অস্পৃশ্যনামা
“লোকানান্তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহুরুপাদতঃ।
ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশং শূদ্রঞ্চনিরবর্তয়ৎ।”
অর্থাৎ লোকবৃদ্ধির জন্য (স্রষ্টা) মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সৃষ্টি করলেন।
এখানে পরিষ্কার। শূদ্রদের জন্মই হয়েছে পদ বা পা থেকে। নির্দেশ যাদের পা থেকে তাঁরা মাথায় উঠবে কীভাবে! তাই এঁদের স্থান তো পায়ের নিচেই হতে হবে! অতএব জন্মও পায়ের নিচে, কর্মও পায়ের নিচে।
গীতায় শ্রী ভগবানের উক্তি মতে বলা হয়েছে–”আমি গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে চার বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) সৃষ্টি করেছি।” পুরুষ সুক্তের মন্ত্র ব্যাখ্যা করে নির্মল কুমার বসু যে মত ব্যক্ত করেন তা হল চারটি বিশেষ গুণসম্পন্ন এবং বিভিন্ন মাত্রার সং্যাগের ফলে চার বর্ণের মধ্যে গুণের তারতম্য দেখা যায়। প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতের গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে সে জাতির কর্ম উল্লিখিত চার বর্ণের কর্মের সঙ্গে মিল না থাকলে সে জাতি মিশ্র গুণসম্পন্ন ধরে নেওয়া হত। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় তাদের বর্ণ ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, গৌতম প্রভৃতি স্মৃতিকার এ নিয়ে যে মতামত দেন তা প্রণিধানযোগ্য। মনু সংহিতায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। যে প্রত্যেক জাতির নির্দিষ্ট বৃত্তি ছিল এবং স্মৃতিকাররা বৃত্তির ভিত্তিতে সে জাতির বর্ণ ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ করে দিতেন। এর থেকে প্রমাণিত হয়, প্রাচীনকালে কিছু গুণকে উত্তম এবং কিছু গুণকে অধম বলে গণ্য করা হত। একইভাবে কিছু বৃত্তিকে শুদ্ধ এবং কিছু বৃত্তিকে অশুদ্ধ বলে বিবেচনা করা হত। এভাবে গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র–এ চার বর্ণের সৃষ্টি হয়।
ব্রাহ্মণদের প্রভূত্বকামী শাসনব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রধান অস্ত্রই হল চতুর্বর্ণ প্রথা। অর্থাৎ সমাজে চারটি বর্ণের উপস্থিতি— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। এই প্রথার মাধ্যমে গোটা জনগোষ্ঠীকে এক অদ্ভুত বর্ণবৈষম্যের মধ্য দিয়ে বিভাজিত করে যে ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি কায়েম করা হয়েছে, সেখানে স্বঘোষিত বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রশ্নহীন করে রাখা হয়েছে। বর্ণ-মর্যাদার দিক থেকে এর পরই রাজদণ্ডধারী ক্ষত্রিয়ের অবস্থান। তার নিচে বৈশ্য এবং সর্বনিকৃষ্ট বর্ণ শূদ্র। মানব সমাজটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আগ্রাসনবাদী বৈদিক সমাজের সর্বগ্রাসী বর্ণ-বিভেদের ছায়ায়। গোটা মনুসংহিতার কোথাও কোনোভাবে মানুষ নামের কোনো স্বতন্ত্র সত্ত্বার বা মানব জাতির অস্তিত্ব প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে— চারটি বর্ণভিত্তিক ব্রাহ্মণ জাতি, ক্ষত্রিয় জাতি, বৈশ্য জাতি ও শূদ্র জাতি। মনুসংহিতায় ‘ভগবান’ মনু যে চারটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন, তা হল –ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, নারী এবং শূদ্র। এই চারটি ক্ষেত্রেই তিনি সবচেয়ে বেশি নির্দেশ দিয়েছেন। তবে চতুর্বর্ণের বাইরে আর-একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আছে, তা হল— অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য। অর্থাৎ অস্তিত্ব থাকলেও সমাজ যাকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করে না।
বর্ণ ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যে বর্ণে জন্মগ্রহণ করেন তার বাইরে অবস্থান গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। জন্মের দ্বারাই নির্ধারিত হয় যে, সে কোন্ বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। অজানা সময় কাল থেকে একটি বংশধারা এই মর্যাদা ভোগ করে আসছে। অনন্তকাল পর্যন্ত বংশধারার মাধ্যমে এটা অব্যাহত থাকবে। ব্যক্তির মর্যাদা জন্ম দ্বারা নির্ধারিত। একজন ব্রাহ্মণ হিসাবে জন্মগ্রহণ করলে যে-কোনো অবস্থাতেই সে ব্রাহ্মণের জন্য নির্ধারিত মর্যাদা ও পুরস্কার ভোগ করবে। কোনো ব্যক্তি এক বর্ণে জন্মগ্রহণ করে অন্য বর্ণে বিয়ে করতে পারে না। কারণ বর্ণের বাইরে বিয়ে করলে তার বংশগত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। শুধু যে বংশগত পবিত্রতাই মূল কথা তাই নয়, এর সঙ্গে আরও বহু আচার ব্যবস্থা জড়িত, যার মাধ্যমে বর্ণ শুদ্ধতা রক্ষিত হয়। মূল বর্ণগুলির মধ্যেও আছে হাজারও উপবর্ণ। এই উপবর্ণগুলি আবার নিজেদের গোত্রগত বিশুদ্ধতা রক্ষার রীতিনীতি মেনে চলে। এই উপগোত্রগুলি আবার নিজেদের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য নানারূপ বিধিনিষেধ মেনে চলে যেমন সপিণ্ড, সগোত্র ইত্যাদি সংক্রান্ত আচার বিধি। এই নিয়ম কঠোরভাবে মানতে হয়, তা না হলে উঁচু জাতের পবিত্রতা বিনষ্ট হয়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ এবং অব্রাহ্মণের মধ্যে এটা কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। এজন্য পণ্ডিতরা বলে থাকেন, ভারতে বর্ণপ্রথার ইমারতটি গড়ে উঠেছে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের উপর। একজন ব্রাহ্মণ একজন নিচু জাতের লোকের সঙ্গে একত্রে বা হাতের রান্না খাবে না, ছোঁয়া খাবার খাবে না। তাঁর খাওয়া পাত্রে খাবে না, তাঁর স্পর্শ করা খাবার খাবে না। বর্ণ পঞ্চায়েত এবং আচরণরীতি ব্যাপারটার কেন্দ্রে রয়েছে ব্রাহ্মণ সমাজ এবং তাঁদের কৌলীন্য ও মর্যাদার ধারণার গুণগত উৎকর্ষের কারণে সমাজে মানুষ উচ্চতর মর্যাদা এবং পুরস্কারগুলি ভোগ করবে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম, এটাই দস্তুর। একটি বিশেষ পুরস্কার বা সুবিধা বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত থাকে। এর ফলে সমাজের নিম্ন শ্রেণিগুলির মধ্যে উচ্চতর অর্জন প্রেষণা কাজ করে না। সমাজ হয়ে পড়ে বদ্ধ জলাভূমি। এখানে সর্বস্তরের মানুষের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হয় না। মানুষের উচ্চ অর্জন প্রেরণা হচ্ছে সমাজ উন্নয়নের চাবিকাঠি। যেহেতু বর্ণ ব্যবস্থায় ব্যক্তির মর্যাদা এবং পুরস্কার শ্রম ও মেধার সাহায্যে অর্জন করা যায়, তাই সার্বিকভাবে সামাজিক সচলতার উপস্থিতি এখানে লক্ষ করা যায় না।
একজন প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ কী বলছেন জেনে নেওয়া যাক। প্রখ্যাত সেই ব্রাহ্মণটির নাম গদাধর চট্টোপাধ্যায়। সবাই যাকে ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ বলে জানে। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ লীলামৃত গ্রন্থের ২২৫ পৃষ্ঠায় শূদ্রের শয্যাত্যাগ বিষয়ে বলছেন– “পায়স গ্রহণোদ্যত, এমতকালে দেখেন লাটু ও গোপাল দাদা (বৰ্ণ বিচারে শূদ্র) শয্যাধারণ করিয়া আছেন। কহেন, ওদের বিছানা ছেড়ে দিতে বল। কেন করিবে! নরেন্দ্রের প্রশ্নে বলেন– ওরে! ভাত ভাত যে রে। আপনি তো বিধিনিষেধ পার, তথাপি এ আদেশ কেন? নরেন্দ্রনাথ নিবেদন করিলে ঠাকুর বলেন –ওরে ব্রাহ্মণ শরীর যে রে! তাই ব্রাহ্মণ-সংস্কার যাবার নয়। অগত্যা লাটু ও গোপাল দাদাকে শয্যা ছাড়িতে বলা হইল।”
এখানেই শেষ নয়, অন্ন-বিচারেও ‘ঠাকুর’ খড়হস্ত ছিলেন। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে –“যদিও বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত অনেক ভক্ত ছিলেন, তথাপি ঠাকুর সকলের আলয়ে অনুগ্রহণ করেন নাই। বলিতেন– লুচি-তরকারী খেতে পারা যায়, কিন্তু অন্ন নহে। কলিতে অনুগত পাপই মহাপাপ। কিন্তু দেখিয়াছি, পরমভক্ত বলরাম বসুর ভবনে জগন্নাথদেবের অন্নভোগ গ্রহণ করিতেন, বলিতেন– বৈষ্ণব বলে কুলপ্রথায় উহারা জগন্নাথ স্বামীকে অন্নভোগ দেয়, তাই উহা শুদ্ধান্ন। বলরাম মন্দিরে অনুগ্রহণ জানিয়া কোনো ভক্ত তাঁদের শালগ্রাম শিলার অন্নভোগ দিয়া তাঁহাকে সেবা করাইবার প্রস্তাব করিলে ঠাকুর কহেন– তোমার ত কুলপ্রথা নয়, কেবল আমাকে ভাত খাওয়াবার অভিলাষ, আবার তোমার দেখাদেখি অন্য ভক্তরাও এইরূপ করবে। তাহলে আমি সকল শূদ্র ভক্তবাড়িতে খেয়ে বেড়াই!” ঠাকুর রামকৃষ্ণ জাতবিচারে টনটনে ছিলেন। ব্রাহ্মণ বলে কথা! তিনি কোনোদিনই জাতঘৃণার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। যিনি সকলের হতে পারেন না, তিনি কী করে যে ‘যেই রাম সেই কৃষ্ণ হন, তা একমাত্র ভক্তরাই বলতে পারবেন।
বর্ণ ব্যবস্থায় বর্ণ দ্বারা নির্ধারিত হয় ব্যক্তির পেশা। এই বর্ণ ব্যবস্থায় ব্যক্তির মেধা অনুযায়ী পেশা নির্বাচনের কোনো অধিকার সেই ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর থাকে না। পেশা এখানে জন্মগত এবং বংশগতভাবে নির্ধারিত হয়। সমাজ থেকে ব্যক্তির উপর এক ধরনের প্রত্যাশার বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেওয়া হয়, সে তাঁর গোত্র বা বর্ণের পেশাই গ্রহণ করবে। এই সেদিন পর্যন্ত ব্যক্তির পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হত না। এই বর্ণপ্রথায় ব্যক্তির মেধা, যোগ্যতা, শ্রমকুশলতা, আগ্রহ, সৃজনশীলতা কোনো গুরুত্ব পেত না। তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যাঁর যা জন্মগত এবং বংশগত পেশা তাঁরা তাই করে যাচ্ছে, যে মানুষেরা মল বা বিষ্ঠা ফেলার কাজ করত সে তাইই করত (মেথর)। যে কাঠের কাজ করে সে তাই-ই করে যাচ্ছে (ছুতোর)। যে ক্ষৌরকর্মের কাজ করে তাঁর সন্তান-পরম্পরা তাই-ই করে যাচ্ছে (নাপিত)। যে মাছ ধরে বংশপরম্পরায় তাঁরা ওই পেশাই (জেলে) করে চলেছেন। যে মৃতদেহ দাহ করেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম তাই-ই করেন (ডোম)— পরিবর্তনের কোনো চিন্তাই করে না। তবে পরিবর্তন যে একেবারেই হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। এখন ব্রাহ্মণের ছেলেমেয়েকে সেলুনে চুল কাটতে যায়, তেমনি শূদ্ররাও তথাকথিত জাতির পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় আসছেন।
বর্ণপ্রথা সমাজের অভ্যন্তরে নিদারুণ রকমের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে এবং করছে। একটা জাতি হাজার বিভাজনে বিভাজিত হয়ে আছে। যে মন্দিরে ব্রাহ্মণরা পুজো করবেন, সেই মন্দিরে শূদ্র তথা দলিতরা পুজো দিতে পারবে না। যে উৎস থেকে একজন ব্রাহ্মণ জল উত্তোলন করেন, সেখান থেকে একজন দলিত জল উত্তোলন করতে পারেন না। বাবা আম্বেদকরের এ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছে। কেরালাতে একজন ‘নায়ার’ একজন নাম্বুদারি ব্রাহ্মণের কাছে আসতে পারে, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে পারে না। একজন ‘তিয়া’ একজন ব্রাহ্মণ থেকে ৩৬ পদক্ষেপ দূরে থেকে কথা বলবে এবং একজন ‘পুলাইয়া’ একজন ব্রাহ্মণ থেকে ৯৬ পদক্ষেপ দূরে থেকে কথা বলবে। এর চেয়ে কম দূরত্বে আসতে পারবে না। পেশোয়া শাসন আমলে মহারাষ্ট্রে মাহার এবং মঙ সম্প্রদায়ভুক্ত নিম্নবর্গের মানুষদের শুধু সকাল ৯টার পর এবং বিকাল ৩টার আগে পুনা গেটে আসার অনুমতি ছিল, কারণ এর আগে মানুষের ছায়া অনেক দীর্ঘ থাকে এবং কোনো ব্রাহ্মণ যদি সে ছায়া অতিক্রম করে তাহলে তাঁর জাত নষ্ট হয়। অর্থাৎ পবিত্রতা নষ্ট হয়।
এখন প্রশ্ন— এই বর্ণপ্রথার ধারণা এলো কীভাবে? ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় আর্যরা ছিল মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতি। তাঁরা ক্রমেই পূর্বদিকে অগ্রসর হতে হতে সিন্ধু নদ পার হয়ে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে। যেহেতু ভারতের তৎকালীন দ্রাবিড়, কোল, ভিল, মুণ্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতি ছিল কৃষিজীবী এবং খাদ্য আহরক, যারা খাদ্য আহরণ অর্থনীতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। তাঁদের প্রযুক্তি ছিল অতীব প্রাথমিক পর্যায়ের। অপরদিকে পশুপালন এবং শিকারজীবী আর্যরা ছিল যোদ্ধা জাতি। দীর্ঘকায় অশ্বচারী আর্যরা দ্রুতগতিতে ভারতে প্রবেশ করে অপেক্ষাকৃত খর্বকায় নিম্ন প্রযুক্তির ভারতের আদিবাসীদের সহজে পরাভূত করে দাসে পরিণত করে। এই দাসত্বকে স্থায়িত্ব দান করার জন্য এর একটা সামাজিক ব্যাখ্যা দান করা হল। যার বহিঃপ্রকাশ বর্ণপ্রথা। এটা ইউরোপীয়দের বর্ণবাদের মতোই নিবর্তনমূলক প্রথা। কারণ সাধারণত কোনো ব্রাহ্মণ ক্ষুদ্র-কৃষ্ণকায় হয় না, আবার কোনো শূদ্র দীর্ঘ নাসিকা সংবলিত দীর্ঘদেহী শ্বেতকায় হয় না। যেহেতু আর্যরা এমন অঞ্চল থেকে এসেছিল যেখানে জীবন ছিল সংগ্রামমুখর, গতিময় আর আহার্যের স্বল্পতা।
বহিঃশত্রুর আক্রমণ, চারণভূমির জন্য কিংবা পালিত পশুর নিরাপত্তার জন্য সর্বদাই তাদের যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতে হত। সংগ্রামী জীবন তাঁদেরকে উচ্চ মেধা এবং কল্পনা শক্তি দিয়েছিল। সেই কারণেই হয়তো সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত কৃষিজীবী ভারতীয়দের তাঁরা সহজে পরাভূত করতে পেরেছিল। আর্যরা উপলব্ধি করল এখানে খাদ্যের প্রাচুর্য আছে যার জন্য তাঁদের আজীবন সংগ্রাম করতে হত। তাই চতুর ও বিচক্ষণ আর্যরা বিজিত কৃষিজীবীদের তাঁদের স্বপেশায় নিয়োজিত রেখে উৎপাদনের চাকা সচল রাখল এবং এমন এক কর্মকৌশল উদ্ভাবন করল যাতে করে তাঁরা কখনোই সমাজের উপরিকাঠামোর অংশীদারিত্ব দাবি না করে। ফলে এমন এক অভিনব ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটল, যার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা অটুট থাকল, যার জন্য আর্যদের অহর্নিশি সংগ্রাম করতে হত। আবার সামাজিক শৃঙ্খলা বিধানের দুরূহ কার্যটিও আনায়াসে সমাধান হয়ে গেল, যার জন্য পৃথিবীর প্রায় সব সমাজকে বাড়তি অর্থ এবং শ্রম নিয়োজিত করতে হত। এভাবেই আর্যরা আদিবাসী ভারতীয়দের কার্যত দাসে পরিণত করল।
ঋগবেদের যুগেই যে চারটি বর্ণের উৎপত্তি হয়েছিল তার বীজ বা প্রমাণ পুরুষ সুক্ত (১০/৯০)। সেখানে দ্বাদশ ঋকে আছে পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ হল, দুই বাহু বা হাত থেকে রাজন্য হল, দুই ঊরু থেকে বৈশ্য হল এবং দুই চরণ বা পা থেকে শূদ্র হল। ঋগবেদের অন্যত্র দুটি মূল ভাগ পাই– আর্য এবং দাস (১০/১০২/৩)। মনে হয় এটি জাতিভিত্তিক (racial) বিভাগ। পরবর্তী সময়ে যখন এই দাসজাতি সমাজের অঙ্গীভূত হয় গেল তখন তাঁরা শূদ্র বলে বর্ণিত হল। অথর্ব বেদে দাস অর্থে শূদ্র শব্দের ব্যবহার হয়েছে (৪/২০/৪)। বৃত্তি বা পেশা অনুসারেই যে বিভাগের ব্যবস্থা হয়েছিল তা বোঝা যায়। অবশ্য তখনও বর্ণ বিভাগ পুরুষানুক্রমিক হয়নি। তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ ৯/১১২ সুক্ত। তাতে দেখা যায় একই পরিবারে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন রকম বৃত্তি অবলম্বন করত। সেই পরিবারের একজন স্তোত্রকার, তাঁর পুত্র চিকিৎসক এবং কন্যা যব ভাঙে। যে ঘৃণ্য জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে আজ ভারতবর্ষ আকুল, ঋগবেদের যুগে কিন্তু এ জাতিভেদ প্রথার সৃষ্টি হয়নি। তখন জাতি বলতে মাত্র দুটি শ্রেণিই বুঝাত– আর্য এবং অনার্য। পরবর্তীকালে শূদ্রদের মতো অনার্য জাতির লোকেরা তাদের ভয় করে চলত বলে অনেকে মনে করেন। আর্য বর্ণের মানুষরা ইন্দ্রের কাছে কী প্রার্থনা করছে একবার দেখা যাক– “হে মেঘবন! নীচ বংশীয় ধন আমাদের প্রদান করো” (৩/৫৩/১৪)। এই বাক্যে অনার্যদের প্রতি বিন্দুমাত্র সমীহ আছে বলে আমার মনে হয় না। যাই হোক, সে সময় কিন্তু বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল বলে মনে হয় না। এটা মুসলমান। আকবর আর হিন্দু রাতপুতদের মধ্যে ভালোবাসার মতোও হতে পারে! তবে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, ঘৃণা –এসব পরবর্তীকালের সংযোজন।
পরবর্তী ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সমাজব্যবস্থাকে কঠোরভাবে চার বর্ণে ভাগে ভাগ করে দিল। ভাগ করে দিল কাজ, কর্তব্য এবং অধিকার।
(১) ব্রাহ্মণ : “অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা/দানং প্রতিগ্ৰহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।” অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের জন্য তিনি সৃষ্টি করলেন অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগৃহ।
(২) ক্ষত্রিয় : “প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।/ বিষয়েষপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ।” অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের কর্ম লোকরক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন ও বিষয়ে অত্যাসক্তির অভাব।
(৩) বৈশ্য : বৈশ্যের কর্ম হল পশুপালন, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, সুদে অর্থ বিনিয়োগ ও কৃষি।
(৪) শূদ্র : প্রভু শূদ্রের একটিমাত্র কর্ম নির্দেশ করলেন। তা হল সকল বর্ণের অসূয়াহীন সেবা করা।
আর কেনই-বা করবে না! সমস্ত শূদ্রদের প্রশ্নহীনভাবে উপরের তিন বর্ণের ফাই-ফরমাশ খাটতেই হবে। এটাই দস্তুর, নিয়তি। কারণ –জাতমাত্রেই ব্রাহ্মণ পৃথিবীতে সকল লোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন এবং সকল সৃষ্ট পদার্থের ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভু হন–
“ব্রাহ্মণণা জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে।”
অথবা– পৃথিবীতে যা কিছু আছে সেই সব ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য হেতু ব্রাহ্মণ এই সবই পাওয়ার যোগ্য–
“সর্বং স্বং ব্রাহ্মণেস্যেদ্যং যৎকিঞ্চিজ্জগতীগতম্।
শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহর্হতি।”
কিংবা –ব্রাহ্মণ নিজের অন্নই ভক্ষণ করেন, নিজের বস্ত্র পরিধান করেন এবং নিজের দ্রব্য দান করেন। অন্য লোকেরা যা ভোগ করে, তা ব্রাহ্মণের দয়া হেতু করে।
অপরদিকে শাসক বা রাজা বা ক্ষত্রিয়দেরও প্রভু পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিচক্ষণ সমাজপতিরা। মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায় দেখুন— রাজশূন্য এই জগতে চারদিকে ভয়ে (সকলে) প্রচলিত হলে এই সমগ্র (চরাচর জগতের) রক্ষার জন্য ঈশ্বর ইন্দ্র, বায়ু, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র ও কুবেরের শাশ্বত অংশ গ্রহণ করে রাজাকে সৃষ্টি করেছিলেন–
“অরাজকে হি লোকেহস্মিন সর্বতো বিদ্যুতে ভয়াৎ।
রক্ষার্থমস্য সর্বস্য রাজানমসৃজৎ প্রভুঃ।
ইন্দ্রানিলমার্কাণামগ্নেশ্চ বরুণস্য চ।
চন্দ্রবিত্তেশয়োশ্চৈব মাত্রা নিত্য শাশ্বতীঃ।”
যেহেতু এই শ্রেষ্ঠ দেবগণের অংশ থেকে রাজার সৃষ্টি হয়েছিল, সেইজন্য তিনি সকল জীবকে তেজে অভিভূত করেন–
“যস্মদেষাং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভ্যো নৃপঃ।
তস্মাদভিভবত্যেষ সর্বভূতানি তেজস্য।”
অথবা –রাজাকে বালক হলেও মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ইনি মানুষের রূপে মহান দেবতা —
“বলোহপি নামমন্তব্যো মনুষ্যা ইতি ভূমিপঃ।
মহতী দেবতা হ্যেষা নররূপেণ তিষ্ঠতি।”
এই অধ্যায়ে এ রকম ২২৬টি শ্লোকে ভয় ধরানো বর্ণনা, বিশেষণ এবং নিদানের উল্লেখ আছে।
দেখা যাচ্ছে এঁরা সবাই-ই দেবতা বা সুর, এঁরা ছাড়া বাকি সব দৈত্য বা অসুর। তাই নিয়মনীতিও আলাদা —
“ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্ৰয়ো বৰ্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।” (১০/৪)
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণের পক্ষে উপনয়ন সংস্কারের বিধান থাকায় এঁরা ‘দ্বিজাতি’ নামে অভিহিত হয়। আর চতুর্থ বর্ণ শূদ্র উপনয়ন সংস্কারবিহীন হওয়ায় দ্বিজাতি নয়, তাঁরা হল ‘একজাতি’। কারণ শূদ্রের পক্ষে উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নেই। অতএব অনিবার্যভাবে শূদ্ররা হল নিম্নবর্ণ। ফলে এঁরা ব্রত যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদি পালনের যোগ্য হতে পারে না। এছাড়া পঞ্চম কোনো বর্ণ নেই অর্থাৎ ঐ চারটি বর্ণের অতিরিক্ত যাঁরা আছে তাঁরা সকলেই সঙ্করজাতি। হিন্দুধর্মের চারবর্ণের সর্বশেষ ধাপে অবস্থান শূদ্রের। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য– যাঁদের সভ্য ভাষায় বলা হচ্ছে উচ্চবর্ণ বা উঁচু জাত এবং শূদ্রদের বলা হয় নিন্মবর্ণ বা নিচুজাত বা ছোটোজাত।
ডা. ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে মনুর শ্লোকে ‘অনার্য’ শব্দের কুল্লুকভট্ট অর্থ করেছেন ‘শূদ্র’। কিন্তু অনার্য হলেই শূদ্র হয় না। Buehler অনার্য শব্দটির অর্থ করেছেন non-Aryan। এই অর্থ ঠিক নয়। Jones বলেছেন –base-man ও base-women। অনার্য শব্দের অর্থ নীচ, হীন এবং ব্রাহ্মণবিরোধী।
একজন মানুষ মৃত্যু বরণ করলে, মৃত ব্যক্তির পুত্র-কন্যা ও নিকট আত্মীয় স্বজনেরা হিন্দু সমাজের বিধান অনুযায়ী অশৌচ হয়ে যায়। এ জন্য জাতিভেদের নিয়ম অনুসারে ১০-১২-১৫-৩০ দিন অশৌচ পালন শেষে ব্রাহ্মণ দ্বারা মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করে তারপর পবিত্র হতে হয়।
“শুধ্যেদ্বিপ্যো দশাহেন দ্বাদশাহেন ভূমিপঃ।
বৈশ্য পঞ্চদশাহেন শূদ্রো মাসেন শুধ্যাতি।”
— যাঁরা ১০দিন অশৌচ পালন শেষে ১১দিনে শ্রাদ্ধনুষ্ঠান করে তাঁরা ব্রাহ্মণ, যাঁরা ১২দিন অশৌচ পালন শেষে ১৩ দিনে শ্রাদ্ধনুষ্ঠান করে তাঁরা ক্ষত্রিয়, যাঁরা ১৫দিন অশৌচ পালন শেষে ১৬দিনে শ্রাদ্ধনুষ্ঠান করে তাঁরা বৈশ্য, আর যাঁরা ৩০ দিন অশৌচ পালন শেষে ৩১ দিনে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে তাঁরাই শূদ্র। এরকম হাজারো বৈষম্যমূলক নিয়মনীতি শূদ্রদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ঘৃণ্য করে তুলেছে। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, মনুসংহিতা, রামায়ণ, মহাভারত– সর্বত্রই শূদ্রদের অপমানের বিবরণ। প্রতি পদে পদে শূদ্রদের প্রান্তিক করে দিয়েছে, শৃঙ্খলিত করেছে। উদাহরণ দিয়ে প্রবন্ধটি ভারাক্রান্ত করতে চাই না।
বহু বছর আগে একটি মহামূল্য গ্রন্থ পাঠ করেছিলাম। গ্রন্থটি ডাঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ভারতীয় সমাজ পদ্ধতি’। গ্রন্থটি সম্ভবত তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থে লেখক প্রাচীন ভারতের শূদ্রদের অবস্থান নিয়ে যে সমাজচিত্রটি তুলে ধরেছেন, তা শুনলে চমকে যেতে হয়। টুকরো টুকরো মনে পড়ছে। স্মৃতি থেকে এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করি। তিনি লিখেছিলেন– মুড়া নামের এক নীচ জাতীয় নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। চন্দ্রগুপ্ত আসলে জারজ সন্তান। মৌর্যদের শূদ্র বলে গণ্য হত। ভারতীয় জনশ্রুতিতে চন্দ্রগুপ্তকে শূদ্র বলেই অভিহিত করা হয়েছে। পুরাণেও চন্দ্রগুপ্তের গোষ্ঠীকে শূদ্র বলা হয়েছে। রাজা নন্দকেও প্রজারা পছন্দ করত না। কারণ তিনি ছিলেন নীচকুলোদ্ভব নাপিতের ঔরসজাত। তাই তিনি ঘৃণার যোগ্য।
শেষ নন্দরাজা কিংবা চন্দ্রগুপ্তের ধমনীতে শূদ্ররক্ত প্রবাহিত ছিল কি না তা নিশ্চয় গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু মৌর্যরা যে শূদ্রবংশীয় ছিলেন, তা ভারতীয় লেখকরাই লিখে গেছেন। ব্রাহ্মণদের দ্বারাই মৌর্যরা উৎপাটিত হয়েছিল। শূদ্র তো ছাড়, ক্ষত্রিয়দের পিছনেও ব্রাহ্মণরা আদাজল খেয়ে লেগেছিল। সেইকাল থেকেই ব্রাহ্মণদের উপর ক্ষত্রিয়দের ঘৃণার সূত্রপাত হয়েছিল। ব্রাহ্মণদের উপর ঘৃণার জন্য ক্ষত্রিয়রা পর্যন্ত বৈদিক ধর্ম পরিত্যাগ করেছিল। ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে দীর্ঘ সংগ্রাম এবং জৈন ও বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তর ব্রাহ্মণদের বড়োই বিচলিত করে তুলেছিল। ক্ষত্রিয়ের আধিপত্য ধ্বংস করার জন্য ব্রাহ্মণরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। সেসব কাহিনি আমরা রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণগুলিতে পাই। এইসব গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই, ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে কীভাবে ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ব্রাহ্মণপ্রবর কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে এইসব কার্যের সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে। যে সময় ক্ষত্রিয়রা ঘৃণাভরে দলে দলে বৈদিক ধর্ম ত্যাগ করতে থাকল, তখন ধুরন্ধর এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ব্রাহ্মণ নতুন এক অস্ত্র বা পথের সন্ধান করতে থাকল। সেই পাওয়াও গেল। ব্রাহ্মণপ্রবর কৌটিল্য (চাণক্য) শূদ্রদেরকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করলেন। সামশাস্ত্র মতে, আর-এক ব্রাহ্মণপ্রবর ভরদ্বাজ বলেন, সুযোগ পেলে ব্রাহ্মণ মন্ত্রীরা ক্ষত্রিয় শাসন অপসারণ করে ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে। কিন্তু বিচক্ষণ কৌটিল্য সেই মত গ্রহণ করলেন না। কৌটিল্য চন্দ্রগুপ্তের মতো অসভ্য’ শূদ্র-সর্দারদের রাজারূপে হাজির করলেন। পুরাণগুলো থেকে জানা যায়, মহাপদ্ম নন্দের পর ক্ষত্রিয়কুল নির্বংশ হয়। এরপর ‘পৃথিবীর রাজারা শূদ্রবংশীয় ছিল’ (বিষ্ণুপুরাণ ৪, ২৪)। সামশাস্ত্রী বলেন– এটা অস্বীকার করা যায় না যে, বিরুদ্ধবাদী ক্ষত্রিয় রাজাদের দ্বারা অত্যাচার ও উৎপীড়নের যন্ত্রণায় বিতারিত হয়ে ব্রাহ্মণরা শূদ্রবংশীয় জংলি সর্দারদের সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই সুযোগে জংলি কৌম দলপতিরা অনেকে আর্যরাষ্ট্রে রাজা হয়ে যান। এইভাবে শূদ্রদের সাহায্য নিয়ে এক ক্ষত্রিয় জাতি ধ্বংস করে অন্য ক্ষত্রিয় জাতির সৃষ্টি করে। সেই সত্যকে একটু ঘুরিয়ে পরশুরামের পৃথিবীকে ২১ বার নিঃক্ষত্রিয় করার কাহিনি উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিষ্ণুপুরাণে আমরা পাচ্ছি– “মগধে বিশ্বস্ফটিক নামে একজন রাজা অন্য জাতিদের (উপজাতি) প্রতিষ্ঠিত করবেন। তিনি ক্ষত্রিয়দের নির্বংশ করে জেলে, বর্বর, যদু, পুলিন্দ এবং ব্রাহ্মণদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করবেন। পদ্মবতী, কান্তিপুর ও মথুরাতে নয়জন নাগ জাতি রাজত্ব করবেন। দেবরক্ষিত নামে একজন রাজা সমুদ্রতীরে একটি নগরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কোশল, ওড়, পুক আভিরেরা এবং শূদ্রেরা সৌরাষ্ট্রে, অবন্তী, সুর, আরবুদ মরুভূমি দখল করবে। শূদ্র, অন্ত্যজ এবং বর্বররা সিন্ধুতীর, দ্বারিকা, চন্দ্রভাগা ও কাশ্মীরে অধীশ্বর রূপে রাজত্ব করবে।”
এখন প্রশ্ন, পুরাণোক্ত এই বিশ্বস্ফটিক (কারও বিশ্বসফানি) কে ছিলেন? এঁর প্রকৃত নাম বাণস্পর। ইনি শক-সম্রাট কনিষ্কের অধীনে বেনারস বা বারাণসী প্রদেশের শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি খ্রিস্টীয় ৯০ সাল থেকে ১৩০ সালের মধ্যে রাজত্ব করেছিলেন। তিনি ভারতীয় সমাজকে ব্রাহ্মণশূন্য করেছিলেন। উচ্চশ্রেণির বৈদিকধর্মীদের নামিয়ে নীচ জাতি এবং বিদেশিদের উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। ক্ষত্রিয়দের নির্বংশ করে নতুন শাসকজাতি সৃষ্টি করেছিলেন। কৈবর্ত শ্রেণি থেকে একটি নতুন শাসক অথবা রাজকর্মচারীশ্রেণি সৃষ্টি করেছিলেন। অস্পৃশ্য পচ্চকদের মধ্য থেকেও রাজকর্মচারী সৃষ্টি করেছিলেন। শক, পুলিন্দ জাতির লোক এনে বুন্দেলখণ্ড ও বিহারের মধ্যবর্তী স্থানগুলোতে উপনিবেশ করান। এই বক্তব্য ‘History of India’ গ্রন্থের লেখক শ্ৰীযুক্ত জয়সওয়ালের। জয়সওয়াল লিখেছেন– এই বাণস্পর বংশ এখনও বুন্দেলখণ্ডে আছে, তাঁরা নীচ বংশীয় বলেই গণ্য হয়। রাজপুতদের সঙ্গে তাঁরা বিবাহকার্য করতে পারে না।
এই বিশ্বস্ফটিকই কি ইতিহাসে চন্দ্রগুপ্ত? ঐতিহাসিক ডা. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত অবশ্য এমনই দাবি করেছেন তাঁর গ্রন্থে। যাই হোক, মোদ্দা কথা হল, ব্রাহ্মণদের দাপট ও দৌরাত্ম্য সাময়িক হলেও চূর্ণবিচূর্ণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন বিশ্বস্ফটিক। তাঁর এই মহা-বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্রাহ্মণদের পরিকল্পিত বর্ণাশ্রম ধর্ম এবং পুরুষসূক্তের বর্ণগুলির উৎপত্তি ও তাঁদের কর্ম বিষয়ে ব্যবস্থাপদ্ধতি চরমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
বেদোক্ত ‘দস্যু’, ‘দাস’, এবং পরবর্তী সময়ে শূদ্রেরা যখন ভারতের শাসকরূপে উন্নীত হল, তখন ফ্রান্সের মতো পতিতদের উত্থান হয়েছিল বলে স্বীকার করতে হবে। মূলত অর্থনৈতিক বিবিধ ফ্যাক্টরের মধ্যে বৌদ্ধ বনাম ব্রাহ্মণদের তুমুল কলহ ও সংঘর্ষই ছিল শূদ্র উত্থানের পটভূমি।
একদা বিদেশিরা ভাবত ভারতের ব্রাহ্মণসমাজ সারাজীবন ধর্মচর্চা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মৌর্যযুগের প্রাককালে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র আবিষ্কারের পর পণ্ডিতমহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তাঁরা বুঝলেন, কেবল ধর্মচর্চা নয়, ছিল যুদ্ধচর্চাও। তাঁরা রাজনীতি ও বিজ্ঞানের চর্চাও করতেন। এই অর্থশাস্ত্রই মৌর্য সাম্রাজ্যে আইনরূপে গৃহীত হয়েছিল, যার প্রভাব বৈবস্বত মনু। রচিত মনুসংহিতায় ব্যাপকভাবে পড়ে।
কৌটিল্য গান্ধার দেশীয় ব্রাহ্মণ ছিলেন। ব্রাহ্মণ হলেও তিনি কৃষ্ণবর্ণ ও কদাকার ছিলেন। সেই কারণে মহারাজ নন্দ তাঁকে পদে পদে অপমান করতেন। এই অপমানের শোধ তুলতে ব্রাহ্মণপ্রবর কৌটিল্য শূদ্র চন্দ্রগুপ্তের দ্বারা নন্দবংশের ধ্বংসসাধনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সেই কারণে ব্রাহ্মণদের প্রতি তাঁর অশেষ দুর্বলতা থাকলেও শূদ্রদের জন্যেও কিছুমাত্র প্রসাদের ব্যবস্থা করেছিলেন। আহ্লাদে নয়, তোষণ করতে। শূদ্ৰজাতিদের তোল্লা দিতেই অর্থশাস্ত্রের তৃতীয় খণ্ডে তেরো অধ্যায়ে বলেছেন –যে শূদ্র গোলামরূপে জন্মগ্রহণ করে নাই ও সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয় নাই, এবং জন্ম দ্বারা যে আর্য (আর্যপ্রাণ); তাহাকে তাহার জাতিরা বিক্রয় করিলে অথবা বন্ধক দিলে তাহারা ১২ পণ শাস্তি পাইবে; বৈশ্যদের এই প্রকার হইলে ২৪ পণ, ক্ষত্রিয়দের ৩৬ পণ, ব্রাহ্মণদের ৪৮…ম্লেচ্ছদের মধ্যে এই প্রকার কার্য দোষবহ বলিয়া গণ্য হয় না। কিন্তু কোনো আর্য গোলামে পরিণত হইতে পারে না।
কৌটিল্য আরও বলছেন –“যে নিজেকে গোলামরূপে বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছে এরূপ ব্যক্তির পুত্র একজন ‘আর্য হইবে।”(১৬) “যে পরিমাণ অর্থের জন্য একজন গোলামে পরিণত হইয়াছে, সেই অর্থ প্রত্যার্পণ করিলে সেই গোলাম পুনঃ তাহার ‘আর্যত্ব’ ফিরিয়া পাইবে।” (১৭) কৌটিল্য ব্রাহ্মণদের শূদ্রা নারীকে গ্রহণ বা বিবাহের অনুমতিও দিয়েছিলেন।
আমরা কৌটিল্যের ‘সংবিধান’ থেকে যে তথ্য পেলাম, তা হল, শূদ্রদের ‘আর্যত্ব’ প্রাপ্তি। আর্য’ শব্দটি এখানে নরতত্ত্ববাচক নয়, এটি রাজনীতিবাচক বলেই প্রতীত হয়। অতএব একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, মৌর্য সাম্রাজ্যের স্বাধীন বা মুক্ত প্রজারা সকলেই ‘আর্য’ বলে গণ্য হয়েছিল। অথচ শূদ্র-উত্থান তথা কৌটিল্যের প্রবেশের আগে ব্রাহ্মণদের রচিত গ্রন্থগুলি আমরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদেরই ‘আর্য’ হিসাবে পাই। আর এই বেনিফিটটা শূদ্ররা পায় ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের মধ্যে সংঘর্ষের ফলেই। যদিও বেনিফিটটা ছিল সাময়িক।
ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের মধ্যে সংঘর্ষ কতটা তীব্র ছিল সেটা আমরা রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণগুলি নির্মোহ বিশ্লেষণ করলেই পেয়ে যাব। রামায়ণে আমরা দেখতে পাই ক্ষত্রিয়দের ‘শিখণ্ডী’ করে ব্রাহ্মণগোষ্ঠী অনার্যদের নির্বংশ করেছে। এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমার ‘যুক্তিবাদীর চোখে রাম ও রামায়ণ’ গ্রন্থে। তাই রামায়ণের ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণদের সংঘাতের কাহিনি এখানে। আলোচনা করছি না। মহাভারতেও আমরা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের সংঘাতের চিত্র পাই। সেখানেও ব্রাহ্মণগোষ্ঠী ক্ষত্রিয়দের বিরুদ্ধে ক্ষত্রিয় লেলিয়ে ক্ষত্রিয় ধ্বংস করেছে। একই সঙ্গে যদুবংশও ধ্বংস করেছে। সে যুগে যখন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা পরস্পরের প্রতি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে যুযুধান, তখন জমদগ্নিরাম ব্রাহ্মণদের নিয়ে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনীকে ব্যবহার করে পরশুরাম একুশবার ক্ষত্রিয় ধ্বংস করেছেন। মহর্ষি ভৃগুর (পরশুরামের প্রপিতামহ) বাক্যানুযায়ী পরশুরাম বৃত্তিতে ক্ষত্রিয় হয়েছিলেন। তাই জগতে তিনিই প্রথম ব্রাহ্মণ যোদ্ধা। পরশুরামের মা রেণুকা ছিলেন অযোধ্যার সূর্যবংশের মেয়ে। এই বংশেই রামচন্দ্রের জন্ম হয়। জমদগ্নির ঔরসে রেণুকার গর্ভে পাঁচ পুত্রের মধ্যে পরশুরাম ছিলেন কনিষ্ঠ। একবার চিত্ররথ নামে এক রাজাকে সস্ত্রীক জলবিহার করতে দেখে রেণুকা কামার্ত হয়ে পড়েন। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সেই দৃশ্য অবলোকন করেন জমদগ্নি। এই অপরাধে স্ত্রীকে শাস্তি দিতে পাঁচ পুত্রকে আহ্বান করলেন। মাকে হত্যা করতে কোনো পুত্র রাজি না-হলেও কনিষ্ঠ পুত্র পরশুরাম রাজি হয়ে যান এবং পিতার আদেশে কুঠারের আঘাতে মায়ের শিরচ্ছেদ করেন। তবে মাতৃহত্যাজনিত পাপে তাঁর হাতের কুঠার হাতেই সংযুক্ত হয়ে যায়। অপরদিকে পুত্রের মাতৃহত্যাজনিত কর্মে খুশি হয়ে পিতা জমদগ্নি তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বলেন এবং অখুশি হয়ে বাকি পুত্রদের অভিশাপ দেন। বর হিসাবে পরশুরাম পিতার কাছ থেকে মায়ের পুনর্জন্ম, মাতৃহত্যাজনিত পাপ ও মাতৃহত্যার স্মৃতি বিস্মৃত হওয়া, ভাইদের জড়ত্ব মুক্তি, নিজের দীর্ঘায়ু এবং অজেয়ত্ব প্রার্থনা করেন। জমদগ্নি তাঁকে সবকটি বরই প্রদান করেন। ব্ৰহ্মকুণ্ডে স্নান করার পর হাত থেকে কুঠার বিচ্ছিন্ন হয়েছিল পরশুরামের। হৈহয়রাজ কীর্তবীর্য জমদগ্নির হোমধেনুর গোবৎস বহন করেছিলেন বলে পরশুরাম তাঁকে হত্যা করেছিলেন। কীর্তবীর্যের পুত্ররা প্রতিশোধ নিতে আশ্রমে এসে তপস্যারত জমদগ্নিকে হত্যা করে। ক্ষুব্ধ পরশুরাম একাই কীর্তবীর্যের সব পুত্রকে হত্যা করেন। এরপর তিনি একুশবার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন। তিনি ক্ষত্রিয়দের রক্ত দিয়ে সমস্ত পঞ্চক প্রদেশের পাঁচটি হ্রদ পূর্ণ করেন। (সমস্ত পঞ্চকোপাধ্যান– দ্বিতীয় অধ্যায়– আদিপর্ব, মহাভারত) শেষে পিতামহ ঋচিকের অনুরোধে ক্ষত্রিয় হত্যালীলা বন্ধ করেন পরশুরাম। ক্ষত্রিয়রা পরাভূত হন ব্রাহ্মণদের সশস্ত্র বাহিনীর হাতে।
‘বিদুর’ গ্রন্থে লেখক মিহির সেনগুপ্ত লিখেছেন– ক্ষত্রিয়দের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে ব্রাহ্মণরা বৈশ্য প্রভৃতি বর্ণের সাহায্যও কখনো-কখনো গ্রহণ করেছিল এবং তথাপি পরাজিতও হয়েছিলেন। সে বোধহয় পরশুরামের আবির্ভাবের আগেকার কথা হবে। জামদগ্ন্যরাম যখন ক্ষত্রিয়দের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেননি, তখন তাঁরা নাকি বৈশ্য এবং শূদ্রদেরও সহায়তা নিয়ে ক্ষত্রিয়দের কাছে বারবার পরাজিত হচ্ছিলেন। মিহির সেনগুপ্ত আরও লিখেছেন– যুদ্ধবিরতিকালীন সাময়িক শান্তির সময়ে ব্রাহ্মণেরা ক্ষত্রিয়দের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাঁরা কেন বিজয়ী হতে পারছেন না! ক্ষত্রিয়রা তখন বলেছিলেন যে, এক অখণ্ড নেতৃত্বের অধীনে সংগ্রাম না করলে বিজয় লাভ করা যায় না। আপনারা যে যাঁর বিচারমতো চলতে চান। তাই কখনোই বিজয়লাভ করতে পারেন না। অতঃপর জামদগ্ন্যরামকে ব্রাহ্মণরা তাঁদের অখণ্ড নেতা হিসাবে নির্বাচন করার পরই তাঁরা জয়লাভ করতে শুরু করে। তার পরবর্তী দীর্ঘকাল এই পরশুরামের অনুগামী ব্রাহ্মণেরা শস্ত্রশিক্ষা বিষয়ে সবিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়ে আসছিলেন। এঁদের পরবর্তী সব দলপতিকেই এঁরা ‘পরশুরাম’ নামে অভিহিত করে থাকেন। পরশুরাম’ নামটি একদা তাঁদের গোত্ৰনাম হয় এবং গোত্ৰাধিপতি এই নামেই পরিচিত হতে থাকেন। যখন ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণদের বৃত্তির কোনো নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বিভাগ ছিল না, তখন এইসব পরশুরামেরা বহুবার ক্ষত্রিয়দের নিঃশেষ করার সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন।
বস্তুত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কারণেই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের এই দীর্ঘকালীন বিরোধ। এরপর ব্রাহ্মণেরা বিধ্বংসী ও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। সূক্ষ্ম বুদ্ধিপ্রয়োগে শাসকের আসনে না-বসলেও ক্ষত্রিয়দের পুতুলে পরিণত করে ব্রাহ্মণরাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠলেন। এমনকি সামরিক বিভাগটিও ব্রাহ্মণরা নিজেদের দখলে রেখেছিলেন। বিশ্বামিত্র, বশিষ্ট, দুর্বাসা, দ্রোণাচার্য, মার্কণ্ডেয়, অগস্ত্য প্রমুখ দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রাহ্মণেরা ছিলেন সামরিক শক্তির আধার। বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার ছিল তাঁদের। যুদ্ধকালে এইসব ব্রাহ্মণদের কাছ থেকেই অস্ত্র সংগ্রহ করতে হত ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের। প্রাচীন যুগে ব্রাহ্মণরাই ছিলেন মূল ক্রীড়ক, ক্ষত্রিয়রা ছিলেন ক্রীড়নক মাত্র।
মৌর্যযুগের কৌটিল্য শূদ্রদের ঢেলে অধিকার দিয়েছে, একথা ভাবা মূর্খামি। ব্রাহ্মণদের আধিপত্য ঘষালো আনা অক্ষুণ্ণ রেখেই শূদ্রদের যৎসামান্য দেওয়া হয়েছে। ভিক্ষার দান! না-হলে নিজে ব্রাহ্মণ হয়েও কীভাবে শূদ্রদের ঘি-মাখন খাওয়ার ব্যবস্থা করে! কাজ হাসিল করে পিছনে পদাঘাত। কৌটিল্য শূদ্রদের এতই মঙ্গল চেয়েছিলেন যদি, তাহলে শূদ্র-শাসনকালেই শূদ্ররা পূর্ণমুক্তি পেল না কেন? মৌর্য সাম্রাজ্যের চরম উন্নতি হয় চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র অশোকের রাজত্বকালে। যদিও চন্দ্রগুপ্তকে সম্রাট করে ব্রাহ্মণরা নিজেদের আধিপত্য একচেটিয়া করতে যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে ব্রাহ্মণদের সেই আশায় ছাই ঢেলে দেয়। অশোক বৌদ্ধ হয়েই অনুশাসন যজ্ঞে জীবহিংসা নিষিদ্ধ করে দেন। এই অনুশাসন অবশ্যই ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে গেল। কারণ এই অনুশাসন একজন শূদ্ররাজার হুকুম। অশোক বারবার মনে করিয়ে দিতেন –যাঁরা পূর্বে পৃথিবীতে দেবতা বলে মান্য হতেন, তাঁদের তিনি মিথ্যা দেবতায় পরিণত করে দিয়েছেন। বৌদ্ধধর্ম গ্রন্থে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন– যাঁরা ‘ভূদেব’ (ব্রাহ্মণ) বলে সম্মান ও পুজো পেত, তাঁদেরও তিনি মিথ্যা বলে প্রমাণ করে দিয়েছেন। অতঃপর অশোক ধৰ্ম্ম-মহাপাত্র, অর্থাৎ নীতি পর্যবেক্ষণের নিযুক্তি করে ব্রাহ্মণদের অধিকার ও সুবিধাভোগের উপর হস্তক্ষেপ করেন।
ব্রাহ্মণদের অনুশাসনে শূদ্ররা যেসব নির্যাতন ভোগ করত, অশোক তা সংশোধন করেন। তিনি জাতি, বর্ণ ও ধর্মে সাম্য স্থাপনে সচেষ্ট হন। এই সাম্যবাদ ব্রাহ্মণদের স্বার্থে কুঠারাঘাত করে। তাঁদের কাছে খুবই অসহ্য ও আপত্তিজনক মনে হয়েছিল। কারণ এই সাম্যবাদে ব্রাহ্মণেরা ‘অবধ্য ও মৃত্যুদণ্ডের অতীত’ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। ব্রাহ্মণেরা এ সময়কালে খাপে খাপ হয়ে গিয়েছিলেন। একদম কোণঠাসা অবস্থা। তথাপি কোণঠাসা হয়েছিলেন বলে তাঁরা হাত গুটিয়ে বসে থাকননি। অপেক্ষা করছিলেন একটা সুযোগের জন্য। খুঁজছিলেন কৌশল।
মৌর্যশাসনের সময়ই পাটলিপুত্র নগরে রাজসৈন্যের কুচকাওয়াজের সময়। ব্রাহ্মণ-সেনাপতি পুষ্যমিত্র রাজাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে নেয়। বলা যায় ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীলতা এই সময় থেকেই শুরু হয়ে গেল। এ সময় থেকেই বৌদ্ধশাসন ভেঙে দিয়ে ব্রাহ্মণ আধিপত্য কায়েম হয়ে যায়। এই সময়েই তথাকথিত মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতি পুনঃসংকলিত (নবরূপে) প্রকাশ্যে এলো। জয়সওয়াল ও জলির মতে, এই গ্রন্থ পাটলিপুত্রের জনৈক ব্রাহ্মণ সুমতী ভার্গব কর্তৃক রচিত হয়। গ্রন্থটি রচনার সময় পুষ্যমিত্রকে মাথায় রেখে কী প্রকার অবস্থায় অথবা কী প্রকার চরিত্রের রাজা বিনষ্ট হয়, তা বর্ণিত হয়েছে। মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায় জুড়ে রাজা কে, রাজা কী, রাজা কেন, রাজা কীভাবে, রাজা কী করবে, কী করবে না –তার পুঙ্খানুপুঙ্খ নীতিনির্দেশ লিখিত হয়েছে। কারণ রাজা পুষ্যমিত্র ছিলেন একজন রাজহন্তা। বস্তুত ভার্গবই শূদ্র-বিদ্বেষপূর্ণ এবং পুষ্যমিত্রের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ মনুসংহিতায় বিষবৃক্ষ রোপণ করে দিলেন।
এই স্মৃতিগ্রন্থেই ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করা হয়েছে এবং অবশ্যই শূদ্রদের প্রতি কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। শূদ্রদের ঘৃণ্যতর করা হয়েছে। আদি মনুসংহিতায় বা স্মৃতি সমূহে শূদ্রদের প্রতি এত বিদ্বেষ ছিল না। মনুর মতে– “শূদ্র বিচারকের পদ পেতে পারে না।” (৮/২০) “যে রাজ্য শূদ্রবহুল, নাস্তিকতাক্রান্ত এবং দ্বিজশূন্য –সেই রাজ্য অচিরেই দুর্ভিক্ষ ও বহুবিধ ব্যাধিপ্রপীড়িত হয়ে বিনষ্ট হয়ে থাকে।” (৮/২২) বাস্তবিকই এই গ্রন্থ থেকে অশোকের দণ্ড সমতাগুলি বাতিল করা হয়েছে। উপরন্তু বলা হয়েছে, উচ্চশ্রেণির মানুষরা যদি নীচশ্রেণির মানুষদের উপর অত্যাচার করলে দণ্ড কম হবে। কিন্তু নীচশ্রেণির মানুষরা যদি উচ্চবর্ণের উপর অত্যাচার করে তাহলে তাঁর দণ্ড অধিক হবে। “দর্পের সঙ্গে শূদ্র যদি ব্রাহ্মণকে ধর্মোপদেশ দেয়, তাহলে রাজা তাঁর মুখে ও কানে গরম তেল ঢেলে দেবে।” (৮/২৭২) শূদ্র যদি শ্রেষ্ঠ জাতির প্রতি কোনো প্রকার হিংসামূলক কাজ করে তাহলে সেই অপরাধের জন্য হাত বা পা, নিতম্ব কর্তন করে দেবে, অথবা ঠোঁট দুটি ছেদন করে দেওয়া হবে।” (৮/২৭৯-২৮৩) মনু নির্দেশ দিয়েছেন– ব্রাহ্মণ বিশ্রদ্ধচিত্তে দাস-শূদ্রের ধন সম্পদ আত্মসাৎ করতে পারেন। কোনো জিনিসই তাঁর নিজস্ব নয়। তাঁর সমুদয় অর্থই ভর্তৃহার্য। (৮/৪১৭) এখানেই শেষ নয়, নিজেদের বন্দোবস্তও করিয়ে রাখেন। বলছেন –“রাজা অর্থাভাবে মরণাপন্ন হলেও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের কাছ কখনো কর গ্রহণ করবে না।” (৭/১৩৩) সেই মনুর নীতি আজও অব্যাহত। আজও মন্দিরের রোজগার আয়কর নেওয়া হয় না। মন্দিরের আয় নিষ্কর। আয়কর দফতরকে কোনো রিটার্ন জমা দিতে হয় না। অথচ ভাবুন তো কী বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ মন্দিরগুলো আয় করে। কষ্ট করে ভাবার দরকার নেই। আসুন দেখে নিই মন্দিরের রাজগার।
ভারতের সবচেয়ে সম্পদশালী মন্দিরটি হল কেরালায়। মন্দিরটির নাম পদ্মনাভস্বামী। এদের বার্ষিক আয় কত জানা যায় না। তবে এখানের সম্পদের মূল্য প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা।
তালিকার দ্বিতীয় নাম্বারে রয়েছে তিরুপতি বালাজি মন্দির। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেবতা। মন্দির চত্বরের মূল মন্দিরটি সোনা দিয়ে মোড়া। মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রদীপের আলোয় দেবদর্শন। কালো বিশাল মূর্তির মাঝে সোনার প্রলেপ। বছরভর ভিড় লেগেই থাকে এই বিশ্ববিখ্যাত মন্দিরে। হতদরিদ্র থেকে কোটিপতি, অভিনেতা থেকে মেগাস্টার, রাজনীতিবিদ থেকে মন্ত্রীসান্ত্রী, এমনকি দেশের বাইরের কূটনীতিবিদরাও তিরুপতি মন্দিরে আসেন। বছরভর প্রচুর মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। প্রতিদিন প্রায় ৭০ হাজার ভক্ত এখানে উপাসনা করতে আসেন। উৎসব ও পার্বণে এই সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই মন্দিরের বার্ষিক আয় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আয় হয় দান থেকে। দর্শনার্থীদের কাছে টিকিট বিক্রি করে আয় হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। বাকিটা আসে বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ থেকে। আছে ডোনেশন। এই মন্দিরে ২০ টন সোনা ও হিরার গহনা আছে। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুমালা তিরুপতি ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে শুধু সোনা রয়েছে ৩০০০ কেজি, আর তাদের ঘোষিত সম্পত্তি রয়েছে ৫০,০০০ কোটি টাকা।
জম্মু ও কাশ্মীরের বিষ্ণুদেবী মন্দির সবচেয়ে পুরাতন মন্দির। প্রতিবছর আনুমানিক ৮০ লাখ ভক্ত এখানে উপাসনা করতে আসেন। যে সংখ্যাটি বালাজি মন্দিরের পরেই। এই মন্দিরের আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। অন্য মন্দিরগুলোর মতোই এখানেও থাকার বন্দোবস্ত আছে।
সম্পদের দিক থেকে চার নাম্বারে পাঞ্জাবের অমৃতসরের গোল্ডেন টেম্পল বা সোনালি মন্দির। শিখ গুরু অর্জুন ষোড়শ শতকে এই মন্দির নির্মাণ করেন। প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার ভক্ত এখানে আসেন। কাঠ, সোনা আর রূপার কারুকাজে পুরো মন্দির দৃষ্টি কাড়ে। এই মন্দিরের বার্ষিক আয় সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।
মুম্বাইয়ের গণপতি মন্দির হল দেবতা গণেশের মন্দির। অষ্টাদশ শতকে এই মন্দির তৈরি করা হয়েছে। গণেশের মূর্তির মুকুটে সাড়ে তিন কেজি সোনা ব্যবহার করা হয়েছে। দিনে গড়ে প্রায় লাখ খানেক ভক্ত গণেশকে একনজর দেখতে এখানে আসেন। মুম্বাইতে হওয়ার কারণে বলিউডের নামিদামি তারকারা এখানে আসেন। তারা মুক্তহস্তে দান করেন। ফলে সবমিলেয়ে বছরে আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা আয় করে এই মন্দির।
মুম্বাই শহরের প্রান্তে আর-একটি মন্দির আছে সাঁইবাবা মন্দির। প্রতিবছর কয়েক লাখ দর্শনার্থী এখানে আসেন। এই মন্দির দান থেকে প্রতিবছর আয় করে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
যাই হোক, ভারতীয় শ্রেণিগুলি যত বনিয়াদি স্বার্থ বিবর্তিত করে নিজেদের স্থানুবৎ অচল করতে লাগল ততই উচ্চশ্রেণির রক্তের বিশুদ্ধতা, জন্মের পবিত্রতা, আচার-ব্যবহারের নানাপ্রকারের বিভিন্নতা ও দাবি উদ্ভূত হতে থাকল। পরিশেষে এলো Divine Right of King। ভারতীয় সমাজ প্রবেশ করল সামন্ততান্ত্রিক যুগে। মানবধর্মশাস্ত্রে ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও শূদ্র এবং পতিতদের প্রতি বিশেষ কঠোর ব্যবস্থা দেখে জয়সওয়ালের অনুমান সত্য বলে মনে হয় যে, মৌর্য সাম্রাজ্য ধ্বংস হওয়ার পর ব্রাহ্মণাধিপত্যের সময় ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে মনুসংহিতা তৎসহ বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র রচিত হল। পুষ্যমিত্রের রাজত্বাধীন রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণাধিপত্যের প্রথম যুগ বলা হয়। রাষ্ট্রীয় আইন-অনুশাসনও তখন সেই শ্রেণির স্বার্থ-সুবিধা অনুসারেই সৃষ্টি হয়।
মৌর্যযুগ অবসানের পর ব্রাহ্মণরা ‘অবধ্য’ ঘোষিত হলেও মৌর্যযুগে বা তারও আগে ব্রাহ্মণ বধ্যই ছিল। অনেকে মনে করেন অশোকের সমদণ্ডনীতিতেই ব্রাহ্মণরা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ল। এর ফলে ব্রাহ্মণ-বিদ্রোহে মৌর্য সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়। বাস্তবিক এ তথ্য সত্য নয়। পূর্বে স্থলবিশেষে ব্রাহ্মণদেরও মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। মহাভারতে যেমন ব্রাহ্মণদের মৃত্যুদণ্ড ছিল, তেমনই বৃহদারণ্যক উপনিষদেও দেখতে পাই জনৈক ব্রাহ্মণ তার্কিক যাজ্ঞবন্ধ্যের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় মুণ্ডহীন হয়েছিল। পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণে বর্ণিত আছে, মনিবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার করলে পুরোহিতেরও মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। তবে এগুলো ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের শ্রেণি-সংঘাতের পরিচায়ক। অর্থশাস্ত্রেও আমরা পাচ্ছি, বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে ব্রাহ্মণকে জলে ডুবিয়ে মারার নির্দেশ। ব্রাহ্মণপ্রবর কৌটিল্য মৌর্যসাম্রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন। কাজেই ব্রাহ্মণের বধ্যতা মেনে নিতে হয়েছিল। ব্রাহ্মণদের অকথ্য অত্যাচারে সমাজের বেশিরভাগ নীচজাতীয় মানুষজন বৌদ্ধধর্মে চলে যাচ্ছিল। এসময় কৌটিল্যের পক্ষে শূদ্রদের ‘আর্যত্ব’ না। দিয়ে আর কোনো উপায় ছিল না। অধিকাংশ মানুষ তখন ভেরীঘোষ অপেক্ষা বুদ্ধের ধর্মঘোষ শ্রবণ করাই শ্রেষ্ঠ মনে করেছিলেন। ধৰ্ম্মঘোষ শ্রবণ করা মানেই পুরোহিত ডেকে যাগযজ্ঞ করার মানুষজনও আর থাকছিল না। বৌদ্ধধর্ম ও শূদ্ৰাধিপত্যের ফলে ব্রাহ্মণদের বনিয়াদি স্বার্থে ব্যাপক আঘাত লাগে। সেই আঘাতেই ব্রাহ্মণপ্রবর ক্ষেপে ওঠেন। প্রাচীন মনুসংহিতা গ্রন্থটি চালাচালি করে নব সংযোজন করলেন। মনুর নামেই মনুসংহিতা প্রয়োগ হতে থাকল। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পর মনুশাসন শূদ্রদের দাবিয়ে রাখার জন্য কঠোর বিধিনিষেধ প্রণয়ন করলেন।
শাস্ত্রসমূহ ঘোষণা দিল –সব ধরনের পাপের পাপী হলেও ব্রাহ্মণকে কখনোই হত্যা করা যাবে না (মনুসংহিতা, ৮/৩৮০)। রাজাকে নির্দেশ দেওয়া হল– ক্রীত হোক বা না হোক, শূদ্রকে দিয়ে সমস্ত রকমের দাস্যকর্ম করিয়ে নেবেন। কারণ বিধাতা শূদ্রদের দাস্যকর্ম করানোর জন্যেই সৃষ্টি করেছেন। শূদ্র প্রভুমুক্ত হলেও দাসত্বমুক্ত হয় না। দাস্যকর্ম তাঁর জন্য স্বাভাবিক। অতএব কার সাধ্যি শূদ্রদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবে? এইভাবেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কৌশলে শূদ্রদের ‘চিরঅভিশপ্ত থেকে যাওয়ার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেল। শূদ্রদের প্রতি ঘৃণা এমন পর্যায়ে চলে গেল যে, শূদ্রের কেউ উচ্চবর্ণের দাওয়ায় বসলে সে উঠার পর গোবরজল দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয় শূদ্রের ছায়া মাড়ালে বা শূদ্র ছুঁয়ে দিলে উচ্চবর্ণের মানুষরা স্নান করে শুদ্ধ বা পবিত্র হত। উচ্চবর্ণের সামনে দিয়ে শূদ্রকে কোমর ভেঙে পাশ কাটাতে হবে। উচ্চবর্ণের সামনে ছাতা মাথায় দেওয়া যাবে না, কখনোই পায়ে জুতো পরা যাবে না, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো কাপড় রাখতে পারবে না ইত্যাদি নানাবিধ অবমাননাকর সমাজব্যবস্থা প্রচলন হল।
ব্রাহ্মণ রাজা হতে পারে। ব্রাহ্মণ দেবতাও হতে পারে। কিন্তু শূদ্র দাস ছাড়া কিছুই হতে পারে না। ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী বৌদ্ধ ও শূদ্রদের প্রতি এইভাবেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। মৌর্যরাও ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী ছিলেন। ব্রাহ্মণ্য প্রতিক্রিয়ায় মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন হল। শুরু হল ব্রাহ্মণ্যাধিপত্যের প্রথম যুগ, তা হল পুষ্যমিত্রের রাজত্বাধীন রাষ্ট্রেই। এই সময় সুঙ্গ, কম্ব বংশ মগধের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে উত্তর ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার লাভ করে। পরে দক্ষিণ ভারতে অন্ধ্র, শতবাহন বংশ প্রভূত্ব শুরু করে।
এ সময় দক্ষিণ ভারত উপমহাদেশে এক রাজশক্তির উত্থান হয়। এঁদের অন্ধ্র বা অন্ধ্রভৃত্য বলা বলা হত। মনু তাঁর স্মৃতিগ্রন্থে মেদ, চণ্ডালের মতো গোষ্ঠীকে পতিত বলেছেন। যদিও অন্ধ্রভৃত্য শতবাহন বংশ নিজেদেরকে ব্রাহ্মণ বলত। এই বংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা সিরি সতকর্ণি গোতমিপুত্ত নিজেকে ‘একবীর’ ও ‘একব্রাহ্মণ’ বলতেন। ইনি ব্রাহ্মণ্যত্বের ঠেলায় ক্ষত্রিয়দের অহংকার নষ্ট করে দেন। দ্বিজদের স্বার্থোন্নতি সাধন করে চতুর্বর্ণের মিশ্রণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
অতএব যে শ্রেণির হাতে শাসনযন্ত্র থাকবে রাষ্ট্রের আইন-অনুশাসন ইত্যাদি ব্যবস্থাপত্রও সেই শ্রেণির স্বার্থ ও সুবিধা অনুসারেই সৃষ্ট তথা বিধিবদ্ধ হয়। আজও তার অন্যথা হয় না। অতএব রাজবংশের পরিবর্তন হলেও শাসন পদ্ধতির তেমন কোনো পরিবর্তন হত না। তথাকথিত ধর্মগ্রন্থগুলি তো আদতে শাসনগ্রন্থ বা আইনগ্রন্থই। প্রাচীন রাষ্ট্রধারণায় ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা শাসিত হলেও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুশাসন তেমন অনুসরণ করা হয় না। তবে সামাজিক অনুশাসনে আজও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রভাব আছে। পুরোহিততন্ত্র সেই অনুশাসন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মৌর্যযুগের অবসানের পরপরই ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের অস্ত্র হিসাবে শাস্ত্র-সংহিতা পুরাণাদি রচিত হল। এইসব গ্রন্থগুলি পাঠ করেই অনুধাবন করা যায় ব্রাহ্মণদের মূল লক্ষ্য সমাজের চার শ্রেণি– ব্রাহ্মণ, রাজা বা ক্ষত্রিয়, নারী ও শূদ্র। এই চার শ্রেণির জন্য ব্রাহ্মণগণ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে ফেলেছেন, যা হিন্দুসমাজে সম লাভ করেছে। ঐতিহাসিক জয়সওয়াল বলেন, অন্ধ্ররাজাদের সমসাময়িককালে উত্তর ভারতেই যাজ্ঞবল্ক্যর সংহিতা রচিত হয়। যাজ্ঞবল্ক্য শতবাহন বংশের রাজত্বকালের সমসাময়িক ছিলেন। যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর সংহিতার প্রথম অধ্যায়ের ২৭৩ নম্বর নির্দেশিকায় বৌদ্ধভিক্ষুর বিরুদ্ধে বিষ উগড়ে দিয়েছেন। তিনি সেই নির্দেশিকায় বলেছেন –“হরিদ্রা রঙের কাপড় পরিধানকারী ব্যক্তিগণ অশুভ-দর্শন”। শূদ্রদের বিরুদ্ধে বলছেন– “দ্বিজজাতিদের শূদ্রা স্ত্রীলোক গ্রহণ নিষিদ্ধ। শূদ্র কেবল নিজ জাতির মধ্যে বিবাহ করবে। কারণ প্রতিলোম বিবাহের সন্তানেরা ‘অসৎ’ এবং অনুলোম বিবাহের সন্তানেরা ‘সৎ’ বলে বিবেচিত। ভারতে যে ‘মিতাক্ষরা’ আইন, তা যাজ্ঞবন্ধ্যের সংহিতার উপরই তার ভিত্তি স্থাপিত, যা আজও ভারতে বিদ্যমান। অথচ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শিরোমণি তথা আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকর কী বলছে পড়ন– “শূদ্র মহিলাদের প্রথম সন্তান ব্রাহ্মণ ঔরসজাত হওয়া বাঞ্ছনীয়, তাঁর বিবাহ যাঁর সঙ্গেই হোক না কেন। এতে ব্রাহ্মণ জাতের গুন নিচু জাতের মধ্যে সম্প্রসারিত হয়” (অর্গানাইজার, ১৯৬১)।
ব্রাহ্মণ্যযুগের পর পুনরায় বৈদেশিক আক্রমণ হল উপমহাদেশে প্রবেশ করে বর্বর শক জাতি। এরা ইরানীয় জাতি হলেও ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে ভারতীয় সভ্যতা ও ভারতীয় ধর্ম গ্রহণ করে। এরপর মধ্য এশিয়া থেকে কুষাণরা ভারতে প্রবেশ করে শকদের স্থান দখল করে নেয়। তবে কনিষ্করা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম (এ সময় হিন্দু নামে ধর্ম ছিল না। সেইসময়কার কোনো গ্রন্থে এই ধর্মের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।) প্রত্যখ্যান করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। এ সময় ধর্মাচরণে ও সমাজে ব্যাপক ওলোটপালোট লক্ষ করা যায়। এই সময়েই শৈবধর্ম, মহাযান, সূর্যপুজো ও কৃষ্ণের উপাসক সম্প্রদায়ের উত্থান হয়।
বিদেশি তথা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বলে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা কুষাণরা চিরকাল বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। কুষাণ ক্ষত্রপরা ভারতীয় নাম ও ধর্ম গ্রহণ করলেও গুপ্তসম্রাটদের দাপটে সমূলে উৎপাটিত হয়। কুষাণরা ব্রাহ্মণদের অবিশ্বাস করতেন। সেইজন্যেই কুষাণ রাজারা শূদ্ৰজাতিদের মধ্য থেকে নিজেদের কর্মচারী নিয়োগ করতেন। এ সময়েই বৌদ্ধপণ্ডিত অশ্বঘোষ বলেছেন– “ব্রাহ্মণদের আর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করার কোনো কারণ নেই। কারণ শূদ্ররা এখন ব্রাহ্মণদের সমান পণ্ডিত হয়েছে। এক্ষণে ব্রাহ্মণ ও শূদ্র সমান” (বজ্ৰচ্ছেদিকা)। বস্তুত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রচারের সময় থেকেই ভারতের ইতিহাসে ‘পতিত’ শ্রেণির পুনরুত্থান হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী ধর্মের সঙ্গে ব্রাহ্মণশ্রেণির এত বিরোধ ও সংঘর্ষ ছিল যে, সমাজের নিম্নস্তরের শ্রেণি তৎসহ পতিত শ্রেণিরা অন্য নতুন ধর্ম গ্রহণ করে উচ্চবর্ণের উৎপীড়ন ও শোষণনীতির কবল থেকে উদ্ধার পেতে চাইছিলেন। প্রথম দিকে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মে এবং ইসলাম ধর্মে ধর্ম গ্রহণ করে মুক্তির পথ খুঁজে নেয়। অসংখ্য নিম্নবর্গীয় হিন্দুও খ্রিস্টধর্মে চলে আসেন।
কুষাণযুগের পর শুরু হয় গুপ্তযুগ। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে এই যুগটা প্রাচীনকালের হিন্দু-সভ্যতার চরমাবস্থা। এই সভ্যতার ইতিহাস পাঠ করলেই জানা যায়, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রাধান্যকালে পতিতদের অবস্থা কেমন ছিল। বৌদ্ধ পরিব্রাজকরা এই সময়েই ভারতে এসেছিলেন। তাঁদের রচিত গ্রন্থ থেকে জানা যায় শূদ্র, চণ্ডাল তথা পতিতদের দুরবস্থার ইতিহাস। জানা যায়, নিম্নজাতির মানুষরা এই সময়েই জাতিচ্যুত বলে বিবেচিত হত এবং তাঁদের নগরের বাইরে বসবাস করতে হত। অনেকের মতে, গুপ্ত সাম্রাজ্যেই বর্তমানের ব্রাহ্মণ্যবাদীয় হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজ বিবর্তিত শুরু করে। এই সময় থেকেই পৌরাণিক ধর্ম আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে এবং পুরাণসমূহ ও মহাকাব্যগুলি বর্তমান কলেবর প্রাপ্ত হয়েছে। সংকলনের কাজও শেষ হয়। এরপর ভারতে জাতীয়বাদীয় যুগ আরম্ভ হয় এই একজাতীয়তা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবাধীন হয়। গুপ্ত শাসনকালেই ব্রাহ্মণরা নিজেদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে ‘ভূ-দেবতা’ রূপে জাহির করতে থাকে। এই যুগে স্মৃতিকারদের মধ্যে নারদ ও বৃহস্পতি ছিলেন প্রধান। এই সময়েই নারদ ‘বিষ্ণুসংহিতা’ গ্রন্থে ব্রাহ্মণদের অবধ্য ও শারীরিক শাস্তিভোগের অতীত বলেছেন। গুপ্তযুগেই পুরোহিত শ্রেণি ভগবানের প্রতিনিধি হয়ে গেলেন। সেই কারণেই তাঁদের সাত খুন মাফ। সেইসঙ্গে রাজারাও যে ভগবানের প্রতিনিধি ও দৈবশক্তিসম্পন্ন, সেটাও প্রচার হতে থাকল। সেটা নথি হিসাবে মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ে সংযোজিত হয়। বিষ্ণুসংহিতাতে বলা হয়েছে, “নিম্নশ্রেণির মানুষ উচ্চশ্রেণির মানুষের আসনে বসলে সেই নিম্নশ্রেণির নিতম্বে আগুনের ছাপ দিয়ে নির্বাসিত করে দেবে।” শূদ্রদের উদ্দেশ্যে আরও বলা হয়েছে –“সে যদি থুতু ফেলে তাঁর ঠোঁট কেটে দেবে।” বলা হয়েছে– “শূদ্র জাতিচ্যুত, তাই কোনো জাতিচ্যুত ব্যক্তি সাক্ষীরূপে গৃহীত হবে না।” শূদ্রদের সঙ্গে দ্বিজদের বিবাহ নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছে– “দ্বিজেরা যদি নিম্নশ্রেণির স্ত্রীলোককে বিবাহ করে তাহলে তাঁরা তাঁদের পুত্রদের ও বংশকে শূদ্রের স্তরে নামিয়ে দেয়। আর এসব ধর্মোপসনার জন্য রক্তের পবিত্রতা রক্ষার তাগিদেই এমন কঠোর ব্যবস্থা। এই অজুহাতেই নীচজাতির সঙ্গে বিবাহ আহারাদি বন্ধ করা হয়। এ বিষয়ে ঐতিহাসিক ডা. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত স্পষ্ট করে বলেছেন –“প্রকৃতপক্ষে ইহা কিন্তু নিম্নশ্রেণি হইতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপালন করিবার জন্য আলাদা হইবার ফন্দি মাত্র। এই যুগে রাজা ও পুরোহিত উভয়েই ভগবানের সনদপ্রাপ্ত লোক হয়। এই সময়েই গণ-সাধারণকে শোষণ ও লুণ্ঠনের জন্য ধর্ম ও রাষ্ট্র এক হয়।”
কিন্তু খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যেও তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে হুন আক্রমণে। হুনরা ছিল মধ্য এশিয়া থেকে আসা এক নিষ্ঠুর ও বর্বর জাতি। হুনদের বাধা দিতে গিয়ে গুপ্তরাজগণ হীনবল হয়ে পড়ে। এখন প্রশ্ন হল– এইসব শক, কুষাণ, হুন, পারদ, গুর্জরদের মতো বিদেশি বর্বর জাতিগুলো ভারতে প্রবেশ করেছিল এবং তাঁরা উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজত্ব করেছিল, তাহলে এঁরা গেল কোথায়? তাঁরা সমূলে নির্বংশ হয়ে গেছে এমন কোনো তথ্য তো পাওয়া যায় না। অতএব অনুমান করে নিতেই পারি, এঁরা কোনো না-কোনো ভারতীয় ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে স্বকীয়তা খুঁইয়েছে। গ্রিকদের অনেকেই ভারতীয় ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এঁদের সকলেরই সত্তা ভারতীয় সমাজে বিলীন হয়ে গেছে। তাঁরা কেউ বৌদ্ধ, কেউ জৈন, কেউবা ব্রাহ্মণ্যবাদীয় হয়ে তথাকথিত হিন্দুধর্মে মিশে যায়। ব্যতিক্রম কেবল বিদেশি আক্রমণকারী মুসলিমরা। মুসলিম আক্রমণকারীরা ভারতে প্রবেশ করেছে, রাজত্ব করেছে দীর্ঘ ৮০০ বছর। কিন্তু তাঁরা কেউই নিজের ধর্মীয় স্বকীয়তা ত্যাগ করে ভারতীয় কোনো ধর্মের ধারেকাছে ঘেঁষেনি। উপরন্তু তথাকথিত হিন্দুধর্মে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে ইসলাম ধর্ম প্রচুর অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে পড়তে থাকল নানা কারণে। ইসলামের এই আগ্রাসন থেকে হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-শিখ সকল ভারতীয় ধর্মই ব্যর্থ হল। ইসলাম শাসনকালে সবচেয়ে বেশি ধর্মান্তরিত হয়েছিল তথাকথিত নিম্নবর্গীয়রা। কিন্তু একজন মুসলিমও হিন্দু বা বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকেই ভারতীয় হিন্দু-বৌদ্ধ শাসকরা ক্ষমতাচ্যুত হতে শুরু করে। সেই মুসলিম শাসক দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হিন্দু-বৌদ্ধ রাজাদের বিস্তারিত ইতিহাস তেমন পাওয়া যায় না। সেই পতনের ইতিহাস কেউ বোধহয় লেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। তবে মুসলিম শাসনে অমুসলিম শাসকরা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পড়লেও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ভেদ-বিভাজন কঠোর থেকে কঠোরতর করে চলছিল। সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ্যবাদীয় মনোবৃত্তি পর্যবেক্ষণ করে সেই সমাজের অবস্থা বোঝা যায়। এ সময়েই রচিত হয়েছিল বেশকিছু কঠোর অনুশাসনযুক্ত গ্রন্থ। তার মধ্যে সৎত্রিমিসাংমাতা’ গ্রন্থে বলা হল –“বৌদ্ধ, পাশুপত্য, জৈন, নাস্তিক কপিলে শিষ্যদের গাত্র স্পর্শ করলে স্নান করতে হয়। পাঠক লক্ষ করুন, মুসলিমরা কিন্তু এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে অচ্ছুৎ হয়নি। অচ্ছুৎ সেদিন থেকেই হল যেদিন থেকে নিম্নবর্গীয়রা মুসলিম হতে শুরু করে দিল। নতুন কিছু নয় এটা। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ঠিক যেভাবে হিন্দু নিম্নবর্গীয়দের ঘৃণ্য ও অচ্ছুৎ ভাবত, ঠিক সেই সূত্রেই মুসলিম হয়ে যাওয়া নিম্নবর্গীয়দের ঘৃণ্য ও অচ্ছুৎ করল। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তথাপি নিম্নবর্গীয়দের যথাযথ সম্মান জানিয়ে ফিরিয়ে আনার ন্যূনতম চেষ্টা করেনি। সেদিন যদি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ব্রাহ্মণ্যবাদে কিঞ্চিৎ শিথিলতা এনে নিম্নবর্গীয়দের যথাযযাগ্য সম্মান জানাতে পারত, তাহলে কখনোই এত সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায় থেকে মানুষ ইসলাম ও বৌদ্ধধর্মে কনভার্ট হয়ে যেত না।
বিদেশি শত্রুদের সঙ্গে বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন ছিল নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা। ঐক্য তো দূরের কথা, উল্টে একটা জাতি ভেঙে হাজার টুকরো হয়ে গেল। ফলে বিদেশি আক্রমণকারীরা পেয়ে গেল ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী একটা গোষ্ঠীর সাহচর্য। তা না-হলে বিদেশ থেকে আসা ভিন্ন ধর্মের একটা জাতি দীর্ঘ ৮০০ বছর ভারত শাসন করতে পারত না। আরও কিছু তথ্য শোনাই আপনাদের। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ‘বিষ্ণুধর্মশাস্ত্র গ্রন্থ লিখে ফেললেন এসময়। কী বলছেন এ গ্রন্থে? বলছেন –“হরিদ্রাবণের বস্ত্র পরিহিত সাধুদের (বৌদ্ধ) ও কাপালিকদের দর্শন মঙ্গলজনক নয়।” এই গ্রন্থে ম্লেচ্ছ, অন্ত্যজদের সঙ্গে বাক্যালাপ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ম্লেচ্ছদেশে (সমুদ্র অতিক্রম করে যে দেশে যেতে হয়, কালাপানি) পর্যটনও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বস্তুত এ সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী তথা উচ্চবর্গীয় হিন্দুসমাজ নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। ফলে হিন্দুসমাজ সংকীর্ণ হতে হতে ক্রমশ কূর্মাবস্থা প্রাপ্ত হতে শুরু করল। মনু, যাজ্ঞবল্ক্যরা বৌদ্ধ দেশগুলিকে ব্রাহ্মণবর্জিত ‘ম্লেচ্ছদেশ’ বলে ঘোষণা করে দিল। অচ্ছুৎ হিসাবে বৌদ্ধ আর মুসলিমদের এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিল বলা যায়। এমনভাবে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণবাদীরা নিজেদের চারদিকে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তুলে দিল। এ সময় থেকেই জাতিভেদ, স্পর্শদোষ, বিধর্মীদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন গেড়ে বসতে থাকল। এমতাবস্থায় শূদ্র-অন্ত্যজ তথা পতিতদের ভাগ্যে অতীব দুর্দশা চিরস্থায়ীভাবে পোক্ত হয়ে গেল। ব্রাহ্মণ্যবাদী ঘূত্মার্গীয় জাতিভেদের ভীষণ কঠোরতা ও বিধিনিষেধ সংবলিত বর্তমান এই ভারতের হিন্দুসমাজের এই সময় থেকেই পাকাপাকিভাবে শুরু গেল, যা আজও প্রবাহমান। ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্গীয়দের উৎপীড়ন সংখ্যালঘু স্বদেশি বৌদ্ধদের দেশ থেকে উৎখাত করতে সক্ষম হলেও সংখ্যালঘু বিদেশি মুসলিম শাসকদের উৎখাত করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যে জাতি নিজেদের মধ্যে কোন্দল হানাহানি রক্তারক্তি করে থাকে, সেই জাতির দিগ্বিজয় অনেক দূরের স্বপ্ন, জয়ী হতেই পারে না।
পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষক প্রমোদবরণ বিশ্বাস তাঁর ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ ও দলিত সমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন– “…বিবেকানন্দ কিন্তু এই দরিদ্র মূর্খদের জন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করে যাননি। বরং বাস্তবে তিনি ঠিক এর বিপরীত কাজটিই করে গেছেন। বিবেকানন্দের নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কোন্ সমাজের ছাত্ররা ভর্তি হতে পারবে। তার একটা সুনির্দিষ্ট ধারা তিনি রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের সংবিধানে নিজের হাতে Fotelcata– Only the Hindu boys of good family will be admitted in this mission.’ অর্থাৎ একমাত্র কুলীন হিন্দু পরিবারের ছেলেরাই এই মিশনে ভর্তি পারবে। এই গোপন সার্কুলারের মধ্য দিয়েই আমরা প্রকৃত বিবেকানন্দকে দেখতে পেলাম। সুতরাং দলিতদের দৃষ্টিতে স্বামী বিবেকানন্দ আসলে হঠকারী ব্যক্তিত্ব। তাই তো দেখি রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দরিদ্র, মূর্খ, চাষাভূষো তফসিলি এবং আদিবাসী সমাজের ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির জন্য সংবিধান নির্দেশিত সামান্য সংরক্ষণ প্রথাও মান্য করা হয় না। আর সংরক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ তো দূর অস্ত! কারণ এতে নাকি মিশনের ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাবে।”
“স্বধর্মে নিধনং শ্ৰেয় পরধর্মো ভয়াবহঃ”– এই শ্লোকটি গীতায় পাওয়া যায়। এখানে যে ধর্মের কথা বলা হয়েছে, সেটা হিন্দুধর্ম নয়। সেই ধর্ম ব্রাহ্মণদের ধর্ম ব্রাহ্মণ্যধর্ম। এ সময় দুটোই ধর্ম– একটি আর্য ধর্ম, অন্যটি অনার্য ধর্ম। আবার চতুর্বর্ণের মধ্যে একে অপরের বিচারে ‘পরধর্ম’। বর্ণবাদী ব্রাহ্মণেরা শ্রীকৃষ্ণের মুখে কথাগুলি বসিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করেছেন। সে সময় বর্তমান হিন্দুধর্মের মতো সন্মিলিত ধর্মের সৃষ্টি হয়নি, সে সময়ের ভারতীয় ধর্মকে সনাতন ধর্ম বললেই সঠিক হয়। গীতায় উল্লিখিত এই ধর্ম আসলে ব্রাহ্মণ ধর্ম, ক্ষত্রিয় ধর্ম, বৈশ্য ধর্ম এবং শূদ্র ধর্ম। এই ধর্ম রক্ষা করতেই ত্রেতাযুগের রাজা রামচন্দ্র শূদ্র শম্বুককে হত্যা করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তপস্যা করে ব্রাহ্মণ হতে চেয়েছিলেন। তার অপরাধ, তিনি লুকিয়ে বেদ পাঠ করেছিলেন। ঘটনাটি এ রকম : এক কুলিন ব্রাহ্মণের বালকপুত্র অসময়ে মারা যায়। রাজপুরোহিতরা রামকে বলেন, “রাজ্যে কেউ পাপ করেছে, যার ফলে এই অঘটন ঘটছে”। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, শম্বুক নামে এক শূদ্র সশরীরে দেবত্ব পাওয়ার জন্যে তপস্যা করছে এবং তা সে নিজেই সেই কথা স্বীকার করল (রামায়ণ : ৭/৬/২)। “সেই শূদ্রটি কথা বলতে বলতেই উজ্জ্বল খঙ্গ কোশ থেকে বের করে তার শিরোচ্ছেদ করলেন রাঘব।” তখন দেবতারা রামকে সাধুবাদ দিয়ে বললেন, “রাম তুমি দেবতাদের কার্যসাধন করলে, তোমার জন্য এই শূদ্র স্বভাক হতে পারল না।” (পৃ: ১৩)
রাবণ, কুম্ভকর্ণ, ইন্দ্রজিৎ, শূর্পণখা হত্যা তো আসলে শূদ্র তথা অনার্য হত্যাই। শূদ্র নির্যাতনের আর-একটি কাহিনি সকলেই কিছুটা জানেন, যা মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি এরকম : একলব্য ছিলেন মগধের অধিবাসী নিষাধরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র। গুরুদেব দ্রোণের কাছে একলব্য গিয়েছিলেন যুদ্ধবিদ্যা শিখতে। কিন্তু একলব্য ক্ষত্রিয় ছিল না বলে দ্রোণ তাকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি হননি। কিন্তু বালক একলব্য দ্রোণকেই গুরু মেনে গহীন বনে একমনে যুদ্ধবিদ্যা শিখতে থাকে। একদিন দেখা যায় একলব্য দ্রোণের ক্ষত্রিয় শিষ্যদের চেয়েও বড়ো যোদ্ধা হয়ে গেছেন। বনে ঘুরতে এসে একদিন দ্রোণ একলব্যের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে জানতে চান কে তার গুরু। একলব্য দ্রোণকেই গুরু বলে জানায়। দ্রোণ তখন পশ্চিমাকাশে কালো মেঘ দেখতে পান। দূরদর্শী দ্রোণ গুরুদক্ষিণা হিসাবে একলব্যের ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল দাবি করে বসলেন। ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে ফেলা মানে ধনুক চালানো সারাজীবনের জন্য শেষ। তা সত্ত্বেও সরলমনা একলব্যকে বিনাবাক্যে গুরুকে তা দিয়ে দিতে হল। আঙ্গুল কেটে দিতেই হত। না-হলে তাঁকে নিশ্চিত মৃত্যুবরণ করতে হত। দ্রোণাচার্য নিশ্চয় তাঁকে ক্ষমা করতেন না। এই ঘটনাটিকে অনেকে অত্যন্ত মহান হিসাবে দেখে থাকে। কিন্তু আমি সেভাবে দেখতে পারছি না। খুঁজে দেখা যাক কেন একলব্যকে তাঁর অত্যন্ত মূল্যবান বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি খোয়াতে হল। কারণ— (১) শিক্ষাগুরুর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছাড়াই একলব্য যে অস্ত্রবিদ্যা অর্জন করেছিল, সেই বিদ্যা তখনও পর্যন্ত দ্রোণের খাসশিষ্য অর্জুনের পক্ষে শেখা হয়ে ওঠেনি। কেন-না ব্রাক্ষণ ও ক্ষত্রিয় তথা দ্বিজ ছাড়া অন্য কারোকেই শিক্ষালাভ ও শিক্ষাদানের অধিকার দেওয়া হয়নি। কেবলমাত্র ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরা উপযুক্ত দক্ষিণার বিনিময়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে পারত। শূদ্রের বেলায় যে-কোনো শিক্ষাই নৈব নৈব চ।
অপস্তম্ভ ধর্মসূত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে– শূদ্র যদি বেদ পাঠ করে তবে তাঁর জিহ্বা কর্তন করা হবে এবং যদি বেদপাঠ শ্রবণ করে তাঁর কর্ণে গরম সিসা ঢেলে দেওয়া হবে। অতএব ক্ষত্রিয় অর্জুনকে পিছনে ফেলে শূদ্র একলব্য সামনে এগিয়ে যাবে, তা কী করে হয়! মাহাত্ম দিয়ে কী মল ঢাকা যায়? কারণ –(২) একলব্য ছিলেন মগধ দেশের উপজাতি। এই মগধের রাজা ছিলেন জরাসন্ধ এবং সেনাপতি ছিলেন শিশুপাল। মগধ ছিল হস্তিনাপুরের শত্রুদেশ, তাই হস্তিনাপুরের অন্নজলে প্রতিপালিত দ্রোণাচার্য চাননি যে, তাঁর বিদ্যা হস্তিনাপুরের বিপক্ষে প্রয়োগ হোক। একলব্য অজেয় হয়ে উঠলে দ্রোণের সমূহ বিপদ। দ্রোণের মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে না। কী সেই মনোবাঞ্ছ? দ্রোণের সঙ্গে দ্রুপদরাজার ভয়ানক শত্রুতা ছিল। দ্রুপদরাজাকে উচিত শিক্ষা দিতে অর্জুনকেই দ্রোণের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। দ্রোণ কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্র শিক্ষা শেষে গুরুদক্ষিণা হিসাবে দ্রুপদকে বন্দি করে আনার কথা বললে, এঁরা দ্রুপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং অর্জুন দ্রুপদকে বন্দি করে দ্রোণের কাছে নিয়ে আসেন। দ্রুপদের মৃত্যু হয় দ্রোণের শাণিত অস্ত্রেই এবং দ্রুপদ রাজার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের খড়গ দ্বারা দ্রোণের শিরচ্ছেদ হয়।
যদিও রামায়ণ-মহাভারত মহাকাব্য বই অন্য কিছু নয়, তা সত্ত্বেও বলব এই মহাকাব্য দুটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এই মহাকাব্য দুটিতে প্রচুর ইতিহাসের উপাদান আছে, যা তৎকালীন সমাজব্যবস্থার ছবি রক্ষিত আছে। সেই সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের প্রতাপ ছিল দোর্দণ্ড। এঁদের নির্দেশ ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়তে সাহস পেত না। রামায়ণ মহাভারতের পরতে পরতে মনুসংহিতার নির্দেশিত ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-শূদ্রের ছবি স্পষ্ট হয়েছে। সেইজন্য বোধহয় ব্রাহ্মণ্যবাদের কর্তৃত্বে এই মহাকাব্য দুটি ধর্মীয় গ্রন্থের সম্মান পায়। মহাভারতে আমরা দেখতে পাই ক্ষত্রিয় সমাজের অস্ত্রশিক্ষাও ব্রাহ্মণগণ নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন। ক্ষত্রিয় নন, অথচ পরশুরাম, দ্রোণাচার্য প্রমুখ ব্রাহ্মণগণ অস্ত্রগুরু হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। রাজকার্য পরিচালনাতেও তাঁরা ক্ষত্রিয়দের অভিভাবক হন। ব্রাহ্মণসেবা ও তাঁদের নির্দেশ পালন করাই হল ক্ষত্রিয় রাজার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। তাই ব্রাহ্মণ বশিষ্ঠের নির্দেশে ক্ষত্রিয় রামচন্দ্র শূদ্ৰপণ্ডিত শম্বুকের ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দেন। সেই সময়কার সমাজে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়রা কতটা ‘পাওয়ারফুল’ ছিলেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা আমি আমার ‘যুক্তিবাদীর চোখে রাম ও রামায়ণ’ গ্রন্থে আলোচনা করেছি।
ভগবান (?) মনু যতভাবেই প্রত্যাখ্যাত হোন-না-কেন, বৃহত্তর সংখ্যার মানুষ কিন্তু মনুর প্রভাব থেকে কোনোভাবেই মুক্ত হতে পারছেন না। আজও নানাভাবে সমাজে এবং বর্তমানের আধুনিক সমাজে আবর্তিত হচ্ছেন। মনু তাঁর হিন্দুত্বের প্রলম্বিত ছায়া দিয়ে আধুনিক সময়ের সমাজকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। সেই চেষ্টা উচ্চবর্ণেরা তো করেই, তার চেয়ে বেশি করে নিন্মবর্ণেরা। এমনকি দেখা যায়, উচ্চবর্ণদের কেউ কেউ যদিও উদারতার পরিচয় দিতে চায়, সেক্ষেত্রে নিন্মবর্ণের মানুষেরাও নিদান নিয়ে আসে, হিন্দুধর্ম শেখায়। মনুবাদে এত আনুগত্য! যদিও ২০০০ সালের ৩০ জানুয়ারি ‘পাইওনিয়ার’ পত্রিকায় তথ্য দিয়ে ছাপা হয়েছিল– জাতপাত ব্যবস্থাভিত্তিক ধর্মের অনুশাসনে ভারতে শত শত বছরে লক্ষ লক্ষ দলিত নিহত হয়েছেন শুধুমাত্র দলিত হওয়ার অপরাধে। তার মধ্যে প্রায় ত্রিশ লক্ষ দলিত নিহত হয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে। জ্ঞাতসারেই হোক কিংবা অজ্ঞাতসারে –মনুর নির্দেশ নিরন্তর পালিত হয় সারা ভারতেই।
মনু শূদ্র নিধনের জন্যে তো প্রেরণা দিয়েই রেখেছেন তাঁর মূল্যবান সংহিতায়। একাদশ অধ্যায়ের ১৩১ নম্বর শ্লোক তথা নির্দেশে বলছেন –একটা শূদ্র হত্যা করলে একটা বিড়াল বা নকুল বা চাষপক্ষী বা ভেক বা কুকুর বা গাধা বা পেচক বা একটা কাক পাখি হত্যার সমান পাপ হয় এবং সেই পাপ স্খলনের জন্যে ঠিক ততটুকুই প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।
“মার্জারনকুলৌ হত্বা চাষং মণ্ডুকমেব চ।
শ্বগোধোককাকাংশ্চ শূদ্ৰহত্যাব্রতং চরেৎ।”
একজন শূদ্ৰহত্যা একটি ব্যাঙ হত্যার সমান। খুবই ক্ষুদ্র বা তুচ্ছ কাজ বটে! উচ্চবর্ণের হিন্দুত্ববাদীদের মদতে পুষ্ট বিহারের রণবীর সেনা’ নামের সংগঠন শূদ্ৰহত্যার কাজে নিবেদিতপ্রাণ। ভারতে প্রতি ঘণ্টায় দুজন শূদ্র প্রহৃত হয়, প্রতিদিন ধর্ষিতা হন তিনজন দলিত নারী, প্রতিদিন খুন হচ্ছেন দুজন দলিত এবং পুড়িয়ে দেওয়া হয় দুটি দলিত-গৃহ (Report of the Ministry of Welfare of the Government of India, 1992-1993),
এহেন ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ব্রাহ্মণদের গা-জোয়ারি ফতোয়া যে সকলে মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন, তা কিন্তু মোটেই নয়। প্রতিবাদ যেমন হয়েছে, বিদ্রোহও হয়েছে। প্রতিবাদ যে হয়েছে তার প্রমাণ চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, বৈষ্ণব প্রভৃতি ধর্ম বা দর্শন ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফল। এইসব ধর্ম বা দর্শন গড়ে উঠেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের সৃষ্ট অস্পৃশ্যতা ও পতিতদের ঘৃণার বিরুদ্ধেই। এইসব ধর্ম বা দর্শন সমাজের প্রান্তিক অচ্ছুৎ ব্রাত্য দলিত শূদ্র পতিত অন্ত্যজদের সাম্যবাদের সমাজ উপহার দিল। বিরোধিতা বা মুখ খোলার পরিণাম কী হয়েছিল তা ইতিহাসেই রক্তের অক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে।
সম্ভবত চার্বাকরাই সর্বপ্রথম ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন। শুধু ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধেই নয়, প্রতিবাদ করেছে বেদের বিরুদ্ধেও। তাই চার্বাকরা নাস্তিক তকমা পেল এবং নিশ্চিহ্ন হতে হল। পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখ ভোগই মানুষের একমাত্র কাম্য’ বলে চার্বাকরা মনে করত। চার্বাক দর্শনের প্রভাব বুদ্ধের সময় ও প্রাক-বুদ্ধ যুগে উপস্থিত ছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন। মৈত্ৰায়ণীয় ও ছান্দোগ্য উপনিষদের রচনাকালেই চার্বাক মতবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। ঐতরেয় উপনিষদের কিছু অনুচ্ছেদে দেহাত্মবাদ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে মরণোত্তর চৈতন্যের অস্তিত্বের অস্বীকৃতির স্বপক্ষে কিছু শ্লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। কঠ উপনিষদের পরলোকগামী আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ছান্দোগ্য উপনিষদ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী বলে অনুমান করা হলে চার্বাক মতের জন্ম এই কালেই হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
চার্বাকগণের মতাদর্শ অনুসারে, ব্রাহ্মণরা হিন্দু নয়। বেদ, গীতা, মনুসংহিতা ইত্যাদি ব্রাহ্মণ্যধর্মের শাস্ত্র। চতুর্বর্ণপ্রথা, জাতপাত, অস্পৃশ্যতা এগুলি ব্রাহ্মণ্যধর্মের জিনিস। ব্রাহ্মণ্যধর্ম হিন্দুধর্ম নয় বা হিন্দুধর্মের কোনো অংশ নয়। ব্রাহ্মণ্যধর্ম হিন্দুধর্মের উপর পরগাছার মতো চেপে বসা একটি ধর্ম। আর এই ব্রাহ্মণ্যধর্মকে অবলম্বন করেই ব্রাহ্মণরা হিন্দু জাতির উপর আধিপত্য করে যাচ্ছে। হিন্দু জাতির উপর ব্রাহ্মণদের আধিপত্য কায়েম করার জন্যই ব্রাহ্মণ্যধর্মের সৃষ্টি। ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্রে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিধিবিধান, নিয়মনীতি, সত্যাসত্য বোধ বা পাপপুণ্যের ধারণাকে সেভাবেই সাজানো হয়েছে, যাতে তা নিঃসংশয়ে হিন্দুজাতির উপর ব্রাহ্মণদের প্রভুত্বকে কায়েম করে এবং হিন্দু জাতিকে ব্রাহ্মণদের বিশ্বস্ত ও অনুগত ক্রীতদাসে পরিণত করে।
এইভাবেই চার্বাকগণ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করতেন। কিন্তু লোকবল, বাহুবল এবং অস্ত্রবল না-থাকায় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের রক্তচক্ষুর সামনে চার্বাকগণ পরাস্ত এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল চিরতরে।পুড়িয়ে দেওয়া হল চার্বাকদের রচিত গ্রন্থসমূহ। যদি চার্বাকরাও সশস্ত্র প্রতিপক্ষ হিসাবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সঙ্গে সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতে পারত, তবে হয়তো অন্য এক ভারত দেখতে পেতাম। মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধরা এভাবে লাখো লাখো হিন্দুদের ধর্মান্তরে নিয়ে যেতে পারত না। এত সাম্প্রদায়িক হানাহানি হত না।
ব্রাহ্মণবাদীরা চার্বাকদের নিশ্চিহ্ন করতে এক তুড়িতে সমর্থ হলেও, বৌদ্ধদের সঙ্গে তেমন এঁটে উঠতে পারেনি। ব্রাহ্মণ্যবাদের চরম বিরোধিতা করে বৌদ্ধদর্শন এবং বৌদ্ধ অনুগামীরা সারা ভারতে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকল। প্রাক-বুদ্ধ ও বুদ্ধ-পরবর্তী সমাজে ব্যাপক ক্রীতদাস প্রথা ছিল, ভয়ংকর দারিদ্র্য ছিল। অত্যন্ত চড়া সুদে ঋণ দিতেন শ্ৰেষ্ঠী, বণিক, ধনী সম্প্রদায়। ঋণে জামিন হিসেবে সম্পত্তি না রাখতে পারলে বউ, বোন বাঁধা রাখতে হত ঋণদাতার কাছে। এই মহিলাদের শ্রমের সঙ্গে দেহ দিতে হত। এরপর ঋণ শোধ না হলে ঋণগ্রহীতাকে দাস হিসাবে থাকতে হত ঋণদাতার কাছে। দারিদ্র্য ও দাসত্বের এই যন্ত্রণা ও দুঃখছিল ভয়ংকর। শ্রমজীবী শূদ্রদের জীবনও ছিল বিভীষিকাময়। দিন থেকে রাত কঠোর শ্রমের বিনিময়ে একবেলা উচ্ছিষ্ট খাবার মিলত। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতে যাঁদের শূদ্র বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, বৌদ্ধগ্রন্থে তারাই চণ্ডাল, নেসাদ, পুকুস নামে পরিচিত। পরিচয় পাল্টালেও ধনী মহাজনদের উৎপীড়ন একই রইল। শোষিত শূদ্ররাও বৌদ্ধধর্মকে গ্রহণ করে ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিল।
উচ্চবর্ণের ভারতীয় দার্শনিক ও ঐতিহাসিকরা বুদ্ধকে উপজাতীয় থেকে ক্ষত্রিয় বানিয়ে ছেড়েছেন। শুদ্ধোধনকে বানালেন রাজা। অথচ বুদ্ধের সময়কার ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছে বুদ্ধ ছিলেন নীচবংশীয় মানুষ। চরক, সুশ্রুত, নাগার্জুন, ভাস্করাচার্য, বাৎসায়ন, কৌটিল্য, পাণিনি, অশ্বঘোষ প্রমুখ মননশীল পণ্ডিতরা ছিলেন বৌদ্ধ বা বৌদ্ধভাবাশ্রয়ী। বৌদ্ধযুগে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল। ভারতবর্ষে তখন বৌদ্ধধর্ম রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম হল উদার। জাত পাত-বর্ণ নেই। সবাইকে গ্রহণ করতে হাত বাড়িয়েই আছে। এই অবস্থায় বিদেশ থেকে আগত রাজশক্তি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করাকেই সম্মানজনক মনে করেছিলেন। এই কারণেই গ্রিক, শক, কুষাণ প্রভৃতি রাজশক্তি ও তাঁদের সঙ্গে আসা সৈন্য-সামন্ত বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই বৌদ্ধধর্ম রাজশক্তির সহযোগিতায় তুঙ্গে উঠেছিল। বৌদ্ধধর্মের উত্থান ঠেকাতে কিছুটা কৌশল গ্রহণ করল। ব্রাহ্মণবাদীরা গ্রিক, শক, কুষাণদের ‘পতিত ক্ষত্রিয়’ বলে আখ্যা দিল। এতে দুটি ঘটনা ঘটল— (১) ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বর্ণপ্রথা বড়ো ধরনের ধাক্কা খেল। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের একটা বড়ো অংশই বর্ণের নতুন সমীকরণ মেনে নিল না। (২) সমাজের বহু নিচু বর্ণের মানুষ বিদেশিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে সমাজের দু-এক ধাপ উপরে উঠতে চেষ্টা করল। এরপর একটা প্রশ্ন উঠে আসতেই পারে, সম্রাট অশোক তো বিদেশি ছিলেন না, তিনি কেন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন? যুদ্ধ, গণহত্যা, লুণ্ঠন, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে অশোক তাঁর রাজত্বকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। এই বিস্তৃতির পিছনে নিষ্ঠুর সামরিক শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়েছে। বস্তুত সেই রক্তাক্ত হাত ধুয়ে ফেলতেই ধর্ম পরিবর্তন করে নিরামিষাশী হয়ে গেলেন। সবাই বললেন। ‘বোধোদয়। তারই পরিণতিতে অশোক অহিংস বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
বৌদ্ধধর্মের নিরন্তর প্রসারে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ভীত হয়ে পড়লেন। ব্রাহ্মণদের ফতোয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা শূদ্র তথা অন্ত্যজরা ব্রাহ্মণ্যধর্ম ত্যাগ করে দলে দলে বৌদ্ধধর্মে চলে যাচ্ছিলেন। সংকটে পড়ে গেল ব্রাহ্মণ্যধর্ম। অপ্রতিরোধ্য বৌদ্ধধর্মকে প্রতিরোধ করতে আদি শঙ্করাচার্যকেও আসরে নামতে হয়েছিল। তাঁরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল বৌদ্ধধর্মে যাওয়া আর ব্রাহ্মণ্যধর্মে থাকা একই ব্যাপার। কারণ ভগবান বুদ্ধ স্বয়ং বিষ্ণুরই অবতার। বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই অংশ। বলা হয় বৌদ্ধধর্ম সবসময়ই হিন্দুধর্মের ভিতরেই। বর্তমান ভারতের সংবিধানেও বৌদ্ধ, জৈন, শিখদের হিন্দুধর্ম হিসাবে দেখানো হয়েছে, যা নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে মামলা পর্যন্ত। কিন্তু সে বিষয়ে আজও কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। যদি এঁরা হিন্দুধর্মের মধ্যেই, তবে বুদ্ধের সংস্কার হিন্দুধর্ম কেন মেনে নেয়নি, তার উত্তর পাওয়া যায় না। যাই হোক, ব্রাহ্মণ্যবাদের তীব্র প্রভাবে বৌদ্ধরা ভারতে গুটিয়ে গেলেও ভারতের বাইরে বিস্তার লাভ করতে কোনো অসুবিধাই হয়নি।
পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে খুব চাপ হয়ে গেল ভারতে মুসলিমদের আগমনের পর। রিচার্ড ইটনের প্রামাণিক গ্রন্থ “দি রাইজ অফ ইসলাম অ্যান্ড দি বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’ সূত্র থেকে জানা যায়, মোগল যুগে কোন্ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের নতুন কারণে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় কৃষকরা ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। এই আকৃষ্ট এতটাই ছিল যে অবিভক্ত বাংলাদেশে মুসলিমরাই সংখ্যাগুরু হয়ে গেল। কীভাবে? সহজিয়া দর্শনের প্রথম সাংস্কৃতিক প্রকাশ ঘটেছিল নবম-দশম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার আদি স্রষ্টা সিদ্ধাচার্যের রচিত চর্যাপদে। চর্যাপদে যে সহজ’ সাধনার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়েছিল তা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতার সব শৃঙ্খল পরিত্যাগ করতে উন্মুখ ছিল। সহজিয়া দর্শনে আত্মোপলব্ধির জন্য, বিগ্রহ ও ব্রাহ্মণের প্রয়োজন নেই। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দশকে সেনবংশের রাজাদের অপসারিত করে তুর্ক-আফগান সেনানায়করা সংগঠিত সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলার সমাজে নতুন প্রক্রিয়ার উদ্ভবের সূচনা করে। বলাই বাহুল্য, তুর্ক-আফগান সেনানায়কদের ধর্ম ছিল ইসলাম। সে সময় ব্রাহ্মণ্যধর্মের জাতপাতের জাঁতকলের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি পেতে নিম্নবর্গের মানুষেরা ইসলাম ধর্মে চলে আসে। জোর করে ভয় দেখিয়ে মুসলমানরা ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বীদের ইসলাম ধর্মে টেনে আনা হয়েছিল, একথা সর্বৈ সত্য নয়। যে ইসলামকে বাঙালি মুসলমান গ্রহণ করেছিল তা গোঁড়া মোল্লা ও মৌলভীদের ধর্মীয় আদেশ দ্বারা পরিচালিত হয়নি। সেই গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ইসলামের সুফি মতবাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছিল। কারণ তার মেলবন্ধন ঘটেছিল প্রাক-মুসলিম সহজিয়া’ মানবধর্মের সঙ্গে, বিশেষত সমন্বয়ধর্মী ‘নির্গুণ’ বাউল সহজিয়াদের সঙ্গে লোকায়ত স্তরে। সুফি সাধকরা বাংলার সহজিয়াদের কাছে এসেছিলেন, কারণ উভয়ই বাংলার সমাজে ব্রাহ্মণ্যধর্মের আরোপিত বর্ণভেদের বিরোধিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন। উভয়ই গোঁড়া হিন্দু পণ্ডিত ও মুসলমান শাস্ত্রজ্ঞদের অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সুফি দর্শনের মেলবন্ধনের প্রক্রিয়াটি সক্রিয় ছিল বাংলার তুর্ক আফগান ও মোগল রাজত্বকালেসেই মেলবন্ধনের প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটেই নিম্নবর্গের মানুষরা ইসলামকে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল, সক্ষম হয়েছিল লোকায়ত সমন্বয়বাদী দর্শনের আধারে। ইসলাম ধর্মকে কখনো জোরপূর্বক চাপানো হয়নি তুর্ক-আফগান ও মোগল রাজত্বের সময়। এই ধর্মের প্রসার ঘটেছিল সুফি সাধকদের সমন্বয়বাদী তৎপরতার ফলে।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে জনগণনা হয়। এই সময় থেকে বাঙালি জাতির উদ্ভব বিকাশ ইত্যাদি নিয়ে কথা শুরু হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দেই জনগণনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় স্থানীয় মুসলমানরা বেশিরভাগই তথাকথিত নিচুজাতের হিন্দুসমাজ থেকে উদ্ভূত। ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দীতে সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু হয়। তখনকার সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বিরাট অংশের নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম ধর্মে চলে আসে।
নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম ধর্মে গেলেন কেন? শুধুই কি জাতপাতের ঘৃণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, নাকি অন্য কোনো কারণ? ইসলাম ধর্মের তত্ত্বে কি জাতিভেদের কোনো স্থান নেই? জাতপাত ইসলাম ধর্মেও আছে। সমগ্র ইসলামি সমাজকে প্রধানত দু-ভাগে ভাগ করা যায় –(১) শিয়া এবং (২) সুন্নি। শিয়াকে আবার দুই ভাগে ভাগ হয়েছে– (১) ইসনে আসারিয়া এবং (২) ইসমাইলিয়া। অপরদিকে সুন্নিদেরও দুই ভাগে ভাগ করা হয়– (১) শরিয়তি এবং (২) মারফতি। শরিয়তিও দুই ভাগে বিভক্ত– (১) হানাফি এবং (২) মোহম্মদী/আহলে হাদিস। হানিফরা চারভাগে বিভক্ত –(১) হানাফি, (২) সাফি, (৩) হাম্বলি ও (৪) মালেকি। এইভাবে ৮০টি ভাগ জানা যায়।
দারিদ্র্য আর বর্ণবৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার আশায় বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম কিংবা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে পড়েন লক্ষ লক্ষ দলিত। ধর্মের পরিবর্তন হয়েছিল বটে, তবে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। এমনই একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম মাহবুব তালুকদার। পেশায় ধোপ মাহবুব সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার আশায় ধর্মান্তরিত হন। পূর্বনাম দীপক থেকে মাহবুব হয়ে যায়। অল্পদিনের মধ্যেই সে বুঝে যায় ধর্মান্তর কোনো সমাধান নয়। তিনি জানান ‘ধর্মান্তরিত হওয়াটা কোনো সহজ ব্যাপার নয়, তাঁরা বলে এটা ঠিক নয়। আমি জিজ্ঞাসা করি, কেন? তাঁরা জানায় এর কারণ ভারতে মুসলিমদের খুব সুনাম নেই। চলে হত্যার চেষ্টা। আর-এক দলিত মইনুল ইসলামকে তো ধর্মান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে রীতিমতো জীবন বাজি পর্যন্ত রাখতে হয়েছিল। ধর্মান্তরের পূর্বনাম সমীর বাগদি। তিনি জানান, ধর্মান্তরের চেষ্টায় তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। মইনুল ইসলাম বলেন, ‘যখন একজন মানুষ ধর্মান্তরিত হয়, তখন নতুন ধর্মের লোকেরা তাঁকে স্বাগত জানায়। কিন্তু পুরোনো ধর্মের লোকেরা তাঁকে থামানোর চেষ্টা করে। যদি থামাতে না পারে, তবে তাঁরা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে। সেটাই আমার সঙ্গে হয়েছে। হিন্দুধর্ম থেকে যাঁরা ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মে চলে গেলেন তাঁরা আর পুরোনো ধর্মে ফিরে এলেন না কেন? কারণ হিন্দুধর্ম থেকে যাওয়া যায়, কিন্তু ফেরা যায় না। ফেরার কোনো পথ খোলা নেই। কারণ ধর্মান্তর হয়েছ মানেই তুমি ম্লেচ্ছ, অচ্ছুৎ। ফেরতযোগ্য নও।
হিন্দু সমাজে জাতবর্ণ প্রথা এক সচল প্রথা। চতুর্বর্ণের অজস্র উপবিভাগ এবং সংকর জাতগুলির উদ্ভব এক দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়ার ফসল। বৃত্তি ও তৎসংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যগুলি ধর্মান্তরিত জনগণের মধ্যে বেঁচে থাকায় কসাইরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছিল। আর প্রাচীন ভারতে যাঁরা যত শ্রম করে তাঁরা তত ঘৃণিত নীচুজাত। বৃত্তি বাহিত হয়ে পুরুষানুক্রমে এই বৈশিষ্ট্য ইসলামি জনগণের মধ্যেও বাহিত হয়েছে। তাই বলে ইসলামে জাতপাত নেই, একথা বলা যায় না। তবে ছোটোজাতের মানুষগুলো কতটা ঘৃণিত হয়ে থাকে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
মুসলিম শাসনের প্রায় ৮০০ বছরে এই ভারত উপমহাদেশে জাতপাত নিয়ে বহু জলঘোলা হয়েছে। জাতপাতের ঘৃণা থেকে মুক্তি পেতে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষগুলো বারবার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। ধর্মান্তরিত হয়েছে। গোষ্ঠী বদল করেছে। জাতপাতের ইস্যু নিয়ে মুসলিম শাসন চলাকালীনই উত্থান হয়েছে ব্রাহ্মসমাজ, বৈষ্ণব আন্দোলন, খ্রিস্টান বা মিশনারিদের। ব্রাহ্মসমাজ বা ব্রাহ্মসভা উনিশ শতকে স্থাপিত এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন, যা বাংলার পুনর্জাগরণের পুরোধা হিসাবে পরিচিত। কলকাতায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ২০ আগস্ট হিন্দুধর্ম সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ও তাঁর বন্ধুবর্গ মিলে এক সার্বজনীন উপাসনার মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ শুরু করেন। কিন্তু কেন এ ব্রাহ্মসমাজ? বস্তুত ব্রাহ্মসভার মূল বক্তব্য ছিল, ঈশ্বর এক ও অভিন্ন, সকল ধর্মের মূল কথা এক। রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার দত্তের মতো প্রসিদ্ধ মানুষেরা এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। একেশ্বরবাদ, ধর্মের গোঁড়ামি, শাস্ত্রীয় আচারপালন, কুসংস্কার এবং অবশ্যই জাতিভেদ প্রথা পুরোপুরি বিলোপ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন তাঁরা। ব্রাহ্মসমাজের উদ্দেশ্য হিন্দু সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি কুপ্রথার অবসান ঘটানো। সেই সঙ্গে নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন করে ভারতীয় নারীদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধন করা। তবে ব্রাহ্ম আন্দোলন। আর বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি, বরং দিনে দিনে শক্তি হারাতে থাকে। অর্থাৎ ব্রাহ্মসমাজের মানুষরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের তীব্র বিরোধিতা করলেও, ব্রাহ্মণ্যধর্মের দাপটে ব্রাহ্মসমাজ বৃহত্তর মনুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তাই এই সমাজ সমাজে প্রান্তিক হয়েই রইল।
শ্রীচৈতন্য মধ্যযুগে, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপে, আর্যাবর্তেও বৈদিকধর্মের চতুর্বর্ণ প্রথার (Caste System) নিষ্পেষণ এবং বিদেশি শাসকদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক অহিংস আধ্যাত্মিক আন্দোলনের সঞ্চার করেন, যার নাম গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম। ধর্মগুরু আর রাজ-শাসনের অত্যাচারে জর্জরিত বাংলার দিশেহারা অন্ত্যবর্ণ সাধারণ জনগণকে তিনি মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহস জুগিয়েছেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে। তাঁর আবির্ভাবে এবং কর্মতৎপরতায় গণমানুষের উদ্যোগে তৎকালীন সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। মানুষ হিসেবে জন্মলাভ করে স্বাভাবিক মনুষ্য জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। ধর্মের জন্য মানুষ না-হয়ে মানুষের জন্য ধর্ম— এই বোধ সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব সাহিত্যের নতুন ধারা সৃষ্টি হয়, যা গণমানুষকে জাগাতে সাহায্য করে। বাংলার সংস্কৃতিতে উদারনৈতিকতা, সহনশীলতা ও সাহসিকতার রূপান্তর ঘটে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন বাঙালি সভ্যতাকেও ভারতীয় হিন্দু সভ্যতা থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। তাই, বাঙালির গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মকে আর্যাবর্তের বৈদিক ধর্ম থেকে পুরোপুরি আলাদা মনে করাই সংগত। ধর্মতত্ত্বের ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো ধর্ম ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ না-থাকলেও প্রতিটি ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায়, সেখানকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংকট সমস্যাকে কেন্দ্র করে। যেমন ইসলামের উদ্ভব হয়েছে আরবের মক্কায় হজরত মোহাম্মদের মাধ্যমে সেকালের ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ থেকে মুক্তিকে কেন্দ্র করে। ঠিক তেমনই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মও এসেছে প্রাচীন বাংলার বাঙালি শ্রীচৈতন্যের মাধ্যমে তৎকালীন হিন্দুধর্মের চতুর্বর্ণ প্রথা, বিদেশি শাসকদের নিপীড়ন এবং হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের এলিটদের জোরজবরদস্তি থেকে ব্রাত্যজনের মুক্তির বার্তা নিয়ে।
বাংলায় চৈতনদেবের আন্দোলনে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কেঁপে ওঠে। কেঁপে ওঠাই স্বাভাবিক। একদিকে হুসেন শাহর আমলে অন্ত্যজদের ইসলামপ্রীতি, অপরদিকে চৈতন্যদেবের কৃষ্ণপ্রেমে আকৃষ্ট হয়ে ছোটোজাতের মানুষগুলো বৈষ্ণবধর্মে ভিড়তে থাকল। চৈতন্যদেবের শোভাযাত্রা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রত্যাখ্যান করে জাতপাতমুক্ত বৈষ্ণবধর্মে অন্ত্যজদের আত্মসমর্পণ। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ক্ষেপে উঠলেন। কিছুটা দিশাহারাও। হয়ে উঠলেন। প্রতিহিংসাপরায়ণ। মাহাত্মের খবর্তায় ভীত-সন্ত্রস্ত। একদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দিকে ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে সাঁড়াশি আন্দোলন, অন্যদিকে বৈষ্ণব ধর্মের দিকে ইসলাম তথা রাজরোষ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতিরোধ। উভয় সংকটের ধর্ম সংকট। চৈতন্যদেবের অন্তিম পর্ব সম্পর্কে যৌক্তিক বিদ্যায়তনিক সংশয় অপেক্ষা, অযৌক্তিক অপপ্রচারই বড়ো হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। সন্দেহ কেন? দুটি স্পষ্ট কারণ— (১) চৈতন্যদেবের মৃত্যু ঠিক কীভাবে হল সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা নেই। এবং (২) শ্রীচৈতন্য জগন্নাথে মানে নীলাচলে লীন হয়ে গেলেন, এই প্রচার অনেকেই তাঁকে হত্যা করার সন্দেহই করছেন। জয়ানন্দের ‘পায়ে ইট লেগে মৃত্যু’-র তত্ত্ব বাস্তবে এক্কেবারেই অসম্ভব নয়। কিন্তু অন্যান্য কাব্যগুলি এই ভাবনাকে সমর্থন করে না বলে এ নিয়ে মানুষের সন্দেহ আছে। চৈতন্যদেবের ‘জগন্নাথে লীন হয়ে যাওয়ার বর্ণনা এই সন্দেহকে আরও জোরদার করেছে। অনেকের ধারণা পাণ্ডারা তাঁকে হত্যা করে এই প্রচার করেছে– মহাপ্রভু জগন্নাথে লীন হয়ে গেছেন! নিরঞ্জন ধর তাঁর ‘অবতার শ্রীচৈতন্য ও মানুষ নিমাই’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধে যে কথা লিখেছেন, সেটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক: ‘রাজরোষ’-এ পড়ে চৈতন্য নীলাচলবাসী হন এবং প্রতাপরুদ্রের সভাপতি নিযুক্ত হন। রাজরোষ’ থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই নিমাই গৃহত্যাগী হন। মহানিষ্ক্রমণের রাতে নিমাই দুই বলবান মায় বিশ্বস্ত সহচর গদাধর ও হরিদাসকে নিজের দু-পাশে নিয়ে শুয়েছিলেন। এ ঘটনায় বোঝা যায়, নিমাই ওই রাতের অন্ধকারে সুলতানের লোকেরা তাঁকে ধরতে আসতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন। ইতিমধ্যেই যে সুলতান তাঁর বিশ্বস্ত হিন্দু কর্মচারী কেশবছত্রীর উপর চৈতন্যকে ধরে আনার ভার দিয়েছেন। একথা শোনামাত্র সেদিনই রাতের অন্ধকারে তিনি ওই স্থান ত্যাগ করেন।
রাজশক্তির সঙ্গে প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন নিমাই। নিমাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। সঙ্গে দণ্ড রাখতে শুরু করেন তিনি। চরম নিরাপত্তাহীনতার কারণে নিমাই নবদ্বীপ ছেড়ে পুরীতে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে মনস্থ করেন। কারণ একাধিক। প্রথমত ওড়িশা তখন পূর্ব ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী হিন্দুরাজ্য, তদুপরি বৈষ্ণব-প্রভাবিত ছিল। দ্বিতীয়ত পুরী বৈষ্ণবদের এক সর্বভারতীয় প্রধান তীর্থক্ষেত্র বটে এবং পুরীর রাজা প্রতাপরুদ্ররা স্বয়ং ছিলেন বৈষ্ণবভাবাপন্ন। সর্বোপরি, নবদ্বীপবাসী যাঁরা মুসলিম শাসকদের অত্যাচারে ও নানা ফতোয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে দেশত্যাগ করেছিলেন, তাঁরা প্রায় সকলেই পুরীতে এসে জমায়েত হয়েছিল। বাংলা-ওড়িশার সীমান্তের পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল থাকলেও চৈতন্য কোনো ঝুঁকি নেননি। তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর রামচন্দ্র খানের সঙ্গে তিনি আগে থেকেই আগাম বন্দোবস্ত করেছিলেন, যাতে তিনি নির্বিঘ্নে বাংলা-ওড়িশা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেন। তিনি বাংলার রাজরোষ অতিক্রম করে সীমান্ত পেরিয়ে ওড়িশায় প্রবেশ করলে এতটাই নিরাপদ বোধ করছিলেন যে, সর্বক্ষণের সঙ্গী তাঁর হস্তস্থিত দণ্ড সপাটে ভেঙে ফেলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল কোথায়! ওড়িশায় গিয়েও তিনি নোংরা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। হ্যাঁ, চৈতন্য ওড়িশার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন। বস্তুত ওড়িশার সেদিনকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি পরিষ্কার দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদিকে প্রতাপরুদ্র ও চৈতন্যসম্প্রদায়, অপরদিকে বিদ্যাধর ও মন্দিরের পুরোহিতকুল।
উৎকলবাসীরা শ্রীচৈতন্যকে যখন ‘সচল জগন্নাথ’ ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, ঠিক সেই সময়কালে ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্ষমতা দখলের চরম পর্যায়ের প্রস্তুতি হিসাবে গোবিন্দ বিদ্যাধর চৈতন্যশিবিরকে ছত্রখান করতে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতকুলের সাহায্যপ্রার্থী হলেন। তাঁদের চৈতন্যবিরোধিতা তো ছিলই, উপরন্তু তাঁদেরকে আর্থিক টোপও দেওয়া হল। বলা হল– তীর্থযাত্রী, ভক্তদের কাছ থেকে পূজা-দান-প্রণামী ইত্যাদি বাবদ মন্দিরের যে বিরাট আয় হত তার সবটুকুই পুরোহিতদের প্রাপ্য। চৈতন্য যে এইসব ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেননি তা নয়। তা বুঝেই কাশীশ্বর নামে এক ভীমদেহী ব্যক্তি অঙ্গরক্ষক রূপে সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন, যখন চৈতন্য মন্দির প্রদর্শনে আসতেন। যে দণ্ড তিনি সীমান্তে ভেঙে ফেলেছিলেন, তেমন দণ্ড তিনি আবার ধারণ করতে শুরু করলেন।
তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। সেদিন ছিল জগন্নাথের চন্দন উৎসব। চন্দন সরোবরের চারপাশে দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ছে। মন্দির প্রায় পরিত্যক্ত বলা যায়। কয়েকজন প্রহরী ও দু-একজন পুরোহিত মন্দির-প্রাঙ্গনে টুকটাক কাজে ব্যস্ত। এমন সময় সতর্ক পাহারা এড়িয়ে চৈতন্য একাকী মন্দিরে এসে উপস্থিত। তিনি মন্দিরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশপথগুলি বন্ধ করে দেওয়া হল। চৈতন্য অনুচরেরা দরজা খোলার জন্য দরজার বাইরে হইচই করতে থাকলেন, ভিতর থেকে কোনো সাড়া এলো না। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে দরজা খুলে মন্দিরের প্রহরী জানিয়ে দিল যে— চৈতন্য জগন্নাথের অংশ, জগন্নাথের দেহে মিশে গেছেন এবং তাঁর মৃতদেহ জগন্নাথের আদেশে ক্ষেত্রপাল আকাশ দিয়ে বয়ে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছেন।
জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতদের এহেন দুর্বল চিত্রনাট্য সরল ও শান্তিপ্রিয় বৈষ্ণবরা মাথা পেতে মেনে নিল বিনাবাক্যব্যয়ে। বৈষ্ণব তথা চৈতন্যভক্তগণরাও মনে করেন, ব্রাহ্মণ পাণ্ডারা চৈতন্যদেবের উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। তদুপরি চৈতন্যদেবকে একা একা মন্দিরে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। রাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেবকে লিখিতভাবেই কড়া নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, তাঁর মরদেহ কোথায় গেল –এসব প্রশ্নের উত্তর আজ আর নেই।
তবে অনেকেই মনে করেন মহাপ্রভু চৈতন্য অন্ত্যজদের উদ্ধার করার জন্য হরিনামে নগরকীর্তন করতেন না। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদ রক্ষার্থেই অন্ত্যজদের নিয়ে এই সংগঠন করেছিলেন। কারণ তখন বাংলায় ছিল হুসেন শাহর আমল এবং সুফিবাদের প্লাবন। এ সময়ে প্রচুর অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষরা হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছিলেন। এই ধর্মান্তর স্রোতকে ঠেকাতেই ঘুর পথে অন্ত্যজদের ‘অস্পৃশ্য’ বলে ঘৃণা— এই অপবাদ এবং অপমানের অভিমানকে কাজে লাগিয়ে হিন্দুধর্মে ধরে রাখতে পারলেন তিনি, হিন্দুধর্মের শাখাধর্ম বৈষ্ণব ধর্মের আবরণে।
ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বশেষ ধর্মীয় আগ্রাসন এলো খ্রিস্টান মিশনারিদের হাত ধরে। টার্গেট আবার সেই অশিক্ষিত দলিত শ্রেণি। ব্রিটিশ আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রেম ছড়াতে ছড়াতে খ্রিস্টান মিশনারিরাও ঢুকে পড়ল ভারতের মাটিতে। খ্রিস্টান মিশনারি খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত সংগঠন। প্রধানত প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রিস্টান মিশনারি উপনিবেশিক আমলে বাংলায় সক্রিয় থাকলেও তাঁদের সংযোগ স্থাপন শুরু হয় ষোলো শতকে। প্রারম্ভে জেসুইট ও রোমান ক্যাথলিকবৃন্দ একত্রে কাজ করেছেন এবং ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে একটি গির্জা ও একটি মঠ স্থাপন করেন। ধর্মশিক্ষার জন্য একটি কনভেন্ট স্কুল ও সেন্ট পলের জেসুইট কলেজও প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে সেইন্ট পল কলেজের রেক্টর হিসেবে ফাদার পিটার গোমেজের নিয়োগের মধ্য দিয়ে ধর্মসংক্রান্ত শিক্ষা কার্যক্রম পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়। বি. রড্রিকস্, জেমস গোমেজ, সাইমন দি ফিগুরেডো ও আন্দ্রে ম্যাশাডো এটিকে শিক্ষাদান ও খ্রিস্টান ধর্মের সুসমাচার পৌঁছানোর একটি মহতী কেন্দ্রে পরিণত করেন। এক দশকের মধ্যে দশ হাজারের মতো ব্যক্তিকে ধর্মান্তরিত করা হয় বলে দাবি করা হয়। আঠারো শতকের শেষ দশকে ব্রিটিশ প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচারকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় তথা গোটা ভারতবর্ষে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার কাজ একটি সংগঠিত আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। সমসাময়িক ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের পুনরুজ্জীবনের ফলে সকল দেশে খ্রিস্টের বাণী প্রচারের জন্য বেশ কয়েকটি ধর্মপ্রচারক সমিতি গঠিত হয়। এগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল ১৭৯২, ১৭৯৫ ও ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত যথাক্রমে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি, লন্ডন মিশনারি সোসাইটি ও চার্চ মিশনারি সোসাইটি। কয়েক দশক পর ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্ডার ডাফ (১৮০৮-১৮৭৮)-এর অধীনে স্কটল্যান্ডের গির্জা বাংলায় ধর্মপ্রচার কাজ শুরু করে। কিন্তু এ সকল গির্জা বাংলায় ধর্মপ্রচার কাজ চালানোর ক্ষেত্রে প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়। স্কটিশ ধর্মপ্রচারকগণ ও আইরিশদের গির্জার যাজকীয় শাসনতন্ত্রের সমর্থকবৃন্দও এ কার্যক্রম অনুসরণ করেছিলেন। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা উনিশ শতককে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের বিশিষ্টতম শতকে রূপান্তরিত করে।
খ্রিস্টান ধর্ম ও উপমহাদেশের ধর্মসমূহের মধ্যকার সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ ইসলামের অনুসারীদের প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হন, সম্ভবত। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী মুসলিমগণ খ্রিস্টান ধর্মের ‘ত্রিত্ববাদী’ মতবাদকে গ্রহণ করতে পারেনি। সাধারণভাবে মুসলিম সমাজ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের প্রচেষ্টার আওতার বাইরে থেকে যায় এবং মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামীণ পূর্ববঙ্গে খুব অল্প কয়েকটি ধর্মপ্রচার কেন্দ্র গড়ে ওঠেছিল। শ্রীরামপুর এয়ী কিছু হিন্দু সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আচারানুষ্ঠান, যেমন জাতিভেদ প্রথা, সতীদাহ, সন্তানকে গঙ্গায় বিসর্জন, অন্তৰ্জলি ইত্যাদি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের এই মাঝের সময়টুকুতে এ রকম কিছু আচারকে নিষিদ্ধ করতে আইন পাসে তাঁরা সহায়ক ছিলেন। সাঁওতাল মিশনে জর্জ ক্যাম্বেলের গভীর আগ্রহ এবং সাঁওতালদের শিক্ষার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুদান ধর্মপ্রচারকদের অনুপ্রাণিত করে। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ সাঁওতালদের শিক্ষিত করে তোলার কাজ একচেটিয়াভাবে ধর্মপ্রচারক সমিতিগুলির উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের প্রধান উদ্দেশ্য, যা ছিল খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার মাধ্যমে বাংলার মানবগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন সাধন করা, কখনও পূরণ হয়নি। তাঁদের ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করত জাতিচ্যুত ও উপজাতিদের ধর্মান্তরকরণের মধ্য দিয়েই। চার্চ ও ব্যাপ্টিস্ট মিশনসমূহের সর্বাধিক সংখ্যক ধর্মান্তরিতগণ আসত কর্তাভজাদের (ঈশ্বরের পূজারী) মধ্য থেকে, যাঁরা ছিল ‘নিম্নবর্গ’ পদমর্যাদার হিন্দু, যেমন চণ্ডাল ও নমঃশূদ্রদের মধ্যে গড়ে ওঠতে থাকা একটি হিন্দু সমতাবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়। সমাজের দরিদ্র মানুষের সেবা করার ছলে তাঁরা গরিব হিন্দু-মুসলমানদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করে আসছে, আজও যা অব্যাহত। খ্রিস্টান মিশনারিরা এমন সব জায়গায় যায় যেখানকার মানুষগুলো খুবই দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং অবশ্যই দলিত শ্রেণির। খ্রিস্টান মিশনারির কর্মচারীরা এমন লোক খুঁজে বেড়ায় যাঁরা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারছে না, অসুস্থ টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না, টাকার অভাবে না খেয়ে মরে যাওয়ার অবস্থা— এককথায় অভাবী এবং সমাজে ঘৃণিত মানুষদের খুঁজে বেড়ায়। খ্রিস্টান মিশনারিরা এই সুযোগে তাঁদের টাকা দিয়ে সাহায্য করে, আর সাহায্য করার ছলে ধর্মের প্রচার এবং ধর্মান্তর করতে থাকে। এদের টার্গেট দলিত, দরিদ্র এবং অনাথ। বিভিন্ন দেশের দরিদ্র এবং অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী খুব সহজেই তাঁদের ছলনায় চিন্তা করে হিন্দু অথবা মুসলমান হয়ে তো কোনো লাভ নেই। তাঁরা মনে করেন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে তাঁদের অনেক সুবিধা, তাঁদের সমস্ত অভাব দূর হয়ে যাবে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছিল পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম খ্রিস্টধর্মী দেশ। ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে তা পঞ্চমে উন্নীত হবে (সূত্র : www.worldchristiandatabase.org)। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছিল পৃথিবী দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। যা ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয়তে চলে যাবে (সূত্র : www.worldchristiandatabase.org)। মজার বিষয় হল– বৌদ্ধ, ইসলাম, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যতটা অসহিষ্ণু ছিলেন, খ্রিস্টান মিশনারিদের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই সহিষ্ণু কেন! দলিতদের খ্রিস্টধর্মে চলে যাওয়ার ঘটনায় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এত উদাসীন ছিলেন কেন! ইংরেজপ্রীতি, নাকি অন্য কোনো মতলব! ইংরেজপ্রীতি যে ছিলই সেটা ব্রিটিশ ভারত ইতিহাসের পরতে পরতে চিহ্ন রাখা আছে। মানবসেবা, সমাজসেবার নামে দিনের পর দিন অতীতে মাদার টেরিজা চালিয়েছিলেন, বর্তমানে স্টিভ ‘ও সহ অনেকেই ধর্মান্তরের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ছলে আর কৌশলে! এই ধর্মান্তরযজ্ঞের জন্য কোটি কোটি ডলার আসছে বিদেশ থেকে।
কেউ কেউ বলেন জাতপাতের এই বিড়ম্বনা নাকি হিন্দুধর্মের নয়। হিন্দুধর্মে নাকি জাত-বিভাজনের বালাই নেই –এসব নাকি ব্রাহ্মণ্যধর্মের হিন্দুদের ঘাড়ের চাপিয়ে দেওয়া নিষ্পেষণ-চাক্কি। তাহলে কি ব্রাহ্মণ্যধর্ম আর হিন্দুধর্ম সমার্থক নয়! এ ভাবনার যুক্তি কী? তাঁরা বলছেন– (১) তাঁদের প্রত্যেকের ধর্মপালনের নীতি-নিয়ম একই হবে। (২) তাঁরা একই পদ্ধতিতে ধর্মাচরণ বা উপাসনা করবে। (৩) তাঁদের মধ্যে অবাধ বিবাহ সম্পর্ক চালু থাকবে। (৪) ধর্মের দৃষ্টিতে তাঁরা সবাই অভিন্ন বলে বিবেচিত হবে। (৫) তাঁদের মধ্যে কোনো উঁচু-নীচু ভেদ থাকবে না। (৬) তাঁরা সবাই সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। থাকবে। (৭) একই ধর্মের অনুগামী বলে তাঁরা পরস্পরের প্রতি একাত্মবোধ করবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর ক্ষেত্রে এক নয়, আলাদা। এ পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে বোঝা যায় ব্রাহ্মণ ও হিন্দু এক ধর্মভুক্ত নয়, তাঁদের ধর্ম আলাদা। তা ছাড়া দুটি আলাদা ধর্মের মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যে বৈসাদৃশ্যগুলি থাকে ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যেও তা লক্ষ করা যায়। বৈসাদৃশ্যগুলি মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে, যেমন— (১) ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক হয় না। যদিও কিছু ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায়, তবে ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। (২) ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের ভাব দেখা যায় না, বরং ঘৃণার সম্পর্ক দেখা যায়। (৩) একজন ব্রাহ্মণ ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে যে অধিকার পায়, একজন হিন্দু তা পায় না। (৪) ব্রাহ্মণ ও হিন্দু পরস্পরের সঙ্গে একাত্ম মনে করে না। (৫) ব্রাহ্মণ হিন্দুকে তাঁর সঙ্গে সমমর্যাদার ভাবে না, তাঁর থেকে নীচু ভাবে। (৬) ব্রাহ্মণদের ধর্মপালনের উদ্দেশ্য শূদ্রদের সম্পদ হাতানো। হিন্দুদের ধর্মপালনের উদ্দেশ্য সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। (৭) ব্রাহ্মণ্যধর্মে অব্রাহ্মণ আছে এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই অব্রাহ্মণরা হল পথভ্রান্ত, নিজের অজান্তে বিপথে চালিত ধর্মচ্যুত হিন্দু, ব্রাহ্মণরা যাঁদের উপর অপমানজনক, ঘৃণ্য ‘শূদ্র’ নামের ছাপ্পা মেরে দিয়েছে। কিন্তু হিন্দুধর্মে কোনো অহিন্দু নেই। (৮) ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুযায়ী ব্রাহ্মণ সবার শ্রেষ্ঠ, সবার প্রভু। আর ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুগামী অব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণ অপেক্ষা নিকৃষ্ট, এমনকি কেউ কেউ আবার ব্রাহ্মণদের নিকট ঘৃণার বস্তু, অস্পৃশ্য। কিন্তু হিন্দু ধর্মে কোনো উচ্চনীচ ভেদাভেদ নেই, সবাই সমান। (৯) বর্ণভেদ, জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, সতীদাহপ্রথা, গুরুপ্রসাদী প্রথা ইত্যাদি অমানবিক, অশালীন প্রথাগুলি ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই অবদান। কিন্তু অপরদিকে হিন্দুধর্ম একটি সুসভ্য, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী ধর্ম। (১০) ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুগামীরা সবাই ব্রাহ্মণ নয়, কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ শূদ্র ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু হিন্দুধর্মের অনুগামী মাত্রেই সবাই হিন্দু এবং কেবলমাত্র হিন্দু। হিন্দুদের একমাত্র পরিচয়— তাঁরা হিন্দু। (১১) ব্রাহ্মণদের উপনয়ন হয়, হিন্দুদের হয় না। (১২) ব্রাহ্মণ্যধর্মে জাতপাত, বর্ণভেদ, অস্পৃশ্যতা আছে, কিন্তু হিন্দুধর্মে ওইসব কদর্য জিনিস নেই। ওগুলো সম্পূর্ণতই ব্রাহ্মণ্যধর্মের ব্যাপার, হিন্দুধর্মের নয়। (১৩) ব্রাহ্মণরা পৈতে পরে, কিন্তু হিন্দুরা তা পরে না। তাই পৈতে পরা দেখে ব্রাহ্মণকে সহজেই স্বতন্ত্র ধর্মের অনুগামী হিসাবে সনাক্ত করা যায়— যেমন টুপি (ফেজ) পরা দেখে সহি মুসলমানদের সনাক্ত করা যায়, বুকে ক্রুশ দেখে খ্রিস্টান সনাক্ত।
এইসব তথ্য বিচার ও বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুমিত হয় যে, ব্রাহ্মণ্য ও হিন্দু দুটি স্বতন্ত্র ধর্ম, কখনোই এক ধর্ম নয়। অতএব ব্রাহ্মণ্যবাদের সব রকম অন্যায়-অবিচার হিন্দুধর্মের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা সুবিচার হয় না। এ ব্যাপারে শিবরাম চক্রবর্তীর বক্তব্য অনুধাবনযোগ্য— “এই হিন্দু সভ্যতায় ব্রাহ্মণের দান অতি সামান্যই, বলতে গেলে ব্রাহ্মণের থেকে যতটা এ নিয়েছে –তাই এর কলঙ্ক। ……ব্রাহ্মণের দ্বারা প্রভাবিত না হলে এ সভ্যতা আরও প্রাণবান, আরও বেগবান, আরও বীর্যবান হতে পারত। …… ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার চেয়ে ঢের বড়ো এই হিন্দু সভ্যতা। ব্রাহ্মণ না জন্মালেও এ হত এবং ব্রাহ্মণ লোপ পেলেও হিন্দু সভ্যতা থাকবে।….. ব্রাহ্মণরা সমাজের মাথা নয়, বরং টিকি। সমাজের মাথা থেকে ওটাকে কেটে বাদ দিলে সমাজটার কোনো ক্ষতি হবে না, বরং তাকে আরও বেশি আধুনিক দেখাবে।”
সেই কারণেই বোধহয় অন্ত্যজ বা দলিতদের সম্মানের জন্য যাঁরা লড়াই করেছেন এবং করছেন, তাঁরা সকলেই প্রায় উচ্চবর্ণের হিন্দু। রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধি প্রমুখ উচ্চবর্ণীয় ব্যক্তিগণ দলিতদের পক্ষে জোরদার আন্দোলন করেছেন। অবশ্য ড: ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের আন্দোলনও দলিত সমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও বাবা আহম্মেদকর উচ্চবংশীয় ছিলেন না, বরং তিনি দলিত শ্রেণির। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে লিখেছেন– “ভারতবাসীর কেবল ভারবাহী পশুত্ব, কেবল শূদ্রত্ব।” বিবেকানন্দের সমকালীন। ভারতে ব্রাহ্মণত্ব, ক্ষত্রিয়ত্ব, বৈশ্যত্বের অধিকারী হলেন ইংরেজ এবং তাঁদের শাসন-শোষণের ভার পশুর মতো বহন করে চলেছে শূদ্ররূপ ভারতবাসী। বিবেকানন্দ মনে করতেন, “শূদ্রজাতি মাত্রেই এজন্য নৈসর্গিক নিয়মে পরাধীন।”
ব্রাহ্মণ্যবাদী স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘শূদ্র জাগরণ’ প্রবন্ধে লিখেছেন– “ব্যক্তিবিশেষ ইংরেজ কৃষ্ণবর্ণ বা নেটিভ অর্থাৎ অসভ্য বলিয়া আমাদিগকে অবজ্ঞা করিলে, ইহাতে ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই, আমাদের আপনার মধ্যে তদপেক্ষা অনেক অধিক জাতিগত ঘৃণাবুদ্ধি আছে; এবং মূর্খ ক্ষত্রিয় রাজা সহায় হইলে ব্রাহ্মণেরা যে শূদ্রদের জিহ্বচ্ছেদ, শরীরভেদাদি পুনরায় করিবার চেষ্টা করিবেন না কে বলিতে পারে?”
‘দলিত’ কথাটির অর্থ এমন বস্তু বা মানুষ যাঁদের কেটে ফেলা হয়েছে, ভেঙে দেওয়া হয়েছে, টুকরো টুকরো করে পিষে ফেলা হয়েছে এবং ধ্বংস করা হয়েছে। মারাঠি সমাজসংস্কারক ও বিপ্লবী মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে হিন্দু সমাজে নিপীড়িত অবর্ণ ও অস্পৃশ্য জাতিগুলির ক্ষেত্রে এই কথাটি ব্যবহার করেন। সাধারণভাবে ‘দলিত’ কথাটির অর্থ নিম্নবর্ণ বা দরিদ্র নয়, বরং এই শব্দটি দিয়ে বোঝানো হচ্ছে এক অবদমিত অবস্থা। সামাজিক রীতি তাঁদের যে অধঃপতিত করেছে দলিত বলতে সেটাই বোঝাচ্ছে। যাঁদের দলন করা হয় তাঁরাই দলিত। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয় যে, যাঁরা নিচু কাজ করে তাঁরা পুনর্জন্মে খারাপ জন্ম পায়। তাঁরা কুকুর বা শুয়োর বা চণ্ডাল হিসাবে জন্মায়। এই অস্পৃশ্য দলিত/শূদ্রদেরই মহাত্মা গান্ধি বললেন ‘হরিজন’। তিনি ‘হরিজন’ নামে একটি সংবাদপত্র করতেন এবং হরিজনদের বিষয়ে লেখালেখি করতেন। সে সময়েও শূদ্ররা শুধু অস্পৃশ্যই ছিলেন না, তাঁদের ছায়া পর্যন্ত পড়তে পারত না ব্রাহ্মণদের শরীরে। ব্রাহ্মণরা যে পথে চলবেন সে পথে শূদ্রদের চলন গর্হিত অপরাধ। ব্রাহ্মণদের সামনে শূদ্রদের ছাতা মাথায় বুক চিতিয়ে যাওয়াটা চরম ধৃষ্টতা। শূদ্র, অর্থাৎ অস্পৃশ্যদের কোনো দেবতা নেই। দেবতা নেই, দেউলও নেই। এইসব অস্পৃশ্যদের কোনো মন্দিরে প্রবেশ করার অধিকার ছিল না। অপবিত্র হয়ে যাবে দেব ও দেউল। একই কুয়োয় জল ব্যবহারের অধিকার ছিল না। শূদ্ররা যেখানে বসে সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর গৃহস্থ গঙ্গাজল গোবরজল ছিটাবে। গান্ধিজি ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধিজি অস্পৃশ্য হরিজনদের হাতে ‘অনুগ্রহণ আন্দোলন’-এর প্রথম সারির উদ্যোক্তা ছিলেন। তা সত্ত্বেও বলা যায়, মহাত্মা গান্ধি শূদ্রদের জন্য তেমন কিছু করে উঠতে পারেননি। তিনি সকলের কাছে ‘বাপুজি’ হতে সক্ষম হলেও শেষপর্যন্ত শূদ্রদের বাপুজি হতে পারেননি। অস্পৃশ্য শূদ্রদের নতুন নাম হরিজন’ দিলেন বটে, কিন্ত একবিন্দু মর্যাদা দিতে পারেননি। নাম বদলালেই মর্যাদা বদলায় না। হরিজন কেন? এই হরি কি ঈশ্বর হরি? তাই যদি হয় হরি তো সকলেরই ঈশ্বর; হরিজন তো সকলেই। তাহলে কেন শূদ্রদেরই কেবল হরিজন বলা হচ্ছে। তাঁদেরকে কি হরি আলাদাভাবে জন্ম দিয়েছেন? উচ্চবর্ণের হরি আর নিম্নবর্ণের হরি কি আলাদা? হরিজন মানে যদি ঈশ্বরের সন্তান হয় তাহলে দলিত ছাড়া বাকিরা কার সন্তান?
আসলে প্রকারান্তরে গান্ধিজি ব্রাহ্মণ্যধর্মের সৃষ্ট বর্ণবৈষম্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন। উনি উপলব্ধি করেছেন বর্ণপ্রথার প্রয়োজন আছে। যদিও তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন না, কিন্তু দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ব্রাহ্মণরাই তাঁকে ঘিরে থাকতেন। তদুপরি, তিনি কোনো শূদ্রের সঙ্গে আত্মীয়তা সম্পর্ক গড়েছেন বলে জানা নেই। গান্ধিজি ভারতের ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে যেতে পারেননি। বলা যায় গান্ধিজি ব্রাহ্মণ্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, ব্রাহ্মণ্যবাদে বিশ্বাস অটুট রেখে শূদ্রদের মঙ্গল করা সম্ভব নয়। হয়ওনি। গান্ধিজি যদি আন্তরিকভাবেই শূদ্রদের মর্যাদাই চাইতেন তাহলে এত সময় রাজনীতিতে ব্যয় না-করে ভারতের দলিত অর্থাৎ পিছড়ে বৰ্গদের অধিকার আদায়ের কাজে লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারতেন। তিনি বদলে দিতে পারতেন ভারতের ইতিহাসের ধারা। তৈরি হতে পারত নতুন এক ভারত। মুছে যেত ব্রাহ্মণ-শূদ্রের স্বতন্ত্র পরিচয়। তিনি শূদ্রদের ‘হরিজন’ শিরোপা দিয়ে সকলকেই যদি ‘হিন্দু হতে বলতেন, তাহলে সব ব্রাহ্মণ না-এলেও অনেকেই দলিত/শূদ্রদের পাশে এসে দাঁড়াতেন। তাহলে আজকের দিনেও কোনো উচ্চবর্ণের সাহস হত না একটি দলিতকেও নগ্ন করতে। bjpwb indiawb ফেসবুক পেজ থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা একথা লিখতে সাহস পেত– “কিছুদিন পরে আমরা পুরো ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবাংলায় শাসন করব, তখন মুসলিম-আদিবাসী-খ্রিস্টান সকলকে হিন্দুধর্মে রূপান্তরিত করব, না-হলে ঘরে ঢুকে এক এক করে হত্যা করব। এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। এরই নাম হিন্দুত্ব এবং হিন্দুরাষ্ট্র”? এই পেজেই আর-একটি পোস্টে বলা হয়েছে– “সামনের ইলেকশনে টিএমসি, সিপিএম এবং অন্যান্য দলগুলিকে একতরফা হারিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি পশ্চিমবাংলায় সরকার গঠন করবে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মুল্লাদের, খ্রিস্টানদের, আদিবাসী ও দলিতদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে যাওয়া লাগবে।” বিজেপির বিধায়ক রাজা সিংহও বলতে সাহস পায়– “দলিতোঁ কি পিটাই সে খুশি মিলতি হ্যায়”। দলিত তথা আদিবাসীরা কি হিন্দু নয়? তাই যদি হয়, এই হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার কোনো পথই খোলা রইল না। দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যবাদীরা হিন্দুধর্মের যে সর্বনাশ করার কাজ হাতে নিয়েছিল, এই বাণীগুলি কি একবিংশ শতাব্দীতেই অন্তিমপর্ব চলছে?
দেবদাসী প্রথা দক্ষিণ ভারতে এখনও টিকে আছে। এসব দেবদাসীরা অধিকাংশই হরিজন সম্প্রদায়ের থেকে আসা। ব্রাহ্মণরা তাঁদের দিনের পর দিন ভোগ করলে জাত যায় না। জাত যায় তাঁদের হাতের জল খেলে। দলিত হরিজনরা এখনও মূলস্রোতের সঙ্গে মিশতে পারেনি। ফলে তাঁরা কলোনিভিত্তিক জীবনযাপন করে যাচ্ছে ব্যাপক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। দলিত-হরিজনরা যেন অস্পৃশ্য। দলিত সম্প্রদায় জন্ম ও পেশাগত কারণে বৈষম্য এবং বঞ্চনার শিকার মানুষরা আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশেষ করে পণ্ডিতদের কাছে ‘দলিত’ নামে পরিচিতি পায়।
এক ঈশ্বরের সৃষ্টি, এক ধর্মালম্বী, একই নিয়মে পিতা-মাতার মাধ্যমে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এত জাতিগত বৈষম্য কেন? নিশ্চয় এটা বিধির বিধান নয়, এটা সম্পূর্ণ মানুষের (ব্রাহ্মণের) তৈরি জাতিভেদের দলিল মাত্র, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ ছাড়াও এক জাতি বা বর্ণের পুরুষের ঔরসে অন্য জাতি বা বর্ণের নারীর গর্ভে সন্তান জন্ম হলে শাস্ত্র বিধান মতে তাঁদেরকে অস্পৃশ্য, পতিত, জারজ, নীচু জাতি বা বর্ণ শঙ্কর বলা হত এবং এঁদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ তথা উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অমানবিক আচরণ করত। যেমন ক্ষত্রিয়ের ঔরসে বৈশ্য নারীর গর্ভে বাগদির জন্ম, এরা অস্পৃশ্য বা পতিত জাতি। শূদ্রের ঔরসে দ্বিজ (ব্রাহ্মণ) রমণীর গর্ভে চণ্ডালের জন্ম, এঁরা জারজ দোষে পতিত বা অস্পৃশ্য।
এইভাবে ছত্রিশ বর্ণ বা জাতির উৎপত্তি, এরূপ বহু ছোটো জাত বা অস্পৃশ্য জাতির উল্লেখ আছে (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ব্রহ্মখণ্ড, ৫৯ পৃষ্ঠা)। হিন্দুধর্মে পালনীয় অপস্তম্ব ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে, কেউ চণ্ডালকে স্পর্শ করলে তাঁকে জলে স্নান করতে হবে। কেউ চণ্ডালের সঙ্গে কথা বললে তারপর ব্রাহ্মণের সঙ্গে কথা বলতে হবে। চণ্ডালের উপরে চোখ পড়লে তারপর আকাশের সূর্য, চন্দ্র, তারার দিকে তাকিয়ে চোখ শুদ্ধ করে নিতে হবে। পরাশর স্মৃতিতে বর্ণিত হয়েছে আরও কঠোরতা। বলছে, কোনো দ্বিজ অনুগ্রহণের সময় কোনো কুকুর বা চণ্ডাল যদি তাঁকে স্পর্শ করে তাহলে সেই খাদ্য ফেলে দিতে হবে। চণ্ডালের ছোঁয়া কুয়ো থেকে কোনো ব্রাহ্মণ যদি জলপান করে তাহলে তাঁকে তিনদিন ধরে গোমূত্র মেশানো যব খেতে হবে। কারও ঘরে যদি চণ্ডাল প্রবেশ করে তবে গোবর মেশানো জল দিয়ে সমস্ত ঘর ধুয়ে ফেলতে হবে। মাটির হাঁড়িকুড়ি ফেলে দিতে হবে। বাড়ির পরিচারক সহ পরিবারের লোকেরা দিনে তিনবার করে গোমূত্র মিশ্রিত ঘোল খাবে। পরের তিনদিন গোমূত্র মিশ্রিত যবের জল খাবে। তারপরের তিনদিন গোমূত্র মিশ্রিত দুধ খাবে। তারপর এইসব মিশ্রণ একদিন করে খেতে হবে। এইভাবে বারো দিন ধরে শুদ্ধিকরণ চলবে। নারদের মতে –শ্বপাক, মেদ, চণ্ডাল ও মালারা ছিল মনুষ্য সমাজের বর্জ। তাঁদের জন্য মৃত্যুদণ্ডই ভালো, কেননা অর্থদণ্ড করলে তাঁদের ছোঁয়া অর্থ নেওয়া যাবে না। তাঁদের অর্থও দূষিত (নারদস্মৃতি, পৃষ্ঠা ৪১)। কী তীব্র ঘৃণা, ভাবুন! কোনো একটা ধর্মগ্রন্থ নয়, বরং যুগ যুগ ধরে কীভাবে হিন্দুসমাজ অস্পৃশ্যতার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল সেটা বোঝা যায়। আসলে এই হল সনাতন ধর্ম, যে চিরন্তন এইভাবে।
হিন্দুসমাজের এক সময়কার রাজা বল্লালসেন সমাজের মহা সর্বনাশ করেছেন। যতদিন এই পৃথিবী থাকবে ততদিন বল্লালসেনের অনাচার ও অনাসৃষ্টি হিন্দু সমাজ ভুলবে না। তিনি ছিলেন ধর্মে বৌদ্ধ এবং তাঁর গুরু ভট্ট-পাদ সিংহগিরি তাঁকে দীক্ষা দিয়ে শৈব মতে আনলেন। বাংলার রাজা বল্লালসেন বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে হলায়ুদ উমাপতি নামে দুই ব্রাহ্মণের সাহায্য চান। হলায়ুদ বল্লালের মন্ত্রী ও উমাপতি তাঁর পঞ্চরত্নের অন্যতম ছিলেন। এঁদের সাহায্যে বল্লাল সেন ছলে-বলে-কৌশলে বঙ্গে ব্রাহ্মণ প্রাধান্য স্থাপন করেন। ব্রাহ্মণের বশতা স্বীকার করার নাম ব্রাহ্মণ্যধর্ম। ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের ফলে অনেক মানুষ হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেন। বল্লাল সেন বৌদ্ধধর্ম উচ্ছেদ করেন এবং দ্বেষ, ঈর্ষা, স্বার্থপূর্ণ নৈতিকতাহীন ব্রাহ্মণধর্ম প্রচারে নিবেদিত হলেন। যার ফলে এ বঙ্গে শত শত জাতি ও উপজাতির সৃষ্টি হল। আত্মকলহ, ঝগড়া-বিবাদ, হিংসা, ঘৃণায় জাতি অসার ও বলহীন হয়ে পড়ল।
যে সকল জনসাধারণ রাজার ও ব্রাহ্মণদের নিয়মনীতি মানল না তাঁদের পতিত ঘোষণা করা হল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দেওয়া ঘুষের মহিমায় শাস্ত্রের নামে জালিয়াতি করে প্রচার করল– ব্রাহ্মণ বাদে বাকি সকল মানুষই শূদ্র। সকলেই হীন, নীচ,পতিত, অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য ও বর্ণ সঙ্কর।
‘পরশুরামসংহিতা’ নামক একটি গ্রন্থে শূদ্রবিদ্বেষী ব্রাহ্মণেরা প্রচার করলেন, বারুজীবীর বীর্যে তেলি, কর্মকারের বীর্যে মালাকার, গোপের বীর্যে বারুজীবী, তেলির বীর্যে কর্মকার, মালাকারের বীর্যে পট্টিকার, পট্টিকারের দ্বারা কুম্ভকার, কুম্ভকারের দ্বারা কুবেরী এবং কুবেরীর দ্বারা নাপিতের জন্ম হয়েছে। মনুসংহিতা এবং মহাভারতের মধ্য দিয়ে প্রচার করা হল ক্ষত্রিয়-স্বামী ও ব্রাহ্মণী-স্ত্রীতে মিলনের ফলে সূত জাতি জন্ম (সূত জাতি যে কত ঘৃণ্য তা মহাভারতে প্রতিফলিত হল কর্ণের মধ্য। স্বয়ংবর সভায় কর্ণকে সূতপুত্র বলে চরম অপমান করা হল। সূতপুত্র বলে তাঁকে স্বয়ংবর সভায় অংশগ্রহণ করতেই দেওয়া হল না। যদিও কর্ণ ছিলেন ক্ষত্রিয়ের সন্তান। কুন্তি ও সূর্যের সন্তান। সে সম্পর্ক গোপন রাখা হয়েছিল কুন্তী কুমারী থাকাকালীন কর্ণকে জন্ম দিয়েছিলেন। ফলে এই অবৈধ সন্তান কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দিতে হয়েছিল। সেই সন্তানকে বড়ো করে তোলেন অধিরথ ও তাঁর স্ত্রী রাধা। সূত সম্প্রদায়ের অধিরথ ছিলেন ভীষ্মের সারথী।)।
বৈশ্য-স্বামী ও ক্ষত্রিয়-স্ত্রীতে মাগধ জাতির জন্ম। বৈশ্য-স্বামী ও ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে বৈদেহ জাতির জন্ম। (মনুসংহিতা : ১০/১১, মহাভারত : অনুশাসন ৪৮/১০)। কিন্তু পৌরাণিক কাহিনিতে এসে অন্য প্রকার তথ্য পাই। পিতা জমদগ্নি ব্রাহ্মণ, মাতা রেণুকা ক্ষত্রিয় কন্যা— পুত্র জন্মালেন পরশুরাম। তিনি সূত না-হয়ে ব্রাহ্মণ হলেন। কোথাও কোথাও প্রচার হল শূদ্র পিতা ও ব্রাহ্মণী মাতাতে যে সন্তান হয় সেই সন্তান হয় চণ্ডাল। মগধের রাজা বিন্দুসার শূদ্র, বিবাহ করেন এক ব্রাহ্মণীকে— পুত্র হলেন বিশ্বখ্যাত ক্ষত্রিয় রাজা অশোক। অশোক পণ্ডিতদের তৈরি শ্লোকের প্রভাবে চণ্ডাল হননি। বল্লালসেন সকলের দ্বিজত্ব উঠিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণবাদের সকল হিন্দুদের শূদ্র নামে ঘোষিত করেন। মাহিষ্যরা ছিলেন বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয়। মহারাজ কার্তবীর্যাজুন এঁদের পূর্বপুরুষ। ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এঁদের বহুকাল যুদ্ধ-সংঘর্ষ হয়। বৌদ্ধযুগের একদল সন্ত, সাঁই বা সাধু বল্লালসেনের অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে বিহারের পাহাড়ে আশ্রয় নেন। এঁরাই পরে সাঁইতার বা সাঁওতাল নামে খ্যাত হন। শঙ্খনির্মিত অলংকার বিক্রেতা শাঁখারী বা শঙ্খবণিক, কাঁশারী, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিকেরা ব্রাহ্মণ ছিলেন। বল্লালসেন এঁদের পৈতা ছিঁড়ে ফেলে শূদ্র ঘোষণা করে দেন। সূত্রধরেরা ছিলেন ব্রাহ্মণ। এভাবে রাজা বল্লালসেনের অত্যাচারে তেওর, জালিক, রজক, দুলে, বেহারা, কেওরা প্রভৃতি অনেকেই বৈশ্য বংশে জন্মগ্রহণ করেও বল্লালসেনের ফতোয়ায় সকলেই শূদ্র হতে বাধ্য হন। বল্লালসেন যেসব ব্রাহ্মণ, বৈশ্য এবং ক্ষত্রিয়কে জোর করে শূদ্র করেন তাঁদের গৃহে পৌরহিত্য করতে অন্য ব্রাহ্মণদের নিষেধ করে দিলেন। বল্লালসেনের অত্যাচারে হিংসা ও নীচতায় এ বঙ্গে হিন্দুসমাজের মেরুদণ্ড ঠুনকো হয়ে গেল। হাজার হাজার ব্রাহ্মণের পৈতা জোর করে ছিঁড়ে তাঁদের শূদ্র ঘোষণা করলেন এবং অনেক পদলেহী শূদ্রকে তিনি ব্রাহ্মণ উপাধি দিলেন।
আচার্য সুভাষ শাস্ত্রী বলেন, “ভ্রষ্ট চরিত্রের বল্লাল সেন এক বিবাহিতা ডোম কন্যাকে জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেন এবং তাঁর কৃত পাপ অর্থ সম্পদ দ্বারা হিন্দু সমাজের সমাজপতি ও পণ্ডিতগণকে নিমন্ত্রণ করলেন। পার্বত্য ডোমজাতি বল্লালসেনের ছোঁয়ায় ব্রাহ্মণ জাতিতে পরিণত হল। বল্লালসেনের চরিত্র ছিল নারীহরণ ও ব্যাভিচার দোষে কলুষিত। যেসব ব্রাহ্মণগণ তাঁকে মান্য করলেন তিনি তাদের কুলীন উপাধি দিলেন। … ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় ও শূদ্রের মুণ্ডপাত করে নিজের পাপাচার ও ক্ষমতাকে হিন্দুসমাজের মধ্যে স্থায়ী আসন দেওয়ার জন্য তাঁর পোষা পুরোহিতদের ব্যবহার করেন এবং হিন্দুসমাজের মধ্যে বর্তমান বিভেদ-বৈষম্য, ছুৎমার্গ, অস্পৃশ্যতা, জাতভাগ, হিংসা, ঘৃণা এবং বর্তমান সময়ে ধর্মের নামে সকল প্রকার পাপাচারের জন্মদাতা তিনি। তাই হিন্দুসমাজ বর্তমানে প্রায় পঙ্গু।”
এক রামে রক্ষে নেই তার উপর সুগ্রীব দোসর! ব্রাহ্মণ্যবাদকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আবির্ভাব হলেন রঘুনন্দন ভট্টাচার্য। ইনি আবার বল্লালসেনের চেয়ে এককাঠি উপরে। কে এই রঘুনন্দন ভট্টাচার্য? রাজা বল্লালসেনের কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তন ও মানবসমাজকে চিতায় তুলে দিলেন এবং এরপর রঘুনন্দন সেই মানবসমাজের চিতায় অগ্নিসংযোগ করে ভস্ম করার দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন। নবদ্বীপে ভগ্ন-কুলীন ব্রাহ্মণের ঘরে রঘুনন্দন ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন। সমাজরক্ষার ধুয়ো তুলে তিনি একটি গ্রন্থও রচনা করে ফেললেন। নাম ‘অষ্টাবিংশতিত্ত্ব স্মৃতি। উহাই হিন্দুসমাজে নতুন শাস্ত্র’ হইল। ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য বিস্তার করার জন্য তিনি ঘোষণা করলেন— “যুগে জঘন্যে দ্বিজাতি ব্রাহ্মণ শূদ্র এবহি”। অর্থাৎ- কলিযুগে মাত্র দুটি জাতি আছে একটি ব্রাহ্মণ ও অপরটি শূদ্র। রঘুনন্দন ক্ষুরধার ফতোয়া দিয়ে হিন্দুসমাজের ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সমাজকে বিলুপ্ত করলেন। তাঁর লেখনিতে বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাখ, পাল, সাহা, কুণ্ডু, নাপিত সহ সকল শ্রেণির হিন্দুমানুষ বল্লালসেনের গড়া জাতবিভাগে সবাই শূদ্র শ্রেণিতে ঘোষিত হল। রঘুনন্দন ব্রাহ্মণসমাজ যাতে সহজে শূদ্রদের শোষণ করতে পারে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নানাবিধ ব্যবস্থা করে দিলেন। ব্রাহ্মণ সমাজ রঘুনন্দনের নববিধান মুঠোয় পেয়ে শূদ্র জাতিকে শোষণের জন্য তৎপর হয়ে উঠল। শ্রাদ্ধ, বিবাহ, পঞ্চামৃত, সাধভক্ষণ, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, পুকুরখনন, গৃহপ্রবেশ, বিদেশযাত্রা, পুজো-পার্বন, তিথি, নক্ষত্রদোষ প্রভৃতি কাজে ব্রাহ্মণের খাজনা বা ভোলা চাই শূদ্রের কাছ থেকে। মৃত যজমান শ্মশানে চলেছে, সেখানেও ব্রাহ্মণের খাজনা আদায়। যজমান মৃত মাতা-পিতার বা পুত্র-কন্যার শোকে পাগল, ব্রাহ্মণ চোদ্দো পুরুষের পিণ্ডদানের ফর্দ করে শোকাতুর যজমানের শোকের অবসরে যজমানকে লুণ্ঠন ও শোষণ করে, রাস্তার ভিখারিতে পরিণত করে। কেননা ভিক্ষা করে হলেও ব্রাহ্মণদের আবদার পূরণ করতে হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে। মৃতদের স্বর্গে বসবাসের জন্য কত রকমের ব্যবস্থা, কত রকমের ফন্দিফিকির। বিকল্পে মোটা অঙ্কের দক্ষিণা। যতটুকু তিল ততটুকু স্বর্ণ, জমি, সবৎস গাভী, ষোড়শ দান, পাত পেড়ে ভোজ সারা ইত্যাদি প্রাপ্তি। শোষণ করতে করতে লোভ এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে ব্যক্তির পরমাত্মীয়ের মৃত্যু হওয়ার কারণে পেট ভরতি করে চব্যচোষ্য ভোজ করার মতো অমানবিক নিষ্ঠুর প্রথা চালু করা। বিয়ের আনন্দে ভোজ খাওয়া যেতেই পারে, সন্তান প্রথম ভাত খাচ্ছে সেই আনন্দেও ভোজ চলতেই পারে– তাই বলে কারোর প্রাণপ্রিয় আত্মীয়ের মৃত্যু হলে সেই আনন্দে ভোজ খাওয়া যায়? মৃত্যু কি আনন্দের বিষয়! কারোর আত্মীয়-বিয়োগ হলে কি সেই আনন্দে মিষ্টিমুখ করা যায়! মৃতদেহ সৎকার (দাহ বা কবর) করার পর আর কোনো কাজ থাকে না। তারপর যাঁর শোক সেই-ই বহন করে, আর কেউ নয়। বেদ তো তাই-ই বলে। শ্রাদ্ধ মানে শ্রদ্ধা জানানো, মস্তক মুণ্ডন করে গণ্ডায়পিণ্ডায় গেলানো নয়। আমরা যাঁরা শ্রাদ্ধের ভোজ খেতে যাই, তাঁরা কোন্ আনন্দে সেজেগুজে মৃতব্যক্তির বাড়ি গিয়ে মুখে অন্ন তুলি! নিজেকে অসভ্য, বর্বর, অমানবিক বলে মনে হয় না? না, মনে হয় না। মনে হয় না বলে আমরা শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে গিয়ে গিলতে গিলতে ত্রুটি খুঁজি, রান্নার ভালো-মন্দের চর্চা করি, আপ্যায়নের বিচার করি।
শূদ্রেরা মনে করেন ব্রাহ্মণরাই ব্রাহ্মণ-পুরোহিতরাই মানুষকে স্বর্গে পাঠানোর ঠিকা পেয়েছেন। মনে করেন ব্রাহ্মণের হাতেই মৃতব্যক্তির স্বর্গ ও নরক। ব্রাহ্মণের দাবি মেটালে স্বর্গ, না-মেটালে অবশ্যই নরকে ঠাঁই। শূদ্রের মাথায় ব্রাহ্মণের পা না-চড়ালে স্বর্গ কোথায়! ব্রাহ্মণের কাছে মাথা নত করলেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়, সব পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। রঘুনন্দন এবার তাঁর ভেদনীতি আরও বিস্তার করলেন। বৈদ্য, কায়স্থ, নবশাখ থেকে ডোম, মেথর পর্যন্ত, সকলকেই তিনি ব্রাহ্মণের দাস, শূদ্র বা গোলাম বলে ঘোষণা করলেন। তারপর তিনি শূদ্রদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিকে সৎ বা অসৎ শূদ্র বলে ঘোষণা করলেন। রঘুনন্দনের প্রদত্ত উপাধি আবার কোনো কোনো শূদ্র খুব গর্বভরে গ্রহণ করেলেন। ভাবতে থাকলেন “আমি অন্য শূদ্রদের থেকে একটু ভালো, কারণ আমি কুলীন শূদ্র”। ব্রাহ্মণদের পদাঘাত নীরবে হজম করে শত শত শূদ্রগোষ্ঠী বা গোলামগোষ্ঠী অন্য শূদ্র বা গোলামদের উপর অত্যাচার শুরু করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করল না। তাঁরা ভুলে গেলেন যে– ‘আমরা সকলেই শূদ্ৰশ্রেণি তথাকথিত ব্রাহ্মণদের চোখে। ভুলে গেল বিয়ে, শ্রাদ্ধ, পুজো-পার্বন ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানে শূদ্রদের বসার আসন ব্রাহ্মণদের আসন থেকে সর্বদা আলাদা রাখা হয়।
অবমাননার এখানেই শেষ নয়। যেমন— শূদ্রের সামনে দেবতাকে ভোগ দেওয়া যাবে না। শূদ্রের সকারে কোনো ব্রাহ্মণ অংশগ্রহণ করতে পারবে না, অন্যথায় ব্রাহ্মণের ব্ৰহ্মত্ব নষ্ট হবে। ব্রাহ্মণদের হুঁকোয় শূদ্র শ্রেণির মানুষ তামাক পান করতে পারবে না। স্বামী বিবেকানন্দের বাড়িতে বৈঠকখানায় তাঁর বাবার বিভিন্ন জাতের জন্য আলাদা আলাদা হুঁকো সাজানো থাকত। পাছে জাত যায়, সেই কারণে কেউ কারোর হুঁকোয় মুখ দিতে পারত না। গল্প শোনা যায়, বিবেকানন্দ নাকি স্বয়ং সবকটি হুঁকোয় মুখ দিয়ে টেনে দেখেছিলেন কীভাবে জাত যায়। শ্মশানে শূদ্রের চিতা ভস্মের কাছাকাছি ব্রাহ্মণদের শবদাহ নৈব নৈব চ। শূদ্রের বেদে ও গায়ত্রী মন্ত্রে অধিকার নেই; শূদ্র ওম স্বধা বা স্বাহা প্রভৃতি বেদমন্ত্র উচ্চারণ করবে না। ব্রাহ্মণ শূদ্রের বাড়ির কোনো দেবতাকে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে পারবে না, কারণ শূদ্রের বাড়ির দেবদেবীও শূদ্র। কোনো পুরোহিত শালগ্রাম শিলা নিয়ে কোনো শূদ্রের বাড়ি যাবে না, গেলে সেই বিগ্রহকে প্রায়শ্চিত্ত করে ঘরে তুলতে হবে। শূদ্রের খাবার গ্রহণ করলে পাপ হয়। শূদ্রের বাড়ির পুজোর ভোগ শূদ্ৰান্ন, তাই কোনো অজুহাতেই এই খাবার গ্রহণ করা যাবে না। কোনো শূদ্র প্রতিমা বা ঠাকুরের মূর্তিকে স্পর্শ করবে না, অন্যথায় মূর্তিরূপ দেবতা অশুদ্ধ হয়ে যাবে, জাতিপাত হবে। আহা রঘুনন্দন বাবা, আপনি কত মহান!! আপনার সেই মানবজাতির অসন্মানের ধ্বজা আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি পরম আনুগত্যে।
উচ্চ বর্ণবাদ-বিরোধী অনেক আন্দোলন এ ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে হয়েছে। এ বাংলাতেও কম হয়নি। কয়েকটি আমি আগেই উল্লেখ করেছি। সেইসব আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চায় অনালোচিত থেকে গেছে অনেক আন্দোলন। তাই বলে আন্দোলন থেমে থাকেনি। এমনই এক আন্দোলনের নাম মতুয়া আন্দোলন, পতিত আন্দোলন। মতুয়া আন্দোলনের স্রষ্টা হরিচাঁদ ঠাকুর এবং তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর। হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর সমাজের পতিত নিচুতলার মানুষদের জন্যে ধর্মীয় মতাদর্শগত সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিণত হয়। জাতি বর্ণ বিভক্ত হিন্দু সমাজ, অস্পৃশ্যতা এবং কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধে নিবেদিত হয় মতুয়া ধর্ম আন্দোলন। সমাজের এই জাতপাতভিত্তিক বিপর্যয়ের জন্য হরিচাঁদ ব্রাহ্মণ্যধর্মকেই দায়ী করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এদেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মই প্রধান নিয়ামক শক্তি। তাই বর্ণবিভক্ত সমাজ ব্রাহ্মণ্যধর্মকেই তিনি বেছে নেন। আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবে। এর আগে তথাকথিত নিচুজাতের কোনো নিজস্ব কোনো ধর্ম ছিল না। হরিচাঁদই এইসব অন্ত্যজ ও অনুন্নত শ্রেণির মানুষদের জন্য নিজস্ব মতুয়া ধর্ম প্রচলন করেন। ধর্ম-কর্মে যাঁরা মাতোয়ারা তাঁরাই মতুয়া। হরিচাঁদ ‘হাতে কাম মুখে নাম’ এই বাণীর মাধ্যমে বলেন –নমঃশূদ্ররা কারও চেয়ে হীন বা নিচ নয়। কারও কাছে দীক্ষা নিও না বা তীর্থস্থানে যেও না। ঈশ্বর সাধনার জন্য ব্রাহ্মণদের প্রয়োজন নেই। বাংলার নিম্নবর্ণের নমঃশূদ্র, কাপালি, পৌ, নোয়ালা, মালো ও মুচিদের মধ্যে মতুয়া আন্দোলন জনপ্রিয়তা লাভ করে। অবশ্য এর প্রধান ভিত্তি হল নমঃশূদ্ররা। সংখ্যার দিক থেকে নমঃশূদ্ররা ছিল পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বড়ড়া জনগোষ্ঠী। হরিচাঁদের বার্তা কৃষিজীবী ও মৎস্য আহরণকারী নমঃশূদ্রদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল।
এই অসন্মানের ধ্বজা ড: ভীমরাও রামজি আম্বেদকর বয়ে নিতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন, সোচ্চারেই। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন তিনি। বাবাসাহেব ভারতীয় ব্যবহারশাস্ত্রজ্ঞ (অ্যারিস্ট), রাজনৈতিক নেতা, বৌদ্ধ আন্দোলনকারী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, বাগ্মী, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক, রাষ্ট্রবিপ্লবী ও বৌদ্ধ পুনর্জাগরণবাদী এবং ভারতের দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি গরিব ‘মহর’ পরিবারে (তখন অস্পৃশ্য জাতি হিসাবে গণ্য হত) জন্মগ্রহণ করেন। আম্বেদকর সারাটা জীবন সামাজিক বৈষম্যতার, ‘চতুর্বর্ণ পদ্ধতি’ হিন্দু সমাজের চারটি বর্ণ এবং ভারতবর্ষের অস্পৃশ্য প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন। অস্পৃশ্য’ আম্বেদকরও জাতিবৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছিলেন। অন্যান্য অস্পশ্যদের সঙ্গে আম্বেদকরও বিদ্যালয়ে যেতেন, কিন্তু তাঁদের আলাদা করে বসতে দেওয়া হত ক্লাসঘরে এবং শিক্ষকগণ দ্বারা অমনোযোগী ও অসহায়ক ছিলেন। তাঁদের শিক্ষাকক্ষের ভিতরে বসার অনুমতি ছিল না, এমনকি তাঁদের যদি তৃষ্ণা পেত উচ্চশ্রেণির কোনো একজন উঁচু থেকে সেই জল ঢেলে পান করাত। কারণ নিম্নশ্রেণিদের জলস্পর্শ করার কোনো অনুমতি ছিল না। পরবর্তী সময়ে আম্বেদকরের প্রসিদ্ধি এবং অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় সমর্থনের কারণে, তাঁকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে (Second Round Table Conference) আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধি অস্পৃশ্যদের জন্য গঠিত পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর প্রচণ্ডভাবে বিরোধিতা করেন। যদিও তিনি অন্য সকল সংখ্যালঘুদের যেমন মুসলমানদের ও শিখদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী (Separate Electorate) বিনা দ্বিধায় মেনে নেন এই বলে যে, তিনি অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের গঠনকৃত নির্বাচকমণ্ডলী হিন্দুসমাজকে ভবিষ্যতে বিভক্ত এবং উচ্চশ্রেণির ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে যখন ব্রিটিশরা আম্বেদকরের সঙ্গে একমত হন এবং পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীদের ঘোষণা করেন, তখন মহাত্মা গান্ধি পুনের এরোদা কেন্দ্রীয় কারাগারে (Yerwada central jail) শুধুমাত্র অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর বিরুদ্ধে উপবাস শুরু করেন। গান্ধির এই উপবাস (fast) ভারতজুড়ে বেসামরিকদের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভের উদ্দীপনা জোগায় এবং ধর্মীয় গোঁড়াবাদী নেতারা (Orthodox Politicians), কংগ্রেস নেতারা কর্মীদের মধ্যে মদনমোহন মালব্য ও পালঙ্কর বালো ও তাঁর সমর্থকরা আম্বেদকরের সঙ্গে এরাভাদে (Yeravada) যৌথ বৈঠক করেন। গান্ধিবাদীদের প্রবল চাপের মুখে (Massive coercion) এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিশোধ (Communal reprisal) ও অস্পৃশ্য সম্প্রদায়কে নির্মূলীকরণের আশংকায় আম্বেদকর পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বাতিল করতে সম্মত হন। এই চুক্তির পরে গান্ধি উপবাস পরিত্যাগ করেন। ইতিহাসে এটি পুনে চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তির ফলশ্রুতিতে, আম্বেদকর পৃথক নির্বাচকমন্ডলী গঠনের দাবি ছেড়ে দেন, যা আম্বেদকর গান্ধির সঙ্গে বৈঠকের আগে ব্রিটিশ সাম্প্রদায়িক কর্তৃক শর্ত সাপেক্ষে মঞ্জুর করে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হন। একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন অস্পৃশ্যদের জন্য সংরক্ষিত হয়। এই চুক্তিতে যাকে বলা হয় অস্পৃশ্য সম্প্রদায় (Depressed class)।
বাবা সাহেবের প্রথম স্ত্রী রামাবাই দীর্ঘ অসুস্থতার পরে মৃত্যুবরণ করেন। অসুস্থ অবস্থায় তাঁর স্ত্রী রামাবাইয়ের পান্দরপুর তীর্থে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কিন্তু আম্বেদকর তাঁকে যেতে দিতে অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, তিনি তাঁকে বরং একটি নতুন পান্দরপুর বানিয়ে দিবেন হিন্দু পান্দরপুরের পরিবর্তে– যেটা কিনা তাঁদের অস্পৃশ্য বলে গণ্য করে। ১৩ অক্টোবর নাসিকের কাছে ঈওলার বৈঠকে বক্তব্যে আম্বেদকর তাঁর ভিন্ন ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার অভিপ্রায় ঘোষণা করেন এবং তাঁর অনুগতদেরও হিন্দুধর্ম ত্যাগে প্রণোদিত করেন। নিউইয়র্কে লিখিত গবেষণালব্ধ উপাত্তের ভিত্তিতে একই বছর তিনি তাঁর বই ‘The Annihilation of Cast’ প্রকাশ করেন। ব্যাপক জনপ্রিয় সাফল্যে অর্জনের পর, আম্বেদকর গোঁড়াবাদী ধর্মীয় নেতাদের এবং নিম্ন সাধারণের জন্য অস্পৃশ্য, বর্ণপ্রথার তীব্র সমালোচনা করেন। কংগ্রেস ও গান্ধি অস্পৃশ্যদের প্রতি যা করেছিল, আম্বেদকর কপটতার সহিত তীব্রভাবে গান্ধী ও কংগ্রেসকে আক্রমণ করেন। তাঁর কাজের মধ্যে ‘who were Shudras?’ প্রবন্ধে বর্ণনা করতে চেষ্টা করেন। শূদ্র বর্ণ গঠিত হয় অর্থাৎ পুরোহিত তন্ত্রের হিন্দু বর্ণ প্রথার (Hierarchy of Hindu Caste System) নিম্নবর্ণ গঠনের উপর আলোকপাত করেন। তিনি এও উল্লেখ করেন শূদ্র কীভাবে অস্পৃশ্য থেকে আলাদা। তিনি সারা ভারতের সিডিউল কাস্টেস ফেডারেশনে তাঁর রাজনৈতিক দল বদলে তদারকি করেন, যদিও তা ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সংবিধান পরিষদের নির্বাচনে ভালো করেনি। পরিশিষ্ট লিখতে গিয়ে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে আম্বেদকর হিন্দুবাদকে কর্কশ ভাষায় সমালোচনা করেন তাঁর “The untouchable : a thesis on the origins of untouchability’-60 901– “The Hindu Civilisation…. is a diabolical contrivance to suppress and enslave humanity. Its proper name would be infamy. What else can be said of a civilisation which has produced a mass of people…. who are treated as an entity beyond human intercourse and whose mere touch is enough to cause pollution?” অর্থাৎ “হিন্দু সভ্যতা… হচ্ছে মানবতাকে দমন এবং পরাভূত করতে একটি পৈশাচিক কৌশল। এর প্রকৃত নাম হবে সামাজিক কুখ্যাতি। কাকে সভ্যতা বলে ডাকা যায়, যার একগাদা মানুষ…., যাদের সত্ত্বা মানব সম্পর্কের নীচে গণ্য হয় ও শুধু যাদের ছোঁয়া দূষণের জন্য যথেষ্ট?”
দলিত বৌদ্ধ আন্দোলন বা নববৌদ্ধ আন্দোলন হল বিশ শতাব্দীতে সিংহলী বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের সহায়তায় ভারতের নিম্নজাতিদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটি বৌদ্ধ নবজাগরণ। ভারতের নিম্নজাতি আন্দোলনের পুরোধা ভীমরাও আম্বেদকর বর্ণাশ্রম ভিত্তিক ব্রাহ্মণ হিন্দুসমাজের নিন্দাপূর্বক সমস্ত নিম্নজাতি, অর্থাৎ শূদ্রাদি নিম্নবর্ণীয় ব্যক্তিদেরকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হতে আহ্বান জানান এবং এর ফলে এই আন্দোলন বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে।
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইয়েবেলা সম্মেলনে বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর ঘোষণা করেন যে, তিনি কিছুতেই একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হিসাবে মৃত্যুবরণ করবেন না। কারণ হিন্দুধর্ম বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ আম্বেদকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রত্যেকেই তাঁদের ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার আহ্বান জানান। এরপর বিভিন্ন নিম্নজাতিদের ধর্মান্তরিত হওয়ার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলি দিয়ে আলোচনা করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২২ মে লখনউতে একটি ‘সর্বধর্ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জগজীবন রাম সহ বহু বিশিষ্ট দলিত নেতৃবর্গ উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন। যদিও বাবাসাহেব আম্বেদকর এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে এই সম্মেলনে ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম সহ বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা তাঁদের ধর্মের গুণাবলি দলিত নেতাদের সামনে ব্যাখ্যা করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন ভিক্ষু লোকনাথ বাবাসাহেব আম্বেদকরের দাদরের বাসভবনে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন এবং বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন। পরে গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বৌদ্ধভিক্ষু লোকনাথ ঘোষণা করেন –“আম্বেদকর বৌদ্ধধর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং সমগ্র দলিত সম্প্রদায়কে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।” ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে লোকনাথ তাঁর সিংহলে অবস্থিত ছাপাখানা থেকে ভারতের নিপীড়িত এবং দলিত সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন, যাতে লেখা হয় –বৌদ্ধধর্ম আপনাদের মুক্তি এনে দেবে।
এত কিছু করেও কি বাবা সাহেব সমাজকে বদলাতে পেরেছে? না, পারেনি। সমাজ যেখানে ছিল সেখানেই আছে। কারণ বাবা সাহেবের বার্তা দেশের সর্বত্র পৌঁছায়নি। কারণ অনুসরণকারীদের সদিচ্ছার অভাব। জাতপাতকে সামনে রেখে ভারতীয় রাজনীতিকদের নোংরা রাজনীতি আজও সমান বহমান।
জাতপাতের বিভাজন সামাজিকভাবে এমন নির্যাতনের রূপ নিয়েছিল যে, সমাজে নিম্নবর্গের মানুষদের ঠেকাটাই দায় হয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষে এই বিভাজনের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতি ঘটে বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের। কিন্তু জাতপাতের সংকট ভারত-বাংলাদেশ থেকে আজও যায়নি। এখনও জাতপাতের তাম্রলিপিতে দলিত সম্প্রদায়েরা রয়ে গেছে। মহাত্মা গান্ধি দলিতদের মেথর, সুইপার না বলে ‘হরিজন’ বলার বাণী দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁদের সমাজ ও সামাজিকতার মূল সমাজের সঙ্গে যুক্ত করেনি। অর্থাৎ এক একজন শাসক জাতি বিভাজন করলেও তাঁকে টিকিয়ে রেখেছেন ব্রাহ্মণসমাজ। মহাত্মা গান্ধির হরিজন’ তার একটি প্রকাশ মাত্র।
গো-বলয়ে নিম্নজাতিদের ‘দলিত’ বলা হয়ে থাকে। প্রকৃতভাবে বিচার করলে দেখা যাবে সাংবিধানিকভাবে যাদেরকে বাবাসাহেব নাম দিয়েছেন তফসিলি জাতি বা অনুসূচিত জাতি, তাঁদেরকেই গো-বলয়ে দলিত বলা হয়। এখন প্রশ্ন কেন তাঁদের দলিত বলা হয়? তাঁদের তো সাংবিধানিক নাম আছে, তবুও তাঁদের প্রতি এই ‘দলিত’ শব্দের প্রয়োগ কেন? বাবাসাহেবের কোনো লেখা বা ভাষণে আমরা কি কোথাও দলিত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন? না, পাইনি। ভারতের সংবিধান রচিত হওয়ার পূর্বে যাঁদের অস্পৃশ্য (untouchable) বলে গণ্য করা হত পতিত বলে মনে করা হত, তাঁদের সাংবিধানিকভাবে দু-ভাগে ভাগ করা করা হয়েছে– (১) তফসিলি জনজাতি ও (২) তফসিলি উপজাতি। কারা কোন্ জাতির মধ্যে পড়ে তার বিস্তারিত তালিকা তৈরি করা আছে। তবে অনেক পরে আরও একটা তালিকা তৈরি করা হয়েছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে ওবিসি (other Backward class/OBC)। বাবাসাহেব এঁদের সবাইকেই অস্পৃশ্য বলে চিহ্নিত করেছেন, দলিত বলেননি। তবে গো-বলয়ে এই শ্রেণির জনগোষ্ঠীকে দলিত বললেও বাংলায় কিন্তু নমঃশূদ্র বলা হয়।
তাহলে আমরা দেখে নেব ‘দলিত’ শব্দের উৎপত্তি কোথা থেকে? ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কৌশল হল তাঁরা কখনো সামনে থাকবে না। বরং হাতে থাকবে রিমোর্ট। যা ঘটবে, তা আড়াল থেকে পরিচালিত করা হবে। তাঁরা আমাদের আপন ভাই-জাতি-গোষ্ঠীকে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেবে। আর এই লড়াইয়ে যে পক্ষেরই জয় হোক না-কেন, সে জয় তাঁর নয়। সেই জয় হবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের। তেমনিভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কৌশল করে বাবাসাহেবের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিপক্ষ তৈরি করার জন্য মাধ্যমিক লেভেল থেকে মেধাবী জগজীবন রামকে সমস্তরকম সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে লালনপালন করে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলে। আর ধীরে ধীরে জগজীবন রামকে বাবাসাহেবের প্রতিপক্ষ হিসাবে খাড়া করে। কংগ্রেস এই জগজীবন রামের মাধ্যমে দলিত বা দলিত নেতা শব্দের বিস্তার ঘটাতে শুরু করে। জগজীবন রাম যে সংগঠন তৈরি করেছিলেন, তার নাম ‘দলিত বর্গ সংঘ’। আর বাবাসাহেব তাঁর সংগঠনের নাম দিয়েছিলেন Scheduled Caste Federation। বাবাসাহেব মহাপরিনির্বাণের পূর্বে যে RPI (Republican Party of India)-র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন, পরবর্তীতে কংগ্রেস সেই আরপিআই-এর মাধ্যমে দলিত’ শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করে।
‘দলিত’ শব্দটি কী খুব গর্বের? বহুজন বা বা মূলনিবাসী বলেও অনেকে চিহ্নিত করেন। মূলনিবাসী শব্দেও অনেকের এলার্জি আছে। সংগঠনের নামে ‘বহুজন’ লেখা থাকবে, আবার ‘দলিত’ ‘দলিত’ বলে গলা ফাটাব –সেটা কি ভাবনা ও কর্মের মধ্যে বিশাল অন্তর সৃষ্টি করছে না? কিন্তু আমরা নিশ্চয় SC, ST, OBC ও converted minority-দের মিলন চাই বহজনবাদী ভাবনায়। আর দলিত বলতে যেখানে শুধু সিডিউল কাস্টদেরই বোঝানো হয়, তাহলে সাংবিধানিক শব্দ তফসিলি জাতি বা অনুসূচিত জাতি শব্দগুলোকে ব্যবহার করব না? ব্যবহার হয় না তা নয়, তবে সেগুলি সরকারি কাগজপত্রে।
ভারতে প্রথম জনগণনা হয় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে। সেখানে নমঃশূদ্রদের কোনো উল্লেখ ছিল না। তখন তাদের বলা হত ‘চণ্ডাল’ বা ‘চোঙ’। অবশ্য ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় অবমাননাকর ‘চণ্ডাল’ নামের অবলুপ্তি ঘটে। জনগণনায় ‘চণ্ডাল’ নামের অপসারণ ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু অস্পৃশ্যতা আজও ঘোচেনি। চণ্ডাল একটি বল-বীর্য সমন্বিত অর্থ দ্যোতক শব্দ। চণ্ডের সঙ্গে জাতিসূচক ‘আল’ প্রত্যয় যুক্ত হলে চণ্ডাল হয়। এমনিভাবে লাঙ্গল, জোঙ্গাল, জঙ্গল, ডাঙ্গাল, বহাল, খেড়ওয়াল, সাঁওতাল, বঙ্গাল প্রভৃতি আদি অস্ট্রাল শব্দগুলির ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করলেই ‘চণ্ডাল’ শব্দের গুণগত এবং অর্থগত অভিব্যক্তিটি যথার্থ প্রতিভাত হয়ে উঠবে। ঋকের অনেকগুলি শ্লোকের রচয়িতা বিশ্বামিত্র ছিলেন চণ্ডাল। গুহক চণ্ডাল, রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনি অনন্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। জাতক কাহিনিতে বোধিসত্ত্বকে সতোর প্রতীক হিসেবে ‘চণ্ডাল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে বহুবার। কার্যসিদ্ধির জন্য সুদাস, মনু, অগ্নী, বরুণ। প্রভৃতি দাস বা অসুর নেতাদেরও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত বৈদিক সাহিত্যে। অর্থাৎ রক্ষস (পরবর্তীকালে রাক্ষস বলা হয়েছে), অসুর, নাগ, চণ্ডাল শব্দগুলি কোনোভাবেই ঋণাত্মক নয়— বরং গুণবাচক এবং ঋনাত্মক। অন্যদিকে ‘নমঃশূদ্র’ শব্দটি একেবারেই অর্বাচীন ব্রিটিশ আমলের আরোপিত হীনাত্মক শব্দ। শূদ্র’ শব্দের ‘নমঃ’ জুড়ে দিলেই নমস্য হয়? হয়েছে কি?
১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সেন্সাসে বাঙলার জাতিগুলির মধ্যে নাম পরিবর্তনের একটা হিড়িক তৈরি করা হয়েছিল। তথাকথিত ছোটজাতগুলিকে হিন্দুভুক্ত করার জন্য বাংলার তৎকালীন দিকগজ পণ্ডিতদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। ‘জাতির উন্নয়ন’ নামক গালভরা নামকরণের আড়ালে তাঁরা বিজ্ঞাপন জারি করেছিলেন। প্রায় চল্লিশজন নামকরা মহাপণ্ডিত এই বিজ্ঞাপনে সই করে লিখেছিলেন –“The caste called Namasudra is Brahmin by origin beging descended from the great Brahmin, Kashypa and not ‘chandal’।” শুধু চণ্ডাল নয়, এই হিড়িকে সামিল হয়েছিল বাংলা, বিহার ও আসামের তথাকথিত ছোটোজাতেরা। আবেদনপত্রের ওজন ছিল দেড় মন। চণ্ডালেরা চেয়েছিল নমঃ ব্রাহ্মণ নাম, কোচরা চেয়েছিল ক্ষত্রিয়, বৈদ্যরা চেয়েছিল ব্রাহ্মণ, কাপালিরা চেয়েছিল বৈশ্যকাপালি, বাগদিরা চেয়েছিল ব্যগ্রক্ষত্রিয়, হাঁড়িরা চেয়েছিল ক্ষত্রিয়, সুবর্ণ বণিকেরা চেয়েছিল বৈশ্য আর পোদরা চেয়েছিল পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়। বিহারের ভূমিহারেরা হল ব্রাহ্মণ। কায়স্থরা প্রথমে শূদ্র পরে ক্ষত্রিয়। দুসাদেরা দাবি করেছিল ক্ষত্রিয়ত্বের। এর আসল কারণ ছিল আইন সভায় সংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব করা। বিংশ শতকের শেষ দশকে আগা খাঁ ভাইয়েরা যখন সঠিকভাবে লোক গণনার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছিলেন এবং বারবার প্রমাণ দাখিল করছিলেন যে, হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল, সাঁওতালরা কেউই হিন্দু নয়। যাই হোক ‘জাতির উন্নয়ন’ নামে তৎকালীন ছোটোজাতগুলির মধ্যে হিন্দুকরণের হিড়িক পড়ে যায়। ব্রাহ্মণের আইনসভায় যাওয়ার প্রতিনিধি সংখ্যা বাড়ে। কিন্তু জাতিগুলি সিডিউল্ড তালিকা ভুক্ত হয়ে ব্রাহ্মণের স্থায়ী দাসে পরিণত হয়ে যায়। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের সেনসাসে স্বাধীন বোধি চিত্তসম্পন্ন একটি প্ৰাগ বৈদিক জাতি শূদ্ৰত্বে উন্নীত হয়।
নমো বা নম নামের বিসর্গীকরণ (ঃ) হয়েছে নমঃশূদ্র নাম হওয়ার পরে। সেনসাসে নমোরা চণ্ডাল থেকে নমঃশূদ্র হয়েছে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে। নমো নেতারা ‘নমো’ নামটি উদ্ধার করতে অনেক সংগ্রাম চালিয়েছেন। কিন্তু সর্বপ্রথম দলবদ্ধভাবে আন্দোলন হয় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম লোকগণনাতে। বাংলায় নমোরা ‘চণ্ডাল’ নামে চিহ্নিত হয়েছেন ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আগমনের পর, শুধুমাত্র ‘নিন্দাসূচক বাক্য হিসাবেই। কারণ সম্পদ সৃষ্টিকারী এই সুবিশাল জনগোষ্ঠীর তথাকথিত কোনো ধর্ম ছিল না।
তথাকথিত ‘ধর্ম’ ছিল না, তাই কোনো তথাকথিত ধর্ম মানার দায়ও এই গোষ্ঠীর ছিল না। তাই ব্রাহ্মণরাই তো বটেই, এমনকি বৌদ্ধরাও নিজ ধর্মে টানতে অসমর্থ হয়ে এই জাতিকে ‘চণ্ডাল’ নামে ভূষিত করেছিলেন! অথচ চণ্ডাল একটি আর্যভাষী জনগোষ্ঠী, যারা উত্তর-পশ্চিম ভারতের লোক এবং ব্রাহ্মণ্যসমাজ কর্তৃক নিন্দিত। বাংলায় ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত ব্রাহ্মণ বা অন্যান্যরা যে নমো নরগোষ্ঠীর লোক সে-কথা নৃতাত্ত্বিক পরিমিতিতেও পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার বলেছেন, ভারতীয়রা যে হিন্দু তাঁরা জানতেই পারতেন না, যদি গ্রিকরা সমুদ্রপথে পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করতেন। তখন তাঁদের সিন্ধুনদী অতিক্রম করতে হত না, আর গ্রিক উচ্চারণে ‘সিন্ধু’ নদী ‘হিন্দু’ হত না। ভারতীয়রা হিন্দু হওয়ার পরে সবচেয়ে বড়ড়া হিন্দু সেজেছেন ব্রাহ্মণরা (আমার অন্য একটি প্রবন্ধে জনৈক ব্রাহ্মণ-পাঠক সরাসরিই বলেছিলেন ব্রাহ্মণরাই সনাতন ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছে’)— অবশ্যই নিজেদের স্বার্থে এবং গণসমর্থন পাওয়ার লক্ষ্যেই। যে লক্ষ্যে তাঁরা ১০০ ভাগ সফল, একথা বলাই বাহুল্য। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সৃষ্টির জন্য বল্লালসেন যখন বাংলায় বৌদ্ধদের কচুকাটা করেন এবং বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে জাতপাত সৃষ্টি করেন, তখনও নমোরা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। রাষ্ট্রশক্তির বহির্ভূত হয়েও এই জাতি ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বারবার প্রতিরোধ সংগ্রাম করেছিলেন। পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে সেইসব আর্য-অনার্যদের যুদ্ধ বা সংগ্রামের কাহিনিই স্বর্ণাক্ষরে বর্ণিত আছে। বলা হয়, আমীষভোজী এই নমোগোষ্ঠী জৈবিক জীবনযাপনে যেমন বৌদ্ধ হতে পারেন না, তেমন মানবিক কারণে ব্রাহ্মণ হওয়াও সম্ভব নয়। তাহলে কীভাবে নমোদের নামের সঙ্গে শূদর যোগ করে তাঁদেরকে হিন্দু করা হল? ‘আত্মসমর্পণ না-করা এই নমোগোষ্ঠীকে ‘চণ্ডাল নামে নথিভূক্ত করে রেখেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদীরা।
বড়োলাট ওয়াভেল সকাশে উপস্থিত হয়ে ভারতীয় হিন্দু অস্পৃশ্যদের কংগ্রেসী নেতা বাবু জগজীবন রাম আবেদন জানান– ইংরেজদের উচিত আরও দশ বছর ভারতে তাঁদের দখল কায়েম রাখা। কারণ ইংরেজদের অবর্তমানে বর্ণহিন্দুরা নীচুজাতের মানুষদের উপর নিপীড়ন আর অত্যাচার আরও বাড়িয়ে দেবে (ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশবিভাগ– লাডলীমোহন রায়চৌধুরী, পৃষ্ঠা ৯)। বাবু জগজীবন রামের এই বয়ান থেকে আন্দাজ করা যায়, মহাত্মা গান্ধির হরিজনদের দুর্গতি ছিল কতটা অসহনীয় ছিল। সেই কারণেই বাবু জগজীবনের কাছে কংগ্রেসী শাসনের অপেক্ষা পরাধীনতা তথা ইংরেজদের ন্যায় বিচার অধিকতর গ্রহণীয় ছিল। অস্পৃশ্য সমাজের নেতা আম্বেদকর গান্ধি প্রদত্ত ‘হরিজন’ অভিধাকে অভিহিত করেছিলেন ‘রাজনৈতিক অনুকম্পা’ বলে। আজও অস্পশ্যতা আইনত দণ্ডনীয় হওয়া সত্ত্বেও ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘সেকুলার’ ভারতে নির্বাচনের মরশুমে দেখা যায় রাজনৈতিক অনুকম্পা’-র মহোৎসব। স্বাধীনোত্তর ‘সেকুলার’ ভারতে মন্দির অপবিত্র করার অছিলায় ‘হরিজন’ বধ তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। প্রকৃত ধর্মহীন বা সেকুলার মতাদর্শ আমাদের সমাজ প্রগতির শর্ত সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির বিলোপসাধন করবেন না। কারণ এই ব্যবস্থাই তাঁদের পুষ্টিসাধন করে। গান্ধিজি বললেন– “অস্পৃশ্যতা বিলুপ্ত হবেই, কারণ হিন্দুধর্ম বাঁচবে, আর যদি অস্পৃশ্যতা দূর না-হয় তাহলে হিন্দুধর্ম অবলুপ্ত হবে।” বাবা সাহেবও একই সুরে বলেছিলেন –“হিন্দুসমাজ যদি জাতব্যবস্থা মুক্ত না-হয়, তবে তাঁরা নিজেদের রক্ষা করার শক্তি অর্জন করতে পারবে না।” ডঃ আম্বেদকর আরও বলেছেন –“আজ প্রয়োজন সমস্ত নির্যাতিত ও বঞ্চিত শ্রেণির মানুষের একত্রিত হয়ে ভারতের মাটি থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদের মূল উৎপাটন করে ফেলা। অন্যথায় তাঁরা মানুষের অধিকার নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।” একুশ শতকের ভারতে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সমাজজীবনে আজও কিন্তু অস্পৃশ্যতার ঘৃণা খর্ব করা যায়নি। হিন্দুধর্মের অচলায়তন পূর্ববৎ স্থানুই রয়ে গেছে।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে সংবিধানে বিবৃত ১৭ নম্বর ধারা বলে সারা ভারতে অস্পৃশ্যতার বিলোপসাধন করা হয়। কিন্তু হিন্দুত্বের জগদ্দল পাথরে কোনো আঁচড় পড়ল না তাতে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট, চুনি কোটালকে মনে পড়ছে? পশ্চিম মেদিনীপুরের দলিত আদিবাসী লোধা শবর সমাজের মেয়ে চুনি। তিনিই শবরদের প্রথম গ্রাজুয়েট। নিজ সমাজকে অশিক্ষার অন্ধকার থেকে টেনে বের করে আনার ব্রত নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি জাতপাতের প্রবর্তক সমাজপতিরা। ইউনিভার্সিটিতে তাঁকে এই সমাজপতিদের কঠিন বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয়। একজন শিক্ষিত সমাজ সচেতনার প্রতি শুধু আদিবাসী হওয়ার কারণে দেশের সমাজপতিদের এই বৈষম্যমূলক আচরণ, অসহযোগিতা তিনি মেনে নিতে পারেননি। ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতি ধিক্কারে, ক্ষোধে, দুঃখে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। স্বাধীনতা দিবসের পরের দিনে চুনি কোটাল জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেল এদেশের দলিত আদিবাসী মূলনিবাসীদের বর্ণবৈষম্যের নিপীড়ন থেকে আজও মুক্তি দেয়নি ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ। ব্রাহ্মণ্যবাদের বলি হলেন অন্ত্যজ চুনি কোটাল। যাঁদের জন্য যাঁদের প্ররোচনায় চুনি কোটাল আত্মহত্যা করলেন তাঁদের কোনো শাস্তি হয়েছে বলে আমি শুনিনি।
চুনি কোটালের সত্যিকারের সমস্যা শুরু হয় যখন তিনি স্থানীয় বিদ্যাসাগর মাস্টার্স কোর্সে (এমএসসি) যোগ দেন। এখানে তিনি ধারাবাহিকভাবে তাঁর উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ অধ্যাপক ফাল্গুনী ও অন্যান্যরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকদের দ্বারা বৈষম্যমূলক আচরণ এবং প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে থাকেন, যাঁরা তাঁকে প্রয়োজনীয় পাস গ্রেড দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যদিও চুনি কোটাল তাঁর সকল ধরনের মানদণ্ড পূর্ণ করেছিলেন। অপমানিত ও হতাশ চুনি ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট মাত্র ২৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। শুভব্রত সুর ‘হার মানা হার’ উপন্যাসে চুনি কোটাল আজও বেঁচে আছে। তার বাইরে সবাই ভুলে গেছে। তবে মহাশ্বেতা দেবীর ‘বিয়াধথান্দা’ (১৮৮৪) ও ‘দি বুক অব দি হান্টার’ গ্রন্থে চুনি কোটালের আত্মহত্যার বিষয়টি আলোকপাত করেছেন।
অনেক নামই উল্লেখ করা যায়। কিন্তু এত জায়গা কোথা থেকে দেব? পায়েলের কথা বলি। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে হাসপাতাল ক্যাম্পাসের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন মুসলমান উপজাতি সম্প্রদায় থেকে পড়তে আসা বিওয়াইএল নায়ার হাসপাতালের রেসিডেন্ট চিকিৎসক পায়েল তদভি। নিজের হাসপাতালেই জাতিবিদ্বেষমূলক অপমান ও হেনস্থার শিকার হতে হয় ডাক্তার পায়েল তদভিকে। মাসের পর মাস হেনস্থা চালাতে থাকে তিন হিন্দু উচ্চবর্ণ সিনিয়র চিকিৎসক হেমা আহুজা, ভক্তি মেহর ও অঙ্কিতা খাণ্ডেলওয়াল। এই তিন সহকর্মীর দ্বারা একদিকে যেমন কর্মক্ষেত্রে ক্রমাগত অত্যাচারের শিকার হন পায়েল, অন্যদিকে হস্টেলেও তাঁকে নানাভাবে হেনস্থা করতে থাকে এই তিনজন। জাতিবিদ্বেষমূলক মন্তব্য, উপজাতি পরিচয় নিয়ে হেনস্থা ও হস্টেলের ভিতর রেগিং হয়ে ওঠে নিত্যদিনের ঘটনা। পাশাপাশি চলে সামাজিক মাধ্যমে নীতিপুলিশি। কর্মক্ষেত্রে রোগীদের সামনেই পায়েলকে নানাভাবে হেনস্থা করতে থাকে এই সিনিয়র চিকিৎসকরা। অপারেশন করতে বাধা দেওয়া হয় পায়েলকে, ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে। ডিন ও বিভাগীয় প্রধানের কাছে তাঁর নামে অভিযোগ করা হবে বলে শাসানো হতে থাকে পায়েলকে। অত্যাচারী এই ডাক্তারদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে এক ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয় তাঁকে, সেখানেও সমান ভাবে চলতে থাকে অত্যাচার ও হেনস্থা। হস্টেলের ঘরের মেঝেতে তোষক পেতে শুতে বাধ্য করা হয় পায়েলকে। বাথরুম পায়খানা থেকে এসে পায়েলের সেই তোষককে পাপোস হিসেবে ব্যবহার করত হেমা ও ভক্তি। হেনস্থা চলে হোয়্যাটস্অ্যাপ গ্রুপেও, তাঁর উপজাতি পরিচয় নিয়ে সেখানেও ক্রমাগত আক্রমণ চালাতে থাকে ওই তিন উচ্চবর্ণের চিকিৎসক। এরপর হস্টেল ছেড়ে হাসপাতালে রাত্রি কাটাতে বাধ্য হন পায়েল। সিনিয়র চিকিৎসকদের থেকে শুনতে হয়, “আমরা ওদের পড়াশোনা করতে দেব না। ওদের সঙ্গে এভাবেই ব্যবহার করা হবে। এরা নীচুজাতের লোক, এদের সঙ্গে এইভাবেই ব্যবহার করা উচিত।”
পায়েলের আত্মহত্যার পর তাঁর মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে ও বিভিন্ন দলিত ও আদিবাসী সংগঠনের চাপে বিশেষ কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কমিটির রিপোর্টে উঠে আসে পায়েলের উপর দিনের পর দিন চলা অত্যাচারের কথা। অভিযুক্ত তিন ডাক্তারকে গ্রেফতার করে পুলিস। হেমা আহুজা, ভক্তি মেহর ও অঙ্কিতা খাণ্ডেলওয়ালের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা, জাতিবিদ্বেষ বিরোধী আইন, অ্যান্টি রেগিং অ্যাক্ট, আইটি অ্যাক্ট-এ অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
পায়েলের মৃত্যুকে শুধুমাত্র আত্মহত্যা বা ব্যক্তির সিদ্ধান্ত হিসাবে দেখা একটি অপরাধ। পায়েলের মৃত্যুর জন্য দায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক জাতিবিদ্বেষ। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি, হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আম্বেদকারাইট ছাত্র রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রগুলিতে কীভাবে বিদ্বেষমূলক আচরণের শিকার হতে হয় সমাজের নিম্নবর্ণ থেকে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের। কীভাবে সুচারু পদ্ধতিতে জাতির ভিত্তিতে আলাদা করে রাখা হয় তাঁদের, নেমে আসে। শাস্তির খাঁড়া, ক্রমাগত তৈরি করা হয় বিচ্ছিন্নতা, ক্রমশই আরও প্রান্তে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই।
২০০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত সুখদেও থারোট কমিটি রিপোর্টে দেখা যায়, ভারতের অন্যতম অগ্রণী শিক্ষাক্ষেত্র অল ইন্ডিয়া ইনস্টিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স (এইমস)-এ দলিত ও উপজাতি সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে ক্রমাগত উচ্চবর্ণের শিক্ষকদের বিদ্বেষের মুখে পড়েন। এই বিদ্বেষের প্রভাব পড়ে ক্লাসের শিক্ষণে, প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় ও পরীক্ষার নম্বরে। হস্টেলে ঘেটো বানিয়ে থাকতে বাধ্য হন এই দলিত ও উপজাতি সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরা। তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় সেই সব হস্টেলে যেখানে শুধুমাত্র নিম্নবর্ণের ছাত্রছাত্রীদের বাস। কখনও তা হয় কর্তৃপক্ষের আদেশে, আবার কখনও উচ্চবর্ণের ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা দিনের পর দিন অত্যাচারিত হয়ে তাঁরা সেখানে চলে যেতে বাধ্য হন। ব্যক্তিগত পরিসরে অন্তরঙ্গতার অভাব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে বার বার অভিযোগ জানিয়েছেন নিম্নবর্ণের ছাত্রছাত্রীরা। হস্টেলের খাবার ও রান্নাতেও আধিপত্য চলে উচ্চবর্ণের, সেই খাবারগুলোই সেখানে রান্না হয় যা উচ্চবর্ণের খাদ্য। আমাদের আরও মনে রাখা দরকার, আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে রেগিং চলে তা শুধুমাত্র নতুন পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের হেনস্থার একটি উপায়ই নয়, এই রেগিংয়ের মধ্যে দিয়েই চিহ্নিত করে নেওয়া হয় সেই সব ছাত্রছাত্রীদের যারা সমাজের প্রান্তিক অবস্থান থেকে পড়তে এসেছেন, দাগিয়ে দেওয়া হয় নিম্নবর্ণের ও নিম্নবর্গের ছাত্রছাত্রীদের।
২০০৭ সালে সুখদেও থোরাট রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে গত ১২ বছরে, দেশের অগ্রণী শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতে আত্মহত্যা করেছেন মোট ২৩ জন দলিত ছাত্রছাত্রী। আধুনিক এই শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতে দলিত ছাত্রছাত্রীদের এই অভিজ্ঞতার কারণ হিসাবে অনেকেই সংরক্ষণ পদ্ধতিকে দায়ী করে থাকেন। একথা ঠিক যে সংরক্ষণের ফলে আজ শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যক দলিত ও বহুজন ছাত্রছাত্রীকে দেখতে পাওয়া যায়, তবে উচ্চবর্ণরা আসলে ভয় পাচ্ছেন দলিত-বহুজন ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সংগঠিত হওয়াকে। দলিত ও বহুজন ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে সংহত হচ্ছেন। আর তাতেই শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর উচ্চবর্ণদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রশ্নের মুখে দাঁড়াচ্ছে। ঐতিহাসিক কাল জুড়ে পেয়ে আসা এই একচ্ছত্র অধিকার হারানোর ভয় হিংস্র হয়ে উঠছে তাঁদের প্রতিক্রিয়া। হিন্দুত্বকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পাস গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে লাগাতার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন তাঁরা। আন্দোলন গড়ে তুলেছেন ধর্মীয় ও আঞ্চলিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত খাদ্য রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে বিফ ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করে রেডিক্যাল বামপন্থী ও আম্বেদকারাইট অ্যাসোসিয়েশনের ছাত্রছাত্রীরা। এই অপরাধে পুলিসি হেনস্থার মুখে পড়তে হয় তাঁদের। এই ধরনের সংগঠনগুলোর উপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় খাঁড়া। তা আম্বেদকর স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনই হোক, বা দিল্লির দলিত আদিবাসী বহুজন মাইনরিটি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অথবা দেশের বিভিন্ন আইআইটিগুলোতে গড়ে ওঠা আম্বেদকর ফুলে স্টাডি সার্কেল। ছাত্র রাজনীতিকে চরমপন্থী করে তোলা, দেশদ্রোহিতা, প্রতিষ্ঠানবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ তুলে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায় রাষ্ট্র।
২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ, দেশের শীর্ষ আদালত একটি গাইডলাইন প্রকাশ করে। তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি (নিপীড়ন বিরোধী) আইনের আওতায় সরকারি কর্মচারি বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে ‘বিধিবহির্ভূতভাবে ও অবিলম্বে গ্রেফতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এই নির্দেশনামা। ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ফ্যাসিস্ট মতাদর্শকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে এমন সবকিছুকেই বাতিল করে দিতে উদ্যত আজকের ভারত রাষ্ট্র। ইউজিসি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক সহ রাষ্ট্রের প্রতিটি হাতিয়ারকে আজ তাঁরা এই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করছে। একই উদ্দেশ্যে, নতুন ও পুরোনো দুই ক্ষেত্রেই ‘অপ্রয়োনীয়’ পিএইচডি গবেষণার বিষয়কে খতিয়ে দেখার নিদান দিতে চলেছে। রাষ্ট্র।
প্রান্তিক মানুষদের জন্য সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তৈরি সাংবিধানিক অধিকারগুলোকে খর্ব করে, আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে দ্রুতই ব্রাহ্মণ্যবাদী এক পরিসরের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে রাষ্ট্র। ঐতিহাসিককাল ধরে শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর উচ্চবর্ণের একচ্ছত্র শক্তি প্রতিষ্ঠার যে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রীতি চলে আসছে তারই পরিণতি আমরা দেখতে পাই পায়েল তদভি (২০১৯), রোহিত ভেমুলা (২০১৬), বালমুকুন্দ ভারতী (২০১০), এম ভেঙ্কটেশ (২০১৩), সেন্থিল কুমার (২০০৮), রেজানি এস আনন্দদের (২০০৪) মৃত্যুতে। পায়েল তদভীর মৃত্যু তাই কোনো একক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নয়। এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা। এই মৃত্যুর কারণ, হিন্দু সমাজ জীবনে গভীরভাবে গেঁথে থাকা বর্ণবৈষম্যমূলক মানসিকতা ও জাতিবিদ্বেষ। এই হেমা আহুজা, ভক্তি মেহর ও অঙ্কিতা খাণ্ডেলওয়াল আসলে মূলধারার হিন্দু নারীবাদের প্রতিনিধি, নিম্নবর্ণের পুরুষ ও নারীকে নিপীড়ন করেই প্রতিষ্ঠিত হয় যে নারীবাদ। স্মৃতি ইরানি, কঙ্গনা রানাউত, প্রজ্ঞা ঠাকুরের গৈরিকি নারীবাদ, যা ধর্মের নামে হত্যা করে, দমন চালায় প্রান্তিকের উপর, আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে সেই নারীবাদের বিরুদ্ধে। (সূত্র : বাস্তার সলিডারিটি নেটওয়ার্ক)
ভারতে প্রতি ১৫ মিনিটে দলিত নাগরিকের উপরে একটি অপরাধ সংঘটিত হয়, প্রতিদিন ৬ জন দলিত নারী ধর্ষিত হয় এবং প্রতি বছর বস্তিতে বসবাসকারী ৫৬,০০০ শিশু অপুষ্টির দরুন মারা যায়। করোনার অতিমারির মধ্যেও উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে ধর্ষণ, হত্যা ও মাঝরাতে দলিত ধর্ষিতার শবদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। উত্তরপ্রদেশ ও নৈনিতালের উচ্চবর্ণের করোনা রোগীরা আইসোলেশন কেন্দ্রে দলিত রাঁধুনির রান্না খেতে অস্বীকার করে। লকডাউনের জন্য চেন্নাই থেকে গ্রামে ফিরে এম সুধাকর তাঁর ছয় মাসের বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে দেখা স্ত্রীর বাবা তাঁকে খুন করে। কারণ এম সুধাকর ছিলেন দলিত এবং তাঁর স্ত্রী ছিলেন উচ্চবর্ণের মেয়ে। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ৬ তারিখে ১৭ বছরের দলিত তরুণ বিকাশ কুমার জাটভকে কেবল উত্তরপ্রদেশের আমবোহাতে মন্দিরে ঢোকার অপরাধে ৪ জন যুবক গুলি করে হত্যা করে। ২০২০ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রদেশে উঁচু জাতের জন্য রাখা খাবার স্পর্শ করার অভিযোগে বছর পঁচিশের যুবক দেবরাজ অনুরাগীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানায় হত্যাকারী দুই যুবকের নাম যথাক্রমে সন্তোষ পাল ও ভুরা সোনি। ২০২১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে ধর্ষণ করে খুন করা হল একটি ৯ বছরের কিশোরীকে। কিশোরীর বাড়ির পাশেই শ্মশান। সেখানে কুলার থেকে ঠান্ডা জল আনতে গিয়েছিল ৯ বছরের দলিত কিশোরী। শ্মশানেই তাঁকে ধর্ষণ ও হত্যা করে কয়েকজন দুষ্কৃতি। তারপর তড়িঘড়ি পরিবারের বিনা অনুমতিতে মৃত কিশোরীকে চিতায় তুলে দেয়। পুলিশ পুরোহিত সহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে।
ভারতীয় সংবিধানে জাতিভেদ কেন্দ্রিক অস্পৃশ্যতাকে নিষিদ্ধ করেছে, বলা হয়েছে— “Untouchability is abolished and its practice in any form is forbidden….. ‘untouchability’ shall be an offence punishable in accordance with law”. (The Constitution of India, Part III, Fundamental Rights) এই সংবিধান মোতাবেক ভারতের সমস্ত অঞ্চলের পুণ্যতীর্থ, দেবমন্দির, উচ্চ-নীচ নির্বিশেষে সকল জাতের মানুষের কাছে সমানভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। অস্পৃশ্য ও দলিত শ্রেণির মানুষ ভারতের বিভিন্ন পুণ্যতীর্থে, দেবমন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে, শহর-নগরের পুষ্করিণী বা কূপের জল পান করতে পারবে, উচ্চবর্ণ মানুষের সঙ্গে একই বিদ্যালয়ে পাশাপাশি বসে শিক্ষালাভ করতে পারবে, একই কর্মক্ষেত্রে মিলিত ভাবে কাজ করতে পারবে, একই ভোজনালয়ে পাশাপাশি বসে পানাহার করতে পারবে। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ভারত সরকার নিম্নবর্গের মানুষদের উচ্চবর্গে উন্নীত করার জন্য বিভিন্ন প্রকার উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা করেছে। দলিত ও তফসিলিদের (Schedule Caste) জন্য শিক্ষা ও জীবিকার ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রচলন করে তাঁদের শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটানোর প্রয়াসও রয়েছে।
কতটা বদলেছে সমাজ? কতটা বদলেছি আমরা? সময়ের সংকটে কয়েকজন যুক্তিমনষ্ক মানুষদের কিছুটা বদলালেও এখনও দলিত শ্রেণির মানুষেরা তিমিরেই পড়ে আছে। এখনও জাতির ক্ষেত্রে স্বজাতি বিবাহ শাস্ত্রসম্মত, উঁচু জাতির সঙ্গে নীচু জাতির বিবাহ গ্রহণ হয় না। আজও ব্রাহ্মণ-পুত্রসন্তান যদি কোনো শূদ্র-কন্যার বিবাহ হয় তাহলে তাঁকে শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে জাতিচ্যুত না-হলেও পরিবারচ্যুত হতে হয়। খবরের কাগজে ‘পাত্রপাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনে লক্ষ করুন কেমন জাতবিচারের ধূম! চূড়ান্ত বজ্জাতি। এ বজ্জাতি কি অসংবিধানিক নয়? অবশ্যই এ বজ্জাতি কি অশাস্ত্রীয় নয়? অবশ্যই। কী বলছে শাস্ত্র? একবার ফিরে দেখা যাক –“অথ ব্রাহ্মণস্য বর্ণানুক্রমেণ চতস্রো ভাৰ্য্যা ভবন্তি।১। তিস্রঃ ক্ষত্রিয়স্য।২। দ্বে বৈশ্যস্য।৩। এক শূদ্রস্য।৪।— অর্থাৎ ব্রাহ্মণ স্বর্ণ ব্যতীত অন্য তিন বর্ণের কন্যাকে বিয়ে করতে পারবে। ক্ষত্রিয়, বৈশ্যা ও শূদ্রাদের বিয়ে করতে পারবে; বৈশ্যেরও শূদ্রা বিবাহে কোনো আপত্তি নেই, শুধুমাত্র শূদ্ররাই শূদ্রা ভিন্ন অন্য কারোকেও বিয়ে করতে পারবে না। তার মানে উচ্চবর্ণের বিয়েতে কোনো বাছবিচার নেই, তাঁদের বিয়ে সকল বর্ণের সঙ্গে হতে পারে। তাহলে পাত্রপাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের এত জাতপাতের বিচার কেন আজও জারি আছে। এটা কি হিন্দুদের শাস্ত্রের অবমাননা নয়? অপরদিকে শূদ্রের পাত্ররা শূদ্র ব্যতীত অন্য কোনো উচ্চবর্ণের পাত্রীকে বিয়ে করতে পারবে না। কারণ বিবাহ সূত্রে সেইসব উচ্চবর্ণের পাত্রীরা শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হবে। এ ব্যবস্থা আজও মেনে চলা হয় আমাদের সমাজে। সে কারণে নিম্নবর্ণ উচ্চবর্ণে উন্নীত হতে না পরলেও সমান হতে পারল না। মনু বলেছেন– যে স্বপত্নী শূদ্রাতে ব্রাহ্মণ ঔরসে জাতা কন্যা যদি অন্য ব্রাহ্মণ বিবাহ করে এবং তার কন্যাকে যদি অপর ব্রাহ্মণ বিবাহ করে এবং এমনভাবে ব্রাহ্মণ সংসর্গ যদি ধারাবাহিক সাতপুরুষ পর্যন্ত হয়, তবে ওই বর্ণ ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হয় এবং এমনভাবে যেমন শূদ্র ব্রাহ্মণ হয়, তেমনই ব্রাহ্মণও শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। ভুলে গেলেন ব্রাহ্মণেরা, পিছিয়ে গেলেন শূদ্রেরা। কোনো এক অনৈতিক উদ্দেশ্যে ক্রমে ক্রমে শূদ্রের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ রহিত হয়ে গেল। বললেন –“ব্রাহ্মণী ক্ষত্রিয়া বৈশ্যা ব্রাহ্মণস্য প্রকীৰ্ত্তিতাঃ।/ক্ষত্রিয়া চৈব বৈশ্যা চ ক্ষত্রিয়স্য বিধীয়তে।/বৈশ্যৈব ভাৰ্য্যা বৈশ্যস্য শূদ্রা শূদ্রস্য কীৰ্ত্তিতাঃ।” শূদ্র সমাজশরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। তাঁদের আর বর্ণান্তর প্রাপ্তির সুযোগ থাকল না।
মাঝেমাঝেই দেশনেতাদের মুখে শোনা যায়, শূদ্রদের শিক্ষার মাধ্যমে ক্রমোন্নত করাই আমাদের সমাজের লক্ষ্য। সেই আদর্শ তো ছিলই, সব ভুলে গেলেন কেন? কিরকম সেই শিক্ষা?
“ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বিশস্ত্ৰয়োবর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
শ্রুতিস্মৃতি পুরাণোক্ত ধৰ্ম্মযোগ্যাস্তুনেতরে।
শূদ্রোবর্ণশ্চতুর্থোপি বর্ণত্বাদ্ধৰ্ম্মমহতি।
বেদমন্ত্রস্বধা-স্বাহা ষষ্কারাদিভিবিনা।”
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য এই তিন জাতি দ্বিজ শব্দবাচ্য। এঁরাই শ্রুতি স্মৃতি ও পুরাণোক্ত ধর্মের অধিকারী। অন্য জাতি নয়। শূদ্রজাতি চতুর্থবর্ণ বলে ধর্মে অধিকারী, কিন্তু বেদমন্ত্র ও স্বাহা, স্বধা বষটকারাদি শব্দের উচ্চারণের অধিকারী নয়। শুধু ধর্ম বিষয়েই নয়, লৌকিক বিষয়েও শূদ্রকে কোনো উপদেশ দিতে মনু নিষেধ করেছেন এই বলে –“ন শূদ্রায় মতিং দদ্যাৎ।” শাস্ত্রকারগণ খুবই ন্যায় বিচারক, ধর্মবেত্তাগণ তো সেটাই বলেন! কেমন সেই ন্যায় বিচার? চার বর্ণের একই অপরাধের শাস্তি চার প্রকারের। ব্রাহ্মণগণের সত্য দ্বারা শপথ করলেই হত, ক্ষত্রিয় অশ্ব বা আয়ুধ দ্বারা এবং বৈশ্য গো, বীজ বা কাঞ্চন দ্বারা শপথ করত, কিন্তু এত অল্পে ছাড়া যায় না। তাই শূদ্রের জন্য ফতোয়া —
“অগ্নিং বা হারয়েদেমন্দু চৈসং নিমজ্জয়েৎ।
পুত্রদারস্য বাপ্যেনং শিরাসিং স্পর্শয়েৎ পৃথক।
সমিদ্ধো ন দহত্যগ্নিরাপো নোন্মজ্জয়ন্তি চ।
ন চার্তিচ্ছতি ক্ষিপ্রং স জ্ঞেয়ঃ শপথে শুচি।”
অর্থাৎ “শূদ্রকে অগ্নিপরীক্ষা, জলপরীক্ষা কিংবা স্ত্রীপুত্রাদির মাথা স্পর্শ করে পরীক্ষা করবে। অগ্নি যাকে দগ্ধ না করে, জল যাকে না ভাসায় এবং স্ত্রীপুত্রাদির মাথা স্পর্শ করলে শীঘ্রই কোনো যন্ত্রণা ভোগ না করে –শপথ সম্বন্ধে সেই ব্যক্তিকে শুচি বলে জানবে।” শূদ্রের কী অবর্ণনীয় অবস্থা! এখন এই ব্যবস্থার প্রচলন নেই ঠিকই, একদা এহেন ব্যবস্থা প্রচলন ছিল এটা ভাবলেই তো শিউরে উঠতে নয়। মহামতি শাস্ত্রকারগণ এখানেই ক্ষান্ত হননি। নির্দয় অপরাধপ্রবণ শাস্ত্রকারগণ শূদ্রদের আগুনে পুড়িয়ে আর জলে ডুবিয়ে মেরেও। শান্তি পাননি। তাঁরা টু শব্দ করলেই শূদ্রদের হাত-পা কেটে নেওয়ার হুকুম দেওয়া হত, ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কর্কশবাক্যে কথা বললে জিভ কেটে নেওয়ার আদেশ হত, ব্রাহ্মণকে বামনা’ ‘বিটকেল’ বলে পালালে শূদ্রকে লোহার ডাণ্ডা ছুঁড়ে মারার কথা বলা হয়েছে। শূদ্র যদি দর্পিতভাবে ব্রাক্ষণকে ধর্মোপদেশ করে, তবে রাজার উচিত কাজ সেই শূদ্রের মুখে ও কানে গরম তেল ঢেলে দেওয়া হবে, শূদ্র যে অঙ্গ ব্যবহার করে শ্রেষ্ঠ জাতি ব্রাহ্মণকে মারবে রাজা তাঁর সেই অঙ্গটাই কেটে ফেলে দেবে। শূদ্র যদি উচ্চবর্ণের সঙ্গে একাসনে বসে তবে রাজা তাঁর কটিদেশে গরম লোহার শালাকা দিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে, অথবা মরে না যায় এমনভাবে তাঁর পাছা দুটির মাংস কেটে দেওয়া হবে, শূদ্র যদি অহংকার করে ব্রাহ্মণের গায়ে থুতু দেয় তাহলে রাজা তাঁর ঠোঁট দুটো কেটে দেবে, ব্রাহ্মণের গায়ে প্রস্রাব করে দিলে লিঙ্গ সমূলে কেটে দেবে, ব্রাহ্মণের সামনে বাতকর্ম বা বায়ু নিঃসরণ করলে পায়ুপথ বা গুহ্যদেশ কেটে নেবে। শূদ্র যদি দ্বিজগণের ধন হরণ করে তবে প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে, শূদ্র যদি বেদ শ্রবণ করে তাহলে রাজা সিসা ঢেলে তার কান বন্ধ করে দেবে, বেদমন্ত্র উচ্চারণ করলে জিভ কেটে দেওয়া হবে। ব্রাহ্মণগণ শূদ্রদের শুধু হাতে মেরেই তুষ্ট হতে পারেননি, ভাতে মারার ব্যবস্থাও করে রেখেছেন।
“শক্তেনাপি হি শূদ্রেন ন কাৰ্য্যে ধনসঞ্চয়ঃ।
শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণনেব বাধতে।”
(মনুসংহিতা, দশম অধ্যায়, শ্লোক ১২৯, )
বর্ণ পিরামিডের উপরের স্তরে অবস্থানকারীরা ‘শুদ্ধ’ বলে বিবেচিত এবং তাঁদের অসংখ্য পদবি আছে। পিরামিডের নীচের অধিবাসীরা হলেন অচ্ছুৎ, তাঁদের কোনো পদবি নেই, কিন্তু অসংখ্য কর্তব্য আছে। এই শুদ্ধ এবং অচ্ছুতের বিন্যাস উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পেশা এবং বর্ণভেদভিত্তিক বিশাল ব্যবস্থার অধীনে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এ ব্যবস্থা মানুষের উপকারী কার্যক্ষমতাকে হত্যা করে, পঙ্গু করে এবং ছিন্নভিন্ন করে দেয়। নিম্নবর্ণের মানুষদের জোর করে একঘরে করে রাখা হত। যে রাস্তা দিয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা হাঁটেন সেই রাস্তা দিয়ে অস্পৃশ্যরা হাঁটতে পারতেন না। গণকুপের জল পান করতে পারতেন না, হিন্দুমন্দিরে প্রবেশ করতে পারতেন না তাঁরা, উচ্চবর্ণের স্কুলে তাদের প্রবেশাধিকার ছিল না, নিম্নবর্ণের মানুষরা ঊর্ধ্বাঙ্গ বস্ত্রাবৃত করতে পারতেন না। আম্বেদকর যে মাহার বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন সেটি সহ কিছু নির্দিষ্ট বর্ণের লোকেদের তাঁদের কোমরে ঝাঁটা বেঁধে রাখতে হত, যাতে হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের ছাপ মুছে ফেলতে পারে। আর-এক নিম্নশ্রেণিকে গলায় পিকদানি ঝুলিয়ে রাখতে হত তাঁদের মুখের দুষিত লালা সংগ্রহ করার জন্য। উচ্চবর্ণের হিন্দুপুরুষের অবিসংবাদিত অধিকার ছিল অস্পৃশ্য নারীদের দেহের উপর। রামায়ণ, মহাভারত সহ প্রাচীন সাহিত্যে এরকম প্রচুর ধর্ষণের কাহিনি পাই। ভারতের অনেক অঞ্চলেই এখনও এসব ব্যবস্থা অনেকাংশে রয়ে গেছে। বর্তমান জন্মের অবাধ্যতায় শাস্তির মেয়াদ বেড়ে যাবে অর্থাৎ পরবর্তী পুনর্জন্মে আর-একবার অস্পৃশ্য অথবা একজন শূদ্র হিসাবে জন্মাতে হবে। তাই বিধিনিষেধ মানাটাই সর্বোত্তম।
শূদ্রগণ বড়োই অস্পৃশ্য। মাছ মারে বলে ধীবর ও কৈবর্তের জল অস্পৃশ্য, কিন্তু তাঁদের হাতের জলটুকু পান করলে যাঁদের জাত মারা যায়, তাঁদের কাছে পরম উপাদেয় আহার মাছ। শুড়ির হাতে মদ্য পান করলে জাত যায় না, তবে জল পান করলে জাত যায়। হাড়ি শুয়োর পালন করে বলে অস্পৃশ্য, কিন্তু হিন্দু রাজপুতেরা অনেক ক্ষেত্রেই শূয়োর ভক্ষণ করেও উচ্চশ্রেণির। নমঃশূদ্রের হাতের জল অচল, কিন্তু কারিগর কারা জেনেও বিরিয়ানি গপগপ করে খেতে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। সোমরস পানের জন্য ব্রাহ্মণগণের তো শূদ্রই একমাত্র অবলম্বন ছিল, অবশ্য তার বিনিময়ে একটি বাছুর দেওয়া হত; সোমরস দিয়ে শূদ্র কিছুদূর যাওয়ার পর পথিমধ্যে সেই দেওয়া বাছুর কেড়ে নেওয়া হত শূদ্রের গালে চড় মেরে।
এই হল ভারতের সামাজিক ভিত। শূদ্রদের অপমানের উপর যে সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে শূদ্রদের কতটা মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পারলাম। ন্যূনতম সদিচ্ছা আছে কী? সংবিধান রচনার সময় বলা হয়েছিল আগামী ১০ বছরের মধ্যে শূদ্রের হৃত সন্মান ফিরিয়ে দিতে হবে। চাকরির ক্ষেত্রে, শিক্ষার ক্ষেত্রে সংরক্ষণ দিয়ে তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতির মানুষদের সমান উচ্চতায় আনা হবে। কিস্যু হয়নি। ১৫ বছরে তো হয়ইনি, ৭৫ বছরেও হয়নি। হয়নি, কারণ সংরক্ষণের নামে ওদের নিয়ে কেবলই নোংরা রাজনীতি হয়েছে। তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতির মানুষগুলো রাজনীতির বোড়ে। এই বোড়ে চেলে উত্তরপ্রদেশের মায়াবতী যেমন মুখ্যমন্ত্রী হয়, বিহারে লালু-নিতীশরা মুখ্যমন্ত্রী হয়। তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতির মানুষদের কিছু হয় না। এই সংরক্ষণের সুবিধা প্রকৃতই যাঁদের প্রয়োজন তাঁরা অধরাই থেকে যায়, ক্রিমি লেয়ারে অবস্থিত তফসিলি জাতির মানুষ তেলে মাথায় তেল পায়। এক প্রকৃত দরিদ্র মেধাবী ছাত্রীকে নিয়ে বিডিও অফিসে গিয়েছিলাম শিডিউল কাস্ট সার্টিফিকেটের জন্য। সেখানকার অফিসার জানালেন এমন কোনো দলিল দেখাতে হবে যাতে প্রমাণ হবে যে সে ৫০ বছর আগেও শিডিউল কাস্ট ছিল।, দেখানো যায়নি। কারণ তাঁরা এতটাই গরিব ছিল যে, কোনো সম্পত্তি-সম্পদ তাঁদের ছিল না। তাই প্রমাণ করাও গেল না যে সে তফসিলি উপজাতি বাগদি সম্প্রদায়। বাগদি কি উচ্চবর্ণ! আমি নিজ দায়িত্বে তাঁকে বিনা পয়সায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত টিউশন দিতে পেরেছিলাম, কিন্তু সংরক্ষণের সুযোগসুবিধা নেওয়াতে পারিনি। মেধা অকালেই ঝরে গেল!
সুষ্ঠুভাবে সমাজ, সংসার মায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে কর্ম-বিভাজন অত্যন্ত আবশ্যিক, বর্ণ-বিভাজন নয়। যাকে যে কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হবে তাঁকেই সেই কাজ করতে হবে। যে যেই কাজে দক্ষ সে সেই কাজ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। মানবসমাজের প্রতিটি মানুষই হাতে হাত মিলিয়ে সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছেন এইভাবে। তাহলে কেন শুধু দ্বিজরাই সর্বোচ্চ সম্মান পাবে, উচ্চাসনে উপবেশনের মর্যাদা পাবে –কেন সেই মর্যাদার অংশীদার শূদ্ররাও পাবে না? কেন তাঁদের কীটাণুকীটের মতো ঘৃণা করা হবে? মানুষ কেন মানুষকে ঘৃণা করবে শুধুমাত্র ‘নিচু কাজ করার জন্য। অফিস-আদালতে বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে ‘এ গ্রুপ’ ‘বি গ্রুপ’ ‘সি গ্রুপ’ ‘ডি গ্রুপ’-এর কর্মচারীরা বিভিন্ন কাজ করেন। সন্মান ও মর্যাদাও তাই ভিন্ন ভিন্ন। এ গ্রুপ’ যেমন ব্রাহ্মণ বর্ণের মর্যাদা পায়, তেমনি শূদ্রের মর্যাদা পায় ডি গ্রুপের কর্মচারীরা। ডি গ্রুপের কাজ উপরের তিন গ্রুপের সেবা করা। এ গ্রুপের স্যারেরা নীচের দুটি গ্রুপের কর্মচারীদের কর্তৃত্ব করলেও তার সীমাবদ্ধতা আছে। ডি গ্রুপের কর্মচারীদেরকে দিয়ে সবরকম কাজ করিয়ে নিতে পারবে। জুতো পরিয়ে দেওয়া বা মুছে দেওয়া, বাজার করানো থেকে সবরকমের ফাইফরমাস করে খাঁটিয়ে নেওয়া যায়। মন চাইলে ডি গ্রুপের কর্মচারীকে কান ধরে উঠ-বোস করিয়ে দেওয়া যায়। উপরের তিন গ্রুপের বসার জন্য নির্দিষ্ট চেয়ার বরাদ্দ থাকলেও ডি গ্রুপের বসবার জন্য কোনো চেয়ার থাকে না। উপরের তিন গ্রুপের সামনে প্রায়-ক্রীতদাসের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয় পরবর্তী হুকুমের জন্য। ডি গ্রুপের কর্মচারীরা উপরের তিন গ্রুপের সামনের আসনে বসে পড়া বা বসে থাকা অভদ্রতা। সারা ভারতে তেমনটা না-হলেও পশ্চিমবঙ্গে সাতাত্তরে বামফ্রন্ট সরকারের শাসনকালে ডি গ্রুপের কর্মচারীদের ‘শূদ্রত্ব’ কিছুটা কাটে। বসার চেয়ার-টেবিল হয়েছে, একটা সংগঠন হয়েছে অভাব-অভিযোগ জানানোর জন্য। মর্যাদা বৃদ্ধি হয়েছে কি? না, হয়নি। আমি বেশ কয়েকটি অফিস-আদালতে গিয়ে দেখেছি উচ্চবর্ণের মানে সন্তানের বয়সি এ বি সি গ্রুপের কর্মচারীরা মা বা বাবার বয়সি ডি গ্রুপের কর্মচারীদের অবজ্ঞা-ভরা ‘তুমি’ সম্বোধন করে কথা বলেন, দুর্ব্যবহার করেন। এটা নিশ্চয় অসন্মানজনক। অফিস-আদালতেও ‘বর্ণবাদ’ অত্যন্ত সক্রিয়। ডি গ্রুপের কর্মচারীরা প্রতিনিয়ত পদদলিত হচ্ছে উপরের গ্রুপ কর্তৃক।
বৃহৎ শূদ্রসমাজকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁদের উপর শাসন ও শোষণের যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, তা আজও অব্যাহত। হিন্দুসমাজের অধিকাংশ মানুষ গভীর নিষ্ঠা সহকারে পালন করে স্বেচ্ছায় ব্রাহ্মণশ্রেণির খবরদারি ও শোষণের বলি হয়ে চলেছে। হিন্দুসমাজে বিভেদমূলক জাতিভেদ প্রথা ও পুজো-পার্বণের মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী অর্থনৈতিক শোষণের ব্যবস্থা কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩.৫ ব্রাহ্মণগণ এখনও রীতিমতোভাবে শূদ্রদের ভীরুতার সুযোগ নিয়ে শাসন ও শোষণ করে চলেছে। তাই শূদ্রদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও তাঁরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই আছে। কারণ কাদা দিয়ে যেমন কাদা পরিষ্কার করা যায় না, তেমনি বুদ্ধিজীবী শোষকশ্রেণির নেতৃত্বে কখনও শোষণের অবসান ঘটানো গেল না। শোষণকে উচ্ছেদ করতে হলে প্রয়োজন শোষিত উৎপাদক শ্রেণির নেতৃত্ব। ডঃ আম্বেদকরের মতে, ‘জাতব্যবস্থার বিলুপ্তি’ ঘটাতে পারলেই আসবে শ্রেণি-সংগ্রাম। যাঁরা জাতকে বহাল রেখে শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলছেন তাঁরা শ্রমজীবী মানুষদের ধোঁকা দিচ্ছে। জগজীবন রাম 761690– “Any movement for social equality must be anti Brahmin in character.” অর্থাৎ সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য যদি কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে হয় তবে তা হতে হবে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী। ডঃ আম্বেদকরের ভাষায় –“The Brahmin is always opposed to change. For, to him change means loss of power and loss of pelf.” অর্থাৎ ব্রাহ্মণজাতি সর্বদা পরিবর্তনের বিরোধী। কারণ তাঁদের কাছে পরিবর্তনের অর্থ হল প্রভাব ও সম্পদলাভের সমূহ ক্ষতি।
ভারতে ব্রিটিশ মুক্তির পর বাবা সাহেবের তত্ত্বাবধানে তফসিলিদের জন্য যে সংরক্ষণ চালু হল, সেটার যথাযথ প্রয়োগ হল কি? না, প্রয়োগ হয়নি। চাকুরিতে কোটা হয়েছে, শিক্ষা ইত্যাদিতেও কোটা হয়েছে। কারা পাচ্ছেন এইসব সুবিধা? যাঁদের দারিদ্রতা থেকে মুক্তি হয়নি তাঁরা পেল কি? আলোকিত মানুষরা আরও বেশি করে আলোকিত হল বটে, যে বৃহৎ অংশ আঁধারে ছিল, তাঁরা আঁধারেই আছে। উল্টে সংরক্ষণ ভোগীরা সমাজে বিদ্রুপের পাত্র হয়ে গেলেন। সংরক্ষণ কোটায় চাকরি বা শিক্ষায় যাঁরা প্রবেশাধিকার পায়, তাঁদেরকে অন্যরা করুণার চোখে দেখে, তিরস্কৃত হয়। এই সংরক্ষণ আসলে সমাজকে বিভাজিত করে রাখল, একত্রিত করতে পারেনি। ব্রাহ্মণ্যবাদের এই সুচতুর কৌশলে ১০০ ভাগ ব্যর্থ হয়ে গেল বাবা সাহেবের স্বপ্ন। আজও, এখনও উচ্চবর্ণেরা মায় নিম্নবর্ণ পর্যন্ত কোনো চিকিৎসকের নামের পিছনে দাস-মণ্ডল বিশ্বাস পদবি থাকলে তাঁর কাছে চিকিৎসা করাতে দ্বিধা বা কুণ্ঠাবোধ করে। কম নম্বর পেয়েও বিশেষ কোটায় প্রাপ্ত চাকরি বা পেশায় যুক্ত ব্যক্তিকে অযোগ্য কম শিক্ষিত ভাববে এটা আর নতুন কী! তাঁর জ্ঞান তাঁর দক্ষতা নিয়ে তো প্রশ্ন ওঠবেই। ভাবতে অবাক লাগে দাস-মণ্ডল-বিশ্বাস পদবিধারী চিকিৎসকদের তথাকথিত নিম্নবর্গের রোগীরাও সহসা চিকিৎসা করাতে চান না। তাঁদের মোহ আজও ব্যানার্জি-চ্যাটার্জি-মুখার্জি পদবিধারী চিকিৎসকদের প্রতি ধাবমান।
হার্দিক পটেলের মামলায় গুজরাত হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি পর্দিওয়ালা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছিলেন। ওই মামলায় রায় গিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “দুটি জিনিস দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বা বলা ভাল, দেশকে সঠিক পথে এগোতে দেয়নি। এক, সংরক্ষণ, দুই, দুর্নীতি।” সংরক্ষণের বিরুদ্ধে ‘অসাংবিধানিক’ মন্তব্য করায় গুজরাত হাইকোর্টের এই বিচারপতিকে ‘ইমপিচ করা অর্থাৎ সরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছিল সংসদে। যে ৫৮ জন সাংসদ চেয়ারম্যানকে দেওয়া পিটিশনে সই করেছেন, তাঁদের মধ্যে কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআই, জেডি(ইউ), বিএসপি, ডিএমকে, এনসিপি –সব দলের সদস্যই ছিল। তবে তৃণমূল কংগ্রেসের কেউ ছিল না। কংগ্রেসের তরফে আনন্দ শর্মা, অশ্বিনীকুমার, অস্কার ফার্নান্ডেজ, অম্বিকা সোনি, বি কে হরিপ্রসাদ, সিপিআইয়ের ডি রাজা, সিপিএমের কে এন বালগোপাল, জেডি(ইউ)-র শরদ যাদবরা ওই পিটিশনে সই করেছিলেন। গুজরাতের বিচারপতির বিরুদ্ধে পিটিশনে বলা হয়েছে –বিচারপতি পর্দিওয়ালা হার্দিক পটেলের মামলার রায়ে বলেন, “যখন সংবিধান তৈরি হয়েছিল, এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল যে দশ বছরের জন্য সংরক্ষণ প্রথা বজায় থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল, স্বাধীনতার ৬৫ বছর পরেও সংরক্ষণ চলছে।” সাংসদের যুক্তি, “সংবিধানে দশ বছরের রাজনৈতিক সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। সেটি সংসদ বা বিধানসভায় তফসিলি জাতি উপজাতির জন্য সংরক্ষণের বিষয়। তার সঙ্গে শিক্ষা বা চাকরিতে সংরক্ষণের সম্পর্ক নেই। একজন বিচারপতি যে তফসিলিভুক্ত মানুষের সংরক্ষণের বিষয়ে অবহিত নন, সেটা দুর্ভাগ্যজনক।”
তবে কি সংরক্ষণ শুধু রাজনৈতিক, চাকুরি আর শিক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকবে? সমাজে সাম্যতার প্রয়োজন নেই? সমাজে সাম্যতার জন্য ভোট-রাজনীতিকরা কী কী প্রকল্প ভেবেছেন? ভাবেননি, ভাবলে আজও দলিত শ্রেণির মানুষ অপমানিত হত না, নির্যাতিত হত না, লাঞ্ছিত হত না, ধর্ষিত হত না, তদুপরি ছোটোজাতের মানুষ হয়ে জীবন ধারণ করতে হত না।
ভোট-রাজনীতি বা ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে উঠে এল কাঁসিরামের দলিত সম্প্রদায় (বহুজন সমাজ পার্টি বা বিএসপি)। খুব সহজ ছিল না সেই যাত্রাপথ। ত্রয়োদশ লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বড়ো চমক ছিল মায়াবতী এবং মুলায়ম সিং যাদব। প্রচারের আলো মুলায়মের উপর কিছুটা পড়লেও মায়াবতী অন্ধকারে। দলিত মায়াবতীকে পদে পদে হেয় এবং হাস্যাস্পদ করে বর্ণহিন্দুর সমাজ-রাজনীতি-গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সার্থক করতে চাইছিল। মিডিয়ার উপেক্ষা, উপেক্ষা এবং অবশ্যই অপেক্ষা। মায়াবতীকে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখল না কেউ। বস্তুত কারোকে হেয় করার পক্ষে উপেক্ষার চেয়ে আর কোন্ অস্ত্র সর্বাধিক ধাঁরালো হতে পারে? কিন্তু সেই অমোঘ উপেক্ষাকে অগ্রাহ্য করে মায়াবতী একাই ছুটলেন তাঁর রাজ্যের ৮৫টি লোকসভা কেন্দ্রের প্রতিটি কোনায় কোনায়। রাস্তার ধুলো উড়িয়ে তাঁর মোটরগাড়ি এক সভাস্থল থেকে অন্য সভাস্থলে ছুটে গেছে। গোরুর গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো গাড়িতে চড়তে অভ্যস্ত দলিতরা তাঁদের নেত্রীর এই মোটরগাড়ি চড়া দেখে গর্বিত বোধ করেছে। “ভোট হামারা রাজ তুমহারা, নেহি চলেগা নেহি চলেগা”— অবশেষে ব্রাহ্মণ্যবাদ তথা শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে এসে গেল দলিত শ্রেণির চোখ-ধাঁধানো সাফল্য। তিলতিল করে গড়ে তোলা নিজেদের গণভিত্তি ধরে রাখতে পেরেছিল মায়াবতীর বিএসপি। তৎসহ তাঁদের বার্তা সম্প্রসারিত করতে পেরেছিল নতুন নতুন জনগোষ্ঠীর মধ্যে। দলিত মায়াবতী অত্যন্ত নিপুণ চাতুর্যের সঙ্গে পাটিগণিতের মিশেল ঘটিয়ে ক্ষমতার অলিন্দে চলে এলেন, সদলবলে। বৰ্ণহিন্দুদের আধিপত্য খর্ব হল, দলিত শ্রেণির ক্ষমতায়ন হল।
এখন প্রশ্ন– শুধুমাত্র দলিতের ভোটেই ক্ষমতার অলিন্দে আসা সম্ভব? না, নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। যে পার্টি শুধুমাত্র দলিতদের জন্য, সেই দলকে উচ্চবর্ণের ভোটাররা ভোট দেবে কেন? দেবে, কারণ রাজ্যের জনবিন্যাসের কাঠামোয় সম্প্রদায় ও জাতের অনুপাত অনুযায়ী তিনি ৩৮ শতাংশ অনগ্রসর, ২০ শতাংশ দলিত, ১৭ শতাংশ মুসলিম এবং ১০ শতাংশ উচ্চবর্ণীয় প্রার্থীকে টিকিট দিয়েছিলেন মায়াবতী। আসন বণ্টনেই বাজিমাত করেছিলেন মায়াবতী। যুদ্ধের অর্ধেক জয় এখান থেকেই শুরু। প্রজাতন্ত্রের সমগ্র অতীত ইতিহাসে যেসব ‘ছোটোজাত’ ‘অস্পৃশ্য’রা বুথের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারত না, সেই ছোটোজাতরাই লোকসভার আসনগুলি অলংকৃত এবং আলোকিত করে রাখলেন।
এতদসত্ত্বেও মায়াবতীর স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপে দলিতরা শেষপর্যন্ত অনাস্থা জ্ঞাপন করলেন। কারণ মায়াবতীরা সুশাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেননি। নন্দিত নয়, বরং নিন্দিত হলেন দেশজুড়ে। কারণ ক্ষমতার গোলকধাঁধায় মায়াবতীরাও ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিলিপি হয়ে উঠলেন। ক্রমে ক্রমে মায়াবতীও ‘দেবী’ হলেন, মানে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুকরণে ‘ঈশ্বর হয়ে গেলেন। রাজ্যের দিকে দিকে ‘দেবী’ মায়াবতীর মূর্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। জাস্ট ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্ধ অনুসরণ করলে শাসনের নতুন ধারা পাবেন কীভাবে দলিতরা? উল্টে ব্রাহ্মণ্যবাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে উত্তরপ্রদেশে। ভাবলে অবাক লাগে উত্তরপ্রদেশের দলিত শ্রেণি থেকে উঠে আসা ধনী মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী যখন দলিতদের জন্য কোনো মঙ্গলই করতে পারেন না। উল্টে তিনি তাঁর আইপিএস অফিসারকে দিয়ে নিজের জুতো পরিষ্কার করান, মাথার উপর এসি নিয়ে মিটিং মিছিল করেন ইত্যাদি। আহা, মর্যাদার কী অপচয়! অথচ কাঁসিরামের বহুজন সমাজ পার্টি এই উত্তরপ্রদেশেই যখন শাসনক্ষমতার অংশীদার হন তখন সর্বজনীন ভোটাধিকারের সুযোগ সদ্ব্যবহার করে দলিত-অনুসূচিতরাও যে ক্ষমতা দখল করতে পারে তা কাঁসিরাম হাতেকলমে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। দেশব্যাপী নিম্নবর্গীয় সমাজের গ্লানি ও হীনম্মন্যতা যেমন অনেকাংশে কেটেছে, উজ্জীবিত করেছে। দলিত শ্রেণি তো শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশেই নেই, ভারতের সমস্ত রাজ্যেই তাঁরা বিপুল সংখ্যায় আছেন– তা সত্ত্বেও কাঁসিরামের দল ‘বহুজন সমাজ পার্টি’ অন্য কোনো রাজ্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেননি। শূদ্র জাগরণ তো দূর-অস্ত? ভোটে রাজনীতিতে জাগরণ না-হলেও সামাজিক জাগরণে বাধা কোথায়? সামাজিক জাগরণে ব্যর্থ হল কাঁসিরামের দলিত বহুজন সমাজ পার্টি বা বিএসপি।
বাবাসাহেব আম্বেদকর থেকে জগজীবন রাম, মায়াবতী থেকে শিবু সোরেন– সকলেই হয় জাতীয় কংগ্রেস, না-হয় বিজেপির খপ্পরে গ্রাসিত হয়েছেন। ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের যিনি ঝড়-বৃষ্টি-অগ্নি, সেই দলিত শিবু সোরেন পর্যদস্ত হলেন জাতীয় রাজনীতিকদের ষড়যন্ত্রে। কেন্দ্রের ইউপিএ জোট সরকারের তিন শরিক দল– জেএমএম, কংগ্রেস ও আরজেডির কোয়ালিশন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শিবু সোরেন। শিবু সোরেন আগে ছিলেন কেন্দ্রীয় কয়লামন্ত্রী। অবশেষে শিবু সোরেনও বর্ণহিন্দুদের ফাঁদে শরীর ডোবালেন। দুর্নীতি ও খুনের মামলায় তাঁকে পদত্যাগ করতে হল। বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার জোট সরকারে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে এমন বিধায়কের সংখ্যা ৩১। এদের নিয়েই নতুন ঝাড়খণ্ড সরকার গড়বেন দলিত শিবু সোরেন। সে কথা ঘোষণা করতে এসে বড়ো মুখে বললেন। দুর্নীতিমুক্ত সরকার জনসাধারণকে উপহার দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার নিজেরই ১৮ জন বিধায়কের মধ্যে ১৭ জনের নাম দাগি আসামি হিসাবে পুলিশের খাতায় জ্বলজ্বল করছে। একমাত্র ক্রিমিনাল রেকর্ডহীন বিধায়ক শিবু সোরেনের পুত্রবধূ প্রয়াত দুর্গা সোরেনের স্ত্রী সিতা সোরেন। শিবুর বিধায়কদের মধ্যে সর্বোচ্চ অপরাধের অভিযোগটি আছে জগন্নাথ মাহাতোর নামে। তাঁর নামে দায়ের করা আছে ১৪টি অপরাধ। শিবুর ছেলে হেমন্ত সোরেনের নামে আছে ৬টি অপরাধের অভিযোগ। জেএমএম ছাড়াও জোট সঙ্গীদের মধ্যে আছেন বাকি ১৪ জন বিধায়ক, যাঁরা নরহত্যা সহ বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত।
শিবু সোরেনও দলিতদের নিয়ে ঝাড়খণ্ড বানালেন, মুখ্যমন্ত্রী হলেন। ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্ধ অনুসরণ করলেন এবং পুনরায় পতিত হলেন। ঝাড়খণ্ড এবং শিবু সোরেন আদিবাসী চেতনায় একটি সমার্থক শব্দ হওয়া সত্ত্বে পতন হল। বর্ণবাদের বিষ বড়োই ভয়ানক। শিবু সোরেনরা কখনোই অরণ্যের অধিকার, মাটির অধিকার, জলের অধিকার, আকাশের অধিকার, বাতাসের অধিকার অর্জন করতে পাবে না? ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের মসৃণ অগ্রগতির পথ থেকে অস্পৃশ্যদের সরে যেতেই হবে! ষড়যন্ত্র আর প্রতারণার শিকার হবে! শম্বুক, একলব্যরা চিরকাল হননযোগ্য হয়েই থাকবে?
উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থ ‘জাতের বিড়ম্বনা’য় বলছেন –“স্মৃতিশাস্ত্রকে এখন রান্নাঘরের হাঁড়িকুঁড়ির শাস্ত্র বলিলেই চলে। রন্ধনটা যে ব্রাহ্মণের একটা বিশেষ কাৰ্য্য একথা সেকালের ধৰ্ম্মশাস্ত্রকারেরা লিখিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। আমাদের একালের পণ্ডিত মহাশয়েরা সে ভুলটা সংশোধন করিয়া লইয়াছেন। এখন বামুন ঠাকুর, অর্থে রাঁধুনি। আজকাল ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য জাতের ভাত খাইলে আমাদের ঠাকুর মহাশয়দের এক তাল গোবর খাইয়া সে ভাত হজম করিতে হয়। কিন্তু সেকালে ব্রাহ্মণদের এতটা অজীর্ণ হয় নাই। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যের অন্নের ত কথাই নাই; অনেক শূদ্রের হাতের ভাতও তাঁহারা নির্বিবাদে হজম করিতেন। তাঁহাদের জাতটি যে তাহাতে মারা যাইত, এরূপ কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। আজকাল আহার বিষয়ে যিনি যত বড়ো ‘ছুৎমার্গী’, তিনি তত বড়ো পণ্ডিত।”
কিন্তু কী আশ্চর্য! অস্পৃশ্যের অজুহাতে যে ঘৃণা যে প্রকার উচ্চবর্ণেরা করে থাকে তা মূল শাস্ত্রীয় বিধিতে পাওয়া যায় না। লৌকিক যুক্তিও নেই। যা আজকাল চল আছে তা হল অহংকারপ্রসূত দেশাচারমাত্র। শাস্ত্রে যা নির্দেশ আছে তা নিশ্চয় কার্যকর হয় না। মুচি বা ঢুলি বা চর্মশিল্পী গোরু-ছাগলের ছাল ছাড়ায় বলে তাঁরা খুবই ঘৃণ্য, কিন্তু তাঁদের তৈরি তবলা-ঢোলক ব্যবহার করলে ঘৃণ্য হই না, টিউবওয়েলে গোরুর চামড়ার ওয়াশার ধোয়া জল খেলে জাত যায় না। নমঃশূদ্রের জল অচল— মুসলমানের বরফ, ডাবের জল, খাসির মাংস, বিরিয়ানি খেলে জাত যায় না। যদিও একটা পর্যায়ে মুসলমানরাও ভয়ানক অচ্ছুৎ ছিল। আজও নেই সে কথা বলা যায়ে না। আসলে হিন্দুসমাজের চোখে মুসলমানেরাও তো দলিত শ্রেণিই। দলিত খ্রিস্টান কিংবা দলিত মুসলিমদের ধারণাটি আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী বলে মনে হতে পারে। ভারতে মতো দেশে দলিতরাই প্রধানত খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্মে অন্তরিত হয়েছেন। অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদপীড়িত হিন্দুসমাজের নিম্নবর্গীয় জনসমাজই সাম্য ও সৌভ্রাত্রের আকর্ষণে একদিন হিন্দুধর্ম ছেড়ে ইসলামকে বরণ করেছিলেন। বরং বলা ভালো– হিন্দুধর্মে তাঁরা কখনোই সেভাবে আঁকড়ে ধরার সুযোগই পাননি, ধর্মধ্বজাধারীরা ও সমাজপতিরা কাঁটাতারের ওপারেই রেখে দিয়েছিলেন। দলিত হিন্দুরাই যে ধর্মান্তরিত হয়ে ভারতীয় মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান হয়েছেন, এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। যেহেতু সেই দলিতই আজকের মুসলিম, তাই মুসলমানও অস্পৃশ্য। কিন্তু দলিত হয়েও ভারতীয় খ্রিস্টানরা কী আদরনীয়? ২৫ ডিসেম্বর বড়োদিন এবং ফার্স্ট জানুয়ারি হিন্দুদের উল্লাসে কোনো খামতি দেখি না। ঘরে ঘরে সান্তাক্লজ এসে মোজায় উপহার দিয়ে যাওয়ার নিয়ম পালন করে, কেক খান। কিন্তু ইদের দিনে কোনো হিন্দুকে দেখিনি বিরিয়ানি-ফিরনি খেতে। ডাবল স্টান্ডার্ড মানসিকতা কেন? মর্মান্তিক হলেও সত্য, ইসলাম বা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেও ভারতীয় দলিত ও জনজাতীয়রা আগের মতো প্রান্তিক হয়ে থেকে গেছেন। নতুন সম্প্রদায় হয়েও জাতে উঠতে পারল না ভারতীয় সমাজে।
জাতপাত ব্যবস্থা বর্ণগত মই বাহিত হয়ে নিচে নেমে যায় এবং কখনোই পুরোপুরি অদৃশ্য না-হওয়ায় আম্বেদকরের বর্ণিত ‘অনুকরণের সংক্রমণ’ প্রতিটি বর্ণেরই ক্রমপরম্পরায় নিম্নতর বর্ণের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা হয়। তেজস্ক্রিয় অণুর অর্ধেক জীবনের মতো ‘অনুকরণের সংক্রমণ’ গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নষ্ট করে দেয়। এর ফলে এমন এক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে যেটাকে আম্বেদকর বলেছেন ‘ক্রমবিন্যস্থ বৈষম্য’। এতে আরও নিচুর তুলনায় নিচু বর্ণও বিশেষ অধিকার ভোগের অবস্থানে থাকে। প্রতিটি বর্ণই বিশেষ অধিকার ভোগ করে, প্রতিটি শ্রেণিই ব্যবস্থাটি বজায় রাখার ব্যাপারে আগ্রহী। আমাদের সমাজে পচনের মূলেই আছে এই জাতপাত প্রথা। অধস্তন জাতের প্রতি যা কিছু করা হয়েছে, তা তো আছেই, সেইসঙ্গে এটা বিশেষ অধিকারভোগকারী বর্ণের নৈতিকতার মূলে পচন ধরিয়েছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর মতে, প্রতি ১৬ মিনিটে একজন দলিতের সঙ্গে আর-একজন অদলিত অপরাধ করে, প্রতিদিন ৪ জনেরও বেশি অস্পৃশ্য নারী স্পৃশ্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। প্রতি সপ্তাহে ১১ জন দলিত খুন হয় এবং ৬ জন দলিত অপহৃত হয়। শুধুমাত্র ২০১২ খ্রিস্টাব্দেই ২৩ বছর বয়েসের ১ জন নারী দিল্লিতে গণধর্ষণের শিকার হয়, ১৫৭৪ জন দলিত নারী ধর্ষিত হয় (বৃদ্ধাঙ্গুলির শাসানির জোরে দলিতদের সঙ্গে ঘটা ধর্ষণ বা অন্যান্য অপরাধের মাত্র ১০ ভাগ প্রকাশিত হয়) এবং ৬৫১ জন দলিতকে হত্যা করা হয়। এগুলি ছিল ধর্ষণ ও বর্বরতা, যা লুণ্ঠন আর নগ্ন হতে বাধ্য করাই নয়, জোরপূর্বক মানুষের মল খাওয়ানো, জমি দখল, সমাজচ্যুত করা, খাওয়ার জল আনতে বাঁধা দেওয়া। এ পরিসংখ্যানে পাঞ্জাবের বান্ত সিংয়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি, যিনি ছিলেন একজন মাজহাবি দলিত শিখ। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে যার দুই হাত এবং একটি পা কেটে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দেওয়া হয়। কারণ সে তাঁর মেয়েকে গণধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। তিনটি অঙ্গ ছেদ হওয়া ব্যক্তির জন্য আলাদা কোনো পরিসংখ্যান নেই। কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে—
ঘটনা– ১: ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বর। মধ্যপ্রদেশ। তার খেতে ঢুকে ফসল খেয়ে নিচ্ছিল গরুর দল। গোরুর মালিককে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানাতে গিয়ে চরম লাঞ্ছনার শিকার হতে হল এক দলিত নারীকে। তাঁকে নগ্ন করে মারধরের পর প্রস্রাব খেতেও বাধ্য করা হয়। ছত্তরপুর জেলায় এই নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় স্থানীয় থানার নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টিও প্রকাশ্যে এসেছিল। ওই মহিলাকে নিয়ে দলিত সম্প্রদায়ের কয়েকজন জেলার সহকারী পুলিশ সুপার নিরজ পান্ডের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় নওগং থানা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নিগৃহীতার অভিযোগ, বিজয় যাদবের বাড়িতে গিয়ে তার খেতে গোরু ঢোকার বিষয়টি জানান। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে বিজয় ও তার স্ত্রী বিমলা তাঁকে মারধর করেন। এমনকি জামাকাপড় খুলে তাকে প্রস্রাব খেতেও বাধ্য করা হয়।
ঘটনা– ২ : ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর। উত্তরপ্রদেশ। এক দলিত পরিবারের পুরুষ ও নারীদের প্রকাশ্যে নগ্ন করে পেটাল পুলিশ। সন্তান ও লোকজনের সামনে এই দম্পতিকে নগ্ন করার ঘটনা ঘটল। বুদ্ধনগর জেলার ধানকুড় থানায় এই ঘটনা ঘটে। স্থানটি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ঘটনার দিন ধানকুড় থানায় একটি ডাকাতির মামলা করতে যান সুনীল গৌতম নামে একজন দলিত পুরুষ। পুলিশ ওই মামলা না-নিয়ে স্ত্রীসহ সুনীলকে বাজারে রাস্তার মধ্যে কাপড় খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন করে দাঁড় করিয়ে রাখে। এরপর নগ্ন দম্পতিকে পেটায়। এ ঘটনার পর স্থানীয় এক সাংবাদিক পুরো ঘটনাটির একটি ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন। প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ পোশাক পরা এক ব্যক্তি রাস্তায় দাঁড় করিয়ে ওই দম্পতির কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। আর পাশেই দাঁড়িয়ে ঘটনাটি দেখছে পুলিশের পোশাক পরা এক ব্যক্তি। কিছুক্ষণ পর সেই পুলিশও মারধরে অংশ নেয়। ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত দুজনকে পুলিশ বলে চিহ্নিত করেছেন ওই দলিত দম্পতি।
ঘটনা– ৩ : ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে। উত্তরপ্রদেশ। শাহজানপুর জেলার জালালাবাদের কাছে একটি গ্রামের অন্তত পাঁচজন দলিত মহিলা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের চেয়ে তুলনায় উঁচু জাতের কাশ্যপ সমাজের অন্তত পনেরো জন নারীপুরুষ সেদিন সকালে তাঁদের উপর চড়াও হয়। তারপর তাঁদের কাপড়চোপড় খুলে নিয়ে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তাঁদের বেত দিয়ে পিটনো হয়। বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে এই নির্যাতন। দলিত সমাজের একটি ছেলে কাশ্যপদের একটি নাবালিকা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগে তাঁদের উপর এই নির্যাতন চালানো হয়। ওই মেয়েটির মা এবং অন্য আত্মীয়রা এসে ছেলেটির মা-নানি-চাচিদের উপর হামলা চালান। তাঁদের মারধর করা হয়, শাড়ি ও কাপড়চোপড় খুলে নেওয়া হয়। এসময় হামলাকারীরা বলতে থাকেন- “আমাদের সম্মান যাঁরা নষ্ট করেছে তাঁদের আবার ঘোমটা কীসের, তাঁদেরকেও আমরা ইজ্জত রাখতে দেব না।” ঘটনার তদন্তে যে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন তাঁরা এসে রিপোর্ট দিয়েছেন দলিত মহিলাদের অবশ্যই নগ্ন করে ঘোরানো হয়েছিল। এসময় প্রশাসনও প্রথমে নির্বিকার ছিল। তবে জানা গেছে দলিতদের বে-ইজ্জতি করার জন্য কাশ্যপ সমাজের মোট দশজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এঁদের মধ্যে চারজন পুরুষ ও তিনজন মহিলাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও তিনজন পলাতক মহিলাকে ধরার জন্য বিশেষ দলও গঠন করা হয়েছে।
ঘটনা– ৪ : ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি। মহারাষ্ট্র। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চ্যবনের নিজ জেলায়ই এক মহিলাকে নগ্ন করে রাস্তায় ঘোরানো হয়েছে। এ ঘটনার আগে ৪৫ বছর বয়সি ওই নারীকে একদল মানুষ প্রহার করে। এসব ঘটনার পর তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দলিত শ্রেণির ওই মহিলা এখন বিচার চাইছেন সবার কাছে। কিন্তু তিনি দলিত শ্রেণির বলে তাঁর অভিযোগ নিবন্ধিত করতে বিলম্ব করা হয়। অভিযোগ আছে, ওই ঘটনায় জড়িতরা মুখ্যমন্ত্রীর খুব কাছের বলে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে বিলম্ব করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে না। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর উচ্চবংশীয় এক যুবতাঁকে নিয়ে পালিয়ে যায় নির্যাতিত ওই দলিত মহিলার ছেলে। এরপর ওই যুবতীর অভিভাবকরা তাঁদের মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। মর্মে একটি অভিযোগ দাখিল করে। একই সঙ্গে তাঁরা ওই মহিলাকে তাঁদের মেয়ে বের করে দিতে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। ওই সময় তিনি জানিয়ে দেন তাঁর ছেলে ও ওই মেয়ে পালিয়ে কোথায় গেছে তা তিনি জানেন না। নিখোঁজ যুবতীর পরিবার একটি স্থানে ডেকে নেয় দলিত শ্রেণির ওই মহিলাকে। এরপর তাঁকে প্রশ্নবাণে তাঁরা জর্জরিত করতে থাকে। এক পর্যায়ে। তাঁরা তাঁকে ধমকাতে থাকে, প্রহার করতে থাকে, এমনকি তাঁকে নগ্ন করে গ্রাম ঘুরতে বাধ্য করে। এ ঘটনায় ওই মহিলা মারাত্মক আহত হন। তাঁকে পরের দিন একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দলিত মহাসংঘ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাচিন্দ্র সাকাতে বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নিজের জেলায় এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় কর্তৃপক্ষ চোখ বন্ধ করে আছে। তাঁরা রাজনৈতিক কারণে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”
ঘটনা– ৫: ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গ। কুড়ি বছরের এক আদিবাসী তরুণীকে ১২ জন ব্যক্তি গণধর্ষণ করেছে বীরভূম জেলায়। গ্রামে সালিশী সভায় ওই তরুণীকে ‘অপরাধী’ বলে চিহ্নিত করে গণধর্ষণের শাস্তি দেওয়া হয়। ওই মেয়েটির ‘অপরাধ’ অনাদিবাসী একটি ছেলের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল গত পাঁচ বছর ধরে। গ্রামের মোড়ল ও ধর্ষণকারী সহ মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বীরভূমের পুলিশ প্রধান সি সুধাকর জানিয়েছেন, “সোমবার রাতে রাজারামপুর গ্রামে সালিশী সভায় ওই গণধর্ষণের নির্দেশ দেন গ্রামের মোড়ল বলাই মান্ডি। অভিযোগে বলা হয়েছে, চৌহাট্টা গ্রামের এক অনাদিবাসী ছেলের সঙ্গে অত্যাচারিতা ওই মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক জানাজানি হয়। সেদিনই সালিশী সভায় দুজনকে অপরাধী বলে চিহ্নিত করা হয় আর ২৫০০০ টাকা করে জরিমানা ধার্য করা হয়। যুবকের পরিবার টাকা। মিটিয়ে দিতে পারলেও ওই তরুণীর পরিবার তাঁদের আর্থিক অবস্থার কথা জানিয়ে টাকা দিতে পারবে না বলে জানায় গ্রামের প্রধানদের। তখনই মোড়ল বলাই মান্ডি বলে “যাও, ওকে নিয়ে মজা করো”। পরপর ১২ জন ধর্ষণ করে তরুণীটিকে, যাঁদের মধ্যে মেয়েটির বাবার বয়সি লোকও ছিল, আবার তাঁর ভাইয়ের বয়সি ছেলেও ছিল। প্রধান বলাই মান্ডি আবার ওই তরুণীর গ্রাম সম্পর্কে কাকা। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে এক তরুণীকে নগ্ন করে গ্রামে ঘোরানো হয় এক যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কারণে। আদিবাসী সমাজে অনাদিবাসী। কাউকে বিয়ে করলে সমাজচ্যুত করার চল রয়েছে। এ হল দলিত কর্তৃক দলিতের লাঞ্ছনা।
ঘটনা– ৬ : ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই। আসাম। ডাইনি সন্দেহে এক বৃদ্ধাকে নগ্ন করে শিরোচ্ছেদ করা হয়েছে। আসামের সোনিতপুর জেলায় আদিবাসীদের একটি গ্রামের এ ঘটনায় পুলিশ দুজন মহিলা সহ সাতজনকে আটক করেছে। পুলিশের স্থানীয় এক কর্মকর্তা সামাদ হুসেন বলেন, ওই গ্রামে গত কিছুদিন ধরে অসুখ-বিসুখ ছড়িয়ে পড়ছিল। এর জের ধরে গ্রামবাসীরা ৬৩ বছর বয়সি পুরনি ওরাংকে দায়ী করা শুরু করে। এক পর্যায়ে তাঁরা ওই বৃদ্ধাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে শিরোচ্ছেদ করে। প্রসঙ্গত, আসামে অনেক আদিবাসী সমাজে এবং চা শ্রমিকদের মধ্যে মহিলাদের ডাইনি হিসাবে সন্দেহ করার চল রয়েছে। গত বছর অক্টোবর মাসে দেবযানী বোরা নামে ভারতের জাতীয় পর্যায়ের অ্যাথলেটকে ডাইনি হিসাবে অভিযুক্ত তাঁকে বেদম মারধর করা হয়। রাজ্য পুলিশের দেওয়া হিসাবে, গত ছয় বছরে ডাইনি সন্দেহে আসামে ৯০ জনকে হয় মাথা কেটে নেওয়া হয়েছে অথবা জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ৩১ আগস্ট হরিয়ানার গোহানায় বর্ণহিন্দুদের জনাকয়েক ক্ষমতাবান লোক দলিতদের একটি বস্তির ডজনখানেক বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। সরকার থেকে ঘোষণা করা হল পুড়ে যাওয়া বস্তির প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু অন্যায় কাজটি যাঁরা করল তাঁদের কী শাস্তি হল কেউ জানে না। হরিয়ানায় যখন দলিতদের বস্তি পুড়ে ‘রাখ’, ঠিক তখনই বিহারে রণবীর সেনাদের গুলিতে ঝাঁঝরা দলিত মানুষেরা। এ-রকম না-হলেও অন্যরকম হতে বাধা কোথায় পশ্চিমবঙ্গে! তমলুক শহরের পদুমপুর গ্রামের তফসিলিভুক্ত পরিবারগুলি মন্দিরে ঢুকতে পারে না।পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য প্রভাস ধাঁড়া স্বীকার করেছেন, গ্রাম কমিটির নামে মোড়লদের দাপট এখানে এতটাই বেশি যে অনেকবার বৈঠক করেও তফসিলিদের মন্দিরে ঢোকার ব্যবস্থা যায়নি। ফলে তফসিলি পরিবারগুলি পুজো দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত।” এ-সময়। রাজ্যের তখত-এ-তাউসে উপবিষ্ট কমঃ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
বর্ণহিন্দু মানে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের কথা বলা হয় না, বর্ণহিন্দু বলতে বোঝায় শূদ্র ছাড়া বাকি সকল দ্বিজাতি। এখানে বিষয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তা হল দলিতদের উপর শুধুমাত্র বর্ণহিন্দুরাই অচ্ছুৎ বা অস্পৃশ্য ভাবে বা নির্যাতন করে, তা বললে সত্যের অপলাপ হয়। ঘৃণা নিচু জাতের সঙ্গে নিচুজাতেরও কম নেই। স্তরে স্তরে ঘৃণা। সকলেই একে অপরের থেকে উঁচু জাত সেটাই প্রমাণ করতে চায়। হিন্দুসমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র– এই চারভাগে ভাগে ভাগ করেছে ব্রাহ্মণ্যবাদ। কিন্তু শূদ্ররা নিজেরাই বিভাজিত হয়ে আছেন হাজার ভাগে। মুচিরা মেথরদের ঘৃণা করেন, মেথররা ডোমদের ঘৃণা করেন, মণ্ডল মজুমদারদের ঘৃণা করেন, হালদাররা প্রমাণিকদের ঘৃণা করেন, বিশ্বাসরা ঘৃণা করেন বাগদিদের ইত্যাদি। অত্যাচার-নির্যাতনও চলে। একে অপরের সঙ্গে বিবাহ-শুভকার্যাদিও করেন না। উচ্চবর্ণে উন্নীত হওয়ার আকুতি অন্ত্যজদেরও বিভাজিত করে রেখেছে। উচ্চবর্ণরাই দলিতদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করেন তা সবসময়ই নয়, অন্ত্যজরাও অন্ত্যজদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করেন ‘ছোটোজাতের’ অস্পৃশ্যতায়। চারখানি ঘর তো ছিলই, এই ঘরের মধ্যে ঘর তুলেছে দলিতরাও।
এ রকম হাজার হাজার ঘটনা উল্লেখ করা যায়। তাতে লাভ কী! এমন ঘটনা যেমন মায়াবতীর রাজ্যে সংঘটিত হয়, তেমনি কমিউনিস্টদের রাজ্যেও হয়। ভারতের যে-কোনো গ্রাম্য পুলিশকে তাঁর কর্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে বলবে, তাঁদের কাজ ‘শান্তি রক্ষা করা। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটি করা হয়, অবশ্যই বর্ণপ্রথাকে ধারণ করার মাধ্যমে। কারণ দলিতদের উচ্চাভিলাষই শান্তি ভঙ্গ করে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার ‘নবজীবন’ নামের গুজরাটি জানালে লিখেছেন– “আমি বিশ্বাস করি যে বর্ণপ্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে হিন্দুধর্ম আজও বেঁচে আছে। বর্ণপ্রথা লোপ করে পাশ্চাত্য ইউরোপিয়ান ব্যবস্থাকে গ্রহণ করা মানে হচ্ছে হিন্দুদের অবশ্যই বর্ণপ্রথার মূল ভিত্তিকে অর্থাৎ তাঁদের পূর্বপুরুষের পেশাকে ত্যাগ করতে হবে। উত্তরাধিকার সূত্র একটি চিরন্তন সূত্র। একে পরিবর্তন করা মানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। আমার কাছে একজন ব্রাহ্মণের কোনো দাম নেই যদি জীবনের মূল্যেও আমি তাঁকে ব্রাহ্মণ না ডাকতে পারি। যদি প্রতিদিন একজন ব্রাহ্মণ শূদ্রতে এবং একজন শূদ্র ব্রাহ্মণে রূপান্তরিত হয় তবে তা বিশৃঙ্খলার জন্ম দেবে।”
নমশূদ্ররা দাবি করেন বল্লালসেনের আমলেই তাঁদের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার হরণ করে, তাদের ‘চণ্ডাল’ নামে অভিহিত করা হয়। তখন থেকেই তাঁরা হিন্দু সমাজের নিন্মতর বর্ণে অধঃপতিত হয়ে যায়। তবে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইংরেজ শাসনকালে আদমসুমারিতে অসন্মানজনক ‘চণ্ডাল’ নামের পরিবর্তে তাদের নতুন নাম ‘নমশূদ্র’ আনুষ্ঠানিক অনুমোদন লাভ করে। ভারতের ব্রিটিশ-মুক্তির পর চণ্ডাল তথা নমশূদ্রের নতুন পরিচয় হল ‘তফসিলি’ (তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি এবং ওবিসি বা অনগ্রসর জাতি)।তফসিলি সৃষ্টি করে হিন্দু সমাজে তৈরি হল নতুন বর্ণবাদ। আর তাই ৭০ বছরেও শূদ্রাবস্থার অবসান হল না। তফসিলিভুক্ত সব জাতিই নিম্নবর্ণের। অর্থাৎ পূর্বে যাঁরা শূদ্র ছিলেন, আজও তাঁরা শূদ্রই আছেন। কারোর কারোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও তাঁদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তফসিলি জাতিরা [Scheduled Castes (Dalit)] কিছুটা ভালো অবস্থায় থাকলেও তফসিলি জনজাতিদের [Scheduled Tribes (Adivasi)] একদম সঙ্গিন।
কারণ সদিচ্ছার অভাব। তফসিলি জাতি ও তফসিলি জনজাতিরা সত্যি সত্যিই সাম্যবাদ সম-মর্যাদা ভোগ করুক এটা কেউ কোনোদিন মনেপ্রাণে চায়নি। ব্রিটিশ-ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তব সম্ভাবনা একটা তৈরি হয়েছিল বর্ণবাদের অস্পৃশ্য সমাজব্যবস্থার জগদ্দল পাথরকে উপড়ে ফেলার। কিন্তু বাস্তবে সেই উজ্জ্বল সম্ভাবনাটাকে বাস্তবায়িত করা গেল না। কেন বাস্তবায়িত করা গেল না? ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বে প্রায় সবাই-ই ছিলেন উচ্চবর্ণের লোক। তাঁরা কেবলই নানা পথে নানা ফন্দি-ফিকিরে নরমে-গরমে, কখনো আপোস করে কখনো পাপোস হয়ে নিজেরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতেই বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন। মৌলিক সামাজিক-অর্থনৈতিক কিংবা মতাদর্শগত কোনো অর্থেই পরিবর্তন ঘটানোর প্রকৃত ইচ্ছা প্রায় ছিলই না। জমিদারি স্বার্থের বিরুদ্ধে তাঁরা কখনো যেতে চাননি। বস্তুত শ্রেণিগত বিচারে যাওয়াটা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অতএব প্রাচীন সমাজের জাতিবর্ণগত অবস্থানকে মৌলিকভাবে পরিবর্তনের কোনো কর্মসূচি কোনোদিনই জাতীয় আন্দোলনে নেওয়া হয়নি। জাতীয় আন্দোলনে ক্রমবর্ধমান জোয়ারে নিচুবর্ণের মানুষেরা প্রচুর সংখ্যায় এলেও জাতিবর্ণগত বিভেদের মূল উৎপাটনে জাতীয় নেতৃত্বের অনীহা ও বাস্তব সক্রিয়তার অভাব অনেক সময়েই তাঁদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে। দূরে সরিয়ে দিলেই কি দূরে সরানো যায়! শূদ্ৰজাতিদের যতই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে জাতীয় নেতৃত্বে শূদ্রেরা ততই সংঘবদ্ধ হয়েছে। ততই প্রকটিত হয়েছে।
আমাদের এই ভারত উপমহাদেশে প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বারবার বিদেশি আক্রমণকারীরা আক্রমণ করেছে, দখল করেছে, শাসন করেছে। কীভাবে পারল? পারল কারণ ভারতীয়রা হাজার খণ্ডে খণ্ডিত। এক খণ্ডিত জাতিকে কুপোকাত করা তো অখণ্ড জাতিদের কাছে বাঁয়ে হাথ কা খেল। তাই খণ্ডিত জাতিদের কাছ থেকে কোনো প্রতিরোধ আসেনি। তাই অবলীলায় নিজেদের পরহস্তগত হয়ে গেছে বারবার। হাজার হাজার ধরে ভারতীয়রা পরাধীন থেকে গেছে। গোটা উপমহাদেশে ব্রাহ্মণরাই রাজ করবে, অথচ রাজত্ব রক্ষা করতে পারেনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী শূদ্রদের বিচ্ছিন্ন করে রেখে। শূদ্রদের প্রতি ঘৃণা সনাতন ধর্ম দুর্বল থেকে দুবর্লতর হয়ে গেছে। যে মন্দিরে শূদ্রদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হত না, সেই মন্দির কেন শূদ্ররা রক্ষা করবে? যে মন্দির শূদ্রদের নয়, যে মন্দিরে ব্রাহ্মণদেরই একাধিপত্য, যে মন্দিরে ঢোকার অপরাধে শূদ্রদের হত্যা করা হয়েছে, সেই মন্দির কেন তাঁরা রক্ষা করবে? ওই মন্দিরের দেবতা তো কোনোদিনই শূদ্রদের ছিল না। সেই কারণে সুলতান মামুদের পক্ষে ১৭ বার সোমনাথমন্দির লুঠপাট করতে, ধ্বংস করতে। শুধু তো সোমনাথ মন্দিরই নয়, খাজুরাহো মন্দির ধ্বংস হয়েছে প্রতিরোধে। এই দেশ তো বৌদ্ধদেরও ছিল। তাঁদের উপরেও অত্যাচার করে দেশ থেকেই বিতারণ করে দিয়েছে ব্রাহ্মণবাদীরা। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যচার আর বঞ্চনায় নিম্নবর্গীয়রা সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম বা অন্যান্য ধর্ম গ্রহণ করেছে। সনাতন ধর্মের জাতিরা ক্রমশই শক্তিহীন হয়ে পড়ল। আজও হারানো শক্তি অর্জন করতে পারছে না বিভাজনের কারণে। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলিতেছে। সমগ্র হিন্দু জাতিকে জাগানো যাচ্ছে না। শতধায় বিভক্ত একটা জাতি সদাসর্বদা আত্মহননে ব্যস্ত। আজও দলিত তথা শূদ্র জাতিদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়, অমানবিক অত্যাচার করা হয়।
তাই কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছে— “যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে, সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তাঁরে;/যে জাতি জীবনহারা অচল অসার, পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাঁচার”
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ। সেদিন ছিল বড়োদিন। বাবাসাহেব ডাক দিলেন মহারদের সহ অন্যান্য দলিতদের –“এসো, আমরা ওই নিষিদ্ধ জলে স্নান করি, ওই নিষিদ্ধ জল পান করি।” ‘নিষিদ্ধ জল’ কেন! যুগ যুগ ধরে চাদর সরোবরের জল স্পর্শও করতে পারত না দলিতরা। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এটাই নিষেধাজ্ঞা। সেই সরোবরের জল বৰ্ণহিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-কুকুর-গোরু-মোষ-গাধা কারোরই জন্য নিষেধ ছিল না, বাদ ছিল দলিতরাই। যাই হোক, বাবাসাহেবের ডাকে সেই সরোবরে জমায়েত হলেন হাজার হাজার দলিত মানুষ। বিশাল এক সমাবেশ হল। উচ্চবর্ণদের সাহসে কুলালো না একজন দলিতের মাথা ডাণ্ডা মেরে ঠান্ডা করার। পুলিশ পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অকুস্থলে। হাজার হাজার দলিত মানুষ সেই সরোবরের জলে নেমে পড়লেন। শিশুদের মতো জলে নেমে স্নান করতে থাকলেন এবং নাচতে থাকলেন। সরোবরের পাড়েই আয়োজিত হল বিরাট জনসভা। পুড়িয়ে দেওয়া হল সেই গ্রন্থ, যে গ্রন্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ শূদ্রদের ঘৃণ্য করেছে। হ্যাঁ, মনুসংহিতা। সেইদিন থেকে এমন গ্রন্থ সমাজ থেকে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু সেটা হয়নি। উচ্চবর্ণের উচ্চাসন টলে যাবে যে!
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন– “সকল জাতিকেই আমাদের জলচল করিয়া লইতে হবে।” কীভাবে জলচল করে নেওয়া যাবে যতদিন মনুসংহিতার প্রভাব থাকবে? ভারতের সেকুলার শাসনকর্তারা ভারতের অস্পৃশ্য-অচ্ছুৎদের জলচল করে তোলার শিক্ষা দিতে ভয় পায়, নিতেও। কারণ হিন্দুত্বকে ধ্বংস না করে নিম্নবর্গদের জলচল করা সম্ভব নয়। তাই বোধহয় দলিতদের শ্লোগান এমনই হয়ে যায় –“তিলক, তরাজু অওর তলোয়ার ইনকো মারো জুতে চার”। ব্রাহ্মণের তিলক, ক্ষত্রিয়ের তলোয়ার এবং বেনিয়ার তরাজু (দাঁড়িপাল্লা)। উত্তরপ্রদেশের ‘চামার কি বেটি’ মায়াবতী মুখে দলিতদের কথা বললেও ব্রাহ্মণরা স্বাগত ছিলেন। তাঁর কাছে বেনিয়া-ক্ষত্রিয়রা অচ্ছুৎ হলেও, ব্রাহ্মণরা নন। ক্ষমতার রাজনীতি বড়ো বালাই, সত্যি! অথচ মনুবাদের যথার্থ এবং প্রবলতম প্রবর্তক এই ব্রাহ্মণরাই। কারণ কী? বর্ণযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা? হ্যাঁ, ভারতের প্রথম বর্ণযযাদ্ধাই পরশুরাম, যিনি ব্রাহ্মণ। একবার নয়, একুশবার ধরিত্রীকে নিঃক্ষত্রিয় করার যুদ্ধ করেছেন। ব্রাহ্মণ বনাম ক্ষত্রিয়ের যে দ্বন্দ্ব একদা আর্য ও দ্রাবিড়ভূমিকে দীর্ণ করেছিল, ব্রাহ্মণদের তরফে পরশুরামই ক্ষত্রিয় হৈহয় অধিপতি কার্তবীর্যাজুনকে সপরিবার নিধন করে তার শীর্ষবিন্দু রচনা করেন। এমন বর্ণযোদ্ধাকে ‘দেবী’ মায়াবতী আর কোথায় পাবেন? সেই কারণেই কাঁসিরামের মানসপ্রতিমা মায়াবতীকে উত্তরপ্রদেশের জেলার জেলায় ব্রাহ্মণ সম্মেলন করে বেড়াতে দেখা যায়। সেই ব্রাহ্মণ সম্মেলনের মঞ্চে দেখা যায় একদিকে একটি বাবাসাহেব আম্বেদকর, অন্য একটি পরশুরামের মাল্যবান কাট-আউট।
একটা বড়ো প্রশ্ন –তা হল উচ্চবর্ণের সর্বোচ্চ আসনে উপবিষ্ট ব্রাহ্মণরা কেন ঘৃণ্য ‘চামার কি বেটি’ মায়াবতীর বহুজন সমাজের হাতি চিহ্ন-সংবলিত পতাকার নীচে আশ্রয় নিল? আসলে উত্তরপ্রদেশে সৃষ্ট হওয়া গড্ডলিকা প্রবাহ। এখানে দলিতদের সংগঠন আছে, জনজাতিদের সংগঠন আছে, অনগ্রসরদেরও সংগঠন আছে –ব্রাহ্মণদের কোনো সংগঠন নেই। তার মানে কী ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যাবর্তের দলিতায়ন থেকে দলিতের ক্ষমতায়নের রূপান্তর!
ভারতীয় সংবিধান ভারতের অনগ্রসর জনসমষ্টিকে তিনভাগে ভাগ করেছে— (১) তফসিলি জাতি (Scheduled Caste বা S.C), (২) তফসিলি উপজাতি (Scheduled Tribes বা S.T.) এবং (৩) অন্যান্য অনগ্রসর জাতিসমূহ (Other backward Classes বা 0.B.C.)। ভারত সরকার সংবিধানের ৩৪০ ধারা অনুযায়ী ভারতের অনগ্রসর শ্রেণিগুলির সমস্যাদির অনুসন্ধান এবং তা নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার সুপারিশ গ্রহণের জন্য এ পর্যন্ত দুটি কমিশন নিযুক্ত হয়েছে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে কাকা কালেলকার কমিশন এবং ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে মণ্ডল কমিশন। লক্ষণীয় যে, সংবিধান তফসিলি জাতি বা উপজাতিদের তালিকা নির্ণয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিনির্ধারণ করলেও অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলির ক্ষেত্রে তেমন কিছু করেনি। কেবল বলা হয়েছে, যে আদেশবলে কমিশন নিযুক্ত হবে সেই আদেশেই কমিশনের কার্যপদ্ধতি বিবৃত থাকবে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যক্তি বা সম্প্রদায়েরই সংগত অধিকার ও আকাঙ্ক্ষা থাকে দেশের শাসন-প্রশাসনে অংশগ্রহণ করার। যে পরিস্থিতি দেশের ৫২%। জনগণকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, অবশ্যই তার জরুরি সংশোধন প্রয়োজন।
ভারত স্বাধীনতা অর্জনের পর যে নতুন সংবিধান গৃহীত হল তাতে ন্যায়, স্বাধীনতা এবং সমতার প্রতিশ্রুতি রক্ষার কথা বলা হল। বলা হল আইনের চোখে সব নাগরিকই সমান এবং ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী আইন তাঁদের এই অধিকার রক্ষা করবে। ১৫ এবং ১৬ নম্বর ধারা মোতাবেক কারও প্রতি বৈষম্য–করার নীতি গৃহীত হল। ১৭ নম্বর ধারা মোতাবেক অস্পৃশ্যতার মতো ঘৃণ্য প্রথা নিষিদ্ধ করা হল। পাশাপাশি সংবিধান সামাজিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোকে বিশেষ সহায়তাকে স্বীকৃতি দেয়। কিছু পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীকে ক্ষতিপূরণমূলক বৈষম্যের সুযোগ দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্টের ১৯ নম্বর সাংবিধানিক আদেশে (তফসিলি জাতি) যেসব জাতিকে তফসিলি জাতি বলে গণ্য করা হবে তার তালিকা দেওয়া হয়। শুধু হিন্দুরাই নয়, শিখ-বৌদ্ধরাও তফসিলি জাতিভুক্ত। পূর্বে যাঁদের অস্পৃশ্য জাতি বলা হত তাঁরাই স্বাধীনোত্তর ভারতে তফসিলি। এদের সুযোগ-সুবিধার কথা বলা আছে তা মূলত তিন প্রকারের। প্রথমতঃ, এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের আইনসভায়, সরকার-চালিত বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ। দ্বিতীয়তঃ ঋণ, স্কলারশিপ, জমির পাট্টা ইত্যাদি নানাবিধ আর্থিক সুবিধা। তৃতীয়তঃ অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে নানাবিধ ব্যবস্থা এবং আবদ্ধ শ্রমিকদের মুক্ত করার কিছু পদক্ষেপ। বাস্তবে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য ছিল ইংরেজি জানা শহুরে রাজনৈতিক নেতাদের। বস্তুত রাজ্য ও স্থানীয় স্তরে উচ্চবর্ণের এবং অন্তত উত্তর ভারতে এঁরা ছিলেন উচ্চবর্ণ জমি মালিক শ্রেণির। দক্ষিণ ভারতে পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা ছিল। কারণ পঞ্চাশের দশকের মধ্যেই নিম্নবর্ণ নেতারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঢুকতে শুরু করেছিলেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তামিলনাড়তে দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম ক্ষমতায় আসে। এটা ছিল একটি অ-ব্রাহ্মণ পার্টি। ৫০/৬০ দশকে দক্ষিণ ভারতের নিন্মবর্ণগুলি নিজেদের পার্টি ও নেতা তৈরি করে ফেলেছিল। ৮০ এবং ৯০-এর দশকে উত্তর ভারতেও নিম্নবর্ণ রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়ে যায়। বারংবার লালুপ্রসাদ যাদব, কাঁসিরাম এবং মায়াবতীর নাম সামনে আসতে থাকে। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ এবং আবার ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ মূলত নিম্নবর্ণ রাজনৈতিক জোট দিল্লির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে অখণ্ড ভারত খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল রাজনৈতিক কুটিলতায়। ঘরছাড়া হয়ে ভেসে গেল লক্ষ লক্ষ মানুষ, এঁদের মধ্য একটা বড় অংশই ছিল দলিত শ্রেণি। ১৯৪৭, ১৯৪৯-এর পর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে সরকারি হিসাব অনুযায়ী আসাম-ত্রিপুরা-পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে পনেরো লক্ষ বিরাশি হাজার উদ্বাস্তু ভারতে চলে আসে। এদের মধ্যে প্রায় ১৬ আনাই ছিল দলিত শ্রেণি এবং বেশিরভাগই নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ। ভারতে ফেরার পর এঁদের অবস্থা মোটেই ভালো হয়নি, আজও। সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান চালু হতেই যে জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন শেষ হয়ে গেল তা বলা যায় না। তবে পূর্বে যেমন সমস্ত রকমের নিপীড়ন মুখ বুজে সহ্য করে যেত, এখন তেমন নয়। প্রতিবাদ করতে শিখেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলিত হতে থাকল শূদ্র জাগরণের তরঙ্গ। নিচুজাতির মানুষেরা নিজেদের দাবি উত্থাপন করার এবং জাতিব্যবস্থাকে বিরোধিতা করার আন্দোলন ক্রমশ জঙ্গিরূপ গ্রহণ করতে থাকে। মন্দিরে ঢোকা, পুকুর-কুয়ো-রাস্তা ব্যবহারের আন্দোলনের মধ্যে এটা লক্ষ করা যায়। ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থার বিরোধিতা শুধু অস্পৃশ্য জাতিগুলি করেনি, যাঁরা অস্পৃশ্য ছিল না সেই শূদ্র জাতিগুলিও সামনে এগিয়ে আসতে থাকে। দক্ষিণ ভারতে ই ভি রামস্বামীর নেতৃত্বে এই শূদ্র প্রতিবাদ সুসংহত রূপ ধারণ করে। সংগঠিত হল এবং বিপ্লবী রূপ গ্রহণ করল। তিনি তামিলনাড়ুর অব্রাহ্মণদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতার জন্য ব্রাহ্মণদের এবং তাঁদের সংস্কৃতভিত্তিক ভাবধারাকে দায়ী করে। তিনি সেই সংস্কৃতির শিকড় সমূলে উৎপাটন করতে চেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, যেসব বিষয়ে ই ভি রামস্বামীর নেতৃত্বাধীন ‘আত্মসম্মান’ আন্দোলন লাগাতার সংগ্রাম গড়ে তোলে সেগুলি হল মন্দিরে প্রবেশ, সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং রাস্তায় প্রবেশের অধিকার, অস্পৃশ্যতা বর্জন, তদুপরি ব্রাহ্মণ্যবাদ-জাতিব্যবস্থা-ধর্মের বিরোধিতা করা। এই আত্মসম্মানপন্থীরা ছিলেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী, ধর্মশাস্ত্র বিরোধী এবং ধর্মীয় বিশ্বদৃষ্টিকোণ ও রীতিনীতির বিরোধী তথা ধর্মীয় উৎসবের বিরোধী।
সবই আছে, কিন্তু প্রয়োগ কোথায়? সুরক্ষা আছে, সুরক্ষার কবচও আছে– কার বাজুতে বাঁধা আছে সেই কবচ? কেমন সেই কবচ? একনজরে দেখে নিতে পারি সকলের অবগতের জন্য। তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতিদের উপর তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি নয় এমন কেউ যে যে নিপীড়ন চালানোর অপরাধে যেরকম শাস্তির বিধান আছে, সেগুলি হল– (১) যদি তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কোনো ব্যক্তিকে কোনো অখাদ্য বা অপেয় বস্তু খেতে বা পান করতে বাধ্য করলে, (২) যদি তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কোনো মানুষের বাড়ির উঠোনে বা আশেপাশে মলমূত্র, বর্জ্য পদার্থ, মরা পশু বা অন্যান্য আপত্তিকর বস্তু নিক্ষেপ করলে এবং এইভাবে সেই ব্যক্তিকে আহত, অপমানিত বিরক্ত করলে, (৩) যদি তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কোনো মানুষের শরীর থেকে কাপড় খুলে নিলে, বা তাকে নগ্ন করে হাঁটায়, বা তাঁর মুখে রং মাখিয়ে হাঁটায় বা এই ধরনের মানবিক মর্যাদা হানিকর অপর কোনো কাজ করলে, (৪) যদি তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কোনো ব্যক্তির মালিকাধীন বা যথাসাধ্য কর্তৃপক্ষ তাঁকে যে জমি চাষ করার জন্য দিয়েছে সেই জমি অন্যায়ভাবে দখল করার চেষ্টা করলে বা সেই জমি হস্তান্তরিত করে নিলে, (৫) যদি তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তাঁর জমি বা বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করলে অথবা জমি, বাসস্থান বা জলের উপর যে অধিকার সে ভোগ করছে তা থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করলে, (৬) যদি তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কোনো মানুষকে ‘বেগার’ বা অন্য কোনো ধরনের বাধ্যতামূলক শ্রম করতে বাধ্য করলে, (৭) যদি তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কোনো ব্যক্তিকে নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে বা না দিতে বাধ্য করলে অথবা আইনানুগ নয় এমনভাবে ভোট দিতে বাধ্য করলে, (৮) যদি তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কোনো ব্যক্তির নামে মিথ্যা বা উদ্দেশ্যমূলক মামলা করলে, (৯) কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে এমন কোনো তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা বা সাজানো অভিযোগ করে যার ভিত্তিতে ওই সরকারি ব্যক্তি সেই তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষটির কোনো ক্ষতি বা তাকে বিরক্ত করলে, (১০) প্রকাশ্য স্থানে কোনো তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি ভুক্ত মানুষকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করে বা ভয় দেখায়, (১১) কোনো তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মহিলাকে অসম্মান বা শ্লীলতাহানির জন্য ভয় দেখালে, (১২) নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে কোনো তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মহিলার উপর যৌনশোষণ চালায় (এই ক্ষমতা না থাকলে মহিলাটি যৌনক্রিয়ায় রাজি হবে না), (১৩) তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্তদের ব্যবহার্য পুকুর, কুয়ো বা খালের জল দূষিত করলে এবং সেটাকে ব্যবহারের অযোগ্য করলে, (১৪) সর্বসাধারণের ব্যবহার্য যেসব স্থান অন্যরা ব্যবহার করে এবং তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতিদের সেগুলি ব্যবহার করতে বাধা দিলে, (১৫) কোনো তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি মানুষকে গ্রাম বা তার বাসস্থান ছাড়তে বাধ্য করলে– এইসব অপরাধের জন্য অপরাধীর ন্যূনতম ছয়মাস এবং সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।
এখানেই শেষ নয়, যদি (১) তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি নয় এমন কেউ তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় (এটা জেনে যে ওই সাক্ষ্যের ফলে তার মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে), তাহলে এই অপরাধের জন্য তাঁর যাবজ্জীবন সাজা এবং জরিমানা হতে পারে; এবং যদি এই ধরনের সাক্ষ্যের ফলে কোনো তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতির তালিকাভুক্ত ব্যক্তির সাজা ও মৃত্যুদণ্ড হয়ে যায় তাহলে মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তির সাজা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। (২) যদি অগ্নিসংযোগ করে বা বিস্ফোরক ফাটায় (এটা জেনে যে তাতে তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতির মানুষদের সম্পত্তির ক্ষতি হতে পারে) তাহলে ওই ব্যক্তির সর্বনিম্ন ছয়মাস সাজা হতে পারে বা সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।
রাষ্ট্রের কাছে গচ্ছিত আছে আপনাদের রক্ষাকবচ, আর আপনাদের কমণ্ডলুতে আছে ব্রাহ্মণ্যবাদের রক্ষাকবচ। ছুঁড়ে ফেলে দিন। একদা যে ব্রাহ্মণ্যবাদকে ঘিরে হিন্দুধর্ম পরিপূর্ণতা এবং পরিপুষ্টতা লাভ করেছিল, সেই ব্রাহ্মণ্যবাদের কারণেই হিন্দুধর্ম ক্ষয়িষ্ণুর পথে। ব্রাহ্মণ্যবাদই হিন্দুধর্মের আধার। এই ব্রাহ্মণ্যবাদ ধ্বংস না-হলে হিন্দুধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে কালের স্রোতে। বহু বিভাজনে কোনো জাতি টিকে থাকতে পারে না। যতদিন না এক মন এক মত এক জাতি এক ধর্ম হবে ততদিন বিচ্ছিন্ন হতে হতে একটা জাতি অক্ষমের লড়াই করতে থাকবে আরএসএসের হাত ধরে। আক্ষেপের বিষয় হল এই যে, ব্রাহ্মণ্যবাদ যত-না মুষ্ঠিমেয় উচ্চবর্ণীয়রা অনুসরণ করে তার চেয়ে অনুসরণ করে তথাকথিত নিম্নবর্ণীয় বৃহৎ সংখ্যক মানুষেরা। অথচ বিবেকানন্দ থেকে জগজীবন রাম প্রত্যেকেই পইপই করে বলেছেন– ব্রাহ্মণ্যবাদ ধ্বংস করো, পুরোহিততন্ত্রের বিনাশ করো। শুধু আমরা দলিত আমরা দলিত’ বলে চিৎকার করলে কিস্যু হবে না, ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদগুলি ইগনোর করতে হবে। সেইজন্যই জগজীবন রামের কথা স্মর্তব্য– “Any movement for social equaliy must be anti-Brahmin in character.” অর্থাৎ সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য যদি কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে হয় তবে তা হতে হবে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী। “হিন্দুধর্মের যথার্থ নাম ব্রাহ্মণ্যবাদ, আর হিন্দুধর্ম হল প্রকৃতপক্ষে জাতব্যবস্থা। ব্রাহ্মণ্যবাদ ধ্বংস নাহলে ভারতে সমাজতন্ত্র আসতে পারে না (“Brahminism, which is the appropriate name for Hinduism, is nothing but Cast System. Socialism will not come to India without destroying Brahminsim”– V.T. Rajshekhar) i
ইগনোর করুন ব্রাহ্মণ্য-ব্যবস্থা। কীভাবে ইগনোর করবেন? শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে ব্রাহ্মণদের নির্দেশ হলে এমন সব নির্দেশ অগ্রাহ্য করুন। কারণ তথাকথিত শাস্ত্র যা, শাস্ত্রের লিখন যা –তার সবই ব্রাহ্মণ-শাসক দ্বারা রচিত। যেমন– মন্ত্রপাঠ করে বিয়ে করা (রেজিস্ট্রি করে ম্যারেজ করুন, সামর্থ্য অনুযায়ী প্রীতিভোজ দিন)। শিশু প্রথম ভাত খাক এবং তা মামাই খাওয়াক (পুরোহিত আনবেন না), প্রীতিভোজও সামর্থ্য অনুযায়ী। পুজো করতে চাইলে আপনি নিজে করুন, পুরোহিতের প্রয়োজন নেই, মন্ত্রও লাগে না। প্রিয়জন বিয়োগে মৃতদেহ দাহ করুন বা মাটি দেন– এখানেই সৎকার শেষ করুন। হবিষ্যি খাওয়া, অশৌচ পালন, ধরা বাঁধা, মস্তক মুণ্ডনাদি ক্ষৌরকর্ম, পিণ্ডদান, ব্রাহ্মণভোজন, প্রীতিভোজ বাতিল করুন। সবচেয়ে উত্তম হয় যদি আপনার আত্মীয়ের মরদেহ মেডিক্যালে বিজ্ঞানের স্বার্থে দান করতে পারেন। উত্তম এই কারণে যে, মানুষের মৃত্যুর পর মরণোত্তর দেহদানের পর কী করণীয় তার কোনো শাস্ত্রীয় অঙ্গুলি-নির্দেশ বা বিধান নেই। তাই কোনো চাপও থাকছে না। অ-কার্যকর সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিরোধিতা করুন, এ ব্যবস্থা আপনার কোনো কাজে লাগে না। এ ব্যবস্থা আপনাকে ভয়ানকভাবে চিহ্নিত করে যে, আপনি দুর্বল, অযোগ্য, আপনি ছোটোজাত, আপনি পরাজিতের দলে, আপনি অসুর দৈত্য-দানো। যোগ্যতার মাপকাঠিতে সমস্ত ক্ষমতা অর্জন করতে হবে, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে হবে, নইলে নয়। দয়া নয়, অর্জন করে নিতে হবে। আপনারা সংখ্যালঘু নন, আপনারাই সংখ্যাগুরু।
————
সাহায্যকারী তথ্যসূত্র :
১. ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস –নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
২. বৌদ্ধ দর্শন– রাহুল সাংকৃত্যায়ন
৩. অলৌকিক নয় লৌকিক (তৃতীয় খণ্ড)– প্রবীর ঘোষ
৪. মুসলিম সমাজ কয়েকটি প্রাসঙ্গিক আলোচনা— মইনুল হাসান
৫. বাংলার সমাজে ইসলাম সুচনাপর্ব– অতীশ দাশগুপ্ত
৬. ব্রাহ্মণ্যবাদ– রণজিৎ কুমার সিকদার
৭, অনীক(অক্টোবর-নভেম্বর ২০০৫)
৮. আমি শূদ্র, আমি মন্ত্রহীন– কঙ্কর সিংহ
৯. মনুসংহিতা– সুরেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
১০, ক্ষমতা হস্তান্তর ও দেশবিভাগ– লাডলীমোহন রায়চৌধুরী
১১. অনীক (অক্টোবর-নভেম্বর ২০০৫)।
১২. মানবাধিকার ও দলিত– দেৰী চ্যাটার্জী,
১৩. শূদ্র জাগরণ– গৌতম রায়,
১৪. বর্তমান ভারত– স্বামী বিবেকানন্দ,
১৫. প্রাচীন ভারতে শূদ্র– রামশরণ শর্মা,
১৬. জাতের বিড়ম্বনা– শ্রীউপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।