এগারো
পরদিন সকাল দশটা। জাহাজ ছাড়তে এখনও এক ঘণ্টা বাকি। একটি ক্যানু থামল এসে লা ফোদরের পাশে। এক রেড ইন্ডিয়ান মই বেয়ে উঠে এল। দলা পাকানো একটি কাগজ দিল সে লিভাসের হাতে।
কাগজটা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল ত্রস্ত হাতে লেখা গভর্নরের মেয়ের চিঠি। লিখেছে:
ডার্লিং, আমি এখন ওলন্দাজ জাহাজ জংভরো-তে। একটু পরেই জাহাজ ছাড়বে। বাবা আমাকে ইউরোপে ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সে আমাদের জন্মের তরে আলাদা করে দিতে চায়। তুমি আমাকে বাঁচাও!
শুধু তোমারই
ম্যাডেলিন।
সমুদ্রের চারপাশে বন্য দৃষ্টি বুলাল, লিভাসে। কিন্তু ওলন্দাজ জাহাজটিকে দেখতে পেল না। রেড ইন্ডিয়ানটিকে কি যেন জিজ্ঞেস করাতে সে আঙুলের ইশারা করল। বহুদূরে একটি পাল দেখা যাচ্ছে।
ওই যে যায়, বলল রেড ইন্ডিয়ান।
যায় মানে! ফরাসির মুখ ফ্যাকাসে। কড়া মেজাজে দূতকে জিজ্ঞেস করল, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আগে আসেনি কেন? জবাব দাও!
পিছু হটে গেল আতঙ্কিত রেড ইন্ডিয়ান। লিভাসে ওর গলা চেপে ধরে দুবার ঝাঁকিয়ে পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। দূত বেচারা সাঁতার জানে না, পাথরের মত পানির অতলে তলিয়ে গেল।
মাথা ঠাণ্ডা করুন, ক্যাপ্টেন। কি হয়েছে? লেফটেন্যান্ট কাহুসাক ওর কাঁধে হাত রেখে জানতে চাইল।
তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে ওকে সব জানাল লিভাসে।
মাথা ঝাঁকাল কাহুসাক। অসম্ভব! কোন ওলন্দাজ জাহাজকে আক্রমণ করার প্রশ্নই ওঠে না।
কে ঠেকাবে আমাদের? গর্জে উঠল লিভাসে।
আপনার কুরা রাজি হবে না। তাছাড়া ক্যাপ্টেন ব্লাডের মতামতও তোনিতে হবে।
ক্যাপ্টেন ব্লাড-ফ্লাড চিনি না…
চিনতে হবে। আমি যদ্দূর জানি সে রাজি তো হবেই না উল্টো একথা শুনলে আমাদেরই ডুবিয়ে,মারবে। ওলন্দাজদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ওর।
আহ, দাঁতে দাঁত পিষে বলল ক্যাপ্টেন লিভাসে। ভাবছে। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল। কাহসাক ঠিকই বলেছে। রাড় তার উপস্থিতিতে ওলন্দাজ জাহাজটিতে হামলা চালাতে দেবে না। ফলে, যা করার ওর আড়ালে করতে হবে; যাতে পরে জানতে পারলেও বাধা দেয়ার সুযোগ না থাকে।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে অ্যারাবেলা আর লা ফোরে অভিযানে বেরিয়ে পড়ল। ওলন্দাজ জাহাজটি সারাদিন দৃষ্টিসীমার ভেতরেই রইল। কিন্তু সন্ধের দিকে উত্তর দিগন্তে, ছোট্ট একটা বিন্দুর মত দেখা যেতে লাগল ওটাকে। ব্লাড ও লিভাসে পুবে হিসপ্যানিওলার উপকূল বরাবর স্যালটাটুভোস নামে একটি দ্বীপের উদ্দেশে যাবে ঠিক করেছে। অ্যারাবেলা সারা রাত নির্ভুল নিশানায় এগোল। ফলে, সকাল হলে দেখে সঙ্গের জাহাজটি নেই। রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব উত্তরদিকে ধেয়ে গেছে লা ফোদরে।
কাহুসাক আপত্তি জানিয়েও সুবিধে করতে পারেনি।
বোকা কোথাকার! ধমকে বলেছে লিভাসে। জাহাজ তো জাহাজই, তার আবার স্প্যানিশ আর ওলন্দাজ কিসের?
লেফটেন্যান্ট অগত্যা মুখ বন্ধ রেখেছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন একটি মেয়ের জন্যে কথার বরখেলাপ করায় দুঃখিত হয়েছে সে।
ভোর থেকেই জংভরোর লাগোয়া হয়েছে লা ফোদরে। যার কারণে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে ওলন্দাজ জাহাজটিতে। ম্যাডেলিনের ভাই লিভাসের জাহাজ চিনতে পেরে ক্যাপ্টেনকে সতর্ক করেছে। জংভরো সব কটা পাল তুলে দিয়ে পালানোর জন্যে মরীয়া চেষ্টা চালাল। কিন্তু লা ফোদরের গতিকে হার মানানো সহজ নয়। লা ফোদরে থেকে প্রতিপক্ষের উদ্দেশে আচমকা গুলি চালিয়েছে লিভাসে। ওয়ার্নিং শট। জংভরোর সব কটা বন্দুক থেকে মুহূর্তে প্রত্যুত্তর এল। কিন্তু পেশাদার জলদস্যদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না ওলন্দাজরা। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাদের জাহাজ শক্রর দখলে চলে গেল। লিভাসে সদলবলে জংভয়োর ডেকে এসে উঠেছে।
ওলন্দাজ ক্যাপ্টেন শুকনো মুখে আগে বাড়ল। পেছনের ফ্যাকাসে যুবকটিকে চিনতে কষ্ট হলো না লিভাসের। গভর্নরের ছেলে।
ক্যাপ্টেন লিভাসে, আপনি অন্যায় করেছেন। এর শাবি পেতে হবে, রাগান্বিত ওলন্দাজ ক্যাপ্টেন বলল। আমার জাহাজে কি চান?
প্রথমে আমার জিনিস বুঝে নিতে চাই, বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বলল লিভাসে। কিন্তু আপনি যেহেতু যুদ্ধ বেছে নিয়েছেন সেহেতু এ জাহাজ এখন আমার। যুদ্ধে আমিই জিতেছি।
ম্যাডামজেল ডি ওগের ওপর ডেক থেকে প্রেমিকের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাইল। কি চমৎকার লাগছে লিভাসেকে, একদম নায়কের মত। লিভাসেও প্রেমিকাকে দেখতে পেয়েছে। আনন্দে চিৎকার করে দৌড় লাগাল। ক্যাপ্টেন তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে কালক্ষেপণ করল না সে। কুড়ালের এক আঘাতে ক্যাপ্টেনের মাথা ফাঁক করে দিল। রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। প্রেমিক লিভাসে ক্যাপ্টেনের শরীরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরতে ছুটল।
ম্যাডামজেল পিছু হটে গেছে। ভীত। প্রেমিককে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলল, কেন, কেন খুন করলে ওঁকে?
নায়কের অনুকরণে অট্টহাসি হাসল লিভাসে। ও আমাদের পথের কাঁটা ছিল। যে আমাদের দুজনকে আলাদা করতে চাইবে তারই ওই দশা হবে।
মৃদু হেসে প্রেমিকার দিকে আবার চাইল ও। কিন্তু পাল্টা হাসি ফুটতে দেখল না। প্রেমিকের নিষ্ঠুরতার নিদর্শন চাক্ষুষ দেখেছে মেয়েটি। এই প্রথম। হঠাৎ উপলব্ধি করল বাপ-ভাইরা এ লোক সম্বন্ধে এতদিন যা যা বলেছে সব সত্যি।
ম্যাডামজেল ঘুরেই এক দৌড়ে কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ফোঁপাচ্ছে।
.
বারো
পরদিন ভোরে স্যালাটুডোসের সৈকতে অদ্ভুত একটি দৃশ্যের অবতারণা হলো। একটা খালি পিপের ওপর বসে ফরাসি, বোম্বেটে লিভাসে কাহুসাক ও অন্যান্য জলদস্যুদের সঙ্গে জরুরী বৈঠক করছে। ম্যাডামজেলের ভাই ইয়াং ডি ওগেরন তার সামনে দাঁড়ানো, দুজন নিগ্রোর প্রহরায়। তার পরনে কোট নেই, তরোয়ালটিও কেড়ে রাখা। হয়েছে; দুহাত পেছনে বাধা। সুদর্শন যুবকটির চেহারা এখন মড়ার মত বিবর্ণ। কাছেই একটি বালির টিবির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে তার। বোন। সে-ও প্রহরাধীন। অসম্ভব ভয় পেয়েছে।
লিভাসে ডি ওগেরনের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলল। শেষে জুড়ল, সব পরিষ্কার নিশ্চয়ই? জরুরী শর্তগুলো আবার বলে দিচ্ছি, যাতে কোন ভুল বোঝাবুঝি না হয়। বিশ হাজার স্প্যানিশ কয়েন হচ্ছে তোমার মুক্তিপণ। টাকাটা জোগাড় করতে টরটুগায় যেতে পারবে তুমি। আমিই জাহাজ দেব। এক মাসের ভেতর টাকা নিয়ে ফেরত আসতে হবে। ততদিন তোমার বোন আমার জিম্মায় থাকবে।
যুবক মাথা উঁচিয়ে সরাসরি লিভাসের চোখে চোখে চাইল।
আমি প্রত্যাখ্যান করছি, দৃঢ়তার সঙ্গে জানাল।
না বুঝেই! হেসে বলল লিভাসে। তুমি কি চাও তোমার বোনের ক্ষতি হোক?
যুবকের চেহারায় ভয়ের ছাপ পড়তে দেখল লিভাসে। বোনের দিকে বন্য দৃষ্টি হানল ডি ওগেরন।
নিজে বাঁচো, বোনকে বাঁচাও, বলে চলল লিভাসে। যে টাকা চেয়েছি তা তোমার বাপের কাছে নস্যি। কমই চাওয়া হয়েছে। কাজেই পুরোটা আদায় করে নেব।
কিসের জন্যে টাকা চেয়েছেন জানতে পারি? আমুদে গলায় প্রশ্ন করেছে কে একজন। সবার মাথার ওপর দিক থেকে এসেছে কণ্ঠটি।
চমকে সেদিকে চাইল লিভাসে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। পেছনের বালির ঢিবিতে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা, পাতলা গড়নের এক লোক। ক্যাপ্টেন ব্লাডের মুখে তখনও হাসি লেগে রয়েছে।
লিভাসে বিস্ময়ের ধ্বনি করে উঠে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন ব্লাডকে এখানে দেখবে কল্পনাও করেনি। ওদের দেখা হওয়ার কথা ছিল বন্দরে। সেটি এখান থেকে অনেক দূরে। ব্লাড ধীরে ধীরে ঢিবির চুড়ো থেকে নেমে সৈকতের দিকে এগিয়ে এল। তাকে অনুসরণ করছে উলভারস্টোন এবং আরও ডজন খানেক লোক। কাছে এসে ম্যাডেলিনের সম্মানে হ্যাট খুলল ব্লাড। তারপর ফিরল লিভাসের দিকে।
গুড মর্নিং, মাই ক্যাপ্টেন, বলল ও। আপনাকে মীটিং প্লেসে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পড়েছি। কিন্তু এঁরা কারা?
লিভাসে ঠোঁট কামড়ে নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। দেখতেই তো পাচ্ছেন–দুজন বন্দী।
ও, পানিতে ভেসে এসেছে বুঝি?
না, লিভাসের সংক্ষিপ্ত জবাব। এরা একটা ওলন্দাজ জাহাজে ছিল।
আপনি কি কোন ওলন্দাজ জাহাজ পাকড়াও করেছেন নাকি?
হ্যাঁ। এরা আমার বন্দী- ব্যাপারটা ব্যক্তিগত। দুজনই ফরাসি।
ফরাসি! ব্লাডের নীল চোখজোড়া প্রথমে লিভাসে পরে বন্দীদের পরখ করল।
ডি ওগেরন আগের মতই ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। এ মুহূর্তে চেহারায় ভয়ের লেশমাত্র নেই। সেখানে এখন আশা। এ লোকটি হয়তো কোন সাহায্য করতে পারবে। তার বোনের অনুভূতিও ভিন্ন নয়। সে সামনে ঝুঁকে রয়েছে, ঠোঁট ফাঁক।
ক্যাপ্টেন ব্লড চিন্তিত ভঙ্গিতে লিভাসের উদ্দেশে ভ্রূকুটি করল।
মনে হচ্ছে স্বদেশীরাও আপনার কাছে নিরাপদ নয়, বলল সে।
তাতে আপনার কি? বলেছিই তো এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, ক্রুদ্ধ জবাব লিভাসের।
ও, তা এঁদের নাম কি?
লিভাসে চুপ। কিন্তু বন্দীরা মুখ খুলল। আমি হেনরী ডি ওগেন, আর এ হচ্ছে আমার বোন।
ডি ওগেরন? ক্যাপ্টেন ব্লাড চমকে চাইল। আপনার সঙ্গে আমার বন্ধু টরটুগার গভর্নরের কোন সম্পর্ক আছে?
উনি আমার বাবা।
ব্লাড ঝট করে লিভাসের দিকে ফিরল। আপনি কি পাগল হয়েছেন? চেঁচাল ও। প্রথমে ওলন্দাজ জাহাজে হামলা চালালেন তারপর টরটুগার গভর্নরের ছেলেমেয়েদের পাকড়াও করলেন- অথচ একমাত্র ওই দ্বীপেই আমরা নিরাপদ…
ক্ষুব্ধ লিভাসে বাধা দিল।
কবার বলব ব্যাপারটা ব্যক্তিগত? টরটুগার গভর্নরের সঙ্গে বোঝাঁপড়া যা করার আমিই করব।
আর বিশ হাজার কয়েন? সেটাও আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার?
অবশ্যই।
একমত হতে পারলাম না। লিভাসের এতক্ষণ দখল করে রাখা খালি পিপেটার ওপর বসে বলল ব্লাড।
আপনি এঁদেরকে যেসব শর্ত দিয়েছেন সবই শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তাছাড়া ভুলে যাবেন না আমরা দুজন চুক্তিবদ্ধ। বিশ হাজার কয়েন চেয়েছেন মুক্তিপণ বাবদ। সেটা আমাদের দুজাহাজের মধ্যে ভাগ হওয়ার কথা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি ব্যাপারটা চেপে যেতে চাইছেন। সেজন্যে শাস্তির ব্যবস্থাও কিন্তু রাখা হয়েছে। চুক্তিতে।
হো, হো, কর্কশ কণ্ঠে হেসে উঠল লিভাসে। আমার ব্যবহার অপছন্দ হলে চুক্তি বাতিল করতে পারেন।
তাই করতে হবে। তবে আমার যখন ইচ্ছে হবে তখন বাতিল করব। তার আগে জাহাজ ছাড়ার আগের প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে আপনাকে।
মানে?
এদের মুক্তিপণ ধরেছেন বিশ হাজার কয়েন। আর এই মহিলাকে আপনি সঙ্গে রাখছেন। কোন যুক্তিতে? চুক্তি মোতাবেক এঁর ওপর আমাদের সবার অধিকার রয়েছে।
লিভাসের চেহারায় মেঘ ঘনাল।
তবে, বলল ব্লাড, এই মহিলাকে আপনি কিনে নিতে চাইলে আমার আপত্তি নেই।
কিনে নিতে?
মুক্তিপণের টাকায়।
সেটা ওর ভাইয়ের জন্যে। টরটুগার গভর্নর এর টাকা মেটাবে, বলল লিভাসে।
না, না। দুজনের জন্যেই ওই টাকা ধরেছেন আপনি। টাকাটা এখনই দিয়ে দিন, আমাদের ক্রুদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাক।
খুনে মেজাজে হাসল লিভাসে। ভাল হাসাতে পারেন দেখছি!
হ্যাঁ, তা পারি, জবাবে বলল ব্লাড।
লিভাসের কাছে ব্লাড হাসির পাত্র। মাত্র জনা বারো লোক এনে হুমকি দিচ্ছে একশো লোকের নেতা লিভাসেকে। কিন্তু দলের ক্রুদের দিকে চেয়ে গলা শুকিয়ে এল ওর কুরা ব্লাডের সঙ্গে একমত, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন, রাগ চেপে বলল ও। টাকা আসুক, সমান ভাগে ভাগ হবে।
কিন্তু ধরুন ডি ওগেরন টাকা দিতে অস্বীকার করলেন? প্রশ্ন ছুঁড়ল ব্লাড। হেসে অলসভাবে উঠে দাঁড়াল। উই, মেয়েটাকে রাখতে চাইলে এখুনি টাকা দেবেন। লিভাসের ক্রুরা সমস্বরে সায় জানাল।
গর্দভের দল! গর্জাল লিভাসে। বিশ হাজার কয়েন কি গাছে ধরে? অত টাকা আছে আমার সঙ্গে?
তবে যার আছে সে বন্দীদেরকে কিনে নিক, প্রস্তাব করল ব্লাড।
কার আছে? আমার নিজেরই তো নেই।
আমার আছে, জানাল ব্লাড। পিপেটায় আবার বসে পড়ে কোটের পকেট থেকে ছোট্ট একটি চামড়ার থলে বার করল। থলের ভেতর থেকে বেরল গোটা পাঁচেক প্রমাণ সাইজের মুক্তো। গত শীতে মুক্তোর জাহাজ লুটে যা পেয়েছিল তার বখরা। আরও প্রায় পনেরোটার মত রয়েছে থলেতে।
কাহুসাক দুআঙুলে ধরে গভীর মনোযোগে একটি মুক্তো পরখ করল। এটার দাম কমপক্ষে একহাজার কয়েন দেখে-টেখে বলল।
আপনার ভ্যালুয়েশন মেনে নিলাম, বলল ব্লাড। এখানে অমন দশটা আছে তারমানে দশ হাজার কয়েন। বাকি মুক্তোগুলো আমার ক্রুদের সঙ্গে বেটে নেব। উলভারস্টোন, আমার সম্পত্তিদেরকে অ্যারাবেলায় তুলে দাও। উঠে দাঁড়িয়ে আঙুলের ইশারায় বন্দীদের দেখিয়ে দিল।
দাঁড়ান, ক্রোধে ফেটে পড়েছে লিভাসে। মেয়েটাকে পাবেন না। ব্লাডের মুখোমুখি সে, তরোয়ালে হাত। রাগে কাঁপছে। আমি বেঁচে থাকতে ও আপনাদের সঙ্গে যাবে না।
তবে আপনি মরলে যাবে, বলেই একটানে খাপ থেকে তরোয়াল বার করে আনল ব্লাড। মুহূর্তে অসিযুদ্ধ বেধে গেল।
লড়াই ফুরাতেও দেরি হলো না। ব্লাডের দক্ষতার সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা লিভাসের বন্য শক্তির কম্ম নয়। কমিনিট পরেই সাদা বালিতে সটান হলো ও। কাশছে। ব্লাড চাইল কাহুসাকের দিকে।
চুক্তির আর দরকার দেখছি না, বলল ব্লাড।
কাহুসাক ঠাণ্ডা, নির্লিপ্ত চোখে নেতার পতিত দেহের দিকে দৃষ্টি দিল। লোকটিকে ঘৃণা করে সে, প্রচণ্ড ঘৃণা। বোম্বেটেদের কাছে একটি দোষ ক্ষমার অযোগ্য। সেটি হচ্ছে অন্যদের বখরা আত্মসাৎ করা। লিভাসে সেই দোষে দোষী।
আমার সঙ্গে রওনা হতে চাইলে, কাহুসাককে বলল ব্লাড, আসতে পারেন। কিন্তু এক শর্তে- ওলন্দাজ জাহাজটাকে ছেড়ে দিতে হবে, ওটার কার্গোকেও।
অমত করল না কাহুসাক। ব্লাড তার অতিথিদের দিকে ফিরল। হ্যাট খুলে গভর্নরের মেয়েকে সম্মান দেখাল।
ম্যাডামজেল, ভয় পাবেন না, বলল ও। আমরা এখুনি টরটুগার দিকে রওনা হয়ে যাব।
মেয়েটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ব্লাডের দিকে চাইল। ওর ভাই উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, মঁসিয়ে, ঠাট্টা করছেন না তো?
কক্ষনো নয়। আমি জলদস্যু হতে পারি কিন্তু লিভাসের মত নই। আমার একটা আত্মসম্মানবোধ আছে।
বাউ করে চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরল ও। ম্যাডামজেল ফেরাল তাকে। সিয়ে!
ব্লাড ফিরে চাইলে ধীর পায়ে ওর কাছে এসে দাঁড়াল ম্যাডেলিন। আপনি সত্যিই ভদ্রলোক! বলল ও। ব্লাডের হাত টেনে নিয়ে চুমু খেল।
ক্যাপ্টেন ব্লাডের মুখে মৃদু হাসি। আমি অবশ্য তা মনে করি না! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল। বোম্বেটে হিসেবে ওর কুখ্যাতি এতদিনে নিশ্চয় অ্যারাবেলা বিশপের কানে পৌঁছে গেছে। জানে, মেয়েটির চোখে, ও ঘৃণার পাত্র। তবে মনে গোপন আশা, আজকের ঘটনার কথা অ্যারাবেলার কানে গেলে হয়তো ওর প্রতি ঘৃণা খানিকটা হলেও কমবে। আসলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিস ডি ওগেরন আর তার ভাইকে সে রক্ষা করেছে আবেগতাড়িত হয়ে। সর্বক্ষণ ভেবেছে, অ্যারাবেলা উপস্থিত থাকলে ওর এই সৎসাহসের জন্যে সন্তুষ্ট হত।
.
তেরো
টুরটুগার গভর্নর স্বভাবতই ব্লাডের প্রতি কৃতজ্ঞ হলেন। নানাভাবে তা প্রকাশও করলেন ভদ্রলোক। তার কল্যাণে ক্যাপ্টেন ব্লডের নাম জলদস্যুদের মধ্যে আরও ছড়াল। বোম্বেটেরা তাকে রীতিমত পূজা করতে শুরু করেছে। তারা ব্লাডের দলে যোগ দেয়ার জন্যে এক পায়ে খাড়া। ফলে, টরটুগা থেকে পরবর্তী অভিযানের সময় ওকে পাঁচটি জাহাজ এবং হাজারেরও বেশি লোক নিয়ে রওনা হতে হলো।
ওদিকে ক্যারিবিয়ান সাগরে ডন মিগুয়েল ডি এসপিনোসা তর্কে তঙ্কে রয়েছে। ব্লাডের প্রতি তীব্র প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলছে সে। হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে পরম কাঙ্ক্ষিত শত্রুকে। গত একটা বছর বৃথাই খোঁজাখুঁজি করেছে। বড় অদ্ভুতভাবে হঠাৎই সাক্ষাৎ হয়ে গেল দুজনার।
পনেরোই সেপ্টেম্বরে সাগরে ভাসছিল তিনটে জাহাজ। এ গল্পে জাহাজগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
প্রথম জাহাজটি ভরাবেলা। ঝড়ের তাণ্ডবের কারণে দলছুট হয়ে একাই ভেসে চলেছে।
দ্বিতীয় জাহাজটি মিলাগ্রোসা। স্প্যানিশ জাহাজ। প্রতিশোধোনাখ ডন মিশুয়েল রয়েছে ওটায়।
তৃতীয় তথা সর্বশেষ জাহাজটির নাম রয়্যাল মেরি। রণতরী। প্রাইমাউথ থেকে জ্যামাইকার পথে যাচ্ছে। লর্ড জুলিয়ান ওয়েড নামে এক ভি. আই. পি ওটার যাত্রী। ইংল্যান্ড থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মিশন দিয়ে পাঠানো হয়েছে তাকে। রাজা দ্বিতীয় জেমস বোম্বেটেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ স্প্যানিশদের ক্রমাগত নালিশ শুনতে শুনতে বিরক্ত। সেক্রেটারি অভ স্টেট লর্ড সান্ডারল্যান্ড একজন ক্ষমতাশালী লোককে জ্যামাইকার ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেছেন। এই ক্ষমতাশালী লোকটি আর কেউ নয়, কর্নেল বিশপ।
কর্নেল বিশপ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। এতদিনে পিটার ব্লাডকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার সুযোগ পেল। তারই এক সময়কার পলাতক ক্রীতদাস এখন জ্বালিয়ে মারছে স্প্যানিশদেরকে, জলে এমনকি ডাঙাতেও। এতে করে ইংল্যান্ড ও স্পেনের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। কর্নেল বিশপ চিঠিতে সেক্রেটারি অভ স্টেটকে জানিয়েছে এ সমস্যা সমাধানের কোন রাস্তা দেখছে না। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না বুঝে লর্ড সান্ডারল্যান্ড আঙুল বাঁকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে, ব্লাড পরিস্থিতির শিকার হয়ে জলদস্যুতা বেছে নিয়েছে। সুযোগ দিলে সে হয়তো ঝাটমুক্ত জীবনে আবারও ফিরে আসতে পারে।
তো, সান্ডারল্যান্ড তার কাজিন লর্ড জুলিয়ান ওয়েডকে পাঠিয়েছেন ব্লাডের জন্যে একটি প্রস্তাব দিয়ে। ব্লাড যদি রাজার, নৌবাহিনীতে নিয়মিত অফিসার হিসেবে যোগ দেয় তবে ক্ষমা করা হবে তাকে।
রয়্যাল মেরি জ্যামাইকার পূর্ববর্তী বন্দর সেন্ট নিকোলাসে ভিড়েছে। এদিকে, কর্নেল বিশপের ভাতিজী কমাস আগে সেন্ট নিকোলাসে আত্মীয় স্বজনদের কাছে বেড়াতে এসেছে। এখন জ্যামাইকায় ফিরে যাবে। রয়্যাল মেরিতে তার ফেরার ব্যবস্থা করা হলো। লর্ড জুলিয়ানের খুশি ধরে না। অ্যারাবেলাকে খুব পছন্দ হয়েছে তার। জাহাজ যখন সেন্ট নিকোলাস ছাড়ল তখন দুজনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনিবার্য ভাবেই লর্ড জুলিয়ানের কথাবার্তায় ক্যাপ্টেনরাডের প্রসঙ্গ এল।
আপনি কি কখনও, ডেকে পাশাপাশি হাঁটার সময় কথা তুললেন জুলিয়ান, ক্যাপ্টেন রাডকে দেখেছেন? শুনেছি সে আপনার চাচার ক্রীতদাস ছিল।
মিস বিশপ প্রথমে পাথরের মত জমে গেল। তারপর জাহাজের রেলে হেলান দিয়ে শান্তস্বরে বলল, অনেকবারই দেখা হয়েছে। ভালমত চিনি।
সত্যি? আগ্রহের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন লর্ড জুলিয়ান লোক কেমন সে?
তখন তো মনে হত ভদ্রলোক। কপাল খারাপ।
ওর সমস্ত ঘটনা জানেন?
বলেছিল, জানাল অ্যারাবেলা। মনে মনে তার সাহসের প্রশংসা করতাম। কিন্তু তারপর কি করল? এখন মনেহয় আমাকে যা বলেছে সব সত্যি নাও হতে পারে।
কোন সন্দেহ নেই মনমাউথের বিদ্রোহের পর ওর প্রতি অবিচার করা হয়েছিল, পাল্টা বললেন জুলিয়ান। মনমাউথের দলে ও-কখনোই ছিল না। কিন্তু ও প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে।
সেজন্যেই ক্ষমা করা যায় না, খাটো গলায় বলল অ্যারাবেলা। ও নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে।
কুড়াল মেরেছে? হেসে উঠলেন জুলিয়ান। অত নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে? শুনেছি প্রচুর টাকা কামিয়েছে। সব নাকি জমা আছে ফ্রান্সে। ওর হবু শ্বশুর ডি ওগেরন এ ব্যাপারটা দেখাশোনা করছেন।
হবু শ্বশুর? অ্যারাবেলার দৃষ্টি লর্ডের চোখে। টরটুগার গভর্নর ডি ওগেরন?।
হ্যাঁ। কথাটা সেন্ট নিকোলাসে থাকতেই শুনেছি। কেন, আপনি জানেন না?
জবাব না দিয়ে মাথা ঝাঁকাল অ্যারাবেলা। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। চোখ এখন তরঙ্গের দিকে। কমুহূর্ত বাদে মুখ খুলল। কণ্ঠস্বরে বিন্দুমাত্র কম্পন নেই।
কিন্তু তাহলে নিশ্চয় ডাকাতি ছেড়ে দিত? যদি…যদি কাউকে ভালবেসেই থাকে, পয়সাও কামিয়ে থাকে তবে এই বিপজ্জনক জীবন থেকে কেন সরে যাচ্ছে না?
তা ভাবারই বিষয়, বললেন লর্ড জুলিয়ান। কিন্তু আমি যদ্র জেনেছি ছি ওগেরন টাকার আগে দৌডয়। আর তার মেয়েটাও নাকি বেপরোয়া প্রকৃতির। সে হয়তো ব্লাডকে উসকায়। ওর আগের প্রেমিকটাও জলদস্যু ছিল; ব্লাডের হাতে মরেছে। ওই ব্যাটাকে মেরে তবেই মেয়েটার মন জিতে নিয়েছে।
ওই মেয়ের জন্যে খুন করেছে? অ্যারাবেলার কণ্ঠে আতঙ্ক।
হ্যাঁ, লিভাসে নামে এক জলদস্যুকে। মেয়েটার প্রেমিক ছিল।
অ্যারাবেলার ঠোঁটজোড়া ফ্যাকাসে, চোখ জ্বলছে ধকধক করে।
কার কাছে শুনেছেন? জানতে চাইল।
কাহুসাক নামে আরেক জলদস্যু। সে খুনের সময় ওখানে ছিল। মেয়েটা?
মেয়েটা ছিল?
হ্যাঁ। ও সবই দেখেছে। লিভাসেকে খুন করে ব্লাড ওকে উদ্ধার করেছিল।
অ্যারাবেলার শুকনো মুখের দিকে চোখ পড়ল জুলিয়ানের।
মানুষ চিনতে কি ভুলই না করেছি! নিচু স্বরে বলল মেয়েটি। বাঁকা হেসে যোগ করল: অমন মানুষকে ভুলে যাওয়াই ভাল। একথা বলেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।
বেশ ভালভাবেই সময় কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু অনর্থ বাধাল বদমেজাজী ডন মিগুয়েল। আক্রমণ করে বসল রয়্যাল মেরিকে। পাল্টা গুলি চালাল রয়্যাল মেরির ক্যাপ্টেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের। মিলাগ্রোসা জাহাজ থেকে ছোঁড়া গোলার আঘাতে রয়্যাল মেরির ডেকে রাখা গানপাউডারে আগুন ধরে গেল। মূল যুদ্ধ শুরুর আগেই উড়ে গেল জাহাজটির অর্ধেক খানি। ইংরেজ ক্যাপ্টেন মারা পড়েছে, সঙ্গে ক্রুদের অধিকাংশ। বাকিরা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব। আর এই সুযোগে জাহাজে উঠে এল স্প্যানিশরা।
ক্যাপ্টেনের কেবিনে লর্ড জুলিয়ান তখন অ্যারাবেলা বিশপকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল দরজা। গটমট করে ঢুকে পড়ল ডন মিগুয়েল। পাঁই করে ঘুরে তার মুখোমুখি হলেন লর্ড। তরোয়ালে হাত চলে গেছে।
বোকামি করবেন না, ধারাল কণ্ঠে আদেশ করল উন মিগুয়েল। বোকামি করলেই মরবেন। আপনাদের জাহাজ ডুবছে।
ডন মিগুয়েলের ঠিক পেছনে তিন চার জন সশস্ত্র লোক। লর্ড জুলিয়ান পরিস্থিতি বুঝে সামলে নিলেন নিজেকে। তরোয়াল থেকে হাত সরালেন। কিন্তু মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিল ডন।
ওটা দিন, বলল সে।
দ্বিধা করছেন লর্ড, মিস বিশপের দিকে চকিতে চাইলেন।
দিয়েই দিন, শান্ত শোনাল অ্যারাবেলার কণ্ঠ। শ্রাগ করে। তরোয়াল সমর্পণ করলেন লর্ড।
আপনারা আমার জাহাজে আসুন, আমন্ত্রণ জানিয়ে কেবিন ছাড়ল উন।
যেতেই হলো, কারণ জাহাজ ডুবে যাচ্ছে। লর্ড জুলিয়ান.. কি রেগে টং। স্প্যানিশ জাহাজে উঠেই হামলাকারীর নাম জানতে চাইলেন।
আমি ডন মিগুয়েল ডি এসপিনোসা, জবাব এল। স্পেনের রাজার নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল।
ঢোক গিললেন লর্ড। স্প্যানিশ অ্যাডমিরাল বোম্বেটেদের মত আচরণ করল। ইংল্যান্ড এখন কি ভূমিকা নেবে?
আমাদের সঙ্গে বোভেটেগিরি করার কি দরকার ছিল? প্রশ্ন করলেন লর্ড।
স্মিত হাসল ডন মিগুয়েল।
কর্নেল বিশপ বড়লোক মানুষ, আপনিও টাকার কুমীর আপনাদের মুক্তিপণের ব্যবস্থা শিগগিরই হয়ে যাবে। খানিকটা ঘুরিয়ে যা বলার বলে দিল ডন।
আপনি স্প্যানিশ নৌবাহিনীর কলঙ্ক, খেপে উঠলেন লর্ড। আপনাদের রাজা এ ব্যাপারে কি বলেন দেখব আমরা।
অ্যাডমিরালের হাসি মিলিয়ে গেছে।
যা করার পুরুষ মানুষের তাগদেই করেছি। আপনাদের মত ক্যাপ্টেন ব্লাড, হ্যাঁগথর্পদের লেলিয়ে দিয়ে বলছি না আমরা দায়ী নই, আমাদের কোন দায় দায়িত্ব নেই।
ক্যাপ্টেন ব্লাডরা ইংল্যান্ডের অ্যাডমিরাল নয়, প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন লর্ড।
নয়? জানব কিভাবে? স্পেনের অত কিছু জানার সুযোগ আছে? আপনারা ইংরেজরা মিথ্যুক নন- বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন?
স্যার! তীব্র ক্রোধে তীক্ষ্ণ হয়েছে লর্ডের কণ্ঠ। জ্বলছে দুচোখ তার বাবা পড়ল যেখানে তলোয়ার ঝুলছিল সেখানে। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, স্প্যানিশদের রীতিই এই। তার ধার ধারে না। নইলে একজন নিরস্ত্র লোকের সঙ্গে কেউ এমন যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতে পারে!
অ্যাডমিরালের মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করল। আঘাত করার ইচ্ছায় হাত খানিকটা উঠিয়েও কি ভেবে নামিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
.
চোদ্দ
ডন মিগুয়েল তার বন্দীদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহারই করছে। লর্ড জুলিয়ান ও অ্যারাবেলা বুঝতে পারছে তাদের ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ, মুক্তিপণের জন্যে আটক করা হয়েছে। মিলাগ্রোসা সহযোগী জাহাজ হিডালগাকে নিয়ে প্রথমে দক্ষিণ পশ্চিম, পরে পুব দিকে রওনা দিতেই মুখোমুখি পড়ে গেল ক্যাপ্টেন ব্লাডের। এ ঘটনা ঘটল পরদিন সকালে। এক বছর ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে শেষ পর্যন্ত আকস্মিকভাবে শত্রুকে পেয়ে গেল ভুন। একেই বলে ভাগ্যের ফের। এমন একটা সময় উন মিগুয়েল ব্লাডের জাহাজের দেখা পেল যখন অ্যারাবেলা জাহাজটি সম্পূর্ণ একা।
মিস বিশপ তখনই আপার ডেকে লর্ড জুলিয়ানের সঙ্গে উঠে এসেছে। বিশাল আকৃতির লাল রঙা জাহাজটি শ্বেতশুভ্র পাল তুলে রেখেছে। মূল মাস্তুল থেকে পতপত করে উড়ছে ইংল্যান্ডের পতাকা। মিস বিশপ এ দৃশ্য দেখে রীতিমত রোমাঞ্চিত।
দেখুন! লর্ড জুলিয়ানের উদ্দেশে বলল। ভদ্রলোক অবাক হয়ে দেখলেন মেয়েটির দুচোখে অদ্ভুত দীপ্তি। উত্তেজিত। ও কি ব্যাপারটা বুঝতে পারছে? অ্যারাবেলার পরবর্তী কথায় সমস্ত সংশয় দূর হয়ে গেল লর্ডের।
ইংলিশ জাহাজ, ফাইট করবে, বলল অ্যারাবেলা।
ঈশ্বর, ভরসা, বললেন লর্ড। ওটার ক্যাপ্টেনের মাথায় ছিট আছে। স্প্যানিশদের দুটো জাহাজের সঙ্গে পারবে কি করে? ডন মিশুয়েলকে দেখো। ব্যাটা কী খুশি!
নিচের ডেক থেকে বন্দীদের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল ডন। হাসছে। আগুয়ান জাহাজটিকে ইশারায় দেখিয়ে ক্রুদের উদ্দেশে নিজের ভাষায় কি যেন বলল।
গোলন্দাজরা কামান নিয়ে তৈরি, নাবিকরাও আসন্ন যুদ্ধের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত। ডন মিগুয়েলের সঙ্কেতে হিডালগা কাছ ঘেঁষে এল মিলাগ্রোসার। ইংলিশ জাহাজটির প্রস্তুতি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওরা। অ্যারাবেলা এখন কামানের রেঞ্জের মধ্যে। গোলন্দাজরা কেবলমাত্র নির্দেশের অপেক্ষায়। বারবার চাইছে অ্যাডমিরালের দিকে। মাথা নাড়ল সে।
ধৈর্য ধরো! গর্জাল ভন। আরও এগোব। তারপর পাখি শিকার করব।
অ্যারাবেলা স্রোতের টানে স্প্যানিশ জাহাজ দুটির মাঝ বরাবর এগোচ্ছে। লর্ড জুলিয়ান না বলে পারলেন না, লোকটা পাগল! দুজাহাজের চাপ খেয়ে ভর্তা হয়ে যাবে।
ঠিক সে মুহূর্তে অ্যাডমিরালকে হাত তুলতে দেখে গোলন্দাজরা কামান দাগল। ইংলিশ জাহাজটির সামান্য সামনের পানি ছিটকে উঠল। প্রায় একই সঙ্গে দুবার স্ফুলিঙ্গ ছড়াল অ্যারাবেলার দুটো কামান। গোলার আঘাতে মিলাগ্রোসা কেঁপে উঠেছে। হিডালগাও চুপ করে বসে রইল না। তবে তাদের দুটো গোলাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।
একশো গজের দূরত্বে থাকতে আরাবেলার কামানগুলো দাগা। হলো আবার। মিলাগ্রোসার সামনের অংশ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। ধোয়া উঠছে। ওদিকে ইংলিশ জাহাজটি ক্রমেই এগোচ্ছে। জুলিয়ানের নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, মিস বিশপ ভয়ে জাহাজের রেল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে রইল। চকিতে ডন মিগুয়েল ও তার স্যাঙাৎদের দিকে চাইল ও। অ্যারাবেলা এখন স্প্যানিশ জাহাজ দুটোর ঠিক মধ্যখানে। ডন মিগুয়েল ভেরীবাদকের সঙ্গে কথা বলল। লোকটি সিলভার বিউগল তুলে জাহাজ দুটোকে গুলি করার নির্দেশ দেবে। কিন্তু সে ঠোঁটের কাছে বিউগল তুলতেই অ্যাডমিরাল তার হাত চেপে ধরে নিরস্ত্র করল। সে আচমকা উপলব্ধি করেছে স্প্যানিশ জাহাজ দুটো তাদের প্রতিপক্ষকে আঘাত করতে গিয়ে পরস্পরকেই আক্রমণ করে বসতে পারে। ক্যাপ্টেন ব্লাড ঠিক এটাই চাইছে। মুহূর্তে অ্যারাবেলার দু পাশ থেকে আঠারোটা কামান মিলাগ্রোসা আর হিডালগার ওপর গায়ের ঝাল মেটাল।
মিস বিশপ বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতায় লর্ড জুলিয়ানের ওপর ছিটকে পড়েছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী চারদিকে, সবাই বিভ্রান্ত। আহত স্প্যানিশদের আহাজারি আর খিস্তি খেউড়ে বাতাস ভারী মিলাগ্রোসা টিকে থাকতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। মত্ত গর্ত তার একপাশে। হিডালগার অবস্থা আরও করুণ। দ্রুত ডুবছে। ক্রুরা নৌকা নামাতে মরীয়া হয়ে উঠেছে।
ডন মিগুয়েল যতই চেঁচাক না কেন, কেউ গায়ে মাখছে না। অ্যারাবেলা মুখ ঘুরিয়ে মিলাগ্রোসার পাশে এসে পড়েছে। ঘর্ঘর, ঝনঝন নানারকম ধাতব শব্দে স্প্যানিশ জাহাজটিকে কজা করে নেয়া হলো। তার পর পরই একদল বুনো চেহারার জলদস্যু লাফিয়ে মিলাগ্রোসার, ডেকে এসে নামল। স্প্যানিশরা অসহায়। জলদস্যদের সঙ্গে পেরে উঠল না ওরা। ডন মিগুয়েল অক্ষম রাগে ওপরের ডেকে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে লর্ড জুলিয়ান আর মিস বিশপ এতক্ষণ মারামারি দেখছিল। ওরা দেখতে পেল, স্প্যানিশ পতাকা নেমে গেছে। সেখানে এখন ইংল্যান্ডের নিশান। পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করেছে ইংরেজরা। নিরস্ত্র স্প্যানিশরা কোণঠাসা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো।
মিস বিশপ হঠাৎ সামনে ঝুঁকে তাকাল। চোখ বিস্ফারিত, গাল ফ্যাকাসে। লম্বা, তামাটে মুখের এক লোক মই বেয়ে ওপরে উঠে আসছে- দৃপ্ত ভঙ্গিমায়।
আবার দেখা হয়ে গেল, ডন মিগুয়েল, বিশুদ্ধ স্প্যানিশে বলল। খুশি হয়েছেন নিশ্চয়? একটু শুধু গড়বড় হয়ে গেছে। এভাবে বোধহয় দেখা করার প্ল্যান ছিল না আপনার?
ক্রুদ্ধ ডনের হাত চলে গেল তরোয়ালে। কিন্তু তার কব্জি বজ্রমুষ্ঠিত চেপে ধরল ক্যাপ্টেন ব্লাড।
ওসব চালাকি চলবে না, ধীর কণ্ঠে বলল। আপনি এখন আমার কজায়।
দীর্ঘ একটি মুহূর্ত পরস্পরকে নিরীখ করল ওরা।
কি করতে চান? কর্কশ শোনাল ডনের কণ্ঠ।
কাঁধ ঝাঁকাল ব্লাড। স্মিত হাসল।
যা করার করে ফেলেছি, জবাব এল। আপনার নৌকাগুলো রেডি। চাইলে দলবলসুদ্ধ চলে যেতে পারেন। কারণ জাহাজটা ডুবিয়ে দিচ্ছি আমি। হিসপ্যানিওলা দ্বীপটা কাছেই- নিরাপদেই পৌঁছতে পারবেন। আর একটা কথা, আমি আপনার জন্যে আনলাকি। আমাকে আর খুঁজবেন না।
পরাজিত অ্যাডমিরাল বিনাৰাক্যব্যয়ে মই বেয়ে নিচে নেমে গেল। বিজেতা সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে স্প্যানিশদের বন্দী দুজনের দিকে চাইল। হঠাৎ কাঠ হয়ে গেছে সে।
লর্ড জুলিয়ান তার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে এলেন। ওই শয়তানটাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলেন? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন অতটাকে এমনিতে এগিয়ে এল
আপনি কে? জানতে চাইল ব্লাড। আপনার এত লাগছে কেন?
আমি লর্ড জুলিয়ান ওয়েড, ঠাণ্ডা স্বরে জানালেন লর্ড।
ব্লাড চিনেছে বলে মনে হলো না। তাই? তা এই জাহাজে কি করছেন জানতে পারি?
লর্ড জুলিয়ান সংক্ষেপে অসহিষ্ণু গলায় সব খুলে বললেন।
ডন মিগুয়েল আপনাদের বন্দী করেছিল? মিস বিশপকেও?
আপনি মিস বিশপকে চেনেন? লর্ড অবাক।
চেনার সৌভাগ্য হয়েছিল, বলল ব্লাড। বাউ করল মেয়েটির উদ্দেশে। তবে মিস বিশপ বোধহয় আমাকে চিনতে পারেননি। অ্যারাবেলাকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে বলল।
চোর-ডাকাতদের সঙ্গে মিশি না তো চিনব কিভাবে? বলল মেয়েটি।
ক্যাপ্টেন ব্লাড? আপনি ক্যাপ্টেন ব্লাড? উত্তেজনায় লাল দেখাচ্ছে। লর্ডের মুখ।
হ্যাঁ, স্যার, অন্যমনস্কভাবে জানাল ব্লাড। অ্যারাবেলার কথায় আঘাত পেয়েছে। নীল চোখ দুটোয় বেদনার ছাপ স্পষ্ট। আপনি মিস বিশপকে নিয়ে আমার জাহাজে আসবেন? এটা যে কোন মুহূর্তে ডুবে যাবে।
অ্যারাবেলার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে ঘুরে হাঁটা ধরল ও।
.
পনেরো
সে সন্ধেয় একাকী ডেকে পায়চারি করছে ব্লড। কোথাও কোন গোলমাল নেই। যুদ্ধের চিহ্ন ইতোমধ্যেই অপসৃত। একদল নাবিক চমৎকার শান্তু সন্ধেটিতে নিচু স্বরে গান গাইছে।
ব্লাড অবশ্য কান দিচ্ছে না। আসলে কানে ঢুকছে না কিছু, বাজছে শুধু নিষ্ঠুর কথাগুলো।
চোর-ডাকাত!
তিন বছর আগে জলদস্যুর জীবন বেছে নেয়ার সময় থেকেই বুঝতে পারছিল অ্যারাবেলা তাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করবে। আর কোনদিন দেখা হবে তাও ভাবেনি। তবে প্রতিটি মুহূর্তেই মেয়েটিকে নিজের পাশে কল্পনা করেছে। অ্যারাবেলার কথা মাথায় রেখে সে কঠোর আইন-কানুন তৈরি করেছে অনুসারীদের জন্যে নিষিদ্ধ করেছে সব ধরনের নিষ্ঠুরতা। কিন্তু তাতে কি লাভটা হলো? অ্যারাবেলার দৃষ্টিতে সে তো যে কে সেই।
চোর-ডাকাত! পুড়ে যাচ্ছে অন্তরটা। অ্যারাবেলা এক কথায় ওকে চোর-ডাকাতদের দলে ফেলে দিল। একবারও ভাবল না কী পরিমাণ অন্যায় অবিচার সইতে হয়েছে ওকে। ওর প্রতি বিন্দুমাত্র করুণা বা সহানুভূতি নেই মেয়েটির। দুহাতে মুখ ঢেকে হতাশায় ফুঁপিয়ে উঠল ব্লাড।
ওদিকে নারী অন্তর সম্বন্ধে ব্লাড়ের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ লর্ড জুলিয়ান কিন্তু কটি প্রশ্নের জবাব খুঁজে চলেছেন। মিস বিশপ ক্যাপ্টেন ব্লাডের প্রতি অতখানি নিষ্ঠুর হচ্ছে কেন? স্প্যানিশদের কবল থেকে বাঁচানোর পরও কেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে না? ক্রীতদাস ব্লাডকে সে ঠিক কতখানি চিনত? লর্ড জুলিয়ান একটি ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন। ব্লাডের জাহাজটির নাম অ্যারাবেলা। কেন? মিস বিশপের নামটিই কেন বেছে নিতে হলো ব্লাডকে! দুনিয়ায় আর কোন নাম কি ছিল না? নিশ্চয়ই কোন যোগসূত্র আছে। লর্ড জুলিয়ানের মনে পড়ছে মিস ডি ওগেরনের উদ্ধার কাহিনী খুশি করতে পারেনি অ্যারাবেলাকে ঈর্ষা? লর্ডের স্বপ্নালু দুচোখ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে মেয়েটিকে। ব্লাডকে এত ঘৃণা করার কি আছে? আপন মনে প্রশ্ন করলেন।
লর্ড জুলিয়ান ক্যাপ্টেন ব্লাডের প্রতি রীতিমত শ্রদ্ধা পোষণ করছেন। তার ভাল লাগছে এই ভেবে যে, লোকটিকে তিনি সৎপথে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা রাখেন। ব্লডের খোঁজ করতে করতে ডেকে চলে এলেন ভদ্রলোক। ব্লাড তখনও পায়চারি করছে। ক্যাপ্টেনের বাহুতে নিজের বাহু ঢুকিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলেন লর্ড।
কি হচ্ছে? সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করল ব্লাড। এ মুহূর্তে উটকো ঝামেলা পছন্দ করতে পারছে না।
কিছু মনে করলেন না লর্ড।
আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই, বললেন তিনি। এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। আমি আসলে আপনাকে খুঁজতেই ইন্ডিজে এসেছি। মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন ভদ্রলোক।
লর্ডের কথা শেষ হলে হাত সরিয়ে নিল ব্লাড। বিস্মিত।
আপনি আমার মেহমান,” বলল ও, আমি চোর-ডাকাত হলেও পচে যাইনি। সামান্য ভদ্রতাবোধ এখনও আছে। আপনারা যে অফার নিয়ে এসেছেন সেটার ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। আপনার কি ধারণা আমি রাজার কমিশন গ্রহণ করব? মরলেও না। আমাকে চোর ডাকাতদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, সেজন্যে রাজা জেমস ছাড়া আর কেউ দায়ী নন। আমি তো বিদ্রোহ করিনি, ডাক্তার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি শুধু। বিচারের রেকর্ড ঘাটুন, দেখতে পাবেন একজন বিদ্রোহীর চিকিৎসা করেছিলাম বলে আমাকে ক্রীতদাস বানিয়ে দেয়া হয়।
নিজেকে হঠাই সামলে নিয়ে দুঃখের হাসি হাসল ব্লাড।
খামোকাই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে! আপনার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ, লর্ড জুলিয়ান। কিন্তু আমার মনের অবস্থাটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?
লর্ড জুলিয়ান ঠায় দাঁড়ানো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, দুঃখজনক। সত্যিই দুঃখজনক! হাত বাড়িয়ে দিলেন, কিন্তু আমাদের বন্ধু হতে বাধা কোথায়?
কোন বাধা নেই। কিন্তু…আমার মত চোর-ডাকাতের সঙ্গে… কাটখোট্টা হাসল ব্লাড। বাড়ানো হাতটির দিকে দৃষ্টিপাত না করে ঘুরে চলে গেল।
লর্ড জুলিয়ান দাঁড়িয়ে থেকে লম্বা লোকটিকে জাহাজের রেলের দিকে যেতে দেখলেন।
লোকটা আসলেই ভাল, আপন মনে আওড়ালেন, কিন্তু ওর জন্যে আমার কিছু করার নেই। ধীর পায়ে কেবিনে ফিরে গেলেন তিনি।
.
ষোলো
তিন মাস পরে ব্লাড আবারও টরটুগায় ফিরল। ইতোমধ্যে লর্ড জুলিয়ান ও মিস বিশপকে জ্যামাইকার রাজধানী পোর্ট রয়্যালে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে, ডেপুটি গভর্নরের নাগাল এড়িয়ে। কর্নেল বিশপ অ্যারাবেলা জাহাজটিকে পাকড়াও করতে না পেরে রেগে কাঁই। তার ভাতিজীকে যে উদ্ধার করা হয়েছে সেজন্যে কোন কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। শেষমেশ ঠিক করল, গোটা জ্যামাইকান নৌবহর নিয়ে ব্লাডকে খুঁজতে বেরবে। সে জানে, জলদস্যুরা টরটুগায় খুব বেশিদিন থাকবে না। সমুদ্রে তাদের ভাসতেই হবে। আর তখনই কাঁক করে ব্লাডকে চেপে ধরবে বিশপ। ডেপুটি গভর্নর হিসেবে তার যে দ্বীপে থাকা কর্তব্য বেমালুম ভুলে গেছে। বিশেষ করে তখন যে কোন মুহূর্তে ফ্রান্স ও স্পেনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ বাধার সমূহ সম্ভাবনা।
চতুর্দশ লুইয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সমগ্র ইউরোপে যুদ্ধের উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়াও কানাঘুষা চলছে ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ বাধবে। রাজা জেমসের অত্যাচারে জনগণ তিতিবিরক্ত। শোনা যাচ্ছে উইলিয়াম ডি অরেঞ্জকে ইংল্যান্ডে আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রতি সপ্তাহান্তে, ইংলিশ জাহাজগুলো নিত্য নতুন খবর সরবরাহ করছে। উইলিয়াম মার্চ মাসে রাজমুকুট মাথায় চড়াল। জেমস পালিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছে ফ্রান্সে। ব্রিটিশ জাহাজ ইম্পেরেটরে ডেপুটি গভর্নর বিশপ প্রতি রাতেই মদে চুর হচ্ছে। ক্যাপ্টেন ব্লাডের আসন্ন পরাজয় কামনা করে রাতটা এভাবেই উদযাপন করে সে।
ওদিকে ব্লাড টরটুগায় ফিরে তার বিচ্ছিন্ন নৌবহর চারটের দেখা পেয়েছে। ইদানীং মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে থাকে, তার। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে মনে, টরটুগায় কেন এল? বোঝে, জলদস্যুর জীবন ফুরিয়ে যেতে চলেছে। তবে আর এখানে কেন? এ প্রশ্নের জবাব মেলে অন্য আরেকটি প্রশ্নে: এছাড়া অন্য কোথায়ই বা যাবে?
শেষ পর্যন্ত অবশ্য তার এই মুড ঝেটিয়ে বিদায় করতেই হলো। এক রোদেলা সকালে টরটুগার গভর্নর অ্যারাবেলার ডেকে এলেন। সঙ্গে মোটা মৃত হাসিখুশি এক ভদ্রলোক। নাম তার ডি কাসি। ফ্রেঞ্চ হিসপ্যানিওলার গভর্নর।
আপনার কমান্ডে বিরাট দল আছে জানি, পরিচয় পর্ব শেষ হলে বললেন কাসি।
আটশো জনের মত হবে, সঁসিয়ে, জানাল ব্লাড।
বসে থাকতে নিশ্চয় ভাল লাগে না তাদের?
শ্রাগ করল ব্লাড।
ফ্রান্স থেকে খবর এসেছে স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধ বেধে,গেছে। আমরা চাই যুদ্ধটাকে নিউ ওয়ার্ল্ডে” ছড়িয়ে দিতে। ব্রেস্ট থেকে ব্যারন ডি রিভাররালের কমান্তে একটা নৌবহর আসছে। সে আমাকে চিঠিতে জানিয়েছে এখানে পৌঁছেই এক হাজার লোকের একটা দল্প পেতে চায়। সেজন্যে আপনাকে ডি রিভারোলের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্যে বলতে এসেছি।
ব্লাড ভাবনায় ডুবে গেছে। ফ্রান্সের রাজার পক্ষে সম্মানজনক পদে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে তাকে। বিষয়টি ভেবে দেখার মত।
আমার অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে দেখি, বলল ও। উলভারস্টোন আর হ্যাঁগথপকে ডেকে পাঠাল। সে সঙ্গে ইয়েবারভিল নামে আরেকজন ফরাসি বোম্বেটে। সে ল্যাচেসিস নামের একটি সহযোগী জাহাজের ক্যাপ্টেন।
শর্ত নিয়ে খানিক তর্কাতর্কির পর সেদিনই চুক্তি সাক্ষরিত হলো। জানুয়ারির শেষাশেষি পেটি গোভ-এ সমবেত হবে বোম্বেটেরা। ডি রিভাররালের সেখানেই আসার কথা।
পরের মাসে ক্যাপ্টেন ব্লাড তার নৌবহরসহ টরটুগা ত্যাগ করে পেটি গোভের বন্দরে নোঙর ফেলল। কদিন বাদেই পৌঁছল রিভারোল। তার অধীনে রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক আর, নিগ্রো সহ প্রায় বারোশো লোক। ব্লাডের আটশো তোক পেয়ে দুহাজারের একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন হয়ে গেল। মার্চের মাঝামাঝিতে কার্টাজেনা-র পথে রওনা হলো ওরা, স্প্যানিশ নৌবাহিনীকে আক্রমণ করতে।
অল্পের জন্যে কর্নেল বিশপের নৌবহরের সঙ্গে দেখা হলো না ওদের। ব্লাডের খোঁজে টরটুগায় দুদিন পর পৌঁছল বিশপ।
—
নিউ ওয়ার্ল্ড: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আমেরিকা মহাদেশ।
.
সতেরো
এপ্রিলের গোড়ায় ফরাসি বাহিনী কার্টাজেনার কাছাকাছি পৌঁছল। রিভারোল আক্রমণের পন্থা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে তার জাহাজে বৈঠক ডাকল।
বোকা বানিয়ে শহরটা দখল করে নিতে হবে, বলল সে। অতর্কিতে। যাতে ধনসম্পদ সরিয়ে ফেলার সুযোগ না পায়। আজ রাতে শহরের উত্তর দিকে একটা দল পাঠাব। প্ল্যান পরিকল্পনা বিস্তারিত জানাল ও।
শ্রদ্ধার সঙ্গে তার কথাগুলো গিলল অফিসাররা। ব্লাড পাত্তাও দিল না। কারণ সে জানে, পরিকল্পনায় গলদ আছে। দু বছর আগে সে-ও একইরকম প্ল্যান করেছিল, শহরটি দখলে নেয়ার জন্যে। কার্টাজেনায় গোপনে ঘুরেও গিয়েছিল। গোটা এলাকাটি খুব ভালভাবে চেনা আছে ওর। অন্যদিকে রিভারোলের জ্ঞান শুধুমাত্র ম্যাপ পর্যবেক্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে কার্টাজেনা অদ্ভুত একটি অঞ্চল। শহরটির পুব আর উত্তরে পাহাড়, পশ্চিমমুখী শহরটির সামনের দিকে দুটো বন্দর। বাইরের দিকের বন্দরটিতে ঢুকতে হলে বোকা চিকা নামে সঙ্কীর্ণ একটি প্রণালী পেরোতে হবে। সেটি আবার একটি দুর্গের নজরবন্দী। এটি ছাড়া আরেকটি সরু চ্যানেল রয়েছে, ভেতরের বন্দরে ঢোকার জন্যে। এই চ্যানেলটিও পাহারা দিচ্ছে অন্য একটি দুর্গ। শহরটির পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম সমুদ্রের দিকে উনাক্ত। দেখে মনে হয় প্রতিরক্ষার কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আসলে সবার চোখে ধুলো দেয়ার জন্যেই অমন ব্যবস্থা। আর রিভারোলও ধোকা খেয়ে গেছে।
আপনি নিশ্চয় কিভাবে আক্রমণ করবেন আলোচনা করার জন্যে আমাদের ডেকেছেন?ব্লাড বলল।
না, ঠাণ্ডা স্বরে জানাল রিভারোল। আলোচনার কিছু নেই। আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আপনি এখানে এসেছেন আমার নির্দেশ শুনতে। বুঝেছেন?
বুঝেছি, হেসে বলল ব্লাড। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে আপনি নিজে বুঝছেন কিনা। রিভারোলকে জন্ম দেয়ার সুযোগ না দিয়ে বলে চলল, আপনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বললেন। যদি তাই হয় তবে আমাদের সবাইকে নিয়ে মরার ফলী করেছেন। উত্তর দিক থেকে এই শহরে হামলা চালানো খুব সোজা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এতই যদি সোজা তবে স্প্যানিশরা দক্ষিণ দিক সামলাতে এত ব্যস্ত কেন? ওখানে দুর্গ কিসের জন্যে?
রিভারোল নিচের ঠোঁট কামড়ে নিশ্চুপ।
স্প্যানিশদের যতটা বোকা ভাবছেন ওরা আসলে তা নয়, বলছে ব্লাড, দুবছর আগে হালচাল বুঝতে এসেছিলাম এখানে। কজন। ভারতীয় ব্যবসায়ী বন্ধুর সঙ্গে ভারতীয় সেজে। ইচ্ছে ছিল শহরটা দখলে নেবার। পরে আবিষ্কার করলাম উত্তরে প্রায় আধ মাইলের মত এলাকায় সমুদ্রের পানি একেবারে অগভীর। কোন জাহাজের পক্ষেই কাছে এসে শহরটা উড়িয়ে দেয়া সম্ভর নয়।
ছোট ছোট নৌকা আর ক্যানুতে চেপে ডাঙায় লোক নামাতে পারি আমরা, বাজখাই গলায় চেঁচাল রিভারোল।
সি লেভেলের ঠিক নিচে এক সারি পাথর পড়ে আছে। স্রোতেরও খুব টান। যে কোন ছোট নৌকাও উল্টাতে বাধ্য।
হোক, তবু চেষ্টা করব, রিভারোলের কাছে এখন আত্মসম্মানের প্রশ্ন।
আপনার তবে যা ইচ্ছে তাই করুন, বলল ব্লাড। আমি দলবলসুদ্ধ মরতে রাজি নই।
আমি আদেশ করলে… রিভারোল বলতে চেষ্টা করলে বাধা দিল ব্লাড।
ডি কাসি আমাদেরকে আপনার সঙ্গে যোগ দিতে বলেছেন; কারণ আমাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে। আমার লোকবল ছিল না বলে কার্টাজেনা আক্রমণ করিনি। আপনার অবশ্য সে অসুবিধে নেই।
ঝটিকা হামলা চালিয়ে স্প্যানিশদের গুপ্তধন কেড়ে নেব আমরা।
শ্রাগ করল ব্লাড।
জানা ছিল না লুটপাটই আপনাদের আসল উদ্দেশ্য, অবজ্ঞা ঝরে পড়ল ব্লাডের কণ্ঠে।
রাগে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে রিভারোল।
বাজে বকবেন না! গর্জাল ও। ভীতু কোথাকার! যান, আপনার জাহাজে ফিরে যান। আমি একাই একশো।
আক্কেল সেলামীও দিতে হলো তাকে। বিকেলে উপকূলের এক মাইলের ভেতর জাহাজ নিয়ে এল সে। সাঁঝ ঘনাতে তীরের উদ্দেশে তিনশো লোক ক্যানু আর নৌকায় চাপল। প্রথম ছটা নৌকা বিশাল ঢেউয়ের তোড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ডুবো পাথরে বাড়ি খেয়ে সব কজন যাত্রীর ভবলীলা সাঙ্গ হলো। সমুদ্রের গর্জন এবং বিপদগ্রস্ত দের আর্তচিৎকার পেছনের সারির যাত্রীদের বাঁচিয়ে দিল। তারা নৌকার মুখ ফিরিয়ে প্রাণপণে দাঁড় বেয়ে পালাল। তা সত্ত্বেও জনা পঞ্চাশেক সঙ্গীকে হারাল ওরা। তাছাড়া, ছটা নৌকায় মজুদ অস্ত্র শস্ত্র, গোলাবারুদেরও সলিল সমাধি হয়েছে।
রিভারোল রাগে কাঁপতে কাঁপতে জাহাজে ফিরল। ক্যাপ্টেন ব্লাডের ওপর মহাখাপ্পা সে। দুর্ভাগ্যের জন্যে খামোকাই ব্লাডকে দায়ী মনে করছে। রাতে বিছানায় শুয়ে দাঁত কিড়মিড় করল। কাল সকালে খুবসে ধমকাবে বোম্বেটেটাকে।
ভোরে গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভাঙল তার। নাইট ড্রেস পরে ডেকে এসে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখল। জলদস্যুদের চারটে জাহাজ বোকা চিৎকার আধ মাইল দূরত্ব থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করছে, দুর্গের উদ্দেশে। পাল্টা গুলি চালাচ্ছে দুর্গরক্ষীরা। কিন্তু জলদস্যুরা অত্যন্ত ধূর্ত। রক্ষীরা রিলোড করছে যেই অমনি ঝাঁকে ঝাকে গুলি পাঠাচ্ছে নির্ভুল নিশানায়।
রিভারোল যুদ্ধ দেখছে আর ভেতর ভেতর ফুঁসছে। তার অনুমতি ছাড়া কোন সাহসে হামলা চালাল ব্লাড? ভিক্টোরিয়াস জাহাজের অফিসাররা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার কথায় সায় দিচ্ছে। ব্লাড়ের প্রতি তাদেরও ক্ষোভ, ঘৃণা আছে।
তুমুল লড়াই চলছে। দুর্গের অবস্থা কাহিল। জলদস্যুরাও যে খুব একটা পার পাচ্ছে তা নয়। চারটে জাহাজেই গোলা পড়েছে। অ্যারাবেলার মূল পালটি গোলার আঘাতে উড়ে গেছে। নিবোধ রিভারোলের দুচোখ খুশিতে চকচক করছে।
স্প্যানিশরা শয়তানটার চারটে জাহাজই ডুবিয়ে দিক, প্রার্থনা করল সে।
কিন্তু তার মনোবাঞ্ছ পূর্ণ হলো না। পরের মুহূর্তেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের ফলে দুর্গের অর্ধেকটায় আগুন ধরে গেল। জলদস্যুদের একটি গোলা কপাল গুণে গোলাবারুদের গুদামে গিয়ে আঘাত হেনেছে।
কঘণ্টা বাদে ক্যাপ্টেন ব্লাড ভিক্টোরিয়াসের ডেকে উঠে এসে স্যালুট দিল রিভারোলকে।
বোকা চিকা দুর্গ এখন আমাদের দখলে, বলল ও। ফরাসি ফ্ল্যাগ উড়ছে টাওয়ার থেকে। বাইরের বন্দর আপনার নৌবহরের জন্যে একদম খোলা।
রিভারোলকে বাধ্য হয়ে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখতে হলো।
কপাল ভাল বলে পার পেয়ে গেছেন, বলল সে। এরপর থেকে আমার আদেশ ছাড়া আর আক্রমণ করতে যাবেন না।
ব্লাড সবকটা দাঁত বার করে হাসল।
আর কখনও এমন করব না, বলল সে। এখুনি আবার হামলা চালানোটা জরুরী।
ভেতর বন্দরের দুর্গটির দিকে ইঙ্গিত করল। শহর দখলের আগে ওটাকে অকেজো করতেই হবে। সে পরামর্শ দিল, ফরাসি জাহাজগুলো বাইরের বন্দরে ঢুকে তখনই যেন আক্রমণ শুরু করে। অন্যদিকে সে তিনশো জলদস্যকে নিয়ে পুর্ব দিক দিয়ে ঢুকে পেছন থেকে দুর্গে হামলা চালাবে।
মুহূর্তে রিভারোলের ব্যবহার পাল্টে গেল। মনে মনে ব্লাডের বুদ্ধির তারিফ করে তক্ষুণি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দিল। কিন্তু ব্লাডকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারল না। সন্ধে নাগাদ দুর্গের পতন ঘটল। কার্টাজেনা রিভারোলের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠাল।
ফরাসিরা বিপুল সম্পত্তি হাতিয়ে নিল। পরবর্তী চারদিন অবিরাম পরিশ্রম। একশো খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে সোনা চালান করে দেয়া হলো ফরাসিদের জাহাজে।
.
আঠারো
ক্যাপ্টেন ব্লাড ও তার দলবলকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখেছে রিভারোল। শহর দখলের পেছনে ব্লডের প্রধান ভূমিকা থাকলেও আত্মসমর্পণের চুক্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার বৈঠকে ডাকা হয়নি ওকে।
ব্লাড মুখ বুজে অপমান হজম করে নিলেও খেপে উঠল জলদস্যুরা। ক্যাপ্টেনকে ন্যায্য হিস্যা বুঝে নেয়ার জন্যে রিভাররালের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য করল। রিভারোল শীতল অভ্যর্থনা জানাল ওকে।
আপনাকে একটা কথা মনে করিয়ে দিতে এসেছি, সিয়ে, বলল ব্লাড, কার্টাজেনার লুটের মালে আমাদেরও অধিকার আছে। আপনার সঙ্গে তেমন চুক্তিই হয়েছে। আমরা কিন্তু এখনও একটা ফুটো পয়সাও পাইনি। আমার লোকেরা অসন্তুষ্ট।
অসন্তুষ্টির কারণ? জানতে চাইল রিভারোল।
আপনার অসততা।
ফরাসি লোকটি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। চোখে আগুন।
চোরের বাচ্চাদের এত বাড় বেড়েছে! চিৎকার করে বলল সে।
আমার লোকদের কি দোষ? সবাই জানে আপনারা জাহাজ ভরে ফেলেছেন লুটের মাল দিয়ে, বিন্দুমাত্র পরোয়া নেই ব্লাডের কণ্ঠে। ওরা চাপ দিচ্ছে সমস্ত কিছু ওদের সামনে মেপে সমান ভাবে বেঁটে দিতে হবে।
তুমি কি বলতে চাও, শালা চোট্টা? আমি আর্মিদের লিডার, ছিঁচকে চোরদের নই।
ব্লাড ওর রাগ দেখে হেসে ফেলল।
তুমি যে-ই হও না কেন আমার কিছু যায় আসে না। সাবধান করে দিচ্ছি, ওদের অনুরোধ গায়ে না মাখলে মুশকিলে পড়বে। কার্টাজেনা থেকে বেরতে পারবে না।
তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? চেঁচাল রিভারোল। খানিক হম্বিতম্বির পর শেষ পর্যন্ত কথা দিতে বাধ্য হলো যে পরদিন সকালে সব মাল সামান জলদস্যুদের সামনে হাজির এবং ওজন করা হবে।
ব্লাড নিজের জাহাজে ফিরে কথাটা সঙ্গীদের জানাতে সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল ওরা। কিন্তু পরদিন ভোরের আলো ফুটলে দেখা গেল অ্যারাবেলা ও তার তিনটি সহযোগী জলদস্য জাহাজ ছাড়া বন্দরে অন্য কোন জাহাজ নেই। ফরাসি জাহাজগুলো রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে পালিয়েছে। রিভারোল তার সঙ্গীসাথী আর লুটের মাল নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে।
ওদের ধাওয়া করে উচিত শিক্ষা দিতে হবে! সমস্বরে গর্জাল বোম্বেটেরা। ব্লাডও সায় দিল। কিন্তু ধাওয়া শুরু করলে মন খচখচ করতে লাগল ওর। অ্যারাবেলা শুনলে ওকে কি ভাববে?
ভেবেছিলাম ডাকাতি ছেড়ে দেব, কিন্তু তা আর পারছি কই? জেরেমি পিটকে মনের কথা প্রকাশ করল ব্লড। ইংল্যান্ডের রাজার পক্ষে কাজ করা অসম্ভব। ফ্রান্সের পক্ষে কাজ করার এই তো ফল হলো। এখন ডাকাতি ছাড়া আর বাকি রইল কি?
বাকি ছিল- স্বপ্নেও যা ভাবতে পারেনি ব্লাড।
হিসপ্যানিলা ওদের গন্তব্য। ওরা জানে ফ্রান্সে পালাতে চাইলে ওখান থেকে জাহাজ রিফিট করতে হবে রিভারোলকে। দুদিন দুরাত একটানা উত্তরমুখো চলেও ফরাসি জাহাজগুলোর দেখা পেল না ওরা। কিন্তু তৃতীয় দিন সকালে দূরাগত গুলির শব্দ কানে এল।
কামানের গোলা! বলল পিট। ডেকে ব্লাডের সঙ্গে দাঁড়ানো সে।
সায় জানিয়ে কান পাতল ব্লাড।
দশ মাইল, হয়তো পনেরো মাইল বোধহয় পোর্ট রয়্যালে, পিট যোগ করল।
পোর্ট রয়্যালের কামান…তারমানে কর্নেল বিশপ হয়তো আমাদের দোস্তদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। আমাদের এগিয়ে দেখা দরকার।
গোলাগুলির শব্দ লক্ষ্য করে পরবর্তী এক ঘণ্টা ভেসে চলল ওরা। তারপর হঠাৎ করেই চারদিক নীরব, নিথর। নজরে এল একটি বস্তু, খানিক বাদেই বোঝা গেল বড় একটি জাহাজ। আগুন ধরে গেছে। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে। টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে জাহাজটির প্রধান মাস্তুল থেকে সেন্ট জর্জের ফ্ল্যাগ উড়তে দেখল ব্লাড।
ইংলিশ জাহাজ! চেঁচিয়ে বলল। যুদ্ধজয়ীকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। শেষ পর্যন্ত তিনটে বিশাল জাহাজের আবছা অবয়ব দেখতে পেল, তিন-চার মাইল দূরে। হতভম্ব ব্লাড উপলব্ধি করল সবচেয়ে বড় জাহাজটি হচ্ছে রিভারোলের ভিক্টোরিয়াস।
কিছুক্ষণ পরে রক্ষাপ্রাপ্তদের নিয়ে ভাসমান নৌকাগুলোর মুখোমুখি হলো ওদের জাহাজ। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে তখনও অনেকে আটকা পড়ে রয়েছে।
.
উনিশ
কটি নৌকা অ্যারাবেলার এক পাশে ধাক্কা খেল। বেঁটে, নাদুস নুদুস এক ভদ্রলোক উঠে এলেন ডেকে। নিঃসন্দেহে তিনি বোম্বেটে নন। তার পেছন পেছন এলেন আরেকজন মোটা, লোক। তবে ইনি লম্বা। তামাটে চেহারা, হাসি-হাসি মুখ। নীল চোখজোড়া ঝিলিক দিচ্ছে।
বেঁটে লোকটি মই বেয়ে নামতেই ব্লাডের দেখা পেলেন।
কোথায় এলাম রে, বাবা! আপনি ইংরেজ নাকি?”
আমার নাম ব্লাড– ক্যাপ্টেন পিটার ব্লাড। এটা আমার জাহাজ অ্যারাবেলা।
ব্লাড! আঁতকে উঠলেন ভদ্রলোক। জলদস্যু। দশাসই লোকটির দিকে ফিরলেন। কুখ্যাত জলদস্যু, ফন ডার কুইলেন। একেবারে বাঘের ঘরে ঢুকে বসে আছি।
তাই? লম্বা ভদ্রলোকের কণ্ঠে বিদেশী টান স্পষ্ট। হঠাৎ হাসতে লাগলেন তিনি।
আরে, হাসির কি হলো? চেঁচালেন বেঁটে। প্রথমে রাত্তির বেলা ফ্লীট হারিয়ে ফেললেন, তারপর ফরাসিদের হাত থেকে কোনমতে পালিয়ে বাঁচলেন; তারপর এখন ধরা পড়েছেন জলদস্যুর হাতে। ভাল, খুব ভাল। যত ইচ্ছে হাসুন।
ভুল বললেন, স্যার, শান্ত, স্বরে বলল ব্লাড। আপনাদের ধরা, হয়নি, বাঁচানো হয়েছে। একটু বোঝার চেষ্টা করে দেখুন কৃতজ্ঞতা আসবে।
মেজাজী ভদ্রলোক ব্লাডের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে নিজের পরিচয় দিলেন।
আমি লর্ড উইলোবি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে রাজা উইলিয়ামের গভর্নর জেনারেল। আর ইনি অ্যাডমিরাল ফন ডার কুইলেন। রাজার ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান স্ক্রীটের কমান্ডার।
রাজা উইলিয়াম? বিস্মিত বনে গেছে ব্লাভ। কে তিনি?
এবার অবাক হওয়ার পালা লর্ড উইলোবির।
রাজা তৃতীয় উইলিয়াম রানী মেরির সঙ্গে তিনমাস ধরে ইংল্যান্ড শাসন করছেন।
কথাটা হজম করতে ব্লাড কসেকেন্ড সময় নিল।
জেমস খচ্চরটাকে শেষপর্যন্ত জুতো মেরে তাড়ানো হয়েছে? প্রশ্ন করল ও।
লর্ড স্মিত হাসলেন। আপনি জানতেন না? এতদিন ছিলেন কোথায়? দুনিয়ার সঙ্গে গত তিন মাস ধরে কোন যোগাযোগ নেই।
তাই হবে! আর এই তিন মাসে দুনিয়ায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলেন তিনি। রাজা জেমস ফ্রান্সে পালিয়ে গিয়ে রাজা লুইয়ের দরবারে আশ্রয় নিয়েছে। ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যে যুদ্ধ চলছে তার অন্যতম প্রধান কারণ এটি। রিভারোল কোনভাবে জানতে পেরেছিল সেটা। তা নইলে ইংলিশ জাহাজ আক্রমণ করার ধৃষ্টতা দেখাত না।
ব্লাড খবরটা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠল। জেমস যদি রাজা না-ই হয়ে থাকে তবে ইংল্যান্ডে ফিরতে তার অসুবিধে কোথায়? সব আবার নতুন করে শুরু করলেই তো হয়! মনের কথা খুলে বলল উইলোবিকে।
দেশে ফিরতে চাইলে ফিরতে পারেন, বললেন লর্ড। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, চারবছর আগের ঘটনা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। কিন্তু এত তাড়া কিসের? আপনি তো ক্যাপ্টেন হিসেবে রীতিমত বিখ্যাত। সুযোগটা নিন না। যুদ্ধে রাজা উইলিয়ামের পক্ষে লড়ন। ওয়েস্ট ইন্ডিজে আপনার অভিজ্ঞতা সরকারের অনেক কাজে আসবে।
ব্লাড বলল ভেবে জানাবে।
আগে আপনার একটা ব্যবস্থা করি, বলল ও। পোর্ট রয়্যালে ফিরতে চান নিশ্চয়ই?
পোর্ট রয়্যাল? রাগত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। গত সন্ধেয় পোর্ট রয়্যালে ঢু মেরেছেন তাঁরা, কিন্তু ডেপুটি গভর্নরকে পাননি।
গোটা নৌবাহিনী নিয়ে জলদস্যুদের পেছনে লাগতে গেছে ও।
ব্লাড হতভম্বের মত এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে হেসে ফেলল।
এ সময় কেউ এমন কাজ করে? লোকটা পাগল নাকি?
ফরাসিদেরকে আক্রমণ করার রাস্তা খুলে দিয়ে গেছে, বিরক্ত লর্ড বললেন। জেমসের সরকার অমন অযোগ্য লোকদেরই চাকরি দিয়েছে। ভাবতে পারেন!
হাসি মুছে গেল ব্লাডের মুখ থেকে।
রিভারোল একথা জানে?
জবাব দিলেন ওলন্দাজ অ্যাডমিরাল।
রিভারোল আমাদের কজন লোককে বন্দী করে নিয়ে গেছে। ওরা বলে দেবে পোর্ট রয়্যালে পাহারা নেই। এমন সুযোগ ছাড়বে না ও।
মেজাজ আরও চড়ল, লর্ডের।
পোর্ট রয়্যালের কোন ক্ষতি হলে বিশপ গর্দভটাকে মজা বোঝানো হবে। টরটুগায় যাওয়ার ওর কি দরকারটা ছিল?
হাসল ব্লাড।
আমাকে খুঁজছে, মাই লর্ড। আমার মনে হয় ওর অবর্তমানে জ্যামাইকা রক্ষার দায়িত্ব আমারই নেয়া উচিত। চেঁচিয়ে পিটকে নির্দেশ দিল। পোর্ট রয়্যালে যেতে হবে। যত জলদি সম্ভব।
লর্ড উইলোবি ও অ্যাডমিরাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।
কিন্তু ওদের সঙ্গে পারবেন কিভাবে! রিভারোলের জাহাজ আপনারটার চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি শক্তিশালী।
ওকে হারাতে না পারলেও আমাদের জাহাজগুলো ডুবিয়ে দিয়ে বন্দরের মুখটা তো বন্ধ করতে পারব, বলল ব্লাড। এই ফাঁকে হয়তো বিশপও ফিরে আসবে।
তাতে লাভ কি? প্রশ্ন করলেন উইলোবি। সংশয় দূর হচ্ছে না তার।
বলছি, মাই লর্ড। রিভারোল ঝুঁকিটা নেবে। কার্টাজেনার সমস্ত লুটের মাল ওর জাহাজে। ও পোর্ট রয়্যালে গেছে সবসুদ্ধ। ও আমার সঙ্গে হারুক-জিতুক, এটা ঠিক পোর্ট রয়্যাল থেকে লুটের সামান নিয়ে বেরতে পারছে না।
লর্ড উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
ক্যাপ্টেন ব্লাড, আপনি সত্যিই গ্রেট, বললেন তিনি। আক্রমণের পরিকল্পনা করতে তখুনি বসে পড়ল ওরা।
.
বিশ
সেদিন বিকেল। জলদস্যুদের জাহাজগুলো পোর্ট রয়্যালের বাইরের দিককার সঙ্কীর্ণ জমির আড়াল নিয়ে ধীরে ধীরে বন্দরের কাছে এসে নোঙর করল। দুঘণ্টা হলো পৌঁছেছে ওরা, শহরবাসী আর রিভাররালের চোখ ফাঁকি দিয়ে। সর্বক্ষণই ওদের কানে এসেছে কামানের গর্জন। ফরাসি ও পোর্ট রয়্যালের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে।
দেরি করছেন কেন, মাই ফ্রেন্ড? ব্লাডকে জিজ্ঞেস করলেন ফন ডার কুইলেন।
ব্লাড ওঁর দিকে চেয়ে হাসল।
আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাব না, বলল, সবুরে কিন্তু মেওয়া ফলে। ফরাসি জাহাজগুলো ড্যামেজ হবেই, তাতে আমাদের সুবিধে। কান পাতল ও। এখনই সময়, বলে চলল, দুর্গের দিক থেকে গুলি বন্ধ। আমরা এখন আক্রমণ করব।
চেঁচিয়ে জেরেমি পিটকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল ও। মুহূর্তে অ্যারাবেলা আর এলিজাবেথের ক্রুদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হলো। দুটোই বন্দরের দিকে এগোচ্ছে। মিনিট পনেরোর মধ্যে বন্দরের প্রবেশমুখে চলে এল। দুর্গ এখন ভগ্নপ। বিজয়ী বাহিনী শহরের দখল নিতে দ্রুত এগোচ্ছে।
ব্লাড শক্রদের জাহাজগুলো লক্ষ করে মৃদু হাসল। ভিক্টোরিয়াস মোটামুটি অক্ষতই রয়েছে, অন্য দুটোর বেহাল অবস্থা।
দেখলেন তো! ফন ডার কুইলেনের উদ্দেশে চিৎকার করে বলল। অপেক্ষার সুফল। এবার নিজের লোকদের প্রতি চেঁচিয়ে আদেশ করল। যে যে ভাবে পারো আক্রমণ করো।
পেল্লায় জাহাজটিকে হঠাৎ নিজের দিকে আসতে দেখে কলজে শুকিয়ে গেছে রিভারোলের। সে কোন নির্দেশ দেয়ার ফুরসত পেল না। প্রতিপক্ষ সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। গোলার আঘাতে কেঁপে উঠল ভিক্টোরিয়াস, ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আসছে। ফরাসিদের বিহ্বলতা কাটার আগেই দ্বিতীয় দফা আক্ৰমণ এল।
জেরেমি, চিৎকার করছে ব্লাড, আরও ভেতরে ঢুকে পড়ো। ওদের ডেকে নামব। হেটন হুকগুলো! ফ্রন্টের গোলন্দাজকে বলল যত বেশি পারে ফায়ার করতে।
অতিথিদেরকে ত্বরিত প্ল্যান ব্যাখ্যা করল ব্লাড।
ওদের ডেকে নেমে হাতাহাতি করতে হবে। সেটাই একমাত্র সুযোগ। ওদের বিরুদ্ধে কামানযুদ্ধে বেশিক্ষণ টিকতে পারব না আমরা।
ইতোমধ্যে প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে উঠে পাল্টা আঘাত হানতে আরম্ভ করেছে ফরাসিরা। কামানের তোপে টলমল করছে অ্যারাবেলা। মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত করে আবার এগোতে শুরু করল। সামনের অংশ চূর্ণবিচূর্ণ, ডেক বিধ্বস্ত, পানির স্তরের সামান্য ওপরে বড় একটি গর্ত দেখা দিয়েছে। এ্যাপলিং হুক নিয়ে অতিকষ্টে এগিয়ে আসছে অ্যারাবেলা। ওদিকে রিলোড করে আবারও আক্রমণ শানিয়েছে রিভারোল বাহিনী। কামানের গর্জন এবং আহতদের আর্তচিৎকারের মধ্য দিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে কালো ধোঁয়ার আড়ালে আশ্রয় নিল জাহাজটি। এ মুহূর্তে শত্রুপক্ষ দেখতে পাচ্ছে না ওদের। পিট চেঁচিয়ে জানাল, জাহাজ দ্রুত ডুবছে। ভিক্টোরিয়াস নাগালের মধ্যেই রয়েছে, তবু যেন মনে হচ্ছে বহুদূর; পৌঁছতে পারবে না।
ভিক্টোরিয়াসের সাত আট গজের মধ্যে এখন ওরা। নিচের ডেক ইতোমধ্যে পানির তলে, উল্লসিত ফরাসিদেরচাঁচামেচি আর হাসির শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ব্লাডের লোকেরা সামনে লাফিয়ে দু জাহাজের মধ্যের ফাঁকা জায়গায় গ্র্যাপলিং হুক ছুঁড়ে দিল। দুটো হুক ফরাসিদের ডেকে আটকেছে। অভিজ্ঞ বোম্বেটেরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে জাহাজ দুটিকে একত্র করার চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত সফলও হলো। দুজাহাজ বাড়ি খেল। ভিক্টোরিয়াসের সঙ্গে ফাঁসানো ছটা হুক নামকাওয়াস্তে ভাসিয়ে রাখল অ্যারাবেলাকে।
ব্লডের নেতৃত্বে জলদস্যুরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ফরাসিদের ওপর। একটানা আধ ঘণ্টা ধরে দুপক্ষে সংঘর্ষ চলল। ফরাসিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফলে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলল। কিন্তু বোষেটেরা জানে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, পালানোর পথ বন্ধ। ওরাও বেপরোয়া। ভিক্টোরিয়াসকে হয় নিজেদের দখলে আনো নয়তো মরো।
প্রায় অর্ধেকের মত, সঙ্গীকে হারিয়ে শেষ অবধি জাহাজটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারল ওরা। মাথায় গুলি খেয়ে প্রাণত্যাগ করেছে রিভারোল। যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া গুটি কয়েক ফরাসি আত্মসমর্পণ করে প্রাণভিক্ষা চাইল। ব্লাডের নির্দেশে হুকগুলো খুলে দেয়া হলো। ক্যাপ্টেনের চোখের সামনে তার প্রিয় জাহাজটি সমুদ্রের গভীরে ঠাই নিল।
দৃশ্যটি দেখতে দেখতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ব্লাড।
.
একুশ
কদিন পরে ফন ডার কুইলেনের বাদ বাকি নৌবহরগুলো পোর্ট রয়্যালের বন্দরে নোঙর করল। লর্ড উইলোবি বৃথা সময় নষ্ট না করে অন্যান্য ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান দ্বীপগুলো ঘুরে দেখার জন্যে জাহাজ ভাসাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
ওই গাধা ডেপুটি গভর্নরটার জন্যে এত পিছিয়ে গেলাম আমরা, অ্যাডমিরালের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন ভদ্রলোক।
সেজন্যে আর ভেবে কি হবে? বললেন ফন ডার কুইলেন। যোগ্য লোক তো আপনার চোখের সামনেই রয়েছে। তাকেই দায়িত্ব বুঝিয়ে দিন না।
ব্লাডের কথা বলছেন?
আর কার কথা বলব? তার চেয়ে ভাল লোক আর পাবেন?
তো একই রকম চিন্তা আপনার মাথাতেও এসেছে দেখি? মন্তব্য করলেন লর্ড উইলোবি। ও নিঃসন্দেহে বিশপের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য।
ডেকে পাঠানো হলো ব্লাডকে। প্রস্তাব শুনে খানিকটা অবাকই হয়েছে ও। স্বপ্নেও এমন প্রস্তাবের প্রত্যাশা করেনি। ও কি পারবে অমন গুরুত্বপূর্ণ একটি পদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে? তাছাড়া মিস বিশপের চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এ বাড়িতেই রয়েছে মেয়েটি, যদিও এখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। ওর প্রতি সামান্যতম করুণাও যদি থাকত অ্যারাবেলার…! ওর উপস্থিতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছে মেয়েটি। ওরই চাচার পদে দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাবে রাজি হওয়াটা কি ঠিক হবে?
লর্ড উইলোবি ও বোম্বেটে বন্ধুদের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হলো ব্লাডকে। গ্যারিসন কমান্ডারের উপস্থিতিতে ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব বুঝে নিল সে।
এবার আমরা নিজেদের কাজে মন দিতে পারব, সাফল্যের হাসি হেসে বললেন ফন ডার কুইলেন।
কাল সকালে রওনা দেব, জানালেন লর্ড।
বিস্মিত ব্লাড চাইল ওঁর দিকে।
কর্নেল বিশপের কি হবে?
সে আপনি জানেন। আপনি এখন ক্ষমতায়। সে ফিরলে আমার চিঠিটা ওর হাতে দেবেন, একটি চিঠি ব্লাডের হাতে দিলেন লর্ড।
ক্যাপ্টেন ব্লাড তখনই কাজে লেগে পড়ল। পোর্ট রয়্যালের বিপর্যস্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। বিধ্বস্ত দুর্গটি পরিদর্শন করে জরুরী ভিত্তিতে মেরামতের নির্দেশ দিল।
পরদিন সকালে ফন ডার কুইলেনের জাহাজ যখন পাল তোলার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন গভর্নরের অফিসে বসা ব্লাডের কানে একটি সুখবর মধু ঢালল। বিশপের ফ্লীটকে নাকি আসতে দেখা যাচ্ছে।
খুব ভাল হলো, বলল ব্লাড। লর্ড উইলোবির সঙ্গে দেখা হবে। ও এখানে পৌঁছলেই গ্রেপ্তার করে আমার কাছে নিয়ে আসবে।
চেয়ারে বসে ছাদের কড়িকাঠ গুণছে ব্লাড। পেরোচ্ছে সময়। দরজায় টোকা পড়ল। একজন ভৃত্য ঢুকে জানতে চাইল মহমান্য ব্লাড মিস বিশপের সঙ্গে দেখা করবেন কিনা।
মান্যবরের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কাঠ হয়ে বসে ভূত্যের দিকে কমুহূর্ত চেয়ে রইল। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
মেয়েটি প্রবেশ করলে উঠে দাঁড়াল ব্লাড। অ্যারাবেলার চেহারাতেও মলিনতা। এক মুহূর্ত পরস্পরকে নীরবে লক্ষ করল। তারপর এগিয়ে এসে মেয়েটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করল: আ…আমি এইমাত্র খবরটা শুনেছি…ইয়োর এক্সেলেন্সী, তোতলাচ্ছে রীতিমত।
ভয়ের কিছু নেই, মিস যিশপ, অভয় দিল ব্লাড। আপনার চাচার সঙ্গে আমার শত্রুতা থাকতে পারে, কিন্তু প্রতিশোধ নেব না আমি। বরঞ্চ তাকে রক্ষা করার চেষ্টাই করব। লর্ড উইলোবি অবশ্য তার ওপর। মহা খাপ্পা, কঠোর শাস্তি দিতে চান। তবে আমার ইচ্ছা আপনার চাচাকে বার্বাডোজে ফেরত পাঠানো।
ধীর পায়ে আরেকটু এগোল অ্যারাবেলা।
আমি…আমি খুব খুশি হলাম, হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল।
ঠাণ্ডা চোখে বাড়ানো হাতটা দেখল ব্লাড। তারপর বাউ করে বলল, চোর-ডাকাতদের সঙ্গে হাত মেলাবেন?
প্লীজ, ওকথা বলে আমাকে আর লজ্জা দেবেন না, হাসার চেষ্টা করছে মেয়েটি। আমি কি কোনদিনই ক্ষমা পাব না?
ক্ষমা করতে খানিকটা কষ্ট তো হচ্ছেই। যাকগে, ওসব নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
বিষণ্ণ চোখে ব্লাডের দিকে চেয়ে আবার হাত এগিয়ে দিল অ্যারাবেলা।
আমি যাচ্ছি, ক্যাপ্টেন ব্লাড। চাচার সঙ্গে বার্বাডোজে ফিরে যাব। আর হয়তো কখনও দেখা হবে না। আমি আপনার সঙ্গে অনেক দুর্ব্যবহার করেছি, সেজন্যে ক্ষমাও চেয়েছি। আমাকে…আমাকে কি গুড বাই-ও বলবেন না?
অন্তরের সমস্ত তিক্ততা মুহূর্তে ঝেড়ে ফেলল ব্লাড। মিস বিশপের হাত ধরে নরম গলায় বলল, অ্যারাবেলা! কণ্ঠে মিনতি, বার্বাডোজে আপনাকে ফিরতেই হবে? নাকি আমার সঙ্গে ইংল্যান্ডে ফিরবেন? কাঁদছেন কেন! আমার কোন কথায় কষ্ট পেয়েছেন?
আমি আসলে এমন কথা শুনব আশা করিনি, কান্নার ভেতরে হেসে ফেলল আরাবেলা।
এরপর বলাইবাহুল্য দুজনে দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রেমালাপ করল। ব্লাড বেমালুম ভুলে গেছে তার অফিসের দায়িত্বের কথা।
ইতোমধ্যে বিশপের জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে। সে নেমেছে জাহাজ থেকে। হতাশ, ক্ষুব্ধ লোকটির কপালে আরও দুঃখ বাকি ছিল। মেজর ম্যালার্ডের নেতৃত্বে একদল মিলিশিয়া তাকে গ্রেপ্তার করার জন্যে অপেক্ষা করছে। তার সঙ্গে অচেনা দুজন লোক।
ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসেছে ম্যালার্ড।
কর্নেল বিশপ, আপনাকে গ্রেপ্তার করার অর্ডার আছে।
বিশপ হতবাক। রাগে থমথম করছে মুখ।
কি যা তা বকছেন। গ্রেপ্তার আমাকে? কার অর্ডারে?
জ্যামাইকার গভর্নরের অর্ডারে, অপরিচিতদের মধ্য থেকে একজন বললেন। বিশপ খুনী চোখে তার দিকে চাইল।
গভর্নর? পাগল নাকি! সবার ওপর নজর বুলিয়ে বলল, গভর্নর তো আমি।
ছিলেন, খাটো লোকটি বললেন। এখন আর নন। শহরটাকে তোপের মুখে ফেলে আপনি নৌবহর নিয়ে হাওয়া খেতে গিয়েছিলেন। ব্যাপারটা আমাদের কাছে ছেলেখেলা নয়। আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে কিনা সেটার বিচার করবেন আপনার উত্তরসূরি।
পিলে চমকে গেছে বিশপের।
আপনি কে?
আমি লর্ড উইলোবি। রাজার ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কলোনিগুলোর গভর্নর জেনারেল ও জানতেন নিশ্চয়ই আমি যে আসছি?
আলখাল্লার মত খসে পড়ল বিশপের অবশিষ্ট রাগ-ঝাল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে।
কিন্তু, মাই লর্ড… বলতে চেষ্টা করল ও।
স্যার, আমার অজুহাত শোনার কোনও দরকার নেই। বাধা দিয়ে বললেন লর্ড। আমি এখন রওনা দেব। হাতে সময় কম। গভর্নরকে সব বলুন, তিনিই যা ব্যবস্থা নেয়ার নেবেন।
মেজর ম্যালার্ডের উদ্দেশে তিনি ইঙ্গিত করলে বিশপকে গভর্নরের বাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। এ বাড়ি এতদিন তারই ছিল। ওকে হল-এ দাঁড় করিয়ে রেখে গভর্নরকে ওর কথা জানাতে গেল ম্যালার্ড।
কমান্ডার যখন রূমে প্রবেশ করল তখনও মিস বিশপ আর ব্লাড প্রেমালাপে মশগুল। সব শুনে অ্যারাবেলা অনুনয় করল, চাচাকে ক্ষমা করবে না? আমার খাতিরে অন্তত ওঁকে ছেড়ে দাও।
ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না, নরম করে বলল ব্লাড। ম্যালার্ড কর্নেল বিশপকে ডেকে আনতে গেলে সুড়ত করে পেছন দরজা দিয়ে বাগানে সেঁধোল অ্যারাবেলা।
মহামান্য গভর্নর আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, এই বলে দরজা খুলে দিল ম্যালার্ড।
কর্নেল বিশপ রূমে ঢুকে অপেক্ষা করতে লাগল।
এক ভদ্রলোক ওর টেবিলটিতে বসেছেন। তার কোঁকড়া কালো চুলগুলো ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। মাথাটা উঁচু হলো হঠাৎ। একজোড়া নীল চোখ সাপের মত শীতল চোখে বন্দীর দিকে চেয়ে রয়েছে। কর্নেল বিশপ আঁক করে একটা শব্দ করল। মুখ হাঁ। হতভম্ব। যার জন্যে টুরটুগা ছুঁড়ে মরেছে সেই পরম শত্রু যে সামনেই বসা!