কর্তব্যরত অবস্থায় একজন জাহাজের ক্যাপ্টেনকে সবসময় দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। রাত অথবা দিনের যে কোনো মুহূর্তে তার ডাক পড়তে পারে। হাল যখন সমুদ্রে জাহাজ ভাসায় তখন জুডিথ-এর উপস্থিতি তার কাজের ব্যাঘাত ঘটাক এটা সে চায়নি। একারণেই তার নাবিকেরা তাকে সম্মান আর প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখে। এমনকি জুডিথও সেটা চায় না। কারণ সে জানে একজন নেতাকে কি রকম হতে হয়। সে হাল এবং তার দায়িত্বের মাঝে আসতে চায় না। এমনকি হাল যদি তা চাইত তাহলে হয়ত বা সে হালকে এখনকার মতো এতটা সম্মান করত না।
কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত এক ঘণ্টা তারা একে অপরকে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকে। এ সময় অন্য কোনো কাজ নয়, অন্য কোনো চিন্তা ভাবনা নয়। এই সময়টুকু তারা তখনই বেছে নেয় যখন জাহাজ শান্ত থাকে। বাতাস আর সমুদ্র নীরব থাকে। যেন শান্ত এবং নীরব পরিবেশে তারা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারে-সেটা কথায় কিংবা কাজে অথবা উভয়ের মাধ্যমে।
জুডিথ-এর প্রতি তার ভালবাসা ছিল অপরিসীম-এ আকাক্ষা কখনোই পুরোপুরি মিটবার নয়। জুডিথের মাঝে ডুবে থাকতে তার খুব ভাল লাগে। আর সেই আদিম প্রেমের গভীরতা এতটাই বেশি যে কোথায় গিয়ে তার শরীর শেষ হয় আর জুডিথের শুরু হয় সেটাই সে মাঝে-মাঝে বুঝতে পারে না। শুধু বুঝতে পারে যে এরকম আশীর্বাদপুষ্ট সময়ের সাথে পৃথিবীর আর কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। এখন পর্যন্ত হাল-এর হৃদয়ের সবচেয়ে প্রশান্তির মুহূর্ত হলো জুডিথকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পাওয়া। অন্ধকার কেবিনেও সে জুডিথের চেহারা দেখতে পায়। তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। জুডিথও হাল-এর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করে। তার বিশ্বাস এবং ভালবাসার গভীরতা এতই বেশি যে হাল সারাজীবন তাকে রক্ষা করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
মিতসিওয়া থেকে এক হাজার মাইল দূরে আফ্রিকার উপকূলে যখন ওরা আট দিনের জন্য অভিযানে বের হয় তখন একদিন সকালে গোঙানির শব্দে হাল জেগে উঠে। সে চোখ খুলে দেখতে পায় জুডিথ তার পাশে শান্তিতে ঘুমিয়ে নেই। বরং বাঁকা হয়ে পাদুটো বুকের কাছে নিয়ে তার দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সে যে আওয়াজ করছে তা থেকে বোঝা যায় সে কোনো রকম শারীরিক অসুস্থতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
“ডার্লিং, তুমি কী ঠিক আছ?” হাল জিজ্ঞেস করল। কণ্ঠে দুশ্চিন্তার আভাস লুকোতে ব্যর্থ হয় সে।
“ এটা কোনো ব্যাপার না, ঠিক হয়ে যাবে”, জুডিথ উত্তর দেয়। কিন্তু তার শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠে, এরপর বমি করার জন্য উদ্যত হয় সে। কিন্তু তার কণ্ঠ দিয়ে গরগর জাতীয় শব্দ ছাড়া কিছুই বের হয় না।
“তুমি তো অসুস্থ”, অস্থির হয়ে জুডিথের কপালে হাত রেখে বলে হাল। “তোমার শরীর গরম। তোমার কী জ্বর এসেছে?”
জুডিথ ঢোক গিলে হাল-এর দিকে পাশ ফিরে। সে কনুই-এ ভর দিয়ে বসে এবং অন্য হাতটা হাল-এর ওপর রাখে। “চিন্তা করো না। আমি অসুস্থ নই। এমনকি এর চেয়ে বেশি সুস্থ আমি জীবনে কখনো ছিলাম না।”
হাল জুডিথের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, “প্লিজ, ডার্লিং”, আমি জানি তুমি অনেক সাহসী, কিন্তু…”
“শসস্” সে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে। “আমি তোমাকে বললাম তো, এখানে দুশ্চিন্তার কিছু নেই…” একটু মৃদু হাসার চেষ্টা করে আবারো বলে, “অবশ্য যদি তুমি তোমার পিতৃত্ব নিয়ে চিন্তিত হও তো…”
“পিতৃত্ব…?” সে অবাক হয়ে বলে, “তুমি…তার মানে তুমি…?”
“হ্যাঁ, ডার্লিং। আমার মধ্যে তোমার সন্তান বেড়ে উঠছে। আমি তোমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছি…”
“সত্যিই অসাধারণ একটা খবর দিলে,” হাল উল্লসিত হয়ে বলে উঠে। পরমুহূর্তেই আবার সন্দেহের সুরে বলে, “কিন্তু তুমি কী নিশ্চিত? তুমি কিভাবে জান যে এটা সত্যি খবর?”
“কারণ যুদ্ধের কাউন্সিল-এর জন্য দুইমাস আমরা একত্রে ছিলাম। তোমার কী মনে পড়ছেনা…”
“ওহ্, অবশ্যই আমার মনে আছে। বেশ ভালভাবেই মনে আছে…”
এরপর থেকে আমার ঋতুস্রাব হয়নি এবং আজকে সকালে আমি একরকম অসুস্থ বোধ করছি। আমি যদি বাড়িতে থাকতাম তাহলে মা, খালা কিংবা বাড়ির অন্যকোনো মহিলা আমাকে এই কথাটা বলে দিত যেটা এখন আমি তোমাকে বলছি,” সে ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলল। “সম্ভবত আমি তোমার মতো শক্তিশালী, সুদর্শন এবং দয়ালু কোনো ছেলের মা হতে যাচ্ছি।”
“কিংবা একটি মেয়ে যে কি-না তার মায়ের মতই সুন্দরী মায়াময় এবং সাহসী।”
কিছু সময়ের জন্য তারা দুজনেই একটা মোহের মধ্যে দিয়ে সময় পার করতে লাগল-অল্প বয়সি দুজন বালক-বালিকা প্রথম প্রেমের সন্ধান পেয়ে যেমন মোহের মধ্যে থাকে, অনেকটা সেরকম। পৃথিবীটাই তাদের কাছে এখন নতুন মনে হচ্ছে।
হাল-এর মোহাচ্ছন্ন ভাবটাই প্রথমে কাটে। হঠাৎ করেই সে মুখের অভিব্যক্তি বদলে ফেলে কেবিনের জানালা দিয়ে দূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো।
“তোমার হঠাৎ কী হল?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী কোনো সমস্যায় পড়েছ?” “তুমি ভয় পেয়ো না। আমি তোমার সন্তানকে নিরাপদে রাখব।”
“না, ঠিক সেটা নিয়ে ভাবছি না”, হাল উত্তর দেয়। অন্য কিছু ভাবছি।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। এরপর দ্রুত জামাকাপড় আর জুতা পরতে শুরু করল। গায়ের জামা খোলা রেখেই নিচু হয়ে জুডিথ-এর কপালে চুমু খেয়ে বলল, “আমি অন্য একটা ব্যাপার দেখতে যাচ্ছি। চিন্তা করো না। এটা হয়ত তেমন কোনো ব্যাপার না।” জুডিথ-এর দুশ্চিন্তাভরা মুখ দেখে আশ্বস্ত করার জন্য ছোট্ট একটা হাসি দিল হাল। “আমাকে তুমি আজকে আমার জীবনের সেরা খবরটা দিয়েছ। আমি তোমাকে আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালবাসি। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে ফিরে আসব।”
যদিও হাল জাহাজের ডেক-এর দিকে যাচ্ছে, কিন্তু তার মনটা পড়ে রয়েছে বিছানায়।
দুইদিন আগে পাহারাদার একটা ডার্চ কারাভাল দেখতে পায় স্টারবোর্ড থেকে কয়েক কি. মি. দূরে। বাতাসের গতির পরিবর্তনের কারণে সেটা কখনো দেখা যাচ্ছিল আবার কখনো দেখা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল ওরা হয়ত গোল্ডেন বাউকে নজরে রাখছে। যদি যুদ্ধের সময় হত তাহলে এটা খুব দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল। যদিও কারাভেলটা গোল্ডেন বাউ-এর চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু অনেক সময় অনেক বড় বড় শক্তিশালী জাহাজও ওত পেতে থাকলে দেখা যায় না। কিন্তু ইংল্যান্ড ও হল্যান্ড-এর মধ্যে অনেকদিন ধরেই শান্তি বিরাজ করছে। তাই হাল দুশ্চিন্তার কোনো কারণ দেখে নি। এছাড়া সকাল হওয়ার সাথে সাথেই কার্নিভেলটা অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু হাল-এর মন থেকে সেই অস্বস্তির ভাবটা যায়নি।
এখন আবার হালের মনে সেই একই রকম অস্বস্তি কাজ করছে। কিছু একটা তাকে জানাচ্ছে যে সেই ডাচম্যানটা এখনো সেখানে আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কারাভেল-এর ক্যাপ্টেন-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। হাল জাহাজের ডেক-এ উঠেই একটা স্নিগ্ধ পরিবেশ অনুভব করে। ঠাণ্ডা নরম বাতাস বইছে। রুপালি চাঁদের আলোতে সাগরের পানি চকচক করছে। ডেক-এর পাশে অ্যামাড়োডা যোদ্ধারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এরা সবসময় এরকম খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। নেড টেইলর জাহাজের হালের মধ্যেই ছিল। সে ক্যাপ্টেনকে বলে, “এ সময়ে আপনি এখানে কেন ক্যাপ্টেন?” “আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আপনি আপনার সঙ্গিনীর ওপর বিরক্ত হয়ে এত রাতে নিজের কেবিন ছেড়ে এখানে এসেছেন।”
“মোটেও না,” হাল একটু হেসে জবাব দেয়। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সেই ডাচ্ কারাভেলটা এখনো সেখানে আছে।”
“টম ছেলেটা তো কোনোকিছুই বলেনি। সে খুবই ভাল ছেলে। ডিউটি বাদ দিয়ে ঘুমানোর মতো ছেলে সে নয়।”
টম মার্লি হচ্ছে নাবিকদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়সি। বেশ দুরন্ত কিন্তু দায়িত্ববান ছেলে। তবুও হাল নিশ্চিত হতে চায় যে সে সঠিক লোককে দায়িত্ব দিয়েছে। তাকে এখানে নিয়ে আসুন, মি. টেইলর।”
“ঠিক আছে, স্যার।”
নেড মাস্তুলের ওপর দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা চিকন শিস বাজাল। সাথে সাথেই টম মার্লি মাথা বাঁকিয়ে নিচের দিকে তাকাল। তাকে নিচে নেমে আসার জন্য ইশারা করল নেড়। টম মার্লি নির্ভয়ে খুব দ্রুত নামতে থাকল। টম মার্লিকে নামতে দেখে হাল-এর অতীত জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। বেশিদিন আগের কথা নয় যখন হালকে বাবার আদেশে দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার এভাবে উঠা-নামা করতে হতো।
মার্লি ডেক-এ নেমে খুব দ্রুত নেড-এর কাছে চলে আসল। এরপর পেছনে হাত দিয়ে খুব বিচলিত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
“চিন্তার কিছু নেই, টম,” তুমি কোনো ভুল করনি। হাল এই কথা বলার পর ছেলেটির কাধ অনেকটা শিথিল হয়ে যায়। “আমি শুধু জানতে চাচ্ছি গত দুই-এক দিনের মধ্যে তুমি ডাচদের কোনো জাহাজ বা নৌকো দেখেছ কি-না। অথবা সন্দেহজনক কোনো কিছু?”।
টম মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না স্যার, আমি কিছু দেখি নি। আমি সবসময় আমার চোখ খোলা রেখেছি। কখনো একটুও ঘুমাই নি।”
“আমি জানি তুমি ঘুমাও নি। এখন যাও দেখ, রাঁধুনি হয়ত এতক্ষণে কিছু বেঁধেছে। খেয়ে নাও।”
“কিন্তু আমার দেখা এখনো শেষ হয়নি স্যার।”
“সেটা নিয়ে চিন্তা করো না” হাল, বলল। হঠাৎ তার মনে হল নিজ চোখে একটু দেখা প্রয়োজন। অন্য কারো ওপর ভরসা করার চেয়ে নিজ চোখে দেখা ভাল।
“আপনার কী মনে হয় ওখানে উঠা আপনার উচিত হবে। একটু ভেবে দেখুন, নেড় জিজ্ঞেস করে।
“আপনি কী বলতে চাচ্ছেন যে আমি জাহাজের অন্য যে কারও চেয়ে দ্রুত উপরে উঠতে পারব না।”
“না, স্যার। আমি শুধু বলতে চাইছি…”
“আচ্ছা, তাহলে চেয়ে দেখুন। আমি উঠছি।”
আর তারপর হাল মাস্তুলের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা মোটা রশি ধরে আকাশের দিকে উঠতে থাকে।
*
পেট অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিল। যদিও জাহাজের প্রত্যেকেরই অনেক খিদে পেয়েছিল। জাহাজের ডেক এমনকি প্রতিটা আনাচে কানাচে হ অন্তত একটা ইঁদুর খুঁজে পাওয়ার জন্য তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। যদি কোনো গাংচিল বা সামুদ্রিক পাখি ভুলক্রমেও ডেক এর ওপর এসে বসেছে কিংবা ওপর দিয়ে উড়ে গিয়েছে তাহলে সেটাকে কোন তীর দিয়ে বা পাথর নিক্ষেপ করে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে সেটাকে হত্যা করা হয়েছে। যদি কোনো ডলফিন খেলার ছলে জাহাজের পাশ দিয়ে সাঁতার কেটে গিয়েছে তবে সেটাকেও ছোট বন্দুক দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এরপর কোনো হাঙর পাখিটাকে খেয়ে ফেলার আগেই জাহাজের নাবিকেরা সাঁতার কেটে সেটাকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে।
পেটও ক্ষুধার্ত ছিল তবে সেটা ছিল অন্যরকম। সে গত এক সপ্তাহ একটা অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ইঁদুরে কাটাকুটি করা ঘরে কাটিয়েছে। সে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বলেছিল যে সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সিনিয়র অফিসার, সেই সাথে অনুরোধ জানিয়েছিল তাকে যেন একজন ভদ্রলোক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন তার কোনো কথা না শুনে তাকে বন্দি করার আদেশ দিয়েছিল।
“আপনাকে বুঝতে হবে যে আমার লোকেরা ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ শেষ করেছে সে বেশিদিন হয়নি। তাদের মনে হয়তো বা এখনো আপনাদের জন্য কোনো ভালবাসা নেই।” কাঁধ ঝাঁকিয়ে আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন ক্যাপ্টেন। “তাছাড়া এরা অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। খাদ্য এখন তাদের কাছে খুবই আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। আমি কিভাবে নিশ্চয়তা দিব যে খাবারের জন্য তারা কোনো অমানবিক কাজ করে ফেলবে না। আপনার ভাগ্য ভাল যে আমি আপনাকে উদ্ধার করার আদেশ দিয়েছি। আমার লোকের অনেকেই যেটা চায় নি। কারণ ওরা চায় নি আরেকটা ক্ষুধার্ত মুখ বাড়াতে। আমি সেসময় তাদেরকে একটা হাস্যকর প্রস্তাব দিয়েছিলাম যার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমি ওদেরকে বলেছি যে যদি তোমরা ওকে পছন্দ না কর তাহলে তাকে খাবার হিসেবেও মজুদ রাখতে পার। আমার ভয় হচ্ছে যে তাদের মাঝে কেউ হয়ত বা সেটা করেও ফেলতে পারে।”
তখন থেকে ক্ষুধার চেয়ে বেঁচে থাকাটাই পেট-এর জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার শরীর শুকিয়ে একেবারে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছে। মাংস চামড়া সবই একেবারে প্রায় হাড়ের সাথে লেগে গিয়েছে। কিন্তু পেট এমন মানুষ যার খাদ্যের প্রতি খুব একটা আগ্রহ কখনোই ছিল না। তাই খাদ্যের অভাবে তার বড় কোনো ক্ষতিই হয়নি। কিন্তু অন্য আরেকটা ক্ষুধা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। কখন সেই স্বর্গীয় কণ্ঠ তাকে আদেশ দিবে পৃথিবীকে পাপমুক্ত করার, তার নিজেকে সেই কাজের জন্য প্রস্তুত করার। পেট জানে না কখন সেই স্বর্গীয় স্বর আবারো ভেসে আসবে। মাঝে মাঝে এমনও হয় যে একমাস যাবত সেই কণ্ঠের কোনো খোঁজ থাকে না, আবার মাঝে মাঝে একদিন বা একসপ্তাহ পরেই সেই কণ্ঠ ভেসে আসে। সেই কণ্ঠ যখন আসে তখন চিৎকার করে বারবার তাকে একই আদেশ দিতে থাকে। “হত্যা কর, এখুনি।”
এই জাহাজে বন্দি থাকা অবস্থায় পেটকে মুক্ত করার মতো কেউই ছিল না। আর তখনি, অন্য সব বারের মতোই, ঐ স্বর্গীয় কণ্ঠের অধিকারী তার জন্য একজন সঙ্গী পাঠিয়েছেন।
সে ছিল তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত, শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া একজন নাবিক। তার অপরাধ ছিল সে ক্যাপ্টেন-এর কোয়ার্টার-এর লকার থেকে একটা মূল্যবান ধাতব পাত্র চুরি করেছিল। পেট-এর মনে হয় লোকটা অনেকটা উন্মাদ। নয়ত সে গুলি করে লকার খুলতে যেত না, যেখানে জাহাজের একপ্রান্তে গুলি করলে অন্যপ্রান্ত থেকে শোনা যায়। এমনও হতে পারে সে হয়ত কি ঘটতে পারে সে ব্যাপারে পাত্তাই দেয়নি। গত বার ঘণ্টা ধরে সে পেট-এর সামনে বসে আছে। মাঝে মাঝে আবোল তাবোল কথা বলছে। কখনো কেঁদে উঠছে, আবার কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ছে। পেট অনেক চেষ্টা করছে লোকটাকে থামিয়ে তার মনে একটু শান্তি দিতে। যদিও তাদের দুজনকেই নির্দিষ্ট দূরত্বে শেকল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। পেট-এর হাতে লাগানো রিংটাকে আবার আরেকটা শেকল দিয়ে পায়ের সাথে আটকে রাখা হয়েছে। যার ফলে লোকটার কাছে গিয়ে তাকে আঘাত করা পেটের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তবে পেট নিশ্চিত যে স্বর্গীয় দূত যেহেতু এই লোকটিকে এখানে এনেছে তাহলে নিশ্চয়ই এর কোনো একটা বিহিত হবেই। তবে এটা নিশ্চিত যে ঘটনা পেট এর দিকেই এগুচ্ছে।
জাহাজের দেয়ালগুলো এমনভাবে তৈরি যে সবকিছু পরিষ্কারভাবে শোনা না গেলেও বেশ ভালই শোনা যাচ্ছিল। অনেক দৌড়ঝাঁপ এবং চলাফেরার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। হয়ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বা মালামাল উঠানোর জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করছিল ওরা।
অবশেষে পেট শুনতে পায় যে একটা নৌকো নিচে নামানো হচ্ছে। যদিও অনেকটা নীরবতার সাথে করা হচ্ছে পুরো কাজটা যেন ব্যাপারটা সম্পর্কে তারা কাউকে অবগত করতে চাচ্ছে না। কিন্তু যখনই নৌকোটা নিচে নামানো হলো তখন জাহাজে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের কথায় একটু বিতর্কের আভাস পাওয়া গেল। ব্যাপার যাই হোক, এটা নিশ্চিত যে তারা পেটকে নিয়ে কোনো কথা বলছে না বা পেট-এর দিকে কোনো মনোযোগ দিচ্ছে না।
আর তাই সে বিনা পরিশ্রমে তার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সে আস্তে আস্তে সামনে এগোতে শুরু করেছে। তার পায়ের ব্যথাকে উপেক্ষা করে সে শিকারী চিতাবাঘের মতো সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
পেট খুব নীরবে সতর্কতার সাথে এগিয়ে যেতে লাগল যেন শব্দ শুনে শিকার সজাগ না হয়ে যায়। লোকটা হঠাৎ পেট-এর আগমন দেখে শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল; সে বুঝতে পারছে যে সে কোনো একটা বিপদের ভেতর রয়েছে। সে পেট-এর দিক থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। প্রায় অন্ধকারের মধ্যেও লোকটার ভয়ার্ত সাদা চোখ চকচক করছিল। পেছনে যেতে যেতে লোকটা জাহাজের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফেলল, আর বুঝতে পারল যে খুন করার উদ্দেশ্যেই কেউ কারও দিকে এভাবে এগোয়।
পেট সামনে এগুতে থাকে। সে যখন তার ভয়ার্ত শিকার ধরে ফেলতে যাচ্ছিল তখনই তার পায়ের শেখলে টান পড়ে। সে বিপদ বুঝতে পেরে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত লোকটির পা ঝাঁপটে ধরে ফেলে সে। লোকটি পা নাড়া দিয়ে পেটকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু পেট শক্তভাবে ধরে লোকটিকে নিজের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করতে থাকে। লোকটিও খুব শক্তভাবে জাহাজের ডেক ধরে রাখার চেষ্টা করে। আঙুলগুলো হুক-এ ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে সে। কিন্তু এই বন্ধ ঘরে দেয়াল মেঝে সবকিছু ইঁদুরের বিষ্ঠায় পিচ্ছিল হয়েছিল। তাই লোকটির আর কিছুই করার ছিল না।
লোকটি আবারও জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। তার কণ্ঠ ভয়ে ভেঙে যাচ্ছিল। সে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বোধহয় ওর প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। তার হয়ত অন্য কোনো পরিকল্পনা ছিল। সেই স্বর্গীয় দূত আর অন্যান্য ফেরেশতারা হয়ত পেট-এর পক্ষ হয়ে প্রার্থনা করছিল। এখন পেট-এর মুখ লোকটির দুর্গন্ধময় উরুর কাছাকাছি চলে এসেছে। এরপরেও পেট ক্রমাগত তাকে নিজের দিকে টেনে আনছে। সত্যটা হচ্ছে যে তার নিজের জীবনও এটার ওপর নির্ভর করছে।
“চুপচাপ থাক। তাহলে আমি দ্রুত কাজ সেরে ফেলতে পারব,” পেট এমনভাবে বলল যেন সে তার নিঃশ্বাসের অপচয় করছে। লকলকে চিকন আঙুলগুলো পেট-এর মুখে থাবা দিল; লোকটি প্রাণপণে চেষ্টা করছিল পেটকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পেট লোকটির থাবা সরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের হাত লোকটির শরীরের উপরের দিকে উঠাতে থাকে। একসময় লোকটির কণ্ঠনালী পেয়ে যায় সে। এরপর নিজের হাত দিয়ে লোকটির স্বরনালী চেপে ধরে।
অপুষ্টিতে ভুগলেও বন্দি নাবিকটির শক্তির অভাব ছিল না। অনেক বছর সমুদ্রে কাটানো, মাস্তুল বেয়ে উঠা-নামা করা, যুদ্ধ করা সবমিলিয়ে লোকটি বেশ শক্তিশালী ছিল। সে পেট-এর থাবা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে আততায়ীর হাত। কিন্তু উইলিয়াম পেট অত্যন্ত কৌশলী লোক। সে এর আগে বহুবার এই কাজ করেছে। সে জানে কোন মুহূর্তে কী ধরনের বাধা আসতে পারে। সে জানে যে এই মুহূর্তে শুধু আর একটু সময় হাতের থাবাটাকে আটকে রাখতে হবে। শুধু আর একটু সময়।
এই ধরনের কাজে পেট একজন বিশেষজ্ঞ বটে; অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার হাতে। দক্ষ লোকের মতোই সে তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। লোকটির হাত আস্তে আস্তে শিথিল হতে থাকে। ধীরে ধীরে নীরব হয়ে যায় লোকটি।
পেট এখনো শক্ত করে ধরে আছে লোকটার গলা। মৃত লোকটি শেষবারের মতো কেঁপে উঠল। এরপর সবকিছু শেষ।
ভালভাবে কাজ সম্পন্ন করেছে, সেই স্বর্গীয় কণ্ঠটি ফিসফিস করে বলে উঠল, …”কিন্তু তুমি একটা জাহাজে আছ। এরপর থেকে কোনো একটা লম্বা কাঠের টুকরা বা ধাতব পিন কান-এর ভেতর দিয়ে ব্রেইন-এ ঢুকিয়ে দিবে। তাহলে আর সন্দেহ করার মতো কোনো চিহ্ন থাকবে না, আর কাজটাও দ্রুত সম্পন্ন হবে।”
স্বর্গীয় কণ্ঠটি ঠিকই বলেছে। এরপর থেকে এভাবেই ভাববে সে। কিন্তু এখন তাকে মুক্তির জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
তার আগে মৃত লোকটিকে একপাশে এমনভাবে রেখে দিতে হবে যেন দেখে মনে হয় যে ঘুমের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু শেকলে বাঁধা থাকার কারণে পেট লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারল না। তাই সে মৃত লোকটির শরীরটাকে উল্টিয়ে দেয়, যার ফলে সে উপুর হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে।
এরপর পেট নিজের জায়গায় সরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
*
হাল আস্তে ধীরে অনেকটা নমনীয় নির্ভরতার সাথে মাস্তুলের উপরে উঠতে লাগল। যখন সে একেবারে চূড়ায় নাবিকের বসার জায়গাটিতে উঠে আসে তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় চাঁদের আলোর ফাঁকে এক চিলতে মেঘ দেখা যাচ্ছে। তার নিঃশ্বাস স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা দ্রুত হয়ে এসেছে যেটা এক সময় দিনে দুই-তিন বার মাস্তুলে উঠা-নামা করার সময়ও হত না। কিন্তু এখনো বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার আনন্দটা শেষ হয়ে যায়নি। স্নিগ্ধ, কোমল নরম বাতাসকে এখনো সর্বরোগের ওষুধ মনে হয়। জাহাজে পালের ভেজা, বাসি গন্ধ, সাগরের পানির ওপার থেকে ভেসে আসা আফ্রিকার মাটির মিষ্টি গন্ধ এখনো এক অন্যরকম অনুভূতি জাগায় হাল-এর মনে।
হাল উত্তর দিকে তাকিয়ে ডাচদের কোনো চিহ্ন দেখা যায় কি-না সেটা খুঁজতে থাকে। হঠাৎ করে সাদা রঙের কিছু একটা হাল-এর চোখে দৃশ্যমান হলো-পরমুহূর্তেই সে বুঝতে পারল যে ওটা আর কিছুই নয়, বরং মেঘ ভেদ করে চাঁদের আলো বেরিয়ে এসেছে। হাল-এর নিজের দৃষ্টি শক্তির প্রখরতার ওপর আত্মবিশ্বাস আছে। সে জানে জাহাজের অন্য কারও চেয়ে তার চোখের তীক্ষ্ণতা অনেক বেশি। একারণেই সে নিজ চোখে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যকারও ওপর ভরসা করে সে স্বস্তি পাচ্ছিল না। কিন্তু সে চাঁদের মৃদু আলোতে দূর থেকে দূরান্তে দৃষ্টি প্রসারিত করেও কিছু খুঁজে পেল না।
“তাহলে তুমি কোথায়?” সে বিড়বিড় করে নিজের মনে বলে উঠল। রাতের চাদরের কিনারায় লেগে থাকা এক চিলতে রক্তের দাগের মতো করে সকালের সূর্যটা উঁকি দিতে থাকে। জাহাজটা উদ্দেশ্যহীনভাবেই একটু নড়ে উঠল যেন ওটা তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। কুয়াশা জাহাজটার চারপাশটাকে ঘিরে রেখেছে। সামুদ্রিক ঢেউ এসে জাহাজের গায়ে ধাক্কা খেয়ে এক ধরনের মৃদু শব্দ করছে। জাহাজটাও সেই ঢেউ-এর তালে তালে দুলতে থাকে। হাল হয়ত বাচ্চা ছেলের মতো তার কেবিন-এ ঘুমিয়ে থাকত যদি না নেড টেইলর তাকে হঠাৎ করেই ডাকত। সে চাচ্ছিল নোঙর ফেলে এখানেই থেকে যেতে। এরকম জোরালো ঢেউ-এর ভেতর যাত্রা শুরু করাটা ভয়ংকর ব্যাপার হবে, তার চাইতে জাহাজটা এখন যেখানে আছে সেখানে থাকাটাই অনেক নিরাপদ মনে করছে সে।
হাল-এর মনে এখন একটু অপরাধবোধ কাজ করছে। তারুণ্যের পতাকা বহন করে ছেলেমানুষের মতো এখানে উঠে না এসে ক্যাপ্টেন-এর মতো করে ডেক-এ থাকলেই বরং বেশি ভাল হত। কিন্তু সে এখনি হাল ছেড়ে দিতে নারাজ; তার প্রতিটি ইন্দ্রিয় তাকে বলছে যে এখনো ডাচরা আশেপাশেই রয়েছে। তিনটা পালযুক্ত ছোট্ট একটা কারাভেল ছিল ওটা। হাল অনুমান করল যে ওটা স্পেনিশ বা পর্তুগীজদের কাছ থেকে কেনা হয়েছে, কারণ ডাচদের এরকম কারাভেল দেখা যায় না। ওটা আকারে বড়জোর বাউ-এর অর্ধেক হবে তাই এরকম জাহাজ নিয়ে হাল দুশ্চিন্তার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ যুদ্ধ করতে আসলে ওটাকে উড়িয়ে দেয়া বাউ-এর জন্য কোনো ব্যাপারই না।
সে চোখদুটোকে সরু করে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন কুয়াশা ভেদ করে তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে অসীমে। যুদ্ধ শেষে ইংরেজ এবং ডাচদের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যদিও হাল-এর তাতে কিছু যায় আসে না; তার বাবার মৃত্যুর জন্য ডাচরাই দায়ী। কেপ কলোনির ডার্চ গভর্নর-এর আদেশেই তার বাবার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। যুদ্ধ সে বৈধতা দিয়েছে। যে নিয়ম। বেঁধে দিয়েছে সেটা হাল মেনে নিয়েছে। কিন্তু সুযোগ পেলে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিবে সে। ডাচদের রক্তের বন্যা বইয়ে দিবে।
হঠাৎ তার মনে হলো যে সে ডাদের জাহাজটাকে দেখতে পেয়েছে। কিন্তু ওটা নিমিষেই কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়। অ্যাবোলি ঠিকই বলে? স্যার ফ্রান্সিস হালকে জাহাজ পরিচালনার জন্য যথাযযাগ্যভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এছাড়াও আরও একটা ব্যাপার আছে যেটা হালকে তার বাবা শিখিয়ে দেয় নি। কিন্তু একজন যোদ্ধার সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে সেটা এমনিতেই তার মধ্যে তৈরি হয়েছে। হাল অনুভব করে সেই সহজাত প্রবৃত্তি যেটা তার রক্তের সাথে মিশে শিরায় প্রবাহিত হয়। সেই সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই সে তার নরম বিছানা এবং বিছানার ওপর সুন্দরী রমণী রেখে উঠে আসতে পেরেছে। সেই সহজাত প্রবৃত্তিটাই তাকে এখনকার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছে।”
গোল্ডেন বাউ-এর ডেক-এর ওপর উড়ে আসা হুকগুলোকে হাল প্রথমে দেখতে পায়নি ঠিকই, কিন্তু কুয়াশার মাঝ দিয়ে অন্ধকার ভেদ করে আসতে থাকা ছায়াগুলোকে সে-ই প্রথমে দেখতে পায়।
“তৈরি হও! তৈরি হও সবাই,” চিৎকার করে সতর্ক বাণী পাঠাল হাল। আর তখনই অন্ধকার ভেদ করে বন্দুকের গুলির শব্দ পাওয়া যায়। বন্দুকের গুলির আলোয় শত্রু পক্ষের মুখ সে প্রথমবারের মতো দেখতে পায়। হাল এরই মধ্যে ওপর থেকে নামতে শুরু করে দিয়েছে।
.
সে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাল কারণ অ্যামাডোডা উপজাতিরা খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। আর তাই, সবার আগে এই লোকগুলো দ্রুত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হয়ে যেতে পারল। উপজাতীয়রা লাঠি, বর্শা, কুঠার এসব হাতে নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকে। মাস্তুল থেকে প্রায় অর্ধেকটা পথ নেমে যার পর সে বুঝতে পারল যে যারা আক্রমণ করতে এসেছে তাদের হাতে ভারী অস্ত্র রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে পিস্তল আছে, সেই সাথে কাঁধে ঝুলানো আছে আরো এক জোড়া। যখন হাল নিচের দিকে তাকায়, সে দেখতে পায় যে শক্রর ছোঁড়া বুলেট একজন অ্যামাডোডার বুকে বিঁধেছে। লোকটি ডেক-এর ওপর পড়ে যায়, তার চোখের বল ঘুরে গিয়ে সাদা অংশ সামনে চলে আসে।
আর পাঁচ ফিট বাকি থাকতেই লাফ দিয়ে ডেক-এর ওপর নেমে আসল হাল। যখন সে পাটাতনের ওপর পা রাখল তখনই তার মনে হলো যে সে অস্ত্র শূন্য। কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় তার পিস্তল এবং তলোয়ার দুটোই আনতে ভুলে গিয়েছে সে।
“গান্ডওয়েন, এটা নাও!” হাল ঘুরে তাকিয়ে অ্যাবোলির ছুঁড়ে দেয়া তরবারির বাঁটটা দ্রুত ধরে ফেলে। এরপর তরবারি হাতে সে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথমেই একজনের মুখে আঘাত করে, এরপর অন্য একজনের পেটে সজোরে ঢুকিয়ে দেয় ধারালো প্রান্তটা।
“গোল্ডেন বাউ-এর অধিবাসীরা কোথায়?” সে চিৎকার দিয়ে উঠে। তার সাথে সাথে অ্যামাডোডারাও হর্ষধ্বনি দিয়ে সামনের দিকে ধেয়ে গেল। ততক্ষণে গোল্ডেন বাউয়ের বাকি ক্রু মেম্বাররাও চলে এসেছে।
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাল আর অ্যাবোলি শত্রুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। ওদিকে গুলি ভরা পিস্তল হাতে ওলন্দাজরা এগিয়ে আসছে।
এক বিশাল আকারের ওলন্দাজ-যার ঘন কালো দাঁড়িতে সমস্ত মুখ প্রায় ঢেকে আছে-তার বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ে, এরপর ওটা দিয়ে পেছন দিকে সজোরে আঘাত করে। তিনজন অ্যামাডোডা সৈন্য মাটিতে লুটিতে পড়ল। কিন্তু বিগ ডেনিয়েল এখনো টিকে আছে। তার তলোয়ার একটা মৃত মানুষের কাঁধে আটকে আছে। কিন্তু তার গায়ের শক্তিও কোনো ধারালো অস্ত্রের চেয়ে কম নয়। সে তার বাহু দিয়ে আঘাত করে এক ওলন্দাজের হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিল। এরপর লোকটার দাড়ি দুইহাত দিয়ে ধরে সামনে টেনে নিয়ে যেতে লাগল, এরপর নিজের মাথা দিয়ে ওলন্দাজটার নাকে আঘাত করে বসলো। হাড় ভেঙে যাওয়ার যে শব্দটা হলো তা এই বিশৃংখলার ভেতরেও শুনতে পেল হাল।
ওলন্দাজটার মুখ আর দাড়ি রক্তে ভিজে গিয়েছে। বিগ ডেনিয়েল অন্যদিকে তাকিয়ে মৃত লোকটার কাঁধ থেকে নিজের তলোয়ার ছাড়িয়ে আনে। এরপর কসাই যেভাবে মাংসের দিকে তাকায়, ঠিক সেভাবে ওলন্দাজটার দিকে তাকাল।
হাল চিৎকার দিয়ে বিজয়ের উল্লাস করে উঠে। হঠাৎ আক্রমণ করে ডাচ যে সুবিধাটা পেতে চেয়েছিল সেই সুবিধাটা ওদেরকে পেতে দেয়নি গোল্ডেন বাউ-এর নাবিকেরা। তারা অতিদ্রুত প্রস্তুত হয়ে দক্ষতার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বিজয় এখনো সম্পূর্ণ তাদের হাতে আসেনি। কিন্তু হাল সেই ছোটবেলা থেকেই জাহাজের ওপর যুদ্ধ ক্ষেত্র দেখে শিখেছে যে বিজয় কার দিকে যেতে পারে। শেষ মুহূর্তের কোনো আক্রমণও যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। সবাইকে একত্র করার উদ্দেশ্যে চিৎকার দিতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে সে অ্যাবোলির কণ্ঠ শুনতে পায়।
“গান্ডওয়েন!”
সে ঘুরে তাকায়-অ্যাবোলি তলোয়ার হাতে নিয়ে জাহাজের পেছনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
“না”, সে নিজের অজান্তেই বলে উঠে, “এটা হতে পারে না।”
*
জুডিথ অসুস্থ হওয়ার কারণে বিছানা থেকে উঠে বমি করার জন্য একটা বেডপেন খুঁজতে বের হয়। এই বমি বমি ভাবটাই তার জীবনকে বাঁচিয়ে দেয়। সে দেখতে পায় কুয়াশার মধ্যে কিছু ছায়াশরীর এগিয়ে আসছে। ক্যাপ্টেন-এর জানালা দিয়ে গোল্ডেন বাউ-এর ভেতরে ঢুকছিল লোকগুলো। এরপর ওদের মাঝেই একজন লোক পেন্ডুলাম-এর মতো দেখতে একটা মোটা রশি ঝুলিয়ে দেয় গোল্ডেন বাউ জাহাজ থেকে। সেই রশি বেয়ে আরো ছায়াশরীর উপরে উঠতে থাকে।
শত্রুর জন্য অপেক্ষা করছে জুডিথ। তার পরনে ছিল নাইট গাউন, হাতে শোভা পাচ্ছে ওর তলোয়ার যাকে সে কাস্কারা বলে ডাকে। ভাগ্যিস, গোল্ডেন বাউতে আসার সময় তার লাগেজের সাথে করে অন্যান্য মিলিটারি সরঞ্জামের সাথে ছোট্ট তলোয়ারটা এনেছিল!
যে ওলন্দাজটা সবার প্রথমে তার কেবিনে ঢোকার জন্য পা বাড়িয়েছিল, তার পুরো শরীর ভেতরে আনার আগেই কাস্কারার এক কোপে গলাটা ধড় থেকে আলাদা হয়ে গেল। লোকটি যখন পড়ে যাচ্ছিল তখন জুডিথ অনেকটা নতত্যর ভঙ্গিতে খুব দ্রুত তার কাছ থেকে সরে গিয়ে দ্বিতীয় আক্রমণকারীর দিকে এগিয়ে যায়, এরপর লোকটির পেছনে গিয়ে কিডনি বরাবর শক্ত হাতে আঘাত করে। ওলন্দাজটা চিৎকার দিয়ে গোঙাতে গোঙাতে মুহূর্তেই ভূপাতিত হয়ে যায়।
আরও লোকজন জুডিথের কেবিনে ঢুকতে থাকে। জুডিথ বুঝতে পারে সে একটা বড় বিপদের মধ্যে রয়েছে। কেবিনের একপাশে সরে গিয়ে দরজাটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধ করতে থাকে সে। দরজার কাছ থেকে দ্রুত সরে এসে তলোয়ারটাকে যত দ্রুত সম্ভব ঘুরিয়ে শত্রুদের ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে জুডিথ। ক্রমাগত বাড়তে থাকা শক্ৰসংখ্যার বিরুদ্ধে প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। হঠাৎ সে বুঝতে পারে যে তার বাম কাঁধের ওপর দিক থেকে একটা আঘাত এগিয়ে আসছে। নিজেকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে আঘাতটা প্রতিহত করার চেষ্টা করে জুডিথ। সেই সাথে নিজের তলোয়ারটা আক্রমণকারীর বাহুতে বসিয়ে দিয়ে দু’টুকরা করে ফেলে। জুডিথ তার কঠোর যুদ্ধ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে যুদ্ধে টিকে থাকার প্রধান শর্তগুলো হচ্ছে : শত্রুদের চিৎকার চেঁচামেচির ভেতর মাথা ঠাণ্ডা রেখে অস্ত্র চালনায় পূর্ণ মনোযোগ দেয়া, শান্তভাবে প্রতিটি হিসেব কষা, আশেপাশের শত্রুদের সংখ্যা পর্যবেক্ষণ করা, শত্রুর চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনের ভাব বোঝার চেষ্টা করা।
যদিও জুডিথ নিজের জীবন বাজি রেখে প্রাণপণে যুদ্ধ করছে তবুও সে শত্রুদের মধ্যে ভীষণ বেপরোয়া ভাব দেখতে পাচ্ছে। জুডিথের শত্রুদের চোখে মুখে বন্যক্ষুধা উপচে পড়ছে যখন তারা দেখছে যে তাদের তলোয়ার-এর আঘাতকে সে বারবার প্রতিহত করছে। কিন্তু প্রতিটা আঘাত ফিরিয়ে দেয়ার সাথে সাথে তার শক্তি একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে আসছে।
সে আফ্রিকায় বেড়ে উঠেছে। সে জানে ক্ষুধা কি জিনিস, আর তাই, একজন ক্ষুধার্ত মানুষ দেখেই সে চিনতে পারে। এই হানাদার বাহিনীরা যারাই হোক না কেন তারা এমনভাবে আক্রমণ করছে যেন তাদের হারানোর কিছুই নেই। ওপর থেকে যুদ্ধের গোলাগুলি, চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। জুডিথ বুঝতে পারে যে হাল এবং তার নাবিকেরা প্রাণপণে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছে। গোল্ডেন বাউ-এর ভবিষ্যৎ তলোয়ার-এর তীক্ষ্ণতা আর ধার-এর ওপর নির্ভর করছে।
তাদেরকে জিততে হবে। জুডিথকে বেঁচে থাকতে হবে। তার নিজের জন্য না হলেও তার ভেতরে বেড়ে ওঠা অনাগত সন্তানের জন্য বেচে থাকতে হবে। সে নিজের ভেতর যুদ্ধ করার এক ধরনের স্পৃহা, এক ধরনের প্যাসন অনুভব করে। সে জানে শত্রুপক্ষকে কখনো তার মুখোমুখি আসতে দেয়া যাবে না। তার আগেই যেভাবে হোক তাদের প্রতিহত করতে হবে। কেবিনের দরজার পাশে সে এরই মধ্যে দুই তিনজনকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। পরবর্তী আক্রমণের জন্য কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে থাকে সে। যখন দেখে কেউই আসছে না তখন সে আস্তে আস্তে কেবিনের বাইরে বের হয়। কোয়াটার ডেক এর দিকে এগুতে থাকে যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা দেখার জন্য।
জুডিথ-এক সেকেন্ডের জন্য থামে। কিন্তু সেই এক সেকেন্ড সময়ই তার জন্য অনেক দীর্ঘ সময় হয়ে দাঁড়ায়। সে হঠাৎ বুঝতে পারে যে পেছন থেকে কেউ একজন তাকে ধরে ফেলেছে। একটা হাত তার কোমড় জড়িয়ে ধরেছে, আরেকটা হাত তার গলায়। পেছনের লোকটি তাকে আঁকড়ে ধরে উপরে উঠিয়ে ফেলে। হাত দিয়ে, তলোয়ার দিয়ে নানাভাবে লোকটিকে আঘাত করে মুক্ত হবার চেষ্টা করে জুডিথ, কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
লোকটি হাসতে হাসতে চিৎকার করে ওলন্দাজ ভাষায় কিছু একটা বলছিল।
জুডিথ ওলন্দাজ ভাষা জানে না। কিন্তু সে বুঝতে পারে লোকটি চিৎকার করে ক্যাপ্টেনকে ডাকছে। সে খুব ভালভাবেই জানে যে হাল কখনোই জুডিথের জীবনের ঝুঁকি নিবে না। এমনকি গোল্ডেন বাউ-এর জন্যও না। তার মানে হচ্ছে, জুডিথ যার কজায় থাকবে, গোল্ডেন বাউও তারই হবে।
জুডিথ অসহায়ভাবে তলোয়ার ফেলে দিয়ে হাল ছেড়ে দেয়। তলোয়ার নিচে পড়ার শব্দ তার কানে যায় না। সে শুধু বুঝতে পারে যে তার কারণেই গোল্ডেন বাউ আজকে যুদ্ধে হেরে যাবে।
.
জুডিথ-এর পেছনে একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পায় হাল। সাথে সাথে সে বুঝতে পারে যে জুডিথ কোনো একটা বিপদে আছে। তার এবং জুডিথ-এর মাঝখানে ওলন্দাজ আর অ্যামাডোডা যোদ্ধারা আছে। সবার মাঝখান দিয়ে জুডিথ-এর দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। জুডিথকে ধরে ফেলে লোকটি, এরপর ঝাঁপটে ধরে তার গলায় ছুরি বসিয়ে দেয়।
তাদের সামনে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে যাকে জুডিথ ওলন্দাজ ক্যাপ্টেন বলে সনাক্ত করে। তার পোশাক অন্যান্য নাবিকদের চেয়ে একটু আলাদা। সিল্কের পাড় দেয়া সাদা রঙের ওয়েস্টকোট পরে আছে লোকটা। সামনে এগুতে এগুতে লোকজনকে আদেশ দিচ্ছে সে। হঠাৎ মাথার হ্যাটটা খুলে ডেক-এর ওপর ভেসে থাকা ধোয়ার মধ্যে ছড়িয়ে দিল ক্যাপ্টেন। পূর্ব দিকে আস্তে আস্তে সূর্য উঠতে থাকে। সকালের কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের আলো জাহাজের ওপর পড়তে শুরু করেছে। ওলন্দজরা যদি আর কিছুক্ষণ পর আসত তাহলে হাল ওদেরকে জাহাজে উঠার সুযোগই দিত না। কিন্তু ভাগ্য আজ শত্রুদের পক্ষে।
হাল সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার ধারালো তলোয়ারটা এখনো তার হাতে ধরা। কিন্তু এটা ব্যবহার করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। সবাই আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে যুদ্ধ প্রায় শেষের পথে। তাই এখন আর লড়াই করার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। লড়াই বাদ দিয়ে কেউ কেউ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কেউ কেউ ব্যথায় চিৎকার করছে। একজন তার উড়ে যাওয়া ডান হাতটা বাম হাত দিয়ে ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে-ভাবছে, ওটা কিভাবে এখানে এল।
“আমি স্যার হেনরি কার্টনি। গোল্ডেন বাউ-এর ক্যাপ্টেন।” হাল চিৎকার করে বলল, এরপর নিজের তলোয়ারটা ডাচ্ ক্যাপ্টেন-এর দিকে বাড়িয়ে দিল। “আর তুমি? তুমি একজন কাপুরুষ!” তুমি চোরের মতো একজন নারীকে পেছন থেকে আক্রমণ করে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছ।’
ওলন্দাজ ক্যাপ্টেন ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকাল। পরমুহূর্তেই তার দৃষ্টি ফিরে এলো সামনের দিকে। “যে নারী পুরুষের মতো যুদ্ধ করতে পারে তাকে আমাদের সেভাবেই ভাবা উচিত। কাঁধ ঝাঁকাল ক্যাপ্টেন, এরপর চেহারায় এক ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে বলল, “এসবে কী আসে যায়? চলুন আমরা এসব অর্থহীন যুদ্ধ বন্ধ করে ভাল মানুষের মতো কথা বলি।”
দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যায় হাল। সে তার আগের প্রেমিকা সুকিনাকেও একই রকম পরিণতি বরণ করতে দেখেছে-ওই সময় সেও তার সন্তান-এর মা হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। সুকিনা আর তার অনাগত সন্তান হাল-এর বাহুর উপরে মারা গিয়েছিল। সে জুডিথেরও একইরকম পরিণতি দেখতে চায় না। সে চায় না তার আরেকটি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগে মৃত্যুবরণ করুক।
যে কারণে সে আর তার নাবিকেরা প্রাণপণে যুদ্ধ করেছে, সেটা সে এত সহজে কীভাবে ছেড়ে দেয়? একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে এখন তার কী আচরণ করা উচিত? কোয়ার্টার ডেক-এর দিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ মনে মনে ভাবতে লাগল যে তার বাবা স্যার ফ্রান্সিস সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। গর্বিত, সোজা মস্তকে তার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, সেই সাথে হাল-এর মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।
কিন্তু সেই প্রতিচ্ছায়া হালকে বলে দিল যে এখন কি করতে হবে। গোল্ডেন বাউ তারই জাহাজ ছিল। সে-ই এটার প্রথম ক্যাপ্টেন ছিল।
“আমি ডেফট-জাহাজের ক্যাপ্টেন, ট্রোম্প। আর এখন দেখা যাচ্ছে…” ওলন্দাজটা মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তুলে বলতে শুরু করল, “…এখন থেকে এই গোল্ডেন বাউ-এরও ক্যাপ্টেন।”
ট্রোম্পস-এর লোকেরা সাথে সাথে উল্লাসধ্বনি করে উঠল। গোল্ডেন বাউ এর নাবিকেরা হতবাক হয়ে হাল-এর দিকে তাকিয়ে রইলো। তাদের হাতে এখনো রক্তমাখা অস্ত্র। হাল আদেশ দিলেই তারা আরেকবার গর্জে উঠবে। গোল্ডেন বাউ-এ রক্তের বন্যা বইয়ে দিবে। কিন্তু হাল-এর ভালবাসা আর তার আগত সন্তানের কারণে ওরা সেটা করতে পারছে না।
“আমরা এক থেকে পাঁচ গুনব”, ক্যাপ্টেন ট্রোম্প। হাল জুড়িথের প্রতি তার দুর্বলতা লুকোনোর চেষ্টা করে গর্জে উঠল। এবং আশা করল জুডিথও যেন সেটা বুঝতে না পারে। একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে জাহাজের প্রতি তার দায়িত্বকে সে সবকিছুর উপরে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করে।
“কিন্তু আপনি এখন আর যুদ্ধ করছেন না”, ট্রোম্প বলে উঠে। তাই আমি বলতে পারি যে, এই নারীকে বাঁচানোর জন্য আপনি যেকোনো পদক্ষেপ নিতে রাজি আছেন, তাই না?” “ক্যাপ্টেন আমি মনে করি যে, আপনি একজন ভদ্রলোক। যে কারণে আপনি হাতের তলোয়ার ফেলে দিয়েছেন সেটা শুধুই একজন নারীর জীবন রক্ষা করার জন্য নয়। এই মেয়ের কাছে আপনার হৃদয় দিয়ে বসে আছেন, তাই না, ক্যাপ্টেন?”
জুডিথ-এর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল হাল। ভোরের সূর্যের আলোতে সে ঐ চোখের তেজ দেখতে পেল পরিষ্কারভাবে। জুডিথ-এর মধ্যে ভয়ের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে না সে। একজন লোক পেছন থেকে তার গলায় ছুরি ধরে থাকার পরেও জুডিথ স্থিরচিত্তে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”
‘“আমার মনে হয় না ওরা জুডিথকে হত্যা করবে,” হাল-এর কাঁধের ওপর দিয়ে অ্যাবোলি ফিসফিসিয়ে বলে উঠে, “কারণ ওরা জানে যে ওরা যদি এটা করে তবে ওরা সকলেই এখানে মারা পড়বে।”
|“আমাদেরকে শুধু একবার আদেশ দিন। আমরা ওদেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলব। রবার্ট মুন নামে গোল্ডেন বাউ-এর একজন সর্দার হালকে উদ্দেশ্য করে বলে।”
জন লোভেল নামে আরেকজন সর্দার ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠে, “আমরা ওদের কলিজা কেটে হাঙরকে খেতে দিব।”
হাল তার মস্তিষ্কে এক ধরনের চাপ অনুভব করে। এরকম মুহূর্তে তার কী সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত সে বুঝতে পারছে না। একদিকে তার জাহাজ, তার নাবিকেরা আর অন্যদিকে তার ভালবাসার মানুষটা, যার পেটে তার সন্তান।
“আমি কীভাবে ওর ক্ষতি হতে দেই অ্যাবোলি?” হাল ফিসফিস করে বলে উঠে, সেই সাথে তার তলোয়ারটা নামিয়ে নিতে শুরু করে। ঠিক সেই মুহূর্তেই জুডিথ মাথা দিয়ে তার গলা ধরে থাকা লোকটার নাকে সজোরে আঘাত করে। লোকটার নাকে ডিমের খোলস ভাঙার মতো আওয়াজ পাওয়া গেল। ব্যথায় কাতরে উঠে লোকটি। নাবিকটি সাথে সাথে জুডিথকে ছেড়ে দিল, এরপর ছুরিটা ফেলে দিয়ে দুই হাত দিয়ে রক্তাক্ত নাকটা চেপে ধরল। মুহূর্তের মধ্যেই জুডিথ তার তলোয়ার উঠিয়ে নিল, এরপর তার দিকে এগিয়ে আসা লোকটির পেটে ঢুকিয়ে দিল বাটসহ। পরক্ষণেই ট্রোম্প-এর দিকে লাফ দেয় সে। ট্রোম্প-এর সমস্ত মনোযোগ ছিল হাল-এর দিকে। তার পেছনে কি ঘটে যাচ্ছে এটা বুঝতে তার কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে। যতক্ষণে সে বুঝতে পারে ততক্ষণে জুডিথ তার তলোয়ার-এর লম্বা অগ্রভাগ ট্রাম্প-এর গলায় বসিয়ে দিয়েছে।
এটা দেখার সাথে সাথে ট্রোম্প-এর কিছু লোক হাল-এর লোকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারে যুদ্ধ কিংবা মৃত্যু এই দুটোর যে কোনো একটি তাদের বেছে নিতে হবে। কিন্তু তারা টিকতে পারে না। ট্রোম্প-এর বাকি লোকেরা হাঁটু গেড়ে বসে হাতের তলোয়ার উঁচিয়ে ধরল-আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে ওরা।
“ইট ইজ ওভার, ক্যাপ্টেন”, অ্যাবোলি ট্রোম্প-এর গলায় জুডিথ-এর ধরে রাখা তলোয়ারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে।
এই লোকগুলো জুডিথকে কতটা বিপদের মুখে ফেলেছিল, সেই সাথে তার জাহাজকে আত্মসমর্পণের কতটা শেষ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, এটা মনে আসা মাত্র হাল প্রচণ্ড রাগে, ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে উঠে। হাল সামনের দিকে এগিয়ে ট্রোম্প-এর গলা কেটে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু অ্যাবোলি তার কাঁধে হাত রেখে বাধা দিল।
“ইট ইজ ওভার”, সে আবারও বলে। ক্রোধ থামিয়ে নিজের শরীর আর পেশিকে শান্ত করতে হাল-এর কিছুটা সময় লাগে। তারপর সে হেঁটে হেঁটে জুডিথ আর ক্যাপ্টেন ট্রোম্প-এর দিকে এগিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন ট্রোম্প আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে তার তলোয়ার-এর বাটটা সামনের দিকে এগিয়ে রেখেছে। জুডিথ-এর কাস্কারার অগ্রভাগ এখনো ট্রোম্প-এর গলায় ঠেকানো আছে।
“আমি আত্মসমর্পণ করলাম, ক্যাপ্টেন কার্টনি”, ওলন্দাজটা তার নাকটাকে হাল-এর দিকে ঘুরিয়ে বলল। সে তার মাথাটাকে এক বিন্দুও এদিক সেদিক নাড়ানোর সাহস পাচ্ছে না।
“এত সহজ নয়”, হাল গর্জন করে উঠে এবং তলোয়ারটা তার হাত থেকে কেড়ে দিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাবোলির দিকে ছুঁড়ে মারে। “তোমার মতো বোকার পক্ষেই আমার জাহাজ কেড়ে নেয়ার কথা চিন্তা ভাবনা করা সম্ভব।”
হাল জুডিথ-এর দিকে তাকায়। জুডিথ দ্রুত মাথা নাড়িয়ে তাকে আশ্বস্ত করে যে, সে আর তার সন্তান অক্ষত আছে। তার হয়ত একে অপরকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে বিজয় উদযাপন করার সময় পাবে, কিন্তু সেটা এখন নয়।
ট্রোম্প তাকিয়ে তাকিয়ে তার সামনে ঘটে যাওয়া ব্যক্তিগত নাটক দেখতে লাগল। বিশালদেহী আফ্রিকান আর তারা ক্যাপ্টেন-এর মধ্যেকার নিবিড় বন্ধন অনুভব করতে পারল সে। সেই সাথে বুঝতে পারল সেই আত্মিক বন্ধন, যেটা ক্যাপ্টেন আর তার সেই প্রেয়সীর মাঝে বিদ্যমান, যে অপূর্ব রূপসী হয়েও অন্য যেকোনো বীর পুরুষের ন্যায় যুদ্ধ করতে পারে।
“আমি বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোক, ক্যাপ্টেন কার্টনি।” সে সাধারণভাবেই কথাটা বলল। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার কাছে ক্ষুধার মতোই ভয়ংকর, যে ক্ষুধা তাকে অল্প কয়েকজন নাবিক নিয়ে এত বড় অস্ত্রসজ্জিত জাহাজ আক্রমণে তাড়িত করেছে।
“তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার মূল্য এখন তোমাকে জীবন দিয়ে দিতে হবে।” হাল বলল। সে তার ঔদ্ধত্য, উগ্রতা থামিয়ে রাখার চেষ্টা করল। তার বাবা একসময় তাকে বলেছিল বিজয়ী যোদ্ধাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হয়। প্রতিশোধ স্পৃহাকে ঝেড়ে ফেলতে হয়। সেই ধৈর্যশীলতাকে সে কোমলতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। একজন মহান যোদ্ধা হতে গেলে এই ভুলগুলো এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতির যে চুক্তি হয়েছিল তুমি সেটা ভেঙে ফেলেছ, ক্যাপ্টেন ট্রাম্প।” নিজের তলোয়ারের রক্ত একটা রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে হাল ওলন্দাজটাকে বলল।
“চুক্তি হয়েছিল নাকি? ট্রোম্প চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে জানতে চাইল।”
“তুমি জান না? মাথা মোটা কোথাকার!” মাস্তুল-এর পেছনে লুকিয়ে থাকা হাল-এর একজন লোক চিৎকার দিয়ে উঠে।
“ক্যাপ্টেন ট্রোম্প, চুক্তি না হলেই বরং খুশি হতো, এখানে এমন লোক তুমি একা নও।” হাল বলতে থাকে। এই চুক্তি নাহলে আমি অন্তত খুশিমনে সীমান্তের ভেতরে, বাইরে, এমনকি নরকের দরজা থেকেও ওলন্দাজ ধরে এনে হত্যা করতাম। আমিও আমার বাবার মতো ওলন্দাজদের মৃত্যুর দূত হতাম। দুই দিন আগে যখন তোমার ছায়া দেখতে পাই আমি তখনই তোমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতাম।”
“শুনে ভাল লাগল যে, আমাদের দুই দেশ তাদের পুরোনো শত্রুতা ভুলে গিয়েছে। ট্রোম্প খুব ধূর্ত হাসি দিয়ে কথাটা বলল। যে হাসিটার জন্য হয়তো বা অনেক সুন্দরী নারী সারাজীবনের জন্য তার গোলাম হয়ে যেতে রাজি হয়ে যাবে।
ট্রোম্প-এর চেহারা ক্ষুধায় কুচকে যাচ্ছিল। তারপরও হালের মনে হলো যে মেটে রঙের চুল আর ইন্ডিয়ান মহাসাগরের মতো একই রঙের চোখ নিয়ে গঠিত টোম্প-এর চেহারাকে বেশ হ্যান্ডসামই বলা যায়। হাল বুঝতে পারে অ্যাবোলি ঠিকই বলেছে। ট্রোম্প কখনোই জড়িথকে হত্যা করতে পারত না। পাশার দান উল্টে দিতে গিয়ে সে নিজেই হেরে গিয়েছে। এখন সে হাল-এর বন্দি, আর সমুদ্রের নিয়ম অনুযায়ী তার জাহাজ ডেফটও এখন হলি-এর দখলে।
যখন হাল চারদিকে পরীক্ষা করে দেখছিল, তখন সে বুঝতে পারে যে ওলন্দাজরা বাউ আক্রমণ করার জন্য দুটি পানসিতে করে এসেছিল। তবে একদম সামনা সামনি এসে আক্রমণ চালানোর কারণে ওদের সাহসের প্রশংসা করতেই হয়। ওরা হয়ত গোল্ডেন বাউ দখল করেই ফেলত যদি না অ্যামাডোডা সৈন্যরা খোলা আকাশের নিচে না ঘুমাত। তারা সবাই মিলে একসাথে। চিতাবাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধ করেছে। আর সবশেষে জুডিথ-এর সাহস আর দক্ষতাই গোল্ডেন বাউকে ওলন্দাজদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছে। এখন জুডিথ-এর জন্য হাল-এর বেশ গর্ব হচ্ছে।
নাবিকেরা জুডিথকে তার সাহসের জন্য অভ্যর্থনা জানানোর পর সেই গর্ব আরও বেড়ে গেল। তারা জুডিথকে আগে থেকেই পছন্দ করত, তার খ্যাতির প্রশংসা করত। কিন্তু আজকে তারা স্বচক্ষে দেখল যে জুডিথ আসলে কি করতে পারে। জুডিথকে নিয়ে তাদের সমস্ত ভয় এখন গর্বে পরিণত হয়েছে।
“যাও গিয়ে বিশ্রাম নাও”, হাল জুডিসকে বলে। ওদিকে বিগ ডেনিয়েল আর অ্যাবোলি, ট্রাম্প আর তাদের লোকদের ঠিক মতো বাঁধা হচ্ছে কি-না, তা দেখছে। উইলিয়াম স্টেলি আর অন্যান্য নাবিকরা মৃতদেহগুলো জাহাজ থেকে সরাচ্ছে।
“আমি প্রার্থনা করেছিলাম আমার যেন আর মানুষ খুন করতে না হয়।” জুডিথ তার একটা রক্তমাখা হাত পেটের ওপর রেখে কথাটা বলল। যদিও সে ভয় পাচ্ছিল যে তার পেটের ভেতর থাকা সন্তান যদি কোনোভাবে এসব দ্বারা প্রভাবিত হয়।”
“তুমি জাহাজটা রক্ষা করেছে। মাই হার্টু,” হাল খুব নরম সুরে বলে।
“আমি এক পর্যায়ে ভয়ই পাচ্ছিলাম যে আমার কারণে না আবার তোমাদেরকে জাহাজ হারাতে হয়”, জুডিথ উত্তর দিল। এরপর সে ওলন্দাজ বন্দিদের দিকে তাকিয়ে দেখে ওদেরকে জাহাজের একেবারে নিচের ডেক-এ বন্দিখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সে হাল-এর হাতের ওপর একটা নরম ছোঁয়া দিয়ে বলে, “ওদের ক্ষতি করো না।”
“না, আজকে আর কোনো খুনোখুনি নয়।” সে তাকে আশ্বস্ত করে। এরপর হাল পূর্ব দিকে তাকায় যেদিকে সাগরের বুক চিরে সূর্যের সোনালি রঙ ছড়িয়ে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বলে, “যদি ক্যাপ্টেন ট্রাম্প তার জাহাজ আমার হাতে দিয়ে দেয়, তো এসবের আর দরকার হবে না।”
“আপনি চিন্তা করবেন না, ম্যাম, লোকটা এটাই করবে। নাহলে যে তাকে হাঙর-এর মুখে তুলে দেয়া হবে, সেটা সে ভাল করেই জানে।” বিগ ডেনিয়েল ক্যাপ্টেন ট্রাম্পকে ধাক্কা দিয়ে জাহাজের ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল।
আবোলি তাকিয়ে দেখল পরাজিত ক্যাপ্টেন-এর মাথা আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এরপর সে হাল-এর সঙ্গে নিজের ভাষায় কথা বলতে শুরু করল যেন অন্য কেউ তা বুঝতে না পারে। আমরা জাহাজ আক্রমণ করতে গেলে যদি ওদের নাবিকেরা আমাদের বাধা দেয় গান্ডওয়েন? আমরা আজকে আমাদের যথেষ্ট লোক হারিয়েছি। আমরা আক্রমণ চালালে হয়ত আরও লোক হারাব। আর বাতাসও আজকে খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। যদি ওরা কোনোভাবে জানতে পারে আমরা আসছি তাহলে ওরা আরও সতর্ক হয়ে যাবে।”
“হুম…”, হাল মাথা নাড়াল এবং ভাবতে লাগল অ্যাবোলির কথার কি জবাব দেয়া যায়। তার জন্ম আর বেড়ে ওঠা কেবল সমুদ্রে রাজত্ব চালানোর জন্যই হয়েছে। সে কোনোভাবেই একজন পরাজিত ক্যাপ্টেন-এর জাহাজকে ছেড়ে দিতে পারে না।
সে অ্যাবোলির দিকে ফিরে শুদ্ধ ইংরেজিতে বলে উঠল, “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। হাল কথাটা এমনভাবে বলল যেন নাবিকেরা শুনতে পায়, সেই সাথে তার কথা থেকে সাহস নিতে পারে।” “ডেনিয়েলকে বল ক্যাপ্টেন ট্রোম্পকে উপরে নিয়ে আসতে। তাকে আমাদের এখানে প্রয়োজন হবে।”
হাল-এর কথা শুনে জাহাজের অন্য সবার চেয়ে যে বেশি খুশি হলো সে হচ্ছে, অ্যাবোলি।
*
ডেফট জাহাজটার নোঙর এখনো ফেলে রাখা হয়েছে। নেড সে টেইলর গোল্ডেন বাউকে ঘুরিয়ে পূর্বদিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে যেন ডেফট-এর বামপাশে চলে যাওয়া যায় সহজেই। এতে করে ডেফট-কে উপকূলের মাটি আর গোল্ডেন বাউ-এর মাঝখানে আটকে ফেলা যাবে। কাছে যেতে যেতে গোল্ডেন বাউ যখন ডেট থেকে দুই নটিকেল মাইল দূরত্বে চলে এলো তখন হাল দেখতে পেলো যে কিছু নাবিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ডেফট-এর ওপর অবস্থান করছে। কেউ কেউ মাস্তুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিছু নাবিক পাল ছাড়ার ব্যবস্থা করছে। হাল বুঝতে পারে ট্রাম্প গোল্ডেন বাউ আক্রমণ করতে যাওয়ার সময় কিছু কঙ্কালসার নাবিক জাহাজে রেখে গিয়েছিল। হাল বামহাতে তার চকচকে পাথর খচিত বন্দুক আর ডানহাতে তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যেটার শরীর থেকে এই কিছুক্ষণ আগেই শত্রুর রক্ত পরিষ্কার করেছে সে।
“ক্যাপ্টেন, আমাদের পতাকা দেখে তারা হয়ত সহজেই বুঝে ফেলবে। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে ওরা,” বিগ ডেনিয়েল হালকে বলল।
বাউ-এর ডেক-এর ওপর শুধু অল্প কয়েকজন নাবিক রয়েছে যারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে নিজেদের লুকিয়ে রাখার। আর বাকি সবাইকে হাল নিচে থাকার আদেশ দিয়েছে যেন তারা হাল আদেশ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত ট্রোম্প-এর বন্দিদশা নিশ্চিত করতে পারে।
ট্রোম্প নিজে ডেকের পেছন দিকে হাল-এর কাছ থেকে আট ফিট দূরে দাঁড়িয়ে আছে আর ডান হাতে হাল-এর কথা বলার সিঙাটা ধরে আছে।
সকালের ঠাণ্ডা বাতাস এখনো বইছে। যদিও ওলন্দাজটার চেহারা থেকে নদীর মতো করে বইছে ঘামের পানি। অ্যাবোলি ছুরি হাতে নিয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা তরবারিটা সে এমনভাবে ধরে আছে যে যদি ওলন্দাজটা কোনোরকম নড়াচড়া বা চালাকি করার চেষ্টা করে তবে সে খুব সহজেই খোঁজা হয়ে যাবে।
“সবকিছ যদি আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়, তাহলে শক্ররা মনে করে বসবে যে ওদের ক্যাপ্টেন আমাদের জাহাজটা জিতে নিয়েছে, বিগ ডেনিয়েল প্ল্যানটা সবাইকে বুঝিয়ে বলল। “আর সেখানেই ভুলটা করবে তারা।”
হাল-এর বাকি সব লোক অস্ত্র হাতে এখানে সেখানে লুকিয়ে আছে। প্রস্তুত হয়ে আছে যে কখন তাদের এখান থেকে বের হওয়ার ডাক আসবে। জাহাজে লাগানো বন্দুকের মুখগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তবে বন্দুকের পেছনে লোক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্দুকে গান পাউডর ভর্তি করা হয়েছে যেন আদেশ করা মাত্রই ওরা ডেট-এ গুলি চালাতে পারে।
হাল-একটা গভীর শ্বাস নেয়। পাশে রাখা আলকাতরার ট্যাংক থেকে ভেসে আসা গন্ধ তার ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে। ট্রোম্প-এর দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠে, “এবার আপনাকে যা বলতে বলেছি তা বলুন, স্যার,নয়তো যেকোনো মুহূর্তে আপনি নপুংসক হয়ে যাবেন।”
ওলন্দাজটা বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করতে লাগল। থুতনিতে থাকা দাড়িগুচ্ছকে নাড়াচাড়া করতে লাগল হাত দিয়ে। নিচের দিকে তাকিয়ে তার দুই পায়ের মাঝখানে তাক করা তরবারিটার দিকে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ, এরপর কথা বলার সিঙাটা মুখের কাছে এনে সোজা সামনের দিকে তাকাল, এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথা বলতে শুরু করল।
“ডেফট-এর লোকেরা আমার কথা মন দিয়ে শোন। আমরা অনেক বড় একটা বিজয় ছিনিয়ে এনেছি”, হাল খুব ভাল করেই জানে শান্ত পানির ওপর দিয়ে ট্রোম্প-এর কথা ভেসে গিয়ে ডেফট-এর লোকদের মনে কতটা আনন্দের জোয়ার বয়ে আনবে। “আমি তোমাদের জন্য ইংরেজদের জাহাজ গোল্ডেন বাউ জয় করে নিয়ে এসেছি। এর ভেতর যত ধন সম্পদ আর গুপ্তধন রয়েছে সব এখন তোমাদের।”
ডাচদের জাহাজ থেকে আনন্দ উল্লাসের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। ট্রোম্প বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে তার হাতের মুষ্টি আকাশের দিকে তুলে ধরল। তাকে আর কিছু বলতে হবে না। তার কাজ শেষ হয়েছে। অ্যাবোলি হাল-এর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। কৌশল কাজে লেগেছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের জাহাজটা ডেফট-এর সাথে গিয়ে ধাক্কা লাগল ততক্ষণ পর্যন্ত হাল অপেক্ষা করল।
“বের হয়ে এসো সবাই,” হাল গর্জে উঠার সাথে সাথেই জাহাজের পাটাতনগুলো খুলে দেয়া হল। সাথে সাথে অস্ত্রে সজ্জিত মুখোশ পরা সব ইংরেজ, স্কটিশ আর আইরিশ লোকেরা সমস্বরে যুদ্ধনিনাদ দিতে দিতে বের হয়ে এল। তাদের পেছনে অ্যামাডোড়া সৈন্যরাও কুঠার হাতে বের হয়ে এসে আরেকবার তাল মেলালো সবার সাথে।
নাবিকরা সবাই এসে ডেক-এ জমা হওয়ার পর হাল কথা বলার শিঙাটা আবার হাতে তুলে নিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ট্রোম্পও ওটাকে হাল-এর হাতে দিয়ে দিল। অ্যাবোলির তাক করে রাখা ছুরিটার দিকে আবারো তার নজর গেল-সেটা যেকোনো মুহূর্তে তার বংশ উৎপাদনের অঙ্গটা কেটে ফেলতে পারে।
“ডেফট-এর নাবিকেরা মন দিয়ে শোন,” ডাচদের উদ্দেশ্যে হাল চিৎকার করে উঠল। “তোমাদের ক্যাপ্টেন কোনো বিজয় অর্জন করেনি। সে আর তার লোকেরা অত্যন্ত সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকজনই বেঁচে আছে, যারা সবাই আমাদের বন্দি হিসেবে আছে। তোমরা যদি আমাকে তোমাদের জাহাজ দিয়ে দাও তাহলে আমি তোমাদের খাদ্য দিব। আর যদি না দাও তাহলে এক টুকরো রুটিও পাবে না। সেই সাথে আমি তোমাদের সাগরে নিক্ষেপ করব।”।
বাউ-এর নাবিকেরা জাহাজের কিনারায় যে অগ্নিমূর্তি ধরে দাঁড়িয়েছিল সেটার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। ডেফট-এর লোকদের ভরপেটে খাবার দেয়ার আশ্বাসই যথেষ্ট ছিল। বিনা বাক্য ব্যয়েই হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়ে দিল লোকগুলো।
.
যে লোকটি জাহাজের লণ্ঠন হাতে বন্দিশালায় প্রবেশ করল সে পায়খানার গন্ধে চোখ মুখ কুঁচকিয়ে ফেলল সাথে সাথে, এরপর মৃতদেহটি দেখতে পেয়ে ওটার ওপর আলো ফেলল। জুতার অগ্রভাগ দিয়ে দেহটাকে কয়েকবার তত দিয়ে পেছনে দাঁড়ানো লম্বা আফ্রিকান লোকটার দিকে তাকাল সে। আফ্রিকান লোকটার শক্ত, পেশিবহুল দেহ লণ্ঠনের আলোতে চকচক করছিল।
“এটা বরং কাঁকড়ার খাবার হিসেবেই থাক,” সে বলে উঠে। বাতির আলোতে পেট দেখতে পায় যে লোকটা অনেক অল্পবয়স্ক হলেও তার মধ্যে একটা নেতৃত্বের ভাব আছে। তার ঈগল পাখির ঠোঁটের মতো নাক দেখেই বোঝা যায় সে কোনো উচ্চ বংশীয় পরিবার থেকে এসেছে। দেখে মনে হয়, নিজের ওপর অগাধ আস্থা রয়েছে লোকটার ভেতর, যে ভরসার অর্ধেকটা এসেছে ওর আদেশ দেয়ার ক্ষমতার কারণে, যার ওপর মানুষের জীবন নির্ভর করে, আর বাকি অর্ধেকটা এসেছে স্বীয় আদেশ পালন হওয়ার নিশ্চয়তা সম্পর্কে সে পুরোপুরি সংশয়হীন বলে। দরজা থেকে যতদূর সম্ভব দূরে গিয়ে অবস্থান নেয় পেট। আগত লোকদুটি এখনো পেট-এর অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারেনি। এদের দুজনের আগমনই পেটকে বলে দিয়েছে যে অভিযাত্রী দল ডেফট ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাকে কি কি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে ডাচরা সফল হয়নি এবং তাদের এই ব্যর্থতার কারণে জাহাজটাও তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। এখন ওর সামনে রয়েছে সেই জয়ী ক্যাপ্টেন। যদিও লোকটার প্রতি পেটের বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে, কিন্তু তার ব্যাপারে পেট এখনো কোনো কিছু ঠিক করে নি। সে কি লোকটাকে তার একজন মক্কেল হিসেবে দেখবে? নাকি সে এমন এক লোক যাকে পেটের অন্য মক্কেলরা মৃত অবস্থায় দেখতে চায়? পেট এখনো কিছু বুঝতে পারছে না।
“কাকড়াদের অবশ্যই এটা খাওয়া উচিত গান্ডওয়েন,” আফ্রিকান লোকটা তার তরবারি দিয়ে ঘৃণাসহকারে একটা খোঁচা দিয়ে বলল। এই লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে যথেষ্ট সাহসী যোদ্ধা, একই সাথে তার ক্যাপ্টেন-এর ডান হাত। পেট এই লোকটিকেই সম্ভাব্য প্রতিবন্ধক হিসেবে মনে করতে শুরু করে দিল। ক্যাপ্টেন-কে যদি কখনো হত্যা করার প্রয়োজন হয় তবে এই লোকটিই সবার আগে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া অন্য কোনো কারণে এই লোকটির ব্যাপারে পেট-এর কোনো আগ্রহই নেই।
“এ তো খুবই দুঃখের ব্যাপার স্যার, এই লোকটি মুক্তি পাওয়ার পূর্বেই মারা গেল।” হঠাৎ করেই কথা বলে উঠল পেট।
আরও দ্রুত মারা যেত। আরও দ্রুত। সেই স্বর্গীয় কণ্ঠটি পেট-এর মাথার ভেতর এত উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠে যে পেট-এর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে সে ছাড়া অন্য কেউ এই গর্জন শুনতে পাবে না। কিন্তু সাদা লোকটি শুধু তার কণ্ঠটিই শুনতে পায়। হাতের লণ্ঠন উঁচিয়ে এদিক সেদিক খুঁজতে থাকে সে। এরপর চিৎকার করে উঠে, “কে ওখানে?”
“স্যার আমার নাম পেট। গত এক সপ্তাহ যাবত আমাকে এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছে, যতদূর আমি মনে করতে পারি আরকি। অবশেষে আমার প্রার্থনা সফল হয়েছে। এই একটু আগে যখন আমি আবারো একজন ইংরেজ লোকের কণ্ঠ শুনতে পেলাম, আমি আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, স্যার।” সে তার শেকল লাগানো পা-সহ সামনে আগানোর চেষ্টা করে বলতে থাকে, “আপনারা কী সেই জাহাজের যেটাকে ঐ মাথা মোটা ক্যাপ্টেন ট্রাম্প ধরতে চেয়েছিল?”
“আমি স্যার হেনরি কার্টনি,” গোল্ডেন বাউ-এর ক্যাপ্টেন। যুবক লোকটি বলে উঠে, “তুমি জেনে খুশি হবে যে তোমার বন্দিদশা শেষ হয়েছে।”
কার্টনি মত দেহটির দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করে, “এই লোকটি কীভাবে মারা গেছে?”
“তুমি যখন তাকে শ্বাসরোধ করতে গিয়ে অনেক সময় নিচ্ছিলে, ঠিক তখনই সে মারা গিয়েছিল-তোমার উপর বিরক্ত হয়ে।” স্বর্গীয় কণ্ঠটি বলে উঠল।
“ক্ষুধা?” পেট একটা কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে জবাব দেয়। আমি কোনো কবিরাজ নই ক্যাপ্টেন। আমি যদিও এই গরিব লোকটিকে ভালভাবে চিনি না কিন্তু আপনি এখন যা দেখছেন সেটা হয়তো আমি আটকাতে পারতাম। এই জাহাজটা আসলে ক্ষুধার্ত নাবিকদের জাহাজ। তারা আমার প্রতি কোনোরকম মানবিকতা দেখায় নি। আরেকটি মুখ বাড়বে ভেবে তারা আমাকে এই অন্ধকার, পাতালপুরীতে নিক্ষেপ করে। কিন্তু এই লোকটিই আমার একমাত্র সঙ্গী ছিল। এই লোকটিকে আমি আমার নিজের হাতে সমাধিস্থ করতে চাই, “ক্যাপ্টেন, যদি আপনার অনুমতি থাকে তো। অন্য কেউ এই লোকটির দুর্দশা দেখার আগেই ওটা করতে চাই আমি।”
“আমার কোনো আপত্তি নেই,” হেনরি কার্টনি বলে উঠে। এরপর কালো আফ্রিকান লোকটির দিকে ফিরে বলে, “ক্যাপ্টেন ট্রোম্পকে জিজ্ঞেস কর যে সে মি. পেট-এর শেকলের চাবিটা কোথায় রেখেছে। যদি খুঁজে না পাওয়া যায় তবে মিস্ত্রী আনিয়ে খোলার ব্যবস্থা কর।”
“ঠিক আছে, গান্ডওয়েন”, কালো লোকটি বলল। এরপর সে সিঁড়ি দিয়ে উপরে হারিয়ে গেল।
“আপনার অনেক দয়া, ক্যাপ্টেন”, পেট-এর মাথায় এতক্ষণ ধরে যে সমস্যাটা ঘুরছিল সেটার সহজ সমাধান পেয়ে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে চায় না মৃত লোকটির গলায় চোখে মুখে তার খুনের চিহ্ন কেউ দেখতে পাক।
“কিন্তু তুমি ক্যাপ্টেন ট্রোম্প-এর বন্দিশালায় কী করছো?” ক্যাপ্টেন কার্টনি জিজ্ঞেস করল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পেট। তবে যতটা নাটকীয় ভাব দেখাতে চেয়েছিল ততটা পারল না। “সে এক লম্বা দুঃখের কাহিনী ক্যাপ্টেন। সে কাহিনী বলার আগে আমার শূন্য পেটে কিছু খাবার পড়লে হয়তো আমার কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরুবে।”
“অবশ্যই!” কার্টনি মাথা নেড়ে বলল। “আজকে রাতের ডিনারে তোমাকে আমন্ত্রণ জানালাম আমি। কিন্তু এখন আমাকে জাহাজের বাকি অংশটুকু পরিদর্শন করে দেখতে হবে। ভয় পেয়ো না। আমার লোক এসে যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে মুক্ত করবে।”
“অবশ্যই, ক্যাপ্টেন”, পেট বলল। সে তার নিজের ভাগ্যকে সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিল না। সৃষ্টিকর্তা সত্যিই বেশ রহস্যময়ভাবে কাজ করে। ক্যাপ্টেন চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ সে একা একা অন্ধকারে পড়ে রইল। যদিও সে পুরোপুরি একা নয়। সেই স্বর্গীয় কণ্ঠ আর সকল ফেরেশতারা তার সঙ্গে আছে। তাদের উপস্থিতিতে উইলিয়াম পেট-এর কাছে নিজেকে সত্যিই বেশ আশির্বাদ পুষ্ট বলে মনে হতে লাগল।
.
যখন ট্রোম্প বলেছিল যে তার কাছে সোনা বা মসলা জাতীয় কিছুই নেই তখনই হাল ধারণা করে নিয়েছিল যে ডেফট-এ মূল্যবান কিছু পাওয়া যাবে না। প্রথম দেখাতেই হাল-এর ধারণা পরিষ্কার হয়ে যায়। জাহাজের প্রতিটা খোল প্রায় শূন্যই বলা যায় যেগুলো এতদিন পর্যন্ত বড় বড় অফিসারদের কোয়ার্টার হিসেবে কিংবা অসুস্থ লোকদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হতো। জাহাজের একেবারে শেষদিকে বাঁকানো অংশে বারটা ব্যারেল রশি দিয়ে এমনভাবে আটকানো আছে যেন সাগরের ঢেউয়ের তালে এগুলো পড়ে না যেতে পারে। অ্যাবোলি তার তরবারির অগ্রভাগ দিয়ে ব্যারেলগুলোর ভেতরে খোঁচা দিয়ে বুঝতে পারে এগুলোতে মিষ্টি জাতীয় পদার্থ আছে। হাল যখন ব্যারেলগুলো ধরতে পারল তখন সেগুলোর ভেতর হাত ঢুকিয়ে ঘোট ঘোট কতকগুলো বক্স বের করে আনল সে। সেগুলোর মাঝে একটা খোলার পর ওটার ভেতর একটা ছোট কাঁচের বোতল দেখতে পায় হাল যেটা লম্বায় তার বুড়া আঙুলের চেয়ে বড় হবে না।
“আমি ভাবতে পারি নি যে ক্যাপ্টেন ট্রোম্প-এর ওয়াইন রাখার সেলার এরকম হতে পারে।” কথাটা মজা করেই বলল হাল। এরপর ছোট্ট কাঁচের বোতলটা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে লণ্ঠনের সামনে ধরে দেখতে থাকল।
“আমি ইন্ডিয়ান হিন্দু নাবিকদের মুখে অমৃত-এর কথা শুনেছি। যেটা খেলে নাকি অমরত্ব লাভ করা যায়।” অ্যাবোলি হাল-এর দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে বলে।
হাল হেসে ফেলে। ট্রাম্প যদি ওরকম কোনো মহৌষধ পেত তবে সে এই পর্তুগীজ জাহাজটাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আমাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত।
“এটা টক স্বাদের কিছু হবে,” ছোট্ট বোতলে রাখা জিনিসটার গন্ধ শুঁকে বলে উঠল হাল।
“একজন মানুষ অমরণশীল কি-না সেটা পরীক্ষা করার খুব ভাল একটা উপায় জানা আছে আমার।” অ্যাবোলি তার তরবারিটা নাড়িয়ে বলে উঠল। কিন্তু হাল-এর হাসার মতো মনমানসিকতা ছিল না। বরং সে মনে মনে আশা করতে লাগল যে ট্রাম্প-এর নিশ্চয়ই এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কার্গো রয়েছে। সত্যি বলতে আসলেই তার জাহাজে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলনা। কিন্তু এই ছোট্ট বোতলগুলোর নিশ্চয়ই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে, নাহলে এগুলো বাক্সে বন্দি করে রাখা হয়েছে কেন? ছোট্ট শিশিতে এমন কোনো সুগন্ধী রাখা নেই যেটা মহিলারা অনেক চড়া দামে কিনবে। কিংবা এটাতে যদি মূল্যবান কোনো ওষুধ থাকত তবে এটার গায়ে তা লেভেলিং করা থাকত। হাল-এর ভয় হতে লাগল যে, সে হয়ত না জেনেই কোনো বিষের গন্ধ নিয়ে ফেলেছে, হয়তো একটু পর নিজেই বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল যে সে এখনো সুস্থ আছে। অ্যাবোলি পরবর্তী বোতলটার ছিপি খুলে ফেলার পর প্রহেলিকা কেবল আর গাঢ় হলো। বোতলটার ভেতর বুড়ো আঙুলের সমান লম্বা তিনটা কাঠের টুকরা দেখতে পায় তারা। যদিও প্রতিটা টুকরা দেখতে কাঠের গুঁড়ির মতো কিন্তু এগুলোকে শিপওয়ার্ম-এর মতো মনে হচ্ছিল না।
“তোমার কী কোনো ধারণা আছে যে এগুলো কী?” অ্যাবোলি হালকে জিজ্ঞেস করল। হাল বুঝতেই পারছিল না যে এগুলো কী হতে পারে। অ্যাবোলিও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে তারও কোনো ধারণা নেই এগুলোর ব্যাপারে।
“আমার মনে হয় শুধু একজনই পারে এই সমস্যার সমাধান দিতে,” হাল বলে উঠল। “যাও গিয়ে ট্রোম্পকে ধরে আন। সে নিজের মুখে এগুলোর ব্যাখ্যা দিবে।”
কিছুক্ষণ পরই অ্যাবোলি ডেফট-এর পূর্বের মালিককে ধরে নিয়ে আসে। হাল একটা কাঠের টুকরো উঁচিয়ে ধরে বলে, “এগুলো কী?”
ট্রোম্প চোখে মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, “এগুলো হচ্ছে সত্যিকার ক্রস-এর টুকরো।”
ক্রিশ্চিয়ান ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে এরকম কিছু অভিজ্ঞতা আছে হাল-এর। তাই প্রথম কয়েক সেকেন্ড তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে সেই সত্যিকার ক্রসের টুকরো হাতে ধরে আছে সে যেটার ওপর যিশু খ্রিস্ট মৃত্যুবরণ করেছিলেন। “কিন্তু যদি তাই হয় তবে ট্রোম্প কেন হাসছে। তার কী নিজের ভাগ্যের প্রতি এতটুকু বিশ্বাস নেই। সে কিভাবে যিশুখ্রিস্টের মৃত্যু নিয়ে মজা করতে পারে?”
খানিকক্ষণ চুপ করে পর্যবেক্ষণ করে হাল। এরপর কাঠের টুকরোগুলোকে আবার আগের জায়গায় রেখে দেয় সে। তারপর সর্ব প্রথমে যে সবুজ রঙের কাঁচের বোতলটা পেয়েছিল তারা, সেটা তুলে ধরে।
“আহ!” ট্রোম্প আক্ষেপের সুরে মাথা নাড়ায়। “সবচেয়ে পুরনো গুপ্তধনটাই খুঁজে পেয়ে গেছেন আপনি। এই পুরনো বোতলটাতে ভার্জিন মেরীর বুকের দুধ রয়েছে। এরকম আরেকটা বোতল রয়েছে যেটাতে ভার্জিন মেরীর চোখের অশ্রু পাবেন, যে অশ্রু তার চোখ থেকে ঝরেছিল ছেলেকে পাওয়ার খুশিতে।”
অবশেষে কথা বলে উঠল হাল। বেশ রেগে আছে ও। “গড।” “তুমি আমাদের যিশু খ্রিস্টের নাম মুখে আনবে না। মাতা মেরীর নামও না। তোমার মুখে এসব কথা মানায় না। তুমি ঈশ্বরনিন্দা করবে আর আমি সেটা চুপচাপ শুনব, তা হবে না।”
ওলন্দাজটা বেশ দৃঢ়ভাবে হাত উপরে তুলে হালকে থামিয়ে দিল। “ক্যাপ্টেন কার্টনি।” “আমার তো মনে হয় না আপনি সহজে বোকা হওয়ার মতো লোক। আপনাকে তো বেশ বুদ্ধিমান লোকই বলা যায়। অথচ আপনি এই সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। আমি এই মূল্যবান জিনিসগুলো চড়া দামে বিক্রির উদ্দেশ্যেই রেখে দিয়েছিলাম।”
“আর বাকি যেগুলো রয়েছে সেগুলোতে কী আছে?” হাল বাকি ব্যারেলগুলো দিকে ইঙ্গিত করে বলে।
ট্রোম্প একজন দক্ষ ব্যবসায়ীর মতো হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার কাছে খ্রিস্টের দাঁত, চুল এবং রক্ত আছে। আমার কাছে সেই কাপড়ের টুকরা আছে যে কাপড় দিয়ে ছোট বেলায় যিশু খ্রিস্টকে মোড়ানো হয়েছিল। এরপর সে ঠোঁট কামড়ে মনে করার চেষ্টা করে যে তার কাছে আর কী কী আছে।” “আমার কাছে সেই স্বর্গীয় দূত-এর কাটা আঙুল রয়েছে। এমনকি আমার কাছে তার ফোরস্কিনও পাবেন, যেটা তার খানা করার সময় কাটা হয়েছিল। সে একটা হাত ব্যারেলগুলোর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এখন আমার জাহাজ যেহেতু আপনার তাই এই জিনিসগুলোও আপনার।”
হাল ঠোঁট বকিয়ে এক ধরনের মুখভঙ্গি করল, যা দেখে পুনরায় হাত উঠাল ট্রাম্প।
“আমি স্বীকার করি যে এই কার্গোটা খুবই অস্বাভাবিক আর ক্ষমার অযোগ্য” ট্রোম্প আবার বলতে থাকে। কিন্তু আমি যে অবস্থায় ছিলাম সেখানে থাকলে ধর্মীয় নৈতিকতা এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে যায়।”
“এমনিতেও তোমাকে দেখতে খুব একটা নৈতিকতাসম্পন্ন লোক বলে মনে হয় না”, হাল দ্রুত বলে উঠল।
“আপনার সাথে কথায় পারবো না।” ট্রোম্প একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দিয়ে বলে উঠল।
“ড্যাম, এই ওলন্দাজটাকে বেশিক্ষণ অপছন্দ করে থাকা যাচ্ছে না।” মনে মনে ভাবল হাল।
“এপাশের দুনিয়ার সম্পর্কে আপনারা ইংরেজরা সব সময় একটা কথা বলেন, ট্রাম্প বলল। কিভাবে যেন বলেন? ওহ? হ্যাঁ…অল ইজ ফেয়ার বিয়ন্ড দ্য লাইন। ঠিক না?”
হাল অ্যাবোলির দিকে তাকাল। তারা দুজনেই এই কথাটা প্রায়ই তার বাবার মুখে শুনত-যখন ছদ্মবেশে কিংবা কৌশল খাঁটিয়ে কোনো ডাচ্ জাহাজ ধরার চেষ্টা করা হত, তখন। আর ঠিক তখনি, তার মাথায় একটা ব্যাপার কাজ করল। আজ ট্রোম্প যেভাবে তার ডেটকে গোল্ডেন বাউ-এর পেছনে লাগিয়ে ছিল, হাল-এর বাবাও মাঝে মাঝে তার জাহাজ নিয়ে একই কাজই করতেন।
“হ্যাঁ, এরকমই বলি আমরা”, বাদে আর কিছুই বলতে পারল না হাল। এরপর সে জিজ্ঞেস করল, “কে এসব তুচ্ছ জিনিস কিনবে?”
ট্রোম্প চিন্তা করল কিভাবে এর সর্বোত্তম উত্তর দেয়া যায়। আমার মনে হয় ক্যাপ্টেন, আপনি প্রোটেস্টট্যান্ট বাদে বিশ্বাসী।”
“তোমার ধারণা সঠিক।”
“যাক আমি তাহলে ঠিক ধরেছি। আপনি জানেন যে, আমরা ওলন্দাজরা ব্যবসায়ী। আমরা লাভের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঘুরে বেড়াই। আর সেই লাভ আমরা ইস্ট ইন্ডিয়ায় খুঁজে পেয়েছি। মশলার ওপর ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা করছে সেখানে।”
“ব্যতিক্রম ঘটে তখন, যখন ইংরেজরা কিছু মশলা নিজেদের সাথে করে নিয়ে যায়”, হাল বলে উঠে। সেই সাথে তার বাবার আটক করা কার্গোগুলোর কথা ভাবতে থাকে।
“ডাকাতি করছে বললে কি আরো ভাল হয় না, ক্যাপ্টেন কার্টনি?” ট্রোম্প আরেকটা হাসি দিয়ে বলে। “আপনি লক্ষ করবেন অনেক আগে থেকেই আমাদের দুই জাতির মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি চলছে। তাই ডাদের মশলা নিয়ে যাওয়াটা ডাকাতির সমপর্যায়ের অপরাধ।”
এই লোকটা তো বেশ ধূর্ত, হাল মনে-মনে চিন্তা করল। তারপর বলল, “এসবের সাথে তোমার এসব নকল ধ্বংসাবশেষ-এর কী সম্পর্ক রয়েছে?”
“সহজ হিসাব। আমরা ওলন্দাজরা ধর্মপ্রচারক নই। দেখুন স্পেনিস ও পর্তুগীজ যারা দীর্ঘদিন ইস্ট ইন্ডিজ-এ আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তারা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মতোই ক্যাথলিক বিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। জিউসরা ফিলিপাইন, চীনা এবং জাপানের দ্বীপগুলোতেও তাদের হাত প্রসারিত করছে যেখানে তাদের শাসকেরা নিজেদেরকে আড়াল করে রাখছে বিশ্ব থেকে। তারা যেখানেই যাচ্ছে সাথে করে ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ নিয়ে যাচ্ছে, অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ওগুলোকে। এসব অস্ত্র নতুন বিশ্বাসীদের মনকে প্রভাবিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।”
“ধর্মীয় ধ্বংসাবশেষ যদি সত্যিকারের ধ্বংসাবশেষ হয় তবে তার অন্যরকম শক্তি থাকার কথা। আমি নিজে টেবারন্যাকল দেখেছি এবং নিজ চোখে এর তাৎপর্য অনুধাবন করেছি।” এখন বলন, “একজন মানুষ যে নিজেকে ধর্মযাজক বলে সে কী ধর্মীয় নিদর্শনের নামে মিথ্যে জিনিস ফেরি করে বেড়াতে পারে?”
ট্রোম্প কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে আবার বলা শুরু করল, “কথা হচ্ছে, যদি মিথ্যা জিনিসগুলো অবিশ্বাসীদের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে তবে ঈশ্বর নিশ্চয় রাগ করবেন না, করবেন? তবে সেটা আমার চিন্তার বিষয় নয়। আমার কাছে চিন্তার বিষয় হচ্ছে টাকা। আমি আমার কাছে থাকা সর্বশেষ পেনিটা দিয়েও বাতাভিয়ার এক কারিগরের কাছ থেকে এসব তৈরি করেছি যেগুলো আপনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। আমি আর আমার নাবিকেরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় আছি কারণ আমাদের হাতে আর অবশিষ্ট কিছুই নেই। তবে আমরা মনে করি আমাদের ক্ষুধার চেয়ে এগুলো বেশি মূল্যবান।”
চোখ তুলে তাকাল ট্রোম্প, ওর চোখগুলো বাজারের ব্যবসায়ীদের মতো চকচক করে উঠল। “একবার ভেবে দেখুন। ভেবে দেখুন, আফ্রিকার বাজারে এগুলোর কত চাহিদা রয়েছে। পর্তুগীজরা এখন মোজাম্বিক এবং সোফালার দায়িত্ব নিয়েছে। তারা উপকূলবর্তী এলাকায় আর বড় বড় নদীতে ব্যবসা চালাচ্ছে, আর যেখানেই ব্যবসা চার্চ সেখান থেকে বেশি দূরে নয়। জিউসরা তাদের প্রতি খুবই খুশি হয় যারা তাদের এসব যোগান দেয়। এসব বস্তু তাদের ধর্মপ্রচারের কাজে খুবই সহযোগিতা করে। ক্যাপ্টেন কার্টনি, আমি বলছি এগুলো ভাগ্য বদলে দিবে। এই কার্গো যে কোনো সোনাদানা পূর্ণ কার্গোর চেয়েও মূল্যবান।”
“এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।” হাল বিরক্তি সহকারে তার হাতের বোতলটা নিচে ছুরে মারে, এরপর পায়ের বুট দিয়ে সেটাকে আঘাত করে।
ট্রোম্প হাত দিয়ে এমনভাবে তুড়ি বাজায় যেন সে ব্যারেলগুলো অদৃশ্য করে দিবে। “আপনি একদম সঠিক বলেছেন। এগুলো অসৎ ব্যবসা। এসব মিথ্যে জিনিস বিক্রি করা আমাদের অনুচিত।” ব্যাপারটাকে ট্রোম্প এক মুহূর্তেই উড়িয়ে দেয়, ঠিক যেভাবে হাল ছোট্ট বোতলটাকে পিষে ফেলে, সেভাবে। কিন্তু ব্যাপারটাকে আপনি অন্যভাবে ভেবে দেখতে পারেন। আমি আমার ধারণা আপনাকে বলব।”
কিন্তু হাল ট্রোম্প-এর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে তার একজন নাবিককে ডাক দেয়, “মি লোভেল।” “ক্যাপ্টেন ট্রাম্পকে তার লোকজনের কাছে নিয়ে যাও। আর খেয়াল রেখো ওরা সবাই যেন খাবার পায়, আমরা অন্তত সম্মানের সাথে ব্যবহার করতে জানি।”
“আসুন, ক্যাপ্টেন, লেভেল ক্যাপ্টেন ট্রোম্পকে সাথে নিয়ে চলে যায়। হাল আর অ্যাবোলি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে।
আফ্রিকানটি নিজের রাগকে ছাপিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তার স্বরে বলে, “তাহলে তোমাদের লোকেরা আফ্রিকায় দাস কিনতে আসে না বরং মিথ্যে ধবংসাবশেষ দিয়ে লোকজনকে বোকা বানাতে আসে। মিথ্যে হাড়, পুরনো সুতা আর গরুর দুধ দিয়ে, তাই না?”
“তারা আমার লোক নয়। তারা দাস ব্যবসায়ী, প্রতারক”, লজ্জিত হওয়ার ভাবটা নিজের পেটের মধ্যে আটকে রেখে কথাটা বলে হাল। এরপর সে সামনে এগিয়ে গিয়ে আফ্রিকান লোকটির কাঁধে হাত রেখে বলে, “আমার নাবিকেরা আমার লোক। আর অ্যাবোলি আমার ভাই, তাই না?” অ্যাবোলি হাল-এর দিকে এক পলক তাকায়। অন্ধকারে তার মুখোশ যদিও ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল, কিন্তু বেশিক্ষণ সে নিজের অনুভূতি চাপিয়ে রাখতে পারল না। হাসিতে ফেটে পড়ল।
“শয়তান, অ্যাবোলি”, হাল বলে। “আমি তো ভেবেছিলাম তোমার সাথে মারামারি করতে হবে এখন-আগে যেমন করতাম আরকি। অবশ্য, তোমাকে এখন বুড়ি মহিলাই বলা যায়।”
অ্যাবোলি হাল-এর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখল। হালকে বললো, “গ্যান্ডওয়েন, তুমি আমাদের ক্যাপ্টেন, এর বেশি কিছু আমি পছন্দ করি না।” সে আরও বলল, “ভাবছি, তোমার লোকেরা যখন দেখবে যে তাদের ক্যাপ্টেন ছোট্ট মেয়ের মতো মুখ ঘুরিয়ে কাঁদছে, তখন তারা ব্যাপারটা কিভাবে নেবে?”
অ্যাবোলির কথা শুনে হাসতে শুরু করে দিল হাল। এরপর তারা দুজন একসাথে ডেফট-এর বাকি অংশটুকু দেখার জন্য পা বাড়াল।
*
উইলিয়াম পেট হাতে এক পেগ ক্যানারি ওয়াইন নিল, এরপর বিস্ময়াবিভূত হয়ে কেবিন-এর চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ৰৈ এটার সাজসজ্জা, কাঠের আসবাবপত্র, ম্যাপ, টেবিল, ক্যাপ্টেন এর কোট, যেটা এখন হুক থেকে খুলে দেয়ালের পাশে রেখে দেয়া হয়েছে।
পেট বলল, “আপনার জাহাজটা অনেক সুন্দর ক্যাপ্টেন কার্টনি। যেটা তৈরি করতে আর মানসম্মতভাবে সাজাতে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়েছে।” পেট আরও বলতে থাকে, “অনধিকার চর্চা করছি মনে হলে ক্ষমা করবেন, কিন্তু আমার কৌতূহল হচ্ছে যে আপনি এত অল্প বয়সে এরকম একটা জাহাজের মালিক কীভাবে হলেন? উত্তরাধিকার সূত্রে নাকি অন্য কোনো উপায়ে?”
‘না, মি পেট”, হাল উত্তর দেয়। “আমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ অন্য কোথাও আছে। একজন প্রতারক-এর কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলাম এই গোল্ডেন বাউ জাহাজটা। সে এটাকে কোথাও থেকে চুরি করে এনেছিল।”
“আমার তো মনে হয় না, এরকম কাজ আপনার চরিত্রের সাথে যায়”, পেট বলল। “একারণেই এটার পেছনের গল্পের ব্যাপারে আমার আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।”
“আমি কোনো গল্পকার নই”, বেশ ভদ্র কিন্তু গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠল হাল। “আমি কাজ করি আর অন্য লোকেরা সেটা নিয়ে গল্প বানায়।”
পেট-এর আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। এই যুবক ক্যাপ্টেন-এর জীবনে অন্তত একজন শত্রু আছে। আর যখন কারো নতুন শত্রু গজায়, পেট তখন একজন নতুন মক্কেল পায়। সে হাল-এর দিকে তাকিয়ে এক অমায়িক হাসি দিয়ে বলে, “ওহ, আপনি একজন ন্যায় বিচারক স্যার। আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে আপনার মতো মানুষের শ্বাসরুদ্ধকর আর রোমাঞ্চকর অভিযান সবসময়ই শ্রোতাদের মনে আগ্রহ জাগায়। আমাকে অন্তত বলুন যে কে সেই বদমাশ যার কাছ থেকে আপনি গোল্ডেন বাউ কেড়ে নিয়েছেন? আর সে-ই বা কার কাছ থেকে এটা চুরি করেছিল?”
হাল বিরক্তিসহকারে পেট-এর দিকে তাকায়। কিন্তু তখনই পেট-এর। কথায় সারা দিয়ে আলোচনায় যোগ দেয় জুডিথ। “মাই ডিয়ার, আমি তোমার গল্পের শেষটুকু খুব ভালভাবেই জানি। কিন্তু তুমি কখনো আমাকে এটার শুরুটা বলনি। আমিও সেটা শুনতে চাই। তুমি কী আমাকে গল্পটা বলবে না?”
“এরকম সুন্দর একজন মানুষের সুন্দর অনুরোধ কীভাবে প্রত্যাখ্যান করবেন আপনি?” পেট বলে উঠে।
“বলুন স্যার”, বিগ ডেনিয়েলও যোগ দেয়। “মি. পেটকে বুজার্ড সম্পর্কে বলুন। তাকে বলুন যে আমরা কিভাবে বুজার্ডকে পরাস্ত করেছিলাম।”
হাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, এরপর আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলা শুরু করল, “আচ্ছা ঠিক আছে বলব। তার আগে আমাকে একটু ক্যানারির বোতলটা দিন তো মি পেট, গল্প শুরু করার আগে গলাটা একটু ভিজিয়ে নেয়া প্রয়োজন।”
এরপর পুরো একগ্লাস ওয়াইন গলায় ঢেলে দিল হাল। “পুরো ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল শেষ রাতের দিকে, ঠিক ভোরের সূর্য উঠার পূর্বে। ঐ সময় হঠাৎ করেই আমি আমার নাকের মাধ্যমে জাহাজটার সন্ধান পাই।”
“আপনার নাকের মাধ্যমে স্যার?” পেট বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলে উঠে, “তখন কী এতটাই অন্ধকার ছিল যে জাহাজটা আপনার নাকে এসে ধাক্কা দেয়ার আগ পর্যন্ত আপনি জানতেনই না যে সেখানে একটা জাহাজ ছিল?”
হাল উচ্চস্বরে হেসে উঠে, “না স্যার, জাহাজটা আমার নাকে এসে ধাক্কা লাগায় নি। আসলে ওটার ভেতর থাকা মসলার তীব্র গন্ধ আমার নাকে এসে লেগেছিল। আমি তখন লেডি এডউইনার মাস্তুলের ওপর ছিলাম। লেডি এডউইনার নামকরণ করা হয়েছিল আমার মৃত মায়ের নামে। আমার বাবা স্যার ফ্রান্সিস-এর মালিকানাধীন থাকার পূর্বে এটা ওলন্দাজদের জাহাজ ছিল। স্যার ফ্রান্সিস কার্টনি এটাকে দখল করে নিজের কাজে ব্যবহার করেন।”
“গন্ধটা পাওয়ার পর আমি দ্রুত মাস্তুলের নিচে নেমে এসে বাবাকে ঘটনাটা জানাই। আমরা দুই মাস যাবত সমুদ্রে ছিলাম শুধু এই সময়টারই অপেক্ষায়।
আমার বাবার কাছে শত্রুর জাহাজ আক্রমণ করার একটা অনুমতিপত্র ছিল যেটায় কিং চার্লস-এর পক্ষ থেকে লর্ড চ্যান্সেলর-এর স্বাক্ষর করা ছিল। সেটাতে বলা ছিল যে তিনি যেকোনো ওলন্দাজ জাহাজ আক্রমণ করার অধিকার রাখেন। ব্যাপারটা হচ্ছে, মি. পেট, ঐ সময় ইংল্যান্ড আর হল্যান্ড যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।”
হাল আর এক পেগ ওয়াইন খাওয়ার জন্য থামে। এ সময় কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে। সেও চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে সেও গল্প বলায় খারাপ না।
“সেখানে আমাদের একা থাকাটা বিপজ্জনক ছিল। জায়গাটা ছিল ইন্ডিয়ান সাগরের দক্ষিণ দিকে। ক্যাপ্টেন কোকরান-যে কি-না বুজার্ড নামে পরিচিত ছিল-সমুদ্র অভিযানে আমার বাবার সাথে একসাথে কাজ করার ওয়াদা করেছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের অপেক্ষায় সে অস্থির হয়ে গিয়েছিল, আর তাই, একদিন আগেই, সে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল-ভেবেছিল আশেপাশে জাহাজ পেলে লুটপাট করে নেবে।”
“আপনি ‘গাল অব মেরে’-এর গন্ধ নিয়ে তাকে তাড়া করতে পারতেন।” বিগ ডেনিয়েল মন্তব্য করল। “বুজার্ড যে নোংরা দাসগুলোকে জাহাজে রাখত, এদের শরীরের দুর্গন্ধ হাজার ধুলেও যাবে না।”
“গন্ধ দাসদের শরীর থেকে আসে না”, অ্যাবোলি বলল। তার হাতে থাকা ছুরিটা সে শক্ত করে ধরে আছে এখন। “দুর্গন্ধটা আসে মানুষেরই আত্মা থেকে। যেটা ওদেরকে দাস বানিয়ে রাখে।”
“আরে শোন তো”, হাল দ্রুত বলে উঠে। “যে জাহাজটাকে আমরা প্রায় আক্রমণ করতে যাচ্ছিলাম সেটার নাম ‘স্ট্যান্ডস্টিগেইড, যেটার অর্থ হচ্ছে রিজলিউশন।” লেডি এডউইনার চেয়েও অনেক বড় জাহাজ ছিল ওটা, আর লোকসংখ্যাও ছিল বেশি। বাউ আক্রমণ-এর ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন ট্রাম্প-এর যেমন কোনো আশা ছিল না, আমাদেরও তখন এর চেয়ে বেশি সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমার বাবার কাছে ডাচদের পতাকা ছিল যেটাকে উনি তখন জাহাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন যাতে করে ডাচরা আমাদের জাহাজটাকে বন্ধু জাহাজ মনে করে। আর একারণেই আমরা নির্ভয়ে ওদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে আমার পিতা স্যার ফ্রান্সিস নিজের স্বল্প বাহিনী আর আপন বীরত্বের বলে ওদের জাহাজ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।”
“আপনি যুদ্ধক্ষেত্রের সমস্ত কাহিনী বললেন না, গান্ডওয়েন”, অ্যাবোলি বলে। ‘
“যেটুকু বলা প্রয়োজন আমি সবই বলেছি”, হাল উত্তর দেয়।
“আমি কি জানতে পারি কী কী বাদ দেয়া হয়েছে, পেট জিজ্ঞেস করে।
“স্যাম বাউলস নামে এক কাপুরুষের দ্বারা আমরা প্রতারিত হয়েছিলাম।” অ্যাবোলি বলতে শুরু করে। সে লেডি এডউইনাকে সাগরে ভাসিয়ে দেয়। আমরা যারা ডাচ্ জাহাজের উপরে ছিলাম তারা সেখানেই আটকা পড়ি। কিন্তু তখন আমাদের ক্যাপ্টেন-এর পুত্র তার বাবার মতোই সাহসের পরিচয় দেয়। সে লেডি এডউইনাকে পুনরায় ডাচ্ জাহাজের কাছাকাছি ফিরিয়ে নিয়ে আসে।”
“আমরা যারা সাগরে পানসিতে করে ভাসছিলাম তাদেরকেও উঠিয়ে নিয়ে এসেছিল, এটা বলতে ভুলনা অ্যাবোলি।” বিগ ডেনিয়েল বলে।
“বিজয়ের গৌরব-এর পুরোটাই আমার বাবার, আমার নয়”, হাল বলে। যদিও সে বেশ বুঝতে পারছিল যে তার বীরত্বের কাহিনী শুনে জুডিথ যথেষ্ট মুগ্ধ হয়েছে।
“এই যুদ্ধের কাহিনী কবেকার ঘটনা, এটা বলেননি আপনি,” পেট বলে। “কতদিন আগের ঘটনা এটা।”
“১৬৬৭ সালের সেপ্টম্বর মাসের চার তারিখের ঘটনা এটা।” হাল উত্তর দেয়। “দিনটির কথা আমার মনে আছে কারণ, ঐদিনই আমি প্রথমবারের মতো জাহাজের লগ-এ প্রবেশ করেছিলাম।”
“তার মানে তিন বছর আগের ঘটনা?” পেট একটু চিন্তা করে বলল। “তখন আপনার বয়স কত ছিল?”
“সতেরো বছর, মি পেট।”
“ওই বয়সেই এরকম সাহসিকতা যে দেখাতে পারে, তাকে বেশ প্রশংসার দাবিদারই বলতে হবে। কিন্তু স্যার এরপর সেই বুজার্ভ ভদ্রলোকের কী হয়েছিল, বলবেন কী?”
“সে কোনো ভদ্রলোক ছিল না, আমি আপনাকে অন্তত এইটুকু বলতে পারি। কিন্তু তার গুপ্তধন সংগ্রহের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল বলতে হবে। তার সংগ্রহে তিন’শ টন বিরল প্রজাতির শক্ত কাঠ ছিল। টিক, বালু এবং অন্যান্য অনেক কাঠ যেগুলো খ্রিস্টান রাজত্বের বনগুলোতে কখনো খুঁজেই পাওয়া যায় না। ওগুলো এতই মূল্যবান ছিল যে আমরা ঐ কার্গোকে অন্য কোনো কার্গোর সাথে তুলনাই করতে পারব না। এছাড়াও জাহাজটাতে বিয়াল্লিশ টন নানা প্রজাতির মশলা ছিল-যেমন, ককিনিয়াল-এর ব্যারেল, পিপার, ভ্যানিলা, স্যাফ্রন, ক্লোভস, কার্ডামম। এগুলো এদের সম ওজনের রুপার চেয়েও বেশি মূল্যবান ছিল। সেখানে রুপাও ছিল দশ হাজার পাউন্ড ওজনের আর তিন’শ খাঁটি সোনার বার ছিল। মি. পেট আপনি আপনার মুখ বন্ধ করে এখানে বসুন। কথা শেষ হয়নি-সেখানে আরও অনেক কিছুই ছিল।”
“আরও?” পেট হাল-এর দেয়া আরও এক পেগ ড্রিংক দ্রুত শেষ করে বলল, “এটা কী করে সম্ভব?”
“খুব সহজ”, ওলন্দাজদের জাহাজে একজন যাত্রী ছিল। তার নাম ছিল পেট্রাস ভ্যান ডি ভেলডি। সে কেপ অব গুড হোপ-এর ডাচ্ কলনীর পরবর্তী গভর্নর হতে যাচ্ছে। আমার পিতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে তার মুক্তিপণ হিসেবে দুইশ হাজার গিল্ডার সোনা অথবা চল্লিশ হাজার পাউন্ড স্টালিং চেয়েছিলেন।”
“ক্ষমা প্রার্থনা করছি ক্যাপ্টেন, কিন্তু আমার মনে হয় আপনি সবচেয়ে মূল্যবান গুপ্তধন-এর কথা বলতে ভুলে গিয়েছেন। বিগ ডেনিয়েল খানিকটা আড়চোখে হাল-এর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল।
“আমার মনে হয় রিজলিউশন-এ যা যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সবকিছুর কথাই আমি বলেছি।” হাল বেশ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিল। যদিও সে বুঝতে পেরেছে যে বিগ ডেনিয়েল কিসের কথা বলতে চাচ্ছে। কিন্তু ঐ ব্যাপারে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না। ডেনিয়েল বুঝতে পারে যে, সে এবার একটা অদৃশ্য সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলেছে। আর কোনো কথা না বলে চুপ হয়ে গেল সে। হাল আবারও তার গল্প চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু নারী জাতির কৌতূহলের কারণে পুনরায় তাতে বাধা পড়ে।
“আপনার গল্পে বাধা দেয়ার জন্য দুঃখিত,” জুডিথ বলে উঠল। “যেহেতু আমার মনে হচ্ছে যে, আপনি ভুলে গিয়েছেন ব্যাপারটা, অতএব আমি আশা করব যে ডেনিয়েল-এর কাছ থেকে উত্তরটা পাবো আমি।”
“আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ম্যাম।”
“অনেক ধন্যবাদ। আমার প্রশ্ন হল : সেখানে কী ভ্যান ডি ভেলডি’ নামে কোনো বিবাহিত লোক ছিলেন?”
ডেনিয়েল হচ্ছে এমন একজন ব্যক্তি যে কখনও যুদ্ধের ময়দানে ভীত হয় না, এমনকি সমুদ্রের ঝড়ো বাতাসও কখনো তার মধ্যে ভয় জাগাতে পারে না। কিন্তু জুডিথ-এর এমন প্রশ্ন আর চোখে মুখে কোমল কৌতূহলের ছাপ তার মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। সেই ভয় চোখে মুখের অভিব্যক্তিতেও প্রকাশ পায়।
“আ…আ…আমার যতদূর মনে পড়ে সে হয়ত বিবাহিত লোক ছিল, ম্যাম।”
“আপনি কী তার স্ত্রীর বর্ণনা দিতে পারবেন? যেমন, সে কী যুবতী ছিল নাকি বৃদ্ধা?”
“তাকে বুড়ি না বলে যুবতী বলাটাই ভাল হবে, ম্যাম।”
“উত্তর যেহেতু পাওয়া হয়েছে, অতএব…হাল বলতে শুরু করল, “মিস্টার পেট নিশ্চয়…”
কিন্তু পেট তাকে মাঝপথে বাধা দিয়ে বসল। “সমস্যা নেই, ম্যাডাম, আপনি আপনার প্রশ্ন চালিয়ে যান।” জুডিথের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলে উঠল সে।
“ধন্যবাদ স্যার,” জুডিথও ভদ্রতার সাথে জবাব দেয়। “ডেনিয়েল, এখন আমরা মি, ভ্যান ডি ভেলডি আর তার যুবতী স্ত্রীর সম্পর্কে কথা বলব।” কথাগুলো বলার সময় তার ঠোঁটে এক ধরনের বাঁকা হাসি খেলা করছিল। সে আসলে হালকে টিজ করছিল, ওরা মজা নিচ্ছিল। “আপনি কী তার নাম মনে করতে পারবেন?”
“আমম…ক্যাট জাতীয় কিছু একটা। সঠিক মনে করতে পারছি না।”
হাল-একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ক্যাটিংকা…মিসেস ভ্যান ডি ভেলডির ক্রিশ্চিয়ান নাম ছিল ক্যাটিংকা। এখন খুশি?”
“ধন্যবাদ, ডিয়ার,” জুডিথ বেশ লম্বা সুরে কথাটা বলে উঠল, “আমি খুবই খুশি যে আপনার স্মৃতিশক্তি এখনো নষ্ট হয়ে যায় নি। ডেনিয়েল ক্যাটিংকা ভ্যান ডি ভেলিডি নামটা অনেক সুন্দর।” “আচ্ছা, সে কী দেখতে সুন্দরী ছিল নাকি কুৎসিৎ?”
“ম্যাডাম সেটা তো সহজে বলা যায় না। সৌন্দর্য এক একজনের চোখে এক এক রকম। এটা কারও রুচির ব্যাপার। যেমন…।”
“সাদা রমণী হিসেবে বেশ সুন্দরীই ছিল সে।” অ্যাবোলি কথা বলে উঠল। “গান্ডওয়েন ওর প্রেমে পড়েছিল। সে তখন বালক ছিল। বেচারা তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি যে, একজন সত্যিকার পুরুষ যখন তার ভালবাসার নারীকে খুঁজতে থাকে, তখন তার আফ্রিকার দিকেই চোখ দেয়া উচিত। সৌভাগ্যবশত, পরবর্তীকালে সে তার ভুল সংশোধন করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।”
“ধন্যবাদ অ্যাবোলি, ব্যাপারটাকে এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার জন্য।” এরপর জুডিথ একটু গম্ভীর কিন্তু শান্তভাবে বলল, “তুমি কী আমাদেরকে ক্যাটিংকা সম্পর্কে বলবে না, ডিয়ার…?”
আরেক গ্লাস ওয়াইন শেষ করে গ্লাসটা নিচে নামিয়ে রাখে হাল। “আরে, এটা কোনো ব্যাপার?” সে বলতে শুরু করে। “তার সোনালি রঙের চুল আর বেগুনি রঙের চোখ ছিল। সে এতই জঘন্য রকমের পাপাত্মা ছিল যে স্বয়ং শয়তানও তার সামনে উপস্থিত হলে ভয় পেয়ে যেত। একবারেই নষ্টা চরিত্রের একজন নারী। আর হ্যাঁ, সে আমাকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল বটে, আর আমিও তখন সেটাতে বাধা দিতে পারি নি। কিন্তু পরে আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে সঠিক পথে ফিরে আসি, আর আফ্রিকাতেই আমার প্রিয়জন খুঁজে নিই। আর সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, আমি তোমার সঙ্গে কাটানো একটা সেকেন্ডও ক্যাটিংকা ভ্যান ডি ভেলডির সঙ্গে বিনিময় করতে রাজি নই। এবার কী আমি আমার গল্পে ফিরে যেতে পারি?”
“অবশ্যই,” জুডিথ বলল। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে শুরু থেকেই ঠিক যে উত্তরটা সে খুঁজছিল, ওটাই পেয়েছে সে।
“দ্রুত শেষ করে দিচ্ছি গল্পটা। নয়তো আজ রাতে আমরা কেউই ঘুমোতে পারব না”, হাল আবার শুরু করল। “এখন বুজার্ডের কথায় আসি। আমি যেমন মসলার গন্ধ পেয়েছিলাম, ঠিক তেমনি করে সেও বাতাসে গুপ্তধনের গন্ধ পেয়েছিল। আমরা যখনই রিজলিউশন দখল করে এর ধনসম্পদ নিয়ে ফেলি তখনই সে শূন্য থেকে উদিত হয়ে তার অংশ দাবি করতে থাকে।”
“কিন্তু গুপ্তধন পাওয়ার আগেই তো বুজার্ড তোমাদেরকে একা ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।” বুজার্ডের ঔদ্ধত্যে বেশ রেগে গেল জুডিথ।
“একদম ঠিক এটাই আমার বাবা তাকে বলেছিল। কিন্তু বুজার্ড কোনো কথাই মানে নি। সে সোজা গুড হোপ-এর দিকে রওনা করে, এরপর যেখানে আমরা রিজলিউশন মেরামত করছিলাম আর সোনা-রুপা লুকোচ্ছিলাম, ঐ জায়গাটা ডাচদেরকে দেখিয়ে দেয়…”।
“ডাচদের লোকবল আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। সে বলতে থাকে, আমার বাবা আত্মসমর্পণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি তার নিজের এতগুলো লোককে খুন হতে দেখতে চাননি। আর ঠিক তখনই, বুজার্ড দুইমুখী শয়তানের মতো কাজ করে। তারই মিথ্যে কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমার বাবাকে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়। শেষে নিজের জীবনটাও হারাতে হয়।”
“সে কী বলেছিল?” পেট জিজ্ঞেস করে। স্যার ফ্রান্সিস-এর মৃত্যুর কথা উল্লেখ করাতে সে যে উত্তেজনা অনুভব করছিল সেটা লুকোনোর চেষ্টা করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ওকে।
“আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে আমি বলেছিলাম ইংল্যান্ড এবং হল্যান্ড তখন যুদ্ধে লিপ্ত ছিল? আমার বাবাকে তার রাজা ডাচ্ জাহাজ আক্রমণ এবং লুট করার আদেশ দিয়েছিলেন।”
“আমার মনে আছে, পেট জবাব দিল।
“তো, যাই হোক, একারণেই আমার পিতা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী রিজলিউশন আক্রমণ করেন। তিনি যেটা জানতেন না, সেটা হচ্ছে, তিনমাস আগে ডাচ্দের নেভী জাহাজ আমাদের ডকইয়ার্ডে হামলা চালিয়ে অনেক জাহাজ পুড়িয়ে ফেলে, যার মধ্যে আমাদের জাহাজ রয়াল চালর্সও ছিল। তারা তখন আমাদের রাজাকে যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে আসতে বাধ্য করে।”
“লেডি এডউইনা যখন রিজলিউশন আক্রমণ করে তখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমরা কেউই সেটা জানতাম না। আমার বাবা দ্রভাবে সেটা জানিয়ে দেন। ডাচ কমান্ডার কর্নেল শিউডার সেই কথা মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুতও ছিল। সে যদিও আমাদের পারিবারিক শত্রু ছিল আর শেষে আমি তাকে হত্যা করি, কিন্তু সে সবসময়ই আত্মসম্মানের সাথে যুদ্ধ করত। তো যাই হোক, সে আমার বাবার ব্যাখ্যা শুনে সন্তুষ্ট হয়। এরপর কথাগুলোর সত্যতা যাচাই-এর জন্য বুজার্ডকে জিজ্ঞেস করে, কারণ সে জানত যে বুজার্ড আমাদের সাথেই ছিল। কিন্তু বুজার্ড…” হাল হঠাৎ বুঝতে পারে এই গল্প শেষ করা তার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। পূর্বের স্মৃতিগুলো তাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছিল।
বিগ ডেনিয়েল সামনে এগিয়ে আসে। “সেই মিথ্যেবাদী বাস্টার্ডটা বলে যে সে স্যার ফ্রান্সিসকে বলেছিল যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়েছে। সে আরও বলেছিল যে সব জানার পরও নাবিকদেরকে জাহাজ আক্রমণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন উনি। অথচ তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন। কিন্তু এই মিথ্যেটাকে ঐ শয়তানটা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। যার ফলে আমাদের ক্যাপ্টেনকে জীবন দিতে হয়। আমাদের সবাইকে গাল অব মোরের অন্যান্য দাসের সাথে বন্দি করা হয়। আমাদেরকে গুড় হোপ-এ নিয়ে যাওয়া হয়, সাধারণ বন্দিদের মতো অত্যাচার করা হয়। আমার পিঠে এখনো সেই চাবুকের দাগ আছে। অ্যাবোলির পিঠেও আছে। আমার মনে হয় ক্যাপ্টেন-এর পিঠেও আছে।”
“হ্যা!”-হাল ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলে, “আমার পিঠেও আছে। কিন্তু আমরা ওখান থেকে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।” “আপনি ভদ্রলোককে সেই গল্পটা বলুন।”
“কী ঘটেছিল এরপর?” পেট জিজ্ঞেস করে।
“আমার বাবার মৃত্যু দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর আমরা সবাই কোনোভাবে পালিয়ে যাই। আমরা সাগরের সেদিকে যেতে থাকি যেখানে আমাদেরকে প্রথম ধরা হয়েছিল।”
“ওরকম একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গার দিকে কেন যাত্রা করেছিলেন?”
“একটা কারণতো ছিলই। ভেবেছিলাম আমরা হয়ত বুজার্ডকে সেখানে পাব।”
“তারও সেখানে যাওয়ার নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল?” পেট বলল। সে মনে-মনে একটা কথাই ভাবছিল: কার্টনির বিশ্বস্ত পুত্র যা-ই বলুক না কেন, সত্যটা হচ্ছে, গুপ্তধনের লোভ স্যার ফ্রান্সিস কার্টনি আর বুজার্ডকে একই বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছিল।
“হ্যা”, হাল বলল। “কিন্তু ঘটনা আরও একটু জটিল হয়েছিল। আমরা পালিয়ে যাওয়ার কারণে শ্রিউডারকে দায়ী করা হয়েছিল, অসম্মান করা হয়েছিল তাকে। পরে আমি শুনেছি সে তার প্রেমিকা ক্যাটিংকা ভ্যান ডি ভেলডি’র কাছে গিয়েছিল। সেখানে সে ক্যাটিংকাকে স্লো জন নামে এক ঘাতকের সাথে এক বিছানায় পেয়েছিল।”
“তার মানে সে সত্যিই নষ্টা চরিত্রের অধিকারী ছিল।”
“নারীরূপী শয়তান ছিল সে”, হাল উত্তর দেয়। “মেসালিনা নামে রোমের এক সম্রাজ্ঞী ছিল যে নিজের আনন্দের জন্য বেশ্যাবৃত্তি বেছে নিয়েছিল। ক্যাটিংকাকে তার সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু সে তার পাপের শাস্তি পায়। শিউডার প্রচণ্ড ক্রোধে অন্ধ হয়ে তাকে হত্যা করে। এরপর সে তার নিজের কাজের ব্যাখ্যা করার জন্য গোল্ডেন বাউ-এর দিকে যাত্রা করে। গোল্ডেন বাউ তখন ক্যাপ্টেন ক্রিস্টোফার লেয়োনিল-এর কমান্ডে গুড হোপ-এ অবস্থান করছিল।”
“আরেকজন ভালমানুষ খারাপ নারীর পাল্লায় পড়ে ভুল কাজ করল,” উইল স্ট্যানলি বলে উঠে, যে এতক্ষণ যাবত চুপচাপ হাল-এর গল্প শুনছিল। “আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, ম্যাম,” সে বলতে থাকে, “যখন মাথা মোটা কর্নেলটা গোল্ডেন বাউ আক্রমণ করে তখন আমি সেখানে কর্মরত ছিলাম।”
“তাহলে আমি কোনো ভুল বললে আপনি তা শুধরে দিতে পারবেন,” হাল বলতে শুরু করে। “ভিসকাউন্ট নামে বাউ-এর একজন অফিসার ছিল। সে আর শিউডার বাজি ধরে পাশা খেলতে বসেছিল একদিন। শিউডার পৃথিবীতে তার যত ধনসম্পদ আছে সবকিছুই বাজিতে রেখেছিল কিন্তু পাশার চাল উইন্টারটন-এর পক্ষে যায়। শ্রিউডার সেটা মেনে না নিয়ে উইন্টারটনকে ধোকাবাজ বলতে থাকে, এরপর তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানায়।”
“গাল অব মোরে” নোঙর করাই ছিল। হাল আবার বলতে শুরু করে। “দ্বন্দ্বযুদ্ধ শেষে উিডার উইন্টারটনকে হত্যা করে, এরপর বুজার্ড ক্যাপ্টেন লেয়ানেল-এর সাথে প্রতারণা করে তাকে গোল্ডেন বাউ থেকে বের করে দেয়। নিজেকে খুব চালাক মনে করে বুজার্ড তখন উল্লাস করছিল, কারণ সে ভেবেছিল যে তার এখন দুটো জাহাজ রয়েছে। কিন্তু আমরা যে কয়জন লেডি এডউইনার নাবিক বেঁচে ছিলাম তারা পরমুহূর্তেই সেখানে পৌঁছে যাই, এরপর বুজার্ডকে উপকূলে নিক্ষেপ করি…আর এভাবেই এই গুরুত্বপূর্ণ জাহাজটা সেদিন আমার হাতে চলে আসে। যদিও আমি সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে এটাকে এর সঠিক মালিকের কাছে ফেরত দেব-যদি সে বেঁচে থাকে।”
“ক্যাপ্টেন কার্টনি আপনি যখন গোল্ডেন বাউ দখল করেন তখন কী কর্নেল শিউডারকে হত্যা করেছিলেন?”
“না, তখন নয়। ইথিওপিয়ায় অভিযানের সময় করি।”
“এরপর বুজার্ডের কী হয়েছিল? সে কী এখনো তার পাখা ছড়িয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, আর অন্যের ধন সম্পদে ভাগ বসাচ্ছে?”
“আমি এর উত্তর দিতে পারি,” জুডিথ বলে উঠে। “বুজার্ড মারা যায়। যখন গাল অব মোরে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করা হয় সেদিনই সে আগুনে পুড়ে মারা যায়। আমি জানি…আমি তাকে মরতে দেখেছি। আমি আশা করি সে এখনো পুড়ছে-নরকের আগুনে।
“তার উচিত শাস্তি হয়েছে। কিন্তু আপনার গল্পের ব্যাপারে আমি একটা কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারছি নে। বুজার্ড কী সাগরে সেটা খুঁজে পেয়েছিল যা সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল?”
“আমি দুঃখিত, আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনি,” হাল বলল। যদিও হাল বুঝতে পেরেছিল পেট কী জানতে চায়। কিন্তু সেটার সঠিক উত্তর দেয়ার কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না।
“আমার যতদূর মনে পড়ছে আপনি বলেছিলেন যে, মুক্তি পাওয়ার পর আপনারা যে উপসাগরের দিকে গিয়েছিলেন, বুজার্ডকে সেখানে পাওয়ার একটা কারণ আছে। আমার ভুলও হতে পারে অবশ্য…কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সেই একই সাগর যেখানে আপনার বাবা গুপ্তধনসহ রিজলিউশন নিয়ে গিয়েছিল, তাই না?”
“হ্যাঁ, আমিও একই সাগরের কথা বলছিলাম।”
“আমার ধারণা, বুজার্ড হয়ত ভেবেছিল যে আপনার বাবা স্যার ফ্রান্সিস কিছু গুপ্তধন সেখানে লুকিয়ে রেখেছেন। আর সেটা খুঁজতেই বুজার্ড সেখানে গিয়েছিল।”
“বুজার্ড হয়তো তাই ভেবেছিল। সে তার লোকদেরকে দিয়ে ঐ স্থানের আশেপাশের দ্বীপগুলোর মাটি খুঁড়েছিল। হয়তো সে কিছু একটা খুঁজছিল। কিন্তু আমি যতদূর জানি, আমার বাবা ওই উপসাগরে কিছুই লুকোনোর চেষ্টা করেননি, আর আমাকেও কখনো এরকম কোনোকিছু বলেননি। তাই অন্য কেউ যদি পূর্বে সেখানে কোনো ধন সম্পদ লুকিয়ে না রেখে থাকে তবে বুজার্ড অযথাই তার সময় আর লোকবল নষ্ট করছিল। তাছাড়া…বুজার্ড তো এখন মৃত।”
“ঠিক আছে। তাহলে সবকিছু জানা হয়ে গেল।” টেবিলের চারদিকে বসা সবার দিকে তাকাতে থাকে পেট, বিশেষ করে যারা সেসময় ক্যাপ্টেন কার্টনির সাথে ছিল তাদের দিকে। ডেনিয়েল এবং স্ট্যানলির দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া তার চোখ এড়ায় নি। এরপর সে অ্যাবোলির দিকে তাকায় যদিও অ্যাবোলি শূন্যদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। তারপর পেট-এর মনে হয় আফ্রিকান লোকটা কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে।
এরপর হাল ডিনার-এর সমাপ্তি ঘোষণা করে, তারপর তার সিনিয়র নাবিকদের রাতের নির্দেশনা দিতে থাকে। পেটও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার জন্য নির্ধারিত কেবিন-এর দিকে রওনা দেয়। নিজের রুম-এ গিয়ে শুয়ে-শুয়ে একটা কথাই ভাবছিল সে : গুপ্তধন তাহলে আসলেই আছে! যদিও তার মনে হয়না যে হাল কার্টনি তার সব নাবিককে জায়গাটার সন্ধান দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এরপরেও…অন্তত একজন জানে। লোকটার দৃষ্টিই সব বলে দিচ্ছিল।
ঐ আফ্রিকান অ্যাবোলি, যাকে কার্টনি অসম্ভব বিশ্বাস করে।