২. খেতে বসেছে সকলে

খেতে বসেছে সকলে। কিন্তু কেউই সারিবদ্ধভাবে বসেনি। অল্প একটু জায়গার মধ্যে সকলেই প্রায় বসেছে জবুথবু হয়ে। অ্যালুমিনিয়াম বা লোহার থালা সকলের হাতে।… জায়গাটা অন্ধকার, একটি মাত্র রেশ এসে পড়েছে রান্নাঘরের লম্ফটার।

কালো রয়েছে রান্নাঘরে। যে যার থালা নিয়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর খাবার নিয়ে বসে পড়ছে পাশাপাশি। বাড়িওয়ালাও তাদের সঙ্গেই বসেছে, একটু দূরে রান্নাঘরের দরজাটার কাছেই।

গোবিন্দ একটা অন্ধকার কোণ থেকে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখছিল।

সকলেই প্রায় চুপচাপ খাচ্ছে। খাওয়ার, জিভ নাড়ার ও হাত চাটার হুসহাসের সঙ্গে অসমান কাঁচা মেঝেয় থালার ঠকঠক শব্দের এক বিচিত্র ঐকতান উঠেছে। মাঝে মাঝে কেউ কেশে উঠছে বা কথা বলে উঠছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, এখানে বুঝি কোনও মানুষ নেই, শ্মশানের বটতলার ঝুপসিতে একদল প্রেত নিঃশব্দে ফলারে বসেছে।

কে একজন আচমকা নিশ্বাস ফেলে বলে উঠল, যাঃ শালা, থালা সাফ হয়ে গেছে।

অমনি একজন হি-হি করে হেসে উঠে বলে, আন্ধারে খেতে বসার মজা আছে। কখন যে সব ফুরিয়ে যায়।

দীর্ঘ পথ হাঁটা ক্লান্ত গোবিন্দের পেটভরা ক্ষুধা যেন একটা পাক খেয়ে থম ধরে গেল। এই অতৃপ্ত ক্ষুধার আবহাওয়ায় যেন বর্ষার অশান্ত হাওয়ার বেগও থেমে গেছে, মেঘ অনড় হয়ে গেছে আকাশে। … উপোস এক কথা কিন্তু খেতে বসে ক্ষুধার অতৃপ্তি আর এক কথা। এ কী হাভাতের আস্তানায় উঠেছে সে। মনটা তার বারবার বলে উঠল, চলে যেতে হবে, এখান থেকে।

কিন্তু কোথায়! পেছনে ফেলে আসা জীবনটা এক খলখল হাসিতে ভেসে উঠল তার সামনে, যে জীবনের ছবিতে অনাহার একটা একটানা চৌঘরা রেখার মতো বেড় দিয়ে রেখেছে। সেই খলখল হাসির তাড়ায় আজ আবার এসেছে সে এই চটকল শহরে, ছুটে গেছে ডায়মন্ডহারবার থেকে তিনসুকিয়া, নোয়াখালি থেকে পশ্চিমের কয়লার খনিতে। মহারুদ্র মন্বন্তরের করাল থাবার ছায়ায় ঢাকা পথে পথে ঘুরে সব হারিয়ে, পঞ্চাশ সালের গলিত জনপদের উপর উধ্বশ্বাস প্রেতের মতো পদে পদে আটকে যাওয়া পা জোর করে তুলে ছুটেছে সে। তবু আজও বুকের কোনখানটায় ব্যথা ও জ্বালা বোধের একটা ছোট জায়গা রয়ে গেছে, যেখানে পথচলা জীবনের সব ধারা খটখট করে বারবার বেঁধে যায়।

হঠাৎ তার কানে এল বাড়িওয়ালার কর্কশ গলার শব্দ, এই-এই নগিনা, খালি থালাটা ঘাঁটছিস কেন, অ্যাঁ?

নগেন যেন চমকে উঠে বলল, কী বললে?

তোর মাথা।… নে নে, আমি দুটো দিচ্ছি… খেয়ে নে। বলে ঠাস করে পাতে কী যেন দিল।

নগেন বলে উঠল তার স্বাভাবিক মোটা গলায়, থাক না বাড়িওয়ালা।

এহে, কোথাকার জামাই এল। কড়া ধমকের গলায় বাড়িওয়ালা বলে উঠল, লে লে খেয়ে উঠে যা। ব্যাটা জন্মালি, তো এত বড় শরীরটা নিয়ে কেন?

তারপর হেঁকে উঠল, কই হে ফোর টুয়েন্টি, আবার রাস্তা হারালে নাকি?

গোবিন্দের মুখে আবার সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসিটি ফুটে উঠল। কাছে এসে বলল, সব যে জেগে আছে।

বাড়িওয়ালা হাসল না কাশল কিছু বোঝা গেল না, কেবল একটা হুঙ্কার শোনা গেল।

বাজিকর কাছে এসে সাহেবি কায়দায় সেলাম ঠুকে বলল, শোনো বাবা ফোর টুয়েন্টি, ভাতের ফেনটা রোজ আমার পাওনা। আমার পোষা সাপ তিনটে দুধের চেয়ে ফেনটাই বেশি খায়, বুঝেছ?

নগেন তার অবশিষ্ট গরাসটা মুখে তুলে বলল, হ্যাঁ, ওর একটা মস্ত হেলে আর একটা বিঘতখানেক ঢ্যামনা সাপ আছে।

সদী বুড়ি বলল কেশো গলায় হেসে, ও আবার ঢ্যামনটাকে দেখিয়ে তোককে বলে ন্যাজ ক্ষয়া তক্ষক।

কথাগুলির উদ্দেশ্য তাদের নতুন বন্ধু গোবিন্দকে শোনানো। কিন্তু খুব স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো বাজিকরের মনে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। সে হঠাৎ রেগে বলে উঠল, বিষদাঁতগুলো ঝরিয়ে দিয়েছি, নইলে একবার মজাটা দেখিয়ে ছাড়তুম।

ওই যা দুখুঃ! বলে নগেন উঠে গেল।

সদী বুড়ি হলেও প্রাণটা তার এদিক থেকে ডাঁটো রয়ে গেছে। সে বেশ খাপচি কেটে ধীরে ধীরে বলে, বিষ নেই বলেই তো চক্করঅলা সাপকেও ঢোঁড়া বলে, তাতে রাগের কী আছে! কী বলল হে, ফোরটোয়েন্টি না কী তোমার নাম। বলেই সে চাপা গলায় হাসে খলখল করে। গোবিন্দ ভাবে, বাঃ বুড়ি ভারী রসিক তো। তার সেই বহুদিনের আগে গাঁয়ের কথা মনে পড়ে যায়। সে ভাবে, এই আস্তানায় ও আবহাওয়ায় বুড়ির প্রাণটা এমন টাটকা রয়েছে কেমন করে! কিন্তু বাজিকর খেপে ওঠার আগেই সদী বুড়ি চকিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাজিকর চেঁচিয়ে কিছু একটা বলার পূর্বেই গোবিন্দ তার হাত ধরে বলল, ছেড়ে দাও ভাই, বুড়ি মানুষ। আমি তো আর অবিশ্বাস করিনি।

বাজিকর একটু সন্দিগ্ধভাবে তাকাল গোবিন্দের দিকে। বলল, ফোর টুয়েন্টি লোক তুমি, তোমার কথায় কিছু বিশ্বাস আছে? আচ্ছা কালই তোমাকে সাপগুলো দেখিয়ে দেব, তখন বুঝবে।… আর আমাকে মিথ্যুক বলে লাভ কি? মাদারিখেলা, সেও তো এক ফোর টুয়েন্টি, হ্যাঁ এই তত সাদা কথা। লোকে কী ঘাস খায় যে কিছু বোঝে না।

নিশ্চয়ই। গোবিন্দ তাকে ঠাণ্ডা করতে চাইল।

কিন্তু বাজিকর থামল না।আর ফোর টুয়েন্টি নয় কে বললা? কোনও শালা এসে আমার সামনে বলুক চারশো বিশ করেনি, পাঁচজুতি খেয়ে তার আমি মাদারিখেলাই ছেড়ে দেব।

কালো রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, কই গো প্রেমযোগিনী, ভাত নিয়ে যাবি, না-কি? ফুলকি, এই ফুলকি।

বাড়ির ও-পাশ থেকে জবাব এল, সে তত বেহুঁশ। ঠাণ্ডার দিনে খুব টেনেছে।

এ পড়ে আছে।

কালো বলল, খোঁচা দিয়ে তুলে দে তো।

তারপর গোবিন্দকে ডাকল সে খেতে। বাজিকর আবার ফ্যানের কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে বিদায় নিল।

বাড়ির উত্তর দিকটাতে একটা চেঁচামেচি পড়ে গেছে। সানুনাসিক জড়ানো একটি মেয়ে-গলার টেনে টেনে কান্নার মতো শব্দটা ভেসে আসছে।

কালো বলে উঠল, এই সেরেছে হুঁড়ি এখন আবার গান ধরেছে।

গোবিন্দ জিজ্ঞেস করল, কে ও?

প্রেমযোগিনী।

মানে? মানে?

মানে কী আর সব কথার আমরাই জানি? কালো বলল বিকৃত মুখে, বলেছি তো তোমাকে, এ চটকল বাজারের মতি গতি ভগবানও জানে না। নাম ওর ফুলকি কিন্তু হয়ে গেছে প্রেমযোগিনী। বলে ও নাকি খুব ভাল আর বড় ঘরের মেয়ে ছিল। পিরিতের মানুষ হারিয়ে অবধি ও পথে পথে ঘুরে শেষটায় মরেছে এই চটকলে। শেষের দিকে কালোর গলার স্বরটা চেপে এল তিক্ততায়।—হুঁড়ি মদ খাবে কাঁড়ি কাঁড়ি আর সন্ধে হলে রোজ চেঁচিয়ে মরবে.. মা বাপ নেই. কোনও কিছুর মা বাপ নেই। থাকবে কী করে? চটকলের কি মা বাপ আছে।

ফুলকির চেয়ে কালোর কথাগুলোই গোবিন্দের মনে লাগে বেশি এবং তার বারবারই মনে হচ্ছিল কথাগুলো কালো বলছে না। ওর ভেতর থেকে আর একজন একটা ক্ষতবিক্ষত গলা থেকে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে।

ফুলকির বেসুরো সরু গলার গান ভেসে এল, আমার কানুমণি মথুরায় গেছে..’ এবং গেছে বলে সেই বিলম্বিত টান আর থামতে চায় না মনে হয় সেই বিলম্বিত টানের রেশ গান থেকে শেষটায় যেন কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।

বাড়িওয়ালার গম্ভীর গলা শোনা গেল, ফুলকি।

চট করে গান বন্ধ হয়ে গেল এবং দড়াম করে একটা শব্দ হল দরজা বন্ধের।

কালো বলল, নেও হয়ে গেছে। আজ আর ও খাবে না।

কেন?

ওই যে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এরকম হয় ওর পেরাই।

পাগল নাকি? জিজ্ঞেস করল গোবিন্দ।

পাগল নয় কে? এক কথায় যেন সব মীমাংসা করে দিল কালো। ভাত দিল খেতে গোবিন্দকে।

কালোর মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে ভরসা পেল না গোবিন্দ।

প্রায় হামা দিয়ে কালোর সঙ্গে একটা খুপরির মধ্যে ঢুকল গোবিন্দ। ফস করে একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে কালো ধরালো একটা মোটা পাকানো পাটের কেঁসো। মনে হল যেন দপ করে আগুন জ্বলে উঠল ঘরটাতে।

কালো বলল, তোমার বিছানাপত্তর কিছু আছে তো?

গোবিন্দ বলল, একটা গামছা আছে।

কালো বক্র ঠোঁটে ফিরে তাকাল, ও, তুমি দেখছি আর এক কাঠি ওপরে।

খালি নর্দমার জলে হাত ধুতেই যত গা ঘিনঘিন মন চেকনাই?

তা বলে নর্দমার জলে কারও যাওয়া ঠিক নয়।

কেন?

ব্যামো ট্যামো হতে পারে।

কালো হেসে উঠল এবং বোধ হয় এই প্রথম সে হাসল। হাসিটিও বড় বিচিত্র। ওপর পাটির সামনের দুটি দাঁত নেই, পাশের দাঁত দুটো ষ্টুলো ও লম্বা। তাতে হাসিটা তার খানিক জান্তব হয়ে উঠেছে।

ব্যামো? নর্দমার জলে হাত না ধুয়ে এখানে তুমি ব্যামো আটকাবে? বলতে বলতে তার চোখ দুটো যেন কোনও বীভৎস দৃশ্য দেখে উদ্দীপ্ত ও বড় হয়ে উঠল।

কোথায় ব্যামো নেই? এই ঘরে, এর দেওয়ালে, চালে, মেঝেয়, সারা বস্তি, পথ, বাজার; দুনিয়াময় থিক থিক করছে ব্যামো। ব্যামো আটকাবে তুমি?

প্রতিবাদ করলে কালো খেপে উঠতে পারে ভেবে একটু তোয়াজ করে, তার হাত ধরে বলল, মানি ভাই তোমার কথা, তবু আটকাতে হবে তো। নইলে মানুষ তো সাবাড় হয়ে যেত কবে।

হবেই তো। কালো যেন ব্যাধিগ্রস্ত বিকারের রোগীর মতো বলতে লাগল, মানুষ তো সব সাবাড় হবেই, কে বেঁচে থাকবে? ব্যামো যে মানুষের মনে।

তা হলেও ব্যামো সারাতে হবে। মানুষ কত কষ্ট করে বাঁচতে চায়, দেখোনি তুমি? গোবিন্দ বলল।

দেখিনি? পোড়া মাছের খাবি খাওয়া খুব দেখেছি।

গোবিন্দ এবার দৃঢ় গলায় বলল, মনে তোমার যাই থাক, কালো তুমিও বাঁচতে চাও। না চাও যদি তো খাও কেন, উপোস তো দেও না। বিষ মিশিয়ে খাওয়াও না কেন সবাইকে রায়ার মধ্যে দিয়ে? পোড়া মাছ তো মানুষ নয়, তুমি মানুষের কথা বলল।

কালো একদৃষ্টে কিছুক্ষণ গোবিন্দের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আর শালা, তুমি আমাকেও ফোর টুয়েন্টি করছ; বোঝাচ্ছ আমাকে? আচ্ছা থাকো দু-দিন চটকল বাজারে, দেখো চোখ ভরে প্রাণের নিশানা—

থেকেছি আমি। দশ বছর আগে আমি এখানে কাজ করে গেছি।

এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে গিয়ে হঠাৎ যেন চুপসে যাওয়ার মতো কালো চুপচাপ বসে পড়ল। না, গোবিন্দ দশ বছর আগে এখানে ছিল, সেজন্য নয়। সে মনে মনে বলে উঠল, গোবিন্দ বুঝবে না তার কথা, গোবিন্দ চিনবে না তাকে। একটা ঘাগী ভবঘুরে। সে কী করে বুঝবে তার কথা, যার জীবনে ঘর শুধু বারবার ভেঙেই গেছে। বাঁচতে চাওয়াটাই কি বাঁচা! মরার মুখে কুটো আঁকড়ানো জীবন সার, তবে বেঁচে থেকে লাভ।

গোবিন্দ তাকিয়ে রইল কালোর দিকে। এই কালোর মতো একদিন সেও আশা ছেড়ে দিয়েছিল। পথে পথে ঘুরেছে আর বিদ্রূপ করেছে সব কিছুকে। বিদ্বেষ পোষণ করেছে সবকিছুর উপর আর গালাগালি দিয়েছে জীবনকে আঁকড়ে ধরে থাকা মানুষগুলিকে। কিন্তু আবার মুখ থুবড়ে পড়েছে এসে সেইখানেই। সে অনেক শান্ত হয়ে গেছে আজ। একটা অদ্ভুত ধৈর্য ও দৃঢ়তা পেয়েছে সে।

আঁকড়ানো জীবন সার, তবে বেঁচে থেকে লাভ!

বুঝল কালো তাকে বিশ্বাস করেনি কিন্তু এও সে বুঝল এ কালো আসল কালো নয়। এর ভেতরে আর এক কালো আছে, যে কালোর আনাগোনা বহু তলায়। যার হদিস সহজে পাওয়া যাবে না। সে কালোর প্রাণে বোধ হয় আছে কোনও দগদগে ঘা, যার জ্বালায় নিয়ত সে মৃত্যুর দাপট দেখছে। বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে বাঁচার। সে তাকিয়ে দেখল কালোর দিকে। দেখে মনে হয় আধবুড়ো, কিন্তু তত বয়স হয়নি সত্যি কালোর। মাথার চুলগুলো প্রায় সবই পেকে গেছে, শরীরটা যেন পাথরের মতো শক্ত। মোটা মোটা হাড় বেরিয়ে পড়েছে খোঁচা খোঁচা পাহাড়ের গায়ের মতো চোখ দুটোতে তার এত ঘন ভাবের দ্রুত খেলা যে, তাকে চেনা ভারী মুশকিল।

সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কালো, তোমার আর কে কে আছে?

কেউ না।

সে কি। বাপ মাও নেই?

সে দুটো তো কবেই গেছে।

বে-টে করনি?

 একবার নয়, দু-বার।

কী হল তাদের?

যা হয়। কেটে পড়েছে।

মানে? মরে গেছে?

মরবে তত তোমাকে আর মানুষের মনের ব্যানোর কথা বলব কেন? আটকুঁড়ো নই, কয়েকটি ছেলেমেয়ে হয়েছিল, সবসুদ্ধ শালা গায়েব হয়ে গেছে। .

বলতে বলতে দপ করে জ্বলে উঠল আবার কালো।অথচ কী না করেছি? জান কাবার করে দিয়েছি, তবু বাঁচতে চেয়েছি। আমার সে-মুখে শালা লাথি মেরে পর পর দুটো চলে গেল।.. কামাতে গেল চটকলে, আর এল না।

বলে সে হঠাৎ যেন জাদুকরের মতো দাঁড়িয়ে উঠে ফেঁসোর মশালটা হাত দিয়ে চেপে নিভিয়ে দিল। তারপর ধপ করে শুয়ে পড়ল মাদুরের এক কোণে। বলল, শুয়ে পড়ো।

গোবিন্দকে যেন কেউ মুখের উপর থাবড়া মেরে চুপ করিয়ে দিয়েছে। সে নির্বাক, নিস্পন্দ। তার বারবার ইচ্ছে করছে কালোকে দু-হাতে সাপটে ধরে সন্তানের মতো বুকে চেপে রাখে। তার অনেক কথা হুড়মুড় করে ঠেলে আসতে লাগল গলায়। কিন্তু সে-সব কথা হয়তো অর্থহীন উপহাসের মতো ঠেকবে এখন কালোর কাছে। কালোর যে প্রাণে সত্যিই আগুন লেগে গেছে! সে আগুনে দিশেহারা কালো দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে আর চারিদিকেই দেখছে মানুষের চিতা পাতা রয়েছে। পথে পথে ঘাটে ঘাটে।

আছে সত্য, কিন্তু গোবিন্দ দেখেছে মানুষ সে চিতা এড়িয়ে এড়িয়ে অন্য পথে চলেছে। কালোর বউয়েরা কি বুঝে শুনে কোনও চিতায় পা বাড়িয়েছে, না অন্ধজীবনের পোড়ানি থেকে, প্রেমহীন খোলা আকাশের সোয়াস্তি চেয়েছিল? কিন্তু কোথায় খোলা আকাশ জীবনের? তাকে যে আড়াল করে রয়েছে বেড়াজালের ঘেরাটোপ!

গোবিন্দের নিজের হারিয়ে-যাওয়া জীবনের ছবি ভেসে উঠতে লাগল অন্ধকারে…মায়ের প্রশস্ত কোল জোড়া মেটে বর্ণের হোঁতকা ছেলে, অমৃতভরাট পূর্ণ স্তন ঠাসা ছেলের মুখে। মায়ের আধবোজা চোখে অপূর্ব রহস্যময় হাসি, হাসি যে নামহীন বিচিত্র স্বপ্নের! এক ফোঁটা আগুনের মতো সিঁদুরের টিপ কেঁপে কেঁপে উঠেছে। অদূরে গিন্নির মতো আঁট করে চুলের চুড়োবাঁধা ছোট্ট মেয়ে বেঁধেছে খেলাঘর।… মায়ের সেই অপূর্ব চোখের দৃষ্টি আড়ে আড়ে দেখছে অদূরের পেয়ারাতলার পুরুষের দিকে, করাতের ঘরঘর শব্দে যে গোরুর গাড়ির চাকা বানাচ্ছে।

তারপর? এক দুঃস্বপ্নের ঝোড়ো ঝাপটায় সে ছবি গেছে ছিঁড়ে খুঁড়ে। শিশু হোঁতকা ছেলে যেন একটা রাক্ষুসে ময়ালের মতো হাঁ করে খেতে চাইছে মায়ের কাছে চুড়ড়া বাঁধা মেয়ে খেলাঘর ভুলে টেনে টেনে ছিঁড়েছে মায়ের কাপড়, শুন্য জঠর মা কাঠির মতো শরীরটা নিয়ে লুটিয়ে মরেছে উঠোনে। গোরুর গাড়ির ভাঙা চাকায় মুখ দিয়ে পড়ে আছে পুরুষ…

তারপর যেন কোনও অদৃশ্য দানবের থাবার ঝাপটায় এক একটাকে টেনে টেনে নিয়ে গেল। কেবল রয়ে গেল পেয়ারাতলার ছুতোর। …তাদের সেই চলে যাওয়ার সঙ্গে কালোর বউয়েদের চলে যাওয়ার ফারাক কতখানি? দুজন গেছে বেড়াজাল থেকে বেড়াজালেই মুক্তির সন্ধানে আর এদের মেরেছে বেড়াজালের রুদ্ধশ্বাস চাপ।

গোবিন্দ ডাকল, কালো!

কালো জবাব দিল, বললা!

গোবিন্দ বলল, মানুষের বড় পোড়ানি। সে পোড়ানিতে সব আঘাটে মাঘাটে জল খোঁজে। যদি ঘোলা জলে গিয়ে পড়ে, তাকে দোষ দিয়ো না।

কালো জবাব দিল না। দুজনেই তারা চুপ করে পড়ে রইল। বাইরে কোথায় খট করে একটা দরজা খোলার এবং বন্ধ করে দেওয়ার শব্দ হল।

কালো বলে উঠল, ওই শোনো লোটন বউ দরজা খুলে সে দুটোকে ঘরে নিয়ে গেল। এর পর শোনা যাবে ফুলকির গালাগাল।

কেন?

ও এক প্রেমযোগিনী, আবার ওর প্রেমে যে হাবুড়ুবু খাচ্ছে অনেকে। তারা গিয়ে দরজায় টোকা মারবে।

তারা কারা?

এ বাড়িরই লোক।

তা, ফুলকি দরজা খোলো না?

তবে আর তোমাকে বলছি কী। সব তো মনের ব্যানো। এদিকে রাতদিন প্রেমের কথা, কিন্তু কে যে ওর পিরিতের লোক, তা ভগবানই জানে। বেওয়ারিশ ছুঁড়ি…মরজিতে চলে। খাবে কোন দিন শকুনেরা ছিঁড়ে। একে বলে চটকলবাজার।

পরদিন গোবিন্দের ঘুম ভাঙল শ্বাস টান লেগে। নিশ্বাস না নিতে পেরে সে ফড়িয়ে উঠল। কিন্তু সব অন্ধকার। পাশে হাতিয়ে দেখল কালো নেই। একটা সামান্য আলো দেখা যাচ্ছে দরজার দিকে। সে তাড়াতাড়ি সেদিকে ছুটে গেল।

বাইরে এসে ও দেখল সব ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। হঠাৎ এত ধোঁয়া এল কোত্থেকে? সে ভাল করে। তাকিয়ে দেখল, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সমস্ত ঘরগুলো থেকেই প্রায় ধোঁয়া বেরুচ্ছে, উনুনে আগুন দিয়েছে সব। আকাশটা পর্যন্ত দেখা যায় না। হাওয়া নেই। চারিদিকে কেবল ধোঁয়া, ধোঁয়ার গায়ে যেন আঠা মেখে দিয়েছে, তার নড়বার উপায় নেই। সমস্ত জগৎটা যেন ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। মনে হয় যেন জমাট কুয়াশায় ঠাসা চারিদিক। ছেলেবেলায় একবার গোবিন্দ শুনেছিল, নরকটা নাকি ধোঁয়ায় ভরা। পাপীদের শাস্তির জন্য সেখান থেকে স্বর্গ দেখা যায় না আর সেই ধোঁয়া থেকে আচমকা এক একটা বিদঘুটে প্রেত হাঁ হাঁ করে এগিয়ে আসে। এ যেন সেরকম, হঠাৎ কারও মুখ দেখা যাচ্ছে, কিংবা কেউ হুস করে ধোঁয়ার ঝাপটা দিয়ে চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে।

গোবিন্দ লক্ষ করে দেখল, আস্তে আস্তে পেটভরা ময়ালের মতো ধোঁয়া পাক খেয়ে খেয়ে সরছে। বুঝি হাওয়া লেগেছে। সে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিতে চেষ্টা করল…এই ধোঁয়া ঠেলে উঠবে আকাশের চাপ বাঁধা মেঘ সরিয়ে, তারপর আবার সে ধোঁয়াকে তাড়া করে নিয়ে যাবে দক্ষিণ বাতাস।

হঠাৎ বাড়িওয়ালার ক্রুদ্ধ গর্জন শুনল সে, বেরো, পুঁটকে খচ্চরের দল।

অমনি উঠোনের এপার ওপার থেকে একদল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুড়দাড় করে ছুটে যেতে লাগল বাইরে যাওয়ার গলিটার দিকে। কেউ ন্যাংটো, কেউ ইজেরটা কোমরের কাছে ধরে কিংবা পাছা থেকে জামা গুটিয়ে।

একটা মেয়ে-গলার খিলখিল হাসি শোনা গেল।

বাড়িওয়ালা আবার চিৎকার করে উঠল, যার যার বাচ্চারা টাট্টি করেছে, তারা সব উঠোন সাফ করে দেও।

বলে সে বেরিয়ে গেল।

গোবিন্দও গেল তার পিছনে, বাইরে। বাইরে এসে দেখল দোতলা বাড়িটার ছাদ থেকে দুটো ছেলে বেধড়ক ঢিল ছুড়ছে পেছনের নর্দমাটার দিকে।

গোবিন্দ সেদিকে গিয়ে দেখল ছেলেমেয়েগুলি ন্যাংটো হয়ে নর্দমায় বসেছিল ঢিলের তাড়া খেয়ে আবার ছুটেছে সড়কের দিকে। সড়কের উপর যমদূতের মতো দাঁড়িয়েছিল মেথর একটা। সে হেঁকে উঠল, খবরদার, রাস্তায় বসলেই ঠ্যাঙাব।

কিন্তু শিশুদের দেহের ভিতরের সে বেগ আর আটকে রাখার উপায় ছিল না, তারা সমস্ত কিছু অগ্রাহ্য করে বসে পড়ল রাস্তার ধারে ধারে।

মেথরটা একে তাড়া করে তো আর একটাকে পারে না। এমনি করেই বাচ্চাগুলোর প্রাতঃকৃত্য শেষ হয়। তখন কারও ঠ্যাঙে কারও পায়ে লেগে থাকে বিষ্ঠা। আবার ছোটে জলের সন্ধানে। ঠিক এ সময়েই চটকলের ও অন্যান্য কারখানার বাঁশি ভোঁ গোঁ গোঁ করে চিৎকার করে ওঠে।

কাণ্ড দেখে গোবিন্দের যেন দম আটকে এল। দেখল, তার পাশে দাঁড়িয়ে বাড়িওয়ালাও ভু। কুঁচকে সে দৃশ্য দেখছে আর আনমনে গোঁফ টানছে জোরে জোরে।

গোবিন্দ বলে ফেলল, একটা পায়খানা নেই?

ভ্রূ জোড়া করে খানিক কুঁচকে বলল, হ্যাঁ, আশমান থেকে পড়বে।

কেন, বানানো যায় না?

কী করে?

 এই ইট দিয়ে, জনমজুর খাটিয়ে।

তোমার কাছ থেকে তা শিখতে হবে? প্রায় ধমকে উঠল বাড়িওয়ালা। মিসিপালটির হুকুমটা কে

দেবে অ্যাঁ? তুমি?

ও! সে কথাটা গোবিন্দ ভুলেই গিয়েছিল। দেয় না কেন?

কেন দেবে? অফসরের ঘুষের টাকা না দিলে? বলি ঠিকা জমিতে মিসিপালটির মেথর খাটবে না। বলতে বলতে সে রকের উপর তার সে খাটিয়াতে বসে আপনমনেই বকবক করতে লাগল, আর আমি যদি শালা মানুষের বাচ্চা হই, এক আধেলাও ছাড়ব না। আর পায়খানা আমি করবই, জলকলও আনবই, দেখি কে আমাকে রোখে। বলে ভূর তলা থেকে একবার চকিতে গোবিন্দকে দেখে হাতছানি দিয়ে তাকে কাছে ডাকল। গোবিন্দ কাছে এলে দেখা গেলা তার ভ্রূ দুটো উঠে গিয়ে বিচিত্র দুটো স্বপ্নভরা চোখ বেরিয়ে পড়েছে। মুখের সমস্ত কোঁচগুলো কোথায় পালিয়ে গিয়ে একটি শান্ত মুখ বেরিয়ে পড়ল হঠাৎ। এদিক ওদিক দেখে সে বিস্মিত গোবিন্দকে আরও কাছে ডেকে ফিসফিস করে বলল, এটা আমি পাকা বাড়ি করব, ইটের গাঁথনি আর ছাদ দিয়ে। হাঁ তার আগেই জলকল আর পায়খানা আমি করে ফেলব, কী রকম হবে?

বলেই একটু হেসে ফেলে আবার বলল, এই এদেরই আমি রাখব, যারা এখনও আছে। আমি তো ছিচকে চোর বাড়িওয়ালা নই, বিরিজমোহনও নই, সেজন্য আমার সঙ্গে কারও বনে না। তা এরা এসব বোঝে না। রাম! রাম! ভাড়ার টাকাটাও ঠিকমতো কেউ দেয় না। কিন্তু বস্তি নাম আমি ঠোচাবই—হাঁ।

আচমকা কাছেই কোত্থেকে সদীর গলা শোনা গেল, সে কথা তো বিশ বছর ধরে শুনে আসছি, হয় না তো।

একেবারে এক কড়া গরম দুধে এক ফোঁটা লেবুর রস পড়ে ছানার মতো কুঁকড়ে দলা পাকিয়ে গেল বাড়িওয়ালার মুখটা। তীব্র দৃষ্টিতে একবার দেখে নিল গোবিন্দের মুখে কোনও ভাবান্তর ঘটছে কিনা। ফুঁসে উঠে বলল, এবার দেখো, দেখো ও আমাকে কোনওদিন পুরো ভাড়া দেয় না। আবার আমাকে বিশ বছরের কথা শোনাচ্ছে। একদিন ধরব, এক একটাকে, আর গলা ধাক্কা দিয়ে বের করব। ঠিক দেখে নিয়ে।

গোবিন্দ এতক্ষণ প্রায় ভ্যাবাচাকা খেয়েছিল। সে সত্যি কল্পনা করবার চেষ্টা করছিল যেন, এ বস্তিটা নেই, একটা সুদীর্ঘ এক-তলা বাড়ি উঠেছে, হলদে তার রং। পায়খানার ছাদটা দেখা যাচ্ছে, ছর ছর করে জল পড়ছে ঝকঝকে পরিষ্কার মেঝে। সামনে মাঠ—নয়া সড়ক হয়ে গেছে পিচের রাস্তা।

সদী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, তা তোমার ঠিকে জমির উপর ছাদওয়ালা বাড়ি বানাতে দেবে কেন! পায়খানার হুকুমই বা মিলবে কী করে?

বাড়িওয়ালা বলল মুখ ভেংচে, ঠিকে বুঝি মৌস করা যায় না? তেমনি গলায় বললল সদী, হাঁ, জাদু মন্তরে মৌস হবে। আগের জমিদারের আমলে তো হয়েছিল মৌরস। নতুন মালিক তো আবার ঠিকে বানিয়ে দিলে। কী করলে তুমি?

হঠাৎ কোনও জবাব না আসাতে বাড়িওয়ালা নিজের উপরেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল কী সদীর পরেই রেগে গেল বোঝা গেল না। চেঁচিয়ে উঠল, আমি টাকা দিয়ে মৌরস করবার, টাকা দিয়ে, বুঝেছ?

সদী একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, তোমার গাছ আছে টাকার। যখ দিয়ে রেখেছ যে!

গোবিন্দ কী একটা বলতে চাইল। তার আগেই বাড়িওয়ালা খেকিয়ে উঠল, টাকা কী আমার ক্লোনওদিন হবে না? কোথাকার উল্লুক মেয়েমানুষ!

সদী নির্বিকারভাবে ঠোঁট উলটে বলল, সে তোমার মতো বাড়িওয়ালাকে দিয়ে হবে না।

চোপ, চোপরাও। বলে ধমকে উঠল বাড়িওয়ালা। হয় কী না হয়, দেখিয়ে দেব। তুই তোর ভাড়াটা মিটিয়ে দিস।… শালা কারও সঙ্গে আর মহব্বত রাখব না!

বলে উঠে বাড়ির ভিতর চলে গেল। সেখানে আবার কীসের একটা গোলমাল চলছে।

সদী বুড়ি চোখ মটকে হেসে বলল, গোবিন্দকে, একটা পাগল!

গোবিন্দ খানিকটা বোকার মতো বলল, পাগল?

সদীর রেখাবহুল মুখটা কুঁচকে যেন ছোট হয়ে গেল। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তা ছাড়া আর কী বলব? এ সংসারে ওর মতো মানুষ কেন জন্মায়, তাই ভাবি।… ওর ওই অসুরের মতো শরীরটা দেখলে লোকে ভয় পায়। আমি দেখি, ও একটা ছ-মাসের বাচ্চা, হ্যাঁ…। বলতে বলতে সদী কেমন অস্বস্তিতে ছটফটিয়ে ওঠে। তার কুঞ্চিত চামড়ায় ঢাকা চোখ দুটো বড় করে, মাটিতে দাগ কষে বলল, কেন? না, ওর মাথাটা গোবরে ঠাসা। নইলে ভাবো এ বস্তির ভাগাড়কে কিনা ও সগগ বানাতে চায়, বলে পাকা বাড়ি তুলবে। আরে আজ বাদে কাল তোকে কোথায় উঠে যেতে হবে, বিরিজামোহনের মতো হারামজাদা বস্তি মালিকরা রাতদিন তোর সব্বোনাশের সিঁদ খুঁড়ছে আর ও মেতে আছে ওর নেশায়। কি? না আমি সবাইকে ভাল রাখব, পালন করব রাজার মতো।

রাজার মতো? গোবিন্দ প্রায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

গলার ভেতরে একটা অদ্ভুত শব্দ করে বলল সদী, তবে আর তোমাকে বলছি কী। সে পাগলামি ততা শোনোনি। ও যে নিজেকে রাজা ঠাউরে বসে আছে।

বলে সদী বুড়ি হঠাৎ চুপ হয়ে গিয়ে পশ্চিমের মেঘভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তার বুড়োটে গলায় বলতে আরম্ভ করল, কে ভেবেছিল ও আবার এত বড়টা একদিন হবে, বিদেশে এসে বাড়িওয়ালা সেজে বসবে!… গাঁয়ে ওকে সেদিন জন্মাতে দেখলুম। অ্যাই সেদিনের কথা, পাটোয়ারী দিনে দুকুরে ওদের ঘর জ্বালিয়ে দিল, খুন হয়ে গেল ওর বাপটা। কার বা কানুন, কে বা বিচার করে!… ওর মা খাপসুরত জোয়ান অওরত, ওকে কোলে করে ভেগে গেল একটা সাধুর আড্ডায়। ভগবানের ডেরা। এ তো তখন দু-এক বছুরে বাচ্চা। … বলে সদী বুড়ি হেসে উঠল, না তীব্র বিদ্রূপে হু হু করে উঠল বোঝা গেল না। গোবিন্দের দিকে ফিরে বলল, সে ভগবানের ডেরায় গিয়ে ওর মা বছরে বছরে একটা করে মরা বাচ্চা বিয়োতে শুরু করলে। গাঁয়ের নজদিক তো, আমরা দেখতে যেতুম। জানের ভয়ে বেচারা মুখ খুলতে পারত না।.. তারপর দশ বছর বাদে মাগী মরে গেল। সে মড়াটা তো আর সাধুরা ছুঁতে পারে না, ডোম দিয়ে ভাসিয়ে দিলে জাহ্নবীর কোলে।

জাহ্নবী?…

সদীর গলা মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। এক চিমটি রোদ উঁকি মেরেছে মেঘের ফাঁকে। সে আলোয় হঠাৎ নেমে আসা ইলশেগুঁড়ির ছাট যেন অজস্র মুক্তোকণার মতো ঝিকমিকিয়ে উঠল। বি. টি. রোডের সারবন্দি কারখানা থেকে ভেসে আসছে যন্ত্রের ও বয়লারের মূছহত গোঙানির শব্দ।

সদী উত্তেজিত গলায় ফিসফিসিয়ে উঠল, মা মরল তো কী হল কমলি যে ছোড়তা নেহি। ওর মার ব্যাপারটা সাধুরা ছেলেকে দিয়ে পুষিয়ে নিতে লাগল। তখন ও বেশ নাদুস নুদুস ছেলেটি। ওকে সাধুরা…।

গোবিন্দের বিস্মিত কৌতূহল ভরা চোখ ও থমারা মুখের দিকে তাকিয়ে বন্ধ হয়ে গেল সদর গলা। আপনমনে মাথা নেড়ে সে কী সব বিড়বিড় করতে লাগল। কুঞ্চিত গালের ভাঁজে ভাঁজে নেমে এল জলের ধারা। বেচারা অবুঝ বাচ্চা…যেন সীতার লব কুশের একটা। মনে মনে মহাদেওকে ডেকে বলতুম, হে দেওতা এ সনসারের হর আদমির যৌবন তুই খাক করে দে। থু থু..মানুষ এত বড় জানোয়ারও হয়।

গোবিন্দ উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল?

কী আর হবে। ওকে কয়েদির মতো সাধুরা রেখে দিল, কারও সঙ্গে বাত-পুছ করতে দিত।…তারপর, ও নিজেই একদিন কোথায় পালিয়ে গেল, তা আমরাও জানতুম না।…বহত দিন বাদ বাঙলায় এলুম। হাওড়া বজবজ ঘুরে এখানে এসে দেখা মিলল। দেখি, বাড়িওয়ালা বনে গেছে। আমাদের পেয়ে খুব খুশি। খুশি হলে কী হবে, আমি খুশি হইনি। কেন? না ওর পাগলামি দেখে। হেন বাড়িওয়ালা নেই যে ওর দুশমন নয়, ওর নতুন জমিদার ওকে কাবু করবার তালে আছে। সবে এসেছে, এখন দেখবে একা বিরিজামোহনই ওকে পাগল করে দিতে পারে। ও যে একেবারে বোকা…বোকা! ও যদি বাড়িওয়ালার মতো বাড়িওয়ালা হত!… পাগল! এ ঠিকে জমি আর কদ্দিন। ওকে আবার ভাসতে হবে…।

গলাটা বন্ধ হয়ে এল সদর।

কিন্তু গোবিন্দের চোখের উপর কেবল বাড়িওয়ালার সেই শান্ত ও স্বপ্নভরা মুখটা ভেসে উঠেছিল। পাগল, কিন্তু এ কী দুরন্ত পাগলামি, এ কী অদ্ভুত বাসনা মানুষটার মনে!

বাড়ির মধ্যে গণ্ডগোল শোনা গেল। তারা দুজনেই ভিতরে এসে দেখল, সব মেয়েমানুষই প্রায় মারমুখো হয়ে পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়েছে। কারণ, উঠোনের বিষ্ঠা কে পরিষ্কার করবে, তাই হল সমস্যা। কার বাচ্চা এখানে মলমূত্র ত্যাগ করেছে, কে বলতে পারে? বাচ্চাগুলোকে জিজ্ঞেস করতেই তারা একযোগে কলের পুতুলের মতো বলে ওঠে তারা কেউই নয়।

তারা মায়ের মন চেনে, সুতরাং স্বীকার পাওয়া অসম্ভব। যেন উঠোনটা তা হলে নোংরা করেছে ভূতে!

কিন্তু বাড়িওয়ালা সে সব প্রমাণের ধার দিয়েও গেল না। সে হঠাৎ বউগুলোকে ঠেলে ঠেলে দিতে লাগল আর চেঁচাতে লাগল, সব জেনানাকে সাফা করতে হবে, কোনও বাত-পুছের দরকার

নেই। চালাও, চালাও।

এও দৈনন্দিন ব্যাপার। মেয়েরা সব চিৎকারে কান্নায় গালাগালিতে আকাশ ফাটাতে ফাটাতে উঠোন পরিষ্কার করতে লাগল আর প্রত্যেকেই তার নামহীন শত্রুকে উদ্দেশ করে বলতে লাগল, সে যদি অপরের বাচ্চার ময়লা সাফ করে থাকে, তবে যেন সে বাচ্চা আজই পিশাচের মুখে যায়; এবং পরিষ্কার হওয়ার পরই শুরু হয় বাচ্চাগুলোর উপর পীড়ন ও মারধোর।

শিশুদের চিৎকার আর মায়েদের গালাগালিতে একটা প্রচণ্ড হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেল।

বাড়িওয়ালা একমুহূর্ত তা দেখে গোবিন্দকে বলল, দেখো একবার কাণ্ডটা। আর আমি এদের জন্যে পাকাবাড়ি বানাতে চাইছি। তারপর গলার স্বরটা পরিবর্তন করে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, তখন আর বোধ হয় এ-সব হবে না ঠিক বন্ধ হয়ে যাবে। কী বলল তুমি?

নির্বাক গোবিন্দ বাড়িওয়ালার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

বাড়িওয়ালা চলে গেল বিকৃতমুখে বিড়বিড় করতে করতে। এ কি একটা আস্ত পাগল না, মূর্তিমান শয়তান!

গোবিন্দের হঠাৎ নজর পড়ল লোটন বউয়ের উপর। লোটন বউ হাসছে তার সেই মোটা মোটা ঠোঁট বিস্ফারিত করে। বুকের পাটা ফুলিয়ে বাচ্চাদের ক্ষিপ্ত মায়েদের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু চোখে তার কোনও ভাব নেই। যেটা আছে সেটা ভাব নয়, নিষ্পলক একজোড়া চোখ কাচের মতো ছায়ালীন, শুধুমাত্র দেখবার জন্যই। বিচিত্র আনন্দ লোটন বউয়ের। এদের এ জ্বালা যন্ত্রণায় তার এত খুশির কী আছে! তাকে উঠোন পরিষ্কার করতে হয় না, তাই কি?

গোবিন্দের সারা গায়ের মধ্যে রি রি উঠল লোটন বউয়ের হাসি দেখে।

লোটন বউয়ের হঠাৎ নজরে পড়ল গোবিন্দকে। চকিতে হাসি মিলিয়ে গিয়ে সেই অপলক দৃষ্টি পুরুষের দিকে তাকাল। কালকের গণ্ডগোলে গোবিন্দকে সে দেখেনি। তার তালগাছের মতো শরীরটাকে সে স্বভাবসিদ্ধ একটা দোলানি দিয়ে এক পা পেছিয়ে ঠোঁট উলটে বলল, ও মা এটা আবার কে রে?

গোবিন্দ চকিতে তার সেই স্বাভাবিক হাসিটি নিয়ে বলল, গোবিন্দ শর্মা, তোমাদের নতুন মানুষ।

এলাকার পরিবেশে বাতিক্রম আশ্চর্য রকম ফরসা ও পাতলা শাড়িটা গায়ের সঙ্গে আরও ভাল করে লেপটে, নাক কুঁচকে লোটন বউ প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, ওমা! কে ওর নাম জিজ্ঞেস করছে। সরে যাক এখান থেকে।

তা যাচ্ছি লোটন ঠাকরুন। বেশ রয়ে ভয়ে বলল গোবিন্দ, আমি তোমার দেওর হই কিন্তু, বুঝলে ঠাকরুন।

আ মলো যা! মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল লোটন বউ, ও-সব কথা যে-সব মেয়েমানুষে ভালবাসে মিনসে তাদের কাছে যাক না।

গোবিন্দ বলল হেসে, হেঁ হেঁ, বউদিকে কেউ খারাপ কথা বলে? নন্দ-হরিশ যে আমার দোস্ত হয়।

তাই! আরও খানিকটা বিষ দিয়ে বলল লোটন বউ, ওই কমিনা কুত্তা দুটোর দোস্ত বলে এরকম বেহায়া।

এবার গোবিন্দ স্তব্ধ হয়ে গেল। লোটন বউ যাদের খায়, যাদের পরে, তাদেরই এমন ঘৃণা করে। ভালবাসার কথা না হয় বাদই গেল। সামান্য করুণা থাকলেও কেমন করে সে সেই কমিনা কুকুর দুটোর সঙ্গে ঘর করে! অথচ যাদের সে কুকুর বলে, তাদের উপর দাপট খানিক তারই আছে, তারা তো ওই পাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করেই বসে আছে।

কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে হল, ললাটন বউয়ের জীবন ধারণের ভাবনাই হয়তো বড়। সেই তাগিদেই হয়তো সে এরকম ঘৃণ্য জীবন বেছে নিয়েছে।

নন্দ-হরিশকে সে মারুক ধরুক, লড়িয়ে দিক পরস্পরের মধ্যে, ঘৃণা করুক, তবু হয়তো তাকে বাধ্য হয়েই এ-ঘরে থাকতে হয়। বেশ্যারা কী কখনও তাদের হাজারো অতিথিদের কাউকে ভালবাসে পয়সা দিয়ে যারা ধরিত্রীর অনির্বনীয় সুধাকে পান করতে যায়; হাজার হোক পয়সার যুগ, ধরিত্রী কি সেখানে সুধাভাণ্ডের প্রলেপ দিয়ে দিয়ে বিষভাণ্ডই তুলে ধরে না! তারাও কি লোটন বউয়ের মতো মনে মনে তাদের কমিনা কুকুর বলে ক্লেদাক্ত ভার বহন করে না! নিরন্তর প্রেমহীন জীবন, তাই তো সবচেয়ে বড় অভিশাপ।

লোটন বউয়েরও কি তাই? আবার ভাবল গোবিন্দ, কী জানি হয়তো যে কথা তার গালাগাল মনে হল, সে কথাই নন্দ-হরিশের কাছে সোহাগের সুরঝংকার হয়তো।

এইসব ভাবতে ভাবতেই সে রান্নাঘরের দিকে তাচ্ছিল। কলকারখানার লোকজনেরা সকলেই বেড়িয়ে গেছে। মেয়েরা কেউ বেরুচ্ছে ঝুড়ি মাথায় বগলে করে কয়লা আর গোবর কুড়াতে। বেশির ভাগই ছোট মেয়ে, ছোট ছেলের দলও আছে তার মধ্যে। রায়াও শুরু হয়েছে কোনও কোনও ঘরে। ধোঁয়ার সেই আঁকড়ে ধরা ভাবটা অনেকখানি কেটে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে এসেছে।

ছ্যাকড়া মেঘের ভিড় আকাশে। বৃষ্টি নেই, মেঘলা ভাঙা রোদ ছায়ার ধারে ধারে উঠছে হেসে।

গোবিন্দের চোখে পড়ল কালো কী যেন এক হাতে নিয়ে আর এক হাতের আড়াল করে, দ্রুত একটা ঘরে ঢুকে পড়ল। অবাক হল গোবিন্দ, ভারী কৌতূহল হল তার। কালোর আবার কীসের এত লুকোচুরি। এক পা এক পা করে সে কালো যে ঘরে ঢুকেছে, সেই ঘরের দিকে গেল। কাছে এসেই কালোর গলা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সে শুনল কালো ডাকছে, ফুলকি, এই ফুলকি, ওঠ ওঠ জলদি!

ফুলকির ঘুমন্ত গলা শোনা গেল, কী বলছ।

কলে যাবিনি? কলে বাঁশি বেজে গেছে যে।

বিরক্ত ফুলকির গলা ভেসে এল, আ মলো! তাতে তোমার কী? ভাগো, ভাগো।…

মুহূর্ত চুপচাপ। আবার কালোর খানিকটা খুশি মাখানো হুতোশের গলা শোনা গেল— খাবিনি? তোর ভাত কাউকে দিইনি দ্যাখ; রেখে দিয়েছি মাইরি! খেয়ে নে।

ফুলকির ঘুমন্ত গলা সতেজ হয়ে উঠল, মাইরি! তার উঠে বসার শব্দ শোনা গেল কাপড়ের খখস্ ও চুড়ির বাজনায়। গোবিন্দ কৌতূহল না চাপতে পেরে একটা ছোট্ট ফুটো দিয়ে উঁকি মেরে দেখল। …আধো অন্ধকার ঘরটিতে আগুনের নীল শিখার মতো শ্যামা ফুলকি, ঘুমের জড়তা নিয়েও একখণ্ড ইস্পাতের মতো জ্বল জ্বল করছে। শক্ত পুষ্ট বন্য ঢেউ ভোলা শরীর। বিস্রস্ত বেশবাস। জামার বোম খুলে গিয়ে বুকের বঙ্কিম রেখা উঁকি মেরে আছে। কপালের টিপটা গেছে খানিক বেঁকে, রুক্ষ চুল এলোমেলো হয়ে পড়েছে ছড়িয়ে। কোনও রকমে উঠে বসে কালোর দেওয়া ভাতগুলো গিলছে গপগপ করে। মুখের ভাত না গিলেই বলছে, উঃ কী খিদেটাই পেয়েছিল।

কালো যেন দেবীদর্শনের মতো হাঁটু গেড়ে তার কাছে বসেছে এবং অদ্ভুত করুণায় বেদনায় ও আনন্দে মগ্ন হয়ে চেয়ে আছে ফুলকির দিকে। বলল, কেন খেয়ে নিস্ না সন্ধেবেলা। কত বারণ করি, তবু রোজ সরাপ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে থাকবি।

সে কথা ছাড়ো। কালোর দিকে না তাকিয়েই ফুলকি বলল, একটু জল দেওততা।

কালো তাড়াতাড়ি উঠে গেলাস না পেয়ে কলসিটাই নিয়ে এল। বিনাবাক্যে ফুলকি হাঁ করল, কালো একটু একটু করে জল ঢেলে দিতে লাগল তার মুখে। মদমত্ততার রাতভর পিপাসা আর মিটতে চায় না ফুলকির। ফুলকির সঙ্গে কালোও ঢোক গিলছে। যেন সেও জল পান করছে। জল গলায় বুকে বেয়ে পড়ল ফুলকির।

পিপাসা মিটলে চোখ বুজে একটা আরামের শব্দ করে উঠল ফুলকি, আঃ! বাঁচলাম!

কালো কলসিটা রেখে উঠল, বাঁচলি না ছাই। তোর মরণ কেউ কি আটকাতে পারবে?

তা এমনি করেই না হয় মরেই গেলাম, আরাম করে তো মরব। বলে হেসে ফেলে ফুলকি।

কালো অপলক চোখে আবেগ নিয়ে তাকিয়ে রইল।

ফুলকি ঠোঁট টিপে চোখ পাকিয়ে বলল, আবার তুমি ওরকম পাগলের মতো তাকিয়ে আছ?

দেখি তোকে, ভাবি কেন তোর মরতে প্রাণ চায় ফুলকি?

মরণে যে সুখ আছে।

কী সে মরণ?

ফুলকি ঠেটি বেঁকিয়ে হেসে বলল, তুমি তো সেরকম কবারই মরেছ।

ব্যাকুল গলাটা বুঝি কালোর কেঁপে উঠল। বলল, তবে আবার মরব।

লকি খিলখিল করে হেসে উঠল, ঢেউয়ে ঢেউয়ে যেন তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল তার শরীর। বলল, এই মরেছে! তোমার খালি পাগলামি! যাও বাপু, আমি তাড়াতাড়ি কলে ছুটি, সায়েব সর্দার দুটোকে আবার ভুজুং ভাজং দিয়ে টাইমে নামটা লেখাতে হবে।

কালো বলল, নতুন রাঁধিয়ে এসেছে, তার চোখ ফাঁকি দিয়ে কি আর খাবার আনতে পারব?

না পারো, রেখে দেবে।

উপোস থাকবি! কালো বলল। এ-সব ছাড় না কেন?

ফুলকি আবার হেসে উঠল, তোমার খালি এক কথা।

আর না শুনে গোবিন্দ তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। তার সারা মুখে ব্যথা ও হাসির বিচিত্র খেলা। কালো না কাল মরতে চেয়েছিল? সে কি এই মরণ! কালোর সেই বুক থেকেই কি ওই আবেগের থর থর ধ্বনি হাহাকার করে উঠেছে যে বুক পুড়ে পুড়ে তার ছাই হয়ে গেছে!

এই কালোই না পোড়া মাছের খাবি খাওয়া দেখে উপহাস করেছে মানুষের বাঁচার তাগিদকে। হায়! দু দুবারের দাগা খাওয়া প্রাণে তার আবার পোড়ানি। না, এ সংসারে মানুষের পোড়ানির শেষ নেই। পোড়া সংসার যে!

বেলা বাড়ছে ধীরে ধীরে। আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে আসছে সমস্ত বস্তিটা।

গতকাল রাত্রের সেই গুরুগম্ভীর বেসুরো গলায় আবার শোনা গেল—

মন আমার নির্বাণ নগরে যদি যাবে–

একটি মাথা-চাঁছা রোগা টিংটিঙে ছেলে বসেছিল একটা ঘরের সামনে আকাশের দিকে চেয়ে। শরীরটাতে তার কিছু নেই। মনে হচ্ছিল বসে বসে বুঝি ঢুলছে। কিন্তু সেই গুরুগম্ভীর গলায় গান শুনেই সে ভেংচে উঠল ওই বুড়োটে গান অনুকরণ করে-মন আমার নির্বাণ নগরে যদি যাবে।

সেই গুরুগম্ভীর গলায় আবার শোনা গেল,

এক স্বন্নের অলংকার, গঠন বিবিধাকার…
পুনবারে গেলে দেখ যেই স্বন্নো সেই হবে…

ছেলেটা তার ওই রোগা দেহ থেকে অস্বাভাবিক জোরে চিলের মতো শব্দ করে মুখ বেঁকিয়ে উচ্চারণ করে ভেংচাতে লাগল। তাতে সেই গান থেমে গেল না।

ছেলেটার মা এক মধ্যবয়সী মেয়েমানুষ, আরও দুটো বাচ্চাকে নিয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে।…এখানে এ খোলার চালায় অন্ধযুগের আদিম মায়ের মতো মেয়েমানুষটি। তার লজ্জার কোনও বালাই নেই। একটিমাত্র নেংটি পরনে, বাদবাকি সমস্তটাই ভোলা। তার নড়াচড়ার তালে তালে নত বুক দুলছে কিন্তু কোনও অস্বস্তি নেই। লজ্জার কথা ভাবাই দুষ্কর। রোগা নয়, কিন্তু শরীরটা যে ফোঁপরা, তা তার ভাবভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে। মানুষের গলায় মাদুলি থাকে। তার জট বাঁধা চুলে সেই মান্ধাতা আমলের বাঁধা বেণীতে একটা তামার মাদুলি ঝুলছে। মুখোনি নিতান্ত ভালো মানুষের মতো সরল, চোখ দুটো যেন আলগা করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অত্যন্ত করুণ ও মিষ্টি গলায় সে তার ছেলেকে বলল, থাম বাবা চেঁচাসনি অমন। নাড়ি ছিঁড়ে যাবে যে!

সে কথায় ছেলেটা যেন আরও দুর্বার হয়ে উঠল। হ্যাঁ চেঁচাব। বলে সে আরও জোরে চেঁচাতে লাগল। তার রুগ্ন মুখটা রক্তহীন নীল শিরায় ছেয়ে গেল। মনে হল গলার শিরাগুলো ছিঁড়ে যাবে এক্ষুনি। মা অন্য দুটোকে রেখে রোগাটাকে বুকের কাছে নিয়ে আরও নরম, আরও অসহায় স্নেহঝরা চোখে বলল, চেঁচালে যে মরে যাবি? শরীলে কী বা আছে তোর?

না থাক। বলে ছেলেটা ধাক্কা দিয়ে খামচে, লাথি দিয়ে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল আর বলতে লাগল, গায় কেন ও শালা, কেন গায়? আমার ভাল লাগে না বলছি।…

মা তার সেই মারগুলো অবিকৃত শান্তভাবেই গ্রহণ করলে, বুকের আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, গাক, ওর খুশি হয়েছে তাই গাইছে। তোর ভাল না লাগলে ওর কী আসে যায়।

তারপর তার সেই একঘেয়ে তরঙ্গহীন গলার স্বরে বলল, তুই না বড় হয়ে কী করবি বলছিলি?

সে কথায় ছেলেটা হঠাৎ রাগ ভুলে মুখভরা হাসি নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠল। বলল, মাকি সায়েবের সঙ্গে বিলেতে যাব।

তার পর?

খুব বড় মিস্তিরি হয়ে ফিরে আসব। স্বপ্নাচ্ছন্ন গলায় যেন বলল ছেলেটা।

মা বলল, আর?

বিচিত্র লজ্জায় মায়ের ভোলা বুকে মুখ ঢেকে আধো জড়ানো গলায় বলল, মেমসায়েব বিয়ে করব।

গাইগোরুর দাঁত বেরুলেও তার যেমন কোনও ভাব বোঝা যায় না, মায়ের হাসিটিও প্রায় তাই। বলল, আমরা? তোর ভাই বোনেরা?

ওরাও থাকবে আমার কাছে।

তাতে তোর মেমসাহেব যদি রাগ করে?

তা হলে ঠ্যাঙাব খুব পড়ে পড়ে।

সে ভবিষ্যতের কথা ভেবে মায়ের আনন্দ হল কি দুঃখ হল বোঝা গেল না। কেবল দেখা গেল ছেলেটাকে সে বুকের কাছে নিয়ে দোলা দিচ্ছে। ছেলেটার চোখ বুজে আসছে আস্তে আস্তে।

আসলে রুগ্ন খ্যাপা ছেলেকে শান্ত করার এই বোধ হয় মায়ের কৌশল।

ওইটুকু তার শান্তি। মায়ের এই খোলা বুক, নগ্ন কোলটুকু সে চেয়েছিল নিরঙ্কুশভাবে। কিন্তু পায়নি। আরও ভাই বোন এসেছে বছরের পর বছরে। বিষ খেয়ে মা অমৃত ধারণ করত বুকে। অমৃতহারা হয়ে, বাইরের খাবার খেয়ে কঠিন রোগ ধরেছে তাকে। মায়ের কোলের জন্য হিংসে এসেছে। বিদ্বেষ ও আক্রোশ তার সকলের উপরে। বিশেষ, একঘেয়েমি, গাম্ভীর্য, সুরহীনতা তার সহ্য হয় না একটুও। যখন পা দুটোতে ছিল ক্ষমতা, তখন গঙ্গার ধারে সাহেব কুঠির কাছে গিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকত। সাহেব মেম দেখত, আদালিকে জিজ্ঞেস করতে নানান কথা। রোগ, মায়ের কোলের শোক যেত ভুলে। স্বপ্ন দেখত বিলেত যাবে, মেম বিয়ে করবে। সেই স্বপ্নটুকুই কচি রুগ্ন মনে বাসা বেঁধে আছে। সব যন্ত্রণায় ওইটুকু ধরিয়ে দিলেই শান্ত হয়ে যায়। মায়ের কোলে দোলা দিলেই ঘুমে ঢলে পড়ে।

কিন্তু এখানকার সমস্ত কিছু হঠাৎ গোবিন্দের প্রাণের মধ্যে অত্যন্ত ভারী হয়ে চেপে আসে। অস্বস্তিতে ছটফট করে তার সর্বাঙ্গ। সমস্ত দুঃখ দৈন্য অনাহার নিয়েও ভোলা আকাশ, পথের পর পথ, দিগন্তবিসারী মাঠ তাকে ডাক দেয়। সংসারের, ঘর-বেষ্টনীর বেড়াজালের বাইরে সেই নিঃসঙ্গ মুক্ত বাউলের ডাক এ পরিবেশকে যেন আরও যন্ত্রণাদায়ক করে তোলে। চব্বিশটা ঘণ্টা না কাটতেই পালাই পালাই করে উঠে তার মনে।

কিন্তু কালোকে বেরিয়ে আসতে দেখেই মনটা আবার তার থিতিয়ে যায়, মনে পড়ে যায় কালকের দুর্যোগময়ী সন্ধ্যার কথা। বাড়িওয়ালার আহ্বান, সমস্ত মানুষগুলোর সরলভাবে হাসি দিয়ে তাকে গ্রহণ। আর গতকাল রাত্রে সে নিজেই না কত কথা বলেছে কালোকে। বাঁচা অনেক দুঃখ, অনেক যন্ত্রণায় ছাইমাখা সোনার মতো বাঁচা।

নরক বটে! কিন্তু এ জগতে কাজের বিনিময়েই বা ক’জনা ডাকে দুমুঠো পেটে দেওয়ার জন্য, অন্ধ কুঠরির আশ্রয়ের জন্য।

কালোর মুখের দিকে দেখল সে। সে মুখ মেঘলাভাঙা রোদের মতো আলোছায়ায় ভরা। বোধ করি সেই আলোছায়ার মধ্যেই একটি বিবাগী হাসির রেখা গেলে রয়েছে তার ঠোঁটের কোণে।

এসেই বলল গোবিন্দকে, বাঃ একেবারে নির্জলা ফোরটুয়েন্টি করছ বসে বসে? রাঁধবে কখন? বাঁক আর টিন নিয়ে কল থেকে জল নিয়ে এসো।

গোবিন্দ এক মুহূর্ত কালোর মুখের দিকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। ঠিক এ সময়েই ফুলকি পেছন থেকে বলে উঠল, এই বুঝি সেই ফোরটুয়েন্টি?

গোবিন্দ ফিরে তাকাল। প্রায় তেমনি অগোছাল ফুলকি, উড় উড় চুল, রাত্রির নেশার ছাপভরা মুখ। ঠোঁটের কোণের হাসিতে যেন বিদ্রূপের আভাস। সে দাঁড়িয়েছে বেঁকে, বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। কাপড় পরার ধরনটা তার ছত্রিশগড়ি আঁটসাঁট ও চড়াই উতরাইয়ের মতো।

কালো বলল, হাঁ, এই ফোরটুয়েন্টিবাজ, ভারী রসিক, জানলি?

গোবিন্দ একটু হেসে উঠল।

ফুলকি বলল, তা বাড়িওয়ালার দেখছি পছন্দ আছে। তবে—

কপালের টিপ ঝিলিক দিয়ে বলল, হাসিটা আর চোখ দুটো কিন্তু সুবধের নয় বাপু, সাবধান। ও কোন্ অওরতকে কখন ফোরটুয়েন্টি করে দেবে কিছু ঠিক নেই।

বলে দুরন্ত বেগে খিলখিল করে হেসে উঠল।

কালো হেসে উঠল তার সামনের দুটি দাঁতহীন ফাঁক দিয়ে।

গোবিন্দ তেমনি হেসে বলল, যাকেই করি, তোমাকে তো পারব না।

ও মা গো! ঢলে পড়ল ফুলকি হাসিতে, এ যে খুব কথা বলে গো! তা আমি যে প্রেমযোগিনী…কখন মরব কে জানে।

বলে সে একবার চকিতে কালোর মুখের দিকে দেখে নিল। কালো যেন অর্থহীনভাবে হ্যাঁ হ্যা

করে হাসছে।

গোবিন্দ পেছোয় না। বলল, তা তোমাকে মারার ক্ষমতা নেই বাপু আমার।

বুঝে গেছ? বলে চকিত কটাক্ষে একবার দেখে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ফুলকি। সে হাসিতে একটু তীক্ষ্ণ বিদ্রূপের আভাস যেন।

গোবিন্দ তাকিয়ে দেখল পাশে কালো নেই। কোথায় গেল? রান্নাঘরে ঢুকে দেখল একটা অন্ধকার কোণে কুলোর মধ্যে চাল নিয়ে কালো কাঁকর বাছার জন্য তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিড়বিড় করছে, শালা মরে গেছি।…

কী কথা যেন গোবিন্দের মুখের কাছে এসেও ফিরে গেল। সে বাঁক আর টিন নিয়ে গেল বেরিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *