরী ভূমিকা না থাকার দরুন এই অংশটা বেশ কয়েক পুরুষ পরে লুপ্তপ্রায় অংশে পরিণত হওয়া বা অবিরাম ঘর্ষণ ও ক্ষতের ফলে তার ক্রমবিকৃতি ঘটাও মোটেই অসম্ভব নয়। যেমন ম্যাকাকাস ব্রুনাস বানরদের লেজের বেরিয়ে থাকা অংশ এখন এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে এবং এম, ইকাউদেতাস ও আরও অনেক উন্নত জাতের বানরদের মধ্যে এই অংশটা পুরোপুরি লুপ্তই হয়ে গেছে। আর শেষত আমরা দেখতে পাই যে মানুষ ও বনমানুষদের মধ্যে লেজের আর কোনো অস্তিত্ব নেই, লেজের অন্তিম অংশে দীর্ঘদিন ধরে ঘর্ষণজনিত ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার ফলে তা অদৃশ্য হয়েছে। অন্যদিকে, লেজের গোড়ার দিকের দৃঢ় অংশটি আকারে হ্রাস পেয়েছে ও পরিবর্তিত হয়েছে, যাতে তা পুরোপুরি বা আংশিকভাবে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পক্ষে উপযোগী হয়ে উঠতে পারে।
আমি দেখতে চেষ্টা করছি যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মানুষ কীভাবে তার একান্ত নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল মনে রাখা দরকার, শরীরের যে সমস্ত আকারগত বা গঠনগত পরিবর্তন কোনো প্রাণীকে তার জীবনযাত্রার অভ্যাস, প্রয়োজনীয় খাদ্য বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার পক্ষে উপযোগী হয়ে উঠতে সাহায্য করে না, সেগুলো কিন্তু এইভাবে অর্জিত হতে পারে না। তবে প্রতিটি প্রাণীর পক্ষে কোনো কোনো পরিবর্তন সুবিধাজনক, সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না। কারণ শরীরে এমন অনেক অংশ আছে যেগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও খুবই সীমিত। যেমন আমরা সত্যিই কি খুব ভালোভাবে জানি যে রক্ত ও কোষকলার মধ্যে কী কী পরিবর্তন ঘটার ফলে প্রাণীরা কোনো নতুন পরিবেশ বা নতুন ধরনের খাবারের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। আন্তঃসম্পর্কের নীতির কথাও আমাদের মনে রাখা উচিত। অধ্যাপক ইসিডোর জিওফ্রে দেখিয়েছেন যে মানুষের গঠনগত অনেক বিচিত্র বিচ্যুতি আসলে এই নীতির দ্বারাই একসূত্রে গ্রথিত। আন্তঃসম্পর্ক ব্যতিরেকেও, কোনো-একটি অংশের পরিবর্তন অনেক সময় অপ্রত্যাশিত ধরনের আরও কিছু পরিবর্তনের জন্ম দেয় এবং সেটা ঘটে অন্যান্য অংশের বর্ধিত বা হ্রাসপ্রাপ্ত ব্যবহারের ফলস্বরূপ। দু-একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বোঝা যেতে পারে। যেমন, কোনো পোকামাকড়ের বিষে উদ্ভিদের কাণ্ডে একপ্রকার আশ্চর্য বৃদ্ধি (gall) ঘটে। আবার তোতাপাখি ইত্যাদিকে বিশেষ এক ধরনের মাছ খাওয়ালে বা ব্যাঙ জাতীয় প্রাণীর বিষ তাদের দেহে প্রবেশ করিয়ে দিলে তাদের পালকের রং উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। এগুলো থেকে বোঝা যায় যে, বিশেষ উদ্দেশে শরীরের তরল অংশকে পরিবর্তিত করলে তা থেকে অন্যান্য ধরনের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। আমাদের বিশেষ করে মনে রাখা উচিত যে, কোনো প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্যে অতীতে যে-সমস্ত পরিবর্তন ঘটেছিল এবং দীর্ঘদিন ধরে চালু ছিল, সেগুলো সম্ভবত নির্দিষ্ট বা স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে বংশগত হয়ে পড়েছিল।
কাজেই জীবজগতের অসংখ্য ঘটনাকে অনায়াসেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফল বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে, গাছপালা সম্পর্কে নাজেলি-র প্রবন্ধ, পশুপাখি সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষকের মন্তব্য এবং বিশেষ করে সম্প্রতি প্রকাশিত অধ্যাপক ব্রকা-র প্রবন্ধ পড়ার পর আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমার ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ বইটির প্রথম দিককার সংস্কারণগুলোতে আমি বোধহয় প্রাকৃতিক নির্বাচন বা যোগ্যতমের উদ্বর্তনের ভূমিকাকে বড় করে দেখেছিলাম। তাই বইটির পঞ্চম সংস্করণে আমি কিছু অদল- বলদ করেছি, যাতে শুধুমাত্র গঠন-প্রকৃতির অভিযোজনগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ থাকে। অবশ্য গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি যে শরীরের অনেকগুলো অংশ যা আমাদের কাছে এখন অকেজো বলে মনে হচ্ছে, সেগুলোও পরে একসময় দরকারি হয়ে উঠবে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের আওতায় এসে পড়বে। তথাপি, ইতিপূর্বে আমি এই সমস্ত গঠন-আকৃতির অস্তিত্বকে যথাযথভাবে বিচার করে দেখিনি, যেগুলো আমাদের বর্তমান জ্ঞান অনুযায়ী উপকারীও নয়, অপকারীও নয়, আর এটাকে আমি আমার সমস্ত কাজের মধ্যে একটি সবচেয়ে বড় গাফিলতি বলে মনে করি। অজুহাত হিসেবে অবশ্য বলতে পরি যে, এ-ব্যাপরে আমার মধ্যে দুটি নির্দিষ্ট চিন্তা কাজ করছিল। প্রথমত, আমি দেখাতে চেয়েছিলাম বিভিন্ন প্রজাতি আলাদা আলাদাভাবে সৃষ্টি হয়নি, এবং দ্বিতীয়ত, পরিবর্তনের কাজে প্রাকৃতিক নির্বাচনই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল, যদিও এই কাজে অভ্যাসের বংশগত প্রভাব অনেকখানি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রত্যক্ষ ক্রিয়া সামান্য পরিমাণে সাহায্য করেছিল। তবে আমি কিছুতেই আমার এই পূবর্তন বিশ্বাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না (যে-বিশ্বাস তখন প্রায় সার্বজনীন হয়ে উঠেছিল) যে প্রত্যেকটি প্রজাতি উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি হয়েছে। এই বিশ্বাস থেকেই আমি এই গোপন অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে লুপ্তাংশ বাদে গঠন-আকৃতির প্রতিটি অংশেরই নিজস্ব কিছু কিছু বিশেষ কাজ রয়েছে, যদিও বেশ কিছু বিষয় আমাদের অজ্ঞাত রয়ে গেছে। এই ধারণা থেকে যে-কেউই অতীত বা বর্তমানের ঘটনাবলির প্রশ্নে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভূমিকাকে স্বাভাবিকভাবেই অনেক বাড়িয়ে দেখতে বাধ্য। যাঁরা বিবর্তনের নীতিকে মেনে নেন অথচ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতবাদ মানেন না, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আমার বইটির সমালোচনা করার সময় বেমালুম ভুলে যান যে উপরিউক্ত চিন্তা দুটি মাথায় রেখেই বইটি লিখেছিলাম। অতএব, যদি আমি প্রাকৃতিক নির্বাচনকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভুল করে থাকি (অবশ্য তা মানতে আমি আদৌ রাজি নই) বা তার ক্ষমতাকে অতিরঞ্জিত করে দেখিয়ে থাকি (এই ব্যাপারটা অবশ্য হয়ে থাকতে পারে), তাহলেও বলব অন্তত একটি কাজ আমি করতে পেরেছি—আলাদা আলাদাভাবে বিভিন্ন প্রজাতি সৃষ্টির মতবাদকে সমূলে উৎপাটিত করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছি।
এমনটা হওয়া অসম্ভব নয় যে সমস্ত জীবের, এমনকী মানুষেরও, গঠন- আকৃতির মধ্যে এমন কিছু অংশ আছে যেগুলো আগে বা এখন কোনো সময়েই তাদের কোনো কাজে আসেনি বা আসে না, ফলে এগুলোর কোনোরকম শারীরবৃত্তীয় গুরুত্বও প্রত্যেকটি প্রজাতির প্রতিটি জীবের মধ্যে কেন অসংখ্য ছোট ছোট পার্থক্য দেখা যায়, তার সঠিক কারণ আমাদের জানা নেই। পুনরাবৃত্তি বা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আকার, স্বভাব ইত্যাদি পাওয়ার আলোয় বিচার করতে গেলে সমস্যাটা প্রায়শই আরও জটিল হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্যের পিছনে উপযুক্ত কারণ তো থাকতেই হবে। এই কারণগুলো, তা সেগুলো যা-ই হোক না কেন, যদি আরও সম্মিলিতভাবে ও সজীবভাবে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করত (এর বিপরীত কোনো জোরালো যুক্তি দাঁড় করানো যায়নি), তাহলে তার ফল সম্ভবত শুধুমাত্র জীবে-জীবে সামান্য পার্থক্য না হয়ে একটি সুস্পষ্ট ও নিয়ত পরিবর্তনকেই সূচিত করত, যদিও এই পরিবর্তনের তেমন কোনো শারীরবৃত্তীয় গুরুত্ব থাকত না। পরিবর্তিত গঠন- আকৃতি, যেটা কোনোভাবেই শরীরের উপকারে লাগে না, সেটা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে কখনোই একইরকম হতে পারে না, তবে ক্ষতিকারক দিকগুলো এর মাধ্যমে দূরীভূত হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে কতকগুলো উদ্দীপক কারণের অনুমানসিদ্ধ সমরূপকে অনুসরণ করে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্যসমূহ নিজেদের মধ্যে অবাধ যৌনমিলনের ফলেই ঘটে থাকে বলে মনে হয়। উত্তরকালব্যাপী একই প্রজাতির জীবের মধ্যে এইভাবে নানা পরিবর্তন ঘটতে থাকে এবং যতদিন উদ্দীপক কারণগুলো একই থাকে ও অবাধ যৌনমিলন চালু থাকে, ততদিন এই পরিবর্তনগুলো প্রায় সমভাবেই তাদের উত্তরপুরুষদের ওপরে বর্তায়। তথাকথিত স্বতঃস্ফূর্ত বৈচিত্র্যের মত এই উদ্দীপক কারণগুলো সম্বন্ধেও আমরা শুধুমাত্র এইটুকুই বলতে পারি—যে অবস্থার মধ্যে কোনো পরিবর্তনশীল জীব প্রতিপালিত হয়, তার পরিবেশগত প্রকৃতির তুলনায় এগুলো তার শারীরিক গঠনাকৃতির সঙ্গে অনেক বেশি নিকট সম্পর্কযুক্ত।
সিদ্ধান্ত
এই পরিচ্ছেদে আমরা দেখলাম যে আজকের দিনে অন্যান্য প্রাণীদের মতোই মানুষের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে যেমন বহু ধরনের পার্থক্য বা সামান্য বৈসাদৃশ্য থাকতে পারে, তেমনি মানুষের আদি পূর্বপুরষের মধ্যেও এসব বৈসাদৃশ্য নিঃসন্দেহেই বর্তমান ছিল। আজকের দিনে এগুলো যে-কারণে ঘটে থাকে তখন সেই একই কারণেই এগুলো ঘটত এবং একই সাধারণ ও জটিল নিয়ম অনুযায়ীই পরিচালিত হতো। আবার সমস্ত প্রাণীদের মধ্যেই যেমন তাদের জীবনধারণের উপায়কে ছাপিয়ে সংখ্যাবৃদ্ধি করার প্রবণতা রয়েছে, তেমনি মানুষের পূর্বপুরুষরাও নিশ্চয়ই এই নিয়মের বাইরে ছিল না। আর এ থেকেই শুরু হয়েছিল তাদের বেঁচে থাকার লড়াই এবং দেখা দিয়েছিল প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম। দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটিকে (প্রাকৃতিক নির্বাচন) দারুণভাবে সাহায্য করেছিল শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের বর্ধিত ব্যবহারের বংশগত প্রভাব। এবং এই দুই প্রক্রিয়া (বেঁচে থাকার জন্য লড়াই ও প্রাকৃতিক নির্বাচন একে অপরের ওপর অবিরাম প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়াও যৌন নির্বাচনের মাধ্যমেও মানুষের দেহে নানা অপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে হয়। সেইসব অজানা কার্যসাধনশক্তির অনুমানসিদ্ধ সমরূপ কার্যকলাপের দরুণ সংঘটিত পরিবর্তনসমূহের কিছু ব্যাখ্যাতীত অবশেষ অবশ্য থেকেই যায়, যেগুলো কখনো কখনো আমাদের গৃহপালিত জন্তুদের গঠন-আকৃতিতে দারুণ উল্লেখযোগ্য ও আকস্মিক বিচ্যুতির সৃষ্টি করে থাকে।
বন্য জনসমষ্টি ও বিশাল সংখ্যক চতুষ্পদ প্রাণীদের আচার-আচরণ লক্ষ করলে বোঝা যায় যে প্রাচীনকালের মানুষ, এমনকী তাদের বনমানুষ-সদৃশ পূর্বপুরুষরাও, সমাজবদ্ধভাবেই বসবাস করত। এই সমাজবদ্ধ প্রাণীদের কারও কারও ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন কখনো কখনো সমাজের পক্ষে মঙ্গদায়ক বৈচিত্র্যেগুলোকে সংরক্ষণ করার মাধ্যমে কার্যকরী হতো। তাই দেখা যায় যে- সমাজে বহু গুণে ভূষিত বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ থাকে, সেই সমাজের লোকসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তারা কম গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সমাজের ওপর সর্বদাই আধিপত্য করে থাকে। অবশ্য এই ধরনের সমাজভুক্ত কোনো-একজন সদস্য ওই সমাজের অন্যদের তুলনায় কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হয় না। সমাজবদ্ধ কীটপতঙ্গেরা এইভাবে বহু উল্লেখযোগ্য গঠন-আকৃতি অর্জন করেছে, যেমন শ্রমিক মৌমাছিদের ফুলের পরাগ-সংগ্রাহক অঙ্গ বা হুল, অথবা সৈনিক-পিঁপড়েদের শক্ত চোয়াল ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো এককভাবে এসব কীট-প্রত্যঙ্গের কোনো কাজেই লাগে না অথবা খুবই সামান্য কাজে লাগে। সমাজবদ্ধ উন্নতশ্রেণির প্রাণীদের বেলায় এই ধরনের গঠন-আকৃতিগুলো কিছু গৌণ কাজকর্মে সাহায্য করে থাকে—অবশ্য আমার জানা নেই যে শুধু সমাজের মঙ্গলার্থে কাজকর্ম করার জন্য গঠন-আকৃতির কোনো পরিবর্তন কখনো ঘটেছে কি না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পুরুষ- গণ্ডারের শিং ও পুরুষ-বেবুনের কেনাইন-দাঁতকে তাদের যৌন-বিষয়ক দ্বন্দ্বের অস্ত্র বলে মনে হলেও আসলে কিন্তু এগুলো তাদের গোষ্ঠী বা দলকে রক্ষা করার কাজেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু মানসিক ক্ষমতার বিষয়গুলো সম্পূর্ণ অন্যরকম (পঞ্চম পরিচ্ছেদে আমরা এ-বিষয়ে আলোচনা করব), কারণ এই ক্ষমতাগুলো প্রধানত বা শুধুমাত্র সমাজের মঙ্গলের জন্যই গড়ে উঠেছে এবং সেইসঙ্গে প্রতিটি পৃথক পৃথক প্রাণী পরোক্ষভাবে কিছু সুবিধাও পেয়েছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে স্ততই প্রতিবাদ উঠবে, তবু এটাই সত্যি যে জীব- জগতের মধ্যে মানুষ এমন একটি জীব যে ভীষণ অসহায় ও প্রতিরোধশক্তিহীন। প্রাথমিক ও অপেক্ষাকৃত অল্পোন্নত অবস্থায় সে আর অসহায় ছিল। এই প্রসঙ্গে আরজিলের ডিউক জোর দিয়ে বলেছেন, ‘মানুষের শারীরিক কাঠামো পশুদের থেকে অন্যরকম। শারীরিকভাবে মানুষ অনেক অসহায় ও দুর্বল। অর্থাৎ, শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলেই এসব পার্থক্য সৃষ্টি হয়নি।’ এর দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি মানুষের দেহের অনাবৃত ও অরক্ষিত অবস্থার কথা, শত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা করার জন্য বড় দাঁত বা থাবার অনুপস্থিতির কথা, জোরে দৌড়নোর অক্ষমতা ও দৈহিক শক্তির ঘাটতির কথা, খাদ্য-অন্বেষণ বা বিপদ এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ঘ্রাণশক্তির অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। এইসমস্ত অভাবের সঙ্গে আরও একটি গুরুতর ঘাটতির কথা যোগ করা যায়—মানুষ দ্রুত গাছে উঠতে পারে না, ফলে শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করতেও পারে না। গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের অধিবাসীদের পক্ষে দেহের লোমশূন্যতা এমন কিছু ক্ষতিকারক নয়, কারণ আমরা জানি যে নগ্নদেহী ফুজিয়ানরা কঠিন জলবায়ুতেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। মানুষের এই প্রতিরোধহীন অবস্থার সঙ্গে বানরদের অবস্থার তুলনা করার সময় মনে রাখা দরকার যে কেবলমাত্র পুরুষ-বানরদের মধ্যেই বৃহদাকার কেনাইন দাঁতের পূর্ণ বিকাশ দেখা যায়, এবং মুখ্যত যৌন প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে সংগ্রামের জন্যই এটি ব্যবহৃত হয়। তথাপি লক্ষ করার বিষয় হলো—স্ত্রী বানরদের মধ্যে এই দাঁত অনুপস্থিত থাকলেও তারা কিন্তু দিব্যি বেঁচে থাকে।
দৈহিক আকার বা শক্তির ব্যাপারে বলা যায় যে শিম্পাঞ্জির মতো ছোট আকারের কোনো প্রাণী থেকে অথবা গরিলার মতো শক্তিশালী কোনো প্রজাতি থেকে মানুষ ক্রমবিকশিত হয়েছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। তাই এটা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে মানুষ তার পূর্বপুরুষদের থেকে চেহারায় বড় ও বেশি শক্তিশালী হয়েছে, নাকি ছোট ও দুর্বলতর হয়েছে। তবে এটা মনে রাখা দরকার যে কোনো জন্তু যদি বিপুল আকৃতি, শক্তি ও হিংস্রতার অধিকারী হয় এবং গরিলার মতো নিজেকে সমস্ত শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে, তাহলে সে কখনোই দলবদ্ধ বা সামাজিক জীবে পরিণত হবে না। ফলস্বরূপ তার মধ্যে উন্নত মানসিক গুণাবলি প্রায়শই অনুপস্থিত থাকবে, যেমন সঙ্গীসাথিদের প্রতি সমবেদনা ও ভালোবাসার মতো গুণ তার মধ্যে দেখা যাবে না। তাই অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোনো জীব থেকে বিবর্তিত হওয়াটা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত সুবিধাজনক হয়েছে বলেই মনে হয়।
মানুষ তার দৈহিক শক্তির ঘাটতি ও জোরে দৌড়ানোর অক্ষমতা এবং প্রকৃতিদত্ত অস্ত্রের অভাব ইত্যাদিকে দারুণভাবেই পূরণ করে নিতে পেরেছে, প্রথমত তার মননশক্তির সাহায্যে, যা দিয়ে সে বর্বর অবস্থায় থাকাকালেই তৈরি করেছে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি, এবং দ্বিতীয়ত তার সমাজবন্ধ গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সাহায্যে, যা তার দলের সাথিদের সঙ্গে সুন্দর বোঝাপড়ার রাস্তা প্রশস্ত করে দিয়েছে। আমরা জানি পৃথিবীতে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো এ- রকম হিংস্র জন্তু-জানোয়ারে ভরা দেশ আর দুটি নেই। আবার এ-ও অজানা নয় যে উত্তরমেরুর মতো এমন ভয়ঙ্কর দৈহিক কষ্টের জায়গাও পৃথিবীতে আর নেই। তথাপি দেখা যায় যে বুশম্যান নামক খুবই দুর্বল একটি জাতি দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং অত্যন্ত খাটো আকৃতির এস্কিমোরা উত্তরমেরুতে বহাল তবিয়তে বসবাস করছে। নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে মানুষের পূর্বপুরুষদের মেধা এবং সামাজিক বিন্যাস সম্ভবত আজকের দিনের সবচাইতে বন্যদশায় থাকা মানুষদের চেয়েও হীনতর ছিল। কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না যে তারা গাছে চড়া ইত্যাদির মতো পশু-সদৃশ ক্ষমতাগুলো ক্রমশ হারিয়ে ফেলার সময় তাদের মেধাশক্তি উন্নত না হয়ে উঠলে জীবন-সংগ্রামে টিকে থাকা বা উন্নতি করা তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হতো না। কিন্তু এই পূর্বপুরুষেরা যদি অস্ট্রেলিয়া, নিউ গিনি বা বোর্নিওর মতো (গা বর্তমানে ওরাংওটাংদের বাসভূমি) কোনো গরম মহাদেশ বা বৃহৎ দ্বীপের অধিবাসী হতো, তাহলেও আজকের দিনের বন্য মানুষদের থেকে অনেক বেশি অসহায় ও প্রতিরোধহীন হওয়া সত্ত্বেও তাদের তেমন কোনো মারাত্মক বিপদের মোকাবিলা করার দরকার হতো না। এই ধরনের কিছু বৃহৎ অঞ্চলের গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে উদ্ভব হয়েছিল প্রাকৃতিক নির্বাচনের, আর তারই সঙ্গে দেখা দিয়েছিল আচার-আচরণের বিভিন্ন বংশগত প্রতিক্রিয়া, এবং অনুকূল অবস্থায় এই দুয়ের মিলনই মানুষকে সমগ্র জীবজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
.
১. ‘ইনভেস্টিগেশন ইন মিলিটারি অ্যান্ড অ্যানথ্রোপলিজক্যাল স্ট্যাটিসটিকস্ অফ আমেরিকান সোলজারস’, বি.এ. গোল্ড, ‘১৮৬৯, পৃ. ২৫৬।
২. ‘হেরিডিটারি জিনিয়াস : অ্যান এনকোয়ারি ইনটু ইট্স লজ অ্যান্ড কনসিকোয়েনসেস’।
৩. মি. বেট্ দ্য (দ্য ন্যাচারা লিস্ট অন্য দ্য আমাজন—১৮৬৩, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৫৯)। দক্ষিণ আমেরিকার একই গোষ্ঠীভুক্ত ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘তাদের মধ্যে কোনো দুজনের মাথার আকৃতি একরকমের ছিল না। একজনের কিছু সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যসহ ডিম্বাকৃতি মাথা এবং অন্যজনের গণ্ডদেশের বিস্তৃতি ও স্পষ্টতা, নাসারন্ধ্রের বিস্তৃতি এবং দৃষ্টির প্রখরতায় পুরোপুরি একজন মঙ্গোলিয়ান’।
৪. মিটফোর্ড-এর ‘হিস্ট্রি অফ গ্রিস, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা, ২৮২। এটা আরও জানা যায় জেনোফেন-এর ‘মেমোর্যাবিলিয়া’ বইটির একটি অংশ থেকে (যার প্রতি রেভারেন্ড জে. এন. জোর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন)। গ্রিকদের একটি স্বীকৃত নিয়মই ছিল যে পুরুষরা ভবিষ্যৎ সন্তানদের স্বাস্থ্য ও প্রাণপ্রাচুর্যের দিকে লক্ষ রেখে তাদের স্ত্রী-নির্বাচন করবে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে গ্রিক-কবি থিওগনিস্ মনে করেছিলেন মানুষের উন্নতির পক্ষে এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন, যদি তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়। তিনি দেখেছিলেন সম্পদ প্রায়শই যৌন নির্বাচনের সঠিক কাজের পক্ষে বাধাস্বরূপ। এ বিষয়ে তাঁর একটি চমৎকার কবিতাও আছে।
৫. এই সূত্রগুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি আমার ‘ভ্যারিয়েশনস অফ অ্যানিম্যালস অ্যান্ড প্ল্যান্টস্ আন্ডার ডোমেস্টিকেশন’, ২য় খণ্ড, ২২ ও ২৩ পরিচ্ছেদ। এম. জে. পি. ডুরান্ড ‘দ্য দিফ্লুয়েঁস দে মিলিউ’ নামে একটি মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। এখানে তিনি মাটির প্রকৃতি অনুযায়ী উদ্ভিদের বিষয়টিতে অত্যন্ত জোর দিয়েছেন।
৬. পলিনেশিয়ানদের ব্যাপারে দ্রষ্টব্য, অধ্যাপক রিচার্ডের ‘ফিজিক্যাল হিস্ট্রি অফ ম্যানকাইন্ড’, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৪৫ ও ২৮৩, এবং অধ্যাপক গর্ডনের ‘দ্য লেসপেস্’, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৯। আবার উচ্চ গাঙ্গেয় উপত্যকায় বসবাসকারী হিন্দুদের সঙ্গে বাংলার (সমভূমির অধিবাসীদের হাবভাব অনেক মিল আছে। দ্রষ্টব্য, অধ্যাপক এলফিনস্টোনের ‘হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩২৪।
৭. একটি বিরল এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা হলো—নাবিকদের দৃষ্টিশক্তি সাধারণত ডাঙার মানুষদের তুলনায় কম হয়ে থাকে। ড. বি. এ. গোল্ড তাঁর গ্রন্থে (‘স্যানটারি মেমোয়্যারস অফ দ্য ওয়ার অফ দ্য রবেলিয়ন’, ১৮৬৯ পৃষ্ঠা ৫৩০) এ-কথা প্রমাণ করেছেন এবং তিনি মনে করেন নাবিকদের দৃষ্টিসীমা সাধারণত ‘জাহাজের দৈর্ঘ্য ও মাস্তুলের উচ্চতা’র মধ্যে আবদ্ধ থাকে বলেই তাদের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়।
৮. ‘স্যগেথিয়ের ফন প্যারাগুয়ে’, পৃ. ৮, ১০। ফুজিয়ানদের প্রখর দৃষ্টিশক্তি প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এ বিষয়েও আরও দ্রষ্টব্য অধ্যাপক লরেন্সের বই, ‘লেকচারস অন ফিজিওলজি ইত্যাদি, ১৮২২, পৃ. ৪০৪। মি. গিরজিউলন সম্প্রতি এ-বিষয়ে প্রচুর মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছেন। (দ্রষ্টব্য, ‘রেভ্যু দা কুর সায়েনটিফিক’, ১৮৭০, পৃ. ৬২৫) এবং কমদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়ার আসল কারণসমূহ উল্লেখ করেছেন (C’est le travail assldu de pres)।
৯. ড. উইলকেন্স (দ্রষ্টব্য, ‘ল্যান্ডউইদ চ্যাফ্টও উশেনব্লাট’—সংখ্যা ১০, ১৮৬৯) সম্প্রতি একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী গৃহপালিত পশুদের দৈহিক গঠন কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
১০. অধ্যাপক লেকক্ পশু-সদৃশ নির্বোধদের ‘থেরয়েড’ নামে চিহ্নিত করে তাদের চরিত্রের সারসংকলন করেছেন। দ্রষ্টব্য, ‘জার্নাল অফ মেন্টাল সায়েন্স’, জুলাই ১৮৬৩। আবার ড. স্কট (দ্রষ্টব্য, ‘দ্য ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব’, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৮৭০,পৃ. ১০) খাবারের গন্ধ সম্পর্কে এদের অচেতনতার কথা উল্লেখ করেছেন। এই বিষয়টি এবং নির্বোধদের রোমশতা বিষয়ক ব্যাখ্যার জন্য দ্রষ্টব্য ড. মডস্লের গ্রন্থ, ‘বডি অ্যান্ড মাইন্ড’, পৃ. ৪৬ থেকে ৫৭; পাইনেল-ও জনৈক নির্বোধের রোমশতা সম্পর্কে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা জানিয়েছেন।
১১. আমার ‘ভ্যারিয়েশনস অফ অ্যানিম্যালস অ্যান্ড প্ল্যান্টস আন্ডার ডোমেস্টিকেশন’ (২য় খণ্ড, পৃ. ৫৭ ) বইটিতে শরীরে অতিরিক্ত স্তনগ্রন্থি বিশিষ্ট অনেক স্ত্রীলোকের কথা জানিয়েছি এবং এর কারণ হিসেবে আমি পূর্বপুরুষদের শারীরিক গঠনে প্রত্যাবর্তনের কথাই উল্লেখ করেছিলাম। মেয়েদের বুকে সুসমঞ্জস্যভাবে অবস্থিত অতিরিক্ত স্তনগ্রন্থি থাকার ঘটনাটি লক্ষ করেই এই সম্ভাব্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম আমি। বিশেষ করে একটি ঘটনা আমাকে এই সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে গিয়েছিল—জনৈকা স্ত্রীলোকের কুঁচকিতে একটি কার্যকরী স্তনগ্রন্থি ছিল এবং তার মায়ের শরীরেও ছিল অতিরিক্ত স্তনগ্রন্থি। কিন্তু আমি এ-ও দেখেছি যে শরীরের নানা অংশ, যেমন পিঠ, বাহুমূল বা উরুতে, স্তনগ্রন্থির মতো দেখতে অংশ সৃষ্টি হয়। জনৈকা নারীর উরুতে সৃষ্টি হওয়া এ-রকম স্তন থেকে এত দুধ পাওয়া যেত যে তার সাহায্যেই তার বাচ্চাকে দিব্যি খাওয়ানো যেত। কাজেই, অতিরিক্ত স্তনগ্রন্থি সৃষ্টির কারণ হচ্ছে পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন—এই সিদ্ধান্তটি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিদ্ধান্তটি এখনও আমি যথেষ্ট সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত বলেই মনে করি, কারণ এমন অনেক নারীর কথা আমি জানতে পেরেছি যাদের বুকে সুসমঞ্জস্যভাবে অবস্থিত দু-জোড়া স্তন দেখা গেছে। সকলেই জানেন যে লেমুর জাতীয় বানরদের বুকে দু-জোড়া স্তন থাকে। কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় যখন শুনি যে এমন পাঁচজন পুরুষমানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের প্রত্যেকের শরীরে একজোড়ারও বেশি স্তন আছে (অবশ্যই একেবারে প্রাথমিক ধরনের)। দ্রষ্টব্য, ‘জার্নাল অফ অ্যানাটমি অ্যান্ড ফিজিওলজি’, ১৮৭২ পৃ. ৫৬; এখানে ড. হ্যান্ডিসাইড দু’জন ভাইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, যাদের মধ্যে এই অস্বাভাবিক অংশটি দেখা গেছে। আরও দ্রষ্টব্য ড. বার্টেলস-এর গবেষণাপত্র ‘রিচার্টস অ্যান্ড দ্যুবোয়া-রেমান্ডস আর্কাইভ’, ১৮৭২, পৃ. ৩০৪; তাছাড়া ড. বার্টেস একজন মানুষের শরীরে পাঁচটি স্তনগ্রন্থির কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলোর মধ্যে একটি মোটামুটি বিকশিত অবস্থায় নাভির উপরে অবস্থিত ছিল (মেবেল ফন হেনস্বাথ মনে করেন, এই ঘটনাটি কিছু কাইরোপটেরা জাতীয় প্রাণীর মোটামুটি বিকশিত স্তনের সঙ্গে তুলনীয়। মোটের ওপর আমাদের সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে যে মানুষের পূর্বপুরুষদের শরীরে একজোড়ার অধিক স্তনের অস্তিত্ব না থাকলে পরবর্তীকালের নারী বা পুরুষদের মধ্যে অতিরিক্ত স্তন কখনোই যথেষ্ট পরিমাণে বিকশিত হয়ে উঠতে পারত কি না।
উপরোল্লিখিত গ্রন্থটিতে (ভ্যারিয়েশনস অফ অ্যানিম্যালস অ্যান্ড প্ল্যান্টস আন্ডার ডোমেস্টিকেশন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২) কিছু দ্বিধা সত্ত্বেও আমি একাধিক উদাহরণের সাহায্যে দেখিয়েছিলাম যে মানুষ ও অন্যান্য বিভিন্ন প্রাণীর হাতে বা পায়ে পাঁচটির বেশি আঙুল (Polydactylism) আসলে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়াকেই সমর্থন করে। কিছু ইথিওপটেরিজিয়া প্রাণীর হাতে বা পায়ে পাঁচটির বেশি আঙুল থাকে—অধ্যাপক ওয়েনের এই তথ্য আমাকে অনেকটাই সহায়তা করেছিল, যার ফলে আমি ধারণা করেছিলাম যে এগুলো (আঙুল) প্রাথমিক অবস্থা ফিরে যেতে পারে। কিন্তু অধ্যাপক জিগেনবোর ( দ্র. ‘জেনাইশ্চেন জেইতশ্চরি’, বি. ৫. হেফ্ট ৩, পৃ. ৩৪১) অধ্যাপক ওয়েনের বিরোধিতা করেছেন। অন্যদিকে, হাড়ের কেন্দ্রীয় অবস্থানের (central chain) উভয় পাশে গাঁটযুক্ত হাড়ের আভাস (bony rays) থাকা প্যাডল সেরাটোডাস (Paddle ceratodus) প্রাণীদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে মি. গান্থার বলেছেন, মধ্যমার একপাশে বা দু’পাশে ছ’টি বা তার বেশি আঙুল এমন কিছু বড় রকমের অসুবিধা সৃষ্টি করে না; এক্ষেত্রে এগুলো প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পুনরুদ্ভাবিত হয়। ড. কুতেভিন আমাকে জানিয়েছেন যে এমন একজন লোকের কথা তাঁরা নথিভুক্ত করেছেন যা রহাতে ও পায়ে ২৪টি করে আঙুল আছে। এ থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে অত্যধিক আঙুলের উপস্থিতি প্রত্যাবর্তনের জন্যে হলেও তা শুধুমাত্র বংশগতির মাধ্যমে প্রাপ্ত নয়, এবং তার চেয়েও বড় কথা হলো, আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি যে নিম্নশ্রেণির মেরুদণ্ডী প্রাণীদের স্বাভাবিক আঙুলের মতো তা ছেদনের পর পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা লাভ করে। অবশ্য আমি আমার বইয়ের (ভ্যারিয়েশনস অফ অ্যানিম্যালস অ্যান্ড প্ল্যান্টস আন্ডার ডোমেস্টিকেশন) দ্বিতীয় সংস্করণে ব্যাখ্যা করেছি কেন এখন আমি নথিভুক্ত বিভিন্ন ঘটনার এই ধরনের পুনরুৎপাদনের ওপর যথেষ্ট আস্থাশীল নই। তথাপি লক্ষণীয় যে বেশির ভাগ গতিরুদ্ধ বিকাশ ও শারীরিক অংশের প্রত্যাবর্তন একটি আন্তঃসম্পর্কিত পদ্ধতিবিশেষ। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, ওই অবস্থায় বা গতিরুদ্ধ দশায় ভ্রুণের বিভিন্ন প্রকার গঠন-আকৃতি বা অধ্যাপক মেকেল ও অধ্যাপক ইলিডোর জিওফ্রে সেন্ট-হিলেয়ার বার বার উল্লেখ করেছেন, যেমন নাকের নিচে চেরা ঠোঁট, যুগ্ম জরায়ু ইত্যাদির কথা। কিন্তু এখন বোধহয় সবচেয়ে নিরাপদ হবে যদি আমরা একইসঙ্গে অত্যধিক আঙুলের বিকাশ ও কিছু নিম্নশ্রেণির মানুষের পূর্বপুরুষদের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া শারীরিক অংশের মধ্যে সম্পর্কের ধারণাটি আপাতত সরিয়ে রাখি।
১২. অধ্যাপক কানেত্রিনি তাঁর বইয়ের (দ্র., Annuario della Soc, del Naturalistic in Modena’, ১৮৬৭) ৮৩ পাতায় প্রমাণিত তথ্যসহ এই বিষয়েও ওপর অতিরিক্ত সংযোজন করেছেন। অধ্যাপক লারিলার্ড পরীক্ষা করে দেখেছেন বিভিন্ন প্রকার মানুষ ও কিছু বানরের দেহে দুটি ম্যালার হাড়ের গঠন, সৌষ্ঠব, এমনকী সম্পর্ক পর্যন্ত সম্পূর্ণ একইরকমের। তাছাড়া তিনি মনে করেন না যে এদের এই বিন্যাস কোনো আকস্মিক ঘটনামাত্র। এ ব্যাপারে ড. সারিওতি-র একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তুরিনের পত্রিকায় (দ্র., Gazzetta delle cliniche, Turin, ১৮৭১)। তাতে তিনি বলেছেন, হাড়ের বিভাজন চিহ্ন শতকরা দু’ভাগ পরিণত করোটিতে পাওয়া যেতে পারে এবং তা কখনোই অন্যান্য জাতিগুলোর তুলনায় আর্যজাতির পূর্বপুরুষদের মধ্যে বেশি ছিল বলে দাবি করা যায় না। এ বিষয়ে আরও দ্রষ্টব্য, জি, দেলোরজি (The nuovi casi dianomalia dell’ osso malare’, Torino, ১৮৭২) এবং অধ্যাপক ই, মর্শেলি-র (‘Sopra unarara anomalia dell’ osso malare’, Modena, ১৮৭২ ) লেখা। এখনও পর্যন্ত আমি যতদূর জানি, অধ্যাপক গ্রুবার সম্প্রতি হাড়ের বিভাজন সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বই লিখেছেন। এ-সমস্ত উল্লেখ এই জন্য করা যে জনৈক সমালোচক উপযুক্ত কোনো ভিত্তি ছাড়াই নির্দ্বিধায় আমার বিবৃতিতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
১৩. ইসিডোর জিওফ্রে সেন্ট-হিলেয়ার এসব ঘটনার একটি পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করেছেন (দ্র. ‘হিসতোয়ার দে অ্যানোম্যালি’, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৩৭)। শরীরের বিভিন্ন অংশের গতিরুদ্ধ বিকাশের বেশ কিছু ঘটনা নথিভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তা নিয়ে আলোচনা না করায় জনৈক সমালোচক আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে দোষারোপ করেছেন (দ্র. ‘জার্নাল অফ অ্যানাটমি অ্যান্ড ফিজিওলজি’, ১৮৭১, পৃষ্ঠা ৩৬৬)। আমার মতবাদ অনুযায়ী, তিনি বলেছেন, ‘বিকাশের সময় শরীরের কোনো অংশের প্রত্যেকটি ক্ষণস্থায়ী অবস্থা শুধু তার উদ্দেশ্যসাধনের উপায়মাত্র নয়, যদিও পূর্বে এটি স্বয়ং সে উদ্দেশ্যেই সাধন করেছিল।’ জানার পক্ষে এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমার মনে হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, বিকাশের প্রারম্ভিক অবস্থায় শারীরিক অংশগুলোতে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া বা প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত থেকেও বৈসাদৃশ্য ঘটে না কেন? তথাপি এই ধরনের বৈসাদৃশ্য সংরক্ষিত হয় ও সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় যদি কোনোভাবে তা কার্যকরী হতে পারে, যেমন বিকাশের সময়সীমা কমিয়ে বা সরলীকরণের দ্বারা। আবার কেনই বা অস্তিত্বের পূর্ববাস্থার সঙ্গে সম্পর্কহীন অপুষ্টিজনিত ক্ষয়কারক অংশ বা অত্যাধিক পুষ্টির ফলে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অংশের মতো ক্ষতিকারক অস্বাভাবিকতা প্রাথমিক অবস্থায় বা পূর্ণতাপ্রাপ্তির সময়ে দেখা যায় না?
১৪. এই নথিপত্রগুলো অত্যন্ত মনোযোগী অধ্যয়নের দাবি রাখে, বিশেষ করে যদি কেউ জানতে আগ্রহী হন কীভাবে আমাদের মাংসপেশিগুলো বারবার প্রভেদ সৃষ্টি করে এবং প্রভেদ সৃষ্টি করতে গিয়ে চতুষ্পদ প্রাণীদের সঙ্গে সাদৃশ্য গড়ে তোলে। নিম্নলিখিত উদহারণগুলো আমার মূল বইতে উল্লিখিত বেশ কিছু দৃষ্টি-আকর্ষণকারী বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত (দ্র. ‘প্রস, রয়্যাল সোস্’, খণ্ড ১৪, পৃ. ৩৭৯-৩৮৪, খণ্ড ১৫, পৃ. ২৪১-৪২, ৫৪৪; খণ্ড ১৫, পৃ. ৫২৪।) এখানে আমার শুধু এটুকুই বলার আছে যে ড. মুরি ও মি. সেন্ট জর্জ মাইভোর্ট তাঁদের প্রবন্ধে দেখিয়েছেন সর্বোৎকৃষ্ট প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নস্থানীয় প্রাণী লেমুরজাতীয় বানরদের কিছু মাংসপেশি কেমন অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তনশীল। এমনকী নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের মাংসপেশির কাঠামোগত পরিবর্তনও লেমুরজাতীয় বানরদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।
১৫. অধ্যাপক ম্যাকলিস্টার তাঁর পর্যবেক্ষণগুলোকে তালিকা করে সাজিয়ে দেখেছেন যে পেশিগত অস্বাভাবিকতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অগ্রবাহুতে, তারপর যথাক্রমে মুখমণ্ডলে ও পায়ে।
১৬. রেভারেন্ড ড. হটন মানুষের হাতে ফ্লেক্সর পলিসির লংগাস পেশিটির একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য জানিয়ে (দ্র. ‘প্রস. আর. আইরিশ অ্যাকাডেমি’, ২৭ জুন, ১৮৬৪, পৃ. ৭১৫) বলেছেন, ‘এই চমৎকার উদাহরণটি থেকে বোঝা যায় যে, মানুষ কখনো কখনো ম্যাকাকাসজাতীয় বানরদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হাতের বুড়ো আঙুল ও অন্যান্য আঙুলের পেশিবন্ধ (tendons ) ব্যবস্থা ধারণ করে। কিন্তু আমার নিশ্চিতভাবে জানা নেই এ-রকম কোনো ঘটনা থেকে এটা মনে হতে পারে কি না যে ম্যাকাকাস মানুষকে ঊর্ধ্বমুখে ঠেলে দিচ্ছে বা মানুষ ম্যাকাকাসকে নিম্নমুখে ঠেলে দিচ্ছে, অথবা এটা প্রকৃতির সম্পূর্ণ সহজাত একটি খেয়াল মাত্র।’ অবশ্যই এটা আশাব্যঞ্জক যে একজন, যোগ্য শারীরতত্ত্ববিদ ও বিবর্তনবাদের একজন তীব্র বিরোধী প্রথম দু’টি উক্তির মধ্যে যে-কোনো একটির সম্ভাব্যতা আছে বলে স্বীকার করেছেন। অধ্যাপক ম্যাকালিস্টার, বানরজাতীয় চতুষ্পদ প্রাণীদের ফ্লেক্সর পলিসিস লংগাস পেশির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত উল্লেখযোগ্য নানান বৈসাদৃশ্যের কথা বলেছেন (দ্র., ‘প্রস, আর. আইরিশ অ্যাকাডেমি’, ১০ম খণ্ড, ১৮৬৪, পৃ. ১৩৮)।
১৭. এই বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার আগে মি. উড অপর একটি প্রবন্ধে গলা, ঘাড় ও বুকের কিছু পেশির বৈসাদৃশ্যের কথা বলেছেন (দ্র. ‘রিল, ট্রানজাকশনস্’, ১৮৭০, পৃ. ৮৩)। তিনি এখানে দেখান যে, এই পেশিগুলো কী ভীষণ পরিবর্তনশীল এবং নিম্নশ্রেণির প্রাণীদের স্বাভাবিক পেশিগুলোর সঙ্গে এরা কত বেশি নিকট সাদৃশ্যযুক্ত। অবশেষে তিনি বিষয়টির উপসংহার টানেন এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে যে, ‘আমার অভিলাষ পূর্ণ হবে যদি আমি দেখাতে সমর্থ হই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু গঠন-আকৃতি মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশে বৈচিত্র্য আনার সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে সুস্পষ্ট কার্যের ধারা প্রদর্শন করে এবং তাকে শারীরতত্ত্ববিদ্যার ক্ষেত্রে ডারউইনের প্রত্যাবর্তন নীতি বা বংশগতির সূত্রের প্রমাণ ও উদাহরণ হিসেবে বিচেচনা করা যেতে পারে।’
১৮. ‘স্পেকটেটর’ পত্রিকায় মার্চ সংখ্যায় (১২, ১৮৭১, পৃ. ৩২০) জনৈক লেখক মন্তব্য করেছেন)—’মি. ডারউইন মানুষের বিকাশের অধোগমনের একটি নতুন মতবাদ পুনরুত্থাপিত করতে বাধ্য হয়েছেন। উচ্চশ্রেণির জন্তুদের সহজাত প্রবৃত্তি যে মানুষের বন্য জাতগুলোর আচার-আচরণের তুলনায় অনেক উন্নত মানের, তা দেখিয়েছেন তিনি। এবং সেই কারণেই প্রচলিত গোঁড়া ধ্যানধারণা অনুযায়ী এই তথ্য পুনরুত্থাপিত করতে নিজেকে বাধ্য করেছেন তিনি, যদিও সেই ধ্যানধারণা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অচেতন ছিলেন। মানুষের জ্ঞানার্জনের ব্যাপারটি সাময়িক অথচ দীর্ঘকাল ধরে কার্যকরী নৈতিক অধঃপতনের কারণ ঘটেছিল—এ সম্পর্কে একটি বৈজ্ঞানিক অনুমানসিদ্ধ তত্ত্ব তিনি পুনরুত্থাপিত করেছেন এবং বন্য জাতিগুলোর খারাপ রীতিনীতিসমূহ, বিশেষত তাদের বিবাহপ্রথাই যে এর মূলস্বরূপ, তা দেখিয়েছেন। মানুষের নৈতিক অধঃপতনের ইহুদিধারা তার সর্বোচ্চ সহজাত প্রবৃত্তির দ্বারা অর্জিত জ্ঞানের মধ্য দিয়ে এর বাইরে আর কিছু করতে পারে কি?
১৯. মি. মুরি ও মি. মাইভার্ট তাঁদের ‘অ্যানাটমি অফ দ্য লেমুরওডিয়া’ (দ্র. ‘ট্রানজাকট, জুলজিক্যাল সোসাইটি,’ ৭ম খণ্ড, ১৮৬৯ ও পৃ. ৯৬-৯৮) প্রবন্ধে বলেছেন, ‘শরীরে কিছু কিছু মাংসপেশির উপস্থিতি এতই অনিয়মিত যে তারা উপরিউক্ত শ্রেণির কোনো-একটিতে ভালোভাবে পড়ে না।’ এই মাংসপেশিগুলো এমনকী একই শরীরের দুই বিপরীত পাশে থেকেও ভিন্নতা প্রকাশ করে।
২০. যাঁরা ‘অ্যানথ্রোপলজিক্যাল রিভিউ’তে প্রকাশিত মি. ওয়ালেসের বিখ্যাত গবেষণাপত্র ‘দ্য অরিজিন অফ হিউম্যান রেসেস ডিডিউস্ড ফ্রম দ্য থিওরি অফ ন্যাচরাল সিলেকশন’ পড়েছেন, ‘তাঁরা সম্ভবত আমার মূল বইতে তাঁর মন্তব্যের উদ্ধৃতি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করবেন। আমি এখানে মি. ওয়ালেসের সেই কাজটির প্রসঙ্গে স্যার জে. লুবক-এর অত্যন্ত সঠিক মন্তব্যটি (দ্র. ‘প্রিহিস্টোরিক টাইমস’, পৃ. ৪৭৯) উল্লেখ না করে পারলাম না—’কোনোরকম একদেশদর্শিতার মধ্যে না গিয়ে মি. ডারউইন এটিকে (অর্থাৎ প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটিকে) ব্যক্ত করেছেন। যদিও সকলেরই জানা যে তিনি একা একাই এই ধারণাকে আয়ত্ত করেছেন ও প্রকাশ করেছেন, তবু সবসময় তিনি একই যুক্তি বা ব্যাখ্যা রাখেননি।’
২১. ‘ডাবলিন কোয়ার্টারলি জার্নাল অফ মেডিকেল সায়েন্স’-এ প্রকাশিত মি. লসন জেইত-এর ‘ল্য অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ থেকে উদ্ধৃত। ওই একই রিপোর্ট থেকে ড. কেলার-কে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
২২. হাইলোবেত্স সসিডোকটিলাস বানরদের নাম থেকে বোঝা যায় এদের পায়ের দুটি আঙুল জুড়ে থাকে এবং লার ও লোসিসকাস বানরদের পায়ের আঙুলে এটা লক্ষ করা যায়—এই বিষয়টি আমাকে জানান মি. বিথ-এর তথ্য অনুযায়ী এইচ. এজিলিস। কলোবাস বানররা প্রধানত বৃক্ষবাসী ও অস্বাভাবিক রকমের কর্মঠ (দ্র. ব্রে, ‘থিয়েরলেবেন’, বি, ১ম, পৃ. ৫০), কিন্তু তারা একই শ্রেণির অন্তর্গত অন্য কোনো প্রজাতির তুলনায় গাছে চড়তে বেশি পারদর্শী কি না আমার জানা নেই। তাছাড়া দেখা গেছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় বৃক্ষবাসী প্রাণী শ্লথের (দক্ষিণ আমেরিকার এক ধরনের বৃক্ষবাসী জন্তু) পায়ের পাতা বিস্ময়করভাবে আঁকশি-সদৃশ।
২৩. মানুষ কীভাবে দ্বিপদে উন্নীত হলো—সে বিষয়ে অধ্যাপক হ্যাকেল-এর একটি চমৎকার আলোচনা রয়েছে (দ্র., Naturliche Scopfungsgeschichte’, ১৮৬৮, পৃ. ৫০৭)। ড. বাসনার মানুষের মধ্যে এখনও বর্তমান এ-রকম অঙ্গ হিসেবে পায়ের ব্যবহারের কয়েকটি চমৎকার ঘটনার কথা বলেছেন (দ্র. ‘ Conferences sur la Theohrie Darwinienne, ১৮৬৯, পৃ. ১৩৫)। উচ্চশ্রেণির বানরদের উন্নতির ধারা সম্পর্কেও তিনি আলোকপাত করেছেন যা আমি প্রসঙ্গেক্রমে পরবর্তী অনুচ্ছেদে বলেছি। শেষোক্ত এই বিষয়টির জন্য দ্রষ্টব্য, অধ্যাপক ওয়েনের ‘অ্যানাটমি অফ ভার্টিব্রেটস,’ ৩য় খণ্ড,পৃ. ৭১।
২৪. আমার পুত্র মি. এফ. ডারউইন আমাকে ফরমিকা রুফা-র সেরিব্রাল গ্যাংলিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখিয়েছে।
২৫. সম্প্রতি প্রকাশিত একটি চাঞ্চল্যকর প্রবন্ধে অধ্যাপক ব্রকা মন্তব্য করেছেন, সভ্য জাতিগুলোর মধ্যে বেশ কিছু মানুষের করোটির গড় ধারণক্ষমতা বেশ কমে যায় যেহেতু সেখানে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল একদল মানুষকে সংরক্ষণ করা হয় যারা বন্য সময়ে অতি সহজেই ধ্বংস হতে বাধ্য। অন্যদিকে, ‘অ-সভ্যদের ক্ষেত্রে গড় ধারণক্ষমতা শুধুমাত্র অত্যন্ত সক্ষম ব্যক্তিদের দিয়েই নির্ধারিত হয় যারা জীবনের চরম কঠিন অবস্থাতেও বেঁচে থাকতে সক্ষম। তাই তিনি বলেছেন—অন্যথায় এটা ব্যাখ্যাতীত হয়ে পড়ে যে, কীভাবে লজ্যার-এর প্রাচীন ট্রগলোডাইটদের অনুন্নত মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা আধুনিক ফরাসিদের চেয়ে বেশি হয়।
২৬. জ্যারোল্ড (দ্র., ‘অ্যানথ্রোপলজিয়া’, পৃ. ১১৫-১৬। অধ্যাপক ক্যান্সারও তাঁর নিজের পর্যবেক্ষণ থেকে দৃষ্টান্তস্বরূপ কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন মাথার অস্বাভাবিক অবস্থানের জন্য করোটির আকারগত পরিবর্তন হয়। তিনি মনে করেন কিছু কিছু পেশার ক্ষেত্রে, যেমন জুতো তৈরির সময়, মাথা সবসময় সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে, ফলে কপাল আরও বেশি গোল ও প্রক্ষিপ্ত হয়।
২৭. ইসিডোর জিওফ্রে সেন্ট-হিলেয়ার (দ্র., Hist, Nat, Generale’, ২য় খণ্ড, ১৮৫৯, পৃ. ২১৫-২১৭) মানুষের মাথায় বড় চুল থাকার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে আরও উল্লেখ করেছেন বানর ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী জন্তুদের দেহের ওপরের অংশ নিম্নাংশের তুলনায় বেশি ঘন চুল বা লোম দ্বারা আবৃত থাকে। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিরাও সহমত পোষণ করেন। অধ্যাপক পি. গার্ভেস (দ্র. ‘ Hist, Nat, des Maommi feres’, ১ম খণ্ড, ১৮৫৪, পৃ. ২৮) বলেছেন যে গরিলাদের পিঠে চুলের পরিমাণ নিম্নাংশের তুলনায় পাতলা, এমনকী দু-এক জায়গায় নেই বললেও চলে।
২৮. দ্রষ্টব্য, ‘দ্য ন্যাচরালিস্ট ইন নিকারাগুয়া’, পৃ. ২০৯। মি. বেল্টের মতের সমর্থনে আমি এখানে স্যর ডব্লু. ডেনিসনের লেখা থেকে একটি অংশ (দ্র. ভ্যারাইটিস অফ ভাইরিগ্যাল লাইফ’, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৪০) উদ্ধৃত করছি, ‘অস্ট্রেলিয়াবাসীদের অভ্যাস হলো এই যে ক্ষতিকারক পোকামাকড়দের উৎপাতে তারা বিরক্ত হয়ে ওঠে।’
২৯. এ প্রসঙ্গে ড. ব্রাইন-সেকোয়ার্ড কৃত সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত গিনিপিগের অস্ত্র-চিকিৎসার ফলে পরিবর্তিত প্রভাবের পর্যবেক্ষণগুলো উল্লেখযোগ্য, এবং সেই সঙ্গেই উল্লেখ করা যায় অতি সম্প্রতি তাদের গলার সংবেদনশীল স্নায়ুতন্ত্র কাটা যাওয়ার অনুরূপ প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা। পরে আমি সুযোগমতো মি. স্যালভিন-এর সাড়া-জাগানো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে মো-মো-রা (mot-mots) তাদের লেজের পালকগুচ্ছ কোনো কাঁটা ফুটলে তা বংশগত প্রভাবের দ্বারা দাঁত দিয়ে তুলে ফেলে। এ-বিষয়ে আরও দ্রষ্টব্য, ‘ভ্যারিয়েশনস অফ অ্যানিম্যালস অ্যান্ড প্ল্যান্টস আন্ডার ডোমেস্টিকেশন’, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২-২৪।