২. ছবিগুলো চোখের সামনে

ছবিগুলো চোখের সামনে ফুটে উঠছে, চলে যাচ্ছে, ছুটোছুটি করছে।…

সেখানে নিতাইকাকা আছে, বাবা আছে, বরেন আছে, আর আছে কতকগুলো জঘন্য নোংরা গুণ্ডা শ্রেণীর লোক। তাদের মধ্যে পাঞ্জাবী আছে, বেহারী আছে, মুসলমান আছে, বর্মী আছে, চীনে আছে, আরও কত রকম যেন জাতের লোক আছে, তারা তাড়ি খাচ্ছে, তাস খেলছে। মাতাল হয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে, আবার কী সব ষড়যন্ত্র করছে ওরই মধ্যে।

প্রথম প্রথম বুঝতে পারত না চৈতালী, পরে বড় হয়ে বুঝেছে, ওরা সব লুকিয়ে আফিং কোকেনের ব্যবসা করে। ওর মধ্যে আবার একজন একবার সোনা নিয়ে ব্যবসাও ধরেছিল। ধরা পড়ল, শেষে জেলে গেল।

তবে এই সব লোকের সামনে চৈতালীকে বার করত না কোনদিন বাবা। প্রাণ গেলেও না।

 নিতাইকাকা বলত, আহা-হা তাতে কি? তোমার মেয়ে সবারই মেয়ের মত চা নিয়ে গেল, খাবার পরিবেশন করল–এতে দোষ কি?

বাবা বাঘের মত গজরে উঠে বলত, না!

পরিবেশন করত বরেন।

 বরেন আসত বাড়ির মধ্যে।

মানে তখন, যখনও বাড়ী বলে বস্তুটা ছিল বাবার। শ্যামপুকুর বাই লেনের সেই নোনাধরা ইট বার করা বাড়িটাও রাখতে পারেনি বাবা, বেচে দিয়েছিল। তারপর থেকে নানাস্থানী।

কিন্তু তখন বাড়িটা ছিল।

এঁদোপড়া রান্নাঘরটায় প্রকাণ্ড একটা উনুন জ্বেলে বিরাট হাঁড়িতে মাংস আর ভাত রাঁধতে হত এক একদিন। বরেন ভেতরে এসে নিয়ে নিয়ে যেত।

বরেনের চেহারাটা মনে পড়তেই ঠোঁট কামড়ালে চৈতালী। ঠিক যেন রাস্তার একটা ঘেয়ো কুকুর। তেমনি মানঅপমানহীন, তেমনি লোভী।

কতই বা বয়েস তখন চৈতালীর?

পনেরো, ষোলো। তখন থেকেই কী বিরক্তই করত চৈতালীকে।

জোর নয়, দাবী নয়, উৎপাত অত্যাচার নয়, শুধু গা ঘিনঘিনে কাঙালপনা। একদিন চৈতালী একখানা লোহার খুন্তি উনুনের আগুনে লাল টকটকে করে তাতিয়ে বরেনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলেছিল, দেখ, আর কোনদিন যদি এই সব কথা বলতে আসো, জেনো তোমার কপালে এই আছে। কাউকে বলে দিয়ে শাস্তি করাতে যাব না আমি, নিজের হাতেই শাস্তির ব্যবস্থা করব।

সেদিন থেকে গুম হয়ে গিয়েছিল বরেন, আর বেশী কথা বলত না। নীরবে রান্নাঘরে আসত যেত।

.

কিন্তু বাবার মনের ইচ্ছে জানত চৈতালী। বাবা ওই লক্ষ্মীছাড়া বরেনটাকেই মনে মনে জামাইয়ের আসনে বসিয়ে রেখেছিল। ভেবেছিল একবার একটু বেশী পয়সা পিটে নিয়ে এসব কাজ ছেড়ে দেবে, শ্বশুর জামাই দুজনে মিলে একটা সত্যিকার সৎ কারবার ফঁদবে। বাকী জীবনটা নিশ্চিন্তে নিরুদ্বেগে কাটাবে।

হঠাৎ চোখ উপচে জল এল চৈতালীর।

 বাবাকে সে শ্রদ্ধা করত না, ভক্তি করত না, কিন্তু ভালবাসত। ভাল না বেসে কি করবে?

বাবা ভিন্ন আপনার লোক তার রইল কোথায়?

মেসো মারা যেতেই নাকি দেখা গিয়েছিল অগাধ দেনা তার। নিঃসন্তান মাসী যথাসর্বস্ব বেচে দিয়ে কাশী-বাসিনী হবার উপক্রম করছেন, সেই সময় বাবা গিয়ে পড়ল মেয়ে মেয়ে করে। মাসী চোখের জল মুছতে মুছতে ছেড়ে দিলেন। বাবা মেয়ে মেয়ে করেছিল অবশ্য নিতাইয়ের প্ররোচনায়। নিতাই বলেছিল একটা কমবয়সী মেয়ে দলে থাকলে ব্যবসার পক্ষে খুব জুতের। তাকে দিয়ে মাল পাচার করা যায়, কেউ সন্দেহ করতে পারে না। স্কুলের বই খাতা ব্যাগের মধ্যে দিয়ে

তা করেছিল সে কাজ চৈতালী অনেকবার, কিন্তু ওই বদ লোকগুলোর হাতে তাকে ছেড়ে দেয়নি বাবা। নিতাইয়ের পরামর্শে নিয়ে এলেও তার পিতৃচেতনা মেয়েকে অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছে। মেয়েটাকে বড্ড বেশী ভালও বেসে ফেলেছিল। তবে প্রথম প্রথম চৈতালীকে বাগে আনতে খুব বেগ পেতে হয়েছে বৈকি শচীন মজুমদারকে। মাসীর বাড়ির তুলনায় বাবার বাড়িটাকে নরক মনে হত চৈতালীর। প্রতি মুহূর্তে সেই মনে হওয়াটা ধরা পড়ে যেত। বাবা সেটা বুঝত না তা নয়।

বুঝত আর রেগে রেগে বলত, মাসী মেসো উপকারের মধ্যে এইটি দেখছি করেছেন, মেয়েকে আমার রাজনন্দিনী বানিয়ে রেখে গেছেন।

তা চৈতালী কথায় কম যেত না। চৈতালীও বলে উঠতো, বড় অন্যায় করেছে। মা-মরা মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে হাড়ির হাল করে মানুষ করলেই খুব ভাল হত, কেমন?

তা যেমন অবস্থা তেমন ব্যবস্থাই ভাল। রাজার হাল করে আপনি তো কাটিয়ে গেলেন কর্তা, শেষরক্ষা হল? পরিবারের গলায় দেনার পাহাড়টি ঝুলিয়ে তো মরলেন।

সত্যিই তাই করে গেছেন ভদ্রলোক। অথচ খোদমেজাজি বেপরোয়া, সৌখিন আর দরাজ বুক সেই মানুষটাকে দেনা করে বাবুয়ানা করে গেছেন বলে নিন্দে করতেও বাধে।

চৈতালীর চুপ করে থাকার সুযোগে বাবা বলত, আমিও একদিন ভদ্রলোক ছিলাম রে চৈতি, তোর ওই ফ্যাসানি মেশোর সঙ্গে এক শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে যখন একসঙ্গে বসে নেমতন্ন খেয়েছি, ওর থেকে আমাকে ভাল দেখাত, বুঝলি? এখন তুই দেখছিস বাবার হাড়ের ওপর চামড়া নেই। গরীব ছিলাম বটে, কিন্তু এমন ছোটলোক ছিলাম না, সেটা শুনে রাখ।

বাবার চেহারা যে একদা ভালই ছিল সেটা চৈতালীও দেখেছে বৈকি, মানুষটাকে দিয়ে নয়, ছবির মধ্যে। মাসীর ঘরের দেয়ালে একটা বর-কনের ছবি দেখেছে বরাবর। ছোটমাসী মেয়েটাকে চিনিয়ে দিয়েছিল, তোর মা তোর বাবা।

সেই বরবেশী বাবাকে কি ভালই লাগত চৈতালীর!

কিন্তু বাবা যখন তাকে নিতে গেল? বাবার চেহারা দেখে সে আড়ষ্ট হয়ে গেল। রোগা পাকসিটে, অর্ধেক চুল পাকা, পেশীর রেখায় শ্রীহীন মুখ, আর পোড়া পোড়া তামাটে রঙ। সেই লোকটাকে দেখে তার স্রেফ একটা ঘোটলোকই মনে হয়েছিল।

তা বাবার কথার উত্তরে ঝঙ্কার দিয়ে উঠত চৈতালী, শুনে তো রাখছি, বলি ছোটলোক হতে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল?

কে?

শচীন যেন আকাশে বার্তা পাঠাচ্ছে এইভাবে ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠত, কে? এই তোমারই গর্ভধারিণী!

মা? আমার মা?

আলবাৎ! কেন, মরতে কে বলেছিল তাকে সাতসকালে? বড় ডাক্তার ডাকবার ক্ষমতা যার না থাকে, তার পরিবার বাঁচবে না? মরে গিয়ে দগ্ধে রেখে যাবে?

তা মা কি রাগ করে আত্মহত্যা করেছিলেন বাবা?

না করুক। বলি মরল তো ভাল চিকিৎসার অভাবে। আমি যদি বড় বড় ডাক্তার ডাকতে পারতাম, দামী দামী ওষুধ খাওয়াতে পারতাম, সাধ্যি ছিল ওর দুম করে মরে যাবার? যাক, আমিও সেই চিতে ছুঁয়ে দিব্যি করলাম, শালার বড়লোক হতেই হবে, যেত তেন প্রকারেণ।

আবার এক এক সময় ভারী মনমরা হয়ে যেত বেচারা শচীন মজুমদার। হয়তো এমনি, হয়তো বা ভাগ-বখরা নিয়ে দলের লোকদের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেলে। তখন মেয়েকে কাছে ডেকে বলত, দেখ চৈতি, এ শালার ব্যবসা-বাণিজ্য আর নয়। তোর একটা বিয়ে দিয়ে জামাই ব্যাটার সঙ্গে মিলে একটা সৎ কারবার ফাঁদব।

চৈতালী বলত, কিন্তু সৎ হবার ক্ষমতা তোমার আর আছে বাবা?

শচীন মজুমদার বলত, মাঝে মাঝে সে ভয়ও করে চৈতি, আবার ভাবি ওই হারামজাদা পাজীগুলোর সঙ্গ ত্যাগ করতে পারলে

হ্যাঁ পারলে, তবে পারবে না।

বলে মুখ ঝামটে চলে যেত চৈতালী।

আর ভাবত মা যদি না অকালে মরত তার, তাহলে মাসীর বাড়ির মত সংসার তাদেরও হত। তার মা, মাসীর মত রোজ বিকেলে স্টোভ জ্বেলে খাবার করতে বসত, আর চৈতালীকে ডেকে ডেকে বলত, আয় কাজ শেখ। সিঙ্গাড়াগুলো গড়ে দে। হয়তো হেসে হেসে বলত কচুরি বেলতে না শিখলে বিয়ে হয় না, বুঝলি?

সেই এগারো বছর বয়সেই তো কত কাজ শিখে ফেলেছিল চৈতালী। ঘর সাজানো, টেবিল গোছানো, আলনায় কাপড়-চোপড় ঠিকমত করে ঝোলানো, সব শেখাতেন মাসী।

ফুলগাছের টব ছিল ছাদে, বেল মল্লিকা গোলাপের, মাসীর সঙ্গে জল দিতে উঠত, আর মাসীকে বলতো, আচ্ছা মা, ছাতে কেন শিউলি গাছ পোঁতো না?—

হ্যাঁ মাসীকেই মা বলে ডাকত চৈতালী।

মাসী বলত, মা ডাক শিখিয়েছি, কিন্তু মা তোর ছিল রে, আমাদের সকলের ছোট্ট বোনটা। তাকে মুছে ফেলতে চাই না। তোর ওই ছবির মাকে তুই প্রণাম করবি, ভালবাসবি, ভক্তি করবি, বুঝলি?

চৈতালী বলত, ধ্যেৎ! নেই, দেখতে পাই না, তাকে আবার ভক্তি ভালবাসা। না দেখলে বুঝি ভালবাসা যায়?

মাসী বলত, যায়! যাবে না কেন! ভগবানকেও তো আমরা দেখতে পাই না, তাবলে

মেসোমশাই শুনতে পেলে হৈ চৈ করে উঠতেন, হয়েছে, মাথা-খাওয়া শুরু হয়েছে। দেখ ভগবান জিনিসটা একটু দুষ্পচ্য, ওটা এ বয়সে হজম হয় না। ওটা আর ওকে এক্ষুনি গুলে খাওয়াতে বোসো না। মেলোমশায়ের কথাগুলো কী সুন্দরই ছিল! এমন কি মাসীর বাড়িতে যারা বেড়াতে আসত, তারাও যেন সব সুন্দর চমৎকার চকচকে ঝকঝকে।

আর তার এই বাবার বাড়িতে?

ভাবলেই চোখে জল আসত চৈতালীর।

আজ আবার সেই বাড়ির জন্যেই চোখে জল আসছে।

 বাবা মরে গেল তার।

আর কোনদিন ভাল হবার দিন পেল না বাবা, দিন পেল না সৎ কারবার ফঁদবার।

.

অবশ্য সেই সৎ আর ভাল সম্বন্ধে তখন মোহ খুব একটা আর ছিল না চৈতালীর। চুরি জোচ্চুরি লোক ঠকানো, এগুলোকে সে প্রায় বাহাদুরীর পর্যায়ে ফেলত, এবং জগতে যে ভাল লোক বলতে কেউই নেই, সবাই চোর, এ ধারণা ক্রমশই বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল তার।

বাবার মন্ত্রে দীক্ষা হচ্ছিল চৈতালীর, তবে বাবার রুচিতে তার রুচির মিল ছিল না। বরেনকে বাবা জামাই করবার বাসনায় আছে মনে করলেই বাবার ওপর রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে যেত, এবং বরেনকে বঁটা মারতে ইচ্ছে করত।

তবু কৌশিকের মত আলোয় গড়া মানুষও যে পৃথিবীতে আছে, তা তো তখন স্বপ্নেও জানত না চৈতালী।

জানত না সুলক্ষণার মত এমন মা থাকে জগতে।

 সুদক্ষিণাকে ভয় করেছিল প্রথমটা।

সে ভয় ভেঙে যাচ্ছে।

ভয় ভাঙছে, কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য আসছে কি? দৈবাৎ অসতর্কে ভুলে গিয়ে হয়তো একটু সহজভাবে কথা কয়ে উঠল, পরক্ষণেই কুঁকড়ে যায় মন, মনে হয় আমি ওদের সঙ্গে সমান হয়ে কথা বলছি?

ওরা কী, আর আমি কী!

আমি কি ওদের কাছে বসবারও যোগ্য?

 সুলক্ষণা মহীয়সী, সুলক্ষণা করুণাময়ী, তাই চৈতালী এই স্বর্গে প্রবেশের অধিকার পেয়েছে।

না হলে কি হত!

ভাবতে গিয়ে শিউরে ওঠে চৈতালী।

শচীন মজুমদার নামক লোকটা অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির ছাপ মেরে হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরে চালান হওয়ায় পর চৈতালী মজুমদার নামক মেয়েটাকে কি সেই বাঘ ভাল্লুকের দল আস্ত রাখত?

কিন্তু

আর একটা কথা স্মরণ করলেই সমস্ত মনটা তার কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসে।

কথা নয়, দৃশ্য।

প্রথম দিনকার সেই দৃশ্য।

একটা গেলাস চুরি করতে এসে ধরা পড়েছে চৈতালী!

চাকর বংশী তাকে জাপটে ধরে রেখেছে। ছি ছি ছি!

ভাবলে তখুনি মরে যেতে ইচ্ছা হয়। এরা আশ্চর্য মহানুভব, তাই সে দৃশ্যের কথা ভুলে গেছে। কিন্তু চৈতালী? সে কেমন করে ভুলবে?

তা ছাড়া

 অপর্ণা!

অপর্ণা কি ভুলতে দেবে?

অপর্ণার চোখে তো আজও সেই প্রথম দর্শনের দৃষ্টি।

সেই ঘৃণা বিস্ময় আতঙ্ক!

দীর্ঘ পল্লবাচ্ছাদিত বিস্ফারিত দুই চোখে তেমনি করেই চেয়ে থাকে অপর্ণা চৈতালীর দিকে।

কথা বলে না।

না, দু একদিন কথা বলেছিল। বলেছিল, আমার বাপের বাড়িতে নতুন কোনও ঝি চাকরকে ঢোকাবার সময় প্রথমেই তার ঠিকানা জেনে নেওয়া হয়।

তারপর তার আগের জীবনের ইতিহাস জেনে নেওয়া হয়। মা বলেন, কে জানে বাবা চোর হবে কি ডাকাত হবে, খুনে হলেও হতে পারে। রান্নায় যদি বিষই মিশিয়ে দেয়। যাকে জানি না, শুনি না, তাকে বিশ্বাস কি?

চৈতালীর মুখ লাল হয়ে উঠেছিল।

চৈতালী তবু মৃদু স্বরেই বলেছিল, তা তো ঠিক। তবে বিশ্বাস যাকে নেই, সে যে তার নাম পরিচয় অতীত ইতিহাস সব ঠিক বলবে, তাতেই বা বিশ্বাস কি?

অপর্ণা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, সেই তো! আমার বাবা বলতেন, আগুন সাপ আর চোর, এই তিন নিয়ে ঘর করা যায় না। হয় ঘর যাবে, নয় প্রাণ যাবে।

নিজের জবানে সব কথা গুছিয়ে বলতে পারে না অপর্ণা, বাপ-মায়ের জবানীতে বলে।

অপর্ণার কাছ থেকে সরে সরে বেড়ায় চৈতালী। দুধ দিতে, খাবার দিতে, একটি একটি করে গরম লুচি ভেজে ঘরে দিয়ে আসতে অপর্ণার কাছে আসতেই হয় বটে, সাধ্যপক্ষে কথা বলে না। বোবা পুতুলের মত যায় আসে, কাজ করে।

কি জানি যদি অপর্ণা তার মার নিয়মে চৈতালীর অতীত ইতিহাস জানতে চায়!

সে যে বড় ভয়ানক।

কিন্তু সুলক্ষণাকে তো সেদিন সব বলেছিল চৈতালী, সুলক্ষণা কি সে কথা কাউকে বলেননি?

 চৈতালী ভেবেছে।

ভেবে ভেবে অনুমান করেছে, সুলক্ষণা সে সব কথা নিজের মধ্যেই আবদ্ধ রেখেছেন।

আশ্চর্য, আর কোনদিন একটিও কথা জিগ্যেস করলেন না সুলক্ষণা। যেন ভুলে গেছেন, চৈতালী এ বাড়ির লোক নয়। ভুলে গেছেন, চৈতালী এই সেদিনও এ বাড়িতে ছিল না।

যদি না ভুলতেন

যদি চৈতালীর জীবনের প্রতিটি দিনের ঘটনা জানতে চাইতেন?

চৈতালী কি তাহলে বলতে পারত পৈতৃক বাড়ি বিক্রী করে ফেলার পর হতভাগা শচীন মজুমদার একটা তরুণী অনূঢ়া মেয়ের হাত ধরে কত ঘাটের জল খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত মাঠকোঠায় এসে পৌঁছেছিল! সে ইতিবৃত্ত কি বর্ণনা করার?

মেয়েকে শচীন কখনো পরিচয় দিয়েছে ভাইঝি বলে, কখনো ভাগ্নী বলে, কখনো বলেছে বন্ধুর মেয়ে। চৈতালী রেগে উঠে প্রশ্ন করলে বলেছে, আহা বুঝছিস না, আমার মত হতভাগার মেয়ে তুই, এটা লোককে বলতে চাই না!

অথচ এই বোকামীর জন্য একবার একটা ভাল আশ্রয় ছাড়তে হয়েছিল তাদের।

বাড়িওলি-গিন্নী চৈতালীকে সুনজরে দেখেছিলেন, তার কী একটা অসুখের সময় চৈতালী সেবা করেছে, তার সংসারের রান্না করে দিয়েছে। ওর পরিপাটি কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি, কিন্তু একদিন বাধল বিপত্তি।

হঠাৎ গিন্নী একদিন ডেকে প্রশ্ন করলেন, হ্যাগা বাছা, শচীনবাবু তো বলে তুমি নাকি তার ভাগ্নী, তবে তুমি বাবা বাবা কর কেন ওকে?

চৈতালী জোর দিয়ে বলে ফেলেছিল, উনি ভুল বলেছেন, উনি আমার বাবা।

ভদ্রমহিলা রেগে গেলেন।

রেগে আগুন হয়ে বললেন, এমন কথা তো বাপের জন্মে শুনিনি। ভুল করে মেয়েকে বলবে ভাগী!

কথাটা শচীনের কানে গেল।

গেল তো গেল, শচীন যখন একটু রঙে রয়েছে। শুনতে পেয়ে বলে উঠল, বেশ করব বলব, আলবৎ বলব। আমার মেয়েকে আমি যা খুশী বলব, উনি জবাবদিহি চাইবার কে?

কে তা দেখিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা।

 আশ্ৰয়টা গেল। অমন ভাল আশ্রয়।

ভালমন্দ কত আশ্রয়ই গেল তারপর। এখন শচীন মজুমদার সেরা আশ্রয় পেয়ে গেছে, এরপরে আর বাসা খুঁজে বেড়াতে হবে না তাকে।

আর শচীন মজুমদারের মেয়ে?

তার কপালে তো স্বর্গবাস লেখা ছিল। সেই স্বর্গে এসে পৌঁছেছে সে। কিন্তু কদিনের জন্যে?

 কে জানে?

অপর্ণার চোখ যেন তীব্র শাসন করে বোঝাতে চেষ্টা করে,–এ তোমার অনধিকার প্রবেশ।

সুলক্ষণা সুদক্ষিণার মত উচ্চমনা যদি হত অপর্ণা! তা নয় সে।

শুধু দেহটাই তার অসুস্থ নয়, মনটাও অসুস্থ।

সুদক্ষিণা গল্প করেছে

 বিয়ের সময় কি সুন্দর চেহারা ছিল বৌদির! কী হাসিখুসি মুখ! কোথা থেকে যে এক বিশ্রী রোগ এল–

চৈতালী ভেবে পায়নি দেহে রোগ এল বলে মনেও রোগ আসবে কেন।

 ভেবে পায়নি বলেই সুদক্ষিণার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।

সুদক্ষিণা বলেছে, বৌদির কথায় কখনো কিছু মনে করো না ভাই। উনি একটু ওই রকমের। ছোড়দা বলে–

সব কথায় ছোড়দার কথা আনে সুদক্ষিণা। কারণ ছোড়দার সঙ্গেই যত গল্প সুদক্ষিণার।

সেদিন চৈতালীকে একটা বই হাতে দিয়ে বসিয়ে ছুটে যায় তিনতলার ঘরে। হাঁপিয়ে বসে পড়ে বলে, দেখ ছোড়দা, আমাদের মোটেই উচিত নয় ওকে বংশীর অ্যাসিস্টেন্ট করে রেখে দেওয়া! আসলে ও সত্যিই ভদ্র ঘরের মেয়ে, শুধু বাবার দোষে

কিন্তু বাপের ওপর কি ভালবাসা! বাবাঃ!

খুবই স্বাভাবিক। আর যখন কেউ নেই।

সুদক্ষিণা একটু চুপ করে থেকে বলে, কিন্তু দেখ ছোড়দা, একটা কথা আমি ভাবছি

ওরে বাবা তুই আবার ভাবছিস? শুনি কি ভাবনা?

কথাটা গুছিয়ে গাছিয়ে বলে সুদক্ষিণা।

বলে, ওই অশৌচ না কি, ওটা মিটে গেলেই তো মা আবার চৈতালীকে রান্নাঘরে ভরতি করে দেবেন, যার জন্যে সেই অদ্ভুত অবস্থায় ওকে ঘরে তুলে নিয়েছেন মা পথ থেকে।

কিন্তু সেটা কি ন্যায়ধর্ম এবং মানবিকতা হবে? চৈতালী যখন একটা সত্যিকার আস্ত ভদ্রমেয়েওর মধ্যে বস্তু রয়েছে, সে বস্তুকে মূল্য দিয়ে ওকে উঁচু কোঠায় তুলে নেওয়া যায়। ওকে একটা সত্যিকার মানুষে পরিণত করা যায়।

যেটা করা যায়, সেটা না করা কি অমানবিকতা নয়? নিজেদের সুবিধের জন্যে রাঁধুনী করে রেখে দেওয়া হবে ওকে!

.

তা এ কথাটা যে একা সুদক্ষিণাই ভেবেছে তা তো নয়।

কৌশিকও ভেবেছে বৈকি।

সেদিন অতগুলো ঘণ্টা চৈতালীর সঙ্গে নানা বিপাকের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়ে এবং সদ্য পিতৃশোকাতুর মেয়েটার সঙ্গে একত্রে অতটা রাস্তা এক গাড়িতে আসায়, অনেকটা পরিচয় ঘটেছে। তারপর আরোই ঘটছে।

সে পরিচয় অনেকটা ভাবিয়ে তুলেছে কৌশিককে, অনেক প্রশ্ন এসেছে মনের মধ্যে। আর বার বার মনে হয়েছে, এখন তো দুচার দিন, তারপর?

তারপর তো সেই বংশীর শাগরেদী!

 সেটা কি ঠিক হবে?

কিন্তু বলবে কে?

তুই বল, বলল সুদক্ষিণা।

কৌশিক বলে, আমায় আবার কেন জড়াচ্ছ বাবা এর মধ্যে? তোমার বান্ধবী হয়েছে, তুমি বলগে না তোমার মাকে।

সুদক্ষিণা হঠাৎ একটু চোরা হাসি হেসে বলে ওঠে, কে বলতে পারে, ভবিষ্যতে তোরই বান্ধবী হয়ে উঠবে কিনা।

কৌশিক হেসে উঠে বলে, তা তো নিশ্চয়, ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? কিন্তু আপাতত যখন হয়ে ওঠেনি, তখন আর–আমি কেন বাবা?

জীবে দয়া হিসেবে।

 তুই পারবি না?

পারব না কেন? তবে তুই বললেই বেশী কাজ হবে।

বেশ।

এও ওদের এক হিসেবের ভুল।

মেয়ের কাছ থেকে না শুনে ছেলের কাছ থেকে শুনে বেশী প্রভাবিত হবেন সুলক্ষণা, এমন মনে করবার হেতু নেই।

সুলক্ষণা ওঁর ওই ক্ষ্যাপা ছেলেটার দিকেও গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালেন।

তারপর বললেন, রান্নাবান্না করতে দেব না? তাহলে এই অখণ্ড সময়টা নিয়ে কি করবে ও?

লেখাপড়া করবে। কৌশিক নিশ্চিন্ত দৃঢ়তায় বলে, লেখাপড়ার থেকে ভাল জিনিস আর কী আছে?

কিন্তু তাতে আমার কী লাভ হল?

তোমার লাভ? তোমার কী লাভ হল তাই ভাবছ? সে কী গো মা! এই রকম তুচ্ছ একটা লাভ-লোকসানের কথা তুমি ভাবতে পারলে? তুমি?

সুলক্ষণা মনে মনে একটু নরম হলেন।

দেখলেন এটা সেই তার চিরকালের ছেলেটা। এর ওপর অন্য সন্দেহ করা অবিচার। তবু হাসলেন না।

বললেন, তা কোনদিন কি বলেছি, আমি কোনমতে স্বর্গ হতে টসকে, পড়েছি এ মর্ত্যভূমে বিধাতার হাত ফসকে। সংসারী মানুষ, সংসারের লাভ-লোকসান দেখব না?

না, দেখবে না।

আর ওকে যখন রাখলাম, তখন যে বড্ড ঠাট্টা করেছিলি?

কৌশিক হেসে উঠে বলে, সেই কথা দেখছি মনে করে রেখেছ? ঠাট্টায় বিচলিত হবার লোক তো তুমি নও বাপু! হল কি তোমার? লিভারের কাজ ভাল হচ্ছে না বুঝি?

যা পালা, ইয়ার ছেলে!

সুলক্ষণা একটু তাড়া দিলেন, তারপর বললেন, কিন্তু মনস্তত্ত্বের অনেক তত্ত্ব আছে, বুঝলি? কাজ একটা না দিলে ওরই বা ভাল লাগবে কেন? নিজেকে দরকারী মনে হবে কেন? সব সময় যদি মনে পড়ে, আমি এদের দয়ার ওপর আছি, তাহলে স্বস্তি পাবে কেন?

তা কৌশিক তো পাগলই।

তাই পাগলের মতই একটা কথা বলে বসে।

তা আমিও তো তোমাদের সংসারের কোন কাজে লাগি না। নিজেই তো বল, সংসারের একটা কুটোও ভাঙতে পারে না। কিন্তু কই স্বস্তির কিছু অভাব তো নেই আমার? সর্বদা তো মনে পড়ে না, আমি সুলক্ষণা দেবীর দয়ার ওপর পড়ে আছি।

এবার না হেসে পারেন না সুলক্ষণা। হেসে ফেলেন। হাসতে হাসতে বলেন, তোর যেমন কথা! তুই আর ও?

আহা একেবারে এক রকম না হলেও, কৌশিক মার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তুমি তো ওর ভার নিয়েছ? ওর মা হতে স্বীকার পেয়েছ?

সুলক্ষণা আরও হেসে ওঠেন, মা নয়, মাসী।

 সে তো তোমার হিংসুটে ছেলেমেয়ে দুটোর ভয়ে।

 ও বলেছে বুঝি তোকে? খুব গপপো করেছিস ওর সঙ্গে, কেমন?

কৌশিক বলে, করেছি বৈকি। একটা মানুষ, যোবা নয়, কালা নয়, তার সঙ্গে সাক্ষণ এক বাড়িতে থাকছি, কথা কইব না?

তা তোর দিক থেকে তো তুই খুব উদারতা মানবিকতা হৃদ্যতা আরও এ ও তা দেখাচ্ছিস, কিন্তু ক্ষেণু? ক্ষেণু তো ওকে দেখতেই পারে না। ওকে না খাঁটিয়ে শুধু যদি আদর করে মানুষ করে তুলতে থাকি, ক্ষেণু রেগে আগুন হবে না?

কৌশিক একটু চুপ করে থেকে গম্ভীরভাবে বলে, তাহলে বুঝতেই হবে মেয়ে মানুষ করবার ক্যাপাসিটি তোমার নেই। নিজের মেয়েটাকে মেয়েমানুষ করেই রেখে দিয়েছ। হিংসুটি খলকুটি গাঁইয়া মেয়ে।

তারপর হেসে উঠে বলে, আসলে এ বার্তা ক্ষেরই প্রেরিত। আমি দূত মাত্র।

ক্ষেণুর!

হ্যাঁ। ওই আমাকে সাধলো, ছোড়দা মাকে ভেজাগে যা। আহা মেয়েটা একটু সুযোগ পেলেই মানুষ হতে পারে, ওকে ওই বংশীদার অ্যাসিস্টেন্ট করে রাখা কি ঠিক?

মেয়ের এই আনুকূল্যে সুলক্ষণা অবাক হলেন। সুলক্ষণা হয়তো খুশীও হলেন। নিজের মনের মধ্যে যে বাসনার উদ্ভব হয়েছিল, যে বোধ দেখা দিয়েছিল, তার জন্যে আর লড়াই করতে হবে না ভেবে শান্তি পেলেন, তবু মনের মধ্যে সেই কাঁটাটি খচখচ করতে লাগল।

আমারটি ওরা নিয়ে নিল!

 যেটি একান্ত নিজস্ব ছিল, সেটি সকলের হয়ে গেল!

বললেন, আর তোদের দাদা বৌদি?

কৌশিক তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ওনারা তো মহৎ ব্যক্তি! ওঁদের জন্যে ভাবনা কি?

 কথাটা সত্যি। ওরা হিংসুটে নয়।

অতএব নির্ভাবনায় চৈতালী নামক ভাগ্যহত প্রাণীটিকে ভাগ্যের দরজার কাছে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া চলে। ওর সমস্ত ঘাটতি কেবলমাত্র দয়ার বাটখারা চাপিয়ে চাপিয়ে সমান করে নেওয়া চলে।

 ভাবা চলে, ওকে কোন স্কুলে ভরতি করে দেওয়া হবে, না বাড়িতে মাস্টার রেখে পড়ানো হবে! নাকি এরাই ভাইবোনে একটা বেওয়ারিশ ছাত্রীর ওপর হাত পাকাবে?

.

কিন্তু ও পক্ষও তো নিরেট দেওয়াল নয়!

ও পক্ষেও বুদ্ধির ঘরে জানলা দরজা আছে।

সে বেঁকে বসল।

যেদিন গঙ্গার ঘাটে নিয়ে গিয়ে চৈতালীকে শুদ্ধ করিয়ে নিয়ে এলেন সুলক্ষণা, সেদিন সুলক্ষণাকে সে প্রশ্ন করল, এবার সব কাজ করতে পাবো তো মাসীমা?

সুলক্ষণা বললেন, এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? শরীর মন ভাল নেই, থাক না

শরীর তো খুবই ভাল আছে মাসীমা! আপনার যত্নে তো এই কদিনে ডবল মোটা হয়ে গেলাম।

হ্যাঁ গেলি! তা যাক মনটা একটু সুস্থির থোক না।

 কাজ না করলে মন আরও অস্থির হয়ে ওঠে মাসীমা।

তা বইটই তো পড়ছিস।

সে কী সারাক্ষণ?

সুলক্ষণা হেসে উঠে বলেন, তা সারাক্ষণই চালা। ক্ষেণু কুশী তো আমার ওপর কড়া নিষেধ জারি করে দিয়েছে, যাতে তোকে ওই সব হাবিজাবি কাজে না ভরতি করি আবার। করলে ওরা আমায় ফাঁসি দেবে!

চৈতালী এ পরিহাসে হাসে না।

শঙ্কিত চোখে বলে, কেন মাসীমা?

 কেন আর? লেখাপড়া শিখে মানুষ হবি। বংশীর শাগরেদী করবি না–

চৈতালী মুখ তুলে বলে, কাজ না করতে পেলে আমি টিকতে পারব না মাসীমা! আর–আর যদি মানুষ হওয়ার কথা বলেন? আমার মধ্যে যদি কিছুও মনুষ্যত্ব থাকে, আপনাদের হাওয়াতেই মানুষ হয়ে যাব। লেখাপড়া কি আর কাজকর্ম করলে হয় না?

তা সেই কথা বোঝাস তোর দাদা-দিদিকে।

 বলে চলে যান সুলক্ষণা।

 দিদিই বলেন ক্ষেণুর সম্পর্কে।

বয়সে ছোট হলেও।

 ওটুকু শ্রেণী বিচার রয়েছে এখনও তার মনের মধ্যে।

.

 অপর্ণা কদিন একটু ভাল আছে।

উঠে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

অতএব এখন এদের উৎসবের দিন।

এখন সুদক্ষিণা বলতে পারে, অনেকদিন সিনেমা দেখা হয়নি মা!

কৌশিক বলতে পারে, মা ভাবছি সামনের ছুটিতে দুদিন কোথাও ঘুরে আসি।

কৌস্তুভ বলতে পারে, রেডিওটা বন্ধ পড়ে থেকে থেকে ইয়ে হয়ে গেল, খুলব অপর্ণা? গান শুনবে?

আর স্বয়ং অপর্ণার বলতে ইচ্ছে হয়, আমায় কিছু করতে দিন না মা! বেশ তো ভাল আছি।

সুলক্ষণাকে সস্নেহ ভর্ৎসনায় নিবৃত্ত করতে হয় অপর্ণার সেই সহজ হয়ে যাবার ইচ্ছেটাকে।

 তবু বাড়িতে আনন্দের হাওয়া বয়।

.

আপাতত সেই হাওয়া বইছিল বাড়িতে।

সুদক্ষিণা বলল, চল্ ছোড়দা, সিনেমা দেখে আসি।

 কেন? কৌশিক স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলে, আর একটু ফ্যাশান শিখতে? কি করে আঁচলটা আরও কায়দা করে বাতাসে ওড়ানো যায়, কি করে মুখে আরও বেশী করে চুনকালি মাখা যায়–

থাম্ থাম্। যথেষ্ট সেকেলেপনা হয়েছে। রাস্থ কথা। টিকিট কেটে আনগে যা।

কৌশিক ইতস্তত করে বলে, কটা টিকিট?

কটা? কটা আবার? আর কে যাবে?

 মানে বলছি, সে তো জানি–মা যান না, বৌদির কথা বাদ, কিন্তু ধর চৈতালীকে তো অফার করতে পারিস তুই।

চৈতালীকে? হুঁ! সে তার অন্নপূর্ণার আসন ত্যাগ করলে তো! সেই রান্নাঘরে পড়ে আছে। দেখলি তো সেদিন? কম বোঝানো বোঝালাম? সেই এককথা, কাজ না করলে বাঁচব না। যারা কাজ না করতে পেলে মারা যায়, এই সুখের পৃথিবীর আমোদ আহ্লাদ তাদের জন্যে নয়, বুঝলি? তারা ওই ঘানিই ঘোরাবে। আমি ওকে মানুষ করে তোলবার আশা ছেড়ে দিয়েছি।

তবে যে সেদিন বললি, পড়াশোনায় খুব চাড় আছে

তা আছে। সেটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু রান্নাঘর ভাড়ারঘরের অধিকার ত্যাগ করে নয়। ষোল আনা বজায় রেখে

তবে থাক। যে যার নির্বুদ্ধিতার ফল ভোগ করবে। তবে ভাবছিলাম মনটন খারাপ, কিছু তো করা হয় না। ও বেশ বেঁধে চলেছে, আর আমরা বেশ খেয়ে চলেছি, ব্যস!

সুদক্ষিণা বলে, বলে দেখব?

দেখ! হয়তো বৃথা পণ্ডশ্রম। যাইহোক মাকে কিন্তু বলিস আগে।

সুলক্ষণা তখন বৌয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন।

.

সুদক্ষিণা এসে ভূমিকা করল, মা, সন্ধ্যেবেলার রান্নাটা বংশী চালিয়ে নিতে পারবে না আজ?

সুলক্ষণা অবাক হলেন।

অপর্ণা অবাক হয়ে তাকাল।

 সুদক্ষিণা আবার বলল, কি, পারবে না?

পারবে না কেন? কিন্তু কারণটা কি? চৈতালী কি শরীর খারাপ টারাপ কিছু বলেছে?

না, না, শরীর খারাপ হতে যাবে কেন? ভাবছিলাম, সিনেমা যাই। তা ও বেচারী তো কোথাও যেতে টেতে পায় না–রাতদিন বাড়ির মধ্যে থাকে, ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না– থেমে গেল সুদক্ষিণা। থতমত খেল।

অপর্ণার ফ্যাকাশে মুখ শাকমূর্তি হয়ে গেছে।

 সুলক্ষণা অস্বস্তি অনুভব করলেন।

কত বছর যেন হয়ে গেল, অপর্ণা বাড়ির বাইরে যায়নি, জগতের কোন আমোদ আহ্লাদের ভাগ গ্রহণ করতে পায়নি।

সুদক্ষিণাও বোধ করি বৌদির মুখ দেখে অপ্রতিভ হল। এমন দিনও তো ছিল অপর্ণার, যখন নিজে সে সেজেগুজে পরীর মত হয়ে এসে বলত, ক্ষেণু, সিনেমা যাবে?

সুদক্ষিণা বলত, বাবা সামনে পরীক্ষা

 আরে দূর! জীবনভোর তো পরীক্ষা দেবে। পৃথিবীকে ভোগ করে নিতে হয়।

সুলক্ষণা বলতেন, পড়ো মেয়ে, এত নিত্যি নিত্যি সিনেমা থিয়েটার দেখা কেন বৌমা? তোমরা যাচ্ছ যাও!

অপর্ণা বলত, ওকে ফেলে যেতে ভাল লাগে না মা!

.

 সে সব কদিনের ব্যাপার? সে সব কবেকার ঘটনা? কদিন পৃথিবীকে ভোগ করে নিতে পেরেছিল অপর্ণা?

কিন্তু আজ সুদক্ষিণার ভূমিকা প্রধান।

সুদক্ষিণাকে আজ আর নিয়ে যেতে হয় না, সে নিজেই নিয়ে যাবার মালিক। তাই সেও আজ বলছে ওকে ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না।

কিন্তু সেই ওটা অপর্ণা নয়। সে আর একজন। ধুলো মাটি থেকে কুড়িয়ে তুলে ঠাকুরঘরে স্থাপনা করা হয়েছে যাকে। সে যে বাইরে কোথাও যেতে পায় না, সারাদিন বাড়ির মধ্যে পড়ে থাকে, এই কষ্টকর অবস্থাটা অনুভব করে কাতর হচ্ছে সুদক্ষিণা!

এতে যদি শুধু অপর্ণার সাদা ফ্যাকাশে রঙটা বাসী শাকের মত হয়ে যায়, আর কিছু হয় না, সেটা অপর্ণার অসীম ক্ষমতার পরিচয়। দেহে যার রক্ত নেই, তার পক্ষে এতটা ক্ষমতা আশ্চর্য বৈকি।

সেই আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে অপর্ণা শুধু তাকিয়ে রইল।

 সুদক্ষিণা অপ্রতিভ হয়েছে।

বৌদির সামনে কথাটা বলতে আসা শোভন হয়নি বুঝতে পেরেছে, কিন্তু হাতের ঢিল মুখের কথা! এখন কথা অসমাপ্ত রেখে চলে যাওয়া আরও লজ্জা!

তাই আস্তে আস্তে বলে সুদক্ষিণা, বেচারীর বাপ মারা গেল সেদিন।

 এইটুকু তবু হাতে ছিল।

 এইতেই মুখরক্ষা!

সুলক্ষণা বৌয়ের মুখের দিকে অলক্ষ্যে একবার তাকিয়ে নিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বলেন, চালিয়ে নিতে বংশী না পারে তা নয়, তবে চৈতালীই ছাড়তে চায় না। যার হাতে জিনিস, সে যদি না ছাড়ে, আর একজন ধরবে কি করে?

অপর্ণা হঠাৎ শাশুড়ীর হাত থেকে চুলটা ছাড়িয়ে নেয়। দাঁড়িয়ে উঠে বলে, আমি রান্না করব এবেলা!

একথা শুনে হেসে উঠল সুদক্ষিণা।

নিশ্চিন্ত ব্যাধ!

 জানে না বাণটা কোথায় গিয়ে বিঁধল।

 জানে না তাই হেসে ওঠে। লহরে লহরে হাসে।

যাক বাবা সমস্যাটা মিটল। বংশীকেই বা দরকার কি? তাহলে তো আজ

এইমাত্র যে অপর্ণার মুখের চেহারা বদলে গিয়েছিল, সে কথা ভুলে যায় সুদক্ষিণা, তাই হেসেই ওঠে সে।

হেসে হেসেই কথা শেষ করে, ভালমন্দ কিছু দেখছি আজ খাওয়া যাবে।

 সুদক্ষিণা এত নির্বোধ হল কেন?

প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে শঙ্কিত হন সুলক্ষণা।

ঈষৎ কঠিন স্বরে বলেন, পাগলামি করিসনে ক্ষেণু! নিজেরা যাচ্ছিস যা।

ক্ষেণু এই হঠাৎ সুর বদলে চকিত হয়। বোধকরি সচেতন হয়। বৌদির বদলে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে আস্তে সরে যায়। ভাবে, দূর ছাই! আমাদের আবার হাসিঠাট্টা! যা একখানি বৌ হয়েছেন বাড়িতে!

করুণার বদলে রাগ আসে সুদক্ষিণার, সেই ফ্যাকাশে-মুখ মানুষটার ওপর। ভাবে, যাই। ছোড়দাকে জানাইগে মাতৃ-আজ্ঞা। ছোড়দা হয়তো বলবে, থাকগে গিয়ে কাজ নেই।

তা বলতে পারে।

হঠাৎ এই বিরক্তির মধ্যেও সুদক্ষিণার মুখে একটা আলগা হাসি ফুটে ওঠে।

ছোড়দাটা যা পাগলা। হয়তো

.

আর একখানা মুখেও তখন ফুটে উঠেছে এইরকম একটু আলগা হাসি।

সে মুখ এ বাড়ির রাঁধুনীর।

দ্রুতহাতে কুটনো কুটে নিচ্ছিল সে, এখন হাতটা নিশ্চল। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

সামনেই একটা বেতের মোড়া পড়েছিল, সেটাকে টেনে নিয়ে জুত করে বসেছে কৌশিক। বলছে, তা নিজেকে এত দরকারী করে তোলার প্রয়োজনই বা কি? না হয় লোকে ভাবলই, মেয়েটা কোন কর্মের নয়। হলটা কি তাতে? আমাকে তো সবাই কোন কর্মের নয় বলে খরচের। খাতায় লিখে রেখেছে, কই আমি তো কোন অপরাধ বোধ করি না। অস্বস্তিও পাই না।

চৈতালীর মুখে ওই হাসিটা ফুটে উঠেছে।

 এত অদ্ভুত কথা বলেন আপনি!

কথাটা অদ্ভুত কিছুই নয়। তুমিই অদ্ভুত। আজ পর্যন্ত তো দেখিনি, কোন মেয়ে সিনেমা দেখতে আপত্তি করে।

চৈতালী কি ভুলে যায়, ও কে?

তাই কৌশিকের সঙ্গে কৌতুক করে বসে? দুই চোখ নাচিয়ে হেসে উঠে বলে, কোন মেয়ে করে না। অনেক মেয়ে আপনি দেখেছেন বুঝি?

দেখছিই তো হরদম। কিন্তু তোমার মত এমন দেখলাম না। খাও দাও ঘুরে বেড়াও, সুখে স্বচ্ছন্দে থাক–তা নয়। বেশ তবে কাজকর্ম করো, হেসেখেলে কাটাও, তা নয়। অদ্ভুত!

.

চৈতালী কৌশিকের এই কথার ধরনে না হেসে পারে না। হাসে। কিন্তু পরক্ষণেই গম্ভীর স্বরে বলে, আমি কি সাধারণ আর সবাইয়ের মত?

বেশ, না হয় অসাধারণই। কিন্তু এই সাধারণদের সঙ্গে একটুআধটু মিশলে মাহাত্ম্য কিছু ক্ষুণ্ণ হবে না।

আমি যদি আপনাদের সঙ্গে মিশতে যাই, আপনাদের মাথা হেঁট হবে না?

আমাদের মাথা কি এতই হালকা যে, এই সামান্য ভারে হেঁট হয়ে যাবে?

 কিন্তু আমি যে কী, তা তো আমি নিজে জানি। কোন লজ্জায় কবে–

কৌশিক এবার গম্ভীর হয়।

সত্যিকার গম্ভীর।

 বলে, জীবনের প্রারম্ভে মানুষ যা জানে, সেটাই শেষ জানা হতে পারে না। নতুন করে জানতে শিখতে হয়, নতুন করে নিজেকে গড়তে হয়। কেউ যদি কোন অগৌরবের মধ্যে জন্মায়, সেটা তার নিজের হাত নয়, কেউ যদি জ্ঞান বুদ্ধি জন্মাবার আগে ভুল নির্দেশে চলে কাঁটাঝোপে গিয়ে পড়ে, সেটাই তার পথ নয়। প্রতিদিনের জন্মানোর মধ্যে দিয়ে গৌরব সৃষ্টি করতে হয়, প্রতিদিনের চেষ্টার মধ্যে দিয়ে ভাল পথ নির্ণয় করতে হয়। আর সেটা শুধু নিজের ওপর শ্রদ্ধা থাকলে। নিজের ওপর শ্রদ্ধা না থাকলে–কে? কে ওখানে?

চমকে উঠে পড়ল কৌশিক।

বলল, সিঁড়ির তলার দরজা দিয়ে এসে কে চট করে ওপরে উঠে গেল মনে হল না?

 কি জানি, দেখিনি তো।

 দেখনি? কিন্তু আমি যেন দেখলাম, সাদা কাপড়ের মত কি যেন একটা

তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল কৌশিক।

.

কিন্তু সত্যিই কি দেখেনি চৈতালী?

দেখেছে।

শুধু আজ নয়, রোজই দেখে। যখন তখন দেখে। দেখে আর কণ্টকিত হয়। অবাক হয়। ভয়ে বেশীক্ষণ ভাবতেও পারে না।

তাই হিসেব মেলাতেও পারে না।

কোন প্রকারেই পারে না।

অথচ আগ্রহাতুর মুগ্ধ একজোড়া চোখের দৃষ্টি যেন শরীরী হয়ে সর্বাঙ্গে লেগে থাকে, আটকে থাকে, একা ঘরে বসেও মনে হয় মুছে ফেলা যাচ্ছে না তাকে।

সেই দৃষ্টি দুজনের ওপর স্থির হয়েছিল এতক্ষণ নিভৃত কোন অন্তরাল থেকে। বুঝতে পেরেছে চৈতালী।

.

বৌয়ের চুল বেঁধে দিয়ে এসে বসেছিলেন সুলক্ষণা। ওকে দেখতে পেলেন তিনি। বললেন, কি খুঁজছিস রে কৌশিক, এঘর-ওঘর করে?

চোর!

চোর খুঁজছিস?

হ্যাঁ, মনে হল কে যেন সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। একটু সাদার আভাস

উঠে এল তো খোকা!

খোকা!

তাই তো দেখলাম।

 কিন্তু? না না, দাদা কেন অমন ঝট করে চলে আসবে? আমরা রয়েছি ওখানে।

সুলক্ষণা হেসে ফেলে বললেন, তাহলে দেখ খুঁজে, কোথায় চোর! এক চোর নিয়েই তো–

চোর ফোবিয়া! কৌ

স্তুভ শান্ত গলায় বলে, এ রকম হয় মানুষের।

হয়? কৌশিক বলে, তোমাদের কথার কোন মানে হয় না। তুমিই তাহলে ওরকম চট করে উঠে এসেছ?

কৌস্তুভ গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে হ্যাঁঙারে ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে বলে, বললাম তো আমি যেমন ভাবে রোজ আসি, ঠিক সেই ভাবেই এসেছি।

হ্যাঁ, ঠিক এই কথাই প্রথমে বলেছে কৌস্তুভ। বলেছে, কেন, তাড়াতাড়ি আসতে যাব কেন? যেমন আসি–

কৌশিক বলেছে, তুমি তো সিঁড়ি ওঠ গুনে গুনে—

কথাটা সত্যি।

কৌশিকের মত কৌস্তুভ কোনদিনই দুটো সিঁড়ি একসঙ্গে টপকে ওঠে না।

 কৌশিকের রাগে রাগ করেনি কৌস্তুভ। হাসেওনি। শুধু বলেছে, তাই-ই এসেছি।

তাহলে চোর সোজা ছাতে উঠেছে—

 কৌস্তুভ বলেছে চোর ফোবিয়া।

 কিন্তু চোর শুনে যার ভয় পাবার কথা, সে ভয় পায় না। শুধু ওদের দুই ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, লোকটাকে কী রকম মনে হল ঠাকুরপো? মেয়ে না পুরুষ?

 কি জানি বাবা! সিঁড়ির ঠিক বাঁকটায় ওঠার সময় একটা পাঞ্জাবির কোণের মত

কী মজা! কী মজা! হঠাৎ হাততালি দিয়ে ওঠে অপর্ণা। নেহাৎ ছেলেমানুষের মত বলে, তাহলে যে করে তোক খুঁজে বার করে ফেল ঠাকুরপো। চোরে চোরে বিয়ে দিয়ে দিই। বাড়িতে যখন এত চোরের আমদানি!

কচি খুকীর মত হাসি কথা আর হাততালি।

কৌশিক অবজ্ঞার হাসি হাসে।

.

একদা যখন অপর্ণার বিয়ে হয়েছিল, এক গা গহনা আর সরস্বতী প্রতিমার মত রূপ নিয়ে ঝলমলিয়ে এসে ঢুকেছিল অপর্ণা এ সংসারে, তখন কৌশিকের কিশোর চিত্ত একেবারে মুগ্ধ হয়ে সেই ঔজ্জ্বল্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল। বৌদির কাছ থেকে নড়তে ইচ্ছে করত না তখন কৌশিকের।

কিন্তু সে ঔজ্জ্বল্য আজ হারিয়ে গেছে।

রক্তমাংসের মানুষটা কাগজের পুতুল হয়ে গেছে, আর বিচ্ছিরি রকমের বোকা হয়ে গেছে। ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠা কৌশিকের তাই বৌদিকে নিতান্ত নাবালিকা বলে করুণা হয়। ওর নিতান্ত ছেলেমানুষের মত কথা শুনে হাসি পায়।

তাই অবজ্ঞার হাসি হাসল কৌশিক।

 কিন্তু কৌশিকের বড় ভাই?

তার মুখটা লাল হয়ে উঠল কেন? বোধ করি অপমানেই। কৌশিকের এই হাসি তত তার চোখে পড়েছে।

অপর্ণা বলল, তোমরা সিনেমা যাচ্ছ শুনলাম।

যাচ্ছিলাম তো। কৌশিক বলে, মার ওই পুষ্যি বোনঝিটিকেও অফার করেছিলাম। কিন্তু সময় নেই তার। কাজের অসুবিধা হয়ে যাবে। মানুষ যে কী করে এত কাজ-পাগলা হতে পারে! বংশী তো প্রায় বেকার হয়ে গেছে আজকাল। সেদিন দেখি, ও বাসন মাজছে। বকতে গেলাম বংশীকে, বংশী উলটে আমাকেই বকে দিল। বলল, শুনবে না, আমার হাত থেকে কাজ কেড়ে নিয়ে নিয়ে সব কাজ করবে। আমি কি করব? আর সত্যি এতও পারে! সব কাজ শেষ করে ফেলে ছাতে উঠে যায়, চাল ডাল বড়ি আচার রোদ্দুরে দিতে।

অপর্ণা বোকার মত বলে, ছাতে? তোমার ঘরের সামনেই তো ছাত? দেখা হয় না তোমার সঙ্গে?

কৌস্তুভ অগ্রাহ্যভরে বলে, গরীব দুঃখীর মেয়ে, খেটে খাওয়াই অভ্যাস–আশ্চয্যি হবার কি আছে?

.

না, তা হয় তো নেই।

কিন্তু আশ্চয্যি হতে হচ্ছে এখন কৌশিককে অপর্ণার উত্তেজনায়।

 তোমরা সিনেমা যাও, আমি আজ রাঁধব।

 ঘোষণা করে অপর্ণা উত্তেজিত মুখে! রক্ত ফুরিয়ে যাওয়া শরীর আরক্ত করে তুলতে পারে না মুখটাকে, শুধু ঘাম গড়িয়ে পড়ে রগের পাশ দিয়ে।

 তুমি রাঁধবে!

কৌশিকও সুদক্ষিণার মতই ভুল করে।

 হা হা করে হেসে ওঠে।

কেন? আমি রাঁধতে জানি না? খাওনি কখনো তোমরা আমার হাতে?

আহা খেয়েছি বৈকি। কিন্তু সে সব তো প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা। এখন তোমার হাতের রান্না খাওয়া মানে তো হত্যাপরাধ। হঠাৎ এ খেয়াল?

অপর্ণা আঁচলটা টেনে গায়ে ঘুরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রুদ্ধ গলায় বলে, কেন, একদিন ইচ্ছে হতে পারে না? যাও, তোমরা ওকে নিয়ে যাও। আমি রাঁধবই।

কৌস্তুভ গম্ভীর ভাবে বলে, পাগলামি কোর না অপর্ণা, শুয়ে পড়ো। বেশী হাসি-ঠাট্টাও তোমার শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর তা জানো তো! শোও, শোও।

না, শোব না।

.

শান্ত অপর্ণা হঠাৎ জেদী হয়ে উঠেছে।

বুঝলাম অপর্ণা অবুঝ হয়ে উঠেছে।

আমি যাচ্ছি।

আঃ অপর্ণা! কি ছেলেমানুষী হচ্ছে?

না, আমি যাব। আমি কাজ করবো।

কৌস্তুভ ধরে ফেলে।

 কৌশিককে ইশারা করে পাখাটা বাড়িয়ে দিতে।

 অপর্ণাকে শুইয়ে দেয়।

 অবশ্য শুইয়ে দেবার দরকার বিশেষ ছিল না। নিজেই শুয়ে পড়েছে সে ঘেমে ঠাণ্ডা হয়ে!

দেখ দিকি, ছি ছি! কী যে পাগলামি করো!

কৌস্তুভ স্ত্রীর হাতের ওপর আস্তে আস্তে হাত বোলায়। নীল নীল শিরা-ওঠা সাদা প্যাকাটির মত হাত।

এই হাতে একগোছা করে চুড়ি পরে থাকে অপর্ণা। হাতের ওই শীর্ণতার দৈন্য যেন আরও বেশী স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাতে।

কৌশিক বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

ভাবে, দাদা যদি মাঝে মাঝে বকত বৌদিকে, তাহলে হয়তো ভদ্রমহিলার কিছুটা উপকারই হত। ভাবে, ওকে একবার সহজ মানুষের মত ছেড়ে দিলে কী হয়? এখানে না থোক, কোথাও চেঞ্জে নিয়ে গিয়ে। হয়তো ওকে সর্বদা ওই তুমি মারা গেলে, মারা গেলে ভাবটা মনে করিয়ে দেওয়াই ওকে মৃত্যুর দিকে খানিকটা এগিয়ে দেওয়া।

কিন্তু কৌশিকের বুদ্ধি নিচ্ছে কে?

মা আর ছেলেতে মিলে–

না, সিনেমা আর যাওয়া হয় না সেদিন সুদক্ষিণার। তার বদলে কৌশিককে যেতে হয়। ডাক্তারকে ডাকতে।

অনবরত ঘেমে ঘেমে ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছিল অপর্ণা।

ডাক্তার আসে। তাই পুরো ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আর পৌঁছয় না।

বয়েস বেশী নয় ডাক্তারের, কিন্তু বিচক্ষণ। ওর বিচক্ষণতার জোরেই তো এযাবৎ টিকে আছে কৌস্তুভ রায়ের স্ত্রী অপর্ণা রায়।

.

উৎসবের দিন ফুরোয়।

আবার সেই বিষণ্ণ আবহাওয়া।

 অপর্ণার ওঠা বারণ।

কৌস্তুভের রোজ অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, সুলক্ষণাকে রোজ দুতিনবার স্নান করতে হচ্ছে।

সুলক্ষণা?

তা সুলক্ষণা ছাড়া আর কে?

নার্স রাখা কি সম্ভব?

বারো মাস তিরিশ দিনের জন্যে?

 কিন্তু চৈতালীর কথা মনে পড়ছে না সুলক্ষণার?

বিনি পয়সায় যে খেতে পাচ্ছে, পরতে পাচ্ছে, থাকতে পাচ্ছে!

 সুলক্ষণার মনে পড়ে না।

মনে পড়ে চৈতালীর নিজেরই।

যখন খেতে বসেছে কৌস্তুভ, সুলক্ষণা কাছে বসে।

 সুলক্ষণা বলেন, কী যে বলিস। তুই আর কত করবি?

আরও অনেক করা যায় মাসীমা। আমার যা কাজ, সে তো তক্ষুনি ফুরিয়ে যায়। সারাদিনই মনে হয় বসে আছি।

তা হোক। রুগীর সেবা কি সোজা নাকি?

সোজা নয় বলেই তো বলছি মাসীমা! শক্ত কাজেই আনন্দ আমার। আমি বৌদির সেবার ভার নেব। দাদা, আপনি বলুন মাকে।

আপনি বলুন!

 দাদা!

কৌস্তুভ চমকে ওঠে। বলে, আমি? কী বলবো আমি?

কী আর! মাকে বোঝাবেন। আমার ওপর যাতে বৌদির ভারটা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্দি হতে পারেন!

সে কি, সে কি? তাই কি সম্ভব?

কেন? অসম্ভব কিসে?

 চৈতালী দৃঢ়স্বরে বলে, বৌদি আমার হাতের সেবা নেবেন না?

কৌস্তুভ আবারও হয়তো সে কি সে কি বলতে যাচ্ছিল, সুলক্ষণা হঠাৎ তাকে অপ্রতিভ করে দিয়ে বলে ওঠেন, না নেওয়াই সম্ভব।

আচ্ছা, নেন কি না নেন, আমি বুঝব।

না না, কৌস্তুভ বলে, সে হয় না।

কেন হয় না, তা তো বলছেন না।

 সে, ও ইয়ে মানে লজ্জা পাবে।

 লজ্জা পাবেন? কেন? আমি যদি বাইরের নার্স হতাম?

সে আলাদা কথা রে চৈতালী– সুলক্ষণা বলেন, ওসব খেয়াল ছাড়।

চৈতালী দৃঢ়স্বরে বলে, মোটেই ছাড়ব না। আপনাকে আর এত খাটতে দেব না। লজ্জা তো আমারও আছে। বেশ তো, মাইনে করা লোককে যদি লজ্জা না হয় তো মাইনেই দেবেন আমাকে। বলেছেন তো প্রথমে।

কথাটা মিথ্যা নয়।

হাতখরচ করিস বলে কিছু টাকা প্রথম দিকে দিতে চেয়েছিলেন সুলক্ষণা, নিতে চায়নি চৈতালী। হাতজোড় করে প্রত্যাখ্যান করেছে। বলেছে, হাতে হাতে তো সবই পাচ্ছি মা, আশার অতিরিক্ত, দরকারের অতিরিক্ত পাচ্ছি। তবে আবার টাকা নিয়ে কি করব আমি?

বাঃ, তোর যদি কিছু ইচ্ছে হয়—

 তোমার কাছে চেয়ে নেব মা। চাইলে দেবে না?

.

সামনে মাসী, আড়ালে মা।

নিভৃত সেবার সময়।

যখন দুপুরে ছেলেমেয়ে বাইরে থাকে সুলক্ষণার, বৌ ঘুমোয়, তখন চৈতালী গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় সুলক্ষণার, চুলের জট ছাড়িয়ে দেয়। সুলক্ষণার ঘর গুছিয়ে দেয়, বিছানা রোদে দেয়।

প্রথম প্রথম অস্বস্তি বোধ করতেন সুলক্ষণা, অনভ্যস্ত চিত্ত কারও কাছে সেবা নিতে সঙ্কুচিত হত, কিন্তু এই নম্র অথচ প্ৰবলা মেয়েটার কাছে হার মানতে হয়েছে সুলক্ষণাকে।

এখন ভাল লাগে।

একটা মানুষ কেবলমাত্র আমার জন্যে নিজেকে দিচ্ছে, দিতে পেরে কৃতার্থ হচ্ছে, এ অনুভূতি, বড় সুখের। তাই ওর হাতে সঁপে দিয়েছেন নিজেকে।

তাই আড়ালে এই সম্বোধনের লুকোচুরি।

আড়ালে মা, তুমি, সামনে মাসীমা, আপনি।

 মা বলে ডাকতে পায়নি কখনো।

এই আকাঙ্ক্ষা সেই অভাবের।

সুলক্ষণা বলেন মাঝে মাঝে, আর অত কষ্ট কেন বাপু? মা-ই বলিস। আর কিছু বলবে না ওরা।

চৈতালী মাথা নীচু করে হেসে বলেছে, না, এই বেশ। এই মজা! আমি যে তোমার চোর মেয়ে! তাই লুকোচুরি!

সুলক্ষণা বলেন, হ্যাঁ সত্যি, সে কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু চোর মেয়ে নয়, চোরের মেয়ে! তাই আমার মত আস্ত একটা মানুষকেই চুরি করে বসে আছিস।

.

এরপর আর মাইনের কথা ওঠেনি।

আজ উঠল।

 চৈতালী নিজেই ওঠাল।

 সুলক্ষণা বললেন, মাইনে নিবি তো?

 নিতেই হবে! চৈতালী কৌস্তুভের আনত মুখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়স্বরে বলে, না নিলে যখন বৌদি আমার হাতের সেবা নেবেন না!

পরাস্ত হলেন সুলক্ষণা।

এত কথা সুদক্ষিণা জানে না।

কৌশিক তো নয়ই।

সুদক্ষিণাই জানতে পেরে জানাল কৌশিককে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ছোড়দা শুনেছিস, চৈতালীকে দিয়ে বৌদির সব কিছু করানো হচ্ছে।

সব কিছু মানে?

সব কিছু মানে সব কিছু। বিছানায় পড়ে থাকার পিরিয়ডে এখন বেডপ্যান পর্যন্ত

ধেৎ!

ধেৎ মানে? নিজের চোখে দেখে এলাম।

মা কি বললেন?

মাকে জিগ্যেস করিনি। দেখেই তাজ্জব হয়ে তোর কাছে ছুটে এসেছি। সত্যি ছি ছি, না হয় একটা বেওয়ারিশ মেয়ে পাওয়া গিয়েছে, তাই বলে এই সমস্ত কাজ

সুদক্ষিণার নিজের মত বয়সের একটা মেয়েকে এ কাজ করতে দেখে ভারী বিচলিত বোধ করছে সুদক্ষিণা।

মা করেন, কিছু মনে আসে না।

মা যেন সব কিছুর ঊর্ধ্বে।

কৌশিক ওর পিঠটা ঠুকে দিয়ে বলে, উত্তেজিত হয়ো না ভগ্নী, এটা ওকে দিয়ে কেউ জোর করে করায় নি। সুযোগও নেয়নি। এ ওর স্বখাত সলিল। নিশ্চয় নিজেই ব্যাকুলতা করেছে, বেডপ্যানটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছে মার সঙ্গে

তুই কি করে বুঝলি?

বুদ্ধির দ্বারা। তোর ঘটে একফোঁটা বুদ্ধি থাকলে তুইও বুঝতিস।

আমি কিন্তু মাকে বলব

কেন মিথ্যে মাথা গরম করছিস?

যা হচ্ছে হতে দে

হ্যাঁ, ওই কথাই বলে কৌশিক।

 ওই বলেই বোনকে প্রবোধ দেয়।

কিন্তু নিজে?

 নিজে জেরার পথ ধরে।

সুবিধেও হয়ে যায়।

দুপুরবেলা কৌশিক যে বাড়ি আছে, জানত না চৈতালী।

নিত্যি যেমন দুপুরে বালতিখানেক কাপড়-চোপড় সাবান কেচে ছাতে মেলে দিতে আসে, তেমনি এসেছিল। নিত্যি যেমন কাজ সেরে নীচে নেমে যাবার সময় কৌশিকের ঘরটায় একবার ঢুকে একটু বসে, একটু গুছিয়ে রেখে চলে যায়, তেমনিই ঢুকেছিল, সেদিন ঢুকেই থতমত খেল।

কিন্তু চট করে চলে যাওয়াও বিপদ। হয়তো বা সন্দেহজনকও। তাই প্রশ্ন করতে হল, এ কী, আপনি এখন ঘরে যে?

কৌশিক ইজিচেয়ারে শুয়ে পা দোলাচ্ছিল, উঠে বসল।

গম্ভীর ভাবে বলল, আমিও প্রশ্ন করতে পারি, এ কী তুমি এখন এ ঘরে যে?

চৈতালী চারদিকে চেয়ে দেখে।

রোদে ঝাঁ ঝাঁ স্তব্ধ দুপুর, ছাতের একধারের একখানা মাত্র ঘর, তিনদিকের রোদ পেয়ে যেন ভাজা ভাজা হচ্ছে। অথচ কৌশিক নির্বিকার চিত্তে বসে আছে মাথার ওপরকার পাখাটা পর্যন্ত না খুলে।

প্রথমেই পাখাটা খুলে দেয় চৈতালী।

 যতটা ঠেলে দেওয়া যায় পয়েন্টটা দেয়।

হয়তো কিছু একটা করে আড়ষ্টতা কাটাবার জন্যেই এই কাজটা করা। হয়তো বা করে ওই আত্মভোলা ছেলেটার ওপর মমতার বশেই।

খুলে দিয়ে নিত্য অভ্যাসমত টেবিলের অগোছালো বইগুলো গোছাতে গোছাতে বলে, আমি তো এ সময় রোজই আসি।

কৌশিক আরও গম্ভীরের ভান করে।

 বলে, কেন? এ ঘরে কী কাজ? কি জন্যে আসো?

 চৈতালী ফিরে দাঁড়ায়।

 হঠাৎ অন্য এক চোখে চায়, অন্য এক সুরে কথা বলে ওঠে, যদি বলি চুরি করতে আসি!

.

এই স্তব্ধ দুপুরের পটভূমিকায়, যখন দূরে কোথায় যেন একটা ঘুঘু পাখির ডাক ছাড়া কোথাও কোন শব্দ নেই, তখন এই অন্য চাওয়া, অন্য সুর কৌশিককে বুঝি একটু কাঁপিয়ে দেয়, একটু বুঝি অস্বস্তিতেও ফেলে, তবু সামলে নিতে জানে সে।

তাই হেসে উঠে বলে, দ্যাটস্ রাইট। তাই আমি কিছুদিন থেকে কোন কিছু যেন খুঁজে পাচ্ছি না। সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে।

কী কী হারিয়েছে?

 লিস্ট করে রাখিনি। তবে মনে হচ্ছে যে বেশ অনেক।

দুই হাত বিস্তারিত করে মাপটা দেখায় কৌশিক।

চৈতালী তেমনি এক সুরে বলে, লিস্ট করে রাখবেন, পুলিসে ডায়েরী করার সময় কাজে লাগবে।

তাই রাখব ভাবছি।

আমি কিছু ভাবছেন না?

আর কি?

ভাবছেন না–এই জন্যেই বলে, স্বভাব যায় না মলে! এত পাচ্ছে চোরটা, তবু মাঝদুপুরে চুপি চুপি এসে আমার ঘর খুলে চুরি করতে আসে!

তাও ভাবছি হয়তো কৌশিকও যেন আর এক চোখে চায়।

 নাকি চায় না?

ও শুধু চৈতালীর চোখের ভ্রম!

কৌশিকের চোখের দৃষ্টি কোনদিন শরীরী হয়ে এসে আক্রমণ করে না। আগুনের তাপের মত জ্বালা ধরায় না। মুছলেও মুছতে চায় না, এমন ভাবে গায়ে লেগে থাকে না।

ওর চোখ আলোর মত।

আয়নার মত।

দীঘির জলের মত।

কৌশিক বলে, সে অপরাধের বিচার হবে।

 কোথায়?

 এই এখানেই। এটাই কোর্ট। আর এই মান্যগণ্য ব্যক্তিটিই জজ!

আমার কাজ আছে। নীচে যাচ্ছি।

নো নো, আগে বিচারটা হয়ে যাক।

 এভাবে দুপুরবেলা বসে বসে আপনার সঙ্গে গল্প করলে লোকে কি বলবে?

কী আবার বলবে? কৌশিক ভুরু কুঁচকে বলে, এটা গল্প নয়, কাজের কথা হচ্ছে। বলছি–এটা কী হচ্ছে?

কোনটা?

এই একাধারে রাঁধুনী চাকরানী খোবানী ঝাড়দারনী মেথরানী, সব কিছুর পার্ট প্লে করে চলা! মানে হয় এর?

চৈতালী হেসে ওঠে, নাম করে করে বললেই অনেক। আমার তো কিছুই কষ্ট হয় না। গায়েই লাগে না।

বাহাদুরি নেবার জন্যে অনেকে পিঠে হাতি তোলে, তাতেও তাদের গায়ে লাগে না।

 বাহাদুরি নেবার জন্যে?

তবে আবার কি?

যদি বলি আমার ভাল লাগে?

তামা-তুলসী-গঙ্গাজল হাতে করে এসে বললেও বিশ্বাস করব না।

কেন, কেউ কি কাজ করতে ভালবাসে না?

বাসে। বাসতে পারে। কিন্তু শ্রীমতী অপর্ণা রায়ের সেবার ভার কেউ ভালবেসে কাঁধে তুলে নেয়, এ আমাকে কেটে ফেললেও বিশ্বাস করব না।

আর মার বুঝি কষ্ট হয় না?

ক্ষুব্ধস্বরে বলে ওঠে চৈতালী।

 মা!

মাসীমা, মাসীমা! আপনাদের মা। তাকেই তো ওই সব কিছু

সেটা মার অভ্যাস হয়ে গেছে।

 আমারও হবে।

কৌশিকের তরল কণ্ঠে একটু বুঝি গভীরতার স্পর্শ লাগে। সে ম্লান হেসে বলে, তা হয়তো হবে। কিন্তু মার হল, নিজের ছেলের রুগ্ন বৌ। মার কথা আলাদা। কিন্তু তুমি করবে কোন্ প্রেরণায়? দৈনিক কমণ চালের ভাত খাও যে সেই ভাতের দাম আর উসুল হচ্ছে না!

চৈতালী চোখ তুলে বলে, শুধু ভাতের দাম? সেই ঋণ শোধ করছি আমি?

কৌশিক হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।

ওই নির্ভীক স্পষ্ট চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে এক পলক। তারপর স্তব্ধতা ভেঙে বলে, ভাতের ছাড়া আর যদি কোন ঋণ থাকে, সে কি শোধ দেবার?

আমি যাই!

যাবে। তার আগে শোনো, এভাবে পাগলের মত আত্মপীড়নের কোন মানে হয় না।

 যদি বলি আত্মপীড়ন নয়, আত্মনিবেদন!

কৌশিক আর একবার স্তব্ধ হয়।

তারপর বলে, অপর্ণা রায়ের কাছে অন্তত সে নিবেদন না করলেও চলে।

বিশেষ করে কারও কাছেই নয়। ধরুন শুধু এই সংসারের কাছেই।

তোমার হিসেবের সঙ্গে আমার হিসেব মেলে না– কৌশিক বলে, বংশীকে বসিয়ে রেখে? তার কাজগুলো পর্যন্ত করার প্রয়োজনীয়তা কিছুতেই স্বীকার করানো যাবে না আমাকে।

চৈতালী টেবিলের ওপরটা আঁচল দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে মুখ না ফিরিয়ে বলে, বসে থাকলেই আমার হাত-পায়ের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি হতে থাকে, হয়তো চোরের রক্ত বলেই–

চৈতালী!

চৈতালী চুপ।

চৈতালী, শোনো। এইটুকু শুধু বলে রাখি, এ সংসারে তোমার পোেস্ট কেবলমাত্র দয়ার আশ্রয়ের আশ্রিতার নয়।

এত ভয় দেখাবেন না!

ভয়?

হ্যাঁ, ভয়! ভয়ানক ভয়! আমার এই নতুন জীবনটুকু মুছে যাবার ভয়, এই আশ্রয়ের বাসাটি ভেঙে যাবার ভয়। মার মুখোমুখি দাঁড়ানোর ভয়

হঠাৎ সমস্ত শরীরে একটা মোচড় দিয়ে ছুটে নীচে নেমে যায় চৈতালী।

আর কৌশিক ভাবে, মানুষ কি নিজেই নিজের কর্তা? নিজের ওপর কি কন্ট্রোল রাখতে পারে মানুষ?

এই মুহূর্তে যে সব কথা হয়ে গেল এখানে, তার সম্পর্কে কি এক বিন্দুও ধারণা ছিল কৌশিকের? ও কি ভেবেছিল এই সব কথা বলবে? শুধু আলটু-বালটু কতকগুলো কাজ করার জন্যে বকবে বলেই তো দাঁড় করিয়েছিল চৈতালীকে।

তারপর ভাবল, বিচলিত হচ্ছি কেন?

তা ছাড়া আর কী-ই বা বলেছি? কথার পিঠে কথা পড়ে যে ধারায় চলে গেছে, সেই ধারায় কথাকে ঠেলে দিয়েছি বৈ তো না। ওতে ভাববার কিছু নেই।

ভাবল ভাববার নেই, তবু ভাবতে লাগল।

 প্রথম থেকে পর পর কী কথা হল ভাবতে লাগল।

ভাবতে লাগল প্রতিদিন দুপুরে এ ঘরে আসে চৈতালী, আশ্চর্য!

অনেক কিছু ভাবার পর হঠাৎ সচেতন হয়ে ভাবতে চেষ্টা করল, চৈতালী এ বাড়িতে ঢুকেছিল বাসন চুরি করতে!

ভাবতে পারল না।

বার বার খেই হারিয়ে গেল সেদিনের কথা, ঝাপসা হয়ে গেল সে-দিনের ছবি।

.

ফুলের মত সুরভিত, পালকের মত হালকা অথচ ভয়ানক একটা ভয় পাওয়ার মত দুরুদুরু মন নিয়ে ছাত থেকে নেমে এসেছিল চৈতালী। এসেই থমকে গেল। অপর্ণার ঘরে সুলক্ষণা।

ব্যস্ত হয়ে একখানা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করছেন বৌকে।

চৈতালী এসে দাঁড়াতেই ঈষৎ কঠিন সুরে বলেন, ভার যদি নিতে পারবি না তো সাহস করেছিলি কেন?

মূক চৈতালী অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে তার চোখ বোজা, চোখের কোণে জল।

ডেকে ডেকে নাকি পায়নি তোকে! ছিলি কোথায়?

ছাতে।

 ছাতে? আবার আজ গুচ্ছির সাবান কেচেছিস বুঝি?

চৈতালী মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে।

আর বন্ধ চোখ আস্তে খুলে, অপরিসীম ক্লান্ত সুরে অপর্ণা বলে, ঠাকুরপোর আজ ছুটি না?

সুলক্ষণার ঘরের পাশে একটা ঘর আছে, ছোট্ট এক ফালি, ট্রাঙ্ক বাক্স রাখবার, কাপড় ছাড়বার। সুলক্ষণার সুবিধের কথা ভেবেই যখন বাড়ি তৈরী হয়েছিল, তখন সুলক্ষণাই এ বাড়ির প্রধান ছিলেন। তখন কিসে সুলক্ষণার সুবিধে হবে, সেটাই চিন্তা ছিল সংসারের সমস্ত সদস্য কটির। তখন অপর্ণা শুধু বৌ!

শান্ত নম্র মিষ্ট হাস্যমুখী বৌমা মাত্র।

 তার জন্যে ভাল শাড়ী দামী গহনা ছাড়া আর কিছু ভাবা হত না।

কিন্তু কখন কোন্ ফাঁকে অপর্ণাই কেন্দ্রে এসে গেছে। সুলক্ষণা সরে গেছেন কেন্দ্র থেকে। এখন শুধু অপর্ণার সুবিধে ভাবা হয়। শুধু সুলক্ষণার ঘরের পাশের এই ফালি ঘরটা ওঁর সেই সব দিনের সাক্ষ্য দেয়। সে বলে, এক সময় ওঁর সুবিধের জন্যে অনেক ভাবা হত।

কিন্তু সুলক্ষণাই সেই স্মৃতিটুকু মুছে ফেলেছেন। সেই ঘরটার দখল ছেড়ে দিয়েছেন। সেখানে চৈতালীকে জায়গা দিয়েছেন। এটা এখন চৈতালীর ঘর।

নিজের ঘর।

সেই ঘরে এসে জানলার কাছে দাঁড়াল চৈতালী।

এ জানলা রাস্তার ওপর নয়, বাড়িরই পাশের গলির ধারে।

 তবু দাঁড়াল।

 ভাবল, আমি কি চলে যাব?

তারপর দেখল কখন যেন চারটে বেজে গেছে, উনুনে আগুন দিয়েছে বংশী। নেমে এল আস্তে আস্তে।

.

কিন্তু আগুন কি শুধু উনুনেই?

 মানুষের হাতের তালুতেও আগুন থাকে না কি? আঙুলের ডগায়?

সেই উত্তপ্ত আগুন-ভরা হাতে যদি কেউ কারও কবজি চেপে ধরে, জ্বলে যায় না সেখানটা? ফোঁসকা পড়ে যায় না?

হাতটা ছাড়িয়ে নেবার ব্যর্থ চেষ্টায় ঘেমে উঠে হাতের অধিকারিণী রুদ্ধকণ্ঠে বলে, ছাড়ুন!

 না ছাড়ব না! আগে কথা দাও, অপর্ণার ঘরে আর যাবে না তুমি?

 কেন?

সে প্রশ্ন থাক না।

বিনা যুক্তিতে শুনব কেন কোন কথা?

ওকে সেবা করতে যাবারই বা কী দরকার তোমার?

ধরুন টাকার জন্যে। বিনি মাইনের কাজ করছি আপনাদের বাড়ি, ভাবলাম বড়লোকের স্ত্রীর নার্সিং করে যদি ভাল মাইনে পাওয়া যায়?

বিশ্বাস করি না।

অবিশ্বাসের কী আছে, আমি গরীব, আমি চোর।

 তবু বিশ্বাস করব না।

হাত ছাড়ুন!

না।

যদি চেঁচাই?

 পারবে না।

কী করে জানলেন?

 জানি। এ আশ্রয় ভেঙে যাবার ভয়ে সব সয়ে চুপ করে থাকবে তুমি!

যদি মাকে বলে দিই?

পারবে না। কারণ জানো মা বিশ্বাস করবেন না। আমি জানতে চাই, তুমি কেন হঠাৎ অপর্ণার সেবা করবার জন্যে ব্যাকুল হলে?

যদি বলি, ওই ঘরের আশ্রয়টাই নিরাপদ মনে হয়েছিল!

কী? কী বললে?

হ্যাঁ, তাই! ভেবেছিলাম কান যে কথা বিশ্বাস করবে না, সে কথা প্রমাণিত করার একমাত্র উপায় চোখ! অহরহ ওই চোখের পাহারায় থাকতে পেলে–

চুপ, চুপ করো।

আমি বলতে চাইনি।

 কুশীর সঙ্গে তোমার কিসের এত গল্প?

 জিগ্যেস করে উত্তর আদায় করবেন?

না, জিগ্যেস করব না। জিগ্যেস না করেই বুঝতে পেরেছি। জানো, একথা যদি মার কানে ওঠে—

জানি উঠবে না। ওঠাতে পারবেন না। আপনি বেশ ভাল রকমই জানেন, তাতে আমার এ বাড়ির আশ্রয় যেতে পারে। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর তত পেলেন, এবার হাত ছাড়ুন! কবজিটা ভেঙে যাবে।

অপর্ণার ঘরে আর ঢুকবে না নিশ্চয়?

কথা দিতে পারছি না।

তোমার কাছে হাতজোড় করছি।

ওই তো কাগজের পুতুল, ওকে আপনার এত ভয় কেন?

ভয় কেন? আশ্চর্য! এটা একটা প্রশ্ন? শোনো, তুমি এসে পর্যন্ত সমস্ত সংসার জটিল হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে আরও কিছু যেন আসছে। ভয়ানক কোন বিপদ..ভীষণ কোন ঝড়…

তবে আমাকে চলে যেতে দিন।

না না! তা হয় না। শুধু তোমায় মিনতি করছি—

আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে, কি জবাব দেব?

জবাব আমি দেব। বলব, অপর্ণা পছন্দ করে না, অপর্ণা বিরক্ত হয়।

কিন্তু সেটা তো বানানো কথা! উনি তো খুব পছন্দ করছিলেন আমাকে। ডেকে সাড়া না পেলেই বরং বিরক্ত হন। যদি ডাকেন? তাহলে?

জানি না, তাহলে কি! কিন্তু আমি বলছি, খুব একটা ভয়ঙ্কর পথ বেছে নিয়েছ তুমি। এ পথে বিপদ আসতে পারে, মৃত্যু আসতে পারে। খুব সাবধান!

অথচ আপনি সাবধান হলে সবই সহজ হয়ে যায়।

আমি? আমি কি সাবধান হই না? হচ্ছি না? কিন্তু রক্তমাংসের তৈরী মানুষ আর কত বেশী সাবধান হতে পারে বলতে পারো?

.

জানলার ধারে গিয়ে হাতটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল চৈতালী।

না, ফোসকা পড়েনি, শুধু রক্ত জমে গিয়ে কালশিটে পড়ে গেছে, শুধু আগুনের ফুলকির মত যেন একটা দাহ উঠছে ভেতর থেকে।

কি হল? হাতে কি হল?

ক্ষেণু এসে হাতের বইগুলো দুদ্দাড় করে নামাল।

আর হঠাৎ রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে উঠল চৈতালীর। সবাই সুখী থাকতে পারে, সবাই নিশ্চিন্ত। শুধু পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা, সমস্ত ভয় জমানো আছে চৈতালীর জন্যে।

শুধু একটি ভদ্র আশ্রয়, শুধু একটু মাতৃস্নেহ, শুধু একখানি সংসারের পরিবেশ, এই তো রাজার ঐশ্বর্য হয়েছিল চৈতালীর, এতেই তো সে ধন্য হয়ে গিয়েছিল, সেই পাওয়াটুকু নিয়েই সমস্ত জীবন কাটিয়ে দিতে পারত, কিন্তু চৈতালীর ভাগ্যের শনি সেটুকুকে তিষ্ঠোতে দিল না। আনলো ঘূর্ণিঝড়!

সে ঝড় একদিকে যেমন সারাজীবনের দুঃসহ গুমোট কাটিয়ে দিয়ে আনল উদার আকাশের • খোলা হাওয়া, তেমনি আনল ধুলো বালি শুকনো পাতা। সে বালি চোখে ঝাঁপটা মারছে, সমস্ত আলো থেকে আড়াল করে ধরছে।

কই কি হল বললে না? হাত পোড়ালে বুঝি?

রাগকে লাগামে কষে আটকাতে হবে।

চৈতালী কেমন একরকম হেসে বলে, হ্যাঁ।

তা তো পুড়বেই। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কাজ নিজের ঘাড়ে তুলে নিতে গেলেই কাটে, ঘেঁড়ে, পোড়ে। ওষুধ লাগিয়েছ কিছু?

নাঃ! লাগাতে কিছু হবে না।

না না, অবহেলা করা ঠিক নয়। তিল থেকেই তাল হয়– সুদক্ষিণা বলে ওঠে, যাক আজকের কী খাবার বল? খিদেয় তো নিজেকেই নিজে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে।

.

চৈতালীর মনে পড়ে, ছোলার ডাল সেদ্ধ করে বেটে রেখেছিল আজ, ডালপুরী করে দেবে বলে। নিরামিষ খাবার করলে সুলক্ষণারও খাওয়া হয়, তাই রোজ বিকেলেই দেশী খাবার বানায় চৈতালী।

সুলক্ষণা বলেন, ছিলি তো একটা বাউণ্ডুলে বাপের কাছে, এত সব শিখলি কোথায়?

চৈতালী হাসে। বলে, এমনি।

কিন্তু এমনি নয়, কিছুদিন তার বাবা একটা খাবারের দোকানের ভেতরদিকের একটা ঘরের ভাড়াটে ছিল। সে ঘরের সামনেই সর্বদা দোকানের যাবতীয় রসদ প্রস্তুত হত।

বড় বড় তেলজবজবে বারকোশে রাশি রাশি ময়দা, বড় বড় গামলায় শিঙাড়ার পুর, বড় বড় পরাতে কচুরির ভাজি, ডালপুরীর পুর, সব বসানো থাকত ওদের ঘরের সামনের ঘরটায়।

খাবারওলা বলেছিল ওর কারিগরদের একজন দেশে গেছে, চৈতালীরা বাপ-বেটিতে যদি

তা সেই সময় অনেক কাজ শিখে ফেলেছে চৈতালী। কিন্তু সে কথা বলা যায় না। বলতেই হয়, কি জানি, এমনি!

সুদক্ষিণাকে বলল চৈতালী, তুমি যাও ওপরে, হাত মুখ ধুয়ে আসতে আসতে হয়ে যাবে।

তার মানে হয়নি!

তা তো হয়নি। চৈতালীর অনেক খানিকটা সময় যে হরণ করে নিয়ে গেল এক দস্যু।

আর শুধুই কি সময় হরণ করল?

হয়ে যাবে!

সুদক্ষিণা বলে, আহা থাক না তবে বাবা। ওই হাত-টাত পুড়িয়েছ! আগে তো রোজ এসে। টোস্ট খেতাম, তাই খাওয়া যাবে। চল চল, বরং একটা মজার কথা আছে–

মজার কথা?

 হ্যাঁ ভারী মজার! ছোড়দা এলেই বলব ভাবছিলাম।

বাড়িতেই তো আছেন এখন ছোড়দা!

বাড়িতে? এ সময়? এত সুমতি? তাহলে তো আজ একটু সিনেমাতেও যাওয়া যায়। সেদিন তত বৌদি মার্ডার কেস করে ছাড়ল।

ছোড়দা, ছোড়দা! ডাকতে ডাকতে দুমদাম করে ওপরে উঠে গেল সুদক্ষিণা।

.

এ শব্দ অপর্ণার বুকে গিয়ে হামানদিস্তার ঘা দিল।

অপর্ণা ক্ষীণ গলায় বলল, দরজাটা বন্ধ করে দেবে? তবু একটু

কৌস্তুভ উঠে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আসে।

অপর্ণা বলে, অত দূরে বসছ কেন?

দূরে কোথা? এই তো কাছে।

 বিছানায় উঠে এসে বসে কৌস্তুভ।

অপর্ণা একটু নিঃশ্বাস ফেলে বলে, জীবনে আমার বড় ঘেন্না ধরে গেছে।

কৌস্তুভ আস্তে ওর গায়ে হাত রেখে কাতর গলায় বলে, এসব কথা বললে আমি কত কষ্ট পাই বোঝো না কেন অপু?

না, তাই বলছি। যদি সেকাল হত, বেশ সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী একটি মেয়ে দেখে আর একটা বিয়ে দিয়ে দিতাম তোমার।

কৌস্তুভ ওর গালের হাড়ে একটু টোকার মত দিয়ে বলে, সেকালে জন্মাইনি বলে আপসোস হচ্ছে আমার।

অপর্ণা একটু চুপ করে থেকে বলে, মার ওই পুষ্যি মেয়েটার খুব স্বাস্থ্য।

অপর্ণার দেহের মধ্যে নতুন রক্ত আর তৈরী হয় না বলেই কি স্মৃতিশক্তি অত কমে গেছে অপর্ণার? .

একশোবার শুনেও চৈতালী নামটা মুখস্থ করতে পারে না? বলে, মার পুষ্যি মেয়ে!

কৌস্তুভ চকিত হয়ে বলে, কে? কার কথা হচ্ছে?

ওই যে তোমাদের বাড়ির রাঁধুনী। যখন এসেছিল কী রোগা, কী নোগা! আর এই কমাসেই দেখ চেহারা। গা দিয়ে তেল পিছলে পড়ছে। একটা জোয়ান মেয়ের চেহারা যেমন হওয়া উচিত, ঠিক তেমনি।

কথা বলে আর স্বামীর মুখের দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকে অপর্ণা!

কী দেখছ?

 তোমায়।

কখনো দেখনি বুঝি?

কই আর দেখলাম!

থাক, আর দেখতে হবে না। ওষুধটা খেয়ে ফেল।

ওষুধটা ঢালতে ঢালতে ভাবে কৌস্তুভ, রক্তশূন্যতা শুনে শুনে কান পচে গেল। এত রক্ত শুষেও কোন উন্নতি হচ্ছে না।

আশ্চর্য!

 ওষুধ খেতে চায় না অপর্ণা, ভুলিয়ে ভালিয়ে প্রতিবার খাওয়াতে হয়।

সে পর্ব মিটলে, অপর্ণা আস্তে থেমে থেমে বলে, ওকে একবার ডাক না?

কাকে? শঙ্কিত চোখে চায় কৌস্তুভ।

ওই যে ওই চৈতালীকে।

না, নামটা বিস্মৃত হয়নি তাহলে।

কৌস্তুভ শান্ত গলায় বলে, ওকে কেন?

বিছানাটা একটু ঝেড়ে দেবে

কী আশ্চর্য! এটুকুর জন্যে লোক ডাকতে হবে? আমি দিচ্ছি

না, আরো কাজ আছে। ডাক না।

কৌস্তুভ উঠে দাঁড়ায়। টেবিলে রাখা ওষুধের শিশিগুলোর দিকে তাকায় একবার। তাকায় দেরাজের ওপর আর আর্শির সামনে। সর্বত্রই শিশি। শুধু শিশিই নয়, নানারকম শিশি কৌটো টিউব।

সেইগুলোর দিকে তাকিয়ে যেন নাম পড়ে নিতে চায় কৌস্তুভ। যেন ওই নামগুলোর মধ্যে ওর ভয়ানক দরকারী একটা কিছু লুকোনো আছে।

তারপর বেরিয়ে ডাকে, বংশী!

বংশীকে কেন?

ও ডেকে দেবে।

কেন? তুমি ডাকতে পার না? ডাক না?

আমার ডাকার কী দরকার?

বাঃ, রোজ ভাত খাও ওর কাছে

বেশী কথা বলা হয়ে যাচ্ছে। একটু চুপ কর। দরকারী কথা ছাড়া আর কিছু বলা বারণ, মনে নেই?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *