২. অসমসাহসিকতা

মল্লিকা দেবী, এ রকম অসমসাহসিকতা করছেন কেন?

 কী করব? কখন কথা বলব আপনাকে?

 আজও ভেঙে পড়ে মল্লিকা, দিনের বেলা চারিদিকে পাহারা। ওই গণেশটা হচ্ছে মামার চর। সহস্র চক্ষু ওর। শুধু এই রাত্তিরে তাড়ি খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে।

কিন্তু কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন!

 আশ্চর্য! আশ্চর্য আপনি! মল্লিকার তীক্ষ্ণকণ্ঠ ধিক্কার দিয়ে ওঠে, আপনি কী শুকদেব?

মল্লিকা দেবী! আপনার ওপর থেকে আমার শ্রদ্ধা কেড়ে নেবেন না!

মল্লিকা সংযত হয়।

ক্ষুদ্ধহাস্যে বলে, কি জানেন, পুরুষের একটা রূপই দেখেছি, তাই সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়। আর ভালো কথা, সভ্য সুশ্রী কথা, কবে শিখলাম বলুন? সেই আট বছর বয়েস থেকে মামার হোটেলের চাকরাণীগিরি করছি। মামার হুকুমে তার খদ্দেরদের আকর্ষণ করতে

থাক। শুনতে কষ্ট হচ্ছে। আজ আপনার কী বক্তব্য সেটাই শুনি!

 মল্লিকা খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

জানলা দিয়ে ছায়া-ছায়া জ্যোৎস্না আসছে। ওকে মনে হচ্ছে বন্দিনী রাজকন্যা।

তবে—

আজ ওর গলা কান্নায় ভেজা নয়। ক্লান্ত বিষণ্ণ মধুর।

মিস্টার গোস্বামী, আজ আমি কিন্তু নিজের স্বার্থে আসিনি। এসেছি আপনাকে সাবধান করতে। কিন্তু তার আগে প্রশ্ন করছি, রোজ আপনি কী এত লেখেন?

লিখি! লিখি মানে? চিঠি লিখি!

 কাকে? কাকে এত চিঠি

প্রভাত বিরক্ত কণ্ঠে বলে, কেন বলুন তো? এ কী অদ্ভুত কৌতূহল আপনাদের? আপনার মামাও কাল নানান জেরায়, আপনাদের হোটেলের খাতায় এ নিয়মটাও তাহলে লিখে রাখা উচিত ছিল, এখানে থাকতে হলে বাড়ীতে চিঠি লেখা নিষেধ!

আপনি রাগ করছেন? কিন্তু জানেন, মামার সন্দেহ হয়েছে আপনি পুলিশের লোক!

 চমৎকার!

ওই তো–গণেশ বোজ খবর দিচ্ছে আপনি লিখছেন। মামার ভাবনা, এগুলো আপনি রিপোর্ট লিখছেন। কারণ প্রথম দিন এসে নাকি নানা অনুসন্ধান করেছিলেন।

আরও চমৎকার লাগছে!

রাগ করলেও সাবধান হোন, এই অনুরোধ। মামার এখানে অনেক রকম ব্যাপারই তো চলে। বলতে গেলে বেআইনি কাজের ঘাঁটি!

হু। সেইরকমই সন্দেহ হচ্ছিল।

হওয়াই স্বাভাবিক। আপনি সরল হলেও নির্বোধ নয়। কিন্তু জানিয়ে রাখি শুনুন, কিছুদিন আগে আপনারই মতো একটি বাঙালী ছেলে বোর্ডারের ছদ্মবেশে এসে বাসা নিয়েছিল টিকটিকিগিরি করতে। সে আর ফিরে যায়নি।

মল্লিকা দেবী!

মল্লিকা কিন্তু এ আর্তনাদে বিচলিত হয় না। তেমনি দার্শনিক ভঙ্গিতে বলে, হ্যাঁ, তাই। ওই জঙ্গলের দিকে অনুসন্ধান করলে হয়তো এখনো তার হাড়ের টুকরো পাওয়া যেতে পারে।

বিচলিত প্রভাত সহসা আত্মস্থভাবে বলে, কিন্তু কি করে বুঝব আপনিও আপনার মামার চর নয়?

কী করে বুঝবেন! মূঢ় শোনায় মল্লিকার কণ্ঠস্বর।

হ্যাঁ, বিশ্বাস কি? যেখানে এত সতর্ক চক্ষু, সেখানে কী ভাবে আপনি রাত্রিবেলা একজন যুবকের ঘরে

হঠাৎ প্রায় শব্দ করে হেসে ওঠে মল্লিকা।

সেটাই তো ছাড়পত্র মিস্টার গোস্বামী। ওরা সন্দেহ করেছে আর অনুমান করেছে আমি আপনার প্রেমে পড়েছি। আর প্রেমে পড়ার একটামাত্র অর্থই ওরা জানে। কিন্তু আমি অনুরোধ করছি আপনি এখান থেকে পালান। মামাকে বলবেন, অফিসের দূরত্বের জন্যেই

প্রভাত আর একবার চেয়ে দেখে। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ রাত্রির গভীরে আরও পরিস্ফুট হচ্ছে। মল্লিকাকে অলৌকিক দেখাচ্ছে।

ক্ষণপূর্বের কটু মন্তব্যের জন্য নিজেকে ধিক্কার দিল প্রভাত। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বলল, কিন্তু গতকাল তো একথা হয়নি, আমি একা পালাব?

কাল আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। এই নরকের মধ্যে আর শাসনের মধ্যে বাস করতে করতে মাঝে মাঝে বুদ্ধিবৃত্তি নষ্ট হয়ে যায়। তাই যা অসম্ভব

কিন্তু যদি আমি সম্ভব করতে পারি?

 চেষ্টা করতে যাবেন না, মারা পড়বেন।

মল্লিকা, যদি আমি খোলাখুলি তোমার মামার কাছে প্রস্তাব করি আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই!

আর বুঝি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না মল্লিকা। বসে পড়ে বলে, আপনি–আপনি কি পাগল! এ প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে খুন হয়ে যাবেন, তা জানেন?

খুন!

তা না তো কি! জানেন না, বুঝতে পারেন নি, আমিই মামার শিকার ধরবার সবচেয়ে দামী টোপ!

বেশ, তবে লুকানো রাস্তাই ধরতে হবে। শুধু তুমি রাজী কিনা–

আমি রাজী কিনা–শুধু আমি রাজী কিনা!

একটা প্রবল বিক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে সহসা কি একজোড়া হিমশীতল সাপ এসে আছড়ে পড়ল প্রভাতের উপর? আর প্রভাতকে বেষ্টন করে ধরল দৃঢ় বন্ধনে?

কিন্তু নাগপাশের বিভীষিকা নিয়েও বন্ধন কেমন করে এমন আবেশময় হয়ে উঠতে পারে?

মল্লিকা!

.

চেষ্টার অসাধ্য কাজ নেই এ-কথাটা সব ক্ষেত্রে সত্য হয় কিনা জানি না, কিন্তু প্রভাতের পক্ষে হল।

ভালোমানুষ প্রভাত, মধ্যবিত্ত গৃহস্থমনা ভাত, অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে একটা অসাধ্যসাধনই করে বসলী

কিন্তু এই অসাধ্যসাধন কি সত্যিই প্রেমের আকর্ষণে?

প্রভাত এমন করেই একটা হোটেলওয়ালি মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল যে, ভয়ভাবনা ত্যাগ করে ফেলল? মস্ত একটা বিপদের ঝুঁকি নিতে পিছপা হল না?

মাত্র কয়েকটি দিনে এমন প্রেমের সৃষ্টি হওয়া সম্ভব? হয়তো তা নয়।

মল্লিকার রূপযৌবন একটা মোহের সঞ্চার করলেও, প্রভাতের ভদ্রচিত্তের কাছে সেই আবেদনই শেষ কথা হয়ে ওঠে নি।

মানবিকতার প্রশ্নটাও ছোট নয়।

মল্লিকার অশ্রুজলের আবেদন, একটি নিঃসহায় নিরুপায় মেয়ের জীবনের অনিবার্য শোচনীয়তা প্রভাতকে বিচলিত করে তুলল। তাই হঠাৎ মোহে নয়, যা করল জেনে বুঝেই করল।

মল্লিকা যে নিষ্কলঙ্ক নয়, মামার শিকারের টোপ হবার জন্যে ওকে যে অনেক খোয়াতে হয়েছে, এ বুঝতে ভুল হয়নি প্রভাতের।

তবু সে মানবিকতার সঙ্গে যুক্তি আর বুদ্ধিকেও কাজে লাগিয়েছে। ভেবেছে যুগটা আধুনিক।

এ যুগে সভ্যজগতের নিয়ম নয়, মানুষকে মাছদুধের মত নষ্ট হয়ে গেছে বলে ফেলে দেওয়া।

ভেবেছে, এ যুগে তো বিধবা বিয়ে করছি আমরা! বিবাহ-বিচ্ছেদের সমুদ্র পার হওয়া মেয়েকে বিয়ে করছি!

ভেবেছে, ও তো মানসিক পাপে পাপী নয়। দুর্ভাগ্য যদি ওকে নিদারুণতার মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলে থাকে, সে দোষ কি ওর? একটা মানুষকে যদি পঙ্কের মধ্যে থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে সুন্দর জীবনের বৃন্তে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে প্রভাত, সে কাজে নিশ্চয়ই ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাবে।

তবু মিথ্যা কৌশল অনেক করতে হল বৈকি। প্রভাতকে কলকাতা থেকে বন্ধু মারফৎ মায়ের মারা অসুখ বলে টেলিগ্রাম আনিয়ে ছুটি মঞ্জুর করতে হল, আর মল্লিকাকে স্টেশনের ধারে টাঙ্গা থেকে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভাঙতে হল।

অসহ্য যন্ত্রণার অভিনয়ে অবশ্য মল্লিকাও কম পারদর্শিতা দেখায় নি।

চ্যাটার্জি তাকে হিঁচড়ে টাঙ্গায় তুলবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জায়গাটা স্টেশন! অনেক লোকের ভিড়! তাদের পরামর্শের চাপে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ভাগ্নীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল চ্যাটার্জিকে, আর ডাক্তার নেই, চারটের সময় আসবেন। রেখে যান নার্সের এই হুকুমও মানতেই হল।

তারপর?

উৎকোচের পথেও আসতে হয়েছে বৈকি। উৎকোচ আর ধরাধরি।

এই দুই পথেই তো অসাধ্যসাধন হয়। এই তো জগতের সব সেরা পথ।

.

ট্রেনে চড়ে বসার পর আর ভয় করে না।

চ্যাটার্জি কি নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে ভাগ্নী খুঁজতে বেরবে?

আর পুলিশ?

তার কাছে জবাব আছে। মল্লিকা নাবালিকা নয়।

 আর ততদিনে–পুলিশ যতদিনে খুঁজে পাবে, হয়তো রেজিস্ট্রি করেই ফেলতে পারবে।

 রেজিস্ট্রি?

হ্যাঁ, ওটা চাই।

ওই তো রক্ষামন্ত্র। তারপর অনুষ্ঠানের বিয়েও হবে বৈকি! প্রভাত বলে, ওটা নইলে মন ওঠে না। সেই যে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি।

মল্লিকাও তার স্বপ্নসাধের কথা বলে, জানো, ছেলেবেলায় এক পিসতুতো দিদির বিয়ে দেখেছিলাম, সেই থেকে সেইরকম কনে হবার যে কী সাধই চেপে বসেছিল মনে–খেলাঘরে বিয়ে বিয়ে খেলতাম, কনে হয়ে ঘোমটা দিতাম, ঘোমটা খুলে অদৃশ্য অদেহী বরের দিকে চোখ তুলে তাকাতাম!

উঃ, ওইটুকু বয়সে কম পাকা তো ছিলে না? প্রভাত হেসে ওঠে।

.

চলন্ত ট্রেনের কামরা।

জানলা দিয়ে হু-হু করে দুরন্ত বাতাস আসছে, মল্লিকা গল্প করছে তার ছেলেবয়সের দুরন্তপনার কথা।

কেমন করে গাছে চড়ে বসে থেকে মাকে নাজেহাল করত। কেমন করে পারানির মাঝিদের সঙ্গে ভাব করে নৌকোয় চড়ে গঙ্গার এপার ওপার হত।

হ্যাঁ, গঙ্গার তীরেই গ্রাম।

যোগের স্নানে লোক আসত এ-গ্রাম ও-গ্রাম থেকে। মল্লিকা সেই ভিড়ে মিশে মেলাতলায় ঘুরত।

আবার মার সঙ্গে মার কাজও করেছি বৈকি। ওই অতটুকু বেলাতেই করেছি! তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়েছি। ছোট্ট কাঁচা শাড়ি পরে চন্দন ঘষেছি, ফুল তুলে রেখেছি। …তারপর কোথা দিয়ে কী হল, ফুলের বন থেকে গিয়ে পড়লাম পাঁকের গর্তে। স্বর্গ থেকে পড়লাম নরকে। ওর থেকে যে কোনোদিন উদ্ধার পাব, সে আশা

কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে যায় মল্লিকার। অশ্রু টলটল করে দুটি চোখে।

আমার জীবন, যেন একটা গল্পের কাহিনী!

মল্লিকা চেয়ে থাকে সুদূর আকাশের দিকে।

তা চ্যাটার্জির জীবনও একটা গল্পকথা বৈকি।

চাটুজ্যেবামুনের ঘরের ছেলে, বাপ সামান্য কি চাকরি করে, আবার যজমানীও করে। ছেলে ছোট থেকে উচ্ছন্নের পথে। নীচ জাতের ঘরে পড়ে থাকে, তাদের সঙ্গে তাড়ি খায়, গাঁজা খায়। বাপ বকেঝকে যজমানী কাজ করতে বললে হি হি করে হাসে আর বলে, বাগদীর ঘরের ভাত খেয়ে আমার তো জাতজন্মের বালাই নেই, ছুঁলে তোমার শালগেরামের জাত যাবে না?

কিন্তু ছেলেবেলার সেই দুষ্টুমি বয়েস হতেই পরিণত হল কেউটে বিষে। একবার বাগদীদের। হাতে মার খেয়ে হাড় ভেঙে ঘরে পড়ে রইল তিন মাস, তখন বাপের কাছে দিব্যি গাললো, কান মললো, নাকে খৎ দিল, আর সেরে উঠে মানুষ হয়েই একদিন রাতের অন্ধকারে গেল নিরুদ্দেশ হয়ে।

আর সেই রাত্রে বাগদীদের সেই রঙ্গিণী বৌটাও হল হাওয়া। যার জন্যে মার খেয়ে হাড় ভাঙা।

.

তারপর বহু বহুকাল পাত্তা নেই, অবশেষে একদিন বোনকে অর্থাৎ মল্লিকার মাকে একটা চিঠি লিখে জানাল, বেঁচে আছি, তবে এমন জড়িয়ে পড়েছি যে যাওয়া অসম্ভব। ঠিকানা দিলাম, বাবা মরলে একটা খবর দিস। যতই হোক বামুনের ছেলে, নেহাৎ শূয়োর গরুটা আর খাব না সে সময়। ছেলে চলে যেতে মেয়ে-জামাইকে কাছে এনে রেখেছিল চাটুজ্যের বাপ।

তা বাপ মরতে দিয়েছিল চিঠি–বোন নয়, ভগ্নিপতি।

আর সেই খবর পেয়েই চাটুজ্যে অতকাল পরে গ্রামে ফিরে এসে বাপের ভাঙা ভিটেটুকু আর দুপাঁচ বিঘে যা ধানজমি ছিল, বেচে দিয়ে বোন-ভগ্নিপতিকে উচ্ছেদ করে আবার স্বস্থানে প্রস্থান করেছিল। . এসব কথা মল্লিকা তার মার মুখে শুনেছে। তখনও সে শিশু। তারপর তারও বাপ মরেছে। মা লোকের বাড়ী ধান ভেনে, বড়ি দিয়ে, কাজেকর্মে বেঁধে দিন গুজরান করে মেয়েটাকে মানুষ করে তুলছিল। তা সে মাও মরল। আর কেমন করে না জানি খবর পেয়ে মামা এসে তাকে ধরে নিয়ে গেল।

কে জানত যে সেই তখন থেকেই মতলব ভাঁজছিল চাটুজ্যে!

তখন তো বুঝিনি মল্লিকা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, মামার মুখে মধু, ভিতরে বিষ! আমাকে কোলে জড়িয়ে বোনের নাম করে কত কাঁদল, কত আক্ষেপ করল, আমায় এতদিন আদরযত্ন করেনি বলে হা-হুঁতাশ করল। মুখের মধুর মোহে তখন খুব ভালবেসে ফেললাম। মনে হল, মামার নামে যা কিছু নিন্দে শুনেছি সব বাজে। কিন্তু বয়েস হবার সঙ্গে সঙ্গে

শিউরে ওঠে মল্লিকা। চুপ করে যায়।

প্রভাত ওর মুখের দিকে তাকায়। সরল পবিত্র মুখ।

সত্যি, মানুষ কি এতই সস্তা জিনিস যে সামান্য খুঁৎ হলেই তাকে বর্জন করতে হবে?

.

দূরপথে পাড়ি। কত কথা, কত গল্প!

 সেই বাগদীদের বৌটা?

সেটা নাকি আর কার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। মামা বলত, আপদ গেছে। হাড় জ্বালিয়ে খেয়েছে আমার! এখন আর কোন কিছু নেশা নেই মামার, শুধু পয়সা আর পয়সা।

আচ্ছা তা তো হল, কিন্তু এর মাঝখানে লেখাপড়া শিখল কখন মল্লিকা? এমন কায়দাদুরস্ত হল কি করে?

তা তার জন্যে মামার কাছে ঋণী বৈকি।

 যে উদ্দেশ্যেই হোক, মেম রেখে ইংরিজি শিখিয়েছে মামা, শিখিয়েছে চালচলন।

না, উদ্দেশ্যটা মহৎ নয়। দুরস্ত করেছে যত অবাঙালী খদ্দেরদের জন্যে-তবু যে ভাবেই হোক মল্লিকা তো পেয়েছে কিছু!

বাংলা? সেটা সম্পূর্ণ নিজের আকুলতায় আর চেষ্টায়। পার্সেলে বই আনিয়ে আনিয়ে

 তাতে আপত্তি ছিল না মামার?

না। এদিকে যে আবার মল্লিকার তোয়াজ করতেন। বুঝতেন তো মল্লিকাই খদ্দেরদের অর্ধেক আকর্ষণ। স্টেশনে একা গেলে তোক আসতে চায় না, মল্লিকা গেলে ঠিক বঁড়শি গেলে!

তার সাক্ষী তো স্বয়ং আমিই–হেসে উঠেছিল প্রভাত।

হ্যাঁ, ওখানে সব আছে।

মদ, জুয়া, ভেজাল, কালোবাজার! তারাই তো দামী খদ্দের! আর ওইজন্যেই তো পুলিশে অত ভয় চাটুজ্যের। পুলিশের লোক বলে সন্দেহ হলেই

সব কথাই বলছি তোমায়, সব কথাই বলব। মল্লিকা বলে, প্রথম যেদিন তোমার ঘরে এসেছিলাম, সেদিন ঠকিয়েছিলাম তোমায়। অভিনয় করেছিলাম।

অভিনয়!

আড়ষ্ট হয়ে তাকায় প্রভাত।

মল্লিকা মুখ তুলে বলে, হ্যাঁ অভিনয়। অভিনয় করতে করতেই তো বড় হয়েছি। মামার শিক্ষায় অভিনয় করেছি। আবার মামাকে ঠকাতেও করেছি। সেদিন গিয়েছিলাম মামার শিক্ষায় তোমার পকেট থেকে চিঠি চুরি করতে।

চিঠি চুরি! পৃথিবীটা দুলে ওঠে প্রভাতের।

কিন্তু মল্লিকা অকম্পিত। সে সব বলবে। তারপর প্রভাত তাকে দূর করে দিক, আর মুখ না দেখুক, তাও সইতে পারবে।

মরতে ইচ্ছে হত মাঝে মাঝে। কিন্তু রূপ রস গন্ধ স্পর্শময়ী এই পৃথিবীর দিকে তাকালেই মনটা কেঁদে উঠত। নিজের ওপর মায়ায় ভরে যেত মন। আর কল্পনা করত, কবে কোনদিন আসবে তার ত্রাণকর্তা!

আরও তিনজন আশ্বাস দিয়েছিল।

প্রথমবার এক বাঙালী মহিলা, মহিলা!

হ্যাঁ, একজন নার্স! স্বাস্থ্যান্বেষণে এসেছিলেন। অনুভব করেছিলেন মল্লিকার দুঃসহ যন্ত্রণা। টের পেয়েছিলেন মল্লিকার জীবনের গ্লানি। বলেছিলেন, মল্লিকাকে নিয়ে যাবেন। তাকে সুস্থ

জীবনের স্বাদ এনে দেবেন।

কিন্তু হঠাৎ একদিন মল্লিকাকে কিছু না বলে পালিয়ে গেলেন।

তারপর আপনারই মত দুজন যুবক। সহানুভূতি দেখিয়েছেন, উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন বলেছেন, যাবার সময় ভুলে গেছেন।

তার মানে ওই আশা দিয়ে লোভ দেখিয়ে রেখে বিশেষ সুবিধে আদায় করে নিয়েছে। প্রভাত রাগ করে বলে।

মল্লিকা মুখ তুলে বলে, পৃথিবীতে দেবতা আর কজন জন্মায়?

প্রভাত তার হাতের ওপর একটা হাত রাখে, ঈষৎ চাপ দেয়। তারপর বলে, কিন্তু মনে আছে তো? তোমার পরিচয়টি কি? মনে রেখো তোমার মামা গরীব ব্রাহ্মণ, মামী হঠাৎ মারা যাওয়ায় তোমাকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছেন। দূরে প্রবাসে ছোট্ট একটি দোকান আছে, সেইটি ছেড়ে বাংলাদেশে এসে ভাগ্নীর জন্যে পাত্র খুঁজবেন, এমন অবস্থা নয়। দৈবক্রমে আমার সঙ্গে পরিচয়। আমি গোস্বামী শুনে হাতে স্বর্গপ্রাপ্তি

হেসে ওঠে প্রভাত।

 মল্লিকা বলে, ভুলে যাব না।

না, ভুলে গেল না তারা।

ওই গল্প দিয়ে ভোলালো বাড়ীর লোককে, আত্মীয়বর্গকে।

কিন্তু সমাজ সংসারী ঝুনো মানুষদের ভোলানো কি সোজা? নাঃ, সোজা নয়। তাই কাজটা খুব সহজ হয়নি। অনেক ভুরু কুঁচকে উঠেছিল।

প্রথম ভুরু কোঁচকালেন মা।

প্রভাত-জননী করুণাময়ী।

ভুরু কুঁচকে বললেন, বাংলা-বিহার ছাড়া পাণ্ডববর্জিত দেশ সেই পাঞ্জাব বর্ডারে লোকটা যে একা পড়ে আছে, এর কারণ কি? কোনও দোষঘাট ছিল কিনা কে জানে? শুনে মনে হচ্ছে যেন সমাজ সংসার থেকে পালিয়ে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে বসে থাকা লোক! বলি তার জ্ঞাতি-গোত্তর আত্মবন্ধু কাউকে দেখেছিস সেখানে?…দেখিস নি? তবে? বলি তার জাতকুলের নিশ্চয়তাই বা কী? সে বলল, আমি বামুন, অমনি তুই মেনে নিলি বামুন! জাত ভাঁড়িয়ে অরক্ষণীয়া কন্যে পার করার কথাও আমরা শুনি নি এমন নয়। এরপর যদি প্রকাশ পায় তেলিতামলি কি–হাড়ি ডোম–

প্রভাত মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিল, দেখে কি হাড়িডোম বলে ভ্রম হচ্ছে তোমার?

শুনে করুণাময়ী কিঞ্চিৎ থতমত খেয়েছিলেন, বলেছিলেন, আহা, সে কথা বলছি না। তবে সময় সময় গোবরেও পদ্মফুল ফোটে না তা নয়।

সে পদ্ম তুলে নিয়ে ঠাকুরপূজো কর না তোমরা?

হল কুতকুর সুরু করুণাময়ী বলেন, ফুলের জাত আছে?

নেই। আর মানুষেরও থাকা উচিত নয়। মানুষ হচ্ছে মানুষ, এই তার পরিচয়। তার সত্যিকার পরিচয় তৈরি হয় তার আচার আচরণে, রুচি প্রকৃতিতে

করুণাময়ী ঝঙ্কার দেন, এই কদিন বিদেশ ঘুরে এসে অনেক কথা শিখেছিস দেখছি। এ আর কিছু নয় তোর খুড়ির কুশিক্ষা। চিরদিন দেখেছি ছোটবো তোকে বেশি ভালবাসার ভান করে আমার বিপক্ষে উস্কেছে। আর এবার তো একেবারে বেওয়ারিশ হাতে পেয়েছিস!

আহা কী মুশকিল! সে ভদ্রমহিলাকে আবার এর মধ্যে টানছ কেন? যার কথা হচ্ছিল তার কথাই হোক না। ওই মামা নামক ভদ্রলোকটির পদবী চ্যাটার্জি এতে সন্দেহ নেই। দীর্ঘকালের ব্যবসা-বাণিজ্য সেখানে তার। জীবনের প্রারম্ভে কি আর ভদ্রলোক ভবিষ্যৎ দর্শন করে রেখেছিলেন যে, সুদূর কালে তিনি ভাগ্নীদায়ে পড়বেন, আর এই আমা হেন গুণনিধি তার কবলে গিয়ে পড়বে, তাই সেই আগে থেকে গলায় পৈতে ঝুলিয়ে চাটুজ্যের খাতায় নাম লিখিয়ে বসে থেকে ছিলেন?

হয়েছে, অনেক কথা শিখেছিস। যাক তবুও হেস্তনেস্ত আমি দেখব। ওই রিষড়ে না কোথায় যেন মেয়ের বাপের দেশ বলছিস, সেখানে খোঁজ করাব আমি–তবে বৌ বরণ করে ঘরে তুলব।

প্রভাত চুপ করে ছিল। চট করে মুখের ওপর বলতে পারে নি রিষড়েই হোক আর রাজস্থানই হোক, যতই তুমি তোলপাড় করে ফেলো মা, বিয়ে ওকে আমি করবই। আমাকে করতে হবেই। আমি ওকে আশ্রয় দিয়েছি, আশ্বাস দিয়েছি।

ভেবেছিল দেখাই যাক না মায়ের দৌড়! কে যাবে অত খোঁজখবর নিতে।

মল্লিকা তখন অবস্থান করছে প্রভাতের এক ছেলেবেলার বন্ধুর বোনের বাড়ীতে। করুণাময়ীই। এ ব্যবস্থার ব্যবস্থাপক।

বলেছিলেন, বাড়ীতে এনে ভরে রেখে তারপর বৌ করে বরণ করা সে যে একেবারে পুতুলের বিয়ের বেহদ্দ! ওর থাকার ব্যবস্থা আমি করছি। যা দেখছি, বিয়ে তুমি ওকে করবেই, তবু লোক-সৌষ্ঠবটা তো রাখতে হবে!

হ্যাঁ, প্রথমটা এমনি কঠিনই হয়েছিলেন করুণাময়ী। কিন্তু মল্লিকার নম্রতা, মল্লিকার দুঃখগাথা আর মল্লিকার রূপ, এই তিন অস্ত্রে ক্রমশ কাবু হয়ে পড়েছিলেন।

তা মেয়েরাই কি মেয়েদের রূপে মুগ্ধ হয় না? হয় বৈকি। রূপকে হৃদয়ের নৈবেদ্য না দিয়ে . উপায় কোথায় মানুষের? প্রকৃতিই যে তাকে এই দুর্বলতার কাছে মেরে রেখেছে।

তবু তল্লাস করতে ছাড়লেন না।

রীতিমত তোড়জোড় করেই তল্লাস করলেন, রিষড়েয় আঠারো বিশ বছর আগে সুরেশ মুখুজ্যে বলে কেউ ছিল কিনা।

যে লোককে পাঠিয়েছিলেন, সে এসে বিস্তারিত বলল, হ্যাঁ, ছিল বৈ কি, ছিল। সেই সুরেশ মুখুজ্যের জ্ঞাতিরা তো রয়েছে এখনো রিষড়েয়।

সুরেশ মুখুজ্যে মরেছে অনেকদিন, তার স্ত্রী কন্যা ছিল। মেয়েটাকে নিয়ে দুঃখুকষ্ট করে চালাচ্ছিল ও, কিন্তু সুরেশের স্ত্রীও মরল। আর সেই খবর পেয়ে তার ভাই, অর্থাৎ ওই আপনাদের মেয়ের মামা মাদ্রাজ না পাঞ্জাব কোথা থেকে এসে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেল। তারপর কে কার খবর রাখে! অবিশ্যি একথা বলতে ছাড়েন নি সুরেশ মুখুজ্যের জ্ঞাতিভ্রাতা, মেয়েটাকে আমার কাছে রাখবার জন্যে ঢের চেষ্টা করেছিলাম মশাই, বলি ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকুক, বিশ্ব বাংলা ছেড়ে কোথায় যাবে? দেখেশুনে বে-থা আমরাই দেব। কিন্তু মামাটি মশাই রগচটা। বলল, না না, ও আমার কাছেই থাকবে ভালো। বলি–তবে তাই হোক। ভালো থাকলেই ভালো। তারপর মশাই কে আর খবর রাখছে?

ভদ্রলোকের কথার বাঁধুনি দেখে অবশ্য বোঝবার উপায় ছিল না তার সেই মহানুভবতার গল্পটি গল্পই মাত্র।

করুণাময়ীর প্রেরিত লোক এসে সেই কথাই বলে, বংশ ভাল বলেই মনে হল। কাকাটি অতি ভদ্র। পাজী ছিল ওই মামাটা। নিজে তো চিরকেলে বাউণ্ডুলে, বাপ মিনসে মেয়ে জামাইকে কাছে নিয়ে রেখেছিল, তা সেই বাপ মরতে নাকি গরীব বোন ভগ্নিপতিকে ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে বেচে কিনে চলে গিয়েছিল। কাকা তাই বলছিল–বৌ মরেছে? হাড়ির হাল হয়েছে? বেশ হয়েছে, হবেই তো! অমন লোকের দুর্দশা হবে না তো কার হবে? পাজী লোকের পয়সা কখনো থাকে না।

তা না থাক, করুণাময়ীর শান্তিটা থাকল। তার কোঁচকানো ভুরু কিছুটা সোজা হল। বৌ বরণ করে ঘরে তুললেন তিনি।

কিন্তু করুণাময়ীর পতিকুলেই কি জ্ঞাতি নেই? না তাদের ভুরু নেই?

এ যুগে যে সমাজ নামক শব্দটার কোনও অর্থ নেই এ তারা জানলেও, এবং নিজেরা সমাজকে সম্যকরূপে না মানলেও, এ বিয়ের যজ্ঞিতে খাওয়া-দাওয়ার অনিচ্ছে প্রকাশ করতে ছাড়েননি তারা। আর একথাও বলেছিলেন, ওই একটা অজ্ঞাতকুলশীল মেয়েকে প্রভাতের হঠাৎ ঘাড়ে করে নিয়ে এসে বিয়ে করতে বসা দেখে তারা এত বেশি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন যে, হয়তো করুণাময়ীর সঙ্গে একেবারেই সম্পর্ক ছেদ করতে হবে তাদের।

করুণাময়ী নিজের সেই জ্ঞাতিদের রিষড়ের সুরেশ মুখুজ্যের জ্ঞাতির ঠিকানা দিলেন। বললেন, খোঁজ করে এস।

খোঁজ?

এমন পাগল আবার কে আছে যে গাঁটের কড়ি খরচা করে তথ্যানুসন্ধানে যাবে? হাওড়া থেকে রিষড়ে গোটাকতক পয়সার মামলা? তাতে কি? তাই বা কেন? জ্ঞাতিদের সঙ্গে সম্পর্ক চোকালেই যখন সব চুকে যায়।

শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি সম্বন্ধ চুকল না। আর ভোজবাড়ীতে চর্বচোষ্য লেহ্যপেয়র স্বাদ নিতেও কার্পণ্য করলেন না তারা, তবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। মোটকথা পাত্র-পাত্রী দুপক্ষের মধ্যে

লাখ কথা না হলেও, সেই লাখ কথাটা এক পক্ষেই হল।

তবু শেষ অবধি সবই হল। বিয়ে নামক অনুষ্ঠানটির যে মোহময় এবং ভাবময় ছবিখানি আঁকা ছিল বর আর কন্যার হৃদয়পটে, সে ছবি মলিন হল না। সেই গায়েহলুদ আর ছাঁদনাতলা, কুশণ্ডিকা আর কড়ি খেলা, এয়োদের হুড়োহুড়ি আর তরুণীদের বাড়াবাড়ি ইত্যাদি সপ্তসমুদ্র পার হয়ে অবশেষে ফুলশয্যার ঘাটে তরী ভিড়ল।

পুষ্প আর পুস্পসারের সম্মিলিত তীব্র মধুর গন্ধে উতলা হয়ে উঠল বাতাস, আর পরিহাস রসিকার দল বিদায় নেওয়ার পরেও যেন ঘরের মধ্যে উত্তাল হয়ে রইল তাদের পরিহাসের উদ্দামতা।

আমার জন্যে কত জ্বালা তোমার!

মল্লিকা গভীর কালো চোখ দুটি তুলে তাকায়।

প্রভাত সেই গভীর দৃষ্টির ছায়াকে নিবিড় করে তুলে আবেগকাঁপা গলায় বলে, হ্যাঁ ভারী জ্বালা! অনেক জ্বালা!

না সত্যি। কে জানে কেন কুগ্রহের মত হঠাৎ এসে পড়লাম তোমার জীবনের মধ্যে

 বোধকরি কোন সুগ্রহের আশীর্বাদে

চিরদিন কি এ স্নেহ রাখতে পারবে তুমি আমার ওপর?

 সন্দেহ কেন মল্লিকা?

না গো না, ভুল বুঝো না তুমি আমায়! সন্দেহ নয় ভয়?

 ওটা বড্ড সেকেলে, বড় পুরোনো। শরৎবাবুর উপন্যাসের নায়িকার উক্তির মত।

 মল্লিকা আবার সেই গভীর চোখ দুটি তুলে তাকায়। মল্লিকাকে আর রূপসী বলে মনে হয় না, মনে হয় লাবণ্যময়ী। রমণীয় নয়, কমনীয়। বিদ্যুৎ নয়, গৃহদীপ।

সেই আরতির দীপের মত দৃষ্টিটি তুলে মল্লিকা বলে, তা ভাগ্য যাকে সেকেলে উপন্যাসের নায়িকা করে তুলেছে

তা বেশ তো। সেকেলে উপন্যাসের কেন, হেসে ওঠে প্রভাত, আধুনিক উপন্যাসের নায়িকা হও। যারা প্রতি পদে ভয় পায় না, প্রতি পদে নিজেকে ছোট বলে মনে করে না। সাহসিকা তেজস্বিনী

ঘনিষ্ঠ করে কাছে টেনে নেয় প্রভাত আইন এবং অনুষ্ঠান উভয় শক্তিতে লাভ করা সদ্যলব্ধাকে।

মল্লিকা ভেঙে পড়ে।

অস্ফুট স্বরে বলে, না না, ওসব কিছু হতে চাই না আমি। আমি শুধু বৌ হতে চাই। বাংলার গ্রামের বৌ। যে বৌয়ের ছবি দেখেছি জীবনের শৈশবে। যারা পবিত্র সুন্দর মহৎ।

নাঃ, বড্ড বেশি সিরিয়াস হয়ে উঠছ। মনে রেখো এটা আমাদের ফুলশয্যার রাত্রি।

পরিবেশ হালকা করে তুলতে চায় প্রভাত। জীবনের এই পরম রাত্রিটিকে ভারাক্রান্ত করে তুলতে চায় না কতকগুলো ভারী ভারী কথায়। বিয়েটাকে একেবারে সাধারণ বিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলেই বা ক্ষতি কি?

এ বিয়েতে কাকিমা অবশ্য আসেন নি। খবর পেয়ে নিজের গালেমুখে চড়িয়েছেন, আরও আগে কেন গেঁথে ফেলেন নি বলে। আর শেষ আক্ষেপের কামড় দিয়েছেন বড়জার কাছে চিঠিতে, তাঁর বোন ভগ্নিপতি কী পরিমাণ দানসামগ্রী, আর কী পরিমাণ নগদ গহনা দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তার হিসেব দাখিল করে।

করুণাময়ী একবার কপালে করাঘাত করেন, আবার একবার ভাবেন, মরুক গে! সে হলে ছেলেটা তো আমার স্রেফ ছোট গিন্নীর সম্পত্তি হয়ে যেত!

প্রভাত হাসে। মল্লিকার কাছে। বলে, উঃ, ভাগ্যিস ওই দানসামগ্রী আর নগদের কবলে পড়ে যাইনি!

.

ওদের হাওড়ার বাড়ীতে এখনও গ্রাম-গ্রাম গন্ধ। ঘরে গৃহদেবতা, উঠোনে তুলসীমঞ্চ, রান্নাঘরে শুচিতার কড়া আইন।

তাছাড়া গোহালে আছে গরু, পুকুরে আছে মাছ।

মল্লিকা বিভোর হয়, বিগলিত হয়। এই তো ছিল স্বপ্ন! ভাবে, ভগবান, আমার জন্যে এত রেখেছিলে তুমি!

প্রথম প্রথম সর্বদা একটা অশুচিতাবোধ তাকে সব কিছুতে বাধা দিত। শাশুড়ি ডাকতেন, বৌমা, আজ লক্ষ্মীপূজো, ঘরে-দোরে একটু আলপনা দিতে হয়–পারবে তো? মেলেচ্ছ দেশে মানুষ, দেখনি তো এ সব। যাক, যা পারো দাও।

মল্লিকা ভয়ে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। কিন্তু পারাটা তার নেহাৎ যেমন তেমন হয় না। মনের জগতে ভেসে ওঠে শৈশবে-দেখা মায়ের হাতের কাজ। এ বাড়ী ও-বাড়ী থেকে আলপনা দিতে ডাকত মল্লিকার মাকে, ডাকসাইটে কর্মিষ্ঠে ছিলেন তিনি।

শাশুড়ি প্রীত হন। ভাবেননাঃ, যেমন ভেবেছিলেন তেমন নয়। সদ ব্রাহ্মণের আচার জানে! ডাকেন, বৌমা, একখানা সিল্কের শাড়িটাড়ি কিছু জড়িয়ে আমার ঠাকুরঘরে একবার এসো তো। চন্দন ঘষে, ফুলকটায় একটু মালা গেঁথে দেবে।

মল্লিকা কম্পিত চিত্তে ভাবে, এই মুহূর্তে ভয়ানক একটা কিছু হয় না তার! হঠাৎ পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কি ওইরকম কিছু?

শাশুড়ী ডাকেন, কই গো বৌমা

ছুটে যাওয়া ভিন্ন গতি থাকে না।

ক্রমশ ভয় ভাঙে। নিজেই এগিয়ে যায়। কিন্তু রাত্রে কাতরতায় ভেঙে পড়ে। বলে, আমার এতে পাপ হচ্ছে না?

প্রভাত আদরে ডুবিয়ে দেয়। বলে, কী আশ্চর্য! পুণ্যি না হয়ে পাপ হবে? এসব তো পুণ্যকর্ম, বরং যদি কিছু পাপ থেকে থাকে, ধুয়ে মুছে যাবে। কিন্তু এখনো এত কাতর কেন তুমি মল্লিকা? আমি তো তোমায় বলেছি, স্বেচ্ছায় অন্যায় না করলে পাপ স্পর্শ করে না।

ধীরে ধীরে বুঝি কেটে যায় সমস্ত গ্লানি! নতুন আর-এক জন্মে জন্ম নেয় মল্লিকা! মন বদলেছে, দেহটাও বুঝি বদলাচ্ছে।

নখের আগায় নেলপালিশের বদলে হলুদের ছোপ, ঠোঁটে লিপস্টিকের বদলে পানের রাঙা, সুর্মাবিহীন চোখ ন কোমল। শাড়ী পরার ভঙ্গিমা বদলে ফেলেছে মল্লিকা, বদলেছে জামার গড়ন।

মল্লিকা আস্তে আস্তে তার মার মত হয়ে যাচ্ছে। পুণ্যবতী সতীমায়ের মত। যে মা তার খেটে খেয়েছে, কিন্তু সম্মান হারায়নি।

.

কিন্তু অনাবিল সুখ মানুষের জীবনে কতক্ষণ? প্রভাতের কাকার চিঠি আসে, বিয়ে তো আমরাও একদা করেছিলাম বাপু, কিন্তু এভাবে উচ্ছন্ন যাইনি। আর বেশি ছুটি নিলে চাকরীতেই ছুটি হয়ে যাবে। শীঘ্র চলে এসো। এবার একেবারে খোদ রাজধানী! তাছাড়া কোয়ার্টার্স পাওয়া যাবে।

অর্থাৎ নানা টালবাহানা করে করে মেডিক্যাল লিভ নিয়ে নিয়ে যে বিভোর গৃহসুখের জগতে বাস করছিল প্রভাত, তার থেকে বিদায় নিতে হবে।

কিন্তু বিদায়ই বা কেন? কোয়ার্টার্স তো পাওয়া যাচ্ছে।

এখনো ভাইপোর জন্য কাকার দরদের পরিচয়ে কাকিমা বিরূপ, কিন্তু কাকা নিজ নীতিতে অটল আছেন।

চিঠিখানা হাতে নিয়ে মাকে দেখায় প্রভাত। মা বলেন, তা বটে! কিন্তু আমার যে অভ্যেস খারাপ করে দিলি বাবা! বৌমাটিকে ছেড়ে

প্রভাত বলে, উঃ মা! নিজের ছেলেটিকে ছেড়ে এতদিন থাকতে পারলে

 মা হাসেন। বলেন, কী করব। মেয়েটা বড় মায়াবিনী!

মায়াবিনী শব্দের নতুন অর্থে হাসে প্রভাত। আর মল্লিকাকে গিয়ে ক্ষ্যাপায়, ওগো মায়াবিনী, কি মায়া জানো?

মল্লিকার চোখে কিন্তু শঙ্কা ঘনায়।

.

দিল্লী!

দিল্লী যে বাঘের গুহার তল্লাটে! মামাকে মাঝেমাঝেই আসতে হয় দিল্লীতে-মামার বেশির ভাগ খদ্দের আসে দিল্লী থেকে!

প্রভাত বলে, দিল্লী কত বড় শহর, কত তার লোকসংখ্যা! কে সন্ধান রাখবে, কোন কোয়ার্টার্সে সেই মিসেস ব্যানার্জি বাস করেন, যার পুরনো নাম ছিল মল্লিকা!

না গো, আমার ভয় করছে।

তবে চাকরীবাকরী ছেড়েই দেওয়া যাক, কি বলো?

 তাই দাও না গো! মল্লিকা লুটিয়ে পড়ে, কলকাতায় একটা চাকরী জোগাড় করে নিতে পারবে না?

হয়তো পারি। কিন্তু লোকের কাছে পাগল নাম কিনতে চাই না, বুঝলে? কেন ভয় পাচ্ছ?

কিন্তু ভয়! ভয়! ভয় যে মল্লিকার স্নায়ুতে শিরাতে পরিব্যাপ্ত! কি করে তার হাত এড়াবে সে? কেউ যদি দেখতে পায়? যদি সে গিয়ে মামাকে খবর দেয়? যে মামা দেখতে নিতান্ত নিরীহ হলেও বাঘের মতই ভয়ঙ্কর। কে বলতে পারে অসতর্ক প্রভাতের তাজা রক্তে একদিন দিল্লীর রাস্তা ভিজে উঠবে কি না।

তাই শেষ পর্যন্ত মল্লিকার ভয়ই জয়ী হয়।

লোকের কাছে পাগল নামই কিনে বসে প্রভাত।

কাকাকে লিখে পাঠায়, বাংলার বাইরের রুক্ষ জলবায়ু তার ঠিকমত সহ্য হয়নি। এখন তো আরও হবে না, কারণ শরীরটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। নচেৎ কেন এতবার মেডিক্যাল লিভ নিতে বাধ্য হচ্ছিল?

অতএব?

পৌনে পাঁচশ টাকার চাকরী? তা কি আর করা যাবে?

প্রভাতের দুই দাদা, যাঁরা বাড়ীর মধ্যেই আড়াল তুলে মায়ের সঙ্গে পৃথকান্ন হয়ে বাস করছেন, তাঁরা ছি ছি করেন, এবং পুরাণ উপপুরাণ থেকে সুরু করে আধুনিক ইতিহাস পর্যন্ত স্ত্রীর বশ পুরুষের কী কী অধোগতি হয়েছে তার নজীর দেখান।

কাকা চিঠির মারফতই সম্পর্ক ছেদ করেন, এবং পাড়া-প্রতিবেশী গালে হাত দেয়।

 দিল্লী নামক ইন্দ্রপুরীর স্বর্গীয় চাকরী যে কেউ স্বেচ্ছায় বিসর্জন দেয়, এ লোকের ধারণার বাইরে।

শুধু করুণাময়ী!

 করুণাময়ী ছোট ছেলের এই সুমতিতে পাঠবাড়ীতে হরিলুট দিয়ে আসেন।

 ধারেকাছে দুই ছেলে বৌ, কিন্তু করুণাময়ী থাকতেন বেচারীর মত। নিঃসহায় নিরভিভাবক। অথচ তেজ আছে ষোল-আনা, তাই পৃথকান্ন ছেলেদের সাহায্য নিতেন না। অসময়ে দরকার পড়লে বরং পাড়ার লোকের কাছে জানাতেন তো ছেলেদের নয়।

শাশুড়ীর এই অহঙ্কারে ছেলের বৌরাও ডেকে কথা কইত না।

প্রভাত এসে পর্যন্ত করুণাময়ী একটা সহায় পেয়েছেন। তাছাড়া ছোটবৌয়ের রূপগুণ! যেটা বড় মেজ বৌকে থ করে দেবার মত! করুণাময়ীও একটা রাজত্বের অধীশ্বরী হয়েছিলেন এই কমাস।

তবু মনের মধ্যে বাজছিল বিদায়রাগিণী। ফুরিয়ে যাবে, ফুরিয়ে যাবে এই আবুহোসেনের রাজ্যপাট! ফুরিয়ে যাবে সংসার করা!

ছুটি ফুরোলেই বৌ নিয়ে লম্বা দেবে প্রভাত, আর আবার দুই বৌয়ের দাপটের মাঝখানে পড়ে করুণাময়ীকে শুধু হরিনামের মালা সম্বল করে মানমর্যাদা বজায় রাখতে হবে।

বেশ করেছে প্রভাত দূরের চাকরী ছেড়ে দিয়ে। তেমন চেষ্টা করলে কি আর কলকাতায় একটা চাকরী জুটবে না?

তা মাতৃআশীর্বাদের জোরেই হোক আর চেষ্টার জোরেই হোক কলকাতায় চাকরী জোগাড় হয়।

প্রভাত এসে মাকে প্রণাম করে বলে, মাইনে অবিশ্যি এখানে ও চাকরীর থেকে কম, কিন্তু ভবিষ্যৎ খারাপ নয়।

করুণাময়ী আশীর্বাদের সঙ্গে অশ্রুজল মিশিয়ে বলেন, তা হোক। তা হোক। ঘরের ছেলে ঘরের ভাত খাবি, কী বা খরচ! আমি বলছি এই চাকরীতেই তোর উন্নতি হবে।

তা হলে খুশী?

 হ্যাঁ বাবা, খুব খুশী।

 ঘরে গিয়ে মল্লিকাকেও সেই প্রশ্ন করতে যায়। কিন্তু ঘরে পায় না মল্লিকাকে।

কোথায় সে? রান্নাঘরে? ভাড়ারঘরে? ঠাকুরঘরে? গোহালে?

না।

ছাদে উঠেছে মল্লিকা।

প্রভাত এসে আলশের ধারে বসে পড়ে। বলে, উঃ খুব খাটালে! এই চূড়োয় উঠে বসে আছ যে?

খুঁজবে বলে। মল্লিকা হাসে।

 কিন্তু হাসিটা কেমন নিষ্প্রভ দেখায়।

 আমি কিন্তু ভেবেছিলাম আজ আমার জন্যে পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকবে!

ইস! সেইরকম বাড়ি কিনা তোমাদের!

আহা, বাড়ি মানে তো বড়বৌদি মেজবৌদি! ওঁদের নিয়ে কিছু এসে যায় না। যাক, খুশী তো?

খুশী।

 মল্লিকা অমন চমকে ওঠে কেন? কেন বলে, কিসের খুশী?

 বাঃ চমৎকার! দিল্লীর সঙ্গে সম্পর্কছেদের পাকা বনেদ গাঁথা হল না? ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রির কাজটা পেয়ে গেলাম না আজ!

ওমা তাই বুঝি! সত্যি হল? মল্লিকা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

কিন্তু প্রভাতের হঠাৎ মনে হয় মল্লিকার এই উচ্ছ্বাসটা যেন রঙ্গমঞ্চের অপটু অভিনেত্রীর শেখা ভঙ্গির মত।

ভুরু কুঁচকে বলল, কই, খুব খুশী তত মনে হচ্ছে না!

মল্লিকা জোর হেসে উঠল, কী যে বলল। আমি বলে তোমাদের ঠাকুরের কাছে পূজো মেনেছিলাম, যাতে তোমার আগের চাকরীটা ঘোচে, এখান থেকে আর কোথাও যেতে না হয়!

প্রভাত হাসে। বলে, আমাদের ঠাকুর নয়, তোমার ঠাকুর, সকলের ঠাকুর।

মল্লিকা মাথা দুলিয়ে বলে, হ্যাঁ গো মশাই, তাই।

তবু প্রভাতের মনে হয় মার কাছে যে আন্তরিক অভিনন্দন পেল, মল্লিকার কাছে বুঝি তেমন নয়।

অথচ মল্লিকার জন্যেই তো

কেন? এখানে টাকার অঙ্ক কম বলে? কিন্তু তাই কি হতে পারে? মল্লিকার দিল্লীর ভীতি তো দেখেছে সে!

তবে কেন তেমন খুশী হলো না মল্লিকা?

 কিন্তু সত্যিই কি মল্লিকা খুশী হয়নি?

 নিজেই সেকথা ভাবছে মল্লিকা।

খুশী খুশী, খুশীতে উপচে পড়া উচিত ছিল তো তার। কিন্তু তেমন হচ্ছে না কেন? কেন হঠাৎ ভয়ঙ্কর একটা শূন্যতাবোধ সমস্ত স্নায়ু-শিরাকে নিস্তেজ করে দিচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে কোথায় বুঝি একটা মস্ত জমার ঘর ছিল তার, সে ঘরটা সহসা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল!

কি সেই জমা? কী সেই ফুরিয়ে যাওয়া?

.

গভীররাত্রে যখন প্রভাত পড়েছে ঘুমিয়ে, আর প্রভাতদের এই পাড়াটা নিঃঝুম নিঃসাড় হয়ে যেন ছায়াদৈত্যের মত ঘাপটি মেরে পড়ে আছে, তখন মল্লিকা বিছানা ছেড়ে উঠে জানলার ধারে এসে দাঁড়ায়।

জানলার ঠিক নীচেটাতেই খানিকটা ঝোঁপ, তা থেকে কেমন বুনো বুনো গন্ধ আসছে। মল্লিকার মনে হল এ গন্ধ যেন জোলো ভাবপ্রবণতার, সস্তা উচ্ছ্বাসের।

আগে, অনেকদিন আগে এমনি করে মাঝরাতে উঠে জানলার ধারে কি দাঁড়াত না মল্লিকা? . দাঁড়াত বৈকি, দাঁড়াত। কিন্তু সে জানলা খুলতেই এক ঝলক বাতাসের সঙ্গে যে গন্ধ এসে ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে ধাক্কা দিত, সে গন্ধ বনকচু আর আশশ্যাওড়ার নয়। সে গন্ধ যেন অদূরে বিচরণশীল বাঘের গন্ধ। যার মধ্যে ভয়ঙ্কর এক ভয়ের রোমাঞ্চ, উগ্র এক মদের স্বাদ।

আর উদ্দাম সেই পাহাড়ী ঝড়।

যে ঝড় হঠাৎ কোনও এক রাত্রির বুক চিরে ক্রুদ্ধ-গর্জনে ছুটে আসত কোন দূর-দূরান্তের অরণ্য থেকে। ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত গুঁতো মারত পাহাড়ের গায়ে গায়ে। তার সেই উন্মত্ত আক্ষেপের ফেঁ-ফেঁসানিতে উত্তাল হয়ে উঠত দেহের সমস্ত রক্তকণিকা, সমস্ত প্রাণ আছড়ে পড়তে চাইত অজানা কোনও এক ভয়ঙ্করতার মধ্যে।

জীবনে আর কোনও দিন সেই দূর অরণ্যের দুরন্ত ডাক শুনতে পাবে না মল্লিকা? দেখতে পাবে না ঝড়ের সেই মাতামাতি?

আচ্ছা মামা কি এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছেন মল্লিকাকে? দেখতে পেলেই একখানা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুচিকুচি করে কেটে ফেলবেন বলে? যতদূর নয় ততদূর বেইমানী তো করে এসেছে মল্লিকা তার সঙ্গে!

তা বেইমানী বৈকি। তাছাড়া আর কি।

মামা তার জীবনের ভয়ঙ্কর এক রাহু, কিন্তু মামা তার জীবনদাতাও নয় কি? মল্লিকা যে এই মল্লিকা হল, যে মল্লিকা ভাবতে জানে, স্বপ্ন দেখতে জানে, জীবন কি তা বুঝতে জানে সে মল্লিকাকে গড়ল কে?…কোথায় থাকত সেই মল্লিকা, মামা যদি তাকে নিয়ে না যেত?

মামা নিয়ে না গেলে তো তাদের সেই রিষড়ের বাড়ীতে কাকাদের আশ্রয়ে গণ্ডমুখ গাঁইয়া একটা মেয়ে হয়ে পড়ে থাকতে হত মল্লিকাকে, হয়তো কোন্ কালে হতভাগা একটা বরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যেত, হয়তো একপাল ছেলেমেয়েও হত এতদিনে। পাহাড়ী ঝড়ের উন্মত্ত রূপ কোনদিন দেখতে পেত না মল্লিকা, দেখতে পেত না হঠাৎ-বিদ্যুতের মত বাঘের গায়ের হলুদ কালো ডোরা।

তবে মামাকে সে বন্ধু বলবে, না শত্রু বলবে?

হঠাৎ একটা ঝোড়ো ঝোড়ো বাতাস ওঠে, আর সেই বাতাসের শব্দের মধ্যে যেন হা-হা-করা একটা হাসি ভেসে আসে। অনেকগুলো মাতালের সম্মিলিত হাসি।…হাজার মাইল দূর থেকে কেমন করে ভেসে এল এ হাসি!

বুক কেঁপে উঠল মল্লিকার। আর ঠিক সেই সময় বুঝি ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতই পিঠের উপর একখানা স্নেহ-কোমল হাত এসে পড়ল।

প্রভাত ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে।

নরম গলায় বলছে, এমন করে দাঁড়িয়ে আছ কেন মল্লিকা? ঘুম আসছে না?

 ফিরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ স্বামীর বুকের ওপর আছড়ে পড়ে মল্লিকা। রুদ্ধ গলায় বলে, তুমি কেন ঘুমিয়ে পড়? তুমি কেন আমার সঙ্গে জেগে থাক না?

সহজ স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নেয় প্রভাত–এ হচ্ছে মল্লিকার অভিমান। সত্যি মল্লিকা যখন জেগে বসে আছে, তখন এমন অচৈতন্য হয়ে ঘুমনো উচিত হয়নি প্রভাতের। তাই ওকে কাছে টেনে নেয়, আরও নরম গলায় বলে, সত্যি মল্লিকা, আমি একটা বুন্ধু।

এমন স্বীকারোক্তির পর পরিস্থিতি নিতান্ত সহজ হর যেতে দেরি হয় না, কিন্তু সেই সহজ সুর কি স্থায়ী হয়? মাঝে মাঝেই কেটে যায় সে সুর মাঝে মাঝেই বিস্বাদ হয়ে ওঠে মল্লিকার, এই ছকে বাঁধা সংসারের সুনিপুণ ছন্দ।

কিন্তু ঘরকুনো প্রভাত বড় খুশীতে আছে। হাওড়া থেকে বালি, অফিস থেকে বাড়ী। খাবার ঘর থেকে শোবার ঘর, মার স্নেহচ্ছায়া থেকে স্ত্রীর অঞ্চলছায়া।

তাঁতির মাকুকে এর বেশি আর ছুটোছুটি করতে হয় না। আবাল্যের পরিবেশ মনকে সর্বদা সুধারসে সিক্ত করে রাখে, মাঝখানের বিদেশবাসের তিনটে বছর ছায়ার মত বিলীন হয়ে যায়।

এতদিনে বুঝি প্রভাত জীবনের মানে খুঁজে পায়।

কিন্তু মল্লিকা ক্রমশ জীবনের মানে হারাচ্ছে কেন? কেন ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে? স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে? হয়তো বা মাঝে মাঝে একটু রুক্ষও!

এতদিন ভোর থেকে সুরু করে রাত্রি পর্যন্ত গৃহস্থালীর কাজগুলির ভার পেয়ে যে সে প্রতিমুহূর্তে কৃতার্থ হয়েছে, বিগলিত হয়েছে তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে, লক্ষ্মীর ঘরে ধূপধুনো দিতে, পূর্ণিমায় পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণের জন্যে মালা গাঁথতে, চন্দন ঘষতে!

সেই কৃতাৰ্থমন্যতা কোথায় গেল? কাজগুলো যান্ত্রিক হয়ে উঠছে কেন?

সংসারী গৃহস্থের মূর্ত প্রতীক প্রভাত। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে অসময়ের ফুলকপির জোড়া হাতে ঝুলিয়ে ভাবতে ভাবতে আসে, মাকে বলবে, মা, দুটোই যেন তুমি চিংড়িমাছ দিয়ে বেঁধে শেষ করে দিও না। তোমার নিরিমিষ ঘরে রাঁধবে একটা

মল্লিকার মধ্যেকার সুর কেটে যায়।

 প্রভাত কেন এমন জোলো, এমন ক্ষুদ্র সুখে সুখী?

 এমনি এক সুরকাটা সন্ধ্যায়, যখন প্রভাতের মা গিয়েছেন পাঠবাড়ীতে পাঠ শুনতে, আর নির্জন বাড়ীর দালানের একেবারে একটেরে ছোট্ট একটা তোলা উনুন জ্বেলে মল্লিকাকে ক্ষীর জ্বাল দিতে হচ্ছে শাশুড়ীর রাতের খাওয়ার জন্যে, খিড়কির দরজায় হুড়কো ঠেলার শব্দ হল।

পাড়াগাঁয়ের প্রথামত হুড়কোটা এমনভাবে ঠেকানো থাকে, যাতে বাইরে থেকেই খুলে বাড়িতে ঢোকা যায়। আর সে পদ্ধতিটা বাড়ির সকলেরই জানা থাকে। প্রভাতও প্রায়শই এই পিছন-দরজা দিয়ে ঢোকে। শব্দটা শুনে মল্লিকা ভাবল তাই হবে–প্রভাতই এসেছে। আর তাকিয়ে দেখল না।

অন্যদিন হলে হয়তো মল্লিকা তাড়াতাড়ি তাকিয়ে দেখত, কিন্তু আজকের সন্ধ্যার সুর কাটা। আজ আর মল্লিকা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসে না। বরং আরও ঘোমটা টেনে হেঁটমুখে কড়ায় হাতা নেড়ে নেড়ে দুধ জ্বাল দিতে থাকে। পরণে একখানা লাল হলদে ছাপ মারা সিল্কের শাড়ি আর শাড়ির পাড়ের সঙ্গে মিলোনো একটি লাল সিল্কের ব্লাউস। যদিও সাজটা বাহারী তবে এ একেবারে ভাড়ারঘরের আলনায় রাখা বিশুদ্ধ। ক্ষীর জ্বাল না হওয়া পর্যন্ত এ পরে কাউকে স্পর্শ করার উপায় নেই।

প্রভাত প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় এসে এই দৃশ্যটিই দেখে। মা পাঠবাড়ীতে যান, ঝিটা সারাদিনের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যার মুখে বিদায় নেয়, আর মল্লিকা বিশুদ্ধ শাড়ি পরে শাশুড়ির রাতের খাওয়ার ক্ষীর জ্বাল দেয়।

প্রভাত অনুযোগ করে, কাজটা একটু আগে আগে সেরে রাখতে পারো না? সারাদিনের পর বাড়ি এসে ঝপ করে একটু ছুঁতে পাই না–এ যেন বক্ষে অগাধ তৃষ্ণা, অথচ সামনে লবণ সমুদ্র!

মল্লিকা ভ্রভঙ্গী করে উত্তর দেয়, তৃষ্ণাটা একটু কমাও, বাড়ির যখন এই ব্যবস্থা। গরু দোহা হবে সন্ধ্যার মুখে। আমাদের ওখানে তো বেলা চারটে না বাজতেই কথাটা প্রায়শই শেষ হয় না। যে কোনও সময় অসতর্কে আমাদের ওখানে বলে ফেলেই থেমে যায় মল্লিকা। তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, চারটে-পাঁচটার সময় দুধটা দোহা হলে ঠিকই কাজ সেরে রাখতাম।

কিন্তু এসব হচ্ছে যেদিন ভিতরের সুর ঠিক থাকে। তাল ভঙ্গ হয় না। আজ আর ঠিক তেমনটি ছিল না। আজ মল্লিকার ভিতরের সুর গেছে কেটে, তার গেছে ঢিলে হয়ে। আজ তাই খিড়কির হুড়কো ঠেলে যে ব্যক্তি ঢুকল, তার দিকে উদাস একটি দৃষ্টিনিক্ষেপ করে মল্লিকা নিজের কাজ করে চলে।

কিন্তু বাড়িতে যে ঢুকল সে কি প্রভাত?

.

মল্লিকা ত্রস্ত হল।

তারপর দেখল পরিমল। বছর কুড়ি-বাইশের একটি সুকান্তি ছেলে। ফরসা রং, চুলগুলি উল্টে আঁচড়ানো, পরণে একটা পায়জামা আর পাঞ্জাবি। মুখে মৃদু হাসি।

জেঠিমা বাড়ী নেই? বলল ছেলেটা।

মল্লিকা বৌগিরি বজায় রেখে আস্তে বলে, মা তো রোজই এ সময় পাঠ শুনতে যান।

আর প্রভাতদা?

 সেও তো সেই কখন ফেরে।

ছেলেটা দাওয়ার একধারে বসে পড়ে বলে ওঠে, এ ভারী অন্যায় প্রভাতদার। আপনি এই সন্ধ্যাবেলা একা থাকেন, ওর একটু আগে ফেরাই উচিত। পাঁচটায় তো ছুটি হয়ে যায় ওর।

ছেলেটা প্রভাতের খুড়তুতো ভাই, একটু বেশি বাক্যবাগীশ। তবে জেঠিমা অর্থাৎ প্রভাতের মার কড়া দৃষ্টির সামনে সে বাক্যস্রোত রুদ্ধ রাখতে হয়। সেই রেখেই আসছে। আজ এমন নির্জন বাড়ীতে বৌদিকে একা পেয়ে তার বাক্যের ধারা উথলে ওঠে…প্রভাত সম্পর্কে ওই মন্তব্যটুকু সেই উথলে ওঠার সূচনামাত্র। কথাটা নিতান্তই বলার জন্যে বলা।

কিন্তু তুচ্ছ এই কথাটুকুই যেন মল্লিকার সমস্ত স্নায়ু শিরা ধরে নাড়া দিয়ে দেয়। ওর মনে হয়, সত্যিই তো? এ অন্যায়, একান্ত অন্যায়। এই নির্জন সময়টুকু প্রভাত ইচ্ছে করে নষ্ট করে। এ সময় ও যায় বাজার ঘুরে নতুন ফুলকপি কি অসময়ের আম, গঙ্গার ইলিশ কি টাটকা ছানা সওদা করতে।

ছি ছি!

নিশ্চয় প্রভাতের মনের মধ্যে নেই আগ্রহের ব্যাকুলতা। তাই খুড়তুতো দেওরের এই কথায় বিদ্যুৎ-শরাহতের মত উঠে দাঁড়িয়ে সরে এসে বলে, উচিত কাজ তোমাদের এই বাড়িতে কে বা করছে! নইলে তোমাদের দাদার কি উচিত ছিল এই আমাকে বিয়ে করা?

কী মুশকিল! সেটা আবার কী এমন অনুচিত হল? আমরা তো নিত্য প্রভাতদাকে হিংসে না করে জলগ্রহণ করি না।…

ভুল-ভুল, সব ভুল। উচিত হয়নি আমাকে বিয়ে করা। বনের পাখীকে ধরে খাঁচায় এনে পোরা।

ছেলেটা হেসে উঠে বলে, তা সুন্দর পাখীটি দেখলে কেই বা না চেষ্টা করে তাকে ফাঁদ পেতে ধরে ফেলে খাঁচায় পুরতে। সত্যি চাকরী করতে বিদেশে তো সবাই যায়, প্রভাতদার মত এমন অচিন দেশের রাজকুমারীর দেখা কে পায় বলুন?

হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে মল্লিকা। সহসা চকিত করে ভোলা বাঁচাল হাসি। এ হাসি আজও মনে আছে মল্লিকার? আজও পারে এ হাসি হাসতে? এ ওকে চেষ্টা করে করতে হল না? অনেকগুলো মাতালের সম্মিলিত হাসির বিপরীতে? চেষ্টা করে আনা, শেখানো বাঁচাল এই হাসি মল্লিকার রক্তের মধ্যে মিশে গেছে নাকি?

কখন গেছে? কোন অসতর্কতায়?

ছেলেটা বোধ করি সহসা এই বাঁচাল হাসির ঘায়ে বিমূঢ় হয়ে যায়, তাকিয়ে থাকে হাঁ করে, আর লজ্জায় লাল হয়ে যায় মল্লিকার পরবর্তী কথায়, অচিন দেশের রাজকুমারীটিকে দেখছি নঠাকুরপোর বেজায় পছন্দ! একটু আধটু প্রসাদকণিকা পেয়ে ধন্য হতে চাও তো বল! রাজকুমারী কৃপণ নয়, তার ভাঁড়ারে অনেক ঐশ্বর্য।

বাক্যবাগীশ ছেলেটা তার বাক্যস্রোত হারিয়ে ফেলে নির্বোধের মত তাকিয়ে থেকে বলে, কী বলছেন?

বলছি তোমার মাথা! যে মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছু নেই। সাধে কি আর তোমাদের এই বাংলাদেশে ঘেন্না ধরে যাচ্ছে আমার? নাও সরো, সরে বোসো। এখান দিয়ে আমাকে রান্নাঘরের দিকে যেতে হবে। তোমার সঙ্গে ছোঁওয়া গেলে তো জাতিপাত।

ছেলেটা ত্রস্ত হয়ে সরে বসে।

মল্লিকা একটা তীব্র কটাক্ষ হেনে দাওয়া থেকে নেমে উঠোনে নেমে পড়ে রান্নাঘর থেকে বাটি আনতে।

শাশুড়ির স্পেশাল পিতলের বাটিটি। যেটি দেখতে ছোট খোলে বড়।

কিন্তু সেই বাটিটি নিয়ে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই অবোধ ছেলেটা একটা বেখাপা কথা। বলে বসে। বলে, সাধে কি আর এত মোহিত হয় লোকে? সুন্দর মানুষদের সবই সুন্দর। রাগও অপূর্ব।

তাই নাকি?

মল্লিকা চোখে বিদ্যুৎ হানে।

ছেলেটা বোধ করি নেহাতই ঘায়েল হয়ে গিয়ে বলে ওঠে, তাই তো! আর শাড়িখানাও কি আপনার তেমনি অদ্ভুত! পেলেন কোথায় এই বাঘ-ডোরা শাড়ি? যখন রাগ করে এখান থেকে সরে গেলেন, ঠিক যেন মনে হল একটা বাঘ চলে গেল!

কী, কী বললে? মল্লিকা যেন ছিটকে ওঠে।

ছেলেটা আর একবার থতমত খেয়ে বলে, মানে বলছি আপনার শাড়ির ছোরাটা ঠিক বাঘের গায়ের মত

বাঘ না বাঘিনী?

আর একটা বিদ্যুৎ হানে মল্লিকা। যে বিদ্যুকটাক্ষ ছেলেটা তার এই বাইশ বছরের জীবনে কোথাও কোনদিন দেখেনি।

কোথা থেকেই বা দেখবে? নিতান্তই যে গৃহপালিত জীব এরা।

তাই এবার সে ভয় পায়। ভয়ঙ্কর এক ভয়ের রোমাঞ্চ তাকে যেমন একদিক থেকে এই দাওয়ার সঙ্গে পেরেক পুঁতে আটকে রাখতে চায়, তেমনি আর একদিক থেকে ধাক্কা মেরে তাড়াতে চায়।

শেষ অবধি জয় হয় শেষোক্তেরই।

বনকচু আর আশশ্যাওড়ার জোলো জোলো বন্য গন্ধ এদের রোমাঞ্চকে ভয় করতেই শিখিয়েছে।

অতএব আমি যাই বলে উঠে দাঁড়ায় ছেলেটা।

 মল্লিকা ওর ওই ত্রস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে এবার একটু করুণার হাসি হাসে।

ওর মনের দৃষ্টির সামনে ভেসে আসে অনেকগুলো পুরুষের নির্লজ্জ বুভুক্ষু দৃষ্টি। যে দৃষ্টি যাই বলে সরে যেতে জানে না, খাই বলে লাফিয়ে পড়তে আসে।

যাও, বাড়ী গিয়ে মাথায় একটু ঠাণ্ডা জল দাও গে। নইলে রাতে ঘুম হবে না। বলে আর একবার তেমনি বাঁচাল হাসি হেসে ওঠে মল্লিকা।

আর ও চলে যেতেই সহসা যেন একটা নিষ্ঠুর কাঠিন্যে প্রস্তরময়ী হয়ে যায়।

কী বিশ্রী, কী পানসে এখানের এই পুরুষগুলো! ছিঃ! বাইশ বছরের একটা জোয়ান ছেলের রক্ত এত ঠাণ্ডা!

বাঘিনী দেখে ভয় পায়, তাকে শিকার করবার লোভে দুরন্ত হয়ে ওঠে না! হবেই তো, এরা যে গোস্বামী!

প্রভাত গোস্বামীর শিরায়-শিরায়ও এই জোলো রক্তের স্তিমিত প্রবাহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *