২. চুলের মুঠি

সুমনা যখন ঘরের অন্য কাজ করে, তখন অজীন চিৎকার করে ওঠে, ও দিদি দিদি, নিজের চুলের মুঠি নিজে ধরছে! ও দিদি, নিজে নিজে কান মলছে!

সুমনা এসে হেসে হাত ছাড়িয়ে নেয়। জানে, এক্ষুনি কেঁদে উঠবে।

 ওরকম করে কেন দিদি?

সুমনা হেসে বলে, বোধহয় নিজেকে নিজে শাস্তি দেয়। বলে,ওরে বোকা গাধা ছেলে কেন তুই তবুও বেঁচে থাকলি! কেন বাঘের পেটে শেয়ালের পেটে গেলি না।

যাঃ ও বুঝি কিছু বুঝতে পারে?

পারে। সব পারে। ছোট্ট বাচ্চারা যে ভগবান, জানিস না?

ভগবান!

ছোট্ট বাচ্চারা ভগবান!

অজীন খেলতে চলে যাবার পর সেদিন সুমনা ভেবেছিল, জগতে কত ছোঁদো কথাই না চলে আসছে।

কথার সেই অদ্ভুত অসার ছেঁদোত্ব নিয়ে কেউ কোনওদিন হাসাহাসি করে না। বলে না, হায় শিশুরূপী ভগবান! মানুষের দেওয়া সামান্য একটু পরিচয়পত্রের অভাবে তো তোমার ভগবানত্বের রসাতল প্রাপ্তি।

আজ সুজাতা কেঁদে চলে যাবার পর আর একবার ভাবল সুমনা, স্নেহ ভালবাসা বিশ্বাস! এ শব্দগুলোও তা হলে কত হেঁদো!

সুমনা!

যে নাকি এ বাড়ির সবচেয়ে আদরের আর সবচেয়ে গৌরবের মেয়ে!

রূপে গুণে বিদ্যায় হৃদয়বত্তায় যার নাকি জুড়ি খুঁজে পেতেন না জেঠিমা জেঠামশাই ঠাকুমা কাকা!

মুহূর্ত দ্বিধা হল না তাঁদের সুমনা সম্পর্কে এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে।

 সম্ভাব্য অসম্ভাব্য যৌক্তিক অযৌক্তিকতারও বিচার মাত্র নেই, সুমনা যে ওঁদের একটা পৈশাচিক উল্লাসের জোগান দিতে পেরেছে এটাই পরম লাভ।

তা লাভ বইকী! পৈশাচিক আনন্দ উপভোগের সুযোগ কবেই বা আসে মানুষের।

ভিতরের পিশাচ সত্তা তো উপবাসী হয়ে পড়ে থাকে। তাই না সুযোগ পেলে তার একটি কণাও ছাড়তে চায় না মানুষ।

অথচ ইচ্ছে করলেই ওরা উদার হতে পারত, সহজ হতে পারত, এই ছোট্ট খেলনাটা নিয়ে কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ি করে বাইরের আরও পাঁচজনের কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই হালকা করে ফেলতে পারত।

সুমনার এই কুড়োনো ছেলেটা একমাত্র সুমনারই সম্পত্তি হয়ে থেকে সংসারে একটা পাষাণভারের সৃষ্টি করত না।

ওরা তখন এই নামহীনের একটা নাম দিত।

আর কৌতুক করে বলত সুমনার ছেলে। যেমন বলত ছেলেবেলায়, সুমনার ডল পুতুলটাকে।

কিন্তু না! সহজ কৌতুকে তেমন আনন্দ নেই লোকের, যেমন আনন্দ নিষ্ঠুর কৌতুকে।

.

চিন্তায় ছেদ পড়ল।

ঘরে ঢুকলেন কান্তিকুমার।

আদৌ যিনি আর ঢোকেন না এ ঘরে। তাকিয়ে দেখলেন, সুমনা নিবিষ্ট হয়ে কী একটা সেলাই করছে।

বাবাকে দেখে হাতের জিনিসটা রেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। হয়তো বা ইচ্ছে করেই তাকে একটু আড়াল করে দাঁড়াল, যাকে জগতের চোখ থেকে আড়াল করে রেখেছে নিজের সমস্ত প্রাণটুকু দিয়ে।

হাতের সেলাইটাকে কিন্তু আড়াল করতে পারল না। তাকিয়ে দেখলেন কান্তিকুমার।

কী ও?

সুনিপুণ এম্ব্রয়ডারির কাজের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে পড়ে আছে।

কাঁথা নাকি! তাই! তাই নিশ্চয়।

 হতাশ দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকান কান্তিকুমার।

কিন্তু শুধু কি ওর ওই নির্বুদ্ধিতার প্রমাণটুকুকেই আড়াল করেছে সুমনা? আড়াল করেনি নিজেকে?

সুমনার ওই দৃঢ় কঠিন মুখের রেখার অন্তরালে সেই সুমনাকে কি আর কোনওদিন খুঁজে পাওয়া যাবে? যাকে কান্তিকুমার ঘরে এসেই বলতে পারতেন, আঃ ঘাড় পিঠে ব্যথা করে কী হচ্ছে ওসব? সবে এই একটু সেরেছিস। যাকে আগে আগে বলতেন, সুমি, তুই নাকি ফলের রস খেতে চাস না?…সুমি তুই এই ঠাণ্ডার সময় পাতলা জামা গায়ে দিয়ে বেড়াচ্ছিস যে!..

না, সে সুমনা ঢাকা পড়ে গেছে ওই কঠিন রেখাগুলোর অন্তরালে।

কষ্টে নিশ্বাসের গভীর শব্দটা চেপে কান্তিকুমার বলেন,তোমার আজ রেজাল্ট বেরোবার দিন, মনে নেই বোধহয়।

রেজাল্ট বেরোবার দিন!

এ ভাষা এখনও আছে জগতে।

সমস্ত চেতনার মধ্যে ভয়ানক একটা আলোড়ন ওঠে। বাবার নিষ্ঠুরতায় মাথার মধ্যে যেন ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে।

জানত না। মনে ছিল না।

 তবু কষ্টে ঘাড় নাড়ে।

মনে আছে? যাক তবুও ভাল। বেলা চারটেয় টাঙিয়ে দেবে শুনছি। আমি তা হলে কোর্ট থেকে একটু সকাল সকাল আসছি–

হঠাৎ গলাটা ঝেড়ে পরিষ্কার গলায় বলে ওঠে সুমনা, তুমিই তো দেখে আসতে পারো বাবা!

আমি! আমি দেখে আসতে পারি। হ্যাঁ, পারব না কেন? দেখে আসব। তুমিই তা হলে পারছ না!

কী করে পারব? সুমনা ঘাড়টা ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,ওকে কি কেউ দেখে?

না দেখাই স্বাভাবিক। তুমি তো কাউকে বিশ্বাস করো না।

বাবা!

বলো।

 চেতনায় সেই ক্ষণপূর্বের আলোড়ন এখনও রয়েছে। কলেজ, সহপাঠিনীরা, বাইরের পৃথিবী!…ঝলসে উঠছে চোখের সামনে! তবু গলা কাঁপতে দেবে না সুমনা।

বাবা, বিশ্বাস করবার আশ্বাস কি কেউ আমাকে দিয়েছে?

সুমনা! তুমি একটা ছোট জিনিস নিয়ে এত বেশি বাড়ালে যে, লোকে দিশেহারা হয়ে গেছে; আমি ভাবতে পারছি না সুমনা, তুমি তোমার সমস্ত কেরিয়ারকে নষ্ট করে, ক্রমশ ফসিল হতে থাকবে ওই জীবটার জন্যে! বাইরে বেরোনো তো দূরের কথা, ঘর থেকে বেরোনো পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছ। এ বাড়িতে কারও সঙ্গে যে তোমার কোনও সম্বন্ধ কখনও ছিল, মনে হয়, তা ভুলে গেছ। রেজাল্ট বেরোবার পর যে আর কোনও করণীয় আছে ভাবছও না সে কথা

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার কথা বলছ?

বলছি না কিছু। সেই রকম একটা কথা ছিল, সেইটুকুই মনে পড়িয়ে দিচ্ছি।

বাবা! আবার খাটের ওপর বসে পড়ে সুমনা। মুখে হাতচাপা দিয়ে বলে,তুমি আমাকে তাড়িয়েই দাও। আমি আর এই স্নেহহীন বাড়িতে থাকতে পারছি না।

কাঠিন্যের আড়ালে আজও তা হলে আছে সুমনা?

কান্তিকুমার কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে বলেন,স্নেহ তো তুমি নিজেই ইচ্ছে করে ফেলে দিচ্ছ সুমনা। শুনলাম তুমি শিমুলতলা থেকে এসে অবধি কারও সঙ্গে দেখা করোনি, প্রণাম করোনি, ভালভাবে কথা বলোনি। কেউ কথা বলতে এলে উদ্ধত ভাবে কথা বলেছ

কেউ তো আমার সঙ্গে বলতে আসছে না বাবা, আসছে উপদেশ দিতে।

তা তাতেই বা তুমি অসহিষ্ণু হচ্ছ কেন? তাঁরা তোমার কল্যাণকামী।

হ্যাঁ। দৃশ্যত তাই বটে।

বেশ তো, অদৃশ্য লোকের কথাটা নাই ভাবলে। গুরুজনের কথা ভাবে নেওয়াই তো ভাল। আগে তো কখনও তোমাকে এসব শিক্ষা দিতে হয়নি সুমনা! তোমার বুদ্ধিতে কী এসে আশ্রয় করল! হতাশ-নিশ্বাসের শব্দকে আর গোপন করতে পারেন না কান্তিকুমার।

সুমনা কী উত্তর দিত কে জানে!

ঠিক এই মুহূর্তে ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল ছেলেটা।

পরিত্রাহি কান্না।

যে কান্নাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির লোকের কান আড়াল করে রাখবার চেষ্টা করে সুমনা।

কান্তিকুমার উঠে দাঁড়ান।

বলেন, তা হলে তোমার আর রেজাল্টের জন্যে যাবার সুবিধে হচ্ছে না?

সেই কান্নার দরজায় একটা হাত চাপা দিয়ে রেখে সুমনা বলে, না, যাব।

আচ্ছা!

বাবা!

কান্তিকুমার চলে যাচ্ছেন।

সুমনার ডাকটা পিছনে আছড়ে পড়ে।

ফিরে তাকান কান্তিকুমার।

তাকান প্রত্যাশার পাত্র হাতে। ভাবেন, হয়তো এই মুহূর্তে বলে উঠবে সুমনা, বাবা তুমি যা ভাল বোঝ করো।

কিন্তু না।

তা বলে না সুমনা। শুধু বলে, তুমি মাকে বোলো তখন এ-ঘরে একটু থাকতে।

ছেলেটাকে কোলে করে ভোলাতে ভোলাতেই বলছে সুমনা।

কান্তিকুমার একটু চুপ করে থেকে বলেন,বেশ। বলে দিচ্ছি। তোমার মার কাছে এটুকু বলার সাহসও তোমার হচ্ছে না, এটা অভিনব। তোমার এই কুণ্ঠাই অনেকের অনেক সন্দেহের উপকরণ জোগাচ্ছে। যাক সে কথা। কিন্তু সুমনা, ওই বাচ্চাটাকে কতদিন তুমি ঘরে আগলে রাখতে পারবে? ও তো ঘর থেকে বেরোবে। শিশুর স্বধর্ম যা, তা পালন করবে। তখন?

আমি পরের কথা কিছু ভাবতে পারছি না বাবা।

না ভাবাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বলি শোনো–আমি ওর জন্যে আয়া রেখে দেব। তুমি এম. এ. পড়বে।

কান্তিকুমার বেরিয়ে যান ঘর থেকে।

.

একটু পরে অনড় সুমনার কানে একটা হইচই শব্দ এসে পৌঁছয়। কে যেন এসেছে। কে এসেছে? পিসিমা। পিসিমা এলে তো দাদাও আসবে। যার আশায় দিন গুনছে সুমনা। এখনও যার ওপর একটু আশা রেখেছে। প্রতিদিন যার কথা মনে পড়েছে, একজন কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছে দাদা কবে আসবে, দাদা যেখানে গেছে তার ঠিকানা কী। পারেনি জিজ্ঞেস করতে।

হ্যাঁ পিসিমাই।

এসে পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি।

পুরী গিয়েছিলেন রথের রশি টানতে। থেকে গিয়েছিলেন তারপর মাস দেড়েক। তাঁর সঙ্গেই অলক গিয়েছিল।

দাদা? দাদা কোথায় রে? এসেই জিজ্ঞেস করেছিল সুমনা, কোনও একটা ছোট ছেলেকে।

শুনেছিল দাদা পিসিমার কাছে পুরী গেছে।

দাদা! জেঠিমার একমাত্র ছেলে। একান্নবর্তী পরিবারে জেঠতুতো খুড়তুতোর বিভেদ ছোটদের হৃদয়ে বিষগাছ রোপণ করে না। নিজের দাদা থাকলে সুমনা এই জেঠতুতো দাদার চাইতে কিছু বেশি ভালবাসত, এমন ধারণা তার অন্তত নেই।

তাই পিসিমার গলার শব্দে আশায় উদ্বেল হয়ে ওঠে সুমনা।

তবে দাদাও এসেছে।

 কিন্তু

যদি দাদাও!

হ্যাঁ, যদি দাদাও ওদের মতো হয়ে যায়। যদি মুখটা কালো করে ঘরের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করে, ঘরের মধ্যে না তাকায়! যদি দাদাও ভাবে, ওই কুড়িয়ে পাওয়ার গল্পটা একটা বানানো গল্প মাত্র।

বেরোতে গিয়ে থেমে যায় সুমনা।

ফিরে আসে দরজার কাছ থেকে।

ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলে,আসুক আসুক, আরও ঝড় আসুক। দেখব আমার শক্তি।

দাদার গলার শব্দও ভেসে আসছে। ওর স্বভাবগত উচ্ছ্বাসে ঠাকুমার সঙ্গে কথা চালাচ্ছে। দাদার এই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠের ধ্বনির তরঙ্গে যেন ভেসে আসছে আরও একটা কণ্ঠধ্বনি।… বাইরে নয়, মনে।

আশ্চর্য!

কলকাতায় ফিরে আসার এই এতদিন পরে মনে পড়ল তাকে সুমনার। কান্তিকুমারের কথাই তা হলে ঠিক? সুমনাকে ভূতে পেয়েছে?

তাই সুমনা জামাকাঁথা ভিজে বিছানা ফিডিংবটল আর হাসি কান্নার মধ্যেই একেবারে সমাধিস্থ হয়ে গেছে।

সত্যিকার মা, নতুন মা, অনেক তো দেখেছে সুমনা, কই এমন অবস্থা তো হয় না তাদের। সারাক্ষণ শুধু চোখ পেতে বসে থাকতে তো দেখে না। বরং বাপরে মারেই করে কত সময়।

সুমনার হৃদয়েই কি মাতৃস্নেহ এত প্রবল যে, সমস্ত পৃথিবী বিস্মৃত করে দিচ্ছে সেই স্নেহপ্লাবন। অথচ যে মাতৃস্নেহ কৌতুককর!

সুমনা ভাবে, সত্যিকার মাদের কি সর্বদা এমন হারাই হারাই ভয় হয়? তাদের কি এককণা একটা প্রাণকে সারাক্ষণ পৃথিবীর অকরুণ আর হিংস্র দৃষ্টির আওতা থেকে রক্ষা করে ফিরতে হয়?

সুমনার মতো দুর্ভাগ্য কার?

কান্তিকুমার বলে গেলেন সুমনা গুরুজনের সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহার করেছে। অন্যায় সুমনার, ঘোরতর অন্যায়। কিন্তু গুরুজন যদি গুরুত্ব হারায়? তারা যদি স্নেহ সহানুভূতির কোঠা থেকে নেমে এসে মজা দেখার কোঠায় দাঁড়ায়?

সুমনা কী করেছে?

কী এমন গর্হিত কাজ।

একটা জীবন, হয়তো সেই মুহূর্তে বিনষ্ট হয়ে যেত, তাকে রক্ষা করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই তার অপরাধ।

কিন্তু কেউ তাকে বলেনি সত্যিই তো ঠিক করেছ।

অবশ্য তারপর কান্তিকুমার যা ব্যবস্থা করেছিলেন, হয়তো সেইটাই মেনে নেওয়া উচিত ছিল সুমনার।

 পারেনি সুমনা।

কচি কোমল মাতৃদেহ স্পর্শাকাঙ্ক্ষী শিশু দেহখানি বুকে চেপে ধরে সুমনা। মনে মনে বলে, না পারিনি।

মনে হয়েছে ও যেন ওর ওই কাঁচের মতো চোখ দুটি তুলে সুমনার কাছে আশ্রয় চেয়েছে।

 কিন্তু সুমনাকে কেউ সুবিচার করল না।

সুমনার প্রকৃতি কারও মনে পড়ল না।

মনে পড়ল না অনেকদিন আগে একটা পথ থেকে কুড়নো ঘেয়ো কুকুরছানাকে এমনই বুক দিয়ে আগলে থেকেছিল সুমনা। শত তিরস্কারেও ত্যাগ করেনি তাকে।

তারপর তো সে নিজেই মুক্তি দিয়ে গেল সুমনাকে।

একে নিয়ে তাই না এত উৎকণ্ঠা সুমনার। এতগুলো কুটির বিষ হজম করে ও কি বাঁচবে?

ভ্রূকুটি।

 সবাইয়ের ভ্রূকুটি।

যাদের স্বার্থে এতটুকু আঁচড় লাগবে না, তারাও এসে কুটিল দৃষ্টিতে তাকায়।

না, এখন আর কেউ আসছে না, কিন্তু প্রথম প্রথম সবাই এসেছে এ-ঘরে। মেলার বাজারে পাঁচপেয়ে গোরু দেখতে যেমন আসে, তেমনই এসেছে খোকা কোলে সুমনাকে দেখতে।

সুমনা তাদের সঙ্গে উদ্ধত হয়ে কথা বলেছে। সে খবর পেয়েছেন কান্তিকুমার। কিন্তু খবর পেয়েছেন কি কীভাবে তারা কথা বলেছে?

কতটা ব্যঙ্গরসাশ্রিত।

কতটা ঘৃণা আর ধিক্কার মিশ্রিত!

 ঠাকুমা!

যে ঠাকুমার চক্ষের নিধি সুমনা।

সুমনার যাত্রাকালে যিনি বাহান্ন দেবতার নির্মাল্য আর চরণামৃত এনে হাজির করেছিলেন, আর চোখের জল মুছে-মুছে আঁচলের কোণটা ভিজিয়েই ফেলেছিলেন।

সেই ঠাকুমা এসে গাল হাত দিয়ে ছি ছি করে উঠলেন, হ্যাঁ রে মনা, এই তোর বিদ্যেবুদ্ধি, এই তোর রুচি প্রবৃত্তি! রাস্তায় ফেলে দেওয়া জঞ্জাল কুড়িয়ে এনেছিস তুই! তোর বাবা অনাথ আশ্রমে দিতে চেয়েছিল, দিসনি!

তখনও মানুষের ওপর একটু আশা রাখত সুমনা। তখনও জানত না মানুষ সত্যি কত ক্ষুদ্র, কত দীনচিত্ত!

তাই সেই ফুলের মতো ছেলেটাকে দু হাত বিছিয়ে ধরে ঠাকুমার সামনে বাড়িয়ে বলেছিল, আচ্ছা দিদা, তাকিয়ে একবার দেখো তো, ডাস্টবিনের জঞ্জাল বলে মনে হচ্ছে?

ঠাকুমা সাত পা পিছিয়ে গিয়েছিলেন। হাঁ হাঁ করে বলে উঠেছিলেন, হচ্ছিল আর একটু হলে। এই অবেলায় নেয়ে মরতে হত।

নেয়ে মরতে তুমি একে ছুঁলে?

তা আমার এখনও পুজো পাঠ ছিষ্টি বাকি। না নাইলে? তোমার ওই সোনার কার্তিকটি কীসের ছেলে তা তো আর

হ্যাঁ, উদ্ধত হয়েছিল সুমনা।

বলেছিল, দিদা, খুব তো বড় বড় কথার বড়াই করো। খুব তত ভাগবত আর চৈতন্যচরিতের পাঠ শুনে এসে জীবে দয়ার গুণকীর্তন করো, ভেতরে ভেতরে মন এত ঘোট কেন?

ঠাকুমা রেগে উঠে বলেছিলেন, তা তোর মতন এত উঁচু মন যদি ভগবান না দিয়ে থাকে? বলি আইবুড়ো মেয়ে তুই, তোর এত ফড়ফড়ানি কেন রে? লোকলজ্জা নেই? ছেলে ছেলেকরে আদিখ্যেতা করলে লোকে বলবে কী?

দিদা! সংসারে যদি একটা মা-মরা ছেলে থাকত, তাকে মানুষ করলে আইবুড়ো মেয়ের নিন্দে হয়?

শোনো কথা! তাতে আর এতে! এর মা কি মরেছে? কে জানে কোন চুলোখাকি—

দিদা! এর কাছে তো এর মা মৃতই।

ঠাকুমা বিরক্তকণ্ঠে বলেছিলেন,অত কথা জানি নে মনা, ওসব অশুদ্ধ ছেলে ঘরে থাকলে সকলের সঙ্গে ছোঁয়া নাড়া হবে না? আর তুই ওর ঝি-গিরি করলে তোর হাতেই বা কে জল খাবে?

উদ্ধত হয়েছিল সুমনা।

বলেছিল, আমি কাউকে হাতের জল খাওয়াতে যাবও না দিদা। আর কেউ না খেলে দুঃখে মরেও যাব না। তবে তোমাদের ধর্ম পুণ্যি গীতা ভাগবত সব মর্ম জানা হয়ে গেছে আমার। তাই ভয়ও নেই।

.

এসেছিলেন জেঠি।

সকালবেলা স্নানের আগে।

ডিঙি মেরে ঘরের মধ্যে একটু পা বাড়িয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ রে সুমি, ঠাকুমাকে নাকি যাচ্ছেতাই করেছিস?

সুমনা উদ্ধত হয়েছিল।

কারণ, সুমনা তখন মানুষের ওপর থেকে আশা সরিয়ে নিচ্ছিল।

 তাই বলেছিল, হ্যাঁ করেছি।

 ওমা শোনো কথা। হ্যাঁ লা সুমি, তুই তো আগে এমন ছিলি না।

আজকাল ওইরকমই হয়েছি জেঠিমা। ভূতে পেয়েছে কিনা।

দেখ সুমি, তোর ঘরে আমি পা ধুতেও আসতাম না, এসেছি নেহাত দুটো সৎ উপদেশ দিতেই। তা অপমানটা করলি ভাল। তবে বলি, এ বাড়িতে তোর ওই ছেলে নিয়ে আদিখ্যেতা চলতে থাকলে আমাদের দু প্রাণীকে বাধ্য হয়েই আশ্রমে গিয়ে থাকতে হবে।

সুমনা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল।

বলেছিল,আহা! জেঠিমা, আমাকে তা হলে একদিন সন্দেশ খাইয়ে দিও। আমিই যখন তোমার উচ্চমার্গের পথপ্রদর্শক।

অতটা অহংকার ভাল নয় সুমি—

বলেছিলেন জেঠিমা।

যে জেঠিমা বাড়িতে কেউ এলেই শতমুখে সুখ্যাতি করতে বসতেন সুমনার। বলতেন, এমন গুণের মেয়ে এ-যুগে জন্মায় না। বলতেন,এত রূপ, এত গানের গলা, বাপের কত পয়সা, বছর বছর ক্লাসে ফাস্ট, অথচ এতটুকু চাল অহংকার নেই। মেয়ে তো নয়, সোনার মেয়ে।

সেই জেঠিমা বললেন, অত অহংকার ভাল নয় সুমি।

বলেছিলেন, বাপের পয়সায় ধরাকে সরা দেখছিস, মনে জানিস রাজপুত্তুর এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে, যাকে যা ইচ্ছে বলে নিতে পারি। কিন্তু ওই ছেলে পালতে বসলে বিয়ে হবে না, তা মনে রাখিস।

মনে রাখব।

বলেছিল সুমনা।

চলে গিয়েছিলেন জেঠি।

এসেছিলেন জেঠা।

অনেক জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিয়েছিলেন, আর বলেছিলেন, এখন আমার কথা তেতো লাগবে। কিন্তু দেখো পরে বলতে হবে, হ্যাঁ বলেছিল বটে জেঠামশাই।

উদ্ধত হয়েছিল সুমনা।

বিনয়ের ছদ্মবেশে যতটা ঔদ্ধত্য সম্ভব। বলেছিল, আপনার উপদেশ আমার মনে থাকবে জেঠামশাই।

পর পর তাসের মতো সাজিয়ে দেখছে সুমনা।

এসেছিলেন কাকা।

যাচ্ছেতাই গালাগাল করতে করতেই ঢুকেছিলেন। সুমনাকে নয়, সুমনার মা বাপকে।

আর বলেছিলেন, একান্নবর্তী পরিবারে কারও যা খুশি করবার স্বাধীনতা নেই। হতে পারেন মেজবাবু হাইকোর্টের উকিল, কিন্তু ছোটবাবু আইনের সাহায্য নিয়ে এই স্বেচ্ছাচার অনাচার বন্ধ করে দিতে পারেন। মেজবাবুকে বাধ্য করতে পারেন ওই ছেলেটাকে অনাথ আশ্রমে পাঠাতে।

মানুষের ওপর আশা আর তখন ছিল না সুমনার, তাই উদ্ধত হয়েছিল। বলেছিল, সেই চেষ্টাটাই বরং করা গে ছোটকাকা। তবু কিছু পরকালের কাজ হবে।

বাঘিনীর মতো দরজা পাহারা দিয়ে কথা বলেছিল ওদের সঙ্গে। পাছে কারও নজর লাগে।

কিন্তু ছোটখুড়ির সঙ্গে উদ্ধত ব্যবহারের কোনও কারণ ছিল কী? ছোটখুড়ি তো ওদের বিপক্ষে। সুমনারই পক্ষে।

অর্থাৎ ওইটাই স্বধর্ম মালবিকার। প্রত্যেকে যা বলে, ও তার উলটো বলে। প্রত্যেকে যে ব্যাপারের বিপক্ষে রায় দেয়, ওর রায় সব সময় তার স্বপক্ষে। একবার একটা ঝি বাসন চুরি করে ধরা পড়েছিল। বাড়িসুষ্ঠু সকলে তাকে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করে তাড়িয়েছিল, মালবিকা সে চলে যাবার মুখে তাকে ঘরে ডেকে দশটা টাকা বকশিশ দিয়ে বলেছিল,অনেক লাঞ্ছনা খেয়েছিস। নে সন্দেশ খা।

কাজেই মালবিকা যে সুমনাকেই সমর্থন করবে, এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু মালবিকার সঙ্গেও নম্রতা করেনি সুমনা। সুমনা ধৈর্য হারিয়েছিল।

 মালবিকা যখন ঘরে এসে বলেছিল, কই দেখি যশোদার গোপালকে!

তখন সুমনা ছেলে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল। মালবিকা বুঝতে পারেনি, কোলে করতে গিয়েছিল, সুমনা প্রায় হাত থেকে কেড়ে টেনে নিয়েছিল। বলেছিল, থাক ছোট খুড়িমা, বকুনি বরং সহ্য হয়ে যাচ্ছে, ব্যঙ্গটা হজম করতে পারব না।

মালবিকা বলেছিল,আমি তোকে ব্যঙ্গ করতে আসিনি সুমি! ভাল ভেবেই এসেছি।

সুমি বলেছিল,বিশ্বাস করা শক্ত ছোটখুড়িমা।

আহত হয়ে চলে গিয়েছিল খুড়ি।

তারপর রাগ আর বিরক্তি, অপছন্দ আর আক্রোশ ধোঁয়াতে ধোঁয়াতে আগুন দেখা দিয়েছে, সুমনাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে মালবিকাও।

জেঠি সকলকে চুপি চুপি বলে বেড়াচ্ছেন, মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দেখো। রঙের সঙ্গে রং।

আশ্চর্য!

আশ্চর্য!

 তবু দাদার কণ্ঠস্বরে বুকটা আশায় ভরে উঠতে চাইছে সুমনার।

 মনে হচ্ছে দাদা ওদের মতো নয়।

এক হিসেবে সত্যিই নয়।

 অন্তত তার মা-বাপের মতো তো নয়ই। মা-বাপের সম্পূর্ণ বিপরীত সে।

সস্ত্রীক শান্তিকুমার যেমন আচারনিষ্ঠ, দেবদ্বিজপরায়ণ, ধর্মে মতি ভক্তিবিগলিত, তাঁদের পুত্র অলক তেমনই ম্লেচ্ছচারী, দেবদ্বিজে মতিহীন, বেপরোয়া!

মা একটু চরণামৃত খাওয়াতে এলে বলে,দোহাই মা, ওই এক কোটি কলেরার বীজাণু হজম করি, এত গুরুবল আমার নেই।

গুরুদেব এলে বাপ যদি বলেন, এই যে বাবা এইটি আমার ছেলে। এই পড়ছে–অলক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাপের শত ইশারাতেও মাথা নোয়ায় না।

স্ফূর্তিবাজ বেপরোয়া।

এম. এ. পরীক্ষার আগের দিন গানের জলসায় সারারাত কাটিয়ে সকালে ফিরে বিছানায় লম্বা হয়ে বলে,আমায় ঠিক নটার সময় উঠিয়ে দিও তোমরা।

দাদা সুমনার প্রাণতুল্য।

সেই দাদাকে কতদিন দেখেনি সুমনা, সেই দাদার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছে, তবু লাফিয়ে গিয়ে বলছে না–দাদা!

সুমনা সত্যিই তা হলে ভয়ানক একটা কিছু বদলে গেছে! সুমনা আর আগের সুমনা নেই।

আচ্ছা, ভূতে পাওয়া কথাটা কি সত্যি!

.

সুমনা গেল না।

দাদা এল।

 লাফাতে লাফাতেই এল।

কী রে মনা, কী ব্যাপার!কী একখানা কাণ্ড পাকিয়ে বসেছিস? হাওড়া স্টেশন থেকে তো শুধু তোর গুণগরিমা শুনতে শুনতেই এলাম।

সুমনার চোখে কেন জল উপচে ওঠে?

অনেকদিন পরে স্বাভাবিক কথা শুনে? ফিকে একটু হেসে, সেই জলটাকে চাপা দেয় সুমনা।

তারপর বল তো শুনি প্রকৃত ঘটনা। জুত করে বসে অলক। খাটের ধারেই বসে। সুমনার অচিনকুমারের দিকে চোখ পড়ে যায়। ভোলা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে,আরে এ যে দেখছি ঘটনা সত্য! অ্যাঁ, এই সেই ফাঁসির আসামি! এর বিরুদ্ধেই এত ষড়যন্ত্র। ঠাকুমাতে, পিসিমাতে আর আমার মাতৃদেবীতে তো এখন গোল টেবিল বৈঠক বসে গেছে। পরামর্শপ্রার্থিনী জননী ও পিতামহী, পরামর্শদায়িনী পিতৃস্বসা। তা বেড়ে দেখতে তো! কাদের মাল বাবা! ছেলেটার গালে একটু টোকা দেয়, অল্প নিচু হয়ে ওর নাকে নাকটা ঠেকায়, তারপর বলে, তা হলটা কী?

হলটা কী, সে কথা কি বিশদ বলতে পারে সুমনা? সে ক্ষমতা কি ওর আছে? তাই মৃদু হেসে বলে, হাওড়া স্টেশন থেকেই তো শুনতে শুনতে আসছিস দাদা!

তা আসছি বটে! শুনে শুনে মোহিতও হয়েছি। শুনছি তোকে নাকি বেহ্মদত্যিতে পেয়েছে। তুই নাকি গুরু লঘু জ্ঞান করছিস না। হিতাহিতের মাথা খেয়ে বসে আছিস। বলেছিস নাকি রেজাল্ট দেখতে যেতে তোর দায় পড়েছে, এম. এ. নাকি শুধু পাগলেরা পড়ে।

সুমনা অনেকদিন পরে হেসে ওঠে।

হেসে ওঠে, বোধ করি খানিকটা বেঁচে ওঠে। যেমন বেঁচে ওঠে বোশেখ-জষ্টির রোদে নেতিয়ে থাকা কচি গাছ, প্রথম বর্ষার জল পেয়ে।

হেসে উঠে বলে, তবে তো প্রকৃত সত্য সবই জেনে ফেলেছিস।

হ্যাঁ, সত্যটা জানা হয়ে গেছে, এখন শুধু তত্ত্বটা জানতে বাকি! সিদ্ধার্থ আসে?

সুমনা মাথা নাড়ে।

হু! আমিও ওইরকম একটা কিছু অনুমান করছিলাম। তা সে হতভাগার আবার কী হল? তোর তো বেহ্মদত্যি, তার কি ব্ৰহ্মজ্ঞান? তাই আর এইসব ঐহিকের তুচ্ছতা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না? খোঁজ করিসনি তুই?

নাঃ!

নাঃ! নাঃ মানে?

 মানে কিছু নেই। এমনি।

ছেলেটাকে তুলে নিয়ে হাঁটুতে বসিয়ে নাচাতে নাচাতে বলে অলক, নমস্কার বাবা, তোমাদের ক্ষুরে ক্ষুরে নমস্কার; সংসারে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে জানলে আমি সেই প্রভু জগড়নাথের চরণে লীন হয়ে পড়ে থাকতাম।

তোমার কী? সুমনা হাসে, তোমার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?

 সম্পর্ক কী! চমৎকার! তুমি আমার বোন, এটা মানো তো?

 একটু একটু।

যাক, ওই একটু একটু হলেই চলবে। যাক, আমি তার অর্থাৎ সে আমার বন্ধু, এটাও মানতে হয়। এই বোন আর বন্ধু এই দুটো বস্তুকে একত্রে মিশিয়ে মিক্সচার করে ফেলবার বাসনা আমার নেই বাল্যাবধি। আজ যদি সে বাসনায় ছাই পড়ে, দুজনের একজন যদি ব্রহ্মে আর অপরজন যদি ব্ৰহ্মদত্যিতে লীন হয়ে যায়, করবার আর রইল কী!

কিছু না!

বলে দুহাত উলটে হতাশার ভঙ্গি করে সুমনা।

ঠাট্টা রাখো। সিধুবাবুর সঙ্গে তা হলে দেখা হয়নি?

না। চমৎকার! ওঁরা দুজন–এই এই…এই সর্বনাশ করেছে। ওরে বাবা!…

ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি তুলে নেয় সুমনা অলকের কোল থেকে। হেসে ফেলে বলে, বাবাঃ! এমন করে চেঁচালি তুই। যেন কী না কি রাজ্য রসাতলে গেল।

অলক ভিজে পাজামাটা হাত দিয়ে ধরে আড়ষ্ট হয়ে ঘর থেকে যেতে যেতে বলে, তার চাইতে কিছু কমও নয়। ধোবার বাড়ির পাজামাটা গেল।…ইস…ইচ্ছে করে মানুষ এই জীব পোষে?

সুমনা ছেলেটার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতে করতে মৃদু হেসে বলে,ত্রিসংসারের লোক তো তাই করছে।

ছুটে আসে অজীন।

দাদা, তুমি না খেয়ে-টেয়ে এসে দিদির সঙ্গে গল্প করছ? জেঠিমা রাগ করছেন।

আরে ব্রাদার রাখো তোমার জেঠিমা। দেখছ আমার অবস্থা?

দেখতে পায় অজীন। হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে।

সুমনা তাকে ডাকে।

বলে, শোন। পিসিমা চলে গেছেন?

 ও বাবা চলে গেছেন কি? এখন তো চারদিন এখানে থাকবেন।অজীন গলা নামিয়ে বলে, জানো দিদি, পিসিমা বলেছে, এই অচিনকুমারটাকে বোর্ডিঙে না হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে ছাড়বে সে।

সুমনা ভুরু কুঁচকে তাকায়।

মুহূর্তে কঠিন হয়ে ওঠে ক্ষণপূর্বের হালকা হয়ে যাওয়া মনটা।…অলকের সঙ্গে কথার মধ্যে যে প্রসঙ্গটি প্রাণের মধ্যে হঠাৎ অনেক ভাবের তোলপাড় তুলেছিল, আনন্দ, অনুতাপ, অভিমান, মন কেমন, সেই ভাবের ওঠাপড়া থেমে গেল, ভুরু কুঁচকে কঠিন হয়ে বসে রইল।

বসে রইল যুদ্ধের বর্ম গায়ে এঁটে।

 সিদ্ধার্থের কথা ভাবতে ভুলে।

অথচ আগে দিনান্তে সিদ্ধার্থের সঙ্গে একবারও দেখা হয়নি, এমন দিন ওদের খুব কমই হত।

সিদ্ধার্থ পাড়ার ছেলে।

সিদ্ধার্থ অলকের বন্ধু।

সিদ্ধার্থ তিলে তিলে সুমনারও বন্ধু হয়ে উঠেছিল।

 চেঞ্জে যাবার আগে দেখা করতে গিয়েছিল সুমনা। গিয়েছিল সেই ওদের নির্দিষ্ট প্রিয় জায়গাটিতে। হ্যাঁ, দেখা করার একটা জায়গা ওদের নির্বাচন করা ছিল। আর দেখা করার দায়টা সুমনা সর্বদা নিজের ঘাড়েই রেখেছিল।

বাড়িতে কথা কওয়া শক্ত।

বাড়িতে কত লোক, কত চোখ, কত মন্তব্য।

দুমাসের জন্যে যাচ্ছে শুনে সিদ্ধার্থ বলে উঠেছিল, দুমাস! অসম্ভব। আমাকেও তা হলে চেঞ্জে যেতে হবে।

ওখানেই বোধহয়?

 তবে না তো কী?

হ্যাঁ দেখব কত দৌড়। চলে গেলেই নিশ্চিন্দি হবে।

ধারণাটা উচ্চাঙ্গের। কিন্তু চিঠি এক-আধটা লিখলে এমনই বা কী দোষ ছিল? একেবারে কড়া নিষেধের

না না সেই ভাল।

ভাল?

হুঁ।

বেশ। তবে ধরো যদি শুধু পোসটোকাটেদু-এক ছত্র–সুমনা, আশা করি তোমার ওখানে গিয়ে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে অথবা সুমনা, তোমাদের রেজাল্ট বেরোবার আর বিলম্ব নেই–

আহা, তাতে লাভ?

লাভ অনেক। সে বোঝবার ক্ষমতা থাকলে তো।

না না থাক। দেখাই যাক না।

কী দেখা যাক না?

 সুমনা মৃদু হেসে বলেছিল, বহর।

কিন্তু সুমনা নিজেই দেখাল শেষ পর্যন্ত।

সুমনা এ কী করেছে! ছি ছি!

সুমনার চিন্তায় ছেদ পড়ল।

পিসিমা ঘরে এলেন।

বেশ হইহই করতে করতে।

কই গো কানাইয়ের মা, তোমার কানাই দেখি।

সুমনা উঠে গিয়ে প্রণাম করল।

 পিসিমা থাক থাক বলে একটি আশীর্বাদ সহযোগে বললেন, এসে তো শুনে অবাক। সবাই বলে, সুমি আমাদের না বিইয়ে কানাইয়ের মা হয়ে বসে আছে। হ্যাঁ রে তা লেখাপড়া জলাঞ্জলি দিয়ে একটা ছানা নিয়ে এমন উন্মাদ হয়ে বসে আছিস কেন?

উন্মাদই হয়ে গেছি যে পিসিমা। এত খবর জানলে, আর সুমি পাগল হয়ে গেছে, এ খবরটুকু জানলে না?

ওমা! তোর কথাবার্তাও তো আর আগের মতন নেই দেখচি। ওরা তো ঠিকই বলেছে। পিসিমা গম্ভীর মুখে বলেন, ছোটবউ বলল, সরল মনে ছেলে নিতে গেলাম, নিতে দিলে না। ওর ধারণা ছেলেকে আমরা মেরে ফেলব।

তা ধারণাটায় আশ্চয্যি কি পিসিমা? যাকে নিয়ে সারা সংসারে অশান্তি

পিসিমা সহসা হৃদ্যতায় গলে গিয়ে বলেন,তা সেই কথাই তো বলছি বাছা। সংসারসুদ্ধ লোককে অশান্তি কেন দিচ্ছিস মা? কত লক্ষ্মী মেয়ে তুই, কত মায়া তোর শরীরে—

পিসিমা! ওই–ওইটাই সমস্যার মূল। মায়া জিনিসটার এমন দোষ, সে পাত্রপাত্র বাছতে ভুলে যায়।

হু! বুঝেছি। বাচ্চাটার ওপর মায়া পড়ে গেছে তাই বলছিস! তা অবিশ্যি পড়তেই পারে। পিসিমা আরও বিগলিত হয়ে বলেন, একটা পাখি পুষলেও মানুষের মায়া পড়ে, তা এ তো রক্তমাংসের জীব। তবে তোরা এত লেখাপড়া জানা, তোদের আর কী শেখাব, অপাত্রে মায়াটা তো কোনও কাজের কথা নয়! আজ বাদে কাল বাবা বিয়ের চেষ্টা করবে, তখন এই ছেলের কথা প্রকাশ পেয়ে গেলে কেলেঙ্কারির আর শেষ থাকবে? হয়তো কত জনে কত অকথা কুকথা ভাববে–

সুমনার মুখের রেখা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। গলার শির নড়ে ওঠে ভয়ানক একটা কিছু বলবার তীব্র ইচ্ছায়। ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে পিসিমার এই ছদ্ম মমতার আবরণ। কিন্তু সংযত করে নেয় নিজেকে।

চুপ করে থাকে। চেষ্টা করে চুপ করে থাকে।

পিসিমার চোখে এই চেষ্টাটা ধরা পড়ে না।

তাই তিনি ওষুধে কাজ হচ্ছে ভেবে বলতে থাকেন, তার থেকে বলি শোন। খুব ভাল পরামর্শ, আমার বাড়ির ঘর ঝাড়া-মোছার ঝিটা দেখেছিস তো? নাম গৌরী। ভদ্রঘরের মতো চেহারা। স্বামী আছে, শাশুড়ি আছে। সে মাগী একটা ছেলে-ছেলে করে পাগল! কত মাদুলি কবচ পরে, কত ওষুধ পালা খায়, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এখন বলে একটা পথে কুড়োনো ছেলেও পাই তো পালি। ছেলেটাকে আমি নিয়ে গিয়ে তাকে পালতে দিই। কী বলিস? বরং ইচ্ছে হলে কিছু কিছু করে মাসোহারাও দিতে পারিস।…আর চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে।

পিসিমা।

 সেই তীব্র ইচ্ছার তীক্ষ্ণ প্রকাশটা আর চেষ্টা করে থামিয়ে রাখতে পারে না সুমনা। সে-ইচ্ছে ফেটে পড়ে, পিসিমা, দোহাই তোমাদের, আমার কথা তোমরা একটু কম ভেবো।

আর কারও সঙ্গে ঔদ্ধত্য করবে না ভেবেছিল।

 সংকল্প বজায় রইল না।

পিসিমা চোখ ভুরু কুঁচকে চলে গেলেন।

সারাদিন আর কেউ সুমনার খোঁজ করল না।

বিকেল চারটেয় কান্তিকুমার এলেন। অঞ্জনাকে দিয়ে বলে পাঠালেন, দিদিকে ঠিক হয়ে নিতে বলো।

ঠিক হয়েই ছিল সুমনা।

বেরিয়ে এল।

সুজাতা ওর ঘরে গিয়ে বসেছে। ভারী ভারী মুখে বলেছে, কখন কী খাবে দেখিয়ে দিয়ে যাও। মাপটাপগুলো একটু বুঝিয়ে দাও।

বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে সুমনা।

আর তারপর? বাইরে বেরিয়ে সমস্ত বহিঃপ্রকৃতির দিকে চোখ বুলিয়ে দেখে দেখে নিজে বুঝতে পারছে না, কোথায় ছিল সে এতদিন?

সুমনা নামক জীবটা এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছিল না কি! কী জন্যে?

বাইরে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে মন, ঘরটা ঝাপসা হয়ে আসে, নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।…

এম. এ. না পড়লে কী হয়! সবাই কি এম. এ. পাস করে? এ চিন্তাটা ধূসর হয়ে ওঠে।

সহপাঠিনী বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হয়। সুমনা নামে যে মেয়েটা বলতে গেলে ওদের মধ্যমণি ছিল, তাকে দেখে সবাই কলকাকলিতে উচ্ছল হয়ে ওঠে। পরস্পরের মার্কশিটের স্তর-বিভেদ নিয়ে আলোচনায় তৎপর হয়।

তোর আর ভাবনা কী?

এই প্রশ্নে মুখর হয়ে উঠেছে বান্ধবীরা।

তুই তো ফার্স্টক্লাস পেয়েছিস

ত্যি, কী করে পেলাম রে তাই ভাবছি। একেবারে আশা করিনি। যা ভুগেছি তখন।

আগের সুরে আগের মতো করেই কথা বলে সুমনা। বলতে পারে।

আশ্চর্য, এই হালকা সুরটা এখনও তবে আছে সুমনার স্বরযন্ত্রে?

আরে রেখে দে। তুই তো পরীক্ষা না দিলেও পাস করতিস।…যা একখানা মাথা!..

ওরা সুমনার সেই ভয়ংকর নির্বুদ্ধিতার খবর রাখে না।

তাই উচ্ছ্বসিত উল্লাসে সুমনার যা একখানা মাথার তারিফ করছে।

ওরা জানে না।

 তাই সুমনা ওদের কাছে সহজ হতে পারছে–পুরনো মূর্তিতে ঝলসে উঠতে পারছে।

কান্তিকুমার মার্কশিট দেখে নেবার পর বিচলিত আনন্দে তাড়াতাড়ি গিয়ে গাড়িতে বসে আছেন।

আর ভাবছেন, আগে হলে, আগের সুমনা আর আগের সংসার থাকলে সুমনার এই কৃতিত্বের খবর নিয়ে বাড়ি ঢুকতেন কী উল্লাসের সমারোহ নিয়ে!

এখন তা হবে না।

এখন হয়তো সুমনা বাড়ি ঢুকবে পাথরের মতো!

কান্তিকুমার ঢুকবেন অপরাধীর মতো।

.

কয়েকটা মেয়ে হইহই করতে করতে এগিয়ে এল কান্তিকুমারের কাছে।

মুখপাত্র সোমা।

সিদ্ধার্থের ভাগ্নী।

কিছুটা চেনা বলে মুখপাত্র হয়েছে। সবাই ঘটাঘট প্রণাম করে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

সন্দেশ কই? সন্দেশ কই? সুমনার পাসের সন্দেশ।

ইস্ শুধু সন্দেশে ছাড়ব নাকি? রীতিমত ভোজ চাই।

ভোজ ছাড়াও আমাদের ব্যাচকে সিনেমা দেখাতে হবে। হ্যাঁ ছাড়ব না। শেষ দাবিটা সোমার।

কান্তিকুমার তাকিয়ে দেখেন।

কান্তিকুমার যেন অবাক হয়ে যান। জগতে এখনও এত আনন্দ আছে, আলো আছে।

আর সুমনার মুখে।

সেখানেও যে এই আলোর আভা।

এই আনন্দের জগৎ থেকে সুমনা স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়েছে। অন্ধকার সেলে বন্দি করে রেখেছে নিজেকে!

এদের আনন্দোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে কান্তিকুমার বলেন, সবাই তো পাস করেছ? পালা করে সন্দেশ খেতে খেতে সন্দেশে তো অরুচি হয়ে যাবে।

বাঃ আমরা বুঝি সুমনার মতো? আমরা তো এলেবেলে! সুমনার স্পেশাল কেস।

 হবে হবে। আসবে সবাই একদিন।

এই উচ্ছ্বাসের মুখে কান্তিকুমার বণ্ডে সই করে বসেন, তোমাদের বন্ধু নেমন্তন্ন করছে তোমাদের। কবে খাবে বলো?

কী মজা! কী মজা!

হইচইয়ের মধ্যে কবেটা হারিয়ে যায়।

গাড়ি গাড়ি।

 গাড়ির শোভাযাত্রা।

 যাদের গাড়ি আছে তারা তো গাড়ি নিয়ে এসেইছে। যাদের গাড়ি নেই তারাও আজ বন্ধু আত্মীয় প্রতিবেশী কারও না কারও গাড়ি চড়ে এসেছে। আবার বাসে ট্রামে পায়ে হেঁটেও এসেছে কেউ কেউ।

গাড়ির মিছিল।

মেয়ের মিছিল।

 সুমনা তাকিয়ে দেখে।

গাড়িতে ওঠে।

অবাক হয়ে ভাবে, আশ্চর্য! এই এত মেয়ে, কারও জীবনে তার মতো সমস্যা আসেনি।

 অবাক হয়ে ভাবে, কিছুদিন আগে পর্যন্তও আমি এদের মতো ছিলাম।

সোমাকে গাড়িতে তুলে নিতে চেয়েছিল।

 সোমা বলেছে, না, এখন তো মামার বাড়ি যাচ্ছি না, আগে বাড়ি যাব। তারপর মামার বাড়ি! একেবারে মাকে নিয়ে।

সঙ্গে কে আছে?

ছোটমামা।

ছোটমামা!

সিদ্ধার্থ!

সিদ্ধার্থ এখানে ছিল।

দেখা হয়নি সুমনার সঙ্গে।

দেখা করেনি সিদ্ধার্থ। অভিমান!

 সুমনা কি অভিমান ভেঙে নিজে যাবে?

প্রশ্নের উত্তর পেল না।

অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতার পর হঠাৎ মনে পড়ল, সে কৃতিত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় পাস করে বাবার সঙ্গে বাড়ি যাচ্ছে, সারা পথ চুপ করে। ভাবল, পাস করে সিদ্ধার্থর সঙ্গে দেখা করলাম না। সিদ্ধার্থও না।

তাকিয়ে দেখল বাইরের দিকে।

তেমনিই তো আছে সব।

সেই গোধূলিবেলার সোনালি আলো, সেই বৃষ্টিহীন শ্রাবণ দিনের ঈষৎ আর্দ্র মিষ্টি বাতাস, সেই রাস্তা বাড়ি দোকান। শুধু সুমনা আর সেই নেই।

এতক্ষণ বন্ধুদের দলে থেকে ভুলে গিয়েছিল, এখন মনে পড়ল।

বাবা গাড়ি চালাচ্ছেন।

 ঘাড়টা দেখা যাচ্ছে। ঘাড় আর পিঠ।

কিন্তু সেইটুকুতেই যেন ধরা পড়ে যাচ্ছে কান্তিকুমার ক্লান্ত। কান্তিকুমার আনন্দহীন।

বাবাকে ডেকে কিছু একটা বলবার জন্যে মনটা আকুল হয়ে উঠল। কিন্তু কী বলবে? আগের মতো কি আছে সুমনা? আগে ইন্টারমিডিয়েটের সময় কৌতুকচ্ছলে বলেছিল, বাড়ি গিয়ে বলব, ফেল করেছি। তুমি যেন ফাঁস করে দিও না বাবা।

কান্তিকুমার মেয়ের এই ছেলেমানুষিতে হেসে উঠেছিলেন, বলেছিলেন, কেন? এমন অদ্ভুত খেয়াল কেন?

বাঃ, বেশ কেমন মজা হবে। সবাই বলবে, এরকম হবেই জানতাম। একেবারে পড়ে না!…ছোটকাকা বলবেন, আড্ডাটা একটু কমাও হে। পরীক্ষা জিনিসটা ছেলেখেলা নয়। পরীক্ষার সময় গান স্পোর্টস আড্ডা! হল তো?

হেসে কুটি কুটি হয়েছিল সুমনা, ছোটকাকার সুরের নকল করে।

আজ সুমনা বাবাকে ডাকতে পারছে না।

যেন সুমনা সত্যিই অশুচি।

 এ অবস্থার কি প্রতিকার সম্ভব নয়?

অন্ধকার সেল থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের আলোয় বুদ্ধিকে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে পরিষ্কার করে নেয় সুমনা। বাবার কথাই শুনবে। এম. এ. পড়বে। সহজ হয়ে উঠবে। বাবাকে ডেকে সেই কথাই বলবে এক্ষুনি। আর বলবে, ওর জন্যে সেই যে কী আয়ার কথা বলেছিলে বাবা

হঠাৎ কান্তিকুমারের গম্ভীর মৃদুকণ্ঠ ধ্বনিত হল, বাড়ি গিয়ে সকলকে প্রণাম কোরো সুমনা।

চমকে উঠল সুমনা।

না, এই কণ্ঠের সামনে সহজ হওয়া সম্ভব নয়।

তবু একটু পরে আস্তে বলল, বাবা, ইউনিভার্সিটিতে শিগগির চেষ্টা করাই ভাল।

কান্তিকুমার একটু চুপ করে থেকে বলেন, তা হলে পড়বেই ঠিক করছ?

হ্যাঁ।

আর একটু চুপ করে গাড়ি চালাবার পর প্রায় বাড়ির দরজায় এসে উত্তর দেন, চেষ্টা করবার কিছু নেই। রেজাল্ট ভাল হয়েছে। সহজেই হবে।

কথাগুলো যেন যন্ত্র থেকে বার হচ্ছে। স্ক্রু ঢিলে শিথিল যন্ত্র।

বাবার ওপর কি করুণা করবে সুমনা?

 বাবার সঙ্গে যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে, যেমন করে হোক সে ব্যবধান দূর করবে? বাবাকে—

বাড়ির দরজায় এসে গাড়ি থামল।

আর

বাড়ি ঢুকেই ব্যর্থ হয়ে গেল সমস্ত সংকল্প। টানটান করে বাঁধা তারের বাজনা ছিঁড়ে, ছড়িয়ে পড়ল খানখান হয়ে।

দরজায় পা দিয়েই শুনতে পেল শিশুকণ্ঠের করুণ আর্তনাদ। উপর উপর কেঁদেই চলেছে।

কান্তিকুমার সে কান্না সম্পর্কে কোনও ব্যস্ততা দেখালেন না। তিনি এখন গাড়িতে চাবি লাগাবেন। ধীরেসুস্থে বাড়ি ঢুকবেন। ঢুকে নীচতলার অফিসঘরে বসবেন। যেখানে মক্কেলের দল বসে আছে ভিড় করে।

সুমনা বিদ্যুৎগতিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়। আর শুনতে পায় এক তীক্ষ্ণ বিষাক্ত ভাষা। যে বিষের জ্বালায় মুহূর্তে এম. এ. পড়ার সংকল্প ত্যাগ করে সুমনা। ত্যাগ করে বাবার পয়সায় ঝি রেখে বাবার বাড়িতে থেকে ছেলে আর নিজে দুজনে মানুষ হয়ে ওঠবার বাসনা।

সুজাতা।

হ্যাঁ, সুজাতার গলাই শুনতে পেয়েছে প্রথমে সুমনা। সে গলা তীব্র অসহিষ্ণুতার সঙ্গে মন্তব্য করল, এই হয়েছে শিক্ষা! কান মলছি বাবা, আর যদি কোনওদিন স্বীকার পাই। এরপর থেকে সুমি যদি বেরোয় যেন ছেলে গলায় ঝুলিয়ে বেরোয়।

দোতলার বারান্দায় পা দিয়েই শুনতে পায় ঠাকুমার কথা, তুমি আর পাড়া জানিয়ে ছেলে ছেলে কোরো না বউমা। শুনলে ঘেন্না করে। সেদিন অমনিই কার সামনে যেন বলে বসলে, সুমি ছেলে নিয়ে ঘরে বসে আছে। ইচ্ছে করে আর পাঁক তুলে গায়ে মেশোনা বাছা।

তা ছেলে না বলে নাম একটা দিলেই হয়, হেসে ভেঙে পড়ছে ছোটখুড়ি, আমরা তো ওকে যিশু বলতে শুরু করেছি।

শিশুকণ্ঠের কান্না ছাপিয়ে ওর হাসিটা তরঙ্গে তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।

মালবিকাও বদলে গেছে।

বোধ করি মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে।

অথবা সুমনার উগ্র প্রখর প্রবল মাতৃস্নেহের ভঙ্গি লক্ষ করে করে। ওইটাই তো বেশি সন্দেহজনক।

বুঝি ঝিটা পর্যন্ত বলে, আইবুড়ি মেয়েছেলের এত ছেলের আঁট! বাবার জন্মে দেখিনি বড়মা।

 যন্ত্রণা ওদেরও কি কম?

জেঠি খুড়ি ঠাকুমা পিসি জেঠা কাকার? ওরা তো ভেবে ঠিক করতে পারছে না, কোন্টা বেশি অপবিত্র? মাতৃপরিত্যক্ত রাস্তার জঞ্জাল, না কুমারী কন্যার কলঙ্কচিহ্ন?

সন্দেহের ফল অবিরত ছোবল দিচ্ছে তাদের।

সুমনা দোতলায় পৌঁছে কেমন করে মায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ছেলেটাকে, আর কেমন করে তাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই ধমাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, না, তার নিজেরই মনে পড়ছে না।

শুধু সুমনার স্পর্শমাত্র যে আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে গেল ছেলেটা, এই এক আশ্চর্য অনুভূতি অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন করে রইল তাকে।

সে অনুভূতি পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকল সমস্ত পরিমণ্ডলে।

একে ভাসিয়ে দিয়ে নিজেকে আবার সহজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে তোলবার ইচ্ছে পোষণ করছিল বলে ধিক্কার দিল নিজেকে।…

ফিকে হয়ে গেল বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল সোনালি রং।

এই ঘরের বাইরের পৃথিবীকে আর মনে রাখতে পারল না সুমনা।

মনে রইল না বাবার নির্দেশ।

মনে পড়ল।

 অনেকক্ষণ পরে মনে পড়ল।

 যখন ফুড তৈরি করে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ফেলতে পারল ছেলেটাকে।

কিন্তু তখন কি আর ঘরের দরজা খুলে বাড়ির সবাইকে প্রণাম করতে যাবে সুমনা?

শুধু দেরি হয়ে যাওয়ার বাধা নয়, প্রধান বাধা দরজা বন্ধ করার সেই দুম শব্দটা!

 হাতুড়ির ঘায়ের পর কি প্রণাম চলে?

.

কান্তিকুমার অনেক পরে ভিতরবাড়িতে ঢুকলেন। আশা করেছিলেন আজকের আবহাওয়া একটু অন্যরকম দেখবেন। আজ সুমনা কিঞ্চিৎ সহজ বুদ্ধিতে এসেছে, এভাবে নিজেকে একটা ভাবপ্রবণতার কাছে বিকিয়ে দেওয়া যে বোকামি তা বুঝতে পেরেছে, অতএব আজ অবশ্যই তার সেই উগ্র জেদের চেহারাটা বদলেছে।

আর তার পরীক্ষার এই সাফল্যের খবর নিশ্চয়ই বাড়ির অন্যান্য সদস্যকেও নরম করেছে। তাই নিজেই অনেকটা আগের মতো নরম আর প্রসন্ন মন নিয়ে বাড়ির মধ্যে এলেন কান্তিকুমার।

কিন্তু কই? কোথায় আবহাওয়ার উজ্জ্বলতা?

বাড়ির সর্বত্র জ্বলছে বটে চড়া পাওয়ারের আলো, কারণ কান্তিকুমার দেখতে পারেন না মিটমিটে ঘোলাটে আলো, তাই বাড়ির ভাঁড়ার ঘর পুজোর ঘর থেকে শুরু করে সিঁড়ির তলাটিতে পর্যন্ত চড়া পাওয়ারের বাল্ব লাগানো। তবু ভেতর দালানে পা দিয়েই মনে হল কান্তিকুমারের, সমস্ত আলোগুলো যেন ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। আর সমস্ত সংসারটা যেন ভয়ানক কোনও একটা আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেছে।

এ আঘাত কার হাত থেকে এল?

কান্তিকুমার পরিবেশটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। কর্তাপুরুষ বাইরে থেকে বাড়িতে ফিরলে যে চাঞ্চল্য বা স্বীকৃতি স্বাভাবিক নিয়মেই দেখা যায়, তার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না।

অবশ্য আগে কান্তিকুমারকে দেখলেই সকলের মধ্যে যে একটা তটস্থ ভাব দেখা যেত, সেটা কান্তিকুমারের মেয়ের অপরাধেই যেন ক্রমশ হারাচ্ছিলেন কান্তিকুমার, কিন্তু আজকের ধরনটা আরও শোচনীয়।

দালানের ও-কোণে ঠাকুরঘরের সামনে যোগমায়া হরিনামের মালাগাছটা হাতে করে বসে ছিলেন, যেমন ছিলেন তেমনিই রইলেন, শুধুমাত্র একটা উদাসীন দৃষ্টিপাত করলেন ছেলের দিকে।

স্বর্ণপ্রভা উজ্জ্বল আলোর নীচে বসে বইয়ের লেখা লাইনের তলায় আঙুল রেখে রেখে তাঁর গুরুগ্রন্থজীবে দয়া ও ঈশ্বরপ্রেম পাঠ করছিলেন, তিনি উদাসীন দৃষ্টিপাতটুকুও করলেন না। যেন দেখতেই পেলেন না দেবরকে। মালবিকা মাথা নিচু করে পান সাজছিল, পানই সাজতে লাগল। কান্তিকুমারের যে বিধবা ভাগ্নীটি বিধবা হয়ে ইস্তক এ বাড়িতে রয়েছে সে একখানা চটের আসনে ফুল তুলছিল, তুলতেই লাগল, শুধু ঘাড়টা আরও নিচু করল।

সাধারণত এই সান্ধ্য আসরে সুজাতা থাকেই। হয় বসে সুপুরি কুচোয়, নয় একতাল মাখা ময়দা নিয়ে লেচি কাটে বসে বসে, নিদেনপক্ষে পরদিন সকালের জন্যে কুটনো কোটে। কিন্তু আজ সুজাতা অনুপস্থিত।

বুড়ি ঝিটা পর্যন্ত নিশ্চুপ।

কই গো দাদাবাবু মেয়ের পাসের সন্দেশ কই? বলে ছুটে এল না। একপাশে পা ছড়িয়ে বসে নিজের পায়ে নিজেই তেল ডলছিল, শুধু পা-টা একটু গুটিয়ে বসল।

কান্তিকুমারের মেয়ের যে আজ মস্ত একটা সাফল্যের খবর ওরা জেনেছে, এটা ওদের মুখ দেখে বোঝা গেল না।

কিন্তু এত থমথমে অবস্থা অকারণও নয়। কান্তিকুমার এক মিনিট দাঁড়ালেন, তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন।

দেখলেন, দোতলার সামনেই মেয়েদের পড়ার ঘরে অঞ্জু অরুণা, জয়ন্তীকুমারের ছোট ছেলে দুটো আর ভাগ্নীর মেয়ে সবিতা নিঃশব্দে বসে লুডো খেলছে। অজীন অভীককে দেখতে পেলেন না।

কান্তিকুমারকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল দু-একজন। কান্তিকুমার বললেন,থাক থাক, তোমরা খেলো।

ছোটরা সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

অথচ এই শিশুদের রাজ্যে কান্তিকুমারের ছিল রাজাসন। আগে হলে কান্তিকুমার সহাস্যে ঘরে ঢুকে পড়ে বলতেন, কে জিতছে? কে হারছে?

ওরা হইহই করে জানাত হার-জিতের খবর। কান্তিকুমার বসে পড়ে বলতেন,আচ্ছা দেখি আমায় কে হারাতে পারে।

মহা কলরব পড়ে যেত ওদের মধ্যে। কে কান্তিকুমারের ঠিক পাশটিতে বসবে তাই নিয়ে প্রায় মারামারি লেগে যেত। আজ ওরা সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ওরাও বুঝে ফেলেছে বাড়ির অবস্থা আর স্বাভাবিক নেই।

ওরাও তাই ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে, নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। সংসারের সেই আনন্দ কোথায় গেল? সেই রং কোথায় গেল? কে যেন মুঠোয় করে চেপে উপড়ে নিয়েছে সে আনন্দ, হাতের তেলোয় মুছে নিয়েছে সে রং।

কে?

 কে সে? কোন নিষ্ঠুর ব্যক্তি? ভাগ্য?

কিন্তু কান্তিকুমার কি ভাগ্যের সেই নিষ্ঠুরতাকে পরাজিত করতে পারেন না? নিজের জোরে আবার আনতে পারেন না সেই আনন্দ, সেই রং? আবার আগের মতো এই ছোটদের নিয়ে হইহই করে বেড়াতে যেতে পারেন না? সার্কাস দেখাবার কি একজিবিশন দেখাবার, গান শোনাতে নিয়ে যাবার কি খাবার-দাবার বেঁধে নিয়ে পিকনিক করতে যাবার হুজুগ তুলে ওদের মাতিয়ে দিতে পারেন না?

আর এখন ওদের কাছে গিয়ে বলতে পারেন না, কী? কে জিতছে? কে হারছে?

.

না, তা পারবেন না কান্তিকুমার।

 গলায় সে সুর ফুটবে না। সুরহীন চেষ্টাকৃত ভাষা নেহাত বেখাপ্পা লাগবে।

নিজেকে নিজের মনের মতো ছাঁচে গড়তে চাইলেই কি গড়তে পাওয়া যায়? সংসারের মধ্যে সেই স্বয়ংসম্পূর্ণতার জায়গা কোথায়? পরিবেশের খাঁজে খাঁজে তো বসাতে হবে নিজেকে। অতএব পরিবেশই হচ্ছে গঠনকর্তা।

সেই পরিবেশ অহরহ নিত্য নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, নিজেকে বিকৃত করছে, ছাঁচ বদলাচ্ছে। কে পারবে তবে জোর করে বলতে, আমি বদলাব না, আমি যা আছি তাই থাকব।

তা থাকলে, কোন খাঁজে বসাবে মানুষ নিজেকে? কোন খাপে খাপ খাওয়াবে? নেই কোথাও সেই নিজের গড়নের খাপ।

তবে আর কী করা?

 বেমানান হবার ভয়ে বদলাতে হবে নিজেকেই। সেই বদলানো নিজেকেই বসিয়ে নিতে হবে বিকৃত সেই ছাঁচের খাঁজে খাঁজে।

তাই কান্তিকুমারকে শান্ত শিথিল গলায় বলতে হচ্ছে,থাক থাক, তোমরা বোসো৷ বলে চলে যাচ্ছিলেন, যেতে গিয়ে ফিরলেন। বললেন, অজি অভিকে দেখছি না?

অঞ্জনা মাথা নিচু করল।

অরুণা আর সবিতা উসখুস করল; আর ওদের ছোটকাকার ছোট ছেলেটা হি হি করে বলে উঠল, সেজদা নদা-কে মেজ জেঠিমা মেরে তুলো ধুনেছে।

কান্তিকুমার যেন হঠাৎ সামনে সাপ দেখলেন। বিচলিত হয়েও স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, কী করেছেন?

অরুণা ভাইকে আর কথা কইতে না দিয়ে তাড়াতাড়ি বলে, কী অসভ্য তুই। আঃ। না না, কিছু না। এমনি দুষ্টুমি করছিল তাই

কিন্তু কথা বলবার সুযোগ যে পেয়েছে সে কি আর ছাড়ে? তাই দিদিকে থামিয়ে বলে,দিদা যে বললে, মেরে তুলো ধুনে দাও অমন ছেলেদের। তুলো ধোনা মানে কী জানো মেজজেই? মানে হচ্ছে

.

কিন্তু মেজজেঠু ততক্ষণে চলে গিয়েছেন, সরে গিয়েছেন।

.

কিন্তু কোথায় সরবেন কান্তিকুমার?

কোথায় চলে যাবেন?

ছেলেদের গায়ে হাত তোলা কান্তিকুমারের চিরদিনের বিরক্তিকর। বাড়ির সকলেই মেনে চলত এ নির্দেশ। সুজাতা তো নিশ্চয়ই। কিন্তু আজ পালা বদলেছে। আজ সংসারে কান্তিকুমারের সেই গৌরবের আসন আর নেই। আজ তাঁর বিরক্তিকে কেউ ভয় করছেনা। আজ কান্তিকুমারের মা অনায়াসেই বলতে পারেন, ওদের মেরে তুলো ধুনে দে–আর কান্তিকুমারের স্ত্রী নির্ভয়ে তা করতে পারে।

ওরা বুঝে ফেলেছে কান্তিকুমারকে ভয় না করলেও চলে।

হয়তো এও এক সাংসারিক নিয়ম। হঠাৎ যদি কারও চোখে পড়ে যায়, অকারণ একটা ভয়ের কাছে কাঁটা হয়ে ছিলাম, অর্থহীন একটা আশঙ্কায় জড়সড় হয়ে থাকতাম, ওটা নিষ্প্রয়োজন, তা হলে ভয় ভাঙার নিষ্ঠুর খেলায় সবাই মেতে ওঠে।

সুজাতা বুঝে নিয়েছে কান্তিকুমার এই ছেলে মারা নিয়ে তীব্র তিরস্কার করতে পারবেন না সুজাতাকে। যদি করতে আসেন, সুজাতা মুখর হয়ে উঠবে। তার কত জ্বালা কত যন্ত্রণা শতমুখে তার ব্যাখ্যা করতে বসবে। সুজাতার সেই সাহস জোগান দিচ্ছে কান্তিকুমারের অবাধ্য মেয়ে।

যে কান্তিকুমার নিজের একটা অবাধ্য মেয়েকে শাসন করতে পারেন না, তিনি আবার অন্যকে শাসন করতে আসেন কোন মুখে? এই অভিযোগ লেখা রয়েছে সংসারের প্রত্যেকটি সদস্যের মুখের রেখায়। সুজাতাও তাদের ছাড়া নয়।

.

দুঃসহ একটা পাষাণভার নিয়ে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন কান্তিকুমার। যে ঘরটা দালানের একেবারে শেষ প্রান্তে। এই ঘরটাই নাকি বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে ওঁচা, অন্তত সুজাতার তাই ধারণা; তবু একদা কান্তিকুমার এই ঘরটাই বেছে নিয়েছিলেন কোণের দিকে বলে। চলাচলের পথ নয় বলে।

ঘরের মধ্যে দিয়েই আর একটা ছোট ঘর। সেই ঘরে কান্তিকুমারের একক শয্যা। বড় ঘরটায় জোড়া খাটে সুজাতা শোয় দু ছেলে নিয়ে। মেয়েরা শোয় অন্যত্র। কান্তিকুমার দেখলেন সেই খাটের উপর সুজাতা বসে আছে একটা বই হাতে নিয়ে। আর ছেলে দুটো বিছানায় পড়ে আছে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে।

দুরন্ত ছেলে দুটোর এই দৃশ্য যেমন বিস্ময়কর তেমনি বিস্ময়কর সুজাতার হাতে বই। কান্তিকুমার একবার দুটো দৃশ্যের প্রতিই দৃষ্টিপাত করলেন। তারপর নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।

কিন্তু সুজাতা এই নিঃশব্দ বেদনাকে সমীহ করবে না। সুজাতা প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে। তাই পরমুহূর্তেই বইটা ফেলে রেখে ও-ঘরের দরজায় গিয়ে বলে ওঠে, তুমি কী ঠিক করেছ? একটা কিছু বিহিত করবে, না আমি গলায় দড়ি দেব?

কান্তিকুমার ঈষৎ বিদ্রুপের স্বরে বলেন, ওকাজটা কি কেউ কারও অনুমতি নিয়ে করে?

 তবু জানিয়ে রাখলাম। সংসারের এই অবস্থা চলতে থাকলে গলায় দড়িই দিতে হবে আমায়।

কান্তিকুমার আরও বিদ্রুপের সঙ্গে বলে ওঠেন,কেন, ছেলে ঠেঙিয়ে গায়ের জ্বালা কমিয়ে ফেলা যাচ্ছে না? জ্বালা কমাবার ওইটাই তো শ্রেষ্ঠ পন্থা তোমাদের।

ওঃ, সেটি ইতিমধ্যেই টের পাওয়া হয়েছে। শুধু টের পাও না রাতদিন কী অশান্তিতে আমি কাটাচ্ছি। ছেলে ঠেঙানোটাই দেখলে, কেন ঠেঙালাম সেটা একবার বুঝতে চাইছ?

ওটা বোঝবার ক্ষমতা আমার নেই।

 তা থাকবে কোথা থেকে? নিজের সংসারটি কেমন তা তো আর জানলে না কোনওদিন।

জানাবার সাহসই যে এযাবৎ কোনওদিন হয়নি সুজাতার, সে কথা মনে পড়ল না তার। তার মনে হচ্ছে কান্তিকুমার একটু জোর করলেই সুমনা-ঘটিত ব্যাপারটার হেস্তনেস্ত একটা হত, ইচ্ছে করেই সে জোর-টুকু করছেন না কান্তিকুমার। তলে তলে মেয়ের প্রতি তাঁর প্রশ্রয় আছে।

মেয়েরা যখন সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, ভাবে আমার ভাগ্য। আমার প্রাপ্য পাওনা পাচ্ছি। যখন অসুবিধেয় পড়ে তখন স্বামী নামক জীবটাকে সমস্ত যন্ত্রণার কারণস্বরূপ ধরে নিয়ে তাকে ছোবল হেনে হেনে যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করে।

সুজাতাও মেয়ে।

কিন্তু আশ্চর্য!

সহসা সংসারটা এমন নিরাবরণ হয়ে গেল কী করে? কান্তিকুমার বলেন, এযাবৎ একান্নবর্তী পরিবারের যে মধুর স্বপ্ন দেখে এসেছেন তিনি, আর যার একটি সুষ্ঠু রূপ দিতে সমস্ত অর্থ আর সামর্থ্য ব্যয় করেছেন, সেটা তা হলে কিছুই না? এই নিরাবরণ নির্লজ্জতার জন্যেই উদগ্রীব হয়ে ছিল সবাই? একটা উপলক্ষ পেয়ে বেঁচে গেছে? সভ্য থাকবার দায়টা ঘুচিয়ে ফেলে উল্লসিত হয়ে উঠছে।

বন্য আদিবাসীদের থেকে সভ্যসমাজ নাকি অনেক দূরে সরে এসেছে। কান্তিকুমারের হঠাৎ মনে হল কথাটা। আর মনে হল, না। একতিলও সরে আসিনি। বন্যতা বর্বরতাই আমাদের মূল কাঠামো। তাই নগ্ননৃত্যেই আমাদের আনন্দ। উপরের খোলসটা খুলে ফেলবার সুযোগ এলেই তাই এমন খুশিতে উন্মাদ হয়ে উঠি।

ভাবলেন, কথায় কথা বাড়বে।

তাই সুজাতাকে আর কিছু না বলে ছেলেদের প্রশ্ন করলেন,অজি অভি, খাওয়া হয়েছে তোমাদের?১৯০

বলা বাহুল্য, উত্তর মিলল না।

শুধু উঠল একটা ক্রন্দনোচ্ছ্বাস। বুঝলেন খাওয়া হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনার সাহসও হচ্ছে না। কে জানে কোন কেঁচোর নীচে কোন কেউটে ছোবল দেবার জন্যে অপেক্ষা করছে।

এড়ানোই ভাল। ওদের যা অবস্থা, ওরা খেতে পারবেও না।

 কিন্তু এড়াবো বললেই কি এড়ানো যায়? শেষ পর্যন্ত কেউটের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। কারণ সুজাতা আজ বদ্ধপরিকর হয়ে বসে আছে, আজকের ব্যাপার বলবে বলে। অথচ ব্যাপারের কারণটা নিতান্তই তুচ্ছ। পিঠোপিঠি দুই ভাই সাধারণ রীতিতেই কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া শুরু করেছিল, এবং যথানিয়মেই সেটা ক্রমশ মারামারির উচ্চগ্রামে উঠেছিল। কিন্তু অহরহ দেখা এই দৃশ্য দেখে সহসাই নাকি আজ যোগমায়া মন্তব্য করে বসেন, এমন অসভ্য ছেলে নাকি তিনি ভূভারতে দেখেননি, মা বাপের প্রশ্রয়েই নাকি মেজবউয়ের ছেলেমেয়েরা পাজির পা ঝাড়া হয়ে হয়ে তৈরি হচ্ছে। যোগমায়ার নিজের যদি এক্তার থাকত এইসব ব্যাদড়া পাজি ছেলেদের মেরে তুলো ধুনে শায়েস্তা করতেন।

এরপরেও ছেলেদের না মেরে চুপ করে থাকতে পারবে, এত ঠাণ্ডা রক্ত সুজাতার নয়। মেরেছিল, বেদমই মেরেছিল। আর তখন সুজাতার গুণের ধ্বজা মেয়ে দোতলা থেকে নেমে এসেছিলেন মাকে শাসন করতে! যে মেয়ের জন্যেই এত অপমান।

হ্যাঁ, মেয়েকে রেয়াত করেনি সুজাতা। সুমনা যখন তীব্র তিরস্কার করেছিল, মা, কী হচ্ছে কি? বাড়িটা যে ক্রমশ নরক করে তুলছ তোমরা!

তখন সুজাতা বলেছিল, সুমনার লজ্জা করে না একথা বলতে? নরকের পাপ ঘরে তুলে এনে সুমনাই তো সংসারকে ছারখার করল। সুজাতাদের এত অপমানিত অপদস্থ হয়ে থাকার কারণ কে? ইত্যাদি

সুমনা চুপ করে গিয়েছিল।

তারপর আস্তে আস্তে চলে যাবার সময় বলে গিয়েছিল,আচ্ছা, শিগগিরই তোমাদের মুক্তি দিয়ে যাব।

এখন সংসারের সবাই বলছে, সুমনা হয় বিষ খেয়ে, নয় গলায় দড়ি দিয়ে কেলেঙ্কারির চরম করবে, এবং তার জন্যে দায়ী সুজাতাই। বাড়ির ছোট ছেলেরা দুষ্টুমি করলে বড়রা বকেই থাকে, সেই রাগে সুজাতা যদি ছেলেদের খুন করতে বসে, আর অতবড় তেজি মেয়েকে গালমন্দ করে, তা হলে সংসার আলাদা করা ছাড়া পথ নেই। এবং বোঝা যাচ্ছে, সেটাই সুজাতার অভিপ্রেত।

তবে?

বলুন কান্তিকুমার সুজাতার করণীয় কী?

কান্তিকুমার গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, কথা বস্তুটাকে একটু ঝেড়ে ফেলতে শিখলেই সব জিনিসটা সহজ হয়ে যায়।

ঝেড়ে ফেলতে! তুমি পারো ওইরকম সব কথা ঝেড়ে ফেলতে?

কান্তিকুমার এক মিনিট তাকিয়ে থেকে বলেন, তবে কি তোমার ধারণা, কথার জ্বালায় অস্থির হয়ে ওই বাচ্চা দুটোকে পিটোতে বসতাম?

পুরুষের কানে সংসারের নীচ কথাগুলো তো সব ওঠে না—

কেন ওঠে না সেটাই বরং নির্ণয় করো।

তা হলে তুমি কোনও কিছুর প্রতিকার করবে না?

কীসের প্রতিকার?

সুমি এইভাবেই চালিয়ে যাবে?

উপায় কী? যদি কখনও ওর নিজের দিক থেকে সহজ হবার প্রেরণা আসে, যদি

আর যদি ও আত্মহত্যা করে বসে-বলেই হঠাৎ সুজাতা হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে।

কান্তিকুমার ওর কান্নাকে একটু থামতে দিতে সময় দেন। তারপর ক্ষীণ একটু হেসে বলেন,সে ভয় কোরো না সুজাতা। যে বন্ধনের পাকে নিজেকে জড়িয়েছে ও, সে পাক থেকে মুক্ত হয়ে মরবারও ক্ষমতা নেই ওর।

.

না, কান্তিকুমারের হিসেবে ভুল নেই।

 মরে অপমানের জ্বালা জুড়োবে, সে ক্ষমতা হয় না সুমনার। যদিও সেদিন রাগের মাথায় মনে হয়েছিল তার, মরে এদের জব্দ করতে পারি! ঠিক হয়।

কিন্তু ওই ছেলেটাকে ঠিক কোন অবস্থায় রেখে মরা চলে, সেটা ভাবতে ভাবতে মরার ইচ্ছেটা জুড়িয়ে গেল। এখন শুধু চিন্তা, কী করে সংসারকে মুক্তি দিয়ে চলে যাওয়া যায়।

তা সে চিন্তাই কি দানা বাঁধতে পারে? যতক্ষণ না ও একটু বড় হচ্ছে–

তাই মরাও হয় না, চলে যাওয়াও হয় না। শুধু আরও একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে সুমনা, আরও মৌনী। আর সংসার থেকে আরও বিচ্ছিন্ন।

এমনি করে দিন যায়।

আর সংসারে এক-একদিন এক-একটা ঘটনা ঘটতে থাকে, যেটা ইচ্ছাকৃত।

আর দিনে দিনে

প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে প্রতি পলে পলে অনুভব করতে পারছে সুমনা কোন প্রাণে মা ফেলে দিয়ে যায় শিশুকে।

শুধু একটু মমতার দায়েই যদি জীবন এমন বিড়ম্বিত হয়ে ওঠে, মস্ত একটা ভুলের দায়ে কলঙ্কিত জীবনে তবে কত বিড়ম্বনা এসে জোটে।

একটা শিশু!

কতটুকু বা ওজন।

 কিন্তু কী ভয়ানক তার ভার।

সে ভার কেবলমাত্র একা বহন করব, এ প্রতিজ্ঞা অবাস্তব।

 তার খাওয়া চাই, পরা চাই, আশ্রয় চাই, আগলাবার লোক চাই।

সুমনা যদি নিজেকে ফসিল করে ফেলেও ওকে আগলে বসে থাকে, বাকি জিনিসগুলোর জন্যে তো মুখাপেক্ষী হতে হবে ওর প্রতি নিষ্করুণ এই সংসারের কাছে।

হচ্ছেই তো।

 ওর যা প্রয়োজন তা নিয়মিত এসে পৌঁছয় সুমনার ঘরে।

 ভালবাসার উপহার হিসেবে নয়।

হয়তো দয়ার দান হিসেবে, হয়তো দায়ের ঋণ শোধ হিসেবে। কান্তিকুমারের হুঁশ আছে।

অঞ্জনা অভীক অজীন কেউ না কেউ রেখে যায় ঘরে, কান্তিকুমারের হুঁশের পরিচয়।

সুমনা যদি ওই দয়ার দান না চায়, সুমনা যদি উপার্জন করতে নামে, কে একে আগলাবে? কী করে রেখে যাবে একে এই বিমুখ সংসারের কাছে?

আর যদি সুমনা এ আশ্রয় ত্যাগ করে?

ভেবে পায় না, ঠিক তার পরমুহূর্তটা কী হবে? কোথায় গিয়ে প্রথম দাঁড়াবে একটা বসতে পর্যন্ত না শেখা ছেলেকে নিয়ে?

আশ্রয় ত্যাগ করা সোজা নয়।

 বহু লাঞ্ছনা সহ্য করে আশ্রয়টাকে আঁকড়ে থাকে মানুষ।

বিশেষ করে মেয়েমানুষ।

জগতের কোটি কোটি শিশুর রক্ষয়িত্ৰী আর পালয়িত্রী!

মা, আত্মীয়া, ঝি, নার্স, করুণাময়ী প্রতিবেশিনী, কাউকে না কাউকে চাই শিশুর, যতক্ষণ না সে শিশু পৃথিবীর মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়াতে শেখে।

সুমনার ছেলে কতদিনে দাঁড়াতে শিখবে?

আর কতদিনে শিখবে সত্যিকার নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে?

তবে তো ছুটি সুমনার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *