০২.
উৎসর্গ : পার্থপ্রিয় বসু ও কুশল গুপ্তকে
জলযান
রাতের বেলা আলো ঝলমল স্টীমারঘাটের জেটি আর বার্জ পেরিয়ে একফালি অন্ধকার জলের উপর পাতা তক্তার পোর্টেবল সাঁকো দিয়ে স্টীমারে উঠেই বুঝলাম, এ একটা বিস্ময়কর অচেনা বাড়ি। মোটা তক্তা আর লোহার পাতের মেঝে, রেলিং লাগানো সরু সরু সিঁড়ি, একতলা দোতলার ডেক, কেবিন, তেতলার সারেংসাহেবের ছোট্ট রঙিন চিলেকোঠা, বাটলারদের রসুইখানা, ডাকের সর্টারবাবুর খুপরি, রহস্যময় এঞ্জিনের পাতালঘর, চারদিকে চলে যাওয়া মোটা সরু আঁকাবাঁকা পাইপলাইন, এখানে ওখানে টিমটিমে আলো, দড়ি লাগানো ছোট ছোট ঘণ্টা টিং টিং করে বাজে, একজায়গায় একগাদা টিউবের সঙ্গে লাগানো ঘড়ির মতো নানান গেজ মিটার ইনডিকেটর, এখানে ওখানে বাঁকাচোরা আলো আর আবছায়া, ছোট শতরঞ্জি পেতে টিনের প্যাটরা বা পুঁটুলি মাথার নিচে দিয়ে ঘুমন্ত মানুষ, অন্ধকারে বসে বিড়িফোকা মানুষ, নিবে থাকা অন্ধকার সার্চলাইট, তার কাছাকাছি ঘুমন্ত মুরগির খাঁচা, খালাসিদের ডেরা, দু পাশে নিথর দুই প্রপেলার। এই নিয়ে রাতের থেমে থাকা স্টীমার।
সেই মিটারের ঘড়িগুলোর কাছাকাছি একটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে গোপালমামা আমাদের দুটো ছোট ছোট বিছানা পেতে ফেলল। আমি বসে বসে ঐ অদ্ভুত ঘড়িদের দেখি। তেল, রং, কয়লা, তাপ, উষ্ণ বাষ্প আর পেঁয়াজরসুনের রান্নার ভূগর্ভ গন্ধের সঙ্গে মেশে নদীর সপ্রাণ সজল বাতাসের গন্ধ। সুদূর বাতাসের গন্ধ মাঝে মাঝে সব গন্ধকেই উড়িয়ে নিয়ে যায়।
রাতের তৃতীয় প্রহরে স্টীমারের পাতালঘর থেকে ভুটভাট ঝকঝক হুড়হুড় গুড়গুড় আওয়াজ আসতে লাগল। তক্তার সাঁকো তুলে ফেলা হল। ঘড়ঘড় করে নোঙর ভোলার শব্দ হল। স্টীমার পোতাশ্রয় থেকে বেরিয়ে চলল। এখন বড় নদীতে রাতের অন্ধকারে, খালাসিরা সার্চলাইট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছায়াপথের মতো আলো ফেলে। জলের পোকা স্থলের পোকা উড়ে আসে। দলছাড়া রাতের হাঁস বা ঘুমপাওয়া মেয়েদের ভাঙা ভাঙা গম্ভীর গলার স্বরের মতো মাঝে মাঝে স্টীমারের ভোঁ শোনা যায়।
ভোরবেলা লোকেরা কী ব্যস্ত! তোয়ালে গামছা দাঁতের মাজন নিয়ে কলের কো ভিড় করেছে। আমি রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে নদী দেখি। স্টীমারের সামনে জল ফেনি হয়ে দু ভাগে ভাগ হয়ে পিছনে ছুটে চলেছে। সামনেই পড়ে আছে দৈত্যাকৃতি নোঙর তার ফলায় তখনও নদীর বুকের কাদা। নোঙরের মোটা শিকল পাশেই স্তূপ করা ইতস্তত ছড়ানো চার-পাঁচটা ক্যাপস্ট্যান, তাতে তারের মোটা দড়ি, হেম্পের কাছি জড়ানো, দু পাশে, চাকাঘরের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় প্রপেলার ঘুরছে ঘুরন্ত প্রপেলারের ভিজে ব্রেডে মুহূর্তের জলবিন্দুর সঙ্গে ছেঁড়া শৈবাল, কুচো চিংড়ি উঠে আসছে। একতলায় চলে গেলে সেখানে অনেকখানি জায়গায় মেঝে নেই, সেই বিরাট গর্তে যাতে কেউ পড়ে না যায় তাই চারদিকে রেলিং। রেলিঙে ভর দিয়ে অবাক হয়ে দেখি, নিচের পাতালে বয়লারের গনগনে আগুনে কয়লা দিচ্ছে একজন মাল্লা। আর দৈত্যের চেঁকির মতো তালে তালে উঠছে পড়ছে স্টীম এঞ্জিনের জোড়া জোড়া হাতপা।
বেলা বাড়লে দোতলার রেলিঙের সারি সারি লাইফ বয়ের পাশে দাঁড়িয়ে দেখি রৌদ্রে ঝকঝক করছে নদীজল। পদ্মা মেঘনা- সাদা জল কাজল জল গায়ে গা লাগিয়ে চলেছে। এখন আর ওপার দেখা যায় না। শুশুক ভুস করে লাফিয়ে উঠে কালো পিঠ দেখিয়ে আবার জলে পড়ে।
কীর্তনখোলা-পদ্মা-মেঘনার রাত্রি আর দিনের জলস্রোত পাড়ি দিয়ে স্টীমার যেখানে আমাকে পৌঁছে দিল সেই তিন-দিকে-নদী জায়গাটার নাম চাঁদপুর। চাঁদপুরে দাদামশায়ের একটা অফিস ছিল, সেখানে মাঝে মাঝেই তাঁকে আসতে হয়। এবারে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সন্ধেবেলা চাঁদপুর থেকে আমাদের ট্রেন ছাড়ল। ট্রেনেও দাদুর কাজ থাকে। আমি জানলার পাশে বসে চাঁদনীরাতের আবছা বন, পাহাড়, পতিত জমি, জলজমা খানাখন্দ দেখতে দেখতে চললাম। মাঝে মাঝে ট্রেন আধঘুমন্ত স্টেশন পেরুচ্ছে- লাকশাম, আখাউড়া, কুলাউড়া। পৃথিবী বড় রহস্যময়, অপরিচিত। বালকদেরও রাত্রের ঘুম কেড়ে নেয়।
.
নতুন দেশ
স্টেশনে নেমে দাদুর সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে যেতে যেতে দেখি, এ একটা নতুন দেশ। অল্প কোঁকড়ানো চুলের মতো ঘাসে ঢাকা এখানকার ভূমি একটু ঢেউ খেলানো। মনে হয়, মাটির নিচে পাথর আছে তাই এমন। খুব বেশি গাছে লতায় ঝোপে জায়গাটা জংলা হয়ে যায় নি। বড় বড় গাছের জটলা এবং ছোট ছোট মাঠ বেশ মিলেমিশে থাকায় জায়গাটাকে উপবনের মতো লাগে। বাড়িগুলো একতলা কাঠের ফ্রেম, টিনের চাল আর ইকড়ের বেড়ায় খুব হালকাভাবে তৈরি। ভূমিকম্পে পুকুর যখন বাটিভরতি জলের মতো এদিক ওদিক হতে থাকে তখনও এসব বাড়ির কোনো ক্ষতি হয় না। ইকড় হচ্ছে এক জাতের নলখাগড়া। ইকড়ের বেড়াতে গোবর মাটি বালি সিমেন্টের পলেস্তারা লেপে, খটখটে করে শুকিয়ে নিয়ে চুনকাম করা হয়। অতএব সব বাড়িরই দেয়াল ধবধবে সাদা, দরজা জানলা সিলিং বাদামী আর চাল লাল বা দস্তা রঙের। বৃষ্টির শেষে বিকেলে, ঝকঝকে টিনের উপর শুয়ে, ঝেপে আসা পেয়ারা গাছ থেকে উঁশা পেয়ারাটি তুলে নেওয়া যায়। ভেজা পেয়ারাপাতার ফাঁকে নীল আকাশটি দেখতে দেখতে আনমনে পেয়ারায় কামড় দেওয়া যায়। কোনো কোনো বাড়ি ঘিরে কাঁটামেহেদির ছাঁটা বেড়া– যেগুলো অযত্নে আছাটা সেগুলো আরো সুন্দর, ডাল লম্বা হয়ে ছোট ছোট হালকা বেগুনী ফুল আর গাঢ় কমলা রঙের থোলো থোলো ফলে এদিক ওদিক নুইয়ে পড়েছে। বাড়িগুলো রাস্তার পাশে সার বাঁধা। আমাদের পাড়ায় আবার রাস্তার এক পাড়ে বাড়ি, অন্য পাড় ফাঁকা সেদিকে শিমুল গাছ, মাঠ, পুকুর, আর একটা অদ্ভুত জিনিস- একটা প্রায় একশো ফুট উঁচু লোহার সটান দাঁড়ানো মই। তার দুই পা মাটিতে সিমেন্টে গাঁথা, মাথা তারের শক্ত দড়িতে বেঁধে চারদিকে টার্নবাকল লাগিয়ে টানা দেওয়া। ওটা ওখানে কেন, কি জন্য কে জানে। ঐ লম্বা মইয়ের ওদিকে মুসলমান ছেলেদের মাদ্রাসা। সেখানে জালালি কবুতরদের সাতপুরুষের আড্ডা।
অনেকখানি পাকা রাস্তা, তার পর লাল ল্যাটেরাইট নুড়ির পথে চলে ঘোড়ার গাড়িটা বাড়ির দরজায় এসে থামল। তখনও সকাল শেষ হয়ে যায় নি। পাড়াটা শান্ত। দক্ষিণমুখো এগারোটি সারিবদ্ধ বাড়ির উপর পুবের রোদ্দুর তখনও কোনাচে হয়ে আছে। দাদুর বাড়িটি প্রথম পরিচয়ে বেশ সুশ্রী ও সুখকর। বৈঠকখানাঘর দিয়ে ঢুকেই বড় একটি উঠোন। উঠোনের বাঁ দিকে রান্না ও ভাঁড়ার ঘর, ডান দিকে গোপালমামার ঘর, শেষ প্রান্তে শোবার ও থাকার বড় ঘর। এই আলাদা চারটি ঘরের ফাঁকে ফাঁকে চারটি বাগান। বৈঠকখানাঘরের ডান দিকের ছোট বাগানটা শুধু গোলাপের। সেখানে বড় বড় গোলাপ ফোটে, কিন্তু গাছের এলোমেলো লম্বা ডাল কাঁটায় কাঁটায় আটকে জড়াজড়ি করে থাকার ফলে ঢোকা কঠিন। বাঁ দিকের বাগানে পাতাবাহার, জবা আর স্থলপদ্ম। সে বাগানে নীলুদের বাড়ির ছায়া পড়ে থাকে। গোপালমামার ঘরটি ছোট, কুটির স্টাইলের, বর্ষাকালে তরুলতা বেয়ে উঠে সে কুটির ঢেকে যায়। সেই ঘরেরই ডাইনে বাঁয়ে বাকি দুটো বাগান। ছোট বাগানটার দক্ষিণ দিকে শুধু দোলনচাপার বন। বর্ষায়, যখন বিকেলবেলায় দোলনচাপা ফোটে তখন বাগানে ঢুকলে গাছের পাতায় লেগে থাকা বৃষ্টিজলে গা-মুখ ভিজে যায়। ফুলের মিষ্টি গন্ধ সেখানে ফোঁটা ফোঁটা জলে ভিজে আটকে থাকে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘোরে। কিন্তু ঢুকবে কে সেখানে। হিলহিলে জোকগুলো দ্রুত পাতা বেয়ে বেয়ে এসে শরীরে সেঁটে যায়।
অন্য বাগানটা বেশ বড়। কিন্তু সেখানে একমাত্র শোভা বড় রোয়াল গাছটা। রোয়াল ফল স্তবকে স্তবকে সোনালি হয়ে পেকে যখন ঝুরি নামিয়ে দোলে তখন একটা গাছেই বাগান আলো হয়ে যায়। কিন্তু সে ফল টিয়াও খায় না, বাদুড়ও ছোঁয় না।
বড় ঘরের পিছনে ডোবা। ডোবার পশ্চিমপাড়ের ঢালুতে শীতের সকালে দু-তিনটে টোড়া সাপ রোদ পোহায়। ডোবার গায়ে বিশাল কুল গাছ আকাশ ঢেকে রেখেছে। শীতের সময় প্রচুর কুল ফলে রাত্রে বাদুড় এসে খায়, আর কিছু আমাদের জন্য মাটিতে ঝরিয়ে রেখে যায়। ডোবার অগ্নিকোণে এক বাতাবিলেবুর গাছ। শরতের শুরুতে তার ফুলের গন্ধ সন্ধে থেকে গাছের মাথায় ঘনিয়ে থাকে, যত রাত হয় সেই গন্ধ তত যেন পাখা মেলে। আমি ওদিকে গেলে পাই, আর জোনাকিরা সারা রাত সেই গন্ধ শুঁকে শুঁকে উড়ে বেড়ায়। হেমন্তে বাতাবি এত রসালো হয়ে পেকে ওঠে যে তার নিচের দিকটা একটু ফেটে যায়। আমি দুপুরবেলা গাছে বসে বসে একটা পরিপুষ্ট বাতাবি বেছে নিয়ে সেই ফাটে আঙুল ঢুকিয়ে ছিঁড়ে ফেলতাম। তার পরে একটু একটু করে পুরো বাতাবিটা বিনা নুন-চিনিতেই নিঃশেষে খেয়ে নেমে আসতাম। বাতাবি গাছের পরে বিশাল ঝুপসি একটা আম গাছ। সে আমে বুনো গন্ধ। তার পর পায়খানা। ডোবার ওপারে বাড়ির সীমানায় একটা বড় চালতা গাছ, কলা গাছের ঝাড়। এই হল দাদুর বাড়ি। গোপালমামা খুব পরিচ্ছন্ন করে রাখে। আর দিদিমাও বেঁধেবেড়ে, ভাঁড়ার গুছিয়ে খুব সুশৃঙ্খলভাবে চালান। বাড়িটাকে এবং বাড়ির মধ্যেকার দিদিমাকে আমার ভালো লাগল।
এর মধ্যে পাশের বাড়ির ছেলে দুলালদা এসে হাজির। সে আমাকে নদীর পাড়ে জাহাজঘাটা দেখাতে নিয়ে চলল। নদীতীর পাঁচ মিনিটের পথ। তখন নদী বয়ে চলেছে শান্ত গতিতে, জল মোটামুটি স্বচ্ছ। ওপারে বহুদূরে বরাইল পাহাড় নীল হয়ে আছে। অনেকখানি উন্মুক্ত আকাশ। কে জানত, ঐখানে সেদিন থেকে একটু একটু করে আট বছরের মনখারাপ, মনভালো জমা রেখে আসব। এ জন্মের আটটা বছর অন্তত একটা জায়গায় থেকে গেল।
.
দিদিমা
কলতলায় চৌবাচ্চাভরা টলটলে জল ধরা ছিল। স্নান করে খেয়েদেয়ে দিদিমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। বিকেলে দু-একজন প্রতিবেশিনী এসে গল্প করে গেলেন। সন্ধে হল। লোক নেই, হৈ চৈ নেই। রাত্রে খেতে বসে বুঝলাম দিদিমার রান্নার স্বাদ খুব ভালো। এবং আরও একটা কথা: আমি তখনও বেশ ছোট, কারণ বড়দের জলের গ্লাস ধরতে গিয়ে কিছুতেই এক হাতে বেড় পাচ্ছি না।
দু দিন পরে দাদু ট্যুরে গেলেন। বাড়িতে শুধু দিদিমা আর আমি আর গোপালমামা। একরাত্রে দিগন্তে বোধিসত্ত্বের স্বপ্নে দেখা হাতির দাঁতের মতো চাঁদ উঠল। বারান্দায় শুয়ে দিদিমা একটা অদ্ভুত গল্প বললেন–
“এখানে পাহাড়-বন থেকে বিশাল বিশাল গাছ কেটে, তাদের মোটা মোটা গুঁড়িতে নম্বর দেগে নদীপথে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এই নদীতে জোয়ারভাটা নেই- জলস্রোত শুধু একদিকে চলে। অতএব সেই কাঠ কুমিরের মতো, ঘড়িয়ালের মতো মাইলের পর মাইল ভাসতে ভাসতে আসে। এইভাবে নদীপথে কাঠ পাঠানোয় খরচ প্রায় নেই ট্রেনের মাশুল, লরি ভাড়া কিছুই লাগে না। শুধু যেখানে ভাসানো হয় সেখানে পোষা হাতিরা আছে, তারা ঐ ভারী গুঁড়িগুলোকে শুড়ে করে তুলে নিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। আবার যে ঘাটে নদী থেকে কাঠ তোলা হবে সেখানেও হাতিরা আছে তারা জলে নেমে গিয়ে শুড়ে পেঁচিয়ে খুঁড়িগুলো উপরে তুলে আনে। আমাদের এই জাহাজঘাটাতেও প্রত্যেক বছর হাতিরা নদী থেকে কাঠ তোলে।
তখন আমি বউমানুষ। উনি বদলি হয়ে এখানে এসেছেন। তখনকার কথা। একদিন তিন-চারটে হাতি নদী থেকে কাঠ তুলছিল। এ দিকের পাড়টা তো অতখানি উঁচু, শীতের সময় জল আরও নিচে নেমে গেছে। পাড়ের মাটি নরম, জলের কিনারায় তলতলে কাদা। ধাপ কেটে কেটে দেওয়া হয়েছে। হাতিরা ভারী শরীর নিয়ে সাবধানে নামছে, কাঠের গুঁড়ি নিয়ে আরও সাবধানে উঠে আসছে। সারা দিন এইভাবে তারা খাটছিল- খাটতে খাটতে বোধ হয় হাঁপিয়ে পড়েছিল, তাই বিকেলের দিকে একটু অসাবধান হয়ে গেছে। একটা হাতি শুড় বাড়িয়ে কাঠ জড়িয়ে ধরতে জলে একটু নিচে নেমে এসেছে। তার হাঁটু পর্যন্ত তলতলে কাদায় ডুবে গেছে। হঠাৎ সে উঠতে গিয়ে দেখল, পা তুলতে পারছে না। সে যত চেষ্টা করে পা তত ডুবে যায়। কিছুক্ষণ পরে সে যেন বুঝতে পারল, কী ঘটতে যাচ্ছে- সে পাগলের মতো উঠতে চেষ্টা করল। সে যতই দাপাদাপি করছে ততই ডুবে যাচ্ছে। এইভাবে তার চারটে পা-ই পুরো কাদায় ঢুকে গিয়ে পেটও এসে কাদায় ঠেকল। হাতিটা এখন আর নড়তে পারছে না। তখন সন্ধে পেরিয়ে গেছে। তার মাহুত কাছে দাঁড়িয়ে শুড়ে হাত বুলিয়ে দিল। কলা গাছ টুকরো করে, ছাতু গুড় তাল পাকিয়ে খাওয়াল। অন্য হাতিরা উপরে দাঁড়িয়ে ছিল, মাহুতেরা তাদের ফিরিয়ে নিয়ে। চলে গেল। অনেকক্ষণ পরে তার মাহুতও চলে গেল। সে, কাদায় চার পা গাঁথা, জলের মধ্যে পেট নিয়ে রাত্রির মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল।
পরদিন ভোরে মাহুতেরা এবং হাতির মালিক মোটা শিকল নিয়ে এল। সারা দিন ধরে সেই ডোবা হাতিকে শিকলে বেঁধে অন্য হাতি দিয়ে টেনে তোলার চেষ্টা হল। চারটে ট্রাক নিয়ে এল, মোটা কাছি নিয়ে এল। কিছুতেই কিছু হল না। সারা শহরের লোক দেখতে এল নদীর পাড়ে। আবার বিকেল হল। সেদিন হাতিকে খাওয়ানো গেল। সে তার মরণকে দেখতে পেয়েছে। টানাহ্যাঁচড়ায় ওঠা দূরে থাক, তার পেটের খানিকটা সেদিন কাদায় ডুবে গেছে। রাত্রে সবাই বাড়ি ফিরে গেল। হাতি একলা নদীতে দাঁড়িয়ে ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল। পাড়ার লোকেরা বিছানায় শুয়ে শুনতে পেল। পরদিন হাতি আরও ডুবে গেল। সে নিজের শরীরের ভারেই এখন ডুবছে। সেদিনও সে কিছুই খেল না। পরদিন থেকে তার দুই ছোট ছোট চোখে সমানে জল গড়াচ্ছে নিঃশব্দ কান্না। সে আর চিৎকার করছে না। সে বুঝতে পেরেছে। লোকেরা এসে দেখে দেখে যাচ্ছে। আমরাও দেখতে গেলাম। সেই সন্ধেবেলায় সে অস্পষ্ট হয়ে গেছে তার পিঠ জলে ডুবে গেছে। ক্রমশ তার চোখসমেত, বিশাল কানসমেত মাথাটি ডুবে যাবে। সবাই বলছে, সে শুড় ভাসিয়ে রাখবে, তার পর দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। সে রাত্রে মাহুত আর বাড়ি ফিরল না, নদীপাড়েই বসে রইল। সারা রাত নাকি হাতি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখবে বনের স্বপ্ন, বাচ্চা বয়সের স্বপ্ন, মৃত্যুর পর সে যেখানে যাবে সেখানকার স্বপ্ন।
শীতের ভোর হল। নদীতে কুয়াশা। মাহুত চাদর মুড়ি দিয়ে বসেছিল। এইবার ওর চোখ জলে ডুবে যাবে। এক চা-বাগিচার সাহেবের কাছে খবর গেছে। সে এসে পর পর কপালে দুটো গুলি করে হাতিটাকে মেরে ফেলল। পাঁচ দিন হাতিটা ঐখানে দাঁড়িয়েছিল। তার পরও তার শরীর ডুবে যেতে লাগল।”
গল্প শেষ হলে আমি চুপ করে রইলাম। আমার মনে হল, এত বছর ধরে হাতিটা ডুবে চলেছে। এখনও ডুবছে– তার বিরাট কঙ্কাল সাদা হয়ে নিচে নামছে। শেষে, পৃথিবীর মাঝখানে গিয়ে আটকাবে, রত্নের মতো জ্বলজ্বল করবে।
দিদিমাকে দেখে সাধারণ মনে হলেও তিনি মোটেই তা নন। তিনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, প্রচুর খাটেন, রাত্রে গভীর ঘুমে তাঁর নাক ডাকে, কিন্তু ছোট ছোট মায়োপিক চোখে সব দিকে দৃষ্টি রাখেন। সংসারটা তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র, আত্মম্ভরিতার বিচরণভূমিও বটে।
দিদিমা শ্যামলা, মধ্যউচ্চ, মোটাসোটা, পদস্থ চাকুরের স্ত্রী। দাদু থেকে শুরু করে দিদিমার বাড়িতে সবাই মাঝারি উচ্চতার এতে তাঁর কর্তৃত্বের সুবিধা হয়েছিল। ছেলেমেয়ে বা কর্তা লম্বাচওড়া হলে কি হত বলা যায় না।
দিদিমা বাংলা ভাষাটা অত্যন্ত ভালো জানতেন। প্রবাসী, ভারতবর্ষের গ্রাহক ছিলেন। মেঘনাদবধ কাব্য, রৈবতক, বৃত্রসংহার তার মুখস্থ। দুপুরে শুয়ে শুয়ে চোখ বুজে আবৃত্তি করতেন–
কি কহিলি, বাসন্তি? পর্বত-গৃহ ছাড়ি
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
দানবনন্দিনী আমি; রক্ষঃ-কুল-বধ;
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,
আমি কি ডরাই, সখি, ভিখারী রাঘবে?
পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভুজ-বলে,
দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমণি?
এই আবৃত্তির উচ্চাবচ স্বর যেতে যেতে তৃতীয় সর্গের অনেক ভিতরে চলে যেত। মনে হত, স্বয়ং মাইকেল বা দানবরমণীরাই বুঝি তাঁকে ভর করেছে।
দিদিমা গিন্নীদের সাধারণ সাজের সঙ্গে, আরামের জন্য, রোদচশমা আর ভেলভেটের নাগরা পরতেন। কয়লার গুঁড়ো অনেক জমে গেলে গোপালমামা মাঠ থেকে গোবর কুড়িয়ে এনে পাহাড় করত। সকালের চা-জলখাবার খেয়ে দিদিমা তাঁর রোদচশমা আর নাগরা পরে কাজে লাগতেন। গোপালমামা কোদাল চালিয়ে কয়লার গুঁড়ো, মাটি, গোবর একত্র করে মাখত। দিদিমা হাতে নাচিয়ে নাচিয়ে গোল করে সারা উঠোন ভরে গুল দিতেন। শীতের টনটনে রোদে বিকেলবেলা অথবা পরের দিন সব শুকিয়ে যেত। গোবরের ক্ষারে আর কয়লা-মাটির ঘষায় দিদিমার সোনার চুড়ির গোছা স্নানের পরে ঝিকমিক করত।
এইভাবে যা সাশ্রয় হত অন্যভাবে তা আবার খরচ হয়ে যেত। বিজয়ার রাতে সব বাড়িতেই নারকেলের মিষ্টি আর নাড়ু দিত। দিদিমার বন্দোবস্ত অন্য রকম। দশমীর রাত্রে উঠোনে একটি জোরালো বাতি জ্বালানো হত। সেখানে পাশাপাশি দুটো বিশাল পিতলের গামলায় কানায় কানায় ভরা রসগোল্লা আর পানতুয়া। ঐখান থেকেই প্লেটে করে গৃহতদের দেওয়া হত। সাদা ফেনি বাতাসার ধামার মতো শুক্লা চাঁদ তাড়াতাড়িই মধ্যগগনে ওঠে সেই চাঁদ আর তার নিচে সাদা কালো মিঠাই ভরতি দুটি গোল গামলা একটি জ্যামিতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করত।
খাওয়া এবং খাওয়ানোর দিকে দিদিমার একটা ঝোঁক ছিল। দাদু নিয়মিত ট্যুরে যেতেন। আর ট্যুরে গেলে দিদিমার ফরমাস অনুযায়ী নানা জায়গা থেকে উৎকৃষ্ট খাদ্যগুলি কিছু কিছু নিয়ে আসতেন। শীতের দিনে দু-তিন হাঁড়ি পাতক্ষীর, খোয়াক্ষীর, কলসিভরা নলেন গুড়, ছাতকের কমলালেবু, গ্রীষ্মের দিনে গোয়ালন্দের বিশাল তরমুজ, বর্ষায় জলঢুবের আনারস। দাদু পেটরোগা, মাসিমা মামা খেতে চায় না। সুতরাং এই খাদ্যসম্ভারকে সম্ভাষণ জানাতে বাকি থাকছি শুধু দিদিমা আর আমি।
পুনশ্চ: কিছু দিন গেলে বাড়িটা শোলক-বলা কাজলাদিদির মতো আর তেমন শান্ত মধুর থাকল না। মাসিমা শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এল। মামা অন্যত্র পড়ত, বছর দেড়েক পরে সেও ফিরে এসে ক্লাস টেনে ভরতি হল। দুই আপন ছেলেমেয়েকে কাছে পাওয়া দিদিমাকে নিয়ে বাড়িটা এবার পালটাতে শুরু করল।
.
উপত্যকা
উপত্যকাটিকে কাছে দূরে ঘিরে আছে টিলা বন চা-বাগান। সেইসব বনে শেয়াল বেজি উল্লুক বাঁদরদের সঙ্গে হাতি বাঘ ভাল্লুক ময়ালও ছিল।
ময়ালের একটা গল্প শুনতাম। দূরের এক জংলা গায়ের স্কুলে একটি দুষ্টু বালককে মাস্টারমশাই ছুটির পরে পাশের ঘরে আটকে রেখেছিলেন। কিছুক্ষণ পরে ছেলেটা পরিত্রাহি চেঁচাতে শুরু করল আমারে সাপে ধরিল, সাপে ধরিল। আমারে খাই ফেলিল। ছুটির পরে তখন স্কুলে কেউ নেই। মাস্টারমশাই ভাবছেন, শয়তান ছেলেটা দুষ্টুমি করে চেঁচাচ্ছে। খানিক পরে চেঁচামেচি বন্ধ হল। বাড়ি ফেরার আগে মাস্টারমশাই পাশের ঘরের দরজা খুলে দেখেন– ছেলেটা নেই, তার বদলে বিরাট এক ময়াল পেট ফুলিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে।
এবার আমার স্বচক্ষে দেখা ময়ালের গল্পটি বলছি। একদিন দুজন লোক বনের মধ্যে দেখতে পেল একটা ময়াল নিথর হয়ে পড়ে আছে। সে মাঝারি মাপের একটা হরিণ গিলে এখন আর নড়তে পারছে না। লোকদুটো বেতের ফাস গলায় পরিয়ে তাকে টানতে টানতে নিয়ে এসেছে কাছারিতে, সবাইকে দেখাবে।
আমরা টিফিনের সময় গিয়ে দেখি, বারো ফুটের মতো লম্বা পাইথনের মাঝখানটা অস্বাভাবিক ফোলা, স্পষ্ট বোঝা যায়, হরিণের আস্ত শরীরটা ঐখানেই লম্বা হয়ে আছে। সাপের মাথাটা ছোট। কিন্তু জীবজন্তু গেলবার সময় চোয়াল বড় হয়ে ফাঁক হয়ে যায়। তার চোখ দুটো কড়ির মতো, নিশ্চল। কষ থেকে রক্ত ঝরছে। অত দূর থেকে বেতের ফাস গলায় দিয়ে তাকে টানতে টানতে আনা হয়েছে। তার হাড়গুলো নিশ্চয় এতক্ষণে খুলে গেছে। ঐ লোক দুটি কয়েকটা টাকা বকশিশ পাবে, আর তার চমৎকার চামড়াখানা কমিশনার সাহেবের বাংলোর দেয়ালে অমর হয়ে থাকবে।
একবার শীতের সময়ে বনের লোকেরা একজোড়া বাঘ মেরে দেখাতে নিয়ে এল। শীতের সকালটি বেশ ঠাণ্ডা- তারা পাড়ায় পাড়ায় বাঘ দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। দুটি বাঘই মাঝারি মাপের, মুখ দেখে মনে হয় কমবয়সী, বেশ মোটাসোটা, বলিষ্ঠ চারটি থাবা, হলদে না হয়ে বরং সাদার দিকে রং। বোধ হয় দুই ভাই।
শহর থেকে ট্রেনে গিয়ে, তার পরেও খানিকটা হেঁটে ঘাঘরা ফলস। শীতের দিনে আমরা সেখানে বনভোজনে যেতাম। ছোট একটি স্রোতস্বতীর মতো চওড়া ঝরনা। শ্যাওলায় পিছল মস্ত মস্ত পাথরের উপর দিয়ে জলধারা শব্দ করে ফেনায় ভেঙে বয়ে চলেছে। আমরা অতি সাবধানে পা টিপে টিপে ওপারে যাই। সেখানে ঝরনার কিনারা থেকে দশ পনেরো ফুট দূরেই টিলা সেখানে শীতের ম্রিয়মাণ বন, নলখাগড়া, সরু বাঁশের ঝাড় উপরে উঠে গেছে। বাতাস ঝিরঝির করে বইছে। ঝরনার পাড় শক্ত হলে কি হবে, টিলার গোড়ার মাটি ভেজা ভেজা, নরম। কিছু দূর গিয়ে সেই ঘাসহীন নরম মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গেল। আমরা খুব সোরগোল করলাম যাতে বাঘ দূরে থাকে। খেয়েদেয়ে, বিকেলের রোদ পড়ে যাবার আগেই ফেরার পথ ধরা হল। পিছনে ফিরে দেখি, টিলার মাথায় গাছপালায় শীতবিকেলের রোদ, চারদিক কী চুপচাপ, ঘাঘরার জলের মৃদু ঝরঝর শব্দ। এই রকম সময়ে কোথাও চলে যেতে, কিছু ছেড়ে যেতে মনে কেমন যেন কষ্ট হয়।
মাঘ ফাল্গুনে, নদীর ভাটিতে কখনো কখনো দুধপাতিলের দিকে গিয়েছি। সেখানে টিলা আর গাঁ মিলেমিশে অসংগত কিন্তু বেশ মজার উঁচুনিচু তৈরি করেছে যেন পাশাপাশি তিনতলা চারতলা দোতলা পাঁচতলা। সরু পথের এক দিকে গাছপালা নিয়ে টিলা উপরের দিকে উঠেছে, আর অন্য দিকে চোখের সামনে হঠাৎ অনেক নিচে নেমে মেটে ঘরের বাঁকাতেড়া আঙিনা। পাখির চোখে দেখা যাচ্ছে, কোথাও এতটুকু স্যাঁতসেঁতেভাব নেই, শীতের মিষ্টি রোদে পেকে বাড়িটাও যেন মিষ্টি হয়ে আছে। সরু পথের এ মোড়ে সে মোড়ে বুনো কুলের ছোট্ট গাছ ভরে কুল পেকেছে। খাবার কেউ নেই। পথের পাশের বড় বড় ঘাসের গোছা এখন বাদামী হয়ে আছে। কয়েক মাস পরে বর্ষায় আবার সবুজ হবে।
কাঠলিছড়া চা-বাগান অনেক দূরে। চুয়ামাসিমার স্বামী সেখানে বাগানের ডাক্তার। সেখানে অনেকগুলো ছড়া বা অগভীর জলস্রোত আছে। কতগুলোতে শুধু পায়ের পাতা ডোবে, কতগুলোতে জল গুলফ পর্যন্ত, কতগুলোতে হাঁটু পর্যন্ত। গাছের ছায়ার তলায় তলায় লাল নুড়ির পথে বয়ে চলেছে এই জলের ধারা।
কাঠলিছড়ায় গিয়ে আমি আর সুনু জায়গাটা একটু দেখেশুনে বেড়াচ্ছিলাম। পথে ঐ রকম হাত দুয়েক চওড়া, মাত্র পায়ের পাতা ডোবা একটা ছড়া পড়ল। এবার একটা মজার ঘটনা ঘটল যেই আমরা ঐ ছড়ায় দুই পা দিয়েছি অমনি দুজনেই জলের মধ্যে পপাত। ঐটুকু তো জল, স্বচ্ছ কাঁচের পাতের মতো তিরতির করে বইছে, দেখে কিছু বোঝা যায় না তার স্রোতের শক্তি। জল তো নয়, যেন পালিশ শানে সিল্কের কাপড় পাতা- যেই পা দিয়েছি, হুস করে কেউ সেটা আচমকা টেনে নিল।
পরের দিন রাতে সূচীভেদ্য অন্ধকারে আমরা যখন গাড়ি করে ফিরছি হঠাৎ একটা জায়গায় তীব্র পচা গন্ধ পাওয়া গেল। হরেশঠাকুর চেঁচিয়ে উঠলেন টাইগার! টাইগার! খানিকক্ষণ পরে দেখি, সেই ঘন অন্ধকারে একটি লোক, এক হাতে একটি সরু লাঠি, অন্য হাতে লণ্ঠন, হনহন করে চলেছে। সে জায়গাটায় এত পুঞ্জ পুঞ্জ জোনাকি যে মনে হয় লোকটি যেন জোনাকির ঢেউয়ের মধ্যে ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে চলেছে।
ঈশান না বায়ু, কোন কোণ থেকে হাওয়া আসত জানি না। বর্ষা সমাগমের আগে কদিন ধরে বিকেলে পশ্চিম দিগন্তে ঘন নীল মেঘ ওঠে। হু হু করে তারা আকাশ ছেয়ে দেয়। সেই কালো মেঘের ভাঁজে ভাঁজে নিঃশব্দ বিদ্যুৎ ম্যাগনিসিয়াম তারের মতো জ্বলে। আমি ছুটে এসে আমাদের রাস্তার শেষে দাঁড়াই। মুসলমান হস্টেলের সামনে, মাঠের পাশে এই জায়গাটায় ভাবা যায় না হাওয়ার কী জোর! আমি ধুতিটি পতাকার মতো ওড়াই। পতপত ফতফত করে পুরো ধুতিটা বাতাসের টানে উড়ে যেতে চায়। আমি এদিক ওদিক ঘুরে কাপড় ওড়াই। আমার অসম্ভব আনন্দ হয়। অনেককাল পরে অবহট্ঠ কবিতায় পড়ি–
সো মহ কন্তা
দূর দিগন্তা।
পাউস আএ
চেলু দুলাএ।
প্রাবৃষ আসছে, কাপড় ওড়ানো হবে। হাজার বছর আগে আমারই মতো কেউ ছিল, যে পাউস এলে চেলু দোলাত।
.
নরসিংহ স্কুল
আমি অসময়ে এসেছি। তখন গভর্নমেন্ট স্কুলে ছাত্র ভরতি শেষ। সুতরাং এ বছরটার জন্যে গরিব মলিন চেহারার নরসিংহ হাই স্কুলে ভরতি হতে হল।
বাড়ি থেকে ইস্কুল তিন মিনিটের পথ। তারকাঁটা ও জংলা ঝোপে ঘেরা বেশ বড়সড় একটা অযত্নের কম্পাউন্ড। একটা ধ্যাধধেড়ে লোহার ফটক। বিবর্ণ লাল রঙের টিনের চাল ও নিচু মেঝের তিন সারি লম্বা বাড়ি। এই বাড়িগুলোকে পাটিশনে ভাগ করে করে অজস্র খোলামেলা ক্লাসঘর, হেডমাস্টারের ঘর, অফিস, লাইব্রেরি করা হয়েছে। ব্যাপারটা খুব সাদামাটা, অথচ কোথাও কোনো অভাব বা অসুবিধে নেই। স্কুলের তিন দিকে রাস্তা একদিকে রাস্তার ওপারে সাহেবদের ক্লাব, অন্যদিকের পথটা খুব নিরিবিলি, বড় বড় গাছে ছায়া করা, সেই গাছের ফাঁকে দেখা যায় ট্রেজারি বন্দুকধারী গোখা সৈন্যেরা দিনরাত পাহারা দেয়। আরেকটা পথ শহরের খেলার মাঠ হয়ে স্টেশনের দিকে গেছে।
হেডমাস্টারমশাইয়ের কালো-সাদা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, পরনে গলার বোতাম বন্ধ সাদা টুইলের শার্ট আর ধুতি। কাঁচের আলমারিতে অনেক ইংরেজি বই, কিছু দেয়াল ম্যাপ এবং বিরাট একটি গ্লোবে সাজানো তাঁর কামরাটি বেশ সম্ভ্রম উদ্রেককারী।
ক্লাস থ্রিতে সবাই নতুন ছেলে। মাস্টারমশাই রেজিস্টারে আমার নাম তুলে রোল নম্বর বলে দিলেন। কড়া মাস্টারমশায়রা, যাঁরা ছেলেদের আপন হতে চান না, নাম ধরে না ডেকে রোল নম্বর ধরে সম্বোধন করেন। এই প্রথম আমি সমবয়সী অচেনা বালকসমাজের সামনে একা। যতই বিবর্ণ হোক, আমি টের পাচ্ছিলাম, এই হল সেই প্রতিষ্ঠান যেখানে খাতাপত্রে আমার নাম বয়েস ইহজন্মের মতো তোলা হয়ে গেল। আমি গুটি গুটি গিয়ে শেষ বেঞ্চে রোগা, কালো, হাফপ্যান্ট হাফশার্ট পরা একটা ছেলেকে পছন্দ করে তার পাশে বসে পড়লাম।
নরসিংহ স্কুলে আমার কোনো অসুবিধে হল না। এখানে সাজপোশাকের পূর্ণ নৈরাজ্য। বেশির ভাগ ছেলেই মধ্যবিত্ত বা গরিব পরিবারের। তারা হাফপ্যান্ট বা ধুতি এমনকি (মুসলমান হলে) লুঙ্গির উপরে শার্ট পরে, খালি পায়ে স্কুলে আসে। এই যদৃচ্ছ চলাফেরা আমার পক্ষে সুবিধাজনক হল। প্রথমদিকে একটু ব্যবধান ছিল ভাষার। এরা সব কাছাড়ি সিলেটি বলে, আর আমি বরিশালি ছাড়া কিছু জানি না। আমি বুঝেছিলাম এক্ষেত্রে গোঁয়ারতুমি করলে চলবে না। অতএব অবিলম্বে আমি স্থানীয় ভাষা শিখে নিলাম। এমনই শিখলাম যে বাড়িতেও খুলনাইয়া দাদু-দিদিমার সঙ্গে সেই ভাষায় কথা বলি।
.
টমাস
প্রথম দিনই বেছে নিয়ে যে রোগা কালোকোলো ছেলেটার পাশে গিয়ে বসেছিলাম তার নাম টমাস। টমাস সাজপোশাকে একেবারেই দলছাড়া। তার খাকি হাফপ্যান্টের মধ্যে গোঁজা সাদা হাফশার্ট। পায়ে কালো মোজা, কালো নটি বয় জুতো, মাথায় একটি খাকি রঙের সোলা টুপি। তার পাতলা চুল পরিপাটি আঁচড়ানো। গলায় কালো কারে লটকানো একটি রুপোর ক্রস। সে ব্যাগে ভরে বই আনে। সে যেন একটি খ্রীষ্টান নীলমণি, তার মা যশোদা তাকে সাজিয়েগুজিয়ে আদর করে স্কুলের গোঠে পাঠিয়েছে। টমাসের পাশে বসে মহানন্দ দাস। তার বিশাল দেহ, মালকোঁচা মেরে ধুতি পরা, গায়ে ছিটের হাফশার্ট, খালি পা। কে বলবে সেও টমাসের মতোই খ্রীষ্টান। শহর ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে একই টিলার উপরে তাদের দুজনেরই বাড়ি। মহানন্দ কি তবে বলরামের অবতার?
কপটী কানাই ঐ টমাস একদিন আমাকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে বিপদে ফেলল।
চাঁদপুর থেকে ট্রেনে খানিকটা এগোবার পরই নিসর্গ পালটে যেতে থাকে- পথের ধুলোয় রং লাগে, মাটি থেকে হঠাৎ পাথরের ঢেউ, পাথরের চাতাল উঁকি দেয়, মাইলের পর মাইল পৃথিবী জনহীন হয়ে আছে। পুববাংলার নদীতীরের দিগন্তলীন ধান বা পাট খেতের নিরবচ্ছিন্ন নীলাভ সবুজ এখন ক্রমশ বাদামীহলদে, ছোপ ধোপ সবুজ বা ছাড়া ছাড়া ধূসর। কোথাও কোথাও খাদে জল চলে যাবার দাগ, কোথাও জল আটকে আছে নিচু জমিতে। ঠকঠক ঠকঠক শব্দ করে ট্রেন যায় যেতে যেতে দেখি, বেত মুলিবাঁশ আর লতার নিচ্ছিদ্র জঙ্গলে আবার ঢেকে গেল পাহাড়ের সানু এবং পাদমূল। চাঁদপুর থেকে আখাউড়া হয়ে মাছিমপুর পর্যন্ত কেবল এই অতুলনীয় নীরব সৌন্দর্য।
বনপাহাড়ের সৌন্দর্য যে এমন হয় আমার জানা ছিল না। সেই তৃষ্ণা মনে লেগেই ছিল। কথায় কথায় টমাস তা বুঝতে পেরে আমাকে লোভ দেখাল সে জানাল, তার বাড়ি শহর ছাড়িয়ে আরও মাইল দুয়েক দূরে ছোট একটা টিলার উপর। শহরের সঙ্গে সঙ্গে পাকা রাস্তাও শেষ, কিন্তু তার পরেও কাঁচা রাস্তা রয়েছে বনের মধ্য দিয়ে। সেই বুনো পথ দিয়ে সে রোজ স্কুলে আসে, ফিরে যায়। টমাস তার মতো করে বর্ণনা দিলেও আমি আমার মতো করে সেই পথ যেন দেখতে পেলাম। ঠিক হল, শনিবারে আমরা একসঙ্গে ঐ পথে তাদের বাড়ি যাব।
শনিবারে আধ ঘণ্টার মতো হাঁটার পর দেখলাম শহরের সীমা শেষ হল, আর সেই একই রাস্তা ধীরে ধীরে চলল ছাড়া ছাড়া পল্লী, ছোট ছোট মাঠ আর বনের গা ঘেঁষে। বিকেলের সূর্যের আলো এসে পড়েছে বনের নানারকম গাছের নানারকম পাতার গায়ে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে টমাসের সঙ্গে চললাম। কোথায় রাস্তা বাঁক নিয়েছে, কখন রাস্তা দু ভাগ হয়ে গেল, কখন রাস্তা বনের মধ্যে ঢুকল এসব কিছুই খেয়াল করলাম না। পথটি সম্পূর্ণ জনহীন। মানুষ তো নেইই, বরং টমাসের সোলার হ্যাট, টাই, গ্যালেস লাগানো প্যান্ট দেখতে যে দু-চারটে কাঠবেরালি ছুটে এসেছিল তারাও মুহূর্তমধ্যে অন্য গাছে লুকিয়ে পড়ল। ঝোপেঝাড়ে কিছু কিছু পাখি ছিল বটে, কিন্তু তারাও উদাসীন, নিজেদের মধ্যে শিস দেওয়া ডাকাডাকি করা ছাড়া অন্য কিছুতে তাদের মন নেই।
টমাসের বাড়ি পৌঁছতে বিকেল হল। জায়গাটা সত্যি অন্য রকম। টিলার উপরে পাশাপাশি তিনটি বাড়ি কাঠের ফ্রেমে ইকড়ের হালকা বেড়া, নতুন লাল রং করা করুগেটেড শিটের চাল। টিলার গোড়া থেকে ধাপ কেটে কেটে বাড়ির চাতাল পর্যন্ত আনা হয়েছে।
টমাস আমাকে অপেক্ষা করতে বলে লাফিয়ে উঠে গিয়ে বাড়ির মধ্যে মিলিয়ে গেল। আমি টিলার নিচে দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। দু-চারটে মুরগি এদিক ওদিক চরে বেড়াচ্ছে। বিকেল স্লান হয়ে আসছে। টমাসের ফিরে আসার নাম নেই। অচেনা খ্রীষ্টান পল্লী। কোথাও কোনো লোকজন নেই, সাড়াশব্দ নেই। টমাসের নাম ধরে ডাকাডাকি করতে আমার সংকোচ হল। নেমতন্ন রাখা হল, এখন তাহলে মানে মানে ফিরে যাই। এমন সময় পাশের বাড়িটি থেকে মহানন্দের হাসিহাসি মুখ দেখা গেল। এ কি চেনা দেওয়ার হাসি, না কি ধরে ফেলার হাসি! আমি আর না তাকিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। বনের মধ্যে দ্রুত ছায়া পড়ে আসছে। আকাশে তখনো বিকেলের আলো, কিন্তু বনের মধ্যে সন্ধ্যা নামল। ঘোর অন্ধকার হবার আগে বনের মধ্য থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। এমন সময় দেখি রাস্তা তিন ভাগে ভাগ হয়ে তিন দিকে চলে গেছে। আমি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, কোন্ রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম। একটা রাস্তা তো নিশ্চয় গেছে আমাদের শহরের দিকে। বাকি দুটো কোথায় গেছে? লুসাই পাহাড়ের দিকে? লংগাই নদীর পাড়ে? চা-বাগানের দিকে? না কি অন্য কোথাও? আমার মাথা গুলিয়ে গেল। বুক ধকধক করতে লাগল। আমি কোনো বিচার না করে অন্ধের মতো একেবারে ডান দিকের রাস্তাটা ধরলাম। মনে একটা সূক্ষ্ম হিসেব ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে যদি আমাদের শহরের কোনো চিহ্ন না দেখি তো আবার ফিরে এসে বাকি দুটোয় চেষ্টা করব।
তখন পথে ভালো রকম অন্ধকার নেমে এসেছে। কিছুদূর যাবার পর পথ আবার দু ভাগে ভাগ হল, আমি আবার ডান দিকের রাস্তা ধরলাম। আমার কান্না পেল আমাকে বোধ হয় ডান দিকের ভূতে পেয়েছে। কতক্ষণ হেঁটেছি জানি না। একসময়ে দেখি বনের বাইরে বেরিয়ে এসেছি। মাথার উপর তারাদের মধ্যে যেন ঝড় বইছে। আমি টমাসের বিশ্বাসঘাতকতা ভুলে, বাড়িতে লাঞ্ছনার কথা ভুলে, রাতের অন্ধকার ভুলে হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎই একটা ছবি মনে পড়ল, এক নতুন দেশে একটা একা কুকুর রাত্রে, শীতে, ন্যাংটো দৌড়ে চলেছে- সেটলমেন্টে ঢুকতে না পেরে তার চোখ পরের দিন দুপুর থেকে বিষণ্ণ উগ্র পিঙ্গল।
যা হোক, ঘুরপথে ঘুরে ঘুরে নাজেহাল হয়ে আমি সেই রাত্রেই বাড়ি ফিরেছিলাম।
সোমবার স্কুলে যথারীতি টমাসের সঙ্গে দেখা। তার নিষ্পাপ মুখে কোথাও কোনো নষ্টামির চিহ্ন নেই। আমার ইচ্ছে করছিল খ্রীষ্টানটার টাই ধরে এক হ্যাঁচকা টানে মাটিতে শুইয়ে ফেলি। কিন্তু আমি ওর দিকে দৃষ্টিপাতও করলাম না, এবং আশ্চর্য, সেও আমার দিকে তাকাল না। ক্রমশ আমার মনে সন্দেহ হতে লাগল, টমাস কি সত্যিই ঐ বাড়িটাতে বাস করত? সেখানে কি সত্যিসত্যিই ওর মা বাবা আছেন? কিন্তু সেদিনের ব্যাপারটা কোনো ভুতুড়ে ঘটনা নয়। মহানন্দ সাক্ষী।
.
গ্রীষ্মের ছুটির আগের দিন
যেহেতু জায়গাটা উপত্যকা অতএব গ্রীষ্ম বর্ষা শীত এই তিনটে ঋতুই এখানে খুব প্রবল। ঐ তীব্র ঋতুগুলির ফাঁকে স্নিগ্ধ, বিধুর, মধুর হয়ে দেখা দিত গৌণ ঋতু শরৎ হেমন্ত বসন্ত। মাথার উপর খোলা আকাশ, কাছে নদী, অনতিদূরে বনাকীর্ণ টিলা তবু সারাটা গ্রীষ্ম জুড়ে ভ্যাপসা গরম। ক্লাসে ক্লাসে কয়েকদিন টানা পাংখা চলবার পর, এক মাসেরও বেশি সময়ের জন্য গ্রীষ্মের ছুটি হত। ছুটির আগের দিন আমার এক মধুর অভিজ্ঞতা হল। সেদিন ভোরের স্কুল পড়াশোনা নেই, শুধু হাজিরা দেওয়া আর হৈ-হুঁল্লোড় করে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ছুটি হয়ে যাওয়া। স্কুলে পৌঁছে দেখি, ক্লাসঘরগুলো এবং বাইরের টানা বারান্দা ও গেট রঙিন কাগজের শিকলি আর নিশান দিয়ে উৎসবের সাজে সাজানো। বিদায়ের দিনে দরজায় দরজায় ওয়েলকাম, স্বাগতম নানা ছাঁদে নানা রঙে লিখে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। সব ক্লাসেই কয়েকজন উৎসাহী ছেলে থাকে খুব ভোরে এসে তারাই এসব করেছে। আমি ছাড়া, সবাই এসেছে কিছু কিছু নিয়ে ফুলের মালা, বিস্কুটের মালা, রঙিন কাগজের মালা, ফুলের তোড়া, ফুলসুদ্ধ ভাঙা ডাল। সারা শহরের বাগান আজ কুসুমশূন্য। নিচু ক্লাসের মাস্টারমশাইরা তাঁদের একটি-দুটি অপোগশু সন্তানকেও আজ নিয়ে এসেছেন। ক্লাসে ঢুকে তাদের টেবিলের উপর বসিয়ে দিয়ে নিজে চেয়ারে বসলেন। বাচ্চাদের মায়েরা আজ ভোরে তাদের কাজল পরিয়ে, চুলটুল আঁচড়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। এতক্ষণে সে কাজল চোখে গালে লেপটালেপটি। কেউ জামাপ্যান্টের বোতাম খুলে ভুঁড়িটি, নুনুটি বার করে বসে আছে, কারো দুধদাঁত পড়ে যাওয়া মুখে অনাবিল খুশির হাসি। ছেলেরা তাদের অভ্যর্থনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আড়াল থেকে নানাবিধ লোভনীয় বস্তু দেখিয়ে উচাটন করে তুলল। মাস্টারমশাই আজ দেখেও দেখছেন না। নাম ডাকা হয়ে গেলে এক একজন করে ছাত্র গিয়ে মাস্টারমশাইকে মালা পরায়, নমস্কার করে, আর বাকিরা তুমুল শব্দে হাততালি দেয়। জবাফুলের মালা, হলুদ ঘণ্টাফুলের মালা, আকন্দফুলের মালা ছেলেদের হাতে গাঁথা এই মালাগুলোর কোনো ছিরিছাঁদ না থাকলেও হর্ষে, হাততালিতে ও আসন্ন ছুটির বিভায় দৃশ্যগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু বিস্কুটের মালাগুলো ফুলমালার মতো তত অবিমিশ্র আধ্যাত্মিক নয় বলেই হয়তো সেগুলো পরাবার সময় আমাদের সরল দরিদ্র মাস্টারমশাইদের মুখে স্পষ্ট খুশির হাসি দেখতে পেলাম। টেবিলে বসা শিশুরা এবার চঞ্চল হয়ে হাত বাড়ায়, আর সারা ক্লাসে তুমুল করতালি। আজ এসব কথা মনে পড়লে মন ছলছলিয়ে ওঠে।
ওরই মধ্যে দপ্তরীর হাতে নোটিস আসত: স্কুল অমুক তারিখ থেকে তমুক তারিখ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে এবং অমুক তারিখে পুনরায় খুলবে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে হিসেব করলাম, এক মাসের উপর আর কদিন ফাউ হল। এর পর স্যারের কিছু মামুলি উপদেশ হল। ভোরের আমেজ কেটে গিয়ে গরম টের পাওয়া যাচ্ছে, রোদ ক্রমশ কড়া হয়ে উঠছে। স্যাব তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অর্থাৎ ছুটি হয়ে গেল। কেউ একজন চকের টুকরো কুড়িয়ে বোর্ডে লিখল: 9.7. 1933– আবার দেখা হইবে। চলে যাবার মুহূর্তে এই ‘আবার দেখা হইবে!’ বালকদের মায়ামমতাহীন পা যেন ছুটির দেশে ঢুকবার মুখে হালকা একটু থতমত খেল!
.
গভর্নমেন্ট স্কুল
কিন্তু মলিন টানা পাংখা এবং সস্তা কাঠের বেঞ্চ-হাইবেঞ্চের নিরপরাধ স্কুলটি ছেড়ে পরের বছরই আমি গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে গিয়ে ভরতি হলাম। এ স্কুলের চাকচিক্যই আলাদা। এখানে ঝকঝকে কাঁচের বড় বড় দরজা, জানলা, উঁচু ছাদ থেকে ইলেকট্রিক পাখা ঝুলছে। প্রত্যেকের ডেসকের দোয়াতে দপ্তরী নিয়ম করে ঘন কালি দিয়ে যায়। মুসলমান টিচাররা থ্রী পিস স্যুট পরে স্কুলে আসেন। হেডমাস্টারমশাইয়ের ট্রাউজার্স ও গলাবন্ধ কোট।
এই স্কুলে আমার সাতটি বছর, অর্থাৎ পুরো কৈশোর কাটল। কিন্তু এই বিদ্যালয় কতটুকু জড়িয়ে আছে আমার জীবনের সঙ্গে? এতগুলো সহপাঠীর একজনও আমার চিরজীবনের সখা হল না। শিক্ষকদের কারো সঙ্গে আমার আচার্য-শিষ্যের বন্ধন হল না। স্কুলের টুর্নামেন্টে কোনোদিন খেলতে গেলাম না, স্কুল লাইব্রেরি থেকে বই ধার নিলাম না, প্রত্যেক বছর লাল রিবনে বাঁধা যে তাড়াতাড়া বই ভালো ছেলেরা প্রাইজ পেত তার এক-আধখানাও কোনোদিন কপালে জুটল না। ছাত্র হিসেবে পুরনো রেকর্ডে আমার নাম থাকার কথা। ঐটুকু ছাড়া অত বড় স্কুল কমপ্লেক্সে কোনো ডেসকে, কোনো দেয়ালের কোনায় বা কারো মনে আমার কোনো চিহ্ন নেই।
শুধু স্কুলে কেন, ঐ শহরেও আমাকে কারো মনে নেই। খুব দুর্বৃত্ত বা খুব ভালো না হলে কেউ মনে রাখে না।
ঐ উপত্যকার সঙ্গে যে আমার বন্ধন হল না তার আসল কারণ এখন বুঝি আমি ওখানে ছিলাম পরবাসী, পরভৃত। আর সেদিক থেকে, এই জীবনের শেষে, মনে হয়, এই পৃথিবীতেই আমি পরবাসী এবং পরভৃত।
তবু পাশে বসা ছেলেদের সঙ্গে ঐ বয়সে একরকম আলগা বন্ধুত্ব হবেই। কিছুদিন আমার এ পাশে দেবব্রত পুরকায়স্থ আর ও পাশে সুশান্ত দাস বসেছিল। ফরসা, লম্বা, পলকা দেবব্রত ধুতি আর শার্ট পরে আসত। তার নীল চোখের দৃষ্টি ঐ বয়সেই কৃপালু আর নির্লিপ্ত। সে রোজ সকালবেলায় খবরের কাগজ পড়ে। সুশান্তর চোখদুটো কাঁচের গুলির মতো গোল, তার ক্ষিপ্র শরীর এখনি যেন একটা কোন্দল বাঁধাবার জন্য তৈরি। সুশান্ত কালো হাফপ্যান্টের সঙ্গে হলদে পাঞ্জাবি পরে। দেবব্রতর হাত ছিল ভিজে ভিজে, হিমশীতল। সুশান্তর আঙুল আস্ত সুপুরির মতো শক্ত।
মণিপুরী এবং তোখা ছেলেরা সাধারণত একটু বেশি বয়সে পড়তে আসত। তাছাড়া ছাত্রবৃত্তি পাশ করে, নর্মাল স্কুলে না গিয়ে যারা এখানে ক্লাস ফাইভে এসে ভরতি হত তাদের গোঁফের রেখা তখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রসন্নও ছাত্রবৃত্তি পাশ করে এসেছিল। ময়লা গায়ের রং, ময়লা ধুতি, নীল ডোরা শার্ট, জবজবে করে মাথায় তেল মাখা প্রসন্ন মুখে মুখে সব অঙ্ক কষে ফেলত। বাংলাতেও সে দারুণ। কিন্তু ইংরেজি কিচ্ছু জানে না। লতা যেমন আকর্ষী পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গাছকে বেঁধে বেঁধে গভীর বনে ঢোকে, লেখাপড়ার অধ্যবসায়ে সেও সেই রকম। কেন জানি না, তার অর্ধেক বয়সী আমাকে সে গুরু বানাল। সে খেলতে যায় না, টিফিনে ডেক ছেড়ে ওঠে না। সারা দিন সে ইংরেজি হাতের লেখা লেখে, শব্দার্থ মুখস্থ করে, আমাকে ধরে ছোট ছোট বাক্য বানাতে শেখে। দূরের কোনো গ্রাম থেকে সে আসে। বোধ হয় সে রাত জাগে- নিশি পোয়ানো লণ্ঠনের চিমনির মতো তার চোখের তলায় কালি। পরীক্ষার পরে দেখা গেল ইংরেজিতে সে আমাদের সমান সমান হয়ে গেছে।
আর এক সহপাঠী নৃপেন্দ্রকুমার চক্রবর্তীকে আমি একদিন নতুন ভূমিকায় আবিষ্কার করলাম। সেদিন দিদিমা শনিপুজোর জোগাড় করেছেন। সন্ধের পর অন্ধকারে নৃপেন গুটি গুটি একেবারে নতুন বেশে ভোল পালটে এসে উপস্থিত। জানা গেল সে এই বাড়ির ক্রিয়াকর্মের পুরুত রামমণি ঠাকুরমশাইয়ের ভাইপো। জ্যাঠামশাই আসতে পারেন নি বলে ভাইপো এসেছে। নৃপেন খাটো করে ধুতি পরেছে, খালি গায়ে পাতলা উড়ুনি, মোটা একগোছা সাদা পইতে যেন ইচ্ছাকৃতভাবে পরিস্ফুট। সে আমার দিকে ঘেঁষলই না। ঘটির জলে হাতপা ধুয়ে, কাঁধের গামছায় পরিপাটি করে মুছে সে বেশ জুত করে আসনে বসল। দিদিমা সব এগিয়ে দিতে লাগলেন- সে ঘণ্টা বাজাল, পুজো করল, সংস্কৃতে মন্ত্র পড়ল, শনির পাঁচালি পড়ল। অবশেষে গামছায় চালকলা বেঁধে, তাঁকে দক্ষিণা গুঁজে উঠে দাঁড়ালে দিদিমা মাসিমা ভক্তিভরে তাকে প্রণাম করলেন। আমি বাক্যহীন হয়ে শুধু ব্যাপারটা দেখছি। এইবার আমার পালা। দিদিমা বললেন প্রণাম কর, ঠাকুরমশাইকে প্রণাম কর। আমি বললাম- আরে তোমরা কি পাগল হলে? নৃপেনকে প্রণাম করছ! ও তো আমাদের ক্লাসের ছেলে। দিদিমা বললেন- তা হোক, প্রণাম কর। নৃপেন বলল- থাক থাক।
মণিপুরী ছেলে জগৎ সিং, পুরো নাম জগৎমোহন সিংহ, ছিল আমাদের ক্লাস সিক্সের ফার্স্ট বয়। জগৎ বসত ক্লাসের প্রথম সীটটিতে। আমি কেউ নই, জগৎ আমার বন্ধুও না, তবু কিছুদিন জাতের পাশের সীটে বসেছিলাম। জগতের ষোল-সতেরো বছর বয়স, রং কালো, ভরন্ত চেহারা, গলায় তুলসীর মালা, নির্বিরোধী শান্ত স্বভাব। আমি হয়তো শান্তির ও লেখাপড়ায় উন্নতির আশায় জগতের পাশে বসতাম। জগৎ ধুতি আর টুইলের সাদা শার্ট পরে আসত। ঐ একটিই তার জামা। রবিবারে কাঁচত সোমবারে জামাটি বেশ পরিষ্কার ও প্রফুল্ল থাকত, বুধবার থেকে ক্রমশ ময়লা হত, ঘামের হলদে দাগ লাগত। শনিবারে জামাটা একেবারে মলিন। জগতের গায়ে বুধবার থেকে শনিবার পর্যন্ত কেমন ডালভাতের গন্ধ। নিরামিষাশী জগতের ব্যক্তিত্বে ঐ গন্ধ একটা চরিত্র দিত।
জগৎ চিরদিন ফার্স্ট বয় থাকতে পারে নি। ক্লাস এইটে আবুবক্কর তার জায়গাটি কেড়ে নিল। আবু ছিল যত্নশীল, সন্দেহপরায়ণ এবং ছদ্মবেশী। আবুর পোশাক, লুঙ্গি, পাজামা, শার্ট যাই হোক ছিল অতি পরিচ্ছন্ন, যেন সূর্যকরে ধৌত, উপরন্তু সে সর্বদা মাথায় পরত একটি মলমলের টুপি। শুক্রবার দুপুরের নমাজ সেরে আবু আসত বিধর্মী সহপাঠীদের জন্য এক নিস্তব্ধ অবহেলা নিয়ে।
এতদিনে আবু নিশ্চয় বাংলাদেশে গিয়ে একটা কেউকেটা হয়েছে। আর জগৎ? সে বোধ হয় সেই নদী উপত্যকার কোনো গ্রামে বাংলার মাস্টার হয়ে তার শান্ত জীবন কাটিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য পুরুষের ভাগ্য কে বলতে পারে। হতে পারে আবুবক্কর নাসায় বিজ্ঞানী, আর বিয়ে করে জগৎ জলঢুবে আনারস বাগানের মালিক।
আবুল কালাম ছিল নরম স্বভাবের ছেলে। স্পষ্ট অক্ষরে সে আলাদা আলাদা খাতায় প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে লিখে রাখত। পরীক্ষার আগে আমি তার ইংরেজি আর ইতিহাসের খাতা বাড়িতে এনে টুকে নিই। টুকতে ঢুকতে আমার হাতের লেখা আবুলের লেখার ছাদ ধরল। আবুলের ফরসা সুকুমার চেহারা। ধুতি আর শার্টের সঙ্গে সে কালো লোমশ একটি আস্ট্রাখান টুপি পরে আসত।
কামালের মুখে সব সময় পেঁয়াজরসুনের বিজাতীয় গন্ধ, কিন্তু সে ছিল সবচেয়ে কম মুসলমান। কামাল আমারই বয়সী, আমারই মতো হাফপ্যান্ট আর হাফশার্ট পরা, আমারই মতো পড়াশোনায় খারাপ। কামালের বাবা অবাঙালি, মা বাঙালি। সেন্ট্রাল রোডে ওদের বেকারি ছিল। একটা ট্যাক্সিও ছিল ওদের। একই জায়গায় দোকান, বেকারি, গ্যারাজ এবং সংসার। বেশ ম্লেচ্ছ এবং আধুনিক ধরনের জীবন ছিল ওদের।
আরেকজন ছেলে, ধনেশ্বর পরিধা, যেন অজ্ঞাতবাসে থেকে থেকে হঠাৎ একদিন এসে হাজির– তার সঙ্গে ক্লাসের অন্য ছেলেদের স্বভাবচরিত্রের কোনো মিল নেই। তার বাবা প্লান্টারদের ক্লাবের কেয়ারটেকার বা গ্লামার বা ককটেল তৈরির ওস্তাদ কিছু একটা হবেন। বিশাল চেহারার এলোমেলো ধনেশ্বর যেন পথ ভুলে ইস্কুলে এসে পড়েছে। এখানে তার মন বসা অসম্ভব। এক-আধ ঘন্টা ক্লাসে ঘোরাঘুরি করে সে ক্লাবে চলে যায়। সাহেবরা যা যা খায় তাই খায়। মাঝে মাঝে ইস্কুলে একগাদা পুরনো টেনিস বল, পোলোর বল নিয়ে আসে। কিছুদিন পরে আর সে এল না।
এই উপাস্ত্য ছেলেদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল শ্ৰেণীসচেতন উন্নতিশীল বাড়ির সন্তানেরা। উকিল, পুলিশকর্তা, অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন, আন্দামানের কাঠব্যবসায়ী, ওষুধের দোকানী, সরকারি কর্মচারী, চা-বাগানের অংশীদার, অর্থকরী আরও অন্যান্য পেশার মানুষদের প্রতিপাল্য কিশোরগণ সবাই প্রায় এক রকম। তারা সাপনালার জলের ধারে বা গাছের নিচে আড্ডা দেয়, সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে গড়িমসি করে, রেস্তরায় খায়, ফ্যাশনেবল মেয়েদের দেখে আঁকুবাঁকু করে, তাদের বাড়ির কাছে দাঁড়ায় বা না থাকতে পেরে শেষে চিঠি দেয়। ঐ দুই ধরনের ছেলেদের কোনো দলেই আমি ছিলাম না। আমার না ছিল আত্মবিশ্বাস, না অঢেল পয়সা।
.
শিববাড়ি
মধুরবন্ধ, ফাটকবাজারের দিক থেকে বাঁক নিয়ে জাহাজঘাটায় বরাক উত্তর বাহিনী হয়ে চলে গেছে তার পর আর তাকে স্পষ্ট দেখি না, মনে হয় বুঝি উঁচু পাড় ও গাছপালার আড়ালে বাঁ দিকে ঘুরল সে। আসলে সে সেখান থেকে গেছে মধুরামুখ, দুধপাতিলের দিকে।
জাহাজঘাটে দাঁড়িয়ে ভাটির দিকে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়ে বহু দূরে আকাশে লম্বা হয়ে অর্ধোঙ্খিত ভেসে আছে বরাইল পাহাড়। সারা বছর সেই পাহাড় তার আকাশপটের সঙ্গে রং মিলিয়ে ধূসর আর বামন হয়ে মিশে থাকে। কিন্তু বর্ষাকালে সাত দিন দশ দিন চোদ্দ দিনের অঝোর বৃষ্টির পরে ক্ষান্তবৰ্ষণ কোনো বিকেলে দেখি, পাহাড় যেন উঠে বসেছে, তার গায়ের রোম অপরাজিতার মতো নীল, আমাদের অনেক কাছে চলে এসেছে। সে, বর্ষায় তার বুকের যে জায়গাটা অনেকখানি পাথর-জঙ্গল সমেত ধসে গেছে সেখানে দেখা যায় মাটির নরম বাদামী রং। পাহাড়ের ঘাড়ে গলায় যে মেঘ ঘন হয়ে জমে আছে সেই নতুন মেঘের রং আর ঐ বুকভাঙা আনকোরা মাটির রং এত দূর থেকে প্রায় একই রকম দেখায়।
ঐ উত্তর দিকে, শহর শেষ হবার পরেও মাইল তিনেক রাস্তা হাঁটলে শিববাড়ি। আর্যপট্টি পেরিয়ে ল্যাটেরাইট নুড়ির রক্তাভ রাস্তা ক্রমশ ধূসর ধুলোর পথ হয়ে গেছে। ঝোঁপঝাড় নির্জনতা পার্শ্ববর্তী প্রাচীন আম বট অশ্বত্থ গাছ রাস্তার উপর এসে পড়েছে। বুনো আকন্দ আর পাহাড়ী ধুতরোর ঝোঁপ ঘন হয়ে বন হয়েছে তার তলায় কীটপতঙ্গগুলো সবাই অল্পবিস্তর নেশাড়। যেতে যেতে হাঁটু পর্যন্ত পা যখন ধুলোর রেণুতে ভরে গেছে, জলতেষ্টা পেয়েছে, তখন দেখতাম সেই পায়ে চলা পথ ঢুকে গেছে শিববাড়ির হাতায়।
অনেকখানি জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা নিয়ে শিববাড়ি। মন্দিরহীন, মার্জনাহীন, শ্রীহীন এক বন্য দেবালয়। এলোমেলো গাছপালার মধ্যে একটি ছোট পুকুর, তার অনতিদূরে উদম খোলা একটা বড় চালাঘর। সেই চালার এক প্রান্তে একটু খুপরিমতো করা, সেখানে কষ্টিপাথরের এক বিশাল শিবলিঙ্গ, বাকি জায়গাটায় এখানে ওখানে নির্বাপিত, প্রায়নির্বাপিত দু-তিনটে ধুনি। দড়িতে কালো কর্কশ কম্বল, এক-আধখানা সাদা বা গেরুয়া ছেঁড়া কাপড় আর কপনির ফালি ঝুলছে। খুঁটির পেরেকে টাঙানো রয়েছে দরিয়ার নারকেলের ভিক্ষাপাত্র আর মোষের শিঙের শিঙা। আর কোনো তৈজসপত্র নেই।
মাটির মেঝেয় সরু চাটাই পেতে দিনের বেলাতেও আধশোয়া হয়ে ঝিমোয় দু একজন রুক্ষ চেহারার বলিষ্ঠ লোক। ঝাঁকড়া চুল আর ঝুপসি দাড়িতে তাদের মাথাগুলো বিরাট। তাদের পরনে শুধু একফালি কৌপীন, কেউ কেউ আবার ধুনির ছাই মেখে ধূসর হয়ে বসে আছে। এরাই শিববাড়ির সাধু। আমার মনে হত এরাই শিবের চেলা, অনুচর, দ্বারপাল, দেহরক্ষী– হয়তো এমন হতে পারে, কৈলাস থেকে ডাক এলে এরা কাউকে না বলে-কয়ে একদিন সেখানে চলে যাবে। পাথরের নিস্তব্ধ শিবলিঙ্গটি ছাড়া আর সবই যেন আজ আছে, কাল থাকবে না- ক্ষণস্থায়ী, তবু কোথাও তাদের ছটফটানি নেই।
এই সাধুরা সবাই পশ্চিমা, হিন্দিভাষী। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন খুব বলিষ্ঠ। দু মাসে হয়তো এক দিন তিনি ভিক্ষে নিতে আসতেন আমাদের পাড়ায়। বিকেলবেলায় যখন ছায়া হেলে পড়েছে তখন উঠোনে এসে এক বার সজোরে শিঙায় ফুঁ দিতেন। মুখে কোনো কথা নেই, ভিক্ষে নিয়ে নীরবে চলে যেতেন।
যে চার-পাঁচজন সাধু শিববাড়িতে থাকতেন ভাও গিরি ছিলেন তাঁদের প্রধান। ভাও গিরি কদাচিৎ পাড়ায় এলেও বাড়িতে ঢুকতেন না। আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তার ধারের শিমুল গাছটার নিচে তার বেঁটে কাঠের আসার উপর শরীরের ভর রেখে বসতেন। শিথিল একটা হাসি মুখে লেগে থাকত। তাঁর শরীরে কোথাও যেন কোনো জোড় নেই, অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লিগামেন্টের বাঁধন নেই, হাওয়া পড়ে গেলে গাছের মর্মর যেমন নিস্তেজ হয়ে যায় তাঁর স্বর ও কথা বলার ভঙ্গি সেই রকম আড়োআড়ো ছাড়োছাড়ো।
ভাও গিরি ছিলেন অতি রূপবান ও সুগঠন পুরুষ। ধুনির তাপ, কঠোর জীবন ও মধ্যবয়স তাঁর সোনার মতো দেহবর্ণকে সামান্য ম্লান করেছে। তার পাতলা দাড়ি, মাথার লম্বা জটা, ঈষৎ ঢুলুঢুলু চোখ, প্রাণসার শরীর আমি খুব নিরীক্ষণ করে দেখতাম। ভাও গিরির মধ্যে একটা ভাব খুব স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠত, সে ভাব নির্ভেজাল বৈরাগ্যের। ভাও গিরি গাঁজাটাজা খেতেন নিশ্চয়। কে জানে, হয়তো তারই ফল এই সর্বাঙ্গীণ নিরাসক্তি। আজও ভাও গিরিকে ভাবলে আমার নন্দলালের শিবের কথা মনে আসে না, মনে পড়ে প্রমোদ চট্টোপাধ্যায়ের শিব।
ভিক্ষা দেবার ভার আমার উপর ছিল বলে সাধু, বৈষ্ণব, ভিখিরিদের সঙ্গে আমার একটু চিন-পরিচয় ছিল। আমি শিববাড়ির সেই চালাঘরে ঢুকলে সাধুরা ভ্রূক্ষেপ করতেন না ধুনির পাশে বৃহৎ এক একটা কাঠের গুঁড়ির মতোই অচঞ্চল পড়ে থাকতেন। আসলে ঐ সাধুদের চেয়ে শিববাড়ি এবং পথের নির্জনতা আমার অনেক বেশি ভালো লাগত। দিন দিন মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যত অসহজ হচ্ছিল আমার কল্পনাও ততই দিবাস্বপ্নের মধ্যে প্রবেশ করছিল। এইভাবে, লোকালয় থেকে অনেক দূরে এক সমাজপরিত্যক্ত শিববাড়ি, এক নিভে যাওয়া যজ্ঞকুণ্ড এবং নিজেকে নিয়ে ইচ্ছাপূরণের এক অধজগৎ তৈরি হল। আর, এরই ফলে সেখানে আমি একদিন পাশুপত অস্ত্র পেলাম।
একদিন শিববাড়ির উদাসীরা বহুকাল ঔদাসীন্যে আচ্ছন্ন থাকার পর যেন কোনো স্পৃহায় চঞ্চল হয়ে উঠল। শোনা গেল শিববাড়িতে বিরাট যজ্ঞ হবে। কিভাবে কি হল কে জানে। দেখা গেল কাশী থেকে জটাজুটধারী রামায়ণের মুনিঋষিদের একটি দল শিববাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। তাঁরা হিন্দি আর সংস্কৃত ছাড়া অন্য ভাষায় বাক্যালাপ করেন না। ঘি মাখানো ডালরুটি ছাড়া কিছু খান না। ন্যাংটো ছোট ছেলেদের মা ঠাকুমা যেমন আদর করে নানারকম ঘুনসি পরিয়ে দেয় কারো ঘুনসিতে একটা ফুটো পয়সা, কারো ঘুনসিতে একটা ছ্যাদা কড়ি, কারো ঘুনসি লাল, কারো কালো, কারো ঘুনসিতে রঙিন পুঁতি, কারো বা জালের কাঠি– এই সাধুদেরও দেখছি সেই রকম- কারো কোমরে সরু বেতের চিরস্থায়ী ডোর, কারো ডোর গাছের ছালের আঁশ থেকে বুননো, কারো বা ডোর সাদামাটা কাপড়ের। এসব ডোর কি গুরু তাঁদের আদর করে পরিয়ে দিয়েছেন, না কি নিজেরাই যে যেমন পারেন কোমরে বেঁধে নিয়েছেন।
শূন্যের মধ্যে যজ্ঞের আগুন অদৃশ্য হয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশলাই নয়, চকমকি নয়, এই মুনিঋষিরা যজ্ঞকুণ্ডে বেল আর ডুমুর কাঠ সাজিয়ে কাঠে কাঠে ঘষে সেই আগুনকে ধরে আনলেন। এই একটি অদ্ভুত কর্মেই শহরবাসীর তাক লেগে গেল।
শিববাড়ির সাধুরা ভিক্ষে করে খায় অথচ যজ্ঞে মন মন ঘি পোড়ানো হল। কেউ কেউ বলল, এরও দরকার আছে। যজ্ঞের ধোঁয়া আকাশে উঠে পৃথিবীকে পবিত্র করে, পাপ নাশ করে, মেঘ তৈরি করে বৃষ্টি ঝরায়। কিন্তু চেরাপুঞ্জির প্রতিবেশী আমাদের এই শহরে কি আরও বৃষ্টির দরকার ছিল?
যজ্ঞ শেষ হলে সবাই চলে গেল। শিববাড়ি আবার ঘুমিয়ে পড়ল। এখন, যখন সেখানে যাই দেখি যজ্ঞকুণ্ডের তলদেশ পুরু ধূসর শান্ত ছাইয়ে ঢেকে আছে। একদিন বিকেলে আমি সেই চৌকো গর্তে নেমে পড়লাম। আমার কি জানি কেন বিশ্বাস হয়েছিল সেই যজ্ঞে তৈরি হয়েছে কোনো অলৌকিক অস্ত্র এখন সেটি গুপ্তধনের মতো লুকিয়ে আছে ঐ ছাইয়ের নিচে। হাঁসের পায়ের মতো আমার পাতলা পায়ের পাতার নিচে যজ্ঞের ছাই কতকালের ঠাণ্ডা আর নরম। ছাই ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে লাগলাম, কোথায় সেই পাশুপত অস্ত্র। খুঁজে খুঁজে এক হাত পুরু ছাই উলটেপালটে সত্যিই অবশেষে পাওয়া গেল এক অদ্ভুতদর্শন দশ ইঞ্চি লম্বা ছোরা। তার ফলা বাঁট সমস্তটাই আস্ত একখণ্ড কাঁচের তেড়াবাঁকা, সুতীক্ষ যজ্ঞের ঘন ঘোর আগুনে গলে গলে তৈরি হয়েছে- যজ্ঞের আগুনেরই মতো রং, শুধু খাঁজকাটা বাঁটের দিকটা একটু নীলচে। আমি ছোরাটা কোমরের বেটে গুঁজে যজ্ঞকুণ্ড থেকে উঠে এলাম। এখন এটা আমার।
শিববাড়ি থেকে বাড়ি ফেরার পথে সবুজ আগাছাভরা মাঠ, কিছুটা জঙ্গল। সমস্তটাই বড় নির্জন। হঠাৎ কি খেয়াল হল– আমি ছোরাটাকে ফলার দিকে দু আঙুলে ধরে আকাশের মধ্যে ছুঁড়ে দিলাম। আশ্চর্য ব্যাপার আমি স্পষ্ট দেখলাম, আকাশে উঠে সেটা ময়ূরের মতো নীল সবুজ হলদে পেখম মেলে খানিকক্ষণ ভাসল, ভেসে ভেসে চক্কর মারল। তার পর হঠাৎ ডানা মুড়ে সোঁ করে যেন উড়ে গিয়ে বিধল একটা গাছের গুঁড়িতে। দৌড়ে গিয়ে দেখি, ছোরার প্রায় অর্ধেকটাই বিধে গেছে সেই গাছে। আর গাছের বাকল গরুর গায়ের চামড়ার মতো কেঁপে কেঁপে শিউরে উঠছে। আমার হাতে এ অস্ত্র এল কি পৃথিবীর রাজ্য জয় করবার জন্যে? ইস্কুলে, খেলার মাঠে, বাজারে দুষ্টের দমনের জন্যে?
আমি ভাবতে ভাবতে চলেছি, আর আমার পায়ের তলায় পৃথিবীটা যেন অলক্ষ্যে সংকুচিত হয়ে ছোট হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে তার বর্তুলতা স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি যেন এক বিশাল মাঠের উঁচু ঢেউয়ের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি একটা আকাশে ওঠা গম্বুজের একটা ভাসমান ফানুসের একটা দশ নম্বরী বলের একটা মার্বেলের একটা কুঁচবিচির শেষে শূন্যকশার উপর দাঁড়িয়ে ভেসে চলেছি। তখন বিকেলও পড়ন্ত দশদিকে অসীম শূন্যের মধ্যে কোথায় পৃথিবী! কোথায় আমাদের বাড়ি, গাছপালা, রাস্তা, বরাক নদী! শূন্যের মধ্যে সমুদ্রের মতো গেরুয়া আলোয় যেন জোয়ার। রক্তবর্ণ সম্পূর্ণ সূর্য নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। কিন্তু অস্তে নামার কোনো পাট নেই। আমি নিজের দিকে তাকিয়ে কোথাও আমাকে দেখতে পেলাম না একটা অসম্ভব লম্বা পেঁজা তুলোর ছায়া যেন ছোরাটা মুঠোয় ধরে আছে।
যখন বাড়ি পৌঁছলাম তখন সন্ধে হয়ে গেছে। অভয়াচরণ ভট্টাচার্য পাঠশালার চৌকিদার তার আঙিনার অন্ধকারে ঢং ঢং করে কাঁসর পেটাচ্ছে আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নাম করছে রাধে রাধে গোবিন্দ। আমি ছোরাটা পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে লুকিয়ে রেখে হাতপা ধুতে গেলাম। পড়তে বসতে হবে। কিন্তু মাথার ভিতরটা যেন গোলমেলে হয়ে গেছে। বার বার বাইরে এসে আকাশ দেখছি। ঝকমক করছে তারা।
পরদিন যখন মনে পড়ল, ড্রয়ার খুলে দেখি সেখানে ছোরার কোনো চিহ্ন নেই। অন্য সব কিছুই তো ঠিক আছে। তবে? এ হল দিবাস্বপ্ন। এ হল ইচ্ছার স্বপ্ন।
ভাও গিরির গল্পের একটা সংশয়াচ্ছন্ন শেষ আছে। দশ-বারো বছর পরে কলকাতায় বসে খবর শুনেছিলাম- ভাও গিরি নাকি মার খেয়েছেন। আমার আর খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হল না। কিন্তু এখনও যখন মনে পড়ে, ভাবি কেন? কি হয়েছিল? সন্ন্যাসীর যৌন পতন? জমিজায়গা নিয়ে কলহ’? উনি কি ওখানেই আছেন, না কি অপমানিত হয়ে চলে গেছেন? এতদিনে তিনি প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, হয়তো বা মৃত।
.
স্বামী পুরুষাত্মানন্দ
শহর ছাড়িয়ে এক প্রান্তে যেমন ছিল শিববাড়ি তেমনি অন্য প্রান্তে ছিল রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রম। সেখানে বিনা চাঁদায় গল্পের বই পড়তে পাওয়া যেত। মিশনের পথে ঢেউ খেলানো মাঠ, মাঠের শেষে গোখা সৈন্যদের পল্টন, তার পরে পোড়ো জংলা জমি, অবশেষে মিশনের আশ্রম। তখনও সীমানার কোনো বেড়া নেই, কিন্তু বাঁশের একটা আগলখোলা গেট আছে। শীতের বিকেলে আশ্রমে ঢুকে দেখতাম, অনেকটা জমিতে বাঁধাকপির চাষ হয়েছে। ছেলেরা ইস্কুল থেকে ফিরে জল দিচ্ছে।
এই আশ্রমে একজন সন্ন্যাসী, একজন ব্রহ্মচারী আর বারো-তেরোজন ছেলে। একটি ঠাকুরঘর, একটি গোশালা, একটি লাইব্রেরি আর একটি খড়ের চালের ব্যারাক বাড়ি।
রামকৃষ্ণ মিশনের অবস্থাও তখন প্রায় শিববাড়ির মতোই। কিন্তু শিববাড়িটি ক্রমশ মাটিতে নুয়ে পড়বে, আর এই আশ্রম উন্নতিশীল। ষাট বছর পরে আজ সেখানে নিশ্চয় ইটের পাঁচিল, লোহার গেট বসেছে। বিনিম্নাদায় আর সেখানে গল্পের বই পাওয়া যায় না। আবাসিক ছেলেরা পরীক্ষায় দারুণ ফল করছে। যাক গে, আমি ষাট বছর আগেকার কথাই বলি।
এই আশ্রমে সারা দিন কত রকমের কাজ। মহারাজ ছিলেন হরফন মৌলা না জানতেন হেন কাজ নেই। দান ও ভিক্ষায় পাওয়া সামান্য অর্থ আর বাকিটা কায়িক পরিশ্রম, এই দিয়েই তিনি গড়ে তুলতে চাইছিলেন একটা কিছু। কি তাঁর উদ্দেশ্য ছিল– লোকসেবা? মঠের নির্দেশে প্রতিষ্ঠান গড়া? না কি কাজের খেলায় মজে গিয়ে তপস্যায় ফাঁকি দেওয়া?
মহারাজ অর্থাৎ স্বামী পুরুষাত্মানন্দের প্রৌঢ় শরীরটি খর্ব হলেও অত্যন্ত সুগঠিত। বোঝা যায়, যৌবনে তিনি জিমনাস্ট ছিলেন। বহুদিন অনুশীলনের অভাবে আর উদাসীনতায় পেশিগুলি এখন শ্লথ হয়ে আছে তবু কাজ করতে করতে চাড় পড়লে তারা মাছের মতো লাফিয়ে ওঠে। গায়ের রং ময়লা, রোদে পোড়া। দাড়িগোঁফসমেত সম্পূর্ণ মাথাটি মাসে এক বার করে মুণ্ডন করেন। তখন তাঁকে মোটেই ভালো দেখায় না। কিন্তু অন্য সময় সেটি অতিশয় তৃণাঙ্কুর উদগত পাথরটিবির মতো দেখায় এবং দেখে আমার মায়া জন্মায়।
মহারাজ যেমন পূর্বাশ্রমের কথা বলতেন না তেমনি আধ্যাত্মিক উপদেশও দিতেন না। আমি লাইব্রেরি থেকে ইলিয়াড, ওডিসি নিয়েছি, নর্স ও টিউটনদের পুরাণকাহিনী ‘সোনার তাল’ নিয়েছি, টমকাকার কুটির নিয়েছি, তিনি কখনো জিজ্ঞেস করেন নি। ঠাকুর স্বামীজীর বই কেন নিচ্ছি না। ব্রহ্মচারীদাদা বরং সুযোগ পেলেই লোকসংগ্রহের চেষ্টা করতেন, ভবিষ্যতে আমি সাধু হব কিনা ঘুরিয়েফিরিয়ে জানতে চাইতেন। ঐসব কথায় আমার অস্বস্তি হত। তাঁকে এড়িয়ে চলতাম। মহারাজ কিন্তু অন্য রকম। কে সাধু হবে না হবে তাতে তার কোনো আগ্রহ নেই। তিনি সন্ন্যাসী, আড়কাঠি নন। তাছাড়া দীর্ঘকালের সন্ন্যাসজীবন হয়তো তাঁকে চিনিয়েছিল ঐ জীবনের গোপন দুঃখ। সেই দুঃখ আরও একটা ছেলে ভোগ করুক, তা চান নি তিনি।
মহারাজের নিরাভরণ খুপরিতে ছিল একটা তক্তপোশ, একটা কাঁচা কাঠের টেবিল, একটা কেঠো চেয়ার। তাঁর লুঙ্গি, কপনি, ঢিলে গেঞ্জি ঝুলত বেড়ার গায়ে, ব্র্যাকেটে। টেবিলের উপর কালির দোয়াত, নিবের কলম, নিকেলের চশমা। ড্রয়ারে হিসেবের পাতলা খাতা। সেই সস্তার দিনেও মহারে কঠোর দারিদ্র্য সহজেই টের পেতাম। কিন্তু তিনি কি দারিদ্র্য ঘোচাবার চেষ্টা করেছেন। শহরের সঙ্গে, দাতাদের সঙ্গে তাঁর চটপটে শরীর এবং দ্রুতগতি সাইকেলটি নিয়ে যাবতীয় যোগাযোগ রাখতেন ব্রহ্মচারীদাদা। মহারাজ তাহলে করতেনটা কি?
একবার কালীপুজোর তিন দিন আগে আশ্রমে গিয়ে দেখি, মহারাজ প্রতিমা বানাচ্ছেন। হঠাৎই নাকি ঠিক হয়েছে আশ্রমে এবার কালীপুজো হবে। আমি ছেলেবেলা থেকে খোদ কুমোরদের অনেক দেবমূর্তি গড়তে দেখেছি, এবার মহারাজের কারিগরি দেখতে লাগলাম। দুটো ছেলে মাটি ছানছে আর মহারাজ আধুনিক ভাস্করদের কায়দায় বাঁশ দিয়ে মূর্তির একটি মোটামুটি কাঠামো খাড়া করে তাতে মাটি চাপাচ্ছেন। মূর্তিটি ফুট চারেকের বেশি উঁচু হবে না। কিন্তু কালীর পায়ের তলায় শায়িত শিব এক নিরেট মাটির পেডিল এবং কাঠামোয় খড় না দেবার ফলে কালীও নিরেট হয়ে যে ওজন নিয়ে দাঁড়াবে তাতে আর তাকে নাড়াচাড়া করা যাবে না। মহারাজের কাজ দেখে বুঝতে পারছিলাম, তিনি আনাড়ী, কিন্তু মনোমতো কাজ পেয়ে ছোট ছেলেদের মতো মশগুল হয়ে আছেন। কাঁচা নরম মাটির পিণ্ড তার নিজের ভার সামলাতে না পারায় মা কালীর উদর ও স্তনের অনেকখানি খসে পড়ল। আমার মনে হল খেঁদা-বোঁচা মা কালীর পেট থেকে এইবার ছানাপোনা বেরিয়ে পড়বে। মহারাজ একটু পেছিয়ে এসে একটা বিড়ি ধরিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। তার পর আবার মাটি চাপিয়ে ন্যাকড়ার পট্টি মূর্তির বুকে পেটে বেঁধে দিলেন। দেবীর দেহের কনটুর এবার অনেক অনুগ্র এবং বিতত দেখাল। মহারাজ বোধ হয় কালীর মধ্যে মহামাতৃকাকে দেখে সন্তুষ্ট হলেন।
পরদিন বিকেলে গিয়ে দেখি, মাটির কাজ শেষ। মহারাজ সত্যি সত্যি এক অন্য রকম কালীমূর্তি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বুক পেট থ্যাবড়া-থোবড়া যেন ঐ কোলে উঠলে শিশু আরাম পাবে, গরম পাবে। মুখখানা তখনও পুরো ভেজা কিন্তু সে মুখ স্পষ্টতই এক আনাড়ী বালকের বানানো, যেন কোলে শোয়া বাচ্চার দৃষ্টিতে দেখা তার মায়ের মুখ। ভিজে মাটিতে রং দেওয়া নিয়ে তেমন সমস্যা হল না, কারণ এ তো সরস্বতী বা জগদ্ধাত্রীর রং নয়, কালীর রং। আর শিব আগেই খানিকটা শুকিয়ে গিয়েছিলেন।
পুজোর পরদিন গিয়ে দেখি আশ্রম চুপচাপ। সবাই কাল সারা রাত জেগেছে, আজ তাই বিকেলে আলসেমি করছে। চাদর টাঙানো সামিয়ানার নিচে মহারাজের কালী শীতের পরিপূর্ণ দুপুরে বেশ একা একা দাঁড়িয়ে আছে। মহারাজ নানা রকম রং দিয়ে তাকে যেন বালিকা সাজিয়ে দিয়েছেন। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে নানা দিক দেখছিল। কে জানে মন কালী কেমন।
সবাই বলল, কাল গভীর রাতে পুজো খুব জমেছিল। অমাবস্যার রাতে, নির্জন খোলা জায়গায় মা কালী ভক্তদের হাত ছাড়িয়ে অনেকদিন পরে দূরে দূরে খুব ঘুরেছিলেন। সেবার আশ্রমের বাগানে বাঘের মাথার মতো বিরাট বাঁধাকপি আর টুকটুকে লাল টম্যাটো হল প্রচুর। নিজেদের তৈরি এই খাদ্যভাণ্ডার দেখে মহারাজ প্রস্তাব করলেন- এবার ভালো করে ঠাকুরের জন্মতিথির উৎসব করা যাক।
ছেলেরাই খেটেখুটে বাঁশ আর খড় দিয়ে আদিবাসী কমিউনিটি গৃহের মতো প্রশস্ত একটি ঘর বানাল। এখানে তিন দিন ধরে দরিদ্রসেবা, ধর্মকথা, গানবাজনা হবে। মহারাজ আমাদের অবাক করে দিয়ে বাঁশের মই, তার, হোল্ডার, প্লায়ার্স ইত্যাদি নিয়ে একাই ঐ ঘরের এবং প্রাঙ্গণের ওয়্যারিং করে আলো জ্বালিয়ে দিলেন।
উৎসবের দিন দূর থেকে দেখতে পেলাম, ঢুকবার মুখেই খুব লম্বা একটা বাঁশ পুঁতে তার ডগায় গেরুয়া এক তিনকোনা নিশান উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উঁচু আকাশের অনন্ত নীলের মধ্যে সন্ন্যাসীর সেই লম্বা নিশান পতপত করে উড়ছে। আমি মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম- এক একটা ছোটখাটো প্রতীক মনের রং কেমন পালটে দেয়।
সিলেট শিলং থেকে কয়েকজন মহারাজ এসেছিলেন। তাঁদের চেহারায় বেশ চাকচিক্য পরিষ্কার কামানো মাথা-মুখ, জামাকাপড় পরিপাটি। আমাদের মহারাজ এঁদের ঔজ্জ্বল্যের আড়ালে আরামে লুকিয়ে পড়লেন।
সাধুর জীবন অতি কঠোর, শম দম জপ ধ্যান তাকে আরও শুষ্ক করে তোলে। এরই মধ্যে নিজের ভাবের গান গেয়ে সাধু নিজেকে একটু ভিজিয়ে রাখে। অতএব শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, বেদান্তী সব সাধুরই নিজের নিজের গান আছে। এমনকি ছাইমাখা সাধুরাও পথের আড্ডায় চিমটে বাজিয়ে গান গায়। এখানেও ঠাকুরের জন্মোৎসবে সন্ধেবেলা এক ঢালাও গানের আসর বসল। আমাদের শহরে এত যে ভালো সব যুবক গাইয়ে ছিল জানতাম না। রাত বাড়তে লাগল আর শ্যামাসংগীত, ব্রহ্মসংগীত, হিন্দি ভজন আর ধ্রুপদী গানের স্রোত বইতে লাগল। তারায় ভরা আকাশের নিচে, গভীর রাতের হিমেল বাতাসের মধ্যে, শহর থেকে দূরে সেই আদিবাসী কমিউনিটি হাউসের মতো দরাজ ছাউনিতে মানুষের আত্মার সাধনা এবং বেদনা কতভাবে বিস্তারিত হতে লাগল। এই আসরে ঠাকুর-স্বামীজীকে নিয়ে লেখা গান কিছুটা অপ্রস্তুত শোনাল। গানের আপনহারা অনাসক্তির মধ্যে কোনো পুণ্য উদ্দেশ্যও এক ব্যর্থতা তৈরি করে।
তার পরে কতকাল কেটে গেল। ষাট বছর প্রায় একটি আস্ত পরমায়ু। এতদিন ধরে স্বামী পুরুষাত্মানন্দকে আমার মনে রাখা এবং ভালোবাসার একটি গূঢ় কারণ আছে। শ্রীরামকৃষ্ণের চেলাদের মধ্যে যিনি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেন সেই স্বামী অদ্ভুতানন্দ বা লাটু মহারাজের সঙ্গে পুরুষাত্মানন্দ মহারাজের চেহারায় কিছু সাদৃশ্য ছিল। দুজন সন্ন্যাসীই খর্বকায়, ব্যায়ামপুষ্ট, কালো, রুক্ষ, অযত্নমলিন। দুজনের মধ্যেই শ্রমজীবীর লক্ষণ। দুজনেরই ছেঁড়া কাপড়, ঢিলে বেখাপ্পা গেঞ্জি, দুজনের মুখেই অসচেতন দীনতা, রুক্ষতা, ভানহীনতা এবং দুজনেরই পৌরুষ ভস্মাচ্ছাদিত।
.
কৃষ্ণসাধু
পীত ধড়া, মোহন চূড়া পরে আসতেন কৃষ্ণসাধু। কৃষ্ণসাধু ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের বুড়ো মানুষ– ছোটখাটো হালকা শরীর, মাথায় হলদেটে সাদা চুল, চাঁদির দিকে একেবারে পাতলা। দু মুঠো সাদা দাড়িগোঁফের মধ্যে তার ঠোঁট দুটি বালকের ঠোঁটের মতো রক্তিম আর আনন্দের হাসিতে কুঞ্চিত। অবিকল ছবির কৃষ্ণটি মাথায় বেড় দিয়ে ময়ুরপুচ্ছের চুড়ো, গলায় পুঁতির মালা, খালি পায়ে বাঁকা নূপুর। আদুড় গায়ে কাঁধ থেকে পিঠ ঢেকে ঝোলে একখানা কারুকার্য করা কাঁথার পাছড়া বা পাছুড়ী। একদিন সেই পাছুড়ী খুব উজ্জ্বল রঙের ছিল, এখন তা ধূসর এবং জীর্ণ। অধোবাস একখানা হলদে রঙে ছোপানো হেটো ধুতি, মালকোঁচা দিয়ে পরা। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে বর্ণনা আছে:
পাটের পাছড়া পৃষ্ঠে ঘন উড়ে বায়।
ধড়ার আঁচল লুটি পাএ পড়ি যায়।
অবশ্য কৃষ্ণের চেয়ে দুটি জিনিস তাঁর অতিরিক্ত ছিল একটি হল ভিক্ষের ঝুলি, অন্যটি হল বাঁশের ডাঁটের একখানা ছাতা।
কৃষ্ণসাধু আসতেন অনেক দূর থেকে, হেঁটে। বোধ হয় তাঁর বাড়ি ছিল কোনো টিলার পাদমূলে। পায়ে হাঁটু পর্যন্ত ধুলো, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঝুলি থেকে ভাঁজ করা গামছা বার করে মাথা-মুখ পুঁছতেন। গামছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খেয়ে ক্লান্তি দূর করতেন। সকালে বার হবার সময় বোধ হয় অলকাতিলকা কেটেছিলেন, এখন সেসব মুছে গেছে। কৃষ্ণসাধুর ঝুলিতে ছোট একটি পিতলের বাঁশি থাকত। বললে পরে বিনাবাক্যে সেটি বার করে বাজাতেন। তাতে সাতটি ফুটো ছিল ঠিকই, কিন্তু কৃষ্ণসাধু ছোট ছেলেদের মতোই বংশীবাদক- এলোমেলো এ ফুটো ও ফুটো টিপে পুঁ পুঁ করে আওয়াজ বার করা ছাড়া কোনো রাগিণীই তাঁর বাঁশিতে বাজত না।
কৃষ্ণসাধু কেন ঐ রকম সাজ করতেন জানি না। কিন্তু বেশ লাগত যখন এক মাস দু মাস পরে তিনি ঠা ঠা দুপুরের শেষে কোনো রংজ্বলা অপরাহ্নে এসে হাজির হতেন। ভিতরের বারান্দায় মোড়ার উপর বসতেন। একটু জিরোতেন, মৃদু মৃদু কথা, অল্প অল্প হাসিতে তাঁর প্রসন্নতা ফুটে উঠত। আমার মনে হত, উনি ভিখিরিও না, বৈষ্ণবও না, একজন স্বাধীন মজার মানুষ।
.
গৌরদাস বাবাজী
বৈষ্ণব অনেক রকমের দেখেছি সংসারী, সন্ন্যাসী, মোহন্ত, ভিখিরি, নির্বিকার, চঞ্চল। কিন্তু বৈষ্ণব যেমনই হন, সংসারের আগুন সবাইকেই তাড়া করে বেড়ায়।
গৌরদাস বাবাজী ছ ফুট লম্বা, হাড়সর্বস্ব এক ল্যাগবেগে মানুষ। যেন কোনো উট বা ঘোড়ার কঙ্কালের উপর উনি নিজের ছালটি পরিয়ে নিয়েছেন। যেন সেই জন্যেই তাঁর চামড়া অমন ঢিলে, হলদেটে, খড়ি ওঠা। তাঁর বড় বড় ফাটা পা, মুড়নো মাথা, বড় বড় কান, ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখে রুক্ষ কাতর দৃষ্টি। সাদা কোরা থানের অধোবাস পরা, ধুকড়ি চাদর গায়ে, গলায় দু তিন প্যাঁচ ছোট দানার তুলসীমালা, গরুড়পক্ষী নাকে তিলক। দূরের কোনো পাহাড়তলিতে বাবাজীর আখড়া। বছরে এক বারের বেশি এই শহরে আসতে পারেন না।
বাবাজীর অত বড় শরীরটা কখনোই সুস্থ থাকত না। বেশি কথা বলতেন না, কথা বললে হাঁপানির টান উঠত। আমাদের উঠোনে শীতের রোদের মধ্যে মোড়ায় বসে থাকতেন হাতের পাতায় চোখ ঢেকে অনেকক্ষণ। তুলসীপাতা দেওয়া গরম চা খেতেন। দিদিমা তাঁর কাছে বসে খবরাখবর নিতেন। কানে আসত ছেলেপিলেরা ভালো হয় নি। সংসারে অশান্তি অনটন।
বাবাজী ভিখিরি ছিলেন না, কিন্তু অন্যের কৃপার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এই শহরে সপ্তাহখানেক কাটিয়ে, কয়েকটা বাড়ি থেকে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে তিনি চলে যেতেন। হয়তো পালা করে আরও কয়েকটা জায়গায় তাঁকে ঘুরতে হবে। সাধুর সব চেয়ে বড় শত্রু রোগ আর সন্তান তাঁকে পেড়ে ফেলেছিল।
তাঁর কোনো শিষ্য-ভক্ত ছিল না। আধ্যাত্মিক কথা দূরে থাক, সামান্য সুখদুঃখের কথা বলতে গেলেও কাশির দমকে তাঁর নিশ্বাস আটকে যায়। চোখের গর্তের নিচে রাতের অনিদ্রার চওড়া কালো দাগ নিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকেন। এইভাবে আর কত দিন যাবে কে জানে!
.
বৈষ্ণবীদিদি
বৈষ্ণবীদিদি আসতেন রাসপূর্ণিমা উপলক্ষে হেমন্তকালে। কোনো এক চা-বাগানে ছিল তাঁর ডেরা। এসে উঠতেন সাধুদিদির কাছে। বৈষ্ণবীদিদি বিধবা মানুষ, মধ্যবয়সিনী। সংসারে তাঁর নিজের কে ছিল জানি না, কিন্তু সন্তানের মতো কোলে করে আনতেন একটি কাঠের গৌরাঙ্গ। মূর্তিটি রঙিন, খাড়া দাঁড়ানো, তিন বছরের বালকের উচ্চতা আসনে বা মেঝেয় দাঁড় করিয়ে দিলে সোজা হয়ে সে অনন্তকাল হাসিহাসি মুখে, বড় বড় চোখে চেয়ে দাঁড়িয়েই থাকবে। বৈষ্ণবীদিদি ফুর্তিবাজ লোক- গৌরাঙ্গকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়েই হেসে গেয়ে নেচেকুঁদে মাত করে দিতেন মহিলামহল।
বৈষ্ণবীদিদি এলে নাগাবাবার ভোগরাগের জাঁকজমক খুব বেড়ে যেত। কাঠের গৌরাঙ্গেরও ভোগ হত। একই ঘরে দুই ঠাকুর। গামলা ডেগ জামবাটি ভরতি করে নানা পদ ঠাকুরের সামনে সাজিয়ে দিয়ে, ধূপ দীপ জ্বালিয়ে, ঘরের দরজা বন্ধ করে সাধুদিদিরা বাইরে এসে ভোগের গান ধরতেন। বন্ধ ঘরের মধ্যে, লোকচক্ষুর অগোচরে ঠাকুররা শুক্তো থেকে পায়েস– কোন পদের পর কোন পদ খাচ্ছেন তারই ধারাবিবরণী হচ্ছে এই গান। গানের শেষটা এখনও মনে আছে—
আচমন করিয়া প্রভু মুখে দিলেন পান,
সিংহাসনে বসলেন যেন পুন্নিমার চান।
জয় জয় গোবিন্দ গোপাল গিরিধারী।
তৃতীয় ছত্রটি হল ধুয়া। এসব গান চন্দ্রাবতীর রামায়ণের মতোই মহিলাদের রচনা, যা দরকার মতো টেনে বাড়ানো, হেঁটে কমানো এবং ভোগের পদ অনুযায়ী পরিবর্তন করা যেত।
অতঃপর পাঁচ মিনিট নীরবতা পালন করে দরজা খোলা হত। দরজা খোলা মাত্র গোবিন্দভোগ চালের গন্ধে, রান্নার সুবাসে ঘরটি ম ম করত।
কোজাগরী পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমাটিই রাসপূর্ণিমা। আমাদের উপত্যকা শহরে সন্ধে থেকে পৌর্ণমাসীর পূর্ণচাঁদ উঠেছে। হেমন্তের রাতে শীত তত নয়, কিন্তু হিম আর কুয়াশা পড়েছে খুব। সারা দিন ঠাকুরের কত রকম রঙিন সাজপোশাক হল– ফুলমালা, উত্তরীয়, উষ্ণীষ পরানো হল। রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটায় যখন পথ জনহীন, ঘরে ঘরে বাতি নিবে গেছে, পাখিরা ঘুমিয়ে পড়েছে তখন বৈষ্ণবীদিদি নাগাবাবাকে রাসের সাজে সাজিয়ে দিয়ে উঠোনে নেমে এলেন। এখন, সাধুদিদি, বৈষ্ণবীদিদি, দিদিমা, কালোশশীর মা, রাধের মা, আরও কেউ কেউ—সাদা কুয়াশায় সবিকে চেনা যায় না—নাগাবাবার খোলা দরজার সামনে উঠোনে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে গাইতে নাচছেন। এই প্রৌঢ়াদের কারো সংগীতের কোনো শিক্ষা নেই, নাচ বলতে খেমটা ছাড়া আর কোনো নাচের নাম পর্যন্ত তারা শোনেন নি। তাছাড়া, বয়স যেমন গলার কোমলতা মুছে নিয়েছে বাতের ব্যথা তেমনি কোমরের নমনীয়তা নষ্ট করেছে, আর এ গানও ছড়ার বেশি কিছু নয়। সব সত্যি। কিন্তু তবু সেই নাচ এখনও মনে রয়ে গেছে একটি অলৌকিক ছবি হয়ে। গোবিন্দদাস কবিরাজের পৌখলী রজনীর মতো কোমল সাদা রঙের এই অঘ্রানের রাত, মাথার উপরে হিমে আবছা পূর্ণচন্দ্র, মহিলাদের পরনে তাঁদের প্রৌঢ়দিনের সাদা ধবধবে শাড়ি, সাদা মিহি কুয়াশা- আকাশ থেকে যেন কুড়চিফুলের রেণু ঝরছে। পুরুষগণ নিদ্রাভিভূত। কেবল ঐ নিবৃত্তরজস্কা মহিলারা গোল বৃত্ত করে, সামনে ঝুঁকে, হাতে তালি দিয়ে গাইতে গাইতে রাসের নাচ নাচছেন।
.
ভোলা গিরির চেলা
বাড়ির কাছের এইসব দীনদুঃখী সাধু বৈরাগীরা তো আমাদের আপনজন। এঁরা ছাড়াও আসতেন কিছু বাইরের উটকো মহাত্মা।
একবার এলেন ভোলা গিরির দুই সন্ন্যাসী চেলা। তারা উঠেছিলেন সাধনদের বাড়িতে। দুজনেরই মুণ্ড চকচকে কামানো। তখন শীতের দিন। দুজনেরই পরনে আজানুলম্বা মেরুন রঙের গরম পাঞ্জাবি। পাশাপাশি দাঁড়ালে মনে হয় যেন জুড়ি দোহার।
এঁদের একজন গলার মধ্যে একটি কৃত্রিম গর্ত বানিয়ে গোল্ড স্টোনের একটি নিটোল নুড়ি রেখেছিলেন। নুড়িটি ইঞ্চিটাক লম্বা, ওভাল আকৃতির। ঐটি তাঁর উপাস্য। পুজোয় বসে নুড়িটিকে তিনি আঁক করে উগরে হাতের পাতার উপর ফেলেন। তার পর ধুয়েপুঁছে যথাবিহিত পুজো করে আবার সেটিকে কপ করে গলাধঃকরণ করেন। তিনি বলেন ওটিকে তিনি কলিজার মধ্যে পাঠিয়ে দিচ্ছেন কারণ ঈশ্বরের সবচেয়ে প্যারা জায়গা হল ভক্তের কলিজা।
অনেকদিন পরে পড়েছিলাম, চোরেরা ও জেলকয়েদীরা গলার ভিতরে সীসের গুলি রেখে মাংস ক্ষইয়ে ক্ষইয়ে একটা গর্ত তৈরি করে নেয়। সেখানে তারা মূল্যবান রত্ন আর মোহর লুকিয়ে রাখে। দরকার মতো আবার তা উগরে বার করে। এই গর্তটি হল তাদের ভল্ট এবং সর্বক্ষণের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। সাধুজী মুখে যাই বলুন, উনিও ঐ রকমই একটি গর্ত তৈরি করেছিলেন।
.
মায়াপুরের বৈষ্ণব
এই বহিরাগত সাধুদের মধ্যে ছিনে জেঁকের মতো লেগে থাকার ক্ষমতা দেখেছিলাম মায়াপুরের গৌড়ীয় মঠের বৈষ্ণবদের। শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ছিলেন এই সংগঠনের প্রধান। কোনো বসন্তে বা গ্রীষ্মে, ঠিক মনে নেই, মঙ্গল গ্রহের হানাদারদের কায়দায় এঁরা শহরটাকে আক্রমণ করলেন। হঠাৎ একদিন দেখা গেল তিলক-কণ্ঠি-গেরুয়াধারী স্বাস্থ্যবান একদল লোক ট্রেন থেকে নেমেই শহরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেন। এঁদের কিছু প্রচারপুস্তিকা ছিল, খোল করতাল ছিল, আর ছিল নবদ্বীপ-শান্তিপুরের মিষ্টি ভাষায় তোক পটানোর ক্ষমতা। এঁরা, সময় নেই অসময় নেই, গেরস্তের বাড়ি বাড়ি টু দিতে লাগলেন। সিংহ বা চিতা যেমন দল থেকে একটি প্রাণীকে বধ করবার জন্য বেছে নেয়, এঁদেরও সেই কৌশল।
একদিন এঁদের দু-তিনজন সকালে আমাদের বাড়িতে এলেন। তখন দাদুর অফিসে যাবার বেলা। দিদিমার রান্নার তাড়া। সুতরাং ওরই মধ্যে তাঁরা এই গৃহের পরমভাগবত গৃহকর্তা ও মা-জননীর প্রশংসা করে কিছু এককালীন দানের আবেদন জানিয়ে তাড়াতাড়িই বিদায় নিলেন। তাঁরা পাড়ার সব বাড়িতেই যাচ্ছেন, কিন্তু কেন জানি না, আমাদের পাড়ায় নির্বাচন করলেন দাদুকেই। তাঁদের দাবি দু শো এক টাকা। তখনকার দিনে ছ আনা মাংসের সের, দু আনা দুধের সের, ছ আনায় এক শো ছাতকের কমলালেবু, এক পয়সায় তিন সের টম্যাটো, দেড় টাকা আমার স্কুলের মাইনে। সুতরাং দাদু কিছুতেই ঐ টাকা দেবেন না। ওদিকে সাধুদেরও চলে যাবার দিন এগিয়ে আসছে। যাবার এক দিন আগে, সন্ধেবেলায়, একেবারে অন্দরমহলে এসে ওঁরা তিনজন দাদুকে পাকড়াও করলেন।
প্রথমেই এক কোপে দু শো টাকাটাকে কেটে এক শো টাকা করে দিলেন। আমি বসে বসে তাঁদের বিক্রয়নৈপুণ্য দেখলাম। আধঘণ্টার উপর ধস্তাধস্তি চলল। দাদু সরল সিধে লোক, শিবের পুজো করেন, অজানা অচেনা, কপালে ত্রিপুণ্ডকের বদলে নাকে তিলক টানা ঐ লোকগুলোকে অতগুলো টাকা দেবার তাঁর দরকারটা কি! তবু শেষ পর্যন্ত পারলেন না। বাবাজীদের সুললিত প্রশংসা এবং বাক্যের ছটায় ভেসে গিয়ে মাসিমা হঠাৎ ‘টাকাটা আপনারা পাবেন’ বলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে বাবাজীরা সমস্বরে পরমভাগবত অমুকবাবুর জয় বলে তিন বার উচ্চৈঃস্বরে জয়ধ্বনি দিলেন। দাদু মাসিমার মান ও আদর রেখে টাকাটা বার করে দিলেন। তখনও ইসকন হয় নি, কিন্তু ইসকন যে হবে এটা তার ভূমিকা।
.
অরুণাচল
সুরমা মেলের রেললাইন এসে শেষ হয়েছে আমাদের শহরে। এর আগের স্টেশনটির নাম মাছিমপুর। ইচ্ছে হলে বিকেলের ট্রেনে সেখানে যাই। সাইকেলেও যাই। কোথাও একটি মানুষ নেই। পাহাড়ী রাস্তার দু দিকে গাছপালা ঝোঁপঝাড় নীরব হয়ে আছে। মাছিমপুর এক ছেড়ে যাওয়া জায়গা। বর্মা অয়েল কোম্পানী এখানে একসময়ে গভীর কূপ খুঁড়ে পেট্রল খুঁজেছিল। কিছু না পেয়ে তারা চলে গেছে। পড়ে আছে তাদের ডিগিংয়ের লোহালক্কড়, অতিকায় যন্ত্রপাতি, আর আকাশের উঁচাইয়ে লোহার কয়েকটা দানবাকৃতি চৌবাচ্চা। তাতে এক এক পুকুর জল ধরে। একদিন বিকেলে লোহার সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেখেছিলাম, সে চৌবাচ্চা জলে ভরতি। অত উঁচুতে হু হু করে একটানা গর্জন করে হাওয়া বইছে আর জলে ঢেউ উঠছে। কোথাও জনপ্রাণী নেই। দূরে কয়েকটা টিলা ধূসর নীলচে বনের মধ্যে মিলিয়ে গেছে। সেই বিশাল বৃত্তাকার চৌবাচ্চার কিছুটা ঢাকা, সেখানে শুলে কেমন লাগবে ভেবে একটু শুলাম– টের পাচ্ছি, শয়ান শরীরের নিচেই লোহার পাতে জলের দুর্জয় ধাক্কা। অত হাওয়ায় শীতশীত করে, অথচ পড়ন্ত রোদে লোহার পাতের আরামদায়ক উষ্ণতা।
মাছিমপুরে একটি টিলার মাথায় ছিল অরুণাচল আশ্রম। অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত তাঁর স্মৃতিকথা ‘তামসী’তে লিখেছেন: ‘গুরুদাস চৌধুরী একটি আশ্রম খুললেন, দয়ানন ঠাকুর নাম নিয়ে। তার নিশ্চয়ই একটা আকর্ষণ ছিল। কারণ অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি দয়ানন্দের আশ্রমে যোগ দিয়েছিলেন। আশ্রম ছিল পুববাংলার জগৎসীতে আর শিলচরে কাছে অরুণাচলে। পুলিশের সন্দেহ হল এই আশ্রমে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ হয়। হয়তে সন্দেহটা অমূলক ছিল না’।
আমার কাছে অরুণাচলের অর্থ ছিল, যে পাহাড়ে উষা বা সন্ধ্যা-রাগ এসে লাগে, অথবা যে পাহাড় থেকে উষার বা সন্ধ্যার গোলাপী আভা দেখা যায়। এমন একটি নামেও তো মন ভোলে।
বিশেষ উৎসব ছাড়া সাধারণ দিনে প্রায় নির্জন সে জায়গা। একটি উঁচু গম্বুজের শক্তপোক্ত মন্দির আর কলমের নিচু নিচু আম গাছের আড়ালে ঘাস বাঁশ মাটির তৈরি ছোট ছোট কুটির। অনেক কুটিরই ফাঁকা। কিন্তু কেউ তাদের মোটামুটি পরিষ্কার করে রেখেছে- যে কোনো সময়ে অতিথি আগন্তুক এলে আশ্রয় পাবে।
অরুণাচলের দেবতা কে, আশ্রমবাসীরা কোন সম্প্রদায়ের, সেসব কথা আজ কিছু মনে নেই। মন্দিরের লম্বা সিঁড়িতে বসে বিকেলটা বেশ কেটে যায়। সন্ধ্যা নামে। একদিন এই রকম সন্ধ্যায় শুক্লপক্ষের আকাশে চাঁদ উঠল। ঘুরে ঘুরে দেখি কুটিরের পাশে পাশে খটখটে সাদা মাটিতে আমের ডালপালার আলোছায়া।
.
দেবদেবী পুরাণ
শৈবদের এক বরফের মতো সাদা শিব, আর শাক্তদের লাল কালো নীল হলদে অনেক দেবী। এই অমানুষী দেবীদের পুজোর রীতিপদ্ধতি খুব গূঢ়, তমসাঘোর। বৈষ্ণবেরা অন্য রকমের মানুষ সেই জন্যে তাদের দেবদেবী অপরূপ শরীরের যুবকযুবতী, কিশোরকিশোরী, এমনকি হামাগুড়ি দেওয়া শিশু। রসে লীলায় আনন্দে কখনো এরা টলমল করে, কখনো ডগমগ করে। এইসব দেবদেবীর মধ্যে বৈষ্ণবেরা নিজেরাই নিজেদের উপভোগ করে সেই জন্যেই কথায় কথায় তাদের এত গান, কীর্তন আর উৎসব। স্তব্ধতা এবং কবিতা কিন্তু শৈবদের। রঙের রহস্য এবং ছবি হয়তো শাক্তদের।
আমরা পিতৃকুল মাতৃকুল উভয় দিক থেকেই নিচ্ছিদ্র শাক্ত হওয়া সত্ত্বেও দিদিমা তাঁর বাড়িতে এক শব্দঘোর বৈষ্ণব উৎসব প্রবর্তন করলেন। এ হল সেই বাসনা যার জন্যে মানুষ দেউলচূড়ায় সোনার কলসি বসায়। দাদু দিদিমার ইষ্ট ছিলেন শিব। রুপো আর ধূসর বর্ণের একটি নুড়িতে তৈরি চমৎকার শিবলিঙ্গটিকে দুজনেই পুজো করতেন এছাড়া দিদিমার ছিল আবার স্বাধ্যায় বাংলা পদ্যে গীতা, ভাগবত, আর মূল চৈতন্যচরিতামৃত পড়তেন স্পষ্ট উচ্চারণে, অনেকক্ষণ ধরে। শিবলিঙ্গের পাশে বৈষ্ণব বই ভাগবত আর চৈতন্যচরিতামৃত দিদিমারই সংযোজন।
কান খাড়া করে আমি শ্রীমদ্ভাগবত শুনতাম। তাতে অনেক অদ্ভুত কাহিনী আছে: ব্রহ্মা যখন চরাচর সৃষ্টি করছেন তখন এক যাচ্ছেতাই কেলেঙ্কারি ঘটালেন। দিন-রাত সৃষ্টির সময় সন্ধ্যাকেও সৃষ্টি করলেন। কিন্তু সেই কন্যার এমন দুর্নিবার রূপ যে বাবা হয়েও ব্রহ্মা কামাতুর হয়ে তাকে ধরতে ছুটলেন। ব্রহ্মার সন্তান মনুরা বাবার এই কাণ্ড দেখে অধোবদন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সন্ধ্যার উজ্জ্বল রং লজ্জায় ক্রমশ ম্লান হতে হতে কালো অন্ধকার হল। এইসব কাহিনীর সঙ্গে আবার পাতাজোড়া রঙিন ছবিও ছিল। বাড়িতে যখন কেউ থাকত না, আমি হাতপা ধুয়ে পবিত্র হয়ে সেই বই নামিয়ে নিয়ে পড়তাম, ছবি দেখতাম- বুড়ো ব্রহ্মাতে একবার চোখ বুলিয়ে, নিবিষ্ট হয়ে সন্ধ্যার শরীরের রূপ বুঝবার চেষ্টা করতাম। কার যে কোথা থেকে কি হয়! ধর্মগ্রন্থ পড়েই আমার কামের স্ফুরণ হল।
.
সাধু দিদি
এত রকম ধর্মকর্ম দিদিমা বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর আধ্যাত্মিক সহায় ও আদর্শ ছিলেন প্রতিবেশিনী সরোজিনী বসু ওরফে সাধুদিদি বা দিদি।
আমি যখন দিদিকে দেখি তখন তিনি প্রৌঢ়ত্বের শেষ দিকে। তাঁর বড় ছেলে অধ্যাপক, ছোট ছেলে মুনসেফ, বড় মেয়ে চা-বাগানের ডাক্তারের গৃহিণী, ছোট মেয়ে স্বামীর সঙ্গে বর্মাপ্রবাসিনী। তাঁর অনেক নাতিনাতনী। মেয়েরা, নাতিনাতনীরা মাঝে মাঝেই আসে, থাকে। বাড়িতে ঝুলনও হয়, দুর্গোৎসবও হয়। বাড়িটি সারা বছর জমজমাট।
দিদি খুব সুকুমারী, হয়তো একটু বাতের ব্যথাও আছে, কোনো পরিশ্রমসাধ্য কাজ করেন না। আমি তাঁকে কোনোদিন রান্নাবান্না, ঘরের কাজকর্ম করতে দেখি নি। তাঁর বিছানাটি বেশ বড়, সাদা ধবধবে লেপ চাদর বালিশে ভরতি। দিনরাতের অনেকটা সময় তিনি সেখানেই শুয়ে বসে জপ করেন, ধর্মগ্রন্থ পড়েন, চা খান। বেলা হলে ঠাকুরঘরে যান, পুজো করেন। এত বড় সংসারটা যেন হেসে খেলে নিজে নিজেই চলে যায়। পাড়ার দু-চারজন প্রৌঢ়া গৃহিণী তাঁর খুব অনুগত। বিকেলে ফরসা জামাকাপড় পরে তাঁদের নিয়ে বেড়াতে বেরোন, হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দিদিমা মাসিমাকে ডেকে নেন। এই মহিলার দল বেশ খানিকটা হাঁটেন হাঁটতে হাঁটতে কখনো নদীর পাড়ে যান, কখনো ইটখোলার দিকে, কখনো লোকাল বোর্ডের অফিসের পাশের অশ্বত্থ বটের ছায়াঘোর পথে। যেতে যেতে নানারকম সাংসারিক গল্প হয়। দিদি সবার খোঁজখবর নেন, কিন্তু কারো বাড়িতে ঢোকেন না। তার একটা স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব আছে। বয়স্ক গৃহিণীরা, তরুণীরা তাঁকে সমীহ করে। এদের কাছে তিনি কৌরবপুরস্ত্রীদের কাছে গান্ধারীর মতন।
কিন্তু অন্ধকারই হোক আর চাঁদের আলোই হোক, সন্ধে নামলেই দিদি অন্য মানুষ বাচ্চার মতো ভয়কাতুরে, অসহায়। এখন সারা রাত ঘরে লন্ঠন জ্বালিয়ে রাখতে হবে, কাছে কাউকে না কাউকে থাকতে হবে। অস্থান কুস্থান থেকে এখন আচম্বিতে তাঁর কাছে প্রেতাত্মারা আসবে। কী যে কষ্ট তাদের! দিনের বেলায় ওরা দেখা দেয় না তা নয়, কিন্তু তখন তো চারদিকে আলো, মানুষজন। দেখতে পেলেও ততটা ভয় হয় না। কিন্তু রাত্রে তাদের যন্ত্রণার চেহারা, বীভৎস চেহারা দেখে রক্ত হিম হয়ে আসে। রাত্রে দিদি একা থাকতে পারেন না। কাউকে না কাউকে কাছে শুতে হবে।
সাধুর সঙ্গে ভূতের ও ভগবানের একটা সম্পর্ক আছে। দুজনেই সাধুর কাছে আসেন। রাত যত গম্ভীর হয় দুজনকেই তত বেশি অনুভব করা যায়। যেমন ভূতেরা আসত তেমনি সাধুদিদির ঠাকুরও রাত্রে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে নানা কথা বলে যেতেন। সাধুদিদির বিগ্রহের নাম নাগাবাবা। বিঘতপ্রমাণ একটি ধাতুর মূর্তি, সোনার মুকুট পরানো। আদর করে অনেকে, ছেলেপুলের মতো, ঠাকুরদেরও নামকরণ করে যেমন রুবীর, বেঙ্কটেশ্বর, মদনমোহন, রামলালা তেমনি এই বিষ্ণুমূর্তিটির নাম কেউ দিয়েছিল নাগাবাবা। নাগাবাবা দিদির সঙ্গে ঢাকা জেলার ভাষায় কথা বলতেন। এবং উচ্চমার্গের কথা না বলে সংসারী কথাই বেশি বলতেন। যেমন দিদিমার মুখে অনেক বার শুনেছি, আমার মার বিয়ের পর, বিয়েটা কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করায় নাগাবাবা গম্ভীর হয়ে এক কথায় বলেছিলেন– ‘ছালির বিয়া’। অর্থাৎ বিয়ে না ছাই!
ভূতেদের নানারকম বিকট মূর্তি: কখনো তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো অসহায়, কখনো স্ত্রীলোকের সৌন্দর্যে লোলুপ, বাসনাব্যাকুল, কখনো জলছবির মতো নিষ্প্রাণ, দ্বিমাত্রিক, ভয়ংকর এইসব প্রেতের কথা দিদির কাছে শুনে এসে দিদিমা বন্ধুমহলে বলতেন।
অনেক দিন পরে কয়লা ঘুঁটে কাঠ রাখা, আবর্জনায় ভরা ঘরটা পরিষ্কার করা হচ্ছিল। হঠাৎ সেখান থেকে বীভৎস দুটো প্রেত বেরিয়ে এল। একজনের নাকে মোষের নাকের মতো বড় ঘেঁদা, তাতে দড়ি পরানো। আরেকজনের পেটে একটা ঘা, সেই ঘায়ের গর্ত দিয়ে তার নাড়িভুড়ি বাইরে ঝুলে পড়েছে, সে দু হাত দিয়ে সেগুলো ধরে আছে। বেরিয়ে এসে তারা পায়খানার দিকে ছুটে পালাল। তখন বেলা দশটা এগারোটা। দিদি তাদের দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু উনি যাদের দেখেন আমরা কেউ তাদের দেখতে পাই না।
একদিন সেই লোকাল বোর্ডের পাশের বড়-বড়-গাছে-ঝুপসি পথে বেড়িয়ে এসে বললেন- ‘আগো ঝুনুর মা, ঐ আন্ধার পথে আর না যাওনই ভালো। ঐ গাছগুলানে কতগুলা ভূত থাকে। মাইয়ামানুষ দেখলে তারা ফাল দেয়, বিয়া করতে চায়’। আজ এখানটা লিখতে লিখতে আমার হাসি পাচ্ছে। গাছের উপরে ওগুলো সত্যিকারেরই ভূত ছিল নইলে প্রৌঢ়ত্ব পেরোনো, স্থূলাঙ্গী, বাতের ব্যথায় কাতর, ঘোমটা পরা ঐ পুরন্ধ্রীদের কেউ বিয়ে করতে চায়!
এক একটা সময়ে দিদির এই ক্ষমতাটা খুব বেড়ে যেত। স্থানে অস্থানে আত্মাদের দেখতে পেতেন। একদিন একটা কালভার্টের নিচে কাঁচা ড্রেনের নোংরা পাঁকজলে বিকেলে গোঁ গোঁ শব্দ শুনে দেখেন, সেখানে আধমরা মাছের মতো খাবি খাচ্ছে কতগুলো আত্মা। কী অসহ্য কষ্ট তাদের! দিদিমার মুখে ঐ কথা শুনে আমি পরের দিন বিকেলে ভয়ে ভয়ে ঐ কালভার্টের কাছে গেলাম। থিতিয়ে যাওয়া পাঁকের উপরে কালো শ্যাওলা, আর শ্যাওলার উপর দিয়ে তিরতির করে আধ ইঞ্চি জল বয়ে চলেছে। কাছে একটা ছোট শিমুল গাছে তিনটে কাক রোদ পোয়াচ্ছে। তাদের নুড়ির মতো ন্যাড়া মাথা থেকে বাঁকা ছুরির মতো ঠোঁট বেরিয়ে আছে।
রাত্তিরে আরও নানা রকম দুষ্ট আত্মা আসে। ভয়ে তরাসে দিদি ঘুমোত পারেন না। তাহলে জেগে জেগে জপ করাই ভালো।
পরিণত বয়সে দিদির স্বামী মারা গেলেন। নিরাভরণ নিভৃত নিরাসক্ত মানুষটি কোনো রোগে ভোগেন নি, কাউকে কষ্ট দেন নি। বাড়িটিতে শুধু যেন একটু শীতের বাতাস বয়ে গেল উঠোনের পেয়ারা গাছের কিছু পাতা ঝরে পড়ল, এক মহিলার পাকা চুল থেকে সিঁদুরচিহ্ন মুছে নিল, তার শাড়ির পাড়টিকে সাদা করে দিয়ে হাওয়াটুকু চলে গেল।
কর্তা মারা যাবার পরে দিদি তাঁর বড় ছেলের কাছে চলে গেলেন। বাড়িটা জনহীন ফাঁকা পড়ে রইল। বাড়ির সদর দরজা খোলা। বড় ঘরের দরজায় শুধু একটি পলকা তালা লাগানো। কি মনে করে আমি একদিন শেষবিকেলে সেই বাড়িতে ঢুকলাম। কী মলিন বাড়ি। বাড়ির উপরের টুকরো আকাশটুকু পর্যন্ত বিবর্ণ হয়ে আছে। ঘরগুলো যেন পোড়া ফানুসের মতো বেঁকে তুবড়ে কালো হয়ে আছে। হঠাৎ মনে পড়ল এই বাড়ির আনাচেকানাচে সর্বত্র তো ভূতের বাসা। আর দাঁড়ায় কেউ সেখানে!
এর পরেরটুকু অর্থাৎ দিদির বাকি কাহিনীটা এখানেই বলে নিই। দিদির সঙ্গে তাঁর পুত্রবধূর বনল না। অতএব তিনি ফিরে এলেন। শরৎকালের দুর্গোৎসবে নাতিনাতনী ছেলেমেয়ে পাড়াপ্রতিবেশী নিয়ে আবার ঝলমল করে উঠল বাড়িটা। কিন্তু সময়ের ক্ষয় একবার শুরু হলে আর তাকে আটকানো যায় না। পুজোর পরে ছেলেমেয়েরা সবাই তো আবার ফিরে যাবে, একা মাকে কে দেখবে এখানে। সুতরাং এবার প্রবাসী ছোটছেলে তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে। ছোটছেলের নাম ইন্দু- কি রকম ইন্দু সেটা বোঝাতে মা তার ডাকনাম রেখেছিলেন ‘কালাচাঁদ।
কালাচাঁদমামা একজন অসাধারণ মানুষ। আত্মীয় অনাত্মীয়, বৃদ্ধ বৃদ্ধা, যুবক যুবতী, বালক বালিকা সকলের কাছ থেকে এত অঝোর ধারায় স্নেহ টেনে নিতে তাঁর মতো কাউকে দেখি নি। চল্লিশের কোঠায় বয়স, চিরকুমার, নিরামিষাশী, পেটানো শরীর, আড়াই মন ওজন, ভাগনে ব্যায়ামবীর জলিদাকে একদিন হাসতে হাসতে আমাদের সামনে তুলে আছাড় দিয়েছিলেন।
কালাচাঁদমামার চকচকে চোখ, একমাথা কালো কোঁকড়া চুল। জলের পাইপের মতো মোটা পার্কার ফোন্ডে বিচারের রায় লেখেন। কোর্টের বাইরে ধুতি আর পাঞ্জাবিই তাঁর পোশাক। একসঙ্গে এক ডজন পাঞ্জাবি আর দু ডজন রুমাল বানিয়ে নেন, কেননা নস্যির গুঁড়ো পড়ে সারা দিন তাঁর জামা নষ্ট হতে থাকে। আসলে ডজন হিসেবে জিনিস কেনা তাঁর বাতিক। এক গ্রোস দেশলাই, এক কার্টন কাঁচি সিগারেট, ছটা টুথ ব্রাশ, ছটা নিম টুথ পেস্ট, এক ডজন সাবান, তিনটে নস্যির কৌটো বিরাট একটা কালো ট্রাংকে তাঁর ভাঁড়ার। কিন্তু সেটা খোলাই পড়ে থাকে। তাঁর মিষ্টি খাবার ব্যাপারটাও ঐ রকম। জীবনের শেষ দিকে, যখন কলকাতায় ছিলেন, সকালে টালিগঞ্জ থেকে বেরিয়ে প্রথমে রাসবিহারীর মোড়ে নামতেন, হাসিহাসি চোখে বলতেন- ‘চলো নেফিউ, জলযোগে একটু পয়োধি সেবন করে আসি। পয়োধি হল। তার পর ভবানীপুরে দ্বারিকে রসগোল্লা, ভীম নাগে সন্দেশ। তার পর এসপ্ল্যানেডে কে সি দাসের রসমালাই। তার পর আর ব্রেক জানি নয়, সোজা কলেজ স্ট্রীট– পুঁটিরাম। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা দুটো।
কালাচাঁদমামা পেংগুইনের বই কিনতেন একসঙ্গে তিনখানা করে। তখন পেংগুইন ছ আনা করে, কিন্তু একসঙ্গে তিনখানা এক টাকা। দি অ্যাডভেঞ্চারস অব দ্য ব্ল্যাক গার্ল ইন হার সার্চ ফর গড-এর ছবিওয়ালা শক্ত মলাটের সংস্করণ আমি তাঁর কাছেই প্রথম দেখি। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বিচিত্রা- তিনটে পত্রিকারই তিনি গ্রাহক। বছরের শেষে সেট করে বাঁধিয়ে রাখতেন। ঐ পত্রিকাগুলিতে কত যে লেখকের লেখা পড়েছি। রামপদ মুখোপাদ্যায়, পৃথ্বীশচন্দ্র ভট্টাচার্য, সুবোধ বসু, নীরদরঞ্জন দাশগুপ্তের কথা কি কেউ মনে রেখেছে আজ। সুবোধ বসুর হাসির নাটক ‘কলেবর’ এবং মিষ্টি উপন্যাস ‘মানবের শত্রু নারী’ এত দিন পরেও মনে পড়ে। তার সঙ্গে জড়িয়ে ষাট বছর আগেকার সময়টাও মনে পড়ে। ১৯৩৮ সালে শরৎচন্দ্র হঠাৎ মারা গেলেন। যকৃতে ক্যানসার হয়েছিল। তাঁর শেষ দিকের অনেক কথাবার্তা, টুকরোটাকরা চিঠি, ঘনিষ্ঠ খবরাখবর তখনকার ভারতবর্ষ আর বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল।
কালাচাঁদমামার একটি চোঙওয়ালা গ্রামোফোন ছিল। সেই গ্রামোফোনে দিলীপ রায় উমা বসুর সমস্ত গান, সাবিত্রীদেবী কৃষ্ণাণের গান, স্বামী সত্যানন্দের গান, হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গান যতবার ইচ্ছে শুনেছি। জীবনের গোড়ার দিকের এইসব সঙ্গ ও আনন্দের জন্য আমি এই জন্মের কাছে, এই মানুষদের কাছে ঋণী।
যে সময়টার কথা বলছিলাম সে সময় দিদি বরিশাল শহরে তাঁর কালাচানের কাছে থাকছেন। গরমের ছুটিতে বাড়ি যাবার পথে আমিও সেখানে কদিন কাটালাম। এখানে দিদিকে দেখলাম একটু বদলেছেন। ব্যক্তিত্ব আরও স্পষ্ট। আগের মতো ভূতের ভয় নেই। ধবধবে বিছানার পাশের সাদা দেয়ালটি পেনসিলের ছোট ছোট দাঁড়িতে ভীষ্মের শরশয্যা হয়ে আছে। জপ যতবার হাজার সংখ্যা পূর্ণ হয় ততবার দেয়ালে একটি করে দাঁড়ি টানেন। এই চলেছে দিনরাত। তাঁর বিছানায় কেউ বসবে না, তাঁর গদিমোড়া কৌচ কেউ ছোঁবে না। ঠাকুরমশায় খাঁটি ঘি ছড়িয়ে অতি সুঘ্রাণ নিরিমিষ রাঁধেন। নিত্য ভোগ হয়। নাগাবাবা এখানেই আছেন। দিদিমা মাসিমাও এখানে এসে কিছুদিন দিদির পরিচর্যা করে গেছেন।
কিন্তু নাগাবাবার এত সুখ সহ্য হল না। কালাচাঁদমামার অকালে মৃত্যু হল। পুত্রশোকাতুর রোগজীর্ণ বৃদ্ধাকে কাছাড়ের চা-বাগানে বড় মেয়ের কাছে আশ্রয় নিতে হল। সেখান থেকে দিদিমাকে চিঠি লিখতেন।
রোগ এক রকমের তপস্যা। দুঃখও এক রকমের তপস্যা। এতদিন রোগে যা হয় নি এবার পুত্রশোকে তাই হল– বৃদ্ধা রানীর মতো মহিলা পুত্রশোকে দীনভিখারির মতো হয়ে গিয়েছিলেন।
দিদি তো প্রথম থেকেই খুব জপ করতেন। দিনরাত জপতে জপতে ভক্তের হাড়ে ইষ্টের নাম ছাপা হয়ে যায়। পুত্রশোকও নাকি হাড়ের গায়ে ছেলের নাম লিখে যায়। মৃত্যুর আগে দিদির জীর্ণ হাড়গুলি এইভাবে আরও জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাদের সারা গায়ে শুধু দুটি নাম ব্রেইলের অন্ধ ঘুচে কুঁড়ে কুঁড়ে লক্ষ বার লেখা।
নাগাবাবা দিদিকে কারো কারো পূর্বজন্মের কথা বলে দিতেন। একটি নাতনী সম্বন্ধে বলেছিলেন ও আছিল হাউদা গোয়ালনী অর্থাৎ বোকা গোয়ালিনী। ঐ কিশোর বয়সে ব্যাপারটা আমার কাছে রোমাঞ্চকর লেগেছিল। ঐ মেয়েটা সেই কৃষ্ণের সময়কার গোকুল বৃন্দাবনে জন্মেছিল বোকাসোকা হলেও গোপীদের একজন ছিল? পুরাণের আমল থেকে জন্মাতে জন্মাতে এত দূর পর্যন্ত এসেছে!
পরে, যখন সে বড় হল, যুবতী হল, আমি ভালো করেই বুঝেছিলাম, জীবনের কতগুলো বাস্তব চরিতার্থতার ব্যাপারে সে এজন্মেও বোকা রয়ে গেছে, কিন্তু জন্মান্তরের সূত্রে তার চরিত্রে আছে পৌরাণিক নায়িকার সবলতা, আকর্ষণী শক্তি এবং কর্মকুশলতা। আধুনিকতা এবং পৌরাণিকতা, ঈশ্বরভক্তি এবং অভিসারিকাভাব তার স্বভাবে অদম্য হয়ে কাজ করত। দুঃখী এবং অশক্ত আত্মীয়স্বজনের ভরসা এবং ছিটকে যাওয়া স্বার্থপর আপনজনদের যোগসূত্র ছিল সে। তার অকালমৃত্যুর পরে ঐ পরিবারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ চিরতরে ছিন্ন হয়ে গেল।
.
উদয়াস্ত
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।
এই দুই ছত্র গান সূর্যের উদয়ের আগে শুরু হয়ে অবিচ্ছেদে চলে গিয়ে শেষ হবে সূর্যাস্তের পরে। এই হল উদয়াস্ত কীর্তন। সাধুদিদির বাড়িতে প্রত্যেক বছর উদয়াস্ত হয়। দেখাদেখি দিদিমাও নিজের বাড়িতে সেটি চালু করলেন। নির্মেঘ নাতিশীতোষ্ণ সময়ের একটি সাধারণ ছুটির দিন ধার্য করা হল। আমাদের বারবাড়িটি ফাঁকা করে মেঝেয় শতরঞ্জি বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। শেষরাতের প্রায়ান্ধকার ঘরে আশপাশের কয়েকজন খোল করতাল নিয়ে গান শুরু করল। দুটো লন্ঠনে ঘরে একটু আলো হয়েছে। ঐ শেষরাতে কোথায় আর তেমন গাইয়ে পাওয়া যাবে আমাদের ফুটবলের রাইট আউট, গোসাঁইপ্রভুর শিষ্য, তেরো-চোদ্দ বছরের রাধারমণ দাস, ডাকনাম রাধে, মূল-গায়েন হল। খোল টেনে নিয়ে গৌরচন্দ্রিকা, বন্দনা শেষ করে সে-ই হরে কৃষ্ণ ধরল। রাধের গানের গলা এবং খোলের হাত দুটোই মধুর। কিন্তু ঐ সকালে তার দোহারদের বেশির ভাগেরই বসা গলা, ধরা গলা, ভাঙা গলা। অবস্থা দেখে গোপালমামা এক ডজন কাপ আর বড় কেতলি ভরে গরম চা নিয়ে এল। ক্রমশ আলো ফুটল, আম গাছে ভোরের পাখি ডাকল, লণ্ঠন নিবিয়ে দেওয়া হল, হরে কৃষ্ণ চলতে থাকল।
এসব উৎসবে সেভাবে কাউকে নিমন্ত্রণ করা হয় না। তবু খবর ছড়িয়ে যায়। ভক্তের দায় ভগবান নির্বাহ করেন। ক্রমশ ভরাট গলার নতুন নতুন কীর্তনীয়া এসে জোটে। তারাই উঠোনের পাশে কাঠের গুঁড়ি দিয়ে ধুনি জ্বালায়। গোপালমামা আবার কেতলি ভরা চা আর চৌকো করে কাটা হালুয়া আনে। গায়করাই আরও খোল করতাল জুটিয়ে আনে। বাড়ি ভরে ক্রমশ চেনা লোকদের সঙ্গে অচেনা লোকের দল মিশে গিয়ে খাটে, খায়, গান গায় উৎসবে মাতে। বেলা বাড়ছে, এখন গান আবার স্তিমিত হয়ে যাবে। সকালের কীর্তনীয়ারা যে যার বাড়িতে গিয়ে স্নানটান করে পেটে খিদে নিয়ে ফিরে আসবে।
গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত পাড়ার মহিলারা উঠোনে বসে গল্প করেছেন আর বঁটি পেতে ঝুড়ি ঝুড়ি তরকারি কুটেছেন। আজ উঠোনে পাশাপাশি তিন-চারটে নতুন উনুন পেতে, একটুখানি ত্রিপল টাঙিয়ে বড় বড় হাঁড়ায় বৈষ্ণবসেব্য খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। খিচুড়ি নামলে পাঁচমিশুলি তরকারি চাপবে। খটখটে পরিচ্ছন্ন উঠোনের একদিকে একটু ছায়া পড়েছে। এই ছায়া আরও ছড়িয়ে যাবে। সেখানে আসন কলাপাতা বিছিয়ে পংক্তিভোজন
দুপুরে কীর্তন ঝিমিয়ে এল। এক দল খেতে আসে তো অন্য দল কীর্তন চালু রাখে। এরা খেয়ে ফিরে গেলে আবার ওরা আসবে খেতে। কিন্তু পেট ভরে খাওয়ার পরে একটু ভাতঘুম পায়, একটু বিড়িতামাকের নেশা পায়। অতএব তখন গান চলে গ্রীষ্মের হাওয়ায় চলন্ত শুকনো পাতার শব্দের মতো পাতারা যেন হাই তুলতে তুলতে ফিসফাস গুজগুজ গল্প করছে বা চলে যাচ্ছে।
কিন্তু বিকেল পড়তে না পড়তে নতুন নতুন শক্তিশালী লোক এসে যোগ দিতে থাকে, ঝিমিয়ে পড়ারা চাঙ্গা হয়ে ফিরে আসে। পুরো কীর্তনের দলটি ঘর থেকে নেমে আসে উঠোনে। সকালবেলা রাধে একটু ঘুমভাঙা ভোরাই সুর দিয়েছিল, তার পর থেকে সারা দিন একঘেয়ে ঝালাপালা চলছে। এবার কয়েকজন গাইয়ে পূরবী, পুরিয়া, মুলতান, ইমন-এ গেয়ে বেশ মাধুর্য আনলেন। কীর্তনীয়াদের গলা যাতে শুকিয়ে না যায় তাই লবঙ্গ দিয়ে গাঁথা খিলি খিলি পান সারা দিন ধুচুনি ভরে এসেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসে। জোরালো বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। শহরের এবং শহরতলির ডাকসাইটে ভক্তেরা এসে যেন কীর্তনটিকে অধিগ্রহণ করেন। তখন আর কেউ বসে নেই, সবাই গোল হয়ে মণ্ডলী করে ঘুরে ঘুরে গাইছে, লাফিয়ে লাফিয়ে খোল বাজাচ্ছে, মধ্যিখানে জনা দুই উদ্দাম নৃত্য করছেন। তাঁদের পরিপুষ্ট ভোলা গা ঘামে ভেসে যাচ্ছে। নাচতে নাচতে অবধারিতভাবে একজনের ভাব হবে তিনি বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে কীর্তনীয়াদের পায়ে পায়ে মসৃণ উঠোনের মাটিতে পড়ে গড়াতে থাকবেন। কীর্তনীয়ারা সরে সরে তাঁকে গড়াবার জায়গা করে দেবে। ইতিমধ্যে আরেকজনেরও ভাব হবে। তিনিও মাটিতে পড়ে গড়াতে থাকবেন। কীর্তন উদ্দাম হয়ে উঠবে।
একবার এক ভক্ত, আমার মনে আছে, ঐ রকম গড়াতে গড়াতে ধুনির উপর দিয়ে চলে গেলেন। সবাই হা হা করে উঠল। কিন্তু অমন ভাবে পাওয়া মানুষকে ছুঁতে নেই, আর ভাবগ্রস্ত মানুষটিরও চেতনা ফিরতে নেই। অতএব তিনি দ্বিতীয় বার পিঠ পুড়িয়ে, উলটো পাকে গড়িয়ে গড়িয়ে আবার ধুনিটা পেরিয়ে এলেন। এই নিয়ে পরে যুবকমহলে হাসাহাসি হয়েছিল।
এক সময় বাতাসার লুট হয়। ভাবে আপ্লুত হয়ে ভক্তেরা এ ওকে প্রণাম করে। এই শেষ পর্যায়ে এসে কীর্তন একটা চূড়ায় পৌঁছত। আসলে পুরুষদের গান তো, শেষ পর্যন্ত বীররস দেখা দেবেই। গায়কেরা গাইতে গাইতে হুংকার দিত, আকাশে লাফ দিত। অবশেষে বার তিনেক বিলম্বিত লয়ে গাওয়ার পর আচম্বিতে সেই গান থামত। এত উচ্চ নিনাদের পর হঠাৎ সব নীরব, শুনশান। আমাদের কান ভোঁ ভোঁ করছে। একটু একটু চাঁদ উঠেছে। মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে। আড়াই শো তিন শো মানুষের প্রসাদ পাওয়া হয়েছে, উদয়াস্তের মধ্যে মুহূর্তের জন্যেও গানে ছেদ পড়ে নি। সবাই খুশি। দিদিমার মুখে সৌভাগ্যবতীর ও বিজয়িনীর হাসি। অন্তঃপুর থেকে তিনি একাই প্রায় সমস্তটা পরিচালনা করেছেন। গোপালমামা তাঁর লেফটেন্যান্ট।
.
বাটঠি মৌলবী
নরসিংহ স্কুলের মুসলমান হস্টেল আমাদের পাড়ার গা ঘেঁষে। মাটির ভিতের লম্বা ব্যারাক ছ-সাতটা কামরায় ভাগ করা। রসুইঘরটি আলাদা, সেখানেই ছেলেরা মাটিতে বসে ভাত খায়। ইস্কুলের আরবী ফারসীর মৌলবী হলেন হস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট। প্রথম ঘরটিতে তিনি তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন। বাকি ঘরগুলোয় আছে দশ-বারোজন মুসলমান ও একজন খ্রীষ্টান ছাত্র। সবাই একান্নবর্তী। সপ্তাহে একদিন দুটি করে মুরগি জবাই হয়। সন্ধেবেলা তাদের গলায় ছুরির পোচ দিয়ে ছেড়ে দিলে যন্ত্রণায় তারা রসুইখানার পিছনে অন্ধকার ঝোপের মধ্যে পালিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড ঝটাপটি করে থেমে যায়।
পাড়ায় মৌলবীসাহেবের অবস্থানটি বেশ অদ্ভুত। স্কুলের ছাত্রেরা ও পাড়ার ছেলে বুড়ো তরুণী সবাই তাঁকে বাটঠি মৌলবী অর্থাৎ বেঁটে মৌলবী বলে উল্লেখ করেন। প্রাচীন ইট্রাসকান পুরুষের মতো তাঁর চওড়া, চ্যাপটা, মোটা ঘাড়। গোঁফ কামানো, কালো কুচকুচে আবক্ষ দাড়ি, চোখে সুর্মা। লুঙ্গি বা পায়জামার উপরে আলখাল্লার মতো ঢিলে লম্বা পিরান পরেন তিনি। তাছাড়া, স্কুলে যাবার সময় মাথায় ফেজ, অন্য সময়ে সাদা মলমলের টুপি।
মৌলবীসাহেব কারো সঙ্গে কথা বলেন না, কারো ভালোমন্দের খোঁজ নেন না। কী কথাই বা বলবেন! স্কুলে একদল হিন্দু সহকর্মী, পাড়ায় একগাদা হিন্দু প্রতিবেশী। এদের সঙ্গে কি নিয়ে কথা বলবেন তিনি? তাঁর পাঁচ-ছটি পুত্র দুটি দুটি করে তারা বাবার কাছে থেকে মানুষ হয়, তার পরে বৃহৎ সংসারে বেরিয়ে পড়ে। মুসলমান এবং ইহুদী অর্থাৎ প্রাচীন সেমেটিক জগতের দু দিক মিলিয়ে তিনি ছেলেদের নাম রেখেছেন ইব্রাহিম, ইসাক, ইয়াকুব, ইউসুফ, ইসমাইল অর্থাৎ আব্রাহাম, আইজাক, জেকব, জোসেফ, মাইকেল…। এসব কে বোঝে! ইয়াকুব ও ইউসুফ আমার বন্ধু ছিল- দুজনই দেখতে ভালো, ফরসা, দৃঢ়স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্ন। তারাও নিজেদের নামের পিছনে এত যে কুদরত তা কিছুই জানত না। আমি তো জানতামই না।
রোজ একটা সময়ে মৌলবীসাহেবকে পাড়ার সবাই দেখতে পায়। প্রাতঃকৃত্যের পর মাথায় আরব শেখদের স্টাইলে গামছা ফেলে, লুঙ্গি পিরান পরে মিউনিসিপালিটির পুকুরে স্নান করতে চলেছেন। পাড়ায় যেমন কালোশশীমাসির বাবা রমণীদাদু আছেন, সাধ্যবাড়ির কর্তা আছেন, আমার দাদু আছেন, তেমনি বাটুঠি মৌলবীও আছেন। এইভাবেই চলছিল।
কিন্তু রাধারঞ্জন ডাক্তারের সাত বছরের ছেলেটি ছিল ছিটগ্রস্ত, সে যে কখন কি ভাবে, কখন কি করে বসে ঠিক নেই। বাটঠি মৌলবীর গাম্ভীর্য, ভিনদেশী হালচাল তার পছন্দ হয় নি। সে তক্কে তক্কে ছিল। একদিন যখন মৌলবীসাহেব পুকুরে যাচ্ছিলেন সে পিছন থেকে গিয়ে আচমকা তাঁর লুঙ্গিটি তুলে ধরল। দিবালোকে এই রকম বেইজ্জত! মৌলবী খেপে গেলেন। পাড়াতে বিরাট হৈ চৈ এবং অল্পবয়সীদের মধ্যে হাসাহাসি। যা হোক, সাত বছরের বালক শাস্তিযোগ্য নয়- এই কথা বিবেচনা করে মৌলবীসাহেব শেষে শান্ত হলেন। কয়েকদিন পরে, যেমন পুকুরে যাচ্ছিলেন তেমনি যেতে লাগলেন। পাড়ার সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
.
কুঞ্জলতা
আর্যপট্টি থেকে একদিন শীতের বিকেলবেলা কুঞ্জলতা এল। অন্দরের দিকে না গিয়ে আমার পড়ার ঘরে চুপি চুপি অপ্রস্তুত মুখে এসে দাঁড়াল। কুঞ্জদিদি আমার চেনা, কিন্তু কোনোদিন তাকে তেমন লক্ষ করে দেখি নি। দিদিমাদের আলগা কথাবার্তার মধ্যে শুনেছিলাম, তার দু-তিন বছর হল বিয়ে হয়েছে, কিন্তু বর তাকে নেয় না। সে দাদা বৌদির আশ্রয়ে থাকে। কিন্তু তার দুঃখ-সুখের খবর আমি কী জানি। আজ দেখলাম, শীতের কুঞ্জলতার মতোই তার চেহারা ময়লা শাড়ি, রুক্ষ ত্বকে আঁচড় কাটলে দেহে হরেকৃষ্ণ লেখা যাবে, ঘন চুলের শ্যাম চিরল চিরল পাতা এখন শুকিয়ে গিয়ে পাঁশুটে হয়েছে।
কুঞ্জদিদি আঁচলের আড়াল থেকে একটি পোস্টকার্ড বের করে সলজ্জ মুখে নিজের ভাষায় যা বলল তার নির্গলিতাৰ্থ হল- অনেকদিন সে ভাইয়ের বাড়িতে পড়ে আছে। তার খুব দুঃখ। এই পোস্টকার্ডে তার স্বামীকে একটি চিঠি লিখে দিতে হবে যাতে সে অবিলম্বে এসে তাকে নিয়ে যায়। এ রকম চিঠি লেখার অভ্যাস আমার আছে। ছুটির দিনে দিদিমা প্রায়ই রাঁধতে রাঁধতে তাঁর ভাই বোন আর গুরুদেবের চিঠি ডিক্টেট করেন আর আমি তলিপির মতো হুবহু তাই লিখি। অতএব আমি সেই কায়দায় কুঞ্জদিদির দিকে তাকিয়ে বললাম- বলো। কুঞ্জদিদি থতমত খেয়ে বলল- তুই লেখ। অগত্যা আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে লিখলাম, শ্রীচরণকমলেষু। লিখেই মনে হল, পরমারাধ্য পূজ্যপাদ লিখলে বোধ হয় আরও ভালো হত। যাক গে। আমি আবার কুঞ্জদিদির দিকে তাকালাম- হ্যাঁ, তার পর বলো। কুঞ্জলতা বেপরোয়াভাবে বলল- লিখ্যা দে, আইত্যো বুইল্যা। অর্থাৎ লিখে দে, যেন সে আসে। আমি একটু থমকে গিয়ে প্রায় দোভাষীর মতো লিখলাম, আপনি আসিবেন।–-হুঁ, তার পর বলো। কুঞ্জলতা অধৈর্যভরে বলল– আরে তুই লিখ্যা দে না, আইত্যো বুইল্যা। আসলে ঐ একটিই তো তার জরুরি কথা, হৃদয়ের আর্তি। আমি আবার লিখলাম, আপনি অবশ্য ২ আসিবেন। চিঠি শেষ। এর পর নিচে শুধু সেবিকা কুঞ্জলতা। চিঠির মাথায় কুঞ্জলতা বর্ধনের দাদার নাম, ঠিকানা ও তারিখ লেখা হল। উলটো পিঠে স্বামীর নাম ঠিকানা টোকা হলে আমাদের পত্ররচনা শেষ হল। এবং শেষ হওয়ামাত্র কুঞ্জদিদি চিঠিটি আঁচলের তলায় লুকিয়ে ফেলল। সুযোগ খুঁজে সে নিজেই ডাকে দেবে।
মাস দুয়েক অপেক্ষার পর কুঞ্জদিদি আবার একদিন বিকেলে এল। আবার সেই একই চিঠি একই প্রণালীতে লেখা হল। তখন বসন্তকাল। শীত নেই বলে এবার তার গায়ে খড়ি উড়ছে না। এছাড়া কোনো পরিবর্তন নেই। একই চিঠি নিয়ে দুটি ঋতু চলে গেল, কিন্তু কুঞ্জদিদির স্বামী এল না। স্বামী না আসায় কুঞ্জদিদি বোধ হয় আমাকেই অকর্মা এবং অপয়া ভেবেছিল। এর পর আর দেখা হলেও সে কথা বলে নি।
ধীরে ধীরে তার চেহারা আরও মলিন হয়েছে, একলা এখানে সেখানে যেন সে কিছু খুঁজে বেড়ায়। সারসীর মতো কুৎসিত পা, উঁচু কপাল, রোগা লম্বা গলা, তেমনি থমকে থমকে চলা তাকে লোকালয়ের চেয়ে নদীতীরেই বেশি মানায়। ক্রমশ সে আর মানুষের চোখে পড়ে না।
.
নাটাই মঙ্গলচণ্ডী এবং সংকটতারিণী
সৌভাগ্যবতী হবার জন্য দিদিমা আরও যেসব ধর্মাচরণ করতেন তার মধ্যে নাটাই মঙ্গলচণ্ডী আর সংকটতারিণী ব্ৰত দুটি বেশ কৌতুককর। সন্ধে পেরনো রাত নাটাই মঙ্গলচণ্ডীর সময়। দেবীর মূল প্রসাদ হল চালের পিটুলি। সেই পিটুলিটুকুতে যেন আলো না লাগে অন্ধকারে নিতে হয়, ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে গিয়ে মনস্কামনা জানিয়ে খেতে হয়। বারান্দায় পুজো হত। আমি আমার পিটুলিটুকু নিয়ে বড়ঘরের পিছনে আম গাছের ঘুটঘুটি অন্ধকারের নিচে গিয়ে দাঁড়াতাম। এখন তো দাদু ঠাকুমা কাকা কেউ নেই, তাদের জন্য কিছু চাইবারও নেই। সুতরাং কিছু একটা চেয়ে, নাটাই মঙ্গলচণ্ডী বা অন্ধকারের কানে কানে সেই কথা জানিয়ে সেই স্বাদহীন পিটুলি খেয়ে মাথায় হাত মুছে ফিরে আসা।
সংকটতারিণী ব্ৰত ছিল সত্যিকারের মজার, আমার পক্ষেও, দিদিমা মাসিমার পক্ষেও। এটি হত শীতের দিনে, দুপুরবেলায়, হেঁশেলে, যখন বাড়ির কর্তারা অনুপস্থিত। ব্রতটির নিয়ম খুব সরল। কোনো পুজোআচ্চার ঝঞ্জাট নেই। প্রত্যেক ব্রতধারিণীর জন্য এর উপকরণ হল: ১৬ মুঠো চালের ভাত, ১৬ টুকরো পাকা রুই ও ১৬ টুকরো ফুলকপির ঝোল। শেষপাতে ১৬ হাতা দুধ আর ১৬টি পাকা কলা। স্নানটান করে এই ভাত এবং মাছের ঝোল যার যার হাঁড়ি কড়ায় নিজের হাতে বেঁধে পুরো পাত্রসুদ্ধ সাজিয়ে নিয়ে খেতে বসতে হবে। পিঁড়িতে বসে ব্রতকথাটি, অর্থাৎ আধ ঘণ্টার একটি লম্বা গল্প, প্রথমে বলে নিয়ে তার পর খাওয়া শুরু। আমার মনে হত, এই খাওয়াটাই আসল ব্রত।
মাসিমার খাওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। সুতরাং খুব ছোট ছোট মুঠোয় সে চাল নিত। কপি আর মাছ ছোট ছোট টুকরো করত। দিদিমা ওসব ফাঁকিবাজিতে নেই। চুপচাপ দুপুরবেলা যার যার হাঁড়িভরা ভাত, জামবাটিভরা মাছের ঝোল, দুধ, কলা ইত্যাদি নিয়ে পাশাপাশি বসতেন। দিদিমা গল্পটি বলতেন। গল্পটি আর কিছু নয়, কি করে এক মহিলা এই ব্রত করে ভয়ংকর সব বিপদ পেরিয়েছিলেন। মাসিমা শুনত, দরজার বাইরে বসে আমিও শুনতাম, কারণ এই ব্যাপারে শেষটায় আমারও একটি মোক্ষম ভূমিকা থাকবে।
ব্রতকথা শেষ হলে খাওয়া শুরু হল। এই খাওয়ার তিনটি নিয়ম আছে: খাবার সময় কথা বলা চলবে না। শুধু মাছের কাঁটা ও কলার খোসা ছাড়া ভাত বা তরকারির একটি দানাও অবশিষ্ট থাকবে না। উবু হয়ে বসে ডান হাতটি ডান পা ও জানুর ফাঁক দিয়ে গলিয়ে ভাত মাখতে হবে এবং ঐভাবেই মুখে গ্রাস তুলতে হবে। খাওয়া শেষ হলেও হাতটি ঐ পায়ের ভাঁজের মধ্য থেকে বার করা চলবে না, কথা বলাও নিষেধ, যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য এক ব্যক্তি ব্ৰতিনীদের ‘সংকটে পার হও, সংকটে পার হও, সংকটে পার হও’ বলে সংকটমুক্ত করে দিচ্ছে। এইটে করার জন্যই বুঝিয়েসুঝিয়ে আমাকে ঐখানে মোতায়েন রাখা। ইশারা করার পরও আমি গড়িমসি করতাম। প্রত্যেক বারই দারুণ ইচ্ছে হত ঐ দুই টুঈডলডাম আর টুঈডলডিকে অনন্তকাল ধরে ঐ ভঙ্গিতে বসিয়ে রাখি। কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে ওঁদের পার করে দিতাম।
.
নাগাদের কথা
জায়গাটা আসলে উপনিবেশ। ভূমিপুত্র কেউ নেই। শহরটি ছোট, কিন্তু রাস্তাঘাট মসৃণ, সাইকেলে আধ বেলাতেই প্রদক্ষিণ করে আসা যায়। শহরের কেন্দ্রটুকু ছাড়িয়ে গেলেই জনবসতি ক্রমশ হালকা। আদিতে এখানে যারা ছিল তারা কোথায় গেছে কে জানে। নতুন করে, তিন রকমের লোক এখানে এসে বাসা বেঁধেছে। প্রথম দলে আছে সিলেট আর পুর্ববাংলার বাঙালিরা। দ্বিতীয় দলে আছে কিছু মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর লোক- নাগা, মিজো, মেইতেই, গোখা, খাসি। তৃতীয় দলে আছে অতি অল্প পরিমাণে ইউরোপয়েড।
নানা কারণে নাগারা আমার মনকে টানত। নাগারা টিবেটো-বার্মিজ গোষ্ঠীর লোক। আসাম-ব্রহ্ম সীমান্তে পাহাড়-জঙ্গলে তাদের কত কালের দুর্ভেদ্য দেশ! তারা নৃমুণ্ডশিকারী, গভীর জঙ্গলে নিজের বাড়িতে তারা লেংটিটুকুও পরে না। দা এবং বর্শা তাদের অস্ত্র। ব্রিটিশ সরকার তাদের সঙ্গে একেবারেই পেরে উঠত না। অবশ্য সেই বাঁশ-লতা-গাছে ঘনাচ্ছন্ন দুর্গম পাহাড়ে পেরে ওঠা কঠিনও বটে। মুখরক্ষার জন্য অগত্যা সরকার বাহাদুর তাদের গ্রামপ্রতি বার্ষিক এক টাকা কর ধার্য করেছিলেন। নাগারা সেই এক টাকাও দিত
এই নদীউপত্যকা নাগাদের জায়গা নয়। তবু তারা এসেছিল জীবিকার খোঁজে, অথবা একটি অদ্ভুত জীবিকা দিয়ে তাদের এখানে আনা হয়েছিল। তখনও সেপটিক ট্যাংকের প্রচলন হয় নি। শহরে ভূগর্ভ পয়ঃপ্রণালীও ছিল না। পাড়ার সারবাঁধা বাড়িগুলির পিছনের দিকে গাছে ঢাকা, খটখটে শুকনো নালার দুই পাড়ে ছিল খাটা পায়খানাগুলো। এই পায়খানার মেথররা সবাই ছিল নাগা। সেই নালায় নেমে টিনের বালতিতে তারা দুপাশে থেকে মল সংগ্রহ করত। কতদিন এমন হয়েছে, পায়খানায় গেছি, পিছনের নালায় শুকনো পাতা আর গাছপালার নড়াচড়ার শব্দ শুনে চমকে দেখি, লেংটিপরা হরিতালবর্ণ সুঠাম শরীরের কোনো পুরুষ তার মলের বালতি নামিয়ে রাখছে বা খাটা পায়খানার গামলার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। ওরা আমাদের দিকে চেয়েও দেখত না, কথাও বলত না। পুজো গেছে, দোল গেছে, কোনোদিন বাড়ির দরজায় এসে একটি পয়সা বকশিশ চায় নি। কুকুর বেড়াল ছাগল সাপ কাঠবেরালির মতো পিছনের জঙ্গলাকীর্ণ নালায় কেবল ওরাই চলাফেরা করে। পুরুষরা কোমরে জড়িয়ে সাদা লেংটি পরে। মেয়েরা শৌখিন, তারা ব্লাউজের নিচে স্কার্টের মতো করে ঘরে বোনা লাল কালো ডুরে লুঙ্গি পরে। তারা নকল গয়না পরে, সুন্দর করে চুল বাঁধে। পুরুষেরা বালতি করে মল নিয়ে এলে তারা সেগুলোকে হুইল ব্যারো করে দূরে নিয়ে যায়। মাইনের দিন দুপুর থেকে ওরা পুরুষ মেয়ে মিলে মিউনিসিপ্যালিটির চত্বরে এসে জমা হয়।
নাগাদের জন্য আমার মন খুব খারাপ হত। ঐ শুকনো নালার মধ্যে হলুদ শ্বাপদের মতো ওদের নীরব চলাফেরার ছবি আমার মনে পড়ত। কেউ চালাকি করে ঐ নোংরা কাজটা ওদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। পরে যখন নাগারা ইংরেজি শিখেছে, কটিবাস ছেড়ে প্যান্টশার্ট ধরেছে, নিজেদের রাজ্য দাবি করেছে, তখন মনের মধ্যে একটা বহুদিনের রুদ্ধ প্রতিশোধ যেন ছাড়া পেয়ে উদ্ভাসিত হয়ে হাততালি দিয়েছে বেশ হয়েছে! ভালো হয়েছে।
রাস্তার কুকুরেরা নাগাদের দেখলেই পরিত্রাহি চেঁচাত। কুকুরের মাংস ওদের প্রিয় খাদ্য। মাঝে মাঝে কাজের শেষে বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় রাতের ভাতমাংসের জন্য একটা কুকুর কেউ ধরে নিয়ে যায়। বেতের ফাঁসে ধরা কুকুরটা ছাড়া পাড়ার আর সব কুকুর চেঁচাতে চেঁচাতে চলল ওদের পিছনে। নাগাদের কুকুর খাওয়ার পদ্ধতিটি অদ্ভুত। জ্যান্ত কুকুরটাকে তারা কাঁচা চাল খাওয়াতে থাকে। আমিষাশী কুকুর চাল খাবে কেন! অতএব ওরা জোর করে তার মুখ ফাঁক করে কামানের মধ্যে বারুদ গাদার মতো ঠেসে ঠেসে তাকে আকণ্ঠ চাল খাওয়ায়। ঐভাবে চাল খেতে খেতে কুকুরটা মরে যায়। এখন আগুনে ঝলসালে তার মাংস ও পেটের মধ্যেকার চাল সুপক্ক হয়ে উঠবে। এর পরে, তারায় ভরা নৈশ আকাশের নিচে নিভন্ত আগুনের চারদিকে গোল হয়ে বসে ঐ মাংস আর ভাতের পিণ্ড খাবার সুখ আমি না দেখেও ভেবে নিতে পারি।
কিন্তু, আরও রাত্রে, বালিশের কাছে, পাড়ার কুকুরটার কাঁচা চালে আটকে যাওয়া দমবন্ধ গলার কান্না শুনতে পাই যেন।
.
মণিপুরীদের কথা
মেইতেইদের দেশ মণিপুর বলে আমরা তাদের ডাকনাম দিয়েছি মণিপুরী। মণিপুরীরা চিনে জাপানীদের মতো চোখ নাক মুখের জায়গায় ছোট্ট ছোট্ট ফুটো, অভিব্যক্তিহীন মঙ্গোলয়েড না। তাদের চোখে, ঠোঁটে, শরীরে, আঙুলে ভাব আছে, বাঙালিদের মতোই তাদের মন সহজে পড়া যায়। তারা ধর্মে বৈষ্ণব, নাচে গানে মার্শাল আর্টে পারঙ্গম। সংস্কৃতির দিক থেকে ভারতীয় মূল স্রোতেই রয়েছে তাদের শিকড়। তাদের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা, তব সেই ষাট সত্তর বছর আগে দেখেছি, বাংলা ভাষা ও বাঙালি শিক্ষার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল তারা। আমাদের সঙ্গে যে মণিপুরী ছেলেরা পড়ত তারা তো আমাদের মতোই সাধু বাংলায় লেখাপড়া আর কথ্য বাংলায় আগল্প চালাত। ক্লাস সিক্সে আমাদের ফার্স্ট বয় ছিল জগৎ সিং, স্কুল টিমের গোলকীপার ছিল বীরেন সিং, অ্যাডভেঞ্চারার এক্সপ্লোরার ছিল ক্লাস নাইনের মাধব সিং, আমাদের অঙ্কের মাস্টারমশাই ছিলেন রমণ সিং, সারা শহরে গানের একমাত্র টিউটর ছিলেন ব্রজেন সিং। এঁরা তো সবাই মণিপুরী।
মণিপুরী জীবনের রঙিন সৌন্দর্যের দেখা পেতাম মণিপুরী মেয়েদের মধ্যে। তারা বিকেলের দিকে প্রকাণ্ড ধামায় করে টাটকাভাজা মুড়ি নিয়ে আসত, শীতের সকালে খেতের শিশিরভেজা রাইশাক মুলো নিয়ে আসত বিক্রির জন্যে। মণিপুরী মেয়েরা নিপুণ তাঁতী। তারা ঘরে পা ছড়িয়ে বসে কোমরে টানা বেঁধে বিচিত্র রঙের সুতোয় তাঁত বোনে। তাদের পুরো সাজ বুক অবধি মোটা খাপি লুঙ্গি, স্তনের উপর লুঙ্গিটিকে বাঁধবার গামছার মতো রঙিন কাপড় নিজেরাই বুনে নেয়। তরুণী বউদের জন্যে এর উপর থাকে সুতি বা সিল্কের ওড়না। ওড়নাগুলো একরঙা হালকা জাফরানী, ফিরোজা, কুসুম রং। তাদের মাথায় পরিপাটি করে আঁচড়ানো এলো খোঁপা। সারা শরীরে একমাত্র অলংকার কাঁচা সোনার দুটি ভারী কুণ্ডল। এত ভারী যে কানের ঘেঁদা আধ ইঞ্চি লম্বা হয়ে ঝুলে পড়েছে। এই পোশাকে এক একটি মেয়েকে এক একটি সৌন্দর্যছবির মতো লাগত।
এক মাঝবয়সিনী তার নতুন বিয়ে হওয়া পুত্রবধূকে নিয়ে মুড়ি বেচতে আসত। নিজের মাথায় ধামা, বউয়ের মাথায় বিরাট বস্তা। তারা গ্রাম থেকে নদী পেরিয়ে এসেছে পায়ে ধুলো, পরিশ্রান্ত মুখে ঘাম। নতুন বউটির নাকের ডগা চকচক করে, ঠোঁট দুটি টুকটুক করে, কপালে হলদে গিরিমাটির একটি টিপ। দিদিমা টিন ভরে মুড়ি কিনতেন।
এরা অনেক সময় তিনখানা ছেঁড়া কাপড় আর বারো আনা পয়সা নিয়ে খেস বানিয়ে দিত। সেই খেসগুলির রঙের পরিকল্পনা যেন কোনো রাজারানীর দেশের। এই মণিপুরী স্ত্রীলোকদের আমরা, কেন জানি না, দাদী বলে ডাকতাম। কথাবার্তা বাংলাতেই হত। ব্যবসার দামদর, একটু আধটু সুখদুঃখের কথা ওরা সহজেই চালাতে পারত।
একবার আমি একটা গর্হিত অপরাধ করেছিলাম, অবশ্য না বুঝে। এক ছুটির দিনের সকালে স্টেশন রোড ধরে প্রাতভ্রমণ করে ফিরছি। এই সময়ে জায়গাটা চুপচাপ থাকে। মধ্যবয়স্কা এক মণিপুরী স্ত্রীলোক ঐ পথেই কোথাও যাচ্ছিল। আর্যপট্টির একটা চেনা ছেলে দাঁড়িয়েছিল, আমাকে দেখতে পেয়ে ডেকে বলল- যা তো, ঐ দাদীকে, কাছে গিয়ে ‘দাদী মথন করিতো নি? বলে আয় তো। আমি তার গলার স্বরে বুঝতে পারছিলাম, কথাটা বললে বেশ একটা মজা হবে। ঐ ছেলেটা আর আমি প্রায় একই বয়সী। মৈথুনের অর্থ, বা মথন যে তার অপভ্রংশ তা আমিও জানি না, সম্ভবত সেও স্পষ্ট জানে না।
এদিকে দাদীর কাছে আমার অমন শুভ প্রস্তাব দেওয়ামাত্র একটা বিস্ফোরণ ঘটল। দাদী গালাগাল দিয়ে তেড়ে এল, এবং আমি পালালাম। একটু দূরে গিয়ে তাকিয়ে দেখি, আর্যপটির ছেলেটা খ্যাখ্যা করে হাসছে এবং এবার দাদী তার দিকে তেড়ে যাচ্ছে। আমি তখন কথাটার অশ্লীলতা আন্দাজ করেছি। নিজেকে খুব হীন মনে হল। পালিয়েছি বলে দ্বিগুণ হীন।
.
ইংরেজদের কথা
নদীউপত্যকায় আমাদের শহরটা ঘুরে দেখলেই বোঝা যায়, এটা ঐতিহ্যপূর্ণ প্রাচীন নগরী নয়, একেবারে আনকোরা, ইংরেজদের হাতে তৈরি একটা ছোট্ট পরিকল্পিত শহর। চা-বাগানের সাহেবদের এখানে ছিল আড্ডা এবং যাতায়াত, তাছাড়া ছিল শাসনকর্তা ইংরেজদের কিছু সরকারী অফিস ও বাংলো। দূর থেকে, কাছ থেকে এই ইংরেজদের সঙ্গে আমাদের প্রায়ই দেখা হত। কিন্তু সে এক অদ্ভুত দৃষ্টিহীন দেখা। অনেক পরে, যখন ফচকেমি করতে শিখেছি তখন এ বিষয়ে বন্ধুদের কাছে একটা গল্প শুনেছিলাম
এক বাগিচাসাহেবের বাংলোয় দুই চুনকামমিস্ত্রী কাজ করতে গেছে। দুজনেই যুবক এবং সুরসিক। তারা কাজ করে আর ফাঁকে ফাঁকে সুযোগমতো লুকিয়ে দ্যাখে অপরূপ সুন্দরী মেমসাহেবটিকে। নিজেদের মধ্যে সেই বিস্ময় বলাবলি করে–
–পিঠত দুইখান পাখনা লাগাই দিলে পরী হই উড়ি যাইত!
— গায়ের রং দেখছেন নি?
— ভিৎরে কিতা আছে কওছাইন।
— ভিৎরে দালান, হাওয়ামহল, ক্ষীরপুখৈর…
–আরে বা, দেশর ভাই শুক্কুর মহম্মদ!
পরের দিন যখন ওরা স্নানঘরে কাজ করছে মেমসাহেব এসে বিবস্ত্র হয়ে বাথটবে নামলেন। ওরা ভয়ে লজ্জায় দেয়ালের গায়ে সিঁটিয়ে রইল। যাবার সময়, দরজার কাছে, অর্ধেলঙ্গ মেমসাহেব ওদের ধাক্কা দিয়ে চলে গেলেন একজনের বাহুতে তাঁর উন্মুক্ত স্তনটি ঘষটে গেল। মেমের স্পর্শজনিত পুলকে তো লোকটির মূৰ্ছা যাবার অবস্থা। আহা! কী নরম! যেন স্বর্গত লই গেল! কিন্তু একটু পরেই তার আহত পৌরুষ চাড়া দিয়ে উঠল– দেখছেন, আমরার মানুষ বইলাই মনে করে না। ঘরত বিড়ালটা মুরগাটার সামনে যেমন ল্যাংটা হয় আমরার সামনেও ল্যাংটা হইল। সাধারণ ভারতবাসী সম্বন্ধে এই ছিল ইংরেজদের মোটামুটি মনোভাব। আমরা যেন সত্যি নই, আমরা যেন ছায়াবাজির লোক।
কাছাড় ক্লাবের প্রশস্ত লনে বিকেলে টেনিস খেলা হত। পুরুষ মেয়ের মিক্সড় ডাবলস্। চারটি কোর্ট ছিল। মেহেদি গাছের ছাঁটা বেড়ার এপাশে দাঁড়িয়ে পথিকেরা ভিড় করে খেলা দেখত। খেলার মান কতটা ছিল কে জানে, কিন্তু সাহেবদের দীপ্ত চেহারা, সাদা পোশাক, উচ্চ হাসি, মেমদের বব করা চুল, জানু দেখানো স্কার্ট, রঞ্জিত লাল অধরোষ্ঠ খেলায় একটা আশ্চর্য জৌলুশ এনে দিত। সন্ধে পর্যন্ত খেলা চলতেই থাকত। একটা দল ধবধবে তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে লনের পাশের বেতের চেয়ারে গিয়ে বসলে অন্য দুই জুটি কোর্টে নামে। দূরে বসা স্ত্রীপুরুষদের উপর পিছনের মেহেদিবেড়ার ছায়া পড়ে ইংলন্ডের গ্রামের কোনো সানন্দ বিকেলের আভাস আনত। বেশ বুঝতে পারতাম, ওরা নিজেদের মধ্যে নিজেদের খুব উপভোগ করছে। অবশ্য খানিকটা তো দেখানোপনা ছিলই।
আমাদের বাড়ি থেকে আট-দশ মিনিটের দূরত্বে চার্চ আর ছ-সাত মিনিট দূরে কবরখানা। উঁচু উঁচু প্রাচীন ঝাউ গাছে ছায়া করে আছে ঢালাই লোহার রেলিংয়ে ঘেরা অনেকখানি শান্ত জায়গা। সেই উঁচু গাছদের ছাড়িয়ে মধ্যিখানে আরও উঁচুতে উঠেছে গির্জার গথিক মিনার। জায়গাটা দিনরাত নিস্তব্ধ নির্জন হয়ে থাকে, রবিবারের সকালেও তেমন কেউ আসে না, মোরামের রাস্তায় যখন পাতা উড়ে উড়ে পড়ে মালী সাফ করে। সেখানে বিয়ে নিশ্চয় হয়েছে, তবে আমি দেখি নি। শ্রাদ্ধ হয়তো নীরবে সম্পন্ন হত, তাও দেখি নি। আমি উদ্দেশ্য ছাড়াই কোনোদিন পথে যেতে যেতে হঠাৎ ঢুকে পড়েছি। ছবিতে যেমন দেখা যায় তেমনি কাঠের আসনের সারি, পুলপিট, পিয়ানো। সিলিং অসম্ভব উঁচু। মাথার দিকে আর্চ, লম্বা লম্বা জানলা। তাতে রঙিন স্টেইনড় গ্লাস। নিশ্চয় ইউরোপ থেকে আনানো।
এক ছুটির দিনে বাজার থেকে কিছু বাঁশপাতা মাছ কিনে ফিরছিলাম। মাছের ন্যাকড়ার পোঁটলাটা আমার হাতে ঝোলানো। বেশ আসছিলাম, কোথাও কোনো সন্দেহের বাষ্প নেই। কাছারির কাছাকাছি যেই এসেছি, আচম্বিতে যেন হাতে কেউ দারুণ ঝাঁকুনি দিল। চমকে দেখি নদীপারের গাছ থেকে একটা বাজ ছোঁ মেরে মাছের পোঁটলাটা নিয়ে গিয়ে বসল কাছারির বট গাছে। আমি বোকার মতো তার পেছু পেছু ছুটলাম। দু-চারটে ঢিল মারতে সে বিশাল পাখায় উড়ে গিয়ে গির্জার চুড়োয় বসল। আমি অসহায়ের মতো গির্জার হাতায় ঢুকে আবার ঢিল মারতে লাগলাম। বাজ চুড়ো থেকে উড়ে গাছে বসে, এক গাছ থেকে অন্য গাছে যায় আর তার নখে ধরা পোঁটলা থেকে দুটো-চারটে মাছ খসে পড়ে। প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় অর্ধেকের বেশি মাছ পুনরুদ্ধার করে বিমর্ষ মনে বাড়ি ফিরলাম। বাজে মাছ নিয়েছিল একথা বাড়িতে বলা যাবে না। বাজের এঁটো দিদিমারা খাবেন কিনা কে জানে।
গির্জাকে এড়ানো যায়, কিন্তু কবরকে ফাঁকি দেবার উপায় নেই। শহরে বা কাছাকাছি চা-বাগানে যে ইংরেজরা মারা যেত তাদের কবর দেবার জন্য মোটা দেয়াল আর গাছপালায় ঘেরা একটা গোপন হয়ে থাকা জায়গা ছিল। জায়গাটা এস ডি ও-র বাংলো এবং লোকাল বোর্ডের অফিসের পিছনে। এই অতি সুন্দর জায়গাটিতে কোনো জীবিত ব্যক্তির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় নি। কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখি নি, কোনো কবরের উপরে কোনো মেমসাহেবকে ফুল সাজিয়ে কাঁদতেও দেখি নি। জায়গাটা এত নির্জন যে এখানে কোনো দরোয়ান বা মালী আছে মনে হয় না। ঘাস ছাঁটা হয় না। ফুলগাছগুলোয় কিন্তু প্রচুর ফুল। পরিচর্যা করে কে?
তিরিশ চল্লিশটি কবরের উপরে নানা মাপের, নানা মণ্ডনের পাথরের বেদি। এই পালিশ করা বেদিগুলোর বিচিত্র কারুকার্য এবং শিয়রে একটি ক্রস খ্রীষ্টান পরলোককে সৌন্দর্যে আর শান্তিতে আবিষ্ট করে রেখেছে। বেদির গায়ে মৃতের পরিচয় লেখা। কোনো কোনো কবরকে ঘিরে লতানে ঘণ্টাফুল উঁই গোলাপের নিচু চাদোয়া। আমি কল্পনা করতাম, তলায় যে শুয়ে আছে সে নিশ্চয় ছটফটে, জাদরেল, মদোন্মত্ত কেউ। এখন বুকের উপর বিরাট পাথর চাপ দিয়ে তাকে শান্ত করছে, ঠাণ্ডা করছে, তার চারদিক ঘন অন্ধকার করে রেখেছে।
কোনো কোনো বেদি অপেক্ষাকৃত ছোট, নিচু সবুজ ঘাসের মধ্যে সাদা পাথরের আসন যেন। তলায় নিশ্চয় ছোট কেউ ঘুমিয়ে আছে।
আমি কখনো কখনো বড় কবরের ঐ কাঁচের মতে: মসৃণ পাথরের উপরে বসতাম, তার মসৃণতার গায়ে হাত বোলাতাম, চিত হয়ে শুয়ে পড়তাম। একদিন, মনে আছে, শুয়ে আছি, সূক্ষ্ম রেণু রেণু বৃষ্টি পড়ছিল– ঘণ্টাফুলের পাপড়িতে, পাতায়, কবরের পাথরে বৃষ্টি পড়ছিল। আজ ষাট বছর পরে লিখতে লিখতে ভাবছি, এতদিনে মাটির তলায় হাড়গুলি সেই উড়ো বৃষ্টির মতো, দু মিনিটের বেড়াতে আসা বালকের মতো, কিংবা বিতানের ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দে লাফিয়ে নামা বিকেলের রোদটুকুর মতো হালকা পলকা হয়ে যায় নি কি! ডুমস ডের দিন যখন তার নাম ডাকা হবে, ততদিনে সে নাম ভুলে গেছে।
চা-বাগানের সাহেবরা চাকরির শেষে প্রায় সবাই দেশে ফিরে যেতেন, শুধু দু একজন কোনো কারণে এখানে থেকে গেলেন। এই রকম একজন ছিলেন মিঃ মান্ডি। স্টেশন রোডের প্রথম বাংলোবাড়িটাই হল তাঁর। বাড়িটা ছোট না, কিন্তু বড্ড শ্রীহীন। ঘাসের লন নেই, ফুলগাছ নেই। ধুলোভরা পথে আর আঙিনায় সারা দিন কতগুলো লেণ্ডিগেণ্ডি ফরসা অপরিচ্ছন্ন ছেলেমেয়ে খেলে বেড়ায়। ইংরেজ মান্ডিসাহেব তাদের বাবা, আর মা মান্ডিরই বাগানের পাতা তোলা মজুরনী। এখন সবাই তাকে মান্ডিসাহেবের কুলি মেম বলে উল্লেখ করে। সে বেঢপ গাউন পরে, স্কার্ট ব্লাউজ পরে, লম্বা চুলে বিনুনি করে অনেকটা জিপসি মেয়ের মতো দেখায়। বাচ্চাগুলো খেলতে খেলতে গেট খুলে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। সে মা-মুরগির মতো তাড়া দিয়ে ভিতরে ঢোকায়।
মান্ডিসাহেব লম্বা, অস্থিসার, বুড়োমানুষ। অযত্নে তারও রং জ্বলে গেছে। আমাদের ডাক্তারবাবু বলেন, মান্ডিসাহেব পেটের অসুখে ভোগে আর প্রাতরাশে ছটা করে ডিম খায়।
সাহেবরা যে আছে তা সব সময়েই টের পাওয়া যেত। কিন্তু তারা যে আমাদের প্রভু, তারা যে আমাদের দেশে বসে আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে সুখ আর শখের চরম করে ছাড়বে, এইটেই প্রকট হয়ে উঠত বড়দিনের সময়। তখন নানা বাগান থেকে প্লানটাররা বউদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তারা দেখবে, স্বামীরা কেমন ক্যাম্প-জীবন কাটায়। কাছাড় ক্লাবের কাছে পোলো মাঠের গা ঘেঁষে সারি সারি খাকি আর সাদা চল্লিশ পঞ্চাশটা তাঁবু পড়েছে। এক দঙ্গল বাবুর্চী, বেয়ারা, খানসামা, সহিস খিদমতে ব্যস্ত। ক্লাবের বড় বড় ওয়েলার ঘোড়াদের সাদা কালো পিঙ্গল চামড়া সাটিনের মতো উজ্জ্বল। বিকেলে সাহেবরা ঘোড়ায় চেপে পোললা খেলে। বিশাল পোলো মাঠের একদিকে উলুঘাসের বন, সেখানে শরতে কাশও ফুটেছিল, এখন হেমন্তে ঝরে গেছে। হালকা খড়ের রং মাঠ, সেখানে সাদা কালো পাটকিলে ঘোড়া ছুটিয়ে সাহেবরা পোলো খেলে। দূরে কৌরব শিবিরের মতো ওদের সারি সারি তাঁবু। শীতের পরিষ্কার ঠাণ্ডা বাতাসে সূর্য লাল হয়ে অস্ত যাচ্ছে। এই জাঁকজমক, বীরত্ব ও রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হত আর্টিস্টিসের দিন (১১ নভেম্বর), তার বাৎসরিক স্মরণ প্যারেডের মধ্য দিয়ে।
আর্মিস্টিসের সকালে পল্টনের গোখা সৈন্যেরা নিখুঁত উর্দি পরে, যন্ত্রের মতো কুচকাওয়াজ করে মাঠে এসে ফাইল করে দাঁড়াত। গত মহাযুদ্ধের পুরনো, অবসর পাওয়া জমাদার, সুবাদারদের সেদিন খুব আদর। পুরো উর্দিতে ফিটফাট হয়ে বুকে মেডেল, ইনসিগনিয়া, ওভারসীজ ব্যাজ লাগিয়ে তাঁরা নিমন্ত্রিতদের জায়গায় এসে বসেছেন। চা-বাগানের ছোট ম্যানেজারই হোন বা অফিসের বড়সাহেবই হোন শ্বেতাঙ্গ হলেই সর্ববিদ্যাবিশারদ। অতএব আর্মিস্টিস অনুষ্ঠানেও খাকিটাকি পরে তাঁরাই প্রধান পুরুষ।
শীতের দিনে খোলা মাঠে হু হু করে হাওয়া বইছে। বিউগল বাজল- বিউগলে জটিল সুর বাজে না, কিন্তু তার স্বর উঁচু আকাশের দীর্ঘডানার পাখির ডাকের মতো বাতাসে ভেসে অনেক দূরে চলে যায়।
বিউগলের সুর, ইউনিয়ন জ্যাকের ওড়া, গোখা প্লাটুনের কুচকাওয়াজ, সেনাধ্যক্ষ সেজে সাহেবদের নিশ্চল দাঁড়ানো জায়গাটাকে চঞ্চল, ভারিক্কি, পরদেশী করে তুলল। ফৌজদের হাঁটাচলা, অভিবাদন করে এক পা পিছিয়ে ঘুরে যাওয়া মানুষের উদ্ভাসিত যন্ত্রের মতো ব্যবহার অদ্ভুত লাগে। এক সময় ভেরী তুরী ড্রাম ট্রাম্পেটে মিলিটারি ব্যান্ড বাজে। বাদ্যকরদের পোশাকের কী বাহার! সকাল এগারোটায় যখন আর্মিস্টিস হয়েছিল, ঘড়ি ধরে ঠিক সেই সময়ে সমস্ত প্লাটুন নিশ্চল হয়ে দাঁড়ায়। মৃতদের স্মরণে টানা সুরে তিন বার লাস্ট পোস্ট বাজে। শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
এই একচিলতে শহরে এত ঘটা করে বছর বছর নকল আর্মিস্টিস অভিনয়ের মানে কি? দর্শক তো আমরা বাঁশের রেলিঙের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কাছাড়ী নেটিভরা।
.
ঐ দ্বীপবাসী লোকগুলো এই দেশে এসে অহংকারে মটমট করত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না’- ভূগোলে ইতিহাসে এই অদ্ভুত বাক্যটি আমাদের পড়তে বাধ্য করত। স্কাউটদের ইউনিয়ন জ্যাক আঁকতে শেখা ছিল আবশ্যিক। নিজেদের কোনো রাজা নেই, জাতীয় সংগীতও নেই, অথচ ‘গড সেভ দি কিং’ শুনি ব্যান্ডে। আমি তো পঞ্চম জর্জ ও রানী এলিজাবেথের যুগল ছবিও চটপট আঁকতে পারতাম– দশ মিনিটের বেশি লাগত না।
ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ভাবভঙ্গি গ্রাম্য সামন্ততন্ত্রেরই মতো। একটি শোক পালন এবং একটি রাজ্যাভিষেকে ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন পঞ্চম জর্জ মারা গেলেন। ইংরেজরা এই শোকের ভার সাম্রাজ্যের কোটি কোটি পরদেশী প্রজার উপর চাপিয়ে দিল। হাতের মুঠোয় রয়েছে সরকারী কর্মীরা, তাদের নির্দেশ দেওয়া হল, জামার হাতা ঘিরে কনুইয়ের উপর মখমলের একটা কালো ফিতে পরতে হবে। দাদুকে দেখতাম হালকা ঘিয়ে রঙের কোটের হাতায় ঐ রকম ফিতে লাগিয়ে অফিসে যাচ্ছেন। আমাদের বাপমা মরলেও তো দশদিনে অশৌচ যায়, আর এক্ষেত্রে পুরো এক মাস! যা হোক, এর পর ছেলে ষষ্ঠ জর্জের রাজ্যাভিষেক হল। এই উৎসবে শহরের বড় বড় বাড়িতে দীপান্বিতার আলো দেওয়া হল। সমস্ত স্কুলের ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠে নিয়ে গিয়ে একদিন মেঠাই খাওয়ানো হল। তবে, সে মিষ্টি জমিদারবাবুর ছেলের উপনয়নে চাষী প্রজাদের চিড়েগুড়ের ফলারের মতোই উৎকৃষ্ট। রাত্রে পোলোর মাঠে আতশবাজি পোড়ানো হল। আকাশ আলো করে লাল সবুজ নীল তারার ফুলঝুরি ঝরল।
.
জেলার কমিশনার আমাদের শহরে থাকতেন। তাঁর একলা বাংলোটি একটা গাছে ছাওয়া বীথিকার শেষ প্রান্তে। বীথিপথের দু পাশে এবং বাড়িটি ঘিরে বড় বড় প্রাচীন গাছ তাদের ডালপালা থেকে বসন্তকালে ফুলের ছড়া দোলে। কমিশনার খুব একটা লোকসমক্ষে আসতেন না। পুরো জায়গাটাই খুব নিরিবিলি।
একবার ঐ অসাধারণ সুন্দর রাস্তাটায় একা একা মুগ্ধ হয়ে হাঁটছিলাম। রাস্তার দুটি পাশই ঢালু, কোনো বাড়ি নেই। গাছের ছায়া আর বিকেলের ছায়া মিশে গিয়ে জায়গাটা একটু ঘোর ঘোর। হঠাৎ কমিশনারের কিশোরী মেয়ে সাইকেল চালিয়ে সেই ঢালু রাস্তায় আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। মেয়েটা পড়েও যায় নি, ব্যথাও পায় নি, তবু একটা গালাগাল দিয়ে সবেগে ঐ ঢালু পথে নেমে গেল।
ভাবছি, ষাট বছর আগেকার ঐ ঘটনা যদি আজ ঘটত, এই যুগের ছেলেদের কাছে ঐ সাদা মেয়েটা এত সহজে পার পেত না। না, ভুল হল- অত উঁচু বাড়ির মেয়ে আমার মতো কোনো ছেলের ঘাড়ে এসে পড়বার আগেই জেড ক্যাটিগরির রক্ষীরা ছেলেটাকে পেটাতে পেটাতে নিয়ে যেত, পিটিয়ে পিটিয়ে দেশছাড়া করত।
কিন্তু এই উড়ো ভাবনাটা থাক। ঘটনাটার আজও যেটুকু সত্যি মনে রয়ে গেছে তা হল মেয়েটার ক্রুদ্ধ গালাগাল, সাইকেলে তার দ্রুত অপস্রিয়মাণ শরীরের ভঙ্গিমা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি মনে আছে জায়গাটার সৌন্দর্য তার ছায়া, চতুর্দিকে গাছ থেকে নামা ময়ালসাপের মতো ফুলের ঝুরি।
.
তখন বোধ হয় ক্লাস ফাইভে পড়ি, একদিন নোটিশ এল আসামের গভর্নর আমাদের স্কুল দেখতে আসছেন। ইতিহাসের বইয়ে হেস্টিংস, বেন্টিংক, কর্ণওয়ালিসের ছবি দেখেছি। ধরে নিয়েছিলাম ইনিও ঐ রকমই একজন হবেন। যেমন ভেবেছিলাম, ঠিক তাই দেখলাম, গভর্নর সেই রকমই আঁদরেল পোশাক পরা দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ, ছুঁচলো গোঁফ, কালো প্যান্টের কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত তিনটি লাল রঙের ডোরা টানা, বুকে পদক, ব্যাজ, কোমরে তলোয়ার। গম্ভীর। কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, কারো সঙ্গে কথাও বলছেন না। আমরা ক্লাসসুদ্ধ ছেলে তাঁর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তাঁর সঙ্গে হেডমাস্টার মশাই ছিলেন, সাধারণ কোটপ্যান্ট পরা আরও তিন-চারজন ইংরেজ ছিলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। যা হোক, দু-মিনিটের মধ্যেই তাঁরা পাশের ক্লাসে চলে গেলেন। গভর্নরের পোশাক, চেহারা এবং গাম্ভীর্য নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হলে মাস্টারমশাই বললেন ঐ কোমরে-তলোয়ার লোকটি তো বডিগার্ড, আসল গভর্নর হলেন সাদামাটা কোটপ্যান্ট পরা টাকমাথা সাহেবটি। কিন্তু আমরা যে তাঁকে খেয়াল করে দেখিই নি। যাক গে। আমাদের মন ঘুরতে লাগল সেই দীর্ঘকায় বীরের পিছনে।
.
এই সময়ে আমি জীবনে প্রথম উড়োজাহাজ দেখি। একটা ছোট্ট লাল রঙের বিমান, পাখির মতো ডানা ঝাঁপটে নয়, একটা বড় উড়াকু মাছের মতো ভেসে এসে নামল সেই পোলো খেলার মাঠে। মাত্র একজন সাহেব সেটা চালিয়ে এনেছে। যন্ত্রে কোনো গোলমাল দেখা দিয়েছিল তাই এখানে বাধ্য হয়ে নামা। আমরা দূর থেকে দেখতাম লোকটি সারা দিন বিমানটি নিয়ে ঠুকঠাক কাজ করে যাচ্ছে, আরও দু-একজন সাহেব তাকে সাহায্য করছে। আমার অবাক লাগত- ওরা কি সব রকম কাজ জানে নাকি। একদিন বিকেলে সেই বৈমানিক কাজ করছিল। ককপিটে বসে হঠাৎ এঞ্জিন চালু করল। খানিক দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, দারুণ বেগে পাখা ঘুরছে, কাছের লোকগুলোর টুপি উড়ে গেল। বিমান দ্রুতগামী গাড়ির মতো চলতে চলতে হঠাৎ শূন্যে উঠে পড়ল। আকাশে উঠে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে চলে গেল। আমি মনে মনে খুব হকচকিয়ে গেলাম। বৈমানিক কি প্রস্তুত ছিল? না কি বিমানটা নিজের ইচ্ছায় হঠাৎই উড়তে শুরু করল! এই বিকেলের আকাশে সে এখন কোথায় যাবে? এখানে ওখানে পাহাড়। একটু পরেই তো অন্ধকার নেমে আসবে।
.
বন্যা
বর্ষার শেষ দিকে আমাদের এই পাহাড়ী নদী ঘোলা জলে তীব্র স্রোতে বয়ে চলে। অতখানি খাড়া উঁচু পাড় ছাপিয়ে উঠতে চায় জল। পশ্চিম দিগন্ত থেকে আকাশের তিন-চতুর্থাংশ মেঘে ঢাকা, অন্য দিকে বরাইল পাহাড়ের গা ঘেঁষে ভিজে মেঘের ছায়া এবং নিষ্প্রভ সূর্যের স্রিয়মাণ আলো। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে নদী অসম্ভব ফুলে উঠেছে। এই গম্ভীর ঘোলা জলের রাশি কোথা থেকে আসে? আমরা শুনি, মণিপুরে আর লুসাই পাহাড়ে দারুণ বৃষ্টি হচ্ছে সেখান থেকে জল নামছে পাহাড়ের গা বেয়ে। জিরি, চিরি, হোরং আর লংগাই উপনদী থেকে জল এসে পড়ছে মূল নদীতে। তখন, বৃষ্টি শেষ হয়ে এলেও এই উপত্যকা বিপদের মুখোমুখি। বড় বড় তিন চারটে মালবাহী গাধাবোট নোঙর করে রাখা হয়েছে। বোটগুলির বিশাল বিশাল গহ্বর এখন শূন্য, অন্ধকার। আমরা দু-একজন ছেলে নেংটি ইঁদুরদের সঙ্গে সেই বোটের মধ্যে ঘুরে বেড়াই, তাদের কিনারায় গিয়ে নদীকে দেখি। গাধাবোটের লোহার খোলে জলের ধাক্কা লেগে মাঝে মাঝে চাপা গুমগুম শব্দ ওঠে। জল শুধু ঘোলা নয়, ময়ালের গায়ের চকরা-বকরার মতো তারও গায়ে মধ্যে মধ্যে ফেনা বোঝা যায়, কোনো গভীর অরণ্যের মধ্যে ঘুরে গাছপালা লতাকে নিষ্পিষ্ট করে এসেছে এই জল। গভীরতর জায়গায় কুমোরের চাকের মতো ঘূর্ণি- সেই ঘূর্ণি নাকি ঘুরতে ঘুরতে তলার মাটি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অকস্মাৎ পূতিগন্ধে তাকিয়ে দেখি গরু বা মোষ মরে ঢোল হয়ে ভেসে চলেছে- আর সেই ভাসমান পশুদেহের উপর বসে শকুনি তার নাড়িভুড়ি টেনে বার করছে। মৃতদেহগুলির গতিবেগ দেখে বুঝতে পারি জলের স্রোত কী সাংঘাতিক তীব্র।
দিদিমার কাছে শুনেছি, আগে নাকি ভরা বর্ষায় এই নদীতে হাতিও ভেসে গেছে। আমি হাতি ভেসে যেতে দেখি নি, কিন্তু তার চেয়েও একটা আশ্চর্য জিনিস দেখেছিলাম। একদিন দুপুরবেলা। তখন ঘোলা জলে আকাশের ছায়া পড়ে না, মাছেরাও বোধ হয় ভয় পেয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। হঠাৎ দেখি, দূরে, স্তম্ভের মতো সোজা দাঁড়ানো অবস্থায় একটা আস্ত বাঁশঝাড় নদীর মধ্যভাগ ধরে ভেসে আসছে। কাছাকাছি এলে স্পষ্ট দেখা গেল, সেই উপড়ে আসা বাঁশের জঙ্গলে বাঁদরদের ছোট একটা দল ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। তারা লাফালাফি করছে না, চেঁচামেচি করছে না। আমার মনে হল, বাঁদরদের এমনিতেই বসা গাল যেন আরও বসে গেছে, গোল গোল কপিশ চোখ যেন নিথর হয়ে আছে। দেখতে দেখতে সেই বাঁশঝাড় আর অভিশপ্ত বাঁদরের দল দৃষ্টির বাইরে মিলিয়ে গেল। আমি এখনও ভাবি, এ কি সম্ভব! নদীর মরীচিকা আমাকে ভুল দেখায় নি তো?
প্রত্যেক বছরই নদীতে এই রকম ঢল নামে। কিন্তু কোনো কোনো বছর নদী আর তার জল ধরে রাখতে পারে না। বন্যায় তখন এই উপত্যকা ভেসে যায়। তখন শঙ্কিত আকাশের নিচে সবাই আগেকার বন্যার কথা বলাবলি করে একবার নাকি জল বাড়িতে ঢুকে লাফিয়ে লাফিয়ে চাল ছুঁয়ে ফেলেছিল। সেবার পোটলাপুটলি নিয়ে মহিলারা আশ্রয় নিয়েছিলেন দুর্গের মতো শক্তপোক্ত পোস্টঅফিসে। দিন দশেক সেখানে এক হেঁশেলে খিচুড়ি খেয়ে আর দিনরাত গল্পগুজব করে কয়েকটা পরিবারের মধ্যে নতুন করে সৌহার্দ্য গড়ে উঠল।
জল সরে যাবার পর বাড়ি ফিরে এসে সে কী কাণ্ড! এক হাত মোটা হয়ে নদীর পলি জমে আছে উঠোনে, ঘরের মেঝেয়, তক্তপোশে, চেয়ার টেবিলে, তাকে, কলতলায়, চৌবাচ্চায়, বাগানে। আর সে কী দুর্গন্ধ! যাদের মাটির ঘর তাদের দুর্দশা আরও বেশি। জলের ঘূর্ণি ঘরের মেঝেয় গভীর গর্ত খুঁড়ে রেখে গেছে, গলিত উনুন বুজে আছে কাদায়।
একবার আমি প্রাণসংশয় বিপদে পড়েছিলাম। সেবার বর্ষা শেষ হবার মুখে পাহাড়ে নতুন করে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি শুরু হল। দেখতে দেখতে কয়েকদিনে আমাদের নদী প্রমত্ত হয়ে উঠল। শোনা যেতে লাগল মণিপুরের বাঁধ উপচে জল নামছে। তার পর একদিন শোনা গেল সেই বাঁধ ভেঙে গেছে, এবং এক্ষুনি তা মেরামত করা অসম্ভব। রাত্রে রাত্রে কখন কি যে হল জানি না। ভোরবেলা জেগে দেখি নদী ছাপিয়ে, রাস্তা ডুবিয়ে জল এসে গেছে আমাদের পাড়ার প্রতিটি বাড়ির উঠোনে। দেড় মানুষ সমান নিচু আমাদের খেলার মাঠ এখন গভীর জলের তলায়। দূরের ঢালুতে ঘরবাড়িগুলোকে দেখাচ্ছে যেন জলের চোরাবালিতে ডোবা অসহায় টিনের প্রাণী।
উঠোনে আমার জানু পর্যন্ত জল। সেই জলে দিয়েই বুঝলাম, এ স্পর্শ পুকুরের বা নদীর মতো না, এ অনেক বন্য, উপদ্রুত, দূরদেশের জল। দায়িত্বশীল যুবকেরা ধুতি গুটিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে, খোঁজখবর নিচ্ছে। বেলা একটু বাড়লে খলবল করে বালকেরাও বেরিয়ে পড়ল। রাস্তার ওপারে মুসলমান হস্টেলের নিচু ভিতের ব্যারাক বাড়িটাতে জল ঢুকেছে। ছাত্রেরা বাক্স-প্যাটরা তুলে তক্তপোশের উপর রেখে ভাবছে, কী করা যায়। সেখানে এক পাক ঘুরে আমাদের পিছনের পাড়া নতুন পট্টির দিকে এগুলাম। সেখানে বাণীভবন লাইব্রেরিতে এ বছর অনেক নতুন বই কেনা হয়েছিল। বইগুলো কি জল থেকে বাঁচবে? নতুন পট্টির শেষ দিকে আলিঝালিদের বাড়ি, জঙ্গুদের বাড়ি, মসির বাড়ি। কাছেই নিচু বিশাল খেলার মাঠ। মাঠের ওপারে ইটখোলার রাস্তায় একটা বড় কালভার্ট। এদিককার সমস্ত বৃষ্টির জল ঐ কালভার্টের নিচের খাদ দিয়ে নেমে তীব্র বেগে একচিলতে বন পেরিয়ে একটা ছোট্ট স্রোতস্বতীতে গিয়ে পড়ে। লম্বা লম্বা জারুল গাছ, ক্ষয়ে যাওয়া কঠিন মাটি-পাথরে উঁচু কংক্রিট আর্চ, বয়ে যাওয়া জলধারা আর ছায়াবিজনতা নিয়ে জায়গাটা অতি সুন্দর। ঐ ছোট নদীর ওপারে কৃষির মাঠ, মাঠের শেষে মণিপুরীদের গ্রাম। এখন এই সমস্তই বানের জলে একাকার হয়ে আছে।
নতুন, পট্টির রাস্তা থেকে গঙ্গেশ চক্রবর্তীর ভাইপোরা একটা কলা গাছের ভেলায় চেপে খেলার মাঠের গভীর জলের দিকে যাচ্ছিল। বেলা বাড়ছে, আকাশ বেশ পরিষ্কার, জল ঈষৎ তপ্ত হয়ে উঠছে। এবার ঘরে ফেরা দরকার। চারদিক কেমন যেন পাঙাশ ধূসর।
খাওয়াদাওয়ার পর দুপুর আর কাটতে চায় না। পুব দিকে যেতে ভয় করে সেখানে গভীর খরস্রোতা নদী বানের জলে মিশে সচল চোরাবালির মতো মারাত্মক হয়ে বইছে। ভুল করে তার গণ্ডির মধ্যে গিয়ে পড়লে আর রক্ষা নেই। আমরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় কাঠি দিয়ে জল মাপি। সকালের পর এই শেষদুপুর পর্যন্ত দুই ইঞ্চির বেশি বাড়ে নি। সাধুদিদিদের বাড়িটা অনেক দিন জনশূন্য হয়ে পড়ে আছে। সেখানে দুর্গামণ্ডপের পিছনে দারুণ মোটা আর সতেজ কলা গাছের ঝাড় অযত্নে বেড়ে উঠেছে। আমি সবার অলক্ষ্যে একখানা দা নিয়ে বেরুলাম। দুটি পুষ্ট কলা গাছ কাটতে পারলেই চমৎকার একটা ভেলা তৈরি হবে।
একটা ফাঁকা জনহীন বাড়িতে বানের ঘোলা জল এসে ঢুকেছে। একটা ছেলে তার মধ্যে ঢুকে কলা গাছ কাটছে। সাধুদিদির ভৌতিক আত্মারা চামচিকের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। এখানে পচা কলা গাছের রস খেয়ে মশার দল খুব তেজী ছুঁচের মতো হুল নিয়ে তারাও উড়ছে। বেলা পড়ে আসছে। কলা গাছের চারখানা কাণ্ড পাশাপাশি রেখে তার মধ্যে তিনটে বাঁশের গোঁজ ঢুকিয়ে, দড়ির বাঁধন দিয়ে চমৎকার একটা ভেলা তৈরি হল। আজ এটি এখানেই লুকনো থাক। কাল সকালে এই জলযানে ভ্রমণে বেরুব। সেদিন রাত্রে বৃষ্টিহীন তারায় ভরা আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ জল ক্রমশ শীতল হল। মৃদু হাওয়া উঠল। জল বোধ হয় আরও ইঞ্চি দুয়েক বাড়ল। জলের গন্ধে অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে সামুদ্রিক স্মৃতি জাগে।
ভোরবেলা রোদ চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেলে আমি ভেলা নিয়ে পাড়া ঘুরতে বেরুলাম। এই বিরাট জল যেন অদৃশ্য আয়তক্ষেত্র আর ট্রাপিজিয়মের খোপে ভাগ করা এক এক জায়গায় এক এক রকম শৈত্য। জল কি করে বাড়ে? নতুন জল কি পুরনো জলের তলা দিয়ে আসে ডুবসাঁতার কেটে, না কি ভেসে আসে সফেন জলদেবতার মতো জলস্তরের উপর দিয়ে। দু-এক বার ভেলা উলটে গিয়ে জলে পড়লাম। এখন বাড়ি ফেরা দরকার। খিদে পেয়েছে। দিদিমা এসব গ্রাম্য ডানপিটেমি পছন্দ করেন না। তাছাড়া পরের ছেলের যদি কিছু হয়ে যায় তো কে তার দায় নেবে? দিদিমার কিছু বাঁকা বাক্য হঠাৎ যেন বঁড়শির মতো এসে আমার কানকোয় বিধল। আমি লগি মেরে ভেলাটাকে ঠেলে দিলাম খেলার মাঠের গভীর জলে। এখান থেকে কোনাকুনি গেলেই বাড়ির রাস্তায় পৌঁছে যেতে পারি। ঐ তো ছেদির কুঁড়েঘর, মুসলমান হস্টেল, নীলুদের বাড়ি। সবই হাতের মধ্যে। কিন্তু আমার কী যে দুর্মতি হল- আমি সবই হাতের বাইরে চলে যেতে দিলাম। আমি লগি ঠেলে সেই কালভার্টের দিকে এগিয়ে গেলাম। একবারও মনে পড়ল না, সেই দিকেও তো নদী! আমার অজান্তে কেউ যেন ভেলাটাকে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। যখন টের পেলাম তখন ভেলা স্রোতের মধ্যে পড়ে গেছে। আমি প্রাণপণে লগি দিয়ে ভেলাটাকে ভেসে যাওয়া থেকে আটকাবার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। কিন্তু হরি যাকে রাখেন- হঠাৎ ভেলাটা কালভার্ট ডিঙিয়েই ওপাশের জারুল গাছেদের ছড়িয়ে দেওয়া শাখায় আটকে গেল। আমার বুকের মধ্যে ধকধক শব্দ হতে লাগল। আমি কালক্ষেপ না করে ভেলা ছেড়ে জারুলের শাখা আশ্রয় করলাম। এখন শরীর কেমন যেন নিস্তেজ লাগছে। বেগুনী ফুলে ভরা জারুলবনে এখন কোথাও একটা ভ্রমর নেই। এই গাছগুলি, কালভার্টের নিচে যেখানে ঝরনা বয়, খাদের সেই স্নান ছায়া থেকে উঠেছে বলে বেশ লম্বা। কাণ্ডগুলো ডুবে গেলেও, জটিল ছড়ানো শক্ত শাখাগুলি এখনো জলের উপরে। দুপুর ঢলে পড়েছে। গাছের ডালপালার মধ্যে বসে আছি। এখন আর খিদে নেই। মনে হচ্ছে, এইখানে বসে বসে কয়েকদিন পরে আমি আর মানুষ থাকব না। গাছবাসী রোগা পাঙাশ রং কৃলাস হয়ে যাব।
এদিকটা এমনিতেই জনমানবহীনদু-চারটে মাত্র বাড়িবিজনদের বাংলো, সুপুরি-বাগানের মধ্যে সুজিতদের বাড়ি, শিল্পী অনন্ত ভট্টাচার্যের বাড়ি, এছাড়া জংলা জমি শেয়ালের নেউলের গর্ত নিয়ে নেমে গেছে নদীকিনারায়। এখন তো জল এসে সব ঘিরে ধরেছে। চিৎকার করে কোনো লাভ নেই, শুধু নিজের অবরুদ্ধ গলা নিজের কানে ভূতের-ভয়-পাওয়া-কুকুরের ডাকের মতো শোনাবে। বিশ-ত্রিশ গজ পিছনে জলের মধ্যে বইছে লুকনো নদী। বিকেল হয়ে এল। পাতার ফাঁক দিয়ে তীক্ষ্ণ রোদ এসে লাগছে চোখে, কানের পিছনে। এর পর সন্ধে নামবে। এখনই যে করে থোক এ জায়গা ছেড়ে বেরুতে হবে। আমি অতি সাবধানে গাছের ডাল বেয়ে যতটা পারা যায় রাস্তার দিকে এগুলাম। তার পর শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে জলের গা ছুঁয়ে উজান বাওয়া মাছের মতো ঝাঁপ দিলাম। রাস্তার পাথরে হাত ছড়ে গেল। আঃ! এইবার ডুবে থাকা রাস্তা ধরে ধরে বাড়ি পৌঁছতে পারব। ভেজা গায়ে, কোমর পর্যন্ত জলস্রোতে দাঁড়িয়ে আমার ভিতর থেকে শীতের কাঁপুনি আর কান্না উঠল।
পরদিন থেকে জলে ভালো রকম টান ধরল। দিন চারেক পরে শহরের মাঠ বাট আঙিনায় ঘন কাদার স্তর জমিয়ে রেখে জল নেমে গেল। সেই পলি ধুলো হয়ে শিশিরে ধুয়ে ক্রমশ শিকড়ের দিকে মাটিতে ঝরে গেল। নদী ধীরে ধীরে আবার স্বচ্ছ ও অলস হয়ে এল।
.
বিচিত্র পেশা: ম্যাজিশিয়ান
বর্ষায় যেমন ঢাকা জেলা থেকে ছাতা সারাইওলারা আসত, পুজোর পর বহুরূপীরা আসত তেমনি শরৎ শীত বসন্তে বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে আসতেন ম্যাজিশিয়ান, ব্যায়ামবীর, কথকঠাকুর ও পালাগায়কেরা। এঁরা ভ্রাম্যমাণ অভাবী মানুষ হলেও নিজের বিদ্যেটি ভালোই জানতেন।
একবার এক ম্যাজিশিয়ান এলেন- রোগা, লম্বা, কালো পোশাক পরা, সালভাদর দালির মতো গোঁফ। নিজের স্ত্রীর জিভ কেটে এক বীভৎস খেলা দেখালেন তিনি। মহিলা আধোঘোমটা, পাট করা শাল গায়ে, ভদ্র, সভ্য, বাঙালির মেয়ে। জাদুকর তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে, সম্মোহন করে ঘুম পাড়িয়ে ফেললেন। তার পর বলতে লাগলেন শো মী ইঅর টাং, শো মী ইঅর টাং। ইংরেজিতে স্বামীর আদেশ শুনে অচেতন স্ত্রী একটু একটু করে এতখানি লম্বা জিভ বার করলেন। জাদুকর আমাদের চোখের সামনে দু আঙুলে জিভটিকে টেনে ধরে ধারালো ক্ষুরে কেটে ফেললেন। একটি গাঢ় লাল রঙের প্লেটে রেখে দর্শকদের কাছে নিয়ে গিয়ে সেটি দেখালেন। দর্শকরা নিশ্চিত হলে, কাটা অংশ স্ত্রীর মুখের বাকি অংশের সঙ্গে আবার চেপে ধরা মাত্র জিভটি জোড়া লেগে গেল। অচেতন মহিলা এবার পুরো জিভটি মুখের মধ্যে টেনে নিলেন। জাদুকর বলতে লাগলেন- ওয়েক আপ, ওয়েক আপ, জাগো, জাগো। ধীরে ধীরে মহিলার সম্মোহন কেটে গেল। জাদুকর বললেন- তোমার কি কিছু মনে পড়ে? মহিলা কথা না বলে দু দিকে মাথা নাড়লেন। তোমার জিভটা এঁদের দেখাও। ভদ্রমহিলা বিনাবাক্যে তাঁর জিভটি বার করে দেখালেন। আস্ত জিভ। কোথাও কোনো কাটা বা জোড়ার চিহ্ন নেই। সবাই হাততালি দিচ্ছে; কিন্তু ভদ্রমহিলার রক্তশূন্য, দুঃখী, লম্বাটে মুখে কষ্টের চিহ্ন।
পরে জেনেছিলাম, এ খেলাটা কিছুই নয়। মাংসের দোকান থেকে সামান্য পয়সায় ছাগলের একটা কাটা জিভ জোগাড় করা যায়। খেলার আগে সেই জিভটি সহকারী মুখের মধ্যে রাখেন। সেই জিভই তিনি একটু একটু করে বার করেন। জাদুকর সেটিই কাটেন। সেটিই জোড়া দেবার ভান করেন। তার পর সহকারী পুরো জিভটিই মুখের মধ্যে নিয়ে গিলে ফেলেন। পরে নিজের আস্ত জিভটি দর্শকদের দেখান। তখন মনে পড়ল, জাদুকর জিভটি কেটেছিলেন, কিন্তু একফোঁটাও তো রক্ত পড়ে নি। মহিলা একটিও কথা বলেন নি, ছাগলের কাটা জিভ গিলে অতি কষ্টে যেন বমি চাপছিলেন।
আরেকজন ম্যাজিশিয়ান দেখিয়েছিলেন একটা সত্যিকারের ভোজবাজি। নরসিং স্কুলের ঘাসের উঠোনে ক্লাসঘর থেকে গোটা ছয়েক নিচু প্ল্যাটফর্ম বার করে এনে এক বেলার এক অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হল। এই মঞ্চ এতই নিরাভরণ যে সেখানে কৌশলের কোনো অবকাশ নেই। জাদুকরটিও দেখতে সাধারণ।
ঘণ্টা দেড়েক খেলা দেখাবার পর ক্লান্ত জাদুকর বললেন– অনেকগুলো খেলা দেখানো হল। বেশ পরিশ্রম হয়েছে। তাছাড়া এই শীতের রাত। একটু চা হলে ভালো হত। তার পর ফাঁকা মঞ্চের চারদিকে তাকিয়ে হতাশের অভিনয় করে বললেন কিন্তু এখানে তো দেখছি চেয়ার টেবিল চায়ের সরঞ্জাম কিছুই নেই। যাক গে, দেখছি কি করা যায়। স্তিমিত স্বরে এইসব বলতে বলতে জাদুকর হঠাৎ যেন কাজের লোক হয়ে গেলেন। দেখুন, আপনারা ভালো করে দেখুন, এখানেই এক্ষুনি সব এসে যাচ্ছে–কাঠের প্ল্যাটফর্মের উপর শব্দ করে তিনি জাদুদণ্ডটি ঠুকলেন, আর চুম্বককাঠিতে লেগে লোহা যেমন উঠে আসে তেমনি একটি বড়সড় গোল টেবিল যেন প্ল্যাটফর্মের কাঠ ফুঁড়ে উঠে এল। আমরা স্তম্ভিত। তার পর জাদুদণ্ডের আঘাতে চারটি চেয়ার উঠল। ব্যাপারটা কিছুই বোঝা গেল না। প্ল্যাটফর্মের কাঠ অটুট, যেমন ছিল তেমনি। এবার জাদুকর টেবিলের উপর জলতরঙ্গের মতো লাঠিটি বাজান আর টুকটুক করে চায়ের পাত্র, দুধের পাত্র, চিনির পাত্র আর পেয়ালা পিরিচ দেখা দেয়। জাদুকর টিপট থেকে গরম ধোঁয়াওঠা লিকার ঢাললেন, দুধ চিনি মেশালেন। চেয়ারে বসে আরাম করে কাপে চুমুক দিলেন। আমাদেরও চায়ে ডেকেছিলেন, কিন্তু কেউই সাহস করে গেল না। চা খাওয়া হলে জাদুকর একটি একটি করে কাপ, টিপট চেয়ার টেবিলে জাদুদণ্ডটি ছোঁয়ান আর তারা যেন মাটিতে মিলিয়ে যায়।
এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি আমি দশ বছরের সতেজ চোখে মাত্র তিন ফুট দূরত্ব থেকে দেখেছিলাম।
.
কথকঠাকুর
ঢাকা, ফরিদপুর থেকে আসতেন কথকঠাকুরেরা। এঁরা নিজেরা ধর্মপ্রাণ বৃদ্ধ, এঁদের শ্রোতারাও বেশির ভাগই ধর্মপ্রাণা প্রৌঢ়া এবং কিছু গল্পখোর বালক। এই কথকেরা স্বল্পে সন্তুষ্ট, গৃহকত্রীর দেওয়া দুটি টাকা দক্ষিণাতেই গৃহস্থের উঠোনে সন্ধ্যারাত্রে পুরাণ ভাগবতের কাহিনী কথকতা করে শোনান। আমি এইসব আসরে বসে অজামিল, নলদময়ন্তী, ধ্রুব, প্রহ্লাদ এবং আরও কত কাহিনী শুনেছি। এঁরা অসাধারণ গল্প বলিয়ে এবং এঁদের ভাণ্ডারও অফুরন্ত।
ঢাকা জেলা থেকে একজন বুড়ো মানুষ পুজোর পরে আসতেন। তিনি মোটা পুঁথিটি খুলে রেখে সেদিকে আর তাকাতেন না, নিজের মনের ভিতর থেকেই যেন অফুরান গল্প উপচে উঠতে থাকে। তার বলায় কোনো ব্যস্ততা ছিল না, একটু একটু করে কাহিনী ঘনীভূত হয়, একটু একটু করে পাত্রপাত্রী চারদিকে শিকড় ছড়ায়, ডালপালা মেলে, একটু একটু করে গল্প পরিণামের দিকে যায়। সাধারণত একটি গল্প আড়াই ঘণ্টা তিন ঘণ্টা ধরে বলেন। কিন্তু আমি জানি, ইচ্ছে করলে সেই একই গল্প সন্ধ্যারাতে শুরু করে শেষরাত অবধি বলে যেতে পারেন, জীবনের এত খুঁটিনাটি এত টুকিটাকি জানা ছিল তার।
অভিনয়ে পারদর্শী এই কথকেরা পাত্রপাত্রীর সংলাপ প্রায় অভিনয় করে শোনাতেন। দরকার মতো শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে গল্পে মহিমা আনতেন। কখনো কখনো দু-এক, কলি গানের সুরে মাধুর্যের ফুলকারি করতেন। জাতি, ধর্ম, দেশ ও শাস্ত্র সম্বন্ধে তাঁদের গভীর জ্ঞান কথকতার মধ্যে মিশে থাকত। হয়তো এইভাবে গল্প বলে নিজেদের জীবিকা সংস্থানের পাশাপাশি এঁরা নৈতিক মূল্যবোধ, জীবনের শান্তি, প্রাণের তৃপ্তি ও বিশ্বের ভারসাম্য সম্বন্ধে মানুষকে অবহিত করতেন।
যেহেতু অবলুপ্ত অতএব একক মানুষের এই মিশ্র শিল্পটি সম্বন্ধে এখানেই বলে রাখি, এটি মুখস্থ শিল্প বা রিহার্সাল শিল্প ছিল না। বুড়ো কথক মানুষটি প্রত্যেক বার তাঁর কাহিনীগুলিকে নতুন করে সৃষ্টি করতেন। গল্পের মধ্যে, পাত্র-পাত্রীর গলার স্বরে তাঁর নিজের মেজাজের জোয়ারভাটা আর সুখদুঃখের আলো আঁধারি খেলা করত। একই গল্প দু দিন দু রকম লাগত।
.
পালাগায়ক
পালাগায়কেরা ছিলেন মূলত সংগীতশিল্পী। কৃষ্ণ আর গোপীদের বয়ঃসন্ধির লীলানাট্যের গান গাইতেন তারা। কথকঠাকুরদের যদি ক্লাসিক মেজাজ তো এঁদের হল লিরিক। কথকঠাকুরদের কাঁচাপাকা কদমছাট চুল, বড় টিকি তো এঁদের তেলচুকচুকে মিশকালো বাবরি। কথকঠাকুরদের আমলকী-হরতুকির মুখশুদ্ধি তো এঁদের মশলা দিয়ে সাজা পান।
নৌকাবিলাস, মাথুর, মানভঞ্জন, উদ্ধবসংবাদের মান অভিমান বিরহ আমার খুব একটা ভালো লাগত না। কিন্তু ঘটনার রস বুঝে মুহূর্তে মুহূর্তে সুর পালটে নতুন গান ধরা সোজা কথা নয়। তাছাড়া, তখন তো মাইক্রোফোন ছিল না স্পষ্ট উচ্চারণে, কোমল মধুর উদাস গান অত উঁচু পর্দায় গাওয়া! পালাগায়কেরা খালিগায়ে, গলায় ফুলমালা, কোমরে রেশমী উত্তরীয় জড়িয়ে, দুই হাতের আঙুলে মুদ্রা দেখিয়ে গাইতেন। গাইতে গাইতে ঘামে ভেসে যেত শরীর।
মহিলাসমাজে এঁদেরও আদর কিছু কম ছিল না। তরুণী যুবতীরা স্বাভাবিক সংকোচেই এদের কাছাকাছি আসতেন না। কিন্তু বয়সিনী বা প্রৌঢ়ারা গানের শেষে স্নেহভরে এঁদের খাওয়াতেন। গান শুনে হয়তো নিজের অল্প বয়সের কথা মনে পড়ে। গায়ক যখন নৌকাবিলাস পালায় নদীঘাটে কৃষ্ণকে দেখে রাধার হয়ে হঠাৎ সুর ও ঠাট পালটে গান ধরেছেন ‘সখি, এই কি ঘাটের নেয়ে তখন যেন হঠাৎ এই শুকনো আসরে যমুনার নীল জল আছড়ে পড়ল- কতদিন আগেকার ছেড়ে আসা নৌকো দুলে উঠেছে।
.
কার্নিভাল
কোনো কোনো শীতে সার্কাসের দল এসে তাঁবু ফেলত। তাদের বাঘ সিংহ ঘোড়া ছাগল ট্রেনে চেপে আসত। সার্কাসের মাঠে একবার কার্নিভালের মেলা বসল। সন্ধের পর জায়গাটা আলোর মালায়, গরম চা ও খুচরো খাবারের দোকানে আর শীতের জামা কাপড় পরা লোকের ভিড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে। ভিতরে টিকিট কেটে নানারকম লটারি হয়। সবই গ্রাম্য লোকেদের ঠকাবার কৌশল। কিন্তু সেখানে একটা খেলা ছিল দারুণ। সেটা আমরা আলাদা পয়সা দিয়ে ভিতরে ঢুকেও দেখতাম, আবার আধ মাইল দূর থেকে, কালো রাতের পটে ছবির মতো, বিনি পয়সাতেও দেখতাম।
কার্নিভালের মাঠে একটা ঘেরা জায়গায় সত্তর-আশি ফিট উঁচু একটা কাঠের মই তারের দড়ির টানা দিয়ে খাড়া দাঁড় করানো হয়েছিল। মইয়ের মাথায় কোনোক্ৰমে একজন লোক দাঁড়াতে পারে এইরকম একটি ডাইভিং বোর্ড। মইয়ের সামনে ধানের গোলার মতো বড় লোহার পাতের চৌবাচ্চা, জলে ভরতি। রাত সাড়ে আটটার সময় কার্নিভালের পুরো মাঠ স্তব্ধ হয়ে যায়। একটা মৃদু বাজনা বাজতে থাকে। পি সি পাল নামের এক দুঃসাহসী খেলোয়াড় হলদে রঙের অগ্নিনিরোধক পোশাক, ঘাড় ঢাকা টুপি এবং চোখ ঢাকা কালো চশমা পরে ধীরে ধীরে একটি একটি করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠেন। সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে তাকিয়ে থাকে। পি সি পাল যখন উপরে গিয়ে ডাইভিং বোর্ডে দাঁড়ান তখন তাঁকে সিকি মাপের দেখায়। ভয়ে যেন বাজনা থেমে যায়। পি সি পাল একটি জেরিক্যান থেকে নিজের গায়ে বেশ করে পেট্রল ঢালতে থাকেন। তাঁর মন, তাঁর স্নায়ু আশি ফিট নিচ থেকে আমরা কিছু বুঝতে পারি না। নিচ থেকে ম্যানেজার চেঁচিয়ে বলেন
– মিস্টার পি সি পাল, আর ইউ রেডি?
— ইয়েস, আই অ্যাম রেডি। পি সি পাল উত্তর দেন।
–নো ওয়ান ইজ রিসপনসেবল ফর ইঅর লাইফ।
— নো ওয়ান ইজ রিসপনসেবল ফর মাই লাইফ।
এই অদ্ভুত সংলাপটি শুনে শুনে আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ঐ আশি ফিট উপরে শীতের হু হু করা রাতের বাতাসে একচিলতে তক্তার উপর দাঁড়িয়ে পি সি পাল তাঁর জীবনের জন্য আর কাকে দায়ী করবেন? পি সি পাল হঠাৎ দেশলাই ঠুকে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। পাঁচ সেকেন্ড একটা জ্বলন্ত মশাল হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে নিচের চৌবাচ্চা লক্ষ্য করে ঝাঁপ দেন। নিজের গায়ে আগুন না দিলে আমরা তাঁকে এই অন্ধকার আকাশে দেখতেই পেতাম না। পি সি পাল পড়ামাত্র চৌবাচ্চা থেকে তরল আগুন ছিটকে ওঠে। দু মিনিট পরে ভেজা পোশাকে পি সি পাল এসে আমাদের সামনে দাঁড়ান।
এর পর, কার্নিভাল চলে গেলেও, অনেকদিন রাত সাড়ে আটটা বাজলেই কে যেন আমাকে বলত, মিস্টার পি সি পাল, আর ইউ রেডি?
মাস তিনেক পর খবর পাওয়া গেল, কোথায় যেন খেলা দেখাতে গিয়ে পি সি পাল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে চৌবাচ্চার কিনারায় পড়ে দু-আধখানা হয়ে গেছেন।
.
পুনশ্চ
আমি বিচিত্র পেশার এই লোকদের লক্ষ করি। মানুষের কত যে গুণ। কত যে শিল্প। কিন্তু একটা জিনিস তখন থেকেই বুঝতে পারতাম– এই গুণীদের পুরো দলটাই হতভাগ্য। দুটি ভাত কাপড়ের জন্য তারা তাদের গুণটুকু নিয়ে লোকের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ায়। ভিখিরির মতো মুখাপেক্ষী হয়ে চেয়ে থাকে। পৃথিবীতে নিগুণ লোকগুলোই মজায় আছে।
নিজের কথাও চিন্তা করি। আমিই বা ভবিষ্যতে কি করে খেয়ে পরে বাঁচব। আজ এখানে আছি, কালকেই চলে যেতে পারি। লেখাপড়া এইখানে ইতি হয়ে যেতে পারে। তার পর কি করে গ্রাসাচ্ছাদন জোগাড় হবে। আমি ভেবে ভেবে পথ বার করার চেষ্টা করি। ভাবতে ভালোও লাগে। আমার চিন্তার ধারা খুব সরল রেখায়, বাস্তব খাতে বইত। এত সরল এবং বাস্তব বলেই বন্ধুরা প্ল্যান শুনে হেসেটেসে আমাকে ঘোর অবাস্তববাদী বলত। আমার হিসেবগুলো কিন্তু আমার কাছে সোজা। যেমন বছরভরে ৩৬৫টি কলা গাছ পুঁতলে রোজ ১ ছড়া করে কলা পাওয়া যাবে। অর্ধেক কলাতেই পেট ভরবে, বাকি অর্ধেক বিক্রি করা যাবে। কলা গাছের জায়গায় নারকেল গাছ, পেঁপে গাছও লাগানো যেতে পারে।
কলা নিয়ে আমার এই প্ল্যান মোটেই আকাশকুসুম কল্পনা নয়। অনেক দিন পরে খনার বচনেও দেখছি–
তিন শ ষাট ঝাড় কলা রুয়ে। থাক গেরস্ত ঘরে শুয়ে ৷৷
রুয়ে কলা কেট না পাত। তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।
শতেক ধেনু, হাজার কলা। কি করবে আকাল শালা।
ধেনু আমি সামলাতে পারব না। দরকারও নেই। শুধু কলাতেই আমার চলে যাবে।
বাসস্থান, জামাকাপড়, বিছানা এবং অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়েও চিন্তা করতাম। আমি তখন থেকেই নিজেকে চিনি। আমার মতো মানুষকে দিয়ে কোনো কীর্তি সম্ভবপর নয়। যতটুকু না হলে নয় ততটুকু, যতটুকু না হলে নয় ততটুকু- এইভাবে খুদে খুদে হাতে একটু একটু নিয়ে, একটু একটু দিয়ে, পৃথিবীকে বিরক্ত না করে এতদিন কাটল। ছবি আঁকার সময় মিনিয়েচারের থেকে একটু বড় আঁকি। লিখবার সময় ছোট ছোট বই লিখি- একটি একটি শব্দ ভেবে সময় কাটাই। বেশ লাগে। পৃথিবীর আলোবাতাসের সঙ্গে শব্দগুলি কেমন দোয়েলের মতো, চডুয়ের মতো, কাঁচপোকার মতো মেশে, দেখি। বেশ লাগে।
আমি কি পাহাড়ের বাঁকে অজন্তা এলোরা বানাতে পারতাম? অসম্ভব। আমি উদয়গিরির চেয়েও অনেক ছোট একটি গুহা বানিয়ে ছেড়ে দিতাম। সেখানে বসে মেঘে বর্ষায় বৃষ্টির রেখা, শীতে অস্তমান সূর্যের রেখা দেখতাম।
.
উদয়শংকর
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন বিদেশে নাচ দেখিয়ে ভারতবর্ষে ফিরলেন উদয়শংকর। শান্তিনিকেতনে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকে নাচ দেখালেন, তার পর কলকাতায় নাচ দেখিয়ে স্বদেশ সফরে বেরুলেন। দেশে ও দেশের বাইরে তখন তাঁর খুব নাম। আমাদের শহরে এলে শহরবাসীরা সুন্দর করে পদ্মফুলে হল সাজিয়ে এক সকালে তাঁকে সংবর্ধনা দিলেন। চমৎকার ভাষায় একটি মানপত্র পড়া হল। পুঁথির মতো লম্বাটে কয়েক পৃষ্ঠার একটি স্মারকপত্র বেগুনী কালিতে ছেপে অভ্যাগতদের মধ্যে বিলি করা হল। আমাদের শহরের পক্ষে এসব একটু অভিনব। স্মারকপত্র এক কপি আমিও জোগাড় করেছিলাম।
আজ ভাবি, সারা জীবনে এই রকম কত কাগজপত্র, হ্যান্ডবিল, বিজ্ঞপ্তি, সুভেনির, অনুষ্ঠানের প্রোগ্রাম, বিয়ের চিঠি, জরুরি চিরকুট, যাও পাখি বলো তারে চিঠি হাতে এসেছে। সব যত্ন করে রাখা উচিত ছিল, কিন্তু কিছুই রাখা হয় নি। রাখলে আজ নিজস্ব ‘আ ব্রীফ হিস্ট্রি অব টাইম’ লেখা যেত।
তিন আনা দিয়ে টিকিট কেটে সন্ধেবেলায় উদয়শংকরের নাচ দেখতে গেলাম। খোলা জায়গায় টিন দিয়ে ঘিরে এক অস্থায়ী প্রেক্ষালয় এবং গাঢ় নীল কাপড়ের একটি নাচের মঞ্চ বানানো হয়েছে। সীটের কোনো নম্বর নেই, দর্শকেরও শেষ নেই। আমি বাঁশের আগল টপকে টপকে একেবারে সামনে গিয়ে বসলাম। একসময়ে হট্টগোল থেমে গেল। শীতের রাত। কী দেখব ঠিক জানি না, কিন্তু সবাই এক গভীর আশা নিয়ে বসে আছি। তার পর মঞ্চের নীল পর্দাটি সরে গেল।
উদয়শংকরের দলে তখন ছিলেন সিমকি, জোহরা আর উজরা দুই বোন, রাজেন্দ্ৰশংকর, দেবেন্দ্ৰশংকর, আলাউদ্দীন খাঁ, তিমিরবরণ, বিষ্ণুদাস শিরালী, গুরু শংকরণ নাম্বুদিরি। তেরটি নাচ হয়েছিল কার্তিকেয় নৃত্য, রাসলীলা, স্নান, সাপুড়ে, তরবারি নৃত্য, গজাসুরবধ ইত্যাদি।
ঘন নীল মোটা কাপড়ের পর্দা দু দিকে সরে গেলে চোখের সামনে নাচ-মঞ্চের ফ্রেমে বাঁধানো একটি দ্বিমাত্রিক ছবি দেখা গেল। স্বর্ণাভ এক যোদ্ধা দেবতা ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন: কার্তিকেয় উদয়শংকর। মঞ্চেই পিছন দিকে বাজিয়েরা একটা লম্বা সারিতে বসে আছেন। বাজিয়েদের মধ্যে স্বয়ং আলাউদ্দীন আছেন, তিমিরবরণ আছেন। উদয়শংকরের শিল্পে বাজনা ও নাচ অঙ্গাঙ্গী। বাতাসের সমুদ্রে তারযন্ত্রের আঘাত, অনন্ত নৈঃশব্দ্যকে ছন্দে নাচিয়ে দেওয়া তালবাদ্য, কদাচিৎ বংশীধ্বনির চন্দ্রালোকের মতো গড়িয়ে যাওয়া বা পাখির ডাকের মতো বিস্ময়ে ফুকরে ওঠা, হঠাৎ ঝাঁঝরের শব্দে পরিস্থিতি খানখান করে দেওয়া আশ্চর্য এই ধ্বনিসম্মিলন আমার অপরিণত মনে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের আভাস আনল। রূপলোক ও দেবলোকের যে দরজা সহজে খোলে না তার সামনে আমরা ক্ষুদ্র মানব– এই ভাব আনতে কমপোজার ঐ সংগীতে স্তবগানও মিশিয়েছিলেন।
বাদ্যধ্বনির আঘাতে মানুষপ্রমাণ সেই দেবতার দ্বিমাত্রিক ছবিটির মধ্যে নিশ্বাস জেগে উঠল, উত্তেজনা এল– নিশ্চল ছবিটি নাচের গতিভঙ্গে ত্রিমাত্রিক মূর্তি হয়ে দেখা দিল। সেই নাচ শুধু নাচ হিসেবে কতখানি ভালো, চোদ্দ বছরের ছেলে আমি, কি করে বলব? কিন্তু আমাকে সেদিন থেকে আজও মুগ্ধ করে রেখেছে সেই দৃশ্যগুলির চিত্রধর্ম, ভাস্কর্যধর্ম, রূপের ভাষা। যে কার্তিক কৃষ্ণ শিব পার্বতী রাধা এবং স্নানরতা মেয়েদের উদয়শংকর দেখালেন তারা সবাই আমার অচেনা। আমি পটের বা পুজোর বা যাত্রার যে কার্তিক কৃষ্ণ শিব দেখেছি তাদের কারো সঙ্গে এই কার্তিক কৃষ্ণ শিবের মিল নেই। এরা ইন্দ্রিয়েরও সৌন্দর্য, ধ্যানেরও সৌন্দর্য, আবার শুধুই সৌন্দর্য।
পশ্চাৎপট, পার্শ্বপট ঘন নীল এবং মঞ্চ নিরলংকার থাকায় নাচটি কোথায় হচ্ছে এ বিষয়ে ভ্রম জন্মে মনে হয় এ নাচ পৃথিবীতে না, দূর আকাশের কোথাও হচ্ছে গ্রহতারারা বুদের মতো নাচিয়েদের গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। রাসনৃত্যে কৃষ্ণ আর গোপীদের জামাকাপড়ের এমন রং যে মনে হয় আকাশ আর পৃথিবী জ্যোৎস্নায় ভেসে গেছে।
পুরুষ এবং নারীর দেব এবং দেবী রূপ চূড়ান্ত হয়ে উঠল গজাসুর বধ নাচে। সে নাচে উদয়শংকর শিব, সিমকি পার্বতী। শীতের রাত। শিব শুধু একটি অলংকৃত কটিবাস আর রত্নখচিত মুকুট পরেছেন। পার্বতীর বল্কল ধরনের কাপড়। কি করে তারা অতটা শীতে অমন খালি গায়ে না কেঁপে দাঁড়িয়েছিলেন। দুজন দুজনকে আলিঙ্গন করে আছেন অথচ কোথাও স্পর্শ করছেন না। ঐ রকম সৌন্দর্যের রচনা আজ পর্যন্ত আর দেখি নি। ছোট ছোট জিনিস নিখুঁত করে করে একটা বড় পরোকর্ষে পৌঁছনো। পোশাক, অলংকার, চুল বাঁধা, কাপড় পরা, শরীরের প্রসাধন সমস্ত দিকে কত যে কল্পনা, কত যে মনোনিবেশ পেয়ে ঐ চলচ্ছবি তৈরি হয়েছিল। সেদিন ঐ নাচ দেখে যেন ভারতীয় দেবকল্পনার শিল্পমহলটিতে উপস্থিত হলাম। কাংড়া শৈলীর চিত্র, এলোরার কৈলাস গুহার মূর্তি, দক্ষিণ ভারতের নটরাজ মূর্তি। এই দলেরই আর একটি ছিল উদয়শংকর-সিমকির হরপার্বতী নাচ।
নাচের পরের দিন ট্রাউজার্স, পুলওভার পরা উদয়শংকরকে খুব কাছ থেকে দেখলাম সবল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, অত্যন্ত সুষম শরীর, যেন বিদেশী মানুষ। মুখে কঠিন ভাব। গায়ের রং গোলাপের পাপড়ির মতো। ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছিলেন।
এর কিছু আগে দুটো বই পড়েছিলাম- অক্ষয়কুমার নন্দীর লেখা ‘বিলাত ভ্রমণ আর অমলা নন্দীর লেখা ‘সাত সাগরের পারে’। অক্ষয় নন্দী প্যারিসের বিশ্বপ্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন তাঁর রোলড গোল্ডের গয়নার দোকান নিয়ে। অমলা তাঁর বালিকা মেয়ে, যিনি পরে উদয়শংকরের দলে সিমকির জায়গাটি নেবেন।
.
দিলীপকুমার রায়
সে সময়ে শোনা গেল দিলীপকুমার রায় উমা বসুকে নিয়ে প্রতিবেশী শহরগুলিতে গান গাইতে আসছেন। শহরের সংস্কৃতিমনস্ক মুরুব্বীরা দিলীপকুমারদের এখানে এনে গান শোনাবার ব্যবস্থা করলেন। সেদিন শহরে অপেক্ষার চাপা উত্তেজনা বিকেলবেলা ওঁরা এসে পৌঁছবেন। দিলীপকুমারের গান রেকর্ডে শুনি, ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকায় তাঁর লেখা গান আর স্বরলিপি নিয়মিত বেলোয়–
বুলবুল মন, ফুল-সুরে ভেসে
চল্ নীল মঞ্জিল উদ্দেশে।
অম্বর-বাঁশরী ঐ ডাকে, আয়
পিঞ্জর পাসরি চল্ অধরায়।
এ ধরায় দে বিদায়।
অধরায় প্রাণ চায়।
সন্ধেবেলায় খবর এল– সড়কপথে আসবার সময় ওঁদের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। উমা বসুর বাবা ধরণী বসুর মৃত্যু হয়েছে। ওঁরা ফিরে চলে গেছেন।
.
মাসিমা
আমার মাসিমার মতো দুর্ভাগিনী আমি কমই দেখেছি। নাগাবাবাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, আমার মার বিয়েটা যদি ছাইয়ের বিয়ে হয়, তো মাসিমার বিয়েটা কি? পাত্র সদ্বংশের, শিক্ষিত, রোজগেরে- সব ঠিক। কিন্তু বিয়ের পরই টের পাওয়া গেল মাসিমাকে তার স্বামীর দরকার নেই। কারণ সে জন্যে তার বিধবা কাকিমা আছেন। কাকা বেঁচে থাকতেই কাকির সঙ্গে ভাইপোর সম্পর্ক ঘটেছিল। কাকা মারা যেতে কোথাও কোনো গোপনতা রইল না। কলকাতায় তাঁরা একই বাড়িতে থাকতেন। মেসোমশাইয়ের বাবাজ্যাঠারা ভেবেছিলেন বিয়ে দিলে ছেলে শুধরে যাবে। পুলিশ বদ্যি ওঝা রোজা ডাকার বদলে তাঁরা আমার ফজবেনে মাসিমাকে মোতায়েন করলেন তাঁদের ছেলের মতি ফেরাতে। সে কি পারে ঐ জবরদস্ত পাকা খুড়িশাশুড়ির সঙ্গে। বছর দুয়েক চেষ্টা করে মাসিমা চিরতরে চলে এল তার বাবামায়ের কাছে।
আমি মেসোকে কখনো দেখি নি। কিন্তু তার খুড়িকে দেখেছি। আগেই গল্প শুনেছিলাম, পূর্ণিমা অমাবস্যার গভীর রাতে ছাদে গিয়ে মহিলা অটুট যৌবনের জন্য অদ্ভুত সব ক্রিয়াকলাপ করেন। আমি যখন দেখি তখন তাঁর বয়স হয়েছে। পরনে কালো পাড় শাড়ি, তখনও দীর্ঘ কালো চুল, কপালে কালো টিপ, ঝকঝকে তীক্ষ্ণ দাঁত।
মাসিমা সারা জীবন সধবা ছিল, সিঁদুর পরত, শাঁখা পরত। কিন্তু স্বামী বেঁচে আছে কিনা খোঁজ নিত না। তার সধবা মূর্তির সিঁদুর কুঁড়ে ভেসে থাকত তার কুমারীত্ব, একটু তিরিক্ষি খেপা বালিকাভাব।
মাসিমা ফিরে আসার পর বাড়িটা আস্তে আস্তে বদলাতে শুরু করল। এই শান্ত শহরে দাদু-দিদিমার জীবন একটা স্বাভাবিক বয়সোচিত পরিণতির দিকে যাচ্ছিল, কিন্তু এখন মাসিমা এলে আবার নতুন করে শিশুপালন আরম্ভ হল। আবার দুশ্চিন্তা, শঙ্কা। এই মেয়ের সারা জীবন কি করে কাটবে? কে দেখবে তাকে? খুব তাড়াতাড়ি তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া দরকার। মাসিমা প্রাইভেটে ম্যাট্রিক দেবার জন্য তৈরি হতে লাগল। বই খাতা এল। গৃহশিক্ষক এলেন। তার ভাগ্যের ক্ষতি পূরণ করতে যথেষ্ট শিফন, জর্জেট, জামদানি কেনা হল। সেলাইকল এল। স্যাকরা ডেকে নতুন নতুন গয়না গড়ানো হতে লাগল। বিছানাও অনেক ঝকঝকে হল। সংসার একটা এঞ্জিনে চলত, এখন দুটো এঞ্জিনে চলতে লাগল অর্থাৎ বেশি কয়লা, বেশি স্টীম, বেশি হৈ চৈ, বেশি অশান্তি। আর দিদিমা খুব দ্রুত পালটে যেতে থাকলেন। তাঁর মধ্যে যে শোকের কারুণ্য, যে একাকী থাকার শান্তি ছিল তা দায়িত্বের চাপে এবং অহংকারের তাপে উবে গেল।
এর দু বছর পরে মামা ফিরে এলে সংসারটা আরো পালটে গেল। মামা কিন্তু এঞ্জিন না, একটি শৌখিন সেলুন কার। তার ইচ্ছায় এই পরিবারে একটা নতুন চমক যুক্ত হল। বছরে এক বার বাজার করতে, আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে এবং আনন্দ করতে কলকাতা যাওয়া শুরু হল। কলকাতায় এরা দিদিমার ভাইবোনদের বাড়িতেই উঠবে। সুতরাং দিদিমাই টীম তৈরি করতেন, আর আমি অবধারিতভাবে বাদ যেতাম। আনন্দ থেকে বাদ পড়লে কোন্ বালক আর খুশি হয়। তবু দিদিমারা রওনা হয়ে গেলেই আমি তেড়েফুঁড়ে উঠতাম। ভালোই হয়েছে। একলা একটা বাড়িতে আমি বরং এই এক মাস তোফা কাটাব। তোফা কাটাবার জন্য আমি তোড়জোড় শুরু করি। কৃচ্ছসাধনের কথা আছে বইয়ে। কৃচ্ছসাধনের জন্য সরু একটা বিছানা করি। চাদর, বালিশের ওয়াড় ধবধবে করে কেচে শুকোই, টানটান করে পাতি। চরিত্রকে একতরকারি ভাত রাঁধতে বলি। বন্ধুদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে একবোঝা বই নিয়ে আসি। রাত্রে লণ্ঠন জ্বেলে, বুকের নিচে বালিশ দিয়ে পড়ব। ভাবতে থাকি, এই পূর্ণ স্বাধীনতাকে কিভাবে কাজে লাগাব। বিনয়দের বাড়ি যাই। তিন চারটে বাঁশঝাড় পেরিয়ে পুকুরের কাছে ওদের বাড়ি। বিনয়রা দুই ভাই। ওদের পড়ার ঘরটা ছাগলের খোয়াড়ের মতো ছোট, এবং তার বাইরের বেড়া মাঝখানে বেঁকে গিয়ে ত্রিভঙ্গমুরারী। ওদের অবস্থা খুব খারাপ। গাড়ির চাকার বাতিল টিউব থেকে রবারের ফিতে কেটে চামড়া আর গাছের ডাল দিয়ে ওরা গুলতি বানায়। এক একটা গুলতি দুই থেকে তিন আনা। এই করে দুই ভাই কিছু পয়সা রোজগার করে। ওরা অনেক কিছু জানে, আমার চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন। কিন্তু ওদের নিস্তেজ চোখের নিচে কালি, হঠাৎ হঠাৎ দাঁত থেকে রক্ত পড়ে। ওদের বার্শিহীন চেয়ারটা খুব আরামের। অনেকক্ষণ বসে থাকি। একটা গুলতি কিনি। ওরা প্ল্যান করছে, খুব কায়দার বাঁশের লাঠি বানাবে, গাছের ডাল থেকে হকি স্টিক বানাবে, গাড়ির স্প্রিং কামারশালায় দিয়ে ক্ষুরের মতো ধারালো ছোরা বানাবে।
মাসখানেক পরে দিদিমারা নতুন কেনা জিনিসপত্র নিয়ে, দেখাসাক্ষাৎ শেষ করে, তাজা হয়ে ফিরে আসতেন। একবার আমার জন্যে সতীকান্ত গুহর ‘দুরন্ত কাহিনী এবং শিবরাম চক্রবর্তীর ‘টম সয়্যারের গল্প’ এল। দুখানা বইই শক্ত মলাটের, সচিত্র, এবং মূল্য ছ আনা মাত্র। তখন তিন আনা, দু আনা সিরিজেরও বই ছিল।
কিছুদিন হল দেখছি, দিদিমা মাসিমার মধ্যে যেন একটা চুক্তি হয়েছে– সব বিষয়ে মতের মিল। যখন কোনো কাজ থাকে না, চায়ের পর বিকেলে বসে বসে দুজন দুজনার প্রশংসা করে। সর্বৈব বানানো কথা, শুনে শুনে আমার গা জ্বালা করে। আমি তাদের উৎসাহে একটি বরুণ বাণ নিক্ষেপ করে পালিয়ে যাই। আজ মনে হয়, তাদের তেমন দোষ ছিল না। মেঘলা বিকেলে দিন যদি না কাটে, আশা যদি না থাকে তবে বসে বসে কি করবে তারা।
নিন্দামন্দ করা বা শত্রুতা করার একটা এজমালি লোক পেলে একতাটা খুব সহজ হয়। কাজের লোকের দোষ ধরার সময় কর্তা-গিন্নী কত একমত, বাড়ির বিধবা বোনটাকে ঠকাবার সময় সব ভাইয়েরা এককাট্টা, বিধর্মীকে খুঁচিয়ে মারার সময় পুরো ধর্মস্থান একসঙ্গে সড়কি বল্লম বার করে। এক্ষেত্রে আমাকে পেয়ে দিদিমা মাসিমার পারস্পরিক সম্পর্কটি বেশ উছলে উঠল। কিন্তু আমি তত সুবিধাজনক না হওয়ায় ঈশ্বর শিগগিরই সব দিক থেকে আরও উপযুক্ত একটি পাত্র অযাচিতভাবে জুটিয়ে দিলেন। আরও ভালো, ইনি পাত্র নন, পাত্রী। মহিলাটি দিদিমারই আত্মীয়া, বিখ্যাত এক গুণী পরিবারের মেয়ে, মাসিমারই সমবয়সী। মহিলাকে তাঁর স্বামী দিদিমার বাড়িতে নির্বাসনে বা সংশোধনের জন্য পাঠালেন কারণ একটি গর্হিত অপরাধ করেছিলেন তিনি বিয়ের পর, সন্তান হবার পর এক বিবাহ-অতিরিক্ত প্রণয়ে জড়িয়েছিলেন। আমি এতদিন দিদিমার সংসারকে খানিকটা বর্সটল স্কুলের মতো করে রেখেছিলাম, ঐ মহিলার জন্য এবার সেটা পুরোদস্তুর উদ্ধারাশ্রম হল। এর নেমিসিস পরে, অতি ধৈর্যসহকারে, ধীরে ধীরে কাজ করেছিল।
মহিলা যখন এ বাড়িতে এলেন তখন আমার বয়স এগারো আর তাঁর পঁচিশ ছাব্বিশ। তিনি আমার রাঙাদি হলেন। রাঙাদি বেশ অন্য রকমের লোক। তাঁর চৌকো চৌকো স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পাথর বসানো হারখানা সোনার না, কিন্তু খুব সুন্দর। তাঁর বেঁটে কালো শেফার্স পেনে দিস্তের পর দিস্তে কাগজ অতি দ্রুত নির্ভুল লিখতে পারতেন তিনি। ত্বরিত হাতে বিনা আয়াসে রান্নাবান্না ও ঘরের কাজ করেন। সামান্য হাসির কথায় বা না-কথায় এমন হাসতে থাকেন যে দিদিমা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকেও তাঁকে থামাতে পারেন না। এই ঝরনার মতো অসংবৃত হাসির জন্যে তাঁকে আরও সন্দেহজনক লাগে। মাসিমা তাঁর উপরে নজর রাখে, এবং দিদিমা মর্মান্তিক বাক্যে তাঁকে কাবু করার চেষ্টা করেন।
রাঙাদি আসার পর পুরো রান্নার কাজ তাঁর উপর পড়ল। আমি মাঝে মাঝে তাঁর পিঠের উপরে গিয়ে পড়ি বড্ড খিদে পেয়েছে। রাঙাদি ঐ অবস্থায় খুন্তি ঠেলতে (ঠলতে বলেন- রো রো এই হয়ে এল। রান্নার কাজে শরীর কালি হয়, তাই রবিবার বেলা দুপুরে রাঙাদি আমাকে কলতলায় ডাকেন পিঠে সাবান ঘষে দিতে। তাঁর শরীরটি অন্য রকম কোমর খাঁজ, পেটে খাঁজ, ধাতুর মতো উজ্জ্বল টানটান চামড়ার নিচে পুরু এক স্তর চর্বি। প্রচুর চুল ছোট কপালটিতে চুল প্রায় জোড়াভুরুর কাছে চলে এসেছে। তাঁর শরীরের সঙ্গে সমুদ্রের শুশুকের খুব মিল আছে। সে শরীর অনেক জলের চাপ নিয়ে নিচে যেতে পারে, আবার ভুস করে ভেসে উঠতে পারে। দিদিমা মাসিমা চেষ্টা করে করে তাঁর হাসি অনেকটা শুষে নিয়েছিল। আর, অনেক বছর পরে শেষটায় তো তাঁর না-হাসির বয়সই এসে গেল।
ননিদা আমাকে একটা ছোট্ট নোটবই দিয়েছিল। নোটবইটা ভারি সুন্দর। প্রথম দুটো পৃষ্ঠায় কয়েকটা অজানা নাম ঠিকানা লেখা– কিন্তু হাতের লেখাটা অতি সুকন্দর বলে পাতা দুটো ছিঁড়ি নি। কোথায় রাখব, তাই আস্ত নোটবইটা রাঙাদির ডালা খোলা সুটকেসে রেখে দিয়েছিলাম। তার পরে ভুলে গিয়েছি। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি, বাড়িতে তুমুল কাণ্ড। মাসিমা রাঙাদির বাক্স হাঁটকে সেই নোটবই বার করেছে। সারা দিন ধরে তাঁকে ঐ নামঠিকানার লোকগুলো সম্বন্ধে জেরা করা হয়েছে। রাঙাদি হতচকিত হয়ে গেছেন, দুপুরে খান নি, ভাঁড়ার ঘরের কোণে আঁচল পেতে বসে আছেন। আমি কাছে যেতে যুগপৎ কেঁদে এবং ফুঁসে উঠলেন। আমি মামাকে গিয়ে ব্যাপারটা খুলে বললাম। তার বজ্র আঁটুনি অমন ফসকা গেরো হয়ে যাবে মাসিমা তা কি করে হতে দেয়। অতএব সে বলল– না, এ খাতা তোর না।
আমি বললাম– তাহলে কার খাতা?
— যার বাক্সে পাওয়া গেছে তারই খাতা।
আমি বললাম– তোমার বাক্সয় আমার প্যান্ট শার্ট আছে, তাহলে সেগুলোও তোমার? ভালো চাও তো আমার নোটবই ফেরত দাও।
– না, ও খাতা আমার কাছেই থাকবে।
আমি বললাম– তুমি গোপনে লোকের বাক্স ঘেঁটে দ্যাখো, সেখান থেকে অন্যের জিনিস বার করে নাও। তোমার ঘাড়টি আমি একদিন মুচড়ে দেব।
সেদিন থেকে আমি পুরো রাঙাদির দিকে চলে গেলাম।
কয়েক বছর পরে রাঙাদির গল্প গড়িয়ে গড়িয়ে এক দিকে চলে গেল আর মাসিমার গল্প গেল অন্য দিকে। ছেলেবেলার এত যে কাছাকাছি থাকা তবু আমি সেই দুই অগভীর জলস্রোতের পথে কোথাও ছিলাম না।
.
পুনশ্চ: কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই কিছু না। তিনি হাড়ীর মাকে নিয়ে তাড়ীর মা করেন। মাসিমা, সেই মাটো, পাটোয়ারীবুদ্ধিহীন মেয়েটি জীবনের শেষ পর্বে যেখানে পৌঁছেছিল রাঙাদি, দিদিমা বা আমি কেউ সেখানে পৌঁছতে পারি নি। দাদুর মৃত্যুর পর দুবুদ্ধি এবং দুর্ভাগ্যবশত পরিবারটি ক্রমশ গরিব এবং ছত্রখান হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকেরই নিজের নিজের ইচ্ছা এবং স্বার্থ ছিল, মাসিমারই শুধু নিজস্ব কিছু নেই। সে তার সামান্য বিদ্যে নিয়ে ছাত্র পড়ায় ছোট ভাড়া বাড়িতে মায়ের সংসারটাই চালায়। মাকে দেখে, ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের মায়ের স্নেহ এবং বাবার দায়িত্ব নিয়ে পালন করে। দিদিমা যখন মারা গেলেন, সে একা হয়ে যায় নি। ঐ পাঁচ-ছটা ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে আছে। মামা অসুস্থ হয়ে কলকাতায় মাসিমার কাছেই ফিরে এল, মাসিমার কাছেই মারা গেল। অনেক দিন পরে মাসিমা যখন মারা গেল তখনও ঐ ছেলেমেয়েরা, মেয়েদের বরেরা তাকে সন্তানের মতো ঘিরে আছে।
.
মামা
মামা দাদুদিদিমার একমাত্র ছেলে এবং শেষ সন্তান। আমার চেয়ে মামা সাত বছরের বড়, মাসিমার চেয়ে সাত বছরের ছোট। এই শহরে পড়াশোনার অসুবিধে হওয়ায় মামা তার মামার কাছে দিনাজপুরে পড়তে গিয়েছিল। সেখানেও শিক্ষার উন্নতি হল না দেখে আবার বাড়িতেই ফিরে এল। প্রথমটায় যখন আমি দিদিমার কাছে যাই তখন পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক ছিল। মাসিমা আসার পর আমার স্থানটা এক ধাপ নিচে নেমে গিয়েছিল, মামা আসার পর সে স্থান আরও এক ধাপ নিচে নামল।
মামার গায়ের রং অত্যন্ত ফরসা, কালো চোখ ও কালো চুল, অসম্বদ্ধ দাঁত, শুকনাস, নরম চিবুক, পরিশ্রমবিমুখ দেহ। মামা কিন্তু লোক ভালো। তাহলে তাকে নিয়ে সমস্যাটা কোথায়? মামা যখন বাড়ি ফিরে এল তখন সে ক্লাস টেনের ছাত্র, আর আমি সবে ফাইভে উঠেছি। মামা তার পাঠ্য বাংলা কবিতা আবৃত্তির মতো করে পড়ে, শুনে শুনে সত্যেন দত্তের হিমালয়াষ্টক এবং মেথর আমার মুখস্থ হয়ে গেল। তার বাংলা সিলেকশনের বইটি নিয়ে আমি গল্প আর কবিতাগুলো পড়তাম। গাড়ির আড়ি, মহেশ, প্রেমের ঠাকুর, ভারতবর্ষ, গুপ্তধন। গুপ্তধনের মতো গল্প এর আগে কখনো পড়ি নি। সেই যে সন্ন্যাসী হরিহরকে বললেন- “বাবা, ছোটো হইয়া সুখে থাকো। বড়ো হইবার চেষ্টায় শ্রেয় দেখি না। হরিহর বোঝেন নি, কিন্তু সেই বয়সেই প্রারব্ধবশত কথাটা আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেল। এবং গল্পটা শেষ হলে মন উচ্চাশাহীন বালসন্ন্যাসীর মতো হল। পড়তে পড়তে বিকেলের আলো পড়ে এসেছিল। পৃথিবীতে এখন কি গোধূলি আসিয়াছে। আহা, সেই গোধূলির স্বর্ণ। সে স্বর্ণ কেবল ক্ষণকালের জন্য চোখ জুড়াইয়া অন্ধকারের প্রান্তে কাঁদিয়া বিদায় লইয়া যায়। তাহার পরে কুটিরের প্রাঙ্গণতলে সন্ধ্যাতারা একদৃষ্টে চাহিয়া থাকে। এই জায়গাটায় এসে, চোখ তুলে পশ্চিম আকাশে তার প্রতিবিম্ব দেখে মন আশা নিরাশার, সুখ ও দুঃখের অতীত এক অবোধ ব্যথা অনুভব করল। আজ বুঝি, তা ছিল বিশুদ্ধ সৌন্দর্যানুভূতির আঘাত।
অনেক দিন পরে আর একটা সমাপতন চোখে পড়েছিল– গল্পটা কার্তিক ১৩১৪ সালে লেখা। অর্থাৎ আমার জন্মের সতেরটি বছর আগে, হেমন্তে। আমার কেন জানি না মনে হয়, সেই উদাসীন হেমন্ত, সেই তৃণে শষ্পে গাছের পাতায় শিশিরের নিশ্বাস ফেলা হেমন্তই গল্পের চারদিকে জড়িয়ে ছিল, যেমন সে জড়িয়ে ছিল আমার জন্মের চারদিকে।
সেই সময়টাতে মামার প্রধান সমস্যা দাঁড়াল পরীক্ষা পাশ করা। মামা নেশাভাং করে না, গল্পের বই পড়ে না, শীতের বিকেলে দু-তিন গেম ব্যাডমিন্টন ছাড়া অন্য খেলা খেলে না, ছবি আঁকা গল্প লেখা জিমন্যাসটিকস্ বা দাবা এসব উটকো বাই কিছু নেই, বারমুখোও নয়, রাজনীতিও করে না, অর্থচিন্তা বা অন্য দুশ্চিন্তাও নেই, তবু সে এবারেও ফেল করল। বাড়িতে যেন কদিন অশৌচ চলল- খিদে পেলে খাবার চাওয়া বারণ, চেঁচিয়ে কথা বলা বারণ, ঘরের বারান্দা থেকে উঠোনে লাফিয়ে পড়া বারণ। দিদিমা এমন তাকাবেন, তাঁর দৃষ্টি যেন কেটে কেটে বলে পরের হেনস্তায় খুব ফুর্তি! খোকনের বদলে তুমি কেন ফেল করলে না। মামার জন্যে আমার খারাপ লাগে তার মধ্যে কোনো নীচতা নেই, হিংস্রতা নেই। কেন সে বার বার ফেল করে। ক্রমশ এ বিষয়ে একটা অদ্ভুত কথা আমার মনে এল; পিতৃশাসিত সমাজও ভালো, মাতৃশাসিত সমাজও ভালো, হয়তো শাসনহীন সমাজও ভাল। কিন্তু আমাদের পিতৃশাসিত পরিবারে কত্রীর মেট্রিআর্ক ভূমিকা সর্বনাশা। সন্তানকে তা হাঁসজারুর মতো বিকলাঙ্গ ব্যক্তিত্ব দেয়। পরিবারে দিদিমার একাধিপত্য ও পুত্রস্নেহ মামাকে পুরুষের দায়িত্ব এবং সন্তানের কর্তব্য থেকে সরিয়ে রেখেছিল। নিজের সুখটি ছাড়া অন্যের কষ্টদুঃখের কথা সে বুঝতেই শিখল না।
ছাত্রাবস্থাতেই মামাকে বিলাসিতায় পেয়ে বসেছিল। সে ফিনফিনে ধুতির সঙ্গে সিল্ক, মটকা, গরদের শার্ট ছাড়া কিছু পরে না। সে শার্টে আবার সোনার বোতাম। তার জুতো সাদা সোয়েডের কিংবা কালো গ্লেস কিডের। এবেলার জামাকাপড় ওবেলায় চলে না। বেরোবার আগে পায়ের কাছে ছাড়া কাপড় দিয়েই সে জুতো ঝেড়ে চলে যায়। কয়েক মাস আগে আঠাশ টাকা দিয়ে একটি অ্যাংলো স্যুইসের ঘড়ি কিনেছে, আবার এ মাসেই তিরিশ টাকা খরচ করে একটা র্যালে সাইকেল কিনল। কিন্তু এইটুকু বিলাসিতায় কি ম্যাট্রিক পাশ করা আটকে যায়।
শুধু বাবু নয়, মামা অলসও বটে। সে সংসারের কোনো কাজ করে না। বাজার করে না, বাগানে জল দেয় না, উঠোনের মাটি দুরমুশ করে না, কাপড় কাঁচে না। রাত
মামা ভাগ্নে সম্পর্কটা, আমি ক্রমশ টের পাচ্ছিলাম, খুব অনির্দিষ্ট সম্পর্ক। হয়তো সব সম্পর্কই অনির্দিষ্ট। আমি যদি বাবার সঙ্গে বড়দিনের ছুটিতে এখানে বেড়াতে আসতাম তো একরকম হত। এখন অন্য রকম হল। মামার সঙ্গে আমার দূরত্বের ভদ্র সম্পর্ক আস্তে আস্তে আটপৌরে আর রুক্ষ হয়ে এল।
মামা মাঝে মাঝে কর্তব্যবোধ আমার পড়াশোনার দিকে দৃষ্টি দিত। খাওয়াদাওয়ার পরে রাত সাড়ে নটায় যখন ঘুমে ঢুলে পড়ছি তখন গোটা পাঁচেক প্রশ্নের অঙ্ক দিয়ে পরীক্ষা করত। আমি যেহেতু একটাও পারতাম না অতএব শাস্তিস্বরূপ ঐ পুরো প্রশ্নমালার পঞ্চাশটা অঙ্কেরই সমাধান না করে সেই রাতে আমার শুতে যাওয়া নিষেধ হল। পঞ্চাশটা অঙ্ক সুদূরপরাহত ব্যাপার। অতএব আমি একটি আঁকড়িও না টেনে সমস্ত রাতের জন্য তৈরি হয়ে গা ছেড়ে চেয়ারে হেলে বসতাম। মামা আড়াইটের সময় জেগে দেখত, আমি নিঃশব্দে বসে আছি। অত রাতে আর হম্বিতম্বি চলে না।
মামার পরীক্ষার আগে একবার গুরুদেবকে জানানো হল। তিনি ডাকযোগে বেঁটে মোটা একটি কাঠের কলম আর গোটা পাঁচেক স্টিল নিব মন্ত্রপূত করে পাঠালেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না, মামা এবারও ফেল করল। যা হোক, পরের বছর ফল বেরোবার দিন কণ্ঠায় প্রাণটি নিয়ে যখন সবাই অপেক্ষা করছে, তখন সন্ধেবেলা কলকাতা থেকে টেলিগ্রাম এল: মামা তার হিমালয়ের প্রথম বরফচূড়াটি জয় করেছে।
এই শহরে কোনো কলেজ নেই, অতএব মামা কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়তে চলে গেল। কলেজের দীর্ঘ ছুটিগুলোয় সে বাড়ি আসত। অধ্যাপকদের সম্বন্ধে মজার মজার গল্প শোনাত। তখন তাকে বেশ লাগত। উজ্জ্বল দেখাত। কিন্তু এক বছরের মাথায় আবার দেখা দিল তার সেই পুরনো সংকট পরীক্ষায় ফেল করে বাড়ি ফিরে এল সে। এখানে ততদিনে নদীর ওপারে শহরের প্রথম কলেজটি হয়েছে। এবারে সে সেই নতুন কলেজেই ভরতি হল। এপার থেকে খেয়ানৌকোয় যুবকেরা কলেজে যায়। মামা আর জলিদা দুই বন্ধু একসঙ্গে যায়। নদীর ওপারে মেঘ ঘনিয়ে থাকে, কিংবা রোদ্দুর ধূ ধূ করে- এ পাড়টা যেমন খাড়া উঁচু ও পাড়টা তেমনি অনেক দূর থেকে ঢালু হতে হতে জলে নেমেছে।
ভালোবাসা, স্নেহ পেতে গেলে কতগুলো গুণ থাকা দরকার। আমার মধ্যে সেই গুণগুলি জন্ম থেকেই নেই। স্বভাবে না থাকলেও চর্চা করে তা একটু-আধটু বাড়ানো যেত। আমি সে চেষ্টাও করি না। অতএব ক্ষুরধারবুদ্ধি দিদিমা আমাকে ঘোর অপছন্দ করেন, মাটোবুদ্ধি মাসিমার সঙ্গে আমার খটাখটি বাধে। আর এই দুই বুদ্ধির প্ররোচনায় দুর্বলবুদ্ধি মামা আমাকে ভুল পথে শাসন করবার চেষ্টা করে।
ইতিমধ্যে আমার বালকবয়স শেষ হয়ে যাচ্ছিল বালিকার কণ্ঠস্বর ভেঙে পুরুষের মোটা গলা জেগে উঠছিল, চামড়ার নিচে মাংসপেশির গঠন অ্যানাটমির ছবির মতো হচ্ছিল, পেশির মধ্যে হাড় তেজোময় হচ্ছিল। অভিভাবকদের খেয়াল রাখা উচিত, ঐ সময়ে কিশোরদের শরীরে কাম এবং রুদ্র একসঙ্গে জেগে ওঠেন। তাদের অসম্মান করতে অনর্থ ঘটতে পারে।
আমার দুষ্টুমি, অসভ্যতা, অবাধ্যতার শেষ ছিল না। লেখাপড়াতেও ভালো নই, সুতরাং দাদু দিদিমা মাসিমা মামা চারজনই আমাকে অল্পবিস্তর মারধর করত। তাতে আমি আপত্তির কিছু দেখি নি। বাবার কাছে থেকে আমার ভাইয়েরা তো আরও বেশি মার খায়। মারের আঘাতকে আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না, গভীর সূক্ষ্মতা নিয়ে লক্ষ করি মারের উদ্দেশ্য।
একটি একটি করে এবার বলি। দিদিমার নালিশ শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে দাদু হঠাৎ হয়তো আকস্মিকভাবে দু-চার ঘা লাগাতেন। আমি স্পষ্ট বুঝতাম, মারতে গিয়ে দাদু নিজেই কষ্ট পাচ্ছেন। সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরেও তাঁর মুখখানি দুঃখিত হয়ে থাকত। আমি জানি, কখনো কখনো বড় মেয়ের কথা মনে পড়ে তাঁর। আমাকে মারলে অবধারিতভাবে মনে পড়বেই।
দিদিমার মার দেবার পিছনে ছিল আক্রোশ। অতএব তাঁর মারবার কায়দাও ছিল একেবারে অন্য রকম- যাতে আমি সত্যিকারের ব্যথা পাই, যাতে চামড়া ছিঁড়ে রক্তপাত হয়। এই দুষ্ট বুদ্ধি বুঝতে পেরে একদিন তাঁকে বেশ দু ঘা দিলাম। দিদিমা এমন হাউমাউ করে উঠলেন যেন কেউ তাঁকে খুন করছে। সন্ধেবেলা সবাই ফিরে এলে পারিবারিক আদালতে সেই মামলা উঠল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সেদিন তা নিয়ে কেউ বিশেষ উচ্চবাচ্য করল না।
মাসিমার কাণ্ডাকাণ্ডজ্ঞানহীনতা আমাকে খুব বিপদে ফেলত। লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই এনেছি। মাসিমা সে বই লুকিয়ে রাখল। বই ফেরত দেবার দিন পেরিয়ে গেল, রোজ জরিমানা হতে লাগল। আমি বিপদে পড়ে কাকুতি-মিনতি করি কিন্তু মূর্খ মাতৃম্বসার কাছ থেকে বই ফেরত পাই না। এ মহিলাকে এবার কি করা উচিত?
মাঝে মাঝে তার বিদ্যেবুদ্ধি তাক লাগিয়ে দিত। পুরনো প্রবাসী থেকে যীশুর একটি ছবি, সম্ভবত রাফাইলের, কপি করছিলাম। সে ছবিতে যীশুর দাড়িগোঁফ নেই, লম্বা চুল। রাফাইলের চুল আঁকার নিপুণতা আমার শুকনো পেনসিলের ডগায় আনবার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ মাসিমা পিছন থেকে এসে ছোঁ মেরে ছবিটা তুলে নিল ‘দেখি কি করছিস। এই বয়সে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েমানুষের ছবি আঁকছ! মাসিমা চেঁচামেচি করতে লাগল। দিদিমা তাঁর খুলনাইয়া গলায় ঘেন্না ঝরিয়ে বললেন- “আউ আউ আউ ছি ছি ছি’। আমি বাক্যহীন হয়ে মা-মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
দাদুর দূর সম্পর্কের এক ভাইপো, জ্ঞানমামা, এস ডি ও টি হয়ে এই শহরে এলেন। জ্ঞানমামা অসাধারণ সুপুরুষ, বর্মায় মানুষ, সদ্যবিবাহিত, আমাদের বাড়ির কাছে তাঁর বাংলো। একদিন উনিই খোঁজখবর করে আমাদের বাড়িতে এসে দেখা করে গেলেন। আমি মাঝে মাঝে তাঁর বাংলোয় যাই। তাদের বিশাল ড্রইংরুমের পুরো মেঝে কার্পেটে ঢাকা। ইন্দিরামামী কেবল কুশনের পর কুশন তৈরি করেন। তাঁর সময় কাটে না। চমৎকার শাড়ি পরে, স্ট্র্যাপ লাগানো রঙিন খড়ম পায়ে খটখট করে বারান্দায় হাঁটেন। নিজের হাতে ছানা কাটিয়ে সন্দেশ বানিয়ে, কেক বানিয়ে খাওয়ান।
একদিন সেখানে ডিনারে আমার নেমন্তন্ন। সন্ধেবেলা তৈরি হতে গিয়ে দেখি, একটা প্যান্ট ভেজা, দুটো প্যান্ট যাচ্ছেতাই ময়লা, আর একটা প্যান্ট অবশ্য সঁতসেঁতে হলেও পরা যাবে। কিন্তু শার্ট তো নেই চারটেই ছেঁড়া ভেজা ময়লা। ফিজি সিল্কের একটা সাদা হাফশার্ট মাসিমার বাক্সে পাট করা আছে, কিন্তু সেটা সে কিছুতেই দিচ্ছে না। একটা ফরসা ধুতি অবশ্য আছে। তাহলে আমি কি এই বর্ষার সন্ধ্যায় তাঁদের সোফা কৌচে সাজানো বাড়িতে ধুতি পরে, কোচার খুট গায়ে দিয়ে যাব? আমার নেমন্তন্নের আনন্দ চলে গিয়েছিল। কিন্তু নেমন্তন্ন যখন নিয়েছি, না গেলে ঠিক হবে না, সুতরাং ঐ ধুতিটি পরে, খুট গায়ে দিয়েই গেলাম। জ্ঞানমামা, ইন্দিরামামী আর আমি টেবিলে বসেছি, বাবুর্চী মং পরিবেশন করছে, ওঁরা গল্প করছেন, যেন কোথাও কোনো বৈসাদৃশ্য নেই। কিন্তু আমার ভিতরকার সেই বিপন্নতা আমি আজও ভুলি নি। এত কথা মনে আছে, কিন্তু কি খেয়েছিলাম কিছু মনে নেই।
মামা লাইব্রেরি থেকে গল্পের বই আনতে শুরু করেছিল। আমি ফাঁক পেলেই সে বই পড়ি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের বেনামী বন্দর ঘোট বই কিন্তু তার ‘শুধু কেরানী’ গল্পটির বলার ভঙ্গিমা আমাকে চমৎকৃত করেছিল। আমি মিঃ ব্রেক আর তাঁর সহকারী স্মিথের রহস্যলহরী সিরিজের বই অনেকগুলো পড়েছিলাম। পাগলের প্রলাপ মনে হত। মামার আনা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশের ডায়েরী’ আর ‘ব্যোমকেশের কাহিনী পড়ে বুঝলাম গোয়েন্দা গল্প কাকে বলে। নাওয়া খাওয়া ভুলে বইদুটো পড়েছিলাম। অন্নদাশংকর রায়ের ‘আগুন নিয়ে খেলা এক সন্ধেবেলায় হাতে এল। রাত জেগে পড়লাম। পেগি। স্কট সেই রাতের বেলা যেন রক্তমাংসের দেহ ধরে আমাকে উচাটন করে তুলল। এই সময়ে আর একটা বই, ‘লন্ডন রহস্য’, কোত্থেকে জোগাড় হয়েছিল মনে নেই। সে এক অদ্ভুত বই। মূল বই ‘দি মিস্ট্রিজ অব দি কোর্ট অব লন্ডন’। এ হল তার বাংলা তরজমা। মোটা, বৃহৎকায়, বইটা জুড়ে অধ্যায়ে অধ্যায়ে কেবল বিলিতি লর্ড আর লেডিদের উত্তপ্ত রতিক্রিয়া আর উত্তেজিত কামকেলি। ঐ বয়সে সেই বই পড়ে স্ত্রীসংসর্গের অস্বস্তি আর সুখানুভূতি হল। মামার বিছানার নিচে লাল রেক্সিনে বাঁধাই এক সচিত্র বই পেলাম ‘যৌবন পথে। বইটা একেবারেই ভালো লাগে নি। মেয়েরা কি আঁধার রাত মাপবার গভীর কুয়ো? গল্প উপন্যাস পড়ে পড়ে আমার তো তাদের সুদূর ও বাসনা-করুণ মনে হত।
এই সময়ে একদিন বিকেলের চায়ের আগে মামা আমাকে বড়ঘরে ডাকল। দিদিমা মাসিমাও সেখানে আছে। মামার হাতে একটা বই তার প্রথম কয়েকটা পৃষ্ঠা কেউ ছিড়ে নিয়েছে, লাইব্রেরির সীলের উপরেও কালি বুলনো হয়েছে। মামা সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, কেন আমি এ কাজ করেছি। আমি হতবাক। বইটা এর আগে আমি দেখিই নি। আর, যে-আমি বইয়ের একটা পাতা মুড়লে বা আঙুলের একটা ছাপ ফেললে চটে যাই সেই আমি কেন করব ও রকম। মাসিমা তার বোকা বুদ্ধিতে বলল– যাতে লাইব্রেরিতে তুই অপদস্থ হোস, তাই এসব করেছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, ও, তাই বুঝি তুমি আমার ‘পাতাবাহার’ আর ‘ছন্দের টুং টাং গায়েব করেছিলে?
মামার বিপত্তিটা আমি বুঝলাম। তার ফরসা মুখ ক্রমশ লাল হয়ে উঠছিল। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ সে খাট থেকে নেমে আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি তৎক্ষণাৎ স্থির করে নিলাম, এই প্রথম লড়াই-ই যেন তার সঙ্গে আমার শেষ লড়াই হয়। আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম– একবার গায়ে হাত দিয়ে দেখ তোমার কি অবস্থা করি। আমি তৈরি হয়ে দাঁড়ালাম। মামা বুঝতে পেরেছিল। সে আর এগোল না। আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সন্ধে ঘোর হল। কোথায় আর যাব, নদীর পাড়ে গিয়ে বসে রইলাম। ওপারটা অন্ধকারে ডুবে গেছে। আজ তারারাও ওঠে নি। হয়তো মেঘ করেছে। মামাকে ওভাবে বলা উচিত হয় নি। মামা তো লোকটা ভালো। বইটা ছিঁড়ল কে?
যা হোক, এইভাবে ধীরে ধীরে শাসন আলগা হয়ে এল। ভালোবাসাও যেটুকু ছিল তাও আলগা হল।
.
গোপালমামা
গোপালমামা হল দাদুর পিয়ন। পুরো নাম গোপালচন্দ্র ভদ্র। কিশোর বয়সে বরিশালের গ্রাম থেকে এসেছিল, তার পর থেকে এই বাড়িতেই আছে। এখন তার বয়স তিরিশ বত্রিশ হবে। সে দিদিমার সব আত্মীয়স্বজনকে চেনে, বাড়ির সব ঘটনা জানে। দাদু ট্যুরে গেলে সঙ্গে যায়, বাড়িতে বাজার করে, বাসন মাজে, উনুন ধরায়, শীতে গ্রীয়ে বাড়ি সংস্কার করে।
গোপালমামার সঙ্গে আমার সম্পর্কটি চমৎকার। একটা সময়ে সে লিঅ্যানে আমাদের বাড়িতে ছিল, কাকার দোকানে সাহায্য করত। ঠাকুমা তাকে কুটুম্বদের ছেলে হিসেবেই দেখতেন। এখানে, আমাকে গোপালমামা তার দেশের গল্প বলত, কাকার সঙ্গে মালপত্র কিনে ফেরার সময় বড় নদীতে ডাকাতের হাতে পড়ার গল্প বলত। দাদুর সঙ্গে সে পাহাড়-লাইনে ট্যুরে যায়, বর্ষাকালে সেখানে পাহাড় ধসে ট্রেন আটকে থাকে। একবার টানেলের মুখে লাইনের উপর হাতির দল বসে পড়ে ট্রেনকে দু দিন আটকে রেখেছিল।
গোপালমামার নানারকম ব্যবসাবুদ্ধি ছিল। শীতের দিনে পাঁচ-ছ ঝুড়ি সিলেটের কমলালেবু কিনে কমলার লটারি করত। তিন আনা করে টিকিট। প্রথম পুরস্কার ১০০ লেবু, দ্বিতীয় পুরস্কার ৫০, তৃতীয় পুরস্কার ৩০, তার পরে ৫টি পুরস্কার ১০টি করে লেবু। সিলেটের কমলালেবু খুব পুষ্ট ও বড়। লটারির বিকেলে সামনের শিমুল গাছের তলায় শতরঞ্জির উপর কমলালেবুর ভূপগুলি দেখলে লোভ হবেই। চটপট টিকিট বিক্রি হত। গোপালমামা একটা কাঁসর এনে নিলামের স্টাইলে পিটত। শীতের পড়ে আসা বিকেলে গাছতলায় উজ্জ্বল কমলালেবুর স্কুপ! বেশ হৈ চৈ ফুর্তি উৎসবের মতো লাগত লটারির বিকেল-সন্ধে। সবাই বলত গোপালদার লটারি।
গোপালমামা আরও একটা ব্যবসা করত, সেও এই শীতের দিনে। আর্যপট্টির মাঠে প্রত্যেক শীতে যুবকদের নাটকের দল দু-তিনখানা নাটক নামাত। একবার হয়েছিল লাল পাঞ্জা। গোপালমামা এই থিয়েটারের মাঠে চায়ের দোকান দিত। ডিশ, কাপ, কেতলি, ছাঁকনি, তোলা উনুন, বিস্কুটের টিন নিয়ে গোপালমামা খদ্দেরদের গরম চা বানিয়ে দিত। প্রচুর বিক্রি হত।
গোপালমামা মামাকে খোকন বলে ডাকত। মাসিমাকে দিদিমণি, দিদিমাকে মা। দিদিমাকে মা ডাকতে ডাকতে সে বোধ হয় নিজেকে বাড়িরই ছেলে ভেবে বসেছিল। ছোটখাটো আদর স্নেহ নিয়ে দিদিমার উপর অভিমান করে ফেলত। গোপালমামা অত বুদ্ধিমান, তবু বুঝতে পারত না, এই গৃহিণীটির অপত্য স্নেহ নিজের দুটি ছেলেমেয়েকে ঢেলে দেবার পরে যদি উদ্বৃত্ত এক-আধ ফোঁটা থাকে তবে তো সে পাবে।
.
বই আর ছবি
শরীর কি বস্তু, সেই যৌবনে টের পেয়েছিলাম, আর এখন বার্ধক্যে টের পাই নদীকে মাঝিরা যেমন টের পায় জোয়ার আর ভাটায়।
মৃত্যুর পরে শ্মশানে বসে হয়তো দেখব শরীর ফিরছে তার অঙ্গারে, জলে, ধাতুতে, লবণে। আর তার সূক্ষ্ম বিদেহ আভা চলে যাচ্ছে আকাশে- আলো মেঘ আর শান্তির দেশে। শরীর তো যা পেয়েছিলাম তাই ছিল, কিন্তু অস্তিত্বের ঐ বিদেহ আভা আমিই দিনে দিনে তৈরি করেছিলাম বই পড়ে, ছবি দেখে, গান শুনে।
সেই ছেলেবেলাতেই প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতী, বিচিত্রা ছাড়াও অন্য পত্রিকার কিছু পুরনো সেট পড়েছিলাম। এসব কাগজ হয়তো আমার জন্মের আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মালঞ্চ, গল্পলহরী, মানসী ও মর্মবাণীর গল্পগুলিতে সেই পুরনো দিনেও আমি আরও পুরনো দিনের গন্ধ পেতাম। একটি বেশ মোটাসোটা নিয়মিত পত্রিকা, এখন নাম মনে পড়ছে না, ছিল শুধুই ভূতের গল্পের। এই পত্রিকাটি ছিল বড়দের জন্য এর গল্পগুলিতে স্ত্রীপুরুষের ইহজীবনের রিরংসা, লালসা, প্রতিহিংসা, কামনার ভয়ংকর কাহিনী পুনরভিনীত হত পুরনো অট্টালিকার ছায়াজগতে। এসব হচ্ছে, নিতান্তই গল্পখোর পাঠক পাঠিকার কাগজ, তবু এরাও মাথার মধ্যে ঢুকে বসে আছে।
বসুমতীই ছিল দীনেন্দ্রকুমার রায় বা তাঁর রহস্য লহরী সিরিজের পৃষ্ঠপোষক। মিঃ ব্রেক ও স্মিথের একের পর এক গোয়েন্দা কাহিনী একদল পাঠক গোগ্রাসে গিলত। আমিও দুলালদার কাছ থেকে এনে কয়েকটা পড়েছিলাম। কিন্তু সেই কামারে গল্প আর তার অদ্ভুত ভাষা বেশি দিন সহ্য করা গেল না। মাসিক বসুমতীতে তখন সতীশ সিংহ এবং চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় পাতার পর পাতা ভরে অজস্র ব্যঙ্গচিত্র আঁকতেন। ক্রোধ, প্রতিহিংসা, অট্টহাস্য, হাহাকার, ভয়, বিস্ময়, সেঁতো হাসি– এই রকম সব ক্যাপশনসহ ‘ভাবের অভিব্যক্তি’ শিরোনাম দিয়ে এক ব্যক্তির নানা ভঙ্গির প্রচুর ফোটো বেরুল একবার।
ভারতবর্ষের প্রধান লেখক ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পরশুরাম, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলবালা ঘোষজায়া, প্রবোধকুমার সান্যাল সেই সময়ে এঁরা প্রত্যেকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, অথচ আজ শরৎচন্দ্র ও শরদিন্দু ছাড়া কারো বই দোকানে পাওয়া যাবে না। শৈলবালা ‘শেখ আন্দু লিখেছিলেন। তখনকার জীবনে যেহেতু ভালোবাসবার মতো মেয়ে পাওয়া সম্ভব ছিল না অতএব প্রবোধ সান্যালের ‘আঁকাবাঁকা’, ‘আলো আর আগুন’ কিংবা প্রিয় বান্ধবীর নায়িকাকে তরুণেরা বুকে করে রেখে ভালোবাসত। ভারতবর্ষে একটি করে গানের স্বরলিপি থাকত। ভলগার মাঝিদের গানের সুরে দিলীপকুমার রায় একটি গান লিখে তার স্বরলিপি করেছিলেন। এসব গান কাগজের পৃষ্ঠায় বোঝা যায় না, শব্দগুলি যেন মাছির মতো বসে থাকে, কিন্তু গাইলেই অন্য রকম, যেন যাযাবর হাঁস ভেসে পড়েছে আকাশে। আমি সত্যিই গানের মধ্যে তার ডানার ঝাঁপট শুনতে পাই কে এলে হিমেলা বায়ে, মেলে পাখা মেলে পাখা মেলে পাখা। কিন্তু মুশকিল হল- উমা বসু ছাড়া কে গাইবে এই গান।
ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ লিখতেন না। কিন্তু ‘মধুগন্ধে ভরা মৃদুস্নিগ্ধছায়া’ এবং প্রেম এসেছিল নিঃশব্দচরণে’ গান দুটি স্বরলিপিসমেত বোধ হয় সেখানেই ছাপা হয়েছিল। অর্থ না বুঝে, সুর না শুনেও, শুধু ভাষার ছবি আমাকে এমন মুগ্ধ করল যে আমি তাদের আমার নোটখাতায় টুকে নিলাম–
সে তখন স্বপ্ন কায়াবিহীন
নিশীথতিমিরে বিলীন
দূরপথে দীপশিখা রক্তিম মরীচিকা ৷৷
এই নোটখাতা বহুদিন আমার কাছে ছিল। গীতবিতান কেনার পর ক্রমশ সেটি নিরর্থক হয়ে লুপ্ত হল।
বনফুলের ‘জঙ্গম’ উপন্যাস কয়েক বছর ধরে ভারতবর্ষে বেরিয়েছিল। প্রত্যেক মাসে শংকর, করালীচরণ, মিষ্টিদিদির জন্য অপেক্ষা করতাম। জঙ্গম পড়ে কলকাতার অলিগলি, উত্তর কলকাতার স্ত্রীপুরুষের বিচিত্র জীবন ও বিপন্নতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেছিলাম।– শহরের নদীজল, নর্দৰ্মার জল আর ঢেলে দেওয়া চোলাই একস্রোতে বয়ে চলেছে। কয়েক বছর পরে শুনেছিলাম, জঙ্গমের অনেক চরিত্রই বাস্তব থেকে নেওয়া। ভনটু সত্যিই একজন ছিল, করালীচরণ সত্যিই একজন ছিলেন। আর শংকর নাকি ‘শনিবারের চিঠি’র সজনীকান্ত দাস। এইখানটাতে আমার মন বেঁকে বসল- শংকরকে আমি দারুণ পছন্দ করি। সেই চমৎকার যুবকটির সঙ্গে কিছুতেই ঐ চওড়া-চোয়াল, ঘাড়ছাঁটা চুল, ওভারকোট গায়ে লোকটিকে মেলানো যায় না।
সেই সময়কার শ্রেষ্ঠ পত্রিকা ছিল, নিঃসংশয়ে প্রবাসী। প্রত্যেক সংখ্যা শুরু হত রবীন্দ্রনাথের নতুন কবিতা দিয়ে। অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্যপ্রশিষ্যদের ছবি সেই যুগে আমি প্রবাসীতেই পেয়েছি। সেই বয়সে আমি কতটুকুই বা বুঝতাম। হয়তো বুঝতাম না বলেই ঐ সৌন্দর্য একলা পেয়ে আমাকে আবিষ্ট এবং বিভোর করে দিত। অনুচিত জেনেও, কিছু কিছু ছবি কেটে নিয়ে, লুকিয়ে আলাদা অ্যালবাম তৈরি করেছিলাম। এত বছর, এত রণ রক্ত বিফলতার পরেও সেই কয়েক শশা ছবি যক্ষের ধনের মতো এখনও আমার কাছে রয়েছে। এখনও সেই অ্যালবামগুলি আমি বার করে দেখি।
‘মাসিক বসুমতী’তে মিস্টার টমাস নামক একজন প্রতিসংখ্যায় ছবি আঁকতেন- সে ছবি হল স্খলিত-শাড়ি কোনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ের ফোটোগ্রাফ, বেশ সমুচিতভাবে রং করা। সুন্দরীর পায়ের কাছে ছাড়া কাপড়ের মতো ক্যাপশন হিসেবে পড়ে থাকত রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন। অন্য কাগজে রবি বর্মার ছবিও ছাপা হত সে ছবির একটা জৌলুশ ছিল সোনার গিল্টি করা মোটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে সে ছবি প্রাসাদের দেয়ালে টাঙালে মানাবে ভালো- নিচ দিয়ে যারা আসবে যাবে তাদের উপর নিঃশব্দে হুকুম করবে সে ছবি। কিছু নিসর্গচিত্র ছিল থিয়েটারের ড্রপ সীনের মতো। কিছু পৌরাণিক বিষয়াশ্রিত ছবি ছিল ক্যালেন্ডারের ছবির চেয়ে হয়তো একটু আলাদা।
অবনীন্দ্রনাথ চিত্রের ঐ জগৎটাকেই পালটে দিলেন। ছবি শুধু চিত্রকরের আঁকা নয়, ছোট ছেলেরও আঁকা। চিত্রকর এই ছোট ছেলেটিকে প্রথম দেখতে পেয়েছিলাম অবনীন্দ্রনাথে, তার পর গগনেন্দ্রনাথে। ওঁরা খেলতে ভালোবাসতেন। আচার্য এবং ওস্তাদ নন্দলালও শেষে খেলার দিকেই গিয়েছিলেন।
ভারতী, প্রবাসী, বিশ্বভারতী পত্রিকা এবং আরও নানা কাগজে অবনীন্দ্রনাথের কত যে প্রিন্ট দেখেছি, প্রদর্শনীতে কত যে মূল ছবি দেখেছি মুঘল শৈলীর ছবি, কৃষ্ণলীলার ছবি, পাখির ছবি, মুখোশের ছবি, প্রতিকৃতি, ঠাকুরবাড়ির গলিতে নামা সন্ধ্যার কলকাতার ছবি, সাজাদপুরের ছবি, পাহাড়ের ছবি, পুরীর পথের ছবি। কিন্তু সব ছবিকে ছাপিয়ে যেন কুঠুরির পর কুঠুরি পেরিয়ে আসল ঘরটিতে রয়েছে শিশু হয়ে খেলার ছবি, শিশু ভাবের ছবি। মৌচাকে বেরিয়েছিল একখানা সোয়া দু ইঞ্চি বাই সোয়া পাঁচ ইঞ্চি ছবি : জগৎ-পারাবারের তীরে ছেলেরা করে মেলা। পিছনে সুদূরে নীলসবুজ সমুদ্রের একটি ঢেউ, সামনে বেলাভূমিতে লাল ফতুয়া গায়ে ন্যাংটো একটি শিশু খেলায় আর স্বপ্নে ডুবে আছে। ছেলের পালের মেলা নয়, শুধু একলা একটি ছেলে। ছবিটিতে কোথাও একটি ঘাস নেই, পাতা নেই, পাখি নেই- ঐ একটি ঢেউয়েই সিন্ধুর কলরোল দোলনার দুলুনির মতো শোনা যায়। এই হল জগৎ-পারাবার। এই একটি নিরলংকার ছবি দেখার পর থেকে জগৎ এবং জগতে আমার জন্মজন্মান্তরের উপর অতি কোমল কুয়াশা পড়তে থাকে।
‘পুত্তলিকাপুরের দেশের ছাড়পত্র’ ছবিটি সামনে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখার পর মনে হতে থাকে, এই ছবির জমিটিতে পা দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই চলে যাব এক অন্য পৃথিবীতে। এই ছবিটি একটি ইশারা। অবনীন্দ্রনাথের রূপের পৃথিবীতে কোনো বাসনা নেই, অথচ যা আছে তা বাসনার চেয়ে মনকে অনেক বেশি ব্যথিত করে।
অবনীন্দ্রনাথের চেয়েও অনেক বেশি ছবি দেখেছি নন্দলাল বসুর, কারণ অনেক বেশি এঁকেছিলেন তিনি। এই পৃথিবী, নিসর্গ, মানুষ ও দেবদেবী অনেক দিন তাঁর কাছে বস্তু ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নিরেট দেয়াল হয়ে ছিল ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করতে করতে, আঁকতে আঁকতে জগৎ শেষে আত্মপ্রকাশ করল। ক্রমশ প্রাণীর কঙ্কাল, পাতার শিরা, গাছের গাঁট, পাথরের স্তব্ধতা বা ঢেউয়ের অস্থিরতা পেরিয়ে তিনি তাদের আত্মায় বা গহন দেবত্বে পৌঁছলেন। বাংলার নতুন চিত্রকলায় তিনিই একমাত্র সাধনসিদ্ধ পুরুষ।
শেষ অনেকগুলি বছর ধরে নন্দলালের ছবির অবলম্বন ছিল লোকজীবন, সাধারণ জীবন, পারিপার্শ্বিক জীবন। কলম রং কালি তুলি মাধ্যম যাই হোক; ওঅশ টেম্পারা চীনা কালির টাচ- পদ্ধতি যাই হোক, আচার্যের কৃৎকৌশল ফুটে বেরোত টানটোন দ্রুত এবং অমোঘ ভাব, রূপ, বিন্যাস এবং প্রাণ চারটি জিনিস নিয়ে চতুষ্কোণ ছবিটি চমৎকার সমতা পেত। মেয়েদের প্রতীক্ষার অজস্র ছবি, সন্ধ্যাপ্রদীপ দেবার ছবি, সাঁওতাল জীবনের ছবি, সহজ পাঠের ছবি, ভজার বাঁশীর ছবি, ক্ষুধার্ত শিব ও অন্নপূর্ণার ছবি, ছড়ার ছবির ছবি, হরিপুরা কংগ্রেসের মণ্ডপ সজ্জার ছবি নিয়ে কত সময় কেটে গেছে আমার।
আমার জন্মের বছর বার আগে প্রবাসীতে ভারতশিল্পে মূর্তি নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। সে লেখায় সদৃশ বস্তুর সঙ্গে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মিলের কথা ছিল। পাশাপাশি নন্দলাল এবং বেঙ্কটাপ্পার রেখাচিত্র দিয়ে ব্যাপারটা চমৎকার বোঝানো হয়েছিল। কুকুটাণ্ড অথবা পানপাতার সঙ্গে মুখমণ্ডলের মিল। চিবুকম্ আবীজ। পদ্ম, খঞ্জন, চেরা পটোল ও পুঁটিমাছের সঙ্গে বিভিন্ন রকম চোখের সাদৃশ্য। আমি দেখলাম, খঞ্জনের মতো করে চোখটি আঁকলে খঞ্জনের মতোই সেই চোখ নেচে ওঠে। বান্ধুলী ফুলের মতো অধর। কলা গাছের মতো মেয়েদের ঊরু। নানা জাতের শরীরের কিছু মাপজোকের কথা ছিল। নরমূর্তি দশ তাল, ক্রমূর্তি বারো তাল, অসুরমূর্তি ষোল তাল, বালমূর্তি পাঁচ তাল। আমি তখন কুমারমূর্তি, আমার মাপ ছয় তাল। সেই লেখাটি পড়ে, ছবিগুলি দেখে ভারতশিল্পে শারীরসৌন্দর্যচিন্তা বিষয়ে আমার কিছুটা ধারণা হল।
প্রবাসীতে তখন আরও ছাপা হত ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়, সারদা উকিল, আবদুর রহমান চুঘতাই-এর ছবি। এঁদের কারো কারো মূল বড় ছবি অবিভক্ত ভারতবর্ষে লাহোর জাদুঘরে টাঙানো দেখেছি। জানি না এখনও সেসব ছবি সেখানে আছে কিনা।
আচার্য নন্দলালও শেষে শিশু-দৃষ্টির কথা বলেছিলেন। সেই কাহিনীটা এখানে বলে রাখি। আমার যখন চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স তখন ছবির টানে, বৈতালিকের গানের টানে, সুরেন করের স্থাপত্যের টানে, খোয়াইয়ের উপর অপরাহু দেখার টানে মাঝে মাঝে শান্তিনিকেতনে যেতাম। স্কুল কলেজ হস্টেল যখন বন্ধ থাকত সেই জনহীন সময়টাই আমি বেশি পছন্দ করতাম। প্রথম বার যখন নন্দলাল বসুর সঙ্গে দেখা করি তাঁর কাছে আমার রং লাগাবার সমস্যা নিয়ে কতগুলো প্রশ্ন ছিল। আকাশ থেকে আসা আলোর উজ্জ্বলতা কিছুতেই আমি আঁকতে পারি না। বিকেলের আলো, মেঘের গায়ে সন্ধ্যার আলো, চাঁদের আলো আঁকতে গেলে সমস্ত আলোর উপর ছায়া পড়ে, শেষে দেখি বেশি রং লাগিয়ে ছবি আরও ময়লা হয়ে গেছে।
সেদিন তখন বেলা নটা-দশটা। বাইরে বীরভূমের রোদ বেশ চড়া হয়েছে। নন্দলাল আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নন্দনে এলেন, তালা খুলে ঘরে ঢুকলেন। মাথা থেকে পাট করা ভিজে গামছাটি নামিয়ে যথাস্থানে রেখে তাঁর আসনে বসলেন। আমার স্কেচ খাতা দেখলেন। কতকালের শিক্ষক তিনি, মুখে কিছু না বলে, সেই দুর্বল স্কেচের উপর ট্রেসিং কাগজ রেখে পুরো ছবিটাকে আমার চোখের সামনে নতুন করে এঁকে দিলেন।
তার পর আমার জিজ্ঞাসা ও সমস্যার উত্তরে বললেন– দ্যাখো, আলো ওভাবে আঁকা যায় না। প্রকৃতি যে আলো ফোঁটায় সে আলো আমরা কি করে ফোঁটাব। আমি যে এতকাল ধরে আঁকছি, আমিও পারি না। তাহলে এই রং নিয়ে আলো আর ছায়া কিভাবে দেখাব? ইতিমধ্যে ঘরের লাল মেঝেটিতে কানাই সামন্ত এসে নিঃশব্দে বসেছেন। নন্দলাল বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন- ঐ দ্যাখো, জানলার পাশে কাঞ্চন গাছে রোদ পড়েছে। যেখানটায় রোদ পড়েছে সেখানটা সাদা, যেখানে পড়ে নি সেখানটা কালো। অর্থাৎ আলো, ছায়া। সাদা কাগজে শুধু কালো রং দিয়ে এই আলো ছায়া আঁকা যায়। কালো এই একটা রং-ই যথেষ্ট। আমি কাঞ্চনের ঝোপে স্পষ্ট সাদা কালো দেখছি। তুমি দেখতে পাবে না। তোমার বয়স হয়েছে। তোমার বুদ্ধি তোমাকে দেখাবে সবুজ সবুজ আর কম-সবুজ, গাঢ় সবুজ আর হালকা সবুজ। ছোট ছেলেরাই ঠিক দ্যাখে। আমি এখন ছোট ছেলের মতো দেখার চেষ্টা করি। তোমার বয়স হয়েছে, বুদ্ধি হয়ে গেছে। তুমি এখন পারবে না।
.
পুরনো প্রবাসীতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপরাজিত পড়েছিলাম। আরণ্যক যখন মাসে মাসে বেরুত আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। এর বছরখানেক পরে বই আকারে পথের পাঁচালী পড়লাম। এসব বইয়ের দেশকাল আমারই সময়কার। সে দেশকাল এখন লুপ্ত হয়ে গেছে। আমরা মরে গেলে তার জীবন্ত স্মৃতিটি লীন হয়ে যাবে বইগুলির ছাপার অক্ষরের দেহে। পথের পাঁচালীতে মায়াময় শব্দটা অনেক বার আছে। আচার্য শংকরের চেয়ে বিভূতিভূষণ মায়া কাকে বলে অনেক গভীরভাবে বুঝিয়েছেন।
মৌচাকে চাঁদের পাহাড় বেরুত (১৯৩৫)। আমি সহপাঠী শংকরের কাছ থেকে মৌচাক এনে পড়তাম। চাঁদের পাহাড় এত সরলভাবে লেখা যে আমি অনেকদিন ঐ গল্পটিকে সত্য কাহিনী বলেই জানতাম। ঐ একজন লেখক যাঁর লেখা, গল্প জেনে শুরু করলেও, পড়তে পড়তে সত্য বলে মনে হয়। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, এমনকি তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পেও সেই এক মায়া।
তখনও সিনেমার পত্রিকা বেরুত দীপালি, খেয়ালী। সচিত্র ভারত নামে একটি নতুন পত্রিকা বেরুল চিত্রসংবাদের। আগাগোড়া আর্ট পেপারে ছাপা। বিচিত্র বিষয়ের ফোটোর সঙ্গে স্বল্প পরিসর খবর ছাপা হত। এই কাগজে দুটো ছবি দেখেছিলাম অনাগারিক পি গোবিন্দ আর লি গোতমীর আঁকা। দুটি ছবিরই রং এবং ড্রইং এমন যে মনে থেকে যায়, চিত্রীদের নাম দুটিও এমন যে ভোলা যায় না। পরে জেনেছিলাম গোবিন্দ জার্মান, গোতমী পারসী। গোতমীর আগেকার নাম ছিল রতি পেটিট। তাঁরা বৌদ্ধ হয়ে নতুন নাম নিয়ে বিয়ে করেছেন। রতি অনেক সুখদুঃখ পার হয়ে এসেছিলেন। তার পরে তাঁদের কি হল জানি না।
গোবিন্দ বা গোতমী খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ না, তবু তাঁদের কথা উল্লেখ করলাম এই ভেবে যে মানুষের চিরকল্লোলময় মহাসমুদ্রে এই রকম কত জীবন একসময়কার কাগজপত্রে একটু চিহ্ন রেখেছিল তারা বুদবুদের মতো ক্ষণিক জেগে উঠে আবার মিলিয়ে গেছে। এত রকম বিচিত্র জীবনের স্মৃতি যদি চয়ন করে রাখা যেত তাহলে কেমন দাঁড়াত?
সাধুদিদির বাড়িতে রান্না করতেন নবকুমারঠাকুর। তাঁর বই পড়ার নেশা ছিল। তিনি ‘ছোট গল্প’ নামে একটি অভিনব সাপ্তাহিক রাখতেন। অতি পরিচ্ছন্ন পত্রিকা একটি সংখ্যায় একটি গল্প। দাম এক আনা। এক সংখ্যায় মনোজ বসুর ‘দেবী কিশোরী’ পড়েছিলাম। নবকুমারঠাকুরের কাছে আর একটি বেশ মোটাসোটা বই ছিল : দেবগণের মর্ত্যে আগমন।
আমার এত নানারকম বই পড়ার পিছনে কারণ ছিল। আমি জীবনটাকে নিংড়ে নিতে চাইতাম। অন্য কোনো উপকরণ না পেয়ে অজস্র জীবনের প্রতিরূপ নিষ্প্রাণ বইগুলিকেই নিংড়ে নিতাম। তবু অদ্ভুত অদ্ভুত অজস্র বই পড়লেও আমি ক্রমশ নির্বাচক হয়ে উঠছিলাম। নিষেধাজ্ঞা মুক্ত হয়ে পথের দাবী’ নতুন করে বেরুলে পাঠকমহলে বেশ গোপন উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। আমি দু দিনের কড়ারে অতি কষ্টে সে বই জোগাড় করে পড়লাম। ভালো লাগে নি। অত নামকরা বই শেষ প্রশ্নও ভালো লাগে নি। এত কথা! তবু শেষ পর্যন্ত কেমন শূন্যগর্ভ মনে হল।
অবশ্য সময় না হলে কেউ কিছু বোঝে না। রবীন্দ্রনাথের বাঁশরি পড়ে বুঝি নি। ছোট্ট বই ডাকঘর-ও কি বুঝেছিলাম? কিন্তু বইটি শেষ করার পরে সেই দিনটা কেমন উন্মনা হয়ে গেল।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা অতি সামান্য পড়েছিলাম। কিন্তু যেহেতু আমার যৌবনাগমের তখনও কিছু দেরি ছিল অতএব সুবিধা করতে পারি নি। আমার এখনও ধারণা, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ঢুকবার প্রথম উপযুক্ত সময় হল আরক্ত, বেদনাহত প্রথম যৌবনকাল।
সেই ছেলেবেলা থেকে বড়দের বই আর ছোটদের বই আমি একইসঙ্গে পড়ে আসছি। এখনও সেই অভ্যাস যায় নি। তাহলে বড়দের বইয়ের পরে এবার ছোটদের বইয়ের কথা বলি।
একই বছরে (১৩২৭) অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সন্দেশে খাতাঞ্চির খাতা আর মৌচাকে বুড়ো আংলা লিখেছিলেন। মাসে মাসে সেই সব টাটকা সন্দেশ আর মধু যারা চেখেছিল তারা কেউ হয়তো এখন আর বেঁচে নেই, কিন্তু তাদের বাল্যকালটা রয়ে গেছে বইগুলিতে। আমি যখন ক্লাস ফাইভে তখন পনেরো বছরের পুরনো সেই সংখ্যাগুলি পড়ছিলাম। পুতু বা যক হয়ে যাওয়া রিদয়, কাউকে ঠিক বুঝতে পারি নি জায়গাটা সত্যি, অথচ ঘটনা দুটো যেন রূপকথা। পড়তে পড়তে জোড়াসাঁকোর আকাশের উপর দিয়ে বা হাঁসের দলের সঙ্গে চাঁদপুর-মেঘনার চরের উপর দিয়ে উড়ে যাই। সন্দেশে জোড়াসাঁকো অঞ্চলের একটা অতি মজার ম্যাপ ছিল। বই করে বার করার সময় প্রকাশকমশায়রা সেটিকে কোথায় খোয়ালেন।
মৌচাক ছিল শহুরে কাগজ আর শিশুসাথী ছিল পল্লীবাংলার পত্রিকা। মৌচাকে যেমন চাঁদের পাহাড়, আবার যকের ধন বেরিয়েছিল শিশুসাথীতে তেমনি বেরিয়েছিল খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ভোম্বল সর্দার। যকের ধনের বিমল-কুমার হল গল্পের দুই বাঙালি বীর। তারা মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরে, বন্দুক হাতে আফ্রিকার জঙ্গলে গোরিলাদের মুখোমুখি হয়। আর ডোম্বল হল আমাদের গাঁয়ের ছেলে, আলগা-বাঁধন কিশোর খালি গায়ে এক কাপড়ে সে গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলেছে। সেও বীর। ফণী গুপ্ত এই বইটির পাতায় পাতায় ছোট ঘোট ছবি এঁকেছিলেন। সে ছবিতে গ্রামের পুকুরজলের তরল ঢেউ, গাঁয়ের পথে গাছপালার ছায়া, পদ্মবিলে সাপ, একলা-থাকা বুড়ী আর তার গরুর কথোপকথন, নায়েব-গোমস্তার কাছারিবাড়ি, পাঠশালার পোড়, এমনকি হাটের ময়রার দোকানের মাছির ঝাঁকের গুঞ্জন পর্যন্ত দেখা যায়, শোনাও যায়।
হেমেন্দ্রকুমার রায় ছিলেন ছেলেদের একচ্ছত্র প্রিয় লেখক। তাঁর ময়নামতীর মায়াকানন, অদৃশ্য মানুষ, কিং কং, জয়ন্তের কীর্তি, মানুষ পিশাচ, সন্ধ্যার পর সাবধান রুদ্ধনিঃশ্বাসে পড়েছি। ভয় দেখানোর গল্পে তাঁর জুড়ি নেই।
একদিন রাত সাতটা-সাড়ে সাতটা। বাড়িতে কেউ ছিল না। মাসপয়লা পত্রিকায় হেমেন্দ্রকুমারের গল্প ‘মিসেস কুমুদিনী চৌধুরী’ পড়ছিলাম। কুমুদিনী এক পিশাচী। শীতের রাতে লেপ জড়িয়ে লন্ঠনের আলোয় সেই গল্প পড়তে পড়তে ভয়ে যেন নিশ্চল হয়ে গেছি। বাইরের দিকে অন্ধকারে তাকাতেও সাহস পাচ্ছি না। এমন সময় কাঠের খাটটা ছতরি-ডাণ্ডা সমেত দারুণ ঝাঁকুনিতে খটমট করে নড়ে উঠল। আমি কুমুদিনীর হাত থেকে বাঁচতে সঙ্গে সঙ্গে লেপ মুড়ি দিলাম। হঠাৎ চারদিক থেকে শাঁখের আওয়াজ আর উলুর শব্দ উঠল– বাড়িগুলি থেকে দুড়দাড় করে বেরিয়ে সবাই রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। ভূমিকম্প হচ্ছে। কুমুদিনী পিশাচীর চেয়ে ভূমিকম্প সহস্র গুণে ভালো আমিও এক লাফ দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।
আগে পুজোয় বার্ষিক ‘শিশুসাথী’ বেরুত। পরে তার সঙ্গে শুরু হল দেব সাহিত্য কুটিরের পূজা-বার্ষিকী। এসব বইয়ের কাগজ, ছবি, ছাপা, বাঁধাই অতুলনীয়। দেব সাহিত্য কুটিরের প্রথম বার্ষিকী ‘ছোটদের চয়নিকা’। তাতে শুধুই কবিতা। কয়েক মাসেই সে বই ফুরিয়ে গেলে সে বছরই বাসন্তী পূর্ণিমাতে আরও সুন্দর করে দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুল। এ ঘটনা থেকে সে যুগের ছোটরা কেমন ছিল, তাদের অভিভাবকেরা কেমন ছিলেন খানিকটা বোঝা যাবে।
এক বছর বার্ষিকী বেরুল ‘সোনার কাঠি’। সোনার কাঠির প্রথম লেখা ‘মোগলু’ মাঠের শেষে গ্রাম/সাতপুরিয়া নাম। বইটা সত্যিই সোনার কাঠি মলাট খোলামাত্র পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরের শিল্প আর প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁশ গাছের আড়ালে সাতপুরিয়া গাঁয়ের শুকনো নদীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া স্রোতের ছবি। এসব পৃষ্ঠা এখনও চোখে ভাসে।
আমার বইয়ের কোনো অভাব হয় না। জুল ভেন, ডিফো, ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়, কোনান ডয়েল, শিবরাম চক্রবর্তী, রেমার্কের বই তো সবাই পড়ে, আমি পরীর দৃষ্টি, হাতেম তাই, বেপরোয়া, মরণের মুখে, পাইলট শিলু, লালন ফকিরের ভিটে, কানাকড়ির খাতার মতো তুচ্ছ বই পড়েও ছায়া-অন্ধকার নেমে আসা বর্ষা-শীতের বিকেলকে ফুরফুরে করে নিতাম। অনেক সময় ত্রুটিহীন জমাট কাহিনীর চেয়ে খেয়াল-খুশির হালকা লেখা আমার বেশি ভালো লাগত। এইসব লেখায় কেমন যেন রঙিন অবহেলা জড়িয়ে আছে। এটা একটা দুর্লভ গুণ। সুনির্মল বসুর ছবি ও কবিতায় এই দুর্লভ গুণটি দেখতে পেয়ে আমি তাঁর ভক্ত হয়েছিলাম। তাঁর উশ্রীগিরিডির সাঁওতালের ঘরে ফেরার জংলা সুরে রয়েছে ঐ অলস বিষণ্ণ সৌন্দর্য–
বন-পাহাড়ী জংলা ভারি
আংলা বুড়োর দেশ।
উঁচু নিচু ঘাসের জমি,
পথের নাহি শেষ।
ফাগুনবেলা শেষ হয়ে যায়।
আগুন হাওয়া বয়
সন্ধ্যারেতে জাগতে পারে।
ভূত-পেরেতের ভয়।
ঝরা পাতায় পথ ঢেকেছে,
হায় হল মুশকিল
শিরশিরিয়ে উঠছে দূরের
শিরশিরিয়ার ঝিল।
ওরই পাশে মাঠটি যেন।
জানা জানা ঠিক
ছোটকু মাঝির ভিটে ছিল
ওরই কোনো দিক।
এমনি দিনে ছোটকু মাঝি
বাঘের পেটে যায়–
এমনি দিনে, এমনি বেলায়,
এমনি নিরালায়।
জংলা দেশের ঠিক কি বল্
মংলা ভায়া জলদি চল্
জলদি চল।
(মাদল– দিপির দিপাং দিপির দিপাং দিপির দিপাং তাং
বাঁশি– তুতুর তু আ উতুর তু আ তুতুর তু আ তু…)
আমাদের পাশের পাড়ার প্রতিবেশী অনন্ত ভট্টাচার্য মাসপয়লাতে ছবি আঁকতেন। ছবিতে সই করতেন AB। গুরুপদদা আর আমি তাঁর বাড়িতে যেতাম। অনন্ত ভট সাত্ত্বিক ধরনের মানুষ। মাসে দু-তিনটি জল রঙের ছবি করতেন। খুব চুপচাপ জীবন। শরীরও ভালো ছিল না।
সমর দে প্রধানত আঁকতেন মৌচাকে। তাঁর কাজ একেবারেই অন্য রকম রেখাই সে ছবির সৌন্দর্য। রেখা এঁকেবেঁকে পালতোলা নৌকোর মতো, জলের ঢেউয়ের মতো নিটোল সুষম শরীরের খোকাখুকু, বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীর মূর্তি ধরেছে। তাঁর ফ্রক পরা, লম্বা বিনুনি করা, স্যান্ডেল পায়ে মেয়েদের মধ্যে একটা পরী পরী ভাব তারা মাটিতে হেঁটেও যেন বাতাসে উড়ন্ত। কবিতার গুণ পেত তাঁর ছবি।
ছোটদের গল্প-কবিতার সঙ্গে যাঁরা ছবি আঁকতেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো তিনজন ছিলেন প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, ফণী গুপ্ত আর সমর দে। তাঁদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব স্টাইল, কিন্তু একটা মূল জায়গায় তারা এক তারা তিনজনই প্রাণ ভরে তখনকার বাংলা দেশ আর বাঙালিজীবনের ছবি এঁকে গেছেন। বাড়িগুলো সব বাঁশবন, চাঁপা গাছ, ধানখেত বা নদীতীর সন্নিহিত কুটির। মায়েরা সব হাসিমাখা মুখ, ঘরোয়া ধরনে শাড়ি পরা। তিরিশের দশকের একেবারে প্রথম দিকের ছবিতে দেখতাম, বালক-বালিকাদের পরনে ধুতি ও শাড়ি সেগুলি তারা যেন ছোটদের অগোছালো ধরনে নিজেরাই পরে নিয়েছে। ছেলেদের গায়ে জামা নেই, মেয়েরাও খালি-গা, খালি-পা। রাখালছেলের হাতে পায়ে বালা ও নূপুর, গলায় মাদুলি, নদীর ধারে বনের ছায়ে বসে বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছে।
পরের তিন-চার বছরে দেখছি– বাবা কাকা ডাক্তারবাবু ঠিকাদারবাবু যিনিই হোন তাঁর পরনে ধুতি পাঞ্জাবি শার্ট বা শার্টের উপরে কোট। শার্ট বা কোট যাই হোক, ট্রাউজার্স কখনো না। শার্ট ধুতির মধ্যে খুঁজে পরা। পায়ে ফিতে বাঁধা জুতো। বালিকারা তখনও ফ্রক পরছে না।
তিরিশের শেষ দিকের ছবিতে কৃচিৎ পুরুষেরা প্রয়োজনে ট্রাউজার্স পরছেন। বালিকারা কিন্তু ফ্রক ধরেছে, স্যান্ডেল পরছে। মা কাকিমা বৌদিরা ব্লাউজ এবং জুতো পরছেন, কদাচিৎ কেউ ঘড়িও হাতে দিয়েছেন, কিন্তু শাড়ি ছাড়া আর কিছু পরার কথা কল্পনাও করছেন না। ঘরবাড়ির দেয়ালে তখনও গাছের ছায়া দোলে, গ্রাম গ্রামের মতোই আছে। শহরও তেমন প্রমত্ত হয়ে ওঠে নি। কলকাতার বাড়িগুলিও সব একতলা দোতলা। তখনকার ছোটদের বইয়ের এই অজস্র ছবি একত্র করলে একটি অতি চমৎকার, নির্ভরযোগ্য, দেশভাগের আগেকার ‘চিত্রে বাঙালিজীবন’ তৈরি হতে পারে।
গুরুপদদা আই এ পড়ার সময়ে রবীন্দ্রনাথকে বুদ্ধি খাঁটিয়ে একটি চিঠি লিখেছিল। তাতে কবির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা, তাঁর কবিতার প্রতি অসীম অনুরাগ এবং নিজের আর্থিক অসংগতি জানিয়ে বিনা মূল্যে এক কপি সঞ্চয়িতা প্রার্থনা করেছিল। গুরুপদদা ভেবেছিল, রবীন্দ্রনাথ বই পাঠাবেন না, কিন্তু যদি দয়ার্দ্র হয়ে পাঠান তবে তাতে নিশ্চয় দু লাইন শ্রীমান গুরুপদ দাশগুপ্ত, কল্যাণীয়েষু আশীর্বাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিনিকেতন থাকবেই। এবং বইটি চিরজীবনের জন্য তার অমূল্য সম্পদ হবে। যা হোক, খুব তাড়াতাড়িই গুরুপদ দাশগুপ্তের নামে একটি পার্সেল এল। প্যাকেট খুলে দেখা গেল, এক কপি কাগজের মলাটের সঞ্চয়িতা। তাড়াতাড়ি পাতা উলটে গুরুপদদা দেখল, কোথাও কোনো আশীর্বাণী নেই, সঙ্গে একচিলতে চিঠি নেই, কে পাঠালেন তার কোনো হদিশ নেই। গুরুপদদার পেয়েও না পাওয়ার হরিষে বিষাদ উপস্থিত হল। এর পর অভিমানে গুরুপদদা আর রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেই ‘বাংলা কাব্য পরিচয়’ সংকলনটি ডাকযোগে আনাল।
আলাওল, গগন হরার নাম আমি এই প্রথম জানলাম। সেই বইয়ে অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা ছিল–
মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর
পোড়ো বাড়িটার
ঐ ভাঙা দরজাটা।
মেলাবেন।
অথচ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বেলা ছাপা হল তাঁর ১৯২৬ সালে লেখা ‘নবীন লেখনী’–
অধুনা-আনীত নব অলিখিত
লেখনী মোর,
কি জানি কেমন ভাগ্যলিখন
আছে রে তোর।.. ইত্যাদি ইত্যাদি
কী অন্যায় কথা!
একেবারে শেষ দিকে ছিল দিনেশ দাসের ‘মৌমাছি’–
এসেছে আমার ঘরে ছোট এক বুনন মৌমাছি,
ডানায় ডানায় যার অরণ্যফুলের কাঁচা ঘ্রাণ
পাঁশুটে শরীরে যার সোঁদা গন্ধ অজানা বনের।
গুরুপদদা প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘প্রথমা’র গুণগান করে। আমি প্রথমা এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত পূজাবার্ষিকী ‘মায়ামুকুর’ একসঙ্গে পড়ি। গুরুপদদা আর একজন কবি হীরালাল দাশগুপ্তের কথা বলত। তাঁর বইয়ের নাম ‘না’।
বীরেনদা এম এ পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় সদ্য প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর প্রথম খণ্ড নিয়ে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথের নিজের লেখা সে বইয়ের ভূমিকা নাকি অসাধারণ। একদিন বীরেনদা তার বই-ছড়ানো নিরিবলি ঘরে সে ভূমিকা পড়ে শোনাল। শ্রোতা গুরুপদদা আর আমি। তখন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ বই আমার কাছে ‘ডাকঘর’, আমি কতটুকু বুঝব সে ভূমিকার।
গুরুপদদা আমাকে তারা দেখতে শিখিয়েছিল। ছবি সংগ্রহ করে কিভাবে অ্যালবাম করে রাখতে হয় শিখিয়েছিল। কাগজের ক্লিপিং রাখতে শিখিয়েছিল। তাকে দেখে আমি কাপড় কাঁচা শিখেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই ইস্তিরি করাটা শেখা গেল না। গুরুপদদা কি এখনও বেঁচে আছে?
.
বয়ঃসন্ধি
বয়ঃসন্ধি একটা অদ্ভুত সময়। সেই বয়সে শরীরকে বড় দুর্বোধ লাগে। এই জীবনের কোনো অর্থ বুঝি না, এদের নিয়ে কি করব তাও বুঝি না। যৌবনগ্রন্থি থেকে নীলাভ বিষাক্ত কোনো বেদনা ক্ষরিত হয় আর সন্ধেবেলা অসহ্য মাথা ধরে। হঠাৎ কখনো কখনো শরীরকে বজ্রবিদ্যুতের মতো শক্তিশালী মনে হয়। আয়রন ম্যান নীলমণি দাসের চার্ট থেকে আমি সন্ধ্যার প্রথম অন্ধকারে বাতাবিলেবুতলায় দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টা ধরে ব্যায়াম করি। দরদর করে ঘাম ঝরে। শরীর শান্ত হয়। বাড়িটা চুপচাপ, কেউ নেই। জীবনই আমার একমাত্র সম্বল। সংসার আমাকে সব বাঁধন কেটে ছেড়ে দিয়েছে। কখনো মুষড়ে পড়ি। ভবিষ্যতের রেস্ত কোথায়? কখনো দারুণ ভালো লাগে– জীবন হল কানাকড়ির মির্যাকল। নিজেই নিজেকে বলি, ভয় নেই, ভয় নেই। তোমার এতগুলো বছর একলা তোমার জন্য, তোমারই মুখ চেয়ে বসে আছে।
আমাদের পরিবারে কয়েক পুরুষ ধরে সফলতার কোনো চিন্তা চেষ্টা নেই। পরিবারের ধর্ম আমার মধ্যেও নিশ্চয় ছিল, অতএব ‘ছাত্ৰাণাম অধ্যয়নং তপঃ এই সোজা উচিত কথাটা মনে পড়ল না, মনে ধরুল দারিদ্রদুঃখদহনায় নমঃ শিবায়। সেই দারিদ্রদুঃখদহনকারী শিবকে নমস্কার। আমার মনে হল, নিরাসক্ত ভিখিরি শিবই আমাদের দারিদ্র্যদুঃখকে পুড়িয়ে দেবেন, দারিদ্র্যের চেয়েও খারাপ দরিদ্রম্মন্যতাকে ভস্ম করে উড়িয়ে দেবেন।
এক দিকে বয়ঃসন্ধির কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্যথা, অন্য দিকে চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে স্থির পথটি বেছে নেওয়া এই দুই দিকে একসঙ্গে লড়তে পারব না, আমি বরং উভয়কেই বিদ্ধ করব একটি বাণে। সেই বাণ সাধুর জীবন।
শতজীবনী নামে একটি চমৎকার বই জোগাড় করেছিলাম। শংকরাচার্য থেকে শুরু করে এক শো সাধুর জীবনী। আমি তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা নিই নিঃসঙ্গ থাকার শিক্ষা, প্রসন্ন থাকার শিক্ষা। আকাশবৃত্তি এবং অজগরবৃত্তি আমার কাছে কঠিন অ্যাডভেঞ্চার মনে হল। জীবনকে নির্ভয় ও দুর্জয় করার জন্য তাঁরা কত দিক থেকে নিজেকে তৈরি করেন– কোনো মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ো না। রত্নকে পাথর মাত্র ভেবো। নিজেকে মাঝে মাঝে মৃত ভেবো। কাল কি খাবে চিন্তা কোরো না। কালকের জন্য এক কুচো আমলকীও জমিয়ো না। সেলাই করা কাপড় পোরো না। জনহীন জায়গায় থেকো। দরকার ছাড়া কথা বোলো না। মানুষ পশু পাখি পোকা যত প্রাণী দেখবে ভাবতে থাকবে তুমি প্রত্যেকের মধ্যে আছ, কিছুদিন পরে আবার ভাবতে থাকবে, তারা প্রত্যেকে তোমার মধ্যে আছে।
আমি বিকেলবেলা পুকুরের চাতালে বসে বইটি পড়তাম। একটু হাওয়া আসে আর পুকুর জুড়ে জলে শিহরন ওঠে। চারদিক স্নিগ্ধ আর শীতল।
আর একটা বই পেলাম, ব্রহ্মচর্য। পাতলা চটি বই, চার আনা দাম। কিন্তু সাংঘাতিক জঙ্গী বই। তার মূল কথা হচ্ছে- মরণং বিন্দুপাতেন, জীবনং বিন্দুধারণাৎ। একফোঁটা শুক্র কোনক্রমে বেরিয়ে গেলেই সর্বনাশ। কোন্ ছেলে পারবে এভাবে চলতে! ধাতুদৌর্বল্যের ওষুধের পুস্তিকার মতোই এ বই ভীতি উৎপাদক।
এই সময় আর একটি ছোট মাপের পকেট-বই পেলাম, স্বামী ব্রহ্মানন্দ-সংকলিত, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপদেশ। এটিরও দাম চার আনা। মুখপাতে ফ্রান্স ডোরাকের আঁকা সেই বিখ্যাত রঙিন ছবি। এই বইয়ের সারল্য, স্বচ্ছতা আর সুনিশ্চয়তা আমার মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিল। বইটি যেন বালকদের জন্যই লেখা। বইটি আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হল, এমনকি স্কুলেও সেটি নিয়ে যেতাম। তার পর এতদিন কেটে গেছে। সেই বালক শষ্পের সতেজ সবুজাভা এখন পাটকিলে হয়ে বিবর্ণ। এখনও বইটির একটি কপি হাতের কাছে রাখি, শুধু সেই দিনগুলির স্মরণে।
যে কোনো বিষয়ের বই, দরকারের সময় ঠিক জুটে যায়। পাটাতনের লফট থেকে একখানা ঘেঁড়াখোঁড়া শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত প্রথম ভাগ পেয়ে গেলাম। কিছুদিন পরে কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীর পাঁচ খণ্ড সদ্গুরুসঙ্গ জোগাড় হল। নিজের দুর্বলতা, যৌবনসমস্যা ও সাধনসংকট নিয়ে এমন অকপট ডায়েরী আর কোনো সাধক লিখেছেন বলে জানি না। ফলে এই পাঁচ খণ্ড বই শিক্ষানবীশদের পক্ষে ভরসাস্থল এবং সাহায্যকারী হয়ে ওঠে। তাছাড়া বইটি অলৌকিক কাহিনীরও ভাণ্ডার। অলৌকিক ঘটনা কখনো কখনো আকস্মিক বিদ্যুতের মতো আমাদের চমকে দিয়ে দৃষ্টির আবরণ সরিয়ে দেয়।
ঈশ্বরকে নিয়ে আমি তেমন ভাবি নি। আমার দু রকমই মনে হত একটি নুড়িকে যত্ন করে করে দুধে জলে স্নান করিয়ে অনেকদিন ধরে ফুলজল দিয়ে আদর করতে করতে সে সত্যিই ঈশ্বরের মতো প্রসন্ন হয়ে ওঠে। আবার হাতের মুঠো শূন্য করে সন্ধ্যাকাশের আলো আর মেঘের দিকে তাকিয়ে, গাছপালার দিকে আর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অপূজিত, অনিকেত ঈশ্বরকেও অনুভব করা যায়।
খুব বিপদে পড়লে আমি কাউকে নিঃশব্দে ডাকতাম। এবং অ্যাকসিডেন্টের মুখে হতাশ এঞ্জিনের মতো বা সমস্ত নিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে ফুটো বেলুনের মতো ডাকলে কাজ হয়। হয়ই। কিন্তু ঐখানেই শেষ। ঈশ্বরের সঙ্গে আমি লেগে থাকতে পারি না।
ঈশ্বরভক্তি নয়, সাধুত্বও নয়, আমাকে টানত সাধুর জীবন। আমার মনে হত ঐটিই শিল্পীর জীবন, যোদ্ধার জীবন, পুরুষের জীবন।
এসব কথা কাউকে বলি নি, নিজেই চিন্তা করতাম, নিজেই অভ্যাস করতাম। যোগৈশ্বর্যের কথা বইতে পড়েছি, চোখে কখনো দেখি নি। কিন্তু বালকেরা অভ্যাস করলে কিছু একটা ফল ফলে। বালকদের ভিতরটা নতুন একটা পাওয়ার হাউসের মতো। বাইরের জগৎকে প্রত্যাহার করতে করতে একটা ভিতরের জগতের আভাস যেন পাওয়া যায়। সেখানে চাঁদপুর বরিশাল দূরের কথা গোলোক কৈলাসও নেই। হরপার্বতী দূরের কথা দাদুঠাকুমাও নেই।
তার পর জীবন কোথায় কোথায় চলে গেছে। ব্যর্থতাও নয়, সফলতাও নয়, আমার যা হবার ছিল তাই হয়েছে। কিন্তু সেইসব অভ্যাস কিছু কিছু এখনও রয়ে গেছে। এখনও একা থাকতে পারি, কথা না বলে থাকতে পারি, অনেক ভোগ্যই আমার প্রয়োজনে আসে না। বাহুল্যের মধ্যে অস্বস্তি ভোগ করি।
তবু আমি শেষ পর্যন্ত সংসারীই তো হলাম। এমন ঘোর সংসারী যে মরার আগের দিনও কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, বিলিবন্দোবস্ত শেষ হল না। মন পালাই পালাই করে, এইসব যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
.
একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ খুব তেড়ে বৃষ্টি এল। আমি মিউনিসিপ্যালিটির পুকুরে চিতসাঁতার দিয়ে, বৃষ্টির মোটা মোটা ফোঁটা গায়ে নিতে নিতে স্নান করছি। বৃষ্টির জল ঠাণ্ডা আর পুকুরের জল গরম। চটরপটর চটরপটর শব্দে বৃষ্টি পড়ছে ঠাণ্ডা গরম ফোয়ারা। জায়গাটা সম্পূর্ণ নির্জন। এমন সময় রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের ইলা রাজা মেয়েলি সাঁতারে বুক দিয়ে ঢেউ দিতে দিতে আমার দিকে আসতে লাগল। সেই সময়টাতে ইলার লিঙ্গ-রূপান্তর ঘটছিল– তার চার ভাগের তিন ভাগই তখন মেয়ে হয়ে গেছে। মেয়েলি কিশোর এবং যুবতী নারীর মধ্যবর্তী চেহারা। এ সৌন্দর্য সেই বিষমেশানো মিঠাইয়ের মতো, যা খেয়ে বাচ্চা ভীম অচেতন হয়ে ডুবতে ডুবতে নাগলোকে গিয়েছিল। আমি তাকে দেখে অবশ হয়ে জলতলে ডুবতে লাগলাম। সে যেন সব জানে- ডুব দিয়ে সে কাছে চলে এল। রামায়ণে আছে, একটি বৈশাখ মুহূর্তে ফুরিয়ে গেল। আমার দুটি মাত্র মিনিটকেই মনে হল দীর্ঘ একটি বৈশাখ। আমি কিছু জানি না, সেই আমাকে দিয়ে অবর্ণনীয় কেলি করিয়ে নিচ্ছে। ইলাকে দেখতে ক্রমশ যেন আমার কোনো চেনা মেয়ের মতো লাগছে। সে আমাকে নিয়ে কি করতে চায়। আমি তাকে নিয়ে কি করতে চাই? হঠাৎ প্রচণ্ড উত্তেজনায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। স্প্রিংয়ের পাতের উপর ভারী হাতুড়ি মারলে যেমন হয় শরীরে সেইরকম কেউ যেন আঘাত করছিল। মন যারপরনাই বিষাদাচ্ছন্ন- মরণং বিন্দুপাতেন। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। আজ পুবের আকাশে শুকতারা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। সারা দিন মন ঘোলাটে আর মেঘলা হয়ে রইল।
.
রাজা ইলের কাহিনী অনেকের না জানা থাকতে পারে তাই সংক্ষেপে এখানে বলে রাখি। বাহীক দেশের রাজা ইল একদিন মৃগয়া করতে করতে বনে যেখানে কার্তিকের জন্ম হয়েছিল সেখানে এসে উপস্থিত হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীত্ব পেলেন। সেখানে শিব স্বয়ং স্ত্রীরূপে পার্বতীর সঙ্গে খেলা করছিলেন। যা হোক, ইল অনেক কান্নাকাটি করাতে স্থির হল, রাজা এক মাস পুরুষ থাকবেন, এক মাস মেয়ে হবেন। মেয়ে অবস্থায় তিনি বুধকে দেখে মুগ্ধ হলেন এবং বুধের সঙ্গে বিজন সরোবরে ক্রীড়া করতে লাগলেন। ন মাস পরে সেই ইলার গর্ভে পুরূরবার জন্ম হল।
মহাভারতেও একটি অনুরূপ কাহিনী আছে। রাজা ভঙ্গাস্বন মৃগয়া করতে গিয়ে একটি সরোবরে স্নান করে অকস্মাৎ স্ত্রীত্ব পেলেন। স্ত্রী হয়ে বনে তিনি এক তাপসের সঙ্গে বাস করতে লাগলেন। কালক্রমে তার গর্ভে একশো ছেলে হল। ভঙ্গাস্বনকে বেছে নেবার স্বাধীনতা দিলে তিনি স্ত্রীরূপেই থাকতে চেয়েছিলেন, কারণ স্ত্রীপুরুষ সংযোগকালে স্ত্রীরই অধিক সুখ হয়।
স্বাভাবিক একটি মেয়ে না এসে ঐ বয়সে কেন আমার প্রথম স্বপ্নে লিঙ্গ-পরিবর্তিত মেয়ে ইলা এল। আমার যৌন পছন্দে কি কোথাও কোনো অস্বাভাবিক ছিল? মেয়েরা সে যুগে কিশোরদের কাছে নিষিদ্ধ বস্তু। এই ট্যাবু কি আমার মানসিকতায় কোনো কাজ করেছিল? হতে পারে সবই। কিন্তু এখনও আমার মনে হয়, মেয়েরা যদি থ্যাবড়াথোবড়া স্তন জঘন ও নিতম্বের বদলে বালক-কিশোরের হালকা পলকা উড়ন্ত শরীর পায় তবে বোধ হয় তাদের সৌন্দর্য আরও অপ্রতিরোধী হয়ে ওঠে। অবশ্য এক এক জনের এক এক সৌন্দর্যপ্রতিমা।
যে পুকুরে, জেটির মতো ঘাটের প্রান্তে বসে, আমি বিকেলে ধর্মগ্রন্থ পড়তাম, ঠিক সেই জায়গাতেই জলে ডুবে ডুবে আমি দুপুরে ইলার সঙ্গে কেলি করেছিলাম। একই জলপৃষ্ঠের দু হাত উপরে আর দশ হাত নিচে দুই জীবন– এর নিশ্চয় কোনো মনস্তাত্বিক তাৎপর্য ছিল। একই মনের উপরিতল এবং গভীরতলে আমি দুই অস্তিত্ব বহন করে চলেছি।
.
মেড়ামেড়ীর ঘর
ছেলেবেলা থেকে অতি ছোট, একলার মতো, নিভৃত কুটির বানাবার ঝোঁক ছিল আমার। ঘর কত ছোট আর হালকাপলকা হতে পারে আমি তার অনেক রকম নকশা ভাবতাম। স্টীমারের সারেঙের কেবিন, ক্যাপ্টেন স্কটের জাহাজের খুপরিটি, ঢাকনা খোলা কফিন, এক-তাতামির জাপানী কুঁড়ে, পানের দোকানের নিচে বিড়ি বাঁধার ঘর, গ্রামের ঘরের ভিতে হাঁসের খোয়াড়, সাধুর গুহা, নীলগিরির টোডাদের কুটির ছোট নির্জন ঘরের কত বিচিত্র সম্ভাবনা।
এই রকম ঘরে আমার প্রথম গৃহপ্রবেশ হল এক নীরব দুপুরে বারবাড়ির তক্তপোশটির নিচে মেঝের উপর একটি মাদুর আর একটি বালিশ আর চার-পাঁচখানা গল্পের বই নিয়ে সেই ঘর। অতি শান্তির নীড় গ্রীষ্মের ছুটির দুপুরে ঠাণ্ডা, পরিচ্ছন্ন। চিত হয়ে শুলে মাত্র দেড় হাত উপরে তক্তপোশের কাঠের পাটাতন অর্থাৎ আমার বাড়ির সিলিং। বারবাড়ির ঘরে ঢুকেও কেউ টের পাবে না যে আমি ওখানে আছি। শান্ত জানলা গলে আসা আলোয় শুয়ে শুয়ে ‘চারু ও হারু পড়ছি।
এটা যদি গ্রীষ্মাবাস হয় তো শীতের অস্থায়ী আস্তানাটি ছিল মায়ের গর্ভের মতো নরম এবং উষ্ণ। শীতের রোদে-ভেসে-যাওয়া বারান্দার রেলিঙে সারা দুপুর লেপ মেলে দেওয়া হত তপ্ত হবার জন্যে। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে আমি বড় লেপটাকে তাঁবুর মত করে তার ভাঁজের মধ্যে ঢুকে যেতাম। সঙ্গে থাকত গোটা ছয়েক কমলালেবু। সেই লেবুগুলো একটা একটা করে খেয়ে ঘণ্টা দুয়েক পার করে যখন উঠতাম তখন আরামের চূড়ান্ত হয়ে গেছে।
আমাদের ঐ অঞ্চলে ছেলেদের একটা চমৎকার উৎসব ছিল মেমেড়ীর ঘর। পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন ছেলেরা দলে দলে ভাগ হয়ে মেড়ামেড়ীর ঘর তৈরি করত। নদীর ওপারের গা থেকে খড় আর মুলিবাঁশ আনা হত। মাঠ এবং ফাঁকা জায়গার তো অভাব নেই। অতএব এক একটা দলের এক একটা আলাদা ঘর। বাঁশের খুঁটি, বাঁশের আড়া, খড়ের চাল আর বেড়া। মাটিতে পুরু করে খড় বিছিয়ে গদি করা হয়েছে। খড়ের নিজস্ব ওম আছে। সারা রাত পৌষের ঠাণ্ডায় নক্ষত্র থেকে, দূরের পাহাড়শিখর থেকে, গাছের মগডাল থেকে ঐ নতুন হলদে খড়ের বাড়িগুলোর উপর হিম ঝরছে। কিন্তু ভিতরে আমাদের ঠাণ্ডা লাগে না।
রাত্রে ঐ মেড়ামেড়ীর ঘরের বাইরে হাওয়া আড়াল করে মাটিতে উনুন পেতে বা স্টোভে রান্না হবে। খিচুড়ি ডিমভাজা বা ভাত মাংস। সেজন্যে চাঁদা তোলা হয়েছে। গভীর রাত্রে বার বার চা এবং লেডো বিস্কুট। সারা রাত ছেলেরা ঘুমোয় না। নিজেদের ঘর থেকে চাদর মুড়ি দিয়ে অন্য দলের ঘরে আড্ডা দিতে যায়। বাড়িতে যারা লেপের নিচে বিছানায় শুয়ে আছে তারা মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে ছেলেদের হুল্লোড় শুনতে পায়। সারা রাত হিম পড়ে, লক্ষ্মীপেঁচা আর বাদুড় ওড়ে, পুবের তারারা পশ্চিমে চলে যায়। বড় ছেলেরা লণ্ঠন জ্বালিয়ে ঐ খড়ের ঘরে তাস খেলে। ছোটরা চাদর পেতে ঘুমিয়ে পড়ে।
ভোরে উঠে ছেলেরা শীতের হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে বরাকের জলে স্নান করে এসেই ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। খড়ের ঘর মুহূর্তে দপ করে জ্বলে ওঠে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে সবাই আগুন পোয়। মাঠে পর পর এখানে ওখানে খড়ের ঘরে আগুন লাগে, আর ছেলেরা গুনতে থাকে কাদের ঘরে বাঁশের গাঁট ফেটে কটা শব্দ হল। কান করে শুনলে আগুন চলারও একটা স্রোত চলার মতো সোঁ সোঁ, ঝরঝর, কলকল শব্দ আছে।
রাতের বাসাকে পুরো ছাই করে ছেলেরা এর পর বাড়ি ফেরে। সেখানে মা পিসি মাসিরা তাদের জন্য পৌষের পিঠে বানিয়ে রেখেছে।
মেড়ামেড়ী মানে কি? শব্দ দুটো কোথা থেকে এসেছে? হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘বেনের মেয়ে’ বইয়ে মেড়া সম্বন্ধে লিখেছেন- ‘শীত হইল মেড়া অসুর, তাহাকে আগের দিন মারিয়া পোড়াইবার পরের দিন [ দোল ] উৎসব। মাঠে সারি সারি মেড়া অসুর সাজানো আছে, বাঁশের উপর খড়জড়ান একটা বিকট মূর্তি।… সন্ধ্যাটি হইল, আর ছেলেরা উন্মত্ত হইয়া মেড়ায় আগুন লাগাইতে লাগিল। কতকগুলা ঘোট ঘোট ঝোঁপড়ার মত ঘর ছিল, তাহাতেও আগুন লাগাইয়া দিল, আগুন ধূ ধূ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। তাহারা নাচিতে লাগিল, গাইতে লাগিল ও হাততালি দিতে লাগিল, আর কত রকম বাঁদরামী করিতে লাগিল, তাহা আর লিখিয়া কাজ নাই। চতুর্দশীর চাঁদ উঠিল, আগুন তখনও নিভে নাই। তাহারা চারিদিকে একবার চাহিল, একটা হল্লা করিয়া উঠিল, তাহার পর যে যাহার ঘরে গেল’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন দোলের আগের সন্ধ্যার কথা, আমি বলছি তার দু মাস আগেকার পৌষ সংক্রান্তির আগের রাত্রির কথা।
কিন্তু বয়ঃসন্ধির কালে কোনো ছেলের ভাগ্যে এই আনন্দ-উৎসবের রাতও করুণ হয়ে আসে। প্রথম যে বার আমি দলে মিশে মেড়ামেড়ীর ঘরে রাত কাটাব স্থির করলাম, মাসিমা বাধা দিল। এই হুল্লোড়, এই লাগামছাড়া রাতের মধ্যে তুমি যাবে না। আমিও যাবই। শেষে রফা হল- আমি বাড়ির মধ্যেই শুকনো লতাপাতা দিয়ে একটা ঘর বানাব, সে ঘরে রাতের খাবার এনে খেতে পারব, কিন্তু পরদিন ভোরে তাতে আগুন দিতে পারব না।
একা একা তো এই আনন্দ হয় না, অতএব মাসিমাই বলল অঙ্কুর আর তার বোন অলিকে নেমন্তন্ন করতে। আমার সমবয়সী সহপাঠী অঙ্কুর কোনো হুজ্জতে থাকে না, সভ্য, নরম, মাসিমার খুব পছন্দের ছেলে। আর ওরা যখন খাবে তখন লুচি মাংসই হোক।
আমি ভাঁড়ার ঘরের পিছনে কাঁঠাল গাছ ও তেলাকুচো লতায় ছায়া করা একটা সরু নিঃসঙ্গ জায়গা বেছে নিলাম। ডোবার পাড় থেকে শুকনো কলাপাতা টেনে টেনে ছিঁড়ে আনলাম। সারা দিন ধরে খেটে সেই ছায়ায় একটি ঘর বানালাম। তাতে তিনজন বেশ বসতে পারব। ঘরের মধ্যে শুকনো কলাপাতার হালকা বুনো গন্ধ। এখন আমি একাই সেখানে একটু বসে থাকি। শুধু একটু তেলাকুচো লতার আড়াল, তবু সংসারের বাইরের ঠাণ্ডা ছায়া এখানে অনুভব করি।
অঙ্কুর আর অলি সন্ধের একটু আগে এল। মেডামেড়ীর ঘরের নিয়ম মেনে আজ রাত্রে ওরা এখানেই থাকবে। আমি এতেই কৃতজ্ঞ। রাত্রে প্লেটে বাটিতে করে খাবার এল লণ্ঠনের আলোয় ভেঁড়া কলাপাতার কুটিরে মাংস লুচি। কিন্তু আমার সারা দিনের আশা এবং পরিশ্রম যেন ব্যর্থ। রাত নটা-সাড়ে নটা পর্যন্ত সহ্য করে মাসিমা আমাদের শুতে যেতে বলল। আমাদের শোবার ব্যবস্থা হয়েছে বারবাড়ির ঘরে। চমৎকার গরম ধবধবে বিছানা। পর পর অঙ্কুর আমি মাসিমা আর অলি। অঙ্কুর জুতো মোজা গরম জামা খুলে লেপের মধ্যে ঢুকে গেল। আজ সারা রাত নিঘুম থাকার মতো ক্ষমতা আর উত্তেজনা আমার ভিতরে যেন চার্জ করা রয়েছে। আমি কি করে তার সুইচ অফ করি!
মাসিমা খেতে গেছে। অলি ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে তার লম্বা চুল খুলল, চিরুনি চালিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আঁচড়ে ফিতে বেঁধে একটা বিনুনি করে ফেলল। মুখে শীতের ক্রীম মাখল। তার কানের সোনার রিং দুটো এবার ঝিকমিক করছে। গরম জামা স্কার্টের নিচে তার সাদা হালকা টেপ ফ্রক। সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বিছানার এক ধারে লেপের ভাঁজ খুলে শুয়ে পড়ল। আমি বসে রইলাম আমি মেড়ামেড়ীর ঘরের কথা, আজকের দিনের আশা নিরাশার কথা ভুলে গেলাম। মনের মধ্যে একটা অবুঝ ব্যথা, অস্থির ব্যথা- জলের উপরে কালির ফোঁটা ফেললে যেমন হয় তেমনি হাত পা দশ আঙুল মেলে ছড়িয়ে যেতে লাগল। মাঝখানে মাসিমার জন্য জায়গা রেখে আমি শুয়ে পড়লাম। শরীর চিত হয়ে কাঠের মতো পড়ে আছে। মন কেবলই চলে যায় ঐ মেয়ের দিকে, তার হালকা বালিকা শরীরের দিকে, তার কোল্ড ক্রীমের গন্ধের দিকে। আমি যদি হাত বাড়িয়ে দিই, অথবা গড়িয়ে চলে যাই ওর কাছে। কী হবে? কী হবে? কী হবে? কিন্তু আমি চিত হয়ে শুয়ে রইলাম, চোখের পাতা অপলক খোলা, শুকনো গলায় ঢোক গেলার শব্দটুকু পর্যন্ত নেই। ওপাশে মেয়েটি রাতের ফুলের মতো নিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে, সুগন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। মাসিমা তার ঠাণ্ডা হাতপা নিয়ে শুতে এল, হাত ঘষাঘষি করল। আমি নিশ্চল। নিশ্চল থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু আড়াইটে তিনটের সময় ঘুম আচমকা ভেঙে গেল। মাসিমা লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোয়। আমি দুটো নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ঘর অন্ধকার। এইভাবে শুয়ে থাকা অসম্ভব। আমি নিঃশব্দে উঠে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরে আসামাত্র স্নেহময় জগৎ আমাকে জড়িয়ে ধরল। গুরুপদদা আমাকে তারা দেখতে শিখিয়েছিল। উপরে তাকিয়ে দেখি, সিংহরাশি শেষ পৌষের মধ্যআকাশ ছাড়িয়ে গেছে, মিথুন আর লুব্ধক হেলে পড়েছে, কৃত্তিকা অস্ত যাচ্ছে। দুরে, অল্প দূরে ছেলেদের খড়ের ঘরগুলো, তাদের লণ্ঠনের আলো, হৈ হুল্লোড়, শীতের কুকুরের ডাক। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঐ বিছানায় ফিরে যেতে কেন জানি না অপমানিত লাগছে।
এত দিনের পরে আজ আর কিছুরই কোনো চিহ্ন নেই, শুধু মনে পড়াটি আছে একতরফা মনে পড়া, এত খুঁটিনাটি মনে পড়া, লিখতে লিখতে খুঁচিয়ে তুলেছি বলে মনে পড়া।
এর পরের বছর থেকে মাসিমা আর আমাকে আটকাতে পারে নি। আমি সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে মিলে মণিপুরীদের গ্রাম থেকে খড় এনেছি, বাঁশ এনেছি, পুকুরের কাছাকাছি মাঠে দশবারোজন হেঁটেচলে বেড়াবার মতো ঘর বানিয়েছি সারা রাত বাড়ি ফিরি নি।
.
রাজনীতি
আমি যখন ক্লাশ এইটে তখন হঠাৎ একদিন অনেকগুলো ছেলে অকারণে খেপে গেল। তারা খেপবে বলেই তৈরি হয়ে এসেছে। তারা আজ স্কুলে আসবে না, হাত নেড়ে নেড়ে অন্যদেরও বেরিয়ে আসতে বলছে। তাদের চোখে মুখে রণং দেহি ভাব। শেষে, এত চেঁচামেচি উত্তেজনার কারণ শোনা গেল কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্রদের মধ্যে স্টুডন্টস ফেডারেশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছে। আজ সেই সংগঠনের ছেলেরা এইভাবে তাদের বিপ্লবী অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। কিন্তু আমার হল মুশকিল। রাজনীতিচেতনাহীন আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই অকারণ হুজ্জতি এবং জবরদস্তি মনে হল।
নিজেকে বেশি পর্যালোচনা করব না। তবে ছেলেবেলাতেই বুঝেছিলাম, কোনো রকম দলে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। আর এখন তো আমি চাই, সমস্ত দল ভেঙে যাক, অবশিষ্ট থাকুক শুধু একটি একটি বিচ্ছিন্ন মানুষ, যারা নিজের হালকা ওজনটি নিজেই বইবে, তাও যদি না পারে তো মারা যাবে। নিজের উচ্চাশার বোঝা অন্যকে দিয়ে বওয়াবার ধৃষ্টতা যেন কারো না হয়। রাজনীতি সেই ধৃষ্টতা।
আমাদের শহরে এক এক করে জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, মানবেন্দ্রনাথ রায়, বাটলিওয়ালা, সোমনাথ লাহিড়ী এসে বক্তৃতা করে গেলেন। অভয়াচরণ ভট্টাচার্য পাঠশালার লাগোয়া মাঠটি ছিল সভার জায়গা। নেহরুর বক্তৃতামঞ্চটি যেন সমুদ্রজলের উপরে একটি উঁচু পেরিস্কোপ অথবা আজান দেওয়ার মিনারেট। সিঁড়ি ভেঙে লাফিয়ে লাফিয়ে তিনি একলা উঠে গেলেন- গোলাপী গায়ের রং, ধবধবে সাদা জামাকাপড়ের উপর জহরকোট, গান্ধী টুপি, জোরালো আলোয় মাঠের শ্যামাপোকা তাঁকে ঘিরে ধরেছে বক্তৃতা দিতে দিতে কয়েকবার পোকা তাঁর মুখের মধ্যে চলে গেল। হেসে বললেন, পোকা খেয়ে ফেলেছি, জল চাই। দীর্ঘ সেই বক্তৃতার একটি শব্দও মনে নেই, শুধু ঐ। পোকার কথাটি ছাড়া।
সুভাষচন্দ্র বসু গম্ভীর মানুষ, ছটফটে ভাব একেবারে নেই। সামান্য চওড়া হৃষ্টপুষ্ট শরীর। বক্তৃতার পরে তিনি স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জায়গাটাকে বুঝতে চাইছিলেন। পরদিন সকাল দশটা-সাড়ে দশটার সময় তিনি মিউনিসিপালিটির অফিসের সামনে পতাকা উত্তোলন করলেন। সেই জমায়েতে ছিল দশ-বারোজন বয়স্ক মানুষ আর খবর পেয়ে দেখতে ছুটে আসা আমাদের মতো কিছু বালক। খুব কাছে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম, লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি পরেছেন। মনে হল, রাত্রে তাঁর ভালো ঘুম হয় নি, মুখে হালকা অপ্রসন্নতা ও শুষ্কতার ছাপ। পতাকা উত্তোলনের পর তিনি হেঁটে হেঁটে আমাদের পাড়া হয়ে, নতুনপট্টি হয়ে বেশ কিছুটা চললেন। পাড়া থেকে যুবকেরা সঙ্গ নিল, আমরা বালকেরা তো আছিই। তিরিশ-চল্লিশজনের একটি দল, ল্যাজের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বন্দেমাতরম ধ্বনি উঠছে। সুভাষচন্দ্র আস্তেসুস্থে হাঁটছিলেন। সেই দলের সঙ্গে কোনো পুলিশ ছিল না, কোনো দেহরক্ষী ছিল না। বলতে নেই, কিন্তু মনে হল, কলকাতা থেকে যেন নতুনকাকা এসেছেন, আমরা তাঁকে আমাদের পাড়া ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি।
সুভাষচন্দ্রকে জীবনে ঐ এক বারই দেখেছি। তার পর তো ত্রিপুরী কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক, রহস্যময় অন্তর্ধান, আই এন এ এবং দুর্ঘটনায় মৃত্যু। সুভাষচন্দ্রের কিছুই স্থায়ী হল না। অন্যদিকে নেহরুর চিরস্থায়ী কীর্তি হল দেশভাগ এবং নিজের রাজবংশের পত্তন। কিন্তু স্বাধীনতার আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে লাহোরের সেনাছাউনিতে বসে আসমুদ্রহিমাচল ভারতের নানা জাতের নানা ধর্মের সিপাহীদের মধ্যে যে দুজন মানুষের অটল জনপ্রিয়তা টের পেয়েছিলাম তাঁদের একজন হলেন সুভাষচন্দ্র বসু অন্যজন পঙ্কজকুমার মল্লিক। আশ্চর্যের কথা, দুজনেই বাঙালি। সুভাষ বোসের বীরত্ব আর দেশপ্রেম পাঠান পাঞ্জাবী জাঠ মারাঠা মাদ্রাজী মহীশূরী তাবৎ ফৌজদের হৃদয়ে এক অদ্ভুত শ্রদ্ধার জন্ম দিয়েছিল। আর পঙ্কজ মল্লিকের গান! আহা অমন গাইয়ে আর কে আছে য় দর্দভরী দিলকি আবাজ সুনায়েংগে।
এম এন রায়, বাটলিওয়ালা, সোমনাথ লাহিড়ীর জন্য মঞ্চ বাঁধা হয় নি। কিন্তু প্রত্যেকের সভাতেই ভিড় হয়েছিল। মানবেন্দ্রনাথ রায় এসেছিলেন তাঁর মেমসাহেব স্ত্রী এলেন রায়কে নিয়ে। রায়ের গায়ের রং বেশ কালো, দীর্ঘ বলিষ্ঠ শরীর, ভরাট গম্ভীর স্বর, কোট প্যান্ট টাই পরা। ইংরেজিতে মাতৃভাষার মতো দ্রুত এবং অনর্গল বক্তৃতা দিলেন। তাঁর ভাষায় এবং চালচলনে দীপ্তি এবং পৌরুষের বিচ্ছুরণ। বাটলিওয়ালা ফরসা, হাফপ্যান্ট আর চৌখুপী হাফশার্ট পরা। সোমনাথ লাহিড়ী কৃশকায়, অযত্নের ধুতি এবং ল্যাগবেগে শার্ট পরা।
নেতাদের বাগ্মিতায় শহরে কোনো কাজ হয়েছিল এমন মনে হয় না। বরং এর বিপক্ষে নিদারুণ কার্যকরী হল ইংরেজের দুষ্টবুদ্ধি। শিক্ষা ও পুলিশ বিভাগে প্রচুর মুসলমানকে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। আমাদের স্কুলে এখন অনেক মুসলমান শিক্ষক। তাঁরা হিন্দু শিক্ষকদের সঙ্গে নিজেদের একটা পার্থক্য তৈরি করে নিলেন। হিন্দু শিক্ষকদের সরল নিরলংকার ধুতি শার্ট বা পাঞ্জাবির বিপরীতে তাঁরা কেতাদুরস্ত সুট ও কামাল আতাতুর্কের ফেজ টুপি পরতেন। আছদ্দর আলী, মহসীন আলী, আবদুর রহমান হাবশী ও মূর কায়দায় ভারি চিত্তাকর্ষক দাড়ি রেখেছিলেন।
আমি যখন ক্লাস সেভেনে, সেই বছর, এই হিন্দু মুসলমান বিভেদটাকে কর্তৃপক্ষ আরও একটু উসকে দিলেন। পর পর কয়েক শুক্রবার দেখলাম মুসলমান ছেলেরা টিফিনের ছুটি শেষ হবার আধঘণ্টা পরে ক্লাসে ঢুকছে। ব্যাপার কি? না, তারা এখন থেকে প্রত্যেক শুক্রবারেই নমাজ পড়ার জন্য এক ঘণ্টার বিশেষ ছুটি পাবে। মুসলমান বালকদের ধর্মাচরণের জন্য খ্রিস্টান রাজার এই আগ্রহ নিশ্চয় অকারণ ছিল না। এইসব জলসিঞ্চনে মুসলিম লীগ বেশ সতেজ হয়ে উঠল।
আমি যখন স্কুলের শেষ ক্লাসে তখন শহরের প্রথম সাম্প্রদায়িক রক্তপাতটি ঘটল। এমন বেশি কিছু রক্ত পড়ে নি, তবুও তো সেটাই ছিল প্রথম রক্তপাত।
কিছুদিন হল সুনীল সুশীল নামে দুই বলিষ্ঠবপু যুবা এই শহরে বসবাস করতে এসেছে। তারা যমজ ভাই, একেবারে এক রকম দেখতে, খদ্দরের ধুতি আর পাঞ্জাবি পরা। সভাসমিতির শুরুতেই এক রকম জামা পরে হারমনিয়ম নিয়ে যমল গান গায় কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফ্যাল কর রে লোপাট। ক্রমশ সারা শহর তাদের চেনে, তাদের ভালোও বাসে। ইতিমধ্যে স্বদেশী করে তারা জেল খেটেছে। জেলের অফিসারেরা তাদের আলাদা করে চিনতে পারত না বলে সুনীল বা সুশীল কারো একজনের কড়ে আঙুলের ডগাটা হেঁটে দেওয়া হয়েছিল।
একদিন খুব হৈ চৈ শোনা গেল : জ্যাকেরিয়া নামক মুসলিম লীগের এক যুবক সুনীলকে রাস্তার উপর ছুরি মেরেছে। কিন্তু সে পালাতে পারে নি। রক্তাক্ত অবস্থায় সুনীল তার বজ্রমুষ্টিতে জ্যাকেরিয়াকে ধরে পুলিশের কাছে নিয়ে গেছে।
.
স্রোতের পথে
আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার বছরটায়, শেষ দিকে, বেশ গোলমাল পাকিয়ে উঠল। দিদিমার এমন অসুখ করল যে তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠাতে হল। মাসিমা মামা সঙ্গে গেল। আবার সে বছরটাতেই দাদুরও চাকরি শেষ। দু-তিন সপ্তাহ পরে অবসর হলে দাদুও চলে গেলেন কলকাতায়। বাড়িতে শুধু আমি আর কাজের লোক চরিত্র। আমাকে কেউ বলে নি, তবু মনে হল, ওরা আর কেউই এখানে ফিরে আসবে না। পরিবারটি কলকাতাতেই স্থায়ী হবে। মাস দেড়েক পরে পরীক্ষা শেষ হলে আমিও চলে যাব কোথায় যাব এখনও মুখ ফুটে কেউ বলে নি কিছু। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, আমার ভবিষ্যৎ এবার খড়কুটোর মতো অনিশ্চিতের স্রোতে ভাসবে, কিংবা ট্র্যাপীজের দারুণ খেলোয়াড়ের মতো এ দড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে ও দড়ি ধরে ফেলবে। আমি কিছুই আর আটকাবার চেষ্টা করি না, প্রস্তুত হবারও চেষ্টা করি না। কষ্ট এড়াবার জন্য বরং অসাড় থাকার অভ্যাস করি।
মাস দুয়েক একা একা এতদিনের বাড়িটাতে বেশ কাটল। চরিত্র বাজার করে, রান্না করে। বাড়িটা এতদিন যেন দিদিমার ভয়ে আমাকে প্রাণ খুলে আদর করতে পারে নি, এবার একলা পেয়ে বুকের মধ্যে জাপটে ধরল। শীতের রাতে ঘরগুলো উষ্ণ হয়ে থাকে। লেপটা নিজে নিজেই আরামের তাপমাত্রা পায়। ধীরে ধীরে বসন্ত এল। বাড়িটিতে একটু আধটু পাখির ডাক ছাড়া কোনো শব্দ নেই। মসৃণ হাওয়া। কোথাও কোনো দ্রুকুটি নেই। জলের খরচ নেই, সারা দিন চৌবাচ্চারা জল টলটল করে। উঠানে পড়ে থাকা তক্তপোশটার উপরে চিত হয়ে শুলে অনেক উপরে শঙ্খচিলদের ডানা মেলে ভাসতে দেখি। এবার বসন্ত এসে আমার গায়ের চামড়াকে আমের নতুন পাতার মতো ঝকঝকে আর আতা করে তুলল। আমার ফুসফুসের মধ্যে রক্তের সঙ্গে প্রচুর অক্সিজেন মিশছে টের পাই। কিশোর শরীরের মেটাবলিজম অ্যানাবলিজমের ইন্দ্রজাল তার কাজ করে চলেছে, কিন্তু আমার আত্মার কি হল? এত অনিশ্চিতির মধ্যে আত্মা টুকরো টুকরো ছেঁড়া কাগজের মতো হয়ে যায়।
একদিন একদিন করে পরীক্ষা শেষ হল। যেমন পড়া তেমনি পরীক্ষা। বাংলা পরীক্ষার সময়, উত্তর সাধু ভাষায় লিখব না চলিত ভাষায়, তাই স্থির করতেই আধ ঘণ্টা কেটে গেল।
এর মধ্যেই চিঠি এল– আমি যেখান থেকে এসেছিলাম সেইখানে, সেই নিজের গ্রামেই ফিরে যাবার নির্দেশ। দুমাস পরে পরীক্ষার ফল বেরুবে। যদ্দিন না বেরোয় তদ্দিনই নিশ্চিন্ত।
বসন্ত ভালোভাবে এসে গেছে। একদিন বিকেলবেলা চাঁদপুরের ট্রেনে চাপলাম। সঙ্গে কয়েকটি বই আর একটি মাটির মূর্তি। ট্রেনের জানলায় বিদায় দিতে শুধু গুরুপদদাই এসেছে।
বিদায়ের মুহূর্তে কিভাবে বিদায় নিতে হয় আমি জানি না। দুঃখে আমার মুখে কথা আসছিল না। হঠাৎ নিজেকে সেই চোরাকাদায় ডুবতে থাকা অন্ধকার রাতের হাতিটার মতো মনে হল। পরমুহূর্তেই মনে হল, ধ্যাৎ। মাথার উপর সিংহরাশি, লুব্ধক, ব্ৰহ্মহৃদয়, কালপুরুষ- বিরাট ছায়াপথ আছে না- তারও উপরে নিশ্চয় আরও অসীম বেপরোয়া শূন্য।
আমি হাসিমুখে গুরুপদদাকে প্রণাম করে ট্রেনে উঠে বসলাম।
.