দ্য ব্রিদিং মেথড
আমার বয়স এখন আশির কাছাকাছি। অর্থাৎ এই শতকের জন্মের সময়েই আমার জন্ম। প্রায় সারাজীবন ধরেই একটা বিল্ডিংয়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ঠিক বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিল্ডিংটা। দেখে মনে হয়, ধূসর রঙা বিশাল এক জেলখানা, যেন আ টেল অফ টু সিটিস-গল্পটা থেকে সরাসরি তুলে আনা হয়েছে। এখানের প্রায় সবাই নিশ্চয়ই জানেন, ওটা আসলে একটা হাসপাতাল। হ্যারিয়েট হোয়াইট মেমোরিয়াল হাসপাতাল। যার নামে এর নামকরণ করা হয়েছে, উনি হলেন আমার বাবার প্রথম স্ত্রী। ভদ্রমহিলা যে আমলে হাতে-কলমে নার্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তখনো সেন্ট্রাল পার্কের চারণভূমিতে সত্যি সত্যি ভেড়া চড়ে বেড়াত। বিল্ডিংয়ের সামনের একটা বেদীতে ওনার (আমার জন্মের সময় বেঁচে থাকলে উনি আমার সৎ মা হতেন) আবক্ষ ভাস্কর্য আছে। কেউ যদি ওটা দেখে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই কখনো না কখনো ভেবেছেন, এ রকম আপোষহীন, কঠোর মুখের কেউ এতো নম্র, চমৎকার পেশায় কেমন করে এলো? বেদীর পাদমূলে যে শ্লোগানটা লেখা আছে, ওর মধ্যেকার লাতিন ভাষার ভারটা ঝেড়ে ফেলে কথাটা খেয়াল করলে দেখবেন, জিনিসটা আরো অস্বস্তিকর। কঠোর, কাটা কাটা ভাষায় ওতে লেখা আছে, কষ্ট ছাড়া সুখ পাওয়া যায় না; সেজন্যই আমরা মুক্তিকে কষ্টের পাল্লায় মাপি। ক্যাটো, তুমি মানো আর না মানো, এটাই সত্যি!
ধূসর পাথরে বানানো সেই বিল্ডিংয়ের ভেতরেই আমার জন্ম। দিনটা ছিল ২০শে মার্চ, ১৯০০। তারপর, ১৯২৬ সালে আমি আবারো ওখানে ইন্টার্ন হিসেবে ফিরে গিয়েছিলাম। চিকিৎসা-জগতের জন্য ছাব্বিশ বছর বয়স নিতান্তই অল্প। কেবল পা রাখার বয়স হয়েছে, বলা যায়। কিন্তু ততদিনে আমি বাস্তবেই হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেলেছি। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষাশেষি অবস্থা। আমি ছিলাম ফ্রান্সে। পেট ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসা নাড়িভুঁড়ি ভেতরে ভরে সেলাই করে দেওয়া কিংবা কালোবাজারে প্রচলিত নকল এবং ভয়ংকর ক্ষতিকরসব মরফিন থেকে আসল জিনিস খুঁজে বের করে রোগির চিকিৎসা করা-দিনের পর দিন এসব করেই কেটেছে।
তারপর এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সে সময় আরো একটা প্রজন্ম একইরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তুলনা করলে দেখা যাবে, সব মিলে আমরা ওদের চেয়ে অনেক পরিণত। হাজার হাজার অস্ত্রোপচারের ফলে হাত পাথরের মতো স্থির হয়ে গেছে। এমনকি মেডিকেল স্কুলের রেকর্ড চেক করলে দেখা যাবে, ১৯১৯-১৯২৮ সালের মধ্যে হাতেগোণা অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই সফলভাবে পাশ করে বেরিয়েছে। আমরা বয়সে যেমন বড় ছিলাম, তেমনি ছিলাম অনেক বেশি অভিজ্ঞ এবং ধীরস্থির। আমরা কি ওদের চেয়ে জ্ঞানীও ছিলাম? আমি জানি না…কিন্তু অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছিলাম ভেতরে ভেতরে। জনপ্রিয় মেডিকেল উপন্যাসগুলোতে যেমন দেখা যায়, প্রথমবারের মতো ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে বমি করে দেওয়া কিংবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলা-ওসব ছিল না আমাদের মধ্যে। নো ম্যানস ল্যান্ডে পড়ে থাকা সৈনিকদের পঁচা লাশ, গ্যাস জমে বিস্ফোরিত হওয়া ওদের পাকস্থলীর মধ্যে মা ইঁদুরকে দেখেছি, বাচ্চাকাচ্চা পেলেপুষে বড় করে বেরিয়ে আসছে। এসব দেখতে দেখতে ততদিনে অভ্যাস হয়ে গেছে। বমি আর জ্ঞান হারানোর ওসব অভ্যাস সেই কবেই পেছনে ফেলে এসেছি!
হ্যারিয়েট হোয়াইট মেমোরিয়াল হাসপাতালে ইন্টার্ন শেষ করার নয় বছর পরে আমার সাথে একটা ঘটনা ঘটেছিল। হাসপাতালের লোকজন তখন এসে আমাকে বুঝতে পেরেছে। আজকে আমি আপনাদেরকে এই গল্পটাই বলবো। আপনারা হয়তো ভাববেন, এটা আসলে ক্রিসমাসের সময়ে বলার মতো গল্প না (যদিও এর সমাপ্তিটা এক ক্রিসমাসের সন্ধ্যায়-ই ঘটেছিল)। কিন্তু এই বীভৎস গল্পটাই, আমার মনে হয়, আমাদের এই ধ্বংসাত্মক, অভিশপ্ত প্রজাতির অসম্ভব চমৎকার দিকটার কথা বলে। এর মাঝে আমি আমাদের বিস্ময়কর ইচ্ছেশক্তির ক্ষমতা যেমন দেখতে পাই…তেমনি এর ভয়ংকর অন্ধকার দিকটাও স্পষ্ট দেখতে পাই।
জন্ম জিনিসটা অনেকের কাছে খুবই ভয়ংকর জিনিস। বাচ্চা জন্মের সময় বাবার উপস্থিতি আজকের দিনে ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এর ফলে যদিও অনেক বাবাই প্রচন্ড অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করে, যেটা আমার কাছে মনে হয়, তাদের প্রাপ্য না (তার উপর অনেক মহিলাকে দেখেছি, জেনেশুনেই এই অপরাধবোধটাকে স্বামীপ্রবরের বিরুদ্ধে নির্মমভাবে ব্যবহার করে), তারপরও ব্যাপারটা আসলে ভালো এবং বেশ স্বাস্থ্যকর। অথচ অনেককেই দেখেছি, রক্ত আর কান্না এবং চিৎকার দেখে-শুনে, ফ্যাকাশে মুখে কাঁপতে কাঁপতে ডেলিভারি রুম থেকে বেরিয়ে গেছে, কিংবা বাচ্চা মেয়ের মতো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এক বাবার কথা মনে আছে। পুরো সময়টা লোকটা বেশ ভালোভাবেই সবকিছু নিয়েছে…কিন্তু যখনই ওর ছেলে। সম্পূর্ণ সুস্থাবস্থায় পৃথিবীর বাতাসে শ্বাস নিয়েছে, ওই লোক তখন অপ্রকৃতিম্ভের মতো চিৎকার করতে শুরু করেছে। বাচ্চাটা ওর মাঝেই চোখ খুলে চারপাশ দেখছিল…এবং চোখদুটো শেষপর্যন্ত বাবার উপরে এসে স্থির হয়েছে।
জন্ম বেশ বিস্ময়কর জিনিস, এটা সত্যি। কিন্তু কোনোভাবেই এটাকে সুন্দর কিছু বলা যায় না। আকাশ-কুসুম কল্পনার আবেশে মুড়িয়েও সুন্দর বলার উপায় নেই অসম্ভব নির্মম এই প্রক্রিয়াটাকে। মহিলাদের গর্ভ হলো ইঞ্জিনের মতো। যখনই পেটে বাচ্চা আসে, ইঞ্জিনটা চালু হয়ে যায়। শুরুর দিকে জিনিসটা অত কাজ করে না, মোটামুটি অলস পড়ে থাকে…কিন্তু জন্মের সময় যত এগিয়ে আসে, ইঞ্জিনের কাজ-কর্ম, কাজের গতি তত বেড়ে যেতে থাকে। এক সময়ের অলস ফিসফিসানি প্রথমে মৃদু গুঞ্জনে পরিণত হয়, তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে ভয়াবহ চিঙ্কারে গিয়ে থামে। একবার সেই নিশুপ ইঞ্জিন যখন চালু হয়ে যায়, সব হবু মায়েরাই বুঝতে পারে, তার জীবনটা একটা সরু সুতোয় ঝুলতে শুরু করেছে। হয় সে। বাচ্চাকে জন্ম দেওয়ার মাধ্যমে ইঞ্জিনটা আবারো বন্ধ হয়ে যাবে, আর না হয় ইঞ্জিনটা ক্রমেই জোরে চিৎকার করতে থাকবে, বাড়িয়ে দেবে কাজের গতি। চাপ বাড়তে থাকবে, সব কিছু ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠবে। প্রচন্ড বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে, রক্ত আর প্রবল যন্ত্রণার বন্যা বইয়ে দিয়ে তাকে খুন করে ফেলবে ইঞ্জিনটা।
এটা একটা জন্মের গল্প। যে জন্মকে আমরা গত দুই হাজার বছর ধরে উদযাপন করে আসছি, সেরকম এক জন্ম-উদযাপনের বিকেলে এই ঘটনার সমাপ্তি হয়েছিল।
আমি ১৯২৯ সালে মেডিসিন অ্যাক্টিস করতে শুরু করি। যে কোনো কিছু শুরু করার জন্যেই বছরটা খারাপ ছিল। দাদা আমাকে অল্প কিছু টাকা ধার দিতে পেরেছিলেন। কাজেই বলা যায়, অন্যান্য সহকর্মীদের চেয়ে কিছুটা সৌভাগ্যবান-ই ছিলাম। তারপরেও, পরবর্তী চার বছর প্রচণ্ড কষ্ট করতে হয়েছে। টিকে থাকার জন্য কেবল বুদ্ধির উপরে নির্ভর করা ছাড়া আর কিছু ছিল না আমার।
১৯৩৫ সালের দিকে এসে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। মোটামুটি নির্দিষ্ট কিছু রোগি তৈরি হয়ে গিয়েছে আমার ততদিনে। সেইসঙ্গে একটা নাম তৈরি হয়েছে। নিজস্ব রোগি ছাড়াও, হোয়াইট মেমোরিয়াল হাসপাতালের পক্ষ থেকে অনেক সময় নতুন রোগি আসলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিত। তো, সে বছরের এপ্রিলে এভাবেই এক নতুন রোগি এলো আমার কাছে। বয়সে তরুণী সেই রোগিকে আমি এখানে ‘স্যান্ড্রা স্ট্যান্সফিল্ড’ বলে ডাকব। এই নামটা আসলে ওর বাস্তব নামের খুবই কাছাকাছি। যাই হোক, মেয়েটার গায়ের রঙ ফর্সা। ওর ভাষ্যমতে, বয়স নাকি আটাশ। কিন্তু পরীক্ষা করার পরে আমি বুঝলাম, ওর বয়স আরো তিন থেকে পাঁচ বছরের মতো কম হবে। স্বর্ণকেশী, রোগা শরীর এবং সে সময়ের মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা-পাঁচ ফিট আট ইঞ্চির মতো। মেয়েটা আসলে দারুণ সুন্দরি, কিন্তু একটা অদ্ভুত কাঠিন্য সৌন্দর্যটাকে অনেকটাই গিলে নিয়েছে। সমস্ত ছাপিয়ে স্পষ্ট যৌবন উঁকি দিচ্ছে। চোখ দুটোতে ঠিকরে বেরোচ্ছে বুদ্ধির ছাপ…কিন্তু মুখের মধ্যে ফুটে উঠেছে দৃঢ় প্রত্যয়। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের বেদীতে রাখা হ্যারিয়েট হোয়াইটের পাথুরে ভাস্কর্যের মতোই মেয়েটার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। ফর্মে স্যান্ড্রা স্ট্যান্সফিল্ডের জায়গায় নিজের নাম লিখেছে জেন স্মিথ। পরীক্ষা করে বুঝতে পারলাম, মেয়েটা প্রায় দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু হাতে বিয়ের কোনো আঙটি নেই।
প্রাথমিক পরীক্ষার পর-তখনো প্রেগন্যান্সি টেস্টের মূল ফলাফল আসেনি, আমার নার্স এলা ডেভিডসন বলেছিল, ‘গতকালকে যে মেয়েটা আসলো, জেন স্মিথ? ওটা নিশ্চয়ই বানানো নাম। বাস্তবে অমন কোনো নাম আমি জীবনেও শুনিনি।”
একমত হলাম। তারপরও মেয়েটাকে আমার কাছে প্রশংসার যোগ্য বলে মনে হয়েছে। সচরাচর মেয়েরা এসে যেরকম নাটক করে, এই মেয়ে তার ধারে-কাছে দিয়েও যায়নি। করুণ মুখ করে, চোখের জল ফেলে করুণা চায়নি। সোজাসাপ্টা স্পষ্ট কাজ করেছে। ব্যবসায়িদের মতো। ভুয়া নামটা শুনেও নিজের লজ্জা আড়াল করার চেয়ে বরং অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। বলে মনে হয়েছে। বাস্তবতা আনার জন্য ‘বেটি রাকলহাউজ’ বা ‘টারনিনা ডিভিল’ ধরণের কোনো নাম সে দেয়নি। ফর্ম পূরণ করার জন্য নাম লাগে, এটাই আইন। সেজন্যই সে একটা নাম বলেছে। যেন বলতে চাইছে, নাম লাগবে? এই নাও নাম। কিন্তু যে লোককে চিনি না তার পেশাগত নৈতিকতার উপর ভরসা না করে আমি বরং নিজের উপরেই ভরসা করছি। কিছু মনে করো না যেন!
এলা ঘোঁত করে উঠল। সেইসঙ্গে বেশ কিছু মন্তব্য যোগ করতে ভোলেনি। আধুনিক মেয়ে এবং ‘লজ্জা-শরম আছে নাকি! যেভাবে ঝলমল করছিল’-এ রকম বেশ কিছু মন্তব্য করেছিল। তবে, এলা মানুষ ভালো। ফর্ম নিয়ে কথায় কথায় বলার জন্যেই কেবল ওগুলি বলেছে, আসলেই ওসব। বুঝিয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। আমার মতো সেও জানত, আমার নতুন। এই রোগি আর যাই হোক, কঠিন চোখ আর গোল-তলা হিল পরা সস্তা কোনো পতিতা না। জেন স্মিথ’ বরং অসম্ভব সিরিয়াস এবং প্রচন্ড দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এক তরুণী। ওর জন্য এটা কেবল একটা বাজে পরিস্থিতি (আপনাদের হয়তো মনে আছে, তখনকার দিনে এটাকে ‘চেঁছে ফেলা বলত। আর, এখন তো অনেক মেয়েই বাজে পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে এই ‘চেঁছে ফেলার পদ্ধতি ব্যবহার করে), এবং মেয়েটা যেভাবেই হোক, সম্ভবত যতটুকু মান-সম্মান নিয়ে ওই পরিস্থিতে থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব, তা-ই করতে চাচ্ছিল।
প্রথমবার দেখিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে আবার এলো মেয়েটা। সেদিনের আবহাওয়া বেশ চমৎকার ছিল। কেবলই বসন্ত শুরু হয়েছে, তার ফল। মৃদু বাতাস বইছে, আকাশ হালকা নীল দুধ-সাদা রঙ গায়ে জড়িয়েছে। বাতাসে কেমন একটা হালকা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে-উষ্ণ, বর্ণনাতীত এক গন্ধ। যেন প্রকৃতি নিজের মতো করে বুঝাতে চাইছে, আরেকটা জন্ম চক্রে ঢুকতে যাচ্ছে সে। এ রকম দিনে সব দায়দায়িত্ব থেকে সহস্র মাইল দূরে কোথাও পছন্দের মানুষটার সাথে বসে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে। জায়গাটা কনি আইল্যান্ড হতে পারে, হতে পারে হাডসন নদীর ধারে কোথাও। হয়তো হাতে থাকবে পিকনিক হ্যাঁম্পার। সাথের মানুষটার পরনে থাকবে ‘লেডিদের’ সাদা কার্টহুইল হ্যাট, এবং ঝকঝকে রৌদ্রস্নাত দিনের মতো সুন্দর স্লিভলেস গাউন।
জেন স্মিথের গায়ের সাদা লিনেনের জামাটায় বাদামি বর্ডার দেওয়া। জামাটায় স্লিভ, মানে লম্বা হাতা ছিল। তারপরও দেখতে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের মতোই সুন্দর লাগছিল। পায়ে বাদামি পাম্প শু, হাতে সাদা হাতমোজা, মাথায় পুরনো দিনের ক্লচে হ্যাট-হাল আমলে যারা ফ্যাশন করে, তারা এখন আর এসব হ্যাট পরে না। এটা দেখেই আমি প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলাম, মেয়েটা মোটেও ধনী কেউ না।
‘আপনি অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু আপনার নিজেরও এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তাই না?’ বলার পর ভাবছিলাম, কান্নাকাটি পর্ব শুরু হলে সেটা এখনই শুরু হবে।
‘না, নেই।’ মেয়েটার গলা পুরোপুরি শান্ত। বাইরের আকাশে যেমন মেঘের ছিটেফোঁটা চিহ্নও নেই, মেয়েটার চোখও সেরকম, পরিস্কার। স্থিরভাবে বলল, আমার সবসময় নিয়ম করেই মাসিক হতো।
এক মুহূর্তের নিরবতা।
তারপর জানতে চাইল, ‘তো, ডেলিভারি কখন হতে পারে? প্রায় নিঃশব্দে, সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস বের করে দিল সে। প্রচন্ড ভারি কোনো বোঝা কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য ঝুঁকলে মানুষের বুক থেকে যেমন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, সেরকম শোনাল।
‘বাচ্চাটা ক্রিসমাস-বাচ্চা হবে,’ জবাব দিলাম। এমনিতে আমি বলব ১০ ডিসেম্বর। তবে, দুই সপ্তাহ এদিক-ওদিক হতে পারে আরকি।
‘আচ্ছা।’ মুহূর্তখানেকের জন্য একটুখানি অস্বস্তি ভর করল ওর গলায়। তারপর প্রশ্নটা করেই ফেলল, ‘আমি বিবাহিত না, এটা জেনেও আপনি আমার ডেলিভারি করবেন?
‘হ্যাঁ, করবো। তবে একটা শর্ত আছে।’
মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। সেই মুহূর্তে ওকে দেখে একেবারে আমার বাবার প্রথম স্ত্রী, হ্যারিয়েট হোয়াইটের মতোই লাগছিল। মাত্র তেইশের মতো বয়সি কারো কুটি যে এতোটা ভারি মনে হতে পারে, সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে সে। নতুন কোনো ডাক্তারের কাছে গেলে আবারো একই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে-এই ব্যাপারটাও ওকে আটকাতে পারবে বলে মনে হচ্ছিল না।
শেষ পর্যন্ত নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে, ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করল, কী শর্ত?
এবারে আমার অস্বস্তি বোধ করার পালা। ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার প্রচন্ড তাড়না বোধ করছিলাম। কিন্তু নিজের উপর প্রচন্ড জোর খাঁটিয়ে, ওর চোখে চোখ রেখে বললাম, আমি আপনার আসল নাম। জানতে চাই। হ্যাঁ, আপনি চাইলে আমার ফি ক্যাশ টাকায় দিতে পারবেন, কোনো সমস্যা নেই। আমি আপনার সব রিসিড মিসেস ডেভিডসনকে জেন স্মিথের নামেই করে দিতে বলব। কিন্তু আগামী প্রায় সাত মাস ধরে আপনাকে দেখতে হবে আমার। এই পুরো পথটা যদি একসাথে পাড়ি দিতেই হয়, তাহলে আমি আপনার আসল নাম জানতে চাই। বাকি জীবনে সবাই আপনাকে যে নামে ডাকবে, আমিও আপনাকে সে নামেই ডাকতে চাই।
উদ্ভট বক্তৃতাটা ওখানেই শেষ করলাম। দেখলাম, মেয়েটা ভেবে দেখছে, কী করবে। মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, সে এখুনি উঠে দাঁড়াবে। এতোদিন সময় দেওয়ার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যাবে চিরদিনের জন্য। আর ফিরে আসবে না। কিন্তু এমনটা হলে আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগবে। মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, শতকরা নব্বই শতাংশ মহিলা এ রকম পরিস্থিতিতে মিথ্যে বলে-টলে একাকার করে ফেলত। সাধারণত নিজের ভেতরে টিকটিক করে চলা ঘড়িটাকে প্রচন্ড ভয় পায় তারা। আর এতো বেশি লজ্জিত বোধ করতে থাকে যে, বুদ্ধি খাঁটিয়ে, ভেবে-চিন্তে সামনে এগোনোটা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে জায়গায় মেয়েটা এতো সোজাসাপ্টা সব কিছু সামাল দিচ্ছে দেখে ওকে শ্রদ্ধা হচ্ছিল আমার।
এখনকার অনেক তরুণ-তরুণী সম্ভবত এসব বিশ্বাসই করতে চাইবে । কোনো মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হলে এমন কিছু করার কথা ভাবতে পারে এটা তাদের কাছে হাস্যকর এবং বিশ্রী মনে হতে পারে। মানুষ নিজের মনের বড়ত্ব দেখাতে এতো উতলা হয়ে উঠেছে যে, বিবাহিতার চেয়ে অবিবাহিতা কেউ অন্তঃসত্ত্বা হলে লোকে আজকাল দ্বিগুণ উদ্বেগ দেখায়। হিপোক্রেসি বা ভন্ডামি আর সততা একসাথে মিশে গিয়ে যে কী ভয়াবহ অবস্থা করতে পারে, সেটা সম্ভবত আপনারা বুঝবেন। জীবনের জটিল গিঁটের মাঝে পড়ে গিয়ে যে মেয়ে তখন কুল হাতড়ে বেড়াচ্ছে, মানুষ তার জীবন আরো অসহনীয় করে ফেলে। আর, আগেকার দিনে বিবাহিত অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা দারুণ প্রভাবশালী হতো। নিজের ভবিষ্যত নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত থাকত। স্রষ্টা তাদেরকে যে উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে বলে তারা ভাবত, সে উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারার গর্বে গর্বিত হয়ে উঠত। এদিকে অবিবাহিতা অন্তঃসত্ত্বারা শুধু লোকের চোখেই না, নিজেরাও নিজেদেরকে পতিতা বলে ভাবতে থাকত। এলা ডেভিডসনের ভাষায়, ওরা। হলো ‘সস্তা মেয়েমানুষ। সে সময়ের পৃথিবীতে মেয়েদের ‘সহজে ধরা দেওয়া মানুষ সহসা ভুলতে পারতো না। তাই, এসব মেয়েরা লুকিয়ে চুরিয়ে অন্য শহরে চলে যেত বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য। কেউবা পিল খেয়ে নিত, কেউবা ঝাঁপ দিত উঁচু বাড়ির ছাদ থেকে। বাকিরা কসাইয়ের মতো। অ্যাবরশনিস্টের হাতে নিজেকে সঁপে দিত, অথবা নিজেই একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলার চেষ্টা করত। ডাক্তার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় আমি নিজেই চারজন মহিলাকে বিক্ষত জরায়ু থেকে রক্তপাতের ফলে, অনেক বেশি রক্তহানী হয়ে মারা যেতে দেখেছি। এর মাঝে একজনের জরায়ু ঝাড়ুর হাতলে বাঁধা মরিচ-বোতলের কাছের মাথা দিয়ে কাটা হয়েছে। ভাবা যায়? আজকের এই সময়ে বসে এসব হয়েছে বলে কল্পনা করাও কঠিন। ভাইরে, এর সবই এক সময় হয়েছে। সব! এক কথায় বললে, একজন তরুণী এক জীবনে এরচেয়ে খারাপ পরিস্থিতে আর পড়তে পারে না।
মেয়েটা শেষ পর্যন্ত নিরবতা ভেঙে বলল, ‘ঠিক আছে। আপনি অন্যায় কিছু বলেননি। আমার নাম স্যান্ড্রা স্ট্যান্সফিল্ড।’-বলে, হ্যান্ডশেকের জন্য একহাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। বেশ চমৎকৃত হলাম। হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিলাম। ভাগ্য ভালো, এলা ডেভিডসন আমাকে এ অবস্থায় দেখেনি। দেখলে সে কিছু বলত না, কিন্তু পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাকে জঘন্য কফি খেতে হতো।
মেয়েটা হাসল-সম্ভবত আমার কিছুটা চমকে যাওয়া হতভম্ব মুখভঙ্গি দেখে মজা পেয়েছে। সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আশা করি, আমরা বন্ধু হতে পারব, ডক্টর ম্যাকক্যারন। আমার আসলে অনেক ভয়ে লাগছে। এখন আমার একজন বন্ধু খুব দরকার।
‘সেটা আমি বুঝতে পারি। আপনার বন্ধু হওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করব আমি, মিস স্ট্যান্সফিল্ড। আমি কি আপনার জন্য এই মুহূর্তে কিছু করতে পারি?’
হাতব্যাগ খুলে মুদি দোকান থেকে কেনা একটা প্যাড আর কলম বের করল মেয়েটা। প্যাড আর কলমের মুখ খুলে নিয়ে আমার দিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য তীব্র আতঙ্ক জাপটে ধরল আমাকে। মনে হচ্ছিল, মেয়েটা আমার কাছে কোনো অ্যাবরশনিস্টের নাম-ঠিকানা জানতে চাইবে। তারপর বলল, ‘কী খেলে আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে, বলুন তো। মানে, বাচ্চার জন্য জানতে চাচ্ছিলাম আরকি।
আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। মেয়েটা অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল।
‘মাফ করবেন-আপনার কাজকর্ম অনেকটা ব্যবসায়িদের মতোন।
‘হুম, হতে পারে, মেয়েটা জবাব দিল। কিন্তু এই বাচ্চাটার দায়িত্ব এখন আমার জন্য ব্যবসায়িক কাজের মতো সিরিয়াস-ই তো, নাকি, ডক্টর ম্যাকক্যারন?
‘তা তো অবশ্যই। আর, আমার একটা ফোল্ডার আছে। এটা আমি অন্তঃস্বত্তা সব রোগিকেই দেই। খাওয়া দাওয়া, ওজনের দিকে খেয়াল রাখা, পানীয়, ধুমপান ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়েই ওতে বিস্তারিত বলা আছে। কিন্তু, এটা পড়ে হাসবেন না, প্লিজ। আমি নিজেই লিখেছি তো, হাসলে কষ্ট পাব।’
জিনিসটা ওকে দিলাম। আসলে ওটা তখন ঠিক ফোল্ডার ছিল না। বরং পাতলা পুস্তিকা মতো কিছু বলা যায়। সময়ের সাথে সাথে কলেবরে বাড়তে বাড়তে পরে এক সময় পুরোদস্তুর বইতে পরিণত হয়েছিল-অ্যা প্র্যাক্টিক্যাল গাইড টু প্রেগন্যান্সি অ্যান্ড ডেলিভারি। সে সময় আমি ধাত্রী এবং প্রসূতিবিদ্যা নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলাম-সত্যি বলতে, এখনো আছি-তবে, সে কালে উপরের লোকজনের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ না থাকলে এ রকম একটা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়াটা মোটেও সহজ ছিল না। আর, যোগাযোগ থাকলেও, ঠিক করে নিজেকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অন্তত দশ থেকে পনের বছর চর্চা তো করা লাগতই। কিন্তু কৈশোর আর যৌবনের একটা বড় সময় যুদ্ধের মাঠে কাটিয়ে দেয়ার ফলে আমার মোটামুটি অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল। এর বেশি নষ্ট করার মতো সময় আছে বলে মনে হয়নি আমার কাছে। বরং মনে হয়েছিল, যেটুকু জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা আছে, সেটা কাজে লাগালে অনেক অন্তঃস্বত্তা মাকে প্রয়োজনীয় সেবাটুকু দিতে পারব, এবং অনেক চমৎকার বাচ্চাকে ঠিকভাবে ডেলিভারি করাতে পারব। আমি তা-ই সে কাজেই আত্মনিয়োগ করেছিলাম। যদুর মনে পড়ে, অন্তত দুই হাজারের বেশি বাচ্চা ভালো ভাবেই ডেলিভারি করেছি আমি-যাদেরকে দিয়ে অন্তত দুইশ ক্লাসরুম ভরে ফেলা যাবে!
সাধারণ রোগিদেরকে দেখার ক্ষেত্রে যেটুকু শ্রম দিয়েছি এবং যে পরিমাণ পড়াশোনা করেছি, তারচেয়ে বাচ্চা ডেলিভারি করার ব্যাপারে অনেক বেশি শ্রম এবং সময় দিয়েছি আমি। পড়াশোনা করেছি, এবং রোগিদেরকে যথেষ্ট স্মার্ট চিকিৎসা দিয়েছি। ফলে আমার একটা নাম হয়ে গিয়েছিল। আমার মতামতগুলো দিন দিন অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছিল। রোগিরাও বেশ আগ্রহ করেই এসব নিয়ম মেনে চলত। তাই, যেসব প্রচলিত ফালতু নিয়মতালিকা প্রসূতি-মায়েরা মানতেই চাইত না, তাদেরকে ওসব অযথাই না দিয়ে নিজের মতো করে একটা পুস্তিকা লিখে নিয়েছিলাম আমি। ফালতু ওসব নিয়মতালিকার সবকিছু নিয়ে বলতে গেলে সারা রাত কেটে যাবে, তাই সব আর বলছি না। তবে কিছু জিনিসের। ব্যাপারে একটু বলি-তাহলে আপনারা কিছুটা বুঝতে পারবেন।
অন্তঃস্বত্তা মায়েরা সাধারণত সারাক্ষণ বিশ্রাম নিতে চায়। কিছুটা দূরে কোথাও হেঁটে যাওয়া তো দূরের কথা, পা দুটো মাটিতে ছোঁয়াতেই চায় না তারা। পাছে আবার মিসক্যারিজ বা বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়ে যায়! কিন্তু বাচ্চা জন্ম দেওয়াটা অসম্ভব পরিশ্রমের কাজ। কাজেই, তাদেরকে সারাক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার উপদেশ দেওয়াটা হচ্ছে, কোনো ফুটবল খেলোয়াড়কে শক্তি বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো খেলার আগে প্র্যাক্টিস বা কাজকর্ম সব বাদ দিয়ে সারাক্ষণ বসে থাকতে বলার মতো। অনেক ডাক্তার এ রকম আরেকটা ভয়াবহ উপদেশ দিত সে কালে। ওজন কিছুটা বেশি, এ রকম অন্তঃসত্তা মা-দেরকে তারা ধুমপান করতে বলতো…ধুমপান! এটাকে ‘যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য সে কালে প্রচলিত লাকি সিগারেটের বিজ্ঞাপনের একটা স্লোগানের কথা বলা যায়, স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে চাইলে মিষ্টির বদলে লাকি খান! যারা মনে করে, বিশ শতকে পা দেওয়ার সাথে সাথে আমরা চিকিৎসাশাস্ত্রের দারুণ এক যুগেও পা দিয়েছিলাম, তারা চিন্তাই করতে পারবে না, চিকিৎসাশাস্ত্রের এই জগত কীরকম অদ্ভুত হতে পারে! ওসব নিয়ে ভাবতে গেলে তাদের চুল পেকে সাদা হয়ে যাবে আসলে।
মিস স্ট্যান্সফিল্ডকে ফোল্ডারটা দেওয়ার পর, প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে সে ওটা মনযোগ দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। এ সময় আমি পাইপ ধরনোর অনুমতি চেয়েছিলাম। চোখ না তুলেই, আনমনে অনুমতি দিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা যখন চোখ তুলে তাকাল, ওর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠেছে। জানতে চাইল, ‘ডক্টর ম্যাকক্যারন, আপনি কি মৌলবাদী?
‘হঠাৎ এই কথা বলছেন? কেন? নিজের টুকটাক কাজের জন্য কোথাও যেতে হলে অন্তঃস্বত্তা মা-দের গাড়ি চড়ে না গিয়ে হেঁটে যাওয়া উচিত-লিখেছি দেখে?
‘প্রি-ন্যাটাল ভিটামিন…জিনিসটা যাই হোক, খাওয়ার কথা লিখেছেন। সাঁতার কাটতে বলেছেন…আর, নিঃশ্বাসের ব্যায়াম! এই নিঃশ্বাসের ব্যায়াম জিনিসটা আবার কী?
‘ওইটা এখনই লাগবে না, আরো পরে। আর না-আমি মৌলবাদী নই। বরং এরচেয়ে কয়েকশ হাত দূরের মানুষ। আর, এখন আমি পরবর্তী রোগির পাঁচ মিনিট সময় এখানে ব্যয় করে ফেলা এক ডাক্তার।
‘ওহ! আমি দুঃখিত। মেয়েটা চট করে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত হাতে হাতব্যাগে ফোল্ডারটা ঢুকিয়ে রাখছে।
‘না, সমস্যা নেই।
পাতলা কোটটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে, সবুজ-বাদামি চোখে সোজাসুজি আমার দিকে তাকাল সে। না, আপনি মৌলবাদী বা গোঁড়া নন। আপনি বরং রোগিদেরকে অনেকটা…সাচ্ছন্দ্য বোধ করানোর চেষ্টা করেন। আমি কি ঠিক শব্দ বললাম?
‘এতেই চলবে,’ জবাব দিলাম। এই শব্দটা আমার নিজেরও পছন্দ। আর, মিসেস ডেভিডসনকে বললে উনি আপনাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিডিউল দিয়ে দিবে। পরে কবে, কখন আসতে হবে-সব ওখানেই বলা থাকবে। আর, আগামী মাসের শুরুর দিকে চলে আসবেন, তখন একবার দেখে দেব।’
‘আপনার ওই মিসেস ডেভিডসন আমাকে ঠিক পছন্দ করেনি।
‘নাহ, অমন কিছু না।’ বললেও, মিথ্যে জিনিসটা কখনোই অত ভালো বলতে পারি না আমি। টের পেলাম, আমাদের মধ্যেকার এতক্ষণের উষ্ণ ভাবটুকু আর নেই। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আর গেলাম না। পেছন থেকে ডাক দিলাম, ‘মিস স্ট্যান্সফিল্ড?
মেয়েটা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। চোখের শান্ত দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা।
‘আপনি কি বাচ্চাটাকে আসলেই রাখবেন?’
মুহূর্তখানেকের জন্য আমার কথাটা ভেবে দেখল সে। তারপর হেসে ফেলল-রহস্যময়, গোপন এক হাসি। আমার ধারণা, শুধু অন্তঃস্বত্তা মায়েরাই এভাবে হাসতে পারে। ‘হ্যাঁ, অবশ্যই,’ বলে বেরিয়ে গেল মেয়েটা।
দিন শেষ হতে হতে একগাদা রোগি দেখলাম। দেখতে একইরকম। জমজ দুই বাচ্চার পয়জন আইভি নিয়ে সমস্যা হয়েছে। এটা আসলে বিষাক্ত এক ধরণের আমেরিকান লতা-যেটা শরীরে লাগলে চামড়া লাল হয়ে যায়, আর প্রচণ্ড চুলকাতে থাকে-সেটা দেখে দিলাম। একজনের চামড়ার নিচে পুঁজ জমে গিয়েছিল। পরিস্কার করে ড্রেসিং করে দিলাম। পাত ঝালাইয়ের কাজ করতে গিয়ে চোখে আংটা ঢুকে গেছে এক রোগির। সেটা বের করে দিলাম। অনেক পুরনো এক রোগি এসেছিল। দেখে মনে হল, নিশ্চিত ক্যানসার হয়েছে। হোয়াইট মেমোরিয়াল হাসপাতালে যেতে বলে দিলাম ওনাকে। এসব করতে করতে স্যান্ড্রা স্ট্যান্সফিল্ডের কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। এলা ডেভিডসন আমাকে আবার ওর কথা মনে করিয়ে দিল। বলল, ‘মেয়েটা হয়তো অতটা স্বস্তাও না।
শেষ যাকে দেখেছি, তার ফোল্ডারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তাকিয়ে ছিলাম, আর ডাক্তারদের যখন আর কিছু করার থাকে না, তখন যে প্রচণ্ড অসহায় বোধ হয়, সেরকম অসহায় বোধ করছিলাম। নিজেকে অসহ্য লাগছিল খুব। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ভাবছিলাম, এ ধরণের ফাইলগুলির জন্য আলাদা একটা রাবার-স্ট্যাম্প বানানো দরকার-যেখানে অ্যাকাউন্ট রিসিভেবল বা পেইড ইন ফুল বা পেশেন্ট মুভড এর জায়গায় লেখা থাকবে, ডেথ ওয়ারেন্ট। হয়তো এর উপরে একটা খুলি আর ক্রসের মতো করে রাখা দুটো হাড়ের ছবি থাকবে-বিষের বোতলে যেমন থাকে। ওর কথা শুনে চোখ তুলে তাকালাম, বুঝতে পারিনি। কী বললে?
‘আপনার জেন স্মিথ। আজকে ওনার অ্যাপয়েন্টমেন্টের পর অদ্ভুত এক কাজ করেছেন।‘ মিসেস ডেভিডসনের মাথা আর মুখের অবস্থান ও ভাবভঙ্গি দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল, যেসব অদ্ভুত কাজ সে পছন্দ করে, মেয়েটা ওরকম কিছুই করেছে।
‘কী করেছে?’
‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট কার্ড দেওয়ার পর আমাকে জিজ্ঞেস করল, মোট কত খরচ পড়বে। মানে, ডেলিভারি, হাসপাতালে থাকাসহ সব মিলিয়ে কত পড়বে, সেটা।
মহিলা ঠিকই বলেছে, কাজটা আসলেই অদ্ভুত। মনে রাখতে হবে, তখন ১৯৩৫ সাল। আর মিস স্ট্যান্সফিল্ডকে যতটুকু দেখেছি, মনে হয়েছে, মেয়েটা নিজেই নিজের সমস্ত খরচ বহন করে। সেটা কি সে ঠিকভাবে করতে পারে? আরাম করে দিন কাটানোর মতো যথেষ্ট টাকা-পয়সা কি তার আসলেই আছে? আমার সেটা মনে হয়নি। জামা-কাপড়, জুতা, হাত মোজা সব ঠিকই আছে, কিন্তু মেয়েটা কোনো ধরণের অলংকার-ই পরে ছিল না। এমনকি, মেয়েরা ইমিটিশনের টুকটাক যেসব অলংকার পরে, অমন কিছুও পরেনি। তারউপর মান্ধাতা আমলের ক্লচে হ্যাটটা তো আছেই।
জানতে চাইলাম, ‘হিসেব দিয়েছ?’
মিসেস ডেভিডসন এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। দিয়েছি মানে? অবশ্যই দিয়েছি! এবং মেয়েটা পুরো টাকা পরিশোধ করে দিয়ে গেছে। ক্যাশ।
শেষের যে শব্দটা মিসেস ডেভিডসনকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে (আর অবশ্যই মুগ্ধ করেছে, সেটা আমাকে একটুও অবাক করেনি। জেন স্মিথের মতো মেয়েরা আর যাই করুক, কখনোই চেক লিখে দেবে না।
মিসেস ডেভিডসন বলে যাচ্ছিল, ‘হাতব্যাগ থেকে একটা পাসবই বের করেছিল। তারপর হিসেব মতো টাকার পুরোটা আমার ডেস্কের উপর রেখে, রিসিডটা টাকার জায়গায় রেখে পাসবইটা আবার ঢুকিয়ে রেখেছে। তারপর গুড ডে বলে বেরিয়ে গেছে। খারাপ না, কী বলেন? বিশেষ করে প্রায় সময়ই আমাদেরকে যেরকম ‘সম্মানিত’ মানুষজনকে তাড়া করে বিল নিতে হয়, সে তুলনায় অনেক ভালো বলতে হবে।’
কথা সত্যি। কিন্তু কিছু একটা খুব খোঁচাচ্ছিল আমাকে। স্ট্যান্সফিল্ড এই কাজ করেছে দেখে আমি ঠিক খুশি হতে পারিনি। কেন, সেটা আমি তখন যেমন পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, এখনো পারি না। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে নিজেকে আমার খুব ক্ষুদ্র, তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। এদিকে মিসেস ডেভিডসন আবার ওর এই কাজে, এবং আমার উপরে দারুণ খুশি এবং সন্তুষ্ট হয়েছে।
মিসেস ডেভিডসনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হাসপাতালে থাকার জন্য মেয়েটার তো একদম ঠিক করে টাকা দিতে পারার কথা না, নাকি?’ খুঁত ধরার জন্য এটা খুবই ফালতু বিষয় হলেও নিজের অসন্তুষ্টি আর হতাশা প্রকাশ করার জন্য সে সময় আর কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। বললাম, ওর ঠিক কতদিন থাকতে হবে, সেটা তো আমরা কেউই নিশ্চিতভাবে জানি না। নাকি তুমি আজকাল ক্রিস্টাল-বলের দিকে তাকালে ভবিষ্যৎ দেখতে পাও, এলা?
‘আমিও ওকে সেটাই বলেছি। মেয়েটা তখন জিজ্ঞেস করল, সমস্যা না হলে হাসপাতালে সাধারণত গড়ে কয়দিন থাকতে হয়। বলেছি, তিন দিন। ঠিক বলেছি তো, ডক্টর ম্যাকক্যারন?’
স্বীকার করতে হলো, ঠিকই বলেছে।
‘তখন সে বলল, তিনদিনের টাকা দিয়ে যাবে। যদি বেশিদিন থাকতে হয়, তাহলে বাকিটা পরে দিয়ে দিবে। আর যদি—’
‘আরো কম সময় লাগে, তাহলে বাকিটা আমরা ওকে ফিরিয়ে দিলেই হবে।’ তিক্ত স্বরে বললাম। মনে মনে ভাবছি, মেয়ে একটা!-তারপর হেসে ফেললাম। মেয়েটার সাহস আছে, বলতেই হবে।’
মিসেস ডেভিডসনও হেসে ফেলল, এবং সেটা আটকানোর চেষ্টাও করল না। এখন আমার বয়স হয়ে গেছে…কখনো যদি বোকার মতো মনে হয়, আমার চারপাশের কারো ব্যাপারে যা যা জানার, সব জেনে গেছি-তখন আমি সেই হাসির কথা মনে করার চেষ্টা করি। সেদিনের আগ পর্যন্ত আমি জীবন বাজি রেখে বলতে পারতাম, অবিবাহিতা এবং অন্তঃস্বত্তা কারো কথা ভেবে আমার দেখা সে সময়ের হিসেবে সবচেয়ে ‘যথাযথ ভদ্রমহিলা মিসেস ডেভিডসনকে কেউ কখনো এভাবে হাসতে দেখবে না।
‘সাহস আছে কি না, জানি না, ডক্টর। তবে মেয়েটা কী করতে চায়, সেটা খুব ভালো করে জানে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’
মাস পেরিয়ে গেল। নির্ধারিত সময়ে মিস স্ট্যান্সফিল্ড চলে এলো আবার দেখিয়ে যেতে। নিউ ইয়র্কের বিশাল জনসমুদ্রের মাঝ থেকে উঠে আসা তাজা প্রাণ বলে মনে হচ্ছে ওকে। নীল রঙের পরিস্কার একটা জামা পরেছে। নিশ্চিতভাবেই জামাটা সে একইরকম একগাদা জামার ভিড় থেকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে, এই জামা পুরো পৃথিবীতে আর কারো নেই। কেমন একট মৌলিকত্ব ফুটে উঠেছে এর মাঝে। তবে, পায়ের পাম্প শু জামার সঙ্গে মেলেনি। আজকেও আগের সেই বাদামি জুতো। জোড়াই পরে এসেছে।
ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলাম। সব ঠিকই আছে। ওকে জানালাম সেটা। কথা শুনে খুশি হয়ে গেল, ‘প্রি-ন্যাটাল ভিটামিনগুলি পেয়েছি, ডক্টর ম্যাকক্যারন।’
‘তাই নাকি? ভালো খবর শোনালেন।’
মেয়েটার চোখের তারায় দুষ্টুমি ঝিলিক দিয়ে উঠল, ‘ফার্মেসির দোকানী আমাকে অবশ্য এসব খেতে নিষেধ করে দিয়েছিল।’
‘এসব হাতুড়েদের হাত থেকে স্রষ্টা আমাকে বাঁচাক!’-আমার কথা শুনে শব্দ করে হেসে ফেলল সে, হাত দুটো দিয়ে টেবিলে ভর দিয়ে রেখেছে। দেখে মনে হলো, কোনো বাচ্চা বুঝি প্রাণ খুলে হাসছে। চারপাশের আর কিছুর দিকে কোনো খেয়াল নেই। বলতে লাগলাম, আজ পর্যন্ত কোনো ফার্মাসিস্ট পেলাম না, যারা নিজেদেরকে ডাক্তার বলে মনে করে না। ওরা আবার নতুন সব কিছুকে খুবই ভয় পায়। এরা সবাই রিপাবলিকান। প্রি ন্যাটাল ভিটামিন নতুন এসেছে তো, সেজন্য খুব ভয়ে আছে। আপনি কি এতদিন ওর পরামর্শ শুনে চলেছেন?
‘না, আমি আপনার পরামর্শ মেনে চলেছি। আপনি-ই আমার ডাক্তার।’
‘ধন্যবাদ।
‘ধন্যবাদের কিছু নেই।’ এটুকু বলেই মেয়েটা সোজাসুজি আমার দিকে তাকাল। আর হাসছে না। ডক্টর ম্যাকক্যারন, আমি যে গর্ভবতী, সেটা কখন থেকে দেখে বোঝা যেতে শুরু করবে?
‘যদ্দূর বুঝি, আগস্টের আগে বোঝা যাবে না। কিংবা সেপ্টেম্বর, যদি কাপড়-চোপড় সেভাবে…বাড়তি আকৃতির সাথে মিলিয়ে পরেন আরকি।’
‘ধন্যবাদ।’ হাতব্যাগটা হাতে তুলে নিলেও উঠে গেল না মেয়েটা। মনে হচ্ছিল, কিছু বলতে চায়…কিন্তু কোত্থেকে-কিভাবে শুরু করবে, সেটা বুঝতে পারছে না।
‘আপনি তো সম্ভবত কর্মজীবী, নাকি?’
মাথা ঝাঁকাল, ‘হ্যাঁ, আমি কাজ করি।’
‘কোথায়, সেটা কি জিজ্ঞেস করতে পারি? অবশ্য আপনি না চাইলে-’
মেয়েটা হাসল-প্রাণহীন শুষ্ক হাসি। আগের প্রাণখোলা সেই হাসির সাথে এই হাসির আকাশ-পাতাল তফাৎ। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করি। মোটা হাবড়াসব মহিলার কাছে পারফিউম বিক্রি করি। এদের কাজই হলো চুল বারবার ধোয়া, আর ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো করে বারবার বিন্যস্ত করা। এই শহরে অবিবাহিতা কেউ আর কোথায় কাজ করবে?
‘কিন্তু এই কাজ কতদিন চালিয়ে যাবেন?’
‘আমার এই অবস্থা যতদিন লোকের চোখে না পড়বে। চোখে পড়লেই আমাকে চলে যেতে বলবে। না গেলে আবার ওসব মোটকুর দল যদি কিছু মনে করে বসে! অবিবাহিতা এবং অন্তঃসত্ত্বা কারো কাছ থেকে সেবা নিয়েছে ভেবে যে মানসিক ধাক্কা খাবে, এতে করে দেখা যাবে, ওদের চুল সব সোজা হয়ে গেছে।’
হঠাৎ করেই মেয়েটার চোখদুটো ভিজে গেল। ঠোঁট কাঁপতে শুরু করেছে। হাত বাড়িয়ে একটা রুমাল তুলে নিলাম। কিন্তু ওর চোখ থেকে। একফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়েনি। মুহূর্তখানেকের জন্য চোখ দুটো জলে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, পরমুহূর্তে চোখ পিটপিট করে সামলে নিল সে। ঠোঁট দুটো শক্ত হয়ে চেপে বসেছে…তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে এল। যেন মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোনোভাবেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে না। হারায়ওনি। দেখার মতো একটা ব্যাপার ছিল এটা!
‘আমি দুঃখিত। আপনি আমার সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করেছেন। এর বদলে প্রায় সবার জীবনে ঘটা সাধারন কোনো গল্প আমি আপনাকে শোনাতে চাই না।’
চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। আমিও সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম।
বললাম, আমি কিন্তু বেশ ভালো শ্রোতা। আর এখন আমার হাতে
অনেকটা সময়ও আছে। পরবর্তী রোগি ক্যানসেল করে দিয়েছে আজকে।
‘না, থাকুক। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু এখন না। থাকুক।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু আরেকটা ব্যাপার ছিল।‘
‘বলুন?
‘আমার রোগিদেরকে-কোনো রোগিকেই আরকি-সেবা দেওয়ার আগেই টাকা নিয়ে রাখাটা আমার নিয়মে নেই। আশা করি আপনি…মানে, যদি চান বা প্রয়োজন হয়…’ বলে চুপ করে গেলাম। আর কী বলবো, বুঝতে পারছি না।
‘চার বছর ধরে নিউ ইয়র্কে আছি, ডক্টর ম্যাকক্যারন। আমি এমনিতে অনেক মিতব্যয়ী। আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরের পর থেকে কাজে ফেরার আগ পর্যন্ত আমাকে সেই জমানো টাকার উপরে নির্ভর করেই চলতে হবে। তো, এর পরিমাণ আসলে খুব বেশিও না। অনেক সময়, বিশেষ করে একাকি রাতে এসব ভেবে আতঙ্কিত হয়ে যাই আমি।’
বৃক্ষের মতো সবুজ-বাদামি চোখে মেয়েটা কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, আমার কাছে এটাই ভালো-আর নিরাপদ-মনে হয়েছে যে, বাচ্চাটার জন্য প্রয়োজনীয় টাকাটুকু আগে পরিশোধ করে দেওয়া উচিত। কারণ, আমার সমস্ত ভাবনা জুড়ে সবার আগে এই বাচ্চা। আর তাছাড়া, পরে দেখা যাবে টাকা প্রয়োজন, কিন্তু বেশি টাকা নেই। তখন হয়তো এই টাকা অন্য কাজে খরচ করে ফেলতে পারি।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু এটুকু অন্তত মনে রাখবেন যে, টাকাটা এখনি খরচের খাতায় ঢুকে যায়নি। লাগলে অন্তত বলবেন।‘
‘মিসেস ডেভিডসনের ভেতরের ড্রাগনটা আবার বের করে আনার জন্য, নাকি? ওর চোখের তারায় দুষ্টুমির ছায়া আবার ফিরে এসেছে। সেটা চাই না, থাকুক। এখন, ডাক্তার—’
‘আপনি তো যতদিন সম্ভব কাজ করে যেতে চান?’
‘হ্যাঁ, করা তো লাগবেই। কেন?’
‘যাওয়ার আগে আপনাকে আরেকটু ভয় দেখানো দরকার আমার, তাই।’
মেয়েটার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। ‘এমন করবেন না, প্লিজ। আমি এমনিতেই যথেষ্ট আতঙ্কিত।‘
‘সেজন্যই আমাকে এটা করতে হবে। বসে পড়ুন, মিস স্ট্যান্সফিল্ড।’ মেয়েটা তারপরও দাঁড়িয়ে আছে দেখে মৃদু গলায় বললাম, ‘প্লিজ।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসে পড়ল সে।
‘আপনি এখন বেশ কঠিন এক অবস্থার মধ্যে আছেন,’ বলতে বলতে সামনে টেবিলের দিকে ঝুঁকে এলাম। ‘কিন্তু এর মাঝেও আপনি সবকিছু দারুণভাবে সামাল দিচ্ছেন।’
ওকে কথা বলার জন্য মুখ খুলতে দেখে হাত তুলে থামিয়ে দিলাম।
বলে যাচ্ছি, এটা ভালো। আমি আপনাকে সেজন্য শ্রদ্ধা করি। কিন্তু নিজের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে কোনোভাবে বাচ্চাটার ক্ষতি করে ফেললে আমার সেটা ভালো লাগবে না। আগে আমার এক অন্তঃসত্ত্বা রোগি ছিল। কথা শোনেনি। দিন যত এগোচ্ছিল, সে তার কোমরবন্ধনী তত শক্ত করে বেঁধে নিয়ে কাজ করেই যাচ্ছিল। বোকা ছিল মেয়েটা। আমার মনে হয়, সে আসলে তার বাচ্চাটাকে চায়ইনি। মাহ-জং খেলার সময় আজকাল লোকে অবচেতন মন নিয়ে যেসব কথাবার্তা বলে, ওসব আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না। কিন্তু বিশ্বাস হলে আমি বলতাম, সে নিজে কিংবা তার অবচেতন মনের কোনো একটা অংশ-বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছিল।’
‘শেষ পর্যন্ত কী হলো?’ জানতে চাইল সে। ওর মুখের একটা পেশীও কাঁপল না।
‘বাচ্চাটা মারা যায়নি, কিন্তু কিছুটা অপূর্ণাঙ্গ অবস্থায় জন্ম নিয়েছে। হ্যাঁ, হতে পারে, বাচ্চাটা হয়তো এমনিতেই এ রকম হয়েই জন্ম নিত। আর আমি বলছি না, এখানে অন্যকিছু হয়েছে–এ রকম হওয়ার পেছনের কারণ নিয়ে আমরা আসলে কিছুই জানি না। কিন্তু সম্ভাবনা আছে, হয়তোবা মেয়েটার কারণেই এমন হয়েছে।’
‘আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি,’ মেয়েটা নিচু স্বরে বলল। ‘আপনি চান না আমি নিজেকে এভাবে…বেঁধে ছেদে আরো একমাস বা ছয় সপ্তাহ কাজকর্ম করি। স্বীকার করছি, এ রকমটা করার কথা আমি ভেবেছি। কাজেই…ভয় দেখানোর জন্য ধন্যবাদ।’
এইবার আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কত বেশি-কিংবা কত অল্প পরিমাণ-টাকা ওর কাছে জমা আছে; এবং একেবারে অর্থশূন্য হয়ে পড়ার কতটা কাছাকাছি চলে এসেছে। ভালো করেই জানতাম, জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। এই প্রশ্নের জবাব সে দেবে না। তাই, কোনোরকমে বিদায় জানালাম ওকে। শেষে এসে অবশ্য ভিটামিন নিয়ে আরেকটু মজা করেছিলাম। যাই হোক, সে চলে গেল। পরবর্তী একমাস ধরে অদ্ভুতসব সময়ে, টের পেলাম, আমি ওর কথা ভাবছি। আর—’
এই সময় জোহানসেন ম্যাকক্যারনের গল্পে বাধা দিল। আমাদের সবার মনে যে প্রশ্নটা উঁকি দিয়ে গেছে, সেটা ও-ই ম্যাকক্যারনকে জিজ্ঞাসা করল।
‘তুমি কি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলে, এমলিন? সেজন্যেই কি তুমি ওর চোখ এবং হাসির এ রকম বর্ণনা দিচ্ছ? সেজন্যই কি অদ্ভুতসব সময়ে ওর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল তোমার?’
ভেবেছিলাম, এভাবে বাধা দেওয়ায় ম্যাকক্যারন হয়তো বিরক্ত হবে। কিন্তু দেখা গেল, সে মোটেও বিরক্ত হয়নি। সম্ভবত অনেক দিনের পুরনো বন্ধুত্বের ফলে এটুকু জানতে চাওয়ার অধিকার ওর ছিল। সেজন্যই ম্যাকক্যারন জবাবে বলল, ‘এটুকু জানতে চাওয়ার অধিকার তোমার আছে।’ বলে একটুখানি থামল, আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছিল, সে নিজেই বুঝি সম্মোহিত হয়ে গেছে। তারপর যখন লাকড়ির একটা গিট বিস্ফোরিত হলো, আলোকিত হয়ে উঠল চারপাশ, ঘুর্ণির মতো করে কিছুটা কয়লা ছিটকে উঠে গেল চিমনির দিকে-ম্যাকক্যারন ফিরে তাকাল। প্রথমে জোহানসনের দিকে, তারপর আমাদের সবার উপর একে একে চোখ বুলালো সে।
‘না, আমি ওকে ভালোবাসিনি। জানি, ওর চোখ, হাসি, পোশাকসহ যেসব জিনিসের বর্ণনা দিয়েছি, সাধারণত প্রেমে পড়লেই কারো ওসব জিনিসের বর্ণনা দেওয়ার কথা। বলতে বলতে বজ্রের মতো নকশা করা একটা লাইটার দিয়ে পাইপটা জ্বালানোর চেষ্টা করতে লাগল। মাথার দিকে অনেকটা পুড়ে গিয়ে কয়লা হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওভাবেই ধরে রাখল। তারপর, লাইটারটা বন্ধ করে দিয়ে জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিল। যখন ধোঁয়া ছাড়ল, দেখা গেল ধীরে ধীরে ধোঁয়ার মেঘ ওর মাথা ঘিরে ফেলছে।
‘আমি ওকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রশংসাজনক মনে হয়েছিল আমার কাছে মানুষটাকে। ব্যাস, এইটুকুই। যতবার ও আমাকে দেখাতে এসেছে, দিন দিন আমার মুগ্ধতা কেবলই বেড়েছে। সম্ভবত অনেকেই ভেবেছেন, গল্পটা ঘটনার ঘনঘটায় ছাওয়া একটা প্রেমের গল্প। চরম ভুল ধারণা। এই গল্প আসলে প্রেমের ধারেকাছেও নেই। যাই হোক, পরবর্তী ছয়মাস ধরে ওর গল্পটা আমি ধীরে ধীরে জেনেছি। আমি নিশ্চিত, শোনার পরে সবাই স্বীকার করবেন, মেয়েটা যেমন বলেছিল, গল্পটা আসলেই খুবই কমন। হাজারো মেয়ের মতোই সেও একটা ছোট্ট মফস্বল শহর ছেড়ে এই শহরে পাড়ি জমিয়েছিল…
…লোয়া অথবা নেব্রাস্কার কোন এলাকা থেকে এসেছিল সে। কিংবা মিনেসোটাও হতে পারে-এখন আর ঠিক মনে নেই। ওখানে, হাইস্কুলে থাকতে অনেকগুলো হাইস্কুল-ড্রামায় অভিনয় করেছিল। বেশ কিছু কম্যুনিটি থিয়েটারেও কাজ করেছিল। কাউ এন্ড সাইলিয়েজ জুনিয়র কলেজের ইংরেজি ডিগ্রিধারী এক নাট্য-সমালোচক স্থানীয় সাপ্তাহিকে ভালো রিভিউ দিল ওর অভিনয় নিয়ে। সেই দেখে মেয়েটা অভিনয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য নিউ ইয়র্কে চলে আসে।
এ নিয়েও দারুণ বাস্তববাদী ছিল ছিল মেয়েটা-মানে, আকাশ কুসুম উচ্চাকাঙ্খ মানুষকে যতটুকু বাস্তববাদী হতে দেয় আরকি। মুভি ম্যাগাজিনগুলোতে যেমনটা লিখে, যে কোন তরুণীই হলিউডে আসলে তারকা হয়ে যেতে পারে-আজকে যে মেয়েটা শোয়্যাব’স ড্রাগ স্টোরে সোডায় চুমুক দিচ্ছে, হয়তো কালকে তাকে গ্যাবল অথবা ম্যাকমারির বিপরীতে অভিনয় করতে দেখা যেতেও পারে-এসব ফালতু কথায় বিশ্বাস করে নিউ ইয়র্কে আসেনি মেয়েটা। সে আমাকে বলেছিল, নিউ ইয়র্কে আসার কারণ, এখানে কাজের সুযোগ বেশি। হয়তো কোথাও সুযোগ করে নেওয়াটা তুলনামূলক সহজ হবে। আর আমার মনে হয়েছে, সিনেমায় সুযোগ পাওয়ার চেয়ে নাট্যমঞ্চে কাজ করতেই ও বেশি আগ্রহী ছিল।
এলাকার একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে পারফিউম বিক্রি করার চাকরি পেয়ে গেল। সেই সঙ্গে ভর্তি হয়ে গেল অভিনয়ের ক্লাসে। শুধু স্মার্টই না, প্রচন্ড দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল মেয়েটি। সত্যি বলতে ওর ইচ্ছেশক্তি হচ্ছে খাঁটি ইস্পাতের মতো। একবার যা ভাববে, সেটা না করে ছাড়বে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্যদের মতোই সেও তো কেবল-ই মানুষ। এর বেশি কিছু না। খুব একাকী ছিল ও। মফস্বল ছেড়ে সদ্য শহরে এসে ওঠা একাকী মেয়েরা ছাড়া আর কেউ এই একাকীত্বের আসল মানে বুঝবে না। হোমসিকনেস বা বাড়ির টান সাধারণত অস্পষ্ট, স্মৃতিকাতর এবং সুন্দর এক অনুভূতি হয়ে ফোটে আমাদের কাছে। কবিদের কলমের ছোঁয়ায় আমাদের মনে এই চিত্রটা একরকম গেঁথে গেছে। কিন্তু এই তীব্র আকুলতা ধারালো ছুরির মতো হয়ে উঠতে পারে। শুধু রূপক অর্থে অসুস্থতা নয়, বরং বাস্তবেই ভয়াবহ অসুখ হিসেবে জাপটে ধরতে পারে। বদলে দিতে পারে পৃথিবীর দিকে তাকানোর দৃষ্টিভঙ্গি। অচেনা শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে চারপাশের লোকজনের চেহারার দিকে তাকালে শুধু অচেনা নয়, বিশ্রি মনে হতে পারে। মনে হতে পারে নির্মম, ক্রুর কোন রসিকতা। হোমসিকনেস। একটা সত্যিকারের অসুখ-গাছের মূল উপড়ে ফেললে যেরকম কষ্ট হয়, অনেকটা সেরকম।
মিস স্ট্যান্সফিল্ড যত শক্ত এবং প্রশংসাজনক মানসিকতারই হোক-যতই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হোক-এই তীব্র একাকীত্ব থেকে মুক্ত ছিল না। গল্পের বাকি অংশটা এতই কমন যে, এটা আর আলাদা করে বলা দরকার পড়ে না। ওর সাথে অভিনয়ের ক্লাসে এক তরুণ ছিল। দুজনে মিলে। অনেকবারই বাইরে ঘুরতে গেছে। মেয়েটা ওকে ভালোবাসত না যদিও, কিন্তু বন্ধু দরকার ছিল ওর। যতদিনে সে বুঝতে পেরেছে যে, ওই ছেলে ওর বন্ধু ছিল না এবং কখনো হবেও না, ততদিনে দুবার ঘটনা ঘটে গেছে। সেক্সয়াল ইনসিডেন্ট। মেয়েটা আবিষ্কার করেছে, সে অন্তঃসত্ত্বা। ছেলেটাকে সে এই ঘটনা জানিয়েছিল। ছেলেটা উত্তরে বলেছে, সে সারাজীবন। মেয়েটার পাশে থাকবে এবং সঠিক কাজ মানে বিয়ে করে নেবে। সপ্তাহখানেক পর ছেলেটা তার লজিং ছেড়ে চলে গেছে। পেছনে কোন ঠিকানা বা যোগাযোগের মাধ্যমও রেখে যায়নি। তখন গিয়ে মেয়েটা আমার কাছে এসেছে।
চতুর্থ মাসে আমি মিস স্ট্যান্সফিল্ডকে ব্রিদিং মেথডের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। বর্তমানে এটাকে লামাজ মেথড বলে। তখনকার দিনে, বুঝতেই পারছেন, মানুষ মঁসিয়ে লামাজের নাম সেভাবে শোনেইনি।
‘তখনকার দিনে’-কথাটা বারবার ফিরে ফিরে আসছে, সেটা আমিও বুঝতে পারছি। সেজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আমার আসলে আর কোনো উপায় নেই। এতক্ষণ ধরে যা যা বললাম এবং আরো যা বলব, এই ঘটনাগুলি এভাবে ঘটার কারণ, এগুলি তখনকার দিনে ঘটেছে।
তো, ‘তখনকার দিনে’, মানে, আজ থেকে আরো পঁয়তাল্লিশ বছর আগে আপনারা কেউ যদি কোনো বড় আমেরিকান হাসপাতালের ডেলিভারি রুমে যেতেন, মনে হত, ভুল করে বুঝি পাগলখানায় চলে এসেছেন। মহিলারা পাগলের মতো কাঁদছে, চিৎকার করে বলছে, মরে যেতে পারলেই ভালো হতো কিংবা এতো যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছে না’…কেউ কেউ চিৎকার করে ঈশ্বরকে ডেকে কৃত অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাইছে। ভয়ংকর এবং অশ্লীলসব গালি দিয়ে উঠছে কেউ কেউ-এরা এ রকম সব গালি জানতে পারে বলে তাদের বাবা কিংবা স্বামীরা কোনদিন কল্পনাও করেনি। যদিও একদম প্রসবের সময়টুকুতে প্রচন্ডভাবে ফুঁপিয়ে ওঠা, ঘোঁত ঘোঁত করে প্রসব যন্ত্রণার কথা জানান দেওয়ার কথা বাদ দিলে, পৃথিবীর বেশিরভাগ মহিলাই তখন নিঃশব্দে সন্তান প্রসব করত। তারপরেও, এসব অশ্রাব্য গালি-গালাজ সে সময়ের মানুষ স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছিল।
তবে, বলতে খারাপ লাগলেও সত্যিটা হচ্ছে, এ রকম হিস্টিরিয়াগ্রস্থের মতো আচরণের পেছনে ডাক্তারদেরও কিছু দোষ ছিল। তাছাড়া, যেসব আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আগে বাচ্চা নিয়েছে, তাদের ভয়ংকর সব গল্পও এর পেছনে অনেকটা দায়ী। বিশ্বাস করুন-আপনাকে যদি কেউ আগে থেকে বলে দেয় যে, অমুক কাজ করতে গেলে কষ্ট হবে, তাহলে কষ্ট আপনার হবেই। ব্যথার অনেকটাই তৈরি হয় মস্তিষ্কে। সেজন্য কোনো মহিলা যদি আগে থেকেই মাথায় ঢুকিয়ে রাখে যে, বাচ্চা জন্ম দিতে গেলে অসম্ভব যন্ত্রণা হবে-আর এসব কথা সে যদি তার মা, বোন বা বিবাহিত কোনো বান্ধবীর কাছ থেকে শোনে, কিংবা ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারে-সেই মহিলা প্রসবের সময় শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ভয়াবহ ব্যথা অনুভব করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়।
আমার তখন কেবল ছয় বছরের অভিজ্ঞতা। এর মাঝেই দেখেছি, বেশিরভাগ মহিলা একই সাথে দুটো সমস্যা সমাধানে সমানভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একদিকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় নিজের যত্ন এবং আগত সন্তানের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যেমন আছে, তেমনি বেশিরভাগই মনে করতে থাকে যে, তারা মৃত্যুপুরীর ছায়ায় প্রবেশ করেছে। এদের মধ্যে অনেকেই মারা যাওয়ার পরে স্বামীর যেন কোনোরকম সমস্যা না হয়, সেজন্য জমিজমা স্বামীর নামে দলিল করে দেওয়া থেকে শুরু করে নানাবিধ ব্যবস্থা করে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত।
ধাত্রীবিদ্যা বা গাইনি বিষয়ে কথা বলার সময় বা জায়গা এটা না, আমি জানি। কিন্তু আপনাদের এটুকু জানা উচিত যে, ‘তখনকার দিনের’ আগের অনেকটা সময় পর্যন্ত জন্ম দেওয়ার প্রক্রিয়াটুকু পশ্চিমা দেশগুলোতে ভয়াবহ ব্যাপার হিসেবে ভাবা হতো। ১৯০০ সালের শুরুর দিকে চিকিৎসা শাস্ত্রে একরকম বিপ্লব ঘটেছিল। যার ফলে এই প্রক্রিয়াটা অনেকটা নিরাপদ হয়ে ওঠে। কিন্তু হাতেগোণা অল্প কয়জন ডাক্তার ছাড়া আর কেউ কেন যেন অন্তঃসত্তা মায়েদেরকে এই কথাটা জানাতোও না। কেন, কে জানে! তো, এই যখন অবস্থা, বেশিরভাগ ডেলিভারি রুমে ঢুকলে যে বেলেভ হাসপাতালের মানসিক রোগিদের নয় নম্বর ওয়ার্ডের কথা মনে পড়ে যাবে, সেটা কি খুব বেশি অস্বাভাবিক? শেষ পর্যন্ত বেচারিদের সময় এসেছে। অথচ যে প্রক্রিয়াটার মধ্যে দিয়ে যেতে যাচ্ছে, প্রাচীন ভিক্টোরিয়ান আমলের মানুষদের কাছ থেকে এ নিয়ে খুবই ভাসাভাসাভাবে শুনেছে তারা। অথচ বেচারিরা কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুভব করবে, জন্ম দেওয়ার পেছনের ইঞ্জিনটা পূর্ণ শক্তিতে চলতে শুরু করেছে। প্রচন্ড অবাক বিস্ময়ে তারা থমকে যাবে, এবং এই থমকে যাওয়াটুকু কাটবে প্রবল যন্ত্রণার মাধ্যমে। এই সবকিছু তাদের মস্তিষ্কে আগে থেকে গেঁথে যাওয়া কষ্টের কথা জানান দিচ্ছে। ফলে তাদের বেশিরভাগই এ সময় এসে মনে করতে থাকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই কুকুরের মতো প্রবল যন্ত্রণায় ভুগে মারা যাবে তারা।
গর্ভাবস্থা নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে, নিঃশব্দে প্রসব করার পেছনের কারণ এবং ব্রিদিং মেথডের ধারণা পাই আমি। চিৎকার করলে শরীরের শক্তি খরচ হয়। এই শক্তিটুকু বরং বাচ্চাকে বের করে দেওয়ার পেছনে খরচ করা যায়। চিৎকার করলে শরীর কাঁপতে থাকে, জোরে জোরে দ্রুত শ্বাস নিতে হয়–এটা আবার শরীরকে জরুরি অবস্থার কথা জানান দেয়। ফলে প্রবল বেগে অ্যাড্রেনালিন বইতে থাকে, নিঃশ্বাস এবং পালসের হার বেড়ে যায়-এই সব কিছুই প্রসবের সময়ের জন্য পুরোপুরি অদরকারি। ব্রিদিং মেথডের কাজ হলো, প্রসূতি মায়েদেরকে শরীরের সমস্ত কিছু ব্যবহার করে শুধু একটা নির্দিষ্ট কাজের দিকে মনযোগী করে তোলা, যাতে সে ব্যথার সাথে পাল্লা দিয়ে প্রসবের প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে নিতে পারে।
এই পদ্ধতিটি সেকালে ভারত এবং আফ্রিকায় প্রচুর ব্যবহৃত হতো। আমেরিকার কিওয়া, শশনে এবং মিকম্যাক ইন্ডিয়ানস উপজাতীর মানুষদের মধ্যেও এর চল ছিল। এদিকে এস্কিমোরাও এ পদ্ধতি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করত। কিন্তু, বুঝতেই পারছেন, বেশিরভাগ পশ্চিমা ডাক্তারদের-ই এ নিয়ে কোনরকম আগ্রহ ছিল না। আমার এক সহকর্মী-এমনিতে বেশ মেধাবী মানুষ-গর্ভাবস্থা নিয়ে আমার লেখা পুস্তিকাটা পড়ে-উড়ে, ১৯৩১ সালের শরতে যখন আমাকে ফেরত দিয়েছিল, দেখলাম, ব্রিদিং মেথড নিয়ে লেখা পুরো অংশটার প্রতিটা লাইনের নিচে লাল কালির দাগ দেওয়া। সাথে মার্জিনে লেখা, যদি ‘কালোদের অতিলৌকিক বিশ্বাস নিয়ে জানার ইচ্ছে হতো, তাহলে আমার এই পুস্তিকা না, বরং পত্রিকা স্ট্যান্ডে গিয়ে উইয়ার্ড টেইলস-এর কোন একটা সংখ্যা কিনে পড়ত সে।
ওর কথায় আমি অবশ্যই পুস্তিকা থেকে ব্রিদিং মেথডের অংশটুকু বাদ দেইনি। তবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আমি মিশ্র ফলাফল পেয়েছি-এটুকু স্বীকার করতেই হবে। কেউ কেউ বেশ সফলভাবে এটা ব্যবহার করেছে। এবং বেশ উপকৃতও হয়েছে। আবার কেউ কেউ আইডিয়াটা বেশ ভালোভাবে বুঝলেও, কন্ট্রাকশন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। তবে এসব অবস্থায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি, অতিশুভাকাঙ্খী বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজন-যারা জীবনে এ রকম কিছুর কথা কখনো শোনেনি-রোগিনিকে বলেছে, এসব আদৌ কাজ করবে বলে তারা বিশ্বাস করে না। ফলে, মস্তিষ্কের অবচেতনে ব্রিদিং মেথড আর জায়গা করে নিতে পারেনি, বরং সেই ভয়টা প্রবলভাবে গেঁড়ে বসেছে।
এই পদ্ধতিটা যে আইডিয়ার উপরে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, সেটা হলো, দুজন মানুষের প্রসব প্রক্রিয়া পুরোপুরি এক না হলেও, সাধারণভাবে এরা প্রায় একইরকম। এখানে মোট চারটা ধাপ আছে। কন্ট্রাক্টিভ লেবার, মিড-লেবার, জন্মদান, এবং জন্মদান পরবর্তী প্রক্রিয়া। কন্ট্রাকশন মানে হচ্ছে, অ্যাবডোমিনাল বা তলপেটের পেশি এবং পেলভিক বা শ্রোণিদেশের (জরায়ুর কাছাকাছি অংশটুকু) পেশি শক্ত হয়ে কুঁচকে আসা। বেশিরভাগ অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের ক্ষেত্রে এটা ষষ্ঠমাস থেকে শুরু হয়। প্রথমবারের মতো যারা অন্তঃসত্ত্বা হন, তাদের অনেকেই আরো কষ্টদায়ক কিছুর আশংকা করতে থাকেন। যেমন, অন্ত্ৰ কুঁচকে যাওয়ার ফলে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া বা এ রকম কিছু। কিন্তু প্রসূতি মায়েদের কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি, এতোটা কষ্টদায়ক হয় না জিনিসটা। শারীরিক যন্ত্রণা অবশ্যই হয়, যেটা প্রথমদিকে মৃদু কম্পন হিসেবে শুরু হলেও ধীরে ধীরে ব্যথায় রূপ নেয়। কেউ যদি ব্রিদিং মেথড প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে তাকে শুরুর দিকে ছোট ছোট করে শ্বাস নিতে আর ফেলতে থাকতে হবে। প্রত্যেকবার শ্বাস ফেলাটা হবে। হালকা করে ফুঁ দেওয়ার মতো। ডিজি গিলেস্পি নামের আমেরিকান ভেঁপুবাদক যেভাবে মৃদু স্বরে ভেঁপু বাজাত, অনেকটা সেরকম।
মিড-লেবারের সময় কন্ট্রাকশনের মাত্রা আরেকটু বেড়ে যায়। এ সময় কন্ট্রাকশন প্রতি পনের মিনিটে একবার করে যায়-আসে। এ সময় কিছুটা দীর্ঘশ্বাস নিতে হবে। ফেলতেও হবে সেভাবেই। ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগীতায় প্রতিযোগী বাঁশি দেওয়ার একেবারে আগমুহূর্তে দৌড়ের প্রস্তুতি হিসেবে যেভাবে শ্বাস টেনে নেয়, অনেকটা সেরকম। এভাবে কন্ট্রাকশনের মাত্রা যত বাড়তে থাকবে, শ্বাস-প্রশ্বাস তত দীর্ঘ হতে থাকবে। আমার পুস্তিকায় এই ধাপটাকে আমি লিখেছি ‘ঢেউয়ের বুকে চড়ে বসার মতো’।
শেষ ধাপে এসে আমাদেরকে যেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে, সেটাকে আমি বলি ‘লোকোমোটিভ’ (ট্রেন)। বর্তমানে লামাজ পদ্ধতির প্রশিক্ষকরা একে বলেন ব্রিদিং মেথডের ‘চু চু’ ধাপ। গর্ভাবস্থার এই শেষধাপে এসে যন্ত্রণা প্রকট আকার ধারণ করে। একেবারে পাতলা কাঁচের মতো অবস্থা হয় শরীরের। অল্পতেই প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছেয়ে যায় সবকিছু। এ সময় মায়েদের পেটে চাপ দিয়ে, ধাক্কা দিয়ে বাচ্চাটাকে বের করে দেওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে হতে থাকে। আসলে, এই সময়টাতে এসেই বিস্ময়কর সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর সেই ইঞ্জিনটা চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে যায়। সারভিক্স, মানে জরায়ুর মুখটা যথাসম্ভব প্রশস্ত হয়ে ওঠে। বাচ্চাটা জন্মনালী ধরে তার সংক্ষিপ্ত যাত্রা শুরু করে। কেউ যদি এ সময় প্রসূতি মায়ের দুপায়ের ফাঁক দিয়ে সরাসরি তাকায়, খোলা বাতাস থেকে ইঞ্চিকয়েক দূরেই বাচ্চাটার খুলির সামনের অংশটুকু দেখতে পাবে। সেই মা যদি ব্রিদিং মেথড ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে ছোট ছোট করে শ্বাস নিতে এবং ছাড়তে থাকবেন। নিশ্বাসটা তার মুখ থেকেই বেরিয়ে যাবে-ফুসফুস ভর্তি করে ফেলবে না; ফলে জোরে জোরে দ্রুত শ্বাস নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না। বরং অনেকটা নিয়ন্ত্রিত এবং নিয়মিতহারে হাঁপানোর মতো করে শ্বাস পড়তে থাকবে। পিচ্চিরা খেলার সময় বাষ্পচালিত লোকোমোটিভ ইঞ্জিন চালানোর ভঙ্গি করে যেরকম শব্দ করতে থাকে, এক্কেবারে সেরকম।
শরীরের উপর এই সবকিছুর চমৎকার প্রভাব পড়ে-প্রসূতি মায়ের নিঃশ্বাসে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু শরীর একে জরুরি অবস্থা হিসেবে শনাক্ত করে না। সেই মা নিজে সচেতন অবস্থায় থাকে, প্রয়োজনে কোনকিছু জিজ্ঞাসা করতে পারে, কিংবা জবাব দিতে পারে। কোনকিছু করতে বলা যায়, পরামর্শ দেওয়া যায়। তবে এসবের চেয়ে তার মানসিক অবস্থার উপর ব্রিদিং মেথডের প্রভাব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই মা নিজে বুঝতে পারেন, সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রক্রিয়াটায় তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন। সহজ কথায়, এই সময়টায় সেই মা নিজেকে পুরো অভিজ্ঞতাটুকুর বাইরে নিয়ে এসে, ব্যথা-বেদনার উর্ধ্বে উঠে গিয়ে, পুরো প্রক্রিয়াটাকে নিজের সুবিধামতো পরিচালনা করতে পারেন।
বুঝতেই পারছেন, পুরো জিনিসটাই নির্ভর করে আসলে রোগির মানসিক অবস্থার উপর। ব্রিদিং মেথড নামের এই পদ্ধতিটা পুরোপুরি অন্যরকম। ইউনিক হলেও এর নিজস্ব দুর্বলতা আছে। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে গিয়ে যে কয়বার আমি অসফল হয়েছি, সেসবের ব্যাখ্যা দিতে গেলে বলব-ডাক্তার একজন রোগিকে যেটুকু বোঝাতে পারেন, উপলব্ধি করাতে পারেন, অতিরিক্ত বুদ্ধিমান আত্মীয়-স্বজনরা অপরিচিত এই পদ্ধতির কথা শুনে রোগিকে ভয় ধরিয়ে দিয়ে তার সবটা ভেঙেচুরে দিতে পারে।
অন্তত এদিক থেকে মিস স্ট্যান্সফিল্ড ছিল একেবারে আদর্শ। একবার ব্রিদিং মেথড মানবে বলে ঠিক করে ফেললে, উল্টোপাল্টা কথা বলে মানতে বারণ করবে-এমন কোনো বান্ধবী বা আত্মীয়-স্বজন তার ছিল না (সত্যি বলতে, এই মেয়ে কোনকিছু করবে বলে একবার ঠিক করে ফেললে, ওকে কেউ কোনোদিন ফেরাতে পারবে বলে আমার মনে হয় না–এটা বোধ হয় আগে থেকেই স্বীকার করে নেওয়া উচিত)। আর মেয়েটা ব্রিদিং মেথড মেনে চলবে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
প্রথমবার আলোচনার সময়-ই সে জানতে চেয়েছিল, ‘জিনিসটা কিছুটা আত্মসম্মোহনের মতো, তাই না?
একমত হলাম। কিছুটা খুশিও হলাম। একদম ঠিক বলেছেন। কিন্তু তাই বলে এটাকে কোন ট্রিক বলে ভাববেন না যেন! কারণ, এ রকমটা ভাবলে কঠিন সময় গিয়ে আর ধরে রাখতে পারবেন না নিজেকে।
‘আমি মোটেও তেমন কিছু ভাবছি না। আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, ড, ম্যাকক্যারন। আমি নিয়মিত প্র্যাক্টিস করার চেষ্টা করবো। মোট কথা, ওকে দেখে মনে হবে, ব্রিদিং মেথড যেন এই মেয়ের জন্যই আবিষ্কৃত হয়েছে। আর ও যখন প্র্যাক্টিস করার কথা বলেছে, সত্যিই বলেছে। আসলেই সে বাসায় প্র্যাক্টিস করবে। এর আগে কখনো কাউকে কোনো আইডিয়া এতোটা আগ্রহের সাথে আপন করে নিতে দেখিনি…তবে হ্যাঁ, ব্রিদিং মেথড মেয়েটার মেজাজ-মর্জির সাথেও দারুণ মিলে গিয়েছিল। পৃথিবীতে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ আছে, যারা যে কোনো পরামর্শ বা নির্দেশ সহজে মেনে নিতে পারে। এদের বেশিরভাগই খুব চমৎকার মানুষ। কিন্তু এমন মানুষও আছে, নিজের জীবনের লাগাম নিজের হাতে তুলে নিলে যাদের হাত ব্যথা করে। মিস স্ট্যান্সফিল্ড আসলে এ রকম একজন।
আমি যে বললাম, ব্রিদিং মেথডকে সে পুরোপুরি আপন করে নিয়েছে, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই এটা বুঝিয়েছি। আর যে ডিপার্টমেন্ট স্টোরে মেয়েটা পারফিউম আর কসমেটিকস বিক্রি করত, ওখানকার শেষদিনের ঘটনা থেকে এটা পুরো স্পষ্ট হয়ে যায়।
আগস্টের শেষাশেষি তার চাকরির শেষ পর্যায় চলে আসে। মিস স্ট্যান্সফিল্ড এমনিতে শুকনোদেহী, আকর্ষণীয়া তরুণী ছিল। আর এটা তার প্রথম সন্তান। যে কোনো ডাক্তারই আপনাকে বলবে, এ রকম কেউ প্রথম পাঁচ মাস, এমনকি ছয় মাসেও হয়তো কোনো চিহ্ন দেখাবে না…তারপর, একদিনের মধ্যেই সমস্ত চিহ্ন প্রকটভাবে ফুটে উঠবে।
মাসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সেপ্টেম্বরের প্রথমদিন এলো মেয়েটা। কষ্টের হাসি হেসে আমাকে বলল, ব্রিদিং মেথডের আরেকটা ব্যবহার সে আবিষ্কার করেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, কী সেটা?
সবুজ-বাদামি চোখ দুটো নাচিয়ে সে বলল, ‘কারো উপর প্রচণ্ড রেগে গেলে নিজেকে সংযত রাখার জন্য দশ পর্যন্ত গোণার চেয়ে ব্রিদিং মেথড ভালো কাজ করে। তবে, ওভাবে শ্বাস নিয়ে নিয়ে ফেলা শুরু করলে, মানুষ পাগলের দিকে যেভাবে তাকায়, সেভাবে তাকাবে।
তারপর পুরো ঘটনাটা বলল। অন্যান্য দিনের মতোই গত সোমবার কাজে গিয়েছিল সে। কথা শুনতে শুনতে, পরম কৌতূহলে আমি কেবল একটা জিনিসই কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম। শুকনো আকর্ষণীয়া এক তরুণী সপ্তাহখানেকের মাঝে রাতারাতি অন্তঃসত্ত্বায় বদলে গেল-ক্রান্তি অঞ্চলে যেমন দীর্ঘসময় ধরে দিন থাকার পর রাতারাতি রাত চলে আসে-সেরকম। ব্যাপারটা কেমন লেগেছিল তার সুপারভাইজারের কাছে? নাকি, দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহ করছিল? সেদিন বুঝতে পেরেছিল, ব্যাপারটা শুধু সন্দেহের পর্যায়ে আর নেই।
মিসেস কেলি নামের সেই সুপারভাইজার মহিলা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বিরতির সময় আমার অফিসে দেখা কোরো। মহিলা এতদিন মিস। স্ট্যান্সফিল্ডের সাথে খুবই বন্ধুবৎসল ছিল। নিজের হাইস্কুল পড়ুয়া দুই বাচ্চার ছবি দেখিয়েছে, এমনকি রান্নার রেসিপিও বিনিময় করেছে। প্রায়ই মিসেস কেলি জিজ্ঞাসা করত, কোন ‘ভালো ছেলের সাথে ওর পরিচয়। হয়েছে কি না। আগের সেই ভালো আচরণ এখন নেই হয়ে গেছে। মিস। স্ট্যান্সফিল্ড বিরতির সময় মহিলার অফিসে যাওয়ার আগেই বুঝতে পেরেছিল, কী হতে যাচ্ছে।
মহিলা কাটাকাটা গলায় বলল, ‘তুমি বিপদ বাঁধিয়ে বসেছ।‘
‘হ্যাঁ, কেউ কেউ এটাকে তা-ই বলে।’
এ কথা শুনে মিসেস কেলির গালটা পুরনো ইটের মতো লাল হয়ে গেল। আমার সাথে স্মার্টগিরি দেখিয়ো না, মেয়ে। তোমার পেট দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এরমাঝে যথেষ্ট স্মার্টগিরি দেখিয়ে ফেলেছ।
গল্প শুনতে শুনতে মানস চোখে ওদের দুজনকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। মিস স্ট্যান্সফিল্ডের সবুজ-বাদামি চোখদুটো সরাসরি মিসেস কেলির উপর নিবদ্ধ। চোখ নামিয়ে নিতে, ফুঁপিয়ে উঠতে কিংবা লজ্জিত হয়েছে-এমন ভাব প্রকাশে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। স্বাভাবিক। ততদিনে মহিলার বাচ্চাদুটো বড় হয়ে গেছে। স্বামী মোটামুটি সম্মানিত মানুষ, সেলুন-মালিক এবং রিপাবলিকানদের ভোট দিয়েছে। কাজেই, আমার বিশ্বাস, কতটা বিপদে আছে, সেটা নিয়ে সুপারভাইজারের চেয়ে মিস স্ট্যান্সফিল্ডেরই বেশি বাস্তব ধারণা ছিল।
‘স্বীকার করছি, আমার সাথে যেরকম প্রতারণা করেছে, সে তুলনায় তোমাকে নিতান্ত কম লজ্জিত বলে মনে হচ্ছে,’ বলতে বলতে রাগে ফেটে পড়ল মিসেস কেলি।
‘আমি, আপনার সাথে কোনোরকম প্রতারণা করিনি। আজকের আগে আপনি তো আমাকে গর্ভধারণের কথা জিজ্ঞাসাই করেননি। মহিলার দিকে কিছুটা কৌতূহলী চোখে তাকাল সে, ‘তাহলে প্রতারণার কথা কোত্থেকে আসে?’
‘আমি তোমাকে বাসায় নিয়ে গেছি,’ মিসেস কেলি প্রায় কেঁদে ফেলল। চোখে স্পষ্ট তীরস্কার। বলল, আমার ছেলেদের সাথে একসাথে ডিনার পর্যন্ত করিয়েছি।
এ কথা শোনার পর মিস স্ট্যান্সফিল্ডের রাগ উঠতে শুরু করে। মেয়েটা আমাকে বলেছিল, এক জীবনে তার কখনো এত রাগ ওঠেনি। গর্ভধারনের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর সুপারভাইজারের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে, এ ব্যাপারে সে নিজেও সচেতন ছিল। কিন্তু আপনারা সবাই জানেন, তাত্ত্বিক হিসেব-নিকেশ আর বাস্তবতার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকে।
আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে, দুইহাত শক্ত করে কোলের উপর রেখে মিস স্ট্যান্সফিল্ড বলল, আপনি যদি বলতে চান, আপনার ছেলেদেরকে আমি কখনো পটাতে চেয়েছি বা চাইব, তাহলে বলব, এরচেয়ে বাজে, নোংরা কিছু জীবনে কখনো শুনিনি আমি।’
মিসেস কেলির মাথা এমনভাবে ঝাঁকি খেয়ে পেছনে সরে গেল, যেন কেউ তাকে কষে চড় মেরেছে। কেবল দুই জায়গায় ছোপ ছোপ লালচে আভা ছাড়া গাল থেকে পোড়া ইটের মতো লাল রংটুকু সরে গেল। দুজনের মাঝের টেবিল ভর্তি পারফিউমের নমুনা বোতল, পুরো ঘর জুড়ে ফুলের মৃদু সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। এর মাঝেই টেবিলের দুপাশ থেকে দুজন একে অন্যের দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মিস স্ট্যান্সফিল্ডের ভাষায়, বাস্তবে এই মুহূর্তটুকু যতক্ষণ স্থায়ী হয়েছে, তারচেয়ে তখন অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছিল।
তারপর মিসেস কেলি শব্দ করে ড্রয়ার খুলে একটা হলদেটে খাম বের করে আনল। উজ্জ্বল গোলাপী রংয়ের একটা স্লিপ আটকানো ছিল ওতে। কর্মীদেরকে বিদায় করে দেওয়ার সময় এ রকম স্লিপ দেওয়া হয়। দাঁতমুখ। খিঁচিয়ে, চিবিয়ে চিবিয়ে প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণ করল মহিলা, ‘শত শত দ্র মেয়ে এই শহরে কাজের খোঁজে ঘুরে ফিরছে। তোমার মত নষ্টা কাউকে কর্মী হিসেবে রাখার কোনো প্রয়োজন আমি দেখি না, ডিয়ার।
মেয়েটা বলছিল, শেষের ‘ডিয়ার’ শব্দটা শুনেই সমস্ত রাগ একেবারে মাথায় চড়ে গিয়েছিল। মুহূর্তখানেক পরে মিস স্ট্যান্সফিল্ডকে দেখে হাঁ করে, বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল মিসেস কেলি। মেয়েটা ততক্ষণে লোহার শেকলের মতো শক্ত করে নিজের হাতদুটো চেপে ধরেছে-এত জোরে ধরেছিল যে, হাতে দাগ পড়ে গেছে (সেপ্টেম্বরের এক তারিখে যখন আমাকে দেখাতে এসেছে, দাগগুলি কিছুটা মিলিয়ে গেলেও, তখনো চিহ্ন রয়ে গিয়েছিল)-তারপর দাঁত চেপে শুরু করেছে ব্রিদিং মেথডের ‘লোকোমোটিভ’ ধাপ।
গল্পটা কিন্তু এমনিতে কোনো মজার গল্প না। কিন্তু মাথার মাঝে ফুটে ওঠা ছবিটা দেখে হাসিতে ফেটে পড়েছিলাম আমি। মিস স্ট্যান্সফিল্ডও আমার সাথে যোগ দিয়েছিল। হাসির শব্দ শুনে মিসেস ডেভিডসন এসে দেখে গিয়েছিল-লাফিং গ্যাসখ্যাত নাইট্রাস অক্সাইড টেনে ফেলেছি কি না, সম্ভবত সেটা নিশ্চিত হয়ে নিতে চাচ্ছিল।
মেয়েটা বলছিল, ‘আর কিছু করার কথা মাথায়-ই আসছিল না, বুঝলেন? হাসতে হাসতে ওর চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেছে। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বলে যেতে লাগল, কারণ সেই মুহূর্তে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, টেবিল থেকে পারফিউমের নমুনা বোতলগুলি নিয়ে মেঝেতে আছড়ে ফেলেছি। একটাও বাকি রাখিনি। আর, জিনিসটা আমি কেবল ভাবছিলাম-ই না, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম-কার্পেটবিহীন কংক্রিটের মেঝেতে আছড়ে পড়ছে বোতলগুলি, চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যাচ্ছে, এবং সবগুলো মিলেঝিলে জঘন্য এক গন্ধে ভরে যাচ্ছে পুরো ঘর।
‘আমি ঠিক এটাই করতে যাচ্ছিলাম। হাতি দিয়ে টেনেও কেউ আমাকে থামাতে পারত না। কিন্তু তারপর নিয়ম মেনে যখন নিঃশ্বাস নেওয়া শুরু করলাম, সবকিছু ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে এলো। সত্যি বলতে, এই ব্রিদিং মেথডের জোরেই সেদিন কোনোমতে বকেয়ার চেক আর গোলাপী পিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। তখনো লোকোমোটিভ ট্রেইনের মতো শ্বাস ফেলছি। ফলে, মহিলাকে আর ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি।’
দুইজন একসাথে আরেকদফা হেসে উঠলাম। তারপর মেয়েটা আস্তেধীরে স্বাভাবিক হয়ে এলো।
‘যাক, ওসব এখন অতীত। পরে এমনকি বেচারির জন্য আমার কিছুটা কষ্টও লেগেছে-নাকি বেশি নির্মম হয়ে গেল কথাটা?’
‘মোটেও না। বরং এ রকম কারো জন্য এটুকু অনুভব করাটা আসলে প্রশংসনীয়।‘
‘সেদিন পাওয়া বকেয়া টাকাটা দিয়ে একটা জিনিস কিনেছি। আপনাকে দেখাতে পারি, ডক্টর ম্যাকক্যারন?’
‘হ্যাঁ, চাইলে দেখাতে পারেন।‘
মেয়েটা হাতব্যাগ খুলে একটা ছোট্ট বাক্স বের করে আনল। বলল, ‘একটা সস্তা দোকান থেকে দুই ডলার দিয়ে কিনেছি আরকি। কিন্তু এই পুরো দুঃস্বপ্নের মতো সময়টার মাঝে এটা কেনার সময়ই আমি প্রচণ্ড লজ্জিত বোধ করছিলাম। নোংরা নোংরা লাগছিল নিজেকে। কেমন অদ্ভুত না ব্যাপারটা?’
বাক্সটা খুলে টেবিলে রেখে দিল, যাতে ভেতরটা দেখতে পাই। জিনিসটা দেখে মোটেও অবাক হইনি-স্বর্ণের বিয়ের আঙটি।
‘প্রয়োজনীয় সবকিছু করতেই আমি রাজি আছি। যেখানে উঠেছি, মিসেস কেলি এটাকে নিশ্চিতভাবেই ‘সম্মানজনক বোর্ডিং হাউজ” বলত। মালিক মহিলা যথেষ্ট ভালো এবং বন্ধুবৎসল…কিন্তু মিসেস কেলিও তো তা ই ছিল। মনে হচ্ছে, যে কোনো সময় আমাকে চলে যেতে বলতে পারে মহিলা। ওঠার সময় যে জামানত দিয়েছিলাম, সেটা চাইলেও নিশ্চয়ই মুখের উপর হেসে ফেলবে।
‘কিন্তু ডিয়ার, এ রকম কিছু করা তো বেআইনি। আইন-আদালত আইনজীবী-সবাই আপনাকে সাহায্য করবে–’
‘ওসব আদালত হচ্ছে ছেলেদের সংঘটন,’ মেয়েটা স্থির গলায় জবাব দিল। ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে আমার মতো কারো গতি করার ঠেকা পড়েনি ওদের। টাকাটা হয়তো ফেরত পেয়ে যাব, হয়তো পাব না। সেটা যা-ই হোক, সেজন্য যে পরিমাণ খরচ আর ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে-আর যেসব বাজে কথাবার্তা ইত্যাদি শুনতে হবে-সাতচল্লিশ ডলারের জন্য এসব করার কোন অর্থ নেই আসলে। আপনাকে এটা বলারও তেমন কোন অর্থ নেই। জিনিসটা এখনো ঘটেনি, হয়তো ঘটবেও না। তবে যা-ই হোক, আমি এখন থেকে পুরোপুরি বাস্তববাদী হিসেবে সব কাজ করতে চাই।’
মেয়েটা মাথা তুলে তাকালে আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।
‘গ্রামের দিকে একটা ঘর দেখে রেখেছি-যদি দরকার লেগে যায়। আরকি। ঘরটা তৃতীয় তলায়। ভালোই পরিস্কার আছে। এখন যেখানে থাকি, সেখান থেকে ভাড়াও পাঁচ ডলার করে কম পড়বে।’ বলতে বলতে বাক্স থেকে আঙটিটা বের করে নিল সে। ‘ওখানকার বাড়ির মালিক ঘর দেখানোর সময় এটা পরেছিলাম।‘
আবারো চোখ তুলে তাকাল মেয়েটা। চোখ দুটো জলে টলমল করছে। আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই এক ফোঁটা অশু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।
‘প্লিজ,’ আমার গলায় আকুলতা ফুটে উঠল। টেবিলের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওর একহাত ধরলাম। অসম্ভব শীতল হয়ে আছে হাতটা। সেই হাতে হাত রেখে বললাম, ‘কাঁদবেন না, প্লিজ।‘
মেয়েটা আমার হাতের মধ্যেই হাত উল্টে নিল-বাম হাত ছিল ওটা-এবং আঙটির দিকে তাকাল। জোর করে একটুখানি হাসল-পিত্তের মতো প্রচন্ড তেতো মনে হলো হাসিটাকে। তারপর আরেকফোঁটা-কেবল একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
‘অবিশ্বাসীদেরকে যখন বলতে শুনি, অলৌকিকতা আর জাদুর দিনগুলি ফুরিয়ে গেছে, বুঝলেন ডক্টর ম্যাকক্যারন, আমি নিশ্চিত জানি, ওরা সবাই বোকা। ঠিক বলেছি না, বলুন? সস্তা কোন দোকান থেকে আপনি যদি দেড় ডলারে আঙটি কিনে জারজতা আর লাম্পট্য নিমেষে মুছে ফেলতে পারেন-এটাকে আপনি জাদু না বলে আর কী বলবেন, বলুন? সস্তা জাদু।’
‘মিস স্ট্যান্সফিল্ড,..স্যান্ড্রা, আমি যদি…মানে, আপনার যদি কোনকিছুতে সাহায্য লাগে বা আমি যদি কিছু করতে পারি।’
মেয়েটা হাত সরিয়ে নিল-আমি যদি বামহাতের বদলে ওর ডানহাতটা ধরতাম, তাহলে হয়তো সে হাত সরিয়ে নিত না। একটু আগেই বলেছি, আমি ওকে ভালোবাসিনি। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি ওকে ভালোবেসে ফেলতে পারতাম; ওর প্রেমে প্রায় পড়েই গিয়েছিলাম, বলা যায়। মিথ্যে আঙটি পরা হাতটা না ধরে আমি যদি ওর অন্য হাতটা হাতে তুলে নিতাম, আর ও যদি আমাকে আর কিছুক্ষণ হাতটুকু ধরে থাকার সুযোগ দিত, নিজের উষ্ণতা দিয়ে ওর শীতল হাতটাকে উষ্ণ করে তুলতে দিত, তাহলে হয়তো আমি আসলেই ওর প্রেমে পড়ে যেতাম।
‘আপনি খুব ভালো মানুষ। আমার আর আমার সন্তানের জন্য। এমনিতেই অনেক করেছেন…আর, আপনার ব্রিদিং মেথড এই আঙটির চেয়ে অনেক অনেক ভালো জাদু। শুধু এর জন্যেই তো সেদিন ভাংচুর করার জন্য জেলে যাওয়া থেকে বেঁচে গেলাম, তাই না?’
একটুখানি পরেই মেয়েটা বেরিয়ে গেল। রাস্তা ধরে ওকে ম্যাডিসন অ্যাভিনিউয়ের দিকে এগিয়ে যেতে দেখার জন্য আমি জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। হায় ঈশ্বর, ঠিক সেই মুহূর্তে কী অসম্ভব ঘোর লাগা মুগ্ধতা-ই না ভর করেছিল আমার উপর! ওকে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসা এক অন্তঃসত্ত্বা তরুণী বলে মনে হচ্ছিল-কিন্তু কেন যেন একটুও মুষড়ে পড়া বা ভীতু বলে মনে হচ্ছিল না। মেয়েটা একবারও এলোমেলো পা ফেলেনি। দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি রাস্তার এই ফুটপাত ধরে এমন করে হেঁটে যাওয়াটা ওর অধিকার। এখানে আর কারো কিছু বলার নেই।
ধীরে ধীরে আমার চোখের আড়ালে চলে গেল সে। টেবিলের দিকে ঘুরে তাকালাম। ঠিক সেই মুহূর্তে দেয়ালে আমার ডিপ্লোমা সার্টিফিকেটের পাশে ঝোলানো ছবিটার দিকে চোখ চলে গেল, এবং আমার সমস্ত দেহের মধ্যে দিয়ে একটা তীব্র কাঁপুনি বয়ে গেল। আমার সবটুকু ত্বক-এমনকি কপাল বা হাতের উল্টোপিঠের চামড়ার মধ্যে দিয়েও প্রচণ্ড শীতল একটা কিছু বয়ে গেল। এক জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ আতংক, নিঃশ্বাস আটকে ফেলার মতো করে আমাকে গিলে নিল। টের পেলাম, ঠিক করে শ্বাস নিতে পারছি না। আটকে যাচ্ছে। ভাইয়েরা আমার, সেই মুহূর্তে আমি যেন কিছুক্ষণের জন্য ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিলাম। এ রকম কিছু আদৌ ঘটতে পারে কি না, এ নিয়ে আমি কোনো তর্কে যাব না। কারণ, আমি জানি এ রকম হয়। সেই তীব্র গরমে ছাওয়া সেপ্টেম্বরের বিকেলে আমার নিজের সাথেই হয়েছে। কেবল একবার-ই হয়েছে, কিন্তু হয়েছে। আর সষ্টার কাছে প্রার্থনা করি, আর কখনো যেন না হয়।
আমি যেদিন মেডিকেল স্কুল শেষ করলাম, সেদিন আমার মা এই ছবিটা তুলে দিয়েছিলেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দুহাত পেছনে দিয়ে আমি হোয়াইট মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আর প্যালিসেডস পার্কের রাইডগুলোর সারা দিনের পাস পেয়ে যাওয়া এক পিচ্চির মতো খুশিতে দাঁত বের করে হাসছি। আমার বামে হ্যারিয়েট হোয়াইটের ভাস্কর্যটা দেখা যাচ্ছে। যদিও ভাস্কর্যের পায়ের মধ্যভাগের কিছুটা উপরে কাটা পড়েছে, কিন্তু নিচের বেদী এবং ওতে খোদাই করা নির্মম কথাটা-কষ্ট ছাড়া সুখ পাওয়া যায় না; সেজন্যই আমরা মুক্তিকে কষ্টের পাল্লায় মাপি-স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। প্রায় চারমাসের মতো পরে, বাচ্চা ডেলিভারি করানোর জন্য হাসপাতালে পৌঁছার পর পর-ই উদ্ভট এক দূর্ঘটনায় আমার বাবার প্রথম স্ত্রীর ভাস্কর্যটার পায়ের কাছে, খোদাই করা লেখাটার ঠিক নিচে, স্যান্ড্রা স্ট্যান্সফিল্ড মারা যাবে।
*
সেই শরতে মেয়েটা কিছুটা আতংকিত হয়ে পড়েছিল এই ভেবে যে, ডেলিভারি করানোর সময় আমি হয়তো হাসপাতালে থাকব না। হয়তো ক্রিসমাসের ছুটিতে থাকব, কিংবা ঠিক যখন সে আসবে, তখন আমার দায়িত্ব থাকবে না। ভয় পাওয়ার পেছনে একটা কারণ হলো, যদি এমন কোনো ডাক্তারের হাতে পড়ে যায়, যে ব্রিদিং মেথড ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং এর বদলে গ্যাস বা স্পাইনাল ব্লক দিয়ে দেবে।
যথাসম্ভব নিশ্চিত করলাম ওকে। বুঝিয়ে বললাম, শহর ছেড়ে বেরনোর কোন কারণ নেই আমার। ছুটির দিনে দেখতে যাওয়ার মতো পরিবারের কেউ নেই। মা মারা গেছেন দুই বছর আগে। ক্যালিফোর্নিয়ায় আমার এক চিরকুমারি খালা থাকেন…ট্রেইনে করে ওখানে যেতে আমার ভালো লাগে না। মিস স্ট্যান্সফিল্ডকে এসব কিছুই বুঝিয়ে বললাম।
সে জানতে চাইল, ‘আপনি কি খুব একাকী বোধ করেন?
মাঝে মাঝে। সাধারণত অনেক ব্যস্ত থাকি তো, এসব নিয়ে ভাবার সময়-ই হয় না। আপনি এটা রাখুন। বলে আমার বাসার টেলিফোন নাম্বার লেখা একটা কার্ড ধরিয়ে দিলাম। প্রসববেদনা শুরু হলে হাসপাতালে কল দিয়ে অ্যানসার মেশিনের রিপ্লাই পেলে বাড়ির নাম্বারে ফোন করবেন।
‘না না, থাকুক–’
‘ব্রিদিং মেথড ব্যবহার করতে চান তো, নাকি? নাকি হাতুড়ে কারো কাছে ডেলিভারি করাতে চান-যে বরং ব্রিদিং মেথডের লোকমোটিভ ধাপ দেখলে আপনাকে পাগল ভেবে ইথার দিয়ে অজ্ঞান করে দেবে?’
মেয়েটা হেসে ফেলল। ‘ঠিক আছে। আমি কনভিন্সড।’
ধীরে ধীরে হেমন্তের দিন কেটে যেতে লাগল। থার্ড অ্যাভিনিউয়ের কসাইরাও ততদিনে প্রতি পাউন্ড ‘রসালো ও তাজা’ টমের দাম ধরে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেছে। টের পেলাম, মেয়েটা মানসিকভাবে এখনো শান্তি পাচ্ছে না। আমার সাথে প্রথম দেখা করার সময় যেখানে থাকত, সেখান থেকে আসলেই ওকে বের করে দেওয়া হয়েছে। গ্রামে চলে যেতে হলো। অবশ্য সেটা ওর জন্য ভালোই হয়েছিল। একটা কাজও পেয়ে গেল ওখানে। যথেষ্ট আয়-রোজগারসম্পন্ন এক অন্ধ মহিলা সপ্তাহে দুদিন এসে টুকটাক ঘরের কাজ করে দেওয়ার জন্য রেখে দিল ওকে। সেইসঙ্গে কাজ শেষে মহিলাকে জিন স্ট্রাটন-পোর্টার এবং পার্ল বাক পড়ে শোনানোর দায়িত্ব পড়ল। গর্ভকালীন সময়ের শেষ তিনমাসে সাস্থ্যবান মেয়েরা যেরকম। প্রস্ফুটিত গোলাপ-বরন ধারণ করে, ওর তখন সেরকম অবস্থা। কিন্তু চেহারায় একটা কালোছায়া রয়েই গেছে। প্রশ্ন করলে অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে উত্তর দিত। একবার যখন আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না, যে নোটগুলো টুকে নিচ্ছিলাম, সেখান থেকে চোখ তুলে তাকালাম। মেয়েটা দেখি আমার ডিপ্লোমা সার্টিফিকেটের পাশে বাঁধানো ছবিটার দিকে অদ্ভুত, স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে আছে। সেদিনের সেই তীব্র কাঁপুনিটার অস্তিত্ব আরেকবার টের পেলাম…এমন সময় মেয়েটা কথা বলে উঠল। আমার একটু আগের প্রশ্নের সাথে এই কথার কোন সম্পর্কই নেই। বরং কথা শুনে অস্বস্তি কাটার বদলে একটু যেনে বেড়েই গেল।
‘কেমন যেন লাগছে, বুঝলেন, ডক্টর ম্যাকক্যারন? তীব্র একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে বুঝি ধ্বংস নেমে আসছে।’
কেমন সস্তা, মেলোড্রামাটিক শোনায়, তাই না? কিন্তু উত্তরে আমার মুখে উঠে আসতে যাচ্ছিল : হ্যাঁ, আমারও একই অনুভূতি হচ্ছে। জোর করে কথাটাকে চাপা দিলাম। যে ডাক্তার এমন কথা বলে, সব চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, বই-পত্র বিক্রি করে দিয়ে তার বরং কার্পেট বেচা বা টয়লেট প্লাম্বিংয়ের কাজ শুরু করা উচিত।
ওকে বললাম, এ রকম অনুভূতি হওয়াটা নতুন কিছু না। অন্তঃসত্ত্বাদের এমনটা প্রায়ই হয়। ওর আগে অনেকের যেমন এই অনুভূতি হয়েছে, ওর পরেও অনেকের তা-ই হবে। এটা এতোই সাধারণ যে, ডাক্তাররা মুখে মুখে একে দ্য ভ্যালি অফ দ্য শ্যাডো সিনড্রোম বলে ডাকে। এরমধ্যে এর কথা একবার বলেছিও তো মনে হয়।
মিস স্ট্যান্সফিল্ড সিরিয়াস ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। মেয়েটাকে তখন কেমন তরুণী লাগছিল, পেটটা কতটুকু ফুলেছিল-এ সবকিছুই আমার একদম স্পষ্ট মনে আছে। সেটার কথা তো জানি,’ সে বলছিল। অমনটা আমারও অনুভূত হয়েছে। কিন্তু এটা কেমন যেন আলাদা, অন্যরকম। মনে হচ্ছে যেন…কিছু একটা যেন ধীরে ধীরে পাকিয়ে উঠছে। অন্ধকার চিড়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, আমাকে গিলে নিতে চাচ্ছে। এরচেয়ে ভালোভাবে জিনিসটা ব্যাখ্যা করতে পারব না আমি। জানি, ফালতু শোনাচ্ছে, কিন্তু জিনিসটাকে সরাতে পারছি না।’
উত্তরে বললাম, ‘চেষ্টা করুন। এটা কোনভাবেই বাচ্চার জন্য ভালো না–’
কিন্তু মেয়েটার মনযোগ ততক্ষণে আমার উপর থেকে সরে গেছে। আবারো ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে সে।
‘কে এটা?’
‘এমলিন ম্যাকক্যারন। সিভিল ওয়ারের আগের ছবি তো, ছেলেটা তখনো বেশ তরুণ ছিল!’ মজা করে পরিস্থিতি হালকা করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু কথাটা কেমন হাস্যকর আর দুর্বল শোনাল।
‘আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি। কিন্তু মহিলাটা?’ একটু থেমে আবার জানতে চাইল, ‘মহিলাটা কে?’
‘ওনার নাম হ্যারিয়েট হোয়াইট,’ বলতে বলতেই মনে হল: বাচ্চা ডেলিভারি করাতে আসলে ওনার চেহারাই আপনি সবার আগে দেখবেন। আবারো সেই কাঁপুনিটা ফিরে এল-আকার আকৃতিহীন সেই আদিম আতংক মুহূর্তখানেকের জন্য ছুঁয়ে গেল আমাকে। হ্যারিয়েটের পাথুরে চেহারাটা চোখে ভাসছে।
‘আর, ভাস্কর্যটার বেদীতে ওটা কী লেখা?’ জিজ্ঞেস করল। চোখদুটো ওর কেমন কবরের মতো আচ্ছন্ন দেখাচ্ছে।
মিথ্যে করে বললাম, ‘জানি না। আমার লাতিন অতোটা ভালো না।’
সেদিন রাতে জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নটা দেখেছিলাম। যে ভয়াবহরকম তীব্র আতংক নিয়ে জেগে উঠেছি-বিবাহিত হলে আমার বেচারী বউটা হয়তো ভয়ে মরেই যেত।
স্বপ্নে আমি যে রুমে রোগি দেখি, সেটার দরজা খুলে দেখি, স্ট্যান্ড্রা স্ট্যান্সফিল্ড। পায়ে বাদামি রংয়ের পাম্প জুতো। গায়ে বাদামি পাড় লাগানো, স্মার্ট দেখতে সাদা লিনেনের জামা এবং পুরনো দিনের সেই ক্লচে হ্যাট। হ্যাটটা ওর দুই স্তনের মাঝে দেখা যাচ্ছে। কারণ, মেয়েটা নিজের বিচ্ছিন্ন মাথাটা দুই হাতে ধরে রেখেছে। সাদা লিনেনের জামাটা জমাট রক্ত লেগে কালচে হয়ে গেছে। কাটা ঘাড়ের কাছ থেকে রক্ত ছিটকে উঠে সিলিংয়ের জায়গায় জায়গায় লেগে আছে।
তারপর বন্ধ চোখ দুটো হাট করে খুলে গেল-আকর্ষণীয় সবুজ-বাদামি দুটো চোখ-আমার উপরে এসে স্থির হলো।
‘ধ্বংস,’ বিচ্ছিন্ন মাথাটা বলে উঠল। ‘ধ্বংস হয়ে গেছি আমি। একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছি। কষ্ট ছাড়া মুক্তি মেলে না। এসব সস্তা জাদু, কিন্তু এছাড়া আর কিছু তো নেই আমাদের কাছে।‘
ঠিক এই সময় আমি চিৎকার করে জেগে উঠলাম।
*
ডেলিভারির দিন হিসেবে ধরে রাখা ১০ ডিসেম্বর এসে চলেও গেল। ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ ওকে পরীক্ষা করে দেখলাম। জানালাম, বাচ্চাটা এ বছর, মানে ১৯৩৫ সালে জন্ম নিবে ঠিকই, কিন্তু ক্রিসমাসের আগে দর্শন দেবে বলে মনে হয় না। মিস স্ট্যান্সফিল্ড ভালো ভাবেই এটা মেনে নিল। সেই শরতে ওর মাথার উপর যে কালোছায়া ঝুলে ছিল, মনে হলো, সেটা আর নেই। মিসেস গিবস নামের যে অন্ধ মহিলা ওকে টুকটাক কাজ আর বই পড়ে শোনানোর জন্য রেখেছিল, দেখা গেল, মেয়েটার কাজ-কর্মে উনি দারুণ খুশি। এই মুগ্ধতা নিয়ে নিজের বান্ধবীদেরকেও তিনি বলেছেন যে, এই সাহসি বিধবা মেয়েটা স্বামীর সাম্প্রতিক মৃত্যু এবং নিজের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থা নিয়েও যে দৃঢ়ভাবে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে-তার তুলনা হয় না। ফলে মহিলার অনেক বান্ধবী বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর ওকে কাজে রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সে আমাকে বলছিল, বাচ্চাটার জন্য আমি ওই কাজগুলিও নেব। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আরো ভালো এবং স্থায়ী কোন কাজ খুঁজে বের করার আগ পর্যন্ত এভাবেই চালিয়ে যাব যথাসম্ভব। মাঝে মাঝে মনে হয়, যা কিছু ঘটেছে, এরমধ্যে সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটা হলো-মানুষকে আগে যেরকম ভাবতাম, সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা একদম পাল্টে গেছে। নিজের মনে প্রায়ই ভাবি, “এই যে বুড়িকে এভাবে মিথ্যে বলেছি, প্রতারণা করছি, এসব করার পর রাতে ঘুম আসে কিভাবে?” তারপরেই মনে হয়, “জানলে অন্যদের মতো এই মহিলাও আমাকে বের করে দিত।” নিজেকে যা-ই বলি, শেষ পর্যন্ত এসব কিছু তো মিথ্যে-ই। বুকের মধ্যে ভারটা খুব চেপে বসছে।
সেদিন বেরিয়ে যাওয়ার আগে, হাতব্যাগ থেকে যত্ন করে র্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা ছোট প্যাকেট বের করে টেবিলের উপর দিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যারি ক্রিসমাস, ডক্টর ম্যাকক্যারন।
‘এই কষ্টটা না করলেও হতো,’ বলতে বলতে টেবিলের ড্রয়ার খুলে আমি নিজেও একটা প্যাকেট বের করলাম। ‘কিন্তু আমি নিজেও যেহেতু—’
এক মুহূর্তের জন্য অবাক চোখে আমাকে দেখল সে…তারপর দুজনেই একসাথে হেসে উঠলাম। মেডিকেল-চিহ্ন আঁকা একটা রুপালি রংয়ের টাই ক্লিপ দিয়েছিল সে আমাকে। আর আমি ওকে একটা অ্যালবাম দিয়েছিলাম বাচ্চাটার ছবি রাখার জন্য। টাই-ক্লিপটা এখনো আছে আমার কাছে। অ্যালবামটার পরে কী হয়েছে, আমি জানি না।
ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলাম। দরজার কাছে পৌঁছে গেছি, এমন সময় মেয়েটা ঘুরল। দুহাতে আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে পায়ের উপর ভর দিয়ে একটু উঁচু হলো, এবং আমার ঠোঁটে চুমু খেল। ওর ঠোঁটগুলো ঠান্ডা, মিষ্টি। চুমুর মাঝে কোন কাম ছিল না। কিন্তু কোনো বোন বা খালা বা এমন কেউ আপনাকে এভাবে চুমু দিবে না, এটুকু বলতে পারি।
‘ধন্যবাদ, ডক্টর ম্যাকক্যারন,’ কিছুটা হাঁফিয়ে গেছে মেয়েটা। গালদুটো লাল হয়ে গেছে, সবুজ-বাদামি চোখ দুটোতে প্রবল তৃষ্ণা এসে ভর করেছে। আবারো বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ।‘
অস্বস্তি নিয়ে একটুখানি হাসলাম। বললাম, ‘স্যান্ড্রা, এমনভাবে বলছেন যেন আমাদের আর দেখা-ই হবে না!’ সম্ভবত সেদিনই দ্বিতীয় এবং শেষবারের মতো ওর প্রথম নাম ধরে ডেকেছিলাম।
সে বলল, ‘অবশ্যই দেখা হবে। এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।‘
ঠিকই বলেছিল। কিন্তু যে ভয়ংকর অবস্থায় পরেরবার আমাদের দেখা হবে, সেটা আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারিনি।
*
ক্রিসমাস ইভ, মানে ক্রিসমাসের আগের দিন সন্ধ্যা ঠিক ছয়টার দিকে স্যান্ড্রা স্ট্যান্সফিল্ডের প্রসব বেদনা শুরু হলো। এরমাঝে সারাদিনের গুঁড়িগুড়ি তুষারপাত শিলায় পরিণত হয়েছে। তারপর, দুই ঘন্টা পেরোনোর আগেই ওর মিড-লেবার শুরু হয়ে গেল। ততক্ষণে শহরের পুরো রাস্তা জুড়ে বরফের আস্তরণ পড়ে গেছে।
মিস গিবস নামের সেই অন্ধ মহিলা দোতলায় একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকত। সাড়ে ছয়টার দিকে মিস স্ট্যান্সফিল্ড ধীরে ধীরে সিঁড়ি ধরে নেমে এসে দরজায় নক করলে, মহিলা দরজা খুলে দিল। মেয়েটা ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, ক্যাব ডাকার জন্য ফোনটা একটু ব্যবহার করতে পারবে কি না।
‘বাচ্চার জন্য, মা?’ মিস গিবস জানতে চাইল, একরকম দৌড়াচ্ছে।
‘হ্যাঁ, লেবার শুরু হয়ে গেছে। এখনো শেষ ধাপে পৌঁছাতে দেরি আছে, কিন্তু এই আবহাওয়ায় রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। আগে থেকেই ডেকে রাখি। আসতেও তো অনেক সময় লাগবে।’
ক্যাব কল করে আমাকে ফোন দিল মেয়েটা। ঘড়িতে তখন ৬:৪০ বাজে। জানাল, প্রায় পঁচিশ মিনিট পর পর কন্ট্রাকশন হচ্ছে। কৈফিয়তের সুরে আবারো বলল, আবহাওয়ার জন্য সব কিছু একটু আগে থেকেই করা শুরু করেছে। ‘আগে গিয়ে বসে থাকলেও ভালো। দেরি করে ইয়েলো ক্যাবের পেছনে প্রসব হয়ে যাওয়ার রিস্ক নিতে চাই না।’ কথা শুনে টের পেলাম, মেয়েটার গলা অসম্ভব শান্ত এবং স্থির শোনাচ্ছে।
ক্যাব এলো দেরি করে। এদিকে মিস স্ট্যান্সফিল্ডের লেবার আমার ধারণার চেয়েও দ্রুত শেষ পর্যায়ের দিকে এগোচ্ছিল। আসলে, আগে থেকে ধারণা করে লাভ হয় না। কারণ, আগেই বলেছি, দুইজন মানুষের লেবার। কখনোই একরকম হয় না। যাই হোক, ড্রাইভার এসে যখন দেখল, যাত্রীর কিছুক্ষণ পর বাচ্চা হতে যাচ্ছে, মেয়েটাকে আস্তে-ধীরে সিঁড়ি ধরে নামতে সাহায্য করল সে। সেইসাথে একটু পর পর বলেই যাচ্ছে, ‘আপা, একটু সাবধানে পা ফেলেন।’ কথার জবাবে মিস স্ট্যান্সফিল্ড শুধু মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে। কন্ট্রাকশনের শুরু থেকেই ব্রিদিং মেথড চর্চা শুরু করেছিল। ফলে, মুখ দিয়ে শ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে-সেজন্যেই আসলে কিছু বলছে না। ল্যাম্পপোস্ট আর গাড়ির ছাদে বরফের টুকরো অবিরাম ঝরেই চলেছে। ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মিত হারে শব্দ হচ্ছে, টিক টিক টিক…তারপর, গলে গিয়ে বড় বড় ফোঁটা ঝরে পড়ছে ট্যাক্সির কাঁচের উপর। মিস গিবস আমাকে পরে বলেছিলেন, ‘বেচারি স্যান্ড্রা’র চেয়ে ক্যাব ড্রাইভার-ই বেশি নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। দুর্ঘটনার পেছনে এটা ছিল একটা বড় কারণ।
আরেকটা বড় কারণ ছিল স্বয়ং ব্রিদিং মেথড।
ড্রাইভার এমনিতে দেখেশুনে ধীরেসুস্থেই গাড়ি চালাচ্ছিল। রাস্তাঘাট বেশ পিচ্ছিল হয়ে আছে। রাস্তার মধ্যেকার ডিভাইডারের মাঝের ফাঁকা দিয়ে পেরিয়ে এসে, মোড় ধরে আস্তেধীরে হাসপাতালের দিকে এগোচ্ছিল সে। দুর্ঘটনায় সে ততটা আহতও হয়নি। পরে আমি হাসপাতালে ওর সাথে কথা বলেছিলাম। সে বলছিল, পেছনের সিট থেকে স্থিরভাবে নিঃশ্বাস নেওয়া আর ফেলার যে শব্দ ভেসে আসছিল, সেটা ওকে নার্ভাস করে ফেলেছিল। রিয়ারভিউ মিররে চোখ রেখে বারবার পেছনে তাকাচ্ছিল সে। ভাবছিল, মেয়েটা মরে টরে যাচ্ছে না তো আবার! ওর ভাষ্যমতে, মেয়েটা যদি সাধারণ লেবারের রোগিনীদের মতো কয়েকটা বড় বড় শ্বাস ফেলত, তাহলে হয়তো ওর আরেকটু কম নার্ভাস লাগত। এক-দুইবার মেয়েটাকে সে জিজ্ঞেসও করেছিল, সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না। কেবল মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল মেয়েটা, মুখে সেই ‘ঢেউয়ে চড়ার মতো’ দীর্ঘশ্বাস নেওয়া আর ফেলা চালিয়েই গেছে।
হাসপাতাল থেকে দুই-তিন ব্লক দূরে থাকতেই মিস স্ট্যান্সফিল্ড সম্ভবত টের পেয়েছিল, লেবারের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হয়ে গেছে। প্রচুর যানজট ছিল রাস্তায়। ক্যাবে চড়ার পর থেকে ততক্ষণে একঘন্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও, প্রথম বাচ্চা হচ্ছে, এমন কারো জন্য এতো দ্রুত লেবারের শেষ পর্যায় শুরু হয়ে যাওয়াটা আসলে অস্বাভাবিক। ড্রাইভারও খেয়াল করেছিল। ব্যাপারটা-মেয়েটার নিশ্বাস নেওয়ার ধরন বদলে গেছে। আমাকে বলার সময় ড্রাইভার বলছিল, ‘ডাক্তার সাহেব, মেয়েটা একদম গরমকালের কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছিল!’ আসলে, ও তখন ‘লোকোমোটিভ’ ধাপ শুরু করে দিয়েছে।
ঠিক এ রকম সময় শম্বুক গতিতে এগোতে থাকা যানজটের মধ্যে ড্রাইভার হঠাৎ করে একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে গেল। ফাঁকাটা ধরে সরাসরি হোয়াইট মেমোরিয়াল হাসপাতালে চলে আসা সম্ভব। দূরত্ব বলতে, মাত্র তিন ব্লক। সে বলছিল, ‘বেদীতে বসানো মূর্তিটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। বেচারা ততক্ষণে পেছনের সিটে বসে হাঁপাতে থাকা অন্তঃসত্ত্বা রোগির হাত থেকে মুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ফলে, সেই মুহূর্তে গ্যাস প্যাডালে চাপ দিল সে। গাড়ি যাকে বলে, একদম লাফ দিয়ে আগে বাড়ল। নিচের পিচ্ছিল বরফে বনবন করে ঘুরতে থাকা চাকা বরফের গায়ে সামান্য বাধা পাচ্ছে, কিংবা পাচ্ছেই না বলা চলে।
ওদিকে আমি হেঁটে আসছিলাম। ওদের গাড়ি আর আমি একই মুহূর্তে পৌঁছেছি-আমি আসলে বুঝতেই পারিনি, রাস্তায় এতো জ্যাম পড়বে। ভেবেছিলাম, গিয়ে দেখব, রোগি উপরের তলায় শুয়ে আছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব সাইন করা হয়ে গেছে, সম্পন্ন হয়েছে প্রসবের প্রস্তুতি পর্ব। আর রোগিনী ধীরেসুস্থে মিড-লেবার পেরিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি তখন কেবল সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করেছি। এমন সময় চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম, বরফ ঢাকা রাস্তায় দুইজোড়া হেডলাইটের আলো প্রতিফলিত হয়ে এদিকেই আসছে। রাস্তা পরিস্কারের লোকজন। তখনো বরফ পরিস্কারের সময়-ই পায়নি। ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তে ঘুরে তাকিয়েছিলাম।
এদিক থেকে একটা অ্যাম্বুলেন্স জরুরি বিভাগের র্যাম্পওয়ে ধরে বেরিয়ে এসেছে। ওদিকে মিস স্ট্যান্সফিল্ডের ক্যাবটা স্কয়ারের পাশ দিয়ে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে আসছে। ক্যাবটা এতো দ্রুতবেগে আসছিল যে, ওটাকে এরমাঝে থামানো কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এদিকে, ক্যাব ড্রাইভার অ্যাম্বুলেন্সটাকে দেখে পুরো দিশেহারা হয়ে গেছে। ব্রেক-প্যাডালে ধীরেসুস্থে বারবার করে চাপ দেওয়ার বদলে একেবারে চেপে ধরে ডাবিয়ে দিয়েছে। ফলে বরফ মোড়া রাস্তায় ক্যাব পিছলা খেয়ে অনেকটা উল্টো পাশে ঘুরে গেছে। এদিকে, অ্যাম্বুলেন্সের উপরের লালবাতি জ্বলছে আর নিভছে–রক্তবর্ণের দাগ দাগ, গোল গোল আলোর ফুটকি গিয়ে পড়ছে। সামনের দৃশ্যটার উপর। তার মধ্য থেকে কিছুটা আলো গিয়ে মুহূর্তখানেকের জন্য মিস স্ট্যান্সফিল্ডের মুখের উপরে পড়ল। ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। মনে হলো, আমি বুঝি স্বপ্নের সেই রক্তাক্ত মুখটা দেখতে পাচ্ছি। রক্ত মাখা, চোখ হাট করে খোলা সেই কাটা মাথাটা যেন স্বপ্ন থেকে উঠে চলে এসেছে।
কান্না কান্না গলায় ওর নাম ধরে চিৎকার করে উঠলাম। দুই সিঁড়ি নেমে এসেছি, এমন সময় পিছলা খেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করলাম। হাত-কনুই বাড়ি খেয়ে অসাড় হয়ে গেছে, তবু কেমন করে যেন হাতের কালো ব্যাগটা ধরে রেখেছিলাম। গড়িয়ে সিঁড়ির নিচে এসে থেমেছি। মাথা বনবন করছে, হাত-কনুই জ্বালাপোড়া করছে। এরমাঝে, ওখানে শুয়েই বাকি ঘটনা ঘটতে দেখলাম।
অ্যাম্বুলেন্স ব্রেক করেছিল, কিন্তু পিচ্ছিল রাস্তায় থামার সুযোগ আর পায়নি। পিছলা খেয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা ঘুরে গেছে, ফলে পেছনের অংশটা ভাস্কর্যের বেদীতে বাড়ি খেল। পেছনের দরজা হাট করে খুলে গেছে। ছেঁড়া জিহ্বার মতো ওর মাঝ থেকে একটা স্ট্রেচার ছিটকে বেরিয়ে এল। সৌভাগ্যক্রমে খালি-ই ছিল সেটা। অনেকটা দূরে গিয়ে রাস্তার মাঝে উল্টো হয়ে পড়ে রইল, চাকাগুলো তখনো বনবন করে ঘুরছে। গাড়িদুটোকে পরস্পরের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে ফুটপাতের এক তরুণী গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে দিল দৌড়। এলোমেলো পা ফেলতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। দুই পা এগোতে না এগোতেই আছড়ে পড়ল পেটের উপর। ফলে, পিনবল বোলিং গেমে মানুষ যেভাবে বল ছুঁড়ে মারে, ঠিক সেভাবে হাত থেকে ছিটকে রাস্তায় আছড়ে পড়ে পিছলে যেতে লাগল মেয়েটার হাতব্যাগ।
এতোক্ষণে ক্যাবটার মুখ পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। ড্রাইভারকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। শিশুপার্কে বাম্পার কারে উঠলে বাচ্চারা যেরকম পাগলের মতো স্টিয়ারিং ঘোরানোর চেষ্টা করে, ঠিক সেভাবে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে পেছনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এদিকে অ্যাম্বুলেন্সটা মিসেস হোয়াইটের বেদীতে ধাক্কা খেয়ে কৌণিকভাবে কিছুটা ঘুরে গিয়ে সামনে এগোতে শুরু করেছে…ফলে মুহূর্তখানেক পরেই সেটা গিয়ে ক্যাবের একপাশে প্রচণ্ডবেগে ধাক্কা দিল। ক্যাবটা একটা ছোট্ট বৃত্ত ধরে লাটিমের মতো একপাক ঘোরার সাথে সাথে সবটুকু শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়ল বেদীটার গায়ে। ছাদের উপরে লাগানো হলুদ বাতির মাঝে ‘অন রেডিও কল’ লেখাটা তখনো জ্বলজ্বল করছিল। পর মুহূর্তেই সেটা ভয়াবহভাবে বিস্ফোরিত হলো। এদিকে ক্যাবের বামপাশটা একদম টিস্যু পেপারের মতো দুমড়ে গিয়েছে। মুহূর্তখানেক পরে টের পেলাম, শুধু বামপাশ-ই না, ক্যাবটা এতো জোরে ধাক্কা খেয়েছে যে, মাঝখান দিয়ে একদম দুইভাগ হয়ে গেছে। বরফের উপর বিচুর্ণ কাঁচের গুঁড়োর ছিটকে পড়া দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি হীরে-বৃষ্টি হচ্ছে। আর, দুইভাগ হয়ে যাওয়া গাড়িটার ডানদিকের পেছনের কাঁচ ভাঙা জানালা দিয়ে আমার রোগিনি একদম ডল-পুতুলের মতো উড়ে এসে বাইরে আছড়ে পড়ল।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেলাম, কখন যেন উঠে দাঁড়িয়েছি। সেইসঙ্গে সিঁড়ি ধরে ছুটতেও শুরু করে দিয়েছি। এরমাঝে একবার পিছলা খেতে গিয়ে রেলিং ধরে সামলে নিলাম। পরমুহূর্তেই আবারো ছুটতে শুরু করলাম প্রাণপনে। আমার সমস্ত মনযোগ তখন মিস স্ট্যান্সফিল্ডের দিকে। অ্যাম্বুলেন্সটা শেষ পর্যন্ত যেখানে গিয়ে থেমেছে, তার থেকে অন্তত বিশ ফিট দূরে, হ্যারিয়েট হোয়াইটের বিকট দর্শন মুর্তিটার ছায়ায় কেমন অসহায়ভাবে পড়ে আছে মেয়েটা। এরমাঝে থেকে থেকে অ্যাম্বুলেন্সের লাল আলো রাতের গায়ে রক্তের ছোপ এঁকে দিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা ভয়াবহ অসঙ্গতি আছে মেয়েটার ওভাবে পড়ে থাকার মধ্যে। কিন্তু অসঙ্গতিটা যে ঠিক কী-সেটা একেবারে কাছাকাছি যাওয়ার পরে ভারি কিছু একটা পায়ে বেঁধে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারিনি। জিনিসটা পায়ে লেগে আরেকটু হলে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। যেহেতু ছুটে যাচ্ছিলাম, পায়ে লেগে, মানে লাথি খেয়ে জিনিসটা কিছুটা পিছলা খেয়ে দূরে চলে গেছে-ঠিক ফুটপাথের সেই মেয়েটার হাতব্যাগের মতো। পিছলে গিয়ে যেভাবে স্থির হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি একদলা চুল-রক্তে মেখে গেলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, চুলগুলি সোনালী রংয়ের। জায়গায় জায়গায় কাঁচের গুঁড়ো লেগে গেছে, বোঝা যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে আমি প্রথমবারের মতো বুঝলাম, জিনিসটা আসলে কী। দুর্ঘটনায় মেয়েটার মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। একটু আগে আমি সেই বিচ্ছিন্ন মাথাটাকে লাথি মেরেছি।
প্রচন্ড শকে হতভম্বের মতো ছুটছিলাম। থামলাম গিয়ে মেয়েটার দেহের একেবারে সামনে। দেহটা উল্টে দিলাম। যা দেখলাম, সেটা দেখার সাথে সাথেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করেছিলাম, মনে হয়। করলেও লাভ হয়নি, গলা দিয়ে কোনো শব্দ-ই বের হয়নি। পুরো জমে গিয়েছিলাম। ভাইরে, ওই মেয়ে তখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছিল! হালকা, ছোট ছোট করে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো করে বুক উঠানামা করছে। ভোলা কোটের ফাঁকে, রক্তমাখা জামায় বরফ জমে গেছে। এরমাঝেও আমি চিকন বাঁশির শব্দ মতোন শুনতে পাচ্ছিলাম। চায়ের কেতলি থেকে সেদ্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে যেমন বাঁশির মতোন শব্দ শোনা যায়-বাড়ছে, কমছে-সেরকম। ওটা ছিল কাটা শ্বাসনালীতে বাতাস ঢোকা আর বের হওয়ার শব্দ। সেইসঙ্গে কেমন একটা শব্দহীন আর্তনাদ-মুখবিহীন শব্দনালী একে শব্দে পরিণত করতে না পারলেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
দৌড়ে পালাতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু পায়ে কোনো জোর পাচ্ছিলাম না। ওর পাশেই হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলাম, একহাতে মুখ ঢেকে রেখেছি। এক মুহূর্ত পর টের পেলাম, মেয়েটার জামার নিম্নাংশ থেকে তাজা রক্ত বেরিয়ে আসছে। ঠিক সেই মুহূর্তে, একরকম হুট করেই মনে হলো, হয়তো বাচ্চাটাকে এখনো বাঁচানোর সুযোগ আছে।
রাস্তার বরফের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলাম, ‘সস্তা জাদু! তারপর একটানে মেয়েটার জামা উঠিয়ে দিলাম কোমর পর্যন্ত। যতটুকু মনে পড়ে, সে সময় আমি শব্দ করে হাসছিলাম। পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আসলে। মনে আছে, মেয়েটার দেহ তখনো উষ্ণ ছিল। প্রতিটা শ্বাসের সাথে আন্দোলিত হচ্ছিল ওর শরীর। অ্যাম্বুলেন্সের পুরুষ নার্সদের একজন মাতালের মতো টলতে টলতে এগিয়ে এলো, এক হাতে মাথার একপাশ চেপে ধরে রেখেছে। আঙুলের ফাঁক গলে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল।
‘সস্তা জাদু!’ আবারো চিৎকার করে উঠলাম। তখনো পাগলের মতো হাসছি। হাতড়ে মেয়েটার যোনিমুখ পরীক্ষা করে দেখছিলাম। টের পেলাম, ওটা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বড় হয়ে উঠেছে।
নার্স লোকটা স্যান্ড্রা স্ট্যান্সফিল্ডের মাথাবিহীন দেহটার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিল। লাশটা যে এখনো নিশ্বাস নিচ্ছে, সেটা সে আদৌ বুঝতে পেরেছিল কি না, আমি জানি না। হয়তো ভেবেছিল, এটা কেবলই নিস্তব্ধ হয়ে আসার আগে কিছু স্নায়ুর শেষ কারিকুরি। কিন্তু সে যদি আসলেই অমন কিছু ভেবে থাকে, তারমানে দাঁড়ায়, সে খুব বেশিদিন অ্যাম্বুলেন্স চালায়নি। মাথা কেটে ফেলে দিলে মুরগী হয়তো কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়াতে পারে, কিন্তু মানুষ-খুব বেশি হলে হাজারে এক-দুইজন-এক-দুই পা ফেলার মতো অবস্থায় থাকে। ব্যাস, তারপরেই সব শেষ।
চিৎকার করে বললাম, ‘তাকানো বন্ধ করে আমাকে গিয়ে একটা কম্বল এনে দাও।‘
লোকটা টলতে টলতে হেঁটে চলে গেল। অ্যাম্বুলেন্সের দিকে যাওয়ার বদলে টের পেলাম, টাইম স্কয়ারের দিকে হাঁটা ধরেছে। ওভাবেই হাঁটতে হাঁটতে রাতের বুকে মিলিয়ে গেল। ওর যে কী হয়েছে, কিছুই বুঝলাম না। মরে গিয়েও কোনোভাবে এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকা লাশটার দিকে চোখ ফেরালাম। মুহূর্তখানেক ইতস্তত করে আমার কোটটা খুলে নিয়ে, ওর কোমর ধরে কিছুটা তুলে কোটটা নিচে ঢুকিয়ে দিলাম। তখনো চিকন সুরের সেই বাঁশিটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। ওর দেহ তখনো কোনো এক বিচিত্র উপায়ে ‘লোকোমোটিভ’ চালিয়ে যাচ্ছিল। ভাইরে, আমি এখনো ঘুমের মাঝে, দুঃস্বপ্নে এই শব্দ শুনতে পাই।
একটা জিনিস স্পষ্ট করে বলি। আপনাদেরকে বুঝতে হবে, এই সবকিছুই কিন্তু খুব দ্রুত ঘটেছে-আমার কাছে যদিও সবকিছু সে সময় অনেক দীর্ঘসময় ধরে ঘটছে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু আমি আসলে ঘটনাটার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলাম। আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে সময় তখন ধীর হয়ে গেছে। এরমাঝেই কাজ করে যাচ্ছিলাম। কী হয়েছে, সেটা দেখার জন্য লোকজন তখন কেবল হাসপাতালের দিকে দৌড়ে আসতে শুরু করেছে। আর, আমার পেছনে একটা মেয়ে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা বিচ্ছিন্ন মাথাটা দেখে তীক্ষ্ণ চিৎকার জুড়ে দিয়েছে।
একটানে আমার কালো ব্যাগটা খুলে ফেললাম। স্রষ্টাকে অনেক ধন্যবাদ যে, পড়ার সময় ওটা হারাইনি। খুঁজে পেতে একটা ছোট স্ক্যালপেল, মানে, অপারেশনের ছুরি বের করে নিলাম। ওটা দিয়ে মেয়েটার আন্ডারওয়্যার কেটে খুলে ফেললাম। এ সময় দেখি অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার এগিয়ে আসছে। পনের ফিটের মতো দূরে থাকতেই জায়গায় জমে গেল বেচারা। ওর দিকে ফিরে তাকালাম, মনে প্রাণে চাইছি, কেউ এসে একটা কম্বল দিয়ে যাক। ততক্ষণে বুঝে গেছি, একে দিয়ে এই কাজ হবে না। মাথাবিহীন দেহটার নিশ্বাস নেওয়া দেখতে দেখতেই বেচারার চোখের কোটর দুটো বড় বড় হয়ে গেল। আরেকটু বড় হলেই সম্ভবত চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ছেলে-পেলেদের ইয়ো-ইয়োর মতো অপটিক নার্ভ থেকে ঝুলে থাকত। এক মুহূর্ত পরে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল সে, হাতদুটো প্রার্থনার ভঙ্গিতে তুলে ধরেছে। ও তখন প্রার্থনাই করছিল, আমি নিশ্চিত। নার্স লোকটা হয়তো বুঝতে পারেনি, কিন্তু সে ব্যাপারটা ঠিকই বুঝেছে। চোখের সামনে যেটা ঘটে চলেছে, সেটা এক কথায় অসম্ভব ছাড়া আর কিছু না। পরমুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ও।
সে রাতে আমি ব্যাগে করে ফোরসেপ নিয়ে এসেছিলাম। কেন এনেছি, আমি নিজেও জানি না। এগুলি আসলে বড় আকারের চিমটার মতো-বাচ্চা বের না হলে ওটা ঢুকিয়ে বাচ্চার মাথা চেপে ধরে বের করে আনা হয়। নাম বলবো না, কিন্তু তিন বছর আগে এক ডাক্তারকে ফোরসেপ ব্যবহার করতে গিয়ে নবজাতকের চাঁদি ছিদ্র করে মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে দেখেছিলাম। বাচ্চাটা সাথে সাথেই মারা গিয়েছিল। ওর লাশটা আর লাশ ছিল না। আসলে যেটা বেরিয়ে এসেছিল, তাকে আর যাই হোক লাশ বলা যায় না। জন্ম হতে যাওয়া নামহীন এক মৃত শিশুর কথা লেখা হয়েছিল ডেথ সার্টিফিকেটে। সেই থেকে এই জিনিস আমি একবারের জন্যেও ব্যবহার করিনি। কিন্তু যে কোনো কারনেই হোক, সেদিন ওটা আমার সাথেই ছিল।
মিস স্ট্যান্সফিল্ডের দেহ ততক্ষণে শক্ত হতে শুরু করেছে। পেট চেপে বসছে-মাংস থেকে পাথরে পরিণত হচ্ছে ধীরে ধীরে। চাপের ফলে নবজাতকের মাথা বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য মাথাটা চোখে পড়ল, রক্তাক্ত, থকথকে জেলির মতো মেখে আছে, কাঁপছে। হ্যাঁ, কাঁপছিল। বুঝলাম, বাচ্চাটা বেঁচে আছে। অন্তত তখনো বেঁচে ছিল।
মেয়েটার পেটটা আবার একটুখানি নরম হয়ে এল। মাথাটা ঢুকে গেল ভেতরে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘ডাক্তার, বলুন কী করতে পারি?’
দেখলাম, মাঝ বয়সি এক নার্স দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি বলতে, এই মহিলারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের পেশার মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। এদের জন্যেই আসলে এই পেশা এতোদিন ধরে টিকে আছে। শ্বাস ফেলতে থাকা অদ্ভুত দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বেচারির মুখ ভয় আতংকে বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে আতিলৌকিক আতংক-সব মিলে মহিলার মুখ দুধের মতো সাদা, ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কিন্তু এসব কিছুর পরেও বুঝতে পারছিলাম, এই মহিলাকে দিয়ে আপাতত কাজ চালানো যাবে।
কাটা কাটা স্বরে বললাম, সম্ভবত এখনো কিছুটা সুযোগ আছে। আপনি আমাকে একটা কম্বল এনে দিতে পারেন। খেয়াল করলাম, মহিলার পেছনে হাসপাতালের প্রায় দুই ডজনের মতো মানুষ সিঁড়ির ওখানটায় দাঁড়িয়ে আছে। কেউই এগিয়ে আসতে চাচ্ছে না। এরা ঠিক কতটুকু দেখেছে? জানার আসলে কোনো উপায় নেই। শুধু জানি, এই ঘটনার পরের অনেকগুলি দিন এরা আমাকে এড়িয়ে গেছে (কেউ কেউ আর কখনোই কথা বলেনি)। আর কেউই, এমনকি এই নার্সও পরে আর কখনো এ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেনি।
যাই হোক, মহিলা ঘুরে হাসপাতালের দিকে পা বাড়াল।
চিৎকার করে বললাম, ‘অত সময় নেই, নার্স। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নিয়ে আসুন। বাচ্চা চলে আসছে।’
মহিলা হাঁটার দিক পাল্টাল। বরফ মোড়া পথে হাঁটতে গিয়ে পিছলে পিছলে যাচ্ছে। এসব দেখে লাভ নেই। আমি মিস স্ট্যান্সফিল্ডের দিকে চোখ ফেরালাম।
গতি কমার বদলে টের পেলাম, লোকোমোটিভ পদ্ধতিতে শ্বাস নেওয়ার গতি বেড়ে গেছে…এবং মেয়েটার দেহ আবারো শক্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পুরো দেহ এক হয়ে নিম্নাঙ্গে চাপ দিচ্ছে। বাচ্চাটার মাথা দেখা গেল আবার। আশা করছিলাম, আবারো ভেতরে ঢুকে যাবে; কিন্তু গেল না। তারমানে, ফোরসেপ দিয়ে টেনে বের করার কোনো দরকার পড়বে না। এ সময় বাচ্চাটা একরকম উড়ে এসে আমার হাতে পড়ল। দেখলাম, ছেলে বাচ্চা হয়েছে-ভুল বোঝার কোনো উপায় নেই। টের পেলাম, নবজাতকের রক্তাক্ত নগ্ন শরীরে ঝির ঝির করে বরফ ঝরে পড়ছে।
নবজাতকের শরীর থেকে বরফ মোড়া অন্ধকার রাত যখন মায়ের দেহের ভেতরের তাপের শেষ অংশটুকুও শুষে নিচ্ছিল, দেখলাম ওর শরীর থেকে বাষ্প বেরিয়ে যাচ্ছে। রক্তাক্ত ছোট ছোট মুঠি দুটো টা টা দেওয়ার ভঙ্গিতে নড়ে উঠল। চিকন সুরে ভেসে এলো প্রথম কান্নার আওয়াজ।
‘নার্স,’ পাগলের মতো চিৎকার করছি, দ্রুত আয়, হারামজাদী! ভাষাটা ভদ্র ছিল না, আমি জানি। কিন্তু সে সময় কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছিল বুঝি ফ্রান্সে ফিরে গেছি। ঝির ঝির শব্দের সাথে একটু পরেই হয়তো মাথার উপর থেকে গোলা উড়ে আসার আওয়াজ ভেসে আসবে, মেশিনগানগুলো গর্জন করে উগরে দেবে জ্বলন্ত আগুন। অন্ধকারের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসবে জার্মান সৈন্যের দল। ছুটতে ছুটতে কেউ কেউ পিছলে পড়ে যাবে, কেউবা গালি দিয়ে উঠবে, আবার কেউ ধোঁয়া আর কাদার মাঝে মরে পড়ে থাকবে চুপচাপ। একের পর এক লাশ আর মানুষের মোচড় খেয়ে আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে মাথার মধ্যে একটা কথাই পাক খেয়ে উঠবে: স্বস্তা জাদু! কিন্তু তুমি একটা কথা খুব সত্যি বলেছিলে স্যান্ড্রা। এই স্বস্তা জাদু ছাড়া আর কিছু আসলে আমাদের নেই। সেই মুহূর্তে আমি সম্ভবত মাথা খারাপের সবচেয়ে কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম।
‘ঈশ্বরের দোহাই লাগে, নার্স!’
বাচ্চাটা আবারো কেঁদে উঠল। চিকন সুরের সেই কান্না হারিয়ে গেল মুহূর্তের মাঝে। তারপর চুপ হয়ে গেল। দেহ থেকে ওঠা বাষ্পের পরিমাণও কমে গেছে। চিকন ফিতের মতো করে বাম্প উঠে যাচ্ছে। ওর মুখের মাঝে আমার মুখ লাগালাম। টের পেলাম, রক্ত আর নাড়ির গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সিপিআর, মানে ওর মুখের মধ্যে বাতাস দিতে লাগলাম। বুঝলাম, ছেলেটা আবারো ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে শুরু করেছে। এতোক্ষণে কম্বল নিয়ে নার্স এসে পৌঁছেছে। কম্বল নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম।
মহিলা আমাকে কম্বলটা দিতে গিয়েও থেমে গেল। ‘ডাক্তার, যদি..যদি এটা আসলে কোনো দানব হয়ে থাকে? তাহলে?’
‘কম্বলটা আমাকে দাও। উঠে এসে পাছায় লাথি মারার আগে ভালোয় ভালোয় কম্বলটা দিয়ে দাও, বলছি।’
মহিলা শান্ত গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, ডাক্তার।’ (মহিলাকে আমাদের আসলে আশির্বাদ করা উচিত। অতশত বোঝার চেষ্টা না করেই এরা আসলে বুঝতে পারে, কখন কী করা উচিত বা উচিত না।) আর আমার দিকে কম্বল বাড়িয়ে দিল। কম্বলে মুড়ে নিয়ে বাচ্চাটা মহিলার হাতে তুলে দিলাম।
‘ওকে যদি ভুলেও ফেলে দাও, তাহলে এই জীবনে আর চাকরি-বাকরি করতে হবে না তোমার।
‘ঠিক আছে, ডাক্তার।‘
‘এর পুরোটাই আসলে স্বস্তা জাদু, বুঝলে? কিন্তু স্রষ্টা আমাদেরকে এছাড়া আর কিছু তো দেয়নি।‘
‘হ্যাঁ।‘
দেখলাম, বাচ্চাটাকে নিয়ে মহিলা আধো দৌড়ে, কিছুটা হেঁটে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ির লোকজন সরে গিয়ে জায়গা করে দিচ্ছে ওর জন্য। এতোক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে থাকা দেহটা থেকে কিছুটা সরে এলাম। তাকিয়ে দেখি, দেহটা এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে, ঠিক বাচ্চাটার মতো নিঃশ্বাসটা কোথাও যেন আটকে যাচ্ছে, তারপর আবারো ঝাঁকি খেয়ে সচল হয়ে উঠছে…থেমে যাচ্ছে কখনো কখনো…তারপর আবার ঝাঁকি…আবারো থেমে যাওয়া…।
পেছনে সরে আসতে শুরু করলাম। কিছু একটায় পা আটকে গেল। ফিরে তাকিয়ে দেখি, বিচ্ছিন্ন মাথাটা পড়ে আছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েও আমার কথামতো কাজ করে যাচ্ছে। এক হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে পড়লাম। মাথাটা ঘুরিয়ে সোজা করে দেখি, চোখ দুটো এখনো খোলা– এই সবুজ-বাদামি চোখ দুটোয় সবসময় অসম্ভব প্রাণ আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ দেখেছি। চোখ দুটোয় তখনো প্রবল দৃঢ়তা ঠিকরে বেরুচ্ছে। ভাইসব, মেয়েটা তখনো আমাকে তাকিয়ে দেখছিল।
দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে, কিন্তু ঠোঁট দুটোর মাঝে একটুখানি ফাঁক দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, লোকোমোটিভ ধাপ মেনে এখনো ওর দাঁত আর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে নিঃশ্বাস ঢুকছে আর বেরুচ্ছে। এ সময় চোখ দুটো একটু ঘুরে গেল; কোটরের কিছুটা বামে সরে এসে আমাকে আরো ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে। ঠোঁট দুটো আবারো নড়ে উঠল, একটুখানি ফাঁকা দেখা গেল ওর মাঝে। ঠোঁট নাড়িয়ে মাথাটা বলল, ‘থ্যাংক ইউ, ডক্টর ম্যাকক্যারন। শব্দগুলো আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। না, মুখ থেকে না। বিশ ফিট দূরে পড়ে থাকা দেহটার শব্দনালীর মাঝ থেকে ভেসে এলো কথাগুলো। কিন্তু শব্দকে আকৃতি দেওয়ার জন্য আমরা যে জিহ্বা, দাঁত এবং ঠোঁট ব্যবহার করি-ওর এসব-ই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আমার সামনে পড়ে ছিল। ফলে শব্দনালী থেকে যেটা ভেসে এল, সেটা অনেকটা আকৃতিহীন দলাপাকানো ধ্বনির মতো বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু ওর শব্দনালী থেকে একটা নয়, বরং সাতটা ধ্বনি পরপর বেরিয়ে এসেছে, এবং বাক্যটাতেও। ঠিক ৭টা সিলেবল-ই ছিল: থ্যাংক-ইউ-ডক-টর-ম্যাক-ক্যা-রন।
‘স্বাগতম, মিস স্ট্যান্সফিল্ড। জবাবে বললাম, ‘আপনার ছেলে বাচ্চা হয়েছে।‘ ঠোঁটদুটো আবারো নড়ে উঠল। পেছন থেকে চিকন, ভুতুড়ে স্বরে ভেসে এল, ‘এলেলেলে—’
তারপর, চোখদুটো থেকে হঠাৎ-ই সমস্ত মনযোগ আর দৃঢ়তা নিভে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল, আমার পেছনে, বহুদূরে কিছুর দিকে বুঝি তাকিয়ে আছে। হয়তো নিকষ আঁধার আর তুষার ছাওয়া আকাশ দেখার চেষ্টা করছিল। পরমুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল চোখদুটো। লোকোমোটিভ শুরু হয়ে গিয়েছিল আবার…কিন্তু এক মুহূর্ত পরে সেটাও থেমে গেল। এতোক্ষণ ধরে যা-ই হচ্ছিল, সেটা শেষ হয়ে গেছে। মহিলা নার্সটা এর কিছুটা দেখতে পেয়েছে, হয়তো সেই অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারও জ্ঞান হারানোর আগে অল্প কিছু দেখতে পেয়েছে। কিন্তু এখন সেটা ফুরিয়ে গেছে। পড়ে আছে কেবল একটা নির্মম দুর্ঘটনার ধ্বংসাবশেষ…আর, হাসপাতালের ভেতরে রয়ে গেছে এক নবজাতক শিশু।
চোখ তুলে হ্যারিয়েট হোয়াইটের ভাস্কর্যটার দিকে তাকালাম। এখনো সেটা ওভাবেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে, পাথুরে চোখে বাগানের মাঝ দিয়ে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে আনমনে। যেন এখানে একটু আগে কিছু ঘটেনি। যেন, এই পৃথিবীতে অমন দৃঢ় প্রত্যয়ের কোনো অর্থ-ই নেই…কিংবা হয়তো আরো খারাপ-হয়তো এ জগতে কেবল এই একটি জিনিসের-ই কিছুটা অর্থ ছিল। সবটুকু দিয়ে কিছুটা পার্থক্য গড়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল নিরর্থক আর সবকিছু থেকে।
যতটুকু মনে পড়ে, ওখানে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলাম। বিচ্ছিন্ন মাথাটার সামনে বসে অসহায়ের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত যখন এক ইন্টার্ন আর দুজন নার্স মিলে আমাকে ধরে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে গেল, মনে আছে, তখনো কাঁদছিলাম।
কখন যেন ম্যাকক্যারনের পাইপ নিভে গেছে।
আমরা সবাই পিনপতন নিরবতার মাঝে স্থির বসেছিলাম। বন্ধু আকৃতির লাইটার বের করে সে পাইপটা আবার ধরিয়ে নিল। মনে হচ্ছিল, বাইরে বুঝি বাতাস মাতম করছে। লাইটার বন্ধ করে রেখে দিতে গিয়ে চোখ তুলে তাকাল। মনে হলো, আমাদেরকে এখনো এখানে বসে থাকতে দেখে কিছুটা চমকে গেছে।
‘শেষ তো। গল্পটা এখানেই শেষ! তোমরা এখন আবার কিসের অপেক্ষা করছ? আগুনের নাচ দেখতে চাচ্ছিলে নাকি?’ নাক দিয়ে ঘোঁত করে উঠল সে, মনে হলো, মনে মনে নিজের সাথে কী এক বোঝাঁপড়া করছে। ‘ওর শেষকৃত্যের সব খরচ আমি নিজের পকেট থেকে দিয়েছিলাম। বুঝতেই পারছ, ওর আর কেউ ছিল না।’ ম্যাকক্যারন একটুখানি হাসল। ‘ওয়েল…আমার নার্স এলা ডেভিডসন অবশ্য ছিল। জোর দিয়ে বলেছিল, এর মাঝে সেও পঁচিশ ডলার দিতে চায়। বেচারির অতটা করার সেরকম সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু সে যখন কিছুতে জোর করে—’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে, শ্রাগ করল সে। তারপর হালকা স্বরে হেসে উঠল।
হঠাৎ করেই টের পেলাম, জোর গলায় জিজ্ঞেস করে বসেছি, ‘আপনি নিশ্চিত, এর পুরোটা কেবল-ই রিফ্লেক্স ছিল না? আপনি একশত ভাগ–’
ম্যাকক্যারন শান্ত গলায় জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত।’ ‘প্রথম কন্ট্রাকশনটা হয়তো রিফ্লেক্সের কারণে হতে পারে। কিন্তু পুরো প্রসব প্রক্রিয়াটা তো আর কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ছিল না। সব কিছু শেষ হতে হতে বেশ কয়েক মিনিট লেগে গেছে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আরো বেশি সময় লাগলে মেয়েটা ততক্ষণ পর্যন্ত-ই টিকে থাকত। আরো বেশি সময় যে লাগেনি, সেজন্য আমি বরং স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দেই।’
জোহানসেন জানতে চাইল, ‘বাচ্চাটার কী হলো?’
পাইপে আরেকটা টান দিল ম্যাকক্যারন। কেউ একজন দত্তক নিয়েছিল। বুঝতেই পারছ, সে সময় এসব দত্তকের রেকর্ডপত্র যথাসম্ভব গোপন রাখা হতো।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু বাচ্চাটার পরে কী হলো?’ জোহানসেন আবারো জিজ্ঞেস করল। ম্যাকক্যারনের হাসি শুনে মনে হলো, ধরা পড়ে গেছে।
‘তুমি সহসা কিছু ছাড়তে চাও না, না?’
এ কথা শুনে জোহানসেন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কেউ কেউ কষ্ট পেতে পেতে এটুকু শিখেই যায়। এখন বলল, বাচ্চাটার কী হলো?
‘ওয়েল, এতোকিছু যেহেতু শুনেই ফেলেছ, তাহলে বলি। বুঝতেই পারছ, বাচ্চাটার কী হলো, এ নিয়ে আমারো অনেক আগ্রহ ছিল। অন্তত আমার সেরকম-ই মনে হয়েছে। এক তরুণ দম্পতি-ওদের নাম হ্যারিসন না হলেও কাছাকাছি কিছু হবে। মেইন শহরে থাকত। নিজেরা বাচ্চা নিতে পারছিল না। তো, ওরা পরে বাচ্চাটাকে দত্তক নিয়েছিল। নাম রেখেছিল…ওয়েল, তোমাদের জন্য জন নামটা চলবে তো? তাহলে ধরে নাও, ওর নাম জন রেখেছিল।’
আরেকবার পাইপে টান দিল সে। কিন্তু পাইপটা আবারো নিভে গেছে। অস্পষ্টভাবে টের পাচ্ছিলাম, স্টিভেন্স আমার পেছনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম, আমাদের কোট এতোক্ষণে প্রস্তুত হয়ে গেছে। উঠলেই ও আমাদের হাতে সেগুলো তুলে দেবে…আর কোট গায়ে চড়িয়ে আমরা আবারো নিজ নিজ জীবনে ফিরে যাব। ম্যাকক্যারন যেমনটা বলছিল আরকি, আগামী এক বছরের জন্য গল্পের আসর এখানেই শেষ।
কিন্তু ম্যাকক্যারন আবারো কথা বলে উঠল, সে রাতে আমি যে বাচ্চাটা ডেলিভারি করিয়েছিলাম, সে এখন এই দেশের সেরা প্রথম দুই থেকে তিনটি কলেজের একটির ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। ওর বয়স পঁয়তাল্লিশও পেরোয়নি। বুঝতেই পারছ, এখনো তরুণ তো, সময় আসেনি। কিন্তু আশা করি একসময় সে ওই স্কুলের প্রেসিডেন্ট হবে। এ নিয়ে আমার আসলে কোনো সন্দেহ নেই। ছেলেটা দারুণ সুদর্শন, অমায়িক এবং বেশ বুদ্ধিমান।
‘একবার এক অজুহাতে ওখানে গিয়েছিলাম। শিক্ষকদের প্রাইভেট ফ্যাকাল্টি ক্লাবে একসঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়া করেছিলাম। আমরা ছিলাম চারজন। আমি সেদিন খুব কমই কথা বলেছি। পুরোটা সময় আমি আসলে ওকে দেখছিলাম। ছেলেটা ঠিক ওর মায়ের মতোই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, বুঝলে…’
‘…এবং ওর চোখদুটো ঠিক ওর মায়ের মতো, সবুজ-বাদামি।’